যূথিকা। এসো, এসো, প্রাণনাথ এসো ; আমার হৃদয়ের ভিতর এসো ; আমার হৃদয় ভরিয়া যাউক। কত কাল ধরিয়া তোমার আশায় ঊর্দ্ধমুখী হইয়া বসিয়া আছি, তা কি তুমি জান না? আমি যখন কলিকা, তখন ঐ বৃহৎ আগুনের চাকা-ঐ ত্রিভুবনশুষ্ককর মহাপাপ, কোথায় আকাশের পূর্ব্বদিকে পড়িয়াছিল! তখন এমন বিশ্বপোড়ান মূর্ত্তিও ছিল না। তখন এর তেজের এত জ্বালাও ছিল না-হায়! সে কত কাল হইল! এখন দেখ, সেই মহাপাপ ক্রমে আকাশের মাঝখানে উঠিয়া, ব্রহ্মাণ্ড জ্বালাইয়া, ক্রমে পশ্চিমে হেলিয়া হেলিয়া, এখন বুঝি অনন্তে ডুবিয়া যায়! যাক্! দূর হৌক-তা তুমি এত কাল কোথা ছিলে প্রাণনাথ? তোমায় পেয়ে দেহ শীতল হইল, হৃদয় ভরিয়া গেল-ছি, মাটিতে পড়িও না! আমার বুকে তুমি আছ, তাতে সেই পোড়া তপন আর আমাকে না জ্বালাইয়া তোমাকে কেমন সাজাইতেছে! সেই রৌদ্রবিম্বে তুমি কেমন রত্নভূষিত হইয়াছ। তোমার রূপে আমিও রূপসী হইয়াছি-থাক, থাক, হৃদয়স্নিগ্ধকর!-আমার হৃদয়ে থাক, মাটিতে পড়িও না।
টগর। (জনান্তিকে কৃষ্ণকলির প্রতি) দেখ্ ভাই কৃষ্ণকলি,-মেয়েটার রকম দেখ্!
কৃষ্ণকলি। কোন্ মেয়েটার?
টগর। ঐ যূঁইটা। এত কাল মুখ বুজে ঘাড় হেঁট করে, যেন দোকানের মুড়ির মত পড়িয়া ছিল-তার পর আকাশ থেকে বৃষ্টির ফোঁটা, নবাবের বেটা নবাব, বাতাসের মোড়ায় চ’ড়ে একেবারে মেয়েটার ঘাড়ের উপর এসে পড়িল। অমনি মেয়েটা হেসে, ফুটে, একেবারে আটখানা। আঃ, তোর ছেলে বয়স! ছেলেমানুষের রকমই এক স্বতন্ত্র।
কৃষ্ণকলি। আ ছি! ছি!
টগর। তা দিদি! আমরা কি ফুট্তে জানিনে? তা, সংসারধর্ম্ম করিতে গেলে দিনেও ফুট্তে হয়, দুপুরেও ফুট্তে হয়, গরমেও ফুট্তে হয়, ঠাণ্ডাতেও ফুট্তে হয়, না ফুট্লে চলবে কেন বহিন? আমাদেরই কি বয়স নেই? তা, ও সব অহঙ্কার ঠেকার আমরা ভালবাসি না।
কৃষ্ণকলি। সেই কথাই ত বলি।
যুঁই। তা এত কাল কোথা ছিলে প্রাণনাথ! জান না কি যে, তুমি বিনা আমি জীবন ধারণ করিতে পারি না?
বৃষ্টিবিন্দু। দুঃখ, করিও না প্রাণাধিকে! আসিব আসিব অনেক কাল ধরিয়া মনে করিতেছি, কিন্তু ঘটিয়া উঠে নাই। কি জান, আকাশ হইতে পৃথিবীতে আসা, ইহাতে অনেক বিঘ্ন। একা আসা যায় না, দলবল যুটিয়া আসিতে হয়, সকলের সব সময় মেজাজ মরজি সমান থাকে না। কেহ বাষ্পরূপ ভাল বাসেন, আপনাকে বড় লোক মনে করিয়া আকাশের উচ্চ স্তরে অদৃশ্য হইয়া থাকিতে ভাল বাসেন ; কেহ বলেন, একটু ঠাণ্ডা পড়ুক, বায়ুর নিম্ন স্তর বড় গরম, এখন গেলে শুকাইয়া উঠিব; কেহ বলেন, পৃথিবীতে নামা, ও অধঃপতন, অধঃপাতে কেন যাইবো? কেহ বলেন, আর মাটিতে গিয়া কাজ নাই, আকাশে কালামুখো মেঘ হ’য়ে চিরকাল থাকি, সেও ভাল ; কেহ বলেন, মাটিতে গিয়া কাজ নাই, আবার সেই চিরকেলে নদী নালা বিল খাল বেয়ে সেই লোণা সমুদ্রটায় পড়িতে হইবে, তার চেয়ে এসো, এই উজ্জ্বল রৌদ্রে গিয়া খেলা করি, সবাই মিলে রামধনু হইয়া সাজি, বাহার দেখিয়া ভূচর খেচর মোহিত হইবে। তা সব যদি মিলিয়া মিশিয়া আকাশে যোটপাট হওয়া গেল, তবু জ্ঞাতিবর্গের গোলযোগ মিটে না। কেহ বলেন, এখন থাক্; এখন এসো, কালিমাময়ী কালী করালী কাদম্বিনী সাজিয়া, বিদ্যুতের মালা গলায় দিয়া, আমরা সেইখানে বসিয়া বাহার দিই। কেহ বলে, অত তাড়াতাড়ি কেন? আমরা জলবংশ, ভূলোক উদ্ধার করিতে যাইব, অমনি কি চুপি চুপি যাওয়া হয়? -এসো, খানিক ডাক-হাঁক করি। কেহ ডাক-হাঁক করে, কেহ বিদ্যুতের খেলা দেখে-মাগী নানা রঙ্গে রঙ্গিণী-কখন এ মেঘের কোলে, কখন ও মেঘের কোলে, কখন আকাশপ্রান্তে, কখন আকাশমধ্যে, কখনও মিটি মিটি, কখনও চিকি চাকি-
যূঁই। তা তোমার যদি সেই বিদ্যুতেই এত মন মজেছে, তা এলে কেন? সে হ’লো বড়, আমরা হলেম ক্ষুদ্র।
বৃষ্টিবিন্দু। আ ছি! ছি! রাগ কেন? আমি কি সেই রকম? দেখ, ছেলে ছোকরা হাল্কা যারা, তারা কেহই আসিল না, আমরা জন কত ভারি লোক, থাকিতে পারিলাম না, নামিয়া আসিলাম। বিশেষ তোমাদের সঙ্গে অনেক দিন দেখা শুনা হয় নাই।
পদ্ম। (পুকুর হইতে) উঃ, বেটা কি ভারি রে! আয় না, তোদের মত দু লাখ্ দশ লাখ্ আয় না-আমার একটা পাতায় বসাইয়া রাখি।
বৃষ্টিবিন্দু। বাছা, আসল কথাটা ভুলে গেলে? পুকুর পুরায় কে? হে পঙ্কজে, বৃষ্টি নহিলে জগতে পাঁকও থাকিত না, জলও থাকিত না, তুমি ভাসিতেও পাইতে না, হাসিতেও পাইতে না। হে জলজে, তুমি আমাদের ঘরের মেয়ে, তাই আমরা তোমাকে বুকে করিয়া পালন করি,-নহিলে তোমায় এ রূপও থাকিত না, এ সুবাসও থাকিত না, এ গর্ব্বও থাকিত না। পাপীয়সি! জানিস্ না-তুই তোর পিতৃকুলবৈরী সেই অগ্নিপিণ্ডটার অনুরাগিণী!
যূঁই। ছি! প্রাণাধিক! ও মাগীটার সঙ্গে কি অত কথা কহিতে আছে। ওটা সকাল থেকে মুখ খুলিয়া সেই অগ্নিময় নায়কের মুখপানে চাহিয়া থাকে ; সেটা যে দিকে যায়, সেই দিকে মুখ ফিরাইয়া হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে, এর মধ্যে কত বোলতা, ভোমরা, মৌমাছি আসে, তাতেও লজ্জা নাই। অমন বেহায়া জলেভাসা, ভোমরা মৌমাছি আশা, কাঁটার বাসার সঙ্গে কথা কহিতে আছে কি?
কৃষ্ণকলি। বলি, ও যূঁই, ভোমরা কথাটা ঘরে ঘরে নয় কি?
যূঁই। আপনাদের ঘরের কথা কও দিদি, আমি ত এই ফুটিলাম। ভোমরা মৌমাছির জ্বালা ত এখনও কিছু জানি না।
বৃষ্টিবিন্দু। তুমিই বা কেন বাজে লোকের সঙ্গে কথা কও! যারা আপনারা কলঙ্কিনী, তারা কি তোমার মত অমল ধবল শোভা, এমন সৌরভ দেখিয়া সহ্য করিতে পারে?
পদ্ম। ভাল রে ক্ষুদে! ভাল! খুব বক্তৃতা কর্চিস! ঐ দেখ, বাতাস আসচে!
যূঁই। সর্ব্বনাশ! কি বলে যে!
বৃষ্টিবিন্দু। তাই ত! আমার আর থাকা হইল না।
যূঁই। থাক না!
বৃষ্টিবিন্দু। থাকিতে পারিব না। বাতাস আমাকে ঝরাইয়া দিবে।-আমি উহার বলে পারি না।
যূঁই। আর একটু থাক না।
[বাতাসের প্রবেশ]
বাতাস। (বৃষ্টিবিন্দুর প্রতি) নাম্।
বৃষ্টিবিন্দু। কেন মহাশয়!
বাতাস। আমি এই অমল কমল সুশীতল সুবাসিত ফুল্লকলিকা লইয়া ক্রীড়া করিব! তুই বেটা অধঃপতিত, নীচগামী, নীচবংশ-তুই এই সুখের আসনে বসিয়া থাকিবি? নাম্!
বৃষ্টিবিন্দু। আমি আকাশ থেকে এয়েছি।
বাতাস। তুই বেটা পার্থিবযোনি-নীচগামী-খালে বিলে খানায় ডোবায় থাকিস-তুই এ আসনে? নাম্।
বৃষ্টিবিন্দু। যূথিকে! আমি তবে যাই।
যূঁই। থাক না।
বৃষ্টিবিন্দু। থাকিতে দেয় না যে।
যূঁই। থাক না-থাক না-থাক না।
বাতাস। তুই অত ঘাড় নাড়িস কেন?
যূঁই। তুই সর।
বাতাস। আমি তোকে ধরি, সুন্দরি! [যূথিকার সরিয়া সরিয়া পলায়নের চেষ্টা]
বৃষ্টিবিন্দু। এত গোলযোগে আর থাকিতে পারি না।
যুঁই। তবে আমার যা কিছু আছে, তোমাকে দিই, ধূইয়া লইয়া যাও।
বৃষ্টিবিন্দু। কি আছে?
যূঁই। একটু সঞ্চিত মধু-আর একটু পরিমল।
বাতাস। পরিমল আমি নিব-সেই লোভেই আমি এসেছি। দে-
[বায়ুকৃত পুষ্প প্রতি বল প্রয়োগ]
যূঁই। (বৃষ্টিবিন্দুর প্রতি) তুমি যাও-দেখিতেছ না ডাকাত!
বৃষ্টিবিন্দু। তোমাকে ছাড়িয়া যাই কি প্রকারে? যে তাড়া দিতেছ, থাকিতেও পারি না-যাই-যাই-
[বৃষ্টিবিন্দুর ভূপতন]
টগর ও কৃষ্ণকলি। এখন, কেমন স্বর্গবাসী! আকাশ থেকে নেমে এয়েচ না? এখন মাটিতে শোষ, নরদমায় পশ, খালে বিলে ভাস-
যূঁই। (বাতাসের প্রতি) ছাড়! ছাড়!
বাতাস। কেন ছাড়িব? দে পরিমল দে!
যূঁই। হায়! কোথা গেলে তুমি অমল, কোমল, স্বচ্ছ, সুন্দর, সূর্য্যপ্রতিভাত, রসময়, জলকণা! এ হৃদয় স্নেহে ভরিয়া আবার শূন্য করিলে কেন জলকণা! একবার রূপ দেখাইয়া, স্নিগ্ধ করিয়া, কোথায় মিশিলে, কোথায় শুষিলে প্রাণাধিক! হায়, আমি কেন তোমার সঙ্গে গেলেম না, কেন তোমার সঙ্গে মরিলাম না! কেন অনাথ, অস্নিগ্ধ পুষ্পদেহ লইয়া এ শূন্য প্রদেশে রহিলাম-
বাতাস। নে। কান্না রাখ্-পরিমল দে-
যূঁই। ছাড় ; নহিলে যে পথে আমার প্রিয় গিয়াছে, আমিও সেই পথে যাইব।
বাতাস। যাস্ যাবি, পরিমল দে।-হুঁ হুম্।
যূঁই। আমি মরিব-মরি-তবে চলিলাম।
বাতাস। হুঁ হুম্! [ইতি যূথিকার বৃন্তচ্যুতি ও ভূপতন]
বাতাস। হু! হায়! হায়!
যবনিকা পতন
EPILOGUE
প্রথম শ্রোতা। নাটককার মহাশয়! এ কি ছাই হইল?
দ্বিতীয় ঐ। তাই ত, একটা যূঁই ফুল নায়িকা, আর এক ফোটা জল নায়ক। বড় ত Drama!
তৃতীয় ঐ। হতে পারে, কোন Moral আছে। নীতিকথা মাত্র।
চতুর্থ। না হে-এক রকম Tragedy.
পঞ্চম ঐ। Tragedy, না একটা Farce?
ষষ্ঠ ঐ। Farce না-Satire-কাহাকে লক্ষ্য করিয়া উপহাস করা হইয়াছে।
সপ্তম ঐ। তাহা নহে। ইহার গূঢ় অর্থ আছে। ইহা পরিমার্থবিষয়ক কাব্য বলিয়া আমার বোধ হয়। “বাসনা” বা “তৃষ্ণা” নাম দিলেই ইহার ঠিক নাম হইত বোধ হয়, গ্রন্থকার ততটা ফুটিতে চান না।
অষ্টম ঐ। এ একটা রূপক বটে। আমি অর্থ করিব?
প্রথম ঐ। আচ্ছা, গ্রন্থকারই বলুন না কি এটা।
গ্রন্থকার। ও সব কিছুই নহে। ইহার ইংরাজি Title দিব-
“A true and faithful account of a lamentable Tragedy which occurred in a flower-plot on the evening of the 19th July 1885, Sunday, and of which the writer was an eye-witness!”