পঞ্চতন্ত্র
মাভৈঃ!
বাঙালি সবদিক দিয়েই পিছিয়ে যাচ্ছে, এরকম একটা কথা প্রায়ই শুনতে পাওয়া যায়। কথাটা ঠিক কি না, হলফ খেয়ে বলা কঠিন, কারণ দেশ-বিভাগের ফলে তার যে খানিকটে শক্তিক্ষয় হয়েছে সে বিষয়ে তো কোনও সন্দেহই থাকতে পারে না। পার্লামেন্টে যদি আপনার সদস্যসংখ্যা কমে যায় তবে সবকিছুই কাটতে হয় ধার দিয়ে ভার দিয়ে কাটার সুযোগ আর মোটেই জোটে না।
দিল্লিতে থাকাকালীন আমি একটি বিষয় নিয়ে কিঞ্চিৎ চিন্তা করেছিলুম। কেন্দ্রে অর্থাৎ ইউপিএসসি-তে বাঙালি যথেষ্ট চাকরি পাচ্ছে কি না? ওই অনুষ্ঠানের সদস্য না হয়েও যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের বিশ্বাস, বাঙালির এতে যতখানি কৃতকার্য হওয়া উচিত ততখানি সে হচ্ছে না। একদা বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমাকে সেখানে ডাকা হয়েছিল; আমি তখন চোখকান খোলা এবং খাড়া রেখে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করেছিলুম।
দিল্লিতে এখন যারা বসবাস করেন তারা বিলিতি কিংবা বিলিতি ঘষা পোশাক পরেন, ছুরিকাঁটা দিয়ে খাওয়া প্রচুর বাড়িতে চালু হয়েছে, ইংরিজি আদব-কায়দা, বিশেষ করে ইংরিজি এটিকেট এঁদের কাছে আর সম্পূর্ণ অজানা নয়।
ইউপিএস সি-এর তাবৎ মেম্বারই সায়েবিয়ানা পছন্দ করেন, এ-কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু যেখানে সে-আবহাওয়া বিদ্যমান, মানুষ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় তার থেকেই প্রাণবায়ু গ্রহণ করে। তাই যদি বাঙালি ছেলের পোশাক ছিমছাম না হয়, চেয়ার টেনে বসার সময় সে যদি শব্দ করে, মোকামাফিক পার্ডন, থ্যাঙ্কু না বলতে পারে এবং সর্বক্ষণ ঘন ঘন পা দোলায় তবে সদস্যরা আপন অজান্তেই যে তার প্রতি কিঞ্চিৎ বিমুখ হয়ে ওঠেন সেটা কিছু আশ্চর্যজনক বস্তু নয়।
কিন্তু আসল বিপদ অন্যত্র। বাঙালি উমেদার ইংরিজিতে ভাব প্রকাশ করতে পারে না। পাঞ্জাবি, হিন্দিভাষী কিংবা মারাঠি যে ইংরিজি বলে সেটা কিন্তু আমরি আমরি করবার মতো নয়। বিশেষত পাঞ্জাবি, হিন্দি-ভাষী ও সিন্ধিদের ইংরিজিজ্ঞান শিলিং-শকার ও পেনি-হার থেকেই আহরিত। তা হোক, কিন্তু ওইসব বুঝে-না-বুঝেই যারা বেশি পড়ে তাদের কথাবার্তার অভ্যাস হয়ে যায় বেশি, অন্তত থ্যাঙ্ক, পার্ডন, আই এম এফ্রেড তারা তাগমাফিক লাগিয়ে দিতে কসুর করে না।
এ স্থলে ইতিহাসের দিকে একনজর তাকাতে হয়।
মুসলমান আগমনের পর থেকে ১৮৪০-৪২ পর্যন্ত বাঙলা দেশের ব্রাহ্মণ তথা বৈদ্য সম্প্রদায়ের বিস্তর লোক সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেন, এবং মুসলমান ও কায়স্থরা ফারসি (এবং কিঞ্চিৎ আরবির) চর্চা করেন। এদেশের বড় বড় সরকারি চাকরি, যেমন সরকার (চিফ সেক্রেটারি) কানুনগো (লিগেল রিমেমব্রেন্সার) বখসি (একাউন্টেন্ট জেনারেল পে মাস্টার) অর্থাৎ এডমিনস্ট্রেটিভ তাবৎ ডাঙর ডাঙর নোকরিই করেন কায়স্থেরা; ইংরেজের আদেশে এঁরাই কলকাতাতে প্রথম ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন। বস্তৃত ফারসি তাদের মাতৃভাষা ছিল না বলে তারা সেটা অনায়াসে ত্যাগ করে ইংরেজি আরম্ভ করে দিয়েছিলেন এবং ফলে হাইকোর্টটি তাদের হাতে চলে যায়। ব্রাহ্মণরা আসেন পরে; তাই তারা পেলেন বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলমান আসেন সর্বশেষে, তার কপালে কিছুই জোটেনি।
তা সে যাই হোক্, আমরা বাঙালি প্রথমেই সাততাড়াতাড়ি ইংরেজি শিখেছিলুম বলে বেহার, উড়িষ্যা, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এস্তক সিন্ধুদেশ পর্যন্ত আমরা ছড়িয়ে পড়ি।
এর পর অন্যান্য প্রদেশেও বিস্তর লোক ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন। ক্রমে ক্রমে আমাদের চাহিদা ও কদর কমতে লাগল। এসব কথা সকলেই জানে, কিন্তু এর সঙ্গে আরেকটি তত্ত্ব বিশেষভাবে বিজড়িত এবং সেই তত্ত্বটির প্রতি আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
যে দুটি জাতীয় সঙ্গীত ভারতের সর্বত্র সম্মানিত সে দুটিই বাঙলা দেশেই রচিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রাম সর্বপ্রথম আরম্ভ হয় বাঙলা দেশেই। এটা কিছু আকস্মিক যোগাযোগ নয়। এর কারণ বাঙালি আপন দেশ ভালোবাসে এবং সে বিদ্রোহী। দেশকে ভালোবাসলে মানুষ তার ভাষাকেও ভালোবাসতে শেখে।
আশ্চর্য, ইংরেজি ভালো করে আসন জমাবার পূর্বেই বাঙলাদেশে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। (ঠিক সেইরকম ফারসি যখন একদা আসন জমাতে যায় তখন কবি সৈয়দ সুলতান আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন,
আল্লায় বলিছে মুই যে দেশে যে-ভাষ,
সে-দেশে সে-ভাষে করলুম রসুল প্রকাশ।
যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন।
সেই ভাষা তাহার অমূল্য সেই ধন্য৷)
এবং আরও আশ্চর্যের বিষয়, সে বিদ্রোহীদের কাণ্ডারী ছিলেন সে-যুগের সবচেয়ে বড় ইংরেজি (ফরাসি, লাতিন, গ্রিক) ভাষার সুপণ্ডিত মাইকেল। কাজেই যদিও সে উইলসেন, কেশবসেন ও ইস্টিসেন এই তিন সেনের কাছে জাত দিয়ে ছুরি কাঁটা ধরতে শিখল (আজ যা দিল্লিতে বড়ই কদর পাচ্ছে) তবুও সঙ্গে সঙ্গে ওর বিনাশের চারাকে জল দিয়ে বাঁচাতে আরম্ভ করল। এটাকে বাঙালির স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। এ সময় সে গাছেরও খেয়েছে, তলারও কুড়িয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই চোখে পড়ল, বাঙালি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজি বইয়ের আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যেরকম কাতর হয়ে পড়েছিল এবারে সে সে-রকম হাঁসফাস করল না। স্বরাজ লাভের সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, বাঙালি ইংরেজি ভাষা, আচার-ব্যবহার কায়দা-কেদা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছে এবং ফলে দিল্লিতে আর কল্কে, সরি, সের্ভিয়েট পায় না।
তর্ক করে, দলিল-দস্তাবেজ দিয়ে সপ্রমাণ করতে হলে ভূরি ভূরি লিখতে হবে। তা না হয় লিখলুম, কিন্তু পড়বে কে? তাই সংক্ষেপে বলি,
পৃথিবীর সভ্যাসভ্য কোনও দেশই বিদেশি ভাষা দিয়ে বেশিদিন কারবার চালায় না। আজকের দিনে তো নয়ই। ফারসি এদেশে ছশো বছর ধরে রাষ্ট্রভাষা ছিল– আমরা একে চিরন্তনী ভাষা বলে গ্রহণ করিনি।
তাই হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠিওলারাও একদিন ইংরেজি বর্জন করে আপন আপন মাতৃভাষায় কাজকারবার করতে গিয়ে দেখবেন, আমরা বাঙালিরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি, মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গিয়েছে কারণ আমরা অনেক পূর্বে আরম্ভ করেছিলুম। তখন যখন কেন্দ্রে আপন আপন মাতৃভাষায় পরীক্ষা দিতে হবে তখন আবার আমরা সেই যুগে ফিরে যাব, যখন একমাত্র বাঙালিই ইংরেজি জানত। হিন্দি কখনও ব্যাপকভাবে বাধ্যতামূলক হবে না, আর হলেও বাঙালিকে যেমন মাতৃভাষার ওপর হিন্দিতে পরীক্ষা দিতে হবে, হিন্দিওলাকে হিন্দি ভিন্ন অন্য একটি ভাষায় পরীক্ষা দিতে হবে। অমাতৃভাষা অমাতৃভাষায় কাটাকুটি গিয়ে রইবে বাঙলা বনাম হিন্দি। তাই অবস্থা একই দাঁড়াবে আমরা এগিয়ে যাব।
তাই মা ভৈঃ ॥
.