বাংলার মন্দিরগাত্রচিত্র – অঞ্জন সেন
পশ্চিমবঙ্গে একসময় মন্দিরগাত্রচিত্র প্রচলিত ছিল। এখন অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে, তিনটি মাত্র মন্দিরে কিছু গাত্রচিত্র রয়ে গেছে।
পূর্বকথা
আদিম যুগ থেকেই মানুষ গুহাগাত্রে ছবি এঁকেছে। এসবের নিদর্শন আছে ফ্রান্সের দোর্দন বা স্পেনে যেগুলি প্রস্তর যুগের। ভারতে গুহাচিত্রের নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে একটু পরে, মধ্যপ্রদেশের ভিমবেটকা, উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের কয়েকটি গুহা, পশ্চিমবঙ্গে ঝাড়গ্রামের কাছ লালজল—সবমিলিয়ে ১০০১টি গুহাচিত্র (সংখ্যাটি অশোক দত্তের দেওয়া) দেখা গেছে। এসব আদিম মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশ ও সংযোগ স্থাপনের উপায়। পরবর্তী অর্থাৎ, প্রাক-ইতিহাসের পরবর্তী যুগের গুহাচিত্র পাওয়া গেছে সুরগুজায় যোগীমারা গুহায়, এগুলি জৈন সম্প্রদায়ের চিত্রকলা বলে ব্যাখ্যাত হয়েছে, সময়কাল প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দ (স্টেলা ক্রামরিশ)। ভারতীয় চিত্রকলার উৎকর্ষের প্রকাশ অজন্তা গুহায় (অজন্তায় ৯ ও ১০ সংখ্যক গুহার চিত্রণের কাজ শুরু হয়েছিল যথাক্রমে, খ্রিস্টপূর্বাব্দের দ্বিতীয় ও প্রথম শতাব্দীতে)। সেইসঙ্গে ইলোরা, বাগ, বেদশা, কারলি, কাহ্নেরি ও জুনার-এ। দক্ষিণ ভারতেও গুহাচিত্র বা মন্দিরগাত্রচিত্রের সূচনা প্রায় একই সময়ে হয়, বাদামি বা বাতাবিপুরে চারটি গুহা চিত্রিত ছিল, এখন মাত্র একটিতে চিত্রকলার অস্তিত্ব আছে। দক্ষিণ ভারতে মন্দিরগাত্রচিত্র অঙ্কনের প্রথা অনেক দিন চলেছে। তার দৃষ্টান্ত রয়েছে লিপাক্ষি, তিরুনান্দিক্কর, মাদুরা, পদমনাভপুরুম ও কাঞ্চিপুরমের মন্দিরগাত্রচিত্রগুলির। এখানে গুহাচিত্র ও মন্দিরগাত্রচিত্রগুলিকে একই পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছে।
ভারতীয় চিত্রকররা যাত্রা করেছিলেন মধ্য এশিয়া ও চিনে, সেখানে অনেকগুলি গুহা ও মন্দিরগাত্র তাঁরা চিত্রিত করেছিলেন। এর বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় উপেন্দ্র ঠাকুর রচিত দি ইন্ডিয়ান মঙ্ক পেন্টার্স ইন চায়না (১৯৮৬)-তে। এর নমুনা রয়েছে খোটান, কুচা, কিজল, কাশগড়, তুমসুক, সেরচুক, দাণ্ডান, বেজেকলি, ইয়ারখন্ড, মিরণ উইলিক প্রভৃতি মধ্য এশিয়ার গুহাগুলিতে। ভারতীয় মধ্য এশীয় চিনা মিশ্র অঙ্কন শৈলির সূচনার খ্রিস্টীয় সপ্তম, অষ্টম শতাব্দীতে শুরু হয়েছে যার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, সানসি প্রদেশের তিয়েন-লুন-সান, কানসুর তুন হুয়াং ও হোনান প্রদেশের গুহাচিত্রগুলিতে। এই ধারা ক্রমশ জাপান কোরিয়া ও সিংহলে ছড়িয়ে পড়ে। সিংহলের সিগিরিয়া, জাপানের হরিয়ুজি, কোরিয়ার সক্কলঅমে এ-রকম দৃষ্টান্ত দেখা যায়, দেখা যায় মায়ানমার (বর্মা)-এও।
পূর্বভারতেও এই ধারার বিকাশ হয়েছিল, নালন্দার ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাপ্ত তিনটি চিত্রিত পাথর বা মন্দিরের গাত্রচিত্রের রূপ পাওয়া গেছে। বাংলার শিল্পকলা পালযুগে চরম উৎকর্ষে পৌঁছেছিল। নালন্দাবিহারেও পাল রাজাদের অবদান আছে। তাই অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না, যে বাংলার কিছু বৌদ্ধবিহার বা মন্দির চিত্রিত ছিল। পালযুগের তিনটি বৌদ্ধবিহার পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় ও জগজীবনপুরে টেরাকোটাতেও প্রস্তরখোদিত প্রচুর রিলিফের কাজ পাওয়া গেছে, যার সঙ্গে পালযুগের পুথিচিত্রের রূপকল্পনা ও আকৃতিগত অনেক সাদৃশ্য আছে। এই তিনটি বৌদ্ধবিহারে যে দেওয়ালচিত্র ছিল না এমন কথা বলা যায় না। পালপূর্ব যুগে হিউ এন সাঙ বাংলায় অনেক বৌদ্ধবিহার ও মন্দির দেখেছিলেন, হয়তো সেগুলিতেও ভাস্কর্যের সঙ্গে সঙ্গে চিত্রিত ছিল। চতুর্থ শতকে ফা-হিয়েন তাম্রলিপ্তে চিত্রকরদের অবস্থান ও অঙ্কনের কথা লিখেছেন। পটচিত্রের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় সাঁচি স্তূপের প্যানেলগুলি থেকে, বুদ্ধদেবের সময় থেকে বা তারও আগে থেকে ভারতে পটচিত্র অঙ্কিত হত যদিও ভারতে প্রাচীন পটচিত্রের কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি। চিনে একটি দেওয়ালচিত্রে দেখা যায় বুদ্ধ একটি দীঘল পট বা লাটাইপটের মতো একটি পট দেখেছেন, ওই চিত্রটি থেকে আমরা খ্রিস্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকের দীঘলপটের চেহারা খানিকটা অনুমান করতে পারি।
বঙ্গীয় চিত্রকলার এ যাবৎ প্রাচীনতম উপাদান পালযুগের পুথিচিত্র। এগুলির সঙ্গে অজন্তার দেওয়ালচিত্রের সম্পর্ক সহজেই লক্ষ করা যায়। ভারতে শিল্প গোষ্ঠীর বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত ছিল, তাই এই সংযোগ সম্ভব হয়েছে। শিল্পী, ঐতিহাসিক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন পালযুগের ছোটো আকারের পুথিচিত্রগুলির উৎস দেওয়ালচিত্র। ওই দেওয়ালচিত্রের অঙ্কনশৈলী ঘননিবদ্ধ হয়ে পুথিচিত্রে এসেছে। পুথিচিত্রগুলি যাঁরা এঁকেছিলেন তাদের নাম পাওয়া যায় না, কিন্তু শিল্পীসংঘের অস্তিত্বের কথা জানা যায়, বীতপাল, ধীমান, রণক, শূলপানি প্রমুখ শিল্পী (ভাস্কর?)দের নাম পাওয়া যায়। বাংলায় মধ্যযুগে দেখা গেছে, একই শিল্পী সম্প্রদায় টেরাকোটা, কাঠের কাজ, পুথির চিত্র এবং ভাস্কর্য করতেন। এটি যদি ঐতিহ্য হয় সম্ভব যে বীতপাল-ধীমানও চিত্রকর্ম করতেন। অজন্তা শৈলীর সঙ্গে প্রচলিত পূর্ব-ভারতীয় বা বঙ্গীয় শৈলীর মিশ্রণ ঘটেছে পালযুগের চিত্রকলায়।
বাংলায় চোদ্দো শতকে মন্দির বা বিহার সম্ভবত নির্মিত হয়নি। বৌদ্ধ শিল্পীরা নেপাল অঞ্চলে চলে গিয়েছিলেন বা শিল্পকর্ম ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে অনুমান করা যায়। তবে পনেরো শতকেও (১৪৪৬, ১৪৫৫) বৌদ্ধ পুথিচিত্র পাওয়া গেছে বিহারের আরা থেকে, পূর্ববর্তী পালযুগের শৈলী থেকে যার খানিকটা রূপান্তর হয়েছে।
এই পালযুগের পুথিচিত্র শৈলি তার রেশ রেখে গেছে বাংলার বৈষ্ণব চিত্রকলায়। দেবপ্রসাদ ঘোষ ১৪৯৯ সালের একটি পুথির পাটায় অঙ্কিত দশাবতার চিত্রে পালযুগের শৈলীর ছায়া দেখিয়েছেন।
উত্তর কথা
চৈতন্যদেবের সময়ে বাংলায় চিত্রকলা যে বহুল প্রচলিত ছিল তার বিবরণ বিভিন্ন চৈতন্যজীবনী সাহিত্য থেকে পাওয়া যায়। চৈতন্যদেব কানাই-এর নাটশালায় গিয়ে কৃষ্ণচিত্রলীলা (চৈতন্যচরিতামৃত) দেখেছিলেন। এতে অবশ্য পরিষ্কার নয় ওই কৃষ্ণলীলাচিত্রগুলি পট ছাড়াও কোনো দেওয়াল বা মন্দিরগাত্রের চিত্র কিনা। আরও বিবরণ পাওয়া যায়, চৈতন্যদেবের জীবিতকালে রচিত গৌরলীলামৃত-তে (কাননবিহারী গোস্বামী সম্পাদিত)। ‘একদিন গৌরাঙ্গ ভক্তগণ-সহ শ্রীবাস মন্দিরে এসেছেন তখন সেখানে এক ভাস্কর এল এবং শ্রী গৌরাঙ্গকে ব্রজলীলার পট দেখাল’—
এক চিত্রপট লই ভাস্কর ঠাকুর।
গৌরাঙ্গে দেখায়ে মেলি চিত্র সুমধুর।।
গোদোহন যে যে স্থানো যে রূপমাধুরী।
পৃথক পৃথক সব আছ চিত্র করি।।
তাহা দেখি গৌরচন্দ্র সুখে ভরি গেল।
নিত্যানন্দ করে ধরি নৃত্য আরম্ভিল।।
এই বিবরণ থেকে আমরা কয়েকটি তথ্য পেতে পারি—১. নবদ্বীপ অঞ্চলে শিল্পীদের বাসস্থান ছিল বা তাদের যাতায়াত ছিল। ২. পৃথক পৃথক চিত্র দেখানো হয়েছে, তা চৌকা পট হতে পারে। ৩. একজন ভাস্কর চিত্রপট নিয়ে এসেছিলেন।
সে সময় চিত্রকর বা মূর্তি নির্মাতাদের ভাস্কর উপাধি দেওয়া হত। এ-রকম অনেকের নাম পাওয়া যাচ্ছে বৈষ্ণবগ্রন্থগুলিতে—নয়ন ভাস্কর (১৬ শতক, হালিশহর), বংশীধর (খড়দা অঞ্চল), নবীনানন্দ আচার্য (১৬ শতক দাঁইঘাটা)।
মধ্যযুগে দেওয়ালচিত্র বা মন্দিরগাত্রচিত্র প্রচলিত ছিল, মঙ্গলকাব্য থেকে জানা যায়—
আজ্ঞা পায়্যা আনন্দে অচ্যুত চিত্রকর।
চপল নির্মাণ করে চারিদ্বার ঘর।।
উত্তর দুয়ারে লেখে কৃষ্ণ অবতার।
দান ছলে মনোভঙ্গ হইল রাধার।।
কোনখানে পুতনাবধ কেশীবধ কোথা।
কৃষ্ণ গেল মথুরায় কংসের বিতথা।।
—মানিক গাঙ্গুলির ধর্মমঙ্গল, অষ্টাদশ শতক
এই বিবরণে মন্দির দেওয়ালচিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায় এবং মন্দিরগাত্রটির অঙ্কন বঙ্গে প্রচলিত ছিল।
মন্দির কথা
পশ্চিমবঙ্গে যে তিনটি গাত্রচিত্র অঙ্কিত দেখা গেছে, সে তিনটি মন্দির আঠারো শতকের শেষ ভাগে ও উনিশ শতকের প্রথম তিন দশকের মধ্যে নির্মিত বা অঙ্কিত। তিনটির শৈলী তিন রকমের। এর মধ্যে হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির বৈচিত্র্যময়। মন্দিরের নির্মাণকাল নিয়ে সুধীন্দ্রচন্দ্র মিত্র এবং নৃসিংহপ্রসাদ ভট্টাচার্য এক মত নন।
নৃসিংহপ্রসাদ ভট্টাচার্যের মতে, নবকলেবর মন্দিরটি ‘আঃ ১৮০৭ সালে নির্মিত হয় এবং ১৮১১ সালে মন্দির শাস্ত্রানুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়।’ তারাপদ সাঁতরার মতে আঠারো শতকের শেষার্ধে এই মন্দির নির্মিত হয়। বাগবাজারের গঙ্গানারায়ণ সরকার এই মন্দির নবনির্মাণের ব্যয়ভার গ্রহণ করেন। মন্দিরটির গর্ভগৃহ বর্গাকার চিত্রিত, প্রবেশপথও চিত্রিত। এই চিত্রগুলিতে তিনটি শৈলী দেখা যায় ১. লোকায়ত শৈলী, কিছু মানুষের চিত্র এই লোকায়ত শৈলীর, পটচিত্রের সঙ্গে যার সাদৃশ্য। ২. পাশাপাশি অবস্থান করছে মিশ্র মুঘলরীতির নকশা, যার উৎপত্তি মুর্শিদাবাদে। এই নকশাগুলি পশ্চিমবঙ্গের আরও অনেক প্রসাদ বা মন্দিরগাত্রে দেখা যায়। প্রবেশপথের সিলিংও এইভাবে নকশা করা। ৩. রাজপুত শৈলীর সঙ্গে কোম্পানি স্কুল শৈলীর মিশ্রণ। একটি কৃষ্ণলীলা চিত্রে দেখা যাচ্ছে ডিম্বাকৃতির বা ওভাল আকারের সমুদ্রসম জলাশয় তাতে নৌকা ভাসছে। ওই চিত্রেই মেঘের চিত্র অনেকটা কোম্পানি শৈলীর, ডাচ বা ফ্লেমিস শৈলীর। এই ওভাল শেপ ও ফ্লেমিস মেঘ অঙ্কন রীতি ইউরোপ থেকে আগত শিল্পীদের কাছ থেকে দেশি শিল্পীরা আয়ত্ত করেন। কৃষ্ণলীলার কৃষ্ণ ও সখীগণ-সহ রাধার চিত্র অনেকটা রাজপুত মিনিয়েচার ধরনের। রাজস্থানি চিত্রকররা বিষ্ণুপুর ও মুর্শিদাবাদে আগেই এসেছিলেন এবং বেশ কিছু পুথির পাটায় রাজপুত শৈলী বা মিশ্র রাজপুত শৈলী দেখা যায়। মুর্শিদাবাদে প্রাপ্ত একটি চৌকাপট চিত্রে শিল্পীর পূর্বনিবাস জয়পুর লিখিত আছে।
আবার বর্গাকার ক্ষেত্রগুলিতে কিছু পাখি, বৃক্ষ, ফল ও ঘোড়ার চিত্রগুলি কোম্পানি শৈলী মিশ্রিত। আশ্চর্যের বিষয় একই প্যানেলে, দেওয়ালে পাশাপাশি লোকশিল্প ও কোম্পানি স্কুল প্রভাবিত শিল্প দেখা যাচ্ছে। এগুলি একই শিল্পীর কাজ বলে মনে হয় না। এমন হতে পারে একটি শিল্পী গোষ্ঠীতে দু-তিন ধরনের শিল্পী ছিলেন। তাঁরা সমবেতভাবে এই দেওয়ালচিত্রগুলি এঁকেছিলেন অথবা কিছু ছবি নষ্ট হওয়ার পর আরেক শিল্পগোষ্ঠী এঁকেছিলেন। এখন অনেকগুলি বর্গাকার দেওয়ালচিত্র নষ্ট হয়ে গেছে, কিছু টিকে আছে। মন্দিরের ওপরের প্যানেলের চিত্রগুলি জুম লেন্স ব্যবহার করেও পরিষ্কারভাবে আনা যায়নি।
একই মন্দিরে লোকশিল্পী ও পেশাদার শিল্পীদের কাজের প্রভেদ চোখে পড়বে। পূর্বালোচিত কৃষ্ণলীলার চিত্রের রাধাকৃষ্ণের অবয়ব। এ ছাড়াও যে সরস্বতীর চিত্রটি রয়েছে, এটি কোনো লৌকিক শৈলীর বা রাজপুত শৈলীর নয়। মিশ্র কোম্পানি বা মিশ্র ডাচ শৈলী ততদিনে বাংলায় বহুল প্রচারিত হয়েছে।
দেওয়ালচিত্রগুলি অঙ্কিত হয়েছে দেশি পদ্ধতিতে প্রস্তুত ভূমির ওপরে একটা আস্তরন দিয়ে এবং দেশি আঠা ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো ভাবেই ইতালীয় ফ্রেসকোরীতির আঙ্গিকে রং ব্যবহার বা গ্রাউণ্ড কোটিং করা হয়নি। এই পদ্ধতির দেওয়ালচিত্র বাংলায় খুব প্রচলিত ছিল।
নৃসিংহপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন আটচালা বা আটবাংলা এই মন্দিরের চিত্রগুলি অঙ্কিত হয়েছে ম্যানেজার রাজেন্দ্র রায়ের মঠ প্রশাসন কালে। শিল্পীরা স্থানীয় বা কলকাতা বা হুগলি-চুঁচুড়া বা মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছিলেন কিনা এ তথ্য জানা যায় না। নবনির্মিত মন্দিরের পৃষ্ঠপোষক কলকাতার আবার কাছেই চুঁচুড়া-চন্দননগর বা অল্প দূরের মুর্শিদাবাদ ওল্ড বেঙ্গল স্কুলের শিল্পীদের বাসস্থান। অথবা এঁরা স্থানীয় সূত্রধর শিল্পী ছিলেন, যে সূত্রধর শিল্পীরা চিত্রকলা-ভাস্কর্যে বাংলা ঐতিহ্যে বিশিষ্ট শিল্পরীতি যোগ করেছিলেন। মন্দিরগাত্রচিত্রগুলি সংস্কারের প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল কিছুকাল আগে, রাসায়নিক উজ্জ্বল রং প্রয়োগে ছবির মূলরূপ থেকে সরে গেছে, হারিয়েছে মূলের সৌন্দর্য।
মঠের অধীন গুপ্তিপাড়ার রথও চিত্রিত ও খোদিত। তবে সেই চিত্র ও খোদাই কর্মের সঙ্গে মন্দিরগাত্রচিত্রের সাদৃশ্য প্রায় নেই, বিশেষ করে যেখানে ওভাল আকার ব্যবহার করা হয়েছে বা মিশ্র মুঘলশৈলির নকশা আঁকা হয়েছে। তারাপদ সাঁতরার মতে গুপ্তিপাড়ার রথ সূত্রধর শিল্পীদের সৃষ্টি। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের কাঠের রথ মূলত সূত্রধর শিল্পীদের তৈরি এবং অনেকগুলি রথ নানাভাবে চিত্রিত, বিশেষ করে রাধাকৃষ্ণ, জগন্নাথ বলরাম, দুর্গা ইত্যাদি দু-শো বা তার কিছু বেশি বছরের রথচিত্র এখন কয়েকটি সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত এবং এর সঙ্গে পটচিত্রের সাদৃশ্য লক্ষণীয়।
হুগলি জেলার আরেকটি চিত্রিত মন্দিরে কথা উল্লেখিত হয়েছে। মহানাদের ব্রহ্মময়ী মন্দির, এটি হল একটি নবরত্ন মন্দির। এটির প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণচন্দ্র নিয়োগী, এটি ১৮২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। সুধীরকুমার মিত্র তাঁর হুগলি জেলার দেব দেউল গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ১৩০৩ বঙ্গাব্দে ভূমিকম্পে মন্দিরের অনেক চিত্র নষ্ট হয়ে যায়। এখন আর চিত্রের অস্তিত্ব নেই।
গুপ্তিপাড়া মন্দিরের উল্লেখ্য চিত্রগুলি হল ষড়ভুজ চৈতন্য, কৃষ্ণ যশোদা এবং বাবু। হালকা-নীল রঙের ওপর নৃত্যরত গৌর-নিতাই, একই বাংলা শৈলীর। ভোলানাথ ভট্টাচার্য যাকে বাংলা কলম বলেছেন—এ কি সেই শৈলীর। রেখার সাবলীলতা থেকে বোঝা যায়, কালীঘাট পটশৈলী একটি দেশীয় ঐতিহ্য থেকে উঠে এসেছিল, একই দৃষ্টান্ত দেখা যায় বহড়ুর দেওয়ালচিত্রে, বিশেষ করে ষড়ভুজ চৈতন্যচিত্রটিতে।
সবচেয়ে আলোচিত গাত্রচিত্রসমন্বিত মন্দির বহড়ু (১২৩২ বঙ্গাব্দের কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ১৮২২-২৩?) চিত্রকর দুর্গারাম ভাস্কর। আরেকটি মন্দির সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর, কৃষ্ণনগরের চেতলানীয়া মন্দির, রাজস্থান থেকে শিল্পীরা এসে এখানে দেওয়ালচিত্র এঁকেছিলেন। এগুলি নিয়ে আমরা পরবর্তীকালে পৃথক আলোচনা প্রকাশ করব।
কালিদাস দত্ত (প্রবাসী, চৈত্র ১৩৩৯) মন্দিরগাত্রচিত্র সম্পর্কে জানাচ্ছেন, ‘এই চিত্রগুলি বেশি পুরাতন না হইলেও বাংলা দেশের প্রাচীর ভিত্তি চিত্রাঙ্কন প্রথার সহিত এক্ষণে আমাদের পরিচিত হইবার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কেবলমাত্র বাঁকুড়া জেলা ব্যতীত এ-প্রদেশের অন্য কোনো অংশের এই প্রকার চিত্রের বিবরণ ও প্রতিলিপি এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।’ বাঁকুড়া জেলার মন্দিরগাত্রচিত্র (টেরাকোটা নয়) নিয়ে কোনো নিবন্ধ আমরা এখনও সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে কয়েকটি মন্দিরে ফ্রেসকোর মতো কাজ আছে, যেমন সোনামুখীর শ্রীধর জিউ মন্দির (সূত্র : প্রদীপ কর, টেরাকোটা ২:১.২০১১)।
বাঁকুড়ার রাউতখন্ড গ্রামের যে ভগ্ন মন্দির (বিগ্রহহীন) ও তার গায়ে মন্দিরের মধ্যে যে ভিত্তিচিত্রের ছবি প্রদীপ করের সূত্রে দেখা গেল তা থেকে এ ধারণা দৃঢ় হল বাঁকুড়ার যে সূত্রধর সম্প্রদায়ের শিল্পীরা যারা পুথির পাটার চিত্র আঁকতেন—মন্দিরের মধ্যে বিবর্ণ, অনেকটা নষ্ট হয়ে যাওয়া চিত্রগুলি তাঁদেরই আঁকা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পালযুগের শিল্পীরাও বৌদ্ধবিহারে ভিত্তিচিত্র এবং পুথিচিত্র দু-রকমই এঁকেছেন। বাংলায় মন্দিরগাত্রচিত্রের বিরল দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে এটি অন্যতম। ভিত্তিচিত্র আঠারো শতকের শেষপাদে অঙ্কিত মনে হয়। বৃষের ওপরে চড়ে শিব চলেছেন সঙ্গে দু-জন শিবগণ এই মন্দিরের একটি ভিত্তিচিত্র। এ ধরনের পাটাচিত্র আছে আশুতোষ মিউজিয়ামে গণেশজননী অভিমুখে বৃষ বাহনে শিব চলেছেন শিঙা বাজাতে বাজাতে এক সঙ্গী-সহ (মেদিনীপুর জেলার আঠারো শতকের পাটা)। রাউতখন্ড মন্দিরের ভিত্তিচিত্র আর মেদিনীপুরের পাটা দুটোরই ভূমিতে উজ্জ্বল লালের ব্যবহার দর্শনীয়। এ ছাড়া, রাউতখন্ড মন্দিরে যে রাধাকৃষ্ণ অঙ্কিত তাও ওই পাটাচিত্রেরই শৈলী। দেশি চিত্র এবং খানিকটা লৌকিক ঐতিহ্যের চিত্র মিশেছে। ২৪ পরগনার বহড়ুর দুর্গারাম ভাস্করের (সূত্রধর শিল্পীরা ভাস্কর উপাধি পেতেন) মন্দিরগাত্রচিত্র আবার অনেকটাই বঙ্গ-রাজস্থান শৈলীর অঙ্কন, যে ধরনের বহুসংখ্যক পাটাচিত্র পাওয়া গেছে দক্ষিণবঙ্গে। এঁরা পরম্পরাগত শিল্প ঐতিহ্যে শিক্ষিত শিল্পী। এঁদের অনেকেই টেরাকোটা মন্দিরের ভাস্কর্য করেছেন, টেরাকোটা ভাস্কর্যের সঙ্গে পুথি পাটাচিত্র শৈলীর সাদৃশ্য দেখা যায়। অবহেলায়, সংস্কারের অভাবে মন্দিরটির জীর্ণ অবস্থা, কিছু চিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও টিকে আছে। অবিলম্বে সংরক্ষণ দরকার। (মন্দিরটি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন টেরাকোটা পত্রিকা সম্পাদক প্রদীপ কর। আলোকচিত্র পাঠিয়ে তিনি আমাদের এ বিষয়ে অবগত করেন।
এখানে কালিদাস দত্ত মহাশয়ের ‘বহড়ু গ্রামের কয়েকটি পুরাতন ভিত্তিচিত্র’ নিবন্ধের কিছু অংশ উদ্ধৃত হল—
‘বাংলা দেশের কোথাও অজন্তা, ইলোরা ও বাঘগুহা প্রভৃতি স্থানের মতো প্রাচীন ভিত্তিচিত্রের নিদর্শন বর্তমান নাই। এদেশের জলবায়ু অত্যধিক আদ্র এবং মন্দির ও গৃহাদি ইষ্টক-নির্মিত হওয়ায় ওই প্রকার চিত্র সমস্তই নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বর্তমান সময়ে এখানে যে-সকল পুরাতন ভিত্তিচিত্র বিদ্যমান আছে, সেগুলি খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী হইতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ কালের। এই চিত্রগুলি বেশি পুরাতন না হইলেও বাংলা দেশের প্রাচীন ভিত্তি চিত্রাঙ্কন-প্রথার সহিত এক্ষণে আমাদের পরিচিত হইবার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেবলমাত্র বাঁকুড়া জেলা ব্যতীত এ-প্রদেশের অন্য কোনো অংশের এই প্রকার চিত্রের বিবরণ ও প্রতিলিপি এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয় নাই।
কিছুদিন পূর্বে ২৪ পরগনা জেলায় বহড়ু গ্রামে একটি রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে আমি কতকগুলি এই জাতীয় চিত্র দেখিয়াছি। এই প্রবন্ধে উহাদের বিবরণ প্রকাশিত হইল। এই বহড়ু গ্রামটি অধুনা আলিপুর মহকুমার অন্তর্গত জয়নগর থানার অধীন এবং কলিকাতার প্রায় ত্রিশ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। এখানকার উক্ত মন্দিরটি চুনারের প্রস্তর দ্বারা পশ্চিমদেশীয় গৃহের আদর্শে নির্মিত এবং শ্যামসুন্দরের মন্দির নামে প্রসিদ্ধ। বহড়ুর জমিদার বসুবাবুদের বাটীর কাগজপত্রে দেখা যায় যে, সন ১২৩২ সালের কয়েক বৎসর পূর্বে তাঁহাদের পূর্বপুরুষ নন্দকুমার বসু কর্তৃক উহা নির্মিত হয়।
এই মন্দিরের সম্মুখস্থ দরদালানের পূর্ব ও পশ্চিম দিকের দেওয়ালে ও মন্দিরগৃহের প্রবেশপথগুলির উপরিভাগে উল্লিখিত চিত্রগুলি একপ্রকার ঘন লেপের উপর অঙ্কিত আছে। ওই লেপ বাংলা দেশের পুরাতন পটের জমির মতো গোবর মাটি দিয়া প্রস্তুত নহে, উহা খড়ির ন্যায় একপ্রকার দ্রব্যের দ্বারা প্রস্তুত। ভিত্তি-চিত্রাঙ্কনে এইরূপ আস্তর দেওয়ার প্রথাও যে প্রাচীনকালে বাংলা দেশে ছিল তাহা এই চিত্রগুলি দেখিলে বুঝা যায়। অজন্তা ও বাঘগুহার কতকগুলি চিত্রেও এই প্রকার সাদা রঙের জমি আছে (রামগড় ও বাঘগুহা, শ্রীঅসিতকুমার হালদার পৃ. ৩৩); তবে এখানে ব্যবহৃত আস্তর অজন্তা ও বাঘের ভিত্তি-চিত্রাঙ্কনে ব্যবহৃত আস্তরের মতো একই উপাদানে প্রস্তুত কি না তাহা বলা কঠিন।
এই লেপের উপর একপ্রকার আঁটাল পদার্থের সংযোগে উক্ত চিত্রগুলি অঙ্কিত। উহাদের বর্ণবিন্যাস ও ধরণ (style) অনেকটা কালীঘাট প্রভৃতি স্থানের প্রাচীন চিত্রাবলির অনুরূপ। কিন্তু কালীঘাটের চিত্রে যেরূপ রেখার টানের বিশেষত্ব দেখা যায় ওইগুলিতে সেরূপ বিশেষত্ব নেই এবং কিছু আলো ও ছায়ার সমাবেশ আছে। এইরূপ অঙ্কন-রীতিও যে প্রাচীনকালে বাংলা দেশে ও ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ছিল এখন তাহার অনেক নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে।
প্রাচীন রীতি অনুসারে মন্দিরে দেবতা প্রত্যক্ষ করিবার পূর্বে দেবলীলার সহিত দর্শকগণকে পরিচিত করাইয়া তাঁহাদের চিত্তকে রসাদ্র করিবার উদ্দেশ্যেই বোধ হয় ওই চিত্রগুলি মন্দিরমধ্যে না দেখাইয়া দরদালানে অঙ্কিত হইয়াছিল। উহাদের মোট সংখ্যা আটান্নটি, তন্মধ্যে দরদালানের পূর্বদিকের দেওয়ালে তিন সারে তেরোটি চিত্র আছে। এখানে উপরের সারে প্রথমেই দশ অবতারের মূর্তি প্রদর্শিত হইয়াছে। ইহাতে নবম অবতার বুদ্ধের পরিবর্তে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের চিত্র অঙ্কিত আছে। তৎপার্শ্বে দ্বিতীয় চিত্রে বৈকুন্ঠধামে সনক, সনন্দ ও দক্ষিণে সনাতন সহ লক্ষ্মীনারায়ণের যুগলমূর্তি ও তৎপরে তৃতীয় চিত্রে নারায়ণের অনন্তশয্যার দৃশ্য আছে। এই চিত্রগুলির নিম্নে, দ্বিতীয় সারে শ্রীচৈতন্যের ষড়ভুজ মূর্তি, অষ্টসখীসহ রাধাকৃষ্ণের একটি বড়ো যুগলমূর্তি, শ্রীরাধার মানভঞ্জন, কৃষ্ণকালী ও হরিহর মূর্তি যথাক্রমে প্রদর্শিত হইয়াছে এবং সর্বনিম্নে তৃতীয় সারে যশোদার শ্রীকৃষ্ণকে মাখনপ্রদান, যমলার্জুনবধ, কৃষ্ণের মথুরায় গমন, বিশাখা কর্তৃক শ্রীরাধাকে চিত্রপ্রদর্শন ও কংসবধ অঙ্কিত আছে।
পশ্চিমদিকের দেওয়ালে বৃন্দাবনের প্রসিদ্ধ কুঞ্জসমূহের ও যমুনা নদীর দৃশ্য প্রদর্শিত হইয়াছে। এই যমুনা নদীর উপরেও কতকগুলি কৃষ্ণলীলার চিত্র আছে। ইহাদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশটি হইবে। এই দৃশ্যগুলির মধ্যস্থলে একটি চক্রের মধ্যে শ্রীরাধা ও জনৈক সখী-সহ শ্রীকৃষ্ণের একটি বড়ো মূর্তি আছে। চক্রের বেড়ের উপরও কৃষ্ণমূর্তি-সহ অষ্টসখীর চিত্র প্রদর্শিত হইয়াছে। এই সকল চিত্রের নিম্নে বাংলা অক্ষরে চিত্রের নাম ও প্রতিপাদ্য বিষয়গুলিও লিখিত আছে।
দরদালানের উত্তরে মন্দির-গৃহের পাঁচটি প্রবেশপথের উপরিভাগে নিম্নলিখিত চিত্র কয়েকটি অঙ্কিত আছে। ১. রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি, ২. চৈতন্য-নিত্যানন্দ সংকীর্তন, ৩. মন্দির-প্রতিষ্ঠাতা নন্দকুমার বসুর পুত্র ও পুরোহিতের প্রতিকৃতি-সহ গণেশ মূর্তি, ৪. লক্ষ্মণ, ভারত ও শত্রুঘ্ন সহ রামসীতার মূর্তি ও ৫. দুই পার্শ্বে নন্দী-ভৃঙ্গী-সহ কৈলাসে বৃষোপরি উপবিষ্ট হরপার্বতীমূর্তি।
বহুদিন পরিষ্কৃত না হওয়ায় এই চিত্রগুলি ক্রমশ ময়লা পড়িয়া অস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। শুনা যায়, বসুবাবুদের বাটীর পুরাতন কাগজে এগুলি দেশি উপায়ে পরিষ্কার করিবার পদ্ধতি লিখিত আছে, কিন্তু দুঃখের বিষয় উক্ত পদ্ধতি অনুসারে এ-পর্যন্ত কোনো কাজ হয় নাই।
এই সকল চিত্রের মধ্যে তিনখানি চিত্রের প্রতিলিপি ও বিস্তৃত পরিচয় এই প্রবন্ধের সহিত প্রকাশিত হইল।
প্রথমখানি মন্দিরের দ্বিতীয় প্রবেশপথের উপরিভাগে অঙ্কিত পূর্বোক্ত চৈতন্য-নিত্যানন্দ সংকীর্তনের চিত্র। ইহাতে মহাপ্রভু সঙ্গিগণ-সহ মত্ত হইয়া নৃত্য করিতেছেন। ইহার বামদিকে যবন হরিদাস, তৎপরে নিত্যানন্দ, মধ্যে তুলসীমঞ্চ, তৎপার্শ্বে শ্রীচৈতন্য, অদ্বৈত ও অন্য একজন ভক্তের প্রতিকৃতি আছে। ভক্তগণসহ মহাপ্রভুর এইরূপ উদ্দন্ড নৃত্যের বর্ণনা চৈতন্যভাগবত-এর অনেক জায়গায় দেখিতে পাওয়া যায়।
নিম্নে উক্ত পুস্তক হইতে এইরূপ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত হইল। উহা হইতে এই চিত্রের মর্ম অবগত হওয়া যাইবে।
উঠিল পরমানন্দ কৃষ্ণসংকীর্ত্তন।
বিহ্বল হইয়া নৃত্য করে ভক্তগণ।।
ক্ষণেকে শ্রীগৌরচন্দ্র করিয়া হুঙ্কার।
উঠিয়া লাগিলা নৃত্য করিতে অপার।।
… … … …
প্রভু করিয়াও কারো কিছু ভয় নাই।
প্রভু ভৃত্য সকলে নাচয়ে একঠাঁই।।
প্রেমরসে মত্ত হই বৈকুন্ঠ ঈশ্বর।
নাচেন লইয়া সব প্রেম অনুচর।।
দ্বিতীয় চিত্রখানিও চৈতন্যলীলা-বিষয়ক। ইহা দরদালানের পূর্বদিকের দেওয়ালের দ্বিতীয় সারে অঙ্কিত আছে। এই চিত্রখানিতে মহাপ্রভুর ষড়ভুজ মূর্তি প্রদর্শিত হইয়াছে। চৈতন্যভাগবত-এ দেখা যায়, পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্রের সভাপন্ডিত, পরমভক্ত, সার্বভৌম ভট্টাচার্যকে মহাপ্রভু ভাগবতের গূঢ়তত্ত্ব ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে ষড়ভুজ মূর্তি দেখাইয়াছিলেন। ভাগবতে উহার এইরূপ বর্ণনা আছে :
ব্যাখ্যা শুনি সার্ব্বভৌম পরম বিস্মিত।
মনে গণে এই কিবা ঈশ্বর বিদিত।।
শ্লোক ব্যাখ্যা করে প্রভু করিয়া হুঙ্কার।
আত্মভাবে হইল ষড়ভুজ অবতার।।
… … … …
অপূর্ব্ব ষঢ়ভুজ মূর্ত্তি কোটি সূর্য্যময়।
দেখি মূর্চ্ছা গেল সার্ব্বভৌম মহাশয়।।
বিশাল করেন প্রভু হুঙ্কার গর্জ্জন।
আনন্দে ষঢ়ভুজ গৌরচন্দ্র নারায়ণ।।
এখানে চৈতন্যভাগবতকার বৃন্দাবনদাস মহাপ্রভুর প্রতি ভক্তিবশত তাঁহার মহিমা প্রচারার্থ তাঁহাকে খুব অপ্রাকৃতভাবে চিত্রিত করিলেও, আমাদের দেশের চিত্রকর কিন্তু এই চিত্রে তাঁহাকে সে-ভাবে অঙ্কিত করেন নাই। তিনি ভাগবতের বর্ণনানুযায়ী, মহাপ্রভুর ছয়টি হস্ত অঙ্কিত করিলেও, সার্ব্বভৌম পন্ডিতের মূর্চ্ছা হইবার মতো হুঙ্কার ও গর্জনে উন্মত্ত তাঁহার অতিপ্রাকৃত মূর্তি না দেখাইয়া তাঁহাকে সুন্দর মানবরূপেই প্রদর্শন করিয়াছেন। এবং তাঁহার এই প্রাকৃতিক মূর্তির মধ্যেই দেবভাব ফুটাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছেন।*
ইহাতে শ্রীচৈতন্যদেবের ছয় হস্তে যে-সমস্ত প্রহরণ দেখানো হইয়াছে সেগুলির নরোত্তমের ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এর বর্ণনার সহিত বেশ মিল আছে। নিম্নে ‘চৈতন্যমঙ্গল’ হইতেও আমরা উক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়া দিলাম।
হেনই সময়ে প্রভু ষড়ভুজ শরীর।
দেখি সার্ব্বভৌম হইল আনন্দ অস্থির।।
ঊর্দ্ধ দুই হাতে ধরে ধনু আর শর।
মধ্য দুই হাতে ধরে মুরলী অধর।।
নিম্ন দুই হাতে ধরে দন্ড কমুন্ডল।
দেখি সার্ব্বভৌম হইল আনন্দে বিহ্বল।।
তৃতীয় চিত্রখানি শ্রীকৃষ্ণলীলা সম্বন্ধীয়। ইহাও দরদালানের পূর্বদিকের দেওয়ালে আছে। ইহাতে দেখা যায়, শ্রীরাধিকার অষ্টসখীর মধ্যে দ্বিতীয়া সখী বিশাখা তাঁহাকে দূর হইতে শ্রীকৃষ্ণের চিত্র নিজে আঁকিয়া দেখাইয়াছেন এবং উহা দেখিয়া শ্রীরাধা কৃষ্ণবিরহে কাতরা হইয়া বসিয়া আছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বহড়ু হাইস্কুলের জনৈক ছাত্র পেনসিল ঘষিয়া রাধার মুখখানি কাল ও বিকৃত করিয়া দিয়াছে। ঠোঁটের উপর ও মুখের চতুর্দিকে পেনসিলের কাল দাগ এত বেশি ছিল যে, আমরা বিশেষ চেষ্টা করিয়াও উহা একেবারে উঠাইতে পারি নাই।
এই চিত্রখানির নিকটে পূর্বোল্লিখিত অষ্টসখী সহ রাধাকৃষ্ণের বড়ো যুগলমূর্তির নিম্নে বাংলা অক্ষরে লিখিত একছত্র একটি লিপি আছে। উহা পাঠে জানা যায় যে, দুর্গারাম ভাস্কর নামে জনৈক শিল্পী কর্তৃক উক্ত চিত্রগুলি অঙ্কিত হয়। বাংলা দেশে পূর্বে একদল চিত্রকরের এইরূপ ভাস্কর উপাধি ছিল। প্রবাদ, উহাদের পূর্বপুরুষেরা প্রাচীনকালে ভাস্করের কাজ করিত, পরে ওই ব্যবসা লোপ পাইলে পুরুষানুক্রমে ছবি আঁকিত। এখনও এ-প্রদেশে এই নামে পরিচিত কতকগুলি চিত্রকরকে প্রাচীন রীতিতে প্রতিমার চালচিত্র আঁকিতে দেখা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কয়েক বৎসর হইল ইউরোপ হইতে ছাপা চালচিত্রের আমদানি হওয়ায় ইহাদেরও ব্যবসা লোপ পাইবার উপক্রম হইয়াছে।’ [প্রবাসী, চৈত্র, ১৩৩৯]
মন্দির ভিত্তিচিত্র শিল্পীরা জানতেন এগুলির সংরক্ষণের উপায়।
কালিদাস দত্ত জানাচ্ছেন, বহড়ুতে একটি খাতা ছিল তাতে কীভাবে ছবিগুলি পরিষ্কার রাখতে হবে সে বিবরণ ছিল। শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, শিল্পীদের উদ্যোগে ভিত্তিচিত্র নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত রাজস্থান থেকে ভিত্তিচিত্র বিশেষজ্ঞ এসে কাজ শিখিয়েছিলেন। নন্দলাল-বিনোদবিহারী কি বাংলা ভিত্তিচিত্রকারদের সন্ধান পাননি? না বিংশ শতাব্দীর তৃতীয়-চতুর্থ শতকে তাঁরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন?
[কৃতজ্ঞ প্রয়াত শিল্প ঐতিহাসিক ড. টি. কে. বিশ্বাসের কাছে। গুপ্তিপাড়া মন্দিরগাত্রচিত্র নিয়ে অনেক সংশয় তিনি দূর করে দিয়েছেন]
* অতিপ্রাকৃত মূর্তিতেও এইরূপ মানবীয় ভাবের বিকাশ বাংলা দেশের শিল্পে খুব প্রাচীনকাল হইতেই দেখা যায়। এদেশে আবিষ্কৃত পালরাজত্বকালের বহু মুখ ও হস্তপদাদি যুক্ত বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর অতিপ্রাকৃত মূর্তিগুলিই উহার চাক্ষুষ নিদর্শন।