পাঁচ
পরাশর হাত দেখাবার জন্যে এখানে নেমেছে। কথাটা প্রথমে বিশ্বাস করতেই পারি নি। হাত দেখাবে পরাশর! সব আজগুবি দুর্বলতা ত কোনদিন তার ছিল না। সে কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে! কিন্তু সত্যিই সে যখন মিনিট দশেক হাঁটিয়ে একটা গলি গোছের রাস্তার একটি দোতলা বাড়ির সামনে নিযে গিযে দাঁড়াল, তখন তার নতুন দুর্বলতা সম্বন্ধে আর সন্দেহ রইল না।
বাড়িটার পরিচয় ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত তার সর্বাঙ্গে লাগানো নানা বিচিত্র সাইনবোর্ডেই ঘোষিত। দুধারের দেয়ালে ষটচক্র সুষুম্মা কাণ্ড ইত্যাদি কি সমস্ত দেহরহস্যের ছবি আঁকা বোর্ড ঝোলানো। দরজার মাথায় প্রকাণ্ড সোনালী হরফে লেখা বোর্ড। তাতে উঁচু-করা জ্বলজ্বলে অক্ষরে লেখা – নিখিল বরেণ্য যোগসিদ্ধ জ্যোতিষ চক্রবর্তী শঙ্কর মহারাজ। বাংলার চেয়ে আরো বড় ও উঁচু হরফ ইংরাজি। তাতে অবশ্য আর একটু সংক্ষেপে প্রথম লাইনে লেখা ‘শঙ্কর মহারাজ, অ্যাষ্ট্রলজার সুপ্রিম অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড, আর তার নিচের লাইনে লেখা ‘রীডস ইওর লাইফ-লাইক এ বুক’।
শঙ্কর মহারাজের পসার কি রকম ও কাদের মধ্যে তা ঐ গলির ভেতরই দাঁড় করানো দুটি দামী মোটরেই বোঝা যায়। মক্কেলদের একজন আমরা ওপরে যাবার মুখেই নেমে এসে গাড়িতে উঠলেন। দুজনেই বর্ষয়সী বিদেশী মেম-সাহেব। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা শুনে এটুকু বোঝা গেল যে তাঁরা জ্যোতিষ চক্রবর্তীর কাছে নতুন আসছেন না। নাতি প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যাবার পর আরেক যে মক্কেলকে অত্যন্ত কৃতার্থভাবে বিদায় নিতে দেখলাম তিনিও শ্বেতাঙ্গ। তাতে এইটুকু অন্ততঃ বোঝাগেল যে শঙ্কর মহারাজের খ্যাতিটা দেশের চেয়ে বিদেশেই বেশী না হোক কম নয়।
জ্যোতিষ চক্রবর্তীর প্রণামী বেশ একটু বেশী বলে ওপরে সাধারণ প্রার্থীর ভিড় একেবারেই নেই। আমাদের আগের শ্বেতাঙ্গ মক্কেল চলে যাবার পর আমরাই শুধু সেখানে রইলাম। শঙ্কর মহারাজের কাছে পরাশর একেবারে অচেনা নয় দেখলাম। কাছে গিয়ে বসতেই একতু যেন সকৌতুক ভৎর্সনার সুরে মহারাজ বললেন, “আবার কি হল।”
“আজ্ঞে হাতটা এবার একটু দেখুন।” বলে পরাশর তার ডান হাতটা বাড়িযে দিল।
“হাত দেখতে হবে না।” জ্যোতিষ চক্রবর্তী হাত ঠেলে দিয়ে বললেন, “আমি তোমার মুখেই সব দেখতে পাচ্ছি। অপেক্ষা কর এক মিনিট।”
জ্যোতিষ চক্রবর্তী যতক্ষণ পরাশরের মুখ দেখলেন তাঁর মধ্যে আমিও তাঁকে তখন দেখে নিলাম। ভক্তি না হোক সম্ভ্রম জাগাবার মত চেহারা বটে। দামী গালচের ওপর পাতা জাজিমের আসনে দুধারে মখমলের তাকিয়া নিয়ে যেন ছোটখাটো পাহাড়ের মতো বসে আছেন। লোমশ বুকের ভাঁজ ভুঁড়ির ভাঁজ সবই দেখবার মত। এই দেহের অনুপাতে বিরল কেশ মুণ্ডটাও বিরাট। মুখটি পরিপাটি করে কামানো ও কপাল থেকে গাল, গলা ও বুক পর্যন্ত বিধিত্র সব তিলক চিহ্ন আঁকা। বিদেশীদের কাছে এই চেহারার এক উদ্ভট আকর্ষণ থাকতে পারে কিন্তু পরাশরের এখানে ভাগ্য গণনার জন্য আসা যে কল্পনাতীত। এরকম আজগুবী খেয়াল কেমন করে তার হতে পারে। জ্যোতিষ চক্রবর্তীর পরের কথায় তার কিছুটা হদিশ অবশ্য পেলাম।
মুখে ঈষৎ কৌতুকের কুঞ্চন নিয়ে শঙ্কর মহারাজ বললেন, “হুঁ, অবস্থা বেশ সঙ্গীন দেখছি। রোগটা একেবারে সাংঘাতিকভাবে চেপে ধরেছে। আশা ভরসা কিছু দিতে পারছি না। মঙ্গল আর কেতুর সংযোগ পেয়ে বিপক্ষ একেবারে অপরাজেয়। তবে …না না দাঁড়াও দাঁড়াও। বুধ আর শুক্রকে যদি বক্রী করা যায়! এমনিতেই দেখছি অবস্থানের শনির দৃষ্টি পড়েছে। স্থান-ত্যাগের ব্যাকুলতা দেখা যাচ্ছে তাই। সিদ্ধিলাভ ত্বরান্বিত করবার তাই চেষ্টা। শনির অপ্রসন্নতার সঙ্গে বুধ আর শুক্রকে যদি বক্রী করা যায় তাহলে – তাহলে তোমার অভিলাষ পূর্ণ হতেও পরে।”
পরাশরের মুখটা গোড়া থেকেই লক্ষ করছিলাম। শঙ্কর মহারাজ তাঁর গণনার সিদ্ধান্ত জানাতে শুরু করার পর থেকে বেশ একটু ম্লান থাকবার পর এতক্ষণে তা একটু যেন উজ্জ্বল হতে দেখলাম।
“স্থান ত্যাগের ত্বরাটা যথার্থই বলছেন?” বলে পরাশর এবার উৎসুকভাবে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর দিকে চাইল।
“আমার গণনা ত তাই বলে,” হেসে বললেন শঙ্কর মহারাজ। “বুধ আর শুক্রকে বক্রী করবার ব্যবস্থা যদি চাও ত করা যেতে পারে।”
“আজ্ঞে অনুগ্রহ করে তাই করবেন।” বলে ব্যাগ খুলে করকরে একটি একশ টাকার নোট বার করে জ্যোতিষ মহারাজের পায়ের কাছে নামিয়ে দিলে পরাশর।
তারপর ভক্তি ভরে প্রণাম করে আমার সঙ্গে নিচে নেমে আসবার সময় তার মুখের ভাব দেখে মনে হল এতক্ষণে সে যেন একটু বল ভরসা পেয়েছে।
ভেতরটা তখন আমার তেতো হয়ে গেছে। তবু রাস্তায় বেরিয়ে ট্যাকসি নেবার পর থেকে তার বাড়িতে পরাশরকে পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত জোর করে নিজেকে চেপে রেখেছিলাম। তার বাড়িতে পৌঁছে ট্যাকসি ছেড়ে দিলে তার বাইরের ঘরে গিয়ে পা দেবার পর আর নিজেকে রুখতে পার্লাম না।
“তোমার এই অধঃপতন এখন হয়েছে।” গলাটা যতদূর সম্ভব রুক্ষ রেখেই বললাম, “প্রেমে কি আর কেউ কখনো পড়ে না!”
পরাশর তখনও তার সোফায় গিয়ে বসেনি। আমার কথায় আর গলার স্বরে বেশ একটু নাড়া খেলেও সব বুঝেও যেন না বোঝার ভান করে যেন অসহায়ভাবে আমার দিকে চাইল। সে চেহারা দেখে মায়া-দয়া কিন্তু আমার হল না।
আগের মতই ঝাঁঝের সঙ্গে বলে গেলাম, “তোমার এমন মতিভ্রম ধরেছে যে জ্যোতিষীদের কাছে ভালবাসায় জেতবার মন্তর নিতে গেছ!”
“আমি… আমি,” পরাশর একটু যেন থতমত খেয়ে দুর্বল প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করলে, “বললে… বললে — আমি প্রেমে পড়েছি।”
“দিনের আলোর মতো যা স্পষ্ট তা এখনো অস্বীকার করছ!” এবার একটু সহনুভূতির সঙ্গেই বললাম, “তোমার চেহারা চাল-চলন কতাবার্তা সব যে যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিচ্ছে।”
একটু থেমে তার প্রেমে পড়ার প্রত্যক্ষ প্রমাণগুলো তার সামনে ধরে দিলাম। তোমার আজকের সারা সকালের কাণ্ড-কারখানা দেখলেই তোমর আস্থা বুঝতে যে কারুর বাকি থাকে না। আচার্যদেবের বাড়িতে যাওয়ার পর থেকে সারা সকাল তুমি প্রায় একেবারে চুপ। যে মানুষের মুখে সারাক্ষণ কথার খই ফোটে সে হঠাৎ কিসে বোবা হয়ে যেতে পারে। পারে শুধু হঠাৎ ভালোবাসায় পড়লে।
ভালবাসায় খোঁড়া যেন পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ভীরু কাপুরুষ সাসসী বীর হয়ে ওঠে, তেমনি বাচাল বোবা হয়ে যায়, বুদ্ধিমান হয়ে যায় হাঁদা, যেমন তুমি হয়েছ। তা না হলে তুমি ভালোবাসায় কি হবে জানতে জ্যোতিষীর কাছে যাও। তাও আবার ঐ রকম ভণ্ড বুজরুক জ্যোতিষী নতুন নেশা ধরা সাহেব-মেমদের মাথায় হাত বুলিয়ে যে ফাঁকির ব্যবসা ফাঁপাচ্ছে। তার ঐ বুজরুকিতে বিশ্বাস করে তার সাহায্য নিতে তুমি আবার অতগুলো টাকা সঁপে দিয়ে এলে আহাম্মকের মত।”
এতক্ষণ এত যে কথা শোনালাম পরাশার তাতেও একেবারে চুপ। বুঝলাম মনে মনে সে নিজের অন্যায়টা বুঝে রীতিমতো লজ্জা পেয়েছে। এবারে তাই সহানুবূতির সঙ্গে ভালো কথাটাই তাকে জানালাম। বললাম, “শোনো, তোমার এই জ্যোতিষী যাই বলুক তার চেয়ে খাঁটি কথা আমি তোমায় শোনাচ্ছি। তোমার এমনভাবে হঠাৎ প্রেমে পড়ে যাওয়াটা একটু অদ্ভুত। তবে বয়স বাড়ার পর অসময়ে হলে রোগটা এমনি বেয়াড়াভাবেই চেপে ধরে বলে জানি। তোমার তাই কোন দোষ দিচ্ছি না। তার বদলে একটা ভরসা দিচ্ছি এই যে যতই কন্দর্পকান্তি হোক তোমার এলসার বারোহার ওপর একটুও টান নেই।
“তুমি তাই বলছ।” পরাশর যেন অবিশ্বাসের সঙ্গে বললে, “তুমি বুঝলে কি করে?”
“বোঝা ত জলের মত সোজা!” হেসে বললাম এবার, “ভালবাসার তোড়ে হঠাৎ হাত-পা মুখ থেকে বুদ্ধিশুদ্ধি অমন অবশ নাহয়ে গেলে তুমিও পারতে: বারোহার ওপর এলসার কোনো দুর্বলতা যদি থাকত তাহলে তার সঙ্গে ভারতবর্ষ টহল দেবার অমন সুযোগটা সে নয় না? এ যুগে তাদের জগতে তাতে লোকনিন্দার ভয়ও নেই। সুতরাং তোমার এই অসময়ের বেয়াড়া রোগ যদি কাটিয়ে না উঠতে পারো তাহলে বলব বারোহার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভয় করবার তোমার কিছু নেই।”
“এই তোমার মত?” পরাশর মনের খুশিটা মুখে আর লুকোতে না পেরে উৎসাহভরে জিজ্ঞাসা করলে।
“হ্যাঁ, এই আমার মত! তোমার জ্যোতিষীর কথায় তুমি গুলি মারতে পারো!” বলে পরাশরের কাছ থেকে বন্ধুকৃত্য করবার বেশ একটা তৃপ্তি আর গর্ব নিয়েই সেদিন নিজের বসায় ফিরলাম।
বেলা তখন দুপুর পার হয়ে গেছে। আমার পত্রিকার কয়েকটা দরকারী কাজের কাগজপত্র টেবিলের ওপর পড়ে আছে দেখলাম। কিন্তু সেগুলো এখন সারতে হলে স্নান খাওয়া-দাওয়া মাথায় উঠবে। সেগুলো তাই বিকেলের জন্যে স্থগিত রেখে স্নান করবার জ্ন্যে গায়ের জামাটা খুলতে গিয়ে পরাশরের সকালবেলা পকেটে গুঁজে দেওয়া কাগজটা হাতে ঠেকল। সেটা পকেট থেকে বার করে এনে প্রথমে তা আমাকে দেবার মানেটাই বুঝতে পারলাম না। খামে ভরা চিঠি-টিঠি নয়। কোন একটা ছাপানো পত্রিকা থেকে ছিঁঠে নিয়ে ভাঁজ করে মোড়া একটা পাতার টুকরো মনে হল প্রথমে। তারপর ছেঁড়া কাগজটার এক পিঠে ছাপা হরফের ওপরেই বড় বড় করে ধ্যাবড়া কলমে লেখা কটা কথা দেখতে পেলাম। অত্যন্ত তাড়াতাড়িতে হাতের কাছে অন্য কাগজ না পেয়েই পরাশর বোধহয় ছাপানো পত্রিকার পাতার এই ছেঁড়া ফালিটা তার কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু ও কাগজে আমার বাড়ি ফিরে পড়বার জন্যে যা লিখেছে তাতেই ত মেজাজটা ঠিক রাখা শক্ত হল।
পরাশর লিখেছে, – এলসা মেয়েটি ঠগ। ভালো করে লক্ষ করে থাকলে প্রমাণগুলো মনে করে রেখে আমায় জানিও।
এ লেখাটুকু পড়বার পর মেজাজ একেবারে খিঁচড়ে যায় কি না? আমি যে আহাম্মকের মত এতক্ষণ তার প্রেমে পড়াটা নিশ্চিত বলে ধরে নিয়ে তাকে ভৎর্সনা আর উপদেশ দিতে বক-বক করে মরেছি, বিন্দুমাত্র তার প্রতিবাদ না করে পরাশর তাহলে সেগুলো মজা করে উপভোগ করেছে! এর শোধ তাকে যেমন করে হোক দেবই প্র্রতিজ্ঞা করে ভালো করে পড়বার জন্যে ছেঁড়া কাগজটা আর একবার খুলে ধরলাম। কিন্তু পরশরের লেখা কথাগুলোর আগে আরেকটা জিনিষ যা সেখানে চোখে পড়ল তাতে কেমন একটু ধোঁকা লাগল মনে।
কাগজের ফালিটা যেভাবে তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে, তাতে একদিকে একটা ছবির খানিকটা অংশ কাটা অবস্থায় থেকে গেছে। ছবিটা একটি বিদেশী মেয়ের, ছবিটা শুধু নয় তার নিচের লেখা নামের অংশটুকুও মাথার মধ্যে কোথায় যেন অস্পষ্ট টনক নড়লো। নামটায় যতটুকু ওখানে পাওয়া গেছে তা হল, — বারবারা চেরিল … কোথায় দেখেছি এ ছবিটা? কোথায় পেয়েছি এ নাম? কোন পত্রিকা পাতাটা ছেঁড়া হয়েছে তাও যদি বুঝতে পারা যেত। সে পত্রিকা বা অন্য যেখানেই গোক ও ছবি আর নাম আমার যে চোখে পড়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। শুধু তাই নয় ছবিটা আর ঐ নামের সঙ্গে একটা কি খুব অসাধারণ ব্যাপারও জড়িত হয়ে অছে। সেটা কি মনে করবার চেষ্টায়, পরাশরের ওপর অভিমানটাও খানিক বাদে যেন চাপা পড়ে গেল। পরাশরকে কি তার বাসার কোন পত্রিকা থেকে ছবির অংশটা ছিঁড়েছে জিজ্ঞাসা করব? না, সেটা এখন আর সম্ভব নয়। সে কথা জিজ্ঞাসা করতে গেলে পরাশরের এই লেখাটুকুর শোধ আর নেওয়া হবে না। না, অমি নিজে নিজেই ও ছবিটা কি সূত্রে কোথায় দেহেছি তা ভেবে বার করব। যে পর্যন্ত তা না পারি নিজে থেকে পরাশরের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখব না।
বার করতে ঠিকই পারলাম শেষ পর্যন্ত। তবে সেদিন নয়। তার পরের দিন সকালবেলা আচমকা নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে। সমাধানটা যখন হয তখন আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবনায় একেবারে অস্থির হয়ে আছি। কারণ তার কিছুক্ষণ আগে ভোরের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে পরাশরের কাছ থেকে অদ্ভুত বেয়াড়া এক ফোন পেয়েছি।