নীল পাহাড় – ২

দুই

বংশালে গেট দেয়া দেয়াল ঘেরা একটা বাড়িতে থাকে মানিক। একতলা টিনের চালের বাড়ি, সামনে বারান্দা। উঠানের এক কোণে বাঁধানো কলপাড়, তার পাশেই রান্নাঘর। উঠানের ঠিক মাঝামাঝিতে একটি বরই গাছ। এই বাড়িতে মানিক একা থাকে, অথচ এককালে এখানে একটা সুখী পরিবার থাকত। বাড়ির পেছনে গিন্নীর লাগানো হাসনাহেনা গাছ এখনো রাতে মাতাল করা গন্ধ ছড়ায়। বরই গাছের কাণ্ডে বাড়ির ছোট্ট ছেলেটির স্বাক্ষর আজও মুছে যায়নি। কর্তার ইজি চেয়ারের দাগ বারান্দার মেঝেতে রয়ে গেছে।

কাপড় শুকানোর জন্য আড়াআড়িভাবে বাঁধা নাইলনের দড়িটি এখনো বাঁধা আছে, সেই দড়িটি বড় অলস সময় কাটাচ্ছে। দড়িতে কোনো কাপড় দেখলেই যে কেউ বলতে পারত এখানে বাবা-মা ভাই-বোনের সুখের সংসার।

ডা. সুধীর দত্ত বংশালে এই বাড়িতে তার সংসার পেতেছিলেন। কত স্বপ্ন দেখতেন বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়ে, পত্রিকা পড়তে পড়তে আবার ঘুমিয়েও যেতেন। ঘুমিয়েও সেই একই স্বপ্ন দেখতেন। মেয়েটিকে একটি ভালো ছেলে দেখে পাত্রস্থ করবেন। ছেলেটিকে স্কলারশিপে বিদেশে পাঠাবেন। বুড়ো-বুড়ি নাতি-নাতনিদের সাথে গল্প করবেন আরো কত কী। বউয়ের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙত কিন্তু স্বপ্ন ভাঙত না। কলপাড়ে বসে মাছ কাটতে কাটতে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে বসত গিন্নী। কর্তার বাজার জ্ঞান বরাবরই কাঁচা।

বিশ বছর ধরে বাজার করেও নিয়মিত ঠকে যাচ্ছেন। সুধীর বাবু ইজি চেয়ারে শুয়েই তার মেয়েকে ডাকেন—

কই গো মা আমার। বাবার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আয় তো। তোর হাতে চা না খেয়ে যাই কী করে বল?

সুধীর বাবুর মেয়ে হাতে একটা লিস্ট এনে বাবার হাতে ধরিয়ে দেয়। বলে—

বাবা এই বইগুলো এনে দিও তো।

সুধীর বাবু আদুরে গলায় বলে—

মাগো, এই বয়সে মেয়েরা সাজগোজের জিনিসের জন্য আবদার করে, তোকে তো দেখলাম না কোনোদিন লাল ফিতা কিংবা নতুন ফ্যাশনের জামা চেয়েছিস!

মেয়ে বলে—

সবাই নিজেকে সাজায় আমি আমার মনকে সাজাই।

সুধীর বাবুর বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে। তিনি বলেন—

বুঝলি মা, আশ্রমে একটা ছেলে আছে মানিক নাম। একেবারে গোবরে পদ্ম ফুল, ব্রিলিয়ান্ট বয়। একদিন নিয়ে আসব। ম্যাট্রিকটা পাস করলেই বাসায় নিয়ে আসব। খোকনকে পড়াবে।

খোকনকে পড়ানো হয়নি মানিকের। তার আগেই একাত্তর এসে গিয়েছিল। দুইটি বেয়নেটের সামনে বসে সুধীর বাবু দেখছিলেন কীভাবে তার জীবন থেকে স্বপ্নলোকে টেনেহিঁচড়ে খাবলে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল পশুরা। ঘর থেকে তার মেয়ের চাপা চিৎকার ভেসে আসছিল, মেয়েটা বারবার বাবা বাবা বলে চিৎকার করছিল। অসহায় সুধীর বাবু নিজের মাথা ঠুকছিলেন। তার বউ রান্নাঘরের পাশে যে গোঙ্গাচ্ছিল, বুকের ভেতর বেয়নেট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে তাকে। রক্তের প্রবাহ এঁকেবেঁকে মাটিতে গড়িয়ে যাচ্ছে।

মৃত্যুর আগে সুধীর বাবুর দিকে তাকিয়ে ছিল তার বউ, তার চোখে তীব্র বেদনা ছিল, নিজের মৃত্যুর বেদনা নয়, মেয়ের সম্ভ্রম, খোকনের প্রাণের আশঙ্কায়। খোকন বরই গাছে উঠে বাঁচতে চেয়েছিল, তাই দেখে হাসছিল জানোয়ারগুলো। সুধীরবাবু চিকোর করে বলছিলেন—

সে বাচ্চা ছেলে, ওকে ছেড়ে দাও। সে কিছু করেনি।

তারা কেউই কিছু করেনি, একমাত্র অপরাধ তারা হিন্দুর ঘরে জন্ম নিয়েছিল। সেটা কীভাবে তাদের অপরাধ হলে, সুধীর বাবু কিছুতেই বুঝতে পারে না। এক বাঙালি দালাল বলে উঠল—

হিন্দুর পোলা হিন্দু হইবে। ইন্ডিয়ার দালালি করবো।

বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নামানোর চেষ্টা করছিল এক উর্দি পরা পাকি জানোয়ার। কিন্তু গাছের ডাল উঁচু হওয়ায় নাগাল পাচ্ছিল না। একটা হাস্যসের সৃষ্টি হয়েছিল, খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছিল বাঙ্গালি জানোয়ারটি। খোকন আঁকড়ে ছিল গাছটি, ভয় পেলে যেভাবে মাকে আঁকড়ে ধরে সেভাবে।

মোটা গোঁফওয়ালা পাঞ্জাবি কমান্ডার ঘর থেকে নিজের শার্ট পরতে পরতে বের হলো, আরেকজন ঢুকবে পরে কিন্তু এই মজার দৃশ্য ফেলে সে যেতে পারছে না। পাঞ্জাবি কমান্ডার এসে বললেন—

ইতনা কঞ্জুসি মাত কারো, এক গোলি কা হি তে মামলা হ্যায়।

একজন সৈন্য উৎসাহী হয়ে বন্দুক তাক করে গুলি করল। সাথে সাথেই খোকনের হাতের বাঁধন খুলে গেল। বরই গাছের নিচে তার শরীরটা একবার ভীষণভাবে মুচড়ে উঠে নিথর হয়ে গেল। গাছের নিচে রক্তের একটা গোল বৃত্ত তৈরি হলো। ঘরে ঢোকা সৈন্যটি রাগতে রাগতে বের হয়ে বলল—

কমবখত ল্যারকি ফাঁস লে লি। রেন্ডি কাহি কা।

তার ভোগ না মিটিয়ে মরায় সে খুব ক্ষুব্ধ। সুধীর বাবু মূর্ছা গেলেন।

পাকিস্তানিরা সুধীর বাবুকে ছেড়ে দিয়েছিল। কমান্ডার বলেছিল—

ইয়ে বুড্ডা অউর পেয়দা নেহি কার সাকতা। ইস্কো ছোড় দো।

সেদিন যদি পাকিস্তানিরা তাকে মেরে ফেলত তৰে সুধীয় বাবু বেঁচে যেত। সেদিনের পর থেকে তিনি প্রতিদিন মৃত্যু কামনা করেন। জীবন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, মৃত্যুও।

সেদিনের পর থেকে কখনো নিজের ঘরে ঢুকেননি সুধীর বাবু, বারান্দায় থাকতেন। ম্যাট্রিকের পর মানিককে নিয়ে এসেছিলেন। বৃষ্টির রাতে বারান্দায় বসে বসে ভিজতেন কিন্তু ঘরে যেতেন না। মানিক অনুরোধ করলে বলতেন—

ঘরে যাব না রে মানিক, ঐ ঘর থেকে আমার মেয়ের চিৎকার শুনি আমি। বাবা বাবা বলে ডাকে। আমি কিছুই করতে পারি না।

মানিকের মনে হয় সুধীর বাবু কাঁদছে কিন্তু বুঝতে পারে না, বৃষ্টিতে চোখের পানি আলাদা করা যায় না। উঠানে তিনি জমাট বাঁধা রক্তের কালো দাগ দেখতে পান, মানিককে ডেকে বলতেন—

দেখ তো বরই গাছের নিচে কালো হয়ে আছে না?

মানিক কিছুই দেখত না। প্রতিদিন বেশ কয়েকবার সুধীর বাবু উঠানে পানি ছিটিয়ে দিতেন। কিন্তু তবুও সন্তুষ্ট হতেন না। যত দিন যায় তিনি তত কালো দাগ দেখতে পান আর তত পানি ছিটান। কয়েক বছর পরে মানিক যখন ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হলো, তখন একদিন সুধীর বাবু বলল—

আমি চলে যাব রে, এই মাটির লোভে দেশ ছাড়িনি, সব হারিয়েছি। কিন্তু আজ এই মাটি কালো হয়ে যাচ্ছে রে। আমি এখানে থাকব না। তোকে সব দিয়ে গেলাম। কাগজপত্র করেই দিলাম। এমনি এমনি দিচ্ছি না, বাকি থাকল, ডাক্তার হয়ে দেনা শোধ করবি। কলকাতায় আমার আত্বীয়স্বজন আছে। সেখানে গিয়ে থাকব, ভালো না লাগলে আবার চলে আসব। তখন যেন আবার আমায় তাড়িয়ে দিস না।

মানিক মনে মনে বলল, আপনার দেনা শোধ করার মতো ক্ষমতা আমার কোনোদিন হবে না।

মাটি ছেড়ে যেতে পারেননি সুধীর দত্ত। যেদিন কলকাতায় রওনা হওয়ার কথা তার আগের দিন বারান্দার ইজি চেয়ারটাতে শোয়া অবস্থায় সুধীর বাবু মারা গেলেন। তার অপেক্ষার অবসান হলো।

সেই ইজি চেয়ারটাতে কখনো বসে না মানিক। এই বাড়ি এখন তার, কিন্তু একবারের জন্যও তাব সেটা মনে হয় না। নিজ বাড়িতে ঢুকলে বুকটা হু হু করে ওঠে, এই বাড়ির মতোই মানিক একা, সব হারিয়েছে তার। অবশ্য হারানোর মতো কিছু ছিলও না মানিকের।

পাশের বাসায় শাশুড়ি আর বউয়ে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে, প্রায়ই হয়। স্বামীটি একেবারে চুপচাপ, বউ স্বামীর সাথে ঝগড়া করে মজা পায় না, তাই শাশুড়িই ভরসা। আরেক বাসায় দুই ভাই-বোন গলা উচু করে পড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। তাদের এই প্রতিযোগিতায় আশেপাশের মানুষদের তাদের পড়া মুখস্থ হয়ে যায়। আশেপাশের বাসাগুলোতে একটু পরে বাবারা আসে। কোনো বাসায় বাবারা আসলে চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে যায়, আবার কোনো বাসায় শুরু হয়। খোশগল্প অথবা ঝগড়া হয় কোথাও। মনোযোগ দিয়ে শুনে মানিক। মাঝে মাঝে সব ছাপিয়ে যায় বৃদ্ধের কাশি। হাঁড়ি-পাতিলের সাথে চামচের ঠুকাঠুকি শুরু হয় একটু পর, কোলাহলটা কমে যায় একটু তখন। মানিকের মনে পড়ে তাকে খাওয়ার জন্য হোটেলে যেতে হবে।

আশেপাশের কোলাহল এই বাড়িটাকে আরো নীরব করে দেয়। সব বাড়ি কথা বলে, এই বাড়ি বোবা। মানিক পরিবার পায়নি, প্রতিবেশীও না। সে চেষ্টা করত একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়তে, কিন্তু পারত না। বৃদ্ধকে দেখে কতবার মনে হয়েছে জিজ্ঞাসা করবে, কাশিটা কমেছে কি না, কিন্তু করতে পারে না। শাশুড়ীটাকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, তাদের ঝগড়া এখন বন্ধ কেন, বউ কি বাপের বাড়ি গেছে? পাশের বাসার ভাবিকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, তার বাবুটা কেমন আছে? পারে না, কী যেন একটা সঙ্কোচ তাকে ঘিরে ধরে। সে খেয়াল করেছে, যে নারীর অনেক ভাই, সে আরো ভাই পাতবে। যার বোন আছে সে আরো অনেককে বোন ডাকবে। তার কিছুই নেই, তাই সে কাউকে কিছু বানাতে পারে না। সে সবাইকে আপন ভাবে, তাই কাউকেই আপন করে নিতে পারে না। নারায়ণ বাবুর বউ ঘরে মেহমান এলেই আশেপাশের বাসায় চায়ের পাতা, দুধ, চিনি চাইতে আসেন। অনেকেই এখন আর দেয় না। মানিক চা খায় না তবুও সে চায়ের পাতা, দুধ, চিনি এনে রেখেছে। কোনোদিন যদি বৌদি আসে তবে সে নিঃসঙ্কোচে দিবে। কিন্তু নারায়ণ বাবুর বউ সব ঘরে যায়, তার ঘরে আসে না। একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন গেট খুলে রাখে যাতে বাচ্চারা ফুল নিতে পারে কিন্তু তার বাসা থেকে ফুল চুরি করতে আসে না কেউ, এরকম গেট খুলে আহ্বান জানালে সেটা ঠিক চুরির মর্যাদা পায় না, তাই হয়তো।

মানিক ওয়ার্ডে ডিউটি করছিল। ওয়ার্ড বয় মনসুর গোমড়া মুখে এসে বলল—

স্যার আপনেরে ডাইরক্টর সাব বুলায়।

মনসুরের গোমড়া মুখ খুব দুর্লভ বস্তু। ভয়ানক বিপর্যয়ের খবরও সে হাসিমুখে দেয়। একবার ঠোঁট প্রসারিত করে হাসতে হাসতে বলল, স্যার তিন নম্বর বেডের রোগী মইরা গেছে।

তারপর আরেকটা লাজুক হাসি দিয়ে বলল, রোগী কালা সেলিমের আত্মীয় আছিল, তারা হাসপাতাল ভাংচুর করতাছে।

সেই মনসুর যখন গোমড়া মুখে কোনো খবর দেয় তখন সেটা কত খারাপ খবর সেটা ধারণা করা যায় না।

নিজের চেম্বারে বসে আছেন ডা. বদরুল আলম। বিশাল চেয়ারটির কারণে তাকে ক্ষুদ্র দেখাচ্ছে। চেয়ার এত বড় হবে মানুষ তত ক্ষুদ্র হবে। বদরুল আলম সামনে ঝুঁকে মানিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি জানো, এই হসপিটালে সবাই তোমাকে কত ভালোবাসে, এমনকি মনসুরও? সে বলেছে তোমার চাকরি চলে গেলে সেও চাকরি ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যাবে, বলদের সাথে মিলে মিশে হাল দিবে। সোবহান সাহেব ভয় দেখিয়ে একজন নার্সকেও তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে রাজি করাতে পারেননি। নার্স নাসরিনকে চিনো? তার দুই বছরের বাচ্চা আছে, ঘরে মা আছে, এক ভাই আছে কিন্তু স্বামী নেই। এই চাকরি গেলে হয় ভিক্ষা করতে হবে নয়তো নিজেকে বিক্রি করতে হবে। সেও বলেছে, চাকরি গেলে যাবে কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারবে না।

মানিক মাথা নিচু করে রইল, এতো ভালোবাসা তার আশেপাশেই ছিল, সে খুঁজে পায়নি, শুধু হাতড়ে বেড়িয়েছে। আবেগে বুঝি তার চোখটা একটু ভিজে উঠল।

বদরুল আলম বললেন,

কিন্তু আমরা যেহেতু মগের মুল্লুকে বাস করি তাই ক্ষমতাবানরা তোমার লঘু শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। তোমাকে বান্দরবানের থানচি উপজেলায় পোস্টিং দেয়া হয়েছে। খুব সম্ভবত তোমাকে ইউনিয়ন সাবসেন্টারে পাঠাবে। আমার কাছে এই শাস্তিটা লঘু মনে হয়নি—পাহাড়ের অবস্থা এখন ভালো না। পত্রিকা খুললেই দেখি খুন, সংঘর্ষ, অপহরণ।

একটু থেমে বদরুল আলম বললেন—

তবে সুখবর হলো থানচিতে আমার এক বাল্যবন্ধু আছে, সেখানে কী যেন একটা এনজিও চালায়। আমি তাকে চিঠি লিখে দিব, তোমার সব ব্যবস্থা সে করবে।

মানিক বুঝতে পারল না নিজের মনের অবস্থা। তার কোনো আক্ষেপ হলো না, আবার উচ্ছ্বসিতও হলো না। সে বদরুল আলমের দিকে তাকিয়ে বলল—

ধন্যবাদ সার।

বলেই মানিক উঠল। বদরুল আলম বললেন—

মানিক সাবধানে থেকো।

এই কথাটা বলার সময় বদরুল আলমের গলাটা একটু কেঁপে উঠল। মানিক দেখল বদরুল আলমকে আর পিজি হাসপাতালের হামবড়া পরিচালক মনে হচ্ছে না। এই প্রথম তাকে বাবার মতো লাগছে। কিন্তু এই কথাটা সে কখনোই বদরুল আলমকে বলতে পারবে না। তার বুকে ভালোবাসার আগ্নেয়গিরি আছে কিন্তু কখনোই তার উদ্গীরণ হয় না।

মানিক ঢাকা অনাথ আশ্রমের তত্ত্বাবধায়কের ঘরে বসে আছে। ছোট্ট একটা ঘর। এলোমেলোভাবে কাগজপত্র ছড়ানো। দুটি কাঠের চেয়ার আছে বসার জন্য, সেই চেয়ারগুলোতে ঘুণপোকারা আশ্রম খুলে বসেছে। জানালাতে পাতলা ময়লা একটা পর্দা দড়ি দিয়ে ঝুলানো হয়েছে, দড়িটি ঢিলে হয়ে যাওয়ায় পর্দাটি উপরের দিকে বাঁকা চাঁদের মতো ঝুলে আছে। দেয়ালে আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা রানি রাশমণির একটা সাদাকালো পোর্ট্রেট আছে, রানি রাশমণি স্বয়ং দেয়ালে ঝুলেও এই ঘরটার শ্রী বৃদ্ধি করতে পারেননি। রানির পাশেই একটি পত্রিকার কাটিং বাঁধিয়ে টাঙ্গানো হয়েছে। পত্রিকার কাটিংয়ে সাদাকালো ছবি, নিচে লেখা অনাথ আশ্রমের শিক্ষকদের সাথে ঢাকা বোর্ডে চতুর্থ হওয়া মেধাবী মানিক মিত্র। কিন্তু ছবিতে মানিককে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারো দৃষ্টিশক্তি প্রখর হলে দেখতে পাবে, শিক্ষকদের আড়ালে ছোট্ট একটা মুখ দেখা যায়। ছবি তোলার সময় চণ্ডীদাস বাবু মানিককে ঠেলে নিজেই মধ্যমণি হয়ে বসেছিলেন, গায়ে-মুখে কেজি খানেক পাউডার মেখে মাথায় চপচপে তেল দিয়ে সরু সিঁথি করে চুল আঁচড়ে এসেছিলেন তিনি। বিয়ের সময়ও বোধ হয় তিনি এত সাজেননি। সাজবেনই বা না কেন, আজকাল না মরলে তো আর অত সহজে পত্রিকায় ছবি ওঠানো যায় না।

এই চণ্ডীদাস বাবুই সুধীর দত্তকে মানিকের সামনেই বলেছিলেন,

আপনে মশায় যত বড় ডাক্তারই হন না কেন, বুদ্ধিশুদ্ধি আপনার একটু কমই। এই আশ্রমের ছেলেকে কেউ গাটের পয়সা খরচ করে দামি স্কুলে ভর্তি করায়? আপনি সপ্তাহে দুদিন এসে যে বাচ্চাদের কে বিনে পয়সায় দেখে যান, তাই বা কম কি! স্বর্গে তো জায়গা তাতেই পাকা হয়ে গেছে। এই আশ্রমের ছেলেপেলে লেখাপড়া শিখে করবেটাই কী? দোকানের কর্মচারী হবে, হোটেলে ধোয়া-মোছ করবে, মেকানিক হবে নয়তো জেল খাটবে। ম্যাট্রিক পাশ করতে পারলেই নামটা পাল্টে দিবেন আমার।

চণ্ডীদাস বাবুর নাম ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর নামখানা বহাল তবিয়তেই ছিল। সুধীর বাবু সে কথা আর তুলেননি, চণ্ডীদাস বাবু তো তুলবেনই না, নিজের নামখানা অতিপ্রিয় তার।

ঢাকা অনাথ আশ্রমের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক চন্দন বাবু ঘরে ঢুকলেন। মাথায় এখনো ঝাঁকড়া চুল, সব সাদা হয়ে গেছে। ত্রিশ বছর ধরে এই আশ্রমে কাজ করছেন। মানিককে নামতা শিখিয়েছেন তিনি। মানিক মাত্র সাত বছর বয়সে উনত্রিশের নামতা বলে সুধীর বাবুকে অবাক করে দিয়েছিল। চন্দন বাবু অবাক হতেন না, তিনি সুধীর বাবুকে বলতেন—

এই ছেলে কাঁচা সোনা, সুধীর বাবু এঁকে আপনি আকার দিন।

মানিক উঠে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। মানিক যতবার তাঁর পা ছোঁয় ততবার তিনি বিব্ৰত হন কিন্তু বুকটা যেন ফুলে ওঠে। কত বড় ডাক্তার তার মতো স্বল্পশিক্ষিতকে গুরু মেনে পা ছোঁয়। চন্দন বাবু বলেন—

কেন আমাকে লজ্জা দাও মানিক। আমি সামান্য মানুষ, বাচ্চাদের দেখাশুনা করি, বিনিময়ে টাকা নিই, কোনো ভালো কাজ তো করছি না। তোমরা ভালো কাজ কর, তোমাদের মতো মানুষের দানেই এই আশ্রম চলে, আমরা চলি।

মানিক হেসে বলল—

আপনি আমার গুরু। গুরুকে সম্মান দেয়ার শিক্ষা আপনিই দিয়েছেন। আর দানের কথা বলছেন? আমার সব কিছুই তো দানে পাওয়া। ঠিকানা পেয়েছি দানে, নাম পেয়েছি দানে, পরিচয়টাও দানে পাওয়া। আমি যতই দিব এর প্রতিদান দেয়া হবে না।

চন্দন বাবু আবেগী হয়ে গেলেন, বললেন—

ওভাবে বলো না বাবা। তোমার পরিচয় তুমি নিজেই।

মানিকের চোখে বেদনা ফুটে উঠল। আকুতি নিয়ে বলল—

সেটা তো মানুষের কাছে, আমি তো বাবা-মার জন্য প্রার্থনাও করতে পারি না। আমি জানিই না তারা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।

নিজেকে সামলে নিয়ে বলল—

মাষ্টার মশাই আমার ট্রান্সফার হয়েছে, বান্দরবানে। আগামী মাস থেকে আমি মানি অর্ডার পাঠাব। পোস্টম্যানটাকে বলে রাখবেন।

প্রণাম করে উঠে গেল মানিক। চন্দন বাবু মানিকের চলে যাওয়া দেখছিলেন। মনে মনে ভাবলেন, ছেলেটা নিজের পরিচয়ের জন্য ক্ষুধিত হয়ে ঘুরছে কিন্তু সেই পরিচয় তার মনের ক্ষুধা মেটাবে না, বেদনা বাড়বে, ঘৃণা বাড়াবে।

.

খুব ছোটবেলায় মানিকের মনে মায়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না, প্রয়োজনও না। সে বুঝতে শেখার পর থেকেই নিজেকে আশ্রমে আবিষ্কার করেছে। সেখানে নিয়ম ছিল, শৃঙ্খলা ছিল কিন্তু মায়ের আদর সেখানে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে অনুপ্রবেশ করতে পারত না।

সেখানে আবদার ছিল না, অভিমান ছিল না। তাদেরকে কৃতজ্ঞ হওয়া শেখাত মাসিদের চোখ আর আয়াদের কটু কথা। সেখানে কেউ মাকে ডেকে কাঁদতে শিখেনি, বাবার কাঁধে চড়ে খিলখিল হাসির অস্তিত্ব কেউ জানতও না।

মা এসেছিল একদিন কালো শ্লেটে। ‘ম’-এর সাথে ‘আ’ কার দিয়ে মা হয়েছিল। সাদা শব্দটি জ্বলজ্বল করছিল। সে মাসিকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল—

মাসি আমার মা কোথায়? মাসি বলেছিল—

তোর মা নাই বাবা নাই, মারা গেছে।

বাবা-মায়ের মৃত্যু সংবাদে সে কোনো কষ্ট পেল না, কারণ আগে তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিলই না। সে জিজ্ঞাসা করল—

আমার বাবা-মা কে?

মাসি মুখস্থ বলে দিয়েছিলেন—

তোর বাপের নাম কৃষ্ণ কুমার মিত্র, আর মার নাম লক্ষ্মীরানী মিত্র।

মানিক মুখস্থ করে নিয়েছিল। মাঝে মাঝেই নিজের মনে আওড়ত নাম দুটি। তার কাছে মা ছিল কিছু ব্যঞ্জনবর্ণের সমাহার। একদিন আশ্রমে ‘মা’ ডাক শুনতে পেল তারা। মানিক নিজের ঘর ছেড়ে মাষ্টার মশাইদের ঘরে উঁকি দিল। তার বয়সী একটা ছেলে একজন মহিলার আঁচল ধরে চিৎকার করে ‘মা মা’ ডাকছে। যার আঁচল ধরেছে সেই বুঝি মা। মানিক দেখল মহিলাটি ছেলেটিকে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তার মুখে কি আশ্চর্য এক মায়া আর কী গভীর বেদনা। মাসিদের মুখ তো অমন হয় না!

আয়ারাও অমন করে জড়িয়ে ধরে কাঁদে না কখনো। ছেলেটার প্রতি হিংসায় মন ভরে গেল তার। ছেলেটার নাম ছিল কার্তিক। কার্তিককে থাকতে দেয়া হলো মানিকের সাথে। কার্তিক প্রায় সারাদিন কাঁদতো মা মা করে। মানিক কার্তিকের সৌভাগ্য দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। কার্তিকের জ্যান্ত মা আছে, যে কিছুদিন পর তার সাথে দেখা করার জন্য আবার আসবে। কিন্তু সেই কিছুদিন আর পার হয় না, কার্তিক তখনো তিন বেলা খাওয়ার পর নিয়মিত বিলাপ করত। আয়ারা এসে ধমক দিয়ে যেত, বলত,

তোর মার বিয়া হইছে আবার, কেমনে আইব?

কিন্তু কার্তিকের বিশ্বাস ছিল তার মা আসবে, মানিকও তা বিশ্বাস করত। মানিক যখন তার ব্যঞ্জনবর্ণের মার নাম আওড়াত তখন শুধু কার্তিকের মায়ের অশ্রুশিক্ত মুখটাই মনে ভাসত। একদিন সে কার্তিককে প্রস্তাবটা দিয়েই দিল, বলল—

খাওয়ার সময় আমার ডাল আমি তোকেই দিব, তুই আমাকে তোর মা দিস।

শুধুমাত্র খাওয়ার সময় কার্তিক প্রস্তাবটা মেনে নিত। অর্ধপেটে মায়ের স্বপ্নে বিভোর মানিকের ঘুম আসত না। কার্তিকের কাছে শুধু মায়ের গল্প শুনত। মা কিভাবে তাকে ঘুম পাড়াতো, কিভাবে মুখে তুলে খাওয়াতো, মায়ের কোলে মাথা রাখলে কীভাবে হাত বুলিয়ে দিত, সব খুঁটিনাটি শুনত সে। আর কল্পনায় কার্তিককে সরিয়ে নিজেকে ভাবত। কার্তিকের মা কখনো আসেনি, মানিকের ডাল, মাছ বৃথাই কার্তিকের পেটে যেত।

অনাথদের বাবা-মা ভূতের মতো তাদের ঘাড়ে চেপে বসে, তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই কিন্তু অস্বীকার করাও যায় না। তারা নেই কিন্তু তাদের নাম লেগে যায় আঠার মতো। স্কুলে নিজের নাম লিখতে শেখানোর পরই বাবা-মায়ের নাম লেখা শিখানো হয়। মানিক খুব যত্ন করে রুল টানা খাতায় নিজের মাকে ফুটিয়ে তুলল, বাবাকেও অক্ষর দিয়ে এঁকে দিল পাতায়। বেশ কিছুক্ষণ স্পর্শ করল আঙুল দিয়ে। রুল টানা খাতা থেকে কৃষ্ণ কুমার মিত্র এবং লক্ষ্মীরানী মিত্র যেন তার দিকে মায়া ভরা দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। মানিকের নিজের কিছুই ছিল না, কোন এক ধনীর নাদুসনুদুস পুত্রের ঢিলেঢালা জামা আর দড়ি দিয়ে বেঁধে হাফ প্যান্ট পরত, তার সব কিছুই ছিল অন্য কারো উচ্ছিষ্ট। এই প্রথম নিজের কিছু হলো তার, তার বাবা-মা হলো।

কিন্তু তার ভুল ভাঙতে বেশি দিন লাগল না। তার সাথের আরো তিনটা ছেলেও বাবার জায়গায় কৃষ্ণ কুমার মিত্রের নাম এবং মায়ের জায়গায় লক্ষ্মীরানী মিত্র লিখেছে। এটা কী করে সম্ভব! যা তার ছিল তা তার একার নয় তবে। পরে জেনেছিল এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা তার কলমের পিতা-মাতা, যাদের কোনো পরিচয় নেই তাদের তারা নিজেদের নাম দিতেন। এখনো সেই চর্চা চালু আছে। মানিক নিজের যা পেয়েছিল, সেই বাবা-মায়ের নামটাও উচ্ছিষ্ট। তার মৃত বাবা-মায়ের আবার মৃত্যু হলো। এবারের মৃত্যুতে মানিকের মনে হলো তার সব কিছু হারিয়ে গেছে। বাবা-মায়ের নাম দুটি ফরম পূরণ ছাড়া আর কখনো লিখেনি সে, মনেও আনেনি। এই নামগুলো শুধু প্রয়োজনের, এই নামে কোনো আত্মা নেই, কোনো আবেগ নেই, শুধু আছে কালো জড় অক্ষর।

কার্তিকের সাথে দেখা হয়েছিল অনেক বছর পর। কার্তিক অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করছিল। মানিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল। ভিক্ষার জন্য বাড়িয়ে দেয়া কার্তিকের হাত ধরে শুধু কার্তিকের নাম ধরে ডেকেছিল। মুহুর্তেই কার্তিকের চোখ খুলে গেল, সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেল, দৃষ্টি ফিরে এলো। মানিককে জড়িয়ে ধরল, এতক্ষণ গলায় যে আকুতি আর দুর্বলতা ছিল সব শেষ হয়ে গেল। এই অলৌকিক ঘটনায় মানিক হতবিহ্বল হয়ে গেল, আশেপাশের মানুষও। একজন ভিক্ষুক একজন লোককে জড়িয়ে ধরেছে এবং মানিক মানিক বলে আনন্দে চিৎকার করছে, চোখ কচলে দেখছে সবাই। পাশের বোবা ভিক্ষুকটিও প্রথমে একটু অবাক হলো, তারপর বলল—

কার্তিক তুই আমাগো ব্যবসা নষ্ট করবি, হালার পো।

গালি খেয়ে যেন কার্তিক আরো খুশি হয়ে গেল, নিজের পয়সা ভর্তি থালাটা বোবা ভিক্ষুককে দিয়ে চলে এলো। বোবা লোকটি আর কথা না বলে স্বভূমিকায় ফিরে গিয়ে ব্যবসায় মনোযোগ দিল।

মানিকের হতভম্ব ভাবটা যেন কাটতেই চাচ্ছে না। কার্তিক তার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, চোখে আঠা লাগাইয়া ভিক্ষা করি। কষ্ট আছে, তয় ইনকাম ভালোই।

মানিক বলল—

অন্য কোনো কাজ করতে পারিস না?

আমার কাজডারে ছোড কইরা দেহিস না, এক্টিং জানা লাগে। আর কয়েক দিন এদিকে ভিক্ষা কইরা যাত্রাপালাতে যামুগা। নায়কের পাট পাইতেও পারি, তোর ডাইল মাছ খাইয়া শইলডাও তাগড়া হইছে।

ডাল, মাছের শোধ দে তাহলে?

শোধ দিমু কেমনে? আমার মা মইরা গেছে।

কী অবলীলায় বলে দিল কার্তিক। মানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কার্তিকের দিকে। সেদিন অনেক অনুরোধ করার পরও কার্তিক মানিকের সাথে যায়নি। চোখে আঠা লাগিয়ে চলে গিয়েছিল নিজ ব্যবসায়।

বারান্দায় টুলে বসে আছে মানিক। এই বাড়ি ছেড়ে কাল চলে যাবে পাহাড়ে। কেমন যেন মায়া লাগছে বোবা বাড়িটার জন্য। এতদিন সে ছিল, রাতে মরচে পড়া গেইট খুললে গেইটটা আর্তনাদ করে উঠত। ঘরের দরজা লাগানোর ঠুকঠাক শব্দ হতো, জানালার কপাট খুলে দিয়ে জোছনা ঢুকাত ঘরে। শব্দগুলো যেন জানান দিত এই বাড়ি মরে যায়নি, এখনো বেঁচে আছে। মানিক শুয়ে পড়েছে, জানালার পর্দা ঠেলে মৃদু বাতাস ঢুকছে ঘরে। পাশের বাসার বৌদি তার ছেলেটিকে ঘুম পাড়ানোর জন্য ঘুমপাড়ানি গান গাইছে।

রাতের এই সময়টার জন্য মানিক সারাদিন অপেক্ষা করে থাকে। মনে হয় যেন কেউ হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, কার্তিকের মায়ের চেহারাটা চোখে ভাসে তখন। তার অজান্তেই গান শুনতে শুনতে চোখ টলমল করে ওঠে, চোখ বন্ধ করলে চোখ ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মানিকের মনে হলো, কার্তিককে বলে যাবে এখানে থাকতে, যেভাবেই হোক রাজি করাতেই হবে। এই বাড়িকে মরতে দেয়া যাবে না। পাশের বাসার বৌদির ছেলেটি আজ ঘুমাতেই চাচ্ছে না, মায়ের কাছে আবদার করে বলছে, আরেকটা।

মানিকও চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল, আরেকটা।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *