পুনর্জন্ম (নিশীথের নির্জন আঁধারে)

পুনর্জন্ম

নিশীথের নির্জন আঁধারে
বারে বারে
শুনিলাম বিপাশার আদিম আহ্বান।
আতঙ্কে উৎকণ্ঠি মোর প্রাণ,
গৌরী কাপালিকা
দাঁড়াল সম্মুখে আসি, নরমেধ প্রলয়ের শিখা
প্রতিভাত করি তার রৌপ্য স্তনতটে।
মুখে রটে
নিবিদের মন্ত্র উচাটন;
তরল মাতনে ভরা ঘূর্ণ্যমান নীলিম নয়ন
হানে শিষ্ট সভ্যতার কঠিন সংহতি;
উদ্দাম প্রগতি
স্পষ্টতর বিমুখ কুন্তলে;
দলিত সুন্দর, শান্ত শিব পদতলে;
খর খড়্গগে মুকুরিত সৃজনের প্রথম ভাস্কর;
তার ইষ্ট দেবতাও পুরাণ বর্বর,
যার তৃষ্ণা মিটাবার তরে
যুগে যুগান্তরে
সন্ধানে সে তপ্তরক্ত বলি।।

মোর কণ্ঠনলী
বদ্ধ যেন অগোচর যূপে;
মৃত্যুর প্রবেশপথ প্রতি রোমকূপে,
হৃদয়ের মহাশূন্য কম্পমান নির্বাণের শীতে;
নিখিল নাস্তিতে
মৌনের বিশ্রম্ভালাপ উপশয়ী বিভীষিকা-সনে;
অসীম গগনে
উধাও নক্ষত্রপুঞ্জ মুমূর্ষুর সংক্রাম এড়ায়।
শোনা যায়,
অনন্তের সীমান্তরে ব’সে,
উন্মন আলসে
নিঙাড়ে আয়ুর সার ত্রিকালের স্বামী;
নিমীলিত নেত্রে দেখি আমি
মহাকালহস্তচ্যুত, অপ্রচুর, অন্তিম নিমেষ
ক্ষণে ক্ষণে হয় নিরুদ্দেশ
প্রতিধ্বনিপরিপূর্ণ বিস্মৃতির অতল পাতালে।।

হেন কালে
অমৃতের প্রতিশ্রুতি নিয়ে,
তুমি এলে অনাহূত প্রেতস্তব্ধ গৃহে;
চির মোহ-ময়,
তুচ্ছ, প্রয়োজনহীন বাক্য-কতিপয়
চুম্বনের অবকাশে মৃদু স্বরে উচ্চারণ করি,
দিলে ভরি
নিরিক্ত অন্তরে মোর আকাঙ্ক্ষার সহজ বিস্ময়।
অসংগত সেই অঙ্গীকার,
বুঝো নাই, অনভিজ্ঞা, হয়তো বা অভিপ্রায় তার;
সম্ভবত দেখো নাই ভাবি
মিটিবে না সর্বস্বান্ত যৌবনের দাবি
ক্ষণিকের আত্মবলিদানে।
তবু আচম্বিতে তব অগাধ নয়ানে
তটের শাসন ঘুচে, রুদ্রমূর্তি বিপাশার জল
ভুলে গেল প্রত্ন হিংসা, হল সুনির্মল;
তব ক্ষুদ্র প্রেমের উপরে
নিশ্চিন্তে নির্ভর পেল অনশ্বর মুহূর্তের তরে
তুলাসাম্যহৃত বিশ্ব প্রলয়ের পথে।।

যে-দিন জগতে
আমার আপন ব’লে নাহি ছিল কেহ;
পথপ্রান্তে পরিহরি আমার অমূল্য বরদেহ
আগন্তুক মরণের দক্ষিণা-স্বরূপে,
সহযাত্রী সবে চুপে চুপে
আত্মরক্ষা করেছিল দৃষ্টির আড়ালে,
সে-দিন, সাবিত্রীসম, পাশে এসে, একেলা দাঁড়ালে
নিঃশঙ্কিনী
তুমি, বিদেশিনী।
সে-সেবার নেই প্রতিদান;
প্রতিশ্রুত একনিষ্ঠা তার অপমান।।

শুধু যবে অন্তিম নিশীথে
চারিভিতে
ফিরিবে বীভৎস নৃত্যে আজন্মের নিষ্ফলতা যত,
দ্বারের বাহিরে
ঝঞ্ঝার গর্জন-মত্ত অখণ্ড তিমিরে
বৈতরণী পুনর্বার ডাকিবে আমারে অবিরত,
সে-দিন তোমার নাম নিঃশব্দে উচ্চারি,
লব কাড়ি
মৃত্যুর বিজয় হতে তুষ্টির প্রসাদ।
সীমাশূন্য শূন্যতার মাঝে
সে-দিন শুনিব পুন ক্ষীণ সুরে বাজে
আজিকার মূল্যহীন কয়টি কথার অনুনাদ।।

১২ অক্টোবর ১৯২৯

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *