সর্পিল রাস্তা, চুলের কাঁটার মতো বাঁক। একপাশে ঢালের পাথুরে দেওয়াল, অন্যপাশে অতলান্ত খাদ। আপাতত বৃষ্টি থামলেও সকাল পর্যন্ত দুদিন ধরে দফায় দফায় বৃষ্টি হয়েছে। পিচ্ছিল পথ, তাই ধীরে, সাবধানে চলছিল রসময়বাবুর গাড়িটা। তিন ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে এলেও ডিমাপুর পৌঁছতে আরও ঘণ্টা চারেক সময় লাগবে। অর্থাৎ সন্ধ্যা নাগাদ রসময়বাবুর পৌঁছবার কথা ডিমাপুর। নাগাল্যান্ডের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো যেমন নির্জন তেমন মনোরম। দূরে দূরে পাহাড়ের গায়ে দু—একটা নাগা উপজাতিদের গ্রাম ছাড়া এ অঞ্চলটা জনশূন্যই বলা যেতে পারে। দু—পাশে পাহাড় আর জঙ্গল, পাহাড়ের মাথাতে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। পথের কোথাও বা ওপর থেকে নেমে আসা ঝোরা বা ছোট ঝর্ণার জল। রাস্তা ভিজিয়ে নেমে যাচ্ছে বিপরীত দিকে খাদের ভিতর। এ সব দৃশ্যই চলন্ত গাড়ির ভিতর বসে দেখছিলেন রসময়বাবু। হঠাৎ তার গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল উল্টো দিক থেকে আসা একটা গাড়িকে পথ করে দেবার জন্য। যে গাড়িটা এসে দাঁড়িয়ে পড়ল রসময়বাবুর গাড়িটার পাশে, সে গাড়ির বেশ কিছু স্থানীয় ভাষায় কথা বলল রসময়বাবুর ড্রাইভারকে। তারপর পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
সে চলে যাবার পর রসময়বাবুর সরকারি গাড়ির ড্রাইভার তাকে বলল, ‘স্যার একটা বড় সমস্যা হল!’
‘কি সমস্যা?’ জানতে চাইলেন রসময়বাবু।
ড্রাইভার বলল, ‘লোকটা বলে গেল, কিছুটা এগিয়েই একটা জায়গাতে ধস নেমেছে, রাস্তাগুলো বন্ধ। যদিও ডিমাপুরে ইতিমধ্যে খবরটা পাঠানো হয়েছে, কিন্তু তারা সে জায়গাতে পৌঁছে পাথর সরিয়ে রাস্তা তৈরি করতে অন্ধকার নেমে যাবে। হয়তো বা কাল ভোরের আগে রাস্তা চালু হবে না।’
রসময়বাবু কথাটা শুনে মৃদু চিন্তিত ভাবে বললেন, ‘তাহলে এখন কি উপায়?’ তাহলে কি রাস্তায় রাত কাটাতে হবে? নাকি আমরা যে গ্রাম থেকে এলাম, সে গ্রামেই আবার রাত্রিবাসের জন্য ফিরে যেতে হবে?’
ড্রাইভার একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘আধ ঘণ্টা আগে রাস্তার পাশে নাগা উপজাতিদের একটা ছোট গ্রাম চোখে পড়েছিল খেয়াল করেছিলেন। ওখানে গিয়ে একবার দেখা যেতে পারে এক রাতের জন্য ওখানে কোনো ঘর পাওয়া যায় নাকি? নইলে অর্ধেক রাস্তা আবার পেরিয়ে যে গ্রাম থেকে এসেছি সেখানেই যেতে হবে।’
আরতো কোনো উপায়ও নেই, কাজেই রসময়বাবু, ড্রাইভারকে বললেন, ‘তবে তাই করো।’
ড্রাইভার গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিয়ে আবার এগোল যেদিক থেকে তারা এসেছিল সেদিকেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি সেই গ্রামে পৌঁছে গেল। বেশি বড় গ্রাম নয়, গোটা কুড়ি ঘর আছে গ্রামে। বাঁশের দেওয়াল, আর তার মাথায় দু—পাশে ঢালু বাঁশের ছাউনি দেওয়া বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা তফাতে তফাতে রাস্তার গায়ে। অনেক বাড়ির সঙ্গেই আপেল গাছ বা আপেল বাগান রয়েছে। সবুজ রঙের আপেল ফলে রয়েছে গাছগুলোতে। এখানকার আপেল সবুজই হয়। তবে খেতে লাল আপেলের মতো মিষ্টি। ডিমাপুরের বাজার থেকে এ আপেল কিনে খেয়েছেন রসময়বাবু। ড্রাইভার জানাল, এ গ্রামটা হচ্ছে ‘ইয়ো’ নাগা উপজাতিদের গ্রাম। রসময়বাবুর গাড়িটা গিয়ে থামল রাস্তার পাশে একটা বাড়ির সামনে। একটা দোকান মতো বাড়িটা। তার সামনের অংশে ঝুড়িতে আপেল সহ নানা ধরনের ফল, সবজি সাজানো রয়েছে। পথ চলতি ট্যুরিস্টরা অনেক সময় আগ্রহ করে গাড়ি থেকে নেমে এসব ফল কেনে। স্থানীয় মানুষ’রা নিজেরা এসব কেনে না, তারা এসব জঙ্গল বা বাগান থেকেই সংগ্রহ করে। সেই ছোট্ট দোকানটার সামনে জটলা করছিল বেশ কয়েকজন নাগা পুরুষ। তাদের পরনে কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত জড়ানো মোটা সুতোর বোনা নাগা শাল, গলাতে পাথরের মালা, বলিষ্ঠ উন্মুক্ত বাহুতে উল্কি আঁকা। রসময়বাবু আর তার ড্রাইভার গাড়ি থেকে নামতেই কৌতূহলী হয় সেই ইয়ো নাগারা তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। রসময়বাবুর এসব জায়গা অপরিচিত হলেও তার ড্রাইভার ছেলেটা দীর্ঘ দিন ধরে সরকারি লোকদের ডিমাপুর থেকে নিয়ে যাওয়া আসা করছে এ পথে। তাই স্থানীয় ভাষা সে বুঝতে ও কিছুটা বলতে পারে। ড্রাইভার ছেলেটা লোকগুলোকে বলল, ‘আমরা ডিমাপুর ফিরছিলাম। কিন্তু সামনে ধস পড়ে পথ বন্ধ, কাল ভোর পর্যন্ত থাকার জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আর সম্ভব হলে কিছু খাবার। আর সে জন্য অবশ্যই পয়সা দেওয়া হবে।’
প্রস্তাবটা শুনে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কি সব কথাবার্তা বলল। তারপর একজন নাগা যুবক বলল, তার নাম ওকখ। তার একটা ঘর আছে গ্রাম প্রধান রিখসুর আপেল বাগানের কাছে। সে ব্যবস্থা করে দিতে রাজি। কিন্তু এ গ্রামে বাইরের লোককে থাকতে হলে গ্রাম প্রধানের অনুমতি লাগবে।’
এ সব জায়গাতে গ্রাম প্রধান বলতে ঠিক সরকার নির্বাচিত প্রতিনিধি বোঝায় না। বোঝায় গোষ্ঠী প্রধানকে। বহু দূরে দূরে অবস্থিত ছোটো ছোট উপজাতি গ্রাম গুলোকে নিয়ে একটা সরকারি সমিতি আছে ঠিকই, কিন্তু এ সব গ্রামের পরিচালক হল স্থানীয় গোষ্ঠীপতি বা গ্রাম প্রধানরাই। তারাই গ্রামের আইনকানুন বা সামাজিক—ধর্মীয় নিয়মকানুন নির্ধারণ করেন যা অনেক সময়ই তার পাশের গ্রাম অথবা বাইরের পৃথিবীর সাথে মেলে না। অনেক সময় সরকারি সামগ্রীর বিলি বণ্টনও কি হবে তাও ঠিক করে দেয় এই গ্রাম প্রধানরা। এ সব গ্রামের শাসকও তারাই। গ্রামবাসীরা গোষ্ঠী প্রধানের নির্দেশ মেনে চলে।
‘ওকখ’ নামের নাগা যুবকের কথা শুনে রসময়বাবুর ড্রাইভার বলল, ‘গ্রাম প্রধান কোথায়? আমরা তার সাথে কথা বলব।’
ওকখ তাকে অনুসরণ করতে বলল রসময়বাবুদের। কিছুটা এগিয়েই রাস্তার পাশে বেশ বড়ো একটা বাঁশের তৈরি বাড়ি। বাড়ির চালের মাথায় বেশ বড়ো একটা হরিণের শিং সমেত খুলি ঝুলছে। দরজার দু—পাশেও কোন প্রাণীর খুলি বাঁশের মাথায় পোঁতা। ওকখ দরজায় দাঁড়িয়ে গ্রাম প্রধানকে ডাকতেই সে বাইরে বেড়িয়ে এল। দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় এক নাগা। তার পরনে লাল রঙের শাল, বুক পর্যন্ত পাথরের মালা। লোকটার পিঠে ঝুলছে একটা গাদা বন্দুক, তার দু—বাহু আর গোড়ালিতে সম্ভবত ভাল্লুকের চামড়ার ব্যান্ড পরা আছে। গ্রাম প্রধান রিখসু প্রথমে সন্দিগ্ধভাবে রসময়বাবুদের দেখে নিয়ে তারপর জানতে চাইল, ‘কি ব্যাপার?’
রসময়বাবুর ড্রাইভার আর ওকখ নামের নাগা যুবক ব্যাপারটা তার সামনে বলতেই গ্রাম প্রধান বলল, ‘না, ট্যুরিস্টদের ঘর ভাড়া দেব না’
ড্রাইভার বলল, ‘আমার সঙ্গের সাহেব সরকারি লোক।’
প্রধান বলল, ‘তাহলেও আমি গ্রামে থাকার অনুমতি দেব না।’
বেগতিক দেখে রসময়বাবুর বুদ্ধিমান ড্রাইভার এবার তার মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করল। সে গ্রাম প্রধান রিখসুকে বলল, ‘ডিমাপুর থেকে তোমাদের জন্য মাঝে মাঝে যে সরকারি চাল—গম—ওষুধ পাঠানো হয় তার দেখভাল কিন্তু এই সাহেবই করেন। তাকে থাকতে না দিলে কিন্তু ভবিষ্যতে তোমাদের অসুবিধে হতে পারে।’
এ কথাটা শুনে থমকে গেল গ্রাম প্রধান। সরকারি অনুদান আসতে যদি সমস্যা দেখা যায় তবে তার সমস্যাই সবথেকে বেশি হবে। কারণ, অনুদানের খাদ্যশস্যর সিংহভাগ গ্রাম প্রধানের ঘরেই মজুত হয়। সম্ভবত এসব কথা ভেবে নিয়েই শেষ পর্যন্ত বেশ অসন্তুষ্ট ভাবেই বলল, ‘ঠিক আছে, এক রাতের জন্য থাকার অনুমতি দিলাম। কিন্তু আমাকে যেন আর বিরক্ত না করা হয়। আমি ব্যস্ত, ফল পেকেছে, কাল ট্রাক আসবে নিয়ে যেতে। ওকখ কাল ভোরে বাগানে চলে আসবে আপেল পাড়ার জন্য।’— কথাগুলো বলে ঘরের ভিতর ঢুকে গেল গ্রাম প্রধান রিখসু।
অনুমতি পেয়ে ওকখ এবার পিছু হটে রসময়বাবুদের নিয়ে ফিরে চলল সেই দোকানের দিকের রাস্তাতে। দোকান পেরিয়ে অন্য বাড়িগুলোর থেকে একটু তফাতে গ্রামে ঢোকার মুখেই তার বাড়ি। রসময়বাবুকে নিয়ে ওকখ প্রথমে উপস্থিত হল তার বাড়ির সামনে। রসময়বাবুর ড্রাইভারও গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে সেখানে নিয়ে এল। গ্রামের অন্য বাড়িগুলোর মতোই এ বাড়িটাও বাঁশের তৈরি ছোট বাড়ি। একটাই ঘর, ওকখের সাথে ঘরে ঢুকে রসময়বাবু দেখলেন ঘরটা বেশ পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন। শোবার জন্য বাঁশের মাচাও আছে। তার ওপর পরিষ্কার শাল বিছানো। ঘরের কোণে জলের পাত্রও আছে। একটা রাত সেখানে থাকতে কোন অসুবিধা হবে না। ড্রাইভার ছেলেটা বলল রাতে সে গাড়িতেই থাকবে। রসময়বাবুর মালপত্রগুলো সে গাড়ির ভিতর থেকে নামিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। ঘরের পিছন দিকে আরও একটা দরজার ঝাপ ও অন্য একপাশে একটা জানলা আছে। জানলাটা খুললেন রসময়বাবু। জানলার বাইরে দেওয়াল লাগোয়া কয়েকটা আপেল গাছ দেখা যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে যে পথে তারা ফিরবেন তার কিছুটা আর নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বড় সবুজ পাহাড়। কিছুটা দূরে একটা ছোট টিলার মতো পাহাড়ের ওপর গাছের আড়ালে একটা ঘর বা বাড়িও যেন অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ল তার। রিস্ট ওয়াচ দেখলেন রসময়বাবু। দুপুর সাড়ে তিনটে বাজে। তিনি ভাবলেন কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে বিকালবেলা একটু বাইরে বেড়িয়ে আসবেন। এমন নির্জন সৌন্দর্যে বেড়াবার সুযোগতো বড় একটা ঘটে না। রসময়বাবুর ড্রাইভার আর ঘরের মালিক ওকখ, দুজনেই দরজার বাইরে কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল। রসময়বাবু তার ড্রাইভারকে বললেন, ওর সাথে কথা বলে দেখো রাতে যদি ও কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে।’
একথা বলে দরজা বন্ধ করে ব্যাগ থেকে একটা চাদর বার করে সেটা মুড়ি দিয়ে রসময়বাবু বাঁশের মাচাতে শুয়ে পড়লেন।
২
ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রসময়বাবু। তার যখন ঘুম ভাঙলো তখন বিকাল প্রায় পাঁচটা বাজে। বাইরে একটু বেড়িয়ে আসার ইচ্ছা আছে তার। কাজেই তাড়াতাড়ি মাচা থেকে তিনি নেমে পড়লেন। বাড়ির পিছন থেকে কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছে। তার মধ্যে একটা কণ্ঠস্বর রসময়বাবুর ড্রাইভারের। তাই তিনি প্রথমে ঘরের পিছন দিকের ঝাপটা সরিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলেন। ওকখ আর তার ড্রাইভার ছেলেটা দাঁড়িয়ে আপেল বাগানের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে। রসময়বাবুও সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিশাল আপেল বাগানটা পাহাড়ের ঢাল বরাবর এগিয়েছে। পুরুষ্টু আপেল ফলে আছে গাছে। বাগানটার দিকে তাকিয়ে রসময়বাবু বললেন, ‘বেশ বড় আপেল বাগানতো!’
ড্রাইভার ছেলেটা দোভাষীর কাজ করে কথাটা বলল ওকখ’কে। রসময়বাবুর কথা শুনে ওকখ বলল, ‘হ্যাঁ, তবে এটা গ্রাম প্রধানের সম্পত্তি। ওই দেখো, বাগানটা যেখানে শেষ হয়েছে তার গায়ে রিখসুর বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। যেখানে আমরা গেছিলাম। কাল সকালে ওই বাগানে আমাকে আপেল পাড়ার জন্য যেতে হবে।’
রসময়বাবু জানতে চাইলেন, ‘কত মজুরি পাবে?’
ওকখ বলল, ‘মজুরি নয়, ও কাজ এমনিতেই করে দিতে হয় আমাদের। সবাই তাই করে।’
রসময়বাবু প্রশ্ন করলেন, ‘তোমাদের পেট চলে কি কিভাবে?’
ওকখ জবাব দিল, ‘বনের ফল—মূল—কন্দ খেয়ে। কখনও বা শিকার করা মাংস। বছরে কোন সময় সরকারি গম—চাল পাই। তবে হাতে পয়সা বলতে যে টুকু পাই তা এই আপেল থেকেই। প্রধানের বাগানের মতো বড় না হলেও আমাদের প্রত্যেকের বাড়িতেই একটা করে আপেল বাগান আছে। গাড়ি থামিয়ে অনেক সময় আপেল কিনে নিয়ে যায়।’
এ কথা বলার পর ওকখ বলল, ‘বলতে গেলে আপেলই আমাদের সবকিছু। গতবছর এ সময় বাদুড়ের খুব উপদ্রব হয়েছিল। বিশেষত রিখসুর এই বাগানে। ফল খেয়ে নষ্ট করছিল প্রাণীগুলো। জাল দিয়ে ধরে মারা হল বাদুরগুলোকে। এখন অবশ্য সে উপদ্রব নেই।’
নাগা যুবকের কথাতে রসময়বাবু বুঝতে পারলেন এ অঞ্চলের অন্য গ্রামের বাসিন্দাদের মতো এরাও খুব গরিব। তিনি তার পার্স থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বার করে এগিয়ে দিলেন ওকখ—এর দিকে। টাকাটা হাতে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখমুখ। সে বলল, ‘এত টাকা!’
ড্রাইভার ছেলেটা এরপর বলল, ‘ওকখ বলল একজন ফাঁদ পেতে একটা বন মোরগ ধরেছে। আমি ওর সাথে সেটা আনতে যাব। রাতে মোরগের ঝোল রান্না হবে। আমিই করব।’
বাড়িটা থেকে বেড়িয়ে পড়লেন রসময়বাবু। গ্রামের ভিতর দিকে না গিয়ে তিনি সেই রাস্তা ধরে এগোলেন যে রাস্তা দিয়ে পরদিন তিন ডিমাপুরের দিকে ফিরবেন। সূর্য পাহাড়ের আড়ালে মুখ লুকাতে শুরু করেছে। দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়গুলোর মাথায়, তার ঢালের জঙ্গলে। চারপাশের নিস্তব্ধতার মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু ভেসে আসছে নাম না জানা পাখির ডাক। ভারি মনোরম পরিবেশ চারিদিকে। এগোতে লাগলেন তিনি। বেশ কিছুটা এগোবার পর রসময়বাবু দেখতে পেলেন রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ওপরে একটা টিলা মতো জায়গার মাথার ওপর একটা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেটা দেখে ঠিক নাগাদের বাঁশের বাড়ি বলে মনে হচ্ছে না। বাড়িটার টিনের ছাদ আর পাথুরে দেওয়ালের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশ থেকে পাথুরে সিঁড়ির ধাপ ঢালের পা বেয়ে ওপরে বাড়িটার দিকে উঠে গেছে। বাড়িটা বন দপ্তরের বা অন্য কোনো ছোট সরকারি বাংলো নাকি?’
প্রৌঢ় রসময়বাবু আজীবন বাঙালি পোশাক পরতেই অভ্যস্ত। পরনে ধুতি—পাঞ্জাবি, পায়ে পাম শু, গায়ে শাল। তিনি শালটাকে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে, ধুতিটা একটু উঠিয়ে কৌতূহলবশত বাড়িটা দেখার জন্য পাথুরে ধাপ বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন। আলোটা একটু কমে এল। সূর্য ডুবে গেল পাহাড়ের আড়ালে। ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছে পথটা। একসময় তিনি বুঝতে পারলেন, নীচ থেকে বাড়িটা যত কাছে মনে হয়েছিল তা তত কাছে নয়। আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। একখণ্ড মেঘও যেন ভাসতে শুরু করেছে আকাশের বুকে। বৃষ্টি আসবে নাকি? রসময়বাবু ভাবলেন, অর্ধেক পথ যখন তিনি উঠেই পড়েছেন তখন বাড়িটা দেখেই ফিরবেন। আবারও উঠতে শুরু করলেন তিনি। একসময় তিনি ওপরে উঠে এলেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাথুরে দেওয়াল আর টিনের ছাদ অলা মাঝারি আকৃতির বাড়িটা। সামনের দিকে জানলাটা বন্ধ। তবে দরজা খোলা। পাহাড়ের ওপর দিক থেকে আসা বাতাসে মৃদু মৃদু নড়ছে দরজার খোলা পাল্লাদুটো। বাড়িটাকে দেখে একটা পরিত্যক্ত বাড়ি বলেই মনে হল তার। কেউ কোথাও নেই। তা দেখে মৃদু হতাশ হলে রসময়বাবু। ঠিক এই সময় চারপাশে যেন আরও আলো কমে এলো। রসময়বাবু আবারও আকাশের দিকে তাকালেন। বড় বড় পাহাড়গুলোর মাথা থেকে মেঘ নেমে এসে দ্রুত ঢেকে দিচ্ছে আকাশটাকে। বৃষ্টি নামবে। এবার ফিরতে হবে রসময়বাবুকে। এ বাড়িটাতে দেখা বা জানার মতো তো কিছুই নেই। তাই রসময়বাবু আবার তাড়াতাড়ি নীচে নামার জন্য পা বাড়াতে যাচ্ছিলেন পিছু ফিরে, ঠিক সেই সময় একটা কণ্ঠস্বর কানে এলো—’আপনি কি বাঙালি?’
এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন রসময়বাবু। তিনি দেখলেন যে বাড়িটাকে তিনি পরিত্যক্ত ভেবেছিলেন তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন লোক! সম্ভবত সে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়েই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার পরনে শার্ট—ট্রাউজার, গায়ে একটা চাদর। লোকটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকে দেখে রসময়বাবুরও বাঙালি বলেই মনে হল।
রসময়বাবু জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, বাঙালি।’
লোকটা আবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি ট্যুরিস্ট?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘না, ঠিক ট্যুরিস্ট নয়। একটা কাজে এদিকে এসেছিলাম।’
লোকটা মুহূর্তর জন্য মনে হয় কি যেন ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আসুন, ভিতরে আসুন।’
ঠিক সেই সময় একটা বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ল রসময়বাবুর হাতে। বেশ বড় বৃষ্টির ফোঁটা। বৃষ্টি শুরু হল বলে! লোকটার ডাকে সাড়া দিলে অন্তত বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। তাই একগাল হাসিমুখে রসময়বাবু এগোলেন দরজার দিকে। লোকটার পিছন পিছন তিনি প্রবেশ করলেন বাড়ির ভিতর। আর সেই মুহূর্তে ঝম ঝম শব্দে বৃষ্টি নামল বাড়ির ছাদে। দরজা দিয়ে ঢুকেই বেশ বড় একটা ঘর। একটা লন্ঠন রাখা আছে ঘরে। সেই আলোতে আধো অন্ধকার ঘরটা দেখে রসময়বাবুর ঘরটাকে বৈঠকখানা ঘর বা লাইব্রেরী রুম বলেই মনে হল। একদিকের দেওয়ালে মানুষ সমান উঁচু বই রাখার লোহার র্যাক দেওয়ালের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। যে দরজা দিয়ে রসময়বাবু ঘরটাতে ঢুকলেন তার ঠিক উল্টো দিকের দেওয়ালের গায়ে একটা বন্ধ দরজা আর জানলা আছে। সেই জানলার গায়েই একটা লম্বা টেবিল ও তার দু—পাশে দুটো চেয়ার। লন্ঠনটা টেবিলের ওপরই রাখা। লোকটা, রসময়বাবুকে টেবিলের যে প্রান্তে ঠিক বন্ধ জানলার সামনে চেয়ার রাখা আছে তাতে ইশারায় বসতে বলল। বসলেন রসময়বাবু। লোকটাও বসল তার মুখোমুখি টেবিলের অন্যদিকে। রসময়বাবু তাকালেন লোকটার মুখের দিকে। মাঝবয়সী একজন লোক। গোঁফ—দাড়ি কামানো। তবে তার সার মুখমণ্ডল জুড়ে বসন্ত রোগ বা পক্স রোগের দাগের মতো বিন্দু বিন্দু দাগ আছে। অনেকের এ সব দাগ সারাজীবন থেকে যায়। হয়তো লোকটার একসময় তেমন কোনো রোগ হয়েছিল মনে মনে ভাবলেন রসময়বাবু। তবে লোকটার পোশাক দেখে তাকে ভদ্রলোক বলেই মনে হল রসময়বাবুর। লোকটা কেমন একটা অদ্ভুত নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।
মৃদু অস্বস্তি বোধ করলেন রসময়বাবু। কথা শুরু করার জন্য তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো বোধকরি বাঙালি? কি নাম আপনার? এখানেই থাকেন?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, বাঙালি, নাম, মহেন্দ্রনাথ শীল। বছর দুই হল এখানেই থাকি। আপনার পরিচয়? কলকাতা থাকেন?’
রসময়বাবু বললেন, ‘আমার আদি বাসস্থান কলকাতা। সরকারি বদলির চাকরির সুবাদে বছর খানেক ধরে ডিমাপুর আছি। নাম, রসময় তালুকদার। গতকাল সরকারি কাজে এ জায়গার থেকেও ভিতরে একটা গ্রামে ইন্সপেকশনে গেছিলাম। সেখান থেকেই ফিরছিলাম। সামনে ধস পড়ে রাস্তা বন্ধ। তাই আপনাদের এ গ্রামটাতে রয়ে গেলাম একটা ঘর ভাড়া নিয়ে। কাল ভোরেই আবার ডিমাপুরে রওনা হব।’
একটানা কথাগুলো বলে রসময়বাবু জানতে চাইলেন, ‘আপনিও সরকারি লোক নাকি? এ জায়গাতে পড়ে রয়েছেন কেন?’
মহেন্দ্রনাথ বললেন, ‘না, ঠিক সে অর্থে সরকারি কর্মচারী নই। তবে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে জীববিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা করতাম ও গবেষণা করতাম। এ অঞ্চলের বিশেষ এক ধরণের প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে এসেছিলাম, তারপর এখানেই রয়ে গেছি।’
রসময়বাবু বললেন, ‘তবেতো আপনি পণ্ডিত লোক মশাই! সে জন্যই আপনার ঘরে এমন র্যাক ভর্তি বই! তা এখানকার কোন প্রাণী নিয়ে আপনার গবেষণা?’
বাড়ির চালের মাথাতে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে। অন্ধকারও নেমে গেছে নাগাল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই পাহাড়ি জনপদে। একটু চুপ করে থেকে ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘বাদুড়’।
‘বাদুড়’!—মৃদু বিস্মিতভাবে বলে উঠলেন রসময়বাবু।
মহেন্দ্রনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, বাদুড়। নাগাল্যান্ডের এই পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ এক প্রজাতির বাদুড় পাওয়া যায়। তাদের নিয়ে গবেষণা আর সংরক্ষণের কাজেই আমি এখানে এসেছিলাম। এক বছরের মধ্যেই সংখ্যাতে বেশ বাড়িয়েও তুলেছিলাম এদের। দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির বাদুড়।’—এ কথা বলে থেমে গেলেন তিনি।
রসময়বাবু প্রশ্ন করলেন, ‘দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির বাদুড় মানে কি?’
মহেন্দ্রনাথ তার কথায় কোন জবাব না দিয়ে তাকালেন লন্ঠনটার দিকে। বাতিটা কেমন যেন দপদপ করতে শুরু করেছে। তেল মনে হয় শেষ হয়ে এসেছে।’
রসময়বাবু আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির বাদুড় মানে?’
এবারও যেন রসময়বাবুর প্রশ্নটা কানে গেলনা তার। আর এরপরই লন্ঠনটা দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল। অন্ধকার নেমে এল ঘরে। আলোটা নিভে যাওয়াতে মহেন্দ্রনাথ কোনো কথা বললেন না, বা উঠে নতুন কোনো ব্যবস্থা করলেন না আলো জ্বালাবার জন্য।
রসময়বাবু একটু স্বগতোক্তির স্বরে বললেন, ‘বৃষ্টি কখন থামবে কে জানে!’
টেবিলের ওপাশ থেকে অন্ধকারের মধ্যে শুধু একটা শব্দ ভেসে এল ‘হুম।’
রসময়বাবুর এবার মনে হল এই ভদ্রলোক বৃষ্টি আসছে দেখে তার বাড়িতে ডেকে আশ্রয় দিলেও তার সাথে সম্ভবত আর বিশেষ কথা বলতে আগ্রহী নন। তাছাড়া অধ্যাপক, গবেষক মানুষেরা অনেক সময় তাদের চিন্তার জগতে আচ্ছন্ন থাকেন। এ কথা ভেবে নিয়ে চুপ করে গেলেন রসময়বাবু। তিনি অন্য নানা কথা বলবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ঘরের ভিতর নিশ্চিদ্র অন্ধকার আর বাইরে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। সময় এগিয়ে চলতে লাগল। অন্ধকার নেমেছে বাইরেও।
দু—একঘণ্টা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল। বৃষ্টি তখন কিছুটা স্তিমিত হলেও থামেনি। এবার বেশ অস্বস্তি বোধ হতে লাগল তার। এ ভাবে কতক্ষণ অন্ধকার ঘরে চুপ করে বসে থাকা যায়। তার সামনেই ঘরের মধ্যে একটা মানুষ বসে আছে, সে কথা বলছে না! আর এরপরই রসময়বাবুর মনে হল অন্ধকারের মধ্যে ভদ্রলোক চেয়ার থেকে উঠে অন্য কোথাও চলে যাননি তো?
ভাবনাটা মাথায় আসতেই রসময়বাবু একটু গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘ও মশাই আছেন তো?’
এবার তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘হ্যাঁ, আছি। বুঝতে পারছি আপনার অসুবিধে হচ্ছে। বৃষ্টি মনে হয় ধরে আসছে। জানলাটা খুলে ফেলুন।’
মহেন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর শুনে বসে থাকা অবস্থাতেই জানলার পাল্লা খুলে ফেললেন রসময়বাবু। কিছুটা চাঁদের আলো ঢুকল ঘরে। বৃষ্টি না থামলেও তা অনেকটা ধরে এসেছে। রসময়বাবু দেখলেন, টেবিলের অন্যদিকে একইভাবে বসে আছেন ভদ্রলোক। ঠোঁটের কোনে একটা আবছা হাসিও যেন লেগে আছে।
আবার নতুন করে কথা শুরুর জন্য রসময়বাবু বললেন, ‘আপনাদের গ্রামটা খুব সুন্দর, আর শান্ত। মানুষরাও হয়তো ভালো।
ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোনের হাসিটা এবার স্পষ্ট হল। তিনি বললেন, ‘এর আগে কি যেন প্রশ্ন করেছিলেন? দুষ্প্রাপ্য প্রজাতিটা কি?’
রসময়বাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই। দুষ্প্রাপ্য প্রজাতি মানে কি ধরনের বাদুড়?’
মহেন্দ্রনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, বিশেষ প্রজাতি। ওদের দাঁত একটু বড় আকৃতির। তবে ওরা রক্তচোষা বা ভ্যাম্পায়ার ব্যাট নয়। খুবই নিরীহ প্রজাতির। শুধু ফল খায়। তবুও ওদের বাঁচাতে পারলাম না। গ্রামবাসীরা ওদের মেরে ফেলল!’
শেষ কথাটা বলার পর ঠোঁটের কোণের হাসি মুছে কেমন একটা বিষণ্ণতা ফুটে উঠল মহেন্দ্রনাথের মুখে।
তার কথাটা শুনে রসময়বাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আমি যে লোকটার ঘরে উঠেছি সে বলছিল বটে যে গতবছর বাদুড় তাদের আপেল নষ্ট করেছিল। তাই গ্রামের লোকেরা জাল দিয়ে ধরে তাদের মেরে ফেলল।’
মহেন্দ্রনাথ এবার বেশ উত্তেজিত ভাবেই বললেন, ‘না, তেমন ফসল নষ্ট করেনি তারা, ওরা বনের ফলই খেত। দু—একটা প্রাণী শুধু গ্রাম প্রধান রিখসুর বাগানে আপেল খেয়েছিল। আর রাত্রিবেলা আমাকেও তো গুলি চালিয়েছিল রিখসু। যদিও সে সবাইকে বলেছিল যে রাতের অন্ধকারে কোনো জন্তু ভেবেই সে গুলি চালিয়েছিল, কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে জেনে বুঝেই গুলি চালিয়েছিল। যাতে আমার অবর্তমানে বাদুড়গুলোকে মেরে ফেলা যায়। আমার মুখের যে দাগগুলো দেখছেন তা বন্দুকের ছররার আঘাতের চিহ্ন।’
বৃষ্টি প্রায় থেমে এসেছে, মেঘ সরে গিয়ে ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে গোল চাঁদ। ঘরের মধ্যেও চাঁদের আলো বেশ ভালো করে ঢুকতে শুরু করেছে। একফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে মহেন্দ্রনাথের মুখে। রসময়বাবুর মনে হল মহেন্দ্রনাথের মুখের দাগগুলো যেন এবার আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
মহেন্দ্রনাথের কথায় কি আর বলার থাকতে পারে রসময়বাবুর। তিনি শুধু একবার বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই রিখসু লোকটাকে আমার ঠিক সুবিধার বলে মনে হয়নি। লোকটা শুনলাম ওর আপেল বাগানে গ্রামের লোককে দিয়ে বেগার খাটায়।’ —কথাগুলো বলে জানলার বাইরে চুপ করে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
চাঁদের আলো ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে, ঘরটার পিছনে। নীচে এবার গ্রামের ঘরগুলো চোখে পড়ল রসময়বাবুর। আর তারপর চোখে পড়ল ঘরগুলোর পিছনের আপেল বাগানটা। বিশাল আপেল বাগান। তিনি বললেন, ‘ওটাইতো গ্রাম প্রধান রিখসুর আপেল বাগান, তাই না?’ শুনছিলাম কাল ভোরে আপেল তুলে শহরে পাঠানো হবে।’
কথাটা শুনেই যেন একটু সোজা হয়ে বসলেন মহেন্দ্রনাথ। তিনি প্রথমে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ওটাই।’ তারপর বললেন, ‘আমি যে বাদুড় গুলোকে নিয়ে কাজ করতাম তাদের আপনি দেখবেন? ভারি সুন্দর প্রাণী। এখানেই আছে ওরা।’
রসময়বাবু আধো অন্ধকার ঘরটার চারপাশে তাকিয়ে বললেন, ‘এখানেই আছে মানে?’
মহেন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘এখানে আছে মানে একটা খাতার পাতাতে কাজ করার সময় আমি এদের প্রচুর ছবিও এঁকেছিলাম। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, ওদের প্রত্যেককে আমি আলাদাভাবে চিনতে পারতাম। তাদেরই ছবি এঁকেছি আমি। ওই যে আপনার পিছনের র্যাকে যে বাঁধানো ড্রয়িং বুকটা আছে, ওটা নামান, ওতেই আছে। দেখতে পাবেন কী সুন্দর প্রাণীগুলো!’
বৃষ্টি থেমে এসেছে। রসময়বাবু এবার বেড়িয়ে পরবেন। মহেন্দ্রনাথের মন রক্ষার জন্যই তিনি র্যাকে খাতাটা দেখতে পেয়ে সেটা নামিয়ে এনে আবার চেয়ারে বসলেন।
বোর্ড বাঁধানো খাতাটা মনে হয় অনেকদিন খোলা হয়নি। মলাটটা খুলতেই মৃদু পট করে একটা শব্দ হয়ে সুতো ছিঁড়ে পাতাগুলো আলাদা হয়ে গেল। চাঁদের আলো এসে পড়েছে খাতার পাতাতে। বেশ বড় আকারের একটা বাদুড়ের ছবি আঁকা আছে তাতে। হ্যাঁ, প্রাণীগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে তাদের দাঁতগুলো। চোয়ালের বাইরে বেরিয়ে আছে তীক্ষ্ন দাঁতগুলো! পরপর বেশ কয়েকটা পাতা ওল্টালেন তিনি। সব পাতাতেই নানা ভঙ্গিতে আঁকা বাদুড়ের ছবি। সবথেকে বড় কথা ছবিগুলো এতো নিখুঁত যে জীবন্ত বলে মনে হয়! যেন তারা খাতার পাতা থেকে চেয়ে আছে রসময়বাবুর দিকে।
রসময়বাবু বললেন, ‘খুব সুন্দর ছবি। মনে হয় যেন জীবন্ত!’
মহেন্দ্রনাথ অস্পষ্ট হাসলেন। তারপর রসময়বাবুকে অবাক করে বললেন, ‘আপনাকে একটা অনুরোধ করছি। একটা পাতা খুলে বাইরে ফেলে দিন।’
রসময়বাবু বললেন, ‘কি বলছেন! আপনার এত সুন্দর ছবির পাতা আমি বাইরে ফেলব কেন?’
ভদ্রলোক বললেন, ‘না, আমি আর খাতার পাতায় ওদের বন্দি রাখতে চাই না। এবার ওদের মুক্ত করার সময় হয়েছে। দয়া করে কাজটা করুন। একটা পাতা খুলে জানলার বাইরে ফেলুন।’
মহেন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বরের মধ্যে এমন কোনো একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, যার জন্য বিস্মিত হলেও রসময়বাবু তার অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারলেন না। সুতো ছেঁড়া খাতা থেকে একটা পাতা খুলে নিয়ে গরাদহীন জানলার বাইরে ফেললেন তিনি। পাতাটা ভাসতে ভাসতে নীচের দিকে নামতে লাগল। গ্রামের বাড়িগুলোর মাথা পর্যন্ত নামার পর রসময়বাবুর হঠাৎ যেন মনে হল পাতাটা যেন আর না ভেসে হঠাৎই উড়ে গেল ঘরগুলোর ছাদ অতিক্রম করে সোজা আপেল ক্ষেতের দিকে!
কি হল ব্যাপারটা? রসময়বাবু তাকালেন ভদ্রলোকের দিকে। মহেন্দ্রনাথের ঠোঁটে হাসি। তিনি বললেন, ‘আর একটা পাতা ফেলুন।’
একটু ইতস্তত করে দ্বিতীয় পাতাটা খুলে নিয়ে জানলার বাইরে ফেললেন তিনি। পাতাটা এবার ভাসতে ভাসতে আগেরটার মতো বেশি নীচে না নেমে হঠাৎই ঝটপট করে একটু পাক খেল বাতাসে। চাঁদের আলোতে রসময়বাবু স্পষ্ট দেখতে পেলেন সেটা আর খাতার পাতা নয়! বেশ বড় একটা বাদুড়! বাতাসে বার কয়েক পাক খেয়ে আরও নীচে নেমে ঘরগুলোকে অতিক্রম করে সোজা এগোলো আপেল ক্ষেতের দিকে। এরপর আর রসময়বাবুকে খাতার পাতাগুলো বাইরে ফেলতে হল না। কোথা থেকে যেন একটা দমকা বাতাস প্রবেশ করল ঘরে। খাতার পাতাগুলো টেবিল থেকে উড়ে গিয়ে পরতে লাগল গরাদহীন জানলার বাইরে। তারপর বাদুড়ের রূপ নিতে থাকল। চাঁদের আলোতে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় সোজা নেমে যেতে লাগল নীচের বাড়ি ঘরগুলো অতিক্রম করে গ্রাম প্রধান রিখসুর আপেল ক্ষেতের দিকে। বাকরুদ্ধ, হতভম্ব রসময়বাবু যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না! এ কিভাবে সম্ভব? ম্যাজিক নাকি? খাতার শেষ পাতাটাও বাইরে বেরিয়ে বাদুড় হয়ে মিলিয়ে যাবার পর রসময়বাবু জানলার দিক থেকে সামনে তাকালেন। মহেন্দ্রনাথ হাসছেন রসময়বাবুর দিকে তাকিয়ে। অন্য কোনো লোক হলে হয়তো এই পরিস্থিতিতে ভয় পেয়ে যেতেন, কিন্তু রসময়বাবু সাহসী—শক্ত মনের মানুষ। তিনি মহেন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করলেন, ‘এ কি ভাবে সম্ভব? আমি কি ভুল দেখলাম, না ঠিক? খাতার পাতাগুলো কি সত্যিই বাদুড় হয়ে উড়ে গেল! কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?’
মহেন্দ্রনাথ তার কথার কোনো স্পষ্ট জবাব দিলেন না, তিনি শুধু চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কাল সকালে হয়তো ব্যাপারটা জানতে পারবেন। বৃষ্টি থেমেছে, এবার আপনি আসুন। আবারও বৃষ্টি শুরু হতে পারে।’
রসময়বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। তারপর বাড়িটার বাইরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহেন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘বৃষ্টির মধ্যে আশ্রয় দেবার জন্য ধন্যবাদ। তবে ওই বাদুড়ের ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হল না।’
তার কথার জবাবে বাদুড় গবেষক মহেন্দ্রনাথ বললেন, ‘শুধু মনে রাখবেন, বাদুড় অতি নিরীহ প্রাণী। সাবধানে ফিরবেন।’
আর কথা না বাড়িয়ে ব্যাপারটা কিভাবে ঘটল তা বোঝার চেষ্টা করতে করতে রসময়বাবু ফেরার পথ ধরলেন। ধাপ বেয়ে নীচে নেমে গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছতেই তিনি দেখলেন তার ড্রাইভার ছেলেটা ওকখ’কে সঙ্গে করে লন্ঠন হাতে তাকে খুঁজতে বেড়িয়েছে। তাদের সঙ্গে দেখা হবার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই রসময়বাবু পৌঁছে গেলেন তার রাত্রিবাসের জায়গাতে।
৩
পরদিন ভোরের আলো যথা নিয়মেই ছড়িয়ে পড়ল সেই ছোট্ট নাগা গ্রামের মাথায়। সেই বাড়িটা থেকে ফিরে আসার পর কোনো কথা তার ড্রাইভার ছেলেটা বা ওকখ’কে জানাননি রসময়বাবু। নিজের চোখে দেখা যে ঘটনা তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তা অন্যকে বলবেন কি ভাবে। গত রাতে ঘরটায় ফিরে এসে খাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছিলেন রসময়বাবু। তবে সারারাত ভালো ঘুম হয়নি তার। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল, চোখের সামনে ফুটে উঠছিল সেই অদ্ভুত দৃশ্য—খাতার পাতা বাদুড় হয়ে যাচ্ছে।
যেন আলো ফোটার জন্যই প্রতীক্ষা করছিলেন রসময়বাবু। মনে মনে তিনি ঠিক করে ফেলেছেন, দিনের আলো তিনি আবার সে বাড়িতে যাবেন, কথা বলবেন সেই ভদ্রলোকের সাথে। তার থেকে তিনি জানা চেষ্টা করবেন, যে দৃশ্য তিনি দেখেছেন তা সত্যি কিনা? সত্যি হলে তা কেমনভাবে সম্ভব?
রসময়বাবু যখন বুঝতে পারলেন ভোর হয়েছে তখন বেরোবার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে এলেন তিনি। বাইরে ড্রাইভার ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। রসময়বাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওকখ কোথায়?’
সে জবাব দিল, ‘একটু আগে ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই সে আপেল বাগানে চলে গেছে। তবে টাকাতো তাকে দেওয়া হয়ে গেছে, কাজেই আমাদের ফিরে যেতে কোনো অসুবিধা নেই। এখনই রওনা হবেন?’
রসময়বাবু বললেন, ‘তুমি এখানে আধ ঘণ্টা সময় অপেক্ষা করো, আমি আধ ঘণ্টা হেঁটে আসি। তারপর আমরা রওনা হব ফেরার জন্য।’— একথা কথা বলে তিনি রওনা হলেন তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
সকালের নতুন আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশের পাহাড় আর গ্রামটার ওপর। জেগে উঠেছে চারদিকের সবকিছু। গ্রামের ভিতর মোরগ ডাকছে, পথের দু—পাশ থেকে ভেসে আসছে পাখির ডাক। আকাশেও কোনো মেঘ নেই। বেশ সুন্দর পরিবেশ। এ সব দেখতে দেখতে রসময়বাবু এক সময় উপস্থিত হলেন বাড়িটার নীচে রাস্তার গায়ে সিঁড়ির ধাপের সামনে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে তিনি ওপরে উঠে এলেন। ভোরের ঝলমলে আলোতে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাড়িটাকে বিবর্ণ, বিষণ্ণ দেখতে। সেই দরজাটা আগের মতোই খোলা। দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে রসময়বাবু হাঁক দিলেন— ‘মহেন্দ্রবাবু, ও মহেন্দ্রবাবু? আছেন নাকি?’
বার কয়েক হাঁক দেবার পরও যখন তিনি তার কোনো সাড়া পেলেন না। তখন তিনি একটু ইতস্তত করে ঘরের ভিতর পা রাখলেন। দরজা আর পাশের খোলা জানলা দিয়ে আলো ঢুকছে ঘরে। সেই আলোতে রসময়বাবু দেখলেন ঘরের মেঝেতে জমে আছে পুরু ধুলোর স্তর আর কাঠকুটো। যেন বহুদিন কেউ প্রবেশ করেনি এ ঘরে। দেওয়ালের যে র্যাকগুলোতে তিনি বই পত্তর ঠাসা দেখেছিলেন সেগুলো থেকে জলে ভেজা, উঁই ধরা বইগুলো মাটিতে খসে পরে আছে। তবে তিনি দেখলেন, টেবিলের ওপর সেই লন্ঠন আর সেই বাঁধানো খাতাটা রাখা আছে। তা দেখে তিনি এগোলেন টেবিলের দিকে। যে চেয়ারটাতে মহেন্দ্রবাবু বসেছিলেন সেই চেয়ারের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখলেন, চেয়ারটার সর্বত্র উঁই পোকার প্রলেপ। যেন তার ওপর বহুদিন কেউ বসেইনি। তবে নিজের চেয়ারটার কাছে গিয়ে ধুলোর আস্তরণের ওপর গত রাতে নিজের বসার চিহ্ন দেখতে পেলেন তিনি। লন্ঠনটার দিকে একবার প্রথমে চোখ পড়ল তার। কাঁচ ভাঙা লন্ঠনের ভিতর নিশ্চিন্তে জাল বুনেছে একটা মাকড়শা। এ লন্ঠন তো তার মানে বহুদিন জ্বালানোই হয়নি! বিস্মিত রসময়বাবু খাতাটা খুললেন। শুধু মলাটটাই আছে, খাতার ভিতরে কোনো পাতা নেই। খাতাটা নামিয়ে রেখে জানলার বাইরে একবার তাকালেন তিনি। রোদ ঝলমলে আকাশের তলায় গ্রামের ঘরগুলো আর আপেল বাগানটা দেখা যাচ্ছে।
সে ঘরে থেকে যে আর কোনো লাভ হবে না বুঝতে পেরে দরজার দিকে এগোলেন রসময়বাবু। তিনি দরজার বাইরে পা রাখতে যাচ্ছেন ঠিক সেই সময় মাথার ওপর একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে ওপর দিকে তাকাতেই এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলেন। যে লোহার দণ্ডগুলো দিয়ে মাথার ওপর টিনের ছাদটা ধরা আছে। তার থেকে সার সার ঝুলে আছে অসংখ্য বাদুড়! সিলিং—এর কাছে তেমন আলো না পৌঁছলেও তাদের তীক্ষ্ন দাঁতগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন রসময়বাবু। তবে কি এই বাদুড় গুলোই রসময় টেবিলের সামনে দিয়ে খোলা জানলা দিয়ে বাইরে উড়ে গেছিল? আর রসময়বাবুকে ঘরে বসিয়ে রেখে মহেন্দ্রনাথ অন্য কোথাও চলে গেছিলেন? খাতার পাতাগুলো বাদুড় হয়ে উড়ে যাওয়া নিছকই রসময়বাবুর মনের ভুল? এ ঘরে বসে ঘুমিয়ে পরে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেননি তো তিনি? বাদুড়গুলোকে ভালো করে দেখার পর ঘর থেকে বেরিয়ে রসময়বাবু ফেরার পথ ধরলেন।
ওকখের বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলেন রসময়বাবু। ড্রাইভার ছেলেটাকে তিনি বললেন, ‘আমার মালপত্রগুলোকে গাড়িতে ওঠাও। এবার রওনা হব।’
তার নির্দেশ পালন করে ঘর থেকে রসময়বাবু ব্যাগ ইত্যাদি বার করে গাড়িতে তুলে ফেলল ছেলেটা। তারপর তারা যখন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছে ঠিক তখনই ঘরটার পিছনে আপেল বাগানের দিক থেকে এসে রসময়বাবুদের সামনে এসে দাঁড়াল ওকখ। রসময়বাবু দেখলেন ওকখের চোখ মুখে জেগে আছে স্পষ্ট উত্তেজনার ছাপ! ব্যাপারটা নজর এড়ালোনা ড্রাইভার ছেলেটারও। সে তাকে প্রশ্ন করল, ‘কি হয়েছে?’
ওকখ উত্তেজিতভাবে বলল, ‘কাল রাতে বাদুড়ের পাল হানা দিয়েছিল! সব আপেল তারা কামড়ে নষ্ট করেছে! কাল রাতে গ্রাম প্রধান তার আপেল বাগান দেখতে গেছিল। সেও মরে পড়ে আছে!’
এ কথা বলে সে একটু স্বগতোক্তির স্বরে বলল, ‘গ্রাম প্রধান রিখসুর মুখে আর শরীরে অসংখ্য ফুটো ফুটো দাগ! বাদুড়ের দাঁতের দাগ মনে হয়! সেই লোকটার মুখে, গায়ে বন্দুকের ছররা লেগে যেমন দাগ হয়েছিল অনেকটা ঠিক তেমনই।’
ড্রাইভার ছেলেটার এসব ব্যাপারে কিছু জানা নেই। সে বলল, ‘প্রধান মারা গেছে! কার মুখে বন্দুকের ছররা লেগে দাগ হয়েছিল?’
একটু চুপ করে থেকে ওকখ বলল, ‘বাইরে থেকে কয়েক বছর আগে একটা লোক এসেছিল এখানে। শহরের লোক। সেই আপেল বাগানের ওধারের জঙ্গলে বাদুড়ের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছিল। বাদুড়গুলোকে মারতে দিত না লোকটা। একদিন রাত্রিবেলা লোকটা যখন জঙ্গল ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন তাকে রিখসু বন্য জন্তু মনে করে আপেল বাগানের ভিতর থেকে গুলি চালায়। রিখসু আমাদের সে কথাই বলেছিল। ছররা গুলির আঘাতে লোকটার মুখ—শরীর ওরকমই ফুটো ফুটো হয়ে যায়। আর এর কদিন বাদেই ঘা বিষিয়ে উঠে লোকটা মারা যায়। তারপর আর কোনো বাধা না থাকাতে জাল দিয়ে ধরে মেরে ফেলা হয় বাদুড়গুলোকে।’
ওকখের কথাগুলো ড্রাইভার তর্জমা করে দিতেই রসময়বাবু বিস্মিত ভাবে ওকখকে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি নিশ্চিত যে সে লোক মারা গেছিল?’
ওকখ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, ওই আপেল বাগানের ওপাশে খাদের ধারে তাকে যারা কবর দিয়েছিল তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম।’
ওকখের কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন রসময়বাবু। তবে একই সাথে পুরো ঘটনাটাও স্পষ্ট হয়ে গেল তার কাছে। ওকখ এরপর বলল, ‘হঠাৎ আবার বাদুড়ের পাল কোথা থেকে এসে হানা দিল কে জানে? জঙ্গলেতো আর এখন বাদুড় নেই!’
ওকখের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে রসময়বাবু উঠে পড়লেন তার গাড়িতে। চলতে শুরু করল গাড়ি। কিছুটা এগিয়ে রসময়বাবু যে জায়গাতে পৌঁছে গেলেন সেখানে রাস্তার গা থেকে পাথরের সিঁড়ির ধাপ ওপরে উঠেছে সেই বাড়িটার দিকে। চলন্ত গাড়ি থেকে রসময়বাবু তাকালেন ওপর দিকে। মুহূর্তের জন্য তার চোখে পড়ল সেই বাড়িটা। আর সেটা দেখেই রসময়বাবুর চোখে ভেসে উঠল সেই দৃশ্য। তার সামনে টেবিলের উল্টো দিকে বসে হাসছেন বাদুড় গবেষক মহেন্দ্রনাথ। আর তার খাতার পাতাগুলো জানলার বাইরে বেরিয়ে, জীবন্ত বাদুড় হয়ে চাঁদের আলোতে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নেমে যাচ্ছে নীচের আপেল বাগানের দিকে!
ড্রাইভার ছেলেটা বলল, ‘এতক্ষণে নিশ্চয়ই রাস্তার পাথর সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ওয়েদার খুব ভালোই। আমরা তাড়াতাড়ি ডিমাপুর পৌঁছে যাব। তবে ওকখ যে বলল বাদুড় গ্রাম প্রধানকে মেরে ফেলেছে, এ কথা আমার ঠিক বিশ্বাস হল না। আমি এ ঘটনা আগে কোথাও শুনিনি!’
কথাটা শুনে রসময়বাবু মনে মনে বললেন, ‘হ্যাঁ, বাদুড় অতি নিরীহ প্রাণী, যদি না তাদের দিয়ে কেউ অন্যায়ের প্রতিশোধ নেয়!’