নুড়ি পাথরের দিনগুলি – ১০

১০

সবুজ ময়দানের পাশে একটা ধবধবে সাদা রঙের বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

বিকেলবেলা কলকাতা ময়দানের গা ঘেঁযে এরকম গাড়ি সব সময়েই দু’–একটা চোখে পড়ে। ময়দানের হাওয়া খেতে আসে। কেউ গাড়ি থেকে নেমে ঘাসে খানিকটা হেঁটে নেয়, কেউ গাড়িতে বসেই বাদাম চিবোয়। কখনও দু’জন নারীপুরুষ চুমু খায়। কিন্তু এই গাড়ি ‘হাওয়া খেতে’ আসেনি। দাঁড়িয়ে থাকলেও গাড়ির ইঞ্জিনটা চালু। কাচ তোলা। ভিতরে এসি চলছে নিঃশব্দে।

গাড়ির সামনের সিটে বসে দু’জন নিচু গলায় কথা বলছে। চালকের আসনে যে সুদর্শন মানুষটি বসে আছেন, তাঁর নাম কমলেশ রায়। তাঁর পাশে দু’দিনের না-কাটা কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে বসে আছে বিভূতি। বিভূতির দাড়ি না কাটাটা আসলে এক ধরনের ছদ্মবেশ। হেলাফেলা ধরনের ‘কমন ম্যান’ সেজে থাকা।

কমলেশ বললেন, “তোমার ইনফর্মেশনে কোথাও গোলমাল করছে না তো?”

বিভূতি বললেন, “আমি স্যর ডবল চেক করে কাজ করি। আপনার বেলায় তো আমি আরও অ্যালার্ট থাকি।”

কমলেশ বলল, “তুমি বাড়িটা দেখেছ?”

“বাড়ি না। ফ্ল্যাট।‌ উঠে দেখিনি। নীচ থেকে দেখেছি। আর স্যর, শুধু দেখিনি, ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব খোঁজও নিয়েছি।”

কমলেশ রায় আজ বিভূতিকে পিজি হাসপাতালের সামনে দাঁড়াতে বলেছিলেন। লাঞ্চের ঘণ্টাখানেক পর অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন। দীনেশের কাছ থেকে চাবি চাইলে সে একটু থতমত খেয়ে যায়। কমলেশ হেসে বলেন, “তোমার পাল্লায় পড়ে গাড়ি চালানো ভুলে না যাই। কত দিন যে স্টিয়ারিং-এ বসা হয় না! দাও চাবিটা দাও, নিজে ড্রাইভ করে একটা কাজ সেরে আসি।”

বিভূতিকে ফোনে বলা ছিল কোথায় দাঁড়াবে। সে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বিড়ি খাচ্ছিল। লোকটা এমন ভাবে ভিড়ে মিশে যেতে পারে যে চট করে আলাদা করা মুশকিল। কমলেশ রায় ভাবেন, মানুষ কী অদ্ভুত সব পেশা বেছে নিতে পারে। এই যে বিভূতি, ইচ্ছে করলেই তাঁর কাছ থেকে একটা চাকরিবাকরি চেয়ে নিতে পারত। নেয়নি। তাকে অফার করার পরও নেয়নি।

“স্যর, এই কাজ ছাড়তে পারব না।”

কমলেশ ভুরু কুঁচকে বলেছিলেন, “কেন পারবে না? গুপ্তচরবৃত্তিতে সম্মানও নেই, অর্থও নেই। কোনও কোনও সময়ে কাজ না থাকলে অবস্থা নিশ্চয়ই খুব খারাপ হয়। তার থেকে একটা কাজকর্ম করাই তো ভাল, সবাই যেমন করে।”

বিভূতি হেসে বলে, “সম্মান নেই কে বলল স্যর? যখন খবর এনে দিই পার্টি খুশি হয়, খাতির যত্ন করে। সম্মান স্যর এক-এক জনের কাছে এক-এক রকম। আপনি অফিসের চেয়ারে বসলে যে সম্মান পান, না বসলে কি আর পাবেন? সম্মান ব্যাপারটা অনেকটা বুদবুদের মতো স্যর। এই আছে, এই নেই। তার থেকে এটাই ভাল। নিজের মতো আছি। হ্যাঁ, টাকাপয়সার টানাটানি হয় ঠিকই, সে আর কী করা যাবে? তবে স্যর, কাজটাকে ভালবাসি। আমার বাবাও এই লাইনে ছিলেন। উনি ছিলেন দু’নম্বরি-স্পেশালিস্ট। ভেজাল, নকল, জালি জিনিসের খবর রাখতেন। যার যেমন দরকার, টাকা নিয়ে ইনফর্মেশন সাপ্লাই করতেন। বাবার সোর্স ছিল মারাত্মক। আমাকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছেন। স্যর, পেশা কি আর শুধু টাকা দিয়ে বিচার হয়? এই যে কলকাতা শহরের ফুটপাতে পুরনো বই বিক্রি হয়, কত টাকা লাভ থাকে? অথচ এই পেশাটা উঠে গেলে, শহরটাকে আর কলকাতা বলেই মনে হবে না।”

এর পর আর কথা বাড়াননি কমলেশ। বুঝেছিলেন, এই লোক কাজটাকে ভালবেসেই করে। কমলেশ রায় আজ বিভূতিকে অতি গোপনীয় কাজে ডেকেছেন। বিভূতি সেই ‘খবর’ জোগাড় করেছে। সে আজ ফোন করেছিল।

কমলেশ গলা নামিয়ে বললেন, “টেলিফোনে শুনব না। আমার সঙ্গে দেখা করো। আরও কথা আছে।”

বিভূতি বলল, “কোথায় যাব স্যর?”

কমলেশ‌ একটু ভেবে বললেন, “তুমি এখন কোথায় আছ?”

“পিজি হাসপাতালের কাছে। একটা কাজে আছি স্যর।”

কমলেশ বললেন, “ঠিক আছে, তুমি কাজ সারো, এক ঘণ্টা বাদে আসছি।”

কমলেশ চল্লিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। বিভূতিকে গাড়িতে তুলে রেসকোর্সের সামনে থেকে একটা চক্কর দিয়ে চলে এসেছেন ময়দানে। রাস্তার এক পাশে গাছের তলায় গাড়ি দাঁড় করিয়েছেন। আগে থেকে ভাবেননি এখানে আসবেন। যেতে যেতে মনে হল, এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললেও তো হয়। গাড়িতে বসেই বিভূতি ‘খবর’ বলছে।

কমলেশ বললেন, “ফ্ল্যাটে আর কে থাকে?”

বিভূতি বলল, “ছেলে আর মা।”

কমলেশ বললেন, “মহিলার বয়স কত? সিক্সটি? নাকি কম?”

বিভূতি বলল, “দেখে তো ষাট হয়েছে বলে মনে হল না। তবে কাছাকাছি। ফিফটি সেভেন–এইট হতে পারে।”

কমলেশ চুপ করে থেকে একটু ভাবলেন। বললেন, “তারপর?”

বিভূতি বললেন, “আগে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের কাছে একটা ফ্ল্যাটে ছিল। সেই ফ্ল্যাট ছোট। বছরখানেক হল বেচেবুচে এখানে এসেছে। তারও আগে ছিল নর্থ ক্যালকাটায়। টালা পার্কে বাড়ি ভাড়া নিয়ে। স্যর, ওদের অরিজিনাল বাড়ি যে গ্রামে তার নাম.‌.‌.‌ অদ্ভুত নামটা.‌.‌.‌ দাঁড়ান কাগজ দেখে বলছি।” কথা থামিয়ে বিভূতি প্যান্টের পকেট হাতড়ে গাদাখানেক কাগজের টুকরো বের করে ঘাঁটতে লাগল।

কমলেশ শান্ত গলায় বললেন, “কাগজ দেখতে হবে না। আমি জানি। গ্রামের নাম ছায়াপাতা। ‌আর কী জেনেছ? মহিলার পাস্ট?”

বিভূতি বলল, “বাবা দেবাদিত্য বসু মারা যাওয়ার পরই মাকে দেশের বাড়ি থেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল সৌহার্দ্য। এই ছেলে এখন আপনার আন্ডারে চাকরি করছে। অফিসে ঢোকার কিছু দিনের মধ্যেই সে ম্যানেজমেন্টের নজরে পড়েছে। কেন, এখনও জানতে পারিনি।”

কমলেশ খানিকটা অধৈর্য গলায় বললেন, “এসব আমি জানি। নতুন খবর বলো।”

বিভূতি মাথা চুলকে বলল, “সৌহার্দ্যর মা শ্রীকণা বসু কলকাতার মেয়ে। সাধারণ পরিবারের। সাধারণ বললেও কম বলা হবে, বেশ নিম্নবিত্তই ছিলেন। বাবা ছোটখাটো চাকরি করতেন। এক মেয়ে, এক ছেলে। ছেলেটি পরে কাজকর্ম নিয়ে মিডল ইস্টে চলে যায়। সে আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। কলেজ পাশ করার পর বাড়ির লোক তড়িঘড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়।”

বিভূতির কথা থামিয়ে কমলেশ রায় বললেন, “তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়!‌ কেন? তড়িঘড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়‌ কেন?”

বিভূতি একটু চুপ করে থেকে মাথা চুলকে বলল, “স্যর এই ইনফর্মেশন এখনও আমি পুরোটা জোগাড় করতে পারিনি। বিয়ের আগে শ্রীকণা যেখানে থাকতেন, সেখানকার ঠিকানা জোগাড় করেছি। দমদমে। একদিন গিয়েছিলাম, কিন্তু সে বাড়ি আর নেই, ফ্ল্যাট উঠে গেছে। শ্রীকণা বসুর বাবা–মা কেউই সম্ভবত বেঁচে নেই। আমি ওঁর এক আত্মীয়ের খোঁজ পেয়েছি। তার সঙ্গে কথা বলতে হবে।”

কমলেশ রায় হালকা বিরক্ত হয়ে বললেন, “এটা তো তোমার বিষয় বিভূতি। কার সঙ্গে কথা বলতে হবে তুমি জানো। আমি তো বলেছিলাম, এই মহিলার অতীত সম্পর্কে আমি ইনফর্মেশন চাই। বিশেষ করে তার কমবয়সের সময়টা কেমন ছিল, বন্ধুবান্ধব কেমন ছিল, কারও সঙ্গে অতিরিক্ত মেলামেশা ছিল কি না, বিয়ে কীভাবে হল— এই সব। তার ফ্ল্যাট, বাড়ি, গ্রামের হিসেব নিয়ে আমি কী করব? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা আমার চাই। জানি কাজটা টাফ। টাকাপয়সা নিয়ে ভাববে না।’

বিভূতি মাথা নামিয়ে রইল। কমলেশ রায় নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আর এক জনের খবর? বিতান নামের ছেলেটির?”

বিভূতি সঙ্গে হাতলওয়ালা একটা চামড়ার ব্যাগ এনেছে। আদ্যিকালের ব্যাগ। কালচে হয়ে গেছে। ব্যাগ থেকে একটা নীল রঙের ফাইল বের করে কমলেশের দিকে এগিয়ে বলল, “স্যর, এর মধ্যে আছে।”

ফাইলটা নিয়ে কমলেশ প্লাস্টিক কভার উলটোলেন। ভিতরে বাংলায় ঝকঝকে টাইপ করা দুটো পাতা। কমলেশ অবাক হলেন। ফাইলে টাইপ করা রিপোর্ট বিভূতির সঙ্গে যায় না। একটা কর্পোরেট চেহারা। বিভূতি কমলেশ রায়ের মনের কথা যেন বুঝতে পারল। লজ্জা পাওয়ার মতো হাসি হেসে বলল, “স্যর, এসব না করলে আজকের দিনে চলে না। পার্টি পছন্দ করে। তবে স্যর, আমি নিজেই টাইপ করি।‌ সিক্রেট ব্যাপার অন্য কারও হাতে ছাড়ি না। ভাল করেছি না?”

কমলেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, “এটা করেছ ঠিক আছে, কিন্তু ‌আমার কাজের বেলায় আর কখনও করবে না। লেখা মানে রেক‌র্ড থেকে যাওয়া। কম্পিউটারে তো থাকলই। এর পর থেকে তেমন হলে আমাকে নিজের হাতে পেনসিলে লিখে দেবে, তার বেশি নয়।”

বিভূতি বলল, “স্যরি স্যর।”

কমলেশ ফাইলটা পাশে রেখে বললেন, “পরে দেখে নেব। এই ছেলেটা সম্পর্কে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট কোনটা মনে হয়েছে?”

“স্যর, আমার কাছে সব পয়েন্টই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই ছেলেটির ফ্যামিলিতে বড় ধরনের কোনও লাফড়া আছে‌।”

কমলেশ মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “লাফড়া!‌”

বিভূতি তাড়াতাড়ি জিভ কেটে বলল, “স্যরি স্যর.‌.‌.‌ গোলমাল। ছেলেটার চালচুলো কিছু নেই। বন্ধুর ফ্ল্যাট পাহারা দেয়। তার বদলে সেখানে থাকতে পেরেছে।”

কমলেশ ভুরু কুঁচকে ফেললেন। এ কেমন ছেলেকে আহি পছন্দ করেছে!‌ মানিব্যাগ থেকে দু’হাজার টাকার একটা নোট বার করে বিভূতির দিকে এগিয়ে দিলেন।

“নাও ধরো। বাকিটা কাজ শেষ করলে পাবে। তুমি কোথায় নামবে?”

বিভূতি ‌উজ্জ্বল মুখে টাকা নিল। বলল, “স্যর, আমাকে পিজির সামনে নামিয়ে দিন। অদ্ভুত একটা কাজ পেয়েছি। এক পেশেন্টকে তার পুরনো বউ দেখতে আসে কি না নজর রাখতে হবে।‌‌ আমার অ্যাসিসট্যান্টকে ওয়ার্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। এবার আমি যাব।”

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে কমলেশ বললেন, “পুরনো বউকে চিনবে কী করে?”

“আমরা গিয়ে তাকে চিনে এসেছি স্যর।”

“কত দিনের ডিউটি?”

বিভূতি কাঁচুমাচু মুখে বলল, “কিছু মনে করবেন না স্যর, ‌সেটা বলা যাবে না। সিক্রেট।”

কমলেশ বললেন, “স্যরি।”

‌পিজি হাসপাতালের সামনে গাড়ি দাঁড় করালেন কমলেশ। বিভূতি নামার আগে ‘এক সেকেন্ড’ বলে দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করল। এগিয়ে দিয়ে বলল, “স্যর, এখানে ফটো আছে।”

কমলেশ অবাক হয়ে বললেন, “ফোটো!‌ কার ফোটো?”

বিভূতি বলল, “শ্রীকণা বসুর। ভাল ফটো নয় স্যর। দূর থেকে মোবাইলে তোলা। বড় করতে গিয়ে ফেটে গেছে। সেই জন্য দিচ্ছিলাম না। তা ছাড়া আপনি তো ফটো চাননি। ভেবেছিলাম পুরো রিপোর্ট হলে ‌আপনাকে একসঙ্গে.‌.‌.‌’

কমলেশ কথার মাঝখানেই হাত বাড়িয়ে খামটা নিলেন। তাঁর ইচ্ছে করছিল এখুনি খাম খুলে দেখেন, কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন। বিভূতির সামনে এতটা কৌতূহল ঠিক হবে না। বিভূতি গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পরও পাশে পড়ে থাকা খামে হাত দিলেন না। তাড়াহুড়ো কিছু নেই।

অফিসে ঢুকে কমলেশ রায় খবর পেলেন, কম্পিউটার সিস্টেমে বড় ধরনের গোলমাল হয়েছে। সার্ভার ডাউন হয়ে গিয়েছিল। তাকে চালু করা গিয়েছে, কিন্তু তাতে নতুন জটিলতা হচ্ছে। চেয়ারে বসতেই মনোজ ত্রিপাঠীর ফোন।

“স্যর, আপনি কি কম্পিঊটার অন করেছেন?”

কমলেশ বললেন, “না, শুনলাম কী গোলমাল করছিল। ঠিক হয়েছে?”

ত্রিপাঠী বলল, “বেসিক প্রবলেম ঠিক হয়েছে, কিন্তু এখনই ‌কম্পিউটার খুলবেন না। ফাইল ডিলিট হয়ে যাচ্ছে।”

কমলেশ বললেন, “সে কী!‌ সে তো ভয়ংকর!”

ত্রিপাঠী বললেন, “আমাদের ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছে। বাইরে থেকেও এক্সপার্ট কল করা হয়েছে।”

“তা হলে এখন গোটা অফিসে কাজ বন্ধ?”

ত্রিপাঠী শুকনো গলায় বলল, “এক রকম তা-ই। সবাই মেশিন খুলতে ভয় পাচ্ছে। যদি ফাইল ডিলিট হয়ে যায়!”

কমলেশ চিন্তিত গলায় বললেন, “দেখো কত তাড়াতাড়ি নরমালসি রেস্টোর করা যায়। জানিয়ো।”

কমলেশ রায় দরজার বাইরের ‘বিজ়ি’ আলো জ্বালালেন। ইন্টারকম তুলে চা পাঠাতে বললেন। বলে দিলেন বাইরে থেকে ফোন এলে বুঝেশুনে লাইন দিতে হবে। সব ফোন দেওয়ার দরকার নেই। পরে করলেই হবে। ইন্টারকমের রিসিভার নামিয়ে টেবিলের উপর ফেলে রাখা খামটা টানতে গিয়ে থমকে গেলেন কমলেশ রায়। এটা পরে, আগে বিতানের ফাইলটা দেখা দরকার। ফাইল নিয়ে দ্রুত চোখ বোলালেন কমলেশ। যত এগোতে লাগলেন তত ভুরু কোঁচকাতে থাকল তাঁর।

নবনী বরং কম করে বলেছে। ছেলেটার শুধু কাজকর্ম করার ইচ্ছে নেই এমনটাই নয়, মনে হয় যোগ্যতাও নেই। একটার পর একটা চাকরি ছেড়ে দেয়। অথবা তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করে ছেলেকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তার পরেও সেখানে যাতায়াত আছে। কেন যাতায়াত সে ব্যাপারে বিভূতির রিপোর্টে স্পষ্ট করে কিছু লেখা নেই। তবে ইঙ্গিত আছে। মনে হয়, টাকা চাইতে যায়। অন্য কোনও উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। ভদ্রলোকের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর একটি মেয়ে আছে। সেই মেয়ে কলেজে পড়ে। মেয়েকে নিয়েই মহিলা বিতানের বাবার কাছে এসে উঠেছিল। ছেলেটি কেন ওই বাড়িতে যাতায়াত করবে? আহি কি এত সব জানে?

