প্রতিশোধের ছোরা

প্রতিশোধের ছোরা

কতজনের জানা আছে যে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এক সুন্দরী বাঙালি তরুণীকে দেখবার জন্য দেশের রাজধানী দিল্লির হাইকোর্টের বাইরে ভিড় প্রায় উপচে পড়ত? নীল নয়না স্বপ্নসুন্দরী বাঙালিনী যে কাউকে ছুরি মেরে হত্যা করতে পারে, সেটা ভেবেই বিস্ময়ের তুঙ্গে পৌঁছে যেত মানুষ?

তখন নারী সবেমাত্র অবগুণ্ঠন খুলে বাইরের সমাজে বেরিয়ে আসছে, ধীরে ধীরে সমাজে মিশতে শুরু করেছে, ঘরে ঘরে কর্মরতার সংখ্যাটা তখনও নিতান্তই হাতে গোনা। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার আস্বাদ কেউ কেউ পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীই তখনও মনে মনে পরাধীনতার খাঁচায় বন্দি, অন্যায় অবিচার সহ্য করে মানিয়ে নেওয়াতেই বিশ্বাসী।

তেমন অবস্থায় যদি ভদ্রপরিবারের একজন উচ্চশিক্ষিতা সুন্দরী বাঙালি কন্যা প্রকাশ্য রাজপথে ছুরি মেরে খুন করে, তাও আবার এক চরিত্রহীন প্রতারককে শাস্তি দিতে, লোকসমাজে তাই নিয়ে কেমন আলোড়ন উঠতে পারে, তো বোধ হয় সহজেই অনুমেয়।

সত্তরের দশকের দিল্লি। নভেম্বরের মাসের শেষের দিক। অন্যবারের মতো এবারেও দিল্লিতে এর মধ্যেই বেশ জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়তে শুরু করে দিয়েছে। সন্ধ্যে বেলাতেও উঁচু বাড়িগুলোর মাথায় জমাট বেঁধে রয়েছে কুয়াশা।

বিজয় সেহগাল নামে এক শিক্ষিত সুদর্শন যুবক তার নববিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে মহারানিবাগের একটা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল। দু—জনে বেরিয়েছিল সপ্তাহান্তের টুকিটাকি কেনাকাটাতে; কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ বিজয়ের গাড়িটা গেল খারাপ হয়ে। বাধ্য হয়ে গাড়িটাকে একটা গ্যারাজে রেখে সে এখন স্ত্রীকে নিয়ে বাস ধরে বাড়ি ফিরবে।

মনটা তার খুঁতখুঁত করছে। সদ্য গাড়িটা কিনল, এর মধ্যেই হঠাৎ কী হল? বিজয় দেড় মাসের পুরোনো স্ত্রীর দিকে তাকাল, ”গাড়িটার কী হল বলো তো? দিব্যি চলছিল, হঠাৎ একটা বিশ্রী শব্দ হয়ে বন্ধ হয়ে গেল! এই এতগুলো কড়কড়ে টাকা দিয়ে কিনলাম!”

”কী জানি, আমিও তো তাই ভাবছি! এখন এই সিজন চেঞ্জের সময় এইভাবে বাসে ফিরতে হবে, আমার আবার ঠান্ডা না লেগে যায়। কাল ভোরেই প্রোগ্রাম আছে, তখনও তো বাসেই যেতে হবে।” বিজয়ের স্ত্রী সুরিন্দর ভ্রূ কুঁচকে বলল।

সুরিন্দর বিজয়ের থেকে ফুটদুয়েক দূরেই দাঁড়িয়েছিল। ইদানীং গজল গায়িকা হিসেবে তার বেশ নামডাক হয়েছে। মাত্র বছরদেড়েক আগে সে আকাশবাণীতে ঢুকেছিল অস্থায়ী শিল্পী হিসেবে; আর এর মধ্যেই তার সুললিত কণ্ঠ আর অনবদ্য সুরমূর্ছনায় শ্রোতারা ওকে বেগম আখতারের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেছেন।

সুরিন্দরের স্বপ্ন, ও একদিন ভারতের একনম্বর গায়িকা হবে। তার জন্য প্রয়োজন প্রতিভা আর কাছের মানুষদের উৎসাহ। প্রতিভা যে ওর আছেই, তা অনস্বীকার্য; আর বিজয়ের মতো সর্বক্ষণ প্রেরণা জোগানো স্বামী পাওয়াও খুব ভাগ্যের ব্যাপার।

মহারানিবাগ এখন রীতিমতো জমজমাট এলাকা হলেও পঞ্চাশ—ষাট বছর আগে অতটা হইহুল্লোড় ছিল না। তা ছাড়া এই বাসস্ট্যান্ডটা একটা ছোটো রাস্তার ধারে। এই রুট দিয়ে খুব কম বাস যায়। কোনো অফিসকাছারিও কাছেপিঠে নেই। কাজেই মানুষজন এই সন্ধ্যে বেলায় খুব একটা নেই।

বাসস্ট্যান্ডে তো শুধু ওরা দু—জন। সামনের ল্যাম্পপোস্টে লাগানো রয়েছে তিনটে বালব, তার মধ্যে জ্বলছে মোটে একটা। দূরে একটা পান—বিড়ির গুমটি টিমটিম করে জ্বলছে।

সামনের রাস্তাও আলো—আঁধারি।

বিজয় একটা সিগারেট ধরিয়ে ডানপাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীকে বলতে যাচ্ছিল, ”স্কার্ফটা ভালো করে গলায় জড়িয়ে নাও। কাল সকালে ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসব চিন্তা কোরো না।” কিন্তু বিস্ময়ে আতঙ্কে তার কথা মাঝপথেই অসম্পূর্ণ হয়ে রয়ে গেল।

একটা তীক্ষ্ন শব্দ। সুরিন্দর হঠৎ একটা তীব্র আর্তনাদ করে মাটিতে বসে পড়ল, তারপর এলিয়ে পড়ল একদিকে।

বিজয় সবিস্ময়ে ওই আবছা আলোতেও দেখতে পেল, সুরিন্দরের বুকের সামনের কাপড়টা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আকস্মিক আঘাতে ওর কথা প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে, শুধু চোখদুটো যেন বেদনায় ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

ঘটনার আকস্মিকতায় বিজয় প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেও পরমুহূর্তে তার চেতনা ফিরে আসে, তারপর সারা শরীরের সমস্ত শক্তিকে প্রাণপণে একত্রিত করে চিৎকার করতে থাকে, ”কে কোথায় আছেন, শিগগির এদিকে আসুন! আ—আমার স্ত্রী …!”

সদ্য ধরানো সিগারেটটা একপাশে ফেলে দিয়ে সুরিন্দরকে পাঁজাকোলা করে তোলার চেষ্টা করতে করতে বিজয় দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ওই অন্ধকারেও ঠিক সেই মুহূর্তে দেখতে পেল একটা নীল রঙের সালোয়ার কামিজ বিদ্যুৎবেগে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে পেছনের স্কুল বাড়িটার দেওয়াল টপকে।

বিজয়ের মুখ দিয়ে অজান্তেই একটা শব্দ অস্ফুটে বেরিয়ে এল, ”শেফালী!”

এর পেছনের হৃদয়বিদারক কাহিনিপট জানতে হলে পিছিয়ে যাওয়া যাক ঠিক এক বছর আগে।

ঘটনাস্থল অপরিবর্তিত, রাজধানী দিল্লি। সত্তরের দশক।

তখনও কম্পিউটারের দাপটে সরকারি বেসরকারি—দপ্তরগুলোয় এমন ব্যাপকভাবে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়নি। ক্রি—রি—রিং ক্রি—রি—রিং শব্দে টেলিফোনে, আকাশবাণী অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো খবর শুনে আর ছুটির দিনে খবরের কাগজের খেলার পাতায় কিংবা রেডিয়োতে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, গাভাসকারের বিধ্বংসী ব্যাটিং—এর কমেন্ট্রি শুনে দিন কাটে মধ্যবিত্ত ভারতীয়ের।

বিজয় সেহগাল নামে এক ঝকঝকে যুবক এমনই এক সময়ের ছেলে। দিল্লির করোলবাগে তার নিজস্ব বাড়ি। তার বাবা মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। বিধবা মা আর একমাত্র বোন ধ্যানকে নিয়ে বিজয়ের ছোটো স্বচ্ছল পরিবার।

তাঁদের পরিবার বেশ রুচিশীল। শৃঙ্খলতার গণ্ডি না অতিক্রম করেও যথেষ্ট আধুনিক। বিজয়ের মা নিজে উচ্চঙ্গ সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। ছেলে—মেয়ের মধ্যেও তিনি গানের সুর—তাল—ছন্দের সূক্ষ্মবোধ জারিত করে দিয়েছেন।

বিজয়ের বোন ধ্যান সদ্য ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করেছে। সে খেলাধূলোয় ভারি পটু, বিভিন্ন ধরনের অ্যাথলেটিকস থেকে শুরু করে প্রায় সবধরনের খেলায় সে ছোটো থেকে ওস্তাদ। বিশেষ করে ব্যাডমিন্টনে তো সে নামকরা খেলোয়াড়; স্কুল লেভেল, কলেজ লেভেল এমনকী নিজের ইউনিভার্সিটিকেও সে প্রতিনিধিত্ব করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বেশ কয়েক বার। একইসঙ্গে বন্ধুমহলে সে দারুণ জনপ্রিয়। তার অগণিত বন্ধুবান্ধবী প্রায়ই বাড়িতে আসে। তারা একসাথে গল্পগুজব, গানবাজনা করে, কখনো—সখনো দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে দিল্লির বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থান পরিদর্শনে।

বিজয় আধুনিকমনস্ক হলেও এতটা নয়। এই নিয়ে সে মাঝেমধ্যে মৃদু আপত্তি তোলে।

বিজয়ের মা বোঝান, ”যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয় বাবু! তোর বোনের প্রতিটা বন্ধুকে আমি চিনি, সবাই ভালো পরিবারের ভদ্র ছেলে—মেয়ে। এই বয়সে একটু আনন্দ করবে না তো কবে করবে? সবসময় অত দাদাগিরি দেখাবি না তো, তাতে হিতে বিপরীত হবে!”

বিজয় কিছু বলে না। সে সম্প্রতি অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর হেড অফিসে অফিস সুপারিনটেডেন্টের চাকরি পেয়েছে। পড়াশুনো শেষের পর থেকেই সে সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, বেসরকারি চাকরি তার কোনোকালেই পছন্দ নয়। সরকারি দশটা—পাঁচটার নিরুপদ্রব চাকরি সে চায়, যাতে সারাজীবনটা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারে। আর এই অল্পবয়সেই তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে।

আকাশবাণী ভবনে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর অনুষ্ঠানে তখন অংশ নিতে আসেন দেশের তাবড় তাবড় শিল্পী, নাট্যব্যক্তিত্বরা। তাঁরা কে কখন আসবেন, কার অনুষ্ঠান কতক্ষণের হবে, কার কী কী বাদ্যযন্ত্র বা আনুষঙ্গিক সামগ্রীর প্রয়োজন—সেইসব রেকর্ড রাখা হল বিজয়ের কাজ। আকাশবাণী ভবন চব্বিশঘণ্টা খোলা থাকত, ফলে বিজয়ের চাকরিও শিফটের ডিউটি। কোনো সপ্তাহ তাকে ‘ডে’ শিফট করতে হত, কোনো সপ্তাহে আবার ‘নাইট’। এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহে একদিন করে ‘অফ’। সেই দিনটা সে কিছুটা বাড়িতে, কিছুটা বন্ধু দীনেশের সঙ্গে গল্পগুজবে, আড্ডায় কাটায়।

বিজয়ের বন্ধু দীনেশ একটা ছোটো ফার্মে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়েছে। সারাদিন সে ফার্মে মুখ বুজে কাজ করে, তারপর সন্ধ্যের পর কখনো সিনেমা, কখনো খেলার মাঠ করে ফুর্তিতে কাটায়। মাঝে মধ্যে সে আবার বিজয়ের জন্য বিচিত্র সব কাজের খবর নিয়ে আসে। কখনো কোনো বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর মডেল হওয়ার অ্যাসাইনমেন্ট, কখনো আবার বোম্বাই সিনেমাপাড়ায় কাজের খোঁজ নিয়ে।

বিজয় হেসে উড়িয়ে দেয়, ”ধুস, ওসব আমার দ্বারা হবে না। এই নির্ঝঞ্ঝাট চাকরি নিয়ে বেশ ভালো আছি।”

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, বিজয় সেহগাল ছিল অপরূপ এক সুপুরুষ। তাকে একঝক দেখলে মনে হত, গ্রিক কোনো দেবতা বুঝি ভুল করে জন্ম নিয়ে ফেলেছেন দিল্লির করোলবাগের এই মধ্যবিত্ত পরিবারে। তথাকথিত সৌন্দর্যের মাপকাঠি মেনে তার গায়ের রং ফ্যাটফেটে ফর্সা নয়; বরং গমরঙা চামড়ার ওপর পুরুষালি কঠোরতা পুরনো দিনের হলিউডি নায়ককে মনে পড়ায়। তার টিকালো নাক, চওড়া কাঁধ থেকে শুরু করে বলিষ্ঠ ঋজু গড়ন, গোটাটাই তার ব্যক্তিত্বকে আলাদা একটা মাত্রাদান করে।

বলাই বাহুল্য, এমন সুপুরুষ যুবকের প্রতি পরিচিত মেয়েরা ভীষণভাবে আকৃষ্ট। ধ্যানের প্রচুর বান্ধবী ওদের বাড়িতে আসে শুধুমাত্র ওর দাদা বিজয়কে দেখার জন্যই। এ ছাড়াও আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী মহলে সুদর্শন, সরকারি চাকুরে বিজয় হল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

বিজয় নিজেও তার এই বিশেষ কোয়ালিটি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। মেয়েমহলে তাকে নিয়ে যে প্রায়ই আড়ালে আবডালে আলোচনা হয়, ধ্যান বান্ধবীদের নিয়ে গল্পগুজবের ফাঁকে সে হঠাৎ করে বাড়ি ঢুকলে যে অতিথিদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন খুশির আমেজ বয়ে যায়, সেটাকে সে বেশ উপভোগ করে। মেয়েদের ব্যাপারে সে যে উদাসীন, এমন অপবাদ অতি বড় শত্রুও তাকে দিতে পারবে না; বরং কলেজ—জীবন থেকেই সমান্তরালভাবে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে সে বেশ পোক্ত।

সেদিনটা ছিল রবিবার। বিজয় কোথায় যেন বেরিয়েছিল, দীনেশকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখে শেফালী এসেছে। বসার ঘরে বসে হালুয়া—জাতীয় কিছু একটা খাচ্ছে আর হেসে হেসে ধ্যানের সঙ্গে গল্প করছে। বিজয়ের মাও সেই আড্ডায় যোগ দিয়েছেন।

বিজয়কে দেখতে পেয়েই ওর মা বললেন, ”ওই তো, বাবু এসে গেছে। এই দ্যাখ, শেফালী এসেছে। তোরা বরং গল্প কর সবাই মিলে, আমি কফি করে আনি।”

দীনেশ এই প্রস্তাবে বেশ খুশি হয়ে এগোতে যাচ্ছিল, কিন্তু বিজয় ওর উৎসাহে জল ঢেলে দিল, ”না না, আমরা ভেতরের ঘরে যাচ্ছি। দীনেশের সঙ্গে আমার কিছু জরুরি আলোচনা আছে।”

বিজয়ের ঘরে গিয়ে দীনেশ মনঃক্ষুণ্ণ স্বরে বলল, ”কী ব্যাপার বল তো, তোর বোনের অন্য বান্ধবীরা এলে তুই বেশ হেসে হেসে গল্প করিস। এদিকে এই ফর্সা মেয়েটা এলেই কেমন গুটিয়ে যাস।”

বিজয় বিরক্ত মুখে সিগারেট ধরাল, ”বিজয় সেহগাল মেয়েদের সামনে কখনো গুটিয়ে যায় না ভাই। শেফালীর ব্যাপারটা অন্য।” ফস করে একটা ধোঁয়া ছাড়ল ও, ”মা চান শেফালীকে বাড়ির বউ করে আনতে।”

”আরে এ তো দারুণ প্রস্তাব!” দীনেশ উল্লসিত হয়ে উঠল, ”দিনক্ষণ সবঠিক হয়ে গেছে?”

”ধুর!” বিজয় দীনেশের এই উচ্ছ্বাসে আরও বিরক্ত হয়ে উঠল, ”আমার একটুও ইচ্ছে নেই ওকে বিয়ে করার।”

”কেন? মেয়েটা তো দারুণ সুন্দরী ভাই! কী নাম বললি, শেফালী? পাঞ্জাবি?” দীনেশ বলল।

”না। বাঙালি। তবে ওরা অনেক বছর দিল্লিতে আছে। আর তুই যে সুন্দরী বলছিস …।” বিজয় ঠোঁট কামড়াল, ”ওরকম সৌন্দর্য আমার ঠিক পছন্দ নয়।”

বিজয়ের কথাটা খুব একটা ভিত্তিহীন নয়। শেফালী চৌধুরীর চেহারাটা এমন, হাজার লোকের ভিড়েও ওকে আলাদা করে চোখে পড়বে। বেশ লম্বা, টকটকে ফর্সা গায়ের রং, চোখের মণি বিদেশিদের মতো নীল, দোহারা গড়ন, স্মার্ট। বিজয়ের বোন ধ্যানের মতো শেফালীও খেলাধুলোয় ওস্তাদ, ভলিবল আর বাস্কেটবলে সে দারুণ পটু। তাই তার চেহারার মধ্যে মেয়েলি কমনীয়তার থেকেও একটা তেজি পুরুষালী ভাব ফুটে ওঠে, যেটা বিজয়ের মতো অনেকেই হয়তো পছন্দ করবে না।

শেফালী দিল্লিরই একটা নামজাদা স্কুলের খেলাধুলোর শিক্ষিকা। এ ছাড়া তার প্রচুর গুণ। সে দারুণ ভালো সেলাই করতে পারে, রান্নাবান্নাতেও পটু, সঙ্গে গৃহসজ্জার জন্যও খেয়ালবশত ট্রেনিং নিয়েছে। এখন কী শখ হয়েছে, টাইপ—রাইটিং শিখছে। এত গুণের অধিকারিণী হয়েও সে অহংকারী তো নয়ই, বরং বেশ মিশুকে। ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা চুলে সাইকেল চালিয়ে সে যখন ধ্যানের বাড়ি গল্প করতে আসে, তাকে একঝলক দেখলে বিদেশিনিই মনে হয়। তার বাড়ি দিল্লিতে হলেও নিজের খুশিমতো জীবনযাপনের জন্য সে স্কুলের শিক্ষিকাদের হোস্টেলে থাকে।

প্রথম প্রথম বিজয় বিরক্ত হত, ”ওফ মা, তোমাকে তো বলেছি। ওইরকম ষণ্ডাগুন্ডা মেয়ে আমার ঠিক পছন্দ নয়। আমি সংসারী মেয়ে চাই।”

”ষণ্ডাগুন্ডা কাকে বলছিস?” বিজয়ের মা অবাক, ”শেফালী সংসারী নয়? আগের সপ্তাহে যে অত সুন্দর পনিরের কোর্মাটা খেলি, ওটা তো ও—ই বানিয়ে এনেছিল। তারপর ধ্যানকে জন্মদিনে কত সুন্দর একটা সোয়েটার দিল, ওটাও তো ওর বোনা। আর মুখ—চোখ কী সুন্দর কাটা কাটা, তুই কিনা বলছিস গুন্ডা?”

”সে হলেও, এই তো ধ্যান বলছিল, সে—দিন দুজনে কোথা থেকে ফিরছিল, কয়েকটা বাজে ছেলে নাকি টিপ্পনি কেটেছে, শেফালী রাস্তায় সবার সামনে একটা ঘুরিয়ে এমন রদ্দা মেরেছে ছেলেটার কানে, তার প্রায় যায় যায় অবস্থা।” বিজয় মেয়ের দিকে তাকাল, ”মেয়ে হয়ে এতটা বাড়াবাড়ি আমার মোটেও পছন্দ নয়। কেন, পাত্তা না—দিয়ে চলে আসলেই হত। এত বড়ো মেয়ে হয়ে ছেলেদের মতো চুল, ছেলেদের সাইকেল চালানো এসব কী!”

বিজয়ের মা এবার গুম হয়ে যান, ”তা বাপু দিনকাল যা পড়েছে, মেয়েদের মধ্যে একটু তেজি ভাব থাকা ভালো। যা সব অসভ্য ছেলেছোকরা আজকালকার, কেউ কেউ মাঝেমধ্যে একটু উচিৎশিক্ষা না—দিলে তো মাথায় উঠে বসবে। আর তুই তো দেখছি ভারি প্রাচীন পন্থী?”

বিজয় মাকে বোঝাতে পারে না। শেফালীর চোখ ঝলসানো উগ্র রূপের চেয়েও সে চায় শান্তশিষ্ট কমনীয় কোনো মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেতে। নারীসঙ্গ সে প্রচুর পেয়েছে, এখন থিতু হওয়ার বয়েসে এসে অনুভব করছে আধুনিকতার চেয়ে ঘরোয়া স্ত্রীই তার পছন্দ।

দীনেশ শুনে রাগ করে, ”ব্যাটা নিজে সাত ঘাটের জল খেয়েছ, আর বউ চাইছ ধোয়া তুলসীপাতা!”

ধ্যানও চায় তার সবচেয়ে প্রিয় এই বান্ধবীটি দাদার স্ত্রী হয়ে আসুক। সে বলে, ”দ্যাখ দাদা, শেফালী যা চাকরি করে, তাতে ওর চুল বড়ো রাখাটা অসুবিধা। আমি তোকে বলছি, বিয়ের পর আমি শেফালীকে কিছুতেই আর চুল কাটতে দেব না। তখন দেখবি কত স্নিগ্ধ লাগবে ওকে। আর তা ছাড়া …” ও রসিকতা করত, ”আমাদের মধ্যে এত ভাব, তোকে কোনোদিনও বউ—বোন—শাশুড়ির ঝগড়া নিয়ে চাপই খেতে হবে না। আর তোদের দু—জনের মধ্যে ঝগড়া হলে তো আমি আর মা ওকেই সাপোর্ট করব। হা হা!”

এইভাবেই আনন্দে, গল্পে—গুজবে ওদের দিন কাটছিল।

মানুষের মন। কখন কার কথায় কোন দিকে গতিমুখ পরিবর্তন করে তা বলা মুশকিল। বিজয়েরও তাই হল। মা বোনের কথায়, শেফালীর নিত্য আনাগোনায় ও ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হল শেফালীর প্রতি। শেফালী তো আগে থেকেই বিজয়কে পছন্দ করত, এরপর শুরু হল ওদের উদ্দাম প্রেম।

বিজয়ের অফিসে প্রায়দিনই স্কুল শেষে শেফালী চলে আসত, তখন বিজয়ের একটা স্কুটার ছিল। সেই স্কুটারে চেপে দু—জনে চলে যেত দূরের কোনো ফাঁকা জায়গায়, কখনো—বা পাড়ি দিত পুরোনো দিল্লির ইতিহাস মাখানো অলিতে গলিতে; এভাবেই দু—জনের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল।

মাঝে মধ্যে শেফালী বিজয়দের বাড়ি থেকেও যেত, অনেক রাত পর্যন্ত দু—জনে গল্প করত, তারপর শেফালী গিয়ে ধ্যানের পাশে শুয়ে পড়ত।

কিন্তু এরপরেই ঘটনার গতিপথ অন্যদিকে মোচড় দিতে শুরু করল, যার ভয়ঙ্কর পরিণতি পূর্বে বিবৃত মর্মান্তিক খুনটি।

আগেই বলেছি, বিজয় এমনিতে ভদ্র—শান্ত হলেও তার মেয়েদের প্রতি একটু বেশি মাত্রায় দুর্বলতা ছিল। মায়ের কথায় সাময়িক সে শেফালীকে নিয়ে থিতু হওয়ার কথা ভাবলেও কুকুরের লেজ যেমন কোনোদিনও সোজা হয় না, সেই ফর্মূলাতেই এক নারীতে বেশিদিন তার মন টিকলো না।

সম্প্রতি আকাশবাণী দিল্লির চ্যানেলে নতুন একটা গলা শোনা যাচ্ছিল, সেই গলার অধিকারিণী সুরিন্দর নামে পাঞ্জাবি মেয়েটি অচিরেই বিজয়কে মুগ্ধ করে তুলল। প্রথম প্রথম বিজয় অত গুরুত্ব দেয়নি, আর পাঁচজন সাধারণ উঠতি শিল্পীর মতোই সুরিন্দর ওর কাছে আসত তার প্রোগ্রামের সময়সূচী বা অন্যান্য বিশদ জানতে।

মেয়েটা বেশ সুন্দরী, কিন্তু খুব শান্তশিষ্ট, ধীর স্থির। এত আস্তে কথা বলে প্রায় শোনাই যায় না। বিজয় এমনিতেই একটু পুরোনোপন্থী ছিল,নিজের অজান্তেই সে সুরিন্দরকে পছন্দ করতে শুরু করল।

বাঙালি মেয়ে হয়েও শেফালীর চেহারার গড়ন দেখে অনেকে যেমন তাকে পাঞ্জাবি ভেবে ভুল করে, তেমনই সুরিন্দর পাঞ্জাবি হলেও তার নমনীয় স্নিগ্ধ সৌন্দর্য দেখে সবাই ভাবে ও বুঝি বাঙালি।

একদিন আকাশবাণীর নতুন শিল্পীদের নিয়ে এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সুরিন্দরের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত শুনে বিজয় অবাক হয়ে গেল, ”তুমি এত ভালো বাংলা কী করে জানলে সুরিন্দর?”

”ভালো বাংলা কোথায়?” সুরিন্দর স্মিত মুখে বলল, ”বাংলা আমি জানিই না। গানটা হিন্দিতে লিখে নিয়ে শিখেছি।”

”তুমি খুব সুন্দর গান গাও।” বিজয় মন্ত্রমুগ্ধ চোখে সুরিন্দরের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর হঠাৎ মনে হল, এমন লজ্জাশীলা, নম্র মেয়েই সে যেন মনে মনে খুঁজছিল। শেফালী মেয়েটা এমনিতে ভালো, মনটাও খারাপ নয়; কিন্তু একটু বেশিই যেন উদ্ধত, নারীসুলভ কোমলতা ওর মধ্যে অনুপস্থিত।

বিজয় বেশ কিছুদিন চরম দোটানায় রইল। কী করা উচিত ওর? একদিকে শেফালীকে সে পুরোপুরি মন থেকে দূরও করতে পারছে না, মেয়েটার আর যাই হোক, বিজয়ের প্রতি ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। ছোটোখাটো নানা জিনিসের মাধ্যমে সে বিজয়কে খুশি করার চেষ্টা করে চলে। ধ্যান তো বটেই, মা’ও ওকে পছন্দ করেন। অন্যদিকে সুরিন্দরও যেন ওকে টানছে প্রায় চুম্বকের মতো।

হতাশ গলায় বিজয় একদিন দীনেশকে বলল, ”আচ্ছা, এখন আর একসাথে দুটো বিয়ে করা যায় না, বল!”

দীনেশ বিজয়ের এই কথায় চমকে উঠল। ওরা দু—জনে যমুনা ঘাটে বসেছিল। সামনেই যমুনা নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। ”মানে! এ আবার কী কথা! দুটো বিয়ে করবি মানে? শেফালী ছাড়া আর কাকে বিয়ে করার কথা ভাবছিস তুই!”

বিজয় আর কিছু না—বলে চুপ করে গেল।

আস্তে আস্তে যত দিন যেতে লাগল, বিজয় আর সুরিন্দরের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে শুরু করল। অফিসের পুরো সময়টাই বলতে গেলে দু—জনে একসঙ্গে কাটায়, টিফিন, আসা—যাওয়া সব একইসাথে করে। সপ্তাহান্তের দিনগুলো বিজয় শেফালীর সঙ্গে বেরোয় বটে, কিন্তু শেফালী বুঝতে পারে বিজয়ের সেই অনুভূতি যেন আর নেই। শেফালীর সঙ্গে বেরিয়েও ওর মন যেন অন্য কোথায় পড়ে থাকে।

শেফালী মনে মনে কষ্ট পায়, কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। অন্য কোনো মেয়ে হলে হয়তো ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করত, কিন্তু ওর সেগুলো ধাতে নেই। ও নিজের মনেই কষ্ট পায়।

শেফালীর কষ্টটা আরও বেড়ে গেল বুধবার। সেদিন ওর স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাওয়ায় ও গিয়েছিল পার্লামেন্ট স্ট্রিটে বিজয়ের অফিসে। বিকেল প্রায় হয় হয়, বিজয়ের কাজ হয়ে গেলেই দু—জনে বেরিয়ে পড়বে—এটাই ছিল ওর ইচ্ছে।

কিন্তু ও স্পষ্ট বুঝতে পারল বিজয় যেন ওকে দেখে খুশি হয়নি।

”কী হল? অবাক হচ্ছ কেন? শেফালী তবু হাসি হাসি মুখে বিজয়ের উলটোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে বলেছিল।

”না না অবাক হব কেন!” বিজয় মুহূর্তের মধ্যে মুখে হাসি টেনে এনেছিল, ”বলো কী খাবে? কফি না ঠান্ডা কিছু?”

”কিছুই খাব না।” শেফালী বলল, ”তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করো তো! এক জায়গায় যাব।”

”কোথায়?” বিজয় প্রাণপণ চেষ্টা করেও বিরক্তি লুকোতে পারল না। এখন ঘড়িতে সওয়া পাঁচটা। ছ—টার শোতে ওর আর সুরিন্দরের সিনেমার টিকিট কাটা আছে। ওকে দশ মিনিটের মধ্যে বেরোতেই হবে। সুরিন্দর এমনিতে শান্ত, কিন্তু রেগে গেলে চুপ হয়ে যায়। আর ওর ওই নীরবতাই বিজয়ের অপরাধবোধ আরও বাড়িয়ে দেয়।

”একটা ভালো ডিজাইন পেয়েছি। ভাবছি ক—টা চুড়িদার বানাব। তুমি চলো, আমাকে রং পছন্দ করে দেবে।” শেফালী বলল।

বিজয় ছটফটিয়ে উঠে বলল, ”কিন্তু শেফালী, এখন তো আমি কিছুতেই যেতে পারব না। আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন ভদ্রলোক আছেন, তাঁর সঙ্গে আমাকে একবার রামকৃষ্ণপুরম যেতে হবে একটা কাজে।” ও বুঝতে পারছিল নিজের অজান্তেই বিরক্তির চিহ্নগুলো ওর মুখে আঁকা হয়ে যাচ্ছে, ”আর তা ছাড়া তোমার যা রং, তাতে যাই পরো না কেন, দুর্দান্ত লাগবে।” বলে কাষ্ঠ হাসতে চেষ্টা করল।

শেফালী সেদিনের কথাটা মনে করলে যেন স্পষ্ট বুঝতে পারে, বিজয় ওকে এড়িয়ে যাচ্ছিল, মনে মনে চাইছিল কখন শেফালী উঠে চলে যাবে।

কিন্তু কেন? আর আগে কত গুরুত্বপূর্ণ সব কাজও বিজয় বাতিল করে ওর সাথে বেরিয়েছে। আর এখন এমন ব্যবহার?

শেফালী এমনিতে চাপা মেয়ে, ধ্যান ছাড়া তার তেমন কোনো কাছের বান্ধবী নেই। আর এই ব্যাপারটা এমনই যে ধ্যানের সঙ্গেও আলোচনা করা যাবে না। ও স্কুল বাদে বাকি সময়টা হোস্টেলে নিজের ঘরে শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

পঞ্চাশ বছর আগে মোবাইল তো দূর, ঘরে ঘরে টেলিফোনও ছিল না। সেই বুধবারের পর দু—সপ্তাহ হয়ে গেল বিজয়ের সঙ্গে কোনো দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। অথচ আগে তিন—চারদিন হলেই স্কুল থেকে বেরনোর সময় দেখত বাইরের গেটের পাশে হাসিমুখে অপেক্ষা করছে বিজয়।

সত্যি! মানুষ কত বদলে যায়! কখনো কারণে, কখনো—বা অকারণে। বিজয়েরও এহেন পরিবর্তনের কারণ শীঘ্রই শেফালী জানতে পারল।

এক শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে শেফালীর খুব মন কেমন করছিল, হঠাৎ মনে হল, শুক্রবার তো বিজয়ের অফ ডে, ধ্যানের সঙ্গে গল্প করার ছুতো করে গিয়ে এখন বিজয়কে চমকে দিলে কেমন হয়?

যেমন ভাবা তেমন কাজ। শেফালী জলখাবার খেয়ে নিয়েই বেরিয়ে পড়ল বিজয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বেচারি তখন জানেও না যে ‘অফ’ ডে থাকার সুবাদে সেদিন সকাল থেকে সুরিন্দরকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে বিজয়। মার শেফালীকে যতই পছন্দ হোক, সুরিন্দরের মতো সুন্দরী সুগায়িকা পাঞ্জাবি মেয়েকে দেখলে মায়ের মন গলবেই, সেটা ও ভালো মতো জানত। সেই মতো সকাল হতে—না—হতেই ট্যাক্সি করে সুরিন্দরকে ও বাড়ি নিয়ে এল।

আগের দিনই বিজয় মাকে বলে রেখেছিল, ”মা, কাল একজন নতুন আর্টিস্টকে খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করেছি। অল্প দিনেই খুব নাম করেছে। সকালে নিয়ে আসব, গানবাজনা হবে, তারপর বিকেলে চা খেয়ে চলে যাবে।”

মা সংগীতপিপাসু হওয়ায় আগেও ও এরকম গায়ক বা কোনো যন্ত্রশিল্পীকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছে। মা সেইমতো বলেছিলেন, ”ভালো করেছিস। অনেক দিন বাড়িতে জলসা হয় না। কোথায় বাড়ি এই ছেলেটার?”

বিজয় একটা গলাখাঁকারি দিয়েছিল, ”ইয়ে, ছেলে নয়, মেয়ে। এত ভালো গান করে, এখনই লোকে ওকে বেগম আখতার বলছে।”

মার অভিজ্ঞ চোখ, বিজয়ের মুখের অভিব্যক্তি দেখে চুপ করে গিয়েছিলেন। কিছু পরে বলেছিলেন, ”শেফালীকেও আসতে বলতে পারতিস তাহলে। ও—ও শুনত!”

বিজয় একটু ইতস্তত করে মাথা নেড়েছিল, ”ওর তো গানবাজনায় তেমন আগ্রহ নেই, পরে কোনোদিন না—হয় …!”

শেফালী যখন ওর সাইকেল নিয়ে বিজয়ের বাড়ি ঢুকল, তখন ওদের বাড়িতে সত্যিই জলসার পরিবেশ। সুরিন্দর গজল শুরু করেছে, বিজয় তবলা বাজিয়ে সংগত করছে, ওদিকে বিজয়ের মা হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন। ধ্যান মন দিয়ে শুনছে।

শেফালী দেখে হকচকিয়ে গেল। বিজয়ের চোখে—মুখেও যেন একটা বিব্রত ভাব ফুটে উঠল।

ধ্যান এর মধ্যে উঠে এসেছে, ”খুব ভালো হয়েছে তুই এসেছিস। এই দ্যাখ—না, দাদা সুরিন্দরদিদিকে নিয়ে এসেছে, এখন রেডিয়োতে গজল গায়, খুব নাম হয়েছে শুনিসনি? আজ সারাদিন দিদি আমাদের গান শোনাবে। মা আজ বিরিয়ানি রান্না করছে। তুই কিন্তু খেয়ে যাবি!”

শেফালীর ততক্ষণে মাথায় গনগন করে উত্তাপের আগুন চড়ছে। আজ ও বুঝতে পারছে বিজয়ের ওর প্রতি উদাসীনতার কারণ! এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক? ওর হঠাৎ মনে পড়ল, দিন কয়েক আগে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ওর স্কুলের একজন বয়স্ক কলিগ কল্পনাজি ওকে বলেছিলেন, ”শেফালী, সুন্দর পুরুষদের থেকে দূরে থাকবি, ওরা কিন্তু চিরকাল মেয়েদের বিশ্বাস ভাঙে।”

কল্পনাজি বিজয়কে ভালো মতো চেনেন, তিনি কি তার মানে আগেই কোনোদিন বিজয় আর এই মেয়েটাকে দেখতে পেয়েছিলেন কোথাও?

বিজয়ের মা বললেন, ”দ্যাখ তো মা, বিরিয়ানিটা টেস্ট করে কেমন হয়েছে?”

শেফালী অনেক কষ্টে নিজের মাথা ঠান্ডা করল, ”না মাসিমা, আজ আপনাদের বাড়িতে গেস্ট এসেছে, আমি পরে আসব।”

”ওমা পরে আসবি কী?” ধ্যান ওর হাত চেপে ধরল, ”তুই না—খেয়ে যাবি না, মা এমনিই তোর কথা বলছিলেন সকাল থেকে …!”

শেফালী কিছুতেই শুনল না। ও দুর্বলচিত্তের মেয়ে নয়, একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তার নড়চড় হয় না। ধ্যান আরও কিছুক্ষণ ঝুলোঝুলি করল, কিন্তু ও গম্ভীরমুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। এই গোটা সময়টায় ও লক্ষ করল বিজয় একবারও উঠে ওর কাছে পর্যন্ত এল না, মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা।

হোস্টেলে নিজের ঘরে গিয়ে জীবনে যেটা করেনি, সেটাই করে ফেলল শেফালী। হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। এত ভালোবেসে ও এই প্রতিদান পেল? বিজয় ওকে এইভাবে ঠকাতে পারল?

পরেরদিন শেফালীর স্কুলে বিজয় ফোন করল, ”তুমি তো জানো মা গানবাজনা ভালোবাসেন, তাই সুরিন্দরকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। ইয়ে … আজ বিকেলে প্রগতি ময়দানের মেলায় যাবে?”

শেফালী বিজয়ের কথার কোনো উত্তর না—দিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখল। বিজয় কি ওকে সস্তার মেয়ে ভেবেছে? একদিকে ও সুরিন্দরের সঙ্গে প্রেম করবে, অন্যদিকে শেফালীকেও নাচাবে? ওর কোনো সম্মান নেই?

শেফালীর ওই ফোন নামিয়ে রাখাই ছিল দু—জনের মধ্যে আজকের ভাষায় অফিশিয়াল ব্রেক আপ। তারপর শেফালীও আর কোনো যোগাযোগ করেনি, বিজয়ও আর শেফালীকে মানানোর চেষ্টা করেনি। বিজয় ভাবল, একদিকে ভালোই হয়েছে, দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার চেয়ে শেফালী নিজেই যখন সরে গেছে। ও এবার নির্দ্ধিধায় সুরিন্দরের সঙ্গে ঘোরাফেরা শুরু করল।

ধীরে ধীরে বিজয় সেহগাল হয়ে উঠতে লাগল উঠতি গায়িকা সুরিন্দর সাহনির প্রেমিক কাম ম্যানেজার। সুরিন্দরকে সমস্ত প্রোগ্রাম, ফাংশনে দিয়ে আসা, নিয়ে আসা, সব ভার ওর ওপর। শুধু তাই নয়, সুরিন্দরকে কোনো ক্লাব বা অফিস গান গাওয়াতে চাইলে তাদের প্রথমে যোগাযোগ করতে হয় অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর বিজয় সেহগালের সঙ্গে। তিনিই যে সুরিন্দর ম্যাডামের সব প্রোগ্রাম ঠিক করেন।

ইতিমধ্যে ধ্যানের বিয়ে হয়ে গেল। নিমন্ত্রণ করতে ধ্যান গিয়েছিল প্রিয়তমা বান্ধবীর হোস্টেলে, কিন্তু শেফালী তাকে একরকম এড়িয়েই গেল।

ধ্যান খুব আঘাত পেল, কিন্তু বন্ধুকে দোষ দিতে পারল না। ওর নিজের দাদা যেটা করেছে, সেটার পর শেফালীর এই প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক। ও নিজে হলেও সেটাই করত। ওর শুধু কষ্ট হচ্ছিল এত ভাল একটা বন্ধু ওর হারিয়ে গেল।

একটা ব্যাপার বিজয় বা ধ্যান দু—জনেই ভুল বুঝেছিল যে শেফালী আঘাত পেয়ে দূরে সরে গেছে।

ভুল। শেফালী কোথাও সরে যায়নি। প্রতিশোধপরায়ণা নারী আহত বাঘের চেয়েও সাংঘাতিক। তীক্ষ্নদৃষ্টিতে ও নজর রাখত বিজয় আর সুরিন্দর কোথায় যাচ্ছে, ওদের সামনে না এলেও আড়াল থেকে লক্ষ করত সব কিছু। আগে সে মাসে এক—দুবার নিজের বাড়ি যেত, ধীরে ধীরে তাও কমিয়ে দিল। প্রতারিত হওয়ার রাগ তার বোধবুদ্ধিকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। কোনোমতে স্কুলের সময়টুকু সে কাটায়, তারপরেই সে দাবার ঘুঁটি সাজায়—কীভাবে বিজয়কে শায়েস্তা করবে।

অবশেষে একদিন খবরের কাগজে এক কোথায় শেফালী দেখতে পেল বিজয় আর সুরিন্দরের বিবাহের নিমন্ত্রণ পত্র ছাপা হয়েছে। তখন সম্ভ্রান্ত পরিবারে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আনন্দানুষ্ঠান ঘোষণার চল ছিল। দেখে সে আর সহ্য করতে পারল না, তার খেলোয়াড়ি শরীরে রাগের আগুন জ্বলে উঠল।

পরদিন দুপুরে সে সটান হাজির হল বিজয়ের অফিসে। বিজয় ওকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেও সৌজন্য দেখাল, ”শেফালী! বসো। কেমন আছ?”

”বসতে আমি আসিনি বিজয়।” শেফালী ওর চোখে চোখ রাখল—কোনো ভণিতা না—করে বলল, ”তোমাদের বিয়ের খবর দেখলাম কাগজে।”

বিজয় পলকে চোখ নামিয়ে নিল, ”হ্যাঁ মানে …!”

”ওই বিয়ের অনুষ্ঠানটা তোমাকে ভাঙতে হবে বিজয়।” শেফালী ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল। এই ছ—সাত মাস সে অনেক ভেবে দেখেছে। বিজয় অন্য কারুর হয়ে যাবে, সেটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বেঁকাতেই হবে।

ও হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে সামনে এগিয়ে দিল, ”বিয়েটা ক্যানসেল না করলে এই কাগজটা তোমার ওই বেগম আখতার কিন্তু খুব শিগগিরই হাতে পাবে। ওর বাড়ির ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলেছি। পোস্ট করে দেব কালই।”

বিজয়ের কপালে এই শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল, ও কাঁপা গলায় বলল, ”ক—কী এটা?”

”মনে নেই আটমাস আগে যখন আমাকে নিয়ে ডা লালের ক্লিনিকে গিয়েছিলে? বলেছিলে তোমার আরও কিছুদিন সময় চাই? এটা সেই অ্যাবরশনের রিপোর্ট।” শেফালী একইরকম নির্বিকারভাবে বলে যেতে লাগল, ”তুমি কী ভেবেছ, আমাকে নিয়ে যা—খুশি করবে, আর আমি তোমাকে ছেড়ে দেব? আমি কি প্রস্টিটিউট?”

”এসব তুমি কী বলছ শেফালী? তুমি আমার সঙ্গে সেদিনের পর আর কোনো যোগাযোগ করলে না, ধ্যানের বিয়েতে এলে না … আর এখন হঠাৎ করে এসে …।” বিজয়ের ক্রমশ কথা হারিয়ে যাচ্ছিল।

”ওসব ছেঁদো কথায় আমাকে আর ভুলিও না মি সেহগাল। যোগাযোগ বন্ধ না করলে তুমি আরও কিছুদিন মহানন্দে দু—জনের সঙ্গেই প্রেমটা চালাতে, তাই না?” শেফালী উঠে দাঁড়াল, ”একটা কথা জেনে রেখো বিজয়, আমি তোমার ওই সুরিন্দরের মতো নেকুপুষু মেয়ে নই, আমি কিন্তু তোমাদের ছাড়ব না। সামনের সপ্তাহেই তোমাদের বিয়ে ক্যানসেল হয়েছে এই মর্মে বিজ্ঞাপন যেন আমি দেখতে পাই।”

শেফালী চলে যেতে বিজয় প্রথমে দিশেহারা হয়ে গেল, শেফালী তো পুরোপুরি ব্ল্যাকমেল করছে। ওর কি থানায় যাওয়া উচিত? কিন্তু থানায় গেলে তো সুরিন্দরের কাছে কিছুই গোপন থাকবে না। তখন কী করে মুখ দেখাবে ও?

বিজয় ছুটল ধ্যানের কাছে। ধ্যানের শ্বশুরবাড়ি দিল্লিরই হাউজ খাস নামে একটা জায়গায়। বিজয়ের মনে হল শেফালীকে ধ্যান যেরকম চেনে, ততটা কেউ চেনে না। কাজেই ধ্যান ভালো পরামর্শ দিতে পারবে।

ধ্যান প্রথমে শুনে কিছুক্ষণ নিজের বান্ধবীর প্রতিই সহানুভূতি প্রকাশ করল, তারপর বলল, ”আমার মনে হয় দাদা, তুই সুরিন্দরভাবিকে এখনই সব বলে দে। ভাবি তোকে ভালোবাসে, হয়তো সাময়িক রাগ করবে, কিন্তু তাতে বড়ো ক্ষতি কিছু হবে না।”

”কী বলব? পাগল নাকি!” বিজয় তোতলাচ্ছিল, ”সুরিন্দর সোজা সরল মেয়ে। এত বড়ো কথা লুকিয়েছি জেনে প্রচণ্ড আঘাত পাবে।” ”তাহলে বলবি এমনি হালকা প্রেমের সম্পর্ক ছিল।” ধ্যান বলল।

”কিন্তু, ওই রিপোর্টটা হাতে পেলে তারপর?” বিজয় আর ভাবতে পারছিল না।

ধ্যান একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে দাদার হাতের ওপর হাত রাখল, ”আমি শেফালীকে চিনি দাদা। ও ওরকম মেয়ে নয়। তোকে রাগের মাথায় ভয় দেখিয়েছে। ও কারুর ক্ষতি করবে না।”

ধ্যান কী একটা ব্যাপার ভুল বুঝেছিল যে, প্রবল প্রতিহিংসা মানুষের নৈতিক মূল্যবোধকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলে দেয়?

শেফালী রিপোর্টটা পাঠাল না, কিন্তু শ্যেন দৃষ্টিতে নজর রাখছিল। কিন্তু পরের সপ্তাহে বিয়ে ক্যানসেলের বিজ্ঞাপন তো বেরোলই না, বরং আরও বড়ো করে বিবাহবাসর, অনুষ্ঠানসূচী জানিয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হল।

শেফালী আবার গেল বিজয়ের অফিসে।

বিজয় প্রস্তুত হয়েই ছিল, বলল, ”শেফালী তুমি আমাকে ক্ষমা করো। যা হয়েছে সব ভুলে যাও।”

”ক্ষমার কোনো প্রশ্নই নেই।” শেফালী বলল, ”তোমাকে এই বিয়েটা ভেঙে আমাকে বিয়ে করতে হবে।”

”এটা তুমি কী বলছ শেফালী? এই অবস্থায় বিয়ে ভেঙে দিলে দুটো পরিবারেরই কতটা বেইজ্জতি হবে বুঝতে পারছ? তা ছাড়া সুরিন্দরের তো কোনো দোষ নেই! ও কতটা আঘাত পাবে বলো তো!” বিজয় বোঝাতে চেষ্টা করল।

”আমার কী দোষ ছিল?” শেফালী চোখ সরু করে বলল, ”আমি আঘাত পাইনি?”

”দ্যাখো শেফালী, সুরিন্দর এখন মোটামুটি জনপ্রিয় একজন শিল্পী, ওর এইভাবে বিয়ে ভেঙে যাওয়াটা লোকে অন্যভাবে নিতে পারে। শুধুশুধু ওর বদনাম হয়ে যাবে, তুমি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করো।” বিজয় কাকুতির স্বরে বলল।

শেফালী এবার মাথা নাড়ল, ”বুঝেছি। তুমি তাহলে কথা শুনবে না। তাহলে এটাও দেখে রাখো,” উঠে দাঁড়িয়ে ও হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা বেশ বড়ো ছুরি বের করল, ”তোমাদের কিন্তু আমি শেষ করে দেব।” কথাটা বলেই ও ছুরিটা ব্যাগে ভরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বিজয় হতভম্ব হয়ে বসে রইল।

অফিসছুটির পর বিজয় আবার ছুটল ধ্যানের কাছে, ধ্যান এবারেও বলল, ”অত ভয় পাস না। ও তোকে এমনি এমনি ভয় দেখাচ্ছে।”

এরপর আর তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল না। নির্দিষ্ট দিনেই ওদের বিয়েটা সাড়ম্বরে হয়ে গেল।

বিয়ের পর বিজয় আর সুরিন্দর কয়েক দিনের জন্য সিমলা কুলু মানালি ঘুরে এল। এর মধ্যেই বিজয়ের হঠাৎ অফিসে পদোন্নতি ঘটল। সেই আনন্দে বিজয় একটা চারচাকা গাড়িও কিনে ফেলল।

মাঝেমধ্যে যে ওর শেফালীকে একেবারেই মনে পড়ে না তা নয়। কিন্তু সেদিনের সেই ছুরি দেখিয়ে ভয় দেখানোর পর থেকে শেফালী যেন উবে গেছে।

একটা নিঃশ্বাস ফেলে ও ভাবে, ধ্যান ঠিকই বলেছিল। যতই তেজি হোক, শেফালী ভদ্রঘরের বাঙালি মেয়ে, ছোরা—টোরা কী করে চালাবে?

শেফালী কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও বিজয়কে ভোলেনি। প্রতিশোধের তীব্র আক্রোশে নিজেকে প্রতিনিয়ত আরও তাতিয়েছে—হয়ে উঠেছে আরও বেশি জিঘাংসাপ্রিয়।

তার ফলস্বরূপ পরিণতি সেই নভেম্বর মাসের বিকেল বেলা সুরিন্দরের বুকে ছোরা বসিয়ে দেওয়া।

ছোরার আঘাত এতটাই তীব্র ছিল যে সেটা বাঁ—স্তনের নীচ দিয়ে ঢুকে হৃদপিণ্ডের নীচের অংশ আর ফুসফুসকে প্রায় ফালাফালা করে দিয়েছিল। বিজয় চেঁচামেচি করে লোকজন এনে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পথেই সুরিন্দরের মৃত্যু হল।

দুঃখে, ঘটনার আকস্মিকতায় বিজয় হতবুদ্ধি হয়ে গেল। শুধু বিড়বিড় করছিল, ”শেফালী তুমি এটা কী করে করতে পারলে!”

এই হত্যাকাণ্ড সেইসময় রাজধানীতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল।

পুলিশ সারা দিল্লি তোলপাড় করে ফেলল, কিন্তু শেফালীর চিহ্নমাত্র খুঁজে পেল না। শেফালীর বাড়ির লোক বলল সে বেশ কয়েক দিন হয়ে গেল বাড়ি আসেনি। হোস্টেল কর্তৃপক্ষ বলল সেদিন সকালের পর থেকে সে আর ঘরে ফেরেনি।

অকুস্থল থেকে কিছু দূরেই স্কুলবাড়ির দেওয়ালের গায়ে ছুরিটা পাওয়া গেল। বিজয় দেখেই বলল, ”এই তো! এই ছুরিটা নিয়েই অফিসে শেফালী আমাকে ভয় দেখিয়েছিল।”

ছুরির পাশেই পাওয়া গেল এক পাটি জুতো, অন্য পাটি পাওয়া গেল একটু দূরে স্কুলের ভেতরে। সেই জুতোজোড়া কিন্তু পুরুষের।

স্কুলের দারোয়ান পুলিশকে বলল, ”হুজুর আমি ছুরি মারতে কাউকে দেখিনি, তবে একটা লম্বা—চওড়া মেয়ে দেখলাম পাঁচিলের ওদিক থেকে লাফিয়ে এদিকে এসে পড়ল। আমি তাড়া করেছিলাম হুজুর, তার আগেই কোথায় যেন উবে গেল। আসলে ইশকুলের পেছনদিকটা জঙ্গল মতো তো! আর আমার বয়স হয়েছে হুজুর, হাঁটুতে ব্যাথা, অত জোরে ছুটতেও পারি না আর!”

বাসস্ট্যান্ডের পাশেই ছিল এক পানওয়ালার গুমটি, সে—ও ওই একই কথা বলল। ছুরি মারতে সে দেখেনি, তবে নীল সালোয়ার কামিজ পরা একটা মেয়েকে পালাতে দেখেছে।

দু—দিন কেটে গেল। শেফালীর ফোটো পৌঁছে গেল দিল্লি এবং উত্তরপ্রদেশের প্রতিটা ছোটোবড়ো থানায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার কেউ কোনো হদিশ দিতে পারল না।

ওদিকে তখন এই হত্যাকাণ্ড দিল্লিতে হইচই ফেলে দিয়েছে। প্রতিটা খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বড়ো বড়ো করে ছাপা হচ্ছে হত্যার বিবরণ। এইভাবে পাবলিক প্লেসে ছোরা মেরে খুন কোনো শিক্ষিত ভদ্র মেয়ে করতে পারে ভেবে সবাই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিল।

দিল্লির প্রথম সারির কাগজ ‘অমর উজালা’ লিখল, ”পুলিশের সন্দেহ হত্যাকারী একজন সুন্দরী বাঙালি তরুণী। তিনি লম্বা, ফর্সা, চোখের রং নীল, চুল ছোটো করে কাটা। পরনে ছিল নীল রঙের সালোয়াড় কামিজ। কিন্তু একজন বাঙালি রমণীর পক্ষে এইভাবে ছুরি মেরে হত্যা কি সম্ভব? কিছুতেই সেই নারীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতা পুলিশেও খবর দেওয়া হয়েছে। তারাও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।”

তদন্তকারী অফিসার মি রত্নেশ তিওয়ারির তখন নাওয়াখাওয়া বন্ধ প্রায়। এইভাবে একজন প্রখ্যাত গায়িকা খুন হল, তাও ভর সন্ধ্যে বেলা, পুলিশ কেন কিছুতেই কোনো কিনারা করতে পারছে না, সেই ব্যাপারে তাঁকে ধমক খেতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পুলিশের স্নিফার ডগকেও সেই চপ্পল শুঁকিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে, কিন্তু সে বেচারা শেফালীর হোস্টেল অবধি গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছে।

অবশেষে খুনের ঠিক সাতদিন পরে শেফালী থানায় এসে আত্মসমর্পণ করল, ”স্যার, আমার নামই শেফালী চৌধুরী। কিন্তু আমি কেন সুরিন্দরকে মারতে যাব? ওইদিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত আমি আমার স্কুলে ছিলাম। তারপর আমি লুধিয়ানা চলে যাই।”

সুরিন্দর খুন হয়েছে সন্ধ্যে ছ—টার কিছু পরে। যে পুরুষ জুতো পাওয়া গিয়েছিল, সেটা দিব্যি শেফালীর পায়ের মাপের সঙ্গে মিলে গেল। ইনস্পেক্টর তিওয়ারি আর কালবিলম্ব না করে শেফালীকে গ্রেফতার করলেন।

যথারীতি কোর্টে কেস উঠল। শুরু হল শেফালী চৌধুরী বনাম কেন্দ্রশাসিত দিল্লি মামলার সওয়াল জবাব।

এই মামলাকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল।

প্রকাশ্য বড়ো রাস্তায় একজন শিক্ষিতা সুন্দরী যুবতী অন্য এক জনপ্রিয় গায়িকাকে তারই স্বামীর সামনে ছুরি মেরে খুন করে পালিয়ে গেল—এটা খুবই আজব বটে। তার ওপর পুলিশের ক্ষমতাও হয়নি তাকে ধরার। শেফালী নিজেই এসে ধরা দিয়েছিল।

শেফালীকে দেখবার জন্য আদালতে প্রচণ্ড ভিড় হতে লাগল। এমনকী কিছু বিবাহ প্রস্তাবও এসে পৌঁছোল তার কাছে, ”আপনার মতো তেজি মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই …!” ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু আইডেন্টিফিকেশন প্যারেডের আয়োজন করা হতে, পানওয়ালা শেফালীকে সনাক্ত করতে পারল না। স্কুলের দারোয়ানও নিশ্চিতভাবে বলতে পারল না যে এ—ই সেদিনের সেই মেয়ে। সেদিন অন্ধকার ছিল, কেউ মেয়েটাকে স্পষ্ট দেখতে পায়নি।

শেফালীর পক্ষের দুঁদে আইনজীবীর ক্রমাগত জেরায় বিজয় বলতে বাধ্য হল, ”না আমি শেফালীকে খুন করতে দেখিনি। তবে নীল সালোয়াড় কামিজ পরা একটা মেয়েকে পালাতে দেখেছিলুম, তার গড়ন পেছন থেকে শেফালীরই মতো।”

শেফালীর ঘর সার্চ করে কোনো নীল রঙের সালোয়ার কামিজ পাওয়া গেল না। সরকারি পক্ষের কৌঁসুলি বললেন, ”এটা আবার কোনো যুক্তি হল! শেফালী লুধিয়ানা বা অন্য কোথাও গিয়ে তো সেটা ফেলে দিয়ে আসতেই পারে!”

প্রকাশ্য রাস্তায় খুন করলেও কেউ খুনিকে সনাক্ত করতে পারল না। শেফালী বলল, ”স্যার, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। বিজয় সেহগাল আমার বন্ধু ছিল, আমাদের মধ্যে বিয়ের কথাও উঠেছিল, কিন্তু আকাশবাণী ভবনে ছুরি নিয়ে ভয় দেখানোর কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যা! আমাকে মিথ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।”

ওদিকে সুরিন্দরের বুকে বসিয়ে দেওয়া ছুরির হাতলে শেফালীর আঙুলের ছাপ না পাওয়া গেলেও হাতের ভেতরের দিকের অস্পষ্ট ছাপ পাওয়া গেল। কিন্তু শেফালীকে খুন করতে কেউ দেখেনি। তার ওপর বিজয় জেরার মুখে আগেকার কাহিনি বলতে গিয়ে আরও ধোঁয়াশার সৃষ্টি করল।

সব কিছু বিচার বিবেচনা করে নিম্ন আদালত শেফালীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল।

তার কয়েক দিন আগে থেকেই উৎসুক জনতা ভিড় জমাচ্ছিল আদালত চত্বরে। শেফালীকে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময়ে কিছু অতি উৎসুক লোক চেঁচিয়ে উঠল, ”শেফালী বহেন জিন্দাবাদ! ছাড়া পেয়ে তুমি চম্বলে চলে যেয়ো।”

শেফালী হাল ছাড়ল না। নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করল হাইকোর্টে।

হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার কে এস ট্যান্ডন বললেন, ”শুধুমাত্র circumstantial evidence অর্থাৎ অবস্থাগত ঘটনাবলির ওপর ভিত্তি করে হত্যার অভিযোগ আনা যায় না। প্রসিকিউশন কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি। পানওয়ালা এবং দারোয়ানের সাক্ষ্য অস্পষ্ট। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩০২ ধারা অনুযায়ী প্রত্যক্ষ প্রমাণ বিনা খুনের আসামিকে নির্দোষ বিবেচনা করতে হবে।”

অতএব শেফালী মুক্তি পেল।

কিন্তু ওই যে বিখ্যাত আমেরিকান নেতা Douglas Horton একবার বলেছিলেন,  “While seeking revenge, dig two graves – one for yourself!”

সেই প্রবাদটি এখানেও নির্ভুল প্রমাণিত হল। বিশ্বাসঘাতকতার চরম প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শেফালী নষ্ট করে দিল একটা জীবন। প্রমাণাভাবে ছাড়াও পেয়ে গেল, কিন্তু শান্তি পেল কি?

এই মামলা শেষ হবার পর পেরিয়ে গেছে কয়েক বছর।

১৯৮১ সালে দিল্লির খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় একটা খবর বেরোল, ”কাল রাতে নিজের ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন এক অবিবাহিতা মহিলা, তার নাম শেফালী চৌধুরী। মৃত্যুর কারণ স্পষ্ট নয়। তবে প্রতিবেশীদের দাবি তিনি দীর্ঘদিন অবসাদে ভুগছিলেন।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *