পাততাড়ি গুটানো
পাততাড়ি গুটানো অর্থে বুঝায় পালিয়ে যাওয়া, চম্পট দেয়া, কাজ সেরে চলে যাওয়া বা সরে পড়ার বিষয়কে। এটি আমাদের প্রবাদে বহুল প্রচলিত।
আমাদের দেশে গত শতাব্দীর প্রথমার্ধেও গ্রামগঞ্জে শিশুদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বাঁশের কঞ্চির কলম, হাতে বানানো কালি, তালের পাতা কিংবা কলার পাতায় লেখা ইত্যাদির প্রচলন ছিল। গ্রামের গুরুগৃহে দলবেঁধে পড়তে যাবার বিষয়টিও ছিল সেইসাথে। লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম শ্রীখাতায় জন্মগ্রহণকারী ধর্মনারায়ণ সরকার ভক্তিশাস্ত্রী (১৯১৭-১৯৯২ খ্রি.) তার অপ্রকাশিত জীবনকথায় বলেছেন-
‘সকালে বই, শ্লেট, কলাপাতা, মোটা ঢেকিয়ার কলম ও হাঁড়ির কালির মাটির দোয়াতে ছিপি এঁটে তার (শিক্ষক জলধর রায়ের) কাছে যেতাম ও ঘণ্টাখানেক লেখাপড়া করতাম এবং নাকে, হাতে, কাপড়ে কালি মেখে বাড়ি ফিরতাম। তাই দেখে মায়ের যে কত আনন্দ ও মমতা বাড়তো, সে আমার বর্ণনার অতীত।’
প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রায় প্রত্যেকেরই শিশুকালের এ রকম অনেক অভিজ্ঞতা আছে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকেও স্কুল থেকে কালির বড়ি দেয়া হতো পরীক্ষার আগে। ঐ বড়ি বা ট্যাবলেট দোয়াতে গুলিয়ে কালি বানাতে হতো। এদেশে তালপাতার ওপর স্থানীয়ভাবে বাড়িতে তৈরি কালি দিয়ে লেখা পাণ্ডুলিপির স্থায়িত্ব আমাদের চোখের সামনে। এর অনেক ইতিহাস আছে। আপাতত সে দিকে যাচ্ছি না।
পাত বলতে পাতাকেই বুঝায়। প্রাচীন শিক্ষার্থীদের কাছে তা ছিল কলার পাতা, তালপাতা, ভূর্জপত্র (ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৪০০০ ফুট উচ্চে হিমালয় পর্বতমালায় উৎপন্ন নরম বাকলযুক্ত ছোট গাছের ছাল। প্রাচীনকাল থেকে এই পাতলা ছালের ওপর শাস্ত্রগ্রন্থ, মন্ত্র, কবচ ইত্যাদি লেখা হয়ে থাকে। এখনো সীমিত আকারে তাবিজ-কবচের মন্ত্র লিখতে এই ভূর্জপত্র ব্যবহৃত হয়)। তাড় অর্থ তালগাছ। তাড়ি অর্থে তাড়া বা গোছা বুঝায়। তাড়ি অর্থে আবার তালগাছও বুঝায়, তাল বা খেজুরের মাদক রসও বুঝায়।
তাহলে পাততাড়ি অর্থে সহজভাবে আমরা লেখাপড়ার কাজে ব্যবহৃত বইখাতা (প্রাচীনকালের) ইত্যাদি বুঝি। পাঠশালা ছুটি হলে ছাত্রছাত্রীরা পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়। কোনো কাজ সম্পন্ন হলে জিনিসপত্র গুছিয়ে তোলা এবং অতঃপর রওনা হওয়া অর্থে পাততাড়ি গুটানো প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।