ফাইল পড়া শেষ হলে কমলেশ রায় চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। নবনী ঠিক বলেছে। মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে হবে। অবশ্যই বলতে হবে। আহি এই ছেলেকে নিয়ে জীবনে চলার কথা ভাবলে বিরাট বিপদে পড়বে। কিন্তু কীভাবে তাকে আটকানো যাবে? আহি আর পাঁচ জনের মতো নয়। সে সেন্সিটিভ, জেদি। নিজে যা ভাল বুঝবে করবে। আজ পর্যন্ত কোনও বিষয়ে সে ভুল করেনি। এই কনফিডেন্স তাকে সমস্যায় ফেলবে।‌‌ ঠিক মানুষ অনেক সময় মাত্র একটা ভুলে নিজের সাজানো-গোছানো জীবন লন্ডভন্ড করে ফেলে। এই ছেলে কোনও ভাবেই আহির সঙ্গে ম্যাচ করবে না। প্রেমের উন্মাদনা কেটে গেলে আহির সমস্তটাই বৃথা মনে হবে। তবে সবার আগে জানা দরকার, আহি এই ছেলেকে সত্যি কতটা পছন্দ করে।

কমলেশ ফাইল সরিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিলেন। জটিল সমস্যায় পড়া গেল! মেয়ে তাঁকে বিশ্বাস করে। বাবা তার ভালবাসার মানুষকে সরিয়ে দিতে চাইছে, সে ভাবতেই পারবে না। তা হলে?

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিলেন কমলেশ। সোনালি বর্ডারের শৌখিন কাপ। কাপটা রাখতে গিয়ে থমকে গেলেন। সেদিন সৌহার্দ্য নামের ছেলেটা এই রকমই একটা কাপ ভেঙেছিল না? ভাঙেনি, ওর‌ হাতে লেগে পড়ে গেল।

আপনা থেকেই ভুরু কুঁচকে গেল কমলেশের। টেবিলের কোনায় রাখা কাপটার দিকে ভাল করে তাকালেন। কাপটা সেদিন কীভাবে পড়েছিল? হাতে লেগে? না কি হাতের ধাক্কায়? হঠাৎ এরকম একটা অদ্ভুত প্রশ্ন মাথায় আসার কারণ কী? অস্বস্তি শুরু হল কমলেশের। তিনি মাথা ঝাঁকালেন। এরকম একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? নিজের ওপর বিরক্তি হল। ঘটনাটা যেন উড়ে এসে মাথার ভিতর জুড়ে বসল। বেরোতে চেষ্টা করলেন, পারলেন না।‌‌ খচখচ করছে।

কাপটা টেবিলের কোনায় রাখলেন কমলেশ। যত কোনায় রাখলে সামান্য ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে, ততটা কোনায়। তারপর হালকা ভাবে হাত লাগালেন। পড়ল না। আরও একবার হাত দিলেন। ডিশের উপর রাখা কাপ সামান্য নড়ল, কিন্তু এবারও পড়ল না। বোঝাই যাচ্ছে, কাপ টেবিল থেকে ফেলতে গেলে অল্প হলেও ধাক্কা লাগবে। হাতে ধাক্কা লাগলে কি বোঝা যাবে না? তার থেকেও বড় কথা, ধাক্কায় কাপ নীচে পড়লে একেবারে জানা যাবে না, এটা হতে‌ পারে না। অথচ সেদিন সৌহার্দ্য এমন ভাবে ঘর থেকে বেরোল যেন কিছুই জানতে পারেনি!‌ কাপটা পড়ল, ভাঙল, তার পরেও নির্বিকার ভাবে বেরিয়ে গেল। তবে কি সে ইচ্ছে করে কাপটা ফেলে দিয়েছিল? তার কোনও রাগ, ঘৃণা জানিয়ে গেল?

কমলেশ ঝিম মেরে বসে রইলেন। এসব তিনি কী উলটোপালটা ভাবছেন!‌ কেনই বা ভাবছেন? তিনি কি কোনও অপরাধবোধে ভুগতে শুরু করেছেন? মনে হচ্ছে তা-ই।‌ হাত বাড়িয়ে টেবিলে পড়ে থাকা খামটা টানলেন। তাঁর মন বলছে, তিনি যা ভাবছেন সেটাই সত্যি। বিভূতির ‘খবর’ সে দিকেই ইঙ্গিত করেছে। সৌহার্দ্যও মায়ের নাম বলে, কাপ ভেঙে সে কথা বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।

পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোটা দেখে কমলেশ রায় চমকে ওঠার বদলে মুচকি হাসলেন। মনে মনে নিজেকে তারিফ করলেন। ঠিক বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। কর্পোরেট জগতের শুকনো জীবন মানুষের মনকে পুরোপুরি দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে না। পারে না বলেই শ্রীকণাকে তিনি এক বারে চিনতে পারলেন।

সাঁইত্রিশ বছরে শ্রীকণা পুরোটাই বদলে গিয়েছে, কিন্তু তার চোখের মায়া এখনও মোছেনি। এই মায়া সে তার পুত্রের মধ্যেও রেখে দিয়েছে। প্রথম দিন সৌহার্দ্যর চোখ দেখে তাই মনে হয়েছিল, কোথায় যেন দেখেছি। শ্রীকণার চোখ দেখেই একদিন তিনি তার প্রেমে পড়েছিলেন।

“তুমি আমাকে এত ভালবেসেছ কেন কমলেশ? কী পাও আমার মধ্যে?”

“তোমার চোখ আমার মাথা খারাপ করে দেয়।”

“ও! তা হলে আমাকে নয়, তুমি আমার চোখের সঙ্গে প্রেম করো?”

“শ্রীকণা, মানুষের মনের ভিতরটা চোখেই প্রকাশ পায়। যার চোখ এমন মায়া-মাখা, তার মনটাও না জানি কত মায়ার।”

“ধুস, পাগল একটা।”

“পাগল হব কেন? রবীন্দ্রনাথই তো লিখে গিয়েছেন, কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দোলায় মন, তাই কেমন হয়ে আছিস সারা ক্ষণ।”

কমলেশের মুখ থমথমে হয়ে গেল। এইভাবে কি হুড়মুড়িয়ে সব মনে পড়বে? তরুণ বয়সের যাবতীয় ছেলেমানুষি!‌

মোবাইল তুলে নম্বর টিপলেন কমলেশ।

“স্যর বলুন।”

কমলেশ চাপা গলায় বললেন, “বিভূতি, শ্রীকণা বসুর ফাইলটা বন্ধ করে দাও। তার সম্পর্কে আমার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই।”

বিভূতি এক মুহূর্ত থমকে বলল, “আচ্ছা স্যর।”

কমলেশ বললেন, “চিন্তা কোরো না। বাকি পেমেন্ট তুমি পুরোটাই পাবে।”

ফোন রেখে কমলেশ আর একবার ফোটোটা হাতে তুললেন। শ্রীকণার চুলে পাক ধরেছে। মুখটা ভারী হয়েছে। কিন্তু চিবুকের কাছের তিলটা এখনও একই রকম আছে। জীবন খুব অদ্ভুত। কম্পিউটারের ফাইলের মতো। মনে হয়, কত ফাইল ডিলিট হয়ে গেছে। আসলে হয় না, থেকে যায়। ফিরে আসে।

ইন্টারকম বেজে উঠল। কমলেশ ফোন ধরলেন।

“স্যর, ত্রিপাঠী।”

“সিস্টেম ঠিক হয়েছে?”

ত্রিপাঠী গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যাঁ স্যর, ডিলিট ফাইলগুলো পাওয়া যাচ্ছে।”

কমলেশ বললেন, “গুড। কাজ তা হলে শুরু করা গেছে।”

ত্রিপাঠী বলল, “করা গেছে। তবে একটা জরুরি কথা আপনাকে বলার ছিল।”

“বলো।”

ত্রিপাঠী প্রায় ফিসফিস করে বলল, “স্যর, মনে হচ্ছে, সিস্টেমে কোনও সাবোটাজ হয়েছে।”

কমলেশ বললেন, “সে কী!‌”

১১

আহিরীকে দেখতে পেয়ে বিতান হাত তুলল। বিতানের মুখ হাসি-হাসি। রাস্তার ও পাশে থাকলেও বিতানের হাসি বোঝা যাচ্ছে।

আহিরীর বুক ধক করে উঠল। বিতানের মুখে হাসি মানে নিশ্চয়ই আবার গোলমাল হয়েছে। গোলমাল হলে এই ছেলের মুখ হাসি-হাসি হয়ে যায়। এ আবার কেমন রসিকতা? এত দিনেও মেনে নিতে পারেনি আহিরী।

বিতানের রিয়েল এস্টেটের কাজটা সম্পর্কে আহিরীর কোনও আশা নেই। ওটা ঠিকঠাক কোনও কাজই নয়। আজ আছে কাল নেই। থাকলেও বা কী? টাকাপয়সা খুব কম। লোককে বলাও যাবে না। আজকের ইন্টারভিউটার দিকে সে তাকিয়ে আছে। আইটি কোম্পানির এই কাজটা যদি হয়ে যায়, খানিকটা স্বস্তি পাওয়া যাবে। এর আগে তিন–তিনটে কাজ ছেড়েছে বিতান।

প্রথমটা ছিল সেলসের চাকরি। একটা নতুন কোম্পানির ওয়াটার পিউরিফায়ার বেচতে হবে। দু’মাস যেতে না যেতে কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল সে।

আহিরী জিজ্ঞেস করেছিল, “কেন? সমস্যা কী? বেশ তো শহরেই কাজ করতে পারতে। এই কাজে প্রসপেক্টও ভাল ছিল। মানুষ এখন খুব হেলথ কনশাস। হাইজিন খোঁজে।”

বিতান বলল, “তা হয়তো পারতাম, কিন্তু বেশি দিন মিথ্যে বলা পোষাল না। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গুণের কথা বলতে হত। হয়তো আছে পাঁচ, বলতে হত পঞ্চাশ। মনে হচ্ছিল, লোক ঠকাচ্ছি।‌”

আহিরী বলল, “ঠকানোর কী আছে!‌ সেলসের চাকরিতে একটু বাড়িয়ে তো বলতেই হয়। ওসব কাস্টমার কনভিন্সড করার কায়দা।”

বিতান বলল, “হতে পারে, কিন্তু আমি বুঝেছিলাম ও কাজ আমার দ্বারা হবে না। কোনও কিছু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলাতে আমি নেই। দুনিয়ার সব কায়দা তো সবার জন্য নয় আহিরী।”

আহিরীর এই যুক্তি পছন্দ হয়নি। তবে সে মুখ ফুটে বলেনি কিছু। পরের কাজটা ছিল কোনও এক স্ট্যাটিসটিক্যাল প্রোজেক্টের ফিল্ড ওয়ার্কারের। ঘুরে ঘুরে ডেটা সংগ্রহ করতে হত। বিতান গল্প করেছিল।

“বুঝলে আহিরী, কাজটা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। নাম ছিল ‘আরবান ডিসকমফর্ট’। নাগরিক জীবনে সমস্যা। পলিউশন, ট্রাফিক জ্যাম, স্বার্থপরতা, নিঃসঙ্গতা, র‌্যাট রেস— সব এর মধ্যে পড়ে। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে লোকের সঙ্গে কথা বলতাম। মজা লাগত। চার ঘণ্টা কাজে চারশো টাকা। সেই সময়ে আমার জন্য তো বেশ ভালই রোজগার। আমার কাজও ওদের পছন্দ হচ্ছিল। বলল, এটা শেষ হলে নতুন প্রজেক্টে নেবে। কিন্তু একদিন ফিল্ড অফিসারের সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেল। আমি নাকি যে ফর্ম দেওয়া হয়েছে তার বাইরে প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছি। ব্যস, কাগজপত্র ছুড়ে ফেলে চলে এলাম। ভাল করেছি না?”

এই ঘটনাও ভাল লাগেনি আহিরীর। তার মনে হয়েছিল, বিতানের একটা না একটা অজুহাতে কাজ ছেড়ে দেওয়া আসলে এক ধরনের অস্থিরতা। তাও সে কিছু বলেনি। বিতান তো কোনও ছোট ছেলে নয়। তিন নম্বর চাকরিটা ভাল ছিল। কর্পোরেট অফিসে জুনিয়র ম্যানেজার। সে দিনের ঘটনা মনে আছে আহিরীর।

আজকের মতোই ঠিক সেদিনও এসে দাঁড়িয়েছিল আহিরী। সবে কলেজে পড়াতে শুরু করেছে তখন। কয়েক মাস হয়েছে মোটে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল ছ’টার সময়। ঠিক ছিল, বিতান অফিস থেকে বেরোলে দু’জনে কলামন্দিরে একটা প্রোগ্রাম শুনতে যাবে। আহিরী যে গাইডের কাছে গবেষণা করেছে তাঁর বউয়ের গানের অনুষ্ঠান ছিল। মহিলার গান আগেও শুনতে হয়েছে আহিরীকে। অতি খারাপ। গলা চড়ার দিকে উঠলে খ্যানখেনে হয়ে যায়। তার পরেও যেতে হবে। নইলে ভাববে কাজ ফুরিয়েছে, গাইডকেও ভুলে গিয়েছে। আহিরী ঠিক করেছিল, একটু ক্ষণ থাকবে। বিতানকেও নিয়ে যাবে। আগে থেকে তাকে কিছু বলেনি। বিতান যদি রাজি না হয়, হল থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে দু’জনে ঘুরে আসবে। কোথাও খেয়ে, বাড়ি ফিরবে।

আহিরী সেদিন আগেই বিতানের অফিসের কাছে চলে যায়। জ্যামে-ট্যামে পড়েনি। রাস্তা পেরিয়ে বিতান কাছে আসতে আহিরী জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে, হাসছ কেন?”

বিতান মাথার চুলে আঙুল বুলিয়ে বলল, “একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। তাই হাসছি।”

আহিরী বলেছিল, “মজার ব্যাপারটা কী, জানতে পারি?”

বিতান বলেছিল, “অবশ্যই পারো। তবে আগে আমি কি কিছু খেতে পারি? আজ অফিসে কিছু খাওয়া হয়নি। খুব খিদে পেয়েছে। চলো কোথাও ঢুকে খাই।”

“ঠিক আছে। তারপর কিন্তু আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যেতে হবে। রাগারাগি করবে না।”

বিতান হেসে বলেছিল, “তোমার সঙ্গে আমি সব জায়গায় যেতে রাজি।”

ছোট একটা রেস্তরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড় করাল আহিরী। এখন কলকাতার অলিতে-গলিতে ভাল ভাল খাওয়ার জায়গা হয়েছে। একটা ভেজিটেবল চাউমিন নিয়ে দু’জনে ভাগ করে নিল।

আহিরী বলল, “এবার বলো মজার ব্যাপারটা কী?”

আয়েশ করে খেতে খেতে বিতান সেদিন বলেছিল, “মজার ব্যাপার অতি সামান্য। এই ‌চাকরিটাও নট হয়ে গেল।”

আহিরী খাওয়া থামিয়ে মুখ তুলে বলল, “সে কী!‌ চাকরি চলে গেল!‌‌‌ কেন?”

বিতান বলল, “তা তো বলতে পারব না! লাঞ্চের পর ইন-চার্জ ডেকে বলল, ‌কাল থেকে আর আসতে হবে না। বকেয়া যা আছে, তার সঙ্গে এক মাসের এক্সট্রা স্যালারি পেয়ে যাবেন। ক্যাশে চলে যান, এখনই দিয়ে দেবে। আজ আমি একজন ধনী মানুষ আহিরী। পকেটে দেড় মাসের মাইনে। এই কারণে হাসছি। তোমার টাকা লাগলে বলো, ধার দিতে পারব। লাগবে?”

আহিরী হতভম্ব হয়ে বলল, “ওরা বলল আসবেন না আর ‌তুমি কিছু বললে না?”

বিতান খানিকটা চাউমিন মুখে নিয়ে চোখ আধখানা বুজে ফেলল, “বিউটিফুল!”

আহিরী রেগে গিয়ে বলল, “কী বিউটিফুল? তোমার চাকরি যাওয়াটা বিউটিফুল!”

বিতান হেসে বলেছিল, “এদের খাবারটা বিউটিফুল।”

আহিরী থমথমে গলায় বলল, “যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। তুমি কিছু বললে না?”

বিতান খাওয়া থামিয়ে আহিরীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “কী বলব? এর আগের কাজগুলোও তো গিয়েছিল। তখন টাকাপয়সা কিছু পাইনি। এবার তো তা নয়। কিছু টাকা অন্তত পেয়েছি। বেটার সিচুয়েশন। সবটা মার যায়নি।”

“এবার তো তুমি ছাড়োনি, তা হলে কাজটা গেল কেন?”

বিতান বলল, “কেন গেল জিজ্ঞেস করে লাভ কী? আজকাল তো সব কনট্র্যাক্ট সা‌র্ভিস। আমারটা তো মোটে ছ’মাসের ছিল। এখন বিনা নোটিশে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার নিয়ম আছে। কারণ লাগে না। শুনলাম আজ আরও দশ জনকে নোটিশ দিয়েছে। পরে আরও দেবে। কোম্পানি ওভারহেড কমাচ্ছে। এ কী, তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছ কেন? খাও।”

আহিরী নিচু গলায় বলেছিল, “কাজ চলে গেছে আর তুমি খাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে?”

বিতান বলল, “কী করব? ডাক ছেড়ে কাঁদব?”

‌আহিরী চুপ করে রইল। বিতান একটা হাত বাড়িয়ে আহিরীর হাতের উপর রাখল।

“চিন্তা কোরো না। ঠিক আবার একটা কিছু হয়ে যাবে। উনিশ বছর বয়স থেকেই কিছু না কিছু করছি, সাতাশ হতে চলল। এত দিন পারলাম যখন, আবার পারব।”

আহিরী নিচু গলায় বলল, “এই ভাবে কত দিন চলবে? সবই তো নড়বড়ে কাজ। আজ আছে কাল নেই। এবার একটা ঠিকঠাক চাকরির খোঁজ করো।”

বিতান হাসিমুখেই বলল, “আমি তো তোমার মতো লেখাপড়া জানি না আহিরী। তোমার মতো কলেজের মাস্টারনি হওয়ার পরীক্ষাও দিতে পারব না। আমি একজন অর্ডিনারি ছেলে। আমি যে ধরনের চাকরির পরীক্ষাগুলো দিই তাতে শুধু পরীক্ষায় পাশ করলে হয় না, আরও কিছু লাগে। চেনাজানা লাগে, টাকা লাগে, তোষামোদি লাগে। ওসব আমার নেই। আমাকে এ ভাবেই চলতে হবে। সুতরাং বেশি ভেবে লাভ কী?”

“তোষামোদি ছাড়া কারও চাকরি হয় না?”

বিতান গ্লাসের জলে চুমুক দিল, “হবে না কেন? অবশ্যই হয়‌। আমার মতো অ্যাভারেজে ছেলের হয় না। এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো আমি স্মার্ট নই। কাজ চলে যাওয়ার পিছনে আমার নিজের অযোগ্যতাও নিশ্চয়ই আছে। এটাও এক ধরনের শহুরে জীবনের ক্রাইসিস। হয় কমপিটিশনে টিকে থাকো, নয় কেটে পড়ো।”

আহিরীর মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। লেখাপড়ায় বিরাট ডিগ্রি নেই, ফড়ফড় করে দুটো ইংরেজি বলতে পারে না তো কী হয়েছে? মানুষ হিসেবে বিতান তো ভাল। সে একজন সৎ মানুষ। তার কোনও দাম নেই? তবে বিতান যখন নিজের সমস্যা নিয়ে রসিকতা করে, তখন তার রাগ হয়। সে অবশ্য বলে, “আহিরী, এটা রসিকতা নয়, রসবোধ। রসবোধ হল পদ্মপাতার মতো। দুঃখ কষ্ট সব পিছলে যায়।’

আহিরী কড়া গলায় বলে, “স্যরি, এত রসবোধ আমার নেই, দরকারও নেই। আমার সহ্যও হয় না। আমি কাঠখোট্টা ‌বাস্তবের মানুষ।”

বিতান কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে কপালে‌ হাত ঠেকিয়ে বলে, “জো আজ্ঞা জাঁহাপনা। আপনি যা বলবেন। এবার থেকে আমি রামগরুড়ের ছানা হয়ে যাব। তার মতো মুখ করে থাকব। নো হাসি, নো মসকরা। চিন্তা একটাই, দাড়িওলা রামগরুড় কি হয়? আমি কি দাড়ি কেটে ফেলব?”

আহিরী সেদিন নিজেকে সামলাতে পারেনি। বিতানের হাতে জোর চিমটি কাটে। “আহ্‌!” বলে ওঠে বিতান। আহিরী চাপা গলায় বলে, “আবার ঠাট্টা করলে আরও জোর চিমটি কাটব।”

সেদিন মন এতটাই খারাপ হয়েছিল যে গান শুনতে আর যেতে পারেনি আহিরী। বিতানের সঙ্গে খানিকটা এলোমেলো ঘুরে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল।‌

আজও‌ একটা ইন্টারভিউ ছিল বিতানের। ওয়াক-ইন ইন্টারভিউ। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়েছিল। হায়দরাবাদের কোম্পানি, কলকাতায় নতুন অফিস খুলছে। বিজ্ঞাপনে বলেছিল, ইন্টারভিউ হল-এই জানিয়ে দেওয়া হবে। বিতানের হাসিমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে তার হয়নি। এই ইন্টারভিউয়ের জন্যই বিতানকে ভাল করে প্রিপারেশন নিতে বলছিল সে। সেদিন কলেজ থেকে ফোনে খানিকটা কড়া কথাও বলে ফেলেছিল। সেই কারণেই আরও আসা।

বিতান বলল, “কখন এলে?”

“কিছুক্ষণ। বলেছিলাম তো আসব। খানিক আগে মেসেজ দিয়েছি, দেখোনি?”

সিগারেটের প্যাকেট বের করল বিতান। প্যাকেট খুলে দেখল, ফাঁকা।

“না, মোবাইলের মেসেজ সব সময় দেখি না।”

“আমারটাও দেখো না?”

বিতান হেসে বলল, “ও দিকে অনেক সময়েই তাকাই না। যাক, আহিরী, টাকা ধার দাও দেখি। সিগারটে কিনব।”

আহিরী ব্যাগ খুলে টাকা বের করে দিল।

“এত লাগবে না।”

আহিরী নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছে, “ধার তো। বেশি করেই নাও। কম ধার নিলে ভুলে যাবে।”

এগিয়ে গিয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনে ধরাল বিতান। আহিরীর কাছে এসে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “চলো।”

আহিরী বলল, “আগে সিগারেট শেষ করো। জানো তো গাড়িতে স্মোকিং নট অ্যালাওড।”

বিতান উদাস মুখ করে বলল, “এই জন্য গাড়ি কিনি না। দাঁড়াও, সিগারেটটা আয়েশ করে শেষ করি। ধারের পয়সায় কেনা জিনিস হুটোপাটি করে খাওয়া যাবে না।”

আহিরী মুখ ফেরাল। রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছে। অফিস ছুটি হয়েছে। সল্টলেক সেক্টর ফাইভে কমবয়সি ছেলেমেয়েদের ভিড়। বুকে আই কার্ড ঝুলিয়ে আকাশছোঁয়া অফিসবাড়ি থেকে সবাই বেরিয়ে আসছে। বাস, ক্যাব ধরছে। নিজেদের বাইক, গাড়ি, পুল কারও রয়েছে। নাইট শিফট শুরু হবে এবার। তার ভিড়ও বাড়ছে। কলকাতার পুরনো বিবাদীবাগের অফিসপাড়ার থেকে এই অফিসপাড়ার একেবারে আকাশ পাতাল তফাত। একটা ঝলমলে ব্যাপার আছে। বয়স কম বলে ছেলেমেয়েরা অনেকক্ষণ কাজ করেও কেউ ধুঁকছে না, মুখও গোমড়া নয়। বরং রাস্তাতেই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে তারা। হাসছে, ঝগড়া করছে। কেউ কেউ খেতে যাওয়ার প্ল্যান করছে। কোনও কোনও দলের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে, অফিস নয়, ইউনিভার্সিটি ছুটি হয়েছে। আহিরীর ইচ্ছে করল, গিয়ে ওদের আড্ডায় ঢুকে পড়ে।

বিতান সিগারেট শেষ করলে আহিরী বলল, “কোথায় যাবে?”

বিতান হালকা দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “স্বর্গের দিকটায় গেলে কেমন হয়? একটু পরেই চাঁদ উঠবে। স্বর্গের কিনারায় দাঁড়িয়ে বাদাম খেতে খেতে তুমি আর আমি জ্যোৎস্না দেখব।”

আহিরী মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‌এত গোলমালের মধ্যেও এই ছেলের রসিকতা বন্ধ হয় না। চাকরির কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছে। এমনও হতে পারে, হালকা ভাব দেখিয়ে আহিরীর কাছ থেকে সে সমস্যা আড়াল করে রাখতে চায়। ভান করছে, সব ঠিক আছে। সব যে ঠিক নেই, আহিরী ভাল করেই জানে। সমস্যা ঘন হয়ে আসছে। বিতান যদি এবারও কোনও কিছু করে উঠতে না পারে, তার পক্ষে খুব মুশকিল হবে। বাড়ি কীভাবে সামলাবে? বাইরেই বা কী বলবে? কারও দিকে না তাকিয়ে, কারও আপত্তি না শুনেও সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু বিতান কি তার জন্য তৈরি? এই সিদ্ধান্ত একা নেওয়া যায় না।‌

বিতান বলল, “ওয়র্ডসওয়র্থ স্বর্গের আলো নিয়ে অবশ্য অন্য রকম কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, স্বর্গের সব আলোই আসলে ভোরের আলো। দ্য লাইটস অব হেভেন ফল হোল এন্ড হোয়াইট/ অ্যান্ড ইজ নট স্যাটায়ার্ড ইনটু ডাইজ়/ দ্য লাইট ফরএভার মর্নিং লাইট‌।”

আহিরী নিজেকে হালকা করার জন্য বলল, “রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওয়র্ডসওয়র্থ আবৃত্তি করাটা ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না? তোমার কবিতা শোনার জন্য ভিড় হয়ে গেলে সমস্যা হবে। চলো অন্য কোথাও যাই।”

বিতান ঘুরে আহিরীর মুখোমুখি হল। বলল, “তোমাকে একটা কথা বললে রাগ করবে?”

আহিরী বলল, “তোমার কোন কথাটা রাগ করার মতো নয়?”

বিতান হেসে বলল, “আমি যে রাগ করার মতোই মানুষ। আহিরী, তোমার সঙ্গে অনেক রসিকতা করেছি, আজ কয়েকটা সিরিয়াস কথা বলব।”

আহিরী একটু থমকাল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “বাপ রে, হঠাৎ গুড বয় হয়ে গেলে যে বড়?”

বিতান চোখ পাকিয়ে বলল, “যারা হাসিঠাট্টার মধ্যে থাকে তারা ব্যাড বয় নাকি?”

আহিরী এবার খানিকটা রাগের সুরে বলল, “ব্যাড নয়, ওটা আসলে জীবনের রিয়েলিটিকে এড়িয়ে থাকার একটা ধরন। লুকিয়ে রাখারও বলতে পারো।”

বিতান বলল, “যদি সেটা বাধ্যতামূলক হয়?”

আহিরী ভুরু কুঁচকে বলল, “কে তোমাকে বাধ্য করছে? নিজে যা ভাল মনে করবে সেটাই ঠিক।”

বিতান বলল, “ঝগড়াটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে না করে, কোথাও গিয়ে করলে ভাল হত না?”

আহিরী বলল, “স্যরি। এস গাড়িতে ওঠো।”

গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে আহিরী বলল, “কোন দিকে যাবে? হোয়্যার‌‌ ইজ ইয়োর হেভেন? সিট বেল্টটা লাগাও।”

বিতান বলল, “আমার স্বর্গ সব সময়েই আমার বাড়ি, আমার ঘর। দেয়ার ইজ নো বস, নো চাপ।‌ আগে ট্র্যাফিকের ভিড় টপকে চলো বাইপাসে উঠি।”

আহিরী চুপ করে গাড়ি চালাতে লাগল। সেক্টর ফাইভের রাস্তাগুলো সরু। সতর্ক হয়ে গাড়ি চালাতে হয়। যারা জায়গাটা বানিয়েছিল, তাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। এই দেশে এটা বড় সমস্যা। পরিকল্পনার সময় কেউ দূরটা দেখতে চায় না। এখানেও বুঝতে পারেনি, এক সময় অফিস, গাড়ি, লোকজনের এতটা চাপ বাড়বে। একটা সময়ে পিক আওয়ারে গাড়ি নড়তে চাইত না। তাও তো ‘ওয়ান ওয়ে সিস্টেম’ দিয়ে এখন অবস্থা কিছুটা সামলানো হয়েছে। আহিরীর মনে হল, জীবনে এরকম কোনও সিস্টেম থাকলে ভাল হত। পথের মতো জীবনের জটও ছাড়ানো যেত। বিতান কোথায় যেতে চাইছে? কফি শপে? রুবি মোড় থেকে একটু গেলে গলির মধ্যে ছিমছাম একটা কফি শপ আছে। কয়েক বার দু’জনে বসেছে।

বিতান সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “সিরিয়াস কথা নম্বর এক হল, আজকের ইন্টারভিউতেও ফেল করেছি। নিজের ইচ্ছেতেই ফেল করেছি। ওরা জিজ্ঞেস করল, হায়দরাবাদ বা কোচিতে যেতে রাজি আছি কি না। বললাম, না।”

আহিরী স্টিয়ারিং থেকে মুখ ঘুরিয়ে অবাক গলায় বলল, “কেন? রাজি নও কেন?”

বিতান একটু চুপ করে থেকে বলল, “আমি গেলে তুমি খুশি হতে?”

আহিরী উত্তেজিত হয়ে বলল, “আমার খুশি হওয়া না হওয়ার কী আছে? চাকরি করতে হলে তো বাইরে যেতেই‌ হবে। এখন ক’টা লোক কলকাতায় বসে আছে? আমাদের মতো যারা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় তাদের কথা আলাদা। তাও বাইরের ভাল কোনও ইনস্টিটিউটে চান্স পেলে চলে যাবে।”

বিতান আহিরীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “তুমিও যাবে?”

আহিরী খানিকটা তেড়েফুঁড়ে বলল, “শিয়োর! ইউরোপ বা আমেরিকার‌ কোথাও পড়ানোর চান্স পেলে ছেড়ে দেব? সেরকম হলে ওখানে গিয়ে আবার রিসার্চ করব। আমি তো তোমার মতো কেরিয়ার না করা, গুটিয়ে থাকা মানুষ নই।”

বিতান মৃদু হেসে বলল, “কেরিয়ারের জন্য যোগ্যতা লাগে আহিরী ম্যাডাম।”

যুবভারতী স্টেডিয়ামকে ডান দিকে রেখে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে বাইপাসে উঠল আহিরী। তার রাগ হচ্ছে। কলকাতার বাইরে যেতে হবে বলে ভাল চাকরির সুযোগ কেউ ছেড়ে দেয়!‌

“তুমি বাইরে যেতে রাজি হলে না কেন?”

বিতান বলল, “বললে বিশ্বাস করবে না।”

সামনের গাড়িটাকে আলোর সিগনাল দিয়ে জায়গা দিতে বলল আহিরী। জায়গা দিচ্ছে না। নিশ্চয়ই গ্লাসে তাকে দেখে নিয়েছে। মেয়েদের গাড়ি চালানো আজও এই শহর পুরো মেনে নিতে পারেনি। অ্যাক্সিলেটরে হালকা চাপ বাড়িয়ে আহিরী বলল, “তাও শুনি!”

বিতান বলল, “আমার এখানে কাজ আছে।”

সামনের গাড়িটার একেবারে গায়ের কাছে চলে গেল আহিরী। হর্ন দিল। লাভ হল না। ইচ্ছে করে যেন তাকে আটকাচ্ছে।

“তোমার কাজ!‌”

বিতান বলল, “বলেছিলাম, বিশ্বাস করবে না। যাই হোক, তোমাকে সেকেন্ড সিরিয়াস কথাটা বলি। আমি এখন যে রিয়েল এস্টেট কোম্পানিটায় পার্ট টাইম কাজ করছি সেটাও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

সামনের গাড়িটাকে ওভারটেক করতে করতে আহিরী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “স্কাউন্ড্রেল!‌”

বিতান ভুরু তুলে বলল, “কে? আমি তো?”

আহিরী বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “ডোন্ট বি ওভারস্মার্ট। গালটা ওই গাড়ির ড্রাইভারের জন্য। যাক, এই কাজটা ছেড়ে দিয়ে ভাল করলে। ফুল বেকার হতে পারলে।”

আহিরীর ব্যঙ্গ বিতান গা করল না। বলল,‘কোম্পানির মালিককে বলেছি, ভোরবেলা ফ্ল্যাটের জানলায় কীভাবে পাখি ডাকবে আমি কাস্টমারদের শোনাতে পারব না স্যার। আপনি বরং আমার জায়গায় কোনও হরবোলাকে রাখুন। ওরা পশুপাখির ডাক ভাল পারবে।’

আহিরী থম্ মেরে গাড়ি চালাতে লাগল। বিতান বলল,‘আমার হাতে আরও একটা সিরিয়াস কথা আছে। এটাই লাস্ট। কথাটা গাড়িতে বলা যাবে না। বলল, “তুমি কি শুনবে?”

আহিরী বলল, “আমি শুনতে চাই না।”

বিতান অল্প হেসে বলল, “তুমি রেগে গেছ আহিরী। আমি চাকরিটা নিলে তুমি খুশি হতে। সেটাই স্বাভাবিক। স্যরি।”

আহিরী সত্যি রেগে গিয়েছে। কিন্তু এতখানি প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় একটু লজ্জা পেল। ছেলেমানুষি হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমার রাগের কী আছে? তুমি নিশ্চয়ই সুবিধে অসুবিধে বুঝেই ডিশিসন নিয়েছ। এবার বলো, কোথায় তুমি তোমার লাস্ট সিরিয়াস কথাটা বলতে চাও।‌”

বিতান একটু চুপ করে থেকে বলল, “থাক। এক দিনে অনেক সিরিয়াস কথা বলা হয়ে গেছে। তুমিও অনেক রাগারাগি করলে। পরে কোনও দিন বলব। বরং চলো, আজ তোমাকে কফি বানিয়ে খাওয়াই। গরম কফি খেয়ে মাথা ঠান্ডা করবে।”

গিয়ার বদলে আহিরী অবাক গলায় বলল, “তুমি কফি বানাবে মানে!‌”

বিতান চোখ বড় করে বলল, “কেন? আমি কফি বানাতে পারি না? শুধু কফি কেন, রান্নাও করতে পারি। সব সময় আমাকে তুমি শুধু আন্ডারএস্টিমেট করে গেলে আহিরী, আর আমার উপর রাগ করে গেলে। টিপিক্যাল মাস্টারনি টাইপ হয়ে যাচ্ছ। সবাইকে ছাত্র হিসেবে দেখছ, ধমক দিচ্ছ, আর জ্ঞান বিতরণ করছ— ভাল করে লেখাপড় করো, ভাল চাকরি পাও, ভাল সংসার করো।”

আহিরী বলল, “কী বলব? লেখাপড়া না করে উচ্ছন্নে যাও?”

বিতান বলল, “আবার ঝগড়া করছ? আমি রোজ খাই কী? ঘাস? নিজের রান্না নিজে করে খাই। তোমাদের মতো তো আমার বাড়িতে কুক নেই।”

আহিরী বলল, “সার‌প্রাইজ়িং!‌ আমি তো জানি, তুমি ভাত সেদ্ধ ছাড়া কিছুই পারো না। ও হ্যাঁ, ডিম ভাজতে পারো। আমাকে বলেছিলে।”

বিতান মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “নিজেকে ডেভেলপ করেছি। সাহস থাকলে চলো, আজ পরীক্ষা হয়ে যাক। আজ আমার বাসস্থানে তোমার ডিনারের নেমন্তন্ন।”

আহিরীর ভাল লাগছে। এত ক্ষণে সে সহজ হতে পেরেছে। সত্যি কি সে টিপিক্যাল মাস্টারনি টাইপ হয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই হচ্ছে। সারা ক্ষণ ভবিষ্যতের কথা ভাবছে। বিতানের কেরিয়ার নিয়ে ভাবা মানে তো আসলে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবা। বিতান বিতানের মতো। এলোমেলো। কেরিয়ারবিমুখ। সে অল্প নিয়ে থাকতে চায়। তার বিশ্বাস–অবিশ্বাস, ভ্যালুজ় তার মতো। এই মানুষটাকে সে ভালবেসেছে। সেই ভালবাসায় ভবিষ্যতের হিসেব কষা অঙ্ক ছিল না। তা হলে? এত টেনশন কেন? মা ভাল বিয়ের চাপ দিচ্ছে বলে? শুধু কি তা-ই? নিজের খচখচানি নেই? কলেজে পড়াচ্ছে, সমাজে এক ধরনের সম্ভ্রম পাচ্ছে, সে কেমন ছেলের সঙ্গে মিশছে পাঁচ জন দেখবে, তা নিয়েও কি চিন্তিত নয়? শুধু মায়ের চাপের কথা বললে কেন হবে? নিজের ওপর রাগ হল আহিরীর।

বিতান বলল, “কী হল, আমার হাতের প্রিপারেশনে ডিনার করবে তো?”

আহিরী বলল, “সিরিয়াসলি বলছ নাকি?”

বিতান বলল, “অবশ্যই। আর একটু গেলেই আমার ফ্ল্যাট। তুমি তো কখনও গিয়ে দেখোনি আমি কেমন ভাবে থাকি। সেটাও দেখে আসবে।”

আহিরী এবার থতমত খেয়ে খেল। বিতানের সঙ্গে তার ফ্ল্যাটে যাবে? যেখানে বিতান ছাড়া আর কেউ থাকে না।‌ এই প্রস্তাব আগে কখনও বিতান তাকে দেয়নি। যাওয়া ঠিক হবে? আহিরী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল। না, ঠিক হবে না। যে ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন থাকবে কোনও ঠিক নেই, তার সঙ্গে একা ফ্ল্যাটে সময় কাটানোর কথা ভাবতে তার অস্বস্তি হচ্ছে। অন্য কেউ হলে এই অস্বস্তি হত না। বিতান বলেই হচ্ছে। এই ছেলের সঙ্গে সে মনের দিক থেকে যুক্ত।

রুবি পেরিয়ে আরও খানিকটা গিয়ে বাঁ পাশে গাড়ি দাঁড় করাল আহিরী। যতটা সম্ভব সুন্দর করে হেসে বলল, “আজ থাক। বাড়িতে চিন্তা করবে। ঘেরাওয়ের ঘটনাটার পর থেকে মা চিন্তা করে।”

বিতান বলল, “ডিনার করতে হবে না। কফি খেয়ে যাও প্লিজ়।”

বাঁ হাতটা বাড়িয়ে বিতানের হাতের উপর রাখল আহিরী। বলল, “আজ নয়। পরে একদিন।”

বাইরের রাস্তা আলো-ঝলমলে হলেও, গাড়ির ভিতরটা আলো–ছায়া মাখা। বিতান আহিরীর মুখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, “পরে একদিন কি আর সময় হবে আহিরী?” তারপর একটু হেসে, দরজা খুলে বলল, “থাক। তোমারও তো একটা প্রেস্টিজ আছে। ‌চলি। গুড নাইট।”

বিতান নেমে যাওয়ার পর আহিরী গাড়ি স্টার্ট দিল। মিনিট পাঁচেক ড্রাইভ করার পরই বুঝল, তার মন খারাপ।‌ খুব মন খারাপ। সে মোবাইল তুলে নম্বর টিপল।

“মা, আমি এক বন্ধুর বাড়িতে কফি খেতে যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে। আরে না না, ঘেরাও টেরাও নয়.‌.‌.‌ গাড়ি চালাচ্ছি শুনতে পাচ্ছ না? উফ, কার বাড়ি তুমি শুনে কী করবে? আমি কি স্কুলে পড়ি? কার বাড়ি বললে নিশ্চিন্ত হবে? আমাদের এইচওডি চান্দ্রেয়ীদির বাড়ি বললে? ‌খুশি?”

মোবাইল ড্যাশবোর্ডে রেখে আহিরী নিজের মনে বলল, “মহিলার ‌মাথাটা পুরো গেছে।”

সামনের মোড় থেকে গাড়ি ঘোরাল আহিরী।

‌‌‌‌১২

“তুমি শিয়োর?”

সৌহার্দ্য বলল, “হ্যাঁ স্যর।”

কমলেশ রায় স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কীভাবে শিয়োর হলে ‌জানতে পারি?”

সৌহার্দ্য বলল, “স্যর, আমি আগে একটা ফার্মে কাজ করেছি। সেখানে সেম প্রবলেম হয়েছিল। হঠাৎ একদিন সার্ভার ডাউন হয়ে গেল। সব কম্পিউটার একসঙ্গে ডাউন। ঠিক করার পর দেখা গেল, অনেক ফাইল ডিলিট হয়ে যাচ্ছে। তারপর পি সি ধরে ধরে চেক করার সময় বিষয়টা ধরা পড়ে।”

কমলেশ বলেন, “কী ধরা পড়ে?”

সৌহার্দ্য শান্ত ভাবে বলে, “ধরা পড়ে ইট ওয়াজ নট আ টেকনিক্যাল ফল্ট স্যার। সিস্টেমে ইচ্ছাকৃত ভাবে ভাইরাস ইনপুট করা হয়েছে।”

কমলেশ ত্রিপাঠীর দিকে তাকালেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে নার্ভাস। সৌহার্দ্যকে সে–ই জেনারেল ম্যানেজারের কাছে নিয়ে এসেছে। কম্পিউটার সারানোর পর সৌহার্দ্যই তাঁকে ভাইরাসের ঘটনাটা জানায়। বলে, এটা কেউ ইচ্ছে করে করেছে। ত্রিপাঠীর বিশ্বাস হয়নি। এতগুলো মেশিন ইচ্ছে করে শাট ডাউন করা যায় নাকি!‌

সৌহার্দ্য বলল, “কেন যাবে না? ভাইরাস ঢুকিয়ে দিলেই সম্ভব। অফিসের সার্ভার অ্যাফেক্টেড হলেই তো সব কোলাপ্‌স করবে।”

ত্রিপাঠী অবিশ্বাসের সুরে বললেন, “ইঞ্জিনিয়ার তো কিছু বলল না! বাইরে থেকে যে এল, সেও.‌.‌.‌”

সৌহার্দ্য বলল, “কেন বলেনি আমি বলতে পারব না স্যর। মনে হয় ধরতে পারেনি।”

এর পরই ত্রিপাঠী ঘাবড়ে গিয়ে কমলেশ রায়কে ফোন করেন। এই ছেলের কথা তিনি পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারেননি। ক’দিন আগেই সৌহার্দ্য তাদের চমকে দিয়েছে। যে ভুল এত বছরেও কেউ বুঝতে পারেনি, মাত্র ক’দিন এসে তা খুঁজে বের করেছে। একে দুম করে অবিশ্বাস করা মুশকিল। সৌহার্দ্য তাঁর ঘর থেকে চলে যাওয়ারই পরেই তিনি জেনারেল ম্যানেজারকে ফোন করেছেন। সৌহার্দ্যকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর ঘরে এসেছেন।‌ সৌহার্দ্য খুব সহজ ভাবেই কথা বলেছে। তার চোখমুখ বলছে, ঘটনা সম্পর্কে সে নিশ্চিত।

কমলেশ রায় বললেন, “ইচ্ছাকৃত ভাবাটা আমাদের বেশি হয়ে যাচ্ছে না তো? ‌বাইরে থেকেও তো ভাইরাস ঢুকতে পারে। সারা পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ।”

ত্রিপাঠী বললেন, “উই ইউজ় লেটেস্ট অ্যান্টি-ভাইরাস সফটওয়্যার, স্যর।”

সৌহার্দ্য বলল, “হতে পারে স্যর। তবে আমার পুরনো অফিসের এক্সপিরিয়েন্স অন্য কথা বলছে। সেখানেও অ্যান্টি-ভাইরাস প্রোটেকশন ছিল। যে কাজটা করেছিল, সে জেনেবুঝেই করেছিল।”

কমলেশ চেয়ারে হেলান দিলেন। সৌহার্দ্য ছেলেটাকে তিনি বোঝার চেষ্টা করছেন। ছেলেটা কি তাঁর সঙ্গে কোনও খেলা খেলতে চাইছে? সে কি তার মায়ের সঙ্গে কমলেশ রায়ের রিলেশনের কথা‌ জানে? জানে বলেই প্রথম দিন বাবার নাম জিজ্ঞেস করায় মায়ের নামও জুড়ে দিয়েছিল! বহু দিনের লুকিয়ে থাকা ভুল খুঁজে বার করে নজরে পড়তে চেয়েছে। পড়েছেও। এক লাফে জেনারেল ম্যানেজারের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তারপর কাপ ভেঙে সাবধান করেছে। বুঝিয়ে গিয়েছে, আমি কিন্তু ছাড়ব না। আর আজ এসে বলছে, অফিসে সাবোটাজ হয়েছে! এই পর্যন্ত ভেবে কমলেশ মনে মনে নিজেকে ধমক দিলেন। কী উদ্ভট কথা ভাবছেন তিনি!‌ তাঁর যুক্তিবুদ্ধি কি সব লোপ পেল? সৌহার্দ্য তাঁর কথা জানবে কী করে? তার মা নিশ্চয়ই নিজের ভেঙে যাওয়া প্রেমের গল্প ছেলের কাছে করবে না।‌‌ ত্রিপাঠীর কথায় ঘোর কাটল কমলেশের।

“স্যর, হোয়াট শুড উই ডু নাউ?”

কমলেশ চিন্তিত ভাবে বললেন, “ভাবতে হবে। সৌহার্দ্য যা বলেছে তা যদি সত্যি হয় সেটা একটা ক্রাইম। মেজর ক্রাইম। ফলে আমাদের আগে মোর দ্যান হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিয়োর হতে হবে। বাইরে থেকে কাউকে এনে স্টাফেদের পি সি চেক করতে গেলে সবারই সন্দেহ হবে। আপত্তিও করতে পারে। একেই কিছু দিন আগেই প্রোডাকশন ম্যানেজার আদিত্য সাহার ঘটনাটা ঘটেছে। আমাদের প্রতিটা স্টেপ ভেবেচিন্তে ফেলতে হবে।”

সৌহার্দ্য বলল, “স্যর, আপনারা যদি অনু্মতি দেন আমি একবার চেষ্টা করতে পারি।”

ত্রিপাঠী অবাক হয়ে বললেন, “তুমি চেষ্টা করবে!‌ কী চেষ্টা করবে?”

সৌহার্দ্য বলল, “স্যর, একটা সময় আমি কম্পিউটার নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছি। নিজের ইন্টারেস্টেই। আমার ধারণা, খুব বেশি সার্চ করতে হবে না। প্রোডাকশন আর অ্যাকাউন্টসের মেশিনগুলো একটু দেখলেই হবে।”

কমলেশ বললেন, “কেন?”

সৌহার্দ্য মাথা নামিয়ে বলল, “কেন তা এখনই বলতে পারব না। তবে মনে হচ্ছে।” একটু থেমে সৌহার্দ্য হাসল। বলল, “আমি অবশ্য চাইব, আমার এই সন্দেহ মিথ্যে প্রমাণ হোক।”

কমলেশ ও ত্রিপাঠী মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। বসের ইঙ্গিত বুঝতে পারলেন ত্রিপাঠী। সৌহার্দ্যকে বললেন, “তোমার কথা শুনলাম। আমরা একটু কথা বলে নিই। দেন উই শ্যাল টেক আ ডিসিশন।”

সৌহার্দ্য উঠে দাঁড়াল। চেয়ার সরিয়ে ওঠার সময় কমলেশ খুব মন দিয়ে নজর করলেন, ছেলেটার বাঁ হাতটা ঠিক কোথায় থাকে। সামনে রাখা চায়ের কাপে ধাক্কা মারে কি?

না, সৌহার্দ্য স্বাভাবিক ভাবেই হাত সরিয়েছে। তা হলে সেদিন কী ঘটেছিল? প্রথম দিনের নার্ভাসনেস? এ নার্ভাস হওয়ার মতো ছেলে নয়।

সৌহার্দ্য ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে ত্রিপাঠী বললেন, “কী করব স্যর? আমার তো মনে হয় এই ছেলের ওপর ডিপেন্ড না করে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। সে কিছু সাসপেক্ট করছে কি না জানা দরকার।”

কমলেশ ভুরু কুঁচকে বললেন, “অবশ্যই। ত্রিপাঠী, আমার বিশ্বাস, ছেলেটি বেশি বলছে।”

ত্রিপাঠি বললেন, “মোটিভ?”

কমলেশ অস্ফুটে বললেন, “পুরোটা বুঝতে পারছি না। হয়তো কোম্পানির অ্যাটেনশন চাইছে।”

ত্রিপাঠী বললেন, “অলরেডি তো কিছুটা পেয়েছে। আজও পেল। অ্যাটেনশন পাওয়ার মতোই ছেলে। ও যা বলছে তা যদি সত্যি হয়.‌.‌.‌”

কমলেশ বললেন, “এখনই ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলো। দরকারে আমিও বসব। ইট’স আ ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। ‌দেরি করা ঠিক হবে না।”

ত্রিপাঠী চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন, “আমি যোগাযোগ করছি স্যর। মুম্বই থেকে ঘটনার একটা রিপোর্ট চেয়েছে। আমি প্রাইমারি একটা লিখে আপনার মেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। দেখে নিন।”

ঘর ফাঁকা হলে চেয়ারে হেলান দিলেন কমলেশ রায়। কয়েকটা দিনের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা পর পর ঘটে গেল। সৌহার্দ্যর সঙ্গে যোগাযোগ, এত বছর পরে কোথা থেকে যেন ভেসে এল শ্রীকণা, আহির বিয়ের জটিলতা, অফিসের সমস্যা। সেই সঙ্গে বেড়ে চলেছে নবনীর সঙ্গে দূরত্ব। জীবনের এটাই নিয়ম। যখন ঘটনা ঘটতে থাকে তারা আসে পর পর, ঢেউয়ের মতো। খুব দ্রুত ঘটতে থাকে।

শ্রীকণার সঙ্গে সম্পর্কের শেষটুকুও খুব দ্রুত ঘটেছিল। ঘটেছিল, নাকি তিনি ঘটাতে বাধ্য হয়েছিলেন?

কমলেশ ইন্টারকমে আর এক কাপ চা চাইলেন। অফিসে সত্যি যদি সাবোটাজ হয়ে থাকে সেটা তাঁর জন্য মোটেও ভাল নয়। কেরিয়ারে একটা খুঁত থেকে যাবে। আর ক’টা দিনই বা কাজ করবেন? হেড অফিস থেকে যতই বলুক, তিনি এবার এক্সটেনশন নেবেন না। একটাই চিন্তা, বাড়িতে সারা দিন থাকা যাবে না। একটা ইনভল্‌ভমেন্ট খুঁজে নিতে হবে।

শ্রীকণার সঙ্গে আলাপ কলেজে। থার্ড ইয়ার তখন। ফার্স্ট ইয়ার আসার পর প্রতি বছরের মতো সে বারও হইহই করে ‘ফ্রেশার্স ওয়েলকাম’ হল। পড়াশোনায় মনোযোগী ছাত্র কমলেশ এই সবের মধ্যে থাকতেন না। ফাংশনের সময় পিছনে বসে খানিকটা সময় কাটিয়ে পালিয়ে যেতেন। সে বারও তাই প্ল্যান ছিল। এই ফাংশনের একটা মজা ছিল, ফার্স্ট ইয়ারের নতুন ছেলেমেয়েদের জোর করে স্টেজে তুলে দেওয়া। তারা গান, আবৃত্তি, নাচ করবে। না পারলে দুটো কথা বলবে। তাও যদি না চায় শুধু হাত নাড়লেও চলবে। কিন্তু স্টেজে একবার উঠতেই হবে। সেদিনও এই সব হচ্ছিল। কমলেশ উঠব উঠব করছেন, এমন সময় জড়োসড়ো ভাবে একটি মেয়ে স্টেজে এল। বাকিদের মতোই শাড়ি, আর চুলের বেণিতে ফুলের মালা জড়ানো। এই ধরনের ফাংশনে অল্পবয়সি মেয়েরাও ‘বাঙালি’ সাজতে খেপে ওঠে। কমলেশ ওঠার আগে মেয়েটির দিকে তাকান। শরীর ঝনঝন করে ওঠে।‌ মেয়েটি যে খুব রূপসি এমন নয়, কিন্তু দুটো চোখে এ কী মায়া!‌ এমন চোখ কমলেশ আগে দেখেননি। মেয়েটি মাথা নিচু করে গান শুরু করল, দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি/ তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি.‌.‌.‌

উদ্দাম হুল্লোড় নিমেষের জন্য যেন থমকে গেল। কমলেশ গানবাজনা বোঝেন না। মেয়েটি ভাল গাইছে না মন্দ, কোনও ধারণাও তাঁর নেই। কিন্তু এটুকু বুঝলেন, লাজুক, সাধারণ এই মেয়েটিকে পাশে না পেলে তাঁর জীবনটাই অর্থহীন, শূন্য হয়ে যাবে। এই মায়াভরা চোখের দিকের তাকিয়ে তাঁকে সারা জীবন পথ চলতে হবে।

যারা প্রেমের পাশ দিয়ে কখনও যায় না এবং পণ করে থাকে, ‘আর যাই করি, প্রেমে পড়ে সময় নষ্ট করব না’, তারা হঠাৎ প্রেমে পড়লে বিরাট সমস্যা। একটা ঘোর তৈরি হয়। যুক্তি, বু্দ্ধি সব লোপ পায়। কমলেশ রায়ের তা-ই হল। মেয়ে হিসেবে শ্রীকণা সত্যি সাধারণ। মধ্যবিত্ত পরিবার, সংসার চলে টেনেটুনে। শ্রীকণার বাবা দুই ছেলেমেয়েকে কষ্ট করে লেখাপড়া শেখাতেন। কোনও উচ্চাশা ছিল না। ছেলে চালিয়ে নেওয়ার মতো একটা চাকরি পাবে, মেয়ের মোটামুটি একটা ঘরে বিয়ে হবে। বুদ্ধিদীপ্ত, লেখাপড়ায় চৌখস, স্বভাব–চরিত্রে ভাল, সুদর্শন একটি তরুণ তার প্রেমে পড়েছে জেনে শ্রীকণা প্রথমটায় যত না অবাক হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। সেই পর্যায় কেটে যাওয়ার পর তিনিও কমলেশকে আকুল হয়ে ভালবাসতে শুরু করলেন।

শ্রীকণার বাড়িতে জানাজানি হল। খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে নয়, কিন্তু বাবা–মা, এমনকী কাছের কয়েক জন আত্মীয়ও জেনে গেল— এই সাধারণ বাড়ি এক অসাধারণ ছেলেকে পেতে চলেছে। শ্রীকণার বাবা গদগদ হয়ে পড়লেন। মা মাঝে মাঝেই নাকি আনন্দে চোখের জল মুছতেন। মেয়েকে সকাল-বিকেল বিরক্ত করতেন।

“কী রে!‌ আর কত দিন?”

শ্রীকণা বলতেন, “উফ মা, সে কি চার্টার্ড পড়া ছেড়ে বিয়ের ‌পিঁড়িতে লাফ দিয়ে এসে বসবে?”

“তা না। তবে দু’বাড়ির মধ্যে তো একটা পাকা কথা হওয়া দরকার।”

শ্রীকণা বলতেন, “না, ওরা ঠিক আমাদের মতো ছাপোষা মানুষ নয়। সময় হলে সব করবে। ও তো বাড়িতে বলে রেখেছে।”

শ্রীকণার বাবাও মেয়ের কথা সমর্থন করতেন। স্ত্রীকে বলতেন, “ছেলেটাকে লেখাপড়া করতে দাও তো!”

কমলেশ এসব শ্রীকণার মুখে শুনেছিলেন। মুখে হাসলেও মনে মনে হালকা চিন্তিত হতেন। তত দিনে নিজের উজ্জ্বল কেরিয়ার দেখতে পাচ্ছেন কমলেশ। বুঝতে পারছিলেন, তাঁর জন্য একটা ঝকঝকে জীবন অপেক্ষা করে আছে। তবে শ্রীকণাকে ভালবাসায় কোনও খামতি দেখাননি। শ্রীকণাও উজাড় করে দিয়েছিলেন। যাবতীয় মধ্যবিত্ত ট্যাবু সরিয়ে রেখে কমলেশের শরীরের ভালবাসাও গ্রহণ করেছেন তিনি। সেই মিলনের আগাম কোনও পরিকল্পনা ছিল না। একেবারে হঠাৎই হয়েছিল।

এক শান্ত, নিস্তব্ধ দুপুরে কমলেশ শ্রীকণার বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে ম্যানেজমেন্ট পড়ার দুর্দান্ত সুযোগের খবর জেনেছিলেন সেদিনই। ভেবেছিলেন, শ্রীকণাকে খবরটা দিয়ে চমকে দেবেন। গিয়ে দেখলেন, শ্রীকণা ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। উত্তরপাড়া না ব্যান্ডেলে আত্মীয়ের বিয়েতে গিয়েছে সবাই।

“তুমি যাওনি?”

শ্রীকণা বলেছিলেন, “ধুস, এখন কোনও অনুষ্ঠানবাড়িতে গেলে কেবল একটাই প্রশ্ন, তোর কবে বিয়ে। কান ঝালাপালা হয়ে যায়। আমি আর কোথাও যাই না। শরীর খারাপ বলে কাটিয়ে দিই।”

“বেশ করো। চট করে কিছু খেতে দাও দেখি। ‌খুব খিদে পেয়েছে। খেতে খেতে তোমাকে একটা দারুণ খবর দেব।”

‌‌বাড়িতে তৈরি ঘুগনি আর পাঁউরুটি এনে দিলেন শ্রীকণা। মেনু দেখে মজা পেলেন কমলেশ। ঘুগনি পাঁউরুটি দিয়ে কবে শেষ টিফিন করেছেন মনে পড়ল না। খাওয়া শেষ করে বিদেশে পড়তে যাওয়ার খবরটা দিলেন। শ্রীকণার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আবার ম্লানও হয়ে গেল।

“মন খারাপ হয়ে গেল?”

শ্রীকণা জোর করে হেসে বললেন, “ছি ছি, ভাল খবরে মন খারাপ হবে কেন? কত দিন থাকবে?”

কমলেশ শ্রীকণার হাত ধরে পাশে বসিয়েছিলেন। “যত তাড়াতাড়ি পারি কোর্স শেষ করে চলে আসব। এই সুযোগ খুব কম জনেই পায়।” বলতে বলতে শ্রীকণার হাত ধরেছিলেন।

শ্রীকণা ম্লান হেসে বলেছিলেন, “তুমি তো কম জনের একজন। এই পড়া এখানে পড়া যেত না?”

কমলেশ ভুরু কুঁচকে বিরক্ত গলায় বললেন, “যাবে না কেন? তা হলে ওই দশ জনের একজন হয়ে থাকতে হবে।”

‌শ্রীকণা বলল, “ও। আমি তো এত জানি না।”

কমলেশ নিজেকে সামলে নরম গলায় বলেছিলেন, “আমার স্বপ্ন ছিল চার্টার্ড পাশ করার পর বিদেশ থেকেও আরও ডিগ্রি নিয়ে আসব। শ্রীকণা, আমার স্বপ্ন সত্যি হলে তুমি খুশি হবে না?”

শ্রীকণা বলেছিলেন, “আমি খুশি হয়েছি।”

কমলেশ বলেছিলেন, “ওই ভাবে বললে হবে না, হেসে বলতে হবে।”

শ্রীকণা হেসে বলেছিলেন, “আচ্ছা, হেসেই বলছি, আমি ভীষণ ভীষণ খুশি।”

দু্’হাতে শ্রীকণার মুখ চেপে ধরে বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখের পাতায় চুমু খেয়েছিলেন কমলেশ।

“এই, কী হচ্ছে!‌ ছাড়ো ছাড়ো!” বলতে বলতে গভীর লজ্জা নিয়ে সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিলেন শ্রীকণা। ঘরের এক পাশে রাখা সামান্য তক্তপোশের ওপর শ্রীকণাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে কমলেশ অনুভব করেছিলেন, শুধু চোখ নয়, এই মেয়ের সারা শরীর জুড়ে মায়া ছড়িয়ে আছে। অপটু, অনভিজ্ঞ হাতে শ্রীকণাকে আদরে পাগল করে দিতে দিতে কমলেশ সেদিন তাঁর কানে ফিসফিস করে বলেছিলেন, “আমার জন্য অপেক্ষা করবে। যত দেরি হোক, আমার জন্য অপেক্ষা করবে।”

কমলেশের বুকে আঙুল বোলাতে বোলাতে শ্রীকণা বলেছিলেন, “আচ্ছা, আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি না?”

কমলেশ বলেছিলেন, “খেপেছ? আমি স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাচ্ছি, তুমি কী করবে?”

শ্রীকণা একটু থমকে থেকে বলেছিলেন, “কেন, স্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া যায় না?”

কমলেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, “এটা ঠিক নয় শ্রীকণা। কোথায় তুমি বলবে, আমি যেন ভাল করে কোর্সটা শেষ করতে পারি, তা না করে তুমি বিয়ে-টিয়ের মতো পাতি বিষয় নিয়ে ভাবছ।”

“রাগ করছ কেন? মজা করলাম তো।‌”

কমলেশ শ্রীকণার মুখটা কাছে টেনে এনে বললেন, “বললাম তো অপেক্ষা করবে।”

শ্রীকণা গাঢ় স্বরে বললেন, “সাবধানে থাকবে। মেমসাহেবদের পাল্লায় পড়বে না। আর.‌.‌. আর শুনেছি ওসব জায়গায় সবাই খুব ড্রিঙ্ক-ট্রিঙ্ক করে। তুমি কিন্তু একদম না.‌.‌.‌ মাতালে আমার বড্ড ভয়।”

কমলেশ হোহো হেসে উঠে বলেছিলেন, “তুমি কি একশো বছর আগের মানুষ শ্রীকণা?”

টেবিলে চা দিয়ে গিয়েছে। চোখ খুলে, চেয়ারের ব্যাক-রেস্ট থেকে মাথা তুলে কমলেশ হাত বাড়ালেন। চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। কাপটা সরিয়ে নিজের মনেই হাসলেন কমলেশ। জীবনের অনেক উত্তাপই এরকম। কখন যে ঠান্ডা হয়ে যায়, বোঝাও যায় না। হঠাৎ একসময় খেয়াল হয়।

সে দিনের পর থেকেই খটকা শুরু হয়েছিল। বিদেশে পড়া শুরু করেই কমলেশ খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিলেন, বড় ভুল করেছেন। শ্রীকণার মতো শান্ত, অতি সাধারণ মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করা উচিত হয়নি। তিনি যে জীবনে প্রবেশ করতে চলেছেন, সেখানে শ্রীকণা বেমানান। টিফিনের মেনুতে ঘুগনি–পাঁউরুটি‌, মেমসাহেবদের সঙ্গে না মেলামেশা করা, মদ খাওয়া নিয়ে সেকেলে ভাবনাচিন্তা হয়তো বাইরে থেকে বদলানো যাবে, ভিতর থেকে যাবে না। এটা কি কমলেশ হঠাৎ জানতে পারলেন? নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলেন কমলেশ।‌ না, শ্রীকণা যে একজন সাধারণ মেয়ে, সে কথা তিনি সেই কলেজ-জীবন থেকেই জানতেন। তিনি নিজেও তো অসাধারণ কিছু ছিলেন না। লেখাপড়া, কেরিয়ারের মধ্যে দিয়ে যত একটু একটু এগিয়েছেন, আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা হয়েছেন। শ্রীকণার সঙ্গে মেলামেশা করেই বুঝেছেন, টাকাপয়সা, শিক্ষা, রুচিতে দুটো পরিবারে তফাত অনেকটাই। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজনই হয়নি। নিজের পারিবারিক আভিজাত্য, বাবা–মা, দুই দিদির নাক-উঁচু আচরণ তাঁকে হয়তো খানিকটা ক্লান্ত করেছিল। শ্রীকণাকে ভাল লাগার এটাও একটা বড় কারণ। এই মেয়ে সাধারণ মেয়ে। তখন তো ভাবতে হয়নি এই ‘সাধারণ মেয়ে’টিকে তরুণ বয়সে ভাল লাগছে ঠিকই, কিন্তু সারা জীবন পাশে নিয়ে চলতে কেমন লাগবে? মায়াভরা দুটো চোখ কখনও অর্থহীন, অসহ্য মনে হবে না তো? ‌এত দিনের ভালবাসা, আবেগ, মুগ্ধতা বিয়ের মতো একটা সামান্য কারণে বিশ্রী কলহ, হিংসা, ডিভোর্সে ভেসে যাবে না তো? যাবেই তো। কমলেশ স্পষ্ট দেখতে পেলেন। জীবন তাঁর ঝকঝকে কেরিয়ারের জন্য বারবার বাধা তৈরি করছে। সেদিন শরীরের ভালবাসায় মেতে ‘অপেক্ষা’ করতে বলাটা কি ভুল হয়েছে? হতে পারে। মানুষ কি ভুল করে না? সেই ভুল সংশোধনও করে।

কিন্তু কীভাবে? শ্রীকণাকে এসব কথা মুখে বলা যাবে না। চিঠি লিখে? না, তাও নয়। এ প্রত্যাখান শ্রীকণা বুঝতে পারবে না। কমলেশ ক’দিন খুব অশান্তির মধ্যে রইলেন। ক্লাসে মন বসল না, রাতে ঘুম হল না।

এক ঝিরঝিরে বৃষ্টির বিকেলে হাইড রোডের পাবে বসে বিয়ার খেতে খেতে কমলেশ নিজেকে বোঝালেন, কিছু কিছু সময় জীবনকে কঠিন হতে হয়। চারপাশে অনেকেই ভুল বোঝে, নিন্দে করে। করুক। শ্রীকণা আর তাঁর স্বার্থেই, তিনি শ্রীকণাকে ভুলে যাবেন। ভুলতে হবে। তিনি ভুলতে শুরুও করলেন। যোগাযোগ একেবারে বন্ধ করে দিলেন। দেশে ফিরলেন পাঁচ বছর পর। সঙ্গে দু’বছর ম্যানেজমেন্ট পড়া ডিগ্রি আর তিন বছর বিদেশে চাকরি করার জবরদস্ত সিভি। কলকাতায় নয়, বিমান থেকে কমলেশ নামলেন মুম্বই। সেখানেই বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তাঁকে প্রথম পোস্টিং দেয়। নবনীকে বিয়ে তারও এক বছর পর। ম্যাট্রিমনিতে যোগাযোগ।

মোবাইল বেজে উঠল। কমলেশ রায় চমকে উঠলেন। এত খুঁটিনাটি সব মনে আছে!‌ না কি মস্তিস্ক ভুলে যাওয়া সব কিছু ফিরিয়ে দিচ্ছে আবার? ডিলিট হয়ে যাওয়া ফাইল‌ ফিরে পাওয়ার মতো!

মোবাইলটা বেজেই চলেছে। ক্লান্ত ভাবে কমলেশ ফোন তুললেন। নবনীর ফোন।

১৩

বিতান রান্নাঘরে। টুংটাং, খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। আহিরীকে বলে দিয়েছে, রান্নাঘরে উঁকিঝুঁকি দেওয়া চলবে না।

আহিরী গলায় কৌতুক নিয়ে বলল, “ঠিক আছে যাচ্ছি না। কিন্তু কী বানাচ্ছ জানতে পারি?”

বিতান কাঁধ ঝাঁকিয়ে কায়দা করে বলল, “অবশ্যই পারো। কিন্তু সবটা পারো না। সারপ্রাইজ় এলিমেন্ট নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তোমার জন্য আজ একটা ইতালিয়ান ডিশ বানাচ্ছি ম্যাডাম।”

আহিরী আঁতকে উঠে বলল, “এই রে!‌ বিতান, সুস্থ ভাবে বাড়ি ফিরতে পারব তো? আমাকে কিন্তু ড্রাইভ করতে হবে।”

বিতান বলল, “দেখেছ, তুমিই আমাকে বলো, সব ব্যাপারে রসিকতা করবে না? বলো কি না?”

আহিরী বলল, “সরি স্যর।”

বিতান বলল, “আমি গান চালিয়ে দিচ্ছি, তুমি শোনো। অনুভবের মিউজিক সিস্টেমটা চমৎকার। ইচ্ছে না থাকলেও আমাকে মাঝে মাঝে চালাতে হয়। অনুভব এসে যদি দেখে না চালিয়ে ওটা বিগড়েছে, বিরাট চেঁচামেচি করবে। হয়তো সারানোর খরচ চেয়ে বসবে।”

ফ্ল্যাটটা সাজানো গোছানো। মালিক যে শৌখিন তা বোঝা যায়। যাকে সে থাকতে দিয়েছে, সেও যত্ন করেই রেখেছে। ড্রইংরুমটা বেশ। সোফা ছাড়াও নিচু ডিভান রয়েছে। ডিভানের ওপর কুশন। আহিরী কোলের ওপর একটা কুশন নিয়ে ডিভানে পা তুলে বসেছে। বসেছে আরাম করে, কিন্তু অস্বস্তিও হচ্ছে। সকাল থেকে এক শাড়ি–জামায় রয়েছে, এই জন্য অস্বস্তি। শাড়িটা সুন্দর। কটন কোটা, গোলাপি-কালো কম্বিনেশন। আজ কলেজে কয়েক জন কলিগ প্রশংসা করেছে। করিডরে কয়েক জন ছাত্রীও বলল, “ম্যাম, ইউ আর লুকিং গর্জাস।”

আহিরী হেসে বলেছে, “থ্যাঙ্কু। রেজাল্ট ভাল হলে তোমাদেরও এরকম গর্জাস লাগবে।”

সাজগোজে আলাদা করে বিরাট মন না দিলেও কলেজে আসার সময় শাড়িটা বেছেই পরে আহিরী। ফ্যাশনের জন্য নয়, রুচিশীল আর এনার্জেটিক দেখানোর জন্য। সে বিশ্বাস করে, একজন শিক্ষককে কখনওই ক্লান্ত, বিষণ্ণ দেখানো উচিত নয়। তাকে যত ঝলমলে দেখাবে, ছেলেমেয়েরাও তত নিজেদের একঘেয়েমি ঝেড়ে ফেলতে পারবে। এই ব্যাপারটা নিয়ে আজও কোনও কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকার নাক-কোঁচকানো ভাব আছে। আহিরী তর্কও করেছে। একটা সময় ছিল, শিক্ষকরা যেমন-তেমন পোশাক পরে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে আসতেন। পুরুষরা কাঁধে তাপ্পি দেওয়া ব্যাগ, এক মুখ দাড়ি, ময়লা জামাকাপড়ে ক্লাস নিতেন। মহিলারা সাদা শাড়ি, হাতখোঁপা, হাতে গাদাখানেক বইয়ে ছিলেন স্বছন্দ। সময় বদলেছে। যে ছেলেমেয়েরা বাইরে ঝলমলে জীবন দেখছে তারা লেখাপড়ার জগৎটাকে বিবর্ণ দেখবে কেন? কেন তাদের মনে হবে লেখাপড়া নিয়ে থাকা মানে ময়লা পোশাক, তাপ্পি দেওয়া ব্যাগ? তখন বেতন কম ছিল, এখন তো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা গাড়ি চড়ছে। ভাল ফ্ল্যাট কিনছে। পোশাক ফিটফাট থাকতে সমস্যা কোথায়? এই বিশ্বাসেই কলেজে যাওয়ার আগে নিজের সাজপোশাকে একটু হলেও খেয়াল রাখে আহিরী।

আহিরীর মনে হচ্ছে, স্নান করতে পারলে হত। বিতানকে দেখে হিংসে হচ্ছে। সে একটা কালো রঙের ক্যাজু্য়াল ট্রাউজার পরেছে। গায়ে লাল টি-শার্ট। আর সে কিনা বসে আছে জবুথবু হয়ে, সারা দিনের ঘাম আর ধুলো মেখে। বিচ্ছিরি!

‌মিউজিক সিস্টেম চালু করে দিয়ে গিয়েছে বিতান। পেন ড্রাইভে গান বাজছে। কারপেন্টার্সের ‘টপ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। আহিরীর খুব প্রিয় গান। বিতান জানল কী করে? গাড়িতে শুনেছে নিশ্চয়ই। ‌

আহিরী ভেবেছিল, বেল টিপে বিতানকে চমকে দেবে। যদিও সে ফ্ল্যাটের নম্বর জানে না। তাতে কী? ঠিক জেনে নেওয়া যাবে। জানা হল না। গেটে সিকিয়োরিটি আটকে দিল। বিতান মুখোপাধ্যায়ের নাম বলে লাভ হল না। ফ্ল্যাটের নম্বর চাই। যাওয়ার অনুমতিও চাই। আহিরী বাধ্য হয়ে বিতানকে ফোন করল। বিতান ফোন ধরল তিন বার বাজার পর।

“কী হয়েছে?”

আহিরী বলল, “বড় বিপদ হয়েছে। তুমি ভিআইপি হয়ে গেছ।”

বিতান অবাক হয়ে বলল, “মানে!‌”

‘তোমার ফ্ল্যাটের গেটে দাঁড়িয়ে আছি। পারমিশন ছাড়া ভিআইপির ফ্ল্যাটে যেতে অ্যালাও করছে না। আটকে দিয়েছে। এসে উদ্ধার করো।”

বিতান চিৎকার করে বলল, “তুমি… তুমি এসেছ আহিরী? এক মিনিট দাঁড়াও আমি আট‌তলা থেকে লাফ দিচ্ছি।”

আহিরী প্রতিজ্ঞা করেছে, বিতানের ফ্ল্যাটে সে কিছুতেই এমন আচরণ করবে না যাতে বিতানের মন খারাপ হয়ে যায়। তাকে যেন একজন খিটখিটে মাস্টারনি মনে না হয়, যার একটাই কাজ, সবাইকে নিজের ছাত্রছাত্রী ভেবে জ্ঞান দেওয়া। সত্যি তার ভাবনাচিন্তা কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে এত ভাবার কী হয়েছে? মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে বলে? না কি বিতান ফাইনাল কিছু বলছে না তাই? যা খুশি হোক। এখন এসব গোল্লায় যাক। আজ শুধু একটাই কাজ, বিতানের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করা। বড্ড বকাবকি করা হয়ে গেছে। ছেলেটা এমনিতেই চাপে থাকে, তার উপর সেও যদি চাপ দেয়, বেচারি যায় কোথায়?

এক মিনিট না হোক, বিতান খুব তাড়াতাড়ি এসে হাজির হল। তখনও তার চোখ ছানাবড়া হয়ে আছে। গাড়ি পার্ক করিয়ে, লিফ্‌টে করে নিজের ফ্ল্যাটে এসেও বিতানের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, আহিরী এসেছে।

আরাম করে বসার জন্য আহিরী সোফার বদলে ডিভানটাই বাছল।

“হাঁ করে দেখছ কী? যাও কী সব রান্না করবে করো। আমার তো হেভি খিদে পেয়েছে। সেই জন্যই তো গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলাম।”

বিতান থতমত গলায় বলল, “আমার মাইরি বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি এটা তুমি তো!”

আহিরী বলল, “তোমাকে মাইরি বিশ্বাস করতে হবে না। তুমি খাবারের ব্যবস্থা করো।”

বিতান চোখ বড় করে বলল, “এ কী!‌ আহিরী তুমিও স্ল্যাং ইউজ় করছ!‌”

আহিরী ডিভানে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল, “আরও জানি। শুনবে? ভাবো কী? আমি স্টুডেন্ট ক্যান্টিনে আড্ডা মারা প্রফেসর। চাইলে তোমাকেও ঝক্কাস কয়েকটা শিখিয়ে দিতে পারি। আচ্ছা বলো তো.‌.‌.‌”

বিতান ঘাবড়ে যাওয়ার অভিনয় করে বলল, “ওরে বাবা, থাক থাক। বলতে হবে না। অত সহ্য হবে না।”

আহিরী হাসতে হাসতে বলল, “ছেড়ে দিলাম।”

বিতান ভুরু কুঁচকে খানিকটা ঝুঁকে পড়ে বলল, “কী ব্যাপার বলো তো আহিরী, এইটুকু সময়ের মধ্যে এতটা বদলে গেলে!‌‌ এতক্ষণ ধমকধামকের ওপর ছিলে, পারলে কান ধরে ওঠবস করিয়ে ফেলো, এখন কমপ্লিটলি চেঞ্জড!‌”

আহিরী একটা উদাসীন ভাব দেখিয়ে বলল, “তাতে কী হয়েছে? বদলের জন্য কি‌ অনেক বেশি সময় লাগে? কুঁড়ি থেকে ফুল হতে কতক্ষণ লাগে? মোমেন্টস? দুম করে কোন মুহূর্তে ফুটে যায়। গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কত সময় ধরে? বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলেন জ্যোৎস্নায় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। ব্যস, মনে হল, সংসার অসার। তিনি বেরিয়ে পড়লেন। তারপর ধরো.‌.‌.‌ গাছ থেকে আপেল পড়তেই নিউটন ‘ইউরেকা’ বলে লাফ দিয়েছিলেন। কত সময় লেগেছিল?”

বিতান চোখ গোল গোল করে বলল, “বাপ রে, তুমি তো দেখছি নাটকের ডায়লগও দিচ্ছ!‌”

মিউজিক সিস্টেমে নিচু গলায় গান বাজছে—‘সাচ আ ফিলিং কামিং ওভার মি/ দেয়ার ইজ় ওয়ান্ডার ইন মোস্ট এভরিথিং আই সি/ নট আ ক্লাউড ইন দ্য স্কাই, গট দ্য সান ইন মাই আইজ়/ অ্যান্ড আই ওন্ট বি সারপ্রাইজ়ড ইফ ইট্‌স আ ড্রিম।’

সত্যি খানিকটা যেন স্বপ্নের মতো লাগছে আহিরীর। খুব ভাল লাগছে। ভাগ্যিস এসেছে! নইলে আজকের গোটা দিনটাই তেতো হয়ে থাকত। বিতানের ওপর শুধু রাগই হত। মনে হত, ছেলেটা স্বার্থপর। তার কথা একটুও ভাবছে না। রাগ হত নিজের ওপরেও। ছেলেটাকে শুধু বকাঝকাই করে। তার সমস্যা বোঝার চেষ্টা করে না। বিয়ে করবে বলে তো বিতান তার সঙ্গে মিশতে শুরু করেনি। সেও করেনি। টাকা ফেরত দেওয়ার ছুতো করে কলেজে প্রথম যেদিন এসেছিল বিতান, সেই রাতেই তাকে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল আহিরী।

“সেদিন পাখির ছবি কী তুলেছিলেন? দেখাবেন না?”

একটু পরে বিতান লিখে পাঠাল, “দেখানোর কোনও চান্স নেই, পাখি সব উড়ে গেছে।”

আহিরী লিখল, “মানে!‌”

“ছবি পছন্দ হয়নি। ক্যামেরা থেকে মুছে দিয়েছি।”

“অন্যায় করেছেন। কিছু ছবি নিশ্চয়ই ভাল হয়েছিল।”

“না হয়নি। পাখিদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ওরা বলেছে, এর পর ওদের কাছে মোবাইল দিয়ে দিলেই হবে। ওরা সেলফি তুলে পাঠিয়ে দেবে। সে ছবি ঢের ভাল হবে। তখন আপনাকে দেখাব।”

আহিরী মুচকি হেসে লিখল, “অবশ্যই দেখাবেন। মানুষের সেলফি দেখে দেখে ক্লান্ত। এবার পাখিদের সেলফি দেখতে চাই। শুধু বলে দেবেন, ওরা যেন আকাশে ওড়ার সময় ফোটো তোলে।”

এর কিছুক্ষণ বাদে বিতান একটা ফোটো পাঠিয়েছিল। বকের মতো একটা সাদা পাখি ঝিলের জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। মুখ আর ঠোঁটটা লাল। ঘাড় এক পাশে‌ কাত করে দার্শনিক একটা ভাব নিয়ে বসে আছে। খানিকটা উদাসীনও।

ছবির তলায় বিতান লিখেছিল, “এটা আমার সেলফি। এই মাইগ্রেটরি বার্ডটি বরফের দেশ সাইবেরিয়া থেকে এসেছে। আবার ফিরে যাবে।”

খুব মজা পেয়েছিল আহিরী। একজন বুদ্ধিমান রসিক মানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। যে মানুষটার কোনও ভান নেই। এই ভাললাগাটাই ধীরে ধীরে ‘ভালবাসা’ হয়ে গিয়েছে।‌

বিতান একটা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকল।

“বোর হচ্ছ না তো? আর একটু ওয়েট করো।‌ তারপরই গরম গরম সার্ভ করব।”

আহিরী বলল, “দেখো, এমন গরম খাবার দিয়ো না যাতে তোমার মুখ পোড়ে।‌ তার আগে অনুগ্রহ করে ওয়াশরুমটা দেখিয়ে দাও। অনেকক্ষণ থেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি। হাতমুখ না ধুয়ে আর পারছি না। নতুন সাবান আছে?”

বিতান শশব্যস্ত হয়ে বলল, “ওহো স্যরি। আমার আগেই দেখিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। নো চিন্তা, একেবারে প্যাকেট ছিঁড়ে সাবান দিচ্ছি।”

আহিরী উঠে পড়ে বলল, “ঘরদোর এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখো কী করে?”

বিতান হাত উলটে বলল, “আমাকে কিছু করতে হয় না। লোকজন আছে। অনুভব দূর থেকে কন্ট্রোল করে। তবে আমার আর ভাল লাগছে না। এখান থেকে চলে যাব ঠিক করেছি। অনুভবকেও বলেছি।”

ড্রয়িংরুম লাগোয়া ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাল বিতান। ভিতরে পা রেখে একটু থমকাল আহিরী। এই ঘরটা অগোছালো। বিছানা এলোমেলো। এক পাশে জামাকাপড় ডাঁই করে ফেলে রাখা। বেডসাইড টেবিলে বইপত্র, ছাই-ভরতি অ্যাশট্রে। একটা ব্যাচেলর-ব্যাচেলর ভাব। ঘরের গন্ধটাও কেমন যেন পুরুষমানুষের শরীরের গন্ধের মতো। সিগারেট, ঘাম, আফটারশেভ লোশন মিশলে যেমন হয়। এই অগোছালো ঘরটা বেশি পছন্দ হল আহিরীর। বিতানের চরিত্রের সঙ্গে যায়। মাপে ছোট এই যা। তা হোক।

বিতান তাড়া‌তাড়ি এগিয়ে গিয়ে খাটের জামাকাপড় সরাতে গেল। লজ্জা পাওয়ার হাসি হেসে বলল, “এই সবই কাচা হয়েছে। ভাঁজ করে রাখতে পারেনি।”

আহিরী হাত তুলে বলল, “থাক। ভাল লাগছে। যাই বলো এই ঘরটা আমার বেশি পছন্দ।”

বিতান বলল, “মাস্টার বেডরুমটা খুব টিপটপ করে সাজানো। ওটা তালা মেরে রেখেছি। অনুভবকে বলে দিয়েছি, ওই ঘরে শুলে আমার ঘুম হবে না। আমি গেস্ট রুমেই থাকব। তুই যদি চাপাচাপি করিস পালাব। ও আর কিছু বলেনি। তবে আমি এমনিই এ বাড়ি ছেড়ে দেব।”

আহিরী কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। এখন এসব কথা ভাল লাগছে না। তার ভিতরটা কেমন ফুরফুরে লাগছে। সে বলল, “সে যখন ছাড়বে দেখা যাবে। এখন তো ছাড়ছ না। এবার ঘর থেকে ভাগো দেখি। ওইটা ওয়াশরুম তো? ফ্রেশ টাওয়েল আছে?”

বিতান হকচকিয়ে বলল, “টাওয়েল!‌ টাওয়েল দিয়ে কী হবে?”

আহিরী ফিক করে হেসে বলল, “তোমার মুখে চাপা দিয়ে খুন করব।” তারপর চোখ বড় করে শাসানির ভঙ্গিতে বলল, “টাওয়াল দিতে বলেছি দাও। হাতমুখ মুছব কী দিয়ে? শাড়ির আঁচল দিয়ে?”

বিতান বিছানায় রাখা কাপড়চোপড়ের স্তূপ ঘেঁটে সত্যি একটা কাচা তোয়ালে বার করে ফেলল। আলমারির তাক থেকে একটা নতুন সাবানও দিল।

“বাহ্‌, তুমি তো দেখছি বেশ সংসারী!‌ গুডবয়।‌”

বিতান বেরিয়ে যাওয়ার পর ঘরের দরজায় লক লাগিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল আহিরী। ছোট বাথরুম কিন্তু পরিচ্ছন্ন। বেসিনের কল খুলে হাত পেতে দিল। আহ্‌, কী আরাম!‌ এক মুহূর্ত ভাবল আহিরী, তারপর দ্রুতহাতে শাড়ি-‌জামা খুলে বাথরুমের আধখোলা দরজা দিয়ে ছুড়ে দিল ঘরের খাটে।

নগ্ন হয়ে শাওয়ারের তলায় মাথা বাঁচিয়ে দাঁড়াল আহিরী। চুল যেন না ভেজে। আহ্, কী শান্তি!‌ সারা দিনের ক্লান্তি, বিরক্তি, অভিমান ধুয়ে যেতে লাগল জলের ধারায়। আহিরী গুনগুন করে গাইতে লাগল, ‘অ্যান্ড দি ওনলি এক্সপ্ল্যানেশন আই ক্যান ফাইন্ড.‌.‌.‌ ইয়োর লাভ পুট মি অ্যাট দ্য টপ অব দ্য ওয়র্ল্ড.‌.‌.‌’

শাওয়ার বন্ধ করে গা মুছতে মুছতে আহিরী নিজের মনেই অবাক হল। সত্যি সে বদলে গেল নাকি? এই প্রথম সে বিতানের সঙ্গে কোনও বাড়িতে একা আছে, অথচ মনে হচ্ছে, এই বাড়িতে সে আর বিতান বহু কাল ধরে থাকে। একসঙ্গে খায়, গল্প করে। ভালবাসে, ঝগড়া করে। ইমোশনকে সে চিরকাল নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। আবেগ কেউ যেন দেখে না ফেলে। বুদ্ধিমতী মেয়ে হওয়ার এটাই সমস্যা। প্রেম করার জন্য কত পুরুষ যে হাঁকপাক করেছে তার ঠিক নেই। এখনও করে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে রোজই কেউ না কেউ প্রেম নিবেদন করছে। বিবাহিত, অবিবাহিত দুই–ই আছে। এদের মধ্যে কিছু আছে যারা ‘প্রেম– প্রেম’ বলে কান্নাকাটি করে, আসলে সেক্স চায়। ফাঁদে ফেলে যদি দেখা করা যায়। আবার কেউ কেউ আছে, সত্যি প্রেমে কাতর। একটা সময় মাথা গরম হয়ে যেত। ফোন করলে ধমকাত, আর বিরক্ত করলে ‘থানায় যাব’ বলে ভয় দেখিয়েছে। এখন আর এসব গায়ে লাগে না। বিতান সবটার দখল নিয়েছে। এক দিন সে ফোন না করলে আহিরীর মন খারাপ হয়ে যায়। তবে চট করে সে প্রকাশ করে না। ভালবাসার মানু্ষের উপরে রাগ অভিমান খুব জটিল ব্যাপার। তারা যে কখন কী করবে বোঝা যায় না।

তোয়ালে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল আহিরী। নিজের পোশাকের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল। মুচকি হাসল একটু। বিতানকে চমকে দিলে কেমন হয়? বড় রসিকতা-করিয়ে এবার তার রসিকতা দেখে কুপোকাত হয়ে যাক। খাটের উপরে পড়ে থাকা নিজের শাড়ি, জামা, অন্তর্বাস থেকে হাত সরিয়ে নিল আহিরী।

বিতান হাতে ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে। ঘেমেনেয়ে একসা। ঘরে ঢুকেই সে চমকে উঠল। ডিভানে এটা কে বসে আছে!‌

“এ কী!‌ আহিরী… তুমি!‌”

আহিরী হাতের ম্যাগাজিনটা সরিয়ে রেখে গম্ভীর ভাবে বলল, “না আমি নই, তুমি।”

বিতান থতমত গলায় বলল, “এসব কী পরেছ!‌”

আহিরী মাথার চুল বাঁচিয়ে গা ধুয়েছে, তার পরেও কিছুটা জল লেগেছে। সেই জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “নিজের জামাকাপড় চিনতে পারছ না? একে বলে ট্র্যাক প্যান্ট, আর এটা একটা ফুল স্লিভ শার্ট। তোমার জামাকাপড়ের স্তূপ থেকে বের করলাম। চোখগুলো অমন গোল গোল হয়ে গেল কেন? মনে হচ্ছে ধপাস করে পড়ে যাবে।‌”

বিতান একই রকম অবাক হওয়া গলায় বলল, “এ সব কখন পরলে?”

“কখন পরেছি তাতে তোমার কী? ঘড়ি ধরে জামাপ্যান্টের ভাড়া আদায় করবে না কি?”

বিতান কথা গুলিয়ে বলল, “না, তা নয়.‌.‌.‌।”

আহিরী কড়া গলায় বলল, “তোমার এখানে অন্য কারও স্নান করা বারণ? বন্ধু বকবে?”

বিতান জিভ কেটে বলল, “তা কেন? ভাল করেছ। বেশ করেছ। আসলে এই ড্রেসে তো তোমাকে কখনও দেখিনি, তাই চমকে গেছি।”

আহিরী হেসে বলল, “রসিকতাসম্রাট, এত ঘাবড়াবেন না। মনে রাখবেন, রসিকতা আমিও জানি। অনেক ক্ষণ‌ ধরেই মনটা স্নান-স্নান করছিল। ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ারটা দিলাম খুলে। গা ধোওয়ার পর মনে হল, শাড়ির ভারে জবুথবু হয়ে না থেকে হালকা কিছু পরি। কিছু ক্ষণ তো এখানে আছি। দেখলাম, তোমার জামাপ্যান্টই বেস্ট। কেমন লাগছে আমাকে?”

বিতান এক পা পিছিয়ে, ভুরু কুঁচকে, এ পাশ- ও পাশ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “হলিউডি মুভির কোনও নায়িকার মতো। ‌সিক্সটিজ়ের কোনও এক জন.‌.‌.‌ গ্রেস কেলি? অড্রে হেপবার্ন? মেরিলিন মনরো? চিন্তায় ফেললে। কোন জন, ঠিক ধরতে পারছি না। দাঁড়াও বলছি। আর একটু দেখতে হবে।”

আহিরী দু’হাতে বিতানের গলা চেপে ধরল।

“একদম খুন করে ফেলব। আমার রূপ নিয়ে ঠাট্টা? জানো, এই রূপের জন্য দেশে-বিদেশে কত লোক পাগল!”

বিতান কান্নার অভিনয় করে বলল, “মরে যাব.‌.‌.‌ মরে যাব। ট্রে উলটে পড়বে।”

আহিরী বলল, “পড়ুক। আগে স্যরি বলো।”

বিতান বলল, “স্যরি, স্যরি, স্যরি।”

আহিরী হেসে, ‌গলা ছেড়ে, ডান হাত দিয়ে বিতানের নাক নেড়ে দিয়ে বলল, “গুড বয়। ‌দাও এবার কী করেছ। খিদে ডবল হয়ে গেছে।”

ডিভানের উপরেই ট্রে রাখল বিতান। দুটো বড় বড় মেলামাইনের বাটি। চামচও দেওয়া আছে।

“এই নাও, ইতালিয়ান ডিশ। দ্য গ্র‌্যান্ড পাস্তা।”

আহিরী বাটি হাতে নিয়ে চোখ বড় করে বলল, “এই তোমার রান্না!‌”

বিতান বলল, “অবশ্যই। ঠিকমতো পাস্তা রান্না করা কম খাটুনি না কি? তোমাদের ভাত আর মাছের ঝোলের থেকে মোটেই কম নয়। আমি তো বেশির ভাগ দিনই এতেই লাঞ্চ সারি। চিজ, দুধের পরিমাণ ঠিকমতো হয়েছে কি না দেখো। তুমি খাবে তাই নার্ভাস হয়ে বানিয়েছি।”

আহিরী উৎসাহে চামচে করে তুলে একটু মুখে দিল। তার পর চোখ বুজে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক!‌”

বিতান খুশি-খুশি গলায় বলল, “এই জন্যই বলছি, চিন্তা কোরো না। চাকরি-বাকরি না পোষালে একটা রেস্টুরেন্ট খুলব। কলকাতা এখন সিটি অব রেস্টুরেন্টস। সেই সিটিতেই ঠঁাই হবে মোর।”

আহিরী হাসি-হাসি মুখে খেতে লাগল। নুন কম হয়েছে। রসুনকুচিও আর একটু দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সে সমালোচনার মধ্যে গেল না। বিতানের খুশির কাছে এই সব অতি তুচ্ছ। শুধু্ বিতান কেন, সে নিজেও খুব খুশি। আজ না এলে অনেক ভাললাগা মিস হত। কম বয়সে প্রেম করা হয়নি। প্রেম যখন হল, তখন অনেকটা পরিণত হয়ে গিয়েছে সে। ফলে প্রেমের হইহই ব্যাপারটা পাওয়া হয়নি। আজ সে তার স্বাদ পাচ্ছে। বিতানের ভিতরের এই ছেলেমানুষটাকে দেখা হত না। শুধু কি বিতানের ছেলেমানুষি? সে নিজেও তো ছেলেমানুষ হয়ে গিয়েছে!

“আজ না এলে এই চমৎকার খাওয়াটা মিস করে যেতাম বিতান। বাড়িতে ফোন করে বলে দিচ্ছি— ডিনার অফ।”

বিতান বলল, “দূর, এখন তো মোটে সাতটা। একটু পরেই খিদে পাবে। জানো আহিরী, সত্যি সত্যি ভাবছি বিজ়নেস করব। কারও আন্ডারে চাকরি-টাকরি করা আমার পোষাবে না।”

আহিরী খুব সহজ ভাবে বলল, “রেস্টুরেন্ট খুলবে?”

“না না, ও তো মজা করলাম। অত টাকাপয়সা কোথায়? অন্য কিছু ভাবতে হবে।”

আহিরী খাওয়া শেষ করে বাটি-চামচ নামিয়ে বলল, “ও সব পরে ভেবো।‌ তোমার রান্নায় যদি নম্বর দেওয়ার কোনও স্কোপ থাকত, তা হলে আমি অনেক নম্বর দিতাম।”

বিতান কুর্নিশ করার ভঙ্গি করে বলল, “এবার কফি হবে জাঁহাপনা!”

বিতান কফি করতে গেলে আহিরী উঠে জানালার ধারে দাঁড়াল। কাচের বড় বড় দুটো জানলা। বাইরে আকাশ ভরা তারা। নীচ দিয়ে বাইপাস ছুটছে। গাড়ির হেডলাইট আলোর মালা তৈরি করেছে। দূরের আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোতে বিন্দু বিন্দু আলোর ফোঁটা। কাচ সরাতে হুড়মুড় করে খানিকটা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ল ঘরে। আহিরীর চুল এলোমেলো করে দিল।

“এই নাও।”

বিতান কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারেনি আহিরী। তার হাত থেকে কফির মগ নিয়ে আহিরী নিচু গলায় বলল, “এই জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। এখান থেকে বাইরেটা দেখতে এত ভাল লাগছে!‌”

বিতান হেসে বলল, “আরও সুন্দর করে দেব?”

আহিরী কৌতূহল নিয়ে তাকাল। বিতান ঘরের লাইটগুলো নিভিয়ে দিয়ে মিউজ়িক সিস্টেমে গান চালাল। গমগমে পুরুষকণ্ঠ গেয়ে উঠল— ‘আই লাভ ইউ বিকজ় ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, ডিয়ার.‌.‌.‌’

আহিরীর পাশে এসে দাঁড়াল বিতান। নিচু গলায় বলল, “জিম রিভস গাইছেন।”

সত্যি জায়গাটা আরও সুন্দর হয়ে গেল। আহিরীর এবার মনে হচ্ছে, সে আকাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল।

বিতান গাঢ় স্বরে বলল, “তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে আহিরী।”

আহিরী জানালায় হাত রেখে বলল, “বকাঝকা করছি না বলে?”

বিতান বলল, “সেটা এক রকম সুন্দর। এটা আর এক রকম।”

আহিরী হেসে ফিসফিস করে বলল, “ও, ‌বুঝেছি। তোমার পোশাক পরেছি তাই।”

বিতান বাইরের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল, “মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে তোমার কষ্টই বাড়ছে। কত ভাল ছেলের সঙ্গে তোমার দেখা হতে পারত। হবেও, আহিরী। সে তার বন্ধুর নয়, নিজের ফ্ল্যাট থেকেই তোমাকে এমন সুন্দর একটা আকাশ দেখাবে। আমাকে ভুলে যাও আহিরী। আমার অনেক গোলমাল। অনেক ভুল। তোমার পাশে আমাকে মানায় না।”

আহিরী দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে বিতানের ঠোঁটের উপরে হাত রাখল। ‌বলল, “চুপ, একদম চুপ। আর এক বার এ সব বললে খুন করে ফেলব।”

বিতান আহিরীর হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “এটাই তো সত্যি আহিরী। জীবন সম্পর্কে আমার ভাবনা যে একেবারে ছন্নছাড়া। তোমাদের সুরের সঙ্গে তা মিলবে না। তোমাদের পরিচিতজনের কাছে বলার মতো কোনও পরিচয় আমার নেই। কেউ যখন বলে তোমার সঙ্গে আমাকে দেখেছে, সংকোচে মরি। তোমার কথা ভেবে গুটিয়ে যাই। আমাকে ভুলে যেতে হবে তোমায়।”

আহিরী এগিয়ে গিয়ে তার দুটো হাত বিতানের দুই কাঁধে রাখল। তার পর নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরল বিতানের ঠোঁটের ওপর। এক সময় মুখ তুলে অস্ফুটে বলল, “আমাকে তোমার অগোছালো ঘরে নিয়ে চলো বিতান। প্লিজ নিয়ে চলো।”

বিতান আহিরীকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।

১৪

শ্রীকণার শরীর ভাল নেই।

সকালে বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় মাথা ঘুরে গেল। তিনি দরজা ধরে নিজেকে সামলেছেন। টলমলে পায়ে ঘরে এসে খাটের ওপর কিছু ক্ষণ বসে রইলেন। ধীরে ধীরে শরীরটা ঠিক হল। তার পরেই উঠে পড়েছেন। অনেক কাজ। যতই লোক থাকুক, তাদের বলে না দিলে ঠিকমতো কিছু করে না। কলকাতায় আসার পর সৌহার্দ্য এক জন এক জন করে হেল্‌পিং হ্যান্ড বাড়িয়েছে। শ্রীকণা বারণ করলে শোনেনি।

“অনেক করেছ, আর নয়।”

শ্রীকণা বলেছিলেন, “দুটো তো মোটে মানুষ, রান্নাটা তো অন্তত আমাকে করতে দিবি। তার মধ্যে তুই তো বেশির ভাগ দিনই আবার বাড়িতে খাস না। রান্নার জন্য লোক রেখে কী হবে?”

সৌহার্দ্য বলেছে, “অনেক হেঁশেল ঠেলা হয়েছে মা। তোমার জীবন থেকে ওই ফেজ় এখন গন। এখন থেকে তুমি শুধু ইনস্ট্রাকশন দেবে আর এক একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়ে আমাকে খাওয়াবে।”

সকালের এই সময়টায় শুয়ে থাকলে চলে না। তা ছাড়া শুয়ে থাকলেই সৌহার্দ্যর সন্দেহ হবে। শরীর খারাপ, বুঝলেই জোর করে শুইয়ে রাখবে। মাথাই তুলতে দেবে না। মায়ের কিছু একটা হলে বড্ড খেপামি করে ছেলেটা। শ্রীকণা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

“তুই বাইরে থাকলে কী হত? আমার অসুখ করত না? না কি আমি মরে যেতাম?”

সৌহার্দ্য বলে, “মা, আমি তো বলেছি, যেখানে যাব তোমাকে ব্যাগে ভরে নিয়ে যাব।”

“ছেলেমানুষের মতো কথা বলিস না। এবার নিজের কথা ভাব। তোর কিছু হলে কে দেখবে? আমি তো চিরকাল থাকব না।‌ বিয়ে কর এবার।”

সৌহার্দ্য বলে, “এই ডায়ালগ বাঙালি মায়েরা দুশো বছর ধরে দিয়ে যাচ্ছে। আর কত বছর দেবে কে জানে!”

শ্রীকণা বলেন, “কথা ঘোরাস না। এবার একটা বিয়ে কর।”

সৌহার্দ্য সিরিয়াস হবার ভান করে বলে, “পাত্রী খুঁজছি মা।”

শ্রীকণা স্থির চোখে তাকিয়ে বলেন, “সত্যি? না কি ঠাট্টা করছিস?”

সৌহার্দ্য বলে, “অবশ্যই সত্যি। এখন পর্যন্ত সতেরো জনকে পছন্দ করেছি। ওটা পঁচিশ হলেই তোমার কাছে আসব। লটারি হবে। লাকি ড্র। ঝুলি থেকে তুমি যার নাম তুলবে, তাকেই অ্যাপ্রোচ করব। সে রাজি হলেই বিয়ে।”

শ্রীকণা রেগে গিয়ে বলেন, “কোনও মেয়ে তোকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। এ রকম ফাজিলকে বর হিসেবে কে মেনে নেবে?”

সৌহার্দ্য কাঁচুমাচু হওয়ার অভিনয় করে বলে, “সেটাও একটা কথা। মা, তুমি বরং একটা কাজ করো। পেপারে ‘পাত্রী চাই’ কলমে অ্যাড দাও। সব সু–এর ওপর ছাড়বে। সুদর্শন, সুচাকুরে, সুচতুর, সুফাজিল পাত্রের জন্য সুপাত্রী চাই।”

শ্রীকণা হেসে ফেলে বলেন, “ছোটবেলায় তো এত পাজি ছিলি না সোহো!‌ সারা ক্ষণ কেমন বই মুখে বসে থাকতিস!”

সৌহার্দ্য দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে নাটকীয় কায়দায় বলে, “এই সমাজ, এই সংসার আমাকে পাজি বানিয়েছে।” তার পর কাছে এসে বলে, “আসলে কী জানো মা, বাবার দাপটে গুটিয়ে থাকতাম। প্রাণ খুলে হাসতেও পারিনি। তুমিও তাই।”

শ্রীকণা বলেন, “থাক ও সব পুরনো কথা। এবার তোর দাপট থেকে আমাকে বাঁচতে দে দেখি!”

সৌহার্দ্য বেলা করে ওঠে। উঠেই অফিসের জন্য হুটোপাটি শুরু করে দেয়। শ্রীকণা রান্না না করলেও ছেলের ব্রেকফাস্ট নিজের হাতে গুছিয়ে দেন। সেই ব্রেকফাস্ট কোনও রকমে গিলতে গিলতে ছেলে দৌড় লাগায়। আজ ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন, সৌহার্দ্য ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ডাইনিং টেবিলে বসে ল্যাপটপে খুটখাট করছে।

শ্রীকণা বললেন, “আজ হল কী!‌ সকাল সকাল উঠে পড়েছিস যে বড়?”

সৌহার্দ্য বলল, “ভাল ছেলে হয়ে গেছি মা। চা দাও। চা খেতে খেতে তোমার সঙ্গে কথা আছে।”

‌শ্রীকণা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, “তোর সঙ্গে কথা বলার মতো সময় আমার নেই।”

ছেলের ব্রেকফাস্ট করতে করতে শ্রীকণা বুঝতে পারলেন, মাথাটা ভারী লাগছে। বয়স হয়েছে, শরীর তো মাঝে মাঝে বিগড়োবেই।‌ ছেলেটা না বুঝতে পারলেই হল। শ্রীকণা চা বসালেন। কিছুক্ষণের মধ্যে টোস্ট, ডিমসেদ্ধ, আপেল এনে টেবিলে রাখলেন।

সৌহার্দ্য বলল, “তুমি খাবে না?”

শ্রীকণা বললেন, “আমি এখন খাই? আমাকে কি অফিস ছুটতে হবে? বল কী বলবি।”

সৌহার্দ্য টোস্ট তুলে কামড় দিয়ে সহজ ভাবে বলল, “মা, মনে হচ্ছে কলকাতার পালা শেষ। মনে হচ্ছে কেন, শেষই ধরে নাও। যাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন চলছে তারা আমার ডিমান্ড প্রায় সব ক’টাই মেনেছে। দু’–একটা খুচরোখাচরা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সেগুলো ফাইনাল হলেই আমাকে জানিয়ে দেবে। সেই মেল দেখতেই এই সাতসকালে উঠে ল্যাপটপ খুলে বসেছি।”

শ্রীকণা বললেন, “দিল্লি না মুম্বই?”

সৌহার্দ্য চামচে ডিমসেদ্ধ কাটতে কাটতে বলল, “আর একটু দূরে। ইংল্যান্ড। লন্ডনে অফিস, ওয়ার্কশপ আউটস্কার্টে। সব জায়গাতেই যাতায়াত করতে হবে।”

শ্রীকণার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, “বাঃ খুব ভাল। মুখটা বাড়া, একটু আদর করে দিই।”

সৌহার্দ্য মুখ বাড়িয়ে বলল, “আদর পুরোটা কোরো না। একটু ধরে রেখো। অফার লেটারটা ওরা পাঠাক, তারপর বাকিটা করবে।”

সৌহার্দ্য মায়ের দিকে মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল। শ্রীকণা হাত বাড়িয়ে ছেলের থুতনি ছুঁলেন। তাঁর চোখের কোল ভিজে উঠল। কপালে চন্দনের টিপ নিয়ে ছেলের প্রথম দিন ছায়াপাতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার ছবিটা চোখে ভেসে উঠল।

সৌহার্দ্য টোস্টে জ্যাম লাগাতে লাগাতে বলল, “ছেলের বিলেত যাত্রার খবরে তুমি কিঞ্চিৎ ইমোশনাল হয়ে পড়লে। আমি তোমার আবেগকে সম্মান দিয়েই বলছি, আজকাল চাকরি করতে দেশের বাইরে যাওয়াটা কমন প্র্যাকটিস। কোম্পানি একটু বড় হলেই পাঠিয়ে দেয়। কখনও দু’–তিন বছরের অ্যাসাইনমেন্টে, কখনও পাকাপাকি।”

শ্রীকণা বললেন, “তোর বাবা বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন।”

সৌহার্দ্য কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, “শিয়োর। অফার লেটারের টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন্স দেখলে আরও খুশি হতেন।”

শ্রীকণা বললেন, “আজ আর গাল দিস না। আজ একটা শুভ দিন।”

সৌহার্দ্য চোখ বুজে পঁাউরুটি চিবোতে চিবোতে ‌বলল, “বাবাকে আমি তো কখনওই গাল দিই না। উনি যা করেছেন, আমার ভালর জন্যই করেছেন। সেই ভাল আমার হচ্ছেও। প্রফেশনে একটার পর একটা বেটার অফার পাচ্ছি। সেইমতো জাম্পও দিচ্ছি। কিন্তু মা, আমি যে আমার অন্য রকম ভাল চেয়েছিলাম। এই বিদেশ যাওয়াটা যদি আমার অ্যাকাডেমিক কারণে হত আমি খুশি হতাম বেশি।”

শ্রীকণা বললেন, “যা হয়নি তা নিয়ে এত অনুশোচনা ঠিক নয়।”

সৌহার্দ্য বলল, “আমি কি অনুশোচনা করি? তোমাকে মাঝে মাঝে বলি এই যা। আমি তো আমার কেরিয়ারকে আমার পিঠে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছি। শুধু অফিস নয়, আমার জীবনযাপনও সেরকম। পার্টি করি, গার্লফ্রেন্ড মেনটেন করি, অফিসে কীভাবে ম্যানেজমেন্টের নজরে থাকা যায় তাই নিয়ে ব্যস্ত থাকি।”

শ্রীকণা কপালের দু’পাশে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করছেন। তিনি চোখমুখ স্বাভাবিক রাখলেন।

“ঠিক আছে হয়েছে। তুমি কী করো তার অত ফিরিস্তি আমাকে দিতে হবে না। যাওয়া কবে?”

‌সৌহার্দ্য চা খেতে খেতে বলল, “বললাম যে। আগে সবটা ফাইনাল হোক। তবে এই অফিসকে আজই হয়তো মেল করে দেব। তোমাকে বলার দুটো কারণ আছে। এক, বিদেশ যাওয়ার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। তুমি সেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করো। আমি আগে গিয়ে জয়েন করব। তারপর তোমার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্য দেশ। ইচ্ছে করলেই তো কাউকে নিয়ে গিয়ে পাকাপাকি রেখে দেওয়া যায় না। ভিসার অনেক নিয়মকানুন আছে।”

শ্রীকণা নিচু গলায় বললেন, “আমি আর কোথাও যাব না সোহো। আমাকে আর টানিস না। আমার ক্লান্ত লাগছে। আমি এখানেই থাকব। মাঝে মাঝে না হয় তোর কাছে ঘুরে আসব।”

সৌহার্দ্য বলল, “এখানে একা তু‌মি কী করে থাকবে!‌”

শ্রীকণা হেসে বললেন, “একা কোথায়? কত লোক আছে।‌ তা ছাড়া আমাদের উর্বরা আছে না? ওদের সঙ্গে আরও জড়িয়ে যাব। ওখানে কত কাজ!”

কলকাতা আসার পর থেকেই‌ ‘উর্বরা’ সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত শ্রীকণা। মেয়েদের হাতের কাজ শেখান। ছায়াপাতায় থাকবার সময় সেলাই করতেন। সেই বিদ্যে কাজে লাগছে। ওখানে কত মেয়েদের সঙ্গে দেখা হয়। তাদের যে কত যন্ত্রণা, কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে তার ঠিক নেই। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আবার নতুন করে লড়াই করছে। এখানে কাজ খুব ভাল লাগে শ্রীকণার। এই রকম জায়গায় গেলে বোঝা যায়, কলকাতা শহর শুধু ব্যস্ত, স্বার্থপর নয়, শহরটার খুব বড় একটা মন আছে। মায়ের এই কাজে সৌহার্দ্যেরও সমর্থন রয়েছে। ফাংশন, এগজ়িবিশন হলে ডোনেশন জোগাড় করে দেয়।

সৌহার্দ্য একটু চিন্তিত হয়ে বলল, “আচ্ছা, সে দেখা যাবে।”

শ্রীকণা বললেন, “আর কিছু দেখার নেই। এটাই ফাইনাল। তুই চলে গেলে সব সময়ের জন্য একজন লোক রেখে আমি এখানেই থেকে যাব। এখন তো সব সময় যোগাযোগ করা যায়।”

সৌহার্দ্য বলল, “তোমাকে ভিডিয়ো কল, স্কাইপ— সব শিখিয়ে দেব।”

‌শ্রীকণা বললেন, “তা হলে কীসের চিন্তা?”

সৌহার্দ্য কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “মা, এবার আমি তোমাকে দু’নম্বর কথাটা বলব। মন দিয়ে শুনবে।”

শ্রীকণা নড়েচড়ে বসলেন। ছেলের এই ভঙ্গি তিনি চেনেন। ছেলে সত্যি সিরিয়াস কথা বলতে চায়। সৌহার্দ্য একটু ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করল। সম্ভবত মনে মনে গুছিয়ে নিল।

“মেয়েটির নাম আহিরী রায়। মোটের ওপর সুন্দরী, লেখাপড়া করেছে। কলেজের টিচার। স্মার্ট, আধুনিক, সাহসী মনের মেয়ে। নিজে গাড়ি চালিয়ে কলেজে যায়। ক্যান্টিনে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আড্ডা মারে। প্রিন্সিপাল না টিচার-ইন-চার্জ ঘেরাও হলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নেগোশিয়েট করে ঘেরাও তোলার ব্যবস্থা করে। পরিবারটিও শিক্ষিত। বাবা বড় কোম্পানির উঁচু পদে আছেন। মেয়েটি এখনও বিয়ে করেনি।”

এতটা বলে সৌহার্দ্য থামল। শ্রীকণা ভুরু কুঁচকে বললেন, “ব্যাপার কী? একটা অবিবাহিত মেয়ে সম্পর্কে এত খোঁজখবর নিয়েছিস যে বড়?”

সৌহার্দ্য বলল, “আমি নিইনি। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ব্যাচমেট অর্জক নিয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পাট চুকিয়ে ফিজিক্স পড়তে চলে গিয়েছিল। তারপর কম্পিউটার সায়েন্স। অর্জক এখন আমেরিকায়। এই মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল, আর এগোয়নি। কিছু দিন আগে তার সঙ্গে হঠাৎই ফেসবুকে যোগাযোগ হল। তারপর হোয়াটসঅ্যাপ-এ কথা বলি। চাপা স্বভাবের ছেলে। অনেক দিন পরে যোগাযোগ হলে বন্ধুদের যেমন বিয়ে-থা, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে প্রশ্ন করতে হয়, আমিও করলাম। দেখলাম, বাঙালি মেয়ে বিয়ের ব্যাপারে অভিমান। চেপে ধরতে আহিরী রায়ের কথা বলল। কলকাতায় এসে মেয়েটির সঙ্গে দেখাও করেছে। প্রোপোজ়ও করে গেছে। কিন্তু সাড়া পায়নি। আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু যখন মেয়েটির আরও পরিচয় জানতে পারলাম, চমকে যাই।”

সৌহার্দ্য থামল। শ্রীকণা শরীরে আবার অস্বস্তি বোধ করছেন। বাঁ কাঁধের কাছটায় একটা ব্যথা হচ্ছে। ব্যথা লুকিয়ে তিনি বললেন, “কী পরিচয়?”

সৌহার্দ্য কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শ্রীকণার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “শি ইজ় দ্য ডটার অব মাই বস।”

“তাই!‌’ শ্রীকণার গলাতেও বিস্ময়। বললেন, “এ তো একেবারে গল্পের মতো!”

সৌহার্দ্য হাত বাড়িয়ে মায়ের হাত ধরে চোখের পাতা না ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “মা, গল্পটা আর একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”

শ্রীকণা অবাক হয়ে বললেন, “মানে!‌”

সৌহার্দ্যর চোখ ঝকঝক করছে। সে আরও নিচু গলায় বলল, “ইউ উইল টক টু দিস ফ্যামিলি। আমি অপেক্ষা করছিলাম, এখন আমার আর কোনও বাধা নেই। আহিরী রায়ের বাবার কোম্পানি আমি ছেড়ে দিচ্ছি। আমি তোমাকে সব কনট্যাক্ট নম্বর দিয়ে দেব। ইফ আই অ্যাম নট রং, তুমি মেয়েটির মাকে চিনতেও পারো। ওঁর নাম বনানী রায়। উনিও তোমাদের ওই উর্বরা সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত। আমি অফিস থেকে শুনেছি, বছরে একবার করে ডোনেশন যায়।”

শ্রীকণা সাগ্রহে বললেন, “কী নাম বললি?”

“বনানী রায়।”

‌শ্রীকণা বললেন, “মনে হচ্ছে চিনি।”

মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে সৌহার্দ্য বলল, “তুমি ওঁর সঙ্গে কথা বলো।”

শ্রীকণা শরীরের অস্বস্তি ভুলে হেসে বললেন, “পাগলের মতো এসব কী বলছিস সোহো!‌ তোর বন্ধুর হয়ে আমি কী বলব? আমি কে? তার বাড়ির লোককে বুঝতে দে। তারা বলুক।‌”

সৌহার্দ্য ‌এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল‌, “বন্ধুর জন্য নয়, তুমি আমার জন্য বলো।”

শ্রীকণা থমকে গেলেন। ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, “তুই কি আবার আমার সঙ্গে ঠাট্টা শুরু করছিস সোহো?”

সৌহার্দ্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে। পায়চারি করতে করতে অনেকটা নিজের মনেই বলতে থাকে, “আহিরী রায়ের পাত্র হিসেবে আমি তো কিছু কম যোগ্য নই। তার বাবার কোম্পানিতে ইতিমধ্যেই আমি আমার ক্রেডিবিলিটি প্রমাণ করেছি। নিজের অ্যাসাইমেন্ট তো করেইছি, যা আমার কাজের মধ্যে পড়ে না, তাও করেছি। কোম্পানির ভিতর একটা বড় সাবোটাজ় হচ্ছিল। কম্পিউটার সিস্টেমে ভাইরাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আমি নোটিশ করায় ওরা অ্যালার্ট হয়েছে। না করালে বড় ক্ষতি হয়ে যেত। দে আর ভেরি হ্যাপি।”

শ্রীকণা বললেন, “‌তুই সত্যি ওই মেয়েকে বিয়ে করতে চাস?”

সৌহার্দ্য শ্রীকণার চেয়ার ধরে, চোয়াল শক্ত করে বলল, “না মা, বিয়ে করতে চাই না। বিয়ের সব ফাইনাল করে বিদেশ চলে যেতে চাই।”

শ্রীকণা চমকে উঠলেন। ছেলে এসব কী বলছে! এ তো অমানুষের মতো কথা!‌ এসব ভাবনা ওর মাথায় এল কী করে!‌ শ্রীকণা বুঝতে পারছেন, তাঁর কান, মাথা গরম হয়ে আসছে। শরীর ভারী লাগছে।

“কী পাগলের মতো বকছিস সোহো? বিয়ে করব বলে পালিয়ে যাবি!”

সৌহার্দ্য বাঁকা হেসে বলল, “ইয়েস।‌ প্লিজ় আর কিছু জানতে চেয়ো না। পালিয়ে যাওয়ার কথাটা আমি তোমার কাছে লুকোতে পারতাম। লুকোইনি। যাতে তুমি আমাকে পরে ভুল না বোঝো।‌”

শ্রীকণা ধমক দিলেন, “আমি কক্ষনও এ কাজ করব না। তুই এরকম বিশ্রী একটা কথা আমাকে বললি কী করে? তুই এত নিচুতে নেমেছিস!”

সৌহার্দ্য একটু হেসে বলল, “আমি জানতাম তুমি এরকম একটা কিছু বলবে। তোমার মতো নরম মনের মানুষের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। ঠিক আছে, আমি কিন্তু একটা সুযোগ.‌.‌.‌” এ‌কটু থেমে সৌহার্দ্য বলল, “আমি সব বলে দিলে তুমি হয়তো আমার ওপর এভাবে রাগ করতে না।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন শ্রীকণা। বললেন, “আমি তোর কোনও কথা শুনতে চাই না। তুই সামনে থেকে চলে গেলে আমি খুশি হব।”

সৌহার্দ্য সামান্য হেসে বলল, “চিন্তা কোরো না, আমি অফিসে বেরিয়ে যাচ্ছি। মাথা ঠান্ডা করো। আমি সামান্য একটা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম মা। তার বেশি কিছু নয়।”

সৌহার্দ্য বেরিয়ে যাওয়ার পর, রান্নার মাসিকে সব বুঝিয়ে নিজের ঘরে এলেন শ্রীকণা। মাথাটা টলমল করছে।‌ খানিক ক্ষণ শুয়ে থাকা দরকার।

শ্রীকণা শুয়ে শুয়ে ভাবলেন, আজ সোহো যা বলল, সেই কাজ তো কমলেশ তার সঙ্গে করেছিল। কোনও খবর না পেয়ে প্রথমে খুব চিন্তা হয়েছিল। অসুখবিসুখ, দুর্ঘটনা হয়নি তো? তখন যোগাযোগের এত উপায়ও ছিল না। কমলেশ ঠিকানা, ফোন নম্বর কিছুই দেয়নি। দুশ্চিন্তায় খাওয়াদাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছিলেন শ্রীকণা। কমলেশের কথা বাড়িতে সবাই জানত। এমনকী বাইরে যাওয়ার আগে ছেলে এক দুপুরে ফাঁকা বাড়িতে এসেছিল, সে কথাও। মা রাগের ভান করেছিল, কিন্তু চোখমুখ বলছিল, খুশি হয়েছে। আহা রে, ছেলেটা কত দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে, দু’জনে একটু একা থাকবে না? সেই ছেলে বিদেশে গিয়ে উধাও। মেয়ের অবস্থা দেখে বাবা মাকে বলেছিলেন, “আমি কমলেশের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে আসছি।”

বাবা ফিরেছিলেন থমথমে মুখে। বলেছিলেন, ভয়ংকর অপমানিত হতে হয়েছে। পরিচয় শোনার পর ভাল করে কথাও বলতে চায়নি ওরা। শুধু বলেছে, ছেলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে। সে পড়তে গেছে, কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে।

তার পরেও অপেক্ষা করেছিলেন শ্রীকণা। এক পরিচিত লোক মারফত খবর পেয়েছিলেন, লন্ডনে কমলেশ খুব ভাল আছে। আপাতত সে দেশে ফিরছে না। বাবা সব শুনে মাকে বললেন, “অনেক নাটক হয়েছে। এবার বিয়ে দিয়ে দাও। আর অপেক্ষা করলে মেয়ের বেলেল্লাপনা জানাজানি হয়ে যাবে।”

হাতের কাছে যাকে পাওয়া গেল তার সঙ্গেই কথা পাকা হল। গ্রামের স্কুলমাস্টার। শ্রীকণা ক্ষীণ আপত্তি করেছিলেন। মা ফোঁস করে উঠে বলেছিল, “তোকে যে অ্যাবরশন করাতে হয়নি এই যথেষ্ট। চুপ করে থাক।” অতীত গোপন রেখে বিয়ে হল। তার পরেও সৌহার্দ্যর বাবা সব জেনে গিয়েছিল।

সোহো ওর বসের মেয়ের সঙ্গে সেই একই কাজ করতে চাইছে!‌ কী যেন মেয়েটার নাম? মাহিরী? শায়েরি? নামটা সুন্দর, কিন্তু মনে পড়ছে না। কোন প্রতিশোধের কথা বলতে চাইছিল? নিশ্চয়ই অফিসের কোনও ঝামেলা। ছি ছি, অফিসের গোলমালের জন্য এত নীচে নামতে চাইছে সোহো!‌

শ্রীকণা পাশ ফিরে শুলেন। বুকে একটা চাপ অনুভব করলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *