পরিশোধ | |
নাট্যগীতি | |
কথা ও কাহিনীতে প্রকাশিত “পরিশোধ” নামক পদ্যকাহিনীটিকে নৃত্যাভিনয় উপলক্ষে নাট্যীকৃত করা হয়েছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এর সমস্তই সুরে বসানো। বলা বাহুল্য ছাপার অক্ষরে সুরের সঙ্গ দেওয়া অসম্ভব ব’লে কথাগুলির শ্রীহীন বৈধব্য অপরিহার্য। | |
গৃহদ্বারে পথপার্শ্বে | |
শ্যামা। | এখনো কেন সময় নাহি হল নাম-না-জানা অতিথি, আঘাত হানিলে না দুয়ারে কহিলে না, দ্বার খোলো। হাজার লোকের মাঝে রয়েছি একেলা যে, এসো আমার হঠাৎ আলো পরান চমকি’ তোলো॥ আঁধার বাঁধা আমার ঘরে জানি না কাঁদি কাহার তরে॥ চরণসেবার সাধনা আনো, সকল দেবার বেদনা আনো, নবীন প্রাণের জাগরমন্ত্র কানে কানে বোলো॥ |
রাজপথে | |
প্রহরীগণ। | রাজার আদেশ ভাই চোর ধরা চাই, চোর ধরা চাই, কোথা তারে পাই? যারে পাও তারে ধরো কোনো ভয় নাই॥ |
বজ্রসেনের প্রবেশ | |
প্রহরী। | ধর্ ধর্, ওই চোর, ওই চোর। |
বজ্রসেন। | নই আমি, নই নই নই চোর। অন্যায় অপবাদে আমারে ফেলো না ফাঁদে। নই আমি নই চোর। |
প্রহরী। | ওই বটে ওই চোর ওই চোর। |
বজ্রসেন। | এ কথা মিথ্যা অতি ঘোর। আমি পরদেশী হেথা নেই স্বজন বন্ধু কেহ মোর; নই চোর, নই আমি, নই চোর। |
শ্যামা। | আহা মরি মরি, মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি উন্নতদর্শন কারে বন্দি ক’রে আনে চোরের মতন কঠিন শৃঙ্খলে। শীঘ্র যা লো সহচরী, বল্ গে নগরপালে মোর নাম করি, শ্যামা ডাকিতেছে তারে। বন্দী সাথে লয়ে একবার আসে যেন আমার আলয়ে দয়া করি। |
সহচরী। | সুন্দরের বন্দন নিষ্ঠুরের হাতে ঘুচাবে কে; নিঃসহায়ের অশ্রুবারি পীড়িতের চক্ষে মুছাবে কে। আর্তের ক্রন্দনে হেরো ব্যথিত বসুন্ধরা, অন্যায়ের আক্রমণে বিষবাণে জর্জরা, প্রবলের উৎপীড়নে কে বাঁচাবে দুর্বলেরে, অপমানিতেরে কার দয়া বক্ষে লবে ডেকে। |
প্রহরীদের প্রতি | |
শ্যামা। | তোমাদের এ কী ভ্রান্তি, কে ওই পুরুষ দেবকান্তি, প্রহরী,মরি মরি। এমন ক’রে কি ওকে বাঁধে। দেখে যে আমার প্রাণ কাঁদে। বন্দী করেছ কোন্ দোষে? |
প্রহরী। | চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে চোর চাই যে ক’রেই হোক্ হোক-না সে যেই-কোনো লোক; নহিলে মোদের যাবে মান। |
শ্যামা। | নির্দোষী বিদেশীর রাখো প্রাণ দুই দিন মাগিনু সময়। |
প্রহরী। | রাখিব তোমার অনুনয়; দুই দিন কারাগারে রবে তার পর যা হয় তা হবে। |
বজ্রসেন। | এ কী খেলা, হে সুন্দরী, কিসের এ কৌতুক। কেন দাও অপমান-দুখ, মোরে নিয়ে কেন, কেন এ কৌতুক। |
শ্যামা। | নহে নহে, নহে এ কৌতুক। মোর অঙ্গের স্বর্ণ-অলঙ্কার সঁপি দিয়া,শৃঙ্খল তোমার নিতে পারি নিজ দেহে। তব অপমানে মোর অন্তরাত্মা আজি অপমান মানে। |
বজ্রসেন। | কোন্ অযাচিত আশার আলো দেখা দিল রে তিমির রাত্রি ভেদি দুর্দিন দুর্যোগে, কাহার মাধুরী বাজাইল করুণ বাঁশি। অচেনা নির্মম ভুবনে দেখিনু এ কী সহসা কোন্ অজানার সুন্দর মুখে সান্ত্বনা হাসি॥ |
কারাঘর শ্যামার প্রবেশ | |
বজ্রসেন। | এ কী আনন্দ হৃদয়ে দেহে ঘুচালে মম সকল বন্ধ। দুঃখ আমার আজি হল যে ধন্য, মৃত্যুগহনে লাগে অমৃত সুগন্ধ। এলে কারাগারে রজনীর পারে উষাসম, মুক্তিরূপা অয়ি, লক্ষ্ণী দয়াময়ী। |
শ্যামা। | বোলো না, বোলো না, আমি দয়াময়ী। মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা। এ কারাপ্রাচীরে শিলা আছে যত নহে তা কঠিন আমার মতো। আমি দয়াময়ী! মিথ্যা, মিথ্যা,মিথ্যা। |
বজ্রসেন। | জেনো প্রেম চিরঋণী আপনারি হরষে, জেনো, প্রিয়ে, সব পাপ ক্ষমা করি ঋণশোধ করে সে। কলঙ্ক যাহা আছে দূর হয় তার কাছে, কালিমার ‘পরে তার অমৃত সে বরষে। |
শ্যামা। | হে বিদেশী, এসো এসো। হে আমার প্রিয়, এই কথা স্মরণে রাখিয়ো, তোমা সাথে এক স্রোতে ভাসিলাম আমি হে হৃদয়স্বামী, জীবনে মরণে প্রভু॥ |
বজ্রসেন। | প্রেমের জোয়ারে ভাসাবে দোঁহারে বাঁধন খুলে দাও, দাও দাও। ভুলিব ভাবনা পিছনে চাব না পাল তুলে দাও, দাও দাও। প্রবল পবনে তরঙ্গ তুলিল– হৃদয় দুলিল, দুলিল দুলিল, পাগল হে নাবিক ভুলাও দিগ্বিদিক পাল তুলে দাও, দাও দাও॥ |
শ্যামা। | চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে। জীবণ মরণ সুখ দুখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে॥ স্খলিত শিথিল কামনার ভার বহিয়া বহিয়া ফিরি কত আর, নিজ হাতে তুমি গেঁথে নিয়ো হার, ফেলো না আমারে ছড়ায়ে॥ বিকায়ে বিকায়ে দীন আপনারে পারি না ফিরিতে দুয়ারে দুয়ারে, তোমার করিয়া নিয়ো গো আমারে বরণের মালা পরায়ে॥ |
বজ্রসেন ও শ্যামা তরণীতে | |
শ্যামা। | এবার ভাসিয়ে দিতে হবে আমার এই তরী। তীরে বসে যায় যে বেলা, মরি গো মরি॥ ফুল ফোটানো সারা ক’রে বসন্ত যে গেল স’রে নিয়ে ঝরা ফুলের ডালা বলো কী করি॥ জল উঠেছে ছল্ছলিয়ে ঢেউ উঠেছে দুলে, মর্মরিয়ে ঝরে পাতা বিজন তরুমূলে, শূন্যমনে কোথায় তাকাস সকল বাতাস সকল আকাশ ওই পারের ওই বাঁশির সুরে উঠে শিহরি॥ |
বজ্রসেন। | কহো কহো মোরে প্রিয়ে আমারে করেছ মুক্ত কী সম্পদ দিয়ে। অয়ি বিদেশিনী, তোমারি কাছে আমি কত ঋণে ঋণী। |
শ্যামা। | নহে নহে নহে। সে কথা এখন নহে। ওই রে তরী দিল খুলে। তোর বোঝা কে নেবে তুলে॥ সামনে যখন যাবি ওরে, থাক্ না পিছন পিছে প’ড়ে, পিঠে তারে বইতে গেলে একলা প’ড়ে রইবি কূলে॥ ঘরের বোঝা টেনে টেনে পারের ঘাটে রাখলি এনে তাই যে তোরে বারে বারে ফিরতে হল গেলি ভুলে। ডাক্ রে আবার মাঝিরে ডাক্, বোঝা তোমার যাক ভেসে যাক, জীবনখানি উজাড় ক’রে সঁপে দে তার চরণমূলে॥ |
বজ্রসেন। | কী করিয়া সাধিলে অসাধ্য ব্রত কহো বিবরিয়া। জানি যদি প্রিয়ে, শোধ দিব এ জীবন দিয়ে এই মোর পণ॥ |
শ্যামা। | নহে নহে নহে। সে কথা এখন নহে। তোমা লাগি যা করেছি কঠিন সে কাজ, আরো সুকঠিন আজ তোমারে সে কথা বলা। বালক কিশোর উত্তীয় তার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর মত্ত অধীর। মোর অনুনয়ে তব চুরি-অপবাদ নিজ-‘পরে লয়ে সঁপেছে আপন-প্রাণ। এ জীবনে মম ওগো সর্বোত্তম সর্বাধিক মোর এই পাপ তোমার লাগিয়া॥ |
বজ্রসেন। | কাঁদিতে হবে রে, রে পাপিষ্ঠা জীবনে পাবি না শান্তি। ভাঙিবে ভাঙিবে কলুষনীড় বজ্র-আঘাতে। কোথা তুই লুকাবি মুখ মৃত্যু-আঁধারে॥ |
শ্যামা। | ক্ষমা করো নাথ, ক্ষমা করো। এ পাপের যে অভিসম্পাত হোক বিধাতার হাতে নিদারুণতর। তুমি ক্ষমা করো। |
বজ্রসেন। | এ জন্মের লাগি তোর পাপমূল্যে কেনা মহাপাপভাগী এ জীবন করিলি ধিক্কৃত। কলঙ্কিনী ধিক্ নিশ্বাস মোর তোর কাছে ঋণী। |
শ্যামা। | তোমার কাছে দোষ করি নাই, দোষ করি নাই, দোষী আমি বিধাতার পায়ে; তিনি করিবেন রোষ– সহিব নীরবে। তুমি যদি না কর দয়া সবে না, সবে না,সবে না॥ |
বজ্রসেন। | তবু ছাড়িবি নে মোরে? |
শ্যামা। | ছাড়িব না, ছাড়িব না। তোমা লাগি পাপ নাথ, তুমি করো মর্মাঘাত। ছাড়িব না। |
শ্যামাকে বজ্রসেনের হত্যার চেষ্টা | |
নেপথ্যে। | হায়, এ কি সমাপন! অমৃতপাত্র ভাঙিলি, করিলি মৃত্যুরে সমর্পণ। এ দুর্লভ প্রেম মূল্য হারালো, হারালো, কলঙ্কে, অসম্মানে॥ |
পথিক রমণী | |
[প্রস্থান | |
বজ্রসেন। | ক্ষমিতে পারিলাম না যে ক্ষমো হে মম দীনতা– পাপীজনশরণ প্রভু। মরিছে তাপে মরিছে লাজে প্রেমের বলহীনতা, ক্ষমো হে মম দীনতা। প্রিয়ারে নিতে পারি নি বুকে, প্রেমেরে আমি হেনেছি, পাপীরে দিতে শাস্তি শুধু পাপেরে ডেকে এনেছি, জানি গো তুমি ক্ষমিবে তারে যে অভাগিনী পাপের ভারে চরণে তব বিনতা, ক্ষমিবে না, ক্ষমিবে না আমার ক্ষমাহীনতা॥ এসো এসো এসো প্রিয়ে মরণলোক হতে নূতন প্রাণ নিয়ে। নিষ্ফল মম জীবন, নীরস মম ভুবন শূন্য হৃদয় পূরণ করো মাধুরীসুধা দিয়ে॥ |
নূপুর কুড়াইয়া লইয়া। | |
শ্যামার প্রবেশ | |
শ্যামা। | এসেছি প্রিয়তম। ক্ষমো মোরে ক্ষমো। গেল না, গেল না কেন কঠিন পরান মম তব নিঠুর করুণ করে। |
বজ্রসেন। | কেন এলি, কেন এলি, কেন এলি ফিরে– যাও যাও চলে যাও। |
[ শ্যামার প্রণাম ও প্রস্থান | |
বজ্রসেন। | ধিক্ ধিক্ ওরে মুগ্ধ, কেন চাস্ ফিরে ফিরে। এ যে দূষিত নিষ্ঠুর স্বপ্ন এ যে মোহবাষ্পঘন কুজ্ঝটিকা, দীর্ণ করিবি না কি রে। অশুচি প্রেমের উচ্ছিষ্টে নিদারুণ বিষ, লোভ না রাখিস প্রেতবাস তোর ভগ্ন মন্দিরে॥ নির্মম বিচ্ছেদসাধনায় পাপ ক্ষালন হোক, না করো মিথ্যা শোক, দুঃখের তপস্বী রে, স্মৃতিশৃঙ্খল করো ছিন্ন, আয় বাহিরে আয় বাহিরে॥ |
নেপথ্যে। | কঠিন বেদনার তাপস দোঁহে, যাও চিরবিরহের সাধনায়, ফিরো না, ফিরো না, ভুলো না মোহে। গভীর বিষাদের শান্তি পাও হৃদয়ে, জয়ী হও অন্তর বিদ্রোহে॥ যাক পিয়াসা, ঘুচুক দুরাশা, যাক মিলায়ে কামনা-কুয়াশা। স্বপ্ন-আবেশবিহীন পথে যাও বাঁধন-হারা, তাপবিহীন মধুর স্মৃতি নীরবে ব’হে॥ |