ফাউস্ট (কাব্য-নাটক) ১

ট্রাজেডির প্রথম অংশ 

প্রথম দৃশ্য 

রাত্রিকাল

(একটি উন্নত ধরনের ফুলবাগানের মাঝে পথিক ধাঁচের এক অপ্রশস্ত কক্ষে দেবরাজের সামনে একটি চেয়ারে অশান্ত অবস্থায় উপবিষ্ট ফাউস্ট।) 

ফাউস্ট : আমি দর্শনশাস্ত্র, আইনবিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যা পড়েছি। হায়, এমনকি বহুকষ্ট স্বীকার করে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত ধর্মতত্ত্বেও ব্যুৎপত্তি লাভ করেছি। কিন্তু আমার এত সব অধীত জ্ঞানবিদ্যা থাকা সত্ত্বেও আজ আমি আগেই মতোই মূর্খ রয়ে গেছি। কখনও শাসক ও কখনও ডাক্তাররূপে আমি দীর্ঘ দশ বছর ধরে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে সোজা বা বাঁকা পথে ন্যায়সঙ্গত বা অন্যায়ভাবে বহু পণ্ডিতকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছি; কিন্তু পরিশেষে শুধু এই কথাই জেনেছি যে কিছুই ঠিকভাবে জানা যায় না। উপরন্তু জ্ঞান আমার ক্ষতিসাধনই করছে। আমার অধীত জ্ঞানবিদ্যার ফলে আমি শিক্ষক, ডাক্তার, শাসক, কেরাণি ও ধর্মপ্রচারক থেকে বেশি চতুর হয়ে উঠেছি। কোনও কুণ্ঠা বা সংশয় এখন আমায় আঘাত করতে পারে না। কোনও নরক বা শয়তানের কোনও ভয় আমাকে আর ভীত করে তুলতে পারে না। তার ফলে জীবনে কোনও আনন্দই উপভোগ করতে পারছি না আমি। জগতে আমি কোনও কিছুই জানার যোগ্য বলে ভাবতে পারছি না। কোনও মানুষকে জ্ঞানলাভে সাহায্য করা অথবা সৎপথে টেনে আনার ব্যাপারে শিক্ষকদের ভূমিকার কোনও সার্থকতা দেখতে পাচ্ছি না আমি। আমার অধিকারে কোনও জমি-জায়হা বা টাকাকড়ি নেই। কোনও সম্পদ, ঐশ্বর্য বা সম্মান কিছুই নেই আমার। এই হীন অভিশপ্ত জীবন কোনও কুকুরেও সহ্য করতে পারবে না। এই দুঃখে বর্তমানে আমি যাদু বা ইন্দ্রজালবিদ্যা শিক্ষা করে এই জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাই, যাতে আমি আত্মতত্ত্ব ও অভূতপূর্ব এক আত্মশক্তি অধিগত করে প্রভূত বাকশক্তি অর্জন করতে পারি। যে বিষয়ে আমি কিছু জানি না সে বিষয়ে যতসব মিথ্যা অসার কথা বলে মানুষকে আর ভোলাতে চাই না আমি। বিশ্বের অন্তর্নিহিত যে নিগূঢ় নিবিড় শক্তি সব কিছুকে আবদ্ধ করে রেখেছে, যে শক্তি তার গতি-প্রকৃতিকে পরিচালিত করছে, সেই সৃষ্টিশীল অন্তঃশায়ী শক্তির রহস্যকে উদগাটন করতে চাই আমি। আর আমি যত সব শূন্য অসার কথার ফুল ঝুরি ছোটাব না মুখে। 

আয়ত উজ্জ্বল হে পূর্ণচন্দ্র, সন্ধ্যা হতে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত কতদিন আমার এই জানালা থেকে দেখেছি তুমি ধীরে ধীরে দিগন্ত থেকে উঠে গেছ মধ্য গগনে। জানি না, তোমার রশ্মির মাধ্যমে আমার সর্বশেষ দুঃখের কথা জেনেছ কি না। হে আমার দুঃখের বন্ধু, বিষাদের সাথী, তোমার উজ্জ্বল চক্ষু কত রাতে বই-এর উপর ঝুঁকে পড়ে শাস্ত্রপাঠে নিবদ্ধ আমার নজ দেহটিকে নিরীক্ষণ করেছে। আমার এই বদ্ধ গ্রন্থজগতের বিষবাষ্প হতে নিজেকে মুক্ত করে তোমার আলোর দ্বারা পরিপাবিত কোনও পর্বতের আধিত্যকাপ্রদেশে যার চারদিকের পর্বতকন্দরে প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়ায়, সেইখানে আমি গিয়ে এখন দাঁড়াতে পারতাম। তোমার ঝাপসা-ধূসর ঝর্নাধারা প্রবাহিত প্রতিটি প্রান্তরে আমি যদি ভেসে বেড়াতে পারতাম, আমি যদি সে ধারায় অবগাহন করে অভিস্নাত হতে পারতাম তাহলে সত্যিই কত আনন্দ লাভ করতাম।

হায়, আমি এখনও সেই অন্ধকার কক্ষটিতে বিরাজ করছি। সেই নীরস নিরানন্দ অট্টালিকার একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষ যার বহুবর্ণচিত্রিত কাঁচের রুদ্ধ গবাক্ষপথ দিয়ে প্রবেশ করতে গিয়ে দিবালোকও ম্লান হয়ে যায়, সে কক্ষের ভিতরে চারদিকে স্তূপকৃত বইগুলো উদ্ধত স্পর্ধায় কড়িকাঠটাকে স্পর্শ করে, যে কক্ষের মধ্যে সর্বত্র ছড়ানো আছে গ্লাস, বাক্স, নানা রকমের যন্ত্রপাতি আর কিছু পৈত্রিক পুরনো আমলের আসবাবপত্র। এই সব নিয়ে আমার জগৎ আর এই জগতে আমি বাস করি। 

আজ আমি নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, কেন আমার হৃদয়ে আজ এত দ্বিধা ও কুণ্ঠা, কেন আজ কতকগুলো অপার্থিব অতিসূক্ষ্ম প্রয়োজনের সুতীক্ষ্ণ আঘাতে ক্ষণে ক্ষণে। বিকম্পিত হচ্ছে সে হৃদয়? অনির্বচনীয় সে আঘাত আমার স্বচ্ছন্দপ্রবহমান প্রাণপ্রবাহকে স্তব্ধ ও অবরুদ্ধ করে দিতে চাইছে কেন? হায়, জীবন্ত প্রকৃতির যে রাজ্যে ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট মানবজাতিকে সংস্থাপিত করেছেন সে রাজ্য বড় ভীষণ। ধূমায়িত বিষবাষ্পে ভরা বিদেহী মানুষ ও পশুর করোটি কঙ্কালের সে এক অদ্ভুত জগৎ। 

হে আত্মা, এই দুঃসহ জগৎ থেকে পালিয়ে চলো। মুক্ত আকাশের এক আয়ত উদার বিশালতায় আপন মুক্তিকে খুঁজে নাও এবং এ বিষয়ে নীডামাস রচিত রহস্যের বইটির সুনিবিড় সাহচর্য ও সহায়তাই যথেষ্ট মনে করি। আমি যখন গ্রহনক্ষত্রদের গতিবিধি জানি এবং আমার ভবিষ্যৎ জীবনধারা সম্পর্কে নিয়মিত কাছ থেকে নির্দেশের সন্ধান করি তখন আমি যদি মৃত আত্মাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার মনের কথা তাদের বোঝাতে পারি তাহলে এক নিগূঢ় অতিপ্রাকৃত শক্তির অত্যাশ্চর্য আলোকোজ্জাসের চকিত উদ্ভাসে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে আমার আত্মা। কিন্তু এখানে বসে বসে শুধু ব্যর্থ চিন্তায় সময় নষ্ট করার কোনও অর্থ হয় না। সেই সব আত্মাদের পবিত্র প্রতীকগুলোর সঙ্গে শুধু নিষ্প্রাণ অনুমানের মাধ্যমে পরিচিত হওয়াতেও কোনও লাভ নেই। তার চেয়ে হে আত্মারা, তোমরা আমার কাছে এস, আমার অনেক কাছে এস। যদি আমার কথা শুনতে পেয়ে থাক তাহলে তার উত্তর দাও। 

(ফাউস্ট সেই রহস্যের বই খুলে আত্মাদের লক্ষণ দেখতে পেল। হায় আমার স্বতঃ প্রবাহিত ইন্দ্রিয়চেতনাগুলোকে অতিক্রম করে সহসা এক অদম্য আবেগ কেন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে আমার অন্তরে? সহসা এক যৌবনসুলভ শক্তি অনুভব করছি আমি দেহে। আমার এ দেহের প্রতিটি শিরায় ও স্নায়ুতে অনুভব করছি এক পবিত্র পরমানন্দের বৈদ্যুতিক প্রবাহ। তবে কি কোনও দেবতা আমার বিক্ষুব্ধ বিভ্রান্ত চিত্তের গভীরে অন্তহীন এক প্রশান্ত আনন্দকে সঞ্চারিত করে বিশ্বপ্রকৃতির নিগূঢ় শক্তির রহস্যকে উদঘাটিত করছেন আমার জীবনে? এই কি তার অভ্রান্ত অভিজ্ঞান? তবে আমিই কি দেবতা হয়ে উঠেছি? আমার দৃষ্টি কত স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে সহসা আমার দেহমনের এক অভূতপূর্ব অকৃত্রিম পবিত্রতায় আমি এক সৃষ্টিশীল শক্তির বিরাট রহস্যকে ক্রমোদঘাটিত দেখছি আমার অন্তরাত্মার মধ্যে। ধর্মসাধকদের বাণীর মর্মার্থ আজ আমি বুঝতে পারছি। তাঁরা বলতেন, রুদ্ধদ্বার ইন্দ্রিয়ের মধ্যে মৃত অন্তরের অধস্তন স্তরে তোমার আত্মজগৎকে সীমায়িত ও অবরুদ্ধ করে রেখো না। হে আমার প্রিয় শিষ্য, ওঠ, নূতন আশায় বুক বাঁধ। নিশাশেষে নবারুণ উষালোকে অভিস্নাত হয়ে নবজীবন লাভের জন্য ছুটে চলো অক্লান্ত গতিতে। 

(অলৌকিক অতিপ্রাকৃত লক্ষণ সম্পর্কে চিন্তা করতে লাগল ফাউস্ট) কেমন সুন্দরভাবে প্রতিটি বস্তুই তার প্রতিটি অংশে তার অন্তর্নিহিত শক্তির অংশবিশেষ দান। করে আর সেই অংশগুলো কেমন চমৎকারভাবে পরস্পরে মিলেমিশে বাস করে ও কাজ করে। দেখে মনে হয় যেন অনন্ত স্বর্গীয় শক্তিপূর্ণ এক স্বর্গপাত্র থেকে মর্ত্য ও মর্ত্য থেকে স্বর্গে ক্রমাগত উঠানামা করতে করতে বিশ্বের সকল বস্তুকেই এক স্বকীয় সামর্থ্য, মূল্য ও সঙ্গতি দান করছে। এ দৃশ্য বড়ই মহান। তবু শুধু দৃশ্য। হে অসীম বিশ্বপ্রকৃতি, আমাকে তোমার আপন করে নাও, আমাকে একান্ত করে নাও। বিশ্বের সকল বস্তুসত্তার উজ্জ্বল উৎসস্বরূপ, কোথায় তুমি? 

যে উৎস হতে স্বর্গ-মর্ত্যের সকল কামনা উৎসারিত হয়, যে উৎসস্থল আমাদের সকল অতৃপ্ত উচ্চাশার প্রাণকেন্দ্র সেই উৎস হতে আজ অমিত অমৃতধারা ঝড়ে পড়ুক আমার চিত্তে। আমার সকল ক্ষুধা তৃপ্ত হোক চিরতরে। নিবৃত্ত হোক আমার সকল প্রবৃত্তির সকাম উচ্ছ্বাস। তা না হলে বুঝব ব্যর্থ হলো আমার সকল দুঃখভোগ। 

(অধৈর্য সহকারে বই-এর পাতা ওলটাতে ওলটাতে পৃথিবীর অধিষ্ঠাতা অপদেবতার চিহ্ন দেখতে পেল) 

এই চিহ্ন বা লক্ষণটি আমার উপর পরোক্ষভাবে কাজ করে। হে ধারিত্রীরূপী অপদেবতা, তুমি আমার আরও কাছে এস। আমার অন্তবৃত্তিগুলো আগের থেকে আরও সমুন্নত হয়ে উঠেছে। আরও স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে আমার দৃষ্টিশক্তি। সদ্যপ্রস্তুত মদ্যপানে মত্ত ব্যক্তির মতো আকস্মিক এক শক্তিতে উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছি আমি। এক নূতন শক্তি অন্তরে সঞ্চারিত হয়ে সমগ্র জগতের মুখোমুখি হবার জন্য অনুপ্রাণিত করছে আমায়। পৃথিবীর সুখদুঃখ আকর্ষণ করছে আমায় দুর্বার বেগে। সামুদ্রিক ঝঞ্ঝার প্রবল আঘাত যতই ভীতি প্রদর্শন করুক না আমায়, আমার জীবনতরীকে কোনও দিন নিমজ্জিত করতে পারবে না তা আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার চারদিকে পুঞ্জীভূত হচ্ছে কৃষ্ণকুটিল মেঘমালা। ঢেকে ফেলেছে পূর্ণচন্দ্রের সব আলোকে। সব আলো নির্বাপিত হয়ে যাচ্ছে। আকাশ থেকে এক ভীতিপ্রদ কুয়াশা নেমে আসছে। কার ক্রোধারুণ দৃষ্টির সুতীক্ষ্ণ তীর নেমে আসছে যেন আমার উপর। এক অজানিত শঙ্কার শিহরণ আচ্ছন্ন করে ফেলছে আমার চেতনাকে। হে অপদেবতা, আমি তোমার উপস্থিতি অনুভব করছি আমার মর্মের মাঝখানে। আমি তোমাকে আবাহন করে এনেছি। এবার স্বচ্ছন্দে আত্মপ্রকাশ করো। হায়, আমার অন্তরে এক মৃদু অথচ মর্মভেদী আঘাতের মাধ্যমে আমার ইন্দ্রিয়চেতনাকে আলোড়িত করে তুলছে কে যেন। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার অন্তরে এসে গেছ, নিঃশেষে আত্মসাৎ করে নিয়েছ আমার সমগ্র সত্তাকে। বেশ করেছ, আমি তাই চাই। তাতে এ জীবন গেলেও ক্ষতি নেই। 

(বইটি ভালো করে শক্ত করে ধরে অপদেবতার নাম করতেই এক লালাভ অগ্নিশিখা সহসা প্রজ্বলিত হয়ে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে সেই শিখার মাঝে আবির্ভূত হলো পৃথিবীর অধিষ্ঠাতা অপদেবতা) 

অপদেবতা : কে ডাকে আমায়?

ফাউস্ট : (কম্পিত ও বিচলিত অবস্থায়) এই দৃশ্য সত্যিই ভয়ঙ্কর। 

অপদেবতা : আমাকে তুমি দীর্ঘ দিন ধরে আকৃষ্ট করে এসেছ। আমার রাজ্য থেকে তোমার খাদ্য সংগ্রহ করেছ। 

ফাউস্ট : বড় দুঃখের কথা। আমি তোমাকে সহ্য করতে পারছি না। 

অপদেবতা : কিন্তু আমাকে দর্শন করার জন্য তুমি ব্যাপক হয়েছ, আমার কণ্ঠস্বর শুনতে ও আমার মুখমণ্ডল দেখতে চেয়েছ। তোমার ইচ্ছার নিবিড়তা বিচলিত করে তোলে আমায়। আমি তাই এসেছি। এতে এত বিচলিত হবার কি আছে তোমার? তুমি না অতিমানব, ভয়ে কাঁপছ? তোমার আত্মার সেই গর্বোদ্ধত ভাব কোথায় গেল? কোথায় গেল সেই বুক, যে বুক নিজেই সমগ্র পৃথিবীকে ধারণ ও বহন করার বড়াই করত। আমাদের মতো সমস্ত দেবতা-অপদেবতা সমন্বিত এমন এক বিরাট পৃথিবী গঠন করে তাকে ইচ্ছামতো রূপ দিতে চেয়েছিলে যে পৃথিবীতে চির আনন্দে বিরাজ করবে অন্তহীন প্রসারতায়। কোথায় তুমি ফাউস্ট যার কণ্ঠস্বর আমার মর্মকে ভেদ করে, যে তুমি তোমার সমস্ত শক্তির নিবিড়তা দিয়ে চাপ দিতে থাকো আমার উপর। আমাদের প্রভু হতে চাও। হ্যাঁ, তুমিই সেই ফাউস্ট যে আমার উপস্থিতিতে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছ আর তার সমগ্র অস্তিত্ব আমূল কেঁটে উঠছে সেই ভয়ে। তোমার শঙ্কাপীড়িত দেহই এ কথার প্রমাণ। 

ফাউস্ট : তোমাকে মানে এই ক্ষীণ অগ্নিশিখাটুকুকে ভয় করব আমি? হ্যাঁ, আমি ফাউস্ট, আমিই তোমার পরিচালক,তোমার প্রভু। 

অপদেবতা : উত্থানপতনসঙ্কুল বিচিত্র জীবনতরঙ্গ ও বিভিন্ন কর্মের ঝঞ্ঝাসমন্বিত জন্ম-মৃত্যুর চক্রাবর্তনে চির আবর্তিত এক বিক্ষুব্ধ বিশাল সমুদ্র চিরকাল প্রবাহিত হয়ে চলেছে। কালের চরকায় আমি নিজের হাতে সুতো কেটে যে সব জীবনের পোশাক তৈরি করি, দেবতা ও অপদেবতারা তাই পরিধান করে থাকে। 

ফাউস্ট : যে তুমি সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে তার চারদিক থেকে আবর্তিত হচ্ছ, সেই তোমাকে কত কাছে আজ অনুভব করছি আমি। 

অপদেবতা : তুমি আমাকে বুঝতে পারনি বা ধরতে পারনি। তুমি তোমার বোধায়ত এক দেবতার মতো হবার চেষ্টা করছ। (অন্তর্হিত হলো)। 

ফাউস্ট : (অভিভূত অবস্থায়) তোমাকে পাইনি আমি! তাহলে কে এসেছিল আমার কাছে? যে আমি ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি সেই আমার মতো হতে পারলাম না, তোমাকে ধরতে পারলাম না। (দরজায় করাঘাত) মৃত্যু ভালো ছিল এর থেকে। আমি জানি–যে এসেছে সে হচ্ছে আমার প্রিয় ফেমুলাস। হায়, সৌভাগ্য লাভ করেও কোনও ফল হলো 

আমি যখন আমার মধুর স্বর্গরাজ্যে পরিপূর্ণ ভাবে নিমগ্ন ছিলাম তখন এই নির্মম লোকটা আমায় বাধা দিল। 

(রাত্রিকালীন টুপি ও ড্রেসিং গাউন পরিহিত অবস্থায় ওয়াগনারের প্রবেশ। ফাউস্ট অধৈর্য সহকারে মুখ ঘুরিয়ে নিল) 

ওয়াগনার : ক্ষমা করো। আমি তোমার বিরক্তিসূচক চিৎকার শুনে এলাম। মনে হয় গ্রীক ট্রাজেডি পড়ছিলে। যেহেতু এই সব নাটক পাঠ করে মানুষ অনেক কিছু শিখতে পারে সেই হেতু এ নাটক পড়তে জানা চাই। তার জন্য প্রস্তুতি দরকার। আমি অনেকবার একটা কথা শুনেছি যে কোনও ধর্মপ্রচারক হাস্যরসের অভিনেতার কাছ থেকে অনেক কিছু শিক্ষালাভ করতে পারে। 

ফাউস্ট : হ্যাঁ, এখন যেমন হয়েছে অর্থাৎ ধর্মযাজক নিজেই যখন হাস্যরসের অভিনেতা। 

ওয়াগনার : তোমার মতো যে লোক পিঞ্জরাবদ্ধ জীবনের মতো শুধু ঘরের মধ্যে বসে বসে বই পড়ে দিনরাত, যে একমাত্র ছুটির দিন বা উৎসবের দিন চশমার ভিতর দিয়ে ছাড়া বইয়ের জগৎটাকে একবারও দেখে না, সে লোক কোনও মানুষকেই কিছু বোঝাতে পারবে না। 

ফাউস্ট : মানুষকে বোঝানো অত সহজ কাজ নয়। মানুষকে তুমি বোঝাতে কিছুতেই পারবে না যদি না এক নিবিড় অনুভূতি তোমার অন্তরাত্মার গভীরতম প্রদেশ থেকে জেগে উঠে প্রশান্ত অথচ আদিম অদৃশ্য শক্তিতে তোমার অন্তর হতে শ্রোতাদের অন্তরে সঞ্চারিত হয়। তা না হলে তুমি শুধু অপরকে বোঝাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাবে চিরকাল, অপরের খাদ্যদ্রব্যের অবশিষ্ট টুকরো বৃথাই রান্না করে যাবে আর ছাই-এর গাদা হতে ফুঁ দিয়ে অনেক কষ্টে একটা ক্ষীণ শিখা জাগিয়ে তুলে শুধু কিছু শিশু আর বাঁদরকে মুগ্ধ করতে পারবে। কিন্তু আগে তোমার অন্তর যদি অনুভূতির রসে সিক্ত ও সোচ্চার না হয়ে ওঠে তাহলে অন্তর দিয়ে অপরের অন্তরকে স্পর্শ করতে বা অপ্রপ্রাণিত করতে পারবে না। 

ওয়াগনার : তবু বলার ভঙ্গিমার জোরে বাগীরা অনেক ক্ষেত্রেই সাফল্য লাভ করে। আমি অবশ্য এখনও সে সাফল্য লাভ করতে পারিনি। 

ফাউস্ট : সে সাফল্য সম্ভাবে লাভ করার চেষ্টা করো। নির্বোধের মতো কাজ করো না। যথাসম্ভব কম কলাকৌশল অবলম্বন করে স্পষ্ট বুদ্ধি ও অনুভূতির দ্বারা শ্রোতাদের ভাবপ্রকাশের ক্ষমতাকে জাগিয়ে তুলবে। যদি সত্যি সত্যিই তাদের কিছু বলার জন্য গভীরভাবে আগ্রহ বোধ করো এবং শ্রোতাদের মধ্যে আগ্রহ জাগাতে পার তাহলে তার কি চাই? কিন্তু তোমার বক্তব্য বিষয় যদি জাঁকজমকপূর্ণ ও অলঙ্কারবহুল হয় তাহলে মোচড়ানো কাগজের মতো তোমার সে বক্তব্য বিকৃত হয়ে যাবে। গাছের পাতাদের হাড় কাঁপিয়ে তোলা হেমন্তের কুয়াশা ভেজা ঠাণ্ডা কনকনে বাতাসের মতোই সে বক্তব্য বিষয় অবাঞ্ছিত ও অস্বস্তিকর মনে হয় শ্রোতাদের কাছে। 

ওয়াগনার : হা ভগবান! জীবন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু শিল্প অক্ষয়, চিরস্থায়ী। সমালোচক হিসাবে আমার পবিত্র কর্তব্যের খাতিরে আমি প্রায়ই দেখতে পাই আমাদের মাথার চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি আর বুকের অনুভূতির মাঝে কোথায় যেন বড় রকমের একটা গলদ আছে। সৃষ্টির মূল উৎস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা সত্যিই কত কঠিন। উৎসের পথে যেতে যেতে অর্ধেক রাস্তাতেই অসহায় মানুষকে তার মরদেহ ত্যাগ করতে হয়। 

ফাউস্ট : তৃষ্ণার্ত শুষ্কতাই কি তোমার কাছে পবিত্র ঝর্নাধারা বলে মনে হয় যে ধারা থেকে মাত্র এক অঞ্জলি জল পান করলেই তোমার সকল তৃষ্ণার শান্তি হবে? জেনে রাখবে, তোমার আপন আত্মা থেকে স্বতোৎসারিত কোনও রসধারা ছাড়া। বাইরের কোনও জলধারাই তা যতই স্নিগ্ধ বা শীতল হোক না কেন, তোমার তৃষ্ণাকে। যথাযথভাবে পরিতৃপ্ত করতে পারবে না। 

ওয়াগনার : ক্ষমা করো আমায়, অতীতের কথা ভেবেও অনেক সময় আনন্দ পাই। যুগের আত্মার মধ্যেও অনেক আনন্দ নিহিত আছে। যখন আমরা দেখি আমাদের আগের যুগ দূর অতীতে অনেক বিজ্ঞ মুনিঋষিরা কত ভালো কথা ভেবে গেছেন, কত বড় কাজ করে গেছেন এবং আমরা তাদের চিন্তাধারার উত্তরসাধক, তখন মনে মনে অনেক আনন্দ পাই। 

ফাউস্ট : তাহলে তো তুমি দেখছি নক্ষত্রের জগতে বিচরণ করছ। শোনো বন্ধু, যে যুগ অতীত হয়ে গেছে তা মুখবন্ধ বই-এর মতোই অর্থহীন। তুমি যাকে যুগের আত্মা বলছ তা হলো তোমাদের সকলের সম্মিলিত আত্মা যার মধ্যে যুগগুলো প্রতিফলিত। হয়। সুতরাং যারা মনে করে যুগ গতিশীল এবং ক্রমবিলীয়মান, তারা ভুল করে। আসলে বিভিন্ন যুগে তথাকথিত মহাপুরুষেরা যে সব বড় বড় কথা বলে মানুষের মনকে নাড়া দেবার চেষ্টা করেন তা পুতুলের মুখেই শোভা পায়। 

ওয়াগনার : কিন্তু মানুষের অন্তরে আবেগ অনুভূতি আছে, তার মস্তিষ্কে বুদ্ধি আছে। এবং এগুলো খারাপ জিনিস নয়। কিন্তু এসব বিষয়ে অনেকে জানতে চায় না। 

ফাউস্ট : হ্যাঁ, মানুষ অন্তর দিয়ে অন্তরকে জানতে চায় না, চায় শুধু গোপনতা। কেউ তার সন্তানের আসল গুণের কথা, তার প্রকৃত স্বরূপকে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে চায় কি? একমাত্র যারা শুথু নির্বোধের মতো সরল ও অকপট এবং যে কোনও রকমের গোপনতাকে ঘৃণার চোখে দেখে তারাই আপন সন্তানের দোষের কথা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না। তারাই বারবার লোকের কাছে ধিকৃত হয়েছে, জ্বালাময়ী অপমানের শিকার হয়ে এসেছে চিরকাল। আমার কথা শোনো বন্ধু, এখন আর না, এখন মধ্যরাত্রি। আমাদের আলোচনা এখানেই সমাপ্ত হওয়া উচিত। 

ওয়াগনার : তোমার কথা শুনে আমি খুশি হতাম যদি আমাদের এই মনোজ্ঞ আলোচনাকে দীর্ঘায়িত করতে পারতাম। আগামীকাল ঈস্টারের ছুটি আছে। তোমার আপত্তি না থাকলে এ বিষয় ও আরও কিছু বিষয় আলোচনা করা যাবে। বিশেষ আগ্রহ ও উদ্যম সহকারে আমি বিদ্যা অর্জন করতে চাই। যদিও আমি অনেক কিছুই জানি তথাপি আমি আরও অনেক কিছু জানতে চাই এবং জ্ঞানার্জন সম্পর্কে আমার উচ্চাভিলাষের অন্ত নেই। (প্রস্থান)। 

ফাউস্ট : (এক) আমাদের মস্তিষ্ক কখনও কোনও অবস্থাতেই আশা ছাড়ে না। তার সে মস্তিষ্কের প্রবলতার স্রোত চিরকাল অগভীর তুচ্ছ বস্তুর প্রতিই প্রবাহিত হয়ে থাকে। সেই অগভীর তুচ্ছ বস্তুর গভীরে কোনও সোনার খনি আবিষ্কারের এক দুর্মর আশায় আর অপরিসীম আগ্রহের সঙ্গে আমাদের মন যেন মাটি খুঁড়ে চলে। এমন মানুষ পৃথিবীতে কি কেউ নেই যার দৃপ্ত কণ্ঠস্বর আমার সম্মুখস্থিত এই অতিপ্রাকৃত অপদেবতার অবাঞ্ছিত উপস্থিতির অশুভ প্রতিক্রিয়ার মাঝে বিঘ্ন ঘটাতে পারে? যদি এমন কেউ থাকে তাহলে সে সর্বাপেক্ষা দরিদ্র ও নির্বোধ ব্যক্তি হলেও আমি তাকে অজস্র ধন্যবাদে ভূষিত করব। কারণ তাহলে এক নিদারুণ অস্বস্তিকর অবস্থা হতে উদ্ধার পাব আমি। যে অপদেবতা তার দৈত্যসূলভ বিরাট ছায়াবয়ব নিয়ে আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়চেতনাকে অভিভূত করে দিয়েছে, আমার আত্মার সমস্ত ক্রিয়াশীলতাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে সেই অপদেবতার হাত থেকে আমাকে মুক্ত করবে সেই মানবিক কণ্ঠস্বর। 

যে আমি ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি, যে ভাবে চিরন্তন সত্যের সন্ধান যে পেয়ে গেছে, যে ভাবে স্বর্গীয় জ্ঞানের প্রদীপ্ত স্বচ্ছতা আর স্বর্গীয় আলোর সুবিরল সুষমায় অন্তরাত্মা তার স্বতোদভাসিত, আপন মদমত্ততার আতিশয্যে পৃথিবীর অন্য সব মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করত, সে ভাবত চেরাবের থেকে যে বেশি শক্তিধর। যে সামান্য মানুষ হয়েও তার মানবিক সীমাকে ছাড়িয়ে দিয়ে এই মর্ত্যভূমির মাঝে থেকেই ঐশ্বরিক জীবনযাপন করতে চেয়েছিল, সেই আমির আজ অবস্থা দেখো। শুধূ এক অপদেবতার বগম্ভীর একটি শব্দ আমার স্বাভাবিক অবস্থা থেকে কেন্দ্রচ্যুত করছে। 

আজ আমি নিজেকে তুলনা করতে সাহস পাচ্ছি না। যদিও তোমাকে আকর্ষণ করা ও কাছে টানার মতো প্রভূত ক্ষমতা আমার হাতে ছিল তথাপি তোমাকে আমার কাছে রেখে দেওয়ার ক্ষমতা আমার হাতে শেষ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। যখন সেই আবেগঘন মুহূর্ত আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল আবার, নিজেকে একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মহান বলে মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু তুমি আমাকে নির্মমভাবে প্রত্যাখান করে সাধারণ মানবজীবনের অনিশ্চিত ভাগ্যের কঠিন ভূমির উপর নিক্ষেপ করেছিলে। কী আমি বর্জন করব? কার নির্দেশ আমি মেনে চলব? আমি কি সেই দুঃখ আর দ্বন্দ্বের জীবন মেনে নেব? শুধু আমাদের মতো সব দুঃখ নয়, আমাদের যে কোনও কর্মই আমাদের জীবনের অগ্রগতিকে ব্যাহত করে তোলে। যখনই আমাদের মন কোনও মহৎ ও সুন্দর বস্তুর প্রতি প্রধাবিত হয় তখনি কোথা হতে সম্পূর্ণ বিরূপ বিপ্রতীপ এক ভাবসত্তা সে মনের অখণ্ডতাকে দীর্ঘ-বিদীর্ণ করে তার গতিবেগকে প্রতিহত করে দেয়। যখনই এ জগতে আমরা ভালো কিছু লাভ করতে যাই, তখন আরও ভালো কিছুর প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে এইভাবে জীবনের সব শুভ প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দেয়। যে সূক্ষ্ম সুকুমার আবেগানুভূতি আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে ক্রমোন্নতির পথে নিয়ে যায় সেই সব আবেগানুভূতি প্রায়ই পার্থিব উন্মত্ততার অসংখ্য কলরবের স্থূপান্তরালে এক হিমশীতল স্তব্ধতায় মূক হয়ে থাকে। আমাদের আশান্বিত কল্পনা যদি এক স্পর্ধিত কামনার অনন্ত প্রসারিত উচ্ছ্বাসে উধ্বে উত্তীর্ণ হতে চায় তাহলে সে বাস্তব অবস্থার সীমায়িত বন্ধন ও বেষ্টনীকে অতিক্রম করতে পারে না কখনও। কালের দুর্বার স্রোত অনেক মানুষের ভাগ্যকেই ব্যর্থতায় চরায় ফেলে দিয়ে যায় ও আটকে দিয়ে যায়। আসলে সকল মানুষের অন্তরের তলদেশে বিরাজ করছে অন্তহীন অবিচ্ছিন্ন দুঃখ। না পাওয়ার এক গোপন বেদনা নীরবে কাজ করে চলেছে সব অন্তরের মধ্যে। আশাহত কল্পনার পৌনঃপুনিক আঘাতে অস্থির ও চঞ্চল হয়ে ওঠে আমাদের জীবন। সমস্ত আনন্দ, আরাম ও বিরাম হতে বিচ্যুত হয়ে একই জীবন বিচিত্র রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন জীব বা জড় অবস্থা প্রাপ্ত হয়। একই জীবন কখনও পত্নী, কখনও পুত্র, কখনও পথ, কখনও ঘর, কখনও তরল, কখনও কঠিন, কখনও জল, কখনও অগ্নি প্রভৃতি বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। যে আঘাত আমরা কখনও অনুভব করি না সে আঘাতের কল্পনা করে ভীত হয়ে পড়ি অনেক সময়। যে বস্তু আমরা হারাই না তার জন্যও শোক প্রকাশ করে থাকি অনেক সময়। আমি দেবতাদের মতো নই–এই সত্যটি নিবিড়ভাবে অনুভব করি আমি। আমার শুধু এই কথাটি মনে হয় যে আমি পথের ধূলির মধ্যে বসবাসকারী এক ক্ষুদ্র জীব। পথের ধূলির মধ্য হতেই আমার খাদ্য আহরণ করে জীবন। ধারণ করি আমি এবং একদিন কোনও পথচারীর পদচাপেই নিষ্পেষিত হবে আমার দেহ। ধূলিরাশির মধ্যেই অকালে সমাধিলাভ করব আমি। 

আমার এই ধুলিমলিন পার্থিব দেহসত্তার প্রাচীরবেষ্টনী আর তার অসংখ্য স্তরভেদ বাস্তব জগত ও জীবনের বিচিত্র ঐশ্বর্য ও অলংকৃত বাগবিন্যাসের অর্থহীন জৌলুস আমার অন্তরাত্মাকে প্রতিনিয়ত প্রপীড়িত করে চলেছে। সেই অন্তরাত্মার মুক্তির ব্যাপারে আমি কোন শাস্ত্রপাঠ বা পুঁথিগত বিদ্যালাভ হতে সাহায্য পাব? অসংখ্য বই পড়ে আমি কি শুধু এই শিক্ষাই পাব না যে এই পৃথিবীর সর্বত্র আত্মনিপীড়িত মানুষের হৃদয় হতে রক্ত ঝরছে? হয়তো কোন অজ্ঞাত নির্জনে দুই-একজন সুখী মানুষ নির্বিঘ্নে দিনাতিপাত করছে। বোকার মতো হাসছ কেন? তুমি আমি–আমরা সবাই নির্বোধ, অসার অনুর্বর আমাদের মস্তিষ্ক। জেনে রাখো, আমার মতো তোমার মস্তিষ্কও অস্বচ্ছম্লান দর্পণের মতো আলোকদীপ্ত এক উজ্জ্বল দিবসের জন্য মুহূর্ত গণনা করে পরিশেষে ক্লান্ত ও ব্যর্থ হয়ে গোধূলির প্রায়ান্ধকার ধূসরতার দ্বারাই আচ্ছন্ন হয়ে আছে। সত্যের প্রতি তার পিপাসা তীব্র হলেও মিথ্যার প্রতি তার অধোগমন অব্যাহত রয়েছে। 

হে যন্ত্রসমূহ তোমরা তোমাদের অদ্ভুত আকৃতি ও বিচিত্র রূপ নিয়ে আমাকে যে বিদ্রূপ করছ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আমি অনেক কষ্টে আমার গন্তব্যস্থল এক বিরাট সৌধের দ্বারদেশের সন্ধান পেয়েছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি প্রবেশ করতে পারিনি তার মধ্যে। হায় চাবি, তুমি ব্যর্থ হয়েছ। তুমি কোনও সুদক্ষ কারিগরের দ্বারা কৌশলে নির্মিত হলেও আমার সম্মুখস্থ সেই রুদ্ধদ্বার উঘাটিত করতে পারনি। তোমরা যান্ত্রিক শক্তির সমস্ত ক্রিয়াশীলতা এই স্পষ্ট দিবালোকেও উঘাটিত করতে পারেনি সেই রুদ্ধদ্বারের রহস্যকে। আমাদের সকল চিৎকার ও তর্জন-গর্জন সত্ত্বেও প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপ ও শক্তি এইভাবে অবগুণ্ঠিত ও রহস্যাবৃত হয়ে থাকে আমাদের কাছে। প্রকৃতি তার অন্তর্নিহিত কোনও রহস্য যদি স্বেচ্ছায় নিজে থেকে উঘাটিত না করে তাহলে কোনও জটিল যন্ত্রশক্তিই তা করতে পারে না। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে বা স্কু ঢুকিয়ে সে রহস্য উঘাটিত করা কোনওক্রমেই সম্ভব নয়। হে প্রাচীন যন্ত্রসমূহ, এক আমার পিতা তোমাদের ব্যবহার করতেন। তারপর হতে তোমরা অব্যবহৃতই রয়ে গেছ, কারণ আমি তোমাদের ব্যবহার জানি না। আজ এই অস্পষ্ট দীপালোকে আমার দেবরাজের উপর অবস্থিত তোমাদের অবয়বগুলোকে বড় বিবর্ণ মনে হচ্ছে আমার। আমি এখন স্বীকার করছি, এই সব যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলার থেকে আমি যদি আলস্য সহকারে জীবনযাপন করতাম তাহলে অনেক ভালো হতো। পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনও বিদ্যা না শিখলে তা আয়ত্ত করতে পারা যায় না। আর কোনও যন্ত্রের প্রয়োগ না হলে তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য সাময়িক প্রয়োজনই মানুষকে কোনও যন্ত্র প্রয়োগে বাধ্য করে। মানুষের প্রয়োজন মেটাবার ক্ষমতার উপরেই নির্ভর করে কোনও যন্ত্রের যোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা। 

কিন্তু সহসা আমার দৃষ্টি ওদিকে নিবন্ধ হলো কেন? ঐ ফ্লাস্ক বা জলপাত্রটি চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে কেন? চন্দ্রলোকদীপ্ত নৈশ বনভূমির মতো আমার অন্ধকার গৃহাভ্যন্তর সহসা আলোকিত হয়ে উঠল কেন?

হে বিরল বিস্ময়কর জলপাত্র, তোমাকে স্বাগত জানাই। তোমাকে পরীক্ষা করার অভিপ্রায়ে শ্রদ্ধা সহকারে গ্রহণ করলাম তোমাকে। তোমার মধ্যে আমি পেয়েছি মানুষের বুদ্ধি ও কলাকৌশলের মিলিত পরিচয়। তুমি হচ্ছ মানুষের সুখনিদ্রার সুমধুর রসনির্যাস। তার ভয়ঙ্করসুন্দর শক্তির সার তুমি। তোমার প্রভুর কাছে অকপটে তোমার প্রকৃত গুণের পরিচয় দাও। তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত যন্ত্রণার উপশম ঘটছে। তোমাকে হস্তে ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের ঘটছে নিঃশেষিত অবসান। আমার অন্তরের বিক্ষোভের জোয়ারে ভাটা পড়ছে। এক বিশাল মহাসমুদ্রের উপর পাখা মেলে যতই উড়ে চলেছে আমার স্বপ্ন ততই মনে হচ্ছে অসংখ্য আলোর ঢেউ উচ্ছলিত হয়ে উঠছে আমার পদতলে। ততই মনে হচ্ছে সেই সব আলোর ঢেউগুলো যেন অঙ্গুলি নির্দেশ করে দূরস্থিত এক নতুন তটভূমির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে আমার। 

আজ উজ্জল বাতাসে ভর দিয়ে এক আগ্নেয় রথ আমার কাছে এসে পড়েছে। আমি সেই রথে চেপে সুদূর আকাশমণ্ডলের কত অজানা স্তর ভেদ করে এক নূতন কর্মলোকে গিয়ে উপনীত হবার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠছি। দেবতাসুলভ এক উচ্চাভিলাষের দ্বারা যখন আমার প্রাণময় স্পন্দিত, উর্ধ্বায়িত এক মহান অস্তিত্বে আমি যখন উন্নীত হতে চলেছি তখন আমি সামান্য এক কীটের মতো কোনও পথচারীর দ্বারা পদদলিত হতে পারি না। উজ্জ্বলতর ও সুদূরতর কোনও আলোর জগতে যাবার জন্য আমি পৃথিবীর সূর্যের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করছি। এ বিষয়ে আমি কৃতসংকল্প। আজ একথা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করার সময় এসেছে যে আমি মানুষ হয়েও নিজেকে উন্নীত করে মানব জগতের বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বর্গদ্বার উঘাটন করতে পারি। আমি দেখিয়ে দিতে পারি মানুষও তার যোগ্যতার দ্বারা দেবতার স্তরে উন্নীত হয়ে দেবতাদের সমমর্যাদা লাভ করতে পারে। মানবপোক ও দেবলোকের মধ্যে অন্ধকার যে অন্তহীন শূন্যতা চিরবিদ্যমান, যার চারদিকে প্রজ্বলিত নরকাগ্নির লেলিহান শিখা ঊর্ধ্বায়িত হয়ে ওঠে প্রতিনিয়ত, সে শূন্যতার ব্যবধান অতিক্রম করার জন্য মানুষের কল্পনা এক নিষ্ফল বেদনার সংগ্রাম করে আসছে চিরকাল। আমি কিন্তু ভীত হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসব না। যদিও জানি এর পরিণামে এক নঞর্থক শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই তথাপি আমি সানন্দে এ সিদ্ধান্ত এ সংকল্প গ্রহণ করেছি। 

হে আমার স্ফটিকস্বচ্ছ পানপাত্র, তুমি যেন বহু যুগের ওপার হতে উঠে আসছ আমার কাছে। তোমার সঙ্গে সঙ্গে বহু দিনের বহু বিস্মৃত কথা উঠে আসছে আমার মনে। সুদূর অতীতে একদিন তুমি আমার পূর্বপুরুষদের কত ভোজসভা উজ্জ্বল করে। তুলতে। কত গণ্যমান্য অতিথিদের প্রীত করতে তুমি। তুমি তখন এক হাত হতে অন্য হাতে ফিরতে। সেই সব নৈশ্যভোজসভায় কত ধনী ও সুদক্ষ ব্যক্তি তোমাকে পেয়ে মত্ত হয়ে উঠত। অনেক সময় আমি এক চুমুকে একটি পূর্ণ পাত্র নিঃশেষিত করতাম। আবার অনেক সময় নিজে না খেয়ে একটি পাত্র অপরের হাতে তুলে দিতাম। আমার। যৌবনকালের সেই সব আনন্দোচ্ছল উৎসব রজনীর কত স্মৃতি ছন্দোবদ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসছে আমার মন থেকে। আর কিন্তু কখনও কোনও ভোজসভায় আমার পার্শ্ববর্তী কোনও অতিথির হাতে তোমায় তুলে দেব না। তোমার গর্ভনিহিত সমস্ত মদ্য পান করেও কিভাবে আমার চেতনা ও বুদ্ধি অক্ষত থাকে তার পরীক্ষা আর কোনওদিন করব না। আজ তোমার স্ফটিকস্বচ্ছ গর্ভে বাদামী রঙের যে রসমাধুরী বিরাজ করছে তা পান। করার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত নিদ্রা নেমে আসে চোখে। আমি সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে রসমাধুরী নিঃশেষে পান করতে চাই। তারপর সুগভীর সুখনিদ্রায় নিবিড় নিশাকাল যাপন করে এক উজ্জ্বল প্রভাতকে বরণ করে নিতে চাই আমি। 

(পান পাত্রটি মুখের কাছে নিয়ে গেল) 

(মৃদু ঘণ্টাধ্বনি ও সমবেত সঙ্গীত)। 

দেবদূতদের সমবেত গান

খ্রিস্টের পুনরভ্যুত্থান ঘটেছে
সমগ্র মানবজাতির পক্ষে এ এক বিপুল আনন্দের কারণ।
অসংখ্য প্রয়োজনের বন্ধনে
খ্রিস্টকে নতুন করে আবদ্ধ করতে চাইছে 
অযোগ্য মানুষ।

ফাউস্ট : আমার ওষ্ঠাধরের সঙ্গে পানপাত্রের মিলনের সঙ্গে সঙ্গেই কিসের এক মৃদুমধুর গুঞ্জনধ্বনি চমকিত করে তুলছে আমায়। তবে কি এ ধ্বনির মধ্যে খ্রিস্টের জন্মমূহূর্ত ঘোষণাকারী সানন্দ ঘন্টাধ্বনিই ঘোষিত হয়ে উঠেছে নূতন রূপে? হে অস্কুট সঙ্গীত, খ্রিস্টের মৃত্যুর পর সারা রাত্রিব্যাপী দেবদূতের কণ্ঠনিঃসৃত সান্ত্বনা বাণী ছড়িয়ে পড়েছিল স্বর্ণ ও মর্তের আকাশে-বাতাসে। ঈশ্বরের নূতন আদেশ-বিধৃত যে দৈববাণী বার বার ঘোষিত হয়েছিল, তোমার মধ্যে আজ কি সেই বাণীই ধ্বনিত হয়ে উঠছে। বারবার? 

নারীদের সমবেত গান

মূল্যবান ওষধি আর মশলা দিয়ে প্রলেপ তৈরি
করে লাগিয়ে দিলাম তাঁর ক্ষতস্থানে।
যথাযোগ্য শ্রদ্ধা আর সম্মানের সঙ্গে
তাঁকে আমরা শুইয়ে দিয়েছিলাম।
পরিষ্কার বস্ত্রখণ্ড দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলাম ক্ষতগুলো।
কিন্তু পরিশেষে চোখ মেলে দেখলাম
খ্রিস্ট নেই; আমাদের এতগুলো চক্ষের
প্রহরাকে ফাঁকি দিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল তাঁর দেহাবয়ব! 

দেবদূতদের সমবেত গান

পুনরভ্যুত্থিত হয়েছেন খ্রিস্ট
পরম স্বর্গীয় সুখে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে তার নবজীবন।
যে দুঃখকষ্টে একদিন তিনি প্রপীড়িত হন,
যে অপমানে একদিন তিনি অপমানিত হন
যে পরীক্ষায় একদিন তিনি পরীক্ষিত হন,
আজ তার সব কিছুর অবসান ঘটেছে 
এক অভিনব গৌরবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার দেহ।

ফাউস্ট : স্বর্গলোকাগত হে শান্ত অথচ বলিষ্ঠ শব্দসুষমা, কেন তুমি এই ধূলিমলিন জগতে এসে আমাকে প্রলুব্ধ করতে চাইছ? তার থেকে বরং তুমি আমার থেকে দুর্বলমনা ব্যক্তিদের কাছে যাও। তোমার অন্তর্নিহিত সুরময় বাণী আমি শুনেছি। কিন্তু যে ধর্মবিশ্বাস হতে দৈববাণীর প্রতি এক ঐন্দ্রজালিক আসক্তি ও ভক্তির জন্ম হয় সে ধর্মবিশ্বাস ঈশ্বর আমাকে দেয়নি। যেখান হতে উৎসারিত হচ্ছে এই পরমানন্দ অভিনিষ্যন্দী বাণী সেই স্বর্গলোকে আমি উঠে যেতে চাই না। তথাপি আমার সুদূর শৈশবকাল হতে আমি এ বাণী এ গান শুনে আসছি। আজ আমার সেই গান সেই বাণী আনুগত্যের এক নূতন দাবি নিয়ে এসেছে আমার জীবনে। 

আজও আমার মনে আছে অতীতে কোনও এক ছুটির দিনে সহসা স্বর্গীয় প্রেমের এক উত্তপ্ত চুম্বন নেমে আসে আমার ললাটদেশে। এক পবিত্র ধর্মভাবের আভাসে উদভাসিত হয়ে ওঠে আমার অন্তর। কোথা হতে ভেসে আসা চার্চের মৃদু ঘণ্টাধ্বনি সমন্বিত প্রার্থনার অশ্রুত সঙ্গীত ধ্বনিত হয়ে ওঠে আমার কর্ণকুহরে। এক পরম স্বর্গীয় সুখানুভূতির অতলে নিঃশেষে বিগলিত হয়ে যায় আমার সমগ্র অন্তরসত্তা। এক মধুর। অথচ দুর্বোধ্য ব্যাকুলতার মদাবেশাকুলা অরণ্যপ্রান্তচারিণী বনহরিণীর মতো লঘু হয়ে। ওঠে আমার পদযুগল। অজস্র অশ্রুবিন্দুর তপ্ত জ্বালা সত্ত্বেও আমার মনে হলো স্তবকিত আশা ও আনন্দের অমিত ঐশ্বর্যভাবে সজ্জিত এক বিরাট পৃথিবী প্রতীক্ষায় রয়েছে আমার জন্য। 

আমার যৌবনে এই গান একদিন আনত বসন্তের আনন্দোচ্ছ্বাস। কিন্তু আজ সে সব কথা মনে পড়লে মনে হয় শিশুসুলভ এক বাতুলতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম তখন আমি। স্থিতপ্রজ্ঞ এই পরিণত বয়সে সে পথ থেকে ফিরে এসেছি। সে স্বর্গসুধাসিক্ত সুমধুর দৈববাণী, তুমি গীত হয়ে চলো এমনি করে অবিরাম। তোমার অন্তর্নিহিত গীতিরসসুধাপানে চোখে জল আসছে আমার। তবু তোমাকে সহজ বিশ্বাসের দ্বারা বরণ করে নিতে পারছি না। আমি মাটির পৃথিবীর সন্তান। আমার সেই কল্পলোকবিহারিণী সুউচ্চ স্বর্গসুখদ্বার হতে আমি আমার পৃথিবীমাতার মাটির কোলেই ফিরে এসেছি। আবার। 

শিষ্যগণের গান

শূন্যবদ্ধ সমাধিগহ্বর হতে তিনি কি
উঠে এসেছেন পুনরুজ্জীবিত হয়ে?
পুনরায় কি সমাসীন হয়েছেন তিনি
পূর্ণ গৌরবের আয়ত উন্নত আসনে?
পুনর্জন্মের গৌরবে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে
কি তার এই অপ্রতাশিত নবজীবন?
কিন্তু আমরা এই মর্তভূমির অধিবাসী 
তার দর্শনাভিলাষী একান্ত বিশ্বস্ত অনুচর হয়েও
কেন তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না?
দেখা দাও হে প্রভু। আমরা কাঁদছি।
আমাদের অশ্রুসজল এই সকাতর প্রার্থনায় সাড়া দাও।
তোমার সন্দর্শনসুধাদানে ধন্য করো আমাদের। 

দেবদূতগণের গান

সমস্ত নরকের পাপ আর দুর্নীতির গর্ভ
বিদীর্ণ করে বেরিয়ে এসে পুনরাবির্ভূত হয়েছেন খ্রিস্ট।
যতসব অবিশ্বাস আর সঙ্কীর্ণতার কারাগার ভেঙে
বেরিয়ে এস তোমরা!
স্বার্থসম্পৃক্ত আত্মার দুষিত গুহা থেকে তোমরা বেরিয়ে এস!
দীর্ণ-বিদীর্ণ করে ফেল সমস্ত অন্ধকার।
দিক দিগন্তে অনন্ত প্রসারিত হয়ে উঠেছে যে বিপুল আলোকতরঙ্গ
তাতে অবগাহন করো, অভিম্নত হও।
খ্রিস্টের প্রশস্তি গান করো।
অখণ্ড অন্তরের অনন্ত ব্যাকুলতা নিয়ে কামনা করো
সেই প্রেমঘন মূর্তিকে।
ভাই-এর মতো তার হাত ধরে খাওয়াও।
তাঁর উত্তরাধিকারীরূপে তার বাণী প্রচার করো।
মনে রেখো, আমাদের প্রভু এইখানেই আছেন
আমাদের কাছেই আছেন। 

দ্বিতীয় দৃশ্য

নগরদ্বারের সম্মুখস্থ স্থান 

(বিভিন্ন শ্রেণীর পথচারীদের আগমন)

কয়েকজন শিক্ষানবিশী : ওদিকে যাচ্ছ কেন তোমরা?

অন্যান্যরা : আজ আমরা শিকারির বাসভবনের দিকে যাচ্ছি। 

অন্যান্যদের মধ্যে একজন : আমরা অদূরবর্তী ঐ নিচু জায়গায় অবস্থিত একটা কারখানায় যাচ্ছি। 

প্রথম শিক্ষানবিশী : আমার মতে ট্রাভার্ন নদীতে তোমাদের যাওয়া উচিত।

দ্বিতীয় শিক্ষানবিশী : কিন্তু যাই হোক, পথটা ভালো নয়। 

অন্যান্যরা : কিন্তু তোমরা কোথায় যাবে? 

চতুর্থ শিক্ষানবিশী : বার্গডফ পর্যন্ত যাবে? সেখানে গেলে প্রচুর আনন্দের খোরাক পাবে। কত উৎকৃষ্ট মদ আর সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে পাবে সেখানে। কত হাসিঠাট্টার উপকরণ যে আছে! আমার কথা বিশ্বাস করো। 

পঞ্চম শিক্ষানবিশী : তোমার গোপন কথা কি আবার ফাঁস করে ফেলতে চাও? এই নিয়ে তিনবার হলো। খুব হয়েছে। আর বড়াই বা বাহাদুরী করতে হবে না। আমি আর সেখানে যাব না। ও সব হাসিঠাট্টা আর ভালো লাগে না আমার। 

তরুণী ভৃত্য : না, না, আবার শহরে ফিরে যাব।

অন্য তরুণী : নিশ্চয় আবারা তাকে ঐ সব পপলার গাছের পাশে পাব। 

প্রথম তরুণী : তাতে আমার কোনও সৌভাগ্য বৃদ্ধি হবে না, তা আমি বেশ জানি। তুমি তাকে পাবে এবং তারই সঙ্গে সর্বত্র ঘুরে বেড়াবে। তুমি হবে তারই নৃত্যের সহচরী কিন্তু তাতে কি যায় আসে? 

অন্য তরুণী : সে নিশ্চয় একা নেই আজ। আমি তাকে বলতে শুনেছিলাম তার সঙ্গে থাকবে কোন কুঞ্চিতকেশা তরুণী। 

জনৈক

ছাত্র : হা ভগবান, মেয়েগুলো কেমন হাঁটছে দেখো। আমরা তাদের বসে বসে দেখব। পুরনো কড়া মদ আর একটা পাইপ যদি পাই তাহলে রবিবারের উজ্জ্বল পোশাক পরিহিতা এই সব মেয়েদের দেখে বড় মজা পাই আমি। 

জনৈক ভদ্র নগরবাসীর কন্যা : ঐ সব সুন্দর যুবকগুলোর কাণ্ড দেখো। আমি বলছি, সমাজে যখন ভদ্র পরিবারের মেয়েরা রয়েছে তখন ঐ সব নিম্নশ্রেণীর দাসী মেয়েদের পিছনে ছোটা ওদের পক্ষে সত্যিই লজ্জাজনক ব্যাপার।

দ্বিতীয় ছাত্র (প্রথম ছাত্রের উদ্দেশ্যে) : এত তাড়াতাড়ি যেও না বাছা! একজন সামনে, আর দুজন পিছনে। কী চমৎকার ঝকঝকে পোশাক পরেছে দেখো। ওদের মধ্যে একজন আবার প্রতিবেশিনী দেখছি। ও আমার হৃদয় কেড়ে নিয়েছে। তারা কোনও দিকে না তাকিয়ে এক কৃত্রিম ঔদাসিন্যে আত্মলীন হয়ে এগিয়ে চলেছে। তবু তারা আমাদের নিবেদিত প্রেমকে স্বীকার করে নেবে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। 

প্রথম

ছাত্র : না ভাই। তাদের গতিবিধি আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। তাড়াতাড়ি করো। তা না হলে ওরা আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে কোথায় চলে যাবে। শনিবারে তাদের যে হাত সম্মার্জনী ধারণ করে গৃহমার্জনা করে, রবিবার সেই হাতই আদর প্রভৃতি নানারূপ শৃঙ্গারকার্যে থাকবে ব্যাপৃত। 

জনৈক নাগরিক : নূতন পৌরপতিকে আমার তো মোটেই ভালো লাগে না। উনি ওঁর পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে কোনও কাজ হয়নি। ওঁর অহঙ্কার শুধু দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। উনি আসার পর আমাদের শহরের কি কোনও উপকার বা উন্নতি হয়েছে? উন্নতি তো দূরের কথা শহরের অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। উনি শুধু আমাদের কাছ থেকে আগের থেকে আরও বেশি করে আনুগত্য আর কর চাইছেন আর আমরা তা অকাতরে দিচ্ছি। 

ভিক্ষুকের গান : হে ভদ্রমহোদয়গণ এবং সুন্দরী নারীগণ! আপনাদের মুখমণ্ডল কত সুন্দর, আপনাদের পোশাক কত সুন্দর! একবার আমার দিকে তাকান। দেখুন আমার পক্ষে আপনাদের সাহায্য কতখানি প্রয়োজন। আপনারা ইচ্ছা করলেই আমার দুঃখ-দুর্দশার অনেকখানি লাঘব করতে পারেন। আপনাদের নিকট আমার আবেদন যেন ব্যর্থ না হয়। দেখবেন দানেতেই আছে প্রকৃত আনন্দ। আজ ছুটির দিন আপনারা যদি একটু দয়া করেন তাহলে সেটা আমার পক্ষে সত্যিই লাভজনক হবে। 

অন্য একজন নাগরিক : রবিবার আমার মোটেই ভালো লাগে না। শুধু যুদ্ধের গল্প আর গল্প। সুদূর তুরস্কের কোথায় যুদ্ধ হচ্ছে, পৃথিবীর আর কোথায় কারা যুদ্ধ করছে, ঘরের মধ্যে জানালার ধারে বন্ধুদের সঙ্গে মদের গ্লাস হাতে বসে বসে শুধু সেই গল্প করে সময় কাটাতে হয়। আর মাঝে মাঝে নদীর উপর দিয়ে নিঃশব্দে যে সব জাহাজ চলে যায় তা দেখা। তারপর রাত্রিতে বাড়ি ফিরে গিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়া। 

তৃতীয় নাগরিক : হে আমার প্রিয় প্রতিবেশী, আমার মতও তাই। মাথা খারাপ ওদের; সুবুদ্ধি সুমতিতে জলাঞ্জলি দিয়ে রিপুপরবশ হয়ে ওরা যা করে করুক। ওদের তাই করতে দাও। আমরা কিন্তু প্রাচীন প্রথাগত রীতিনীতিকেই মেনে চলব। 

জনৈক বৃদ্ধা (ভদ্র নাগরিকের কন্যার প্রতি) : হা ভগবান! কী চমৎকার! যেমন দেহভরা যৌবন তেমনি লাবণ্য উপচে পড়ছে। তোমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার হৃদয় দিয়ে দেবে না এমন কে আছে? তবে অত দর্প আর মেজাজ দেখিও না। আমি অবশ্য কোনও কথা বলব না। তুমি যা চাইবে আমি তার ব্যবস্থা করে দেব। 

নাগরিকের কন্যা : এস আগাথা! ওই ডাইনি বুড়ির কাছ থেকে আমি সরে যেতে চাই। সকলের সামনে ওর কাছে থাকলে আমাদের সম্বন্ধে ভুল ধারণা হবে লোকের মনে। ও অবশ্য সেই সেন্ট অ্যান্ডরু রাত্রিতে আমার ভাবী প্রণয়ীকে দেখিয়েছিল। 

অন্য তরুণী : আমারও ভাবী প্রণয়ীকে দেখিয়েছিল ও। পরিষ্কারভাবে। কয়েকজনের মধ্যে একটি যুবক সৈনিক ছিল। সেই সৈনিকই আমার প্রণয়ী। আমি তাকে তারপর থেকে সর্বত্র খুঁজে চলেছি, কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। 

সৈনিকরা : সুউচ্চ প্রাকার ও চূড়াসহ কত সৌধমালা ও কত সুন্দরী কুমারী আমাদের করতলগত হবে। আমরা যদি সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাই তাহলে তার যথাযোগ্য পুরস্কার পাবই। সুতরাং হে যুবকগণ, তোমাদের আহ্বান করে দিকে দিকে জয়ঢাক নিনাদিত হোক। তার ডাকে সাড়া দিয়ে তোমরা জীবনের যত সব ভোগসুখ ও পরিশেষে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাও। আমাদের বিক্ষুব্ধ জীবনে এই ভোগসুখই হলো একমাত্র সান্ত্বনা। সুন্দরী ললনা আর সৌধাবলী লাভ করার জন্য সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলো। পুরস্কার একদিন পাবেই। সৈনিকরা এইভাবেই চিরকাল এগিয়ে যায় তাদের আপন আপন জীবনে। 

ফাউস্ট ও ওয়াগনার : উদার বসন্ত সমাগমের সঙ্গে সঙ্গে শীতকালীন বরফের বন্ধন হতে মুক্ত হয়ে নদী প্রস্রবণগুলো ছুটে চলেছে সমতলভূমির পানে। নূতন আশার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে উপত্যকাগুলো। দুর্বল শৈত্যরাজ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিঃসঙ্গ নির্জন পর্বতচূড়ায় গিয়ে মুকুটহীন সম্রাটরূপে অধিষ্ঠিত করেছে নিজেকে। তবে পশ্চাদ্ধাবনকালে সে মাঝে মাঝে কয়েক পশলা নিষ্ফল বৃষ্টি আর কিছু মেঘান্ধকার দ্বারা ছায়াছন্ন করে তোলে সবুজ ভূমিগুলোকে। সূর্যকিরণ ক্রমশ প্রখর হয়ে ওঠায় তুষারপাত বন্ধ হয়ে যায়। দিকে দিকে অব্যাহত ও অপ্রতিহত হয়ে ওঠে যত সব সৃষ্টি আর অগ্রগতির স্রোত। সূর্যের সুতপ্ত ইচ্ছায় রঙে রঙে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সমগ্র জগৎ। নীল, হলুদ, লাল প্রভৃতি রঙ-বেরঙের কুঁড়িগুলো ফুল হয়ে ফুটে ওঠে। 

এবার প্রকৃতিজগৎ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নগরের দিকে একবার তাকাও। বিচিত্র রঙের পোশাক পরে আনন্দোচ্ছল নরনারীরা তাদের রুদ্ধদ্বার গৃহান্ধকার হতে বেরিয়ে এসেছে। তাদের ভগবান যীশুর পুনরভ্যুত্থানের দিনটি আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করতে তারা। তারা যেন নিজেদের মধ্যেও অনুভব করছে নবজীবনের এক উন্মাদনা। অন্ধকার গলি আর সংকীর্ণ গৃহকোণের বন্ধন, দারিদ্র্যের পীড়ন, কর্মের তীব্রতা আর স্তবগম্ভীর ধর্মীয় পরিবেশ প্রভৃতি থেকে মুক্ত হয়ে তারা যেন নবজীবন লাভ করেছে। চারদিকে মাঠে প্রান্তরে বাগানে নদীবক্ষে নৌকারোহণে অসংখ্য নরনারী নবজীবনের অদম্য উন্মাদনার উচ্ছ্বসিত আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নদীতে ছোট ছোট ডিঙি নৌকাগুলো যাত্রীদের ভারে ডুবতে বসেছে। দূরে ঐ পাহাড়ি পথে বিচিত্র রঙে পোশাক পরিহিত লোক যাচ্ছে। আমি দূর গ্রাম থেকে কলরবের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আজ যেন স্বর্গ নেমে এসেছে পৃথিবীতে। উচ্চ-নীচ সকল ব্যক্তি সমান ভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে খুশিতে। 

ওয়াগনার : স্যার ডক্টর, আপনার সাহচর্য ও সঙ্গলাভ আমার পক্ষে সত্যিই সম্মানজনক এবং লাভজনক। কিন্তু এই সব অগভীর কোনও আলোচনা করতে আমি চাই না। কারণ যা কিছু স্কুল তার প্রতিই বিতৃষ্ণা জাগে আমার মনে। সাধারণ মানুষের এই উল্লসিত কলরব, এই আনন্দোন্মত্ততাকে আমি ঘৃণা করি। তারা যাকে আমোদপ্রমোদ বা গান বলছে তা হলো মত্ততাজনিত এক ক্রীড়া আসলে যা শয়তানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। 

লিভেন গাছের তলায় একদল কৃষক 
(নাচগান)
লাল ফিতে, ফুলের মালা আর মজার পোশাক পরে
গ্রামের যত সব রাখাল বালক-বালিকারা
নাচতে এসেছে এই গাছের তলায়।
এই লিনডেন গাছের চারদিকে
উন্মত্ত চরণক্ষেপে নৃত্য শুরু করার জন্য
প্রস্তুত হয়ে উঠেছে একযোগে।
হুররে! কী মজা!
নাচিয়েদের মধ্য থেকে এক তরুণ যুবক
সহসা বেরিয়ে এসে দর্শকদের মধ্য থেকে
এক কুমারীকে ধরে বগলদাবা করে নিয়ে গেল।
মেয়েটি দর্শকদের মধ্যে থেকে নাচ দেখছিল।
মেয়েটি তখন তাকে বলল, তুমি একটি মাথামোটা ছেলে।
হুররে! কী মজা!
যারা নাচ দেখতে চাও, ভালোভাবে দাঁড়িয়ে থাকো। 

তারপর ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগল তারা।
কখনো বাঁয়ে কখনো ডাইনে নেচে যেতে লাগল অক্লান্তভাবে।
নাচতে নাচতে উত্তপ্ত হয়ে উঠল তাদের দেহ
মুখচোখ হয়ে উঠল লাল।
হাত ধরাধরি করে নাচতে নাচতে হাঁপাচ্ছিল তারা। 
অনেকে থেমে পড়ছিল হাঁপাতে হাঁপাতে।
তাদের পাছা আর বগল খুব দুলছে।
এখানে কিন্তু তোমরা সব খুব বেশি মাখামাখি করো না,
কারণ অনেকেই এখানে ভাব করে পরে তার প্রেমিকাকে ছেড়ে দেয়।
অনেক সময় বিশ্বাসঘাতকতা করে।
এই লিনডেন গাছের তলায় এক নিবিড় ও অসতর্ক মুহূর্তে
যে প্রেম গড়ে ওঠে তা দুদিন পরেই উবে যায়। 
হুররে, হুররে, খুব করে ‘ফিডন বো’ খেলো।

জনৈক বৃদ্ধ কৃষক : হে মহাশয় ডাক্তার ফাউস্ট, আপনার মতো একজন সুপণ্ডিত ব্যক্তি যে এই উল্লসিত জনতার মাঝখানে দয়া করে নেমে এসেছেন সেটা আপনার মহানুভবতার পরিচায়ক। যদি এসেছেন তাহলে সবচেয়ে সুন্দর পানপাত্রটি ধরুন, আমি তাতে মদ ঢেলে দিই। আমার বিনীত ইচ্ছা, আপনি এখন পান করুন এবং অসংখ্য মদের বিন্দুর মতোই আপনার জীবনের আয়ুর দিন বেড়ে যাক। 

ফাউস্ট : তুমি ভালোবেসে যে পাত্র দিচ্ছ, আমি ধন্যবাদের সঙ্গে তা গ্রহণ করছি। তোমাদের স্বাস্থ্য কামনা করি আমি। 

(ফাউস্টের চারপাশে জনতা ভিড় করে দাঁড়াল)

বৃদ্ধ কৃষক : সত্যি কথা বলতে কি, আপনি আমাদের আনন্দের দিনেই এসে পড়েছেন। খুব ভালো হয়েছে। আপনি যিনি আমাদের দুঃখের দিনে আমাদের প্রচুর সাহায্য করেন, আজ সুখের দিনে তাকে পেয়ে আমাদের বড় ভালো লাগছে। এখানে আজ এমন অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে যাদের প্রাণ আপনার পিতা সুদক্ষ হাতে ভয়ঙ্কর জ্বরে বা প্লেগের কবল থেকে রক্ষা করেন। আপনি নিজেও যত সব দীন-দুঃখীর বাড়ি বাড়ি ঘুরে অনেক অনেক সাহায্য দান করেন। বহু মৃতদেহ নিজের ঘাড়ে করে সৎকার করেন। তাতে আপনার কোনও ক্ষতি হয়নি। জীবনের কোনও পরীক্ষাই এড়িয়ে যাননি আপনি। আপনার সাহায্যের অফুরন্ত ভাণ্ডার যেন কোনও দয়ালু দেবতার আশীর্বাদে ধন্য ও সমৃদ্ধ ছিল। 

সকলে : আমরা সেই সুদক্ষও বহু পরীক্ষিত সুমহান ডাক্তারের স্বাস্থ্য কামনা করি। আমাদের সকলের উপকার ও সাহায্য দানের জন্য তিনি যেন দীর্ঘকাল জীবিত থাকেন। 

ফাউস্ট : যিনি স্বর্গ থেকে আমাদের সমস্ত সাহায্য দান করেন, যিনি আমাদের সমস্ত বিষাদ থেকে উদ্ধার করেন, হে বন্ধুগণ, তোমরা তার উদ্দেশ্যে মাথা নত করে তাঁকে প্রণাম করো। 

(ফাউস্ট ওয়াগনারের সঙ্গে এগিয়ে চলল)

ওয়াগনার : হে মহান, জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধার্ঘ্য কিভাবে কি মনে গ্রহণ করবেন তা জানি না, তবে এইটুকু জানি যে যিনি আপন গুণে ও যোগ্যতায় এই ধরনের শ্রদ্ধা ও সম্মানে ভূষিত হন তিনি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান ব্যক্তি। তরুণদের কাছে। ওরা আপনাকে পরিচিত করে দিচ্ছে। আপনার জন্য ওদের নৃত্যগীত থেমে গেছে। ওরা আপনার দিকে তাকিয়ে আপনার কথা বলাবলি করছে। আপনি যাচ্ছেন আর ওরা ওদের মাথায় টুপি খুলে উঁচুতে তুলে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। আপনি যদি ওদের কাছে আর একটু এগিয়ে যান ওরা হয়ত নতজানু হয়ে আপনার বন্দনা করবে, মনে। হবে যেন কোনও দেবদূত এসেছে ওদের কাছে। 

ফাউস্ট : আর একটু উপরে উঠে চলো। ঠিক ঐ পাথরটার কাছে ওখানে গিয়ে আর আমরা এগোব না। ওখানেই আপাতত কিছুক্ষণ থাকব। আগে যখন আমি উপবাস আর উপাসনায় নির্বোধের মতো দিন কাটাতাম তখন কতদিন গভীরভাবে চিন্তামগ্ন অবস্থায় ঐ পাথরটার কাছে একা বসে থেকেছি আমি। ওখানে আমি কতদিন মনেতে এক বলিষ্ঠ আশা আর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে চোখে অশ্রু আর বুকভরা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে করজোড়ে ঈশ্বরের কাছে কত মৃত্যুকামনা করেছি। অনন্ত প্রসারিত মৃত্যুর শান্তিময় অঞ্চলভাগটাকে কোনও রকমে একটুখানি স্পর্শ করার জন্য কত কাতর প্রার্থনা করেছি ঈশ্বরের কাছে। 

আজ জনগণের এই উচ্ছ্বসিত শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনে ঘৃণাবোধ করছি আমি। আমার ও আমার পিতার উদ্দেশ্যে ওরা যে প্রশংসার উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল তাতে আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে কি অনুভূতি জাগছে তা যদি তুমি একবার বুঝতে পারতে। আমার পিতা ছিলেন একজন গম্ভীর প্রকৃতির চিন্তাশীল লোক। তিনি শুধু প্রকৃতির রাজ্য থেকে কল্যাণকর উপাদানগুলো ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করে তাই দিয়ে মানুষের রোগ-যন্ত্রণার প্রতিকার হিসাবে কিছু ওষুধ প্রস্তুতের জন্য নির্বোধের মতো শ্রম ও সংগ্রামে মেতে উঠতেন। তিনি তাঁর প্রায়ান্ধকার দোকানঘরে সব সময় কুঁজো হয়ে বসে বিচিত্র উপাদানের সংমিশ্রণে ওষুধ তৈরি করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তৈরি ওষুধটার মধ্যে রঙের জৌলুস থাকলেই তা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই যেন রোগীদের রোগ সেরে যেত। কিন্তু কেউ জানতে চায়নি সঠিকভাবে কার্যত কার কার রোগ সেরেছে সেই ওষুধে। আমাদের প্রদত্ত সে ওষুধ অনেক সময় বিষের মতো কাজ করত আর তাতে অসংখ্য লোক মারা যেত। এইভাবে পার্শ্ববর্তী এই সব পার্বত্য এলাকায় আমরা দুজন এক জীবন্ত মহামারীরূপে ঘুরে বেড়াতাম। আজ সেই নির্লজ্জ নরঘাতকদেরই ওরা প্রশংসা করছে আর আমাকে তা শুনতে হচ্ছে। 

ওয়াগনার : তার জন্য আপনি চিন্তাৰিত হচ্ছেন কেন? পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রদত্ত কোনও পেশার উন্নতি সাধনে সর্বপ্রযত্নে চেষ্টা করা যে কোনও সৎ লোকেরই উচিত। আপনি একজন যুবক; আপনি নিশ্চয় আপনার পিতাকে শ্রদ্ধা করেন। তাহলে তার দেওয়া পেশাগত শিক্ষা থেকে অবশ্যই আপনার আনন্দ পাওয়া উচিত। মানুষ হিসাবে আপনি নিশ্চয় আপনার জীবনের লব্ধ সত্যের ভাণ্ডার বর্ধিত করতে চান। তাহলে আপনি অবশ্যই আপনার পুত্রকেও এই পেশা শেখাবে যাতে সে আপনাকেও যোগ্যতায় ছাড়িয়ে যেতে পারে পরবর্তীকালে।

ফাউস্ট : ভ্রান্তিজনিত অধঃপতনের গভীরে পতিত হয়েও পুনরুত্থানের আশা রেখে যারা নূতন আশায় সঞ্জীবিত হয়ে আবার ওঠার চেষ্টা করে তারা সত্যিই সুখী। ভবিষ্যতের যে সত্য তার কাছে অজ্ঞাত সেই সত্যই আস্থা স্থাপন করে চলে মানুষ ইচ্ছা করে; কিন্তু যে সত্য তার জ্ঞাত তা সে মেনে চলতে চায় না। কিন্তু সে যাই হোক, এই সব হতাশার কথা ভেবে আজকেই এই মুহূর্তের আনন্দকে তিক্ত করে লাভ নেই। ঐ দেখো, প্রাকসন্ধ্যার এই অস্তগত প্রায় সূর্যের শেষ সোনালী আলোয় সবুজ বাড়িগুলো কেমন চকচক করছে। এখন ক্রমশই ম্লান হয়ে আসছে সূর্যের আলো। অবসান ঘটেছে সারাদিনের যত সব কাজকর্মের। এখন শেষ সূর্যরশ্মি এ জগৎ ছেড়ে নূতন কোনও জগৎ ও জীবনের আশায় যাত্রা শুরু করেছে। হায়, এমন কোনও পাখা নেই যার উপর ভর করে আমি এখান থেকে বহু ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে এই সূর্যরশ্মির যাত্রাপথটির অনুসরণ করতে পারি। তাহলে অনন্ত এক স্বর্ণোজ্জ্বল সূর্যাস্ত দেখে ধন্য হতাম আমি। অস্তম্লান স্বর্ণরশ্মির আভায় পরিপ্লাবিত হয়ে উঠত আমার নিম্নস্থ ধরণীতল। এক আগ্নেয় দীপ্তিতে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠত পর্বতশৃঙ্গগুলো। সেই অমিত দীপ্তিরাশি ঝরে পড়ে রূপালি নদীজলধারাগুলোকে স্বর্ণপ্রভ করে তুলত চিরকালের জন্য। চিরশান্তি বিরাজ করত পার্বত্য উপত্যকাগুলোতে। তখন আমি হয়ে উঠতাম দেবতাদের মতোই অবাধ ও অপ্রতিহত গতি। অসংখ্য পর্বতমালা সংলগ্ন গভীর খাদগুলো কোনওক্রমেই গতিরোধ করতে পারত না আমার। আমার চক্ষুর সামনে অনন্তপ্রসারিত মহাসমুদ্রের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ মালাগুলো কোন যাদুমন্ত্রে যেন এক চির উজ্জ্বল ও আয়তনীল মুখে সমাহিত হয়ে থাকত। মরণশীল মানবজীবন সুলভ অবসাদ মুহূর্তে দূরীভূত হয়ে যেত আমার দেহমন থেকে। অনন্ত স্বর্গীয় আলোকসুধা পান করে জরামৃত্যুহীন এক দৈব প্রাণের উন্মাদনায় আশ্চর্যরূপে সপ্রতিভ হয়ে উঠতাম আমি। অবিরাম অনাবিল সুখে সমৃদ্ধ সেই স্বর্গবাস গৌরবময় এক স্বপ্নমাধুরী নিয়ে পরিপূরিত করে তুলত আমার দিনরাত্রিগুলোকে। 

কিন্তু হায়, সে গৌরব কত ক্ষণভঙ্গুর। হায়, আমার এই মাটির দেহটিকে এই মাটির পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে যাবার মতো কোনও পাখা সৃষ্ট হয়নি আজও। কিন্তু তা সত্ত্বেও যখনি এই পৃথিবীর নদীতে হ্রদে সমুদ্রে পাল তুলে কোনও জাহাজ ভেসে যায় দূর আকাশে, কোনও উদ্ধত পাখা মেলে কোনও ঈগল উড়ে যায় অথবা ঊর্ধ্বগগনে উড্ডীন কোনও লার্ক পাখি মুঠো মুঠো গান ছড়িয়ে দেয় পাহাড়ে প্রান্তরে ঠিক তখনই প্রতিটি মানুষের অন্তরের মধ্যে জেগে ওঠে সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির এক অভ্রভেদী উন্মাদনা। অবুঝ উচ্চাকাঙ্ক্ষী পাখির মতো সে তখন আকাশের ওপারে গিয়ে নীল আলোর গভীরে হারিয়ে যেতে চায় নিঃশেষে। 

ওয়াগনার : আমার মনের মাঝে সময়ে সময়ে এই ধরনের এক অদ্ভুত খেয়াল জাগত বটে, কিন্তু কখনও আপনার মতো এমন উন্মাদনা অনুভব করিনি আমি। কোনও অরণ্য বা প্রান্তর যত মনোরমই হোক না কেন তার পানে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ক্লান্তি অনুভব করি আমি। কোনও আকাশগামী পাখির গানের যত মায়াই থাক না কেন সে পাখির পাখা আমি কখনও কামনা করি না। বই পড়তে পড়তে যে কল্পনা প্রসারিত হয়ে ওঠে আমার মনে, আমি তাতেই পাই আনন্দ আর নবজীবনের আস্বাদ। শীতের রাত্রিতে আমি যখন কোনও আরামশয্যায় ডুব দিয়ে থাকি, তখন আমার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের শিরায় শিরায় কৃত্রিম তাপের যে বন্যাপ্রবাহ খেলে যায় তাতে মনে হয় আমার চারিদিকে তখন স্বর্গ নেমে এসেছে। এক অফুরন্ত স্বর্গসুখ ঘন হয়ে উঠেছে আমার এই পার্থিব জীবনে। 

ফাউস্ট : একটা কথা ভালোভাবে মনে রেখো, অপর কোনও মানুষকে যেন জানতে যেও না। আমার নিজের বুকের মধ্যেই দুটো আত্মা আছে। আমি ভেবেছিলাম এই দুই আত্মার মধ্যে ভ্রাতৃসুলভ এক গভীর ও অবিচ্ছিন্ন সম্প্রীতি বিরাজ করবে। কিন্তু হায়, একে অন্যকে ঘৃণার সঙ্গে এড়িয়ে চলে। একজন যদি সমগ্র বিশ্বজগৎকে এক গভীর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চায়, অন্য আত্মাটি তখন সে ভালোবাসার বন্ধনকে ঘৃণাভরে ছিন্নভিন্ন করে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিতে চায় শূন্যে। স্বর্গ আর মর্ত্যলোকের মধ্যবর্তী কোনও জগতে যদি কোনও প্রেতাত্মা থাকত যদি সে আমার নির্দেশ মতো আকাশে-বাতাসে অবাধে ছুটে বেড়াতে পারত, তাহলে আজ সে এক সোনালী ইন্দ্রজাল বিস্তার করে আমাকে এক নূতন সত্তা দান করতে পারত। আমি যদি আমার সেই ঐন্দ্রজালিক শক্তি আবার ফিরে পাই, যদি সে শক্তির প্রভাবে জগতে ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াতে পাই তাহলে রাজ-ঐশ্বর্যের বিনিময়েও আমি সে শক্তি হারাতে চাইব না কখনও। 

ওয়াগনার; অতিলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত আত্মাদের এভাবে আবাহন করো না। তারা তাহলে তাদের অশুভ শক্তিবলে এ দেশের সমস্ত আকাশ-বাতাসকে কলুষিত করে। তুলবে। তাদের জাতিকে সব দিক থেকে বিপদাপন্ন ও বিব্রত করে তুলবে তারা। তাদের একটি দল যখন উত্তর দিক থেকে তীক্ষ্ণ কাঁটাতার দিয়ে বাঁধবার চেষ্টা করবে, পুব দিক থেকে আর একটি দল নিয়ে আসবে ভয়াবহ উত্তাপ আর শুষ্কতা। আবার একটি দল যখন দক্ষিণের মরু অঞ্চল থেকে নিয়ে আসবে অগ্নিপ্রবাহ, তখন সে আগুন নির্বাপিত করার জন্য পশ্চিম দিক থেকে একদল নিয়ে আসবে প্রবল বন্যার ধারা। সে বন্যার স্রোতে মাঠ-ঘাট পাহাড়-প্রান্তর সব ভেসে যাবে। ঐ সব অতি প্রাকৃত আত্মার দল সব সময় মানুষের ক্ষতি করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। ওরা সানন্দে আমাদের সাদর আহ্বানে সাড়া দেয়, কারণ ওরা তার ফলে সহজেই প্রতারিত করতে পারে আমাদের। তারা এমন ভাব দেখায় যাতে মনে হয় তারা স্বর্গ হতে দেবতাদের প্রতিনিধি। হিসাবে দেবদূতরূপে নেমে এসেছে। কিন্তু আসলে তারা ছলনা করে আমাদের সঙ্গে। যাই হোক, চলুন, এখন যাওয়া যাক। এখন সন্ধে হয়ে গেছে। শিশির পড়ছে। শীতের রাতে গৃহকোণই সবচেয়ে মূল্যবান। কিন্তু চোখ দুটো অমন বিস্ফারিত করে তাকিয়ে রয়েছেন কেন? কী এমন কারণ থাকতে পারে যার জন্য এই সন্ধ্যার প্রাক্কালে বিষাদে কাতর হয়ে উঠেছে আপনার মন? 

ফাউস্ট : অদূরে শস্যক্ষেত্রের উপর দিয়ে একটা কালো কুকুরকে হেঁটে যেতে দেখছ? 

ওয়াগনার : অনেকক্ষণ আগে থেকেই দেখছি। কিন্তু কোনও গুরুত্ব দিইনি।

ফাউস্ট : ভালো করে দেখো দেখি। কি মনে হয় পশুটাকে? 

ওয়াগনার : কোনও একটা সামান্য কুকুরমাত্র যে তার প্রভুকে দেখতে না পেয়ে পথ শুঁকে শুঁকে তার বাড়ি ফিরছে। 

ফাউস্ট : দেখছ না, একটা অগ্নিগোলক কুকুরটাকে রহস্যময়ভাবে অনুসরণ করে চলেছে। কুকুরটা যতই এগিয়ে আসছে ততই সেটাকে দেখা যাচ্ছে না আর ঐ অগ্নিগোলককে কেন্দ্র করে যে আলোকবৃত্ত গড়ে উঠেছে তার পরিধিটা ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে। 

ওয়াগনার : আমার তো মনে হচ্ছে আপনার চোখ কিছুটা প্রতারিত করছে আপনাকে। কারণ আমি একটা কালো লোমাটা কুকুর ছাড়া আর কিছু দেখছি না। 

ফাউস্ট : আমার মনে হচ্ছে এক মোহপ্রসারী কৌশলের দ্বারা ঐ পশুটা আমাদের চলৎশক্তিটাকে বিকল করে দিচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়ত আমাদের গতিশক্তিকে শৃঙ্খলিত করে দেবে একেবারে। 

ওয়াগনার : আমি দেখছি পশুটা আমাদের কাছে এসে সংশয়াচ্ছন্ন মনে ইতস্তত ছোটাছুটি করছে। কারণ ও ওর প্রভুর খোঁজে এসে দেখছে তার জায়গায় দুজন অপরিচিত ব্যক্তিকে। 

ফাউস্ট : আলোকবৃত্তটার পরিধি আরও সংকীর্ণ হয়ে উঠেছে। ও এসে গেছে আরও কাছে। 

ওয়াগনার : ওটা একটা কুকুরমাত্র, আপনি যা ভাবছেন সে ধরনের কোনো অলৌকিক বস্তু নয়। ওই দেখেন ও থেমে গেছে। এখন ও বুকের উপর ভর দিয়ে শুয়ে আছে। ওর লেজ নড়ছে। ঠিক সাধারণ পশুর মতোই অবিকল ওর আচরণ। 

ফাউস্ট : কই এস, আমাদের পিছু পিছু এস। আমাদের অনুসরণ করো। কাছে এস। 

ওয়াগনার : এ এক আশ্চর্য অদ্ভুত পশু। আপনি দাঁড়িয়ে থাকলে ও বসে থেকে অপেক্ষা করবে। আর ওকে কোনও কথা বললেই সঙ্গে সঙ্গে ও সে আদেশ পালন করবে। যদি কোনও জিনিস আপনার হারিয়ে যায়, যদি জলস্রোতে আপনার হাতের বেতের ছড়িটি পড়ে যায় তাহলে ও হয়ত তৎক্ষণাৎ তা এনে হাজির করবে।

ফাউস্ট : তুমি যে এ বিষয়ে ঠিক সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি ঐ পশুটার মধ্যে মন বলে কোনও পদার্থ দেখতে পাচ্ছি না। শুধু দেখছি অভ্যাসের গুণ। 

ওয়াগনার : কোনও কুকুর যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পায় তাহলে সে জ্ঞানীলোকেরও সঙ্গী হতে পারে। এখন দেখছি কুকরটা সত্যিই আপনার সঙ্গলাভের যোগ্য। মেধাবী। ছাত্রের মতোই ও চতুর। (তারা নগরদ্বারের ভিতর দিয়ে চলে গেল। 

তৃতীয় দৃশ্য 

পাঠাগার

ফাউস্ট : (লোমছাঁটা একটি কুকুরসহ প্রবেশ) আমার পশ্চাতে মাঠ-ঘাট-প্রান্তর সব ঘুমোচ্ছে। এই গভীর রাত্রিতে আমি সম্পূর্ণ একটা। নিশীথ–নিবিড় রাত্রির এই স্তব্ধ অবকাশে চিন্তাশীল বহু মনীষী অনেক জ্ঞানের আলো খুঁজে পান তাঁদের মগ্নচৈতন্যের গভীরে। যত সব দুর্বার কামনা ও উদ্ধত উত্তপ্ত আবেগানুভূতিরা শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে একে একে। এখন তাদের জায়গায় মনের মাঝে জেগে উঠছে উদার মানবপ্রেম। ও ঈশ্বরপ্রেমের প্রশান্ত গম্ভীর এক অনুভূতি। 

শান্ত হও হে সারমেয়। অশান্ত হয়ে চঞ্চলতা প্রকাশ করো না অকারণে। ওখানে তক্তপোশের কাছে কি কছ? ঐ চুল্লিটার কাছে শান্ত হয়ে বিশ্রাম করো। আমি তোমাকে আমার একটি নরম আরামপ্রদ আসন দান করেছি। কিছুক্ষণ আগে তুমি ঐ অদূরবর্তী পাহাড়ে ছোটাছুটি ও লাফালাফি করে আমাদের অনেক আনন্দ দান করেছ। তাই এখন আমি চাই তুমি আমার ঘরে শান্ত হয়ে বিশ্রাম করো আমার কাছে। 

আমার এই সংকীর্ণ পরিসর কক্ষটিকে বাতিটি শান্তভাবে জ্বলছে। এক-একটি অগ্নিশিখা বুকে নিয়ে জ্বালানী কাঠগুলো ক্রমশই স্তিমিত হয়ে পড়ছে। আমি আমার অন্তরের অন্ধকারে অনুভব করলাম সহসা উদ্দীপিত হয়ে উঠেছে এক দুর্মর আশার আলো। নূতন উৎসাহে উৎসাহিত করছে আমায়। স্তিমিত তন্দ্রাহত যুক্তিবোধ জেগে। উঠেছে আবার। সত্তার শ্লথগতি নদীগুলো জীবনের উৎস সন্ধানে তীব্র বেগে প্রবাহিত হয়ে চলেছে অদম্য আশায়।

গর্জন করো না হে সারমেয়। জগৎ ও জীবনের অশ্রুত অথচ পবিত্রমধুর যে ঐকতান, যে শান্ত সুরসঙ্গতি আমার অন্তরাত্মা তার গভীরে খুঁজে পেয়েছে, তাকে আগ্রহভরে আলিঙ্গন করছে সে বারবার। তার সঙ্গে তোমার এই পাশবিক গর্জন মোটেই মানায় না। আমরা জানি মানুষ যা বুঝতে পারে, তা তার বোধগম্য হয়ে ওঠে। উপলব্ধির জগতে, তাকেই সে ঘৃণার চোখে দেখে। জীবনে যা কিছু শুভ, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সত্য, তার বুদ্ধিবৃত্তির স্বল্পতাহেতু তার যথার্থ মূল্য অনেক সময় নিরূপণ করতে পারে না মানুষ। তবে কি তার বোধাতীত সুন্দরকে বুঝতে না পেরেই তার প্রতি এই অশান্ত গর্জনের মাধ্যমে এক তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করছে এই সারমেয়? 

আমি বেশ বুঝতে পারছি কামনার প্রবলতর প্রতিকূলতার সন্তোষের নদীটি সহজ সাবলীল গতিতে প্রবাহিত হতে পারছে না আগের মতো। এক জ্বলন্ত কামনার বিস্তীর্ণ মরুপথে যেতে সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে সে নদী। এক বিশাল তৃষ্ণার জ্বালাময়ী শুষ্কটা নিঃশেষে শোষণ করে নিচ্ছে আমার সত্তার সব রস। আমি জীবনে অনেক জ্ঞানবিদ্যা অর্জন করেও এই জ্বলন্ত কামনার বেগকে জয় করতে পারিনি। তাই আজ আমি চাই কোনও না কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তির অলৌকিক সহায়তা। নিউ টেস্টামেন্টে বর্ণিত ঈশ্বরপ্রেরিত বোধি বা এক অধ্যাত্ম অনুভূতি ব্যাকুলভাবে কামনা করি। আজ আমি। আমি তার অর্থ আজ নূতন করে উপলব্ধি করতে চাই। মূল ভাষায় লেখা। ঈশ্বরের সেই পবিত্র অলৌকিক বাণী আজ আমি আমার প্রিয় জার্মান ভাষায় অনুবাদ করতে চাই। 

(একখানি গ্রন্থ খুলে পড়তে লাগল)

এতে লেখা আছে, সৃষ্টির আদিতে ছিল শুধু শব্দ। কিন্তু একথা আমি মানতে পারি না। শব্দ? –অসম্ভব। শব্দকে এতখানি গুরুত্ব দেওয়া কখনই উচিত হবে না। দৈবের। কাছে যে শিক্ষা আমি লাভ করেছি তা যদি সার্থক হয় তাহলে আমি ঠিকই বলছি, কথাটাকে ঘুরিয়ে বলছি। সৃষ্টির আদিতে শুধু ছিল চিন্তা। তবে কথাটাকে ভালো করে তলিয়ে দেখতে হবে, আমি আবার অধৈর্য হয়ে তাড়াহুড়ো করে কিছু বলে ফেলছি না। তো? আচ্ছা, চিন্তাই তো সকল ধর্ম ও সৃষ্টিশীলতার মূলে। আমি পড়েছি, সৃষ্টির আদিতে ছিল শক্তি। কিন্তু কথাটাকে আমি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখিনি। দৈবানুকূল্যে এখন আমি আলো দেখতে পাচ্ছি এ বিষয়ে। আমি বুঝেছি। তাই লিখছি, সৃষ্টির আদিতে ছিল কম। 

হে সারমেয়, আমার এই ঘরে একান্তই যদি তুমি থাকতে চাও, তাহলে তোমাকে অবশ্যই গর্জন থামাতে হবে। তুমি আর চিৎকার করো না। এমনভাবে গোলমাল করলে। আমি তোমাকে থাকতে দেব না আমার কাছে। শোনো আমার কথা। তোমাকে যেতেই হবে। আর আমি তোমাকে আমার আতিথেয়তা দান করতে পারব না। আমার ঘরের দরজা খোলা, তুমি যেতে পার। কিন্তু আমি কি দেখছি? এটা কি স্বাভাবিক, বাস্তব সত্য। না কল্পনা? সেই সামান্য কুকুরটা কি বিরাট লম্বা হয়ে উঠেছে সহসা। এখন ওকে দেখে। পশু বলে মনে হয় না। কী অদ্ভুত দৃশ্যই না আমি দেখছি। ওকে দেখে এক ভয়ঙ্কর। জলহস্তী বলে মনে হচ্ছে। ওর চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। ওর দাঁতগুলো খুবই ভয়ঙ্কর! এবার আমি তোমায় চিনতে পেরেছি। তোমার অর্ধ-নারকীয় ভয়ঙ্কর আকৃতি। সত্ত্বেও সলোমনের জ্ঞানের চাবিকাঠির সাহায্যে আমি তোমার স্বরূপ জানতে পেরেছি। 

অপদেবতাবৃন্দ (বারান্দায়) : ঘরের ভিতর একজন মানুষ আমাদের জালে ধরা পড়েছে। তোমরা সব বাইরে থাকো, তার কাছে যেও না। ফাঁদে পড়া খেকশিয়ালের মতো সে ছটফট করছে। এধার-ওধার করতে করতে সে নিজেই বেরিয়ে আসবে। তবে এ কাজে যদি তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন হয় আর তাহলে তাকে দিও, কারণ সে আমাদের খুশির শিকার হিসাবেই এভাবে ধরা পড়েছে।

ফাউস্ট : এই জন্তুটার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে চারটি ভৌতিক দেবতাকে আবাহন করতে হবে। সে সালামান্দার বা অগ্নিদেবতা, তুমি উজ্জ্বলভাবে কিরণ দান করে যাও। হে জলদেবতা, তুমি বেগে প্রবাহিত হও। সে সিলফ বায়ু, তুমি আপাতত লুক্কায়িত থাকো; হে নম বা মৃত্তিকা, তুমিও কাজ করে যাও, চুপ করে থাকো না। 

এই সব ভৌতিক দেবতাদের গুণের কথা কে জানে না। তাদের শক্তি ও গুণের কথা সবাই জানে। অপদেবতাদের দমন করার কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই। 

এই চার ভৌতিক দেবতা কোনও প্রভাবই বিস্তার করতে পারল না ঐ জন্তুটার উপর। সে অবাধে শুয়ে শুয়ে অহেতুক ঘৃণাসূচক চিৎকারে ফেটে পড়ছে। এখনও পর্যন্ত আমি তাকে কোনও কষ্ট দিইনি। এবার আয়, শোন হীন জার্নোয়ার, এবার আমি তোর মুখোশ খুলে ফেলে প্রকৃত স্বরূপ উঘাটিত করার জন্য ইন্দ্রজাল প্রয়োগ করব তোর উপর। তুই কি নরক হতে বিতাড়িত হয়ে আমার কাছে এসেছিস? এবার আমি তোকে এমন এক চিহ্ন দেখাব যার কাছে নরকের সব জীবই মাথা নত করে। 

গায়ের লোমগুলো খাড়া করে জার্নোয়ার ফুঁসে উঠছে। 

শোন রে হীন ঘৃণ্য পশু, তুই কি সেই নামহীন অন্তহীন যদি শক্তিকে জানিস যে শক্তি সমগ্র দ্যুলোকে ভুলোক ব্যাপ্ত করে আছে? সূক্ষ্ম অথচ অপরিহার্য যে শক্তির প্রভাব হতে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও কিছুই মুক্ত হতে পারে না। 

ঐ চুল্লীটার পাশে এখন ওকে একটা বিরাট হাতির মতো দেখাচ্ছে। আরও বড় হও। ফুটে ওঠো। হ্যাঁ হ্যাঁ। এখন ওটা কুয়াশার মতো সারা বায়ুমণ্ডলকে আচ্ছন্ন করে আছে। আবার দ্রুত বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ঠিক আছে, আর উঠতে হবে না। এবার তোর প্রভুর পায়ের কাছে বসে থাক। এবার বুঝতে পারছিস তো? আমি তোকে বৃথা ভয় দেখাইনি। আমার ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা সত্যিই আছে কিনা দেখ। এবার এক মন্ত্রপূত অগ্নির দ্বারা তোকে দগ্ধ ও বিদ্ধ করব। এখন জানতে চাস না যে তিনটি জ্যোতি আমার মাথার চারদিকে উজ্জ্বলভাবে শোভা পাচ্ছে তা আসলে কি। জানতে চাস না কি শক্তিশালী বিদ্যা আয়ত্তাধীন আছে আমার। 

(কুহেলিসদৃশ বাষ্প ক্রমশ বিলীন হয়ে যেতেই ভ্রাম্যমাণ এক পণ্ডিতের বেশে মেফিস্টোফেলিস প্রবেশ করল।) 

মেফিস্টোফেলিস : গোলমাল কিসের? আমার প্রভুর কি হুকুম তামিল করতে হবে? 

ফাউস্ট : তাহলে এই হলো সেই রোঁয়া ওঠা কুকুরটার আসল রূপ? একদা ভ্রাম্যমাণ পণ্ডিত ব্যক্তি। এই হলো তার পরিবর্তিত রূপ। 

মেফিস্টোফেলিস : হে সুপণ্ডিত ভদ্রমহোদয়, আমার প্রণাম গ্রহণ করো। তুমি আমাকে রীতিমতো কষ্ট দান করেছ।

ফাউস্ট : তোমার নাম কি? 

মেফিস্টোফেলিস : এ তো সামান্য প্রশ্ন দেখছি। জেনে রাখো, আমি এমনই একজন যে বেশি কথা বলতে ঘৃণা বোধ করে, যে কোনও বস্তুর বাইরের রূপের জৌলুসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে তার গভীরতর সত্তাকেই মূল্য দেয় বেশি। 

ফাউস্ট : সব তো জানলাম। তবু বলব, নামের মধ্যে দিয়ে যে কোনও বস্তু বা ব্যক্তির আসল পরিচয় অনেকটা প্রকাশিত হয়। যেমন ধরো, ‘বীলজীবাব’, ‘ডেস্ট্রয়ার’ বা সর্বসংহারকর্তা, বা ফাদার অফ লাইজ’ বা মিথ্যার জনক। তোমার নামটি তাহলে কি? 

মেফিস্টোফেলিস : যে শক্তি সব সময় মন্দ ও অমঙ্গল পরিকল্পনা করা সত্ত্বেও সব সময় মঙ্গল করে চলে সে শক্তিকে কোনও নামের মাধ্যমে ঠিক বোঝা যাবে না। সে। শক্তির সবটুকু বোঝা যায় না। 

ফাউস্ট : এই জটিল হেঁয়ালিপূর্ণ কথার মধ্যে কি গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি এমনই এক অপদৈবশক্তি যে সব কিছুকেই অস্বীকার করে। আর তার যথেষ্ট কারণও আছে, কারণ শূন্য থেকেই সকল বস্তুর সৃষ্টি হয়, আবার তা ধ্বংসের পর শূন্যেই বিলীন হয়ে যায়। সুতরাং কার সত্যতাকে স্বীকার করব? তাই বলি, আমার জন্ম না হলেই ভালো হতো। তোমরা যাকে বলো পাপ, যাকে বলল অশুভ আসলে তা ধ্বংস ছাড়া অন্য কিছুই না। সেই ধ্বংস বা সংহারকারিণী শক্তিই হলেই আমার আসল রূপ। 

ফাউস্ট : তুমি নিজেকে কোনও এক শক্তির অংশ বললে কেন? আমার তো মনে হচ্ছে তুমি এক পূর্ণায়ত অখণ্ড শক্তি। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি এক মহতী সত্যের কথা তোমায় বুঝিয়ে বলছি। মানুষ হচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক নির্বোধ এক সত্তা। সেই মানুষ কখনও তার সত্তার পূর্ণতা বা অখণ্ডতাকে কখনই বুঝতে পারবে না। তা সম্ভব নয় তার পক্ষে। বিশ্বজগৎ সৃষ্টির আগে এক আদিম অন্তহীন অন্ধকারের দ্বারা পরিব্যাপ্ত ছিল সব কিছু। তারপর এক সময় সেই চিররাত্রিরূপিণী আদিম অন্ধকারের সঙ্গে আলোর সংগ্রাম বাধে এ জগতের অধিকার নিয়ে। সেই আলোই অন্ধকারের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ ছিন্ন করে আমাকে সৃষ্টি করেছে। আলো থেকেই সব কিছুর সৃষ্টি। কিন্তু সৃষ্টির আদি যুগ থেকে এই অনন্তশক্তিসম্পন্ন আলো-অন্ধকারের সঙ্গে সংগ্রাম করেও সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্থান কালের অর্ধাংশের বেশি অধিকার করতে পারেনি, আলোর মতো অন্ধকারও সত্য হয়ে আছে আজও। আজও প্রতিদিন সৌরমণ্ডলের হিংসাশ্রয়ী শরসন্ধানকে ব্যর্থ করে সেই আদিম অন্ধকার রাত্রিরূপে আসে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে। সমগ্র বিশ্বের সমগ্র ভূখণ্ড ও কালখণ্ডের অর্ধাংশের উপর জানিয়ে যায় তার অপ্রতিহত প্রতিষ্ঠাকে। বিশ্বের সকল বস্তু বা শক্তির অবয়ব আলোর দ্বারাই গঠিত হয়। আলোই সমস্ত দেহাবয়বকে উজ্জ্বলতা দান করে, তাদের সুন্দররূপে করে তোলে প্রতিভাত। তথাপি সে দেহাবয়বকে সুন্দর ও উজ্জ্বল করে তোলে আলো সেই দেহের দ্বারা ব্যাহত হয় তার গতি। সৃষ্টির এই হলো নিয়ম। তাই প্রতিহতগতি এই আলোর অভিশাপেই হয়ত এমন ক্ষণজীবী ও ক্ষণভঙ্গুর হয়ে উঠেছে প্রতিটি দেহাবয়ব। জন্মের পর হতে সকল দেহই দ্রুত এগিয়ে যার মৃত্যুর দিকে। প্রতিটি দেহের পতনে বা মৃত্যুতে তার সম আয়তন স্থান আলোর অধিকার আসে। সে স্থানে আলোর গতি হয় স্বচ্ছ এবং অবাধ। 

ফাউস্ট : আমি তোমার মতলবের কথা বুঝতে পেরেছি। তুমি সাধারণভাবে সমগ্র বিশ্বের উপর কোনও ধ্বংসকার্য ঘটাতে পার না বলেই ছোটখাটো ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যেতে চাও। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, এত করেও কিছু করতে পারলাম না। আমার সমস্ত সংগ্রামী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বসেছে। এই কুৎসিত অবাঞ্ছিত পৃথিবীটার অতি ক্ষুদ্র একটা অংশকেই আমি আমার ধ্বংসকার্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত করেছি। অবশ্য মাঝে মাঝে ভূমিকম্প, ঝড়, বন্যা, আগ্নেয়গিরির অগ্নদগার প্রভৃতির মাধ্যমে ধ্বংসের দুর্বার ধারা নেমে আসে পৃথিবীতে। কিন্তু তা শুধু ক্ষণকালের জন্য। ক্ষণকাল পরেই আবার শান্ত হয়ে ওঠে বিক্ষুব্ধ জল ও স্থল। আর হতভাগ্য পশুসুলভ মানুষগুলোকে নিয়ে খেলা করেই বা কি হবে? আমি কত মানুষের জীবনাবসান ঘটিয়েছি। কিন্তু আবার 

অসংখ্য নূতন মানুষ সৃষ্ট হয়েছে। জলে-স্থলে-বাতাসে-শীতে-গ্রীষ্মে সর্বত্র সর্বক্ষণ। অসংখ্য জীবকণা জন্মলাভ করে চলেছে। তা দেখে এক প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠি আমি। আমার এই অলৌকিক শক্তির শিখাটুকু না থাকলে আমিও তাদের সঙ্গে মিশে যেতাম। 

ফাউস্ট : সৃষ্টিশীল যে প্রাণশক্তি বিশ্বের প্রতিটি কন্দরে কাজ করে চলে সর্বত্র জীবনের ধারাকে চিরপ্রবহমান ও অবিচ্ছিন্ন রেখেছে, তুমি এক নারকীয় ঘৃণা ও বিতৃষ্ণাসহযোগে সে শক্তির বিরোধিতা করছ। কিন্তু জেনে রেখো, ব্যর্থ হবে তোমার সব বিরোধিতা। বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলার হে ঘৃণ্য সন্তান, এভাবে বিরোধিতা করে কিছু করতে পারবে না। অন্য কোনও উপায় খুঁজে বার করো। 

মেফিস্টোফেলিস : ঠিক আছে। ভেবে দেখো। তুমি এখনও আমার আসল মনোভাবটা বুঝতে পারনি। আমি কি এখন যেতে পারি? 

ফাউস্ট : একথা জিজ্ঞাসা করার কি আছে? এর কোনও কারণ দেখি না আমি। যদিও অবশ্য আমাদের পরিচয় খুব একটা বেশি দিনের নয়। এর পরেও তুমি যখন খুশি আসতে পার। আমার ঘরের জানালা খোলা, অদূরে ঐ দরজাও ভোলা আছে। ওখানে একটা চিমনিও আছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি একথা স্বীকার করছি আমি আর এগিয়ে যেতে পারছি না। একটা সামান্য বাধা আমার গতিকে নিয়ন্ত্রিত করছে। তোমার ঘরের মেঝের উপর কোনও এক ঐন্দ্রজালিকের পায়ের যে ছাপ রয়েছে সেই ছাপই হলো সে বাধা। 

ফাউস্ট : ঐ ছাপটা তোমাকে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। নরকের হে ঘৃণ্য সন্তান, বলো আমার ওটাতে বাধা পেলে তুমি কি করে আমার কাছে আসবে? তোমার মতো এক বিরাট অপদৈব শক্তি সামান্য ঐ বাধার দ্বারা হবে প্রতারিত ও প্রতিহত।

মেফিস্টোফেলিস : ভালো করে পরীক্ষা করে দেখো। ছাপটা এখনও ঠিক মতো আঁকা হয়নি। বাইরের দিকে রেখাগুলো এখনও স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। 

ফাউস্ট : ঠিক আছে, তাতে ভালোই হয়েছে। তাতে আমাদের আসল উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। এখন তুমি আমার কাছে বন্দি। 

মেফিস্টোফেলিস : একদিন যে রোঁয়া ওঠা কুকরটা তোমার পিছু নিয়েছিল, আজ সেটা আর বোরোতে পারছে না। শয়তানটা দেখছি বন্দি হয়ে পড়েছে। 

ফাউস্ট : খোলা জানালাটা তার জন্য ব্যবহার করে দেখতে পার।

মেফিস্টোফেলিস : শয়তান ও ভূতপ্রেতের ক্ষেত্রে একটা নিয়ম প্রচলিত আছে। তারা একবার যদি কোনও জায়গায় ঢুকে পড়তে পারে তাহলে সেখান থেকে বেরোতেও পারবে। আমরা একটা পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হয়েছি। কিন্তু আর একটা বাকি আছে। 

ফাউস্ট : নরকেও তাহলে নিয়মকানুন মেনে চলা হয়? ভালো কথা। তাহলে তোমার মতো এক ভদ্রলোকের সঙ্গে এক চুক্তি করা যেতে পরে। আশা করি সেটা অবশ্যই মেনে চলবে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি যা যা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা সব ঠিকমতো পালন করব এবং তাতে তুমি আনন্দ পাবে। চিন্তাভাবনাহীন ব্যস্ততার মধ্যে গৃহীত কোনও সিদ্ধান্তের মতো এ চুক্তি ব্যর্থ হবার নয়। আমরা এ বিষয়ে শীঘ্রই আবার আলোচনা করব। এখন আমি শুধু তোমার কাছে একটামাত্র বর প্রার্থনা করি–এখন থেকে চলে যাবার অনুমতি দাও। 

ফাউস্ট : আর কিছুক্ষণ থাকতে বলব তোমায়। আমাকে অন্তত কিছু সুসংবাদ শোনাও। 

মেফিস্টোফেলিস : এখন আমাকে মুক্তি দাও। শীঘ্র আবার আসব আমি। তখন আমাকে প্রশ্ন করে অনেক কিছু জেনে নিতে পারবে তুমি। 

ফাউস্ট : আমি তো তোমাকে ধরার জন্য জাল বিস্তার করিনি তোমার চারিদিকে। তুমি তো নিজে থেকেই এ ফাঁদে ধরা দিয়েছ। কেউ যদি শয়তানকে একবার ধরতে পায় তাহলে তাকে শক্ত করে ধরে রাখে, কারণ এত বড় দামী শিকার দ্বিতীয়বার কখনও পাওয়া না যেতেও পারে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমার সাহচর্যে তুমি আনন্দ পাবে জেনে আমি খুশি। আমি তোমার সামাজিক পরিবেশের মধ্যে থেকে তোমার সেবা করে যাব। আমি আমার কলাকৌশলের দ্বারা তোমাকে আনন্দদান করতে পারব ভেবে আমি সব সময় খুশি মনে কাজ করে যাব। তোমার সেবা করে যাব। 

ফাউস্ট : এ বিষয়ে আমার কোনও অমত নেই, তবে অবশ্য তোমার আনন্দ দানের বিষয়বস্তুর মধ্যে সত্যি সত্যিই যদি আনন্দের খোরাক থাকে। 

মেফিস্টোফেলিস : হা বন্ধু, পাবে। সারা বছরের একটানা নীরস জীবনযাপনের। পর এক অনাবিল আনন্দের খোরাক অনেক পাবে। আমার অধীনস্থ অতিপ্রাকৃত শক্তিরা যে গান তোমায় শোনাবে, যে ছবি তারা তোমাকে দেখাবার জন্য আনবে তা সামান্য ইন্দ্রজাল-খেলার থেকে অনেক বেশি। তোমাকে অতি উপাদেয় যে সুখাদ্য দেওয়া হবে তার সুবাস তোমাকে দেবে অভূতপূর্ব আনন্দ। তাদের স্পর্শে কত মাধুরী কত আবেগের রোমাঞ্চ জাগাবে তোমার দেহের স্নায়ুতে। কোনও প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও আমরা এইখানেই সব কিছু উপস্থাপিত করব এখনি। 

অপদেবতারা : হে চাপ চাপ ঘনান্ধকার, তোমরা সবাই ওঁর মাথার উপর থেকে সরে যাও। শূন্য বায়ুমণ্ডল হতে উজ্জ্বল আলোকমালা নির্গত হয়ে ঘন-কৃষ্ণ মেঘমালাকে অপসরিত করতে দাও। শান্ত ও স্থিরায়ত সূর্য সুদূর আকাশে তির্যকভাবে কিরণ দান করছে। উজ্জ্বল পোশাক পরিহিত স্বর্গের সন্তানস্বরূপ আলোকতরঙ্গগুলো সুদূর আকাশ হতে নেমে এসে মর্ত্যভূমির সব কিছুকে আলোকিত করে তুলছে। তাদের গতিপথে যে সব বনস্থলী ও নিভৃত কুঞ্জবন পড়ে, যেখানে মোহমুগ্ধ প্রেমিক-প্রেমিকারা অলস প্রেমচিন্তায় একান্তভাবে হয়ে ওঠে মগ্ন সেই সব বন ও কুঞ্জবনও আলোকিত হয়ে উঠুক আলোকতরঙ্গগুলোর দুর্বার আঘাতে। কুঞ্জবনে কত আঙ্গুরলতা অবাধে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠছে। সে লতায় একদিন কত আঙ্গুর ধরবে। সেই আঙ্গুর থেকে যে উত্তম মদ হবে তা অসংখ্য স্বচ্ছ সুন্দর ঝকঝকে পাত্রে শোভা পাবে। মাঠে মাঠে কত সবুজ শস্য পান্নার মতো শোভা পাচ্ছে। বহু কীটপতঙ্গ ফুলের মধু পান করে সূর্যের পানে উড়ে চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা আলোর মহাসমুদ্রে ভাসতে ভাসতে কোনও দ্বীপের সন্ধান করছে উদভ্রান্ত চিত্তে। ঐ শোনো, তাদের উড়ে চলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাদের চক্রাকার নৃত্যের মোহপ্রসারী ছন্দ বড় মধুর। দূর আকাশে ও শূন্য বাতাসে ভাসমান পাখিগুলো কত মুক্ত ও সুন্দর। কেমন চমৎকারভাবে তারা উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের কারো কারো গতি চক্রাকার, আবার কারো কারো গতি উধ্বায়িত। তারা সকলেই। বাঁচতে চায়। উৎকেন্দ্রিক আনন্দময় ও প্রেমময় এক জীবনাস্তিত্বের চিরউজ্জ্বল নক্ষত্রলোকের উর্ধভিসারে উধাও হয়ে যেতে চায় তারা সবাই। 

মেফিস্টোফেলিস : ও এখন ঘুমোচ্ছে। যথেষ্ট হয়েছে। হে সুন্দরী পরীগণ, তোমাদের বায়বীয় উপস্থিতির ফলে চারদিকে যে গতিময় আবহাওয়ার সৃষ্টি হয় তাতে অভিভূত হয়ে ও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তোমাদের এ কাজের জন্য আমি ঋণী তোমাদের কাছে। তুমি আর এখন মানুষ নও। তুমি আর এখন আমার মতো কোনও শয়তানকেও ধরে রাখতে পারবে না।–হে আমার প্রিয় পরীগণ, যত সব সুখস্বপ্নের চিত্রকল্প দিয়ে ওকে ঘিরে ফেলে এক মধুর মিথ্যার সমুদ্রে ওকে ডুবিয়ে দাও। তবু ওর ঘরের মেঝের উপর অঙ্কিত সেই ঐন্দ্রজালিক ছাপটা তোলার জন্য তীক্ষ্ণদন্ত এক বড় ইঁদুরের প্রয়োজন। আমি কোনও দীর্ঘ আবাহন ভালোবাসি না। কোনও চঞ্চলমতি ইঁদুর এখানে শীঘ্র এসে আমার মুক্তির জন্য পথ করে দেবে। 

হে ছোট-বড় ইঁদুর, মাছি, ছারপোকা, ব্যাঙ ও উকুনের দেবতা, আমি এই ঘরের দ্বারপ্রান্তে তোমার উপস্থিতি কামনা করে তোমাকে এখানে আসার জন্য আহ্বান করছি। আমাকে বন্দি করার জন্য ও যেখানটায় একটা ঐন্দ্রজালিক ছাপ এঁকে তার উপর তৈল লেপন করেছে, তুমি এই মুহূর্তে সেখানে লাফিয়ে চলে এস। আমার মুক্তির পথ প্রশস্ত করো। আমি অনেকটা এগিয়ে আছি। তুমি এসে একটা কামড় দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, ছাপটা উঠে যাবে। সুতরাং হে ফাউস্ট, তুমি তোমার স্বপ্ন দেখে যাও। পরে আমাদের আবার দেখা হবে। 

ফাউস্ট : (জেগে উঠে) আমাকে কি আবার মোহমুগ্ধ করে প্রতারিত করা হয়েছে? এখন আর সেই অপদেবতাটা নেই। আমাকে স্বপ্ন দিয়ে ভূলিয়ে সারমেয়রূপ শয়তানটা পালিয়ে গেছে কোথায়। 

চতুর্থ দৃশ্য 

পড়ার ঘর। ফাউস্ট। মেসিস্টোফেলিস।

ফাউস্ট : দরজায় করাঘাত? ভিতরে এস। আবার আমার নীরব নির্জনতা ভঙ্গ হলো। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি।

ফাউস্ট : ভিতরে এস।

মেফিস্টোফেলিস : একথা তিনবার বলতে হবে।

ফাউস্ট : ভিতরে এস। 

মেফিস্টোফেলিস : এবার আমি তোমার ব্যবহারে খুশি হয়েছি। আশা করি, এবার থেকে আমরা দুজনে মিলেমিশে চলতে পারব। আমি তোমার স্বপ্নের ঘোর কাটাবার জন্য সোনার জরির কাজ করা বেগুনি রঙের কোটপরা এক উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন জমিদারের। বেশে এসেছি। আমার মাথার টুপির উপর শোভা পাচ্ছে এক লম্বা মোরগের পালক। লোককে দেখানো বা ঝগড়া-বিবাদের সময় প্রয়োগের জন্য আমরা কটিবন্ধে ঝুলিয়ে রেখেছি এক লম্বা তীক্ষ্ণ তরবারি। আমি তোমাকেও এই ধরনের উজ্জ্বল পোশাক পরিধান করার জন্য উপদেশ দান করেছি। এই প্রায়ান্ধকার পাঠকক্ষ থেকে নিজেকে মুক্ত করে তুমি একবার বাইরে বার হলেই জীবনের আসল সত্যটি উঘাটিত হয়ে উঠবে তোমার কাছে। 

ফাউস্ট : আমার পোশাক যত উজ্জ্বলই হোক না কেন, এই প্রথাগত পার্থিব জীবন দুঃসহ হয়ে উঠবে আমার কাছে। আমার বয়স বর্তমানে এমনই এক স্তরে উপনীত যে আমি একদিকে যেমন কামনা-বাসনাকে একেবারে ত্যাগ করতে পারছি না, আবার অন্য দিকে সেই কামনার আবেগানুভূতিগুলোকে বেশি প্রশ্রয় দিতেও পারছি না। আমার বয়স যেমন খুব একটা বেশিও নয়, আবার খুব একটা কমও নয়। পৃথিবী থেকে আর আমি এখন কি পাব? ত্যাগ ও সংযমের পথে ঠেলে দেব নিজেকে? এই একটিমাত্র গানই নিত্যকাল ধরে সকল মানুষের কানে কানে ধ্বনিত হয় আসছে। সারা জীবন ধরে এ গান শুনে আসছি আমরা। প্রতিদিন সকালে আমি ভয়ে ভয়ে উঠি। ভাবি আশাভঙ্গের বেদনায় সিক্ত আর একটি প্রভাতের সূচনা হলো। এ কথা ভেবে চোখে জল আসে আমার সেই একটি আশাও সফল হয়নি আমার জীবনে। যত কিছু আশার আনন্দ সব ক্ষীণ হয়ে আসে দিনে দিনে। জীবনের সব হাসি মুখোশের মতোই নকল বলে কোনও ভালো কাজও করতে চাই না। আবার যখন রাত্রি আসে তখনও এক গভীর উদ্বেগের। বোঝা নিয়ে শুয়ে থাকি বিছানায়। তখনও শান্তি পাই না মনে। তখন যত সব দুরন্ত স্বপ্ন কার নির্দেশে ভিড় করে আসে যেন আমার মনে। আমার বুকের মাঝে যে ঈশ্বর বিরাজ করেন তিনি আমার অন্তরকে আলোড়িত করতে থাকেন। আবার আমার শক্তির বাইরে ঊর্ধ্ব জগতে যে ঈশ্বর বিরাজ করেন তিনিও বহিরাগত অশুভ শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন না। এইভাবে আমার হতভাগ্য জীবন ধারণের গ্লানি দিনে দিনে বেড়ে আমাকে পীড়িত করে চলেছে বলে আমি মৃত্যুকে কামনা করি নিবিড়ভাবে। 

মেফিস্টোফেলিস : তথাপি মৃত্যু এমনই একজন অতিথি যাকে শত কারণও সত্ত্বেও কোনো মানুষ অকুণ্ঠভাবে স্বাগত জানাতে পারে না। 

ফাউস্ট : যে ব্যক্তি সত্যিই ভাগ্যবান, ভাগ্যদেবী যার উপর সুপ্রসন্ন হয়ে যার গলায় জয়ের মালা পরিয়ে দেন, সে ব্যক্তি নর্তনক্লান্ত অবস্থায় কোনও কুমারী যুবতীর সপ্রেম বাহুদ্বারা আলিঙ্গিত হয়। কিন্তু আমি কি জীবনের এই সব ভোগসুখ হতে বঞ্চিত রয়ে যাব? আমার অধীনস্থ অপদৈব শক্তি কি আমাকে এই সব ভোগ্য বস্তুত কিছু এনে না দিয়েই বিদায় নেবে? 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু সেদিন রাত্রিতে কোনও লোক কাছে পেয়েও মদ ছোঁয়নি। 

ফাউস্ট : পরের গোপন কথা শোনা ও গোপন কাজ দেখায় তুমি আনন্দ পাও দেখছি। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি অবশ্য সর্বজ্ঞ নাই, তবু অনেকের অনেক কথাই আমি জানি। 

ফাউস্ট : যেন কোনও পরিচিত এক মধুর কণ্ঠস্বর আমার মনকে যত সব অন্তর্দ্বন্দ্ব আর চিন্তার অশান্ত আলোড়ন হতে মুক্ত করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। শৈশবসুলভ কত বিশ্বাস ও আশা জাগিয়ে তুলছে তার মাঝে। তথাপি যে সব মিথ্যা আশার ছলনা আমার আত্মাকে স্বপ্নের ফাঁদে ফেলে পীড়িত করতে চায় তাদের আমি ধিক্কার দিই। মিথ্যা আশা বা স্বপ্নের উজ্জ্বল ছলনাজাল আমাদের মনকে শুধু এক নিবিড় বেদনার অন্ধকার গুহার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখে। তাতে কোনও ফল হয় না। যে উচ্চাভিলাষ আমাদের মনকে বিভ্রান্ত করে তোলে আমি তাদের অভিশাপ দিই। যে সব ভুল আপাত উজ্জ্বল প্রলোভন আমাদের সূক্ষ্ম ও পরিমার্জিত অনুভূতির উপর আলোড়ন সৃষ্টি করে আমি তাদের ধিক্কার দিই। ধিক সেই সব নাম, যশ ও জয়ের স্বপ্নকে ভবিষ্যতে যা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। আমাদের আয়ত্তাধীন বা অধিকৃত বস্তুরূপে অথবা আত্মীয় বা আপনজনরূপে যারা আমাদের প্রীত করতে চায় আমি তাদেরও ধিক্কার দিই। যে নিয়তি প্রভূত ধনরত্নের লোভ দেখিয়ে আমাদের উন্মত্ত কর্মচঞ্চলতার মধ্যে ঠেলে দেয় আমি তাকে যেমন ধিক্কার দিই, তেমনি আবার যে নিয়তি আমাদের আলস্যকে প্রশয় দেয়, তাকেও ধিক্কার দিই। উত্তম আঙ্গুরের যে মদ মানুষের মনকে তুরীয় লোকে নিয়ে যায়, মানুষের মনে প্রেমবোধ জাগায়, সে মদকেও ধিক। আশা ধর্মবিশ্বাস ধৈর্য সব কিছুকেই ধিক্কার দিই। 

অদৃশ্য অপদেবতাদের সমবেত সঙ্গীত

ধিক ধিক তোমাকে! এই সুন্দর জগৎকে ধ্বংস করে দিয়েছ তুমি। তোমার মতো একটি অপদেবতার প্রচণ্ড দেহশক্তিসঞ্জাত আঘাতে যে জগত আজ বিধ্বস্ত। সে জগতের ছিন্নভিন্ন ধ্বংসাবশেষ শূন্যে বয়ে নিয়ে চলেছি আমরা। জগতের যে সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে, যে সৌন্দর্য আর কখনও ফিরবে না, সে সৌন্দর্যের জন্য দুঃখ না করে পারছি না। মানবজাতির হে শক্তিমান ভবিষ্যৎ বংশধরেরা, তোমার আবার নূতন করে সেই সুন্দর জগৎকে গড়ে তোলো। তোমাদের হাতে সুন্দরভাবে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠুক সে জগৎ। সেই অপরূপ সৌন্দর্যের জগৎ তোমরা তোমাদের বুকের মধ্যে গড়ে। তোলো। স্বচ্ছ নতুন বোধশক্তি সহকারে নতুন জীবন শুরু করো। দিকে দিকে ধ্বনিত হয়ে উঠুক নবজীবনের গান। 

মেফিস্টোফেলিস : এরা সব নির্ভরযোগ্য এক-একটি শক্তি, এরা সবাই আমার সেবা করে। ওদের কথা শোনো। প্রতিটি কর্মে ও চিন্তায় ওদের পরামর্শ মেনে চললো। এই দ্বন্দ্বময় জগতে, তোমার নির্জন নির্বান্ধব জগতে তোমার বুদ্ধিবৃত্তি পদে পদে তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ওরা তোমার ঠিকভাবে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। যে বেদনা যে যন্ত্রণা এতদিন ধরে তোমার বুকের ভিতরটা শকুনির মতো ছিঁড়ে খাচ্ছিল, সে বেদনা সে যন্ত্রণা চলে যাবে। আর পাঁচজনের মতো তুমিও একজন মানুষ। কিন্তু সে জনতাকে তুমি ঘৃণার চোখে দেখো তার মাঝে তোমাকে ঠেলে দেওয়া উচিত হবে না। আমি এমন কোনও মহান ব্যক্তি নই, তবু তুমি আমাকে সৎ নির্ভরযোগ্য এক বন্ধু হিসাবে বিশ্বাস করতে পার। আমি স্বেচ্ছায় সব সময় তোমার পাশে থেকে তোমাকে জীবনের পথে চালিত করব। যদি তুমি আমার কাজে তুষ্ট হও তাহলে আমি আজ থেকে সারা জীবন যত্ন ও সততার সঙ্গে তোমার সেবা করে যাব। 

ফাউস্ট : তার জন্য আমার কি দিতে হবে তোমায়?

মেফিস্টোফেলিস : এখনও অনেক সময় আছে। এই মুহূর্তে তার জন্য জেদ করো না। 

ফাউস্ট : না, না, সব শয়তানরাই আত্মকেন্দ্রিক। তারা অকারণে মানববিদ্বেষী হয় এবং কাউকেই সাহায্য করতে চায় না। তুমি কি চাও তা স্পষ্ট করে বলো। আমার ভয় হচ্ছে, এই ধরনের শয়তান ভৃত্য হতে অনেক বিপদ আসে। 

ফাউস্ট : আমি ক্রীতদাসের মতো অক্লান্তভাবে তোমার সেবা করে যাব। তোমার প্রতিটি আদেশ পালন করে যাব। পরে যখন অন্যলোকে আবার আমাদের দেখা হবে, আমাদের মিলন ঘটবে, তুমি এমনি করে আমার সেবা করে যাবে। 

ফাউস্ট : তোমার এই অন্যলোক কোনও বিকার সৃষ্টি করতে পারবে না। তুমি যদি এই জগৎ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দাও তাহলে সেই পরলোকে রইল বা না রইল একই কথা। এই জগতে আমাদের সকল আনন্দ-বেদনারই একটা কারণ বা উৎসদেশ আছে। সূর্য তার গতিপথে আমাদের যে আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়। এই জগৎ থেকে আমার জীবন যখন বিচ্ছিন্ন হবে চিরতরে তখন পরলোকে কি ঘটবে না ঘটবে তাতে আমার কিছু যাবে-আসবে না। আমি তখন কিছুই শুনতে বা দেখতে পাব না। তখন সেই পারলৌকিক জীবনে আমি ঘৃণা ভালোবাসা কি চাইব? পরজন্মে উচ্চ বা নীচ কোন বংশে জন্মগ্রহণ করব তা এখন ভাবার কোনও অর্থ হয় না। 

মেফিস্টোফেলিস : এদিক দিয়েও তুমি আমাকে বিশ্বাস করে দেখতে পার। আমার সঙ্গে চুক্তিপত্রে আবদ্ধ হতে পার। আমার কৃতিত্ব ও কলাকৌশল তুমি আনন্দের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করবে। মানুষ যা জীবনে কখনও চোখে দেখেনি আমি তোমাকে তাই দেব। 

ফাউস্ট : যে হতভাগ্য শয়তান, তাহলেও তুমি আমাকে কিছুই দিতে পারবে না। নিজের কৃতিত্বটাকে বড় করে দেখছ কিন্তু মানবাত্মার কৃতিত্বসমূহকে কখনও তোমার মতো শয়তানে বুঝতে পেরেছে? ভেবে দেখো, তোমার কাছে এমন খাদ্য আছে যে তাতে তোমার কখনও পেট ভরবে না। তোমার হাতে এমন স্বর্ণসম্ভার আছে যা শুধু বারবার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায়, যার ছলনাময় উজ্জ্বলতা জয় করা যায় না। কোনওদিন ধরা দেয় না আমাদের কাছে। সেই সোনা ছলনাময়ী কোনও যুবতী কুমারীর মতো আমাদের প্রতারিত করে শুধু। যে যুবতী নারী আমাদেরই বুকে থেকে অন্য কোনও লোকের উপর নিষ্ঠুর দৃষ্টিশর হানে এবং উপরে কপট সম্মানের ভান করে। মনে হয় কক্ষচ্যুত কোনও উল্কা নেমে এসে নাচছে তার চোখের তারায়। আমাকে এমন কোনও গাছ দেখাতে পার যে গাছে প্রতিদিন নূতন পাতা গজিয়ে ওঠে ফলগুলোকে ঢেকে রাখে আর সে গাছের ফলগুলো পাকতে না পাকতেই পচে যায়। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমার এ দাবির কথা শুনেও ভয় পাই না আমি। আমি তোমাকে তাও দিতে পারি। কিন্তু তার এখনও সময় হয়নি বন্ধু। তখন আমরা আরও শান্তি ও উপাদেয় খাদ্য আশা করতে পারব। 

ফাউস্ট : যখন আমি আলস্যভরে নির্জন শয্যায় শুয়ে থাকব তখন তুমি আমায় হয়ত সহজেই মিথ্যা মোহপ্রসারী তোষামোদে আমাকে তুষ্ট ও পার্থিব আনন্দের প্রলোভনে প্রলুব্ধ করতে পার, কারণ তখন আমার স্বাধীন বিচারবুদ্ধি কাজ করবে না। তবে সেই দিনই যেন আমার জীবনের শেষ দিন হয়। তারপর আর আমি বাঁচতে চাই না। 

মেফিস্টোফেলিস : ঠিক আছে। 

ফাউস্ট : আমি আনন্দে সে মুহূর্ত বরণ করে নেব। তবু একটু দেরি করো। তুমি বড় সুন্দর। তুমি প্রথমে আমাকে এক অনন্ত বন্ধনে আবদ্ধ করো। তারপর আমার মৃত্যুর দিন ঘোষণা করো। আমার মৃত্যুকালীন ঘন্টাধ্বনি বেজে উঠলেই আমার সেবাকার্য হতে মুক্ত হবে তুমি। কালের ঘড়ির কাঁটা ভেঙে যাবে, তার সব গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে আমার কাছে। 

মেফিস্টোফেলিস : ভালো করে ভেবে দেখো। আমার স্মৃতিশক্তি খুবই ভালো। 

ফাউস্ট : এ বিষয়ে তোমার পূর্ণ অধিকার আছে। আমি কিন্তু আমার শক্তির মূল্যায়ন নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেছি। হঠকারিতার সঙ্গে এ কাজ করিনি। আমি যাই করি না কেন, আমি আসলে একজন ক্রীতদাস। তোমার না অন্য কার সে বিষয়ে তর্ক করে লাভ নেই। যারই হই, আমি যেন এক ক্রীতদাস। 

মেফিস্টোফেলিস : আজ তাহলে ডাক্তারের ভোজসভায় আমি চাকরের বেশে তোমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকব। তবে একটা কথা, কোনও কিছুর ঝুঁকি না নিয়েই তুমি দু-এক ছত্র লিখে দিতে পার প্রতিশ্রুতি হিসাবে। 

ফাউস্ট : অহঙ্কারী কোথাকার! তুমি আমার কাছে দলিল চাইছ, প্রতিশ্রুতি দাবি করছ? কোনও সত্যিকারের মানুষকে চেন না তুমি? তার কথার সত্যতার প্রমাণ কখনও পাওনি? আজ আমি যা বলছি ভবিষ্যতে তার কোনও নড়চড় হবে না। একথা কি যথেষ্ট নয়? তাছাড়া পৃথিবীতে কোনও কিছুই অক্ষয় নয়। নিরন্তর পরিবর্তনের যে স্রোত বয়ে চলেছে তাতে পৃথিবীর অনেক কিছুই পালটে যাচ্ছে। তুমি কি ভাব এই পরিবর্তনের স্রোতের মাঝে আমার প্রতিশ্রুতির বন্ধনটাই শুধু অক্ষয় হয়ে থাকবে? তবু ভ্রান্তি যায় না মন থেকে। সে ভ্রান্তি থেকে কে মুক্ত করবে আমাদের মনকে নিবিড় সত্যোপলব্ধির দ্বারা যাদের অন্তর নির্মল ও সুন্দর হয়ে ওঠে তারা সত্যই ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য। তাদের কাছে কোনও ত্যাগই দুঃখের নয়। মানুষের বলা কথা কি লিখিত প্রতিশ্রুতির কি দাম আছে? কলমের কালি শুকোতে না শুকোতেই প্রতিশ্রুত কথারা মরে যায়। শুধু তাদের প্রেমূর্তিগুলো জেগে থাকে কাগজের উপর। সে হীন শয়তান, চলো কি চাও আমার কাছ থেকে? মর্মর-প্রস্তর, চামড়ার কাগজ, না কাদামাটি? আমি তোমার উপর ছেড়ে দিচ্ছি নির্বাচনের ভার। বলো কি চাও? 

মেফিস্টোফেলিস : কেন সঙ্গে সঙ্গে এত বেশি কথা বলে নিজেকে অকারণে উত্তপ্ত করে তুলছ? এই ধরনের চুক্তিপত্র লিখে রাখাই ভালো। এতে কাজ হয়। তবে তোমার নামটা কালির বদলে রক্ত দিয়ে সই করতে পার। 

ফাউস্ট : যদি তুমি এতে খুশি হও তাহলে হাস্যকর হলেও এ কাজ আমি করব।

মেফিস্টোফেলিস : রক্ত হচ্ছে সবচেয়ে দামী ও বিরল বস্তুর নির্যাস। 

ফাউস্ট : ভয় করো না, এ চুক্তির বন্ধন থেকে নিজেকে ছিন্ন করে নেব আমি। এ প্রতিশ্রুতি আমি বহু চেষ্টা করে করেছি। আমি নিজেকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অনেক উঁচু করে দেখবার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার আসল স্থান তোমার পাশে। কোনও দেবতা অপদেবতা আমার ডাকে সাড়া দেয়নি। নিষ্করুণ প্রকৃতি তার সব দ্বার রুদ্ধ করে দিয়েছে আমার সামনে। এতদিনের সঞ্চিত জ্ঞান এসেছে শুধু সীমাহীন বিতৃষ্ণা। চিন্তার সূত্র গেছে ছিঁড়ে। চলো, আমরা দুজনে আমাদের কামনা-বাসনার উচ্ছ্বসিত আবেগকে শান্ত করার জন্য ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তির গভীরে চলে যাই। অজানার অস্পষ্ট কুয়াশা ভেদ করতে করতে প্রতি মুহূর্তে মূর্ত হয়ে উঠবে এক একটি চমক। নর্তনশীল কালের অশান্ত স্রোতধারার ঘূর্ণিজটিল অবস্থার উন্মত্ত আবর্তের গভীরে ডুবে যাব আমরা। সুখ-দুঃখ জয়-পরাজয় ক্রমান্বয়ে সঙ্গ দান করবে আমাদের। অভিশ্রান্তভাবে কাজ করে যাওয়াই হলো মানুষের কাজ। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমার জন্য শর্তের বন্ধন থাকবে না। তুমি সব সময় সুখলাভের জন্য চেষ্টা করবে। তবে সে সুখ পাবে কিনা সে বিষয়ে আমার কোনও কিছু বলার নেই। আমার কথা শুধু এই যে, যাই করো সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাবে। কোনওরূপ দুর্বলতা প্রকাশ করবে না। 

ফাউস্ট : তুমি হয়ত শুনে থাকবে আমি নিজের আনন্দের জন্য একথা বলছি না। যে চঞ্চল চপল আনন্দ তীক্ষ্ণতম বেদনার কারণ সেই মধুর অথচ ঘৃণ্য আনন্দের স্বরূপ উদঘাটন করতে চাই আমি। কোনও ব্যর্থতার বেদনাই আমার অশান্ত চিত্তের অনন্ত জ্ঞানপিপাসাকে নিবারিত করতে পারবে না। সৃষ্টির আদি কাল হতে আজ পর্যন্ত যুগে যুগে বিশ্বের মানুষ যে জীবনযাপন করে এসেছে, সে সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা ভোগ করে এসেছে, আমি আমার বোধশক্তির সমস্ত নিবিড়তা দিয়ে তাদের সত্যাসত্য পরীক্ষা করতে দেখতে চাই আপনার আপন সত্তার গভীরে। এইভাবে সূদুর অতীত হতে বর্তমান পর্যন্ত ছোট-বড় মানুষের আত্মার মধ্যে আমার আত্মাটি হবে স্বচ্ছন্দে প্রসারিত। তাদের সঙ্গে আমি হয়ে উঠব একাত্ম। 

মেফিস্টোফেলিস : আমার কথা বিশ্বাস করো। আমিও হাজার বছর ধরে এ পরীক্ষা করে এসেছি। ছোট-বড় মানুষের আত্মার মাংসগুলোকে চিবিয়ে এসেছি আমি। পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ নেই যে সুদূর আবহমান কাল থেকে নিয়তির নিয়ন্ত্রণপ্রভাবে নিরন্তর রূপান্তর লাভ না করে আসছে। আমার কথা বিশ্বাস করবে, আমরা যাকে স্বর্গ আর স্বর্গীয় ঐশ্বর্য ও সুষমা বলি তা শুধু ঈশ্বর নিজের ভোগের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অন্ধকারের মধ্যে আমাদের ঠেলে দিয়ে দিবা-রাত্রির তরঙ্গদোলায় আমাকে-তোমাকে দুলিয়ে তিনি আলোকাজ্জ্বল স্বর্গপুরীতে বাস করছেন। 

ফাউস্ট : তা হোক, তবু আমি।

মেফিস্টোফেলিস : ভালো উত্তরই দান করেছ। তবে একটা ভয়ের কথা আছে। নদীর স্রোতের মতো নিরবধি কালস্রোত প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে। এই কালস্রোতের আঘাত থেকে বাঁচতে হলে সেই কলাবিদ্যা শিখতে হবে যে কলাবিদ্যা দীর্ঘস্থায়ী করে রাখে সব কিছুকে। আমি বলছি, তুমি এই মুহূর্তে কোনও কবির কাছে যাও। বন্ধদ্বারা তার অবাধ কল্পনাশক্তিকে প্রতিহত করগে। তার সৃষ্ট কাব্য-সাহিত্যের গুণের কথা বলে দাও। বল সিংহের প্রবল বিক্রম বন্য হরিণের দ্রুতগতি, হঠকারী জ্ঞানীদের উত্তপ্ত রক্তের উচ্ছ্বাস, উত্তর ইউরোপের দেশগুলোর শীতল সহনশীলতা প্রভৃতি গুণগুলোর দ্বারা সমৃদ্ধ তার কাব্য। কাবে বলবে সে অনেক কিছু করেছে। তবে তার একটা জিনিস করতে হবে। তাকে বলবে সে যেন এমন এক গোপনসূত্র সৃষ্টি করে যা দিয়ে বাঘে-বলদে এক ঘাটে জল খাওয়ানো যায়, যা দিয়ে উচ্চ-নীচে মিলন ঘটানো যায়, মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করা যায়। আর একটা জিনিস শিখবে তার কাছে। তোমার জীবন ও যৌবনের আনন্দকেএকটু অনুশাসিত করে চলতে শিখবে। দেখবে তোমার ভালোবাসা ও ঘৃণার আবেগ যেন সব সময় একটা নিয়ম ও ছন্দ মেনে চলে। আমি কিন্তু মোটেই বড় হতে চাই না। আমি চাই এমন একজন মানুষকে চাক্ষুষ করতে যে পৃথিবীতে সবচেয়ে ছোট। 

ফাউস্ট : তাহলে আমি কি পেলাম! আমি যদি সমগ্র মানব জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনুষত্বের গৌরবমুকুটে ভূষিত হতে না পারলাম তাহলে আমার জীবনের দাম কি। আমি তো সারাজীবন ধরে তাই চেয়ে এসেছি। 

মেফিস্টোফেলিস : দেখো, মোটের উপর তুমি যা তাই আছ, তাই থাকবে। বহিরঙ্গের কিছু রূপান্তর সত্ত্বেও মানুষের জীবনের মূল ধাতুর বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয় না। আজ তুমি যদি বড় হবার জন্য মাথায় অনেক পরচুলা পরো আর তোমার জুতোর তলায় অনেক চামড়া লাগাও তাহলে সত্যিই তুমি বড় হবে।

ফাউস্ট : এখন আমার মনে হচ্ছে এতকাল ধরে মানুষের চিন্তার জগৎ পরিক্রমা করে এত জ্ঞানবিদ্যা অর্জন করে কোনও লাভই হয়নি আমার। আমি কিছুই পাইনি। যখন কোনও অলস মুহূর্তে শান্ত নীরব অবকাশে বসে থাকি তখন অনেক চেষ্টা করেও আমার মস্তিষ্কের কোনও গুহ্য প্রদেশে নূতনতর কোনও শক্তির প্রাণকেন্ত্র আমি খুঁজে পাই না। আমি বেশ বুঝতে পারি আমার মানসিক সমুন্নতি এক চুলও বাড়েনি। ঈশ্বরের অনন্ত মহিমার কাছে এক পাও এগিয়ে যেতে পারিনি। 

মেফিস্টোফেলিস : বাঃ, এইতো চাই। এখন দেখছি, আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো তুমি নিজের বাস্তব অবস্থার যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারছ। জীবনের আনন্দে সব ফুরিয়ে যেতে না যেতেই আমরা তোমাকে আরও জ্ঞানী করে তুলব। তোমার হাত আছে পা আছে আর আছে যত সব অশুভ শক্তিনিচয়। এই সব দিয়ে অনেক কাজ করতে পারবে তুমি। আমার কাছে যদি ছটা বড় আরবী ঘোড়া থাকে তাহলে আমার মনে হবে আমার বিশটার পা আছে তার তাই দিয়ে অনেক জোরে ছুটতে পারব। কিন্তু তুমি তোমার অবাধ কল্পনাশক্তিকে বিদায় দাও। জাগতিক কাজকর্মে মন দাও। আমার কথা শোনো, আমার মতে কোনও কল্পনপ্রবণ ব্যক্তি হলো অনুর্বর মরু প্রান্তরে কোনও অশুভ শক্তির দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত কোনও পশুর মতো যে পশু অদূরবর্তী কোনও সবুজ গোচরণ ভূমিতে না গিয়ে উষর তৃণহীন প্রান্তরে ঘরে বেড়াতে থাকে। 

ফাউস্ট : কাজটা তাহলে কিভাবে শুরু করব?

মেফিস্টোফেলিস : আরও বড় ক্ষেত্রে আমরা এ সত্য যাচাই করে দেখতে চাই। এই শহীদ হবার জায়গা নয়। আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি এইভাবে নিজেকে ও অনুরাগী ভক্ত ও ছাত্রদের সামনে দীর্ঘ বক্তৃতা করে জ্ঞানবিদ্যার বড়াই করাটাই কি বিজ্ঞতার পরিচায়ক? এটাই কি প্রকৃত জীবনযাপনের আদর্শ? তোমার জীবনের যে জ্ঞান সবচেয়ে বড় সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ তা তোমার কোনও ছাত্রের কাছে বলার কোনও সাহস হবে না তোমার। কখনই না। কারও পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছ?

ফাউস্ট : তাকে দেখার কোনও ইচ্ছা নেই আমার। 

মেফিস্টোফেলিস : বেচারা ছেলেটি অনেকক্ষণ ধরে আমার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে এভাবে নিরাশ হয়ে চলে যেতে দেওয়া উচিত হবে না। তোমার টুপি ও পোশাকটা আমাকে একবার ধার দাও। আমি ভালোভাবেই একটু অভিনয় করব। (ছদ্মবেশ ধারণ করল) আমার বুদ্ধির উপর আমার আস্থা আছে। আমার বুদ্ধি ঠিক কাজ করে যাবে। তবে পনেরো মিনিট সময় আমার পক্ষে যথেষ্ট। এর মধ্যেই আমি আমার যাত্রা শেষ করে ফিরে আসব। তুমি তৈরি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি। (ফাউস্টের প্রস্থান) 

মেফিস্টোফেলিস : (ফাউস্টের লম্বা পোশাক পরে) যে যুক্তি যে জ্ঞান মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি তুমি সেই যুক্তি ও জ্ঞানকে ঘৃণা করো। মিথ্যা ছলনার অপদেবতা। ঐন্দ্রজালিক বিদ্যার বন্ধনে তোমাকে আবদ্ধ করে পতনের অন্ধকার গহ্বরে নিয়ে যাক। তোমাকে সেই অবস্থায় আমি শীঘ্রই দেখব। অপ্রতিরোধ নিয়তি তাকে এমন এক মনোভাব দান করেছে যার ফলে সে তার প্রাপ্ত ও প্রাপনীয় পার্থিব ভোেগসুখকে অগ্রাহ্য করে শুধু নিরন্তর অপ্রাপনীয়ের সন্ধানে এগিয়ে চলেছে। আমি তাকে কৌশলে বশীভূত করে উদ্দাম উচ্ছল জীবনযাপনের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাব। অবিরাম দুঃখ বাধা আর সংগ্রামে পীড়িত করতে করতে তার মনকে এমনই উত্তপ্ত ও অতৃপ্ত ও অশান্ত করে তুলব। যে সে শুধু মদ্যপানের স্বপ্নই দেখে যাবে, কিন্তু মদ্যপান করতেও পারবে না, সে কখনও জলযোগও করতে পারবে না। সে পুরোপুরি শয়তানে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। কোনও দিকেই পরিত্রাণ নেই তার। শয়তান হোক বা না হোক তাকে জাহান্নামে যেতেই হবে। (জনৈক ছাত্রের প্রবেশ) 

ছাত্র : আমি অল্পক্ষণ এখানে এসেছি। যে যশস্বী ব্যক্তির নাম অনেকেই আমার কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে অনেকবার করেছে, আমি তাকে শ্রদ্ধা জানাতে ও তাঁর সঙ্গে পরিচয় করতে এসেছি। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমার সৌজন্যে আমি খুশি হলাম। তবে আমি আর পাঁচজনের মতোই এক সাধারণ মানুষ। আচ্ছা, তুমি এর আগে নিশ্চয় কোথাও পড়াশুনো শুরু করেছিলে তোর। 

ছাত্র : আমি একজন ভদ্র ও সঙ্গতিসম্পন্ন ঘরের সন্তান। আমি এখানে সাহসের সঙ্গে এসেছি। আমার মা আমাকে ছাড়তে চাইছিলেন না। কিন্তু উন্নততর জ্ঞানলাভের বাসনার বশবর্তী হয়ে চলে এলাম আমি। 

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে উপযুক্ত জায়গাতেই এসে পড়েছ। 

ছাত্র : না, আমি থাকব না, চলে যাব এখান থেকে। আমি শপথ করে বলছি। এই ঘর, এর দেওয়ালগুলো, এর ছাদ সব দেখেশুনে আমার বড় খারাপ লাগছে। এই সংকীর্ণ অনুদার পরিবেশে আনন্দের কোনও অবকাশ নেই। এখানে কোথাও কোনও গাছ বা সবুজের চিহ্ন নেই। পড়ার ঘরে আমি যখন বক্তৃতা শুনব তখন শব্দ দৃশ্য সহযোগে আমি কিছু কল্পনা বা চিন্তা করার কোনও সুযোগ পাব না। 

মেফিস্টোফেলিস : অভ্যাসের উপরেই নির্ভর করে সব কিছু। প্রথমে দেখবে অনেক সদ্যোজাত শিশু মাতৃস্তনে মুখ দিতে গিয়ে বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে। মাতৃস্তন পান করতে গিয়ে কাঁদে। পরে অনবরত এই মাতৃস্তনের সন্ধান করে। তেমনি জ্ঞানদেবীর স্তনদুগ্ধ পান কর একবার যদি আস্বাদ পাও তাহলে দেখবে তা ছাড়তে পারবে না। দিনে দিনে বেড়ে যাবে জ্ঞানলাভের আনন্দ। 

ছাত্র : আমি সানন্দে লেগে থাকব। নিষ্ঠা ও একাগ্রতার সঙ্গে আমি জ্ঞানলাভ করে যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তার সঠিক পথটি দয়া করে বলে দিন। 

মেফিস্টোফেলিস : তার আগে তুমি প্রথমে বলো কোন বিশেষ বিষয়ে তুমি জ্ঞানলাভ করতে চাও? 

ছাত্র : স্বর্গে মর্ত্যে প্রকৃতি জগতে ও মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে যত রকমের বিদ্যা আছে আমি সেই সব বিষয়ে সর্বোচ্চ বিদ্যালাভ করতে চাই। 

মেফিস্টোফেলিস : এখানেই তুমি পাবে সঠিক পথের সন্ধান। তবে কঠোরভাবে তোমার মনকে নিবন্ধ করতে হবে এ বিষয়ে। 

ছাত্র : দেহ-মন দুটোকেই আমি সমানভাবে নিযুক্ত করব। তবে আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করতে হবে। শুধু গ্রীষ্মের ছুটির দিনগুলোতে আমাকে কিছু স্বাধীনতা দিতে হবে। 

মেফিস্টোফেলিস : যে সময় আমাদের ফাঁকি দিয়ে অতি দ্রুত পালিয়ে যায় সেই পলায়মান সময়কে কাজে লাগাতে হবে। আমি জোর করে বলতে পারি, একমাত্র নিয়মানুবর্তিতার দ্বারাই সময়কে জয় করা যায়, আয়ত্তাধীনে আনা যায়। তাহলে বন্ধু, প্রথমে তোমাকে তর্কবিদ্যা পড়তে হবে। এই বিদ্যা শিক্ষা করার ফলে তোমার মন মার্জিত হবে। স্প্যানিশ বুটজুতোর শক্ত করে লাগানো ফিতের মতো সব বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে শিখবে। এলোমেলো বাতাসের মতো এখানে-সেখানে ঘুরে। না বেড়িয়ে সঠিক চিন্তার পথ ধরে অর্থাৎ সঠিক চিন্তনপদ্ধতি অবলম্বন করে তোমার মন এগিয়ে চলতে শিখবে। তখন তোমার মন তোমার অতীত জীবনের কর্মাকর্মও বিচার করে দেখতে শিখবে। মানুষের মনের পশমী জমিটাও হলো কোনও বয়নশিল্পীর দ্বারা সৃষ্ট শিল্পকর্মের মতোই আশ্চর্যজনক। হাজার হাজার সুক্ষ্ম সুতো দিয়ে যেমন একখানা কাপড় তৈরি হয় তেমনি এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য চিন্তাভাবনার সুতো দিয়ে তৈরি হয় মানুষের মনের জমি। দার্শনিকের কাজ হলো কার্যকারণতত্ত্বের মাধ্যমে মনের জমির সুতোগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটি বিশ্লেষণ করে দেখা। এই সম্পর্ক অপরিহার্য। এক না হলে যেমন দুই আসে না, তেমনি তিন না হলে চার আসে না। তবে দার্শনিক পণ্ডিতরা ঈশ্বরে বিশ্বাস করলেও বয়নশিল্পীদের মতো সমগ্রতা সাধনে সার্থক হন না। বয়নশিল্পীরা সব সুতো সুন্দরভাবে মিলিয়ে একখানি কাপড় তৈরি করেন। কোনও সুতোকে বাদ দেন না। কিন্তু বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতরা বড় একদেশদর্শী। যারা শরীরবিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞান চর্চা করেন তারা আবার আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন না। জোর করে উড়িয়ে দেন। যে আংশিক জ্ঞানকে তিনি আয়ত্ত করেন তাকেই তিনি বড় করে দেখেন। কিন্তু প্রতিটি অংশের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক আছে এবং সে সম্পর্ক না থাকলে কোনও অংশ কখনও সমগ্রে পরিণত হয় না সে সম্পর্ক তারা স্বীকার করেন না। রসায়নবিদ্যা বলে প্রতিটি বস্তুর মধ্যে এক অন্তর্নিহিত স্বরূপ আছে। সেটিকে জানলেই বস্তুর স্বধর্মকে জানা যাবে আর তাহলে সব রহস্যের সন্ধান পাওয়া যাবে। আত্মার কোনও প্রয়োজন নেই। 

ছাত্র : আপনার কথা ঠিক আমি বুঝতে পারছি না। 

মেফিস্টোফেলিস : সব কিছু শেখার পর যখন শ্রেণীবিন্যাস করতে পারবে বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে তখন সব কিছু বুঝবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। 

ছাত্র : আপনার কথা শুনে আমার মাথাটা যেন গুলিয়ে গেল। আমার মাথাটা যেন আরও বেশি মোটা হয়ে গেল। আমার মাথার মধ্যে যেন একটা মিলের চাকা ঘুরছে। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমার প্রথম এবং প্রধানতম কর্তব্য হবে অধিবিদ্যা শেখা। তারপর তার প্রয়োগটা শিখবে দেখবে ব্যাপারটা কত সুন্দর। দেখবে সে সুকঠিন বিদ্যা মানুষের মাথায় ঢোকে না তার থেকে লাভবান হচ্ছ তুমি। এমনকি যে সব তত্ত্ব তোমার মাথায় ঢুকবে না, তুমি তাও মানুষকে উপযুক্ত ভাষা দিয়ে বোঝাতে পারবে। তবে ছটা মাস তোমাকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা সহকারে পড়াশুনা করতে হবে। বুঝতে পারছ? দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা করে পড়তে হবে। ঘড়ি ধরে। তোমাকে এমনভাবে পড়া মুখস্ত করতে হবে যাতে বই-এর একটা কথাও বাদ না যায়। আবার এমনভাবে তাড়াতাড়ি লিখতে শিখবে যাতে মনে হবে সেই ধর্মীয় পবিত্র প্রেত তোমাকে শ্ৰতিলিখন লেখাচ্ছে।

ছাত্র : এ কাজ আমি ঠিক করব। আর আমাকে দুবার বলতে হবে না। আমারও মনে হয় লেখার মতো জিনিস আর নেই। কোনও বিষয় একবার কাগজে লিখে নিতে পারলে তা আমার আয়ত্তে এসে যাবে চিরদিনের মতো। 

মেফিস্টোফেলিস : তা তো হলো। তবে একটা বিষয় নির্বাচন করো। 

ছাত্র : আমি আইন-তত্ত্বের সঙ্গে মোটেই খাপ খাওয়াতে পারি না নিজেকে। 

মেফিস্টোফেলিস : তার জন্য ছাত্রদের আমি দোষও দিতে পারি না। এই আইন তত্ত্বের আজ কি অবস্থা হয়েছে আমি তা জানি। এক যুগ হতে অন্য যুগে, এক স্থান হতে অন্য স্থানে এই সব আইন আর যত সব আইনগত অধিকার এক চিরস্থায়ী রোগের মতো পুরুষানুক্রমে সংক্রামিত হচ্ছে সকলের মধ্যে। যুক্তি পরোপকারপ্রবৃত্তি সব গোল্লায় গেছে। তুমি তো আমার পৌত্রের মতো। এ বিষয়ে তাড়াহুড়ো করার কিছু। নেই। আমরা যারা বয়োপ্ৰবীণ তারা সব ভেবে দেখব। 

ছাত্র : আপনার কথা শুনে আইন-তত্ত্বের উপর আমার স্বাভাবিক বিতৃষ্ণা আরও বেড়ে গেল। আপনার কাছে পড়তে পারাটা সত্যিই ভাগ্যের কথা। আমি প্রায় ঠিক করে ফেলেছি আমি ধর্মতত্ত্ব শিখব। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি চাই না তুমি এ বিষয় শিখতে গিয়ে কারো দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত হও। এই তত্ত্বের ব্যাপারে আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। মানুষ সাধারণত ভুল পথে না গিয়ে পারে না। চিকিৎসাবিদ্যায় যেমন মানুষ ঠিক রোগ ধরতে পেরে ঠিকমতো ওষুধ প্রয়োগ করতে পারে না সব সময় তেমনি ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রেও আসল তত্ত্ব ধরতে পারে না। অনেক গোপন ভ্রান্তি বিষের মতো কাজ করে যাচ্ছে এই তত্ত্বের মধ্যে। শুধু তোমার শিক্ষকদের কথা শুনে যাবে। সেই কথাকেই সত্য বলে। মেনে নেবে। শুধু এই কথাকে অবলম্বন করেই একদিন নিশ্চিত সত্যের মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে। 

ছাত্র : তবে এই কথার মধ্যে কিছু ভাব বা আদর্শ থাকা চাই। 

মেফিস্টোফেলিস : অবশ্যই। তবে খুব বেশি উগ্র বা তীক্ষ্ণ ভাব থাকা ঠিক নয়। কথা দিয়েই খুব ঝগড়া করা যায় আবার কথা দিয়েই খুব ভালো বন্ধুত্বও গড়ে তোলা যায়। কথা দিয়েই বিশ্বাস উৎপাদন করা যায় মানুষের মনে। এই কথার সম্পদ কেউ চুরি করলেও কথার কিছু যায় আসে না। 

ছাত্র : মাফ করবেন। আপনাকে অনেক প্রশ্ন করেছি। আরও কিছু জানার আছে। আমি আপনার কাছ থেকে চিকিৎসাবিদ্যা সম্বন্ধে কিছু শুনতে চাই। আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিন। হা ভগবান! মাত্র তিন বছরে কখনও এই শাস্ত্রের ক্ষেত্রটি পুরোপুরি জানা যায়? 

মেফিস্টোফেলিস : (স্বগত) এই নীরস কথার কচকচি আর আমার ভালো লাগছে না। আমি বিরক্তি বোধ করছি। আবার আমাকে শয়তানের মতো আচরণ করতে হবে। (উচ্চকণ্ঠে) চিকিৎসাবিদ্যার মূল তত্ত্বটি জানা খুবই সহজ। যদিও পরিশেষে তোমাকে একদিন তোমার এই ব্যক্তিগত ও বিশ্বগত জগৎ ছেড়ে চলে যেতে হবে তথাপি এই জগৎ সম্বন্ধে ভালোভাবে জ্ঞানলাভ করাই হলো বিজ্ঞানের যে কোনও শাখার কাজ। বিজ্ঞানের এক একটি বিশাল ক্ষেত্রকে মানুষ যতই পরিক্রমা করুক না কেন, মানুষ তার নিজের সাধ্যের অতিরিক্ত কিছুই শিখতে পারে না। তবে যে মানুষ যে শিক্ষার্থী প্রতিটি মুহূর্তের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে ঠিকমতো সেই হচ্ছে প্রকৃত মানুষ। তোমার দেহটি বেশ সুগঠিত, এটা অস্বীকার করা যায় না। তুমি অবশ্যই একটু চেষ্টা করলে কৃতকার্য হবে। যদি তুমি নিজের উপর আস্থা রাখো, তাহলে অবশ্যই বাইরের সব মানুষ আস্থা রাখবে তোমার উপর। আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়ের মতো শক্তি আর নেই। তবে নারীজাতির মন জয় করতে হলে তোমাকে বিশেষভাবে তাদের আবেগানুভূতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে হবে। তা যদি বুঝতে পার তাহলে দেখবে অনন্তকাল ধরে যে বেদনা যে ব্যর্থতার হাহাকার অসংখ্য নারীকণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তার মূল উৎস কিন্তু এক এবং তার প্রতিকারের উপায়ও এক। যদি তোমার কাজকর্ম অর্ধেক কলাকৌশলেরও পরিচয় দিতে পারে তাহলে তারা তোমার পদানত হয়ে থাকবে। তবে তোমার নামের সঙ্গে একটা জাঁকজমকপূর্ণ উপাধি জুড়ে দিতে হবে এবং দেখতে হবে তোমার দক্ষতা এ ব্যাপারে আর সকলকে ছাড়িয়ে গেছে। তখন তুমি সামান্য অভিবাদনের ভঙ্গিতে অবাধে তাদের দেহ স্পর্শ করতে পারবে। কেউ কোনও বাধা দেবে না। এমনি করে বছরের পর বছর চলতে থাকলে তুমি আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। তখন তুমি তাদের হাত টিপে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া পরীক্ষা করতে গিয়ে আড়চোখে তাদের পানে তাকিয়ে তাদের নিতম্বগুলোকে জড়িয়ে ধরতে পারবে। আর দেখবে তখন তাদের দৃঢ় সংবদ্ধ কটিতটের নীবিবন্ধগুলো শিথিল হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। 

ছাত্র : ভালো কথা। তবে কিভাবে সে দক্ষতা অর্জন করা যায় সেইটাই হলো কথা। 

মেফিস্টোফেলিস : শোনো বন্ধু, একমাত্র জীবনকে উপভোগ করো। জীবনের সোনালী গাছই হলো একমাত্র সবুজ আর সজীব। বাকি সব তত্ত্ব হলো ধূসরবর্ণ, সব নীরস। 

ছাত্র : এসব কথা আমার কাছে স্বপ্নের মতো শোনাচ্ছে। বুকে অন্তহীন বিশ্বাস নিয়ে আমি যদি আবার আপনার জ্ঞানের কথাগুলো শুনতে পেতাম এবং সেই সঙ্গে দুর্বোধ্য জটিল অংশগুলো আপনি সরল করে বুঝিয়ে দিতেন আমায়। 

মেফিস্টোফেলিস : সানন্দে আমি তা যথাসাধ্য অবশ্যই করতাম।

ছাত্র : না না, আমি চলে যেতে পারি না কিছুতেই। আমার স্বাক্ষর-সহ পঞ্জীটি আপনি দেখুন প্রথমে। আমার এ অনুরোধ রাখতেই হবে। এতে আপনাকে কিছু লিখে দিতে হবে। 

মেফিস্টোফেলিস : অবশ্যই। (কিছু লিখে তা ফিরিয়ে দিল ছাত্রের হাতে) 

ছাত্র : (বইটি বন্ধ করে মেফিস্টোফেলিসকে শ্রদ্ধা জানিয়ে চলে গেল।)।

মেফিস্টোফেলিস : প্রাচীন শাস্ত্রকে অনুসরণ করে চলো। যে সাপকে পদদলিত করার জন্য একদিন আদেশ দেওয়া হয়েছিল তোমাকে সেই সাপকেই অনুসরণ করে যাবে। তোমাকে দেখতে যতই দেবতার মতো মনে হোক না কেন, আসলে তোমার অবস্থা হবে বড় সকরুণ। 

(ফাউস্ট প্রবেশ করলো)

ফাউস্ট : এবার কোথায় কোন দিকে যাব আমরা?

মেফিস্টোফেলিস : যেখানে তোমার খুশি যেতে পারো। আমরা প্রথমে ক্ষুদ্র তারপর বৃহত্তর জগৎকে পরিক্রমা করি। কিন্তু এবার তোমাকে খতিয়ে দেখতে হবে এতদিন ধরে এ দুটি জগৎ পরিক্রমা করে, প্রথম থেকে জীবন শুরু করে কী আনন্দ, কী উত্তম বস্তু লাভ করলে?

ফাউস্ট : আমি আমার দাড়ি ধরে শপথ করে বলতে পারি কোনও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা সম্মান আমি পাইনি সে জগতে। এক অর্থহীন সংগ্রাম সন্ধান করে প্রচেষ্টার মধ্যে নিঃশেষিত হয়েছে আমার সকল উদ্যম। আমি আমার জীবনযাত্রার সঠিক পথটি চিনতে পারিনি। আর পাঁচজন মানুষের মধ্যে নিজেকে বড় ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। আর তাই ভেবে বড় অস্বস্তি জাগে মনে। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি আত্মস্থ হও। ধীর ও প্রশান্ত চিত্তে সব কিছু ভেবে দেখো। তোমার মন থেকে সকল অস্বস্তি দূর হয়ে যাবে। জীবনধারণের সব কলাকৌশল তোমার আয়ত্ত্বের মধ্যেই আছে জেনে রেখো। 

ফাউস্ট : এখন কি আমার এই বাড়িটা ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়ব? তোমার লোকজন গাড়ি-ঘোড়া সব গেল কোথায়? 

মেফিস্টোফেলিস : আমার একখানি বস্ত্র কায়দা করে শূন্যে বিছিয়ে দেব। তারপর শূন্যে সাঁতার কেটে পথ করে যাব। দেখবে শূন্যে এইভাবে যখন উড়ে যাব আমরা তখন আমাদের মানপত্রগুলোকেও খুব হালকা লাগবে। এইভাবে আমরা পৃথিবী ছেড়ে বহু ঊর্ধ্বে খুব দ্রুত উড়ে যাব। আমি তোমাকে তোমার এই নতুন জীবনকে স্বাগত জানাই। 

পঞ্চম দৃশ্য

লিপজিগে অবস্থিত অয়েরবাকের কক্ষ। 

পানোন্মত্ত সঙ্গীদের উল্লাসধ্বনি।

প্রসক্‌ : কই, কেউ হাসছে না। কেউ মদ্যপান করছে না? আমি ভাবছি, কেমন করে হাসতে হয় তা তোমাদের শিখিয়ে দেব। সাধারণত তোমরা বেশ গরম হয়ে থাকো, কিন্তু ভিজে খড়ের মতো এমন মিইয়ে উঠেছ কেন? 

ব্র্যান্ডার : সেটা তোমারও দোষ। তুমি মদ্য পান করলেও তোমার মধ্যে তার কোনও লক্ষণই দেখতে পাচ্ছি না। কোনও পাশবিকতা বা নির্বুদ্ধিতারই পরিচয় পাচ্ছি না। 

প্রসক্ : (ব্রান্ডারের মাথায় একপাত্র মদ ঢেলে দিল) এই নাও দুই-এর পরিচয়।

ব্র্যান্ডার : আবার দাও।

প্রসক্ : তুমি যা চেয়েছিলে আমি তা দিয়েছি। 

ব্র্যান্ডার : যারা ঝগড়া করছে ঘর থেকে বার করে দাও তাদের। পুরো ভরা গলায় কোরাস গাও। মদ পান করো ইচ্ছামতো। হৈহুল্লোড়ে মেতে ওঠ। চিৎকার করো, হুল্লা! 

আলত্‌মেয়ার : হা ভগবান! ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছে কে? তুলো নিয়ে এস তাড়াতাড়ি। আমার কানের পর্দা ফেটে গেছে। 

সীবেল : যখন গানের শব্দে আকাশ ফাটে তখন বুঝতে হবে গানের পাত্রটি গভীর আর তাতে অনেক মদ আছে। 

প্রসক্ : বাঃ বেশ বলেছ। যারা এ সব একটুও পছন্দ করে না তারা বেরিয়ে যেতে পারে। গাও, টারা লারা তা। 

আলত্‌মেয়ার : টারা লারা তা।

প্রসক্ : এবার গলার সুর এসেছে। নাও, শুরু করো। 

গান

হে আমার প্রিয় পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, 
কেমন করে তুমি বিধৃত আছে একটিমাত্র ঐক্যসূত্রে।

ব্র্যান্ডার : বাজে গান। ধিক ধিক! এ হচ্ছে রাজনৈতিক গান। অত্যন্ত আপত্তিকর গান। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও। যে প্রতিদিন সকলে তোমাদের রোমান রাজ্য নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। আমি যে দেশের চ্যান্সেলার বা কাইজার হয়ে উঠিনি এজন্য ভাগ্যবান মনে করছি নিজেকে। তবে আমাদের মাথার উপরে অবশ্যই একজন শাসক চাই। তুমি জান গুণই মানুষকে বড় করে তোলে। গুণের জন্যই মানুষকে বড় হিসাবে নির্বাচিত করে। 

প্রসক্‌ : হে আমার মানসী প্রিয় নাইটিঙ্গেল, তোমাকে হাজার বার আমার অন্তরের অভিনন্দন জানাই। 

সীবেল : না না, ও আমার প্রিয়া। আমার প্রিয়াকে তোমার বলে চালিও না। এতে আমার রাগ হচ্ছে। 

প্রসক্ : আমার প্রিয়াকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি, তাবে চুম্বন করছি। আমি তোমার উক্তির প্রতিবাদ করছি । 

গান

চাবি খোলো, দরজা খোলো, আঁধার হয়েছে
চাবি খোলো, দরজা খোলো, প্রেমিক জেগেছে। 
চাবি দাও, দরজা লাগাও, সকাল হয়েছে।

সীবেল : তুমি যত খুশি গান করো। তার গুণগান করো। তার জন্য গর্ব করো। উপযুক্ত সময়ের জন্য আমি অপেক্ষা করব। একদিন যে আমার নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে, এবার তোমাকেও তাই করবে। তার প্রেমিক হবে কোনও একটি কুৎসিত স্কুল প্রকৃতির লোক। ব্লকসবার্গ থেকে আসা একটা বুড়ো পাঁঠা তার সঙ্গে প্রেম করবে। আমাদের মতো দ্রবংশের সন্তান তার উপযুক্ত পাত্র নয়। আমি তাকে স্মরণ করে দেব? অন্তরের প্রতি অভিনন্দন জানাব? কখনই নয়। বরং তার ঘরের জানালা ভেঙে তার সঙ্গে দেখা করব। 

ব্র্যান্ডার : শোনো সকলে। আমার কথা শোনো মনোযোগ দিয়ে। আমি স্বীকার করছি হে ভদ্রমহোদয়গণ, আমি জানি কেমন করে বাঁচার মতো বাঁচতে হয়। এখানে যারা আছেন তারা সকলেই প্রমোদভিলাষী। তাঁদের আপন আপন গুণানুসারে আমি সকলকেই কিছু না কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করব। শোনো তোমরা, এই সুরটা আমার নূতন ধাচের। শুনতে শুনতে সকলেই তাল দেবে। 

গান 

কোনও একটা বাড়িতে বাসা নিয়েছিল একটি বেঁড়ে ইঁদুর।
মাখন আর যত সব চর্বি জাতীয় খাদ্য খেয়ে তার দেহটা
হয়ে উঠেছিল গোলগাল আর মসৃণ।
ডাক্তার লুথারের মতো তার পিঠে একটা কুঁজ ছিল।
একদিন রাঁধুনি মেয়েটি কৌশলে বিষ মিশিয়ে
দিল খাবারের সঙ্গে আর সেই খাবার খেল ধেড়ে ইঁদুরটি। 
তখন তার প্রাণান্তকর অবস্থা।
তখন তার সে অবস্থা দেখে মনে হলো,
তার বুকের ভিতর প্রেমের পাখিটা যেন ছটফট করছে। 

কোরাস

তার বুকের ভিতর প্রেমের পাখিটা যেন ছটফট করছে। 

ব্র্যান্ডার

সে তখন যন্ত্রণায় ছোটাছুটি করতে লাগল।
তার গায়ের জ্বালা মেটাবার জন্য চৌবাচ্চার
ময়লা জলে ডুব দিল।
সারা বাড়িটা আঁচড় কেটে বেড়াতে লাগল;
কিন্তু কিছুতেই যন্ত্রণার উপশম ঘটল তা তার।
উন্মাদের মতো যেখানে সেখানে ঝাঁপাতে লাগল,
ঘুরপাক খেতে লাগল; দেখে মনে হলো,
তার বুকের ভিতর প্রেমের পাখিটা যেন ছটফট করছে। 

কোরাস

যেন তার বুকের ভিতর প্রেমের পাখিটা ছটফট করছে। 

ব্র্যান্ডার

অবশেষে সেদিন সেই স্পষ্ট দিবালোকেই
সে নির্লজ্জের মতো ছুটে চলে গেল রান্নাঘরে।
তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জ্বলন্ত উনোনটার উপর।
প্রচণ্ডভাবে ছটফট করতে থাকা দেহটা তার হঠাৎ নিথর
হয়ে গেল শেষবারের মতো আর ঠিক তখনি
খুনী রাধুনি মেয়েটা হি হি করে হাসতে হাসতে
বলল, বাছাধন, এবার তাহলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছেন,
যেন ওর বুকের ভিতর প্রথম প্রেম জেগেছে। 

কোরাস

যেন ওর বুকের ভিতর প্রথম প্রেম জেগেছে।

সীবেল : দেখো দেখো, বোকা লোকগুলো কেমন ঘটনাটিকে মজার ব্যাপার হিসাবে উপভোগ করছে। আমার কাছে কিন্তু এর অর্থ ভিন্ন। আমার মতে এভাবে বিষ দিয়ে ইঁদুর মারা একটা জঘন্য কৌশলমাত্র। 

ব্র্যান্ডার : তুমি তাহলে তাদের পক্ষ অবলম্বন করবে। 

আলত্‌মেয়ার : আমি জানি ন্যাড়ামাথা উঁড়িমোটা লোকটা জীবনে অনেক ঘা খেয়েই একথা বলেছে। বিষ খেয়ে মরা ঐ ইঁদুরটার মধ্যে ও হয়ত নিজের জীবনের স্বাভাবিক পরিণতিটাই দেখতে পাচ্ছে। 

ফাউস্ট ও মেফিস্টোফেলিস

মফিস্টোফেলিস : এই সব প্রমোদপিপাসু স্ফুর্তিবাজ লোকদের সামনে তোমাকে নিয়ে এসেছি। আমি তোমাকে এখানে এনে দেখাতে চাই এখানে জীবনের গতি কত সাবলীল, কত স্বচ্ছ। এখানে এরা প্রতিটি দিন ছুটির দিন হিসাবে উপভোগ করে। বিড়ালছানা যেমন তাদের লেজ নিয়ে একটা ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে খেলা করে, ওরাও তেমনি একটা সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে সারা জীবন ধরে ঘুরপাক খায়, ওদের মাথার বুদ্ধিসুদ্ধি নেই। যদি বড় রকমের কোনও মাথাব্যথা না ঘটে এবং যতদিন পর্যন্ত না পৃথিবীতে ওদের আতিথেয়তার অবসান হয় ততদিন ওরা বেশ হাসিখুশির মধ্যেই জীবনযাপন করবে। 

ব্র্যান্ডার : আসল কথাটা খুবই সহজ। ওদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে ওরা যেন দেশভ্রমণ থেকে হঠাৎ এখানে এসে পড়েছে যেন এক ঘণ্টাও এখনও অতিবাহিত হয়নি। 

প্ৰসক্‌ : ঠিক আসল জায়গায় ঘা দিয়েছ তুমি। ঠিক বলেছ, লিপজিগ আমার খুবই প্রিয়। প্যারিস অবশ্য কিছুটা। ওখানকার লোকগুলো কি করে এত মার্জিত হয় কে জানে। 

সীবেল : আমাদের মধ্যে বিদেশী বলে কাদের মনে হয় তোমার? 

প্রসক্ : ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি তাদের মদ পান করাব। তারপর যেমন কৌশলের সঙ্গে ছেলেদের মুখ থেকে দুধ-দাত টেনে বার করে নেওয়া হয়, আমিও তেমনি ওদের ভিতর থেকে সব গোপন কথা বার করে নেব। ওদের দেখে বেশ বড় ঘরের লোক বলেই মনে হয়। কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছে ওদের মন-মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে। 

ব্র্যান্ডার : আমাদের এই সব হৈহুল্লোড়ের মাঝে আল্পস পর্বতের ম ব্লা শৃঙ্গের মতো অটল গম্ভীর হয়ে আছে।

আলতুমেয়ার : এই দেখো, আমি এবার ওদের সিগারেট খাওয়াব। মুখে ধোয়া দেব।

মফিস্টোফেলিস : এই লোকগুলো এত সরল প্রকৃতির যে, শয়তান যদি ওদের ঘাড় না ধরে তাহলে কোনওমতেই কাউকে শয়তান বলে সন্দেহ পর্যন্ত করবে না। 

ফাউস্ট : আমার অভিনন্দন গ্রহণ করুণ ভদ্রমহোদয়গণ!

সীবেল : আমাদেরও অভিবাদন ও ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।

(পাশে মফিস্টোফেলিসকে দেখতে পেয়ে কিছু গুঞ্জনধ্বনি তুলল উপস্থিত সকলে) 

লোকটার একটা পা খোঁড়া। 

মফিস্টোফেলিস : এখানে বহু চেষ্টা করেও মদপানের কোনও সুযোগ পাওয়া যায় না। আপনাদের এই প্রমোদানুষ্ঠানে আমরা যোগদান করতে পারি কি? আপনাদের সাহচর্যে আমরা যথেষ্ট আনন্দ পাব। 

আলত্‌মেয়ার : আপনাকে দেখে খুব খুঁতখুঁতে লোক বলে মনে হচ্ছে। 

প্রসক্ : বিপাক থেকে রওনা হতে নিশ্চয় আপনারা দেরি করেছিলেন? মনে হয় সেখানে হ্যাঁনদের সঙ্গে নৈশভোজন সারতে গিয়ে দেরি হয়ে যায়। 

মফিস্টোফেলিস : আজ অবশ্য আমাদের কেউ কোথাও ডাকেনি। তবে রওনা হবার সময় ঐ ভদ্রলোকের জ্ঞাতিভাইরা আমাদের ছেকে ধরেছিল। তাদের সঙ্গে কিছু কথা বলেছিলাম আমরা। তারা চাইছিল আমরা তাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে বিদায় জানাই। 

(মাথা নত করে প্রসকে নমস্কার জানাল)

আলত্‌মেয়ার (জনান্তিকে) : এবার নাও। ও বুঝতে পেরে গেছে।

সীবেল : একটা আস্ত জুয়োচোর। মুখে-চোখে একটা তীক্ষ্ণ চাতুর্যের ভাব।

প্রসক্ : দাঁড়াও না। আমি ওকে দেখছি। 

মফিস্টোফেলিস : কিছুক্ষণ আগে আমরা সুদক্ষ গায়কদের সমবেত কণ্ঠের মধুর গান শুনেছিলাম। সে গান আমরা ভালো করে আবার শুনতে চাই। সুগীত সে গানের সুরধারা আমাদের উপর আবার ঝরে পড়ুক। 

প্রসক্‌ : আপনার কি তীর্থযাত্রী? 

মফিস্টোফেলিস : না না, অবশ্য ধর্ম করার ইচ্ছা আমার অনেক বড়, কিন্তু ক্ষমতায় কুলোয় না। 

আলতমেয়ার : আমাদের একটা গান শোনান। 

মফিস্টোফেলিস : আপনারা যদি একান্তই চান, তবে ঠিক গান নয়, এমনি একটা সুরেলা ছড়া। 

সীবেল : তবে যেন একেবারে নতুন ধরনের হয়। 

মফিস্টোফেলিস : যে দেশ নিয়ত শুধু মদ, হান আর ঘুমে ভরা সেই সুন্দর স্পেন দেশ থেকে এইমাত্র ফিরে এসেছি আমরা। 

গান

কোনও এক সময়ে এক রাজা রাজত্ব করত 
তার এক বড় কালো রক্তচোষা গিরগিটি ছিল।

শোনো শোনো! গিরগিটি। কথাটার মানে বুঝেছ? তবে গিরগিটি আমার মতে বেশ পরিচ্ছন্ন অতিথি। 

মফিস্টোফেলিস

কোনও এক সময়ে এক যে ছিল রাজা।
তার ছিল একটা বড় কালো গিরগিটি।
তাকে সে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসত;
সে ভালোবাসার কারণ কিছু বোঝাই যেত না।
রাজা একদিন তার দর্জিদের ডেকে বললেন, 
ঐ ছেলেটার গায়ের মাপ নিয়ে একটা কোট বানাও। 

ব্র্যান্ডার

তবে দেখো যেন দর্জি আবার খেয়ালশূখি মতো
কোনও ভুল না করে। মাপটা যেন ঠিক নেওয়া হয়।
কাপড়টা যেন ঠিকমতো ছাঁটা হয় 
আর সেলাইটাও যেন ঠিকমতো হয়।

মফিস্টোফেলিস : এইভাবে দামী রেশমী আর মখমলের পোশাকে সাজানো হলো। তার কোটের উপর ফিতে ঝুলত। বুকে ছিল ক্রুশ চিহ্ন। সে লাভ করল মন্ত্রীর নাম এবং পদমর্যাদা। আর তার আত্মীয়-স্বজনেরা পরিণত হলো রাজদরবারের সভাসদবর্গে। 

তারপর দেখা গেল, গিরগিটিগুলো রাজবাড়িতে যত্রতন্ত্র, শোবার ঘরে ও বিছানায় ঘুরে বেড়িয়ে রানি ও রানির সহচরীদের কামড়িয়ে রক্ত বার করে দিচ্ছে। কিন্তু রাজার ভয়ে তাদের গায়ে কারো হাত দেবার সাহস হলো না। কিন্তু আমাদের যদি তারা একবার কামড়ায় তাহলে আমরা তাদের পিষে মেরে ফেলব। 

কোরাস

আমাদের যদি একবার তারা কামড়ায় তাহলে 
তাদের পিষে মেরে ফেলব আমরা তৎক্ষণাৎ।

প্রসক্ : চমৎকার, খুব ভালো হয়েছে।

সীবেল : প্রত্যেকটা গিরগিটি যেন এমন রাজসম্মান লাভ করে।

ব্র্যান্ডার : তোমার আঙুল বাড়িয়ে এই ধরনের গিরগিটিদের মেরে ফেলো।

আলত্‌মেয়ার : স্বাধীনতা আর মদ দীর্ঘজীবী হোক। 

মফিস্টোফেলিস : তোমাদের সঙ্গে মদ পান করা মানেই স্বাধীনতার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কাছে মদপন করা। অবশ্য তোমাদের যে মদ পান করতে দেখছি তা যদি ভালো হয়। 

সীবেল : আবার সেই গান শোনাবে না আমাদের? 

মফিস্টোফেলিস : আমার ভয় হচ্ছে বাড়িওয়ালা রেখে যাবে। তা না হলে দেখিয়ে দিতাম কিভাবে আপনাদের মতো সুযোগ্য অতিথিদের আনন্দ দান করতে হয়। 

সীবেল : সে আনন্দ দান করো তুমি। বাড়িওয়ালা যা বলার আমাকে বলবে। 

প্রসক্ : মদ ভালো হলে আমাদের কাছ থেকে প্রশংসাও পাবে প্রচুর। তবু নমুনা হিসাবে যা দেবে তা যেন খুব অল্প দিও না। কোনও মদ ভালো কি মন্দ তা যাচাই করতে হলে অনেকখানি খেয়ে দেখতে হবে। 

আলত্‌মেয়ার : (স্বগত) রাইন থেকে আনা হয়েছে। আমি অবশ্য তা আগেই ভেবেছিলাম। 

মফিস্টোফেলিস : আমাকে একপাত্র এনে দাও।

ব্র্যান্ডার : তা দিয়ে কি করবে? এ তো খুবই অল্প। 

আলত্‌মেয়ার : ঐ অদুরে বাড়িওয়ালার যন্ত্রপাতির বাক্সটার মধ্যে আর এক বোতল আছে। 

মফিস্টোফেলিস (পানপাত্র হাতে নিয়ে) 
(প্রসকের প্রতি)

এখন তোমাদের কি ধরনের মদ পছন্দ সে-কথা বলো।

প্রসক্ : এ-কথার মানে? তোমার কাছে কি বিভিন্ন রকমের মদ আছে?

মফিস্টোফেলিস : তোমরা ইচ্ছামতো বাছাই করতে পার। মন ঠিক করে ফেলল। 

আলত্‌মেয়ার : তুমি তো মদের কথা শুনেই তোমার হাতের চপটাকে চাটতে শুরু করে দিয়েছ? 

প্রসক্ : ঠিক আছে। আমার পছন্দের কথা যদি বলো তাহলে আমাকে দিতে পার রেনিশ মদ। আমাদের পিতৃভুমিতেই এ মদ প্রচুর পাওয়া যাবে। 

মফিস্টোফেলিস : (প্রসক্ যেখানে বসেছিল সেইখানে টেবিলের ধারে একটা ছিদ্র করে) আমাকে শীঘ্র একটু মোম দাও। এই বোতলের মুখটা ছিপির মতো আটকে দিতে হবে। 

আলত্‌মেয়ার : এ যে দেখছি যাদুকরের ইন্দ্রজাল।

মফিস্টোফেলিস (ব্র্যান্ডারের প্রতি) : আর তুমি কি নেবে?

ব্র্যান্ডারে : আমি চাই শ্যাম্পেন। বেশ যেন উজ্জ্বল আর টাটকা হয়। 

মেফিস্টোফেলিস : (টেবিলে আবার একটা ছিদ্র করল। ইতিমধ্যে একজন মোমের ছিপি দিয়ে বোতলের মুখগুলো বন্ধ করে দিল) 

ব্র্যান্ডার : যা বিদেশী জিনিস, যা ভালো জিনিস তা হাতের কাছে সব সময় পাওয়া যায় না। আবার বিদেশী মানুষের থেকে বিদেশী ভালো জিনিসকে আমরা পছন্দ করি বেশি। দেখো, একজন জার্মান একজন ফরাসিকে কাছে পেয়ে সহ্য করতে পারে না; কিন্তু সে ফরাসি মদ খেতে খুব ভালোবাসে। 

(মফিস্টোফেলিসকে তার আসনের দিকে আসতে দেখে)

সীবেল : আমার কথা যদি বলতে চাও, আমি টক মদ একেবারে পছন্দ করি না। আমার পাত্রে খুব মিষ্টি মদ ঢেলে দাও। 

মফিস্টোফেলিস : অবশ্যই মিষ্টি মদে পানপাত্র ভরে উঠবে তোমার। 

আলত্‌মেয়ার : না না, আমার পানে তাকাও। আমার মুখপানে তাকাও। আমার মনে হচ্ছে আমাদের ঠকিয়ে তুমি মজা করছ? 

মফিস্টোফেলিস : না না, তোমাদের মতো ভদ্রলোকের সঙ্গে আমি প্রতারণা করতে কখনও সাহস পাই? বলো বলো, তোমাদের পছন্দের কথা বলো তাড়াতাড়ি। বলো, কি মদ তোমাদের দেব? 

আলত্‌মেয়ার : যে কোনো মদ–তবে আমাদের চাহিদা যেন মেটে।

মেফিস্টোফেলিস : (নিজে একক অঙ্গভঙ্গি সহকারে)। 

আঙ্গুর গাছে আঙ্গুর থোকা যেমন শোভা পায়
তেমনি মাথার শিং নিয়ে পাঁঠারা বেড়ায়।
আঙ্গুর গাছে কাঠ আছে আঙ্গুর ভর্তি রসে
বলো, কাঠের টেবিলে মদ কেমন করে আসে।
দেখবে যাদু প্রকৃতিতে যেদিকে তাকাও। 
ছিপি খুলে বোতল থেকে দেদার মদ খাও।

(তারা সবাই ছিপি খুলতেই সকলে আপন আপন বোতলে পছন্দমতো মদ পেয়ে গেল) 

বাঃ চমৎকার, মদের ঝর্না বয়ে যাচ্ছে যেন! যে যত খুশি মদ খেয়ে যাও।

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু দেখো,. যেমন মদ মাটিতে পড়ে না যায়। ফেলো না। 

(তারা বারবার মদ পান করল,
সকলে গান করতে লাগল)
যেন পাঁচশত বুনোশুয়োর মিলিত হয়েছে 
আমরা এক পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করছি।

মফিস্টোফেলিস : দেখো দেখো, ওরা কেমন সুখী, ওরা কেমন স্বাধীন।

ফাউস্ট : আমি এখন এখান থেকে চলে যেতে চাই। 

মফিস্টোফেলিস : লক্ষ্য করবে, ওদের এই পাশবিক আনন্দোন্মত্ততা হতে এক অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা হবে। 

(সীবেল অন্যমনস্কভাবে মদ পান করতে গিয়ে কিছু মদ মাটিতে পড়ে যেতেই তা আগুন হয়ে জ্বলে উঠল।) 

সীবেল : কে আছ বাঁচাও। বাঁচাও। আগুন, আগুন। সাক্ষাৎ নরকাগ্নিকে যেন পাঠিয়ে দিয়েছে। 

মফিস্টোফেলিস : (মন্ত্র দ্বারা আগুন নিভিয়ে দিয়ে) শান্ত হও বন্ধুগণ, শান্ত হও। 

(উপস্থিত প্রমোদাভিলাষী ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে) 

আমাদের বাড়াবাড়ির জন্য এ শুধু এক ভর্ৎসনা।

সীবেল : কি বলতে চাও তুমি? থামো থামো। এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। আমরা তোমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেব আমরা কে আর সেটা ভালো হবে না তোমার পক্ষে। 

প্ৰসক : ও খেলা আর যেন খেলতে এসো না আমাদের সঙ্গে। 

আলত্‌মেয়ার : আমার মনে হয় ওকে আমরা যদি একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে প্যাক করে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিই তাহলে ভালো হয়। 

সীবেল : কি দাদা! এতদুর সাহস কোথা হতে পেলেন? আমাদের ঠকানো হচ্ছে। ম্যাজিকের নাম করে! 

মেফিস্টোফেলিস : চুপ করে থাকো, একটা বুড়ো মদের পিপে কোথাকার!

সীবেল : ঝটা কোথাকার! দূর হয়ে যা বেয়াদব, মাথা মোটা।

ব্র্যান্ডার : থামো থামো, সবাই মিলে ঘুষি মার ওকে। ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। 

আলত্‌মেয়ার : (দেশলাই-এর একটা কাঠি জ্বালাতেই আগুন মুখে এসে লাগল।) পুড়ে গেলাম। পুড়ে গেলাম। 

সীবেল : আবার ম্যাজিক! ওকে মার। শয়তনটা দস্যু। ছুরি দিয়ে কেটে ওকে টুকরো টুকরো করো। 

(সকলে ছুরি নিয়ে ছুটে গেল মেফিস্টোফেলিসের দিকে)। 

মফিস্টোফেলিস : (গম্ভীরভাবে) মিথ্যা কথা আর হাওয়া দিয়ে ভরা এক-একটা ফানুস কোথাকার। আপন আপন স্থান পরিবর্তন করো। এখানে-ওখানে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে থাক। আপন আপন বিপন্ন বিহ্বল ইন্দ্রিয়চেতনার মাঝে বন্দি। থাক অসহায়ভাবে। 

(তারা হতবুদ্ধি হয়ে পরস্পরের মুখপানে আশ্চর্য হয়ে তাকাতে লাগল)

আলত্‌মেয়ার : কোথায় আমি? কী সুন্দর দেশ!

প্রসক্ : আঙ্গুর গাছ নয়? আমি কি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি?

সীবেল : কত নীলচে থোকা থোকা আঙ্গুরের গুচ্ছ হাতের কাছে। 

ব্যান্ডার : এখানে হাতের কাছে নুয়ে পড়া শাখায় আঙ্গুর ঝুলছে। কী চমৎকার! (একে অন্যকে ধরাধরি করে দেখাতে লাগল। পরে ছুরি নিয়ে গাছ থেকে আঙ্গুর পাড়ার জন্য হাত বাড়াল) 

মেফিস্টোফেলিস : (আগের মতো গম্ভীরভাবে) ওদের চোখ থেকে মায়ার কাজল ঘুচিয়ে দাও। এবার দেখো শয়তানের খেলা। এবার তোমরা চেতনা ফিরিয়ে নাও। (ফাউস্টসহ মেফিস্টোফেলিস চলে যেতেই আমোদকারীরা স্থান পরিবর্তন করল) 

সীবেল : কী ঘটে গেল?

আলত্‌মেয়ার : কেমন করে ঘটল?

প্রসক্ : আমি তোমার নাকটা কি ধরেছিলাম?

ব্র্যান্ডার : আমি কি তোমার নাকটা এখানে ধরে রয়েছি?

আলত্‌মেয়ার : প্রত্যেকেই প্রত্যেককে আঘাত করে। আমাকে একটা চেয়ার দাও। আমার শরীর অবসন্ন হয়ে পড়েছে। আমার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলছি আমি। 

প্ৰসক্‌ : কিন্তু যা ঘটল তা একবার আমাকে খুলে বলো তো।

সীবেল : লোকটা গেল কোথায়? যদি একবার ধরতে পারি কাপুরুষটাকে তাহলে সে আর জীবিত অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। এখন হয়ত কোথাও লুকিয়ে আছে।

আলত্‌মেয়ার : আমি নিজের চোখে দেখেছি মদের বোতলের একটা ছিপির উপর চড়ে সে ঐ দরজা দিয়ে সোজা ছুটে পালিয়ে গেল। 

এখনও ভয়ের বোঝায় পাগুলো ভারী হয়ে আছে আমার।

(টেবিলের কাছে গেল)

আমার মনে হয় এখনও মদের নেশা কাজ করে যাচ্ছে আমাদের মধ্যে।

সীবেল : সব মিথ্যা মায়া, প্রতারণা।

প্রসক্ : তবু আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন মদ পান করছিলাম।

ব্র্যান্ডার : কিন্তু আর কোথা থেকে এল তা বলো।

আলত্‌মেয়ার : আচ্ছা অলৌকিক কোনও ঘটনার বিশ্বাস করা উচিত নয়? 

ষষ্ঠ দৃশ্য 

যাদুকরীর রান্নাঘর

একটা ছোট চুল্লীর উপর একটা কড়াই বসানো ছিল। চুল্লীতে আগুন জ্বলছিল। কড়াই থেকে যে ধোঁয়া উঠছিল তাতে নানারকমের মূর্তির আবির্ভাব হচ্ছিল। কড়াই-এর ফুটন্ত জল তাতে উথলে কড়াই উপছে না পড়ে তা দেখার জন্য পাশে একটা বানরী বসেছিল। অদূরে তার বাচ্চাদের নিয়ে একটা বানর বসেছিল। রান্নাঘরের দেওয়াল ও কড়িবরগাগুলো অদ্ভুত ধরনের আবরণে ঢাকা। দেখেই বোঝা যায় কোনও যাদুকরের আবাসগৃহ। 

ফাউস্ট। মেফিস্টোফেলিস

ফাউস্ট : যাদুকরীর এই সব যাদুবিদ্যার কৌশলগত জিনিসপত্র আমার মোটেই ভালো লাগে না। তুমি কি বলছ এই যাদুকরীর উন্মাদসুলভ কিছু যুক্তিহীন ক্রিয়াকাণ্ডের মাধ্যমে আমার পূর্ণজ্ঞান আমি ফিরে পাব। আমি কি এই সামান্য বৃদ্ধা যাদুকরীর কাছ থেকে সাহায্য চাইব? আর তার অশুভ প্রভাব আমার জীবনের তিরিশটি বছরের এক বিরাট অস্তিত্বকে মুছে দেবে আমার কাছ থেকে? ধিক আমাকে! অন্য কোনও ভালো উপায় থাকে তো বলো। আর একটি আশা নিশ্চয়ই সকরুণভাবে ব্যর্থ হবে। প্রকৃতি বা মানবজগতে এর কি কোনো শক্তিশালী ওষুধ আজও আবিষ্কৃত হয়নি? 

মেফিস্টোফেলিস : আবার একবার তুমি বিজ্ঞের মতো কথা বললে। তোমার যৌবনসুলভ প্রাণশক্তিকে ফিরিয়ে আনার একটা সহজ উপায় আছে। তোমার কথা অন্য একটি পৃথক গ্রন্থে লেখা আছে আর তা বড় জটিল। 

ফাউস্ট : তবু তা আমি জানতে চাই। 

মেফিস্টোফেলিস : ঠিক আছে। উপায় খুঁজে পাওয়া গেছে। টাকা-পয়সা, যাদু বা চিকিৎসক কিছুই চাই না। শুধু হাতে তুমি ঐ নিকটবর্তী মাঠটায় চলে যাও। ওখানে এক খণ্ড জমি খুঁড়তে থাকো। নিজের কামনা-বাসনাকে সংযত করে ঐ ভূমিখণ্ডটুকুর মাঝে এমন ফসল ফলাবার চেষ্টা করো যা দিয়ে তোমার শরীর পুষ্ট হতে পারে, যা দিয়ে তুমি ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পার। ভূমিচাষের জন্য যে বলদ ব্যবহার করবে তার সঙ্গে বলদের মতো বাস করতে হবে। যে ভূমিতে তুমি ভালো ফসল ফলাতে চাও তাতে সেই সব বলদের গোময় সার হিসাবে ব্যবহার করবে। মনে রাখবে এটাই হলো সবচেয়ে সোজা পথ এবং এই পথেই তুমি দীর্ঘ আশি বছর পর্যন্ত তোমার যৌবনকে অক্ষুণ্ণ রেখে দিতে পারবে তোমার দেহে। 

ফাউস্ট : আমি এ কাজে অভ্যস্ত নই। আমি তো চেষ্টা করে দেখতেও পারব না। কোদাল হাতে নিয়ে কাজ করা বা লাঙল দিয়ে কর্ষণ করা আমার দ্বারা হবে না। ছোট একখণ্ড জমি নিয়ে সারাক্ষণ কাটানো আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। 

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে যাদুকরীর সাহায্যই তোমাকে চাইতে হবে। 

ফাউস্ট : কেন একমাত্র বুড়ি যাদুকরী ছাড়া আর কোনও উপায় নেই? নিজে কোনও ওষুধ তৈরি করে দিতে পার না? 

মেফিস্টোফেলিস : এ এক মজার খেলা এবং এ খেলা আমি ভালোই জানি। ইতিমধ্যে হাজারটা সেতু নির্মাণ করব আমি। আমার একটা পরিকল্পনা আছে। শুধু বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যার দ্বারা সব কাজ হয় না, বড় কাজ করতে হলে ধৈযের দরকার। 

আমার শান্ত শীতল মস্তিষ্ক দীর্ঘদিন যে সৃষ্টিশীল কাজে নিরত রয়েছে, কালের দীর্ঘ সে কাজের প্রচেষ্টাকে নিবিড় আর তার সাফল্যকে সুনিশ্চিত করে তুলেছে। সে কাজের সাফল্য দেখে তুমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাবে। সে কাজ অদ্ভুত মনে হবে তোমার কাছে। শয়তান স্বয়ং আমাকে তা শেখায়, কিন্তু তবু শয়তান নিজে সে কাজ সমাধা করতে পারবে না। 

(কয়েকটি প্রাণী দেখে)

দেখো দেখো, কত সুক্ষ্ম প্রাণী ওরা। ওরা হলো নারী, ওরা হলো পুরুষ। 

প্রাণীদের প্রতি

মনে হচ্ছে তোমাদের রাণি চলে গেছে? 

প্রাণীরা : আজ মদ খেয়ে মাতলামি করতে করতে কোথায় পালিয়ে গেছে চিমনি দিয়ে। 

মেফিস্টোফেলিস : কোন সময়ে সে পালিয়ে গেছে।

প্রাণীরা : যখন আমরা আমাদের থাবাগুলো গরম করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

মেফিস্টোফেলিস : (ফাউস্টকে) কেমন লাগছে এই সব শান্ত প্রাণীগুলোকে?

ফাউস্ট : জীবনে যা কিছু আমি দেখেছি তার থেকে বিদঘুঁটে লাগছে। 

মেফিস্টোফেলিস : এই ধরনের কথাবার্তা আমার সবচেয়ে ভালো লাগে কেন তা বুঝতে পারি না। 

প্রাণীদের উদ্দেশ্যে

হে অভিশপ্ত প্রাণীগণ, বলো, কোন তোমরা ওই কড়াইটাকে এমন করে ঘাটছ।

প্রাণীগণ : আমরা ভিক্ষুকদের জন্য জলের ঝোল বানাচ্ছি।

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে অনেক লোক তোমরা আমাদের দেখাতে পারবে? 

বানর : (মফিস্টোফেলিসের কাছে আবদারের ভঙ্গিতে বলল) নাও পাশার চাল ফেল। তিন দানে আমাকে ধনী করে দাও। আমাকে জিতিয়ে দাও। আজকাল সময় বড় খারাপ যাচ্ছে। মাথার ঠিক থাকছে না। কিন্তু টাকাকড়ি ধনদৌলত পেলেই আমার মাথার সব ঠিক হয়ে যাবে। 

মেফিস্টোফেলিস : কি করে বানরটা জানল একবার তার ভাগ্য পরীক্ষা করলেই তার ভাগ্য ফিরে যাবে। 

(যে সব বাচ্চা বানরগুলো একটা বড় বল নিয়ে খেলা করছিল তারা খেলা বন্ধ করে এগিয়ে এল)

বানর : পৃথিবীটা একটা বলের মতোই ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ওঠানামা করছে। অবিরাম ঘুরছে। একটা গোলাকার কাঁচের ফাঁপা জিনিসের মতো ঘুরছে। যে কোনও মুহূর্তে এটা পড়ে যেতে পারে। ভেঙে যেতে পারে। কোথাও এটাকে উজ্জ্বল আবার কোথাও উজ্জ্বলতর লাগছে। হে আমার প্রিয় পুত্র, আমি বর্তমানে বেঁচে আছি। তুমি সরে যাও। তোমার মৃত্যুর দিন বিধিনির্দিষ্ট। জীবনের এই পাত্রটি মাটির মতোই ঠুনকো। যে কোনও সময়ে ভেঙে যেতে পারে মাটির পাত্রের মতো। 

মেফিস্টোফেলিস : ওই ছাঁকনিটোতে কি হবে? 

বানর : (ছাঁকনিটা হাতে নিয়ে) তুমি কি একজন চোর? আমি তোমার স্বরূপ প্রকাশ করব এবং তোমায় লজ্জায় ফেলব। 

(বানর বানরীর কাছে ছুটে গিয়ে ছাঁকনির মধ্যে দিয়ে দেখতে দেখতে বলল) 

দেখ দেখ, ছাঁকনির ভেতরটা ভালো করে তাকিয়ে দেখ। চোরটাকে চিনতে পারছিস? কিন্তু তার নামটা জোর করে বলতে সাহস পাচ্ছিস না?

মেফিস্টোফেলিস : (চুল্লীর কাছে গিয়ে) এটা কিসের পাত্র চাপানো আছে চুল্লীর উপর? 

বানর ও বানরী : নির্বোধরা তা জানে না। তারা এই পাত্র ও কেটলির মর্ম বুঝবে না। 

মেফিস্টোফেলিস : বেয়াদপ পশু কোথাকার!

বানর : এই ব্রাশটা নিয়ে ঔ পিঠওয়ালা বেঞ্চটার উপর অন্তত বসো। 

(মেফিস্টোফেলিসকে বসার জন্য অনুরোধ করল)।

ফাউস্ট : (ফাউস্ট এতক্ষণ একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ক্রমে সে সেখান থেকে সরে এল) আমি কি দেখছি? কোন সে ইন্দ্রপুরী হতে আগত ও স্বর্গীয় সুষমায় মণ্ডিত এই ঐন্দ্রজালিক মূর্তি প্রতিফলিত হয়ে উঠল সহসা এই কাঁচের আয়নার মধ্যে। হে প্রেম, তোমার দ্রুতগামী পাখা দুটি একটি বারের জন্য দাও আমায়। সে পাখা আমাকে নিমেষমধ্যে নিয়ে যাক ওর অনিন্দ্যসুন্দর রূপের মায়াময় জগতে। আমি ওর কথা মনে ভাবতে ভাবতে এখান থেকে যেখানেই যাই, যেদিকেই তাকাই সেখানেই একরাশ আলতো কুয়াশায় আবির্ভূত হয় তার অতুলনীয় রূপামাধুর্য। অত্যুজ্জ্বল রূপযৌবনসম্পন্না এক নারী। কোনও নারী, সামান্য এক মর্ত্যের মানবী কখনও এত সুন্দর হতে পারে? স্বর্গীয় দ্যুতি আর সুষমার উজ্জ্বলত মূর্তিমতী প্রতীক ঐ নারীকে আমি কি ওখানে বাস্তব অবস্থায় পাব? সারা মর্ত্যভূমিতে কি এই ধরনের এত সুন্দরী নারী দেখতে পাওয়া যায় কোথাও?

মেফিস্টোফেলিস : আমার মনে হয় নিশ্চয় কোনও দেবতা ছয় দিন নিদারুণ দুশ্চিন্তার পর নিজে নিজেই এক অকারণ আত্মপ্রসাদ লাভ করে আপন মনে বলে ওঠেন এই ধরনের সুচতুর এক জীবকে সৃষ্টি করতে হবে। এবার হয়েছে তো? তৃপ্ত হয়েছে তোমার দুচোখের দৃষ্টি? আমি তোমার এই অনিন্দ্যসুন্দরী প্রেমাস্পদকে খুঁজে বার করবই। যে ব্যক্তি তার সুন্দরী প্রিয়তমাকে বন্ধু হিসাবে ঘরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় সে ব্যক্তি সত্যিই খুব ভাগ্যবান। 

(ফাউস্ট সেই আয়নার দিকে অবিরাম অনিমেষ নয়নে তাকিয়ে রইল। মেফিস্টোফেলিস সেই বেঞ্চের উপর পা ছড়িয়ে শুয়ে ব্রাশটা হাতে নিয়ে খেলা করতে লাগল)। 

সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজার মতোই এখানে বসে আছি আমি। মাথায় আমার রাজমুকুট না থাকলে এই ব্রাশটাই যেন আমার রাজদণ্ড। 

প্রাণীরা : (যে সব বানরগুলো এতক্ষণ ধরে বিভিন্ন রকমের ও অদ্ভুত ধরনের অঙ্গভঙ্গি করছিল, তারা একটি মুকুট এনে মেফিস্টোফেলিসকে দিল) তুমি এবার ভালো হয়ে ওঠ। ঘাম আর রক্তের সঙ্গে এই মুকুট তুমি পরিধান করো। 

(তারা মুকুটটাকে এমনভাবে দিল যে তা পড়ে দুখণ্ড হয়ে ভেঙে গেল।) ঠিক আছে। তা যাক। আমরা কথা বলছি, আমরা সব দেখছি। আমি কানে সব শুনছি এবং ছন্দ সৃষ্টি করছি। 

ফাউস্ট : (আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে) ধিক ধিক আমাকে! আমার মনে হচ্ছে বুদ্ধি লোপ পেয়ে যাবে। 

মেফিস্টোফেলিস : (প্রাণীদের দিকে তাকিয়ে)। আমার নিজের মাথাও ঘুরছে। আমিও হয়তো চেতনা হারিয়ে ফেলব। 

প্রাণীরা : আমাদের লক্ষ্য যদি ঠিক হয়, আমাদের চেষ্টা যদি সঠিক হয় তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে আমার চিন্তা। আমরা শুধু চিন্তা করে যাচ্ছি। 

ফাউস্ট : সেই অত্যুজ্জ্বল রূপের স্মৃতি বুকের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে আমার। চলো এখান থেকে যত শীঘ্র সম্ভব পালিয়ে যাই। 

মেফিস্টোফেলিস : তবে যে কোনও মানুষকে একথা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করতে হবে যে এই সব প্রাণীরা যথার্থ কবি। 

বানরীটি এতক্ষণ চুল্লীর উপর বসানো কড়াইটার দিকে নজর দেয়নি। এখন তার জল ফুটতে ফুটতে উথলে উঠল। সহসা তীব্র এক অগ্নিশিখা জ্বলে উঠে চিমনি স্পর্শ করল আর সেই অগ্নিশিখাকে অবলম্বন করে উপর থেকে এক ডাইনির আবির্ভাব ঘটল। 

ডাইনি : ওঃ! ওঃ! ওঃ! শয়তান জন্তুটা পালিয়ে গেল কেটলি থেকে। আবার গান গাইতে শুরু করেছে। জান্নামে যাক। 

(ফাউস্ট ও মেফিস্টোফেলিসকে দেখে)

ওখানে কারা? তোমরা কারা? কি চাও তোমরা? কে আমাদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে? যারা তা করছে তাদের ঘর আর মাথা আগুনে জ্বলে পুড়ে যাক। 

(ডাইনি কড়াই-এর মধ্যে হাতাটি ঢুকিয়ে দিয়ে কিছু কিছু আগুন ফাউস্ট ও মেফিস্টোফেলিক ও বানরদের দিকে ছুঁড়ে দিল। বানরগুলো চিৎকার করতে লাগল) 

মেফিস্টোফেলিস : (হাতে ধরে থাকা ব্রাশটা উল্টে তা দিয়ে জার ও কাঁচের পাত্রগুলোতে আঘাত করতে লাগল)। 

সব ভেঙ্গে দু’খানা হয়ে যাও, সব পাত্র ভেঙে যাক। যত সব জারিজুরি সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। বদমাস গাধা কোথাকার! 

(যাদুকরী ডাইনি ক্রোধে সন্ত্রাসে অভিভূত হয়ে পড়ল)

এবার বুঝেছ আমি কে? তোমাকে আমি ঘৃণা করি। অবশেষে তোমার প্রকৃত মালিক ও প্রভু কে তা জানতে পারলে? জানতে পারলে কোন কারণে আমি এই মুহূর্তে তোমাকে ও তোমার বানরসত্তাদের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত ও বিপন্ন করে তুললাম না? খয়েরি এই কোটের প্রতি কি কোনও শ্রদ্ধা অনুভব করছ না? সেই লম্বা মোরগের পালক চিনেত পারছ এবার? আমার মুখটাকে আমি কি ঢেকে রেখেছি? আমি কি আমার নাম বলব। চামড়ার মুখওয়ালা বুড়ি কোথাকার! 

ডাইনি : আমাকে ক্ষমা করুন মশাই। আমি সাদাসাপটাভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনাকে। কিন্তু আপনার সেই খোঁড়া পা-টা কোথায়? আর আপনার সেই দুটো দাঁড়কাকই বা কোথায়? 

মেফিস্টোফেলিস : এবারকার মতো আমি তোমাকে ঋণের ভার থেকে মুক্তি দিলাম। তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হওয়ার পর থেকে বহুদিন কেটে গেছে। যে। কৃষ্টি যে সংস্কৃতি সারা জগৎকে আচ্ছন্ন করে আছে তা শয়তানদেরও অব্যাহতি দেয় না। উত্তরের সেই সব ভূতপ্রেতদের দিন আর নেই। সেই সব শিং, লেজ আর থাবা আজ 

তুমি কোথায় পাবে? আর যে খোঁড়া পাটার কথা বললে সে পা রাখলে কেউ আমার। কাছে আসত না, সবাই আমাকে ত্যাগ করে যেত। আমি তাই আর পাঁচজন যুবকের। মতো এই কয় বছর ধরে নকল পা ধারণ করেছি। 

ডাইনি : (নাচতে নাচতে) এই জমিদার শয়তানকে দেখার পর থেকে আমি আমার যুক্তি ও বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছি। 

মেফিস্টোফেলিস : হে নারী, ও নাম আর করো না।

ডাইনি : কেন নয়, তাতে তোমার কি? 

মেফিস্টোফেলিস : রূপকথার বই-এ অনেক কাল আগে হতেই একথা লেখা আছে। কিন্তু একথা কেউ ঠিক মেনে চলে না বলে ভালো মানুষ একটাও দেখতে পাচ্ছি  না। সেই আদি শয়তানটাও চলে গেছে, কিন্তু তার জায়গায় অসংখ্য শয়তান নিজেদের প্রতিষ্ঠা অর্জন করে নিয়েছে। আমাকে নাইট উপাধিধারী একজন ব্যারন বা সামন্ত বলে ডাকবে। তাহলে খুবই ভালো হয়। আমি একজন বীর অশ্বারোহী। আমার বংশমর্যাদা সম্বন্ধে তোমার মনে নিশ্চয় কোনও সন্দেহ নেই। আমি যে কোনো অফ আর্মস চিহ্ন ধারণ করে রয়েছি তা দেখ। 

(এক অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করল)।

ডাইনি : (কুৎসিত এক হাসি হেসে) হা হা। আমি জানি এটাই তোমার রীতি। তুমি একটি আস্ত শয়তান। সব সময় সেই একইভাবে আছ। 

মেফিস্টোফেলিস : শোনো বন্ধু আমার অনুরোধ, খুব সাবধান! ভাই, নিজের থেকে সাবধান হও। ওদের এই হলো রীতি। 

ডাইনি : আপনার কি সেবা করতে পারি মহাশয়? 

মেফিস্টোফেলিস : আমাকে সুপরিচিত এক মিষ্টি রসে ভরা এক পানপাত্র দাও। তবে পুরনো হলেই ভালো হয়। এসব জিনিস যত পুরনো হবে ততই তার শক্তি বাড়বে।

ডাইনি : সানন্দে এবং আন্তরিকতার সঙ্গেই আমি তা করব। এই নাও বোতল। এই বোতলের রস থেকে মাঝে মাঝে আমিও আমার গলা ভেজাই। এর কোনও খারাপ গন্ধও নেই। আমি বোতল থেকে এক গ্লাস ঢেলে নিচ্ছি। 

(চুপিচুপি বলতে লাগল)

কিন্তু এই ভদ্রলোকটি যদি ঠিকভাবে প্রস্তুত না হয় এবং অভ্যস্ত না থাকে, যদি হঠাৎ এই রস পান করে তাহলে এক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হবে। তুমি তা জান। 

মেফিস্টোফেলিস : ও আমার এক বন্ধু। ওটা খেলে ওর কিছু হবে না। তোমার রান্নাঘরের সবচেয়ে ভালো খাদ্য ও খাবার যোগ্যতা রাখে। একটা গণ্ডি টান। মন্ত্রপাঠ করো। পানপাত্রটা ভরে দাও। 

(ডাইনি উন্মাদের মতো অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে একটি গণ্ডি টেনে অদ্ভুত কতকগুলো জিনিস তার মধ্যে রাখল। এমন সময় কাঁচের পাত্রগুলো আপনা থেকে বেজে উঠল এবং চুল্লীর উপর কড়াইটা হতে শব্দ হতে লাগল। কারা যেন বাজনা বাজাচ্ছে। এরপর ডাইনি বানরদের ডেকে তাদের অর্ধবৃত্তাকারে সাজিয়ে বসিয়ে তাদের মাথার উপর একটা মোটা বই এনে রাখল। বানরগুলো হাতে করে মশালের আলো দেখাতে লাগল। অবশেষে ফাউস্টকে ইশারা করে ডাকল ডাইনি।)

ফাউস্ট : (মেফিস্টোফেলিসকে) এসব কি হবে? এই সব প্রাণীগুলো অতি প্রাচীন। এদের আচরণ অদ্ভুত এবং উন্মাদসুলভ এদের অঙ্গভঙ্গি। আমার সামনে যত সব ঘৃণ্য প্রতারকদের দেখছি। আমি এদের জানি এবং ঘৃণা করি। 

মেফিস্টোফেলিস : বাজে! ওটা একটা হাসির ব্যাপার। তুমি ওটাকে এত গুরুত্ব। দিচ্ছ কেন? ও তোমাকে একজন ডাক্তার হিসাবে জ্ঞান করছে। পরে যথাসময়ে তার প্রদত্ত মদ তার প্রভাব বিস্তার করবে। 

(ফাউস্টকে গণ্ডির মধ্যে পা দিতে বাধ্য করল)

ডাইনি : (বই থেকে মন্ত্র পড়তে শুরু করল জোর দিয়ে) এই দেখো, এইভাবে এটা হলো। এক থেকে দশ করো এবং তার থেকে দুই বা তিন করো। তাহলেই তুমি ধনী হবে। পাঁচ ও ছয় থেকে চারের উপর জাল ফেলল। যাদুর কসরৎ দেখাও। তারপর সাত আর আট করো। ব্যস, তাহলেই সব শেষ। নয় মানেই এক। দশের কোনও দাম নেই। এই হলো যাদুকরীর এক থেকে একের খেলা। 

ফাউস্ট : ও এমনভাবে কথা বলছে যেন মনে হচ্ছে ও জ্বরে প্রলাপ বকছে। 

মেফিস্টোফেলিস : এখান থেকে যাবার আগে আরো অনেক কিছু শুনবে। বই-এর কথাই ও বলছে। আমিও বই থেকে মুখস্থ বলতে পারি। আমি ইতিহাস পড়ে কত সময় নষ্ট করেছি। এক বিরাট বৈপিরীত্য, জ্ঞানী ও অজ্ঞানীদের মধ্যে সমানভাবে এক রহস্যের সৃষ্টি করে আসছে। চিরকাল ধরে সেই এক শিক্ষা সকল মানুষ শিখে। আসছে–সেই এক আর তিন আর তিন আর এক সারা জগৎ জুড়ে যুগে যুগে এক মিথ্যাকে সত্য বলে ছড়িয়ে আসছে। তারা ভুল শিখিয়ে আসছে, মিথ্যা শিখিয়ে। আসছে। অথচ কোনও মানুষ তার প্রতিবাদ করে না। নির্বোধ শিক্ষকের হাতে শুধু অসংখ্য নির্বোধ তৈরি হচ্ছে। মানুষ সাধারণত যা শোনে তা বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে তাদের সঙ্গে সঙ্গে চিন্তার সব উপাদানও বিনষ্ট হয়ে যায়, বিলুপ্ত হয়ে যায়। 

ডাইনি : (বলে চলল) বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ কলাকৌশল আজও মানুষের জ্ঞানের সীমার বাইরে গভীর গোপনে লুকিয়ে আছে। যার এ বিষয়ে কোনও আগ্রহ নেই, জ্ঞান নেই, যে চায় না। অযাচিতভাবে বিজ্ঞানের সম্পদকে তারই কাছে এনে দেওয়া হয়। 

ফাউস্ট : কী যা তা বাজে সব বকে চলেছে। সব কিছুর নিন্দা করে চলেছে। আমার ভয় হচ্ছে আমার মাথার সব স্নায়ু ছিঁড়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে এক লক্ষ নির্বোধ গান করে চলেছে সমবেতভাবে। 

মেফিস্টোফেলিস : হে সিবিল, চমৎকার। অনেক মন্ত্র পাঠ করেছ। এইবার তোমার রান্নার জিনিসপত্র সব নিয়ে এস। পানপাত্র পূর্ণ করো কানায় কানায়। এই পানীয় আমার বন্ধুর কোনও ক্ষতিই সাধন করবে না। সে হচ্ছে এমনই এক মানুষ যে জীবনে অনেক ডিগ্রি লাভ করেছে এবং অনেক রকমের মদ পান করেছে। 

(ডাইনি অনেক আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের পর পাত্রে মদ ঢেলে দিল। ফাউস্ট পাত্রটি ঠোঁটে স্পর্শ করতেই আগুন জ্বলে উঠল) 

খেয়ে নাও, খেয়ে নাও। পানপাত্রটি শেষ করে ফেল এখনি। এটা পান করার সঙ্গে সঙ্গে নূতন নূতন কামনা ও কামনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠবে তোমার অন্তর। মনে রেখো, শয়তানের সঙ্গে কলাবিদ্যার গলায় গলায় ভাব। তুমি আগুনকে ভয় পাচ্ছ? 

(ডাইনি গণ্ডিটা মুছে দিতেই ফাউস্ট ভিতরে ঢুকল)

মেফিস্টোফেলিস : এবার তুমি যাও। তুমি বিশ্রাম লাভ করনি অনেকক্ষণ।

ডাইনি : এই মদ তোমার অনেক ভালো করবে। 

মেফিস্টোফেলিস : ওয়ালপারগিসের রাত্রিতে তোমার ইচ্ছার কথা প্রকাশ করা হবে সর্বসমক্ষে। পারিতোষিক হিসাবে তোমাকে যা কিছু আমার দেবার আমি সেই সময় দেব।

ডাইনি : একটা গান আছে। যদি তুমি মাঝে মাঝে সেটা গাও তাহলে এক আশ্চর্য ফল পাবে। 

মেফিস্টোফেলিস (ফাউস্টকে) : এস এস, এখনি চলে এস। হঠাৎ হাতের কাজ এসে গেলে শত পরিশ্রম সত্ত্বেও ঘর্মাক্ত কলেবরে তা করা উচিত। এক মদের প্রভাবে এখনি তোমার দেহের মধ্যে ক্রিয়া করতে শুরু করেছে। এক মধুর আলস্যের মাধ্যমে কিভাবে আনন্দ লাভ করতে হয় সে বিষয়ে শিক্ষা দেব তোমায়। এক নিবিড় পুলকের রোমাঞ্চ জাগবে তোমার দেহ-মনে আর সেই সঙ্গে তুমি বুঝতে পারবে লঘুচঞ্চল এক পক্ষবিস্তার করে কিভাবে কামদেবী উড়ে বেড়াচ্ছে তোমার অন্তরের আকাশে। 

ফাউস্ট : কী সুন্দর ঐ নারীর রূপ। যে আয়নায় তার প্রতিফলন পড়েছে সেটা আমার একবার দেখতে দাও। 

মেফিস্টোফেলিস : না, না, আমায় বিশ্বাস করো, সৌন্দর্যের এক সাক্ষাৎ খনি। আয়না কেন, তুমি শীঘ্রই তাকে জীবন্ত দেখতে পাবে। তার দেহের উত্তাপ স্পর্শ করতে পাবে। (স্বগত) এই মদ পানের ফলে তোমার দেহের রক্ত এমনই উত্তপ্ত ও উত্তাল হয়ে উঠবে যে, যে কোনও নারীকেই তোমার হেলেনের মত সুন্দরী মনে হবে। 

সপ্তম দৃশ্য 

রাজপথ

ফাইস্ট ও মার্গারেট পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছিল।

ফাউস্ট : হে সুন্দরী, কিছু মনে করো না, রুষ্ট হয়ো না। আমি তোমার হাত ধরে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেব। তোমাকে সঙ্গ দান করব তোমার পথে। 

মার্গারেট : আমি নারীও নই, সুন্দরীও নই এবং তোমার সাহায্য ছাড়াই আমি বাড়ি যেতে পারব। 

(ফাউস্টের হাত ছাড়িয়ে চলে গেল)

ফাউস্ট : সত্যিই অপূর্ব। জীবনে আমি যত নারী দেখেছি তার মধ্যে সৌন্দর্যে অতুলনীয়া সে। তার অন্তঃকরণে কত পবিত্র এবং বিবিধ গুণরাজিতে পরিপূর্ণ। তবে কিছুটা অহঙ্কারী। তার ওষ্ঠাধর কী চমৎকার লাল। তার গণ্ডদ্বয় প্রথম প্রত্যূষের মতোই উজ্জ্বল। যতদিন আমার দেহে প্রাণ থাকবে আমি তাকে ভুলব না। চকিতে হরিণের মতো যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল আমার অন্তরে তা মুদ্রিত হয়ে থাকবে চিরদিন। সে। স্বল্পভাষিণী, অথচ তার কণ্ঠস্বর কত তীক্ষ্ণ। তার সঙ্গলাভ সত্যিই এক গভীর আনন্দের। ব্যাপার। একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। 

(মেফিস্টোফেলিস প্রবেশ করল)

ফাউস্ট : আমি যে মেয়েটিকে এখনি লাভ করতে গিয়েছিলাম তার কথা জান?

মেফিস্টোফেলিস : কোন মেয়েটি।

ফাউস্ট : এই তো এখনি চলে গেল। 

মেফিস্টোফেলিস : ওই ওখানে যে যাচ্ছে? ওর তো স্বীকারোক্তি করে এইমাত্র আসছে। যত রকমের পাপ আছে তা তো করেছে এবং তা স্বীকার করেছে। আমি নিকটে পিছনে থেকে সব শুনেছি। এত পাপ সত্ত্বেও ও খুব নিরীহ ও এবং নির্দোষ। স্বীকারোক্তির কোনও প্রয়োজনই ছিল না। এমন কাঁচা বয়সের ছেলেমেয়েদের উপর কোনও অশুভ প্রভাব বিস্তার করতে পারি না আমি। 

ফাউস্ট : তবে ওর বয়স তো চোদ্দর থেকে বেশি। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি বাজে লোকের মতো কথা বলছ। এমনভাবে কথা বলছ যাতে মনে হবে জগতে যেখানে যত সুন্দর ফুল ফোটে তা শুধু তোমার জন্য। জগতে। সব শ্রদ্ধা ও সম্মানের একমাত্র পাত্র তুমি। কিন্তু এতেও তুমি সব সময় সব বিষয়ে। সাফল্য লাভ করতে পার না। তোমার আকাক্ষিত বস্তুকে আয়ত্ত করতে পার না। 

ফাউস্ট : হে সুযোগ্য প্রচারক, শোনো। আর নৈতিক আইনের কোনও কথা বলো না। আমি আমার অধিকারের কথাই বলছি। আজ রাত্রির মধ্যে যদি আমার সেই আনন্দের প্রতিমাকে হাতে না পাই তাহলে রাত্রি মধ্যপথে উপনীত হতে না হতেই আমাদের সব চুক্তি ভঙ্গ হবে। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু সুবিধা-সুযোগের কথাটাও তো একবার ভাবতে হবে। আমি অন্তত এক পক্ষকাল সময় চাইছি যাতে তার মধ্যেই কোনও সুযোগ পেয়ে যাব। 

ফাউস্ট : যদি আমি সাতটা ঘণ্টা হাতে পাই তাহলে শয়তানকে ডাকব না আমার সাহায্যে। আমি নিজেই তাকে বুঝিয়ে করায়ত্ত করব।

মেফিস্টোফেলিস : তুমি ঠিক ফরাসিদের মতো বড় বড় কথা বলছ। আমার কথা শোনো, বিরক্ত হয়ো না। কেন হঠাৎ এমন করে আমোদ-প্রমোদে ছেদ টেনে দিচ্ছ? তুমি ভাবছ তোমার সমগ্র জীবন এমনই অন্তহীন অবিচ্ছিন্ন সুখ আর সৌভাগ্যে ভরা যাতে করে তুমি ইচ্ছা করলেই সমস্ত সুন্দর বস্তুকে করায়ত্ব করতে পার আর ইতালীয় প্রেমকাহিনীর নায়কের মতো তার মনটাকে জয় করে স্বমতে নিয়ে আসতে পার। 

ফাউস্ট : ওসব কথা বাদ দাও। আমার ক্ষুধা আছে।

মেফিস্টোফেলিস : এখন ঠাট্টা-বিদ্রূপ বাদ দাও। আমি তোমাকে শেষ কথা বলে। দিচ্ছি। অত তাড়াতাড়ি ঐ সুন্দরী বালিকাকে করায়ত্ত করতে পারবে না। ঝটিকা। আক্রমণের দ্বারা যে বস্তুকে লাভ করা যায় না তাকে কৌশল প্রয়োগের দ্বারা লাভ করতে হয়। 

ফাউস্ট : দেবদুতোপমা ঐ সুন্দরীর কোনও না কোনও একটা স্মৃতিচিহ্ন আমাকে দাও। সেখানে সে নিদ্রা যায় তার সেই সুরম্য শয়নকক্ষে আমাকে নিয়ে যাও। তার বক্ষের রুমাল একটা এনে দাও অথবা তার পায়ের মোজার একটা গার্টার অন্তত দাও। 

মেফিস্টোফেলিস : এবার দেখবে কত শীঘ্র তোমার অতৃপ্ত কামনাকে পরিতৃপ্ত করতে পারি। আর এক মুহূর্তও বৃথা ব্যয় করব না। আর শয়নকক্ষ খুঁজে বার করে সেখানে আজ তোমাকে নিয়ে যাবই। 

ফাউস্ট : আমি কি তাকে দেখতে পাব–তাকে লাভ করব?

মেফিস্টোফেলিস : না। কোনও এক প্রতিবেশীর কাছে সে নিশ্চয় যাবে। ইতিমধ্যে তুমি ভবিষ্যৎ আনন্দোপভোগের আশায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আমরা সেখানে গিয়ে তাকে ধরব। তার সাহচর্য সেখানে তুমি পূর্ণমাত্রায় পাবে। 

ফাউস্ট : সেখানে কি আমরা এখন যেতে পারি?

মেফিস্টোফেলিস : এখনও সে সময় হয়নি। 

ফাউস্ট : আমি চাই তার কাছ থেকে তার কোনও উপহার আমাকে এনে দাও। (প্রস্থান)।

মেফিস্টোফেলিস : এখনি সেটা চাও? ঠিক আছে। অবশ্যই সে মেয়েটিকে পাবে। আমোদ-প্রমোদের বহু স্থানই আমার জানা আছে। বহু গুপ্তধনের সন্ধানও আমার জানা। আছে। দরকার হলে এ বিষয়ে আমাকে জোর করতে হবে। বলপূর্বক ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করতে হবে। (প্রস্থান) 

অষ্টম দৃশ্য

ক্ষুদ্র পরিচ্ছন্ন একটি প্রকোষ্ঠ

সন্ধ্যাকাল

মার্গারেট : (চুল বাঁধছিল) আমি যদি জানতে পারতাম ভদ্রলোক কে তাহলে আমি তাকে কিছু না কিছু দিতে পারতাম। নিশ্চয় ভদ্রলোক সম্ভ্রান্ত বংশজাত কোনও বীরপুরুষ হবেন। তাঁর মুখ দেখেই আমি তা বুঝতে পেরেছি। তা না হলে তাঁর মুখে এমন বীরত্ব ও সাহসিকতার চিহ্ন ফুটে উঠত না। (প্রস্থান) 

মেফিস্টোফেলিস। ফাউস্ট।

ফাউস্ট : এসো, কিন্তু খুব ধীর গতিতে। আমাকে অনুসরণ করো।

ফাউস্ট : (কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর) আমাকে একা থাকতে দাও, আমি অনুরোধ করছি।

মেফিস্টোফেলিস : সকল মেয়েই এমন পরিচ্ছন্ন থাকে না। 

ফাউস্ট : (চারদিকে তাকিয়ে) হে সুন্দর ও মেদুর গোধূলি, এই পবিত্র স্থানটিকে উজ্জ্বল করে আছ। হে মধুর প্রেমের বেদনা, ক্রমবিলীয়মান আশার শিশির বুকে নিয়ে যে অন্তর এক ব্যর্থ প্রতীক্ষায় সঁপে দিয়েছে নিজেকে সে অন্তরকে অনতিশক্ত এক বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ করো। চারদিকে কেমন এক শান্তি-শৃঙ্খলা আর তৃপ্তির স্রোত বয়ে চলেছে। এক পরমানন্দের প্লাবন বয়ে চলেছে আমার ক্ষুদ্র অন্তরে, অথচ কিসের এক অনিৰ্দেশ্য আকুতি প্রবল হয়ে উঠছে ক্রমশ। 

(বিছানার কাছে চামড়ার এক আর্মচেয়ারে বসে)।

হে আমার প্রেয়সী, তোমার মুক্ত ও প্রসারিত বাহুর দ্বারা আমাকে আলিঙ্গন করো। তোমার বাহুলগ্ন হয়ে আমার মনে হচ্ছে আমার হারানো আনন্দবেদনাখচিত অতীতের উজ্জ্বল দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে আমার কাছে। আমার মনে হচ্ছে এই আসনে যেখানে আজ আমি বসে রয়েছি সেখানে আমার পিতা একদিন বসে থাকতেন এবং আজও বসে আছেন। আর তুমিও আমার কলগুঞ্জনরত দুরন্ত সন্তানদল পরিবৃত্ত হয়ে খ্রিস্টোৎসবের উপহার হাতে বসে রয়েছ। চঞ্চল ছেলেরা ভয়ে ভয়ে তাদের পিতামহের শীর্ণ শুষ্ক হাতটি চুম্বন করছে। হে আমার প্রিয়তমা, আমি যেন অনুভব করছি তোমার উপস্থিতি। তুমি যেন চুপিসারে কথা বলছ আমার সঙ্গে। তোমার দেহের বহির্বাসবিমুক্ত কোনও কোনও অংশে ফুটে উঠেছে যৌবনসমৃদ্ধ মাতৃত্বের বিরল মহিমা। শুচিশুভ্র হয়ে উঠেছে তোমার পায়ের তলার মাটি। তোমার এই সুন্দর হাতই মর্ত্যভূমিবিধৃত এই গৃহকোণকে পরিণত করে তুলতে পারে স্বর্গলোকে। 

(বিছানা থেকে মশারি তুলে দিয়ে)

আমার রক্তে এমন মধুর রোমাঞ্চ জাগছে কেন? এখানে আমি সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। এখানে প্রকৃতি তার নিজের হাতে ফুলের কুঁড়ির মতো এক শুচিশুভ্র দেবদূতকে গড়ে তুলেছে খেলাচ্ছলে। এইখানেই শায়িতা ছিল একদিন আমার সন্তান। তার সুন্দর কচি বুকে ছিল প্রাণের উত্তাপ। তার দেবোপম দেহে ছিল স্বর্গীয় সুষমা আর পবিত্রতা। আর আমি? যথাযোগ্য ক্ষমতা সংগ্রহ করে কি কারণে আমি এখানে এসেছি? এই মুহূর্তে এত বিচলিত হয়ে উঠেছি কেন? কি চাই আমি? আমার অন্তরে কেন এত সংক্ষোভ? কেন এত আঘাত, কিসের ক্ষত? হে হতভাগ্য ফাউস্ট! আমি আর তোমাকে চিনতে পারছি না। 

এখানে কি ঐন্দ্রজালিক কোনও বায়বীয় শক্তি কাজ করছে? আমি এখানে এসেছিলাম ক্ষণকালীন আনন্দের সন্ধানে। সে আনন্দ প্রেমের স্বপ্নের এক মধুর অবকাশে নিঃশেষে কোথায় তলিয়ে গেছে। প্রতিটি পরিবর্তনশীল ক্ষণভঙ্গুর কালখণ্ডের হাতে আমরা কি তবে খেলার পুতুল? 

আর যদি সে ঠিক এই মুহূর্তে এখানে এসে পড়ে তাহলে কেমন করে আমি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব? আমার অন্তরস্থিত উদ্ধত অহকারী দৈত্যটা কিভাবে তখন শান্ত হয়ে পড়বে তার পায়ে? 

মেফিস্টোফেলিস : তাড়াতাড়ি করো। আমি দেখতে পাচ্ছি সে ফিরে আসছে।

ফাউস্ট : যাও, যাও, আমি আর কখনও ফিরে যাব না। 

মেফিস্টোফেলিস : এখানে একটি কৌটো রয়েছে। আমি কিছুক্ষণ আগে এটা পেয়েছি। এটা তাড়াতাড়ি চাপা দিয়ে লুকিয়ে রাখ। কারণ এটা সে দেখতে পেলেই তার মাথাটা ঘুরে যাবে। এর মধ্যে আমি কিছু খেলনা রেখেছি যাতে তুমি আর একটা কৌটো লাভ করতে পার। খেলা খেলা এবং শিশু শিশু। তুমি একটা শিশু ছাড়া আর কিছু নও। 

ফাউস্ট : আমি বুঝতে পারছি না এ কাজ করা আমার উচিত হবে কি না। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি আবার জিজ্ঞেস করছ, কুণ্ঠা করছ? তুমি কি নিজেই গোলমালটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাও? আমি তোমাকে বলছিলাম আজকের এই সুন্দর দিনটার মতো তোমার কামনাকে সংযত করে রাখো। আমাকে আর কষ্ট দিও না। তাতে তোমার বিষাদ বা দুঃখের কোনও কারণ দেখি না। যাই হোক, আমি আবার হাতটা ঘষে দেখি ভালো কিছু করতে পারি কি না। 

(কৌটোটা হাতে চেপে ধরে তাতে তালা দিল)। 

এখন তাড়াতাড়ি চলে যাও। যাও, সেই সুন্দরী কুমারীকে ছলনার দ্বারা মুগ্ধ করে তোমার ইচ্ছার বশীভূত করে তোল তাকে। আর কাছে তুমি এমন একটা ভাব দেখাবে যাতে মনে হবে তুমি এই মুহূর্তে পদার্থবিদ্যা ও অধিবিদ্যার মতো কঠিন দুটি বিষয় সম্বন্ধে বস্তৃতা শোনার জন্য কোনও বক্তৃতাসভায় রাখার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছ। যাও, চলে যাও। (উভয়ের প্রস্থান) 

মার্গারেট : (প্রদীপ হাতে) জায়গাটা বড় সংকীর্ণ। এখানে বড় গুমোট গরম। (জানালাটা খুলে দিল) কিন্তু বাইরে এতটা গরম নেই। আমার ভয় হচ্ছে। অথচ বুঝতে পারছি না কেন এই ভয়। আমার মা কি এসে পড়বে? মা কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে? আমার গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেছে। আমার কাঁপুনি আসছে। আমার মনটা দুর্বল। আমি বড় ভীরু প্রকৃতির। 

(পোশাক খুলতে খুলতে গান গাইতে লাগল)

থিউল দেশে এক যে ছিল রাজা। 
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে তার রানির
প্রতি ছিল একান্তভাবে বিশ্বস্ত, যে রানি মৃত্যুকালে
তাকে দিয়ে গিয়েছিল এক সোনার পানপাত্র।
রাজার কাছে এ পাত্র ছিল সবচেয়ে মূল্যবান।
যখনি তিনি এ পাত্রে মদ পান করতেন
এক চুমুকে শেষ করতেন সে মদ আর
সঙ্গে সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ত
নিঃশেষিত সেই পাত্রের বুকে। 
অবশেষে এসে গেল রাজার মৃত্যুর দিন।
উপস্থিত সভাসদদের প্রয়োজনীয় সব কথা
বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর বিষয় সম্পত্তির
সব অধিকার বুঝিয়ে দিলেন তার উত্তরাধিকারীকে;
কিন্তু তার সেই প্রিয় পানপাত্রটি কাউকে দিলেন না।
কাউকে বললেন না তাঁর অশ্রুসজল গোপন রহস্যের কাহিনী।
তখন রাত্রিকাল
রাজার সামনে বসেছিল ভোজসভা।
প্রাসাদের বাইরে গর্জন করছিল তখন 
তরঙ্গায়িত রাত্রির সমুদ্র।
প্রিয়তমার সোনালী স্মৃতিবিজড়িত এই পানপাত্রে
শেষবারের মতো মদ পান করলেন রাজা।
তারপর খোলা জানালা দিয়ে পাত্রটা ছুঁড়ে 
ফেলে দিলেন সমুদ্রের জলে।
তবু সজল আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন রাজা।
দেখলেন চকিত আলোর মুকুটপরা অন্ধকার তরঙ্গগুলোর সঙ্গে
লড়াই করতে করতে সেই স্বর্ণোজ্জ্বল পানপাত্রটা
একবার ডুবছে অসহায়ভাবে, আবার পরমুহূর্তে ভেসে উঠছে।
অবশেষে চিরকালের মতো ডুবে গেল সেটা।
এদিকে দেখতে দেখতে চিরদিনের মতো মুদ্রিত হয়ে এল 
রাজার ক্লান্ত অবসন্ন চক্ষুপল্লব।

(মার্গারেট তার পোশাক গুছিয়ে রাখতে গিয়ে মণিমানিক্যপূর্ণ কৌটোটা দেখতে পেল) 

এই সুন্দর কৌটোটা কোথা হতে কি করে এল? আমি তো এটা অবশ্যই সিন্দুকের মধ্যে চাবি দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। এটা সত্যিই আশ্চর্যজনকভাবে সুন্দর। কি থাকতে পারে এর ভিতর? হয়ত মার কাছে কেউ এটা বন্ধক দিয়ে গেছে এবং মা তাকে কিছু টাকা ধার দিয়েছে। এর সঙ্গে একটা চাবিও রয়েছে। এটা খুলে দেখতে মন চাচ্ছে। একি? হা ভগবান! এ সব জিনিস কোথা থেকে এল? এত সব সুন্দর বস্তু কখনও চোখে দেখিনি আমি। এত সব মূল্যবান গয়না নিশ্চয় কোনও ধনীকন্যার যে উৎসবের দিন এই সব পরে বেড়ায়। এই মুক্তোর চেনটা আমার চুলে থাকবে। এত ঐশ্বর্য কার? 

(সব গয়না পরে নিজেকে সাজিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল)

এই কর্ণকুণ্ডলটা যদি আমার নিজস্ব হতো! এ কুণ্ডল পরিধান করার সঙ্গে সঙ্গে চেহারার ভাবটা কেমন বদলে যায় মুহূর্তে; কেমন উদ্দীপিত করে তোলে যে কোনও নারীর যৌবনসৌন্দর্যকে! যারা এই মূল্যবান অলঙ্কারের অধিকারিণী তাদের কতই না সৌভাগ্য। আর যাদের এ বস্তু নেই তারা কিছু মুগ্ধ বিস্ময় আর কিছু ঈর্ষাসহযোগে খণ্ডিত অন্তরে প্রশংসা করে এ বস্তুর সত্ত্বাধিকারিণীদের। তবে স্বর্ণালঙ্কার কে না চায়? সোনার উপরের জীবনের সৌন্দর্য সম্মান অনেকখানি নির্ভর করে। আমরা যারা এই সোনা হতে বঞ্চিত তারা সত্যই হতভাগ্য। 

নবম দৃশ্য 

পদচারণা

(ফাউস্ট চিন্তান্বিত অবস্থায় পদচারণা করছিল। এমন সময় মেফিস্টোফেলিস তার কাছে এল) 

মেফিস্টোফেলিস : জীবনে কোথাও কোনও প্রেম পেলাম না; পেলাম শুধু ঘৃণা আর প্রত্যাখ্যান। প্রজ্বলিত নরকাগ্নির অপরিহার্য লেলিহান শিখার দ্বারা সতত উত্তপ্ত আমার দেহমন। আমি যদি হীনতর ছলনা ও চাতুর্যসহকারে মিথ্যা শপথবাক্যের দ্বারা মুগ্ধ করতে পারতাম মানুষকে। 

ফাউস্ট : তোমার কি হলো? কিসের বিষাদ তোমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল যাদুকর? তোমার এমন বিষণ্ণ মুখ কখনও দেখিনি। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি যদি শয়তান না হই তাহলে শয়তানের কাছে আত্মসমর্পণ করব নিঃশেষে। 

ফাউস্ট : দুঃখে তোমার এখন মাথার ঠিক নেই। তুমি এখন উন্মাদের মতো আচরণ করবে আর আবোল-তাবোল বকবে। 

মেফিস্টোফেলিস : এখন ভেবে দেখো, মার্গারেটের জন্য যে মুদ্রা রাখা হয়েছিল তা এখন পুরোহিতের পকেটে যাবে। মা তাদের দেখে ফেলে আর সঙ্গে সঙ্গে এক গোপন ভীতিবিহ্বলতা আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে। দূষিত আবহাওয়ার এক স্পষ্ট গন্ধ পেয়েছে। সে। তার মা এমনই মেয়ে যে তার প্রার্থনার বই খুলে তার গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারে কোন শব্দটা ধর্মসমম্মত আর কোন শব্দটা ধর্মসম্মত নয়। তাই মার্গারেটের গায়ে মণিমুক্তোর অলঙ্কার দেখে তার মা বুঝতে পারে এ সব অলঙ্কার সৎ পথে বিধাতার আশীর্বাদস্বরূপ আসেনি। মা বলে, বৎসে, অসৎ পথে অর্জিত বস্তু মানুষের আত্মাকে ফাঁদে ফেলে কুপথে নিয়ে যায়, তার রক্ত শোষণ করে নেয়। সুতরাং এই সব বস্তু আমরা ঈশ্বরমাতা মেরীর সামনে উপস্থাপিত করব, তিনি স্বর্গীয় কোনও উপায়ে এর ঋণ পরিশোধ করবেন। মার্গারেট কিন্তু বিরক্তির সঙ্গে বলল, উপহারের দান-প্রতিদান আজও চলছে। যে ব্যক্তি আমাকে এই সব বস্তু উপহার হিসাবে দান করেছে সে একেবারে নাস্তিক নয়। মার অলক্ষ্যে অগোচরে এক ব্যক্তি আমার ঘরে আসে। এই গয়নার কৌটোটা যেখানে লুকোন ছিল সেখানে তাকিয়ে দেখে এগুলো উদ্ধার করে। তারপর সে বলে, কোনও বস্তু হাতের কাছে পেলে তা আয়ত্ত করতে হয়: এটাই হলো মানবজগতের রীতি। যে সব পবিত্র গির্জা দেখছ, তাদের বিশাল ও বলিষ্ঠ উদর অনেকে জমি গ্রাস করছে। এই সব পবিত্র গির্জাগুলোর অসদুপায়ে অর্জিত সব বস্তুগুলো হজম করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। 

ফাউস্ট : এ কাজ সবাই করে। এক্ষেত্রে রাজা ও সুদখোর ইহুদী একই পথের পথিক। 

মেফিস্টোফেলিস : তারপর এক পুরোহিত এই সব রত্ন ও মণিমুক্তো একটা থলেতে ভরে নিয়ে চলে গেল। ঠিক যেন এক বস্তা বাদাম অথবা ব্যাঙের বিষ্ঠা। কোনও ধন্যবাদ নয়, শুধু বলে গেল স্বর্গে এর প্রতিদান পাওয়া যাবে। যাবার সময় মার্গারেট ও তার মাকে প্রচুর নীতিশিক্ষা দিয়ে গেল। 

ফাউস্ট : আর মার্গারেট? 

মেফিস্টোফেলিস : অশান্ত ও চঞ্চলভাবে বসে বসে শুধু ভাবছে। সে এখন ভেবে ঠিক করতে পারছে না এখন তার কি করা উচিত। অলঙ্কারগুলোর কথা দিনরাত ভাবছে। বিশেষ করে ভাবছে তার কথা যে তাকে এই আনন্দের বস্তুটি দান করে। 

ফাউস্ট : আমার প্রিয়তমার দুঃখে আমি বড় ব্যথা পাচ্ছি। ওকে আমার এক সাজ গয়না এনে দাও। আগেরগুলো খুব একটা এনো না। 

মেফিস্টোফেলিস : তা বটে। এটা যেন একটা ছেলেখেলা। 

ফাউস্ট : আমার ইচ্ছানুসারে সব কিছুর ব্যবস্থা করো। তার কোনও প্রতিবেশীর মাধ্যমে কৌশলে কাজ করবে। শয়তানের মতো অযথা শক্ত হয়ে থেকো না; তার পছন্দমতো নূতন এক কাজ গয়না এনে দাও।

মেফিস্টোফেলিস : ঠিক আছে মহাশয়, তোমার কথামতোই কাজ হবে। (ফাউস্টের প্রস্থান) এই ধরনের মোহগ্রস্ত নির্বোধ প্রেমিকরা তাদের প্রেমিকাদের চিত্তবিনোদনের জন্য সূর্য, চন্দ্র ও গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে বাতাসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে থাকে। 

দশম দৃশ্য 

প্রতিবেশীর গৃহ

মার্থা : (একাকী) ঈশ্বর আমার স্বামীকে ক্ষমা করুন, যদিও সে আমার প্রতি তার কর্তব্য পালন করেনি। আমাকে এই তৃণগুচ্ছের উপর শুতে বাধ্য করে, এই দুঃখের। মধ্যে রেখে সে খুশিমতো পৃথিবী পরিভ্রমণ করতে বেরিয়েছে। তথাপি আমি তাকে কোনওরূপ মনোকষ্ট দিতে চাই না। ঈশ্বর জানেন আমি তাকে কত ভালোবাসি এবং তাকে আমি ভুলতে পারি না। (সে কাঁদতে লাগল) হয়ত আমার স্বামী মারা গেছে। হায় হায়। মৃত্যুর কোনও সার্টিফিকেটও নেই। 

মার্গরেট : (এল) শোনো মার্থা।

মার্থা : মার্গারেট, কি হয়েছে তোমার? 

মার্গারেট : আমি দাঁড়াতে পারছি না। আমার হাঁটু দুটো কাঁপছে। আমি আমার কক্ষে একটা কৌটো দেখতে পাই। তাতে নানারকমের উজ্জ্বল অলঙ্কার ছিল। এই উজ্জ্বল গয়না আগে কেউ কখনও দেখেনি। 

মার্থা : তোমার মাকে তা বলো না। তাহলে তিনি পুরোহিতকে সব দিয়ে দেবেন।

মার্গারেট : দেখো দেখো, তাকিয়ে দেখো।

মার্থা : (তাকে সাজিয়ে) ওঃ, তোমার কি বিরল সৌভাগ্য। 

মার্গারেট : কিন্তু হায়, আমি পথে এই সব অলঙ্কার পরে বেড়াতে পারি না, আবার গির্জাতেও যেতে পারি না। 

মার্থা : তবে এই সব অলঙ্কার গোপন করে এ পথে বেড়াতে পার না যখন-তখন। এখন আমার ঘরের ঐ আয়ানাটার সামনে পায়চারি করে বেড়াও। তাতে আমাদের দুজন্যেই আনন্দ হবে। আপাতত এই থাক। তারপর যখন কোনও ছুটি বা উৎসবের দিন আসবে তখন একে একে গয়নাগুলো বার করবে। যেমন ধরো প্রথমে হার, তারপর অন্যান্য গয়না। তোমার মা দেখতে পাবে না। তারপর কি করা যাবে বা বলা যাবে না আমরা ভেবে ঠিক করব। 

মার্গারেট : যেই আমাকে এই সব মূল্যবান অলঙ্কার এনে দিক না কেন, নিশ্চয়ই কোথাও একটা গলদ আছে, এর মধ্যে কিছু একটা অন্যায় আছে–আমার সন্দেহ হচ্ছে। (দরজায় করাঘাত) হা ভগবান! নিশ্চয়ই আমার মা এসে গেছে। 

মার্থা : (ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে) কোনও এক অপরিচিত ভদ্রলোক দেখছি– ভিতরে আসুন। 

(মেফিস্টোফেলিসের প্রবেশ)

মেফিস্টোফেলিস : আমাকে এভাবে উপযাজক হয়ে আপনাদের ঘরে ঢুকতে হলো এজন্য আমি ক্ষমা চাইছি হে মহোদয়া। 

(মার্গারেটকে দেখে সমসহকারে কিছুটা পিছনে হটে)

আমি মার্থা শোয়াইলিনকে চাই।

মার্থা : আমিই মার্থা। ভদ্রলোকের কি প্রয়োজন আছে? 

মেফিস্টোফেলিস : (মার্থাকে জনান্তিকে) তোমাকে পেয়ে ভালোই হয়েছে। তবে তোমার ঘরে এখন একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা অতিথি হিসাবে রয়েছেন। আমি না হয় বিকালে আবার আসব। 

মার্থা : (উচ্চৈঃস্বরে) নিশ্চয় নিশ্চয়! শোনো মার্গারেট, উনি তোমাকে একজন সম্ভ্রান্ত মহিলা ভাবছেন। 

মার্গারেট : আমি একজন দরিদ্র তরুণী। ভদ্রমহোদয় দয়াপরবশ হয়ে আমার প্রতি উচ্চ ধারণা পোষণ করেছেন। এ সব অলঙ্কার আমার নয়। 

মেফিস্টোফেলিস : শুধু অলঙ্কার নয়। আপনার চোখের দৃষ্টি ও হাবভাবও সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মতো। যাই হোক, আমি এখানে অবস্থানের অনুমতি লাভ করে খুশি। 

মার্থা : আপনার কি দরকার? আমি তা মেটাবার চেষ্টা– 

মেফিস্টোফেলিস : আমার গলার স্বরটা যদি দুঃখে এমন ভারী হয়ে উঠত। কথাটা বলার জন্য যেন কিছু মনে করো না। অন্যভাবে নিও না। তোমার স্বামী মারা গেছে। 

মার্থা : মারা গেছে! হায় তার অন্তঃকরণ কি সরলই না ছিল। আমার স্বামী মারা গেছে, আমাকেও মরতে দাও। 

মার্গারেট : শোনো মেয়ে। বিপদে ধৈর্য ও সাহস হারিও না। 

মেফিস্টোফেলিস : আমাকে এই দুঃখপূর্ণ কাহিনীটা পুরো বলতে দাও। 

মার্গারেট : সুতরাং আমি আর কখনও কাউকে ভালোবাসব না। প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত এই ধরনের ক্ষতি আমাকে মর্মাহত করবে। 

মেফিস্টোফেলিস : যেমন বেদনার পর আনন্দ আসে তেমনি আনন্দের পরও বেদনা উড়ে এসে জুড়ে বসবেই। 

মার্থা : তার জীবনাবসান কিভাবে হলো তা বলো আমায়। 

মেফিস্টোফেলিস : পদুয়ায় তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে সেন্ট অ্যান্টনির পাশে।

মার্থা : তোমার কি আর কিছু বলার আছে? 

মেফিস্টোফেলিস : দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ের কিছু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর তার কিছুই ছিল না। তাকে ঋণের অভিশাপ থেকে বাঁচাবার জন্য আমি নিজের তিনশো টাকা খরচ করেছি। ফলে আমার হাত এখন খালি। 

মার্থা : কি! তার পকেটে একটা কানাকড়িও নেই? কোনও মণিমুক্তো কিছুই নেই? যে কোনও মানুষই হয় চাকরি করে অথবা ভিক্ষে করে কিছু সঞ্চয় করে। এমন নিঃস্ব হয়ে কেউ মরে না। 

মেফিস্টোফেলিস : এটা সত্যি দুঃখের বিষয় ভদ্রমহোদয়া। তবে একটা কথা আমি বলতে পারি, সে কোনও বিষয়ে কখনও বাজে খরচ করেনি। তাছাড়া তার অনুশোচনাও কম ছিল না। তার দুর্ভাগ্যের জন্য প্রায়ই খেদ করতে সে। 

মার্থা : হায়! মানুষ কতই না হতভাগ্য! আমি অবশ্যই তার আত্মার জন্য প্রার্থনা জানাব ঈশ্বরের কাছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আপনি শীঘ্রই আবার বিবাহের প্রস্তাব পাবেন। আপনার সে যোগ্যতা আছে। আপনি দয়ালু, মমতাময়ী। 

মার্থা : না না। তাতে কোনও ফল হবে না। 

মেফিস্টোফেলিস : দ্বিতীয়বার স্বামী না হলেও একজন সুদর্শন প্রেমিক হিসাবে কাউকে গ্রহণ করতে পারেন। প্রেম নিবেদন করার জন্য মনমতো লোক পাওয়াটা ঈশ্বরের একটা বড় দান। 

মার্থা : এদেশের প্রথা তা নয়।

মেফিস্টোফেলিস : প্রথা থাক বা নাই থাক, এটাই সাধারণ ঘটে থাকে।

মার্থা : আপনি বলে যান। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি তার মৃত্যুশয্যায় পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। শয্যা নয়, যেন আধপচা খড় দিয়ে তৈরি সারের স্তূপ। তথাপি সে একজন খ্রিস্টান হিসাবেই মৃত্যুবরণ করে। যে যখন দেখে মৃত্যুর পর দুর্নাম রটবে চারদিকে তখন সে চিৎকার করে বলতে থাকে, আমি আমার নিজের আচরণকেই ঘৃণ্য বলে মনে করি। এইভাবে আমার স্ত্রী, পরিবার, আমার ব্যবসাকে ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়। এই সব কিছুর স্মৃতি মৃত্যুযন্ত্রণার সমতুল। আশা করি আমি আমার স্ত্রীর প্রতি যদি কোনও অন্যায় করে থাকি ঈশ্বর তাহলে তা ক্ষমা করবেন। 

মার্থা : (কাঁদতে কাঁদতে) আহা কী ভালো সে। সে ক্ষমা সে পেয়েই গেছে।

মেফিস্টোফেলিস : তথাপি তার স্ত্রীকেই সে দোষ দিয়ে গেছে। আমাকে নয়। 

মার্থা : সে মিথ্যা বলেছে। মৃত্যুকালে সে মিথ্যা নিন্দার কথা বলে গেছে আমার নামে। 

মেফিস্টোফেলিস : শেষ সময়ে তার চেতনা শিথিল হয়ে পড়ে, আমার যতদূর মনে হয়। সে বলে, আমার কোনো স্বাধীনতা ছিল না, খেলাধুলা বা আনন্দোৎসবের কোনও সময় ছিল না। প্রথম কথা সন্তানদের ভাবনা ভাবতে আর তাদের খাবার জোটাতেই সব সময় কেটে যেত আমার। তার জন্য রাতদিন খাটতে হতো হাড়ভাঙা খাটুনি। তবু শান্তিতে পেট ভরে দুবেলা দুমুঠো খেতে পেতাম না। 

মার্থা : মরণকালে বিস্মৃতিবশত সে কি সব প্রেম ও ঈশ্বরবিশ্বাসের কথা ভুলে গিয়েছিল একেবারে? আমিও যে দিনরাত খাঁটি, সমান উদ্বেগ ভোগ করি সেকথা ভুলে গিয়েছিল সে। 

মেফিস্টোফেলিস : ঠিক তা নয়। সে কথা তার মনে ছিল। সে বলেছিল যখন আমি মালটা থেকে চলে এসেছিলাম তখন আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাই নিবিড়ভাবে। দয়া করে ঈশ্বর বিশেষ এক সৌভাগ্য ও দান। করেন। একজন তুর্কী ব্যবসায়ীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। তার কাছে ছিল প্রচুর সম্পদ। সে তাই নিয়ে সোভান যাচ্ছিল। সাহসের সঙ্গে তাঁর সঙ্গী হিসাবে আমি তাকে। পথে সাহচর্য দান করি আর তার ফলে সেই সাহসিকতার মূল্যস্বরূপ আমার প্রাপ্য সে যথাযথভাবে দিয়ে দেয়। 

মার্থা : বলো, বলো কেমন করে? কোথায়? তার কাছে কি টাকাটা ছিল?

মেফিস্টোফেলিস : কে তার খবর রাখে? কে জানে কোথায় কোন বাতাসে সে টাকা উড়ে গেছে? সে যখন নেপলস-এর একাকী নির্বান্ধব অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন এক সুন্দরী কুমারী তাকে ভালোবেসে সঙ্গ দান করে। সে ভালোবাসার কথা শেষ পর্যন্ত মনে ছিল তার। 

মার্থা : শয়তান! নিজেদের ছেলেদের না দিয়ে সে টাকা ভোগ করা মানে চুরি করা। এত দুঃখকষ্ট পাওয়া সত্ত্বেও তার চৈতন্য হয়নি? সে এই ধরনের নির্লজ্জভাবে উঙ্খল জীবনযাপন করে? 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু দেখ! যাই হোক, সে এখন মৃত। আমি যদি তোমার অবস্থায় পড়তাম, এই সব কিছু সত্ত্বেও তার জন্য পুরো এক বছর শোক প্রকাশ করতাম আমি। তার পরের বছর আমি নিজের দিকে তাকাতাম। নিজের কথা ভাবতাম। 

মার্থা : হা ভগবান! আমার প্রথম স্বামীর মতো এমন ভালোবাসার লোক জগতে কোথাও পাব না আমি। লোকটা বোকা-বোকা হলেও তার স্বভাবটা ছিল বড় মিষ্টি। শুধু সে মাঝে মাঝে আমাকে ছেড়ে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াত। বিদেশী মদ, মেয়েমানুষ আর পাশাখেলার ঝোঁক ছিল তার। 

মেফিস্টোফেলিস : ঠিক আছে। তাও যদি বা সে সুচতুরভাবে তোমার পদস্খলনের ব্যাপারগুলোকেও তুচ্ছ জ্ঞান করে এড়িয়ে যেত। আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমার এই অবস্থা জেনেও আমি তোমার সঙ্গে আংটি বিনিময় করতে রাজি আছি। 

মার্থা : ভদ্রমহোদয় ঠাট্টা করতে ভালোবাসেন। 

মেফিস্টোফেলিস : (স্বগত) সময় বুঝে এখান থেকে কেটে পড়ব আমি। তার কথায় বিশ্বাস করে সে শয়তানকেই গ্রহণ করবে আমার মনে হয়। (মার্গারেটকে) কথাটা শুনে তোমার কেমন লাগছে? 

মার্গারেট : আপনি আসলে কি বলতে চাইছেন? 

মেফিস্টোফেলিস : (স্বগত) তুমি যেমনি সুন্দরী তেমনি নির্দোষ। (উচ্চৈঃস্বরে) ভদ্রমহোদয়গণ, বিদায়।

মার্গারেট : বিদায়? 

মার্থা : বিদায়ের আগে এক মুহূর্তের জন্য একটা কথা আছে। আমি আমার স্বামীর মৃত্যুর আইনসঙ্গত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পেতে চাই। কোথায় কখন কিভাবে তার মৃত্যু হয় তা জানা দরকার। আমি তার মৃত্যুর কথা কোনও সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশ করব। 

মেফিস্টোফেলিস : হ্যাঁ, হে আমার প্রিয়তমা, উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণাদিই কোনও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। আমার এক উচ্চপদস্থ বন্ধু আছে। সেও এই ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে। আমি তাকে নিয়ে আসব। 

মার্থা : হ্যাঁ, তাই করুন। 

মেফিস্টোফেলিস : এই তরুণীই তখন উপস্থিত থাকবেন। আমি যাকে আনব, আমার সেই বন্ধু একজন সাহসী যুবক, প্রচুর দেশভ্রমণ করেছে। তাকে পেয়ে এঁর মতো মেয়েরা আনন্দ পাবেন। 

মার্গারেট : তাঁর কাছে যেতে আমার লজ্জা পাবে।

মেফিস্টোফেলিস : কোনও রাজার সামনে লজ্জা পাওয়া উচিত নয়। ও কথা বলা ঠিক নয়। 

মার্থা : আমার বাড়ির পিছনের দিকে বাগানে আজ সন্ধ্যায় তাহলে আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করব। 

একাদশ দৃশ্য 

রাজপথ

ফাউস্ট। মেফিস্টোফেলিস

ফাউস্ট : কি ব্যাপার? সব ঠিক হয়ে গেছে? প্রস্তুতিপর্ব শেষ?

মেফিস্টোফেলিস : থামো থামো। তুমি যে দেখছি কামনার আগুনে জ্বলছ? ঠিক আছে, শীঘ্রই তুমি মার্গারেটকে পাবে। তার প্রতিবেশিনী মার্থার বাড়িতে তুমি তাকে আজ সন্ধ্যায় দেখতে পাবে। অবৈধ প্রেমসম্পর্কের ব্যাপারে তার মতো মেয়ের কোনও তুলনা নেই জানবে। 

ফাউস্ট : ভালো কথা।

মেফিস্টোফেলিস : তবে আমার দিক থেকে একটা কাজ করার আছে।

ফাউস্ট : কারো কাছ থেকে কিছু পেতে হলে কিছু দিতেই হবে। 

মেফিস্টোফেলিস : তাকে আমাদের বুঝিয়ে বলতে হবে তার স্বামীর মৃতদেহ এখন পদুয়ার পবিত্র ভূমিতে যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে সমাধির মধ্যে শায়িত আছে। 

ফাউস্ট : খুব ভালো কথা। তবে আমাদের এখন সর্বপ্রথম সেখানে অর্থাৎ পদুয়ায় যেতে হবে তো? 

মেফিস্টোফেলিস : কষ্ট করে যাওয়ার কোনও দরকার নেই। তুমি শুধু বলে দেবে তুমি এটা জান। 

ফাউস্ট : তুমি যদি ভালো কথা না শোনো, তাহলে আমি তোমার পরিকল্পনা ছিন্নভিন্ন করে দেব। 

মেফিস্টোফেলিস : ঠিক আছে, ধার্মিক সাধু মহাশয়। এই কি জীবনে প্রথম তুমি মিথ্যা সাক্ষ্যদান করছ? যে ঈশ্বর এই পৃথিবীর স্রষ্টা এবং সর্বত্র বিরাজ করছেন সেই ঈশ্বর ও মানুষ সম্বন্ধে তুমি কি এক নির্লজ্জ সাহসিকতার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলনি? ব্যাপারটা যদি তুমি গভীরভাবে তলিয়ে দেখ তাহলে দেখবে তুমি সোযাতেনের মৃত্যু আর সমাহিত হওয়ার খবরটা জান। আর সেই কথাটাই পরিষ্কার বলে দেবে। 

ফাউস্ট : তুমি দেখছি বরাবর নাস্তিক আর মিথ্যাবাদী রয়ে গেছ। 

মেফিস্টোফেলিস : হ্যাঁ, আমি তোমার মনের গভীর কথা সব জানি বলেই একথা । বলেছি। তুমি কি মার্গারেটের মতো সুন্দরী প্রেমিকাকে পাবার জন্য, করায়ত্ত করার জন্য তার তোষামোদ করবে না? অন্তরের সমস্ত নিবিড়তা দিয়ে তার জন্য শপথ করবে না? 

ফাউস্ট : আমি আন্তরিকতার সঙ্গে তা করব। 

মেফিস্টোফেলিস : চমৎকার। তোমার অনন্ত ভালোবাসা আর সুগভীর বিশ্বাসই কি তোমার অন্তরকে শক্তি জোগাবে? 

ফাউস্ট : থামো, থামো। যদি আমার এই জ্বলন্ত কামনার অগ্নিশিখা আর আমার ইন্দ্রিয়চেতনার সমস্ত তীক্ষ্ণতা দিয়ে অনুসন্ধান করেও আমার মনের মতো মেয়ে না পাই তা হলে সারা বিশ্বসৃষ্টি পরিভ্রমণ করে বেড়াব আমি তার সন্ধানে। এর জন্য যে বিপুল উদ্যম আমি ব্যয় করব তা অনন্ত, মহৎ, চিরন্তন। তুমি কি এটাকে শয়তানি খেলা বলে অভিহিত করতে চাও। 

মেফিস্টোফেলিস : তা যদি বলি তাহলেও আমি ঠিকই করব।

ফাউস্ট : শোনো। আমার একটা অনুরোধ, আমাকে রেহাই দাও। অনেক বকেছি। কারও যদি জিহ্বার জোর থাকে তাহলে সে তার অধিকার অবশ্যই আদায় করে নেবে। তবে এ বিষয়ে আর কথা বাড়ালে তাতে তিক্ততারই সৃষ্টি হবে। আমি এ কাজ করবই তাতে তুমি যাই বলো। 

দ্বাদশ দৃশ্য 

বাগান (ফাউস্টের বাহুলগ্ন অবস্থায় মার্গারেট। মার্থা ও মেফিস্টোফেলিস পায়চারি করছিল) 

মার্গারেট : আমি বেশ বুঝতে পারছি আপনি আমার জন্য নিজেকে ছোট করে তুলছেন। আর তাতে আমি লজ্জাবোধ করছি। অবশ্য পথিকরা যে কোনও ধরনের। খাবার খেতে অভ্যস্ত। আমি জানি আমার এই সব কথাবার্তা আপনার মতো একজন অভিজ্ঞ লোককে তৃপ্তি দান করতে পারবে না। 

ফাউস্ট : তোমার চোখের একটি দৃষ্টি, তোমার মুখের একটিমাত্র কথা জ্ঞানীদের সমস্ত জ্ঞানগর্ভ কথার থেকেও আমাকে বেশি তৃপ্তিদান করবে। (মার্গারেটের হাত চুম্বন করল) 

মার্গারেট : না না, নিজেকে এমন ছোট করবেন না। আমার এই নোংরা দেখতে খারাপ হাতটা কেন চুম্বন করছেন আপনি? আমাকে যে কাজ করতে হয় তার জন্য হাতটা এমন শক্ত হয়ে উঠেছে। আমার মা আমার খুব কাছেই রয়েছে। 

(তারা চলে গেল)

মার্থা : আপনি কি সব সময়ই দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান? 

মেফিস্টোফেলিস : হায়! আমার ব্যবসা আর কর্তব্যের খাতিরেই আমাকে এমনভাবে ব্যস্ত হয়ে ছুটে বেড়াতে হয় দেশে-বিদেশে। কোনও জায়গায় কিছুদিন থাকার পর সে জায়গা ছেড়ে যেতে বড় কষ্ট হয়। তবু বেশিদিন সেখানে থাকার সাহস পাই না। 

মার্থা : যৌবনের উদ্দামতা যতদিন থাকে ততদিন এভাবে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো চলে। মুক্ত পাখির মতো বাধাবন্ধনহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসে দুর্দিন। তখন আত্মীয়-স্বজনহীন অবস্থায় অসহায়ভাবে কবরে যেতে হয়। তার জন্য চোখের জল ফেলার মতো কাউকে পাওয়া যায় না। এই ধরনের মানুষের শেষ পরিণতি বড় দুঃখের। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি ভয়ে ভয়ে দেখতে চাই ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায়। 

মার্থা : তাহলে আপনার ভাগ্যের উন্নতি ঘটাবার চেষ্টা করুন। 

(তারা চলে গেল)

মার্গারেট : হ্যাঁ, চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল। আপনার সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহার এখন আমার খুবই ভালো লাগছে। কিন্তু আপনার জন্য অন্য অনেক জায়গায় বন্ধুবান্ধব আছে। তারা আমার থেকে অনেক জ্ঞানী। 

ফাউস্ট : আমাকে বিশ্বাস করো প্রিয়তমা। লোকে সাধারণত যাদের জ্ঞানী বলে তারা অহঙ্কারী, সংকীর্ণচেতা। 

মার্গারেট : তা কি করে হয়? 

ফাউস্ট : যারা সরল প্রকৃতির,যারা নির্দোষ তারা জানে না তাদের সরলতা ও নির্দোষিতার মূল্য এবং আবেদন কতখানি। এই সরলতা ও নম্রতা প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ দান, মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ। 

মার্গারেট : আপনি যদি আমার কথা মনে এক মুহূর্তের জন্য স্থান দেন, তাহলে আপনি যখন যেখানেই থাকুন আপনার কথা আমি ভাবব। 

ফাউস্ট : তোমার হয়ত খুব একা একা লাগে। 

মার্গারেট : আমাদের সংসার খুবই ছোট। আপনি সেখানে গেলে ভালো আদরযত্ন পাবেন। আপনার মনে হবে এটা আপনার নিজের সংসার। আমাদের বাড়িতে কোনও দাসী নেই। আমি নিজে ঝট দেওয়া, সেলাই করা, উল বোনা, রান্না করা প্রভৃতি সব কাজই করি। সংসার সম্বন্ধে আমার মার জ্ঞান বেশ পাকা। শুধু যে খরচ বাঁচাবার জন্য আমরা সংসারের সব কাজ নিজেরা করি তা নয়। আমাদের আয় ছিল, আমরা আর পাঁচজনের থেকে আরামে থাকতে পারতাম। আমার বাবা আমাদের জন্য বেশ কিছু বিষয় সম্পত্তি রেখে যান। শহরের কাছে একটা বাড়ি আর একটা বাগান আছে আমাদের। বর্তমানে আমাদের জীবনে খুব একটা অভাবের তাড়না বা ব্যস্ততা নেই। আমার ভাই সৈনিকের কাজ করে। আমরা একটা ছোট বোন ছিল। সে মারা গেছে। তাকে নিয়ে অবশ্য আমাকে বেশ কষ্ট সহ্য করতে হয় কিছুকাল। তবু সে ছিল আমার বড় প্রিয় এবং তার জন্য আবার আমি সেই কষ্টের জীবনযাপন করতে রাজি আছি। 

ফাউস্ট : দেবদূতের মতোই গুণবতী তুমি। 

মার্গারেট : আমিই তাকে মানুষ করতাম। আমি তাকে দারুণ ভালোবাসতাম। সে ভূমিষ্ঠ হবার আগেই বাবা মারা যান। মা তখন রোগে শয্যাশায়ী, তার অবস্থা তখন বড়ই খারাপ। কোনও রকমে মা ধীরে ধীরে সেরে উঠছিলেন। তাঁর অত্যধিক দুর্বলতার জন্য তিনি শিশুটার দিক নজর দিতে পারছিলেন না মোটেই। তাই আমিই তার দেখাশোনা করতাম। জল দুধ যা খাওয়াবার আমিই তাকে খাওয়াতাম। আমিই তাকে কোলে রেখে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতাম। তারপর দিনে দিনে সে বেড়ে উঠতে লাগল। তার স্বাস্থ্য ভালো হতে লাগল। সে আমার মুখপানে তাকিয়ে প্রায়ই হাসত। 

ফাউস্ট : তখন নিশ্চয় তুমি এক পবিত্রতম আনন্দ লাভ করতে। তোমার কষ্টের লাঘব হতো। 

মার্গারেট : তবে তাকে নিয়ে আমাকে অনেক ক্লান্তিকর মুহূর্ত যাপন করতে হতো। রাত্রিতে আমার সেই ছোট্ট বোনের দোলনাটা রাখতাম আমার বিছানার ঠিক পাশেই। সে একটু নড়লেই আমি টের পেতাম আর আমার ঘুম ভেঙে যেত। তখন আমি তাকে কোলে নিয়ে আদর করতাম। আমার নরম বুকে নিবিড়ভাবে চেপে ধরতাম তাকে। অনেক সময় সে কাঁদলে চুপ করাবার জন্য তাকে নিয়ে বিছানা ছেড়ে ঘরে পায়চারি। করতাম অশান্তভাবে। তারপর দেখতে দেখতে সকাল হয়ে যেত। মুখ-হাত ধুয়ে বাজার করতে যেতাম। রান্নাঘরের কাজে মন দিতাম। দিনের পর দিন কাটতে থাকে। এইভাবে। যতই পরিশ্রমী হোক না কেন কোনও মানুষ, মাঝে মাঝে ক্লান্তি তার। অবসাদ আসে তার শরীরে। সে তখন ভালো আহার আর বিশ্রাম চায়। 

(তারা চলে গেল)।

মার্থা : এটা সত্যি কথা। গরিব ঘরের মেয়েগুলো বড় নির্লজ্জ। যে সব পুরুষ গোঁড়ামির সঙ্গে কৌমার্যব্রত পালন করে তাদের বিয়েতে মন বসাতে পারে না। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমার মতো যদি কোনও মেয়ে পাই তাহলে প্রেমের এই সব চটুল অভিনয় ছেড়ে আমার জীবনের পরিবর্তন করি। তাহলে সুদিন নিয়ে আসি আমার জীবনে। 

মার্থা : আমাকে সব কথা খুলে বলুন মশাই। আপনি কি এর আগে মনের মতো কোনও মেয়ে পাননি জীবনে? কাউকে আপনার মন দেননি? 

মেফিস্টোফেলিস : একটা প্রবাদ আছে, যে কোনও মানুষের জীবনে একটা গরম চুল্লী আর সতীলক্ষ্মী স্ত্রী সোনা বা মণিমুক্তোর মতোই দামী। 

মার্থা : আমি বলতে চাই, আপনি কখনও এ বিষয়ে কোনও কামনা অনুভব করেননি? 

মেফিস্টোফেলিস : আমি যেখানেই গিয়েছি সর্বত্র আদর-আপ্যায়ন অবশ্য পেয়েছি। পেয়েছি ভদ্র ব্যবহার। 

মার্থা : আমি বলতে চাই, আপনি কি কোথাও কোনও প্রেমময় স্পর্শ পাননি?

ফাউস্ট : মেয়েদের ঠাট্টা করা মোটেই উচিত নয় কারো পক্ষে।

মার্থা : আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছেন না।

মেফিস্টোফেলিস : আমি দুঃখিত যে আমি তা বুঝতে পারছি না। তবে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে আমার প্রতি তোমার দয়ার অন্ত নেই। 

(তারা চলে গেল)

ফাউস্ট : আচ্ছা, আমি যখন তোমাদের বাগানের গেট দিয়ে ঢুকি তখন দেখে আমাকে চিনতে পেরেছিলে? 

মার্গারেট : তুমি কি দেখতে পাওনি আমি তোমাকে দেখে আমার চোখ নামিয়ে নিই। 

ফাউস্ট : তুমি যখন গির্জা থেকে চলে যাচ্ছিলে তখন যদি কিছু বেয়াদবি করে থাকি তবে সে দোষ আমার। আমার এই স্বাধীনতাটুকুকে ক্ষমার চোখে দেখো। 

মার্গারেট : আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম। এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি আমার জীবনে। আমাকে অবশ্য কেউ কোনও দোষ দেয়নি। তবু আমার ভাবনা হচ্ছিল আমার আচরণের মধ্যে যদি উনি কিছু অশালীন অসংযমের পরিচয় পেয়ে থাকেন? তাঁর এমনও মনে হতে পারে যে এই মেয়েটি সহজলভ্য ও বহুবলভা। আমি স্বীকার করছি, তোমাকে পাবার জন্য আমার বুকের মাঝে তখন কি ধরনের আকুতি জেগে ওঠে আমি নিজেই বুঝে উঠতে পারছি না। তবে তোমার প্রতি তখন কঠোর হয়ে উঠতে পারিনি, রাগ করতে পারিনি বলে নিজেই উপর ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। 

ফাউস্ট : হে আমার প্রিয়তমা! 

মার্গারেট : একটু থামো। (একটি ফুল তুলে তার পাতাগুলো একের পর এক করে ছিঁড়ে ফেলতে লাগল) 

ফাউস্ট : ফুলটা কি নাকে নিয়ে শুকবে?

মার্গারেট : না, খেলা করব।

ফাউস্ট : কিভাবে? 

মার্গারেট : যাও তুমি ঠাট্টা করবে আমাকে। (পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে বিড়বিড় করে কি বলতে লাগল) 

ফাউস্ট : কি বিড়বিড় করে বলছ?

মার্গারেট : (অর্ধস্ফুট স্বরে) সে আমার ভালোবাসে না–মোটেই ভালোবাসে না।

ফাউস্ট : হে আমার সুন্দরী প্রিয়তমা। দেবদূতের মতো আমার আত্মা। 

মার্গারেট : আমায় ভালোবাসে না–ভালোবাসে না–না, না। (ফুলের বৃন্ত হতে শেষ পাতাটা ছিঁড়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল)। 

হ্যাঁ, আমায় ভালোবাসে। ভালোবাসে। 

ফাউস্ট : হ্যাঁ, তোমার শিশুসুলভ কণ্ঠে এই ফুলের কুঁড়িটি যে কথা বলছে তার মধ্যে যেন স্বর্গের সুষমা নেমে আসে। হ্যাঁ, সে তোমায় ভালোবাসে। একথার মানে নিশ্চয় তুমি জান? সে তোমায় ভালবাসে)। 

(মার্গারেটের দুটি হাত ধরল)।

মার্গারেট : আমার কাঁপুনি আসছে। 

ফাউস্ট : না না, কেঁপো না। আমার এই দৃষ্টি আর হাতের উষ্ণনিবিড় স্পর্শের খাতিরে তোমার মনের গভীরগোপন সেই অব্যক্ত কথাটি বলে ফেল। জেনে রেখো, পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের মধ্যে যে আনন্দ আছে সে আনন্দ শাশ্বত চিরন্তন। বিচ্ছেদে হতাশা আছে ঠিক, কিন্তু বিচ্ছেদ যেন না ঘটে। 

মাথা : (সামনে এগিয়ে এসে) রাত্রি নেমে আসছে।

মেফিস্টোফেলিস : এবার আমাদের চলে যেতে হবে। 

মার্থা : এখানে তোমাদের আরও কিছুদিন থাকার জন্য বলতাম। কিন্তু এ শহরে নিন্দুকদের জিহ্বা বড় তীক্ষ্ণ। প্রতিবেশীদের কাজকর্মের উপর নজর ছাড়া তাদের অন্য কোনও কাজ নেই। যে যাই করুক, তাই নিয়ে কথা বলাবলি করবে প্রতিবেশীরা। ওরা আবার গেল কোথায়? 

মেফিস্টোফেলিস : বসন্তের সুখী পাখির মতো অদূরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মার্থা : ভদ্রলোককে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আর মেয়েটাও তার প্রেমে পড়ে গেছে। এইভাবে এই সব ভালোবাসাবাসির মধ্য দিয়েই জগৎ এগিয়ে চলেছে। 

ত্রয়োদশ দৃশ্য 

বাগানবাড়ি

(মার্গারেট ঘরের ভিতর ঢুকে দরজার কপাটের আড়ালে লুকিয়ে ফুটো দিয়ে দেখতে লাগল) 

মার্গারেট : ঐ এসে গেছে ও। 

ফাউস্ট : (প্রবেশ করে) দুষ্ট কোথাকার! তুমি আমায় বেশ ঠকিয়েছ। এবার ধরে ফেলেছি। (চুম্বন করল) 

মার্গারেট : (ফাউস্টকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনের প্রতিদান দিল)। 

হে আমার প্রিয়তম! আমি তোমায় অন্তরের সঙ্গে ভালোবাসি।

(মেফিস্টোফেলিস দরজায় করাঘাত করতে লাগল)

ফাউস্ট : কে ওখানে?

মেফিস্টোফেলিস : তোমার বন্ধু।

ফাউস্ট : একটা পশু।

মেফিস্টোফেলিস : আমাদের যাবার সময় হয়ে গেছে।

মার্থা : হ্যাঁ, দেরি হয়ে গেছে।

ফাউস্ট : আমি কি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে পারি না।

মার্গারেট : আমার মা ডাকছে–বিদায়।

ফাউস্ট : হায়, আমি কি থেকে যেতে পারি না? বিদায়।

মার্থা : বিদায়। 

মার্গারেট : আবার শীঘ্রই আমাদের দেখা হবে। (ফাউস্ট ও মেফিস্টোফেলিসের প্রস্থান) 

মার্গারেট : হা ভগবান! একটা মানুষ এত কিছু জানতে পারে? আমি তার কথা শুনতে শুনতে অবাক বিস্ময়ে শুধু দাঁড়িয়ে থেকেছি আর মাঝে মাঝে তার সব কথায় ‘হাঁ’ দিয়ে এসেছি। তার কাছে আমি এক অজ্ঞ শিশুমাত্র। জানি না আমার মধ্যে সে কি পেয়েছে। (প্রস্থান) 

চতুর্দশ দৃশ্য 

অরণ্যপ্রদেশ সংলগ্ন পার্বত্যগুহা

হে মহতী দৈবশক্তি, আমি যা যা প্রার্থনা করেছিলাম তুমি তা সব দিয়েছ। তুমি শুধু প্রজ্বলিত অগ্নির আলোকে তোমার রহস্যময় মুখমণ্ডলটি উদঘাটিত করনি, তুমি আমাকে দান করেছ প্রকৃতির বিরাট রাজ্য আর আমাকে দিয়েছ তা অনুভব করার ও উপভোগ করার ক্ষমতা। তোমার যে মুখমণ্ডল আজ আমার কাছে উদ্মাটিত তা শুধু হিমশীতল ঔদাসীন্যে প্রস্তরীভূত নয়, অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো তোমার বুকের গভীরে সব কিছু প্রত্যক্ষ করতে পাচ্ছি আমি। সমস্ত সচেতন প্রাণীদের আমার কাছে নিয়ে এসে বশীভূত করে দিয়েছ আমায়। বাতাসে জলে নীরব বনভূমিতে আমার ভ্রাতৃপ্রতিম যে সব শক্তি আছে তুমি তাদের চিনিয়ে দিয়েছ আমায়। প্রচণ্ড ঝড়ের গর্জনে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে যখন সমগ্র বনভূমি, দৈত্যকার ফারগাছগুলোর পতনশীল শাখাপ্রশাখা ও কাণ্ডগুলো পরস্পরের আঘাতে বিচুর্ণিত হয়ে থাকে, তখন তুমি আমাকে কোনও নির্জন গুহার নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাও। আমার নিজের অন্তরাত্মাকে উঘাটিত করে তোলো আমার। কাছে। আমার বুকে লুকিয়ে আছে যে রহস্যের ইন্দ্রজাল তার গ্রন্থিগুলোকেও উন্মোচিত করো আমার কাছে। তারপর পূর্ণচন্দ্রের স্নিগ্ধ আলো যখন আমার চোখের সামনে নেমে আসে তখন চারদিকের জটিল বনান্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে যেন সুদূর অতীত যুগের শুভোজ্জ্বল অজস্র প্রেতাত্মা। আমার আনন্দের সমস্ত উচ্ছ্বাসকে সংযত করে তারা। আজ আমি একটি বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় সচেতন যে কোনও মানুষই পরিপূর্ণতা অর্জন করতে পারে না। এই সত্যোপলব্ধির গভীরতা আমাকে ঈশ্বরের সামীপ্যে নিয়ে যায়। তারপর হে শক্তি, তুমি আমাকে দাও এমনই এক বন্ধু ও সহকর্মী যাকে ছাড়া আমি আর একবিন্দুও চলতে পারি না, অথচ যে আমাকে আমার নিজের কাছে ছোট করে তোলে সব সময়ে। সে কেমন যেন উদাসীন; তার সাহচর্য ঘৃণ্য বোধ হয় আমার কাছে। তোমার সব দানকে তুচ্ছতায় নিরর্থক করে তোলে। আমার অশান্ত বুকের ভিতর জাগিয়ে তোলে অবৈধ কামনার এক অক্লান্ত অনির্বাণ আগুন। সেই সুন্দরীকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি আমি। কামনা পরিতৃপ্তির জন্য আমি উন্মত্ত হয়ে ছুটে চলি। কিন্তু সে কামনার বস্তুকে যতই উপভোগ করি ততই বেড়ে যায় সে কামনা। 

(মেফিস্টোফেলিস প্রবেশ করল)। 

মেফিস্টোফেলিস : এ সব চিন্তা ও অনুধ্যান জীবনে তো অনেক করেছ। এ নিয়ে আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন কি? জীবনে যে কোনও পরীক্ষা একবারই করতে হয়। এখন নূতন কিছুর কথা ভাব। 

ফাউস্ট : আমার এই শুভ দিনটাকে অশুভ ও দুষিত করে দেওয়ার জন্য আবার কি কাজের পরিকল্পনা নিয়ে এসেছ? 

মেফিস্টোফেলিস : হ্যাঁ, আমি তোমাকে নূতন কাজেই নিযুক্ত করব। কিন্তু একথা তোমার মুখ ফুটে আমার কাছে বলা ঠিক নয়। তোমার মতো একটা আধপাগলা, অজ্ঞ, সহকমী আমার না থাকলেও আমার বিশেষ কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু কাজ ছাড়া তো মানুষ থাকতে পারে না। হাতে কিছু কাজ তো দরকার। সুতরাং তোমার মুখে একথা সাজে না। 

ফাউস্ট : তোমার সেই এক কথা। সেই এক সুর। তোমাকে আর আমার মোটেই ভালো লাগে না। ধন্যবাদ, যাও। 

মেফিস্টোফেলিস : হে ধরিত্রীর অসহায় সন্তান! আমাকে ছাড়া কেমন করে একা তুমি থাকবে? একদিন আমি তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছি। তোমার চিন্তার দীনতা আর তোমায় পীড়িত করে না। আমি যদি তোমার জীবনে না আসতাম তাহলে তুমি অবশ্য এই গোলাকার পৃথিবীতে ঠিকই চলে ফিরে বেড়াতে। কিন্তু তবে কেন এই পার্বত্যগুহার অন্ধকারে বসে পেঁচার মতো মিটমিট করে চেয়ে আছ? এই সব শ্যাওলাধরা পাথর হতে বিষাক্ত ব্যাঙের মতো চিন্তার কী এমন খোরাক সংগ্রহ করছ? সময় কাটাবার চমৎকার উপায় । আমি দেখছি তোমার মধ্যে সেই ডাক্তারটা এখনও রয়েছে। 

ফাউস্ট : এই অরণ্যময় পার্বত্যপ্রদেশের সঙ্গে নিবিড় সহযোগে কী এমন অভিনব প্রাণশক্তি আহরণ করতে পারি বলে তোমার মনে হয়? তবে সত্যিই তোমার যদি ধারণাশক্তি থাকত তাহলে নিশ্চয় তুমি আমি যে শক্তি সে সম্পদ লাভ করেছি এর থেকে তাতে ঈর্ষাবোধ করতে। 

মেফিস্টোফেলিস : অতিপ্রাকৃত উৎস হতে পরম সুখ। রাত্রিতে শিশির ভেজা পাহাড়ের উপর আকাশের পানে তাকিয়ে ভাববে আর তোমার আকাশচারী কল্পনার অনন্তপ্রসারী প্লাবনে স্বর্গমর্ত্য সব একাকার হয়ে ভেসে যাবে। তোমার মনে হবে তুমি ঈশ্বরের খুব কাছাকাছি চলে গেছ। মনে হবে এক বিরাট দৈবশক্তি লাভ করেছ। সেই শক্তির এক অনাস্বাদিতপূর্ণ অহঙ্কার এক অপার্থিব সূক্ষ্ম সুখানুভূতি তোমার কর্মজীবনের সমস্ত কঠোরতাকে দূরীভূত করে দিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি অস্থিমজ্জায়, তার প্রতিটি অন্ধকার সংকীর্ণতায়, প্রতিটি বস্তুর উপর ঝরে পড়বে। আর ঠিক তখন পরমার্থরূপ চূড়ান্ত পুষ্পটি চয়ন করার এক সমুন্নত প্রবৃত্তি আচ্ছন্ন করে তুলবে তোমার সমগ্র অন্তরাত্মাকে। (অঙ্গভঙ্গি করে) অবশ্য কেমন করে তা সম্ভব হবে তা বলতে পারব না। 

ফাউস্ট : তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। 

মেফিস্টোফেলিস : হ্যাঁ বুঝেছি, কথাটা তোমার খুবই অপ্রিয় লাগছে। বর্তমানে অবশ্য আমাকে লজ্জা দেবার মতো নৈতিক অধিকার আছে তোমার। কোনও সৎ লোকের কাছে এ কথা কেউ বলতে পারে না এবং সৎ লোকের অন্তঃকরণ তা সহ্য করতে পারে না। নিজেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে প্রতারিত করার তোমার এই আনন্দে কখনই ঈর্ষা বোধ করি না আমি। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না তোমার। তুমি এখনই দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। শীঘ্রই ভয়ে উন্মাদ হয়ে যাবে। যাই হোক, ও কথা ছেড়ে দাও। অদূরে বসে রয়েছে তোমার প্রিয়তমা। তাকে বড় বিমর্ষ ও চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছে। এক প্রবল প্রেমানুভূতিতে আলোড়িত হয়ে উঠেছে তার অন্তর। তোমাকে আরও নিবিড় করে পাবার জন্য সে হয়ে উঠেছে আগের থেকে আরও ব্যাকুল। পাহাড় থেকে সমতলভূমির দিকে নেমে আসা বরফগলা জলের স্রোতের মতো একদিন তোমার উচ্ছ্বসিত প্রেমের বন্যায় অবগাহন করে ধন্য হয় সে। আজ তোমার বিরহে শুকিয়ে গেছে সে স্রোতোধারা। আমার মতে এই নির্জন বনপ্রদেশে একা একা বসে না থেকে ঐ তরুণ যুবতীর কাছে গিয়ে তার প্রেমলাভে ধন্য হওয়া ঢের ভালো। তার সময় এখন দুঃখে কাটতে চাইছে না। তার এই ক্রমপ্রলম্বিত সময় কাটানোর জন্য জানালার মধ্য দিয়ে নগর প্রাচীরের উপর ভাসমান মেঘমালার পানে তাকিয়ে থাকে। ‘আমি যদি পাখি হতাম’ এই গানটি সে সারাদিন ও অর্ধরাত্রি পর্যন্ত গেয়ে চলে সকরুণ সুরে। কখনও সে অত্যধিক দুঃখের তাড়নায় চোখের জল ফেলছে, আবার কখনও বা নীরবে বসে বসে ভাবছে। এখন প্রেমোন্মত্ততার লক্ষণগুলো প্রকটিত হয়ে উঠেছে তার মধ্যে পূর্ণমাত্রায়। 

ফাউস্ট : সাপ। সাপ। কুটিল সাপের মতোই তুমি ভয়ঙ্কর। 

মেফিস্টোফেলিস : (স্বগত) হা-হা। এবার কি তাহলে ফাঁদে ফেলতে পেরেছি তোমায়! 

ফাউস্ট : যে অন্যায় করেছ, তাই নিয়েই চলে যাও। আর না। সেই সুন্দরীর নাম আর আমার কাছে করো না। আমার অর্ধাবিষ্ট অর্ধাচ্ছন্ন চেতনার উপর তার লাবণ্যবতী দেহের প্রতি কোনও জারজ লালসাকে নূতন করে জাগিয়ে তুলল না আর। 

মেফিস্টোফেলিস : এখন তাহলে তুমি কি করবে? সে ভাবছে তুমি হয়ত চলে গেছ, পালিয়ে গেছ। এখন দেখছি সত্যিই তোমার সত্তার অর্ধেক পালিয়ে গেছে তোমাকে ছেড়ে আর অর্ধেক অবশিষ্ট আছে তোমার মধ্যে। 

ফাউস্ট : অথচ আমি কাছেই রয়েছি। আমার প্রিয়তমা আমি দূরে না গেলেও আমাকে পাচ্ছে না। আমার প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গণনা করছে। আমি তার মধুর ওষ্ঠাধর স্পর্শ করতে পেলে বেদীর সামনে সহসা আবির্ভূত ঈশ্বরের দেহকেও চাইব না। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমাদের সুন্দর জুটি দেখে আমার বড় ঈর্ষা হয়। তোমরা দুজনে যখন ঘুরে বেড়াও তখন দেখে মনে হয় তোমরা যেন গোলাপের মধু খেয়ে বেড়াচ্ছ গোলাপ বনে। 

ফাউস্ট : দূর হয়ে যাও মিথ্যাবাদী। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি আমাকে গাল দিচ্ছ, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি কৌতুক করছ। যে ঈশ্বর বিশ্বে যৌবন ও সুন্দরী তরুণীদের সৃষ্টি করেছেন তিনি যুবক-যুবতীদের মিলনের ব্যবস্থাও করে রেখেছেন তার সৃষ্টি রক্ষার্থে। এই মিলনের পিছনে আছে গভীর ঐশ্বরিক উদ্দেশ্য। সুতরাং যাও। মনে রেখো, মৃত্যুর কবলে নয়, তোমার প্রতীক্ষমানা প্রিয়তমার নিভৃত কক্ষে যাওয়াই তোমার এখন সবচেয়ে বড় কর্তব্য। 

ফাউস্ট : তার আলিঙ্গনের মধ্যে কি আছে? স্বর্গীয় সুখের সুষমা? যদিও তার অমিত চুম্বনমাধুর্যে আমি ধন্য, তথাপি তার কোনও অভাব বা প্রয়োজন মেটানোও কি আমার কর্তব্য নয়। আমি একজন পলাতকের মতো গৃহহারা অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার কোনও উদ্দেশ্য নেই, লক্ষ্যস্থল নেই। উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুটে চলা উন্মত্ত কোনও পার্বত্য নদীর মতোই আমার জীবন। আর সে আমার এই চলমান জীবন-স্রোতের ধারে প্রস্তরকঠিন এক দৃঢ় ভিত্তিভূমির উপর শান্ত সংসার জীবনযাপন করছে। তার জগৎ এই শান্ত সরল সংসারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর আমি আমার অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন গতির উন্মত্ত আঘাতে পথের দুপাশের পাথরগুলোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে ধুলো করে দিচ্ছি। তবু তার শান্ত গৃহকোণের সেই সুখকে এখনও ঘৃণা করি, তুচ্ছ জ্ঞান করি আমি। হে নরকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তুমি কি তাকে তোমার বলি হিসাবে চাও? হে আমার প্রিয় শয়তান, আমাকে এই দুঃখের মাঝে পথ দেখাও। যা হবার তা যেন তাড়াতাড়ি হয়। তার ভাগ্যকে আমার ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে দাও। তারপর দুটি ভাগ্যকেই পূর্ণ বিচূর্ণ করে দাও। আমরা দুজনেই ধ্বংস হয়ে যাই একসঙ্গে একেবারে। 

মেফিস্টোফেলিস : আবার আবেগে বকতে শুরু করেছে। যাও নির্বোধ, তার কাছে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দাওগে। তোমরা যখন কোনও সমস্যার সমাধান খুঁজে পাও না, কোনও পথ খুঁজে পাও না তখনই ভাব মৃত্যু এসে গেছে নিকটে। যে বিপদের মধ্যে স্থির থাকতে পারে দৃঢ়চেতা স্থিরবুদ্ধি সেই মানুষকে সাদরে বারণ করে নেবে। এমন কি দরকার মনে করলে শয়তানের রূপ ধারণ করবে। হতাশার মতো আর কোনও জিনিস কোনও মানুষকে এত দুর্বল করতে পারে না। 

পঞ্চদশ দৃশ্য 

মার্গারেটের কক্ষ

মার্গারেট : (একাকী চরকা কাটছিল) আমার মনের শান্তি চলে গেছে। আমার হৃদয়ের ক্ষতে রক্ত ঝরছে। হায়, আমি আর তাকে কখনও দেখতে পাব না। কখনও না। অথচ তাকে কাছে না পেলে আমার মৃত্যুবরণ করা ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। গোটা জগত্তা বিষাক্ত ঠেকছে আমার চোখে। তিক্ত লাগছে সবকিছু। আমার অসহায় মস্তিষ্ক উন্মাদের মতো ঘুরছে। আমি আমার চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বিহ্বল হয়ে পড়েছে আমার চেতনা। আমার মনের শান্তি চলে গেছে। হৃদয়ের ক্ষতে রক্ত ঝরছে। হায়, আমি তাকে আর কখনও দেখতে পাব না। অথচ তাকে দেখার জন্য আমি এই জানালার ধারে বসে আছি। শুধু তাকে দেখার জন্যই আমি আবার বাড়ি ত্যাগ করেছি। তার আনন্দোচ্ছল স্বভাব, উন্নত চেহারা, তার সুন্দর মুখের হাসি, তার চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টি, তার কথা বলার আশ্চর্য ঐন্দ্রজালিক ভঙ্গিমা, তার হাতের স্পর্শ ও চুম্বনের মাধুর্য সবকিছু পেতে চাই আমি। আজ আমার অন্তর শুধু তাকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে একান্তভাবে। আজ আমি যদি তাকে আলিঙ্গন করতে পারতাম নিবিড়ভাবে। আজ যদি তাকে প্রাণভরে চুম্বন করতে করতে সেই চুম্বনানন্দের মধ্যে নিঃশেষে তলিয়ে যেত আমার সমস্ত জীবনচেতনা তাহলে কত ভালো হতো। 

ষোড়শ দৃশ্য 

মার্থার বাগান

মার্গারেট। ফাউস্ট

মার্গারেট : বলল, আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও হেনরি–

ফাউস্ট : বলো কিসের প্রতিশ্রুতি! 

মার্গারেট : তোমার ধর্ম কি? মানুষ হিসাবে তুমি ভালো, তোমার অন্তঃকরণ সৎ। তবু মনে হয় ধর্মেকর্মে তোমার মন নেই।

ফাউস্ট : ওকথা এখন বাদ দাও বাছা। তুমি জান আমার প্রেম কত গভীর, কত খাঁটি। এই প্রেমের খাতিরে আমার দেহের রক্ত ও প্রাণ পর্যন্ত দান করতে রাজি আমি। কিন্তু ধর্মের জন্য নয়। 

মার্গারেট : সেটা ঠিক নয়। ধর্মে বিশ্বাস রাখা ভালো। 

ফাউস্ট : তাই নাকি? 

মার্গারেট : তোমার উপর যদি কোনও প্রভাব খাটাতে পারতাম তাহলে হয়ত তুমি ধর্মে বিশ্বাস করতে না। 

ফাউস্ট : ধর্মে শ্রদ্ধা আমার আছে। 

মার্গারেট : কিন্তু ধর্মের কোনও সত্যকে তুমি লাভ করতে চাও না। বহুদিন হলো তুমি প্রার্থনা বা স্বীকারোক্তি করনি। অথচ বলছ ঈশ্বরে বিশ্বাস করো।

ফাউস্ট : হে আমার প্রিয়তমা, কে জোর গলায় বলতে পারে আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি? কোনও পুরোহিত বা সাধককে জিজ্ঞাসা করো। তার উত্তরটা প্রশ্নকারীর কানে উপহাসের মতো শোনাবে। 

মার্গারেট : তাহলে তুমি বিশ্বাস করো না?

ফাউস্ট : আমার কথায় ভুল বুঝো না সুবদনে। কে ঈশ্বরের মহিমাকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে? কে ঈশ্বরকে সর্বক্ষণ অবলম্বন করে বলতে পারে আমি তাকে বিশ্বাস করি? আবার এমনই বা কে আছে যে তার সমস্ত অনুভূতি ও দৃষ্টিশক্তি দিয়ে ঈশ্বরকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করতে পারে? ঊর্ধ্ব অধঃ ও সর্ব দিকে যিনি ব্যপ্ত তিনি তোমাকে আমাকে ও নিজেকে আচ্ছন্ন করে নেই। আমাদের মাথার উপরে কি আকাশ নেই, আমাদের পায়ের নিচেও কি পৃথিবীর মাটি নেই? সেই আকাশের উপর কি উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজি কিরণ দান করে না? তোমার চোখে চোখ দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি কি আমার মস্তিষ্কে ও অন্তরের অন্তঃস্থলে সেই আশ্চর্য শক্তির অস্তিত্বকে অনুভব করছি না, চিরন্তন যে শক্তি অনন্তকাল ধরে আমাদের জীবনে কখনও দৃশ্যত আবার কখনও অপরিদৃশ্যভাবে রহস্যের জাল বুনে চলেছে, সেই মহাশক্তির দ্বারা তোমার অন্তঃকরণকে পরিপূর্ণ করে তুলতে পার। যখন সেই মহাশক্তিকে অন্তরে অনুভব করবে আর সেই অনুভূতির দ্বারা তোমার সমগ্র প্রাণমন আচ্ছন্ন হয়ে উঠবে তখন তুমি তাকে পরম সুখ, ঈশ্বর প্রভৃতি যে কোন নামে অভিহিত করতে পার। আমি তাকে কোনও নামে ডাকতে চাই না। অনুভূতিই হলো আসল কথা। যত সব নামই বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে ঈশ্বরের উজ্জ্বল জ্যোতিকে ম্লান করে দেয়। 

মার্গারেট : এসব কথা শুনতে খুবই ভালো লাগে। ধর্মপ্রচারকরা এইভাবেই কথা বলেন। শুধু শব্দ প্রয়োগের কিছু তারতম্য আছে। 

ফাউস্ট : সব জায়গায় সেই একই ব্যাপার চলছে। কোনও ধর্মীয় উৎসবের দিনে সব মানুষ যেমন একই আনন্দ অনুভব করে আর সেই আনন্দ আপন আপন ভাষায় প্রকাশ করে, আমিও তেমনি আমার আনন্দ আমার নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করি। 

মার্গারেট : তোমার কথা শুনে মনে হয় ঠিক আছে। কিন্তু পরে বোঝা যায় তোমার কথার মধ্যে কিছু অবাঞ্ছিত দিক আছে, কারণ তুমি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করনি। 

ফাউস্ট : হে আমার প্রিয়তমা। 

মার্গারেট : আমি বহু দিন ধরে আশা করে এসেছি তুমি এই ধর্ম সম্প্রদায়ের লোক হয়ে উঠবে। 

ফাউস্ট : কেমন করে! 

মার্গারেট : যে লোকটি তোমার সাথী হিসাবে তোমার সঙ্গে ঘোরাফেরা করে তাকে আমি অন্তর থেকে গভীরভাবে ঘৃণা করি। মুখদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে আমার অন্তরে যে দুঃসহ ঘৃণার অনুভূতি জেগে ওঠে, আমার সারাজীবনের মধ্যে তেমন অনুভূতি আর কখনও জাগেনি। 

ফাউস্ট : না না, তাকে ভয় করো না প্রিয়তমা। 

মার্গারেট : সে এখানে এসে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয় কোনও অশুভ শক্তি এসে হাজির হয়েছে। সে ছাড়া আর সব লোকের প্রতিই আমার সহানুভূতি আছে। যখনি তোমাকে দেখার জন্য অন্তর আমার ব্যাকুল হয়ে ওঠে তখনি তার সম্বন্ধে একটা গোপন বিভীষিকা আমাকে পেয়ে বসে, একেবারে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমার মনে হয় লোকটা এক পাকা জুয়াচোর। যদি আমি তার প্রতি কোনও অন্যায় করে থাকি। তাহলে ঈশ্বর আমায় ক্ষমা করুন। 

ফাউস্ট : এই ধরনের কিছু অদ্ভুত পাখি এখানে ওখানে আছে। 

মার্গারেট : ওই ধরনের লোকের সঙ্গে বাস করা কখনই সম্ভব নয় আমার পক্ষে। সে ঘরের ভিতর ঢুকেই চারদিকে নাসিকা কুঞ্চিত করে কি সব দেখতে থাকে। তার দৃষ্টির সঙ্গে মিশে থাকে অহেতুক রোষ! তার কপালের উপর যেন একটা ব্যথা লেখা আছে। সে ব্যথা হলো, প্রেম মাত্রই ঘৃণ্য তার কাছে; অথচ দেখো, আমার আলিঙ্গনের মধ্যে আমি কত সুখ পাই। মুক্তিতে কত অন্তহীন, আত্মসমর্পণে কত নিবিড় আর প্রেমে কত উত্তপ্ত হয়ে উঠি আমি। অথচ তার উপস্থিতিতে পাথরের মতো কঠিন হয়ে ওঠে আমার অন্তরাত্মা। 

ফাউস্ট : খুব ভীতু তুমি। 

মার্গারেট : এই ভয় আমাকে এতদূর আচ্ছন্ন করে ফেলে যে যখন যেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয়, মনে হয় আমি তোমার প্রতিও আমার সব ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছি। সে কাছে থাকলে আমি ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করতে পারি না। আমার অন্তরে জ্বলতে থাকে শুধু তখন অহেতুক এক বিতৃষ্ণার আগুন। সে আগুনের ছোঁয়া থেকে তুমিও বাদ যাও না। 

ফাউস্ট : আসলে ওটা তোমার মনের স্বাভাবিক বিরাগ।

মার্গারেট : কিন্তু আমি ওটাকে দূর করতে পারি না। 

ফাউস্ট : আচ্ছা আমরা কি কোথাও পরস্পরের খুব কাছাকাছি কিছু নিবিড় নির্জন মুহূর্ত কাটাতে পারি না? সে নৈকট্যের নিবিড়তায় দুজনের দেহ-মন এক হয়ে মিশে যায়, সে নৈকট্য লাভ করতে পারি না? 

মার্গারেট : হায়, যদি আমার পৃথক শোবার ঘর থাকত! আমি তাহলে তোমাকে নিয়ে আমার ঘরে গিয়ে খিল দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু আমাকে মার কাছে শুতে হয় এবং মার ঘুম এমনই সজাগ যে আমরা সেখানে যাওয়া মাত্র তিনি জানতে পারবেন আর সেটা হবে আমার পক্ষে মৃত্যুর সমতুল।

ফাউস্ট : ভয় করো না প্রিয়তমা। এই শিশিটায় ওষুধ আছে। এর তিন ফোঁটা কোনও পানীয়ের সঙ্গে মিশিয়ে তাঁকে যদি খাইয়ে দিতে পার তাহলে এমন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বেন তিনি যে কোনও চেতনাই তার তখন থাকবে না। কিছুই টের পাবেন না। 

মার্গারেট : তোমার আনন্দ বিধানের জন্য এমন কি কাজ আছে যা আমি পারব? এ ওষুধ প্রয়োগ করলে তার কোনও ক্ষতি হবে না তো? 

ফাউস্ট : ক্ষতি হলে আমি তোমাকে এটা প্রয়োগ করতে বলতাম না। 

মার্গারেট : হে প্রিয়তম, তোমার মুখপানে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে জানি না কেন আমি সব কিছু ভুলে যাই। তোমার ইচ্ছাপূরণই তখন আমার একমাত্র কাম্য হয়ে ওঠে। তোমার জন্য আমি আগেই অনেক কিছু করেছি। সুতরাং করার আর অল্পই বাকি আছে। (প্রস্থান) 

মেফিস্টোফেলিসের প্রবেশ

মেফিস্টোফেলিস : ওহে বাঁদর মশাই! মেয়েটা চলে গেছে?

ফাউস্ট : আবার গুপ্তচরগিরি করছ? 

মেফিস্টোফেলিস : আমি শুনতে পেয়েছি কিভাবে মেয়েটা তোমাকে তার কাছে টেনে নেয় আপন করে। এটা এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ডাক্তার ফাউস্ট এখন তার কবলে। আমার আশা, এতে তোমার অনেক মঙ্গল হবে। প্রাচীনদের মতে মেয়েরা চায় তাকে প্রণয়ীরা একই সঙ্গে যৌবনসৌন্দর্য ও সততায় সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক। কারণ একমাত্র সৎ যুবকরাই তাদের অকুষ্ঠভাবে অনুসরণ করে। 

ফাউস্ট : তুমি একটা পশু। তুমি জানতে চাও না এত ভালো মেয়েটা যার অন্তঃকরণ এত পবিত্র সে কেন খারাপ হলো (যদি কিছু খারাপ থাকে তার মধ্যে)। তার বিশ্বাস প্রেমের মধ্যেই সে খুঁজে পাবে তার মুক্তি। তার একমাত্র ভয় যাকে সে ভালোবাসে সেই ভালোবাসার মানুষ বুঝিবা তার হাতছাড়া হয়ে যায়। 

মেফিস্টোফেলিস : ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও ইন্দ্রিয়াতীত কামনাবাসনায় পূর্ণ তুমি। তুমি বুঝতে পারছ না একটা সামান্য নারী তোমার নাকে দড়ি ধরে ঘোরাচ্ছে। 

ফাউস্ট : এই সব কুচিন্তা মনে থেকে দূর করে দাও।

মেফিস্টোফেলিস : মানুষের চেহারা দেখে মনের ভাব সে চমৎকার বুঝতে পারে। আমি আসার সঙ্গে সঙ্গে সে সচকিত হয়ে ওঠে। কেন জানি না, আমার মুখোশের আড়ালে মনের যে ভাব লুকিয়ে থাকে তা সে বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, আমি একটা আস্ত শয়তান হলেও আমি একটা বিরাট প্রতিভা। ঠিক আছে, আজই রাত্রিতে– 

ফাউস্ট : কি আজ রাত্রিতে?

মেফিস্টোফেলিস : আজ রাত্রিতে আমিও কিছু আনন্দ উপভোগ করব। 

সপ্তদশ দৃশ্য 

ঝর্নায় 

কলসীসহ মার্গারেট ও লিসবেথ

লিসবেথ : বারবারার কথা কিছু শুনেছ?

মার্গারেট : না, কোনও কথাই শুনিনি? 

লিসবেথ : সত্যিই তাই। আজই সিবিল্লা বলেছে বারবারা যে ঠকেছে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। অহঙ্কার ও দম্ভের প্রতিফল সে পেয়েছে। 

মার্গারেট : কি ভাবে? 

লিসবেথ : তার বমি বমি ভাব আসে। পানাহারের সময় সে বেশ বুঝতে পারে তার পেটে সন্তান এসেছে। 

মার্গারেট : আঃ। 

লিসবেথ : অবশেষে সে যোগ্য প্রতিফল লাভ করেছে। মেয়েটা ছোকরাটাকে দীর্ঘদিন নিবিড়ভাবে ধরে রেখেছিল। সে কি গলায় গলায় ভাব।! গায়ের সর্বত্র তাদের দুজনকে দেখা যেত, দেখা যেত নাচগানের আসরে। ছেলেটা মেয়েটাকে দেখত মদের মতোই ভোগের এক উপকরণরূপে আর মেয়েটা চাইত তার বেশভূষার পারিপাট্য আর রূপের প্রসাধনে ছেলেটার মন ভোলাতে। মেয়েটা এত নীচ আর নির্লজ্জ যে সে ছেলেটার কাছ থেকে যে কোনও উপহার গ্রহণ করতে কোনওরূপ কুণ্ঠা বোধ করত না। এইভাবে কত সব মদির চুম্বন, আলিঙ্গনের পালা শেষ হতেই প্রেমের কুসুম শুকিয়ে গেল। 

মার্গারেট : আহা বেচারী! 

লিসবেথ : তার প্রতি দয়া দেখাচ্ছ? যখন আমরা রাত্রিতে মার কাছে বসে সেলাই এর কাজ করতাম কষ্ট করে, মা আমাদের একবারও বাইরে কোথাও যেতে দিত না। মেয়েটা তখন তার প্রেমিকের সঙ্গে অন্ধকার গলির মধ্যে ভাব জমাত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গল্প করত। সময়ের কোনও জ্ঞান থাকত না। এখন বাছাধন আর মুখ তুলতে পারবে না, গির্জার এককোণে বসে শুধু অনুতাপের আগুনে জ্বলবে। 

মার্গারেট : ছেলেটা নিশ্চয় তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবে।

লিসবেথ : তাহলে বোকার মতো কাজ করবে ছেলেটা। তরুণ যুবকের চঞ্চল মন। আবার অন্য কোথাও চলে যাবে। তাছাড়া সে এর মধ্যেই চলে গেছে। 

মার্গারেট : এটা কিন্তু খুব খারাপ। 

লিসবেথ : মেয়েটা যদি ছেলেটাকে বিয়ে করে তাহলে তাকে সাবধান করে দিও। পাড়ার ছেলেরা ও আমরা তা বরদাস্ত করব না। তারা তার গলার মালা ছিঁড়ে দেবে। আর আমরা তার ঘরের দরজার সামনে আবর্জনা ফেলে দেব। 

মার্গারেট : একটি মেয়ে যখন প্রতারিত হয় একটি ছেলের দ্বারা তখন আমি ঘৃণাভরে কত তার নিন্দা করেছিলাম। তীক্ষ্ণ ভাষায় অপরের দোষের সমালোচনা করেছিলাম। তাদের দোষটা যত না কালো ছিল তার থেকে বেশি কালো মনে হয়েছিল আমার কাছে এবং নিজেকে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য মনে করেছিলাম। অথচ আসলে জীবন্ত পাপের এক মূর্ত প্রতীক আমি। তবু আমার অন্তর থেকে যেকথা তখন বেরিয়েছিল তা সব সত্য। 

অষ্টাদশ দৃশ্য 

ডন জন

(একটি দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে একটি বেদীর উপর কুমারী ডলোররাসার প্রতিমূর্তি। মূর্তির সামনে একটি ফুলদানী) 

মার্গারেট : (ফুলদানীতে টাটকা ফুল সাজিয়ে রাখতে রাখতে) আমার কথা শোনো হে কুমারী মাতা। দুঃখে ভারাক্রান্ত তোমার হৃদয়। তোমার মুখের উপর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বেদনার ছাপ। অন্তর্বেদনার যে তীক্ষ্ণ তরবারি তোমার বুকের মাঝে লুকোনো আছে তাই নিয়ে তুমি তাকিয়ে আছ সেই স্থানের উপর যেখানে তোমার পুত্র নিহত হয়। তুমি মাঝে মাঝে পরম পিতার পানেও তাকাচ্ছ। ধীরে ধীরে পুঞ্জীভুত হয়ে উঠছে। তোমার দীর্ঘশ্বাস। পরম পিতার দুঃখের সঙ্গে তোমার দুঃখে মিশিয়ে তা ঊর্ধ্ব তুলে ধরছ তুমি। 

হায়, যে গভীর গোপন অন্তর্বেদনায় আমার সারা দেহমনে মুচড়ে উঠছে আমি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমার এই উদ্বিগ্ন অন্তরে কিসের এত জ্বালা, সংশয়ের কেন এত কম্পন, কামনার কেন এই ব্যাকুলতা তা একমাত্র তুমিই জান। একমাত্র তুমিই জান যেখানেই আমি যাই কিসের দুঃখ, সে কোন বেদনায় পীড়িত হতে থাকে আমার অন্তর। ঘরে আমি যখন একা থাকি তখন সর্বক্ষণ বিনিদ্র অবস্থায় আমি শুধু কাঁদতে থাকি। অবিরলভাবে চোখের জল ফেলে যাই। আর সহ্য করতে পারছি না। অন্তর ভেঙে পড়ছে আমার। প্রথম সকালের শিশিরভেজা ফুলের মতো জানালার ধারের পাত্রগুলো আমার চোখের জলে ভিজে যায়। আমার অন্তরের নিভৃতে সকালের সূর্য লাল আলো ফেলে। তবু আমি বুকের ভিতর একরাশ বিষাদ নিয়ে বিছানার উপর বসেছিলাম। 

হে কুমারী দেবী, মৃত্যু ও যন্ত্রণার এই দুর্বিষহ পীড়ন থেকে উদ্ধার করো আমায়। হে বিষাদময়ী, তোমার উদার মুখের মমতা নিয়ে আমার অবস্থার উপর নজর দাও। 

ঊনবিংশ দৃশ্য 

রাত্রি

(মার্গারেটের ঘরের সম্মুখস্থ রাজপথ) 

ভ্যালেন্টাইন। 

মার্গারেটের ভাই ও একজন সৈনিক

মা: ভাই : আমি বসে বসে এতক্ষণ কতকগুলো লোকের দম্ভোক্তি ও গর্বোক্তি শুনছিলাম। প্রত্যেকেই তাদের আপন আপন সুন্দরী প্রেমিকাদের প্রশংসা করছিল আমার কাছে। তারা তখন সকলেই টোস্ট আর মদ খাচ্ছিল। আমি এককোণে শান্তভাবে বসে বসে তাদের গর্বোক্তি শুনছিলাম। আমি তখন আমার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললাম, সকলেই তো প্রেমের ব্যাপারে বাহাদুর। কিন্তু সারা দেশের মধ্যে এমন কি কেউ আছে যে মার্গারেটের মতো খাঁটি মেয়ের সামনে বাতি তুলে ধরতে পারে? তখন সকলেই আমার কথায় সচকিত হয়ে উঠল। কেউ কেউ বলল, “ও ঠিকই বলছে। আবার কেউ কেউ বলল, মার্গারেট সত্যিসত্যিই এক নারীরত্ন। নারীত্বের নিষ্পাপ কুসুম আজও ফুটে আছে তার মধ্যে। আমার সেই কথায় তাদের সব গর্বোক্তি স্তব্ধ হয়ে যায় একেবারে। কিন্তু আজ? আজ ক্রোধে ও বিরক্তিতে আমার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছে এবং মাথাটাকে ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আজ যে কোনও একটা বাজে ছোকরা আমার মুখের উপর তার নাক নেড়ে বিদ্রুপের দ্বারা বিদ্ধ করতে পারে আমায়। 

আমাকে অপমান করতে পারে। আমি তখন কোনও দেউলিয়া ভাগ্যবিড়ম্বিত অধোমর্ণের মতো বসে বসে শুধু ঘামতে থাকি লজ্জায়। আমিও অবশ্য তাদের মুখের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর দিতে পারি। কিন্তু তাদের মিথ্যাবাদী বলতে পারি না। কিন্তু কারা আসছে এই দিকে? আমার যদি দেখতে ভুল না হয় তাহলে ওরা দুজন আছে। যদি একা হয় তাহলে আমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। তাকে তাহলে আর একা জীবিত অবস্থায় ফিরে যেতে হবে না। 

ফাউস্ট। মেফিস্টোফেলিস

ফাউস্ট : দেখো দেখো, কেমনভাবে তার পবিত্র কক্ষের গবাক্ষপথ হতে এক স্বর্গীয় দ্যুতি বেরিয়ে আসছে। কিন্তু একমাত্র সামনে ছাড়া কোনও পাশ থেকে সে আলো দেখা যাচ্ছে না। আর সে আলো দেখতে না পেলেই চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আর তার ফলে আমার অন্তরের মাঝেও অন্ধকার জমছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমার মনে হচ্ছে আমি যেন কোনও ভাবপ্রবণ বিড়ালের মতো আগুনের লম্বা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছি। চুপিসারে চঞ্চল গতিতে চোরের মতো উপরে উঠে যাচ্ছি। তথাপি আমার মধ্যে আছে টনটনে ধর্মজ্ঞান। আমার প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে আমি অনুভব করছি যেন আগামী পরশু তারিখে অনুষ্ঠিতব্য অপেরার সুর বাজছে। 

ফাউস্ট : আমার প্রিয়তমারূপ রত্ন এখানে কি ওঠেনি? আমার মনে হচ্ছে আমি ওই জানালার ধারে তাকে দেখতে পাচ্ছি। 

মেফিস্টোফেলিস : কেটলির ঢাকনা খুললেই যেমন গরম চা পাওয়া যায় তেমনি একটু পরেই তুমি আনন্দ উপভোগ করবে। একটু আগে আমি আড়চোখে দেখেছিলাম সে ঘরের মধ্যেই আছে এবং তাকে চমৎকার দেখাচ্ছে।

ফাউস্ট : আমার প্রিয়তমাকে সাজাবার মতো কোনও গহনা তো দূরের কথা, একটা আংটি পর্যন্ত নেই। 

মেফিস্টোফেলিস : আর পাঁচটা জিনিসের মধ্যে আমি একছড়া মুক্তোর হার রেখেছিলাম। 

ফাউস্ট : তাহলে খুবই ভালো হয়। তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যদি কোনও উপহার দিতে না পারি তাহলে সেটা বড় দুঃখের। 

মেফিস্টোফেলিস : বিনা উপহারে তাকে উপভোগ করার ব্যাপারটাতে এত অস্বস্তিবোধ করো না। এই শান্ত সুন্দর রাত্রিতে আকাশে যখন নক্ষত্ররা কিরণ দান করছে, আমি তখন এক চমৎকার গান গাইব। এ গানের মধ্য দিয়ে প্রথমে তাকে কিছু নীতিশিক্ষা দান করব। পরে তাকে প্রতারিত করব। 

গান

তোমার প্রেমিকের দরজার সামনে
এই আলোকোজ্জ্বল সোনালী সকালে
কি করছ প্রিয়তমা ক্যাথারিন?
কিন্তু সাবধান! ঐ ঘরের মধ্যে একটি
মেয়ে ঢুকেছে এবং সে এখনো বেরোয়নি।
এমন লোকের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে
দেবে জোর করে। একবার ছাড়াছাড়ি হয়ে
গেলেই সব ফুরিয়ে যাবে চিরদিনের মতো।
মনে রেখো, প্রেমের জীবনকাল বড়ই স্বল্প বড়ই সীমিত।
সুতরাং হাতে বিয়ের আংটি না নিয়ে কোনও 
ভণ্ড প্রতারকের কাছে বিকিয়ে দিও না নিজেকে।

ভ্যালেন্টাইন : (এগিয়ে এসে) ইঁদুর ধরার বাঁশি বাজিয়ে কার মন ভোলাতে চাও। প্রথমে বাজনাটা, তারপর ঐ গায়কটাকে শয়তানের কাছে পাঠিয়ে দেব। 

মেফিস্টোফেলিস : আমরা দুজনেই গেলাম।

ভ্যালেন্টাইন : আর একটা মাথা আমার ভাঙতে হবে। 

মেফিস্টোফেলিস : (ফাউস্টের প্রতি) হে ডাক্তারমশাই, পালিয়ে যেও না, আমার অনুরোধ। তুমি শুধু যদি একটু সরে দাঁড়াও, আমি তাহলে এ লড়াইয়ে জিতে যাব। তুমি এখনি চলে যাও বলছি। আমি এখনি ঘুসি আর তরবারি চালাব। 

ভ্যালেন্টাইন : ঠিক আছে, চালাও।

মেফিস্টোফেলিস : কেন চালাব না? এখন আলো ফুটে উঠেছে।

ভ্যালেন্টাইন : সত্যি নাকি?

মেফিস্টোফেলিস : অবশ্যই তাই। 

ভ্যালেন্টাইন : শয়তান দুটো তাহলে লড়বে। কিন্তু আমার হাত যে খোঁড়া। আমি কি করব? 

মেফিস্টোফেলিস (ফাউস্টকে) তরবারিটা একেবারে আমূল বসিয়ে দাও।

ভ্যালেন্টাইন : (পড়ে গেল) হা ভগবান। 

মেফিস্টোফেলিস : এবার দুষ্টু বদমাশটা জব্দ হয়েছে। কিন্তু পালিয়ে চলো তাড়াতাড়ি। এখানে আর থাকা চলবে না আমাদের। খুন খুন বলে চিৎকার করছে লোকে। পুলিশকে তবু পার পাওয়া যায়, কিন্তু ফৌজদারি আদালতে এর বিচার হবে। 

(প্রস্থান)

মার্থা : (জানালায়) শীগগির এস। শীগগির এস।

মার্গারেট : (জানালায়) তাড়াতাড়ি একটা আলো নিয়ে এস। 

মার্থা : (উপর থেকে) ওরা আমাদের আক্রমণ করার ও লড়াই করার হুমকি দিচ্ছে। 

জনতা : এখানে একটা লোক মরে রয়েছে। দেখো দেখো।

মার্থা : (উপর থেকে নেমে এসে) খুনীরা কোন দিকে পালাল?

মার্গারেট : (বেরিয়ে এসে) কে ওখানে পড়ে রয়েছে?

জনতা : তোমার মার পুত্র।

মার্গারেট : হে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর! কী দুঃখের কথা। 

ভ্যালেন্টাইন : আমি মরতে চলেছি। তবে একেবারে এখনও মরে যাইনি। কথাটা বড় তাড়াতাড়ি বলা হয়ে গেছে। কই মেয়েরা, চেঁচাচ্ছ কেন? তার চেয়ে এদিকে এস। এখানে এস। আমার কথা শোনো। (সকলে এসে জড়ো হলো) হে আমার প্রিয় বোন মার্গারেট, তুমি এখনও বয়সে তরুণী আছ। তোমার এখনও বুদ্ধিসুদ্ধি হয়নি। তুমি বড় হালকা। তাই আমি একটা উপদেশ তোমায় দিতে চাই। মনে রাখবে। এখন তুমি যখন একটা বারবণিতায় পরিণত হয়েছে তখন প্রকাশ্যেই তোমার ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া উচিত। 

মার্গারেট : ভাই হয়ে এমন কথা বলতে তুমি পারলে? হা ভগবান!

ভ্যালেন্টাইন : এই সবক প্রমোদক্রীড়ায় বলা যায় না একদিন ঈশ্বরও হয়ত জড়িয়ে পড়তে পারে। যা একবার হয়ে গেছে তা আর ফিরবে না। এরপর কি ঘটবে তাই ভেবে দেখতে হবে। প্রথমে একজনকে নিয়ে এ খেলা শুরু করলে তারপর আর একজন এসে জুটবে। এইভাবে যখন ডজনখানেক লোক আনাগোনা করবে তখন শহরে তোমার নাম ছড়িয়ে পড়বে সব জায়গায়। এ ব্যাপারে যখন প্রথম লজ্জা জন্মায় মনে তখন এ ধরনের মেয়েরা তাদের সব কাজ গোপন রাখার চেষ্টা করে এবং ধীরে ধীরে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। পরে লজ্জার কালো অবগুণ্ঠনটা মাথার ওপর তুলে দেয়। তখন সকলেই তাদের ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে। আর তারাও মনের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করতে করতে প্রকাশ্যে দিনের আলোতেও পাপকাজ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যত তারা নির্লজ্জ হয়ে পড়ে ততই তাদের কুৎসিত দেখায়। আমি বেশ বুঝতে পারছি এমন সময় আসতে তোমার দেরি নেই যখন সকলেই তোমার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তখন তুমি কোথাও কোনও নিরাপদ আশ্রয় পাবে না। যে গলিত মৃতদেহ সংক্রামক রোগ ছড়ায় তার থেকে মানুষ যেমন দূরে থাকতে চায় তেমনি তোমাকেও এড়িয়ে যাবে সবাই। তোমার নিজের পাপ আত্মা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে তোমার কাছে। তোমার মুখপানে কেউ তাকিয়ে সোনার হার উপহার দেবে না। পূজার বেদীতে, নাচগানের আসরে, সব জায়গায় তোমাকে পরিহার করে চলবে সবাই। তোমাকে তখন এককোণে নির্জনে বসে শুধু বিষণ্ণ চিন্তায় ডুবে থাকতে হবে। ভিখারী আর পঙ্গুদের মাঝখানে লুকিয়ে থাকতে হবে তোমায়। ঈশ্বর না করুন, পৃথিবীতে যতদিন বাঁচবে, এক অভিশপ্ত জীবনযাপন করতে হবে তোমাকে। 

মার্থা : ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাও। পরনিন্দার দ্বারা নিজেকে অহেতুক ভারাক্রান্ত করে তুলছ তুমি। 

ভ্যালেন্টাইন : চুপ করো, ঘৃণ্য পাজি বুড়ি কোথাকার! আমি যদি তোর এই শুকনো রোগা দেহটাকে মৃত্যুর কোলে শুইয়ে দিতে পারতাম তাহলে আমার সব পাপ ঈশ্বর ক্ষমা করে দিতেন। 

মার্গারেট : চুপ করো ভাই। এসব কথা নারকীয়। 

ভ্যালেন্টাইন : চোখের জল ফেলো না আর। আমার কথা শোনো। তুমি যখন জীবনে সম্মান হারিয়ে ফেলো তখন আমি অন্তরে বড় আঘাত পাই। এখন আমি অন্তহীন নিদ্রার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের কাছে যাচ্ছি বীর সৈনিকের মতো। 

বিংশতি দৃশ্য 

শেষকৃত্য, শোকসঙ্গীত

অন্যান্যদের মাঝে মার্গারেট। মার্গারেটের পিছনে অশুভ আত্মা

অশুভ আত্মা : এটা কেমন হলো মার্গারেট? তুমি যখন নির্দোষ নিষ্পাপ তখন কেন তুমি এই বেদীমূলে এসে ঐ পুরনো বই খুলে প্রার্থনার বাণী পাঠ করলে? এই। বাণীপাঠের মধ্যে কিছুটা ছিল তোমাদের শিশুসুলভ ক্রীড়ার ভাব আর কিছুটা ছিল ঈশ্বরভক্তি। মার্গারেট, কি ভাবছ? তোমার বুকের মধ্যে কোনও গোপন পাপকে লুকিয়ে রেখেছ? তুমি কি তোমার যে মা দীর্ঘদিন পরলোকগমন করেছেন তাঁর আত্মার নামে প্রার্থনা করছ? তোমাদের ঘরের সামনে কার রক্ত দেখা যাচ্ছে? কে নিস্পন্দ অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং তোমার অন্তরটাই বা কাঁপছে কেন? তোমার এই অশান্ত জীবনের ভবিষ্যৎ খুবই শঙ্কাকীর্ণ। 

মার্গারেট : হায়, হায়! যে সব চিন্তাগুলো বারবার আমার মনের চারদিকে ভিড় করে আসছে সেই সব চিন্তা থেকে আমি যদি মুক্তি পেতাম! 

অশুভ প্রেতাত্মা : ক্রোধ তোমাকে আচ্ছন্ন করে বসেছে। জয়ঢাক বাজছে। কবরের মাটি কাঁপছে। হিমশীতল প্রাণহীন ভস্মতূপ থেকে জেগে উঠে তোমার জীবন জ্বলন্ত আগুনে জ্বলছে। 

মার্গারেট : আমি যদি এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম কোথাও। আমার মনে হচ্ছে অন্তিম সঙ্গীতের এই বাদ্যধ্বনি আমার প্রাণবায়ু রুদ্ধ করে দিচ্ছে। আমার অন্তর বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। 

কোরাস 

(গীত ও বাদ্য)

মার্গারেট : আমি আর নিশ্বাস ফেলতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে চারদিকের বিরাট বড় বড় স্তম্ভগুলোর মাঝে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি আমি। মনে হচ্ছে গোটা ছাদটা ভেঙে পড়ছে আমার উপর। বাতাস কই? 

অশুভ আত্মা : নিজেকে কোথাও লুকিয়ে রাখোে। মনে রাখবে পাপ ও লজ্জার কাজ কখনও গোপন থাকে না। আলো-বাতাস চাও? জাহান্নামে যাও তুমি। 

কোরাস 

গান

অশুভ আত্মা : তারা ভয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তোমার উপর থেকে। যারা পূতঃচরিত্র নিষ্পাপ তারা তোমার হাতের হাত রাখতে গিয়ে হাত সরিয়ে নিচ্ছে ঘৃণায়। 

মার্গারেট : হে আমার প্রতিবেশী! তোমার আন্তরিক সহানুভূতি আমি চাই। (মূৰ্ছিত হয়ে পড়ল) 

একবিংশতি দৃশ্য 

হার্তস পর্বত

(স্কার্ক ও এলেন্দ অঞ্চল)

ওয়ালপার্গিস রাত্রি 

ফাউস্ট। মেফিস্টোফেলিস

মেফিস্টোফেলিস : তুমি কি কোনও তেজী ঘোড়ার সাহায্য নিতে চাও না? আমি তো একটা বলিষ্ঠ পাঁঠার দেখা পেলেও বেঁচে যাই। আমরা যে পথে চলেছি তাতে লক্ষ্য এখনও অনেক দূর। 

ফাউস্ট : আমি তো আমার দুপায়ে বেশ সজীবতা অনুভব করছি। চারদিকের এই অরণ্যসমাচ্ছন্ন জটিল পর্বতমালা আমার তো ভালোই লাগছে। পথের দূরত্বকে স্বল্প করার চেষ্টা করছ কেন? প্রথমে এই সব উপত্যকার গোলকধাঁধায় কিছু ঘুরে বেড়ানো, তারপর ঐ সব অদূরবর্তী পর্বতপ্রাচীরের উপর আরোহণ করা। সেখানে দেখবে কত ঝর্না হতে অন্তহীন জলধারা বিচ্ছুরিত হচ্ছে অনন্তকাল হতে। সে দেখার আনন্দ। উপভোগ করতে গিয়ে আনা থেকে শ্লথ হয়ে আসবে আমার পায়ের গতি। ফুল্লকুসুমিত ও সুবাসিত বার্চ ও ফার গাছের বনে এখন বসন্ত এসেছে। তাদের বুকে এখন উল্লাসের দোলা। এই দোলা থেকে, এই বসন্তের ছোঁয়া থেকে আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো বঞ্চিত রয়ে যাবে বলতে চাও? 

মেফিস্টোফেলিস : আমি স্বীকার করছি, আমি কিন্তু ও সব কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে এখন বিরাজ করছে শীতের জড়তা। আমার পথের উপর আমি শুধু আশা করি বরফ আর তুষারের দুঃসহ শীতলতা। অসম্পূর্ণ চাঁদের নির্জন থালাটা কেমন ধীরে ধীরে আকাশে উঠছে দেখ। তার আলোর মধ্যে কোনও উজ্জ্বলতা নেই। সে আলোয় পথ চলতে গেলে পায়ে পায়ে পাথরে হোঁচট লাগবেই। এখন আমাদের পথের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে হবে। আমি দেখতে পাচ্ছি অদূরে কে আগুন জ্বালাচ্ছে। কে আছ বন্ধু, আমরা তোমার কাছে যাচ্ছি। কেন বৃথা আলোটার অপচয় করছ? 

তার চেয়ে আমাদের ঐ খাড়াই পথটা ওঠার সময় একটু আলো দেখাও। 

জনৈক অপরিচিত ব্যক্তি : আশা করি আমার শ্রদ্ধা আমার চঞ্চল মেজাজটাকে শান্ত রাখবে। পথটা খাড়াই আর আঁকাবাঁকা বলে আমি আলো জ্বালাচ্ছি। 

মেফিস্টোফেলিস : দেখছি সে গোটা মানবজাতিটাকেই তার আদর্শে দীক্ষিত করে তুলতে চায়। এখন শয়তানের নামে সোজা চলে যাও। তা না হলে তোমার সব আগুন। ও আলো লাথি মেরে ফেলে দেব। 

অপরিচিত ব্যক্তি : আমি দেখছি কোনও বাড়ির কর্তার মতোই আপনার মেজাজ। আমি আমার সাধ্যমতো আপনার সেবা করে যাব। কিন্তু ভেবে দেখুন, আজ পাহাড়ের অবস্থা ভালো নয়। এতে আমার মতো এক অজানা লোক পথ দেখালে আপনারা পথ। চিনে যেতে পারবেন না। 

(ফাউস্ট, মেফিস্টোফেলিস ও অপরিচিত ব্যক্তি তিনজনে মিলে গান গাইতে লাগল)

আমার মনে হচ্ছে যেন আমরা এক স্বপ্নের মায়াপুরীতে এসে পড়েছি। আমাদের কথা শোনো। তুমি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাও যাতে আমরা এই জনহীন স্থানে ঠিকমতো পথ চিনে এগিয়ে যেতে পারি।

ঐ দেখো গাছগুলো কত তাড়াতাড়ি এক জায়গা হতে আর এক জায়গায় লাফিয়ে যাওয়া-আসা করছে। খাড়াই পাহাড়গুলো মাথা নত করছে আমাদের সামনে। আমরা। কি কোনও গোলমাল শুনছি? নাকি কোনও গান? পাথরের উপর দেখছি ঘাস গজিয়েছে। প্রবহমান জলস্রোতগুলো কোনও গুহার মাঝে আশ্রয় খুঁজছে। আমরা কি কোনও গোলমাল শুনছি, নাকি কোনও গান অথবা কোনও প্রেমের আবেদন? অনন্ত আশা ও অমরত্ব সম্বলিত কোনো স্বর্গীয় দেবদূতের কণ্ঠস্বর শুনছি কি আমরা? পুরাতন প্রথার মতো তার ক্ষীণ প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে চারদিকে। হু হু করে পেঁচা ডাকছে। ওরা কি এখনও জেগে আছে? সালামান্দার কি পেটমোটা লোকটাকে ঝোঁপের মাঝে ফেলে দিল? বড় বড় সাপগুলো কিলবিল করতে করতে আমাদের ছড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে আসছে। আমাদের গা শিউরে উঠছে। শ্যাওলাধরা পাথর ও ঝোঁপের উপর। দিয়ে বিচিত্র বর্ণের ইঁদুর ছুটে বেড়াচ্ছে। যে জোনাকিরা জ্বলতে জ্বলতে উড়ে বেড়ায় তারা বিষণ্ণ হয়ে ঝাঁক বেঁধে বসে রয়েছে। আমাকে বলে দাও, আমরা কি দাঁড়িয়ে রয়েছি না উপর উঠছি? আমার মনে হচ্ছে সব কিছু ঘুরছে, সব কিছু ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। গাছ পাথর পাহাড় সব। দূরের ইতস্তত সঞ্চরমান আলোকবিন্দুগুলো ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমার জামার দিকটা সাহসের সঙ্গে ধর। এখানে মাঝামাঝি ধরনের এক পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে। এখান থেকে আশ্চর্য রকমের এক আগুন দেখা যাচ্ছে। এই আগুনের মধ্যে এক আশ্চর্য সম্পদ পাবে। 

ফাউস্ট : ঐ শৃঙ্গটার ভিতর থেকে প্রত্যূষের উজ্জ্বল আলোর মতো এক আলোকশিখা বেরিয়ে আসছে। যেন মনে হচ্ছে এক গভীর শূন্যতায় কোথায় এক। অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। আর তার থেকে কখনও এক ঝলক অগ্নিশিখা, কখনও বা একরাশ ধোয়া বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ছে। কখনও বা ঝর্নাধারার মতো জ্বলন্ত আগুনের একটা স্রোত সমস্ত উপত্যকাভূমিকে প্লাবিত করছে আর তার থেকে অসংখ্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সোনালী বালুকণার মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মোট কথা সেই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আগুনের শিখায় সমস্ত পার্বত্যপ্রদেশ আলোকিত হয়ে উঠছে। 

মেফিস্টোফেলিস : পর্বতের অধিষ্ঠাতা দেবতা ম্যাথন আজ রাতে এক ভোজসভা আহ্বান করেছেন। তুমি ভাগ্যবান যে এ দৃশ্য দেখতে পেয়েছ। নিমন্ত্রিত অতিথিরা আসছে একে একে। 

ফাউস্ট : কী প্রচণ্ড বেগে ঝড় বয়ে যাচ্ছে দেখো। আমার ঘাড়ের উপর যেন আছাড় খেয়ে পড়ছে ঝড়টা। 

মেফিস্টোফেলিস : পিছনের দিকে পাহাড়ের পুরনো পাথরগুলোকে শক্ত করে ধরো, তা না হলে পাশের শূন্য খাদের মধ্যে পড়ে যাবে। চারদিকে কালো কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাত্রি। ঝড়ের আঘাতে ঘর্ষণক্লিষ্ট গাছগুলোর আর্ত মর্মরধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ভয় পেয়ে পেঁচার ছানাগুলো চারদিকে ছুটে পালাচ্ছে। সমস্ত বনভূমি কাঁপছে, পাথরের স্তম্ভগুলো যেন ভেঙে পড়ছে। প্রতিটি গাছের কাণ্ড ও শাখাপ্রশাখাগুলো মুচড়ে একে অন্যের উপর পড়ে যাচ্ছে। তাদের শিকড়গুলো পর্যন্ত উপড়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের প্রতিটি কন্দরে ও গুহায় ঝড় প্রচণ্ড বেগে বয়ে যাচ্ছে গর্জন করতে করতে। এর মাঝে কাদের গান শুনতে পাচ্ছ? দূরে অথবা নিকটে কারা যেন গান গাইছে সমবেত কণ্ঠে। পাহাড়ের গায়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই গানের সুর। 

ডাইনিরা : (সমবেত কণ্ঠে) ডাইনিরা এখন ব্রোকেন পাহাড়ের উপর উঠেছে। ফসলের মাথাগুলো সবুজ। কিন্তু তাদের গোড়াগুলো হলুদ। ফসল ওঠার উৎসবে সমবেত হয়েছে উল্লসিত জনতা। সকলের উপরে বসে আছে ইউরিয়ান। সে হচ্ছে এক ডাইনি। 

একটি কণ্ঠস্বর

একটি বুড়ি ববো এক আসছে। সে আসছে লাঙ্গলের সঙ্গে সংযুক্ত মই-এর উপর চেপে। 

কোরাস : তাহলে যোগ্য ব্যক্তিকে সম্মান দাও। তাহলে বুড়ি ববোই এখন ডাইনিদের পরিচালিত করে নিয়ে যাবে। ডাইনিরা এবার তারই অনুসরণ করবে। 

কণ্ঠস্বর : এখান থেকে তাহলে কোন পথে যাবে? 

অন্য

কণ্ঠস্বর : ইনসেন পাহাড়ের উপর দিয়ে। আমি একটা পেঁচার বাসায় উঁকি মেরে দেখেছিলাম সে কেমন আমার পানে কটমট করে তাকাচ্ছিল। 

প্রথম

কণ্ঠস্বর : নরকে যাও তুমি। এত তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছ কেন? তার ফলে পড়ে যাচ্ছ। 

ডাইনিরা : (সমবেত কণ্ঠে) এ পথ একই সঙ্গে দীর্ঘ এবং প্রশস্ত। জনতা উন্মত্ত। ঝাঁটাগুলো সব তারা ফেলে দিচ্ছে। শিশুগুলো চুপ করে আছে। কিন্তু মারা বিরক্তিতে ফেটে পড়ছে। 

পুরুষ ডাইনিরা : খোলার মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে যেমন করে শামুক চলে আমরাও তেমনি শামুকের মতো এগিয়ে চলেছি। আমাদের সামনে যাচ্ছে মেয়েরা। তবে তখন কোনও শয়তানের বাড়ির সামনে এসে পড়ি তখন মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি অতি দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায়। 

অন্যদল : আমরা কিন্তু এভাবে বিচার করি না। মেয়েরা পুরুষদের থেকে হাজার পা এগিয়ে থাকলেও পুরুষরা এক লাফে তাদের ছাড়িয়ে যেতে পারে। 

কণ্ঠস্বর : (উপর থেকে) ঐ পাহাড় ঘেরা হ্রদ থেকে চলে এস। 

কণ্ঠস্বর : (নিচের থেকে আমরা উপরে উঠে যেতে চাই। আমরা নিরন্তর জলধারার দ্বারা বিধৌত এবং শুচিত। তথাপি আমরা চিরকালের জন্য সৃষ্টিকার্যে অক্ষম। 

উভয় কোরাস : এখন ঝড় থেমে গেছে। আকাশ দেখা যাচ্ছে। তবে চাঁদ নাই আকাশে। অন্ধকারের ভিতরে কার এক ঐন্দ্রজালিক গানের সুর ঝরে পড়ছে মৃত্যু বৃষ্টিধারার মতো। 

কণ্ঠস্বর : (নিচের থেকে) কে যাচ্ছে ওখানে, থামো।

কণ্ঠস্বর : (উপর থেকে) নিচের থেকে কে ডাকছে? 

কণ্ঠস্বর : (নিচের থেকে) আমাকেও নিয়ে যাও। আমাকেও সঙ্গে নাও। আমি তিনশ বছর ধরে উপর ওঠার চেষ্টা করছি। কিন্তু আজও দেখা পাইনি শিখরদেশের। আমিও ঐ উক্ৰমণরত জনতার সামিল হতে চাই। 

উভয় কোরাসদল : যতসব কাজের যন্ত্রপাতি নিয়ে আজ রাত্রির মধ্যে যারা উঠতে পারবে না তাদের আর কোনও আশা নেই। তাদের ধ্বংস অনিবার্য। 

ডাইনি : (নিচের থেকে) এখন আমি শুধু বারবার পড়ে যাচ্ছি। আমি বড় দূরবস্থার মধ্যে আছি। অথচ অন্যেরা আমাকে ছাড়িয়ে কত দূরে চলে গেছে। বাড়িতে আমার কোনও বিরাম বা শান্তি নেই। আর এখানেও সে বিরাম বা শান্তিলাভ করতে পারছি না। 

ডাইনিদের কোরাস : ডাইনিদের খুশি করলেই সব পাবে। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। একটা কম্বল তাদের দান করলে একটা জাহাজ পেয়ে যাবে। অথচ আমাদের সঙ্গে যদি আজ রাতে না আসতে পার তাহলে পরে জাহাজ পেলেও কোনও ফল হবে না। 

উভয় কোরাসদল : আমরা যখন এই শিখরদেশের চারদিকে উঠে বেড়াচ্ছি তখন তোমরা সোজা নিচে মাটিতে নেমে যাও। নেমে চারদিকে বনের আশেপাশে ডাইনিদের কাজকর্মের উপাদান খুঁজে বেড়াবে। 

মেফিস্টোফেলিস : তারা একসঙ্গে সমবেতভাবে এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে চলেছে কলরব করতে করতে। তারা কখনও আগুনে পুড়ছে, এবং তাদের গা থেকে গন্ধ বার হচ্ছে। আবার কখনও শুধু আলোক বিচ্ছুরিত হচ্ছে তাদের গা থেকে। প্রকৃত ডাইনি কাকে বলে তা আমরা বুঝতে পারছি তাদের দেখে কাছে এস। তা না হলে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব ওদের দল থেকে। কোথায় তুমি? 

ফাউস্ট : (দূরে) এই যে এখানে। 

মেফিস্টোফেলিস : সে কি! এত দূরে ছিটকে পড়েছ? আমাকেই পথ পরিষ্কার করে দিতে হবে দেখছি। হে জনতা, একটু সরো দেখি, একটু পথ করে দাও। আমাকে ধরো ডাক্তার। এক লাফে আমরা জনতার থেকে কিছুটা দূরে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে পড়ব। অদূরে কিসের একটা স্পষ্ট আলো জ্বলছে ঐ বনের মধ্যে। ওখানে গিয়ে তা দেখতে ইচ্ছা করছে আমার। চলে এস। ওই বনটার কাছে চলে যাই। 

ফাউস্ট : হে বিরোধ ও বিভেদের আত্মা। এগিয়ে চলো। আমি তাকে অনুসরণ করব প্রত্যক্ষভাবে। ঠিকভাবে বিচার করে দেখতে গেলে এ পরিকল্পনা ভালোই হয়েছে। আমরা আজ এই ওয়ালাপার্গিস নৈশ উৎসবের দিন ব্রোকেন পাহাড়ের শিখরদেশে আরোহণ করব। আর তার জন্য আমরা ইচ্ছা করে তাদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু দেখো দেখো, কত বিচিত্র বর্ণের অগ্নিশিখা দেখা যাচ্ছে বনের ভিতর। 

ফাউস্ট : আমার পক্ষে এখন এই শিখরদেশে উঠে যাওয়াই ভালো। সেখানে আগুন আর ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা যাচ্ছে। মানুষ বিবাদ ও গোলমালের সময় কোনও অশুভ শক্তিরও সন্ধান করে। সেই শক্তির কাছে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান হয়। 

মেফিস্টোফেলিস : সেখানে আবার অনেকে নতুন সমস্যার জটও পাকিয়ে যায়। জনতা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে চেঁচামেচি করে মরুক। আমরা এই নির্জনে শান্তিতে থাকব। এইভাবে এই বিরাট পৃথিবীর মাঝে মানুষ ছোট ছোট এক-একটি শান্ত নির্জন জায়গা বেছে নেয়। আমি দেখছি তরুণ যুবতী ডাইনিরা উলঙ্গ অবস্থায় সমবেত হয়েছে এবং বৃদ্ধারা ঘোমটা মাথায় দিয়ে কাপড়ে গা ঢেকে এসেছে। আমার খাতিরে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। এতে কোনও ক্ষতি হবে না, বরং মজা পাবে। আমি শুনতে পাচ্ছি বাদ্যযন্ত্র বাজছে। এই যন্ত্রধ্বনি অশুভ হলেও তা শুনতে হবে। আমার সঙ্গে এস। আমি আগে গিয়ে তোমাকে পরিচিত করে দেব তাদের সঙ্গে। তুমি এই প্রথম আসছ। জায়গাটা ছোট নয়, কি বলো বন্ধু? সামনে তাকিয়ে দেখো, দেখবে। তার শেষ দেখতে পাবে না। প্রায় একশোটা অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে আর তার চারদিকে তারা রান্না করছে, পানাহার করছে এবং উন্মত্তের মতো নাচছে। এটা কি কম মজার কথা? 

ফাউস্ট : আমাকে পরিচিত করিয়ে দিতে গিয়ে তুমি কি পুরুষ ডাইনি বা শয়তানের ভূমিকা গ্রহণ করবে? 

মেফিস্টোফেলিস : আমি অবশ্য অজানা পথিক হিসাবে তাদের মাঝে যেতে অভ্যস্ত। কিন্তু এই ঝড় ও দুর্যোগের রাত্রিতে আজ আমার পরিচয় দিতে হবে। তবে এখানে পা দিয়ে ঘরের মতো স্বস্তি পাচ্ছি। অদূরে একটা শামুক দেখতে পাচ্ছ? কেমন ধীর গতিতে আসছে ওটা। তেমনি এখানকার লোকেরা ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমার আগমন আগেই বুঝতে পেরেছে। এখানে চেষ্টা করেও আমি ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারব না। এখন এস, এখন এই আগুন থেকে অন্য একটা আগুনের কুণ্ডের কাছে যাই। আমিই প্রথমে যাব। (পোড়া কাঠের পাশে বসে থাকা কিছু লোককে বলল) হে দ্রমোদয়গণ, কেন তোমরা এক পাশে বসে রয়েছ? তোমরা যদি ঐ সব যুবকদের মাঝে গিয়ে আনন্দোৎসব করতে পার তাহলে তোমাদের আমি প্রশংসা করব। 

সকলে : বলো, কে বৃদ্ধদের আর বিশ্বাস করবে? যদিও বৃদ্ধদের পরিকল্পনামতো অনেক কাজ হয়েছে। সাধারণ জনগণ আর নারীদের কাছে যুবকরাই বেশি খাতির পায়। 

মন্ত্রী : তারা এখন ন্যায় ও সত্যের পথ থেকে দূরে সরে গেছে। আমি বৃদ্ধদের আজও প্রশংসা করি আর তার কারণও যথেষ্ট আছে। আমাদের হাতে যখন শাসকক্ষমতা ছিল তখন দেশে ছিল স্বর্ণযুগ। 

পারভেনু : আমরাও তখন ভালো কাজ করেছি। কিন্তু এখন সে সব কিছু হচ্ছে না।

গ্রন্থকার : আজ ভালো বই কে পড়বে? আজকালকার লোকে ভালো বইকে বলে সেকেলে। আজকের যুবকরা বড় উদ্ধত এবং অমার্জিত। 

মেফিস্টোফেলিস : (সহসা বুড়ো হয়ে গেল। আমার মনে হয় শেষ বিচারের দিন এসে গেছে। আমি শেষবারের মতো এসেছি এই ডাইনিদের পাহাড়ে। আমার। জীবনরূপ মদ্য হয়ে গেছে নিঃশেষিত। এবার পৃথিবীর শেষ। 

হাক্সটার ডাইনি : শোনো হে ভদ্রলোক, এভাবে আমাকে উপেক্ষা করো না। এ সুযোগ নষ্ট হতে দিও না। আমার জিনিসপত্রগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখ। আমি বেশি কিছু সংগ্রহ করতে না পারলে ও আমার কাছে আছে অনেক বিরল বস্তু। আমার মতো এই দোকান পৃথিবীতে কোথাও পাবে না তুমি। এই দোকানে যে সব জিনিস আছে তার প্রত্যেকটি পৃথিবীর মানবজাতির কোনও না কোনও ক্ষতি সাধন করেছে। এখানে এমন কোনও ছুরি নেই যে কোনও মানুষের রক্তপাত ঘটায়নি। এমন কোনও কাপ নেই যা বিষ প্রয়োগের দ্বারা কারও না কারও মৃত্যু ঘটায়নি। এখানে এমন কোনও মণিমুক্তো নেই যা কোনও নারীকে বিপদাপন্ন করে তোলেনি। এমন কোনও তরবারি নেই যা পিছন থেকে কোনও প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করেনি। 

মেফিস্টোফেলিস : থামাও তোমার কথার কচকচি। এখনকার সময়টা ধরতে পারছ না। বুঝতে পারছ না কালের স্বরূপ। যা হয়ে গেছে গেছে। অতীতের কথা ছেড়ে দাও। নূতন কি জিনিস আছে বললো। একমাত্র নূতনত্ব দিয়েই আমাদের ভোলানো যায়। 

ফাউস্ট : আমি যেন এই সব জিনিস দেখে ভুলে না যাই। এ রকম মেধা জীবনে কখনও দেখিনি আমি। 

মেফিস্টোফেলিস : এই ঘূর্ণিটা উপরে উঠতে চাইছে। আর তার সঙ্গে তোমাকেও টেনে নেওয়া হচ্ছে। 

ফাউস্ট : কিন্তু কে ও?

মেফিস্টোফেলিস : ওকে বিশেষভাবে দেখো। ওর নাম লিলিথ।

ফাউস্ট : কে সে? 

মেফিস্টোফেলিস : ও হচ্ছে আদমের একমাত্র স্ত্রী। ওর মাথায় সুন্দর কেশপাশ আর তার বিন্যাস ও অলঙ্করণই হলো ওর একমাত্র লোভনীয় সৌন্দর্যসম্ভার। তাই দিয়েই ও অনেক যুবককে ফাঁদে ফেলে। আবার তাকে শীঘ্রই মুক্তি দেয়। 

ফাউস্ট : ঐ যে ওরা দুজন–একজন বৃদ্ধ ও একজন যুবক–ওরা অনেকক্ষণ নেচেছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আজ রাতে কারও কোনও বিশ্রাম নেই। আজ বুড়ো-ছোকরা সর্বক্ষণ শুধু নাচবে। একবার হয়ে গেলে আবার নাচবে। 

ফাউস্ট : (এক তরুণী ডাইনির সঙ্গে নাচতে নাচতে) একদিন আমি একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নের মাঝে আমি একটি ফলন্ত আপেল গাছ দেখি। তাতে দুটি সুন্দর পাকা আপেল ছিল। আমি তার আবেদনে মুগ্ধ হয়ে গাছে উঠে পড়ি তৎক্ষণাৎ। 

সুন্দরী ডাইনি : যে আপেল তুমি কামনা করেছিলে সে আপেল প্রথমে স্বর্গে জন্মায়। আজ আমি একথা জেনে খুব আনন্দ পেলাম যে এ আপেল আমার বাগানে এখন জন্মাচ্ছে। 

মেফিস্টোফেলিস : (এক তরুণী ডাইনির সঙ্গে নাচতে নাচতে) একদিন একটা ভয়ঙ্কর অসুন্দর স্বপ্ন আমি দেখি। তাতে একটা ভাঙা গাছ দেখতে পাই। যাই হোক, আমি স্বপ্নে তাই দেখেছিলাম। 

বুড়ি ডাইনি : আমি বুড়ো পা-ভাঙা নাইটকে আমার সাধ্যমতো সেবা ও সম্মান দান করলাম। 

কোনও এক পুরুষ ডাইনি : তোমার সাহস তো কম নয়। তুমি কি জান না যে বাড়ির মালিক বা আশ্রয়দাতা আর অতিথির মর্যাদা এক নয়! অথচ তুমি তার সঙ্গে নাচছ। 

সুন্দরী ডাইনি : ও তাহলে এসেছে কেন আমাদের এই নাচের আসরে? 

ফাউস্ট : (নাচতে নাচতে) সব জায়গায় ওর উপর তোমরা কেন পড়ছ? অন্যেরা যখন নাচছে ও তখন তাদের নাচ দেখছে। ও আগে থেকে হয়তো ঠিক নাচতে পারে না। কিন্তু যদি তোমরা আগে যাও ও পিছনে যাবে অথবা তোমরা যদি চক্রকারে ঘুরে ঘুরে নাচ তাহলে ও ভালোই নাচবে। অবশ্য তোমরা যদি তার কথা শুনে চলো। 

পুরুষ ডাইনি : এখনও তুমি এখানে রয়েছ? এমন কথা কখনও শুনিনি। এখনি চলে যাও। শয়তানরা কোনও ভালো কথা শুনতে চায় না। কোনও আইন-কানুন মানতে চায় না। আমরা সব নির্বুদ্ধিতাকে মন থেকে সরিয়ে মনটাকে পরিষ্কার করার জন্য কত ঝাঁট দিয়েছি। 

সুন্দরী ডাইনি : আমাদের নাচের আসরে এভাবে বিরক্ত করো না আমাদের। 

পুরুষ ডাইনি : শোনো প্রেতাত্মারা, আমি তোমাদের মুখের সামনে বলে দিচ্ছি, আমি তোমাদের কোনও আধিপত্য মানব না। আমার মন তা কখনও মানবে না আর সে আধিপত্য দেখাতেও চায় না। 

(নাচ চলতে থাকে)

ফাউস্ট : এই সব আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে আমি কোনও চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করতে পারব না। তবু আমি আশা করি মৃত্যুর আগে আমি কবি আর শয়তানদের করায়ত্ত করব। 

মেফিস্টোফেলিস : সে আবার জলের ধারে মাটির ঢিবির উপর বসবে। যখন জোকগুলো তার পায়ে ধরে রক্ত চুষতে থাকবে তখনই তার ঘাড় থেকে সব ভূত-প্রেত। নেমে যাবে। (ফাউস্টের নীচ শেষ হতে) যে সুন্দরী মেয়েটি নাচের সময় ভালো গান গাইছিল তাকে কেন ছাড়লে? 

ফাউস্ট : নাচের সময় সে যখন গাইছিল তার মুখ থেকে তখন হঠাৎ একটা ইঁদুর বার হলো। এই কারণেই তাকে ত্যাগ করেছি। 

মেফিস্টোফেলিস : ওটা কিছু নয়। এতে রাগ করার কিছু নেই। একটা ইঁদুর থেকে তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। বিশেষ প্রেমের সময় ওসব দিকে কেউ নজর দেয় না। ওসব কথা কেউ ভাবে না। 

ফাউস্ট : তারপর আমি দেখলাম–

মেফিস্টোফেলিস : কী দেখলে? 

ফাউস্ট : মেফিন্তে, তুমি কি দেখেছ, একা একা একটি সুন্দরী মেয়ে মলিন ও বিষণ্ণ মুখে দূরে বসেছিল? মনে হচ্ছিল তার পায়ে যেন বেড়ি লাগানো ছিল। আমার মনে হচ্ছিল সে যেন আমার প্রিয়তমা মার্গারেট।

মেফিস্টোফেলিস : হতে দাও। ও সব মায়ার সৃষ্টি। প্রাণহীন ঐন্দ্রজালিক প্রতিমা। এসব দেখা ভালো কথা নয়। ঐ সব প্রতিমার শূন্য দৃষ্টি মানুষের রক্ত হিমশীতল করে জমাট বাঁধিয়ে দেয়। মানুষ পাথর হয়ে যায়। মেদুসার গল্প তুমি জান। 

ফাউস্ট : সত্যি করে বলছি, তার চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনও মৃত নারীর চোখ, যে চোখ কোনও প্রিয়জন হাত দিয়ে বন্ধ করে দেয়নি। মনে হচ্ছিল তার ঐ বুকের উপর আমি কত সময় শুয়ে থেকেছি। তার পাশে কত বিশ্রাম, কত শান্তি লাভ করেছি আমি। 

মেফিস্টোফেলিস : সব মায়া। ইন্দ্রজাল। এত অল্পেতে গলে যাও তুমি। তাকে দেখে যে কোনও লোক তার প্রিয়তমা ভাববে। 

ফাউস্ট : তার প্রেমের আবেগে আমি এতদূর আবদ্ধ হয়ে পড়েছি যে তার চোখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছিলাম না আমি। আর একটা আশ্চর্য এই যে তার গলার কাছে ছুরির ফলকের মতো একটা জিনিস দেখেছিলাম। 

মেফিস্টোফেলিস : ঠিক ঠিক। লাল একটা দাগ আমিও দেখেছিলাম। তার কোনও পুরনো শত্রু তার মাথাটা কেটে দিয়েছে আর সেই মাথাটাকে তাকে হাতে করে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তুমি এখনও মায়ার জিনিস দেখতে চাও? এস আমার সঙ্গে। এই ছোট্ট পাহাড়টায় উঠে পড়। আমি যদি খুব একটা ভুল না দেখি তাহলে সেখানে দেখবে একটা থিয়েটার হচ্ছে। কি হচ্ছে? 

রঙ্গমঞ্চের ভৃত্য : শীঘ্রই আবার শুরু হবে নূতন নাটক। সাতটি নাটকের শেষ নাটক। কোনও এক শৌখিন নাট্যকারের দ্বারা এ নাটক লিখিত। আমিও একজন শৌখিন নাট্যানুরাগীরূপেই যবনিকা উত্তোলন করছি।

মেফিস্টোফেলিস : তোমার সঙ্গে আমার ব্লকস্বার্গে দেখা হওয়াই ভাল, সেটাই তোমার উপযুক্ত স্থান। 

দ্বাবিংশ দৃশ্য

ওয়ালপার্গিস রাত্রির স্বপ্ন

ওবেরণ ও টিটানিয়ার বিবাহ 

বিরতি

ম্যানেজার : আজ তোমাদের বিশ্রাম। তোমাদের যন্ত্রপাতির আজ কোনও প্রয়োজন নেই। এক ধূসর পাহাড় আর কুয়াশাচ্ছন্ন উপত্যকাই হবে আজকের দৃশ্যপট। 

প্রহরী : এ বিয়ে হবে সোনার বিয়ে। এ বিয়ের জীবনকাল হবে পঞ্চাশ বছর। তবে যদি কোনও ঝগড়াঝাটি হয় তাহলে আমাকে সব সোনাদানা দিয়ে দাও। 

ওবেরন : হে প্রেতাত্মাগণ, যদি তোমরা এখানে অবস্থান করো তাহলে তোমরা আনন্দোজ্জ্বল মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করো। তোমরা দেখা দাও। পরীদের রাজা আর রানি আজ বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হলো। 

পাক : পাক এসে গেছে। হালকা পায়ে যে নাচছে। তার সাথে এল আরও একশ জন। এসে তার আনন্দের অংশ গ্রহণ করো। 

এরিয়েল : এরিয়েলের গান হচ্ছে স্বর্গের সুরধারার মতোই পবিত্র। তার কণ্ঠস্বর অতীব মধুর। তার মুখটা কুৎসিত হলেও সুন্দরীরা তার দ্বারা আকৃষ্ট হয়। 

ওবেরন : বর-কনে যদি তার দাম্পত্য জীবনে প্রেম-ভালোবাসা চায় তাহলে আগে তাদের বিচ্ছেদ ভোগ করা উচিত। 

টিউনিয়া : স্ত্রী যদি তার মেজাজ সংযত করা সত্ত্বেও তাকে অপমান করে তাহলে স্বামী উত্তর মেরুতে তার স্ত্রীকে বিষুবরেখায় রেখে এস। 

অর্কেস্ট্রা : ঘাসের মাঝে লুকিয়ে থাকা সাপ-ব্যাঙ আর ঝিঁঝি পোকারাই হলো আজকের গায়ক। 

একক সঙ্গীত : আমাদের পথে পাখি ডাকছে। সাবানের ফেনার মতো বুদ্বুদ উঠছে তার কণ্ঠে। তার দুটো নাসারন্ধ্র দিয়ে গানের সুর বেরিয়ে আসছে। 

প্রেতাত্মা প্রথম আকার ধারণ করল

মাকড়সা আর বিষাক্ত ব্যাঙের পা, ছোট ছোট পাখা–আমরা তাদের চিনি। ছোট্ট প্রাণী হলে কি হবে দেখে মনে হবে যেন ছোট্ট একটি কবিতা। 

ছোট্ট একজোড়া বর-কনে

ছোট ছোট পা ফেলে যতই লাফাও না কেন শিশিরভেজা সুবাসিত বনপথের উপর দিয়ে, তোমরা কখনও শূন্যে উঠতে পারবে না। 

কৌতূহলী পথিক : এটা কি কোনও মুখোশনৃত্যের নাটক? আমি কি দেখছি? হে ওবেরন, সুন্দরী নারীদের রাজা, তুমি রাত্রিকালে আমার স্বপ্নের মাঝে এস। 

কোনও গোঁড়া রক্ষণশীল ব্যক্তি

আমি তো এর মাথামুণ্ড কিছুই বুঝছি না। গ্রীক নাটকের মতো শেষকালে কোনও দেবতার পরিবর্তে হয়ত আসবে কোনও শয়তান। সব সমস্যার হয়ত সমাধান করে দেবে। 

উত্তরের শিল্পী : আমি কিন্তু কিছু কিছু বুঝতে পেরেছি এ নাটকের। আমি এখন ইতালি পরিভ্রমণের কথা ভাবছি। 

বিশুদ্ধ ভাববাদী : হায়, দুর্ভাগ্যক্রমে আমি এখানে এসে পড়েছি। মানুষখেকো দৈত্যের মতো কী চীৎকার করছে। ডাইনিদের মধ্যে শুধু দুজন পাউডার মেখেছে। 

তরুণী ডাইনি : এই পাউডারই জামার কাজ করছে আমার। আমি তাই নগ্ন হয়ে বসে আমি আমার ছাগলের উপরে। 

ধাত্রী : যে কোনও মানুষের মনকে ঘুরিয়ে দেবার মতো কলাকৌশল আমাদের যথেষ্ট জানা আছে।

বাদ্যকারের নেতা : হে মাছি আর মশার দল, তোমরা যেন নগ্ন দেহের চারদিকে ঘিরে ধরো না। এখন ব্যাঙ আর ঝিঁঝি পোকারাই গান করবে সময় বুঝে। 

ভবিষ্যদ্বক্তা : (একদিকে তাকিয়ে) সুন্দর কনে হাতে পেলেই যুবকদের রক্ত ফুটে ওঠে টগবগ করে। তারা চায় সমস্ত সমাজ তাদের মনোমতো চলবে। 

ভবিষ্যদ্বক্তা : (আর একদিকে তাকিয়ে) বাঁচাল প্রচারকদের গ্রাস করার জন্য পৃথিবী যদি এখনও মুখ না খোলে তাহলে আমি কেন এত তাড়াতাড়ি নরকে ঝাঁপ দেব? 

জনৈক প্রেত : আমাদের দেখতে ছোট্ট পতঙ্গ মনে হলেও আমাদের পিতা হচ্ছে শয়তান। সুতরাং ইচ্ছা করলে আমরা যে কোনও সম্মানে ভূষিত করতে পারি নিজেদের। 

অন্য প্রেত : ভিড়ের মধ্যে সব মানুষই নির্লজ্জের মতো বড়াই করো। বলে তারা নির্দোষ। 

জনৈক ডাইনি : ডাইনিদের নাচগানের আসরে অনেকেরই মাথা ঘুরে যায়। 

কৌতূহলী পথিক : বলল, কে সবচেয়ে কড়া আর জাঁকজমকপূর্ণ লোক? যে উদ্ধৃতভাবে হাঁটে, তার চলার মধ্যেই বোঝা যায় সে কত অহঙ্কারী। 

প্রেতাত্মা : পরিষ্কার ও কর্দমাক্ত যে কোনও জলাশয় ও জলধারাতেই আমি মাছ ধরতে যা খেলা করতে ভালোবাসি। তেমনি দেখবে ধার্মিক লোকেরা শয়তানদের সঙ্গেও মেলামেশা করছে। 

অন্য প্রেত : হ্যাঁ, ধার্মিক লোকেরা যে কোনও অবস্থা বা উপাদানের সঙ্গে খাইয়ে নিতে পারেন নিজেদের। 

বিপদ : আমি সব সময় ভবিষ্যতের জয়ঢাক শুনতে পাই।

নৃত্যশিক্ষক : খোঁড়া পায়ে কেমন পা ফেলছে আর লাফাচ্ছে। 

জনৈক সজ্জন ব্যক্তি : সাধারণ মানুষগুলো এমনই ইতর যে তারা লোক খুন করে মানুষকে কষ্ট দিয়ে বিদ্রূপ করে আনন্দ পায়। তবে তারা আর্ফিয়াসের বাঁশির মতো নাচগানের দ্বারা বশীভূত হয়। 

গোঁড়া ব্যক্তি : আমি কোনও সংশয় বা সমালোচনার দ্বারা মুগ্ধ হব না। শয়তানও যদি কোনও বিষয়ে নিশ্চিত এবং অটল থাকে আমি তাকে শ্রদ্ধা করি। 

আদর্শবাদী : যে কল্পনা আমাকে অনুপ্রাণিত ও উদ্দীপিত করে মাঝে মাঝে তা অনিবারণীয়। কিন্তু আমি যা নিজেকে দেখছি আমি যদি তাই হই তাহলে কল্পনামুক্ত আমার সেই স্বরূপ খুবই খারাপ। 

বস্তুবাদী : সব দেশেই এই ধরনের নাচগান ও হইহুল্লোড় হয়। এতে আমার ভীষণ বিরক্তি লাগে। এখানে এসে আমি বড় অস্বস্তি বোধ করছি। মনে হচ্ছে অশক্ত ভূমির উপর আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। 

অতিপ্রাকৃতবাদী : আমার তো এ নাটক দেখতে খুব ভালো লাগছে। এ নাটক আমাকে বেশই আনন্দ দান করেছে। অভিনেতাদের যোগ্যতার প্রশংসা করি। শয়তানদের মধ্যে থেকেও আমি ভালো আত্মা বেছে নিতে পারি। 

সংশয়বাদী : যে অগ্নিশিখাকে তারা অনুসরণ করে চলেছে তার শেষ নেই। তাদের চলারও শেষ নেই। তারা ভাবছে তারা তাদের ঈপ্সিত সম্পদের রাজ্যে চলে এসেছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না শয়তান সংশয়ের সঙ্গে মিলেমিশে তাদের প্রতারিত করছে। আমি কিন্তু এখানে বেশ আনন্দে আছি। 

বাদ্যকারদের নেতা : ব্যাঙ আর ঝিঁঝি পোকার থেকে মাছি আর মশা ভালো গায়ক! 

মঠাধ্যক্ষ; আমরা সর্বজীবে দয়ার নীতি প্রচার করি। তাহলে আমাদের পায়ে হেঁটে চলা উচিত নয়, আমাদের মাথা নিচে দিয়ে চলা উচিত। 

অনভিজ্ঞ ব্যক্তি : নাচতে নাচতে আমাদের জুতো ছিঁড়ে গেছে। এখন আমরা খালি পায়ে হাঁটি। 

জলজ আগাছা : জলাশয়ে আমাদের জন্ম। তবু আজ আমরা এখানে সমাজের বড় বড় লোকদের কাছে এসে পড়েছি। 

কক্ষচ্যুত নক্ষত্র : আকাশ থেকে কক্ষচ্যুত হয়ে আমি পড়ে আছি এই ঘাসের উপর। হায় কে আমাকে স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে আবার। 

স্কুলাঙ্গ ব্যক্তিরা : আমাদের জন্য একটু জায়গা করে দাও। চারদিকে শুধু মোটা লোক ঘাসগুলোকে মাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। 

পাক : হাতির ছানার মতো এখানে এস না তোমরা। পাক নিজেই একজন মোটা লোক। 

এরিয়েনা : প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্যকে পিছনে ফেলে মনকে পাখা করে আমার সঙ্গে শূন্য পথে চলে এস। আমি তোমাদের নিয়ে যাব গোলাপের সুন্দর পাহাড়ে। 

অর্কেস্ট্রা : আমাদের মাথার উপর জমে থাকা মেঘ আর কুয়াশা এখন উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। চারদিকে বাতাস বইছে আর সে বাতাসে সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। 

ত্রয়োবিংশ দৃশ্য

একটি দুর্দিন 

প্রান্তর 

ফাউস্ট। মেফিস্টোফেলিস

ফাউস্ট : দুঃখে হতাশায় অনেক হতভাগ্য লোক পৃথিবীতে খারাপ হয়ে যায়, কুপথে চলে যায়। ফলে অপরাধীদের মতো কারাগারে অশেষ দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়। বিশ্বাসঘাতক ঘৃণ্য শয়তান কোথায়! তুমি তার ব্যাপারটা গোপন রেখেছ আমার কাছে। দাঁড়াও ওখানে। তোমার রোষকশায়িত রক্ষচক্ষু যত পার ঘোরাও। তোমার যত। শক্তি আছে তাই নিয়ে আমার সম্মুখীন হও। আমাকে যাত পার চাপ দাও। আমাকে কারাগারে আবদ্ধ করবে? আমাকে অশেষ দুঃখ দেবে? আমাকে শয়তানের হাতে সঁপে দেবে এবং হৃদয়হীন মানুষদের নিন্দার বলিতে পরিণত করবে? এতদিন তুমি আমাকে ভুলিয়ে রেখেছিলে বাজে চিন্তার দ্বারা। আমার প্রিয়তমার দুঃখকষ্টের কথা গোপন রেখেছিলে আমার কাছে। তার জন্য অসহায়ভাবে ধ্বংসের পথে নেমে যেতে হয় তাকে। 

মেফিস্টোফেলিস : একা সেই শুধু কষ্ট পায়নি। 

ফাউস্ট : কুকুর, ঘৃণ্য জার্নোয়ার কোথাকার! হে ঈশ্বর, এই ঘৃণা সরীসৃপটাকে আবার ওর প্রিয় কুকুররূপে পরিণত করো। ও একদিন কুকুররূপেই রাত্রিতে আমার পায়ের কাছে গড়াগড়ি যেত। ও যেন আবার আমার পায়ের কাছে ধুলোর উপর বুক দিয়ে শুয়ে থাকে আর আমি পা দিয়ে ওকে মাড়িয়ে দেব। এ দুঃখ প্রথম নয়। তার মানে যে দুঃখ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না সেই অকল্পনীয় অসহনীয় দুঃখের গভীরে পড়ে আরও অনেক মানুষ মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করবে। অথচ এই একটি মানুষের দুঃখ আমার মর্ম ভেদ করে আমার অস্থিমজ্জাকে কাঁপিয়ে তুলছে আর তুমি অজস্র মানুষের দুঃখে হাসছ? 

মেফিস্টোফেলিস : এখন তোমরা আমরা সবাই বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছি। কেন তুমি মানুষ হয়ে আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এসেছিলে যদি শেষ পর্যন্ত সে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে না পার? তুমি কি এসব সইতে না পেরে পালিয়ে যাবে? কিন্তু তুমি প্রথম আমাদের কাছে আসবে না আমরা তোমার কাছে যাব? 

ফাউস্ট : দাঁতে দাঁত চেপে গর্জন করো না আমার দিকে তাকিয়ে। ভয়ঙ্কর ঘৃণা ও বিরক্তিতে মন আমার ভরে উঠছে। হে গৌরমময় শক্তিশালী আত্মা! তুমি আমাকে মূর্তি ধরে দেখা দিয়েছ, তুমি আমার মনের কথা জান। বলল, কেন তুমি এমন একটা লোকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছ আমাকে যে ক্ষয়ক্ষতি আর ধ্বংস ছাড়া আর কিছু জানে না? 

মেফিস্টোফেলিস : তোমার যা বলার তা বলা হয়ে গেছে? 

ফাউস্ট : তাকে উদ্ধার করো, তা না হলে তুমি জাহান্নামে যাবে। হাজার বছর ধরে ভয়ঙ্কর অভিশাপ ভোগ করতে হবে তোমায়। 

মেফিস্টোফেলিস : তাকে উদ্ধার করব? কে তার ধ্বংস ডেকে এনেছে? আমি না তুমি? (ফাউস্ট চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল) তুমি বজ্র ধারণ করতে চাও? কোনও মরণশীল মানুষ তা পেতে পারে না। কোনও দুর্গত মানুষকে মুক্ত করার নামে এইভাবে অত্যাচারীরা নির্দোষ ব্যক্তিকে শেষে চুর্ণ-বিচুর্ণ করতে চায়। 

ফাউস্ট : সেখানে নিয়ে চলো আমাকে। তাকে মুক্ত করব আমি। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু তাহলে যে বিপদে পড়বে তার কথা ভেবেছ? মনে রেখো, তুমি নিজের হাতে যে রক্তপাত করেছ তা এখনও শহর থেকে মুছে যায়নি। যেখানে তুমি হত্যা করেছিলে সেই ঘটনাস্থলে এখনও প্রতিশোধ গ্রহণকারী প্রেতরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং হত্যাকারীর জন্য প্রতীক্ষা করছে। 

ফাউস্ট : তুমিও তাই করছ। পৃথিবীর সমস্ত হত্যার অপরাধে অভিশপ্ত হও তুমি। জার্নোয়ার কোথাকার। আমাকে সেখানেই নিয়ে চলো তুমি। আমি বলছি, তুমি তাকে মুক্ত করো। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব। শোনো আমি কি করতে পারি। আমার কি স্বর্গমর্ত্যের সব শক্তি করায়ত্ত আছে। প্রথমে আমি জেলরক্ষীর চেতনাশক্তিকে আচ্ছন্ন করে ফেলব। তারপর কারাকক্ষের চাবি নিয়ে তাকে বাইরে নিয়ে আসব। বাইরে প্রস্তুত থাকে ঐন্দ্রজালিক ঘোড়া। আমি তোমাদের দূরে নিয়ে যাব। এত ক্ষমতা আমার আছে। 

ফাউস্ট : চলো। 

চতুর্বিংশতি দৃশ্য 

রাত্রি

মুক্ত প্রান্তর

(কালো ঘোড়র উপর চেপে ফাউস্ট ও মেফিস্টোফেলিস যাচ্ছিল)

ফাউস্ট : ঐ পাথরের চারদিকে বসে কি ওরা বুনছে?

মেফিস্টোফেলিস : আমি জানি না ওরা কি করছে?

ফাউস্ট : কখনও উপরে উঠছে, কখনও নিচে নামছে, কখনও মাথা নত করছে।

মেফিস্টোফেলিস : ডাইনিদের রাজ্য। চলো, চলো। 

পঞ্চবিংশতি দৃশ্য 

কারাগার

(এক হাতে বাতি আর এক হাতে একগোছা চাবি নিয়ে লৌহকপাটের বাইরে) 

ফাউস্ট : এক অভূতপূর্ব কম্পন জাগছে আমার মধ্যে। সমগ্র মানবজাতির পূঞ্জীভূত দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়ছি আমি। সে এখন অন্ধকার সঁতসেঁতে রুদ্ধদ্বার কারাকক্ষে বাস করে। অথচ সে এক মিথ্যা অপরাধে অভিযুক্ত। আমি কি তাকে মুক্ত করতে বিলম্ব করছি? আমি কি তার সঙ্গে দেখা করতে ভয় পাচ্ছি? চলো এগিয়ে চলো। এভাবে দেরি করলে মৃত্যুবরণ করতে হবে আমার। (তালা ধরে খুলতে গেল। ভিতরে গানের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।) 

গান

আমার মা এক বারবণিতা; সেই আমার
মৃত্যু ঘটিয়েছে। আমার পিতা ছিল এক ভৃত্য; 
সে আমার মাথাটা খেয়েছে।
কিন্তু আমার ছোট্ট বোনটা ছিল খুব ভালো।
সে আমার অস্থিগুলোকে এক বনের শ্যাওলাধরা
ভিজে মাটির মধ্যে কবর দেয়।
তখন আমি ছিলাম ছোট একটা পাখি। 
হে পাখি উড়ে যাও। উড়ে যাও।

ফাউস্ট : (তালা খুলে) সে এখনও বুঝতে পারছে না তার প্রেমিক কত আছে। সে হাতের শৃঙ্খলের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। (ঘরে ঢুকল)। 

মার্গারেট (বিছানার চাদরে মুখ লুকিয়ে) : ধিক ধিক! আবার তারা আসছে। এর থেকে মৃত্যু ভালো। 

ফাউস্ট : (চুপি চুপি) চুপ, চুপ। তোমার মুক্তির সময় উপস্থিত।

মার্গারেট : (ফাউস্টের সামনে পড়ে গেল) তুমি যে আমার দুঃখে করুণা দেখাচ্ছ, তুমি কি মানুষ? 

ফাউস্ট : তোমার চিৎকারে রক্ষীরা জেগে উঠবে। তারা তোমার ধরে ফেলবে। (তার পায়ের বেড়ি খুলে দিল)। 

মার্গারেট : (নতজানু হয়ে) আমার উপর এতদূর অধিকার ফলাতে কে তোমায় দিয়েছে? এই নিশীথ রাতে তুমি এসেছ আমার কাছে। আমার উপর দয়া করো, আমাকে বাঁচতে দাও। একটু পরেই সকাল হবে। (উঠে) আমি কি এখনও তেমনি যুবতী আছি? তবু মৃত্যু আমার কাছে আসছে কেন? আমিও একদিন সুন্দরী ছিলাম। আর সেই সৌন্দর্যই হয়ে ওঠে আমার ধ্বংসের কারণ। একদিন আমার প্রণয়ী আমার ছিল, কিন্তু আজ সে দূরে। আমার মিলনের মালা আজ ছিঁড়ে গেছে, ছড়িয়ে গেছে সে মালার ফুল। এত জোরে আমাকে ধরো না। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি তোমার কাছে কি করেছি? আমার অনুরোধ যেন বৃথা না হয়। আমি জীবনে তোমার কখনও দেখিনি। 

ফাউস্ট : এ দুঃখ জীবনে আমি সহ্য করতে পারব? 

মার্গারেট : এখন আমি সম্পূর্ণ তোমার কবলে। কিন্তু প্রথমে আবার বাচ্চাটাকে একটু দুধ খাইয়ে নিতে দাও। আমি সারারাত বাচ্চাটাকে আদর করেছি। কিন্তু ওরা তাকে জোর করে নিয়ে গেছে। অথচ বলছে আমি তাকে হত্যা করেছি। জীবনে আর কোনওদিন সুখী হতে পারব না আমি। ওরা আমাকে নিয়ে গান গায়। 

ফাউস্ট : (নতজানু হয়ে) তোমার প্রণয়ী আজ তোমার পদতলে। সে তোমার দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করতে চায়। 

মার্গারেট : (পাশে পড়ে গিয়ে) এস, আমরা নতজানু হয়ে সাধুদের কাছে প্রার্থনা করি তারা যেন আমাদের লুকিয়ে রাখে। লুকিয়ে রাখে কোনও তক্তার তলায়। বজ্রাঘাতে সমগ্র নরক কাঁপছে। শয়তানরা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে। 

ফাউস্ট : (উচ্চৈঃস্বরে) মার্গারেট, মার্গারেট। 

মার্গারেট : (মনোযোগ সহকারে শুনে) এ কণ্ঠস্বর আমার প্রেমিকের না। (হঠাৎ লাফিয়ে উঠে) কোথায় সে? সে আমার নাম ধরে ডাকছিল। আমি শুনতে পেয়েছি। আমি এখন মুক্ত, কেউ আমাকে আর বাঁধতে পারবে না। আমি আমার প্রণয়ীর কাছে চলে যাব। তার বুকের উপর শোবো। সে একটু আগে আমার নাম ধরে ডাকছিল। নরকের গোলমালের মাঝে নানারূপ নারকীয় তর্জন গর্জনের মাঝে আমি তার মধুর কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। 

ফাউস্ট : এই সেই আমি। 

মার্গারেট : সেই তুমি! আবার বলো (জড়িয়ে ধরে) আমার সেই ভালোবাসার মানুষ। কোথায় আমার যন্ত্রণা? কোথায় কারাগার আর শৃংখলজনিত মনোবেদনা? তুমি! তুমি এসেছ আমাকে উদ্ধার করতে। এখন আমি মুক্ত। আবার আমি দেখতে পারি সেই রাজপথ যেখানে প্রথম দেখি তোমায়। দেখব সেই ফুল্লকুসুমিত উদ্যান যেখানে একদিন আমি মার্থার সঙ্গে তোমার প্রতীক্ষা করতাম। 

ফাউস্ট : (যাবার জন্য উদ্যত হয়ে) এস, এস আমার সঙ্গে।

মার্গারেট : একটু থামো। তোমার সঙ্গে কিছুটা সময় থাকতে চাই। 

(চুম্বন করে)

ফাউস্ট : এখনি পালিয়ে চলো। দেরি করলে পরে আমাদের দুঃখ ভোগ করতে হবে। 

মার্গারেট : আমাকে চুম্বন করো। তাও কি করতে পার না? তুমি কি আগের মতো চুম্বন করতে ভুলে গেছ? আজ তোমার বুকে এত সংশয় জাগছে কেন? একদিন তোমার চোখের দৃষ্টির মধ্যে স্বর্গ খুঁজে পেতাম আমি। তোমার কথার মধ্যেও স্বর্গলাভ করতাম। একদিন তুমি এমন নিবিড়ভাবে চুম্বন করতে যাতে আমার মনে হতো আমি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাব। আমাকে চুম্বন করো। (আলিঙ্গন করল) হায়, তোমার ঠোঁট দুটো এত ঠাণ্ডা কেন? কেমন যেন প্রাণহীন। তোমার প্রেমাবেগের মধ্যে আর সেই নিবিড়তা নেই। কে আমার এই ক্ষতি করেছে? (নিজেকে সরিয়ে নিল) 

ফাউস্ট : এস আমার সঙ্গে। প্রিয়তমা, সাহস অবলম্বন করো। পরে আমি হাজার গুণ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরব। কিন্তু এখন আমার পিছু পিছু চলে এস। 

মার্গারেট : সেই তুমি ঠিক বটে তো?

ফাউস্ট : সেই আমি, চলে এস। 

মার্গারেট : তুমি আমার শৃংখল খুলে দেবে। তুমি আমার আবার স্থান দেবে তোমার কোলে। তুমি আমার দেখে ঘৃণা করছ না কেন? তুমি জান তো কাকে মুক্ত করছ? 

ফাউস্ট : চলে এস, রাত্রি শেষ হয়ে গেছে। 

মার্গারেট : আমি আমার মাকে হত্যা করেছি। তোমার ঔরসজাত সন্তানকে আমি জলে ডুবিয়ে মেরেছি। তোমার হাতটা দাও। স্বপ্ন দেখছি না তো? কিন্তু এ হাত ভিজে কেন? চোখের জল মুছে ফেলো। কিন্তু এ হাতে রক্ত কেন? হা ভগবান! কি করছ তুমি? তরবারিটা খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখো। আমাকে ভয় দেখিও না। 

ফাউস্ট : অতীতকে ভুলে যাও। তোমার কথায় মরতে ইচ্ছা করছে আমার। 

মার্গারেট : না না, তুমি আমাদের থেকে বাঁচবে। তুমিই আমাদের সকলকে কবর দেবে। সবচেয়ে ভালো করে আমার মাকে শায়িত করবে। তার পরেরটাতে আমার ভাইকে। তার থেকে একটু দূরে আমাকে কবর দেবে। আমার ডান দিকে থাকবে আমার শিশুসন্তান, আর কেউ না। তোমার বাহুলগ্ন হয়ে থাকাটা আমার কাছে স্বর্গসুখ। কিন্তু সে সুখ সম্ভব নয়। তোমার গলগ্রহ হয়ে থাকতে হবে তাহলে আমাকে। তুমি আমার চুম্বন এখন আর চাও না। অথচ তুমি কত ভালো, কত দয়ালু। 

ফাউস্ট : তুমি যদি আমাকে চিনতে পেরে থাকো, তাহলে আমার সঙ্গে এস।

মার্গারেট : বাইরে?

ফাউস্ট : স্বাধীনতার রাজ্যে। 

মার্গারেট : যেতে পারি যদি সেখান থেকে উন্মুক্ত সমাধি, যদি মৃত্যু আমার জন্য প্রতীক্ষা করছে সেখানে, যদি সেখানে পাই অনন্ত শান্তি। আর কোথাও যেতে চাই না আমি। তুমি চলে যাও হেনরি! আমি কি করে যাব? 

ফাউস্ট : তুমি পারবে। দ্বার উন্মুক্ত।

মার্গারেট : যেতে আমার সাহস হচ্ছে না। আমার আর কোনও আশা নেই। কি হবে পালিয়ে গিয়ে? ভিক্ষা করতে বাধ্য হব। আহত বিবেক আমার দুঃখ বাড়িয়ে দেবে। আমি পরিত্যক্ত অবস্থায় কিভাবে থাকব? আমাকে আবার ওরা ধরে ফেলবে। 

ফাউস্ট : আমি তোমার সঙ্গে থাকব। 

মার্গারেট : তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো। তোমার ডুবন্ত ছেলেটাকে বাঁচাও। বনের মাঝে নদীর উপর সাঁকোর তলায় বাঁ দিকে এখনও শিশুটা ওঠার জন্য আঁকপাক করছে, চেষ্টা করছে। তাকে ধরো। 

ফাউস্ট : আর এক পা গেলেই মুক্তি। তারপর যত খুশি পুরনো কথা স্মরণ করো। 

মার্গারেট : সেই পাহাড়টা কি আমরা পার হয়ে গেছি, যে পাহাড়টার একটা পাথরের উপর আমার মা বসে আছে। আর মাথা নাড়াচ্ছে। অনেক দিন ধরে আমার মা ঘুমোচ্ছে, কিন্তু জাগছে না। 

ফাউস্ট : আর এক পা গেলেই মুক্তি। তারপর যত খুশি পুরনো কথা স্মরণ করে নিয়ে যাব। 

মার্গারেট : না না, আমাকে ছেড়ে দাও। জোর করো না। তোমার প্রেমের খাতিরে জন্য যে কোনও কাজ করতে পারি। 

ফাউস্ট : সকাল হয়ে গেছে প্রিয়তমা। 

মার্গারেট : সকাল? হ্যাঁ, আমার জীবনের শেষ দিন। অথচ আজ আমার বিবাহের দিন হওয়া উচিত ছিল। কাউকে যেন বলল না তুমি মার্গারেটকে ভালোবেসেছি। আবার আমাদের অবশ্যই দেখা হবে। তবে নাচের আসরে নয়। মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। সমাধিভূমির মতো মৃত্যুর স্তব্ধতা বিরাজ পৃথিবীতে। 

ফাউস্ট : হায়, আমার যদি জন্ম না হতো।

মেফিস্টোফেলিস : (বাইরে থেকে) তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এস। না হলে সকাল হবার আগেই ধরা পড়বে। শুধু বাজে কথা বলে দেরি করছ। এদিকে আমার ঘোড়াগুলো চিৎকার করছে। ভোর হয়ে গেছে। 

মার্গারেট : কে ওখানে? এই পবিত্র স্থানে কি সে চায়? সে আমাকে চায়।

ফাউস্ট : তুমি বাঁচবে।

মার্গারেট : হে ঈশ্বর! আমি তোমার বিচারের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। 

মেফিস্টোফেলিস : চলে এস। তা না হলে তোমাদের দুজনকেই ফেলে রেখে চলে যাব। 

মার্গারেট : হে পিতা, আমি তোমার। আমাকে উদ্ধার করো। হে দেবদূতগণ, আমাকে রক্ষা করো। হেনরি, তোমার কথা মনে করতে বয়ে কাঁপুনি আসছে আমার। 

মেফিস্টোফেলিস : ওর বিচার হয়ে গেছে। অজানা

কণ্ঠস্বর : (উপর থেকে) ও উদ্ধারলাভ করেছে।

মেফিস্টোফেলিস : (ফাউস্টকে) আমার কাছে এস।

(দুজনে অদৃশ্য হয়ে গেল)।

কণ্ঠস্বর : (ভিতর থেকে) হেনরি! হেনরি! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *