নিষাদ – ৬

ঐশানী চ্যাটার্জি থমথমে মুখে বলল, ‘অপূর্ব এমন করবে আমি বুঝতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে, বোঝা উচিত ছিল। সরি বিষাদ, আমার জন্য তোকে এই হ্যারাসমেন্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হল। ভেরি সরি।’

ঐশানী চ্যাটার্জির ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমে বসে আছে নিষাদ। বসে রয়েছে মাথা নামিয়ে। নিচু গলায় বলল, ‘তুমি কী করবে ঐশানীদি? তোমার কী দোষ? অনেকটাই তো করেছিলে, কাজটা প্রায় হয়েও গিয়েছিল‌। আমার তো জয়েন করার কথা।’

ঐশানী দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজের মনেই বলল, ‘ভেবেছিলাম, এরকম একটা জরুরি বিষয়ে অপূর্ব ব্যক্তিগত সম্পর্ক জড়াবে না। পুরনো কথা মাথায় রাখবে না। ভুল ভেবেছিলাম। এতগুলো দিন চলে গেল, তারপরেও বদলায়নি। মানুষ বদলায় না।’

নিষাদ এসব কথার কিছুই বুঝতে পারছে না। কার ব্যক্তিগত সম্পর্ক? কীসের পুরনো কথা? তাকে চাকরি দেয়নি বলে অপূর্ব রায় একেবারে খারাপ হয়ে গেল? তার মনে হল, ঐশানীদি বেশি রিঅ্যাক্ট করে ফেলছে। তাকে তো কেউই চাকরি দেয় না। এত রাগারাগির কী হয়েছে? পরীক্ষা, ইন্টারভিউ তো কম হল না। লাভ হয়েছে কিছু? নিজেরই ভুল হয়েছে, এতটা আশা করা উচিত হয়নি।

পলাশ যেদিন সিগারটে গাঁজা ভরে টান দেয়, কেমন যেন দার্শনিক হয়ে যায়। গুরুগম্ভীর কথা বলে, কতজনকে গালমন্দও করে!‌ নিজেকেও করে।

‘বুঝলি নিষাদ, আমাদের কোনও কিছু নিয়ে আশা করাটাই ভুল। বাজারে কাজকর্ম কিছু নেই, যেটুকু যা আছে তাকে ঘিরে ভিড় আর খামচাখামচি চলছে। তুই, আমি শালা কোন ছার, এলেবেলে ভাবে বিএ, এমএ পাশ করেছি মাত্র, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, ম্যানেজমেন্ট পাশ করা ছেলেমেয়েরা ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেদিন কাগজে দেখলাম, তিনটে চারটে ডিগ্রি নিয়েও ‌পিওনের কাজ পাচ্ছে না। লেখাপড়ার দাম নেই, যাদের কপাল খুলল ভাল, যাদের খুলল না তারা ভোগে। ধরা-করা ছাড়া কিস্যু হবে না। ওরে হারামজাদা, আশার পাছায় লাথ মেরে ধরা-করার চেষ্টা কর।’

নিষাদ অবাক হয়ে বলে, ‘ধরা-করা!‌ ‌কাকে ধরব?’

পলাশ তক্তপোষের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে ঠোঁট ফাঁক করে গলগলিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। ঘন ধোঁয়া। হলুদ বাল্বের আলোয় হস্টেলের মনখারাপ করা ঘর। সেই ঘরে তীব্র গন্ধ থমকে থাকে নিয়তির মতো।

‘তুই এখনও গাধা রয়ে গেলি নিষাদ। বিরাট গাধা, বিগ ডঙ্কি। ‌কাকে ধরবি আবার? যাকে ধরলে একটা চাকরি হবে তাকে ধরবি। ভদ্রলোকের মতো খেয়ে পরে থাকবি, টুসটুসে একটা বউ পাবি, সবাই বলবে গুড বয়।’ আবার সিগারেটে টান দেয় পলাশ। ধোঁয়া ছাড়ে। ফের বলতে থাকে, ‘কমনম্যান হয়ে জন্মেছি, শালা কমনম্যান.‌.‌.‌ এই দুনিয়া কমনম্যান বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। টিপে মেরে দিতে চায়। তখন তোকে এঁটুলি পোকা হয়ে যেতে হবে। মানুষ নয়, জাস্ট একটা এঁটুলি পোকা। যার কোনও মানসম্মানের বালাই নেই, অভিমান কাকে বলে জানে না, কী পড়েছে, কী শিখেছে ভুলে গিয়েছে। যে শুধু একটা জিনিসই বোঝে, বেঁচে থাকতে হবে, যে করে হোক বেঁচে থাকতে হবে। পোকা হয়ে ইনফ্লুয়েনশিয়াল কারও গায়ে ঝুলে পড়তে হবে। সে ঝাড়া দেবে, খোঁচা দেবে। দিক, যত খুশি দিক, খসে পড়া চলবে না ব্রাদার। সেঁটে থাকতে হবে যতক্ষণ না একটা কিছু জুটিয়ে দেয়। বেঁচে থাকতে হবে তো রে কমনম্যান.‌.‌.‌ভদ্রলোক সেজে বেঁচে থাকতে তো হবে।’

নেশায় আচ্ছন্ন এই পলাশকে বেশ লাগে নিষাদের। থিয়েটারের কায়দায় ডায়লগ বলে। মনে হয় নেশাভাঙ যা-ই করুক, ছেলেটার সাহস আছে। ভাবনার সাহস। সেটুকুও তো তার নেই। নিজেরই অবাক লাগে, শাশ্বত সেনগুপ্তর ছেলে হয়ে এমন অকিঞ্চিৎকর সে কেমনভাবে হল? সর্বক্ষণ মনে হয় কোনও অসৎ কাজ‌ করে ফেলছে না তো? কাউকে ঠকিয়ে কাজের সুযোগ খুঁজছে না তো? চাকরির জন্য যে যেখানে যেতে বলেছে, গিয়েছে। যার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়েছে, করেছে। কিন্তু যোগ্যতার বাইরে কিছু চায়নি। বরং গোড়ার দিকে বলেছে, ‘স্যার, আমার একটা কাজের খুব দরকার। তবে কাউকে টপকে নয়।’

যাকে একথা বলেছে, সে অবাক হয়েছে। বলেছে, ‘টপকাতে চাও না তো এসেছ কেন? তুমি কি জান এদেশের কর্মহীনদের লাইন তৈরি হলে তা কত বড় হবে? ধারণা আছে কোনও? লাইনে দাঁড়িয়ে কাজ পেতে কত বছর লাগবে জান?’

নিষাদ মাথা নামিয়ে বলে, ‘জানি না স্যার, তবে কাউকে বঞ্চিত করে কিছু করবেন না।’

‘তুমি এক কাজ করো, অ্যাপ্লিকেশনটা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। তোমাকে যিনি আমার কাছে পাঠিয়েছেন, তার সঙ্গে আমি কথা বলে নেব। আমার কাছে কর্মপ্রার্থীদের লাইন খুব বড়, দেড়শো বছরের আগে তোমার টার্ন আসবে বলে মনে হয় না।’

সবাই নিষাদকে বকাবকি করত। এসব কথা বলার চেয়ে কারও কাছে না যাওয়াই ভাল। ইদানীং কারও কাছে গেলে সে চুপ করে থাকে। তাতেও লাভ কিছু হয় না।‌

‘আমি ক্ষমতাশালী কাউকে চিনি না পলাশ। তুই তো জানিস, আমি মফস্‌সল থেকে আসা ছেলে।’

মুখের উপর ঝুলে থাকা ঘন ধোঁয়া হাত নেড়ে সরিয়ে পলাশ বলে, ‘এসেছ কেন শালা? কে তোমায় কলকাতায় আসার জন্য মাথার দিব্যি দিয়েছিল? ওখানে একটা কিছু জুটিয়ে নিতে পারতিস। কোনও থলথলে ভুঁড়িওয়ালার গদিতে বসে খাতা দেখতিস। চালকল, হিমঘর কি কম আছে ওখানে? কে তোমায় কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে বিদ্যে দিগ্‌গজ হতে বলেছিল?’

নিষাদ মুচকি হেসে বলে, ‘তুইও তো এসেছিস।’

পলাশ ফের সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, ‘এসে ফেল করেছি। কতজন কত কিছু করে নিল, আমি পারলাম না। এটা আমার ফেলিয়োর। আমি নিজের ব্যর্থতা বুঝতে পারি, তুই তো তাও পারিস না। ভাবতে অবাক লাগে তোর বাপ শালা একজন লিডার ছিল। একসময়ে তার হাতে পাওয়ার ছিল। চাইলেই সেই পাওয়ারের কথা বলে আজও একটা কাজ জোটাতে পারিস। আমার তো মনে হয়, গুল দিস। তোর বাপ শালা কিছু ছিল না, কেউ ছিল না। হি ওয়াজ় নোবডি।’

নিষাদ মজা পায়। বলে, ‘তুই ওয়ান্স আপন আ টাইমের কথা বলছিস পলাশ। একদা এক বাঘের গলায় কাঁটা ফুটিয়াছিল। আমার বাবা যখন রাজনীতি করতেন, তখন আমি স্কুলে পড়তাম। আর গুছিয়ে রাখার কথা যদি বলিস, মরে যাওয়ার আগে একটা ইনকমপ্লিট বাড়ি আর গাদাখানেক লোন, ব্যস এটুকুই আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন উনি। ‌ঠিকই বলেছিস, লোকটা কেউ ছিল না। আমার মতোই একজন কমনম্যান ছিল।’

পলাশ প্রসঙ্গ পালটে বলে, ‘আমার দু’-একজন চেনাজানা আছে তারা কেউ নেতা নয়, নেতার আমচা-চামচা। পাতি, ছুটকো বলতে পারিস। তাদের ধরে আমাকে চলতে হয়। এত বছর যে স্টুডেন্ট সেজে হস্টেলে রয়ে গিয়েছি, সে ওই চামচাদের ধরে। ওদের তোর কথা কী বলব? আগে তো নিজেরটা সামলাতে হবে। সামলাতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। আর পাঁচটা হেরে যাওয়া রানারের মতো যে কোনওদিন ট্রাকের উপর মুখ থুবড়ে পড়ব,’ একটু থেমে সিগারেটটা নিষাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নে, টান দে।’

নিষাদ বলেছিল, ‘আমি খাই না।’

‌‌পলাশ বলল, ‘জানি, এবার নেশাভাঙ শুরু কর। অনেক ফ্যাচাং ভুলে থাকবি।’

নিষাদ চুপ করে রইল। নেশা করার সময় এই কথা আগেও বলেছে পলাশ। তবে জোর করে না।

‘বাবা শালা রোজ হুড়কো পাঠাচ্ছে। বলছে, অনেক টাইম নষ্ট হয়েছে, এবার গ্রামে ফিরে মুদি দোকানে বসে পড় বাপু। তোমার পিছনে আর একটা পয়সাও ঢালতে পারব না। যে কোনও দিন ফাইনাল সমন চলে আসবে। তখন ফিরে যেতে হবে। আমি বলেছিলাম, আইটিতে বড় চাকরি করছি, বিশ্বাস না করলে এসে দেখে যাও। এই মিথ্যে বেশিদিন চালানো যাবে না। সেই যে একবার ওরা ডেকেছিল, তারপর থেকে তো নো সাড়া। আফ্রিকা না ভেনেজ়ুয়েলা থেকে নতুন প্রজেক্ট এলে নাকি আবার বলবে। আমি জানি, প্রজেক্ট এলেও ওরা আমাকে আর ডাকবে না। আমার কাজ ভাল হয় না। এই কাজ আমি পারি না। ফিটফাট জামাকাপড় পরা, গলায় কার্ড ঝোলানো দেখে মনে হয়, জগৎটা কত না আহামরি। ওরা রোজ যে কত ছেলেমেয়েকে, ‘ইয়োর সার্ভিসেস আর নো লঙ্গার নিডেড’ বলে ফুটিয়ে দিচ্ছে, তার হিসেব কে রাখে? যাই হোক, আমি আইটি সেক্টরে কাজ করি, এই মিথ্যেটা বাবারও জেনে ফেলতে বেশি দেরি হবে না। মনে মনে ফিরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। এই হস্টেলেই বা কতদিন থাকব? থাকতে দেবে কেন? প্রতিমাসেই নোটিস পাঠায়, ঘর ফাঁকা কর। তা ছাড়া বয়স বাড়ছে, কিছু তো একটা করতে হবে। গাঁয়ে ফিরে মুদি দোকানই ভাল। শুনছি বাবা একটা কোল্ড স্টোরেজ নিয়েছে। সেখানেও বসতে পারি। যাক, চলে যাওয়ার আগে দেখি, যদি তোর জন্য কাউকে ধরে যেতে পারি কিনা। যে তুড়ি মেরে তোকে একটা চাকরি জুটিয়ে দেবে।’

নিষাদ বন্ধুর দিকে মুড়ির ঠোঙা এগিয়ে হেসে বলে, ‘আমার জন্য এত ভাবিস কেন?’

পলাশ তেড়েফুঁড়ে বলে, ‘তুমি একটা গাধা বলে। শুধু তুমি নও, তোমার বাবাও একটা গাধা বলে। সরি, কিন্তু এর চেয়ে ভাল কোনও বিশেষণ খুঁজে পাচ্ছি না। বাপকে গাধা বলছি বলে আমাকে ক্ষমা করিস ভাই। এত বছর অত বড় পার্টিতে লিডারি করেও যে ফ্যামিলিকে গুছিয়ে দিতে পারেনি, তাকে গাধা ছাড়া কী বলব? সেই গাধার ছেলে গাধার জন্য একটু তো ভাবতেই হবে।’

নিষাদ প্রসঙ্গ পালটে বলে, ‘তুই তো আর গাধা নোস। কলেজে পড়ার সময় থেকে কত মেয়ের সঙ্গে মিশেছিস, প্রেমও করেছিস। তারা সব কোথায় গেল?’

মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে পলাশ বলল, ‘অল গন। সব ভেগেছে। কমনম্যানের সঙ্গে কে থাকবে? ‌তবে তুই চিন্তা করিস না, তোর জন্য আমি একটা ব্যবস্থা করে ছাড়ব।’

‌‌এর মধ্যেই একদিন ঐশানীর সঙ্গে দুম করে দেখা হয়ে গেল নিষাদের। তাকে কিছু বলতে হয়নি, অপূর্ব রায়ের সঙ্গে নিজে থেকেই যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে ঐশানীদি। ফোনে ঘটনাটা শোনার পর আজ ফ্ল্যাটে ডেকে পাঠিয়েছে।

ছিমছাম সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট। একটা মেয়ে এসে জল, মিষ্টি দিয়ে গেল। নিষাদ একটুখানি জল খেয়েছে শুধু। আজ কোনও খাবার গলা দিয়ে নামবে না। রেজিস্ট্রি অফিসে রওনা দেওয়ার আগে মেঘপর্ণাকে কম করে কুড়িবার ফোন করেছিল। সুইচড অফ.‌.‌.‌সুইচড অফ শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

পলাশ বলেছিল, ‘তুই খামোকা নার্ভাস হচ্ছিস। ফোন বন্ধ তো কী হয়েছে? এতে কিছু প্রমাণ হয় না। হয়তো ফোনটা গোলমাল করছে।’

নিষাদ বলল, ‘ঠিক আজই গোলমাল করল?’

পলাশ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ফোন কি তোর বিয়ে দেখে চলবে? সে কি ভাববে, না বাবা, আজ নিষাদবাবুর বিয়ে, আজ কিছুতেই গোলমাল করা চলবে না। তুই অকারণ ভাবছিস।‌ এমনও তো হতে পারে, বাড়ির কারও সামনে ফোনটা রয়েছে, তোর ভাবী বউ অন করতে পারছে না। যদি তোর নাম ভেসে ওঠে।’

নিষাদ কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল। মেঘপর্ণা ফোনে তার নাম অন্যভাবে সেভ করেছে। নিষাদের বদলে লিখেছে ব্যাধ। অবাক হয়ে গিয়েছিল নিষাদ।

‘ব্যাধ কেন? নিষাদ নামটা কি তোমার পছন্দ নয়?’

মেঘপর্ণা হেসে বলেছিল, ‘বাহ্, নিষাদ মানে তো ব্যাধ। শিকার করে।’

নিষাদ বলেছিল, ‘যাহ্ বাবা, আমি আবার কী শিকার করলাম!‌’

মেঘপর্ণা বলেছিল, ‘কেন, আমাকে!’

নিষাদ কুণ্ঠিত হয়ে বলেছিল, ‘এটা ভাল কথা নয়।’

মেঘপর্ণা বলেছিল, ‘আমি বলিনি, এটা উষ্ণির কথা। ও খুব অসভ্য কথা বলে। শুনলে তোমার মতো গুড বয় অক্কা পাবে।’

নিষাদ বলল, ‘আসলে কী জান মেঘপর্ণা, আমার মনে হয়, একজন ব্যাধ, শিকারি হিসেবে যত না বড়, তার চেয়েও অনেক বড় লক্ষ্যভেদে। শিকার একটা নিমিত্তমাত্র। জীবনের লক্ষ্য স্থির করে তাকে জয় করাটাই আসল।’

মেঘপর্ণা মুগ্ধ হওয়া গলায় বলেছিল, ‘কী সুন্দর বললে!‌ এই জন্যই তো তোমাকে এত ভালবাসি। তুমি সবার চেয়ে একদম আলাদা।’

নিষাদ বলল, ‘শুধু ব্যাধ নয়, আমার নামের কিন্তু আরও একটা মানে র‌য়েছে। সরগমের সপ্তম স্বরকে বলে নিষাদ।’

মেঘপর্ণার চোখ বড় হয়ে যায়। বলল, ‘তাই নাকি? ইস্‌ আমি তো কিছুই জানতাম না। তুমি কত কিছু জান নিষাদ!‌’

‌নিষাদ মলিন হেসে বলে, ‘জানি বলেই তো এই হাল। টিউশন আর ছাপাখানা ছাড়া কাজ জুটল না‌। তাও ঠিকমতো কাজ নয়। যখন অর্ডার আসে তখন ডাক পাই। তবে বলাইবাবুর ওখানে কাজ করে একটা মস্ত লাভ হয়েছে।’

মেঘপর্ণা অবাক হয়ে বলে, ‘ওইটুকু একটা অন্ধকার প্রেসে কাজ করে তোমার লাভ হয়েছে!‌ টাকাপয়সাও তো কম পাও। ওখানে তোমার লাভ কী হল!‌’

নিষাদ মেঘপর্ণার সঙ্গে বেশি দেখা তো করতে পারেই না, ইচ্ছেমতো পথে ঘুরতেও পারে না। মেঘপর্ণার ভয়, যদি কেউ দেখে ফেলে। নিষাদেরও অস্বস্তি হয়। মাঝেমধ্যে সুরুলপুরের কারও না কারও সঙ্গে তার দেখা হবেই। এই তো গত সপ্তাহে বিডন স্ট্রিটের মোড়ে বিশুকাকার সঙ্গে দেখা হল। ট্রাম থেকে নামছিলেন। বাবার সঙ্গে রাজনীতি করতেন।

কলকাতা বদলে গিয়েছে। চারপাশে কত ছেলেমেয়ে ঝলমলে আলোয় প্রেম করে। তারা পরস্পরের হাত ধরে, কোমর ধরে, কাঁধে হাত রাখে। পার্কে, সিনেমা হলে, কফিশপে, শপিং মলে একে অপরকে আদর করে। কাউকে তোয়াক্কা করে না। নিষাদ এসব ভাবতেও পারে না। মেঘপর্ণাকে নিয়ে পরিচিত কারও সামনে পড়তে চায় না নিষাদ। সে আড়াল চায়। মেঘপর্ণার মতো সেও ভীত হয়ে থাকে। কেউ দেখে যদি ভাবে, অভাবের বাড়িঘর, কষ্টে চলা মা-বোনকে ফেলে এই ছেলে কলকাতায় ফুর্তি করতে এসেছে!‌ মেঘপর্ণার সঙ্গে যে কদাচিৎ দেখা হয়, কোথাও একটা ঢুকে যেতে চেষ্টা করে নিষাদ। ছাতুবাবুর বাজারের কাছে একটা রেস্টুরেন্ট র‌য়েছে। পুরনোদিনের চেয়ার টেবিল। সেখানে চা খায়।

সেখানেই মেঘপর্ণার হাতের উপর হাত রেখে বলল, ‘বাহ্‌, আমি ওই প্রেসে কাজ করি বলেই তো তোমার সঙ্গে দেখা হল।’

মেঘপর্ণা হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, ‘তুমি কোনও কম্পিউটার কোর্সে ভর্তি হয়ে যাও নিষাদ। কতরকম কোর্স রয়েছে। কম্পিউটার শিখলে তো শুনেছি কাজ পাওয়া যায়।’

‌নিষাদ বড় করে শ্বাস ছেড়ে বলে, ‘‘ভুল শুনেছ। কম্পিউটার শিখলে যদি কাজ জুটত, তাহলে চারপাশে আর বেকার ছেলেমেয়ে দেখতে পেতে না। কতজনই তো কম্পিউটার জানে। কাজ পাচ্ছে ক’জন? তবে আজকাল প্রায়ই মনে হয়, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে ভুল করেছি। ইলেকট্রিক, কাঠের কাজ বা জলের কল মেরামতি শিখলে ভাল হত। কাজ পেতাম। চাকরি না হোক, নিজে তো দোকান খুলে বসতাম। ওসব দিকে আমার উৎসাহ ছিল না। মিডিওকার হওয়ার অনেক সমস্যা। আমার বাবা একজন মোটের উপর লেখাপড়া জানা মানুষ ছিলেন। সরকারি চাকরি করে মধ্যবিত্ত ভদ্র জীবনযাপন করতেন। এই মধ্যবিত্ত ভদ্র জীবনযাপনের দিন ফুরিয়ে এসেছে। ভিড়ের গুঁতোগুঁতির জন্য হয় তুমি ওই জীবনে ঢুকতে পারবে না, নয় ওই জীবন তোমাকে ঢুকতে দেবে না।’

মেঘপর্ণা পরিস্থিতি সহজ করার জন্য হেসে বলেছিল, ‘আমার ব্যাধবাবু, এত ভেঙে‌ পড়লে হবে কেন? তুমি নিশ্চয়ই কোনও ভাল চাকরি পাবে। লোককে বলার মতো চাকরি। তবে যাই হোক, আমার মোবাইলে তোমার নাম ব্যাধ বলেই সেভ করা থাকবে।’

সুতরাং ফোনে নাম দেখে মেঘপর্ণার বাড়িতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম।

পলাশ নিষাদের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘এই সময়ে মেয়েদের আশঙ্কা কম? অতিরিক্ত সেনসিটিভ হওয়াটাই স্বাভাবিক। অকারণে ভয়, টেনশন। বিয়ে বলে কথা। তার উপর পালিয়ে বিয়ে। নিশ্চয়ই সেই কারণে ফোন বন্ধ করে, লুকিয়ে রেখেছে। আবার এমনও হতে পারে, মাথা পাগল অবস্থায় ফোনটাই হারিয়ে বসেছে। আর তোর ওই মেঘ না জল তো আসলে একটা বাচ্চা মেয়ে। তোর মুখে শুনে তো আমার সেরকমই মনে হয়েছে। এই মেয়ে বিয়ের দিন ঘাবড়ে যাবে না তো কী হবে? চিন্তা না করে চল, ঠিক এসে যাবে।’

দুশ্চিন্তা নিয়েই রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়েছিল নিষাদ। পলাশ তো ছিলই, সাক্ষী দেওয়ার জন্য তার দুই বন্ধুও গিয়েছিল কথামতো। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও প্রায় আধঘণ্টা থাকে। রেজিস্ট্রি অফিসের উলটো দিকের ফুটপাতে বসে চা খায়। একসময়ে তাদের চলে যেতে বলে পলাশ। যেতে হয় তাকেও। ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার, তবে উপায়ও ছিল না। হাওড়ায় একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা পাওয়ার কথা। বেশি নয়, হাজার তিনেক, পলাশের কাছে তাই অনেক। ছ’মাস ধরে ঘোরাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আজ সন্ধেবেলা সময় দিয়েছে। না গেলে হয়তো আরও ছ’মাস ঘোরাবে। তাই অনিচ্ছে নিয়েও নিষাদকে ছেড়ে যেতে হয়। যাওয়ার সময় বলে, ‘নিশ্চয়ই কোনও সমস্যা হয়েছে। তুই একবার ওর বাড়িতে যা।’

নিষাদ শুকনো হাসে। কোন মুখে সে মেঘপর্ণার বাড়িতে যাবে? তাও চাকরিটা হলে একটা কথা ছিল। ওখানে গিয়ে কী বলবে ওর বাবা-মাকে?

‘আমার নাম নিষাদ। বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় এসে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। তারপরেও কোনও কাজকর্ম পাইনি। যেটুকু উপার্জন করি, তাতে মেসের ঘরে খাট ভাগ করে শুতে হয়। দিনেরবেলায় ঘরে ঢোকার নিয়ম নেই। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছি। তাকে ডাকুন।’

একথা বলা যায়? যায় কিনা জানে না নিষাদ, তবে সেই মনের জোর তার নেই। পলাশ হয়তো পারত। সে তো পলাশ নয়। সে একটা ভিতু, ক্ষমতাহীন, মিথ্যে মানসম্মানের কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকা সাধারণ মধ্যবিত্ত যুবক। যে ভেবেছিল, নিজের যোগ্যতামতো লেখাপড়া শিখে, নিজেকে সৎ রেখে, কারও কাছে মাথা না নামিয়ে মোটামুটি সুখে থাকবে, নিজের ও বাড়ির দায়িত্ব পালন করবে। পারেনি, কিছুই পারেনি। সে কোন মুখে মেঘপর্ণার বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়বে!

পলাশ চলে যাওয়ার একটু পরেই নিষাদের সস্তার মোবাইলে টুং আওয়াজে মেসেজ এল। ফোন তুলে দেখল নিষাদ। মেঘপর্ণার মেসেজ। সংক্ষেপে লিখেছে সে।

‘এই বিয়ে সম্ভব নয়। আমাকে ভুল বুঝো না। নিষাদ, আমি তোমাকে ভালবাসি।’

মেসেজ পড়া শেষ করে দ্রুত হাতে মেঘপর্ণার নম্বর টিপল নিষাদ। ফোন আবার বন্ধ। নিষাদ আর চেষ্টা করল না। আরও খানিকক্ষণ বসে রইল চায়ের দোকানের বেঞ্চে। আবার চা নিল, তবে খেল না। হাতে ধরা গ্লাস ঠান্ডা হয়ে গেল। দিনের আলো মরে যাচ্ছে। কলকাতা শহর একটু একটু করে আলো জ্বালাচ্ছে। পথে, ঘরবাড়িতে, দোকানের শো-রুমে। সারাদিনের পর সে যেন যুবতীর মতো। রংচং মেখে সেজে উঠছে। গালে পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক, কপালে টিপ দিচ্ছে।

শিয়ালদার মোড়ে মানুষের ঘরে ফেরার তাড়া। বাস, গাড়ি, অটোর পিছনে দৌড়। হট্টগোল, ঠেলাঠেলি। সবাই সবাইকে ফেলে ছুটতে চাইছে উন্মাদের মতো। যেন বলতে চাইছে, ‘তুমি নও আমি.‌.‌.‌আমি, শুধু আমি।’ সেই তাড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে নিষাদ বুঝতে পারল, তার কোনও তাড়া নেই। রাস্তার পাশে সরে সিন্ধুরাকে ফোন করল।

‘দাদা, চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নিষাদ বলল, ‘জানি, ঠিক হয়ে যাবে।’

সিন্ধুরা নরম গলায় বলল, ‘তুই সুরুলপুরে চলে আয়। ক’দিন থেকে যা।’

নিষাদ বলল, ‘যাব। টিউশনের ছেলেমেয়েগুলোর সামনে পরীক্ষা, প্রেসেও কিছু কাজ এসেছে। সামলে নিয়ে যাব। এ শহর আমার নয়। এখানে আমাকে মানাচ্ছে না।’

সিন্ধুরা একটু চুপ করে বলল, ‘ওরকম করে বলিস না দাদা, আমার মনখারাপ লাগছে। কোনও শহরই কারও নয়। মেনে নিতে হয়।’

‌নিষাদ বলল, ‘চেষ্টা করলাম তো, পারলাম কই? যাক, চিন্তা করিস না, আবার পরে ফোন করব সিন্ধু। বড্ড গাড়ির আওয়াজ, কথা শুনতে অসুবিধে হচ্ছে। এখন রাখছি, মাকে কিছু বলিস না যেন।’

সিন্ধুরার ফোন কাটতেই ঐশানীর ফোন ঢুকল।

‘কী রে বিষাদ, খবর দিলি না তো কোনও? তোর ওদিকে কী অবস্থা। অপূর্ব রায় কিছু বলল?’

নিষাদ অতি সংক্ষেপে ঘটনা বলল। ঐশানী একটু থমকে থেকে বলল, ‘কই কিছু বলিসনি তো আমাকে?’

নিষাদ বলল, ‘ভদ্রলোক বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, একেবারে জয়েন করে তোমাকে যেন বলি, সারপ্রাইজ়। তোমাকে ফোন করতে হবে অফিসের টেবিল থেকে।’

ঐশানী আবার একটু চুপ করে রইল। বলল, ‘তুই কোথায় আছিস এখন?’

‘শিয়ালদা।’

‘এখনই আমার ফ্ল্যাটে চলে আয়। উইদিন হাফ অ্যান আওয়ার বাড়ি পৌঁছে যাব। গাড়িতে রয়েছি।’

নিষাদ বলল, ‘বাদ দাও ঐশানীদি। কী লাভ? উনি নেবেন বলেছিলেন, তারপরে হয়তো কোনও কারণে পারেননি।’

ঐশানী চাপা গলায় বলল, ‘কথা বাড়াস না, আমার সামনে বসে সবটা শোনা দরকার। একটা ক্যাব নে। মোবাইল থেকে ক্যাব ডাকতে পারবি?’

‌নিষাদ কুণ্ঠিত গলায় বলল, ‘আমার মোবাইল ফোনটা সাধারণ, অতসব হয় না। আমি বাসেই আসছি।’

‌ঐশানী বলে, ‘ঠিক আছে, একটা ট্যাক্সি ধরে চলে আয়। ভাড়া আমি দেব।’

সেই ফোন ছেড়ে মেঘপর্ণাকে আবার ফোন করতে যায় নিষাদ। নম্বর টেপার আগে নিজেই নিজেকে থামিয়ে দেয়। আর নয়। মেঘপর্ণার সিদ্ধান্তই ঠিক। ভয়ংকর ভুল করতে চলেছিল। সারাজীবন ধরে পস্তাতে হত মেয়েটাকে। অবশ্যই তাকেও। প্রতি পদে অপরাধবোধে ভুগতে হত। সে বড় গ্লানির জীবন হত। একটা সুখী মেয়েকে যাবতীয় সুখ থেকে টেনে নামিয়ে দেওয়ার গ্লানি। তারই তো মেঘপর্ণাকে বোঝানো উচিত ছিল। সরে আসা উচিত ছিল তার নিজেরই। জীবনটা গল্প উপন্যাস নয়। সুরুলপুর থেকে সে কলকাতায় গল্প উপন্যাস তৈরি করতে আসেনি। নিষাদের লজ্জা করতে লাগল। রাগ হতে লাগল নিজের উপর। একবার ভাবল ঐশানীর বাড়িতে যাবে না। কী হবে গিয়ে? যা হওয়ার তাই হয়েছে। পরক্ষণেই মনে হল, ঐশানীদি তার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। না যাওয়ার মানে তাকে অপমান করা। সেই তো আগ বাড়িয়ে অপূর্ব রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়েছে। কোনও দরকার ছিল না। কবেকার সেই কলেজের পরিচিত এক বোকাসোকা ছেলেকে কে মনে রাখে? মুখোমুখি না হলে হয়তো এড়িয়ে যেত। আর পাঁচজন পরিচিতের সঙ্গে যেমন আচরণ করে। ঐশানীদিকে দেখেও না হয়, ফুটপাত বদলে আড়ালে চলে যেত। তাহলে কোনও সমস্যা হত না। কিন্তু তা যখন হয়নি, দেখা যখন হয়েছে, তাকে তাচ্ছিল্য করার অধিকার তার নেই। এই নির্মম, কঠিন শহরে ঐশানীদির মতো মানুষও তো রয়েছে।

ঐশানীকে গোটা ঘটনাই বলে নিষাদ। কীভাবে চাকরিতে জয়েন করার জন্য ডেকেও অপূর্ব রায়ের অফিস থেকে তাকে একরকম বার করে দেওয়া হয়, কীভাবে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তার সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি… সবই।

‘ঐশানীদি, তোমাকে ধন্যবাদ। অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলে। এতটা কে করে? আমার তো কোনও চেনাজানা নেই। কোনওদিনই কেউ আমার জন্য বলেনি।’

ঐশানী গম্ভীর মুখে বলল, ‘ধন্যবাদ কেন দিচ্ছিস? কাজটা তো হল না।‌’

নিষাদ শুকনো হেসে বলল, ‘‌ও ঠিক আছে। আমার এমনই হয়। কত জায়গা থেকে চলে আসতে হয়েছে গুনে বলতে পারব না। এমনও তো হতে পারে, ভদ্রলোকের পরে মনে হয়েছে, আমাকে নিলে তার চলবে না। যদিও আমার সিভি টিভি কিছুই দেখেননি, ইন্টারভিউও হয়নি তেমন।‌’

ঐশানী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘কাজ না হওয়াটা বড় কথা নয় নিষাদ, বড় কথা এই হ্যারাসমেন্ট।’

‌‌নিষাদ মুখ তুলে বলল, ‘অপূর্ব রায় কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছিলেন। তোমার জন্যই দিয়েছিলেন।’

ঐশানী চাপা গলায় বলল, ‘আবার আমার জন্যই দিল না।’

নিষাদ অবাক হয়ে বলল, ‘তোমার জন্য দিল না!‌ কী বলছ আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ঐশানীদি।’

ঐশানী উঠে পড়ে বলল, ‘তোকে বুঝতে হবে না। যা বোঝার আমি বুঝে নেব। তোর জন্য আমি আবার চেষ্টা করব বিষাদ। আমি যে কোম্পানিতে কাজ করি, সেটা খুবই স্পেশালাইজ়ড। সেখানে কিছু করতে পারব না, তবে অন্য কোথাও হয়তো পারব। কিছু মনে করিস না। অপূর্বর এই ঘটনা শুধু তোর নয়, আমার জন্য অপমানের। আরও জেদ বাড়িয়ে দিল।’

নিষাদ উঠে দাঁড়িয়ে সংকুচিত ভাবে বলল, ‘আর কিছু করতে হবে না ঐশানীদি। ‌প্লিজ় আমার কথা শোন। আমার জন্য চেষ্টা করলে আবার তোমাকে অপমানিত হতে হবে। আমি নিজেই ঠিক কিছু একটা করে নিতে পারব।’

ঐশানী নিষাদকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে তার হাত ধরে। নিচু গলায় বলে, ‘অপূর্ব রায়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল নিষাদ। আমি সেই বিয়ে ভেঙে দিই। তিন বছর পর আবার নম্বর খুঁজে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। শুধু তোর জন্যই করেছিলাম। এতদিন পরে হঠাৎ তোকে দেখে মনে হয়েছিল, তুই ভাল নেই। মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি যাকে মজা করে বিষাদ বলি, সে কেন সত্যি বিষাদে থাকবে?’ একটু থামে ঐশানী। নিচু গলায় ফের বলে, ‘নিষাদ, আমি তোকে পছন্দ করি। সেই কলেজের সময় থেকেই তোর ভালমানুষি, তোর ইনোসেন্স, তোর একা থাকা আমাকে অ্যাট্রাক্ট করেছে। ভীষণভাবে করেছে। তোকে সামনে থেকে যেমন দেখতাম, আড়াল থেকেও দেখতাম। তুই কলেজে না এলে, তোর সঙ্গে একটাও কথা না হলে মনখারাপ হয়ে যেত। বলিনি কাউকে, সব পছন্দ মুখে বলতে নেই। বয়সে তোর চেয়ে বড় বলে বলিনি, এমন নয়। তোকে বিব্রত করব না বলেই বলিনি। একেই ভিতুরাম, গাঁ থেকে আসা ক্যাবলা একটা, তার উপর যদি শুনতিস, আমার মতো সুন্দরী, স্মার্ট একজন মেয়ের তোর ওপর ক্রাশ হয়েছে, তাহলে বোধহয় হেদুয়ার জলে ঝাঁপ দিতিস। ভেবেছিলাম, ভুলে যাব। হয়তো গিয়েওছিলাম। সেদিন তোকে দেখে পুরনো মনকেমন আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। আজ বলে ফেললাম।’

নিষাদের শরীর কেঁপে উঠল। আজকের দিনটা কী অদ্ভুত!‌ সে কিছু ভাবতে পারছে না। নিষাদ হাত সরিয়ে নিল।

ঐশানী সামান্য হেসে বলল, ‘আমি তোর সঙ্গে আছি রে বিষাদ, যেমন ছিলাম এতদিন।’

ঐশানীর ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে বেরিয়ে নিষাদের মনকেমন করে উঠল।‌ সে বুঝতে পারল না, কার জন্য মনখারাপ হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *