প্রজাপতি – ০৮

প্রজাপতি – ০৮

কিন্তু কী, ব্যাপার কী, সকলেরই যেন চোখ জ্বলছে। কেন, সব কি বাঘ হয়ে গেছে নাকি, আমাকে ছিঁড়ে খাবে? বিমলেটা তো ঠিক সে ভাবেই যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কারখানার খাবার ছুটি হয়েছে। তাই অনেকেই বাইরে। ছোটখাটো চায়ের দোকানগুলোকে ঠিক গুড়ের ওপর মাছির মত ছেঁকে ধরেছে। বিমলে—ভাল করে বললে বিমল—বিমল ব্যানার্জি, আসলে বিমলে-ই। ওর চেহারা চরিত্র ফিটার মিস্তিরির কাজ, সব মিলিয়ে, তা ছাড়া আর কিছু না। সেই জন্যেই তো পূর্ণেন্দুদের গরীবদের দলের, ও হল—কী যেন—উস্—কী যেন কথাটা—হ্যাঁ, লড়ান্ধু! আসলে বাড়ুজ্জেদের আকাট মুখখু ছেলে, ছেলেবেলা থেকেই কারখানার কাজে লেগে গিয়েছে। ওর কেরানী বাবা আর দোকানদার দাদা আবার অন্যরকম। তারা সব ভদ্দরলোক, আর বিমলে ছোটলোক। ও হল খাঁটি গরীবদলের লড়িয়ে, দলের মধ্যে ওব খুব খাতির, কেননা, ওদের তো গরীবদের দল, আর বিমলে তেলকালি মাখা হাফপ্যান্ট পরে, তেলকলি মাখা ছেঁড়া জামা গায়ে দেয়, কচর কচর পান চিবোয়, লাল ছোপ ধরা দাঁতে বিড়ি কামড়ে ধরে নাকের পাটা ফুলিয়ে, ও চিৎকার করে বক্তৃতা দেয়, বন্ধুগণ, আমরা সবাই এক। আমরা গরীবরাজ কায়েম করব, শেষ লড়াইয়ের জন্যে আমরা তৈয়ার। ওহরে বাস, কথা শুনলে মনে হয়, করলো বলে, কিন্তু আমি ভাবি, ওরা গরীবদের নিয়ে নিজেরাই যে সব বাত মারে, তার সঙ্গে বিমলের মিল কোথায়। রাত পোহলেই তো তুই নেয়েধুয়ে, পৈতাটাকে ঘস ঘস করে মেজে ঘষে, মন্তর-টন্তর জপে পুজোয় বসিস, প্রসাদ খাস, তোর বউ তোকে পান দেয়, চিবোতে চিবোতে বউকে বলিস, কারখানার ধোঁকড়াগুলোন দাও তো। যার মানে, ওটা হল কারখানার পোশাক, পরে ঠাকুর চললেন কারখানায়, গরীব লড়াকুটি, যে-কারণে ওর বাবা দাদা ওকে রেগুলার সম্মান দিয়ে কথা বলে, অর্থাৎ নেতা তো, পূর্ণেন্দু রমেশের তুলনায় তাদের ছেলে কম কিসে—একদিন হয়তো ভোটে দাঁড়াবে, চাই কী, মন্তীরও হতে পারে—লে হালুয়া! আমি তো জানি ওদের বাড়ির সবাইকে, বিমলেকেও ছেলেবেলা থেকেই চিনি, লড়াকুটির এখন বেজায় গ্যাস, কারখানায় এসে সারাদিন কাজের চেয়ে বেশী বকে, তারপরে বক্তিমে-টক্তিমে দিয়ে, আবার যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন তিনি অন্য মানুষ—রোজগেরে ছেলে, নেতা, ইস্তিরি সোয়ামি—ই বাববা, এমনি এমনি নয়, করকরে হাজার টাকা পণ, হাতঘড়ি, সসোনার বোতাম নিয়ে লড়াকুটি বিবাহ করিয়াছেন। একঠো সাইকেল ভি মাঙিয়েছিলেন। মগর শ্বশুর মস্‌সাইয়ের ধকে কুলোয়নি। গরীব নেতাটি বাড়ি ফিরে গিয়ে, ধোয়া-মোছা করে, আদির পাঞ্জাবী পরে, ঘাড়ে গদানে পাউডার মেখে বউকে নিয়ে চললেন সিনেমা দেখতে, পান চিবোতে চিবোতে তখন ও খাঁটি ভদ্দরলোক, কারখানা-টারখানার কথা এখন ছাড়’—রাজকায়েমের লড়াই এখন না—যার মানে, কী যেন বলে একে, সেই কী একটা সুন্দর কথা আছে না—আহ্, সেই যে—হাঁ হ্যাঁ, যাকে বলে, দ্বৈত সত্তা। স্‌সাহ্‌ পানের পিচু। আমি ভাবি, আসল গরীবেরা কি সত্যি ধোকাখোর, তারা এসব বোঝে না। কী জানি বাবা, কিন্তু খচ্চরটা আমার দিকে ওরকম করে তাকিয়ে আছে কেন, যেন পাড়ার কুকুর বে-পাড়ার কুকুরকে দেখে কটমট করে তাকায়, আর গর্‌গর্‌ করে।

যাবার আগে আমি ইচ্ছা করেই, মোটরবাইক ঘুরিয়ে ওর পাশে একবার দাঁড়াই। এঞ্জিন বন্ধ না করেই, জিজ্ঞেস করি, ‘কী রে ফটিচার। আমাকে দেখিসনি কোনদিন?’

লড়াক্কুটি সব সময়ে এত লড়াইয়ের কথা বলে, যে-জন্যে আমি ওকে ওই নাম দিয়েছি। ফটিচার—মানে গুল আর বোকাবাজ। ওর চোখ দুটো লাল হয়ে উঠলো। আর পান চিবিয়ে কালো ইয়ে যাওয়া মোটা ঠোঁট দুটো ঠিক ক্ষ্যাপা শুয়োরের মত করে খুলে বললো, ‘দেখছি বৈ কি, তবে তোর দিন ঘনিয়ে এসেছে, ফটিচার কে, সেটা প্রমাণ হয়ে যাবে।’

‘তাই নাকি রে?’

‘হ্যাঁ, দালালি বেশীদিন চলবে না। গরীবরা তাদের লড়াইয়েই তোর মত দুষমনকে হালাল করবে।‘

ছত্যি, আ কুতু কুতু। ইচ্ছা হল, ওর গরীবের পোশাক হাফপ্যান্টটা নেড়ে দিয়ে, ছেলেমানুষের মত আদর করে দিই। কিন্তু তা করতে গেলে, ওদের দল এসে পড়বে। একলা পারব না-—হারামজাদা শুটকা, শিবে—ওরা যে কোথায় থাকে! বললাম, আর তুই তো সেই গরীব, না? ব্যাটা লেখাপড়া শিখলি না কেন, তা হলে পূর্ণেন্দু হতে পারতিস। বিমলের মুখটা সত্যি ভয়ংকর হয়ে উঠলো, আমি ওর দাঁতের কিড়মিড়ি পর্যন্ত শুনতে পেলাম, বললো, ‘তোর মত লোচ্চা আর গুণ্ডার কাছ থেকে লেকচার শুনতে চাই না, তোকে আমরা—’

কথা শেষ করলো না, আর একবার দাঁত কড়মড় করলো, মানে, আমাকে চিবিয়ে খাবে। আমি হেসে শিস দিয়ে মোটরবাইক নিয়ে এগিয়ে চলে যাই, কিন্তু আমার ঘাড়ের পিছনটা কেমন শিরশির করছে, সেইরকম শিউরোনি শিউরোনি ভাব। শিখার কথাগুলো আবার আমার মনে পড়ছে, ‘তুমি সবাইকেই শত্র করে ফেলছ”—তা হবে হয়তো, তা বলে, এইসব ফটিচারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমি চলতে পারব না; আমার চেয়ে ওরা কিসে ভাল! যাক গে, তার কোন দরকার নেই, শিখা যাকে একটা সাধারণ মানুষ বলে, একটা সাধারণ বাঙালী ছেলে—ও যেমন একটা সাধারণ বাঙালী মেয়ে, বিমলে কি তাই! কিন্তু, তা কী করে হবে, সাধারণ লোক তো আর বিমলের মত একটা খচ্চর না। তবে, আচ্ছা, এটাই বা কেমন কথা যে, সাধারণ লোকেরা এদের বা কেশবদের বিশ্বাসই বা করে কী করে। সাধারণ বলতে কি তাই বোঝায়! কিন্তু নিরাপদবাবু—কী বিচ্ছিরি ঘাড়ের কাছে শিউরোনি ভাবটা লেগেই থাকছে, ঠিক যেন, সেই ছেলেবেলায় শ্মশানের পাশ দিয়ে যাবার সময় হত, যেন ভয়ংকর ভয়ংকর ভূতগুলো হাওয়ায় চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অনেকটা যেন সেইরকমই মনে হচ্ছে আমার। শহরের প্রায় বাইরে, একটা রাস্তা দিয়ে আমি বাড়ির দিকে চললাম। এদিকে আমাদের একটা আড্ডা মারবার জায়গা আছে, আর এখানে এসেই দেখলাম, শিবে বসে আছে। এটা একটা চায়ের দোকান—তবে, অন্যান্য জিনিসও পাওয়া যায়। থামিয়ে শিবুকে জিজ্ঞেস করলাম, শুটকাকে দেখেছে কিনা : ও বলতে পারলো না। জিজ্ঞেস করলো, ‘এক পাত্তর চা হবে গুরু?’

বললাম, ‘হোক। তারপরে একটা বেঞ্চে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। হাতটা কপালের কাছে তুলে আনতে গিয়ে দেখলাম, দুটো বাজে। আর ঠিক এ সময়েই সেই—

সেই যে একটা গুরগুরনো ভয়, না, ঘাড়ের কাছে না, আমার ভিতরটা কীরকম করে ওঠে, সেই রকম করে উঠলো অনেকদিন পরে, যে ভয়টা ভিতর থেকে গুরগুরিয়ে উঠলেই, মনে হয় হাত পা অবশ হয়ে যাবে, আর আমি মূছ রুগীর মত পড়ে গিয়ে মাটি খামচে ধরে, মুখ ঘষটাতে থাকবো, ঠিক সেই রকম। ঠিক যেন মনে হল, চারিদিকটা খা খা করছে, আর কে যেন আমার ঘাড় মুচড়ে দিতে আসছে—অথচ আজ এখন তো আমি একলা ঘরে বসে নেই, কয়েকজন তো রয়েছে। আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম, আর তখনই দেখলাম, আমার সামনে চায়ের গেলাস, সেটাকে হাতের এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, ‘হটাও চা, আমাকে এক পাট মাল দাও দয়ালদা।’

দয়ালদা, যে এ দোকানের মালিক, তাড়াতাড়ি গদির নিচে থেকে একটা রাম-এর পাট বের করে দিল, এক মোচড়ে মুখটা খুলে, কাঁচাই খানিকটা ঢেলে দিলাম, এক ঢোক, দু ঢোক, তিন ঢোক, চার—পাঁচ–ছ ….। শিবে বলে উঠলো, ‘এই গুরু, ওরকম খাসনি মাইরি, কলিজা ফেটে যাবে।’

আমিও ওর দিকে একবার তাকালাম, হয়তো কিছু বলতাম, কিন্তু আমার সেই ভাবটা যেন কেটে যাচ্ছিল, গা-টা গরম হয়ে উঠছিল, তবু আমি বোতলের মুখটা আমার মুখে লাগিয়ে বসে রইলাম, একটু একটু খেতে লাগলাম, শিবেটা হা করে তাকিয়ে রইলো, আর দয়ালদা—সত্যি দয়ালু মাইরি, রসের দয়াল, যখন চাইবে, তখনই পাবে, দয়ালদাও আমাব দিকেই চেয়েছিল, আর যে ছোকরাটা চা নিয়ে এসেছিল, সে তো একেবারে দেওয়াল সেটে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি বোতলটা মুখ থেকে সরিয়ে, একবার দয়ালদার দিকে তাকালাম। হাস্‌লাম একটু আর বোতালটা শিবের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। শিবে বোতলটা নিতে নিতে বললো, ‘কী হল রে গুরু, ওরকম করলি কেন?’

‘কী আবার, মাল খেতে ইচ্ছা করলো, তাই।‘

‘তাই বলে ওভাবে, তোর মুখটা আর চোখ দুটো দাখ দিকিনি, কী রকম হয়েছে?’

‘কী রকম?’

‘লাল, আর খুনীর মতন।‘

‘খুনীর মতন?’

কাকে খুন করব, তা তো বুঝতে পারছি না, আজ সকালে, সেই প্রজাপতিটাকে ধরবার সময়, শিখাও বলছিল, আমাকে নাকি খুনীর মত দেখাচ্ছে, আমাকে খালি খুনীব মতই দেখায়। শিবে বাকী মদটা খেতে খেতে বললো, ‘বাড়ি যাবি না? অনেক বেলা হয়েছে।‘

‘তুই কোথায় যাবি।’

‘বাড়ি।‘

‘চল।’

শিবের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশী দূরে না। ও মুখটা কুকুরের পাছার মত করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। মোটরবাইকে আমার পিছনেই বসলো, এটাই ওর আসল দরকার ছিল, আমি মুখ ফিরিয়ে বললাম, ‘দয়ালদা, দামটা কাল নিও।‘

দয়ালদা ঘাড়টা দোলালো, জানে, ওর টাকা আমরা বিশেষ ফাঁকি দিই না, তা ছাড়া দয়ালু দাদাটির দাম একটু আলাদা। কিন্তু হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, ন’কড়ি হালদারের একশো টাকার নোটটা আমার পকেটে রয়েছে-—আশ্চর্য, ভুলেই গিয়েছিলাম। বীণার মুখটা আমার মনে পড়লো, ‘কী করব বীণা, তোর বিয়ের পাসপোর্ট আমি এনে দিতে পারলাম না—পকেট থেকে নোটটা বের করে দয়ালদার দিকে ছুড়ে দিলাম, বললাম, পরে হিসাব হবে। তবু তো মালের জন্যে খরচ হচ্ছে, এ টাকাটা মাটিতে রেখে পেচ্ছাব করতে আরো ভাল লাগতো, কিন্তু তারপরে আবার হাতে করে তুলতে হবে তো। কিন্তু বীণা—মাইরি, সেই বাঙলা পাঁচের মত মুখটা—যাচ্ছেতাই। একটা ছেলে ঘায়েল করতে পারছে না ও। কত মেয়ে তো কত কী করছে! গাড়িটা স্টার্ট দিতেই আমার আবার শিখার কথা মনে পড়লো, যা দিনকাল হয়েছে …. তার মানে কী, সকলের চোখ আমার দিকে বাঘের মতন জ্বলবে! শিবে বলে উঠলো, একটু আস্তে চালা গুরু, কাঁচা মাল টেনে চালাচ্ছিস।

‘স্‌লা ভয় লাগে, নেমে যা।‘

‘না, তা তোর মত হাত আছে কারুর, তবে—!’

কথা শেষ করলো না ও—কিন্তু আমি ভাবছি, একটা সাধারণ মানুষ হওয়াটা কি খুব কঠিন? আমার তো যেন তাই মনে হচ্ছে, একটা ভীষণ কঠিন ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে, ঠিক যেন শিখার মুখটা সেই কষ্টের ভাব করে বলার মতন, কেন তুমি একটা সাধারণ ছেলে হলে না। কিছুই তো না, কাজ করা, খাওয়া, ছেলেমেয়ে নিয়ে আর বউ, মানে শিখার মত বউ নিয়ে, নিরাপদবাবুর মত—উহ্রে স্‌সাহ্‌। কী করে তা হব, ভাবতেই পারছি মা! কেননা, আমার মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা যা ভাবছি, ঠিক তা না।

‘দাঁড়া।’

শিবেদের বাড়ি। মোটরবাইকটা দাঁড় করাতেই ও নেমে গেল, আমি এঞ্জিন বন্ধ করে দিলাম, তাই দেখে শিবে বললো, ‘কী হল, বাড়ি যাবি না?”

‘না, একটু ঘুমোব তোদের বাড়িতে।‘

‘ঘুমোবি? খাবি না?’

‘না, খিদে নেই।‘

আমিই আগে ওদের বাড়ি ঢুকি। এককালে ওদের অবস্থা বেশ ভালই ছিল, এখন হাফ-গেরস্থদের থেকেও খারাপ, ওর বোনই তো মঞ্জরী! প্রকাণ্ড এই পুরনো বাড়িটা ওদের নিজেদেরই, বোধ হয় দেড়শো দুশো লোক আছে—ভাড়াটে না, ওরা নিজেরাই, অবিশ্যি অত লোক নাও হতে পারে, আমার মনে হয়। শিবে বোধহয় এখন আমাকে মনে মনে গাল দিচ্ছে—দিক গে স্‌লা, তোর খালারে তো ভাগ বসাতে যাচ্ছি না, আমি চিৎকার করে বললাম, ‘মঞ্জরী, আমাকে এক গেলাস খাবার জল দিও তো ‘ বলে শিবের অন্ধ কুঠরিটাতে ঢুকে পড়লাম। স্‌সাহ্‌, ব্যাঙও থাকে না এরকম ঘরে, একটা তক্তপোষ পর্যন্ত নেই, খালি মাদুর আর কাঁথা মেঝেয় পাতা। গিয়েই চিত হয়ে পড়লাম, আর একটু পরেই মঞ্জরী এল একটা ফাটা কাচের গেলাসে জল নিয়ে। গেলাসটা ধরে, খাবার আগেই, মঞ্জরীর শাড়ির আঁচলটা ধরলাম—যে কাপড়টা থেকে কাপড়-কাচা সাবান আর তেলের বিচ্ছিরি গন্ধ বেরুচ্ছে, তারপর খেলাম। মঞ্জরী আঁচলটা টেনে বললো, ‘কী করছেন, দাদা আসবে।‘

‘আসুক গে, দাদা কি জানে না!’

মঞ্জরীর যেন হঠাৎ খেয়াল পড়ে, বলে, ‘এ কি, খেয়ে এসেছেন নাকি?

‘কী?’

‘কী আবার। যা খান, গন্ধ বেরুচ্ছে।‘

আমি মঞ্জরীর দিকে তাকালাম। সাবান আর তেল মেশানো চকচকে শাড়িটার মধ্যে শুধুমাত্র ব্রেসিয়ার। কোলের কাছে ওকে টেনে নিলাম—এরকম অনেকবারই নিয়েছি, শিবেও জানে, আর মঞ্জরী তো জানেই। আমি শিখাকে কখনো কিছুই দিইনি, কিন্তু ওকে প্রায়ই দিই, যা পারি জিনিসপত্র, কাপড়চোপড়, টাকা-পয়সা, যখন যা পারি, কিন্তু শিখাকে কোনদিন দিইনি। শিখা চায়নি আমিও দিইনি—ওকে কিছু দেবার কথা মনে হলেই আমার ঘাড়টা যেন কেমন বেঁকে যায়, ‘না, থাক’ এইরকম মনে হয়। মঞ্জরীকে দিই, ও চায়, ওকে আমি দিই, অনেকেই দেয়, শিখাকেও হয়তো অনেকে দেয,আমি দিই না। মঞ্জরীকে আমি দিই, ও আমাকে দেয়, অথচ শিখাকে আমি দিই না, শিখা আমাকে দেয়, সেইজন্যে আমি ওদের মেলাতে পারি না, আমি কখনো মঞ্জরীকে মারতে পারি না, থাপ্পড় বা ওইরকম কিছু, কিন্তু শিখাকে মেরেওছি। মঞ্জরীকে আমার শুধু ডলতে পিষতে কাতুকুতু দিতে ইচ্ছা করে, শুতে ইচ্ছা করে, এখনো তাই করতে লাগলাম : ওর গা-টা ঠাণ্ডা, ভেজা ভেজা, জলে ভেজানো বলের মতন। ও এখন চান করে এসেছে, তাই বললো, এইমাত্র চান করে উঠেছি। তা হোক, ওকে আমি আটকে রাখব না, এখুনি ছেড়ে দেব,–কিন্তু এই মেয়েটার এই এক বিচ্ছিরি, মুখে কী রকম উনুনের ছাই ছাই গন্ধ। তা হোক গে, ওকে কাঁথার ওপরে টানলাম। ও কী বুঝলো, বললো, ‘দাঁড়ান, দরজাটা দিয়ে আসি।‘

তাই এল, আমি ওকে টেনে নিয়ে বললাম, ‘তোমার ঠাণ্ডা গা-টা খুব ভাল লাগছে। আচ্ছা, তুমি একটা বে-থা করতে পার না, মানে সাধারণ মেয়েরা যা করে—!’

মঞ্জরী বললো, ‘দাঁড়ান, আমার চুলে টান লাগছে।‘

চুলটা ছাড়িয়ে নিতে আবার বললাম, ‘বে-থা করে ঘর-সংসার যদি কর।‘

ও বললো, ‘খুব খেয়েছেন নাকি? ‘

‘না। আচ্ছা, এখন সেটা তোমার পক্ষে খুব শক্ত, না?’

‘আমি একটু খেয়ে আসি, কেমন? আড়াইটা বেজে গেছে।‘

‘আচ্ছা, যাও।‘

আমার গা-টা যেন নরম হয়ে এলিয়ে পড়ে গেল, আর চোখটা বুজে কোথায় তলিয়ে যেতে লাগলাম, আর কী আশ্চর্য, দেখলাম, প্রজাপতিটা দেওয়াল ঘেষটে ঘেষটে পড়ছে, শিখা শব্দ করে উঠলো, ‘ইস্‌!’…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *