বদ্যিবুড়োর জীবনকথা

বদ্যিবুড়োর জীবনকথা

বারবাড়ির সামনে একটা নাড়ার পালা। ধান মৌসুম শেষ হয়ে গেছে। এখন ক্ষেতখোলা সাফ করার সময়। পোলারা সারাদিন ক্ষেত সাফ করে। নাড়া তুলে এনে বারবাড়ির সামনে পালা দেয়। সকালে ক্ষেতে যাওয়ার সময় বুড়ো বাপ বদ্যিকে ধরে এনে নাড়ার পালার সামনে বসিয়ে দিয়ে যায়।

নিজে আজকাল হাঁটাচলা করতে পারে না বদ্যিবুড়ো। পোলারা, পোলাদের বউরা নয়তো নাতিনাতকুররা ধরে ধরে ঘরের বার করে। ভেতরে নেয়। আর দিনে সতেরবার বুইড়ার মরণ নাই, বুইড়ারে আল্লায় চোক্কে দেহে না বলে গাল দেয়।

সংসারে এখন বাড়তি মানুষ বদ্যিবুড়ো। বয়স হয়েছে তিন কুড়ির ওপর। অকেজো হয়েছে একযুগ আগে। কী একটা কঠিন ব্যারাম হয়েছিল বদ্যিবুডোর। এখন মরে, তখন মরে অবস্থা। টানা দেড় বছর পাটাতনের ওপর পড়ে থাকল। তারপর আস্তেধীরে সেরে উঠল একদিন। গতরখান তখন আর নেই বদ্যির। চুল দাড়ি পেকে পাটের আঁশ, দাঁত পড়ে মুখটা ফোকলা, কান দুটো গেছে বয়রা হয়ে, চোখে পড়েছে মোটা ছানি। গায়ের চামড়া এত ঝুলে গেছে বদ্যির, জোরে বাতাস দিলে জলের মতন চামড়ার ওপর ঢেউ খেলে। রুজিরোজগারের পথটা বন্ধ হয়ে যায় বদ্যির। পোলাদের মাথায় ধানের বস্তার মতো চেপে বেঁচে থাকে সে।

ততদিনে সংসারের সবাই বদ্যির শত্রু। পোলারা, বউরা এমনকি আণ্ডাবাচ্চা নাতি নাতকুরগুলোও সইতে পারে না বদ্যিকে। অচল মানুষ টানাহ্যাঁচড়া করে, হেগেমুতে ঘর দোর নষ্ট করে সেসব সাফ করা, হাতে ধরে নাওয়া খাওয়াও, কে অত ঝামেলা সইবে! তার ওপর কানের সামনে টিকারা বাজলেও শব্দ পাবে না বদ্যি। চোখের সামনে ক্ষেমটা নাচ হলেও দেখতে পাবে না, এই মানুষের মরণ ছাড়া কে কী চাইবে সংসারে।

কিন্তু বদ্যিবুড়োর মরণ নেই। ধুকেধুকে এখন বেঁচে আছে মানুষটা। সারাদিন খ্যাক খ্যাক করে কাশে, জামরুলের মতো দলা দলা কফ ফেলে বাড়িঘর নষ্ট করে, গোঁফ দাড়িতে মাখামাখি হয়, কে অত সাফ করবে! তাই সকালবেলা বারবাড়ির সামনে নাড়ার পালার ছায়ায় বসিয়ে রাখা হয় মানুষটাকে। গায়ে তেনাটা পর্যন্ত নেই। ন্যাংটোভুতুম বদ্যিবুড়ো ধুলোবালির ওপর বসে দিন কাটায়। পেলে খায়, না পেলে চেঁচিয়ে পোলাদের, বউদের গালাগাল করে। কখনো মনের দুঃখে বুক চাপড়ে, কপাল চাপড়ে কাঁদে। বুড়োকালে এই দুঃখু আর সয়না আল্লা। লইয়া যাও, আমারে তুমি লইয়া যাও।

এসব শুনে ভেতর বাড়ি থেকে বউরা টিপ্পনী দেয়, নিলে তো বাঁচতাম। জানডা আরাম পাইত।

তয় বয়সকালে বেডা আছিল একখান বদ্যি। ওঝা মানুষ। গাইগরুর চিকিৎসা করত। দশ গেরামে বদ্যির নামডাক আছিল। মইরা যায় যায় এমন গাইগরুও খাড়া কইরা হালাইছে বদ্যি। মাইনষে খাতির করত। টাকা-পয়সা দিত। বাগানের ফল পাকুরটা দিত, তরিতরকারিটা দিত।

 টোটকাফাটকা ওষুধ দিত বদ্যি। ফেন খৈলের সঙ্গে ব্যারামি গাইগরুকে খাওয়াত বনেলা গাছের শিকড়বাকড়। পানিপড়া দিত, মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিত। বদ্যির চিকিৎসার পর কোন গাইগরু মারা পড়ছে এমুন কথা দশ গেরামের মাইনষে শোনে নাই।

কাজটা বদ্যি শিখেছিল ধাইদার কাদের খাঁর কাছে। ওঝা আছিল একখান কাদের খাঁ। তল্লাটে বেজায় নাম আছিল মানুষটার। কত ব্যারামের চিকিৎসা যে জানত। ভূতপেত্নির আছর ছাড়াতে জানত, বান জানত বায়ান্ন জোড়া, ফিরানী জানত। টোনা সেরও জানত! লোকের ভালোটা মন্দটা সবই করত।

জোয়ান বয়সে কাদের খাঁর নাম শোনে বদ্যি। তল্লাটে জুড়ে তখন কাদের খাঁর নামডাক। বিশ-তিরিশ মাইল পথ ভেঙে লোক যেত কাদের খাঁর কাছে ওষুধবিষুধ আনতে, পানি পড়া আনতে, বানের ফিরানী আনতে। দিনরাত বাড়ি ভর্তি লোক থাকত কাদের খাঁর। আর চারদিকের মাটিতে দলবেঁধে বসে থাকত মানুষ। মরদ, মাইয়া মানুষ।

নূরানি চেহারা আছিল কাদের খাঁর। মুখে হাসিখান লাইগা থাকত। রাইত দুইফরে গিয়া ডাকলেও ফিরাইত না মাইনষেরে। হাসি মুখে কাম কইরা দিত।

কাদের খাঁর কাছে বদ্যি গিয়েছিল মন্দের ভাগী হয়ে। বিলের এক কানি জমি নিয়ে বদ্যির বাপের আমল থেকে কন্দিপাড়ার মাজেদ দেওয়ানের সঙ্গে গণ্ডগোল ছিল। জমিটা জবরদখল করে রেখেছিল মাজেদ দেওয়ান। সেই আমলে মামলামোকদ্দমায় যেত না। লোকে। বদ্যির বাপও যায়নি। লাঠিসড়কি নিয়ে মারামারি করেছিল বার কয়েক। শেষবার নিজেই সড়কির পার খেয়ে এল বদ্যির বাপ। সেই পাড়েই মরল। তিন চারমাস ভুগে।

বদ্যির তখন জোয়ান বয়েস। বাপের এক পোলা। মা মেয়েমানুষটা বদ্যির ছিল দুনিয়ার ডরহিয়াইল্লা। জমির দখল নিতে গিয়ে পতি মরছে মরুক। পুতটা যেন না মরে। জমি দিয়া কাম নাই। পোলাডা আমার বাঁইচা থাউক।

বদ্যিকে দিনরাত আগলে রাখত মা। চোখে চোখে রাখত, আড়াল হতে দিত না।

কিন্তু বদ্যির ভেতর তখন আগুন জ্বলছে। এক কানি জমি তাও ধানি বিলে। এক মৌসুমে যে ধান হয়, তাতে সংসারের এক বছরের ব্যবস্থা হয়ে যায় মাজেদ দেওয়ানের। জমিটা বদ্যির হাতে গেলে দুনিয়াতে আর কিছু চাওয়ার নেই বদ্যির। হেসে, খেলে একটা জীবন কেটে যাবে। বদ্যি তখন জমিটা পাওয়ার লোভে ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে উঠেছে। লোক বলে, লাঠি বলে মাজেদ দেওয়ানের সঙ্গে বদ্যি পারবে না। জমিটা। পেতে হলে তাকে ধরতে হবে অন্য পথ। সেটা কোন পথ?

টোনা সের করে মাজেদ দেওয়ানের বংশ নির্বংশ করতে হবে। বান মেরে মাজেদ দেওয়ানের গলা দিয়ে রক্ত তুলে মারতে হবে। একে একে মাজেদ দেওয়ানের সাত পোলাকেও খতম করতে হবে।

এক দুপুরে সাত মাইল পথ ভেঙে বদ্যি ধাইদা, কাদের খাঁর বাড়ি গিয়া হাজির। মানুষটার চারদিকে তখন ম্যালা লোকজনের ভিড়। চৌকিতে বসে একেকজনকে একেক কিসিমের রোগব্যারামের চিকিৎসা দিচ্ছে কাদের খাঁ। বদ্যি গিয়ে পা জড়িয়ে ধরল তার। তারপর হাউমাউ কান্না, আমারে বাঁচান ফকির।

কাদের খাঁ, দেড় মণি ডেগের ভেতর মুখ দিয়ে কথা বললে যেমন শব্দ হয় তেমন শব্দে বলল, বাজান, কী অইছে তর?

বদ্যি ইনিয়েবিনিয়ে ঘটনাটা বলল। শুনে কাদের খাঁ হাসে। তুই আমারে কী করতে কস?

 বান মাইরা দেওয়ানের বংশ নির্বশ কইরা দেন! জমিনডা আমারে ব্যবস্থা কইরা দেন। আমি আর কিছু চাই না। টেকা-পয়সা যা লাগে দিমু। আপনে কইলে ক্ষেতখোলা যা আছে বেবাক বেইচা দিমু।

কাদের খাঁ আবার হাসে। তারপর বলে, তুই আমার বাইত্তে দুইদিন বেড়া। চাই ডাইলবাত খা। দেহি কী করন যায়।

বদ্যি থেকে গেল।

পরদিন বিয়ান রাতে বদ্যিকে ডেকে তুলল কাদের খাঁ। ডেকে উঠোনে নিয়ে গেল। তারপর নিজ হাতে পশ্চিমের ঝোপ থেকে কেটে আনল লম্বা একটা বিচিকলার পাতা। পাতাটা উঠোনের সাদা মাটিতে রেখে নিজে গিয়ে বসল তার সামনে। বদ্যিকে বসাল। তারপর বলল, আয় তরে একখান খেইল দেহাই।

বলে কী সব মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটির ওপর লাফাতে শুরু করেছে কলাপাতাটা। লাফাতে লাফাতে সবুজ কলাপাতা গেল খয়েরি হয়ে। কাদের খাঁ বলল, কী বুঝলি বদ্যি?

বদ্যির তখন দমবন্ধ। কথা বলতে পারে না। দেখে কাদের খাঁ ঠাটা পড়ার মতো হাসে। খালি একখান বান মারছিলাম। এমুন বায়ান্ন জোড়া বান জানি আমি।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, মাইনষের ক্ষতি সহজে আমি করি না; ভালোডাই করি। বান মারলে মাজেদ দেওয়ানের বংশ ছাই অইব। তুই বাইত যা। আল্লায় যা করে মাইনষের ভালার লেইগাই করে। জমিন দিয়া কী অইব! আইজ মরলে কাইল দুইদিন।

বদ্যি দুঃখি গলায় বলল, খামু কী ফকির? যেডু জমিন আছে, যেডু ফসল অয়, সংসার চলে না।

কাদের খাঁ বলল, আল্লার দুনিয়ায় কেঐ না খাইয়া থাকে না। রেজেগের মালিক হ্যয়।

তুইও মরবি না।

বদ্যি তখন কাদের খাঁর পা জড়িয়ে ধরেছে। আমারে কিছু দেন ফকির। কইরা খাই। শুনে কাদের খাঁ খানিক ঝিম মেরে থাকে। তারপর বলে, একটা চিকিৎসা আমি করি না। তরে দিতে পারি। তয় বহুৎ সাবধান অইয়া করতে অইব, পারবি? পারুম ফকির। কী?

গরুর ব্যারামের চিকিৎসা। ঐডা করলে আবার হকুনে ধরে। দিন দুইফরে একলা পাইলেই দেকবি কোনহান থনে যেন হকুন আইয়া পড়ছে ঝাকে ঝাকে। তরে ঠোকরাইয়া খাইয়া হালাইব। বুজলি না, গরু না মরলে তো হকুনের খাওনের আকাল পড়ে। তর পেড আছে, হকুনেরও তো পেড আছে। তর খিদা আছে, হেগও তো খিদা আছে। চিকিৎসা কইরা তুই গরু বাচাবি, নিজের পেডখান ভরবি আর হকুনরা থাকব না খাইয়া। ফাঁক পাইলে হেরা তাইলে তরে খাইব না! জীবের মুখের আহার কাইরা লইতে নাই। হের লাইগাঐ চিকিৎসাডা আমি করি না। তুই পায়আতে দরলি যহন তরে দিতে পারি। তয় বহুৎ সাবধানে থাকতে অইব। একলা একলা নিটাল জাগায় যাবি না, দূরের পথ পাড়ি দিবি না, পারবি?

 বদ্যি বলল, পারুম ফকির।

তারপর পুরো একমাস কাদের খাঁর বাড়ি থেকে গেল বদ্যি। গাইগরুর চিকিৎসাটা শিখেই বাড়ি ফিরল। দিনে দিনে বদ্যির নাম ছড়িয়ে পড়ল দশ গেরামে। বিলের জমির লোভ ততদিনে চলে গেছে বদ্যির। গাইগরুর চিকিৎসা করে বদ্যির আয় বরকত ম্যালা। কে চায় বিলের জমি। তবে কাদের খাঁর একটা কথা কিন্তু ফলেছিল। চিকিৎসা শিখিয়ে কাদের খাঁ আবার সাবধান করেছিল বদ্যিকে। সাবধানে পথ চলিস বদ্যি। শকুনে একলা পেলে ছিঁড়ে খাবে। শকুনের মুখের আহার কেড়ে নিবি। ফাঁক পেলে শকুনে তোকে খাবেই।

কথাটা পালন করেছিল বদ্যি। কিন্তু মানুষ তো। কতটা সাবধান হতে পারে। একবার বিপাকে পড়েছিল। ঐ একবারই। জশিলদার খনকার বাড়ির একটা গাইগরুর ব্যারাম হল। গাভীন গাই। পেচ্ছাব-পায়খানা বন্ধ হয়ে গেল। খবর পেয়ে বদ্যি গেছে দেখতে। অনেকক্ষণ দেখে ওষুধ দিল, পানিপড়াটা দিল। দিয়ে ঠায় বসে থাকল দুঘণ্টা। দুঘণ্টায় গাইটা পেচ্ছাব করল চারবার। পায়খানা করল চারবার। দেখে খনকাররা বেজায় খুশি। দুপুরে সুপারির সঙ্গে রাখল একখান পাঁচ টাকার কড়কড়ে নোট। টাকাটা ট্র্যাকে খুঁজে পান চিবাতে চিবাতে, বিড়ি টানতে টানতে বাড়ির পথ ধরেছিল বদ্যি। সেদিন আর কাদের খাঁর কথা মনে ছিল না তার। কাদের খাঁ বলেছিল বদ্যিরে সাবধান সাবধান।

জশিলদা থেকে দোগাছীর কোনাকুনি পথে ধানি বিলটা পড়ে। বিশাল বিল। ধানিজমি, পুকুর ডোবা আর বিলের ঠিক মাঝমধ্যিখানে উঁচু ভিটের ওপর গোরস্থান। গোরস্থানের কোণে বিশাল একটা শিমুল গাছ। বহুদূর থেকে নজরে আসে গাছটা।

গোরস্তানটা আগে, বহুকাল আগে ছিল একটা বাড়ি। লোকে বলত বিলের বাড়ি। চারদিকে বিল, মাঝখানে বাড়ি। লোক টিকতে পারেনি। ভূতপেত্নি আর চোর, ডাকাতের ভয়। বসতি ছেড়ে কবে ভিটের মালিক পালিয়েছিল কে জানে। পরে দিনে দিনে বাড়িটা হল গোরস্থান। দশ গেরামের মানুষ মাটি পড়ে।

গোরস্তানের কাছে গভীর কালো জলের একটা দিঘি। নাম কৌপটাহার। দিঘিটা ভালো না। বর্ষার মুখে মুখে বিলে মাছ মারতে বেরিয়ে কত লোক যে এই দিঘিতে ডুবে মরেছে। দিন দুপুরেও দিঘিটার সামনে দিয়ে একা চলতে ভয় পায় লোকে। কখন কনধনাইয়া এসে চুবিয়ে মারবে দিঘিতে।

সেই দিঘিটার সামনে এসেই বদ্যির মনে পড়েছিল কাদের খাঁর কথা। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠেছিল। হায় হায় করলাম কী এইডা।

কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। বিলের দুদিকেই প্রায় মাইলখানেক করে দূর গ্রাম। কোনও দিকে ফেরার উপায় নেই। কী করে, বদ্যি কী করে! আল্লা খোদার নাম নিয়ে দ্রুত পা চালায়। দিঘিটা মাত্র পেরিয়েছে বদ্যি, হঠাৎ চারপাশে শোনে শাঁ শাঁ শব্দ। চারদিকের রোদ মুছে দিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। বদ্যি ভাবে, আকাশে বুঝি মেঘ জমেছে। ঝড়বৃষ্টি নামবে।

 অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকায় বদ্যি। তাকিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যায়। সর্বনাশ। ঝড়বৃষ্টি নয়, চারপাশ অন্ধকার করে ঝাঁক বেঁধে আসছে শকুনের দল। কাদের খাঁ বলেছিল, বদ্যিরে সাবধান। হকুনের আহার কাইরা নিবি, বাগে পাইলে হকুনে তরেই ছিঁড়া খাইব।

বদ্যির আজ সে কথা মনে ছিল না। আজই হকুনে ছিইড়া খাইব বদ্যিরে।

কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে! বগলে ছাতাটা ছিল বদ্যির। মোলায়েম রোদে খোলার দরকার হয়নি। বুদ্ধি করে ছাতাটা হাতে নিয়েছিল বদ্যি।

ততক্ষণে শকুনের পাল নেমে গেছে তার চারপাশে। কি হি কি হি শব্দ করে, লম্বা গলা বাড়িয়ে তেড়ে আসছে বদ্যির চারদিক থেকে। সামনে পেছনে, ডানে বাঁয়ে শয়ে শয়ে শকুন।

তখুনি ফটাশ করে ছাতাটা সামনের দিকে মেলে ধরে বদ্যি। উকট শব্দে, গোল কালো একখান জিনিশ সামনে দেখে ভয়ে কি হি কি হি শব্দ করে দৌড় লাগায় সামনের দলটা। তারপর আকাশে উড়াল দেয়।

বদ্যি তখন বুকে বল পেয়ে গেছে। সাহস করে সামনে পেছনে, ডানে বাঁয়ে অবিরাম ফটাশ ফটাশ করে ছাতা ফোঁটায়, বন্ধ করে। আস্তেধীরে শকুনের পাল ভয়ে পালায়। ধানি বিলের ওপর দিয়ে দৌড়ে গিয়ে আকাশে উড়াল দেয়।

একবার, ঐ একবারই বিপাকে পড়েছিল বদ্যি। তারপর থেকে বড় সাবধানে কাটিয়েছে জীবনটা। কিন্তু জীবের মুখের আহার কেড়ে নেয়ার পাপ বদ্যিকে ছাড়েনি। জোয়ান বয়সে ভাটি পড়তে পড়তেই ব্যারামে পড়ল। ভুগে ভুগে সারা হলো। এখন অথর্ব। যার দাপটে সংসারটা একদিন রাজার হালে চলত, সে এখন সংসারের জঞ্জাল হয়ে বেঁচে আছে। ওঠতে বসতে গঞ্জনা, অভিশাপ। বুইড়া মরে না ক্যা? আল্লায় বুইড়ারে চোক্কে দেহে না!

বয়রা হয়ে যাওয়া কানে সব কথা যায় না। দু একটা শুনতে পায় বদ্যি। তাতে অনুতাপটা হয়। জীবের মুখের আহার কেড়ে নেয়া, দুনিয়ায় সে বড় পাপকর্ম। পাপের প্রায়শ্চিত্ত এই শেষ বয়সে করছে বদ্যি। আর মনের অনুতাপটা তো আছেই। সেই অনুতাপেই যখন তখন কাঁদে বদ্যি। পোলাপানের মতো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদে। আর দিনমান বারবাড়ির সামনে, নাড়ার পালার ছায়ায়, ধুলোবালির ওপর ন্যাংটো হয়ে, ঝোপঝাড়ের মতো বসে থাকে। লোকে এসব বোঝে না।

হুনছেন নি? ও ফকির

ঠাঠা পোড়া রোদে আধ মাইল পথ ভেঙে এসেছে সীতারামপুরের গেরস্থ হাতেম। গা গতর ঘামে ভিজে জবজবে। নাড়ার পালার ছায়ায়, বদ্যি বুড়োর পাশে মাটিতে বসে পড়ে সে। বসে কোমর থেকে ছেঁড়া গামছা খুলে মুখটা-গলাটা মোছে। তারপর গামছা ভাঁজ করে মুখের সামনে নাড়তে থাকে। তাতে একটু হাওয়া পায়। আরাম হয় হাতেমের। কিন্তুক বুইড়া হুনতাছে না ক্যা?

 হাতেম বদ্যিবুডোর মুখের কাছে ঝুঁকে যায়, তারপর আবার ডাকে, হুনছেন নি, ও ফকির?

নাড়ার পালার ছায়ায় হাত পা মুড়ে, প্রাচীন ঝোপঝাড়ের মতো ন্যাংটা বদ্যিবুড়ো বসে আছে। হাড্ডিসার, ছুলুম বদলানো সাপের মতো ধূসর শরীর। চামড়া ফেটে ইরল চিরল দাগ পড়েছে। পাটের আঁশের মতো চুল দাড়ি। হা করে শ্বাস টানছে মানুষটা। দমের তালে তালে কামারবাড়ির হাপরের মতন পুরো শরীরটা ওঠানামা করছে। দেখে হাতেমের বড় মায়া হয়। আহারে! কী মানুষ কী অইয়া গেছে! এত বড় ফকির। দশ গেরামে নামডাক আছিল। নিজের চিকিৎসা নিজে করতে পারে নাই।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতেম আবার ডাকে। হুনছেননি? ও ফকির।

এবার মুখ তোলে বদ্যি। পচা ডিমের মতো ঘোলা চোখের কোণে জমে আছে কেতুরের সবুজ দলা। গোঁফ মাখামাখি হয়ে আছে গাঢ় হলুদ কফে। আহা সেই বদ্যি আর নাই। মুখটা ভেঙেচুরে শুকনো আতাফলের মতো হয়ে গেছে। চোখে দেখে না, কানে শোনে না।

 উপায় না দেখে বদ্যির কাঁধ ঝাঁকুনি দেয় হাতেম। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, আমি সীতারামপুরের হাতেম। একটা কামে আইছিলাম আপনার কাছে।

ঘোলা চোখ তুলে বদ্যি বলল, কী কাম?

আমার গাইডার দুদ কইম্যা যাইতাছে।

এ্যা। কী কইম্যা যাইতাছে?

দুদ। গাইয়ের দুদ।

বিয়াইছে কবে?

আড়াই মাস।

পয়লা পয়লা কয় সের দুদ অইত?

চাইর পাঁচ সের।

কয় সের?

 হাতেম চেঁচিয়ে বলল, চাইর পাঁচ সের।

অহন?

দেড় সের, দুই সের।

শুনে বদ্যি চুপচাপ কী ভাবে। তারপর বলে, পেড বইরা খাওন দেচ না?

কন কী, জবর খাওন দেই।

তয়?

হেইডাঐ তো বুজতাছি না।

পচা ডিমের মতো চোখ তুলে বদ্যি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 তারপর বলে, চনায় কেমুন?

আগের লাহানঐ।

লাদে কেমুন?

এই হগলে কুনো দোষ নাই।

বদ্যি তারপর একদম চুপ। কী ভাবে কে জানে। অনেকক্ষণ চুপচাপ দেখে হাতেম একটু বিরক্ত হয়। কতা কয় না ক্যান হালায়?

খানিকপর বদ্যি বলল, তর গাইয়ের কুনো ব্যারাম নাইরে। একখান হাপ আছে তর সীমানায়। দুধরাজ হাপ। দুদের লাহান ফকফইক্কা। নিশি রাইতে হেয় আইয়া তর গাইর দুদ খাইয়া যায়।

 শুনে হাতেম একটু চমকে ওঠে। কতাডা তো ফকির ঠিকই কইছে। হাপ তো একখান আছে। বাঁশঝাড় তলায় ছুলুম বদলাইছে।

হাতেম বলল, যাঐ থাউক, আপনে অষইদ দেন।

চোখে পরপর কয়েকটা পলক ফেলে, কপালের চামড়ায় গিঁট ফেলে বদ্যি বলল, কি কইলি?

কইলাম হাপের অষইদঐ দেন।

না। অষইদ দেওন আমি ছাইড়া দিছি।

শুনে হাতেম চুপ মেরে যায়। বদ্যি উদাস হয়ে কী ভাবছে। হাতেম ভাবে, ফকির চিন্তা করতাছে। কইলে কী অইব, অষইদ না দিয়া পারবনি।

বদ্যি বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর বিড়বিড় করে বলে, জীবের মুকের। আহার কাইরা নেওয়া বড় পাপ। হারা জীবন ফকরালি করছি, জীবের মুকের আহার কাইরা লইছি, হের লেইগাঐ শেষকালে আমার এই দশা। কুত্তা বিলাইয়ের লাহান, বাইচ্চা রইছি। ঠিক মতন খাওনডা পাইনা। আহার জোডে না।

শুনে হাতেম খুব অবাক। কন কী ফকির! গাইয়ের দুধ বেইচ্চা আমার সংসার চলে। দুদ না বেচতে পারলে আমার সংসার চলব না। পোলাপানের খাওন জুটব না। জাইনা শুইনা আপনে আমাগ না খাওয়াইয়া রাকবেন, এইডা পাপ অইব না!

কথাগুলো বলেই হাঁফাতে থাকে হাতেম। এতক্ষণ ধরে চেঁচিয়ে কথা বলছে। এত জোরে মানুষ কথা বলতে পারে। বদ্যি বলল, অন্য ব্যারাম অইলে অমুইদ কইরা দিতাম। হাপের অমুইদ আমি দিতে পারুম না। দিলে ঐ হাপে আমারেঐ খাইব। বুড়া মানুষ। চোক্কে দেহি না, কানে হুনি না, বাইর বাইত বইয়া থাকি, কুনসুম আইয়া দংইশা যাইব। উদিস পামু না। দুদ খাইতে চাইলে হারারাইত গাই পাহারা দিচ। অষইদ আমি দিতে পারুম না। হাতেম কথা বলে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠে দাঁড়ায়। তারপর পথে নেমে শুনতে পায় বুড়োবদ্যি চেঁচিয়ে বলছে, বাত দেচ না গোলামের জিরা। খিদায় মইরা গেলাম। আল্লারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *