বালখিল্য

বালখিল্য

ক্ষুদিরামবাবুর শৈশবকালে যিনি তাঁহার নামকরণ করিয়াছিলেন, তিনি ত্রিকালজ্ঞ পুরুষ ছিলেন এরূপ মনে করিবার কোনও কারণ নাই। কিন্তু ক্ষুদিরামবাবুর পঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁহার জীবনে এমন একটি ঘটনা ঘটিল যাহার পর নামমাহাত্ম্য সম্বন্ধে নূতন করিয়া গবেষণা করিবার প্রয়োজন হইয়াছে। শেক্স্পীয়র বলিয়াছেন বটে—‘নামে কিবা করে? গোলাপ, যে নামে ডাকো, সৌরভ বিতরে।’ কিন্তু মহাকবির আপ্তবাক্য আর সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করিতে পারিতেছি না।

ক্ষুদিরামবাবুর সহিত আমার অনেক দিনের ঘনিষ্ঠতা। বয়সে আমি প্রায় পনেরো বছরের কনিষ্ঠ, তবু আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বই ছিল বলিতে হইবে। কলিকাতার ভিন্ন পাড়ায় বাস করিলেও প্রায়ই তাঁহার বাড়িতে যাতায়াত করিতাম। তাঁহার দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। গৃহিণীটি কিছু অধিক মাত্রায় প্রখরা, ক্ষুদিরামবাবুও একগুঁয়ে লোক; দু’জনের মধ্যে প্রায়ই খিটিমিটি লাগিয়া থাকিত, কদাচিৎ ঝগড়ার ঝড় বাদলে ফাটিয়া পড়িত। সন্তানাদি না থাকায় তাঁহাদের প্রকৃতিগত দূরত্বের মাঝখানে সেতুবন্ধন রচিত হয় নাই।

শহরের দক্ষিণ অংশে একটি ছোটখাটো দ্বিতল বাড়িতে এই প্রৌঢ়-দম্পতি বাস করিতেন। সংসারের যাবতীয় কাজ গৃহিণী করিতেন, ক্ষুদিরামবাবু কেবল তাঁহার লাইব্রেরি ঘরে বসিয়া বই পড়িতেন এবং অদ্ভুত যন্ত্রপাতি ও মালমশলা লইয়া বিষ-বৈদ্যের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত থাকিতেন। তাঁহাদের অর্থের অভাব ছিল না, বাড়িটিও নিজস্ব।

ক্ষুদিরামবাবু যে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁহার পাণ্ডিত্যের কোনও ছিরিছাঁদ ছিল না। আধুনিক বিজ্ঞানের সহিত হঠযোগ ও তন্ত্রমন্ত্র মিশাইয়া তিনি তাঁহার মস্তিষ্কের মধ্যে এমন এক প্রকার খিচুড়ি তৈয়ার করিয়াছিলেন যাহা সাধারণ মানুষের পক্ষে একেবারেই দুষ্পাচ্য। অনেকে মনে করিত তাঁহার মাথায় ছিট আছে। অনুমানটা মিথ্যা না হইতেও পারে; কারণ এ সংসারে কাহার মাথায় ছিট আছে এবং কাহার মাথায় নাই তাহা নির্ণয় করিবার মতো প্রকৃতিস্থ ব্যক্তি পৃথিবীতে বিরল। তবে ক্ষুদিরামবাবুর কথাবার্তা চালচলন সাধারণ মানুষের মতো ছিল না তাহা স্বীকার করিতে হইবে। তিনি প্রায় সকল সময় গেরুয়া রঙে রঞ্জিত কোট-প্যান্টুলুন পরিয়া থাকিতেন; আমি একদিন প্রশ্ন করার তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরিয়া আমাকে বক্তৃতা শুনাইয়াছিলেন। সব যুক্তি তর্ক এখন মনে নাই, এইটুকু শুধু স্মরণ আছে যে গেরুয়া কোট প্যান্টুলুন পরিলে শরীরে বৈদ্যুতিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

ক্ষুদিরামবাবুর এত পরিচয় দিবার কারণ, এই কাহিনীটি তাঁহারই জীবনের শেষ অধ্যায়ের ইতিহাস। তিনি আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু ছিলেন, কয়েকটি কারণে আমি তাঁহার কাছে কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলাম; সুতরাং তাঁহার সম্বন্ধে কোনও অতিরঞ্জিত উদ্ভট কাহিনীর অবতারণা করিতেছি এরূপ কেহ যেন মনে না করেন।

শরীরটা কিছুদিন ভাল যাইতেছিল না, তাই ক্ষুদিরামবাবুর বাড়ি যাইতে পারি নাই। হঠাৎ একদিন খবর পাইলাম, তিনি নিরুদ্দেশ হইয়াছেন। খুবই আশ্চর্য হইলাম; ক্ষুদিরামবাবু তো সাধু সন্ন্যাসী হইবার লোক নয়। তবে কিছুই বলা যায় না; গৃহিণীর সহিত অন্তর্যুদ্ধ হয়তো ভিতরে ভিতরে চরমে উঠিয়াছিল। গৃহিণীর সহিত যেখানে মনের মিল নাই, সেখানে গৃহ ও অরণ্যে তফাৎ কোথায়?

অসুস্থ শরীর লইয়াই অপরাহ্ণে বালিগঞ্জে গেলাম। দেখিলাম, সংবাদ মিথ্যা নয়। ক্ষুদি-গিন্নী অনেক বিলাপ করিলেন। বয়স চল্লিশের নিকটবর্তী হইলেও তাঁহার চালচলন একটু নবীনধর্মী। তাঁহার বিলাপের ভিতর দিয়া এই ইঙ্গিতটাই স্পষ্ট হইয়া উঠিতে লাগিল যে, পত্নীকে লোকসমাজে অপদস্থ করিবার জন্যই ক্ষুদিরামবাবু এমন রহস্যময়ভাবে অন্তর্ধান করিয়াছেন।

বস্তুত ক্ষুদিরামবাবুর অন্তর্ধানকে ঘোরতর রহস্যময় বলা যাইতে পারে। গত রাত্রে আহারাদির পর তিনি তাঁহার লাইব্রেরি কক্ষে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। দুইদিন যাবৎ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাক্যালাপ বন্ধ ছিল, সুতরাং স্ত্রী রাত্রে স্বামীর কোনও খোঁজ খবর লন নাই। আজ সকালে উঠিয়া তিনি দেখিলেন, ক্ষুদিরামবাবু রাত্রে শয়ন করিতে আসেন নাই, লাইব্রেরি ঘরের দ্বার পূর্ববৎ বন্ধ আছে। ক্ষুদি-গিন্নী উদ্বিগ্ন হইয়া দরজায় ধাক্কা দিয়াছিলেন; দরজার ছিট্কিনি কিছু আল্‌গা ছিল, কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলির পর খুলিয়া গেল। তখন ক্ষুদি-গিন্নী ঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, স্বামী নাই। তাঁহার গেরুয়া কোট প্যান্টুলুন চেয়ারের উপর পড়িয়া আছে কিন্তু তিনি অন্তর্হিত হইয়াছেন। দ্বিতলের এই ঘর হইতে বাহির হইবার অন্য কোনও পথ নাই; অবশ্য গরাদহীন একটা জানালা আছে, সেই পথ দিয়া অবতরণ করা কঠিন হইলেও একেবারে অসম্ভব নয়। ক্ষুদি-গিন্নী যথারীতি চেঁচামেচি করিয়াছিলেন কিন্তু স্বামীর সন্ধান পান নাই। শুধু তাই নয়, ক্ষুদিরামবাবুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পোষা বিড়ালটাও অদৃশ্য হইয়াছিল, তাহাকে আর খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছিল না।

একি অসম্ভব ব্যাপার! ক্ষুদিরামবাবুর প্রাণে যদি বৈরাগ্যই জাগিয়াছিল তবে তিনি সম্পূর্ণ দিগম্বর বেশে কেবল একটি বিড়ালকে সঙ্গী লইয়া বিবাগী হইলেন কেন? ইহা তো সহজ মানুষের কাজ নয়। তবে কি কোনও কারণে তাঁহার মস্তিষ্ক-বিকার ঘটিয়াছে?

ক্ষুদি-গিন্নী আমাকে লাইব্রেরি ঘরে লইয়া গেলেন। ঘরটি বেশ বড়, দেয়াল ঘিরিয়া বইয়ের আলমারি। মাঝখানে একটি দেরাজ-যুক্ত টেবিল, তাহার উপর বিবিধ আকৃতির বোতল খল্ নুড়ি প্রভৃতি অগোছালোভাবে ছড়ানো রহিয়াছে। এই ঘরে বসিয়া ক্ষুদিরামবাবুর কত আজগুবি গবেষণা শুনিয়াছি। দেখিলাম, তাঁহার চেয়ারের উপর গেরুয়া কোট প্যান্টুলুন পড়িয়া আছে; এমন কি আভ্যন্তরিক অঙ্গবাসও তিনি ফেলিয়া গিয়াছেন। ক্ষুদি-গিন্নী সখেদে টেবিল ও আলমারিগুলি দেখাইয়া বলিলেন, ‘এসব আর কিসের জন্যে ঠাকুরপো? তুমি তো অনেক জানো শোনো, এসব বিক্রি করে ফেলা যায় না?’

আশ্চর্য হইয়া বলিলাম, ‘বলেন কি বৌদি? ক্ষুদিরামদা হয়তো কালই ফিরে আসবেন। যে-বেশে তিনি বেরিয়েছেন পুলিসের হাতে পড়াও অসম্ভব নয়। তাঁর এত আদরের জিনিসপত্র বিক্রি করে ফেলতে চান?’

ক্ষুদি-গিন্নী আর কিছু বলিলেন না। স্বামীর প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা উপলব্ধি করিয়া তিনি প্রসন্ন হইলেন কিনা বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘ক্ষুদিরামদা চিঠিপত্র কিছু রেখে গেছেন কিনা খুঁজে দেখেছেন?’

‘তুমিই খুঁজে দ্যাখো ভাই, আমি তো কিছু পাইনি।’ বলিয়া তিনি ঘর হইতে প্রস্থান করিলেন।

অতঃপর টেবিল দেরাজ সবই হাঁট্কাইয়া দেখিলাম, কিন্তু চিঠিপত্র কিছু পাওয়া গেল না; ক্ষুদিরামদা কোনও কৈফিয়ত না দিয়া নিঃসাড়ে সংসার ত্যাগ করিয়াছেন। বিক্ষিপ্ত চিত্তে ঘরের এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম, ক্ষুদিরামদা কিরূপ মনোভাব লইয়া গৃহত্যাগী হইয়াছেন অনুমান করিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু চেষ্টা বিফল হইল। কোনও অবস্থাতেই তাঁহার নাগা সন্ন্যাসী হওয়া কল্পনা করিতে পারিলাম না।

একটি আলমারিরর কবাট দুই ইঞ্চি ফাঁক হইয়া ছিল। মনে হইল কাল রাত্রে হয়তো এই আলমারি হইতে বই লইয়া ক্ষুদিরামদা পড়িয়াছিলেন। সংসার হইতে বিদায় লইবার প্রাক্কালে কিরূপ বই পড়িবার ইচ্ছা তাঁহার হইয়াছিল, জানিবার ঔৎসুক্য হইল। কাছে গিয়া কাচের ভিতর দিয়া দেখিলাম প্রেততত্ত্ব ঘটিত নানা জাতীয় পুস্তক। ইংরেজী বই আছে, বাংলা আছে।

‘ওহে বিকাশ—!’

চমকিয়া উঠিলাম—কে ডাকিল? কণ্ঠস্বর চেনা চেনা, কিন্তু এত ক্ষীণ ও সুক্ষ্ম যে বিশ্বাস হয় না। রেডিও খুলিয়া দিবার পর প্রথমে যেরূপ বহু দূরাগত অস্ফুট আওয়াজ শোনা যায় এ যেন অনেকটা সেই রকম। কিন্তু কে আমাকে ডাকিল? ঘরের চারিদিকে সচকিত দৃষ্টিপাত করিলাম, কৈ কেহই তো নাই।

‘ওহে বিকাশ—!’

এবার চিনিতে পারিলাম—ক্ষুদিরামদা’র গলা; এবং তাহা আসিতেছে আলমারির ভিতর হইতে! তবে কি ক্ষুদিরামদা কোনও অভাবনীয় উপায়ে প্রেতযোনি প্রাপ্ত হইয়াছেন?

‘শুনছ? আমি এখানে।’

অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে আলমারির দরজা আর একটু খুলিলাম। অমনি নীচের থাকের পুস্তকশ্রেণীর পিছন হইতে তড়াক করিয়া একটি জীব বাহির হইয়া আসিল। আমিও তড়াক করিয়া দুই পা পিছাইয়া আসিলাম। জীবনে এত বিস্মিত কখনও হই নাই।

ভূত-প্রেত নয়—জীবন্ত ক্ষুদিরামদা। সেই টাক মাথা; সেই নিকষ কৃষ্ণ বর্ণ, নাক মুখ চোখ সবই ঠিক তেমনি আছে—কিন্তু তাঁহার দৈহিক দৈর্ঘ্য স্রেফ্ ছয় ইঞ্চি হইয়া গিয়াছে। রুমালের মতো একটা ন্যাক্‌ড়া কৌপীনের আকারে কোমরে জড়াইয়া তিনি ঊর্ধ্বমুখ হইয়া দৃপ্ত-ভঙ্গিতে আমার পানে তাকাইয়া আছেন।

আকস্মিক ধাক্কায় আমার বুদ্ধিসুদ্ধি প্রায় সবই দিশাহারা হইয়া গিয়াছিল, তবু উবু হইয়া বসিয়া তাঁহাকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিলাম। কেমন করিয়া সম্ভব হইল জানি না কিন্তু ইনি নিঃসংশয়ে ক্ষুদিরামদা’র অতি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। মাথাটি আমড়ার মতো এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সেই অনুপাতে। সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা ক্ষুদিরামদা কোন ইন্দ্রজাল প্রভাবে এমন একরত্তি হইয়া গেলেন ভাবিয়া পাইলাম না।

আলোচালের মতো দাঁত বাহির করিয়া ক্ষুদিরামদা হাসিলেন, তাঁহার সূক্ষ্ম অথচ স্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম, ‘চিনতে পেরেছ তাহলে? ভয় পেও না। আগে ঘরের দরজা চট্ করে বন্ধ করে দাও। নইলে গিন্নী দেখতে পেলেই সর্বনাশ।’

তাড়াতাড়ি গিয়া দরজার ছিট্‌কিনি লাগাইলাম। ফিরিয়া আসিয়া দেখি ক্ষুদিরামদা কার্পেটের উপর পদ্মাসনে বসিয়াছেন; কৌপীন পরিহিত বেশে তাঁহাকে বালখিল্য মুনির মতো দেখাইতেছে। আমিও তাঁহার সম্মুখে উপবিষ্ট হইলাম।

তিনি বলিলেন, ‘বড়ই বিপদে পড়েছি হে বিকাশ—’

বলিলাম, ‘তাহলে সত্যিই আপনি ক্ষুদিরামদা?’

তিনি চোখ পাকাইয়া তাকাইলেন। তাঁহার মেজাজ স্বভাবতই একটু তিরিক্ষি, তাই তাড়াতাড়ি বলিলাম, ‘না না, বুঝেছি আপনি ক্ষুদিরামদা। কিন্তু আপনার এ অবস্থা হল কি করে?’

তিনি বলিলেন, ‘সে কথা পরে বলছি। ক্ষিদেয় নাড়ী জ্বলে যাচ্ছে, আগে খাবার ব্যবস্থা কর।’

‘খাবার ব্যবস্থা! কিন্তু বৌদির কাছে খাবার চাইতে গেলে—’

‘না না, ওদিকে যেও না। ঐ আলমারির মাথায় বিস্কুটের টিন আছে নামিয়ে নিয়ে এস।’

বিস্কুটের টিন নামাইয়া কয়েকটি বিস্কুট ক্ষুদিরামদা’কে দিলাম; তিনি একটি বিস্কুট দুই হাতে ধরিয়া কুটুর কুটুর করিয়া খাইতে লাগিলেন।

রলিলাম, ‘এবার বলুন কী করে এই অদ্ভুত রূপান্তর হল।’

তিনি তখন বিস্কুট খাইতে খাইতে আরম্ভ করিলেন, আমি তাঁহার দিকে যতদূর সম্ভব ঝুঁকিয়া শুনিতে লাগিলাম— ‘আর বল কেন? বগুলাবাবার নাম শুনেছ তো? ব্যারাকপুরে এসে আছেন। কিছু দিন থেকে তাঁর কাছে যাতায়াত করছিলুম। —’

বগলানন্দ বাবাজীর নাম অনেকেই জানেন, তিনি একজন উগ্র প্রকৃতির তান্ত্রিক সাধু। বেশীর ভাগ সময় পাহাড় পর্বতে থাকেন; মাঝে মাঝে কলিকাতার উপকণ্ঠে যখন দেখা দেন তখন তাঁহার কাছে লোক ভাঙিয়া পড়ে। বাবাজী নাকি সিদ্ধপুরুষ, অনেক অলৌকিক ক্ষমতা আছে।

ক্ষুদিরামদা বলিয়া চলিলেন, ‘বাবা অষ্টসিদ্ধি লাভ করেছেন। অষ্টসিদ্ধি জানো তো? অণিমা লঘিমা—এই সব। ভাবলুম, দেখি তো সত্যিই অষ্টসিদ্ধি বলে কিছু আছে কিনা। জোঁকের মতন বাবার পেছনে লেগে গেলুম। বাবা প্রথমে কিছুতেই আমল দিতে চান না, কয়েকবার গালাগালি দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। শেষে কাল সকালবেলা নাছোড়বান্দা হয়ে বাবাকে ধরলুম। বললুম বাবা, আজকাল পৃথিবীর লোক কিছু বিশ্বাস করে না, বিজ্ঞান এসে মানুষের মাথা বিগড়ে দিয়েছে। এখন আপনি যদি অষ্টসিদ্ধি প্রমাণ করে দিতে পারেন তাহলে বিজ্ঞানের মুখে চুনকালি পড়বে, মানুষের ধর্মজ্ঞান ফিরে আসবে। শুনে বাবা বললেন, ঐসা বাৎ? আচ্ছা লেঃ! এই বলে ঝুলির ভেতর থেকে একটি পুরিয়া বার করে দিলেন। বললেন, এই পুরিয়ার মধ্যে মন্ত্রপূত গুঁড়ো আছে, মধু দিয়ে মেড়ে রাত্রে খাবি। জিজ্ঞেস করলুম, এতে কী হবে বাবা? বাবা হেসে বললেন, এখন বলব না; খেয়ে দ্যাখ্, বুঝতে পারবি।

‘পুরিয়া নিয়ে ফিরে এলুম। মনে কেমন ধোঁকা লাগল। সাধু সন্ন্যিসির মন বোঝা ভার, কি জানি বাবা যদি আমার হাত ছাড়াবার মতলবে বিষ-টিষ কিছু দিয়ে থাকেন? কিন্তু এদিকে পরীক্ষা না করলেও নয়। একবার ভাবলুম গিন্নীর ওপর পরখ করে দেখি—যায় শত্রু পরে পরে। কিন্তু তাঁকে খাওয়াব কি করে? বিশেষত এখন ঝগড়া চলছে। শেষে ভেবে চিন্তে ঠিক করলুম আমিই খাব, তবে সবটা খাব না; একটুখানি খেয়ে দেখব কোনও ফল হয় কিনা। ভাগ্যিস একটুখানি খেয়েছিলুম, নইলে, একেবারে ‘ভাইরাস’ হয়ে যেতুম, মাইক্রসকোপ দিয়েও আমাকে দেখতে পেতে না।

‘যাহোক, কাল রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর এই ঘরে দোর বন্ধ করে বসলুম। পুরিয়া খুলে দেখি, হলদে রঙের একটুখানি গুঁড়ো। খল নুড়ি মধু জোগাড় করে রেখেছিলুম, গুঁড়ো খলে দিয়ে বেশ ভাল করে মধু দিয়ে মাড়লুম। মুখরোচক একটি সুগন্ধ বেরুতে লাগল।

‘মাড়া শেষ হলে নুড়ির মাথায় যতটুকু ওঠে ততটুকু ওষুধ বেটে নিলুম। তারপর খল নুড়ি সরিয়ে রেখে চেয়ারে বসলুম।

‘দু’ মিনিট যেতে না যেতেই বুঝলুম—ওষুধ ধরেছে। শরীরের ভেতর থেকে একটা ঝাঁঝ বেরুচ্ছে। জ্বালা নয়—তাপ। মনে হল আমার শরীরের যতকিছু পদার্থ সব আগুনের তাপে বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। ক্রমে তাপ অসহ্য হয়ে উঠল, আমি অজ্ঞান হয়ে গেলুম—

‘যখন জ্ঞান হল রাত তখন দুটো। দেখি, চেয়ারের ওপর পড়ে আছি, চেয়ারটা মস্ত বড় দেখাচ্ছে। প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারলুম না, আমার কাপড়-চোপড় এত বড় হয়ে গেছে কী করে? তারপর বুঝলুম, আমিই ছোট হয়ে গেছি! কোটের পকেট থেকে অনেক কষ্টে রুমাল বার করে পরে ফেললুম। লজ্জা নিবারণ করতে হবে তো!’

এতক্ষণে ক্ষুদিরামদা’র অর্ধেক বিস্কুট খাওয়া হইয়াছে, তিনি পেটে হাত বুলাইয়া একটি উদ্‌গার তুলিলেন, বলিলেন, ‘একটু জল পেলে ভাল হত—কিন্তু জল আর কোথায় পাবে? মধু’র বোতলটা নিয়ে এস।’

মধু’র বোতল টেবিলের উপর ছিল, আনিয়া দিলাম। ক্ষুদিরামদা দুই ফোঁটা মধু পান করিয়া তৃষ্ণা নিবারণ করিলেন।

বলিলাম, ‘তারপর?’

তিনি কহিলেন, ‘তারপর অনেক কায়দা করে চেয়ার থেকে নামলুম। কিন্তু দরজা খুল্ব কি করে, ছিট্‌কিনি তো নাগাল পাব না! ঘরময় ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ভাবতে লাগলুম, এখন কী করি? ওষুধ খেয়ে যে এই অবস্থা হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। গিন্নী যদি জানতে পারেন আমি এতটুক হয়ে গেছি, তাঁর আনন্দের সীমা থাকবে না, বলবেন তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করার ফলেই আমার এই দশা হয়েছে। তার ওপর তাঁর যে রকম বিষয়-বুদ্ধি, হয়তো আমাকে সার্কাসে দেখিয়ে টাকা রোজগারের ফন্দি বার করবেন। সুতরাং আর যাই করি গিন্নীকে জানতে দেওয়া হবে না। তোমার ওপর আমার আদেশ রইল একথা কাউকে বলবে না।’ বলিয়া কটমট করিয়া আমার পানে তাকাইলেন।

দেখিলাম, তাঁহার আকৃতি ছোট হইয়া গেলেও প্রকৃতি আগের মতোই আছে। এতটুকু মানুষের আজ্ঞা পালন করিতে হইবে, ইহাতে মনটা খুঁতখুঁত করিতে লাগিল। কিন্তু তবু অমান্য করিবার উপায় নাই, তিনি গুরুজন। আপাতত আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইয়া প্রশ্ন করিলাম, ‘রাত্রে আর কিছু ঘটেনি?’

তিনি চক্ষু ঘুরাইয়া বলিলেন, ‘ঘটেনি আবার? ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ এক সময় দেখি, জানলা দিয়ে একটা প্রকাণ্ড বাঘ ঘরে ঢুকছে। তারপরই বুঝতে পারলুম, বাঘ নয় গিন্নীর পোষা বেড়ালটা; কার্নিশ দিয়ে এসে জানালা খোলা পেয়ে ঘরে ঢুকেছে।

‘বেড়ালটা আমাকে দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ ল্যাজ ফুলিয়ে চেয়ে রইল, তারপর দাঁত খিঁচিয়ে আমাকে ধরতে এল। আমার অবস্থা বুঝতে পারছ, বেড়ালের হাতেই বুঝি প্রাণটা যায়। ঘরময় ঘোড়দৌড় করে বেড়ালুম, পেছনে বেড়াল। ধরে আর কি। ভাগ্যে এই সময় চোখে পড়ল আলমারির দরজা একটু ফাঁক হয়ে আছে, সুট্‌ করে ঢুকে পড়লুম। আলমারির দরজা এত কম ফাঁক ছিল যে বেড়ালটা ঢুকতে পারল না।

‘যাক, এ দফা প্রাণটা তো বাঁচল। আলমারির মধ্যে বইয়ের মাথায় বসে কাচের ভেতর দিয়ে দেখতে লাগলুম, বেড়ালটা গর্‌ গর্ করতে করতে সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর যখন দেখলে আমাকে ধরবার কোনও আশা নেই তখন গিয়ে টেবিলের ওপর উঠল। খলের মধ্যে বাকি ওযুধটুকু ছিল, দেখি তাই চেটে চেটে খাচ্ছে।

‘তারপর পাঁচ মিনিটও কাটল না, দেখতে দেখতে বেড়ালটা ছোট হয়ে বেবাক অদৃশ্য হয়ে গেল, ফোলানো রবারের বেলুন হাওয়া বেরিয়ে গেলে যেমন কুঁচকে যায় ঠিক সেই রকম। সে হয়তো এখনও এই ঘরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিন্তু এত ছোট চোখে দেখতে পাবে না।’

কাহিনী শেষ করিয়া ক্ষুদিরামদা বলিলেন, ‘একে বলে অষ্টসিদ্ধি। অষ্টসিদ্ধির প্রথম কিস্তি হচ্ছে অণিমা—অর্থাৎ অণুর মতো ছোট হতে পারা। বগুলাবাবা ঠক জোচ্চোর নয়, আসল সিদ্ধপুরুষ। হাতে হাতে প্রমাণ করে দিয়েছেন।’

আমি আবেগভরে বলিলাম, ‘এই অদ্ভুত ব্যাপার যখন জগতে প্রচার হবে তখন পাশ্চাত্যের জড়বাদীরা বুঝবে, ভারতের আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে কী জিনিস আছে—’

ক্ষুদিরামদা অধীরভাবে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘ও সব পরের কথা। এখন আমাকে আবার স্বাভাবিক চেহারায় ফিরে যেতে হবে—’

বলিলাম, ‘কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? প্রত্যক্ষ প্রমাণ না দেখাতে পারলে পশ্চিমের নাস্তিকেরা—’

‘উচ্ছন্নে যাক পশ্চিমের নাস্তিকেরা। তাদের জন্য আমি ছ’ইঞ্চির মানুষ হয়ে জন্ম কাটাতে পারব না।’

‘তবে কি করবেন?’

‘শোনো, তোমাকেই এ কাজ করতে হবে। এখনি তুমি ব্যারাকপুরে বগুলাবাবার কাছে যাও; তাঁকে আমার সব কথা বলে তাঁর কাছ থেকে কাটান্-ওষুধ নিয়ে আসবে। বাবা একটু তেরিয়া মেজাজের লোক, কিন্তু তাঁর দাঁত খিঁচুনিতে ভয় পেয়ো না। লেগে থাকলেই বাবা প্রসন্ন হবেন। বুঝলে? এখনি বেরিয়ে পড়—’

এই সময় দ্বারে করাঘাত হইল। ক্ষুদিরামদা কথা শেষ করিলেন না, বিদ্যুৎ বেগে গিয়া আলমারির মধ্যে লুকাইলেন। আমি গিয়া দরজা খুলিয়া দিলাম।

বাহিরে ক্ষুদি-গিন্নী দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহার চোখে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি। ঘরে প্রবেশ করিয়াই তিনি বলিলেন, ‘দোর বন্ধ করে কি হচ্ছিল?’ সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল বিস্কুটের বাক্স ও মধু’র বোতলের উপর। তিনি বিস্ফারিত নেত্রে চাহিয়া বলিলেন, ‘একি ঠাকুরপো, তুমি বিস্কুট খাচ্ছিলে! ক্ষিদে পেয়েছিল আমাকে বললেই হত, আমি জলখাবার আনিয়ে দিতুম।’

লজ্জায় মাথা কাটা গেল। কিন্তু উপায় কি? ক্ষুদিরামদা’কে শত্রুহস্তে ধরাইয়া দিতে পারিলাম না, চুরি করিয়া খাওয়ার দায় ঘাড়ে লইয়া লজ্জিত মুখে বলিতে হইল, ‘না না বৌদি, আপনাকে এই অবস্থায় মিছে কষ্ট দেব না, তাই—। আচ্ছা, আজ আমি চলি, কাল সকালে আবার আসব। ক্ষুদিরামদা’র চিঠিপত্র কিছু পেলুম না, কাল আবার আলমারিগুলো ভাল করে খুঁজে দেখতে হবে। আপনি কিছু ভাববেন না, ইয়ে—ক্ষুদিরামদা নিশ্চয় ফিরে আসবেন।’

নীরস কণ্ঠে ক্ষুদি-গিন্নী বলিলেন, ‘তাই বল ভাই।’

সেখান হইতে বাহির হইয়া সটান ব্যারাকপুরে গেলাম। পৌঁছিতে রাত্রি হইয়া গেল। খোঁজ খবর লইয়া জানিলাম, বগুলাবাবা আজ সকালেই হরিদ্বার যাত্রা করিয়াছেন।

খুব যে দুঃখিত হইলাম তা নয়। আশু বড় হইবার সম্ভাবনা নাই দেখিয়া ক্ষুদিরামদা হয়তো সাধারণে আত্মপ্রকাশ করিতে রাজী হইতে পারেন। পরদিন সকালবেলা ক্ষুদিরামদা’র জন্য কাগজে মুড়িয়া একটি সন্দেশ এবং হোমিওপ্যাথিক শিশিতে এক শিশি জল পকেটে লইয়া তাঁহার বাড়িতে উপস্থিত হইলাম।

ক্ষুদি-গিন্নীর চেহারা দেখিয়া কিন্তু আশ্চর্য হইয়া গেলাম! কাল কান্নাকাটি সত্ত্বেও চেহারার এমন কিছু অবনতি লক্ষ্য করি নাই; আজ দেখিলাম তাঁহার চোখের কোলে কালি, মুখে একটা শঙ্কিত সচকিত ভাব। জিজ্ঞাসা করিলাম, কী হয়েছে বৌদি?

তিনি শুষ্কমুখে বলিলেন, ‘কী জানি ভাই, কাল রাত্তির থেকে কেবলই ভয় পাচ্ছি। এ বাড়ির বোধ হয় কোনও দোষ হয়েছে।’

‘সে কি, ভূত-প্রেত কিছু দেখেছেন নাকি?’

‘না, দেখিনি কিছু—কিন্তু—’ তিনি ঢোক গিলিয়া অন্য কথা পাড়িলেন, ‘আমার আর এ বাড়িতে মন টিকছে না ঠাকুরপো। ভাবছি কিছুদিনের জন্যে রাণাঘাটে দিদির কাছে গিয়ে থাকি—’

প্রস্তাবটা মন্দ লাগিল না। বলিলাম, ‘বেশ তো। এ বাড়িতে কাকে রেখে যাবেন?’

‘ভাবছি বাড়িতে তালা দিয়ে যাব।’

এ আবার এক নূতন হাঙ্গামা। ক্ষুদিরামদা কি বাড়িতে বন্ধ থাকিয়া শেষে অনাহারে মারা পড়িবেন? জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তা কবে যাচ্ছেন?’

‘আজ বিকেল সাড়ে তিনটের গাড়িতে।’

সুতরাং একটা বিলিব্যবস্থা করিতে হইবে। তাঁহাকে বলিলাম, তাহলে ‘আপনি বাঁধা-ছাঁদা করুন গিয়ে, আমি আর একবার লাইব্রেরিটা দেখে নিই।’

এই সময় ক্ষুদি-গিন্নীর কয়েকটি সহানুভূতিশীল বান্ধবী আসিয়া পড়িলেন। ভালই হইল, তিনি বান্ধবীদের লইয়া ব্যস্ত থাকিবেন, আমার কার্যকলাপের উপর নজর রাখিতে পারিবেন না। আমি লাইব্রেরিতে ঢুকিয়া দ্বার বন্ধ করিলাম।

ক্ষুদিরামদা আলমারি হইতে বাহির হইলেন, তাঁহাকে সন্দেশ ও জল খাইতে দিলাম। বগুলাবাবা চলিয়া গিয়াছেন শুনিয়া তিনি অত্যন্ত বিমর্ষ হইলেন। তারপর যখন শুনিলেন যে আজই অপরাহ্ণে গৃহিণী বাড়িতে তালা লাগাইয়া রওনা দিতেছেন তখন তিনি মাথায় হাত দিয়া বসিলেন।

বলিলেন, ‘দেখছ কী সাংঘাতিক মেয়েমানুষ!’

আমি বলিলাম, ‘তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। হাজার হোক মেয়েমানুষ, একলা রাড়িতে থাকতে ভয় করছে।’

ক্ষুদিরামদা’র মুখে একটি বাঁকা হাসি দেখা দিল, ‘ভয় তো করবেই, আমি ভয় দেখিয়েছি।’

‘অ্যাঁ—সে কি?’

অত্যন্ত পরিতৃপ্তির সহিত তিনি বলিলেন, ‘হুঁ। কাল রাত্তিরে দরজা খোলা ছিল, শোবার ঘরে ঢুকেছিলুম। গিন্নী ভারি আরামে ঘুমোচ্ছিলেন—হুঁ হুঁ—তাঁর চুল ধরে টেনেছি, পায়ে সুড়সুড়ি দিয়েছি, আলো নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকারে খিক্ খিক্ করে হেসেছি। গিন্নীর অবস্থা যদি দেখতে—’ বলিয়া তিনি দুই হাতে পেট চাপিয়া খিক্ খিক্ করিয়া হাসিতে লাগিলেন।

আমি বলিলাম, ‘ছি ক্ষুদিরামদা, এ আপনার উচিত হয়নি। অবলা ভদ্রমহিলা—তাঁকে ভূতের ভয় দেখানো—’

তিনি বিদ্রোহীর মতো ঘাড় বাঁকাইয়া বলিলেন, ‘কেন ভয় দেখাব না? সারা জীবন জ্বালিয়েছে আমাকে। কিন্তু সে যাক, এখন আমার উপায় কি হবে বল।’

পরামর্শ করিয়া উপায় স্থির হইল। আমি প্রস্তাব করিয়াছিলাম যে, তাঁহার গৃহিণীকে সব কথা বলিয়া তাহাকেও দলে লওয়া হোক, কিন্তু ক্ষুদিরামদা সতেজে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিলেন। ছয় ইঞ্চি শরীর লইয়া কিছুতেই তিনি গৃহিণীকে দেখা দিবেন না। অগত্যা স্থির হইল, আমি তাঁহাকে লইয়া গিয়া নিজের কাছে রাখিব। আমি একলা মানুষ, আমার বাসায় থাকিলে সহজে ধরা পড়িবার ভয় নাই।

পাঞ্জাবির পকেটে ক্ষুদিরামদা’কে পুরিয়া চাদরটা ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া লইলাম। তারপর দূর হইতে বৌদির নিকট বিদায় লইলাম। তাঁহার বেশী কাছে যাইতে সাহস হইল না; তিনি যেরূপ সন্দিগ্ধ প্রকৃতির লোক, লাইব্রেরি হইতে কোনও মুল্যবান বস্তু চুরি করিয়া লইয়া পলাইতেছি মনে করিয়া খানাতল্লাসী আরম্ভ করিলেই বিপদ। যাহোক, তিনি বান্ধবীদের লইয়া ব্যস্ত ছিলেন, কোনও বিভ্রাট ঘটিল না।

ক্ষুদিরামদা আমার বাসায় আসিয়া অধিষ্ঠিত হইলেন। অতঃপর তাঁহার কাহিনী যথাসম্ভব সংক্ষেপে শেষ করিব। ইহা যদি কাল্পনিক কাহিনী হইত তাহা হইলে বেশ একটা জোরালো উপসংহার উদ্ভাবন করিয়া পাঠককে চমৎকৃত করিবার চেষ্টা করিতাম। কিন্তু সত্য ঘটনা climax-এর ধার ধারে না, বরং anticlimax-এর দিকেই তাঁর ঝোঁক বেশী। ক্ষুদিরামদা’র কাহিনীর পরিসমাপ্তি পড়িয়া যদি কেহ নিরাশ হন আমার দায়-দোষ নাই, আমি নিছক সত্য কথা লিপিবদ্ধ করিয়া খালাস।

আমার বাসায় আমার শয়ন ঘরে একটি ঝাঁপির মধ্যে তুলা বিছাইয়া ক্ষুদিরামদা’র বাসস্থান নির্দেশ করিলাম। নরম বিছানা পাইয়া প্রথমেই তিনি খুব খানিকটা ঘুমাইয়া লইলেন।

তারপর তাঁহার নানাবিধ ফরমাস আরম্ভ হইল। বুরুশ দিয়া দাঁত মাজিবেন, দাড়ি কামাইবেন, রুমাল পরিয়া আর থাকিবেন না, ইত্যাদি। গেরুয়া কোট প্যান্টুলুন যদি একান্তই সম্ভব না হয়, অন্তত ধুতি পাঞ্জাবি তাঁহার চাইই। ধুতি সহজেই ন্যাকড়া ছিঁড়িয়া তৈয়ার হইল, কিন্তু পাঞ্জাবি লইয়া বিশেষ বেগ পাইতে হইল। অবেশেষে পুতুলের জামা তৈয়ার করাইতেছি এই ছল কবি এক দর্জিকে দিয়া পাঞ্জাবি তৈয়ার করাইয়া লইলাম। ধুতি পাঞ্জাবি পরিয়া ক্ষুদিরামদা ভারি খুশি হইলেন। কিন্তু তাঁহার মাপের জুতা কোনও মতেই জোগাড় করা গেল না। বুরুশ দিয়া দাঁত মাজা ও দাড়ি কামাইবার সাধও তাঁহার অপূর্ণ রহিয়া গেল।

সর্বশেষে তিনি বায়না ধরিলেন, হরিদ্বারে গিয়া বগুলাবাবাকে পাকড়াও করিবেন। এ বায়না তাঁহার পক্ষে নেহাত অযৌক্তিক নয়। আমার ডাক্তারও কিছুদিন হইতে আমাকে হাওয়া বদল করিবার অনুজ্ঞা জানাইতেছিলেন, সুতরাং এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে হরিদ্বার যাওয়াই সাব্যস্ত হইল।

ক্ষুদিরামদা’কে ঝাঁপিতে লইয়া হরিদ্বার রওনা হইলাম। পথে যেসব বিপদে আপদ ঘটিয়াছিল, ক্ষুদিরামদা ধরা পড়িতে পড়িতে কিরূপ বাঁচিয়া গিয়াছিলেন, বাহুল্য ভয়ে তাহা আর বর্ণনা করিলাম না।

হরিদ্বারে এক ধর্মশালায় আশ্রয় লইলাম। বগুলাবাবার সন্ধান সহজেই মিলিল, তিনি শহরের বাহিরে এক নির্জন স্থানে বাস করিতেছেন। ঝাঁপি লইয়া তাঁহার কাছে উপস্থিত হইলাম।

বাবা একাকী ছিলেন। উগ্রমূর্তি রক্তচক্ষু সন্ন্যাসী, আমাকে দেখিয়া কট্মট্ করিয়া তাকাইলেন। আমি তাড়াতাড়ি ক্ষুদিরামদা’কে ঝাঁপি হইতে বাহির করিয়া তাঁহার সম্মুখে ধরিয়া দিলাম। বাবা কিছুক্ষণ নিষ্পলক নেত্রে ক্ষুদিরামদা’কে নিরীক্ষণ করিলেন, তারপর তাঁহার জটিল দাড়ি গোঁফ উন্মথিত করিয়া ধমকে ধমকে হাসির লহর বাহির হইতে লাগিল। ক্ষুদিরামদা কাঁচুমাচু মুখ করিয়া হাসিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

বাবার হাসি থামিতেই ক্ষুদিরামদা জোড়হস্তে বলিলেন, ‘বাবা, এ আমায় কী করে দিলে!’

বাবা বলিলেন, ‘প্রমাণ চেয়েছিলি প্রমাণ পেয়েছিস। এখন দুনিয়ার লোককে দেখা।’

‘না বাবা, আমাকে ভাল করে দাও।’

‘ছোট হওয়া সহজ, বড় হওয়া অত সহজ নয়।’

‘তবে কি চিরকাল এমনি থেকে যাব বাবা?’

‘আগের মতো হতে তোর দশ বছর লাগবে—যদি বেঁচে থাকিস। একটু একটু করে বাড়বি। যা—আর আমাকে বিরক্ত করিস না।’ বলিয়া বাবা আকাশের দিকে চোখ তুলিয়া হাসিতে লাগিলেন।

চলিয়া আসিলাম। ক্ষুদিরামদা’র মন তো খারাপ হইলই, আমারও বুক দমিয়া গেল। দশ বছর ধরিয়া ক্ষুদিরামদা’কে বহন করিয়া বেড়াইতে হইবে! দশ বছর না হোক, পাঁচ ছয় বছর তো বটেই। হিসাব করিয়া দেখিলাম, বছরে ক্ষুদিরামদা ছয় ইঞ্চি করিয়া বাড়িবেন। আগামী বছর তাঁর দৈর্ঘ্য হইবে এক ফুট, তার পরের বছর দেড় ফুট। এইভাবে কত দিন চালাইব? ক্ষুদিরামদা’কে আমি ভক্তি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু বছরের পর বছর তাঁহাকে ঝাঁপিতে লইয়া বহিয়া বেড়াইতেছি কল্পনা করিতেই হাত-পা শিথিল হইয়া গেল। বিধাতা যে অন্তরীক্ষে থাকিয়া আমার আশু মুক্তির উপায় চিন্তা করিতেছেন তাহা তখন জানিতাম না।

বগুলাবাবার আশ্রম হইতে শহর অনেকখানি পথ। মাঝামাঝি আসিয়া ক্লান্ত পদে পথের ধারে একটি পাথরের পাটার উপর বসিলাম। ক্ষুদিরামদা ভিতর হইতে ঝাঁপি আঁচড়াইতে লাগিলেন; স্থান নির্জন দেখিয়া তাঁহাকে খুলিয়া বাহির করিয়া দিলাম।

দৃশ্যটি এখনও আমার চোখের উপর ভাসিতেছে। চারিদিকে উপলবন্ধুর ভূমি, ঊর্ধ্বে উজ্জ্বল নীল আকাশ। পথের ধারে চত্বরের মতো একটি শিলাপট্টের উপর আমি বসিয়া আছি, আর একটি ক্ষুদ্র মানবক দুই হাত আস্ফালন করিয়া পাটার উপর পায়চারি করিতেছে।

ক্ষুদিরামদা ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলিতেছেন, ‘এ রকম হবে জান্লে কোন্ শা—। বগুলাবাবা আমার সঙ্গে বজ্জাতি করেছে। নইলে ওষুধ দিয়ে আমাকে ভাল করে দিতে পারত না? নিশ্চয় পারত।’

ক্লান্ত স্বরে বলিলাম, ‘আপনি অষ্টসিদ্ধির প্রমাণ চেয়েছিলেন, এখন আর অনুযোগ করা সাজে না। বরং বাবা যা বলেছেন তাই করা উচিত, দুনিয়ার লোককে দেখানো উচিত যে ভারতের সাধনা মিথ্যে নয়। বিলেতের পণ্ডিতেরা—’

মহা খাপ্পা হইয়া ক্ষুদিরামদা পদদাপ করিলেন, বলিলেন, ‘গোল্লায় যাক বিলেতের পণ্ডিতেরা। চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো আমাকে সবাই দেখবে, গিন্নী মুখে আঁচল দিয়ে হাসবে—সে কিছুতেই হবে না।’

‘আমার কথা শুনুন—’

‘না না না—কখখনো না।’

হঠাৎ মাথায় রাগ চড়িয়া গেল। বলিলাম, ‘আপনি বড় একগুঁয়ে। নিজে ইচ্ছেয় যদি রাজী না হন আমি জোর করে সকলের সামনে আপনাকে দেখাব। কি করতে পারেন আপনি?’

সেদিন ধৈর্য হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম বলিয়া আজ দুঃখ হয়। ক্ষুদিরামদা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া হাত-পা ছুঁড়িতে লাগিলেন, চক্ষু ঘূর্ণিত করিতে করিতে বলিলেন, ‘কী—তোমার এতবড় আস্পর্ধা—’

তাঁহার কথা শেষ হইতে পাইল না। সাঁই করিয়া একটা শব্দ হইল, পরমুহূর্তেই দেখিলাম একটা চিল ক্ষুদিরামদা’কে ছোঁ মারিয়া লইয়া উড়িয়া গেল। চিলের নখের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া ক্ষুদিরামদা চিলের মতোই তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করিতে লাগিলেন। আমি ক্ষণেক হতভম্ব থাকিয়া চিৎকার করিতে করিতে চিলের পিছনে ছুটিলাম। কিন্তু কোনও ফল হইল না, চিল অবলীলাক্রমে ক্ষুদিরামদা’কে বহন করিয়া দূর আকাশে বিলীন হইয়া গেল।

মৃত্যু কখন কোন দিক দিয়া আসিবে বলা যায় না। একচক্ষু হরিণ অপ্রত্যাশিত দিক হইতে তীর খাইয়াছিল। ক্ষুদিরামদা’র জীবন যে অকস্মাৎ চিলের পেটে গিয়া পরিসমাপ্তি লাভ করিবে তাহা কে কল্পনা করিতে পারিত?

অত্যন্ত ভারাক্রান্ত চিত্তে হরিদ্বার হইতে ফিরিয়া আসিয়াছি। সাধুরা সত্যই বলিয়াছেন, সিদ্ধাই ভাল নয়। ক্ষুদিরামদা’র পক্ষে তাহা কল্যাণকর হয় নাই। তবু দুঃখ হয়, আমি যাহা দেখিয়াছি তাহা আর কাহাকেও দেখাইতে পারিলাম না।

ক্ষুদি-গিন্নীকে তাঁহার স্বামীর শোচনীয় পরিণামের কথা বলি নাই। তিনি মনে মনে এখনও আশঙ্কা করিতেছেন, হঠাৎ কোনদিন ক্ষুদিরামদা ফিরিয়া আসিবেন।

মেয়েমানুষের মনে একটু ভয় থাকা ভাল।

৬ ভাদ্র ১৩৫৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *