নেকড়ের বনে

ভলিউম ১০৪/২ – নেকড়ের বনে – তিন গোয়েন্দা – শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী

এক

উলফ লেক বাস স্টেশনে বাস থেকে নামলাম। কড়া রোদ লাগছে চোখে। কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে তাকালাম ছোট্ট পার্কিং লটটার দিকে। সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি এসেছেন কি না দেখছি।

আঙ্কেল-আন্টির চেহারা মনে নেই আমার। শেষ দেখেছি চার বছর বয়েসে। তবে আশা করি এত বছর পরেও ঠিকই চিনতে পারব।

উলফ লেকের বাস স্টেশনটা খুবই ছোট। মস্ত একটা পার্কিং লটের মধ্যে ছোট্ট একটা কাঠের ছাউনি। লোকজনের ভিড় নেই।

 কটা সুটকেস? গর্জনের মত শোনাল ড্রাইভারের কণ্ঠ। অক্টোবরের ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেও ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ধূসর ইউনিফর্মের বগলের কাছটা ঘামে ভেজা।

একটা, জবাব দিলাম।

বাস স্টেশনের অন্য প্রান্তে, একটা গ্যাস স্টেশন ও একটা ছোট জেনারেল স্টোর। তার ওপাশে বন। ডাল আঁকড়ে থাকা শরতের হলদে-বাদামী পাতাগুলো রোদে চকচক করছে। ঝরে পড়া শুকনো পাতা মৃদু সরসর শব্দ তুলে গড়িয়ে যাচ্ছে পার্কিং লটে।

ঘোঁতঘোঁত করে ঘুরে দাঁড়াল ড্রাইভার। হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলল। ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্টের দরজা। কালো রঙের একটা সুটকেস টেনে বের করল। এটা?

মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ। ধন্যবাদ।

উলফ লেকে একমাত্র আমিই নেমেছি।

ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিল আমার। শীতের পোশাক সুটকেসে ভরে দিয়েছে তো মা

খুব তাড়াহুড়া ছিল মা-বাবার। ভুলে যদি না দিয়ে থাকে তো বিপদেই পড়ব।

আমাদের স্কুলের হ্যালোউইনের ছুটির ঠিক আগে এভাবে জরুরি কাজে ডাক পড়বে ওদের, গ্রীন হিলস ছেড়ে চলে যেতে হবে, ভাবেনি। যাওয়ার আগে অন্তত দুই সপ্তাহ আমার থাকার মত একটা জায়গা ঠিক করে দিতে হয়েছে। দুসপ্তার বেশিও থাকতে হতে পারে আমার, ঠিক নেই। মুসারা সপরিবারে বেড়াতে চলে গেছে। আর কিশোররা রকি বিচ থেকে আসেনি এবার। ওরা এলে আমার থাকার অসুবিধে হত না। যাই হোক, অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষে সিডার আঙ্কেল আর জুলি আন্টিকেই পছন্দ হয়েছে মা-বাবার। সিডার আঙ্কেল আমার দূর সম্পর্কের চাচা।

আমার কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরার ব্যাগটা সোজা করলাম। বাসযাত্রার পুরো সময়টাই ওটা আমার কোলের ওপর রাখা ছিল। ব্যাগেজ কমার্টমেন্টে রাখিনি, ঝাঁকুনিতে গড়াগড়ি খেয়ে নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে।

এই ক্যামেরাটা এখন আমার কাছে সবচেয়ে দামি জিনিস। এটা ছাড়া কোথাও যাই না আমি। এমনকী চোখের আড়াল করতেও রাজি নই।

 চত্বরের ওপর দিয়ে সুটকেসটা আমার দিকে ঠেলে দিল ড্রাইভার। দড়াম করে লাগিয়ে দিল ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্টের দরজা। বাসে উঠতে গিয়ে ফিরে তাকাল আমার দিকে। নিতে আসবে কেউ?

আসবে, জবাব দিয়ে আবার তাকালাম সিডার আঙ্কেল আর জুলি আন্টি আসছেন কিনা দেখার জন্য।

কাদায় মাখামাখি নীল রঙের একটা ভ্যানকে চাকার তীক্ষ্ণ শব্দ তুলে পার্কিং লটের দিকে এগোতে দেখলাম। হর্ন বাজল। প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা হাত। আমার উদ্দেশে নাড়াচ্ছে কেউ।

ওই যে, এসে গেছে। বাস ড্রাইভারকে বললাম আমি। সাড়া না পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখি বাসে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে ও। কেমন হিসহিস শব্দ করল বাসটা, গোঙাল, তারপর চলতে শুরু করল।

অ্যাই, রবিন! ভ্যান থেকে ডাকলেন আমাকে জুলি আন্টি।

আমার সুটকেসটা তুলে নিয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে এগোলাম। ওদের দিকে। আমার কাছে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল ভ্যানটা। ড্রাইভিং সিট থেকে নামলেন সিডার আঙ্কেল। অন্যপাশে প্যাসেঞ্জার সিট থেকে নেমে দৌড়ে এলেন জুলি আন্টি।

দুজনেই বেশ মোটাতাজা। ওঁদেরকে দেখে অতি পেটুক নেকড়ের চেহারা ভেসে উঠল চোখের সামনে। দুনিয়ায় এত প্রাণী থাকতে কেন যে নেকড়ের কথা ভাবলাম, জানি না।

 জুলি আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, রবিন, তোমাকে দেখে কী যে খুশি হয়েছি! তুমি আসাতে খুব ভাল লাগছে!

আমাকে ছেড়ে দ্রুত পিছিয়ে গেলেন তিনি। এহহে, আমি তোমার, ক্যামেরা কেসটা নষ্ট করে দিচ্ছি!

না না, ঠিক আছে, কেসের ফিতে ঘুরিয়ে ক্যামেরাটা অন্যপাশে সরাতে সরাতে জবাব দিলাম, এত নরম না যে নষ্ট হবে।

হাসিমুখে আমার সঙ্গে হাত মেলালেন সিডার আঙ্কেল, তারপর পিঠে চাপড় দিলেন। বাতাসে উড়ছে তাঁর কোঁকড়া কালো লম্বা চুল।

বয়েসের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছ, আমার আপাদমস্তক দেখলেন তিনি। তা বাসে আসতে কেমন লাগল?

 প্রচুর ঝাঁকুনি, জবাব দিলাম। একটা গর্তও তো বাদ দেয়নি ড্রাইভার, সবগুলোতে চাকা ফেলেছে। আর আমার পাশের ভদ্রলোক সারাক্ষণ হিক্কা তুলেছেন, একনাগাড়ে।

জুলি আন্টি হাসলেন। বাহ্, বেশ মজার যাত্রাই তো!

আমার ক্যামেরা কেসের দিকে চোখ নামালেন সিডার আঙ্কেল। মনে হচ্ছে ছবি তুলতে খুব পছন্দ করো?

মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ। বড় হয়ে ফটোগ্রাফার হবার ইচ্ছে আছে আমার। আপনাদের দুজনের মত। তিনি

হাসি চওড়া হলো ওঁদের। খুশি হয়েছেন মনে হলো।

কিন্তু দ্রুত মলিন হয়ে গেল সিডার আঙ্কেলের হাসি। খুব কঠিন পেশা। প্রচুর ঘোরাঘুরি করতে হয়, দূর-দূরান্তে যেতে হয়। এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারি না আমরা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জুলি আন্টি। সে-কারণেই এতকাল তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আবার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।

 আমি আশা করেছিলাম আপনাদের সঙ্গে কোথাও ছবি তুলতে যাব, আমি বললাম। আপনাদের কাছ থেকে ছবি তোলার টেকনিক শিখব।

 নিশ্চয় যাবে, হেসে উঠলেন সিডার আঙ্কেল। আমরা যা যা জানি, সবই শেখাব তোমাকে।

 বেশ কিছুদিন তো থাকবে, জুলি আন্টি যোগ করলেন। কোনও চিন্তা নেই, ফটোগ্রাফি শেখার প্রচুর সময় পাবে।

 তবে এই পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে থাকলে প্রচুর সময় আর থাকবে না, কমে যাবে, হেসে বললেন সিডার আঙ্কেল। একটানে আমার সুটকেসটা তুলে নিয়ে ভ্যানের পিছনে ফেললেন তিনি। না গাড়িতে চড়লাম আমরা। কয়েক সেকেণ্ড পরেই বাস স্টেশন ছেড়ে রওনা হলো ভ্যান, শহরের দিকে।

পোস্ট অফিসের পাশ কাটালেন আঙ্কেল। তারপর ছোট একটা মুদি দোকান, আর একটা ধোপর দোকান। একটা রাস্তা পেরিয়ে এসে বনে ঢুকলাম আমরা। ঘন বন চারপাশ থেকে যেন গ্রাস করে নিল আমাদের।

 মাত্র এই কটা দোকানপাট? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

রবিন, জুলি আন্টি বললেন, এসেছ তো বন দেখতে, শহর নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন?

হ্যাঁ, শহরটা ছোট না বড়, তাতে কিছু যায় আসে না, সিডার আঙ্কেল বললেন। গাছপালার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায় তীক্ষ্ণ। মোড় নিল গাড়ি।

না, এমনি জিজ্ঞেস করলাম, জবাব দিলাম। আমি আসলে বনের ভিতরই ঘুরে বেড়াতে চাই। বনের ছবি তুলেই একশো রোল ফিল্ম

খরচ করে ফেলব! ঘোষণা করার মত জানিয়ে দিলাম।

 প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল গাড়ি। লাফিয়ে উঠল আমার শরীর। আরেকটু হলেই ছাতে বাড়ি খেত মাথা।

আস্তে চালাও, জন। জুলি আন্টি বললেন। আমার দিকে ফিরে বললেন, তোমার আঙ্কেল আস্তে চালাতে জানেই না। এত তাড়াহুড়া করে, যেন রকেট নিয়ে ভিনগ্রহে চলেছে, আলোর গতিতে চলতে হবে।

 আলোর কথায় মনে পড়ল, বাইরের আলোতে ছবি তোলার কিছু চমৎকার কায়দা শিখিয়ে দেব তোমাকে, রবিন, সিডার আঙ্কেল বললেন। গতি কমানোর বদলে আরও জোরে গ্যাস পেডাল চেপে ধরলেন তিনি।

 আমাদের স্কুলে একটা ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হবে আমাকে, ওঁদের জানালাম। তার জন্যে ভাল কিছু ছবি দরকার আমার, হ্যালোউইনের ছবি, যাতে প্রতিযোগিতায় জিততে পারি।

ও পেয়ে যাবে। হ্যালোউইনের এখনও দুদিন বাকি।

শুনেছি, হ্যালোউইনের সময় মায়ানেকড়ে বেরোয়। ওগুলোর। একটা ছবি পেলে…

আমার কথা শেষ হলো না। পথের পাশের একটা সাইনবোর্ডে গুঁতো মারল গাড়ি। সিট থেকে প্রায় উড়ে গিয়ে ধাক্কা খেলাম দরজায়। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম অসহায় দৃষ্টিতে। সামনে থেকে গর্জন করে ছুটে আসা একটা ট্রাকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি।

দুই

তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল আমার গলা চিরে।

নিজের চিৎকার বলে মনেই হলো না।

প্রচণ্ড ঝকি খাচ্ছে আমাদের গাড়ি। সিটে বসে থাকতে পারলাম না। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম মেঝেতে।

রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর গাড়ি সরিয়ে নিয়েছেন সিডার আঙ্কেল।

ভারি গর্জন তুলে লাল রঙের একটা ঝিলিমিলির মত আমাদের পাশ কাটাতে দেখলাম ট্রাকটাকে। রেগে গিয়ে হর্ন চেপে ধরে রেখেছে ড্রাইভার।

গাছের নীচে এনে গাড়ি থামালেন সিডার আঙ্কেল। কোঁচকানো মুখটা লাল হয়ে গেছে। দুই হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে মাথা রাখলেন তাতে।

জন, কী হয়েছে? মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন জুলি আন্টি।

সরি, বিড়বিড় করলেন সিডার আঙ্কেল। ভারি দম নিলেন। ঠিক মনোযোগ দিতে পারছিলাম না।

আরেকটু হলেই তো মেরে ফেলছিলে আমাদের। প্যাসেঞ্জার সিট থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমি কেমন আছি দেখলেন জুলি আন্টি। রবিন, ঠিক আছ তো তুমি?; উচীর জানা নয়

আছি, জবাব দিলাম। এখানে যে এত উত্তেজনা, কল্পনাই করিনি! রসিকতার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে গলা কাঁপছে।

আমার খাপ সহ ক্যামেরাটা মেঝেতে পড়ে গেছে। তুলে নিয়ে খাপের ভিতর থেকে ক্যামেরাটা বের করে দেখলাম। মনে হলো ঠিকই আছে।

ছা আবার ইঞ্জিন স্টার্ট দিলেন সিডার আঙ্কেল। রাস্তায় তুলে আনলেন গাড়িটাকে। আমি সত্যিই দুঃখিত, বিড়বিড় করলেন তিনি। এখন থেকে আরও সাবধানে চালাব।

আবার নিশ্চয় উলফদের কথা ভাবছিলে, তাই না? অভিযোগের সুরে বললেন জুলি আন্টি। রবিনকে মায়ানেকড়ের কথা বলতে শুনে ওদের নিয়ে ভাবতে আরম্ভ করেছ আবার, আর তাতেই…

আহ্, থামো তো, জুলি! ধমকে উঠলেন সিডার আঙ্কেল। ওগুলোর কথা বোলো না এখন। রবিন মাত্র এল। বাড়ি পৌঁছার আগেই ওকে ভয় দেখিয়ে কাবু করে ফেলতে চাও?

কিন্তু ও-ই তো মায়ানেকড়ের কথা তুলল।

উলফরা কারা? সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলাম। তাই

থাক, বাদ দাও, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল সিডার আঙ্কেলের কণ্ঠ। বসো আরাম করে।

জুলি আন্টি বললেন, বাড়ির কাছে চলে এসেছি।

মনে হলো দুজনেই আমার প্রশ্নটা এড়াতে চাইছেন। দক

 অন্ধকার লাগছে জায়গাটা। সরু রাস্তার দুই পাশে গাছের মাথা এমনভাবে গায়ে গায়ে লেগে গেছে, রোদ ঢুকতে দিচ্ছে না।

পাশ দিয়ে সরসর করে সরে যাচ্ছে গাছগুলো। হলুদ আর লাল পাতার ঝিলিক দেখছি শুধু। গভীর ভাবনা মনে। আমার আঙ্কেল-আন্টিকে কেমন আজব চরিত্র মনে হচ্ছে। উলফদের কথা বলাতে আন্টির ওপর এমন খেপে উঠলেন, কেন আঙ্কেল?

জায়গাটাকে উলফ লেক বলে কেন? জিজ্ঞেস করলাম।

 যেহেতু ম্যাপে লিখে ফেলা হয়েছে, রসিকতা করতে চাইলেন আন্টি।

এখানকার বনে নাকি প্রচুর নেকড়ে ছিল একসময়, তাই ওই নাম, মৃদুকণ্ঠে জানালেন সিডার আঙ্কেল।

স্বর নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন জুলি আন্টি, সত্যি কথাটা রবিনকে বলে দিলেই পারো।নভীর

চুপ থাকো! হিসিয়ে উঠলেন আঙ্কেল। কেন শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছ ওকে? o প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন জুলি আন্টি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলাম আমরা।

মোড় নিল গাড়ি। ছোট একটা গোলাকার জায়গা চোখে পড়ল। চক্রের ভিতর পাশাপাশি তিনটে বাড়ি। তার ওপাশে ছড়িয়ে আছে বন।

ওই যে আমাদের বাড়ি, মাঝখানেরটা, হাত তুলে দেখালেন। সিডার আঙ্কেল।

তাকিয়ে রইলাম। ছোট একটা চারকোনা সাদা বাড়ি। সামনে সুন্দর করে ছাঁটা লন। লম্বা, নিচু, র‍্যাঞ্চ-স্টাইলের আরেকটা বাড়ি রয়েছে সাদা বাড়িটার ডান পাশে। ধূসর দেয়াল। জানালাগুলো কালো রঙ করা।

 বাঁ পাশের বাড়িটা বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড়ে প্রায় ঢাকা পড়েছে। বাড়ির সামনে লম্বা লম্বা ঘাস। বড় একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়ে ওই বাড়িতে গাড়ি ঢোকার রাস্তাটা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।

মাঝের বাড়িটার ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢোকালেন সিডার আঙ্কেল।

ছোট বাড়িতে থাকতে আমাদের অসুবিধে হয় না, মাত্র দুজন তো মানুষ।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন জুলি আন্টি। হ্যাঁ। তা ছাড়া এক জায়গায় তো বেশিদিন থাকতে পারি না, সব সময় শুধু ঘুরে বেড়ানো, বড় বাড়ি দিয়ে কী হবে।

 আবার আমার দিকে ঘুরলেন তিনি। পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে থাকে, আমাদের পড়শি। ডানের র‍্যাঞ্চ-স্টাইল বাড়িটা দেখালেন। বাড়িতে থাকে ও। বারো বছর বয়েস, তোমার বয়েসী, তাই না?

মাথা ঝাঁকালাম।

 ওর নাম নিনা। খুব সুন্দরী। স্বভাবও ভাল। ওকে বন্ধু বানাতে পারবে। তা হলে আর একা একা লাগবে না।

কোন ছেলে নেই? জিজ্ঞেস করলাম।

ওই বাড়িতে নেই, জবাবটা দিলেন সিডার আঙ্কেল।

ড্রাইভওয়ের শেষ মাথায় এসে গাড়ি থামালেন তিনি। নামলাম আমরা। মাথার ওপর দুই হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম আমি। দেহের সমস্ত পেশি ব্যথা করছে। ছয় ঘণ্টারও বেশি বাস আর গাড়িতে কেটেছে আমার। এ ভ্যানের পিছন থেকে আমার সুটকেসটা বের করে আনলেন সিডার আঙ্কেল।

 বাঁয়ের বাড়িটার দিকে তাকালাম। ভাঙাচোরা, পোড়ো বাড়ির মত লাগছে। অন্ধকার। জানালার কিছু খড়খড়ি খসে পড়েছে। সামনের বারান্দার খানিকটা দেবে গেছে।

 ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে কয়েক পা এগোলাম ভাঙা বাড়িটার দিকে। আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে কে থাকে, আন্টি

ওটার ধারেকাছে যাবে না। চেঁচিয়ে উঠলেন সিডার আঙ্কেল।

ওখানে কারা থাকে এ নিয়েও কোন প্রশ্ন করবে না! ওই বাড়ির কাছ থেকে দূরে থাকবে, ব্যস!,

রহস্যের গন্ধ পেলাম। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমি, ওই বাড়ির কাছে যেতেই হবে আমাকে। কেন কাছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে, জানতে হবে। কিশোর হলেও এই কাজটাই করত।

তিন

শান্ত হও, জন, জুলি আন্টি বললেন। তুমি নিষেধ করেছ, রবিন আর ওখানে যাবে না। আমার দিকে ঘুরলেন তিনি। ফিসফিস করে বললেন, ওই বাড়িতে উলফরা থাকে। আর কোনও প্রশ্ন নয়, ঠিক আছে?

ওই বাড়ি থেকে দূরে থাকবে, চাপা গর্জন করে উঠলেন সিডার আঙ্কেল। এসো, গাড়ি থেকে মালপত্র নামাই।

আবার তাকালাম ভাঙা বাড়িটার দিকে। তারপর আঙ্কেলকে সাহায্য করতে এগোলাম।

মালপত্র নামাতে বেশিক্ষণ লাগল না। আমাকে গেস্টরুমে নিয়ে এলেন জুলি আন্টি। আমার জিনিসপত্র গোছগাছ করে দিতে লাগলেন। সিডার আঙ্কেল গেলেন রান্নাঘরে, মুরগীর মাংস দিয়ে স্যাণ্ডউইচ বানাতে।

আমার ঘরটা খুবই ছোট। দেয়াল আলমারিটা খুদে। পোকামারা ওষুধের গন্ধ বেরোচ্ছে ওটা থেকে। জুলি আন্টি বললেন, কিছুক্ষণ জানালা-দরজা খোলা রাখলেই এ গন্ধ চলে যাবে।

জানালাটা খুলে দিলাম। উলফদের বাড়ির দিকে মুখ করে আছে জানালাটা। মরচে পড়া এক চাকার একটা লোহার ঠেলাগাড়ি বাড়ির একপাশ ঘেঁষে পড়ে রয়েছে। জানালাগুলো অন্ধকার। পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জানালাটার দিকে তাকিয়ে আছি। ভাবছি, উলফদের নিয়ে এত উদ্বেগ কেন সিডার আঙ্কেলের?

জুলি আন্টির কাছে ফিরে এলাম। ড্রেসারের সবচেয়ে ওপরের ড্রয়ারটাতে আমার শার্টগুলো রাখছেন তিনি। ঘরটা খুবই ছোট। তবে থেকে আরাম পাবে। ডেস্কের ওপরটা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। ওটাতে বসে লেখাপড়া করতে পারবে। ১

লেখাপড়া? বিড়বিড় করলাম। মনে পড়ল, বাবা বলে দিয়েছেন, উলফ লেকে যতদিন থাকব, এখানকার স্কুলে যেতে হবে আমাকে। পড়া বাদ দিলে চলবে না।

 সোমবার সকালে নিনা তোমাকে স্কুলে নিয়ে যাবে, জুলি আন্টি। বললেন। সে-ও তোমার মতই সিক্সথ গ্রেডে পড়ে। দর

 অচেনা জায়গায় আজব পরিবেশে একটা নতুন স্কুলে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাল লাগল না আমার। ক্যামেরাটা তুলে নিলাম। বনে যাচ্ছি। ছবি তুলব।

 লাঞ্চটা সেরেই যাও, আন্টি বললেন। লম্বা ধূসর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে গেস্টরুম থেকে বেরিয়ে, ছোট্ট হল পেরিয়ে পথ দেখিয়ে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে এলেন তিনি।

 কাজ করতে করতে ফিরে তাকালেন সিডার আঙ্কেল। তিনটে গ্লাসে কমলার রস ঢাললেন। গোল একটা ডাইনিং টেবিলে রেখেছেন স্যাণ্ডউইচগুলো।

 আমি কিংবা জুলি আন্টি কিছু বলার আগেই পিছনের দরজায় টোকার শব্দ হলো। জুলি আন্টি খুলে দিলেন। ঘরে ঢুকল একটা মেয়ে। নিশ্চয় নিনা। গতকাল; লম্বা, হালকা-পাতলা দেহ ওর। আমার চেয়ে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা হবে। জুলি আন্টি ঠিকই বলেছেন। মেয়েটা সুন্দরী। কালো চুল, জলপাই রঙের চোখ, আর চমৎকার হাসি। ঢিলেঢালা সবুজ রঙের একটা সোয়েটার গায়ে দিয়েছে। পরনে কালো প্যান্ট।

 আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন জুলি আন্টি। দুজনেই হাই বললাম দুজনকে। নতুন কারও সঙ্গে পরিচিত হতে গেলে বিব্রত বোধ করি আমি, তবে মেয়েটার মধ্যে কোন আড়ষ্টতা নেই।

জুলি আন্টি নিনাকে স্যাণ্ডউইচ খেতে বললেন।

না, থ্যাংকস, জবাব দিল নিনা, আমি খেয়ে এসেছি।

 রবিনকে আনতে বাস স্টপেজে গিয়েছিলাম, নিনার দিকে তাকিয়ে বললেন জুলি আন্টি। সেজন্যেই লাঞ্চ খেতে দেরি হলো।

স্যাণ্ডউইচ তুলে নিয়ে কামড় বসালাম। খাওয়া শুরু করার আগে বুঝতে পারিনি কতটা খিদে পেয়েছে।

 নিনা, রবিনকে নিয়ে বনের ভিতর থেকে ঘুরে এসো না? সিডার আঙ্কেল বললেন।

উলফ লেকের বন কী জিনিস দেখিয়ে আনো। বড় সবাই হাসল, আমি বাদে। এর মধ্যে রসিকতাটা কোনখানে বুঝতে পারলাম না।

প্রচুর ফিল্ম নিয়ে এসেছি, নিনাকে বললাম। সব শেষ করব এখানে। নিজের অজান্তেই চেপে ধরলাম ক্যামেরা, কেসটা।

ভালই হবে, নিনা বলল। শরতের পাতা যা রঙ ধরেছে না, উফ।

 সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টিকে গুডবাই জানিয়ে সামনের দরজার দিকে এগোলাম আমরা। শেষ বিকেলের লাল সূর্যটা গাছের মাথা ছুঁয়েছে। পড়ন্ত রোদ ঘাসের ওপর আমাদের লম্বা ছায়া ফেলল।

জন এই এই, আমার ছায়া মাড়িয়ে দিচ্ছ তো তুমি! হেসে উঠল নিনা। পায়ের ছায়া দিয়ে লাথি মারল আমার ছায়াটাকে। এ

 আউ! করে চেঁচিয়ে উঠে ব্যথা পাওয়ার ভান করলাম। ওর ছায়াকে ঘুসি মারলাম আমার হাতের ছায়া দিয়ে।

লাথি দিয়ে, ঘুসি মেরে, খানিকক্ষণ ছায়ায় ছায়ায় যুদ্ধ চালালাম আমরা। দুই পায়ে লাফিয়ে উঠে ওর ছায়াটা নেমে এল আমার ছায়ার ওপর। মাটিতে পড়ে গিয়ে মরে যাওয়ার ভান করলাম।

দুই সেকেণ্ড পড়ে থেকে উঠে বসলাম। হেসে গড়িয়ে পড়ছে নিনা। মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে ওর লম্বা চুল।

 দ্রুতহাতে কেস থেকে ক্যামেরাটা বের করে ওর একটা ছবি তুলে ফেললাম।

হাসি থেমে গেল ওর। মুখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিল। আমার ছবি তুললে কেন?

তলতে ইচ্ছে করল, জবাব দিলাম।

উঠে দাঁড়ালাম। আবার ক্যামেরাটা তুলে নিলাম চোখের সামনে। উলফদের বাড়ির দিকে ঘুরলাম। কয়েক পা এগোলাম বাড়িটার দিকে, ভিউফাইণ্ডারের ফ্রেমে নিয়ে আসার জন্য।

আমার হাত চেপে ধরল নিনা।

আরে! চেঁচিয়ে উঠলাম।

ছবি তুলো না! খসখসে স্বরে আমাকে সাবধান করে দিল নিনা। ওরা দেখে ফেলবে।

 তাতে কী? শাটার টিপে দিলাম। সামনের অন্ধকার জানালায় কিছু একটা নড়তে দেখে গায়ে কাঁটা দিল।

কেউ কি তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে?

ক্যামেরা নামালাম।

এসো, আমাকে টান দিল নিনা। বনে যাবে, নাকি যাবে না?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি উলফদের বাড়িটার দিকে। জানো, ওই বাড়িটার কথা জিজ্ঞেস করায় ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন সিডার আঙ্কেল। ঘটনাটা কী, বলো তো?

 সত্যিই জানি না, আমার হাতটা ছেড়ে দিল নিনা। ইদানীং উলফরা খুব অদ্ভুত আচরণ করছে। একটিবারের জন্যে বাড়ির বাইরে বেরোয় না। অথচ আগে এমন ছিল না। জানালায় মাঝে মাঝে অদ্ভুত ছায়া দেখা যায়, তা-ও রাতের বেলা। নানা রকম ভয়াল গল্প শোনা যায় ওদের ব্যাপারে।

ভয়াল গল্প? কী গল্প?

জবাব দিল না নিনা। দেবে যাওয়া ভাঙা বারান্দা, ছাতের ধূসর। মলিন টালিগুলোর দিকে তাকিয়ে সরু হয়ে এল ওর চোখের পাতা। চলো, এখান থেকে চলে যাই।

 বাড়ির পাশ দিয়ে প্রায় দৌড়ে চলল ও, পিছন দিকে। কিন্তু আমি ওর সঙ্গে গেলাম না। বরং ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম উলফদের বাড়িটার দিকে। সামনের চত্বরের বড় বড় ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে পা রাখলাম।

দাঁড়াও! কোথায় যাচ্ছ তুমি? চেঁচিয়ে ডাকল নিনা।

ক্যামেরাটা কোমরের কাছে ধরে সোজা বাড়িটার দিকে এগোলাম। ওর প্রশ্নের জবাব দিলাম, দেখতে।

রবিন, প্লিজ। নিনা বলল। উলফরা আমাদের মত ছেলেমেয়েদের দেখতে পারে না। ওদের বাড়ির কাছে যাওয়াটা পছন্দ করে না। প্লিজ, চলে এসো। বনে যাই আমরা।

 ফিরে তাকালাম নিনার দিকে। কী হয়েছে, নিনা? এত ভয় পাচ্ছ কেন?

 ও কিছু বলার আগেই ভাঙা বারান্দার পচা কাঠের তক্তায় সাবধানে পা রাখলাম আমি। সামনের জানালাটার দিকে তাকালাম।

যে অস্তগামী সূর্যের লাল আলো ভরে দিয়েছে যেন জানালার কাঁচ। একটা মুহূর্তের জন্য মনে হলো আগুন ধরে গেছে জানালাটায়।

চোখ সরাতে বাধ্য হলাম।

কাঁচ থেকে রোদ সরে গেলে আবার তাকালাম জানালাটার দিকে। নিজের অজান্তেই অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে গেল মুখ থেকে।

জানালার ওপাশের পর্দা দেখা যাচ্ছে। ছেঁড়া। ফালি ফালি করে ফেলা হয়েছে। ও নখ দিয়ে চিরে ওই অবস্থা করেছে যে কোনও ভয়াল জানোয়ার।

চার

নিনা, পর্দার অবস্থা দেখে যাও, ডেকে বললাম। চোখ সরাতে পারছি না ছেঁড়া পর্দা থেকে।

ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে ও। সিডার আঙ্কেলের বাড়িটার দিকে পিছন করে। দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করা। জবাব দিল, না, আমি দেখতে চাই না।

কিন্তু পর্দাগুলো…

আমি তো বলেছি ওরা আজব মানুষ, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল নিনার কণ্ঠ। জানালার কাছে তোমাকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখলে ভীষণ রেগে যাবে। চলে এসো, রবিন।

 পিছিয়ে এলাম জানালার কাছ থেকে। বেরিয়ে থাকা একটা পচা তক্তায় পা বেধে আরেকটু হলেই উল্টে পড়ে যাচ্ছিলাম। নেমে এলাম নীচে।

তুমি বনে যাবে, নাকি যাবে না? অধৈর্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল নিনা।

 সরি, চলো। নিনার কাছে এসে বললাম, উলফদের ব্যাপারে যা যা জানো বলল আমাকে। যত ভয়ালই হোক, আমি শুনব।

না, বলব না, চাপা খসখসে কণ্ঠে জবাব দিল নিনা। প্রায় দৌড়ে চলল সিডার আঙ্কেলের বাড়ির পিছন দিকে। হলুদ আর লাল রঙের পাতাওয়ালা গাছগুলোতে শেষ বিকেলের ছায়া।

প্লিজ! বললাম আমি।

বলব, তবে কয়েক দিন পরে, জবাব দিল নিনা। পূর্ণিমা চলে গেলে।

এখন বললে অসুবিধে কী?

না, এখন বলা যাবে না।

নিনার কথায় অবাক হলাম। ঘটনাটা কী? এখানে সবাই এমন রহস্যময় আচরণ করছে কেন? আমার আঙ্কেল-আন্টি, নিনা, সবাই যেন আমার কাছে কী লুকোতে চাইছে।

নিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে আকাশের দিকে তাকালাম। মস্ত একটা গোল চাঁদ উঠেছে গাছের মাথায়, যদিও দিনের আলো মিলিয়ে যায়নি এখনও।

কেঁপে উঠল নিনা। পূর্ণিমাকে এখানে সবাই ভয় পায়। চলে। যাওয়ার পর শান্তি।

কেন? পূর্ণিমা এলে ক্ষতিটা কী?

উলফদের বাড়ির দিকে ফিরে তাকাল নিনা। জবাব দিল না।

কী হলো? জবাব দাও না কেন?

ভয় লাগে। পূর্ণিমা যাক, তারপর।

কেন, পূর্ণিমা না গেলে ক্ষতি কী?

আছে, ক্ষতি আছে।

তা হলে তোমার ক্ষতি হচ্ছে না কেন?

আমি পূর্ণিমার অনেক আগেই এসেছি। অমাবস্যার সময়। তখন শুনেছি সব। এখন বললে ওরা শুনে ফেলতে পারে।

ওরা কারা?

জবাব দিল না নিনা।

.

বনের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে নামছে যেন ফিকে হয়ে আসা রোদের আলো। মাটিতে নেমে ছোট ছোট সোনালি বিন্দু হয়ে ঝিলমিল করছে। মরা পাতা আর শুকনো ডালে আমাদের পা পড়ে শব্দ হচ্ছে।

বুড়ো একটা গাছ খুঁজে বের করলাম আমরা। প্রচুর গাঁটওয়ালা কাণ্ড গাছটার। বুড়ো মানুষের মত নুয়ে পড়েছে। বয়স্ক মানুষের মতই কুঁচকে গেছে ছাল। মোটা মোটা ধূসর শিকড়ের গোড়া বেরিয়ে পড়েছে মাটি থেকে।

কী সাংঘাতিক! না বলে পারলাম না। কেস থেকে টেনে বের করলাম ক্যামেরাটা।

হাসল নিনা। গাছের ছবি তুলবে?

হ্যাঁ। গাছটার চেহারা দেখেছ! এক্কেবারে জ্যান্ত মনে হচ্ছে।

আবার হেসে উঠল নিনা। গাছ তো জ্যান্তই হয়।

আসলে, আমি বলতে চাইছি ভূতুড়ে, বিড়বিড় করে বললাম।

ঝুঁকে পড়া পুরানো গাছটার ছবি তুলতে শুরু করলাম। পিছিয়ে এসে সামান্য কাত হয়ে থাকা একটা বার্চ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম, যাতে হাত দুটো স্থির রাখতে পারি। গাছটাকে এমনভাবে ফ্রেমবন্দি করতে চাইলাম যাতে ওটাকে মানুষের মত দেখায়।

ওই অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলার পর গাছটাকে ঘিরে চক্কর দিতে থাকলাম। ওটার খাঁজ, ছালের ভাঁজ, সব কিছু দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম কোন অ্যাঙ্গেলে তুললে অন্যরকম ছবি উঠবে, যেটাকে আলাদা কিছ মনে হবে। একটা ডাল লম্বা হয়ে গিয়ে মাটি ছুঁয়েছে মনে হচ্ছে একজন মানুষ কাত হয়ে আছে

এই অ্যাঙ্গেল থেকে একটা ছবি তুললাম।

এরপর হাঁটু গেড়ে বসলাম। শিকড়গুলোকে মনে হলো মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আছে সরু সরু পা। এই অ্যাঙ্গেল থেকে তুললাম কয়েকটা ছবি।

মৃদু গুঞ্জন শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকালাম। ছোট একটা গাছে ফুলের ওপর উড়ছে একটা হামিংবার্ড। খুদে পাখিটাকে ফ্রেমবন্দি করার চেষ্টা করলাম।

 কিন্তু পাখিটা অতিরিক্ত ক্ষিপ্র। আমি শাটার টেপার আগেই উড়ে চলে গেল।

 উঠে দাঁড়ালাম। মাটিতে বসে আছে নিনা। দুই হাতে শুকনো পাতা কচলাচ্ছে। মুড়মুড় করে ভেঙে ডো গুড়ো হচ্ছে পাতাগুলো।

গরমকাল যে চলে গেছে ওই পাখিটা কি জানে না? বিড়বিড় করলাম।

শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে নিনা। আমার কথা যেন। ভুলেই গেছে। আঁ, কী বললে? ও, পাখি। সরি, রবিন, আমি পাখিটাকে দেখিনি। উঠে দাঁড়াল ও।

ওদিকে কী? গভীর বনের দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করলাম।

উলফ লেক, জবাব দিল নিনা। আরেক দিন নিয়ে যাব। এখন চলো, বাড়ি যাই। সূর্য ডোবার আগেই বন থেকে বেরোনো দরকার।

 হঠাৎ করেই মনে পড়ল, বনে নেকড়ে থাকার কথা বলেছিলেন সিডার আঙ্কেল। আর নেকড়ের নামেই উলফ লেকের নামকরণ হয়েছে।

নেকড়েরা এখন আর থাকে না, তাই না? আমি বললাম, ওখান থেকে চলে গেছে।

মাথা ঝাঁকাল নিনা। হ্যাঁ, চলে গেছে।

তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শোনা গেল এ সময়। খুব কাছে থেকে। আমার পিছনে। অনেকটা নেকড়ের ডাকের মত।

চমকে উঠলাম।

পাঁচ

পিছাতে গিয়ে বার্চ গাছটায় ধাক্কা খেলাম। গাছের গায়ে বাড়ি খেল ক্যামেরাটা। তবে হাত থেকে পড়ল না।

নিনা… ওর দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম। বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে নিনার চোখ।

 ও কিছু বলার আগেই ঝোপের ভিতর থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল দুটো ছেলে। মাথা পিছনে হেলিয়ে চিৎকার করে উঠল নেকড়ের মত।

ও, তোমরা! বলে উঠল নিনা। মুখ বাঁকাল বিরক্তিতে।

দুজনেই ওরা স্বাস্থ্যবান, নিয়মিত ব্যায়াম করে মনে হলো। হয়তো স্কুলের ফুটবল, ভলিবল টিমেরও সেরা খেলোয়াড়। দুজনেরই কালো চুল, বাদামী চোখ। আমার দিকে তাকাল। ওদের দুই চোখে, যেন নেকড়ের মতই ক্ষুধার্ত দৃষ্টি।

ভয় পেলে নাকি? আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল একজন। উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে চোখ। গায়ে গাঢ় বাদামী রঙের সোয়েটার, পরনে কালো ডেনিম জিনস। গলায় জড়ানো লম্বা একটা গোলাপি রঙের মাফলার।

 তা তো পেয়েছিই, ব্যঙ্গ করে জবাব দিল নিনা। যা চেহারা তোমাদের। দুঃস্বপ্নে দেখার মত!

দ্বিতীয় ছেলেটার পরনে উলের কাপড়ের ঢোলা শার্ট। পরনের খাকি প্যান্টটা এত লম্বা, ঝুল মাটিতে গড়াচ্ছে। মাথা পিছনে হেলিয়ে আবার নেকড়ের মত তীক্ষ্ণ হাঁক ছাড়ল।

আমার দিকে ফিরল নিনা। ওরা আমার ক্লাসে পড়ে। ওর নাম টনি, লাল মাফলারওয়ালা ছেলেটাকে দেখাল ও। আর এর নাম রজার।

তুমি আসবে, নিনা আমাদের বলেছিল, হাসিমুখে বলল টনি।

তা উলফ লেক কেমন লাগছে? ভুরু নাচাল রজার।

কি কালো চোখ মেলে দুজনেই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন আমি একটা বিচিত্র প্রাণী।

মাত্র তো এলাম, জবাব দিলাম। কিছুই না দেখে কী করে বলি উলফ লেক কেমন? 18

চোখে চোখে তাকাল দুজনে। আমার দিকে ফিরে টনি বলল, ঠিক, সবই দেখা দরকার। বনের কিছু নিয়ম-কানুন এখনই জেনে নাও।

যেমন? প্রশ্ন করলাম।

আমার পায়ের দিকে আঙুল তুলে টনি বলল, বিছুটি গাছের ওপর কখনও দাঁড়াতে নেই।

চট করে সরে গিয়ে মাটির দিকে তাকালাম।

হেসে উঠল ওরা দুজন।

বিছুটি-টিছুটি কিছু নেই। আমার সঙ্গে মজা করেছে টনি।

প্রচণ্ড রাগ হলো। কিন্তু লাগতে গেলে পারব না ওদের সঙ্গে। বাধ্য হয়ে চুপ করে রইলাম। ওই মুহূর্তে মুসার কথা ভেবে মনটা খারাপ লাগল। ইস্, মুসা থাকলে এভাবে আমার সঙ্গে শয়তানি করে পার পেত না ছেলেগুলো।

তোমরা হলে গে বিড়ালের বমি। আমার সঙ্গে ছেলে দুটোর আচরণে নিনাও রেগে গেছে।

তা হলে এই বমি দিয়ে নাস্তা করে ফেলো! টনি জবাব দিল।

হেসে উঠল দুই পাজি। জোরে চাপড় মারল একে অন্যের পিঠে।

হতাশার ভান করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিনা। আহা, কী রসিকতা! কিন্তু এখন তো হাসি আসছে না, পরে চেষ্টা করে দেখব হাসা যায় কি না।

আবার নেকড়ের মত ডেকে উঠল ছেলে দুটো।

হঠাৎ করে আমার ক্যামেরার দিকে হাত বাড়াল টনি। দেখি?

না, সরে গেলাম। খুব দামি জিনিস। কাউকে এটা ধরতে দিই না।

কত দামি! মুখ বাঁকাল টনি। কীসের তৈরি? সোনার। দেখি তো। ধরার জন্য আবার থাবা মারল ও।

আমার ছবি তোলো, দুই আঙুল মুখে পুরে ঠোঁটের দুই কোণ টেনে ধরল রজার, জিভ বের করে দিল।

হ্যাঁ, এবার চেহারাটার অনেক উন্নতি হয়েছে, নিনা বলল।

আমার ছবি তোলো! আবার বলল রজার।

আহ, কী শুরু করলে তোমরা! ধমকে উঠল নিনা। ছাড়োনা ওকে!

 দুঃখ পাওয়ার ভান করল রজার। আমার ছবি তোলে না কেন?

জন্তু-জানোয়ারের ছবি তোলে না ও! নিনা বলল।

হেসে উঠল টনি। আমার হাত থেকে ক্যামেরাটা কেড়ে নিল।

আরে, আরে! আমার ক্যামেরা দাও! নেয়ার জন্য থাবা মারলাম। ধরতে পারলাম না।

রজারের দিকে ক্যামেরাটা ছুঁড়ে দিল টনি। রজার ওটা নিয়ে নিনার ছবি তোলার ভান করল। চেঁচিয়ে উঠল, হায় হায়, তোমার চেহারা দেখেই ক্যামেরার লেন্স ফেটে গেল!

আমি তোমার নাক ফাটিয়ে দেব! নিনা জবাব দিল।

ওটা সত্যিই দামি ক্যামেরা, আমি বললাম। নষ্ট হলে…

থাবা দিয়ে রজারের হাত থেকে ক্যামেরাটা কেড়ে নিয়ে আমার হাতে ___নিনা।

ক্যামেরাটা শক্ত করে ধরলাম, থ্যাংকস।

ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে আমার দিকে এগোতে শুরু করল ছেলে দুটো। চোখের তারা জ্বলছে। ওদের কঠিন চেহারা, চোখের শীতল দৃষ্টি আবার আমাকে বুনো জানোয়ারের কথা মনে করিয়ে দিল।

ওকে ছাড়ো বলছি। চাবুকের মত শপাং করে উঠল নিনার কণ্ঠ।

না, কিছু করছি না তো, জবাব দিল রজার। এমনি একটু মজা করছিলাম। ওর ক্যামেরা নষ্ট করব না।

 আমিও কিছু মনে করিনি, ক্যামেরাটা সরিয়ে রাখলাম ওর নাগালের বাইরে।

 অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল রজার। পাতার ফাঁক দিয়ে আমি শুধু ধূসরতা দেখলাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে, বিড়বিড় করল ও।

 হাসি মলিন হয়ে গেল টনির। চলো, পালাই। দ্রুত দৃষ্টি ঘুরে এল একবার চারপাশের বনে। ছায়া ঘন হচ্ছে। ঠাণ্ডা বাড়ছে।

শুনলাম, কী একটা খেপা জানোয়ার নাকি বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মৃদুস্বরে বলল রজার।

রজার, তুমি থামবে! গুঙিয়ে উঠল নিনা।

না, সত্যি বলছি, রজার বলল। একটা হরিণের মাথা দেখে এলাম। স্রেফ টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।

মাথাটা আমিও দেখেছি, টনি বলল। মলিন হয়ে আসা আলোতেও ওর কালো চোখে আতঙ্ক দেখা গেল। সত্যিই বলছে, ভাঁড়ামো করছে না আর এখন। ভয়ঙ্কর।

হরিণের চোখ দুটো আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, রজার বলল। কাটা গলায় পোকা কিলবিল করছে।

ওয়াক! দুই হাতে মুখ ঢেকে যেন বমি ঠেকাল নিনা। সব বানিয়ে বলছ, তাই না?

না না, সত্যি। মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকাল টনি। পূর্ণিমা এসে গেছে। আর জানোই তো পূর্ণিমার সময় আজব আজব জানোয়ারেরা বেরিয়ে আসে তাদের গোপন আস্তানা থেকে। মৃদু স্বরে কথা বলছে ও, প্রায় ফিসফিস করে। বিশেষ করে হ্যালোউইনের রাতে, চাঁদটা যখন পুরো গোল হয়ে যায়।

গায়ে কাঁটা দিল আমার। ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল। হঠাই ঠাণ্ডা হয়ে এল হাত-পা।

মাটিতে পড়ে থাকা হরিণের মাথাটার কথা ভাবলাম।

নিষ্প্রাণ, কালো চকচকে চোখ জোড়া আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম কল্পনায়।

হ্যালোউইনে কী সাজবে? নিনাকে জিজ্ঞেস করল টনি।

জানি না, মাথা নাড়ল নিনা। এখনও কিছু ঠিক করিনি। আমার দিকে ঘুরল ও। তুমি কী সাজবে, রবিন?

মায়ানেকড়ে।

কাজ চমকে উঠল ছেলে দুটো। পরস্পরের দিকে তাকাল।

হাসি মুছে গেল ওদের মুখ থেকে। নির্বাক হয়ে গেল।

কী হলো? জিজ্ঞেস করলাম।

জবাব নেই।

এই, কী হলো তোমাদের? আবার জিজ্ঞেস করলাম।

মাটির দিকে চোখ নামাল রজার। উলফ লেকে মায়ানেকড়ের অভাব নেই, বিড়বিড় করল ও।

মানে! ভুরু কোঁচকালাম। কী বলছ? এই, মায়ানেকড়ের অভাব। নেই মানে?

কিন্তু জবাব দিল না ওরা।

আচমকা ঘুরে দ্রুত হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের ভিতর।

ছয়

ভয় দিক হলাম বন থেকে ফিরে দেখি, ডিনার রেডি করে বসে আছেন আঙ্কেল-আন্টি।

 ডিনারে আসতে দেরি করে ফেললাম, সরি, বললাম। আসলে সময়ের খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। বনের ভিতর থেকে আসতে ইচ্ছে করছিল না। এত সুন্দর।

নিনাকে ডিনার খেয়ে যেতে বললেন জুলি আন্টি। রান্নাঘরের ছোট্ট টেবিলটা ঘিরে গাদাগাদি করে বসলাম আমরা। বড় বাটি থেকে মুরগীর গরম সুপ চামচ দিয়ে মুখে তুলতে থাকলাম।

 দারুণ সুপ বানান আপনি, আন্টি, নিনা বলল।

জুলি আন্টি হাসলেন। ঠোঁটের কোনা বেয়ে এক ফোঁটা সুপ গড়িয়ে পড়ছে। মোছর জন্য ন্যাপকিন টেনে নিলেন তিনি।থ্যাংক ইউ, নিনা। হাতের কাছে খাওয়ার উপযুক্ত যত রকম জিনিস পাই সবই। ফেলে দিই তো ওই সুপের মধ্যে, তাতেই বোধহয় স্বাদ বেড়ে যায়।

জানালার দিকে চোখ চলে গেল সিডার আঙ্কেলের। চাঁদের দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন উলফদের বাড়িটার দিকে।

একটা অদ্ভুত গাছের ছবি তুলেছি আমি, বললাম। বুড়ো মানুষের মত কজো হয়ে ঝকে রয়েছে গাছটা।

জবাব দিলেন না সিডার আঙ্কেল। তাকিয়ে আছেন জানালার বাইরে।

জন, রবিন কিছু বলছে তোমাকে, রুক্ষ হয়ে উঠল জুলি আন্টির কণ্ঠ।

অ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ! টেবিলের দিকে ফিরে তাকালেন সিডার আঙ্কেল। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকি দিয়ে যেন মগজের ভিতর জমাট বাঁধা ভাবনাগুলো তাড়িয়ে দিতে চাইলেন। সরি। কী বলছিলে? তাতে

বনের ভিতরের বুড়ো গাছটার কথা আবার বললাম তাকে।

 ওই ছবিগুলো ডেভেলপ করতে তোমাকে সাহায্য করব আমি, আঙ্কেল বললেন। কালকেই করে দেব। চিলেকোঠার ছোট্ট বাথরুমটায় ডার্করুম বানিয়েছি আমি। এখানে সবই ছোট ছোট। আরও বড় একটা বাড়ি দরকার আমাদের, ইদানীং যে সব কাজ করছি তার জন্যে।

 আপনি এখন কীসের ছবি তুলছেন? জিজ্ঞেস করলাম।

 নিশাচরদের, জবাব দিলেন তিনি। আবার জানালার বাইরে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম। উলফদের পিছনের জানালাটার দিকে তাঁর নজর। অন্ধকার হয়ে আছে জানালাটা।

নিশাচর জানোয়ারের ছবি তুলছি আমরা, জুলি আন্টি জানালেন। এমন সব জানোয়ার, যেগুলো শুধু রাতেই বেরোয়।

পেঁচা? নিনার প্রশ্ন।

অ্যাঁ! হ্যাঁ! মাথা ঝাঁকালেন জুলি আন্টি। বনের ভিতর দারুণ দারুণ সব পেঁচা দেখেছি আমরা, তাই না, জন? ভাবভঙ্গিতে মনে হলো, কিছু যেন লুকোতে চাইছেন তিনি।

সিডার আঙ্কেলের অন্যমনস্কতা, বার বার বাইরে তাকানো, অকারণেই জুলি আন্টির কণ্ঠস্বর রুক্ষ হয়ে ওঠা, তারপর এখনকার এই লুকোতে চাওয়া ঠিক স্বাভাবিক মনে হলো না আমার কাছে। কোথায় যেন কী একটা রহস্য রয়েছে।

জানালার দিক থেকে ফিরে তাকালেন সিডার আঙ্কেল। ভরা চাঁদের রূপালী জ্যোত্সা যেন ধুয়ে দিচ্ছে জানালার কাঁচ। নিশাচরেরা ক্যামেরার ছবি হতে পছন্দ করে না, বলে এক টুকরো গাজর তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে চিবাতে শুরু করলেন তিনি। ওরা আড়ালে থাকতেই ভালবাসে।

মাঝে মাঝে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমাদের, আন্টি বললেন। কখন উঁকি দেয় তার জন্যে অপেক্ষা করতে হয়।

আমাকে একদিন সঙ্গে নেবেন? অনুরোধের সুরে বললাম। চুপচাপ থাকব আমি, কথা দিচ্ছি। টু শব্দ করব না।

এক টুকরো মুরগীর মাংস খেলেন সিডার আঙ্কেল। যাবে, সে-তো খুব ভাল কথা। পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেলেন। তবে হ্যালোউইনের পরে।

ফিরে দেখলাম এখন জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন জুলি আন্টি। চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, চাঁদটা ভরতে বাকি আছে, কিন্তু এখনই এত উজ্জ্বল।

বাইরে তো মনে হচ্ছে দিনের আলো, সিডার আঙ্কেল বললেন। দ্রুত একটা পরিবর্তন ঘটল চেহারায়।

কীসের?

ভয়ের?

ঠিক বুঝলাম না।

অস্থির মনে হচ্ছে ওঁদেরকে। বার বার জানালার বাইরে কী দেখছেন? উলফদের বাড়িতে কী আছে?

প্রশ্নটা না করে পারলাম না আর, আঙ্কেল, কিছু হয়েছে?

না না, কী হবে? চোখের পাতা সরু করে আমার দিকে তাকালেন আঙ্কেল।

আমার মনে হয়…

হ্যালোউইনের দিন কী পরবে, ভেবেছ কিছু? আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন জুলি আন্টি। প্রসঙ্গ বদল করার জন্যই, বুঝতে পারলাম।

ভাবছি, এ বছরও জলদস্যুই সাজব, নিনা জবাব দিল। চকলেট মিল্ক শেষ করেছে ও। গ্লাসের কিনার চাটছে। মাথায় রুমাল বাঁধব। এক চোখে কালো পট্টি বাঁধব।

পুরানো কিছু কাপড় আছে আমার আর কলিনের, জুলি আন্টি, বললেন। সেগুলো পরে দেখতে পারো। আমার দিকে ফিরলেন তিনি। রবিন, তুমি কী পরবে?

 মায়ানেকড়ে সাজব, বলতে গিয়েও থেমে গেলাম। মনে পড়ল, এ কথাটা বলে আরেকটু হলেই মারা পড়েছিলাম। এত চমকে গিয়েছিলেন সিডার আঙ্কেল, গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিলেন।

মৃদু হেসে বললাম, আমিও ভাবছি জলদস্যুই সাজব।

বাটির বাকি সুপটুকু খেয়ে শেষ করলাম।

তখনও কল্পনাই করতে পারিনি, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আকাশের যখন মাঝখানে চলে যাবে চাঁদটা, কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পাব।

সাত

ডিনার শেষ হতেই উঠে দাঁড়াল নিনা। বলল, আমি যাই, অনেক দেরি করে ফেলেছি। মা বকবে।

তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেল ও।

আমি আমার ছোট্ট বেডরুমটায় এসে ঢুকলাম।

 কাপড় বদলালাম। পরনের কাপড়গুলো ঢুকিয়ে দিলাম ড্রেসারের ভিতর। যতটা সম্ভব গোছগাছ করে রাখতে চাইলাম ছোট্ট ঘরটাকে, নইলে হাঁটাচলার জায়গা থাকবে না।

ডেস্কে বসে মা-বাবাকে চিঠি লিখলাম। জানালাম, আমি ভাল আছি। লিখলাম, গ্রীন হিলসে ফিরে প্রচুর ভাল ভাল ছবি আমি দেখাতে পারব ওদের। কি চিঠি লেখা শেষ হলো। এখনও ঘুম পাচ্ছে না। তবু শুয়ে পড়াই ভাল।

পাজামা নেয়ার জন্য আলমারির দিকে এগোলাম। কিন্তু থেমে গেলাম জানালার বাইরে চোখ পড়তে। পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

তাকিয়ে আছি কমলা আলোর দিকে।

উলফদের বাড়ির একটা জানালায় দেখা যাচ্ছে ওই আলো!

দুটো গাছের মাঝখান দিয়ে আসাতে কাঁপা কাঁপা দেখাচ্ছে আলোটা।

বাতাসে কাঁপছে গাছগুলোর পাতা। ফ্যাকাসে কমলা আয়তাকার আলো দেখা যাচ্ছে বাড়ির পিছন দিকের নীচতলার একটা ঘরের জানালায়।

জানালাটা কি বেডরুমের?

আমার ঘরের জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম। কমলা আয়তাকার আলোটার ওপাশে কী আছে দেখার : চেষ্টা করছি।

উলফদের কাউকে কি দেখতে পাব? দম আটকে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না।

জানালার ওপাশে ছায়া নড়তে দেখলাম। ধূসর একটা ছায়ামূর্তি ধরা পড়ল কমলা আলোয়।

মানুষের ছায়া?

বুঝতে পারলাম না।

নড়ে উঠল ছায়াটা। একটা জন্তু, মনে হলো আমার।

তারপর মনে হলো, না না, মানুষই।

মিস্টার উলফ নাকি?

আরও জোরে নাক চেপে ধরলাম জানালার কাঁচে। আরও ভাল করে দেখতে চাইলাম।

উঁহু, মানুষ না।

বড় কুকুর?

নাকি মানুষই?

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।

জানালা থেকে সরে গেল ছায়াটা।

তারপর তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল।

কুৎসিত, ভয়ানক শব্দ। আধা-মানুষ, আধা-জানোয়ারের। এ রকম শব্দ আগে কখনও শুনিনি।

মেরুদণ্ডে ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল আমার।

আবার শোনা গেল সেই ডাক। ঘন হয়ে গেল আমার নিঃশ্বাস।

জানালার কাছে ফিরে এল ছায়াটা। এখন আর মানুষের মত লাগছে না। মাথা হেলিয়ে দিয়ে, চোয়াল ফাঁক করে আবার ডেকে উঠল ওটা। নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কোনও জানোয়ার।

ওই জানোয়ারটার ছবি তুলতে হবে।

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। মাঝখানের ছোট্ট পরিসর পেরিয়ে এসে প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়লাম ডেস্কের ওপর।

ক্যামেরার জন্য হাত বাড়ালাম।

কিন্তু কোথায় ওটা?

আট

ডেস্কের ওপর পাগলের মত হাতড়ে বেড়াচ্ছে আমার আঙুলগুলো।

কিন্তু ক্যামেরাটা পেলাম না।

সারা ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল আমার দৃষ্টি। সব কিছুই জায়গামত রয়েছে। ড্রেসারটাতে রাখলাম নাকি?

না, ওখানেও নেই।

হাঁটু গেড়ে বসে বিছানার তলায় উঁকি দিলাম।

নেই।

হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম আলমারিটার কাছে। টান দিয়ে। দরজা খুললাম। খুঁজে দেখলাম ভিতরে। নেই ওটা।

আবার শোনা গেল তীক্ষ্ণ চিৎকার। নেকড়ের ডাকের মত।

পরক্ষণে শোনা গেল আরেকটা একই রকম ডাক। একসঙ্গে ডেকে উঠল যেন দুটো নেকড়ে। সাইরেনের শব্দের মত তীক্ষ্ণ হয়ে এসে ঘুরতে থাকল আমার ঘরের ভিতর।

জানালা খোলার শব্দ শুনলাম। ধুপ করে ভারি একটা শব্দ। মাটিতে পায়ে পড়াম। মাটিতে লাফিয়ে পড়ার। ঘোঁতঘোঁত শোনা গেল। তারপর হাঁটার শব্দ। ঠিক আমার ঘরের বাইরে।

জানালার দিকে ছুটলাম। বুকের মধ্যে বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ডটা। বাইরে তাকালাম। আসতে দেরি করে ফেলেছি। কাউকে চোখে পড়ল না। নিভে গেছে উলফদের জানালার কমলা আলো। আবার অন্ধকার হয়ে গেছে বাড়িটা।

থিরথির কাঁপছে গাছের ডাল। নীল-কালো আকাশের পটভূমিতে কালো দেখাচ্ছে। পাতাগুলো চিকচিক করছে। উজ্জ্বল জ্যোত্সায় যেন নেয়ে যাচ্ছে।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম। বুকের কাঁপুনি বন্ধ হওয়ার অপেক্ষা করছি। কান পেতে আছি তীক্ষ্ণ চিৎকার ও ভারি পায়ের শব্দ শোনার আশায়।

শুধুই নীরবতা এখন। আবার মনে পড়ল ক্যামেরাটার কথা।

জানালার কাছ থেকে যেন জোর করে ঘোরালাম নিজেকে। ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে হলওয়ে পেরিয়ে ছুটলাম লিভিং রুমের দিকে। ভুল করে ক্যামেরাটা ওখানে রেখে আসিনি তো?

না। লিভিং রুমেও নেই। রান্নাঘরে খুঁজলাম। সেখানেও নেই।

জুলি আন্টি! সিডার আঙ্কেল! ডাক দিলাম। জবাব এল না।

হল ধরে দৌড়ে চললাম। আমার ঘরটা পেরিয়ে এলাম। পেরিয়ে এলাম বাথরুম ও গরম কাপড় রাখার বড় আলমারিটা। হলের শেষ প্রান্তে তাদের ঘর। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার ক্যামেরাটা দেখেছেন?

ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললাম তাদের বেডরুমের দরজা। অন্ধকার ঘর। ছবি ডেভেলপ করার ঝাঁঝাল রাসায়নিক গন্ধ নাকে ঢুকল। তাতে মনে পড়ল, বনের ভিতর নিশাচর জীবের ছবি তুলতে বেরিয়েছেন দুজনে।

ঘরে আমি একা।

ভারি দম নিলাম। নিজেকে বোঝালাম, শান্ত হও রবিন। কোন ভয় নেই। এখানে তুমি নিরাপদ।

মাথা ঠাণ্ডা করো। তা হলেই খুঁজে পাবে ক্যামেরাটা। ঘরেই আছে ওটা। মাথা গরম করে ফেলেছ বলে দেখতে পাচ্ছ না।

 ফুসফুসের বাতাস ছেড়ে দিয়ে আবার ভারি দম নিলাম। আবার ছাড়লাম। মনে হলো কমে আসছে ভিতরের উত্তেজনা।

 ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এগিয়ে চললাম হলওয়ে দিয়ে।

অর্ধেকটা এসেছি, এই সময় আবার কানে এল মৃদু শব্দ। আবার শোনা গেল পায়েব শব্দ। বরফের মত জমে গেলাম। কান পেতে আছি। কোথা থেকে আসছে? পিছনের দরজার কাছে। কিন্তু কে? নিশ্চয় উলফদের জানালা দিয়ে বেরোনো জনোয়ার দুটো।

নয়

দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লাম। সারা শরীর কাঁপছে।

 ঢোক গিলোম। কান পেতে শুনছি দরজা ধাক্কাননার শব্দ।  এখান থেকে বেরোতে হবে আমাকে!

এই বাড়িটা থেকেই বেরিয়ে যেতে হবে। ব সিডার আঙ্কেল আর জলি আন্টিকে জানাতে হবে, ভয়ঙ্কর কিছু রয়েছে পাশের বাড়িতে।

কিন্তু আমার পা দুটো যেন রবার হয়ে গেছে। এ দুটোয় ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারব কিনা সন্দেহ।

কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। এক পা বাড়ালাম। তারপর আরেক পা।

রান্নাঘরে এসে দরজাটা একটানে খুলে ফেললাম। চেঁচিয়ে উঠলাম কে? কে ওখানে?

আমি, নিনা, জবাব দিল একটা ছায়ামূর্তি।

নিনা! হাঁ করে তাকিয়ে আছি। তু-তুমি এত রাতে?

হ্যাঁ। আব্বা-আম্মা বাড়িতে নেই। গেছে আমার এক আন্টির বাড়িতে, হ্যালোউইনের দাওয়াত দিতে। রাতে ফিরবে বলেও মনে হয় না। একা থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই চলে এলাম। একটু থেমে জিজ্ঞেস করল নিনা, কিন্তু তোমার গলা এমন কাঁপছে কেন?

তোমাকে দেখে আমি ভাবলাম… বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। কথাগুলো যেন আটকে গেল গলায়।

কী ভাবলে?

না, কিছু না!

 কিছু তো বটেই। কী হয়েছে?

প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নিনা, আমার ক্যামেরাটা কোথায় জানো? সারা বাড়ি খুঁজেও পাচ্ছি না…

না, জানি না! গুঙিয়ে উঠল নিনা। বনের ভিতর ফেলে আসনি তো?

 নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেল আমার। কী জানি! হবে হয়তো…

পেটের ভিতর এক ধরনের অস্বস্তিকর খামচে ধরা অনুভুতি হচ্ছে।

টনি আর রজার চলে যাবার সময় তোমার হাতেই ছিল, দেখেছি, নিনা বলল। কিন্তু এখানে ফেরার পর আর দেখেছি কিনা মনে করতে পারছি না।

হুঁ! বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। ওটা আনতে হবে, নিনা। সারারাত বনের ভিতর ফেলে রাখতে পারব না।

না না! চেঁচিয়ে উঠল নিনা। আজ রাতে ওই বনের ভিতর যেয়ো না।

আমাকে যেতেই হবে!

রাতের বেলা ওই বন মোটেও নিরাপদ নয়। ভীষণ বিপজ্জনক।

ঘুরে দাঁড়িয়ে হলওয়ে ধরে ছুটলাম। আমার ঘরে ঢুকে জ্যাকেট গায়ে দিলাম। আলমারিতে একটা টর্চ পেলাম। সুইচ টিপে দেখলাম। ব্যাটারি আছে। আলো বেশ উজ্জ্বল।

বেরিয়ে এসে সিঁড়ির গোড়া থেকে নিনাকে বললাম, কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে আসছি।

না না, প্লিজ, রবিন। ককিয়ে উঠল নিনা। আমার কথা শোনো! আজ রাতে বনের মধ্যে যেয়ো না!

কিন্তু আমাকে যেতেই হবে। এত দামি ক্যামেরাটা নষ্ট হতে দিতে পারি না।

কী যেন ভাবল নিনা। ঠিক আছে, একটু অপেক্ষা করো। আমি জ্যাকেটটা পরে আসি।

কিন্তু বনের ভিতর পড়ে থেকে দামি ক্যামেরাটা নষ্ট হতে দেবার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। তোমার আসতে দেরি হবে। ততক্ষণ সহ্য হবে না আমার। তা ছাড়া দুটো বাড়িকেই খালি ফেলে সবার চলে যাওয়া উচিত হবে না। তুমি তোমাদের বাড়ি পাহারা দাও। এ বা দিকেও খেয়াল রেখো। আমি যাব আর আসব।

বাইরে বেরিয়ে পাল্লার ছিটকানি তুলে দিলাম। নেমে এলাম সিঁড়ির নীচে।

চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে যেন সব কিছু।

দশ

বাড়ির পাশ ঘুরে দৌড়ে চললাম পিছন দিকে।

 হঠাৎ করেই ভারি কালো মেঘে ঢেকে দিল চাঁদ, যেন আমাকে যন্ত্রণা দেয়ার জন্যই।

 রাতের বাতাস খুবই ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা। দৌড়াতে দৌড়াতেই জ্যাকেটের জিপার তুলে দিলাম।

 উলফদের বাড়ির দিকে ফিরে তাকালাম। কাউকে চোখে পড়ল না। পিছনের জানালাটা খোলা। কিন্তু বাড়িটা পুরোপুরি অন্ধকার। একটা আলোও নেই কোথাও।

ভারি শিশিরপাতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে ঘাস। কপালে ঠাণ্ডা ফোঁটা পড়ল।

বৃষ্টি।

ক্যামেরাটার কথা ভেবে গুঙিয়ে উঠলাম। ভোলা জায়গায় পড়ে আছে নিশ্চয়। পানি পড়লে আমার এত দামি ক্যামেরাটা যাবে! বৃষ্টি আসার আগেই ওটা খুঁজে বের করতে হবে।

আমার পায়ের কাছে হুটোপুটি করছে ছোট ছোট জানোয়ার। থেমে গেলাম।

না। জানোয়ার নয়। মরা পাতা। জোর বাতাসে অন্ধকারে ঘাসের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে।

মাথা নিচু করে একটা ডালের তলা দিয়ে এসে বনে ঢুকলাম। পুরানো গাছগুলো থরথর করে কাঁপছে, মড়মড় শব্দ করছে।

দূর থেকে ভেসে আসা পেঁচার ডাক আঙ্কেল ও আন্টির কথা মনে করিয়ে দিল আমাকে। ক্যামেরা হাতে বনের ভিতরেই আছেন কোথাও দুজনে। ভয় লাগছে, তাদের সামনে পড়ে যাব না তো?

বনের ভিতরের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে এগিয়ে চললাম। বৃষ্টির আরেকটা বড় ফোঁটা পড়ল কপালে। মাটিতে ফোঁটা পড়ার টুপুর-টাপুর শব্দ হচ্ছে।

পুরানো, ঝুঁকে থাকা গাছটা নজরে আসতে থেমে গেলাম। বিকেল বেলা এই গাছটারই ছবি তুলেছিলাম। টর্চের আলো ফেললাম গাছের গোড়ায়।

যাক, পথ হারাইনি, ঠিকমতই এসেছি, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললাম। ৪ পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল ডিঙিয়ে এলাম। বাতাসের বেগ বাড়ছে। গাছের পাতায় হুসহুস শব্দ হচ্ছে। নড়ছে জোরে জোরে। থেকে থেকেই ডেকে উঠছে দূরের পেঁচাটা।

 টর্চের আলোটা কমে গিয়ে আবার উজ্জ্বল হলো। গোলাকার আলোকরশ্মি আমার আর গাছগুলোর মাঝে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করেছে যেন। ত। ক্যামেরার কেসটা চোখে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলাম। চ্যাপ্টা একটা শিকড়ের ওপর রেখেছি ওটা। কিন্তু ক্যামেরা ফেলে রেখে যাওয়ার মত এতবড় একটা ভুল কীভাবে করলাম মাথায় ঢুকছে না। উত্তেজিত হলে কত কী-ই না করে মানুষ!

 ছুটে গিয়ে তুলে নিলাম ক্যামেরাটা। ফিরে পেয়ে এত খুশি হয়েছি, মনে হচ্ছে জড়িয়ে ধরে আদর করি। সাবধানে টর্চের আলোয় দেখতে লাগলাম।

ওপরে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়েছে। মুছে ফেললাম। ফিরে চললাম বাড়ির দিকে। টু বৃষ্টি থেমে গেছে আপাতত। মনের আনন্দে গুন গুন করে গান গাইতে লাগলাম। বাড়ি ফেরার তর সইছে না যেন। মনে হচ্ছে এক লাফে রাস্তাটুকু পেরিয়ে বাড়ি চলে যাই। o ক্যামেরাটা আমার কাছে ভীষণ মূল্যবান। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, কখনও আর কোনভাবেই কোথাও ফেলে যাব না এটা।

রাগত একটা শব্দ শুনে গুনগুন থামিয়ে দিলাম।..

গর্জন করে উঠেছে একটা জানোয়ার। গলার গভীর থেকে বেরোচ্ছে চাপা গরগর শব্দ।

হাত থেকে টর্চ খসে পড়ল আমার।

আবার গর্জন করে উঠল জানোয়ারটা।

আমার পিছনে কোথাও!

এগারো

নিচু হয়ে তুলে নিলাম টর্চটা। দুর্বল লাগছে দুই হাঁটু। ঠাণ্ডা ভয়ের স্রোত ছড়িয়ে পড়ল যেন সারা শরীরে।

আবার গর্জন শোনা গেল। রাগত গরগর।

 জোর করে সামনে পা বাড়ালাম। এখান থেকে পালাতে হবে আমাকে।

সামনে মাথা তুলে রেখেছে বড় একটা ঝোপ। ক্যামেরাটা শক্ত করে চেপে ধরে দৌড়ে চলে এলাম ঝোপের অন্যপাশে। হাঁটু গেড়ে বসলাম।

ঝোপের আড়ালে বসে হাঁপাচ্ছি। দম ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছি। বুকের মধ্যে বাড়ি মারতে থাকা হৃৎপিণ্ডটার গতি কমাতে চাইছি।

ঝোপের ঘন পাতার জন্য ওপাশে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু জানোয়ারের গরগর শুনতে পাচ্ছি। যতটা সম্ভব নামিয়ে রেখেছি মাথা, যাতে আমাকে না দেখে। তবে আমার গায়ের গন্ধ পেয়ে গেলে আর কিছু করার থাকবে না। খোদা, গন্ধ যেন না পায়-প্রার্থনা করলাম মনে মনে।

মাটিতে ভারি কী যেন আছড়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ চিৎকার। মনে হলো, কোন কিছুর ওপর হামলা চালিয়েছে।

ভয়ার্ত কাতর আর্তনাদ করে উঠল অন্য একটা জানোয়ার। আতঙ্কিত চিৎকারের শব্দটা মাঝপথেই কাটা পড়ে গেল।

কেটে দেয়া হলো আসলে।

ঝোপের আড়ালে ঝুঁকে বসে আছি। পা কাঁপছে। সারা শরীর কাঁপছে। কানে আসছে ধস্তাধস্তির শব্দ।

এত কাছে, মনে হচ্ছে উঠে দাঁড়ালেই হাত বাড়িয়ে হামলাকারী ও তার শিকারকে ছুঁতে পারব।

প্রতিটি গোঙানি, প্রতিটি ভয়ার্ত ককানি কানে আসছে।

ধুপ করে শব্দ হলো। আরেকটা চাপা গর্জন। আরেকটা অসহায় কাঁতরানি।

মাংস ঘেঁড়ার শব্দ।

চিবানোর শব্দ। চোয়াল খটখটানির শব্দ। আরও চিবানো। জানোয়ারের ঢেকুর তোলা। আবারও মাংস ছেঁড়ার শব্দ। ঘটনাগুলো ঘটছে আমার ঠিক সামনেই, ঝোপের ওপাশে।

চোখ বুজলাম। কী ঘটছে, কল্পনা করার চেষ্টা করলাম। আবারও ধুপ করে শব্দ। তারপর নীরবতা। বাতাসের গতি বাড়ছে।

সামনে হিসিয়ে উঠল কী যেন। তারপর আবার চুপ। চোখ মেলোম। কম্পিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। এ ভারি পায়ের শব্দ কানে এল। পায়ের চাপে ভাঙছে শুকনো ডাল পাতা।

 দ্রুত এগিয়ে আসছে পায়ের শব্দ। আমার দিকে।

 আমাকে ধরতে আসছে জানোয়ারটা?

তার নিজেকে সামলাতে পারলাম না। চাপা আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে গেল আমার গলা চিরে।

শক্ত হাতে ক্যামেরাটা চেপে ধরে ঘুরে দাঁড়ালাম ঝোপের দিক থেকে। দৌড়ানো শুরু করলাম।T,

আমার পিছনে ভারি হাঁপানোর শব্দ হচ্ছে। ফিরে তাকালাম না।

ছুটতে ছুটতে ঢুকে পড়লাম বনের গভীরে। ডানে পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে। কিংবা পানি বয়ে যাবার। নিশ্চয় উলফ লেক। কিন্তু দেখার জন্য থামলাম না।

পাশ দিয়ে যাবার সময় ডালে ঘষা লাগল আমার গাল। ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল মুখ জুড়ে।

হাত দিয়ে চেপে ধরলাম গাল। দৌড়ানো বন্ধ করলাম না।

অন্ধের মত দৌড়াচ্ছি। অন্ধকারে দৌড়ে চলেছি। টর্চটা কোথায়? মনে পড়েছে। ঝোপের কাছে ফেলে এসেছি।

লম্বা নলখাগড়ার বনে ঢুকলাম। গাছগুলো শপাং শপাং করে বেতের মত বাড়ি মারছে আমার গায়ে। শিশির ও বৃষ্টিতে ভিজে আছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাকে।

মাটিতে অর্ধেক গেঁথে থাকা একটা পাথরে পা পড়ল আমার। পিছলে গেল পা। বহু কষ্টে সামলে নিয়ে আছাড় খাওয়া থেকে বাঁচলাম।

নলখাগড়ার বন থেকে বেরিয়ে এলাম। লাফিয়ে পেরিয়ে এলাম একটা উঁচু হয়ে থাকা গাছের শিকড়।

জোরে জোরে হাঁপাচ্ছি। সেই শব্দকে ছাপিয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম পিছনে পায়ের শব্দ আমাকে অনুসরণ করছে কি না। জানোয়ারের গর্জন শোনা যায় কি না। এ টি

এখনও কি জানোয়ারটা আমাকে তাড়া করছে?

মসৃণ একটা গাছের ডাল ধরে দাঁড়িয়ে গেলাম। এত বেশি পা কাঁপছে, মনে হচ্ছে খাড়া থাকতে পারব না। প্রায় ঝুলে পড়লাম ডালটা ধরে। স্বাভাবিকভাবে দম নেয়ার চেষ্টা করলাম।

তারপর ফিরে তাকালাম পিছনে।

কিছুই নেই।

গর্জন নেই। ঘোঁতঘোঁতানি নেই। ছুটে আসা ভারি পায়ের শব্দ হচ্ছে না মাটিতে। 1 হাঁপানো থামছে না আমার। কিছুতেই কমাতে পারছি না ঘন ঘন। শ্বাস নেয়া। পুড়ে যাচ্ছে যেন ফুসফুস। মুখের ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ। ঢোক গিলতে পারছি না।

আমি ঠিক আছি, নিজেকে বোঝালাম। আপাতত আমি নিরাপদ।

গভীর অন্ধকারে কী আছে দেখার চেষ্টা করছি।

আর ঠিক এই সময় মাথায় পড়ল ওটা।

বারো

চমকে গিয়ে প্রথমে চিৎকার করে উঠলেও পরে বুঝলাম জিনিসটা কী। একটা পাখির বাসা। মাটি দিয়ে তৈরি ভাঙা বাসাটা মাথার ওপরের কোনও ডাল থেকে খসে পড়েছে বাতাসে।

কিন্তু কী কাণ্ড! পড়ার আর সময় পেল না! আর পড়বি তো পড়, একেবারে আমারই মাথায়!

 চুলে আটকে যাওয়া একটা শুকনো কুটো ঝেড়ে ফেললাম। ক্যামেরাটা শক্ত করে চেপে ধরে চারপাশে তাকালাম।

কোথায় রয়েছি?

সামনের গাছগুলো কেমন বেঁকে রয়েছে মনে হচ্ছে। যেন হেলে পড়তে চাইছে একে অন্যের গায়ের ওপর। নলখাগড়া বনের কিনারে নিচু একটা পাথরের স্তূপ চোখে পড়ল।

 হারিয়ে গেছি, বুঝতে পারলাম। তার

আকাশের দিকে তাকালাম। চাঁদ নেই। ভারি মেঘে ঢাকা পড়েছে চাঁদ-তারা সব কিছুই। আবছা আভা ছড়িয়ে আছে বনতলে।

ফিরে যাব কীভাবে?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকালাম। রাস্তা খুঁজলাম। পরিচিত কিছু খুঁজলাম।

কিছুই দেখলাম না।

লেকটা খুঁজে পেলে হয়তো পরিচিত সেই জায়গাটায় ফিরে যেতে পারব, যেখানে বুড়ো বাঁকা গাছটা রয়েছে, যেখানে ক্যামেরাটা পেয়েছি।

কিন্তু কোনদিকে রয়েছে উলফ লেক?

পুরো এক পাক ঘুরে চারপাশে তাকালাম।

গায়ে কাঁটা দিল। জ্যাকেটে ঝরে পড়ল বৃষ্টির ঠাণ্ডা ফোঁটা।

আবারও চমকে গেলাম।

যা পড়ছে, তাতেই চমকাচ্ছি।

কী করব?

বনবন করে ঘুরছে যেন মগজটা।

চিৎকার করে ডেকে সাহায্য চাইব?

আমার আঙ্কেল-আন্টিকে ডাকব? জোরে চেঁচালে হয়তো আমার ডাক তাদের কানে পৌঁছবে।

 কিন্তু আমার চিৎকার সেই জানোয়ারটার কানেও যেতে পারে।

এখনও কি আমাকে খুঁজছে ওটা? কাছাকাছিই কোথাও আছে?

সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে বিপদ বাড়ার সম্ভাবনা আছে ভেবে বাদ দিলাম চিন্তাটা। রাত

কী করব তা হলে এখন? কী?

যে কোনও একদিকে হাঁটা শুরু করব? তারপর যা হয় হোক?

না। আন্দাজে ওরকম হাঁটতে গেলে পথ হারানোর সম্ভাবনা বেশি। ভোর হওয়ার অপেক্ষা করাই ভাল। এই অন্ধকারে কোনভাবেই বাড়ি ফিরতে পারব না। দিনের আলোয় পথ চিনে যাওয়াটা সহজতর হবে।

 কিন্তু বনের ভিতর রাত কাটানোটাও ভীষণ বিপজ্জনক। টুপুর টাপুর শব্দ শোনা গেল আবার। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বেশ জোরেই নেমেছে এবার। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি, ঝোড়ো বাতাসের ঝাঁপটায় সুচের মত বিধছে মুখে।

এখানে থাকা যাবে না, বুঝতে পারলাম।

বাড়ি যাওয়ার চেষ্টাই করতে হবে। হাঁটতে শুরু করলাম। তাড়াহুড়া না করে সাবধানে হাঁটছি। যেদিক থেকে এসেছি, সেদিকেই যাচ্ছি কিনা জানি না। তবে পরিচিত ঝোপটা চিনতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এখানে বসেই জানোয়ারের গর্জন শুনেছিলাম। ভাগ্য ভাল, টর্চটাও খুঁজে পেলাম। এমন জোরে আঁকড়ে ধরলাম, যেন ওটাই আমার জীবন-মরণ।

এরপর কোনদিকে যাব? অনুমানের ওপর নির্ভর করে আবার চলা শুরু করলাম।

মিনিটখানেক পরেই কোন কিছুতে হোঁচট খেলাম।

নরম কোনকিছু।

কীসে হোঁচট খেয়েছি দেখতে গিয়ে আতঙ্কিত চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে।

তেরো

টর্চলাইটটা কাঁপছে হাতের মুঠোয়। কাঁপা আলোয় বীভৎস একটা দৃশ্য ফুটে উঠল চোখের সামনে।

 হাঁ করে তাকিয়ে আছি একটা জানোয়ারের দেহের দিকে। না না, দুটো জানোয়ার। কী কী ওগুলো? চেনা কঠিন। নখ দিয়ে কেটে ফালাফালা করে ফেলা হয়েছে।

টুকরো টুকরো করে ভেঁড়া। দড়ি

মাংস ঘেঁড়ার শব্দ শুনেছিলাম, মনে পড়ল। এগুলোকেই ছিঁড়ছিল জানোয়ারটা। পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।

কী ধরনের জানোয়ার ওটা?

অন্য জানোয়ারকে এভাবে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, কোন ধরনের জীবের এত শক্তি?

শিরশির করে উঠল মেরুদণ্ড।

 জোর করে দৃষ্টি সরালাম অন্য দিকে।

একনাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে এখন। ক্যামেরাটা জ্যাকেটের নীচে ঢোকালাম। দৌড়াতে শুরু করলাম আবার।

ভয়ঙ্কর এই দৃশ্য সহ্য করা যায় না। যতটা সম্ভব দূরে পালাতে হবে।

 চারপাশ থেকে ঝাঁপটা মারছে বৃষ্টিমেশানো বাতাস। আগে বাড়তে দিতে চায় না যেন আমাকে। কিন্তু আমিও থামব না। তাই

ভয় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল।

ওই ভয়াল জানোয়ারটা এখনও নিশ্চয় ঘুরে বেড়াচ্ছে বনের ভিতরে। এখনও নিশ্চয় শিকার খুঁজে বেড়াচ্ছে। আশেপাশেই কোনখানে।

জুতো ভিজে গেছে। পিচ্ছিল হয়ে গেছে মাটি। নরম কাদায় উঠছে আর পড়ছে পা দুটো। বার বার পিছলে পড়তে পড়তে বাচছি।

কতক্ষণ দৌড়ালাম বলতে পারব না। লেকের মধ্যে পড়তে পড়তে বাঁচলাম। লেকের ধারে পৌঁছে গেছি। বৃষ্টির পানিতে ভরে গেছে। নিচু পাড় ছাপিয়ে উপচে পড়ছে। যে

ঘুরে দাঁড়ালাম। আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে খানিকটা। লেকের আশেপাশেই কোথাও রয়েছে সেই পায়েচলা সরু পথটা, যেটা ধরে বাড়ি থেকে এসেছি।

দুলন্ত গাছের মাঝখানে রাস্তাটা খুঁজে পেতে দেরি হলো না। বনের ভিতর থেকে বেরোতে পারব তো?

চেষ্টা করতে দোষ নেই।

কিছুদূর এগোতেই ধরে এল বৃষ্টি। তবে সর্বনাশ যা করার করে দিয়ে গেছে। এত কাদা, পা ফেললেই মাটিতে বসে যাচ্ছে জুতো। দৌড়ানো অসম্ভব করে তুলেছে।

ঝুঁকে থাকা বুড়ো-মানুষ গাছটার দেখা মিলল অবশেষে।

এই তো পাওয়া গেছে! এই তো পাওয়া গেছে। চেঁচিয়ে উঠলাম। হাত উঁচু করে বাতাসে ঘুসি মারতে লাগলাম আনন্দে। বাড়ির কাছাকাছি প্রায় পৌঁছে গেছি।

কয়েক মিনিট পরেই বন থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এলাম। পৌঁছে গেলাম আমার আঙ্কেল সিডারের বাড়ির পিছনের আঙিনায়।

খুব খুশি লাগছে! উড়তে ইচ্ছে করছে!

ঘরের ভিতরের উষ্ণতায় পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি। ভেজা কাপড় খুলে শুকনো কিছু পরতে না পারলে শান্তি নেই।

কিন্তু আঙিনার মাঝামাঝি পৌঁছে থমকে দাঁড়ালাম।

তাকিয়ে আছি আমার টর্চের গোলাকার আলোটা যেখানে পড়েছে। সেদিকে।

ভেজা ঘাসে অদ্ভুত কিছু পায়ের ছাপ। গম্ভীর হয়ে বসা ছাপগুলো চলে গেছে উলফদের বাড়ির দিকে।

ভাল করে দেখার জন্য নিচু হলাম। মানুষের পায়ের ছাপের মত লাগল না ওগুলো। অনেকটাই লম্বা, চওড়াও বেশি, মানুষের পা কিংবা জুতোর চেয়ে অন্যরকম।

জানোয়ারের পায়ের ছাপ। আলোটা সামনে বাড়িয়ে রেখে পায়ের ছাপ ধরে এগিয়ে চললাম। চলে এলাম উলফদের আগাছা জন্মে থাকা পিছনের আঙিনায়। অদ্ভুত ছাপগুলো কোথায় গেছে দেখে আরেকবার অবাক হলা। সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে উলফদের শোবার ঘরের জানালায়।

চোদ্দো

পরদিন সকালে নাস্তা করতে রান্নাঘরে ঢুকে দেখি ফোনে কথা বলছেন জুলি আন্টি। আমার দিকে পিছন করে আছেন। আমি আঙ্কেলকে গুড মর্নিং বলতেই আন্টি ঘুরে তাকালেন আমার দিকে। রাগ ঝিলিক দিয়ে উঠল চোখের তারায়।

 হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি, ফোনে বললেন তিনি। ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর কখনও ঘটবে না এ রকম।

সিডার আঙ্কেলের পাশে বসলাম। সাদা একটা কফির মগে চুমুক দিচ্ছেন। চোখ জুলি আন্টির দিকে।

না, আর ঘটবে না, টেলিফোনে আবার বললেন জুলি আন্টি। ভুরু কোঁচকালেন। আর যেন না যায় দেখব আমি। না। আপনার ওপর নজর রাখেনি, মিস্টার উলফ।

বুঝলাম, কার সঙ্গে কথা বলছেন আন্টি।

অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন সিডার আঙ্কেল। আমি তোমাকে ওই বাড়িটার কাছে যেতে নিষেধ করেছিলাম, রবিন। আমি চাই না ওরা আমাকে ফোন করুক।

সরি, বিড়বিড় করলাম। কিন্তু…

গতরাতে যা ঘটেছে সব তাঁকে জানাতে চাইলাম। যা যা দেখেছি, সব।

 কিন্তু ঠোঁটে আঙুল রেখে আমাকে চুপ থাকতে ইশারা করলেন আঙ্কেল। আন্টি যতক্ষণ ফোনে কথা বলছেন, ততক্ষণ যাতে কিছু না বলি।

না। আমার ভাতিজা আপনার বাড়ির ছবি তোলেনি, মিস্টার …, উলফ, জুলি আন্টি বললেন। না, বললাম তো, আর আপনাকে বিরক্ত করবে না। এখুনি ওর সঙ্গে কথা বলছি আমি। হ্যাঁ। ঠিক আছে। গুড বাই।

রিসিভার রেখে সিডার আঙ্কেলের দিকে তাকালেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিড়বিড় করলেন, কী লোক।

সাবধান হতে হবে আমাদের, জবাব দিয়ে চোখের পাতা সরু করে আমার দিকে তাকালেন সিডার আঙ্কেল। ওদের কিছু করতে দেয়া চলবে না।

কিন্তু আমি অদ্ভুত জিনিস দেখেছি… বলতে গেলাম।

শুনলেন না আঙ্কেল। বাধা দিয়ে বললেন, ওরা তোমাকে দেখে ফেলেছে, রবিন। কাল রাতে নাকি ওদের বাড়ির কাছে ঘোরাফেরা করছিলে। ভীষণ রেগে গেছে তাতে।

মগে কফি ঢেলে নিয়ে টেবিলে এসে বসলেন জুলি আন্টি। কপালে এসে পড়া এক গাছি ধূসর চুল হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন।

ও কাল রাতে বাইরে গিয়েছিলে কেন? আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন।

আমি সত্যি দুঃখিত। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। আমার ক্যামেরাটা বনে ফেলে এসেছিলাম। সারারাত বনে পড়ে থাকলে, বৃষ্টির মধ্যে, নষ্ট হয়ে যেত।

কিন্তু উলদের বাড়ির কাছে গিয়েছিলে কেন? জুলি আন্টি জিজ্ঞেস করলেন।

বুনো জানোনায়ারের চিৎকার শুনলাম ওঁদের বাড়ির ভিতরে। অদ্ভুত পায়ের ছাপ গিয়ে শেষ হয়েছে বেডরুমের জানালার নীচে।

 শান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন সিডার আঙ্কেল। কফির কাপে লম্বা চুমুক দিলেন। নিশ্চয় ওদের কুকুরের পায়ের ছাপ, বলে জুলি আন্টির দিকে তাকালেন তিনি।

কুকুর? প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। শুভ।

মাথা ঝাঁকালেন দুজনেই। মস্ত দুটো জার্মান শেফার্ড কুকুর আছে  ওদের, জুলি আন্টি বললেন। সাংঘাতিক হিংস্র।

নেকড়ের মত বড়, সিডার আঙ্কেল বললেন। এক টুকরো টোস্ট নিয়ে তাতে মাখন লাগানো শুরু করলেন।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। দুটো জার্মান শেফার্ড! তীক্ষ্ণ চিৎকার আর ভেজা ঘাসে পায়ের ছাপের একটা মানে পাওয়া গেল এতক্ষণে। কিন্তু কেন যেন মনটা খুঁতখুঁত করতেই থাকল আমার।

স্কুলে যাবে না? জুলি আন্টি জিজ্ঞেস করলেন। যে কোন সময় নিনা চলে আসবে।

 আমি রেডি, জবাব দিলাম। ঢক ঢক করে শেষ করে ফেললাম এক গ্লাস কমলার রস। গত রাতে আমি যখন বনের ভিতর গিয়েছিলাম… এ দুজনকে হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলাম।

 তারপর বললাম, একটা জানোয়ারকে দেখলাম ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে ওটাকে।

 মাথা ঝাঁকালেন সিডার আঙ্কেল। মৃদুস্বরে বললেন, রাতের বেলা বন খুব বিপজ্জনক হয়ে যায়।

বা রাতের বেলা তোমার বনে যাওয়া আমাদের পছন্দ না, রবিন, আমার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে জুলি আন্টি বললেন, কথা দাও, আর কখনও যাবে না।

 যাব না, বিড়বিড় করলাম। আ মি ই আমি জবাব দেবার আগেই দরজার ঘণ্টা বাজল। রান্নাঘরে ঢুকল নিনা। জিনিসপত্রে ফুলে থাকা একটা ব্যাকপ্যাকের ভারে বাঁকা হয়ে আছে।রেডি?

মাথা ঝাঁকিয়ে চেয়ার পিছনে ঠেলে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হ্যাঁ, রেডি। কেমন জানি লাগছে আমার, একটা অপরিচিত স্কুলে যেতে।

 টিচার মিস্টার রোভারকে তোমার ভালই লাগবে, নিনা বলল। ভারি মজার লোক। আর খুব ভাল মানুষ।

 আমার ব্যাকপ্যাক আর জ্যাকেট নিয়ে, জুলি আণ্টি ও সিডার আঙ্কেলকে গুডবাই জানিয়ে সামনের দরজার দিকে রওনা হলাম।

বাইরে এসে গেটের দিকে এগোলাম। ফিরে তাকালাম উলফদের বাড়ির দিকে। বেডরুমের যে জানালাটা খোলা দেখেছিলাম, সেটা এখন বন্ধ। পুরো বাড়িটা অন্ধকার, সব সময় যেমন থাকে।

তোমার ক্যামেরাটা পেলে? নিনা জিজ্ঞেস করল।

মাথা ঝাঁকালাম। হ্যাঁ। কিন্তু মরতে মরতে বেঁচেছি। গতরাতের ভয়াবহ অভিযানের কথা খুলে বললাম ওকে।

গম্ভীর হয়ে গেল নিনা। তোমাকে আমি আগেই সাবধান করেছিলাম, রবিন। রাতের অন্ধকারে ভয়ানক হয়ে যায় বনটা।

হলুদ রঙের একটা স্কুল বাস ভারি শব্দ তুলে পাশ কাটাল আমাদের। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নিনার নাম ধরে ডাকল কয়েকটা ছেলেমেয়ে। ওদের উদ্দেশে হাত নাড়ল নিনা।

আকাশের অনেক নীচে ঝুলে আছে যেন সকালের সূর্যটা। রাস্তার পাশের ঘাস আঁকড়ে রয়েছে শিশিরকণা। ঠাণ্ডা বাতাস যেন মচমচে, চাপ দিলেই ভেঙে যাবে।

 আরেকটা ব্লক পেরোলেই স্কুলে পৌঁছে যাব, নিনা বলল। অস্বস্তি লাগছে?

জবাব দিলাম না। উলফদের কথা ভাবছি আমি। ওদের বাড়ির ভিতর থেকে আসা চিৎকারের কথা জানিয়ে নিনাকে বললাম, দুটো জার্মান শেফার্ড কুকুর নাকি আছে ওঁদের। যেমন বড়, তেমনি হিংস্র।

কে বলল ওদের কুকুর আছে? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল নিনার কণ্ঠ।

থমকে দাঁড়ালাম। কী বললে?

উলফদের কোন কুকুরই নেই, নিনা বলল আবার। কখনও কুকুর পুষতে দেখিনি ওঁদের।

তা হলে আমার আঙ্কেল বললেন কেন?

যাতে তুমি ভয় না পাও, নিনা বলল।

উলফদের যদি কুকুর না থাকে, অদ্ভুত ওই পায়ের ছাপগুলো তা হলে কীসের?

মাথা নাড়ল নিনা। ওর জলপাই-সবুজ চোখের তারা স্থির হলো, আমার চোখের দিকে। রবিন, এখনও বুঝতে পারনি? কিছুই অনুমান করতে পারনি?

কী অনুমান করব? বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম।

উলফরা মায়ানেকড়ে!

পনেরো

অবাক হলাম আমি। তবে বিশ্বাস করলাম না। হেসে উড়িয়ে দিলাম নিনার কথা। এই কম্পিউটারের যুগেও মায়ানেকড়ের কথা বিশ্বাস করে মানুষ?

উলফ লেকের মানুষরা করে, নিনা বলল।

তুমি আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ, বললাম ওকে। কিন্তু এত সহজে আমি ভয় পাই না। একটা জার্মান শেফার্ডকে আমি দেখেছি। উলফদের জানালার কাছে এসে চিৎকার করছিল।

হতাশ ভঙ্গিতে মুখ বাঁকাল নিনা। ওটা কুকুর না।

তা হলে কী? মায়ানেকড়ে? অন্যে যে যা বলে বলুক, তুমি অন্তত ওসব আজগুবি কথা বলে আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা কোরো না, বুঝলে? সব

 কিন্তু স্কুলে একটা মস্ত চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, এমনকী সিক্সথ গ্রেডের শিক্ষক মিস্টার রোভার পর্যন্ত সারাটা সকাল মায়ানেকড়ের আলোচনা করে কাটালেন।

 চল্লিশের কাছাকাছি বয়েস তাঁর। বেঁটে, মোটা। পাতলা হয়ে আসা বাদামী চুল। গোলাকার লাল মুখ। চশমার পুরু কাঁচের ওপাশে কালো চোখ। গায়ে হলুদ সোয়েটার। সব মিলিয়ে তাকে একটা পাকা নাশপাতির মত মনে হলো আমার।

কি তবে নিনা ঠিকই বলেছে। মানুষ হিসেবে তিনি অতি চমৎকার। আন্তরিক ভঙ্গিতে আমাকে স্বাগত জানালেন তিনি। ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দ্রুত পরিবেশটা সহজ করে দিলেন আমার জন্য।

পিছনের দরজার কাছে একটা সিট ঠিক করে দিলেন আমাকে। নিনা বসে সামনের সারিতে।

ঘরের অন্যপ্রান্তে জানালার কাছে বসা দেখলাম রজার ও টনিকে। আমার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল ওরা, তবে হাই-হ্যালো কিছু বলল না।

কেমন দুমড়ানো, ক্লান্ত মনে হলো ওদেরকে। পরনের পোশাক অতিরিক্ত কুঁচকানো। এলোমেলো, উস্কোখুস্কো চুল। সারারাত মনে হয় জেগেই ছিল, ভাবলাম।

এই আজব ভাবনা কেন এল আমার মাথায়, বুঝলাম না।

নাম ডাকার পর নিজের ডেস্কের কিনারে উঠে বসলেন মিস্টার রোভার। পুরো ঘরে ঘুরে এল তার নজর। আমাদের সুস্থির হয়ে বসার সুযোগ দিলেন।

লাইক্যানথ্রপি কি জিনিস জানো তোমরা? ভারি পাওয়ারের কাঁচের ওপাশে জ্বলজ্বল করে উঠল তাঁর চোখ। ] তারই

শব্দটা জীবনে প্রথম শুনলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে কয়েকটা হাত উঠে গেল।

রজারকে বলতে বললেন টিচার।

লাইক্যানথ্রপি মানে মানুষের নেকড়েতে রূপান্তরিত হওয়া, জবাব দিল রজার।

অর্থাৎ মায়ানেকড়ে! বলল টনি।

মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার রোভার। হ্যাঁ, মায়ানেকড়ে। অনেকে। লাইক্যাপি স্টাডি করে। কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন তিনি। যেহেতু এ সপ্তাহের শেষেই হ্যালোউইন-আর এ বছর হ্যালোউইনের রাতেই হচ্ছে পূর্ণিমা-ভাবলাম, কিছুটা সময় লাইক্যানথুপি নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। অনেকেই বিশ্বাস করে, মায়ানেকড়েকে জ্যান্ত করে তুলতে পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের প্রয়োজন। তবে তাদের ধারণা ভুল। যদিও একটা কথা ঠিক, চাঁদ যত বড় হতে থাকে, মায়ানেকড়েরাও ততই শক্তিমান হতে থাকে।SIR

পায়ের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলেন তিনি। দুশো বছর আগে ইয়োরোপে কীভাবে মায়ানেকড়ের কিংবদন্তী চালু হয়, সেই গল্প বললেন। জ্যোৎস্নারাতে একজন স্বাভাবিক মানুষ মায়ানেকড়ের কামড় খেলে সে-ও মায়ানেকড়ে হয়ে যায়।

কামড় খেয়ে যারা মায়ানেকড়ে হয়, তাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন উপায় নেই, মিস্টার রোভার বললেন। চাপকণ্ঠে। কথা বলছেন তিনি, যেন আবহটাকে ভূতুড়ে রূপ দিতে চাইছেন। একবার মায়ানেকড়ে হয়ে গেলে যতই স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টা সে করুক না কেন, চাঁদের আলোয় নেকড়ে হবেই।

মেয়েরাও? নিনা জিজ্ঞেস করল।

হেসে উঠল কয়েকটা ছেলেমেয়ে।

হ্যাঁ, মেয়েরাও, গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন মিস্টার রোভার। মায়ানেকড়েদের অতিরিক্ত রাগ। বার বার চিৎকার করতে থাকে। শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় বনের ভিতর।

গাঁজা! বিড়বিড় করল সামনের সারিতে বসা একটা ছেলে।

হেসে উঠল অনেকেই।

টিচার হাসলেন না। অনেকে আবার জাদু করা নেকড়ের চামড়া পরেও মায়ানেকড়ে হয়, বলতে থাকলেন তিনি। চামড়া পরে পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনবার নেকড়ের মত জোরে জোরে হাঁক দিলেই সে মায়ানেকড়ে হয়ে যাবে। গা থেকে চামড়া খুলে নিলে আবার মানুষের রূপ ফিরে পাবে। এভাবে চামড়া পরে যারা মায়ানেকড়ে হয়, তাদের বেশির ভাগই অতি কৌতূহলের শিকার। ওই চামড়া কোনভাবে পুড়িয়ে ফেলা গেলে গায়েও দিতে পারবে না, আর মায়ানেকড়েও হতে পারবে না। এক ভয়ানক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবে।

গুল! আবার বলল লাল চুলওয়ালা ছেলেটা।

অনেকেই হাসল। উত্তেজিত স্বরে কথা বলতে লাগল ছেলেমেয়েরা।

 থামানোর চেষ্টা করলেন মিস্টার রোভার। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হলুদ সোয়েটারের নীচের দিকটা টেনে নামিয়ে দিলেন। পায়চারি শুরু করলেন চকবোর্ডের সামনে।

মায়ানেকড়ে আছে, কে কে বিশ্বাস করো? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

খুক করে চাপা হাসি হাসলাম। আমার ধারণা কেউ হাত তুলবে না।

 কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘরের বেশির ভাগ ছেলেকে হাত তুলল।

তোমরা বিশ্বাস করো! মিস্টার রোভার জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, করি, রজার বলল।

আমিও করি, সুর মেলাল টনি।

ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কঠিন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনে।

শিহরণ খেলে গেল আমার দেহে। সমস্যাটা কী ওদের? অবাক হয়ে ভাবলাম। এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন?

.

ক্লাস শেষ হলে ঘরের পিছনে আমার কাছে চলে এল রজার ও টনি। ঘরের বাইরে লকারের দরজা লাগানোর জোরাল শব্দ হচ্ছে। হাসাহাসি করছে ছেলেমেয়েরা, উঁচু স্বরে কথা বলছে। দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলছে। ওদের হট্টগোল।

চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে।

ব্যাকপ্যাকের জিপার লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?

 আমাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে বেরিয়ে গেলেন মিস্টার রোভার। এক হাতে ব্রিফকেস। ক্লাসরুমে আমরা তিনজন ছাড়া কেউ নেই।

কেমন লাগছে? টনি জিজ্ঞেস করল।

নতুন স্কুলে সবকিছু নিশ্চয় অন্যরকম লাগছে? রজারের প্রশ্ন।

হ্যাঁ, কিছুটা, জবাব দিলাম। তবে এ নিয়ে ভাবছি না, দু-তিন সপ্তাহের বেশি তো আর এখানে থাকতে হচ্ছে না আমাকে।

তোমার ভাগ্য ভাল, চলে যাওয়ার সুযোগ আছে, রজার বলল। টনি আর আমি পড়ে গেছি ফাঁদে। আটকে গেছি এই জঘন্য জায়গাটায়। কোনও দিন আর এখান থেকে বেরোতে পারব বলে মনে হয় না।

অত খারাপ নয় কিন্তু উলফ লেক। ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে তুলে নিলাম আমি।

আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাৰিয়ে আছে ছেলে দুটো। ঢালা প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল টনি। রজার কড়ে আঙুলে পরা একটা রূপার আংটি ঘুরিয়ে চলেছে অনবরত।

অবশেষে নীরবতা ভাঙল টনি। মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, মায়ানেকড়ে আছে, বিশ্বাস করো না তুমি, তাই না?

আমি? আসলে… বলতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম।

তুমি তো হাত তোলনি, রজার বলল। তারমানে তুমি বিশ্বাস করো না।

 আসলেই আমি বিশ্বাস করি না, জবাব দিলাম। একুশ শতকে এসে এই কম্পিউটারের যুগে কে বিশ্বাস করবে মানুষ নেকড়ে হয়ে যায়? না, আমি করি না। আমি জানি, আমার জায়গায় কিশোর হলেও ঠিক এই জবাবটাই দিত।

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে ওরা।

 কিন্তু মায়ানেকড়ে আছে, গম্ভীর মুখে বলল রজার। আমরা সেটা প্রমাণ করতে পারব।

কেন বাজে বকছ?

বললাম তো, প্রমাণ করতে পারব, রজার ওর কথায় অটল। থাকল। একটা মায়ানেকড়ে আমি তোমাকে দেখাতেও পারব।

একটা সত্যিকারের মায়ানেকড়ে, টনি বলল।

থাক, লাগবে না, আমি বললাম। আমি…

চাইলে ওটার ছবিও তুলতে পারবে তুমি, বাধা দিয়ে বলল রজার।

হ্যাঁ। যত ইচ্ছে ছবি, সুর মেলাল ওর বন্ধু।

তর্ক থামিয়ে চুপ করে ভাবতে লাগলাম। ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় মায়ানেকড়ের ছবি দেখাতে পারলে আমার প্রথম পুরস্কার পাওয়া ঠেকায় কে?

সত্যিকারের একটা মায়ানেকড়ে দেখতে চাও? টনি জিজ্ঞেস করল।

মায়ানেকড়ের ছবি তুলতে চাও? সুর মেলাল রজার।

আমার দিকে তাকিয়ে আছে দুজনে।

চাই, কোনরকম দ্বিধা না করে জবাব দিলাম।

ষোলো

হেসে উঠলেন জুলি আন্টি। নিনা, অদ্ভুত লাগছে তোমাকে! গালে হাত ঠেকালেন তিনি।

থ্যাংক ইউ। নাটকীয় ভঙ্গিতে বাউ করল নিনা। থ্যাংক ইউ।

ডিনারের পর কস্টিউম দেখাতে এসেছে ও। হ্যালোউইনের সময় কী পরবে দেখাচ্ছে। বেশ কিছু পুরানো পোশাক থেকে কাপড় ছিঁড়ে জোড়া দিয়ে সেলাই করেছে। ঢোলা প্যান্টের এক পা বাদামী আরেক পা সবুজ। হাঁটুর কাছে চেক কাপড়ের তালি। হলুদ, লাল, নীল, সবুজ এমন কোনও রঙ নেই, যে রঙের কাপড় নেই শার্টটাতে। শার্টের ওপর জ্যাকেট পরেছে, ওটা আরও বেশি রঙচঙে। পুরানো কম্বল কেটে বানানো হ্যাটটা বার বার কাত হয়ে গিয়ে মুখের ওপর এসে পড়ছে।

আসলে কী সেজেছ তুমি? জিজ্ঞেস করলাম। বাতিল কাপড়ের আড়ত?

নিনা হাসল না। পুরানো বাতিল পুতুল। চিনতে পারছ না? কম্বলের কাপড়ের একটা ছেঁড়া মাথা ধরে টান দিল ও।

জুলি আন্টি ও সিডার আঙ্কেল দুজনেই হাসতে লাগলেন। ওদেরকে হাসতে দেখে ভাল লাগল আমার। ডিনারের সময় খুব ক্লান্ত আর মন খারাপ দেখাচ্ছিল ওঁদের। আমার সঙ্গে প্রায় কথাই বলেননি।

বাতিল পুতুল নিয়ে একটা গানও আছে, জুলি আন্টি বললেন। তোমার মনে আছে, জন?

 মাথা নাড়লেন সিডার আঙ্কেল। কোন কথাই আর এখন মনে করতে পারি না। সকালে ঘুম থেকে ওঠার কথা যদি মনে থাকে, নিজেকে ভাগ্যবান ভাবব।

ধূর, তোমার সঙ্গে কথা বলে মজা নেই! জুলি আন্টি বললেন। কনুই দিয়ে আলতো গুতো মারলেন স্বামীর পিঠে। তারপর বাতিল পুতুলের গান ধরলেন।

কিম্ভুত ভঙ্গিতে কোমর দুলিয়ে হাত ওপরে তুলে নাচ আরম্ভ করল নিনা। সেলাই ছুটে গিয়ে জ্যাকেটের একটা হাতার অনেকখানি ঝুলে পড়ল। সবাই হাসলাম।

তোমার কস্টিউম কই, রবিন? জুলি আন্টি জিজ্ঞেস করলেন। যাও, গিয়ে পরে এসো। দেখি, কেমন লাগে।

আমি…আমি এখনও জোগাড় করতে পারিনি, বললাম।

চলল, কিছু পুরানো কাপড় নিয়ে আসি। আজ রাতেই তোমাকে একটা কস্টিউম বানিয়ে দেব, জুলি আন্টি বললেন।

কিন্তু কস্টিউম নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার। সামনের জানালা দিয়ে বার বার অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকাচ্ছি। কী করতে যাচ্ছি, ভাবছি।

 বনের ভিতর লেকের কাছে টনি ও রজারের সঙ্গে দেখা করার কথা আমার। স্কুলে ওদের সঙ্গে এই কথাই হয়েছে। সাথে করে ক্যামেরাটা নিয়ে যেতে হবে আমাকে।

 ওরা বলেছে, প্রতি রাতেই চাঁদ যখন মাঝ আকাশে ওঠে, মায়ানেকড়ে আসে ওই জায়গাটাতে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ে, কথাটা বলার সময় উত্তেজনায় ফিসফিসে হয়ে গিয়েছিল রজারের কণ্ঠ। তারপর মুখ নামিয়ে চুক চুক করে লেকের পানি খায়।

দাঁড়াও না, আগে দেখো ওটাকে, তারপর বুঝবে কী জিনিস! টনি বলেছে। আধা-নেকড়ে আধা মানুষ! বুঝলে তো? আধা-জম্ভ আধা মানুষ!

দুজনের দিকে চোখ সরু করে তাকিয়েছি। ওরা সত্যি বলছে কিনা বোঝার চেষ্টা করেছি। ভাবভঙ্গি দেখে ধাপ্পা মনে হয়নি। মনে হচ্ছিল, সত্যি কথাই বলছে।

কিন্তু এটা কি সম্ভব? সত্যিই কি আছে মায়ানেকড়ে?

উলফদের জানালায় দেখা অদ্ভুত প্রাণীটার কথা ভাবলাম। বনের ভিতরে দুটো প্রাণীর হিংস্রতার কথাও ভাবলাম। ঘাড়ের কাছে শিশির করে উঠল আমার।

মাঝরাতে দেখা করবে আমাদের সঙ্গে? টনি জিজ্ঞেস করেছিল।

রাতের বেলা বনে যাবার কোন ইচ্ছেই আমার ছিল না, বিশেষ করে একবার ঘুরে সেখানে কী আছে দেখে আসার পর।

কিন্তু আমি যে ভয় পেয়েছি সেটা জানতে দিতে চাইনি ওদের।

তা ছাড়া প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য একটা অন্যরকম ছবি আমার দরকার। মায়ানেকড়ের ছবি নিয়ে যেতে পারলে নিঃসন্দেহে প্রথম পুরস্কার পাব! এর ধারেকাছেও আসতে পারবে না অন্য কোন ছবি।

কাজেই চুপি চুপি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনের মধ্যে দেখা করব। কথা দিলাম টনি ও রজারকে। কিন্তু যতই অন্ধকার হচ্ছে, ততই আমার ___ অস্বস্তি বাড়ছে। এ জানালার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে পেটের ভিতরে মোড় দিতে থাকল আমার। ঠাণ্ডা হয়ে গেল হাতের তালু। ঘামে আঠা হয়ে যাচ্ছে।

রবিন, কী ভাবছ? জুলি আন্টির প্রশ্নে ভাবনার জাল ছিন্ন হয়ে গেল আমার।

অ্যাঁ! চোখ মিটমিট করে তাকালাম। মাথা ঝাড়লাম।

হেসে উঠল সবাই।

জানালা দিয়ে এমন করে বাইরে তাকিয়ে আছ যেন ভূত দেখেছ, নিনা বলল।

না, চাঁদ দেখছিলাম, কোনমতে বললাম।

একে বলে চাঁদের অসুখ! রসিকতা করলেন সিডার আঙ্কেল।

ঘরের সবাই ভাল মেজাজে আছে, শুধু আমি বাদে। মনে হলো, আমারও ওদের সঙ্গে যোগ দেয়া দরকার। কিন্তু বনের ভিতরে যাওয়ার ভাবনাটা আমাকে সহজ হতে দিল না।

একটু পরে বাড়ি চলে গেল নিনা। আণ্টি ও আঙ্কেলকে গুড-নাই। জানিয়ে আমিও নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

বিছানার পাশে রাখা টেবিল ঘড়িটা দেখলাম। দশটা বেজে পনেরো।

আরও অন্তত দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।

ক্যামেরাটা পরীক্ষা করে নিলাম। নিশ্চিত হলাম, হাই-স্পিড ফিল্ম ভরা আছে।

তারপর একটা ফটোগ্রাফি ম্যাগাজিন টেনে নিয়ে পড়তে বসলাম। দ্রুত সময় পার করে দেয়ার জন্য।

 কিন্তু আমার চোখ দুটোই শুধু তাকিয়ে আছে ম্যাগাজিনের দিকে। পড়তে পারছি না। মনোযোগ দিতে পারছি না।

একটু পর পরই ঘড়ির দিকে নজর চলে যাচ্ছে, কটা বাজে দেখার জন্য।

অপেক্ষার মুহূর্তগুলো এত দীর্ঘ হয় কেন?

অবশেষে, বারোটা বাজার দশ মিনিট আগে ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে রাখলাম। গায়ে একটা বাড়তি সোয়েটার চাপালাম। তার ওপরে জ্যাকেট। ক্যামেরা কেসটা তুলে নিয়ে কাঁধে ঝোলালাম। আলো নিলাম। তারপর পা টিপে টিপে এগোলাম বেডরুমের দরজার দিকে।

এতক্ষণে নিশ্চয় বনে চলে গেছেন আমার আঙ্কেল ও আন্টি, নিশাচর জীবের ছবি তুলতে। কিন্তু ঝুঁকি নিলাম না। যদি ঘরে থেকে থাকেন। সেজন্য নিঃশব্দে চললাম, যাতে ওঁরা শুনে না ফেলেন।

অন্ধকারে দরজার নব ধরে মোচড় দিয়ে টান দিলাম।

নব ঘুরল, কিন্তু দরজা খুলল না।

আরে!

আবার মোচড় দিয়ে হ্যাঁচকা টান দিলাম।

এবারও খুলল না।

বিশ্বাস করতে পারছি না।

দরজায় তালা দিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে বেরোতে না পারি।

সতেরো

নাকি পাল্লাটা আটকে গেল?

জোরে জোরে টানতে লাগলাম। জোরে ধাক্কা দিয়েও দেখলাম। কোন কাজ হলো না। পাল্লা খুলল না। তালাই দেয়া হয়েছে। বাইরে থেকে।

রাগে ঝটকা দিয়ে দরজার কাছ থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম।

আমাকে তালা দিয়ে রেখে গেলেন কেন আঙ্কেল ও আণ্টি? অবাক লাগছে আমার। গতরাতে বেরিয়েছিলাম বলে? বনের ভিতর মরতে মরতে বেঁচেছিলাম, তাই?

ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলাম না। রাগে চিৎকার করে উঠলাম।

দৌড়ে গেলাম জানালার কাছে। পর্দা সরিয়ে খড়খড়ির হাতল চেপে ধরলাম। টান দিলাম ওপর দিকে।

কয়েক ইঞ্চি উঠে গেল খড়খড়ি। অস্ফুট শব্দ করে উঠলাম।

জানালাটায় লোহার ডাণ্ডা লাগানো।

নিশ্চয় আঙ্কেল লাগিয়েছেন। কখন লাগালেন? বিকেলে?

আমি এখন বন্দি, নিজেকে বললাম। খাঁচায় বদ্ধ জানোয়ারের মত আটকে রেখে যাওয়া হয়েছে আমাকে।

আবার চিৎকার করে উঠলাম অসহায় রাগে।

জানালার চৌকাঠে উঠে দাঁড়ালাম। দুই হাতে চেপে ধরে ডাণ্ডাগুলো টেনে খোলার চেষ্টা করলাম।

কিন্তু নড়লও না ওগুলো।

ডাণ্ডা ধরে টানাটানি করছি, এই সময় কানে এল চাপা গর্জন।

ডাণ্ডা থেকে আপনাআপনি সরে এল আমার হাত। তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে গেল গলা চিরে।

বরফের মত জমে গেছি।

আবার শোনা গেল গর্জন। আগেরবারের চেয়ে জোরে।

কাছে। খুব কাছে।

তীক্ষ্ণ চিৎকার ছড়িয়ে পড়ল। উলফদের বাড়ি থেকে আসছে।

মুখটা নিয়ে গেলাম ডাণ্ডার কাছে। উঁকি দিয়ে তাকালাম। ওদের বেডরুমের জানালা খুলে গেছে। তবে বাড়িটা পুরোপুরি অন্ধকার। কোথাও কোন আলো নেই।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি অন্ধকারের দিকে। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি অস্পষ্টভাবে।

 ডাণ্ডায় কপাল চেপে ধরে ভালমত দেখার চেষ্টা করলাম। জানোয়ারের ঘোঁতঘোঁত কানে এল। তারপর ধুপ করে একটা শব্দ।

উলফদের জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছে একটা আবছা ছায়ামূর্তি। তারপর আরেকটা ধুপ। আরও একটা মূর্তি লাফিয়ে পড়ল জানালা দিয়ে, চারপায়ে ভর দেয়া।

 একটা মূর্তি আকাশের দিকে মুখ তুলে তীক্ষ্ণ হাঁক ছাড়ল। বিলাপের মত মনে হলো ডাকটা।

হাঁটতে শুরু করল প্রাণী দুটো। চারপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পিছনের আঙিনা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে বনের দিকে।

কী ওগুলো? কুকুর? নেকড়ে? মানুষ? অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না।

তাকিয়েই আছি। রূপালী জ্যোৎস্না এসে যেন ধুয়ে দিতে লাগল। বাড়িটাকে। মেঘ সরে গেছে চাঁদের ওপর থেকে।

তবে দেরি হয়ে গেছে আমার। অনেক দেরি। প্রাণী দুটো উধাও। অসহায় আক্রোশে ডাণ্ডার ওপর কিল মারতে শুরু করলাম।

লেকের কিনারে আমার জন্য অপেক্ষা করছে টনি ও রজার। ওখানে যাবার কোন উপায় নেই আমার। অথচ যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছি আমি।

কী ভাববে ওরা? ভাববে আমি একটা ভীতুর ডিম। একটা দারুণ ছবি তোলা থেকে বঞ্চিত হলাম। রাগে দড়াম করে লাগিয়ে দিলাম জানালাটা।

কাল রাতে! জোরে জোরে বললাম। কাল রাতে অবশ্যই আমি বেরিয়ে যাব এখান থেকে। আঙ্কেল ও আন্টি ঠেকাতে পারবে না আমাকে।

কাল রাতে বনে যাব আমি, আবার বললাম নিজেকে।

মায়ানেকড়ের রহস্য ভেদ করে ছাড়ব!

আঠারো

দুঃস্বপ্ন দেখলাম। মায়ানেকড়ের তাড়া খেয়ে যখন পাগলের মত দৌড়াচ্ছি, হঠাৎ ভেঙে গেল ঘুম। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে। দেখি সিডার আঙ্কেলের বাড়িতে আমার ঘরে শুয়ে আছি। ঘামে নেয়ে গেছে সারা শরীর।

সকাল হয়ে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে এসে রান্নাঘরে ঢুকলাম। কী করে কাজটা করতে পারলেন! অভিযোগের সুরে বললাম। আমাকে না বলে আমার ঘরে তালা লাগালেন কেন?

হাতের কফির মগটা টেবিলে নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকালেন জুলি আন্টি। চোখে অস্বস্তি। ফিরে তাকালেন সিডার আঙ্কেলের দিকে। জন, মনে হচ্ছে ওকে সব বলে দেয়াই ভাল।

আমার দিকে চোখ সরু করে তাকালেন সিডার আঙ্কেল। কাল রাতেও কি বেরোনোর চেষ্টা করেছিলে তুমি?

 ইয়ে… দ্বিধায় পড়ে গেলাম। আমি কী করার পরিকল্পনা করেছিলাম, ওঁদের বলা যাবে না। বললাম, আসলে ঘরটা তখন একটা খাঁচা মনে হচ্ছিল আমার। খাঁচায় থাকতে কার ভাল লাগে? আমার বয়েস বারো হয়ে গেছে, আমি আর এখন ছোট নই…

সরি বাধা দিয়ে বললেন জুলি আন্টি। রান্নাঘরের ঘড়িটার দিকে তাকালেন তিনি। একটা বড় বাটিতে আমাকে কর্নফ্লেক ঢেলে দিলেন।

তোমার ভালর জন্যেই আটকে রেখেছিলাম আমরা, সিডার আঙ্কেল বললেন। উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাতের ন্যাপকিনটা ভাজ করতে লাগলেন। এ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমাদের। আগের রাতের মত বনের ভিতর তোমাকে একা একা ঘুরতে দেয়া ঠিক হত না। রাতের বেলা বনটা নিরাপদ থাকে না।

তোমার দায়িত্ব এখন আমাদের ওপর, কর্নফ্লেকের বাটিটা টেবিলে আমার দিকে ঠেলে দিলেন জুলি আন্টি। তোমার আব্বা আম্মাকে আমরা কথা দিয়েছ তোমাকে নিরাপদে বাড়িতে ফেরত পাঠাব। তোমাকে আটকে রাখা হয়নি, রবিন। বরং আমরা চেয়েছি…

 কিন্তু…কিন্তু…

 আমি কথা শেষ করার আগেই.সিডার আঙ্কেল বললেন, তা ছাড়া গতকাল উলফরা পুলিশকে খবর দিয়েছে।

কী করেছে? চেঁচিয়ে উঠলাম। আমাকে বাধা দেয়ার জন্যে ওরা পুলিশকে খবর দিয়েছে?

মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল। ওরা অভিযোগ করেছে, তুমি ওদের ওপর নজর রাখো।

ওরকম কিছুই করিনি আমি! রেগে গেলাম। কথাটা মোটেও ঠিক না। আমি ওদের ওপর নজর রাখিনি। আমি কিছুই করিনি।

 ঠিক আছে, ঠিক আছে, টেবিলের পাশ ঘুরে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন জুলি আন্টি। উলফদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। শুধু ওদের বাড়ির কাছে যেয়ো না, ব্যস।

আন্টির দিকে ফিরে তাকালাম। ফস করে বলে ফেললাম, কেন, ওরা কি মায়ানেকড়ে?

দম আটকে ফেললেন সিডার আঙ্কেল।

হেসে উঠলেন জুলি আন্টি। নিনা বলেছে বুঝি?

ইয়ে…হ্যাঁ, দ্বিধা করে জবাব দিলাম।

মাথা নাড়লেন আন্টি। কী সব যে ভাবে না নিনা!

উলফরা আসলে আজব স্বভাবের, একেবারেই অমিশুক, বাড়ি থেকে বেরোয়ই না, সিডার আঙ্কেল বললেন। জানালা দিয়ে ওদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন, কুকুর দুটোও বিশ্রী স্বভাবের। যেমন মনিব, তেমন কুকুর।

নিনা, বলেছে ওদের নাকি কুকুর নেই, বললাম।

রেগে গেলেন সিডার আঙ্কেল। নিনাকে বলে দিয়ে এ সব উল্টোপাল্টা কথা যেন না বলে!

মানে?

মানে আর কী! ও তোমাকে ভয় দেখায়। কিন্তু শুধু শুধু ভয় দেখাবে কেন? দরজার ঘণ্টা বাজল। নিনা আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতে এসেছে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে খুশিই হলাম। তবে রাতে আমাকে ঘরে আটকে রাখার কথাটা নিনাকে বললাম না। উলফদের কুকুরটার কথাও আর তুললাম না। নিনাও আমার কাছে সব বলে না, কিছু গোপন করে। তাই ঠিক করেছি, রহস্যের সমাধান আমি একাই করব।

স্কুলে পৌঁছে আমার জ্যাকেটটা লকারে ঝুলিয়ে রেখে ক্লাসের দিকে এগোলাম। মোড় ঘুরতেই রাস্তা আটকে দাঁড়াল টনি ও রজার। তা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল ওরা। দ্রুত এগিয়ে এল আমার দিকে। শঙ্কিত হলাম। রাতে লেকের পাড়ে না যাওয়ার একটা জবাব খুঁজতে থাকলাম মনে মনে। পিছাতে পিছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল আমার। উত্তেজনায় জ্বলছে ওদের চোখ।

এই, রবিন! আঙুল দিয়ে আমার কাঁধে খোঁচা মারল টনি।

মায়ানেকড়ে দেখেছ? রজার জিজ্ঞেস করল।

উনিশ

আমতা আমতা করতে লাগলাম। কী জবাব দেব বুঝতে পারছি না। দেখো…আমার আঙ্কেল-আন্টি…

থেমে গেলাম। ওরা এমন করে তাকিয়ে আছে কেন আমার দিকে?

বিচিত্র হাসি ছড়িয়ে পড়ল টনির মুখে। কাল রাতে বনের ভিতর খুব মজা পেয়েছিলে, তাই না?

মায়ানেকড়েটা দেখতে কেমন ছিল? ভুরু নাচাল টনি। ছবি তুলেছ?

 ধাক্কা দিয়ে দুজনকে সরিয়ে দেয়ালের কাছ থেকে সরে এলাম। তারমানে কাল রাতে ওখানে যাওনি তোমরা?

 হা হা করে হেসে উঠল ওরা। ঠাস ঠাস করে চাপড় মারতে লাগল একে অন্যের পিঠে।

হাসতে হাসতে রজার বলল, তোমার মত পাগল নাকি যে রাত দুপুরে বনের ভিতর মায়ানেকড়ে দেখতে যাব?

হেসে পরস্পরের পিঠে আবারও চাপড় মারল ওরা।

আমাকে তালা আটকে রাখার রাগটা চলে গেল। ভাগ্যিস যাইনি। তা হলে কী বোকাটাই না বনতাম।

 তো? টনি জিজ্ঞেস করল। আমাদের না দেখে খুব অবাক হয়েছিলে, না?

 না। তোমাদের কথা মনেই ছিল না আমার, জবাব দিলাম। কেন জানো? মায়ানেকড়ের ছবি তোলা নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলাম, আর কিছু ভাবারই সুযোগ পাইনি।

তাই? চেঁচিয়ে উঠল টনি।

কী দেখলে? রজারের কণ্ঠে সন্দেহ।

একটা মায়ানেকড়েকে অনুসরণ করে গেলাম, মনে মনে হাসছি। লেকে নেমে পানি খেল ওটা।

গুল মারার আর জায়গা পেলে না, টনি বলল।

মায়ানেকড়ে না ঘোড়ার ডিম দেখেছ। আসলে স্বপ্নে দেখেছ, বলল রজার।

কিন্তু আমি প্রমাণ করে দিতে পারি, বললাম। অনেকগুলো ছবি তুলেছি।

দেখি? টনি বলল।

এখনও ডেভেলপ করা হয়নি, জবাব দিলাম।

আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি বলছি কিনা বোঝার চেষ্টা করছে। ওরা। হাসিতে ফেটে পড়ছি মনে মনে। জোর করে মুখের ভাব স্বাভাবিক রাখছি। কি

ঘণ্টা বাজল।

লেট করে ফেলেছি। চেঁচিয়ে উঠল রজার।

হল ধরে ক্লাসের দিকে দৌড় দিলাম আমরা। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে সিটে বসলাম। ঠিক দুই সেকেণ্ড পর ক্লাসে ঢুকলেন মিস্টার রোভার।

 সারাটা সকাল ধরে যে কী পড়ালেন তিনি, কিছুই মাথায় ঢুকল না আমার। বসে বসে ভাবতে থাকলাম, আগামীকাল যখন ছবি দেখতে চাইবে টনি ও রোজার, কীভাবে দেখাব?

.

চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে যাব আজ রাতে, উলফদের বাড়ির ছবি তুলব, টেলিফোনে ফিসফিস করে বললাম। তুমিও চলে এসো।

 রবিন, ফিসফিস করছ কেন? তীক্ষ্ণ হয়ে আমার কানে বেজে উঠল নিনার কণ্ঠ।

কালো রঙের পুরানো মডেলের টেলিফোন সেটটা রাখা আছে লিভিং রুমের টেবিলে। পাশের ঘরে ডিনারের জন্য খাবার তৈরিতে ব্যস্ত আঙ্কেল ও আন্টি। এখান থেকেও দেখতে পাচ্ছি। নিচুস্বরে নিনাকে বললাম, নিনা, বাড়ির পাশে লুকিয়ে থাকব আমি। বেডরুমের জানালা দিয়ে যা-ই বেরোক, সেটার ছবি তুলব…

জুলি আন্টি ঘরে ঢুকে পড়ায় চুপ হয়ে গেলাম।

ডিনার রেডি, রবিন, তিনি বললেন। কার সঙ্গে কথা বলছ?

নিনা, জবাব দিলাম। আমি খেতে যাচ্ছি, নিনাকে বললাম। পরে কথা বলব। লাইন কেটে দিলাম।

.

ইচ্ছে করেই বড় বড় হাই তুলতে লাগলাম। আঙ্কেল-আন্টিকে বোঝালাম আমার খুব ঘুম পেয়েছে। দশটার কিছু পরে আমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কয়েক মিনিট পর দরজার বাইরে তালা লাগানোর মৃদু শব্দ কানে এল। আবার আমাকে ঘরে বন্দি করেছেন আঙ্কেল ও আন্টি।

 তবে এবার আমি তৈরি। ওঁদেরকে বোকা বানিয়েছি।

 ডিনারের আগে একদলা বাবলগাম ঢুকিয়ে দিয়েছি লকের হুকটা দরজার যে ফুটোতে ঢোকে সেটাতে। তালাটা লাগেনি।

 আবার একটা বাড়তি সোয়েটার গায়ে দিলাম। ভালমত দেখে নিলাম ক্যামেরাটা। তারপর অপেক্ষার পালা।

মাঝরাতের সামান্য আগে ক্যামেরা কেসটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। সহজেই খুলে ফেললাম বেডরুমের দরজা। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম ঘরের বাইরে, উজ্জ্বল চন্দ্রালোকে।

বিশ

দ্রুত একবার চোখ বোলালাম উলফদের বাড়িটার ওপর। তারপর শিশিরভেজা ঘাস মাড়িয়ে প্রায় দৌড়ে চললাম নিনাদের বাড়ির দিকে।

 কোথাও আলো নেই। পিছনের স্টর্ম ডোরটা বন্ধ করেনি। বাতাসে বার বার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে পাল্লাটা, হাত নেড়ে যেন ডাকছে।

নিঃশব্দে চলে এলাম বাড়ির অন্যপাশে নিনার বেডরুমের জানালার কাছে। কাঁচের শার্সিতে চাঁদের রূপালী আলো পড়ে সাদা দেখাচ্ছে।

ভিতরে উঁকি দিয়ে কিছু দেখলাম না। তবে কয়েক ইঞ্চি খুলে রয়েছে জানালার পাল্লা।

নিনা? ফিসফিস করে ডাকলাম। নিনা, জেগে আছ?

ভিতরে নড়াচড়ার শব্দ হলো। পর্দা সরে গেল।

কে? ঘুমজড়িত স্বরে জিজ্ঞেস করল নিনা।

আমি পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথায় ভর দিয়ে দেহটা উঁচু করলাম। রবিন! জানালার কাছে আসবে একটু?

রবিন? এত রাতে? নিনা জিজ্ঞেস করল।

উলফদের ছবি তুলব, বললাম ওকে। যাবে আমার সাথে?

ছবি? কিন্তু এত রাতে! আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…

প্রতি রাতেই ওদের বাড়ি থেকে নেকড়ের ডাক শুনি, আমি বললাম। তারপর কী যেন বেডরুমের জানালা দিয়ে মাটিতে লাফিয়ে নামে। সিডার আঙ্কেল বলেন; ওগুলো নাকি কুকুর…

আমি তো তোমাকে বলেছিই, বাধা দিয়ে বলল নিনা, উলফরা কুকুর পোষে না। তুমি যা দেখো, ওগুলো মায়ানেকড়ে। আমি জানি, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো না। কিন্তু যা বলি, সত্যি। সিডার আঙ্কেল আর জুলি আন্টিও জানেন, এটাই সত্যি। তুমি ভয় পাবে, সেজন্যে তোমাকে জানাতে চান না।

 জলদি কাপড় পরে নাও, নিনা। বেরিয়ে এসো। আমি চাই, আমার মতই তুমিও নিজের চোখে দেখো মায়ানেকড়েগুলোকে।

 তুমি পাগল, রবিন! বাড়ি যাও! জানালার কাছে এসে দাঁড়াল নিনা। খড়খড়ি আরও খানিকটা তুলে দিয়ে মুখ বের করল।

আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না, বলল ও। ভয়ানক বিপজ্জনক। বনের ভিতর মরা জানোয়ার পড়ে থাকতে দেখেছিলে না-কেটে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করা? উলফরা তোমাকে দেখতে পেলে তোমারও ওই অবস্থাই করবে।

ওর কথা শুনে ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল আমার। কিন্তু এ রহস্যের সমাধান আমাকে করতেই হবে। তা ছাড়া প্রতিযোগিতার জন্য ছবি তুলতে আমি মরিয়া। আমিই হব পৃথিবীর প্রথম ফটোগ্রাফার, যে মায়ানেকড়ের ছবি তুলতে পেরেছে।

আমাদের দেখবে না ওরা, নিনাকে বললাম। বাড়ির পাশের ঝোপের ভিতর লুকিয়ে থাকব।

আমার ভীষণ ভয় করছে, রবিন। আমি তোমার সঙ্গে যাব না। তুমিও যেয়ো না। বাড়ি ফিরে যাও।

 প্লিজ! ওর হাত চেপে ধরলাম। বেরিয়ে এসো। তুমিও তো মায়ানেকড়ে দেখতে চাও, চাও না?

না! ঝাড়া দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিল নিনা। বাড়ি যাও। এটা ছেলেখেলা নয়। ভয়ানক বিপদে পড়বে।

শোনো, নিনা…

কিন্তু জানালা লাগিয়ে দিল ও। আরেকবার ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল আমার। ভুলই করছি হয়তো। উলফরা ধরতে পারলে…

চাপা গর্জন শুনে চমকে উঠলাম। জমে গেলাম বরফের মত।

একুশ

আরেকবার শোনা গেল চাপা গর্জন।

নিজের অজান্তেই চিৎকার বেরিয়ে গেল আমার মুখ দিয়ে।

হাঁটু ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে আমার। ভারি, কাঁপা কাঁপা, লম্বা দম নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম, ভূতুড়ে প্রাণীটার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

কিন্তু না।

কি নেই ওখানে।

কিছুই নেই আমার পিছনে। তিনি

 ঢোক গিলোম। মুখের ভিতরটা শুকনো কাঠের মত লাগছে।

আবার গর্জন শোনা গেল। উলফদের বাড়ির পিছন থেকে আসছে শব্দটা।

জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়তে তৈরি হচ্ছে ওরা, বুঝতে পারলাম। প্রতিরাতেই এই শব্দ শুনি আমি, যখন বেডরুমের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসে ওরা।

খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। বেরিয়ে প্রথমেই আমাকে চোখে পড়বে ওদের।

আমার পা কাজ করতে চাইল না। দাঁতে দাঁত চেপে, ভারি দম নিয়ে, মনের জোরে নিজেকে নড়ালাম।

 ভেজা ঘাসে পিছলে যাচ্ছে আমার জুতো। আছাড় খেতে খেতে বাঁচলাম একবার।

একটা ঝোপের কাছে চলে এলাম। আমার আঙ্কেল-আন্টি ও উলফদের বাড়ির মাঝখানে রয়েছে ঝোপটা। এই

হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছি। বুকের মধ্যে এমনভাবে বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ডটা, বুক ব্যথা করতে লাগল।

মাথা নোয়ালাম। ক্যামেরা কেসের ফিতেটা চেপে ধরলাম।

তীক্ষ্ণ, দীর্ঘ একটা চিৎকার ভেসে এল উলফদের জানালার কাছ থেকে। চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওদের বাড়ির পাশটা।

আঙিনাটা প্রায় দিনের মত পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শিশিরে ভিজে চিকচিক করছে সবকিছু।

ঝোপের আড়ালে বসে গাছের প্রতিটি পাতা, ঘাসের ডগা দেখতে পাচ্ছি আমি।

 ক্যামেরা কেসের জিপার ধরে টানলাম। তাড়াতাড়ি বের করতে চাইলাম ক্যামেরাটা। হাতে বেশি সময় নেই। কিন্তু এমনভাবে হাত কাঁপছে, জিপার টেনে খুলতে পারলাম না। তিন

আরেকটা গর্জন জানালার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করল আমাকে

একটা ছায়া নড়ল।

একটা পা বেরিয়ে এল। ক

আরেকটা পা। একটা ছায়ামূর্তি লাফিয়ে নামল মাটিতে। মনে অতি দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাগুলো। সময় যেন ছুটে চলেছে।

আমার চোখ জানালার দিকে। জিপার খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

আরেকটা দেহ বেরিয়ে এল উলফদের ঘরের অন্ধকার জানালা দিয়ে। মাটিতে নামল।

দেহ টান টান করল মূর্তি দুটো। কারণ দুজন মানুষ। নেকড়ে নয়। মানুষ? পরনে কী ওদের? আলখেল্লা? লম্বা হয়ে ঝুলে আছে। আমার দিকে পিছন করে রয়েছে ওরা। মুখ দেখতে পাচ্ছি না।

দুই হাত কোমরে রেখে, পিঠ বাঁকা করে মাথাটা পিছনে হেলিয়ে যেন লম্বা করে ফেলতে চাইছে পেশিগুলোকে।

তারপর চাঁদের দিকে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল।

ঘোরো! ঘুরে দাঁড়াও! ঝোপের আড়ালে বসে কাঁপতে কাঁপতে নীরবে বলতে থাকলাম। প্লিজ, ঘুরে দাঁড়াও। আমি তোমাদের মুখ দেখতে চাই।

 ওরা চলতে শুরু করতেই অস্পষ্ট একটা গোঙানি বেরিয়ে গেল আমার মুখ থেকে। ভারি আলখেল্লাটা ওদের গায়ে শক্ত হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে জ্যান্ত প্রাণীর মত।

এতক্ষণে বুঝলাম, ওগুলো কাপড়ের আলখেল্লা নয়, জানোয়ারের চামড়া।

নেকড়ের চামড়া না তো?

আবার গোঙানি বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে। এত জোরে কাঁপতে শুরু করলাম, হাত থেকে ছুটে গেল ক্যামেরা কেস। দুই হাঁটু পেঁচিয়ে ধরলাম হাত দিয়ে। আবার চেঁচিয়ে উঠল মূর্তি দুটো। রোমশ দুই হাত মাথার ওপর তুলে ধরেছে। থাবা থেকে বেরিয়ে আসছে ধারাল নখ।

দুই থাবার নখ ঘষে যেন পরখ করে নিল শিকারের ওপর কতটা কার্যকরী হবে ওগুলো। গর্জন করছে, ঘোঁতঘোঁত করছে। চারপায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াল।

এখন আর মানুষ নেই ওরা। জানোয়ার…নেকড়ে…পিশাচ…

নিনা ঠিকই বলেছে। সত্যি কথা বলেছে, উলফরা মায়ানেকড়ে। চাঁদের আলোয় ওরা পিশাচ হয়ে যায়। নেকড়ের রূপধারী পিশাচ।

কাঁপা হাতে আবার তুলে নিলাম ক্যামেরা কেসটা। আবার জিপার খোলার চেষ্টা করলাম। সফল হলাম এবার। অবশেষে খুলতে পারলাম আমারটা।

এই সময় ঘুরে দাঁড়াল ওরা। আমার দিকে মুখ করে দাঁড়াল। দুটো নেকড়ে।

লোমে ঢাকা কপালের নীচের অক্ষিকোটর থেকে তাকিয়ে আছে কালো একজোড়া চোখ। লোমে ঢাকা চোয়াল ফাঁক হয়ে বেরিয়ে পড়ল ধারাল দাঁতের সারি।

মায়ানেকড়ে। উলফরা মায়ানেকডে।

পরস্পরের গায়ে নাক ঘষতে লাগল মায়ানেকড়ে দুটো। চাপা গরগর করছে। হাঁটু গেড়ে বসে ক্যামেরা তুললাম।

অন্তত একটা ছবি তুলতেই হবে আমাকে। ভোলো, তোলো, দেরি কোরো না! আদেশ দিলাম নিজেকে।

ভীষণ কাঁপছে আমার হাত। ক্যামেরাটা স্থির রাখতে পারছি না।

 তোলো! তোলো!

চোখের সামনে তুলে আনলাম ভিউফাইণ্ডার। আরেকটু উঁচু করলাম মাথা, ঝোপের ওপর দিয়ে ভাল করে দেখার জন্য।

 উহ! দেহটা উঁচু করতে যেতেই ভাঙা চোখা ডালের খোঁচা খেলাম গালে।

ক্যামেরাটা ছুটে গেল হাত থেকে।

ঘাসের ওপর পড়ল। ঘুরে তাকাল পিশাচ দুটো। দেখে ফেলল নাকি আমাকে!

বাইশ

মাটিতে পেট ঠেকিয়ে শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে।

ওঠানামা করছে আমার বুক। মুখ দিয়ে দম নিচ্ছি এখন। দেহটাকে স্থির রাখার, পুরোপুরি নিঃশব্দ থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি।

ওরা কি আমাকে দেখেছে?

না তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। আবার মাথা উঁচু করলাম। ঝোপের ভিতরের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।

রোমশ নাক উঁচু করে বাতাস শুঁকছে ওরা। আমার গন্ধ পেয়েছে? জেনে গেছে আমি এখানে রয়েছি?

লাফিয়ে ঝোপ ডিঙিয়ে এসে আমার দেহটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে এখন?

আবার বাতাস কল ওরা। চাপাস্বরে ঘোঁতঘোঁত করছে। কিন্তু এল না ওরা। ঘুরে দাঁড়াল। চারপায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটল বনের দিকে। সে ওদের পায়ের শব্দ, চাপা গর্জন আর ঘোঁতঘোঁতানি যখন আর একেবারেই শোনা গেল না, তখন উঠে বসলাম। হাত বাড়িয়ে তুলে নিলাম ক্যামেরাটা।

আমার এত সাধের ক্যামেরা!

কোন ছবিই তুলতে পারিনি। একটা ছবিও না।

কম্পিত পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। লেন্স থেকে শিশির মুছলাম। ফিরে তাকালাম বনের দিকে।

ঠিক করলাম, ওদের অনুসরণ করব আমি।

ছবি আমাকে তুলতেই হবে। এ রকম সুযোগ আর জীবনে পাব না।

মায়ানেকড়ের ছবি তুলতে পারলে প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া শুধু নয়, বিখ্যাত হয়ে যাব আমি। পত্রিকার পাতায় আর ম্যাগাজিনের কভারে আমার ছবি ছাপা হবে। আমার ভোলা উলফদের মায়ানেকড়ে হওয়া ছবিগুলো ফ্যান্সি ফটো গ্যালারিতে শোভা পাবে।

কল্পনা করলাম, আমাকে নিয়ে কতটা গর্ব বোধ করছেন বাবা-মা, সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি।

 আঙ্কেল-আন্টির কথা মনে পড়তেই আতঙ্কিত হলাম। এখন নিশ্চয় বনের মধ্যে রয়েছেন ওঁরা, নিশাচর জীবের ছবি তোলায় ব্যস্ত।

দুটো মায়ানেকড়ে যে বনে ঢুকেছে এটা নিশ্চয় জানেন না তাঁরা। জানেন না, পিশাচ দুটো শিকারের সন্ধানে বনে গেছে।

ওঁরা ওখানে নিরাপদ নন, বুঝতে পারলাম।

মায়ানেকড়ের পিছু নিয়ে বনে ঢোকাটা নিরাপদ তো নয়ই, স্রেফ পাগলামি, বুঝতে পারছি। কিন্তু ওদের পিছু নেয়াটা এখন আমার জন্য জরুরি। ছবি তোলার ব্যাপারটা তো আছেই, আঙ্কেল-আন্টিকেও সাবধান করে দিতে হবে।

ক্যামেরাটা কেসে ভরে কাঁধে ঝোলালাম। তারপর পিছনের আঙিনা ধরে এগিয়ে চললাম বনের দিকে, মায়ানেকড়ের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। শিশিরে ভেজা মাটিতে ছাপগুলো খুব স্পষ্ট।

বনে ঢুকলাম। সেই পথটায় এসে পড়লাম, যেটা দিয়ে প্রথম দিন ঢুকেছিলাম। আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চললাম। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে আসছে চাঁদের আলো, মাটিতে বিচিত্র আলো-আঁধারি সৃষ্টি করেছে। কেমন ভুতুড়ে করে তুলেছে পরিবেশটা। ই মায়ানেকডে দুটোকে ধরতে বেশিক্ষণ লাগল না আমার। পুরানো। সেই বুড়ো-মানুষ গাছটার কাছে এসে ওদের ঘোঁতঘোঁত শুনতে পেলাম। তারপর হামলা চালানোর প্রাণ কাঁপানো গর্জন।

থমকে দাঁড়ালাম। উঁকি দিলাম ঝোপের আড়াল থেকে। মায়ানেকড়ে দুটোকে দেখলাম। মুখ হাঁ করে, থাবা বাড়িয়ে ঝাঁপ দিল ও দুটো।

কোনও প্রাণীকে আক্রমণ করেছে ওরা! কার ওপর হামলা চালাল? কোনও জানোয়ার? নাকি মানুষ! আমার আঙ্কেল-আন্টিকে আক্রমণ করেছে?

.

শিকার নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে ওরা।

যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর চিত হয়ে থাকা একটা প্রাণীর চারটে খুর ওপর দিকে উঠে যেতে দেখলাম।

না, মানুষকে আক্রমণ করেনি। একটা হরিণ ধরেছে। হরিণের বাচ্চা।

খুন করে ফেলবে ওটাকে।

ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে।

কী করব? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। কীভাবে বাঁচাব ওটাকে?

ভাবতে পারছি না। কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। তবুও বিনা চেষ্টায় ছেড়ে দিতে রাজি নই। মাথাটা পিছনে হেলিয়ে নেকড়ের মত চিৎকার করে উঠলাম।

গাছে গাছে প্রতিধ্বনি তুলল আমার চিৎকার।

থমকে গেল মায়ানেকড়ে দুটো। মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল।

খুব সামান্যই সুযোগ পেল বাচ্চাটা। তবে সেটার সদ্ব্যবহার করতে দেরি করল না। মায়ানেকড়ের থাবার নীচ থেকে বেরিয়ে ছুটে পালাল। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে।

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল মায়ানেকড়ে দুটো। বাতাস শুঁকতে লাগল। চাঁদের আলোয় ওদের লাল চোখ ঝকঝক করে জ্বলছে। চাপাস্বরে গর্জন শুরু করল।

মাথা নিচু করে ছুটে আসছে আক্রমণের ভঙ্গিতে। নিশ্চয় আমিই এখন ওদের লক্ষ্য।

তেইশ

নড়তেও ভয় পাচ্ছি।

তবু টলতে টলতে পিছিয়ে গেলাম দুই কদম। দৌড়ানোর সময় নেই। মনে হলো মায়ানেকড়ের পায়ের দাপটে মাটি কাঁপছে। চিৎকার করতে মুখ খুললাম। স্বর বেরোল না।

পিশাচ দুটোর দাঁতে দাঁত ঘষার কুৎসিত শব্দ হচ্ছে। চোখ যেন জ্বলন্ত কয়লার টুকরো।

আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে সামনের দিকে হাত দুটো বাড়িয়ে ধরলাম।

 কিন্তু আমাকে আক্রমণ করল না নেকড়ে দুটো।

আমার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ডানে মোড় নিল তীব্র গতিতে। পাশাপাশি দৌড়াচ্ছে দুটোতে। ভয়ঙ্কর গর্জন করছে।

বাদামী রঙের একটা বড় খরগোশ এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার ওপর।

ওটার দিকেই লক্ষ্য ওগুলোর। সহজেই ধরে ফেলল খরগোশটাকে। কিছুই করতে পারল না ছোট্ট জানোয়ারটা।

একটা নেকড়ে এক কামড়ে ওটার ঘাড় ভেঙে দিল। অন্য নেকড়েটা পেটে কামড় বসাল।

দ্রুত হাতে কেস থেকে বের করে আনলাম ক্যামেরাটা।

ভিউ ফাইণ্ডার চোখের সামনে তুলে আনার সময় লক্ষ করলাম প্রচণ্ড হাত কাঁপছে। দুই হাতে ধরে স্থির করলাম ক্যামেরাটা।

শাটার টিপে দিলাম।

খরগোশটাকে টেনে ছেঁড়ার সময় ছবি তুললাম একটা। আরেকটা তুললাম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খাওয়ার সময়।

 খরগোশটার কিছুই অবশিষ্ট রাখল না ওরা। খাওয়া শেষ হলে ঠোঁট চাটল, তারপর দুলকি চালে অদৃশ্য হয়ে গেল গাছপালার ভিতর।

 দুই হাতে ক্যামেরাটা উঁচু করে ধরে ওগুলোর পিছু নিলাম।

মনে হচ্ছে ঘোরের মধ্যে রয়েছি আমি। ভাবনাগুলো পরিষ্কার হচ্ছে।

 আরেকটু হলেই গেছিলাম আজ। খরগোশটা না এলে এতক্ষণে আমি মায়ানেকড়ের খাবার হয়ে যেতাম।

 ছবি ভোলা হয়ে গেছে। কিন্তু বন থেকে এখনই বেরোতে পারব না।

আমার আঙ্কেল-আন্টিকে সাবধান করে দিতে হবে। ওঁদের খুঁজে বের করে বলতে হবে, উলফদের ব্যাপারে ভুল করেছেন। কী ভয়ানক বিপদের মধ্যে রয়েছেন, জানাতে হবে ওদের।

আতঙ্কে ধড়াস ধড়াস করছে আমার হৃৎপিণ্ডটা। থরথর করে হাত পা কাঁপছে। দুর্বল লাগছে। আমি যেন আমি নই। মনে হচ্ছে আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে তাকিয়ে আছি নিজের দেহটার দিকে।

পিশাচগুলোর কাছ থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে অনুসরণ করে চললাম। ফিরে তাকালে চট করে গাছ কিংবা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ব। ক্যামেরাটা উঁচু করে রেখেছি, ছবি তোলার জন্য।

লেকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওগুলো। পানির কিনারে গিয়ে দাঁড়াল। লম্বা জিভ বের করে কুকুরের মত পানি খেতে লাগল।

দেখে এখন বোঝার উপায় নেই ওরা মানুষ। পুরোপুরি নেকড়েতে রূপান্তরিত হয়েছে। জ্বলন্ত চোখগুলো শিকারি জানোয়ারের চোখের মত জ্বলছে।

অনেকক্ষণ ধরে পানি খেয়ে পেট ভরল ওরা। আরও কয়েকটা ছবি তুললাম।

নিনা আমার সঙ্গে না এসে ভুল করেছে। স্বচক্ষে দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। আর

হঠাৎ ঝটকা দিয়ে পানি থেকে মাথা তুলল পিশাচ দুটো। ঘুরে দাঁড়াল। নাক উঁচু করে বাতাস শুঁকতে লাগল।

আমার গন্ধ পেল নাকি ওরা?

মোটা একটা গাছের আড়ালে সরে গেলাম আমি। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সি কিছুক্ষণ পর সাবধানে আবার মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখি লেকের পাড় ধরে চলে যাচ্ছে ওরা। কিছুটা সময় দিয়ে, গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে দূরত্ব রেখে আবার পিছু নিলাম ওগুলোর।

.

সারাটা রাত মায়ানেকড়ে দুটোকে অনুসরণ করলাম আমি। এক রোল। ফিল্ম শেষ করে আরেকটা ঢোকালাম। পিছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে চাঁদের দিকে মুখ তুলে যখন চিৎকার করছিল ওরা, সেই দৃশ্যের ছবি তুলেছি। ছবি তুলেছি আরও কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্যের। এ ছবি তোলার পাশাপাশি জঙ্গলে খুঁজে বেড়িয়েছি আমার আঙ্কেল আন্টিকে। মরিয়া হয়ে উঠেছি ওদের সাবধান করার জন্য, কী দেখেছি বলার জন্য।

 ভীত, উত্তেজিত অবস্থায় পিশাচগুলোর পিছনে চলতে চলতে সময়ের হিসেব রাখিনি। মনে হচ্ছিল অদ্ভুত এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সমস্ত ঘটনা অবাস্তব।

অবশেষে সূর্যের এক চিলতে লাল আলো এসে পড়ল মাটিতে। কখন যে ভোর হয়েছে খেয়ালই করিনি।

ধীরে হাঁটছে এখন মায়ানেকড়ে দুটো। তাড়াহুড়া নেই। খেয়ে খেয়ে পেট ভরিয়েছে। ভারি করে ফেলেছে শরীর।

 বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে ওদের বাড়ির পিছনের আঙিনায় চলে গেল। হেঁটে গেল বেডরুমের জানালার নীচে।

গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখছি। কাছে যেতে ভয় পাচ্ছি। ক্রমেই ওপরে উঠছে সূর্যটা, আলো বাড়ছে। এখন যদি ঘুরে দাঁড়ায় নেকড়ে দুটো, আমাকে দেখে ফেলবে।

ক্যামেরা উঁচু করলাম। আর মাত্র কয়েকটা শট বাকি।

সামনের দুই পা উঁচু করে দেয়ালে রেখে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল ওরা।

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি। চামড়ার আলখেল্লা খুলছে ওরা।

রোমশ চামড়া যেন সাপের খোলসের মত খুলে যাচ্ছে গা থেকে। এই অবস্থায় একটা ছবি তুললাম।

থাবা থেকে চামড়া সরে যেতেই অদৃশ্য হয়ে গেল নখ। ছবি তুললাম এটারও। চামড়া উল্টে সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ল মানুষের হাত-পা। তারপর শরীর থেকেও চামড়া সরে গেল।

আমার দিকে পিছন ফিরে আছে ওরা। চামড়ার আলখেল্লা খুলে ফেলল। উলফদের চেহারা কেমন দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি। গা থেকে আলখেল্লা খুলে মাটিতে রাখল ওরা। তারপর ঘুরে দাঁড়াল।

ওদের মুখ দেখে চমকে উঠলাম। তবে ক্যামেরার শাটার টিপতে ভুললাম না।

চব্বিশ

সকালের রোদ পড়েছে ওঁদের মুখে।

অনেক কষ্টে চিৎকার ঠেকালাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে আছি।

উলফরা নয়, আমার আঙ্কেল-আন্টিই মায়ানেকড়ে!

আড়মোড়া ভাঙলেন সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি। আঙুল চালিয়ে চুল ঠিক করলেন। হাত দিয়ে টেনেটুনে গায়ের কাপড় ঠিক করলেন। নিচু হয়ে তুলে নিলেন নেকড়ের চামড়া দুটো।

বনের দিকে তাকালেন আঙ্কেল। ঝট করে সরে গেলাম একটা গাছের আড়ালে।

আমাকে কি দেখে ফেললেন?

থরথর করে কাঁপছি। চেঁচিয়ে উঠতে চাইলাম : না না, আমি বিশ্বাস করি না! এ হতে পারে না!

গাছের গায়ে নিজেকে ঠেসে রেখে নিজের মুখ চেপে ধরে রাখলাম। কোনমতেই বেরোতে দিলাম না চিৎকারটা।

ভাবতে হবে আমাকে। এখন কী করব?

ওদের সঙ্গে আর আমার থাকা চলবে না, বুঝে গেছি। দুটো মায়ানেকড়ের সঙ্গে এক বাড়িতে বাস করা অসম্ভব।

 কিন্তু কোথায় যাব? কে আমাকে সাহায্য করবে? আমার কথা কে বিশ্বাস করবে?

নেকড়ের চামড়া দুটো ভাঁজ করছেন আঙ্কেল-আন্টি। তারপর জুলি আন্টিকে বেডরুমের জানালায় উঠতে সাহায্য করলেন সিডার আঙ্কেল। আন্টি ভিতরে যেতেই তিনিও লাফিয়ে উঠে ভিতরে ঢুকে গেলেন।

 উলফদের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা হলো। ওঁরা কোথায়? আঙ্কেল-আন্টি যে ওদের বাড়িতে ঢুকছেন, কিছু বলছেন না কেন? কেন বাধা দিচ্ছেন না? নাকি ওদের খুন করে ফেলেছেন আমার আঙ্কেল-আন্টি।

ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার কথাটা মাথায় ঢুকতে শিউরে উঠলাম।

কয়েক মিনিট পর সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি বেরিয়ে এলেন জানালা দিয়ে। তাড়াহুড়া করে ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

গাছে ঠেস দিয়ে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। উলফদের বাড়ির দিকে চোখ। মনে ভাবনার ঝড়।

 দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে। রাস্তায় বেরিয়ে ছুটে সরে যেতে চাইছি আঙ্কেলের বাড়ি থেকে দুরে, বহুদুরে।

 কিন্তু প্রচণ্ড কৌতূহল আমাকে ছুটতে দিল না। উলফদের কী হয়েছে দেখতেই হবে। সত্যিটা না জেনে কিছুতেই যেতে পারব না। আমি এখান থেকে। তা ছাড়া নিনা রয়েছে। ওকেও নিয়ে যেতে হবে। এই বিপদের মধ্যে ওকে রেখে যাওয়া চলবে না।

আরও কিছুক্ষণ বাড়ি দুটোর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করলাম। কারও ছায়াও দেখলাম না, কোথাও কোন নড়াচড়া নেই। নিজের

গাছের কাছ থেকে সরে এলাম। একছুটে ঢুকে পড়লাম উলফদের বাড়ির পিছনের ঘাসে ঢাকা আঙিনায়। ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে আমার আঙ্কেল-আন্টির বাড়িটার দিকে তাকালাম। ওঁদের বেডরুমের জানালা বন্ধ। খড়খড়ি নামানো।

আবার সোজা হয়ে, দম আটকে দৌড় দিলাম। চলে এলাম উলফদের বেডরুমের জানালার নীচে। জানালার চৌকাঠ ধরে ভিতরে উঁকি দিলাম। অন্ধকার। কিছুই চোখে পড়ছে না।

বিড়বিড় করে নিজেকে বললাম, ঢুকে পড়ো! দেরি করে লাভ নেই! না জানালার চৌকাঠ ধরে নিজেকে টেনে তুললাম ওপরে। চৌকাঠে বসে পা ঘুরিয়ে দিয়ে লাফিয়ে পড়লাম ঘরের ভিতরে। আবছা অন্ধকার চোখে সয়ে আসতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল। চায়

 কিছুই নেই ঘরে। এক র একটা আসবাব নেই। দেয়ালে নেই ছবি কিংবা আয়না। কাঠের মেঝেতে কার্পেট নেই। পুরু হয়ে জমে আছে ধুলো।

শোবার ঘরের সামনের দরজার দিকে তাকাতে চোখে পড়ল নেকড়ের চামড়া দুটো। সুন্দর করে ভাঁজ করে দরজার পাশে রেখে দেয়া হয়েছে।

ভারি দম নিয়ে সাবধানে এগোলাম খোলা দরজাটার দিকে। ওপাশের হলওয়েতে উঁকি দিলাম। শোবার ঘরের মতই এটাও আসবাবশূন্য।

কেউ আছেন? ডাক দিলাম। এই, কেউ আছেন?

জবাব নেই।

 পা টিপে টিপে এগিয়ে চললাম হলওয়ে ধরে বাড়ির সামনের দিকে। যে কটা দরজা পড়ল, সবগুলোর ভিতরে উঁকি দিলাম।

প্রতিটি ঘরই খালি। মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ।

লিভিং রুমের মাঝখানে এসে দাঁড়ালাম। কোনও আসবাব নেই। বাতি নেই।

কেউ থাকে না এখানে! জোরে জোরে বলে ফেললাম। আমার কথা প্রতিধ্বনিত হলো চারপাশের দেয়ালে।

উলফরা কোথায়?

ওদের খুন করে খেয়ে ফেলেছেন আমার আঙ্কেল-আন্টি-ভয়ঙ্কর এই ভাবনাটা আরও বদ্ধমূল হতে থাকল মনে। খরগোশ মেরে ছিন্নভিন্ন করে ওটাকে গোগ্রাসে গেলার দৃশ্যটা কল্পনা করলাম। ক্যামেরায় তোলা আছে সেই ছবি। হরিণ ছানাটাকে আক্রমণের কথাটাও ভাবলাম।

নিনাকে সাবধান করে দিতে হবে। কেউ নিরাপদ নয় এখানে।

নিনা আর ওর বাবা-মাকে সাবধান করে দিতে হবে। তারপর পালাতে হবে এই এলাকা থেকে, যতদূরে পারি।

ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত ফিরে চললাম। শোবার ঘরে এসে জানালার

চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে লাফিয়ে নামলাম।

 গাছের মাথায় এখনও মস্ত একটা লাল বল হয়ে আছে সূর্যটা। ঘাসের ডগায় ঝিলমিল করছে ভোরের শিশির।

নিনা নিশ্চয় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে এতক্ষণে, ভাবলাম। আর যদি না জেগে থাকে তো আমাকেই ওর ঘুম ভাঙাতে হবে।

উলফদের জানালার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়ালাম। ছুটতে শুরু করলাম নিনাদের বাড়ির দিকে।

বড়জোর ছয়-সাত কদম এগিয়েছি। থমকে দাঁড়ালাম জুলি আন্টির।

চিৎকারে, রবিন, কোথায় যাচ্ছ তুমি!

পঁচিশ

চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। হাঁটু ভাঁজ হয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম প্রায়। টলে উঠে কোনমতে সামলে নিলাম।

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন জুলি আন্টি। জিজ্ঞেস করলেন, রবিন, এত সকালে উঠলে যে? আজ তো শনিবার। চোখের পাতা সরু করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি।

আমি…ইয়ে… এমন কাঁপুনি উঠে গেছে শরীরে, কথা বেরোচ্ছে মুখ দিয়ে।

এত তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছ? আণ্টি জিজ্ঞেস করলেন। তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সিডার আঙ্কেলকে।

ওই তো…নিনাদের বাড়িতে… কোনমতে জবাব দিলাম। ওর সঙ্গে কথা আছে…আজ রাতে কী পোশাক পরব, সেটা নিয়ে আলোচনা করব।

আণ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কথা কি বিশ্বাস করেছেন? তাই তাকে

মনে হয় না।

এত ভোরে নিনাদের বাড়ি যাচ্ছ? শপাং করে উঠল তার কণ্ঠ। হাত নেড়ে ডাকলেন, এসো। আগে নাস্তা খেয়ে যাও।

দ্বিধা করছি। ভাবনাগুলো বনবন করে ঘুরছে যেন মাথার ভিতর।

দৌড় দেব নাকি? দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে ছুটতে থাকব?

কিন্তু কতদূর যেতে পারব? ওঁরা আমাকে ধরে ফেলবেন।

আমার আঙ্কেল-আন্টি, দুজনেই মায়ানেকড়ে। ধরতে পারলে কী করবেন? আমাকে দিয়ে নাস্তা করে ফেলবেন?

না। দৌড়ানোটা ঠিক হবে না। এখনও সময় হয়নি। পালানোর আগে নিনাকে সাবধান করে দিতে হবে। ওকেও সঙ্গে নিতে হবে।

গুটি গুটি পায়ে এগোলাম। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আন্টি। ঘরে ঢুকতেই মৃদুকণ্ঠে আমাকে গুড মর্নিং জানালেন সিডার আঙ্কেল। বললেন, বেশি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়েছ।

মাথা ঝাঁকিয়ে নাস্তা খেতে টেবিলে বসলাম।

সারারাত কাজ করেছি আমি আর কেরি, বড় করে হাই তুললেন সিডার আঙ্কেল। চমঙ্কার কিছু ছবি তুলেছি।

মিথ্যে কথা! চিৎকার করে বলতে চাইলাম। আমি আপনাদের অনুসরণ করেছি। আপনারা কী করেছেন দেখেছি। আপনারা কী জিনিস, জানি আমি। আমার সামনে উলফদের কাছে আন্টির ফোন করাটা পুরোই ফাঁকিবাজি। আমাকে দেখানোর জন্যে। উলফরা আমার নামে পুলিশের কাছে নালিশ করেছে, এটাও আপনাদের বানানো কথা!

কিন্তু কিছু বললাম না। তাকিয়ে আছি কর্নফ্লেকের বাটির দিকে।

দুটো মায়ানেকড়ের সঙ্গে নাস্তা, খেতে বসেছি–ভাবনাটা পেটের ভিতর মোচড় দিতে থাকল আমার। সারাটা রাত বনের ভিতর ঘুরে বেড়িয়েছেন আমার আঙ্কেল-আন্টি, অসহায় জানোয়ারগুলোকে ধরে ধরে নিষ্ঠুরভাবে খুন করেছেন।

একটা মুহূর্তও আর বসে থাকতে পারব না, ভাবলাম। উঠে। দাঁড়াতে গেলাম।

আমার কাঁধে হাত রাখলেন সিডার আঙ্কেল। শান্ত হও, রবিন। বসো। নাস্তা খাও, মোলায়েম স্বরে বললেন তিনি।

 কিন্তু, আমি… কী বলব বুঝতে পারছি না। এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি, খেতে ইচ্ছে করছে না। আমার কাঁধ থেকে তার হাতটা সরিয়ে দিতে পারলে ভাল হত। আমার গা কাঁপছে।

খাও। না খেলে শরীর ঠিক থাকবে না, আঙ্কেল বললেন। হ্যালোউইন উৎসব দেখতে বেরোবে না? অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতে হবে।

নাস্তা খাও, নাস্তা খাও, জুলি আন্টি বললেন। কাজে লাগবে।

আমার কর্নফ্লেক খাওয়া দেখতে লাগলেন ওঁরা। শীতল দৃষ্টিতে দেখছেন আমাকে। জোর করে গলা দিয়ে নামাচ্ছি।

ওঁদেরকে অনুসরণ করেছিলাম, ওদের গোপন কথা জেনে গেছি, নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন।

তাই আমাকে যেতে দিতে চান না।

 আমাকে নিনাদের ওখানে যেতে হবে, শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম আমার কণ্ঠস্বর। চেয়ার পিছনে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেলাম।

কিন্তু আবার আমার কাঁধ চেপে ধরলেন সিডার আঙ্কেল। আঙুলগুলো চেপে বসল কাঁধে।

এসো আমার সঙ্গে, আদেশের সুরে বললেন তিনি।

ছাব্বিশ

আমার কাঁধে শক্ত হয়ে চেপে থাকল আঙ্কেলের হাত। আমাকে ঠেলে নিয়ে চললেন গ্যারেজের দিকে। দ্রুত হাঁটছেন। একটা কথাও বলছেন না।

একবার ভাবলাম, ঝাড়া দিয়ে কাঁধ থেকে তাঁর হাত ছুটিয়ে দৌড় দিই।

কিন্তু কতদূর যেতে পারব?

আমার কাঁধ ছেড়ে দিলেন তিনি। কী করবেন আমাকে?

আপনাদের পিছু নেয়াটা ঠিক হয়নি আমার, ফিসফিস করে বললাম, গলা দিয়ে কথা বেরোতে চাইছে না। আমি…আমি কাউকে বলব না, যা দেখেছি।

আমার কথা যেন কানেই ঢুকল না তাঁর। গ্যারেজের কোনায় এসে লম্বা হাতলওয়ালা একটা জিনিস তুলে নিলেন।

আমার দিকে ওটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। প্রচুর কাজ। একা পারব না।

কাজ? ঢোক গিলোম।

মাথা ঝাঁকালেন সিডার আঙ্কেল। এটা দিয়ে ঘাস কাটা হয়। এ জিনিস আর দেখেছ কখনও?

না। যন্ত্রের হাতল ধরা হাতটা কেঁপে উঠল আমার। ব্যবহার করা খুব সহজ, তিনি বললেন। গ্যারেজের পিছনের এই ঘাসগুলো কেটে সাফ করতে হবে তোমাকে।

ঠিক আছে, করব, আবার যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছি আমি।

আর খেয়াল রেখো, উলফদের উঠানে যেন কাটা ঘাস না পড়ে, সাবধান করে দিলেন তিনি। আমি শিওর, তোমার ওপর নজর রাখবেন তাঁরা। কিছু করতে দেখলেই আমাদের কাছে নালিশ করবেন।

ঠিক আছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, কেন শুধু শুধু মিথ্যে বলছেন! উলফ বলে তো কেউ আর এখন নেই! নিশ্চয় আপনারাই খুন করে খেয়ে ফেলেছেন!

আমিও তোমার সঙ্গে কাজ করব, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন তিনি। দুজনে মিলে এই আগাছাগুলোকে এমন একটা শিক্ষা দেব যাতে কোনদিন আর বাড়ার সাহস না দেখায়। আজকে এই প্রথম হাসতে দেখলাম ওঁকে।

 তাঁর সহজ আণ অবাক করল আমাকে। দ্বিধায় ফেলে দিল। কিন্তু নিজের চোখে নেকড়ের খোলস বদলে মানুষে রূপান্তরিত হতে দেখেছি। এটা কি চোখের ভুল ছিল?

.

সারাদিন আঙ্কেলের সঙ্গে আঙিনায় কাজ করলাম আমি। যখনই আমি একটুক্ষণের জন্য থেমে বিশ্রাম নিতে যাই, শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।

প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। যন্ত্র ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালাতে চাইছি।

কিন্তু নিনাদেরকে সাবধান না করে যেতেও পারছি না। কী রকম বিপদের মধ্যে রয়েছেন, সেটা ওঁদেরকে জানানো দরকার। নিনাকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।

 ডিনারের আগে নিনার সঙ্গে দেখা হলো না। আমাদের খাওয়া প্রায় শেষ, এই সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল ও।

কেমন? কী রকম লাগছে আমাকে? বাতিল পুতুলের পোশাক পরা নিনা নাচার ভঙ্গিতে চক্কর দিয়ে ঘুরে দেখাল।

খুব সুন্দর। জুলি আন্টি বললেন।

আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল নিনা। রবিন, এখনও তো রেডি হওনি। উৎসব দেখতে যাবে না?

হ্যাঁ, যাব, আমি বললাম। একটু দাঁড়াও, কাপড় বদলে আসি। বেশিক্ষণ লাগবে না। তুমি বরং এসো, আমাকে সাহায্য করবে।

প্রায় টানতে টানতেই নিনাকে আমার ঘরের দিকে নিয়ে চললাম।

বাইরে চমৎকার জ্যোত্স, এত সুন্দর চাঁদ উঠেছে, নিনা বলল। দারুণ জমবে আজ হ্যালোউইন উৎসব।

ঘরে টেনে ঢোকালাম ওকে। দরজা লাগিয়ে দিলাম। শোনো, একটা ভয়ানক খবর আছে।

কপালের ওপর এসে পড়া টুপিটা ওপরে ঠেলে দিল ও। ভয়ানক খবর?

হ্যাঁ। সিডার আঙ্কেল আর জুলি আন্টি দুজনেই মায়ানেকড়ে।

কী বললে! চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসার জোগাড় হলো নিনার।

সব কথা খুলে বললাম ওকে। গত রাতে যা যা দেখেছি, সব। ফিসফিস করে কথা বলছি। জানালাম, ওঁদের নেকড়ের চামড়া উলফদের বাড়িতে লুকিয়ে রাখেন।

কিন্তু উলফরা… বলতে গেল নিনা।

উলফরা নেই, আস্তে কথা বলার কথা ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। বাড়িটা শূন্য। ওখানে নিয়ে গিয়ে চামড়া লুকান আঙ্কেল ও আন্টি। ওঁদের মেরে খেয়ে ফেলেছেন কিনা কে জানে!

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল নিনা। এখন…এখন কী করব আমরা? সিডার আঙ্কেল ও জুলি আন্টি দুজনেই এত ভাল মানুষ…

 যখন মানুষ থাকেন তখন ভাল, বাধা দিয়ে বললাম। মায়ানেকড়ে হয়ে গেলে পিশাচ হয়ে যান! তোমার আব্বা-আম্মাকে জানানো দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে আমাদের। সাহায্য আনতে হবে। পুলিশকে জানাতে হবে।

 কিন্তু…কিন্তু… কথা বলতে পারছে না নিনা। চোখে-মুখে। আতঙ্ক।

 হঠাৎ করেই বুদ্ধিটা মাথায় এল আমার। বললাম, নিনা, মায়ানেকড়েরা খোলস বদল করে। মিস্টার রোভার বলেছিলেন, যদি সেই চামড়া পুড়িয়ে ফেলে, আর তখন মায়ানেকড়ে হতে পারে না, ভয়ঙ্কর এক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়।

মাথা ঝাঁকাল নিনা। হ্যাঁ। তা বলেছেন। কিন্তু…

আর কোন কিন্তু নেই, উত্তেজিত কণ্ঠে বললাম।

ওই চামড়া পুড়িয়ে ফেলব আমরা, যেভাবেই হোক।

সাতাশ

লিভিং রুমে রয়েছেন আঙ্কেল-আন্টি। ওঁদের নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছি। আমার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। মস্ত একটা গোল সাদা চাঁদ উঁকি দিয়েছে গাছপালার আড়ালে। তার ওপরে কয়েক গাছি কালো মেঘ যেন সাপের মত শরীর মোচড়াচ্ছে।

টেনে আমাকে জানালার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে এল নিনা। ফিসফিস করে বলল, চামড়াগুলো লুকিয়ে ফেলতে পারি আমরা!

লুকিয়ে ফেলব? আমিও ফিসফিস করেই জবাব দিলাম। কী হবে তাতে?

স তা হলে আর ওগুলো খুঁজে পাবেন না তোমার আঙ্কেল-আন্টি, নিনা জবাব দিল। ভালয় ভালয় রাতটা পার করে দিতে পারলেই হয়। নেকড়েতে রূপান্তরিত হতে পারবেন না আর তাঁরা।

ঠিক বলেছ! একটা রাত নেকড়ে না হয়ে পার করে দিতে পারলে হয়তো ভাল হয়ে যাবেন তারা, আর মায়ানেকড়ে হবেন না।

মাথা ঝাঁকাল নিনা। চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কাজ হতেও পারে… হঠাৎ থেমে গেল ও। না, না, দাঁড়াও! আরও ভাল বুদ্ধি এসেছে মাথায়! আমরা নিজেরাই চামড়াগুলো পরে ফেলতে পারি!

কী বললে? নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেল আমার। পরে ফেলব? কেন?

কারণ চামড়া লুকিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারব না। তোমার আঙ্কেল আন্টি কোথাও খুঁজতে বাকি রাখবেন না। বাড়ির ভিতরে, গ্যারেজে, উঠানের ঝোপঝাড়ে, সবখানে খুঁজবেন। কিন্তু আমাদের গায়ে খোঁজার কথা ভাববেন না। কল্পনাই করবেন না আমরা ওগুলো পরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

কিন্তু চামড়া পরে আমরাও যদি মায়ানেকড়ে হয়ে যাই?

হব না, মাথা নাড়ল নিনা। মিস্টার রোভার কি বলেছেন ভুলে গেছ? বলেছেন, চামড়া পরে পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে তিনবার নেকড়ের মত চিৎকার করতে হবে, তা হলেই মায়ানেকড়ে হওয়া যাবে। আমরা চিৎকার করব না।

হু! চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালাম। তবে আমাদেরকে দূরে সরে থাকতে হবে যাতে সূর্য ওঠার আগে কোনমতেই ওঁদের নজরে না পড়ি।

কাজ হবে কিনা, অর্থাৎ আঙ্কেল-আন্টিকে মুক্ত করতে পারব কি না, নিশ্চিত নই। কিন্তু আর কোন উপায়ও দেখছি না। দুজনেই প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি আমরা। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি।

সকাল পর্যন্ত চামড়া পরতে না পারলে হয়তো সুস্থ হয়ে যাবেন। আঙ্কেল-আন্টি, মায়ানেকড়ে হওয়ার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন।

চলো, আর দেরি করে লাভ নেই, আমি বললাম।

হ্যাঁ, চলো, নিনা বলল। তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে নাও। তুমি এসো, আমি ততক্ষণে উলফদের বাড়িতে গিয়ে একটা চামড়া পরে ফেলি। গ্যারেজের পিছনে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। তোমার চামড়াটা আমি নিয়ে আসব।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিনা। লিভিং রুমে ঢুকল। অঙ্কেল আন্টিকে গুডবাই বলল। আমি কাপড় পরে বাইরে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করব, জানাল।

সামনের দরজা লাগানোর শব্দ শুনলাম। তারমানে বেরিয়ে গেছে নিনা।

*

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাপড় পরে আমিও বেরিয়ে এলাম। আঙ্কেল আন্টির অলক্ষে বেরিয়ে এলাম বাড়িটা থেকে।

কথামত উলফদের গ্যারেজের পিছনে আমার জন্য অপেক্ষা করছে নিনা। পরনে একটা নেকড়ের চামড়া। আরেকটা চামড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ওর দিকে তাকিয়ে দম আটকে ফেললাম ক্ষণিকের জন্য। নেকড়ের রোমশ নাকের দুই পাশের ফুটো দিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর চোখ দুটো।

জিজ্ঞেস করলাম, চামড়া পরে কেমন লাগছে?

চুলকাচ্ছে, ঘোঁতঘোঁত করল নিনা। আর ভীষণ গরম। আরেকটা চামড়া আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পরে ফেললো। জলদি করো। চাঁদটা দেখো, ওপরে উঠে যাচ্ছে। শীঘি এগুলো খুঁজতে আসবেন আঙ্কেল-আন্টি।

চামড়াটা নিলাম ওর কাছ থেকে। নরম লোমে ডেবে গেল আমার হাত। ভাঁজ খুলে উঁচু করে ধরলাম। ফিসফিস করে বললাম, এই পোশাকে আমাদের দেখলে সবাই ভাববে হ্যালোউইনের সাজ সেজেছি। কেউ কিছু সন্দেহ করতে পারবে না।

নেকড়ের মাথায় মাথা ঢুকিয়ে দিলাম। কাপড়ের ওপর আমার গায়ে আলখেল্লার মত ঝুলে রইল চামড়াটা। দুই থাবার ভিতর হাত ঢোকালাম। দুই পায়ের ভিতর পা। মুখের কাছে চমৎকার ফিট করে গেল নেকড়ের লম্বা নাকওয়ালা মুখটা।

 ইস, ঠিকই বলেছ তুমি, ভীষণ চুলকায়! গুঙিয়ে উঠলাম। এত গরম। এই জিনিস পরে হাঁটতে পারব বলে তো মনে হচ্ছে না।

 হাত-পা টানটান করো, ঢিল হয়ে আসবে, ফিসফিস করে বলল নিনা। চলো। এখান থেকে পালাই।

পিছনের উঠান ধরে আগে আগে এগিয়ে চলল ও। ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় উঠলাম আমরা।

পাশের ব্লকে ছেলেমেয়েদের হট্টগোল কানে এল। বনের ভিতরে ভিতরে বাড়িঘর এখানে। যার যার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরছে আর উপহার জোগাড় করছে।

অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে থাকাটাই নিরাপদ, আমি বললাম। আলাদা থাকার চেয়ে ওদের সঙ্গে থাকলে…

ঠিকই বলেছ, নিনাও একমত হলো। রাস্তা পেরিয়ে এলাম দুজনে। এ নেকড়ের চামড়া পরে অসহ্য গরম লাগছে। মাথা থেকে কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল আমার,

কয়েকটা ব্লক পার হয়ে এলাম। ছেলেমেয়েগুলো বয়েসে আমাদের চেয়ে ছোট। আমাদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে। হ্যালোউইনে মায়ানেকড়ে সেজেছি মনে করে আমাদের দেখে ভয় পাচ্ছে না ওরা।

রাস্তার মোড় ঘুরে আরও কয়েকটা ব্লক পেরিয়ে এলাম।

ওই দেখো, কারা! আমার বাহুতে কনুই দিয়ে গুঁতো দিল নিনা।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি একজন মহিলা আর একটা রোবট উপহারের ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলেছে একটা বাড়ির সামনের লন দিয়ে।

টনি ও রজার, নিনা বলল।

ওদের সঙ্গেই থাকি, চলো, আমি বললাম। ঘাস মাড়িয়ে ওদের দিকে দৌড়াতে শুরু করলাম। নেকড়ের থাবা নেড়ে ডাকলাম, এই শোনো! দাঁড়াও!

আমাদের দিকে ফিরে তাকাল দুজনে।

দাঁড়াও! রোমশ লম্বা নাকটা উঁচু করে ধরলাম।

চেঁচিয়ে উঠল দুজনে। হাত থেকে ব্যাগ ছেড়ে দিল। তারপর বাঁচাও! বাঁচাও! বলে ঘুরে দিল দৌড়।

আমাদের দেখে পিলে চমকে গেছে ওদের! হাসতে হাসতে বলল নিনা।

হ্যাঁ, জবাব দিলাম। মজাই পেলাম খানিকটা প্রতিশোধ নিতে পেরে। পাজি দুটো বহুত জ্বালান জ্বালিয়েছে আমাকে।

তবে বেশিক্ষণ হাসার সুযোগ পেলাম না।

আমাদের পিছনে পাকা রাস্তায় ভারি পায়ের শব্দ ছুটে আসতে শুনলাম।

ফিরে তাকিয়ে দেখি রাস্তা ধরে দৌড়ে আসছেন আঙ্কেল-আন্টি। ভয়ানক উত্তেজিত মনে হলো।

ওই যে! আমাদের দিকে হাত তুলে চিৎকার করে বললেন আঙ্কেল। ধরো ধরো ওদের! ধরো!

আটাশ

আঙ্কেল-আন্টিকে ওভাবে মরিয়া হয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে আসতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম।

 নোড়ো না! দাঁড়াও! চিৎকার করে বললেন জুলি আন্টি, তাঁর কণ্ঠে অনুরোধের সুর, ওই চামড়াগুলো আমাদের দরকার!

নড়তে চাইলাম। পারলাম না। আমার পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে গেছে। জোরে এক ধাক্কা দিয়ে আমাকে নড়িয়ে দিল নিনা। দৌড় দিলাম দুজনে।

 মরিয়া হয়ে দৌড়াচ্ছি। পাগলের মত। মানুষের বাড়ির লন মাড়িয়ে, উঠান ধরে। একটা বাড়ির পিছনের আঙিনা দিয়ে ছুটে এসে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে পড়লাম বড় একটা ঝোপের ভিতর।

আমাদের পিছনে লেগে রয়েছেন আঙ্কেল-আন্টি। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছেন। চিৎকার করে বলছেন, দিয়ে দাও! আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও।

ওদের রুদ্ধশ্বাস চিৎকার কানে বাজছে আমাদের। কথাগুলো কেমন ভূতুড়ে শোনাচ্ছে, প্রতিধ্বনি তুলছে : আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও! আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও!

ঝোপ থেকে বেরিয়ে আবার ছুটলাম। অন্ধকার ছায়ার মত বাড়িগুলোর পাশ কাটাচ্ছি দ্রুত। ভারি নেকড়ের চামড়া পরা অবস্থায় ছুটতে কষ্টটা বেশি হচ্ছে। ঘেমে গোসল করে ফেলছি। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে হৃৎপিণ্ডটা। মনে হচ্ছে আছাড় খেয়ে পড়ে যাব।

 আরেকটা মোড় ঘুরলাম। আরেকটা বাড়ির পিছনের আঙিনা পেরোলাম। আমাদের সামনে দেখলাম বড় বড় গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

বনের কাছে পৌঁছে গেছি আমরা। একছুটে বনে ঢুকে পড়লাম দুজনে। লম্বা ঘাস মাড়িয়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে ছুটলাম। আঙ্কেল আণ্টি পিছু ছাড়েননি। আমাদের পিছনে লেগে রয়েছেন। একই কথা বলে চলেছেন বার বার : আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও! আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও!

সবুজ গাছপালায় ছাওয়া একটা নিচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে চললাম আমরা। আমার নেকড়ে-পায়ে বাড়ি লেগে গড়িয়ে পড়তে লাগল আলগা পাথর। ধুড়স করে আছাড় খেল নিনা। চার হাতপায়ে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করল।

 আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও!. আমাদের চামড়াগুলো দিয়ে দাও! আঙ্কেল-আন্টির তীক্ষ্ণ একঘেয়ে চিৎকার যেন মাথার ভিতরে ঝাঁকি দিতে শুরু করেছে আমার।

মাথা ঘুরছে আমার।

হাঁপাতে হাঁপাতে ওঁদের দিকে ফিরে তাকালাম আমি ও নিনা।

চাঁদটা… ফিসফিস করে আমাকে বলে চাঁদের দিকে হাত তুলল নিনা। পূর্ণ চাঁদ, রবিন। দেখো, একেবারে মাঝআকাশে।

নিনা যখন ফিসফিস করে কথা বলছে, আঙ্কেল-আন্টি তখন হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। মাথা পিছনে হেলিয়ে চাঁদের দিকে মুখ তুলে দিয়েছে। উজ্জ্বল জ্যোত্সায় ওদের মুখে আতঙ্ক দেখতে পাচ্ছি। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ভুগছেন যেন।

 হাঁ হয়ে গেল মুখ। তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। বিলাপের মত শোনাল সেই চিৎকার।

দুই হাতে মাথা খামচাতে শুরু করলেন ওঁরা। চুল ছিঁড়তে লাগলেন। ব্যথা সইতে না পেরে চোখ বুজে আর্তনাদ করতে থাকলেন। বুকের গভীর থেকে ভিতরের সবকিছু উলটপালট করে যেন বেরোচ্ছে সেই যন্ত্রণাকাতর চিৎকার।

নিনা, এ-কী করলাম আমরা! প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় হলো আমার।

ঊনত্রিশ

চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে চিৎকার করেই চলেছেন আঙ্কেল-আন্টি।

থেমে গেলেন একটা সময়।

হাত সরিয়ে আনলেন মাথা থেকে। চিৎকার বন্ধ করলেন। ভঙ্গি দেখে মনে হলো শান্তির পরশ ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীর জুড়ে।

 তাকিয়ে আছি ওঁদের দিকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন দুজনে। একে অন্যকে উঠতে সাহায্য করলেন। কাপড় ঝেড়ে দিলেন। চিরুনির মত আঙুল চালালেন চুলে।

অবশেষে যখন মুখ তুলে তাকালেন আমাদের দিকে, দেখলাম, গাল বেয়ে পানি পড়ছে দুজনেরই। কাঁদছেন।

থ্যাংক ইউ, আন্টি বললেন।

আমাদেরকে বাঁচানোর জন্যে ধন্যবাদ! ককিয়ে উঠলেন সিডার আঙ্কেল।

তারপর দৌড়ে এলেন দুজনেই। আমাদের জড়িয়ে ধরলেন।

ভয়ঙ্কর অভিশাপ থেকে মুক্তি দিলে আমাদের! জুলি আন্টি বললেন। গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে এখনও। মাঝ আকাশ পেরিয়ে গেছে চাঁদ। এখনও যেহেতু রূপান্তরিত হইনি, আর হব না-আমাদের অভিশাপ কাটল। এখন আর আমরা মায়ানেকড়ে নই!

কী বলে যে ধন্যবাদ দেব তোমাদের! সিডার আঙ্কেল বললেন। তোমাদের সাহস আর বুদ্ধিমত্তার জন্যেই বাঁচলাম আমরা।

 এত প্রশংসায় বিব্রত বোধ করছি। প্রসঙ্গ এড়াতে জিজ্ঞেস করলাম, আঙ্কেল, উলফদের কী হয়েছে, জানেন?

হাসলেন আঙ্কেল। তোমরা নিশ্চয় ভাবছ, ওদের খেয়ে ফেলেছি। না, খাইনি। রহস্যময়ভাবে একদিন উধাও হয়ে গেল ওরা। কয়েক দিন বাড়ি থেকে বেরোতে না দেখে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। দেখি, বাড়ি খালি। তখনই পেয়েছি নেকড়ের চামড়া দুটো। আমাদের অভিশপ্ত জীবনের শুরুও সেদিন থেকেই।

কোথায় গেছে ওরা?

জানি না। সেটা এখনও রহস্য।

তারমানে আরেকটা রহস্যের সমাধান করতে হবে এখন আমাদের, ভালই, ভাবলাম। বললাম, উহ্, ভয়ানক গরম! জঘন্য জিনিস, খোলা দরকার! গায়ের নেকড়ের চামড়ায় চাপড় দিলাম। ভীষণ চুলকাচ্ছে!

হ্যাঁ, খুলে ফেলো, আঙ্কেল বললেন। আর ওগুলো গায়ে রাখার দরকার নেই।

চল, বাড়ি যাই, জুলি আন্টি বললেন। সত্যিকারের একটা উৎসব করব আজ। আনন্দ করব। অনেক দিন পর মনটা আজ খুব হালকা লাগছে।

বাড়ি ফিরে চললাম। সারাটা পথই প্রায় হাসাহাসি করতে করতে এলাম।

রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম আমরা।

জুলি আন্টি বললেন, ঘরে বানানো ডোনাট, আর মগভর্তি গরম গরম চকলেট। কেমন মনে হচ্ছে?

দারুণ! দারুণ! একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি ও নিনা।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *