নীল পাহাড় – ৩

তিন

ঢাকায় মানিকের আপন কেউ নেই, কিন্তু যতই বাসটি শহর ছেড়ে দূরে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে ততই মনে হচ্ছে পুরো শহরটাই তার আপন। ধুলো ওড়ানো রাস্তা, খোলা ম্যানহেল, ডাস্টবিন উপচে পড়া ময়লা, লোকজনে ঠাসা লোকাল বাসে ঘামের গন্ধ সবই মনোহর হয়ে উঠছিল। মানিকের মনটা উদাস হয়ে যায়, কী যেন ফেলে চলে এসেছে মনে হয়। দূরে গ্রামগুলো সাঁই সাঁই করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, তার খুব জানতে ইচ্ছা করে ঐ দূর গ্রামে কারা থাকে। তারাও কি হাসে, কাঁদে? তাদেরও নিশ্চয়ই অনেক আক্ষেপ, অনেক না পাওয়া। কিন্তু দূর থেকে দেখে মনে হয় সবুজ সে গ্রামে কোনো দুঃখ নেই। গ্রামগুলো ধীরে ধীরে ক্ষয়ে গেল বাসের জানালা থেকে। সবুজ ক্ষেতের প্রান্তে উঁচু সবুজ পাহাড় দেখা গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখছে মানিক। ছোটখাটো টিলা সে দেখেছে কিন্তু পাহাড় বুঝি একেই বলে। পাহাড়গুলো জানালাতে আরো বড় হতে লাগল। একেবারে পাড়ের ধার ঘেঁষে ধীর লয়ে চলছে বাস। মানিক জানালা খুলে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে যতক্ষণ পাহাড়ের মাথাটা রাস্তার বাঁকে হারিয়ে না যাচ্ছে। একটু পরেই বুঝল সে পাহাড়ের দেশে চলে এসেছে, পাহাড়ের পাশে আঁকাবাকা, উঁচু-নিচু রাস্তা। রাস্তার পাশে তাকালে দেখা যায় অনেক নিচে ঘন গাছের সবুজ সমুদ্র। কিছু কিছু পাহাড় খুব বিশাল কিন্তু একা, আশেপাশে টিলাও নেই। সেই পাহাড়ের ঠিক চূড়াতে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর।

একা পাহাড়ের মাঝে কে থাকে একা একা? মানিকের মনে হলো তার চোখ ক্লান্ত হবে না কখনো পাহাড় দেখতে দেখতে। বাসের জানালায় বসেই বুঝি জীবন পার করে দিতে পারবে। একটু পরেই মনে হলো, না, পাহাড় দেখলেই সেই পাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে।

ছোট্ট কুঁড়েঘরে কে থাকে জানতে ইচ্ছা করে।

বাস থেকে নেমে মানিক তার একমাত্র ব্যাগটি বাম কাঁধে ঝোলাল। ডান কাঁধটিতে ব্যথা করছে। সেইটি তার পাশের যাত্রীরা নিজেদের নিদ্রাকার্যে ব্যবহার করেছে। ঢাকা থেকে এত দূরে এসেও মানিক নিজের কাঁধের স্বত্ব ফিরে পেল না।

বান্দরবান শহরটি ছিমছাম। অতিরিক্ত সাজানো নয় আবার একেবারে অগোছালোও নয়। মানিক ভেবেছিল এখানে শুধুমাত্র পাহাড়ি মানুষরাই থাকে কিন্তু শহরে নেমে তার মনে হলো বাঙালিই বেশি। দুই-একটা রিকশা মাঝে মাঝে দেখা যায়। দোকানপাট কিছু বন্ধ কিছু খোলা। অধিকাংশ দোকানিই বাঙালি। দোকানের নাম দেখলেই বুঝা যায়, সেলিম ভ্যারাইটিজ স্টোর, কুলসুম বিউটি স্টোর, লোকমান দাওয়াইখানা। লোকমান দাওয়াইখানাতে বেশ ভিড়, লোকজন আশা এবং উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছে, সেখানে বাঙালির পাশাপাশি কিছু পাহাড়িও আছে। একজন পাহাড়ি খামি পরা মহিলা আর একজন ঘোমটা দেয়া বাঙালি মহিলা হাত ধরাধরি করে গল্প করছে, হয়তো সংসারের গল্প। পাহাড়ে যেই ঘৃণা আর হিংসার কথা শুনেছিল এই দৃশ্য দেখলে তা বানানোই মনে হয়।

থানচি বাস স্ট্যান্ডে যে বাসটি দাঁড়িয়ে আছে সেটা দেখে ঢাকার লোকাল বাসের কথা মনে পড়ে গেল। মানিক জানালার পাশে একটা সিটে গিয়ে বসলো। বাসে পাহাড়ি যাত্রীর সংখ্যাই বেশি, তারা নিজেদের ভাষায় কথা বলছে, মানিকের শুনতে বেশ ভালো লাগছে যদিও কিছু বুঝতে পারছে না। মানিকের পাশে এক বাঙালি এসে বসল, গায়ে জর্দার গন্ধ। লোকটি তখনো পান চিবাচ্ছিল। লোকটিকে দেখেই বুঝা যায় এই লোক বাসে ঘুমাবে এবং মানিকের শার্টে তার মুখ থেকে পানের লাল-রস গড়িয়ে পড়বে। একটু পরেই মানিকের ভুল ভাঙল। লোকটি ঘুমাল না, কথা বলা শুরু করল, বুঝলেন ভাই, আল্লায় অসুখ-বিসুখ দিয়া বান্দাগো টেস্ট করে। তার টেস্টে পাস করলে আবার নিজেই রোগ সারায়ে দেন। ডাক্তার কবিরাজ তো সব উছিলা। লোকমান কবিরাজও উছিলা, কিন্তু আল্লাহর নেক নজর আছে তার উপর। ডাক্তর-ফাক্তর যেই রোগ সারাইতে পারে না, হে পারে। যার পাপ বেশি তারে ডাক্তারের বাপেও বাঁচাইতে পারব না। তবুও এই বিধর্মী গো মুল্লুকে কিছু বালা মানুষ আছে, যার উছিলায় এখনো মানুষের অসুখ-বিসুখ সারে। আপনে কী বলেন?

মানিকের অভিমত চাওয়া হলো বোধহয়। মানিক একই ‘হুঁ’ করে শব্দ করল। লোকটির জন্য তাই যথেষ্ট। সে আবার শুরু করল, আসলে দেশে রোগবালাই বাড়ছে এই মালাউন আর এই পাহাড়ি শয়তানগুলার জন্য। পর্দা নাই, কিছু নাই, মাইয়া মানুষ লুঙ্গি পইরা ঘুইরা বেড়ায়। বুকে কাপড় নাই, পাছাত কাপড় নাই, ছিঃ ছিঃ। মালাউনগুলার লগে এই পাহাড়িগুলাতেও গণ্ডগোলের বছর দেশ থেইক্যা ভাগানোর দরকার আছিল।

বাস চিকন রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। চারিদিকে পাহাড়ের সমারোহ। মাঝে মাঝে মানুষের দেখা পাওয়া যায়। মাথায় ঝুড়ি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কোনো এক পাহাড়ি মহিলা। লোকটি ঘাড় বাড়িয়ে যতক্ষণ দেখা যায় মহিলাটিকে দেখল। তারপর আবার শুরু করল, আাল্লাহর গজব পড়ব পর্দা ছাড়া চললে। তারার আছে খালি নাইচ আর গান। মানুষ মরলেও নাচে, কেমুন পাষাণ মাগীগুলা। মালাউনরাও পূজা করে খালি নাচতে আর মদ খাইতে। পর্দা নাই, কিছু নাই।

এমন সময় বাসে পাহাড়ি একটি মেয়ে উঠল, লোকটি কথা বন্ধ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি পেছনের সিটে গিয়ে বসল। লোভী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ মেয়েটিকে দেখা যায়। সে কাপড়ভেদী দৃষ্টির অভাব বোধ করছিল বোধহয়।

এবার মানিক লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, চোখের পর্দা বলতে কিছু নাই?

লোকটিকে একটু ক্ষুব্ধ দেখাল। সে এতক্ষণ পাশের ভদ্রলোককে নিজের দলের মনে করেছিল। তার মুখে এই ধরনের প্রশ্ন শুনে একটু অবাকও হলো। মানিক এবার লোকটিকে হতভম্ব করে বলল, লুঙ্গি পরা মেয়ে দেখতে আপনার এত খারাপ লাগে যে আপনি চোখ ফেরাতে পারেন না, তাই না?

লোকটি অবাক হলো, ক্ষুব্ধ হলো কিন্তু একটু লজ্জাও পেল না, ইতর প্রকৃতির লোকের লজ্জা থাকে না। সে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে প্রশ্ন করল, আপনার নাম কী?

মানিক উদ্ধতভাবেই বলল—

আমার নাম মানিক মিত্র, জি মিত্র। আমি মালাউন।

লোকটি যেন সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। মালাউন শালায় আর কী বুঝবে! একটু পরে উঠে অন্য সিটে চলে গেল।

মানিক এতক্ষণে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকানোর ফুরসত পেল। রাস্তাটা বড় এক অজগর সাপের মতো বয়ে আছে পাহাড়ের গা বেয়ে। নিচে তাকালে রীতিমতো কলিজা কেঁপে ওঠ, বাস একটু এদিক-সেদিক হলেই কয়েক হাজার ফুট নিচে গিয়ে পড়বে। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা মেঘের অপরূপ দৃশ্যও মানিকের মন থেকে উচ্চতাভীতি দূর করতে পারল না। সে বারবার ড্রাইভারের দিকে তাকাচ্ছে, যেন সে না তাকালে ড্রাইভার অমনোযোগী হয়ে যাবে। মাঝে মাঝেই ড্রাইভার কন্ডাক্টরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলছে। সে মুহুর্তেই হয়তো সামনে বিশাল বাঁক। মানিক ভাবছে এই বুঝি গেল বাস খাদে। অস্ফুটে চিৎকার দিয়ে উঠল কিন্তু ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে রেখেই বাঁক ঘুরিয়ে ফেলল। এই রাস্তা তাদের মুখস্থ। চোখ বন্ধ করেও হয়তো চালাতে পারবে।

থানচিতে যখন পৌঁছাল তখন সূর্যটা দুপুরের অহংকার ছেড়ে বেশ বিনয়ী হয়ে গেছে। একটু লাল রং ধরেছে লজ্জায়। ঘাটের কাছে সারি সারি অনেকগুলো ডিঙ্গি বাঁধা। নদীর ওপারে থানচি বাজার। এই বাজারেই একসময় নৌকার যাত্রীরা এসে বিশ্রাম করত।

মারমা ভাষায় থান চৈ মানে বিশ্রামের স্থান। থান চৈ থেকেই বিবর্তিত থানচি হয়ে গেছে। বাজারে এখনো কোলাহল আছে, বিরাট গাছের নিচে কিছু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা দোকানপাট এই পার থেকেও দেখা যাচ্ছে। এই পার সেই তুলনায় নিস্তদ্ধ। মানিক বদরুল আলম সাহেবের বন্ধু শফিক সাহেবের কাছে যাবে, বাকি ব্যবস্থা কাল হবে। ঘাটের কাছে এক মারমা মাঝি গায়ে হেলান দিয়ে বিড়ি ফুঁকছিল, তার গায়ে শার্ট ছিল কিন্তু শার্টে কোনো বোতাম নেই। দুই পাশে শার্টের দুই কোনা বাতাসে উড়ছে। মানিককে দেখেই হাতে বিড়ি ফেলে দিয়ে বলল—

বাজারে যাইবেন?

মানিক ঘাড় নাড়িয়ে বলল, না, আমি শফিক সাহেবের কাছে যাব। উনি কোথায় থাকেন?

মাঝিটি মাটি থেকে বিড়িটি আবার তুলে নিল, তারপর আবার মনের আয়েশে ধোয়া ছাড়তে লাগল কিন্তু আর কোনো কথা বলল না। মানিক একটু বিব্রত হলো, বাজারে না গেলে কি মাঝিদের কথা বলা নিষেধ নাকি? এমন সময় পাশে থাকা একজন বাঙালি যুবক ছেলে এসে জিজ্ঞাসা করল—

আপনি কি ঢাকা থেইক্যা আইছেন?

মানিক বলল—

হ্যাঁ, আমি শফিক সাহেবের কাছে যাব। তুমি কি একটু দেখিয়ে দিতে পারবে?

ছেলেটি বলল—

চলেন, স্যারে আমারে পাঠাইছে। আমার নাম হাশেম।

মানিক বলল—

হাশেম ঐ লোকটি আমার সাথে পরে কথা বলল না কেন?

হাশেম বলল—

স্যারের নাম কইছেন যে এই জন্য। কিছু পাহাড়ি স্যারেরে দেখতে পারে না। স্যারের স্কুল জ্বালাইয়া দিছে। স্যারে নাকি তাগো পোলাপাইনের মাথা নষ্ট করতাছে। এইখানে কেউ কাউরে বিশ্বাস করে না। কত মানুষ মরল অবিশ্বাসের কারণে।

মানিক কিছু বলল না, হাশেম তার ব্যাগটি নিজের কাঁধে নিয়ে সামনে হাঁটতে লাগল। তারা লালচে মাটির পথ দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই একসাথে কয়েকটা ঘর দেখা যাচ্ছে। সূর্য ডুবে গেছে, মাঁচার উপরে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা ঘরে ফেরার আয়োজন চলছে।

নিচে হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়ে গৃহ প্রবেশের চাঞ্চল্য। মারমা মহিলাটি ‘তিড় তিড়’ শব্দ করে তাদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল। উপরে দাওয়ায় বসে শুকনো লোকটি লম্বা বাঁশের চোঙায় তামাক ফুঁকে যাচ্ছে। তার পায়ের লালচে ধুলো জানিয়ে দেয় সারাদিন পাহাড়ে ছিল সে। ছোট ছেলেমেয়েগুলোকে হাঁস-মুরগির মতো সহজে ঘরে ঢুকানো যাচ্ছে না। আদুল গায়ে নতুন হাঁটতে শেখা ছেলেটি দৌড়ে পাশের বাঁশঝাড়ের কাছে চলে যাচ্ছিল কিন্তু তাদের দেখে দৌড়ে আবার মায়ের কাছে ফিরে গেল। কয়েকটি ঘরে তারার মতো কুপি জ্বলে উঠল, কুপির চারপাশে বসে তারা স্বপ্নের কথা বলে। রাতের বেলা পাহাড়ের সারিগুলোকে বড় বিষন্ন দেখায়। মানিক হাঁটতে থাকে বিষণ্ণ পাহাড় আর স্বপ্নঘেরা জীবন দেখতে দেখতে।

শফিক সাহেবের বাড়িটি এখানকার অন্য বাড়িগুলোর চেয়ে আলাদা। কাঠ দিয়ে বানানো ঘর, উপরে ছনের বদলে টালি। নিচে বেশ কয়েকটা ঘর। অন্য ঘরগুলোতে নিচে গরু, ছাগল, মুরগি থাকে। শফিক সাহেব নিচে তার কর্মচারীদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি থাকেন উপরে, একটি ঘর আছে বারান্দার পাশে, সেখানে দুজন পালোয়ান থাকে। শফিক সাহেবের উপর যেকোনো সময় হামলা হতে পারে এই আশঙ্কায় দুজন পালোয়ান এনে রেখেছেন, তাদের কাজ সারাদিন ঘুমানো আর সারারাত জেগে পাহারা দেয়া। শফিক সাহেবের ঘরে ঢুকেই মানিক একটু চমকে উঠল, এই আঁধারের মাঝে যেন এখানে একটু বেশিই আলো। জেনারেটরের মৃদু শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ঘর থেকে দূরে লাগানো হয়েছে যেন শব্দ বেশি পাওয়া না যায়। বেশ গুছানো বসার ঘরটি। পায়ের নিচে মখমলের কার্পেট, বসার জন্য সোফা, দেয়ালে বেশ কিছু ছবি। একটা ছবি চেনা মনে হলো, হ্যাঁ, সাঙ্গু নদীর ঘাট।

শফিক সাহেব ঘরে ঢুকলেন, বদরুল আলমের চেয়ে ওনাকে দেখতে অনেক কম বয়সী মনে হয়। শফিক সাহেব হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন—

বদি আমাকে টেলিগ্রাম করে বলেছিল তোমার কথা। তুমি করে বলছি, কিছু মনে করলে না তো?

মানিক হেসে বলল—

তুমি করে না বললেই বরং মনে করতাম।

শফিক আহমেদ বললেন—

গুড, কোনো সমস্যা হয়নি তো আসতে?

না, আচ্ছা এই পেইন্টিংটা নদীর ঘাট না?

হ্যাঁ, আমিই এঁকেছি। ছবি আঁকতে ভালো লাগে আমার। যখন বয়স ছিল তখন নেশা ছিল পয়সা কামানোর। কামিয়েছিও প্রচুর। একসময় মনে হলো আর না, ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে পাহাড়ে চলে এলাম। ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে, আমি দেশে একা। একা মানুষদের পাহাড়েই থাকা উচিত। কোলাহলের ভেতর একা মানুষদের একাকিত্ব বেশি ধরা পড়ে। এখানে অগ্রযাত্রা নামে একটা এনজিও চালাই নিজের পয়সায়। গরিব মানুষদের সাহায্য করে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তারা এগুতেই চায় না, আমার অগ্রযাত্রাও থেমে আছে।

একটু থেমেই আবার বললেন—

এখানে বাইরে থেকে যেমন অনেক সুন্দর ভেতরে তেমনি কদর্য রূপ। উগ্রপন্থী সংগঠনগুলো খুব তেতে আছে। বড় সংগঠনগুলোকে সামলানো যাচ্ছে না, এরই মধ্যে আরো অনেক গ্রুপ গজিয়ে উঠছে। এরা অস্ত্র জোগাড় করছে, টাকা-পয়সার জন্য চাঁদাবাজি, অপহরণ শুরু করেছে। তাদেরই বা দোষ দেই কীভাবে! নিজের ঘর বাঁচানোর জন্য সবটাই দিয়ে দিবে তারা। এরশাদ সাহেব ঠেলে বাঙালিদের পাহাড়ে পাঠাচ্ছে, পরিকল্পিত বনায়নের নামে তাদের জঙ্গল কেটে সাফ করে দেয়া হচ্ছে, তারা তো রিয়েক্ট করবেই।

বাঙালিদের উপর আক্রমণ করছে, বাঙালিরাও তাদের উপর পাল্টা হামলা করছে। সব মিলিয়ে এখানে ম্যাসাকার অবস্থা।

তারপর মানিকের দিকে তাকিয়ে বললেন—

ওহ, তোমাকে তো মনে হয় প্রথমেই ভয় পাইয়ে দিলাম। সাবধান হওয়ার জন্যই বললাম। কিছু মনে করো না। বদি, মানে তোমাদের বদরুল স্যার অবশ্য তোমার ট্রান্সফারের ব্যাপারে চেষ্টা করছে বলল কিন্তু আশা কম। তা তোমার পোস্টিং কি থানচিতেই? হলে ভালো হয়, আমার সাথেই থাকতে পারবে।

মানিক বলল—

না আমাকে বোধহয় বলিপাড়া ইউনিয়ন সাবসেন্টারে পাঠাবে, একেবারে সর্বোচ্চ শাস্তি যাকে বলে।

শফিক সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেল, বললেন—

বলিপাড়া জায়গাটা সুবিধার নয়। ওখানে আমার একটা স্কুল ছিল, জ্বালিয়ে দিয়েছে। তবে আমার একটা ঘর আছে সেখানে। বাঙালি থাকে আশেপাশে কয়েকজন। ওখানে তোমার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবুও এখান থেকে পালানোর ব্যবস্থা করো। আমি দুজন পালোয়ান নিয়ে থেকেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারি না।

মানিক বলল—

আমার জন্য ভালোই হলো, আপনিই তো বললেন একা মানুষদের পাহাড়েই থাকা উচিত।

শফিক সাহেব একটু হাসলেন। তারপর হাশেমকে ডাকলেন। হাশেম ঘরে ঢুকতেই বললেন—

বরকত আলী এসেছে?

জ্বি স্যার।

ঠিক আছে, তাকে পাঠিয়ে দাও।

বরকত আলী ঢুকতেই, কড়া জর্দার গন্ধ নাকে এসে ঠেকল। মানিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বাসের সেই ইতর লোকটি। বরকত আলীও মালাউনটার চেহারা দ্বিতীয়বার দেখার আশা করেনি। এই দ্বিতীয় সাক্ষাতে তার উদ্বেলিত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না,

হলোও না কিন্তু মুখে একটা বিগলিত হাসি টেনে শফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল—

স্যার আমারে বুলাইছেন?

শফিক সাহেব বললেন—

হ্যাঁ তোমাকে বুলিয়েছি, এত দেরি হলো কেনো? তোমার না আজ দুপুরে ফেরার কথা?

বরকত আলী মুখে হাসিটা ধরেই রেখেছে। শফিক সাহেব মানিক মিত্রকে দেখিয়ে বললেন—

উনি এখানকার নতুন ডাক্তার। বলিপাড়াতে আমার ঘরটাতে সে থাকবে এখন থেকে, তুমি ব্যবস্থা করে দাও। আর আজ রাতে ভালো কিছু আয়োজন করো।

বরকত আলী একটু মুচকি হেসে বলল—

গরু রাঁধতে বলব স্যার?

শফিক সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন—

গরু ছাড়া যা আছে সব করো।

মানিক এবার বলল—

গরুতেও আমার কোনো সমস্যা নেই।

বরকত আলী একটু হতাশই হলো, মালাউনটাকে জব্দ করতে না পেরে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই শফিক সাহেব বললেন, বরকত আমায় ম্যানেজার। একটু বেশি কথা বলে।

মানিক বলল—

আমি জানি। বাসে কিছু সময় সে আমার সহযাত্রী ছিল।

শফিক সাহেব বললেন—

বেশ। তাহলে তো হলোই। চলো তোমাকে আমার স্টুডিও দেখাই। একটা নতুন ছবি আঁকছি, সেটা দেখবে।

স্টুডিওটি বেশ ছিমছাম, একটা টুল, কাঠের ফ্রেম, রঙতুলি রাখার জন্য একটা টেবিল আর বেশ কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্যানভাস ছাড়া আর কিছুই নেই। কাঠের ইজেলে আটকানো একটা অসম্পূর্ণ ছবি। একটা নীল রঙের পাহাড়ের চূড়ায় ডালপালা ছড়িয়ে আছে একটা গাছ। গাছটা এতই বিশাল যে মনে হচ্ছে পুরো পাহাড়টিকে নিজের পাতার আঁচলে ঢেকে দিবে। মানিক ছবিটাতে তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করল—

এটা কোন জায়গা? পাহাড়ের রঙ নীল কেন?

শফিক সাহেব বললেন—

জানি না। কল্পনা করে এঁকেছি। মানিক, আমার স্টুডিওতে আমি সবাইকে আসতে দেই না। যাদের আমি পছন্দ করি তাদের ঢুকতে দেই। আমার স্ত্রী যখন জীবিত ছিল তাকেও কখনো আমার স্টুডিওতে ঢুকতে দেইনি। আর যারা আমার স্টুডিওতে আসে তাদের আমি আমার আঁকা ছবি উপহার দেই, তুমি বলো তোমার কোন ছবি চাই?

মানিক এক মুহুর্ত না ভেবে বলল—

সাঙ্গু নদীর ঘাট চাই আমার।

.

বরকত আলী পরপর তিনটা পান মুখে পুরে নিজের রাগ কমাতে পারছে না। ঐ মালাউনটার মেহমানদারি করতে হবে? তার থাকার জায়গা ঠিক করে দিতে হবে? কি জমানা আসল মোসলমান হইয়া মালাউনের সেবা করতে হয়। বরকত আলী অবশ্য তার জীবনের অর্ধেকই মালাউনদের নুন খেয়ে কাটিয়েছে।

নোয়াখালীর শান্তিবাবুরা ছিলেন জমিদারদের উত্তরসূরি। জমিদারি না থাকলেও তাদের ছিল বিশাল কারবার। তাদের খামারে প্রায় আড়াইশ গরু ছিল, মাছ চাষের জন্য প্রায় পঁয়ত্রিশটি পুকুর ছিল, তাদের জমি মাপা হতো দৃষ্টিসীমায়, যতদূর চোখ যায়। শান্তিবাবুদের খামারগুলোর হিসাব-নিকাশ করত বরকত আলী। প্রায় এগারো বছর এক টানা কাজ করেছে সেখানে। শান্তিবাবু তার জন্য আলাদা ঘর তুলে দিয়েছিলেন উঠানের একপাশে।

কুলসুম শান্তিবাবুর স্ত্রীর ফুট-ফরমায়েশ খাটত। সে যখন উঠান ঝাঁট দিত, তখন বরকত আলী তার ঘর থেকে জানালা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকত। মাঝে মাঝেই সে সবার অলক্ষ্যে কুলসুমকে এটা-সেটা কিনে দিত। কুলসুম উঠান ঝাট দেয়ার পাশাপাশি বরকতের ঘরও ঝাট দিত। অনেক সময় লেগে যেত বরকতের ছোট ঘর ঝাঁট দিতে। কয়েক মাস পর কুলসুম তার ঝাঁট দেয়া উঠানে বমি করল। শান্তিবাবুর মা কুলসুমের হাত-পা দেখে বলল—

কি সর্বনাশ করছস লো। কার লগে পেট বান্ধছস?

নিতান্ত বাধ্য হয়ে চাকরি বাঁচানোর জন্য কুলসুমকে বিয়ে করে বরকত। কিন্তু তার অত্যাচারে দুই বছরের বেশি টিকতে পারেনি কুলসুম। একদিন সকালে তার নিথর দেহটা পাওয়া গেল মেঝেতে। নিন্দুকেরা বলে, বরকতই মেরেছে বউকে কিন্তু বরকত সেদিন খুব কাঁদল, তার কান্না দেখে নিন্দুকদের মনেও মায়া জেগে উঠল। কতজনের বউই তো মরে, কই কেউ তো এভাবে কাঁদে না! কুলসুমের দুই বছরের কন্যাটিও বেশি দিন বাঁচেনি, নিউমোনিয়া হয়ে সেও মরল।

শান্তি বাবুর মেয়ে সুলেখা বারোতে পা দিয়েছে। বরকতকে ডাকত কাকা। সুলেখার ফর্সা উন্মুক্ত ত্বকের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাত বরকত। মনে মনে বলত, মালাউন মাগীগুলা এত সুন্দর হয় কেন?

আদর করার ছলে বরকত অনেকবার সুলেখার গা ছুঁয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হতো তার। একদিন নিজেকে দমন করতে পারেনি, আদরের হাত সুলেখার শরীরে পশুর মতো হাতড়ে বেড়াচ্ছিল কামনা। সুলেখা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল, সে ছুটে বের হয়ে গিয়েছিল, নিজের ঘরে বসে কাঁদছিল অঝোরে, অনেক চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারেনি, প্রচণ্ড ঘৃণায় ডুকরে কেঁদেছিল সে। শান্তি বাবুর স্ত্রী সুলেখাকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

সুলেখা কিছু বলতে পারেনি, কান্নার দমকে কেঁপে উঠছিল সে। শুধু অস্ফুটে বলেছিল, কাকা।

পরদিন বরকতকে বের করে দেয়া হয়। বরকত আলী প্রচণ্ড ক্ষোভে প্রতিশোধের নেশায় উন্মাতাল হয়ে ওঠে। প্রতিশোধের সুযোগ সে খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যায়, দেশে শুরু হলো যুদ্ধ। বৱকত আলী দেশ রাজনীতি ধর্ম কিছু বুঝে না। তার কাছে এই যুদ্ধ অবদমিত কামনা নিবারণের যুদ্ধ, মালাউনদের দেশ ছাড়া করার যুদ্ধ। রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিল সে। প্রথমেই সে হামলা করল শান্তি বাবুর বিশাল বাড়িতে। শান্তি বাবু ইন্ডিয়া যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছিলেন।

বরকত আলী শান্তি বাবুর গলায় ছুরি বসিয়েছিল নিজ হাতে। শান্তি বাবু যতক্ষণ কথা বলতে পেরেছিল, ততক্ষণ শুধু একটা অনুরোধই করেছিল, বরকত, আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দিও। সিন্দুকে সোনার গহনা আছে, সব নিয়ে যাও, আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।

সুলেখাকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এসেছিল বরকত। এমন রূপসী ছোট মেয়ে পেয়ে পাঞ্জাবিরা বেশ খুশি হয়েছিল তার উপর। সুলেখার জন্য অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে বরকতের, সব অফিসাররা সুলেখাকে ভোগ করার পর সে সুযোগ পেয়েছিল। শুধুমাত্র একটা লুঙ্গি কোনোরকমে গায়ে জড়িয়ে রেখেছিল সুলেখা, একেবারে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে, আগের সেই মোহনীয় ভাবটা ছিল না। কিন্তু তাতে বরকতের কামনা এক বিন্দুও কমেনি। সুলেখা গায়ের লুঙ্গিটি খামচে ধরে শুধু অস্ফুটে বলেছিল—

আপনি আমার বাবার মতো।

বরকত আলী বিকৃত হাসি টেনে বলেছিল—

ধুর মাগী, মালাউনগো আবার বাপ ভাই আছেনি।

সুলেখা আর কিছু বলেনি, সে পড়ে ছিল একটা লাশের মতো। সেই লাশটা পশুর মতো খাবলে খেয়েছে বরকত আলী। তিন মাস পরে সুলেখা সত্যি সত্যি লাশ হয়ে গিয়েছিল। পাশের মেয়েগুলো হিংসায় তাকিয়ে ছিল তার লাশের দিকে। তাদের ভাগ্যে যে মরণও জুটে না।

যুদ্ধ শেষে বরকত আলী মুক্তিদের কাছ থেকে পালিয়ে এই পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল। পাহাড় কাউকে ফেরায় না, নিজের উদরে স্থান করে দেয় সবার। সব পাপ লুকিয়ে রাখে।

কাঠের পাটাতনে বসে পানের পিক ফেলে বরকত আলী, মালাউন ডাক্তারটার একটা বিহিত সে করেই ছাড়বে। মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করে নিজের গায়ের জ্বালা কমায় সে।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *