মাসুদ রানা ৪৫ – প্রবেশ নিষেধ ২ – কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি, ১৯৭৬
০১.
ঠিক সকাল নটায় বালিশের নিচে বেজে উঠল খাপে পোরা ছোট্ট অ্যালার্ম ঘড়িটা।
বিরক্তি লাগল রানার। শুয়ে শুয়েই আড়মোড়া ভাঙল, এপাশ-ওপাশ ফিরল বারকয়েক, হাই তুলে লম্বা ডাক ছাড়ল নিশি রাতে ক্রন্দনরত কুকুরের মত, তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে গিয়ে ঢুকল বাথরূমে। কি শেভ-স্নান সেরে বেরিয়ে এল সে দশ মিনিটের মধ্যেই। জামা-কাপড় পরে তৈরি হয়ে নিতে লাগল আরও পাঁচ মিনিট, তারপর নেমে গেল নিচে, রেস্তোরাঁয়। গতরাতে মিস হয়ে গেছে খাওয়াটা, ডাবল ব্রেকফাস্ট দিয়ে পুষিয়ে নিল সে সুদে আসলে। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কফির কাপে চুমুক দিয়ে ধরাল। দিনের প্রথম সিগারেট।
ঝকঝকে দিন। আকাশে ছিটেফোঁটাও নেই মেঘের। প্রফুল্ল মনে বেরিয়ে এল রানা হোটেল কার্লটন থেকে, গজ তিরিশেক গিয়ে নজর বোলাল। চারপাশে, কিন্তু এমন কাউকে চোখে পড়ল না যে কিনা ওকে অনুসরণ করতে পারে। কেন যেন দমে গেছে অনুসরণকারীরা, কাল রাত থেকে কেউ পিছু নিচ্ছে না আর। ট্যাক্সিটার কাছে এসে হঠাৎ একটা সন্দেহ দেখা দিল ওর মনে-ওকে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি তো ওরা? গাড়িতে কিছু ফিট করে রেখে যায়নি তো আবার? সামনের এঞ্জিন, পেছনের বুট, গাড়ির তলা। এবং ভেতরটা ভালমত পরীক্ষা করে দেখল সে পাঁচ মিনিট, তারপর স্টার্ট দিল। গাড়িতে। বোমা বিস্ফোরণে মারা গেল না দেখে রওনা হয়ে গেল সে খুশি মনে, সোজা এসে থামল মার্নিক্সট্রার্টের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। ঠিক দশটায়।
রাস্তার উপরেই একটা মার্সিডিজের মাডগার্ডে হেলান দিয়ে রানার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ড। পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। সংক্ষিপ্ত সম্ভাষণ। রানা টের পেল দুজনেই মনে মনে স্থিরনিশ্চিত-অনর্থক নষ্ট করা হচ্ছে ওদের সময়। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলছে না, কিন্তু দুজনেই জানে, অহেতুক এই ঝামেলা না করলেও চলত।
সার্চ ওয়ারেন্ট তৈরি?
হ্যাঁ। সোজা হয়ে দাঁড়াল ডি গোল্ড। আপনার কি এখনও মনে হচ্ছে। এই সার্চটা জরুরী? মানে, না করলেই নয়?
শোফার চালিত মার্সিডিজের পেছনের সীটে উঠে বসল রানা, জানালা দিয়ে কর্নেলের মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল।
কাল রাতে যতটা মনে করেছিলাম, আজ সকালে তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী বলে মনে হচ্ছে।
চট করে উঠে পড়ল কর্নেল গাড়িতে। ইন্সপেক্টর উঠল সামনের প্যাসেঞ্জার সীটে। গাড়ি ছেড়ে দিতেই ঘাড় ফিরিয়ে রানার দিকে চাইল মাগেনথেলার। বিশেষ কোন কারণ ঘটেছে, যেজন্যে আপনার ধারণাটা ঘন হয়েছে আগের চেয়ে?
ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ল রানা। ইনটিউইশন।
নিজেদের মধ্যে চট করে একবার দৃষ্টি বিনিময় করল ডি গোন্ড এবং মাগেনথেলার। এই জিনিসটার উপর নির্ভর করে যে পুলিসী-তৎপরতা চলে না, সেটা ভাল করেই জানা আছে তাদের। রানার প্রতি ঠিক কতটা আস্থা রাখা। যায় বুঝে উঠতে পারছে না ওরা। অনিশ্চিত দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে রইল কর্নেল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, একটা ভ্যানে করে আটজন সাদা পোশাক পরা পুলিস পাঠিয়ে দিয়েছি ওখানে আগেই। গলির মুখে অপেক্ষা। করবে ওরা আমাদের জন্যে। কিন্তু কাল আপনার কথায় মনে হলো, সার্চ করাটা আপনার ঠিক উদ্দেশ্য নয়, আপনার উদ্দেশ্য হচ্ছে
সার্চটাই প্রধান নয়, বলল রানা, কিন্তু সেটাও একটা উদ্দেশ্য। আমি আসলে যা চাইছি সেটা হচ্ছে ওদের ইনভয়েসগুলো–যার থেকে ওদের সমস্ত সাপ্লায়ারদের একটা লিস্ট তৈরি করে নেয়া যায়।
যা করছেন, আশা করি বুঝেশুনেই করছেন? গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল মাগেনথেলার। ভাবছি, আমাদের আবার কোন বিপদে পড়তে না হয়।
জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল রানা- কেন যেন কথোপকথন জমছে না আজ। সবাই চুপচাপ রইল ভলেনহেভেন অ্যান্ড কোম্পানীর গলিখে না। পৌঁছানো পর্যন্ত। মার্সিডিজটা কয়েক সেকেন্ডের জন্যে থামল ভ্যানের পাশে। সিভিলিয়ানের স্যুট পরা এক লোক এগিয়ে এল গাড়ির পাশে। ওর দিকে। একনজর চেয়েই মৃদু হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে। এই লোক যে পোশাকই পরুক, ধুতি পাঞ্জাবি বা মওলানার আলখেল্লা পরলেও এক মাইল দূর থেকে বলে দিতে পারবে সে-এ লোক পুলিসের লোক, এমনই ছাপ পড়ে গেছে চেহারায়।
স্যালিউট করল না বটে, কিন্তু খুট করে জুতোর গোড়ালি না ঠুকে পারল লোকটা। নিচু হয়ে ঝুঁকে বলল, আমরা রেডি, স্যার।…
গুড। আমরা যাচ্ছি আগে, তোমরা লোকজন নিয়ে এসো পিছু পিছু।
ওয়েরহাউজের সামনে থেমে দাঁড়াল মার্সিডিজ। প্যাকিঙের ঘরে ঢুকতেই একজন তোক দোতলায় নিয়ে গেল ওদের। টাইম লক লাগানো অফিসের দরজা এখন দুপাট হাঁ করে খোলা। ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা তিনজন।
চমৎকার সাজানো গোছানো একটা অফিস। ওয়েরহাউজে এমন একটা হাল ফ্যাশনের অফিসঘর আশা করা যায় না। কার্পেট, ড্রেপিং, আসবাব–সবকিছুতেই আধুনিক রুচির ছাপ। বিশাল একটা টেবিলের ওপাশে বসেছিল এক বিশালবপু লোক, ওদের দেখেই উঠে দাঁড়াল হাসিমুখে, হাত বাড়িয়ে সামনের চেয়ার দেখাল।
আসুন, আসুন। বসুন।
চেয়ারের দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রানা। ফিরল কর্নেল ডি গোন্ডের দিকে।
অল্প কিছুক্ষণের জন্যে ক্ষমা করতে হবে আমাকে, কর্নেল, বলল সে। এক্ষুণি একজনের সাথে দেখা করতে হবে আমার। অত্যন্ত জরুরী। একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।
অবাক চোখে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল কর্নেল রানার মুখের দিকে। তারপর বলল, এতই জরুরী, এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ভুলেই গিয়েছিলেন একেবারে?
টিটকারিটা গায়ে মাখল না রানা। এইভাবে ডেকে এনে হঠাৎ জরুরী কাজ পড়ে গেছে বললে কর্নেলের পক্ষে রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তেমনি। স্বাভাবিক ওর এই হঠাৎ ভয় পাওয়া। এক মুহূর্ত বিলম্ব সহ্য হচ্ছে না ওর যে, ভুল করে ফেলেছে, সেটা এক্ষুণি শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে, নইলে পরে হয়তো আর সুযোগই পাওয়া যাবে না কোনদিন। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। নানান ঝামেলায় ভুলে গিয়েছিলাম। বেশি সময় লাগবে না আমার…
একটা ফোন করলে হয় না? এখান থেকে না হয়… টেবিলের উপর রাখা একটা টেলিফোন সেটের দিকে চোখের ইঙ্গিত করল কর্নেল।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, বলে উঠল মোটা লোকটা। ইচ্ছে করলে আপনি এখান থেকেই…
সেটা সম্ভব নয়। আমার নিজের যেতে হবে।
কী এমন জরুরী, গোপনীয় ব্যাপার যেটা… রানার মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেল কর্নেল।
আপনার গাড়ি এবং শোফার ধার নিতে পারি কয়েক মিনিটের জন্যে?
পারেন। নিরুদ্যম কণ্ঠে বলল কর্নেল। রানার খ্যাপামি দেখে মনে মনে বিরক্ত হয়েছে, বোঝা গেল।
আর..আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করতে পারেন…
কতক্ষণ? কতক্ষণ বসে থাকতে হবে আমাদের আপনার জন্যে?
কয়েক মিনিট। বেশি না।
মিনিট দুয়েক চলবার পর একটা কাফের সামনে থামতে বলল রানা মার্সিডিজের ড্রাইভারকে। গাড়ি ঘোরাতে বলে প্রায় দৌড়ে ঢুকে গেল। ভেতরে। ওদের টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে দ্রুতহাতে ডায়াল করল সোহানাদের হোটেলের নাম্বারে। হোটেল ডেস্কের বুড়িকে ডিঙিয়ে ওদের ঘরে পৌঁছুতে আজ দশ সেকেন্ডের বেশি লাগল না।
সোহানা?
হ্যাঁ। কি খবর, রানা?
মারিয়া বেরিয়ে গেছে?
এই তো, ঘণ্টাখানেক হলো। আমিও বেরোচ্ছি…
শোনো। যে কাজ দিয়েছিলাম, তার চেয়েও জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে। এক্ষুণিআই রিপিট, এক্ষুণি এই হোটেল ছেড়ে দাও। এক্ষুণি বলতে আমি বোঝাচ্ছি বড়জোর দশ মিনিট। সম্ভব হলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে তোমাকে।
বেরিয়ে পড়তে হবে মানে
মানে জিনিসপত্র পাক করে বিল চুকিয়ে দিয়ে কেটে পড়তে হবে ওখান থেকে। অন্য কোন হোটেলে গিয়ে উঠবে। যে কোন হোটেল না, না, গভ, কার্লটনে না। তোমাদের যোগ্য যে-কোন হোটেলে। কেউ যেন অনুসরণ করতে না পারে সেজন্যে ট্যাক্সি যতগুলো খুশি ব্যবহার করতে পারো। হোটেলের টেলিফোন নাম্বারটা কর্নেল ডি গোল্ডের অফিসে ফোন করে জানাবে। উল্টে নেবে নাম্বারটা।
উল্টে নেব! সোহানার কণ্ঠস্বরে বিস্ময়। পুলিসকেও তুমি…।
কাউকেই বিশ্বাস করি না। আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি, সোহানা, বিশ্বাস করতে নয়।
আর মারিয়া?
আগে হোটেল বদলাও। তারপর যেমনভাবে পারো এই হোটেলে উঠতে বাধা দাও মারিয়াকে। পার্কে না গিয়ে চেষ্টা করবে পথেই ওকে আটকাতে। মারিয়াকে ধরে নিয়ে চলে যাবে দুজন বিট্রিক্স শেরম্যানের আস্তানায়। এখন বাসাতেই পাবে আশা করি, বাসায় না পেলে খোঁজ করবে। ব্যালিনোভায়। ওকে বলবে, ওর ভালর জন্যেই ওর এখন তোমাদের সাথে নতুন হোটেলে থাকা দরকার। যতক্ষণ না ওর বাইরে বেরোনো আমি নিরাপদ মনে করছি ততক্ষণ ওর থাকতে হবে তোমাদের সাথে।
আর ওর ভাই…
ওর ভাই থাকুক যেখানে আছে সেখানেই। আপাতত ওর কোন বিপদ। দেখতে পাচ্ছি না। বিপদ এখন তোমাদের তিনজনের মাথার ওপর। যদি তোমাদের সাথে যেতে ও রাজি না হয়, ওকে বলবে হেনরীর ব্যাপারে পুলিসে। ফোন করবে তাহলে তুমি
পুলিসে ফোন করব!
দরকার হবে না, পুলিসের নাম শুনলেই সুড়সুড় করে তোমাদের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করবে মেয়েটা।
কিন্তু অন্যায় হয়ে যাচ্ছে না? মানে, পুলিসের ভয় দেখিয়ে একটা মেয়েকে…
তর্ক কোরো না, সোহানা। যা হুকুম করছি, পালন করো। বলেই নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার।
ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল সে ওয়েরহাউজের অফিসরুমে। ইতিমধ্যেই এখানে আসবার কারণ জানানো হয়েছে ভলেনহোভেনকে। রানা ঢুকে দেখল অমায়িক, দয়ালু ভাবটা দূর হয়ে গেছে মোটা লোকটার মুখের চেহারা থেকে, সেই জায়গায় ফুটে উঠেছে অসন্তোষ বিক্ষোভ আর অবিশ্বাস। বুক পর্যন্ত ঝুলে পড়া থুতনি কাঁপছে আবেগে। একহাতে ধরা রয়েছে একটা কাগজ। খসে পড়ে গেল কাগজটা টেবিলের উপর।
সার্চ ওয়ারেন্ট! দুঃখে ফেটে যাচ্ছে ভলেনহোভেনের বুক। পাথরের মূর্তি পর্যন্ত কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেবে ওর এক্সপ্রেশন দেখে। চেহারাটা অর্ধেক। হলে, বেশ মানিয়ে যেত হ্যামলেট হিসেবে। দেড়শো বছর ধরে বাপ দাদারও বাপের আমল থেকে ব্যবসা করছি আমরা ভলেনহোভেন ফ্যামিলি, সম্মানের সাথে, সতোর সাথে। আজ তার এই পরিণতি! ভলেনহোভেন কোম্পানীতে সার্চ ওয়ারেন্ট! হায়রে, এই ছিল কপালে! শুনলে এক্ষুণি হার্টফেল করবে আমার বুড়ো বাপ। নিজের কপালে দুটো চাপড় দিল। লোকটা। এইবার চুনকালি পড়ল গেল গুডউইল! সর্বনাশ! সার্চ ওয়ারেন্ট! নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করল সে কয়েক সেকেন্ড, তারপর চোখ বুজল, ঠিক আছে, সার্চ করুন। যেখানে খুশি, যা খুশি দেখুন সার্চ করে। আমার কোন আপত্তি নেই।
আমরা কি খুঁজতে এসেছি সেটা জানতে চান না আপনি? নরম গলায় জিজ্ঞেস করল কর্নেল।
কী হবে জেনে! দুঃখে ভেঙে গেল ওর গলা! শেষ! মান-সম্মান ইজ্জত-ব্যবসা সব গেল আমার খোদা! একশো পঞ্চাশ বছর ধরে…
সার্চ ওয়ারেন্ট আর পুলিসের নাম শুনলেই কেন যে পাবলিকের এই রকম অবস্থা হয়! হাসিহাসি মুখ করে বলল কর্নেল ডি গোল্ড। শুনুন, মিস্টার ভলেনহোভেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার ধারণা, স্বর্ণমৃগের পেছনে ছুটছি আমরা। এটা রুটিন চেক। অফিশিয়াল অনুরোধ এসেছে আমাদের কাছে, কাজেই নিয়ম অনুযায়ী সার্চ করতেই হবে আমাদের। এতে আপনার। সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে না। ভেঙে পড়বারও কিছু নেই। আমাদের কাছে ইনফরমেশন এসেছে যে আপনাদের এখানে বেআইনীভাবে সংগ্রহ করা কিছু ডায়মন্ড আছে…
ডায়মন্ড! একেবারে আসমান থেকে পড়ল মোটা লোকটা। রানা লক্ষ করল, এই একটি শব্দে অর্ধেক দুশ্চিন্তা যেন দূর হয়ে গেল লোকটার মুখ থেকে। কোলাব্যাঙের মত মাথাটা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। মান হেসে বলল, ডায়মন্ড? আশ্চর্য! ঠিক আছে, দেখুন খুঁজে। শুধু একটা অনুরোধ যদি পাওয়া যায়, এক-আধটা দয়া করে দিয়ে যাবেন আমাকে। জীবনে দেখিনি আমি এ জিনিস।
এসব টিটকারি গায়ে না মেখে অবিচলিত দৃঢ়তার সাথে বলল কর্নেল, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সন্দেহ করা হচ্ছে, আপনাদের এখানে ডায়মন্ড কাটিং মেশিনারিও রয়েছে।
তাই নাকি? আরও সিকিভাগ দুশ্চিন্তা উড়ে গেল লোকটার চেহারা। থেকে। সত্যিই? সেটা তো নিশ্চয়ই লুকিয়ে রাখবার মত জিনিস না, পেয়ে যাবেন একটু খুঁজলেই। দেখুন খুঁজে।
সেইসাথে আপনাদের ইনভয়েস ফাইলটাও দেখতে হবে।
একশোবার। দেখুন, দেখুন। ভাল করে খতিয়ে দেখুন সব। কোন আপত্তি নেই আমার।
আপনার সহযোগিতার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ, বলল কর্নেল ডি গোল্ড। মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারকে। চট করে উঠে দাঁড়াল মাগেনথেলার, দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল সার্চের ব্যবস্থা করতে। যেন গোপনীয় কিছু বলছে এমনি ভঙ্গিতে সামনে ঝুঁকে এল কর্নেল। এই অসুবিধে সৃষ্টি করার। জন্যে আমি সত্যিই আন্তরিক দুঃখিত, মি. ভলেনহোভেন। পুলিসের কাজ জনসাধারণকে সাহায্য করা, তাদের স্বাভাবিক কাজে বাধা সৃষ্টি করা নয়। কিন্তু কি করব…জানি, এটা বেহুদা সময় নষ্ট, আপনাকে হয়রানি করা, নিজেরাও হয়রানি হওয়া, তবু…
তিরিশ মিনিটের মধ্যেই হয়রান হয়ে ফিরে এল মাগেনথেলার। ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই সার্চ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বুঝতে পেরে আবার হাসিখুশি দয়াল ভাবটা ফিরে এসেছে ভলেনহোভেনের মধ্যে! কেক, বিস্কিট, কফি আনিয়ে আপ্যায়ন করল, অবাঞ্ছিত হলেও, ক্ষমতাধারী অতিথিদের। এক ফাঁকে রানাও ঘুরে এল পুরোটা বাড়ি। গতরাতে যেখানে যা দেখে গিয়েছিল, প্রায় তেমনি রয়েছে সবকিছু। শুধু ক্যানাবিসের গন্ধটা অনুপস্থিত। সেই জায়গায় মিষ্টি একটা এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ। এ ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলল না সে।
নিচে নেমে এসে বিদায় দিল ভলেনহোভেন ওদের হাসিমুখে, যতটা না। ওদের কৃতার্থ করতে, তার চেয়ে বেশি প্রতিবেশী আর সব ওয়েরহাউজের মালিক ও কর্মচারীদের জানাতে যে সার্চ হয়েছে বটে, কিন্তু বে-আইনী কিছুই পাওয়া যায়নি ওর ঘরে। গাড়িতে ওঠার আগে ওর হাত ঝাঁকিয়ে দিল কর্নেল।
আপনার অসুবিধের জন্যে সত্যিই আন্তরিক দুঃখিত, মিস্টার। ভলেনহোভেন। আমাদের ভুল তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিল। অবশ্য কবেই বা ঠিক তথ্য পাই আমরা। যাই হোক, এই সন্দেহ এবং সার্চ সম্পর্কে সব কিছু কেটে দেব আমরা আমাদের ফাইল থেকে। হাসল। ইনভয়েসের ফাইল ধরা। বামহাতটা নাড়ল। এগুলো পরীক্ষার জন্যে দেব আমরা সেই ইন্টারেস্টেড ডিপার্টমেন্টকে। যে মুহূর্তে ওরা নিশ্চিত হবে যে এর মধ্যে কোন বে-আইনী ডায়মন্ড সাপ্লায়ারের নাম নেই, সাথে সাথেই ফেরত দেয়া হবে ফাইলটা। ঠিক আছে? চলি, গুডমর্নিং।
মাগেনথেলার এবং রানাও ওর হাত ধরে ঝাঁকাল, বিরক্ত করবার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করল, তারপর উঠে পড়ল গাড়িতে। রানার হাসিতে কোন। মালিন্য দেখতে পেল না ভলেনহোভেন। পাওয়ার কথাও নয়, কারণ বেচারা। তো আর থট রিডিং জানে না। জানা থাকলে টের পেত, বন্ধুত্বের বিন্দুমাত্র। ছিটেফোঁটাও নেই ওর ভিতর; বরং শত্রুতা রয়েছে রানার হাসিতে, হাত। ঝাঁকুনিতে–সম্পূর্ণ অন্য ধরনের চিন্তা চলেছে ওর মাথায়।
কারণ, গতরাতে এই লোকটাকেই দেখেছিল সে ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাব থেকে সোহানা ও মারিয়ার পিছন পিছন রওনা হতে।
.
০২.
প্রায় নিঃশব্দে ফিরে এল ওরা পুলিস হেডকোয়ার্টারে। ভ্যান ডি গোল্ড আর মাগেনথেলারের মধ্যে যে সামান্য কথা হলো সেটা ভলেনহোভেন বা সার্চ সংক্রান্ত কিছুই না, সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে সাধারণ আলাপ। বোঝা গেল আজকের এই সাৰ্চটা যে একেবারে অনর্থক সময় নষ্ট, বাজে ব্যাপার হয়েছে, সে সম্পর্কে দুজনের কারও মনেই কোন সন্দেহের লেশমাত্র নেই। এই প্রসঙ্গে কোন কথা তুললে পাছে রানা লজ্জা পায় সেজন্যেই নেহায়েত ভদ্রতার খাতিরে অন্য কথা বলছে ওরা। নেমেই নিজের কাজে চলে গেল মাগেনথেলার।
কর্নেলের পিছু পিছু তার অফিসে গিয়ে ঢুকল রানা।
কফি? ভুরু নাচাল কর্নেল ডি গোল্ড। অ্যামস্টার্ডামের সেরা কফি খাওয়াতে পারি আপনাকে।
না, ধন্যবাদ। পরে একদিন হবে। আজ একটু বেশি ব্যস্ত।
ব্যস্ত? তার মানে প্ল্যান তৈরি হয়ে গেছে? কাজে নামতে যাচ্ছেন নিশ্চয়ই?
আরে না। হাসল রানা। রিছানায় শুয়ে শুয়ে খানিক আকাশ পাতাল ভাবব।
তাহলে… তাহলে কেন
তাহলে কেন এখানে এলাম? ছোট্ট দুটো অনুরোধ আছে আমার। আমার জন্যে কোন টেলিফোন মেসেজ আছে কিনা একটু খোঁজ করে দেখবেন?
মেসেজ?
ওয়েরহাউজে আপনাদের বসিয়ে রেখে যার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তার কাছ থেকে আপনার অফিসে একটা মেসেজ আসবার কথা আছে। দেখবেন একটু?
গভীরভাবে মাথা ঝাঁকাল ডি গোল্ড, একটা রিসিভার কানে তুলে নিয়ে। দুএকটা কথা বলল, ভ্রূ কুঁচকে কি যেন শুনল, তারপর কাগজ কলম টেনে নিয়ে বলল, রিপিট করো।
খসখস করে ইঞ্চি চারেক লম্বা ইংরেজি অক্ষর ও নম্বরযুক্ত একটা মেসেজ লিখে কাগজটা রানার দিকে বাড়িয়ে দিল কর্নেল। অক্ষরগুলো অর্থহীন, রানা। জানে, কিন্তু সংখ্যাগুলো ওল্টালেই পাওয়া যাবে সোহানাদের হোটেলের টেলিফোন নাম্বার। কাগজটা পকেটে ফেলল সে।
অসংখ্য ধন্যবাদ। এটা ডিকোড করতে হবে আমার আবার।
এবার দ্বিতীয় অনুরোধ!
একজোড়া বিনকিউলার ধার দিতে পারবেন?
বিনকিউলার?
আমার হোটেলের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে বহুদূরে একটা সুইমিং পুল দেখা যায়। আমার বিশ্বাস অনেক সুন্দরী মেয়ে আসে ওখানে, এতদূর থেকে ভালমত দেখা যায় না। একটা বিনকিউলার হলে…
অবশ্যই, অবশ্যই। নিরানন্দ অবিবাহিত জীবনে এইটুকু আনন্দ থেকে আপনাকে বঞ্চিত করা নিতান্তই অন্যায় হবে। এক্ষুণি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কথাগুলো হালকা সুরে বলল ঠিকই, কিন্তু সামান্যতম হাসির আভাসও নেই, কর্নেলের মুখে। গলার সুর পরিবর্তন করে বলল, দেখুন, মেজর মাসুদ রানা, আপনার সাথে আমার কথা ছিল ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার। ছিল কি না?
নিশ্চয়ই ছিল, এবং আছে।
তাহলে এইসব গোপন তৎপরতার কি অর্থ? অনেক কিছুই আপনি। আমাদের এড়িয়ে চেপে যাচ্ছেন।
চাপছি না, বলল রানা। আপনাদের জানাবার মত কোন তথ্য হাতে এলেই জানাব। ভুলে যাবেন না, আপনারা বছরের পর বছর কাজ করছেন এই ব্যাপারটা নিয়ে, আমি এখানে এসে পৌঁছেছি দুদিনও পুরো হয়নি। চেপে যাওয়ার মত তথ্য থাকলে বরং আপনাদের কাছেই থাকা সম্ভব, আমার কাছে তথ্য কোথায় যে চাপবার প্রশ্ন উঠবে? মিথ্যে বলিনি, আমার কাছে কয়েকটা ব্যাপার বেশ বিদঘুটে ঠেকেছে, ঘরে ফিরে শুয়ে শুয়ে ওগুলো নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করব আমি এখন।
রানাকে বেশি ঘাটাল না কর্নেল। বুঝে নিয়েছে, এই লোকটার কাজে কোনরকম বাধা সৃষ্টি করা বোকামি হবে। এর কাজের ধারা আলাদা হতে পারে, কিন্তু যোগ্যতা সম্পর্কে কোনরকমের কোন সন্দেহ নেই তার মনে। পুলিসী নিয়ম মেনে এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে মেমো আর সার্কুলারের মাধ্যমে করবার মত কাজ যে এটা নয়, সেটুকু বুঝবার ক্ষমতা তার আছে–বিশেষ করে গত কয়েকটা বছরের নিষ্ফল চেষ্টার পর ধারণাটা বদ্ধমূল হয়েছে। বিনকিউলারটা কাঁধে ঝুলিয়ে রানা যখন বেরিয়ে গেল, মস্তবড় একটা শ্বাস ছেড়ে মন দিল সে কাজে।
আধমাইল দূরে একটা টেলিফোন বুদের সামনে গাড়ি থামাল রানা। কর্নেলের কাছ থেকে পাওয়া নাম্বারে ডায়াল করতেই একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে এল, হোটেল প্লাযা।
রানার মনে পড়ল শহরের পূর্বদিকে এই নামের একটা হোটেল দেখেছে সে। ভাল কোন হোটেল না, কিন্তু ওদের দুজনের পরিচয় অনুযায়ী ঠিক যে। ধরনের হোটেলে ওঠা উচিত, তাই পছন্দ করেছে সোহানা।
আমার নাম রানা। মাসুদ রানা। দুজন মহিলা আজ আপনাদের ওখানে। উঠেছেন। এই ঘণ্টাখানেক কি তার চেয়ে কিছু বেশি হবে। ওদের সাথে কথা বলতে পারি?
আমি দুঃখিত। ওঁরা বেরিয়ে গেলেন একটু আগে।
দুজনই? আরও একটু নিশ্চিত হতে চাইল রানা।
হ্যা! দুজনই। হাঁপ ছেড়ে বাচল রানা। তার মানে মারিয়াকে পেয়ে গেছে সোহানা, এখন হয় বিট্রিক্সের খোঁজে বেরিয়েছে, নয়তো গেছে হোস্টেল প্যারিসের মেয়েদের উপর নজর রাখতে। রানার অকথিত প্রশ্ন আঁচ করে নিয়ে। অপর প্রান্ত থেকে লোকটা বলল, আপনার জন্যে একটা মেসেজ রেখে গেছেন। ওরা, মিস্টার রানা। আপনাকে জানাতে বলেছেন যে আপনার হোস্টেস বান্ধবীকে পাওয়া যায়নি।
ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠল রানার। লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামিয়ে রাখল রিসিভার। একলাফে উঠে পড়ল গাড়িতে। বিট্রিক্সকে পাওয়া না যাওয়ার কি কারণ থাকতে পারে?
একেবারে অ্যাপার্টমেন্ট হাউজের সামনে এসে গাড়ি থামাল রানা। দৌড়ে উঠে গেল তিনতলায়। বন্ধ। তালামারা। খুলতে অবশ্য এক মিনিটও লাগল না। রানার। ভেতরে ঢুকে দেখল, গতরাতে যেমন দেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি রয়েছে ঘরটা। সাদামাঠা, বাহুল্যবর্জিত, ছিমছাম। কোথাও ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই। ঘরের যেটা যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। তন্নতন্ন করে দুটো ঘরই খুজল রানা, কিন্তু এমন কোন তথ্য বা ইঙ্গিত চোখে পড়ল না যা দেখে টের পাওয়া যায় বিট্রিক্স বা হেনরী কি অবস্থায় কোথায় গেছে। বারবার। আশঙ্কার একটা কালো ছায়া ভর করতে চাইল ওর মনের উপর, বারবারই মাথা ঝাঁকিয়ে দূর করে দিল সে অশুভ চিন্তা। দরজায় তালা দিয়ে দ্রুতপায়ে। নেমে এল সে নিচে। ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবে দেখতে হবে খোঁজ করে।
পাঁচ মিনিট দমাদম দরজা পিটবার পর সামান্য একটু ফাঁক হলো ব্যালিনোভা নাইট-ক্লাবের সদর দরজাটা। চট করে ফাঁকের মধ্যে জুতোসুদ্ধ। পা ভরে দিয়ে হাত দিয়ে টেনে আর একটু বড় করল রানা ফাঁকটা। একমাথা সোনালি চুল দেখা গেল প্রথমে, তারপর দেখা গেল আবছামত একটা মেয়ে। দাঁড়িয়ে আছে বুকের কাছে চাদর জাতীয় কিছু একটা দিয়ে লজ্জা ঢেকে। গতরাতে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় দেখেছে রানা একে ড্রিঙ্কস সার্ভ করতে, আজ। দিনের বেলা হঠাৎ এর এত লজ্জার কারণ বুঝে উঠতে পারল না সে।
ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই, বলল রানা।
ছটার আগে খুলি না আমরা।
যেটুকু খুলেছ তাতেই চলবে। আমি রিজার্ভেশনের জন্যে আসিনি। চাকরির জন্যেও না। ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই। এই মুহূর্তে।
উনি…উনি তো এখানে নেই।
চাকরিটা খোয়াবার ইচ্ছে আছে? কর্কশ কণ্ঠে বলল রানা। আমি এখানে ইয়ার্কি মারতে আসিনি।
চাকরির কথায় বেশ একটু সতর্ক হয়ে গেল মেয়েটা।
মানে?
কণ্ঠস্বর নিচু করল রানা বক্তব্যে গাম্ভীর্য বাড়াবার জন্যে। মানে হচ্ছে যে, মুহূর্তে ম্যানেজার জানতে পারবে যে আমি দেখা করতে চেয়েছিলাম এবং তুমি বোকার মত ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝে আমাকে বিদায় করে দিয়েছ, তোমার চাকরিটা নাই হয়ে যাবে।
একটু ইতস্তত করল মেয়েটা, অনিশ্চিত দৃষ্টিতে বারকয়েক দেখল রানাকে আপাদমস্তক, তারপর মৃদু গলায় বলল, একটু অপেক্ষা করুন। বলেই দরজাটা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু রানার জুতোর সোল রয়েছে দুই দরজার ফাঁকে, বারকয়েক দরজা বন্ধ করবার বিফল চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল ভেতরে। আধ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা এক লোককে সাথে নিয়ে।
এক নজরেই অপছন্দ করল রানা লোকটাকে। বেশির ভাগ মানুষের মতই রানাও সাপ পছন্দ করে না। কিন্তু একে দেখবার সাথে সাথে ওই প্রাণীটার কথাই মনে পড়ল ওর। এই সাপের বগলের কাছে শোলডার হোলস্টারের আভাস টের পেল সে পরিষ্কার। যেমন লম্বা তেমনি চিকন লোকটা, কিন্তু হাতের কব্জি বক্সারের মত চওড়া। ফ্যাকাসে গায়ের রঙ, চলার ভঙ্গিতে নিশাচর হিংস্র জন্তুর ক্ষিপ্রতা। লম্বা নাক, নাকের দুপাশে কাছাকাছি বসানো একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ। ঠোঁটের কোণে সিগারেট। একগাল ধোয়া ছেড়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে পরীক্ষা করল সে রানার নির্বিকার মুখটা।
কি ব্যাপার, মিস্টার? এই সাতসকালে কি চান? এটা নাইট-ক্লাব– দিনে বন্ধ।
আগেই শুনেছি খবরটা। আপনি ম্যানেজার?
অ্যাসিস্ট্যান্ট। আপনি যদি পরে এক সময়ে আসেন–পরে মানে, এই ধরুন, সন্ধে ছটা নাগাদ আসেন, তাহলে হয়তো ম্যানেজারের সাথে একটা ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা..
ইংল্যান্ড থেকে এসেছি, আমি একজন উকিল, অত্যন্ত জরুরী এক ব্যাপারে। থেমে থেমে বলল রানা। একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে দিল। লোকটার হাতে। এক্ষুণি দেখা করা দরকার আমার ম্যানেজারের সাথে। অনেক টাকার মামলা।
আবার একবার সাপের মত নিষ্পলক দৃষ্টি বোলাল লোকটা রানার উপর। কার্ডটা দেখল। তারপর ঠোঁটে বাকা হাসি টেনে এনে বলল, কোন। কথা দিচ্ছি না, মিস্টার রবার্টসন। ঠিক আছে, কার্ড দেখাই ওকে। হয়তো বলেকয়ে কয়েক মিনিট সময় আদায় করা যাবে ওঁর কাছ থেকে।
লম্বা পা ফেলে চলে গেল লোকটা, ফিরে এল প্রায় সাথে সাথেই। মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল সে রানাকে সামনে এগোবার জন্যে, সরে দাঁড়িয়ে পথ করে দিল, সদর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলল পিছু পিছু। এই ধরনের লোক পেছন পেছন হাটলে সবসময় অস্বস্তি বোধ করে রানা, কিন্তু আপাতত কিছুই। করবার নেই, ওপাশের দরজা ঠেলে সরু একটা মান আলোকিত প্যাসেজ ধরে কয়েক পা এগিয়ে ডানদিকে ফিরল। সামনেই একটা ভারী দরজার গায়ে, ছোট্ট নেমপ্লেট-তাতে লেখা ম্যানেজার।
পেছন থেকে হাত বাড়িয়ে দরজার গায়ে দুটো টোকা দিয়ে হ্যাঁভেলে চাপ দিল লম্বা লোকটা, রানার পিঠে মৃদু চাপ দিল ভেতরে ঢোকার জন্যে। ঢুকে পড়ল রানা।
ছোট্ট অফিসঘর। অত্যন্ত সুসজ্জিত। দুপাশের দুই দেয়াল জুড়ে ফাঁইলিং। ক্যাবিনেট, অন্য দুই দেয়াল ক্রিমসন ও ভায়োলেট রঙের ড্রেপ দিয়ে মোড়া। জানালা আছে কি নেই বোঝা যায় না। কাঁচ ঢাকা মেহগনি-ডেস্কের ওপাশে কাগজপত্রের মধ্যে ডুবে রয়েছে নীল আলপাকা অ্যাটপরা একজন হালকা পাতলা সভ্রান্ত চেহারার মাঝবয়সী লোক। রানা ঢুকতেই চশমাটা খুলে রাখল টেবিলের উপর, আট-দশটা আংটি পরা বামহাতে একটা চোখ ডলতে ডলতে। অন্য চোখ দিয়ে চাইল রানার দিকে।
আসুন, মিস্টার রবার্টসন। উঠে দাঁড়াবার বা হ্যাঁন্ডশেক করবার চেষ্টা করল না সে। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব সুখী হলাম। বসুন। আমার নাম গুডবডি, আমিও ইংরেজ।
ভদ্রতার হাসি হেসে মাথা ঝাঁকাল রানা, যেন সত্যিই যে ওর নাম গুডবডি তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বসল সামনের চেয়ারে। সাথে সাথেই কাজের কথায় চলে এল গুডবডি।
আমার সাথে জরুরী কোন ব্যাপারে আলাপ আছে আপনার। কি সেটা?
আমার কাজটা ঠিক আপনার সাথে নয়, বলল রানা। আপনার এক কর্মচারীর সাথে।
মুহূর্তে ফ্রিজিং পয়েন্টে চলে এল গুডবডির শীতল দৃষ্টি। আমার কর্মচারীর সাথে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তাহলে আমাকে বিরক্ত করবার মানে?
ওকে ওর বাসায় পেলাম না। ওখানেই জানতে পারলাম আপনার। এখানে কাজ করে মেয়েটা।
মেয়ে?
হ্যাঁ। ওর নাম হচ্ছে বিট্রিক্স শেরম্যান।
কি নাম বললেন? বিট্রিক্স শেরম্যান। উঁহু। যেন রানাকে সাহায্য করতে পারলে সুখী হত, কিন্তু মা পারায় বিব্রত বোধ করছে, এমনি ভঙ্গিতে বলল লোকটা, এখানে কাজ করে? অনেক মেয়েই কাজ করে এখানে, কিন্তু ওই নামেনাহ, ওই নামে কেউ আছে বলে তো মনে পড়ছে না!
কিন্তু ওর প্রতিবেশীরা যে বলল এখানেই কাজ করে? বোকা হয়ে। যাওয়ার ভাব করল রানা।
নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে কোথাও। স্যামুয়েল?
প্যাঁচামুখ করে মাথা নাড়ল লম্বা লোকটা। ও নামে কেউ নেই আমাদের এখানে।
আগে ছিল? সহজে হাল ছাড়তে চাইল না রানা।
বিরক্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল স্যামুয়েল, এগিয়ে গিয়ে দেয়ালের গায়ে বসানো ফাঁইলিং ক্যাবিনেটের একটা ড্রয়ার টেনে তার মধ্যে থেকে ফাইল বের করল একখানা। ঝপাং করে সেটা রানার সামনে টেবিলের উপর ফেলে বলল, গত একবছর ধরে যত মেয়ে এখানে কাজ করেছে বা করছে তাদের। সবার নাম ঠিকানা লেখা রয়েছে। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন।
এর উপর আর কোন কথা চলে না। ফাইলের দিকে না চেয়ে সোজা। গুডবডির দিকে চাইল সে, হাসল লজ্জিত ভঙ্গিতে। বোঝা যাচ্ছে, ভুল তথ্য দিয়েছে ওরা। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।
রানার উঠি উঠি ভাব দেখে সামান্য একটু প্রসন্নতার আভাস ফুটে উঠল গুডবডির মুখে। হয়তো কৃপা হলো। বলল, আমার মনে হয়, আশেপাশে আরও নাইট-ক্লাব আছে, সেখানে খোঁজ করলে পেয়ে যেতেও পারেন। কথাটা শেষ করবার আগেই চশমাটা লাগিয়ে নিয়ে কাজে মন দিল। ম্যানেজার। খসখস করে লিখছে একটা কাগজের উপর দামী পার্কার বলপেন, দিয়ে। চোখ না তুলেই বলল, গুড ডে, মিস্টার রবার্টসন।
ইতিমধ্যেই দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করছে স্যামুয়েল। রানাও এগোল ওর পেছন পেছন। দরজার কাছে গিয়ে আবার পেছন ফিরল সে। মুখে লজ্জিত হাসি টেনে এনে বলল, সত্যিই অত্যন্ত দুঃখিত
গুড ডে। মাথা তুলবার প্রয়োজন বোধ করল না লোকটা। ব্যস্ত। দুই সেকেন্ড অনিশ্চিত হাসি হেসে সৌজন্যের খাতিরে আস্তে করে ভিড়িয়ে দিল। রানা দরজাটা। মনে মনে আশা করল, কেবল পুরু আর ভারীই নয়, দরজাটা হয়তো সাউন্ডপ্রূফও।
প্যাসেজে দাঁড়িয়ে নিমপাতার রস খাওয়ার হাসি হাসল স্যামুয়েল রানার। দিকে চেয়ে। মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিত করল আগে আগে হাঁটবার জন্যে। রানা। বুবল, ওরই মত অস্বস্তি বোধ করে লোকটা বিপজ্জনক কেউ পিছু পিছু হাটলে। মিষ্টি করে হাসল রানা, পাশ কাটিয়ে সামনে যাওয়ার সময় হাসিমুখেই, অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে কনুইটা চালাল সে প্রচণ্ডবেগে। নাক দিয়ে। হুক শব্দ বেরোল লোকটার, দুভাজ হয়ে গেল ওর লম্বা শরীরটা পেটের। উপর বেমক্কা গুতো খেয়ে। একটাই যথেষ্ট, তবু ফাউ হিসেবে আরেকটা রদ্দা কষিয়ে দিল সে লোকটার ঘাড়ের পাশে। গুলি খাওয়া সাদা বকের মত ভেঙেচুরে পড়ে গেল লোকটা মেঝের উপর।
পিস্তল বের করে সাইলেন্সরটা পেচিয়ে লাগাল রানা ওটার মাথায়। তারপর কলার চেপে ধরে টেনে নিয়ে এল স্যামুয়েলকে আবার ম্যানেজারের। দরজার সামনে। হ্যাঁন্ডেলে চাপ দিয়েই কাঁধের ধাক্কায় খুলে ফেলল দরজা।
চোখ তুলে আঁতকে উঠল গুডবডি। চশমার ওপাশে বিস্ফারিত চোখ আরও বড় দেখাচ্ছে। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে রানার হাতে ধরা। পিস্তলটার দিকে। রানা লক্ষ করল, সামান্য একটু পরিবর্তন হলো লোকটার। মুখের চেহারায়–মানুষ মনের কোন ভাব বা ইচ্ছা গোপন করতে চাইলে যেমন হয়, তেমনি।
উঁহু! ভাল হবে না। মাথা নাড়ল রানা। কোন চালাকি করতে যাবেন। না। কোন বোতামে চাপ দিতে গেলে, কিংবা ডান পাশের ড্রয়ার থেকে পিস্তলটা বের করতে গেলে মারা পড়বেন। কেউ কোন সাহায্য করবার অনেক আগেই।
হাত বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল লোকটা রানার কথা শুনে। এবার সত্যিকার ভীতি দেখা দিল ওর চেহারায়।
দুই ফুট পেছনে সরিয়ে নিন চেয়ারটা।
চেয়ার সরিয়ে নিল গুডবডি। ওর উপর থেকে চোখ না সরিয়েই কলার। ধরে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে এল রানা স্যামুয়েলের জ্ঞানহীন দেহ, পেছনে। হাত বাড়িয়ে বন্ধ করে দিল দরজা, ফুটোয় লাগানো চাবি ঘুরিয়ে দিয়ে পকেটে। ফেলল চাবিটা। ছোট একটা হুঙ্কার ছাড়ল গুডবডির প্রতি, উঠে দাঁড়ান।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল গুডবডি। টেলিফোনটার দিকে একবার চাইল, তারপর বলল, দয়া করে গোলাগুলি ছুঁড়বেন না, মিস্টার রবার্টসন। যা খুশি নিয়ে যান, আপনার কাজে বাধা দেব না আমি। ডাকাতি করতে…
এদিকে আসুন, মাথা ঝাঁকিয়ে কাছে ডাকল রানা। ভয়ে ভয়ে কাছে এসে দাঁড়াল গুডবডি। আপনি জানেন, আমি কে?
কি করে জানব? গুডবডির চেহারায় বিভ্রান্তির ছাপ। এই একটু আগে আপনি বললেন…
যে আমার নাম রবার্টসন। আসলে কে আমি?
ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি
চেঁচিয়ে উঠল লোকটা কানের উপর সাইলেন্সারের এক ওতো খেয়ে। পিস্তলের ফোরসাইট দিয়ে ইঞ্চি তিনেক লম্বা করে চিরে দিল রানা ওর গালটা। কুলকুল করে রক্ত নেমে এল, টপটপ চিবুক বেয়ে পড়ছে সাদা শার্টের উপর।
কে আমি?
মাসুদ রানা। ভীতির পাশাপাশি ঘৃণাও দেখতে পেল রানা এবার ওর দৃষ্টিতে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল লোকটা, ইন্টারপোল।
এই তো বাছার মুখ ফুটেছে। আবার আঘাত করবার ভঙ্গিতে পিস্তলটা উঁচু করল রানা। কিন্তু আঘাত না করে জিজ্ঞেস করল, বিট্রিক্স শেরম্যান কোথায় কাজ করে?
মারের ভয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল গুডবডি, প্রশ্নের উত্তরে চট করে জবাব দিল, এখানে।
কোথায় ও?
জানি না। আপন গড, সত্যিই জানি না। রানাকে আবার পিস্তল তুলতে দেখে শেষের শব্দ দুটো বলতে গিয়ে কয়েক পর্দা চড়ে গেল ওর কণ্ঠস্বর। কানের উপর ঠিক একই জায়গায় ঠকাশ করে বাড়ি পড়ল পিস্তলের বাটের। ফুঁপিয়ে উঠল লোকটা। কিছু বললে ঠিক দুই ঘণ্টার মধ্যে মারা পড়ব আমি!
না বললে মারা পড়বেন দুই সেকেন্ডের মধ্যে। কোনটা ভাল? আবার হাত তুলল রানা। কি? বলবেন?
বলব।
কোথায় ও?
পালিয়ে গেছে। এথেন্সে।
এথেন্সে?
হ্যাঁ। ভোরবেলায় এসেছিল এখানে। দুমাসের বেতন পাওনা ছিল, সেই টাকার জন্যে।
একা?
না, ওর ভাইও ছিল সঙ্গে। দুজনেই পালিয়েছে। আজ সাড়ে দশটার। ফ্লাইটে। বিশ্বাস না হয় ফোন করে জেনে দেখতে পারেন এয়ারপোটে। আমি নিজেই এই কিছুক্ষণ আগে…
রানাকে একটু আন্ডার-এস্টিমেট করেছিল লোকটা। মনে করেছিল, আরও দুতিনটা সেকেন্ডের জন্যে আকর্ষণ করে রাখতে পারবে ওর মনোযোগ। অবাক হলো রানার ঠোঁটে মৃদুহাসি খেলে যেতে দেখে। পাই করে ঘুরেই লাথি চালাল রানা।
পিস্তল বের করে ফেলেছিল স্যামুয়েল। খটাং করে লাথি এসে লাগল ওর কনুইয়ের নিচে হাড়ের উপর। সাঁ করে উড়ে গিয়ে পিস্তল পড়ল ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে। ওর পাজরের উপর আরেকটা লাথি লাগিয়ে উঠে বসবার ইঙ্গিত করল রানা। ফিরল গুডবড়ির দিকে। পিস্তল দিয়ে টেলিফোনের দিকে ইশারা করে বলল, ডায়াল করুন।
ডায়াল করে তিনবারের চেষ্টায় কানেকশন পেল গুডবডি, রানার দিকে এগিয়ে দিল রিসিভারটা।
আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার বলছি, বুলল রানা। আজকের এথেন্স ফাঁইট সম্পর্কে জানতে চাই খুব সম্ভব কে এল। এমই হবে। বিট্রিক্স শেরম্যান আর হেনরী শেরম্যান বলে দুজন কি এই। ফ্লাইটে কী বললেন?
অপর প্রান্ত থেকে পরিষ্কার কণ্ঠে উত্তর এল, আজ সকাল সাড়ে দশটার। ফাঁইটে এরা দুজন চলে গেছেন এথেন্সে। হেনরী শেরম্যানের ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি উঠেছিল, কিন্তু তেমন কোন অসুবিধে হয়নি, দুজন একসাথেই উঠেছেন প্লেনে।
ধন্যবাদ জানিয়ে নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার।
গুডবডি আর সাপের বাচ্চা স্যামুয়েলকে ঘরের এককোণে পেছন ফিরে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এল রানা। দরজায় তালা মেরে দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে চাবিটা ঢুকিয়ে দিল কার্পেটের নিচে। অ্যালার্ম বেল। রয়েছে, টেলিফোন রয়েছে, স্পেয়ার কী সংগ্রহ করে এই ঘর থেকে বেরোতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না ওদের। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল সে। ব্যালিনোভার সদর দরজা খুলে।
বিট্রিক্সের এই হঠাৎ অন্তর্ধানে বেশ দুঃখই বোধ করল রানা। সাহায্য করব বলে করেনি, সেজন্যে নয়; নিজের অজান্তেই নিজেরই সব পথ বন্ধ করে দিল বেচারী। ওর উপর ভরসা রাখতে পারেনি মেয়েটা। একটি মাত্র কারণে ওর প্রভুরা এখনও খুন করেনি ওকে–ওরা জানে এই হত্যার সাথে জড়িয়ে। দেবে রানা ওদের।
এখন আর কোন বাধাই রইল না।
.
০৩.
বন্দরের কাছেই বিশাল স্কাইস্ক্র্যাপার হ্যাঁভেঞ্জবো। এর ছাতে দাঁড়ালে গোটা অ্যামস্টার্ডাম শহরটা দেখতে পাওয়া যায় এক নজরে। চমৎকার দৃশ্য। কিন্তু দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে ওঠেনি রানা এখানে।
জোর হাওয়া বইছে সমুদ্রের দিক থেকে। শীতল। ঝলমল করছে চারদিক উজ্জল রোদে। উদ্বেল সমুদ্রে ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা। রানার চোখে বিনকিউলার। চেয়ে রয়েছে দূর সমুদ্রের দিকে।
অবজার্ভেশন প্ল্যাটফর্মে টুরিস্টদের ভিড়ে মিশে গেছে রানা। কাঁধে ক্যামেরা হাতে বিনকিউলার-আর সব টুরিস্টদের থেকে আলাদা করবার। কোন উপায় নেই। এপাশ-ওপাশ থেকে মুগ্ধ বিস্ময়ের ধ্বনি ভেসে আসছে ওর, কানে, হাওয়ায় উড়ছে মহিলা টুরিস্টদের চুল, একদল আসছে, দেখছে ঘুরে। ফিরে, চলে যাচ্ছে, আবার আসছে আরেক দল, কিন্তু কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই রানার। স্থির হয়ে রয়েছে ওর দৃষ্টিটা বহুদূরের একটা কোস্টারের উপর। এক হাজার কি বারোশো টনের কোস্টাল স্টীমার, বাঁকা হয়ে ঘুরে ধীরগতিতে গদাই লশকরী চালে এগোচ্ছে জেটির দিকে। এতদূর থেকেও বেলজিয়ান ফ্যাগ দেখতে পেল রানা পরিষ্কার, বাতাসে উড়ছে আগুনের শিখার মত। বয়ালোর একেধারে ধার ঘেঁষে এগোচ্ছে কোস্টারটা। কেন?
অত্যন্ত মনোযোগের সাথে লক্ষ করল রানা ওটার গতিবিধি, ঘাটের কাছে এসে নোঙর ফেলা। ঘড়ি দেখল। দুপুর দেড়টা। ক্যাপ্টেনের সময়জ্ঞান যে টনটনে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু আইন শৃঙ্খলাবোধ যে তেমনি ঢিলে তাতেও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আবছা হলেও নামটা পড়তে পারছে রানা এখন, হলুদ রঙ দিয়ে লেখা আছে ওটার গায়ে-মেরিনো।
এপাশের বার্জ-বন্দরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভালমত দেখে নিয়ে নেমে পড়ল রানা অবজার্ভেশন টাওয়ার থেকে। পথ চলতে চলতে হঠাৎ চোখ পড়ল ওর হ্যাঁভেন রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডের উপর। খিদে নেই, তবু ঢুকে পড়ল রানা ভেতরে-চাট্টে খেয়ে নেয়া দরকার। পরে আর কবে কখন সুযোগ হবে কে জানে।
দুপুর দুটোর দিকে পৌঁছুল রানা হোটেল প্লাযায়। ডেস্কে জানা গেল ফেরেনি এখনও সোহানা বা মারিয়া। লাউঞ্জে অপেক্ষা করবে, বলল রানা লোকটাকে। একটা সোফায় গিয়ে বসল ও, কিন্তু রিসেপশনিস্ট একটু অন্যমনস্ক হতেই চট করে উঠে পড়ল লিফটে। চারতলায় উঠে সোজা গিয়ে ঢুকল সে সোহানাদের কামরায়। দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল একটা আরামকেদারায়। গদিটা একটু নরম ঠেকল-বোঝা গেল, আগের হোটেলের চেয়ে এটার স্ট্যান্ডার্ড কিছুটা উঁচু; ওটা যদি উনিশ হয়, এটা বিশ।
ঘণ্টাদেড়েক শুয়ে শুয়ে পাতা ওল্টাল রানা ভুলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী থেকে পাওয়া ইনভয়েস ফাইলের। বিভিন্ন প্রস্তুতকারকের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের মাল সাপ্লাই পেয়েছে এরা। কিন্তু কয়েকশো ইনভয়েস ঘাটতেই একটা নাম ঠিকানা প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল রানার। গত ছয়মাসে কমপক্ষে বিশ বার মাল সাপ্লাই দিয়েছে এরা এই কোম্পানীকে। মালের ধরনটা রানার ধারণার সাথে মিলে গেল অনেকটা মনে মনে বারকয়েক উচ্চারণ করে ঠিকানাটা মুখস্থ করে নিল সে।
ক্লিক শব্দ তুলে তালা খুলল দরজার, ঘরে ঢুকল সোহানা আর মারিয়া। রানাকে দেখামাত্রই একটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল দুজনের চোখেমুখে, পরমুহূর্তে বিরক্ত ভঙ্গিতে ভ্রূ কোঁচকাল ওরা একসাথে। নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল রানা, কি ব্যাপার? ঘটনা আছে বলে মনে হচ্ছে?
আমাদের এরকম বোকা বানাবার কি অর্থ? ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল। মারিয়া। ডেস্কের লোকটা বলল লাউঞ্জে অপেক্ষা করছেন.আপনি আমাদের। জন্যে…এটা কি লাউঞ্জ হলো?
আধঘণ্টা হাঁ করে বসে থাকলাম আমরা লাউঞ্জে, বলল সোহানা। চলে গেছ মনে করে ফিরে এলাম ঘরে। না এলে আরও কয়ঘণ্টা বসে থাকতে হত ওখানে কে জানে!
ক্লান্তি লাগছিল খুব, একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম, বলল রানা। যাই হোক, মাফটাফ চাওয়া হয়ে গেল, এবার শোনা যাক কে কতদূর কি করলে?
কোথায় মাফ চাওয়া হলো? একেবারে আকাশ থেকে পড়ল মারিয়া। একটু নরম করে কথা বলা মানেই মাফ চাওয়া এবং পাওয়া হয়ে গেল?
বসদের জন্যে ওটুকুই যথেষ্ট। এবার কাজের কথা কে শুরু করবে, তুমি, না সোহানা?
খুব বেশি কিছু বলবার নেই। আপনার সেই বিট্রিক্স শেরম্যান
পালিয়েছে। তোমাদের মেসেজ পেয়ে আমি খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। ভেগেছে।
ভেগেছে মানে?
দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
দেশ ছেড়ে পালিয়েছে?
এথেন্সে।
কেন?
ভয়ে। ওর এক কাঁধে ভর করেছিল খারাপ লোক, আরেক কাঁধে ভাল। লোক–মানে, আমি। দিশে হারিয়ে একেবারে পগার পার হয়ে গেছে।
কি করে জানলে যে সত্যিই পালিয়েছে ও?
ব্যালিনোভার ম্যানেজারের কাছে শুনলাম, তারপর এয়ারপোর্টে ফোন। করেও জানা গেল, ব্যাপারটা সত্যি।
বেশ। তাহলে একটা ঝামেলা চুকল। এবার অন্য কাজের রিপোর্ট দেয়া। যাক। কারটা শুনবে আগে…আমি, না মারিয়া।
আগে এটা দেখো। একটা কাগজের টুকরো এগিয়ে দিল রানা সোহানার দিকে। তার উপর স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা রয়েছে 910020 দেখো তো এর কোন অর্থ বের করা যায় কিনা?
নানান ভাবে দেখল সোহানা নম্বরটা–সোজা করে, উল্টে নিয়ে, কাত করে। কাগজের উল্টোপিঠ দেখল। তারপর মাথা নাড়ল। নাহ। আমার মাথায় ঢুকছে না কিছু।
দেখি, আমি দেখি? হাত বাড়াল মারিয়া। ক্রসওয়ার্ডে আমার তুলনা হয় না। সত্যিই তুলনা হয় না। কাগজটা হাতে নিয়ে তিন সেকেন্ড ওটার দিকে চেয়ে থেকে বলল, নম্বরটা উল্টে নিন। জিরো টু ডাবল জিরো ওয়ান নাইন। রাত দুটোউনিশ তারিখ। অর্থাৎ আগামীকাল রাত দুটো। ঠিক এগারো ঘণ্টা পর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
প্রশংসার দৃষ্টি ফুটে উঠল রানার চোখে। মুখে বলল, দারুণ! মারিয়া। যেটী তিন সেকেন্ডে বুঝে ফেলেছে সেটা বের করতে ওকে প্রায় দেড়ঘণ্টা ব্যয়। করতে হয়েছিল।
কি ঘটতে চলেছে? সরাসরি জানতে চাইল সোহানা।
লেখক সেটা উল্লেখ করতে ভুলে গেছে। সোহানা, মারিয়া দুজনেই বুঝল কিছু একটা চেপে যাচ্ছে রানা ওদের কাছে, এ-ও বুঝল যে রানা জানে। যে ওরা বুঝে ফেলেছে। কাজেই আপাতত চুপ করে রইল ওরা দুজনেই। রানা বলল, মারিয়া তুমি ফাস্ট হয়েছ, তোমার রিপোর্ট দিয়েই শুরু করা। যাক।
এই নতুন ড্রেসটা পরলাম, কারণ এটা ইরিন দেখেনি আগে। বাতাস ছিল, একটা স্কার্ফও জড়িয়ে নিয়েছিলাম মাথায়। সেইসাথে…
একটা গাঢ় রঙের সানগ্লাস পরে নিয়েছিলে চোখে। বলল রানা।
হ্যাঁ। রানার সানগ্লাসের কথা বলবার অর্থ আজেবাজে বিবরণ বাদ দিয়ে আসল কথায় এসো, বুঝল মারিয়া, কিন্তু পাত্তা দিল না। অফিশিয়াল রিপোর্টে কোথাও ফাঁক রাখবার অভ্যেস তার নেই, একেবারে নিখুঁতভাবে কর্তব্য পালন করতে না পারলে ভাল লাগে না ওর। বলল, একটু আগেই চলে গিয়েছিলাম। আধঘণ্টা রিটায়ার্ড বুড়ো আর বাচ্চাদের প্র্যামের ভিড় বাঁচিয়ে ঘুরলাম এদিক ওদিক। তারপর দেখতে পেলাম ওকে। ওকে ঠিক না, ওর সাথের সেই বিশাল মোটা বুড়িটাকে। ঠিক পুতুলের মত ড্রেস। পাশেই ইরিন। সাদা একটা ফুলহাতা কটন ড্রেস পরেছে, কোথাও একদণ্ড স্থির থাকতে পারছে না, সর্বক্ষণ তিড়িং বিড়িং লাফাচ্ছে বাচ্চা ছাগলের মত। একটু থেমে বলল, মেয়েটা দেখতে কিন্তু খুবই সুন্দরী।
তোমার অন্তরটা মহৎ, মারিয়া।
ইঙ্গিতটা বুঝল মারিয়া। বলল, যাই হোক, খানিক ঘোরাঘুরি করে, পায়রাদের বুট খাইয়ে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল ওরা। আমিও গজ তিরিশেক দুরে একটা বেঞ্চে বসে একটা ম্যাগাজিনের উপর দিয়ে চোখ রাখলাম ওদের ওপর। ডাচ ম্যাগাজিন।
চমৎকার! তারপর?
তারপর পুতুলের চুল আঁচড়াতে শুরু করল ইরিন। আমি…
দাঁড়াও, দাঁড়াও। পুতুল? পুতুল কিসের?
বলিনি বুঝি? বড়সড় একটা পুতুল ছিল ওর হাতে। চুল আঁচড়াচ্ছে, এমনি সময় দোহারা চেহারার একজন লোক এসে বসলেন ওদের পাশে। কালো একটা ওভারকোট, প্রিস্ট কলার, সাদা গোফ, মাথাভর্তি ধবধবে পাকা চুল। খুব ভাল লোক বলে মনে হলো।
মাথা ঝাঁকাল রানা। রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস রজারকে ভাল না লেগে উপায় নেই কারও।
ইরিনকে মনে হলো ভদ্রলোকের খুব বড় ভক্ত একজন। আপনাকে যেভাবে ধরেছিল, সেইভাবে জড়িয়ে ধরল বুড়ো লোকটার গলা, কানে কানে কি যেন বলল। ভদ্রলোক কথাটা শুনে এমন ভাব করলেন যেন চমকে গেছেন মেয়েটার প্রস্তাবে। আসলে ভান। হাসিমুখে পকেট থেকে কি যেন বের করে গুঁজে দিলেন ইরিনের হাতে। খুব সম্ভব পয়সা। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে। দাঁড়াল মেয়েটা, লাফাতে লাফাতে ছুটল একটা আইসক্রীম ভ্যানের দিকে। আইসক্রীম কিনে সোজা হাঁটতে লাগল আমার দিকে।
তুমি ভাগলবা?
আরও খানিকটা উঁচু করে ধরলাম ম্যাগাজিনটা। গভীরভাবে বলল মারিয়া। আমার সামনে দিয়ে চলে গেল ও বিশ গজ দূরে দাঁড়ানো আরেকটা খোলা ভ্যানের দিকে!
পুতুল দেখতে?
আপনি জানলেন কি করে? জানা খবর জানাচ্ছে মনে করে হতাশ হয়ে পড়ল মারিয়া।
আন্দাজ। অ্যামস্টার্ডামে ভ্যান বলতে প্রতি দুটোর মধ্যে একটা পুতুল বিক্রির ভ্যান বোঝায়।
তারপর পুতুল ঘাটাঘাটি শুরু করল মেয়েটা। কোনটা কোলে নেয়, কোনটাকে চুমো খায়। ফেরিওয়ালা বুড়ো রেগে ওঠার চেষ্টা করল বারকয়েক, কিন্তু, অমন একটা মেয়ের ওপর কি রাগ করা যায়? ভ্যানের ওপাশে চলে গেল মেয়েটা। কোলের পুতুলটাকে আইসক্রীম সাধছে। বারবার।
এই সময়ে বুড়ো আর বুড়ি কি করছিল?
গল্প করছিল। নাকে-মুখে কথা বলছিলেন বুড়ো ভদ্রলোক, মাথা। ঝাঁকাচ্ছিল বুড়ি। খানিক বাদেই ফিরে এল ইরিন। তিনজনে গল্প করল আরও কিছুক্ষণ, তারপর ইরিনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে উঠে পড়লেন প্যাসটর, বাকি দুজনও রওনা হয়ে গেল বাড়ির পথে।
প্যাসটর আলাদা, বাকি দুজন আলাদা?
হ্যাঁ।
এদের কাউকে অনুসরণ করবার চেষ্টা করেছিলে?
না।
গুড গার্ল। তোমাকে কেউ অনুসরণ করেছিল?
মনে হয় না।
অর্থাৎ, শিওর না?
অনেকেই সেই সময় পার্ক ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। কেউ অনুসরণ করছে, কিনা বোঝার উপায় ছিল না। নিশ্চিত হয়ে কিছুই বলা যায় না। তবে ফিরে আসবার সময় সোহানার সাথে দেখা হয়ে গেল মাঝপথে, তিনবার ট্যাক্সি আর দুইবার ট্রাম বদলে এই হোটেলে পৌঁছেছি–মনে হয় না, কেউ অনুসরণ করতে পেরেছে।
এবার সোহানা। সোহানার দিকে ফিরল রানা।
হোস্টেল প্যারিসের ঠিক উল্টোদিকে একটা কাফে আছে। সেটার মধ্যে ঢুকে বসেছিলাম আমি। অনেক মেয়েই ঢুকল বেরোল। চতুর্থ কাপ কফি শেষ করে একটা মেয়েকে পেয়ে গেলাম–কাল রাতে দেখেছি ওকে গির্জায়। লম্বা, ব্রুনেট, দারুণ দেখতেতুমি একবার দেখলেই…
প্রেমে পড়ে যেতাম? অসম্ভব। তোমাদের দুইজনের প্রেমেই অস্থির হয়ে। আছি, প্রাণ যায় যায়। আপাতত আর কারও প্রেমে পড়ার তেমন ইচ্ছে নেই। কাল নানের বেশে দেখেছ তুমি ওকে। কি করে বুঝলে ব্রুনেট কিনা? চুল তো আর দেখতে পাওনি?
বাম গালে একটা আঁচিল ছিল মেয়েটার।
লাল আঁচিল? চীফ বোনের উপর না? সবুজ চোখ? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।
হ্যাঁ, হ্যাঁ-ওই মেয়েটাই। ধিঙ্গিমার্কা হাঁটা। হাল ছেড়ে দিল রানা। বুঝল, এসব ব্যাপারে কোনরকম সন্দেহ পোষণ করবার কোন মানে হয় না। অকপটে আস্থা রাখা যায় মেয়েদের উপর। এক সুন্দরী মেয়ে যখন আরেক সুন্দরী মেয়েকে দেখে তখন লঙরেঞ্জ দুরবীন হয়ে যায় ওদের চোখ। ওই মেয়েটার পেছন পেছন ক্যালভারস্ট্রাটে গিয়ে পৌঁছুলাম, বলে চলল সোহানা। বিরাট একটা দোকানে ঢুকল মেয়েটা। প্রথমটায় মনে হলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবোলতাবোল, কিন্তু দেখলাম খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেই, সুভ্যেনির, এক্সপোর্ট ওনলিলেখা একটা কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াল। এটা-ওটা-সেটা ঘাটাঘাটি করছে ঠিকই, কিন্তু পাপেটগুলোর প্রতিই যে ওর আসল আগ্রহ। বুঝতে পারলাম আমি পরিষ্কার।
চমৎকার! বলল রানা। আবার সেই পুতুল। কি করে বুঝলে ওর আগ্রহটা ওই দিকেই?
এমনিই বুঝতে পারলাম, এমন সুরে বলল সোহানা যেন জন্মান্ধকে রঙের পার্থক্য বোঝাবার চেষ্টা করছে। দেখলাম, বিশেষ এক ধরনের পুতুলের প্রতিই ওর আগ্রহ বেশি, নাড়াচাড়া করছে। আমি বুঝলাম, ওটা নোক দেখানো, কোনটা কিনবে ঠিক করাই আছে ওর মনে মনে। এটা ওটা নেড়েচেড়ে শেষ পর্যন্ত পুতুল পছন্দ করল, একজন সেলসম্যানকে কিছু বলল, লোকটা কি যেন লিখে দিল একটা কাগজের টুকরোয়।
কতক্ষণ লাগল লিখতে?
বেশি না। একটা ঠিকানা লিখতে যতটা সময় লাগে, ততটা। দাম চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল মেয়েটা।
ওকে অনুসরণ করলে তুমি?
না। দেড়টায় মারিয়ার সাথে দেখা করবার কথা ছিল, তাই দোকান থেকে বেরিয়ে হাঁটা দিলাম অন্যপথে। আমিও গুড গার্ল, না?
হ্যাঁ।
কেউ অনুসরণ করেনি আমাকে। বলেই হাসল। খুব সম্ভব।
দ্যাটস গুড। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল রানা, তারপর ঘোষণা করল, ওয়েল ডান। অকম্মার টেকি তোমরা। আই লাভ ইউ বোথ।
চোখ মটকে পরস্পরের দিকে চাইল সোহানা আর মারিয়া। সিরিয়াস টাইপের মেয়ে মারিয়া ডুক্লজ। প্রথম দিকে যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সাথে গ্রহণ করেছিল রানাকে, কিন্তু গত দুইদিনে কিছুটা সোহানার কাছ থেকে শুনে, কিছুটা নিজে থেকেই পরিষ্কার বুঝে নিয়েছে সে রানার চরিত্র। পৃথিবীর সেরা দশজন স্পাইয়ের একজন রানা, জানা আছে ওর, ভেবেছিল, না জানি কেমন দাপট আর অহঙ্কার থাকবে লোকটার। ভয়-ভয় একটা ভাব ছিল ওর পুরো একটা দিন। কিন্তু যে মুহূর্তে বুঝতে পেরেছে আশ্চর্য এক করুণার ধারা, রয়েছে এই গভীর লোকটার বুকের ভেতর, যন্ত্র নয়–সত্যিকার মানুষের মতই মায়া-মমতা আর গভীর সহানুভূতি রয়েছে ওর মানুষের জন্যে, বাইরের শক্ত খোলসের আড়ালে রয়েছে একটা হাসিখুশি, নিরহঙ্কার অমায়িক মন, সেই মুহূর্তেই দূর হয়ে গেছে ওর সমস্ত ভয়। সোহানার মতই সহজভাবে গ্রহণ করেছে সে রানাকে। বলল, দ্যাট ইজ ভেরি নাইস অফ ইউ।
হ্যাঁ। সাধারণ দুই টাইপিস্টের পক্ষে এটাকে পরম সৌভাগ্যই বলা যায়। আচ্ছা সোহানা, যে পুতুলটা পছন্দ করল, সেটা ভালমত দেখেছ তো?
দেখছি। অনেক পয়সা খরচ করে অবজার্ভেশন ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। আমাকে।
ভুরুজোড়া কপালে তুলে বারকয়েক পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল রানা। সোহানাকে বাকা দৃষ্টিতে, তারপর বলল, সুসংবাদ। হাইলারের কস্টিউম। পরা পুতুল ছিল ওটা। ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম আমরা ওয়েরহাউজে।
আশ্চর্য! তুমি জানলে কি করে?
বলতে পারতাম ইনটিউশন, কিংবা বলতে পারতাম অনেক পয়সা খরচ করে আন্দাজ ট্রেনিং দেয়া হয়েছে আমাকে, কিংবা এটা একটা বিশেষ প্রতিভা। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে কিছু তথ্য জানা আছে আমার যেটা তোমরা জানো না।
বললেই জানতে পারি। বলে ফেলো।
উঁহু। মাথা নাড়ল রানা।
কেন নয়? ভুরু নাচাল সোহানা। আমাদের মানুষ বলে গণ্য করো না তুমি?
করি। তবে ঠিক মানুষ বললে ভুল বলা হবে। তোমাদের আমি। মেয়েমানুষ বলে গণ্য করি। খারাপ অর্থে নয়, ভাল অর্থেই মেয়েমানুষ। এসব কথা তোমাদের জানানো যায় না এজন্যে যে অ্যামস্টার্ডামে খুব একটা নিরাপদ নও তোমরা। এখানে এমন একটা দল আছে যারা ইচ্ছে করলেই যে-কোন সময় যে-কোনখান থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারে তোমাদের, পুরে দিতে পারে নিরিবিলি, অন্ধকার কোন কুঠুরিতে। যা জানা সব গড়গড় করে বলে দিতে বাধ্য হবে তাহলে তোমরা।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল-সোহানা। তারপর বলল, তোমাকে ধরলে তুমিও বলবে।
হয়তো তাই মেনে নিল রানা। নির্যাতন সহ্য করবার ক্ষমতা সবার সমান হয় না; কিন্তু সবারই একটা শেষ সীমা আছে। ওটা পেরিয়ে গেলে আমিছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব থাকে না মানুষের কাছে। ওই পর্যায়ে গেলে হয়তো আমিও বাধ্য হব সব কথা বলতে। কিন্তু তোমরা দুজন সেই পর্যায়ে। নিতে পারবে না আমাকে। আর ওদের পক্ষে আমাকে নিরিবিলি অন্ধকার। কোন কুরিতে পুরে দেয়া খুব একটা সহজ কাজ হবে না। ইনভয়েসের ফাইলটা হাতে তুলে নিল রানা। ক্যাসটিল লিভেন বলে কোন প্রতিষ্ঠানের। নাম শুনেছ কখনও? শোনোনি? আমিও না। এর মধ্যে পেলাম নামটা। দেখা যাচ্ছে ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীকে প্রচুর দেয়ালঘড়ি সাপ্লাই দিয়ে থাকে এরা।
তাতে কি? প্রশ্ন করল মারিয়া।
নিঃসন্দেহ হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে কোন সম্পর্ক থাকতেও পারে আমাদের অ্যাসাইনমেন্টের সাথে। বিট্রিক্স থাকলে ওকে লাগানো যেত এই ব্যাপারে, কিন্তু ও ভড়কে গিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় কাজটা আমাকেই করতে হবে। এখন। ঠিক আছে, কাল দেখা যাবে, এটা নিয়ে এখন তেমন কোন চিন্তা নেই।
আমাদের ওপর ভার দিলে আজই সেরে রাখতে পারি আমরা কাজটা, বলল মারিয়া। একদিন এগিয়ে থাকবেন তাহলে। আমরা ওই ক্যাসটিলে গিয়ে..
না। সোজা মারিয়ার চোখের দিকে চাইল রানা। গম্ভীর। আমার নির্দেশ ছাড়া যদি কোনকিছু করতে যাও, নেক্সট প্লেনে ফিরে যেতে হবে। প্যারিসে। তাও আবার হেঁটে উঠতে পারবে না প্লেনে, কফিনের মধ্যে শুয়ে পা আগে মাথা পেছনে, এই অবস্থায় উঠতে হবে। আমিও খুব খুশিমনে বিদায় দিতে পারব না তোমাদের–কারণ পুরো একটা বেলা নষ্ট হবে আমার ওই দুর্গের পরিখা থেকে তোমাদের লাশ খুঁজে বের করতে। বোঝা গেছে?
একসাথে মাথা নাড়ল সোহানা আর মারিয়া। ফাইলের কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। ব্যস, আজকের দিনের জন্যে তোমাদের ছুটি। কাল সকালে দেখা হবে, ইনশাল্লাহ।
আর তুমি? রানাকে দরজার দিকে রওনা হতে দেখে চট করে ওর। কোটের হাতা খামচে ধরল সোহানা। কাল সকাল পর্যন্ত তুমি কোথায় কি করছ?
বিকেলে গাড়িতে করে গ্রামের দিকে বেড়াতে যাব ভাবছি। উন্মুক্ত হাওয়ায় মাথাটা পরিষ্কার করে আনব। তারপর ঘুম। তারপর হয়তো নৌকাভ্রমণে বেরোতে পারি।
রাত দুটোয়? প্রশ্ন করল মারিয়া।
চট করে ওর মুখের দিকে চাইল রানা। যতটা ভেবেছিল, তার চেয়ে। অনেক বেশি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি রাখে মেয়েটা। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিতেই খামচে ধরল সে রানার আরেক হাতের আস্তিন। দুজনের চোখের দৃষ্টিতে অনুনয় দেখতে পেল রানা। বুঝল, কিছু একটা টের পাচ্ছে ওরা, যেটা ও নিজে বুঝতে পারছে
প্লীজ! বলল মরিয়া। আপনার একা যাওয়া ঠিক হবে না। ভয়ানক কোন বিপদ ঘটতে যাচ্ছে আজ রাতে। আমরাও যাব। অন্তত পেছন থেকে যেন কোন অতর্কিত আক্রমণ না হয়, সেটুকু দেখতে পারব আমরা।
সেসব আরেকদিন দেখো। আজ না। আমার জন্যে ভেব না। বিপদ কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা আমার আছে। তোমরা এই ঘরে বসে থেকেও আমার চেয়ে অনেক বেশি বিপদে পড়তে পারো। কিছুই বলা যায় না।
কিন্তু কথাটা শোনার সাথে সাথেই মনে হলো, কেউ যেন আমার কবরের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল। আমি বুঝতে পারছি, আজ রাতে লাক ফেভার করবে না আপনাকে।
লাক ইজ ইনফ্যাচুয়েটেড উইথ দ্য এফিশিয়েন্ট! মুখস্থ বুলি ঝেড়ে দিল। রানা সুযোগ পেয়ে। আর একটা কথা। আগামী চব্বিশ ঘণ্টা তোমাদের জন্যে ঘর থেকে যত কম বেরোতে পারো ততই মঙ্গল। যদি একান্তই বেরোতে হয়, লোকজনের মধ্যে থাকবে–এমন কোথাও, যেখান থেকে খপ করে মুখ চেপে ধরে একটানে গাড়িতে তোলা যায় না। খেয়াল রেখো, তোমাদের পরিচয়। জানা হয়ে গেছে ওদের।
রাত দুটোর সময় যেতেই হবে তোমার ওই কোস্টারে? এবার আক্রমণ এল সোহানার তরফ থেকে।
কি আছে তাতে? তুমি তো জানো আমাকে, সোহানা। তুমি…
থেকে যাও, প্লীজ! রানা! মারিয়া ঠিকই বলেছে। ভয়ানক অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে আজ রাতে।
হ্যাঁ, কথাটা একটু ঘুরিয়ে নিল মারিয়া। সোহানা বলতে চায়, আমাদেরও তো কিছু অমঙ্গল ঘটে যেতে পারে। আজ রাতটা থেকে যান আমাদের সাথে।
তুমি একা হলে সানন্দে রাজি হয়ে যেতাম, মারিয়া, মৃদু হেসে বলল রানা। কিন্তু দুজনকে দুপাশে নিয়ে ঘুমোতে আমার খুব লজ্জা লাগে। তাছাড়া সোহানাটা দারুণ পাজি, হয়তো তোমার দিকে পাশ ফিরতেই দেবে। সারারাত, তার ওপর দেশে ফিরে যা-তা রটাবে তোমার-আমার নামে।
এসব কথায় হাসি এল না ওদের কারও মুখে। হাল ছেড়ে দিল সোহানা। হাত ধরে টানল মারিয়ার।
ওকে কিছু বলে লাভ নেই, মারিয়া। তার চেয়ে একখণ্ড পাথরের সাথে কথা বলা বরং ভাল। সিদ্ধান্ত নিয়েছে যখন, ঠেকানো যাবে না ওকে, ও যাবেই।
কথাটা বলেই উঁচু হয়ে চট করে একটা চুমু খেলো সোহানা রানার গালে, দেখাদেখি মারিয়াও তাই করল রানার আরেক গালে। বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রানা এপাশ-ওপাশ।
দেখো, বসের সাথে এরকম ব্যবহার করাটা খুবই অন্যায়। এসব ডিসিপ্লিনের জন্যে খুব ক্ষতিকর। ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্বলতা তোমাদের পরিহার করবার চেষ্টা করা উচিত। বসের গালে চুমো খাওয়া কি?
গজর গজর করতে করতে বেরিয়ে গেল রানা আর কাউকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে।
নিজের হোটেলে ফেরার পথে দুইশীট বাউন পেপার আর কিছু সুতো কিনে নিল রানা। ঘরে ঢুকে একসেট জামাকাপড় সুন্দর করে ভাজ করে। পেপার মুড়ে প্যাকেট তৈরি করল একটা। প্যাকেটের উপর যা-তা আবোল তাবোল নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে তরতর করে নেমে এল নিচে। ডেস্কে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।
পোস্ট অফিসটা কোনদিকে হবে বলুন তো? জিজ্ঞেস করল রানা।
একগাল হাসল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নাম-ঠিকানা লেখা প্যাকেটটা দেখল। এসব কাজ আমাদের ওপর নিশ্চিন্তে চাপাতে পারেন, মিস্টার মাসুদ রানা।
তা তো নিশ্চয়। কিন্তু আপাতত আপনাদের কষ্ট না দিয়ে এটা নিজের হাতে পোস্ট করতে চাই।
ও, আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। বলল লোকটা। রানা মনে মনে বলল কচু বুঝেছিস শালা। আসল ব্যাপার, ও চায় না বগলের নিচে প্যাকেট নিয়ে। ওকে হোটেল থেকে বেরোতে দেখে কেউ অতিরিক্ত কৌতূহলী হয়ে উঠুক। পোস্ট অফিসের ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রানা।
পুলিসকারের বুটে কাপড়ের প্যাকেটটা রেখে সোজা উত্তর দিকে গাড়ি হাকাল রানা। শহর ছাড়িয়ে চলে এল শহরতলিতে, তারপর আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে চলল গ্রামের দিকে। রাস্তার ডানদিকে উঁচু পাড় থাকায় দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরই অনুভব করতে পারল রানা, সমুদ্রের ধার ঘেঁষে এগোচ্ছে সে এখন। বেশিদূর নেই আর হাইলার দ্বীপ। রাস্তার বামদিকে মাইলের পর মাইল নিচু জমি দেখা যাচ্ছে–সী-লেভেল থেকেও বেশ খানিকটা নিচু। প্রকৃতির সাথে কঠোর সংগ্রাম করে এরা নিজেদের অস্তিত্ব কেবল টিকিয়ে রেখেছে তাই নয়, দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বীর জাতি হিসেবে, ভাবতে গিয়ে শ্রদ্ধাবোধ জাগল ওর অন্তরে। অনেক আগেই এদের হারিয়ে যাওয়ার কথা সাগরের তলে। ডাইক বেধে ঠেকিয়ে দিয়েছে ওরা। শত্রুকে, বেড়ি দিয়েছে সমুদ্রের পায়ে।
একটা সাইনপোস্টে রানা দেখল হাইলার আর পাঁচ কিলোমিটার। কয়েকশো গজ গিয়েই বয়ে একটা সরু রাস্তা পেয়ে সেই পথ ধরে চলে গেল। আরও কয়েকশো গজ। ছোট্ট একটা গ্রাম। পোস্ট অফিস আছে, পাবলিক টেলিফোন বুদও দেখা যাচ্ছে একটা সাথেই লাগানো। পোস্ট অফিসের সামনে পার্ক করে গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়ল রানা, দরজা আর বুট লক করে। দিয়ে রওনা হয়ে গেল মেইন রোডের দিকে।
বড় সড়কে পৌঁছে রাস্তা পেরিয়ে ডাইক বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল সে। ঘাস বিছানো ঢাল বেয়ে উপরে উঠেই দেখতে পেল সেসমুদ্র। নীল জলে। শেষ বিকেলের রোদ পড়ে আশ্চর্য মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বেশ জোর। একটা শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে সমুদ্র থেকে ডাঙার দিকে। বহুদূরে কালো একটা রেখার মত দেখা যাচ্ছে বকা তীর। তার ওপাশে জমির কোন চিহ্ন দেখা যায় না। এখান থেকে একমাত্র দর্শনীয় বস্তু হচ্ছে উত্তর-পূর্বদিকের মাইলখানেক দূরের একটা দ্বীপ।
এরই নাম হাইলার দ্বীপ। যদিও পুরোপুরি দ্বীপ বলা যায় না একে। এককালে এটা দ্বীপ ছিল, কিন্তু কারিগরি উন্নতির যুগে ওটাকে আর আলাদা থাকতে দেয়নি এদেশের প্রেকৌশলীরা। মেইনল্যান্ড থেকে উঁচু করে পাথরের বাঁধ তৈরি করে নিয়ে গেছে ওই দ্বীপে। বাধের উপর দিয়ে টারম্যাকারে চমৎকার হাইওয়ে। আদি দ্বীপবাসীদের অদ্ভুত আচার-আচরণ, পোশাক পরিচ্ছদ আর লোকনৃত্য দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য ট্যুরিস্ট আসে এখানে। বাধের খরচ উঠে গেছে কবে!
এখান থেকে দেখে অবশ্য তেমন কিছু মোহিত হওয়ার কারণ খুঁজে পেল রানা। দেখে মনে হচ্ছে এত নিচু যে দশ ফুট উঁচু একটা ঢেউ এলেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বাড়ি-ঘর, খামার, হাট-বাজার, সব। বেশির ভাগই ধু-ধু করছে মাঠ, মাঝে মাঝে এক আধটা খামার বাড়ি, সোলা। দ্বীপের পশ্চিম দিকে মুখ করে গড়ে উঠেছে একটা ছোটখাট মফঃস্বল শহর। ওপাশে বন্দরের একাংশও দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দ্বীপের বুকে বেশ কয়েকটা ক্যানেল চকচক করছে। যা দেখবার দেখে নিয়ে আবার রাস্তায় নেমে এল রানা। গজ পঞ্চাশেক এগিয়েই পেয়ে গেল বাসস্ট্যান্ড। একটা সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই শহরগামী বাস পেয়ে উঠে পড়ল সেটায়।
কার্লটন হোটেলে ফিরে এল রানা সন্ধের পরপরই। খেয়ে নিল সকাল সকাল। অ্যালার্মের কাটা ঠিক সাড়ে বারোটার উপর এনে খাপ বন্ধ করে। ঘড়িটা ঢুকিয়ে দিল সে বালিশের নিচে। তারপর শুয়ে পড়ল টানটান হয়ে। মন থেকে সমস্ত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, দূর করে দিতে দুমিনিটের বেশি লাগল ওর। তৃতীয় মিনিট পার হওয়ার আগেই তলিয়ে গেল সে অতল গভীর ঘুমে।
ডানহাতটা রয়েছে ওর বালিশের পাশে রাখা পিস্তলের বাঁটে।
.
০৪.
ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে উঠতেই শিকারি বিড়ালের মত চোখ মেলল রানা। নিঃশব্দে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। কাপড় পরতে পরতে কেমন যেন সুড়সুড়ি জাতীয় অনুভূতি হলো ওর পাকস্থলীতে–অনিশ্চিত জানার পথে পা বাড়াতে হলে হয় ওর এরকম। নেভি রোল-নেক, জাম্পারের উপর গাঢ় ছাইরঙের ক্যানভাস জ্যাকেট চাপাল, পায়ে ক্যানভাসের হকি কেডস্। একটা জিপ লাগানো প্লাস্টিকের ব্যাগে পিস্তল, সাইলেন্সর আর দুটো স্পেয়ার ম্যাগাজিন পূরে ঢুকিয়ে দিল জ্যাকেটের পকেটে। তৈরি হয়ে নিয়ে নেমে এল সে রাস্তায় ফায়ার এসকেপের সিঁড়ি বেয়ে। সরু গলিতে জনপ্রাণীর চিহ্ন দেখা গেল না কোথাও।
নিরাপদেই পৌঁছুল রানা গাড়ি পর্যন্ত। কেউ অনুসরণ করবার চেষ্টা করল না ওকে। ওর উপর নজর রাখবার দরকার বোধ করছে না, আর কেউ কাল সন্ধে থেকে। কেন? এর একমাত্র কারণ, রানার গতিবিধি সম্পর্কে অন্য কোন উপায়ে পূর্ণ ওয়াকিফহাল থাকছে শত্রুপক্ষ। বারণ করে দেয়া হয়েছে অনুসরণকারীদের। আজকে তো বিশেষ করে বারণ করা হবে যেন কোনভাবে। বিরক্ত করা না হয় রানাকে। আজ ওরা জানে কোথায় চলেছে রানা। পরিষ্কার। জানে রানা, ওরা জানে আজ কোথায় পাওয়া যাবে, রানাকে। মনে মনে কামনা করল, রানাও যে জানে যে ওরা জানে, সেটা ওরা না জানলেই ভাল হয়।
হাঁটবার সিদ্ধান্ত নিল রানা। গাড়িটা রেখে এসেছে বিকেলে হাইলার দ্বীপ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। ট্যাক্সির প্রতি কেমন একটা অবিশ্বাস জন্মে গেছে ওর, কাজেই ট্যাক্সিও নেবে না। অলিগলি বেয়ে এগোল সে লম্বা পা ফেলে। সাইড স্ট্রীটগুলোতে লোক চলাচল কমে এসেছে অনেক। প্রশান্ত একটা ভাব বিরাজ করছে শহরের এই অঞ্চলটায়।
ডক এরিয়ায় পৌঁছে প্রথমে নিজের অবস্থানটা ভালমত বুঝে নিল রানা। কোনদিক দিয়ে কোনদিকে গেলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছুতে পারবে বুঝে নিয়ে দ্রুত পা ফেলে বার্জ-বন্দরের পাশে একটা ঢেউটিনের গুদামঘরের গাঢ় ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ঘড়ির উজ্জ্বল ডায়ালের দিকে চাইল। দুটো বাজতে বিশ। বিকেলের চেয়ে আর একটু বেড়েছে. বাতাসের বেগ, আরও শীতল হয়েছে। বৃষ্টি যদিও পড়ছে না, বাতাসে আর্দ্র একটা ভাব টের পেল রানা। পৃথিবীর সমস্ত জেটির ধারে সমুদ্র, আলকাতরা, ডিজেল, রশি ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর গন্ধ মিশে যে অদ্ভুত একটা স্মৃতি জড়ানো তীব্র গন্ধ নাকে আসে, সেই পরিচিত গন্ধ ছাপিয়েও আবছাভাবে রানার নাকে এল বৃষ্টির ভেজা ভেজা। আগাম-গন্ধ। চট করে চোখ গেল ওর আকাশের দিকে। প্রায় মাঝআকাশে, উঠে পড়েছে কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ। খণ্ড খণ্ড মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশময়, মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ছে চাঁদটা, খানিক বাদেই আবার হাসছে রোগাক্রান্ত মান হাসি। চাঁদ ঢাকা পড়লেও পুরোপুরি অন্ধকার হচ্ছে না, কারণ খণ্ড মেঘের ফাঁকে সারা আকাশ জুড়েই রয়েছে উজ্জ্বল তারার ঝালর।
বন্দরের দিকে দৃষ্টি বোলাল রানা। কিছুদুর বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তারপর আবছা, তার ওপাশে অন্ধকার। কয়েকশো বার্জ দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে। কোনটা ছোট্ট বিশ-ফুটি, কোনটা বিশাল জাহাজের সমান। আসলে ওগুলোর দাঁড়াবার ভঙ্গিটাই শুধু এলোমেলো, হ্যাঁভেঞ্জবো। স্কাইস্ক্র্যাপারের অবজার্ভেশন প্ল্যাটফর্ম থেকে বিনকিউলার দিয়ে ভালমত পরীক্ষা করে দেখছে রানা, বেরোবার রাস্তা রাখা আছে–প্রত্যেকটা বার্জ ইচ্ছে করলেই অলিগলি বেয়ে খোলাসমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে। ঠাসাঠাসি ভিড়ের মধ্যেও একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা হয়েছে। বাজগুলো ভেড়ানো। রয়েছে সারি সারি ফ্লোটিং গ্যাঙওয়ের গায়ে। তীর থেকে লম্বালম্বি সমান্তরালভাবে সাগরের দিকে চলে গেছে চওড়া গ্যাঙওয়ে, প্রত্যেকটা আবার বিশগজ অন্তর অন্তর সরু গ্যাঙওয়ে দিয়ে পরস্পরের সাথে জোড়া।
চাঁদটা মেঘে চাপা পড়তেই দ্রুতপায়ে এগোল রানা, একটা চওড়া গ্যাঙওয়ের দিকে। নিঃশব্দে। অবশ্য রাবার সোলের জুতো না পরে যদি আমি বুট পায়ে দিত তবু এখানে ওর আগমন কেউ টের পেত কিনা সন্দেহ। যদিও প্রত্যেকটা বার্জেই অন্তত কয়েকজন করে লোক আছে, এতগুলো বার্জের মধ্যে শুধু দুটো কি তিনটে কেবিন থেকে দেখা যাচ্ছে আলোর রশ্মি। কোথাও টু শব্দ নেই মানুষের। বাতাসের মৃদু গোঙানি, বোটগুলোর খোল ঢেউয়ের মৃদু চাপড়, মাঝে মধ্যে কাঠে কাঠে ঘষা লেগে ক্যাচকঁচ আওয়াজ–সব মিলে। নীরবতাকে আরও গভীর করে তুলেছে। ঘুমনগরী বলে মনে হচ্ছে। এলাকাটাকে, মায়াবিনীর যাদু যেন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে এখানকার সবাইকে। শত্রুপক্ষের কথা আলাদা। রাবার সোল কেন, তুলোর সোল পায়ে দিয়ে এলেও টের পাবে ওরা হয়তো পেয়ে গেছে এতক্ষণে। চারপাশে চেয়ে নিয়ে চলার গতি দ্রুততর করল রানা।
চওড়া গ্যাংওয়ে বেয়ে তিনভাগের এক ভাগ যেতে না যেতেই ফিক করে হেসে উঠল চাঁদটা। থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল রানা।
পেছন থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে দুজন লোক। পঞ্চাশ গজ দুরে। ছায়ামত সিলয়েট দেখা যাচ্ছে ওদের, কিন্তু এতদূর থেকেও টের পেল রানা বাম হাতের চেয়ে ওদের দুজনেরই ডানহাত বেশ খানিকটা বেশি লম্বা। কিছু একটা বয়ে আনছে ওরা ডানহাতে করে।
নড়াচড়ার আভাস পেয়ে চট করে ডানপাশে চোখ গেল রানার। ডানদিকের সমান্তরাল গ্যাঙওয়ে বেয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে আরও দুজন লোক। এদেরও ডান হাত বেশি লম্বা। এই গ্যাঙওয়ের লোক দুজনের চেয়ে এরা কয়েক গজ এগিয়ে আসছে।
বামদিকে দৃষ্টি ফেরাল রানা। আরও দুজন। বাম পাশের গ্যাঙওয়েতে আরও দুটো জলন্ত ছায়ামূর্তি। মনে মনে এদের নিখুঁত সমন্বয়-জ্ঞানের প্রশংসা না করে পারল না রানা। প্রফেশনাল। চট করে ঘুরে পা বাড়াল সে সামনের দিকে।
চলতে চলতেই পকেট থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে জিপার খুলে বের করল রানা পিস্তলটা। সাইলেন্সর সিলিন্ডার পেচিয়ে নিল পিস্তলের মুখে। ওরও ডান হাতটা লম্বা হয়ে গেল বাম হাতের চেয়ে। চাঁদটা ঢাকা পড়ল। মেঘের আড়ালে। দৌড়াতে শুরু করল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। অনুসরণকারীরাও দৌড়াচ্ছে। কয়েক গজ গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আবার চাইল। রানা পেছন দিকে। রানার ঠিক পেছনের দুজন থেমে দাঁড়িয়েছে। পিস্তল তাক করছে কিনা প্রথমটা বোঝা গেল না, পরমুহূর্তে ছোট্ট দুটো লাল স্ফুলিঙ্গ দেখে। নিঃসন্দেহ হলো রানা ওদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কোন আওয়াজ নেই। কয়েকশো বাজে ঘুমন্ত বেপরোয়া সাহসী জার্মান, ডাচ, বেলজিয়ান নাবিকদের। ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বিপদে পড়তে চায় না ওরা। কাজ সারতে চাইছে নীরবে। মেঘের আচ্ছাদন সরে যেতেই আবার রুগ্ন হাসি দেখা দিল চাঁদের মুখে। আবার দৌড় দিল রানা। একেবেঁকে।
জ্যাকেটের হাতায় টান পড়ল, জ্বলে উঠল রানার ডান হাতটা, বাইসেপের কাছে। চামড়া খানিকটা চিরে দিয়ে বেরিয়ে গেছে গুলিটা। আর। ঝুঁকি নেয়া উচিত হচ্ছে না বুঝতে পেরে সাই করে পাশ ফিরল রানা, একলাফে উঠে পড়ল সরু গ্যাঙওয়ের সাথে ভেড়ানো মাঝারি আকারের। বার্জের ডেকে, ছুটে গিয়ে দাঁড়াল হুইলহাউজের আড়ালে। মাথাটা সামনে বাড়িয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল অনুসরণকারীদের দিকে।
রানার ঠিক পেছনের লোক দুজন, অর্থাৎ মাঝের অনুসরণকারী দুজন থেমে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে ইশারা করছে দুপাশের লোকদের। আগে বেড়ে ঘিরে ধরতে পারলে সহজেই খতম করে দেয়া যাবে। রানাকে। ঘিরে ফেলতে চাইছে রানাকে। সত্যিই যদি সফল হয়, কাবু করে। ফেলতে বেশি সময় লাগবে না ওদের।
লোকগুলোর মধ্যে স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের অভাব দেখে অত্যন্ত দুঃখ হলো রানার। তার চেয়ে বেশি হলো ভয়। কারণ খেলোয়াড়সুলভ না হলেও পদ্ধতিটা যে অত্যন্ত কার্যকরী, তাতে রানার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যেমন করে হোক ওদের এই ঘিরে ফেলাটা বন্ধ করতে না পারলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সমুদ্রের নিচে ডুবিয়ে দেয়া হবে ওর লাশটা পাথর বেধে।
মাঝের গ্যাঙওয়ের লোক দুজন আপাতত বিপজ্জনক নয়, বুঝতে পারল রানা। ওরা সামনে এগোবার চেষ্টা না করে পাশের লোকদের সামনে বেড়ে ঘিরে ধরবার অপেক্ষা করবে, তারপর পেছন থেকে গুলি করবার সুবিধের। জন্যে রানার, মনোযোগ সামনের দিকে আটকে রাখবার চেষ্টা করবে। বামদিকের লোকগুলোর অবস্থান বোঝার জন্যে ঘাড় ফেরাল রানা।
ঠিক পাঁচ সেকেন্ড পর দেখতে পেল রায় ওদের। অনেকটা কাছে চলে এসেছে। দৌড়াচ্ছে না এখন, হাটছে সন্তর্পণে, বার্জগুলোর হুইলহাউজ আর কেবিনের ছায়ায় খুঁজছে রানাকে। গুলি করল রানা। প্রায় নিঃশব্দে এলোপাতাড়ি কয়েক পা ফেলে ঢলে পড়ল, ছোট্ট একটা ছপাৎ শব্দ তুলে তলিয়ে গেল একজন সাগর গর্ভে। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে ওর আগেই। আবার গুলি করবার আগেই একলাফে সরে গেল দ্বিতীয় লোকটা পিস্তলের সামনে থেকে, এতই দ্রুত…যেন সাক্ষাৎ ভূত দেখতে পেয়েছে সামনে।
আবার মাঝের লোক দুজনের দিকে চাইল রানা। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। এদিকে কি ঘটে গেছে হয়তো টেরই পায়নি। বেশ অনেকটা দূরে পিস্তলের রেঞ্জের বাইরে রয়েছে এরা দুজন। বিশেষ করে আবছা আধারে লক্ষ্যভেদ করবার পক্ষে বহুদূর। তবু সময় থাকতে ওদের একটু দমিয়ে দেয়ার প্রয়োজনে একটু সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করল রানা। চমকে ওঠার ভঙ্গি করল ওদের একজন, অস্ফুট একটা আওয়াজ কানে এল রানার। খুশি হয়ে উঠতে যাচ্ছিল রানা, কিন্তু সঙ্গীর পেছন পেছন লোকটাকে বিদ্যুৎবেগে লাফ দিয়ে গ্যাঙওয়ে ছেড়ে একটা বার্জের কেবিনের পেছনে আশ্রয়। নিতে দেখে বুঝলি গুরুতর কিছুই নয়, সামান্য জখম করতে পেরেছে সে বড়জোর। মেঘে ঢাকা পড়ল আবার চাঁদটা। ছোট্ট মেঘ। কিন্তু আগামী দুতিন। মিনিটের মধ্যে চাঁদকে আড়াল করবে, কাছেপিঠে সে রকম আর কোন মেঘ দেখতে পেল না রানা, কাজেই এটারই সদ্ব্যবহার করতে হবে যতটা পারা। যায়। ওর অবস্থান জানা হয়ে গেছে শত্রুপক্ষের, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। তিন লাফে আবার গ্যাঙওয়েতে উঠে এল সে, খিচে দৌড় দিল সামনের দিকে।
দশগজ যেতে না যেতেই ঘোমটা সরে গেল চাঁদের মুখ থেকে। ডাইভ দিয়ে শুয়ে পড়ল রানা, চিৎ হয়ে মাথাটা সামান্য একটু তুলে চেষ্টা করল ওদের গতিবিধি লক্ষ করতে। বামদিকের গ্যাঙওয়ে ফাঁকা। বোঝা যাচ্ছে, জীবিত লোকটার আত্মা কেঁপে গেছে চোখের সামনে সঙ্গীকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে। মাঝের গ্যাঙওয়েতে যে দুজন ছিল, হুশিয়ার হয়ে গেছে তারাও, দেখা যাচ্ছে না–হয়তো সাবধানে বার্জের আড়ালে আড়ালে এগোচ্ছে সন্তর্পণে। ডানদিকে চেয়ে অগ্রসরমান দুই ছায়ামূর্তি দেখতে পেল রানা। বেশ খানিকটা। দূরে রয়েছে এখনও। হাঁটার দৃঢ় ভঙ্গি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কি ঘটে গেছে কিছুই জানে না ওরা। দেখে মনে হচ্ছে, রানার কাছে পিস্তল থাকতে পারে সে ভাবনার কথাও জানায়নি কেউ ওদের। কিন্তু জেনে নিতে বেশি সময় লাগল না। পরপর দুটো গুলি করল রানা। লাগল না একটাও, কিন্তু মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল ওরা। এইবার শুরু হলো আসল লুকোচুরি খেলা। ওদের থমকে দিয়ে রানা চাইল যত শিগগির সভব সামনে এগিয়ে যেতে। পরবর্তী পাঁচটা মিনিট ধরে খণ্ড খণ্ড মেঘের ছায়ার সুযোগ নিয়ে ছুটল রানা, মেঘের আবরণ সরে যাওয়ার আগেই দাঁড়াল কোনকিছুর আড়ালে, একটা দুটো গুলি ছুঁড়ল পেছন দিকে, ছায়া পেয়ে ছুটল আবার। ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে এল ওর কাছে যে এভাবে আর বেশিক্ষণ চলতে পারে না। অনেক কাছে চলে এসেছে ওরা, তিনদিক থেকেই কমিয়ে আনছে দূরত্ব। ঝুঁকি নিচ্ছে না, সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগাচ্ছে কৌশলে। একজন বা দুজন ধরে রাখছে রানার মনোযোগ, সেই সুযোগে বাকি কজন এগিয়ে আসছে এক বার্জের আড়াল থেকে আরেক বার্জের আড়ালে। পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা, এক্ষুণি অন্য ধরনের কোন কৌশল যদি বের করতে না পারে, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে এই লুকোচুরি খেলা। বড়জোর আর পাঁচটা মিনিট ঠেকাতে পারবে সে ওদের।
মানসপটে সোহানা আর মারিয়ার মুখ ভেসে উঠল। সত্যিই কি বিশেষ কোন ক্ষমতা রয়েছে মেয়েদের মধ্যে? নইলে অমন উদ্ভট ব্যবহার করে বসল। কেন আজ একসাথে দুজন? সত্যিই কি রানার অমঙ্গল টের পেয়েই বারণ করছিল ওরা আজ রাতে বেরোতে? আজকের রাতের বিশেষ গুরুত্ব জানা নেই ওদের, সেজন্যই অত চাপাচাপি করছিল ওরা। আজ না এলে তিনমাসের জন্য পিছিয়ে যেত রানার কাজ। কি যেন উত্তর দিয়েছিল সে। মারিয়াকে?–লাক ইজ ইনফ্যাচুয়েটেড উইথ দ্য এফিশিয়েন্ট। বাহ! চমৎকার এফিশিয়েনসি দেখাচ্ছে সে। ও আশা করেছিল বিপদ আসবে, কিন্তু কল্পনাও করতে পারেনি, এই ধরনের বিপদ ঘটতে পারে। ভেবেছিল, অন্ধকার ছায়ায় লুকিয়ে থাকবে একজন নীরব পিস্তলধারী, কিংবা কোন নাইফ এক্সপার্ট–তাকে কৌশলে বাগে আনতে বেশি অসুবিধে হবে না। ছয়জন মিলে যে ওকে কুকুর তাড়ানো তাড়াবে, ভাবতেও পারেনি সে। সোহানাকে বলেছিল সে, যে লোক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারে সে আরেকবার যুদ্ধের সুযোগ পায়। কিন্তু পালাতে পারলে তো ফের যুদ্ধের প্রশ্ন! পালাবার রাস্তা চোখে। পড়ল না রানার। বিশ.গজ গিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে মেইন গ্যাঙওয়ে। সত্যিই কি মারা যাচ্ছে ও আজ?
মাথা ঝাড়া দিয়ে বাজে চিন্তা দূর করে দিল রানা। ভাল করেই জানা। আছে ওর, জীবন-মৃত্যু এখন ওর নিজের হাতে। শুধু সাইলেন্সরটা খুলে আকাশের দিকে দুটো গুলি ছুঁড়লেই মুহূর্তে জেগে উঠবে এই বার্জ-বন্দরের শত শত নাবিক, দপ করে জ্বলে উঠবে দশ বারোটা সার্চলাইট, ওকে আর কুকুরের মত গুলি করে মারতে পারবে না শিকারিরা, নিজেরাই পালাবে লেজ তুলে। কিন্তু এই মুহর্তে কাজটা করলে এতদিনের পরিশ্রম, এত অর্থব্যয়, এত কষ্ট, সব, ভেস্তে যাবে। আজ রাতের পর আর কোনদিন কোন সুযোগ পাবে না রানা-ব্যর্থতা নিয়ে ফিরে যেতে হবে ওকে মাথা নিচু করে বাংলাদেশে। জীবনে কোনদিন চোখ তুলে চাইতে পারবে না সে মেজর জেনারেল রাহাত খানের চোখের দিকে। নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হলেও শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে ওর। প্রাণের ভয়ে বানের জলে ভাসিয়ে দিতে পারে না ও সবকিছু।
প্ল্যান ঠিক করে ফেলল রানা। পাগলামি। কিন্তু তাড়া করলে ভাল মানুষও পাগলা কুকুর হয়ে যায়। এর চেয়ে ভাল কিছু মাথায় খেলল না ওর। ঘড়ি দেখল। ছয় মিনিট বাকি দুটো বাজতে। সবদিক থেকেই ফুরিয়ে এসেছে সময়। আকাশের দিকে চাইল। ছোট একটা মেঘ ভেসে আসছে চাঁদের দিকে। বড়জোর এক মিনিট ঢাকা থাকবে চাঁদটা। পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, এই একটি মিনিট ব্যবহার করবে ওরা রানাকে খতম করে দেয়ার জনে–এটাই শেষ আক্রমণ। কাজেই এই একটি মিনিটের মধ্যে বাচবার শেষ চেষ্টা করতে হবে রানার। ডেকের চারপাশে চেয়ে দেখল রানাঃ এ বার্জের কারগো পরানো লোহালক্কড। দশ ইঞ্চি লম্বা একটুকরো জি.আই. পাইপ তুলে। নিল সে হাতে। আবার চাইল ঘন কালো মেঘের টুকরোটার দিকে–যতটা ভেবেছিল, তার চেয়েও ছোট মনে হলো মেঘটাকে। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে। থেকে টের পেল ওটার পেটটা ঠিক চাঁদের নিচ দিয়ে যাবে না, বেশ কিছুটা ডাইনে সরে এগোচ্ছে ওটা–একপাশ দিয়ে ঢাকা পড়বে চদি অল্পক্ষণের জন্যে। যাইহোক, যেটুকু সময় পাওয়া যায় তাই কাজে লাগাতে হবে ওর এখন।
দ্বিতীয় ম্যাগাজিনের পাঁচটা গুলি রয়ে গেছে, অনুসরণকারীদের মোটামুটি অবস্থান লক্ষ্য করে আন্দাজে গুলি করল সে পরপর পাঁচবার। আশা করল, এর ফলে ওরা যদি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে নিরুৎসাহিত হয় সেটাও লাভ। পিস্তলটা চট করে প্লাস্টিকের ব্যাগে পুরে জিপ লাগিয়ে পকেটে ফেলল রানা। তিন লাফে চলে এল বার্জের কিনারায়। গ্যাঙওয়ের পাঁচফুট দুরে। লাফিয়ে। পড়ল গ্যাঙওয়ের উপর, আছড়ে পাছড়ে উঠে দাঁড়াতেই টের পেল, মেঘের বাচ্চা পুরোপুরিই মিস্ করেছে চাঁদটাকে।
হঠাৎ মনের ভেতর থেকে সব ভয় দূর হয়ে গেল রানার। মুহূর্তে শান্ত, স্থির হয়ে গেছে ওর বুদ্ধিটা। মানুষের যখন আর কোন উপায় না থাকে তখন বোধহয় এইরকম অবস্থা হয়, শেষ মুহূর্তে উড়ে যায় ভয়ডর। একটা মাত্র রাস্তা খোলা আছে ওর সামনে, একেবেকে ঝেড়ে দৌড় দিল সে ওই রাস্তা ধরে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাচবার চেষ্টা করছে সে একেবেকে, লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার চেষ্টা করছে আততায়ীর গুলি। প্রাণপণে ছুটছে রানা। আর পনেরো গজ, দশ গজ, পাঁচ গজ। সাইলেন্সড় গানের মৃদু শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে, মুহুর্মুহু–এতই কাছে এসে পড়েছে। বারদুয়েক হ্যাঁচকা টান লাগল ওর প্যান্টে, জ্যাকেটে। হঠাৎ পেছন দিকে বাকা হয়ে গেল রানার শরীরটা, আহত ভঙ্গিতে দুই হাত উঠল আকাশের দিকে, হাত থেকে পাইপের টুকরোটা ছুটে গিয়ে পড়ল পানিতে। সাথে সাথেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে সামনের দিকে। মাতালের মত উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল রানা। বুকের বাম দিকটা। চেপে ধরে আছে দুইহাতে। দিশেহারার মত টালমাটাল দুই পা ফেলেই ঝপাৎ করে পড়ল সে পানিতে। পড়ার আগে লম্বা করে দম নিয়ে নিতে ভুলল না।
পানিটা ঠাণ্ডা, কিন্তু হাড় কাঁপানো নয়। ঘোলাটে। তিন সেকেন্ড পরই মাটি ঠেকল রানার পায়ে। বসে পড়ল রানা। ও জানে, এক্ষুণি গ্যাঙওয়ের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াবে পশ্চাদ্ধাবনকারীরা, পানির দিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করবে সত্যিই মারা গিয়েছে কিনা, পানির নিচটা দেখার চেষ্টা করবে টর্চ জ্বেলে। উপর থেকেই যেন ওরা সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায় সেই চেষ্টা করতে হবে ওর। ততক্ষণ দম আটকে রাখতে পারলে হয়। কিন্তু যদি স্থির নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কেউ পানিতে নামে, তাহলে ছুরি মেরে এখান থেকে ভেগে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না ওর। একহাজার এক, একহাজার দুই, একহাজার তিন–এইভাবে পনেরো পর্যন্ত শুনেই, অর্থাৎ ঠিক পনেরো সেকেন্ড পর মাথার উপর দেখতে পেল রানা আবছা আলো। ছোট দুটো ভুড়ভুড়ি ছাড়ল সে–অর্থাৎ, এই যে, এখানে আমি। আলোটা ঘুরছে মাথার উপর। বোধহয় রক্ত দেখা যায় কিনা খুঁজছে। আরও পনেরো সেকেন্ড পেরিয়ে গেল-রানার মনে হলো পনেরো মিনিট। এবার বড়সড় একটা বুদ্বুদ ছাড়ল রানা–অর্থাৎ দমটা বেরিয়ে গেল, বিশ্বাস করো–মরে গেছি।
কিন্তু সহজে বিশ্বাস করার পাত্র নয় ব্যাটারা। আরও প্রায় মিনিটখানেক আবছাভাবে দেখতে পেল রানা মাথার উপর চলন্ত আলো। মনে মনে প্রথমে ওদের, তারপর ওদের বাপ-মা, তারপর চোদ্দ গুষ্টি তুলে গাল দিল রানা, কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে ওরা বোধ হয় পানিতে নেমে দেখা উচিত কিনা তাই নিয়ে তর্ক করছে নিজেদের মধ্যে নিশ্চিন্তে। ফুসফুসটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে রানার। হার্টবিট অনুভব করতে তো পারছেই, মনে হচ্ছে যেন শুনতে পাচ্ছে। দুই কানে তীক্ষ্ণ ব্যথা শুরু হলো। এখন যদি কেউ নিচে নেমে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, রবিউলের মত স্বাস্থ্য হলেও পারবে না রানা তার সাথে। সহ্যের যখন শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে রানা, তখনই নিবে গেল মাথার উপরের আবছা আলোটা। সাঁতার কাটতে শুরু করল রানা। ডানদিকে একটা বার্জের তলা হাতে ঠেকতেই বুঝতে পারল দিক ভুল হয়নি ওর। চট করে ওটার নিচ দিয়ে ওপাশে চলে গেল সে। তারপর অতি সন্তর্পণে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল উপরে।
ফুঁপিয়ে উঠে শ্বাস নেয়া থেকে বহু কষ্টে বিরত রাখল রানা নিজেকে। হাঁ করে অল্প অল্প করে শ্বাস নিল নিঃশব্দে। অল্পক্ষণের মধ্যেই দম ফিরে পেয়ে নিঃশব্দে সাঁতার কেটে চলে এল সে বার্জের পেছন দিকটায়। গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে মানুষের। হালের আড়াল থেকে উঁকি দিল গ্যাঙওয়ের দিকে। তিনজন দাঁড়িয়ে আছে, রানা ঠিক যেখানটায় অদৃশ্য হয়েছে সেই জায়গায়। একজনের হাতে জ্বলন্ত টর্চ। ডানপাশের দুজনও আসছে এই দিকে সরু গ্যাঙওয়ে বেয়ে। এপাশে দাঁড়ানো তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে লম্বাজন মাথা নাড়ল বারকয়েক, তারপর দুই হাত মাথার উপর তুলে ক্রসচিহ্ন দেখাল। ইঙ্গিতটা কার প্রতি পরিষ্কার বোঝা না গেলেও আন্দাজ করতে পারল রানা। ইঙ্গিতের সাথে সাথে কাছেই একটা ডিজেল এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনে। সিগন্যাল পেয়েছে বিশেষ একটা বাজের ক্যাপ্টেন। গ্যাঙিওয়ের তিনজন রওনা। হয়ে গেল পেছন দিকে। কাজ সমাধা হয়ে যাওয়ায় ব্যথাটা চেগিয়ে উঠেছে একজনের, খোঁড়াচ্ছে।
ছায়ামূর্তিগুলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়ার অপেক্ষায় তিন মিনিট ভেসে রইল রানা হাল ধরে, তারপর নিঃশব্দে, ব্রেস্টস্ট্রোক দিয়ে এগোল শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। ক্রমেই বাড়ছে এঞ্জিনের গর্জন।
রানা যখন কাছাকাছি পৌঁছুল, ততক্ষণে গ্যাঙওয়ের সাথে বাধা কাছি খুলে ফেলা হয়েছে। এক্ষুণি পিছোতে শুরু করবে বার্জটা। রানা যখন ওটার গায়ের। কাছে পৌঁছুল, তখন ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করেছে ওটা। সমুদ্র থেকে বার্জের গা বেয়ে উপরে উঠে আসা শুনতে সহজ মনে হলেও আসলে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। নাট-বল্ট আকড়ে ধরে দুবার চেষ্টা করল রানা আছড়ে পাছড়ে উপরে উঠে পড়বার, দুবারই হাত ফসকে পড়ে গেল আবার পানিতে। সড়সড় করে সরে চলে যাচ্ছে বার্জ পেছনদিকে। কোনদিক দিয়েই উপরে ওঠার কোন কায়দা পাচ্ছে না রানা। আশঙ্কা হলো, তবে কি এত কষ্ট, এত ঝুঁকি, সব বিফলে যাবে ওর? এতকিছুর পর একেবারে গায়ের কাছে এসে। ফসকে বেরিয়ে যাবে বার্জটা?
কিছুদূর পিছিয়েই রানাকে ঠেলে নিয়ে বাম দিকে সরতে শুরু করল বাজটা। সোজা হয়ে নিয়েই রওনা হয়ে যাবে সামনের দিকে। ক্ষোভে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল রানার। পাগলের মত দুহাত বাড়িয়ে খুঁজছে সে। অন্তত ধরে ঝুলে থাকবার মত কিছু একটা। কিছুই বাধছে না হাতে। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ একটা টায়ারের সাথে ধাক্কা খেলো রানা। ট্রাকের টায়ার। বার্জ ভিড়বার সময় বোটের গায়ে যেন চোট না। লাগে সেজন্যে বাধা রয়েছে পেটের কাছে। মুহূর্তে রানার হতাশা রূপান্তরিত হলো স্বস্তির হাসিতে। সামনের দিকে চলতে শুরু করল বাজ। টায়ারের গায়ে পা বাধিয়ে উঁচু হয়ে ধরে ফেলল রানা বার্জের একটা ক্যাপস্টান, সাবধানে মাথা তুলে চাইল চারপাশে।
হুইলহাউজের জানালা দিয়ে মাথা বের করে নেভি-ক্যাপ পরা একজন লোক কি যেন নির্দেশ দিচ্ছে একজন নাবিককে। লোকটা চলে গেল সামনের দিকে। উঠে পড়ল রানা উপরে। নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে গেল হুইলহাউজের দিকে। হুইলহাউজের সাথেই লাগানো ত্রুদের কেবিন। লোহার মই বেয়ে কেবিনের ছাতে উঠে পড়ল রানা, তারপর অতি সন্তর্পণে বুকে হেঁটে চলে এল। হুইলহাউজের মাথায়। নেভিগেশন লাইট জ্বলে উঠল হুইলহাউজের ছাতের। দুইধারে। কিন্তু তাতে বিচলিত হলো না রানা। ওই আলো দুটো জ্বলে ওঠায় ও যেখানে শুয়ে আছে সে জায়গাটা আরও অন্ধকার দেখাচ্ছে।
আরও কিছুটা গম্ভীর হলো এঞ্জিনের শব্দ। ভোলা সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছে এখন বার্জটা।
পিস্তলটা বের করে তৃতীয় ম্যাগাজিন পুরল রানা। মাথার পাশে ওটা রেখে শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে। স্মৃতি রোমন্থনে মন দেয়ার চেষ্টা করল সে ভাঙা। চাঁদের দিকে চেয়ে। আসলে সময় কাটাতে চায়। কিন্তু কিসের কি! খোলা সমুদ্রে পড়তেই প্রচণ্ড শীতের ঠেলায় উড়ে গেল সব স্মৃতি। নিদারুণ কঠোর। বাস্তব ছাড়া আর কিছুই ছাপ ফেলতে পারছে না ওর বর্তমান চেতনায়। অতীত-ভবিষ্যৎ সব এখন ওর কাছে অর্থহীন।
.
০৫.
শীত কাকে বলে টের পেল রানা আজ হাড়ে হাড়ে।
আজ রাতে সমুদ্র যাত্রায় যাবে সেটা জানা ছিল ওর, কিন্তু যাত্রার শুরুতেই যে এইভাবে ভিজতে হবে কল্পনাও করতে পারেনি। ওর মনে হলো। শীতে জমেই মারা যাবে সে আজ রাত ফুরোবার আগে। যাইডার যীর। নিশিরাতের হাওয়া আগাগোড়া লেপমুড়ি দেয়া লাশেরও সারা শরীরে কাপন তুলে দিতে পারেনা রয়েছে ভেজা কাপড়ে। হিমশীতল বাতাসে খানিক, বাদেই মনে হলো জমাট বরফে পরিণত হয়েছে ওর শরীরটা। শুধু বরফ নয়, কম্পমান বরফ। প্রাণপণ শক্তিতে দাতে দাঁত চেপে না রাখলে এতক্ষণে ওর। চারপাশে জমায়েত হয়ে যেত বার্জের সব লোক খটাখট ক্ল্যাপারের শব্দে।
অ্যামস্টার্ডামের বাতিগুলো নিষ্প্রভ হতে হতে শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গেল। বহুদূরে। রানা লক্ষ করল, বেলজিয়ান কোস্টার মেরিনোর মতই এই বাজটাও একেবারে বয়াগুলোর গা ঘেষে এগোচ্ছে। দুটো বয়ার গা ঘেষে পার হয়ে তৃতীয় একটার দিকে প্রায় সোজাসুজি রওনা হলো বাটা। মনে হচ্ছে সোজা গিয়ে চারশো গজ দূরের ভাসমান বয়ার সাথে ধাক্কা খাবে।
হঠাৎ এঞ্জিনের শব্দ কমে গেল। মাথাটা সামান্য উঁচু করে চারপাশে চাইল রানা। দুজন লোক কেবিন থেকে বেরিয়ে এল ডেকের উপর। চট করে। মাথা নিচু করে হুইলহাউজের ছাতের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু এদিকে এল না লোক দুজন। দ্রুতপায়ে চলে গেল ওরা সামনের গলুইয়ের দিকে। কি করছে দেখবার জন্যে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথাটা, উঁচু করল রানা পাশ ফিরে।
একজন লোকের হাতে ছয়ফুট লম্বা একটা লোহার ডাণ্ডা দেখতে পেল রানা, দুমাথায় রশি বাধা। গলুইয়ের কাছে গিয়ে দুজন ধরল রডের দুপাশের রশি, দুজনেই একটু একটু করে ছেড়ে পানির লেভেল পর্যন্ত নামাল রডটাকে, তারপর হুইলহাউজের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল আদেশের অপেক্ষায়। চোখ তুলে বয়াটার দিকে চাইল রানা, বিশগজ আছে আর। বাজটাকে এমনভাবে চালানো হচ্ছে যে ঠিক বয়াটার পাঁচফুট দুর দিয়ে চলে যাবে। গতি অনেক কমে গেছে। হুইলহাউজ থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠের আদেশ শুনতে পেল রানা। সাথে সাথেই রশি ছাড়তে শুরু করল লোক দুজন। সড়সড় করে চলে যাচ্ছে রশি ওদের হাতের মুঠোর মধ্যে দিয়ে। একজন গুনছে এক, দুই, তিন করে। রানা। বুঝল, দুটো রশিতেই সমান দূরে দূরে একটা করে গিঠ দেয়া আছে। গোণা হচ্ছে এই জন্যে যে দুইজনকেই সমান ঢিল দিতে হবে রশিতে, আগে পরে। হলে চলবে না–সমান্তরাল রাখতে হবে লোহার রডটা।
বাৰ্জটা ঠিক যখন বুয়ার পাশাপাশি এল, নিচু গলায় কি যেন বলে উঠল দুজনের মধ্যে একজন। সাথে সাথেই রশি ছাড়া বন্ধ করে ধীরে ধীরে টানতে শুরু করল ওরা কি উঠে আসবে মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছে রানা, বুঝে গেছে কায়দাটা, কিন্তু তাই বলে চোখ ফেরাতে পারল না। গভীর। মনোযোগের সাথে লক্ষ করছে সে ওদের কার্যকলাপ।
প্রথমে পানির উপর ভেসে উঠল একটা, দুফুট লম্বা সিলিন্ডার আকৃতির। বয়া, তারপর উঠল বয়ার সাথে বাধা ছোট্ট একটা চার-আংটার নোঙর। এই নোঙরের সাথেই আটকে আছে লোহার রডটা। নোঙরের পর উঠে এল রশি। বাধা একটা বাক্স। দেখে মনে হচ্ছে টিনের তোরঙ্গ। তিনফুট লম্বা, দুইফুট চওড়া, দেড়ফুট উঁচু। বাক্সটা চট করে কাঁধে তুলে নিল একজন, প্রায় দৌড়ে চলে গেল কেবিনের ভেতর। দ্বিতীয়জন বয়া আর নোঙরটা নামিয়ে দিল আবার। পানিতে। সাথে সাথেই আবার বেড়ে গেল এঞ্জিনের গর্জন, পূর্ণবেগে ছুটছে। বার্জ যাইডার যী ধরে হাইলার দ্বীপের দিকে। পুরো ব্যাপারটা এতই দক্ষতার সাথে এতই নিপুণভাবে ঘটে গেল যে রানার বুঝতে অসুবিধে হলো না বহুদিনের অভ্যাসে একেবারে রপ্ত হয়ে গেছে প্রক্রিয়াটি ওদের। একেবারে সামনে থেকে না দেখলে কারও বোঝার উপায় নেই কি ঘটে গেল। কাল দুপুরে মেরিনোকে বয়াগুলোর কাছ ঘেষে এগোতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু রানাও বুঝতে পারেনি, জায়গামত বাক্সটা নামিয়ে দেয়াই ছিল ওটার আসল উদ্দেশ্য।
সময় বয়ে চলল। ঘটনাবিহীন। ঠকঠক করে কাঁপছে রানার সর্বশরীর, মাঝে মাঝে কুকুরের গা ঝাড়া দেয়ার মত করে শিউরে শিউরে উঠছে। এত কষ্ট জীবনে পায়নি সে কোনদিন.। মনে মনে স্থির করল, যদি প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারে, তাহলে অন্তত দুমাসের বেতন এক সাথে করে পুরানো গরম। কাপড় কিনবে সে সদরঘাটের পাইকারদের কাছ থেকে–দান করবে। স্টেডিয়ামের অর্ধ উলঙ্গ লোকগুলোকে। কথাটা মাথায় আসতেই আরও কিছু সংশ্লিষ্ট চিন্তা এসে ভিড় করতে চাইল ওর মনের মধ্যে। একজন মাসুদ রানা তার দুমাসের কেন, সারা বছরের বেতন দিয়ে গরম জামা কিনে বিলিয়েও প্রয়োজন মেটাতে পারবে না স্টেডিয়ামবাসীদের। কয়জনকে দেবে সে? যারা, পেল, তাদের শীতটা না হয় কিছুটা প্রশমিত হলো–খিদেটা? গরম পেলেই কি, খিদেটা মিটবে? কয়জনকে খাওয়াতে পারবে সে? কতদিন? খাওয়ার পর চাই শিক্ষা, তারপর চাই কাজের সুযোগ। ধুত্তোর বলে ক্ষ্যান্ত দিল রানা। ঠিক করল কাউকে কিছু দেবে না। এটা রাষ্ট্রীয় সমস্যা-রাজনৈতিক সমাধান বের। করতে হবে এর। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। যাদের উপর। নেতৃত্বের ভার রয়েছে তারা করুক একটা কিছু, বের করুক সমাধান। এই নিদারুণ দারিদ্রের পীড়ন থেকে ওরা যদি দেশবাসীকে মুক্তি দিতে না পারে গদি আঁকড়ে ধরে রাখতে পারবে না কেউ, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার। জন্যেই ওদের উচিত মানুষের মঙ্গলচিন্তায় মন দেয়া, একটা কিছু পথ বের করে সেই পথে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাওয়া। তা তারা করবেও। বাধ্য হবে করতে। আজ না হোক, কাল।
এই পর্যন্ত এসে আবার হোঁচট খেলো রানা। সত্যিই কি তাই? তাহলে দিনের পর দিন এক পা দুই পা নয়, দশ পা বিশ পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে কেন দেশটা? নিজেকে রাজনীতির বাইরে ভাবলেই কি ওর দায়িত্ব শেষ? ওর নিজের করবার কিছুই নেই?
আপাতত শীতে ঠকঠক করে কাঁপা ছাড়া আর কি করবার আছে বুঝতে পারল না রানা। ভেবেছিল, এই কষ্টের বাড়া আর কোন কষ্ট হতেই পারে না, কিন্তু ভোর চারটের দিকে ভুল ভাঙল ওর। ঠিকই বলেছিল মারিয়া আজ রাতে লাক ফেভার করবে না ওকে। বরফকে হার মানায় এমনি বৃষ্টি নামল। মুষলধারে। শরীরের তাপে ভেজা গেঞ্জি যাও বা একটু শুকিয়ে এসেছিল, ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল আবার। শুধু ঠাণ্ডা নয়, একেকটা ফোঁটা তীরের মত এসে বিধছে চোখে মুখে। দশমিনিট ভেজার পর হঠাৎ ভয় পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে। বসল রানা। অবশ হয়ে যাচ্ছে ওর সারা শরীর। গায়ের চামড়ায় চিমটি কেটে দেখল-মনে হলো চামড়ার গ্লাভসের উপর চিমটি কাটছে। আর কিছুক্ষণ এই ভাবে থাকলে নড়াচড়ার শক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলবে সে।
এদিকে ভোরের আভাস দেখা যাচ্ছে পুব আকাশে। আর বেশিক্ষণ হুইলহাউজের ছাদের উপর থাকাও নিরাপদ নয়। হাইলার দ্বীপের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এই বার্জের অপেক্ষায় আছে, নিশ্চয়ই আর খানিকটা আলো হলেই খুজবে এটাকে বিনকিউলার চোখে দিয়ে। হুইলহাউজের উপর একজন। লোককে শুয়ে থাকতে দেখলে অত্যন্ত সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবে তার মন।
বুকে হেঁটে লোহার মইয়ের কাছে চলে এল রানা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সন্তর্পণে নেমে এল নিচে। কেবিনের ভেতর লেপের নিচে আরামে ঘুমিয়ে থাকা লোকগুলোর কথা ভেবে তীব্র ঈর্ষা বোধ করল নিজের ভেতর। দ্রুতপায়ে চলে এল সে বার্জের গায়ে বাধা টায়ারের কাছে। নেমে পড়ল। পানিতে। পানিতে নেমেই নিজেকে যা-তা ভাষায় গাল দিল রানা এতক্ষণ খামোকা কষ্ট করার জন্যে। চমৎকার গরম পানি। গরম মানে, আসলে ঠাণ্ডা, কিন্তু বৃষ্টির পানির তুলনায় রানার মনে হলো সাগরের পানি তো না, যেন। চায়ের কাপে নেমেছে সে।
হাইলার দ্বীপের উত্তর তীর দেখা গেল। আবছাভাবে। বাজঁটা দক্ষিণ পশ্চিম দিয়ে ঘুরে গিয়ে পৌঁছুবে সেই ছোট বন্দরে। এত ধীরে চলেছে যে রানার মনে হলো দুপুর হয়ে যাবে এটার বন্দরে গিয়ে ভিড়তে। তীরের দিকে। চাইলে মনে হচ্ছে, থেমে রয়েছে এক জায়গায়। বেলা উঠে গেলে যে ওর পক্ষে আত্মগোপন করে থাকা খুবই অসুবিধেজনক হয়ে পড়বে সেদিকে লক্ষ নেই কারও।
সূর্য উঠল ভোর পাঁচটার দিকে। কিন্তু মিনিট দশেক পরেই আবার ওটাকে মেঘের নিচে ঢাকা পড়তে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাচল রানা। মেঘেরই জয়। হলো। আরও চেপে, আরও বড় বড় ফোঁটায় চারদিক আধার করে যেন। সারাদিনের প্রোগ্রাম নিয়ে নামল আবার বৃষ্টি। টায়ার আঁকড়ে ধরে দাতে দাঁত চেপে ঝুলে রইল সে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে।
ছয়টার দিকে নেভিগেশন মার্ক দেখতে পেল রানা। ঘুরতে শুরু করেছে বাৰ্জটা ওই দিকে। এসে গেছে বন্দর। হাতটা ছেড়ে বার্জের পেটে জোড়া পায়ের একটা লাথি মেরে দূরে সরে গেল রানা। দুপাশে ঢেউ তুলে চলে গেল। বার্জ সামনের দিকে, তারপর বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঠাণ্ডায় প্রায় অসাড় হয়ে গেছে রানার হাত-পা। মিনিট পাঁচেক সাঁতার কাটবার পর একটু একটু করে সাড়া ফিরে এল ওগুলোতে। নেভিগেশন মার্ক ডাইনে রেখে বন্দরের কাছাকাছি তীরে উঠে পড়ল সে। ঠিক এমনি সময়ে থেমে গেল বৃষ্টি। বুকে হেঁটে উঠে পড়ল সে ডাইকের উপর। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বন্দরের দুটো জেটি। শহরেরও অনেকখানি দেখতে পেল, রানা। বেশির ভাগ বাড়িই সবুজ আর সাদা দিয়ে পেইন্ট করা। প্রত্যেকটা বাড়িই তৈরি করা হয়েছে মোটা থামের উপর। সামুদ্রিক বন্যার ভয়ে। বাড়িতে উঠতে হলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। তবে নিচটা একেবারে বেকার যেতে দেয়নি হাইলারবাসীরা, ঘিরে নিয়ে বাথরূম, কিচেন আর স্টোর করেছে। শহরের একটা রাস্তা (খুব সম্ভব এটাই অ্যামস্টার্ডাম যাওয়ার রাস্তা) ছাড়া বাকি সবগুলোই অজগর সাপের মত আঁকাবাঁকা।
জেটির দিকে চেয়ে দেখল রানামাল খালাস শুরু হয়ে গেছে বাজ থেকে। একটা ক্রেন আংটায় বাধিয়ে নানান আকৃতির কাঠের বাক্স, বস্তা তুলে আনছে। বার্জের হোল্ড থেকে। কি মাল খালাস হচ্ছে সে নিয়ে এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করল না রানা। ওসবের মধ্যে যে বেআইনী কিছু নেই সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। আসলে নজর রাখতে হবে ওর কেবিনের উপর। বিশেষ একটা বাক্স কোথায় যায় দেখতে হবে।
আধঘণ্টা চুপচাপ শুয়ে থাকার পর দেখা গেল দুজন লোক বেরিয়ে এল বার্জের কেবিন থেকে। একজনের মাথায় মস্ত এক বস্তা। মুচকি হাসল রানা ঠোঁট বাকা করে। যদিও প্রচুর খড়কুটো ভরে গোল করা হয়েছে বস্তাটাকে, দুটো দিকে পরিষ্কার চৌকোণ বাক্সের আভাস দেখতে পাচ্ছে সে। গ্যাঙওয়ে। বেয়ে নেমে এল ওরা বার্জ থেকে, জেটি পেরিয়ে রাস্তায় পড়ল। মোটামুটি কোনদিকে যাচ্ছে ওরা বুঝে নিয়ে সড়সড় করে নেমে এল রানা ডাইক থেকে, বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলল ওদের পিছুপিছু।
ওদের অনুসরণ করায় কোন মুশকিল দেখা দিল না। ওদের চলার ভঙ্গিতে, পরিষ্কার বোঝা গেল, ওদেরকে যে কেউ কখনও অনুসরণ করতে পারে সেই সন্দেহই জাগেনি ওদের মনে কোনদিন। আঁকাবাকা রাস্তায় নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে চলল রানা ওদের পেছনে, একবার ঘাড় ফিরিয়ে চাইলও না কেউ। আসলে এই কাজটা এতবার নির্বিবাদে সেরেছে যে সাবধানতার ধারটা নষ্ট হয়ে গেছে ঘষায় ঘষায়, বেআইনী কিছু করছে সে কথাই হয়তো ভুলে গেছে, এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ-রাস্তা ও-রাস্তা বেয়ে ছোট্ট শহরের উত্তর প্রান্তে চলে। এল ওরা। বড়সড় একটি বাড়ির সামনে দাঁড়াল। চল্লিশ গজ দূর থেকে রানা। দেখল, এ বাড়িটাও অন্যগুলোর মত থামের উপর উঁচু করে তৈরি বটে, কিন্তু এর থামগুলো রিইনফোর্সড কংক্রিটের, নিচতলার দেয়ালগুলোও টিনের নয়, পাকা। একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল লোক দুজন। দোতলার বন্ধ জানালাগুলোর শিকগুলো এত ঘন এবং মোটা যে বড় সাইজে একটা ছুচোও ঢুকতে পারবে কিনা সন্দেহ। দরজায় তিনটে তালা–গুণ চিহ্নের মত করে লাগানো দুটো লোহার বারের দুমাথায় দুটো, দরজার ভার। কড়ায় লাগানো একটা। একজন পকেট থেকে চাবি বের করে একে একে খুলে ফেলল তিনটে তালা, ভিতরে গিয়ে ঢুকল দুজন, ঠিক এক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এল দুজনই। বস্তাটা রেখে এসেছে ভেতরে। দরজায় তালা লাগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ফিরে চলল যে পথে এসেছিল সেই পথে।
স্কেলিটন চাবির গোছাটা সাথে করে না আনায় মুহূর্তের জন্যে। অনুশোচনার খোঁচা লাগল রানার বুকে। পরমুহূর্তে বুঝতে পারল ওটা সাথে না এনে ভালই করেছে সে। একে তো ওই ঘরের দিকে মুখ করে রাস্তার এপাশে দশ-পনেরোটা বাড়ির বিশ-তিরিশটা জানালা রয়েছে, তালা খোলার চেষ্টা করতে গেলে যেকোন লোকের চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং ওকে দেখে যেকোন হাইলারবাসী বলে দিতে পারবে ও বিদেশী; তার ওপর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সময় আসেনি এখনও। এখন নাড়াচাড়া করলে ধরা। পড়বে চুনোপুটি। চুনোপুঁটির জন্যে বাংলাদেশ থেকে এতদূরে আসেনি। রানাও ধরতে এসেছে তিমি, মারতে এসেছে হাঙর। ওই বাক্সের মধ্যে টোপ রয়েছে হাঙরের। অধৈর্য হয়ে কিছু করে বসলে একেবারে পগার পার হয়ে যাবে হাঙর-কুমির-তিমি, সব।
বন্দরটা পশ্চিমে, কাজেই গাইডবুক বা ম্যাপ ছাড়াই বুঝে নিল রানা, অ্যামস্টার্ডাম ফেরার বাস টারমিনাল পাওয়া যাবে শহরের পূবদিকে। আঁকাবাকা রাস্তা ধরে পূর্ব দিকে রওয়ানা হয়ে গেল রানা। সরু একটা খালের। ওপর দিয়ে একটা পিঠ কুঁজো ব্রিজ পেরোতে গিয়ে প্রথম সাক্ষাৎ হলো ওর সভ্য মানুষের সাথে। তিনজন মাঝবয়সী মহিলা পড়ল সামনাসামনি, প্রত্যেকেই হাইলারের বিশেষ কস্টিউম পরা। তিনজনই সহজ ভঙ্গিতে চাইল রানার দিকে, তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। যেন হাইলারের রাস্তায় সাতসকালে চুপচুপে ভেজা বিদেশী দেখে,দেখে চোখে ছানি পড়ে গেছে ওদের, কৌতূহলী হওয়ার কিছুই নেই।
মহিলা তিনজনকে নিরুৎসুক ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে দেখে ভেতর ভেতর। ভয়ানকভাবে চমকে উঠল রানা। ব্যাপারটা একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে। গিয়ে নিজের কাজের মধ্যে গোটাকয়েক মারাত্মক ত্রুটি টের পেল সে। কমপক্ষে তিনটে ভুল করেছে সে গতকাল।
কয়েকগজ এগিয়েই একটা বড়সড় কার-পার্ক দেখতে পেল রানা। দুটো গাড়ি আর গোটা ছয়েক বাইসাইকেল দেখতে পেল সে পার্কে। গাড়িগুলো লক করা, কিন্তু একটা সাইকেলেও তালা বা চেইন দেখতে পেল না সে। বোঝা গেল এখানকার লোক করলে বড় ধরনের কিছুই করে, ছ্যাচড়া চুরি চামারির মধ্যে নেই। আশপাশে জনপ্রাণীর চিহ্ন দেখতে পেল না রানা। গেটটা তালা মারা। তালা মেরে দিয়ে অ্যাটেনড্যান্ট নিশ্চয়ই নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ ওপাশের ছোট্ট ঘরটায়। দেয়াল টপকে ভেতরে চলে এল রানা। এক সেকেন্ডের জন্যে অপরাধবোধ দ্বিধান্বিত করল ওকে, তারপর সবচেয়ে ভাল সাইকেলটা বেছে নিয়ে ওটাকে শূন্যে তুলে পার করল গেটের ওপাশে, গেটের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে বেরিয়ে এল দেয়াল টপকে। চোর, চোর বলে চিৎকার করল না কেউ। উঠে পড়ল রানা সাইকেলে।
অভ্যেস নেই অনেকদিন। প্রথম কিছুক্ষণ হাত কাপল, তারপর পঙ্খীরাজের মত ছুটল সে টারম্যাকের হাইওয়ে ধরে মূলভূমির দিকে। মনে মনে খুশি হয়ে উঠল সে–এটা হাঁটার চেয়ে অনেকগুণে ভাল হলো। এই চেহারা নিয়ে বাসে ওঠা ঠিক হত না কিছুতেই। বাতাস কেটে এগোলোর ফলে শীত করছে খুবই, বিশেষ করে শরীরের উপরের অংশটা আবার বরফ হয়ে যাবার উপক্রম করছে, তবু এ কষ্ট রাতের তুলনায় কিছুই না, মনে মনে। নিজেকে এই সান্তনা দিয়ে দাতে দাঁত চেপে প্যাডেল করে চলল রানা দ্রুতবেগে।
যেমন রেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়িটা গ্রামের পোস্ট অফিসের সামনে। সাইকেলটা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে টেলিফোনের দিকে চাইল রানা একবার, তারপর হাতঘড়ির দিকে চেয়ে মত পরিবর্তন করে উঠে বসল পুলিস-কারে। এত ভোরে ওদের কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না।
বড় রাস্তা ধরে মাইলখানেক গিয়ে গাড়ি থামাল রানা, বুট থেকে কাপড়ের প্যাকেটটা বের করে পেছনের সীটে বসে ভেজা কাপড় ছেড়ে পরে নিল। শুকনো কাপড়, গাড়ির এঞ্জিন চালু রেখেই। হিটারটা চালু করে দিয়েছিল। গাড়িতে উঠেই, এতক্ষণে গরম বাতাস ঢুকতে শুরু করেছে নানান ফোকর। দিয়ে। আবার ছুটল রানা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, গাড়ির ভেতরটা গরম হয়ে, ওঠায় আরাম পেয়ে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে ওর শরীরটা, মনে হচ্ছে। গাড়ি চালাতে চালাতেই ঢলে পড়বে ঘুমে। চট করে হিটার অফ করে দিয়ে। গতিআর একটু বাড়িয়ে দিল সে। মাইলদুয়েক গিয়ে রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট বাংলো পাওয়া গেল, একটা সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে মোটেল মোটেল হোক আর যাই হোক, খোলা দেখে ব্রেক চাপল রানা। ঢুকে পড়ল ভেতরে।
মোটেলের কর্ত্রী জিজ্ঞেস করল ব্রেকফাস্ট লাগবে কিনা। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জঞ্জ জেনেভারের বোতলের দিকে আঙুল তুলে দেখাল রানা। কথা বলবার সাহস হলো না ওর, পাছে গলা দিয়ে আওয়াজ না বেরোয়। এই ভোরে নাশতার আগেই বোতলের দিকে রানাকে ইঙ্গিত করতে দেখে অবাক। হয়ে গেল মোটা মহিলা, হয়তো বা ওর এলোমেলো ভেজা চুল দেখে ভয়ও পেল একটু, কিন্তু কিছু না বলে বোতলটা এগিয়ে দিল সে রানার দিকে, তার। পাশে ঠক করে নামিয়ে রাখল একটা গ্লাস। ইঙ্গিতে মহিলাকে বোতল থেকে তরল পদার্থ গ্লাসে ঢেলে দেয়ার অনুরোধ করে রানা শুধু বলল, প্লীজ! শব্দটা শোনাল পি-প্লীজের মত।
মদ ঢালা হতেই কাঁপাহাতে গ্লাসটা তুলে নিয়ে গলায় ঢালতে গিয়ে। অর্ধেকই পড়ে গেল রানার চিবুক বেয়ে। দ্বিতীয় গ্লাসের সিকি ভাগ পড়ল। তৃতীয় গ্লাসের থেকে এক ফোঁটাও পড়ল না বাইরে। চতুর্থ গ্লাসটা রানা যখন হাতে তুলে নিল, তখন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে মহিলা রানার হাতের দিকে–একবিন্দু কাঁপছে না হাতটা এখন, মনে হচ্ছে পাথর দিয়ে তৈরি।
মাই গড! মহিলার কণ্ঠস্বরে শুধু বিস্ময় নয়, মমতারও আভাস পাওয়া। গেল। তুমি তো দেখছি, বাছা, ভয়ানক কাহিল অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলে! ভাগ্যিস এই পর্যন্ত এসে পৌঁছুতে পেরেছিলে, আগেই মূৰ্ছা যাওনি! ব্যস্ত হয়ে। পড়ল মহিলা মোটা শরীর নিয়ে। বসে পড়ো, বসে পড়ো। তোমার জন্যে। ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ফেলছি আমি তিন মিনিটে।
অপেক্ষাকৃত ধীরে চতুর্থ গ্লাস শেষ করে শরীরে অনেকখানি বল ফিরে পেল রানা। শরীরের ভেতর প্রবলবেগে ছোটাছুটি শুরু করেছে এখন লোহিত কণিকাগুলো। একটু সুস্থির হয়ে বাথরূম সেরে এল সে তিনমিনিটে, মোটেলের বাথরূমে একটা ইলেকট্রিক রেজর পেয়ে দাড়িগুলোও কামিয়ে নিয়েছে। ঝটপট। তারপর তৃপ্তির সাথে ডিম, মাংস, পনির, চার পদের রুটি, আর গ্যালনখানেক কফি খেয়ে একটা টেলিফোন করবার অনুমতি চাইল।
ডায়াল করবার সাথে সাথেই শোনা গেল নরম পুরুষকণ্ঠ হোটেল প্লাযা।
আমি মাসুদ রানা। সোহানা চৌধুরীকে চাই, ওদের কামরায় কানেকশন দিন।
প্রায় এক মিনিট পর মারিয়ার ঘুমঘুম কণ্ঠস্বর ভেসে এল হ্যালো? কে বলছেন?
মানসচক্ষে পরিষ্কার দেখতে পেল রানা মারিয়াকে, আড়মোড়া ভাঙছে রিসিভার কানে ধরে, হাই তুলছে।
বেলা দুপুর পর্যন্ত ঘুমোবার পারমিশন কে দিয়েছে তোমাদের? কর্কশ। কণ্ঠে বলল রানা।
কে? কি বলছেন? রানার গলা চিনতে পারেনি মারিয়া।
গতকাল বাকি দিনটা ছুটি দেয়া হয়েছিল, তাই বলে আজকেও বেলা দুপুর পর্যন্ত কে ঘুমোতে বলেছে তোমাদের? রিস্টওয়াচের দিকে চাইল রানা। সকাল পৌনে আটটা। কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে?
কে..তুমি? তুমি বলছ, রানা?
তাছাড়া আবার কে? মাসুদ রানা দি গ্রেট। তোমাদের প্রিয়তম প্রভু। জঞ্জ জেনেভারের ঠেলায় তুঙ্গে উঠে আছে রানার মৃড়।
সোহানা! চেঁচিয়ে উঠল মারিয়া। ফিরে এসেছে। আমাদের প্রিয়তম প্রভু বলছে নিজেকে। মারিয়ার কণ্ঠে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের আভাস পেল রানা।
শোকর আলহামদুলিল্লাহ! দূর থেকে সোহানার গলাও শুনতে পেল রানা। আমাদের দোয়া কাজে লেগেছে, মারিয়া!
ওদের দুজনকে এত খুশি হয়ে উঠতে দেখে আশ্চর্য একটা কৃতজ্ঞতাবোধ স্পর্শ করল রানার অন্তর। গতরাতে মারা যাচ্ছিল সে আর একটু হলে, কঠোর সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে ওর–এই সংগ্রাম যে কেবল নিজের জন্যে নয়, আরও মানুষ খুশি হয় ও বেঁচে থাকলে, সেটা বুঝতে পেরে হঠাৎ ভিজে এল ওর চোখের পাতা। সামলে নিয়ে বলল, যথেষ্ট হয়েছে। এত বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোতে হবে না। এবার কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও। কাজ আছে।
ঘুমোলাম কোথায়! সারারাতই তো জেগে আছি। আমাদের ক্রাইস্ট আর তোমাদের মুহামেড-দুই প্রফেটকে অস্থির করে রেখেছি দুজন মিলে। সারারাত। এই তত আধঘন্টাও হয়নি বিছানায়
ভুলে যাও। সোহানা ঘরে থাকুক, তুমি ঝটপট কাপড় পরে বেরিয়ে পড়ো এক্ষুণি। নো ফোমবাথ, নো ব্রেকফাস্ট। একটা ট্যাক্সি নিয়ে…
নো ব্রেকফাস্ট মানে? নিজে নিশ্চয়ই ভরপেট নাশতা খেয়ে উঠেছ এইমাত্র?
অ্যাজ এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট-ইয়েস। মুচকি হাসল রানা। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হাইলার দ্বীপের দিকে রওনা হয়ে যাও।
হাইলার দ্বীপ মানে, যেখানে পাপেট তৈরি হয়?
হ্যাঁ। আমার সাথে দেখা হবে রাস্তায়। লাল-হলুদ স্ট্রাইপের একটা ট্যাক্সিতে থাকব আমি। আমাকে দেখলেই গাড়ি থামাতে বলবে ড্রাইভারকে। যত তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো।
রিসিভার নামিয়ে রেখে বিল চুকিয়ে দিয়ে রওনা হয়ে গেল রানা। মনের ভেতর কেমন যেন ফুর্তি বোধ করছে ও। বেচে থাকার আনন্দ। জীবনে আবার ভোর দেখতে পাবে কল্পনাও করা যায়নি গতরাতে, অথচ ভোর হলো, বেঁচে আছে সে এখনও। নিছক বেঁচে থাকবার আনন্দে এতটা উদ্বেলিত হয়নি। রানা আর কোনদিন। নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে বেরিয়ে এসে এত আনন্দ হয়নি ওর আর কখনও।
সদ্য কেনা প্যাকেট থেকে বের করল সে দিনের প্রথম সিগারেট।
.
০৬.
শহরতলির কাছাকাছি পৌঁছে একটা হলুদ ট্যাক্সির জানালা দিয়ে ড্রাইভারকে হাত নাড়তে দেখে থেমে দাঁড়াল রানা। গাড়ি থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াবার আগেই প্রায় উড়ে এসে হাজির হলো মারিয়া। নেভি র স্কাট আর জ্যাকেট পরেছে মারিয়া, সাদা রাউজ। সারারাত জেগে থাকার কোন চিহ্ন। নেই চোখে-মুখে। সদ্য ফোঁটা ফুলের মত লাগছে ওকে।
অপূর্ব! বলল মারিয়া রানার মুখের দিকে চেয়েই। চেহারার যা ছিরি। হয়েছে না! আস্ত একটা মামদো ভূত। একটা চুমো খেতে পারি?
না। আত্মসম্মান বজায় রাখবার চেষ্টা করল রানা। বসের সাথে তার অধীনস্থ কর্মচারী
হয়েছে, হয়েছে। চুপ করো। বিনা অনুমতিতেই টুক করে একটা চুমো খেলো মারিয়া রানার গালে। এবার শোনা যাক, কী করতে হবে আমাকে।
সোজা চলে যাও হাইলারে। বন্দরের কাছাকাছি অনেক রেস্তোরাঁ পাবে, যে কোন একটায় ঢুকে সেরে নাও ব্রেকফাস্ট। তারপর একটা বাড়ির
ওপর নজর রাখতে হবে তোমার। যতটা সম্ভব কাছে থেকে জাস্ট ওটার ওপর। চোখ রাখলেই চলবে। পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিল রানা ওকে বাডিটার। অবস্থান। বেশি কাছে যাবে না, আর সর্বক্ষণ তৎপরতারও দরকার নেই। শুধু খেয়াল রাখবে কি ধরনের লোক ওই বাড়িতে ঢুকছে বা বেরোচ্ছে। মনে রাখবে, তুমি একজন টুরিস্ট। লোকজনের মধ্যে, অথবা যতটা পারা যায়। লোকজনের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করবে সবসময়। সোহানা কি ঘরেই?
হ্যাঁ। মুচকি হাসল মারিয়া। পাগলের মত ভালবাসে ও তোমাকে। ভাল কথা, একটা ফোন এসেছিল আমি যখন কাপড় ছাড়ছি সেই সময়। সোহানা ধরেছিল। ভাল খবর আছে।
এখানে সোহানা চেনে কাকে যে কেউ ফোন করে কোন সুখবর দেবে ওকে? একপর্দা চড়ে গেল রানার গলা নিজের অজান্তেই। কে ফোন করেছিল?
বিট্রিক্স শেরম্যান।
বিট্রিক্স শেরম্যান! কী যা-তা বলছ! এথেন্সে চলে গেছে ও কাল সকালে। ও আসবে কোত্থেকে?
ফিরে এসেছে আবার, পরম সহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলল মারিয়া। ও পালিয়েছিল, তার কারণ তুমি যে দায়িত্ব দিয়েছিলে ওর ওপর সেটা এখানে। থেকে পালন করতে পারছিল না ও। সবসময় নাকি লোক লেগে ছিল ওর পেছনে। কাজেই এথেন্স চলে যাওয়ার ভান করে প্যারিস থেকে ফিরে এসেছে। আবার। হেনরীকে নিয়ে শহরের বাইরে এক বন্ধুর বাড়িতে আছে। বিট্রিক্সের এই কৌশলে যে ওঁর উপর খুবই খুশি হয়েছে মারিয়া, বোঝা গেল ওর সন্তুষ্ট হাসি দেখে। তোমার জন্যে সুখবর বিট্রিক্স জানিয়েছে, ক্যাসটিল লিন্ডেন সম্পর্কে তোমার সন্দেহ অমূলক নয়। তোমার নির্দেশমত ভলেনহোভেন। কোম্পানীতেও গিয়েছিল ও। সেখানে যদি যাও আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার… রানার মুখের দিকে চেয়ে ভয় পেল মারিয়া। কি হলো!
হায় আল্লা! দেখতে দেখতে বিকৃত হয়ে গেল রানার চেহারা। কি করলাম! কি করলাম এটা!
গাড়িতে উঠে পড়েছিল রানা, কোটের আস্তিন ধরে ফেলল মারিয়া। কি হয়েছে? কি করেছ!
এক্ষুণি যাওয়া দরকার আমার, মারিয়া। এক্ষুণি রওনা হতে হবে!
কিন্তু হঠাৎ কি হলো? কিছুই যে বুঝতে পারছি না আমি! আরও ভয় পেয়ে গেল মারিয়া।
মস্ত ভুল হয়ে গেছে, মারিয়া। সর্বনাশ যা হওয়ার হয়তো হয়ে গেছে। এতক্ষণে। বুঝতে পারছ না–বিট্রিক্স শেরম্যান কি করে জানল তোমাদের হোটেলের নাম্বার?
তাই তো! ভয়ানকভাবে চমকে উঠল মারিয়া এবার। হায় খোদা, সত্যিই তো! ও কি করে জানবে কোন হোটেলে উঠেছি আমরা?
একলাফে গাড়িতে উঠে দড়াম করে দরজা লাগাল রানা। পরমুহূর্তে, বাঘের মত লাফ দিল গাড়িটা সামনের দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রিয়ার ভিউ মিররে বিন্দুতে পরিণত হলো মারিয়া ডুক্লজ, তারপর নাই হয়ে গেল। তুমুল বেগে ছুটে চলেছে বিশেষ এঞ্জিন ফিট করা ওপেল। শহরের যত কাছে আসছে ততই রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ছে দেখে একটা বোতাম টিপে, দিল রানা। নীল ফ্ল্যাশিং লাইট চালু হয়ে গেল গাড়ির মাথায়। আরেকটা বোতাম টিপতেই শুরু হয়ে গেল সাইরেন। এবার এয়ারফোন জোড়া, দুইকানে পরে নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করল ও রেডিও কন্ট্রোল, নব। খটর-মটর। আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই লাইন পাচ্ছে না রানা। এযন্ত্র কিভাবে অপারেট করতে হয় দেখে নেয়নি সে কারও কাছে, এখন দরকারের সময় এটাকে ব্যবহার করতে পারছে না দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ওর নিজের। উপরই। একে তুমুল গতিবেগ-নজর রাখতে হচ্ছে রাস্তার উপর, একটু এদিক ওদিক হলেই যা তা কাণ্ড ঘটে যাবে, তার উপর এঞ্জিনের বিকট গর্জন, সেইসাথে সাইরেনের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ; এই সময় কানে যদি স্ট্যাটিকের খটর মটর কা আওয়াজ আসে, মেজাজ ঠিক রাখা কারও পক্ষেই বোধহয় সম্ভব না। হঠাৎ বাজে শব্দ থেমে গিয়ে শান্ত, দৃঢ় এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল রানার কানে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
অপারেটর, এক্ষুণি আমাকে কর্নেল ডি গোল্ডের কানেকশন দিন। জলদি! আমি কে সে প্রশ্ন অবান্তর। আর্জেন্ট। এই মুহূর্তে কথা বলতে চাই আমি। কর্নেলের সাথে। দুমিনিটের অস্বস্তিকর নীরবতা। গাড়িঘোড়া বাঁচিয়ে তুফান। বেগে ছুটছে রানা। ভিড় বাড়ছে ক্রমে। তারপর ভেসে এল অপারেটরের কণ্ঠস্বর।
কর্নেল ডি গোল্ড এখনও অফিসে আসেননি।
তাহলে তার বাসায় যোগাযোগ করুন। চেঁচিয়ে উঠল রানা। ইমিডিয়েট! আর্জেন্ট। ঠিক তিন মিনিটের মধ্যে ভেসে এল কর্নেলের গম্ভীর। গলা। কর্নেল, রানা বলছি।…হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিট্রিক্স শেরম্যানের ব্যাপারে। আমার মনে হয় মারাত্মক বিপদের মধ্যে আছে মেয়েটা।… সেসব পরে শুনবেন। এক্ষুণি আপনার অ্যাকশন নেয়া দরকার।…ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে। আমার বিশ্বাস ওখানেই পাওয়া যাবে ওকে। জলদি! ফর গড়স সেক, জলদি করুন। ম্যানিয়াকের পাল্লায় পড়েছে মেয়েটা।
কান থেকে এয়ারফোন খসিয়ে রেডিওর সুইচ অফ করে দিল রানা। মন দিল, গাড়ি চালনায়। বারবার ধিক্কার আসছে ওর নিজের উপর, বুঝেও বুঝতে চাইছে না রানা দুর্দান্ত এক ক্রিমিনাল জিনিয়াসের বিরুদ্ধে কাজ করছে সে, বুদ্ধির চালে হেরে গিয়ে ক্ষোভ করবার কিছুই নেই, ও নিজে যে বেঁচে আছে তাই যথেষ্ট। লোকটার চিন্তা-ভাবনা বা তৎপরতার ব্যাপারে আগে থেকে কিছু আন্দাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে ওর পক্ষে–কারণ কেবল জিনিয়াস হলে এক কথা ছিল, তার সাথে যুক্ত হয়েছে ভয়ানক এক সাইকোপ্যাথ। ইসমাইল আহমেদকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছিল বিট্রিক্স, তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই, কিন্তু সেটা ছিল হয় ইসমাইল নয় হেনরী–যে-কোন। একজনকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত! ভাইয়ের প্রাণের বিনিময়ে এই কাজটা করতে হয়েছিল বিট্রিক্সকে। তাও বাধ্য হয়ে। রানার পেছনেও ওকে লাগাবার ইচ্ছে ছিল ওদের, শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠানো হয়েছিল ওকে হোটেল কার্লটনে। কিন্তু যখন দেখা গেল, উল্টে রানাই লেগে গেছে ওর পেছনে, অন্ধকার থেকে টান। দিয়ে ওকে দিবালোকে নিয়ে আসবার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনি অ্যাসেট না। হয়ে লাইয়াবিলিটি হয়ে পড়ল বিট্রিক্স ওদের কাছে।
কিন্তু ঝট করে ওকে খুন করে ফেলবার সাহস হলো না ওদের। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে এখন ব্যাপারটা রানার কাছে। সরাসরি বিট্রিক্সকে খতম করে দেয়ার সাহস হয়নি ওদের, তার কারণ ওদের জানা আছে যে মুহূর্তে ওরা বিট্রিক্সকে খুন করবে, রানা বুঝে নেবে যে ওর আসল উদ্দেশ্য সফল হবার নয়, এবং যেটা মনপ্রাণ থেকে চায়নি সেই কাজটা করতে হবে। তখন তাকে–অর্থাৎ সোজা পুলিসের কাছে গিয়ে যা জানে খুলে বলবে সব। সেটা ওরা চায়নি। কারণ যদিও পুলিসের কাছে গেলে রানার আসল উদ্দেশ্যটা। বিফল হয়ে যাচ্ছে, রানার কাছে যতটুকু তথ্য আছে সেটুকুই ওদের আগামী। কয়েক মাস, এমন কি কয়েক বছরের জন্যে পঙ্গু করে দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ইচ্ছে করলে যে কোন মুহূর্তে চুরমার করে দিতে পারে রানা ওদের সংগঠন। এজন্যেই ব্যালিনোভা নাইটক্লাবে অভিনয় করানো হয়েছিল গুডবডি আর স্যামুয়েলকে দিয়ে। এতই নিখুঁত অভিনয় করেছে ওরা, যে সত্যি বিট্রিক্স আর হেনরী পালিয়ে গেছে, নাকি ওদের নামে আর দুজনকে পাঠানো হয়েছে এথেন্সে, ভালমত তলিয়ে দেখবার কথা মনেই আসেনি রানার। আজ সকালে সোহানার সাথে যখন কথা বলেছে, মেয়েটার কানের উপর যে পিস্তল ধরা ছিল। তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিট্রিক্সকে বাঁচিয়ে রাখবার আর কোন মানেই নেই এখন। শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছে মেয়েটা। এখন যখন রানার তরফ থেকে ভয়ের কোন কারণ নেই, ওদের ধারণা, রাত দুটোর সময়ে বার্জ-বন্দরের সাগরতলে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েছে মাসুদ রানা, তখন বিট্রিক্সকে নিয়ে যা খুশি তাই করতে। বাধবে না ওদের। সূত্র ধরে ধরে এগিয়ে সবই বুঝতে পারল রানা–তবে দেরিতে। অনেক দেরি হয়ে গেছে ওর, পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, মেয়েটাকে রক্ষা করবার আর কোন পথ নেই।
শহরের মধ্যে দিয়ে আশ্চর্য দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল রানা পাগলের মত গাড়ি হাঁকিয়ে। অবশ্য একজন লোকও চাপা পড়ল না ওর গাড়ির নিচে, তবে। এজন্যে রানার যতটা কৃতিত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতিত্ব এখানকার জনসাধারণের। রানার গাড়িটা দেখামাত্র পূর্বপুরুষদের অনুকরণে প্রকাণ্ড লাফ দিয়ে সরে যাচ্ছে সবাই রাস্তা থেকে। পুরানো শহরে চলে এল সে, ওয়ানওয়ে সরু রাস্তা ধরে ছুটল ওয়েরহাউজ অঞ্চলের দিকে। কাছাকাছি গিয়েই থামতে হলো রানাকে। সামনে পুলিস ব্যারিকেড। রাস্তা বন্ধ। একটা জীপ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে, জনাকয়েক অটোমেটিক রাইফেলধারী টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মত। জোরে ব্রেক চেপে স্কিড করে থেমে গেল গাড়ি, লাফিয়ে বেরোল রানা। একজন পুলিস এগিয়ে এল কয়েক পা।
রাস্তা বন্ধ, স্যার। পুলিস ব্যারিকেড।
হারি মুরা। নিজেদের গাড়িটাও চিনতে পারছ না, হাদারাম! বিরক্ত কণ্ঠে বলল রানা। রাস্তা ছাড়ো, যেতে দাও আমাকে।
কাউকেই যেতে দেয়া হচ্ছে না এই রাস্তায়। রাস্তা বন্ধ। অটল গাম্ভীর্যের সাথে বলল কনস্টেবল।
ঠিক আছে, ছেড়ে দাও ওকে। আমাদের লোক। কর্নেলের কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রানা, ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে যাওয়ার গলিমুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ডি গোল্ড। কর্নেলের চেহারা দেখেই ছোট্ট একটা লাফ দিল রানার কলজেটা দুঃসংবাদ আশঙ্কায়। কাছে এসে বলল ডি গোল্ড, দৃশ্যটার দিকে চাওয়া যায় না, মেজর মাসুদ রানা। বীভৎস!
কয়েক পা এগিয়ে গলিখে এসেই পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। গেল রানা। ভলেনহোভেন কোম্পানীর হয়েস্টিং বীম থেকে বলিছে দেহটা। গলায় রশি বাধা। বাতাসে দুলছে, অল্প অল্প। চোখ ফিরিয়ে নিল রানা। সত্যিই তাকিয়ে থাকা যায় না। পাশে এসে দাঁড়াল ডি গোল্ড, আর একবার ঝুলন্ত লাশটার দিকে চেয়ে কাঁধ ছোট করে শিউরে ওঠার ভঙ্গি করল।
লাশটা নামানোর ব্যবস্থা করছেন না কেন?নিজের গলার স্বর কেমন যেন বিসদৃশ ঠেকল রানার নিজের কানেই। মনে হলো, সে নয়, দূর থেকে আর কেউ বলল কথাটা। হাঁটতে শুরু করল সে সামনের দিকে।
ডাক্তারের কাজ। গেছে একজন ওপরে। রানার সাথে সাথে এগোল। কনেল।
মাথা ঝাঁকাল রানা। অনেকটা আপনমনে বলল, খুব বেশিক্ষণ ধরে ঝুলছে বলে মনে হয় না। ঘণ্টাখানেক আগেও বেঁচে ছিল মেয়েটা। ওয়েরহাউজ খোলা হয় অনেক সকালে। এত লোকজনের কেউ দেখল না।
আজ তো শনিবার, বাধা দিয়ে বলল কর্নেল। শনিবার বন্ধ রাখে এরা কাজকর্ম।
আবার মাথা ঝাঁকাল রানা। চরকার বেগে চিন্তা চলছে ওর মাথার ভেতর। হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই থেমে গেল চরকা। মনে মনে আস্ত এক ডিগবাজি খেয়ে উঠল রানা। অনুভব করল দ্রুততর হয়ে গেছে ওর হার্টবিট। ভয়ের ধাক্কায় ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে যেন সে। থমকে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল একটা।
বিট্রিক্সকে দিয়ে সোহানার কাছে টেলিফোন করাবার কি অর্থ? সোহানার মাধ্যমে কিছু একটা জানাতে চায় ওরা রানাকে। বিট্রিক্সের মেসেজের কোন অর্থ নেই ক্যাসটিল লিভেন বা ভলেনহোভেন কোম্পানী কোথাও আসলে যেতে বলেনি ওকে রানা। সোহানা আর মারিয়ার কাছে লিভেনের কথা বলেছিল সে অন্য উদ্দেশ্যে। গতরাতে সমুদ্রযাত্রা করতে গিয়ে যদি কোন কারণে ওর মৃত্যু ঘটে, তাহলে যেন ক্যাসটিল নামটা কর্নেল ডি গোন্ডের কানে ওঠে তারই নিশ্চয়তা বিধান করেছিল। কিন্তু বিট্রিক্সের মেসেজ আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মনে হলেও ওই মেসেজের ভিত্তিতেই সোজা ভলেনহোভেন। কোম্পানীতে এসেছে সে ওর খোঁজে। ওকে দিয়ে এই মেসেজ দেয়া প্রয়োজনই মনে করত না ওরা, যদি ওরা মনে করত মারা গেছে রানা। তার মানে, ওরা জানে বেচে আছে রানা। কি করে জানল? হাইলারের ওই তিন প্রৌঢ়া মহিলা ছাড়া আর কারও সাথেই তো দেখা হয়নি রানার। হয় ওরা। জানিয়েছে, নয়তো অন্য আরও কোন উপায় রয়েছে ওদের রানার গতিবিধি টের পাওয়ার।
আচ্ছা, ধরা যাক, ওরা জানে বেঁচে আছে রানা। তাহলে বিট্রিক্সকে খুন করবার কি মানে দাঁড়ায়? অনেক কষ্ট স্বীকার করে রানাকে বুঝিয়েছে ওরা যে বেচে আছে বিট্রিক্স, পালিয়ে গেছে এথেন্সে, তারপর আবার ওকে হয়েস্টিং বীমের সাথে ঝুলিয়ে দেয়ার কি অর্থ? প্রশ্নটা মনে জাগবার সাথে সাথেই উত্তর পেয়ে গেল রানা। বিট্রিক্সকে খুন করা হয়েছে অনেক আগেই। খুব সম্ভব রাত। দুটোয় রানার মৃত্য সংবাদ পাওয়ার পরপরই ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে হয়েস্টিং বীমের সাথে। রানার বেচে থাকার সংবাদ যখন পেয়েছে ওরা, ততক্ষণে বেলা। উঠে গেছে, লাশটা তখন আর নামিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কাজেই পানিটা ঘোলা করে তোলবার জন্যেই ফোন করানো হয়েছে সোহানার কাছে আর কাউকে দিয়ে। তাড়াহুড়োয় ছোট দুটো ভুল করেছে ওরা খেয়ালই করেনি যে বিট্রিক্সের পক্ষে সোহানা এবং মারিয়া কোন্ হোটেলে উঠেছে সেটা জানা সম্ভব। ছিল না। দ্বিতীয়ত, ওদের জানা আছে যে সোহানা বা মারিয়া কারও সাথে, কখনও কোন কথা হয়নি বিট্রিক্সের, ফলে বিটেক্সের পরিচয়ে যে কেউ একজন ফোন করলেই চলে কিন্তু কথাটা যে রানারও জানা আছে, সেটা ভুলে গিয়েছিল ওরা প্ল্যান তৈরি করবার সময়।
যাই হোক, আসল কথা, সম্মুখ সমরে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে ওরা এবার রানাকে। জানিয়ে দিয়েছে, আর গোপনীয়তার প্রয়োজন নেই, মরিয়া হয়ে শেষ ছোবলের জন্যে প্রস্তুত হয়েছে গোক্ষুর। অর্থাৎ, ভীমরুলের চাকে সত্যিই ঢিল লেগেছে এবার, বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ওরা–এবার মাসুদ রানা, ঠ্যালা সামলাও! দেখা যাক কার পাঞ্জায় কত জোর।
রশিটা ঝুলছে কেবল, লাশটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভলেনহোভেন কোম্পানীর সামনে এসে মুখ খুলল কর্নেল ডি গোন্ড। আপনার চেহারার এই হাল হলো কি করে, মেজর রানা?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রানা বলল, ডাক্তারকে একটু ডেকে পাঠানো যাবে?
কেন যাবে না, একশোবার যাবে। একজন সেন্ট্রিকে হুকুম দিতেই সে গিয়ে ডেকে নিয়ে এল ডাক্তারকে।
অল্পবয়সী ছোকরা ডাক্তার। ফ্যাকাসে চেহারা। রানার সন্দেহ হলো, এর স্বাভাবিক চেহারা হয়তো এতটা ফ্যাকাসে না, হত্যার নির্মমতা উপলব্ধি করেই হয়তো এই হাল হয়েছে।
বেশ অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে মেয়েটা, তাই না? কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন। করুল রানা।
ভুরু কুঁচকে মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার। শিওর হয়ে বলা যাচ্ছে নাঃঘণটা পাঁচেক তো হবেই।
ধন্যবাদ।বলেই ঘুরে গলিমুখের দিকে হাঁটতে শুরু করল রানা। সাথে সাথে আসছে ডি গোল্ড। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে। রয়েছে, কর্নেলের মনে, কিন্তু ঠিক কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বারবার সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইছে রানার মুখের দিকে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ। নেই রানার, নিচু গলায় বলল, আমার জন্যেই মারা পড়ল মেয়েটা। একটু থেমে বলল, হয়তো আরেকজনও মারা পড়তে যাচ্ছে আমারই ভুলের জন্যে।
ঠিক বুঝতে পারলাম না, আরেকটু বিশদ বিশ্লেষণের অনুরোধ কর্নেলের কণ্ঠে।
মৃত্যুর মুখে পাঠিয়েছি হয়তো মারিয়াকে।
মারিয়া?
আপনাকে বলা হয়নি, আমার সাথে আরও দূজন মেয়ে এসেছে ইন্টারপোল থেকে। ওদের একজনের নাম মারিয়া। আরেকজন সোহানা চৌধুরী। হোটেল পেছন থেকে মাগেনহেলারের ডাক শুনে থেমে দাঁড়াল দুজনই। সাদা একটা ভ্যানিটিব্যাগ হাতে খলিয়ে গম্ভীর মুখে সামনে এসে দাঁড়াল, ইন্সপেক্টর। রানা জিজ্ঞেস করল, ব্যাগটা বিট্রিক্স শেরম্যানের? মাগেনথেলারকে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিতে দেখে বলল, ওটা আমাকে দিন, প্লীজ।
ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়ল মাগেনথেলার। এটা দেয়া যাবে না। খুনের কেসে..
দিয়ে দাও, মাগেনথেলার, বলল কলে। চাইছে যখন, নিশ্চয়ই দরকার আছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্যাগটা রানার হাতে তুলে দিল মাগেনথেলার। ওটা হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল রানা। বলল, যা বলছিলাম। হোটেল গাযার তিনশো চৌত্রিশ নম্বর কামরায় রয়েছে সোহানা। দয়া করে। আমার হয়ে একটা টেলিফোন করবেন ওকে, কনেল। মন্তু বিপদে আছে ও। ওকে বলবেন, যেন দরজায় চাবি লাগিয়ে ঘরের মধ্যেই বসে থাকে যতক্ষণ না। আমার তরফ থেকে কোন মেসেজ পায়। বলবেন, আমি ছাড়া আর কেউ যদি টেলিফোন করে, কিংবা চিঠি দেয়, বক্তব্যের মধ্যে যদি মাদাগাস্কার শব্দটা না থাকে তাহলে সেসবের যেন বিন্দুমাত্র মূল্য না দেয়। ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী-ব্যক্তিগতভাবে আপনি নিজে যদি খবরটা ওকে জানান, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।
অলরাইট, মাথা দোলাল কর্নেল। আমি নিজেই ফোন করব।
কর্নেলের গাড়ির দিকে ইঙ্গিত করল রানা। আপনার রেডিও-টেলিফোনে হাইলারের পুলিসের সাথে কথা বলা যাবে না?
যাবে। মার্সিডিজের দিকে এগোল ডি গোল্ড। এক্ষুণি দরকার?
এই মুহূর্তে।
ড্রাইভারকে হাইলার-পুলিসের সাথে কন্ট্যাক্ট করতে বলে সোজা হয়ে দাঁড়াল কর্নেল। রানা বলল, মারিয়াকে খুঁজে বের করতে হবে। মারিয়া ডুক্লজ, পাঁচ ফুট দুই, লম্বা সোনালি চুল, নীল চোখ, দেখতে খুবই ভাল, স্কার্ট আর নেভি র রঙের জ্যাকেট, সাদা রাউজ। হ্যাঁন্ডব্যাগটাও সাদা। ওকে পাওয়া যাবে
এক সেকেন্ড। হাত তুলে রানাকে থামিয়ে দিল কর্নেল ডি গোল্ড। ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে দুই সেকেন্ড পর সোজা হয়ে চাইল রানার চোখের। দিকে। দুঃখিত। হাইলারের লাইনটা ডেড হয়ে আছে, মেজর রানা। আপনি। যেদিকে পা বাড়াচ্ছেন সেদিকেই ডেথ। লক্ষণটা খুব ভাল ঠেকছে না আমার। কাছে, মেজর।
ঠিক আছে, দুপুরের দিকে টেলিফোন করব আমি আপনাকে, বলেই ট্যাক্সির দিকে এগোল রানা।
আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে, বলল মাগেনথেলার।
নানান কাজে হাত জোড় আছে আপনার এখানেই। তাছাড়া আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে পুলিসের লোকের কোন সাহায্য দরকার পড়বে না। আমার।
তার মানে আইনের বেড়া ডিঙোতে যাচ্ছেন আপনি, অনুযোগের সুরে বলল মাগেনথেলার।
এখনই আমি আইনের বাইরে রয়েছি, মাগেনথেলার। ইসমাইল আহমেদ মৃত। বিট্রিক্স শেরম্যান মৃত। এতক্ষণে হয়তো মারিয়া ডকুজও মারা গেছে। আইন কি রক্ষা করতে পেরেছে ওদের? যারা আইনের বাইরে চলে তাদের সাথে মোলাকাত করতে হলে এপারে বসে থাকলে চলবে না, বেড়া ডিঙিয়ে আমাকেও যেতে হবে ওপারে।
সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় আপনার পিস্তলটা আমাদের কেড়ে নেয়া। উচিত, নরম গলায় বলল ইন্সপেক্টর। এই মুহূর্তে।
ঠিক বলেছেন, টিটকারির সুরে বলল রানা। ওটা কেড়ে নিয়ে বরং একটা বাইবেল তুলে দিন আমার হাতে। বাইবেলের বাণী শুনিয়ে ঠিক সুপথে নিয়ে আসব আমি ওদেরকে। তেতো হাসি হাসল রানা। আগে আমাকে খুন। করুন, ইন্সপেক্টর, তারপর পিস্তলটা দখলে পাবেন।
কর্নেল বলল, আপনার কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে, মেজর মাসুদ রানা, যেগুলো আপনি গোপন রাখছেন আমাদের কাছ থেকে।
আমার উত্তর হচ্ছে আছে এবং রাখছি।
কাজটা কিন্তু ভদ্রতা এবং আইনের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঠিক উচিত হচ্ছে কি?
গাড়িতে উঠে বসল রানা। উচিত হচ্ছে কি হচ্ছে না তার বিচার করতে পারবেন পরে–এখন না। কিন্তু ভদ্রতা বা আইন সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি–আপাতত কেয়ার না করাই উচিত বলে মনে করছি।
এঞ্জিন স্টার্ট দিয়েই আড়চোখে লক্ষ করল রানা, দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার, একটা হাত তুলে বারণ করল ওকে কর্নেল ভ্যান ডি গোন্ড। কানে এল, কর্নেল বলছে, যেতে দাও ওকে, ইন্সপেক্টর, যেতে দাও।
.
০৭.
পাগলের মত ছুটল রানা। যে স্পীডে গাড়ি চালাল, তাতে অ্যামস্টার্ডাম থেকে হাইলার পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌঁছুতে অন্তত আধড়জন অ্যাকসিডেন্ট করবার কথা, প্রত্যেকটাই সিরিয়াস, কিন্তু ফ্যাশিং লাইট আর তীক্ষ্ণ সাইরেন যাদুমন্ত্রের মত। পরিষ্কার করে দিল ওর সামনের রাস্তা। সামনের প্রত্যেকটা গাড়িই গতিবেগ কমিয়ে একপাশে সরে পথ ছেড়ে দিল রানার।
অন্য কোন গাড়ি পেলে খুশি হত রানা, কিংবা বাস যদি একশো মাইল বেগে চলত তাহলে তাতে করে যেতে পারলে আরও খুশি হত। কারণ আরও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সাধারণ এক টুরিস্ট হিসেবে যেতে চায় সে হাইলারে, লাল-হলুদ ডোরাকাটা ট্যাক্সি চালিয়ে ওখানে পৌঁছুলে চোখে পড়ে যাবে। হয়তো অনেকের। কিন্তু দ্রুততার খাতিরে অন্যান্য সুবিধে বিসর্জন দিতে হলো ওকে।
শহরতলি ছাড়িয়ে প্রথম যে গ্রামটা পেল, সোজা গিয়ে তার পোস্ট। অফিসের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামল রানা। টেলিফোন বুদে ঢুকে ডায়াল করল। সোহানার হোটেলে। জানা গেল, কিছুক্ষণ আগেই রানার মেসেজ পেয়েছে সোহানা কর্নেল ডি গোল্ডের মাধ্যমে, দরজায় তালা মেরে বসে আছে এখন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়।
আমি খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে রয়েছি সাহানা। তোমাকে কতকগুলো। কথা বলে যাব আমি এখন গড়গড় করে। এসব কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু। ধীরেসুস্থে যে এসবের মানে ব্যাখ্যা করব, তার সময় নেই। তোমার তো বাংলা শট হ্যাঁন্ড জানা আছে, লিখে নাও আমার বাণী–আমার বিশ্বাস, আগাগোড়া বারুদশেক পড়লেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে। গেট রেডি।
এক সেকেন্ড, খুব সম্ভব কাগজ পেন্সিল নিয়ে তৈরি হওয়ার সময় চাইল। সোহানা, ঠিক তিন সেকেন্ড পর বলল, বললো, আমি রেডি।
গড়গড় করে একনাগাড়ে পাঁচ মিনিট কথা বলে থামল রানা। কোনরকম সম্ভাষণ বিনিময় না করেই ঝটাং করে রিসিভার নামিয়ে রেখে একলাফে গিয়ে উঠল গাড়ির ড্রাইভিং সীটে। ছুটল আবার। হাইলারের বাঁধের কাছে এসে গাড়ির গতি কমিয়ে স্বাভাবিকে নিয়ে এল রানা, কয়েক মিনিট পর যেখান থেকে। সাইকেল চুরি করেছিল সেই কারপার্কে এসে থামাল সে ট্যাক্সিটা। ইতিমধ্যেই অনেক গাড়ির ভিড় জমে গেছে। ভালই–ভাবল রানা মনে মনে, ট্যুরিস্টদের। ভিড়ে মিশে যেতে কোন অসুবিধে হবে না।
অ্যামস্টার্ডাম থেকে রওনা হওয়ার সময়ই লক্ষ করেছিল রানা, পরিষ্কার। হয়ে আসছে আকাশটা, হাইলারে পৌঁছে দেখা গেল গত রাতে এত যে বৃষ্টি হয়েছে সেটা আর বিশ্বাস হতে চায় না আকাশের দিকে চাইলে। ডাচ ওয়েদারকে এইজন্যেই বোধ হয় আনপ্রেডিকটেবল বলে। সাদা রঙের, ছোটখাট এক-আধ টুকরো মেঘ ভাসছে আকাশে, বাকি সব ফরসা। কড়া রোদ বাষ্প টেনে তুলছে মাঠের বুক থেকে।
কোট খুলে হাতের উপর ভাজ করে রাখল রানা, সাইলের ফিট করা। পিস্তলটা কোটের পকেটে, পকেটটা এমনভাবে রানার দিকে ফেরানো যে। প্রয়োজনের সময় আধসেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না ওটা বের করে আনতে। সহজ ভঙ্গিতে সেই বাড়িটার দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। বাড়িটার। কাছে এসে দেখল রানা, দরজা দুপাট খোলা, ভেতরে ট্র্যাডিশনাল হাইলার কস্টিউম পরা মহিলা দেখতে পেল। পঞ্চাশ গজ দূরে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে এটা ওটা ঘাটাঘাটি করল কিছুক্ষণ, তারপর একটা সন্ত্রাস কিনল। ওই বাড়ির দরজা দিয়ে লোকজনকে ঢুকতে বেরোতে দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। টুকিটাকি, আরও কিছু জিনিস কিনবার ছলে মিনিট দশেক পার করল রানা এ-দোকান ও দোকানে। আসলে খুজছে মারিয়াকে। ক্রমে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে সে। দুজন লোককে দুটো বাক্স মাথায় করে বেরিয়ে আসতে দেখল রানা বাড়িটা থেকে, এক চাকার ঠেলাগাড়িতে ওগুলো তুলে ঠেলে নিয়ে চলে গেল ওরা বন্দরের দিকে। বোঝা যাচ্ছে, ওটা একটা কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান। কি ধরনের শিল্প চলছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু যে নয় সেটা বোঝা যায় ওদের খোলামেলা ভাব দেখে। দুজন ট্যুরিস্টকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতে দেখল রানা দরজার একপাশে দাঁড়ানো একজন লোককে। ভেতরে ঢুকে ওদের কাজ দেখার অনুরোধ করল, টুরিস্ট দুজন গেল ভেতরে, খানিক পরে আবার বেরিয়েও এল, চোখমুখে মুগ্ধ বিস্ময়ের ভাব। রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোয় মারিয়াকে খুজতে খুজতে অনেক কাছে চলে এল রানা ওই। বাড়িটার। ভয় হলো, আমন্ত্রণ পেয়ে মারিয়াও ঢোকেনি তো ওই বাড়ির। ভেতর? জোর করে আশঙ্কাটা দূর করে দিল রানা মন থেকে। ও যে রকম মেয়ে, ঠিক যা বলা হয়েছে সেটা অমান্য করে বাড়াবাড়ি করবে না কিছুতেই। তবু ওকে খুঁজে পেতে যত দেরি হচ্ছে, ততই অস্থির হয়ে উঠছে রানা ভেতর ভেতর।
বাড়িটার উত্তরে বিস্তীর্ণ এক খড়ের মাঠ। বহু দূরে ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরা কয়েকজন মহিলাকে দেখা গেল, বিশাল কাঁটাচামচের মত দেখতে হে ফর্ক দিয়ে খড় আলগা করছে শুকোবার জন্যে। সংক্ষিপ্তভাবে চিন্তা করল রানা, এখানকার পুরুষ লোকগুলো করে কি? বেশির ভাগ কাজই দেখা যাচ্ছে করছে মহিলারা। সুখেই আছে মনে হয় ব্যাটারা।
আর কিছুদূর এগিয়েই মারিয়ার পিঠ আর মাথা দেখতে পেল রানা। মুহূর্তে দুর্ভাবনার মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমল করে উঠল রানার মনটা খুশিতে। মস্ত একটা ভার নেমে গেল যেন ওর বুকের উপর থেকে। ঠিক যেমন নির্দেশ দিয়েছিল তেমনি একটা সুবিধেজনক জায়গা বেছে নিয়েছে মারিয়া। মস্তবড় একটা সুভ্যেনির-স্টোরে লোকজনের ভিড়ে মিশে এটা ওটা দেখছে নেড়েচেড়ে, কিন্তু সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে ওর সেই কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের দরজার দিকে। রানাকে দেখতে পেল না। ভেতরে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা, মুহূর্তে সজাগ, সতর্ক হয়ে গেল ওর পঞ্চ ইন্দ্রিয়। এখানে কি করছে মেয়েটা? চট করে দরজার আড়ালে সরে গিয়ে চোখ রাখল রানা রাস্তার দিকে।
ইরিন আর মারগ্রিয়েট এগিয়ে আসছে এইদিকে। সীভলেস গোলাপী একটা ফ্রক পরেছে ইরিন, হাতে লম্বা গ্লাভস, বাচ্চা মেয়ের মত স্কিপিঙের। ভঙ্গিতে হাটছে, কালো চুল লাফাচ্ছে ঘাড়ের উপর, মুখে শিশুর পবিত্র হাসি। তার ঠিক পেছনেই মারগ্রিয়েট, পুতুলের পোশাক পরা হিমালয় পর্বত, হাতে ঝুলছে বড়সড় একটা চামড়ার ব্যাগ।
দেখতে পেলেই যদি ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে, সেই ভয়ে একটা রিভলভিং পিকচার-পোস্টকার্ড স্ট্যান্ডের আড়ালে দাঁড়াল রানা, অপেক্ষা করছে। ওদের পার হয়ে যাওয়ার।
কিন্তু পার হলো না ওরা। দরজা ছাড়িয়ে কয়েক কদম গিয়েই কাঁচের ওপাশ থেকে মারিয়াকে দেখতে পেল ইরিন, দেখেই থমকে দাঁড়াল, মারগ্রিয়েটকে কি যেন বলল, মারগ্রিয়েট মাথা নাড়তেই ওর বিপুলায়তন হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দোকানে ঢুকতে হলো মারগ্রিয়েটকে, দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির গাভীর্য। নিয়ে, একছুটে মারিয়ার কাছে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরল ইরিন।
আমি তোমাকে চিনি, খুশি উপচে পড়ছে ইরিনের কণ্ঠস্বরে। আমি চিনি। তোমাকে।
ইরিনের দিকে ফিরে মৃদু হাসল মারিয়া। আমিও তোমাকে চিনি। কেমন আছ, ইরিন?
আর এ হচ্ছে মারগ্রিয়েট। বিপুল চেহারার মারগ্রিয়েটকে দেখে বোঝা যাচ্ছে এসব পছন্দ হচ্ছে না ওর মোটেও। ওর দিকে ফিরে ইরিন বলল, মারগ্রিয়েট, এ আমার বন্ধু, মারিয়া।
ভ্যাংচানোর মত একটা মুখভঙ্গি করল মারগ্রিয়েট মারিয়ার প্রতি, আঙুল দিয়ে ইশারা করল ইরিনকে বেরিয়ে আসবার জন্যে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা করল না ইরিন। মুগ্ধদৃষ্টিতে মারিয়ার মুখের দিকে চেয়ে বলল, মেজর মাসুদ রানা আমার বন্ধু।
আমি জানি সেটা, মদ হেসে বলল মারিয়া।
তুমি খুব সুন্দর। তুমি আমার বন্ধু হবে না, মারিয়া?
নিশ্চয়ই। কেন হব না?
খুশিতে হাততালি দিল ইরিন। বলল, আমার আরও অনেক বন্ধু আছে। হাইলারে। দেখবে? এদিকে এসো, দেখাচ্ছি। হাত ধরে প্রায় টেনে দরজার। কাছে নিয়ে এল ইরিন মারিয়াকে, আঙুল তুলে দুরের গোলাবাড়ির পাশে কর্মরত মহিলাদের দিকে দেখাল, ওই..ই যে, দেখতে পাচ্ছ? উ…ই যে।
ওরা তোমার বন্ধু বুঝি? খুব ভাল।
সত্যিই খুব ভাল, মারগ্রিয়েটের হাতের ব্যাগের দিকে চাইল ইরিন। আমরা যখন আসি, ওদের জন্যে খাবার নিয়ে আসি, কফি নিয়ে আসি। তুমিও চলো, মারিয়া। খুব মজা হবে! মারিয়াকে ইতস্তত করতে দেখে অবাক হয়ে চাইল ওর মুখের দিকে। বলল, এই না বললে, তুমি আমার বন্ধু?
তা তো নিশ্চয়ই, কিন্তু…
কোন কিন্তু নয়। চলো না, আবদারের সুরে বলল ইরিন। খুব ভাল ওরা। সত্যিই খুব ভাল। সবসময় খুশি হয় আমাদের দেখলে। গান শোনায়। কোন কোনদিন হে ডান্স দেখায়। দারুণ! খুব ভাল লাগবে তোমার। মারিয়ার হাত ধরে বাচ্চা মেয়ের মত টানতে শুরু করল ইরিন।
হে ডান্স কি?
খড়ের নাচ। দেখোনি কোনদিন? অপূর্ব! প্লীজ, চলো আমাদের সাথে। আমার কথা রাখবে না তুমি, মারিয়া? এত করে বলছি… কাঁদোকাঁদো হয়ে এল ইরিনের গলা। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ফুঁপিয়ে উঠবে এখুনি।
আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, বাবা, হাসতে হাসতে বলল মারিয়া। এত করে বলছ, তাই যাচ্ছি, ইরিন। কিন্তু আগে থেকে বলে রাখছি, বেশিক্ষণ কিন্তু। থাকতে পারব না।
সত্যিই, খুব ভাল তুমি, মারিয়া। মারিয়ার হাতটা বুকের কাছে চেপে ধরে খুশি প্রকাশ করল ইরিন। আমি তোমাকে ভালবাসি
দোকান থেকে বেরিয়ে গেল তিনজন। দুমিনিট পিকচার পোস্টকার্ড ঘাটাঘাটি করে আলগোছে বেরিয়ে পড়ল রানাও। প্রায় চল্লিশ গজ সামনে একটা সাইড লেন, ধরে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল সে ওদের। পা বাড়াল। সামনে। সাইড লেনের মাথায় এসে দেখল, মাঠের মধ্যে দিয়ে রওনা হয়েছে। তিনজন গোলাবাড়ির দিকে। ছয়-সাতশো গজ দুরে ছোট ছোট দেখাচ্ছে কর্মরত মহিলাদের। দূর থেকে গোলাবাড়িটাকে খুবই প্রাচীন আর নিঃসঙ্গ বলে। মনে হচ্ছে। মন খুলে উঁচু গলায় কথা বলছে ইরিন, খুশির চোটে মাঝে মাঝে লাফাচ্ছে ঠিক ছাগলের বাচ্চার মত, স্থির থাকতে পারছে না।
ওরা একটা ঢিবির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যেতেই পেছন পেছন চলল রানা। টিবির পরেই ময়দানের সীমা চিহ্নিত করবার জন্যে ফুটপাঁচেক উঁচু ঝোপের বেড়া, লম্বালম্বি চলে গেছে সামনের দিকে। ঝোঁপের ওপাশ দিয়ে কোমর থেকে উপরের অংশ সামনের দিকে বাকিয়ে চলল রানা ওদের তিনজনের গজ। তিরিশেক পেছনে। এইভাবে বাকা হয়ে ছয়শো গজ যেতেই কোমর ব্যথা হয়ে গেল ওর। উঁকি দিয়ে দেখল, গোলাবাড়ির পশ্চিম দিকে সূর্যের থেকে আড়াল হয়ে বসল ওরা তিনজন। রঙবেরঙের পোশাক পরা মহিলারা কাজ করছে বাড়িটার উত্তরপশ্চিম কোণে। আরও কিছুদূর এগিয়ে গোলাবাড়িটাকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে এক দৌড়ে চলে এল রানা একটা সাইড ডোরের পাশে, আস্তে করে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
দূর থেকে যতটা মনে হয়েছিল, কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন মনে হলো রানার কাছে গোলাবাড়িটা। এটার বয়স অন্তত একশো বছর তো হবেই। মেরামতের অভাবে একেবারে জরাজীর্ণ অবস্থা। এবড়োখেবড়ো কাঠের তৈরি দেয়ালের কোন কোন জায়গায় দুইঞ্চির বেশি ফাঁক।
মাচায় ওঠার সিড়টার দিকে চেয়ে পুরো আধমিনিট লেগে গেল রানার। উপরে উঠবে কি উঠবে না সেই সিদ্ধান্ত নিতে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, জায়গায় জায়গায় পচে গেছে মাচার কাঠ, ঘুণ ধরেছে কয়েকটা কাঠে। ওর উপর পা দিলেই মড়াৎ করে ভেঙে পড়বে নিচে। সিডিটার অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু তবু উপরে ওঠাই স্থির করল সে। কারণ ওখান থেকেই সবার উপর নজর রাখা সহজ। নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোন মুহূর্তে যে কোন লোকের ভেতরে ঢুকে পড়বার সম্ভবনা তো থাকছেই, তার উপর কাঠের ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিতে গিয়ে দুই ইঞ্চি দরে ভেতর দিকে উঁকিদানরত একজোড়া চোখ। দেখতে পাবে না তার কি নিশ্চয়তা? কাজেই অতি সন্তর্পণে, সামান্যতম আওয়াজও না করে পা টিপে উঠে গেল সে মাচার উপর।
মাচাটার পূর্বদিকের অর্ধেকটা ভর্তি হয়ে রয়েছে গত বছরের খড়ে। ওদিকে না গিয়ে সাবধানে, প্রথমে হালকাভাবে পা ফেলে তার অবস্থা বুঝে নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে শরীরের ওজন চাপিয়ে, এক পা দুপা করে পশ্চিম দিকে এগোল সে। পশ্চিম দেয়ালের কাছে পেছে সবার উপর নজর রাখবার। পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক একটা জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়াল রানা। ঠিক নিচেই দেখা যাচ্ছে বসে আছে ইরিন, মারিয়া আর মারগ্রিয়েট। একটু দূরে বারো-চোদ্দজন মাঝবয়সী মহিলা নিপুণ হাতে খড়ের গাদা তেরি করছে, ছয়ফুট লম্বা কাঠের হাতলের মাথায় কাঁটাচামচের মত ঘুচল লোহার পাতগুলো ঝকঝক করছে রোদ লেগে। ওদের মাথার উপর দিয়ে বহুদূরে কার-পার্কের একটা অংশ দেখতে পেল রানা।
আশ্চর্য একটা অস্বস্তি শিরশির করছে রানার সারা শরীরে। ঠিক কি কারণে যে শরীরের মধ্যে জাগছে এই বোধটা, অনেক ভেবেও কিছুতেই বুঝতে পারল না রানা। খড় গাদা করার দৃশ্য মনের মধ্যে একটা শাস্তির ভাব, একটা পরম নিশ্চিন্ত ভাব সৃষ্টি করবার কথা। গোটা পরিবেশটাই শান্ত, মঙ্গলময়। তবু কেন আবছা অস্বস্তিটা দূর হতে চাইছে না ওর মন থেকে? কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব, বিপদের আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর অবাস্তবতা অনুভব করতে পারছে রানা, কিন্তু ঠিক কিসের থেকে যে এর উৎপত্তি বুঝে উঠতে পারছে না। অবাস্তব শব্দটা পছন্দ হলো রানার। এই লাইনেই এগোবার চেষ্টা করল চিন্তার কয়েক ধাপ, কিন্তু আবছা ঠেকায় বাদ দিল। চিন্তা। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর, কর্মরতা গ্রাম্য মহিলাদের। দিকেই যখন বারবার দৃষ্টি যাচ্ছে ওর, গোলমালটা ওখানেই। নিজেদের অভ্যস্ত পরিবেশে কাজ করছে ওরা একমনে। অভ্যস্ত কাজ, অভ্যস্ত সাজ-কিন্তু তবু যেন ঠিক মানাচ্ছে না। ঝলমলে পোশাক, এমব্রয়ডারি, দুধ-সাদা উইমপল হ্যাট এই পরিবেশের সাথে খাজে খাজে মিলে যাওয়ার কথা; ওদের চেহারা, বয়স, কাজ, পরিবেশ, সবকিছুর সাথে মিলে যাওয়ার কথা কিন্তু কিসের যেন একটা অভাব অনুভব করতে পারছে রানা। একটা নাটক-নাটক অবাস্তব ভাব সবকিছুতে। কেন যেন আবছাভাবে ওর মনে হলো, বিশেষ করে ওরই জন্যে ব্যবস্থা করা হয়েছে এই নাটকের।
প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল, কোথাও কোন শান্তিভঙ্গ হলো না। তেমনি। নিরলস কাজ করে চলেছে মহিলারা, ছায়ায় বসে এদের তিনজনের মধ্যে। দুএকটা টুকরো কথা হচ্ছে, বেশির ভাগ সময়ই চুপ। পরিবেশটা এমনই শান্তিময় যে কথা বলে শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাতে চাইছে না যেন কেউ। ফর্কের মাথায় খড় তুলে গাদার উপর ছুঁড়ে দেয়ার মৃদু খসখস শব্দ, কড়া রোদ, আলস্য, মাঝে মাঝে এক-আধটা বেপথু ভ্রমনের গুঞ্জন, দূর থেকে ভেসে আসা। কোন পাখির মিষ্টি সুরেলা ডাক–পরিবেশটা অন্তর দিয়ে অনুভব করবার, কথা বলে সোন্দর্যহানি ঘটাবার নয়। কোটটা ভাজ করে মেঝের উপর রেখে তার উপর রাখল পিস্তলটা, তারপর সাবধানে একটা সিগারেট ধরাল রানা। ঘন ধোয়াগুলোকে কখনও হাত নেড়ে, কখনও ফুঁ দিয়ে হালকা করে মিশিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে।
আরও কয়েক মিনিট গেল। হাতঘড়িতে সময় দেখল মারিয়া, মারগ্রিয়েটও কব্জি উল্টে পকেট ওয়াচের সমান একটা হাতঘড়িতে সময় দেখল, নিচু গলায়কিছু বলল ইরিনকে। উঠে দাঁড়াল ইরিন, মারিয়ার হাত ধরে টেনে তুলল, দুজন মিলে চলল কর্মরতা মহিলাদের দিকে। খুব সম্ভব ওদের কফি খাওয়ার কথা বলতে। এদিকে ঘাসের উপর একটা চাদর বিছিয়ে চামড়ার ব্যাগ থেকে। খাবার বের করছে মারগ্রিয়েট, ডজন দেড়েক কাগজের তৈরি কাপ আর একটা মস্তবড় ফাস্কও বেরোল ব্যাগ থেকে।
রানার পেছন থেকে মৃদু একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল পিস্তলের দিকে হাত বাড়াবেন না, মেজর মাসুদ রানা। ওটা ছোঁয়ার আগেই মারা পড়বেন।
লোকটা যে-ই হোক, তার কথা বিশ্বাস করল রানা বিনা দ্বিধায়। পিস্তল তুলে নেয়ার চেষ্টা করল না সে।
ঘুরে দাঁড়ান। ধীরে ধীরে।
খুব ধীরে ঘুরে দাড়াঁল রানা। লোকটার আদেশে এমন একটা কিছু আছে যে পরিষ্কার বোঝা যায়, অক্ষরে অক্ষরে পালিত না হলে ঘটে যাবে ভয়ঙ্কর কিছু।
তিন পা সরে যান বামদিকে।
এতক্ষণে গলার স্বরটা চিনে ফেলেছে রানা। সামনে দেখতে পেল না। কাউকে। তিন পা সরে গেল সে বামদিকে।
মাচার ওপাশে জমা করে রাখা খড়ের কাছে নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল। দুজন লোক বেরিয়ে এল আড়াল থেকে। প্রথম জন রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস রজার, দ্বিতীয়জন ব্যালিনোভা নাইট-কাবের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার স্যামুয়েল, যার চেহারাটা দেখেই বিষাক্ত সাপের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল রানার। ভক্টর রজারের হাত খালি, কিন্তু স্যামুয়েলের হাতের বিশাল মাউষার তিনটে পিস্তলের পিলে চমকে দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট। পলকহীন সাপের চোখ স্থির হয়ে রয়েছে রানার চোখের উপর। ওর চোখের উজ্জ্বলতা সাবধান। করে দিল রানাকে, সামান্যতম কোন ছুতো পেলেই গুলি করবে স্যামুয়েল, ছটফট করছে সে প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্যে। বিশাল মাউযারের মুখে লাগানো লম্বা নলটা জানিয়ে দিচ্ছে যত খুশি গুলি করতে পারে স্যামুয়েল, কেউ টের পাবে না কিছু।
বিচ্ছিরি, পচা গরম ওখানটায়, বলল নিকোলাস রজার। দম আটকে আসছিল একেবারে! তার ওপর চুলকানি পোকার ডিপো হয়েছে ওই খড়ের। গাদা। রানার দিকে চেয়ে নিষ্পাপ মধুর হাসি হাসল। অপ্রত্যাশিত সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে আপনাকে আজকাল, মেজর মাসুদ রানা।
অপ্রত্যাশিত মানে? সহজ কণ্ঠে প্রশ্ন করল রানা। আমার আগমন আশা করেননি বুঝি?
আশা করিনি বললে মিথ্যে বলা হবে। মাথা নাড়ল রেভারেন্ড। একজন ধর্মযাজক হিসেবে সেটা উচিত হবে না আমার। সত্যি কথা বলতে কি, গির্জার। সামনে ট্যাক্সি ড্রাইভারের ছদ্মবেশে আপনাকে সেদিন আশা করিনি ঠিকই, কিন্তু আজ আপনার আশাতেই ধৈর্যের সাথে প্রতীক্ষা করছিলাম আমরা। এগিয়ে এসে রানার ভাজ করা কোটের উপর থেকে পিস্তলটা তুলে নিল, যেন লেজ ধরে তুলছে সাতদিনের পচা, পোকা খিতখিতে বোয়াল মাছ, এমনি। মুখভঙ্গি করে ছুঁড়ে ফেলল ওটা খড়ের গাদার উপর। অমার্জিত, কদাকার যন্ত্র। এসব, রুচির কোন বালাই নেই।
তা ঠিক, বলল রানা। এসব স্তর অনেক আগেই পেরিয়ে গেছেন আপনি। হত্যার মধ্যে শিল্পীসুলভ সৃষ্টিশীলতা ছাড়া আপনার মন ভরে না আজকাল।
হ্যাঁ। আমার রিফাইনমেন্টের ডেমনস্ট্রেশন দেখতে পাবেন আর। কিছুক্ষণের মধ্যেই। গলার স্বর খুব একটা নিচু করবার প্রয়োজন বোধ করল না নিকোলাস রজার। কারণ নিচে মারগ্রিয়েটের খাবার ঘিরে রীতিমত হাট বসে গেছে–সবাই কথা বলছে একসাথে। গাদা করা খড়ের ওপাশ থেকে একটা ক্যানভাসের ব্যাগ নিয়ে এল রজার, লম্বা একটুকরো রশি বের করল। তার মধ্য থেকে। মাই ডিয়ার স্যামুয়েল, একটু সজাগ থেকো। মেজর মাসুদ। রানা যদি একটু নড়ে ওঠেন, সেটা সন্দেহজনক বা আক্রমণাত্মক হোক বা না হোক, গুলি করবে নিশ্চিন্তে। একেবারে মেরে ফেলো না আবার, হাঁটু কিংবা উরুতে বুঝতে পেরেছ?
ঠোঁট চাটল স্যামুয়েল। রানা ভয় পেল, ওর হৃৎপিণ্ডের প্রবল ধুকপুকানির। ফলে শার্টের অস্বাভাবিক কম্পনকে না আবার লোকটা সন্দেহজনক কিছু ভেবে বসে। পেছন দিক থেকে সাবধানে এগিয়ে এল রজার, রানার ডান হাতের কব্জিটা শক্ত করে বেঁধে মাথার উপরের মোটা একটা কাঠের বার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল রশির আরেক মাথা, তারপর এমনভাবে বাম হাতের কব্জিতে গিঠ দিল, যেন হ্যাঁন্ডস-আপের ভঙ্গিতে রানার হাতদুটো মাথার উপর। উঁচু হয়ে থাকে। রশির শেষ মাথাদুটো এমনভাবে উঁচু করে গিঠ দিল যেন কিছুতেই রানা হাতের নাগালে না পায়। এবার আর এক টুকরো অপেক্ষাকৃত ছোট রশি বের করল সে ব্যাগ থেকে।
যেন আন্তরিকতার সাথে গল্প করছে, এমনি গলায় বলল সে, স্যামুয়েলের কাছে জানতে পারলাম, আপনার হাতদুটোই কেবল নয়, পা-ও নাকি অস্বাভাবিক দ্রুত চলে। কাজেই ও দুটোকেও একটু শাসনের মধ্যে আনা। দরকার। দুই পা জোড়া করে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কষে বেঁধে ফেলল সে, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলল, এবার মুখেরও একটা ব্যবস্থা। হওয়া দরকার–কি বলো, স্যামুয়েল? মেজর রানা এখন যে দৃশ্য অবলোকন করতে যাচ্ছেন, নাটক চলাকালে সে ব্যাপারে ওর কাছ থেকে আমরা কোন মন্তব্য চাই না। ঠিক? অতএব তোমার রুমালটা বের করো। পকেট থেকে ময়লা একটা রুমাল বের করে দিল স্যামুয়েল, রানার মুখের ভেতর সেটা পুরে দিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে মুখটা বেধে ঘাড়ের পেছনে গিঠ দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল নিকোলাস বজার। কেমন বাধা হয়েছে, স্যামুয়েল? পছন্দ হয়েছে। তোমার?
জ্বলজ্বল করছে স্যামুয়েলের চোখ।
মিস্টার গুডবডির তরফ থেকে এর জন্যে কিছু শুভেচ্ছাবাণী রয়েছে। আমার কাছে, রেভারেন্ড। দিয়ে দেব?
আরে, না। অত অধৈর্য হলে কি চলে? পরে, পরে। আপাতত মেজর রানাকে আমরা পূর্ণ সচেতন, সজ্ঞান অবস্থায় চাই। দৃষ্টি বা শ্রবণ বা চিন্তাশক্তি কিছুমাত্র বিঘ্নিত হলে চলবে না। নইলে আমাদের শিল্পমাধুর্য পুরোমাত্রায় উপলব্ধি করবেন কি করে?
ঠিক আছে, রেভারেন্স, বিনয়ের সাথে মেনে নিল স্যামুয়েল। ঠোঁট চাটল নিস্পলক দৃষ্টিতে রানার দিকে চেয়ে। আপনি যখন বলেছেন, পরেই
হ্যাঁ, পরে। উদারতার অবতার যেন রজার। আমাদের শো-টা ভাঙলেই যত খুশি শুভেচ্ছা জানিয়ে দিতে পারো তুমি ওকে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, রাতে যতক্ষণ না গোলাবাড়িতে আগুন ধরানো হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন জীবিত থাকে। দুঃখের বিষয়, কাছেপিঠে কোথাও থেকে শেষ। দৃশ্যটা আমি নিজে উপভোগ করতে পারব না। মুখ দেখে সত্যিই দুঃখিত মনে হলো রজারকে। আপনার এবং আপনার ওই সুন্দরী সহকর্মিনীর পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশ যখন ছাই ঘেঁটে বের করা হবে, সবাই অনায়াসে বুঝে নেবে। ব্যাপারটা–গোপন প্রেমের জ্বালা মেটাতে এসে জ্বলে মরেছেন। অসাবধানে ফেলা সিগারেটের একটি টুকরোই নিবিয়ে দিয়েছে আপনাদের সব জ্বালা। যাই হোক, চলি এখন, গুডবাই। আবার দেখা হবে–পরপারে। আমি এখন হে, ভান্স দেখতে যাচ্ছি। কাছে থেকে না দেখলে ওটার মজা নেই। আপনিও। দেখতে পাবেন ওই ফাঁক দিয়ে। এমন সুন্দর নাচ জীবনে দেখেননি আপনি, কোনদিন, আর দেখবেনও না।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিকোলাস রজার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সাপের মত পলকহীন চোখে চেয়ে রয়েছে স্যামুয়েল রানার চোখের দিকে, ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর হাসির ভাজ। বাগে পেয়েছে সে এবার, পাওনা শোধ করে আরও কিছু অগ্রিম দিয়ে দেবে। কাঠের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে। নিচের দিকে চাইল রানা।
কফি শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে মহিলারা। মারিয়াও উঠে দাঁড়াল।
কফিটা খুব ভাল না, মারিয়া? আর কেকগুলো? খুশিখুশি গলায় জিজ্ঞেস করল ইরিন।
সত্যিই খুব ভাল। কিন্তু আমার এখন যেতে হবে, ইরিন। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে…কেনাকাটা করতে হবে। অনেক কিছু। আমি এখন চলি, কেমন?
দুটো পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান বেজে উঠল হঠাৎ। বাদকদের দেখতে পেল রানা, মনে হলো সদ্যনির্মিত খড়ের গাদার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে আওয়াজটা। টানা, মিষ্টি সুরেলা।
একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে তিড়িংতিড়িং লাফাতে শুরু করল ইরিন। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চোখমুখ, বাচ্চা মেয়ের মত হাততালি দিচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠল কী মজা! হে ডান্স! হে ডান্স দেখাবে আজ ওরা! তোমার জন্যে, মারিয়া তোমার সম্মানে। এখন তুমিও ওদের বন্ধু হয়ে গেলে!
খড়ের গাদার দিকে গজ দশেক সরে গিয়ে এদিকে মুখ করে সার বেধে দাঁড়াল মহিলা কর্মীরা। গভীর। কারও মুখে কোন ভাবের লেশমাত্র নেই। হে ফর্কগুলো রাইফেলের মত কাঁধের উপর রেখে বাজনার তালে তালে এক পা। সামনে আসছে আবার এক পা পিছিয়ে যাচ্ছে, এক পা ডাইনে সরছে, আবার ফিরে আসছে নিজের জায়গায়। তারপর আবার বায়ে। লাল রিবন বাধা পিগটেল দুলছে তালে তালে। বাজনার আওয়াজ বাড়ছে ক্ৰমে। সামনে পেছনে, ডাইনে-বামে স্টেপ ফেলছে, আর মাঝে মাঝে পাই করে একপাক ঘুরছে সবাই গম্ভীর মুখে। রানা লক্ষ করল, ধীরে ধীরে অর্ধবৃত্তাকারে গোল হয়ে আসছে লাইনটা।
অদ্ভুত! মারিয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল রানা। এই ধরনের ফোক-ডান্স জীবনে দেখিনি আমি।
আর কোনদিন দেখবেও না, বলল ইরিন। সত্য কথাটা সহজ সরল ভাষায় ইরিনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসায় ভেতর ভেতর শিউরে উঠল রানা। ক্যাচ করে যেন চেপে ধরল কেউ ওর কলেজাটা আগুনে-লাল এক সাড়াশি দিয়ে। কি ঘটতে চলেছে, আঁচ করতে পারছে রানা, কিন্তু সাবধান করবার কোন উপায় নেই। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ইরিন, আরে! দেখো মারিয়া, তোমাকে ডাকছে। তোমাকে পছন্দ হয়েছে ওদের!
আমাকে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমাকে ডাকছে। মাঝে মাঝে আমাকে ডাকে, কোনদিন মারগ্রিয়েটকে। আজ ডাকছে তোমাকে।
যেতে হবে আমাকে। আর একদিন…
প্লীজ, মারিয়া, প্লীজ! বেশি না, পাঁচমিনিট। তোমার কিছুই করতে হবে।, তুমি শুধু ওদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্লী-ই-জ! না গেলে ওরা, খুব দুঃখ পাবে। বা অনিচ্ছাসত্তেও রাজি হতে হলো মারিয়াকে। হেসে বলল, আচ্ছা পাগল! ঠিক আছে, যাচ্ছি।
দাতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করল রানা, মাথা নাড়ল। যেন বারণ করতে চায় মারিয়াকে যেয়ো না, মারিয়া! পালাও! সামনে বিপদ!
চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ডের বেশি থাকতে পারল না রানা। চোখ মেলে দেখল, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে অর্ধবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়াল মারিয়া, মুখে সলজ্জ হাসি। চেহারা দেখে বোঝা গেল অত্যন্ত অপ্রস্তুত বোধ করছে। হেফক কাঁধে নিয়ে বাজনার তালে তালে একবার সামনে আসছে, একবার পিছিয়ে যাচ্ছে মহিলারা। ক্রমে বাড়ছে নাচের ছন্দ। গোল করে ঘিরে ফেলল ওরা মারিয়াকে। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে তিন পা এগিয়ে আসছে ওরা। মারিয়ার দিকে, বৃত্তটা সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে, আবার মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে সরে যাচ্ছে তিন পা। বাজনার তালে তালে বৃত্তটা ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে।
নিকোলাস রজারকে দেখতে পেল রানা। মুখে প্রফুল্ল হাসি। বাতাসে। উড়ছে শুভ্রকেশ। ইরিনের পাশে দাঁড়িয়ে একটা হাত রাখল ওর কাঁধে। ঘাড় বাকিয়ে চকচকে চোখে চাইল ইরিন বৃদ্ধের মুখের দিকে।
রানার মনে হলো, এক্ষুণি বমি হবে ওর। শীতল ঘাম দেখা দিয়েছে ওর কপালে। চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারছে না সে মারিয়ার দিক থেকে। পাগলের মত টানাটানি করল সে হাতের রশি-কব্জির উপর আরও চেপে বসল রশির ফাস, লাভ হলো না কিছুই। মারিয়ার মুখের অপ্রস্তুত ভাবের সাথে। বিস্ময় যুক্ত হয়েছে এখন, সেইসাথে প্রকাশ পাচ্ছে আবছা অস্বস্তি। গভীর ভাবলেশহীন মুখে নেচেই চলেছে মহিলারা। দুজনের ফাঁক দিয়ে উদ্বিগ্নদৃষ্টিতে ইরিনের দিকে চাইল মারিয়া। আনন্দে স্থির থাকতে পারছে না ইরিন, হাত নেড়ে উৎসাহ দিল মারিয়াকে।
হঠাৎ ছন্দ এবং সুর পরিবর্তন করল অ্যাকর্ডিয়ানগুলো। ছন্দ বেড়ে গেল। দ্বিগুণ। সেই সাথে আওয়াজ। আশ্চর্য এক কর্কশ, আদিম সুরে গরম হয়ে উঠল পরিবেশটা মূহর্তে। শ্রোতার রক্তে যেন নাচন ধরিয়ে দিতে চাইছে বাদকরা। ক্রমেই ঘন হয়ে আসছে মহিলারা। মারিয়ার দুচোখ ঈষৎ বিস্ফারিত। ভয় পেয়েছে। একপাশে সরে ইরিনের দিকে চাইল সে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে। কিন্তু। সেখানে ভরসার কোন ছাপ দেখতে পেল না। হাসি মুছে গেছে ইরিনের মুখ। থেকে, গ্লাভস পরা হাতদুটো জড়ো করে মুঠি পাকিয়ে দমন করবার চেষ্টা করছে সে তার মানসিক উত্তেজনা, কুৎসিত ভঙ্গিতে চাটছে নিচের ঠোঁট। রাগে, দুঃখে, অনুশোচনায় পানি বেরিয়ে এল রানার চোখ দিয়ে। স্যামুয়েলের দিকে চাইল। চার পাঁচ হাত দুরে আর একটা ফাঁকে এক চোখ আর রানার উপর আরেক চোখ রেখে দুদিকের দৃশ্যই উপভোগ করছে স্যামুয়েল। পিস্তলটা স্থির হয়ে রয়েছে রানার দিকে। অবধারিত অদৃষ্টকে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পেল না রানা।
মারিয়াকে গোল করে ঘিরে মহিলারা অনেক ছোট করে এনেছে বৃত্তটাকে। ওদের নির্বিকার, ভাবলেশহীন মুখে ফুটে উঠেছে এখন নির্মম ঘৃণা। মারিয়ার বিস্ফারিত চোখের ভীতি দেখতে দেখতে রূপান্তরিত হলো তীব্র আতঙ্কে। পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেছে মারিয়া। আরও তীব্র, আরও আদিম হয়ে উঠছে বাজনা। এমনি সময়ে, অকস্মাৎ, রাইফেলের মত করে কাঁধের উপর রাখা হেফকগুলো সাই করে নামিয়ে বেয়োনেটের মত করে ধরল সবাই মারিয়ার দিকে। প্রাণপণে চিৎকার করল মারিয়া, একবার দুবার নয়, বহুবার; কিন্তু অ্যাকর্ডিয়ানের শব্দ ছাপিয়ে শোনা গেল না কিছুই। চারপাশে চেয়ে কোনদিকে মুক্তির পথ দেখতে পেল না মারিয়া। চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে ওকে হেফর্কের কাটা। পাগলের মত সামনে পেছনে পা ফেলছে সবাই উদ্দাম ছন্দে। মারিয়ার অভিম চিৎকারের সামান্য একটু রেশ পৌঁছুল রানার কানে। দুইহাতে নিজের কান চেপে ধরবার চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারল না। আর দেখা যাচ্ছে না, মাটিতে পড়ে গেছে মারিয়া! এখন শুধু পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছে সে, শাবল চালানোর ভঙ্গিতে দ্রুতবেগে হে ফর্কগুলো উঠছে আর নামছে, উঠছে, নামছে। লাল হয়ে গেছে ফর্কগুলোর চকচকে কাটা।
আর চেয়ে থাকতে না পেরে মাথাটা একপাশে ফেরাল রানা। চোখ পড়ল ইরিনের উপর। হাতদুটো খুলছে আর মুঠি পাকাচ্ছে ইরিন, মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রয়েছে সামনের দিকে, মুখে বন্যজন্তুর হিংস্রতা। ওর কাঁধের উপর, হাত রেখে তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছে রেভারেন্ড রজার, মুখে সরল হাসি, কিন্তু ধকধক করে জ্বলছে চোখদুটো। আদিম, জংলী বাজনা অমানুষ করে দিয়েছে। সবাইকে।
বাজনাটা কমে এল। ঢিল হয়ে গেল ছন্দ। ফকহাতে খানিকটা দূরে সরে গেল সবাই, নাচের ছন্দে খানিকটা করে খড় তুলে ছুঁড়ে দিচ্ছে ওরা বৃত্তের মাঝখানে। এক মুহূর্তের জন্য ঘাসের উপর কুকুরের মত ককড়ে পড়ে থাকা লাশটা দেখতে পেল রানা, রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে সাদা রাউজ। পরমুহর্তে ঢাকা পড়ে গেল শরীরটা খড়ের নিচে। অ্যাকর্ডিয়ানের ধীর ছন্দের। সাথে তাল মিলিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উঁচু একটা খড়ের গাদা তৈরি করে। ফেলল ভাবলেশহীন মহিলারা। থেমে গেল বাজনা। শেষ।
রেভারেন্ড ডক্টর রজারের হাত ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে গল্প করতে করতে শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করল ইরিন, পেছন পেছন প্রশান্তবদনে চলল। মারগ্রিয়েট। হাতে সেই মস্ত চামড়ার ব্যাগ।
.
০৮.
মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঠের ফাঁক থেকে চোখ সরাল স্যামুয়েল।
দারুণ। তাই না?মাথা কাত করে একটা ভুরু উঁচু করে প্রশংসার ভঙ্গি করল সে। এসব ব্যাপারে ডক্টর রজারের তুলনা হয় না। হত্যা তো নয়, যেন শিল্পকর্ম। একেক সময় ধিক্কার এসে যায় নিজের ওপর। শালার জীবনভর কি শিখলাম! এইরকম একটা সর্বাঙ্গসুন্দর মৃত্যু দেখলে মনে হয় সার্থক হলো জন্মটা। গ্র্যান্ডমাস্টার! মুগ্ধ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। তারপর ভাবের ঘোর কাটিয়ে উঠে ফিরল রানার দিকে। ওর চোখের দিকে চাইলে মনে হয় এক্ষুণি বুঝি সাপের মত লকলকে জিভ দেখা যাবে ঠোঁটের ফাঁকে। আমার কিন্তু আবার চিৰ্কার না শুনলে মজা লাগে না। গলা ফাটিয়ে চ্যাচাবে, তবে না খেলা!
রানার পেছনে এসে দাঁড়াল লোকটা। ঘাড়ের পেছনে রুমালের গিঠ খুলে মুখ থেকে বের করে মেঝের উপর ফেলল দ্বিতীয় রুমাল, ভালটা ভাজ করে। রেখে দিল নিজের পকেটে। সামনে এসে দাঁড়াল। ঢোক-টোক গিলে তৈরি হয়ে নাও বাছা! খুব জোরে চাচাতে হবে এখন।
কিন্তু আর শ্রোতা কই? নিজের গলা নিজেই চিনতে পারল না রানা। অত্যন্ত কর্কশ আর মোটা হয়ে গেছে গলাটা। বলল, এমন আনন্দ থেকে ডক্টর রজারকে বঞ্চিত করা কি ঠিক হবে?
বাঁকা হাসি হাসল স্যামুয়েল। উনি কল্পনা করে নিতে পারবেন। আটিস্ট মানুষ। এখানে কি ঘটছে সেটা কল্পনা করে নিতে মোটেই কষ্ট হবে না ওর। জরুরী কাজে এক্ষুণি অ্যামস্টার্ডামে ফিরে যেতে হচ্ছে ওকে, নইলে হাতেপায়ে। ধরে রেখে দিতাম যেমন করে থোক। আমার কাজে আর্ট কম, কিন্তু কাজ বড় সলিড। নিজ চোখে দেখলে উনি খুশিই হতেন। কিন্তু কি আর করা, অ্যামস্টার্ডামে ফিরে যাওয়াটা এতই জরুরী…
শুধু ফিরে যাওয়া নয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু বয়ে নিয়ে যাওয়াও।
সে তো বটেই, মৃদু হাসল স্যামুয়েল। দেখো, মাসুদ রানা, তুমি বোধহয় কিছু একটা জেনে ফেলেছ, এইরকম একটা ভাব দেখিয়ে কথা বাড়াবার তালে আছ। গল্পের বইয়ে যেমন দেখা যায় কথা বলে দেরি করিয়ে দিতে পারলেই কেউ এসে উদ্ধার করে ফেলে নায়ককে; হয়তো সহকারী, নয়তো পুলিস। আমি তোমাকে আশ্বাস দিতে পারি, চাই কি কসম খেয়েও বলতে পারি, এখানে কারও সাহায্য পাবে না তুমি। এই গোলাবাড়ির আধমাইলের মধ্যে কাউকে দেখা গেলে সাথে সাথেই জানানো হবে আমাকে, এবং সাথে সাথেই কাজ শেষ করে আগুন ধরিয়ে দেব আমি গোটা বাড়িতে। গল্পের বইয়ের নিয়ম অনুযায়ী আমার এখন উচিত নির্যাতনের আগে লম্বা-চওড়া কিছু বক্তৃতা দিয়ে নিজের ভিলেন রোলটা আরও একটু ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু আমাদের এ গল্প লেখা হবে না কোনদিন। কাজেই ওসব ডিঙিয়ে সরাসরি কাজে নেমে যাওয়া যাক। কি বলো? শুরু করি? এক পা এগিয়ে এল স্যামুয়েল।
পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে প্রলয়কাণ্ড। কথা ফুরিয়ে এসেছে। কথা দিয়ে আর দেরি করানো যাবে না ওকে। হঠাৎ যে কিছু একটা ঘটে গিয়ে উদ্ধার পেয়ে যাবে সে আশাও নেই। তব, নিছক দেরি করাবার জন্যেই বলল, কি শুরু করবে?
মিস্টার গুডবডির শুভেচ্ছাবাণী। বলেই ধাই করে পিস্তলের নল দিয়ে মারল স্যামুয়েল রানার বাম চোয়ালে। তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠল রানা। মনে হলো, এক আঘাতেই তো হয়ে গেছে চোয়ালের হাড়, কিন্তু জিভটা নেড়েই বুঝতে পারল হাড় ভাঙেনি, দাঁত খসে গেছে একটা। আসল নয়, বাঁধানো দাঁতটা।
মিস্টার গুডবডি তোমাকে জানাতে বলেছেন যে পিস্তলের ফোরসাইট দিয়ে গাল চিরে দেয়া মোটেই পছন্দ করেন না উনি, বাঁকা হাসি হেসে বামহাতে নিল স্যামুয়েল পিস্তলটা, সাই করে চালাল ডান গাল লক্ষ্য করে। মাথাটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল রানা, কিন্তু তাতে আঘাত এড়ানো গেল না। দড়াম করে ডান চোয়ালের উপর প্রচণ্ড আঘাত পড়ল। বাধানো দাঁতটা ছিটকে বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। সেই সাথে আত্মহত্যার সুযোগও। ওই দাঁতের মধ্যেই লুকানো ছিল ওর সায়ানাইড ক্যাপসুল। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চোখে কিছুই দেখতে পেল না রানা, মাথাটা ঘুরে উঠেছে, তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে এক্ষুণি। কিন্তু বুদ্ধিটা ঘোলা হলো না। মোটেই। পরিষ্কার বুঝতে পারল সে, স্যামুয়েলকে ঠাণ্ডা মাথায় অত্যাচার, করতে দিলে কপালে অনেক দুঃখ আছে ওর, যেমন করে থোক রাগিয়ে দিতে হবে ওকে।
ফ্লোর-ওয়েটারের কাছে শেখা গোটাকয়েক বাছা বাছা ডাচ গালি ঝেড়ে দিল রানা।
কয়েক সেকেন্ড বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল স্যামুয়েল রানার মুখের দিকে, তারপর খোলস ছেড়ে বিষধর সাপ হয়ে গেল মুহূর্তে। চারপাশ থেকে বৃষ্টির মত শুরু হয়ে গেল ঘুসিবর্ষণ। পিস্তল এবং হাতের মুঠি, দুটোই ব্যবহার করছে সে। নাক, মুখ, চোখ, কান, ঘাড়, পিঠবাদ দিচ্ছে না কিছুই। নাকমুখের আঘাতগুলো যতটা সম্ভব দুই বাহুর আড়ালে ঠেকাবার চেষ্টা করল রানা, ফলে শেষের দিকে বুক, পিঠ আর পেটের উপরই পড়ল বেশির ভাগ আঘাত। স্যামুয়েলের দুই চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। ফোঁস ফোঁস হাপাচ্ছে, বক্সারের মত লাফাচ্ছে রানার চারপাশে, প্রয়োজন নেই, তবু অভ্যাসবশে একটা হাত বারবার উঠে আসছে ওর নাকের কাছে নাকটা গার্ড দেয়ার জন্যে। প্রতিটা আঘাতে ককিয়ে উঠল রানা, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল, তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল ওর মাথাটা, পা দুটো সামান্য ভাঁজ হয়ে। ঝুলে রইল হাতবাধা অবস্থায়।
আরও কয়েকটা ঘুসি মারবার পর বুঝতে পারল স্যামুয়েল, অনর্থক সময়– ও শক্তি নষ্ট করছে সে। থেমে গেল। কেউ যন্ত্রণা বোধ করবার ক্ষমতা হারিয়ে। ফেললে তাকে নির্যাতন করবার কোন অর্থই হয় না। নাক দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ বের করে বিরক্তি প্রকাশ করল সে। কয়েকহাত দূরে সরে গিয়ে দম নিচ্ছে। ফোঁস ফোঁস করে। এরপর লোকটা ঠিক কি করতে যাচ্ছে বুঝতে পারল না। রানা, চোখ খুলতেও সাহস পেল না।
স্যামুয়েলের পায়ের শব্দ শুনে আবার মার শুরু হতে যাচ্ছে কিনা বুঝবার। জন্যে আড়চোখে চাইল সে এক চোখের পাপড়ি সামান্য একটু ফাঁক করে। খ্যাপামি দূর হয়ে গেছে লোকটার। রানার কোটটা তুলে নিল মেঝে থেকে। উপরি যা পাওয়া যায় তাই লাভ। একের পর এক পরীক্ষা করছে পকেটগুলো। কিছুই পাওয়া যাবে না ওখানে। হাতে ঝোলানো কোটের পকেট থেকে মানিবাগ পড়ে যাবে বলে প্যান্টের হিপ-পকেটে রেখেছে সেটা রানা কোট খোলার আগেই। ব্যাপারটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না স্যামুয়েলের। পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। রানার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা, বের করে নিল মানিব্যাগ হিপ-পকেট থেকে।
রানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্যামুয়েল। দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে রানা। অস্ফুট একটা গোঙানির মত শব্দ করে বরগার সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাশ ফিরল রানা। অসহায় ভঙ্গিতে মেঝে স্পর্শ করে রয়েছে। ওর জুতোর ডগা। বাম চোখটা এক ইঞ্চির যোলো ভাগের এক ভাগ খুলল।
প্রথমেই চোখ পড়ল স্যামুয়েলের জুতোর দিকে। তিন ফুট দূরে এইদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা। চট করে একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল, রানা। অত্যন্ত মনোযোগের সাথে রানার মানিব্যাগ থেকে ছোটবড় হরেক মানের, হরেক দেশের নোটগুলো বের করে নিজের পকেটে পুরছে স্যামুয়েল! এত টাকা পেয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি হয়তো সে। বামহাতে মানিব্যাগটা ধরে ডানহাতে আরও নোট বের করছে আরেক খোপ থেকে। ট্রিগারগার্ডের মধ্যে দিয়ে বামহাতের মাঝের আঙুল বাকিয়ে পিস্তলটা ধরে রেখেছে আলগাভাবে। এতই ব্যস্ত রয়েছে টাকা বের করবার কাজে যে লক্ষই। করল না রানার হাতদুটো একটু উপরে উঠে আকড়ে ধরুল রশির দুমাথা।
ঝট করে দুভাঁজ হয়ে গেল রানার শরীর। শরীরের সমস্ত শক্তি রাগ আর ঘৃণা একত্রিত করে উপর দিকে চালাল সে জোড়া পা। এতই দ্রুত, যে কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল টেরই পেল না স্যামুয়েল বাকা হয়ে হুমড়ি খেয়ে রানার গায়ের উপর পড়ল ওর শরীরটা, নিঃশব্দে, তারপর গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝের উপর। চিত হয়ে শুয়ে দাতে দাঁত চেপে চোখ বুজে মাথাটা এপাশ-ওপাশ করছে স্যামুয়েল, তীব্র যন্ত্রণায় এতই বিকৃত হয়ে গেছে মুখের চেহারা যে চেনাই যাচ্ছে না। খিচুনি শুরু হয়ে গেছে ওর হাতপায়ে। জানোয়ার হয়ে গেল। রানাও। নির্মমভাবে লাথির পর লাথি মেরে চলল ওর নাকে, মুখে, কানের পাশে, মাথার তালুতে; যতক্ষণ না স্থির হয়ে গেল দেহটা, থামল না। তখন আর চাওয়া যায় না থ্যাতলানো রক্তাক্ত দেহটার দিকে।
বাম হাতের মাঝের আঙুলটা বাকা করে তেমনি ধরে আছে স্যামুয়েল পিস্তলের ট্রিগারগার্ড। পা বাড়িয়ে নিঃসাড় আঙুলের ফাঁক থেকে টেনে আনল রানা পিস্তলটা নিজের কাছে। বারকয়েক দুই পায়ের জুতো দিয়ে পিস্তলটা আঁকড়ে ধরে উপরে তুলবার চেষ্টা করে বিফল হলো। বারবারই পিছলে পড়ে যায় নিচে। বহুকষ্টে, প্রায় বিশ মিনিটের চেষ্টায় দুই পায়েরই জুতো এবং মোজা খুলে ফেলল সে মেঝের উপর পায়ের গোড়ালি ঘষে।
খালিপায়ে পিস্তলটা চেপে ধরতেই সুন্দর উঠে এল। দুইহাত জড়ো করে। রশিদুটো একত্র করল সে, তারপর ওটা বেয়ে উঠে গেল বরগা পর্যন্ত। বামহাতে বরগাটা ধরে ফেলতেই চারফুট আন্দাজ ঢিল পেল সে ডান হাতের রশিতে। এবার শরীর বাঁকা করে পা দুটো যতদূর সম্ভব উপরে তুলতেই পিস্তলটা চলে এল ওর হাতে।
নিচে নেমে এল রানা, বাম হাতের কব্জির কাছে রশির গায়ে সাইলেন্সারের মুখটা ঠেকিয়ে টিপে দিল ট্রিগার। যেন ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে, এমনি নিখুঁত ভাবে রশি কেটে বেরিয়ে গেল গুলিটা। তিন মিনিটের মধ্যে সব দড়ি খসিয়ে জুতো মোজা পরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। স্যামুয়েলের পকেট থেকে টাকাগুলো উদ্ধার করে আবার ভরে নিল মানিব্যাগে। খড়ের গাদা থেকে নিজের পিস্তলটা তুলে নিয়ে নিঃশব্দ পায়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। স্যামুয়েলের ক্ষতবিক্ষত চেহারা দেখে মনে হলো মরেই গেছে লোকটা, কিন্তু সত্যিই মরেছে কি মরেনি পরীক্ষা করে দেখবার প্রয়োজন বোধ করল না সে।
অনেক কাজ পড়ে রয়েছে ওর সামনে।
.
বিকেলের দিকে ফিরল রানা অ্যামস্টার্ডম। মার খেয়ে ফুলে গেছে চোখমুখ, হঠাৎ দেখলে চিনবার উপায় নেই, বামচোখ বুজে গেছে অর্ধেকটা। চোয়ালে, কপালে প্লাস্টার।
শহরে পৌঁছেই একটা হায়ার-গ্যারেজের কাছে পুলিস-ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে ছোট্ট একটা কালো অস্টিন ভাড়া নিল সে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে। রওনা হওয়ার সময় ট্যাক্সিটার কাছে থেমে বিট্রিক্সের হ্যাঁন্ডব্যাগটা তুলে নিল এ। গাড়িতে। সোজা এসে থামল অস্টিন একটা পরিচিত সাইড রোডে। গাড়ি। থেকে নেমে কয়েক গজ এগিয়ে একটা মোড় ঘুরতে গিয়ে চট করে সরে এল সে, তারপর সাবধানে উঁকি দিল আবার।
আমেরিকান হিউগানট সোসাইটির ফার্স্ট রিফর্মড় চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে। রয়েছে একটা মার্সিডিজ টু টোয়েন্টি। সাদা। হাঁ করা রয়েছে পেছনের বুট, তার মধ্যে ভারী একটা বাক্স তুলছে দুজন লোক। প্রশস্ত বুটে আগেই ভোলা। হয়েছে একই চেহারার আরও তিনটে বাক্স। চুলপাকা, হাসিখুশি লোকটাকে তিন মাইল দূর থেকেও চেনা যাবে অতি সহজে-রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস। রজার। দ্বিতীয়জনের মাথায় ঘন কালো চুল, মুখে বয়সের ভাজ, দুই চোখের নিচে ফুলে রয়েছে দুটো থলে, উচ্চতা মাঝারি, হালকা-পাতলা গড়ন, চেহারা দেখলেই মনে হয় ভয়ানক নিষ্ঠুর। হাতে আজ এয়ারব্যাগ নেই, কিন্তু এক নজরেই চিনতে পারল রানা ইসমাইল আহমেদের হত্যাকারী। ঠাণ্ডামাথায় খুন করেছিল লোকটা ইসমাইলকে শিফল এয়ারপোর্টে, ওর চোখের সামনে। মুহূর্তে মাথার যন্ত্রণা আর অস্বাভাবিক শারীরিক ক্লান্তি দূর হয়ে গেল রানার। গত কয়েকদিন শয়নে স্বপনে বারবার এই লোকটার চেহারাটা ভেসে উঠেছে রানার মানসপটে, যেখানেই গিয়েছে–হোটেল, রেস্তোরাঁ, নাইট-ক্লাব–সব। জায়গায় নিজের অজান্তেই খুঁজেছে সে এই লোকটাকে।
আরও একটা বাক্স নিয়ে বেরিয়ে এল ওরা গির্জা থেকে, এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে এসে তুলল বুটে। বুট বন্ধ করে দুজনকে গাড়ির দুই দরজা। খুলতে দেখেই একছুটে ফিরে এল রানা অস্টিনটার কাছে। গলির ভেতর ঢুকে মোড় নিয়েই দেখতে পেল সে প্রায় একশো গজ সামনে গদাই লশকরী চালে চলেছে মার্সিডিজ। বেশ অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নিল রানা।
শহরের ভিড় এড়িয়ে মার্সিডিজকে মোটামুটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগোতে দেখেই বুঝে নিল রানা ওটার গন্তব্যস্থল। নিশ্চয়ই চলেছে ক্যাসটিল লিভেনের দিকে। শহরতলি ছাড়িয়ে একটা মাইলপোস্টে দেখতে পেল রানা, আর তিন কিলোমিটার আছে ক্যাসটি লিন্ডেনে পৌঁছুতে। বারকয়েক হর্ন বাজিয়ে। একটা ট্রাক মাসির্ডিজকে ওভারটেক করছে দেখে অ্যাকসিলারেটর টিপে ধরল। রানা। সামনে বেড়ে থাকাই ভাল। ট্রাককে সাইড দিল ডক্টর রজার, ট্রাকের পেছন পেছন রানাও বেরিয়ে গেল পাশ কেটে। মুখটা ঘুরিয়ে রাখল সে, কিন্তু পরিষ্কার টের পেল, মার্সিডিজের আরোহীদের কেউই চাইল না ওর দিকে। চাইবার কথাও না। চাইলেও চিনতে যে পারবে না, সে ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত ছিল রানা। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় স্যামুয়েলের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে রজার রানাকে, কল্পনাও করতে পারবে না যে সেই রানাই ভিন্ন গাড়ি চালিয়ে ওভারটেক করছে ওকে।
.
মাইলখানেক গিয়ে ট্রাক চলে গেল বায়ে, রানা ধরল ডাইনের রাস্তা। আরও কিছুদূর গিয়ে তীরচিহ্ন আঁকা নির্দেশিকা দেখতে পেল সে, সেই রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার এগোতেই দেখতে পেল প্রকাণ্ড এক খিলান। খিলানের উপর সোনালি অক্ষরে লেখা রয়েছে ক্যাসটিল লিড়েন। শদুয়েক গজ এগিয়ে গেল রানা, তারপর একটা ঘন ঝোঁপের আড়ালে গাড়িটা লুকিয়ে রেখে চাইল চারপাশে। বামদিকে পাইনের জঙ্গল, জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দুর্গের এক আধটা অংশ দেখা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল রানা সোজা দুর্গের দিকে। জঙ্গলের শেষে বুক সমান উঁচু ঘাসের ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে চাইল সে সামনের দিকে।
সামনেই কাঁকর বিছানো রাস্তা দেখা যাচ্ছে-খিলানের নিচ দিয়ে এসে সামান্য বাঁকা হয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে দুর্গের সামনে। চারতলা দুর্গ, দুর্গের মাথায় গম্বুজ, গায়ে মধ্যযুগীয় কারুকাজ, চারপাশে বিশ ফুট চওড়া পরিখা। কাকর বিছানো রাস্তাটা গিয়ে শেষ হয়েছে পরিখার সামনে। ওখান থেকে দুর্গে। প্রবেশ করবার জন্যে এককালে যে ড্র-ব্রিজের ব্যবস্থা ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে। দেয়ালের গায়ে বসানো প্রকাণ্ড দুটো কপিকল রয়েছে এখনও। কিন্তু এখন আর। ড্র-ব্রিজের ব্যবস্থা নেই, পরিখার উপর একটা স্থায়ী ব্রিজ তৈরি করে নেয়া। হয়েছে। ব্রিজের ওপরে প্রকাণ্ড এক ওক কাঠের দরজা। বন্ধ। রানার বামদিকে, দুর্গ থেকে গজ তিরিশেক দূরে একটা চৌকোণ একতলা দালান, ইটের–দেখে বোঝা যায় বড়জোর বছর তিনেক আগের তৈরি।
খিলানের নিচ দিয়ে এপাশে চলে এল সাদা মার্সিডিজ। কাঁকর বিছানো রাস্তার উপর দিয়ে খৈ ভাজার আওয়াজ তুলে একতলা দালানের সামনে গিয়ে। থামাল গাড়িটা। ড্রাইভিং সীটে বসে রইল ডক্টর রজার, পাশের লোকটা গাড়ি থেকে নেমে গোটা দূৰ্গটা ঘুরে এল একপাক। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে একতলা বাড়ির একটা দরজায় চাবি লাগাল নিকোলাস রজার, দরজা দুপাট হাঁ করে খুলে রেখে দুজন মিলে নামাতে শুরু করল বাক্সগুলো। একটা করে বের করে, ভেতরে কোথাও রেখে আসে সেটা, আবার নামায় একটা। শেষ বাক্সটা ভেতরে নেয়া হতেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
বুক সমান উঁচু ঘাসের আড়ালে আড়ালে অতি সন্তপণে একতলা দালানের একপাশে সরে এল রানা, তিন লাফে ফাঁকা জায়গাটুকু পেরিয়ে সেটে দাঁড়াল। দেয়ালের গায়ে। দুই মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কোনদিক থেকে কারও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পা টিপে এসে দাঁড়াল একটা জানালার সামনে। সাবধানে মাথা তুলে উঁকি দিল পর্দার ফাঁক দিয়ে।
ভেতরে শুধু ঘড়ি আর ঘড়ি। প্রকাণ্ড ঘরটা একযোগে ঘড়ির কারখানা এবং স্টোর। তিন পাশের দেয়াল জুড়ে মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত টাঙানো রয়েছে। ছোটবড় নানান ডিজাইন ও আকৃতির দেয়ালঘড়ি। বড়সড় চারটে ওয়ার্ক টেবিলের উপরও অনেকগুলো করে ঘড়ি আর তার ভেতরের যন্ত্রপাতি কলকজা। একপাশে মেঝের উপর গোটা দশেক বাক্স দেখা গেল, খোলা। মার্সিডিজে করে ঠিক যে রকম বাক্স আনা হয়েছে, সেই রকম। সব দেয়াল ভর্তি হয়ে যাওয়ায় ঘরের একপাশে আড়াআড়ি করে গোটাকয়েক শেলফ রাখতে হয়েছে। প্রত্যেকটা তাক ভর্তি হয়ে যাওয়ায় কয়েকশো ঘড়ি রাখতে হয়েছে মেঝের উপর।
রজার এবং সেই শুকনো-পাতলা লোকটা ব্যস্ত রয়েছে একটা শেলফের কাছে। রজারের হাতে এক টুকরো কাগজ, লোকটার হাতে গোটা দশেক পেন্ডুলাম-নম্বর মিলিয়ে মিলিয়ে একেকটা ঘড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে সেগুলো। নিচু হয়ে ঝুঁকে আবার গোটাকয়েক পেন্ডুলাম তুলে নিল লোকটা একটা বাক্স থেকে। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বলে মনে হলো রানার। মাথা নাড়ছে রজার, ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কাগজের একটা জায়গায় খোঁচা দিল, নিচু গলায় কিছু বলল পাশের লোকটাকে। ঘাড় বাঁকিয়ে কাগজের দিকে চাইল লোকটা, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের কাজে মন দিল। কাগজের উপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই একটা সাইড ডোর দিয়ে বেরিয়ে গেল ডক্টর রজার, অদৃশ্য হয়ে গেল রানার দৃষ্টিপথ থেকে। ইসমাইলের হত্যাকারী পকেট থেকে আরেকটা কাগজ বের করে একই আকারের দুটো করে পেণ্ডুলাম। সাজাতে শুরু করল একটা টেবিলের উপর।
রজার ব্যাটা গেল কই?-ডাবল রানা। সাথে সাথেই উত্তর পেয়ে গেল সে। ঠিক পেছন থেকে।
আমাকে নিরাশ করেননি দেখে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মিস্টার। রানা।
ধীরে ধীরে পেছন ফিরল রানা। সাধুপুরুষের নিষ্পাপ হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেভারেন্ড রজার, হাতে একটা বড় আকাবের বেমানান পিস্তল, পিস্তলের মুখটা সোজা রানার হৃৎপিণ্ডের দিকে ধরা।
বিড়ালকেও হার মানিয়ে দিয়েছেন আপনি, মিস্টার রীনা! আনন্দ বিগলিত কণ্ঠে বলল রজার। আপনাকে বোধ হয় একটু আন্ডারএস্টিমেটই করে ফেলেছিলাম আমি। গত তেরো ঘণ্টার মধ্যে দুই দুইবার আপনার মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছি। আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি আপনার অবধারিত মৃত্যু সম্পর্কে, কিন্তু বড় শক্ত জান আপনার, ঠিক কোন না কোন ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়েছেন, আমার জাল থেকে। আমার জন্যে এটা অত্যন্ত অবমাননার কথা। জীবনে এমন ঘোল কেউ খাওয়াতে পারেনি আমাকে। যাই হোক, দান দান তিন দান। যদিও অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছি আমি, তৃবু তৃতীয়বার যেন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে তদারক করব এবার। স্যামুয়েলকে খুন করে আসা উচিত ছিল আপনার।
মরেনি ও? দুঃখিত মুখভঙ্গি করল রানা।
অত দুঃখিত হওয়ার কিছুই নেই, মিস্টার মাসুদ রানা। এখনও মরেনি। ঠিকই, তবে মরবার আর বেশি বাকিও নেই। সামান্য কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞান। ফিরে পেয়েছিল ও, আমাদের সৌভাগ্য যে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই মাঠের মহিলাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল বেচারী। হাসপাতালে দেয়া হয়েছে, কিন্তু স্কাল ফ্র্যাকচার আর ব্রেন হেমারেজ কাটিয়ে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব হবে। কিনা বলতে পারছে না ডাক্তাররা। এইটুকু বলেছে, যদি বাঁচেও, কোনদিন আর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারবে না স্যামুয়েল।
খুব একটা দুঃখ বোধ করতে পারছি না খবরটা শুনে। সহজ কণ্ঠে বলল, রানা।
তা তো বটেই, মাথা ঝাঁকাল রেভারেন্ড রজার অমায়িক ভঙ্গিতে। কিন্তু কেউ কেউ আবার করছে। এই যেমন স্পিনোযা…মানে, চার্চ থেকে। গাড়িতে করে যে ছেলেটা এল আমার সাথে ওর কলজেটা ফেটে যেতে চাইছে দুঃখে-হাজার হোক, আপন ভাই। হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠার ভঙ্গি করল রজার, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ গল্প করবেন? চলুন, ভেতরে চলুন! হাসল লজ্জিত হাসি। আমি কিন্তু পিস্তলের ব্যাপারে খুবই আনাড়ি লোক। প্রয়োজনের বেশি সামান্য একটু নড়াচড়া দেখলেই টিপে দিই ট্রিগার।
পেছনের একটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল রানা। সোজা এসে থামল সেই ঘড়ি ঘরে। রানাকে দেখে বিন্দুমাত্র বিস্মিত হলো না স্পিনোর্য। বোঝা গেল, অনেক আগেই সাবধানবাণী পেয়ে গেছে ওরা হাইলার থেকে।
এই যে, স্পিনোযা, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে রজার, ইনিই হচ্ছেন সেই স্বনামধন্য মেজর মাসুদ রানা। বাংলাদেশের স্পাই। অ্যামস্টার্ডামে এসেছেন। ইন্টারপোলের সহযোগিতায় আমাদের অর্গানাইজেশনটা ধ্বংস করে দিতে।
পরিচয় আগেই হয়েছে আমাদের, গম্ভীর গলায় বলল স্পিনোযা।
ওহ-হো, কি ভুলো মন আমার! ভুলেই গিয়েছিলাম। রানার দিকে পিস্তল ধরে রাখল রজার, একপাশ থেকে কাছে এগিয়ে রানার পিস্তল বের করে নিল। স্পিনোযা।
এগুলো নিশ্চয়ই স্যামুয়েলের হাতের ছাপ? পিস্তলের মাথা দিয়ে মৃদু দুটো টোকা দিল স্পিনোযা রানার চোয়ালে আঁটা প্লাস্টারের উপর, তারপর ফোর-সাইটটা চেপে ধরে চড়চড় করে তুলে ফেলল একটা প্লাস্টার। ভয়ঙ্কর। একটুকরো হাসি ওর ঠোঁটে। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল, কি? ব্যথা লাগছে খুব?
আহা, স্পিনোযা, আবেগপ্রবণ হয়ো না। আগেই বলেছি তোমাকে, সামলে রাখতে হবে নিজেকে। মনের মধ্যে আক্রোশ এসে গেলেই বুঝবে। ঘোলা হয়ে গেছে বুদ্ধিটা। কয়েক পা পিছিয়ে গেল রজার। এবার পিস্তলটা ওর বুকের দিকে তাক করে ধরো দেখি। স্পিনোযা রানার পিস্তলটা পরীক্ষা। করে দেখে নিয়ে তাক করে ধরল নিজেরটা পকেটে ফেলে মুখ বাঁকা করল রজার। এসব জিনিস আমার মোটেই পছন্দ হয় না, মিস্টার মাসুদ রানা। স্কুল, অমার্জিত, গোলমেলে জিনিস-সৌন্দর্য বা শিল্পমাধুর্যের কিছু…
গলায় রশি বেঁধে হয়েস্টিং বীমের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া, বা হে-ফর্কের। খোঁচায় খোঁচায় হত্যা করার মধ্যে আছে? নরম গলায় জানতে চাইল রানা।
এই দেখুন, আপনি আবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন, একগাল হাসল রেভারেন্ড রজার। যে-কোন শিল্প-সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে, অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার ক্ষমতা অর্জন করে নিতে হয়। এজন্যে প্রস্তুতি দরকার, নিজেকে শিক্ষিত করে নেয়া দরকার। চট করে একদিনে কেউ ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ভক্ত হয়ে যায় না। আপনার যদি ভাল না লাগে, দোষটা আপনার, ক্লাসিক্যাল মিউজিক বা পিকাসোর পেইন্টিঙের না! এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল ডক্টর রজার দুঃখিত ভঙ্গিতে। আপনি নিরাশ করেছেন আমাকে। সত্যি। বলতে কি, আপনার এত নাম শুনেছি যে চমৎকার খেলা জমবে মনে করে। রীতিমত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলাম আমি আপনার আগমন সংবাদে। অনেক আশা করেছিলাম আমি আপনার কাছে। কিন্তু কি দেখলাম? ভুলের পর ভুল করলেন আপনি এখানে, ওখানে, সেখানে নির্বোধের মত পা দিলেন একের পর এক পেতে রাখা ফাঁদে। যখন আমি তীক্ষ্ণবুদ্ধির কোন প্যাঁচ আশা করছি, প্রমাণ পাচ্ছি আকাট নির্বুদ্ধিতার! কি জন্যে যে আপনাকে পৃথিবীর সেরা স্পাই বলা হয় কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না আমি আজ পর্যন্ত। প্রতিটা পদক্ষেপেই ভুল করছেন আপনি। মূর্খের মত কিছু কাজ করে মনে মনে ভাবছেন, ঢিল লাগিয়ে দিয়েছেন ভীমরুলের চাকে, রাগে অন্ধ হয়ে কিছু ভুল। করে বলব আমরা। আবার মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। নাহ! বড়ই নিরাশ হয়েছি। আপনারই দোষে প্রাণ দিতে হয়েছে বিট্রিক্স শেরম্যানকে। কোনরকম সতর্কতা অবলম্বন না করেই আপনি দুই দুইবার গিয়েছেন ওর ঘরে, আপনাদের কথাবার্তা রেকর্ড হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে কোন সন্দেহই জাগেনি আপনার সরল অন্তরে। আপনার সবকিছুতেই ভুল। কোনটা ছেড়ে কোটা বলি? ফ্লোর ওয়েটারের পকেট হাতড়ে যে কাগজটা পাবেন বলে আশা। করেছিলাম, সেটাই পেলেন আপনি–যদিও ওটা আদায় করতে গিয়ে বেচারীকে খুন করবার কোন যৌক্তিকতা দেখি না আমি। পরিষ্কার দিনের আলোয় হেঁটে বেড়াচ্ছেন আপনি হাইলারে, ভাবতেও পারছেন না, ওখানকার। অধেকের বেশি লোক আমার অনুগত, আপনার জীবিত থাকার খবর আমি পেয়ে যাব সাথে সাথেই। চার্চের বেজমেনে আপনার ভিজিটিং কার্ড রেখে আসছেন আপনি, তাজা রক্ত পাওয়া যাচ্ছে মেঝের উপর, অথচ ভাবছেন, কাকপক্ষীও টের পাচ্ছে না কিছু। ওই লোকটাকে খুন করায় অবশ্য কোন রাগ নেই আমার আপনার ওপর। আপনি ওর ব্যবস্থা না করলে আমার নিজেরই করতে হত–মাথার বোঝা হয়ে উঠেছিল লোকটা ক্রমে। যাই হোক, এ কয়দিন দেখে-শুনে আমাদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা হলো। শোনা যাক। কি মনে করেন, ফাঁক পেয়েছেন কোথাও?
আপনাদের তিনটে ব্যবসাতেই ফাঁক রয়েছে। বাইবেল, হাইলারের। পুতুল আর দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলাম–প্রত্যেকটাতেই ফাঁক দেখতে পেয়েছি। চার্চের নিচতলায় যে বিশেষ আকৃতির দোলক তৈরি করা হয় সেটা বুঝতে খুব। বেশি বেগ পেতে হয়নি আমার।
কিন্তু এত বুঝেও ঠেকাতে পারলেন না আমাদের, পবিত্র হাসি রেভারেন্ডের মুখে। ঠিকই ধরেছেন, ফাপা দোলকের মধ্যে পুরে দিচ্ছি আমরা। এক বিশেষ ধরনের পাউডার। বাক্সে পোরা হচ্ছে দেয়াল ঘড়িগুলো, কাস্টম ইন্সপেকশন হচ্ছে, তারপর সীল করে সরকারী দফতরের অনুমোদনপত্রসহ পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আমাদের বিশেষভাবে নির্বাচিত ডিলারদের কাছে। এতই নিখুঁত, এতই…
খুক খুক কুরে গলা পরিষ্কার করল স্পিনোর্য। মিস্টার রজার আপনি বলছিলেন বিশেষ জরুরী এক কাজে…।
ঠিক বলেছ। অযথা বাজে কথায় দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। মিস্টার স্পাইয়ের একটা ব্যবস্থা করেই ছুটতে হবে আমাকে আবার, …চট করে। একপাক ঘরে দেখে এসো তো অল ক্লিয়ার কিনা।
বিতৃষ্ণার সাথে আবার পিস্তলটা বের করল রজার, নিঃশব্দ দ্রুতপায়ে চারপাশের কয়েকটা জানালায় চোখ রেখে ফিরে এল স্পিনোযা, মাথাটা কাত করল ডানপাশে। পিস্তলের মুখে একতলা দালান থেকে বের করে দুর্গের সদর দরজার কাছে নিয়ে আসা হলো রানাকে। বড়সড় একটা চাবি ঢুকিয়ে যোচড় দিতেই ওক কাঠের বিশাল দরজা খুলে হাঁ হয়ে গেল। প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে। দোতলায় উঠে প্যাসেজ ধরে কিছুদূর এগিয়ে আর একটা মস্ত ঘড়ি ঘরে ঢোকানো হলো রানাকে।
একনজরেই বোঝা যাচ্ছে, এটা প্রদর্শনী ঘর। ঘরের চার দেয়ালেই টাঙানো রয়েছে আশ্চর্য সুন্দর কয়েকশো দামী ঘড়ি। প্রত্যেকটা দেয়াল মেঝে থেকে কোমরসমান উঁচু পর্যন্ত সবুজ-সাদা মোজাইক করা, সেখান থেকে ৩ ছয়ফুট চওড়া পালিশ করা কাঠ, তার উপর থেকে সিলিং পর্যন্ত আবার। মোজাইক চার দেয়াল জুড়ে ছয়ফুট চওড়া কাঠের প্যানেলের উপর অপূর্ব। সুন্দর করে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের, বিভিন্ন আকৃতির দেয়ালঘড়ি কোনটা পাঁচফুট বাই তিন ফুট, কোনটা পাঁচইঞ্চি বাই তিনইঞ্চি। ঘড়ির কারুকাজের বাহার হাঁ করে চেয়ে থাকবার মত।
সবগুলো ঘড়ি মিলে কত দাম হবে আন্দাজ করবার চেষ্টা করল রানা, পারল না। লক্ষ করল প্রত্যেকটাই পেন্ডুলাম কুক। মাত্র কয়েকটা ঘড়ি চলছে। সবকটা ঘড়ি যদি একসাথে চলতে শুরু করে তাহলে কি বিকট আর ভয়ঙ্কর শব্দ হবে ভেবে গালদুটো একটু কুঁচকে উঠল রানার। আট-দশটা চলছে, তাতেই বিরক্ত হয়ে উঠল সে দশ সেকেন্ডের মধ্যে। এই ঘরে বসে দশ মিনিটও কোন মনোযোগের কাজ করতে পারবে না সে-ছুটে পালাতে হবে।
অপূর্ব কালেকশন…কি বলেন? আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল ডক্টর রজার। সারা দুনিয়ায় এর জুড়ি পাবেন কিনা সন্দেহ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবেন বরং বলা উচিত, শুনতে পাবেন–এগুলো প্রত্যেকটাই চলে। অচল। ঘড়ি এখানে একটাও নেই।
কথাগুলো শুনল রানা, কিন্তু বক্তব্যটা ঠিক অনুধাবন করতে পারল না। ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠেছে ওর। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে ঘরের। এককোণে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লোকটার দিকে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, পিঠের হাড় দেখা যাচ্ছে কোটের উপর দিয়েও। দুপা এগিয়ে চমকে উঠল। রানা লোকটার মুখের দিকে চেয়ে। বীভৎস! ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল। মুখটা মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে–সেই রকমই রয়ে গেছে। হেনরী শেরম্যান। একনজরেই বোঝা গেল-মৃত! পাশেই পড়ে আছে কয়েক টুকরো সিঙ্গেল কোর রাবার-ইনসুলেটেড বৈদ্যুতিক তার। মাথার পাশে মেঝের উপর পড়ে আছে একটা রাবার মোড়া এয়ারফোন।
অ্যাকসিডেন্ট, দুঃখিত কণ্ঠে বলল রজার! ভাবতেও পারিনি এত অল্পেই পটল তুলবে ছেঁড়া। এতটা যে কাহিল হয়ে পড়েছিল, কল্পনাও করতে পারিনি।
ওকে খুন করেছেন কেন? রজারের দিকে ফিরল রানা। খুন? তা অবশ্য এক হিসেবে খুনই বলা যায় একে।
কেন?
ওর বোনটা যখন আমার ওপর আর ভরসা রাখতে পারল না, ভিড়ে গেল আপনার দলে, তখন এছাড়া আর কি উপায় ছিল ওকে শাস্তি দেয়ার? গত তিনটে বছর ধরে ওকে দিয়ে যা খুশি করিয়েছি আমরা। ওকে ধারণা দেয়া হয়েছিল যে ওর ভাইকে খুনের দায়ে খুঁজছে পুলিস, আমাদের হাতে তথ্য প্রমাণ রয়েছে, যে কোন সময়ে তুলে দিতে পারি পুলিসের হাতে। এই ভাইয়ের মায়া কাটাতে পারেনি বলেই মনের বিরুদ্ধে অনেক কাজ করতে হয়েছে মেয়েটাকে। কাজেই, স্বাভাবিকভাবেই, ওকে শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন যখন দেখা দিল, ওর দুর্বলতম জায়গায় অর্থাৎ, এই ভাইটির ওপরই নির্যাতন চালাতে হলো আমাদের। ওর সামনে। তবে একটা কথা আপনার জানা থাকা ভাল, হেনরী বা তার বোনের মৃত্যুর ব্যাপারে আমি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী আপনি নিজে। শুধু এরাই নয়, আপনার সহকারিণী মারিয়া ডুকজের মৃত্যুর জন্যেও আমি দায়ী করব আপনাকেই। কথাটা বলতে। বলতে ঝট করে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে পিস্তলটা রানার চোখের দিকে লক্ষ্য করে ধরল রজার। ঝাঁপ দিলেই মারা পড়বেন, মিস্টার মাসুদ রানা। আমি বুঝতে পারছি, খড়-নত্য, আপনি একটুও উপভোগ করতে পারেননি। মারিয়ার কাছেও নিশ্চয়ই ভাল লাগেনি আমার ফাইন আর্ট। এবং আমার বিশ্বাস, আজ সন্ধ্যায়। সোহানা চৌধুরীর কাছেও খুব একটা ভাল লাগবে না। তাকেও ওপারের টিকেট কাটতে হচ্ছে আজই সন্ধ্যায়। বাহ! বেশ গভীরে গিয়ে লাগছে মনে হচ্ছে কথাগুলো! গুম! আমাকে হত্যা করার ইচ্ছে হচ্ছে আপনার মধ্যে, মিস্টার মাসুদ রানা। হাসি লেগে রয়েছে রজারের ঠোঁটের কোণে, কিন্তু নিষ্পলক ভাবলেশহীন চোখদুটোর দিকে চেয়ে মনে হচ্ছে উন্মাদের চোখ।
হ্যাঁ। খুবই ইচ্ছে হচ্ছে। সুযোগ পাওয়ামাত্র করব। সহজ কণ্ঠে বলল রানা।
আমি দুঃখিত। এ জন্মে আর সুযোগ পাচ্ছেন না। নেক্সট টাইম, কি বলেন? যাই হোক, যা বলছিলাম, একটা ছোট্ট চিরকুট পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। সোহানা চৌধুরীর কাছে। চোখ টিপল রজার। কি যেন ছিল কোড ওয়ার্ডটা? ও হ্যাঁ, মাদাগাস্কার। ওকে লেখা হয়েছে, ভলেনহোভেন কোম্পানীতে দেখা করতে হবে আপনার সাথে, আজই সন্ধ্যায়। বিচিত্র কর্কশ আওয়াজ করে। হাসল রজার। ভলেনহোভেনকে আর কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। একই ওয়েরহাউজে পরপর দুটো খুন হতে দেখলে কে ভাবতে পারবে ওয়েরহাউজের মালিকের হাত রয়েছে এতে? নিজের বাড়িতে কেউ করে এই কাজ? একটা। ফাইন টাচেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছে ভলেনহোভেন। আবার একটা লাশ ঝুলতে দেখা যাবে কাল সকালে হয়েস্টিং বীমের সাথে; দুলবে বাতাসে।
আপনি জানেন যে আপনি একটা বদ্ধ উন্মাদ? জিজ্ঞেস করল রানা।
বাঁধো ওকে, রানার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে আদেশ করল সে স্পিনোযাকে। মুহূর্তের জন্যে ভদ্রতার মুখোশ খসে যেতে দেখে বুঝতে পারল রানা, কথাটা ওর কোন দুর্বল জায়গায় গিয়ে লেগেছে।
মৃতদেহটার কাছে রানাকে ঠেলে নিয়ে গেল স্পিনোযা। হাতদুটো পিছমোড়া করে বেধে ফেলা হলো মোটা ইলেকট্রিক তার দিয়ে, পা দুটোও বাধা হলো জোড়া করে, তারপর দেয়ালের একটা আংটার সাথে শক্ত বাধা চারফুট লম্বা একটা তারের মাথার সাথে এটে দেয়া হলো রানার হাতের কব্জি।
চালু করো ঘড়িগুলো। হুকুম দিল ডক্টর রজার।
দ্রুতহাতে একের পর এক ঢাকনি খুলে পেন্ডুলামগুলো দুলিয়ে দিতে শুরু করল স্পিনোযা। ছোটবড় নানান রকম।
আপনাকে আগেই বলেছি, অচল ঘড়ি একটাও নেই এখানে–সব সচল। সবটাতেই ঘণ্টা বাজে। পিস্তলটা পকেটে রেখে কাছে এগিয়ে এল ডক্টর রজার। সামলে নিয়ে আবার হাসি-খুশি ভাবটা ফিরিয়ে এনেছে সে নিজের মধ্যে। এয়ারফোনের মাধ্যমে দশগুণ বেড়ে যাবে ঘড়ির আওয়াজ। ঠিক দশগুণ বেশিও না, কমও না–একেবারে হিসেব করা। ওই যে দেখুন অ্যামপ্লিফায়ার, আর ওই যে মাইক্রোফোন। দুটোই আপনার নাগালের বাইরে। এয়ারফোনটা আনরেকেবল। হাজার চেষ্টা করলেও খসাতে পারবেন না ওটা কান থেকে। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে পাগল হয়ে যাবেন আপনি, বিশ মিনিটের মধ্যে জ্ঞান হারাবেন। জ্ঞান ফিরে আসবে আট থেকে দশ ঘণ্টা পরবদ্ধ উন্মাদ অবস্থায়। কিন্তু সে নিয়ে ভাবতে হবে না আপনার, জ্ঞান আর ফিরে আসবে না আপনার কোনদিনই। চারপাশে চাইল রজার। অর্ধেক বাকি আছে চাল হতে এরই মধ্যে কেমন হাটবাজার বসে গেছে দেখেছেন?
এইভাবেই নিশ্চয় খুন করা হয়েছে হেনরীকে? বাইরে থেকে দেখবেন আপনারা, ওই দরজার কাঁচের ওপাশ থেকে। মানুষের যন্ত্রণা দেখতে ভাল লাগে আপনার?
খুব ভাল লাগে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনার কষ্ট সবটা দেখবার সুযোগ। হবে না আমাদের। কিছু জরুরী কাজ পড়ে রয়েছে আমাদের। অবশ্য যত তাড়াতাড়ি পারি সেগুলো সেরে ফিরে আসবার চেষ্টা করব আমরা। বিশেষ করে প্রথম আর শেষটুকু সত্যিই দেখবার মত হয়। এ
একের পর এক দোলক দুলিয়ে চলেছে স্পিনোর্য। মুহুর্মুহু ঘণ্টা পড়ছে, একটা থামে তো শুরু করে আর একটা কোনটায় পড়ছে দুটো ঘণ্টা, কোনটায় নয়টা, কোনটায় একটা, কোনটায় বারোটা। কোনটা হালকা সুরে, কোনটা গভীর, কোনটা উঁচু পর্দায়, কোনটা আবার খুবই খাদে।
আমার লাশ গায়েব করে ফেলে আপনি মনে করেছেন…
আহা, গায়েব করতে যাব কেন? বাধা দিয়ে পাকা মাথাটা দোলাল ডক্টর রজার। কাল রাতে বার্জ-বন্দরে চেয়েছিলাম সেটা। কিন্তু সেটা ছিল তাড়াহুড়োর সিদ্ধান্ত। এখন অনেক ভাল প্ল্যান এসেছে আমার মাথায়। গায়েব করব তো না-ই, ডুবে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই উদ্ধার করা হবে আপনার লাশ।
ডুবে যাওয়ার মানে?
মানে, জ্ঞান হারাবার পর আপনার হাতের ওপর কিছু কারুকাজ করা হবে যাতে মনে হয় হাত পাকিয়ে ফেলেছেন আপনি ইঞ্জেকশন নিয়ে নিয়ে। একডোজ হেরোইনও ঢুকিয়ে দেয়া হবে আপনার শরীরে। তারপর গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসিয়ে গাড়িসুদ্ধ আপনাকে ঠেলে ফেলে দেয়া হবে শহরের কোন খালে। এবং সাথে সাথেই ফোন করা হবে পুলিসে। ঘড়ির গোলমালে প্রায় চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে এখন ওকে। অটপসি হবেই। আপনার হাতে হাইপোডার্মিকের পাংচার দেখে চমকে যাবে সবাই। আরও ইনভেস্টিগেশন করে দেখা যাবে হেরোইন পাওয়া যাচ্ছে। স্বভাবতঃই পুলিস। বিশ্বাস করতে চাইবে না ব্যাপারটা। মাসুদ রানা, ইন্টারপোলের ইনভেস্টিগেটর…সে কি পুশার হতে পারে? অসম্ভব। আপনার মাল পত্র সার্চ করে দেখা হবে। কেচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়বে তখন। এমন কিছু কাগজপত্র পাওয়া যাবে আপনার সুটকেসের গোপন কম্পার্টমেন্টে, যাতে কারও কোন সন্দেহ থাকবে না যে আসলে ড্রাগ রিঙ ধ্বংস করতে আসেননি আপনি অ্যামস্টার্ডামে, এসেছেন তাদের সাথে একটা গোপন চুক্তিতে পৌঁছুতে। বেশ কিছু হেরোইন পাওয়া যাবে আপনার সুটকেসে, আপনার পকেটে পাওয়া যাবে ক্যানাবিসের শুখা। আহা! বড়ই দুঃখজনক! কে ভাবতে পেরেছিল এমন একজন লোক আসলে এই? গাছেরটাও খাচ্ছে, তলেরটাও কুড়োচ্ছে।
গোটাকয়েক গালি দিল রানা। কিন্তু ঘড়িগুলোর প্রচণ্ড গোলমালে বোধহয়। শুনতে পেল না ডক্টর রজার। একগাল হেসে রানার মাথার উপর দিয়ে। এয়ারফোনটা পরিয়ে দিল সে ওর দুই কানে, তারপর একটা অ্যাডহেসিভ টেপের প্রায় অর্ধেক রীল খরচ করে এমনভাবে আটকে দিল ওটাকে, যেন কিছুতেই না খোলে। এয়ারফোনটা কানে পরিয়ে দিতেই ঘড়ির গোলমাল অনেকটা কমে গেল, মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে আসছে হৈ-হল্লার শব্দ। অ্যামপ্লিফায়ারের কাছে চলে গেল এবার ডক্টর রজার, রানার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে টিপে দিল সুইচ।
ঠিক যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে, এমনি প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠল রানা। শব্দ দিয়ে মানুষকে এত ভয়ঙ্কর নির্যাতন করা যায় কল্পনাও করতে পারেনি সে। মুহূর্তে সামনের দিকে বাকা হয়ে গেল ওর শরীরটা, হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝের উপর, পড়েই কাটা মুরগীর মত লাফাতে শুরু করল। প্রচণ্ড শব্দ! দাতে দাঁত চেপে সহ্য করবার চেষ্টা করছে সে। মনে হচ্ছে গরম শিক ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ ওর কানের ভেতর, খোঁচাচ্ছে মগজের মধ্যে। কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে না কেন বুঝতে পারল না রানা, পর্দা ফেটে গেলে নিষ্কৃতি পাওয়া যেত এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু ফাটছে না। রানা বুঝতে পারল, এমনভাবে মাপ বেধে দেয়া হয়েছে যেন কানের পর্দা ফেটে গিয়ে কেউ রেহাই পায় না।
পাগলের মত গড়াগড়ি খাচ্ছে রানা মেঝের উপর। কিন্তু টান করে বাঁধা রয়েছে হাতদুটো কড়ার সাথে, বেশিদূর গড়াতেও পারছে না। বড়শিতে গাঁথা। চিতল মাছের মত যন্ত্রণায় একেবেকে ছটফট করছে সে, নিজের অজান্তেই লাফিয়ে উঠছে শরীরটা আধহাত, কখনও খটাশ করে বাড়ি খাচ্ছে মাথাটা দেয়ালের সাথে–কোনদিক থেকে কোনদিকে গড়াচ্ছে কোন হুশ নেই। এরই ফাঁকে চোখ গেল একবার দরজার দিকে। কাঠের দরজা, উপরটায় কাঁচ বসানো। কাঁচের ওপাশে দেখতে পেল সে ডক্টর রজার আর স্পিনোযাকে। চকচকে কৌতূহলী চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। ঘড়িটা চোখের কাছে। তুলল স্পিনোর্য, কিছু বলল, মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে রানার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল রজার অনিচ্ছাসত্ত্বেও। রানা বুঝতে পারল, যত শিগগির সব কাজ সেরে ফিরে আসবার চেষ্টা করবে ওই সাইকোপ্যাথ।
পনেরো মিনিটে মাথা খারাপ হয়ে যাবে, বলেছে রজার। কিন্তু রানার বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। এই অবস্থায় তিন মিনিটের বেশি কি করে কারও পক্ষে মাথা ঠিক রাখা সম্ভব, বোঝা মুশকিল। এপাশ-ওপাশ মাথা ঠুকল রানা। ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে এয়ারফোন। সরবো-রাবার মোড়া এয়ারফোন যে সত্যিকার অর্থেই আনব্রেকেবল হাড়ে হাড়ে টের পেল সে। মেঝের সাথে কান ঘষে খসিয়ে ফেলবার চেষ্টা করল সে এয়ারফোনটা, পারল না। নিজের অজান্তেই যন্ত্রণা থেকে বাচবার স্বাভাবিক শারীরিক তাগিদে এসব করছে, সে, খেয়ালই করল না যে ঘষাঘষিতে মুখের প্লাস্টারগুলো খসে গিয়ে দরদর করে। আবার নেমেছে রক্তের ধারা।
টিক টিক টিক টিক, ঢং ঢং ঢং ঢং, বিরামহীন বেজে চলেছে ঘড়িগুলো, একটা ঘণ্টা বন্ধ হওয়ার দশ পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে শুরু হয়ে যায়। আরেকটার ঘটা। অসহ্য! এক মুহূর্তও স্বস্তির ব্যবস্থা নেই। সায়ুগুলোকে তীক্ষ্ণ চিরুনি দিয়ে আচড়াচ্ছে যেন কেউ। দেহের একেকটা অংশ এপিলেপটিক কনভালশনের মত আলাদাভাবে লাফাচ্ছে তড়াক তড়াক। পাগলা গারদে রোগীর উপর ইলেকট্রিক শক প্রয়োগ করলে কারও কারও হাড়গোড় ভেঙে যায় কেন বুঝতে পারল রানা। এই প্রচণ্ড শব্দের আক্রমণ ইলেকট্রিক শকের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে অনেক বেশি, কিন্তু অঙ্গহানির পক্ষে যথেষ্ট নয়।
কতক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতে পারল না রানা। এই অবস্থায় সময়ের হিসেব রাখা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। হঠাৎ একসময় পরিষ্কার বুঝতে পারল, অন্ধকারে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে সে! ঘোলা হয়ে আসছে ওর কাছে সবকিছু। হোক, ভাবল রানা। যদি সমস্ত বোধশক্তি হারিয়ে যায়, এই যন্ত্রণার চেয়ে সেটা বরং অনেক ভাল। চরম পরাজয় হয়েছে এবার ওর, হেরে গেছে সে। এ পর্যন্ত যে-ই ওঁর সংস্পর্শে এসেছে, সে-ই মারা পড়েছে। যেখানেই গিয়েছে, দুষ্টগ্রহের মত অশুভ ছায়া ফেলেছে সে। মারিয়া শেষ, ইসমাইল শেষ, বিট্রিক্স শেষ, ওর ভাই হেনরী শেষ–আজ সন্ধেয় শেষ হয়ে যাবে সোহানাও। যাক সব শেষ হয়ে যাক, সেইসাথে সে নিজেও। শেষ হয়ে যাক একটা অশুভ পরিচ্ছেদ।
হঠাৎ মনে হলো, সোহানা আশা করবে ওকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা করবে, ওর স্বপ্নের রাজকুমার মাসুদ রানা যেমন করেই তোক রক্ষা ওকে, করবেই। শুধু আশা নয়, বিশ্বাস করবে সোহান-মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও রানার। প্রতি ওর অটল বিশ্বাস নড়বে না একচুল। গলায় ফাস পরেও ভাববে, আর দেরি নেই, এই রানা পৌঁছুল বলে। কিন্তু আসলে পৌঁছুতে পারবে না রানা। নিজেই শেষ হয়ে বসে আছে সে।
হঠাৎ একজোড়া কাঁচাপাকা ভুরু দেখতে পেল রানা। তীক্ষ্ণ একজোড়া চোখ। চোখের দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা। যেন বলছে রানাকে তোমাকে কি শিক্ষা দিয়েছি আমি রানা? বলেছি না, ভেঙে যাবে, কিন্তু কিছুতেই বাকবে না? সাবধান! বাকা হয়ে যাচ্ছ তুমি, রানা। তোমার হাতে সঁপে দিয়েছি আমি সোহানাকে। যেমন করে পারো বাঁচাও ওকে। হাল ছেড়ো না। চারপাশে চেয়ে দেখো, উপায় আছেই কিছু না কিছু। সব সমস্যারই সমাধান আছে।
দাঁতে দাঁত চেপে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল রানা। না, স্যার। কোনও উপায় নেই, আমি পারলাম না। যদি পারেন, ক্ষমা করে দেবেন।
কোমল হয়ে এল বৃদ্ধের কঠোর দৃষ্টি। রানা!.তোমাকে হারাতে খুব খারাপ লাগবে আমার। খুবই কষ্ট হবে। বুড়ো মানুষটাকে এত দুঃখ দেবে? চারপাশটায় একটু দেখোই না চেয়ে, নিশ্চয়ই উপায় আছে কিছু। তোমার। নাগালের মধ্যেই।
ঝট করে দেয়ালের দিকে ফিরল রানা ঘোর কাটিয়ে উঠে। মৃগী রোগীর মত থরথর করে কাঁপছে ওর সারা শরীর, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে হাত-পা আপনাআপনি স্নায়বিক ঝাঁকুনি খেয়ে। দুই এক সেকেন্ডের বেশি কোনদিকে স্থির থাকতে চাইছে না চোখের দৃষ্টি।, তবু চাইল এদিক ওদিক কিছুই চোখে। পড়ল না ওর। কোন উপায় নেই কোনদিকে। এমনি সময়ে কোনরকম। প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ তীব্রতম হয়ে উঠল মাথার ভেতর শব্দের যন্ত্রণা। মস্ত একটা ঘড়ি প্রচণ্ড শব্দে সময়-সঙ্কেত দিতে শুরু করেছে। কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়েছিল, দড়াম করে আছড়ে পড়ল রানা। আবার মনে হলো, মস্ত এক মুগুর দিয়ে পিটাচ্ছে কেউ ওর কানের উপর। একেকটা ঘণ্টার শব্দে লাফিয়ে আধহাত শূন্যে উঠে যাচ্ছে ওর শরীরটা।
বারোটা বেজে এবং বাজিয়ে দিয়ে থামল ঘড়িটা। তীব্র যন্ত্রণার একচুল, পরিমাণ উপশম হতেই খানিকটা ঝিমিয়ে নিতে যাচ্ছিল রানা, এমনি সময়ে। আবার মনের ভেতর কথা বলে উঠল কেউ; কই, দেখলে না?
পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা, কথা বলছে আর কেউ না, ওর নিজেরই অবচেতন মন। এই মনের কথা জীবনে কখনও উপেক্ষা করেনি সে। খামোকা ভরসা দেবে না এ মন কাউকে। নিশ্চয়ই কিছু একটা ইঙ্গিত দিতে চাইছে। মনটা রানাকে, স্পষ্ট ভাষা জানা নেই বলে স্পষ্ট করে বলতে পারছে না।
আবার ফিরল রানা দেয়ালের দিকে। এইবার চোখে পড়ল ফুটো দুটো। চোখে আগেই পড়েছিল, কিন্তু সচেতন মনে তার কোন ছাপ পড়েনি। কিসের ফুটো? দেয়ালের গায়ে এইরকম ফুটো সষ্টি হওয়ার কি কারণ? চিন্তাশক্তি এতই হ্রাস পেয়েছে রানার যে এই কারণটা বুঝতেই পেরিয়ে গেল ওর, অনেকক্ষণ সময়। ওটা যে কনসীলড ওয়েরিঙের একটা প্লাগ পয়েন্ট, সে কথা। মাথায় এল প্রবল আর এক ঝাঁকুনি খেয়ে দেয়ালের সাথে মাথাটা ঠুকে যেতেই। বহু কষ্টে উঠে বসল রানা।
হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। ইলেকট্রিক কেবলের দুই মাথা খুঁজে পেতেই পেরিয়ে গেল এক যুগ। তারের দুই মাথা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। রানা দুদিক থেকেই খানিকটা করে তার বেরিয়ে রয়েছে। আশার আলো জ্বলে উঠল বুকের ভেতর। তারের দুই মাথা সকেটের দুই ফুটোর মধ্যে ঢোকাবার চেষ্টা করছে সে এখন। ম্যালেরিয়া জুরে কাঁপতে কাঁপতে সুইয়ে। সুতো পরাবার চেষ্টা করছে যেন সে সুই বা সুতো কোনটার দিকে না চেয়ে। কিছুতেই ফুটো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দাতে দাঁত চেপে মনোযোগ স্থির রাখবার চেষ্টা করছে সে কিন্তু কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। একবার পেছন ফিরে দেখে নিল, কিন্তু তার ঢোকাবার চেষ্টা করতে গেলেই হারিয়ে যায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, অনুভব করতে পারছে রানা। একটা ফুটোয় তার ঢুকিয়ে দ্বিতীয়টা খুঁজছে এখন সে, সামনের দিকে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, কিন্তু চোখে আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, নীরবে চিৎকার করছে সে যন্ত্রণায়। হাল ছেড়ে দেয়ার ঠিক পরমুহূর্তে ঝাঝাল একটা নীলচে-সাদা আলো দেখতে পেল রানা, তারপর গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
হয়তো কয়েক সেকেন্ড, কিংবা হয়তো কয়েক মিনিট, ঠিক কতক্ষণ জ্ঞান। হারিয়ে পড়ে ছিল বলতে পারবে না রানা। জ্ঞান যখন ফিরল তখন মনে হলো, ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠেছে সে। অপূর্ব শান্তিময় নীরবতা বিরাজ করছে চারপাশে। অখণ্ড নীরবতা নয়, বহুদূর থেকে হালকাভাবে। হট্টগোলের আওয়াজ আসছে ওর কানে। ঢং ঢং করে আরেকটা ঘড়ির ঘন্টা শুরু হতেই সব মনে পড়ে গেল ওর। সকেটের ভেতর একই তারের দুই মাথা, ঢুকিয়ে ফিউজ করে দিয়েছে সে ইলেকট্রিক লাইন, ফলে বন্ধ হয়ে গেই শব্দের নির্যাতন। উঠে বসল রানা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। অনুভব করল টপটপ করে রক্ত পড়ছে ওর চিবুক বেয়ে, যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কখন যে ঠোঁট কামড়ে কেটে ফেলেছে টের পায়নি। ঘেমে নেয়ে উঠেছে সারা শরীর। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে দুচোখ ভেঙে।
মিনিট দুয়েক কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁপিয়ে বেশ অনেকটা সামলে নিল রানা। তারপর মনে পড়ল ওর, ফিরে আসবে রজার আর স্পিনোযা খানিক বাদেই। এইভাবে ওকে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখলে কি ঘটেছে বুঝে নিতে দেরি হবে না ওদের। চট করে চোখ গেল ওর দরজার দিকে। কেউ নেই।
শুয়ে পড়ল সে আবার। গড়াগড়ি শুরু করল মেঝের উপর। আধ-মিনিটের মধ্যেই একজোড়া মাথা দেখতে পেল সে কাঁচের ওপাশে। আর এক ধাপ বাড়িয়ে দিল রানা গড়াগড়ি, মাঝে মাঝে লাফিয়ে হাতখানেক শুন্যে উঠে যাচ্ছে। ওর শরীরটা, যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখের চেহারা, কখনও টিপে বন্ধ করে রাখছে চোখ, কখনও বড় করে ফেলছে যতটা সম্ভব।
অনাবিল হাসি দেখতে পেল রানা রেভারেন্ড রজারের মুখে। সরল, মধুর হাসি। স্পিনোর্যর দুই চোখ জ্বলছে। দাতে দাঁত চেপে তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে, হয়তো ভাবছে, রানার যন্ত্রণা আরও কোন উপায়ে বাড়ানো গেলে ভাল হত।
অভিনয় করতে গিয়ে টের পেল রানা, এতেও যথেষ্ট কষ্ট; আসল কষ্টের চেয়ে খুব কম না–কাজেই জোরেসোরে একটা লাফ দিয়ে বাকাচোরা ভঙ্গিতে মেঝের উপর পড়েই স্থির হয়ে গেল।
হাসিমুখে ঘরে ঢুকল রজার। স্পিনোযাকে ইঙ্গিত করতেই ঘড়িগুলো বন্ধ করতে শুরু করল সে। নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে অ্যামপ্লিফায়ারের। সুইচ অফ করে দিল। বড় বড় ঘড়িগুলো বন্ধ করে দিয়ে রানার পাশে চলে এল। স্পিনো, দড়াম করে একটা লাথি মারল ওর পাজরে। কেঁপে উঠল রানার সর্বশরীর, কিন্তু টু শব্দ না করে মনে মনে ওর বাপ-মা তুলে কয়েকটা গালি দিয়েই সান্তনা খুঁজল রানা।
উঁহুহু! মাথা নাড়ল রজার। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ সামলে নিতে হবে তোমার, স্পিনোযা। শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে চলবে না। ব্যাপারটা পছন্দ করবে না পুলিস।
দাগ তো পাওয়া যাবেই, স্যার। ওর মুখটা দেখুন না। প্রতিবাদ করল স্পিনোযা।
ওগুলো দুপুরের দাগ। পুরানো। নতুন দাগ আর চাই না। হাত-পায়ের বাধন খুলে দাও, এসব চিহ্নও রয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। হেডফোনটা খুলে নিয়ে প্লাস্টারগুলো আবার সাটিয়ে দাও জায়গামত।
দশ সেকেন্ডের মধ্যে বাধন খুলে দেয়া হলো রানার হাত-পায়ের। এয়ারফোন খুলতে গিয়ে স্কচটেপগুলো এমনভাবে টেনে তুলল স্পিনোযা যে রানার মনে হলো চামড়া তুলে নেয়া হচ্ছে ওর গাল থেকে।
এবার ওইটাকে… হেনরীর দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল রজার, গায়েব করে দেয়ার ব্যবস্থা করো। কিভাবে কি করতে হবে বলেছি, দেখো, আবার নিজের বুদ্ধি খাটাতে যেয়ো না। আর এটা যেমন আছে থাক এখন। আমি গিয়ে মার্সেলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আধঘণ্টার মধ্যেও এসে ইঞ্জেকশনের। ব্যবস্থা করবে, তারপর দুজন মিলে যেমন যেমন বলেছি, লিখেও দিয়েছি, লিস্ট দেখে একে একে করবে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইল সে রানার দিকে, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বুদ্ধি ছিল লোকটার, তিনদিনে পাগল করে তুলেছিল আমাদের। কী জীবন! চলন্ত ছায়া যেন! কী যে কার পরিণতি, কেউ বলতে পারে না। চোখ তুলে চাইল স্পিনোর্যর দিকে। চলি, খেয়াল রেখো, কোথাও কোন ভুল না হয়।
ভুল হবে না, স্যার।
লম্বা পা ফেলে দরজার দিকে এগোল ডক্টর রজার। গুনগুন করে সুর ভাজতে ভাজতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। স্পিনোযাও বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, ফিরে এল এক মিনিটের মধ্যেই–হাতে ডজনখানেক বড় বড় পেন্ডুলাম। রানার পাশ থেকে একটা তার তুলে নিয়ে ওগুলোর আইলেটের মধ্যে দিয়ে তার ঢুকিয়ে মালা গেঁথে ফেলল একটা। এবার সেই মালাটা হেনরীর কোমরে পরিয়ে দিয়ে ঘাড়ের কাছে কোটটা খামচে ধরে ছেড়ে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মেঝের উপর হেনরীর জুতো ঘষার শব্দ শুনতে পাচ্ছে রানা। উঠে পড়ল সে, হাতদুটো মুঠো করল বারকয়েক, ভাঁজ করল, তারপর নিঃশব্দ পায়ে এগোল দরজার দিকে।
দরজার কাছে পৌঁছুতেই মার্সিডিজের এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ এল রানার। কানে। দরজা দিয়ে মাথা বের করে দেখল হেনরীকে মেঝের উপর ফেলে। একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচের কাউকে স্যালিউট করছে স্পিনোযা। নিশ্চয়ই ডক্টর রজারকে। ছায়ার মত নিঃশব্দে এগোল রানা।
স্যালিউট সেরে হাসিমুখে পেছন ফিরল স্পিনোযা হেনরীকে তুলে জানালা গলিয়ে নিচের পরিখায় ফেলবার জন্যে। তারপর হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর শরীরটা, মুখ দেখে মনে হচ্ছে জমে পাথর হয়ে গেছে। পাঁচফুটের। মধ্যে পৌঁছে গেছে রানা। ওর মুখের দিকে চেয়ে পরিষ্কার টের পেল রানা, বুঝে গেছে স্পিনোযা–বুঝে গেছে, অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত। তবু শেষ চেষ্টা করল লোকটা। ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বের করার চেষ্টা করল পিস্তলটা পকেট থেকে। কিন্তু কলজের মধ্যে মৃত্যুভয়ের ছ্যাকা লেগে গেলে ঠাণ্ডা হয়ে আসে হাত-পা, কাজ করতে পারে না ঠিকমত। এক সেকেন্ডের এদিক ওদিকেই নির্ধারিত হয়ে গেল জয়-পরাজয়। পিস্তলটা পকেট থেকে বেরিয়ে এল ঠিকই, কিন্তু সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড এক ঘুসি এসে পড়ল ওর সোলার প্লেকসাসে। দাতে দাঁত চেপে চোখ মুখ বানিয়ে বকা হয়ে গেল স্পিনোযা সামনের দিকে। পিস্তলটা ছিনিয়ে নিল রানা প্রায় বিনা বাধাতেই, ধাই করে মারল সে পিস্তলের বাট দিয়ে ওর চোখ আর কানের মাঝখানে রগের উপর। প্রায় একইঞ্চি নিচু হয়ে গেল জায়গাটা, কলকল করে রক্ত বেরিয়ে এল নাক দিয়ে। নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেল স্পিনোযা। দড়াম করে মারাত্মক লাথি এসে পড়ল ওর তলপেটে। উরুর পেছন দিকটাবাঁধলউইভ-সিলে, স্লো মোশন ছায়াছবির মত ডিগবাজি খেয়ে জানালার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল স্পিনোযার। শরীরটা। পিস্তল হাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রানা যতক্ষণ না নিচ থেকে ঝপাৎ শব্দ কানে এল।
জানালা দিয়ে মাথা বের করে নিচের দিকে চাইল রানা। ঢেউ দেখতে পেল সে পরিখার জলে, বাড়ি খাচ্ছে দুপাশের দেয়ালে। ঠিক মাঝখানটায় বুঁদ উঠছে পানির নিচ থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে বামদিকে চাইল রানা। দুর্গের খিলানের নিচ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ডক্টর রজারের সাদা মার্সিডিজ।
দ্রুতপায়ে নিচে নেমে এল রানা। বিজ পেরোতে গিয়ে আবার একবার চাইল পরিখার দিকে। বুদ্বুদগুলো ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। সুড়কি বিছানো রাস্তা ধরে দৌড়োতে শুরু করল সে খিলানের দিকে।
.
০৯.
অস্টিনের ড্রাইভিং সীটে উঠে বসে হাতের পিস্তলটার দিকে চাইল রানা। ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করল নিজেকে, এই নিয়ে কয়বার হাতছাড়া করতে হলো। পিস্তলটা? দেখা যাচ্ছে, যার খুশি সে-ই কেড়ে নিচ্ছে এটা ওর হাত থেকে–যেন ছেলের হাতের মোয়া। যতখানি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে ওর তাতে, এটাই স্বাভাবিক। আবারও যদি খোয়াতে হয়, এটাকে, অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু গত দুইবার এটা হারিয়ে যে পরিমাণ পিট্টি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, সেটার পুনরাবৃত্তি আর চায় না সে। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে, আরও একটা পিস্তল সাথে রাখা।
কাজেই সীটের নিচ থেকে বিট্রিক্সের হ্যাঁন্ডব্যাগটা বের করে আনল রানা। ছোট্ট লিলিপুট পিস্তল, যেটা আত্মরক্ষার জন্যে দিয়েছিল সে বিট্রিক্সকে, যেটা দ্বিধাহীন চিত্তে ব্যবহার করতে পারেনি বলে প্রাণ হারাতে হয়েছে ওকে এবং ওর ভাইকে, সেটা বের করে আনল রানা হ্যাঁন্ডব্যাগ থেকে। সব ঠিক আছে, কিনা দেখে নিয়ে ফুলপ্যান্টের ডান পা-টা উঁচু করল সে কয়েক ইঞ্চি, ব্যারেলটা নিচের দিকে রেখে গুঁজে দিল পিস্তলটা মোজার ভেতর। আরেকটু ঠেসে গোড়ালির পাশ দিয়ে জুতোর ভেতর ঢুকিয়ে দিল সে পিস্তলের নাকটা, তারপর মোজাটা তুলে দিল উপরে।
শহরে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধে হয়ে গেল। পুরানো শহরের দিকে চলল। রানা যত দ্রুত সম্ভব। ওয়েরহাউজের রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। রাস্তায় একটা জনপ্রাণীও নেই বটে, কিন্তু ভলেনহোভেন, কোম্পানীর তেতলার একটা জানালায় লোক দেখতে পেল রানা। উইন্ডো-সিলের উপর কনুই রেখে রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাচ্ছে একজন তাগড়া চেহারার লোক। হাওয়া খাওয়ার উদ্দেশ্যে যে নয়, বুঝতে অসুবিধে হলো না রানার। দালানটার সামনে দিয়ে গতি, পরিবর্তন না করে এগিয়ে গেল রানা, গলির শেষ মাথায় গিয়ে মোড় নিল ডাইনে। ড্যামের কাছাকাছি ফিরে গিয়ে একটা পাবলিক টেলিফোন। বুঁদ থেকে ডায়াল করল কর্নেল ডি গোল্ডের নাম্বারে।
সারাটা দিন কোথায় ছিলেন আপনি? রানার গলা শুনেই বিরক্ত কণ্ঠে বলল কর্নেল। কোথায় কি করে বেড়াচ্ছেন, এদিকে আমরা দুশ্চিন্তায়…
অত চিন্তার কি আছে? আমি তো আর ছোট্ট খোকা নই! গলার স্বর। পরিবর্তন করল রানা। আমার ইনভেস্টিগেশন কমপ্লিট। সবকিছু জানাবার জন্যে প্রস্তুত আমি এখন।
দ্যাটস গুড! জানান।
এখানে নয়। টেলিফোনে বলা যাবে না। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারকে নিয়ে আপনি এক্ষুণি ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে চলে আসতে পারবেন? আমি এখন ওখানে চলেছি।
ওখানে আপনি সবকিছু জানাবেন আমাদের?
কসম।
বেশ। আসছি।
একটা কথা-প্লেন ভ্যানে করে আসবেন। গলিমুখেই ভ্যান ছেড়ে দিয়ে হেঁটে ঢুকবেন গলিতে। প্রহরী রয়েছে ওদের তেতলার জানালায়।
প্রহরী?
হ্যাঁ। তবে ওকে অন্যমনস্ক করবার ব্যবস্থা আমি করব। আপনারা রওনা হয়ে যান।
সাথে আরও লোক আনব?
না। শুধু আপনারা দুজন।
রিসিভার নামিয়ে রেখে একটা স্টোর থেকে এক পাউন্ড নাইলন কর্ড কিনল রানা, সেই সাথে কিনল বড়সড় একটা পানির পাইপ টাইট দেয়ার ভারী রেঞ্চ। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভলেনহোভেন কোম্পানীর একশো গজের মধ্যে পার্ক করে রাখল রানা অস্টিনটা–ওই গলি দিয়ে না ঢুকে তার আগের গলিটা দিয়ে ওয়েরহাউজের পেছন দিকে চলে এসেছে সে। দুই সমান্তরাল গলি কিছুদূর অন্তর অন্তর দুটো সুইপার প্যাসেজ দিয়ে পরস্পর যুক্ত, আগেই লক্ষ। করেছিল রানা। প্রথম প্যাসেজ দিয়ে কিছুদূর গিয়েই একটা ফায়ার-এসকেপ দেখতে পেল সে। কিন্তু এটার সাহায্যে ছাদে উঠলে ভলেনহেভেন কোম্পানীর দালানটা বেশ অনেকটা দূর পড়ে যাবে মনে করে পুরো গলিটা খুজল সে কাছাকাছি আর কোন ফায়ার-এসকেপ পাওয়া যায় কিনা। পাশের গলিটাও দেখল–কিন্তু আর একটাও ফায়ার-এসকেপ চোখে পড়ল না ওর।
ফিরে এসে অপ্রশস্ত, অন্ধকার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে ছাতে উঠে পড়ল রানা। পিচ্ছিল ছাতের উপর দিয়ে হেঁটে কিনারে চলে এল। ছয়সাতটা, বাড়ি ডিঙোলে পৌঁছুবে সে লক্ষ্যস্থলে। এই ছাতের থেকে পাশের বাড়ির ছাতের দূরত্ব ছয়ফুট, লাফ দেয়া ছাড়া ডিঙোবার আর কোন উপায় নেই। লাফ দেয়ার মুহূর্তে যদি দয়া করে পা-টা একটু পিছলায়, তাহলেই সব খেলা। শেষ–হুড়মুড় করে পড়বে গিয়ে ষাট ফুট নিচে। আবছা আঁধারে ধোকা লাগছে চোখে; তবু আল্লা ভরসা বলে তিন কদম দৌড়ে লাফ দিল, রানা। এইভাবে টপকাতে গিয়ে চতুর্থ ছাতে এসে পিলে চমকে গেল ওর, যখন ছয়ফুট আন্দাজের লাফ দিয়ে দেখল পাশের ছাতটা আট ফুট দূরে। ভাগ্যিস ফুট দুয়েক মার্জিন রেখেই দিয়েছিল লাফটা–একেবারে কিনারে পড়েই চট করে হাঁটু ভাজ করে বসে হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল মাঝের দিকে। আর দুটো.ছাত. পেরিয়ে পৌঁছে গেল সে ভলেনহোভেনের মাথায়। রাস্তার দিকে কিনারায় গিয়ে সামনে ঝুঁকে দেখল, ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছে, প্রায় পঁচিশ-তিরিশ ফুট নিচে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছে লোকটা। একবার এপাশে তাকাচ্ছে, একবার ওপাশে।
স্টীলসন রেঞ্চের হাতলের শেষ মাথার ফোকরে নাইলন কর্ডের একমাথা বাঁধল রানা শক্ত করে। তারপর হয়েস্টিং বীম থেকে বেশ কিছুটা তফাতে শুয়ে পড়ল ছাতের কিনারে বুক পর্যন্ত রাস্তার দিকে বের করে। বিশফুট আন্দাজ রেঞ্চটা নামিয়ে দোলাতে শুরু করল সে পেন্ডুলামের ভঙ্গিতে। প্রতিটা দোলের সাথে সাথেই রানার হাতের ছোট্ট একটা টান পড়ছে, ফলে ক্রমেই বাড়ছে ওটার গতিবেগ। যত দ্রুত সম্ভব কাজ সারবার তাগিদ অনুভব করছে। রানা, হয়েস্টিং বীমের ঠিক নিচেই পাঁচতলার যে লোডিং প্ল্যাটফর্ম, তার পাশের ভেড়ানো দরজার ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল আলো দেখতে পাচ্ছে সে। যে কোন মুহূর্তে খুলে যেতে পারে দরজাটা। কেউ যদি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়, পরিষ্কার দেখতে পাবে রানাকে।
কমপক্ষে তিনসের ওজন হবে রেঞ্চটার। প্রায় নব্বই ডিগ্রী কোণ সৃষ্টি করে দুলছে এখন। সাবধানে আরও কয়েক ফুট নামিয়ে দিল রানা ওটাকে। ভয়। হলো কখন না জানি লোকটা আবার উপরদিকে চায়। মাথার উপর দিয়ে পার। হয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই কিছু না কিছু শব্দ হচ্ছে, কানে গেলেই চট করে চাইবে লোকটা উপরে।
কিন্তু লোকটার খেয়াল এদিকে থাকলে তো টের পাবে! ওর সমস্ত মনোযোগ এখন গলির মুখের দিকে। গলিটা পেরিয়েই থেমে দাঁড়িয়েছে একটা নীল ভ্যান। যদিও দেখা যাচ্ছে না ওটাকে, এঞ্জিনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে স্পষ্ট।, এর ফলে দুদিক থেকে সুবিধে হলো রানার। তেতলার প্রহরী ব্যাপারটা। ভালমত বোঝার জন্যে মাথাটা আর একটু বের করল সামনের দিকে। আর এঞ্জিনের গুঞ্জন ঢেকে দিল ওর মাথার উপর দোদুল্যমান রেঞ্চের বাতাস কাটার শব্দ।
হঠাৎ থেমে গেল এঞ্জিনের শব্দ। রেঞ্চটা ঝুলের শেষ সীমায় পৌঁছে নেমে আসছে আবার। সড়সড় করে আরও তিনফুট আন্দাজ ঢিল দিল রানা নাইলন কর্ডে। হঠাৎ টের পেল প্রহরী যে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে কোথাও। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। কিছু একটা সন্দেহ করে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে উপরদিকে। সাথে সাথেই দড়াম করে কপালের উপর এসে পড়ল স্টীলসন রেঞ্চ। শব্দ শুনে রানার মনে হলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। লোকটার মাথার খুলি। রশি ধরে টেনে রেঞ্জটা তুলে আনতে আনতে দেখল, জানালার চৌকাঠের উপর দুই ভাঁজ হয়ে ঝুলে রয়েছে লোকটা বেড়ার গায়ে শুকোতে দেয়া কাপড়ের মত।
কর্নেল ডি গোন্ড আর ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারকে দেখতে পেল রানা। দ্রুতপায়ে এগোচ্ছে এইদিকে। ডানহাতে ওদের আরও দ্রুত আসবার ইঙ্গিত করে জুতোর মধ্যে গোঁজা পিস্তলটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে শুয়ে পড়ল, রানা হয়েস্টিং বীমের উপর, তারপর পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে কামড়ে ধরল দাঁতের ফাঁকে। এবার দুই হাতে বীমটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়ল নিচের দিকে। বার দুয়েক দোল খেয়ে সামনের দিকে এগোবার সময়। হাত ছেড়ে দিল রানা।
লোডিং প্ল্যাটফর্মের রেলিং নেই, কাজেই কয়েকটা কাজ একসাথে করতে হলো রানাকে। বাম পা প্ল্যাটফর্ম স্পর্শ করবার সাথে সাথেই ডান পা দিয়ে জোরে একটা লাথি মারল সে দরজার গায়ে, দরজাটা হা হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বাম হাতে চট করে চৌকাঠ ধরে বাচল ছিটকে নিচে পড়ে যাওয়া থেকে। ততক্ষণে ডানহাতে চলে এসেছে পিস্তল। দ্রুত বারতিনেক চোখ মিটমিট করে সহ্য করে নিল ঘরের উজ্জ্বল আলো, তারপর পিস্তল হাতে ঢুকল ঘরের ভেতর।
ঘরের ভেতর বসে আছে দুইজন, দাঁড়িয়ে রয়েছে সোহানা। সোহানার পরনে ব্রেসিয়ার আর ছোট্ট জাঙিয়া, মাথার চুল মস্ত এক খোঁপায় বাধা নগ্ন ক্ষীণ কটি জড়িয়ে ধরে, আছে বিশাল মোটা ভলেনহোভেনের। থলথলে হাত, সোহানার নাভির কাছে নাক ঘষছে, আর ভুঁড়ি কাপিয়ে ২।< লোকটা অশ্লীল হাসি। ছটফট করছে সোহানা, একেবেঁকে ওর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করছে। কাছেই একটা চেয়ারে বসে মসৃণ হাসি হাসছে রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস রজার।
দেখতে দেখতে বদলে গেল সবার চেহারা। ভলেনহোভেনের হাসিটা মুখ থেকে ধাপে ধাপে মিলিয়ে গিয়ে কদাকার ভীতির ছাপ ফুটে উঠল ওর মুখের উপর। রানাকে দেখার সাথে সাথেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল নিকোলাস। রজার, মুহূর্তে হা হয়ে গেল মুখ, বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল সে রানার মুখের দিকে। ফ্যাকাসে হতে হতে ওর মাথার পাকা চুলের মতই সাদা হয়ে গেল। ওর মুখটা। দুই পা এগিয়ে গেল রানা ঘরের ভেতর। কয়েক সেকেন্ড অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে ছিল সোহানা, রানাকে নড়ে উঠতে দেখেই এক ঝটকায় কোমর থেকে ভলেনহোভেনের হাত ছাড়িয়ে প্রায় উড়ে এসে পড়ল ওর বুকে। সোহানার বুকের ভেতর কী জোরে হাতুড়ি পিটছে টের পেল রানা। মৃদু দুটো চাপড় দিল- সে ওর পিঠে, তারপর মুচকে হাসল। রজারের দিকে চেয়ে।
হ্যালো, রেভারেন্ড? পরমেশ্বরের ডাক শুনতে পাচ্ছেন?
যা বোঝার বুঝে নিয়েছে দুজনই। বিনা বাক্যব্যয়ে হাত তুলল দুজন মাথার উপর। পিস্তলটা দুজনের-ঠিক মাঝ বরাবর তাক করে ধরে চুপচাপ। দাঁড়িয়ে রইল রানা ডি গোল্ড আর মাগেনথেলারের অপেক্ষায়। ধুপধাপ। জুতোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে সিঁড়িতে। রিভলভার হাতে হুড়মুড় করে প্রথমে ঢুকল কর্নেল, হাঁপাচ্ছে হাঁ করে; তার পেছন পেছন ঘরে ঢুকল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার, ভাবের লেশমাত্র নেই মুখের চেহারায়, পাথর।
এসব কি! তাজ্জব চোখে উপস্থিত সবার মুখের উপর দৃষ্টি বোলাল ভ্যান। ডি গোল্ড। এই দুই ভদ্রলোকের দিকে পিস্তল ধরে রেখেছেন কেন? আপনার…
ব্যাখ্যা করে বললেই সব বুঝতে পারবেন, কর্নেল। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল রানা।
ঘোলাটে কোন ব্যাখ্যায় চলবে না, মেজর রানা, বলল মাগেনথেলার। কেন আপনি শহরের দুজন অত্যন্ত উচ্চ সম্মানিত, নামজাদা নাগরিককে…
আর হাসাবেন না, ইন্সপেক্টর, বলল রানা। গাল কোচকালেই ব্যথা লাগছে।
সেটারও ব্যাখ্যা দরকার। বলল ডি গোল্ড। আপনার চেহারার এই হাল…
সব বলছি। শুরু করতে পারি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকাল ডি গোল্ড।
আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে?
আবার মাথা ঝাঁকাল কর্নেল।
সোহানার দিকে ফিরল রানা। তুমি জানো, মারা গেছে মারিয়া?
জানি। এই একটু আগেই বলছিল লোকটা। রজারের দিকে চাইল সোহানা। বলছিল, আর হাসছিল। তোমার মৃত্যুর খবরও পেয়েছিলাম ওর কাছেই। ও বলছিল, ঘড়িঘরের মধ্যে…।
আমার ব্যাপারে ভুল বুলেছিল। ওর জানা ছিল না যে ইলেকট্রিক কারেন্ট ফিউজ করে দিয়ে কোনমতে বেঁচে গিয়েছি আমি এ যাত্রা ওর হাত থেকে। তবে মারিয়ার ব্যাপারে ঠিকই বলেছে ও। আমার চোখের সামনে হে ফর্ক দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে ওকে। ডি গোন্ডের দিকে ফিরল রানা। এই নিন, বিট্রিক্স শেরম্যানের হত্যাকারীকে তুলে দিচ্ছি আমি আপনার হাতে। সাইকোপ্যাথিক কিলার রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস রজার। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ রয়েছে আমার কাছে। এ-ই হচ্ছে বিট্রিক্স শেরম্যান, হেনরী শেরম্যান আর। ইসমাইল আহমেদের হত্যকারী। এরই ইঙ্গিতে আজ দুপুরে মোরব্বার মত করে হে-ফর্ক দিয়ে কেচে মারা হয়েছে মারিয়াকে।
আপনার চোখের সামনে?
হ্যাঁ। হাত-পা বেঁধে নেয়া হয়েছিল আমার। গত চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তিন তিনবার খুন করবার চেষ্টা করেছে সে আমাকেও। এই লোকই। মৃত্যুপথযাত্রী নেশাখোরের হাতে তুলে দেয় নিজের বোতল–ধু মজা দেখবার জন্যে।
এ-ও কি সম্ভব! কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না ডি গোল্ড রানার কথাগুলো। সে কি করে হবে না, না, এটা হতেই পারে না। ডক্টর রজার? একজন ধর্মযাজক…
ওটা ছদ্মবেশ। আপনাদের জানা নেই, কিন্তু ইন্টারপোলের ফাইলে ওর নাম লেখা আছে। অবশ্য নিকোলাস রজার হিসেবে নয়, ওর আসল নামে। ওর আসল নাম হচ্ছে লুকা বার্যিনি। ঈস্টার্ন সিবোর্ড কোসা নোস্ট্রার প্রাক্তন সভ্য। কিন্তু মাফিয়া হজম করতে পারেনি ওকে। ব্যবসার প্রয়োজনে ছাড়া খুন করে না মাফিয়া, এমন কি ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ পর্যন্ত নেয় না যদি সেইসাথে কিছু টাকার প্রশ্ন জড়িত না থাকে। কিন্তু বার্ষিনি হত্যা করে শুধু হত্যারই খাতিরে। মার্ডার ফর মার্ডারস সেক। আলটিমেটাম পেয়ে ইউনাইটেড স্টেটস ছেড়ে চলে আসতে হয় ওকে–মাফিয়ার হাতে খুন হয়ে। যাওয়া থেকে বাচবার এছাড়া আর কোন পথ ছিল না।
এসব কী বলছেন আপনি! বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে নিকোলাস রজার রানার মুখের দিকে। এসব অত্যন্ত অন্যায়, মানহানিকর কথাবার্তা। যার তার নামে যা খুশি তাই বলতে পারেন না আপনি, মেজর মাসুদ রানা। মুখে যাই বলুক, রানার কথা শুনে আরও ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে ওর। চেহারাটা। একজন নিরীহ…
চুপ করুন! ধমকে উঠল রানা। আপনার হাতের ছাপ থেকে নিয়ে। সিফালিক ইনডেক্স পর্যন্ত রয়েছে আমাদের কাছে। ধোকাবাজি করে কোন লাভ হবে না। বোকার ভান করে কিছুতেই বাঁচতে পারবেন না আপনি, লুকা বার্যিনি। আপনার অতীত জানা আছে আমাদের, বর্তমান সম্পর্কে এবার কিছুটা আলোকপাত করা যাক। সাইকোপ্যাথ হিসেবে আপনার বিরুদ্ধে যে চাজ আনা হবে সেটাই প্রধান নয়–আপনার বিরুদ্ধে আসল চার্জ হচ্ছে হেরোইন ব্যবসা পরিচালনা। বড় চমৎকার সিসটেম তৈরি করে নিয়েছিলেন যাহোক। একেবারে ফুলফ। কারও কিছু টের পাওয়ার উপায় নেই। মাল নিয়ে আসছে কোস্টার, জানা কথা, অথচ সার্চ করে পাওয়া যায় না কিছুই। বন্দরে ভিড়বার আগেই বিশেষ একটা বয়ার পাশে সমুদ্রের নিচে ডুবিয়ে দেয়া হচ্ছে সীল করা স্টীলের বাক্স। সেই রাতেই একটা বার্জ রওনা হচ্ছে। হাইলারের উদ্দেশে-যাবার পথে রশিতে রড বেঁধে তুলে আনছে বয়া, নোঙর, তারপর সেই স্টীলের বাক্স, হাইলারের একটা কটেজ ইন্ডাস্ট্রির ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বাক্সটা, সেখান থেকে বিশেষভাবে চিহ্ন দেয়া। পুতুলের মধ্যে করে চালান হয়ে আসছে এই ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীর ওয়েরহাউজে। কি? ঠিক বলিনি? ভুরু নাচাল রানা ভলেনহেভেনের উদ্দেশে।
হাঁ হয়ে রয়েছে মোটা লোকটার মুখ, কোন জবাব দিতে পারল না, বারকয়েক ঢোক গিলল কেবল। কিন্তু ছটফট করে উঠল নিকোলাস রজার। বলল, প্রিপস্টারাস! পাগলের প্রলাপ। একটা কথাও প্রমাণ করতে পারবেন না, আপনি, মেজর রানা।
প্রমাণ তো আপনিই দিচ্ছেন, রেভারেন্ড। আমার নাম জানলেন কি করে। আপনি? বলুন? ওকে চুপ করে থাকতে দেখে নির্দয় হাসি হাসল রানা। আসলে কোন প্রমাণের দরকার নেই আমার। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজহাতে খুন করতে যাচ্ছি আমি আপনাকে.। যাই হোক, কি যেন বলছিলাম? কর্নেলের দিকে ফিরল রানা। অত্যন্ত নিখুঁত একটা চক্র তৈরি করে নিয়েছিল লুকা বার্ষিনি। ব্যারেল অর্গানবাদক বুড়ো থেকে নিয়ে স্ট্রিপ-টীজ ডালার পর্যন্ত, হোটেলের ওয়েটার থেকে নাইট-ক্লাবের হোস্টেস পর্যন্ত দলের। প্রত্যেকে উঠছে বসছে ওর আঙুলের ইশারায়। টু শব্দ বেরোচ্ছে না কারও মুখ থেকে, জানা আছে সবার-বেরোলেই মৃত্যু অবধারিত। ইতিমধ্যে সবারই জানা হয়ে গেছে এই সৌম্যদর্শন বৃদ্ধের আসল রূপ। নিষ্ঠার সাথে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে সবাই, কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ প্রাণের ভয়ে।
কিভাবে? প্রশ্ন করল ডি গোল্ড। কি কাজ করছে ওরা?
সোজা ভাষায় বলতে গেলে পুশিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং। হেরোইনের কিছুটা অংশ রয়ে যাচ্ছে এখানে বিদেশে রপ্তানির জন্যে, কিছু চলে যাচ্ছে। অ্যামস্টার্ডামের বিভিন্ন দোকানে। কিছু ডিস্ট্রিবিউট করা হচ্ছে ভ্যানে করে ভভেল পার্ক এবং অন্যান্য জায়গায়। লুকা বার্যিনির মহিলা ফোর্স বিভিন্ন। দোকান থেকে বিশেষ চিহ্ন দেয়া পুতুল কিনে সাপ্লাই দিচ্ছে ছোট ছোট স্টোর, হোটেল আর নাইট-ক্লাবে, ভ্যান থেকে সাপ্লাই দেয়া হচ্ছে ব্যারেল অর্গানবাদকদের–ওরা আবার বিক্রি করছে রিটেলে।
কিন্তু এইরকম আনন্দমেলা চলছে, আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছি না কেন? জানতে চাইল ডি গোল্ড।
সে প্রসঙ্গে আসছি আমি খানিক বাদেই। ডিস্ট্রিবিউশনের ব্যাপারটা শেষ। হয়নি এখনও। বাইবেলের মধ্যে করে চালান দেয়া হচ্ছে হেরোইনের বেশ একটা মোটা অংশ। হাইলার থেকে অর্ধেকের বেশি হেরোইন চলে আসছে। হিউগানট সোসাইটির চার্চে, ফাপা বাইবেলের মধ্যে ভরা হচ্ছে মাল। বার্যিনির মহিলা ফোর্সের এক অংশ অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা। বাইবেল হাতে যায় তারা চার্চে। এই মহাপুরুষের কাছ থেকে দুই একটা কঠিন পংক্তির তাৎপর্য বুঝে নিতে, যখন বেরিয়ে আসে, তখন তাদের হাতে অন্য বাইবেল। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে পাঠানো হয় এইসব বাইবেল বিনামূল্যে। এ ছাড়াও রয়েছে ঘড়ির পেণ্ডুলাম। ক্যাসটিল লিভেনে যে ঘড়ির কারখানা রয়েছে তার দোলকগুলো তৈরি এবং সাপ্লাই করা হয় চার্চের বেজমেন্টের এক আধুনিক ফ্যাক্টরি থেকে–ভেতরে পোরা থাকে হেরোইন। ঠিক বলেছি না, বার্যিনি? নাকি কিছু বাদ পড়ে গেছে বর্ণনায়? ২
বারকয়েক মুখ খুলল এবং বন্ধ করল নিকোলাস রজার, কোন আওয়াজ বেরোল না মুখ থেকে।
পিস্তলটা তুলল রানা। সোজা চাইল রজারের চোখের দিকে।
এইবার। রেভারেন্ড বার্যিনি। তুমি প্রস্তুত?
মাথার উপর তুলে ধরা হাত দুটো কাঁপতে শুরু করল রজারের, দুই চোখে দেখা দিল মৃত্যুভীতি। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে, এক্ষুণি টিপে দেবে রানা পিস্তলের ট্রিগার।
সাবধান, মাসুদ রানা! হঠাৎ চিৎকার করে উঠল কর্নেল ডি গোল্ড। নিজের হাতে আইন তুলে নিতে দেয়া হবে না আপনাকে।
ওকে বাঁচিয়ে রাখবার কোন অর্থই হয় না কর্নেল, ওকালতি করছে যেন। রানা। দিই শেষ করে। আপনারা বলতে পারবেন, পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেছে লুকা বার্যিনি।
আর একটু তুলল রানা পিস্তলটা। ঠিকরে বেরিয়ে আসবে বলে মনে হলো নিকোলাস রজারের চোখ। ঠিক এমনি সময়ে দিনের তৃতীয় কণ্ঠস্বর শুনতে পেল রানা পেছন থেকে।
পিস্তল ফেলে দিন, মেজর রানা।
হাত থেকে ছেড়ে দিল রানা পিস্তলটা। খটাং করে মেঝের উপর পড়ল সেটা। ধীরে ধীরে ঘুরল সে পেছন দিকে। একটা র্যাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ইরিন মাগেনথেলার। ডানহাতে ধরা রয়েছে একটা লুগার। সোজা রানার বুকের দিকে তাক করা।
.
১০.
ইরিন! ভুরুজোড়া মাঝ-কপালে উঠে গেল কর্নেল ডি গোল্ডের। ব্যাপারটা কি ঘটে গেল কিছুতেই মাথার মধ্যে ঢুকছে না তার। হায় খোদা! তুমি কোত্থেকে…তোমার হাতে… হঠাৎ থেমে গিয়ে ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল কনেল। খটাং করে কব্জির উপর এসে পড়েছে একটা পিস্তলের বাট। হাত থেকে খসে। পড়ে গেল রিভলভার। হতবুদ্ধি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে আক্রমণকারীর মুখের দিকে। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার! পিস্তলটা সোজা ধরা রয়েছে ডি গোল্ডের বুকের দিকে। মাথার উপর থেকে হাত নামিয়ে আনছে। ভলেনহোভেন আর নিকোলাস রজার। মুহূর্তের মধ্যে একটা পিস্তল বেরিয়ে এল ভলেনহোভেনের হাতে। বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলল কর্নেল, এসব…এসব কি হচ্ছে, মাগেন…
শাট আপ, ধমকে উঠল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। বসে পড়ো মেঝের ওপর। দ্রুতহাতে সার্চ করল সে রানাকে, অস্ত্র না পেয়ে বলল, তুমিও, মাসুদ রানা। এমনভাবে বসবে যেন হাতদুটো সর্বক্ষণ দেখতে পাই আমি।
বসে পড়ল রানা আর ডি গোল্ড। পদ্মাসনের মত পা ভাজ করে বসল রানা, বাহু দুটো রাখল উরুর উপর, ডানহাতটা আলতোভাবে ঝুলছে পায়ের। গোড়ালির কাছে। মেঝের উপর থেকে রানার পিস্তল এবং কর্নেলের রিভলভারটা তুলে নিজের কোমরে গুজল মাগেনথেলার।
এত দেরি করলে কেন, ইরিন?অনুযোগের কণ্ঠে প্রশ্ন করল রেভারেন্ড রজার। ধকলটা পুরোপুরি সামলে নিতে পারেনি এখনও। আর একটু দেরি করলেই খতম হয়ে যেতে পারতাম, তা জানো? একটা রুমাল বের করে ঘাম মুছল কপালের।
উহ! দারুণ জমেছিল মজাটা! প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করেছি আমি। সোহানার দিকে চাইল, তারপর চাইল ভলেনহোভেনের দিকে। যে পর্যন্ত এসে স্থগিত রাখতে হলো বাধা পড়ায়, আবার সেখান থেকেই শুরু করা যাক, কি বলেন?
চকচকে চোখে সোহানার উপর একবার লোলুপ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে লজ্জার ভান করল ভলেনহোভেন, সবার সামনে? তুমি আড়ালে লুকিয়ে দেখতে চেয়েছিলে, সে ছিল এক কথা…আর বার্যিনি আমার বাল্যবন্ধু, ওর সামনে কোন লজ্জা নেই, কিন্তু এত লোকের সামনে কাপড় ছাড়তে…
ব্যাপারটা সবাই বুঝতে পারছে না দেখে একটু ব্যাখ্যা করল রেভারেন্ড রজার, ওরফে লুকা বার্যিনি।
ভলেনহোভেনটা একটু কামুক প্রকৃতির। আমিও ভেবে দেখলাম, মেরে যখন ফেলাই হবে, তার আগে যদি মিস সোহানা চৌধুরীকে একটু আনন্দ দেয়া যায়, আমার তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না তাই রাজি হয়ে গেলাম। মিস শেরম্যানকেও এইরকম আনন্দ দান করা হয়েছিল গলায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়ার আগে। একেই বা বঞ্চিত করি কেন? দশটা মিনিট সময় পেলেই কাজ সেরে বেরিয়ে পড়তাম আমরা এখান থেকে–কিন্তু বাধ সাধল এই হারামী লোকটা। রানার দিকে চেয়ে নিষ্ঠুর একটুকরো হাসি ফুটে উঠল রজারের মুখে। হ্যালো, মাসুদ রানা?. এবার আপনি পরমেশ্বরের ডাক শুনতে পাচ্ছেন?
এসব…এসব কি দেখছি, কি শুনছি, মেজর রানা? বিহ্বল দৃষ্টিতে চাইল কর্নেল রানার মুখের দিকে।
এই প্রসঙ্গে আসছিলাম আমি, বলল রানা। একটু পরেই আমি আপনাকে জানাতাম কেন গত কয়েক বছর ধরে এদের কার্যকলাপের কিছুই টের পাননি আপনি। কেন হাজার চেষ্টা করেও এক কদমও এগোতে পারছে না অ্যামস্টার্ডাম-পুলিস। তার একমাত্র কারণ, আপনার পরম বিশ্বস্ত সহকারী, এখানকার নারকোটিক ব্যুরোর চীফ, শ্রীমান মাগেনথেলার বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখেছেন যেন কারও পক্ষে এক পা-ও অগ্রসর হওয়া সম্ভব না হয়। শুনলে অবাক হবেন আপনার প্রিয় ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারই হচ্ছেন নাটের আসল গুরু, বাকি সবাই তার কুইন, বিশপ, নাইট, পন।
মাগেনথেলার? চোখের সামনে প্রমাণ পেয়েও কথাটা বিশ্বাস করে। উঠতে পারছে না কর্নেল পুরোপুরি। একজন সিনিয়র পুলিস অফিসার যে। এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, বিশেষ করে মাগেনথেলারের মত। একজন কঠোর নীতিপরায়ণ লোক যে এই কাজ করতে পারে, সেটা কর্নেলের। ধারণার এতই বাইরে ছিল যে সব দেখার পরেও ভেতরে বিশ্বাস আসতে চাইছে না। এটা কি করে সম্ভব। এটা হতেই পারে না!
অথচ দেখা যাচ্ছে হয়ে বসে আছে, মৃদু হাসল রানা। আপনার বুকের দিকে ধরা ওই যে জিনিসটা দেখতে পাচ্ছেন ওর হাতে-ওটাকে আবার ললিপপ বলে মনে হচ্ছে না তো আপনার? আপনার রিভলভারটার দিকে হাত বাড়িয়েই দেখুন না একবার, ওই ললিপপটা যদি গর্জে না ওঠে তো আমার নাম নেই। কোন সন্দেহ নেই, কর্নেল, আপনার প্রিয় সহকর্মীই হচ্ছে গোটা ড্রাগ রিঙের পেছনের ক্রিয়েটিভ ব্রেন। সে-ই বস। লুকা বার্ষিনি হচ্ছে ওরই নিযুক্ত সাইকোপ্যাথিক মনস্টার। সম্প্রতি এই দানবকে বশে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে, তাই না মাগেনথেলার? দাবার বোর্ডের বিশপ আর রাণী–বিগড়ে গেছে দুটো গুটিই। তাই না?
ঠিক। নিকোলাস রজারের দিকে চাইল মাগেনথেলার। এই এক চাহনিতেই বোঝা গেল কপালে দুঃখ আছে লোকটার। কঠোর দৃষ্টির সামনে। মুখ শুকিয়ে গেল ওর। ভলেনহোভেনের সাথে সাথে সে-ও কেন পিস্তলটা বের করেনি সেজন্যে খুব সম্ভব দুঃখ হচ্ছে ওর এখন। কিন্তু এখন আর পিস্তল বের করা যায় না। স্পষ্ট বোঝা গেল, অসহায় বোধ করছে লোকটা। এ ইরিনের দিকে চাইল রানা। রানার চোখের দৃষ্টিতে স্নেহের বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটাও নেই।
তোমার দাবার বোর্ডের রাণীএকেবারেই বিগড়ে গেছে, মাগেনথেলার। তোমার উপপত্নী ঘুমোচ্ছে এখন আরেকজনের সাথে। সুযোগ পেলেই..
উপপত্নী! এবার সম্পূর্ণভাবে ভারসাম্য হারাল কর্নেল ডি গোল্ড,। ইরিনকে তুমি বলছ মাগেনথেলারের কেপ্ট?
যাকে বলছি সে তো রাগ করছে না কথাটা শুনে। কেন? তার কারণ। কথাটা স্বীকৃত সত্য। কিন্তু ইদানীং রেভারেন্ড রজারের সাথে ভাবটা তার অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে উঠেছে। আত্মার মিল পেয়েছে ও সাইকোপ্যাথ বার্যিনির মধ্যে। চমৎকার ঘোল খাইয়েছে ইরিন আপনাকে, কর্নেল। পুরোটা ব্যাপারই প্ল্যান করা। নেশার কবলে পতিত অসহায় বালিকা ছিল না ও কোনদিনই। হাতের দাগগুলোও নকল। ওর মানসিক বয়স আট বছরের শিশুর সমান নয়, খোদ শয়তানের সমান। এবং মানুষটা শয়তানের দ্বিগুণ পাজি।
কী জানি, বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল ডি গোল্ড। কিছুই। ঢুকছে না আর আমার মাথায়।
তিনটে ব্যাপারে মাগেনথেলারের প্রয়োজন ছিল ইরিনকে, সহজ করে। বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল রান্যা। ওই রকম একটা মেয়ে যার, নিমেষে সে সন্দেহাতীত চরিত্রে পরিণত হয় সবার কাছে। মেয়েটার অবস্থার কথা জানলে যে-কেউ ধরে নেবে যে ড্রাগ রিঙ ধ্বংস করে দেয়ার জন্যে একান্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে মাগেনথেলার, যেমন করে তোক প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় সে যারা ওর মেয়ের সর্বনাশ করছে তাদের ওপর। দ্বিতীয়ত, নিকোলাস রজারের সাথে মাগেনথেলারের যোগাযোগের একমাত্র সূত্র ছিল ইরিন। রজারের সাথে মাগেনথেলারের দেখা করবার তো প্রশ্নই ওঠে না, টেলিফোন বা চিঠিতেও যোগাযোগ করা নিরাপদ মনে করেনি ওরা–ইরিনের মাধ্যমে চলত আদানপ্রদান। কিন্তু সবচেয়ে জরুরী যে কাজটা করত ইরিন, সেটা হচ্ছে ড্রাগ সাপ্লাই। হাইলারে গিয়ে খালি পুতুল বদলে হেরোইন ভরা পুতুল নিয়ে আসত, ভভেল পার্কের ভ্যানে সে পুতুল বদলে নিত একই চেহারার আরেকটা পুতুলের সাথে। এইভাবে অপূর্ব এক পুতুল খেলা দেখাচ্ছিল সে গত তিন বছর ধরে। কিন্তু ছোট্ট একটা ভুল করেছিল এই আশ্চর্য প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী। চোখে বেলেডোনা ড্রপ দিয়ে অ্যাডিক্টের মত চকচকে অথচ অন্তঃসারশূন্য ভাবটা আনবার চেষ্টা করেছিল সে! তখন বুঝিনি, কিন্তু পরে। আরও দুই-একজন নেশাখোরের চোখ দেখে টের পেয়ে গেলাম আমি ওর অভিনয়। টের পেলাম, ও আসলে পালিতা কন্যা নয়, মাগেনথেলারের। প্রেমিকা। বুঝলাম আপন ভাই ও স্ত্রীকে হত্যা করেছিল মাগেনথেলার এই, ইরিনকে পাওয়ার জন্যেই।
কবে কবে টের পেলেন যে আমি এর সাথে জড়িত? জিজ্ঞেস করল মাগেনথেলার। ভুরুজোড়া কৌতুকের ভঙ্গিতে সামান্য কুঁচকে আছে।
অনেক দেরিতে, বলল রানা। সবই বুঝি আমি, কিন্তু একটু দেরিতে। পুলিস কার দেয়া হয়েছিল আমাকে আপনারই বুদ্ধিতে। মনে আছে? তারপর। থেকে আপনারা আর আমার ওপর নজর রাখবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। কারণ, গাড়িতে লুকিয়ে রাখা ট্রান্সমিটারের সাহায্যে আমার গতিবিধি নখদর্পণে রেখেছিলেন আপনি সর্বক্ষণ। কিন্তু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলাম তখনি…
ঠিক এমনি সময়ে ঝট করে রানার দিকে ফিরল কর্নেল ডি গোল্ড। বোকার মত প্রশ্ন করে বসল, তাহলে? যদি আগে থেকেই সব জানবেন, তাহলে এইরকম অরক্ষিত অবস্থায় এখানে…
প্রমাদ গুণতে যাচ্ছিল রানা, এমনি সময়ে ওকে উদ্ধার করল ইরিন। হঠাৎ অসহিষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, ভ্যাজর ভ্যাজর একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? সোজা চাইল মাগেনথেলারের চোখের দিকে। এই দুটোকে খতম করে। দিলেই তো চুকে যায়। আর বাজে সময় নষ্ট না করে
দাঁড়াও! ইরিনকে পিস্তলটা একটু উপরে তুলতে দেখে বাম হাত তুলে থামবার ইঙ্গিত করল মাগেনথেলার। রানার দিকে এগিয়ে এল এক পা। বিস্মিত হলো রানাঃলোকটার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখে। জরুরী পয়েন্টটা ধরতে। পেরেছে সে ঠিকই। জিজ্ঞেস করল, সেই জন্যেই তুমি আমার সামনে। উচ্চারণ করেছিলে কোড ওয়ার্ড মাদাগাস্কারের কথা। তুমি জানতে যে ওই কোড ওয়ার্ড ব্যবহার করে সোহানা চৌধুরীকে ওর হোটেল কামরা থেকে বের করে আনতে পারি আমরা। তার মানে…
পরিস্থিতিটা হাতের মুঠো থেকে ফস্কে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই বাধা দিল রানা মাগেনথেলারকে।
অত মানে আর এখন খুঁজে কি লাভ? বেকায়দা মত আটকে ফেলেছ। আমাদের। তোমার প্রেয়সী অস্থির হয়ে উঠেছে গুলি করবার জন্যে। খুন যখন। করতেই হবে, ওকে অনুমতি দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
ঠিক বলেছে লোকটা, ইরিনের মুখে দেঁতো হাসি।
দাঁড়াও। এক সেকেন্ড। ভাবতে দাও আমাকে। তুমি জানো যে আমিই ড্রাগরিঙের চীফ, তারপরেও এমন অরক্ষিত অবস্থায় ঢুকেছ কেন তুমি এই মৃত্যুফাঁদে? সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে মাগেনথেলার রানার চোখের দিকে। বাঁচবার পথ না থাকলে…
ঠিক এই কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম আমি তোমার সুন্দরী প্রেমিকাকে, জোর করে হাসি টেনে আনল রানা ওর ক্ষতবিক্ষত মুখে। ফিরল ইরিনের দিকে। গুলি করো, আপত্তি নেই, তবে এর মধ্যে খানিকটা কিন্তু রয়েছে। আমাকে আগে মারবে, না.আর কাউকে–সেটা বুঝে নেয়া দরকার প্রথমে। এই ঘরে আমার চেয়েও তোমাদের বড় শত্রু আরও কেউ থাকতে পারে–দেখো তো চেনা যায় কিনা?
অবাক দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে চাইল ইরিন। শুধু ইরিনই নয়, ঘরের প্রত্যেকেই তাই করল। রানা ছাড়া। সোজা সোহানার চোখের দিকে চাইল রানা। মাথাটা সামান্য একটু ঝুঁকল ওর ইরিনের দিকে। সহজ ভঙ্গিতে ইরিনের দিকে চাইল একবার সোহানা। রানা বুঝল, ওর বক্তব্য পরিষ্কার। অনুধাবন করতে অসুবিধে হয়নি সোহানার।
এইবার শেষ অস্ত্র ছাড়ল রানা।
গর্দভের দল! বলল সে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে। সহজ কথাটা বুঝতে এত দেরি হচ্ছে তোমাদের! ভেবে দেখার দরকার মনে করছ না একবার, এত খবর আমি পেলাম কোত্থেকে? খবর দেয়া হয়েছে আমাকে। তোমাদেরই একজন। দিয়েছে আমাকে সব খবর। এমন একজন, যার কলজে কাপিয়ে দিয়েছি আমি ভয় দেখিয়ে। সাধারণ ক্ষমার লোভে যে ভাসিয়ে দিয়েছে তোমাদের বানের জলে। এখনও আঁচ করতে পারছ না? আরে…ভলেনহোভেন!
তাজ্জব হয়ে চাইল সবাই ভলেনহোভেনের দিকে। মুহূর্তের জন্যে বোকা বনে গেছে যেন সবাই, বুঝে উঠতে পারল না রানার এই অদ্ভুত কথা বিশ্বাস। করা যায় কি যায় না। ভলেনহোভেনের বিস্ফারিত দুই চোখে অবিশ্বাস। হাঁ হয়ে গেছে মুখটা। সেই হাঁ অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করল লোকটা রানার গুলি। খেয়ে। ছোট্ট লিলিপুট পিস্তলটা বেরিয়ে এসেছে রানার হাতে-কড়াৎ করে। মৃত্যু বর্ষণ করেছে। সশস্ত্র ব্যক্তিকে শুধু জখম করবার ঝুঁকি নিতে পারেনি। রানা, শেষ করতে হয়েছে এক গুলিতেই। লাশটা হুড়মুড় করে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়বার আগেই খপ করে ইরিনের পিস্তল ধরা হাতটা ধরে ফেলল। সোহানা, ধরেই জুডোর কায়দায় হিপ হো করল। ছিটকে গিয়ে দরজার বাইরে লোডিং প্ল্যাটফর্মের উপর আছড়ে পড়ল ইরিন, পতন ঠেকাবার চেষ্টা করল কিছু একটা আকড়ে ধরে, কিন্তু কিছুইবাঁধলনা হাতে। রেলিং নেই লোডিং প্ল্যাটফর্মে। মর্মভেদী, তীক্ষ্ণ চিৎকার দ্রুত মিলিয়ে গেল নিচের দিকে।
এদিকে কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ডকে মাগেনখেলারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখতে পেল রানা আড়চোখে। মাগেনথেলারের হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে সে। সফল হলে কি হলো না দেখবার সময় নেই, লুকা। বার্ষিনিকে পিস্তল বের করবার জন্যে পকেটে হাত দিতে দেখেই ডাইভ দিল। সে সামনের দিকে। পিস্তল বের করে ফেলেছে সে ঠিকই, কিন্তু সেটা ব্যবহার। করবার আগেই চেয়ার উল্টে পড়ে গেল পেছন দিকে। যখন উঠে দাঁড়াল, পিস্তল অদৃশ্য হয়ে গেছে ওর হাত থেকে। গলা দিয়ে অদ্ভুত একটা ঘড়ঘড়। আওয়াজ বেরোচ্ছে পেছন থেকে রানার বাম হাতটা গলা পেঁচিয়ে ধরায়, দুই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে।
উঠে দাঁড়িয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেল রানা। দরদর করে রক্ত ঝরছে কর্নেল ডি গোল্ডের কপাল থেকে। পরমূহুর্তে বুঝতে পারল জখমটা মারাত্মক কিছু না। ঠিক রানার মতই পেছন থেকে ডি গোল্ডের গলা পেচিয়ে ধরে রয়েছে। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। দুজনের পিস্তল তাক করে ধরা রয়েছে দুজনের দিকে, কিন্তু গুলি করলে মারা পড়বে নিজেরই লোক।
তুমি জানো, মাসুদ রানা, লুকা বার্যিনির মৃত্যুতে কিছুই এসে যাবে না আমার! হাঁপাতে হাপাতে বলল মাগেনথেলার, এবং আমি জানি, তোমার জেদের জন্যে মারা পড়ুক কর্নেল, সেটা তুমি কিছুতেই চাইতে পারো না। আমি চলে যাচ্ছি। যদি বাধাদাও, মারা পড়বে ডি গোল্ড। বুঝতে পেরেছ?
বুঝতে পারছি, বাধা না দিলেই বরং মারা পড়বে কর্নেল।
আমি কথা দিচ্ছি, মেজর রানা। অনুনয়ের মত শোনাল মাগেনথেলারের কণ্ঠ। আমাকে যদি এখন থেকে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে দাও, গাড়িতে উঠেই ছেড়ে দেব আমি কর্নেলকে।
তোমাকে যদি বিশ্বাস করতাম, তবু তোমার কথায় রাজি হতাম না আমি।
এটা আমার জীবন-মরণ প্রশ্ন, মাসুদ রানা। খেপে উঠল মাগেনথেলার। বেপরোয়া আমি এখন। তুমি বুঝতে পারছ না…
বুঝতে আমি ঠিকই পারছি, মাগেনথেলার। আসলে তুমিই বোঝোনি কিছু। তোমাকে পালিয়ে যেতে দেয়ার জন্যে বাংলাদেশ থেকে এতদূর কষ্ট করে আসিনি আমি, হাদারাম! পালাবার সব পথ বন্ধ। এক পা নড়লেই গুলি খেয়ে মারা যাবে তুমি।
কি করে? কেঁপে গেল মাগেনথেলারের কণ্ঠ।
আরও একটা পিস্তল তাক করে ধরা রয়েছে তোমার দিকে। ওর চোখের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল রানা।
অসম্ভব! সোহানা চৌধুরীর কাছে পিস্তল, নেই।
কে বলল? হাসল রানা। ভয়ে তোমার বুদ্ধি ঘোলা হয়ে গেছে, মাগেনথেলার। অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল তোমার, আমি তোমাদের ফাঁদে ঢুকিনি, তুমিই ঢুকেছ আমাদের ফাঁদে। তুমি যে মাদাগাস্কার শব্দটার। সাহায্যে সোহানাকে ধরে আনবার ব্যবস্থা করবে সেটা জেনেই তোমার সামনে উচ্চারণ করেছিলাম আমি শব্দটা আজ সকালে। সোহানা যখন। এসেছে, প্রস্তুত হয়েই এসেছে। চেয়েই দেখো না, অদৃশ্য হয়ে গেছে ওর খোঁপাটা-তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল। চারফুট তফাত থেকে মিস হবে না ওর গুলি।
কথাটা বিশ্বাস করবে কি করবে না বুঝতে পারল না মাগেনথেলার কয়েক সেকেন্ড। তারপর ঘাড় ফিরিয়ে যখন দেখল, চারফুট নয়, ঠিক চার ইঞ্চি দূরে স্থির হয়ে রয়েছে ছোট্ট একটা লিলিপুট পিস্তলের মুখ। মুহূর্তে ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য হয়ে গেল মাগেনথেলারের চেহারাটা, নিবে গেল চোখের জ্যোতি।
কাজেই দয়া করে হাত থেকে পিস্তলটা ফেলে ছেড়ে দাও কর্নেলকে। এক ইঞ্চি নড়লেই গুলি খাবে কপালের পাশে।
হাত থেকে ছেড়ে দিল মাগেনথেলার পুলিস কোল্ট অটোমেটিকটা। এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে দিয়ে রানার পিস্তলের সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। কর্নেল, পকেট থেকে বের করল দুইজোড়া হ্যাঁন্ডকাফ। মাগেনথেলারের কোমর থেকে রানার পিস্তল আর নিজের রিভলভারটা বের করে নিয়ে রানার দিকে চাইল কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে।
আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না, মেজর মাসুদ রানা। শুধু একটা কথা জানতে চাই–সত্যিই কি আপনার চোখের সামনে হত্যা করা হয়েছিল আপনার সহকর্মীকে হেফর্ক দিয়ে? সত্যিই কি মারিয়া ডুক্লজকে..
সত্যি। দপ করে জ্বলে উঠল রানার দুচোখ। কিন্তু পলকের মধ্যেই সামলে নিল নিজেকে। শান্ত কণ্ঠে বলল, আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়া মিথ্যে কথা বলি না আমি।
সেক্ষেত্রে আমি মনে করি নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার আপনার আছে। লুকা বার্যিনি যদি পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা পড়ে, আমার আপত্তি নেই।
আমার আছে, বলল রানা। হত্যা করবার নেশা নেই আমার কর্নেল। আমি সাইকোপ্যাথ নই। বিচার দেখতে চাই আমি ওদের। খানিক আগে মিথ্যে হুমকি দিয়েছিলাম আমি, ভাব দেখিয়েছিলাম যেন এক্ষুণি গুলি করতে যাচ্ছি …
বুঝতে পেরেছি। আপনি চাইছিলেন, স্ব-মূর্তি ধারণ করুক মাগেনথেলার। ইরিন যে র্যাকের আড়ালে লুকিয়ে ছিল সেটা টের পেলেন কি করে?
টের পাইনি। আমি কেন সোহানাও বোধ হয় জানত না যে ওখানটায়। লুকিয়ে রয়েছে ইরিন তামাশা দেখবার জন্যে। যাই হোক, ভালই হয়েছে–নাটকের শেষ দৃশ্যে সব শিল্পীর উপস্থিতিতে চমৎকার জমে গেল। শেষটুকু।
রানার নির্দেশে বিশালবপু ভলেনহোভেনের দুইহাতে পরাল কর্নেল দুটো হ্যান্ডকাফের একটা কড়া। খালি কড়া দুটো পরিয়ে দেয়া হলো একটা লুকা বার্যিনির, অন্যটা মাগেনথেলারের একেকটা হাতে। নিরস্ত্র করা হয়েছে। দুজনকেই। দুজনে মিলে প্রাণপণ শক্তিতে টানাহেঁচড়া করলেও কয়েকফুটের বেশি নড়াতে পারবে না ওরা ভলেনহোভেনের বিপুল ধড়।
দ্রুতহাতে কাপড় পরে নিয়েছে সোহানা ইতিমধ্যে। তিনতলার প্রহরীটাকে একটা খুটির সাথে আচ্ছা করে কষে বেঁধে নেমে এল ওরা রাস্তায়। হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে ইরিনের লাশ। ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে। গেল ওরা ভ্যানের উদ্দেশে। গলির শেষ মাথায় পৌঁছে থামল রানা।
আমরা বরং এখান থেকেই বিদায় নিই, কর্নেল। আমাদের কাজ শেষ। বাকিটুকু আপনি একা পারবেন না?
বাকিটা কি রেখেছেন, বলুন? হাসল ডি গোল্ড। আমার কাজ তো শুধু ওয়েরলেসে হেডকোয়ার্টারে খবর দেয়া। আর সবই তো সেরে দিয়েছেন আপনি একাই। ঠিক আছে, যান। সকাল থেকে যে ধকল গিয়েছে আপনার উপর দিয়ে..
সকাল নয়, রাত দুটো থেকে। এখন কাহিল লাগছে খুব।
ঠিক আছে, বিশ্রাম করুন গিয়ে। আজ রাতের মধ্যেই যতগুলোকে পারি অ্যারেস্ট করে ফেলব। রানার কাঁধের উপর হাত রাখল কর্নেল। অলরাইট, ব্রেভ ইয়াংম্যান। কাল দেখা হবে আবার। গুড নাইট।
কর্নেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ড্যামের দিকে হাঁটতে শুরু করল ওরা। দুজন। দেড়শো গজ যেতে না যেতেই সাইরেনের শব্দ শুনতে পেল ওরা। প্রবলবেগে ছুটে আসছে কয়েকটা গাড়ি। সাঁই সাঁই করে ওদের পাশ কাটিয়ে ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীর দিকে ছুটে গেল ছয়-সাতটা ট্রাক। ট্রাক ভর্তি ঠাসাঠাসি করে দাঁড়ানো সশস্ত্র পুলিস।
পরস্পরের দিকে চেয়ে মৃদু হাসল রানা আর সোহানা। আবার হাঁটছে। বেশ কিছুদূর হাঁটবার পর সোহানা বলল, মারিয়ার জন্যে বড় কষ্ট লাগছে, রানা। কিছুতেই ভুলতে পারছি না ওকে।
এইজন্যেই আমাদের সার্ভিসে কারও সাথে মাখামাখি করতে বারণ করা হয়।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে রানার মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল সোহানা, তুমি এই বারণ মেনে চলো?
চেষ্টা করি।
তাই বুঝি এড়িয়ে চলো আমাকে?
চেষ্টা করি। কিন্তু পারি কই?
পারো না?
খানিক চুপ করে থেকে মাথা নাড়ল রানা।
না।