নীল পাহাড় – ১১

এগার

অন্ধকার ঘরে হাত-পা বাঁধা মানিক মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে তাঁর জীবনটা কল্পনা করে নিল। বাঁশের সিঁড়িতে পদধ্বনি শুনে মানিক চোখ বন্ধ করে রেখে প্রিয়জনদের মুখ মনে করার চেষ্টা করল, কিন্তু হায় কারো চেহারাই মনে ভাসল না। হন্তারকদের আক্রোশ ভরা কণ্ঠের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে। আংসাই এখনো ঘুমাচ্ছে, তার নাকডাকায় কোনো বিরতি নেই, ক্লান্তিহীনভাবে ডেকেই যাচ্ছে। তার জাগার সময় হয়েছে। কিন্তু যারা এলো তারা আংসাইকে জাগাল না।

ডাক্তার বাবু।

ক্রাসিমার গলা শুনে চমকে উঠল, চোখ খুলে আরো চমকে উঠল, ক্রাসিমার সাথে মংতো আর খায়াচিং। ক্রাসিমা বলল—

আমরা আপনাকে মারতে আসিনি, বাঁচাতেও আসিনি, আরো একটা উপকার চাইতে এসেছি। এর আগে আপনার উপকার চেয়েছি দাবি নিয়ে, এবার কোনো দাবি নেই।

মানিক হতবিহ্বল হয়ে বলল—

আমি মৃত্যুপথযাত্রী, আমি তোমাদের জন্য কী করতে পারি গলাটা বাড়িয়ে দেয়া ছাড়া?

আপনি জীবন বাঁচাতে পারেন, উমের সন্তান হচ্ছে, সে বোধহয় মারা যাচ্ছে।

.

আংসাইকে নির্বিঘ্নে ঘুমাতে দিয়ে তারা সবাই চলে এলো। মন্দিরের পেছনে একটা কুঁড়েঘরে প্রসবের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই গ্রামে এখানেই সব শিশু জন্ম নেয়। এখানে তিন দিন কাটিয়ে মায়ের কোলে শিশু নিয়ে ঘরে ফেরে। সেই ঘরে ফেরা নিয়েও উৎসব হয়, মন্দিরে পুজো দেয়া হয়, ঢাক বাজানো হয়। উমের কপালে সেই ঢাকের শব্দ নেই, তাকে বরণ করা হবে নিঃশব্দে ঝরা কিছু অশ্রু দিয়ে।

এখনো ভোর হতে কিছু সময় বাকি আছে। কিন্তু অনেকেই এই কুঁড়েঘরের সামনে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। তারা উমের জন্য উদ্বিগ্ন, তার সন্তানের জন্য নয়। মানিককে দেখে একটা গুঞ্জন হলো, ফিসফাসও হলো। একজন মহিলা এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—

কপাল পোড়া মাইয়া, তারে বাঁচান। অবস্থা খুব খারাপ।

মানিক ভেতরে ঢুকে গেল, হরিকেন জ্বালানো আছে, নিচে খড় পেতে বিছানা করা হয়েছে। উমে শুয়ে আছে আর হাঁপাচ্ছে। কিন্তু বৃদ্ধা উমের মাথার কাছে বসে আছে। মানিক প্রথমেই মাথায় হাত রাখল, প্রচণ্ড জ্বর। মানিকের হাতের স্পর্শেই উমে চোখ খুলল।

মানিককে দেখেই তার মুখে একটু হসি ফুটে উঠল, তারপর বলে উঠল—

আমার বাচ্চাটারে বাঁচান বাবু।

মধ্যরাত থেকেই প্রসব বেদনায় ভুগছে উমে। প্রচুর রক্ত ঝরেছে, ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। তবুও হল ছাড়েনি। এখন মানিককে দেখে একটু স্বস্তি পেল সাথে সাথে অনুতপ্ত হলো। এই মানিককেই কাপুরুষ বলেছিল, আজ সে মানিক নিজের মৃত্যুকে সামনে রেখে তাকে বাঁচাতে এসেছে।

মানিক দেখল উমের অবস্থা আসলেই অনেক খারাপ, কোনো রকম ঔষধ ছাড়া তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। উমের দিকে একটু করুণায় তাকাল, উমে যেন সব বুঝে নিল, শ্বাস টেনে বলল—

দোহাই লাগে ডাক্তার বাবু, আমার জন্য চিন্তা করবেন না, আমার বাচ্চাটার যাতে কিছু না হয়।

মানিক শার্টের হাতা গুটিয়ে কাজে নেমে পড়ল। এরই মধ্যে উমে কয়েকবার মূর্ছা গিয়েছে। সকালের সূর্যের প্রথম কিরণ বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঢুকার সাথে সাথেই নবজাতক শিশুর চিৎকার শোনা গেল। মানিক দুই হাতে শিশুটিকে জাপটে ধরে উমের কাছে এনে বলল—

তোমার ছেলে হয়েছে।

উমের মুখটা ক্লান্তিতে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, ঠোঁট দুটি নেড়ে দুর্বলভাবে একটু হাসল। রাজ্যের শান্তি নিয়ে সে চোখ বন্ধ করল সাথে নিঃশাসও। তার সদ্য জন্মানে স্বল্পায়ু পুত্রকে অনাথ করে দিয়ে উমে মারা গেল।

যার প্রাণের জন্য সবাই প্রার্থনা করেছে সেই মরল আর যার প্রাণ কেউ চায়নি সেই বেঁচে রইল। তবুও মানিকের কোলে থাকা ফুটফুটে শিশুটিকে সবাই কাঁথা সরিয়ে দেখছে। কী সুন্দর হয়েছে দেখতে সাথেই সাথেই এই অনাথের জন্য মনে ব্যথা অনুভবও করল সবাই। এই শিশুটিকে হত্যা করা হবে ভাবতেই বুক কেঁপে উঠল। কেউ না আবার মনে করিয়ে দেয় এই ভয়ে সবাই তটস্থ হয়ে রইল।

গম্ভীর সে মায়া ভরা সকালে এই শিশুটির ভাগ্যে কী হবে তাই নিয়ে মনে তোলপাড় হচ্ছিল সবার। ঠিক তখন গ্রামের মধ্য থেকে মেয়েলি গলায় একটা ভয়ার্ত চিৎকার শোনা গেল। খায়াচিং আতঙ্কে বলে উঠল—

উথাই।

বলেই সে গ্রামের দিকে বিদ্যুৎবেগে ছুটে গেল, তার পেছনে বাকি সবাই। মানিকও চলল, তার কোলে উমের ছেলে।

থুইনুপ্রুর মাঁচাং ঘরের সামনে জটলা লেগে আছে। কেউ কেউ কাঁদছে, সবাই ভেতরে ঢুকার চেষ্টা করছে কিন্তু মংতো কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। হাহাকার-আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। খায়াচিং বারান্দায় উথাইকে জড়িয়ে ধরে আছে, ক্রাসিমাও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখটা ভাবলেশহীন। মংতো মানিককে আটকাল না। মানিক ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল, থুইনুপ্রু শুয়ে আছে, তার চোখগুলো স্থির, সেখানে বিস্ময় ফুটে আছে। তার বুকের বাম দিকে একটি ছোরা গেঁথে আছে, বুক থেকে একটা করে ধারা বিছানা থেকে মেঝেতে নেমে এসেছে।

পাহাড়িরা খুব ক্ষমাপ্রবণ। উথাইকে শাস্তি দেয়ার কথা কেউ ভাবতেই পারল না, কেউ এসে চোখ রাখল না, ধিক্কার, অভিশাপ দিল না। তাকে মহিলারা ঘিরে আছে। দূরে পুরুষেরা দাঁড়িয়ে শুধু আফসোস করছে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে।

উমে আর থুইনুপ্রুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রস্ততি চলছে। মংতো সব দেখাশুনা করছে। সেই এখন তাদের নেতা, কাউকে বলে দিতে হয়নি সবাই মেনে নিয়েছে।

ক্রাসিমা এখনো ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, এতগুলো ঘটনা একসাথে মেনে নেয়া তার পক্ষে কঠিন। সে মানিককে দেখে এগিয়ে এলো, বলল—

উথাই যদি এই কাজটা না করত আমিই করতাম। একটা রাক্ষসকে দেবতা মেনে পূজা করেছি আমরা। আমাদের সরলতার সাথে কত বড় ছলনা করা হয়েছে।

মানিক ক্রাসিমার দিকে তাকিয়ে বলল—

শিক্ষার অভাব ছিল তাই পেরেছে, শিক্ষা না থাকলে আবার সুযোগ পেলে অন্য কেউ এদের ব্যবহার করবে।

একটু থেমে সে আবার বলল—

সবাই দেখি আমাদের দুজনের কথা ভুলে গেল, আমাদের আয়ু আর কতক্ষণ আছে?

আপনি ঠিকই বলেছিলেন, দেখেন সত্যি সত্যি একজন পাহাড়ির সন্তানকে নদীতে ভাসানোর কথা সবাই ভুলে গেছে।

আর আমাকে?

ক্রাসিমা চুপ করে গেল, মুখের মলিন হাসিটাও মিলিয়ে গেল।

“আপনারে ঠিকি সাঙ্গুত ভাসাইয়া দিবো, তয় নৌকায়” মংতোর কথা শুনে দুজনেই অবাক হয়ে গেল। মংতো কাছে এসে আবার বলল—

আপনের লগে আমাগো কোনো শত্রুতা নাই, আপনেরে কতা দিছিলাম ফিরাইয়া দিয়া আসুম। মংতো নিজের কতা রাকতে জানে।

ক্রাসিমা মংতোর দিকে তাকিয়ে বলল—

মংতোদা আমারও যাবার ব্যবস্থা করে দাও। আমিও চলে যাব।

মংতোর মুখে যেন মেঘ ভর করল। সে শুধু শান্তস্বরে বলল—

ঠিক আছে।

মানিকের কোলের বাচ্চাটা নিজের উপস্থিতি জানানোর জন্যই বোধহয় গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল। ক্রাসিমা মানিকের কোলের দিকে তাকিয়ে বলল,

উমের জন্য খুব খারাপ লাগছে, কিন্তু তার বাচ্চাটার কী হবে? আমাকে দিন, আমি এই সন্তানকে পরিচয় দিব, বাঙালিও বানাব না, পাহাড়িও বানাব না। মানুষ বানাব।

মানিক কিছুক্ষণ বাচ্চাটাকে চুপ করানোর চেষ্টা করল, তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল। ক্রাসিমার দিকে তাকিয়ে বলল—

তোমার চেয়ে ভালো আর কোনো মা পাবে না উমের বাচ্চাটি। কিন্তু তার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেছে। তোমার চেয়ে অন্য কারো বেশি প্রয়োজন আছে তার।

মানিক বাচ্চাটাকে নিয়ে মহিলাদের দুর্গ ভেদ করে উথাইয়ের কাছে চলে এলো। উথাইয়ের দিকে বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিয়ে বলল—

তোমার ছেলে।

উথাই বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। ক্রন্দনরত বাচ্চাটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল—

আমার বু, আমার বু।

তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বহু দিনের জমানো অশ্রু। অলৌকিকভাবে বাচ্চাটার কান্না থেমে গেল। বৃদ্ধরা হাসিমুখে এই মা ছেলেকে আশীর্বাদ করতে লাগল। ক্রাসিমা ছুটে এলো মা ছেলের মিলন দেখতে। এই দৃশ্য দেখে খায়াচিং নিজের কাঠিন্যের খোলস ভুলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। সেও উথাইয়ের গলার সাথে সুর মিলিয়ে বলল—

আমার বু, আমার বু।

উমের সন্তানাটি তার অনাথ জীবনের সমাপ্তি ঘটাল। সবাই ভুলে গেল বাঙালি ধর্ষকের বীর্যে হয়েছে এই সন্তান। উথাই ক্রাসিমার দিকে তাকিয়ে বলল—

দি, একটা নাম দেও আমার ছেলের।

ক্রাসিমা একবিন্দু চিন্তা না করে বলল—

তোমার ছেলের নাম মানিক। বড় ভাগ্যবান তোমার ছেলে, খুব মহান এক মানুষের নাম পেয়েছে।

উথাই ছেলেটাকে আবার বুকে চেপে ধরল আর বলতে লাগল—

মানিক, আমার মানিক।

পৃথিবীর সব সম্মান যেন আজ মানিকের পায়ে অর্পণ করল ক্রসিমা। আবেগে চোখ ভিজে উঠল মানিকের। সে চোখ মুছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মংতোর দিকে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে বলল—

শুধু কথা রাখার জন্যই এই কাজ করলে নাকি উমের সন্তানকে বাঁচাতে?

মংতো হকচকিয়ে বলল—

মানে?

মানিক বলল—

উথাই কখনো থুইনুপ্রুকে মারার সাহস করতে পারত না। যদি পারতও তবে থুইনুপ্রুর বুকে এলোমেলোভাবে পা দিয়ে কোপ দিত। কখনো ছুরি দিয়ে একেবারে হৃৎপিণ্ড বরাবর বসিয়ে দিত না। উথাইয়ের কাছে ছুরিও ছিল না, দা-টা তার পায়ের কাছেই দেখেছি আমি। আমরা কেউই থুইনুপ্রুর আর্তনাদ শুনিনি। ঘুমের ভেতর মুখ চেপে ধরে তার বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়া হয়েছে, উথাই তা পারত না। উথাই এমনিতে দা নিয়ে দৌড়ে এসেছিল, প্রতিদিনের মতো। এই দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠছে। বাকি সবাই মন্দিরের পেছনের ঘরের সামনে ছিল, শুধু তুমি ছিলে না। কেন করলে এ কাজ?

মংতো চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—

আপনারে বাঁচানের জন্য করি নাই, উমের ছেলের জন্যিও না। নিজেগো লাইগা করছি। লোভ ঢুকাইছেন তিনি পাহাড়িগো মইদ্যে, নিজেরও লোভ কম ছিল না। বাঙালিরা আমাগো ধ্বংস করতে পারবে কি না জানি না, লোভ আমাগো ঠিক শেষ করত। এই লোকগুলিরে শেষ হইতে দিতাম না আমি।

মানিক কিছু বলল না, তার মনটা শ্রদ্ধায় ভরে গেল এই স্বল্প শিক্ষিত পাহাড়ির জন্য।

.

ঢাকঢোল বাজিয়েই উমে গ্রামে ফিরল, সাথে কিছু অশ্রুও ছিল। তাকে বহন করা একটা কাঁধ মানিকেরও ছিল। ফুল দিয়ে ঢাকা আর নির্জীব দেহটি, চিতায় শোয়ানো হলো। আগুন জ্বলল চিতায়, আগুনের কুণ্ডলী ধোয়া হয়ে আকাশে মিলিয়ে যাবার আগেই মানিক আর ক্রাসিমা তাদের ফেরার যাত্রা শুরু করল।

কাজাচাই বৈঠা হাতে তাদের সাথে চলল। আরো দুজন সাথে গেল নদী পর্যন্ত এগিয়ে দিতে। অনেক খুঁজেও মংতোকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ক্রাসিমাকে বিদায় দেয়ার সাহস তার নেই, হয়তো তার চোখ ভিজে উঠবে এই ভয়ে সে পালিয়ে ছিল। গ্রামের সবাই চিতা দুটো ঘিরে দাড়িয়ে ছিল, ক্রাসিমা আর মানিক অনাড়ম্বসবেই সবার অলক্ষ্যে বিদায় দিল গ্রামকে। আংসাই একটা জারুল গাছে ঠেস দিয়ে আক্ষেপের সাথে মানিককে দেখছে, তার শিকার এভাবে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই আফসোস হলো তার। কিন্তু মংতোর বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তার নেই। সেই তার নেতা এখন।

সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটতেই নদীর কলব কানে আসল; মানিক খুব অবাক হয়ে গেল, এত কাছে ছিল নদীটি অথচ সে কত ভুল পথেই না হেটে গিয়েছে। তারপর ভাবল, মাঝে মাঝে ভুল পথও সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যায়।

ছোট ডিঙিতে চড়ে বসল মানিক আর ক্রাসিমা। বৈঠা হাতে গলুইয়ের উপর বসল কাজাচাই। তার বৈঠা খুব একটা কাজে লাগছে না, স্রোতের টানেই ডিঙিটি হেলেদুলে চলতে লাগল। ক্রাসিমা মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল—

আপনি কোথায় যাবেন?

মায়ের কাছে যাব। তুমি?

আমাকে মানুষ পাহাড়ের মেয়ে বলে, আমিও আমার মায়ের কাছেই যাব। আমার নিজের ঘরে ফিরে যাব। পাহাড় ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। আমার বাবার মতো পাহাড়েই মরতে চাই আমি।

তারপর অনেক্ষণ নীরবতা, শুধু নৌকার পাটাতনে সাঙ্গুর আলতো ঠেস আর কলকল শব্দ শোনা গেল। তারা নীরবে বসে আছে, যেন এটা কোনো স্বপ্ন, কথা বললেই ভেঙে যাবে। কাজাচাইয়ের অবশ্য কোনো স্বপ্ন মনে হলো না, সে নিজের অক্ষমতার কারণেই নীরব। আকাশে অর্ধেক ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ উঠেছে। নৌকার মাঝি ছাড়া দুজন যাত্রীর একই স্মৃতি মনে পড়ে যায়, পাহাড়ে জোছনা বৃষ্টির স্মৃতি। ক্রাসিমা চাঁদের দিকে তাকিয়েই বলল—

মায়া লাগানো চাঁদ, সব ভাসিয়ে দেয় মায়াবী আলোয় আবার ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়।

আবার তো ফিরে আসে।

চাঁদ ফিরে আসে কিন্তু কিছু জোছনা আর কখনোই ফিরে আসে না।

মনের গভীরে কোথায় যেন হু হু করে উঠল দুজনের। সাঙ্গুর পেটে ভেসে চলল দুটি নীরব মানুষ, যাদের মনে উথাল-পাথাল ঢেউ, একজন বোবা মাঝি আর অর্ধেক চাঁদ।

ভোরবেলা থানচি ঘাটে ডিঙি ভেড়াল কাজাচাই। নদীর পাড়ে নৌকার গলুইয়ের ধাক্কায় স্বপ্নভঙ্গ হলো ক্রাসিমা আর মানিকের। রাতটা যেন খুব দ্রুত কেটে গেল। বিদায়ের সময় হয়েছে। কাজাচাই ডিঙিটা বেঁধে মানিকের পেছনে এসে দাঁড়াল। তার ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে সে মানিকের পিছু ছাড়ছে না। মানিক তাকে ইশারায় বলল, সে অনেক দূরে যাবে। কাজাচইও ইশারায় বুঝাল, সেও যাবে। যদিও কাজাচাই কানে শোনে না, তবুও মানিক শব্দ করেই বলল—

সেই শহরে তুই টিকবি না রে।

তুই পাহাড়েই থাক।

ক্রাসিমার দিকে ইশারা করে আবার বলল—

তোর দিদির সাথে যা, সে তোকে ফেলবে না।

বোবা কাজাচাই মানিকের চোখের ভাষা বুঝে নিল, সে ক্রাসিমার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মানিক ক্রাসিমাকে কী বলবে ভেবে পায় না। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ, অনেক কথা এসে আটকে গেছে ঠোঁটে. অনেক ভার জমেছে যেন তার পায়ে। ক্রাসিমা একটা কথাও বলেনি, মানিকের পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে তারপর উঠে মুখ ঘুরিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়। পথের বাঁকে হারিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মানিক ঘোলাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *