নীল পাহাড় – ১২

বারো

একশ’ ঢুলি মানিকের হৃৎপিণ্ডে বসে ঢাক বাজাচ্ছে। গত দশ মিনিট ধরে সে ঢাকা মেডিকেলের মেডিসিন ওয়ার্ডের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। কত তাড়া করেছে, শত শত মাইল পাড়ি দিয়েছে, সারা জীবন অপেক্ষা করেছে, প্রার্থনা করেছে এই মুহুর্তের জন্য। আজ সেই মুহূর্ত আর কয়েক কদম দূরে, অথচ পা আর চলছে না। সে কি সইতে পারবে এ সুখ, বুক ফেটে কি সে মারা যাবে না? সে মরণও ভাগ্যের মরণ। মানিক পা বাড়ল ভেতরে, এগারো নম্বর বেড তার গন্তব্য। দুই তিন চার নম্বর পার করেছে, মনে হচ্ছে কত জন্ম ধরে হাঁটছে, নীল পাহাড়ও যেন এত দূরে কি না। আশেপাশের সব স্থির হয়ে গেল, রোগীদের গোঙানি, ফিনাইলের গন্ধ, নার্সদের বিরক্তিমাখা কণ্ঠ, স্বজনদের উদ্বিগ্ন মুখ কিছুই নেই যেন। এগারো নম্বর বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মানিক। একজন বৃদ্ধা শুয়ে আছে, তার পাশে কেউ নেই। একেবারে সাধারণ বৃদ্ধা, রাস্তায় এরকম কত জনকে দেখেছে, ধীরে ধীরে ভয়ে ভয়ে রাস্তা পার হয় তারা, ফুটপাতে তাদের পেছনে হাঁটা মানুষরা খুব বিরক্ত হয় এদের স্থবিরতায়। লোকাল বাসে উঠলে হেল্পার চ্যাংরা ছেলেদের উঠিয়ে উনাদের বসতে দেন। মানিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, একজন নার্স এসে কর্কশ কন্ঠে বলল—

আপনে কে? রোগীর কে হন?

আমি রোগীর কেউ না, আমি ডা. মানিক।

নার্সের চোখ একটু কোমল হলো। মানিক জিজ্ঞাসা করল—

উনার নাম কী?

নার্স তার হাতের ফাইল উল্টে বলল—

উনার নাম রহিমা বেগম। উনার সাথের লোকেরা উনাকে রেখে চলে গেছে।

মানিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল—

এই বেডে চঞ্চলা চক্রবর্তী নামে যে রোগী ছিল তিনি কোথায়?

তিনি তো তিন দিন আগেই মারা গেছেন।

মানিক আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, হাঁটু গেড়ে মেঝেতেই বসে পড়ল, নার্স উদ্বিগ্ন হয়ে বলল—

স্যার কী হয়েছে।

কিছু না, আপনি যান।

রহিমা বেগম জেগে উঠল, মানিককে তার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল—

আমার পুতে আইছে?

মানিক বলল—

না আপনার ছেলে আসেনি, মনে হয় আসবে না।

কে কইছে, পেত্যেক দিন আহে, কিন্তু ট্যাহা নাই অসুধ কিনার, হেইলাইগা নাসগো ফাঁকি দিয়া লুকাইয়া আমার কাছে আছে।

আপনার ছেলে আসলে তাকে বলবেন, আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। লুকিয়ে লুকিয়ে মাকে দেখে যেতে হবে না। আপনার ওষুধের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।

রহিমা বেগমের চোখে সুখের ঝিলিক দেখা গেল। মানিক তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল—

আপনি কি একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেন?

রহিমা বেগম বিস্মিত হলো এই আবদারে, তার দুর্বল হাত উঠিয়ে মানিকের মাথায় ঠিকই হাত বুলিয়ে দিল, বলল,

দোয়া করিগো বাপ, আল্লায় তোমার ভালো করুক। তোমার মতো পূত হোক সবাইর।

মানিক আর পারল না, চোখের বাঁধ ভেঙে গেল। বিছানায় মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। রহিমা বেগম পরম আদরে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, তার মাথায় মায়ের হাতে পরশ বুলাচ্ছে।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে মানিক চিঠিটি বের করল, এই চিঠির বোঝা আর বইতে পারবে না সে। অনেক দুর্যোগ আগলে রাখা চিঠিটি কুটি কুটি করে ছিড়ে রাস্তায় উড়িয়ে দিল।

.

বংশালে নিজের কাগজের বাড়িতে এসে মানিক আশ্চর্য হয়ে গেল। বেশ হইচই করে ঘুড়ি আর ফুল নিয়ে কিছু বাচ্চা ছেলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। উঠানে ঝুলানো দড়িতে একটি স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটি লুঙ্গির সাথে একটি শাড়িও ঝুলছে। ঝকঝকে উঠানে একটাও শুকনো পাতা নেই। কলপাড়ে শ্যাওলাদের রাজ্য কেউ উচ্ছেদ করে দিয়েছে। বারান্দায় ইজি চেয়ারে বদরুল আলম সাহেব বসে আছেন, তার নিচে সিঁড়িতে কার্তিক। দুইজনেই মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছে, মনে হচ্ছে যেন স্কুলের পড়া মুখস্থ করছে।

উঠানের ধারে রান্না ঘরে একটি মেয়ে চুলা ধরাচ্ছে। মানিক এগিয়ে আসতেই কার্তিকের চোখে পড়ল। তার মুখটা দুপুরের দিঘীর জলের মতো ঝিকমিক করে উঠল। বদরুল আলমও অবাক খুশিতে তাকিয়ে আছে। কার্তিক তো হইচই শুরু করে দিল, রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে বলল—

কই গো এই দিকে আসো, দেখো কে আসছে।

রান্নাঘর থেকে যে মেয়েটি বেরিয়ে এলো, তার মুখে মায়ার প্রতিচ্ছবি। কার্তিক পরিচয় করিয়ে দিল—

এ তোমার দেওর, মানিক। মেয়েটি মাথায় ঘোমটা টেনে বলল—

না, উনি আমার দাদা।

তারপর পায়ে ধরে সালাম করল মানিককে। মানিক হতবিহ্বল হয়ে বলল—

তোমার নাম নিশ্চয়ই করিমন? তোমাকে আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই দেয়ার নেই আমার।

আপনি অনেক কিছু দিছেন, আর কিছু লাগব না।

যা দিয়েছি তা আমার ছিল না কোনোদিন। এই বাড়ি মরতে বসেছিল, তুমি এসে প্রাণ ফিরিয়ে দিলে। এটা তেমারই বাড়ি। আমাকে শুধু একটু থাকার জায়গা দিও।

দাদা এমন কথা বললে কিন্তু এ বাড়িতে জায়গা হবে না।

মানিক শুধু একটু হাসল। বদরুল আলম সাহেব এগিয়ে এসে বলেন,

ছুটি নিয়ে এসেছ?

না স্যার, চাকরি ছেড়ে দিব।

ভালো, আমিও চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।

তারপর করিমনের দিকে তাকিয়ে বললেন—

কই গো মা, একটু চা দাও তো, তোমার হাতে চা না খেলে যে আমার দিনই শুরু হয় না।

বদরুল আলমের গলাটা যেন সুধীর দত্তর মতোই শোনল।

.

মানিক চাকরি ছেড়ে দিয়ে একটা ক্লিনিকে ডিউটি করে এক বেলা। বিকেলবেলা কার্তিকের দেয়া ফার্মেসিতে বসে রোগী দেখে। মাঝে মাঝে রহিমা বেগমের মতো রোগীরা যখন শাড়ির আঁচল খুলে খুচরো পয়সা বের করে দিতে যায় তখন মানিক বলে—

লাগবে না, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ দিলেই হবে।

ব্যস্ত শহরে এইটুকু সুখ মাঝে মাঝে তার কপালে জুটে। নিজেকে বড় বেমানান মনে হয় তার এখানে। কার্তিকের বাজার নিয়ে প্রতিদিন খুনসুটি করে করিমন, পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে বদরুল আলম সাহেব তা দেখেন আর হাসেন। তাদের থামানোর জন্যই চায়ের দাবি করেন। এই নাটকে মানিক নিজের জন্য কোনো চরিত্র খুঁজে পায়না। সবাই তাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, তবু নিজেকে বেমানান একটা আসবাব মনে হয় তার।

পাহাড়ের সেই বালকের মতো তার পেট পুড়ে। মাচাং ঘরের পাশে ছোট পাহাড়টির জন্য, কাজাচাই-এর জন্য, উথাই খায়াচিং-এর জন্য, ক্রাসিমার জন্য। সব ছেড়ে আবার ফিরতে ইচ্ছে করে পাহাড়ে, সে শুধু অপেক্ষা করে একটা আহ্বানের।

.

মংতো পাহাড়িদেরকে আবার জুম চাষে ফিরিয়ে এনেছে। সে পাহাড়িদের হিংসা-ঘৃণা শিখায় না, প্রতিবাদ করতে শিখায়, নিজেদের রক্ষা করতে শিখায়। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে সে পপি ক্ষেত খুঁজে বেড়ায়। তারপর পথ চিনিয়ে দেয় সেনাবাহিনীকে। পত্রিকায় খবর আসে—

‘বান্দরবানে পঞ্চাশটি পপি ক্ষেত ধ্বংস করল সেনাবাহিনী।’ সেই খবরে কোথাও মংতোর নাম আসে না। কেউ জানে না পাহাড়ের এই বিপ্লবীর খবর।

শফিক সাহেবকে আর দেখেনি কেউ। পপি চাষে তার সম্পৃক্ততা সবাই জানে কিন্তু কোনো এক জাদুবলে পত্রিকায় তার নাম আসেনি। অনেকে বলে তিনি মিয়ানমার চলে গেছেন, কেউ বলে দেশেই লুকিয়ে আছেন কোথাও।

উথাইয়ের মানিক মারমা হাঁটতে শিখেছে। কোনোমতেই থামানো যায় না তাকে, তার কোমরে পিতলের একটা ছোট ঘণ্টা লাগিয়ে দিয়েছে উথাই, সারাক্ষণ টুংটাং বাজে। তার সেই শব্দ তার মনে সুখের দোলা দেয়। মানিক প্রথম যেদিন আধো আধো বুলিতে ‘মুই’ ডেকে উথাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তারপরে তিন দিন কেঁদেছে উথাই। সময় পেলেই বলে—

আবার ডাক বু।

খায়াচিংও কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সে সময় পেলেই মানিককে ‘বা’ ডাকা শেখায়।

ক্রাসিমা স্কুল দিয়েছে বলিপাড়ায়। সেখানে জামরুল গাছের নিচে বসে তার স্কুল। কাজাচাই সে স্কুলের পিয়ন। স্কুলে বাংলা-ইংরেজির পাশাপাশি মারমাও শেখানো হয়। ক্রাসিমা স্বপ্ন দেখতে শেখায় শিশুদের। নিজের স্বপ্নের কথা বলে। সারাদিন পাহাড়ে কাজ শেষ করে ধূলিমাখা পায়ে নারী-পুরুষরাও তাদের মাচাং ঘরের বারান্দায় বসে সে স্বপ্নের কথা শুনে, তাদের চোখের তারায় জ্বলে ওঠে সে স্বপ্নগুলো।

কিছু স্বপ্নের কথা সবাইকে বলতে পারে না ক্রাসিমা। সেগুলো মানিককে বলে, চিঠি লিখে। সে চিঠি কখনো পায় না মানিক, ক্রাসিমা কুপির আগুনে পুড়িয়ে ফেলে সে চিঠিগুলো। সে ভাবে, হয়তো কোনো একদিন কুপির আগুনে আত্মাহুতি দিবে না চিঠিগুলো।

মানিকও সেই ‘কোনো একদিনের’ অপেক্ষা করে থাকে।

একদিন চিঠি পায় মানিক। প্রেরকের ঘরটা খালি। যার চোখে সাঙ্গু নদী বয় সে পাঠিয়েছে চিঠিটি, তার চোখের জলে আঁকাবাকা ঢেউ হয়েছে চিঠিতে। চিঠিতে কিছু লেখা নেই, শুধু অশ্রু আছে। সাদা চিঠিটি মেলে ধরে কলমে কালি ভরে মানিক লিখল, ক্রাসিমা।

তারপর ভাঁজ করে বুক পকেটে রেখে দিল।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *