নীল পাহাড় – ৪

চার

পাহাড়ি রাস্তার দুই পাশের উপত্যকায় মানুষের বসতি। এক পাশে মারমা বসতি আরেকপাশে বাঙালিরা থাকে। তাদের ঘরগুলো দেখেই বলে দেয়া যায়। বাঙালি বসতির একেবারে এক পাশে মানিকের থাকার ঘরটি। এই ঘরটি মারমাদের ঘরের আদলে বানানো হয়েছে।

চারপাশে বাঁশ দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে। সেই বেড়াতে এত দিন লতানো আগাছারা বসতি করেছিল, মানিক আসার আগে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। লতানো গাছের ডগাগুলো মাটিতে ঘাসের উপর পড়ে আছে। মাঁচার উপরে থাকার ঘরটি, কাঠের সিঁড়ি আছে একটি, মারমা ঘরগুলোর মতো বারান্দা রাখা হয়েছে, আর ঘরের উপর খড়ের ছাউনি। এই ঘরটি একেবারে পাহাড়ের পাশে। মায়ের কোল পায়নি মানিক কিন্তু পাহাড়ের কোলে ঠিক জায়গা পেয়ে গেল।

ঘরে খাট আছে, সুন্দর করে বিছানা পাতা হয়েছে। জানালা আছে তাতে আবার হালকা রঙের পর্দা টাঙানো হয়েছে। মানিক জানালার পর্দা সরিয়ে দিল, জানালা দিয়ে শুধু পাহাড়ের সারি দেখা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। ঘরে বাসন-কোসন, রান্নার সামগ্রী সব আছে।

দরজায় কাঠের তৈরি ঝুলন্ত হ্যাঙ্গারে বেশ কিছু রঙিন শার্ট ঝুলতে দেখা গেল, টেবিলে উদ্ভিদবিজ্ঞানের কিছু বই। এক কোণে একটা ফটোফ্রেম। একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি তাতে। মানিক হাশেমকে জিজ্ঞাসা করল—

এই ছবি কার?

রেঞ্জার সাহেবের মেয়ে।

উনি এখানে এসেছিলেন? এই জিনিসপত্র কি তার?

হো, উনাদের বাংলো মেরামত করার সময় এদিকে আছিলেন।

তো উনার জিনিসপত্র নিয়ে যাননি?

না, বাংলো মেরামত হওয়ার আগেই উগ্রপন্থীরা তারে ধইরা নিয়া গেছে। এক সপ্তাহ আগে তার লাশ পাওয়া গেছে সাঙ্গুর পাড়ে। খালি শইলডা আছিল, মাথা নাই। মাথা ছাড়াই মাডি দিতে হইছিল।

মানিক মেয়েটির ছবিটি টেবিলের উপর উল্টে রাখল, বাবা-হারা আদুরে মেয়ের ছবির দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।

.

বলিপাড়া ইউনিয়ন সাবসেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মানিক। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উপরে উঠে গাছপালায় ঢাকা ছোট একটি ঘর। ভূত ছাড়া এখানে কারো আনাগোনা হয় বলে মনে হয় না। দেয়ালে শেওলা জমে আছে, সামনে ঘাসগুলো কোমর সমান ঊঁচু, প্রশ্রয় পেলে আর কিছুদিন বাদে তারা মানুষের উচ্চতায় চলে আসবে। ভেতরে ব্যাঙের ডাক শোনা যাচ্ছে, সুখের সংসার পেতেছে তারা। একটা পঁচা গন্ধ ভেসে আসছে ঘাসের ভেতর থেকে, কিছু একটা মরে পচে গেছে। এই সাবসেন্টারে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট এবং একজন নার্স আছে, মাসে একদিন একটা কাজই করে তারা, থানচি থেকে বেতন তুলে নিয়ে আসে। এই তল্লাটে তাদের চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। তবে আজ একটু সুখের ব্যাঘাত ঘটেছে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ইলিয়াসকে তার মুদি দোকান ছেড়ে নতুন ডাক্তারের অভ্যর্থনায় আসতে হয়েছে। নার্স ইয়াসমিনকে পাওয়া যায়নি, সে গত মাসের বেতন খরচ করার জন্য কোথায় যেন ঘুরতে চলে গিয়েছে। গত পাঁচ মাসে এখানে কোনো ডাক্তারের পদধূলি পড়েনি, আর রোগীরা কোনোকালে এখানে পদধূলি দিয়েছিল সে ইতিহাস কেউ জানে না। এখানে পাহাড়িরা সরকারি ডাক্তারকে বিশ্বাস করে না, উগ্রপন্থীরা পাহাড়িদের সরকারি হাসপাতালে যেতে মানা করে দিয়েছে, তাদের ধারণা সরকার তাদেরকে নির্মূল করার জন্য এখানে ডাক্তার পাঠিয়েছে। ডাক্তাররা এমন ওষুধ দিবে যে তারা আর বংশ বৃদ্ধি করতে পারবে না। আর বাঙালিরা ডাক্তারদের মূর্খ মনে করে, ডাক্তাররা পানি পড়া দিতে পারে না, তাবিজ দিতে পারে না, মূর্খই তো। তার চেয়ে লোকমান কবিরাজ অনেক বেশি দক্ষ এবং বিশ্বস্ত।

ডাক্তাররা প্রথম দিন আসে, জঙ্গল কিংবা হাসপাতালটার চেহারা দেখে তারপর চলে যায়। ইলিয়াস সে জন্য তার ভাগ্নেকে আধা ঘন্টার জন্য দোকানের ভার দিয়ে এসেছে। মানিক ইলিয়াসকে অবাক করে দিয়ে বলল—

ইলিয়াস চলো ভেতরে যাওয়া যাক।

ভিত্রে গিয়া কী করবেন স্যার? চলেন বাজারে যাই, পাহাড়ি পাউপ্পা পাওয়া যায়, হেভি টেস্ট। আপনে যাইবেন কুন সময়? যদি সময় থাকে তো এই গরিবের ঘরে এক বেলা দুইটা ডাইল-ভাত খাইয়া যাবেন।

ইলিয়াস, আমি এখানেই থাকব। এখন ভিতরে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আর নার্সকে খবর দিও কাল সকাল থেকে যেন ডিউটিতে থাকে।

ইলিয়াসের সুখের দিনের অকাল সমাপ্তিতে তার মন বিষাদে ছেয়ে গেল। ঘাসের মাঝ বরাবর কোনোমতে হেটে হাসপাতালের বারান্দায় এসে পৌঁছল। দুটি রুমের একটি রুমে তালা দেয়া অন্যটি ফাকা, সেই রুমের দরজাটিও গায়েব হয়ে গেছে। ডাক্তারের বসার ঘরটি তালা দেয়া, চাবি হারিয়ে ফেলেছে ইলিয়াস। অনেক দিন এই চাবির কোনো প্রয়োজন হয়নি। একটা ইট দিয়ে তালা ভাঙল, দরজা খোলার পর ভেতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হলো। ইলিয়াস জানালা খুলে দেয়ার জন্য ভেতরে ঢুকেই তিন লাফ দিয়ে একেবারে গেইটের বাহিরে চলে গেল। মানিক ইলিয়াসের এমন বানরের মতো লাফিয়ে বাহিরে চলে যাওয়ার হেতু খুঁজতে গিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। ‘ওরে বাবা’ বলে সেও দৌড়ে বাহিরে চলে এলো। ভেতরে বিশাল বড় এক অজগর সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে নিদ্রা যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের অযাচিত আগমনে সাপটির নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটেছে। গলা উঁচিয়ে তার বিরক্তি জানান দিয়ে অজগর সাপটি মানিকের মতো অনাথকেও তার বাবার কথা মনে করিয়ে দিল।

মানিক ইলিয়াসকে পাঠাল লোকজন আনতে। বিনা ডিগ্রিতে ডাক্তারের চেয়ার দখল করা সাপটিকে উৎখাত করতে হবে। ইলিয়াস অনেকক্ষণ পরে একটা মারমা কিশোর ছেলেকে নিয়ে হাজির। মানিক বিরক্ত হলো, এই বাচ্চা ছেলে সাপ দেখে আবার অজ্ঞান না হয়ে যায়। ছেলেটি হেলতে-দুলতে ঘরে গিয়ে ঢুকল। একটু পর দেখা গেল, ছেলেটি সাপের লেজ টানতে টানতে সাপটিকে বের করে আনছে। সর্প জাতির সকল অহংকার ধুলোয় মিশে গেল, হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার জন্য যথেষ্ট মোচড়ামোচড়ি করল অজগরটি, কিন্তু মারমা ছেলের বগল থেকে লেজ এবং সম্মান বাঁচানো একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ল। এরকম সাপ পাহাড়ে অনেক দেখে পাহাড়িরা, তাদের ভয়ে তটস্থ থাকে সাপেরা। সকাল বেলা গর্ত থেকে বেরিয়েই প্রার্থনা করে, কোনো পাহাড়ির পায়ের নিচে যেন না পড়ে। দুই-একটা ভাগ্যবান সাপ কালেভদ্রে বাঙালি পেয়ে যায়। এই সাপটি যেমন পেয়েছিল, কিন্তু ভাগ্যদেবী অজগরটির উপর বোধহয় বেশিক্ষণ তার সুদৃষ্টি রাখেননি।

কোমর সমান ঘাস কাটা হলো, সেই ঘাস নেয়ার জন্য ছাগলের মালিকদের কাড়াকাড়ি অবস্থা। ঘাস কাটার পর সেখান থেকে তিনটা মরা ইদুর আর একটা জ্যান্ত গোখরা আবিষ্কৃত হলো। আত্মগোপনে থাকা চোর পুলিশ দেখলে যেভাবে দিগ্বিদিক ছুটতে চায়, গোখরাটি সেভাবে ছুটে নিজের মান এবং প্রাণ বাঁচাতে চাইল। কিন্তু মধ্যবয়স্ক এক লোক গোখরাটিরে মাথায় লাঠি দিয়ে চেপে ধরল, তারপর মাথাটা ধরে একটা গামছায় পুরে ফেলল। সাপুড়েরা নাকি প্রায়ই এখানে আসে সাপ কেনার জন্য। অজগর সাপ সাপুড়েরা কিনে না তাই সেটা এখন বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। বাচ্চারা পালা করে লেজ টানছে অজগরের।

ধুলোমাখা হাসপাতালটি পরিষ্কার করা হলো, দরজায় নতুন পর্দা টাঙানো হলো। রোগীদের বসার জন্য বারান্দায় চেয়ার বসানো হলো। ওষুধ এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম সাপ্লাইয়ের জন্য চিঠি লিখে ইলিয়াসকে থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠাল। সব করা হলো, কিন্তু যাদের জন্য এত আয়োজন তাদের দেখা নেই। ইলিয়াস সকালবেলা আসে, বাহিরে চেয়ারে বসে ঝিমায়। নার্সের দেখা মিলেনি এখনো। ইলিয়াস মাঝে মাঝে নতুন ডাক্তারের সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে কিন্তু নতুন ডাক্তার কেমন যেন নিরামিষ মানুষ, দশটা কথা বললে একবার হুঁ বলে। কথা বলে মজা নেই। নার্সটা থাকলেও না হয় একটু আলাপ জমানো যেত। মহিলাদের গল্পের অভাব হয় না।

হাসপাতালে বসেই মানিক প্রায়ই মারমা পাড়া কিংবা বাঙালি পাড়া থেকে মহিলাদের বিলাপ শুনতে পায়। এখানে প্রায়ই মানুষজন মারা যাচ্ছে। কিন্তু কেউই হাসপাতালে আসছে না। সন্ধ্যাটা মানিক পাহাড়ে কাটায়, পাহাড়ের আড়ালে সূর্যের মুখ লুকানো দেখতে তার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে পাথড়ের চূড়ায় সবুজ ঘাসের বিছানায় গা এলিয়ে দেয়, আকাশ পরিস্কার থাকলে তারাদের হাট বসে। মানিক কখনো তারা গুনার চেষ্টা করে না শুধু শুয়ে শুয়ে দেখে। এই পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মারমা পাড়া। সেখানেও তারা জ্বলছে—

কুপিবাতির তারা।

একদিন বিকালবেলা মানিক মারমা পাড়া পার হয়ে পাহাড়ে যাচ্ছিল, তখনই একটা বাচ্চা ছেলের গোঙানি শুনতে পেল সাথে একটা চাপা কান্না। ঘরটির বাহিরে কোমরে এক খণ্ড কাপড় ঝুলিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশের বাড়ির উঠানে তার বয়সীরা দৌড়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে। একজন সবাইকে ছুঁতে যাচ্ছে, সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে, যাকে ছুঁয়ে দিবে সেই চোর হয়ে যাবে। সেই কলঙ্ক থেকে বাঁচতে সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে, কাউকে ছুঁতে না পেরে বর্তমান চোর এ আঙিনায় এসে বাচ্চা মেয়েটিকে ছুঁয়ে দিল।

কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি নির্বিকারভাবে বসে আছে, খেলার নিয়ম অনুযায়ী আৱেকজনকে ছুঁয়ে সে নিজেকে কলমুক্ত করার কথা। কিন্তু কলঙ্ক নিয়ে মেয়েটি ঠায় বসে আছে, তার চোখের নিচে গাল বরাবর দুটি রেখা জানান দেয় সে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। মানিক কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল—

কী হয়েছে তোমার? কেন কাঁদছ?

মেয়েটি মানিকের দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল, কিন্তু কিছুই বলল না। আগন্তকের কাছে নিজের দুঃখ বর্ণনা করার কোনো আগ্রহ বোধ করছে না সে। মানিক মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে মেয়েটি বলে উঠল—

জ্ঞামা কোগ্রি।

মানিক ভ্রু কুঁচকাল, মারমা ভাষা সে বুঝেনি, মেয়েটি এবার বাংলায় বলল—

আমার ভাই, মরি যাচ্ছে।

.

আচমকা এক বাঙালিকে ঘরে ঢুকতে দেখে বাচ্চাটির মা যেন ছেলের মরণশয্যার শোক ভুলে আতঙ্কিত হয়ে উঠল। ছোট্ট একটি ঘর, বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে ঘেরা। ঘরে একটা দড়িতে পুরনো কাপড় ঝুলানো আছে, একপাশে কিছু বস্তা জড়ো করে রাখা হয়েছে, বাঁশের খুঁটির সাথে একটি পাতিল ঝুলানো আছে, ছাদ থেকে কিছু শিকে ঝুলছে। ঘরের মাঝখানে একটা বাচ্চা ছেলে শুয়ে আছে, তার মাথার কাছে কিছু বাসি রঙিন ফুল, ছেলেটার গা মোটা কাঁথা দিয়ে ঢাকা আছে। তার পাশেই একপাশে মেঝেতে বসে কাঁদছিল ছেলেটির মা, যিনি এখন কান্না বন্ধ করে হতবাক হয়ে মানিকের দিকে তাকিয়ে আছে। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো, চাঁদের আলো, বাতাস, রোগ-ব্যাধি সব অবাধে প্রবেশ করতে পারে কিন্তু দরজা দিয়ে একজন বাঙলি প্রবেশ করা এখানে আতংকের ব্যাপার। মানিক তাকে আশ্বস্ত করতেই বলল—

ভয় পাবেন না, আমি একজন ডাক্তার, আমাকে একটু দেখতে দিন।

এই কথাতে মারমা মহিলাটিকে যেন আরো বেশি আতঙ্কিত মনে হলো। মহিলাটি কিছু বলার আগেই মানিক ছেলেটির কপালে হাত দিল, বেশ জ্বর আছে, ছেলেটি কাঁপছে। ছেলেটির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল—

কিছুক্ষণ পর পর কি ঘাম হয়?

মহিলাটি একটু আশ্বস্ত হয়েছে, ডাক্তার তার ছেলেকে সুস্থ করে তুলবে সে দুরাশা সে করে না, কিন্তু এই মানুষটি তার ছেলের ক্ষতি করবে না এটা জেনে সে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছে। সে বলল—

খুব ঘামায়, জ্বর সাইরে যাইবে মনে হয়, কিন্তু সারে না!

বলেই আবার নিজের হাঁটুতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। তার প্রতিবেশী পাঞ্চানের ছেলেটারও এরকম হয়েছিল, বৈদ্য এসে ভাতঝরা পূজা করতে বলেছিল, তারা করেনি। করবে কীভাবে, নিজেরাই খেতে পায় না, তাদের জুমের ফসল সব ভেসে গিয়েছিল পাহাড় ধ্বসে। পাঞ্চানের ছেলেটা দুই দিন পরেই মরল।

মানিক বলল—

আপনার ছেলের সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া হয়েছে। দ্রুত ওষুধ না দিলে কোমায় চলে যবে। আমি কিছু ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি।

মহিলাটি ভ্রু কুঁচকাল, ডাক্তারের অদ্ভুত কথা শুনে। তার ছেলে কোথায় চলে যাবে? জ্বর ভালো না হলে যাবে কীভাবে? সে বলল—

মংওয়াইয়ের বাপে বৈদ্যরে আনতে গেছে, ভাতঝরা পূজা হইব, ওষুধ খাইয়া কি দেবতার অভিশাপ যায়? আপনে যান, আমাগো ওষুধ লাগব না।

মানিক আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই দুটি লোক ঘরে ঢুকল। একজনের উদ্বিগ্ন মুখ দেখে বুঝল এটা মংওয়াইয়ের বাবা, আর পাশের গম্ভীর লোকটি বৈদ্য। বৈদ্য লোকটি একেবারে সাধারণ দেখতে, চুল-দাড়ি বড় করে জটা পাকিয়ে আধ্যাত্নিকতার মুখোশ লাগায়নি কিন্তু মুখে গম্ভীর ভাবটা তবুও আছে। পূজার সরঞ্জাম তার হাতে। পূজার থালায় কয়েক রকম পিঠা, কিছু ফুল, পাতা, একটা চামড়া ছাড়ানো মুরগির বাচ্চা। মংওয়াইয়ের বাবা মানিককে দেখে অবাক হলো আর বৈদ্য বিরক্ত হলো। মংওয়াইয়ে মাকে মারমা ভাষায় কী যেন বলল, মানিক কথাগুলো বুঝতে পারেনি কিন্তু এতটুকু বুঝতে পেরেছে, মহিলাটিকে শাসানো হচ্ছে কেন সে ডাক্তার ডেকে আনল। মহিলাটি বুঝানোর চেষ্টা করছে, যে এই ডাক্তার কীভাবে অনধিকার প্রবেশ করেছে এবং রোগ সম্বন্ধীয় যে অদ্ভূত কথাগুলো বলেছে সম্ভবত সেগুলোও বলল। বৈদ্যের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটল। মংওয়াইয়ের বাবা বলল—

আমাগে কোনো ওষুধ লাগব না, আপনে যান।

মানিক শুয়ে থাকা প্রায় অচেতন মংওয়াইয়ের দিকে তাকাল, প্রায় নিষ্প্রাণ মুখ, চোখ পিটপিট করে খোলার চেষ্টা করছে, আগন্তকের চেহারাটা একবার দেখতে ইচ্ছা করছে তার। কিন্তু পারছে না। মংওয়াইয়ের ছোট বোনটি সব খেলায় ইস্তফা দিয়ে দাদার পায়ের কাছে বসেছে। দাদা ছাড়া আর কোনো খেলা ভালো লাগে না, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় তাকে কেউ ছুঁয়ে নিলে দাদা আবার তাকে ছুঁয়ে নিজে চোর হয়, তাকে নিয়ে জঙ্গলে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়, হাঁটতে না পারলে কাঁধে নেয়, কত রঙের ফুল যে এনে দেয় বন থেকে। রাতে ঘুমানোর সময় গল্পও শোনায়। সে এসব কিছু আর চায় না, তার কাছে থাকা কাচের মার্বেল, সাংগ্রাইয়ের মেলায় বাবার দেয়া দশ পয়সাও সে তার দাদাকে দিতে রাজি কিন্তু তার দাদাকে নদীর ধারে কেউ পুড়িয়ে ফেলুক সে তা চায় না। মানিক দরজার কাছে গিয়ে একবার শুধু বলল—

খুব বেশি সময় নেই, একবার শুধু আমার কথা বিশ্বাস করুন।

বলেই বেরিয়ে গেল, দরজার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মংওয়াইনের মায়ের চোখ দুটো আর দেখতে পেল না সে।

.

ঝড় হবে মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড বাতাস বইছে। জানালায় লাগানো পর্দাটি স্থির হয়ে থাকতে পারছে না, উথালপাথাল উড়ে যাচ্ছে। মানিকের ঘরে একটিমাত্র কুপি জ্বলছে, বাসের ঝাপটায় একেবারে নিবু নিবু হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নিভছে না। আগুনের শিখাটি হেলেদুলে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আগুনের শিখাটির দিকে। যেকোনো সময় শিখাটি বাতাসের কাছে পরাজিত হয়ে দপ করে নিভে যাবে, কিন্তু মানিক ঠায় বসে আছে। কাল হয়তো আরেকটি শবযাত্রা দেখতে হবে তাকে। এই পাহাড়ের মানুষগুলো খুব সহজ-সরল, তাদের সরলতাই তাদের ধ্বংস করে দিবে। এখানে ফুল সব দেবতার পূজায় ব্যয় হয়ে যায়। প্রেমিকার মাথায় গোঁজার মতো ফুল অবশিষ্ট নেই এখানে। জুমের ফসল বিক্রি করে দিতে হয় দেবতাদের ভোগ চড়ানোর জন্য। তারা ডাক্তারকে বিশ্বাস করে না কিন্তু কবিরাজ আর বৈদ্যদের কাছে সন্তানের প্রাণ তুলে দেয়।

মানিকের ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে যখন প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটায় কুপিটি নিভে যায়। অলৌকিকতা মানিক বিশ্বাস করে না কিন্তু আগুনের শিখার পরাজয় নিজের পরাজয় মনে হয়, মংওয়াইয়ের ফ্যাকাসে মুখটা ভেসে ওঠে।

হঠাৎ কে যেন ডেকে ওঠে। ঝড়ের সাথে গাছপালার তুমুল যুদ্ধের শব্দটা আলাদা করে সে বুঝতে পারে কেউ তাকে ডাকছে তার ঘরের বাহিরে বাঁশের পাঁচিলে কেউ আঘাত করছে। একটা হারিকেন জ্বালিয়ে ঘরের বাহিরে এসে দেখে বাঁশের দেয়ালের ওপাশে একজন ছোটখাটো মানুষ, তার কাঁধে একটি দেহ। মানিক নিচে নেমে হারিকেন উঁচিয়ে দেখল, মংওয়াইয়ের মা তার দিকে বেদনা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

সন্তানের প্রাণের জন্য মায়েরা নিজেদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস সব দূরে ঠেলে দিতে পারেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত একজন মহিলা ডাক্তার ছিলেন, আমেরিকা থেকে এমআরসিপি করে এসেছিলেন। বাংলাদেশের কুসংস্কার নিয়ে তিনি বেজায় বিরক্ত ছিলেন। একটি বইও লিখেছেন, “আধুনিক চিকিৎসা এবং কুসংস্কার” নামে। সেই বইয়ে তিনি কবিরাজ, দরবেশদের ভণ্ডামি প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু নিজের ছেলের যখন ক্যান্সার হলো, যখন বিজ্ঞান ব্যর্থ হলো তখন তিনি মাজারে মাজারে ঘুরতে লাগলো, মানত করতে লাগলেন।

তাবিজ দিয়ে ছেলের শরীর ভরিয়ে ফেললেন, খালি পায়ে ভারতের আজমির শরিফে গেলেন। মনে ক্ষীণ আশা ছিল, যদি কিছু হয়। কিন্তু কিছু হয়নি। ছেলেটি মারা গিয়েছিল। তিনিও আর কখনো প্র্যাকটিস করেননি।

মংওয়াইয়ের মাও সেই ক্ষীণ আশা নিয়ে কবিরাজ ছেড়ে ডাক্তারের কাছে এসেছে, নিজের স্বামী, নিজের বিশ্বাস সব গ্রাহ্য করে সন্তানের প্রাণের জন্য এসেছে। মানিক ঔষুধের বাক্সটি হাতড়ে কুইনাইন ইঞ্জেকশন পেল। সাথে সাথেই পুশ করে দিল। ভাগ্য ভালো ছেলেটি এখনো কোমায় যায়নি। মানিক ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, তবুও মনে মনে প্রার্থনা করছে এই ছেলেটির প্রাণের জন্য।

.

ভাতঝরা পূজায়, দেবতাদের উৎসর্গ করা জবা ফুলে, বৈদ্যের ভূরিভোজের কল্যাণে, অবিশ্বাসী মানিকের প্রার্থনায় অথবা কুইনাইনের জোরে মংওয়াই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠল। সপ্তাহ দুয়েক পরে একদিন তার ছোট বোনকে ঘাড়ে করে নিয়ে আসল। মেয়েটির হাতে বেগুনি রঙের ফুল। ছেলেটির হতে কিছু সজনে ডাটা। সে সজনে ডাটার আঁটিটি মানিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, জুমের সজিনা ডাক্তার বাবু। মুই (মা) দিছে।

ছোট মেয়েটি বেগুনি ফুলগুলো তার হাতে তুলে দিল। এত সুন্দর ফুল মানিক আর কখনো দেখেনি। এই সজনে ডাঁটা আর বেগুনি ফুলগুলো তার জীবনের প্রথম উপহার। সারাজীবন মানুষের কাছ থেকে দয়া-দাক্ষিণ্য পেয়েছে, এই প্রথম কোনো উপহার পেল।

মানিক মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল—

দেবতার ভোগ আমাকে দিচ্ছিস, দেবতা অভিশাপ দিবে না তো?

মংওয়াই বলল—

ডাক্তার বাবু, মুই কইছে তুই-ই আমাগো দেবতা। তুই আমারে বাঁচাইছস।

মানিক বরাবরই আবেগী, দুঃখ কোনো সময় তার চোখে অশ্রু আনতে পারে না, কিন্তু সুখ পারে। সুখের উপলক্ষ তার জীবনে খুব একটা আসেনি, তাই সামান্য সুখে আবেগী হয়ে পড়ে। চোখের পানি আটকাতে পারে না। তার মতো সামান্য অনাথ মানুষকে দেবতাদের কাতারে ফেলছে এই সহজ-সরল মানুষগুলো, সে একই সাথে লজ্জা এবং সুখ অনুভব করল, চোখ ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। চোখের পানি লুকানোর জন্যই সে মুখ ঘুরিয়ে নিল, পুরুষ মানুষের অশ্রু সব সময় লুকিয়ে রাখতে হয়। চোখ মুছে মংওয়াইয়ের দিকে ফিরে বলল—

আমি তোকে বাঁচাইনি মং, তোর মুই তেকে বাঁচিয়েছে, তাকে পূজা করিস, সে-ই তোদের দেবী।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *