ফাঁকি
।। সোমেশ্বর ।।
ফোনটা আমার সাথেই থাকে। তবু বউ যখন কাছে থাকে তখন ওটা একটু আড়াল রাখি। যখন তখন শাওনি ফোন করে ফেলে বলে ফোনটা একটু লুকিয়ে রাখাই ভাল। শাওনির নম্বরটা আমার মোবাইলে দীপক নামে সেভ করা আছে। দীপক আমার ছোটবেলার বন্ধু। মাঝে মাঝে আমার ফোনটা আমার বউ নিয়ে ঘাটাঘাটি করে। আমায় সন্দেহ করে নাকি জানি না। বলে সুডোকু খেলে। সুডোকু খেলার মধ্যে অত মজার কি আছে জানি না। আমি দুএকবার খেলে দেখেছি, বড় বাজে খেলা। অত নম্বর মাথায় ঢোকে না আমার। কোনাকুনি পাশাপাশি উপর নীচ। এর থেকে শাওনিকে কল্পনা করা সহজ। আসলে শাওনি একটা প্যাকেজ হিসেবে দুর্দান্ত। যাকে বইয়ের ভাষায় বলা চলে ‘উত্তম বাঁধাই, চমৎকার প্রচ্ছদ, তারসাথে প্রত্যেকটা পাতা একেবারে দামী কাগজে ছাপা’।
তার তুলনায় আমার বউ তিতির একদম পুরনো নিউজপ্রিন্টে ছাপা বাতের বিজ্ঞাপনের কাগজ। যাও বা ঠিক ছিল, মেয়ে হবার পর আরও মুটিয়ে গিয়ে আমার জীবনটাকে পাতিলেবু করে দিয়েছে। যখনই ইচ্ছা করে কোনদিন বলে আজ মাথা ব্যথা করছে, কোনদিন ওর কোমরে দারুণ যন্ত্রণা। ভাগ্যিস শাওনি ছিল। মাঝে মাঝেই অফিসে কাজের নাম করে শাওনিকে নিয়ে চলে যাই ভাল একটা হোটেলে। একটা রুমে জমিয়ে খাওয়া দাওয়া আর বাকি কাজ কম্মো হয়। আজকাল শাওনি প্রোমোশান নিয়ে বড্ড জ্বালাতন করে। কি করে যে ওকে বোঝাই ওরে অফিসে বসের সাথে হপ্তায় দুবার শুলে প্রোমোশান হয় না। তা কে শোনে কার কথা। আগের দিন এই নিয়ে ভাল ঝামেলাও হয়ে গেছে। দিব্যি চিকেন তন্দুরি আর দুটো লার্জ হুইস্কি অর্ডার দিয়ে অ্যাটেম্পট নিচ্ছি শাওনির কোমরটার, দুম করে বলে বসল, ‘শর্বাণী কেন এই মাসে একটা ইনক্রিমেন্ট বেশি পেল?’ কি আর বলব সেদিনটা বড্ড খারাপ গেল। শেষ মেষ প্রতিশ্রুতি দিতে হল হেড অফিসে ওর জন্য একটা স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট দাবী করব ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসলে অফিস এলে আবার শাওনির ব্যাপারটা ঠিক মনে থাকে না। একে কাজের মারাত্মক চাপ থাকে তার ওপর শাওনির কাজ কর্ম অনেকেই পছন্দ করে না। ওর আসা যাওয়ার কোন ঠিকও নেই। এখনই ওকে আলাদা সুবিধা দিলে সমস্যা ভালই দেখা দেবে। তাই আপাতত ডিফেন্সিভ খেলছি। সুযোগ বুঝে শাওনির ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা করা যাবে।
বাড়িতে আমার বিয়ের ফটো এখনও বসার ঘরে জ্বলজ্বল করে। কি ছিল তিতির আর কি হল। আমার বসার ঘরে বন্ধু বান্ধবের ভিড় লেগে থাকত। সূর্য তো রীতিমত চাপ নিয়ে বসে থাকত। আমি সবই বুঝতাম। বেশ উপভোগ্য ছিল সেসব দিন।
আর এখন সোনা হবার পর তিতিরের চেহারা দেখলে কান্না পায়। এই মুটকি হোঁৎকা টাইপ। ভানুর কথা মনে পড়ে, ‘একলগে রিক্সায় চাপতে গেলে রিকশাআলা পর্যন্ত কয়, বাবু, আপনি মাঈজীর কোলে বসেন’।
সেক্সের ব্যাপারে আমি আজন্ম ভিখারি। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় টিউশনি পড়াতে আসত সুলগ্না ম্যাডাম। ঢেউ খেলানো চেহারা, তার সাথে সমুদ্রের মত গভীর চোখ। পড়তে গিয়ে প্রায়ই ম্যাডামের গুরুত্বপূর্ণ বস্তু সমূহের প্রতি নজর চলে যেত। ম্যাডাম বুঝত সবই। একদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। পড়াতে বসে হঠাৎ বলে, ‘এই তুই কি চাস রে? রোজ রোজ আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকিস কেন?’ আমি ভাবি নি এরকম প্রশ্ন শুনতে পাব। বলে ফেললাম ‘ভাল লাগে বলে’।
ম্যাডাম কিছুক্ষণ তাকিয়ে নরম গলায় বলেছিল, ‘বড় হোস এরকম অনেক ভাল লাগা পাবি’।
সেদিন আর বেশি পড়া হয় নি। ম্যাডাম তারপর দিন থেকে আর আসতও না।
ওই ম্যাডাম, একটা পাড়ার দিদি, মাসতুতো বোন ইত্যাদিকে নিয়ে ভাবনায় প্রচুর সময় কাটিয়েছি। কিন্তু সমস্যাটা হল বিয়ের আগে অবধি দুর্ভাগ্যবশত আমি একজন পবিত্র ভার্জিন ছিলাম। সম্বন্ধ করে বিয়ে হবার পর ফুলসজ্জায় তিতিরকে দেখে মনে হয়েছিল এই আস্ত একটা মেয়েমানুষ গোটাটাই আমার। কী সব দিন ছিল।
আর বিয়ের চার বছর পর যে তিতির এরকম একটা আগ মার্কা পানসে তেতুল বেরোবে কে জানত। সোনা হবার আগে থেকেই অবশ্য শাওনিকে ফিট করি। এখন ব্যাপারটা বেশ থার্ড গিয়ারে চলছে। চলছেই যখন চলুক জমিয়ে।
শাওনির দরকার প্রোমোশান, ইনক্রিমেন্ট আর আমার দরকার শাওনির নরম শরীর। দরকারটা এভাবেই মিটুক না! ক্ষতি কি!
।।শাওনি।।
একটা লম্বা ছুটি নিতে হবে। সোমকে বলাটাই চাপ লাগে। ব্যাটা সেক্স স্টারভড গাম্বাট। নিজের বউ প্লেজার দিতে পারে না বলে আমাকে ইউজ করে। আর আমাকে কি ভাবে কে জানে। কিছুই বুঝিনা না কী! অ্যাকাউন্টসের শর্বাণীদি আগের মাসে একটা স্পেশাল ইনক্রিমেন্ট পেল। তাপসী দাস একটা প্রোমোশান পেল। আর তার তুলনায় তোর সাথে শুয়ে আমি কি পেলাম? কাঠপেন্সিল!
পিয়াল অনেকদিন ধরেই বলছিল ওর অফিসে ছুটি আছে। মার্চ নাগাদ কাশ্মীর যাবে। আমিও যেতে চাইছি ওর সাথে। সোমের সাথে সারাজীবন শুলে তো আমার চলবে না, আমারও লাইফ আছে। হু দ্য হেল ইজ সোম যে ও সেটাকে স্পয়েল করবে! দু বছরের মধ্যে বিয়ে করছি। যদি তখন দেখি ওর সাথে শুয়ে আমার লাভ হচ্ছে দেন ওকে। নইলে আই হ্যাভ টু থিঙ্ক টোয়াইস।
পিয়ালের সাথে সম্পর্কটা রাখতেই হবে।পিয়ালের ব্রাইট কেরিয়ার। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় পোস্ট। আর তিন চার বছরের মধ্যে ও স্টেটসে শিফট করবে।আঠার মত লেগে থাকতে হবে তাই ওর সাথে। মাঝে মাঝেই বিয়ের জন্য ঘ্যান ঘ্যান করে যখন আমিও একটু আধটু কোমল নি, শুদ্ধ পা ইত্যাদি ওর হারমোনিয়ামে বাজিয়ে দেখে নি ব্যাটা ঠিক বলছে নাকি। এখন অবধি তো ঠিকই বাজছে। কেলো অবশ্য হয়েছিল একবার। কিড স্ট্রিটের এক হোটেলে একরাতে আটটা নাগাদ আমি আর সোম বেরিয়ে সোমের গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি পিয়াল একটা বাস থেকে আমায় দেখতে দেখতে যাচ্ছে। তার আগে ওকে ফোনে বলেছিলাম অফিসে একটা মিটিং আছে। আমায় দেখে তখনই মোবাইলে ফোন।
একটা ইম্পরট্যান্ট সেমিনারে এসছিলাম এইসব বলে ছাড় পেলেও বেশ কটা দিন সন্দেহের চোখে দেখত। আলগা টাইমে ফোন করত। আমি তখন কয়েকটা দিন সোমের সাথে বেরোতাম না। একটু অ্যাভয়েড করতাম সোমকে। কারণ সোম আমার ফাটকা বাজির শেয়ার মার্কেট হলে পিয়াল হল গোটা জীবনের মোটা অঙ্কের ফিক্সড ডিপোসিট। ওকে হাতছাড়া করলে বেশ কিছুদিন লেগে যাবে আরও কাউকে যোগার করতে।
সম্পূর্ণা, জিনিয়ারা প্রায়ই আমার সাথে সোমের মাখোমাখো ভাব নিয়ে অনেক কিছু বোঝাতে চায়। আমি অতটা গায়ে মাখি না। সোমের বস নায়ার যখন কলকাতায় এসছিল তখন দুরাত হোটেলের ঘরে কারা যেত সে সব আমার ভালই জানা আছে। সোম আমায় আড়াল করেছিল বলে যেতে হয় নি। বেশি বলতে এলে ফোঁস করে দি। তখন আবার কিছু দিন চুপ থাকে। আমার তো ভাবতেই ঘেন্না লাগে। মাগো। ওই বুড়োটার সাথে কি করে এক বিছানায় ছ্যা ছ্যা! সোম সেদিক থেকে অনেক ভাল। ইভন পিয়ালের থেকেও। শুনেছি ওর মুটকি বউ নাকি ওর সাথে শুতে চায় না। মদের ঘোরে আমার বুকের উপর পড়ে অনেক সময়েই একটু একটু করে কাঁদে আর ওসব উগড়ে দেয়। আমার ওই সময়টা তাড়া থাকে বাড়ি ফেরার। কোনমতে তুলে মুখে জল টল দিয়ে রেডি করতে করতে বেরিয়ে পড়তে হয়। ওই অবস্থাতেই সোম চেঁচিয়ে যায়, ‘হেল হেল, ওয়াট আ হেল ইজ মাহ লাইফ! ও তিতির, দেখো, শাওনিকে পেয়েছি আমি। আমার ডেস্টিনেশান শাওনি।‘ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সময়টা রোজ বড় অস্বস্তি লাগে আমার। কেন জানি না।
।। তিতির ।।
সোনার দুবছর হবে আসছে ফেব্রুয়ারিতে। আমাদের বিয়ের দুবছরের মাথায় সোনা আসে। আমি যখন কনসিভ করি, খবরটা প্রথম কাকে জানাব ভাবতে হয়েছিল। কে জানলে বেশি খুশি হবে? সোম না সুকুমার?
সুকুমার জানলে খুশি হত কি? বাপের বাড়ি গেলে সুকুমারের ঘরে না গেলে আমার শান্তি হত না। মনে আছে সোম অফিস যাবার পথে আমায় নামিয়ে দিয়ে যেতেই এক অদ্ভুত আকর্ষণে আমার পা দুটো যেন চলে যেত সুকুমারের বাড়ি। ওদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই আমার অবাধ যাতায়াত। তেতলার ছাদে ছোটবেলা থেকেই কত রোদ পুহিয়েছি, এক্কা দোক্কা খেলেছি বাসবীদির সাথে। আমার আর বাসবীদির বিয়ে এক মাসের ব্যবধানে হল। সুকুমার তখন বেকার। আমি দুর্বল গলায় একবার ওকে বলেছিলাম চ’ আমরা পালিয়ে যাই।
আমরা দুজনেই জানতাম সে সব সম্ভব না। বিয়ের পর সুকুমার তাকাত অবাক চোখে। আমার মাথায় সিঁদুর। হাতে শাখা পলা। সোম এক সফল চাকুরে। হাতে দামী ঘড়ি। শশুর বাড়ি এসেও ল্যাপটপ খুলে বসছে। জামাই দেখতে এসে সুকুমাররা দেখত জামাই শশুরবাড়ি বসে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করে চলেছে। সুকুমারের হতাশ চাউনি আমাকেও বিঁধত।
আপাদমস্তক শহুরে সফল প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে সুকুমার বেশ কিছুদিন মিইয়ে থাকত। আমি আসলে থাকত না বাড়ি। কোথায় কোথায় চলে যেত। আমি ওর ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে আসতাম চুপি চুপি। ওর ঘরে ছেলেবেলার একটা খেলনা স্টেনগান এখনও ঝোলানো। আমায় দেখে যেটা নিয়ে তাড়া করত। ব্যাডমিন্টন র্যাকেট পেরেক থেকে ঝুলছে। পরম মমতায় আমি বিছানা বালিশ পরিষ্কার করে যেতাম। দু বছর আগে এক দোলের বিকেলেও এসছিলাম।
বাড়ি নেই শুনে চলে আসছিলাম। কি মনে হল, মশারিটা তখনও ঝুলছে দেখে থাকতে পারলাম না। দ্রুত সেটাকে গোছাতে যেতেই সুকুমারের প্রবেশ। সেদিন যে কি কি হয়েছিল আমার আর মনে নেই। এটুকু মনে আছে খালি আমার ঠোঁটে চুমু খেতে খেতে বার বার বলেছিল রুমকি তুই আমার। তুই আর কারও হতে পারিস না।
সেদিনের পর বিহ্বল হয়ে গেছিলাম। ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ পর্যন্ত খাওয়া ভুলে গেছিলাম। টের পেলাম দুদিন পরে।
তারপর থেকে সোমকে আমি আর নিতে পারতাম না শরীরে। কাকে জানাতাম তখন? ঠিক করতে পারিনি।
এক আধদিন রাত্রিবেলা সোম মদে চুর হয়ে এলে আমায় জড়িয়ে ধরে যখন বলে “শাওনি তোমায় ছাড়া আমি বাঁচব না, তুমি তিতির হয়ে যেও না প্লিজ’’, সেদিন অপরাধবোধগুলি কিছুটা কমে হয়ত। কমে ওই পর্যন্তই।
কতটা কমে জানা নেই…