পরিশিষ্ট : স্বীকারোক্তি

পরিশিষ্ট

স্বীকারোক্তি

…তার পরে ওরা আমাকে এস বি সেল-এ এনে ঢোকাল। বাইশে ডিসেম্বরের বেলা দশটা হবে তখন। আমার কাছে ঘড়ি ছিল না। শীতের বেলা দেখে, আর লালবাজার থেকে লর্ড সিনহা রোড পর্যন্ত রাস্তার চেহারা দেখে আমার মনে হল, তখন বেলা দশটাই হবে, যদিও একটা আচ্ছন্নতা আমাকে গ্রাস করেছিল। সারারাত্রি ঘুম হয়নি। লালবাজার হাজতের সেই ঘর, টিমটিমে অকম্পিত সেই আলো, চার দেওয়াল জুড়ে সেইসব বিচিত্র আঁকাজোকা হিজিবিজি লেখা, আর অর্ধোন্মাদ সেই বন্দি, যে আমার দিকে স্থির চোখে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল, হেসে উঠছিল, বিড়বিড় করে বলছিল বা গুনগুন করে গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে এমন করে দেওয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, যেন ওখানে কোনও দেওয়াল নেই, একটা দরজা আছে, খোলা দরজা-যেখান দিয়ে সোজা বেরিয়ে যাবে। কিন্তু দেওয়ালের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে স্থির নিশ্চল হয়ে যাচ্ছিল। তার পরে আস্তে আস্তে পিছন ফিরে অর্থাৎ হাজতঘরের দিকে ফিরে বক্তৃতামঞ্চের ওপরে দাঁড়াবার ভঙ্গি করে হাত তুলে তর্জনীটা শুন্যে বিধিয়ে বিধিয়ে ভুরু কুঁচকে চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে আবার বিড়বিড় করছিল। ও যে কে আমি তা জানতাম না। পোশাক-আশাক মোটামুটি ভদ্ররকমের হলেও ও রাজনৈতিক বন্দি কিনা আমি বুঝতে পারছিলাম না। চোর কিংবা ডাকাত বা পকেটমার সেরকম কাউকে আমার সঙ্গে একই হাজতঘরে পুরে দেওয়া পুলিশের পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। কারণ ওরা জানত, তাতে আমার মনোবল আরও নষ্ট হবে, আমি আরও বেশি গ্লানি বোধ করব, মুক্তির ইচ্ছে আমার প্রবল হয়ে উঠবে! আর তা উঠলেই ওরা আমার কাছে যা জানতে চাইছে, ওদের ধারণা, তা সহজ হয়ে উঠবে।

এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পরশু ওরা তা-ই রেখেছিল। তিনটি ছোকরাকে সেই ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাদের দেখে আমার মনে হয়েছিল, ওরা যেন হাজতে আসেনি, কোনও চায়ের দোকানে আড্ডা মারতে এসেছে। ওরা বকবক করছিল, হাসাহাসি করছিল, খিস্তি করছিল, আবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও করছিল, এবং সে সময়ে অশ্রাব্য উক্তিই শুধু করছিল না, কোমরের পরিধান শিথিল করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নিম্নাঙ্গ দেখাচ্ছিল যাতে ক্রোধ এবং অবজ্ঞা অত্যন্ত উগ্র হয়ে ফুটে উঠেছিল। স্বভাবতই আমার খুব খারাপ লাগছিল, অস্বস্তি বোধ করছিলাম, এটাও বুঝতে পারছিলাম, ওদের কোনও দোষ নেই, ওরা ওদের স্বাভাবিক ব্যবহারই করছিল, এমনকী ওরা এও বুঝতে পারছিল আমি অত্যন্ত অস্বস্তি ও অশান্তি বোধ করছি, যে কারণে আমার দিকে তাকিয়ে ওরাও একটু সংকুচিত হচ্ছিল, আড়ষ্ট বোধ করছিল এবং আমাকেই সাক্ষী মানছিল, দেখুন না বড়দা…ইত্যাদি। ওদের কথা থেকেই জানা যাচ্ছিল বন্দরের কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে বে-আইনি আমদানি করা মালপত্র পাচার করার সময় ওরা ধরা পড়েছে। ইতিপূর্বেও ওরা কয়েকবার ধরা পড়েছে, কয়েক মাস করে জেলও খেটেছে। কোনও কিছুই নতুন নয়। তবু ধরা-পড়ার কারণগুলো আলোচনা করতে গিয়েই ওদের ঝগড়া হচ্ছিল। একটাই। শুধু আশ্চর্য, আমাকে ওরা কিছুই জিগ্যেস করেনি, আমি কে, কী অপরাধে হাজতবাস করছি। প্রথম। থেকেই ওরা আমাকে বাবুবা বড়দা এইরকম সম্বোধন করছিল। আমি কর্তৃপক্ষের কথা ভাবছিলাম, তারা কেন ছেলে তিনটেকে আমার ঘরেই ঢুকিয়ে দিয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হয়নি পুলিশের ওটা কোনও অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি নয়, একটি সুচিন্তিত পরীক্ষা মাত্র। এটা যখনই বুঝতে পারলাম তখনই মনকে প্রস্তুত করে নিলাম এইভাবে যে আমি যেন কোনওরকম একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝখানে রয়েছি। ভীষণ ঝড় বা ভয়ংকর ভূমিকম্পের মতো কোনও দুর্যোগের মধ্যে নয়, যেন দক্ষিণাঞ্চলের ভেড়িবাঁধের ওপর কোনও গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছি, আমার চারপাশে পাঁক কাদা নোংরা পশুর মৃতদেহ জোঁক আর কেঁচো পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করছে। আর আকাশ কালো, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, আমার কোথাও যাবার উপায় নেই। বৃষ্টির বা পাঁক কাদার বা জোঁক কেঁচোর কোনও দোষ নেই, সবই স্বাভাবিক এবং যা-কিছুরই দায়, সবই আমার জীবনের কার্যকারণের গতি-প্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত, যে গতি-প্রকৃতির দ্বারা আমি লোকালয় বহির্ভূত ভেড়িবাঁধের ওপর একটি বিচ্ছিন্ন একক গাছের নীচে উপস্থিত। অতএব—

অতএব ছেলে তিনটির সঙ্গে হাজতে আমার সারাদিন ও রাত্রি একরকমভাবে কেটে গিয়েছিল। তার জন্যে যেসব কষ্ট, গ্লানি ও পীড়া আমাকে ভোগ করতে হয়েছিল, সে সব আমি স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছিলাম। ওদের খিস্তিখেউড় অশ্লীল গল্প, পরস্পরকে নিম্নাঙ্গ প্রদর্শন এবং রাত্রে আলোকিত হাজতঘরের মধ্যেই কম্বলের আড়াল রাখবার চেষ্টা করে ওদের সমকামী আচার আচরণ হাসি ইশারা গোঙানি এবং আর্তনাদ সবই একটা স্বাভাবিক দুর্যোগের মতো ভাবতে চেষ্টা করছিলাম। আর যেহেতু মন অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগের মতোই অধিকাংশ সময় কোনও কিছু দর্শনে স্মৃতির অন্ধকার দেওয়ালে এক-একটা ঝলক দেখতে পায়, সেইরকম কোনও কোনও সমকামিতার ঘটনা আমার মনে পড়ছিল। যেমন আমাদের শহরের স্কুলের মাস্টার প্রিয়তোষ আর ছাত্র খোকন, কিংবাযাক সে কথা, অর্থাৎ আমাদের আশেপাশে সচরাচর ঘটে থাকে, সেইসব ঘটনা ও ঘটনার চরিত্রদের কথা আমার মনে পড়ছিল। এবং একসময়ে অন্ধকার টানেলের ভিতর দিয়ে এসে যেমন হঠাৎ-আলোর সামনে পড়া যায়, তেমনিভাবে নীরাকে আমার আলিঙ্গনে আবিষ্কার করেছিলাম–যে-আলিঙ্গন আমার স্ত্রীকে, সমাজকে, পার্টিকে এবং গভর্নমেন্টকে ফাঁকি দিয়ে অর্জন করতে হয়। আর নীরাকে মনে পড়ায়, শেষরাত্রের দিকে যেটুকু বা আমার একটু ঘুমের আশা ছিল সেটুকু তিরোহিত হয়েছিল। যদিও তখন ছেলে তিনটি গভীর নিদ্রায় ডুবে গিয়েছিল। দোতলার হাজতঘর থেকে লালবাজারকে স্তব্ধ মনে হচ্ছিল, তবু তখন আর-একটা বন্দি জীবনের নানান পীড়া, গ্লানি, অস্বস্তি, অশান্তি আমাকে কাতর করছিল। এবং আবার নতুন করে একটা স্বাভাবিক দুর্যোগের কথা আমার মনে হচ্ছিল, যে-দুর্যোগ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। ঘটে, আর আমার নিজেরই জীবনের কার্যকারণের গতিপ্রকৃতির দরুন নিরুপায় অবস্থায় দুর্যোগ পার হয়ে যেতে হয়।

রাজনৈতিক মতবাদ যেমন একটি সৎ ও বলিষ্ঠ বিশ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, নীরাকে ভালবাসাও তেমনি এবং পার্টিকে অন্ধের মতো অনুসরণ করা বা ধর্মীয় গোঁড়ামির মতো মেনে নেওয়া একটা অসৎ দুর্বলতা, ভীরুতা, তেমনি এই সমাজের বৈবাহিক বা পারিবারিক নিয়ন্ত্রণগুলোকেও মেনে নেওয়ার মধ্যে পাপ লুকিয়ে আছে। তাই নীরার আর আমার মাঝখানেও শাসন, সন্দেহ, আইন, জেলখানা, পুলিশ সুপার, ইন্সপেক্টর, ইনভেস্টিগেশন, স্বীকারোক্তি, জিজ্ঞাসাবাদ, ভয়-দেখানো, স্নায়ুকে খোঁচানো, সবই আছে। এবং সেখানেও নানান প্রক্রিয়ায় উত্ত্যক্ত করার ব্যবস্থা আছে।

অতএব সামগ্রিক মুক্তির সাধনায় আমার অস্তিত্ব নিয়োজিত, তাই বহুবিধ কল্পনা আমার আশ্রয়।

তার পরে গতকাল সকালবেলা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়ে ছিল। অত্যধিক পান খেয়ে খেয়ে ছুঁচোলো মোটা ঠোঁট, দাঁত নোংরা হয়ে গিয়েছে, কালো মুখ, মোটা লেন্সের চশমা, এইরকম মাঝবয়সি একজন অফিসার কতগুলি মামুলি প্রশ্ন করেছিল–যার জবাব আমি বহুবার দিয়েছি। নাম, ধাম, পেশা, পিতৃ-পরিচয়, বংশ-পরিচয়, পার্টিতে কত সালে এসেছি (পার্টিতে কোনওদিন আসিইনি, এই আমার জবাব ছিল), কোন কোন নেতাকে আমি চিনি, তারা কে কোথায় আছে (আমি জানি না, এই আমার জবাব) ইত্যাদি। কিন্তু অফিসারটি নিতান্ত যেন কর্তব্য করেই যাচ্ছিল, এমনিভাবে প্রশ্ন করছিল, অন্যমনস্কভাবে ফাইল উলটেপালটে দেখছিল, আর এক-একটা প্রশ্ন করছিল। আমার মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কন্যাদায়গ্রস্ত।

ঘণ্টাদুয়েক পরেই আমাকে সেন্ট্রির পাহারায় আবার লক-আপে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তখন সেই ছেলে তিনটে আর ছিল না। আমি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করছিলাম। আধঘণ্টা বাদেই তালা খোলার শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখেছিলাম, সেই অদ্ভুত চরিত্রের বন্দিকে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল–যাকে আমার উন্মাদ বলেই মনে হয়েছিল, যদিও উন্মাদ অপরাধীদের জন্যে আলাদা গারদ আছে। লোকটার সঙ্গে আমার কোনও কথাই হয়নি। কথা বলবার যোগ্য পাত্র সে ছিল না। এমনও হতে পারে, পাগলামিটাই লোকটার ভান, হয়তো পাই, কাছ থেকে আমাকে নিরীক্ষণ করা বা অনুধাবন করাই তার কাজ। শুধু যে সরকারি গোয়েন্দাই হতে পারে তা নয়, পার্টির স্পাই হওয়াও বিচিত্র নয়। হয়তো পার্টিই এই লোকটিকে পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে আমার সান্নিধ্যে আসার নির্দেশ দিয়েছে, আমার গতিবিধি, মানসিক অবস্থা, স্বীকারোক্তি করি কি না এইসব জানতে। কারণ পার্টির পরিচালকেরা জানে তাদের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে আমার মতভেদ আছে। সরকারিই তোক আর পার্টিরই হোক স্পষ্টমাত্রকেই আমার যেন সরীসৃপ-জাতীয় জীব মনে হয়, আমি এদের কাছে কখনওই স্বচ্ছন্দ বোধ করি নে, কেমন যেন গা ঘিনঘিন করে, ভয় ও ঘৃণা হয়। আবার এমনও হতে পারে একটা পাগলকে সারা দিনরাত্রির জন্যে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সেই একই উদ্দেশ্যে, আমাকে উত্ত্যক্ত করে মানসিক ভারসাম্য হারাবার অবস্থায় নিয়ে যাওয়া।

লোকটার ভাবভঙ্গি ব্যবহার, মাঝে মাঝে কাছে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, ফিসফিস করা, বিড়বিড় করা, ধপাস করে আমার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়া এবং হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শের উদ্যোগ করা, হঠাৎ হেসে ওঠা সব মিলিয়ে বিশ্রী উত্ত্যক্ত করেছিল। আমি চোখ বুজতে পারিনি সারারাতে। নানান রকম ভেবেছিলাম। লোকটা যদি আমাকে কামড়েই দেয় বা খামচে দেয়। কত কী-ই করতে পারত। গতকাল সন্দেহ আর উৎকণ্ঠায় আমার রাত্রি কেটেছে। মনে মনে আমি একটা দুর্যোগের কল্পনা করেছিলাম।

.

 আজ ওরা আমাকে এস বি সেল-এ নিয়ে এল। আজ বাইশে ডিসেম্বর। আসন্ন বড়দিনের উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে কলকাতায়, লালবাজার থেকে জিপে যেতে যেতে আমার মনে হচ্ছিল। যদিও কলকাতাকে আমার মোটেই ভাল লাগছিল না। এমনিতেই কলকাতাকে আমার নীরক্ত মনে হয়। তার ওপরে আমার মনের মধ্যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা। আমার দুপাশে সশস্ত্র প্রহরী। ড্রাইভারের পাশে একজন যুবক অফিসার, যে আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি, ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি। সে লুব্ধ দু চোখ ভরে চৌরঙ্গি এলাকাকে যেন গিলছে। আসন্ন বড়দিনের স্বপ্ন তার চোখে। আর, বিশেষ করে কলকাতার এই অংশটাকে আমার সব থেকে বেশি নীরক্ত ও প্রাণহীন বলে মনে হয়।

যদিও প্রশ্ন ও জবাব বিধিবহির্ভূত, তবু আমি জিগ্যেস করলাম, এখন কোথায় যাচ্ছি?

প্রায় এক মিনিট বাদে, যখন জবাবের প্রত্যাশা প্রায় নিঃশেষ, তখন অফিসার মুখ না ফিরিয়েই বলল, এস বি অফিস।

স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিস। জিগ্যেস করলাম, আবার আমি ফিরে যাব?

 জবাব: না, এস বি সেল-এ থাকতে হবে।

লালবাজারেরটা লক-আপ। সেল শুনে জিগ্যেস করলাম, সেখানেও কি লালবাজারের মতোই?

রাস্তায় একঝাঁক মেয়ের দিকে অফিসার তাকিয়ে ছিল। অন্য সময় হলে হয়তো আমিও মেয়েদের তাকিয়ে দেখতাম, খুশি হতাম। মেয়েদের ঝাঁকটা হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে চলেছে। হয়তো বেড়াতে কিংবা বড়দিনের বাজার করতে চলেছে। কিন্তু ওদের নিয়ে আমার চিন্তা বিস্তৃত হল না। জবাবের প্রত্যাশায় অফিসারটির ঘাড়ের দিকেই আমার দৃষ্টি।

মেয়েদের দলটা পার হয়ে যাবার পর জবাব এল, না, সেখানে এক-একজনের এক-একটা ঘর।

কথাটা শোনামাত্রই মনটা খুশি হয়ে উঠল। এক-একজনের এক-একটা ঘর। সেখানে আর কেউ থাকবে না। কয়েকদিন লালবাজার লক-আপ-এ নানান ধরনের অচেনা লোকদের সঙ্গে থেকে, সবসময় বাতি জ্বালানো, প্রস্রাবের দুর্গন্ধ আর দেওয়ালের অশ্লীল লেখা ও হুঁড়ি, তোর দাঁড়কাকে গাল খাবলে খাবে (সম্ভবত এটা কোনও গানের কলি), অনেক নাম, তারিখ, প্রধানত যৌন-বিষয়ক আনন্দের ব্যাখ্যা, অনেক গানের কলিও তাই এবং আনাড়ি হাতের একই বিষয়ের ছবি, দেখে দেখে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার এই, দেয়ালের অনেক লেখা এবং ছবিই পেনসিলে বোলানো। অথচ পেনসিল কোনও কয়েদির কাছেই থাকা উচিত নয়। হাজতে থাকার সময় লজ্জা নিবারণের জামাকাপড় ছাড়া বন্দির কাছে আর কিছুই থাকবার নিয়ম নেই। ধূমপান নিষিদ্ধ। লক-আপ-এর বাইরে গিয়ে খেতে হয়। ভিতরে কিছুই থাকবে না। এমনকী নিজের ঘড়ি আংটি টাকা-পয়সা সবই জমা দিয়ে দিতে হয়। একটুকরো কাগজ থাকাও নিষেধ। বন্দি যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে বা বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও ব্যবস্থা না করতে পারে, সেজন্যেই নাকি এত বিধিনিষেধ। এরকমই আমি শুনেছিলাম।

আমার জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করল, সেই একলা ঘরটায় আমি ধূমপান করতে পারব কিনা, খবরের কাগজ দেখতে পাব কিনা–নিদেন কোনও বই, ছাপার অক্ষরে যে কোনও জিনিস, যা পড়তে পারা যায় এবং জিজ্ঞাসাবাদের শাস্তি এবার শেষ হবে কিনা।

কিন্তু জিগ্যেস করার আগেই গাড়িটা লর্ড সিনহা রোডের একটা বাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়ল। একটা গাছতলায় গাড়ি দাঁড়াতেই আমাকে নামতে বলা হল। নামতেই প্রকাণ্ড পুরনো ধরনের বাড়িটার ভিতরে আমাকে অফিসারটি নিয়ে গেল। দিনের বেলাও সব ঘরেই আলো জ্বলছে। দেখলেই বোঝা যায়, দেয়াল খুব মোটা। উঁচু ছাদ আর বড় বড় ঘর। বাড়ির ভিতরটা বেশ কর্মমুখর। য়ুনিফর্ম আর সাদা পোশাক পরা অনেক লোক চলাফেরা করছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে কথা বলছে বা বসে বসে কাজ করছে। কারুর হাতে ফাইল, কেউ খালি হাতে। কোথাও তেমন সাজানো-গোছানো কিছু নেই। নিতান্তই যেন কাজ চলা গোছের টেবিল চেয়ার বেঞ্চ কোনও কোনও ঘরে রয়েছে। কোনও কোনও ঘর ফাঁকা। অবিশ্যি কোনও কোনও ঘরের দরজায় দামি পরদা, ভিতরে উজ্জ্বল আলোর ঝলকও দেখতে পেলাম। সম্ভবত বড় অফিসারদের ঘর সেগুলো।

একটা বাড়ি পেরিয়ে আবার একটা বাঁধানো উঠোন এবং সেখানেও কয়েকটা গাছ। গাছে পাখিরা জটলা করছে। আমার ভাল লাগল। লালবাজারের সেই দোতলার হাজতঘর থেকে বেরিয়ে এখানে এসে আমার মনটা খুশি হয়ে উঠল। সেখানে ঘরের ভিতর থেকে বারান্দার দিকে ঘিঞ্জি জালে ঘেরা ফাঁক দিয়ে একটা উঁচু বাড়ির মাথায় দু-তিন ফুট আকাশ দেখতে পেতাম মাত্র। ঘরের অন্যান্য বন্দিদের জন্যে সেই ছোট্ট জালের হিজিবিজি-আঁকা আকাশ দেখবার অবকাশও কম হত।

এখানে উঠোনে শুকনো পাতা ছড়ানো। এখানে-ওখানে পাখির বিষ্ঠা। আমি এ-সবই দু চোখ ভরে দেখলাম। চোখ তুলে গাছের দিকে তাকালাম। শুধু কাক শালিক নয়, কয়েকটা পায়রাও রয়েছে। যদিও উঠোনের ওপারেই পুব দিকে আর-একটা তিনতলা প্রকাণ্ড বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তবু নীল আকাশ অনেকখানিই দেখা যায়। আর আকাশটার দিকে চোখ রাখতে আমার অবস্থা যেন ব্রীড়াময়ী সলজ্জ প্রেমিকার মতো হয়ে উঠল। হয়তো আমার চোখে ঠাণ্ডা লেগেছে বা যে কোনও কারণেই হোক, এত ঔজ্জ্বল্য আমার চোখে সইছে না, তাই চোখের পাতা বুজে যাচ্ছে। অথচ প্রাণভরে দেখতে ইচ্ছে। করছে। এস বি সেল কি এই তিনতলা বাড়িতেই? আমি কি এখানেই থাকব?

–এই দিকে।

তিনতলা বাড়ির একটা দরজার কাছ থেকে অফিসারটি আমাকে ডাকল। বাড়ির ভিতরটা অন্ধকার দেখাচ্ছে। আমি ভিতরে ঢুকলাম। এ বাড়িটাও পুরনো। হয়তো শতাধিক বছর বয়স হবে। ভিতরটা কনকন করছে ঠাণ্ডায়। বাড়িটার বুড়ো বয়সের গন্ধ পর্যন্ত টের পাওয়া যায়। মেঝের ঠাণ্ডা যেন আমার জুতোর সোল যুঁড়ে স্পর্শ করছে। গায়ের চাদরটা আর-একটু ভাল করে জড়ালাম। প্রায় আধো অন্ধকার এক-একটা ঘর দিয়ে অফিসারকে অনুসরণ করে যেতে লাগলাম।

এখানেও সশস্ত্র ও নিরস্ত্র, য়ুনিফর্ম ও সাদা পোশাক পরা কর্মচারীরা চলাফেরা করছে, কথাবার্তা বলছে। আগের বাড়িটার মতো ভিড় এখানে নেই। আর একমাত্র বৈশিষ্ট্য, এখানে কোনও কোনও ঘরের দরজা বন্ধ, এবং বন্ধ দরজার সামনে একজন করে বন্দুকধারী প্রহরী। আগের বাড়িটাতে আমাকে কেউই তাকিয়ে দেখেনি। এখানে অনেকেই আমাকে তাকিয়ে দেখল। আমার মনে হল, এই তাকিয়ে দেখার মধ্যে একটা শিকারির তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি রয়েছে। আমাকে দেখার পর প্রত্যেকেই যুবক অফিসারটির সঙ্গে চোখাচোখি করছে। সেই দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে তাদের যে কী নিঃশব্দ কথার আদান-প্রদান হচ্ছে, আমি বুঝতে পারলাম না। একটা কিছু কথা আদান-প্রদান হচ্ছে, সেটা অনুমান করা যায়।

এ বাড়ির আবহাওয়া একটু যেন অন্যরকম। ঠিক নিশ্চুপ নয়, অথচ একটা স্তব্ধতা যেন বিরাজ করছে। এক-একজনের মুখ কেমন একটা ক্রুর উত্তেজনায় ঝলকাচ্ছে। কেন কে জানে। যেতে যেতে আমার সামনেই হঠাৎ একটা বন্ধ ঘরের দরজা খুলে গেল। একজন খুব দ্রুত বেরিয়ে গেল সেই ঘর থেকে। শাস্ত্রী দরজাটা টেনে দেবার আগেই চকিতে আমার চোখে পড়ল, ঘরের মাঝখানের টেবিলে একজন যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে দু হাত ছড়িয়ে, আর একটা কালো কম্বল টেবিলের ওপর থেকে মেঝেয় লুটোচ্ছে। আমি দরজাটা পার হয়ে যেতেই অন্য দিক থেকে আর-একটি লোককে তাড়াতাড়ি আসতে দেখলাম। তার চোখে চশমা, গায়ে ওভারকোট, কোটের পকেট দুটো যেন অনেক মালপত্রে মোটা হয়ে আছে। আর হাতে স্টেথিস্কোপ। মনে হল, লোকটা ডাক্তার। দেখলাম, সে ওই ঘরটাতেই গিয়ে ঢুকল।

আমার গতি সম্ভবত শ্লথ হয়ে এসেছিল। আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে ছিলাম। আমার কাঁধে একটা ঠেলা লাগতেই দেখলাম, অফিসারটি আমাকে আঙুল দেখিয়ে পথনির্দেশ করছে। কুটি বিরক্তি তার মুখে।

আমি তাকে অনুসরণ করে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। আমার চোখের সামনে টেবিলের ওপর সেই মূর্তিটা ভাসছে। আর ডাক্তারের দ্রুত আগমন ভুলতে পারছি না। কোনও অসুখবিসুখের ব্যাপার নাকি? না কি স্বীকারোক্তির জন্যে…? দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া সেই লোকটির চেহারা মনে করতে চেষ্টা করলাম। প্রকাণ্ড চেহারা, উশকোখুশকো চুল, হাতা গোটানো, লোমশ বুকখোলা শার্ট, আর হাতে ঝোলানো কোট। লোকটা কি স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্যে ওকে মেরেছে? যাকে এক মুহূর্তের জন্য খোলা দরজা দিয়ে আমি দেখতে পেলাম, টেবিলের ওপর লুটিয়ে পড়ে আছে? বেত দিয়ে মেরেছে, না কি কম্বল চাপা দিয়ে ভারী রুল দিয়ে পিটিয়েছে? কারণ একটা কালো কম্বলও টেবিল থেকে মেঝেতে লুটোতে দেখলাম। আর কম্বল জড়িয়ে মারার পদ্ধতি কলকাতা পুলিশের আছে। শুনেছি তাতে দেহে কোনও দাগ হয় না। অথচ প্রহার ও পীড়নের সুবিধে হয়।

বন্দির আঘাত কি খুব বেশি হয়েছে, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে, তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাক্তার পাঠিয়ে দিল।

দাঁড়ান।

আমাকেই বলা হল। ওপরে উঠেই বাঁ দিকে টেবিলের সামনে চেয়ারে একজন ফরসা মোটা মাঝবয়সি লোক বসে ছিল। আমাকে যে নিয়ে এল সেই অফিসারটি নিচু হয়ে নিচু গলায় কী যেন বলল মোটা মাঝবয়সিকে। মোটা মাঝবয়সি একবার আমার দিকে তাকিয়ে তার হাতের পেনসিল দিয়ে এক দিকে নির্দেশ করল। অফিসারটি আমাকে ডাকল, আসুন।

অনুসরণ করলাম। সামনেই ডান দিকে পর পর কয়েকটি দরজা। একটা ভেজানো দরজা ঠেলে আমাকে ভিতরে যেতে নির্দেশ করে সে বলল, আপনি একটু বসুন।

আমি জিগ্যেস করলাম, এটা কি সেল?

না। বলেই সে চলে গেল।

একজন শাস্ত্রী এসে দাঁড়াল এবং দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। এটা সেল নয়। একটি টেবিল, দুটি চেয়ার, এই মাত্র আসবাব। ঘরের মেঝে পুরনো, দেয়ালও তাই। ঘরের মধ্যে যেন দলা দলা শীত জমে ছিল। ঢোকা মাত্রই তারা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠল, কেঁপে কেঁপে উঠল, এবং হঠাৎ শিরদাঁড়া শিউরিয়ে ছলাৎ করে যেন একঝলক রক্ত উঠে এল আমার মাথায়। স্বীকারোক্তি! আবার স্বীকারোক্তি!

এটা জিজ্ঞাসাবাদের ঘর। অবিকল সেই নিচের ঘরটার মতোই, যে-ঘরে সেই বন্দি পড়ে আছে। আমার শীতের কাঁপুনিটা বোধহয় এই কারণেই, ওই একটি মুহূর্তের দৃশ্যের জন্যেই। আমাকেও হয়তো স্বীকারোক্তির জন্যে…

একটাই মাত্র জানালা আছে ঘরটিতে। দেয়ালের অনেক উঁচুতে আমার মাথা ছাড়িয়ে। শুধু আকাশই দেখা যায়। আমি একটা চেয়ারে বসলাম। দাঁড়াতে পারছি না, ভীষণ শীত করছে, কাঁপুনিটা বুকের কাছে উঠে এসেছে। হাতে পায়ে তেমন যেন বল নেই। পা তুলে টেবিলটা চেপে ধরে, শক্ত হয়ে, গুটিশুটি হয়ে বসলাম।

তার পরে প্রথমেই আমার মনে পড়ল, আমার চুলের মুঠি আমার বাবার হাতে, ভীষণ লাগছে। গাল দুটো জ্বালা করছে থাপ্পড়ের ঘায়ে। বাবার খালি গা, পেশল শক্ত শরীর ও ক্রুদ্ধ মুখটা মনে হচ্ছে বাঘের থেকে ভয়ংকর, সিংহের থেকে হিংস্র। গলায় হিংস্র জিজ্ঞাসা: বল, ইস্কুল পালিয়ে কোথায় গেছিলি? নৌকো বাইতে? মাছ ধরতে? বল বল বল। তা নইলে খুন করব আজ তোকে।

তার পরেই মনে পড়ল, ঢাকা শহরের সেই প্রায়ান্ধকার গলিটার কথা, যেখানে মাত্র একটি কেরোসিনের লাইটপোস্ট ছিল, এবং তিনজন বন্ধু আমাকে ঘিরে ছিল। পার্টির বন্ধু। আজকের এই পার্টি নয়, অন্য পার্টি, সশস্ত্র গুপ্ত বিপ্লবী পার্টি। তিনজনেরই চোখমুখ ভীষণ নিষ্ঠুর আর হিংস্র দেখাচ্ছিল। সকলেই আমরা সমবয়সি, ষোলো সতেরো আঠারোর মধ্যেই সকলের বয়স। বন্ধু তিনজনের জিজ্ঞাসা, আমি রায়বাহাদুর বিরাজমোহনের বাড়ি বেড়াতেই যাই কি না, কেন যাই এবং বিরাজমোহনের নাতনি অলকাকে আমি সমিতির কথা বলেছি কি না।

আমরা জবাব চাই।ওরা তিনজনেই রুদ্ধশ্বাস ক্রুদ্ধ গলায় জিগ্যেস করল।

বিরাজমোহনকে আমি কোনওদিনই দেখিনি, কিন্তু তাঁদের বাড়িতে যাই। এই যাওয়াটা নিষিদ্ধ, কারণ বিরাজমোহন পার্টির বিচারে বিশ্বাসঘাতক, শত্রু। আমি তাঁর কাছে যাই না, তাঁদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাছে যাই, কারণ ভাল লাগে, তারা সকলেই খুব ভাল। বিরাজমোহনের নাতিনাতনি বলে তাদের কোনও দোষ নেই, তারা বিশ্বাসঘাতক নয়। আর অলকার সঙ্গে আমার প্রেম (অন্তত সেই বয়সে, সেটাই আমাদের বিশ্বাস ছিল। অলকার বয়স তখন বারো, দেখতে বেশ সুন্দর ছিল, আমরা হাতে হাত ধরতাম, অন্নদাশঙ্কর রায়ের আগুন নিয়ে খেলার নায়ক-নায়িকার মতো চুমো খাবার চেষ্টা করতাম, ইত্যাদি), তাকে আমার জীবনের সব গোপনীয়তাই প্রকাশ করে দিই। বিশ্বাস করি বলেই বলেছি। পার্টির বন্ধুরা ঠিক প্রশ্নই করেছিল, তারা ঠিক সন্দেহই করেছিল। কিন্তু ওরা আমার এবং অলকাদের ওপর অবিচার করছে, অন্যায় করছে, তাই আমি অস্বীকার করলাম, এ-বিষয়ে কিছুই জানি না।

প্রথমে নরেশ দুম করে একটা ঘুষি মারল আমার চোয়ালে। বলল, এখনও সত্যি কথা বল।

 জানি না।

সঙ্গে সঙ্গে তিনজনেই মারতে আরম্ভ করল। বলতে লাগল, ট্রেইটার! স্পাই। ওকে খুন করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসতে হবে।

আমার নাক দিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। এমন সময়ে কারা যেন গলিতে ঢুকল। লোকজনের সাড়া পেয়ে বন্ধুরা অন্ধকারে দৌড়ে কে কোথায় চলে গেল। আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে একদিকে চলতে লাগলাম। লোকজনের কাছে বাইরে আমি কিছু জানাতে চাই না। যদিও ওরা নিশ্চয়ই লক্ষ রেখেছিল, আমি কোথায় যাই। আমি বুড়িগঙ্গার ধারেই গেলাম। কারণ জল দিয়ে মুখ-চোখ ধোবার দরকার ছিল।

এর পরেই আমার মনে পড়ল, আমার স্ত্রী আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমার বুকের কাছে জামাটা সে খামচে ধরে আছে। হিংস্র রাগে ওর চোখ, ওর মুখ জ্বলছে। আমি সিঁড়ির কাছে, অদুরেই বাড়ির ঝি ঘর মুছছে ন্যাতা বুলিয়ে, যদিও তার হাত ঠিক কাজ করতে পারছে না, নত মুখ, নত চোখের দৃষ্টি, এদিকে এবং আমার মা ঘরের ভিতর থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। স্বীকারোক্তির জন্যে ও আমার জামায় হ্যাঁচকা টান মেরে ফুঁসে উঠল, বলল, কাল তুমি নীরার সঙ্গে দেখা করেছিলে কি না।

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ওর চেহারাটা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। আমাকে একটা ধাক্কা মেরে বলল, বলল, ওকে তুমি ভালবাসো? কেন ভালবাসো? বলো বলো বলল।

ওর কষ্ট, কষ্টের জন্যে হিংসা, হিংসা থেকে রাগ, রাগ থেকে ঘৃণা এ সবই আমি বুঝতে পারছি, এবং নীরাকে আমি ভালবাসি, নীরার সঙ্গে দেখাও করে থাকি। কিন্তু কেন, এর জবাব, ছেলেবেলায় ইস্কুল পালানোর মতোই, অলকাদের সঙ্গে মেশার মতোই, এবং আজকের এই বিপ্লবী পার্টিতে যোগ দেবার মতোই অপ্রতিরোধ্য ও কোনও ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আমি চুপ করেই রইলাম, জামাটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম।

ও একটা অস্বাভাবিক ক্রুদ্ধ চিৎকার করে উঠল, আর দু হাত দিয়ে আমার জামাটা ছিঁড়ে ফালা করে দিল।

এবার আমার মনে পড়ল, পার্টির লোকাল অ্যাকশন কমিটির তলব। মাত্র মাসদুয়েক আগের কথা, অ্যাকশন কমিটি আমাকে ডেকে পাঠাল। অ্যাকশন কমিটি মানে, পার্টির আর্মস অ্যামুনিশন যাদের তত্ত্বাবধানে, যারা শত্রুকে চিহ্নিত করে ও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয় আর কর্মীদের অপরাধের বিচার করে।

সেই এক জনবিরল লোকালয়, পুরনো বাড়ির দোতলা, প্রায়ান্ধকার ঘর। পাথরের মূর্তির মতো নিরেট শক্ত মুখ নিয়ে পাঁচজন বসে আছে। অ্যাকশন কমিটি। কুরিয়র আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল, বাইরে থেকে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। আমি অ্যাকশন কমিটিকে পার্টির নিয়মতান্ত্রিক অভিবাদন করলাম। কিন্তু কেউই প্রত্যভিবাদন জানাল না। আমাকে শুধু তাদের মুখোমুখি বসতে ইঙ্গিত করা হল।

মিহির, অ্যাকশন কমিটির নেতার এই ছদ্ম নাম, যার স্মার্টনেস, সাহস, চেহারা, বাকভঙ্গির খুবই নাম আছে পার্টির মধ্যে। বোনাপার্ট বলে সবাই যাকে আদর করে, কারণ তার চেহারার সঙ্গে নাকি নেপোলিয়ানের বিশেষ সাদৃশ্য আছে, এবং জিমনাসিয়ামের ক্রীড়ায় বেশ পটু ও স্বভাবতই তার শার্ট-খোলা বুকের ও চলাবসার ভঙ্গি দৃষ্টি-মুগ্ধকর, যার চোখ তীক্ষ্ণ ঈগলের মতো, আর একদম হাসে না, যেটা নিয়ে সবাই বিস্মিত প্রশংসায় ও শ্রদ্ধায় স্তব্ধ, কারণ মিহিরকে কেউ হাসতে পর্যন্ত দেখেনি। আমার ধারণা, মিহির আত্মসচেতন, অনেকটাই ভঙ্গিসর্বস্ব অ্যাডভেঞ্চারার। সে-ই আমাকে জিগ্যেস করল, উম্মম্ হ্যাঁ, কমরেড! অ্যাকশন কমিটি আপনার কাছে জানতে চাইছে, ধ্রুবকে আপনি কোনও শেলটারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কিনা। তার আগে জানতে চাই, পি সি এগারো-শো বাই বারো আট উনপঞ্চাশ নম্বরের সার্কুলার আপনাদের সেল-এ পৌঁছেছিল কিনা, এবং আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিনা।

মিহিরের চোখ থেকে যেন একটি ঘৃণামিশ্রিত বিদ্রুপের ঝিলিক আমাকে হানল, এবং বাকি সকলেরই তাই।

মিহির যা জিগ্যেস করল, সবই সত্যি। গোপন সার্কুলারে ঘোষণা করা হয়েছিল: ধ্রুবকে কতকগুলি বিশেষ কারণে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পাটির বিশেষ স্বার্থে কারণগুলি এখন ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। সভ্যদের সবাইকে জানানো যাচ্ছে, ধ্রুবর সঙ্গে যেন কেউ কোনওরকম সম্পর্ক না রাখেন, এমনকী বাক্যালাপ না করেন, করলে পার্টিবিরোধী কার্যকলাপের জন্যে তাঁকেও শাস্তি পেতে হবে, ইত্যাদি। আমি সে-সার্কুলার পাঠ করেছিলাম, কিন্তু ধ্রুবকে আশ্রয়ও সত্যি দিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম, প্রকৃত দেশপ্রেমিক, বিশ্বাসী সৎ পার্টিজান, চিন্তাশীল, বিবেকবান ধ্রুবর সঙ্গে জেলার একজন নেতা ও অ্যাকশন কমিটির মিহিরের ব্যক্তিগত বিরোধের ফলে তাকে পার্টি থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা চলছিল। তাকে স্পাই আখ্যা দেবার ষড়যন্ত্র চলছিল, এবং সেটা কার্যকরীও করা হয়েছে। অথচ ধ্রুব একজন আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী, পুলিশ তার জন্যে হন্যে হয়ে ফিরছে। এ অবস্থায় তাকে পার্টি থেকে বের করে দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হল, আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে সে বেরিয়ে পড়ুক। অর্থাৎ পুলিশের হাতে চলে যাক। পার্টি থেকে বহিষ্কার মানেই আন্ডারগ্রাউন্ডের আশ্রয় তাকে ছেড়ে দিতেই হবে। তা হলেই পুলিশ তাকে ধরতে পারবে, এবং ধরলেই, যেহেতু ধ্রুব একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী, পার্টি বেআইনি ঘঘাষিত হবার আগে যে প্রকৃতই একজন জননেতা ছিল, তাকে পুলিশ নানাভাবে পীড়ন করবে কথা আদায় করবার জন্যে। এক দিকে পার্টি থেকে বহিষ্কার, অন্য দিকে পুলিশের পীড়ন, দুইয়ে মিলে স্বভাবতই মানসিক শক্তিতে ভাঙন ধরতে পারে, স্বীকারোক্তিও করে ফেলতে পারে।

এ-অবস্থায় ধ্রুব আমার কাছে এসেছিল। পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ডের আশ্রয় ছেড়েই সে আমার শরণাপন্ন হয়েছিল, কেঁদে ফেলেছিল, এবং বলেছিল, আমি আত্মহত্যা করতে পারি, তবু পুলিশের কাছে ধরা দিতে পারব না। মিহির আর যতীন (জেলা কমিটির নেতা) প্ল্যান করে আমার এই সর্বনাশটা করছে, তারা আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চাইছে। অথচ বিশ্বাস করো, কোনওরকম নেতৃত্বের মোহ আমার নেই, আমি শুধু কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওদের কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করেছিলাম। ওরা সেটা সহ্য করতে পারছে না বলেই আমাকে এভাবে বের করে দিচ্ছে।

সৎ ধ্রুবকে আমি দেখলাম, সে অসহায়। আমি তাকেই বিশ্বাস করি। মিহিরের অতীতকে আমি জানি না, তাকে ওপর থেকে আমাদের এলাকায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে বাইরে থেকে এসেছে। আমি ধ্রুবকে চিনি, বুঝি, বিশ্বাস করি এবং তাকে এভাবে ক্ষুধার্ত নেকড়েদের মুখে এক টুকরো মাংসের মতো আমি ছুঁড়ে দিতে পারি না। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু আমার উপায় নেই, অ্যাকশন কমিটির কাছে আমাকে অস্বীকার করতেই হবে। স্বীকার করলে আমার ওপর নির্দেশ অমান্যের শাস্তি নেমে আসবে তো বটেই, ধ্রুবকেও বাঁচানো যাবে না। এখন এই অ্যাকশন কমিটির কাছে বিশ্বস্ত থাকা বিবেকহীন দাস মনোবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি বললাম, সেই সার্কুলার আমি পড়েছি। ধ্রুবকে আমি আশ্রয় দিইনি।

অ্যাকশন কমিটির নিরেট মুখগুলো পরস্পরের দিকে একবার চোখাচোখি করল। মিহির তার বাক্যবাণ প্রয়োগ করল। হেসে ঘাড় কুঁচকে বলল, আপনার মতো একজন খাঁটি কমরেড পার্টির কাছে মিথ্যে কথা বলবে এটা আশা করা যায় না।

মিহির জানত তার এই ভঙ্গিটা অপরের পক্ষে খুবই ক্রোধের উদ্রেক করে। আমি শান্তভাবেই বললাম, আমি মিথ্যে বলিনি।

যদি প্রমাণ হাজির করা যায়?

তা হলে তো কোনও কথাই নেই। আমি জবাব দিলাম।

অ্যাকশন কমিটির পাথুরে মুখগুলো তীক্ষ্ণ ধারে ঝলকাতে লাগল, চোখগুলো অঙ্গারের মতো জ্বলতে লাগল। ঘৃণায় হিংস্র দেখাল। সব থেকে কমবয়স্ক যে, যাক টেক নাম পি পি সে শাসিয়ে উঠল, প্রমাণ হলে মনে রাখবেন, আপনাকেও ধুবর মতোই পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হবে।

জানি। আমি দৃঢ়তা প্রকাশ করলাম।

বিকাশ (ছদ্মনাম) নিষ্ঠুর মুখে, কঠিন গলায় বলল, শুধু বের করেই দেওয়া হবে না, তার চেয়েও কঠিন শাস্তি

বাকিটা তার চোখের আগুনে ও দাঁতে দাঁত ঘষাতেই বোঝা গেল। ওরা অ্যাকশন কমিটির লোক, হয়তো ওদের প্রত্যেকের কাছেই রিভলভার রয়েছে। ওরা ইচ্ছে করলে আমাকে

গত শুক্কুরবার– মিহিরের দৃঢ় গম্ভীর ও নাটুকে গলা বেজে উঠল, গত শুকুরবার রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ ধ্রুব আপনার কাছে যায়নি?

কথাটা মিথ্যে নয় এবং খবরটা কমরেড রেবার (আমার স্ত্রী, পার্টির সভ্যা, অত্যন্ত বিশ্বস্ত, স্ত্রীলোক মাত্রেই যা হয়ে থাকে ভালবাসা ও ধর্মের বিষয়ে যুক্তিতর্কহীন, যদি ধর্ম মানে, এবং বর্তমানে পার্টি, আমার মতে ধর্মীয় দল ও আচার-অনুষ্ঠানের পর্যায়ে পৌঁছেছে, যুক্তি তর্ক বোধ বুদ্ধিহীন অলৌকিক বিশ্বাসে আত্মদানে উন্মুখ, আমার স্ত্রী একজন সেইরকম বিশ্বস্ত কমরেড, এবং বিশ্বস্ততার মূলেও ভালবাসায় যেহেতু আহত, সে ফণিনীতুল্য) কাছ থেকে শুনেছে।

আমি তবু বললাম, না।

তা হলে কমরেড রেবা মিথ্যে বলেছেন? মিহির বলল বেশ বিদ্রুপের ঢেউ দিয়ে, একটু অ্যাসিড-হাসির জ্বালা ছিটিয়ে। যেন এর পরে আর আমার স্বীকারোক্তি না করে উপায় নেই। আমি অবশ্য রেবাকে অনুরোধ করেছিলাম, যেন সে এ-খবর পার্টিকে না দেয়। কিন্তু দিয়েছে।

বললাম, যদি তিনি বলে থাকেন তবে মিথ্যেই বলেছেন।

মিহির গর্জন করে উঠল, কমরেড, সাবধান, আপনি আর একজনকে মিথ্যেবাদী করছেন।

আমি মিথ্যে বলিনি।

শাট আপ লায়ার। পি পি ক্রুদ্ধ স্বরে গর্জে উঠল, নিজের উরুতেই একটা ঘুষি মারল।

আর তার মাঝখান থেকে আহত বাঘের মতো গর্জিত গোঙানি ভেসে উঠল মিহিরের গলায়, আপনি সেই রাত্রেই একটা চিঠি লিখে, টাকা দিয়ে ওকে কোথাও পাঠিয়ে দেননি?

না।

এই ঘৃণ্য মিথ্যে বলার পরিণাম আপনি জানেন?

আমি মিথ্যে বলিনি।

মিহির অসহায় আক্রোশে কী করবে ভেবে পেল না। তার সবল পেশল হাত, মস্ত বড় থাবা অন্ধশক্তিতে কয়েক মুহূর্ত মোচোল। তার পরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ডিসলভ দিস মিটিং, একে আজ চলে যেতে দিন। আমাদের সিদ্ধান্ত একে পরে জানানো হবে।

পি পি বা বিকাশের চলে আসতে দেবার ইচ্ছে ছিল না। তবু সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না।

আমি বললাম, যেতে পারি?

মিহির বলল, নতুন সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত।

আমি চলে এলাম। তখনও আমার ছেলেবেলার কথাই মনে পড়েছিল, কৈশোরের যৌবনের ইস্কুল পালানো, অলকাদের সঙ্গে মেশা, নীরাকে ভালবাসা, ধ্রুবকে আশ্রয় দেওয়া এবং

.

দরজাটা খুলে গেল। স্বীকারোক্তি। কালো গগলস পরা রাশভারী লোকটি পিছন ফিরে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। বগলে একটা ফাইল। এবার জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু সেই শিরদাঁড়া-শিউরনো শীতটা এখন আমার আর নেই। ঘাড়ে গর্দানে স্কুল পেশল লোমশ লোকটি এক টানে গায়ের কোটটা খুলে ফেলল। ফাইলটা টেবিলে রাখল। মোটা স্বর শোনা গেল, এখানে এসে আপনার বডি সার্চ হয়েছে?

না।

দাঁড়ান।

দাঁড়ালাম। লোকটা আমার শূন্য পকেটগুলো, কোমর, পেট, চাদর ঝেড়ে দেখে নিল।

বসুন।

বসলাম। গগলসটা খুলল সে। চোখের পাতায় লোম নেই, কোলগুলো রক্তাভ, অনেকটা কাঁচা ঘায়ের মতো। চেয়ারে বসে ফাইলের পাতা উলটে যেতে লাগল, আর মোটা স্বরে হুম হুম করতে লাগল। তার পরে আচমকা জিগ্যেস করল, কিছু বলবেন, না বলবেন না?

কোন বিষয়ে? আমি বললাম।

লোকটা শব্দ করল, হুম।

মোটা ঠোঁট দুটো চেপে বসল ওর। তার পরে সেই রক্তাভ চোখদুটি তুলে নিষ্পলক তাকাল আমার দিকে। লোকটার মুখটা যেন ফুলে উঠছে, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, ধলেশ্বরীতে ঝড় উঠব-উঠব করছে, আকাশ কালো হয়ে উঠছে, বায়ুকোণে চিকুরহানা বাজের দূর গর্জন। ছোট নৌকো, আমি আর মা যাত্রী, গন্তব্য মামাবাড়ি, একমুখ দাড়িওয়ালা মাঝি পবন। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে বুকের কাছে। চোখে আতঙ্ক। ডাক দিল, পবন।

পবন তখন হাঁক দিচ্ছিল, রও হে, আর দশ ঠেলা।

সে কড়কে বলছিল, আর দশবার হাল ঠেললেই তীরে পৌঁছুবে। নৌকোটা অসম্ভব দুলছিল বাতাসে নয়, পবনের হালের চাড়ে।

গুরু গুরু গুরু। মা বলছিল।

কোন বিষয়ে, অ্যাঁ? লোকটা গোঙানো সুরে উচ্চারণ করল। ঘেয়ো রক্তাভ চোখগুলো অপলক।

একটা আর্তনাদের স্বর ভেসে এল ধলেশ্বরীর তীর থেকে, আর গাছগুলো নুয়ে পড়ল। ঝড়ের আঘাতে পৃথিবীর আর্তনাদ ওটা।

আর একটুখানি, আই দ্যাওয়া! পবন চিৎকার করল আবার।

 লোকটা ভ্যা-ভ্যা করে হেসে ফেলল।

পবন ঝপাং করে লাফ দিল জলে। চিৎকার করল, ডরাইয়েন না মা, বুক জলে।

নৌকোর কাছি পবনের হাতে!

লোকটা বলল, আমরা যেমন জিগ্যেস করি, আপনারা সবাই সেরকমই জবাব দেন। সত্যি বলছি, আমি টায়ার্ড, টায়ার্ড। কোনও মানে হয় না, রোজ রোজ সেই একই কথা। জানা কথাই তো বাপু, আপনারা কেউ কিছু বলবেন না। নিন, সিগারেট খান।…কোনও জীবনেই সুখ নেই মশাই। বিপ্লব করেই বা কী সোনার রাজত্ব তৈরি করবেন আপনারা! ইংরেজ আমলে আমরাও অনেক কিছু ভেবেছিলাম। বসুন, আসছি। কোটটা তুলে নিয়ে ফাইলটা হাতে করে লোকটা চলে গেল। দরজাটা টেনে দিয়ে গেল।

একটা দুর্যোগ গেল। হয়তো আর-একটা দুর্যোগ আসবে, তার পরে আর একটা, তার পরে…। জীবনব্যাপী দুর্যোগ। তাকে রোধ করা যায় না। যে বিশ্বে বাস, সেই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যেই দুর্যোগের নানান কার্যকারণ ইন্ধন, এবং আমি কেন দুর্যোগের মাঝখানে, এর একমাত্র কারণ, আমি যে কারণে ছেলেবেলায় ইস্কুল পালিয়েছিলাম, আরও কৈশোরে চৌদ্দ বছর বয়স হবে তখন, বিধবা বীণাদির গোপন চিঠি অমরদাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম, সেই বিষণ্ণ যুবতী বীণাদি পাড়ার ক্লাবের নেতা লাইব্রেরি-স্রষ্টা অমরদাকে ভালবাসতেন, এবং দুজনের দেখা-সাক্ষাৎ বারণ হয়ে গিয়েছিল, বীণাদির অভিভাবকেরা বীণাদিকে বেরুতে দিতেন না, পাড়ার সব বয়স্ক মানুষেরাই যেন এই দুজনের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, একটা ফ্রন্ট তৈরি করেছিল, পাহারা দেওয়া, গোয়েন্দাগিরি করা, নোংরা রসিকতা ও কুৎসিত কথা বলা, আর স্বভাবতই আমাদের অভিভাবকেরাও ক্লাবে যেতে নিষেধ করেছিল, অমরদার সংস্রব বিষবৎ ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেটা অন্যায় মনে করেছিলাম, এবং ওই বয়সে হৃদয়ের সকল আবেগ ও সমর্থন অমরদা ও বীণাদির পক্ষে ছিল। আমি বীণাদির চিঠি অমরদাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম এবং অমরদার চিঠি বীণাদিকে, আর সেই পৌঁছে দিতে গিয়েই ধরা পড়েছিলাম, যদিচ বামাল নয়, তার পরেই আমি রক্তাক্ত, দাদার একটি ঘুষিতেই কষের দাঁত নড়ে গিয়েছিল, বাবার ছড়ির দাগ আমার শরীরটাকে চিতাবাঘ করে তুলেছিল, আমার মায়ের ক্রুদ্ধ প্রশ্ন, এখনও বল, অমরের চিঠি বীণাকে…?

না।

উঃ ভগবান, এই ছেলেটাকে কেন আঁতুড়েই মুখ নুন পুরে দিইনি।দুঃসহ রাগে ও ঘৃণায় মা চিৎকার করে উঠেছিল।

আর আমি মনে মনে বলেছিলাম, হে ভগবান, বীণাদি আর অমরদা যেন ধরা না পড়ে। এবং তখনও সেই একই দুর্যোগ…

.

দরজাটা আবার খুলে গেল। অন্য একজন ঢুকল। সেই ফাইল হাতে। ধুতি পরা, শার্টের ওপরে কোট। চেয়ারে এসে বসল। পকেট থেকে কতগুলো কাগজ বের করে দেখল। একবার আমাকে তাকিয়ে দেখে বলল, আমি যা পড়ে যাচ্ছি, সেগুলো আগে শুনে যান, কোথাও না মিললে আমাকে বলবেন। …সালে পার্টিতে জয়েন, সময়ে লোকাল কমিটিতে উত্তীর্ণ, সন্দেশখালির কৃষক সম্মেলনে যোগদান, মেটিয়াবুরুজে..তারিখে উত্তেজক বক্তৃতাদান, গান ফ্যাক্টরিতে গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলা, রেলওয়ে ছাব্বিশ নম্বর গেটের ওপারে পার্টির আর্মস সরিয়ে নিয়ে যাওয়া…

লোকটা একটা কথাও মিথ্যে বলছিল না, তারিখ বা সময়, একটাও ভুল বলছিল না। যেন আমারই কোনও সহকর্মী, সর্বক্ষণের সঙ্গী, কতগুলো গোপন ও প্রকাশ্য ঘটনা বলে চলেছে। বলে চলেছে, অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল।…তারিখে, এবং…তারিখে ও…তারিখে কমিটির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়েছে, তারিখে গণপৎ সিং-এর কাছ থেকে এক ব্যাগ ক্র্যাকার নিয়ে সাত নম্বর সেলকে দিয়েছেন (আশ্চর্য! আশ্চর্য! লোকটা হয়তো এর পরে বলবে রেবার সঙ্গে আমার কবে ঝগড়া হয়েছে, নীরার সঙ্গে আমি কোথায় কখন দেখা করেছিলাম), প্রাদেশিক কমিটির আরতি দত্তকে নিয়ে…তারিখে রাত্রে ফিটনে করে পার্কসার্কাস থেকে বালিগঞ্জ স্টেশন (অসম্ভব। এই বিষম সত্যি শুনে নিজেকেই অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে), এবং সেখান থেকে…ইত্যাদি।

লোকটা সত্যি ঘটনা বলে যেতে লাগল, আর ছোট ছোট তীক্ষ্ণ চোখ তুলে আমাকে দেখতে লাগল। আমি সেই যে ভাবলেশহীন মুখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কথাগুলো শুনতে শুনতে আর আমার কোনও ভাবের সঞ্চার হল না। বিস্ময়কে যথাসম্ভব রোধ করে আমি ধরেই নিলাম, আমার মুখের সামনে একটা আয়না ধরা হয়েছে, এবং বলা হচ্ছে, দেখুন আপনার ঠোঁটের ওপর ডান দিকে একটা তিল, বাঁ কানের পাশে ছোট একটি কাটা দাগ, নাকটা…চোখ দুটো ইত্যাদি। আর আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, না, না, না। ওটা আমি নয়, ওটা আমার মুখের ছায়া নয়। না না না

তা হলে সবই মিলছে, সবই সত্যি?

কীসের?

এই আমি যা যা বললাম? আপনি যখন কিছুই বললেন না, তখন সবই মিলে গেছে নিশ্চয়।

আমি বললাম, এ সব আমি কিছুই জানি না।

লায়ার! একটা আচমকা গর্জনের সঙ্গে টেবিলের ওপর প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত পড়ল। মনে হল, গত শতকের পুরনো ঠাণ্ডা ঘরটা কেঁপে উঠল। একটা জ্বলন্ত মুখ, ক্রোধে ও ঘৃণায় আরক্ত। চোয়ালের হাড় কঠিন।

আমি অনেকটা অসহায় বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। একটাই মাত্র মন্ত্র জপ করতে লাগলাম, না না না, না না না, না না না। এবং লর্ড সিনহা রোডের এই ঘরে আমি ঝিঁঝির ডাক শুনতে পেলাম।

ভীষণ স্তব্ধ মনে হল কয়েকটি মুহূর্ত। তার পরেই লোকটির নিচু স্বর শোনা গেল। নিচু কিন্তু অনেক বেশি হিংস্র। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলল সে, বাট আই উইল নট স্পেয়ার ইউ। আই উইল রীড এগেন, হিয়ার অ্যাটেন্টিভলি অ্যান্ড দেন আনসার।

লোকটা আবার সেই কাগজ পড়ে যেতে লাগল। কিন্তু এবার আমি শুনছিলাম না। ওর পড়ার চেয়ে দ্রুত এলোমেলো বহু ঘটনা ও গলার স্বর আমাকে ঘিরে ধরল। অ্যাকশন কমিটি; মিহির এই দেখুন কমরেড রেবার চিঠি, তিনি সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন। ধ্রুব কী ভাবে, আপনার কাছে কখন এল, কী বলল, আপনি কী বললেন, কী করলেন। আপনি এখনও স্বীকার করুন।

…রেবাঃ এই যে সেই চিরকুট, নাম না থাকলেও নীরার হাতের লেখা আমি চিনি। মিথ্যুক। এখনও বলল, তা হলে তুমি ওর সঙ্গে বাসুলি বিলের ধারে দেখা করেছিলে? ছেলেবেলা; বাবাঃ সত্যি কথা বল ইস্কুল পালিয়ে নৌকা বাইতে গেছিলি? কৈশোর; সমিতির বন্ধুরা: বিল অলকাকে কি তুই সমিতির কথা বলেছিস?…অ্যান্ড দেন আনসার।…

আনসার, আই সে আনসার। আবার একটা ঘর কাঁপানো ক্রুদ্ধ গর্জন এবং টেবিলের ওপর প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত।

আমি আমার সামনে দেখলাম, একটা রক্তাভ অঙ্গার মুখ, চিতার ক্রুদ্ধ চোখ। এবং আমি দেখলাম, ঘর কাঁপছে। ভেজা বিছানা থেকে আমি ঘুমন্ত লাফ দিয়ে উঠলাম। দশ বছরের আমি, জলে ভেসে যাওয়া মেঝেয়, অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে বাবার চিৎকার শুনলাম ঘরের বাইরে চলে ফেলু (আমার মায়ের নাম), ছেলেদের নিয়ে ঘরের বাইরে চলো, পশ্চিমের চাল উড়ে গেছে। আমার বুকের মধ্যে ভীষণ কাঁপছিল। ঝড়ের গর্জন আর তার দাপটে টিনের চাল যেন ভয়ে ককিয়ে কাঁদছিল। বিদ্যুঝলকে চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মায়ের আঁচল ধরে আমি ভোলা দরজা দিয়ে নতুন পাকা ঘরের দিকে চলোম। মস্ত বড় উঠোনটা বাতাসে বৃষ্টিতে বিজলি হানাহানিতে তোলপাড় হচ্ছিল। মায়ের একটা হাত আমার কাঁধে এসে পড়ল। সেইদিকে চোখ রেখে আমার সামনে আমি অঙ্গার-মুখ আর চিতা-চোখ ভেসে উঠতে দেখলাম। তার গর্জনের জবাবে, আমি ভিজতে ভিজতে নতুন পাকা ঘরের দিকে যেতে যেতে বললাম, জানি না। আমি এসবের কিছুই জানি না।

আমার মুখে থুতু ছিটকে লাগল, আর কানের কাছে গর্জন শোনা গেল, কী করে জানতে হয় আমি শিখিয়ে দেব। আই উইল টীচ ইউ, ইউ লায়ার, কাওয়ার্ড। একটা সত্যি কথা যে বলতে পারে না, সে করবে বিপ্লব! কাপুরুষ দখল করবে রাষ্ট্র ক্ষমতা! থু থু… ।

সম্ভবত লোকটা পান খায়, আর সুগন্ধি জর্দা, কারণ ছিটকানো থুতুতেই তা অনুমেয়। আমার গা-টা ঘুলিয়ে উঠল। তবু হাত পা শক্ত করে, ঝড়ের দাপটের মধ্য দিয়ে কাঁচা উঠোনের কাদা মাড়িয়ে, মায়ের হাতের স্পর্শে, নতুন পাকা ঘরের দিকে এগিয়ে চলোম।

দড়াম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। আমার সামনের চেয়ারটা শূন্য। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমার ভিতরটাও শুন্য বোধ হল। অবসাদের নিঝুমতায় যেন ডুবে গেলাম। কিন্তু শীতবোধ আর একটুও ছিল না। এবং হঠাৎ আমার হাসি পেতে লাগল গর্জিত গালাগালগুলোর কথা মনে করে, লায়ার, কাওয়ার্ড! তবু লোকটা আশ্চর্যজনকভাবেই, সন্দেহজনক বিস্ময়করভাবেই আমার পার্টিজীবনের গোপন খবরগুলো জেনেছে যা দিয়ে ভিতরের সত্যটাকে ঘায়েল করতে চেয়েছিল। ভিতরের সত্য যা আপেক্ষিক অথচ ধ্রুব, যা কোনও নিয়মাধীন নয় অথচ একটা সুকঠিন নিয়মের প্রেমে আবদ্ধ, যা অথৈ, ছোঁয়া যায় না।

কতক্ষণ একলা বসে ছিলাম জানি না। আমার ভিতরে ভিতরে একটা প্রতীক্ষা ছিল সেই লোকটা আবার আসবে।

দরজাটা খুলে গেল। আবার–। না, একজন য়ুনিফর্ম পরা লোক। আমাকে ডাকল, আসুন।

উঠে আমি লোকটাকে অনুসরণ করলাম। যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই সেই সিঁড়ি দিয়েই আবার চলোম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্য দিকে গেল লোকটা। পুরনো বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আবার একটা সুন্দর সাজানো বাগানে এসে পড়লাম রঙিন ফুল সবুজ ঘাস খোলা আকাশ শীতের রোদ সব মিলিয়ে আমার ক্ষুধার্ত চোখদুটি টনটনিয়ে উঠল। জল এসে পড়ল।

বাঁ দিকের উঁচু পাঁচিল ঘেঁষে আমি লোকটাকে অনুসরণ করছিলাম। সব দিকেই পাঁচিল, পাঁচিলের ওপরে কাঁটাতারের ফেন্সিং, তাতে লতা জড়ানো। সবুজ ঘন লতায় কাঁটাতার ঢাকা। সত্যি, শিল্পীদের দোষ নেই, যারা কাঁটাতারকে বইয়ের মলাটে ফুলের মতো আঁকে। ওতে বৈদ্যুতিক শক্তি যুক্ত থাকলে লতাগুলো বোধহয় মরে যেত…কিন্তু রোদটা কি নিবিড় সুখের মতো গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে, শরীরের ভিতরে ঢুকছে। চাদরটা আলগা করে দিলাম, বুকে যদি একটু রোদ লাগে। আর এই সবুজ, এই ফুল, হোক পাঁচিলে ঘেরা (পাঁচিল কোথায় নেই? একমাত্র সেই অথৈ সত্য ছাড়া, যে আমার অস্তিত্ব, যার নিষেধের কোনও সীমা নেই, অথচ সীমাহীন স্বাধীন), তবু তাদের চরিত্র বদলায়নি। তারা যা, তাই আছে।

য়ুনিফর্ম-পরা লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও দাঁড়ালাম। বাগানটা শেষ, পাঁচিলটা কাছেই দেখলাম, বাঁ দিকের পাঁচিলের পাশ দিয়ে দুটো সিঁড়ির ধাপ উঠে একটা গলি চলে গিয়েছে। বাইরে থেকে সহসা কিছুই বোঝা যায় না। সরু গলি, অন্ধকার, কিন্তু মাথা-ঢাকা ছাদে আলো জ্বলছে। দুটো ধাপের ওপরেই গলির মুখে লোহার গরাদের দরজা। দরজায় একজন বন্দুকধারী শান্ত্রী। আমার সঙ্গের লোকটির নির্দেশে শান্ত্রী লোহার গরাদ খুলে দিল। লোকটি আমাকে ভিতরে অনুসরণ করতে বলল। আমি ঢুকে অনুসরণ করলাম। এইমাত্র দিন অন্তর্হিত, আমি যেন রাত্রির বুকে প্রবেশ করলাম।

বাঁ দিকে দেয়াল, মাথাটা ছাদ-আঁটা, ডান দিকে লোহার গরাদ দেওয়া পর পর কয়েকটা খাঁচার মতো ঘর। একেবারে শেষ ঘরটার কাছে গিয়ে আমার সঙ্গের লোকটি দাঁড়াল। শাস্ত্রী আমাকে ডিঙিয়ে খাঁচার গরাদের তালা খুলল।

য়ুনিফর্ম-পরা লোকটি আমার দিকে একবার তাকাল আর গলিটার শেষ দেয়ালের গায়ে জলভরা চৌবাচ্চা দেখিয়ে বলল, এখানে চান করে নিতে হবে। সেলের মধ্যে খাবার দিয়ে যাবে। একটা সিগারেট যদি ইচ্ছে হয়–

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করল সে। সেলে ঢোকবার আগেই ধূমপান করে নিতে হবে। বুঝলাম, এগুলো এস. বি. সেল। সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে, আমি পিছন ফিরে গলির বাগানের দিকে তাকালাম। এখনও সবুজ, এখনও সিগারেটের নিবিড় নেশা। ভেবেছিলাম, লালবাজারের লক-আপ থেকে এস. বি. সেল ভাল হবে। ভাল হবে! কোথায় গেল সেই পাগলটা, সেই উদ্ধত ছেলেগুলো। ওরা এখানে আসবে না।

মনে হল, মুহূর্তেই সিগারেট পুড়ে শেষ হয়ে গেল। সেলের গরাদ খুলে গেল। আমি ভিতরে ঢুকলাম। শান্ত্রী তালা বন্ধ করে দিল। তার পর দুজনেই চলে গেল। নৈঃশব্দ্য নেমে এল, গভীর নৈঃশব্দ্য।

সামনে দেওয়াল, পিছনে ডাইনে বাঁয়ে দেওয়াল। মাথার ওপরে একটি অকম্পিত স্থির আলো। লোহার খাট, একটা তোশক আর কম্বল। খাটের বাইরে ফুট-তিনেক ঠাণ্ডা মেঝে। চওড়ায় ফুট-তিনেক, লম্বায় আট কি দশ।

আমি খাটের ওপর বসলাম। কোনও শব্দ হল না। ক্লান্তি বোধ করছিলাম। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লাম কাত হয়ে। কোনও শব্দ হল না। হলদে আলোয় তাকিয়ে থাকতে পারছি নে। চোখ বুজলাম। নৈঃশব্দ্য, গভীর গাঢ় নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকার।

এ সবই আমার চেনা, আমার জানা, এই দুয়ারবন্ধ বন্দিত্ব, এই একাকিত্ব, এই নৈঃশব্দ্য, এই অন্ধকার। একমাত্র তফাত, এটা এস. বি. সেল। এ সব ঘোচাবার জন্যেই কি একদা ইস্কুল পালাইনি? ছেলেবেলায় এই বন্দিত্ব এই একাকিত্ব ঘোচাবার জন্যেই কি দুঃসাহসী অবোধ মন নিয়ে ছোট ডিঙিতে করে বর্ষার দুরন্ত নদীর বুকে ভেসে যাইনি? তার পরে সমিতিতে অলকাদের সঙ্গে মিশতে যাইনি? তার পরে রেবাকে বিয়ে করিনি? তার পরে বিপ্লবী পার্টিতে আসিনি? তার পরে নীরার কাছে ছুটে যাইনি? সারাজীবন ধরে এই বোধই কি রূপান্তরের পথে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে না?

আরও কি ছুটিয়ে নিয়ে যাবে না? এই বোধই কি সমষ্টির সঙ্গে জীবনকে ভাগ করে ভোগ করার বাসনাকে বাধ্য করেনি? যারা কোথাও ঠেকে গিয়েছে তাদের বোধ একটা কোথাও নিঃশেষে মুছেছে। আর মিথ্যকেরা উত্তরণের কথা বলে, কারণ একাকিত্ব কখনও নিষ্ক্রিয় থাকে না, বন্দিত্ব কখনও নিশ্চেষ্ট থাকতে পারে না।

এই এস. বি. সেলের থেকে সেই একাকিত্ব কি আরও ভীষণ নয়? আরও ভয়ংকর নিষ্ঠুর মর্মান্তিক নয়? এবং আরও সুন্দর ও মধুর? জ্ঞান মুক্তি ও মৈত্রীর নতুন নতুন চাবিকাঠির সন্ধান যে দিয়েছে। এই তো আমার জপ, আমার আহ্নিকের আচমন।

লোহার গারদ ঝনঝনিয়ে উঠল। আমি তাকালাম। শান্ত্রী। সে আমাকে নাইতে বলল। তালা খুলে দিল। স্নান করার দরকার ছিল কিন্তু কোনও সরঞ্জামই ছিল না। অথচ নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। এখন শুকিয়ে ড্যালা পাকিয়ে রয়েছে। স্নান না করে উপায় ছিল না। তাছাড়া গলির বাইরে সবুজ লন আর ফুলের বাগান দেখতে পাব স্নান করতে গেলে। তাই অগত্যা নগ্ন হয়ে চৌবাচ্চার কাছে গেলাম। জল তোলবার কোনও পাত্র ছিল না। সান্ত্রী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল আর খইনি বানাতে লাগল। আমি সেই দিকেই মুখ করে আঁজলা আঁজলা জল তুলে গায়ে মাথায় ঢালতে লাগলাম। নইলে বাইরেটা, দিনটা দেখা যেত না। দৈহিক প্রশান্তি আমার দেহে সংগীত করতে লাগল যেন।

আবার গরাদ বন্ধ। গা শুকোবার আগেই জামাকাপড় পরে নিলাম। তার পরে একটা লোক এসে গরাদের নীচের কয়েক ইঞ্চি ফাঁক দিয়ে খাবার দিয়ে গেল। মাছ ভাত দই। বোধহয় কাছেই কোনও হোটেলের সঙ্গে অফিসের ব্যবস্থা আছে। এখানে যে কজন বন্দি থাকতে পারে তাদের জন্যে নিশ্চয়ই কোনও রান্নাঘরের ব্যবস্থা নেই।

কিন্তু ঘুম এল না। কেবলই মনে হতে লাগল এই গাঢ় নৈঃশব্দ্যের মধ্যে কী একটা শব্দের প্রতীক্ষা যেন আমার ভিতরে মাথা কুটছে। কী সেটা? গরাদের তালা খোলার শব্দ? আবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ডাকতে আসবে তাই?

না। কেউ আর এদিকে অনেকক্ষণ এল না। আমি উঠে পায়চারি করতে যেতেই থমকে গেলাম। বাজছে, সেই শব্দটা বাজছে! যার প্রতীক্ষা করছিলাম আমি, সেই ঝিঁঝি ডাকছে। মানুষ যাই বলুক নিজের হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে বিশ্বনিরন্তরতার একটা সম্পর্ক সে খোঁজে।

.

পরদিন আমাকে সেই বাড়িতে দোতলার সেই ঘরটায় ডেকে নিয়ে গেল। সকাল থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত দফায় দফায় চারজন জিজ্ঞাসাবাদ করল। বেলা তিনটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত দুজন।

তার পরের দিন একই নিয়মে আটজন।

তারও পরের দিন, সারাদিন কেউ আমাকে ডাকতে এল না। অবাক হলাম, ছুটিও অনুভব করলাম। সন্ধ্যা সাতটাতেই রাত্রের খাবার দিয়ে দেয়। আমি তারই প্রতীক্ষা করছিলাম। কিন্তু গরাদের তালা খুলতে দেখে অবাক হলাম। কারণ খাবার তলা দিয়েই দেয়। তালা খোলার পর দেখলাম একটু য়ুনিফর্ম-পরা অফিসার, কোমরবন্ধে রিভলভার। বাইরের থেকেই তর্জনী নেড়ে আমাকে মোটা গলায় ডাকল, আসুন।

আমি চাদরটা জড়িয়ে তাকে অনুসরণ করলাম। গলির বাইরে এসে দেখলাম অন্ধকার নেমেছে। বাগানে কোনও আলো নেই। সবুজ লন বা ফুল বা কেয়ারি কিছুই স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। সেই পুরনো দোতলা বাড়িটাকে অন্ধকারই মনে হল। রোজকার দেখা বাড়িটা এখন যেন স্তব্ধ দৈত্যপুরীর মতো মনে হল।

দরজার ভিতর দিয়ে ঢুকে সামনের ঘরটায় স্তিমিত আলো দেখতে পেলাম। অফিসারকে অনুসরণ করে আমি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলাম। সিঁড়িতেও তেমনি স্তিমিত আলো, নিজের ছায়াতেই অন্ধকার লাগে। ওপরের আলোও সেইরকম। এবং সেই একই ঘরের মধ্যে আমাকে ঢুকতে বলা হল। রাত্রে আমি কখনও এই ঘরে ঢুকিনি। দেখলাম এই ঘরের আলো একটু জোরালো। আমাকে বসতে বলা হল। বসলাম। অফিসার দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

জিজ্ঞাসাবাদ! নতুন পদ্ধতি। এই কথা আমার মনে হল। কিন্তু আমার শীত করছে না একটুও। আমি প্রস্তুত হবার জন্যে বসলাম।

দরজা খুলে গেল। দেখেই চিনতে পারলাম সেই লোক। একটা কম্বল তার হাতে আর কম্বলের মধ্যে, একটা-কিছু, মোটা ডাণ্ডা হতে পারে, সবসুদ্ধই সে টেবিলের ওপর রাখল। ডান হাতে সেই ফাইল, রিপোর্টস। এ সেই লোক যাকে আমি প্রথম দিন একটা ঘর থেকে রেগে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম, যে ঘরের মধ্যে একজনকে হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে টেবিলের ওপর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম।

পরমুহূর্তেই লোকটা আমার চোখে হারিয়ে গেল। অনেক দৃশ্য ও স্বর আমার দৃষ্টি ও শ্রবণকে ঘিরে ধরল। এবং অ্যাকশন কমিটির শেষ আহ্বানের দৃশ্য ও ঘটনা আমাকে টেনে নিয়ে গেল। ওরা কখনও এক জায়গায় বারে বারে দেখা করে না। সেই অন্য জায়গা। কমিটির সকলের চোখেই দেখলাম নিষ্ঠুর ক্রুর বিদ্রুপের হাসি।

মিহিরের হাসিটা প্রকৃতই নায়কোচিত। চেহারাটিও। আমি যদি ওকে না চিনতাম তবে সেদিনের মূর্তি দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতাম। একাধারে বিজয়ী যোদ্ধা ও দার্শনিকের মতো মনে হচ্ছিল ওকে। অথচ করুণা ও দয়া দেখাবার অঙ্গীকারও রয়েছে যেন চোখের হাসিতে।

ওর হাতে একটা চিঠি ছিল। বলল, আজ আমি শুধু এই চিঠিটাই পড়ব, তার পরে আপনার যা বলবার থাকে বলবেন।

আমার মনে হল চিঠিটা ধ্রুব লিখেছে, সে স্বীকারোক্তি করেছে আমার সাহায্যের কথা। দেখলাম, সকলের চোখগুলোই বিদ্যুৎঝলকে আমাকে যেন তড়িতাহত করতে চাইছে। কিন্তু যদি ধ্রুব লিখেই থাকে

মিহির বলল, পড়ছি।বলে সে পড়তে আরম্ভ করল:

 মাননীয়েষু–
মিহিরবাবু, একটু ভেবে আপনাকে সব সত্যি কথা জানাতে পারব কিনা বলেছিলাম। যদিও আপনাকে আমি আগে কখনও দেখিনি, শুনেছি মাত্র আপনার কথা। আপনাদের পার্টি সম্পর্কে আমার তেমন কোনও ধারণা ছিল না। একমাত্র অনলের (আমার নাম) মুখেই যা শুনেছি। সে একজন বিশেষ কর্মী তাও জানি। আপনার সঙ্গে রেবাদিকে ( আমার স্ত্রী) দেখে অবাক হয়েছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম, রেবাদি বোধহয় আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এসেছেন।

যাই হোক, আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি সত্যি অভিভূত হয়েছি। পার্টির প্রতি, তার বৈপ্লবিক কর্মপদ্ধতির প্রতি আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাকে আপনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি অনল ভুল করেছে। সে আমাকে ভালবাসে, তাই কখনও মিথ্যে কথা বলে না। ধুবর মতো লোককে ক্ষমা করা যায় না। পার্টির, বিপ্লবের এবং অনলের মঙ্গলের জন্যেই আপনাকে আমি তাই জানাচ্ছি অনল সত্যি ধ্রুবকে আশ্রয় দিয়েছে। আমাকে অনল নিজেই সে কথা বলেছে। আমার সঙ্গে তার সব কথাই হয়। আমি সঠিক স্মরণ করতে পারছি না কার আশ্রয়ে ধ্রুবকে ও পাঠিয়েছে। তবে মুর্শিদাবাদে কোনও বন্ধুর কাছে পাঠিয়েছে এই পর্যন্ত মনে আছে। অনল ধ্রুবকে অনেকগুলো টাকাও দিয়েছে। এবং একদিন পার্টির এই সন্ত্রাসবাদী নীতির পরিবর্তন হবে অনল এই বিশ্বাসেই ধ্রুবকে আবার ফিরিয়ে আনবে বলেছে।

আপনার কথায় আমার সম্যক উপলব্ধি হয়েছে অনলকে আমার ঠিক পথে ফিরিয়ে আনা উচিত। আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার নেবেন। ইতি –নীরা

নীরা, নীরা লিখেছে। চিঠিটা আমার হাতে নেবার দরকার ছিল না। ওই কাগজ এবং হাতের লেখা আমার রক্তের সঙ্গে পরিচিত।

চিঠিটা পড়ার পর অ্যাকশন কমিটি নিষ্পলক তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। মিহির হেসে বলল, বলুন। ৭৭২

আমি বললাম, আমি এ সবের কিছুই জানি না।

বোধহয় বজ্রপাত হলেও ওরা এত চমকাত না। মিহির বলে উঠল, আপনি নীরাকেও অস্বীকার করছেন? সে আপনার

আমি চুপ করে রইলাম। আর আমার প্রেমে আদুরে হয়ে ওঠা সেই মুখোনি মনে পড়ল।

মিহির গর্জে উঠল, আপনি নীরাকে এ সব বলেননি?

না।

তা হলে নীরাও মিথ্যে বলছে?

তাই দেখছি।

মিহিরের লায়ার চিৎকারটা আমার কানে বেজে ওঠবার আগেই টেবিলের ওপর কম্বলটা নড়ে উঠল, ভিতরের ডাণ্ডাসহ সেটা একটা মোটা থাবায় উঠল এবং মোটা গোঙানো স্বরের কীএকটা কথার সঙ্গে লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কী শুনতে পেলাম বুঝলাম না, খালি বললাম, আমি জানি না।

তারপর…

[১৯৪৯ সালে বে-আইনি ঘোষিত এক রাজনৈতিক পার্টির একজন সদস্যের বন্দি অবস্থায় লিখিত স্মৃতিচারণ থেকে উদ্ধৃত।]

পরিশিষ্ট

স্বীকারোক্তি

…তার পরে ওরা আমাকে এস বি সেল-এ এনে ঢোকাল। বাইশে ডিসেম্বরের বেলা দশটা হবে তখন। আমার কাছে ঘড়ি ছিল না। শীতের বেলা দেখে, আর লালবাজার থেকে লর্ড সিনহা রোড পর্যন্ত রাস্তার চেহারা দেখে আমার মনে হল, তখন বেলা দশটাই হবে, যদিও একটা আচ্ছন্নতা আমাকে গ্রাস করেছিল। সারারাত্রি ঘুম হয়নি। লালবাজার হাজতের সেই ঘর, টিমটিমে অকম্পিত সেই আলো, চার দেওয়াল জুড়ে সেইসব বিচিত্র আঁকাজোকা হিজিবিজি লেখা, আর অর্ধোন্মাদ সেই বন্দি, যে আমার দিকে স্থির চোখে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল, হেসে উঠছিল, বিড়বিড় করে বলছিল বা গুনগুন করে গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে এমন করে দেওয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, যেন ওখানে কোনও দেওয়াল নেই, একটা দরজা আছে, খোলা দরজা-যেখান দিয়ে সোজা বেরিয়ে যাবে। কিন্তু দেওয়ালের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে স্থির নিশ্চল হয়ে যাচ্ছিল। তার পরে আস্তে আস্তে পিছন ফিরে অর্থাৎ হাজতঘরের দিকে ফিরে বক্তৃতামঞ্চের ওপরে দাঁড়াবার ভঙ্গি করে হাত তুলে তর্জনীটা শুন্যে বিধিয়ে বিধিয়ে ভুরু কুঁচকে চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে আবার বিড়বিড় করছিল। ও যে কে আমি তা জানতাম না। পোশাক-আশাক মোটামুটি ভদ্ররকমের হলেও ও রাজনৈতিক বন্দি কিনা আমি বুঝতে পারছিলাম না। চোর কিংবা ডাকাত বা পকেটমার সেরকম কাউকে আমার সঙ্গে একই হাজতঘরে পুরে দেওয়া পুলিশের পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। কারণ ওরা জানত, তাতে আমার মনোবল আরও নষ্ট হবে, আমি আরও বেশি গ্লানি বোধ করব, মুক্তির ইচ্ছে আমার প্রবল হয়ে উঠবে! আর তা উঠলেই ওরা আমার কাছে যা জানতে চাইছে, ওদের ধারণা, তা সহজ হয়ে উঠবে।

এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পরশু ওরা তা-ই রেখেছিল। তিনটি ছোকরাকে সেই ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাদের দেখে আমার মনে হয়েছিল, ওরা যেন হাজতে আসেনি, কোনও চায়ের দোকানে আড্ডা মারতে এসেছে। ওরা বকবক করছিল, হাসাহাসি করছিল, খিস্তি করছিল, আবার নিজেদের মধ্যে ঝগড়াও করছিল, এবং সে সময়ে অশ্রাব্য উক্তিই শুধু করছিল না, কোমরের পরিধান শিথিল করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে নিম্নাঙ্গ দেখাচ্ছিল যাতে ক্রোধ এবং অবজ্ঞা অত্যন্ত উগ্র হয়ে ফুটে উঠেছিল। স্বভাবতই আমার খুব খারাপ লাগছিল, অস্বস্তি বোধ করছিলাম, এটাও বুঝতে পারছিলাম, ওদের কোনও দোষ নেই, ওরা ওদের স্বাভাবিক ব্যবহারই করছিল, এমনকী ওরা এও বুঝতে পারছিল আমি অত্যন্ত অস্বস্তি ও অশান্তি বোধ করছি, যে কারণে আমার দিকে তাকিয়ে ওরাও একটু সংকুচিত হচ্ছিল, আড়ষ্ট বোধ করছিল এবং আমাকেই সাক্ষী মানছিল, দেখুন না বড়দা…ইত্যাদি। ওদের কথা থেকেই জানা যাচ্ছিল বন্দরের কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে বে-আইনি আমদানি করা মালপত্র পাচার করার সময় ওরা ধরা পড়েছে। ইতিপূর্বেও ওরা কয়েকবার ধরা পড়েছে, কয়েক মাস করে জেলও খেটেছে। কোনও কিছুই নতুন নয়। তবু ধরা-পড়ার কারণগুলো আলোচনা করতে গিয়েই ওদের ঝগড়া হচ্ছিল। একটাই। শুধু আশ্চর্য, আমাকে ওরা কিছুই জিগ্যেস করেনি, আমি কে, কী অপরাধে হাজতবাস করছি। প্রথম। থেকেই ওরা আমাকে বাবুবা বড়দা এইরকম সম্বোধন করছিল। আমি কর্তৃপক্ষের কথা ভাবছিলাম, তারা কেন ছেলে তিনটেকে আমার ঘরেই ঢুকিয়ে দিয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হয়নি পুলিশের ওটা কোনও অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি নয়, একটি সুচিন্তিত পরীক্ষা মাত্র। এটা যখনই বুঝতে পারলাম তখনই মনকে প্রস্তুত করে নিলাম এইভাবে যে আমি যেন কোনওরকম একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝখানে রয়েছি। ভীষণ ঝড় বা ভয়ংকর ভূমিকম্পের মতো কোনও দুর্যোগের মধ্যে নয়, যেন দক্ষিণাঞ্চলের ভেড়িবাঁধের ওপর কোনও গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছি, আমার চারপাশে পাঁক কাদা নোংরা পশুর মৃতদেহ জোঁক আর কেঁচো পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করছে। আর আকাশ কালো, ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, আমার কোথাও যাবার উপায় নেই। বৃষ্টির বা পাঁক কাদার বা জোঁক কেঁচোর কোনও দোষ নেই, সবই স্বাভাবিক এবং যা-কিছুরই দায়, সবই আমার জীবনের কার্যকারণের গতি-প্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত, যে গতি-প্রকৃতির দ্বারা আমি লোকালয় বহির্ভূত ভেড়িবাঁধের ওপর একটি বিচ্ছিন্ন একক গাছের নীচে উপস্থিত। অতএব—

অতএব ছেলে তিনটির সঙ্গে হাজতে আমার সারাদিন ও রাত্রি একরকমভাবে কেটে গিয়েছিল। তার জন্যে যেসব কষ্ট, গ্লানি ও পীড়া আমাকে ভোগ করতে হয়েছিল, সে সব আমি স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছিলাম। ওদের খিস্তিখেউড় অশ্লীল গল্প, পরস্পরকে নিম্নাঙ্গ প্রদর্শন এবং রাত্রে আলোকিত হাজতঘরের মধ্যেই কম্বলের আড়াল রাখবার চেষ্টা করে ওদের সমকামী আচার আচরণ হাসি ইশারা গোঙানি এবং আর্তনাদ সবই একটা স্বাভাবিক দুর্যোগের মতো ভাবতে চেষ্টা করছিলাম। আর যেহেতু মন অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগের মতোই অধিকাংশ সময় কোনও কিছু দর্শনে স্মৃতির অন্ধকার দেওয়ালে এক-একটা ঝলক দেখতে পায়, সেইরকম কোনও কোনও সমকামিতার ঘটনা আমার মনে পড়ছিল। যেমন আমাদের শহরের স্কুলের মাস্টার প্রিয়তোষ আর ছাত্র খোকন, কিংবাযাক সে কথা, অর্থাৎ আমাদের আশেপাশে সচরাচর ঘটে থাকে, সেইসব ঘটনা ও ঘটনার চরিত্রদের কথা আমার মনে পড়ছিল। এবং একসময়ে অন্ধকার টানেলের ভিতর দিয়ে এসে যেমন হঠাৎ-আলোর সামনে পড়া যায়, তেমনিভাবে নীরাকে আমার আলিঙ্গনে আবিষ্কার করেছিলাম–যে-আলিঙ্গন আমার স্ত্রীকে, সমাজকে, পার্টিকে এবং গভর্নমেন্টকে ফাঁকি দিয়ে অর্জন করতে হয়। আর নীরাকে মনে পড়ায়, শেষরাত্রের দিকে যেটুকু বা আমার একটু ঘুমের আশা ছিল সেটুকু তিরোহিত হয়েছিল। যদিও তখন ছেলে তিনটি গভীর নিদ্রায় ডুবে গিয়েছিল। দোতলার হাজতঘর থেকে লালবাজারকে স্তব্ধ মনে হচ্ছিল, তবু তখন আর-একটা বন্দি জীবনের নানান পীড়া, গ্লানি, অস্বস্তি, অশান্তি আমাকে কাতর করছিল। এবং আবার নতুন করে একটা স্বাভাবিক দুর্যোগের কথা আমার মনে হচ্ছিল, যে-দুর্যোগ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। ঘটে, আর আমার নিজেরই জীবনের কার্যকারণের গতিপ্রকৃতির দরুন নিরুপায় অবস্থায় দুর্যোগ পার হয়ে যেতে হয়।

রাজনৈতিক মতবাদ যেমন একটি সৎ ও বলিষ্ঠ বিশ্বাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, নীরাকে ভালবাসাও তেমনি এবং পার্টিকে অন্ধের মতো অনুসরণ করা বা ধর্মীয় গোঁড়ামির মতো মেনে নেওয়া একটা অসৎ দুর্বলতা, ভীরুতা, তেমনি এই সমাজের বৈবাহিক বা পারিবারিক নিয়ন্ত্রণগুলোকেও মেনে নেওয়ার মধ্যে পাপ লুকিয়ে আছে। তাই নীরার আর আমার মাঝখানেও শাসন, সন্দেহ, আইন, জেলখানা, পুলিশ সুপার, ইন্সপেক্টর, ইনভেস্টিগেশন, স্বীকারোক্তি, জিজ্ঞাসাবাদ, ভয়-দেখানো, স্নায়ুকে খোঁচানো, সবই আছে। এবং সেখানেও নানান প্রক্রিয়ায় উত্ত্যক্ত করার ব্যবস্থা আছে।

অতএব সামগ্রিক মুক্তির সাধনায় আমার অস্তিত্ব নিয়োজিত, তাই বহুবিধ কল্পনা আমার আশ্রয়।

তার পরে গতকাল সকালবেলা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়ে ছিল। অত্যধিক পান খেয়ে খেয়ে ছুঁচোলো মোটা ঠোঁট, দাঁত নোংরা হয়ে গিয়েছে, কালো মুখ, মোটা লেন্সের চশমা, এইরকম মাঝবয়সি একজন অফিসার কতগুলি মামুলি প্রশ্ন করেছিল–যার জবাব আমি বহুবার দিয়েছি। নাম, ধাম, পেশা, পিতৃ-পরিচয়, বংশ-পরিচয়, পার্টিতে কত সালে এসেছি (পার্টিতে কোনওদিন আসিইনি, এই আমার জবাব ছিল), কোন কোন নেতাকে আমি চিনি, তারা কে কোথায় আছে (আমি জানি না, এই আমার জবাব) ইত্যাদি। কিন্তু অফিসারটি নিতান্ত যেন কর্তব্য করেই যাচ্ছিল, এমনিভাবে প্রশ্ন করছিল, অন্যমনস্কভাবে ফাইল উলটেপালটে দেখছিল, আর এক-একটা প্রশ্ন করছিল। আমার মনে হচ্ছিল, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কন্যাদায়গ্রস্ত।

ঘণ্টাদুয়েক পরেই আমাকে সেন্ট্রির পাহারায় আবার লক-আপে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তখন সেই ছেলে তিনটে আর ছিল না। আমি একটু ঘুমোবার চেষ্টা করছিলাম। আধঘণ্টা বাদেই তালা খোলার শব্দে ফিরে তাকিয়ে দেখেছিলাম, সেই অদ্ভুত চরিত্রের বন্দিকে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল–যাকে আমার উন্মাদ বলেই মনে হয়েছিল, যদিও উন্মাদ অপরাধীদের জন্যে আলাদা গারদ আছে। লোকটার সঙ্গে আমার কোনও কথাই হয়নি। কথা বলবার যোগ্য পাত্র সে ছিল না। এমনও হতে পারে, পাগলামিটাই লোকটার ভান, হয়তো পাই, কাছ থেকে আমাকে নিরীক্ষণ করা বা অনুধাবন করাই তার কাজ। শুধু যে সরকারি গোয়েন্দাই হতে পারে তা নয়, পার্টির স্পাই হওয়াও বিচিত্র নয়। হয়তো পার্টিই এই লোকটিকে পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে আমার সান্নিধ্যে আসার নির্দেশ দিয়েছে, আমার গতিবিধি, মানসিক অবস্থা, স্বীকারোক্তি করি কি না এইসব জানতে। কারণ পার্টির পরিচালকেরা জানে তাদের নীতি ও কৌশল সম্পর্কে আমার মতভেদ আছে। সরকারিই তোক আর পার্টিরই হোক স্পষ্টমাত্রকেই আমার যেন সরীসৃপ-জাতীয় জীব মনে হয়, আমি এদের কাছে কখনওই স্বচ্ছন্দ বোধ করি নে, কেমন যেন গা ঘিনঘিন করে, ভয় ও ঘৃণা হয়। আবার এমনও হতে পারে একটা পাগলকে সারা দিনরাত্রির জন্যে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করেই আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সেই একই উদ্দেশ্যে, আমাকে উত্ত্যক্ত করে মানসিক ভারসাম্য হারাবার অবস্থায় নিয়ে যাওয়া।

লোকটার ভাবভঙ্গি ব্যবহার, মাঝে মাঝে কাছে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা, ফিসফিস করা, বিড়বিড় করা, ধপাস করে আমার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়া এবং হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শের উদ্যোগ করা, হঠাৎ হেসে ওঠা সব মিলিয়ে বিশ্রী উত্ত্যক্ত করেছিল। আমি চোখ বুজতে পারিনি সারারাতে। নানান রকম ভেবেছিলাম। লোকটা যদি আমাকে কামড়েই দেয় বা খামচে দেয়। কত কী-ই করতে পারত। গতকাল সন্দেহ আর উৎকণ্ঠায় আমার রাত্রি কেটেছে। মনে মনে আমি একটা দুর্যোগের কল্পনা করেছিলাম।

.

 আজ ওরা আমাকে এস বি সেল-এ নিয়ে এল। আজ বাইশে ডিসেম্বর। আসন্ন বড়দিনের উৎসবের ছোঁয়া লেগেছে কলকাতায়, লালবাজার থেকে জিপে যেতে যেতে আমার মনে হচ্ছিল। যদিও কলকাতাকে আমার মোটেই ভাল লাগছিল না। এমনিতেই কলকাতাকে আমার নীরক্ত মনে হয়। তার ওপরে আমার মনের মধ্যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা। আমার দুপাশে সশস্ত্র প্রহরী। ড্রাইভারের পাশে একজন যুবক অফিসার, যে আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি, ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি। সে লুব্ধ দু চোখ ভরে চৌরঙ্গি এলাকাকে যেন গিলছে। আসন্ন বড়দিনের স্বপ্ন তার চোখে। আর, বিশেষ করে কলকাতার এই অংশটাকে আমার সব থেকে বেশি নীরক্ত ও প্রাণহীন বলে মনে হয়।

যদিও প্রশ্ন ও জবাব বিধিবহির্ভূত, তবু আমি জিগ্যেস করলাম, এখন কোথায় যাচ্ছি?

প্রায় এক মিনিট বাদে, যখন জবাবের প্রত্যাশা প্রায় নিঃশেষ, তখন অফিসার মুখ না ফিরিয়েই বলল, এস বি অফিস।

স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিস। জিগ্যেস করলাম, আবার আমি ফিরে যাব?

 জবাব: না, এস বি সেল-এ থাকতে হবে।

লালবাজারেরটা লক-আপ। সেল শুনে জিগ্যেস করলাম, সেখানেও কি লালবাজারের মতোই?

রাস্তায় একঝাঁক মেয়ের দিকে অফিসার তাকিয়ে ছিল। অন্য সময় হলে হয়তো আমিও মেয়েদের তাকিয়ে দেখতাম, খুশি হতাম। মেয়েদের ঝাঁকটা হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে চলেছে। হয়তো বেড়াতে কিংবা বড়দিনের বাজার করতে চলেছে। কিন্তু ওদের নিয়ে আমার চিন্তা বিস্তৃত হল না। জবাবের প্রত্যাশায় অফিসারটির ঘাড়ের দিকেই আমার দৃষ্টি।

মেয়েদের দলটা পার হয়ে যাবার পর জবাব এল, না, সেখানে এক-একজনের এক-একটা ঘর।

কথাটা শোনামাত্রই মনটা খুশি হয়ে উঠল। এক-একজনের এক-একটা ঘর। সেখানে আর কেউ থাকবে না। কয়েকদিন লালবাজার লক-আপ-এ নানান ধরনের অচেনা লোকদের সঙ্গে থেকে, সবসময় বাতি জ্বালানো, প্রস্রাবের দুর্গন্ধ আর দেওয়ালের অশ্লীল লেখা ও হুঁড়ি, তোর দাঁড়কাকে গাল খাবলে খাবে (সম্ভবত এটা কোনও গানের কলি), অনেক নাম, তারিখ, প্রধানত যৌন-বিষয়ক আনন্দের ব্যাখ্যা, অনেক গানের কলিও তাই এবং আনাড়ি হাতের একই বিষয়ের ছবি, দেখে দেখে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার এই, দেয়ালের অনেক লেখা এবং ছবিই পেনসিলে বোলানো। অথচ পেনসিল কোনও কয়েদির কাছেই থাকা উচিত নয়। হাজতে থাকার সময় লজ্জা নিবারণের জামাকাপড় ছাড়া বন্দির কাছে আর কিছুই থাকবার নিয়ম নেই। ধূমপান নিষিদ্ধ। লক-আপ-এর বাইরে গিয়ে খেতে হয়। ভিতরে কিছুই থাকবে না। এমনকী নিজের ঘড়ি আংটি টাকা-পয়সা সবই জমা দিয়ে দিতে হয়। একটুকরো কাগজ থাকাও নিষেধ। বন্দি যাতে আত্মহত্যা করতে না পারে বা বাইরের সঙ্গে যোগাযোগের কোনও ব্যবস্থা না করতে পারে, সেজন্যেই নাকি এত বিধিনিষেধ। এরকমই আমি শুনেছিলাম।

আমার জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করল, সেই একলা ঘরটায় আমি ধূমপান করতে পারব কিনা, খবরের কাগজ দেখতে পাব কিনা–নিদেন কোনও বই, ছাপার অক্ষরে যে কোনও জিনিস, যা পড়তে পারা যায় এবং জিজ্ঞাসাবাদের শাস্তি এবার শেষ হবে কিনা।

কিন্তু জিগ্যেস করার আগেই গাড়িটা লর্ড সিনহা রোডের একটা বাড়ির উঠোনে ঢুকে পড়ল। একটা গাছতলায় গাড়ি দাঁড়াতেই আমাকে নামতে বলা হল। নামতেই প্রকাণ্ড পুরনো ধরনের বাড়িটার ভিতরে আমাকে অফিসারটি নিয়ে গেল। দিনের বেলাও সব ঘরেই আলো জ্বলছে। দেখলেই বোঝা যায়, দেয়াল খুব মোটা। উঁচু ছাদ আর বড় বড় ঘর। বাড়ির ভিতরটা বেশ কর্মমুখর। য়ুনিফর্ম আর সাদা পোশাক পরা অনেক লোক চলাফেরা করছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে কথা বলছে বা বসে বসে কাজ করছে। কারুর হাতে ফাইল, কেউ খালি হাতে। কোথাও তেমন সাজানো-গোছানো কিছু নেই। নিতান্তই যেন কাজ চলা গোছের টেবিল চেয়ার বেঞ্চ কোনও কোনও ঘরে রয়েছে। কোনও কোনও ঘর ফাঁকা। অবিশ্যি কোনও কোনও ঘরের দরজায় দামি পরদা, ভিতরে উজ্জ্বল আলোর ঝলকও দেখতে পেলাম। সম্ভবত বড় অফিসারদের ঘর সেগুলো।

একটা বাড়ি পেরিয়ে আবার একটা বাঁধানো উঠোন এবং সেখানেও কয়েকটা গাছ। গাছে পাখিরা জটলা করছে। আমার ভাল লাগল। লালবাজারের সেই দোতলার হাজতঘর থেকে বেরিয়ে এখানে এসে আমার মনটা খুশি হয়ে উঠল। সেখানে ঘরের ভিতর থেকে বারান্দার দিকে ঘিঞ্জি জালে ঘেরা ফাঁক দিয়ে একটা উঁচু বাড়ির মাথায় দু-তিন ফুট আকাশ দেখতে পেতাম মাত্র। ঘরের অন্যান্য বন্দিদের জন্যে সেই ছোট্ট জালের হিজিবিজি-আঁকা আকাশ দেখবার অবকাশও কম হত।

এখানে উঠোনে শুকনো পাতা ছড়ানো। এখানে-ওখানে পাখির বিষ্ঠা। আমি এ-সবই দু চোখ ভরে দেখলাম। চোখ তুলে গাছের দিকে তাকালাম। শুধু কাক শালিক নয়, কয়েকটা পায়রাও রয়েছে। যদিও উঠোনের ওপারেই পুব দিকে আর-একটা তিনতলা প্রকাণ্ড বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তবু নীল আকাশ অনেকখানিই দেখা যায়। আর আকাশটার দিকে চোখ রাখতে আমার অবস্থা যেন ব্রীড়াময়ী সলজ্জ প্রেমিকার মতো হয়ে উঠল। হয়তো আমার চোখে ঠাণ্ডা লেগেছে বা যে কোনও কারণেই হোক, এত ঔজ্জ্বল্য আমার চোখে সইছে না, তাই চোখের পাতা বুজে যাচ্ছে। অথচ প্রাণভরে দেখতে ইচ্ছে। করছে। এস বি সেল কি এই তিনতলা বাড়িতেই? আমি কি এখানেই থাকব?

–এই দিকে।

তিনতলা বাড়ির একটা দরজার কাছ থেকে অফিসারটি আমাকে ডাকল। বাড়ির ভিতরটা অন্ধকার দেখাচ্ছে। আমি ভিতরে ঢুকলাম। এ বাড়িটাও পুরনো। হয়তো শতাধিক বছর বয়স হবে। ভিতরটা কনকন করছে ঠাণ্ডায়। বাড়িটার বুড়ো বয়সের গন্ধ পর্যন্ত টের পাওয়া যায়। মেঝের ঠাণ্ডা যেন আমার জুতোর সোল যুঁড়ে স্পর্শ করছে। গায়ের চাদরটা আর-একটু ভাল করে জড়ালাম। প্রায় আধো অন্ধকার এক-একটা ঘর দিয়ে অফিসারকে অনুসরণ করে যেতে লাগলাম।

এখানেও সশস্ত্র ও নিরস্ত্র, য়ুনিফর্ম ও সাদা পোশাক পরা কর্মচারীরা চলাফেরা করছে, কথাবার্তা বলছে। আগের বাড়িটার মতো ভিড় এখানে নেই। আর একমাত্র বৈশিষ্ট্য, এখানে কোনও কোনও ঘরের দরজা বন্ধ, এবং বন্ধ দরজার সামনে একজন করে বন্দুকধারী প্রহরী। আগের বাড়িটাতে আমাকে কেউই তাকিয়ে দেখেনি। এখানে অনেকেই আমাকে তাকিয়ে দেখল। আমার মনে হল, এই তাকিয়ে দেখার মধ্যে একটা শিকারির তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি রয়েছে। আমাকে দেখার পর প্রত্যেকেই যুবক অফিসারটির সঙ্গে চোখাচোখি করছে। সেই দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে তাদের যে কী নিঃশব্দ কথার আদান-প্রদান হচ্ছে, আমি বুঝতে পারলাম না। একটা কিছু কথা আদান-প্রদান হচ্ছে, সেটা অনুমান করা যায়।

এ বাড়ির আবহাওয়া একটু যেন অন্যরকম। ঠিক নিশ্চুপ নয়, অথচ একটা স্তব্ধতা যেন বিরাজ করছে। এক-একজনের মুখ কেমন একটা ক্রুর উত্তেজনায় ঝলকাচ্ছে। কেন কে জানে। যেতে যেতে আমার সামনেই হঠাৎ একটা বন্ধ ঘরের দরজা খুলে গেল। একজন খুব দ্রুত বেরিয়ে গেল সেই ঘর থেকে। শাস্ত্রী দরজাটা টেনে দেবার আগেই চকিতে আমার চোখে পড়ল, ঘরের মাঝখানের টেবিলে একজন যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে দু হাত ছড়িয়ে, আর একটা কালো কম্বল টেবিলের ওপর থেকে মেঝেয় লুটোচ্ছে। আমি দরজাটা পার হয়ে যেতেই অন্য দিক থেকে আর-একটি লোককে তাড়াতাড়ি আসতে দেখলাম। তার চোখে চশমা, গায়ে ওভারকোট, কোটের পকেট দুটো যেন অনেক মালপত্রে মোটা হয়ে আছে। আর হাতে স্টেথিস্কোপ। মনে হল, লোকটা ডাক্তার। দেখলাম, সে ওই ঘরটাতেই গিয়ে ঢুকল।

আমার গতি সম্ভবত শ্লথ হয়ে এসেছিল। আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে ছিলাম। আমার কাঁধে একটা ঠেলা লাগতেই দেখলাম, অফিসারটি আমাকে আঙুল দেখিয়ে পথনির্দেশ করছে। কুটি বিরক্তি তার মুখে।

আমি তাকে অনুসরণ করে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগলাম। আমার চোখের সামনে টেবিলের ওপর সেই মূর্তিটা ভাসছে। আর ডাক্তারের দ্রুত আগমন ভুলতে পারছি না। কোনও অসুখবিসুখের ব্যাপার নাকি? না কি স্বীকারোক্তির জন্যে…? দ্রুত বেরিয়ে যাওয়া সেই লোকটির চেহারা মনে করতে চেষ্টা করলাম। প্রকাণ্ড চেহারা, উশকোখুশকো চুল, হাতা গোটানো, লোমশ বুকখোলা শার্ট, আর হাতে ঝোলানো কোট। লোকটা কি স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্যে ওকে মেরেছে? যাকে এক মুহূর্তের জন্য খোলা দরজা দিয়ে আমি দেখতে পেলাম, টেবিলের ওপর লুটিয়ে পড়ে আছে? বেত দিয়ে মেরেছে, না কি কম্বল চাপা দিয়ে ভারী রুল দিয়ে পিটিয়েছে? কারণ একটা কালো কম্বলও টেবিল থেকে মেঝেতে লুটোতে দেখলাম। আর কম্বল জড়িয়ে মারার পদ্ধতি কলকাতা পুলিশের আছে। শুনেছি তাতে দেহে কোনও দাগ হয় না। অথচ প্রহার ও পীড়নের সুবিধে হয়।

বন্দির আঘাত কি খুব বেশি হয়েছে, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে, তাই তাড়াতাড়ি গিয়ে ডাক্তার পাঠিয়ে দিল।

দাঁড়ান।

আমাকেই বলা হল। ওপরে উঠেই বাঁ দিকে টেবিলের সামনে চেয়ারে একজন ফরসা মোটা মাঝবয়সি লোক বসে ছিল। আমাকে যে নিয়ে এল সেই অফিসারটি নিচু হয়ে নিচু গলায় কী যেন বলল মোটা মাঝবয়সিকে। মোটা মাঝবয়সি একবার আমার দিকে তাকিয়ে তার হাতের পেনসিল দিয়ে এক দিকে নির্দেশ করল। অফিসারটি আমাকে ডাকল, আসুন।

অনুসরণ করলাম। সামনেই ডান দিকে পর পর কয়েকটি দরজা। একটা ভেজানো দরজা ঠেলে আমাকে ভিতরে যেতে নির্দেশ করে সে বলল, আপনি একটু বসুন।

আমি জিগ্যেস করলাম, এটা কি সেল?

না। বলেই সে চলে গেল।

একজন শাস্ত্রী এসে দাঁড়াল এবং দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। এটা সেল নয়। একটি টেবিল, দুটি চেয়ার, এই মাত্র আসবাব। ঘরের মেঝে পুরনো, দেয়ালও তাই। ঘরের মধ্যে যেন দলা দলা শীত জমে ছিল। ঢোকা মাত্রই তারা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠল, কেঁপে কেঁপে উঠল, এবং হঠাৎ শিরদাঁড়া শিউরিয়ে ছলাৎ করে যেন একঝলক রক্ত উঠে এল আমার মাথায়। স্বীকারোক্তি! আবার স্বীকারোক্তি!

এটা জিজ্ঞাসাবাদের ঘর। অবিকল সেই নিচের ঘরটার মতোই, যে-ঘরে সেই বন্দি পড়ে আছে। আমার শীতের কাঁপুনিটা বোধহয় এই কারণেই, ওই একটি মুহূর্তের দৃশ্যের জন্যেই। আমাকেও হয়তো স্বীকারোক্তির জন্যে…

একটাই মাত্র জানালা আছে ঘরটিতে। দেয়ালের অনেক উঁচুতে আমার মাথা ছাড়িয়ে। শুধু আকাশই দেখা যায়। আমি একটা চেয়ারে বসলাম। দাঁড়াতে পারছি না, ভীষণ শীত করছে, কাঁপুনিটা বুকের কাছে উঠে এসেছে। হাতে পায়ে তেমন যেন বল নেই। পা তুলে টেবিলটা চেপে ধরে, শক্ত হয়ে, গুটিশুটি হয়ে বসলাম।

তার পরে প্রথমেই আমার মনে পড়ল, আমার চুলের মুঠি আমার বাবার হাতে, ভীষণ লাগছে। গাল দুটো জ্বালা করছে থাপ্পড়ের ঘায়ে। বাবার খালি গা, পেশল শক্ত শরীর ও ক্রুদ্ধ মুখটা মনে হচ্ছে বাঘের থেকে ভয়ংকর, সিংহের থেকে হিংস্র। গলায় হিংস্র জিজ্ঞাসা: বল, ইস্কুল পালিয়ে কোথায় গেছিলি? নৌকো বাইতে? মাছ ধরতে? বল বল বল। তা নইলে খুন করব আজ তোকে।

তার পরেই মনে পড়ল, ঢাকা শহরের সেই প্রায়ান্ধকার গলিটার কথা, যেখানে মাত্র একটি কেরোসিনের লাইটপোস্ট ছিল, এবং তিনজন বন্ধু আমাকে ঘিরে ছিল। পার্টির বন্ধু। আজকের এই পার্টি নয়, অন্য পার্টি, সশস্ত্র গুপ্ত বিপ্লবী পার্টি। তিনজনেরই চোখমুখ ভীষণ নিষ্ঠুর আর হিংস্র দেখাচ্ছিল। সকলেই আমরা সমবয়সি, ষোলো সতেরো আঠারোর মধ্যেই সকলের বয়স। বন্ধু তিনজনের জিজ্ঞাসা, আমি রায়বাহাদুর বিরাজমোহনের বাড়ি বেড়াতেই যাই কি না, কেন যাই এবং বিরাজমোহনের নাতনি অলকাকে আমি সমিতির কথা বলেছি কি না।

আমরা জবাব চাই।ওরা তিনজনেই রুদ্ধশ্বাস ক্রুদ্ধ গলায় জিগ্যেস করল।

বিরাজমোহনকে আমি কোনওদিনই দেখিনি, কিন্তু তাঁদের বাড়িতে যাই। এই যাওয়াটা নিষিদ্ধ, কারণ বিরাজমোহন পার্টির বিচারে বিশ্বাসঘাতক, শত্রু। আমি তাঁর কাছে যাই না, তাঁদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের কাছে যাই, কারণ ভাল লাগে, তারা সকলেই খুব ভাল। বিরাজমোহনের নাতিনাতনি বলে তাদের কোনও দোষ নেই, তারা বিশ্বাসঘাতক নয়। আর অলকার সঙ্গে আমার প্রেম (অন্তত সেই বয়সে, সেটাই আমাদের বিশ্বাস ছিল। অলকার বয়স তখন বারো, দেখতে বেশ সুন্দর ছিল, আমরা হাতে হাত ধরতাম, অন্নদাশঙ্কর রায়ের আগুন নিয়ে খেলার নায়ক-নায়িকার মতো চুমো খাবার চেষ্টা করতাম, ইত্যাদি), তাকে আমার জীবনের সব গোপনীয়তাই প্রকাশ করে দিই। বিশ্বাস করি বলেই বলেছি। পার্টির বন্ধুরা ঠিক প্রশ্নই করেছিল, তারা ঠিক সন্দেহই করেছিল। কিন্তু ওরা আমার এবং অলকাদের ওপর অবিচার করছে, অন্যায় করছে, তাই আমি অস্বীকার করলাম, এ-বিষয়ে কিছুই জানি না।

প্রথমে নরেশ দুম করে একটা ঘুষি মারল আমার চোয়ালে। বলল, এখনও সত্যি কথা বল।

 জানি না।

সঙ্গে সঙ্গে তিনজনেই মারতে আরম্ভ করল। বলতে লাগল, ট্রেইটার! স্পাই। ওকে খুন করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসতে হবে।

আমার নাক দিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল। এমন সময়ে কারা যেন গলিতে ঢুকল। লোকজনের সাড়া পেয়ে বন্ধুরা অন্ধকারে দৌড়ে কে কোথায় চলে গেল। আমিও হাঁপাতে হাঁপাতে একদিকে চলতে লাগলাম। লোকজনের কাছে বাইরে আমি কিছু জানাতে চাই না। যদিও ওরা নিশ্চয়ই লক্ষ রেখেছিল, আমি কোথায় যাই। আমি বুড়িগঙ্গার ধারেই গেলাম। কারণ জল দিয়ে মুখ-চোখ ধোবার দরকার ছিল।

এর পরেই আমার মনে পড়ল, আমার স্ত্রী আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমার বুকের কাছে জামাটা সে খামচে ধরে আছে। হিংস্র রাগে ওর চোখ, ওর মুখ জ্বলছে। আমি সিঁড়ির কাছে, অদুরেই বাড়ির ঝি ঘর মুছছে ন্যাতা বুলিয়ে, যদিও তার হাত ঠিক কাজ করতে পারছে না, নত মুখ, নত চোখের দৃষ্টি, এদিকে এবং আমার মা ঘরের ভিতর থেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। স্বীকারোক্তির জন্যে ও আমার জামায় হ্যাঁচকা টান মেরে ফুঁসে উঠল, বলল, কাল তুমি নীরার সঙ্গে দেখা করেছিলে কি না।

আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ওর চেহারাটা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। আমাকে একটা ধাক্কা মেরে বলল, বলল, ওকে তুমি ভালবাসো? কেন ভালবাসো? বলো বলো বলল।

ওর কষ্ট, কষ্টের জন্যে হিংসা, হিংসা থেকে রাগ, রাগ থেকে ঘৃণা এ সবই আমি বুঝতে পারছি, এবং নীরাকে আমি ভালবাসি, নীরার সঙ্গে দেখাও করে থাকি। কিন্তু কেন, এর জবাব, ছেলেবেলায় ইস্কুল পালানোর মতোই, অলকাদের সঙ্গে মেশার মতোই, এবং আজকের এই বিপ্লবী পার্টিতে যোগ দেবার মতোই অপ্রতিরোধ্য ও কোনও ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আমি চুপ করেই রইলাম, জামাটা ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম।

ও একটা অস্বাভাবিক ক্রুদ্ধ চিৎকার করে উঠল, আর দু হাত দিয়ে আমার জামাটা ছিঁড়ে ফালা করে দিল।

এবার আমার মনে পড়ল, পার্টির লোকাল অ্যাকশন কমিটির তলব। মাত্র মাসদুয়েক আগের কথা, অ্যাকশন কমিটি আমাকে ডেকে পাঠাল। অ্যাকশন কমিটি মানে, পার্টির আর্মস অ্যামুনিশন যাদের তত্ত্বাবধানে, যারা শত্রুকে চিহ্নিত করে ও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয় আর কর্মীদের অপরাধের বিচার করে।

সেই এক জনবিরল লোকালয়, পুরনো বাড়ির দোতলা, প্রায়ান্ধকার ঘর। পাথরের মূর্তির মতো নিরেট শক্ত মুখ নিয়ে পাঁচজন বসে আছে। অ্যাকশন কমিটি। কুরিয়র আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেল, বাইরে থেকে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। আমি অ্যাকশন কমিটিকে পার্টির নিয়মতান্ত্রিক অভিবাদন করলাম। কিন্তু কেউই প্রত্যভিবাদন জানাল না। আমাকে শুধু তাদের মুখোমুখি বসতে ইঙ্গিত করা হল।

মিহির, অ্যাকশন কমিটির নেতার এই ছদ্ম নাম, যার স্মার্টনেস, সাহস, চেহারা, বাকভঙ্গির খুবই নাম আছে পার্টির মধ্যে। বোনাপার্ট বলে সবাই যাকে আদর করে, কারণ তার চেহারার সঙ্গে নাকি নেপোলিয়ানের বিশেষ সাদৃশ্য আছে, এবং জিমনাসিয়ামের ক্রীড়ায় বেশ পটু ও স্বভাবতই তার শার্ট-খোলা বুকের ও চলাবসার ভঙ্গি দৃষ্টি-মুগ্ধকর, যার চোখ তীক্ষ্ণ ঈগলের মতো, আর একদম হাসে না, যেটা নিয়ে সবাই বিস্মিত প্রশংসায় ও শ্রদ্ধায় স্তব্ধ, কারণ মিহিরকে কেউ হাসতে পর্যন্ত দেখেনি। আমার ধারণা, মিহির আত্মসচেতন, অনেকটাই ভঙ্গিসর্বস্ব অ্যাডভেঞ্চারার। সে-ই আমাকে জিগ্যেস করল, উম্মম্ হ্যাঁ, কমরেড! অ্যাকশন কমিটি আপনার কাছে জানতে চাইছে, ধ্রুবকে আপনি কোনও শেলটারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন কিনা। তার আগে জানতে চাই, পি সি এগারো-শো বাই বারো আট উনপঞ্চাশ নম্বরের সার্কুলার আপনাদের সেল-এ পৌঁছেছিল কিনা, এবং আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিনা।

মিহিরের চোখ থেকে যেন একটি ঘৃণামিশ্রিত বিদ্রুপের ঝিলিক আমাকে হানল, এবং বাকি সকলেরই তাই।

মিহির যা জিগ্যেস করল, সবই সত্যি। গোপন সার্কুলারে ঘোষণা করা হয়েছিল: ধ্রুবকে কতকগুলি বিশেষ কারণে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পাটির বিশেষ স্বার্থে কারণগুলি এখন ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। সভ্যদের সবাইকে জানানো যাচ্ছে, ধ্রুবর সঙ্গে যেন কেউ কোনওরকম সম্পর্ক না রাখেন, এমনকী বাক্যালাপ না করেন, করলে পার্টিবিরোধী কার্যকলাপের জন্যে তাঁকেও শাস্তি পেতে হবে, ইত্যাদি। আমি সে-সার্কুলার পাঠ করেছিলাম, কিন্তু ধ্রুবকে আশ্রয়ও সত্যি দিয়েছিলাম। কারণ আমি জানতাম, প্রকৃত দেশপ্রেমিক, বিশ্বাসী সৎ পার্টিজান, চিন্তাশীল, বিবেকবান ধ্রুবর সঙ্গে জেলার একজন নেতা ও অ্যাকশন কমিটির মিহিরের ব্যক্তিগত বিরোধের ফলে তাকে পার্টি থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা চলছিল। তাকে স্পাই আখ্যা দেবার ষড়যন্ত্র চলছিল, এবং সেটা কার্যকরীও করা হয়েছে। অথচ ধ্রুব একজন আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মী, পুলিশ তার জন্যে হন্যে হয়ে ফিরছে। এ অবস্থায় তাকে পার্টি থেকে বের করে দিয়ে নির্দেশ দেওয়া হল, আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে সে বেরিয়ে পড়ুক। অর্থাৎ পুলিশের হাতে চলে যাক। পার্টি থেকে বহিষ্কার মানেই আন্ডারগ্রাউন্ডের আশ্রয় তাকে ছেড়ে দিতেই হবে। তা হলেই পুলিশ তাকে ধরতে পারবে, এবং ধরলেই, যেহেতু ধ্রুব একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী, পার্টি বেআইনি ঘঘাষিত হবার আগে যে প্রকৃতই একজন জননেতা ছিল, তাকে পুলিশ নানাভাবে পীড়ন করবে কথা আদায় করবার জন্যে। এক দিকে পার্টি থেকে বহিষ্কার, অন্য দিকে পুলিশের পীড়ন, দুইয়ে মিলে স্বভাবতই মানসিক শক্তিতে ভাঙন ধরতে পারে, স্বীকারোক্তিও করে ফেলতে পারে।

এ-অবস্থায় ধ্রুব আমার কাছে এসেছিল। পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ডের আশ্রয় ছেড়েই সে আমার শরণাপন্ন হয়েছিল, কেঁদে ফেলেছিল, এবং বলেছিল, আমি আত্মহত্যা করতে পারি, তবু পুলিশের কাছে ধরা দিতে পারব না। মিহির আর যতীন (জেলা কমিটির নেতা) প্ল্যান করে আমার এই সর্বনাশটা করছে, তারা আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চাইছে। অথচ বিশ্বাস করো, কোনওরকম নেতৃত্বের মোহ আমার নেই, আমি শুধু কোনও কোনও ক্ষেত্রে ওদের কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করেছিলাম। ওরা সেটা সহ্য করতে পারছে না বলেই আমাকে এভাবে বের করে দিচ্ছে।

সৎ ধ্রুবকে আমি দেখলাম, সে অসহায়। আমি তাকেই বিশ্বাস করি। মিহিরের অতীতকে আমি জানি না, তাকে ওপর থেকে আমাদের এলাকায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে বাইরে থেকে এসেছে। আমি ধ্রুবকে চিনি, বুঝি, বিশ্বাস করি এবং তাকে এভাবে ক্ষুধার্ত নেকড়েদের মুখে এক টুকরো মাংসের মতো আমি ছুঁড়ে দিতে পারি না। আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি, কিন্তু আমার উপায় নেই, অ্যাকশন কমিটির কাছে আমাকে অস্বীকার করতেই হবে। স্বীকার করলে আমার ওপর নির্দেশ অমান্যের শাস্তি নেমে আসবে তো বটেই, ধ্রুবকেও বাঁচানো যাবে না। এখন এই অ্যাকশন কমিটির কাছে বিশ্বস্ত থাকা বিবেকহীন দাস মনোবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি বললাম, সেই সার্কুলার আমি পড়েছি। ধ্রুবকে আমি আশ্রয় দিইনি।

অ্যাকশন কমিটির নিরেট মুখগুলো পরস্পরের দিকে একবার চোখাচোখি করল। মিহির তার বাক্যবাণ প্রয়োগ করল। হেসে ঘাড় কুঁচকে বলল, আপনার মতো একজন খাঁটি কমরেড পার্টির কাছে মিথ্যে কথা বলবে এটা আশা করা যায় না।

মিহির জানত তার এই ভঙ্গিটা অপরের পক্ষে খুবই ক্রোধের উদ্রেক করে। আমি শান্তভাবেই বললাম, আমি মিথ্যে বলিনি।

যদি প্রমাণ হাজির করা যায়?

তা হলে তো কোনও কথাই নেই। আমি জবাব দিলাম।

অ্যাকশন কমিটির পাথুরে মুখগুলো তীক্ষ্ণ ধারে ঝলকাতে লাগল, চোখগুলো অঙ্গারের মতো জ্বলতে লাগল। ঘৃণায় হিংস্র দেখাল। সব থেকে কমবয়স্ক যে, যাক টেক নাম পি পি সে শাসিয়ে উঠল, প্রমাণ হলে মনে রাখবেন, আপনাকেও ধুবর মতোই পার্টি থেকে বের করে দেওয়া হবে।

জানি। আমি দৃঢ়তা প্রকাশ করলাম।

বিকাশ (ছদ্মনাম) নিষ্ঠুর মুখে, কঠিন গলায় বলল, শুধু বের করেই দেওয়া হবে না, তার চেয়েও কঠিন শাস্তি

বাকিটা তার চোখের আগুনে ও দাঁতে দাঁত ঘষাতেই বোঝা গেল। ওরা অ্যাকশন কমিটির লোক, হয়তো ওদের প্রত্যেকের কাছেই রিভলভার রয়েছে। ওরা ইচ্ছে করলে আমাকে

গত শুক্কুরবার– মিহিরের দৃঢ় গম্ভীর ও নাটুকে গলা বেজে উঠল, গত শুকুরবার রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ ধ্রুব আপনার কাছে যায়নি?

কথাটা মিথ্যে নয় এবং খবরটা কমরেড রেবার (আমার স্ত্রী, পার্টির সভ্যা, অত্যন্ত বিশ্বস্ত, স্ত্রীলোক মাত্রেই যা হয়ে থাকে ভালবাসা ও ধর্মের বিষয়ে যুক্তিতর্কহীন, যদি ধর্ম মানে, এবং বর্তমানে পার্টি, আমার মতে ধর্মীয় দল ও আচার-অনুষ্ঠানের পর্যায়ে পৌঁছেছে, যুক্তি তর্ক বোধ বুদ্ধিহীন অলৌকিক বিশ্বাসে আত্মদানে উন্মুখ, আমার স্ত্রী একজন সেইরকম বিশ্বস্ত কমরেড, এবং বিশ্বস্ততার মূলেও ভালবাসায় যেহেতু আহত, সে ফণিনীতুল্য) কাছ থেকে শুনেছে।

আমি তবু বললাম, না।

তা হলে কমরেড রেবা মিথ্যে বলেছেন? মিহির বলল বেশ বিদ্রুপের ঢেউ দিয়ে, একটু অ্যাসিড-হাসির জ্বালা ছিটিয়ে। যেন এর পরে আর আমার স্বীকারোক্তি না করে উপায় নেই। আমি অবশ্য রেবাকে অনুরোধ করেছিলাম, যেন সে এ-খবর পার্টিকে না দেয়। কিন্তু দিয়েছে।

বললাম, যদি তিনি বলে থাকেন তবে মিথ্যেই বলেছেন।

মিহির গর্জন করে উঠল, কমরেড, সাবধান, আপনি আর একজনকে মিথ্যেবাদী করছেন।

আমি মিথ্যে বলিনি।

শাট আপ লায়ার। পি পি ক্রুদ্ধ স্বরে গর্জে উঠল, নিজের উরুতেই একটা ঘুষি মারল।

আর তার মাঝখান থেকে আহত বাঘের মতো গর্জিত গোঙানি ভেসে উঠল মিহিরের গলায়, আপনি সেই রাত্রেই একটা চিঠি লিখে, টাকা দিয়ে ওকে কোথাও পাঠিয়ে দেননি?

না।

এই ঘৃণ্য মিথ্যে বলার পরিণাম আপনি জানেন?

আমি মিথ্যে বলিনি।

মিহির অসহায় আক্রোশে কী করবে ভেবে পেল না। তার সবল পেশল হাত, মস্ত বড় থাবা অন্ধশক্তিতে কয়েক মুহূর্ত মোচোল। তার পরে হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ডিসলভ দিস মিটিং, একে আজ চলে যেতে দিন। আমাদের সিদ্ধান্ত একে পরে জানানো হবে।

পি পি বা বিকাশের চলে আসতে দেবার ইচ্ছে ছিল না। তবু সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না।

আমি বললাম, যেতে পারি?

মিহির বলল, নতুন সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত।

আমি চলে এলাম। তখনও আমার ছেলেবেলার কথাই মনে পড়েছিল, কৈশোরের যৌবনের ইস্কুল পালানো, অলকাদের সঙ্গে মেশা, নীরাকে ভালবাসা, ধ্রুবকে আশ্রয় দেওয়া এবং

.

দরজাটা খুলে গেল। স্বীকারোক্তি। কালো গগলস পরা রাশভারী লোকটি পিছন ফিরে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। বগলে একটা ফাইল। এবার জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু সেই শিরদাঁড়া-শিউরনো শীতটা এখন আমার আর নেই। ঘাড়ে গর্দানে স্কুল পেশল লোমশ লোকটি এক টানে গায়ের কোটটা খুলে ফেলল। ফাইলটা টেবিলে রাখল। মোটা স্বর শোনা গেল, এখানে এসে আপনার বডি সার্চ হয়েছে?

না।

দাঁড়ান।

দাঁড়ালাম। লোকটা আমার শূন্য পকেটগুলো, কোমর, পেট, চাদর ঝেড়ে দেখে নিল।

বসুন।

বসলাম। গগলসটা খুলল সে। চোখের পাতায় লোম নেই, কোলগুলো রক্তাভ, অনেকটা কাঁচা ঘায়ের মতো। চেয়ারে বসে ফাইলের পাতা উলটে যেতে লাগল, আর মোটা স্বরে হুম হুম করতে লাগল। তার পরে আচমকা জিগ্যেস করল, কিছু বলবেন, না বলবেন না?

কোন বিষয়ে? আমি বললাম।

লোকটা শব্দ করল, হুম।

মোটা ঠোঁট দুটো চেপে বসল ওর। তার পরে সেই রক্তাভ চোখদুটি তুলে নিষ্পলক তাকাল আমার দিকে। লোকটার মুখটা যেন ফুলে উঠছে, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে। আর আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, ধলেশ্বরীতে ঝড় উঠব-উঠব করছে, আকাশ কালো হয়ে উঠছে, বায়ুকোণে চিকুরহানা বাজের দূর গর্জন। ছোট নৌকো, আমি আর মা যাত্রী, গন্তব্য মামাবাড়ি, একমুখ দাড়িওয়ালা মাঝি পবন। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে বুকের কাছে। চোখে আতঙ্ক। ডাক দিল, পবন।

পবন তখন হাঁক দিচ্ছিল, রও হে, আর দশ ঠেলা।

সে কড়কে বলছিল, আর দশবার হাল ঠেললেই তীরে পৌঁছুবে। নৌকোটা অসম্ভব দুলছিল বাতাসে নয়, পবনের হালের চাড়ে।

গুরু গুরু গুরু। মা বলছিল।

কোন বিষয়ে, অ্যাঁ? লোকটা গোঙানো সুরে উচ্চারণ করল। ঘেয়ো রক্তাভ চোখগুলো অপলক।

একটা আর্তনাদের স্বর ভেসে এল ধলেশ্বরীর তীর থেকে, আর গাছগুলো নুয়ে পড়ল। ঝড়ের আঘাতে পৃথিবীর আর্তনাদ ওটা।

আর একটুখানি, আই দ্যাওয়া! পবন চিৎকার করল আবার।

 লোকটা ভ্যা-ভ্যা করে হেসে ফেলল।

পবন ঝপাং করে লাফ দিল জলে। চিৎকার করল, ডরাইয়েন না মা, বুক জলে।

নৌকোর কাছি পবনের হাতে!

লোকটা বলল, আমরা যেমন জিগ্যেস করি, আপনারা সবাই সেরকমই জবাব দেন। সত্যি বলছি, আমি টায়ার্ড, টায়ার্ড। কোনও মানে হয় না, রোজ রোজ সেই একই কথা। জানা কথাই তো বাপু, আপনারা কেউ কিছু বলবেন না। নিন, সিগারেট খান।…কোনও জীবনেই সুখ নেই মশাই। বিপ্লব করেই বা কী সোনার রাজত্ব তৈরি করবেন আপনারা! ইংরেজ আমলে আমরাও অনেক কিছু ভেবেছিলাম। বসুন, আসছি। কোটটা তুলে নিয়ে ফাইলটা হাতে করে লোকটা চলে গেল। দরজাটা টেনে দিয়ে গেল।

একটা দুর্যোগ গেল। হয়তো আর-একটা দুর্যোগ আসবে, তার পরে আর একটা, তার পরে…। জীবনব্যাপী দুর্যোগ। তাকে রোধ করা যায় না। যে বিশ্বে বাস, সেই বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যেই দুর্যোগের নানান কার্যকারণ ইন্ধন, এবং আমি কেন দুর্যোগের মাঝখানে, এর একমাত্র কারণ, আমি যে কারণে ছেলেবেলায় ইস্কুল পালিয়েছিলাম, আরও কৈশোরে চৌদ্দ বছর বয়স হবে তখন, বিধবা বীণাদির গোপন চিঠি অমরদাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম, সেই বিষণ্ণ যুবতী বীণাদি পাড়ার ক্লাবের নেতা লাইব্রেরি-স্রষ্টা অমরদাকে ভালবাসতেন, এবং দুজনের দেখা-সাক্ষাৎ বারণ হয়ে গিয়েছিল, বীণাদির অভিভাবকেরা বীণাদিকে বেরুতে দিতেন না, পাড়ার সব বয়স্ক মানুষেরাই যেন এই দুজনের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, একটা ফ্রন্ট তৈরি করেছিল, পাহারা দেওয়া, গোয়েন্দাগিরি করা, নোংরা রসিকতা ও কুৎসিত কথা বলা, আর স্বভাবতই আমাদের অভিভাবকেরাও ক্লাবে যেতে নিষেধ করেছিল, অমরদার সংস্রব বিষবৎ ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল, স্বাভাবিকভাবেই আমরা সেটা অন্যায় মনে করেছিলাম, এবং ওই বয়সে হৃদয়ের সকল আবেগ ও সমর্থন অমরদা ও বীণাদির পক্ষে ছিল। আমি বীণাদির চিঠি অমরদাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম এবং অমরদার চিঠি বীণাদিকে, আর সেই পৌঁছে দিতে গিয়েই ধরা পড়েছিলাম, যদিচ বামাল নয়, তার পরেই আমি রক্তাক্ত, দাদার একটি ঘুষিতেই কষের দাঁত নড়ে গিয়েছিল, বাবার ছড়ির দাগ আমার শরীরটাকে চিতাবাঘ করে তুলেছিল, আমার মায়ের ক্রুদ্ধ প্রশ্ন, এখনও বল, অমরের চিঠি বীণাকে…?

না।

উঃ ভগবান, এই ছেলেটাকে কেন আঁতুড়েই মুখ নুন পুরে দিইনি।দুঃসহ রাগে ও ঘৃণায় মা চিৎকার করে উঠেছিল।

আর আমি মনে মনে বলেছিলাম, হে ভগবান, বীণাদি আর অমরদা যেন ধরা না পড়ে। এবং তখনও সেই একই দুর্যোগ…

.

দরজাটা আবার খুলে গেল। অন্য একজন ঢুকল। সেই ফাইল হাতে। ধুতি পরা, শার্টের ওপরে কোট। চেয়ারে এসে বসল। পকেট থেকে কতগুলো কাগজ বের করে দেখল। একবার আমাকে তাকিয়ে দেখে বলল, আমি যা পড়ে যাচ্ছি, সেগুলো আগে শুনে যান, কোথাও না মিললে আমাকে বলবেন। …সালে পার্টিতে জয়েন, সময়ে লোকাল কমিটিতে উত্তীর্ণ, সন্দেশখালির কৃষক সম্মেলনে যোগদান, মেটিয়াবুরুজে..তারিখে উত্তেজক বক্তৃতাদান, গান ফ্যাক্টরিতে গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলা, রেলওয়ে ছাব্বিশ নম্বর গেটের ওপারে পার্টির আর্মস সরিয়ে নিয়ে যাওয়া…

লোকটা একটা কথাও মিথ্যে বলছিল না, তারিখ বা সময়, একটাও ভুল বলছিল না। যেন আমারই কোনও সহকর্মী, সর্বক্ষণের সঙ্গী, কতগুলো গোপন ও প্রকাশ্য ঘটনা বলে চলেছে। বলে চলেছে, অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল।…তারিখে, এবং…তারিখে ও…তারিখে কমিটির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়েছে, তারিখে গণপৎ সিং-এর কাছ থেকে এক ব্যাগ ক্র্যাকার নিয়ে সাত নম্বর সেলকে দিয়েছেন (আশ্চর্য! আশ্চর্য! লোকটা হয়তো এর পরে বলবে রেবার সঙ্গে আমার কবে ঝগড়া হয়েছে, নীরার সঙ্গে আমি কোথায় কখন দেখা করেছিলাম), প্রাদেশিক কমিটির আরতি দত্তকে নিয়ে…তারিখে রাত্রে ফিটনে করে পার্কসার্কাস থেকে বালিগঞ্জ স্টেশন (অসম্ভব। এই বিষম সত্যি শুনে নিজেকেই অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে), এবং সেখান থেকে…ইত্যাদি।

লোকটা সত্যি ঘটনা বলে যেতে লাগল, আর ছোট ছোট তীক্ষ্ণ চোখ তুলে আমাকে দেখতে লাগল। আমি সেই যে ভাবলেশহীন মুখে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, কথাগুলো শুনতে শুনতে আর আমার কোনও ভাবের সঞ্চার হল না। বিস্ময়কে যথাসম্ভব রোধ করে আমি ধরেই নিলাম, আমার মুখের সামনে একটা আয়না ধরা হয়েছে, এবং বলা হচ্ছে, দেখুন আপনার ঠোঁটের ওপর ডান দিকে একটা তিল, বাঁ কানের পাশে ছোট একটি কাটা দাগ, নাকটা…চোখ দুটো ইত্যাদি। আর আমি মনে মনে বলতে লাগলাম, না, না, না। ওটা আমি নয়, ওটা আমার মুখের ছায়া নয়। না না না

তা হলে সবই মিলছে, সবই সত্যি?

কীসের?

এই আমি যা যা বললাম? আপনি যখন কিছুই বললেন না, তখন সবই মিলে গেছে নিশ্চয়।

আমি বললাম, এ সব আমি কিছুই জানি না।

লায়ার! একটা আচমকা গর্জনের সঙ্গে টেবিলের ওপর প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত পড়ল। মনে হল, গত শতকের পুরনো ঠাণ্ডা ঘরটা কেঁপে উঠল। একটা জ্বলন্ত মুখ, ক্রোধে ও ঘৃণায় আরক্ত। চোয়ালের হাড় কঠিন।

আমি অনেকটা অসহায় বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। একটাই মাত্র মন্ত্র জপ করতে লাগলাম, না না না, না না না, না না না। এবং লর্ড সিনহা রোডের এই ঘরে আমি ঝিঁঝির ডাক শুনতে পেলাম।

ভীষণ স্তব্ধ মনে হল কয়েকটি মুহূর্ত। তার পরেই লোকটির নিচু স্বর শোনা গেল। নিচু কিন্তু অনেক বেশি হিংস্র। জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলল সে, বাট আই উইল নট স্পেয়ার ইউ। আই উইল রীড এগেন, হিয়ার অ্যাটেন্টিভলি অ্যান্ড দেন আনসার।

লোকটা আবার সেই কাগজ পড়ে যেতে লাগল। কিন্তু এবার আমি শুনছিলাম না। ওর পড়ার চেয়ে দ্রুত এলোমেলো বহু ঘটনা ও গলার স্বর আমাকে ঘিরে ধরল। অ্যাকশন কমিটি; মিহির এই দেখুন কমরেড রেবার চিঠি, তিনি সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন। ধ্রুব কী ভাবে, আপনার কাছে কখন এল, কী বলল, আপনি কী বললেন, কী করলেন। আপনি এখনও স্বীকার করুন।

…রেবাঃ এই যে সেই চিরকুট, নাম না থাকলেও নীরার হাতের লেখা আমি চিনি। মিথ্যুক। এখনও বলল, তা হলে তুমি ওর সঙ্গে বাসুলি বিলের ধারে দেখা করেছিলে? ছেলেবেলা; বাবাঃ সত্যি কথা বল ইস্কুল পালিয়ে নৌকা বাইতে গেছিলি? কৈশোর; সমিতির বন্ধুরা: বিল অলকাকে কি তুই সমিতির কথা বলেছিস?…অ্যান্ড দেন আনসার।…

আনসার, আই সে আনসার। আবার একটা ঘর কাঁপানো ক্রুদ্ধ গর্জন এবং টেবিলের ওপর প্রচণ্ড মুষ্ট্যাঘাত।

আমি আমার সামনে দেখলাম, একটা রক্তাভ অঙ্গার মুখ, চিতার ক্রুদ্ধ চোখ। এবং আমি দেখলাম, ঘর কাঁপছে। ভেজা বিছানা থেকে আমি ঘুমন্ত লাফ দিয়ে উঠলাম। দশ বছরের আমি, জলে ভেসে যাওয়া মেঝেয়, অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে বাবার চিৎকার শুনলাম ঘরের বাইরে চলে ফেলু (আমার মায়ের নাম), ছেলেদের নিয়ে ঘরের বাইরে চলো, পশ্চিমের চাল উড়ে গেছে। আমার বুকের মধ্যে ভীষণ কাঁপছিল। ঝড়ের গর্জন আর তার দাপটে টিনের চাল যেন ভয়ে ককিয়ে কাঁদছিল। বিদ্যুঝলকে চোখ অন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। মায়ের আঁচল ধরে আমি ভোলা দরজা দিয়ে নতুন পাকা ঘরের দিকে চলোম। মস্ত বড় উঠোনটা বাতাসে বৃষ্টিতে বিজলি হানাহানিতে তোলপাড় হচ্ছিল। মায়ের একটা হাত আমার কাঁধে এসে পড়ল। সেইদিকে চোখ রেখে আমার সামনে আমি অঙ্গার-মুখ আর চিতা-চোখ ভেসে উঠতে দেখলাম। তার গর্জনের জবাবে, আমি ভিজতে ভিজতে নতুন পাকা ঘরের দিকে যেতে যেতে বললাম, জানি না। আমি এসবের কিছুই জানি না।

আমার মুখে থুতু ছিটকে লাগল, আর কানের কাছে গর্জন শোনা গেল, কী করে জানতে হয় আমি শিখিয়ে দেব। আই উইল টীচ ইউ, ইউ লায়ার, কাওয়ার্ড। একটা সত্যি কথা যে বলতে পারে না, সে করবে বিপ্লব! কাপুরুষ দখল করবে রাষ্ট্র ক্ষমতা! থু থু… ।

সম্ভবত লোকটা পান খায়, আর সুগন্ধি জর্দা, কারণ ছিটকানো থুতুতেই তা অনুমেয়। আমার গা-টা ঘুলিয়ে উঠল। তবু হাত পা শক্ত করে, ঝড়ের দাপটের মধ্য দিয়ে কাঁচা উঠোনের কাদা মাড়িয়ে, মায়ের হাতের স্পর্শে, নতুন পাকা ঘরের দিকে এগিয়ে চলোম।

দড়াম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। আমার সামনের চেয়ারটা শূন্য। কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমার ভিতরটাও শুন্য বোধ হল। অবসাদের নিঝুমতায় যেন ডুবে গেলাম। কিন্তু শীতবোধ আর একটুও ছিল না। এবং হঠাৎ আমার হাসি পেতে লাগল গর্জিত গালাগালগুলোর কথা মনে করে, লায়ার, কাওয়ার্ড! তবু লোকটা আশ্চর্যজনকভাবেই, সন্দেহজনক বিস্ময়করভাবেই আমার পার্টিজীবনের গোপন খবরগুলো জেনেছে যা দিয়ে ভিতরের সত্যটাকে ঘায়েল করতে চেয়েছিল। ভিতরের সত্য যা আপেক্ষিক অথচ ধ্রুব, যা কোনও নিয়মাধীন নয় অথচ একটা সুকঠিন নিয়মের প্রেমে আবদ্ধ, যা অথৈ, ছোঁয়া যায় না।

কতক্ষণ একলা বসে ছিলাম জানি না। আমার ভিতরে ভিতরে একটা প্রতীক্ষা ছিল সেই লোকটা আবার আসবে।

দরজাটা খুলে গেল। আবার–। না, একজন য়ুনিফর্ম পরা লোক। আমাকে ডাকল, আসুন।

উঠে আমি লোকটাকে অনুসরণ করলাম। যে পথে এসেছিলাম সেই পথেই সেই সিঁড়ি দিয়েই আবার চলোম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্য দিকে গেল লোকটা। পুরনো বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আবার একটা সুন্দর সাজানো বাগানে এসে পড়লাম রঙিন ফুল সবুজ ঘাস খোলা আকাশ শীতের রোদ সব মিলিয়ে আমার ক্ষুধার্ত চোখদুটি টনটনিয়ে উঠল। জল এসে পড়ল।

বাঁ দিকের উঁচু পাঁচিল ঘেঁষে আমি লোকটাকে অনুসরণ করছিলাম। সব দিকেই পাঁচিল, পাঁচিলের ওপরে কাঁটাতারের ফেন্সিং, তাতে লতা জড়ানো। সবুজ ঘন লতায় কাঁটাতার ঢাকা। সত্যি, শিল্পীদের দোষ নেই, যারা কাঁটাতারকে বইয়ের মলাটে ফুলের মতো আঁকে। ওতে বৈদ্যুতিক শক্তি যুক্ত থাকলে লতাগুলো বোধহয় মরে যেত…কিন্তু রোদটা কি নিবিড় সুখের মতো গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে, শরীরের ভিতরে ঢুকছে। চাদরটা আলগা করে দিলাম, বুকে যদি একটু রোদ লাগে। আর এই সবুজ, এই ফুল, হোক পাঁচিলে ঘেরা (পাঁচিল কোথায় নেই? একমাত্র সেই অথৈ সত্য ছাড়া, যে আমার অস্তিত্ব, যার নিষেধের কোনও সীমা নেই, অথচ সীমাহীন স্বাধীন), তবু তাদের চরিত্র বদলায়নি। তারা যা, তাই আছে।

য়ুনিফর্ম-পরা লোকটি দাঁড়িয়ে পড়ল। আমিও দাঁড়ালাম। বাগানটা শেষ, পাঁচিলটা কাছেই দেখলাম, বাঁ দিকের পাঁচিলের পাশ দিয়ে দুটো সিঁড়ির ধাপ উঠে একটা গলি চলে গিয়েছে। বাইরে থেকে সহসা কিছুই বোঝা যায় না। সরু গলি, অন্ধকার, কিন্তু মাথা-ঢাকা ছাদে আলো জ্বলছে। দুটো ধাপের ওপরেই গলির মুখে লোহার গরাদের দরজা। দরজায় একজন বন্দুকধারী শান্ত্রী। আমার সঙ্গের লোকটির নির্দেশে শান্ত্রী লোহার গরাদ খুলে দিল। লোকটি আমাকে ভিতরে অনুসরণ করতে বলল। আমি ঢুকে অনুসরণ করলাম। এইমাত্র দিন অন্তর্হিত, আমি যেন রাত্রির বুকে প্রবেশ করলাম।

বাঁ দিকে দেয়াল, মাথাটা ছাদ-আঁটা, ডান দিকে লোহার গরাদ দেওয়া পর পর কয়েকটা খাঁচার মতো ঘর। একেবারে শেষ ঘরটার কাছে গিয়ে আমার সঙ্গের লোকটি দাঁড়াল। শাস্ত্রী আমাকে ডিঙিয়ে খাঁচার গরাদের তালা খুলল।

য়ুনিফর্ম-পরা লোকটি আমার দিকে একবার তাকাল আর গলিটার শেষ দেয়ালের গায়ে জলভরা চৌবাচ্চা দেখিয়ে বলল, এখানে চান করে নিতে হবে। সেলের মধ্যে খাবার দিয়ে যাবে। একটা সিগারেট যদি ইচ্ছে হয়–

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করল সে। সেলে ঢোকবার আগেই ধূমপান করে নিতে হবে। বুঝলাম, এগুলো এস. বি. সেল। সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে, আমি পিছন ফিরে গলির বাগানের দিকে তাকালাম। এখনও সবুজ, এখনও সিগারেটের নিবিড় নেশা। ভেবেছিলাম, লালবাজারের লক-আপ থেকে এস. বি. সেল ভাল হবে। ভাল হবে! কোথায় গেল সেই পাগলটা, সেই উদ্ধত ছেলেগুলো। ওরা এখানে আসবে না।

মনে হল, মুহূর্তেই সিগারেট পুড়ে শেষ হয়ে গেল। সেলের গরাদ খুলে গেল। আমি ভিতরে ঢুকলাম। শান্ত্রী তালা বন্ধ করে দিল। তার পর দুজনেই চলে গেল। নৈঃশব্দ্য নেমে এল, গভীর নৈঃশব্দ্য।

সামনে দেওয়াল, পিছনে ডাইনে বাঁয়ে দেওয়াল। মাথার ওপরে একটি অকম্পিত স্থির আলো। লোহার খাট, একটা তোশক আর কম্বল। খাটের বাইরে ফুট-তিনেক ঠাণ্ডা মেঝে। চওড়ায় ফুট-তিনেক, লম্বায় আট কি দশ।

আমি খাটের ওপর বসলাম। কোনও শব্দ হল না। ক্লান্তি বোধ করছিলাম। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লাম কাত হয়ে। কোনও শব্দ হল না। হলদে আলোয় তাকিয়ে থাকতে পারছি নে। চোখ বুজলাম। নৈঃশব্দ্য, গভীর গাঢ় নৈঃশব্দ্য আর অন্ধকার।

এ সবই আমার চেনা, আমার জানা, এই দুয়ারবন্ধ বন্দিত্ব, এই একাকিত্ব, এই নৈঃশব্দ্য, এই অন্ধকার। একমাত্র তফাত, এটা এস. বি. সেল। এ সব ঘোচাবার জন্যেই কি একদা ইস্কুল পালাইনি? ছেলেবেলায় এই বন্দিত্ব এই একাকিত্ব ঘোচাবার জন্যেই কি দুঃসাহসী অবোধ মন নিয়ে ছোট ডিঙিতে করে বর্ষার দুরন্ত নদীর বুকে ভেসে যাইনি? তার পরে সমিতিতে অলকাদের সঙ্গে মিশতে যাইনি? তার পরে রেবাকে বিয়ে করিনি? তার পরে বিপ্লবী পার্টিতে আসিনি? তার পরে নীরার কাছে ছুটে যাইনি? সারাজীবন ধরে এই বোধই কি রূপান্তরের পথে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে না?

আরও কি ছুটিয়ে নিয়ে যাবে না? এই বোধই কি সমষ্টির সঙ্গে জীবনকে ভাগ করে ভোগ করার বাসনাকে বাধ্য করেনি? যারা কোথাও ঠেকে গিয়েছে তাদের বোধ একটা কোথাও নিঃশেষে মুছেছে। আর মিথ্যকেরা উত্তরণের কথা বলে, কারণ একাকিত্ব কখনও নিষ্ক্রিয় থাকে না, বন্দিত্ব কখনও নিশ্চেষ্ট থাকতে পারে না।

এই এস. বি. সেলের থেকে সেই একাকিত্ব কি আরও ভীষণ নয়? আরও ভয়ংকর নিষ্ঠুর মর্মান্তিক নয়? এবং আরও সুন্দর ও মধুর? জ্ঞান মুক্তি ও মৈত্রীর নতুন নতুন চাবিকাঠির সন্ধান যে দিয়েছে। এই তো আমার জপ, আমার আহ্নিকের আচমন।

লোহার গারদ ঝনঝনিয়ে উঠল। আমি তাকালাম। শান্ত্রী। সে আমাকে নাইতে বলল। তালা খুলে দিল। স্নান করার দরকার ছিল কিন্তু কোনও সরঞ্জামই ছিল না। অথচ নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। এখন শুকিয়ে ড্যালা পাকিয়ে রয়েছে। স্নান না করে উপায় ছিল না। তাছাড়া গলির বাইরে সবুজ লন আর ফুলের বাগান দেখতে পাব স্নান করতে গেলে। তাই অগত্যা নগ্ন হয়ে চৌবাচ্চার কাছে গেলাম। জল তোলবার কোনও পাত্র ছিল না। সান্ত্রী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল আর খইনি বানাতে লাগল। আমি সেই দিকেই মুখ করে আঁজলা আঁজলা জল তুলে গায়ে মাথায় ঢালতে লাগলাম। নইলে বাইরেটা, দিনটা দেখা যেত না। দৈহিক প্রশান্তি আমার দেহে সংগীত করতে লাগল যেন।

আবার গরাদ বন্ধ। গা শুকোবার আগেই জামাকাপড় পরে নিলাম। তার পরে একটা লোক এসে গরাদের নীচের কয়েক ইঞ্চি ফাঁক দিয়ে খাবার দিয়ে গেল। মাছ ভাত দই। বোধহয় কাছেই কোনও হোটেলের সঙ্গে অফিসের ব্যবস্থা আছে। এখানে যে কজন বন্দি থাকতে পারে তাদের জন্যে নিশ্চয়ই কোনও রান্নাঘরের ব্যবস্থা নেই।

কিন্তু ঘুম এল না। কেবলই মনে হতে লাগল এই গাঢ় নৈঃশব্দ্যের মধ্যে কী একটা শব্দের প্রতীক্ষা যেন আমার ভিতরে মাথা কুটছে। কী সেটা? গরাদের তালা খোলার শব্দ? আবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে ডাকতে আসবে তাই?

না। কেউ আর এদিকে অনেকক্ষণ এল না। আমি উঠে পায়চারি করতে যেতেই থমকে গেলাম। বাজছে, সেই শব্দটা বাজছে! যার প্রতীক্ষা করছিলাম আমি, সেই ঝিঁঝি ডাকছে। মানুষ যাই বলুক নিজের হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে বিশ্বনিরন্তরতার একটা সম্পর্ক সে খোঁজে।

.

পরদিন আমাকে সেই বাড়িতে দোতলার সেই ঘরটায় ডেকে নিয়ে গেল। সকাল থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত দফায় দফায় চারজন জিজ্ঞাসাবাদ করল। বেলা তিনটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত দুজন।

তার পরের দিন একই নিয়মে আটজন।

তারও পরের দিন, সারাদিন কেউ আমাকে ডাকতে এল না। অবাক হলাম, ছুটিও অনুভব করলাম। সন্ধ্যা সাতটাতেই রাত্রের খাবার দিয়ে দেয়। আমি তারই প্রতীক্ষা করছিলাম। কিন্তু গরাদের তালা খুলতে দেখে অবাক হলাম। কারণ খাবার তলা দিয়েই দেয়। তালা খোলার পর দেখলাম একটু য়ুনিফর্ম-পরা অফিসার, কোমরবন্ধে রিভলভার। বাইরের থেকেই তর্জনী নেড়ে আমাকে মোটা গলায় ডাকল, আসুন।

আমি চাদরটা জড়িয়ে তাকে অনুসরণ করলাম। গলির বাইরে এসে দেখলাম অন্ধকার নেমেছে। বাগানে কোনও আলো নেই। সবুজ লন বা ফুল বা কেয়ারি কিছুই স্পষ্ট দেখতে পেলাম না। সেই পুরনো দোতলা বাড়িটাকে অন্ধকারই মনে হল। রোজকার দেখা বাড়িটা এখন যেন স্তব্ধ দৈত্যপুরীর মতো মনে হল।

দরজার ভিতর দিয়ে ঢুকে সামনের ঘরটায় স্তিমিত আলো দেখতে পেলাম। অফিসারকে অনুসরণ করে আমি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলাম। সিঁড়িতেও তেমনি স্তিমিত আলো, নিজের ছায়াতেই অন্ধকার লাগে। ওপরের আলোও সেইরকম। এবং সেই একই ঘরের মধ্যে আমাকে ঢুকতে বলা হল। রাত্রে আমি কখনও এই ঘরে ঢুকিনি। দেখলাম এই ঘরের আলো একটু জোরালো। আমাকে বসতে বলা হল। বসলাম। অফিসার দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল।

জিজ্ঞাসাবাদ! নতুন পদ্ধতি। এই কথা আমার মনে হল। কিন্তু আমার শীত করছে না একটুও। আমি প্রস্তুত হবার জন্যে বসলাম।

দরজা খুলে গেল। দেখেই চিনতে পারলাম সেই লোক। একটা কম্বল তার হাতে আর কম্বলের মধ্যে, একটা-কিছু, মোটা ডাণ্ডা হতে পারে, সবসুদ্ধই সে টেবিলের ওপর রাখল। ডান হাতে সেই ফাইল, রিপোর্টস। এ সেই লোক যাকে আমি প্রথম দিন একটা ঘর থেকে রেগে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলাম, যে ঘরের মধ্যে একজনকে হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে টেবিলের ওপর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম।

পরমুহূর্তেই লোকটা আমার চোখে হারিয়ে গেল। অনেক দৃশ্য ও স্বর আমার দৃষ্টি ও শ্রবণকে ঘিরে ধরল। এবং অ্যাকশন কমিটির শেষ আহ্বানের দৃশ্য ও ঘটনা আমাকে টেনে নিয়ে গেল। ওরা কখনও এক জায়গায় বারে বারে দেখা করে না। সেই অন্য জায়গা। কমিটির সকলের চোখেই দেখলাম নিষ্ঠুর ক্রুর বিদ্রুপের হাসি।

মিহিরের হাসিটা প্রকৃতই নায়কোচিত। চেহারাটিও। আমি যদি ওকে না চিনতাম তবে সেদিনের মূর্তি দেখে সত্যিই মুগ্ধ হতাম। একাধারে বিজয়ী যোদ্ধা ও দার্শনিকের মতো মনে হচ্ছিল ওকে। অথচ করুণা ও দয়া দেখাবার অঙ্গীকারও রয়েছে যেন চোখের হাসিতে।

ওর হাতে একটা চিঠি ছিল। বলল, আজ আমি শুধু এই চিঠিটাই পড়ব, তার পরে আপনার যা বলবার থাকে বলবেন।

আমার মনে হল চিঠিটা ধ্রুব লিখেছে, সে স্বীকারোক্তি করেছে আমার সাহায্যের কথা। দেখলাম, সকলের চোখগুলোই বিদ্যুৎঝলকে আমাকে যেন তড়িতাহত করতে চাইছে। কিন্তু যদি ধ্রুব লিখেই থাকে

মিহির বলল, পড়ছি।বলে সে পড়তে আরম্ভ করল:

 মাননীয়েষু–
মিহিরবাবু, একটু ভেবে আপনাকে সব সত্যি কথা জানাতে পারব কিনা বলেছিলাম। যদিও আপনাকে আমি আগে কখনও দেখিনি, শুনেছি মাত্র আপনার কথা। আপনাদের পার্টি সম্পর্কে আমার তেমন কোনও ধারণা ছিল না। একমাত্র অনলের (আমার নাম) মুখেই যা শুনেছি। সে একজন বিশেষ কর্মী তাও জানি। আপনার সঙ্গে রেবাদিকে ( আমার স্ত্রী) দেখে অবাক হয়েছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম, রেবাদি বোধহয় আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এসেছেন।

যাই হোক, আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি সত্যি অভিভূত হয়েছি। পার্টির প্রতি, তার বৈপ্লবিক কর্মপদ্ধতির প্রতি আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাকে আপনি বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি বুঝতে পেরেছি অনল ভুল করেছে। সে আমাকে ভালবাসে, তাই কখনও মিথ্যে কথা বলে না। ধুবর মতো লোককে ক্ষমা করা যায় না। পার্টির, বিপ্লবের এবং অনলের মঙ্গলের জন্যেই আপনাকে আমি তাই জানাচ্ছি অনল সত্যি ধ্রুবকে আশ্রয় দিয়েছে। আমাকে অনল নিজেই সে কথা বলেছে। আমার সঙ্গে তার সব কথাই হয়। আমি সঠিক স্মরণ করতে পারছি না কার আশ্রয়ে ধ্রুবকে ও পাঠিয়েছে। তবে মুর্শিদাবাদে কোনও বন্ধুর কাছে পাঠিয়েছে এই পর্যন্ত মনে আছে। অনল ধ্রুবকে অনেকগুলো টাকাও দিয়েছে। এবং একদিন পার্টির এই সন্ত্রাসবাদী নীতির পরিবর্তন হবে অনল এই বিশ্বাসেই ধ্রুবকে আবার ফিরিয়ে আনবে বলেছে।

আপনার কথায় আমার সম্যক উপলব্ধি হয়েছে অনলকে আমার ঠিক পথে ফিরিয়ে আনা উচিত। আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার নেবেন। ইতি –নীরা

নীরা, নীরা লিখেছে। চিঠিটা আমার হাতে নেবার দরকার ছিল না। ওই কাগজ এবং হাতের লেখা আমার রক্তের সঙ্গে পরিচিত।

চিঠিটা পড়ার পর অ্যাকশন কমিটি নিষ্পলক তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। মিহির হেসে বলল, বলুন। ৭৭২

আমি বললাম, আমি এ সবের কিছুই জানি না।

বোধহয় বজ্রপাত হলেও ওরা এত চমকাত না। মিহির বলে উঠল, আপনি নীরাকেও অস্বীকার করছেন? সে আপনার

আমি চুপ করে রইলাম। আর আমার প্রেমে আদুরে হয়ে ওঠা সেই মুখোনি মনে পড়ল।

মিহির গর্জে উঠল, আপনি নীরাকে এ সব বলেননি?

না।

তা হলে নীরাও মিথ্যে বলছে?

তাই দেখছি।

মিহিরের লায়ার চিৎকারটা আমার কানে বেজে ওঠবার আগেই টেবিলের ওপর কম্বলটা নড়ে উঠল, ভিতরের ডাণ্ডাসহ সেটা একটা মোটা থাবায় উঠল এবং মোটা গোঙানো স্বরের কীএকটা কথার সঙ্গে লোকটা আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কী শুনতে পেলাম বুঝলাম না, খালি বললাম, আমি জানি না।

তারপর…

[১৯৪৯ সালে বে-আইনি ঘোষিত এক রাজনৈতিক পার্টির একজন সদস্যের বন্দি অবস্থায় লিখিত স্মৃতিচারণ থেকে উদ্ধৃত।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *