প্ৰবাহিণী – আশা

প্ৰবাহিণী
আশা

কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্!–দুঃখ দারিদ্র্যের, হতাশা ও নৈরাশ্যের উপলখণ্ডময় আমার বন্ধুর জীবন-পথের উপর দিয়া চল প্ৰবাহিণী-তরল তরঙ্গে স্ফটিকস্বচ্ছ জলকণা বিকিরণ করিয়া, চল প্রবাহিণী–তোমার স্পর্শে, এ দগ্ধ জীবনের মরু-মারুত আশা-স্নেহের শীকর-সম্পউক্ত হউক! তোমার কোটিতরঙ্গ-কল্লোল-কোলাহলে জীবনের নীরব বেদনাসকল, মুখর হউক! চল প্রবাহিণী,–পৰ্ব্বত ভেদ করিয়া, স্থবিরকায় তুষাররাশিকে বিগলিত করিয়া, নৈরাশ্যের বালুক-বিস্তারকে স্নেহ-সেচনে কোমল ও সরস করিয়া, চল প্রবাহিণী,—আগে চল।

কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্! কোটি বীচি-বল্লরীর ঘাত-প্ৰতিঘাতে আশার রজতনিক্কণ শুনিতে শুনিতে আমার জীর্ণ দেহ তোমার তরঙ্গে ভাসিয়া চলুক। প্রবাহিণী, ভাসিয়া চল!—আগে চল! ঐ দেখ,–ঐ দূরে মহাশ্মশান-কোটি চিতার চটপটারবে নিত্য শব্দময় ঐ শ্মশানে রাবণের চিতা জ্বলিতেছে। কোটি কল্পের গৌরব-স্মৃতি, দশস্কন্ধ রাবণরূপে ঐখানে অহরহঃ জ্বলিতেছে! ঐখানেই সীতার অগ্নিপরীক্ষা হইয়াছিল,—লঙ্কার ঐ মহাশ্মশানেই ধরা-কন্যা নিষ্কলঙ্কা হইয়াছিলেন;-সনাতন কালের, সনাতনী কথার চন্দন-চুল্পী ঐখানেই জ্বলিতেছে! চল প্রবাহিণী, —ঐ ভীম। ভৈরব শ্মশানের তিন দিক বেড়িয়া আমরা উভয়ে ভাসিয়া যাই। চল, চল, আগে চল!

‘যমুনে! এই কি তুমি সেই যমুনা প্রবাহিণী–
যার বিমল তটে রূপের হাটে বিকাত নীলকান্ত মণি।’

কাল ও কালিন্দী–ভাই ও ভগ্নী। যম যমুনার সহোদর–কাল ভাবস্রোতে বিশ্বগতির ভিতর দিয়া ছুটিয়াছেন;–কালিন্দী রসের তরঙ্গে প্রেমের ব্ৰজমণ্ডল দ্বিখণ্ডিত করিয়া অনন্ত রস-সাগরের দিকে ছুটিয়াছেন। চল প্রবাহিণী-সেই রকম কুলু কুলু ধ্বনি করিয়া চল! যে ধ্বনি গোপীদিগের নূপুর-শিল্পনের প্রতিধ্বনি বলিয়া এখনও রসিকে মনে করেন! যমুনার সেই রস-তরঙ্গভঙ্গের অভিব্যঞ্জনা করিয়া গুপ্ত বৃন্দাবনের শ্যাম-শোভা দেখিতে দেখিতে, চল প্ৰবাহিণী—সেই সনাতন যামুন খাত বাহিয়া চল;–সেথায় রূপের হাট দেখিবে! তোমার গর্ভসঞ্চিত কোটি নীল জলকণাকে নয়নীরূপে পরিণত করিয়া,–চল প্ৰবাহিণী, রূপের হাট বাহিয়া আমরা চলিয়া যাই! তোমার চঞ্চল গতিতে আবার যমুনা উজান বহিবে। সেই নীলকান্ত মণির তনু-কান্তি-প্ৰতিচ্ছায়ায় তোমার অঙ্গ নীল বরণ ধারণ করবে। চল—চল—আগে চল!

কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্‌, কুল্‌ কুল্! আর বিলম্ব সহে না! জীবনের পাড়ি প্রায় শেষ করিয়াছি। সন্ধ্যার ঘন তমিস্রা ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, অজ্ঞাতসারে চারি দিকে আসিয়া যবনিকার মত ঝুলিয়া পড়িতেছে! সন্ধ্যার মঙ্গল-তারা ঐ দূরে চক্রবালের উপর, কাৰ্ত্তিকের নদী-প্রদীপের মত টিপি টিপি ফুটিয়া উঠিতেছে। অস্তমিত সূৰ্য্যের সপ্ত দীপ্তি ক্ৰমে অন্ধকারের ক্ৰোড়ে লুকাইল। এইবার গৃহস্থের সান্ধা মঙ্গলশঙ্খ বাজিয়া উঠিবে। আর বিলম্ব সহে না। চল প্রবাহিণী—আগে চল! এখনও যতটুকু সময় বাকী আছে, সেই সময়টুকুর মধ্যে তোমার কৃপায় যত দূর পারি, আগাইয়া যাই! জানি বটে, অনন্ত সাগরের অসীমতায় ডুবিবার অবসর হইবে। না।;-জানি বটে, ‘এবার বা আসা হয় বিফল।’ এবারকার যাত্রা, শুভ যাত্রা নহে। এ দুৰ্গম পথ হাটিয়া শেষ করিতে পারিব না। অনন্তের দেখা পাইব না। তবুও আশা ত ছাড়িতে ‘পারি না! তবুও মনে হয়, প্রদোষের এই মুহূৰ্ত্তকালের মধ্যে তোমার কুপাস্রোতের—করুণার তরল তরঙ্গের উপর গা ভাসাইয়া যাইতে পারিলে, হয়ত বা অনেকটা পথ আগাইয়া যাইব! সাগর-সঙ্গমে পৌঁছিতে না পারি। —মুক্ত-বেণীর মোহনাও ত দেখিতে পাইব! চল প্রবাহিণী–আগে চল। আর যে বিলম্ব সহে না।

মনে পড়ে কত কথা! একে একে স্মৃতির সরোবরবক্ষে কত ব্যথা বুদ্ধদের আকারে ফুটিয়া উঠিতেছে,–নৈরাশ্যের পবন-তাড়নে আবার তাহারা ফাটিয়া গালিয়া কোথায় বিলীন হইয়া যাইতেছে! এই নৈরাশ্যজাডো তুমি আশার গতি! তুমি চলিয়াছ বলিয়া আমিও চলিতে পারিব। তোমার গতি আছে বলিয়া আমার স্থিতির বিসৰ্পণ সম্ভবপর হইবে। আমার অতীতের কালরাত্ৰি অনাগতের উষার দু্যতিতে প্ৰফুল্ল হইয়া উঠিবো! চল, চল প্ৰবাহিণী! স্নেহময়ী-কোটি-আশাবলয়িত তরঙ্গিণী-চল! ভাবের জলরাশি শত উচ্ছাসে উচ্ছাসিত করিয়া তুমি আগে চল! আমার নিথর নিষ্কম্প নৈরাশ্য-সরোবরে গতির শত-তরঙ্গপ্ৰফুল্লিত আশা-মেখলা পরিস্ফুট হইয়া উঠক! চল, চল—আগে চল।

এই সাধ–এই বাসনা—এই আকাঙ্ক্ষা।

“আমি রূপ-সাগরে, পালের ভরে ভেসে যাব।
তরঙ্গ-তুফানে পড়ে ডুবিয়া মরিব।”

ডুবিয়া মরিব,–ভাসিব না! অতল তলে একেবারে মিশিয়া যাইব। আমার আছে নাম,–আর আছে রূপ! সে নাম স্মৃতির চিন্তা-চুল্লীতে অহরহঃ পুড়িতেছে! সে রূপ চিন্তা-অঙ্গের কোটি অগ্নি-জিহবার বেষ্টনে লোল তরঙ্গে ফুটিয়া উঠিতেছে! থাকিবে না কিছু। সব পুড়িয়া ভস্ম হইবে। সে ভস্ম শ্মশান-বায়ুবিতাড়নে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িলে আমি মরমে মরিব। কিন্তু সে ভস্ম, সে বিভূতি আনন্তের নীল অঙ্গে মিশাইয়া দিতে পারিলে কোটি জন্মের তপস্যা সিদ্ধ হইবে। চল চল প্রবাহিণী-ফেব্রুপালের হা-হা রবকে স্তব্ধ করিয়া, শুষ্ক বায়ুর স্বনানকে নিঃশব্দ করিয়া তোমার রসের তরল তরঙ্গের কোটিকণ্ঠে উল্লাস-গীতি গায়িতে গায়িতে—চল প্রবাহিণী-রূপ-সাগরের দিকে অগ্রসর হও! তোমার প্রত্যেক তরঙ্গাভিঘাতে নামের প্রতিধ্বনি জগন্ময় হইয়৷ উঠক! তোমার স্বচ্ছ সলিল বিস্তারে রূপের অমল ধবল সুন্দর রেখা-উদ্ধে ও নিয়ে যুগল ইন্দ্ৰধনুর ন্যায় ফুটিয়া উঠক! আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হউক! মিটবে না কি ? এ সাধ—এ বাসনা মিটবে না কি ? আশা মিটে না,–আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় না। গগনোেপাস্তরেখার মত-যত ধরিতে যাইবে, ততই ছুটিয়া পালাইবে ; কিন্তু চেষ্টায় যে সুখ আছে-ছুটাছুটিতে যে উন্মাদনা আছে—ধরি। ধরি করি ধরিতে নারি, এই প্রয়াসে যে তৃপ্তি আছে, তাহা ত জীবনে আর কিছুতে নাই! তাই বলি, চল প্রবাহিণী, আগে চল। কুল কুল, কুল কুল, কুল কুল,–রজতকিঙ্কিণীর এই নিকণে আমায় আশা-সুখে মুগ্ধ করিয়া চল প্রবাহিণী—আগে চল।

(প্রবাহিণী, ৩ মাঘ ১৩২০)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *