নীল পাহাড় – ১০

দশ

ক্রাসিমা সারারাত জানালার পাশে বসে ভোরের অপেক্ষা করেছে। আবছা আলোতে ঘাস মাড়ানো পথে চোখ পেতে আছে সে, প্রতিদিনের মতো। মনে মনে চাইছে এই পথ শূন্য থাক, তবুও সে চোখ ফেরাতে পারছে না। মন আর চোখ একে অপরের সঙ্গ ছেড়েছে।

দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল, ক্রাসিমা কিছুক্ষণের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল, বুকে রক্ত ছলকে উঠল আশা এবং আশঙ্কা দুটোই মনে প্রতিযোগিতা করতে লাগল। ধীর পায়ে দরজার কপাট খুলে দেখল মতের উদ্বিগ্ন মুখ। ক্রাসিমা মনে স্বস্তি পেল কিন্তু চোখ দুটি টলমল করে উঠল। মংতো ক্রাসিমাকে বলল—

ডাক্তার বাবু চইলা গেছে।

ক্রাসিমা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল—

জানি।

মংতো একটু আহত হল, গতকাল রাতে ভরা জোছনায় ক্রাসিমা আর ডাক্তার বাবুকে দেখেছে সে, শুয়ে শুয়ে একসাথে ভিজেছে দুজন। মংতোও ভিজেছে, চোখের জলে কিংবা বৃষ্টির জলে। ডাক্তার বাবু নেই শুনে দৌড়ে চলে এসেছে ক্রাসিমার ঘরে, তার আশঙ্কা ছিল, ঘরটা খালি থাকবে। ক্রাসিমাকে দেখে মনে মনে খুশি হয়েছে কিন্তু যখন শুনলো, ডাক্তার বাবুর অন্তর্ধান সম্পর্কে ক্রাসিমা আগে থেকে জেনেও কাউকে কিছু বলেনি তখন সে আহত না হয়ে পারল না। এই পাহাড়ের চেয়ে কি সেই বাঙালি ডাক্তার তার কাছে আপন হয়ে গেল, তার ‘পাহাড়ের কন্যা’ নামটি কি সে ভুলে গেল? কিন্তু ক্রাসিমার উপর তার কোনো ক্ষোভ নেই, সেই ক্ষমতাও তার নেই। তার সব রাগ-ক্ষোভ চলে গেল মানিকের উপর। ক্রাসিমার দিকে তাকিয়ে বলল—

আমরা ডাক্তার বাবুকে খুঁজতে যাছচি, উনি পথ চিনে সাঙ্গুত চলি গেলে আমাগো বিপদ হবে।

ক্রাসিমা কিছু বলল না, সে আগের মত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু তার চোখের ঢেউ মংতোর দৃষ্টি এড়াল না। মংতো সেই ঢেউ ছাপিয়ে পড়ার সুযোগ দিয়ে চলে এলো। উগড়ে ওঠা ব্যথা, ক্ষোভ, ভালোবাসা গলার কাছটায় দলা পাকিয়ে আটকে ছিল, সে একটা ঢোক গিলে সবকিছু আবার বুকে পাঠিয়ে দিল।

সকাল হতে হতে পাখির গুঞ্জনের সাথে সাথে মানুষেরও গুঞ্জন বাড়তে লাগল। মহিলারা একসাথে হয়ে কলকাকলিতে মেতে উঠল, গল্পের রসদ পেয়ে তাদের আনন্দিতই মনে হলো। অনেক গল্প চাউর হলো, তার মধ্যে কিছু বিপদের শঙ্কাও মনে জন্মাল। তাতে কলকাকলির কোনো ক্ষতি হলো না। তারা অবাক হতে পছন্দ করে, ভয় পেতেও ভালোবাসে।

মংতোসহ বেশ কিছু পুরুষ চলে গিয়েছে মানিকের খোঁজে। বৈঠা হাতে একদল নদীর দিকে চলল। থুইনুপ্রু অনেক দিন পর তার মাচাং ঘরের বারান্দায় বসে আছে, তার মুখে হাসি নেই, কপালে ভাঁজ আছে। দু’দিন পর যে এমনিতে মুক্তি পেত সে নিজের প্রাণ শঙ্কায় ফেলে কেন পালিয়ে গেল? মানিককে কখনোই তার এত বোকা মনে হয়নি। চিন্তা করতে করতে তার কপালের ভাঁজ আরো গভীর হলো।

খায়াচিং দাঁড়িয়ে আছে থুইনুপ্রুর পেছনে, থুইনুপ্রুর দেখাশুনা করার জন্য তাকে থাকতে হয়েছে। গ্রামের পাহাড়ি রাস্তায় বৈঠা হাতে পুরুষরা হারিয়ে গেল এইমাত্র, তবুও সে ঠায় তাকিয়ে আছে সেদিকে। তার ইচ্ছা ছিল যাওয়ার, আসলে ইচ্ছার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। ডাক্তার বাবুকে তার প্রয়োজন, সে দেখেছে কয়েক দিনের মধ্যে থুইনুপ্রুর নষ্ট পা-টা কীভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। নিজের বিদ্যার ওপর এখন আর এত বিশ্বাস নেই তার, যা ডাক্তার বাবুর সুঁইয়ে আছে। উথাইকে নিশ্চয়ই সারাতে পারত ডাক্তার বাবু। উথাইয়ের চোখে অচেনা দৃষ্টি সরিয়ে আগের উথাইকে ফিরিয়ে দিতে পারত। উথাইয়ের কোলে বাচ্চাটা না দিয়ে সে নিজে নিয়ে আংসাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল। তারপর থেকে উথাইয়ের চোখে তার জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি সে। সেদিন থেকে একবারও উথাই কাঁদেনি। ডাক্তার বাবুর কাছে নিশ্চয়ই কোনো ওষুধ আছে উথাইয়ের চোখে জল আনার।

উমের চোখের জলও শুকিয়ে গেছে। সকালবেলা নিজ ঘরে বসেই খবরটা পেয়ে গেল সে। সে ভুল করেছে, তার চোখের জল, ভরসা ভগবানের চরণে নিবেদন না করে এক বাঙালি পুরুষের চরণে করেছিল। তার চোখের জল এত মূল্যহীন ছিল না।

.

শেষ রাতে ভোরের আলো ফোটার আগেই বের হয়েছিল মানিক। সাথে দেড় লিটার পানি, আগুন ধরানোর জন্য একটা দিয়াশলাইয়ের বাক্স, মাচাং ঘরের নিচে পড়ে থাকা বেশ কিছু চুপড়ি আলু একটা পলিথিনের বড় ঝিল্লিতে বেঁধে নিল। কাজাচাই-এর ছুরিটা নিতে তার বেশি বেগ পেতে হয়নি। গহিন জঙ্গলে অজানা পথে যাত্রা, মানিকের মনে ভয়ের সঞ্চার হলো না। মায়া হলো, এই গ্রামটার জন্য, এখানকার মানুষগুলোর জন্য, সন্ধ্যার গল্পের আসরের জন্য যার অংশ সে কখনোই ছিল না। এতো মায়ার খবর এই মানুষগুলো জানবে না, হয়তো বাঙালিদের ঘৃনা করার জন্য নতুন উপলক্ষ পাবে।

.

সে ঠিক করেছে উত্তর-পূর্ব দিক ধরে হাঁটবে, তাহলেই নদী পেয়ে যাবে। হয়তো এক দিনের বেশি লাগবে, তবুও সাথে বেশ কিছু আলু নিয়ে নিয়েছিল। তাতে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হলো, পুঁটলিটা বেশ ভারী হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারেই সে হাঁপিয়ে উঠেছিল, তবুও থামেনি। ঝোপঝাড়ের বাঁধা ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সূর্য ওঠার পরেই বিপত্তি শুরু হলো, তার সব শক্তি যেন সূর্যটা শুষে নিচ্ছিল। দুটো পাহাড় ডিঙ্গাবার পরে দেহে আর শক্তি অবশিষ্ট রইল না, দুপুরবেলায় সূর্যটা দেখে রীতিমতো ভয় পেল সে।

জঙ্গলে একটা বড় সেগুন গাছ পেয়ে গেল, সেটার নিচেই বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়ল। তারপর কখন ঘুমিয়ে গেছে সে নিজেও জানে না।

মানিক দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের উপর, অনেকগুলো মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ঘিরে রেখেছে কিছু উর্দি পরা লোক। তাদের হাতে ভারী অস্ত্র। মানিক সবকিছু অপষ্ট দেখছে, শুধু ক্রাসিমাকে ছাড়া, ক্রাসিমাকে সে স্পষ্ট দেখতে পারছে। ক্রাসিমার হাত দুটো বাঁধা, তার শরীর রক্তাক্ত, চুল এলোমেলো। দুটো বেয়নেটসহ বন্দুক তার দুই দিকে তাক করা। হঠাৎ বরকত আলীকে দেখা গেল, মানিক অবাক হয়ে দেখল বরকত আলীর মুখে একটা হিংস্র, জঘন্য, লোভী হাসি। সে ক্রাসিমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ক্রাসিমা পিছিয়ে যাচ্ছে ভয়ে। মানিক চিৎকার করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না, তার গলা দিয়ে শুধু একটাই শব্দ বেরুচ্ছে, মা। বুক পকেটে হাত দিল সে, চিঠিটি নেই।

ধড়ফড় করে উঠল মানিক। স্বপ্নের ভয়াবহতায় নাকি রোদ্রের তীব্রতায় তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। বুক পকেটে হাত দিয়ে দেখল, চিঠিটি চুপচাপ শুয়ে আছে তার বুকে। খুব তেষ্টা পেয়েছে। কেরোসিনের গ্যালোনে এক গ্যালোন পানি নিয়ে এসেছিল সে, সেই পানি মুখে দিলেই কেরোসিনের গন্ধে বমি আসে। কিন্তু এখন ঢকঢক করে বেশ কিছু পানি খেয়ে নিল। নিজেকে শক্ত করে স্বপ্নটা ভুলে যেতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, বারবার ক্রাসিমার রক্তমাখা ভয়ার্ত মুখটা মনে পড়ছিল।

রোদের তেজ তখনো কমেনি। আগুন জ্বালানোর জন্য শুকনো কাঠের অভাব নেই আশেপাশে, অনভিজ্ঞ মানিক প্রথমেই কাঠে আগুন ধরাতে গিয়ে পাচটা কাঠি নষ্ট করে ফেলল। তারপর কিছু শুকনো পাতা কুড়িয়ে এনে সেগুলোতে আগুন ধরাল, ধোঁয়ার মধ্যেই সাপের জিহ্বার মতো লকলকে একটা আগুনের শিখা দেখতে পেল। ধোয়াগুলো চোখে গিয়ে বেশ জ্বালা ধরিয়ে একেবারে কাঁদিয়ে ছাড়ল। এবার আগুনে ধীরে ধীরে শুকনো ডালপালা ঠেলে দিল মানিক। ষোল বছরের কিশোরের মতো আগুনটা বেশ উসকে উঠল।

মানিক আগুনের মাঝখানে দু-তিনটা আলু ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ জ্বালানি না পেয়ে আগুনটা ধীরে ধীরে কয়লার মধ্যে হারিয়ে গেল। ইতিমধ্যে মানিক গরমে আর আলুগুলো কয়লার আগুনে সেদ্ধ হয়ে গেছে। সে সেদ্ধ আলুগুলো কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে বের করে নিয়ে আসল, ক্ষিদে তেমন নেই কিন্তু তবুও খাওয়া দরকার। কোনোমতে একটা আলু খেতে পারল, বাকিগুলো পুঁটলিতে ভরে নিল। আরো এক ঢোক পানি গলায় ঢেকে দিল। কেরোসিনের বিশ্রী গন্ধটা নাকে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল। তার কাছে ঘড়ি নেই কিন্তু সূর্যের অবস্থান দেখে বলা যায় তিনটার কাছাকাছি বাজে। পুটলিটা কাঁধে নিয়ে আবার শুরু করল হাঁটা।

পাহাড়গুলো দেখতে যত বিশাল মনে হয়, চড়তে গেলে আরো বিশাল হয়ে যায়। পাহাড়ের পাদদেশে কত সুন্দর ফুল ফুটে থাকে, কত অদ্ভুত গাছ দেখা যায়, কত পাখি যে নানা ভঙ্গিমায় ডেকে যায়। কিন্তু মানিকের মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হবে ধীর লয়ে বয়ে চলা সাঙ্গু নদী, তার কলকল শব্দই সবচেয়ে সুন্দর সুর মনে হবে। পানির শীতল স্পৰ্শ গা জুড়িয়ে দেয়া দখিনা বাতাসের চেয়েও বেশি শিহরণ দিবে।

সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মানিক আবার বসে পড়, তার পাগুলো বাচ্চা মেয়েদের মতো অভিমান করে যেন ফুলে আছে। পলিথিনের ঝিল্লিটা খুলে বিছিয়ে দিল ঘাসের ওপর। তারপর শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়েই সে আরো একটা আলু খেল। এখানেই রাত কাটাবে ঠিক করল সে। আগুন জ্বালানো দরকার কিন্তু বিন্দু পরিমাণ শক্তি অবশিষ্ট নেই। রাতে কত জন্ত-জানোয়ার এসে তাকে খাবার মনে করতে পারে, সাপেরা এসে তার বুড়ো আঙ্গুলকে ইঁদুর মনে করে কামড়ে দিতে পারে। নিজেই নিজেকে মনে করিয়ে দিল। কিন্তু অবসন্ন শরীর পাত্তাই দিল না। চোখ বুজে আসল।

চিত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে মানিক। শিমুল তুলার তোষকেও এত ভালো ঘুম আসে না তার। আজ সে ঘাসের বিছানায় শিশুদের মতো ঘুমাচ্ছে। বাতাসের কারণে মশারা সুবিধা করতে পারছে না, কামড় বসানোর আগেই পা ভেঙে পড়ে যাচ্ছে।

গলার কাছটায় শীতল একটা স্পর্শ ঘুমের মধ্যেই অনুভব করল মানিক, নিতান্ত অনিচ্ছায় চোখ মেলল। চোখ মেলেই চোখটা বড় হয়ে গেল, একটা কালো রঙের মোটা সাপ তার গলার উপর দিয়ে হিস হিস করে চলে যাচ্ছে। হালকা আলোতেই তার চামড়ার কালো আঁশগুলো চকচক করছে। চিৎকার করতে গিয়েও করল না, চুপ করে নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে। নিঃশ্বাস ছাড়লে হয়তো তা চিরতরে আটকে যাবে। জঙ্গলে থাকতে হলে জঙ্গলকে শ্রদ্ধা করতে হয়, জঙ্গলে যারা থাকে তাদেরও শ্রদ্ধা করতে হয়, পাহাড়িরা তাই করে, প্রকৃতিও তাদের দু’ হাত ভরে দেয়। মানিকও কালো সাপটাকে আর ঘাটাল না, সেটা শ্রদ্ধায় অথবা ভয়ে অসাড় হয়ে। সাপটা চলে যেতেই মানিক তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। এজন্যই পাহাড়িরা বনে জঙ্গলে নাকি এক চোখ খোলা রেখে ঘুমাতে হয়। মানিক এক চোখ খোলা রেখে ঘুমাতে পারে না, সে দু’ চোখই খুলে রাখল, আর ঘুম আসছে না তার। কিছুক্ষণ পর পর পাতার খস খস শব্দে এদিক-সেদিক ফিরে তাকায়, কী যেন আছে চারপাশে, আবার শুয়ে পড়ে। মানিক মনে মনে ভেবে আশ্চর্যিত হয়, ঘনবসতির ঢাকা শহরে সে নিজেকে একা অনুভব করত। আর এই জনমানবহীন পাহাড়ি জঙ্গলে মনে হচ্ছে সে একা নয়।

পাতার ফাঁকে সূর্যটা উঁকি দিতেই মানিক উঠে পড়ল। আগুন জ্বালিয়ে দু-তিনটি আলু পুড়িয়ে, বাকিগুলো ফেলে দিল। আর এক দিনের বেশি লাগবে না পৌঁছাতে, তাছাড়া বনে অনেক ফলের গাছও আছে। এত ওজন নিয়ে হাঁটার কোনো মানে হয় না। ওজন কমানোর পরও এগুনো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, পাহাড়গুলোর উচ্চতা যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিজের বাঙালি ফুসফুসের দুর্বলতা টের পেল মানিক। পানির গ্যালনটা অনেক হালকা হয়ে গেছে, কতটুকু পানি অবশিষ্ট আছে তা দেখার সাহস হচ্ছে না। নিজের শরীরের অক্ষমতাকে অস্বীকার করে চলতে থাকল মানিক। কিন্তু দুপুর হতে হতেই সে বুঝল, দিনের বেলায় হাঁটলে পানির পিপাসায়ই সে মারা যাবে। তাই ঠিক করল, সোজা পথ ধরে রাতের বেলা হাঁটবে। রাতের বেলা চোখ বুজাও বিপদ, কত নিশাচর প্রাণী শিকারের সন্ধানে বের হয়। দিনে ঘুমালে দু’ চোখ বন্ধ করেই ঘুমাতে পারবে।

বিকাল পর্যন্ত পাহাড়ের কোলে শুয়েই কাটাল মানিক। পায়ের ফুলো ভাবটা এখনো কমেনি। শরীর ধীরে ধীরে হাল ছেড়ে দিয়েছে, একটু বিশ্রামে আলস্য ভর করে। তখনি তার চোখে ভেসে ওঠে নাভি না কাটা পানিতে ভেসে যাওয়া শিশুর লাশ। তার মাতামহের নরকের ভয় না থাকলে সেও হতে পারত সেই লাশটা। কোনো নালায় পড়ে থাকত, পঞ্চাশ পয়সার পলিথিনের ব্যাগে।

চোয়াল শক্ত করে আবার হাঁটতে থাকে মানিক। প্রথম কয়েক পা দিতেই মনে হলো পায়ে যেন কেউ হাজারটা সুচ ফুটিয়ে দিল, কিন্তু সে থামল না। সব ব্যথা অগ্রাহ্য করে শামুকের মতো বসে থাকা ঝোপঝাড়ের নিদ্রাভঙ্গ করে হাঁটতে লাগল। জঙ্গল রাতে জাগে, মানিকও এখন জঙ্গলের অংশ, সেও রাত জেগে হেঁটে চলেছে। কিন্তু সে জানে না এই জঙ্গল যত মমতাময়ী ততটাই নিষ্ঠুর এবং ছলানময়ী। হাঁটতে হাঁটতে কখন পথ ভুলে, ভুল পথে যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারল না। দুই বেলা পিটি করা মিলিটারিও এই বন-জঙ্গল পাড়ি দেয়ার সাহস করে না, আর এক ডাক্তারের এই অস্পর্ধা জঙ্গল মানবে কেন।

রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভীষণ ক্রোধে কী যেন ছুটে আসছে মানিকের দিকে। নতুন গুল্মের ঈষৎ শক্ত কান্ডগুলোকে নির্দয়ের মতো ভেঙে-চুরে এগিয়ে আসছে। মানিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রায় আশি কিলোগ্রামের একটা শরীর তার উপর আছড়ে পড়ল। একটা বন্য শূকর, দূর থেকে দেখতে কত নিরীহ মনে হয়। বনে অনধিকার প্রবেশের জন্যই বুঝি মানিকের উপর তার এই ক্ষোভ, মানিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই শূকরটি তার ধারালো দাঁত বসিয়ে দিল পায়ে। অসহ্য যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল মানিক, পাটাকে সর্বশক্তি দিয়ে ঝেড়ে দিল। তাতেও শূকরটি পা হাড়ল না, মানিক কোমড়ে হাত দিয়ে কাজাচাই এর ছুরিটি পেয়ে গেল, হাতে নিয়ে একেবারেই নীরিহভাবে শূকরটির গায়ে খোঁচা দিল। এবার বোধ হয় কিন্তু শ্রদ্ধা জাগলো শূকরটির, কুঁই কুঁই করে দৌড়ে ঝোপঝাড়ে হারিয়ে গেল। পায়ের কাছে উষ্ণতা অনুভব করল মানিক।

তাকিয়ে বুঝল রক্ত ঝরছে, বন্ধ করা দরকার, দুই হাতে চেপে ধরেও রক্ত বন্ধ করা গেল না। মানিক খায়াচিং-এর বিদ্যা কাজে লাগাতে চাইল, বেল গাছের কচি পাতা পাঁচ মিনিটের মধ্যে রক্ত বন্ধ করতে পারে। পলিথিনটি একটু ছিড়ে পায়ে বেঁধে বেল গাছের খোঁজে হাঁটতে লাগল সে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, হঠাৎ করেই যেন সব বেল গাছ উধাও হয়ে গেল, কাল পর্যন্ত কত বেল গাছ পেরিয়ে এসেছে সে, আজ একটাও পাচ্ছে না। রক্ত ঝরেই যাচ্ছে, আর কোনো উপায় না খুঁজে পেয়ে মানিক পকেট থেকে দিয়াশলাই বের করল, মাংসপেশি পুড়িয়ে রক্ত বন্ধ করতে হবে। দিয়াশলাইটা জ্বালিয়ে তার কাছে নিয়ে ধরল, পায়ের পশম পোড়া গন্ধ আসল নাকে, সাথে একটু মাংস পোড়ার গন্ধও। তারপর শুরু হলো অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। মানিক নিঃশাস আটকে চোখ বন্ধ করে যন্ত্রণাটা সহ্য করল। যন্ত্রণাটা একটু কমে গেলেও প্রচণ্ড জ্বালা রয়ে গেল তবে রক্ত বন্ধ হয়ে গেল।

এক মুহুর্তের জন্যও মানিক হারেনি, সে হারতে পারে না কারণ এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি তার, উমের ফুটফুটে বাচ্চাটাকে একবার হলেও কোলে নিতে চায় সে, মৃত্যুর আগে একবার হলেও মাথায় মায়ের হাতের স্পর্শ চায়। দরকার হলে এক পায়ে জঙ্গল পেরুবে সে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে লাগল মানিক। সময়জ্ঞান নেই তার, কতক্ষণ হাঁটছে, কয়টা পাহাড় পাড়ি দিয়েছে বলতে পারে না। শুধু চন্দ্রাহত মানুষের মতো হাটছে। পিপাসার কথা ভুলে গেছে, মনে পড়লে বুঝতে পারত প্রায় এক দিন সে পানি পায়নি। বুকের ধুকধুকানি বেড়ে গেল, জ্ঞানহীন শরীর আর সইতে পারল না, শুকনো ডালের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। মানিক দেখল, আবছা আলোতে দৈত্যের মতো দাঁড়ানো একটা কালো পাহাড়, ধীরে ধীরে পাহাড়টা আরো কালো আর ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। মানিকের মনে হলো সে মারা যাচ্ছে, মনে মনে আফসোস হলো বড় অসময়ে মারা যাচ্ছে সে।

শাসনের পর ঘুমন্ত শিশুকে যেভাবে আদর করে মা, সেভাবে গতকালের নিষ্ঠুরতার পর জঙ্গল যেন একটু বেশিই কোমল হলো মানিকের প্রতি। শিশির মাখা ঘাসের ডগা মানিকের ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে দিল। তার কানের কাছে নাম-না-জানা একটা পাখি ঘাসের মধ্যে চঞ্চু ডুবিয়ে খাবার খুঁজছে। মানিককে মৃত ভেবে তার কাছ থেকে পালিয়ে যায়নি পাখিটি, খাবারের খোঁজে মানিকের কানের ভেতর চঞ্চু ডুবিয়ে দিল, তাতেই মানিক জেগে উঠল। রাতে অসাড় হয়ে পড়া শরীরটি বিশ্রামের কারণে কিছু শক্তি ফিরে পেয়েছে। ধীরে ধীরে হাত-পায়ে অনুভূতি ফিরে পেল সে, রক্ত প্রবাহ টের পেল শরীরের ভেতর। চোখ খুলে দেখল সব যেন রং হরিয়েছে, গাছপালা, পাহাড়, আকাশ, পাশে একমনে খাবার খুঁজে যাওয়া পাখিটি সব রংহীন, ফ্যাকাসে। রক্ত প্রবাহ স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে আবার রং ফিরে পাচ্ছিল সব। পাখিটির পালক লাল তাতে ছোপ ছোপ কালো, ঠোঁটটি হলদেটে। পাশে নাম-না-জানা একটি গাছ, তাতে লাল দেখতে খুব সুন্দর ফল ধরেছে। ঘাসগুলো একেবারে সজীব, বাতাসটাও সতেজ। জোরে শ্বাস নিল সে, ফুসফুসে বেশ কিছু সজীব শীতল বাতাস হুড়মুড় ঢুকে পড়ল। মানিক এক পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

সামনের দিকে তাকিয়ে উত্তেজনায় কিংবা শরীরের দুর্বলতায় মানিকের শরীরটি কাঁপতে লাগল। যা দেখছে তা সত্যি হতে পারে না, নিজের চৈতন্যে সন্দেহ হলো তার। সামনে একটি পাহাড়, তার চুড়ান্ত বিশালাকার কৃষ্ণচূড়া ডালপালা মেলে চূড়াটি প্রায় ঢেকে ফেলেছে, কিন্তু অবিশ্বাসের অংশটুকু হলো, পাহাড়টার রং নীল আর উত্তেজনার অংশটুকু হলো, মানিক এই দৃশ্য আগেও দেখেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিলাসবহুল মাচাং ঘরে এই নীল পাহাড় সে দেখেছে। সেটা দেখতে হুবহু এ রকম ছিল কিন্তু এত বিশাল ছিল না, পয়তাল্লিশ বাই ত্রিশ সেন্টিমিটারের ক্যানভাসে শফিক সাহেবের স্টুডিওতে দেখেছিল সে, নীল পাহাড়।

শরীরে অনুভূতি ফেরার সাথে সাথে ক্ষুদা-পিপাসার অনুভূতিও ফিরে এলো। লাল কিছু ফল তার পায়ের কাছেই পড়ে রয়েছে। খেতে গিয়েও খেল না। পাখিটি এত ফল থাকার পরেও মাটিতে খাবার খুঁজছে। বনে, পাহাড়ে না জেনে কোনো ফল পাওয়া উচিত নয়, আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় ফলটা সবচেয়ে বিষাক্ত হয়। মানিক নিজেকে সংবরণ করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল নীল পাহাড়ের দিকে। পাহাড়টিকে দেখতেও খুব আকর্ষণীয় লাগছে, যেন তাকে ডাকছে। মানিক জানে না সেখানে কত বিষ লুকিয়ে আছে।

অতি কষ্টে পা-টাকে আরো যন্ত্রণা দিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে নীল পাহাড়ের চূড়ায় এসে উপস্থিত হলো। শফিক সাহেব যে রহস্য সেদিন ভাঙেনি আজ মানিক তা উদ্ধার করল। পুরো পাহাড় ক্রাসিমার খোঁপায় গোঁজা নীলাতা ফুলে ছেয়ে আছে। কিন্তু নীল পাহাড়ের রহস্য এত সামান্য নয়। এই পাহাড়ের কোলেই বিস্তৃত মাঠ জড়িয়ে আছে পাহাড়ের কলঙ্ক। আড়াই ফুট উচ্চতার পপি গাছগুলো নিরীহভাবে হাসছে এই সমতলভূমিতে। এই ফসল শিশুর ক্ষুধা মেটাবার জন্য নয়, মাচাং ঘরে মজুদ করার জন্যও নয়। এই ফল লোভের, পাপের। যে পাহাড় মায়ের মতো আগলে রাখে তার কোলেই চাষ হচ্ছে বিষের। এই একা পাহাড়টি যেন তার নীরব সাক্ষী। দুঃখে, কষ্ট, কলঙ্কে যেন পাহাড়টি নীল হয়ে আছে।

বিশাল সমতল ভূমির ঐ প্রান্তে ছোট ছোট কিছু পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। এক পাশে বেশ কিছু কুঁড়েঘর। ক্ষেতের চারপাশে কিছু লোক ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে, তাদের নজর পাহাড়ের দিকে। তাদের ঘাড়ে বন্দুক আছে, পাখিমারা এয়ার গান নয়, রীতিমতো রাইফেল।

মানিক অবাক হলো, বন্দুক দেখে নয়, তাদের শার্টের বোতাম লাগানো দেখে। একজন তাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, তার দিকে বন্দুক তাক করে কী যেন বলতে লাগল, তা বুঝার সাধ্য মানিকের নেই। ভাষাটা মারমার কাছাকাছি হলেও উচ্চারণটা একেবারে ভিন্ন।

আরো দুজন এগিয়ে এলো, তারাও বন্দুক উঁচিয়ে রেখেছে। মানিককে ধরে নামাল দুজন, নয়তো নিজে নিজে নামার শক্তি তার ছিল না। দুইজনের কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল, একজন হঠাৎ করে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মানিকের মাথায় আঘাত করল। তারা হয়তো বন্দুকের ব্যবহার খুব একটা করতে পারে না তাই সুযোগ পেয়ে একটু বাঁটটাই ব্যবহার করে নিল। মানিকের মাথার পেছনে চামড়া কেটে রক্ত বের হতে লাগল, মানিককে ধরে থাকা দুজন খুব বিরক্ত হলো, চেঁচিয়ে কী যেন বলল পেছনের জনকে। মানিকের শরীরটা এলিয়ে পড়ল, তারপর দুজন মানিককে ঝুলিয়ে একটা কুঁড়েঘরে নিয়ে এলো। কেউ একজন পানি এনে দিল একটা জগে। মানিক নিমিষেই এক জগ পানি খেয়ে ফেলল তবুও পিপাসা মেটেনি। তাকে একা রেখে ঘরটা বাহির থেকে বন্ধ করে সবাই চলে গেল। মানিক বুঝল, সে দ্বিতীয় বারের মতো বন্দি হলো, প্রথমবারের মতো বন্দুকের নলের মুখে। কিছুক্ষণ পর বুঝল সে একই পক্ষের দ্বারা দুইবার বন্দি হলো যখন সে আংসাইকে দেখল। আংসাইয়ের চেহারায় প্রথমে বিস্ময় ফুটে উঠল—

তারপর চোখে কুটিল এবং হিংস্র একটা দৃষ্টি দেখা গেল। সে মানিকের কাছে এসে বলল—

আমি যত শিকার করছি তার মধ্যে বাঙালি শিকার করতে সবছে ভালো লাগে।

মানিক শান্তভাবে বলল—

এই তোমাদের দক্ষিণের পাহাড়ের চাষবাস? এই লোকগুলো কি মায়ানমারের?

আংসাই কিছুই বলল না, তার মুখে সেই কুটিল হাসিটি ধরে রেখেছে সে। সে তার ছুরিটি বের করল, চকচকে ছুরিটি অকারণেই মানিকের সামনে নাড়াতে লাগল। শিকার ভয় না পেলে শিকারে মজা নেই।

এমন সময় বন্দুক কাঁধে একজন ঢুকল, সে আংসাইকে ধমক দিয়ে বাহিরে নিয়ে গেল। বন্দুকওয়ালাকে আংসাইয়ের তুলনায় আকারে ছোটই বলা যায়, একেবারে শুকনো, চিমসানো শরীর। তারপরও ধমক দিতে একটুও গলা কাঁপল না, তার কাছে যে বন্দুক আছে। আংসাইও বন্দুকের ক্ষমতা মেনে চলে। সে মাথা নিচু করে বাহিরে চলে গেল। তারপর সারাদিন আর কারো দেখা নেই। অনেক শলা-পরামর্শ হলো মানিকের ভাগ্য নিয়ে, সন্ধ্যায় চারজন লোক একটি দড়ির দোলনা এনে তাকে বসিয়ে দিল, বাঁশ দিয়ে চারজন মিলে বয়ে নিয়ে চলল তাকে। এরকম দোলনার পালকিতে আগেও চড়েছে মানিক। রাত্রির অন্ধকারে কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ছাড়াই তারা চলতে লাগল উত্তর দিকে। রাত্রির সব সৌন্দর্য অপচয় করে, জোনাকি পোকাগুলোকে অবহেলা করে মানিক চোখ বুজল।

.

থুইনুপ্রুর ঘরে অনেক মানুষ থাকার পরও কেমন যেন নীরবতা ভর করেছে। আংসাই এক কোণে বসে আছে মেঝেতে। দড়ির পালকির একটা কোনা তার ঘাড়েই ছিল সারারাত, তার চোখে-মুখে ক্লান্তি। মংতো, খায়াচিং আরো কিছু বয়োবৃদ্ধও ঘরে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। থুইনুপ্রু বিছানায় আধশোয়া। বিছানার সামনে একটি চেয়ারে মানিক বসে আছে। তার চোখে কোনো অনুতাপ নেই। ঘরের বাহিরে বারান্দায় কৌতূহলী মহিলারা কাজ ছেড়ে ভিড় করেছে, তারা জানালা, দরজা ধরে উঁকিঝুকি মারছে। যা একটু ফিসফিস শব্দ হচ্ছে সব তারাই করছে। ছোট গ্যাদা বাচ্চাদের মায়েরাও এসেছে, তাদের ব্যাপক কৌতূহল থাকলেও তাদের বাচ্চাদের বিন্দুমাত্র নেই, মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছে। বুকের কাপড় তুলে স্তন মুখে পুরে তাদের শান্ত রাখতে হচ্ছে।

মহিলাদের ঠেলে ঘরে চুল ক্রাসিমা, দৌড়ে এসেছে, একটু হাঁপাচ্ছে। মানিকের ছিন্ন বস্ত্র আর জীর্ণ মুখ দেখে চোখের জল আটকাতে পারল না সে। মুখে হাত দিয়ে নীরবে কাঁদছে, যদিও এই কান্না কারো নজর এড়াল না। মংতোর মনে ভীষণভাবে জ্বলতে থাকল প্রতিটা অশ্রু। মানিক শূন্য দৃষ্টিতে শুধু একবার ক্রাসিমার দিকে তাকাল।

থুইনুপ্রু সিগারেট লম্বা টান দিয়ে বলল—

ডাক্তার বাবু, আপনাকে তো বুদ্ধিমান ভাবতাম, আপনি এই ভুল কেন করলেন?

মানিক শান্ত স্বরে বলল—

আপনি কেন করলেন?

মানে?

আপনাকে হিংস্র, নির্দয় মনে হতো কিন্তু সৎ ভাবতাম। আপনি এই ছলনা কেন করলেন? আপনি পাহাড়িদের দিয়ে পপি চাষ করাচ্ছেন, মায়ানমারের লোকদের সাথে মিলে।

থুইনুপ্রুর চেহারায় বিচলতা দেখা দিল, হাতের সিগারেটটি ফেলে দিয়ে হিংস্রভাবে তাকাল মানিকের দিকে। মানিককে সম্মান দিয়ে আপনি সম্বোধন না করে তুমিতে নেমে এলো। বলল—

তুমি সেদিন আমাকে প্রশ্ন করেছিলে, এত লোকের খরচ কোথা থেকে আসে? তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়েছ। অর্থই হলো শক্তি, সে শক্তি ছাড়া আমরা বাঙালিদের সাথে টিকতে পারব না। ছলনার কিছু নেই, সবাই তা জানে।

আপনি আবারও ছলনা করছেন, আপনি সংগঠনের জন্য পপি চাষ করেন না, আপনি পপি চাষ করার জন্য সংগঠন করেছেন। কেউ কি জানে এই পপি চাষে একজন বাঙালিও জড়িত? বরঞ্চ আমার মনে হয় আপনি তার হয়েই কাজ করেন।

ঘরের মধ্যে এতক্ষণে একটা গুঞ্জন উঠল, কিন্তু কেউই মানিককে বিশ্বাস করল না, কেউ একজন বলে উঠল, হালা বাঙালি! ক্রাসিমা শুধু অবাক হয়ে শুনছে, পপি চাষের কথা সে জানত না। থুইনুপ্রু গলা উঁচু করে বলল—

কী যা-তা বলছ। তোমার হুঁশ নেই।

হুঁশ আমার ফিরে এসেছে। যেই নীল পাহাড়ের ধারে আপনারা এই বিষ চাষ করছেন সেই নীল পাহাড়ের ছবি শফিক সাহেব তার স্টুডিওতে এঁকেছেন, আমি নিজ চোখে দেখেছি। তার তো এই পাহাড় দেখার কথা না।

উনি ছবি আঁকলেই কি প্রমাণ হয়ে যায় যে উনার সাথে আমার যোগাযোগ আছে?

না, তবে আপনার ঘরে যখন তার আঁকা ছবি ঝুলে তখন প্রমাণের কিছু বাকি থাকে না।

মানিক রবীন্দ্রনাথের ছবির দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল—

ছবির নিচে তার স্বাক্ষরও আছে।

সবাই সেদিকে তাকাল, যারা পড়তে পারে না তারাও। মানিক আবার বলতে লাগল—

তিনি একজন শিল্পপতি, শুনেছি তার টাকার নেশা ছিল। সব ছেড়ে উনি কেন এই পাহাড়ে একটা অকর্মা এনজিও নিয়ে পড়ে আছেন? একটা স্কুল দিয়েছিলেন তিনি, তাও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

থুইনুপ্রু গম্ভীরভাবে বলল—

আমরা কারো স্কুল জ্বালাইনি।

আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার মনে হয় তিনি নিজেই জ্বালিয়েছেন। পাহাড়ি বাঙালিদের উসকে দিয়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে। বরকত আলীর মতো লোক দিয়ে পাহাড়িদের নিজেদের জমি থেকে বিতাড়িত করেছেন, আবার সময় হলে সে বরকত আলীকে মেরে ঘৃণাটা জিইয়ে রেখেছেন। আপনি বিতাড়িত পাহাড়িদের আশ্রয় দেয়ার নাম করে এখানে নিয়ে আসেন, তারা কৃতজ্ঞতার বসে আপনার জন্য সব করে, বিষও চাষ করে।

ঘরে নীরবতা ফিরে এলো, বাহিরেও ফিসফাস বন্ধ, দুধের বাচ্চারাও যেন কৌতূহলী হয়ে উঠল। মানিক আবার বলতে লাগল—

আপনি যদি পাহাড়িদের কল্যাণের জন্য কাজ করতেন, তবে তাদের ভূমিহীন করে এখানে এনে আশ্রয় দিতেন না। নিজের ভূমির জন্য লড়াই করে যেতেন। পাহাড়ি সংস্কৃতি রক্ষার নামে জুম চাষের ঐতিহ্য বাদ দিয়ে এদের দিয়ে পপি চাষ করাতেন না। এদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন, তাদের মুর্খ রেখে নিজের ফায়দা লুটতেন না। আপনার স্ত্রী মারা গেছে, আমার বিশ্বাস আপনার ছেলেমেয়ে আছে এবং তারা রেঙ্গুনে বিশাল বাড়িতে খুব আরাম-আয়েশে আছে। পাহাড়িদের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য তাদের জুমচাষও করতে হয় না, পপি চাষও করতে হয় না।

থুইনুপ্রু হুংকার দিয়ে উঠল, সমস্ত গ্রামটা যেন কেঁপে উঠল। সব সময় তাকে শান্ত দেখেছে সবাই, এমন ক্রোধ আগে কেউ দেখেনি। তার চোখ দুটি আগুনের ভাটার মতো জ্বলছে। ফোঁসফোঁস করে নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। মংতোর দিকে তাকিয়ে বলল—

এই মিথ্যাবাদী কুকুটাকে নিয়ে বেঁধে রাখো। আজ রাতে এর ব্যবস্থা করব।

তার আদেশ অস্বীকার করতে শিখেনি কেউ, আজও করল না। মংতো মানিককে ধরে বাহিরে নিয়ে গেল। থুইনুপ্রুর ক্রোধের ঘূর্ণিঝড়ের সামনে কেউ পড়তে চায় না, তারা ধীরে ধীরে সরে গেল। অনেকেই মনে মনে মেনে নিল, মানিক মিথ্যা বলেছে, থুইনুপ্রু যেহেতু বলেছে সেহেতু মানিক মিথ্যা বলেছে। কিন্তু ধানের কুটা পড়া চোখের মতো মনটা খচখচ করতে লাগল। সবাই বেরিয়ে গেল, ক্রাসিমা শুধু রবীন্দ্রনাথের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল, রবীন্দ্রনাথ মুচকি হাসছেন।

থুইনুপ্রুর কপালের পাশের শিরা দুটো দপ দপ করতে লাগল। মাথায় রক্ত চড়ে গেছে, শিরাগুলো রক্ত সরবরাহ করে কূল পাচ্ছে না। আজ তার সব গাম্ভীর্য, সব অহংকার এই ডাক্তারটি মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। সবাই হয়তো বিশ্বাস করেনি কিন্তু সে নিজে জানে সে একজনের সামনে নগ্ন হয়ে গেছে, নিজের কাছে। সে নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, পাহাড়িদের কল্যাণ করছে সে, আজ ডাক্তার তার নিজের আসল প্রতিবিম্ব দেখিয়ে দিল।

ঢাকায় গিয়ে জীবন গড়তে চেয়েছিল সে, কয়েকটা বছর নষ্ট করা ছাড়া কিছুই হয়নি। একমাত্র ব্যাপার যেটাকে সে ভালো বলতে পারে তা হলো, শফিক আহমেদের সাথে দেখা হওয়া। সন্ত লারমার সংহতিতে যোগ দিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছে, অস্ত্র চালনা শিখেছে। গহিন পাহাড়ে সমতলভূমি দেখে সেই-ই প্রস্তাব দেয় পপি চাষের। শফিক আহমেদের ব্যবসায়িক বুদ্ধি ভালো, সে শুষে নেয়। সব ছেড়ে পাহাড়ে আস্তানা গাড়ে। পাহাড়ে এমনিতে তখম বহু পাহাড়ি ভিটে ছেড়েছে, একটা যুদ্ধ চলছে পাহাড়ে। যেখানে যুদ্ধ চলে শকুনেরা সেখানে চলে যায়, খুঁটে খুঁটে মাংস খায়, তারাও খেয়েছে। ভিটে ছাড়া পাহাড়িদের দিয়ে পপি চাষ করাত, সেগুলো পাচার হতো মিয়ানমারে। তারা সবগুলো জমি বাছাই করেছিল সীমান্তের কাছে যাতে পরিবহনে সমস্যা না হয়। তাদের লোভও বেড়ে গেল, শফিক সাহেব একটা ভদ্র, দয়ালু মুখোশ পরে পাহাড়িদের উচ্ছেদ করত আর থুইনুপ্রু তাদের কাজে লাগিয়ে আরো জমি নিয়ে চাষবাস বাড়িয়ে দিল। সারাজীবন ব্যবসা করে যা আয় করেনি শফিক আহমেদের দুই বছরে তার চেয়ে বেশি আয় হলো।

থুইনুপ্রুও রেঙ্গুনে বাড়ি করেছে। দুই ছেলে পড়াশুনা করছে, বউ মারা যাবার পর কম যাওয়া হয় রেঙ্গুনে।

রবীন্দ্রনাথের ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনটা আর্দ্র হয়ে গেল। তার বউ রবীন্দ্রসংগীত গাইত। পাহাড়ি মেয়ের রবীন্দ্রসংগীতে কীভাবে ঝোঁক হলো কেউ বলতে পারত না। খুব সহজেই রেডিওর শিল্পী হতে পারত সে। রেঙ্গুনের বাড়িতে শফিক সাহেব প্রায়ই যেতেন।

তখন তার বউ আবদার করেছিল, রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি এঁকে দেয়ার জন্য, ঘরের দেয়ালে বাঁধাই করে রাখবে। শফিক সাহেব এঁকে দিয়েছিলেন, কিন্তু তত দিনে টাইফয়েডে বউ মারা গিয়েছে। তাই রবীন্দ্রনাথের এই ছবিটি সব সময় নিজের ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখে থুইনুপ্রু। যত খারাপ মানুষই হোক সে, বউকে বড় ভালোবাসত।

ডাক্তারের কথা মনে হতেই মনের আর্দ্র ভাবটা হারিয়ে গিয়ে সেখানে প্রতিহিংসা ভর করল। এখন কিছু করা যাবে না, সবাইকে কথাগুলো ভুলতে একটু সময় দিতে হবে। আজ রাত অপেক্ষা করে কাল ভোর হওয়ার আগেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবল সে তারপর মংতোকে ডেকে পাঠাল।

সারাটা দিন গ্রামে থমথমে অব ছিল, মেয়েরা গল্প করেছে, তাঁত বুনেছে, বুড়োরা হুঁকো টেনেছে, বাচ্চারা এটা-সেটা খেলেছে। পুরুষেরা ক্ষণিক বুড়োদের সাথে ক্ষণিক মেয়েদের সাথে যোগ দিয়েছে। সব কিছু আগের দিনের মতোই হয়েছে, তবুও কোথায় যেন একটা বিষন্নতা বাবলা কাঁটার মতো বিঁধে রইল। ক্রাসিমা নিজের ঘর থেকে এক মুহুর্তের জন্য বের হয়নি, একবার ভেবেছিল মন্দিরে পুজো দিবে, প্রার্থনা করবে কিন্তু কার জন্য করবে ভেবে পায়নি। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে সে, চোখেও কোনো চঞ্চলতা নেই।

শুধু মাঝে মাঝে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

রাতটাও থমথমে অবে কেটে গেল, যারা মুমিয়েছে তারা জানে সকালবেলা গ্রামে পাঁঠা জবাই হবে। কিন্তু কারো মনে আনন্দ নেই, কেউ বুঝতেও পারছে না এমন লাগছে কেন।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *