বহুরূপী

বহুরূপী

ছোটোবেলাকার কত কথাই যে মনে পড়ে, কত কাণ্ডই যে তখন হত। একবার গুপের মামাতো ভাই ভোঁদা বলেছিল যে বহুরূপীরা পর পর সাত দিন আসে, এক-এক দিন এক-এক নতুন সাজে। কখনো কখনো সবাই তাকে বহুরূপী বলে চিনে ফেলে, আবার কখনো কখনো সে এমনি চেহারা বানিয়ে আসে যে কেউ তাকে বহুরূপী বলে টেরই পায় না। তারপর একদিন নিজের সত্যিকার চেহারা নিয়ে এসে, যে যা কিছু টাকাপয়সা দেয় চেয়ে নিয়ে যায়। সেবার মধুপুরেও ঠিক তাই হল। সকালে মামিমা তরকারি কুটছেন, একজন গয়লার মেয়ে এসে কী চমৎকার খোয়া ক্ষীর বিক্রি করে গেল। পরদিন বিকেলে একজন ঝোলা ঝোলা পোশাক-পরা ফিরিঙ্গি পাদ্রি এসে মামার কাছে পোস্টাপিসের রাস্তা জিজ্ঞাসা করে, আধ ঘণ্টা বসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় ইংরাজিতে গির্জার ঘণ্টা মেরামতের গল্প করে গেল। তার পরদিন আবার দেখি যে দশ-মুন্ডুওয়ালা রাবণরাজা সেজে এসেছে। গুপেরা হইচই করে উঠল। মামিমার ছোটো মেয়ে বুচকি ভয় পেয়ে খুব খানিকটা কাঁদল। তার পরদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর অন্ধকার বারান্দায় খট খট শব্দ শুনে ভোদা বাইরে গিয়ে দেখে কী সর্বনাশ, থামে ঠেস দিয়ে বিকট একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে, বাতাসে তার হাত দুটো একটু একটু দুলছে, আর হাড়গোড় থেকে খটাখট শব্দ হচ্ছে। ভেঁদা দারুণ ভয় পেয়েছিল, কিন্তু গুপে এসেই বলল, এই বহুরূপী! তুমি তো ভারি চালাক হয়েছ! অমনি কঙ্কালটা এমন করে অন্ধকার ঝোঁপের পাশে গা ঢাকা দিল যে সত্যি মনে হল বুঝি মিলিয়ে গেল? ততক্ষণে মামাও বেরিয়ে এসেছেন, ধমক দিয়ে বললেন, এই বহুরূপী, সাজতে হয় মজার মজার সাজ করো। এইরকম ভয়াবহ চেহারা করে এলে ছেলেপিলেরা ভীতু হয়ে যাবে যে। অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা খিলখিল হাসি শোনা গেল। তারপর সব চুপচাপ। বড়োদের অনেকেরই নাকি গায় কাঁটা দিচ্ছিল!

পরদিন বহুরূপী মাতাল সেজে এসে আধঘণ্টা সবাইকে খুব হাসাল, বললে হয়তো সবাই বিশ্বাস করবে না, কিন্তু সারাক্ষণ সে ঠ্যাং দুটো উঁচু করে হাতে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। বলল নাকি মাথা ঘুরছে বলে কিছু ঠাওর করতে পারছে না। আর সে যে কীসব আবোলতাবোল বকছিল সবাই হেসে লুটোপুটি। যাবার আগে আবার এক গেলাস জল চেয়ে, সেটা পায়ের আঙুল দিয়ে ধরে, জলটা গলায় ঢেলে নিল। সবাই তো হাঁ!

তার পরদিন সারাদিনই সবাই আশা করে আছে কখন বহুরূপী আসবে, এমন সময় একজন সাপের ওঝা এসে জোরজার করে সাপ খেলা দেখাবেই দেখাবে। সবাই তাকে বহুরূপী মনে করে খুব রসিকতা করছে। এমন সময় একজন পুলিশসাহেব এসে মহা শোরগোল লাগিয়ে দিল; ও নাকি সত্যি ওঝা নয়, ডাকসাইটে চোর, বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নেয় কোথা দিয়ে কীভাবে গিয়ে জিনিসপত্র সরানো যেতে পারে। ওঝাটাও তাকে দেখেই জিনিসপত্রই গুটিয়ে নিয়ে দে দৌড়। তাড়াতাড়িতে একটা সত্যিকারের সাপও ফেলে গেল। কিন্তু শেষপর্যন্ত বটু মালী বলল ওটা হেলে সাপ, কাউকে কিছু বলে না, তবে কেউ কেউ বলে যে ওদের শনি-মঙ্গলবারে বিষ। হয়, কাজেই সাবধানের মার নেই। ততক্ষণে সাপটা যে কোথায় পালিয়েছে তাকে খুঁজেই পাওয়া গেল না। কিন্তু ওই লোক দুটোর মধ্যে কেউ বহুরূপী কি না তা বোঝাই গেল না।

পরদিন বিকেলে একজন বাউল এসে অনেকক্ষণ গান গেয়ে নেচে কুঁদে একাকার। বহুরূপীটার কত যে বিদ্যে জানা ছিল।

সন্ধ্যে বেলা পাশের বাড়ি থেকে হরিপদবাবুরা বেড়াতে এসে খুব রাগ করতে লাগলেন যে এইসব বহুরূপী সেজে যারা বেড়ায় তারাই দাগি চোর হয়, বাড়িতে ঢুকতে দেওয়াই উচিত নয়, আর মামা কি তাদের আশকারা দেন। একদিন যখন চেঁচেপুছে সব নিয়ে যাবে তখন পস্তাতে হবে, ঠিক হবে। যতসব ফেরিওয়ালা, বাউল, বহুরূপী, নাচিয়ে-গাইয়ে বাড়িতে পূরে এখন মহাদেবের মতো ঝুঁদ হয়ে থাকুন-গে, সংসারের ভারি কল্যাণ হবে। এদিকে পাড়ায় তো হামেশাই এটা হারাচ্ছে, ওটা হারাচ্ছে। তাতে আর কার কীবা এসে যাচ্ছে। মামার নিশ্চয় মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিল, কিন্তু কিছু বললেন না।

তবে হরিপদবাবু চলে গেলে ডাক দিয়ে মামিমাকে বললেন, দেখ, ওর সাত দিন হয়ে গেছে, কাল দুটো টাকা দিয়ে বিদায় করে দিয়ে। যদিও অনেক দিন থেকেই ওকে জানি, তবু পাড়া-প্রতিবেশীকে চটাতে নেই। বোঁদা বলল বা ব্বা! বিদেয় করে দিয়ে মানে। কাল ও তো একটা সাজ দেখাবে, একদিন যে আসেনি। মামা অবাক হয়ে বললেন, সে আবার কবে? কেন, যেদিন সেই সাপের ওঝা আর পুলিশসাহেব এসেছিল। ওই ওঝাকে এখানে অনেকে চেনে, ও বহুরূপী নয় কখনো। আর পুলিশসাহেব ও-রকম সাজপোশাক করা একে তো বহুরূপীর কম্ম নয়, অনেক খরচা লাগে। তার উপর পটলাদের কে হন উনি, নতুন এসেছেন।

সবাই ভাবল তা হবেও-বা। মামা আবার বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা, কালকের সাজটা নাহয় দেখেই নিয়ে, কিন্তু ও যাবার সময় দুটো টাকা ওর হাতে দেবে আর বলবে যেন আর এদিকে না আসে।

পরদিন সবাই তাগ করে আছে কখন বহুরূপী আসবে, এমন সময় একটা নেংটি-পরা লোক বগলে একটা নোংরা পুটলি নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে মামিমার পা জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল: মা, মিছিমিছি পাড়ার লোকে আমার পাছু নিয়েছে, আমাকে রক্ষা করুন, দৌড়ে দৌড়ে আর তো পারি নে, এক পেয়ালা চা না পেলে দু-দণ্ড না জিরুলে আমার বুকটা ফেটে যাবে।

এমন চমৎকার বলল যে মনে হল সত্যিই যেন অনেক কষ্টে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসেছে, চা না পেলে আর বিশ্রাম না করলে এক্ষুনি মরে যাবে।

সবাই মিলে তার পিঠ চাপড়ে চায়ের জন্য বাড়ির পিছনে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিল। মামিমা তার হাতে দুটো টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, খুব ভালো সেজেছ, আজকের সাজটা সবচেয়ে ভালো হয়েছে। আর দেখো বাছা, উনি এখন বাড়ি নেই, তোমায় বলতে বলেছেন যে আমরা খুব খুশি হয়েছি কিন্তু তুমি আর এ-বাড়িতে এস না, পাড়ার লোকে আমাদের মন্দ বলে। তুমি চা খেয়ে গোয়ালঘরে বিশ্রাম করে, বাড়ি যেয়ো কেমন? বহুরূপী এমনি চালাক যে তবু কিছু ভাঙল না, সুড়সুড় করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

ঘণ্টা খানেক বাদে হন্তদন্ত হয়ে মামা এসে হাজির! ওগো, সর্বনাশ হয়েছে, একেবারে দিনে ডাকাতি। কাল এত বক্তৃতা করে গেলেন আর আজই হরিপদবাবুরা ওপরে ঘুমুচ্ছেন আর নীচে থেকে তাদের সর্বস্ব চোরে নিয়ে গেছে, টাকাকড়ি গয়নাগাটি, ফাউন্টেন পেন, হাতঘড়ি, মায় চশমাটি অবধিও। হরিপদবাবুরা তাকে দেখতে পেয়েছেন পর্যন্ত, হাতেনাতে ধরাও পড়ত, সবাই মিলে তাড়া করেছিল, কিন্তু এই দিকেই কোথায় যে গিয়ে গা ঢাকা দিল, সবাই মিলে এতক্ষণ গোরুখোজা করলাম, তবু টিকিটিও আর দেখা গেল না। এদিকে আসেনি তো?

মামিমা মাথা নাড়তে যাচ্ছেন এমন সময় রোগা তেল চুকচুকে একজন লোক এসে নমস্কার করে হাতজোড় করে দাঁড়াল, মামা বললেন, আরে বহুরূপী যে! চুরির কথা শুনেছ তো? এবার। তোমাদের সন্দেহ করবে সব। হরিপদবাবু কালকেই সেকথা বলে বেড়াচ্ছিলেন। দাও তো ওর টাকা দুটো। তুমি বাপু এদিকে আর এসো-টেসো না।

বহুরূপী একগাল হেসে বলল, এজ্ঞে না বাবু, আমি এক্ষুনি আটটার গাড়ি ধরে এক্কেবারে রামকিষ্টপুরের ওদিকে মামাবাড়ি চলে যাচ্ছি। ওই হরিপদবাবুটির যেমনি সন্দেহ বাতিক তেমনি অসাবধান।

মামিমা কী আর করেন, দিলেন দুটো টাকা; মামা রেগে যাবেন, বলাও যায় না সব কথা। যাবার সময় বহুরূপী মামার মামিমার পায়ের ধুলো নিয়ে, গুপে আর ভোদার দিকে ফিরে এক বার চোখটা টিপল। পরে আমরা শুনলাম নেংটি-পরা লোকটা, চা খেয়ে জিরিয়ে জুরিয়ে, ঠাকুরের কাছ থেকে পান খাবার জন্য চার আনা চেয়ে কখন গুটিগুটি কেটে পড়েছে। মামিমা বললেন চেপে যেতে। আজ পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিক বোঝা গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *