নীল পাহাড় – ১

এক

১৯৮৪ সালের গ্রীষ্মের কোনো এক দুপুরে মানিক লোকাল বাসে বসে আছে। সে বসেছে জানালার পাশে, রোদে গা জ্বলে যাচ্ছে। খালি পেটে এই অনিচ্ছাকৃত রোদ্রস্লানে মানিকের মাইগ্রেনের ব্যথাটা ঢিপ ঢিপ করে বাড়ছে। খালি পেটেই ক্যান্টিমের চা খেয়েছিল, এখন বমি বমি লাগছে। গ্যাসট্রিকটা বেশ ভালোই বাধিয়েছে সে। বাস ভর্তি লোকজন, তারপরও কোনো এক অজানা কারণে বাস ছাড়ছে না ড্রাইভার। সবচেয়ে বিরক্তি লাগছে ড্রাইভার ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বাসটাকে ইঞ্চি দুয়েকে সামনে নিয়ে আবার পেছনে এনে সামনে-পেছনে দোলাচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনি ছেড়ে দিবে, এরকম মনে হওয়াটা পনেরো মিনিট ধরেই হচ্ছে। জানালার পাশে বসা রোদে পুড়তে থাকা লোকগুলো ক্ষেপে ড্রাইভারকে গালি দিচ্ছে, ড্রাইভার তাদের দিকে না তাকিয়ে সিটে পা তুলে, চোখ বন্ধ করে দিইয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে কান চুলকাচ্ছে। তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে, সে খুব আরাম পাচ্ছে, যাত্রীদের গালির কারণে তার সে আরামে কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। মানিকের পাশে বসা লোকটি এই নরকের মতো পরিবেশও তার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এরকম প্রায়ই হয় আজকাল। তার কাঁধটা যেন জনসাধারণের সম্পত্তি হয়ে গেছে। আগে কাঁধ ঝাকিয়ে সরিয়ে নিত, লজ্জা পেত লোকগুলো তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ত তার কাঁধে মাথা রেখে। এখন আর সরায় না, সেদিন ঘুমিয়ে থাকা এক লোকের মুখ থেকে লালা গড়িয়ে তার শার্ট ভিজে গিয়েছিল, সে খুব যত্নের সাথে লোকটিকে না জাগিয়ে রুমাল দিয়ে নিজের শার্ট এবং লোকটির মুখ ধুয়ে দিয়েছিল।

মুরগির খাঁচার মতো লোক ঢুকানো হয়েছে বাসে। হাত-পা নাড়ানোর উপায় নেই। পিজি হাসপাতাল থেকে যেসব চর্ম রোগীরা বাসে উঠে তাদের খুব অসুবিধায় পড়তে হয়, প্রচণ্ড চুলকানি হয় তবুও নড়ার উপায় নেই। এই ভিড় ঠেলে বাতাসও ভেতরে ঢুকতে পারে না কিন্তু বাসের কণ্ডাক্টর যেন ঠিকই মানুষজন পেরিয়ে ভাড়া তুলতে এসে যায়, এই কণ্ডাক্টরটা স্মৃতিশক্তির সমস্যায় ভুগছে। ভাড়া দেয়ার পরও মানিকের কাছে তিনবার ভাড়া চেয়েছে। বকশীবাজার পৌঁছতে পৌঁছতে বোধ হয় আরো কয়েকবার চাইবে।

রাস্তায় মানুষ হাত তুললেই বাস ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বাসের অবস্থা যাই হোক ব্রেক খুব ভালো। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক রাস্তার ওপাশে থাকা বন্ধুর দিকে হাত নাড়ছিলেন, তাই দেখে বাস থেমে গেল লোকটার সামনে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই হেলপার তাকে টেনে বাসে তুলে ফেলল এবং ভিড়ের মধ্যে ঠেলে দিল। বাসে কোনো এক অজানা কারনে কেউ পিছনে যেতে চায় না। যে একেবারে শেষ পর্যন্ত যাবে সেও চেষ্টা করবে দরজায় দাঁড়াতে। আর পরের স্টপজের লোকগুলো কেন যেন পেছনেই বসে। বাস থামার পর সব যাত্রীকে ঠেলে তাদের নামতে পাঁচ মিনিট লেগে যায়। বৃদ্ধ ভদ্রলোককে কন্ডাক্টর পেছনে টানতে টানতে বলল—

কই যাইবেন মুরব্বি?

ভদ্রলোক চোখ পাকিয়ে বললেন—

আমাকে মুরব্বি ডাকবে না।

কন্ডাক্টর মুচকি হেসে বলল—

আইচ্ছা আঙ্কেল, যাইবেন কই?

বৃদ্ধালোকটি এবার দাঁত চিবিয়ে বললেন—

যেখান থেকে জোর করে উঠিয়েছ সেখানেই যাব, ইডিয়ট কোথাকার।

কন্ডাক্টর বলল—

জোর করছে আর আপনেও উইঠা পড়লেন, আইচ্ছা খাড়ান, সামনে নামাই দিতাছি।

বলেই হেল্পারের উদ্দেশ্যে পশ্চাদ্দেশ সম্পর্কীয় খুবই অশ্লীল একটা গালি দিয়ে বৃদ্ধের ক্রোধকে পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। হেল্পারের কাজ হেল্প করা কিন্তু প্রায়শই তারা উল্টোটাই করে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালের হেল্পাররা অবশ্য ব্যতিক্রম, তারা পারলে মানুষজনকে কোলে করে বাসে ওঠায়, যারা যেতে চায় না তাদেরও; একবার ঢাকার জেলা প্রশাসক দলবল নিয়ে সায়েদাবাদ গিয়েছিলেন টার্মিনাল পরিদর্শনে। দল থেকে একটু সামনে চলে এসেছিলেন। এক হেল্পার ‘নোয়াখালী যাইবেন?’ বলেই তাকে নোয়াখালীর এক বাসে ঠেলে উঠিয়ে দিল। জেলা প্রশাসক বারবার বলছে—

এই করছ কি, আমি যাব না।

হেল্পার বলছে—

আরে বুঝছি, কিছু কম দিয়েন সমস্যা নাই।

জেলা প্রশাসক আবার বললেন—

আমি ঢাকার ডিসি।

ডিসি কী জিনিস হেল্পার বুঝে না, সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ড্রাইভারের দিকে তাকাল, ড্রাইভার পান চাবাতে চাবাতে বলল—

স্যাররে ভিআইপি সিটে বহা, আর ভাড়া হাফ লইছ।

পরে ডিসি সাহেবের অধস্তনরা এসে তাকে উদ্ধার করল, নয়তো ঢাকার জেলা প্রশাসক বদলির অর্ডার ছাড়াই নোয়াখালী চলে যেত।

আরেকবার দুই হেল্পার নতুন বিয়ে করা দম্পতিকে নিয়ে টানাটানি করছিল, পরে তারা ভাগাভাগি করে একজন জামাই নিয়ে গেল আরেকজন বউ। বউ কেঁদেকেটে জামাইয়ের কাছে ফিরেছিল। আর কারো কাছে যদি বড় ব্যাগ থাকে, তখন তারা যাত্রীকে ছুঁবেও না, ব্যাগ নিয়ে বাসে রেখে আসবে। এক্ষেত্রে তারা ‘কান টানলে মাথা আসে’ সুত্র কাজে লাগায়।

মানিক লক্ষ্য করল আসলেই কন্ডাক্টরের স্মৃতিশক্তির সমস্যা আছে, সে বৃদ্ধকে নামানোর ব্যাপারটা বোধহয় ভুলে গেছে। পেছনে গিয়ে কার কাছে যেন চতুর্থবার ভাড়া চেয়ে ঝাড়ি খাচ্ছে। বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি উশখুশ করছেন, পাশের লোকটি রীতিমতা তার উপরে ঢলে পড়ছে কিন্তু তিনি কিছু বলতে পারছেন না। কটমট করে চারদিকে তাকাচ্ছেন, কিন্তু লোকাল বাসে এই দৃষ্টির অর্থ কেউ বুঝে না কিংবা বুঝতে চায় না। এখানে ভদ্রতার বালাই নেই, পায়ে পা পড়লে হাত নিয়ে সালাম করার রীতি নেই, ভুঁড়ি দিয়ে চেপে কোণঠাসা করে দেয়াও এখানে অন্যায় নয়, ঘামযুক্ত বগল নাকে চেপে ধরলেও সেটা প্রতিবাদযোগ্য নয়, এখানে কেউ বড় নয় কেউ ছোট নয়। বৃদ্ধ লোকটি এখন অসহায়ভাবে জানালা দিয়ে রাস্তা দেখার চেষ্টা করছেন, দুই-একবার কন্ডাক্টরের ভারী গলায় ডেকেছেন কিন্তু সেই শব্দ পাশে দাঁড়ানো ভীমের মতো লোকটার ভুঁড়ি পর্যন্ত গিয়েই মিলিয়ে গেল। বুঝা গেল লোকাল বাসে চড়ে অভ্যাস নেই লোকটার। মানিকের কেন যেন তাঁকে চেনা চেনা মনে হয়। কিন্তু মনে করতে পারছে না। বাস বকশীবাজারে পৌঁছে গেল। বৃদ্ধ মানুষটিও কোনমতে তার পেছন পেছন নামল। উনাকে দেখে খুব সম্ভ্রান্ত মনে হয়, মুখে দাড়ি নেই কিন্তু চুল সব সাদা, মুখের ভাঁজ দেখে বয়স অনুমান করা যায়। হেঁটে হেটে কোথাও যাচ্ছিলেন হয়তো, মাঝপথেই অপহরণের শিকার হলেন। মানিক লোকটির দিকে তাকাল, এতক্ষণে চিনতে পেয়েছে। ইনি, ডা. বদরুল আলম। পিজি হাসপাতালে নতুন পরিচালক। গত সপ্তাহে জয়েন করেছেন, প্রথম দিন সবার সাথে হাত মিলিয়ে পরিচিত হয়েছিলেন। তাকে লোকাল বাসে দেখে চিনতে পারেনি মানিকক। মানিক কাছে গিয়ে বলল—

স্যার আদব।

বদরুল আলম সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল—

কে তুমি?

মানিক বলল—

স্যার আমি ডা. মানিক মিত্র। সার্জারিতে আছি।

বদরুলল আলম যেন প্রাণ ফিরে পেল। একটু আগের অপরিচিত ছেলেটিকে এখন যেন বড্ড আপন মনে হচ্ছে। তিনি বললেন—

দেখো তো এদের অবস্থা, হাঁটতে দিচ্ছে না মানুষকে, জোর করে হলেও বাসে তুলে নিবে। চোর-ডাকাত আর ভয় পাই না আমি কিন্তু এই লোকাল বাস দেখলেই কলিজা কেঁপে ওঠে।

বলেই হেসে উঠলেন। এতক্ষণ খুব বিরক্ত লাগছিল, এখন যেন পুরো ব্যাপারটা কৌতুক হয়ে গেল।

মানিক বলল—

স্যার আমি আপনাকে পৌঁছে দেব, চিন্তা করবেন না।

বদরুল আলম বললেন—

সমস্যা নেই, হাঁটতে বের হয়েছি, হাঁটতে হাঁটতেই চলে যাব, দুপুরে হাঁটলে ঘাম বেশি ঝরে। কিন্তু এখনো লাঞ্চ করা হয়নি আমার। ভালো খাবার পাওয়া যাবে কোথায়? চলো কিছু খেয়ে নেই।

মানিক বলল—

আমারও হয়নি, চলুন স্যার।

বাস থেকে নেমে বংশালের কেরামত হোটেলে দুপুরের খাবার খায় মানিক। সে কেরামত হোটেলের বাঁধা খদ্দের। কেরামত হোটেলের রান্নার খুব নামডাক। তাদের সব তরকারিতে তেলের অতিরিক্ত উপস্থিতি এই নামডাকের একটা কারণ। অনেকে ঠাট্টা করে বলে—

কেরামত মিয়ার তেলের খনি আছে। কোলেস্টেরল শব্দটা এখনো এই অঞ্চলে ভীতি জাগাতে পারেনি। তাই কেয়ামত মিয়ার হোটেলে খদ্দেরের অভাব নেই। কেরামত মিয়ার হোটেলের তেলের কেরামতিতে জিহ্বা আরাম পায় বটে তবে কিছু লোকের হৃদয় বিদ্রোহ করে বসেছে। পেঁয়াজের আড়ৎদার রসু বেপারী এই হোটেলে তিন বেলা পদধূলি দিত। তার বউ সারাজীবন কেরামত বাবুর্চিকে হিংসা করত, স্বামীকে খাইয়ে কোনোদিন খুশি করতে পারেনি সে। বউ কত বুঝাত—

ঐ তেলতেইল্যা খাওন খাইও না।

কিন্তু রসু বেপারী কান দিত না। কান না দিলেও প্রাণটা দিতে হয়েছিল। হার্টে দুইটা ব্লক ধরা পড়েছিল, ডাক্তার তার নাতির গা ছুঁইয়ে প্রতিজ্ঞা করাল যেন আর বাহিরের খাবার না খায়। শুধু শাকসবজি খায়। রসু বেপারী এক বেলা খেল, তারপর বলল—

আমি কি গরু নাকি ছাগল, এই ঘাসটাস আমি খাইতে পারুম না।

দুই মাস পরেই কেরামত হোটেলে সকালে খাসির তেহারি খেয়ে ঢেঁকুর দিয়েই চোখ উল্টে পড়ে গেল বেপারী। মৃত্যুর সময়েও তার মুখে সেই তৃপ্তির ঢেঁকুর লেগে ছিল।

এই অঞ্চলের মানুষ মৃত্যুকে যতটা ভয় পায় খাবারকে তার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। সব বাঁধা খদ্দরেরা অবশ্য কেয়ামত মিয়র রান্নার প্রেমে মত্ত না। মানিকের আর কোনো উপায় নেই, ঘরে রান্না করার মতো কেউ নেই। একই কারণে বিয়ে করা হয়নি। পাত্র হিসেবে সে প্রথম শ্রেণির কিন্তু তবুও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা পিছুটান দিচ্ছেন শুধুমাত্র একটা কারণে। সে কারণটা প্রতিমুহূর্তে মানিকের মনে সূচের মতো বিঁধতে থাকে, রক্তাক্ত করতে থাকে তাকে।

মানিকের মতো নারায়ণ বাবুও কেরামতের গুণমুগ্ধ নয়। কিন্তু সকালবেলা লাইন ধরে সবজি-ভাজি কিনতে আসেন। নারায়ণ বাবু ছাড়া কেউ শুধু ভাজি কিনতে আসে না। নারায়ণ বাবু যুদ্ধের বছরে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন সপরিবারে। বছর পাঁচেক আগে ফিরে এসেছেন। তিনি সেসব ভাগ্যবান মানুষদের একজন যার বড়ি দখল হয়ে যায়নি। কলকাতা থেকে ওজন কমিয়ে দেশে ফিরলেন, সাথে নিয়ে আসলেন কলকাতার কিপ্টেমি। কেরামত মিয়ার ভাজির তেলে গিন্নীকে দিয়ে দুপুর এবং রাতের রান্নাটা সারিয়ে নেন।

বদরুল সাহেব নাক-মুখ কুঁচকে কেরামতের হোটেলে বসে আছেন, তার মুখে বয়সের ভাঁজের সাথে সাথে বিরক্তির ভাঁজও ফুটে উঠেছে। মানুষজন খাওয়ার সময় উচ্ছিষ্ট সব টেবিলে স্তূপ করে জমা করছে, প্রত্যেক টেবিলে মাংসের হাড় দিয়ে ছোট ছোট টিলা বানানো হয়েছে, কোনো কোনো টেবিলে তা রীতিমতো পর্বত। মেসিয়ার নামক চটপটে এবং পটপটে মানুষগুলো হনুমানের মতো সেই গান্ধব পর্বত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হোটেলের সামনে গোটা দুই কুকুর সেই হাঁড়ের পর্বতের লোভে অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছে।

হোটেলের ভেতরে সবাই উচ্চস্বরে কথা বলছে, হোটেলের মালিক বাবুর্চি কেরামত মিয়া মেসিয়ারদের বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করছেন। একজন মেসিয়ার রান্নাঘর থেকে কিছু মাংসের হাড় এনে কুকুরগুলোকে দিল। অভূক্ত কুকুরগুলো ঝাপিয়ে পড়ল হাড়ের উপর।

তারা যখন মনোযোগ দিয়ে হাড় চিবুচ্ছিল তখন সেই মেসিয়ার এক গামলা গরম পানি ঢেলে দিল কুকুরগুলোর উপর। কুকুর দুটো ক্যাঁক ক্যাঁক করে চিকন স্বরে আর্তনাদ করতে লাগল। কেরামত মিয়া খুব মজা পেয়েছে এই দৃশ্য দেখে, খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে। বদরুল আলম এই দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠলেন। তিনি মানিকের দিকে তাকিয়ে বললেন—

হাউ ক্রুয়েল দে আর। ইম্পসিবল, আমি এখানে খাব না।

মানিক বলল—

স্যার পৃথিবীটাই নিষ্ঠুর, আমাদের হাসপাতালে এর চেয়েও নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটে। অনেক মানুষ আপনাকেও নিষ্ঠুর বলে, আমাকেও বলে। ডাক্তার মানেই নিষ্ঠুর। আমরা মৃত্যু দেখে বিচলিত হই না তাই আমরা পাষাণ। নিষ্ঠুর শব্দটাই আপেক্ষিক স্যার।

বদরুল সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই কাউন্টার থেকে চেঁচামেচি শোনা গেল। কেরামত মিয়া এক বয়স্ক লোককে নিজের বগলে চেপে ধরেছে। রান্নাঘর থেকে গরম পানি আনতে বলছে মেসিয়ারকে। লোকটি বিশালদেহী কেরামত মিয়ার বগলে ধড়ফড় করছে, ছুটে যেতে চাচ্ছে। লোকটার গায়ের ময়লা জামাটা আগেই ছেড়া ছিল, ধস্তাধস্তিতে সেটা আরো ছিড়ে গেল। লোকটার মুখ লাল হয়ে গেছে, একটু আগে গরম পানিতে পশম হারানো কুকুর দুটি দূর থেকে তাকিয়ে আছে আর কুঁই কুঁই শব্দ করছে…

তাদের একটি মানব সঙ্গী জুটবে মনে হচ্ছে। মানিক উঠে গিয়ে কেরামতকে জিজ্ঞাসা করল—

কী হয়েছে ভাই?

কেরামত মিয়া বগলের বাঁধন আরো শক্ত করে বলল—

মাগীর পুতে দাঁত বিলাইতে বিলাইতে বিল না দিয়া নবাবের লাহান হাইটা চইল্যা যাইতাছিল, মনে করছে চোখ দুইডা আমি পুন্দে দিয়া বয়া রইছি।

মানিক জিজ্ঞাসা করল—

আচ্ছা বিল কত হয়েছে, আমি দিয়ে দিব।

কেরামত মিয়ার রাগ মনে হয় একটু কমেছে, মানিক তার অসুস্থ বউকে মাঝে মাঝেই দেখে আসে। মানিককে সে শ্রদ্ধা করে, তার সামনে মুখ খারাপ করেছে সে জন্য তার অনুশোচনা হয়, সব সময়ই হয় কিন্তু রাগ উঠলে আর মনে থাকে না। সে মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল—

আপনের দেয়া লাগব না।

তারপর বয়স্ক লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল—

বুড়া মিয়া তুমি কামডা ঠিক করে নাই, পয়সা না থাকলে কইবা। কেউ আইসা কইছে ভুক লাগছে আর আমি খাওয়াই নাই এমন হয় নাই। কিন্তু চুরি কইরা খাইলে মাফ নাই। তুমি এহন থেইকা যহন খুশি আইয়া খাইয়া যাইবা, পয়সা লাগব না।

বয়স্ক লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, সে মানিকের দিকে লজ্জিতভাবে তাকাল তার দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিল। মানিক চলে আসল, কৃতজ্ঞ দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, অস্বস্তি লাগে, মনে অহংকার চলে আসে।

বদরুল সাহেব সব দেখছিলেন। মানিককে বললেন—

একটু আগেই লোকটিকে কী নিষ্ঠুর মনে হচ্ছিল, এখন তা মনে হচ্ছে না, এখানে খাওয়া যায়। আচ্ছা বয়স্ক লোকটিকে কি তুমি চিনো?

না স্যার, তবে হতেও পারে তিনি আমার আপনজন।

কীভাবে? মানিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—

স্যার আমি অনাথ, ঢাকা অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। বাবা-মায়ের কোনো পরিচয় জানি না। তাই সব মানুষকেই আমার আপন মনে হয়। এই লোকটিই হয়তো আমার বাবা। সব বয়স্ক লোককেই আমার বাবা মনে হয়।

বদরুল সাহেবের চোখে কেমন যেন একটা বেদনা ফুটে উঠল। তিনি নিজেকে সামলে বললেন—

তোমার নামটা যেন কী, ভুলে গেছি।

স্যার, মানিক মিত্র।

তুমি কি সোবহান সাহেবের আন্ডারে আছ?

জি স্যার।

তুমি কি সোবহান সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দিয়েছ।

জি স্যার।

কী সর্বনাশ! তুমি কি জানো তোমার চাকরি চলে যাবে? রেজিষ্ট্রেশনও ক্যান্সেল হতে পারে।

কেন স্যার, আমি তো অন্যায় করিনি। সোবহান স্যার যেভাবে সেই বাচ্চা মেয়েটিকে এক্সামিন করছিলেন, সেটাকে ধর্ষণের পর্যায়ে ফেলা যায়। তাছাড়া এই হসপিটালে অনেক নার্স এবং মেয়ে ডাক্তাররা উনার সম্পর্কে জানে। কেউ ভয়ে অভিযোগ করে না।

বদরুল সাহেব বললেন—

কেউ করে না এবং করবেও না। কেউ তোমার পক্ষে সাক্ষী দিবে না। উলটো তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবে। তুমি জানো না, সোবহান সাহেব প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের বন্ধু মানুষ। স্বাহ্য সচিব তাকে স্যার বলে ডাকে। বয়সের কারণে সে পরিচালক হতে পারেনি—

আর কয়েক দিন পরেই সে পরিচালক হবে। এক কাজ করো, তুমি তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নাও।

মানিক বলল—

আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি স্যার, আমাকে এমন কিছু করতে বলবেন না যেটা আমি করতে পারব না। আমার কিছু নেই তাই হারানোর ভয় পাই না। আমার যা হওয়ার হবে, দেখা যাবে।

একটু থেমে বলল—

স্যার কাচ্চিটা ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে ভালো লাগবে না।

বদরুল সাহেব তাকিয়ে দেঘলন তৈলাক্ত একটা খাবার তার সামনে, এটা খাওয়া ঠিক হবে না বুঝতে পারছেন কিন্তু ক্ষুধাও লেগেছে। একটু মুখে দিয়েই তার কুঁচকানো মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বেশ খানিকটা খেয়ে বললেন—

চমৎকায় রান্না করেছে। তাই তো বলি, এত বারণ করার পরও কেন রোগীরা এসব খাবার ছাড়তে পারে না। আমার এক রোগীকে তার নাতির মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলাম কিন্তু সে শোনেনি। লোকটার নাম ছিল রসু বেপারী, বিরাট আড়ৎদার।

মানিক একটু হেসে বলল—

স্যার রসু বেপারী এই হোটেলেই মারা গিয়েছিল তেহারি খেয়ে।

বদরুল আলম খাওয়া বন্ধ করে হাঁ করে মানিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন, রসু বেপারীর যন্ত্রণাকাতর মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই যন্ত্রণার ছাপ কিছুটা তার নিজের চেহারায়ও পড়ল। মুখ নামিয়ে কাচ্চির দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন, তারপর পাশ দিয়ে যাওয়া মেসিরকে বললেন—

আরেক প্লেট দিও তো।

স্বাদের কাছে মৃত্যুভয় পরাজিত হলো।

মানিক আর বদরুল সাহেব বের হয় দেখলেন, গরম পানিতে পশম হারানো কুকুর দুটিকে উচ্ছিষ্ট এনে দেয়া হয়েছে। কেয়ামত মিয়ার মন আষাঢ়ের আকাশের মতে, এই রোদের তেজ তো এই বৃষ্টির কোমল পরশ।

বদরুল সাহেব মানিকের দিকে তাকিয়ে বললেন—

বয়স্ক লোক দেখলেই তোমার বাবার মতো মনে হয়, আমাকে কি তোমার বাবার মতো মনে হয়?

না স্যার, অনাথদের বাবা হয় মৃত, দরিদ্র, অসহায় অথবা অপরাধী। আপনি তার কোনোটা নন।

বদরুল সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন—

তুমি বলেছিলে, মানুষের মৃত্যুতে ডাক্তাররা বিচলিত হয় না। কথাটা ঠিক নয়। আমরা বিচলিত হই কিন্তু প্রকাশ করতে পারি না। পৃথীবির সবচেয়ে সুখের খবর আমরাই দেই, মানুষের জন্মের সময়। আবার সবচেয়ে কষ্টের কথা আমাদেরই শোনাতে হয়, মানুষের মৃত্যুর খবর। আমরা বিচলিত হলে এই কাজ করতে পারতাম না। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ করেছি, আমার স্ত্রীকে আমার ছেলের মৃত্যুর খবর দিয়েছি।

আর কিছু বলতে পারলেন না তিনি, হয়তো কোথাও আটকে যাচ্ছিল। হাঁটতে লাগলেন তিনি, বিদায় নিলেন না। মানিক দেখল এক পৃথিবী সমান কষ্টের বোঝা নিয়ে এক বৃদ্ধ কত স্বচ্ছন্দে হেঁটে যাচ্ছে।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *