প্রোফেসর শঙ্কু ও ঈজিপ্সীয় আতঙ্ক
পোর্ট সেইডের ইম্পিরিয়াল হোটেলের ৫ নং ঘরে বসে আমার ডায়রি লিখছি। এখন রাত সাড়ে এগারোটা। এখানে বোধহয় অনেক রাত অবধি লোকজন জেগে থাকে, রাস্তায় চলা ফেরা করে, হই হল্লা করে। আমার পূর্বদিকের খোলা জানালাটা দিয়ে শহরের গুঞ্জন ভেসে আসছে। দশটা অবধি একটা ভ্যাপসা গরম ছিল। তার পর থেকে একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে সুয়েজ ক্যানালের দিক থেকে।
আমার ইজিপ্টে আসা কতদুর সার্থক হবে জানি না, তবে আজ সারাদিনে যে সব ঘটনা ঘটেছে তাতে কিছুটা আশাপ্রদ বলেই মনে হচ্ছে। অনেকদিন থেকেই এদিকটায় একটা পাড়ি দেবার ইচ্ছে ছিল। আমার তো মনে হয় যে কোনও দেশের যে কোনও বৈজ্ঞানিকেরই ইজিপ্টটা ঘুরে যাওয়া উচিত। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেও এরা বিজ্ঞানে যে আশ্চর্য কৃতিত্ব দেখিয়েছিল, তা ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে। এ নিয়ে অনেক কিছু গবেষণা করার আছে। এদের কেমিস্ট্রি, এদের গণিতবিজ্ঞান, এদের চিকিৎসাশাস্ত্র, সব কিছুই সেই প্রাচীন যুগে এক অবিশ্বাস্য পরিণতি লাভ করেছিল।
সবচেয়ে অবাক লাগে এদের mummy-র ব্যাপারটা। মৃতদেহকে এমন এক আশ্চর্য রাসায়নিক উপায়ে ব্যান্ডেজবদ্ধ অবস্থায় কাঠের কফিনে শুইয়ে রেখে দিত, যে পাঁচ হাজার বছর পরেও সেই ব্যান্ডেজ খুলে দেখা গেছে যে মৃতদেহ পচা তো দূরে থাকুক, তার কোনও রকম বিকারই ঘটেনি। এর রহস্য আজ অবধি কোনও বৈজ্ঞানিক উদঘাটন করতে পারেননি।
ইংল্যান্ডের প্রত্নতাত্ত্বিক ডক্টর জেমস্ সামারটন যে বর্তমান ঈজিপ্টের বুবাসটিস অঞ্চলে এক্সক্যাভেশন চালাচ্ছেন, সে খবর গিরিডিতে থাকতেই পড়েছিলাম। এই প্রত্নতাত্ত্বিক দলটির সঙ্গে আলাপ করে নেওয়ার উদ্দেশ্য প্রথম থেকেই ছিল। সামারটনের লেখা ঈজিপ্ট সম্বন্ধে বইগুলো সবই পড়ে নিয়েছিলাম। তিন বছর সাহারায় এক্সক্যাভেশনের ফলে চতুর্থ ডাইন্যাস্টির রাজা খেরোটেপের সেই আশ্চর্য সমাধিকক্ষ সামারটনই আবিষ্কার করেছিলেন। এই সামারটনের সঙ্গে ঈজিপ্টে পদার্পণ করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যে এমন আশ্চর্যভাবে আলাপ হবে তা কে জানত?
সকালে হোটেলে এসে আমার ঘরের ব্যবস্থা করেই গিয়েছিলাম ম্যানেজারের কাছে, সামারটনের খোঁজ নিতে।
ভদ্রলোক আমার প্রশ্ন শুনে খবরের কাগজ থেকে দৃষ্টি তুলে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘আপনিও কি একই ধান্দায় এসেছেন নাকি?’
বলার ভঙ্গিটা আমার ভাল লাগল না। বললাম, ‘কেন বলুন তো?’
ম্যানেজার বললেন, ‘তাই যদি হয়, তা হলে আপনাকে সাবধান করে দেওয়াটা আমার কর্তব্য বলে মনে করি। নইলে সামারটনের যা দশা হয়েছে, আপনারও ওই জাতীয় একটা কিছু হবে আর কি।’
‘কী হয়েছে সামারটনের?’
‘উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে—আবার কী হবে? মাটি খুঁড়ে প্রাচীন সমাধিমন্দিরে অনধিকার প্রবেশের ফলভোগ করছেন তিনি। অবশ্য বেশি দিন কষ্ট পেতে হবে না বোধ হয়। স্ক্যারাব পোকার কামড় খেয়ে কম মানুষই বাঁচে।’
স্ক্যারাব বিট্ল—এর কথা বই-এ পড়েছি। গুবরে জাতীয় পোকা; পুরাকালে ঈজিপ্সীয়রা দেবতা বলে মান্য করত।
আরও কিছু প্রশ্ন করে জানতে পারলাম গতকাল বুবাসটিস-এ এক্সক্যাভেশনের কাজ করতে করতে সামারটন হঠাৎ নাকি চিৎকার করে পড়ে যান। তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা ছুটে এসে দেখে সামারটন তাঁর ডান পায়ের গুলিটা আঁকড়ে ধরে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে পড়ে আছেন আর বলছেন, ‘দ্যাট বিট্ল! দ্যাট বিট্ল।’
পোকাটিকে নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সামারটনকে তৎক্ষণাৎ পোর্ট সেইডের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর অবস্থা নাকি বেশ সঙ্গিন।
খবরটা পেয়ে আর বিলম্ব না করে হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে নিলাম আমার তৈরি ওষুধ—মিরাকিউরল। দেশে কত যে করাইত-কেউটের ছোবল খাওয়া ও কাঁকড়াবিছের কামড় খাওয়া লোক এই ওষুধের এক ডোজ খেয়েই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে তার ইয়ত্তা নেই।
হাসপাতালে গিয়ে দেখি সাহেবের সত্যিই সংকটাপন্ন অবস্থা। কিন্তু আশ্চর্য মনের জোর ভদ্রলোকের। এই অবস্থাতেও শান্তভাবে খাটে শুয়ে আছেন। কেবল মাঝে মাঝে আচমকা ভ্রুকুঞ্চন ও মুখ বিকৃতিতে তাঁর অসহ্য যন্ত্রণা প্রকাশ পাচ্ছে।
আমি নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁর একজন অনুরাগী পাঠক হিসাবে তাঁর দর্শন পাবার জন্য ঘরে ঢুকেছিলাম, কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম যে ভদ্রলোক আমার নামে চিনতে পেরেছেন। শুধু তাই নয়—এই যন্ত্রণাক্লিষ্ট অবস্থায় ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি আমাকে জানালেন যে আমার লেখা বিজ্ঞানবিষয়ক অনেক বইই তাঁর পড়া—এবং ভূতপ্রেতের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সম্পর্কে আমার যে মৌলিক গবেষণামূলক একটি বই আছে—সেটা নাকি তাঁর একটি অতি প্রিয় বই।
আমার উপর এই আস্থার দরুনই বোধহয় আমার ওষুধটা খেতে তাঁর কোনও আপত্তি হল না।
আমি যখন হোটেলে ফিরেছি তখন বেলা সাড়ে এগারোটা। বিকেল তিনটের কিছু আগে খবর এল সামারটন অনেকটা সুস্থ বোধ করছেন। জ্বর নেই, শরীরের নীল ভাবটা কেটে গেছে, যন্ত্রণাও অনেক কম। আগামীকাল সকালের মধ্যে যে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন এ বিষয় আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। কাল সকালে সামারটনের সঙ্গে দেখা করে কয়েকদিনের জন্য তাঁর সঙ্গ নেওয়ার প্রস্তাবটা করতে হবে।
৮ই সেপ্টেম্বর রাত ১২টা
আজ ভোরে উঠেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সামারটন একেবারে সুস্থ। গুবরের কামড়ের দাগটা পর্যন্ত আশ্চর্যভাবে একদিনেই মিলিয়ে গেছে। আমার ওষুধের গুণ দেখে আমি নিজেই অবাক। কী সব অদ্ভুত জিনিসের সংমিশ্রণে ওই ওষুধ তৈরি হয়েছে সেটা আর সামারটনকে বললাম না। বিশেষত গলদা চিংড়ির গোঁফের কথাটা বললে হয়তো তিনি আমাকে পাগলই ঠাউরে বসতেন। যাই হোক—আমার প্রতি সামারটনের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এক্সক্যাভেশনে সঙ্গ নেবার কথাটা আর আমাকে বলতে হল না——উনি নিজেই বললেন। আমি অবশ্য তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম।
ইনিও দেখলাম মামির ব্যাপারে বিশেষ অনুসন্ধিৎসু। শুধু তাই নয়—এই যে সব ভূগর্ভস্থ প্রাচীন সমাধিমন্দিরে প্রবেশ করে তার জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করা, এর ফলে যে কোনও প্রাচীন অভিশাপ সামারটন বা তাঁর দলভুক্ত কাউকে স্পর্শ করে তার অনিষ্ট হতে পারে, এ বিশ্বাসও যে সামারটনের আছে। যে গুব্রে পোকাটি তাঁকে কামড়েছে, তাঁর ধারণা সেটি হল সেই স্ক্যারাব গুব্রে—যাকে নাকি ঈজিপ্সীয়রা পুজো করত। সামারটন যে মন্দিরে কাজ করছেন তার দেওয়ালে নাকি এই গুবরের খোদাই করা প্রতিমূর্তি রয়েছে। ঈজিপ্সীয়রা যে জন্তু জানোয়ার মাছ পাখির অনেক কিছুকেই দেবতার অবতার বলে পুজো করত সে তথ্য আমার জানা ছিল। আমি সামারটনকে বললাম, ‘কোন একটা জায়গায় নাকি এক্সক্যাভেশনের ফলে একটা বেড়ালের সমাধি মন্দির পাওয়া গেছে?’
সামারটন বললেন, ‘আরে, সে তো এই বুবাসটিসেই—আমি এখন যেখানে কাজ করছি, সেখানে। অবিশ্যি এটা অনেকদিনের আবিষ্কার। শত-খানেক বেড়ালের সমাধি রয়েছে সেই ঘরটায়। ঠিক মানুষকে যে ভাবে mummify করে কফিনে বন্ধ করে রাখা হত বেড়ালকেও ঠিক সেইভাবেই রাখা হয়েছে। বেড়াল ছিল নেফ্দেৎ দেবীর অবতার।’
আমি স্থির করলাম, সময় ও সুযোগ পেলে এই বিচিত্র সমাধিকক্ষ দেখে আসব। বেড়াল আমার অতি প্রিয় জিনিস। বাড়িতে আমার পোষা নিউটনকে রেখে এসেছি। তার কথা মনে হলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
সামারটনের সঙ্গে দেখা করে যখন হোটেলে ফিরছি তখন বেলা বেড়ে গিয়ে বেশ গনগনে রোদ উঠেছে। হোটেলের সামনে একটা স্থানীয় লোক আমায় দেখে আমার দিকে এগিয়ে এল। লোকটা লম্বায় ছ’ফুটের ওপর, গায়ের রং পোড়া তামাটে, চুল ছোট করে ছাঁটা ও পাকানো, চোখ দুটো কোটরে বসা, চাহনি তীক্ষ্ণ ও নির্মম।
লোকটা এগিয়ে এসে তার ডান হাতটা অত্যন্ত উদ্ধতভাবে আমার কাঁধের উপর রাখল। তার পর আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টি রেখে ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘আপনাকে তো ভারতীয় বলে মনে হচ্ছে, তবে আপনি এই শ্বেতাঙ্গ বর্বরদের দলে ভিড়ছেন কেন? আমাদের দেশের সব পবিত্র প্রাচীন জিনিস নিয়ে আপনাদের এত কী মাথা ব্যথা?’
আমি পালটা বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বললাম, ‘কেন, তাতে কী হয়? প্রাচীন জিনিস নিয়ে মাথা ঘামালেই কি তার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়? আপনি জানেন আমি প্রাচীন ঈজিপ্সীয় সভ্যতার প্রতি কতখানি শ্রদ্ধা নিয়ে এদেশে এসেছি?’
লোকটার চোখদুটো যেন জ্বল জ্বল করে উঠল। তার ডান হাতটা তখনও আমার কাঁধে। সেই হাত দিয়ে একটা চাপ দিয়ে সে বলল, ‘শ্রদ্ধা এক জিনিস, আর শাবল লাগিয়ে মাটি খুঁড়ে পবিত্র সমাধিকক্ষে প্রবেশ করে মৃতব্যক্তির আত্মার অবমাননা করা আর এক জিনিস। সামারটন সাহেব কোথায় কাজ করছেন তা জানেন?’
‘জানি। বুবাসটিসে চতুর্থ ডাইনাস্টির রাজা থেফ্রেসের আমলের একটি সমাধিকক্ষে।’
‘সেইখানে আমার পূর্বপুরুষদের সমাধি আছে সেটা আপনি জানেন?’
আমি তো হো হো করে হেসে উঠে বললাম, ‘আপনি দেখছি আপনার চৌদ্দশ’ পুরুষ অবধি খবর রাখেন।
লোকটা যেন আরও ক্ষেপে উঠল। তার ডান হাত দিয়ে আমার কাঁধে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘রাখি কি না রাখি, তা ওই সব মন্দিরে আর একটু ঘোরাঘুরি করে দেখুন না, তাহলেই টের পাবেন।’
এই বলে লোকটা আমায় ছেড়ে হনহনিয়ে রাস্তার দিকে চলে গিয়ে ভিড়ের সঙ্গে মিশে গেল। আমিও হাঁফ ছেড়ে আমার ঘরে চলে গেলাম।
সামারটন কালকেই ফিরে যাবেন তাঁর কাজের জায়গায়, এবং আমি যাব তাঁর সঙ্গে। জিনিসপত্তর এই বেলা গোছগাছ করে রাখা ভাল। মনে মনে একটা উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। সেবার নীলগিরি অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেবার সময়ও ঠিক এইরকম হয়েছিল। বেড়ালের সমাধি। ভাবলেও হাসি পায়।…
কাল সামারটনকে এই উদ্ধতস্বভাব আধপাগলা ঢ্যাঙা লোকটার কথা বলতে হবে। আমার মনে হয় ব্যাপারটা আর কিছু নয়—আসলে এই সব পুরনো মন্দিরে অনেক সময়েই মূল্যবান পাথরবসানো সব গয়নাগাঁটি পাওয়া যায়। এই সব স্থানীয় লোকেরা তা ভালভাবেই জানে, এবং এরা হয়তো মনে করে যে হুমকি দিয়ে, অভিশাপের ভয় দেখিয়ে, নিরীহ প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছ থেকে এই সব পাথরবসানো জিনিসের কয়েকটা আদায় করে নিতে পারবে। তবে লোকটা যদি বেশি জ্বালাতন করে, আমি স্থির করেছি ওকে হাঁচিয়ে মারব। আমার snuff gun বা নস্যাস্ত্রটা সঙ্গে এনেছি। নাকে তাগ করে মারলে দু’ দিন ধরে অনর্গল হাঁচি চলবে। তার পর দেখব বাবাজি আর বিরক্ত করতে আসে কি না।
১০ই সেপ্টেম্বর
আমরা কাল সকালে বুবাসটিসে এসে পৌঁছেছি। সামারটনের সঙ্গে কাল দুপুরে সদ্যখনিত চার-হাজার বছরের পুরনো সমাধিকক্ষে নেমেছিলাম। এ যে কী অদ্ভুত অনুভূতি তা লিখে বোঝানো দুষ্কর। একটা সঙ্কীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে নেমে সঙ্কীর্ণতর সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে ঘরটায় প্রবেশ করতে হয়। সামারটনের অনুমান এটা কোনও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর সমাধিকক্ষ। বেশ বড় একটি হলঘরের মাঝখানে কারুকার্য করা কাঠের কফিন। ঘরের চারপাশে আরও ছোট ছোট সারবাঁধা সব ঘর—তার প্রত্যেকটির মধ্যেই একটি করে কফিন। এতে নাকি এই গণ্যমান্য ব্যক্তির পরিষদবর্গের মৃতদেহ রয়েছে। ঈজিপ্সীয়রা বিশ্বাস করত মৃতব্যক্তির আত্মা নাকি মৃতদেহের আশেপাশেই ঘোরাফেরা করে, এবং জীবিত ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় যা কিছু প্রয়োজন হয়, এই সব মৃত আত্মারও নাকি সেই সবের প্রয়োজন হয়। তাই কফিনের পাশে দেখলাম খাবার পাত্রে খাদ্যদ্রব্য, মদের পিপেতে মদ, পোশাক-আশাক, প্রসাধনের জিনিস, খেলাধূলার সরঞ্জাম, সবই রাখা হয়েছে।
সামারটন একটা কফিনের ডালা খুলে তার ভিতরের মামিটা আমায় দেখিয়ে দিলেন। হাত দুটো বুকের ওপর জড়ো করা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ব্যান্ডেজে আবৃত। ডালা খুলতেই একটা উগ্র গন্ধ নাকে প্রবেশ করল। আমি অবাক বিস্ময়ে মৃতদেহটি দেখতে লাগলাম। কত বই-এ পড়েছি এই মামির কথা।
মামির বুকের উপর সেই চার হাজার বছরের পুরনো প্যাপাইরাস কাগজে ঈজিপ্সীয় হাইরোগ্লিফিক ভাষায় কী যেন লেখা রয়েছে। এ ভাষা আমার জানা নেই। সামারটন অবশ্যই জানেন। কিন্তু আধুনিক ভাষার মতো এ তো আর গড়গড় করে পড়া যায় না। এ ভাষা বুঝতে সময় লাগে। সামারটন বললেন, ওই প্যাপাইরাসে মৃতব্যক্তির পরিচয় রয়েছে। শুধু যে নামধাম তা নয়। কবে কী ভাবে মৃত্যু হয়েছে তাও লেখা রয়েছে।’
সারাদিন সমাধিকক্ষে ঘোরাঘুরির পর সন্ধ্যার দিকে তাঁবুতে ফেরার পথে সামারটন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি তো মনে কর ভূত প্রেত বা অলৌকিক সব কিছুরই একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে তাই না? অন্তত তোমার বই পড়ে তো তাই মনে হয়।’
আমি বললাম, ‘সেটা ঠিকই। তবে আমি এটাও মানি, যে বিজ্ঞান যেমন অনেক দিকে এগোতে পেরেছে, তেমনি আবার অনেক কিছুরই হদিস এখনও পর্যন্ত পায়নি। এই যেমন স্বপ্ন কেন দেখে মানুষ, এই নিয়ে তো বৈজ্ঞানকিদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি যে পঁচিশ, কি পঞ্চাশ, কি অন্তত একশো বছরের মধ্যে জগতের সব রহস্যেরই কারণ বৈজ্ঞানিকরা জেনে ফেলবেন।’
সামারটন একটু ভেবে বললেন, ‘এই যে সব প্রাচীন সমাধিকক্ষে আমরা প্রবেশ করছি, এখানকার অনেকের মতে তাতে নাকি আমাদের প্রতি মৃতব্যক্তির আত্মা অসন্তুষ্ট হচ্ছে। এমন কি তারা নাকি আমাদের উদ্দেশ্যে অভিশাপ বর্ষণ করছে। হয়তো একদিন আমাদের এই পাপের ফল ভোগ করতে হবে।’
কথাটা শুনে আমি হেসে ফেললাম, কারণ সে দিনের সেই পাগলটার কথা আমার মনে পড়ে গেল।
সামারটনকে লোকটার কথা বলতে তিনিও হেসে ফেললেন। বললেন, ‘আরে, ও তো প্রথম দিন থেকেই আমার পেছনে লেগেছে। আমাকেও হুমকি দিয়েছিল এসে। ও আর কিচ্ছু না—কিছু বকশিস পেলেই ও আর জ্বালাতন করবে না।’
আমি বললাম, ‘তা দিয়ে দিলেই তো পারেন। আপদ বিদেয় হয়।’
সামারটন মাথা নেড়ে বললেন, ‘এই সব ছ্যাঁচড়া লোকগুলোর পেছনে অর্থব্যয় করার ইচ্ছে নেই আমার। এতে ওদের লোভ আরও বেড়ে যায়। ভবিষ্যতে যাঁরা এই সব কাজে এখানে আসবেন তাঁদের কথাও তো ভাবতে হবে আমাদের। তার চেয়ে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করাই ভাল। কিছুদিন বিরক্ত করে লাভের আশা নেই দেখে আপনিই সরে পড়বে।’
তাঁবুতে ফিরে শরবত খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে একটা ক্যানভাসের ডেক চেয়ার নিয়ে বাইরে বসলাম। পশ্চিমদিকে চেয়ে দেখি অস্তগামী সূর্যের সামনে গিজার পিরামিডটা গাঢ় ধূসর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই পিরামিড যে প্রাচীন যুগে কী ভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল, তা আজও ঠিক বোঝা যায়নি।
তাঁবুর উত্তর দিকে এক লাইন খেজুর গাছ। তার একটার মাথায় দেখলাম গোটা তিনেক শকুনি থুম হয়ে বসে আছে। শকুনিকেও নাকি পুরাকালে এরা দেবতার অবতার বলে মনে করত। আশ্চর্য জাত ছিল এই প্রাচীন ঈজিপ্সীয়রা।
১২ই সেপ্টেম্বর
আজ সামারটন একটা প্রস্তাব করে আমাকে একেবারে হকচকিয়ে দিলেন, এবং প্রস্তাবটা শুনে আমি বুঝতে পারলাম যে মৃত্যুর কবল থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য তিনি আমার প্রতি কী গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
সারাদিন বুবাসটিসের বেড়ালের সমাধিকক্ষ দেখে সন্ধ্যার দিকে যখন তাঁবুতে ফিরছি তখন পাইপের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সামারটন হঠাৎ বললেন, ‘শ্যাঙ্কু, তুমি আমার জন্যে যা করেছ, তার প্রতিদানে আমি কী করতে পারি সেই চিন্তাটা ক’দিন থেকে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। আজ একটা উপায় আমার মাথায় এসেছে, এখন সেটা তোমার মনঃপূত হয় কিনা জানা দরকার।’
এই পর্যন্ত বলে সামারটন একটু দম নেবার জন্য থামলেন। গুবরের কামড় যে ভেতরে ভেতরে তাঁকে বেশ দুর্বল করে দিয়েছে সেটা বুঝতে পারা যায়। কিছুটা পথ চলার পর সামারটন বললেন, তোমার তো মামি নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছে আছে। ধরো যদি আমার আবিষ্কৃত মামিগুলোর মধ্যে একটা তোমাকে দেওয়া যায়—তুমি কি খুশি হবে, না অখুশি হবে?’
আমি প্রস্তাবটা শুনে এমন অবাক হয়ে গেলাম যে প্রথমে আমার মুখ দিয়ে কথাই সরল না। আমার এক্সপেরিমেন্টের জন্য একটা নিজস্ব মামি নিয়ে দেশে ফিরতে পারব, এ আমার স্বপ্নের অতীত। কোনওমতে ঢোক গিলে বললাম, একটা মামি নিয়ে যেতে পারলে, আমার এ অভিযান সম্পূর্ন সার্থক হবে বলেই আমি মনে করি, এবং এ ঘটনা যদি ঘটে তা হলে আমি তোমার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।’
সামারটন মুচকি হেসে বললেন, ‘তুমি কী চাও? বেড়াল, না মানুষ?’
আমার গবেষণার জন্য অবিশ্যি বেড়াল আর মানুষে কোনও তফাত হত না, কিন্তু আমার প্রিয় নিরীহ নিউটনের কথা ভেবে কেন জানি বেড়ালের মামি সঙ্গে নিতে মন চাইল না। নিউটন সব সময়েই আমার ল্যাবরেটরির আশেপাশে ঘুরঘুর করে। হঠাৎ একদিন চার হাজার বছরের পুরনো বেড়ালের মৃতদেহ সেখানে দেখলে তার যে কী মনোভাব হতে পারে সেটা অনুমান করা কঠিন। আমি তাই বললাম, ‘মানুষই প্রেফার করব।’
সামারটন বললেন, ‘বেশ তো—কিন্তু নেবে যখন একটা ভাল জিনিসই নাও। বুবাসটিসেই বেড়ালের কবরস্থানের কাছেই আর একটা সমাধিকক্ষ আমি আবিষ্কার করেছি, যাতে প্রায় ত্রিশ জন মানুষের মামি রয়েছে। এরা যে কী ধরনের লোক ছিল সেটা এখনও বুঝতে পারা যায়নি। আমার মনে হয় এদের মৃত্যুর ব্যাপারে কোনও রহস্য জড়িত আছে। এদের কফিনে প্যাপাইরাস কাগজে যে হাইরোগ্লিফিক লেখা আছে তার মধ্যেও একটা যেন বিশেষত্ব আছে—আমি এখনও পড়ে উঠতে পারিনি। তোমাকে এই ত্রিশটির মধ্যে একটি কফিন দিয়ে দেব। কিন্তু তার ভেতর থেকে লেখাটা আমি বার করে নেব। তার পর দেশে ফিরে গিয়ে পাঠোদ্ধার করে তোমাকে পাঠিয়ে দেব। তার মধ্যে তুমি যা গবেষণা চালাবার তা চালিয়ে যেও—এবং তোমার ফাইন্ডিংস আমাকে জানিয়ে দিও। মামির রাসায়নিক রহস্য তুমি যদি উদঘাটন করতে পার তা হলে হয়তো একদিন নোবেল প্রাইজও পেয়ে যেতে পারো।’
আমার আর ঈজিপ্টে থাকার কোনও প্রয়োজন নেই। সামারটনের দেওয়া কফিনটি প্যাকিং কেসে ভরে ফেলে জাহাজে নিয়ে দেশে ফিরতে পারলেই আমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে! তার পর গবেষণার জন্য তো অফুরন্ত সময় পড়ে আছে। সত্যি, সামারটনের বদান্যতার কোনও তুলনা নেই। আসলে বৈজ্ঞানিকেরা ভিন্ন দেশবাসী হলেও তারা কেমন যেন পরস্পরের প্রতি একটা আত্মীয়তা অনুভব করে। সামারটনের সঙ্গে আমার তিনদিনের আলাপ, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন তিনি আমার বহুকালের পরিচিত।
১৫ই সেপ্টেম্বর
আজ সকালে পোর্ট সেইডে ফিরেছি। এসেই এক বিদঘুটে ঘটনা। আমার হোটেলের কাছেই একটা বড় দোকান থেকে একটা চামড়ার পোর্টফোলিও কিনে রাস্তায় বেরোতেই সেই পাগলাটে লম্বা লোকটির সঙ্গে একেবারে চোখাচুখি। শুধু তাই নয়—সে এগিয়ে এসে আমার শার্টের কলারটা একেবারে চেপে ধরেছে। আমি তো রীতিমতো ভ্যাবাচাকা। সত্যি বলতে কি, গত কয়দিনের আনন্দ উত্তেজনায় আমি লোকটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আর এ ধরনের কোনও বিপদের আশঙ্কা করিনি বলেই বোধহয় আমার সঙ্গে কোনও অস্ত্রশস্ত্রও ছিল না।
লোকটা রক্তবর্ণ চোখ করে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে সেই ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘তোমাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম, তুমি আমার কথা শুনলে না। সেই আমারই পূর্বপুরুষের মৃতদেহ নিয়ে চলেছ তুমি নিজের দেশে। এর জন্যে কী শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হবে তা তুমি ধারণাও করতে পারো না। এর প্রতিশোধ আমি নিজে নেব। আমি নিজে স্বহস্তে এই অপরাধের শোধ তুলব।’
এই বলে লোকটা আমার কলারটাকে খামচিয়ে চাপ দিয়ে প্রায় আমার শ্বাসরোধ করার উপক্রম করছিল এমন সময় রাস্তারই একটা পুলিশ দৌড়ে এগিয়ে এসে গায়ের জোরে লোকটাকে ছাড়িয়ে দিল। পথচারী কয়েকজন লোকও আমার বিপদ দেখে এগিয়ে এসেছিল। তারা আমার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে বলল, ‘ও লোকটা ওই রকমই পাগল। অনেকবার হাজত গেছে—আবার ছাড়া পেলেই উৎপাত করে।’
পুলিশটাও বলল, যে আমাকে আর চিন্তা করতে হবে না। লোকটিকে উত্তমমধ্যম দিয়ে তাকে সায়েস্তা করার বন্দোবস্ত করা হবে।
আমার নিজেরও তেমন উদ্বেগের কোনও কারণ ছিল না। দু’ দিন বাদেই ভারতগামী জাহাজে আমার প্যাসেজ বুক করা হয়ে গেছে। সঙ্গে যাবে সামারটনের দেওয়া খ্রিস্টপূর্ব দু’ হাজার বছরের পুরনো ঈজিপ্সীয়ের মৃতদেহ। দেশে গিয়ে তার ব্যান্ডেজ খুলে চলবে তার উপর গবেষণা। মামির রাসায়নিক রহস্য আমাকে উদঘাটন করতেই হবে।
১৭ই সেপ্টেম্বর
লোহিত সাগরের উপর দিয়ে আবার জাহাজ চলেছে। সমুদ্র রীতিমতো রুক্ষ—কিন্তু তাতে আমার শরীরে কোনও কষ্ট নেই—কেবল কলমটা সোজা চলে না বলে লিখতে যা একটু অসুবিধে। জাহাজের মালঘরে প্যাকিং কেসে বন্ধ কফিন! আমার মন পড়ে রয়েছে সেখানেই। সামারটন বন্দরে এসেছিলেন আমাকে গুডবাই করতে। তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম, কফিনের লেখাটা পড়া হলেই সেটা যেন আমাকে জানিয়ে দেন! তাঁকে এও বললাম যে অবসর পেলে তিনি যেন আমার অতিথি হয়ে গিরিডিতে এসে আমার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে যান।
জাহাজ যখন ছাড়ছিল তখন ডাঙার দিকে চেয়ে ভিড়ের মধ্যে একটা উঁচু মাথা দেখতে পেলাম। দুরবিনটা চোখে লাগিয়ে দেখি সেই পাগলটা আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। তার চোখে ও ঠোঁটের কোণে ক্রুর, হিংস্র হাসি আমি কোনও দিনও ভুলব না। পুলিশ বাবাজি বোধহয় সায়েস্তা করতে পারেনি লোকটাকে।
লোহিত সাগরের উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। এবার লেখা বন্ধ করতে হয়।
২৭শে সেপ্টেম্বর
আজ সকালে গিরিডি পৌঁছেছি। বুবাসটিসের মরুভূমিতে রোদে পুড়ে আমার রংটা যে বেশ কয়েক পোঁচ কালো হয়েছে সেটা আমার চাকর প্রহ্লাদের অবাক দৃষ্টিতে প্রথম খেয়াল করলাম। আমার ঘরের আয়না অবশ্য সে অনুমানের সত্যতা প্রমাণ করল।
নিউটন এগিয়ে এসে আমার পাৎলুনে তার গা ঘষতে আরম্ভ করল। আর মুখে সেই চিরপরিচিত স্নেহসিক্ত মিউ মিউ শব্দ। ভাগ্যিস বেড়ালের মৃতদেহ আনিনি সঙ্গে করে। নিউটন কোনও মতেই বরদাস্ত করতে পারত না ওটা।
কফিনটা ল্যাবরেটরির অনেকখানি জায়গা দখল করে বসেছে। আমার আর তর সইছিল না, তাই দুপুরের মধ্যেই কফিনটা প্যাকিং কেস থেকে বার করিয়ে নিয়েছি।
আজই প্রথম কফিনটাকে ভাল করে লক্ষ করলাম। তার চারপাশে এবং ঢাকনার উপরটা সুন্দর কারুকার্য করা হয়েছে। ঈজিপ্সীয়রা কাঠ খোদাই-এর কাজে যে কতদূর দক্ষতা অর্জন করেছিল তা এই কাজ থেকেই বোঝা যায়।
কফিনের ডালাটা খুলতে আর একটা বাক্স বেরোল। সেটা আকারে একটা শোয়ানো মানুষের মতো। অর্থাৎ ভিতরে যে মৃতদেহটি রয়েছে এটা তারই একটা সহজ প্রতিকৃতি। এর চোখ নাক মুখ সবই রয়েছে আর সর্বাঙ্গে রয়েছে রঙিন তুলির নকশা।
এই দ্বিতীয় বাক্সের ঢাকনাটা খুলতেই সেই চেনা গন্ধটা পেলাম, আর ব্যান্ডেজ-মোড়া মৃতদেহটি দেখতে পেলাম। অন্য সব মামির যেমন দেখেছি, এরও তেমনি হাত দুটো বুকের উপর জড়ো করা। আপাদমস্তক ব্যান্ডেজ মোড়া, তাই লোকটার চেহারা কেমন তার কোনও আন্দাজ পেলাম না। তবে লোকটি যে লম্বা সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমার চেয়ে প্রায় এক হাত বেশি। অর্থাৎ ছ-ফুটের বেশ উপরে।
ব্যান্ডেজ খোলার কাজটা আগামী কালের জন্য রেখে দিলাম। আজ বড় ক্লান্ত; তা ছাড়া আমার গবেষণার সরঞ্জামও সব পরিষ্কার করতে রাখতে হবে। উশ্রীর বালি কিছুটা এসে জমেছে তাদের মধ্যে।
অবিনাশবাবুকে কাল খবর দিয়ে ডেকে এনে এই বাক্সের ডালা খুলে দেখিয়ে দেব; আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা তাঁর একটা বাতিক। এটা দেখলে পর কিছুদিনের জন্য বোধহয় মুখটা বন্ধ হবে। এই কিছুক্ষণ আগে দরজা ধাক্কার শব্দ শুনে আমি তো অবিনাশবাবু মনে করে প্রহ্লাদকে দেখতে পাঠিয়েছিলাম। সে ফিরে এসে বলল, কেউ নেই। তা হলে বোধহয় ঝড়ের শব্দ হচ্ছিল। ক’ দিন থেকেই নাকি এখানে ঝড় বৃষ্টি চলেছে।
২৯শে সেপ্টেম্বর
কাল যা ঘটনা ঘটে গেছে তার পর আর ডায়রি লেখার সামর্থ্য ছিল না। তাই আজ সকালে ঠাণ্ডা মাথায় কালকের ঘটনাটা লেখার চেষ্টা করছি। পরশুর ডায়রিতে সন্ধ্যাবেলা দরজায় ধাক্কার কথা লিখেছি, তখন ভেবেছিলাম বুঝি ঝড়ে এই রকম শব্দ হচ্ছে। রাত এগারোটা নাগাদ ঝড়টা থেমে যায়। আমার ঘুমও এসে যায় তার কিছুক্ষণ পরেই। ক’টার সময় ঠিক খেয়াল নেই, আবার সেই ধাক্কার শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায়।
প্রহ্লাদ আমার ঘরের বাইরের বারান্দায় শোয়। ওর আর সবই ভাল, কেবল দোষের মধ্যে ঘুমটা অতিরিক্ত গাঢ়। এই ধাক্কার শব্দে ওর ঘুমের কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি। অগত্যা আমি নিজেই আমার টর্চটা হাতে করে চললুম দেখতে কে এল এত রাত্রে।
নীচে গিয়ে সদর দরজা খুলে কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম। টর্চের আলো ফেলে চারিদিকটা দেখলাম। কেউ কোথাও নেই। হঠাৎ আমার হাতটা নীচে নামায় আলোটা দরজার চৌকাঠের ঠিক সামনে সিঁড়ির উপর পড়াতে দেখি সেখানে ভিজে পায়ের ছাপ। আর সেই পায়ের আয়তন দেখেই মনের ভেতরটা খচ্ খচ্ করে উঠল। গিরিডি শহরে এত বড় পায়ের ছাপ কার হতে পারে?
যারই হোক না কেন, তিনি উধাও হয়েছেন। এবং একবার এসে যখন ফিরে গেছেন, তখন আশা করা যায় যে এত রাত্রে হয়তো তার আর পুনরাগমন ঘটবে না।
আমি দরজা বন্ধ করে ফিরে গেলাম আমার শোবার ঘরে। যাবার পরে কী জানি খেয়াল হল, ল্যাবরেটরির ভিতরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিলাম। কোনও পরিবর্তন বা অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করলাম না। কফিন যেখানে ছিল সেখানেই আছে, ডালাও বন্ধই আছে।
ল্যাবরেটরির থেকে বেরিয়ে দেখি নিউটন বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, তার লোমগুলো খাড়া, আর সর্বাঙ্গে কেমন যেন তটস্থ ভাব। হয়তো দরজা ধাক্কার শব্দতেই নিউটনের ঘুম ভেঙে গেছে, এবং এত রাত্রে আমার বাড়িতে এ ধরনের ঘটনা নিতান্ত অস্বাভাবিক বলেই সে নিজেও অসোয়াস্তি বোধ করছে।
আমি নিউটনকে কোলে তুলে আমার শোবার ঘরে নিয়ে এলাম। তার পর ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে নিউটনকে খাটের পাশেই মেঝেতে কার্পেটে শুইয়ে দিয়ে নিজেও বিছানায় শুয়ে পড়লাম। |
পরদিন—অর্থাৎ গতকাল সকাল সকাল উঠে কফি খেয়ে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে হাজির হলাম। ঘণ্টা দু’-এক ধরে আমার কাচের সরঞ্জামগুলো পরিষ্কার করলাম। টেস্ট টিউব, রিটর্ট, জার, বোতল, ফ্লাস্ক—এ সবগুলোতেই ধুলো পড়েছিল।
তার পর প্রহ্লাদকে বললাম, আমি যতক্ষণ ল্যাবরেটরিতে আছি ততক্ষণ যেন কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া না হয় এবং সে নিজেও যেন ওয়ার্নিং না দিয়ে না ঢেকে।
তার পরে কফিনের পাশে সরঞ্জাম সমেত একটা টেবিল ও আমার নিজের বসার জন্য একটা চেয়ার এনে আমার কাজ শুরু করে দিলাম। মৃতদেহকে অবিকৃত অবস্থায় রাখার জন্য ঈজিপ্সীয়রা যে সব মশলা ব্যবহার করত তার মধ্যে ন্যাট্রন, কষ্টিক সোডা, বিটুমেন, বলসাম ও মধুর কথা জানা যায়। কিন্তু এ ছাড়াও এমন কোনও জিনিস ঈজিপ্সীয়রা ব্যবহার করত যার কোনও হদিস পরীক্ষা করেও পাওয়া যায়নি। আমাকে অজ্ঞাত উপাদানগুলি গবেষণা করে বার করতে হবে।
বাক্সের ডালা ও কফিনের ডালা খুলে আমি আর একবার ব্যান্ডেজ পরিবৃত মামিটার দিকে চেয়ে দেখলাম। মৃতদেহের কোনও বিকার না ঘটলেও, চার হাজার বছরে ব্যান্ডেজগুলো কিছুটা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। খুব সাবধানে চিমটে দিয়ে খুলতে হবে সেগুলোকে।
হাতে দস্তানা ও মুখে মাস্ক পরে আমার কাজ শুরু করে দিলাম।
মাথার ওপর থেকে ব্যান্ডেজটা খুলতে শুরু করে প্রথম কপাল, এবং তার পরে মুখের বাকি অংশটা বেরোতে আরম্ভ করল। কপালটা বেশি চওড়া নয়। চোখ দুটো কোটরে ঢোকা। নাক বেশ উঁচু। ডানদিকের গালে ওটা কী? তিনটে গভীর ও লম্বা দাগ। কোনও তীক্ষ্ণ জিনিস দিয়ে চেরা হয়েছে যেন গালের চামড়াকে। তলোয়ার যুদ্ধে এ দাগ সম্ভব কী? কিন্তু তা হলে তিনটে হবে কেন? আর দাগগুলো সমান্তরালভাবেই বা যাবে কেন?
ঠোঁটের কাছটা পর্যন্ত যখন বেরিয়েছে তখনই যেন মুখটা কেমন চেনা চেনা বলে মনে হল। এই চোয়াল, এই চোখ, এই নাক—কোথায় দেখেছি এ চেহারা? মনে পড়েছে। পোর্ট সেইডের সেই পাগলের সঙ্গে এ চেহারার আশ্চর্য সাদৃশ্য।
কিন্তু সেটা তো তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের বাঙালিদের পরস্পরের মধ্যে যেমন চেহারার পার্থক্য দেখা যায়—ঈজিপ্সীয়দের মধ্যে পার্থক্য তার চেয়ে অনেক কম। প্রাচীন ঈজিপ্সীয় মূর্তিগুলোর মধ্যে যেমন চেহারা দেখা যায় পোর্ট সেইডের রাস্তাঘাটে আজকের দিনেও সেরকম চেহারা অনেক চোখে পড়ে। সুতরাং এতে অবাক হবার কিছুই নেই। ঈজিপ্সীয়দের মধ্যে ধরে নেওয়া যায় এটা একটা খুব টিপিক্যাল চেহারা।
মনে মনে ভাবলাম, সেই পাগল বলেছিল—আমার পূর্বপুরুষের মৃতদেহ নিয়ে চলেছ তুমি! বোধহয় তার কথায় আমলটা, তখন একটু বেশিই দিয়েছিলাম, তাই এখন আদল দেখে মনে একটা অমূলক আশঙ্কা জাগছে।
পোর্ট সেইডের স্মৃতি অগ্রাহ্য করে আমি ব্যান্ডেজ খোলার কাজে এগিয়ে চললাম। গলার কাছ থেকে ব্যান্ডেজটা সত্যিই পচা বলে মনে হতে লাগল। চিমটের প্রতি টানে সেটা টুকরো টুকরো হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু এ ব্যাপারে অধৈর্য হলে মুশকিল—তাই অত্যন্ত ধীর ও শান্তভাবে চালাতে লাগলাম হাত।
সময় যে কীভাবে কেটে যাচ্ছে, সে বোধ কাজের সময়ে সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। পাঁজরের নীচটায় যখন পৌঁছেছে তখন খেয়াল হল যে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, বাতিটা জ্বালানো দরকার। চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাব—এমন সময় জানালার দিকে চোখ পড়তেই সর্বাঙ্গে যেন একটা শিহরণ খেলে গেল।
জানালার কাছে মুখ লাগিয়ে ঘরের ভিতর একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে পোর্ট সেইডের সেই পাগল। তার চোখে মুখে আগের চেয়েও শতগুণ হিংস্র ও উন্মত্ত ভাব। সে একবার আমার দিকে ও একবার কফিনের দিকে চাইছে।
ঘরে আলো জ্বালালে হয়তো আতঙ্কের ভাবটা একটু কমবে এই মনে করে দেয়ালে সুইচের দিকে হাত বাড়িয়েছি, এমন সময় একটা প্রচণ্ড ধাক্কায় জানালার ছিটকিনিটা ভেঙে উপড়ে ফেলে লোকটা এক লাফে একেবারে আমার ল্যাবরেটরির মধ্যে এসে পড়ল। তার পর তার পৈশাচিক দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ করে হাত দুটোকে বাড়িয়ে আমার দিকে অগ্রসর হতে লাগল।
তার পরের ঘটনাটি ঠিক পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই কারণ সমস্ত জিনিসটা ঘটে গেল একটা বৈদ্যুতিক মুহূর্তের মধ্যে! লোকটাও আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড ফ্যাঁস শব্দ করে নিউটন কোখেকে জানি এসে সোজা লাফিয়ে পড়ল লোকটার মুখের উপর।
তার পর একেবারে রক্তাক্ত ব্যাপার। পাগলের ডান গালে একটা বীভৎস আঁচড় দিয়ে নিউটন তাকে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলল। নিউটনের আক্রোশ আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হল এই যে, লোকটা সেই যে রক্তাক্ত গাল নিয়ে মাটিতে পড়ল—সেই অবস্থা থেকে সে আর উঠতে পারল না। শক্ থেকে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ—এ ছাড়া তার এভাবে মৃত্যুর আমি কোনও কারণ খুঁজে পেলাম না।
লোকটা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে নিউটন লেজ গুটিয়ে সুবোধ বালকটির মতো ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে চলে গেল, আর আমি একটা অসহ্য দুর্গন্ধ পেয়ে কফিনের দিকে চেয়ে দেখি চার হাজার বছরের পুরনো মৃতদেহে বিকারের লক্ষণ দেখা গেছে। এই পাগলটির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ঈজিপ্সিয়ান যাদুর মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে!
আমি আর দ্বিধা না করে কফিনের ডালাটা বন্ধ করে, ছত্রিশ রকম সুগন্ধ ফুলের নির্যাস মিশিয়ে আমার নিজের তৈরি এসেন্সের খানিকটা ল্যাবরেটরির চারিদিকে স্প্রে করে দিলাম।
মামির রহস্য রহস্যই রয়ে গেল এ যাত্রা। প্রাচীন ঈজিপ্সীয় বৈজ্ঞানিক এই একটি ব্যাপারে এখনও ভারতের সেরা বৈজ্ঞানিকের এক ধাপ উপরে রয়ে গেলেন।
স্থানীয় পুলিশে খবর পাঠাতে অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা এসে পড়ল। এখানকার ইনস্পেক্টর যতীন সমাদ্দার আমাকে খুবই সমীহ করেন। তিনি চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ওই কাঠের বাক্সের মৃতদেহটির জন্য তো আর আপনি দায়ী নন। কিন্তু ওই যে মাটিতে যিনি পড়ে আছেন, তাঁর মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে আপনাকে একটু ঝক্কি পোয়াতে হবে।’
আমি বললাম, ‘সে হোক। আপাতত আপনি এই প্রাচীন এবং নবীন লাশদুটোকেই এখান থেকে সরাবার বন্দোবস্ত করুন তো!’
৭ই অক্টোবর
আজ সামারটনের চিঠি পেয়েছি। লিখেছে, ‘প্রিয় প্রোফেসর শঙ্কু, আশা করি নোবেল প্রাইজ পাবার পথে বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়েছ। তোমার কফিনের প্যাপাইরাসটার পাঠোদ্ধার করেছি। তাতে মৃত ব্যক্তির পরিচয় দিয়ে বলা হচ্ছে—‘ইনি জীবদ্দশায় বেড়ালমুখি নেফদৎ দেবীর অবমাননা করেছিলেন বলে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। কিন্তু সেই দণ্ড ভোগ করার আগেই একটি বেড়ালের আঁচড় খেয়ে রহস্যজনকভাবে তাঁর মৃত্যু হয়। অর্থাৎ দেবী তাঁর অবতারের রূপ ধরে তাঁর অপমানের প্রতিশোধ নিজেই নিয়েছিলেন। আশ্চর্য নয় কি? এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী হতে পারে সেটাও এক বার ভেবে দেখতে পারো। তোমার কাজ কেমন চলছে জানিও। আমি ইংলন্ডে ফিরে প্রাণপণে বিটল-মাহাত্ম প্রচার করেছি। ইতি ভবদীয় জেম্স্ সামারটন।’
সামারটনের চিঠিটা পড়ে ভাঁজ করে খামের ভিতর রাখতে যাব এমন সময় আমার পাৎলুনে নিউটনের গা ঘষা অনুভব করলাম। আমি সস্নেহে তাকে কোলে তুলে জিজ্ঞেস করলাম, কি হে মার্জার, তুমিও কি নেফদেৎ দেবীর অবতার নাকি?’
নিউটন বলল, ‘ম্যাও!’