বাসুকির অভিশাপ
অনেক বছর আগে, সম্ভবত ১৯৫৮ সালে আমাকে একবার বীরভূম জেলার বাঘেরহাট বলে একটা গ্রামে যেতে হয়েছিল। আমি তখন চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বোস অ্যান্ড ঘোষ অ্যাসোসিয়েটস-এ আর্টিকল্ড ক্লার্ক ছিলুম। আমার অফিস আমাকে বাঘেরহাটে পাঠিয়েছিল ওখানকার স্বর্ণলতা মেমোরিয়াল বয়েস হাইস্কুলের হিসেবপত্র অডিট করবার জন্য।
সে যুগে বাঘেরহাট যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। বোলপুর থেকে একটা কঙ্কালসার লঝঝড় বাসে গেলুম হরিমোহন বলে একটা জায়গায়। সেটা নাকি একটা গ্রাম। আমি তো গ্রাম-ট্রাম কিছুই দেখতে পেলুম না। চারিদিকে রুক্ষ ঢেউখেলানো লালমাটির জনহীন মাঠ আর দূরে শালবন— এই হল হরিমোহন। বাস থেকে নামলুম সুটকেস বগলে আমি আর কিছু হাটুরে মানুষ। আমি ছাড়া বাকি সবাই নেমেই ম্যাজিকের মতো ওই ফাঁকা মাঠের মধ্যেই কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার পরম সৌভাগ্য যে দেখলুম দু-জন খাটো ধুতি আর হাফহাতা সাদা পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক একটা গোরুর গাড়ি নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ওঁরা না থাকলে আমি বোধ হয় মাটিতে বসে কান্নাকাটি জুড়ে দিতুম। তার কারণ ফেরার বাস ছিল তিন ঘণ্টা পরে।
গোরুর গাড়িতে ভদ্রলোকেদের সঙ্গে পরিচয় হল। দু-জনেই প্রৌঢ়। একজন স্কুলের হেডমাস্টার, নাম মকবুল আলম আর অন্যজন স্কুলের সেক্রেটারি নাম হরিদাস মুস্তাফি। দু-জনেই অত্যন্ত ভদ্র আর বিনয়ী। এঁদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল।
আমরা প্রায় আধঘণ্টা যাবার পরে দেখি তেপান্তরের মাঠের ভেতরে মাঝারি গোছের একটা নদী বয়ে চলেছে। তার দু-পাড়ে জলের খুব কাছাকাছি দুটো মোটা গাছের গুঁড়িতে একটা কাছি বাঁধা। সেটা হালুইকরদের যে মস্ত কড়াই হয়, সেইরকম একটা কড়াইয়ের দুটো আংটার ভেতর দিয়ে গলানো। কড়াইটা জলে ভাসছে। তার ভেতরে একটা বড়ো কাঠের হাতা। আর আংটা দুটোর সঙ্গে বাঁধা দুটো লম্বা দড়ি দু-দিকের পাড়ের ওপরে এনে রাখা হয়েছে। নদীর ওপাড়ে কয়েক জন খাকি কোট আর ধুতি পরা লোক দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল তারা স্কুলের লোক।
এইখানে আমরা গাড়ি থেকে নামলুম। কড়াইটা কী জন্য ওখানে রাখা রয়েছে জিজ্ঞাসা করায় জানতে পারলুম যে ওটা নদী পার হবার একমাত্র উপায়। একজন কড়াইয়ের ভেতরে বসে হাতা দিয়ে জল কেটে কেটে ওপারে গিয়ে ওটা ছেড়ে দেবে। তখন এপারের লোক দড়ি টেনে নিয়ে এসে আর একজনের যাবার ব্যবস্থা করবে।
ব্যাপার দেখে আমার চক্ষুস্থির। কড়াই চড়ে নদী পার হতে হবে কোনোদিন কল্পনাই করিনি। কিন্তু করবার তো কিছুই নেই, কাজেই ওইরকমই করতে হল। বুঝলুম যেখানে যাচ্ছি সেখান থেকে চট করে কেটে পড়া সম্ভব হবে না।
নদী পার হবার পর স্কুলের লোকেরা আমার ব্যাগটা তুলে নিল, তারপরে হন্টন। প্রায় দশমিনিট হাঁটার পর বাঘেরহাট গ্রামে পৌঁছোনো গেল। গ্রামটা কিন্তু বেশ বড়ো এবং বর্ধিষ্ণু। তিন-চারটে পাকা বাড়ি দেখা গেল। আর অনেকগুলো কুঁড়ে ঘর। স্কুলবাড়িটা আমার চৌহদ্দির বাইরে তবে খুব বেশি দূরে নয়। তার একপাশে খেলার মাঠ, ঘাসটাস কিছু নেই, স্রেফ লালমাটির জমি চৌরস করে দু-পাশে দুটো গোলপোস্ট পুঁতে দেওয়া হয়েছে। বাকি সবদিকই ফাঁকা আর পেছনে বেশ কিছুটা দূরে একটা বিশাল শাল-মহুয়ার ঘন জঙ্গল। সেই শান্ত পরিবেশ দেখে বেশ ভালোই লাগল।
তারপরেই বাধল গোলমাল।
যে লোকগুলো আমার ব্যাগটা নিয়ে যাচ্ছিল, তারা সোজা স্কুলের দিকে না-গিয়ে বাঁ-দিকে ঘুরল। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘একী? ওরা ওদিকে কোথায় যাচ্ছে?’
আলম সাহেব বললেন, ‘আপনার জমিদারবাবুর বাড়িতে থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওরা ওখানেই যাচ্ছে।’
বললুম, ‘আপনাদের স্কুলের প্রেসিডেন্ট আপনাদের জমিদার শ্রীজগদীশচন্দ্র রায় না? অডিট করতে এসে আমি তো তাঁর বাড়িতে থাকতে পারি না। আপনি ওই লোকেদের ফিরে আসতে বলুন। আমি স্কুলবাড়িতেই কোথাও থাকব। তার ব্যবস্থা করে দিন। আমি দরকার হলে রাত জেগেও কাজ করতে পারব। আর ওই লোকেদের মধ্যে যদি কেউ রাঁধতে পারে, সে যেন দুবেলা দুটো ভাতেভাত রেঁধে দেয়। তার জন্য যা লাগবে তার পয়সা আমি দিয়ে দেব।’
আমার কথা শুনে আলম সাহেব আর মুস্তাফিবাবু দু-জনেই আঁতকে উঠলেন। প্রায় সমস্বরে বললেন, ‘এ হতেই পারে না। আপনি কেন চিন্তা করছেন? জমিদারবাড়িতে আলাদা অতিথিশালা আছে। সেখানে কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না। এমনকী জগদীশবাবুও না। আপনি ওঁকে যেরকম লোক ভাবছেন, উনি মোটেই তা নন। সেকথাটা সকলেই জানে। আপনার আগে যত অডিটাররা এসেছেন, তাঁরা সকলেই ওখানে থেকেছেন। তাঁদের কোনোরকম অসুবিধে হয়নি।’
আমার তখন অল্পবয়েস, রক্ত গরম। কাজেই, কোনো কথাই শুনতে রাজি হলুম না। প্রায় একঘণ্টা ধরে তর্কবিতর্ক চলল। আমি কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে অনড় রইলুম।
ততক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে। দেখলুম একজন লম্বা-চওড়া ধুতিপাঞ্জাবি পরা বয়স্ক ভদ্রলোক আমাদের দিকে আসছেন। তাঁকে দেখে আমার সঙ্গী দু-জন যেরকম জড়োসড়ো হয়ে পড়লেন, তাতে বুঝতে পারলুম যে ইনিই শ্রীজগদীশচন্দ্র রায়।
ভদ্রলোক এসেই আলম সাহেব আর মুস্তাফিবাবুকে দেরি করার জন্য বকাবকি শুরু করলেন। যখন দেরি হবার কারণটা শুনলেন তখন আমাকে চোখ পাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, ‘শোনো হে ছোকরা, তুমি যদি আমার বাড়িতে না-থাকো, তাহলে আমি তোমার কোম্পানির মেজকর্তা হাঁদু মানে ওই যে কী বলে বিজয়েন্দু বোসের কাছে তোমার নামে কমপ্লেন করব।’
কথাটা শুনে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। যেন বেজায় ভয় পেয়েছি এইভাবে বললুম, ‘না, না, আপনার ওখানে তো তাহলে থাকতেই হয়। তবে কিনা, কাল সকালেই আমি কলকাতায় ফিরে যাব আর ওই যে কী বলে বিজয়েন্দু বোসের কাছে রিপোর্ট দেব যে আপনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমাকে ইনফ্লুয়েন্স করবার চেষ্টা করেছেন বলে আমি কাজ শেষ না-করে ফিরে এসেছি।’
আমার বিদ্রূপে কাজ হল। জমিদারবাবু কিছুক্ষণ তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করে রাগটা সামলালেন। তারপর আলম সাহেবকে বললেন, ‘ঠিক আছে। ওকে স্কুলবিল্ডিং-এ থাকার ব্যবস্থা করে দাও। আর ওকে দিয়ে লিখিয়ে নাও যে ও স্বেচ্ছায় স্কুলবাড়িতে আমাদের বারণ সত্ত্বেও থাকছে এবং এর ফলে ওর যদি ভালো-মন্দ কিছু হয় তবে তার সমস্ত দায়িত্ব ওর। আর, যা যা সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে সেগুলো বিস্তারিতভাবে ওকে বলে দিও।’
আমি কথাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিলুম না। বুঝতেই পারলুম, আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।
আমি ভুল বুঝেছিলুম।
হেডমাস্টারমশায়ের ঘরের লাগোয়া একটা ছোটো ঘরে আমার থাকার বন্দোবস্ত করা হল। ঘরটার দু-দিকের দেওয়াল জুড়ে বই আর খাতাপত্রের আলমারি, একটা দেওয়ালে হেডমাস্টারমশায়ের ঘর থেকে ঢোকার দরজা আর অন্য দেওয়ালে একটা বড়ো জানলা। লক্ষ করলুম যে হেডমাস্টারমশায়ের ঘরের তিনটে আর ছোটোঘরের একটা জানলায় কেবল মোটা গরাদই নয়, তিন-একের বিআরসি জাল লোহার ফ্রেম করে লাগানো। ছোটোঘরের জানলার বাইরে খেলার মাঠের খানিকটা আর জঙ্গল দেখা যাচ্ছিল। সেখানে একটা চৌকি ছিল, বোধ হয় হেডমাস্টারমশায়ের বিশ্রাম নেবার জন্য। স্কুলের লোকেরা কোত্থেকে পরিষ্কার তোশক, চাদর, বালিশ আর মশারি নিয়ে এসে সুন্দর বিছানা করে দিল। একটা কুঁজো আর গোটা দুই হ্যারিকেন লণ্ঠনও দিয়ে গেল।
হেডমাস্টারমশাই বললেন, ‘আপনি তো মনে হয় জমিদারবাবুর বাড়ির খাবারও খাবেন না। হরিদাসবাবু ব্যাচেলার, তিনি অতিথিশালাতেই থাকেন। তাহলে রাত্রি বেলা আপনাকে আমার বাড়ির খাওয়াই খেতে হয়, নইলে মুড়ি আর গুড়। আমি মুসলমান, আমার বাড়ির রান্না আপনি খাবেন কী?’
বললুম, ‘খাব না কেন? নিশ্চয়ই খাব। কিন্তু আপনি কেন কষ্ট করবেন? আপনার ওই লোকেদের কাউকে বলুন না যা-হোক কিছু রান্না করে দিয়ে যাবে।’
হেডমাস্টারমশাই বললেন, ‘আজ একটু দেরি হয়ে গেছে। কাল হয়তো একটা ব্যবস্থা করা যাবে। আর এতে আমার আবার কষ্ট কী? আমি সাতটার মধ্যে খাবার দিয়ে যাব। ততক্ষণে উঠোনে কুয়ো আছে, সেখানে চান সেরে নিন। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়বেন। আমি যাব আর আসব।’
‘সাতটার মধ্যে খাব কী মশায়? আমি দশটার আগে খেতেই পারি না।’
ত্রস্ত হয়ে হেডমাস্টারমশাই বললেন, ‘না না, অত দেরি করবেন না। অত দেরি করা মোটেই ঠিক হবে না।’ বলেই হরিদাসবাবুকে বগলদাবা করে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। অত দেরি করা ঠিক হবে না আমার না তাঁর— সেটা ঠিক বুঝতে পারলুম না।
কুয়োর বাঁধানো পাড়ে দাঁড়িয়ে চান করতে করতে সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোয় দেখলুম একটা হলুদ আর কালোয় ডোরাকাটা সাপ, বোধ হয় চন্দ্রবোড়া, বেশ নিশ্চিন্ত মনে এঁকেবেঁকে আমার সামনে দিয়ে একটা ঝোপের থেকে বেরিয়ে আর একটা ঝোপের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। ব্যাপারটা আমার একেবারেই ভালো লাগল না। চান সেরে দুপদাপ করে যথাসাধ্য পায়ের আওয়াজ করতে করতে স্কুলের বারান্দায় উঠে দেখি কুয়োর পাশে একটা জবাগাছের নীচে আর একটি কুচকুচে কালো সাপ সান্ধ্যবিহার করতে বেরিয়েছে। সেটা কেউটেও হতে পারে আবার নির্বিষ কালনাগিনিও হতে পারে। সেটা যাই হোক, দৃশ্যটা মনোরম নয়। আমার মনে হল, এই সাপের ভয়েই বোধ হয় আমাকে এখানে থাকতে বারণ করা হচ্ছিল। সে কথাটা সোজাসুজি বলতে বাধাটা কোথায়, সেটাই আমার বোধগম্য হল না।
পৌনে সাতটা নাগাদ একটা টিফিন-ক্যারিয়ার নিয়ে হেডমাস্টারমশাই দু-জন লোকের সঙ্গে এসে হাজির হলেন। লোকদুটির হাতে মোটা লম্বা লাঠি আর দুটো পেট্রোম্যাক্স আলো। তারা এসেই এমনভাবে ছটফট করতে লাগল যেন তক্ষুনি পালাতে পারলে বাঁচে। তাদের হাবভাব দেখে হেডমাস্টারমশাইকে টিফিন-ক্যারিয়ারটা রেখে চলে যেতে বললুম। তৎক্ষণাৎ তিনজনে সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন।
যাবার সময় হেডমাস্টারমশাই খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘কয়েকটা কথা বলছি, খুব মন দিয়ে শুনুন। এঘরের বাইরের আর ভেতরের দুটো দরজাই বন্ধ করে শোবেন। দুটো দরজারই ভেতর দিকে কোলাপসিবল গেট আছে, সেগুলোও বন্ধ করে দেবেন। রাত দশটার পর ভুলেও বাইরে যাবেন না। ভোর না-হওয়া পর্যন্ত আপনার ঘর থেকে বেরুবেন না, এমনকী জানলার সামনে গিয়েও দাঁড়াবেন না। আর, যে কেউ এসে ডাকাডাকি করুক না কেন, কিছুতেই দরজা খুলবেন না।’
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘ডাকাডাকি? কার ডাকাডাকি? এখানকার ভয়টা সাপের না?’
হেডমাস্টারমশাই সন্ত্রস্ত গলায় বললেন, ‘সে ভয়তো আছেই। তবে কার ডাকাডাকি সেটা আমার সঠিক জানা নেই। ভয় পাবেন না। আপনার কথায় বুঝেছি যে আপনি দুর্বল হৃদয়ের লোক নন। আপনার সাহস আছে। আমি যা বললুম সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চললে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। কাজেই চিন্তা করবেন না।’
করবেন না বললেই তো আর হয় না। চিন্তা না-করে উপায় আছে? সবাই চলে যাওয়া মাত্র ভাবতে বসলুম যে ব্যাপারটা কী? এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে এখানে অত্যন্ত ভীতিজনক কিছু একটা ঘটে। সেটা কী হতে পারে? ভূত, ডাকাতি, অসামাজিক কাজকর্ম, গোপন বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের আনাগোনা না অন্য কিছু? যদি ভূত হয় তাহলে খুব একটা চিন্তিত হবার কারণ নেই। ভূত বলে কিছু আছে কি না আমি জানি না। যদি থাকেও, তাহলে আমি ভয় না-পেলে সেই বায়বীয় পদার্থ বা অপদার্থের পক্ষে আমার কোনো ক্ষতি করার সম্ভাবনা নেই। শরদিন্দুবাবু লিখেছেন, ভূতে ঘাড় মটকায়— একথা অত্যন্ত অশ্রদ্ধেয়। ভয় পেলে অবশ্য আমি আমার নিজের ক্ষতি করে বসতে পারি। অতএব ভয় পেলে চলবে না। ডাকাত হলেও ভয় পাবার তেমন কোনো কারণ নেই। জামাকাপড় আর শ-খানেক টাকা ছাড়া আমার কাছে কিছুই নেই। সেগুলো পত্রপাঠ তাদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে। বাকি রইল, অসামাজিক বা বিপ্লবী কার্যকলাপ। এই ব্যাপারটা বিপদজনক কারণ যারা এসব কাজ করে তারা তাদের কাজের কোনো সাক্ষীসাবুদ রাখতে চায় না। যদি সেকরম হয় তাহলে একেবারে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে হবে, টুঁ শব্দটিও করা চলবে না। এমনকী জানলার সামনে গিয়েও দাঁড়ানো চলবে না। কৌতূহল দেখাতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা হবে। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। হেডমাস্টারমশায়ের এই দুর্গের মতো সুরক্ষিত ঘরে বিস্ফোরক ব্যবহার না-করে কেউ সহজে ঢুকতে পারবে না।
আটটা নাগাদ খেয়ে নিয়ে আলো নিবিয়ে মশারির ভেতরে ঢুকে গেলুম। কী হয় তার অপেক্ষা করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ একটা অস্বস্তির মধ্যে ঘুম ভেঙে গেল। তার কারণটা খুঁজতে গিয়ে দেখি ঘরের ভেতরে হাওয়াটা কেমন যেন ভারী হয়ে বুকের ওপরে চেপে বসেছে। অসম্ভব গুমোট। সে সময়টা গ্রীষ্মকাল, কাজেই অমন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। জানলার বাইরে দ্বাদশীর চাঁদের আলোয় পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে অথচ অত উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও তা যেন কেমন অদ্ভুত রকমের বিষণ্ণ। তার একটা কারণ চারদিকের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। মনে হচ্ছে যেন বাইরের জগতটা নিঃশ্বাস বন্ধ করে মড়ার মতো পড়ে রয়েছে।
আমিও যতটা সম্ভব নড়াচড়া না-করে স্থির হয়ে শুয়ে রইলুম। আমার মন বলছিল যে কিছু-একটা ঘটতে চলেছে, আমি তারই প্রতীক্ষা করতে লাগলুম। ঠিক করলুম যে কী ঘটে সেটা দেখে আমার কর্তব্য স্থির করব, আগেভাগে কোনো কৌতূহল দেখাব না।
মিনিট পনেরো বাদে হঠাৎ একটা ক্ষীণ খসখস শব্দ শুনতে পেলুম। আমার শ্রবণশক্তি এমনিতে খুব জোরালো, তবু চারদিক যদি একেবারে নিস্তব্ধ না হত, তাহলে হয়তো সেই শব্দ আমার কানেই আসত না। মনে হল যেন দু-একজন লোক খুব সাবধানে পা ঘষে ঘষে হেঁটে আসছে। আওয়াজটা ঠিক আমার জানলার নীচে এসে থামল। খুব নীচু গলায় কে যেন হিসহিস শব্দ করে বিচ্ছিরিভাবে হাসল। ওইভাবেই বলল, ‘জানলাটা খোলা। কেউ আছে না কী?’ কথাগুলো জড়ানো, বীরভূম অঞ্চলের টান আছে কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হল না।
আর একটা চাপা গলা শুনতে পেলুম— মনে হয় না। এর আগের বার খেলার মাঠে গোরুটার যা অবস্থা করেছিলুম আমরা, তারপরে কি আর কেউ থাকবে? দেখছিস না, এখানকার লোকগুলো খুব সাবধান হয়ে গেছে? অবস্থাটা একটু না থিতোলে এখানে কিছু হবে না। মনে হচ্ছে, আমাদের অন্য একটা গ্রাম ধরতে হবে। যাহোক, এসেছি যখন, তখন চল একবার দেখি ভেতরে কেউ আছে কি না।
যারা কথা বলছিল, তারা আবার যেন পা ঘষে ঘষে জানলার তলা থেকে সরে গেল। আমার কেমন একটা ধাঁধা লেগে গেল। ওরা কারা? ভেতরে কেউ আছে কিনা জানবার জন্য তারা জানলা দিয়ে উঁকি মারল না কেন? ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছে না ঠিকই, কিন্তু চাঁদের আলোয় তারা মশারি খাটানো বিছানাটা নিশ্চয়ই দেখতে পেত। খেলার মাঠে একটা গোরুকে কী করা হয়েছিল যাতে স্কুলবাড়িতে কেউ থাকতে পারে না? এই দুটো ব্যাপারের মধ্যে কীসের সম্পর্ক?
এইসব চিন্তার মধ্যে হঠাৎ শুনতে পেলুম হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরে ঢোকার দরজায় কেউ প্রবলবেগে ধাক্কা দিচ্ছে। সেইসঙ্গে মেয়েলি গলায় আর্তনাদ— ঘরে কেউ আছেন? দরজাটা একটু খুলুন না। ভীষণ বিপদে পড়েছি। দয়া করে একটু আশ্রয় দেবেন?
আর্তনাদটা এতই করুণ যে আমার প্রথমেই প্রবল ইচ্ছে হল দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেবার। মশারি তুলে বেরুতে যাচ্ছি, হঠাৎ হেডমাস্টারমশাইয়ের সাবধান করে দেওয়া কথাগুলো মনে পড়ে গেল। এই তাহলে সেই ডাকাডাকি। এতো ভূত বা নিশির ডাকের মতো কিছু নয়। যে কণ্ঠস্বর শুনলুম সেতো মানুষের গলা। খুব সম্ভবত কোনো পুরুষ মেয়েলি গলা করে ডাকছে। উদ্দেশ্য কী? সেটা যে ভালো নয় তাতো বুঝতেই পারছি। একটু আগে যে কথোপকথন শুনেছি তাতে তো উদ্দেশ্যটা ডাকাতি বলে মনে হচ্ছে না। তাহলে সেটা কী হতে পারে?
কিছুক্ষণ বাদে আর্তনাদ বন্ধ হল। আমি এত ক্লান্ত ছিলুম যে চেষ্টা করেও জেগে থাকতে পারলুম না। ঘুমিয়ে পড়লুম।
পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, হাতঘড়িতে দেখলুম ছ-টা বাজছে। বাইরে উজ্জ্বল সকাল, দূর থেকে ভেসে আসছে লোকজনের গলা, গোরুর ডাক, মুরগির আওয়াজ। আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লুম। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে বারন্দায় দাঁড়ালুম। কাল রাত্রে কারা এসেছিল তার একটু খোঁজ করা দরকার।
ভালো করে বারান্দার সিমেন্ট-বাঁধানো মেঝে পরীক্ষা করে দেখলুম। একটা-দুটো পায়ের ছাপ দেখতে পাব আশা করছিলুম। আশ্চর্য ব্যাপার, একটাও পেলুম না। বারান্দার নীচে লাল ধুলোর ওপরে কয়েকটা জুতোর ছাপ পেলুম বটে, কিন্তু মেপে দেখি সেগুলো আমারই। তবে, বারান্দার ওপরে আর নীচে লাল ধুলোর ওপরে কতগুলো অদ্ভুত দাগ আমাকে চিন্তিত করে তুলল। ক্ষীণ আঁচড় কাটার মতো দাগগুলো এঁকেবেঁকে কুয়োতলা পাক খেয়ে ঘুরে চলে গেছে স্কুলের বাইরে। আমি দাগগুলো অনুসরণ করতে করতে চলে এলুম খেলার মাঠের ওপরে। দেখলুম, মাঠ পেরিয়ে দাগগুলো চলে গেছে দূরের জঙ্গলটার দিকে। তখন আর ওদিকে যাওয়ার কোনো মানে হয় না, তাই স্থির করলুম যে একটু বেলা হলে লোকজন নিয়ে দাগগুলো কোথায় যায় সেটা খোঁজ করে দেখতে হবে।
স্কুলের সামনে এসে পৌঁছোতেই দেখি হেডমাস্টারমশাই আর জনা পাঁচেক ভদ্রলোক ভয়ানক চিন্তিত মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে দেখে খুশি হওয়ার চেয়েও তাঁদের মুখে স্তম্ভিত হবার ভাবটাই বেশি বলে মনে হল। আমি যে আমিই, সে ব্যাপারে দেখলুম তাঁদের যেন বেশ সন্দেহ রয়েছে। পারলে আমার গা হাত-পা টিপেটুপে দেখেন আর কী! হেডমাস্টারমশাই তো চেঁচিয়েই উঠলেন, ‘কোথায় ছিলেন আপনি, বিদ্যুৎবাবু? আমরা চিন্তায় মরছি। কাল রাত্রে সব ঠিকঠাক ছিল তো?’
আমি যথাসাধ্য স্বাভাবিকভাবে বললুম, ‘সব ঠিকই ছিল। আমি একটু মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিলুম। আপনি আজ কখন আসছেন এখানে? কাগজপত্র সব তৈরি আছে তো?’
আমার নিরুত্তাপ কথা শুনে হেডমাস্টারমশাই একটু যেন হতাশ হলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আছে।’
‘একটু তাড়াতাড়ি আসবেন। অন্য মাস্টারমশাইরা আসবার আগে আপনার কাছ থেকে সব ব্যাপারটা জেনে নিতে চাই।’
হেডমাস্টারমশাই আমার কথার ইঙ্গিতটা বুঝলেন। বললেন, ‘তাই হবে।’
হেডমাস্টারমশাইয়ের মুখে যা শুনলুম তাতে তো আমি স্তম্ভিত। গত পঞ্চাশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে বাঘেরহাট আর তার আশেপাশের কয়েকটা গ্রামে না কি বাসুকির অভিশাপ লেগেছে। খেলার মাঠের পেছনে যে জঙ্গল রয়েছে, সেখানে না কি নাগরাজ বাসুকির চেলাচামুণ্ডারা আস্তানা গেড়েছে। তারা সেখান থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে এসে বাঘেরহাট বা অন্যান্য গ্রামগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। তখন যা হতে থাকে তা অতি ভয়াবহ। গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি এমনকী মানুষ পর্যন্ত, যা বাইরে পায় তাই তুলে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলে আর তাদের ভুক্তাবশেষ যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রেখে যায়। যখন কিছু পায় না, তখন তারা মানুষের গলায় ডাকে। যে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বাইরে আসে, সে তৎক্ষণাৎ তাদের শিকারে পরিণত হয়। এখানে বেশ কয়েক জন এইভাবে প্রাণ হারিয়েছে। সমস্ত গ্রাম এইসময় আতঙ্কে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। সন্ধ্যের আগেই সব বাড়িতে দরজায় খিল পড়ে যায়, গোরু-বাছুর আর হাঁস-মুরগি ঘরের ভেতরে নিয়ে আসে। এরকম আগে মাস খানেক ধরে চলত, এখন দিনদশেক চলে তারপর সাত-আট মাস বা একবছরের জন্য সব শান্ত থাকে। আবার শুরু হয়। অন্যান্য গ্রামেও একই অবস্থা। তবে, একসঙ্গে দুটো গ্রাম আক্রান্ত হয়নি আজ পর্যন্ত।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘বাসুকির চেলা কথাটার মানে কী?’
হেডমাস্টারমশাই খুব গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আসলে এরা সাপ, মানুষের মূর্তি ধরে আসে। দু-একজন খুব সাহসী লোক পূর্ণিমার রাতে জানলা ফাঁক করে এদের দেখেছে। ছোটো ছোটো বাচ্চাছেলের মতো দেখতে। রাজাবাবুর এক দরোয়ান একবার ওদের দিকে বন্দুকের গুলি চালিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর কারণ সাপের বিষ; যদিও তার শরীরে কোনো ছোবলের দাগ ছিল না। একটা কুকুর তাদের তাড়া করতে গিয়ে একইভাবে একই কারণে মারা যায়। লোকেদের ধারণা যে এরা চোখের মধ্যে বিষ ছুড়ে দিয়ে ওদের মৃত্যু ঘটিয়েছে।’
হেডমাস্টারমশাইয়ের কথা শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারলুম না। জিজ্ঞাসা করলুম, ‘বিষটা যে সাপের সেটা বুঝলেন কী করে?’
‘আমরা গ্রামের মানুষ। এ ব্যাপারে আমাদের ভুল হতে পারে না, বিদ্যুৎবাবু।’
‘বিষ যে ছুড়েছে সে মানুষের রূপধারী সাপ না-হয়ে স্রেফ মানুষ হলে কোনো আপত্তি আছে কী?’
‘আছে। যারা আসে তাদের মানুষের মতো দেখতে হলেও, তাদের কোনো পায়ের ছাপ পড়ে না। তারা যেখান দিয়ে যায় সেখানে মাটির ওপর সাপের চলার আঁকাবাঁকা দাগ দেখা যায়।’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ, সেরকম দাগ আমিও দেখেছি বটে। সেগুলো ফুটবল মাঠের ওপর দিয়ে জঙ্গলের দিকে চলে গেছে। কিন্তু কী জানেন, সাপ মানুষের মূর্তি ধরে আসে— একথাটা বিশ্বাস করা কঠিন। যারা আসে তারা মানুষই। ক্ষুধার্ত, ক্ষিপ্র, নৃশংস আর অত্যন্ত চতুর নরখাদক মানুষ। তারা খুব সম্ভবত ওই জঙ্গলটায় থাকে। আপনারা কি কখনো জঙ্গলটা খুঁজে দেখেছেন বা ওখানে একদল নরখাদক লোক থাকে বলে জনশ্রুতি শুনেছেন?’
‘না, সেরকম কখনো কিছু শুনিনি। আর জঙ্গলটা আমি এখানে আসার পর খোঁজা হয়নি বটে; কিন্তু পনেরো-কুড়ি বছর আগে রাজাবাবুর বাবা রামচন্দ্র রায় লোকজন নিয়ে বেশ কয়েক বার ওখানে গিয়েছিলেন। কিছুই পাননি। তারপর একবার ওখান থেকে ফেরবার সময় ওঁর দলের একেবারে পেছনের দু-টি লোক সাপের বিষে মারা যায়। তখন থেকে আর কেউ ওদিকে যায়নি।’
‘পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি?’
‘হয়নি আবার? কৃষ্ণরামপুরের থানায় অনেকবার খবর দেওয়া হয়েছে, কোনো ফল হয়নি। আসেই-না কেউ। কড়াই চড়ে নদী পেরিয়ে আসতে বাবুদের বয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে একবার এসেছিল। কিন্তু গড়িমসি করে এত দেরিতে এল যে ততদিনে আমাদের হাড়গোড় সবকিছু পরিষ্কার করে ফেলতে হয়েছিল। সেজন্যে তারা কিছুই পেল না, আমাদের গালাগালি করে চলে গেল। আসলে তারা আমাদের কথা মোটে বিশ্বাসই করে না। কেউ করে না। কলকাতার বাবুরা তো নয়ই।’
সেদিন কথাবার্তা ওই পর্যন্ত হল। কিন্তু, আমার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে রইল, কিছুতেই কাজের মধ্যে ডুবে যেতে পারলুম না। সারাদিনই অন্যমনস্ক হয়ে রইলুম। হরিদাসবাবু কাজের ফাঁকে বললেন, ‘কেন এত চিন্তা করছেন, ব্যানার্জীবাবু? রাত্রে যদি সাবধানে থাকেন তাহলে আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। কাজেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কাজ শেষ করে ফিরে যান। আমরা নিশ্চিন্ত হই।’
বললুম, ‘আমার কথা আমি ভাবছি না মুস্তাফিবাবু। আমি ভাবছি আপনাদের কথা। এই রহস্যের একটা সমাধান না-করে তো এখান থেকে যেতে পারি না।’
হেডমাস্টারমশাই হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘সর্বনাশ করেছে! না না, ওসব সমাধান টমাধানের দিকে একদম যাবেন না মশাই। আমরা ঠিকই আছি আর থাকব। আপনি ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরে গেলেই আমাদের সত্যিকারের উপকার করবেন আপনি। তা ছাড়া বাসুকির অভিশাপের তীব্রতা অনেকটা কমে এসেছে। মনে হচ্ছে হয়তো আস্তে আস্তে ভবিষ্যতে একদিন এটা কেটে যাবে।’
আমি হ্যাঁ-না কিছু না-বলে নিঃশব্দে মাথা নাড়লুম। যখন সাড়ে চারটে বাজল, খাতাপত্র বন্ধ করে হেডমাস্টারমশাইকে বললুম, ‘ব্যস, প্রথম দিন এই পর্যন্ত। এবার চলুন, আপনাদের গ্রামটা একটু ঘুরে দেখি।’
আমার কথাটা ভদ্রলোক খুব একটা সন্তুষ্টচিত্তে নিলেন বলে মনে হল না। তবে রাজি হয়ে গেলেন। আমাদের ঘণ্টা খানেক লাগল ঘুরে দেখতে। গ্রামটা নেহাত ছোটো নয়। দুটো স্পষ্ট ভাগ রয়েছে— একটাতে হিন্দুদের আর অন্যটাতে মুসলমানদের বসবাস। দু-ভাগেই দেখলুম আতঙ্কের ছায়া। অনেকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে এসে আমাকে স্কুলবাড়িতে থাকতে বারণ করলেন।
মুসলমানপাড়ার পেছনে একটি চুনকাম করা নীচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কবরখানা। তার একপাশে আর একটু দূরে আর একটা ফুট পনেরো লম্বা আর ফুট দশেক চওড়া ভাঙা-চোরা পাঁচিলঘেরা জমি। তাতে কবর-টবর কিচ্ছু নেই। অযত্নে অবহেলায় পড়ে রয়েছে, তার ওপরে গজিয়েছে আগাছার জঙ্গল। এককোনায় একটা মহুয়াগাছ ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আমি হেডমাস্টারমশাইকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘এটা কীসের জমি? এমনভাবে পড়ে রয়েছে কেন?’
হেডমাস্টারমশাই বললেন, ‘ওটা একজন সাহেবের কবর। শুনেছি পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে উনি এই গ্রামে এসেছিলেন সার্কাস দেখাতে। এখানে সাপের কামড়ে মারা যান। যতদিন না কলকাতা থেকে তাঁর আত্মীয়স্বজন এসে ওঁর দেহ তুলে নিয়ে না-যায়, ততদিন ওঁকে ওইখানে গোর দিয়ে রাখা হয়েছিল। তখনকার রাজাবাবু জমিটা দান করেছিলেন। তবে, ওখানে একজন খ্রিস্টানকে কবর দেওয়া হয়েছিল বলে জমিটা আর কেউ ব্যবহার করে না। এতদিন অমনি পড়ে রয়েছে।’
কথাগুলো আমার মনের ভেতরে হঠাৎ একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটাল। যে অজানা আতঙ্কের জন্য এই গ্রামের অসহায় লোকেরা দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, আমি যেন তার প্রকৃত কারণ খুঁজে পাবার একটা রাস্তা দেখতে পেলুম। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে, মানে ১৮৯৮ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে একজন ভবঘুরে সাহেব এখানে খেলা দেখাতে এসেছিলেন এবং এখানেই মারা যান। বোঝাই যায় যে তিনি খুব একটা পয়সাওলা লোক ছিলেন না। তিনি মারা যাবার পর তাঁর দলের লোকেদের তাঁর মৃতদেহ কলকাতায় নিয়ে যাবারও সংগতি ছিল না। এসব অত্যন্ত জরুরি খবর আর সম্ভবত এর মধ্যেই রয়েছে সমাধানের সূত্র।
হেডমাস্টারমশাইকে উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আপনার স্কুলে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া আছে? ব্রিটানিকা বা অন্য কিছু?’
হেডমাস্টারমশাই কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললেন, ‘আছে। পেয়ার্সের, তবে সাত-আট বছরের পুরোনো। কেন বলুন তো?’
‘না, এমনি। একটা কথা মনে পড়ে গেল। অসুবিধে না-হলে এখন স্কুলে ফিরে যেতে পারবেন? বইটা যদি বের করে দেন তো খুব উপকার হয়।’
‘এখন গেলে দেরি হয়ে যাবে। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমি যখন আপনার খাবার নিয়ে যাব তখন বের করে দেব। তা হলে হবে তো?’
‘হবে। আজও আপনি খাবার আনবেন? বুঝতেই পারছি, রান্না করার লোক পাওয়া যায়নি। ঠিকই তো, এই সময় কেউ কি রাত্রি বেলা তার পরিবার ছেড়ে বাইরে থাকতে চায়?’
বেশিক্ষণ লাগল না। বইটা পাওয়ার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই একটা থিয়োরি খাড়া করে ফেলা গেল। হেডমাস্টারমশাইকে বললুম, ‘কাল সকালে জগদীশবাবুর সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। তার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন?’
হেডমাস্টারমশাই বললেন, ‘দেব। সেখানে কি আমার থাকা দরকার?’
বললুম, ‘অবশ্যই।’
সে রাত্রে ভয়ংকর কাণ্ড হয়ে গেল। ঘরের বাইরে কান্নাকাটি, চ্যাঁচামেচি, দরজায় ধাক্কার পর ধাক্কা, এমনকী একজন চিৎকার করে বলে গেল— ভয়ানক ব্যাপার হয়ে গেছে, রাজাবাবু আপনাকে ডাকছেন, শিগগির বেরিয়ে আসুন। আমি বালিশে মুখ গুঁজে কাঠ হয়ে পড়ে রইলুম, নট চড়ন চড়ন নট কিচ্ছু। কেবল মনে মনে বলে গেলুম— হচ্ছে, তোমাদের ব্যবস্থা হচ্ছে। শেষরাত্রের দিকে যখন সব শান্ত হল, তখন একটু ঘুমোতে পারলুম।
আমার প্রশ্নের উত্তরে জগদীশবাবু বললেন, ‘টমাস প্র্যাট নামে এক সাহেব এখানে খেলা দেখাতে এসেছিল তা আমি জানি। তবে, কীসের খেলা, কতদিন খেলা দেখানো হয়েছিল সেসব আমি কিছুই জানি না। জানার কথাও নয় কারণ তার পরের বছর আমার জন্ম হয়। যাঁরা জানতেন তাঁরা অনেকদিনই গত হয়েছেন। ঠাকুরদার মুখে শুনেছিলুম যে সাহেব মারা যাওয়া মাত্র তার দলের সমস্ত লোকজন পত্রপাঠ পাত্তাড়ি গুটিয়ে রাতারাতি এখান থেকে পালিয়ে যায়। তখন ইংরেজ আমল, একজন সাহেব বেঘোরে মারা গেলে তার সঙ্গীসাথি দিশি লোকেদের প্রচণ্ড পুলিশি ঝামেলার ভয় ছিল। ঝামেলা হয়েও ছিল আর ঠাকুরদাকেই সব সামলাতে হয়। তবে সাহেবের সঙ্গে জন্তুজানোয়ার বোধ হয় ছিল না, থাকলে তাদের কী দশা হয়েছিল সেটাও একটা বলবার মতো কাহিনি হত।’
জিজ্ঞাসা করলুম, ‘তাহলে কীসের খেলা দেখাতে এসেছিলেন সাহেব?’
‘মাদারি-জাতীয় কোনো ইংরেজি খেলা হবে হয়তো, মানে যাকে বলে অ্যাক্রোব্যাটিক্স অথবা অন্য কিছু। কিন্তু সেই সাহেবের সঙ্গে আজকে এখানে যেসব ঘটনা ঘটছে তার কী সম্পর্ক আছে বলে তোমার মনে হয়? তোমার কি ধারণা যে সাহেব কিছু বিশেষ ধরনের সাপ নিয়ে এসেছিল যেগুলো ছাড়া পেয়ে এইসব তাণ্ডব শুরু করেছে? তুমি কী ভাবছ একটু বিশদভাবে বলোতো।’ক্তৃ
আমি তখন জগদীশবাবুকে একটা ছোটোখাটো বক্তৃতা দিয়ে ফেললুম। বললুম, ‘আপনারা তো জানেন যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই যে সমস্ত লোক বিকলাঙ্গ না-হলেও সাধারণ মানুষের থেকে অন্যরকম, যেমন ধরুন যারা ভীষণ লম্বা বা ভীষণ বেঁটে, অত্যন্ত মোটা বা অতিরিক্ত রোগা, শ্যামদেশীয় যমজ বা জোড়ালাগা মানুষ অথবা একটা শরীরে দুটো মাথাওলা লোক, এদের প্রতি আমাদের কৌতূহলের অন্ত নেই। আমার মনে আছে, ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামে রথের মেলায় একবার একটা তাঁবু পড়েছিল; যেখানে ভবানন্দ নামে একটি বাচ্চাছেলেকে দেখানো হয়েছিল যার মুখভরতি প্রকাণ্ড গোঁফ আর লম্বা চাপদাড়ি ছিল। দশটা গ্রামের লোক ভেঙে পড়েছিল তাকে দেখবার জন্য। এরকম দ্রষ্টব্যের প্রতি আকর্ষণ শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই রয়েছে। অদ্ভুতদর্শন এই মানুষদের নিয়ে খেলা দেখানোর ভ্রাম্যমাণ দল রোমান আমল বা তার আগে থেকেই খুব জনপ্রিয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং এই শতাব্দীর গোড়ায় এইধরনের বেশ কিছু দল ইউরোপ আর আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করে বেড়িয়েছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বোধ হয় আমেরিকার উইসকন্সিন রাজ্যের বারাবু শহরের রিঙ্গলিং সার্কাস। এর বেশ কয়েক জন সদস্য বিশ্ববিখ্যাত হয়ে পড়েন, যেমন দু-ফুট এক ইঞ্চি লম্বা জেনারেল টম থাম্ব, আট ফুট এগারো ইঞ্চি লম্বা রবার্ট ওয়াডলো, এক শরীরে দুটো মাথাওলা টকচি, টিংটিঙে রোগা আর বেঁটে অথচ প্রচণ্ড শক্তিধর হিরাম ও বার্নিডেভিস প্রভৃতি। সারা পৃথিবী থেকে এদের সংগ্রহ করতেন সার্কাসের মালিকরা। এঁদের দেখাদেখি অনেক নিম্নবিত্ত লোকও রাতারাতি বড়োলোক হবার আশায় এরকম সার্কাস পার্টি বানিয়ে ফেলেছিল। টমাস প্র্যাট ছিলেন এঁদেরই মতোই একজন দরিদ্র ভাগ্যান্বেষী মানুষ। সে সময় এই ধরনের সাহেবরা ভাগ্য ফেরাতে যেতেন হয় আমেরিকায় নয়তো ভারতবর্ষে। দুর্ভাগ্যবশত উনি এসেছিলেন এখানে। তাঁর জন্য অকালমৃত্যু অপেক্ষা করে বসেছিল।’
এখানে এবার আমাকে কিছু অনুমান আর কিছু কল্পনার সাহায্য নিতে হল। বললুম, ‘ধরুন, প্র্যাট সাহেব এমন এক উপজাতির লোক দিয়ে এক সার্কাসের দল গড়েছিলেন, যারা অত্যন্ত বেঁটে অথচ বিস্ময়কর শারীরিক শক্তি বা ক্ষিপ্রতার অধিকারী। আমার বিশ্বাস, এরা পিগমিদের কোনো প্রজাতির লোক, যাদের উচ্চতা বাচ্চাছেলেদের চেয়ে বেশি হয় না। এই ধরনের কিছু লোক আফ্রিকা থেকে নিয়ে এসে তাদের দিয়ে সাহেব তাঁর দল তৈরি করেছিলেন বলে মনে হয়। নিকোবরের কিছু উপজাতি আছে যারা অনেকটা এই রকমেরই তবে যতই ক্ষুধার্ত হোক-না কেন, এরা কখনোই নরমাংস খাবে না। পিগমিরাও সাধারণত খায় না তবে দুর্ভিক্ষের সময় বা অতিরিক্ত খিদের জ্বালায় এরা নরখাদক হতে পেছপা হয় না। সাহেব মারা যাওয়ায় তারা ছাড়া পেয়ে পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। তারা জঙ্গলের লোক। একবার সেখানে ঢুকে পড়তে পারলে তাদের খুঁজে বের করা অসম্ভব। অবশ্য এখন যারা আসছে, তারা প্রথমে যারা ওখানে আশ্রয় নেয় তাদের বংশধর। স্পষ্টতই, বর্তমান পরিবেশে তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে আর সেই জন্যেই তাদের আক্রমণগুলো আর তেমন ঘনঘন হচ্ছে না। হেডমাস্টারমশাই ঠিকই বলেছেন যে হয়তো ভবিষ্যতে তা একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে।
জগদীশবাবু কাষ্ঠহেসে বললেন, ‘তোমার অনুমানটা নিতান্তই ছেলেমানুষি হে! একেবারে অসম্ভব।’
‘না, অসম্ভব নয়। গুজরাটের সিদ্ধিদের কথা ভাবুন। কোন সুদূর অতীতে এক অজ্ঞাত কারণে তারা আবিসিনিয়া থেকে এসে গুজরাটের এক দুরধিগম্য জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিল। আজ পর্যন্ত তাদের চেহারা, চালচলন, হাবভাব, নাচগান ইত্যাদি সবই আফ্রিকার, কেবল পোশাক-পরিচ্ছদ আর ভাষাটা গুজরাটের। তাদের অস্তিত্বের কথা বহুদিন পর্যন্ত কেউ জানত না; কারণ আগে তারা গ্রাম বা শহরে এলেই লোকেরা তাদের রাক্ষস বা ওই ধরনের কিছু ভেবে তাদের ওপরে চড়াও হত। আবার দেখুন, আমেরিকার ওয়াইওমিং আর কানসাস অঞ্চলে এক ধরনের মানুষ থাকত বলে শোনা যায়, যাদের সাধারণ উচ্চতা আড়াই ফুটের বেশি হত না। ভূত ভেবে অন্যান্য আদিবাসীরা তাদের মেরে সাফ করে দিয়েছিল। এইসব কারণে আপনার ওই জঙ্গলের ক্ষুদ্রাকৃতি লোকগুলো যদি প্রকাশ্যে বাইরে না-আসে বা আসতে ভয় পায়, তাহলে তো আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কেবল, জঙ্গলে যখন খাবারের অনটন হয় তখনই খিদের জ্বালায় পাগল হয়ে তারা বেরিয়ে এসে জঘন্য কাণ্ডকারখানা শুরু করে দেয়।’
জগদীশবাবু বললেন, ‘দ্যাখো, আমি গেঁয়ো জমিদার। তোমাদের মতো জ্ঞান তো আমার নেই। এ গাঁয়ের আর পাঁচজনের মতো আমিও নানা কুসংস্কারে ভুগি। তবে আমি এটুকু জানি যে, পিগমি-ই হোক আর যে-ই হোক, যেকোনো আকারের মানুষ মাটির ওপরে হাঁটলে তার পায়ের ছাপ পড়ে। সাপের চলার মতো আঁকাবাঁকা দাগ পড়ে না।
‘ঠিক কথা। তবে শত্রু বা কোনো গন্ধ-শোঁকা জানোয়ার যাতে তাদের অনুসরণ করতে না-পারে সেইজন্য যদি তারা পায়ের ছাপ মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে লম্বা লতাপাতার ঘাগরা পরে কোমর দুলিয়ে হাঁটে, তাহলে এইরকমই হওয়া সম্ভব। তাদের হাঁটার সময় যে খসখস আওয়াজ পাওয়া যায় তার কারণটা তাই।’
হেডমাস্টারমশাই গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন। বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, আফ্রিকার কোনো কোনো উপজাতির লোক শিকার করতে যাওয়ার সময় এরকম করে বলে কোথাও পড়েছিলুম বটে। তা ছাড়া, বিদ্যুৎবাবুর কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে যারা এদের আক্রমণ করতে গিয়ে রহস্যময়ভাবে সাপের বিষে মারা গেছে, তারও একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।’
‘কী ব্যাখ্যা?’ জগদীশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ইংরেজিতে যাকে বলে ব্লো পাইপ। একটা সরু নলের মুখে বিষ মাখানো সুচের মতো তির রেখে অন্যদিক দিয়ে জোরে ফুঁ দিলে সেটা প্রচণ্ড বেগে ছুটে গিয়ে শিকারের শরীরে ঢুকে গিয়ে তার মৃত্যু ঘটায়। এই নল আর তির সাধারণত সরু গাছের ডাল থেকে তৈরি করে আফ্রিকার বন্য মানুষ।’
‘বেশ, তোমাদের কথা মেনে নিলুম, যদিও জানি যে এই এলাকার বাইরের কোনো লোকই তা করবে না। এখন তোমরা কী করতে বলো? আর একটা কথা। আমি তোমাদের কোনো কথাই শুনব না যদি এই ছোকরা আজ থেকে আমার এখানে না-থাকে।’
আমাকে রাজি হতে হল। তারপর শুরু হল আমাদের পরামর্শ। সেটা যখন শেষ হল তখন হেডমাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন যে, পুলিশকে খবর দেওয়া হবে কি না। জগদীশবাবু রাজি হলেন না। বললেন যে যদি আমাদের অভিযানে কিছুই পাওয়া না-যায় আর তারা বসে থেকে থেকে ফিরে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে কেঁদে মরে গেলেও তারা আর বাঘেরহাটে কোনোদিন আসবে না। তার চেয়ে সবকিছু যদি আমাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী শেষ হয়, তাহলে তাদের তখন খবর দিলেই চলবে।
কলকাতা থেকে মালপত্র এনে সব ব্যবস্থা করতে দিনদুয়েক লাগল। এর মধ্যে প্রত্যেক রাত্রেই বাসুকির চেলাদের আবির্ভাব হয়েছে, ফলে মুসলমান পাড়া থেকে গোটা কয়েক মুরগি আর হিন্দু এলাকা থেকে একাধিক ছাগল খোয়া গেছে।
আমাদের প্রতি-আক্রমণের ব্যবস্থাটা হল এইরকম—
মুসলমান পাড়ায় একটা পরিত্যক্ত আংশিক দোতলা পাকাবাড়ি ছিল। বাড়িটা বেশি পুরোনো নয়। বাড়ির মালিক গুড় ব্যবসায়ী সেলিম শেখ মাত্র কয়েক বছর আগে এখানকার পাট তুলে পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। চাবিটা রেখে গিয়েছিলেন তাঁর ভাইপো আমজাদের কাছে। বাড়িটার দোতলায় একটামাত্র ঘর। একতলায় তিন-চারটে ঘর। তার মধ্যে রান্নাঘরের পাশে একটা বড়োসড়ো গুদামঘর আমাদের রণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেওয়া হল। ঘরটার দেওয়াল বিশ ইঞ্চি চওড়া, একপাশে একটা বড়ো দরজা আর ঠিক ছাদের নীচে একটা মোটা গরাদ লাগানো ঘুলঘুলি ছাড়া জানলা টানলার বালাই নেই।
প্রথমে মোটা মোটা তক্তা স্ক্রু দিয়ে আটকে দরজাটাকে শক্তিশালী করা হল। তারপরে কপিকল আর দড়িদড়া দিয়ে বেঁধে এমন ব্যবস্থা করা হল যাতে দোতলা থেকে দড়ি ছেড়ে খুব তাড়াতাড়ি সেটা বন্ধ করে দেওয়া যায়। বাইরে এমনভাবে দুটো লোহার হুড়কো লাগানো হল যেগুলো পড়ে গেলে ভেতর থেকে খোলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে খুলতে গেলেও একজন তাগড়া লোককে হাতুড়ি মেরে তা করতে হবে।
ঠিক হল, মুসলমান পাড়ার দু-জন ডাকাবুকো ছেলে থাকবে দোতলার ঘরে আর জগদীশবাবুর সঙ্গে আমরা কয়েক জন থাকব উলটোদিকে একটা কুঁড়েঘরের ভেতরে। দু-জন দরোয়ানও থাকবে বন্দুক নিয়ে। জগদীশবাবুর কাছে একটা পিস্তল থাকবে। আমরা পালা করে দরজার একটা ফাঁক দিয়ে উলটোদিকের বাড়িটার দিকে নজর রাখব। স্কুল থেকে আনা দুটো রেফারির হুইসলের একটা রইল আমার কাছে আর একটা রইল হেডমাস্টারমশাইয়ের কাছে। তার আওয়াজ পেলেই দোতলার ছেলে দু-জন দড়ি ছেড়ে নীচের দরজাটা বন্ধ করে দেবে। আমরা না-বলা পর্যন্ত তারা নীচে নামবে না।
গুদামঘরের মেঝেয় গোটা তিনেক শাবল হাতুড়ি মেরে শক্ত করে গেঁথে দিয়ে সন্ধ্যের ঠিক আগে একটা গোরু আর দুটো ছাগল এমনভাবে বেঁধে দেওয়া হল যাতে সেগুলো ওখান থেকে খুলে নেওয়া না-যায়। তারপর সবাই যে যার নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেল। সব প্রস্তুতি শেষ, শুরু হল প্রতীক্ষা।
সেদিন পূর্ণিমা, উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের ঘরের বাইরে কী হচ্ছে তা দেখতে কোনো অসুবিধে ছিল না। রাত বারোটা নাগাদ বাসুকির চেলাদের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। প্রথমে একটা খসখস শব্দ, তারপরে দেখা গেল জনাছয়েকের একটা দল সেলিম শেখের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। আশ্চর্য ক্ষিপ্র তাদের চলাফেরা। একটা বাড়ি বা গাছের ছায়া থেকে তারা অন্য একটায় নিঃশব্দে এত দ্রুতগতিতে যাচ্ছে যে আগে থেকে জানা না-থাকলে তাদের এই গতিবিধি হয়তো আমাদের নজরেই পড়ত না।
যারা আসছে তারা কেউই সাপ বা সর্পাকৃতি নয়। তারা আগাপাস্তলা মানুষ। তাদের গায়ের রং ঘোর কালো, মাথার চুল কোঁকড়ানো, চ্যাপটা নাক, ছোটো ছোটো চোখ, খালি গা আর পরনে লম্বা ঘাসের ঘাগরা। প্রত্যেকের কোমরে ছোটো ছুরি গোঁজা আর কাঁধে ঘাস দিয়ে বোনা থলি। তবে তাদের উচ্চতা তিন থেকে সাড়ে তিন ফুটের ভেতরে। তবে বাচ্চাছেলে বা বাচ্চামেয়ের মতো নয়। বাচ্চাদের সাধারণত মাথাটা শরীরের তুলনায় বড়ো হয়— এদের মোটেই সেরকম নয়। সার্কাসের ক্লাউন বামনদের মতোও নয়। সুন্দর সুঠাম শরীর, শুধু দেখে মনে হয় যেন তারা দূরবিনের উলটোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সেলিমের বাড়ির ভেতরে তখন ছাগলদুটো তারস্বরে ডাকছিল, গোরুটাও মাঝে মাঝে হাম্বা হাম্বা করছিল। বাসুকির চেলারা বাড়িটার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। যে দরজার ভেতর দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল সেটা খোলা দেখে তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর, একজন সন্তর্পণে এগিয়ে গেল। সামান্য ইতস্তত করে ঢুকে গেল ভেতরে। একটু পরে উত্তেজিতভাবে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল। নিজেদের মধ্যে কীসব আলোচনা হল। একজন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে ফিরে গেল আর বাকিরা পালা করে ভেতরে যাতায়াত করতে লাগল। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আরও জনাদশেক চেলা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল।
আমাদের অসীম সৌভাগ্য যে যেরকম আশা করা গিয়েছিল, এরপরের ঘটনাগুলো প্রায় সেরকমই ঘটল। দু-জনকে বাইরে রেখে বাকি দলটা ভেতরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ বাদেই গোরু আর ছাগলের ডাক বন্ধ হয়ে গেল। বাইরের দু-জন এমনিতেই ছটফট করছিল। আর একটু অপেক্ষা করে তারাও ভেতরে চলে গেল। খিদের জ্বালা আর বোধ হয় তাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হল না। জগদীশবাবু ফিসফিস করে বললেন, ‘এইবার!’ অমনি দুটো হুইসল একসঙ্গে বেজে উঠল। তার পরমুহূর্তেই সেলিমের বাড়ির ভেতর থেকে দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ পাওয়া গেল। এরপর প্রথম কয়েক মিনিট কোনো শব্দ পাওয়া গেল না, বাসুকির চেলারা কেউ বেরিয়েও এল না। কিন্তু তারপরেই একটা চাপা কোলাহল শুরু হল। সে এক হৃদয়বিদারক হাহাকার। মেয়েলি গলায় ছেড়ে দেবার জন্য আকুল আকুতি। সেটা সহ্য করা যায় না।
জগদীশবাবুর মুখ কিন্তু কঠিন আর অকরুণ হয়ে রইল। দরোয়ান দু-জনকে বললেন, ‘তোমরা ওবাড়িতে যাও। দোতলার ছেলেদুটিকে বলো বাড়ি চলে যেতে। তারা যেন গুদোমঘরের ধারেকাছেও না-যায়। আর যদি দেখো যে ওই বাসুকির দল দরজাটা ভেঙে ফেলবার উপক্রম করেছে, তাহলে গুলির আওয়াজ করবে যাতে আমরা টের পাই।’
হেডমাস্টারমশাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এবার আমরা কী করব রাজাবাবু?’
‘এখন আমরা সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করব। ভোর হলেই তুমি কৃষ্ণরামপুরে চলে যাবে। থানার ওসি গঙ্গাপদ কানুনগোকে বলবে যে গোরু কাটা নিয়ে এখানে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধতে চলেছে, এক্ষুনি তাঁর আসা দরকার। এইভাবে এফআইআর করবে। বাসুকির দলের কথা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করবে না। তাহলে আর গঙ্গাপদ আসবে না। এইসব করে তোমার আসতে আসতে পরশু বিকেল তো হবেই। আজ ওরা যা খেয়েছে বা খাচ্ছে তাতে এই দু-দিন আর কিছু না-খেলেও চলে যাবে। পুলিশ এলে আমরা দরজা খোলবার কথা চিন্তা করব। যদি তোমার বেশি দেরি হয়, তখন না-হয় ঘুলঘুলি দিয়ে ওদের কিছু খাবার দেওয়া যাবে। ততদিন পর্যন্ত এই ঘরে আমরা পালা করে পাহারা দেব।’
সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না। শেষরাত্রে কান্নাকাটি চেঁচামেচি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। আমরা ভাবলুম যে ওরা বোধ হয় বিশ্রাম করছে। যখন বেলা একটু বাড়ল, তখনও কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমরা তিন-চারজন আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে চুপিসাড়ে সেলিম শেখের বাড়ির ভেতরে ঢুকলুম। দেখলুম গুদোমঘরের দরজা বন্ধই রয়েছে। আমাদের একজন বাড়ির পেছনটা ঘুরে এসে বলল যে ঘুলঘুলির গরাদগুলোও ঠিক আছে, বাঁকানো নেই। তার মানে বাসুকির দল ভেতরেই রয়েছে। অথচ, একেবারে নিঃশব্দ। কেন? চিন্তার কথা। আমরা দরজায় ধাক্কা দিলুম, চ্যাঁচামেচি করলুম। কোনো সাড়া নেই। তখন জগদীশবাবুকে খবর দেওয়া হল।
জগদীশবাবু এসে সবকিছু দেখলেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী একটি ছেলে একটা ফুটোওয়ালা কাঠের টুকরো নিয়ে মই বেয়ে ঘুলঘুলিটার কাছে উঠল। কাঠের টুকরোটি দিয়ে মুখ ঢেকে ফুটোয় চোখ দিয়ে গুদোমঘরের ভেতরে তাকিয়েই দড়াম করে মইয়ের ওপর থেকে নীচে পড়ে গেল। মাথায় জলটল দেবার পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে সে বলল যে ভেতরে অতি ভয়াবহ দৃশ্য। গোরু আর ছাগলদুটোর রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন শরীরের চারপাশে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে বাসুকির দল! দেখে মনে হয়েছে যে তারা কেউ আর জীবিত নেই।
জগদীশবাবু কথাটা বিশ্বাস করলেন না। বললেন যে এটা ওদের চালাকি হতে পারে। অতএব এবার একজন দরোয়ান মই বেয়ে উঠল। ভেতরে একবার তাকিয়েই তারস্বরে রামনাম করতে করতে ঘুলঘুলি দিয়ে বন্দুক ঢুকিয়ে একবার গুলি চালাল। তারপর নেমে এসে বলল যে সত্যিই কেউ বেঁচে নেই।
বন্দিত্বের অপমান আর যন্ত্রণা সহ্য করার চেয়ে মৃত্যুবরণ করাই শ্রেয় বলে স্থির করেছিল বাসুকির দল। পরস্পরকে বিষাক্ত সুচ ফুটিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সকলে।
জগদীশবাবু হেডমাস্টারমশাইকে কৃষ্ণরামপুরে যেতে বারণ করলেন। টমাস প্র্যাটের পরিত্যক্ত কবরে সসম্মানে সমাধিস্থ করা হল হতভাগ্য বাসুকির দলকে। মাটির ওপরে তাদের আর কোনো চিহ্ন রইল না ঠিকই তবে তারা রয়ে গেল বাঘেরহাট গ্রামের লোকগাথায়। আর রইল মহুয়া গাছটা তাদের কবরে ফুল ছড়াবার জন্য।