ফিরিঙ্গি ঠগি

‘ফিরিঙ্গি ঠগি’-র সময়কাল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ। ইংরেজ কুঠিবাড়ির আলোগুলো ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজা-নবাবদের ঘরের বাতিগুলো নিভে যাচ্ছে। রেলপথ চালু হয়নি। হাতি, ঘোড়া, গো-শকট বা নৌকোয় কেউ কেউ যাতায়াত করলেও অধিকাংশ ভারতবাসী পদব্রজেই যাতায়াত করত দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। একটা বিরাট অংশের মানুষ পথেই হারিয়ে যেত। ঘরে ফিরত না। কেউ কেউ বলতেন ভারতের পথে-ঘাটে সে সময় নাকি ঘুরে বেড়াত আরও একদল মানুষ। যাদের হাতের ছোয়ায় নাকি মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে যেত পথিকের দল। সেই মানুষদের সন্ধানে পথে নামলেন এক ব্রিটিশ রাজপুরুষ। উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান। পথে নামলেন পৃথিবীর ইতিহাসে কুখ্যাততম ‘ঠগি’-র সন্ধানে।

–হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

এক

ওই স্লিম্যান সাহেব বড় অদ্ভুত মানুষ। উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান। ওই যে যিনি কোম্পানি বাহাদুরের প্রতিনিধি হয়ে এসেছেন এই জব্বলপুরে। নর্মদা তটের রেওয়া এবং সগর অঞ্চলের কোম্পানির পলিটিকাল এজেন্ট তিনি। এ অঞ্চলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। কিন্তু এ লোকটা অন্য উচ্চপদস্থ রাজপুরুষের মতো নন, যাঁরা শুধু কোম্পানি হাউসে বসে বসে খবর সংগ্রহ করেন, আর রাজনৈতিক বিবাদের মীমাংসা করেন। প্রয়োজনবোধে কখনও-সখনও হাউস ছেড়ে ফৌজ নিয়ে বাইরে আসেন, স্থানীয় কোনও বিদ্রোহ দমন করে সে অঞ্চলে কোম্পানির অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে।

স্লিম্যান সাহেবের ধরন-ধারণ সমপর্যায়ের রাজপুরুষদের একদম উলটো। খুব প্রয়োজনীয় কাজ না থাকলে হাউসে থাকেন না তিনি, লোকলস্করের ধার ধারেন না। একলাই কখনও তাঁর আরবি ঘোড়াটা নিয়ে, কখনও বা পদব্রজে বেরিয়ে পড়েন কুঠি ছেড়ে। কখনও চলে যান নর্মদা তটে, আবার কখনও বা আশেপাশের গ্রামগুলোতে। প্রায়ই দেখা যায় সাহেবের ঘোড়াটা হয়তো হাটে ঢোকার মুখে গাছতলায় বাঁধা। অথবা বিন্ধ্য পর্বতের কোলে কোনও এক অখ্যাত গ্রামের মণ্ডপে বসে গ্রামের পুরুষদের সঙ্গে গল্প করছেন সাহেব। কখনও কখনও পঞ্চাশ বা একশো ক্রোশ দূরেও ঘুরতে ঘুরতে চলে যান তিনি।

সাহেবদের সাধারণত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে ভারতের দরিদ্র গ্রামবাসীরা। বিশেষত সেই ফিরিঙ্গি যদি রাজপুরুষ হন, তবে তো কথাই নেই। দেশটা তো আর এখন নবাব-রাজাদের নেই, নামেই আছেন তাঁরা। সাহেবরাই এখন দেশের মালিক। নবাব, জমিদাররাই এখন তাঁদের ভয় পায়। কখন সাহেবদের কী মর্জি হবে, শেষে মাথাটাই হয়তো কাটা গেল! ওদের এড়িয়ে চলাই ঠিক।

তবে স্লিম্যানের ব্যাপারটা অন্যরকম। তিনি হয়তো প্রথম কোনও গ্রামে গেছেন। তাঁর গ্রামে যাওয়ার খবর পাওয়া মাত্রই সাহেবের খিদমত করার জন্য ছুটে আসেন তহশীলদার, স্থানীয় কাস্টমস হাউসের দারোগা সহ নানা ধরনের দেশীয় রাজকর্মচারীরা। স্বয়ং হুজুর পদার্পণ করেছেন যে তাদের অঞ্চলে! স্লিম্যান তাদের কাছে সামান্য খোঁজখবর নিয়েই তাদের বিদায় দেন। বেশ অবাক হয় লোকগুলো সাহেবের খিদমত করা থেকে বঞ্চিত হয়ে। সাহেব এরপর ডেকে নেন স্থানীয় গ্রামবাসীদের। প্রথমে ভয়ে জড়সড় হয়ে সাহেব সন্দর্শনে তারা হাজির হয়। ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’-য়ে হুজুরের প্রশ্নের জবাব দেয়। কিন্তু অদ্ভুত ক্ষমতা এই সাহেবের। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি মিশে যান অপরিচিত গ্রামবাসীদের সঙ্গে। এদেশের ভাষাটা তিনি মোটামুটি আয়ত্ত করে নিয়েছেন। সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে তাদের ভয় ভাঙে, এক সময় নর্মদার স্রোতের মতোই কলকল করে সাহেবকে তারা বলতে থাকে তাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগের কাহিনি। কখনও তাদের কথাবার্তায় ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গও উঠে আসে।

সাহেব মনোযোগ দিয়ে তাদের সব কথা শোনেন। প্রয়োজনবোধে স্থানীয় তহশীলদার বা কোনও রাজকর্মচারীকে ডেকে পাঠিয়ে অভাব-অভিযোগের প্রতিকারের নির্দেশ দেন। গ্রামের মোড়লের এঁটো হুঁকোতে টান দিতেও তাঁর বাধে না। কোম্পানির নথি অনুসারে, ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে লোকটা এদেশে আসেন, একুশ বছর বয়সে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৮১৪ থেকে ১৮১৬, নেপাল যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে লড়াই করে ক্যাপ্টেন হন। সেখান থেকে বারাকপুর সেনা ছাউনি হয়ে বেশ কিছুদিন কাটান কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। তারপর সামরিক চাকরি ছেড়ে দিয়ে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ধাপে ধাপে সে চাকরিতে উন্নতি করার পর ক্যাপ্টেন স্লিম্যান ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ৩২ বছর বয়সে গভর্নরের সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছেন নর্মদা তটের রেওয়া ও সগর এস্টেটের।

অচেনা-অজানা গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎই তিনি একটা প্রশ্ন করেন তাদের,—তোমাদের এ গ্রাম থেকে বাইরে বেরিয়ে কোনও দিন কি কোনও মানুষ হারিয়ে গেছে? অনেক সন্ধান করেও যার কোনও খোঁজ মেলেনি?

স্লিম্যানের এই প্রশ্ন শুনে গ্রামবাসীরা বিস্মিত হয়। হঠাৎ এ আবার কেমন প্রশ্ন!

স্লিম্যান হয়তো কোনও কোনও সময় পেয়ে যান তাঁর কাঙ্ক্ষিত উত্তর। সমবেত জনতার মধ্যে থেকে একজন লোক বলে ওঠে,—হ্যাঁ, হুজুর, হ্যাঁ। সাত বছর আগে এ-গাঁয়ের কুড়ি জনের একটা দল দুর্গাপুজোর সময় জন খাটতে গেছিল পুবে। তারা আর ঘরে ফেরেনি।

তার কথা কানে যাওয়া মাত্রই স্লিম্যান দোয়াত-কলম-কাগজ নিয়ে সোজা হয়ে বসেন। জিগ্যেস করেন,—তারা সত্যি হারিয়ে গেছে তো? গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে আস্তানা পাতেনি তো?

উত্তরদাতা বিষণ্ণ মুখে বলে,—না, সাহেব না, বউ-বাচ্চা গ্রামে ফেলে ওরা কোথায় আস্তানা পাতবে? তাছাড়া ওদের যেখানে যাওয়ার কথা ছিল পরে সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে দলটা সেখানে নাকি পৌঁছোয়নি! তারা পথেই হারিয়ে গেছে।

স্লিম্যান এরপর লোকটার কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়া লোকগুলোর নামধাম, হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য তারিখ-জায়গা ইত্যাদি জেনে নিয়ে লিখতে শুরু করেন কাগজে। স্লিম্যানের সরকারি ঘরে জমা হতে থাকে কাগজের রাশি। বহু হারিয়ে যাওয়া মানুষের নাম-ঠিকানা লেখা থাকে তাতে।

স্লিম্যানের ভারতবর্ষ। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ। ইংরেজ কুঠিবাড়ির আলোগুলো ক্রমশ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজাদের ঘরের বাতিগুলো একটা একটা করে নিভে যাচ্ছে। তমসাচ্ছন্ন এই দেশ। আরও তমসাচ্ছন্ন ভারতের পথঘাট। রেলপথ তখনও চালু হয়নি এদেশে। ভারতের পথেঘাটে তখন অদৃশ্য নিলামওয়ালা জীবনের দাম হেঁকে যায় ‘কানাকড়ি কানাকড়ি’ বলে! তবুও সে পথেই ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ভারতবাসীর বেঁচে থাকার অবলম্বন। রাজদরবারের রইস ওমরাহ-মন্ত্রী থেকে শুরু করে দীনহীন ফকির-ভিখারি, কোম্পানির রাজপুরুষ, বেনিয়া থেকে শুরু করে নবাব হারেমের সুন্দরী নর্তকী, জমিদারের অত্যাচারে পলায়মান কৃষক, ফৌজ থেকে নাম কাটা সেপাই—সবারই তখন বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা ওই পথ। জীবিকা ও জীবনের প্রয়োজনে উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুব থেকে পশ্চিমে—দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে পদব্রজেই যাতায়াত করে সাধারণ মানুষ। কেউ কেউ অবশ্য হাতি-ঘোড়া বা গোশকটেও যাতায়াত করে, জলপথেও বা কেউ কেউ। তবে সে সংখ্যা নগণ্য। পথে যারা নামে পথই ঠিক করে দেয় তারা গন্তব্যে পৌঁছবে কি না। কেউ কেউ পথেই হারিয়ে যায়। আর ফেরে না।

কিন্তু তা বলে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এত হবে! চল্লিশ হাজার! স্লিম্যান এই হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্প প্রথম শুনেছিলেন বারাকপুর সেনা ছাউনিতে। সাহেবের এদেশের সম্বন্ধে বরাবরই খুব আগ্রহ। তিনি এদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালোবাসেন। বারাকপুরের গঙ্গার ঘাটে বসে উত্তর ভারতীয় এক পাঁড়ে ব্রাহ্মণ সেপাই তাকে গল্পচ্ছলে বলেছিলেন,—জানেন সাহেব, আমার বাড়িতে আমিই একমাত্র পুরুষ। আমার বাবা-কাকা সহ অর্ধেক গ্রামের পুরুষরা হঠাৎ একদিন হারিয়ে গেল! আমি ব্রাহ্মণ মানুষ, পেটের দায়ে ফৌজে নাম লিখিয়েছি।

—হারিয়ে গেল মানে?

পাঁড়ে জবাব দিয়েছিল,—মানে তারা গ্রাম থেকে বেরিয়ে ছিল অযোধ্যায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে পৌঁছতে পারেনি। পথেই কোথাও হারিয়ে গেল।

—এ ভাবে লোকে কখনও হারিয়ে যেতে পারে? বিস্মিত ভাবে জানতে চেয়েছিলেন এদেশে নবাগত ক্যাপ্টেন স্লিম্যান।

উত্তরদাতার মধ্যে কিন্তু কোনও বিস্ময় ফুটে ওঠেনি। যেন তাদের হারিয়ে যাওয়া একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। শান্ত ভাবে সে জবাব দিয়েছিল,—হ্যাঁ, এদেশে মানুষ হারিয়ে যায়। আমাদের পাশের গ্রামের একদল মানুষ এই তো বছরখানেক আগে গঙ্গাসাগরে তীর্থ করতে এসে আর গ্রামে ফিরল না। পথেই হারিয়ে গেল।

‘হ্যাঁ, এদেশে মানুষ হারিয়ে যায়’—পাঁড়ের এই কথাটা একটা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছিল তাঁর মনে। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই ঘটনাচক্রে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের মহাফেজখানায় একটা সরকারি নথি দেখে চমকে ওঠেন স্লিম্যান। কোনও এক প্রসঙ্গক্রমে নথিতে লেখা ছিল গত এক দশক ধরে ভারতবর্ষে প্রতি বছর চল্লিশ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে, কুড়ি কোটির ভারতবর্ষে প্রতি বছর চল্লিশ হাজার মানুষ নিখোঁজ! হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে ভারতবর্ষের পথঘাট শ্বাপদসঙ্কুল। ডাকাত-খুনে হামেশাই দেখা যায় ভারতের পথঘাটে। পথশ্রমের ক্লান্তি অথবা রোগব্যাধিতেও পথের মধ্যে মারা যেতে পারে কেউ কেউ। তা বলে, একদম ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে যাবে? প্রতি বছর চল্লিশ হাজার মানুষ! কেউ কোনও সন্ধান দিতে পারবে না তাদের?

ওই দিন থেকেই এ প্রশ্নের ভূতটা বসেছিল তাঁর ঘাড়ে। কোথায় হারিয়ে যায় এত মানুষ? কী ভাবে হারিয়ে যায়? ফোর্ট উইলিয়ামে ওই কাগজটা দেখার পর থেকেই ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেছেন তিনি। দিন যত এগোচ্ছে ততই স্লিম্যানের ধারণা দৃঢ় হচ্ছে কাগজে লেখা পরিসংখ্যানের সত্যতা সম্বন্ধে। কে নেই সেই নিখোঁজ মানুষের তালিকায়? ব্রিটিশ রাজকর্মচারী, সৈনিক, বণিক, নবাবের ওমরাহ থেকে শুরু করে দেশীয় জমিদার পর্যন্ত! আর সাধারণ গরিবগুর্বো মানুষ তো আছেই।

কিন্তু কীভাবে হারিয়ে যায় তারা? বহু জনের সঙ্গে কথা বলে, বহু অনুসন্ধানের পর ভাসাভাসা কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছেন এ ব্যাপারে। সে তথ্যগুলো যেমন চমকপ্রদ, তেমনই বিস্ময়কর। তবে কোনও মানুষই স্লিম্যানকে তার প্রমাণ দিতে পারেনি এখনও।

এক এক সময় স্লিম্যানের মনে হয় ব্যাপারটা নিছকই অশিক্ষিত ভারতবাসীর মনগড়া ব্যাপার, তাদের কল্পনা। এ দেশের পথে অনেকরকম খুনে ডাকাত আছে, ঠ্যাঙাড়েরা পাবড়া ছুড়ে মানুষ মারে, ম্যাকফ্যানসোরা গাছের ডালে পেরেক পুঁতে মানুষকে ফাঁসি দেয়, গার্টাররা কাঠির জুয়া ধরে পথিকের সর্বস্ব হরণ করে, প্রয়োজনে তাকে খুনও করে। মানুষ ম্যাকফ্যানসোর নাম জানে, ঠ্যাঙাড়ে জানে, গার্টার চেনে, কিন্তু তাদের চেনে না। সত্যি যদি তাদের অস্তিত্ব থাকত, তাহলে কি তাদের সম্বন্ধে একটাও কোনও অভিযোগ লেখা থাকত না সরকারি নথিতে? তন্নতন্ন করে ঘেঁটে দেখেছেন স্লিম্যান, একটা শব্দও উল্লেখ নেই সে ব্যাপারে! ব্যাপারটা কি তাহলে যুগ-যুগ ধরে চলে আসা একটা উপকথা? অন্ধ ধর্মবিশ্বাস?

স্লিম্যান এ প্রসঙ্গে যতটুকু যা শুনেছেন তা হল, যারা নাকি মানুষকে অদৃশ্য করে তারা হিন্দু দেবী ‘মা কালী’র সন্তান। দেবীর বরে তারা অদৃশ্য, চোখে দেখা যায় না তাদের, শুধু মানুষকে অদৃশ্য করার পূর্ব মুহূর্তে তারা এসে উপস্থিত হয় তার সামনে। তারপর সেই লোক সমেত আবার বাতাসে মিলিয়ে যায়।

স্লিম্যান অবশ্য কোনও দৈবতত্বে বিশ্বাস না করলেও যেখানেই যান তাঁর মাথার মধ্যে সবসময় ঘুরপাক খায় একই প্রশ্ন—’এতগুলো মানুষ কীভাবে হারিয়ে যায়?’

এই নর্মদার দেশে আসার পরও নিরন্তর সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য স্লিম্যান ঘুরে বেড়াচ্ছেন আশেপাশে নানা জায়গাতে।

দুই

জনা পনেরো লোকের একটা দল। দেখলেই বোঝা যায় ওরা দূর দেশের যাত্রী। ভারত পথের পথিক ওরা। অগণিত দরিদ্র ভারতবাসীর মতো জীবিকার সন্ধানে পথে নেমেছে। আসছে পুব থেকে, গন্তব্য পশ্চিম। শরতের প্রথম কাশফুল ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবছর ঘর ছাড়ে ওরা। দিন পনেরো আগে ওরা ঘর ছেড়েছে। তারপর শুধু চলা আর চলা। কত গ্রাম, নগর, গঞ্জ, নদীতট, জঙ্গল ভেঙে এগিয়ে চলেছে লোকগুলো। শুধু রাতটুকুতে বিশ্রামের জন্য তারা বেছে নেয় কোনও চণ্ডীমণ্ডপ, মাজার, পরিত্যক্ত কোনও বাড়ি, অথবা রাস্তার পাশে কোনও ছায়া ঘেরা বাগান। সূর্যোদয় হলেই আবার শুরু হয় যাত্রা। সাধারণত বড়-বড় গঞ্জ, শহরগুলোকে ওরা এড়িয়ে চলে। ওখানে জমিদারের পাইক থাকে। কোম্পানির সেপাই থাকে, কাস্টমস হাউসের দারোগা থাকে। সামান্য ছুতোনাতা পেলেই পয়সার জন্য পথিকদের তারা হয়রান করে।

গতকাল এ লোকগুলো রাত কাটিয়েছিল এক নির্জন শিব মন্দিরের চাতালে। ভোরে উঠেই হাঁটতে শুরু করেছিল। সারাদিন হাঁটার পর সূর্য ডোবার কিছু আগে তারা এসে পৌঁছল এক পায়েচলা রাস্তার মোড়ে। আরও একটা রাস্তা এসে মিশেছে সে জায়গাতে, তারপর রাস্তা এগিয়েছে সোজা। কিছু দূরেই জঙ্গলের কালো রেখা চোখে পড়ছে। ওই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দুক্রোশ গেলেই ওপাশে অম্বিকাপুর শহর।

এ পথ চেনা লোকগুলোর। প্রতি-বছর এ পথে আসে তারা। রাস্তার মোড়ের এক পাশে জনহীন দিগন্তবিস্তৃত উন্মুক্ত প্রান্তর, অন্যপাশে বিরাট আমবাগান। আশেপাশে কোনও লোকালয় নেই। শেষ গ্রাম তারা ফেলে এসেছে দশ ক্রোশ পিছনে। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তারা ভাবতে লাগল কী করবে? জোরকদমে হেঁটে জঙ্গল অতিক্রম করে অম্বিকাপুরের কাছাকাছি পৌঁছবে, নাকি পাশের আমবাগানেই রাত কাটিয়ে দেবে?

শেষ বিকালে ওই জঙ্গলে ঢোকা বিপদজনক। বাঘ হানা দেয়। এ-তল্লাটে মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব আছে। এদিকে আসার পথে লোকগুলো হাটুরেদের মুখ থেকে শুনেছে যে ক’দিন আগেই নাকি এ রাস্তায় এক পথচারীকে বাঘে টেনেছে। পথিকদের যে দলপতি তার নাম ফিরিঙ্গিয়া। আসল নাম অবশ্য তার এনায়েত। কিন্তু সাহেবদের মতো ফর্সা রং, আর লম্বা-চওড়া চেহারার জন্য তার সঙ্গীরা তাকে ‘ফিরিঙ্গি’ বলে ডাকে।

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখতে দেখতে কী সিদ্ধান্ত নেবে তা ভাবছিল এনায়েত। হঠাৎ সে দেখতে পেল তাদের অন্যপাশের রাস্তা ধরে তিনজন দেশি লোক, আর খচ্চরের পিঠে একজন ফিরিঙ্গি সাহেব আসছে। সাহেবের কাঁধে বন্দুক, দেশীয় লোকদের মধ্যে দুজনের হাতে পাকা বাঁশের লাঠি। কোম্পানির কাস্টমস হাউসের লোক নাকি? হয়তো এখনই এসে পথিকদের থেকে কর চাইবে!

সাহেবকে দেখে সতর্ক হয়ে গেল এনায়েত ও তার সঙ্গীরা। সাহেব তাদের কাছে এসে কিছুটা তফাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সাহেবের সঙ্গী তৃতীয় ব্যক্তির পরনে ফরসা ধুতি, পিরান। পায়ে চটি জুতোও আছে। সে বাবু লোক। সাহেব তাদের কাছে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই কাঁধ থেকে বন্দুকটা হাতে নিয়েছেন। তীক্ষ্ণ নজরে এনায়েতদের দেখার পর সাহেব আর সেই বাবুর এনায়েতদের নিরীহ পথিক বলেই মনে হল। তবুও সন্দেহ নিরসনের জন্য সেই বাবু এনায়েতদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,—তোমরা হঠাৎ কোথা থেকে এখানে এলে? কোথা থেকে আসছ?

এনায়েতের পাশে দাঁড়িয়েছিল দুর্গা। প্রৌঢ় মানুষ সে। দুর্গা তাদের কাছে গিয়ে সাহেবের উদ্দেশ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানিয়ে বলল,—আমরা আসছি পুব থেকে, আমরা অম্বিকাপুরে দুর্গাপুজোয় জন খাটতে যাচ্ছি।

সামনে কয়েক ক্রোশ দূরেই অম্বিকাপুর বেশ বড় শহর। দুর্গাপুজোর সময় ধুমধাম হয় সেখানে। মাত্র পাঁচ ক্রোশ দূরের জায়গা। ওখানে এ পথ ধরেই যেতে হয়। তবুও সেই লোকগুলোকে বাজিয়ে দেখার জন্য বাবু প্রশ্ন করল,—পুবের কোথা থেকে আসছ? গ্রামের নাম কী?

দুর্গা জবাব দিল,—গ্রামের নাম ইসলামপুর। ভাগীরথীর গায়ে।

—চলতে চলতে হঠাৎ এখানে দাঁড়িয়ে পড়লে যে? আবার প্রশ্ন করলেন তিনি।

দুর্গা বলল,—আর এগোতে ভরসা পাচ্ছি না হুজুর। সামনে জঙ্গল। বাঘের ভয় আছে। পথে শুনলাম ক’দিন আগেই নাকি এখানে মানুষকে বাঘে ধরেছে। তাই…। কথাটা সত্য। পথে আসার সময় বাবুরাও শুনেছেন এ কথা।

এনায়েত এবার এগিয়ে সাহেবের সামনে গিয়ে সেলাম ঠুকে দাঁড়াল। সাহেব তার দিকে তাকালেন। এনায়েতের ফরসা রং, উন্নত ললাট, সনাতন ভারতীয়দের মতো সরলতা মাখা দৃষ্টি। শান্ত স্বরে সে সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল,—হুজুরের কাছে আমাদের একটা নিবেদন আছে। সন্ধ্যায় জঙ্গলে ঢোকা নিরাপদ নয়। সাহেব সঙ্গী হলে পাশের আমবাগানে রাত কাটাতে চাই। সাহেবের বন্দুক আছে, লাঠিয়ালও আছে। তিনি সঙ্গে থাকলে আমাদের ভরসা। তা ছাড়া অনেক দূরের পথে যাচ্ছি বলে পথখরচের সামান্য কিছু পয়সাও আছে। ডাকাতের তো কোথাও অভাব নেই। হুজুর আমাদের মা-বাপ। গরিব মানুষগুলোকে যদি একরাতের জন্য ভরসা দেন…।

এনায়েতের প্রস্তাব শোনার পর তাদের একটু তফাতে গিয়ে সাহেব তার বাবুর সঙ্গে চাপা গলায় আলোচনা শুরু করলেন। লোকগুলোকে দেখে সাহেব ও তার সঙ্গীদের খারাপ বলে মনে হচ্ছে না। লোকগুলোর কারও মুখে কোনও ধূর্ততা বা হিংস্রতার চিহ্ন নেই। তাদের প্রস্তাবটাও মন্দ নয়। সাহেবকেও যেতে হবে ওই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সঙ্গে বন্দুক থাকলেও সাহেব শিকারি নন। বন্দুকটা আছে শুধু চোর-ডাকাতদের ভয় দেখানোর জন্য। এতগুলো লোকের সঙ্গে রাত কাটানো সাহেবদের পক্ষেও নিরাপদ। আলোচনার পর তবুও শেষবারের মতো পথিকদলকে পরীক্ষা করে নেওয়ার জন্য বাবু বললেন,—আমরা রাজি, তবে তার আগে একবার আমরা দেখে নেব তোমাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্র আছে কি না?

এনায়েত সঙ্গে সঙ্গে মোস্তাফা বলে একজনকে ডাকল। তার পোশাকের তলা থেকে বার হল কাপড়ের ফালি দিয়ে সযত্নে জড়িয়ে রাখা একটা কোদালের ফলা। হাতখানেক লম্বা হবে সেটা। এনায়েত সেই ফলাটা ভক্তি ভরে নিজের মাথায় ঠেকাবার পর সেটা কাপড় সমেত সাহেবের দিকে তুলে ধরে বলল,—এই কোদালিটাই শুধু আছে আমাদের সঙ্গে। এটা ঠিক অস্ত্র নয়, মন্ত্রপূত কোদালি। এর আশীর্বাদেই আমরা গন্তব্য স্থানে পৌঁছোতে পারি। এটা আমাদের দেবতা।

সাহেব আর তাঁর অনুচররা ভালো করে দেখল এনায়েতের হাতে ধরা কোদালিটা। মামুলি একটা কোদালি। এ-দেশে কত জাত ধর্মের মানুষ! কতরকমের তাদের আচার-সংস্কার। সাহেব শুনেছেন যে বাংলাদেশে নাকি লাঙলের ফলাকে পুজো করা হয়। পশ্চিম ভারতে রাজপুতরা তলোয়ার পুজো করে। কোদালের ফলাও তবে পূজিত হতে পারে। এ ব্যাপারটা তাই সাহেব বা তার বাবুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হল না। লাঠিয়াল দুজন এরপর পথিকদের পুঁটলিগুলোর তল্লাশি নিল। হাতড়ে দেখল এনায়েত, দুর্গা সহ অন্যদের পোশাক। সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না। অতঃপর সাহেব সবাইকে নিয়ে এগোলেন পথের পাশে আমবাগানের দিকে।

বিরাট আমবাগান। কিছুটা তফাতে তফাতে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বিরাট সব গাছ। এক প্রাচীন গাছের নীচে সাহেবের বসার জন্য মাদুর বিছানো হল। সাহেব তার বাবুকে নিয়ে বসলেন মাদুরে। লেঠেল দুজন আর এনায়েতের লোকজন কাঠকুটো জ্বালিয়ে রান্নার কাজে লেগে গেল। লেঠেল দুজনের সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণের মধ্যে সাহেব ও তাঁর বাবুর নাম-পরিচয় জানা গেল। সাহেবের নাম টিমোথি। সাহেব হলেও তিনি সিভিলিয়ান। বছর দুই হল তিনি এ দেশে এসেছেন। গন্তব্য মধ্যভারতের জঙ্গলপ্রদেশের এক নেটিভ স্টেট। সেখানকার জমিদারতনয়কে ইংরেজি শেখাবার চাকরি নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বাবু হলেন সে স্টেটের গোমস্তা, লেঠেল দুজনও সেখানকারই কর্মচারী। তিনজন মিলে সাহেবকে নিয়ে যাচ্ছেন সেখানে।

সূর্য ডুবে গেল, অন্ধকার নামল আমবাগানে। সাহেবের কাছে একটা মশাল জ্বালানো হল। সন্ধ্যা হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাওয়াদাওয়া সাঙ্গ হল। সাহেব এরপর এনায়েত, দুর্গাসহ কয়েক জনকে কাছে ডেকে নিলেন গল্প শোনার জন্য। নবাগত সাহেবের চোখে ভারতবর্ষ এক বিচিত্র দেশ। এ ভারতবর্ষ হল সেই দেশ যে দেশে বিধবা রমণীকে আগুনে পুড়িয়ে সতী করা হয়, গঙ্গায় সন্তান বিসর্জন দেওয়া হয়, নরবলি দেওয়া হয়, জাতরক্ষায় আটবছরের বালিকার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় আশি বছরের বৃদ্ধর। ভারতবর্ষ হল সেই দেশ যেখানে ছোট-ছোট নেটিভ স্টেটের মণিমাণিক্যের জৌলুস বাকিংহাম প্যালেসকেও হার মানায়! তাজমহল, দক্ষিণ ভারতের মন্দির দেখে ঘোর লেগে যায় ইওরোপীয়দের। কত প্রাচীন দেশ এই ভারতবর্ষ! কত গল্প ছড়িয়ে আছে এই দেশে।

তারই কিছু শোনার জন্য টিমোথি সাহেব এনায়েতদের নিয়ে বসলেন। হিন্দুস্থানী ভাষাটা ইতিমধ্যেই শিখে নিয়েছেন সাহেব। দীনু রজক খুব ভালো গল্প বলে। অদ্ভুত তার বাচনভঙ্গি। সাহেব, গোমস্তাসহ সবাই শুনতে লাগল তার গল্প। আমবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠল। সেই চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো যেন এক-একজন মানুষ। তারা যেন নিঃশব্দে লক্ষ করছে মাদুরের ওপরে বসা ও আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলোকে। ক্রমশ বাড়তে থাকল রাত। সাহেবের বন্দুকটা ঘাসের ওপর শোয়ানো।

একটা গল্প শেষ হয়, সঙ্গে সঙ্গে এনায়েত বা দুর্গা, দীনুকে খেই ধরিয়ে বলে,—এবার তুমি উদয়নালার যুদ্ধের গল্পটা বলো। অথবা আকবর আর প্রতাপসিংহর যুদ্ধ।

শুনতে শুনতে হাই তোলেন গোমস্তা, লাঠিয়ালরা লাঠি নামিয়ে রাখে পাশে। দীনু বলে চলে তার গল্প। প্রহরের পর প্রহর বাড়ে। কয়েকজন পথিক এসে দাঁড়াল সাহেব, লাঠিয়ালদের পিছনে। লাঠিয়াল দুজন একবার পিছন ফিরে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখল তাদের। না, লোকগুলোর দৃষ্টিও দীনুর ওপর নিবদ্ধ, তারাও গল্প শুনতে এসেছে। এগিয়ে চলে দীনুর গল্প।

মশালটা নিবু নিবু হয়ে এসেছে।

আরও কিছুক্ষণ পর সাহেবেরও হাই উঠল। পথশ্রমের ক্লান্তিতে ঘুম নেমে আসছে তার চোখে। বাবু ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। লাঠিয়াল দুজন ঢুলছে। হঠাৎ কোথা থেকে একখণ্ড মেঘ এসে ঢেকে দিল মাথার ওপরের চাঁদটাকে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নেমে এল আমবাগানে। কোথা থেকে একপাল শেয়াল যেন ডেকে উঠল, ঠিক সেই মুহূর্তে এনায়েতের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর শোনা গেল,—সাহেবকে লিয়ে তামাকু লাও।

মেঘ সরে গেল। চারটে নিস্পন্দ দেহ লুটিয়ে পড়ে আছে মাদুরের ওপর। শেয়ালের দল যেন আবার ডেকে উঠে বলল,—কেয়া হুয়া, কেয়া হুয়া? হত্যা হুয়া! হত্যা হুয়া!

পরদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এনায়েতরা যখন আবার সেই আমবাগান ছেড়ে যাত্রা শুরু করল তখন টিমোথি সাহেব আর তার সঙ্গীদের কোনও চিহ্ন নেই। সাহেবের নিঃসঙ্গ খচ্চরটা শুধু চরে বেড়াতে লাগল সেই আমবাগানে। পথের পাশের নির্জন আমবাগানে সাহেবদের হারিয়ে যাওয়ার সাক্ষী রইল শুধু একপাল প্রহরগোনা শেয়াল। যারা কথা বলতে পারে না।

তিন

—সাহেব তুমি ‘দেবী কালী’-র নাম জানো?

সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল বৃদ্ধ লোকটা। বিন্ধ্যাচলের মানুষ সে। স্থানীয় এক গ্রামের মোড়ল লোকটা। এক সময় যুবা বয়সে এ লোকটা নাকি রণপা নিয়ে ডাকাতি করতে যেত দূর গাঁয়ে। আর এখন একগন্ডা নাতি-নাতনি নিয়ে সংসার-জীবন কাটাচ্ছে, আর গাঁয়ে মোড়লগিরি করছে। বহুদর্শী লোক। কিছুদিন আগেই স্লিম্যানের আলাপ হয়েছে এই লোকের সঙ্গে। নাম দশরাজ। প্রথম আলাপেই সাহেব বুঝতে পেরেছিলেন এ লোক জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, শুনেছে। তাই তিনি তার হাউসে আজ নিমন্ত্রণ করে এনেছেন দশরাজকে।

গ্রামের মোড়ল হলেও দশরাজ তার গ্রামের অন্যদের মতোই গরিবগুর্বো মানুষ। দশরাজের সামনে শালপাতায় যখন সাদা ভাত আর খাসির মাংস এনে হাজির করা হল, তখন তা দেখে সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এসে গেছিল। বহুদিন পর পেট পুরে খেয়ে সাহেবের পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে তাকে গল্প শোনাতে বসেছে বৃদ্ধ। সাহেব বসেছেন একটা কেদারায়। মোমের আলোতে বৃদ্ধের মুখমণ্ডলের বলিরেখাগুলো যেন কাঁপছে। তার শনের মতো চুলগুলো যেন আরও সাদা দেখাচ্ছে এই আধো অন্ধকার ঘরে।

লোকটার প্রশ্নর উত্তরে স্লিম্যান জবাব দিলেন,—হ্যাঁ, জানি। তার মূর্তি দেখেওছি।

দশরাজ এরপর বলল,—তাদের অস্ত্র বন্দুক নয়, তলোয়ার নয়, কিরিচ নয়, একখণ্ড রুমাল। তুমি দেখলে ভাববে ওটা হয়তো ‘সাঁস’, অর্থাৎ কোমরবন্ধ। মাত্র তিন হাত লম্বা হলুদ রঙের রেশমের ফালি। কিন্তু ওটা দিয়েই মানুষ খুন করে তারা। ওরা হল ‘ঠগি’। ভয়ঙ্কর জিনিস ওই রেশমি রুমালের ফাঁস!

সাহেব প্রশ্ন করলেন,—কিন্তু গডেস কালীর সঙ্গে ওই রেশমি রুমালের কী সম্পর্ক?

বৃদ্ধ জবাব দিল,—ওই অস্ত্র মা ভবানী বা দেবী কালীই তুলে দিয়েছিলেন তাদের হাতে।

স্লিম্যান কিছুক্ষণ বিস্মিতভাবে বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন এই অদ্ভুত কথা শুনে।

মোমবাতির কম্পমান আলোর দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ যেন কিছুক্ষণের জন্য ডুব দিল স্মৃতির অতলে। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল,—সাহেব তুমি তো জানো পেটের দায়ে যৌবনে অনেক পাপ কাজ করেছি। এ গল্প আমি শুনেছিলাম বহু বছর আগে এক তুসমাবাজের কাছে। ওরা ঠগি নয়, তবে ওরাও মানুষ খুন করে। ভুকুত নামের সেই তুসমাবাজ দলছুট হয়ে কিছুদিনের জন্য ভিড়েছিল আমাদের দলে। সে যে গল্পটা আমাদের বলেছিল সেটা তোমাকে বলি—

সাহেব তুমি নিশ্চয়ই জানো ‘স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল’ বলে তিনটে জিনিস আছে। রক্তবীজ নামে এক অসুর একবার সবাইকে যুদ্ধে হারিয়ে দখল নিল ত্রিভুবনের। রক্তবীজ নাম কেন জানো? তার এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়লেই তার থেকে জন্ম নিত তারই মতো এক সহস্র অসুর-দানব। পৃথিবীকে বাঁচাতে মা ভবানী কালীরূপে আবির্ভূত হলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। রক্তবীজের সঙ্গে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হল তাঁর। কিন্তু দেবী যতবারই খড়গ দিয়ে অসুরের মাথা কাটেন ততবারই তার রক্ত মাটিতে পড়ে জন্ম নেয় নতুন রক্তবীজের দল। যুদ্ধ আর শেষ হয় না। যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত হয়ে উঠলেন দেবী। তখন তাঁর নামমাত্র আর কয়েকজন অনুচর অবশিষ্ট আছে। দেবী ভাবতে লাগলেন, এমন কী অস্ত্র আছে যার দ্বারা অসুর নিধন করা যাবে অথচ একবিন্দু রক্তপাত হবে না? ঘর্মাক্ত দেবী এক সময় ঘাম মোছার জন্য তাঁর কটিবাস থেকে ছিঁড়ে নিলেন রেশমি শুভ্র বস্ত্রখণ্ড। তেজ চুঁইয়ে পড়ছে দেবীর সারা দেহ থেকে। ঘাম মোছার পর সেই বস্ত্রখণ্ড বা রুমাল দেবীর তেজরশ্মিতে হলুদ বর্ণ ধারণ করল। আর এর পরই দেবী বুঝতে পারলেন কী ভাবে একবিন্দু রক্তপাত না ঘটিয়েও ধ্বংস করা যাবে এই অসুরকুলকে। তিনি তাঁর অনুচরদের হাতে সেই বস্ত্রখণ্ড তুলে দিয়ে বললেন, ‘এটাই তোদের অস্ত্র। রুমালের ফাঁসে তোরা শত্রুবধ কর।’

একবিন্দু রক্তপাত আর হল না। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল রক্তবীজের দল। যুদ্ধ শেষে দেবীর অনুচররা যখন দেবীকে রুমাল ফিরিয়ে দিতে গেল, তখন দেবী বললেন, ‘রুমাল আমি তোদেরই দিলাম। এই নাগপাশ তোদের জীবিকা হবে।’—একটানা বেশ কিছু কথা বলে থামল বৃদ্ধ।

স্লিম্যান সাহেব তন্ময় ভাবে শুনছিলেন কথা। বাইরে মনে হয় ঝড় উঠেছে। বাতাস ঢুকছে ঘরে। মাঝে মাঝে মোমবাতির শিখাটা নিবুনিবু হয়ে যাচ্ছে। আলোছায়া খেলা করছে বৃদ্ধর শত বলিরেখাময় মুখে। স্লিম্যান সাহেব বৃদ্ধকে এরপর বললেন,—এ গল্প অস্পষ্ট ভাবে আগেও শুনেছি। ওরা রুমালের ফাঁসে মানুষ মারে বুঝলাম। কিন্তু মৃতদেহগুলো তো আর বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না? এত দেহ কোথায় যায়?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বৃদ্ধ বলল,—রুমাল নিয়ে অনুচরেরা জিগ্যেস করেছিল, মা, আমরা যাদের মারব তাদের দেহগুলো কী হবে?

মা বলেছিলেন,—ও নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না। ও দেহগুলো হবে আমার মহাপ্রসাদ। দেহগুলো তোরা ছেড়ে রেখে যাওয়ার সময় কিন্তু পিছনে ফিরে তাকাবি না।

এরপর থেকে হাজার হাজার বছর ধরে মৃতদেহগুলো নিয়ে ঠগিদের আর ভাবতে হয়নি। দেবীই সেগুলোর গতি করতেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন দুর্মতি হল এক ঠগির। কাজ শেষ করে কিছুটা এগিয়ে পিছনে ফিরে তাকাল লোকটা। করালবদনী দেবী তখন একটা পাথরের ওপর বসে নরমাংসের মহাপ্রসাদ ভক্ষণ সবে শুরু করেছেন। লোকটা ফিরে তাকাতে ভয়ানক কুপিত হলেন দেবী। কী! দেবীর খাবারে নজর দেওয়া! সেই মৃতদেহটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে দেবী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,—তোদের মৃতদেহগুলোর দায়িত্ব আর আমি নেব না। মৃতদেহের দায়িত্ব তোদের। এই বলে অদৃশ্য হলেন মা ভবানী।

ঠগিরা এরপর পড়ল মহা সমস্যায়! সত্যিই আর মৃতদেহর গতি হয় না। মৃতদেহই তো হত্যাকারীদের ধরিয়ে দেয়। ঠগিদের মধ্যে যারা প্রবীণ ছিল তারা দূরদূরান্ত থেকে গিয়ে হাজির হল দেবীর বাসস্থান কালীঘাটের মহাশ্মশানে। সেখানে একশো আটটা নরবলি দেওয়ার পর দেবী তাদের দর্শন দিলে তারা মাকে বলল,—তোমার সন্তানরা না খেতে পেয়ে মরছে মা। তোমার কথা তুমি ফিরিয়ে নাও।

নররক্তের স্বাদ পেয়ে ভবানী তখন তুষ্ট। তিনি সন্তানদের বললেন,—বলা কথা ফেরানো যায় না।

মাটিতে পড়ে ছিল চুল্লির গর্ত কাটার জন্য একটা কোদালের ফলা। ভবানী সেটা উঠিয়ে নিয়ে এক বৃদ্ধ ঠগির হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা তোরা রাখ, মানুষ খুন করার পর এই কোদালি দিয়ে গর্ত করে দেহ পুঁতে দিবি। আর এই কোদালি হল আমার নিশান। এই কোদালি তোদের পথ দেখিয়ে তোদের শিকারের কাছে নিয়ে যাবে।’ সেই পবিত্র কোদালি ঠগিদের হাতে তুলে দিয়ে এরপর মিলিয়ে গেলেন ভবানী। আর এরপর থেকেই ঠগিদের তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠল কলকাতার কালীঘাট। হিন্দু-মুসলমান-ফিরিঙ্গি, সব ঠগিরই মা হলেন ‘দেবী ভবানী।’

সব ধর্মের ঠগিরাই নাকি কালীঘাটে মাকে প্রণাম করতে যায়। লাহোর, মুলতান, কাশ্মীর থেকেও নাকি ঠগিরা যায় সেখানে। তুসমাবাজ একবার বলেছিলেন, কালীঘাটে প্রতি এক গন্ডা মানুষের মধ্যে অন্তত একজন নাকি ঠগি।

মোমবাতির শিখাটা বাতাসে নাচছে। জব্বলপুরের কোম্পানির কুঠিবাড়িতে বসে বুড়ো দশরাজের কথা শুনে মানুষগুলো কোথায় যায় সে ব্যাপারে বহুবছর পর একটা যুক্তিগ্রাহ্য জবাব পেলেন ক্যাপ্টেন স্লিম্যান। হ্যাঁ, হতে পারে তারা মৃতদেহগুলোকে কবর দিয়ে ফেলে, সে জন্য আর মানুষগুলোর চিহ্ন মেলে না।

সাহেব এরপর জিগ্যেস করলেন,—ওদের কি কোনও বিশেষ চিহ্ন আছে? যা দেখে ওদের চেনা যায়?

বৃদ্ধ তার সাদা চুলওয়ালা মাথাটা নাড়িয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, সে সব আমার জানা নেই, তবে শুনেছি ওদের একটা ভাষা আছে। গোপন ভাষা।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল,—তবে পুরন্দোয়া ভাষাটা কিছুটা জানে বলে শুনেছি।

—কে পুরন্দোয়া? সাহেব সোজা হয়ে বসে উত্তেজিত ভাবে জানতে চাইলেন।

—পুরন্দোয়া মানে ‘পুরন্দোয়া লোহার’। ‘লোহার’ মানে যারা বলি দেয়। ভূপালের রাজবাড়িতে ছাগ বলি দিত লোকটা। এক সময় কালীঘাটেও ওই কাজ করত সে। জবাব দিল দশরাজ।

বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে, ঝড় স্লিম্যানের মনের ভিতরও। তিনি প্রশ্ন করলেন,—লোকটা কোথায় থাকে?

দশরাজ বলল,—সে-ও আমার মতো বুড়ো লোক। নর্মদা যেখানে বাঁক নিয়েছে তার কাছাকাছি কোনও একটা গ্রামে থাকে। জব্বলপুরের ছাগহাটে সে আগে আসত। সেখানেই পরিচয়। তার ছেলে ক’দিন আগে এসেছিল এ কুঠিতে। ফেরার সময় আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

বিস্মিত স্লিম্যান বলে উঠলেন,—আমার কুঠিতে?

—হ্যাঁ, সাহেব তোমার কুঠিতে। তিন মাস আগে যখন পল্টনে লোক নেওয়ার জন্য নাম লেখানো হচ্ছিল তখন সে এসেছিল। আমাকে জিগ্যেস করছিল, এখানে কোনও চেনাজানা আছে কি না? যদি তার কাজটা হয়…। কথাটা ঠিক। সগরে কিছু অস্থায়ী সৈন্য পাঠাতে হবে। তার জন্য কুঠিতে নাম লেখানো হচ্ছিল। উইলিয়াম তাঁর পাশে টেবিলে রাখা পেতলের ঘণ্টিই বাজালেন। চাপরাশি এলে সাহেব হুকুম দিলেন,—ফৌজ জমাদারকে তার খাতা নিয়ে এখনই আসতে বলো—।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফৌজ জমাদার তার মোটা খাতা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে সাহেবকে সেলাম ঠুকে দাঁড়াল। খাতাটা তার থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে দেখতে শুরু করলেন। পল্টনে আবেদনকারীদের নাম-ঠিকানা ওতে লেখা আছে। পেয়ে গেলেন সাহেব। লোহার একজন আছে। তার ঠিকানাও আছে। হ্যাঁ, নর্মদার তীরেই তার গ্রাম। সাহেব এরপর নির্দেশ দিলেন,—আভি ঘোড়ে তয়ার করো। জলদি জলদি…। আর তর সইছে না সাহেবের। বাইরে ঝড়ের সঙ্গে এবার বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তুমুল বৃষ্টিতে কুঠি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন স্লিম্যান। গন্তব্য নর্মদা তীরের এক গ্রাম।

পরদিন সকালে নর্মদা তীরে এক পর্ণ কুটিরের দাওয়ায় বসে এক বৃদ্ধর সঙ্গে কথা বলছিলেন স্লিম্যান। বৃদ্ধর হাতে ধরা তার ছেলের ফৌজে ভরতি হওয়ার কাগজ। বয়স হলেও সে বেশ শক্তপোক্ত। বৃদ্ধ বলছিল,—হ্যাঁ, কালীঘাটে মা-র কাছে তারা আসত বটে। মা’র কাছে কেউ এলে তার পরিচয় জিগ্যেস করতে নেই। বিশেষত মাঘ মাসের দিকে আসা শুরু করত তারা। ছোট-বড় দল। সিক্কা বাঁধা হলুদ রুমালে মা-র পায়ের জবা ফুল নিত। তারা কারা আমার জানা নেই। কামারের কাজ করার জন্য ওরা আমাকে আস্ত একটা নিজামশাহী রুপোর টাকা দিয়েছিল। বড় অদ্ভুত ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলত তারা। বাইরের লোকের সামনে না বললেও আমাদের সামনে বলত। কারণ আমরাই তাদের ভেট মা’র কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। বেশ কিছু শব্দ এখনও আমার মনে আছে…। আর হ্যাঁ, ওদের কাছে থাকে একটা কোদালি। আমি সেটা দেখেছি। সেটা ছাড়া ওরা ঘোরে না।

কালীঘাট! সে তো ফোর্ট উইলিয়ামের হাতের কাছেই বলা যায়! স্লিম্যান ফোর্ট উইলিয়ামে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার গেছেন সে জায়গাতে। নদীর পাড়ে প্রাচীন জীর্ণ মন্দির। ভিতরে না ঢুকলেও পুণ্যার্থীদের অনেকের সঙ্গে কথাও বলেছেন। এমনও হতে পারে যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে এমন কেউ ছিল যাদের সন্ধানে এই নর্মদা তীরে বসে আছেন তিনি।—মনে মনে ভাবলেন স্লিম্যান।

বুড়ো বলল, ওরা নিজের মধ্যে প্রথম দেখা হলে বলে—’আউলে ভাই রামরাম’, মোহরকে বলে ‘খোর’, বাচ্চা ছেলেদের বলে ‘খোনতুরা’…।

কখনও একটানা, কখনও থেমে থেমে লোকটা স্মৃতি হাতড়ে বলে যেতে লাগল শব্দগুলো। আর তার কথা শুনে স্লিম্যান সাহেব তা নোটবইতে লিখে যেতে লাগলেন—’তাইওয়া’ অর্থাৎ ‘পথিক’, ‘টিক্কুর’ মানে ‘বিপদ’, ‘পেলাহু’ মানে ‘হলুদ রুমাল!’

বুড়োর কথা যখন শেষ হল তখন পঞ্চাশটার মতো সংকেত শব্দ লিপিবদ্ধ করেছেন স্লিম্যান।

চার

হ্যাঁ, ওই রেশমি রুমালটাই হাতিয়ার এনায়েত-দুর্গাদের। যুগ যুগ ধরে ওটাই তাদের অস্ত্র। টিমোথি সাহেবের অনুচররা এনায়েতদের পুঁটলিগুলোর তল্লাশি নেওয়ার সময় হয়তো বা দেখেওছিল ওরকম কোনও কাপড়ের ফালি। কিন্তু তারা জানত না যে রাস্তার পাশের আমবাগানে শেয়াল ডাকা শেষ প্রহরে ওই নিরীহ কাপড়ের ফালিগুলো নাগপাশ হয়ে চেপে বসবে তাদের গলায়!

এনায়েতরা ধুতুরিয়া, ম্যাকফানসো, তুসমাবাজ বা পাবড়াওয়ালা ঠ্যাঙাড়ে নয়, কত শতাব্দী ধরে যে তারা তাদের এই অস্ত্র বাইরের পৃথিবীর কাছে গোপন করে আসছে তা তাদেরও জানা নেই। ওই অস্ত্রের মতোই এনায়েতদের দেখেও কেউ বুঝতে পারবে না তারা পৃথিবীর নৃশংসতম খুনি-ঠগি। বছরের ক’টা মাস বাদে বাকি সময়টা তারা নিতান্ত গ্রাম্য গেরস্ত। আর পাঁচটা ভারতীয়দের মতোই তারা সহজ-সরল জীবন যাপন করে। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সংসার প্রতিপালন করে। দোল-মহরম পালন করে, মাজারে চাদর দেয়, সত্যনারায়ণকে বাতাসা দেয়, শিশুপুত্রকে কাঁধে চাপিয়ে রথের মেলা দেখাতে নিয়ে যায়, অসুস্থ মাতা-পিতার সেবায় রাত জাগে। তখন কেউ তারা পিতা, কেউ পুত্র, কেউ স্বামী। অন্য মানুষের সঙ্গে কোনও প্রভেদ নেই তাদের। কিন্তু, যখনই শরতের প্রথম কাশফুল ফোটে, বাড়ির আঙিনায় টুপটাপ করে খসে পড়তে থাকে শিউলি ফুল, তখন তাদের রক্ত যেন ডাক দেয়! আদিম সেই ডাক। পথে নামার ডাক। এনায়েত-দুর্গা-দীনুরা তখন কারও বাবা নয়, স্বামী নয়, সন্তান নয়, হিন্দু বা মুসলমানও নয়। তখন তাদের একমাত্র পরিচয় তারা ঠগি! তারা খুনি। তাদের একমাত্র আরাধ্য ‘মা ভবানী’। তারা তাঁর সন্তান। এদের কোমরে গোঁজা থাকে পেলাহু। কোদালি তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় শিকারের সন্ধানে। আমীর-গরিব, ফকির-সন্ন্যাসী সবাই তখন তাদের ‘খৌর’ অর্থাৎ সম্ভাব্য শিকার। দলপতি ‘ঝিরনী’ অর্থাৎ ‘সংকেত’ দেওয়া মাত্রই তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে শিকারের ঘাড়ে।

সেদিন ভোরে সেই আমবাগান ছেড়ে বেরিয়ে সোজা পশ্চিমের পথ ধরল তারা। জঙ্গল পার হলেই অম্বিকাপুর। প্রাচীন জনপদ। বহু লোকের বাস সেখানে। জমিদারের কাছারি, কোম্পানি কুঠি, কাস্টমস কুঠি সব আছে সেখানে।

জঙ্গল পেরিয়ে তারা কিন্তু অম্বিকাপুরে ঢুকল না। অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে শহরটাকে বেড় দিয়ে তাকে পিছনে ফেলে আবার পশ্চিমে এগোল। এনায়েতদের গন্তব্য জব্বলপুর। সেখানে গিয়ে তাদের ঠিক করার কথা তারা ভূপাল হয়ে সগরের পথ ধরবে, নাকি জব্বলপুর থেকে উত্তর-পূর্ব ধরে শোন নদী যে পথ দিয়ে আসছে, সে পথ ধরে উত্তর ভারতের দিকে এগোবে? ভূপালের পথে পথিকের সংখ্যা বেশি, কোম্পানির ফৌজ বা কাস্টসম হাউসের সংখ্যাও বেশি। কারণ, ও পথে গুজরাতি ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করে। আবার শোনের তীর বরাবর নজরদারি কম হলেও ধনবান পথিক সেদিকে কম। তবে হ্যাঁ, শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্য উত্তর ভারতের জহরতের কারবারীরা ও পথ ব্যবহার করে। সে রকম কাউকে পেলে অবশ্য এনায়েতদের ভাগ্য খুলে যেতে পারে। আর কোনওদিন পথে নামার দরকার হবে না তাদের। কয়েকটা দলের ভাগ্যে এ ব্যাপার ঘটেছেও। এনায়েতদের ভাগ্যে যে এ ঘটনা ঘটবে না, তা কে বলতে পারে? তাই ভূপাল, নাকি শোন নদীর পথ, এ ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তারা। তাই আপাতত জব্বলপুরই তাদের গন্তব্য।

অম্বিকা নগরকে পিছনে ফেলে দুদিনের পথ পেরিয়ে এল তারা। পথে একটা নদীও পার হতে হল। এ পথে দুটো পথিক দলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাদের। কিন্তু সুবিধা হয়নি। লক্ষ্মৌ থেকে এক ওমরাহ চলছিল হায়দরাবাদের নিজামের দরবারে। সঙ্গে তার পঞ্চাশজন বন্দুকধারী সেপাই। আর দ্বিতীয় দলটা তীর্থযাত্রীদের। মেয়েছেলে আর বাচ্চা-কাচ্চা মিলিয়ে দশজন লোক যাচ্ছে সোমনাথ মন্দিরে পুজো দিতে। আদর্শ শিকার। তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিন দেখা হল নদীর পাড়ে। কিন্তু এনায়েতরা সেখানে পৌঁছোবার আগেই তাদের পিছু নিয়েছে জলের ঠগি বা ‘ভাঙ্গু’রা। নিজেদের শিকার তারা অন্যর হাতে তুলে দেবে না। কাজেই সেখানেও কিছু করার ছিল না এনায়েতদের।

তৃতীয়দিন ভোরে উঠে যাত্রা করতেই তিলহাই মুস্তাফা পথের ডান পাশে একটা গাছের ডালে ঘুঘু দেখতে পেয়ে দেখাল অন্যদের। ঠগিরা বিশ্বাস করে এটা তাদের কাছে শুভ সংকেত। উৎফুল্ল মনে পা চালাল তারা।

কয়েক ক্রোশ দূরে একটা শুষ্ক নালার মুখে দূর থেকে তারা দেখতে পেল দুজনকে। নালার একপাশে ঘন বাঁশবন। নালা আর বাঁশবনের মাঝ বরাবর শুঁড়ি পথ বেয়ে আসছে তারা। কিন্তু লোক দুজন কাছাকাছি আসার পর প্রাথমিক ভাবে হতাশ হল সবাই। মাঝবয়সি টিকিধারী একজন লোক, গায়ে তার জীর্ণ নামাবলি জড়ানো, সঙ্গে তার বছর দশেকের একটা বাচ্চা ছেলে। তার কাঁধের লাঠির আগায় একটা ছোট্ট কাপড়ের পুঁটলি।

এনায়েতরা বুঝতে পারল এদের কাছে তেমন কিছুই পাওয়া যাবে না, তবে পথের খবর কিছু পাওয়া যেতে পারে। এক সময় তারা দুজন এনায়েতদের মুখোমুখি এসে পড়ল। দুর্গা লোকটার পরিচয় জিগ্যেস করে জানতে পারল লোকটা একজন দরিদ্র বাঙালি ব্রাহ্মণ। সঙ্গের বাচ্চাটা তাঁর ছেলে। ব্রাহ্মণ কী একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে জব্বলপুরে এক যজমানের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছিলেন। এখন পিতাপুত্র ঘরে ফিরছেন। এনায়েতরা যে নদীটা পেরিয়ে এল তাঁর ওপাশেই তাদের গ্রাম। পথের খবর জিগ্যেস করাতে তার কাছ থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর অবশ্য পাওয়া গেল। ঢাকার মনিকারদের একটা দল নাকি এ পথ ধরে যাচ্ছে। জহরতের কারবার করে তারা। পাঁচক্রোশ দূরে এই ব্রাহ্মণ গতকাল এক মন্দিরে ওই দলের সঙ্গেই রাত কাটিয়েছে। জনা সাতেক লোকের একটা দল। পাঁচটা খচ্চরের পিঠে মালপত্র নিয়ে ভোপাল যাচ্ছে।

ব্রাহ্মণের থেকে খবর নিয়ে আবার পা চালাতে যাচ্ছিল এনায়েতরা, হয়তো সন্ধ্যার মধ্যে ধরে ফেলা যাবে দলটাকে। ব্রাহ্মণও এবার নিজের পথ ধরতে যাচ্ছিল, হঠাৎ এনায়েত লক্ষ করল ব্রাহ্মণের ডান হাতে লাল শালু দিয়ে ঢাকা ছোট্ট একটা জিনিস সযত্নে ধরা আছে। এতক্ষণ সে হাতটা নামাবলির আড়ালে ছিল। পা বাড়াতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নিছক কৌতূহলবশত এনায়েত জিগ্যেস করল,—আপনার হাতে ওটা কী?

ব্রাহ্মণ হেসে শালুধরা হাতটা ভক্তিভরে কপালে ঠেকিয়ে বললেন,—এখানে আমার নারায়ণ আছেন। আমাকে তিনি সব বিপদ থেকে রক্ষা করেন।

এনায়েত বা দুর্গারা এরপর কেউই সেই নারায়ণ দর্শন করতে চায়নি। কিন্তু একেই মনে হয় ভবিতব্য বলে, ব্রাহ্মণ তাঁর নারায়ণকে দেখাবার জন্য শালু ওঠালেন। তার নীচে ছোট্ট একটা রুপোর সিংহাসনে বসে আছেন মসৃণ ডিম্বাকৃতি কালো পাথরের নারায়ণ। দুর্গার হঠাৎ চোখ আটকে গেল সেই রুপোর সিংহাসনের দিকে। কতই বা দাম হবে সেই সিংহাসনের? বড়জোর একটা টাকা। কিন্তু তা দেখেই দুর্গা এনায়েতকে বলল,—সিংহাসনটা নিতে হবে। তিন দিনের খোরাকি হয়ে যাবে।

এনায়েত একটু ভেবে নিয়ে বলল,—তা ঠিক, কিন্তু বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না, ঢাকার ওই ব্যবসায়ীদের দলটাকে ধরতে হবে।

দীনু বলল,—হাতের সামনে একটা টাকা পাওয়া গেলে তা ছেড়ে লাভ নেই।

মুহূর্তর মধ্যে সব সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। ব্রাহ্মণ তখন কয়েক পা এগিয়ে গেছেন। হঠাৎ দীনু পিছন থেকে হাঁক দিল,—ঠাকুর দাঁড়ান, একটা নিবেদন ছিল।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন ব্রাহ্মণ। দীনু তাঁর কাছে গিয়ে হাত জোড় করে বলল,—আপনার নারায়ণ দেখে বুঝতে পারলাম, আপনি সত্যি ব্রাহ্মণ। আমরা মুখ্যু মানুষ, পেটের দায়ে এখানে-ওখানে জন খাটি, ধর্মকর্ম করা বা মন্দিরে যাওয়া হয় না আমাদের। কত পাপ যে আমাদের ভগবানের ঘরে জমা হয়ে আছে কে জানে? আপনি বামুন মানুষ, সঙ্গে আবার নারায়ণশিলা! যদি আপনি দু-দণ্ড আমাদের ধর্মপাঠ শোনান তবে পরজন্মর ব্যাপারে একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি।

দীনুর কথা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন ব্রাহ্মণ। ইতিমধ্যে দুর্গা-এনায়েতরাও তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দুর্গা বলল,—হ্যাঁ ঠাকুর, পেটের জন্য কত মিথ্যা কথা বলতে হয় আমাদের। কত পাপ লাগে তাতে। আপনি আমাদের পাপ থেকে মুক্ত করুন।

দীনু এরপর তার কোঁচড় থেকে আটআনা পয়সা বার করে নামিয়ে রাখল ব্রাহ্মণের পায়ের কাছে। এই নির্জন পথে নারায়ণের আশীর্বাদে যে প্রাপ্তিযোগ হতে পারে তা জানা ছিল না ব্রাহ্মণের। নারায়ণের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ব্রাহ্মণ তাঁকে কপালে ঠেকিয়ে রাজি হয়ে গেলেন তাদের প্রস্তাবে। দীনু বলল,—এ জায়গায় বড় রোদ। চলুন আমরা ওই বাঁশঝাড়ের নীচে ফাঁকা জায়গাতে গিয়ে বসি।

ছেলেটার সেখানে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। সে ব্রাহ্মণের নামাবলির খুঁট ধরে টান দিয়ে বলল,—বাবা আর কতক্ষণ দাঁড়াবে?

দরিদ্র ব্রাহ্মণ মাটি থেকে পয়সাটা কুড়িয়ে নিয়ে সস্নেহে ছেলেকে বললেন,—আর একটু সময় আমরা এখানে থাকব বাবা। তারপর নারায়ণ আমাদের ঠিক ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।

ঘন বাঁশবন। দিন-মানেও সেখানে অন্ধকার খেলা করে। ঝিঁঝিঁ পোকার কলতান ভেসে আসছে। চার দিকে অসংখ্য নুইয়ে পড়া বাঁশ। মৃদু বাতাসে খসখস পাতার শব্দ হচ্ছে। পায়ের নীচে খসে পড়া পাতার রাশি। কিছুটা নুইয়ে পড়া একটা বাঁশঝাড়ের নীচে পাতার গালিচার ওপর উত্তর দিকে মুখ করে বসলেন ব্রাহ্মণ। তাঁর ডান পাশে বসালেন নারায়ণকে, আর বাঁ-পাশে বসল বাচ্চা ছেলেটা। পুঁটলিতে একটা পাত্রে গঙ্গাজল ছিল। তা নিজের মাথায় ছিটিয়ে শুদ্ধ হয়ে নারায়ণকে প্রণাম করে ব্রাহ্মণ তার স্মরণ থেকে ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’-র খণ্ডিতাংশ পাঠ শুরু করলেন—

‘ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি—

নায়ং ভূত্বাহভবিতা বা ন ভূয়ঃ।

অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো

ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে…।’

ব্রাহ্মণ এক-একটা সংস্কৃত শ্লোক বলার পর তা এনায়েতদের সামনে সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। বাচ্চা ছেলেটার অবশ্য শ্লোক শোনার ব্যাপারে আগ্রহ নেই। কিছুকাল আগেই উপনয়ন হয়েছে তার। গৌরবর্ণ, মুণ্ডিত মস্তক আদুর গায়ে উপবীতধারী ছেলেটা বড়বড় চোখে উদাস ভাবে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। যে পথ ধরে বাড়ি ফিরবে সে। বেশ কিছুদিন ঘর ছাড়া। হয়তো সে ভাবছে তার মায়ের কথা, তার পাঠশালার বন্ধুদের কথা, অথবা বাড়িতে খাঁচায় পোষা তার আদরের টিয়া পাখিটার কথা…

বেশি সময় ব্রাহ্মণের পিছনে নষ্ট করা যাবে না। সেই জহরতের ব্যবসায়ীদের ধরতে হবে। এনায়েতরা সবাই ব্রাহ্মণের সামনে বসে। শুধু বংশী মালী আর মাধব বলে দুজন লোক ব্রাহ্মণের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর কথা শুনছে। তারা তাকিয়ে আছে এনায়েতের দিকে ‘ঝিরনী’ তোলা অর্থাৎ সংকেতের অপেক্ষায়।

ব্রাহ্মণ একটা নতুন শ্লোক ধরলেন—

‘ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকঃ।’

শ্লোক শেষ করে ব্রাহ্মণ তার ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন,—এ কথার অর্থ হল, কোনও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আত্মাকে ঘায়েল বা ছেদ করা যায় না, আগুনে তাকে পোড়ানো যায় না। ভগবান বলেছেন যে…

তার কথা শেষ হল না। তার আগেই এনায়েত ঝিরনী দিয়ে দিল,—মাধব গঙ্গাজল লাও…!

মুহূর্তের মধ্যে চিরদিনের জন্য থেমে গেল ব্রাহ্মণের কণ্ঠস্বর, ছেলেটার চোখ থেকে হারিয়ে গেল ঘরে ফেরার রাস্তা, তার মায়ের মুখ, পাঠশালা…। নিষ্পাপ শিশুর পলকহীন ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো শুধু চেয়ে রইল অনন্ত আকাশের দিকে।

সিংহাসন ছাড়া ব্রাহ্মণের পুঁটুলি থেকে বেরল এক গন্ডা তামার পয়সা, একজোড়া নতুন শাঁখা আর একটা সিঁদুর কৌটো। সম্ভবত ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রী-র জন্য সেগুলো নিয়ে ঘরে ফিরছিল। সে হতভাগিনী কোনওদিন জানবে না, নালার পাশের এই বাঁশবন চিরদিনের জন্য তার এ জিনিসগুলো কেড়ে নিল।

কবর খোঁড়া হল। তাতে পাশাপাশি শোয়ানো হল পিতা-পুত্রকে। নারায়ণ শিলাও হারিয়ে গেলেন তাদের সঙ্গে। কাজ শেষ করে গর্ত বুজিয়ে পাতা দিয়ে ঢেকে দেওয়ার পর সেই জহরতের কারবারিদের ধরার জন্য আবার পথে নামল সবাই। দ্রুত পা চালাল তারা। পিছনে পড়ে রইল নালার পাশের অজানা সেই বাঁশবন। যেখানে নুইয়ে পড়া বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে বাতাসে হতভাগ্য ব্রাহ্মণের কণ্ঠস্বর তখনও যেন ভেসে বেড়াচ্ছে—”নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবক :…

ঠিক এই সময়ই নর্মদা তীরের সেই গ্রাম থেকে ঘোড়ার পিঠে নিজের হাউসে ফিরছিলেন স্লিম্যান। প্রচণ্ড উত্তেজিত তিনি। মনের মধ্যে বেশ কিছু শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছে। ‘খৌর, গব্বা, ঝিরনী’—এসব নানা অদ্ভুত শব্দ!

পাঁচ

—’গব্বা’ মানে?

—কবর।

—’আঙুছা’ মানে?

—ফাঁস।

—’তাগল’ মানে?

—নেকলেস।

—’ঝিরনী?’

—সংকেত। উত্তর দিলেন স্লিম্যান।

—বাঃ, একদম সঠিক উত্তর দিয়েছ তুমি। হাতে ধরা প্রশ্নপত্রটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে এমিলি বললেন স্লিম্যানকে। পরীক্ষার্থী স্লিম্যান, পরীক্ষক স্ত্রী এমিলি। প্রশ্নপত্রটা অবশ্য এমিলিকে স্লিম্যানই বানিয়ে দিয়েছিলেন। নর্মদার গ্রাম থেকে সেই বৃদ্ধ তার স্মৃতি হাতড়ে চল্লিশটা মতো শব্দ তুলে দিয়েছেন স্লিম্যানের কাছে। সেই শব্দগুলো স্লিম্যান কেমন রপ্ত করেছেন তারই পরীক্ষা নিচ্ছিলেন এমিলি। যদিও শব্দগুলো কোন ভাষার বা স্লিম্যান কেন শব্দগুলো মুখস্থ করছেন সে সম্বন্ধে এমিলির বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। স্লিম্যানকে প্রশ্ন করায় তিনি শুধু মুচকি হেসেছেন।

এমিলি জানেন ভারতবর্ষের সংস্কৃতির ব্যাপারে স্লিম্যানের আগ্রহ প্রচুর। এ দেশে আসার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অন্তত সাতটা ভাষা শিখে ফেলেছিলেন তিনি। শুধু কি তাই, অন্য সব ব্যাপারেও তাঁর প্রবল আগ্রহ। এই তো সেদিন এখানে আসার পর নর্মদা তটে তিনি খুঁজে পেলেন বিরাট এক প্রাণীর ফসিল, তারপর সেটা জাহাজে তুলে পাঠিয়ে দিলেন লন্ডন মিউজিয়মে।

ক’দিন আগে সেখানকার কর্তৃপক্ষ মারফত কোম্পানির গভর্নরের কাছে বার্তা এসেছে যে, ওই প্রস্তরীভূত কঙ্কালটা নাকি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী ডাইনোসরের! এশিয়া মহাদেশের প্রথম প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ফসিল আবিষ্কার করার কৃতিত্ব নাকি সগর ও নের্বুদার কোম্পানির এজেন্ট ক্যাপ্টেন উইলিয়াম স্লিম্যানের। এত বড় একটা ঘটনা, স্বয়ং গভর্নর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন স্লিম্যানকে। কিন্তু স্লিম্যানের কোনও হেলদোলই নেই। তিনি এখন কী একটা নতুন খেয়ালে মেতেছেন এই সব ভাষাটাষা নিয়ে! হয়তো কোনও দেশীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানার জন্যই তাঁর এই খেয়াল। এমনই অনুমান এমিলির।

সাহেবের কুঠিবাড়ির বাইরে সূর্যালোকিত সকাল। নীল আকাশে সাদা তুলোর মতো পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। কুঠিবাড়ির পিছনের মাঠে কাশফুল ফুটেছে। ওই মেঘ আর কাশফুল জানান দিচ্ছে যে হিন্দুদের গডেস দুর্গার পুজোর সময় আসছে। কলকাতায় থাকাকালীন এই পুজোর সময় স্লিম্যান শোভাবাজার জমিদার বাড়িতে পুজো দেখতে গিয়েছিলেন। অপরূপ কিন্তু বিচিত্র দেখতে এই গডেস দুর্গা। তাঁর দশটা হাত! তাঁর পুজো খুব ধুমধাম করে করে হিন্দুরা। এ সময়টা তারা উৎসবে মেতে থাকে। আর তার পরই আসে গডেস কালীর পুজো। গডেস কালী! স্লিম্যান যাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁদের দেবী তিনি।

দিনটা বড় সুন্দর। স্লিম্যান বেরিয়ে পড়লেন কুঠি থেকে। গন্তব্য সামনের এক হাট। বহু লোকের সমাগম সেখানে। কে বলতে পারে স্লিম্যান সাহেব যাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের কেউ সেখানে নেই?

স্লিম্যান পৌঁছে গেলেন হাটে। স্থানীয় মানুষদের অধিকাংশ স্লিম্যানকে চেনে, স্লিম্যানও চেনেন কিছু লোককে। তবে বেশ কিছু অচেনা পথিকও আসে এই হাটে। জব্বলপুর হয়ে যে সব লোক ভূপাল যায় তাদের মধ্যে অনেকেই রসদ সংগ্রহ করে নিয়ে যায় এই হাট থেকে। ভূপাল যাওয়ার পথে এরপর একটাই মাত্র হাট, সেটা নরসিংহপুরে। শুধু যে দেশীয় মানুষরাই হাটে আসে তা নয়, ফিরিঙ্গিরাও থাকে। তারা পথিক, অথবা কোম্পানির বিভিন্ন কর্মচারী।

তবে অচেনা ফিরিঙ্গিদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে চান না স্লিম্যান। ঠগির দলে তো ফিরিঙ্গি থাকতেই পারে। যেমন তুসমাবাজ খুনিদের দলপতিই এক ইংরেজ। তুসমাবাজরাও ঠগিদের মতো ভ্রাম্যমান ও গোষ্ঠীবদ্ধ। তারা পথিককে রাস্তায় দড়ির খেলা দেখায়। বড় অদ্ভুত সে খেলা। দড়ির ফাঁস মাটিতে ফেলে পথিকের হাতে একটা কাঠি তুলে দিয়ে তারা বলে সেই কাঠিটা ফাঁসের মধ্যে আটকাতে। ব্যাপারটা যত সহজ মনে হয় আসলে তা ততটাই কঠিন। ফাঁসে কাঠি আটকাতে পারলে পথিক বাজি জিতল, নইলে বাজিকর বাজি জিতে পথিকের সর্বস্ব হরণ করে হাসতে হাসতে চলে যায়। শেষের ব্যাপারটাই ঘটে বেশি। আর পথিক বাজি জিতলে তার পক্ষে সেটা আরও ভয়ঙ্কর হয়। পথিককে ভুলিয়ে ভালিয়ে কোথাও নিয়ে গিয়ে তাকে বিষ খাইয়ে খুন করে নিজেদের জিনিস ফিরিয়ে নেয় তুসমাবাজরা।

তুসমাবাজি খেলাটার জন্ম অবশ্য এ দেশে নয়। এ খেলাটা স্লিম্যানদের সঙ্গেই এ দেশে এসেছে। লন্ডনের রাজপথে জুয়াড়িরা এই দড়ির খেলা খেলে। নাম ‘প্রিকিং দি গার্টার’, যার ভারতীয় সংস্করণ ‘তুসমাবাজি’।

চুরির অভিযোগে কানপুর রেসিডেন্সি থেকে ‘ক্রেয়াগ’ নামের এক ব্রিটিশ সৈন্যকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অপরাধপ্রবণতা তার মজ্জাগত ছিল। কয়েকজন দেশি অনুচর জুটিয়ে কানপুরে প্রথমে একটা দল খোলে ক্রেয়াগ। এখন তার দেখানো পথ ধরে গোটা উত্তর ভারত ছেয়ে গেছে তুসমাবাজে।

স্লিম্যানের মতো উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ সিভিল সার্জেন্টরা জানেন যে ব্রিটেন থেকে এদেশে আসা প্রতি জাহাজেই এমন কিছু লোক আসে যাদের অতীতটা ওদেশে অন্ধকারময়। শাস্তি এড়াবার জন্য এদেশে পালিয়ে আসে তারা। কোম্পানি তাদের নিজেদের কোনও কাজে বহাল করে না। এদেশে ভিড়ে মিশে গিয়ে তারা নানা ভাবে জীবিকা অর্জন করে। কেউ দেশীয় রাজার ফৌজে ভরতি হয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে, নবাবের হয়ে কোম্পানির ঘরে গুপ্তচরবৃত্তি করে, কেউ কেউ হয়ে যায় তুসমাবাজ বা খুনি ম্যাকফানষো। সাদা চামড়ার লোক যদি তুসমাবাজ বা ম্যাকফানসা হতে পারে তবে ঠগিও হতে পারে। এদের সকলেরই তো আসল পরিচয় তারা খুনি।

হাটে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন স্লিম্যান। অপরিচিত কোনও পথিকের দঙ্গল দেখলেই সেখানে কোনও ছুঁতোয় দাঁড়িয়ে পড়ে তাদের নির্দিষ্ট ভাবে দেখছেন না এমন ভাব দেখিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগলেন তাদের কথাবার্তা। কেনাকাটি দরদামের সময় টাকাকে কি কেউ ‘কাররা’ বা ‘খোর’ বলছে? দুই বা তিন সংখ্যা বোঝাতে হঠাৎ কি কেউ উচ্চারণ করে ফেলছে ‘দুরু’ বা ‘তুরু’?

সেরকম শব্দ খোঁজ করতে করতে স্লিম্যান হাজির হলেন হাটের অন্য প্রান্তে এক জায়গাতে। একটা আমগাছের তলায় নানা বয়সি হাটুরে লোকজন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাটে লোকে শুধু কেনাবেচা করতেই আসে না, মনোরঞ্জনের জন্যও আসে। ভালুকনাচ হয়। সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখায়। বেদেদের দল দেখায় শূন্যে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা বা নাইফ থ্রোয়িং। হয়তো সেরকমই কিছু হচ্ছে সেখানে।

স্লিম্যান কাছে যাওয়ার পর বুঝতে পারলেন তাঁর অনুমান সত্য। গাছের তলায় দুজন লোক কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। ব্যাপারটা কী? সাহেবকে দেখে কাস্টমস হাউসের একজন দেশীয় সেপাই এসে সেলাম ঠুকে দাঁড়াল। সাহেব তার কাছে জানতে পারলেন গতকাল এই সময় একজন বাজিকর নাকি মাটির দশফুট নীচে জীবন্ত সমাধিতে গেছেন। আজ তিনি আবার মাটির তলা থেকে বাইরে আসবেন, সে জন্যই মাটি খোঁড়া চলছে। এ খেলার নাম ‘জীবন্ত সমাধির খেলা’।

এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার আবার হয় নাকি? একটা মানুষ মাটির তলায় এতক্ষণ থাকতে পারে? সেই সেপাই জানাল,—হ্যাঁ সাহেব, ব্যাপারটা সত্যি। সকলের চোখের সামনেই ও কবরে গেছে। এখনই দেখবেন সে ওপরে উঠে আসবে। ওর বাড়ি জব্বলপুরেই, মাঝে মাঝে হাটে খেলা দেখাতে আসে।

তার কথা মিলে গেল। গর্ত খুঁড়ে স্লিম্যানের চোখের সামনেই তুলে আনা হল একজন মাঝবয়সি লোককে। প্রথমে সে মূর্ছা গেছে মনে হলেও এক সময় সে চোখ মেলে উঠে বসল। হাততালি আর তামার পয়সায় ভরে উঠতে লাগল বাজিকরের পাত্র। সাহেবও খুশি হয়ে নগদ রুপোর একটা টাকা রাখলেন সেই পাত্রে। স্লিম্যান এ দেশটাকে যত দেখছেন তত অবাক হচ্ছেন। এ দেশের মানুষজন বড় বিচিত্র। স্লিম্যান যে খেলাটা দেখলেন তা দীর্ঘদিনের যোগাভ্যাসের ফল। স্লিম্যান শুনেছেন, এদেশে কিছু সাধু-সন্ন্যাসী আছেন, যাঁরা নাকি যোগাভ্যাসের ফলে না খেয়ে, এক বিন্দু জল স্পর্শ না করে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারেন। এক পায়ে পাথরের মূর্তির মতো দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। এ সব যে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে নিছক গল্পকথা নয় আজ তার কিছুটা প্রমাণ পেলেন ক্যাপ্টেন স্লিম্যান।

খেলা এরপর ভেঙে গেল। লোকজনও এদিক-ওদিকে চলে যেতে শুরু করল। স্লিম্যানও তাঁর হাউসে ফিরবেন। হঠাৎ তাঁর কানে গেল, একজন লোক, আর একজনকে বলছে,—চল এবার নদীর ঘাটে যাই। আজ ভারি মজা আছে সেখানে। আবার পুণ্যও হবে। সেখানে আজ একজন সতী হবে।

সতী হওয়ার ব্যাপারটা শুনেছেন স্লিম্যান। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক স্ত্রী স্বামীর চিতায় সহমরণে যান। হিন্দু ধর্মে ব্যাপারটা নাকি খুব পবিত্র। যিনি সতী হন তাঁকে দেবীর সমান মর্যাদা দেওয়া হয়। শুনেছেন স্লিম্যান, তবে দেখেননি। স্বামীর মৃত্যুতে কেউ তার চিতায় ঝাঁপ দিচ্ছে, স্বামীর প্রতি ভালোবাসার আর শ্রদ্ধার এর চেয়ে বড় নিদর্শন আর কী হতে পারে? হাটের লোকদুটোর সঙ্গে কথা বলে সতী হওয়ার খবরটায় নিশ্চিত হয়ে কৌতূহলবশত স্লিম্যান রওনা হলেন পাঁচ ক্রোশ দূরের নদীর ঘাটে। ওখানে একটা কাস্টমস হাউস আছে।

স্লিম্যান কাস্টমস হাউসে পৌঁছোতেই কাস্টমস হাউসের দেশি দারোগা বেশ ভয় পেয়ে গেছিল। সাহেব কোনও কাগজপত্র পরীক্ষা করতে এসেছেন নাকি? পরে তাঁর আগমনের কারণটা জানতে পেরে কাস্টমস হাউসের কাঠের জাফরি ঘেরা বারান্দায় যথাসম্ভব আরামদায়ক ভাবে সাহেবের জন্য বসার ব্যবস্থা করলেন। বারান্দার একটু নীচেই ঘাট। সব কিছু স্পষ্ট দেখা যায় সেখান থেকে। সতী হওয়ার খবরটা ইতিমধ্যেই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। আশেপাশের গ্রাম থেকে নানাবয়সি নারী-পুরুষ জমা হতে শুরু করেছে নর্মদার ঘাটে। এমন পবিত্র ঘটনা চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য তো সচরাচর ঘটে না। তাই দলে দলে লোক ছুটে আসছে এ ঘটনার সাক্ষী হতে। কাস্টমস হাউসের বারান্দায় বসে স্লিম্যান প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন সবকিছু।

সময় যত এগিয়ে চলতে লাগল ভিড় তত বাড়তে লাগল। এক সময় দূর থেকে ঢাকের শব্দ কানে এল স্লিম্যানের। সেই শব্দ শুনে জনতার মধ্যেও একটা চাঞ্চল্য শুরু হল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সতীমা এসে পড়বেন ঘাটে! কাস্টমস হাউসের দারোগা থেকে খাজাঞ্চি, কেরানি, এমনকী সেপাইরা পর্যন্ত সব কাজ ফেলে এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়।

এক সময় খুব কাছে চলে এল সেই শব্দ। ঢাকের বাদ্যি, শাঁখের আওয়াজ, হরিধ্বনি, খোল-করতাল, লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি মিলিয়ে এক বীভৎস শব্দ। ওপর থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর পাড়ে। সেই প্রশস্ত পাথুরে ধাপের দুপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল জনতা। ধাক্কাধাক্কিতে দু-চার জন লোক ছিটকে জলে পড়ল। সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই, সবাই দেখতে চায় সতীমাকে। স্লিম্যানের চোখেও কৌতূহল।

খোল-করতাল নিয়ে প্রথম প্রবেশ করল হরিনাম সংকীর্তনের দল। তারপর শববাহকেরা। চারজন লোকের কাঁধে শুয়ে আছে একজন অতিবৃদ্ধ লোক। তার কেশহীন মাথাটা একটা নারকেলের মতো নড়ছে। স্লিম্যান বুঝতে পারলেন যথেষ্ট পরিণত বয়সেই মারা গেছে লোকটা। শববাহীরা তাকে নীচে নামিয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে গেল। আর এরপরই তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে সতীমাকে আনা হল ঘাটে। বিরাট একটা জটলার মধ্যে সতীমা। তাকে ঘিরে ঢাক বাজছে, ধুনুচি নাচ হচ্ছে, সতীমার নামে জয়ধ্বনি হচ্ছে।

বউটাকে দেখে চমকে উঠলেন স্লিম্যান। কত আর বয়স হবে মেয়েটার? ষোলো-সতেরো! কপালে তার সিঁদুর লেপা, হাতে নতুন শাঁখা, নতুন শাড়ির আঁচল লুটাচ্ছে মাটিতে, অবিন্যস্ত কেশদাম, আলুথালু বেশ। দুজন এয়োস্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে সে এসে দাঁড়াল ঘাটের মাথার ওপরে ফাঁকা জায়গাতে। টলছে বউটা। ছোটছোট ছেলেমেয়েরা এসে বউটাকে প্রণাম করছে, এয়োস্ত্রীরা তার কপালে ছুঁইয়ে নিচ্ছে তাদের শাঁখা-সিঁদুর। সতী তো সাক্ষাৎ দেবী!

ওদিকে নদীর পাড়ে চিতার কাঠ সাজানো হয়েছে। তিনজন মাঝবয়সি ভুড়িওয়ালা ধুতি পরা লোক সে ব্যাপারটার তদারকি করছে। স্লিম্যান তার পাশে দাঁড়ানো কাস্টমস হাউসের দারোগাকে জিগ্যেস করলেন,—ওদের পরিচয় কী? এইটুকু মেয়ের সঙ্গে ওই বুড়োর বিয়ে হয়েছিল?

দেশি দারোগা তাঁকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন,—ব্রাহ্মণ পরিবার হুজুর। বাঙালি ব্রাহ্মণ। জাত যাওয়ার ভয়ে বছর খানেক আগে বুড়ো লোকটার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল সতীমার। বুড়োটার দ্বিতীয় বিবাহ। প্রথম পক্ষের স্ত্রী মারা গেছিল বহুবছর আগে। ওই যে মোটাসোটা লোক তিনজন চিতা সাজাবার তদারকি করছে ওরা তার প্রথম পক্ষের ছেলে। অনেক সম্পত্তির মালিক ছিল বুড়োটা।

চিতার কাঠ সাজানো হল। বুড়োটাকে স্নান করিয়ে চিতায় তোলা হল। ব্রাহ্মণ মন্ত্র পড়া শুরু করল, মুখাগ্নি হল। আর এর পরই আরও জোরে বাজতে শুরু করল ঢাক। বউটাকে এবার ধীরে ধীরে নীচে নামানো শুরু হল। শাঁখ, কাঁসর বাজছে, সিঁড়ির দুপাশে মাথায় চুল বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে মহিলারা। সেই চুল মাড়িয়ে ধাপ বেয়ে চিতার দিকে এগোচ্ছেন সতীমা। জয়ধ্বনি হচ্ছে, ‘সতী মাঈ কি জয়! সতী মাঈ কি জয়!’ চিতায় আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। বউটার হাঁটার ধরন দেখে স্লিম্যান এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলেন বউটাকে নিশ্চয়ই কোনও মাদক খাওয়ানো হয়েছে! সে আর হাঁটতে পারছে না। দুজন শক্ত সমর্থ পুরুষ তাকে ধরে নিয়ে চলেছে।

তাহলে সত্যি কি স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় মেয়েটা চিতায় উঠছে না? স্লিম্যানের ধারণা স্পষ্ট হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। চিতার সামনে আসা মাত্রই বউটার যেন হুঁশ ফিরে এল। আর্তচিৎকার করে উঠল সে। যেন ঠেলে সরিয়ে দিতে গেল তাকে ধরে থাকা লোকগুলোকে। কিন্তু তার আগেই বুড়োর দু-জন ছেলে এসে দাঁড়িয়ে ছিল বউটার পিছনে। মুহূর্তের মধ্যে তাকে তারা পাঁজাকোলা করে ছুড়ে ফেলে দিল চিতার আগুনে। জনতা চিৎকার করে উঠল, ‘সতী মাঈ কি জয়!’ ঢাকের বাজনা, শাঁখের শব্দ, জনতার চিৎকারে ঢাকা পড়ে গেল সেই ষোড়শী বালিকার আর্তনাদ। নর্মদা তীরে শেষ বিকালের আলোতে চিতার আগুন ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিল তার সোনার অঙ্গ।

এ তো খুন! হাজার হাজার জনতা খুন করল একটা মেয়েকে! ব্যাপারটা সম্বন্ধে স্লিম্যানের যে ধারণা ছিল তা ভেঙে গেছে। উত্তেজনায় কখন তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন তা তাঁর নিজেরও খেয়াল নেই। তিনি এরপর লক্ষ করলেন কাস্টমস হাউসের দারোগা থেকে শুরু করে সেপাইরা পর্যন্ত বন্দুক পাশে নামিয়ে চিতার আগুনের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে ভক্তি ভরে প্রণাম জানাচ্ছে সতীমার উদ্দেশ্যে। এই পুণ্যদৃশ্য দেখার সুযোগ পেয়ে তারাও কম আপ্লুত নয়! স্লিম্যানের অনেক সতীর্থ ভারতীয়দের সম্বন্ধে যে কথাটা ব্যবহার করেন, কিন্তু স্লিম্যান কোনওদিন যা ব্যবহার করেননি, এ দৃশ্য দেখে জীবনে সেই প্রথমবার রাগে ক্রোধে সেটাই বলে উঠলেন,—ব্লাডি, ফুল ইন্ডিয়ান!

সাহেবের কথাটা কানে গেল পাশে দাঁড়ানো দারোগা সাহেবের। তিনি আমতা আমতা করে বললেন,—সাহেব এটা ধর্মের ব্যাপার!

—ধর্মের ব্যাপার! যদি বউটা তোমার মেয়ে হত তবে এই খুনটা দেখতে পারতে তুমি? গর্জে উঠলেন স্লিম্যান।

স্লিম্যান এরপর তাঁর ক্রোধ সম্বরণ করে নিলেন। মনে মনে ভাবলেন, ‘হ্যাঁ, এ ধর্মের ব্যাপার।’ এই নের্বুদার সর্বেসর্বা কোম্পানির পলিটিকাল এজেন্ট স্বয়ং স্লিম্যানের ক্ষমতা নেই এই ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার। যারা সতীমা-র নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছে তারা ঠগিদের থেকে কম নৃশংস নয়। ঠগিরা মানুষ খুন করে জীবিকার জন্য, আর এরা করে ধর্মের জন্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কালের নিয়মে একদিন হয়তো ছেড়ে যেতে হবে এ জায়গা। কিন্তু পাঁচশো বছর পরও এরকমই কুসংস্কারগ্রস্থ থেকে যাবে এই দেশ।

কারও সঙ্গে আর কোনও কথা না বলে নিঃশব্দে কাস্টসম হাউস ছেড়ে বেরিয়ে ঘোড়ায় চেপে ভারাক্রান্ত মনে নিজের কুঠির দিকে যাত্রা শুরু করেন স্লিম্যান। দিনের শেষ আলো ছড়িয়ে নর্মদার তটে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। তখনও সতীমার নামে জয়ধ্বনি চলছে সেখানে। চিতার আগুনে খাক হয়ে যাচ্ছে এক ষোড়শী। নদীর পাড় থেকে ভেসে আসা সেই চিৎকার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এরপর তাড়াতাড়ি ঘোড়া ছোটালেন স্লিম্যান। আজ তিনি যা প্রত্যক্ষ করলেন তার তুলনায় ঠগিরা আর কত পাপ করে?

ছয়

হ্যাঁ। এনায়েত, দুর্গা, ঝগড়ু, মাধব, দীনু, এরা কেউই মনে করে না এ কাজে পাপ লাগে। তাদের মতো আরও কয়েক হাজার মানুষ যারা এই অন্ধকারময়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতের পথে পথে শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় তারাও মনে করে এ কাজে তাদের পাপ হয় না। পাপ হবে কেন? স্বয়ং ভবানীই তো তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন এই রেশমি রুমাল, কোদালির নিশান। তারা ভবানীর সন্তান। তারা যা করে তা ভবানীই করান। নইলে শরতের প্রথম কাশফুল ফোটার সময় মনের ভিতর তাদের কে হাঁক দেয় ঘর ছেড়ে পথে নামার জন্য? ওই ডাক দেবীরই আহ্বান। ডাক অগ্রাহ্য করলে কুপিত হবেন দেবী।

একবার এনায়েতদের এক অনুচর দেবীর নির্দেশ অমান্য করেছিল। চার-পাঁচ মাস পর এনায়েতরা জানতে পারল তারা ঘর ছাড়ার তিন দিনের মধ্যেই হঠাৎই নাকি সেই অনুচর রক্তবমি করে মারা যায়।

এনায়েতরা বিশ্বাস করে যাদের তারা হত্যা করে তারা দেবীর কাছে কোনও না কোনও পাপ করেছে। রক্তবীজের মতো তাদেরকে এনায়েত-দুর্গাদের মাধ্যমে নিধন করেন দেবী ভবানী। তাহলে কী এমন পাপ করেছিল সেই ব্রাহ্মণ বালক? বাবার সঙ্গে যার আর ঘরে ফেরা হল না, নালার পাশে ঝিঁঝি ডাকা অন্ধকার বাঁশবনে যে হারিয়ে গেল?

এ সব কূট প্রশ্ন অবশ্য এনায়েতদের কেউ করে না। এ পর্যন্ত ন’শো জনের মতো মানুষকে তার হলুদ রুমালে ফাঁস পরিয়েছে এনায়েত, দুর্গা পাঁচশোর বেশি মানুষকে। এনায়েতের দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য যে, তারও হাতের ছোঁয়াতে মিলিয়ে গেছে অন্তত পঞ্চাশ জন লোক। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল শিশু বা নারী। না, এ প্রশ্ন এনায়েতদের কেউ করে না। কারণ, তাদের খোঁজ জানা নেই কারও। হাজার হাজার বছর ধরে ঠগিরা নিজেদের গোপন করে রেখেছে পৃথিবীর মানুষের থেকে। লোকে ভাবে এ দেশের পথে-প্রান্তরে যেমন অনেক আজগুবি গল্পকথা শোনা যায়, তেমনই ঠগি একটা আজগুবি ব্যাপার। বাস্তবে ঠগি বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। অথচ হাজার বছর ধরে এ দেশের পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠগিরা, তাদের হাতের ছোঁয়ায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হারিয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষ।

ঠগিদের প্রাচীনত্বের প্রমাণ মেলে ইলোরা পাহাড়ের গায়ে। সপ্তম শতকে রাষ্ট্রকূট আমলে নির্মিত হয়েছিল ইলোরার স্থাপত্যকীর্তি। লোকে বলে পৃথিবীতে এমন কোনও পেশা নেই, যা ইলোরার পাষাণ গাত্রে খোদিত হয়নি। ঠগিরাও আছে সেখানে। যৌবনে এনায়েত একবার গেছিল সেখানে। সে দেখেছে সেখানে পাথরের গায়ে খোদিত আছে তাদের নানা কর্মপদ্ধতি। ফাঁস পরিয়ে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, সেই মৃতদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কবরের জন্য, কবরের গর্ত খোঁড়া হচ্ছে ইত্যাদি সব ছবি।

সাধারণ মানুষরা অবশ্য সে সব ভাস্কর্যের অর্থ বুঝতে পারে না, এনায়েত-দুর্গারা সে সব ছবি চিনতে পারে। এনায়েত বংশ পরম্পরায় আবার আরও একটা গল্প শুনে আসছে এদেশে তাদের উৎপত্তির ব্যাপারে। তাদের আদি পুরুষ নাকি ছিলেন পারসিক দস্যু দলপতি সাগার্তি। এনায়েতরা তারই বংশধর। মুসলমান শাসকরা যখন এদেশে আসে তখন তাঁদের পায়ে-পায়েই এদেশে পা রাখে সাগার্তির সন্ততি, এনায়েতদের পূর্বপুরুষরা। দিল্লির উপকণ্ঠে এক গ্রামে আস্তানা গাড়ে তারা। সুলতানের হয়ে তারা যুদ্ধ করত। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে তারা দিল্লি নগরীকে রক্ষা করত। সুলতান জালালউদ্দিন ও সুলতান আলাউদ্দিন খলজির আমলে ঠগি সর্দারদের প্রতিপত্তি খুব বৃদ্ধি পায়। সেই শুরু, তারপর মহাকালের রথের পিছন পিছন ঠগিরাও ছড়িয়ে পড়ে এ দেশের মাটিতে। দানব রক্তবীজের মতো হাজারে হাজারে জন্ম নেয় তারা। দেশ-কালের বিচারে গড়ে ওঠে সুলতানি, জুমালদেহী ইত্যাদি ঠগিদের ঘরানা।

এ যাত্রায় এনায়েতের প্রধান সহযোগী দুর্গা বাংলাদেশের ঠগি। আগে তার নিজস্ব দল ছিল। তার দল ভেঙে যাবার পর কয়েকবছর ধরে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে এনায়েতের সঙ্গে সে পথে নামছে। এনায়েত বা ফিরিঙ্গি ও তার নিজস্ব লোকরা হিন্দিভাষী, উত্তর ভারতীয় লোক। দুর্গা, মাধব আর দু-একজন বাংলাদেশের নদীপাড়ের লোক। দলে বিভিন্ন ভাষাভাষীর লোক থাকলে কাজের সুবিধা, তাই এনায়েত দলে নিয়েছে তাদের।

দুর্গা, মাধবদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে বাংলাদেশের মাটিতে এল তা নিয়ে আবার একটা গল্প আছে দুর্গাদেরও। সে গল্প হল জালালউদ্দিন খলজির আমলের। সন-তারিখ দুর্গাদের জানা না থাকলেও সেটা ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ। ঠগিদের দিল্লিতে তখন খুব প্রতিপত্তি। কী একটা ঝগড়াঝাঁটির কারণে একদল ঠগি হঠাৎ ঝিরনী দিয়ে বসল সুলতানের অত্যন্ত প্রিয় এক অনুচরকে। সুলতান ব্যাপারটা শুনে সেই ঠগিদলকে কয়েদ করে প্রানদণ্ডের আদেশ দিলেন। ঠগিদের মধ্যে যারা সে সময় সুলতানের বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিলেন তারা ঠগিদের প্রাণভিক্ষার জন্য কাতর আবেদন জানালেন ক্রুদ্ধ সুলতানের কাছে। দিল্লি রক্ষায় ঠগিদের অতীত ভূমিকার কথা ভেবে সুলতান শেষ পর্যন্ত ওই ঠগিদের প্রাণদণ্ড মকুব করলেন ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিলেন ওই সব ঠগিদের দিল্লির ত্রিসীমানায় থাকা চলবে না। এরপর সুলতানের মুদ্রা গরম করে তার ‘চিনাস’ বা ‘চিহ্ন’ এঁকে দেওয়া হল ওই সব ঠগিদের পিছনে। ওই ছাপ চিরজীবনের মতো আঁকা হয়ে গেল তাদের শরীরে। অর্থাৎ তাদের ‘দাগি’ করে দেওয়া হল। দাগি ঠগিদের কয়েকটা নৌকোতে উঠিয়ে দিয়ে বলা হল যে পূর্ব ভারতে পৌঁছবার আগে কোনও জায়গাতে যদি নৌকো ভেড়ে বা তারা যদি আবার দিল্লিতে ফিরে আসে তবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করা হবে। প্রাণভয়ে সুলতানের সেই নির্দেশ পালন করে ঠগিরা। কোনও এক সুদূর অতীতে সেই নৌকোগুলোরই কোনও একটা এসে লেগেছিল বাংলার কোনও ঘাটে। সে নৌকো থেকে যারা বাংলার মাটিতে পা রেখেছিল তারাই হল দুর্গাদের পূর্বপুরুষ, বাংলাদেশের আদি ঠগি।

 সেই বাঁশবনে ব্রাহ্মণ আর তাঁর পুত্রকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ঢাকার জহরত ব্যবসায়ীদের দলটাকে ধরার জন্য দ্রুত পা চালাল ফিরিঙ্গিয়া আর তার দলবল। কিছুটা পথ এগোবার পর ধুলোময় রাস্তায় খচ্চরের পায়ের ছাপ চোখে পড়ল তাদের। ব্রাহ্মণ মিথ্যা বলেনি। দলটা সম্ভবত ছ-সাত ক্রোশ আগে চলছে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল এনায়েতরা।

আরও দু-তিন ক্রোশ চলার পর দেখল রাস্তার পাশে একজন ভিখারি গোছের লোক মরে পড়ে আছে উপুড় হয়ে। মোস্তাফা উলটে দেখল মৃতদেহটাকে। তার ঠোঁটের কষে রক্তের দাগ। ধুতুরিয়াদের কাণ্ড। ধুতরোর বিষে হত্যা করা হয়েছে লোকটাকে। এই ধুতুরিয়া আর ম্যাকফানসোদের জন্য ঠগিদের কাজের খুব অসুবিধা হয়। কারণ তারা দেহ লোপাট করে না বলে দেহ মিললেই কোম্পানির লোকজন বা জমিদারের পাইকরা সেই এলাকাতে তল্লাশি শুরু করে। এ কারণে ধুতুরিয়াদের চলার পথ ঠগিরা মাড়ায় না। কিন্তু আগেই ওই ঢাকার দলটা গেছে তাই এনায়েতরা সে পথ ধরেই চলল। দলটার সঙ্গে দ্রুত দূরত্ব কমিয়ে আনল তারা।

বেলা পড়ে আসছে। অবশেষে সূর্য ডোবার কিছু আগে দূর থেকে দেখা গেল কিছু মানুষকে। কিন্তু সংখ্যায় তো তারা আরও বেশি মনে হচ্ছে! উটও আছে দেখা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে একটা বাঁওড়ের কাছে সম্ভবত তাঁবু ফেলার উদ্যোগ নিচ্ছে লোকগুলো। এনায়েত মোস্তাফাকে আগে পাঠাল ব্যাপারটা কী খোঁজ নেওয়ার জন্য। মোস্তাফা কিছুক্ষণের মধ্যে এসে জানাল,—হ্যাঁ, বাওড়ের কাছে তাঁবু খাটানো হচ্ছে। ঢাকার ব্যবসায়ীরা সেখানে আছে ঠিকই, কিন্তু তাদের সঙ্গে আরও অনেক লোক। প্রায় পঁচিশ জন লোক। সংখ্যায় তারা এনায়েতদের চেয়ে বেশি। এতগুলো লোককে তো আর ঝিরনী দেওয়া যাবে না। কী করা যায়?

আলোচনা শুরু হল। দুর্গা বলল,—সম্ভবত দুটো দল পথেই মিলিত হয়েছে। এমন হতে পারে যে জব্বলপুর গিয়ে তারা আবার দু-দল দুটো পথ ধরতে পারে। তখন যে কোনও একটা দলের পিছু নেওয়া যাবে।

এনায়েত বলল,—এ প্রস্তাব মন্দ নয়, আপাতত তাহলে ওদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলা যাক। ওদের পরিকল্পনা কী জানা যাবে তাহলে।

তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সবাই এগোল বাঁওড়ের দিকে।

দূর থেকে তাদের দেখতে পেয়েই লোকগুলো প্রথমে সতর্ক হয়ে গেল। তাঁবু খাটানো বন্ধ করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। লোকগুলোর মধ্যে দুজনের হাতে আবার বন্দুকও আছে। এনায়েতরা তাদের কাছাকাছি উপস্থিত হতেই ও দলের একজন বন্দুক উঁচিয়ে চিৎকার করে উঠল,—থামো। তোমরা কারা?

দলবল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে এনায়েত জবাব দিল,—আমরা পথিক। জব্বলপুর যাচ্ছি।

সে আবার প্রশ্ন করল,—কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

—জিলা শোনপুর। বিহার। জবাব দিল এনায়েত ওরফে ফিরিঙ্গিয়া। তারপর দুর্গাকে নিয়ে এগোল বাঁওড়ের গায়ে ফাঁকা জমিটায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে। যেতে যেতেই তাদের সংখ্যাটা গুনে ফেলল এনায়েত। পঁচিশ নয় তেইশজন লোক। তাদের সঙ্গে পাঁচটা খচ্চর আর দুটো উট। সঙ্গে অনেক মালপত্রও আছে। দুজন গিয়ে দাঁড়াল তাদের সামনে। একজনের চেহারা ও দাড়ি দেখে তাদের ধারণা হল লোকটা সম্ভবত মুসলমান। লম্বা-চওড়া চেহারা তার, আর অন্য জন ধুতি-পিরান পড়া টেরি কাটা সিঁথিওয়ালা বাঙালি। সম্ভবত সে ঢাকার জহরত ব্যবসায়ী। ওরকম ধুতি-পিরান পরা আরও দুজন লোকও দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা পিছনে।

পিরানপরা লোকটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল এনায়েতদের দিকে। এনায়েতের চেহারাটা এমন, যা প্রথমেই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সাহেবদের মতো ফরসা রং, টিকালো নাক, মেহেদি মাখা দাড়ি, মাথায় পাগড়ি। সব চেয়ে আকর্ষণীয় তার চোখ দুটো। বড়-বড় চোখ দুটোতে যেন শিশুর সারল্য খেলা করছে। তাকে দেখে কে বলবে ওই চোখের দৃষ্টি যে-কোনও হিংস্র শ্বাপদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। ওই চোখ দুটো কেড়ে নিয়েছে ন’শো মানুষের প্রাণ!

দুর্গার অবশ্য দাড়ি নেই, কিন্তু তার মুখমণ্ডলেও সবসময় অদ্ভুত এক প্রশান্তি জেগে থাকে। যেন সে কোনও যোগীপুরুষ। আর তাদের সব সঙ্গীসাথীদের দেখেই মনে হয় তারা নিতান্ত সহজ-সরল মানুষ। তাদের কারও হাবভাবে এমন কিছু প্রকাশ পায় না, যা দেখে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে।

এনায়েত পিরানপরা লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকে বলল,—আমার নাম রুস্তম আলি। জনমজুরের কাজ করি মাঠে। জব্বলপুর হয়ে ভূপালে কাজের সন্ধানে যাচ্ছি।

এনায়েত এরপর তাকে বলল,—আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আপনাদের পাশে আমরাও আজ রাত কাটাতে চাই। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, পথঘাট ভালো না, যদিও আমাদের দলে সবাই জোয়ান মানুষ, কিন্তু সঙ্গে অস্ত্র তো নেই। বিন্ধ্যাচলের কাছাকাছি চলে এসেছি। এখানকার ডাকাতরা খুবই ভয়ানক। অতর্কিতে আক্রমণ করে, কিছু না পেলে প্রাণে মেরে দেয়। আপনারা আর আমরা মিলে দলটা বেশ বড়ই হবে। দলে ভারী হলে চট করে কেউ হামলা করতে সাহস পায় না। আসার পথে দেখলাম কারা যেন একটা লোককে পথের ধারে মেরে রেখেছে। ডাকাতদের কীর্তি হবে মনে হয়, গরিব মানুষকেও ছাড়েনি। আমরা কয়েকবছর ধরে এ পথে আসা-যাওয়া করছি। আমরা জানি এ পথ ভালো নয়।

এনায়েতদের দেখে খারাপ লোক বলে মনে হল না সেই দাড়িওয়ালা জহরত ব্যবসায়ীর। তা ছাড়া এনায়েতদের থেকে দলেও ভারি তারা। এই বাঁওড়ের গায়ের মাঠটাও কারওর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, কাজেই সেই দাড়িওয়ালা মুসলমান ও ঢাকার লোকটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার পর জহরতের কারবারি বলল, ঠিক আছে এখানে থাকতে চাও থাকো। কিন্তু কোনও ঝামেলা হুজ্জত যেন না হয়, দেখছ নিশ্চয়ই আমাদের বন্দুক আছে?

এনায়েত হেসে বলল,—হ্যাঁ, দেখেছি। সেরকম কিছু হবে না।

লোকগুলোর তাবুর কিছুটা তফাতে নিজেদের রাত কাটাবার ব্যবস্থা করল এনায়েতরা। চুলা জ্বালিয়ে তারা রুটি পাকাতে লেগে গেল। ধীরে ধীরে বাঁওড়ে অন্ধকার নামল। লোকগুলো তাদের তাঁবুর কাছে বেশ কয়েকটা মশাল জ্বালালো। অন্ধকার নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই খাওয়া সারা হয়ে গেল দু-দলেরই। তিনটে তাঁবু পড়েছে। একটা সেই দাড়িওয়ালার, অন্য দুটো ছোট তাঁবু সেই জহরত ব্যবসায়ীদের।

এনায়েতরা বুঝতে পারল ফর্সা ধুতি আর জমিদার পিরান পরা তিনজন লোক হল জহরত ব্যবসায়ী। আর দাড়িওয়ালা লোকটার পরিচয়ও তারা জানতে পারল কিছু পরে। দাড়িওয়ালা ও মণিকারের দল খাওয়া সেরে তাঁবুতে ঢোকার পর বাকি লোকজন একটা অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে তার চারপাশে গোল হয়ে গল্পগুজব করতে বসল। তারা সব চাকর শ্রেণির লোক। শুধু বন্দুকধারী লোক দুজন জহরতকারবারিদের তাঁবুর কাছে খচ্চরগুলোকে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল।

অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে লোকগুলো যেখানে বসল তার কিছুটা তফাতেই এনায়েতরা বসে। এনায়েত ইশারা করতেই দীনু তার পুঁটলি থেকে একটা বাঁশি বার করে তা বাজাতে শুরু করল। আকাশে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। দীনুর বাঁশির সুর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল জনহীন প্রান্তরে। অপূর্ব সেই সুর। অগ্নিকুণ্ড ঘিরে যারা গল্প করছিল তারা গল্প থামিয়ে শুনতে লাগল অপূর্ব সেই সুরের মূর্ছনা। তারপর একজন-দুজন করে পুরো দলটাই এনায়েতদের কাছে এসে দাঁড়াল দীনুর বাঁশি শোনার জন্য। অনেকক্ষণ বাঁশি বাজাল দীনু। সে বাঁশি থামালেই সেই লোকগুলো বলে,—আর একটা সুর ধরো, আর একটা।

কিছুক্ষণের মধ্যে দু-দলের বেশ ভাব জমে গেল। লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলে এনায়েতরা জানতে পারল ওই দাড়িওয়ালা লোকটা আসলে হাতির দাঁতের শৌখিন জিনিসের কারবারি। নাম সরফরাজ আলি। রইস আদমী। উট দুটো তারই, পথে কেনা হয়েছে। আর পনেরো জন লোক তার সঙ্গী। হাতির দাঁতের জিনিসের পসরা নিয়ে তারা কানপুর থেকে আসছে। জব্বলপুর হয়ে যাবে তারা ঔরাঙ্গাবাদ। আর ওই তিনজন বাঙালি মণিকারের সঙ্গে আছে বন্দুকধারী দুজন সহ আরও দুজন লোক আর খচ্চরগুলো। তাদের গন্তব্যস্থল জব্বলপুর হয়ে সোজা ভোপাল। অর্থাৎ জব্বলপুর থেকে দুটো দল দুদিকে ভাগ হয়ে যাবে। যেটা চাইছে এনায়েতরা। জহরত ব্যবসায়ীদের দলপতির নাম ভগবান দাস। সে আদতে ময়মনসিংহ জেলার মানুষ। আজ সকালেই দুটো দলের দেখা হয়েছে, তারপর তারা একসঙ্গে যাচ্ছে।

পরদিন সকালে যখন আবার তাঁবু উঠিয়ে সরফরাজ আলি আর ভগবান দাসের দল পথে নামল ততক্ষণে তাদের দলের লোকজনের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে এনায়েতদের। ঠিক ভাবে চললে দু-দিনের মধ্যেই তাদের জব্বলপুর পৌঁছে যাওয়ার কথা। এনায়েতরা ঠিক করেছে তারা জব্বলপুর ঢুকবে না, শহরটা বেড় দিয়ে নর্মদার পাড় ধরে ভূপালের রাস্তায় উঠে আবার অনুসরণ করবে জহরত ব্যবসায়ীদের। জব্বলপুর ছাড়বার পর নরসিংহপুর জেলা। সেখানে নরসিংহপুর শহর পর্যন্ত রাস্তা জনমানবহীন। এনায়েতরা তাদের কাজ সেরে নিতে পারবে।

সাত

ব্যবসায়ীদের পিছন পিছন এনায়েতরা চলতে লাগল খুব স্বাভাবিক ভাবেই। পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করার জন্য পথিকরা যেমন করে ঠিক তেমনই ওরা নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখের গল্প করছে, হাসিঠাট্টা করছে, কখনও আবার গান করছে। কে বলবে তাদের মনে অন্য কোনও অভিসন্ধি আছে। বরং ব্যবসায়ীদের দলের মধ্যে ওই বন্দুকধারী লোক দুজন সহ আরও এমন বেশ কয়েকজন আছে, যাদের দেখে সন্দেহ হতে পারে অন্য লোকদের।

শুধু চলার পথে একটা দলই একটু ভ্রু কুঁচকে ছিল এনায়েতদের দেখে। সে দলের একজনের ঠোঁটের এক কোণে একটা ক্ষীণ হাসিও যেন ফুটে উঠেছিল তাদের দেখে। জনা কুড়ি লোকের সে দলটা আসছিল উলটোদিক থেকে। পুরুষদের সঙ্গে মহিলা-বাচ্চাকাচ্চারাও ছিল। তাদের পরনে নোংরা পোশাক। এক গাদা কুকুর, বাঁদর, চোখে ঠুলি পরানো বাজপাখি আর খচ্চরের পিঠে শতছিন্ন ময়লা তাঁবু। ব্রিনজার বা বেদেদের দল। শহর-গ্রামে ঘুরে ঘুরে তারা খেলা দেখায়, সুযোগ পেলে চুরিটুরিও করে। ঠগিদের সঙ্গে তাদের পুরোনো সম্পর্ক। দু-দলই এ দেশের প্রাচীন পথিক। এই বিরাট ভারতবর্ষের পথের ধুলো মেখে ঘুরে বেড়ায় উভয়ই। কোনও কোনও ঠগিরা তাদের কাছে পথিকের লুণ্ঠিত মালপত্র বিক্রি করে। নিরাপত্তার কারণে সাধারণত ঠগিরা শহর বা গঞ্জে গিয়ে সে সব মাল বিক্রি করে না।

তবে এই বেদেদের আসল কারবার অন্য। তারা শিশু চুরি করে, শিশু কেনাবেচা করে। এখনও এ দেশের কোনও কোনও জায়গাতে নরবলি হয়। রাজা-জমিদারের লোকজন বেদেদের তাঁবুতে এসে বাচ্চা ছেলে কিনে নিয়ে যায় তাদের পারিবারিক মন্দিরে বলি দেওয়ার জন্য। কোনও সময় আবার বর্ধিষ্ণু লোকেরা বাচ্চা ছেলে কিনে মাটির তলায় চোরাকুঠুরিতে তাদের যখ করে সম্পদ আগলাবার জন্য। ছোট মেয়েদের কেনা হয় নবাব হারেমে দাসীবাঁদি করার জন্য। কানপুর আর জয়সলমীরে দুটো বড় আড্ডা আছে ব্রিনজারদের। রতনে রতন চেনে, সে জন্যই হয়তো এনায়েতদের দিকে তাকিয়েছিল তারা।

সারাটা দিন চলার পর সন্ধ্যা নাগাদ ব্যবসায়ী ও এনায়েতদের পুরো দলটা এসে উপস্থিত হল রাস্তার পাশে একটা পরিত্যক্ত খণ্ডহর প্রাসাদের সামনে। বড় বড় শহরের কাছাকাছি এ ধরনের পরিত্যক্ত প্রাসাদ মাঝে মাঝেই দেখা যায়। হয়তো কোনও দেশীয় জমিদার, রাজা বা নবাব কোনওদিন বানিয়েছিল এসব প্রাসাদ। আসলে এগুলো ছিল তাদের আমোদ-প্রমোদের জায়গা। তারপর কোম্পানির হাতে হয়তো তাদের জমিদারি গেছে, অথবা বিদ্রোহী প্রজারাই লুটে নিয়েছে তাদের সম্পত্তি, এখন এই খণ্ডহর প্রাসাদগুলোই শুধু তাদের সোনালি দিনের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতে এসব প্রাসাদ এখন ভিনদেশী পথিকদের আশ্রয়স্থল, অথবা ঠ্যাঙারেদের আড্ডা। অনেক জনশূন্য মহল সে প্রাসাদে।

সরফরাজ আলি আর ভগবানদাস মিলে আলোচনা করে সেই প্রাসাদেই রাত্রিবাসের সিদ্ধান্ত নিল। প্রাসাদের ভিতরে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে রাত কাটাবার ব্যবস্থা করল এনায়েতরাও। এ ধরনের প্রাসাদে অনেক সময় লুকোনো ধনসম্পদ মেলে বলে শোনা যায়। তাই রাতের খাওয়া শেষে এনায়েতদের দলের কয়েকজন লোক মিলে মশাল জ্বালিয়ে তল্লাশি চালাল প্রাসাদের কোথাও কোনও জিনিসের সন্ধান পাওয়া যায় কি না তা দেখার জন্য। কিন্তু সেরকম কিছুই মিলল না। সূর্য ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই আবার যাত্রা শুরু হল।

জব্বলপুর আর একদিনের পথ। চলতে শুরু করার পরই মাঝে মাঝে এবার তাদের দেখা হতে লাগল অন্য পথিক দলের সঙ্গে। তাদের কেউ কেউ পুজোর মরসুমে সারা বছর পরে ঘরে ফিরছে, কেউ বা আবার পুবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটা ছোট দলও ছিল, রাস্তা বদলে এনায়েতরা অবশ্যই পিছু নিতে পারত। যেমন কোথাকার এক গোমস্তা, দুজন চাকরের মাথায় ভারী ভারী দুটো বাক্স চাপিয়ে তার দেশে যাচ্ছে। সঙ্গে কোনও লোক নেই, সেই চাকর দুজন ছাড়া। শিকার হিসাবে তারা আদর্শ। কিন্তু এনায়েতরা পিছনে ফিরল না। রাস্তায় নামলে গন্তব্যে না পৌঁছে পিছনে ফিরতে নেই। এটা ওদের প্রাচীন সংস্কার। লোকটাকে দেখে এনায়েত শুধু চাপাস্বরে দুর্গাকে বলল,—মনে হয় ফেরা হবে না ওর। আমাদের মতো কেউ নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

পথে নামলে এনায়েতরা আরও অনেক সংস্কার মেনে চলে। যে কারণে যাত্রাপথে সব সময় চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। দিনের বেলা তাদের যাত্রাপথে হঠাৎ যদি শেয়াল বা পেঁচার ডাক কানে আসে, অথবা তারা যদি দেখতে পায় পথের বাঁ-পাশের কোনও মরা গাছের ডালে কোনও দাঁড়কাক বসে ডাকছে, অথবা খরগোশ তাদের রাস্তা কাটছে তবে এ ব্যাপারগুলোকে প্রচণ্ড অশুভ মনে করে সঙ্গে সঙ্গে যাত্রা থামিয়ে দেয় তারা। তাতে যদি শিকার ফসকায় তো ফসকাক। সেদিনের মতো আর এক পা নড়বে না ঠগির দল। আবার রাস্তার ডানপাশে গাছের ডালে যদি ঘুঘু বা হাড়িচাঁচা দেখা যায়, বাঘ যদি তাদের রাস্তা কাটে বা রাস্তার মোড়ে যদি সাপের শঙ্খ লাগা চোখে পড়ে তা হলে আবার সে ব্যাপারগুলো প্রচণ্ড শুভ। এরকম নানা সংস্কারে বিশ্বাসী ঠগিরা।

সূর্য তখন সবে মাথার ওপর উঠেছে। একটা নদীর ঘাটে এসে উপস্থিত হল পুরো দলটা। বেশ বড় ঘাট, নানা জাতের লোকজন সেখানে। নদীটা শোনের এক শাখানদী, এখানে এসে মিশেছে নর্মদার এক শাখার সঙ্গে। অনেক নৌকো ভাসছে নদীর জলে। নদীর পাড় ধরে হাতির দাঁতের কারবারি আর ঢাকার ব্যবসায়ীদের যাত্রাপথ। নদীর ঘাটে উপস্থিত হতেই একদল মাল্লা এসে ঘিরে ধরল। জহরত ব্যবসায়ীদের তারা খচ্চর সমেত নদীপথে জব্বলপুরে পৌঁছে দিতে চায়। তাতে সময় অনেক কম লাগবে। ঢাকার ব্যবসায়ীরা ভাবতে লাগল তারা কী করবে। সরফরাজের দলের সঙ্গে বাকি পথটুকু পদব্রজে যাবে, নাকি জলপথে পাড়ি দেবে?

মাঝিগুলো যে ভাবে ঢাকার ব্যবসায়ীদের নৌকায় ওঠার জন্য পিড়াপিড়ি করছে তা দেখে কেমন যেন সন্দেহ হল এনায়েতদের। দীনু হঠাৎ সর্দার মাঝিটার কানের কাছে গিয়ে বলল, ‘আউলে ভাই রাম রাম!’ কী আশ্চর্য, সেই মাঝির মুখ থেকেও বেরিয়ে এল একই কথা—’আউলে ভাই রাম রাম!’

বেশ কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল দুজন। তারপর সে লোকটা দীনুকে একটু আক্ষেপের সুরে বলল,—বরাত খুব খারাপ যাচ্ছে ভাই। ভবানীর আশীর্বাদে পথে যদি বড় কিছু দাঁও মারতে পারো তবে ফেরার পথে আমাদের কথা একটু মনে রেখো।

হঠাৎই যেন এরপর মাঝিরা জহরত ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দিয়ে এক মুসলমান হিং-এর কারবারিকে নিয়ে পড়ল।

আসলে ওই মাঝিরা ছিল জলের ঠগি বা ভাঙ্গু। বাংলাদেশে ওদের বলে ‘ভাগিনা।’ পথিককে ভুলিয়ে ওরা নৌকোয় তোলে, তারপর নির্জন জায়গাতে নদীপথে তাদের খুন করে। ওদের সবচেয়ে বড় আড্ডা গঙ্গাসাগরে। গঙ্গাপথে ওদিকে ওদের ইলাহাবাদ পর্যন্ত যাতায়াত। ইদানীং মধ্য ভারত হয়ে দক্ষিণ ভারতের দিকেও এগোচ্ছে তারা। ভাঙ্গুরাও মানুষ খুন করার জন্য রুমালের ফাঁস ব্যবহার করে, তাদের কর্মপদ্ধতির কিছু পার্থক্য আছে। ভাঙ্গুরা নৌকোয় পথিকদের হত্যা করবে ঠিকই, একবিন্দু রক্তপাত হতে দেয় না নৌকোতে। সেটা নাকি ভয়ঙ্কর অমঙ্গলসূচক। এনায়েত দুর্গারা ঝিরনী দেয় ‘পান লাও’, ‘তামাকু লাও’ বলে। আর তারা ঝিরনী দেয় নৌকোর পাটাতনে তিনবার বৈঠা ঠুকে ঠক-ঠক করে।

এনায়েত-দুর্গারা গাব্বা খুড়ে দেহ কবর দেয়, ভাঙ্গুরা জলে ফেলে দেয় দেহ। তবে যাতে লাশ ভেসে না ওঠে তার জন্য জলে লাশ ফেলার আগে একটা কাণ্ড করে তারা। লাশটাকে নৌকোর পাটাতনে ফেলে পিঠের ওপর হাঁটু দিয়ে চেপে কাঁধ দুটোকে পিছনে টেনে ধরে মৃত মানুষের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া হয়। এনায়েত একবার শুনেছিল শিরদাঁড়া ভাঙার সেই বীভৎস মটমট শব্দ। ন’শো জনকে ঝিরনী দেওয়া এনায়েতেরও বুক কেঁপে উঠেছিল সে শব্দ শুনে।

ঘাটের পাড় বেয়ে আবার চলতে শুরু করল সবাই। বহু লোকের আনাগোনা এ পথে। পায়ে হেঁটে তো বটেই, গরুর গাড়ি, ঘোড়া, উটের পিঠেও চলেছে অনেকে। মাঝে মাঝে কোম্পানির লোক বা ফিরিঙ্গি সেপাইও চোখে পড়ছে। কাছে এগিয়ে আসছে জব্বলপুর। ওখানে কোম্পানির কুঠি আছে। রেসিডেন্সিও আছে। কাজেই এ পথে ফিরিঙ্গিদের আসা-যাওয়া স্বাভাবিক। এনায়েতরা আরও বেশি সতর্ক হয়ে পথ চলা শুরু করল। সন্ধ্যা নামার কিছু আগে তারা মেঠো রাস্তা ছেড়ে উঠে এল পাকা সড়কে। এ রাস্তা সোজা চলে গেছে পাঁচ ক্রোশ দূরে জব্বলপুরে।

এনায়েতরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে জব্বলপুরে তারা ঢুকবে না। ঢাকার জহরত ব্যবসায়ীদের থেকে আপাতত এখানেই বিদায় নেবে তারা। তারপর শহরটাকে অর্ধচন্দ্রাকারে বেড় দিয়ে ভূপালের পথে উঠবে। ও পথে উঠতে তাদের দু-দিন সময় লাগবে, কিন্তু জহরত কারবারিরা সোজাসুজি গিয়ে একদিনেই উঠে পড়বে সে পথে। তাতে অসুবিধা কিছু নেই। জব্বলপুর থেকে নরসিংহপুর যেতে তিনদিন সময় লাগে। তার মধ্যে এনায়েতরা নিশ্চয়ই ধরে ফেলবে তাদের।

পাকা সড়কে উঠেই এনায়েত সোজা গিয়ে হাজির হল ভগবান দাসের সামনে। তাকে প্রণাম জানিয়ে এনায়েত বলল,—হুজুর আমরা আপনাদের সঙ্গে জব্বলপুর ঢুকব না। আমাদের কাছে সরকারি কোনও কাগজপত্র নেই। কাস্টমস হাউসের লোকদের তো আপনারা জানেনই। পয়সার জন্য নিরীহ পথিকদের ওরা হয়রান করে। আমরা ঘুরপথে ভূপাল যাওয়ার পথে গিয়ে উঠব। ও পথে দেখা হলে হুজুরদের কৃপা থেকে যেন বঞ্চিত না হই।

তিনদিন ধরে এনায়েতদের দেখছে ভগবান দাস। এ লোকগুলোর মধ্যে সে বেচাল কিছু দেখেনি। সে বলল,—হ্যাঁ, যদি দেখা হয় তবে আবার তোমরা আমাদের সঙ্গে যেও।

তার সঙ্গী বন্দুকধারী দুজনও হাসল। এনায়েতদের প্রতি বিশ্বাস জন্মে গেছে তাদেরও।

‘হুজুরের মেহেরবানি।’ এই বলে ভগবানদাসকে সেলাম ঠুকে নিজেদের রাস্তা ধরল এনায়েতরা। আর ভগবান দাস, হাতির দাঁতের কারবারি এরা সব সোজা জব্বলপুরের পথ ধরল।

অন্ধকার নামার পরও সেদিন অনেকক্ষণ হাঁটল এনায়েতরা। রাতে তারা আশ্রয় নিল একটা ছাগলের খামারে। মালিকের মাংসের দোকান আছে জব্বলপুর শহরে। মোস্তাফা তার সঙ্গে ভাব জমিয়ে বেশ কিছু খবর সংগ্রহ করল তার কাছ থেকে। শহরের খবর। রেসিডেন্সিতে নাকি ‘স্লিম্যান’ নামে এক খ্যাপাটে সাহেব এসেছে কিছুদিন হল। সে তাঁর ঘোড়া নিয়ে সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। তবে লোকটা নাকি ভালো। নর্মদার তীরে নাকি লোকটা পুরোনো দিনের প্রাণীর হাড়গোড় খুঁজে বেড়ায়। দু-দিন ধরে রেসিডেন্সিতে নাকি মেলা লোকজন যাচ্ছে। কোম্পানির ফৌজে তারা নাকি নাম লিখিয়েছিল কিছুদিন আগে। এখন তাদের সেখানে পাঠানোর কাজ চলছে।

পরদিন সকালে তারা নর্মদার কাছে পৌঁছে তার পাড় ধরে চলতে শুরু করল। এদিকটা প্রায় জনমানবহীন পাথুরে পথ। লোকজনের তেমন আনাগোনা নেই, জঙ্গল আছে। দূরে দূরে বেশ কয়েকটা গ্রাম। নদী তটে এক সাধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল এনায়েতদের। তপভূমি নর্মদা। সন্ন্যাসীরা এখানে তপস্যা করতে আসেন। ছাই-ভস্ম মেখে এক নগ্ন সাধু বসে আছেন পাথরের ওপর। মোস্তাফা তাঁর সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য এগোতেই সাধু তাঁর পাশে রাখা তলোয়ারটা এমন ভাবে তুলল যে মোস্তাফা আর তাঁর দিকে এগোতে সাহস পেল না।

দুদিন ধরে নদীর পাড় ধরে হাঁটার পর তারা উঠে এল সেই রাস্তায়। যে রাস্তা জব্বলপুর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেছে ভূপালের দিকে। জহরত ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই একদিন আগেই এ পথ ধরেছে। এনায়েত বলল,—তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলতে হবে এবার। যে ভাবেই হোক নরসিংহপুরের আগে তাদের ধরতে হবে।

দুপুর নাগাদ তারা উঠেছিল সেই রাস্তায়, এক সময় সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে গেল, অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক, তারপর এক সময় চাঁদও উঠল। তারও বেশ কিছুক্ষণ পর এক জায়গাতে এসে থামল সকলে। রাস্তার পাশে একটা বিরাট মাঠ। মাঠের ঠিক মাঝখানে বেশ কয়েকটা শূন্য চালা। সম্ভবত কোনও হাট বসে এখানে। রাস্তার কাদা মাটিতে জেগে আছে গরুরগাড়ির চাকার দাগ, এখানে ওখানে পড়ে আছে পশুর নোংরা। তবে কোথাও কোনও লোকজনই নেই। শূন্য চালাগুলোর নীচেই রাত কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তারা। মাত্র তিন প্রহরের তো মামলা। তার পরই হাঁটতে শুরু করবে সকলে। যে গতিতে তারা চলছে তাতে আশা করা যায় অগ্রবর্তী ঢাকার ব্যবসায়ীদের দলটাকে আগামীকাল সন্ধ্যার মধ্যেই ধরে ফেলতে পারবে। সেই মতো শূন্য মাঠে আটচালার নীচে ঠাঁই নিল তারা। দলে কয়েকজন লেগে গেল চুলা জ্বালিয়ে রুটি পাকাবার কাজে। এনায়েত, দুর্গা, দীনু আর মোস্তাফা আলোচনায় বসল কী কৌশলে মণিকারদের দলটাকে ঝিরনী দেওয়া হবে তা ঠিক করার জন্য। সঙ্গে দুজন বন্দুকধারী আছে, তাই কাজটা বেশ সাবধানে করতে হবে।

কথা বলছিল চারজন, হঠাৎ কীসের একটা শব্দ পেয়ে তারা তাকিয়ে দেখল চাঁদের আলোতে ঘোড়ার পিঠে চেপে মাঠের মধ্যে দিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে একজন। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়াল সবাই। ঘোড়সওয়ার সোজা তাদের দিকে এগিয়ে এসে জানতে চাইল,—তোমরা কারা? কী করছ এখানে?

লোকটার কোমরে একটা তলোয়ার ঝুলছে। জমিদারের লোক হতে পারে। হয়তো তার পিছনে পাইকরা এখনই এসে পড়বে। দুর্গা হাতজোড় করে বলল,—হুজুর আমরা পথিক। দূর দেশে থাকি। কাজের সন্ধানে ভূপাল যাচ্ছি। আপনি?

দীনু মশালটা তুলে ধরল একটু ওপর দিকে। আগন্তুকের মুখটা এবার দেখা গেল। লোক না বলে তাকে ছেলে বলাই ভালো। সম্ভবত কুড়ি-একুশ বয়স হবে তার। সুন্দর মুখশ্রী, উজ্জ্বল চোখ, ছিপছিপে চেহারা। সে জবাব দিল,—আমাকে তোমরা কোম্পানির লোকই ধরতে পারো। ফৌজে চাকরি হয়েছে। জব্বলপুর রেসিডেন্সিতে কাজে যোগ দিতে যাচ্ছি। তাই বলে সে লাফ দিয়ে নামল ঘোড়া থেকে। একটা অস্পষ্ট ঝনঝন শব্দ কানে এল। এনায়েতের শ্বাপদের কান, লোকটার গেঁজেতে নিশ্চয়ই কিছু আছে। আর দুর্গা সেই মুহূর্তে দেখতে পেল মশালের আলোতে ঝিলিক দিচ্ছে লোকটার কানের সোনার মাকড়ি। এনায়েত আর দুর্গার মধ্যে নিঃশব্দে একবার দৃষ্টি বিনিয়ম হল। লোকটা বেশ পরিশ্রান্ত। কোন ভোরে সে বেরিয়েছে নর্মদা তীরের এক গ্রাম থেকে। পথে একবারের জন্যও থামেনি। পথ চলতে চলতে আটচালার নীচে লোক দেখে সে একটু জিরোবার জন্য এসেছে। ঘোড়া থেকে নেমে লোকটা বলল,—একটু জল পাওয়া যাবে?

মোস্তাফা সঙ্গে সঙ্গে লোটা ভরতি জল এনে তুলে দিল তার হাতে। বেশ পরিতৃপ্তির সঙ্গে জলপান করল লোকটা।

ওইটুকু সময়ের মধ্যেই যেন এনায়েতের চোখের দিকে তাকিয়ে সবাই জেনে গেল এ লোকটার ভাগ্যে কী লেখা আছে। দুর্গা শুধু একবার তাদের সাংকেতিক ভাষা রামসীতে জিগ্যেস করল, ‘বিছানা কোথায় পাতা হবে?’

এনায়েত মুখে তার কথার জবাব না দিয়ে একবার তাকাল মাঠের শেষ প্রান্তে রাস্তার ধারে যে প্রাচীন বট গাছটা দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে। দুর্গা তার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল।

জল পান করার পর লোকটা জিগ্যেস করল,—কত দূর থেকে আসছ? তোমার দেশ কোথায়?

—বাংলাদেশ। জবাব দিল দীনু।

লোকটা একটু বিস্মিত ভাবে বলল,—বাংলাদেশ! সে তো বহুদূরের পথ। আমি সে দেশের গল্প শুনেছি। কালীঘাটের কথাও শুনেছি। মা’র মন্দির আছে। ফৌজে যখন চাকরি নিলাম, তখন হয়তো সে দেশে কোনও একদিন যাব। ফিরিঙ্গিরা তো সেখান থেকেই সারা দেশ শাসন করত।

‘কালীঘাট’ শব্দটা শুনে মুহূর্তের জন্য একবার চমকে উঠেছিল এনায়েতরা। দুর্গা শান্ত স্বরে বলল,—হ্যাঁ, সে দেশে মা ভবানীর মন্দির আছে। তিনি খুব জাগ্রত দেবী। আমাদের সবার রক্ষাকর্তা। এই বলে কপালে হাত ছোঁয়াল সে। লোকটাও বলল,—হ্যাঁ, দেবী খুব জাগ্রত বলে আমিও শুনেছি।

কথাটা বলে তার ঘোড়ার পিঠে একটা চাপড় মেরে লোকটা আবার ঘোড়ায় উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু এনায়েত বলে উঠল,—হুজুরের কাছে আমাদের একটা অনুরোধ আছে। এখানে দাঁড়ালেনই যখন তখন আমাদের গরিবের রুটি একটু মুখে দিয়ে যান। গরিবের আর্জি। আর তো দেখা হবে না হুজুরের সঙ্গে। এনায়েতের গলায় আন্তরিকতার ছোঁয়া।

এনায়েত বারবার হুজুর শব্দটা ব্যবহার করায় বেশ খুশি হল অল্পবয়সি লোকটা। সে কোম্পানির সৈন্য হতে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের চোখে সে হুজুরই তো বটে। গর্বে ফুলে উঠল তার বুক। কিছু দূরে চুলাতে রুটি সেঁকা হচ্ছে। গরম গরম রুটি! বাতাসে রুটির গন্ধ ভাসছে। খিদেও পেয়েছে তার। দুটো রুটি নয় খাওয়াই যাক। তাতে পেটও ভরবে, পথিকদের অনুরোধ রক্ষাও হবে। মাথা নেড়ে লোকটা সম্মত হয়ে গেল তাদের প্রস্তাবে।

দীনু তাড়াতাড়ি একটা ছোট মাদুর এনে বিছিয়ে দিল আটচালার নীচে। লোকটা তার তলোয়ারটা খুলে পাশে রেখে বসল। আর দীনু তার পাশে বসে কথা বলা শুরু করল। একটু পরেই থালায় করে রুটি আনল একজন। গরম গরম রুটি! কী তার স্বাদ! কথা বলতে বলতে খেতে শুরু করল লোকটা। প্রথম রুটিটা খেয়ে দ্বিতীয় রুটিটা সে সবে মুখে তুলেছে, সঙ্গে সঙ্গে এনায়েত ঝিরনী দিল, ‘হুজুরকে লিয়ে তামাকু লাও!’

একটা অস্পষ্ট আর্তনাদ আর হাত থেকে রুটির থালাটা ছিটকে পড়ার একটা শব্দ হল শুধু। নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে গেল তার দেহ। রুমালের ফাঁসটাকে মজবুত করার জন্য তার গিঁটে একটা রুপোর গোল টাকা বেঁধে রাখে এনায়েতরা। সেই ধাতব চাকতিটা চেপে বসেছে কণ্ঠনালীতে।

সোনার মাকড়ি দুটো ছাড়াও লোকটার গেঁজ থেকে নগদ পনেরো টাকা মিলল। এ ছাড়া তালোয়ারের হাতলে একটা রুপোর পাত লাগানো ছিল। সব নিয়ে এনায়েতরা দেহটাকে কবর দিল রাস্তার পাশে বটগাছের নীচে। আর এখানে থাকা চলে না। ঘোড়াটা সঙ্গে নিয়েই তারা আবার পথে নামল। কয়েক ক্রোশ এগিয়ে একটা জঙ্গলের ধারে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে আবার চলতে শুরু করল। সেই হাটের মাঠ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল তারা। মাঠের মাঝে শূন্য সেই আটচালার বাতাসে পাক খেতে লাগল হতভাগ্য লোকটার রুটির থালা ছিটকে পড়ার সেই শব্দ, যা শুধু বাতাসই শুনতে পারে।

আট

ক’দিন খুব কাজের চাপ গেছে ক্যাপ্টেন স্লিম্যানের। সগর থেকে খবর এসেছিল দ্রুত ফৌজ পাঠাতে হবে সেখানে। ভিলেদের সঙ্গে কোম্পানির আর জমিদারের বিবাদ বেঁধেছে। বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে ভিলেরা। অস্থায়ী সেনা নিয়োগের জন্য নাম লেখানো আগেই হয়ে গেছিল। ঢেঁড়া পিটিয়ে সে সব লোকগুলোকে জোগাড় করা হয়েছে। স্লিম্যানের সহকারী সিমসনের নেতৃত্বে আজ ভোরবেলাই সগরের পথে রওনা হয়েছে সেই অস্থায়ী সেনাদল। কাজ শেষ হয়েছে স্লিম্যানের। তবে উদ্ভট ভাষায় কথা বলার অভ্যাসটা যায়নি স্লিম্যানের। যারা এর মধ্যে তার কুঠিতে এসেছিল ফৌজে যাওয়ার জন্য, তাদের মধ্যে অচেনা বেশ কিছু লোককে স্লিম্যান সম্বোধন করেছেন, ‘আউলে ভাই রাম রাম’ বলে। লোকগুলো সে কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সাহেবের দিকে। কেউ প্রত্যুত্তরে জবাব দিয়েছে শুধু ‘রামরাম’ বলে। কেউ আবার আড়ালে-আবডালে হাসাহাসি করেছে, বলছে—’সাহেব দেখছি সত্যি পাগল। কী সব উদ্ভট কথাবার্তা বলে!’

বেশ ক’দিন কুঠির বাইরে একদম পা রাখা হয়নি। মনটা হাঁফিয়ে উঠেছে স্লিম্যানের। সগরের উদ্দেশ্যে লোকগুলোকে রওনা করে দিয়ে স্লিম্যান তাঁর কুঠি ছেড়ে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। বেশ সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। কুঠিতে থাকলে স্লিম্যানের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। বাইরের পৃথিবীটা কত সুন্দর! দুলকি চালে ঘোড়া চালাচ্ছেন সাহেব। রাস্তায় পরিচিত লোক দেখলে মাথা নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন। চলতে চলতে রাস্তার পাশে একটা জটলা দেখে কৌতূহলবশত সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন সাহেব। আলোচনার বিষয়বস্তুটা জানতে পারলেন সাহেব। একটু আগে একদল ঘোড়সাওয়ার রেশম ব্যবসায়ী এ পথ ধরে গেছে। ভূপালের দিকের রাস্তা ধরে এদিকে এসেছে। সে লোকগুলো বলে গেছে শহরের বাইরে চারক্রোশ দূরে ভূপাল যাওয়ার রাস্তার পাশে যে গোহাট আছে, সেখানে মাটির তলা থেকে একটা টাটকা লাশ বেরিয়েছে! কেউ বলছে কাজটা ধুতুরিয়াদের, কেউ বলছে ঠ্যাঙাড়েরা কাজটা করেছে।

কিন্তু ধুতুরিয়া বা ঠাঙাড়েরা তো মাটিতে লাশ পোঁতে না? মাটির তলাতে লাশ উদ্ধার হয়েছে শুনেই সাহেব ঘোড়া ছোটালেন সেদিকে।

জায়গাটা আসলে গোহাট। আজ রোববার হাটবার। আশেপাশে বেশ কিছু গ্রামের লোকজন এদিন হাটে গরু-মহিষ কেনাবেচা করতে আসে। হাঁস-মুরগি, অন্যান্য গৃহপালিত জীবও বিক্রি হয় হাটে। সাহেব সে জায়গাতে পৌছে গেলেন। রাস্তার পাশে একটা প্রাচীন বটগাছের তলায় বহু মানুষের ভিড়। সাহেবকে দেখে সবাই পথ করে দিল তাকে। জটলার ভিতর দিয়ে গিয়ে তিনি গাছের তলায় নামলেন। একজন জমাদার আর তার অধীনস্থ কোম্পানির দুজন সেপাইও ইতিমধ্যে উপস্থিত হয়েছে সেখানে।

গাছের তলায় একটা গোলাকার গর্ত খোঁড়া। সাহেব ঘোড়া থেকে নামতেই একজন লোক হাউমাউ চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘সাহেব আমি খুন করিনি। আমি কিছুই জানি না সাহেব। আমাকে ফাঁসি দেবেন না।’

জমাদার সাহেব আর সেপাই দুজন এবার কাছে এসে স্লিম্যানকে সেলাম ঠুকে সাহেবের পায়ে লুটিয়ে পড়া লোকটাকে উঠিয়ে তাঁর সামনে দাঁড় করাল। জমাদার সাহেব লোকটাকে ধমক দিয়ে বলল,—স্বয়ং ধর্মাবতার হাজির হয়েছেন এখানে। ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে না চাস তো হুজুরের কাছে সত্যি কথা খুলে বল। কেন তুই মাটি চাপা দিচ্ছিলি লোকটাকে? কেন খুন করলি ওকে?

লোকটা কাঁদতে কাঁদতে স্লিম্যানের উদ্দেশ্যে বলল,—হুজুর আমার মা-বাপ। সত্যি বলছি, আমি এ খুন করিনি। আমি বাজিকর। জীবন্ত কবরের খেলা দেখাই। খেলা দেখাবার জন্য এখানকার মাটি নরম বলে গর্ত খুঁড়ছিলাম। মাটি কাটতেই লাশ বেরিয়ে এল। আমি ভয় পেয়ে গিয়ে লাশটাকে আবার মাটি চাপা দিতে যাচ্ছিলাম, তখনই লোকজন ব্যাপারটা দেখে ফেলল। তারপর জমাদার সাহেবকে তারা ডেকে আনল।

স্লিম্যান এবার চিনতে পারল লোকটাকে। আরে এ তো সেই লোক। যার খেলা দেখে জব্বলপুর হাটে কিছুদিন আগেই তাকে বকশিশ দিয়েছেন স্লিম্যান।

জমাদার সাহেব বলে উঠলেন,—ও মিছে কথা বলছে হুজুর। ও-ই লোকটাকে খুন করে লাশটা গায়েব করতে যাচ্ছিল। হাটুরেরা দেখে ফেলায় আর পালাতে পারেনি।

জনতাও গুঞ্জন করে উঠল জমাদার সাহেবের সমর্থনে। স্লিম্যান এরপর অপেক্ষমান জনতার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,—খুনটা করতে কারা কারা দেখেছ? দিনের বেলা এখানে এত লোকজনের আনাগোনা। খুনটা নিশ্চয়ই হতে দেখেছ তোমরা?

এবার গুঞ্জন থেমে গেল। দুজন লোক শুধু বলল,—তারা গর্ত খুঁড়তে দেখেছে। আর তার ভিতর লাশটাকে দেখেছে।

স্লিম্যান এরপর জিগ্যেস করল,—তবে কি লাশটাকে বয়ে আনতে দেখেছ?

জনতা এবারও নিশ্চুপ। লাশটাকে কেউ বয়ে আনতে দেখেনি।

স্লিম্যান এরপর এগিয়ে গেলেন গর্তটার কাছে। গোলাকৃতি একটা গভীর গর্ত। তার নীচে অর্ধেক মাটি চাপা অবস্থায় পড়ে আছে এক যুবকের মৃতদেহ। স্লিম্যান বেশ খুঁটিয়ে দেখলেন গর্তটা। মনে মনে তার মাপ-ঝোক করলেন। তারপর লাশটা গর্ত থেকে তুলতে বললেন। বাজিকর আর সেপাই দুজন মিলে লাশটা ওপরে তুলে আনল। বাজিকরকে দাঁড় করিয়ে রেখে জনতাকে হটিয়ে দিলেন তিনি। তারপর ঝুঁকে পড়লেন মৃতদেহের ওপর। ভালো করে লাশটাকে দেখার পর নিজেরই যেন উত্তেজনায় দমবন্ধ হওয়ার উপক্রম হল স্লিম্যানের। মৃতদেহর মুখটা একপাশে ফেরানো। তার গলাটা যেন কেমন লম্বাটে দেখাচ্ছে। আর সেই গলায় আঁকা হয়ে আছে ফাঁসের দাগ! এক ইঞ্চি চওড়া স্পষ্ট একটা কালো দাগ। স্লিম্যান সাহেব আজ এতদিন পর নিশ্চিত হলেন সামান্য গল্পগাথার সূত্র ধরে তিনি যাদের সন্ধান করছিলেন, তারা নিছক আলেয়া নয়, তারা সত্যিই আছে! ঘটনাচক্রে এই বাজিকর গর্ত খুঁড়েছিল বলে সত্য উদঘাটিত হল। যে সত্যকে হাজার হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছিলেন ভবানীর আজ্ঞাবাহীরা।

সাহেব এরপর দেহটার তল্লাশি নিতে বললেন।

কোনও দামি জিনিস পাওয়া গেল না তল্লাশিতে। শুধু তার পোশাকের ভিতর থেকে বেরল একটা কাগজের টুকরো। সেটা হাতে নিয়েই আরও চমকে উঠলেন স্লিম্যান। আরে এটা তো তাঁর দেওয়া ফৌজে চাকরির সেই নিয়োগপত্র! যেটা তিনি কিছুদিন আগে তুলে দিয়ে এসেছিলেন নদী পাড়ের বৃদ্ধের হাতে। ছেলেটা যে আসেনি তা আর নানা ব্যস্ততার মধ্যে স্লিম্যান খেয়াল করতে পারেননি। ছেলেটা এখন পড়ে আছে, তাঁর সামনে! গলায় তার রুমালের ফাঁস আঁকা হয়ে আছে!

বেশ কিছুক্ষণের জন্য স্লিম্যান হতভম্ব হয়ে গেছিলেন। তারপর সেই বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে উঠে ভাবতে শুরু করলেন তাঁর কী করা উচিত? লাশের গলায় যেমন ফাঁসের দাগ আছে, তেমনই নিশ্চয়ই যারা ফাঁসটা পরিয়েছিল তারাও কোথাও আছে। দেখে যতদূর অনুমান হচ্ছে তাতে লাশটা খুব বেশি হলে একদিনের পুরোনো। তেমন পচন ধরেনি লাশটাতে। একদিনে কত দূরত্ব অতিক্রম করবে তারা? স্লিম্যানের কেন জানি মনে হল, যারা কাণ্ডটা ঘটিয়েছে তারা জব্বলপুর শহরের দিকে যায়নি। শহরে ঢোকার মুখে তাহলে তারা এই খুনটা করত না। শহরে নজরদারি বেশি বলে ধরা পড়ার সম্ভাবনাও বেশি। অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করেছেন স্লিম্যান। অপরাধী যত গোপনেই অপরাধ সংগঠিত করে থাকুক না কেন, তাদের মনে সবসময় ধরা পড়ার ভয় থাকে, লোকগুলো নিশ্চয়ই শহরের বাইরের পথই ধরেছে। তাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ ভূপালের দিকেই গেছে তারা। স্লিম্যান জমাদারকে হুকুম দিলেন নর্মদা পাড়ের গ্রামে গিয়ে ছেলেটার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে আসতে। আর সেই বাজিকরকেও তাঁর কুঠিতে আসতে বলে স্লিম্যান ঘোড়া ছোটালেন জব্বলপুরের কাস্টমস হাউসের উদ্দেশ্যে।

কাস্টমস হাউসে পৌঁছে স্লিম্যান দারোগাকে নির্দেশ দিলেন,—আমাকে যত দ্রুত সম্ভব খোঁজ এনে দিতে হবে কোনও ভিনদেশি পথিক দল গত দুদিনের মধ্যে ভূপালের পথ ধরে যাত্রা করেছে কি না? সাহেবের নির্দেশ পালনের জন্য তেজি ঘোড়ার পিঠে চড়ে তখনই কয়েকজন সেপাই রওনা হয়ে গেল ভূপাল সড়কের দিকে। আর স্লিম্যান সেখান থেকে নিজের কুঠিতে ফিরে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগলেন।

বেলা দুই প্রহরেই খবর এসে গেল। কাস্টমস হাউসের লোকেরা খবর নিয়ে এসেছে। ‘হ্যাঁ, হুজুর তিনটে ভিনদেশি পথিকের দল ওদিকে গেছে। পরশু হাতির পিঠে চেপে গেছেন এক ওমরাহ। সঙ্গে তাঁর সেপাই-সান্ত্রীও আছে। তার পাঁচ ক্রোশ পিছন পিছন যাচ্ছে বাংলাদেশের জহরতের কারবারি ও হাতির দাঁতের জিনিসের ব্যবসায়ীদের এক বড় দল। সঙ্গে তাদের বন্দুক আছে। আর তাদের এক দিনের তফাতে চলছে জনা পনেরো পুরুষের একটা দল। গরীব মানুষ তারা। সম্ভবত কাজের সন্ধানে তারা ভূপাল যাচ্ছে।’

স্লিম্যানের একবার মনে হল শেষের ওই দলটাকে গ্রেপ্তার করে জব্বলপুর ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। নরসিংহপুর জেলার শেষ সীমানা পর্যন্ত গ্রেপ্তারি পরওয়ানা রুজু করার ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু স্লিম্যান পরক্ষণেই ভাবলেন কী অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করবেন তিনি। যদি কোনও প্রমাণ না মেলে? হয়তো তারা সত্যি নিরীহ মানুষ। যদি তাদের বিরুদ্ধে হাতেনাতে কোনও প্রমাণ পাওয়া যেত…। ভাবতে লাগলেন স্লিম্যান। এরপর তিনি নিয়ে বসলেন এ তল্লাটের একটা ম্যাপ। নরসিংহপুরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সব রাস্তা খুঁটিনাটি ভাবে আঁকা আছে এই সামরিক ম্যাপটাতে। ম্যাপে চোখ রেখে তিনি হিসাব কষতে বসলেন কোন পথে, কত সময় পর্যন্ত যেতে পারে সেই পথিক দল? অন্য একটা চিন্তা তখন স্লিম্যানের মাথায় উঁকি দিচ্ছে।

নয়

সেই আটচালাকে পিছনে ফেলে সূর্য ওঠার আগেই সাত-আট ক্রোশ পথ এনায়েতরা পাড়ি দিয়ে ফেলল। ভোরবেলা তারা পৌঁছল একটা ছোট গ্রামে। রাস্তার পাশেই একটা কুমোরের দোকান। খুব দ্রুত তারা এ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য এনায়েতরা দাঁড়াল। তাছাড়া কিছু খবর নেওয়ারও ব্যাপার আছে। মোস্তাফা গিয়ে ঢুকল সেই কুমোরের দোকানে। তাকে সে জিগ্যেস করল,—এ পথে গতকাল কোনও ধুতি-পিরান পরা বাঙালি পথিকদলকে যেতে দেখেছ? তাদের সঙ্গে দুজন বন্দুকধারী লোক আর গোটা পাঁচেক খচ্চর আছে। আসলে আমরা ও দলেরই লোক, পথে পিছিয়ে পড়েছিলাম।

কুমোর বলল,—হ্যাঁ, দেখেছি তো। গতকাল বিকালে তারা এ পথ পেরিয়ে এগিয়েছে। তবে শুধু তারা ছিল না। সব মিলিয়ে দু-গন্ডা লোক ছিল। দুটো উটও ছিল।

তার কথা শুনে চমকে উঠল মোস্তাফা। তার মানে হাতির দাঁতের জিনিসের কারবারি মত বদল করে ঔরঙ্গাবাদ না গিয়ে ভূপালের দিকে যাচ্ছে। তাহলে এবার কী হবে?

মোস্তাফা বাইরে এসে এনায়েতদের খবরটা দিতেই চিন্তায় পড়ে গেল সবাই। জহরত ব্যবসায়ীদের পিছু ধাওয়া করে আসার পর শেষ পর্যন্ত কি শিকার ফসকে যাবে? যৌবনে এনায়েতরা একবার এই বিন্ধ্যাচলেই চল্লিশজনের এক তীর্থ যাত্রীর দলকে ঝিরনী দিয়েছিল। কিন্তু সেবার তারা নিজেরাই সংখ্যায় ছিল সত্তরজন। এনায়েত, কাদের শেখ আর নারায়ণ দাসের তিনটে দল একত্রে কাজটা করেছিল। কিন্তু মাত্র পনেরো জনের দল নিয়ে তো আর এতজনকে ঝিরনী দেওয়া যায় না! বেশ কিছুক্ষণ শলা করার পর দুর্গা আর এনায়েত দুজনেই বলল,—এতটা পথ যখন ওদের পিছনে এলাম তখন আরও ক’টাদিন দেখা যাক। এমনও হতে পারে নরসিংহপুর পৌঁছোবার পর হাতির দাঁতের কারবারি অন্য পথ ধরল। নরসিংহপুর থেকে বেশ ক’টা রাস্তা গেছে নানা দিকে। সেখান থেকে হাতির দাঁতের কারবারি হায়দারাবাদের পথও ধরতে পারে। তার পসরার বড় বাজার আছে সেখানে। সুতরাং আগের লক্ষ্যেই আবার চলতে শুরু করল সবাই। কিন্তু সামনেই যে তাদের জন্য এক অদ্ভুত ব্যাপার অপেক্ষা করছিল তা জানা ছিল না তাদের।

তখন সূর্য প্রায় মাথার ওপর। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে দ্রুত হাঁটছিল তারা। হঠাৎই এক পথের বাঁকে যেন মাটি ফুঁড়ে তাদের সামনে উঠে এল জনাদশেক অশ্বারোহী। তাদের মাথায় পাগড়ি, হাতে বল্লম, পিতলের বকলস আঁটা কোমরবন্ধে তলোয়ার ঝুলছে। এনায়েতদের পথ আটকে দাঁড়াল তারা। ব্যাপারটা কী? আসলে পথের এ অংশটা নেটিভ এস্টেটের আওতাভুক্ত। এই লোকগুলো হল সেই রাজা বা জমিদারের বরকন্দাজ। রাস্তার এ অংশে তাদের আইনই বলবত। তারা পারানি হিসাবে এনায়েতদের থেকে দাবি করে বসল একশো টাকা! এনায়েত বলল,—হুজুর আমরা গরিব মানুষ, একশো টাকা কোথায় পাব?

বরকন্দাজদের সর্দার বলল,—টাকা দিতে না পারলে চল তাহলে তিনদিন জন খেটে দিবি।

দুর্গাপুজো আসছে। কাজকর্মের জন্য লোকের দরকার। সে জন্য আসলে মাগনা মজুর খুঁজতে বেরিয়েছে জমিদারের লোকজন। দুর্গা-এনায়েতদের বেশভূষা দেখলে যে-কোনও মানুষ বুঝবে তাদের একশো টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। আসলে টাকা চাওয়া অছিলা মাত্র, তারা মহালে ধরে নিয়ে যেতে চায় এনায়েতদের।

এ ঘটনা যে সময়ের তখন এক অরাজক পরিস্থিতি সারা দেশ জুড়ে। বাদশাহ বলে আমার রাজত্ব, জমিদার বলে আমার জমিদারি, আর কোম্পানি বলে আমিই আইন। আর এই তিনজনের জাঁতাকলে পড়ে নাভিশ্বাস উঠত নিরীহ পথিকদের। এনায়েত একবার ভাবল সে একটু দরকষাকষি করে কিছু টাকা তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়, কিন্তু তাতেও বিপদ আছে। লোকগুলোর মনে সন্দেহ হবে এতটাকা তাদের মতো চাষাভূষো লোক পেল কোথায়? তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় শুরু করল এনায়েতরা। কিন্তু তাতে কাজ হল না। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে লোকগুলো এক সময় দীনুকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর বল্লমের খোঁচা দিয়ে এনায়েতদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল মহলের দিকে।

রাস্তার এক ক্রোশ দূরে মাঠের মধ্যে বিরাট এক জমিদার বাড়ি। জমিদার অবশ্য শহরে থাকেন। দুর্গাপুজোর সময় এখানে আসেন। নায়েব আর বরকন্দাজদের হাতেই বাড়িটার ভার। সিংহদরজা দিয়ে এনায়েতদের বিশাল বাড়িটার ভিতর ঢুকিয়ে বরকন্দাজদের সর্দার বলল,—নায়েব জব্বলপুর গেছে। পরশু ফিরবে। তারপর তোদের নিয়ে যা করার তা করা হবে।

পরশু! তার মানে তিনদিন কয়েদ হয়ে থাকতে হবে এ বাড়িতে। তাহলে তো আর জহরতকারবারিদের ধরাই যাবে না! আলোচনায় বসল এনায়েতরা। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল সর্দার বরকন্দাজকে কিছু টাকা ঘুষ দিয়ে যদি মুক্তি পাওয়া যায় সেই চেষ্টাই করতে হবে। কিন্তু লোকটাকে পাওয়া গেল না। এনায়েতদের খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে সে লোকটা তখন অন্যত্র চলে গেছে। আটকে রইল এনায়েতরা। লোকটা যখন ফিরল তখন মাঝরাত। অস্থির হয়ে এনায়েতরা শুধু হিসাব করে চলেছে ব্যবসায়ীরা এ সময়ের মধ্যে কতটা পথ গেল।

বরকন্দাজ সর্দার ফিরে আসতেই এনায়েত আর দুর্গা গিয়ে তাকে ধরল। এনায়েত পঁচিশটা টাকা বার করে বলল,—হুজুর আপনি বরং এই টাকাটা রাখুন। আমাদের যেতে দিন। এ টাকার কথা আমরা কাউকে বলব না।

লোকটা ভেবে নিয়ে দেখল,—নায়েব নেই। টাকাটা নিজেই আত্মসাৎ করা যাবে। নইলে টাকাটা নায়েবের পেটেই যাবে। টাকাটা দিয়ে বরং ছেড়ে দেওয়া যাক লোকগুলোকে। তা ছাড়া আজ বিকালে এদিকে কোম্পানির একঝাঁক ঘোড়সওয়ার এসেছে। বলা যায় না, তারা হয়তো এ জমিদারির দখল নিতে এসেছে! এরকম ঘটনা তো প্রায়ই ঘটে। কাজেই এই লোকগুলোর ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা ভালো।

শেষ পর্যন্ত তিরিশ টাকায় রফা হল। মুক্তি পেল এনায়েতরা। শেষ রাতে আবার পথে নামল সবাই।

আর থামা নেই। জহরতের কারবারিদের থেকে আরও একদিন পিছিয়ে গেছে তারা। নিশ্চয়ই তারা এখন নরসিংহপুরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নরসিংপুরে ঢোকার মুখে চার-পাঁচ ক্রোশের একটা জঙ্গল আছে। চেনা পথ। এনায়েত-দুর্গা-মোস্তাফা-দীনু বহুবার এ পথে আগেও এসেছে। বছর পাঁচেক আগে একবার তারা এক গোমস্তা আর তার তিন সঙ্গীকে ঝিরনী দিয়েছিল নরসিংহপুরের জঙ্গলে। দুশো টিপুশাহী রুপোর টাকা মিলেছিল তার কাছে। যে পথ তারা পিছনে ফেলে এল, যে পথ ধরে তারা এগোচ্ছে, এই বিস্তীর্ণ পথে বহু বছর ধরে যাতায়াতের সুবাদে এনায়েতদের হাতের ছোঁয়ায় মাটির নীচে ঘুমিয়ে আছে বহু মানুষ। সে সব জায়গা বহুবছর পর দেখলেও চিনতে পারে এনায়েতরা।

চলতে থাকল সবাই। সারা দিন ধরে সামনে চলতে চলতে এনায়েতের কেন জানি মাঝে মাঝেই মনে হতে লাগল, এই যাত্রাপথে কেউ যেন আড়াল থেকে তাদের লক্ষ করছে! অথচ কোথাও কেউ নেই! চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে এনায়েতরা। চলতে চলতে কোনও ব্যাপারে সন্দেহ হলেই সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়াচ্ছে তারা। সামনে কোনও বিপদ নেই নিশ্চিত হলে তবেই এগোচ্ছে। এদিকে কাছেপিঠে কোনও লোকালয় নেই। রাস্তার পাশে শুধু বিস্তীর্ণ ঝোপঝাড়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল। তার পরই হঠাৎ চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সকলে। রাস্তার একপাশে নালা, অন্যপাশে জঙ্গল। কিছু দূরে সেই নালার ভিতর থেকে লাফিয়ে উঠে এল বিরাট এক কেঁদো বাঘ। বাঘ দেখা গেছে! শুভ সংকেত। এনায়েতরা বলে উঠল ‘জয় মা ভবানী’। দ্বিগুণ উৎসাহে চলতে শুরু করল সবাই। কিন্তু সন্ধ্যা নামার কিছু আগে আবার থেমে যেতে হল সবাইকে।

কিছু দূরেই নরসিংহপুরের জঙ্গল শুরু হয়েছে। একটা বাঁকের মুখে পৌঁছে এনায়েতরা দেখতে পেল, জঙ্গলে ঢোকার মুখটাতেই জনা কুড়ি লোক দাঁড়িয়ে আছে। এনায়েতদের থেকে বেশ দূরেই দাঁড়িয়ে তারা। কারা ওরা? পথিক? কোম্পানি বা জমিদারের লোক? নাকি তাদের মতোই কেউ? চট করে তাদের সামনে উপস্থিত হওয়া ঠিক হবে না। এনায়েতদের গত দিনের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। জমিদার বা কোম্পানির লোক হলে ফ্যাসাদে পড়তে হতে পারে। এদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। আলোচনা করে এনায়েতরা ঠিক করল তিলহাই মোস্তাফা আগে আবছা আলোতে গা ঢাকা দিয়ে দেখে আসুক ব্যাপারটা কী?

সেই মতো মোস্তাফা ঝোপের আড়াল দিয়ে এগিয়ে লোকগুলোর কাছাকাছি পৌঁছে গেল। জনা কুড়ি লোক। পরনে সাধারণ কাপড়, মাথায় পাগড়ি, খালি পা, সঙ্গে কিছু পোঁটলা-পুঁটলি। তাদের দেখলে সাধারণ গরিব পথিক বলেই মনে হয়, ঠিক যেমন দেখতে লাগে মোস্তাফাদের। কিন্তু তাদের মধ্যে দুটো লোককে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল মোস্তাফা। লোকগুলোর মধ্যে একজন ফিরিঙ্গি। তার পোশাক অবশ্য খুব সাদামাটা। কোম্পানির লোক বলে তাকে মনে হয় না। আর একজন লোক ‘নিয়ামতভিটু’ অর্থাৎ সম্ভ্রান্ত লোক বলেই মনে হয়। পরনে ফরসা ধুতি-পিরান, মাথায় পাগড়ি, পায়ে জুতো। তার হাতে একটা ছোট তোরঙ্গও আছে। ফিরিঙ্গি আর একজন বুড়ো লোক ফরসা কাপড় পরা লোকটাকে কী যেন বোঝাচ্ছে, আর আঙুল তুলে জঙ্গল সংলগ্ন ফাঁকা জমির মধ্যে একটা বিরাট বড় বটগাছের দিকে দেখাচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর ফিরিঙ্গি, নিয়ামতভিটু সমেত পুরো দলটা সেই গাছের তলায় গিয়ে বসল। মোস্তাফার দেখে মনে হল দলটা সেখানে রাত্রিবাসের উদ্যোগ নিচ্ছে। কয়েকজন লোক চুলা জ্বালাবার জন্য মাটিও খুঁড়ছে, কিন্তু কারা ওরা? আড়াল থেকে সব দেখতে লাগল মোস্তাফা। অন্ধকার নামল সেই বনপ্রদেশে। কিছুক্ষণের জন্য চারপাশের সব কিছু মুছে গেল। সেই সুযোগে মোস্তাফা পৌঁছে গেল তাদের আরও কাছাকাছি। একটা মশাল জ্বলে উঠল গাছ তলায়। মোস্তাফা দেখল সেই নিয়ামতভিটু গাছতলায় বসে একজন লোকের সঙ্গে গল্প করছে। আর তার কিছুটা তফাতে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই বুড়ো লোকটা। দলের অন্য লোকেরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নানা কাজকর্ম করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে সেই ফিরিঙ্গিটা নিঃশব্দে দাঁড়াল মাটিতে বসা তোরঙ্গওয়ালা লোকটার পিছনে।

মুহূর্তের জন্য ফিরিঙ্গিটাকে দেখে মোস্তাফার মনে হল, আরে এ তো তাদেরই ছবি! তার সেই চিন্তাটা কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাস্তব রূপ নিল। হঠাৎ বুড়োটা বলে উঠল, ‘বাবুকে লিয়ে হুক্কা লাও!’ আর সঙ্গে সঙ্গেই ফিরিঙ্গিটার রুমালের ফাঁস চেপে বসল নিয়ামতভিটুর গলায়। চারপাশ থেকে অন্য লোকরাও ছুটে এল সেদিকে। কিছুক্ষণের ছটফটানি। তারপর শেষ হয়ে গেল লোকটা। ফিরিঙ্গি আর বুড়ো লোকটা এরপর তার দেহ আর তার তোরঙ্গ হাতড়াতে শুরু করল।

অবাক হয়ে ব্যাপারগুলো দেখছিল মোস্তাফা। হঠাৎ তার পিঠে কে যেন হাত রাখল। চমকে উঠে পিছনে তাকাতেই সে দেখতে পেল এনায়েত আর দুর্গাকে। মোস্তাফার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে তারাও চলে এসেছে সেখানে। তারাও মোস্তাফার মতো দেখেছে ঘটনাটা। তাদের চোখেও বিস্ময়। ফিরিঙ্গি ঠগি? ব্যাপারটাতে কোনও ফাঁক নেই তো? কিন্তু তাদের চোখের সামনেই এরপর দেহটাকে তুলে নিয়ে গাব্বায় ফেলা হল। ঝপাঝপ মাটি ফেলা হতে লাগল সেই গর্তে। এনায়েতদের চোখের সামনেই কিছুক্ষণের মধ্যে মাটির নীচে হারিয়ে গেল নিয়ামতভিটু। ফিরিঙ্গি সহ এ লোকগুলো যে ঠগি, এ ব্যাপারে সন্দেহের আর কোনও অবকাশ রইল না এনায়েতদের।

এনায়েতদের এ পথ ধরে যেতে হলে এই ঠগি দলের সামনে দিয়েই যেতে হবে। লুকোচুরি খেলে কোনও লাভ নেই। তা ছাড়া সামনের পথের হাল-হকিকত ও অগ্রবর্তী জহরত ব্যবসায়ীদের সম্পর্কেও ওরা খোঁজখবর দিতে পারে। কাজেই এনায়েতরা তিনজন আলোচনা করে তাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিল।

নতুন ঠগিদের দলটা তখন কাজ সম্পন্ন করে সবে কবরটার ওপর মাদুর বিছিয়ে খেতে বসেছে, এমন সময় জঙ্গলের থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেল এনায়েতরা। তাদের দেখা মাত্র খাওয়া ফেলে সতর্ক ভাবে উঠে দাঁড়াল সবাই। এই লোক তিনজন তাদের কাজকর্ম দেখে ফেলেছে নাকি? প্রথমে কয়েক মুহূর্ত বিস্মিত ভাবে দু-দলই পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বুড়ো লোকটা আর তার পিছনে সেই ফিরিঙ্গিটা এনায়েতদের সামনে এসে দাঁড়াল। বুড়ো লোকটা সন্দিগ্ধ ভাবে জানতে চাইল—তোমরা পথিক?

এনায়েত প্রথমে জবাব দিল,—হ্যাঁ। তারপর একটু চাপা স্বরে বলে উঠল, আউলে ভাই সালাম।

কথাটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো আর ফিরিঙ্গিটার মুখের ভাব বদলে গেল। তারা বলে উঠল,—আউলে ভাই রাম রাম। দু-দলই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল এই সম্বোধনের পর।

বুড়োটা এবার জিগ্যেস করল,—তোমরা কোথা থেকে আসছ?

এনায়েত জবাব দিল,—পুব থেকে। তবে আমাদের মধ্যে কিছু লোকের ঘর বাংলায়, আর কিছু লোকের ঘর উত্তরে। আমার নাম ‘এনায়েত’। তাবে দলের লোকরা আমাকে ‘ফিরিঙ্গিয়া’ বলে ডাকে।

—ফিরিঙ্গিয়া। বেশ নাম। হাসল বুড়োটা।

মশালের আলোতে বুড়োর পাগড়ির নীচ থেকে তার মুখমণ্ডলের যতটা দেখা যাচ্ছে তা দেখে এনায়েতের মনে হল, এ লোকটার সঙ্গে আগে যেন কোথায় একবার দেখা হয়েছিল! এনায়েত বলল,—তোমাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে?

বুড়ো হেসে বলল,—আমারও তো কেমন যেন চেনা মনে হচ্ছে তোমাকে! আমার নাম ঝগড়ু সর্দার। বস্তারের বাসিন্দা। এ পথে প্রতিবছর আসি। হয়তো চলতে চলতে কোনও সময় তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এই যেমন হল।

হতে পারে। এনায়েতরাও তো কম দিন হল না আসছে এ পথে। পথে বহুবার বহু ঠগিদলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বেশ কয়েকবার একসঙ্গে দু-তিন দল মিলে কাজও করেছে। হয়তো তেমন কোনও দলে ছিল লোকটা। এনায়েত এরপর তাকাল ফিরিঙ্গিটার দিকে। তাকে দলে দেখেই সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছে এনায়েতরা। অবশ্য ফিরিঙ্গি থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তারা থাকেও। আর ম্যাকফানসো বা গার্টারদের দলগুলোই তো চালায় ফিরিঙ্গিরা। তবুও ঠগিদের দলে ফিরিঙ্গি একটু কম দেখা যায়। ফিরিঙ্গিটা যেন এনায়েতের দৃষ্টি দেখে তার মনের ভাব পড়তে পেরে বলল,—কানপুর রেসিডেন্সিতে গোলন্দাজের চাকরি করতাম। নেশার ঝোঁকে সামান্য একটা ঝগড়া ঝামেলায় আমার দেশেরই এক ফিরিঙ্গি ক্যাপ্টেনকে ছুরি মেরে ফেলেছিলাম সাত বছর আগে। আমাকে ফোর্ট উইলিয়ামে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ফাঁসি দেওয়ার জন্য। মাঝপথে পালালাম। তারপর ভিড়ে গেলাম এই ঝগড়ু সর্দারের দলে। এখন নিজেই ফাঁসি দিচ্ছি। আমার নাম ‘হপকিন্স’। নিয়ামতভিটুর ওপর আমার হাতের কাজটা সম্ভবত তোমরা আড়াল থেকে দেখেছ।

মোস্তাফা বলল,—হ্যাঁ দেখেছি, তোমার হাতের কাজ বেশ ভালো।

ঝগড়ু সর্দার হেসে বলল,—হপ সাহেব সঙ্গে থাকায় আমাদের বেশ সুবিধা হয়। লোকেরা চট করে সন্দেহ করে না। মাঝে মাঝে আমরা ওকে কোম্পানির লোক বলে চালিয়ে দিই।

প্রাথমিক পরিচয় সাঙ্গ হওয়ার পর কাজের কথায় ফিরে এল এনায়েত। সে জানতে চাইল,—এ পথে তোমরা কোনও বড় দল দেখেছ? দুটো উট, খচ্চর আর তেইশজন লোক। একজন দাড়িওয়ালা মুসলমান আর তিনজন বাঙালি আছে। বন্দুকধারী দুটো লোকও আছে। আমরা সে দলটারই পিছু ধাওয়া করে আসছি।

ঝগড়ু বলল,—হ্যাঁ দেখেছি তো। আজ ভোরেই তারা এ পথ ধরে গেছে। এতগুলো লোক, তাই পিছু নিলাম না। ওরা কারা? দেখে তো রইস আদমি বলে মনে হল।

এনায়েত বলল,—হ্যাঁ, রইস আদমি। বাঙালি তিনজন জহরত ব্যবসায়ী, ঢাকা থেকে আসছে। আর মুসলমানটা হাতির দাঁতের জিনিস বিক্রি করে। আমরা ওদের সঙ্গে রাতও কাটিয়েছি। জব্বলপুর থেকে দুটো দলের আলাদা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন ওরা একসঙ্গে ভোপালের পথ ধরেছে।

জহরত ব্যবসায়ীর কথা শুনেই ঝিলিক দিয়ে উঠল ঝগড়ু সর্দার আর ফিরিঙ্গির চোখ। বুড়ো ঠগিটা এরপর বলল,—কিন্তু ওরা তো তোমাদের চেয়ে সংখ্যায় বেশি। তোমরা ঝিরনী দেবে কী ভাবে?

এনায়েত বলল,—সেটাই তো সমস্যা। দেখি যদি নরসিংহপুরে গিয়ে দুটো দল আলাদা হয় সেই আশাতেই চলছি।

হপ সাহেব এবার বলে উঠল,—আমরা একসঙ্গে হলে কিন্তু সংখ্যায় ওদের বেশি হব।

—মানে?

—মানে হল, আমরা একসঙ্গে মিললে প্রায় চল্লিশজন। বন্দুকধারী দুজনকে কবজা করতে পারলেই আর সমস্যা হবে না। যাদের ঝিরনী দেওয়া যাবে না, তাদের কোদালির কোপে শেষ করে দেওয়া হবে। কথা শেষ করে সাপের মতো হিসহিস একটা শব্দ করল ফিরিঙ্গিটা।

প্রস্তাবটা মন্দ দেয়নি এই ফিরিঙ্গি। এনায়েত শুনেছে একশো লোকের দলকেও ঝিরনী দিয়েছে ঠগির দল। ব্যাপারটা একটু দুঃসাহসিক হলেও অসম্ভব কিছু নয়। আর শেষ পর্যন্ত যদি হাতির দাঁতের কারবারি আর ঢাকার দলটা একসঙ্গেই ভূপাল যায়, তাহলে এনায়েতদের দল একলা তাদের কিছু করতে পারবে না। অতএব…। এনায়েত তাকাল দুর্গার দিকে।

দুর্গা একটু ভেবে নিয়ে ঠগি সর্দার ঝগড়ুকে বলল,—আমরা অনেকদূর থেকে দলটার পিছু ধাওয়া করছি। হক আমাদের বেশি। যদি ওদের পুরো দলটাই থাকে তবে যা পাওয়া যাবে তার আধাআধি বখরা হবে। আর যদি শুধু ঢাকার দলটা থাকে তবে তিন ভাগের এক ভাগ তোমরা পাবে। রাজি?

একটু ভেবে নিয়ে ফিরিঙ্গি আর ঝগড়ু সর্দার বলল,—হ্যাঁ রাজি।

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল,—জয় ভবানী। মোস্তাফা ডাকতে গেল দলের অন্য লোকদের। দুর্গা এনায়েতকে বলল,—বাঘ যখন দেখা গেল, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম ভালো কোনও ব্যাপার অপেক্ষা করে আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এনায়েত আর ঝগড়ুর মিলিত দল রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ল শিকারের পিছু ধাওয়া করতে।

দশ

নেকড়ের পাল যেমন শিকারের পিছু ধাওয়া করে, জহরত ব্যবসায়ীদের খোঁজে তেমনই ছুটে চলল তারা। জঙ্গল পেরিয়ে ভোরবেলা তারা উপস্থিত হল নরসিংহপুর শহরের উপকণ্ঠে এক গ্রামে। সেখানে পথচলতি এক সাপুড়ের সঙ্গে কথা বলে দুটো খবর জানতে পারল তারা। একটা খবর হল গতকাল সন্ধ্যায় ব্যবসায়ীদের দলটা নরসিংহপুর শহরে ঢুকেছে। আর দ্বিতীয় খবরটা হল কোম্পানির অশ্বারোহী বাহিনীর একটা দলও গতকাল মাঝরাতে ঝড়ের বেগে এ পথ ধরে গেছে। তারা যাচ্ছে সগরে। সেখানে নাকি ভিলেরা বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই সেনা পাঠাচ্ছে কোম্পানি। নরসিংহপুরের কোম্পানির ব্যারাকও নাকি ফাঁকা। সগর নিয়ে বেশ ব্যস্ত কোম্পানি।

খবর তাহলে এনায়েতদের পক্ষে অনুকূলই। কিন্তু এনায়েতরা শহরে ঢুকবে না। ঠিক হল মোস্তাফা আর ঝগড়ু সর্দারের দলের মাধব জমাদার বলে একজন লোক শহরে ঢুকে ব্যবসায়ীদের দলের খবর নেবে। তারপর শহর ছেড়ে বেরিয়ে ভূপাল যাওয়ার রাস্তায় উঠবে। আর এনায়েত-ঝগড়ুদের দলটা ঘুরপথে গিয়ে সে রাস্তায় অপেক্ষা করবে তাদের জন্য। সেই মতোই কাজ হল। দুজন শহরে ঢুকল, আর এনায়েতরা অন্যপথ ধরল। চলতে চলতে এনায়েত ঝগড়ুকে বলল,—ওরা আমাদের পরিচিত, কিন্তু আমাদের সঙ্গে তোমাদের এতগুলো লোক দেখে আবার তারা সন্দেহ না করে!

ঝগড়ু তাকাল ফিরিঙ্গি ঠগির দিকে। ফিরিঙ্গি বলল,—একটা উপায় আমি ভেবে রেখেছি। কিছুদিন আগে কোম্পানির এক ফিরিঙ্গিকে ঝিরনী দিয়েছিলাম। তার পোশাকগুলো আমাদের কাছে আছে। সেই পোশাকে আমাকে বেশ মানাবে। তোমরা বলবে সাহেব আমাদের এ পথ ধরে সগরে নিয়ে যাচ্ছেন কোম্পানির কাজ করানোর জন্য। যুদ্ধ বাঁধলে তখন সৈন্যদের খিদমত করার জন্য নানা লোকের দরকার হয়, সে কাজেই যাচ্ছি আমরা।

এনায়েত তারিফ করল ফিরিঙ্গির বুদ্ধির। সত্যি ভালো সঙ্গী পেয়েছে ঝগড়ু সর্দার। এনায়েত ঝগড়ুকে এরপর একবার বলল,—আমার শুধু বারবার মনে হচ্ছে তুমি আমার চেনা। কিন্তু কোথায় দেখেছি কিছুতেই তা মনে পড়ছে না।

ঝগড়ু সর্দার হেসে বলল,—দুজনেই তো ভবানীর সেবক আমরা। কোথাও নিশ্চয়ই দেখা হয়ে থাকবে। আমার মনে পরলে বলব।

শহরটাকে বেড় দিয়ে ভূপাল যাওয়ার পথের অন্য মুখটাতে পৌঁছে গেল দলটা। কিছুক্ষণের মধ্যে মোস্তাফা আর মাধব জমাদার খবর নিয়ে এল। বেশ ভালো খবর। হাতির দাঁতের কারবারি নাকি শহরেই রয়ে গেছে। আর ঢাকার ব্যবসায়ীরা ভূপালের এক মশলার কারবারির পাঁচজনের ছোট দলের সঙ্গে মাঝরাতে উঠে রওনা দিয়েছে এই রাস্তায়। মাধব জমাদার আবার কাজ খোঁজার অছিলায় কোম্পানি-কুঠির আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে খবর নিয়ে এসেছে। সগরের গোলমালের ব্যাপারে কোম্পানির সবাই ভীষণ ব্যস্ত। এমনকী এ রাস্তায় কোম্পানির টহলদারি সেপাইদেরও পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে মজুত করা হয়েছে কুঠিতে।

এনায়েতরা বেশ একটু উল্লসিত হল খবরটা শুনে। ঝগড়ু আবার একটু বিমর্ষও হল, কারণ, লাভের ভাগটা তাদের কমে যাবে। এনায়েত তাকে আশ্বস্ত করে বলল,—মা ভবানীর কৃপায় তেমন ভালো কিছু যদি পাওয়া যায় তখন নিশ্চয়ই তোমাকে খুশি করার ব্যবস্থা করব। তা ছাড়া ওদের ঝিরনী দেওয়ার পর আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে পারি। পথ আর পথিকের অভাব নেই এ দেশে।

তার কথা শুনে ফিরিঙ্গি ঠগিটা হেসে বলল,—ঠিকই বলেছ তুমি। ভবিষ্যতেও আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। আমার অনুমান ওদের থেকে আমরা তিন প্রহর সময় পিছিয়ে আছি। এখন কথা বলে সময় নষ্ট না করে পা চালিয়ে চললে আশা করি সন্ধ্যার মধ্যেই আমরা ওদের ধরে ফেলে রাত শেষে আবার নতুন শিকারের খোঁজে পথে নামতে পারব।

তার কথার পর সময় নষ্ট না করে নেকড়ের দল আবার চলতে শুরু করল দ্রুত গতিতে।

একবারও বিশ্রামের জন্য থামেনি তারা। পথে দু-একজন নিম্নশ্রেণির পথিকের সঙ্গে কথা বলে এনায়েতরা জানতে পারল তারা ঠিক পথেই এগোচ্ছে। ক্রমশই ব্যবধান কমে আসছে শিকার ও শিকারিদের মধ্যে। বেলা গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকাল। অবশেষে সূর্য ডোবার কিছু আগে এনায়েতরা দেখতে পেল তাদের! এ জায়গার আশেপাশে পাঁচ-সাত ক্রোশের মধ্যে কোনও লোকালয় নেই। রাস্তার এক পাশে দিগন্তবিস্তৃত পতিত জমি, আর অন্য পাশে বড় বড় গাছে তিন দিক ঘেরা জঙ্গল। তার মধ্যে এক খণ্ড ফাঁকা জমি। দিন শেষে সেখানেই রাত কাটাবার উদ্যোগ নিচ্ছে লোকগুলো। তাদের শেষ রাত।

তাদের দেখা মাত্রই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। হ্যাঁ মাত্র বারো জন লোক। অসুবিধা হবে না। লোকগুলো এখনও তাদের দেখতে পায়নি। জহরত ব্যবসায়ীদের সামনে তারা কী ভাবে উপস্থিত হবে, সে পরিকল্পনা আগেই হয়ে গেছে। একটা পুঁটলি থেকে পোশাক বার করা হল। ফিরিঙ্গিটা পরে ফেলল জুতো সমেত সেই পোশাক। তাকে এবার সত্যিই কোম্পানির উচ্চপদস্থ লোকের মতো দেখাচ্ছে। কে বলবে তার হাতের ছোঁয়ায় এনায়েতদের চোখের সামনেই একটা মানুষ কবরে চলে গেল!

জহরত ব্যবসায়ীদের কাছে যাওয়ার আগে শেষ পরিকল্পনাটা এবার সেরে নিতে হবে। এনায়েত বলল,—কে ঝিরনী দেবে?

ঝগড়ু সর্দার বলল,—শিকারটা যখন তোমাদের তখন তুমিই ঝিরনী দিও। আর আঙ্গুছাও তোমরা পড়িও। আমাদের একজন লোক তোমার সঙ্গে থাকবে তোমার শিকারের গলায় আঙ্গুছা পরাবার পর তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলার জন্য। গব্বাগুলো আমাদের লোক খুঁড়ে দেবে।

এনায়েত বলল,—ঠিক আছে, ‘তামাকু লাও’ বলে দুই প্রহরে ঝিরনী তুলব আমি।

এনায়েত-ঝগড়ুর দলবল চাপা স্বরে একবার বলে উঠল, ‘জয় মা ভবানী।’ তারপর আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এগোল লোকগুলোর দিকে।

তিনগণ্ডা লোকের দলটাকে তাদের দিকে আসতে দেখে প্রথমে ঘাবড়ে গেল লোকগুলো। বন্দুকধারী দুজন তাদের বন্দুক তাক করল। মশলা ব্যবসায়ীদের একজন কোমর থেকে টেনে বার করল একটা ভূপালি কুকরি। এ লোকগুলো ডাকাত হলে মরার আগে তারাও কয়েকজনকে খতম করে দিয়ে যাবে। জহরত ব্যবসায়ীদের দলপতি ভগবান দাস শক্ত করে আঁকড়ে ধরল তার হাতের ছড়িটা। একটা গুপ্তি লুকানো আছে ওর মধ্যে।

কিন্তু এনায়েতদের দলটা কাছাকাছি যেতেই বেশ বিস্মিত হল জহরতকারবারিরা। আরে পথের সেই লোকগুলো! আবার একজন সাহেবও আছেন! দলটার সামনে এনায়েত আর সেই সাহেব।

এনায়েত আর ফিরিঙ্গিটা ভগবান দাসের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এনায়েত ভগবান দাসকে বলল,—কোম্পানির সাহেবের সঙ্গে পথে দেখা হল। শুনেছেন তো সগরে গোলমাল শুরু হতে যাচ্ছে। সাহেব তার লোকজন নিয়ে ওখানে যাচ্ছেন। আমরা কাজের সন্ধান করছি জেনে আমাদেরও সঙ্গে নিলেন। আর ভূপাল যাব না। কাল একটু এগিয়ে সগরের রাস্তা ধরব।

কোম্পানির পোশাক পরা ঠগিটা এবার গম্ভীর ভাবে জহরত ব্যবসায়ীদের পরিচয় জানতে চাইল। যেন তিনি অজানা জায়গাতে এতগুলো লোক দেখে বেশ সন্দিগ্ধ। লোকগুলোর সঙ্গে বন্দুক আছে! দিনকাল তো ভালো নয়! এনায়েত সঙ্গে সঙ্গে সাহেবকে আশ্বস্ত করার অভিনয় করে বলল,—হুজুর, এরা রইস, ইমানদার ব্যবসায়ী। কোম্পানির লোকদের খুব সম্মান করে। আমরা এদের সঙ্গে পথ চলেছি। আপনি নিশ্চিন্তে এদের সঙ্গে রাত কাটাতে পারেন।

তার কথা শুনে খুশি হলেন সাহেব। খুশি হল ঢাকার ব্যবসায়ীরাও। কোম্পানির সাহেব বলে কথা! ভগবান দাস সাহেবকে খাতির করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে তার এক অনুচরকে সাহেবের জন্য মাদুর আর তামাকের ব্যবস্থা করতে বলল। নিজের সম্ভ্রম বজায় রাখার জন্য সাহেব অন্যদের থেকে কিছুটা তফাতে মাদুরের ওপর হুঁকো হাতে বসলেন। জহরত ব্যবসায়ীরা ও মশলা ব্যবসায়ীরাও বসল নিজেদের মাদুরে। তাদের কিছু লোক আর এনায়েতদের কিছু লোকও নিজেদের নিজেদের রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নামল রাস্তার পাশে সেই নির্জন বনে।

চাঁদ উঠল এক সময়। ক্ষয়াটে, ফ্যাকাসে, আধখাওয়া রুটির মতো একটা চাঁদ। অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই জহরত ব্যবসায়ীদের তাঁবুর বাইরে ক’টা মশাল জ্বালানো হয়েছিল। কিন্তু মশালের আলো অন্ধকার দূর করতে পারছে না। সেই ছোট্ট ফাঁকা জমিতে হেঁটে চলা মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে তারা যেন মানুষ নয়, অশরীরী অবয়ব মাত্র। সাহেব একইভাবে গাছের তলায় বসে আছেন। ফাঁকা জমিটার তিনদিকের জঙ্গলে জমাট বাঁধা অন্ধকার। ক্ষয়াটে চাঁদের আলো সেখানে প্রবেশ করছে না। ঝিঁঝিঁ পোকার অবিশ্রান্ত কলতান ভেসে আসছে সেখান থেকে।

চাঁদ ওঠার বেশ কিছুক্ষণ পর খাওয়া শেষ হল সব দলেরই। চুলার আগুন নিভিয়ে দেওয়া হল। তাঁবু দুটোর সামনেই একটা ফরাসে বসল ব্যবসায়ীদের দল। সারাদিনের পথশ্রমের ক্লান্তি নিয়ে তাদের লোকজনরাও বসল সেখানে। দীনু আর ঝগড়ু সর্দারও সেখানে গিয়ে বসল। কিছু সময়ের মধ্যেই তাদের সঙ্গে গল্প জমিয়ে দিল দীনু। এনায়েত আর ফিরিঙ্গি ঠগিটা দুটো গাছের তলায় বসে। তাদের অন্য লোকজনরাও এদিকে-সেদিকে বসে বা দাঁড়িয়ে। প্রথম প্রহরে যখন শেয়াল ডাকল তখনও তন্ময় হয়ে দীনুর গল্প শুনছে সবাই।

বেড়ে চলল রাত। এক সময় সারা দিনের পথশ্রমের ক্লান্তিতে হাই উঠতে লাগল সবার, জহরত ব্যবসায়ীরা হয়তো আগেই তাদের তাঁবুতে চলে যেত কিন্তু সাহেবটা একই ভাবে গাছের তলায় বসে আছে। তাকে বাইরে রেখে নিজেরা তাঁবুতে রাত কাটাবে—এ কাজটা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছে না তারা! হাজার হোক কোম্পানির ফিরিঙ্গিসাহেব বলে কথা! অগত্যা ঢুলতে-ঢুলতে দীনুর গল্প শুনে চলল সবাই। অর্ধেক লোক প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন। বন্দুকধারী দুজনও তাদের বন্দুক দুটো নামিয়ে রাখল। সঙ্গে যখন কোম্পানির ফিরিঙ্গি সাহেব স্বয়ং আছেন তখন আর ভয় কী? এর মধ্যে জহরতের কারবারি আর মশলা ব্যবসায়ীদের প্রত্যেকের পিছনে গিয়ে কখন যেন দুজন করে লোক এসে দাঁড়িয়েছে। ভাবখানা এমন, তারা যেন গল্প শোনার জন্য দাঁড়িয়েছে। এনায়েত আর ঝগড়ু সর্দারের একজন করে লোক।

মশালগুলো তখন নিবু নিবু হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে কোথা থেকে যেন একখণ্ড মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদটাকে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে চার দিক। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দু-প্রহরের শেয়াল ডাকবে। এনায়েত এবার উঠে দাঁড়াল। ফিরিঙ্গি সাহেবটাও উঠল। তারা দুজনে গিয়ে দাঁড়াল বসে থাকা লোকগুলোর কাছে। শুধু তাদের পিছনে দাঁড়ানো লোকগুলো তাকাল এনায়েতের দিকে। এখন শুধু সংকেতের অপেক্ষা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হলুদ রুমালের ফাঁস চেপে বসবে লোকগুলোর গলায়।

এনায়েতের দিকে তাকিয়ে আছে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো। পাথরের মূর্তির মতো শেয়ালের ডাক শোনার জন্য কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে সে। শেয়ালের ডাক শুনলেই সে ঝিরনী তুলবে। তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ফিরিঙ্গি ঠগিটা। হঠাৎ একখণ্ড মেঘ চাঁদকে ঢেকে দিল। চাঁদ মুখ তুললেই নির্ঘাত শেয়ালের পাল প্রহর ঘোষণা করবে। কিন্তু শেয়াল ডাকার আগেই অন্ধকারের মধ্যে সেই ফিরিঙ্গি ঠগিটা এনায়েতের বদলে একটা অদ্ভুত ঝিরনী তুলল, ‘সিপাহী লোগ রশি লাও।’ কী যেন একটা ঠান্ডা জিনিসের স্পর্শ লাগল এনায়েতের পাঁজরে। চাঁদ মুখ তুলল আবার কিন্তু তার সঙ্গে তিনদিকের জঙ্গলে জ্বলে উঠল মশালের আলো। শিয়ালও ডাকল, কিন্তু এনায়েতের ঝিরনী দেওয়া হল না। অবাক হয়ে সে দেখল পাশে দাঁড়ানো ফিরিঙ্গি ঠগির পিস্তলের নলটা তার পাঁজর ছুয়ে আছে। দুর্গা-দীনু-মোস্তাফা সবারই এক অবস্থা। ঝগড়ু সর্দারের প্রত্যেক লোকের হাতে পিস্তল, সেগুলো তাক করা তাদের দিকে। জায়গার যে দিকটা ফাঁকা সেদিকে ছুটবার চেষ্টা করল এনায়েতের দলের একজন, কিন্তু কিছুটা এগিয়েই বন্দুকের গুলিতে মুখ থুবড়ে পড়ল সে।

জঙ্গলের ভিতর থেকে ফাঁকা জমি থেকে বেরিয়ে এসেছে কোম্পানির অশ্বারোহী বাহিনী, আর কিছু লোক। সগর যায়নি তারা। নির্দেশমতো তারা অপেক্ষা করছিল এই বনে। তারা ঝটপট বেঁধে ফেলল এনায়েত ও তার সঙ্গীদের। কোম্পানির লোকগুলোর সঙ্গে একজনকে দেখে বেশ অবাক হল এনায়েতরা। আরে এই লোকটাকেই তো কবর দিয়েছিল ঝগড়ু সর্দার আর ফিরিঙ্গিরা! এনায়েতরা তিনজন নিজের চোখে দেখেছে সে ঘটনা। মুর্দা লাশ জিন্দা হয় কী ভাবে? ফিরিঙ্গি আর ঝগড়ু সর্দারই বা কে? মাথাটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে এনায়েতের। সে ফিরিঙ্গিটাকে প্রশ্ন করল, ‘কে তুমি?’

ফিরিঙ্গি হেসে জবাব দিলেন,—আমার নাম ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান। আজ থেকে অবশ্য আমার একটা নতুন নাম হল—’ঠগি স্লিম্যান।’

মশালের আলোতে এবার আলোকিত হয়ে উঠেছে জায়গাটা। ঝগড়ু সর্দার এবার এগিয়ে এসে এনায়েতকে বলল,—আমাকে চিনতে পারছ?

এনায়েত জবাব দিল,—না।

বুড়ো লোকটা বলল,—ঠিকই ধরেছিলে তুমি। আমার সঙ্গে আগে একবার তোমার দেখা হয়েছিল, বহু বছর আগে কলকাতার কালীঘাটের মন্দিরে। সেবার আমি মায়ের কাছে ছাগ বলি দেবার পর তুমি আমাকে আস্ত একটা রুপোর টাকা দিয়েছিলে মনে পড়ে?

হতবাক এনায়েত।

বুড়ো এরপর বলল,—আমার আরও একটা পরিচয় আছে, এ পথে আসার সময় গোহাটের পাশে বটগাছ তলায় যাকে তোমরা শুইয়ে এসেছিলে তার বাবা। এই বলে একটা ছুরি বার করে বৃদ্ধ সেটা এনায়েতের পাঁজরে বসিয়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু স্লিম্যান নিরস্ত করলেন তাকে।

দুই প্রহরের শেয়াল ডাকা রাতে নরসিংহপুর জেলার এই অখ্যাত বনপথে যে কুনাট্যের যবনিকাপাত হল তার পিছনে যে ইতিহাসটা আছে তা জানা দরকার স্লিম্যানের। এনায়েত ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। পরদিন ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে জব্বলপুরের দিকে যাত্রা শুরু করল দলটা। যে হাতে এনায়েত ওরফে ফিরিঙ্গিয়া তার হলুদ রুমালের ফাঁসে ন’শো জনের বেশি মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে, এ দেশের পথে প্রান্তরে তার সেই হাত আজ দঁড়িবাঁধা। সেই দড়ি ধরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে চলেছেন গর্বিত এক নায়ক-ঠগি স্লিম্যান। কুঠিতে ফিরে প্রথমে তাঁকে ঝগড়ু সর্দার ওরফে পুরঙ্গোয়ার জন্য ক্ষতিপূরণ আর সঙ্গের বাজিকরের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে হবে। যারা দুজন তাঁর সঙ্গে না থাকলে কোনওদিনই উন্মোচিত হত না কুয়াশাবৃত এক ভয়ংকর ইতিহাসের আবরণ।

পরিশিষ্ট

‘ঠগি স্লিম্যান’—এই নামেই স্লিম্যান বিখ্যাত হয়েছিলেন পরবর্তী কালে। ইতিহাসের কুখ্যাততম হত্যাকারী ফিরিঙ্গিয়া ওরফে এনায়েতের দলের বেশ কিছু সদস্যের ফাঁসি হয়। রাজসাক্ষী হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এনায়েতের। স্লিম্যান কৌশলে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এবং তার সাহায্যে ঠগি নিধন যজ্ঞে নামেন তিনি। কোম্পানি তাকে ঠগি ও ডাকাতি দমন বিভাগের কমিশনার নিযুক্ত করেন। এনায়েতের সহায়তায় ১৮৩৫-১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ—এই ক’টা বছরের মধ্যে ১৪০০ ঠগির গলায় ফাঁসির দড়ি পড়ান।

উল্লেখিত কাহিনির কিছু অংশ ঐতিহাসিক ভাবে সত্য, কিছুটা কল্পনা আর কিছুটা লোককথা। তথ্য প্রমাণের কষ্ঠিপাথরে বিচার করা কোনও ঐতিহাসিক নিবন্ধ নয়, এটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত নিছকই একটি উপন্যাস মাত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *