নিশাচর

ওসিআর ভার্সন, প্রুফ সংশোধন করা হয়নি

নিশাচর 

প্রথম প্রকাশ : জুন, ১৯৯২ 

ধড়াম করে ফাটলো ট্রাকের টায়ার। চেঁচিয়ে উঠলো মুসা, ট্রাকের ধার খামচে ধরলো। রবিন ধরলো আরেকটা ধার। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলো বোরিস, ছাড়লো, পরক্ষণেই আবার চাপলো। পিছলে চলে গেল গাড়িটা কয়েক ফুট, থামলো, আবার পিছলালো। নাক ঘুরে গেছে আরেক দিকে, মাতালের মতো টলে উঠলো, তারপর গিয়ে কাত হয়ে পড়লো রাস্তার পাশের একটা খাদে, শুধু সামনের অংশটা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল, বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন । 

…. .. —- 

—-++– — -.. 

মুসার মতো চিৎকার করলো না কিশোর পাশা। তবে মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, কাঁপছে সে। বোরিসের পাশে বসেছে। মুসা আর রবিন রয়েছে ট্রাকের পেছনে, খোলা অংশে । 

দরজা খুলে নামলো রোরিস। তখনও ধার খামচে ধরে রয়েছে দুই সহকারী গোয়েন্দা। ওদেরকে জিজ্ঞেস করলো ইয়ার্ডের কর্মচারী বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান, ‘হো-কে?’ 

ধার ছেড়ে দিয়ে সোজা হলো রবিন আর মুসা। মাথা নেড়ে বোঝালো, ভালোই আছে। 

এক এক করে নেমে এলো তিন গোয়েন্দা। ট্রাকের কতোটা ক্ষতি হয়েছে দেখার জন্যে । 

না!’ 

‘দূর,’ বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লো বোরিস। ‘টায়ার ফাটার আর জায়গা পেলো 

‘তোলা যাবে?’ জিজ্ঞেস করলো কিশোর । 

সন্দেহ ফুটলো বোরিসের চোখে। আবার গিয়ে উঠলো ড্রাইভিং সীটে। এঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে গীয়ার দিলো। গর্জন করছে এঞ্জিন। কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকালো সে । নাহ্, বৃথা চেষ্টা। বনবন করে ঘুরছে পেছনের চাকা, কিন্তু ঠিকমতো কামড় বসাতে পারছে না মাটিতে, শুধু ধুলো ছিটাচ্ছে। 

এঞ্জিন বন্ধ করে দিয়ে আবার নেমে এলো বোরিস। আটকে গেছি। কিশোর, মিস্টার পাশাকে খবর দেয়া দরকার। আরেকটা ট্রাক নিয়ে এলে টেনে তোলা যাবে।’ 

ডাকবেন কোত্থেকে?’ মুসার প্রশ্ন। 

প্রায় নির্জন অঞ্চলে আটকা পড়েছে। চারদিক চোখ বোলাতে লাগলো ওরা। মিনিট বিশেক আগে রকি বীচ ছেড়েছিলো, সান্তা মনিকা পর্বতের একটা কেবিনে যাওয়ার জন্যে। ওটার মালিক ইনডিয়ানায় নিজের দেশের বাড়িতে ফিরে যাবে। 

৮০ 

ভলিউম-১৬ 

তাই সমস্ত মালপত্র বিক্রি করে দিচ্ছে 

‘আমার বিশ্বাস ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যাবে,’ লোকটার সঙ্গে কথা বলে ফোন নামিয়ে রেখে বলেছিলেন রাশেদ পাশা। ‘কিশোর, বোরিস কিংবা রোভারকে নিয়ে চলে যা। দেখ গিয়ে, কি বিক্রি করে। বিছানাগুলো সত্যি সত্যি পিতলের হলে সব ক’টা কিনে ফেলবি। আরও যেসব জিনিস মনে হবে কেনা দরকার, নিয়ে নিবি।’ 

‘বুঝেশুনে, নিস,’ হুঁশিয়ার করেছেন মেরিচাচী। রাশেদ চাচা মাল কিনতে চাইলেই সতর্ক হয়ে যান তিনি। তাঁর ধারণা, যতো সব আজেবাজে মাল নিয়ে আসা হবে, যেগুলোর বেশির ভাগই বিক্রি হবে না। তাঁর ধারণা সব সময়ই ভুল হয়, কারণ, যা-ই কিনে আনেন রাশেদ পাশা, সব বিক্রি হয়ে যায়। তবে সেজন্যে কৃতিত্বটা অনেকখানিই কিশোরের প্রাপ্য। পুরনো বাতিল জিনিস মেরামত করে বিক্রির যোগ্য করতে সে ওস্তাদ। 

হাতে কাজ ছিলো না। মাল কিনতে যাওয়ার কথা শুনে খুশিই হয়েছিল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছে দুই বন্ধুকে । তারপর ওদেরকে আর বোরিসকে নিয়ে ট্রাকে করে মাল কিনতে বেরিয়ে পড়েছে। 

কোস্ট হাইওয়ে ধরে উত্তরে এসেছে প্রথমে বোরিস। অনেকখানি এসে মোড় নিয়ে উঠেছে চওড়া একটা পাহাড়ী রাস্তায়, পথটার নাম চ্যাপারাল ক্যানিয়ন রোড। ওই পথ ধরে পাহাড় পেরিয়ে অন্য পাশে এসে নেমেছে স্যান ফারনানদো ভ্যালিতে। চ্যাপারাল ক্যানিয়ন দিয়ে মাইল চারেক এগোনোর পর পাশের আরেকটা সরু কাঁচা রাস্তায় নামতে হয়েছে। ওটার নাম রক রিম ড্রাইভ। ওই পথ ধরে মাত্র কয়েক শো গজ এগোনোর পরেই এই অঘটন । 

মাল কেনা বোধহয় আজ আর হলো না,’ জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো কিশোর। ‘এখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি না ফিরতে হলেই বাঁচি। 

আশপাশের ঢালে ঘন হয়ে জন্মেছে ঝোপঝাড়, বিষণ্ণ দৃষ্টিতে সেগুলো দেখলো সে। বাঁয়ের পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো মলিন একটা বাড়ি । বোঝাই যায় লোকজন থাকে না। নিচতলার জানালাগুলোয় শার্সির জায়গায় তক্তা লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওপরতলায় পাল্লা আছে ঠিকই, তবে শুধু ফ্রেমগুলো, বেশির ভাগ কাঁচই গায়েব। 

“এ-বাড়িতে ফোন নেই,’ মুসা বললো । 

‘এই!’ হাত তুলে বাড়িটার পেছনে দেখালো রবিন। প্রায় চূড়ার কাছাকাছি অনেকগুলো ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে লাল টালির ছাত। ‘আরেকটা বাড়ি। বড়ই তো লাগছে। মুখ নিশ্চয় চ্যাপারাল ক্যানিয়নের দিকে।’ 

‘এতোদূর বোধহয় যেতে হবে না,’ কিশোর বললো। ‘ওই যে, পুরনো গোলাবাড়িটা, দেখছো? টেলিফোনের তার দেখতে পাচ্ছি। মনে হয় লোক থাকে । শর্টকাটেই যাওয়া যাবে। ওই খেতের ভেতর দিয়ে…’ 

থেমে গেল সে। বিস্ময় ফুটেছে চেহারায়। 

কি হলো?’ রবিন জিজ্ঞেস করলো 

শস্য খেত!’ কিশোর বললো। পথের প্রায় কিনার ঘেঁষে যাওয়া বেড়ার গায়ে 

৬-নিশাচর 

৷ হেলান দিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ‘সান্তা মনিকা পর্বতের মধ্যিখানে ফসলের খেত 

কল্পনাই করিনি কোনোদিন। থাকতে পারে, একথাও শুনিনি।’ 

আগস্টের এই প্রচণ্ড রোদেও ঘন সবুজ রয়েছে ছোট্ট খেতের গাছগুলো । শিষ বেরোনোর সময় হয়েছে। গাছের গোড়ার মাটি কালো, ভেজা। প্রচুর পরিশ্রম করে চাষ করা হয়েছে, যত্নও নেয়া হচ্ছে খুব। পথের কিনার থেকে শুরু হয়েছে ঢাল, সেই ঢালেই ফসলের খেত, ওপরের প্রান্তের বেড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটা কাকতাড়ুয়া পুতুল। চটের তৈরি মুখে কালো কালি দিয়ে আঁকা চোখে যেন সদা- সতর্ক দৃষ্টি, ওদের দিকেই মুখ করে আছে। 

আনমনে মাথা নাড়লো কিশোর। ‘এখানে খামার করলো! আজব ব্যাপার! ‘করেছে বলেই বেঁচেছি। ফোন তো পাওয়া গেল,’ রবিন বললো। ‘এসো, যাই ৷ 

“না না, সবার যাওয়ার দরকার নেই। খেত মাড়িয়ে গেলে, আর মালিকের চোখে পড়লে রাগারাগি শুরু করবে।’ 

বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে পড়লো মুসা। ‘তাহলে তুমি একাই যাও,’ কপালের ঘাম মুছলো সে। 

‘তা-ই যাচ্ছি,’ বলে, বেড়া ডিঙালো কিশোর। ফসলের গাছগুলো তার প্রায় মাথা সমান উঁচু । সাবধানে এগোলো ভেতর দিয়ে। পাতায় ঘষা লেগে খসখস শব্দ হচ্ছে। ঢাল বেয়ে ওঠার পরিশ্রমে ভারি হয়ে এলো নিঃশ্বাস। ক্রমেই খাড়া হয়ে আসছে ঢাল, উঠতে গিয়ে বাঁকা হয়ে গেছে তার শরীর। 

আবার তাকালো ওপরের বেড়ার দিকে। একভাবে রয়েছে পুতুলটা। এখন অনেক কাছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মুখটা। তার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে, শয়তানী হাসি । 

‘আর মাত্র কয়েক গজ,’ ভাবলো কিশোর। তারপরেই খোলা জায়গা । 

শরীর আরেকটু সোজা করে মাথা তুলেছে সে, হঠাৎ বড়, কালো কিছু একটা ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়লো তার গায়ের ওপর। 

শয়তান!” চিৎকার করে উঠলো একটা রাগী, পাতলা কণ্ঠ। ‘আজ মুণ্ডু ছিঁড়ে নেবো!’ 

ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে পড়ে গেল কিশোর। পড়ার আগে চোখে পড়লো শুধু একজোড়া চোখ, ভীষণ রাগে বন্য হয়ে উঠেছে। 

সবুজ ডাঁটা আর পাতার ফাঁক দিয়ে নীল আকাশ দেখলো কিশোর। মুহূর্ত পরেই ঢেকে গেল আকাশটা। গায়ের ওপর ঝুঁকে এসেছে মানুষটা, কালো পোশাক পরা একটা কালো ছায়ার মতো, গলা টিপে ধরলো তার। আরেকটা হাত উঠে গেছে ওপর দিকে, বাড়ি মারার ভঙ্গিতে। সে হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে একটা বড় পাথর । 

দুই 

গলায় চাপ, ঠিক মতো আওয়াজ বের করতে পারলো না, ফ্যাসফ্যাস করে 

ভলিউম-১৬ 

কোনোমতে বললো কিশোর, ‘শুনুন, আমি… 

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই গলার ওপর থেকে হাতের চাপ সরে গেল । আরি, এ-তো একটা ছেলে!’ 

ফসলের খেত মাড়িয়ে ছুটে আসার শব্দ শোনা গেল। নরম মাটিতে দুপদাপ করে ভারি জুতোর আওয়াজ হলো। খানিক পরেই আকাশের পটভূমিতে বিশাল আরেকটা দেই চোখে পড়লো কিশোরের, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। 

‘এই, ছাড়ন, ছাড়ুন!’ গর্জে উঠলো বোরিস। লোকটার সরে আসার অপেক্ষা না করেই পেছন থেকে তার শার্ট খামচে ধরে শূন্যে তুলে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো একপাশে । ‘খবরদার, ঘাড় মটকে দেবো ধরে!’ 

আস্তে উঠে দাঁড়ালো কিশোর। ‘দেখলো, বোরিসের দিকে তাকিয়ে চোখ মিটমিট করছে লোকটা। কুঁচকে গেছে চোখের চারপাশের চামড়া, পাওয়ারে গোলমাল আছে বোঝা যায় । হাতড়ে হাতড়ে মাটিতে কি যেন খুঁজছে । 

। 

‘আ-আমার চশমা!’ কণ্ঠে অস্বস্তি। ‘কোথায় যেন পড়লো ! 

মুসা আর ররিনও চলে এসেছে তাড়াহুড়ো করে। মোচড়ানো, ভাঙা একটা ডাটায় ঝুলে থাকা চশমাটা রবিনই দেখতে পেলো সবার আগে। ভারি পাওয়ারের কাঁচ। ফ্রেমটাও মোটা, বৈমানিকেরা যেরকম পরে, অনেকটা সেরকম। তুলে দিলো ওটা লোকটার হাতে। ডেনিম শার্টের ঝুলে কাঁচ মুছে চশমাটা পরলো লোকটা। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে নীল জিনসের প্যান্টে লাগা ধুলো ঝাড়তে শুরু করলো । 

‘ঘটনাটা কি?’ কড়া গলায় জানতে চাইলো বোরিস । পাগল নাকি?’ 

দুঃখিত । সত্যিই খুব দুঃখিত,’ লজ্জিত কণ্ঠে বললো লোকটা। ‘ছেলেটাকে কাকতাড়ুয়া ভেবেছিলাম…’ 

থেমে গেল সে। ফিরে তাকালো বেড়ার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা পুতুলটার দিকে। একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে এদিকে, মুখে কুৎসিত হাসি । 

‘এখানে…ইয়ে…মানে…খুব জ্বালায় – ফসলের গাছ মাড়িয়ে দিয়ে যায় ৷ গোলমাল করে…আসলে, খেতের ভেতর দিয়ে আসছে দেখে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।’ 

আবার থামলো লোকটা। রোদে চকচক করছে মস্ত টাক। ভারি কাঁচের ওপাশে কেমন ফ্যাকাসে লাগছে চোখের মণি। কিশোর দেখলো, মানুষটা ছোটখাটো, লম্বায় তার চেয়ে বেশি হবে না। পাতলা শরীর, তবে রোগাটে নয়। পেশি আর রোদে পোড়া চামড়া দেখেই অনুমান করা যায়, বেশির ভাগ সময়ই বাইরে বাইরে কাটায় লোকটা, আর বেশ পরিশ্রমের কাজ করে। বয়েস তিরিশ মতো । 

‘পাথরটা নিয়েছিলাম বটে, কৈফিয়ত দেয়ার সুরে বললো লোকটা। তবে বাড়ি মারতাম না। আমি আসলে দেখতে এসেছিলাম, খেতে কে ঢুকলো।’ 

‘আমাকে কাকতাড়ুয়া ভেবেছেন।’ 

‘না না, কি যে বলো! তা কেন ভাববো? ভুল বুঝেছো তুমি! এখন দয়া করে বলে ফেলো তো, আমার খেতে ঢুকেছো কেন?’ 

দ্রুত সামলে নিয়েছে লোকটা, ব্যাপারটা অবাক করলো কিশোরকে। মাথা 

নিশাচর 

৮৩ 

ঝাঁকালো একবার। তারপর বলতে শুরু করলো, ‘আমাদের ট্রাকের চাকা ফেটে গেছে। গর্তে পড়েছে ওটা। ওই গোলাবাড়িতে টেলিফোনের তার দেখে ভাবলাম, ফোন করে দিই চাচাকে, আরেকটা ট্রাক নিয়ে আসতে। খেতের মধ্যে দিয়ে শর্টকাটে যেতে চেয়েছিলাম।’ 

‘তাই! আমি সত্যি দুঃখিত। এসো, ফোন করবে। 

ঘুরে ঢাল বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলো লোকটা । পেছনে চললো তিন গোয়েন্দা আর বোরিস। গেট দিয়ে খেত থেকে বেরিয়ে, এক চিলতে ঘাসে ঢাকা জমি পেরিয়ে চলে এলো পুরনো, লাল রঙ করা গোলাবাড়ির কাছে। বড় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো লোকটা। সুইচ টিপে জ্বেলে দিলো উজ্জ্বল ফ্লোরোসেন্ট আলো । হাত নেড়ে ইশারা করলো কিশোরদের ঢোকার জন্যে । 

Į 

বিরাট বাড়ি। কিন্তু খামারে যেসব পোষা জানোয়ার থাকে, সেরকম একটাও দেখা গেল না। ঘরের ভেতর লম্বা লম্বা টেবিল, তাতে নানারকম অদ্ভুত যন্ত্রপাতি ভালো করে ওগুলো দেখার আগেই একটা ডেস্কের কাছে কিশোরকে নিয়ে গেল লোকটা। ডেস্কের ওপরটা বই আর কাগজপত্রে বোঝাই। তার ভেতরে প্রায় চাপা পড়ে আছে টেলিফোনের যন্ত্রটা। সেটা দেখিয়ে বললো, যাও, করো।’ 

কিশোর যখন ফোন করছে, মুসা, রবিন আর বোরিস তখন কৌতূহলী চোখে দেখছে ঘরের ভেতরটা। দরজার কাছে একটা লম্বা টেবিল, তাতে অনেকগুলো কাঠের বাক্স সাজিয়ে রাখা। বাক্সের একপাশের দেয়াল শক্ত কাপড়ে তৈরি, আরেক পাশের দেয়াল কাঁচের। বাকি দুই পাশ কাঠের। খালি। স্ট্যাণ্ডে লাগানো ক্যামেরার চোখ ফিরে আছে ওরকম একটা বাক্সের দিকে । 

আরেকটা টেবিলে বড় বড় কতগুলো কাঁচের জার রাখা। একটা জারের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলো রবিন। প্রথমে মনে হলো, শ্যাওলার টুকরো জড়ো হয়ে পড়ে আছে। পরক্ষণেই চমকাতে হলো। জারের ভেতরে ওগুলো শ্যাওলা নয়, পিঁপড়ে। জীবন্ত, বাদামী রঙের, লম্বা পাওয়ালা প্রাণীগুলো পা আর চোয়ালের সাহায্যে আঁকড়ে রয়েছে পরস্পরকে। অদ্ভুত দৃশ্য! হাঁ হয়ে গেছে রবিন। 

রিসিভার নামিয়ে রেখে ঘোষণা করলো কিশোর, চাচার আসতে আধ ঘন্টা লাগবে।’ 

‘ভেরি গুড,’ বললো টাকমাথা লোকটা। চোখ পড়লো রবিনের ওপর । চোখে চোখ পড়তেই রবিন জিজ্ঞেস করলো, পিঁপড়ে সংগ্রহ করেন নাকি * আপনি?’ 

‘হ্যাঁ,’ জবাব দিলো লোকটা। দেখা হওয়ার পর এই প্রথম কিছুটা উষ্ণতা প্রকাশ পেলো তার কণ্ঠে। শুধু সংগ্রহ করেই ফেলে রাখি না। নজর রাখি। যা যা করে ওগুলো, নোট করে রাখি। কখন কি করবে অনুমানের চেষ্টা করি। আসল কথা, গবেষণা করি পিঁপড়ে নিয়ে।’ 

‘আপনি অ্যানটোমোলজিস্ট,’ কিশোর বললো-। 

হাসলেন ভদ্রলোক । ‘তোমাদের বয়েসী বেশির ভাগ ছেলেই জানে না শব্দটা।’ ‘প্রচুর পড়াশোনা করে আমাদের কিশোর,’ গর্ব করে বললো মুসা। তার অর্ধেক কথাই বুঝি না আমরা। যাকগে, কি যেন বলা হলো… অ্যানটো… 

৮৪ 

ভলিউম-১৬ 

অ্যাটোম…’ 

‘অ্যানটোমোলজিস্ট,’‘বলে দিলেন পিঁপড়ে বিশেষজ্ঞ। ‘পোকামাকড় নিয়ে যারা গবেষণা করে, স্টাডি করে, বিজ্ঞানীও বলতে পারো, তাদেরকে বলে অ্যানটোমোলজিস্ট। আমার নাম ডক্টর হেনরি রেনহার্ড। রেনহার্ড বলা খুব হার্ড, আই মীন, কঠিন, হাসলেন তিনি। ‘পুরোটা বলার দরকার নেই। শুধু রেন বললেই চলবে। সামরিক পিঁপড়ের ওপর কয়েকটা বই লিখেছি আমি। আরেকটা লিখছি । শেষটা কি হবে বলতে পারবো না 

আবার হাসলেন ডক্টর রেন। কিশোরের মনে হলো, লোকটা অমায়িক, অবশ্য যখন ভালো মেজাজে থাকেন। আরও একটা ব্যাপার চট্ করে মনে এলো তার, পিঁপড়ে নিয়ে গবেষণা করেন তিনি, দেখতেও পিঁপড়ের মতোই। পাতলা শরীরের তুলনায় মাথাটা অনেক বড়, চশমার ভারি লেন্স দুটোকে দেখতে লাগছে পিঁপড়ের চোখের মতো। চকচকে টাক, অনেক অনেক বড় একটা পিঁপড়ের টাকের কথা মনে করিয়ে দেয়। ঠেলে বেরোনো চোখা চোয়াল । তাঁর কপালের দিকে তাকিয়ে কিশোরের মনে হতে লাগলো, যে কোনো মুহূর্তে ওখানে দুটো শুঁড় গজিয়ে যেতে 

পারে । 

মাথার পেছনে হাত নিয়ে গেলেন রেন। ‘কি ব্যাপার? কি দেখছো?” 

লজ্জা পেলো কিশোর। ‘না না, কিছু না। আপনার বইয়ের কথা ভাবছি। শেষটা কি হবে জানেন না, তার মানে চলতি গবেষণাটা শেষ হয়নি আপনার। এটাই ল্যাবোরেটরি, না? 

আশপাশের পুরো পাহাড়টাই আমার ল্যাবোরেটরি,’ রেন বললেন। ‘এই গোলাবাড়িতে শুধু কিছু বিশেষ কাজ করি আমি, এইই। ওই যে বাক্সগুলো দেখছো, পিঁপড়ের ছবি নিতে হলে ওগুলোতে ভরে নিই। ম্যাগনিফাইং লেন্স লাগানো আছে ওই ক্যামেরাটায়,’ টেবিলে রাখা একটা ক্যামেরা দেখালেন তিনি। অনেকগুণ বড় হয়ে ছবি ওঠে। ওই কোণে ডার্করুম। গোলাঘরের পেছনে একটা গ্রীনহাউস আছে। ওখানে রয়েছে পিঁপড়েদের বাড়ি। ওখান থেকে কিছু তুলে এনে ভরেছি জারগুলোয়। আপাতত আছে গ্রীনহাউসে, তবে খুব শীঘ্রি অন্য কোথাও সরে যাবে। সরার সময় হয়ে গেছে ওগুলোর ।’ 

‘মাইগ্রেট করবে বলতে চাইছেন, ‘ রবিন বুঝে ফেললো। ‘তা পিঁপড়েরা মাইগ্রেট করার পর নিশ্চয় বইয়ের শেষটা কি হবে জানা হয়ে যাবে আপনার? বুঝতে পারবেন কোথায় যাবে ওরা?”“ 

‘বেশি দূরে বোধহয় যাবে না, রেন বললেন। ‘বড়জোর পাহাড়ের ওপরের বড় বাড়িটার কাছে। বাসা বাঁধবে। সামরিক পিঁপড়ের বাসাকে কি বলে জানো তো? বিভুয়াক, অর্থাৎ ক্যাম্প। অনেকটা মৌমাছির মতোই স্বভাব ওদের। দলের সবাই নির্ভর করে রানীর ওপর। ডিম পাড়ার সময় হলে বিরাট হয়ে যায় রানীর শরীর। জায়গা বেছে নিয়ে বাসা বাঁধে। রানী ডিম পাড়তে বসে, আর শ্রমিকেরা দিকে দিকে বেরিয়ে যায় খাবারের খোঁজে। ডিম পাড়া শেষ হলে আবার শুকিয়ে যায় রানীর শরীর, দলটা বেরিয়ে পড়ে আবার নতুন জায়গার খোঁজে, একেবারে যাযাবর স্বভাব। একজায়গায় থাকতে যেন মন চায় না। আমি আসার পর 

নিশাচর 

te 

গ্রীনহাউসের পিঁপড়েগুলো কয়েকবার মাইগ্রেট করেছে। লম্বা সারি দিয়ে যখন চলতে থাকে সামরিক পিঁপড়ে, দেখার মতো দৃশ্য হয়! 

ভ্রুকুটি করলো কিশোর। ‘এই এলাকায় সামরিক পিঁপড়ে আছে জানতাম না । আফ্রিকান পিঁপড়ের ভয়ঙ্কর গল্প শুনেছি। মাঝে মাঝেই নাকি চড়াও হয় আদিবাসীদের গাঁয়ে, বড় বড় জন্তুজানোয়ার পর্যন্ত খেয়ে ফেলে । 

কথাটা শুনে যেন বেশ মজা পেলেন, এমন ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন রেন। শুধু জানোয়ারই না, খাওয়ার মতো যা পায়, সব খেয়ে ফেলে। বেশির ভাগ পিঁপড়েই নিরামিষ খায়, কিন্তু সামরিক পিঁপড়ে মাংসভোজী, যাযাবর বলেই হয়তো। পিঁপড়ের দল আসতে দেখেই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালায় গায়ের লোক। কারণ পিঁপড়ের কবলে পড়লে মানুষেরও রেহাই নেই, জ্যান্তই খেয়ে ফেলবে।’ 

গায়ে কাঁটা দিলো মুসার । 

দেখলেনই না রেন। বলার নেশায় পেয়েছে যেন তাঁকে । বলছেন, ‘তবে ওই পিঁপড়ে অনেক উপকারও করে ওদের। ইঁদুর, বিছে, আর আরও নানারকম ক্ষতিকারক পোকামাকড় সব খেয়ে সাফ করে ফেলে। গাঁয়ের লোকেরা ফিরে এসে দেখে ঘরবাড়ি সব পরিষ্কার। 

আফ্রিকার পিঁপড়েদের মতো ভয়ঙ্কর নয় আমাদের দেশের পিঁপড়েরা। 

‘পেলে ছোটখাটো প্রাণী খায় বটে, তবে ওষুধের জন্যে এতো খোঁজাখুঁজি করে না। হাতের কাছে পোকামাকড় যা পায় তাই দিয়ে পেট ভরে।’ কিশোরের দিকে তাকালেন রেন। ‘তুমি যে ভাবছো, শুধু আফ্রিকাতেই আছে, তা নয়। অনেক দেশেই আছে সামরিক পিঁপড়ে। পানামায় আছে, মেকসিকোতে আছে, আমেরিকায় আছে। পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি ল্যাটিচিউডের দক্ষিণে বহু জায়গায় দেখা মিলবে ওদের। উত্তরে অরিগন এমনকি মেইনি পর্যন্ত । 

‘এই পাহাড়ের পিঁপড়েদের কথাই বলি। আফ্রিকান পিঁপড়ের সঙ্গে দেহগত অমিল তো আছেই, এমনকি এখানেই আগে যেরকম ছিলো, তার চেয়ে বদলে গেছে এখন। পা লম্বা হয়েছে আরও, শক্ত হয়েছে শরীরের খোলস ।’ 

এক মুহূর্ত থামলেন রেন। উত্তেজনায় চকচক করে উঠলো চোখ। একটা মজার ব্যাপার দেখতে চাও?’ 

জবাবের অপেক্ষা করলেন না তিনি। একটা দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। পেছনে বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা আর বোরিস। 

‘এই জায়গাটার মালিক, উইলিয়াম ওয়াগনার,’ রেন বললেন। ‘নাম হয়তো শুনেছো। কোটিপতি। মনটাও ভালো। বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে অনেক সাহায্য-সহায়তা করেন। গত বসন্তে এদিকে এসেছিলাম পিঁপড়ে খুঁজতে। অদ্ভুত কিছু সামরিক পিঁপড়ে চোখে পড়ে যায়, ওয়াগনারের এলাকায়। তিনি এখানে থাকেন না, তবু তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম। এখানে থাকার অনুমতি দিয়ে দিলেন আমাকে। বলে দিলেন, ইচ্ছে করলে গোলাঘরটাকে ল্যাবোরেটরি বানাতে পারি। শুধু তাই না, বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে ওয়াগনারদের যে ফাণ্ড আছে, তা থেকে কিছু টাকাও দিয়ে দিলেন। গবেষণা চালাতে আর অসুবিধে হলো না আমার।’ 

৮৬ 

ভলিউম-১৬ 

ছোট একটা গ্রীনহাউসের সামনে এসে দাঁড়ালেন রেন। পরিত্যক্ত, অবহেলিত, দেখেই বোঝা যায়। দরজা ঠেলে খোলার সময় কিচকিচ করে প্রতিবাদ জানালো । ‘এই যে, সামরিক পিঁপড়ের কলোনি,’ দেখালেন রেন । 

একটা টেবিলের নিচে স্তূপ হয়ে ঝুলছে কালো পিঁপড়ে, মৌমাছির চাকের মতো। কি করে যেন টের পেয়ে গেল ওগুলো, দরজা খোলা হয়েছে। চাক ভেঙে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো সেদিকে। 

‘খাইছে!’ জোরে কথা বলতে যেন ভয় পাচ্ছে মুসা। ‘এতো চালাক!’ 

‘দারুণ, তাই না?’ খুশি হয়ে বললেন রেন। সামরিক পিঁপড়ের এই প্রজাতিটা নতুন, এরকম আর দেখিনি। কবে, কোথেকে, কিভাবে এসেছে ওরা, কোথায় যাবে, এসব জানার প্রচণ্ড আগ্রহ আমার । জানবো, জানতে আমাকে হবেই!” 

খুদে প্রাণীগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে বোরিস, অস্বস্তি ফুটেছে চেহারায় । যাওয়া দরকার । সাহেবের আসার সময় হয়েছে। 

গ্রীনহাউস থেকে বেরিয়ে গেল সে। মিনিটখানেক পরে বেরোলো তিন গোয়েন্দা। এবার আর খেতের মধ্যে দিয়ে গেল না ওরা, ঘুরে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে নামতে লাগলো । চলতে চলতে ফিরে তাকালো একবার কিশোর। খেতের বেড়ার কাছে দাঁড়িয়ে ওদের দিকেই চেয়ে রয়েছেন ডক্টর রেন। বেড়ার ওপরে দাঁড়িয়ে কাকতাড়ুয়াটাও তাকিয়ে রয়েছে আগের মতোই, ত্রিকোণ চোখ, মুখে শয়তানী হাসি । 

মুসাও ফিরে তাকালো। বললো, ‘আজব মানুষ! পিঁপড়ে নিয়ে এতো মাতামাতি…আস্ত পাগল! কিশোর, ওই কাকতাড়ুয়াটাও যেন কেমন! যখনই তাকাই, মনে হয় আমার দিকে চেয়ে চোখ টিপছে, আর মিটিমিটি হাসছে!’ 

‘ওসব চোখের ভুল । আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে অন্য আরেকটা ব্যাপার। রেনের মতো একজন বিজ্ঞানী, বুদ্ধিমান লোক আমাকে কাকতাড়ুয়া ভেবে বসলেন কেন? জীবন্ত কাকতাড়ুয়া!’ 

তিন 

‘এখান থেকে পাচ মাইল,’ মুসা বললো। তা-ও আবার চড়াই। এই গরমে সাইকেল চালিয়ে ঘামতে ঘামতে আবার যাবো? সাধারণ একটা কাকতাড়ুয়া পুতুল দেখতে?” বিরক্তিতে নাক কুঁচকালো সে। ‘একেই বলে কপাল! দরকারের সময় এখন একটা গাড়িও নেই । 

‘খুব ভালো হয়েছে,’ কিশোর বললো। ‘কতোবার বলেছি, একটা গাড়ি জোগাড় করে দাও আমাকে। কানেই তোলোনি। আমার একটা গাড়ি থাকলে এ অবস্থাটা হতো না । 

কি করে বুঝবো? কপাল যখন খারাপ হয়, তখন আর কিছুই করার থাকে না। নাহলে আমার গাড়িটাও বেঁচে দিলাম। আর সময় পেলো না, রবিনেরটাও গেল বিগড়ে। এমনই বিগড়ানো বিগড়েছে, ঠিক হবে কিনা তাই বা কে জানে । পুরনো ফোক্স ওয়াগন গাড়িগুলোর এই এক অসুবিধে। এঞ্জিন ডাউন দিলেই 

নিশাচর 

৮৭ 

বারোটা বাজলো…।’ 

‘জাহান্নামে যাক ওটা, বাধা দিয়ে বললো রবিন। ‘একটা মাস দেখবো । তারপরও ঠিক করতে না পারলে আরেকটা কিনে নেবো । 

‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকালো কিশোর। টাকা-পয়সা তো আজকাল ভালোই কামাচ্ছো। মুসা, এখনও সময় আছে। একটা গাড়ি জোগাড় করে দাও আমাকে ! হাতে কিছু জমেছে। 

‘আরে দিতাম তো। বসে আছি তোমার নিকিভাইয়ের জন্যে। সেই যে পনেরো দিন পরেই আসছি বলে গেল, আর পাত্তাই নেই।’ 

নিজের কাজ নিজেকে করতে হয়। কারও আশায় বসে থাকলে হয় না।’ 

‘তা ঠিক,’ মাথা দোলালো মুসা। ‘ঠিক আছে, দেখি, আমরা তিনজনেই বেরোবো একদিন। খুঁজে পেতে দুটো গাড়ি বের করে ফেলবো। আমারও একটা দরকার।’ 

‘গোটা দুই মোটর সাইকেল হলেও হতো । এই সাইকেল চালাতে আর ভালো লাগে না।’ 

‘কেন?’ মুচকি হাসলো রবিন। এতোদিন না বলে এসেছো, সাইকেল স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো। চালালে হার্টের অসুখ হয় না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখন কেন?’ 

‘এখনও তা-ই বলছি । তবে, এই গরমের মধ্যে…আসলে, সব সময় সাইকেল দিয়ে হয় না। গাড়ি লাগেই। তাছাড়া আমাদের যে কাজ…যাকগে, ওসব নিয়ে পড়ে ভাববো। আপাতত কাকতাড়ুয়ার ব্যাপারটার একটা কিনারা হোক। 

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম,’ আগের কথার খেই টানলো আবার মুসা। সাধারণ একটা কাকতাড়ুয়া দেখতে গিয়ে লাভটা কি?’ 

ওয়াগনার এস্টেট থেকে আসার কয়েক ঘণ্টা পর, রকি বীচের সীভিউ কাফের একটা বুদে ঢুকে আইসক্রীম খাচ্ছে, আর সকালের ঘটনার কথা আলোচনা করছে, তিন গোয়েন্দা । 

‘কেন, একটুও কৌতূহল নেই তোমার?’ কিশোর বললো। ‘পুতুলটা অদ্ভুত লেগেছে তোমার কাছে, তখন বললে । কেন এরকম লাগলো, তদন্ত করে দেখবে না?’ 

‘এখন আর অদ্ভুত লাগছে না,’ ভোঁতা গলায় বললো মুসা। 

‘বেশ, অন্যভাবে ভাবি। রেনের কেন মনে হলো, তিনি জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া দেখেছেন? আমার ওপর কেন হামলা চালালেন ।’ 

‘সব কিছুতেই রহস্য দেখো তুমি,’ হাত নেড়ে উড়িয়ে দিতে চাইলো যেন রবিন। ‘কোনো কারণে রেগে গিয়েছিলেন। হাতের কাছে তোমাকে পেয়ে ঝালটা ঝাড়লেন।’ 

মাথা নাড়লো কিশোর। ‘আমার তা মনে হয় না। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন। খেতে নাহয় মানুষ ঢুকলোই, তাতে কি কেউ এতোটা উত্তেজিত হয়? হাতের পাথরটা তো দেখোনি। মাথাটা যে আমার ফাটিয়ে দেননি, এটাই বেশি।’ 

‘অথচ লোক তিনি খারাপ নন, অন্তত খুনখারাপি করার মতো তো ননই। যে– 

ভলিউম-১৬ 

দেখলেন আমি একজন মানুষ, ব্যস, শান্ত হয়ে গেলেন। প্রথমে আমাকে অন্যকিছু ভেবেই রেগে গিয়েছিলেন। মানুষ নয়, অন্য কিছু! ব্যাপারটা অদ্ভুত না?’ 

হাসলো মুসা। ‘শেষ পর্যন্ত কাক তাড়ানোর চাকরি দিয়ে দিলো তোঁমাকে পিঁপড়ের বিজ্ঞানী…হাহ্ হাহ্!’ 

হাতাকাটা শার্ট আর গাঢ় রঙের প্যান্ট পরা এক যুবক কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে। কিশোরের দিকে ফিরে বললো, ‘কাকতাড়ুয়া হওয়ার উপযুক্ত নও তুমি। আরেকটু লম্বা, আর স্বাস্থ্য আরেকটু ভালো হলে পারতে।’ 

হাঁ করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে তিন গোয়েন্দা । 

কাপটা তুলে নিয়ে ওদের টেবিলের কাছে এগিয়ে এলো লোকটা। সরে তার জন্যে জায়গা করে দিলো মুসা ৷ 

‘নিশ্চয় চ্যাপারাল ক্যানিয়নের কাকতাড়ুয়ার কথা বলছো তোমরা,’ যুবক বললো । ‘ওয়াগনারের এলাকায় ঘুরে বেড়ায় ৷ 

‘ঘুরে বেড়ায়! তার মানে বলতে চাইছেন, হাঁটে?’ জিজ্ঞেস করলো কিশোর। 

মাথা ঝাঁকালো লোকটা। ছেলেদেরকে চমকে দিয়ে যেন মজা পাচ্ছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমার নাম ডেভি, ডেভি জোনস। ‘সেফ-টি-সিসটেম কোম্পানিতে কাজ করি আমি। বার্গলার অ্যালার্ম সিসটেম তৈরি করে কোম্পানি। বুঝতে পারছো তো কি জিনিস? চোর ঠেকানোর যন্ত্রপাতি। আমার মতো আরও কর্মচারী আছে ওখানে। আমাদের কাজ হলো খদ্দেরের বাড়িতে ওগুলো বসিয়ে দিয়ে আসা, তারপর নিয়মিত গিয়ে সার্ভিসিং করা। এই তো, চ্যাপারাল ক্যানিয়নেও লাগিয়ে দিয়ে এসেছি, মসবি মিউজিয়মে।’ 

‘চিনি’ কিশোর বললো । 

‘সাংঘাতিক, তাই না? মসবির কথা শুনেছি আমি অনেক। বুড়ো নাকি বিরাট বড়লোক ছিলো। সে-ই তৈরি করেছে ওই মিউজিয়ম। নিজের বাড়িটাকে তৈরি করেছে দুর্গের মতো করে। অবশ্য দরকারও ছিলো। অনেক দামী দামী ছবি আছে ওখানে, দুনিয়ার যেখানে যা পেয়েছে, জোগাড় করতে পেরেছে, এনে সাজিয়েছে। সুপার অ্যালার্ম সিসটেম লাগিয়ে দিয়ে এসেছি ওখানে আমরা। হপ্তায় হপ্তায় গিয়ে চেক করি ঠিক আছে কিনা।’ 

“কাকতাড়ুয়ার ব্যাপারটা কি বলুন তো?’ 

‘ও, বলছি। হপ্তাস্নানেক আগে এক বিকেলে গিয়েছিলাম মসবির ওখানে। কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠেছি চলে আসার জন্যে, হঠাৎ চোখে পড়লো ওটা । ওয়াগনার হাউসের পাশ দিয়ে গুটিগুটি হেঁটে চলেছে । আমি যে দেখেছি সেটা বোধহয় টের পেয়ে গেল। দৌড়ে নেমে হারিয়ে গেল পাহাড়ের নিচে।’ 

কফির কাপে চুমুক দিলো ডেভি জোনস । 

‘তারপর?’ শোনার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। 

তারপর আর কিছু না। সন্ধ্যা হয়েছে তখন, আলো কমে গেছে। পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলাম, কাকতাড়ুয়াটাকে আবার দেখার আশায়। আর এলো না । একবার ভাবলাম, যাই, গিয়ে বলি মসবিদের। কিন্তু গেলাম না। বললে আমাকে পাগল ভাবতো ।’ 

নিশাচর 

৮৯ 

‘তা তো ভাবতোই,’ মুসা একমত হলো। 

‘তোমাদের কথা শুনছিলাম ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, কাউন্টার দেখালো যুবক। কিশোরের দিকে তাকালো। ‘তোমাকে কাকতাড়ুয়া ভেবেছে কেউ, তাই না? ভুল করেছে। তুমি পুতুলটার সমান নও।’ 

খেতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম,’ জানালো কিশোর। ‘লম্বা লম্বা গাছ, মাথা সমান, তাই আমাকে ভালোমত দেখা যায়নি। ভুলটা হয়েছে সে-জন্যেই । 

‘হুঁ!’ 

কাকতাড়ুয়াটা দেখতে কেমন?” রবিন জিজ্ঞেস করলো । 

ভুরু কোঁচকালো যুবক। ‘এই মাঝারি উচ্চতা। পাঁচ ফুট সাত কি আট। পাতলা। মাথায় কালো হ্যাট, গায়ে হালকা রঙের জ্যাকেট। মুখটা ভালোমতো দেখিনি। হাতার ভেতর থেকে খড় বেরিয়ে ছিলো। তাই দেখেই বুঝেছি, ওটা কাকতাড়ুয়া পুতুল।’ 

কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ালো ডেভি। ‘থাকগে ওসব কথা। আর নাক গলাতে যাচ্ছি না আমি । আমার পরামর্শ শুনলে, তোমাদেরও যাওয়া উচিত হবে না। জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া! বাপরে, ভাবলেই রোম খাড়া হয়ে যায়! নিশ্চয় সাসকোয়াচের চেয়ে ভয়ঙ্কর! ভুলে যাও, বুঝলে, মন থেকে বিদেয় করে দাও ওটার কথা!’ 

জবাব দিলো না তিন গোয়েন্দা । কাফে থেকে বেরিয়ে গেল ডেভি । 

কান চুলকালো কিশোর। উসখুস করলো। তাকালো দুই সহকারীর দিকে। ‘তোমরা ভুলতে চাও?’ 

‘চাইলেই বা কি?’ হাত ওল্টালো মুসা। ‘ভুলতে কি আর দেবে তুমি? ওঠো। অনেক দূর যেতে হবে।’ 

কাফে থেকে বেরিয়ে র‍্যাক থেকে সাইকেল বের করলো তিন গোয়েন্দা । তারপর কোস্ট হাইওয়ে ধরে রওনা হলো উত্তরে। চ্যাপারাল ক্যানিয়নে পৌঁছে মোড় নিয়ে উঠতে আরম্ভ করলো পাহাড়ী পথ ধরে। 

রক রিম ড্রাইভ একজায়গায় দু’ভাগ হয়ে গেছে। সেখানটায় পৌঁছে সাইকেল থামালো মুসা। পেছনে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো অন্য দু’জনের আসার । ওরা এলে জিজ্ঞেস করলো, ‘খেতের ভেতর দিয়েই যাবো?” 

না, ডক্টর রেনকে আবার রাগানো ঠিক হবে না, কিশোর বললো। ‘দেখো, একটা কাঁচা রাস্তা। নিশ্চয় ওয়াগনার এস্টেটের ভেতর দিয়ে এসেছে,’ খেতের দিকে নেমেছে পথটা । 

‘রাগ যদি করেনই, ওই রাস্তা দিয়ে গেলেও করতে পারেন,’ রবিন যুক্তি দেখালো। 

তা হয়তো। তবে খেতের মধ্যে দিয়ে গেলে দেখতে পাবেন না, ওখান দিয়ে গেলে পাবেন,’ আগে আগে চললো এখন কিশোর। রাস্তায় এসে উঠলো। গোলাঘরটা দেখা যায় এখান থেকে। ওটার বাঁয়ে সামান্য ওপরে রয়েছে সেই গ্রীনহাউস, যাতে বাসা বেঁধেছে পিঁপড়েরা। গ্রীনহাউসের অন্য পাশে একসারি ইউক্যালিপটাস গাছ সোজা নেমে এসেছে ঢাল বেয়ে। ওই গাছগুলোর কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে কাঁচা রাস্তাটা। 

১০ 

ভলিউম-১৬ 

চ্যাপারাল ক্যানিয়নের দিকে তাকালো কিশোর। ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির একটা শাদা বাড়ি দেখতে পেলো, লাল রঙের টালির ছাত। এল-এর ভেতরের কোণে, আঙিনায় একটা সুইমিং পুল। বাড়িটার চারপাশ ঘিরে রয়েছে সুন্দর লন। 

বাড়িটা থেকে কিছু দূরে, পথের ধারে, আরেকটা উদ্ভট চেহারার বাড়ি, জানালা নেই। কংক্রীটের তৈরি 

‘নিশ্চয় ওটাই মসবির দুর্গ,’ মুসা আন্দাজে বললো। ‘লোকটা নিশ্চয় পাগল ছিলো । নইলে এই পাহাড়ের মাঝখানে এসে মিউজিয়ম বানায়!’ 

আগে ওটা মসবির বাড়ি ছিলো,’ কিশোর বললো। ‘এই এলাকায় তখন অনেক বড়লোক বাস করতো। বোঝাই তো যায়, কেন মসবি বাড়ি বানিয়েছে ওরকম করে। দামী দামী ছবি, চোর-ডাকাতের ভয় আছে না? 

‘বিচ্ছিরি দেখতে,’ বললো রবিন। ‘বাজি রেখে বলতে পারি, ওটা যতোবার দেখেছেন ওয়াগনার, ততোবার নাক সিঁটকেছেন।’ 

ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর দিকে এগোলো ওরা। চুপচাপ। সবার মনেই এক ভাবনা, আবার না রেগে যান উক্টর রেন। পিঁপড়ে বিশেষজ্ঞের উন্মাদ হয়ে যাওয়া চেহারা কেউই ভুলতে পারছে না, বিশেষ করে কিশোর 

গাছগুলোর কাছে পৌঁছে খেত আর বেড়ার ওপরের কাকতাড়ুয়াটা চোখে পড়লো। সাইকেল রেখে পায়ে হেঁটে এগোলো তিনজনে। বেড়ার পাশ ঘুরে এসে দাঁড়ালো পুতুলটার কাছে, ভালো করে দেখার জন্যে । 

পা নেই পুতুলটার। শরীরের ভেতরে একটা লাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে, লাঠির নিচের মাথা পেরেক দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে বেড়ার সঙ্গে। কাঁধের নিচে আরেকটা লাঠি আড়াআড়ি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, দু’দিক থেকে বেরিয়ে আছে দুই মাথা, হাতের বিকল্প। মাথায় কালো হ্যাট, গায়ে রঙচটা করডোরয়ের জ্যাকেট, হাতার ভেতর দিয়ে খড় বেরিয়ে রয়েছে। লাঠির দুই মাথায় দুটো পুরনো দস্তানা পরিয়ে দেয়া হয়েছে। মাথাটা তৈরি করা হয়েছে চটের ভেতরে খড় পুরে, তারপর জায়গামতো বসিয়ে তার দিয়ে জুড়ে দেয়া হয়েছে । চোখ আর মুখ এঁকেছে কালি দিয়ে । ‘এটার হাঁটার প্রশ্নই ওঠে না,’ বিড়বিড় করলো কিশোর । 

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো কে যেন। ফিরে তাকালো ছেলেরা। ইউক্যালিপটাসের ভেতর দিয়ে আসা একটা পথের ওপর দাঁড়িয়ে এক মহিলা। দেখেই মনে হলো ওদের, যেন দামী কোনো সেন্টের বিজ্ঞাপনের পাতা থেকে উঠে এসেছে। পাতলা, সম্ভ্রান্ত চেহারা। গায়ে অনেক দামী পোশাক। তবে, ভালো করে তাকাতে চোখে পড়লো তার একদা ঝকঝকে লাল চুলের রঙ মলিন হয়ে এসেছে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। চোখ দুটো অস্থির, বুনো দৃষ্টি। 

কিশোরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো মহিলা, ‘কি যেন বললে?’ 

‘না, বলছিলাম কি… চুপ হয়ে গেল কিশোর। কি বলবে? যদি বিশ্বাস না করে মহিলা, মুখের ওপর হেসে ওঠে? বোকা বনতে চায় না সে। 

‘কি বলেছো, শুনেছি। বলেছো, এটার হাঁটার প্রশ্নই ওঠে না।’ গলা চড়েছে মহিলার, তীব্র কণ্ঠস্বর। যেন নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছে। ‘কাকতাড়ুয়ার কথা কি কি জানো?’ 

নিশাচর 

৯১ 

‘তেমন কিছু না। একটা লোকের সাথে দেখা হয়েছিলো। সে বললো, এই এলাকায় নাকি একটা জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া ঘুরে বেড়ায় । শুনে অবাক লাগলো । তাই দেখতে এসেছি, কথাটা সত্যি কিনা। 

কাকতাড়ুয়া দেখেছে? কোন্ লোক? কোথায় আছে?” 

দ্বিধা করলো কিশোর। বলে দেবে? বড় কোম্পানিতে ভালো চাকরি করে ডেভি জোনস । শুনে তার বসেরা যদি ভেবে বসে, মাথা খারাপ হয়ে গেছে, চাকরি চলে যেতে পারে বেচারার । এতোবড় ক্ষতি করা উচিত হবে না। 

‘কি বলো?’ চাপ দিলো মহিলা । 

‘চিনি না। পথ দিয়ে যাচ্ছিলো, দেখা হলো। আমরা পুতুলটার কথা আলোচনা করছিলাম, শুনতে পেয়ে থামলো। বললো, ওয়াগনারের বাড়ির কাছে হাঁটতে দেখেছে কাকতাড়ুয়াটাকে।’ 

‘ঠিকই দেখেছে!’ খলখল করে হেসে উঠলো মহিলা। তার মাথার ঠিক আছে কিনা, সন্দেহ হলো তিন গোয়েন্দার। জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া একটা সত্যি আছে এখানে! আমিও দেখেছি! 

হঠাৎ করেই দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলো সে! হাসি গায়েব ! 

চার 

তাজ্জব হয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে রইলো ছেলেরা। কি করবে বুঝতে পারছে না। তবে তাড়াতাড়িই শাস্ত হয়ে গেল সে, কিছুটা হতবুদ্ধি হয়েই যেন তাকালো আবার ওদের দিকে। সরি। পাগল ভাবছো তো আমাকে? সবাই তাই ভাবে কিন্তু আমি পাগল নই । সত্যিই এই এলাকায় ঘোরে ওটা।’ 

চট্ করে একবার পুতুলটার দিকে তাকালো কিশোর । 

‘না না, এটা না,’ মহিলা বললো। ‘তবে ওটাও এটারই মতো দেখতে।’ সাবধানে হাসলো কিশোর, মহিলা না আবার রেগে যায়, এই ভয়ে। ‘ঠিক এটারই মতো? যমজ-টমজ না তো?” 

কে জানে! তবে ওটা হাঁটে, এটুকু বলতে পারি। তা এসো না আমার বাড়িতে। মিসেস রোজারিওকে একটু বুঝিয়ে বলবে যে, আমি পাগল নই । পুতুলটার কথা বানিয়ে বলি না।’ 

‘কিন্তু কতোখানিই বা জানি আমরা, আর কি-ই বা বলবো?” 

তাহলে ভাগো আমার জায়গা থেকে!’ চাবুকের মতো শপাং করে উঠলো যেন তীক্ষ্ণকণ্ঠ। ‘এখানে কী! কার কাছে বলে ঢুকেছো!’ 

“না, কারো কাছে বলে ঢুকিনি। দুঃখিত। তবে কি জন্যে ঢুকেছি, বলতে পারি। রহস্য আর ধাঁধা অবাক করে আমাদেরকে, কৌতূহল জাগায় । সমাধান না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাই না।’ পকেট থেকে তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বের করে দিলো কিশোর । 

92 

দেখলো মহিলা। মাথা নাড়লো। ‘বুঝলাম না।’ আমরা গোয়েন্দা। 

ভলিউম-১৬ 

‘তা কি করে হয়!’ 

‘তা-ই হয়েছে,’ জোর দিয়ে বললো কিশোর। ‘অনেক জটিল রহস্যের সমাধান আমরা করেছি। বিশ্বাস না হলে পুলিশ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারকে ফোন করে 

দেখতে পারেন । 

চুপ করে দীর্ঘ এক মুহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো মহিলা । ‘না, ফোন করতে হবে না। তোমার কথা বিশ্বাস করছি। বেশ, তোমাদেরকে ভাড়া করলাম। যা ফিস, তা-ই দেবো। এসো, আমার বাড়িতে এসে মিসেস রোজারিওকে বলো যে, এই এলাকায় সত্যিই একটা জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া আছে। 

বন্ধুদের দিকে তাকালো কিশোর। শুধু এই কথাটা বলার জন্যে টাকা নিতে পারি না আমরা, কি বলো?’ 

‘না, পারি না,’ রবিন বললো । 

‘আমি টাকা দেবো, তোমাদের কি? এসো,’ অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মহিলা । ওদেরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঘুরে হাটতে শুরু করলো। তাড়াতাড়ি তার পাশে চলে এলো তিন গোয়েন্দা । 

‘মিসেস রোজারিও কে?’ জানতে চাইলো মুসা । 

আমার মায়ের সেক্রেটারি ছিলো। এখন আমাদের বাড়ি দেখাশোনা করে । আমি এলিজা ওয়াগনার। অন্য কোথাও যখন থাকতে ভালো লাগে না, মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকি । 

‘তাহলে,’ কিশোর বললো। ‘কাকতাড়ুয়াটাকে আপনিও দেখেছেন, না?’ 

‘কয়েক বার। আমার…আমার মনে হয় আমাকে দেখতেই আসে। সন্ধ্যা বেলায়। সব সময় সন্ধ্যা বেলায়, অন্য কোনো সময় না । 

গাছের জটলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। লন পেরোনোর সময় এলিজা বললো, “আমি ছাড়া এখানকার আর কেউ দেখেনি পুতুলটাকে। তাই আমাকে পাগল ভাবে। বলে, সব বানিয়ে বলি।’ 

আচমকা থেমে গেল সে। মুখে ভয় আর বিতৃষ্ণার মিলিত ছাপ। ‘কাকতাড়ুয়া দু’চোখে দেখতে পারি না আমি! পোকামাকড়ও দেখতে পারি না! দেখলেই বমি আসতে চায়!’ 

কেঁপে উঠলো ‘এলিজা। “থাক, পোকামাকড়ের কথা থাক! এসো, মিসেস রোজারিওকে বলবে আমাকে যা বলেছো। ডাক্তার দেখাও, ডাক্তার দেখাও বলে বলে পাগল করে দিচ্ছে আমাকে। বেভারলি হিলে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে চায় । এরকম করতে থাকলে সত্যি সত্যি কোনোদিন পাগল হয়ে যাবো!’ 

লনের পরে ওয়াগনার ম্যানসন। সিঁড়ি দিয়ে ম্যানসনের বারান্দায় উঠলো এলিজা। তাকে অনুসরণ করে তিন গোয়েন্দাও উঠে এলো । মুগ্ধ চোখে তাকালো সুইমিং পুলটার দিকে, রাস্তা থেকেই যেটা চোখে পড়েছিলো। স্বচ্ছ পানি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগলো মুসাকে, এখুনি গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে তার। পুলের কিনারে একটা টেবিল পাতা। পাতলা শরীরের একজন লোক বসে আছে ওটার পাশে। মাথায় ধূসর চুল। গায়ে শাদা জ্যাকেট। টেবিলে বিছানো একগাদা কাগজ পরীক্ষা করে বোঝার চেষ্টা করছে বোধহয় সবকিছু ঠিক আছে 

নিশাচর 

৯৩ 

কিনা । 

‘ব্রড, মিসেস রোজারিও কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলো এলিজা । 

‘ওর ঘরে,’ লোকটা জবাব দিলো। কথায় ব্রিটিশ টান। ‘আমার বেগম সাহেবও ওখানেই, ওকে সাহায্য করতে গেছে । বললো… 

‘ওই যে, এসে গেছে । 

কালো ইউনিফর্ম আর শাদা অ্যাপ্রন পরা এক মহিলা একটা হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে বারান্দায় বেরোলো। চেয়ারে বসে আছেন এক বৃদ্ধা, বয়েস ষাটের কাছাকছি। মাথার কোঁকড়া চুলগুলো ধবধবে শাদা। গালের ফ্যাকাসে চামড়া রুজ ডলে লালচে করা হয়েছে। নকশা কাটা নরম একটা কাপড় দিয়ে পা ঢেকে দেয়া হয়েছে, কোমরের কাছ থেকে। 

‘এই যে, এলিজা, কোথায় গিয়েছিলে?” বৃদ্ধার চকচকে কালো চোখের তারা স্থির হলো ছেলেদের ওপর। ‘এরা কারা?’ 

‘তিন গোয়েন্দা।’ কার্ডটা বৃদ্ধাকে দেখালো এলিজা। কিশোরের দিকে ফিরে বললো, ‘তুমি নিশ্চয় কিশোর পাশা?” 

‘হ্যাঁ।’ 

‘আর তুমি মুসা আমান?’ 

মাথা ঝাঁকালো মুসা । 

‘বাকি থাকলে তুমি, নিশ্চয় রবিন মিলফোর্ড। হেসে বললো রবিন, ‘অবশ্যই।’ 

‘এর কথাই বলেছিলাম তোমাদেরকে,’ বৃদ্ধাকে দেখালো এলিজা। ‘মিসেস রোজারিও। বৃদ্ধার দিকে ফিরে বললো, ‘এদেরকে নিয়ে এসেছি তার কারণ, এরাও কাকতাড়ুয়াটার কথা জানে। তদন্ত করতে এসেছে। ওই রেন পাগলটার খেতের কাছে দাঁড়িয়ে পুতুলটাকে দেখছিলো। কেন ওদের এই কৌতূহল, জানেন?’ 

‘কেন?’ 

‘একটা লোকের সাথে দেখা হয়েছিলো ওদের। কাকতাড়ুয়াটাকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে সে-ও। ওদেরকে বলেছে।’ 

এলিজা খুব খুশি, উত্তেজিত। কিন্তু মিস রোজারিওকে তেমন একটা আগ্রহী মনে হলো না। ‘ওদেরকে বসতে বলো। আমাদের সাথে চা খাবে। ব্রড, আরও তিনটে চেয়ার দাও।’ 

‘দিচ্ছি।’ তাড়াহুড়ো করে চেয়ার আনতে চলে গেল ব্রড নিউম্যান । পেছন পেছন গেল তার স্ত্রী । 

নিজেই চাকা ঘুরিয়ে চায়ের টেবিলের সামনে হুইল চেয়ার নিয়ে এলেন মিসেস রোজারিও। গোয়েন্দাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তাহলে একটা লোকের দেখা পেয়েছো, যে জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া দেখেছে। ভালো। খুলে বলো তো সব কথা।’ 

চেয়ার আনা হলো। মিসেস রোজারিওর পাশে বসলো কিশোর । শুরু করতে গিয়ে থেমে গেল সে। ডক্টর রেন আসছেন। কাছে এসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ব্যাপারটা কী?’ 

৯৪ 

‘কি আবার? চা খেতে বসেছি।’ শীতল গলায় জবাব দিলো এলিজা। কিছু 

ভলিউম—১৬ 

লাগবে আপনার?’ 

দুপদাপ করে দু’পা এগিয়ে এলেন রেন। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, ‘মিথ্যুকের দল। ট্রাকের চাকা ফেঁসেছিলো, না? সব শয়তানী, সব মিথ্যে কথা! গল্প বানিয়ে বলে আমার ল্যাবোরেটরিতে ঢোকার ফন্দি …আমি… আমি… 

রাগে ভাষা হারিয়ে ফেললেন বিজ্ঞানী। 

‘আপনার ল্যাবোরেটরিতে ঢোকার জন্যে মিথ্যা কথা বলতে যাবো কেন আমরা?’ কিশোর বললো। ‘একটা ফোন করা দরকার ছিলো, করেছি। এছাড়া আর কি কিছু করেছি? তারপর তো বাড়ি ফিরে গেলাম। রকি বীচে একটা লোকের সঙ্গে দেখা। সে বললো, এই এলাকায় একটা জ্যান্ত কাকতাড়ুয়াকে দেখেছে। মিস ওয়াগনারও নাকি দেখেছেন। তিনি বললেন, এখানে একমাত্র তিনিই নাকি দেখেছেন ওটাকে । কথাটা কি ঠিক, ডক্টর রেন? 

জবাব দিলেন না ডক্টর। তবে চেহারা লাল হয়ে গেল । 

তারমানে আপনিও দেখেছেন!’ চিৎকার করে উঠলো এলিজা । লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দেখেছেন, তাই না? কথা বলেন না কেন?’ 

‘ইয়ে…ওই…কিছু একটা দেখেছি,’ স্বীকার করলেন রেন, যদিও অস্বস্তি চাপতে পারলেন না । ‘যে রাতে আমার ল্যাবোরেটরিতে চোর ঢুকেছিলো, পুলিশকে ফোন করেছিলাম, সে রাতে পলকের জন্যে দেখলাম । কাকতাড়ুয়ার মতোই । 

‘কিন্তু আপনি বলেছিলেন চোর!’ 

‘বলেছিলাম, আপনাদেরকে আরও ঘাবড়ে দিতে চাইনি বলে। এমনিতেই পুলিশের সঙ্গে যথেষ্ট ঝামেলা হয়েছে। রকি বীচ থেকে ইয়ান ফ্লেচার এসেছিলেন। সঙ্গে একজন পুলিশ অফিসার। যখন বললাম, একটা কাকাতাড়ুয়া ল্যাবোরেটরিতে ঢুকে আমার মাথায় বাড়ি মেরেছে, পিঁপড়ে চুরি করেছে, চেহারাটা যদি তখন দেখতেন ওদের!’ 

হেসে উঠলো এলিজা। ‘নিশ্চয়ই পাগল ভেবেছে আপনাকে? কিন্তু আমাকে বললে পারতেন । এ-বাড়ির সবাই আমাকে পাগল ভাবে। কেন বললেন না? আমি তো আপনারই দলে।’ 

মুখ কালো করে ফেললেন বিজ্ঞানী, নিজেকে ‘এলিজার দলে’ ভাবতে পারছেন না। ‘দেখুন আমি বিজ্ঞানী, আমার একটা সুনাম আছে। ওসব পাগলামির মধ্যে গেলে আমার সর্বনাশ হবে। আমাকে আর গবেষণা করতে দেয়া হবে ভেবেছেন?” 

রেগে গেল এলিজা। ‘তাই বলে সত্যি কথা বলবেন না? ‘ঘেন্না লাগছে আপনাকে দেখে! ছিহ্!’ দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে গেল সে। সেদিকে তাকিয়ে রইলো মিসেস রোজারিও, চোখে আহারে বেচারি!’ দৃষ্টি । 

জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন রেন। ‘ওটা আসলেই পাগল!’ ছেলেদের দিকে ফিরলেন। ‘কি করতে এসেছো এখানে, বললে না?” 

কাকতাড়ুয়াটাকে ভালোমতো দেখতে এসেছি,’ জবাব দিলো কিশোর । ‘আমাকে তো সকালে কাকতাড়ুয়া ভেবেছেন। ভাবলাম নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণটা কি, তদন্ত করে জানতে এসেছি।’ 

‘সকালে বেআইনী ভাবে ঢুকেছিলে আমার খেতে,’ অভিযোগ করলেন রেন। 

নিশাচর 

৯৫ 

‘এখন এসেছো আবার সেই একই কাজ করতে!’ 

‘আমাদেরকে সন্দেহ করছেন আপনি? খারাপ ছেলে মনে হচ্ছে?’ আর সহ্য করতে না পেরে বলে উঠলো রবিন। মনে অতো খুঁতখুঁতি রেখে লাভ কি? মিস্টার ইয়ান ফ্লেচারকেই ফোন করুন। বলুন আমাদের কথা। চমকে যাবেন।’ 

‘কেন, চমকে যাবো কেন?’ 

কারণ তিনি আমাদের চেনেন। ভালো সার্টিফাই করবেন।’ 

তাই করবো।’ গলা চড়িয়ে ডাকলেন রেন, ‘ব্রড, টেলিফোনটা নিয়ে এসো তো!’ 

একটা টেলিফোন সেট নিয়ে বেরিয়ে এলো হাউসম্যান ব্রড। দরজার পাশের একটা জ্যাকে ঢুকিয়ে দিলো তারের মাথায় লাগানো প্লাগটা। সেটটা এনে রেনের হাতে তুলে দিয়ে আবার চলে গেল ঘরের ভেতর । 

ডায়াল করলেন রেন। ওপাশ থেকে সাড়া আসতেই ফ্লেচারকে চাইলেন । 

‘ডক্টর হেনরি রেনহার্ড বলছি, ওয়াগনার এস্টেট থেকে,’ চীফ টেলিফোন ধরলে বললেন বিজ্ঞানী। ‘তিনটে ছেলে সারাটা দিন ঘুরঘুর করছে এই এলাকায় । খেতে ঢুকেছে। এখন এসেছে কাকতাড়ুয়া পুতুল দেখতে। বলছে গোয়েন্দা, তদন্ত করতে এসেছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে…’ 

থেমে গেলেন তিনি । ওপাশের কথা শুনলেন । 

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, একজনের মাথায় কোঁকড়া চুল। হ্যাঁ, বিদেশী, বোধহয় ইনডিয়ান, ‘ 

বললেন রেন । 

আবার কিছুক্ষণ নীরবতার পর তাকালেন কিশোরের দিকে। ‘তুমি কিশোর পাশা?’ 

মাথা ঝাঁকালো কিশোর । 

ফোনে কথা বললেন রেন, ‘হ্যাঁ, ওর নাম কিশোর পাশা।’ 

আবার ওপাশের কথা শুনলেন বিজ্ঞানী। চীফকে ধন্যবাদ দিয়ে নামিয়ে রাখলেন রিসিভার । 

‘ইয়ান ফ্লেচার তোমাদেরকে সাবধান করে দিতে বলেছেন,’ রেন বললেন ছেলেদেরকে । 

‘ঝামেলা পাকাতে নিষেধ করেছেন। তবে তোমরা ক্ষতিকর নও, একথাও বলেছেন। আসলে, নাক চুলকালেন তিনি, ‘তোমাদেরকে ভালোই বলেছেন, তবে আমার ব্যাপারে শিওর না তিনি । 

ঠিক এই সময় চিৎকার শোনা গেল ঘরের ভেতরে। তীক্ষ্ণ, লম্বিত, কাঁপা কাঁপা চিৎকার! 

‘হায় আল্লাহ!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস রোজারিও। ‘এলিজা! হলো কি 

মেয়েটার!” 

পাঁচ 

ওপরতলার হলঘরে পাওয়া গেল এলিজাকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে কুঁজো হয়ে 

৯৬ 

ভলিউম-১৬ 

আছে। তিন গোয়েন্দা আর রেনফোর্ডকে দেখে চেঁচিয়ে বললো, ‘পিঁপড়ে!’ দরজার দিকে হাত তুললো সে। ‘ওখানে! কোটি কোটি পিঁপড়ে!’ 

‘সর্বনাশ!’ দরজার কাছে ছুটে গেলেন ডক্টর। দরজা খুলে ঢুকলেন ছোট একটা সিটিংরুমে। ছেলেরাও ঢুকলো। অন্যপাশে বড় একটা বেডরুম দেখা গেল । বিশাল বিছানা পাতা। আর ওই বিছানায় ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে শত শত পিঁপড়ে । 

থমকে দাঁড়িয়েছেন ডক্টর। কি করবেন মনস্থির করতে পারছেন না। 

‘নরিটা!’ আবার চেঁচিয়ে উঠলো এলিজা। সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘জলদি স্প্রে নিয়ে এসো!’ 

‘এগুলোই আপনার হারানো পিঁপড়ে?’ জিজ্ঞেস করলো কিশোর। 

এগিয়ে গিয়ে পিঁপড়েগুলোকে কাছে থেকে দেখলেন ডক্টর। হ্যাঁ, এগুলোই ।’ ‘হায় হায়, এসব কি!’ পেছন থেকে বলে উঠলো আরেকটা কণ্ঠ । 

ফিরে তাকালো ছেলেরা। দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে নরিটা নিউম্যান। হাতে একটা পোকামাকড় মারার স্প্রে। তার কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মারছে এলিজা । 

‘এই, সরো তো তোমরা,’ ছেলেদের বললো নরিটা। ‘আমি দেখছি ওগুলোকে । 

বেশ হাসিখুশি কণ্ঠ। কথায় ব্রিটিশ টান, খাস লণ্ডন শহরের বাসিন্দা । এমন ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল, যেন ভয়াবহ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে চলেছে। ওষুধ স্প্রে করতে শুরু করলো পিঁপড়েগুলোর ওপর। 

‘আর ভয় নেই মিস,’ এলিজাকে অভয় দিলো সে। ‘এখুনি শেষ হয়ে যাবে শয়তানগুলো। বিছানার চাদরটা বদলে দেবো। ব্যস, সব পরিষ্কার। মনে হবে কিছুই হয়নি।’ 

জ্বলন্ত চোখে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এলিজা। ‘আপনার দোষ! সব আপনার দোষ! এ-বাড়িতে কখনও পিঁপড়ে ঢোকেনি। আপনার হতচ্ছাড়া গবেষণা…’ 

‘মিস ওয়াগনার,’ বাধা দিয়ে বললেন ডক্টর। ‘আমি আসার আগেই এখানকার পাহাড়ে ছিলো ওই পিঁপড়ে । বাড়িতে ঢুকেছে 

‘আপনাআপনি ঢোকেনি, শুধরে দিলো কিশোর। ‘ঢোকানো হয়েছে। বয়ে এনে ছেড়ে দেয়া হয়েছে ওখানে।’ 

ঝুঁকে বিছানার নিচ থেকে একটা কাঁচের জার বের করে আনলো সে। এখনও কয়েকটা পিঁপড়ে ঘোরাফেরা করছে ওটার ভেতর। ‘এটা কি আপনার?” রেনহার্ডকে জিজ্ঞেস করলো সে। 

মাথা ঝাঁকালেন বিজ্ঞানী। ‘কাকতাড়ুয়া যে চুরি করেছিলো, তারই কাজ এটা মনে হচ্ছে। 

সন্তুষ্টির হাসি ফুটলো কিশোরের মুখে। ‘চোর কাকতাড়ুয়া। দারুণ! ক্রমেই মজা বাড়ছে কেসটার।’ 

“এতো খুশি কেন!’ তীক্ষ্ণ হলো এলিজার কণ্ঠ। ফ্যাকাশে গালে চামড়ার নিচে রক্ত জমতে আরম্ভ করেছে, লাল লাল ফুটকির মতো লাগছে বাইরে থেকে। ‘যাও, 

৭- নিশাচর 

१ 

বেরোও! এই, আপনিও বেরোন! ওই শয়তানের বাচ্চাগুলোকে নিয়ে যান! দাঁড়ান, ব্যবস্থা করছি আজই! ভাইকে ডেকে কালই যদি না তাড়িয়েছি তো…’ 

‘ব্যস, হয়েছে!’ যেন রেগে যাওয়া একটা বাচ্চার সঙ্গে মোলায়েম গলায় কথা বলছে, এমনি ভঙ্গিতে বললো নরিটা। স্প্রেটা নামিয়ে রাখলো মাটিতে। চাদরটা ভাঁজ করলো, ভেতরে রইলো মরা পিঁপড়েগুলো । ওটা ডক্টরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নিন, নিয়ে যান। ভাববেন না ছেড়ে দেবো । ঠিকই খুঁজে বের করবো কার কাজ এটা ৷’ 

মুখ কালো করে চাদরটা নিলেন ডক্টর। তাঁর পেছন পেছন নিচতলায় নেমে এলো তিন গোয়েন্দা । 

হলে এসে থামলেন রেন। ছেলেদের দিকে তাকালেন। বললেন, ‘তোমাদের কেস এখানেই খতম । আমাকেও তাড়াবে কিনা বুঝতে পারছি না। এলিজার মেজাজ-মর্জির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। এই ভালো তো এই খারাপ। রাগ হলে এক কথা বলে, ঠাণ্ডা হলেই ভুলে যায়। দেখা যাক, সত্যিই আজ রাতে তার ভাইকে বলে কিনা!” 

পিঁপড়ে বোঝাই চাদরটা নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বেরোলেন তিনি। বিশাল বাড়িটার লিভিং রুম পেরিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো তিন গোয়েন্দা। আগের জায়গাতেই বসে কফি খাচ্ছেন মিসেস রোজারিও, পিঁপড়ের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়াই হলো না তাঁর। সামরিক পিঁপড়ের আনাগোনা যেন এখানে নিত্যদিনের ব্যাপার। তাঁকে বললো ওরা, চা খাওয়ার জন্যে আর থাকতে পারছে না। শুনে দুঃখ পেলেন যেন মহিলা, ভাবভঙ্গি দেখে সেরকমই মনে হলো। গুডবাই জানালেন 

ওদেরকে। 

রকি বীচে যখন ফিরলো তিন গোয়েন্দা, রাতের খাবারের সময় পেরিয়ে গেছে তখন। পরদিন সকালের আগে আর অদ্ভুত ঘটনাটা নিয়ে আলোচনায় বসতে পারলো না। পরদিন জমায়েত হলো স্যালভিজ ইয়ার্ডে, কিশোরের ওয়ার্কশপে। 

চেয়ারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে টিনের চালার দিকে তাকিয়ে ছিলো কিশোর, এই সময় ঢুকলো রবিন আর মুসা । 

কাকতাড়ুয়ার কথা ভাবছো?’ রবিন জিজ্ঞেস করলো। 

‘তুমি ভাবছো না?’ পাল্টা প্রশ্ন করলো কিশোর । 

নিশ্চয়ই। পিঁপড়েগুলোর কথাও। চুরি করে এনে কে ওগুলোকে ছেড়ে দিলো একজন ভদ্রমহিলার বিছানায়?” 

‘এমন কেউ, যে তাকে পছন্দ করে না,’ জবাব দিলো মুসা। ‘অবশ্য তাকে অনেকেরই পছন্দ হবে না। যা বদমেজাজ 

টিপটিপ করে জ্বলতে শুরু করলো ছাপার মেশিনের ওপরে বসানো বাতিটা। সংকেত। হেডকোয়ার্টারে টেলিফোন বাজছে। 

হুঁ, এটাই ভেবেছিলাম,’ আলোটার দিকে তাকিয়ে ভারিক্কি চালে বললো কিশোর। ‘সকাল থেকেই বসে আছি ওই টেলিফোনের অপেক্ষায়।’ 

দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনা সরিয়ে পাইপের ভেতরে ঢুকলো মুসা। হামাগুড়ি দিয়ে এসে তিনজনে ঢুকলো ট্রেলারে। 

৯৮ 

ভলিউম—১৬ 

বেজেই চলেছে টেলিফোন । 

জবাব দিলো মুসা। কান পেতে ওপাশের কথা শুনে হাসলো। ‘না, আমি মুসা। কিশোর এখানেই আছে। রবিনও।’ 

আবার শুনলো ওপাশের কথা। বললো, ‘ধরুন।’ তারপর মাউথপীসে হাত চাপা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে, আন্দাজ করতে পারো?’ 

‘এলিজা ওয়াগনার,’ শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। ‘আমাদেরকে চাইছে । তদন্ত করে খুঁজে বের করতে বলছে কাকতাড়ুয়া সেজে কে তাকে ভয় দেখায়। কে পিঁপড়ে ছেড়ে রেখে গেছে বিছানার ওপর। 

জিনিয়াসেরাও ভুল করে অনেক সময়,’ কিশোরের জবাব ঠিক হয়নি বলে বেশ খুশি লাগছে মুসার। হাসি ছড়িয়ে পড়েছে সারা মুখে। ‘ডক্টর হেনরি রেনহার্ড। কাকতাড়ুয়া সেজে কে এলিজাকে ভয় দেখিয়েছে, কে তার বিছানায় পিঁপড়ে ছেড়েছে, খুঁজে বের করে দিতে বলছেন। আমাদেরকে গিয়ে দেখা করতে বলেছেন তাঁর সঙ্গে। ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারের কাছ থেকে জেনে নিয়েছেন আমাদের ফোন নম্বর । 

‘হাহ্-হা!’ হাততালি দিয়ে বললো কিশোর। ‘কেস একটা পেলাম অবশেষে । আমি যাবো। রবিন, তুমি?’ 

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো রবিন 

মাউথপীস থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে ডক্টরকে বললো মুসা, ‘এখুনি রওনা হচ্ছি ‘খামরা।’ 

ছয় 

এক ঘণ্টাও লাগলো না, ওয়াগনার এস্টেটের লাল গোলাবাড়িটায় পৌঁছে গেল তিন গোয়েন্দা। 

‘কাল রাতে ভাইকে ফোন করেনি এলিজা,’ ঘোষণা করলেন ডক্টর। বেশ খুশি খুশি লাগছে তাঁকে। টেবিলে কনুই রেখে উঁচু একটা টুলের ওপর বসে আছেন। টেবিলে পড়ে রয়েছে কতগুলো যন্ত্রপাতি-কর্নিক, সাঁড়াশি আর চিমটা। ‘জানি, দখলেও উইলিয়াম ওয়াগনার সেকথা শুনতেন না। তবে বলাও যায় না অবশ্য, বোনের কথায় ভাই কখন রাজি হয়ে যায়। সেজন্যেই চিন্তায় ছিলাম। যাকগে, মাসল কথায় আসি । এই কাকতাড়ুয়ার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। এটা “খন এলিজারই শুধু নয়, আমারও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার পিঁপড়ে নিয়ে গয়ে তাকে ভয় দেখাতে শুরু করেছে কেউ। একটা গোলমাল বাধিয়ে আমাকে সরানোর চেষ্টা এটা, বুঝতে পারছি। কিন্তু গবেষণা ফেলে এখান থেকে যেতে চাই । আমি । 

‘সকালে ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারকে ফোন করেছিলাম,’ বলতে থাকলেন জ্ঞানী। ‘কাল রাতে বিছানায় পিঁপড়ে ওঠার কথা বলেছি। এলিজা যে কয়েকবার শকতাড়ুয়াটাকে দেখেছে, একথাও বলেছি। ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেননি ” । তাঁর ধারণা, এসব কোনো দুষ্টু ছেলের কাজ । আমাদেরকে বিরক্ত করে মজা 

নিশাচর 

পাচ্ছে । তিনি বললেন, এটা তোমাদের উপযুক্ত কেস ।’ 

‘আপনার কি ধারণা?’ জিজ্ঞেস করলো কিশোর। ‘দুষ্ট ছেলের কাজ?’ 

আশেপাশে কোনো ছেলেই নেই । দুই মাইলের মধ্যে বাড়ি বলতে ওয়াগনার হাউস আর মসবি মিউজিয়মটাই শুধু। ওয়াগনার হাউসে যারা থাকে, সবার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তোমাদের। মসবি মিউজিয়মে থাকেন কিউরেটর স্টেবিনস কলিগ আর দু’জন গার্ড। জায়গাটার দেখাশোনাও ওরা দু’জনেই করে। রোজ পাঁচটা বাড়ি ফিরে যায়। মিউজিয়মেই থাকেন কলিগ। মানুষকে বিরক্ত করার মতো লোর নন তিনি।’ 

‘হুঁ, বুঝলাম,’ কিশোর বললো। “তিন গোয়েন্দাকে কাজে লাগাতে চাইে গোড়া থেকে সব খুলে বলুন। আপনি যা যা জানেন । কাকতাড়ুয়া রহস্যের সমাধা হয়তো খুব একটা কঠিন কাজ হবে না।’ 

পকেট থেকে নোটবুক আর পেন্সিল বের করে নোট নিতে তৈরি হলো রবিন 

‘মনে হচ্ছে,’ শুরু করলেন ডক্টর। কাকতাড়ুয়া রহস্যের শুরুটা আর্মি করেছি, খেতের ধারে পুতুল দাঁড় করিয়ে দিয়ে পুরনো কাপড় দিয়ে বানিয়েছি চেয়ে নিয়েছি ওগুলো মিসেস নিউম্যানের কাছ থেকে । চিলেকোঠা থেকে এে দিয়েছে সে। খেতে ফসলও আমি ফলিয়েছি, পিঁপড়ের খাবারের জন্যে। শস খেতের ওপর যে কি লোভ পোকামাকড় আর পিঁপড়েদের, কল্পনাই করতে পারে না তোমরা।’ 

‘তোমাদেরকে আগেই বলেছি, পিঁপড়ের টানেই ঘর ছেড়েছি আমি, এখানে এসে হাজির হয়েছি। দুনিয়ায় পিঁপড়েই আমার একমাত্র আকর্ষণ। ওদেরকে নিয়ে থাকি, গবেষণা করি, ফলে এখানকার লোকজনের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠেি আমার। বেশির ভাগ সময়ই ঘরে বসে থাকি। গবেষণার জন্যে টাকা ছাড়া বিশাল গোলা বাড়িটা আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন উইলিয়াম ওয়াগনার। এটাে ল্যাবোরেটরি বানিয়েছি আমি । গেস্ট হাউসে থাকি, ভাড়া দিতে হয় না।’ 

‘গেস্ট হাউস?’ কিশোর জানতে চাইলো, ‘কোথায় ওটা?’ 

‘ওই বাড়িটার,’ ওয়াগনারদের বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করলেন ডক্টর। ‘পেছনে কিছু দূরে। একটা পাহাড়ের মাথায়। কাল তোমরা দেখনি। ওয়াগনার ম্যানশ আর ওটার মাঝে অনেক ওক গাছ আছে, সেজন্যে দেখা যায় না ।’ 

না।’ 

ভালোই ব্যবস্থা হয়েছে এখানে আপনার। বুঝতে পারছি, কেন যেতে চা 

হ্যাঁ। এখান থেকে চলে যেতে হলে মস্ত ক্ষতি হয়ে যাবে আমার। ভালো কাজ করছিলাম, এলিজা আসার পর গড়বড় হয়ে গেল। 

নোটবুক থেকে মুখ তুললো রবিন। ‘আগে এখানে ছিলো না ও?’ 

‘না, ছিলো না। আমি এসেছি মে মাসে। ও এসেছে জুনে। ওর কথা নিশ্চ একটা জানো না তোমরা। ঘুরে বেড়ানোর ভীষণ শখ। বেশির ভাগ সময় কাটায় ইউরোপে। পুরুষ মানুষের সঙ্গে গোলমাল না হলে ফেরে না।’ 

चिक 

১০০ 

“কি না হলে ফেরে না?’ বুঝতে পারছে না রবিন। 

হাসলেন রেন। ছেলেদের কাছে বলতে লজ্জা পাচ্ছেন যেন। ‘প্রেমটেম- এক 

ভলিউম- 

বেশি করে আরকি এলিজা। বহুবার এনগেজমেন্ট করেছে, কিন্তু কাউকে বিয়ে করেনি। কোনো না কোনোভাবে ভেঙে গেছে এনগেজমেন্ট । গোলমাল একটা হয়েই যায়। তখন বাড়ি ফিরে আসে সে। সান্তা মনিকা মাউনটেইনের চমৎকার পরিবেশে হাওয়া বদল করে, ভাঙা হার্ট জোড়া লাগায়। এই মুহূর্তে একজন হাঙ্গেরিয়ান কাউন্টকে ভোলার চেষ্টা করছে এলিজা। 

‘পোকামাকড় দুচোখে দেখতে পারে না ও। তোমরা নিশ্চয় খেয়াল করেছো ব্যাপারটা। কাজেই আমাকে তার এলাকায় পিঁপড়ে নিয়ে গবেষণা করতে দেখলে যে খুশি হবে না, এ-তো জানা কথাই । কাজেই কাকতাড়ুয়াটাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সন্দেহ করে বসেছে এলিজা। প্রথম কারণ, আমাকে পছন্দ করে না। দ্বিতীয় কারণ, খেতের বেড়ায় কাকতাড়ুয়া লাগিয়েছি আমি । 

‘প্রায়ই দেখে নাকি ওটাকে?’ জিজ্ঞেস করলো কিশোর। 

‘পাঁচবার দেখেছে। প্রায় পাগল বানিয়ে দিয়েছে ওকে। একবার কতগুলো পোকা মাকড় ছেড়ে দিয়েছিলো ওটা তার গায়ে। মিসেস রোজারিওর বিশ্বাস, এলিজা পুরো পাগল। কেউই বিশ্বাস করে না তার কথা। করার কথাও নয়। জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া আছে, এ-কথা কে বিশ্বাস করবে? মিসেস রোজারিও তো আজকাল বেশ চাপাচাপিই করছেন, বেভারলি হিলে গিয়ে একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখিয়ে আনানোর জন্যে। কিন্তু আমি জানি এখন, কাকতাড়ুয়া যেহেতু সত্যি আছে, এলিজাকে ভালো করা ডাক্তারের কর্ম নয়।’ 

মিসেস রোজারিওর কথা বলুন তো । এমন আচরণ করেন… 

‘যেন তিনিই বাড়ির মালিক, কিশোরের কথাটা শেষ করে দিলেন ডক্টর। ‘তা করেন বটে । তিনি এলিজার মায়ের সোশাল সেক্রেটারি ছিলেন । মিস্টার ওয়াগনার অনেক আগেই মারা গেছেন, মিসেস মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। অ্যাকসিডেন্ট করেছিলেন মিসেস ওয়াগনার। সুইমিং পুলে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন পানি ছিলো না ওটাতে, মেরামতের কাজ চলছিলো বলে । দুটো হিপই ভেঙে যায় তাঁর। কোনোদিনই আর ঠিক হবে না, ফলে বাকি জীবনটা হুইল চেয়ারেই কাটাতে হবে।’ 

‘নিউম্যানদের কি খবর?’ 

‘ওরা নতুন কর্মচারী। গত ফেব্রুয়ারিতে মিসেস রোজারিও চাকরি দেন ওদের। এই তো, এই ক’জন লোকই আছে ওয়াগনার ম্যানশনে। এছাড়া খালি আছে, তবে ওরা সব সময় থাকে না। হপ্তায় দু’বার করে আসে, কাজ করে দিয়ে চলে যায়। পুল দেখাশোনা করে যে লোকটা, সে-ও ওভাবেই আসে। মিস্টার কলিগ প্রায়ই আসেন মিসেস রোজারিওর সঙ্গে দাবা খেলতে। তবে তাঁকে সন্দেহ করার কোনো মানে নেই । অন্য কেউ লেগেছে এলিজার পেছনে । কেন, কে জানে ! আমাকে দোষ দেয় সে, সন্দেহ করে, হয়তো এরকম করে করে একদিন ভাগাবে আমাকে এখান থেকে। তার জন্যেই খারাপ হবে সেটা। 

‘তার জন্যে?” কথাটা ধরলো কিশোর। ‘কেন?” 

‘আগেই বলেছি, এখানকার পিঁপড়েদের সম্পর্কে এখনও তেমন জানি মা আমি। কি রকম স্বভাব, কতোটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে, কতোটা ক্ষতিকর, জানি না। 

নিশাচর 

একটা কথাই শুধু জানি, ওগুলো সামরিক পিঁপড়ে। আর সামরিক পিঁপড়েরা পায় তা-ই খায়। 

*এক সময় না এক সময় পাহাড়ের ওপরের কলোনিগুলোতে ভাগাভাি হবেই। শ্রমিকদের নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে অল্পবয়েসী রানীরা। নতুন কলোি গড়বে। আমি তখন এখানে থাকতে চাই। কয়টা কলোনি হয়, কতো বড়, এব কতো তাড়াতাড়ি, দেখতে চাই। কতো দূরে মাইগ্রেট করবে ওরা, বুঝতে পারা না। যতো দূর যাবে, জীবনের চিহ্ন রাখবে না। আফ্রিকান পিঁপড়েরা সারি দিে চলে। চলার পথে জীবন্ত যা-ই পড়ুক, ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই ৷ এখানকা পিঁপড়েগুলো কি কি খাবে, ঠিক করে বলতে পারছি না এখনও। 

আপনার…আপনার কি মনে হয়,’ মুসা ভয় পেয়ে গেছে। ‘মারাত্মক হে উঠবে মানুষের জন্যেও?’ 

‘বিশ্বাস কি? হাজার হলেও সামরিক পিঁপড়ে, আফ্রিকান পিঁপড়ের জাতভাই হলে অবাক হবো না। এখানে এদেরকে ছুঁচো আর মেঠো ইঁদুর খেতে দেখেছি আমি যখন গেছি, বেচারা প্রাণীগুলোর খুদে কঙ্কালের ওপর তখনও জড়ো হে ছিলো পিঁপড়ে। ওরা যখন সরলো, এককণা মাংসও আর তখন লেগে নেই একেবারে ঝকঝকে কঙ্কাল। 

‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন,’ কিশোর বললো। ‘টাইম বম্ব রয়েে এখানে। পিঁপড়ের বোমা!’ 

মাথা ঝাঁকালেন রেন। বুঝতে পেরেছো । যখন তখন ফাটতে পারে! 

ল্যাবোরেটরির খোলা দরজায় খুট্ করে শব্দ হলো। ফিরে তাকালো সবাই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এলিজা। চোখে আতঙ্ক। চেঁচিয়ে বললো, ‘সাংঘাতিক! ভীষণ কথা! বাবা গো, আমার জায়গায় খুনে পিঁপড়ে! আমি…আমি আর সহ করতে পারছি না!’ 

কাঁদতে আরম্ভ করলো সে। 

সাত 

‘এলিজা,’ রাগ করে বললেন ডক্টর। ‘কিছু শুনলেই ওরকম খেপে যান কেন শান্তভাবে যদি নিতে পারেন, তাহলেই আর কিছু হয় না।’ ধরে এনে তাকে বসি দিলেন টেবিলের পাশের একটা টুলে। একবাক্স টিস্যু পেপার ঠেলে দিলেন তা দিকে। ‘চোখ মুছুন, শান্ত হোন, লক্ষ্মী মেয়ের মতো। আমি কথা দিচ্ছি, যতোক্ষ আমি আছি এখানে, ওরকম খারাপ কিছু ঘটতে দেবো না। শুনুন, এই ছেলেগুে এসেছে কাকতাড়ুয়ার ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করতে ।’ 

একটা পেপার বের করে নিয়ে চোখে চাপ দিলো এলিজা। কি বললেন আমাদেরকে? এই আমরাটা কারা? আপনি এবং আমি?’ 

নিশ্চয়। আমাদেরকেই কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে। আপনার সামনে ছা থেকে বেরিয়ে আসে ওটা। আমার মাথায় বাড়ি মারে, জ্বার চুরি করে নিয়ে যায় কিছু একটা করার সময় হয়েছে আমাদের।’ 

১০২ 

ভলিউম- 

হেঁচকি তুললো এলিজা। ‘বেশ। কিন্তু এরা কিভাবে কি করবে? এই ছেলেমানুষরা? 

‘তাহলে কি বড় কোনো গোয়েন্দার কাছে যেতে চান?’ প্রশ্ন তুললেন ডক্টর। ‘বিশ্বাস করবে আপনার কথা? একটা কাজই করতে পারে, মোটা টাকা ফিস নিয়ে চুপচাপ কথা শুনতে পারে আপনার। তারপর হেসে উড়িয়ে দেবে। আপনাকে বোঝানোর চেষ্টা করবে মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে যেতে। ওই পরামর্শের জন্যে টাকা দিতে চান?’ 

‘একটা পয়সাও না! ঠিকই বলেছেন । আমাকে স্রেফ পাগল ভাববে । 

‘কিন্তু আমি জানি আপনি পাগল নন। সত্যিই দেখেছেন কাকতাড়ুয়াটাকে । আমিই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ । আমার মাথায় বাড়ি মেরেছে ওটা।’ 

কেঁপে উঠলো এলিজা । ‘কাকতাড়ুয়া! ভয়ঙ্কর! সারা গায়ে মাছি আর মাকড়সা কিলবিল করে! ভেতরে, বাইরে, সবখানে । 

থাকে। 

‘আমি তো জানতাম,’ কিশোর বললো। ‘কাকতাড়ুয়ার ভেতরে শুধু খড় 

‘তা তো নিশ্চয়ই থাকে। আর খড়ের ভেতরে বাসা বাঁধে মাকড়সা। গায়ের ওপর যেদিন কাকতাড়ুয়া পড়বে, সেদিন বুঝতে পারবে। আমার গায়ে পড়েছিল একবার। হ্যালোউইন পার্টিতে খেলার জন্যে আব্বার সঙ্গে কুমড়ো কিনতে গিয়েছিলাম একবার এক চাষীর বাড়িতে। উপত্যকায়। ওখানেও খেতের বেড়ায় কাকতাড়ুয়া ছিলো, এখানে যেমন আছে। কাছে থেকে দেখতে গিয়েছিলাম বেড়ায় ওঠার চেষ্টা করছি…এই সময়…এই সময়… 

‘ভেঙে পড়লো ওটা আপনার গায়ে?’ 

মাথা ঝাঁকালো এলিজা। ‘কি সাংঘাতিক! এত্তো নোংরা! কয়েক লাখ বছর ধরে বোধহয় ছিলো ওখানে। ভেঙে পড়লো। টুকরো টুকরো হয়ে গেল আমার গায়ের ওপর পড়ে। ভেতরে মাকড়সার ছড়াছড়ি। আমার সারা গায়ে ছুটোছুটি করতে লাগলো ওগুলো । মুখে উঠে এলো, চুলের মধ্যে ঢুকে গেল! বাপরে বাপ, কি বলবো! কোনো দিন ভুলবো না আমি! 

‘হুমমম!’ নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। ‘কাকতাড়ুয়া আর মাকড়সাকে তাহলে ভীষণ ভয় পান আপনি!’ 

‘কোনো পোকামাকড়ই পছন্দ করি না আমি।’ চারপাশে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেল এলিজার, ডক্টর রেনের ল্যাবোরেটরিতে রয়েছে সে। 

‘আমি জানি, কেন আপনি আমাকে পছন্দ করেন না,’ ডক্টর বললেন । ‘পোকামাকড় নিয়ে থাকি বলে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাকে বিরক্ত করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। কেন করবো বলুন? আমার তাতে কি লাভ?’ 

‘অন্য কারোই বা কি লাভ?’ এলিজার জিজ্ঞাসা। কারো বাড়া ভাতে ছাই দিইনি আমি । কারো ক্ষতি করিনি। আমার বাড়িতে শান্ত ভাবে থাকার চেষ্টা করছি আমি, কারো কোনো কিছুতেই বাগড়া দিইনি। তাহলে কেন? কেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছে হতচ্ছাড়া কাকতাড়ুয়াটা! 

চোখ দেখেই বোঝা গেল আবার কেঁদে ফেলবে এলিজা । 

নিশাচর ‘ 

১০৩ 

সেটা ঠেকানোর জন্যেই তাড়াতাড়ি বললো কিশোর, ‘মিস ওয়াগনার, যুক্তিতে আসুন। যে আপনাকে বিরক্ত করছে, সে ভালো করেই জানে আপনি কাকতাড়ুয়াকে ভয় পান। ক’জন লোক জানে একথা?’ 

সোনার একটা কানের দুলে আঙুল বোলালো এলিজা । ভাবলো । ‘গোপন কথা নয় এটা। যে কেউ জানতে পারে। মিসেস রোজারিও জানে। আমাদের সঙ্গে সেদিন সে-ও গিয়েছিল। কাকতাড়ুয়াটাকে আমার ওপর ভেঙে পড়তে দেখেছে । মাকড়সাগুলো দেখেছে। তবে মিসেস রোজারিও কাকতাড়ুয়া সেজে আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, একথা ভাবতেই পারি না আমি । কারণ আমাকে দারুণ ভালোবাসে ও। কখনও কষ্ট দেয়নি। আর ভয় দেখানোর ইচ্ছে থাকলেও পারবে না । কি করে পারবে? গত পাঁচ বছর ধরে হুইলচেয়ার থেকেই উঠতে পারে না । শুতে পর্যন্ত পারে না নিজে নিজে। ধরে তুলে তাকে শুইয়ে দিতে হয় ।’ 

‘নিউম্যানরা জানতো?’ জিজ্ঞেস করলো কিশোর। ‘কাকতাড়ুয়ার ব্যাপারটা শুরু হওয়ার আগে?’ 

‘হয়তো জানে। এবার বাড়ি ফেরার পর একরাতে মিসেস রোজারিওর সঙ্গে বসে টিভি দেখছিলাম। উইজারড অভ ওজ ছবিটা হচ্ছিলো। কাকতাড়ুয়া দেখেই চ্যানেল বদলে দিলাম। অথচ সত্যি সত্যি কাকতাড়ুয়া নয় ওটা; মানুষ। কাকতাড়ুয়ার অভিনয় করেছে রে বোলজার। ওই সময় ওখানে ছিলো নিউম্যানরা। মিসেস রোজারিওর সঙ্গে আলোচনা করেছি, এখনও কি কম ভয় পাই কাকতাড়ুয়াকে। নিউম্যানদেরকে পরে হয়তো আমার ছেলেবেলার গল্প বলেছে মিসেস রোজারিও, জানি না।’ 

‘আমাকেও বলেছেন,’ ডক্টর জানালেন। ‘ছবিতেও কাকতাড়ুয়াকে ভয় পান দেখে দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো তাঁর।’ 

‘সেদিন স্টেবিনস কলিগও ছিলেন সেখানে,’ এলিজা বললো। ‘এখন মনে পড়ছে। মিসেস রোজারিওর সঙ্গে গল্প করতে প্রায়ই আসেন। আমার কাকতাড়ুয়া- ভীতির কথা হয়তো তিনিও জেনে গেছেন। 

‘জ্যান্ত কাকতাড়ুয়াটাকে আপনি প্রথম দেখার আগেই কি এসব ঘটনা ঘটেছে?’ জানতে চাইলো কিশোর । 

‘হ্যাঁ। বাড়ি ফিরেছি যে হপ্তায়, সে হপ্তায়ই। সবে তখন মুনটাকে ঠিক করার চেষ্টা করছি। ইউরোপে একটা গোলমাল হয়েছিল। 

চুপ হয়ে গেল এলিজা। ভেঙে যাওয়া এনগেজমেন্টের কথা ভাবলো কিশোর।, এলিজা কি ধরনের মহিলা ভেবে অবাক হলো। মুখের চারপাশে রেখা পড়েছে। তরুণী আর এখন কিছুতেই বলা চলে না তাকে। সর্বক্ষণ অসুখী । 

‘টিভিতে ওই সিনেমা চলার কয়েকদিন পর আবার বললো এলিজা। ‘এক বিকেলে গাড়ি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। উপকূল ধরে চলেছিলাম। হঠাৎ দেখি ওটা গাড়ির পেছনের সীটে বসে আছে! আমাকে তাকাতে দেখেই খলখল করে হেসে উঠলো। গাড়িটা কনভারটিবল, ছাত নেই, উঠতে ওটার কোনো অসুবিধেই হয়নি। ঝটকা দিয়ে দুদিকে হাত ছড়ালো, আর সঙ্গে সঙ্গে দেখি… দেখি… আমার চুলে মাকড়সা কিলবিল করছে!’ সেকথা কল্পনা করে শিউরে উঠলো এলিজা । 

১০৪ 

ভলিউম-১৬ 

পিঁপড়ে নয়, মাকড়সা, বুঝেছো! এখানকার পাহাড়ে অনেক আছে! কালো কালো, ইয়া বড় বড় একেকটা । 

‘গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে শুরু করলাম। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল ওটা। ছুটে এলো ব্রড আর তার বৌ । ততোক্ষণে চলে গেছে ওটা। 

‘খাইছে!’ সহানুভূতির সুরে বললো মুসা। ‘অদ্ভুত ব্যাপার!’ 

‘হ্যাঁ।’ 

তারমানে কাকতাড়ুয়াটা জানে, কি কি দেখে ভয় পান আপনি, মনের ভাবনাগুলোই যেন প্রকাশ করলো কিশোর। ‘আপনাদের বাড়ির যে কারো কাছ থেকে কথাটা জেনে থাকতে পারে সে। স্টেবিনস কলিগের কাছ থেকেও। আচ্ছা, মিস্টার কলিগের সম্পর্কে কিছু বলুন তো।’ 

শ্রাগ করলো এলিজা । “বলার তেমন কিছু নেই। অনেক দিন ধরে মসবি মিউজিয়মের কিউরেটর হয়ে আছেন। মিস্টার মসবির মৃত্যুর পর থেকেই। বাস করেন মসবি হাউসে । এই-ই জানি, ব্যস, আর কিছু না। 

‘তেমন কিছু জানেন না,’ নোট নিতে নিতে বললো রবিন। 

ডক্টরের দিকে কিশোর তাকাতেই মাথা নাড়লেন তিনি। ‘আমার দিকে চেয়ে লাভ নেই। কিউরেটর সম্পর্কে কোনো আগ্রহ নেই আমার।’ 

ভুরু কুঁচকে বসে আছে এলিজা। ডক্টর থামতেই বললো, ‘আগ্রহ জাগানোর মতো লোকও নন কলিগ। গ্রাহাম আর্ট ইনস্টিটিউটে কিছুদিন কাজ করেছেন, তারপর চলে এসেছেন মিস্টার মসবির ওখানে। মসবি হাউসেই থাকেন, দিনের বেলা যারা কাজ করে, তাদের দেখাশোনা করেন। মিউজিয়মের ছবি আর অন্যান্য জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখেন, সাজানো-গোছানো, দর্শক এলে তাদেরকে গ্যালারি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান। আসার আগে যোগাযোগ করে নিতে হয় সবাইকে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিতে হয়, যাতে কোনো অসুবিধে না হয় তাদের। কলিগ একা মানুষ, ক’দিক সামলাবেন? তাই এই ব্যবস্থা করেছেন তিনি। ভালো চাকরি।’ 

‘পরিবার আছে?’ জিজ্ঞেস করলো কিশোর । 

‘না। কখনও ওসব নিয়ে আলোচনা করতে শুনিনি তাঁকে।’ 

‘নিঃসঙ্গ মানুষ, না? অবসর সময়ে কি করেন? 

‘প্রায় কিছুই না। মিসেস রোজারিওর সঙ্গে এসে দাবা খেলেন। আর কিছু করতে দেখিনি তাঁকে।’ উজ্জ্বল হলো এলিজার মুখ। মনে পড়েছে, আজ দুপুরে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খেতে আসছেন। তারপর নিশ্চয়ই দাবা খেলবেন । আসবে নাকি? দেখা করতে পারো ইচ্ছে করলে। লাঞ্চটাও না হয় আমাদের ওখানেই সারলে?’ 

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। ‘থ্যাংক ইউ। অবশ্যই দেখা করবো। আপনাদের পরিবারের সঙ্গে জড়িত, নিয়মিত দেখা করতে আসে, এরকম সবার সঙ্গেই কথা বলতে চাই আমরা। আমার বিশ্বাস, অতিপরিচিত কেউই আপনার মাথাব্যথার কারণ, সে-ই কাকতাড়ুয়া সেজে ভয় দেখাচ্ছে আপনাকে।’ 

নিশাচর 

১০৫ 

আট 

ওয়াগনার ম্যানশনের ডাইনিং রুম। টেবিলে লাঞ্চ দেয়া হয়েছে। লম্বা টেবিলের এক মাথায় বসে আছেন মিসেস রোজারিও। আরেক মাথায় এলিজা। মিসেস রোজারিওর ডানে বসেছেন স্টেবিনস কলিগ। কথা বলছেন অনর্গল, প্রায় পুরোটাই মসবি মিউজিয়ম সম্পর্কে । 

‘খুব দামী একটা ভারমিয়ার আছে আমাদের,’ তিন গোয়েন্দার দিকে নজর ফেরালেন তিনি। গোল্ডরিড় চশমার ওপাশে চকচক করছে নীল চোখ। খাটো করে ছাঁটা চুল, বেশির ভাগই শাদা হয়ে গেছে। চামড়ার রঙে লালচে আভা চামড়া এতো পাতলা, মুখের রগগুলোও বোঝা যায় কোন্‌দিক দিয়ে গেছে। এক অসাধারণ আঁকিয়ে ছিলো এই ভারমিয়ার! হাতে গোনা বড় যে কজন ওলন্দাজ আর্টিস্ট আছে, তাদের একজন। মিসেস রোজারিও তো সাংঘাতিক ভক্ত তার, তাই না মিসেস রোজারিও?’ 

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস রোজারিও। 

‘ভারমিয়ারের একটা কপি আছে মিসেস রোজারিওর কাছে,’ কিউরেটর বললেন। ‘ওটার নাম “উয়োম্যান উইথ আ রোজ”, এঁকেছে একজন ছাত্র । ভারমিয়ারকে নিয়ে গবেষণা করতে চায় অনেকে । কি করে আঁকতো, বোঝার চেষ্টা করে। তাদের গবেষণায় বাধা দিই না আমরা। গ্যালারিতে এসে যদি এঁকে নিয়ে যেতে চায়, দিই । তবে তার জন্যে আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে রাখতে হয় ওদের। আর, আসল ছবিটার সমান করে আঁকতে দিই না। মাপ ছোট-বড় হলে অসুবিধে নেই, তবে সমান হওয়া চলবে না । 

‘আমারটা আসলটার চেয়ে বড়,’ মিসেস রোজারিও বললেন। ‘সমান হলে মুশকিল হয়ে যেতো। যারা চেনে না, তারা বলতেই পারবে না কোন্‌টা আসল কোটা নকল।’ 

খাওয়া শেষ করে ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে ওটা নামিয়ে রাখলেন মিসেস রোজারিও। ছেলেদের দিকে চেয়ে বললেন, আমার ছবিটা দেখতে চাও?’ 

ওদের জবাবের অপেক্ষা করলেন না কলিগ। মিসেস রোজারিওর হুইলচেয়ারটা ঘুরিয়ে ঠেলে নিয়ে চললেন। ওদেরকে অনুসরণ করে হল পেরিয়ে ছোট একটা সিটিংরুমে চলে এলো তিন গোয়েন্দা আর এলিজা। ওটার জানালা দিয়ে বাড়ির পেছনের লন দেখা যায়। একটা খোলা দরজা দিয়ে আরেকটা ঘর দেখা গেল। সিটিংরুমের লাগোয়া বেডরুম । 

‘ওটা আমার মায়ের ঘর,’ এলিজা বললো। ঘরটা আমার খুব পছন্দ শীতকালে দারুণ আরাম । আগুন জ্বেলে দিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে । 

‘হ্যাঁ, ভালো,’ মিসেস রোজারিও বললেন। ‘কিন্তু এলিজা, আর তো থাকতে পারবো না আমি এখানে। থাকা উচিতও না। সার্ভেন্টস উইঙে বাড়তি শোবার ঘর আছে। আমি ওখানেই বরং চলে যাবো। হাজার হোক, মনিবের ঘর। মনিব যখন নেই…’ 

১০৬ 

ভলিউম-১৬ 

‘দূর, কি যে বলেন,’ হাত নেড়ে তাকে থামিয়ে দিলো এলিজা । ‘আপনি যাবেন কেন? থাকুন । 

ম্যানটেলের ওপরে ঝোলানো ছবিটা হাত তুলে দেখালেন মিসেস রোজারিও। ‘ওই যে, ডারমিয়ারের কপি।’ 

নীরবে দেখতে লাগলো তিন গোয়েন্দা। একজন তরুণীর প্রমাণ সাইজের একটা ছবি । নীল পোশাক পরা। মাথায় লেস লাগানো ক্যাপ। হাতে একটা হলুদ গোলাপ ফুল নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। 

‘খুব সুন্দর, তাই না?’ আরেকবার প্রশংসা করলেন কলিগ । 

চেয়ার নিয়ে তাঁর দিকে ঘুরলেন মিসেস রোজারিও। আজ বিকেলে নিশ্চয় কেউ আসছে না মিউজিয়মে, না? এক কাজ করলে পারেন। ওদেরকে নিয়ে যেতে পারেন,’ তিন গোয়েন্দার কথা বললেন তিনি। ‘আসলটাই দেখুক। নিজে সঙ্গে থেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তো কতোজনকেই মিউজিয়ম দেখান। ওদেরকেও নাহয় একটু দেখালেন। 

‘খুশি হয়েই দেখাবো,’ কলিগ বললেন। ‘কিন্তু আজ দাবা খেলার কথা ছিলো, ভুলে গেছেন?’ 

‘দাবা পরেও খেলা যাবে।’ 

‘বেশ। এই, তোমাদের দেখার ইচ্ছে আছে?’ 

‘নিশ্চয়ই!’ বলতে একটা মুহূর্ত দেরি করলো না কিশোর। আমার চাচা-চাচী একবার দেখতে এসেছিলেন এই যাদুঘর। তখন মিস্টার মসবি বেঁচে ছিলেন । এখনও এর কথা বলেন আমার চাচী । আর সহজে কোনো কিছুর প্রশংসা করেন না তিনি। 

এলিজার দিকে তাকালেন কলিগ । তুমি আসবে?’ 

না। ধন্যবাদ। কয়েক লক্ষবার দেখেছি আমি ওটা।’ 

তাহলে তোমরাই চলো,’ ছেলেদের বললেন কলিগ। এলিজার রূঢ় আচরণে কিছু মনে করলেন না। মিসেস রোজারিও, আসছি। দেরি হবে না। 

ছেলেদেরকে নিয়ে রাস্তায় বেরোলেন কিউরেটর। নিয়ে চললেন জানালাহীন দুর্গের মতো বাড়িটার দিকে, যেটাতে সাজানো রয়েছে মসবিদের সংগ্রহগুলো। 

অনেক ব্যাংকের ভল্টও এই বাড়িটার মতো সুরক্ষিত নয়,’ যেতে যেতে বললেন কলিগ । 

বাড়ির সদর দরজার কাছে এসে ঘণ্টা বাজালেন। খুলে দিলো একজন প্রহরী । ঢুকলো সবাই। ঠিক ভেতরেই বর্গাকার একটা প্রবেশঘর। কয়েকটা ডিসপ্লে কেস পড়ে রয়েছে। আর রয়েছে একটা পুরনো পর্দা, তাতে আঁকা রয়েছে-এক তরুণী ফুলের বাগানে বসে বই পড়ছে। 

দামী দামী শিল্পকর্ম রয়েছে এ-বাড়িতে, কলিগ বললেন। ‘গুগুলো যাতে কেউ চুরি-ডাকাতি করে না নিতে পারে; সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তৈরি হয়েছে বাড়িটা। দেখছোই তো, জানালা নেই। অ্যালার্ম সিসটেমও এই বাড়ির জন্যে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। দিনের বেলা লোকে দেখতে আসে, সে জন্যেই শুধু তখন পাহারার ব্যবস্থা রেখেছি। আলোকিত করার ব্যবস্থাও হয়েছে অনেক 

নিশাচর 

১০৭ 

ভেবেচিন্তে, যত্ন করে। যাতে দিনের আলোর মতো আলো হয়, অথচ ছায়া না পড়ে, বেশি গরম হয়ে না যায়। হলে নষ্ট হয়ে যাবে ছবি, রোদ লাগলে যেমন হয় । তাপমাত্রা আর বাতাসের আর্দ্রতা এখানে চব্বিশ ঘন্টাই একরকম থাকে, হেরফের হয় না । যে কোনো কিউরেটরের স্বপ্ন বলতে পারো এটাকে ।’ 

আজব বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন কলিগ। নিচতলায় কিছু ঘর আছে, ইউরোপের বিভিন্ন দুর্গ থেকে খুলে আনা কাঠ দিয়ে প্যানেলিং করা। অনেক বাক্স রয়েছে সেসব ঘরে। তাতে ভরা রয়েছে রূপোর অনেক পুরনো তৈজসপত্র, দুর্লভ পুরনো কাঁচের গেলাস, আর অদ্ভুত মোড়কে বাঁধানো বই-আলো পড়লে জ্বলজ্বল করে জ্বলে কভারগুলো । 

‘ছবিগুলো কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলো কিশোর । 

‘ওপরতলায়,’ ওপর দিকে আঙুল তুলে বললেন কলিগ । একটা সিঁড়ির কাছে নিয়ে এলেন তিন গোয়েন্দাকে । অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাত করে তৈরি একটা দেয়ালের ধার ঘেঁষে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে সিঁড়িটা। দুটো পেঁচের মধ্যে চওড়া দুটো প্ল্যাটফর্ম মতো রয়েছে। ওঠার সময় ইচ্ছে করলে ওখানে দাঁড়ানো যায়, অন্যদের ওঠার ব্যাঘাত না করে। একটা প্ল্যাটফর্মে জোরে জোরে টিকটিক করছে একটা গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়ি। 

ওপরতলার হলঘরে দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে মার্বেল পাথরের টপ দেয়া টেবিল। প্রতিটি টেবিলের ওপর নানারকম সুদৃশ জিনিস সাজানো ৷ 

‘দেখো এগুলো,’ একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন কলিগ। টেবিলের ওপর রাখা বাতিদানের মতো একটা জিনিস। তাতে রাখা বিশেষ ভাবে তৈরি স্ফটিকের প্রিজম। 

রূপোর বিশাল বাতিদানটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ছেলেরা। সিঁড়িতে ঢং ঢং করে সময় ঘোষণা করলো দাদাঘড়ি। কেঁপে উঠলো বাতিদানে রাখা প্রিজম । 

‘খুব মজার ব্যাপার, না?’ কলিগ বললেন। প্রিজমগুলো এমন করে রাখা হয়েছে, যাতে ঘড়ির শব্দে কেঁপে ওঠে। এটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে । এই বাতিদানটা নতুন সংগ্রহ। গত বছর কিনেছি। বোর্ড অভ ডিরেক্টর যাঁরা আছেন, অবশ্যই তাঁদের অনুমতি নিয়ে ।’ 

এগিয়ে চললেন কিউরেটর। পিছে পিছে তিন গোয়েন্দা। আরেকটা ঘরে এসে ঢুকলো। হালকা রঙের কাঠে তৈরি ছোট একটা চেয়ার রয়েছে ঘরটায়। একটা নিখুঁত ভাবে খোদাই করা চেয়ার, আর একটা মাত্র ছবি । 

‘খাইছে!’ চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও কণ্ঠস্বর নামিয়ে ফেললো মুসা। 

মিসেস রোজারিওর বসার ঘরে যে ছবিটা দেখে এসেছে, হুবহু তারই মতো দেখতে ছবিটা । 

‘একই রকম দেখতে,’ বিড়বিড় করলো রবিন। ‘অথচ দুটো আলাদা! দামেও অনেক তফাৎ!’ হলুদ গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখছে সে। 

‘দেখতে একই রকম হলেও, কিউরেটর বললেন। দুটো দুই জিনিস। একটাতে রয়েছে ওস্তাদ শিল্পীর হাতের ছোঁয়া, যা হাজার চেষ্টা করেও নকলবাজরা 

১০৮ 

ভলিউম-১৬ 

আনতে পারবে না। যারা ছবি বোঝে, তাদের চোখে ধরা পড়বেই। আসলে, ভারমিয়ার ভারমিয়ারই, অন্যে কি আর সেটা পারবে?’ 

কয়েক মিনিট নীরবে ছবিটা দেখলো ছেলেরা। তারপর রবিন বললো, ‘দেখতে তো একেবারে নতুন লাগছে। ভারমিয়ার কি ইদানীংকার শিল্পী?” 

‘তিনশো বছর আগের, কলিগ বললেন। ‘এই ছবিটা আঁকা হয়েছে ষোল শো ষাটের দিকে। মিস্টার মসবি যখন এটা কিনেছিলেন, কয়েকবার করে বার্নিশ লাগানো হয়ে গেছে তখন এর ওপরে। প্রায় বাদামী করে ফেলা হয়েছিল। আমি ওসব বার্নিশ সরিয়ে-টরিয়ে আবার আগের চেহারায় ফিরিয়ে এনেছি । 

‘কাজটা কি যথেষ্ট কঠিন?’ মুসা জানতে চাইলো । 

‘কঠিন মানে? ছবি পরিষ্কার করাও আরেকটা শিল্প। বাহবা পাওয়ার যোগ্য। পাশের ঘরে কয়েকটা রেমব্র্যাঁ আছে, কোনোটা হলদেটে, কোনোটা বাদামী হয়ে গিয়েছিল। কালো কালো ছায়ার মতো দাগ পড়ে গিয়েছিল অনেকগুলোতে । রেমব্র্যাঁ অবশ্যই ওভাবে আঁকেনি। ওসব ছবি আমি আবার ঠিক করেছি, দাগটাগ সব তুলে ফেলে নতুন করে ফেলেছি। এসো। দেখাই ।’ 

হলঘর ধরে যাওয়ার সময় বাতাস শুঁকলো কিশোর । ‘তেল তেল গন্ধ । কোনো কেমিক্যালের? আপনি কাজ করেছেন ওসব দিয়ে, না?” 

‘গন্ধ ওরকম পাবেই। রঙ, সলভেন্ট, সব কিছু থেকেই তেল তেল গন্ধ বেরোয়। আমার ওয়ার্কশপ তেতলায়। সেখানে দর্শকদের ঢোকা বারণ। এমনকি তোমাদের মতো স্পেশাল মেহমানদের জন্যেও। আমি থাকিও তিনতলাতেই ।’ 

চারপাশে তাকালো রবিন। ‘কেমন যেন একা একা লাগে এখানে । বড় বেশি নীরব।’ 

মাঝে মাঝে আমারও খারাপ লাগে,’ স্বীকার করলেন কিউরেটর। ‘আসলেই, বড় বেশি নীরব, নিঃসঙ্গ। সে জন্যেই সান্তা মনিকায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট রেখেছি। এখানে ভালো না লাগলে চলে যাই ওখানে। তবে ওখানে গিয়েও লোকজনের সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করি না। একা থাকতেই ভালো লাগে আমার । 

ভারমিয়ারের ছবি যে ঘরে রয়েছে, তার পাশের গ্যালারিতে ছেলেদেরকে নিয়ে এলেন কলিগ। রেমব্র্যাগুলো দেখালেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য, আর এক বৃদ্ধার ছবি । 

এক ঘর থেকে আরেক ঘরে ঘুরতে থাকলো ওরা। অনেক ছবি দেখলো । দামী দামী সব শিল্পী, রুবেন, ভ্যান ডাইকের মতো ওস্তাদেরা ছাড়াও রয়েছে অখ্যাত কিন্তু অসাধারণ দক্ষ অনেকে। 

আধ ঘণ্টা পর কলিগ ঘোষণা করলেন, দেখা শেষ হয়েছে। ছেলেদেরকে পথ দেখিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে নিয়ে এলেন নিচতলায়। সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। প্রহরী নেই এখন। কাজেই ভারি দরজাটা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলেন তিনি। একটা চাবি দিয়ে অ্যালার্ম সিসটেমটা চালু করে দিলেন। তারপর তিন গোয়েন্দাকে নিয়ে রওনা হলেন আবার ওয়াগনার ম্যানশনের দিকে । 

অর্ধেক পথ পেরিয়েছে ওরা, হঠাৎ শুরু হলো তীক্ষ্ণ চিৎকার! গরমের বিকেলে শান্ত নীরবতার চাদর ফুঁড়ে বেরোচ্ছে যেন সেই চিৎকার। লম্বিত, কাঁপা, কাঁপা 

নিশাচর 

১০১ 

বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে! 

নয় 

‘খাইছে! আবার!’ চেঁচিয়ে উঠে ছুটতে আরম্ভ করলো মুসা। 

লনের মাঝখান দিয়ে ছুটে এসে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠলো রবিন আর মুসা । 

‘এলিজা,’ কিশোরকে বললেন কলিগ। অন্য দু’জনের চেয়ে ধীরে চলেছেন তাঁরা ৷ 

পুলের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে এলিজা ওয়াগনার। পরনে বেদিং স্যুট। পা খালি । বড় একটা তোয়ালে আঁকড়ে ধরে চেঁচিয়ে চলেছে । 

‘এলিজা, থামো, থামো!’ চিৎকার করে বললেন মিসেস রোজারিও । 

তাকিয়ে আছে কিশোর। কেন ওরকম করছে মেয়েটা বুঝতে পারছে না, কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছে না। অথচ চেঁচিয়েই চলেছে এলিজা 

বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে এলো নরিটা। এলিজার কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকাতে শুরু করলো । 

চিৎকার থামিয়ে কান্না আরম্ভ করলো এলিজা । তাকে জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বললো নরিটা, ‘শান্ত হোন, মিস ওয়াগনার, শান্ত হোন। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ 

এলিজাকে ধরে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল সে। তার মোলায়েম কণ্ঠ এখনও শুনতে পাচ্ছে তিন গোয়েন্দা। বোঝা যাচ্ছে, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে দু’জনে। 

‘কি ব্যাপার?” জিজ্ঞেস করলেন কলিগ । 

মিসেস রোজারিও জবাব দেয়ার আগেই লন থেকে উঠে আসা ইঁটের সিঁড়ির মাথায় দেখা দিলেন ডক্টর রেন । ‘কি হয়েছে? চিৎকার শুনলাম?’ 

চত্বরে বেরিয়ে এলো ব্রড নিউম্যান। শান্ত রয়েছে। উদ্বেগের কোনো ছাপ নেই চেহারায়। বললো, ‘জানোয়ারটাকে ফেলে দিয়ে এলাম । 

ভুরু কোঁচকালেন ডক্টর। ‘জানোয়ার?’ 

জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন মিসেস রোজারিও। ‘সাঁতার কাটতে নেমেছিলো এলিজা। পানি থেকে উঠে দেখে মস্ত একটা রোমশ মাকড়সা এগিয়ে যাচ্ছে তার দিকে। চোখের পলকে ওটা তার পায়ের ওপর উঠে গেল। তারপর আর না চেঁচিয়ে কি পারে?’ 

‘আমার মনে হয় ওগুলোকেই টারানটুলা মাকড়সা বলে,’ ব্রড বললো । ‘একটা তোয়ালে দিয়ে চেপে ধরলাম ওটাকে । ময়লা ফেলার পিপেতে ফেলে দিয়ে এসেছি, মেরে। মাকড়সা ধরেছি, ওই তোয়ালে আর কেউ ব্যবহার করবে না, তাই ওটাও ফেলে দিয়েছি।’ 

‘ভালো করেছো,’ মিসেস রোজারিও বললেন। ‘ও আর কে ব্যবহার করে?’ ‘টারানটুলা!’ বিড়বিড় করলেন রেন। ‘চিৎকার তো করবেই এলিজা । আমি যে আমি, পোকামাকড় ঘাঁটি, মাকড়সা পছন্দ করি, সেই আমিও খালি পায়ের ওপর 

১১ 

ভলিউম-১৬ 

টারানটুলা দেখলে আঁতকে উঠবো। কামড়ে যে দেয়নি এই-ই বেশি!’ 

‘এলিজার নিশ্চয় ধারণা,’ কলিগ বললেন। ‘এটাও পরিকল্পনারই একটা অংশ । সমস্ত অঘটনকেই পরিকল্পনার অংশ মনে করে মেয়েটা। 

উদ্বিগ্ন মনে হলো মিসেস রোজারিওকে। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের আড্ডাখানা। এখানে এসে খালি বসে থাকে, কিছু করে না, ভালো আর কতো লাগবে। ওরকমই হয়। আবার ওর ইউরোপে ফিরে যাওয়া উচিত। অন্তত এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত কিছুদিনের জন্যে। আজ একটু শান্ত হোক, দেখি, বেভারলি হিলেই পাঠিয়ে দেবো। পুরনো বন্ধুবান্ধব আছে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দেবে, বাজার-সদায় করবে, আর অবশ্যই দেখা করবে ডক্টর ভিগারের সঙ্গে । ফোন করে আগেই বলে দেবো ডক্টরকে। যা যা হয়েছে সবই জানা থাকা দরকার তাঁর, চিকিৎসার সুবিধে হবে।’ 

‘তা হবে,’ একমত হলেন কলিগ। অবশ্য আপনি না বললেও এলিজা বলবে। পায়ের ওপর টারানটুলা উঠেছিলো, আর একথা বলবে না সে, এটা হতেই পারে 

না।’ 

এমন ভঙ্গিতে কথাটা বললেন কিউরেটর, কিশোরের মনে হলো, এলিজার কথা যেন বিশ্বাস করেন না তিনি। সে বললো, ‘আপনি কি ভাবছেন এটাও মিস ওয়াগনারের একটা কল্পনা? তা কি করে হয়? নিউম্যান নিজের হাতে ধরে নিয়ে গিয়ে ওটাকে মেরে ফেলে রেখে এসেছে।’ 

‘না, কল্পনা অবশ্যই বলছি না,’ তাড়াতাড়ি বললেন কলিগ। তবে পরিকল্পনার অংশও নয় এটা। এটা জাস্ট একটা কাকতালীয় ঘটনা।’ 

‘হুম!’ 

এবার কলিগের তাকানোর পালা। কি ব্যাপার? তোমার ভাবভঙ্গিতে মনে ইচ্ছে এলিজার কথায় বিশ্বাস করো তুমি? তার কাহিনী সত্য বলে মনে করো 

কি?’ 

‘হতেও পারে সত্য।’ হাতঘড়ি দেখলো কিশোর। ‘বাব্বাহ্, তিনটে বেজে গেছে। আমাদের যাওয়া দরকার। 

‘আবার এসো,’ আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন মিসেস রোজারিও। 

‘থ্যাংক ইউ। লাঞ্চের জন্যে মিসেস ওয়াগনারকেও অনেক ধন্যবাদ, তাঁকে জানাবেন, প্লীজ । 

‘আমি তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখবো, কথা দিলেন রেন। তারপর ওরা খন খানিকটা সরে এলো হাত নেড়ে বিদায় জানালেন । 

‘বিচিত্র চরিত্র সব!’ ঢাল বেয়ে নামতে নামতে বললো কিশোর। সবাই যেন কে বাড়ির এক ঘরের লোক, শুধু এলিজা ওয়াগনার ছাড়া, যেন সে-ই বাইরে থকে এসেছে। সবাই তার সাথে এমন আচরণ করছে, যেন সে একটা দুষ্টু মেয়ে, ।খানে জোর করে এসে ঢুকে পড়েছে। কেউ চায় না তাকে এখানে। তার সমস্ত থাকে কল্পনা করে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। সত্যি সত্যি যখন কাকতাড়ুয়া ংবা টারানটুলা দেখছে, তখনও বোঝাতে চাইছেঃ না না, কিছু দেখনি!’ 

‘দোষটা হয়তো ওরই,’ মুসা বললো। ‘আমরা আসার পরই ক’বার পাগলামি 

মিশাচর 

১১১ 

করলো?’ 

‘তা করেছে। মাথা কিছুটা গরমই তার। 

‘কি মনে হয়?’ রবিন জিজ্ঞেস করলো, ‘মাকড়সাটা কি পিঁপড়ের মতোই এনে ফেলে রাখা হয়েছিলো এলিজাকে ভয় দেখানোর জন্যে?” 

‘হয়তো,’ কাঁধ ঝাঁকালো কিশোর। টারানটুলা বা পিঁপড়ে এই অঞ্চলে আছে, ঠিক, তবে যেভাবে এসে হাজির হচ্ছে এলিজার সামনে, সেটাই সন্দেহজনক । 

হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কান পাতলো সে। বাঁয়ে একটা খসখস শব্দ শুনেছে। ‘খেতের মধ্যে কেউ আছে!’ ফিসফিস করে বললো কিশোর । 

‘চলো, দেখি,’ বলেই খেতের দিকে ছুটতে শুরু করলো মুসা। 

খসখস শব্দটা দুপদাপে পরিণত হলো। খেতের গাছ ভেঙে ছুটে গেল কেউ তার পেছনে ছুটলো ছেলেরা। কিন্তু অর্ধেক পথ যাওয়ার আগেই একটা গাড়ির এঞ্জিন স্টার্ট নিলো, ওয়াগনার ম্যানশনের নিচে। আরও জোরে ছুটলো ওরা। বেরিয়ে এলো খেতের বাইরে। দেখলো, অতি সাধারণ একটা ট্রাক গর্জন করতে করতে ছুটে চলেছে চ্যাপারাল ক্যানিয়নের দিকে। 

‘দুউর!’ হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়লো মুসা। 

লাইসেন্স নম্বরটা পড়ার চেষ্টা করছে রবিন। কিন্তু এতো জোরে ছুটেছে ট্রাকটা, পেছনে ধুলোর ঝড় উঠেছে। নম্বর পড়া গেল না। ‘জটিল হচ্ছে রহস্য! 

হাঁপাতে হাঁপাতে বললো কিশোর। পরিশ্রম আর উত্তেজনায় মুখ লাল হয়ে গেছে তার, জ্বলজ্বল করছে চোখের তারা, বোধহয় আনন্দে। আগের ধাঁধাগুলোর সঙ্গে আরেক মাত্রা যোগ হলো। আমি প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম, ওয়াগনার ম্যানশনেরই কেউ এইসব রহস্যের হোতা, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বাইরের কেউও আছে। এখানকার ঘটনাগুলোর ব্যাপারে আগ্রহী । 

‘কাকতাড়ুয়াকেই তাড়া করলাম নাকি?’ রবিনের প্রশ্ন। 

‘জানি না । তবে লোকটার আচরণ বেশ সন্দেহজনক । আমাদের দেখে দৌড় দিলো কেন?’ 

‘এমনিই হয়তো এসেছিলো,’ মুসা বললো। ‘এরকম একটা জায়গায় খেত দেখে কৌতূহল হওয়ায় ঢুকেছিলো। আমাদের দেখে ঘাবড়ে গেছে। 

মনে হয় না।’ 

ওয়াগনারদের সীমানার পাশে পুরনো কাঠের বাড়িটার দিকে তাকালো কিশোর। সামনের উঠনে লতা আর ঝোপের জঙ্গল হয়ে গেছে। ড্রাইভওয়েতে কাঠের খুঁটিতে লাগানো রয়েছে একটা বোর্ড, তাতে লেখা রয়েছে ‘ফর সেল’, অর্থাৎ বিক্রি হইবে নোটিশ, রঙ মলিন হয়ে এসেছে। 

ট্রাকটা নিশ্চয় ওখানে পার্ক করা ছিলো,’ বাড়িটার ড্রাইভওয়ে দেখিয়ে বললো কিশোর। ‘নিচের রাস্তাটা বেশি সরু, একটা ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখলে গাড়ি চলাচলের অসুবিধে হয়। কাজেই ওখানে রাখেনি ট্রাকটা। 

খেতের বেড়া ডিঙিয়ে বাড়িটার দিকে রওনা হলো কিশোর। অন্য দু’জন অনুসরণ করলো তাকে । 

১২ 

যা আন্দাজ করেছিলো কিশোর। ঠিকই, ড্রাইভওয়েতে পড়ে রয়েছে পোড়া 

ভলিউম-১৬ 

তেল। মুখ তুলে ওয়াগনার ম্যানশনের দিকে তাকালো সে। এখানে থাকলে ইউক্যালিপটাস গাছগুলো দৃষ্টিপথে পুরোপুরি বাধার সৃষ্টি করে না। আংশিক দেখা যায় ম্যানশনটা। তবে, গাছগুলো না দিলেও গোলাঘরটা বাধা দেয় এখন, তা-ও অবশ্য আংশিক । 

‘ওয়াগনার ম্যানশনের ওপর চোখ রাখতে হলে,’ আনমনে বললো সে। ‘হয় আরও কাছে যেতে হবে, আমাদের অচেনা বন্ধুটি যেমন গেছে, নয়তো আরও 

ওপরে উঠতে হবে।’ 

পুরনো বাড়িটার ওপরতলায় খোলা জানালা দেখিয়ে রবিন বললো, ‘ওখান 

থেকে? 

‘হ্যাঁ।’ 

ঘরে ঢোকার পথ খুঁজতে লাগলো ওরা। পেয়েও গেল। দেখলো, পেছনের দরজায় তালা নেই। পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে পড়লো তিনজনেই। নিচ তলার শূন্য ঘরগুলোতে আলো কম । দেখার কিছু নেই। সিঁড়িতে পা রাখতেই ক্যাচম্যাচ করে প্রতিবাদ জানালো ওটা, কিন্তু পরোয়া করলো না ওরা। দোতলায় উঠতে শুরু করলো। 

হালকা পায়ের শব্দ শোনা গেল আচমকা। চিকচিক করে ছোটাছুটি শুরু করলো কি যেন। ভীষণ চমকে গেল মুসা। ঝট্ করে মাথা ঘুরে গেল শব্দ যেদিক থেকে এসেছে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঢিল করলো শরীর। ‘ওহ্, ইঁদুর!’ তবে স্নায়ু শান্ত হলো না তার, ভূত ভেবেছিলো প্রথমে । পুরনো সিঁড়ি ভেঙে পড়ার ভয় না করে দুড়দাড় করে উঠে গেল ওপরে। যেন ওই শব্দতেই ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইলো বাড়িতে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু থেকে থাকে, তাদের । 

দোতলায় পেছনের একটা ঘরে বড় চওড়া জানালা দেখা গেল, কাঁচ নেই ৷ 

‘এখান থেকে খুব ভালোমতোই দেখা যায় ওয়াগনার ম্যানশন,’ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মুসা বললো। ‘পেছনের জানালা, পাশের কয়েকটা জানালা, লন আর চত্বরের একটা অংশ দেখতে পাচ্ছি। এবং এই জিনিসটাই কেউ একজন দেখছিলো।’ মেঝেতে কয়েকটা পোড়া সিগারেটের টুকরো দেখালো সে। 

‘রহস্যময় একজন দর্শক, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। টারানটুলা দেখে এলিজা ওয়াগনারকে কি ভয় পেতে দেখেছে সে? তারপর ফিরে গেছে ওয়াগনার ম্যানশনে? নাকি টারানটুলাটা যখন এলিজাকে ভয় দেখাচ্ছে তখনই ম্যানশনে ছিলো সে! জানার কোনো উপায় দেখছি না, তাই মনে হচ্ছে না?” 

Ꮀ 

কথাটা দুঃখের সঙ্গে বললো সে, কিন্তু কণ্ঠস্বরে দুঃখের লেশমাত্র নেই তার, বরং একধরনের উল্লাস, সেই উল্লাস যা প্রকাশ পায় যখন কোনো জটিল ধাঁধা চ্যালেঞ্জ করে তাকে । এই মুহূর্তে বেশ কয়েকজন লোক সন্দেহের তালিকায় পড়ে, যাদের পক্ষে এলিজাকে ভয় দেখানো সম্ভব। 

মাঝে মাঝে বেশ ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলে কিশোর, সেটা ভালো লাগে না মুসার। বললো, ‘সরাসরি কথা বলতে পারো না? যতো যা-ই বলো, ডক্টর রেনকে সন্দেহ করা কিন্তু ঠিক হবে না। ওই ভদ্রলোক এসবে জড়িত নেই, আমি শিওর। তাছাড়া উনি আমাদের মক্কেল।’ 

৮-নিশাচর 

১১৩ 

‘হ্যাঁ, তিনি আমাদের কাজে লাগিয়েছেন বটে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, ‘ স্বীকার করলো কিশোর। কিন্তু মক্কেলরাও অনেক সময় অপরাধের হোতা হয়, এতো সব গোয়েন্দা গল্প পড়ে আশা করি এতোদিনে তা নিশ্চয়ই জেনেছো। তাঁকে কেন সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেবো, বলো? তাঁর সম্পর্কে এমন কি জানি আমরা? শুধু তিনি নিজে যা যা বলেছেন আমাদের। আসলেই কি তিনি এনটোমোলজিস্ট? পিঁপড়ে নিয়ে গবেষণা করেন? নাকি ওয়াগনার এস্টেটে আসার অন্য উদ্দেশ্য আছে তাঁর?’ 

আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? কি কারণ?’ 

‘তা এখনও জানি না।’ আরেকবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো, ‘এলিজাকে কেন জ্বালাচ্ছে কেউ? কাউকে কি হুমকি দিয়েছে, ক্ষতি করবে বলেছে? আহত করেছে কাউকে কোনোভাবে?’ 

যাদেরকে সন্দেহ করছি তাদের সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে হবে। মিসেস রোজারিও কাকতাড়ুয়া সাজতে পারবেন না, কারণ তিনি হাঁটতেই পারেন না। তবে ব্রড নিউম্যান আর তার স্ত্রীর জন্যে ব্যাপারটা অসম্ভব নয়। ওদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেবো আমরা । মিস্টার কলিগের ব্যাপারেও। দেখে অবশ্য মনে হয় না, পোকামাকড় চুরি করায় হাত আছে তাঁর, তবে বলা যায় না কিছু। শুধু চেহারা দেখে মানুষকে বিচার করা বোকামি। ডক্টরের কথাই ধরা যাক ৷ খেত করেছেন, খেতের বেড়ায় কাকতাড়ুয়া দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন পাহারা দেয়ানোর নাম করে। তাঁর গবেষণাগারের পিঁপড়েই নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে এলিজার বিছানায়। হতে পারে, আমাদেরকে যা বলেছেন তিনি তারচেয়ে অনেক বেশি জানেন। এমনও হতে পারে রেনকে দোষী করার জন্যেই অন্য কেউ করেছে কাজটা। পিঁপড়ে চুরি করে নিয়ে গিয়ে বিছানায় ছেড়েছে। 

‘সব কিছুরই একটা উদ্দেশ্য আছে এখানে, যা যা ঘটেছে। মোটিভ। সেই মোটিভটাই জানতে হবে আমাদের। আর তা জানতে হলে লোকের সম্পর্কে আরও বেশি জানতে হবে । কাল সকাল থেকেই তদন্ত শুরু করবো আমরা।’ 

দশ 

সঙ্গে করে আনা নোটবুকে লিখে নিতে লাগলো মুসা। আগে হলে এই কাজটা করতে আসতো রবিন। কিন্তু সে লাইব্রেরির চাকরিটা ছেড়ে দেয়ার পর কিশোর ঠিক করেছে, কারও ওপর বিশেষ একটা কাজের দায়িত্ব দিয়ে রাখবে না সব সময়। তাতে অনেক অসুবিধে। সবাইকে সব কাজ করতে হবে, জানতে হবে। নইলে একজন কোনো কারণে কাজ করতে না পারলে বাকি সব আটকে যেতে পারে। এই ঝুঁকি নেয়া ঠিক না। আর সব সময় পড়া-শোনার কাজটা যে রবিনকেই করতে হবে, এর কোনো মানে নেই। ওকে আজকাল সব সময় পাওয়া যায় না । 

মুসা লিখছে, ইউ সি এল এ থেকে ব্যাচেলর’স ডিগ্রি নিয়েছেন ডক্টর হেনরি রেনহার্ড। স্ট্যানফোর্ড থেকে মাস্টার ডিগ্রি। তারপর এনটোমোলজিতে ডক্টরেট করার জন্যে ফিরে এসেছেন আবার ইউ সি এল এ-তে। তিন বছর আগে পানামায় 

১১৪ 

ভলিউম-১৬ 

গিয়েছিলেন পিঁপড়ে নিয়ে গবেষণা করতে। ডিগ্রি আর কোথায় কোথায় গবেষণার কাজে গিয়েছেন সেসব ছাড়াও বইয়ের জ্যাকেটে লেখা রয়েছে তিনি অবিবাহিত। ইউ সি এল এ-তে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ছিলেন কিছুদিন। 

বইটা রেফারেন্স ডেস্কে ফেরত নিয়ে এলো মুসা । 

‘যা জানার জেনেছো?’ মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো তাকে । ‘নিশ্চয়ই,’ জোর করে মিথ্যে কথাটা বললো মুসা । 

‘তা জানবেই। একবার ডক্টর রেনহার্ডের কাছে কিছুদিন ক্লাস করেছিলাম। পিঁপড়ে সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান, তখনই বুঝেছি। কতো কি যে জানেন! তার কাছে ক্লাস করলে পিঁপড়ের ব্যাপারে জানার আর বোধহয় বাকি থাকে না কিছু। পোকামানব যে বলে ওঁকে, ভুল বলে না। 

‘কে বলে? তাঁর ছাত্রেরা বুঝি?’ 

হেসে উঠলো মেয়েটা । তারপর কি মনে হতে সরাসরি তাকালো মুসার দিকে । ‘তুমি তাঁর কিছু হও নাকি?’ 

‘নাহ! দিন কয়েক আগে সান্তা মনিকা পর্বতের এক বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। গবেষণার কাজে ব্যস্ত। ঠিকই বলে ওরা, পোকামানবই।’- 

‘ঠিক। লোকের সঙ্গে মেশেনও না তেমন একটা, পোকামাকড়ের সঙ্গে যতোটা মেশেন। তোমাদের সাথে যে কথা বলেছেন, এটাই অবাক লাগছে আমার।’ 

‘তাঁর কাজ সম্পর্কেও অনেক কথা বলেছেন। খুব ইনটারেস্টিং মনে হয়েছে আমার কাছে। আগামী গ্রীষ্মে পিঁপড়ে নিয়ে একটা প্রোজেক্ট করার কথা আছে আমার। সে জন্যেই সৈনিক পিঁপড়ে নিয়ে পড়াশোনা করছি। তুমি জানো, এই ক্যালিফোর্নিয়াতেই সৈনিক পিঁপড়ে আছে?’ 

আর।’ 

জানি। ডক্টর রেনের জন্যে খুব সুবিধে হয়েছে। পানামায় দৌড়াতে হয় না 

চুপ করে রইলো মুসা। মেয়েটা আর কিছু বলে কিনা শোনার জন্যে অপেক্ষা, করছে। বললো না। বইটা ডেস্ক থেকে তুলে নিয়ে শেলফে রেখে দিলো। আবার নোটবুক পড়ায় মন দিলো, যেটা পড়ছিলো এতোক্ষণ । 

রোদে বেরিয়ে এলো মুসা। পকেটে নোটবুক। অভিনয় ভালোই করে এসেছে, সে-জন্যে খুশি। আবার একই সঙ্গে নিরাশও হয়েছে, কারণ ডক্টর রেনের ব্যাপারে নতুন কিছুই জানতে পারেনি। শুধু নিশ্চিত হতে পেরেছে লোকটা আসলই, নকল- টকল নয়। তিনি ইউ সি এল এ-তে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ছিলেন, এটা ঠিক সৈনিক পিঁপড়ের ওপর দুটো বইও লিখেছেন। জ্যাকেটের ছবিই প্রমাণ করে দিয়েছে তিনি আসল লোক । 

মুসা যখন এসব কথা ভাবছে, কিশোর তখন বেভারলি হিল-এর ডোহেনি ড্রাইভ থেকে দ্রুত নেমে আসছে। সেদিন সকালে এলিজা ওয়াগনারকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে, নতুন লোক রাখার দরকার হলে কোন্ এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সির সাহায্য নেন মিসেস রোজারিও। ‘সম্ভবত ম্যাকমিলান কোম্পানি,’ জবাব দিয়েছে এলিজা। ‘খুব বিশ্বস্ত। আমার মা পছন্দ করতো ওদের। মিসেস রোজারিওও 

নিশাচর 

১১৫ 

হয়তো ওদেরকেই ফোন করে, লোকের দরকার হলে । জিজ্ঞেস করলো?” 

‘না না, প্লীজ,’ অনুরোধ করেছে কিশোর। ‘আমার তদন্তের ব্যাপারে কোনো কথাই তাঁকে বলবেন না । 

তারপর তার সবচেয়ে ভালো পোশাকটা পরে বেরিয়ে পড়েছে সে । বাসে করে চলে এসেছে বেভারলি হিলে । 

ডোহেনির ছোটো একটা বিজনেস বিল্ডিঙের তিনতলায় চমৎকার আসবাবপত্রে সাজানো দুটো ঘর নিয়ে ম্যাকমিলান কোম্পানির অফিস। বাইরের ঘরটায় বসা এক মহিলা, নীলচে-শাদা চুল আর টকটকে লাল চামড়া। কিশোরকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘বলো?’ 

আমার নাম কিশোর পাশা। কাজ খুঁজছি, আর— 

‘কিন্তু… 

‘আমি জানি আমার বয়েস কম, তাড়াতাড়ি বললো কিশোর। কিন্তু বুদ্ধি-টুদ্ধি ভালোই আছে আমার, অন্তত আমি তাই মনে করি। আর খুব পরিশ্রম করতে পারি। যতো বড় বাড়িই হোক, ঠিক সামলাতে পারবো। জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখতে পারবো, কিছু কিছু জিনিস মেরামতও করতে পারবো। কুকুর থাকলে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারবো…’ 

হাসলো মহিলা। বাহ্, তাই নাকি! তোমার বয়সী একটা ছেলের এতগুলো গুণ থাকাটা খুবই ভালো। কিন্তু বড় বাড়ির লোকেরা বয়স্ক চাকর খোঁজে । খবরের কাগজে গিয়ে চেষ্টা করে দেখ না কেন? কিংবা মার্কেটগুলোতে গিয়েও খোঁজ নিতে পারো । মাঝে মাঝেই বক্স বয় চায় ওরা ।’ 

চোখে মুখে হতাশা ফুটিয়ে তুললো কিশোর। ‘আরও ভালো কাজ আশা করেছিলাম আমি। নিউম্যান আপনার কথা বলে বললো, ‘আপনি নাকি জুটিয়ে দিতে পারবেন।’ 

‘নিউম্যান?’ 

‘ওই যে, ওয়াগনার এস্টেটে কাজ করে। 

চেয়ার ঘুরিয়ে বসলো মহিলা। ফাইলিং কেবিনেটের ড্রয়ার খুলে একটা ফোন্ডার বের করলো। পাতা উল্টে একজায়গায় থেমে হাসলো। ‘হ্যাঁ, এই যে, নিউম্যান। লর্ড হ্যারিগানের লোক। হ্যাঁ, ব্রড আর তার স্ত্রীকে আমরাই কাজ দিয়েছি ওয়াগনারদের ওখানে। মিসেস রোজারিওর কাছে। ভালো লোক ৷’ 

‘রেফারেন্স নিয়ে এসেছি আমি, কিশোর বললো। ‘নিউম্যান বললো আপনারা নাকি রেফারেন্স চান।’ 

‘হ্যাঁ, চাই। বিশ্বস্ত লোক পাঠাতে না পারলে এই ব্যবসায় বেশিদিন টিকতে পারতাম না। এই নিউম্যানের ব্যাপারটাই ধরো। সব রকম জেনে-শুনে তারপর কাজ দিয়েছি। এমনকি লণ্ডনে তার আগের মালিকের ওখানেও টেলিগ্রাম করেছিলাম। লর্ড হ্যারিগান যখন জবাব পাঠালেন, ব্রড নিউম্যান আর তার স্ত্রী খুব ভালো বাবুর্চি, তখনই শুধু ওয়াগনারদের ওখানে চাকরি দিলাম। 

‘তোমার বেলায় অবশ্য রেফারেন্স দিয়েও লাভ হবে না। আসলে, এই বয়েসী ছেলেদের চাকরি আমরা দিই না। সে-রকম ব্যবস্থা নেই।’ 

১১৬ 

ভলিউম-১ 

‘তাই?’ 

‘আমার অবাকই লাগছে, নিউম্যান তোমাকে এখানে আসতে বললো কিভাবে? ও তো জানে।’ 

‘আসলে, ওভাবে বলেনি। যখন শুনলাম তাকে আপনারাই চাকরি দিয়েছেন, আমি ভাবলাম, যাই চেষ্টা করে দেখি।’ 

তাই বলো। কয়েক বছর পর এসে দেখা কোরো আমাদের সঙ্গে। তখন ভালো কিছু একটা জুটিয়ে দিতে পারবো আশা করি ।’ 

মহিলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, খুব যেন নিরাশ হয়েছে এমন ভঙ্গি করে অফিস থেকে বেরিয়ে এলো কিশোর। নিউম্যানের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। একজন ইংরেজ লর্ডের রেফারেন্স নিয়ে যখন এসেছে, লোকটা খারাপ হতে পারে না । এরকম একজন লোক কাকতাড়ুয়া সেজে লোকের বিছানায় পিঁপড়ে ছেড়ে দেবে, এটা আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না । 

পশ্চিমে যাওয়ার বাসে চড়ে কিশোর যখন রকি বীচে ফিরে চলেছে, রবিন তখন আরও পুবে ব্যস্ত। রওনা দিয়েছিলো একই সাথে, পথে কিশোর নেমে যায়, সে চলে আসে গ্রাহাম আর্ট ইনস্টিটিউটের বিশাল বর্গাকার বাড়িটার কাছে। শিল্পকলা, ছবি আঁকা এসব শেখানো হয় এখানে। বেশ কিছু বড় বড় শিল্পী পাস করে বেরিয়েছে এখান থেকে । সামনের চওড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে রবিন ভারি ব্রোঞ্জের তৈরি দরজাটা ঠেলে ঢুকেছে ভেতরে। 

লম্বা-চওড়া একটা হল ঘর। দু’পাশেই অনেক দরজা। গন্ধটা মসবি হাউজের কথা মনে করিয়ে দিলো তাকে। তেল রঙের গন্ধ । 

‘কাকে খুঁজছো?’ নীল জিনসের প্যান্ট পরা এক তরুণ জিজ্ঞেস করলো। পাশের একটা ঘর থেকে বেরিয়েছে, হাতে ছোট একটা মই । 

‘আমি… আমার খালাতো ভাইকে খুঁজছি,’ কথা আটকে যাচ্ছে রবিনের। ধমক লাগালো নিজেকে, মনে মনে। কিশোর হলে তোতলাতো না, কিংবা দ্বিধা করতো না । এমন ভাবে বলতো যেন সত্যি কথাই বলছে । 

লম্বা করে দম নিলো সে। কাঁধ ছড়িয়ে দিয়ে একটা বিশেষ ভঙ্গি করলো আমার খালাতো ভাই এখানে কাজ শিখেছিলো । তার ঠিকানা জানি না, এখন কোথায় থাকে, জানার জন্যেই ইস্কুলে চলে এলাম ঠিকানা জোগাড় করতে। ভাবলাম নিশ্চয় এখানে লেখা আছে।’ হ্যাঁ, হয়েছে। নিজের পিঠ চাপড়ালো রবিন । 

‘নিশ্চয় আছে,’ জবাব দিলো লোকটা। ‘বেরিয়ে যাওয়ার পরও কে কোথায় আছে খোঁজ রাখার চেষ্টা করে ইনস্টিটিউট। তিনতলায় চলে যাও। সামনের দিকে রয়েছে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফিস । জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। 

Į 

লোকটাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হলের শেষ প্রান্তে সিঁড়ির দিকে চললো রবিন সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো তিনতলায় । কাউকে জিজ্ঞেস করতে হলো না, পেয়ে গেল অফিসটা। কাঁচের দেয়াল ঘেরা অনেকগুলো ছোট ছোট কেবিন, সবগুলোই খালি একটা বাদে। ওখানে কাজ করছেন দাড়িওয়ালা একজন লোক। একটা কার্ড ফাইল ঘাঁটছেন। 

রবিনকে কাছে আসতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি চাই?’ 

নিশাচর 

১১৭ 

‘আমার খালাতো ভাই এখানকার ছাত্র ছিলো। তার নাম স্টেবিনস কলিগ । লস অ্যাঞ্জেলেসে বেড়াতে এসেছি আমি। মা বলে দিয়েছিলো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যেতে। কিন্তু তার বর্তমান ঠিকানা জানি না। টেলিফোন বুকেও নাম নেই । ভাবলাম এখানে এলে পেতে পারি । 

‘কলিগ, না? হ্যাঁ, আমারই ছাত্র ছিলো। মসবি মিউজিয়মের কিউরেটর এখন ।’ 

এমন ভাব করে রইলো রবিন যেন মসবি মিউজিয়মের নামই শোনেনি ৷ মুখ তুললেন শিক্ষক । ‘রকি বীচ ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে পাহাড়ের মধ্যে ঢুকলেই পেয়ে যাবে মসবি মিউজিয়ম। ফোনেও পেতে পারো স্টেবিনসকে। মিউজিয়মটাকে খুব ভালোবাসে সে, নিজের জিনিসের মতো। তার সাথে গিয়ে ইচ্ছে করলে মিউজিয়মও দেখে আসতে পারো। পুরনো মাস্টারদের আঁকা ভালো লাগে তোমার?’ 

‘ছবির কথা বলছেন?’ 

‘হ্যাঁ। রেমব্র্যান্ত, ড্যান ডাইক, ভারমিয়ারের মতো আর্টিস্টদের আঁকা ছবি। বোঝাই করে রেখেছে মসবি মিউজিয়ম।’ 

‘তাই নাকি? ভালোই মনে হচ্ছে। কিউরেটর খুব দামী লোক, তাই না? মানে…বোনপো এরকম একটা পোস্টে কাজ করছে শুনলে খুশি হবে মা।’ 

কেমন এক ধরনের শূন্য দৃষ্টি ফুটলো দাড়িওয়ালা মানুষটির চোখে। দামী?…তা অবশ্য বলতে পারো। বেশ সিকিউরড পজিশন, নিরাপদেই আছে । একথা শুনে যদি খুশি হতে পারেন তোমার মা, হবেন।’ 

‘নিরাপদ-টিরাপদ শুনলে কি আর কেউ খুশি হয়? খুশি হয় ভালো কাজ 

করছে শুনলে । 

‘ভালো কাজ বলতে অনেক কিছুই বোঝায়,’ সামান্য ধার ফুটলো শিক্ষকের কথায়। ‘নির্ভর করে অনেক কিছুর ওপর। শিল্পীদের দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ আর দশজনের চেয়ে আলাদা হয় অনেক সময়। তবে সেটাও নির্ভর করে শিল্পীর মানসিকতার ওপর। 

কতোটা আলাদা? 

‘কি করে বোঝাই? আমার কথাই ধরো। আমি ভাবছি, স্টেবিনস তার প্রতিভার অপচয় করছে। অন্যের জিনিস মেরামত আর পাহারা দেয়ার চেয়ে নিজে কিছু আঁকা উচিত ছিলো তার। চেষ্টা করলে ভালো পারতো, আমি শিওর। তার হয়তো ধারণা নিরাপদে থাকাটাই বড় কথা। তাকে বলো, আমি বলেছি তার নিজের কিছু করার চেষ্টা করা উচিত। আমার নাম হাওয়ার্ড ডাবলিন। তোমার ভাই শুনবে বলে মনে হয় না, আগেও বহুবার বলেছি, শোনেনি। তবু, একটা প্রতিভাকে নষ্ট হতে দেখলে খারাপ লাগে, সে জন্যেই বলা। যদি মানসিকতার পরিবর্তন হয়।’ 

‘বলতে বলছেন? আচ্ছাহ্। আসলে…আমি তাকে চিনিই না, দেখিনি কখনও । আমার মায়ের দূর সম্পর্কের বোনের ছেলে। হয়তো আমাকেও খুব একটা পাত্তা দেবে না। মিউজিয়ম না-ও দেখাতে পারে। আপনি তো তাকে চেনেন। স্বভাব- 

১১৮ 

ভলিউম-১৬ 

টভাব কেমন? মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করে?” 

‘সরি, ইয়াং ম্যান, বেশি কথা বলে ঘাবড়ে দিয়েছি তোমাকে। ছবি আঁকবে না পাহারা দেবে সেটা নিয়ে তার সঙ্গে মতের অমিল রয়েছে আমার, কিন্তু তাই বলে লোক সে খারাপ নয়। সহজেই আন্তরিক হয়ে যেতে পারে। অবশ্যই ভালো ব্যবহার করবে তোমার সাথে। হয়তো একদিনের ছুটি নিয়ে তোমাকে ডিজনিল্যাণ্ড কিংবা ম্যাজিক মাউনটেইনও দেখাতে নিয়ে যেতে পারে। ওর দোষটা হলো, সাংঘাতিক নকল বাজ । আসল কিছু করতেই তার যতো অনীহা। যে কোনো ছবি নকল করে ফেলতে পারে। পেইনটিঙে এক্সপার্ট না হলে দেখে বুঝতেই পারবে না ওটা আসল না নকল। জানো নিশ্চয়?’ এক মুহূর্ত থামলেন ডাবলিন। তারপর বললেন, ‘ও, না, তুমি জানবে কি করে। তুমি তো স্টেবিনসকেই চেনো না। আমার কথায় কান দিও না। আমি একজন পুরনো আদর্শবাদী। কে শুনবে আমার কথা? আধুনিক শিল্পীদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমার মিলবে না। ওরা নতুন কিছু দেয়ার চেয়ে নিরাপদে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। স্বভাব বদলাতে পারি না, তাই এখনও ছাত্রদেরকে…যাকগে।’ হাসলেন তিনি। ‘যাও, স্টেবিনসকে ফোন করো । ওর সাথে দেখা হলে বলো সময় করে যেন আমার সাথে এসে দেখা করে। 

“বলবো, স্যার।’ 

ঘুরতে যাবে রবিন, এই সময় ডাবলিন বললেন, ‘খালাতো ভাই বললে না? আশ্চর্য! স্টেবিনসের কোনো আত্মীয় আছে বলেই শুনিনি। ওই সম্পর্কে কোনো আলোচনা করেনি কারো সঙ্গে। একা একা থাকে…নিজের মতো করে।’ 

হাসলো রবিন। ‘সব মানুষেরই আত্মীয় থাকে। কাছের না হোক, দূরের 

তা ঠিক। এখনও কারখানায় মানুষ তৈরি শুরু হয়নি তো, তাই। শিশু জন্ম দিতে বাবা-মায়ের দরকার হয়। আর হলেই আত্মীয়ের প্রশ্ন আসে। আত্মীয় থাকতেই হবে। যাক। যাও, ফোন- করো। লস অ্যাঞ্জেলেস খুব ভালো জায়গা, অনেক কিছু দেখার আছে। দেখো। আর হ্যাঁ, স্টেবিনসকে বলতে ভুলো না কিন্তু, আমার সঙ্গে যেন দেখা করে । ওকে কিছু ধমক-ধামক দিতে হবে এবার।’ 

বলবো, স্যার। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে । 

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বড় দরজাটা দিয়ে বাইরে বেরোলো রবিন। একটা বাস দেখা যাচ্ছে, দৌড় দিলো সেটা ধরার জন্যে। উঠে জানালার কাছে বসলো । উপকূল থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। যেতে সময় লাগবে। যা যা জেনেছে খতিয়ে দেখতে লাগলো মনে মনে । জেনেছে, কলিগের প্রতিভা আছে। নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে, একা একা থাকতে পছন্দ করে। ছবি এঁকে সুনাম কামানোর চেয়ে নিরাপদে নিশ্চিন্তে থাকাটাকে প্রাধান্য দেয়। লোকটাকে দেখে যা মনে হয়েছে, অন্যের মুখে তার স্বভাব চরিত্রের কথা শুনে আলাদা করে কিছু ভাবতে পারছে না সে। ডাবলিনের কথা শুনে বোঝা গেছে, দক্ষ কিউরেটর হওয়ার সমস্ত গুণাগুণ রয়েছে স্টেবিনসের। 

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললো রবিন। তদন্ত তো করলো, কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই বের হলো না। কিশোর আর মুসা কি কিছু করতে পারলো? না পেরে থাকলে নতুন ভাবে তদন্ত চালাতে হবে, অন্য কিছু করতে হবে। যেভাবেই হোক, 

নিশাচর 

১১৯ 

ধরতে হবে ওই কাকতাড়ুয়াকে । 

এগারো 

‘কি বলতে চাও তুমি? আমার ব্যাপারে খোঁজখবর করেছো?’ রেগে গেলেন ডক্টর রেন। ‘সাহস তো কম না! যা যা বলার আমিই তো তোমাকে বলেছি, তারপর আবার কেন?: 

রাগ করবেন না, স্যার,’ শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। ‘আমরা গোয়েন্দা। তদন্ত শেষ করার আগে পুরোপুরি বিশ্বাস কাউকেই করতে পারি না। এলিজা ওয়াগনারকে হেনস্তা করার ব্যাপারে যাকে যাকে সন্দেহ করেছি, সবার ব্যাপারেই খোঁজখবর নিচ্ছি। কাউকে খাতির করে বাদ দিলে তদন্ত হয় না, আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। 

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বিকেলটা আলোচনা করে কাটিয়েছে তিন গোয়েন্দা । খেয়ে দেয়ে চলে এসেছে ওয়াগনার এস্টেটে, মক্কেলের সঙ্গে কথা বলার জন্যে। ল্যাবরেটরিতে দেখা হয়ে গেছে রেনের সঙ্গে। ইউ সি এল এ-তে গিয়ে যে খোঁজখবর নিয়েছে, সেকথা বলে দিয়েছে মুসা। তাইতেই ডক্টরের রাগ । 

‘আপনার কেমন লাগছে, বুঝতে পারছি, স্যার,’ আবার বললো কিশোর ‘নিশ্চয় একমত হবেন আমাদের সাথে, অপরাধ তদন্তের সময় কাউকে খাতির করলে ফল ভালো হয় না।’ 

‘তদন্ত করে যা বুঝলাম, এই এস্টেটে আছে এমন কারোরই এলিজাকে বিরক্ত করার পেছনে কোনো মোটিভ নেই। কাজেই অন্য জায়গায় খুঁজতে হবে আমাদের। এই নিষ্ঠুরতা কে করছে এবং কেন তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। কিন্তু করে চলেছে।’ 

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রেন। মহিলার মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম । অস্থির স্বভাব। মানুষের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। তবে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করবো না, ইচ্ছে করে কারো কোনো ক্ষতি কখনও করেছে।’ 

ইচ্ছে না করেও তো করে থাকতে পারে! আপনিই বলেছেন, কয়েকবার বিয়ে ঠিক হয়েছে তার, প্রতিবারেই ভেঙে দিয়েছে। এতে হয়তো রেগে গেছে কেউ। কষ্ট পেয়েছে। 

‘মিসেস রোজারিও তো অন্য কথা বলেন। কাউকে নাকি কষ্ট দিতে পারে না এলিজা, নিজেই কষ্ট পায় । 

‘তাই?’ 

‘হ্যাঁ। মিসেস রোজারিও এই ইঙ্গিতও দিয়েছেন, এলিজার কিছু কিছু পাণিপ্রার্থীকে নাকি পছন্দ হয়নি তার ভাইয়ের, টাকা খাইয়ে বিদেয় করেছেন। ওরা লোক ভালো না, টাকার লোভেই এলিজাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো, ফলে তাদের খসাতে বেগ পেতে হয়নি মিস্টার ওয়াগনারের। আর আমার ধারণা, তাদের অনেকেই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলো কনের ওপরই, তার খাম-খেয়ালিপূর্ণ আচরণে। 

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। ‘এখন কোথায় আছে?’ 

১২০ 

ভলিউম-১৬ 

• 

‘বেভারলি হিলে । তবে বেশিক্ষণ থাকবে না। কাল রাতে মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার পর নিজেকে বুঝিয়েছে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে মাকড়সাটা তার পা বেয়ে ওঠেনি। মিসেস রোজারিও তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করেছিলেন কয়েক দিন বেভারলি হিলে গিয়ে থাকার জন্যে । 

‘আজ বিকেলে কিছু কফি চেয়ে আনতে গিয়েছিলাম ওয়াগনার ম্যানশনে। মিসেস রোজারিও বললেন, পুরনো একজন বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে নাকি দেখা হয়ে গেছে এলিজার, বেভারলি উইলশায়ার হোটেলে। তাতে এতো অস্বস্তিতে পড়ে গেছে এলিজা, মিসেস রোজারিওকে ফোন করে বলেছে আজ রাতেই ফিরে 

আসবে । 

‘তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মিসেস রোজারিও, অন্য হোটেলে গিয়ে থাকার জন্যে । কিন্তু রাজি হয়নি এলিজা । গোঁ ধরেছে চলে আসবে, আসবেই।’ 

রেনের কথা শেষ হয়েও সারলো না, একটা চিৎকার শোনা গেল । ‘ওই যে, এসে গেছে!’ বলেই দরজার দিকে দৌড় দিলো মুসা। 

তার পেছনে ছুটলো কিশোর আর রবিন। রাগে বিড়বিড় করে কিছু বলতে বলতে ওদের পিছু নিলেন রেন । 

অন্ধকার হয়ে এসেছে। চিৎকারটা চলেছেই। আগের চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কিত হয়েছে যেন এলিজা । 

‘না!’ চিৎকার করে বললো সে। ‘না, না! প্লীজ, না?’ 

হঠাৎ থেমে গেল চিৎকার। ফোঁপাতে শুরু করলো এলিজা। তারপর ভয়াবহ একটা রূপকথার কল্পিত দানোর মতো তিন গোয়েন্দার প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়লো কাকতাড়ুয়াটা। 

চত্বরের আলো জ্বেলে দেয়া হয়েছে। সেই আলোয় কাকতাড়ুয়ার মুখের একাংশ দেখতে পেলো ওরা। হাসছে ওটা। বাতিল ফেলে দেয়া চট দিয়ে তৈরি হয়েছে মুখটা। দড়ি দিয়ে বেঁধে আটকে দেয়া হয়েছে ঘাড়ের সঙ্গে । কালো রঙে তিনকোণা করে আঁকা হয়েছে চোখ। মাথায় বসানো কালো হ্যাট। শস্য খেতের বেড়ার ওপরে যে কাকতাড়ুয়াটা বসানো হয়েছে, ওটারই মতো পুরনো করডুরয়ের জ্যাকেট পরেছে এটাও, খড় বেরিয়ে রয়েছে হাতার ভেতর থেকে । রেন আর তিন গোয়েন্দাকে দেখে মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ালো ওটা। আঁতকে উঠলেন ডক্টর। কাকতাড়ুয়ার হাতে একটা খড় কাটার বাঁকা কাস্তে । 

‘খবরদার!’ চেঁচিয়ে উঠলো মুসা । 

নিচু, খলখলে হাসির সঙ্গে সঙ্গে কাস্তেটা তুলে ধরলো কাকতাড়ুয়া। ‘শাঁই করে বাতাসে কোপ মারলো একবার, এপাশ থেকে ওপাশে। তারপর ধেয়ে এলো তিন গোয়েন্দার দিকে। দস্তানা পরা হাতে কোপ মারার ভঙ্গিতে তুলে ধরে রেখেছে কাস্তেটা । 

সামনে রয়েছে রবিন। চেঁচিয়ে উঠে ঝাঁপ দিয়ে পড়লো একপাশে, কাস্তের সামনে থেকে সরে গেল ৷ 

দৌড় দিতে গিয়ে কিসে পা বেধে পড়ে গেল কিশোর। কোপ থেকে বাঁচানোর জন্যে হাত নিয়ে গেছে ঘাড়ের ওপর। 

নিশাচর 

১২১ 

স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন মুসা। নড়ার শক্তিও নেই। তারপর কাস্তেটা যখন প্রায় চোখের সামনে চলে এসেছে, তখন সচল হলো, ডাইভ দিয়ে পড়লো একপাশে । 

কাউকেই কোপ মারলো না কাকতাড়ুয়া। পালানোর সুযোগ পেয়ে একটা মুহূর্ত দ্বিধা না করে ছুটে গেল ঢাল বেয়ে। সামনে পড়েছিলেন রেন, তিনিও লাফিয়ে সরে গেছেন । 

ইউক্যালিপটাসের ঝাড়ের ভেতর দিয়ে কাকতাড়ুয়ার ছুটে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল । তারপর নীরবতা 

‘মুসা!’ সবার আগে কথা বললো রবিন। ‘তুমি ঠিক আছো?’ 

আস্তে করে উঠে বসে কপাল ডলতে লাগলো মুসা। ‘আছি। কোপটোপ লাগেনি।’ 

শাঁই শাঁই করে যেভাবে ঘোরালো,’ রেন বললেন, কোপ লাগলে মুণ্ডু আলাদা হয়ে যেতো । 

মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বললো, ‘এই, শোনো!” ওপর দিকে তাকালো সে । 

গোঁ গোঁ করছে এলিজা, ছোট জানোয়ার আহত হলে যেরকম করে অনেকটা সেরকম শব্দ। ওয়াগনার হাউসের সামনে আলো জ্বলছে। নিউম্যান আর মিসেস রোজারিওর কথা শোনা যাচ্ছে। সবাই মিলে শান্ত করার চেষ্টা করছে এলিজাকে 

রওনা হলো তিন গোয়েন্দা। ওরা যখন পৌছলো, এলিজাকে তখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে সাহায্য করছে ব্রড। তার পেছনে হলে বসে রয়েছেন মিসেস রোজারিও। উদ্বিগ্ন। ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে রয়েছে এলিজার কনভারটিবল গাড়িটা। ড্রাইভারের পাশের দরজাটা খোলা । 

‘ওটার…ওটার হাতে কাস্তে ছিলো!’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো এলিজা । ‘ঠিক গ্রিম রিপারের মতো!” আমার মাথা কেটে ফেলতে চেয়েছিলো!’ 

আরে না না, তা করবে কেন!’ বোঝানোর চেষ্টা করলো ব্রড। 

করেছে!’ 

একে একে সিঁড়ি বেয়ে উঠলো কিশোর, মুসা, রবিন। 

‘কাস্তে ছিলো,’ কিশোর বললো। ‘আমরাও দেখেছি। 

‘অনেক হয়েছে! যথেষ্ট হয়েছে!’ বলে উঠলো নিউম্যানের স্ত্রী নরিটা। বাড়ির পাশ থেকে যেন ছিটকে বেরিয়েছে। দম নিচ্ছে জোরে জোরে। কাত হয়ে আছে টুপিটা। ‘এতো সব হট্টগোল! এবার আমি পুলিশকে ডাকবোই!’ 

‘থাম তো!’ ধমক দিলেন মিসেস রোজারিও। 

‘না, ডাকাই দরকার,’ ছেলেদের পেছনে উঠে এসেছেন রেন। ‘এবার আর হেসে উড়িয়ে দিতে পারবে না পুলিশ। ব্যবস্থা একটা করবে। 

আমারও তাই মনে হয়,’ নরিটা বললো। এলিজার কাছে গিয়ে হাত ধরে তাকে নিয়ে চললো লিভিং রুমের দিকে। আসুন, মিস। ভালো এক কাপ চা বানিয়ে দেবো। শান্ত হোন। আর আপনাকেই বা বলবো কি? আমার সামনে পড়লে আমিও ওরকম চেঁচাতাম। জানালা থেকে দেখেছি, তাতেই যেরকম ভয় লাগলো! ভূতের মতো চেহারা, হাতে কান্তে, আরেব্বাপরে বাপ! 

ভলিউম-১৬ 

রাস্তায় গাড়ির টায়ার ঘষার শব্দ হলো। ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখলো- হেডলাইট। মসবি মিউজিয়মের ড্রাইভওয়েতে থামলো গাড়িটা। হেডলাইট নিভলো। বেরিয়ে এলো একজন লোক। হেঁটে রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো । কাছে এলে চেনা গেল, স্টেবিনস কলিগ। ‘কি ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করলেন কিউরেটর। কি হয়েছে?’ 

‘আবার কাকতাড়ুয়াটাকে দেখা গেছে, স্যার,’ দরজার কাছে গিয়ে বললো ব্রড। ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে ছিলো। এই সময় গাড়ি নিয়ে ঢুকলেন মিস এলিজা। 

‘ও!’ 

‘এমন করে “ও” বললেন যেন বানিয়ে বলেছেন এলিজা!’ রেগে গেলেন রেন। টাক চকচক করছে, জ্বলে উঠেছে চোখ। অতিবুদ্ধিমান অতিকায় একটা পিঁপড়ের মতোই লাগছে এখন তাঁকে, মুসার মনে হলো। ‘আমরাও দেখেছি। ভয়ংকর চেহারা! বাতাসে যেরকম কোপাকোপি করলো কাস্তে দিয়ে, অল্পের জন্যে বেঁচেছি আমরা সবাই । 

দূরে সাইরেন শোনা গেল। পাহাড়ী পথ ধরে ছুটে আসছে গাড়ি । 

‘ওই যে, পুলিশ আসছে,’ নরিটা বললো। ‘ভাবলাম, আসবে না। অফিসারের কথা শুনে তো খুব একটা গুরুত্ব দিলো বলে মনে হলো না। বিশ্বাসই করেনি হয়তো ৷ 

‘নিশ্চয় চীফ ফ্লেচারও আছেন ওদের সঙ্গে,’ গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর। নইলে আসতো না। আমাদের দেখে আবার কি বলেন, কে জানে! 

বারো 

পরদিন সকালে হেডকোয়ার্টারে মিলিত হলো তিন গোয়েন্দা। আগের দিন বিকেলে ওয়াগনার ম্যানশনে তিন গোয়েন্দাকে দেখে অখুশি হননি চীফ, তবে খুশি হয়েছেন কিনা সেটাও বুঝতে দেননি। বরং গম্ভীর হয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ওদেরকে কাকতাড়ুয়ার কেস থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন। বিপদ হতে পারে হুঁশিয়ার করেছিলেন আগেই। কিন্তু কান দেয়নি তিন গোয়েন্দা। ওরা নাক গলিয়েছেই । কড়া গলায় ওদেরকে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে দিয়েছেন। কাকতাড়ুয়ার কথা ভুলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। 

চীফ যা-ই বলুক, কেস থেকে সরে দাঁড়ানোর কিংবা কাকতাড়ুয়ার কথা ভুলে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই তিন গোয়েন্দার। ‘তবে সাবধান থাকতে হবে আমাদের,’ কিশোর বললো। ওয়াগনার ম্যানশনে আবার আমাদের দেখতে পেলে সত্যি সত্যি রেগে যাবেন চীফ ।’ 

সাবধান থাকার কথা আর বলতে হবে না,’ মুসা বললো। ‘কাল যে কাস্তে দেখেছি শয়তানটার হাতে! আফ্রিকার জঙ্গলই ভালো। বন্দুক-টন্দুক থাকে হাতে । এখানে তো ওসব কিছুই ব্যবহার করতে পারবো না। খপ করে এসে চেপে ধরবে পুলিশ ।’ 

‘কাল বিপদটা অবশ্য তোমার ওপর দিয়েই বেশি গেছে,’ রবিন বললো । 

নিশাচর 

১২৩ 

‘এলিজাকে বাদ দিলে। তবে তার একটা সুবিধেও হয়েছে। এখন সবাই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে, জ্যান্ত কাকতাড়ুয়া একটা সত্যি আছে।’ 

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। কিছু জিনিস ঘটেছে, যেগুলো বিশ্বাস করাই কঠিন। সুস্থ মানুষকে পাগল করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট, যদি স্নায়ুর জোর কম হয়, চেয়ারে হেলান দিলো গোয়েন্দাপ্রধান। জোরে জোরে বার দুই চিমটি কাটলো নিচের ঠোটে। ‘গতরাতে অনেকেই আমরা কাকতাড়ুয়াটাকে দেখেছি। ওটা আছে কিনা এ-ব্যাপারে সন্দেহের অবসান ঘটলো। আমরা দেখেছি। ডক্টর রেন দেখেছেন । নরিটা নিউম্যান বলেছে, সে-ও জানালা থেকে দেখেছে। ব্যাপারটা যখন ঘটে, তখন ওখানে ছিলেন মিসেস রোজারিও আর ব্রড নিউম্যান। দেখেননি শুধু স্টেবিনস কলিগ । 

‘এই, উনি সহজেই কাকতাড়ুয়া হতে পারেন, মানে হয়ে থাকতে পারেন, ‘ রবিন বললো। ‘ধরো, রক রিম ড্রাইভে গাড়িটা ফেলে এলেন তিনি। এলিজাকে ভয় দেখানোর পর ছুটে গিয়ে কাকতাড়ুয়ার পোশাক খুলে রেখে, গাড়ি নিয়ে ফিরে আসার যথেষ্ট সময় পেয়েছেন, পুলিশ পৌঁছার আগেই । 

‘সেটা সম্ভব,’ কিশোর বললো। ‘কলিগ জানেন এলিজা কাকতাড়ুয়া আর পোকামাকড়কে ভয় পায়। বেভারলি হিল থেকে যে এলিজা ফিরে আসছে, এটাও তাঁর পক্ষে জেনে নেয়া সম্ভব । 

কিন্তু আমাদের রহস্যময় অচেনা লোকটার কথা ভুলে গেলে চলবে না, সেদিন খেতের মধ্যে যে আমাদের ওপর নজর রেখেছিলো, যাকে তাড়া করে গিয়েছিলাম আমরা। রক রিম ড্রাইভের পুরনো বাড়িটা থেকে ওয়াগনার হাউসের ওপরও নজর হয়তো সে-ই রেখেছিলো। কাকতাড়ুয়া সে-ও হতে পারে। কিন্তু যতোক্ষণ না হাতেনাতে পাকড়াও করতে পারছি, নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।’ 

গায়ে কাঁটা দিলো মুসার। অশরীরী কিছু হলে ধরার দরকার নেই। কাল যে কাণ্ডটা করলো…আরেকটু হলে নিজেই অশরীরী হয়ে যেতাম!” 

‘সাবধানে থাকতে হবে আমাদের, খুব সাবধানে,’ কিশোর বললো। তবু কাকতাড়ুয়ার ওপর নজর রাখতেই হবে। পুলিশ এখনও তেমন জড়ায়নি এর সঙ্গে, যেরকমটা আমরা জড়িয়েছি। ওটাকে দেখেছি আমরা, কিছু সূত্র আছে হাতে, যেগুলো বেশ সাহায্য করবে। 

‘জানি তো শুধু ওটার হাতে একটা কাস্তে ছিলো। আর কি জানি?’ 

‘জানি, সব সময় সন্ধ্যাবেলায় আসে ওটা। অন্তত এলিজা যতোবার দেখেছে । তখন আলো থাকে কম, স্পষ্ট দেখা যায় না।’ 

যাতে চেহারা চিনতে না পারে কেউ,’ রবিন বললো । 

‘ঠিক। আজ বিকেলে, অন্ধকার হওয়ার আগেই, ওয়াগনার হাউসে যাবো আমরা । চোখ রাখবো। অপেক্ষা করবো।’ 

‘যদি কিছু না ঘটে?’ 

‘তাহলে কাল রাতে আবার যাবো।’ 

‘আর যদি ঘটে?’ কেঁপে উঠলো মুসার কণ্ঠ, ‘যদি আসে কাকতাড়ুয়াটা?’ ওটাকে ভূত ভাবছে সে । 

128 

ভলিউম-১৬ 

তাহলে আড়ালে থেকে তার ওপর চোখ রাখবো। কোথায় যায়, দেখার চেষ্টা করবো। শোনো, ওয়াকি-টকি নিয়ে যাবো আমরা, যাতে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারি। রবিন, তুমি চোখ রাখবে মসবি হাউসের ওপর। স্টেবিনস কলিগকেও এখন সন্দেহ থেকে মুক্ত রাখা যাচ্ছে না। মুসা, তুমি লুকিয়ে থাকবে রক রিমের পুরনো বাড়িটার ওপর। আর আমি থাকবো ওয়াগনার হাউসের আশেপাশে।’ 

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মুসা বললো, ‘আচ্ছা, তাই হবে। আমার ভাল্লাগছে না কাকতাড়ুয়ার পিছে লাগতে, মানুষখেকো সিংহও এর চেয়ে অনেক ভালো । চিতামানবদেরও ভয় পাই না, কিন্তু…. চুপ হয়ে গেল সে । 

সেদিন বিকেলে ওয়াগনার হাউসের পোয়াটাক মাইল দূরে একটা ঝোপের ভেতরে যখন সাইকেল ঢুকিয়ে রাখছে কিশোর আর রবিন, তখনও মন খারাপ করে রেখেছে মুসা। তারটা আগেই ঢুকিয়েছে ঝোপের ভেতর। হাতে একটা ওয়াকি-টকি দিলো কিশোর, আরেকটা রবিনের হাতে। 

এই খুদে যন্ত্রগুলো নিজের ওয়ার্কশপে বানিয়েছে কিশোর। দেখতে অনেকটা সিবি রেডিওর মতো, একটা করে স্পীকার আর একটা করে মাইক্রোফোন লাগানো রয়েছে। নিজেদের তৈরি বিশেষ বেল্ট কোমরে পরেছে তিন গোয়েন্দা। ভেতরে সেলাই করা রয়েছে তামার তার। তারের একমাথা বের করা। তাতে প্লাগ লাগানো। সেই প্লাগ ঢুকিয়ে দেয়া হয় ওয়াকি-টকির সকেটে, অ্যানটেনার কাজ করে তখন তামার তারটা। আধ মাইল দূরের সঙ্কেত ধরা যায়, সঙ্কেত পাঠানো যায়। যন্ত্রের সঙ্গে শক্ত লুপ লাগানো রয়েছে, বেল্টে ঝুলিয়ে রাখার জন্যে। মাইক্রোফোনে কথা বলার সময় একটা বোতাম টিপে ধরতে হয়, স্পীকারে কথা শোনার সময় ছেড়ে দিতে হয় । 

যদি ওটাকে দেখো, ধরার চেষ্টা করবে না,’ সকেটে প্লাগ ঢোকাতে ঢোকাতে সতর্ক করলো কিশোর। শুধু চোখে চোখে রাখবে। সাহায্য দরকার হলে ওয়াকি- টকি ব্যবহার করবে। ‘ 

মাথা ঝাঁকালো মুসা। দ্রুত কমে আসছে দিনের আলো। ওয়াগনার হাউসের কাছে এসে বাঁয়ের পথটা ধরলো সে, কোণাকুণি হেঁটে পেরোলো সামনের খোলা জায়গাটা, তারপর ঝোপ-ঝাড়ের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে চললো রক রিম ড্রাইভের পুরনো বাড়িটার দিকে 

পুরনো রাস্তাটায় পৌঁছে কোনো যানবাহন চোখে পড়লো না মুসার। কোনো গাড়ি পার্ক করা নেই। বাড়িটাকে দেখতে লাগছে শূন্য, কালো, নিঃসঙ্গ। লতাপাতায় ছেয়ে ফেলেছে দেয়াল। সামনের সিঁড়ির দু’পাশে আগাছা, ঢেকে দিয়েছে অনেকখানি । 

ড্রাইভওয়ের পাশে একটা ঘন ঝোপ খুঁজে বের করলো মুসা। ওটাতে লুকালে সুবিধে হবে। সূর্য ডুবছে তখন। 

‘নাম্বার টু, কথা বলে উঠলো ওর স্পীকার, ‘কোথায় তুমি, নাম্বার টু?’ কিশোরের কণ্ঠ । 

রেডিওর বোতাম টিপলো মুসা। ‘পুরনো বাড়িটার কাছে ঝোপের মধ্যে । নিশাচর, 

১২৫ 

শান্ত রাখার চেষ্টা করছে কণ্ঠস্বর। ‘এখানে কিছু নেই।’ 

‘গুড, টু । বসে থাকো। দেখো, কি হয়। রবিন, তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’ কুট করে একটা শব্দ হলো। রবিনের বোতাম টেপার। ‘আমি মসবি হাউসের পেছনে ।’ 

বেশ। অন্ধকার হচ্ছে। সতর্ক থাকবে। তেমন দরকার না পড়লে ওয়াকি- টকি ব্যবহার করবে না।’ 

নীরব হয়ে গেল রেডিও। মাটিতে বসে দুই পা বাঁকা করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে হাঁটুতে থুতনি রাখলো মুসা। কান পেতে রইলো শব্দ শোনার আশায় । প্রথমে কিছুই শুনতে পেলো না। তারপর, দূরে অস্পষ্ট শোনা গেল একটা গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ। লো গীয়ারে খারাপ রাস্তা দিয়ে আসছে, মনে হচ্ছে উপকূলের দিক থেকে। 

সজাগ হলো তার স্নায়ু। চ্যাপারাল ক্যানিয়ন রোড ধরে এ-সময়ে গাড়ি আসাটা খুব একটা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। হতে পারে, পর্বতের ওপর দিয়ে পার হয়ে ওপারের স্যান ফারনানদো ভ্যালিতে নেমে যাবে। 

নাকি রক রিম ড্রাইভের দিকে আসবে? 

এঞ্জিনের শব্দ বদলে গেল। আরও লো গীয়ারে নামিয়েছে ড্রাইভার । ট্রাক আসছে, আন্দাজ করলো মুসা। ক্যাঁচকোঁচ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে শক অ্যাবজরভারের স্প্রিং। হেডলাইট দেখা গেল । রক রিমের দিকেই আসছে । 

মুসার লুকানো জায়গাটা যেন ভেদ করে গেল তীব্র আলোকরশ্মি। ভয় হলো তার, তাকে না দেখে ফেলে ড্রাইভার। ঝাঁকি খেতে খেতে এসে ড্রাইভওয়েতে উঠলো গাড়িটা, থামলো গিয়ে বাড়ির সামনে। এঞ্জিন বন্ধ হলো। আলো নিভলো । হ্যাণ্ডব্রেক টানার শব্দ হলো । 

কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একজন লোক। ছায়া-ঢাকা পথ ধরে নিঃশব্দে চলে গেল বাড়ির পেছনে। দরজা খোলার শব্দ হলো। খানিক পরেই জানালার তক্তার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়লো কাঁপা আলো । 

সোজা ওপরতলায় চলে গেল লোকটা। নগ্ন কাঠের মেঝেতে আর নড়বড়ে সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ হয়েছে জোরে জোরে, স্পষ্টই কানে এসেছে মুসার। 

সাবধানে কয়েক ইঞ্চি এগিয়ে বসলো সে, যাতে দোতলার জানালাগুলো দেখতে পারে, যেগুলো থেকে ওয়াগনার ম্যানশনটা দেখা যায়। শূন্য, কালো জানালা । কয়েক সেকেণ্ড পরেই দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বলে উঠতে দেখা গেল একটাতে । চকিতের জন্যে একটা মুখ দেখতে পেলো মুসা। রোদে পোড়া চামড়া । নাকের কাছ থেকে ঠোঁটের কোণ পর্যন্ত এগিয়ে গেছে গভীর রেখা । 

সিগারেট ধরালো লোকটা। মাথায় ঝাঁকড়া শাদা চুল। নিভে গেল দিয়াশলাইয়ের কাঠি। সিগারেটের মাথার লাল আলোটা ছাড়া পুরো বাড়িটা এখন অন্ধকার । 

উত্তেজনায় কাঁপছে মুসা। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চললো ট্রাকের পেছন দিকে। ঝোপের আড়ালে আড়ালে চলে এলো আরেকটা জায়গায়, যেখান থেকে লোকটা যেদিকে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকটা দেখা যায় । 

১২৬ 

কি দেখছে? ভাবলো মুসা। নিশ্চয় ওয়াগনার হাউস। কিন্তু ম্যানশনে কি 

ভলিউম-১৬ 

রয়েছে? এমন কিছু ঘটছে কিংবা ঘটানো হবে, যেটা একটা সঙ্কেত? দেখার অপেক্ষা করছে লোকটা? দেখলেই পুরনো করডুরয়ের কোট পরে, রঙ করা একটা চটের থলে মাথায় গলিয়ে, কালো হ্যাট মাথায় পরে কাকতাড়ুয়া সেজে বেরিয়ে পড়বে? 

কিশোরের সঙ্গে কথা বলবে কিনা ভাবলো মুসা। বাতিল করে দিলো ভাবনাটা। এখন সামান্য ফিসফিসানিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। বরং উঠে দাঁড়িয়ে ট্রাকের পেছনের দরজার হাতল ধরে টান দিলো। খুলে গেল দরজাটা । 

ভেতরে অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। খানিকক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে সয়ে এলো অন্ধকার। হাত বাড়িয়ে জালের মতো একটা জিনিস ছুঁয়ে দেখলো মুসা। ধাতব একটা চাকতিতে লাগানো জিনিসটা। এছাড়াও প্লাস্টিকের জিনিস রয়েছে-লম্বা হাতলওয়ালা একটা রেঁদার মতো যন্ত্র। তীব্র রাসায়নিক গন্ধ বাতাসে । 

ভেতরে উঠে পড়লো সে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো জিনিসগুলো। গন্ধের জন্যে নাক কুঁচকে রেখেছে। চিনতে পারলো গন্ধটা, ইস্কুলের ল্যাবরেটরিতে এই গন্ধ বহুবার পেয়েছে। ক্লোরিন। আর যন্ত্রগুলো সুইমিং পুল পরিষ্কারের কাজে লাগে । তাহলে কি লোকটা সুইমিং পুলের মিস্ত্রী? 

আনমনেই নিঃশব্দে হাসলো মুসা। লোকটাকে নিশ্চয় ভাড়া করে আনা হয়েছে। নিউম্যানরা আনতে পারে। স্টেবিনস কলিগ, এমনকি ডক্টর রেনও আনতে পারেন। তাদের কেউ একজন হয়তো এলিজা ওয়াগনারকে পছন্দ করে না। লোক ভাড়া করে এনেছে তাকে ভয় দেখানোর জন্যে। কিংবা হতে পারে, এই লোকটা নিজে নিজেই এসেছে, কেউ ভাড়া করেনি। বিকৃত রুচির লোক। মানুষকে ভয় দেখাতে ভালোবাসে। এলিজার পেছনে লেগেছে । 

কোনোভাবে একবার কাকতাড়ুয়া সাজার পোশাকটা বের করতে পারলেই হয়। নিয়ে চলে যাবে মুসা । প্ৰমাণ ৷ 

হঠাৎ বরফের মতো জমে গেল যেন মুসা। খামচে ধরেছে ট্রাকের ধার । নড়তে আরম্ভ করেছে যানটা। 

‘খাইছে!’ ফিসফিস করে নিজেকেই বললো সে। 

মরিয়া হয়ে উঠলো সে। কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই সিটের ওপর দিয়ে এসে ঢুকলো কেবিনে। চেপে ধরলো হ্যাণ্ড-ব্রেকের হাতল । নষ্ট । ঢিল হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি স্টিয়ারিং হুইল ধরে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। ঘুরিয়ে-ঘারিয়ে ট্রাকের গতি আর দিক পরিবর্তনের চেষ্টা করলো। দ্রুত বেগে ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেছে ওটা। ক্রমেই বাড়ছে গতি । পিছিয়ে চলেছে। ব্রেক প্যাডাল চেপে ধরলো সে। ব্রেক ফ্লুইডের কড়া গন্ধ এসে লাগলো নাকে। একটা সিলিন্ডার ফেটে গেছে, কিংবা মুখ খুলে গেছে। কাজ করছে না ব্ৰেক ৷ 

লো গীয়ারে দিলে গতি কমতে পারে। তবে ওটাও কাজ করবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে এখন তার । একটা করে সেকেণ্ড যাচ্ছে, আর বেড়ে চলেছে ট্রাকের গতি। 

ঠেলে দরজা খুললো সে। আবছা অন্ধকারে শাঁ শাঁ করে পাশ কাটাতে দেখলো গাছগুলোকে । আর কোনো উপায় নেই, লাফিয়েই পড়তে হবে। লম্বা করে দম 

নিশাচর 

১২৭ 

নিয়ে ঝাঁপ দিলো সে । 

ওপরে আকাশ, নিচে রাস্তা। মাটিতে এসে পড়লো মুসা। গড়ান খেলো কয়েকটা। ট্রাকটা সরে চলে গেছে। গাছের সঙ্গে ওটার বাড়ি লাগার শব্দ শুনতে পেলো। তারপরই পথের পাশের একটা খাদের মধ্যে গড়িয়ে পড়ে গেল সে। শক্ত কিছুতে বাড়ি খেলো মাথা। পলকের জন্যে চোখে পড়লো সন্ধ্যার কোমল নীলচে- সবুজ আকাশের রঙ, পরক্ষণেই হাজারটা উজ্জ্বল তারা জ্বলে উঠলো যেন মাথার ভেতর । 

নিথর হয়ে গেল মুসা । 

তেরো 

ওয়াগনার হাউসের চারপাশে চতুর্থ বার ঘুরে এলো কিশোর। চাঁদ উঠছে তখন। ম্যানশনের পেছনে একটা উঁচু জায়গায় এসে থামলো। উষ্ণ রাত। তাই কাকতাড়ুয়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও জানালার পর্দা টানা হয়নি। আলোকিত ঘরের ভেতরে তাকালো সে। রান্নাঘরে রয়েছে নরিটা। কি যেন ধুচ্ছে সিংকে। বাঁয়ের ছোট লিভিং রুমটায় টিভি চলছে। ঘর অন্ধকার। টেলিভিশনের আলোয় আবছা ভাবে চোখে পড়ছে ব্রড নিউম্যানকে, চেয়ারে বসে বেস বল খেলা দেখছে । 

ডানে মিসেস রোজারিওর সিটিং রুম। স্টেবিনস কলিগের সঙ্গে দাবা খেলছেন তিনি। একসময় হাসলেন কলিগ, মিসেস রোজারিওর দিকে তাকিয়ে কি যেন বললেন। দাবার চাল চাললেন। মুখ বিকৃত করে ফেললেন মিসেস রোজারিও । 

কিশোর বুঝলো, জিততে চলেছেন কিউরেটর। 

উঠে দাঁড়িয়ে স্পোর্টস জ্যাকেটের বোতাম লাগালেন কলিগ । কথা বলছেন। তারপর মিনিট দুয়েক বাদে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে । 

আরও কিছুক্ষণ বসে রইলেন মিসেস রোজারিও। তাকিয়ে রয়েছেন ভারমিয়ারের পেইন্টিংটার দিকে। তারপর হঠাৎ যেন একটা বুদ্ধি এলো মাথায় । হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে চলে গেলেন কোণের বেডরুমটায়। আলো জ্বাললেন। বড় একটা আলমারির কাছে গিয়ে ওটার দরজা খুললেন । হ্যাঙারে ঝোলানো রয়েছে সারি সারি কাপড় । নানারকম পোশাকের ওপরের তাকে সাজানো রয়েছে অনেক বাক্স। 

চট্ করে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালেন তিনি। যেন বুঝতে পেরেছেন অন্ধকার লনে দাঁড়িয়ে তাঁর ওপর চোখ রাখছে কেউ । কি ভেবে এগিয়ে এলেন জানালার কাছে। পর্দা টেনে দিলেন । 

আপন মনেই হাসলো কিশোর। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলো। চলে এলো বাড়ির ডান কোণে । ওখান থেকে জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে বেরিয়ে থাকা পাতালঘরের দেয়ালের কাছে। মিসেস রোজারিওর ঘরের নিচের পাতালঘর থেকে বেরোনোর একটা দরজা আছে। দরজার সামনেই. পথ । যুক্ত হয়েছে গিয়ে ডানের ড্রাইভওয়ের সঙ্গে। কিশোর আন্দার্জ করলো, এই দরজাটা ঝাড়ুদার আর মাল সরবরাহকারী লোকদের প্রবেশ পথ । 

১২৮ 

ভলিউম-১৬ 

! বাড়ির পাশ ধরে হাঁটতেই থাকলো সে। চারটে গাড়ি রাখা যায় এতোবড় গ্যারেজের পাশ দিয়ে নেমে চলে এলো ড্রাইভওয়েতে। সামনের দিকে ড্রাইভওয়েটা দুই ভাগ হয়ে একটা ভাগ চলে গেছে বাঁয়ে। সেটা ধরেই চললো কিশোর। তারপর পাশের ঘাসে ঢাকা জমি পেরিয়ে এগোলো বারান্দার দিকে। 

বারান্দার ওপাশে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। আবার দেখা গেল সিংকে কাজ করছে নরিটা। তার স্বামী টেলিভিশন দেখছে। পা টিপে টিপে বারান্দায় ওঠার সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসে টবে লাগানো বড় একটা গাছের আড়ালে লুকালো কিশোর। বাঁয়ে লিভিং রুমের বিশাল জানালাগুলো সব খোলা। উঁকি দিয়ে দেখলো সে, সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে এলিজা ওয়াগনার। সামনের কফি টেবিলের ওপর রাখা একটা পাশার ছক । তার সামনে একটা খাড়া পিঠওয়ালা চেয়ারে বসে রয়েছেন ডক্টর হেনরি রেনহার্ড। আলোয় চকচক করছে তাঁর টাক। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছেন পাশার ছকের দিকে । 

ঘরের ভেতর ঢুকলেন কলিগ। তাঁকে বলতে শুনলো কিশোর, ‘ও, শত্রুতা দেখি শেষ হয়ে গেছে!’ 

‘একটা বিশেষ শত্রুর সাথে লড়াইয়ের জন্যে একজোট হয়েছি আমরা,’ জবাব দিলেন রেন। পাশার ছক থেকে মুখ তুললেন না । 

‘ভালো, ভালো । গুড নাইট জানাতে এলাম । ছুটিতে যাবো তো। কিছু জরুরী কাজ সারতে হবে । 

‘ছটিতে যাবেন?’ অবাক হলো যেন এলিজা। ‘তাহলে মসবি কালেকশনগুলোর কি হবে? দর্শকরা আসবে না?’ 

‘মিউজিয়ম বন্ধ থাকবে,’ কলিগ বললেন। ‘প্রতি বছরই আগস্টের শেষ দুটো হপ্তা বন্ধ থাকে, জানো তুমি। আমি না থাকলে চারতলার একটা বাড়তি ঘরে একজন গার্ড থাকে । যাতে কিছু নষ্ট না হয়, দেখে।’ 

‘তাই। মিসেস রোজারিও খুব মিস করবে আপনাকে। তা কখন যাচ্ছেন?’ শুক্রবারে । যাবার আগে দেখা করে যাবো অবশ্যই ।’ 

ঘুরে বেরিয়ে গেলেন তিনি। তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে লনে নেমে পড়লো কিশোর। প্রায় দৌড়ে চলে এলো বাড়ির সামনের দিকে, কলিগকে দেখার জন্যে। রাস্তা পার হয়ে মিউজিয়মের দিকে চলে গেলেন কিউরেটর। 

মসবিদের এলাকায় রয়েছে রবিন। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে নিঃশব্দে হাত নাড়লো কিশোরের উদ্দেশ্যে, তারপর আবার অদৃশ্য হয়ে গেল । 

বারান্দায় ফিরে এসে উঠলো কিশোর। দেখলো, হুইল চেয়ার চালিয়ে লিভিং রুমে ফিরে এলেন মিসেস রোজারিও। কোলের ওপর বড় একটা বাক্স । 

‘এলিজা, শোনো,’ কোমল গলায় ডাকলেন তিনি। ‘তোমার খেলা হয়ে গেলে এসো। ছবিগুলো খুলে দেখবো।’ 

‘কিসের ছবি?” 

‘তোমার। ঠিকঠাক মতো সব করিয়ে আনতে অনেক দিন বসে থাকতে হয়েছে আমায় । সেই বুবার্ডে থাকার সময় থেকে তোমার যতো ছবি তুলেছি, সব আছে এখানে। যখন থেকে বেশি বেশি বিদেশে যাওয়া শুরু করলে, তার আগে 

৯-নিশাচর 

পর্যন্ত সব আছে।’. 

চিন্তিত লাগলো মিসেস রোজারিওকে। ‘তুমি এখানে আছো, ভালোই লাগছে । তবে এখন তোমার ইউরোপে থাকার কথা। কেন তোমার ভাইয়ের কাছে চলে যাও না? ভূমধ্যসাগরে নিশ্চয় ঘুরছে এখনও, তাই না? ওর কাছে চলে গেলেই ভালো করবে। এই হতচ্ছাড়া কাকতাড়ুয়ার ভয় আর পেতে হবে না। উইলিয়াম দেখাশোনা করতে পারবে তোমার। কোনো অসুবিধা হবে না। 

‘মিসেস রোজারিও, আমি ভাইয়াকে বেকায়দায় ফেলে দিই, আপনি ভালো করেই জানেন। আর তাছাড়া আমি… আমি কিছুতেই যাবো না ওই দানবটার ভয়ে । শয়তানী করে আমার বাড়ি থেকে বের করে দেবে, এ-কিছুতেই হতে দেবো 

না । 

‘ঠিক আছে। যা ভালো বোঝো।’ বাক্স খুলে ছবি বের করে দেখতে শুরু করলেন মিসেস রোজারিও। 

পা টিপে টিপে বারান্দা থেকে নেমে এলো কিশোর। আবার চললো তার টহল। অস্বস্তি বোধ করছে। লিভিং রুমেরই কোনো একটা ব্যাপার নাড়া দিয়েছে তাকে । কিছু একটা গোলমাল রয়েছে ওখানে। তবে সেটা কি বোঝার আগেই তার মনে হলো, ইউক্যালিপটাসের ছায়ার মধ্যে কে যেন হাঁটছে । 

· 

ধড়াস করে এক লাফ মারলো তার হৃৎপিণ্ড। কাকতাড়ুয়া! হ্যাঁ, ওটাই হবে! কলিগ চলে গেছেন তাঁর মিউজিয়মে।- ওয়াগনার ম্যানশনের বাসিন্দারাও সব ঘরের ভেতরে। 

নিঃশব্দে গাছগুলোর দিকে রওনা হয়ে গেল কিশোর। মট করে ছোট একটা ডাল ভাঙলো। পাতায় শরীরের ঘষা লেগে খসখস শব্দ হলো। গোলাঘরের দিকে এগিয়ে চলেছে ওটা। 

গাছের নিচের ছায়ায় পৌঁছলো কিশোর, ওটাও বেরিয়ে এলো খোলা জায়গায় । কাকতাড়ুয়াই। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলেছে গোলা ঘরের দিকে । একবারও পেছনে ফিরে তাকালো না। গোলার দরজায় পৌঁছে থমকে দাঁড়ালো । 

কিশোর আন্দাজ করলো, নিশ্চয় বড় শক্ত খিল আটকানো দরজায়। একবার বাড়ি খেয়েছেন রেন। আরেকবার পাহাড়ের কাকতাড়ুয়ার তাড়া খেয়েছেন। হুঁশিয়ার হয়ে গেছেন এখন। ভালোমতো আটকে রেখেছেন ল্যাবরেটরির 

দরজা। 

বিচিত্র একটা গর্জন করলো কাকতাড়ুয়া। অন্ধকারে ওরকম একটা অদ্ভুত জীবের ডাক স্নায়ুর ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করে। পিছিয়ে এলো কিশোর। 

আলগা পাথরেই পা পড়লো বোধহয়। বাঁকা হয়ে গেল গোড়ালি। তাল সামলাতে না পেরে ম্যানজানিটা ঝোপের ওপর পড়ে গেল সে । 

পাঁই করে ঘুরলো কাকতাড়ুয়া । 

দেখতে পাচ্ছে কিশোর, তার দিকে ছুটে আসছে ওটা। অবচেতন ভাবেই হাত চলে এলো মুখের ওপর। গড়িয়ে পাশে সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো । রোম খাড়া করা একটা চিৎকার দিয়ে লাফ দিলো কাকতাড়ুয়া। 

১৩০ 

ভলিউম-১৬ 

চোদ্দ 

আঘাত বাঁচাতে তৈরি হলো কিশোর। গড়িয়ে সরে গেল। তারপর ঝটকা দিয়ে সরিয়ে ফেললো মাথা। আর একটা মুহূর্ত দেরি হলেই তার মাথায় লাগতো কাকতাড়ুয়ার বুট । তবে ওই একবারই, আর লাথি মারার চেষ্টা করলো না ওটা। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে যেতে লাগলো । একা পড়ে রইলো কিশোর । 

একা এবং অক্ষত । 

উঠে বসলো কিশোর। শরীর কাঁপছে। দাঁড়ালো। টলোমলো করে উঠলো পা, দেহের ভার রাখতে কষ্ট হচ্ছে যেন। ওয়াকি-টকিটা পড়ে গেছে। হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করলো ওটা। সুইচ টিপে বললো, ‘রবিন! মুসা!’ গলা কাঁপছে তার। ‘ওটা এসেছিলো! আমি দেখেছি! শুনতে পাচ্ছো?’ 

রবিনের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘তুমি কোথায়?’ 

‘পাহাড়ের ঢালে। ইউক্যালিপটাসের ঝাড়ের মধ্যে। মনে হচ্ছে ওয়াগনার হাউসের দিকেই গেল কাকতাড়ুয়াটা।’ 

‘না, এদিকে তো আসেনি,” মুসা জানালো । কণ্ঠস্বর কেমন বদলে গেছে তার । ‘আমিও একজনকে দেখেছি, তবে সেটা কাকতাড়ুয়া নয়। হতে পারে না । মিনিটখানেক আগেও পুরনো বাড়িটাতে ছিলো। তারপর গিয়ে ট্রাকে উঠলো । হয়তো বুঝেছে আজকের রাতে সুবিধে হবে না। সোজা চলে গেল ।’ 

‘লাইসেন্স নম্বরটা রাখতে পেরেছো?” রবিন জিজ্ঞেস করলো। 

‘না । সরি…’ 

‘কি ব্যাপার?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর। ‘তোমার কিছু হলোটলো 

নাকি?” 

‘না, তেমন কিছু না। পড়ে গিয়েছিলাম, ব্যস । 

‘ঠিক আছে। নজর রাখো। কাকতাড়ুয়াটা ওদিকেও যেতে পারে। রবিন, তুমি চোখ রাখো বাড়ির দিকে।’ 

‘তুমি কি করছো?’ জানতে চাইলো রবিন। 

‘কাকতাড়ুয়াটা কোথায় গেল বোঝার চেষ্টা করছি।’ 

‘খাইছে! কিশোর, সাবধান থেকো, খুব সাবধান!’ হুঁশিয়ার করলো মুসা। হুঁশিয়ারই রইলো কিশোর। ছায়ার মতো নিঃশব্দে এগোলো ইউক্যালিপটাসের ঝাড়ের ভেতর দিয়ে। নিজেকে কাকতাড়ুয়া কল্পনা করে ভাবতে লাগলো, সে যদি ওটা হতো, আর হঠাৎ চমকে যেতো, তাহলে কোথায় যেতো? তাড়াহুড়ো করে লুকানোর দরকার পড়লে? 

কান পেতে শুনছে কিশোর। ঝিঁঝির কর্কশ চিৎকার ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ঝোপের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে সে। পাহাড়ের ওপর মস্ত বাড়িটা চোখে পড়ছে। বারান্দার ওপরের জানালাগুলোয় উজ্জ্বল আলো। লোকজন দেখা যাচ্ছে । কেউ পাশা খেলছে, কেউ ছবি দেখছে বা এমনি কোনো সাধারণ কাজ করছে। ওখানেই পাহাড়ের কোনো অন্ধকার জায়গায় গিয়ে লুকিয়েছে কাকতাড়ুয়াটা। 

নিশাচর 

১৩১ 

আত্মগোপন করেছে কোনো রুহস্যময় জায়গায় । 

কিশোরের পেছনে রয়েছে শস্যের খেতটা। বিশেষ গুরুত্ব দিলো না জায়গাটাকে। ওখানে যায়নি কাকতাড়ুয়া। ওটা দৌড়ে গেছে বাড়ির পেছনের পরিষ্কার জায়গা দিয়ে । ডানে বাঁয়ে তাকাতে তাকাতে সেদিকেই হেঁটে চললো সে। পেছনের লনে কিছু নড়ছে না। ওয়াগনার ম্যানশন থেকে ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া পায়ে চলা পথ ধরে ওকের জটলার পাশ কাটিয়ে নেমে এলো সে। চোখে পড়লো একটা ছোট কটেজ। এমন একটা জায়গায় তৈরি হয়েছে ওটা, সহজে চোখে পড়ে না। নিশ্চয় ওটাই গেস্ট হাউস, যেখানে বাস করেন ডক্টর রেন । 

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো কিশোর। রেনের ঘরে গিয়ে লুকানোর সাহস করবে কি কাকতাড়ুয়াটা? এখনও ওখানেই রয়েছে? নজর রেখেছে তার ওপর? যদি কটেজটার পাশ কাটাতে চায় কিশোর তাহলে কি করবে ওটা? হামলা চালাবে? রক রিম ড্রাইভের দিকে পালানোর চেষ্টা করবে? নাকি পাহাড়ের জঙলা জায়গায় কোথাও লুকিয়ে পড়েছে ইতিমধ্যেই? 

ধীরে ধীরে ছোট ঘরটার দিকে এগোতে শুরু করলো কিশোর । কটেজের কাছে পৌছে সাবধানে উঠে এলো বারান্দায়। বুঝলো, এই সতর্কতার কোনো প্রয়োজন নেই। তার ওপর চোখ রেখে থাকলে এতোক্ষণে তাকে দেখে ফেলেছে ওটা । 

দরজায় থাবা দিলো কিশোর, যেন ডক্টর রেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ‘ডক্টর রেন? আমি, কিশোর। ঘরে আছেন?’ 

থাবা দিয়ে আবার ডাকলো। দরজার নব ধরে মোচড় দিলো। ধক্ করে উঠলো বুক। দরজার পাল্লাটাও ঠিকমতো লাগানো নেই। ঘুরে গেছে নব। ঠেলা দিয়ে খুলে ফেললো পাল্লা। অপেক্ষা করছে সে। কিছুই ঘটলো না। যখন কিছু নড়লোও না ঘরের ভেতর, জোরে জোরে ডাকলো আবার রেনের নাম ধরে । তারপর আনমনেই বললো, ‘ঠিক আছে। একটা নোট রেখে যাই তাঁর জন্যে। দরজার পাশে হাতড়াতে শুরু করলো। সুইচ পেয়ে টিপতেই একসাথে জ্বলে উঠলো কয়েকটা বাতি। 

ছোট একটা লিভিংরুমের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিশোর। মরচে পড়ে গেছে লোহার আসবাবপত্রে। একটা পাথরের ফায়ারপ্লেস রয়েছে। রান্নাঘরটা ডানে। একটা কাউন্টারের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়েছে ছোট একটা চোরকুঠুরি। 

লুকানোর কোনো জায়গা চোখে পড়লো না কিশোরের। তাই ঘরের শেষ প্রান্তের আরেকটা দরজার দিকে এগোলো। ওপাশে ছোট একটা হলওয়ে আছে। বাথরুম আছে। আর আছে একটা বেডরুম, তাতে দুটো বিছানা। বাথরুমে কেউ নেই। বিছানার নিচে, আলমারির ভেতরে কিংবা দরজার আড়ালেও লুকিয়ে থাকতে দেখা গেল না কাউকে। খালি বাড়ি। 

• সন্তুষ্ট হয়ে লিভিংরুমে ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরেই স্থির হয়ে গেল সে। মনে পড়ে গেল সৈনিক পিঁপড়ের ওপর রেনের দেয়া বক্তৃতাগুলো । 

সৈনিক পিঁপড়ের গজখানেক চওড়া সারি কখনও দেখেছো?’ তিনি বলেছিলেন। 

132. 

ভলিউম-১৬ 

ভাবতে পারো, পিলপিল করে চলেছে ওরা, চলার পথে জীবন্ত যা কিছু পাচ্ছে সব কিছুর ওপর চড়াও হচ্ছে, এমনকি বিল্ডিঙের মধ্যে পর্যন্ত ঢুকে পড়ছে মানুষের ওপর আক্রমণ চালাতে!’ 

কল্পনা করার দরকার হলো না কিশোরের। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছে । চৌকাঠ আর পাল্লার মাঝের ফাঁক দিয়ে আসছে ওগুলো। হাজারে হাজারে। মেঝে আর আসবাবপত্র ছেয়ে ফেলছে। একটা চেয়ার ইতিমধ্যেই ঢাকা পড়ে গেছে পিঁপড়ের চলমান কার্পেটে । 

আবার রেনের কথা মনে পড়লো কিশোরের; ‘জ্যান্ত সব কিছুই ওদের খাবার ।’ 

‘না, তা হতে পারে না!’ নিজে বলে নিজেই সান্ত্বনা খুঁজলো সে। এগুলো সেরকম নয়! কারণ এগুলো আফ্রিকান পিঁপড়ে নয় ! 

তারপর তার মনে পড়লো, পাহাড়ের পিঁপড়েগুলো নতুন প্রজাতির। যাদের স্বভাব-চরিত্র রেনও খুব কম জানেন। কল্পনায় দেখতে পাচ্ছে কিশোর, তাকে ছেঁকে ধরেছে পিঁপড়ে। কামড়ে কামড়ে মাংস তুলে নিচ্ছে। জ্যান্ত অবস্থায়ই খেয়ে ফেলছে একটু একটু করে। 

দাঁড়িয়ে থেকে পিঁপড়ের খাবার হতে চাইলো না সে। এক দৌড়ে ঢুকে পড়লো বাথরুমে। জানালার কাছে এসে খোলার চেষ্টা করলো। পারলো না। শক্ত করে লাগানো । 

একটানে পায়ের একটা জুতো খুললো বাড়ি মেরে কাঁচ ভাঙার জন্যে। থেমে, গেল । এই প্রথম খেয়াল করলো, লোহার গ্রিল লাগানো রয়েছে। কাঁচ ভাঙলেও বেরোতে পারবে না । 

ঘুরে তাকালো আবার। এগিয়ে আসছে পিঁপড়ের দল। বন্যার পানির মতো ঘরের ভেতরে ঢুকছে। বেডরুমের বাইরে হলওয়ে ছেয়ে ফেলেছে দেখতে দেখতে । 

আটকা পড়েছে কিশোর! 

পনেরো 

মারাত্মক, আঠালো কোন তরলের মতো লাগছে পিঁপড়ের চলমান চাদরকে । হলওয়ে ছেয়ে এগিয়ে আসছে, আরও, আরও। 

ওয়াকি-টকির বোতাম টিপলো কিশোর। ‘মুসা! রবিন!’ চিৎকার করে বললো সে। ‘পিঁপড়ে! লাখ লাখ পিঁপড়ে! গেস্ট হাউসে ! জলদি এসো! ডক্টর রেনকে নিয়ে!’ 

বেডরুমের দরজা দিয়ে ঢুকছে পিঁপড়ে । 

‘অবস্থা কি খুব খারাপ?’ জিজ্ঞেস করলো রবিন। ‘হ্যাঁ! জলদি এসো! আটকা পড়েছি আমি!’ 

একটা বিছানায় এসে উঠলো কিশোর। একটানে তুলে আনলো বেডকভারটা, যাতে মেঝে ছুঁয়ে না থাকতে পারে। দলামোচড়া করে ফেললো বিছানার মাঝখানে। পায়া বেয়ে এমনিতেও উঠবে গুগুলো। তবে চাদর বেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি উঠে যেতো। যতোটা দেরি করানো যায় তা-ই লাভ । 

নিশাচর 

১৩৩ 

‘মুসা! রবিন! জলদি এসো!’ 

ভেতরে ঢুকে ছড়িয়ে পড়ছে পিঁপড়েরা। আরও এগিয়ে এসেছে। রেডিওতে চিৎকার করে সাহায্য চাইলো কিশোর । 

বাইরে কার পায়ের শব্দ এসে থামলো। ‘সর্বনাশ!’ শোনা গেল রেনের চিৎকার। 

‘কিশোর!’ রবিনের ডাক শোনা গেল। ‘কোথায় তুমি? ঠিক আছো তো?’ ‘বেডরুমে!’ প্রায় ককিয়ে উঠলো কিশোর। জলদি এসো!’ 

নরিটার কণ্ঠ শুনতে পেলো সে। গালাগাল করছে পিঁপড়েকে। তাকে সরে দাঁড়াতে বললেন রেন। বেডরুমের জানালায় থাবা মারছে কেউ । 

পিঁপড়ের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে জানালার দিকে তাকালো কিশোর । দেখলো গ্রিলের ওপাশে মুসার উদ্বিগ্ন মুখ। তার পাশে রবিন। জানালাটা খোলার চেষ্টা করছে মুসা। 

‘আটকে আছে!’ চেঁচিয়ে বললো কিশোর। মনে হয় রঙটঙ লেগে আটকেছে!’ নিউম্যান আর রেন এগিয়ে আসতেই সরে তাঁদেরকে জায়গা করে দিলো রবিন আর মুসা। ডক্টরের হাতে একটা পাথর। ছুঁড়ে মারলেন জানালার কাঁচ সই করে। ঝনঝন করে ভেঙে গেল কাঁচ । 

‘অ্যাইই, ধরো!’ বলেই একটা টিন কিশোরের দিকে ছুঁড়ে মারলেন তিনি। পোকামাকড় মারার বিষ রয়েছে ওটাতে। ‘ছিটিয়ে দাও। জলদি পথ করে এগিয়ে এসো জানালার কাছে।’ 

‘জানালার পাশে একটা হুড়কো আছে,’ নিউম্যান বললো। ‘ওটা খুলতে পারলেই গ্রিলটা খুলে যাবে। বেরোতে পারবে 

বিছানার পায়া বেয়ে উঠতে শুরু করলো পিঁপড়ে। এখনও মেঝেটা পুরোপুরি ভরে যায়নি পিঁপড়েতে। ওষুধ ছিটাতে লাগলো কিশোর। পায়া বেয়ে যেগুলো ওঠার চেষ্টা করছে, প্রথমে গুগুলোকে, তারপর তার নিচের গুলোকে। মরা পিঁপড়ের ওপর নেমে পড়লো সে। মড়মড় করে পিষে গেল ওগুলো। শব্দটা শুনলেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে। শিউরে উঠলো কিশোর। এক পা এগোচ্ছে, ওষুধ ছিটাচ্ছে, আরেক পা বাড়াচ্ছে, আবার ছিটাচ্ছে। 

চলে এলো জানালার কাছে। মেঝেতে পড়ে থাকা ভাঙা কাঁচে পা পড়লো । ‘হুড়কো?’ পাগলের মতো খুঁজছে ওটা সে। ‘কোথায় ওটা?’ 

হাত তুলে একটা চেস্ট অভ ড্রয়ার দেখালো নিউম্যান। ‘ওটা সরাও। দেয়ালে দেখতে পাবে ওটা।’ 

ছোট চেষ্টটা ধরে টান দিলো কিশোর। পিছলে সরে এলো ওটা। অসংখ্য পিঁপড়েকে পিষে দিয়ে। 

সহজ হুড়কো। গ্রিলের ফ্রেমের একটা বাড়তি অংশে ছিদ্র করে তার মধ্যে ছিটকানির মতো একমাথা বাঁকা একটুকরো শিক ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। টান দিতেই খুলে চলে এলো। ‘খুলেছে!’ চিৎকার করে বললো সে। 

‘গুড!’ রেন বললেন। তিনি আর নিউম্যান ধরে টানতেই কজার ওপর পাল্লা যেমন করে খোলে তেমনি করে খুলে গেল গ্রিলটা । 

“১৩৪ 

ভলিউম-১৬ 

মুহূর্ত পরেই বাইরে ঘাসের ওপর লাফিয়ে পড়লো কিশোর। তার ওপরই এলে প্রায় বসে পড়লো নরিটা, বাচ্চার ওপর মা মুরগী যেমন করে গিয়ে বসে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকিয়ে রইলেন রেন । অভিভূত করে দিয়েছে যেন তাঁকে পিঁপড়েগুলো । বিছানাটা ছেয়ে ফেলেছে, একটু আগে কিশোর যেখানে ছিলো। 

দৌড়ে এলো এলিজা ওয়াগনার। গেস্ট হাউসের নরম আলোয় তার মুখ দেখতে পাচ্ছে কিশোর। চোখেমুখে আতঙ্ক। হাতে লাল একটা ক্যান । 

চোখ মিটমিট করলো কিশোর। বুঝে ফেললো কি করতে এসেছে এলিজা । ‘না না, মিস ওয়াগনার, না!’ চেঁচিয়ে উঠলো কিশোর। 

‘সরো! সরে যাও! আমার ধারে কাছে আসবে না!’ 

তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে এলিজার কণ্ঠ। যেন খুনের নেশায় পেয়ে ৰসেছে। ক্যানটাকে এমন করে তুলে ধরেছে, যেন কিশোর বাধা দিতে এলে তার ওপরেই ছুঁড়ে মারবে । 

‘এলিজা, প্লীজ!’ অনুনয় করে বললেন রেন। আমার পিঁপড়ে ওরা! আমার রিসার্চ…প্লীজ! 

কানেই তুললো না এলিজা। রেনের দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালো, যেন ডক্টরও আরেকটা বড় সর্বনেশে পিঁপড়ে। টিন থেকে তরল পদার্থ ঢালতে শুরু করলো কটেজের সামনের বারান্দা আর দেয়ালে । 

পেট্রোলের গন্ধ এসে নাকে লাগলো কিশোরের। 

খোলা দরজা দিয়ে টিনটা ভেতরে ছুঁড়ে ফেললো এলিজা। লিভিং রুমের ভেতরে যেখানে পিলপিল করছে লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ে। সোয়েটারের পকেট থেকে বের করলো অন্য আরেকটা জিনিস 

‘এলিজা! না আ আ!’ লাফ দিয়ে আগে বাড়লেন রেন । 

ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলেই ছুঁড়ে মারলো এলিজা । 

ফুৎ করে একটা শব্দ হলো। চোখের পলকে আগুন লাফিয়ে উঠলো কটেজের সামনের অংশে। ছড়াতে শুরু করলো । লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে ঢুকে পড়লো লিভিং রুমের ভেতরে । 

‘হয়েছে!’ উন্মাদের মতো চিৎকার করে বললো এলিজা। এইবার হয়েছে! বুঝবে এখন ঠেলা! মরুক! ইস্, আর সহ্য করতে পারছি না আমি!’ 

বলতে বলতেই ঘুরে দৌড় মারলো পাহাড়ের দিকে। 

ষোলো 

‘ইস, যদি খালি ট্রাকের লাইসেন্স নম্বরটা রাখতে পারতাম!’ গুঙিয়ে উঠলো মুসা। ‘আমি একটা ছাগল! পারলাম না কেন?’ 

কেবিনে যেদিন আগুন লেগেছে তার পরদিন সকাল। হেডকোয়ার্টারে বসে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। আগের দিনের ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছে। 

‘পুল দেখাশোনার লোক,’ রবিন বললো। ‘এখন আমরা জানি তার কাজটা 

কি । আর তাকে খুঁজে বের করাও হয়তো কঠিন কিছু নয়।’ 

নিশাচর 

১৩৫ 

‘দরকার নেই,’ কিশোর বললো। মুসা, তুমি বললে মাত্র কয়েক সেকেণ্ড বেহুঁশ হয়ে ছিলে। যখন হুঁশ ফিরলো দেখলে লোকটা ট্রাকের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। 

মাথা ঝাঁকালো মুসা। ‘খাদে পড়ে থেমে গেল ট্রাকটা। ওটাতেই চড়লো লোকটা। খাদ থেকে তুলে চালিয়ে নিয়ে চলে গেল। ব্রেক কাজ করছে কিনা সে- ব্যাপারে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামালো না।’ 

তাহলে আমাদের রহস্যময় পুল মেরামত করার লোকটি কাকতাড়ুয়া নয় । কারণ ওই মুহূর্তে সে তার ট্রাক নিয়ে পালাতেই ব্যস্ত। যখন কাকতাড়ুয়াটা ডক্টর রেনহার্ডের ল্যাবরেটরিতে ঢুকেছে। 

তাহলে কে কাকতাড়ুয়া সাজে?’ মুসার প্রশ্ন । 

‘নিউম্যান দম্পতিকে বাদ রাখা যায়,’ কিশোর বললো । কারণ কাকতাড়ুয়াটাকে দেখার আগের ক্ষণেও ওদেরকে ওয়াগনার হাউসে দেখেছি । ডক্টর অবশ্য কাল আমাদের সঙ্গে ছিলেন না, কিন্তু অন্য রাতে যখন দেখলাম ওটাকে তখন ছিলেন। বাকি থাকলেন স্টেবিনস কলিগ, কিন্তু তিনি একাজ করবেন বলে মনে হয় না ।’ 

সামনে ঝুঁকে টেবিলে কনুইয়ের ভর রাখলো সে। ‘এখন যা অবস্থা, সারা জীবন আলোচনা করেও এ-কেসের সমাধান আমরা করতে পারবো না এভাবে। কারণ খুব বেশি সূত্র নেই আমাদের হাতে। অন্যভাবে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। হামলার শিকার হলো এলিজা ওয়াগনার। কাকতাড়ুয়ার নজর তারই দিকে। কাল রাতের মানসিক আঘাতটা নিশ্চয় এতোক্ষণে কাটিয়ে উঠেছে। গিয়ে তাকে এখন কিছু প্রশ্ন করা দরকার । জিজ্ঞেস করতে হবে তাকে এভাবে অস্থির করে দিয়ে কার কি লাভ। 

‘আবার খেপে যেতে পারে,’ হুঁশিয়ার করলো মুসা। 

মাথা ঝাঁকালো রবিন। ‘নিজের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা তার। তাকে কেউ অপছন্দ করবে একথা ভাবলেই আবার রাগবে । 

‘কিন্তু অন্তত একটা লোক যে তাকে অপছন্দ করে একথা মেনে না নিয়ে পারবে না,’ কিশোর বললো। ‘কাকতাড়ুয়া। এলিজার সঙ্গে কথা বলতে হবে। চলো। 

মিনিট কয়েক পরেই সাইকেল চালিয়ে কোস্ট হাইওয়েতে চলে এলো তিন গোয়েন্দা। ওয়াগনার হাউসে এসে কলিং বেল বাজালে দরজা খুলে দিলো এলিজাই। সব সময় যেমন পরে তেমনি ভাবেই পোশাক পরেছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কিন্তু চেহারা একেবারে রক্তশূন্য, ফ্যাকাসে। চোখের চারপাশে কালি 1 

‘মিস ওয়াগনার, ভদ্র কণ্ঠে বললো কিশোর। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে পারবো?’ 

যদি বেশি জরুরী হয়। শরীরটা ভালো না। টায়ারড্ লাগছে। কাল রাতে দমকল বাহিনীর চীফ এসেছিল এখানে। ভীষণ রেগে গেছে আমার ওপর,’ মুখ বাঁকালো এলিজা। ‘অনেক কথা বলে গেল। বললো, ঘরে আগুন না ধরিয়েও পিঁপড়ে মারার নাকি আরও অনেক উপায় আছে । 

১৩৬ 

ভলিউম-১৬ 

মাথা ঝাঁকালো কিশোর, মুখে কিছু বললো না। দমকল বাহিনীর ফায়ার চীফের সঙ্গে একমত । 

‘কাল রাতে ঘুম ভালো হয়নি,’ এলিজা বললো। ‘মিসেস রোজারিওরও শরীর ভালো ছিলো না। পেট ব্যথা করছিলো। একা থাকতে কষ্ট হবে ভেবে আমি গিয়ে কিছুক্ষণ থেকেছি তার সঙ্গে। এখনও ওখানেই বসে ছিলাম।’ 

আমি গিয়ে বরং বসি তাঁর সঙ্গে,’ প্রস্তাব দিলো রবিন। ‘আপনি কিছুক্ষণ ছুটি পাবেন তাহলে। 

“মলিন হাসি হাসলো এলিজা। ‘ভালোই হয়। সিটিংরুমে আছে। দরজায় টোকা দিয়ে ঢুকো।’ 

বাড়ির পেছনে মিসেস রোজারিওর ঘরের দিকে চলে গেল রবিন। অন্য দু’জনকে নিয়ে লিভিংরুমে চলে এলো এলিজা। নিজে সোফায় বসে ছেলেদেরকে চেয়ার দেখিয়ে দিলো । 

‘আপনার চেনাজানা মানুষদের সম্পর্কে কথা বলতে চাই,’ কিশোর বললো । ‘আপনাকে পছন্দ করে না এমন কারও নাম বলতে পারেন?” 

‘আমাকে অপছন্দ করে?” 

‘হ্যাঁ। স্টেবিনস কলিগকে কেমন মনে হয়?’ 

‘দূর, কি বলো! তিনি তো আমাদের ঘরের লোক। ছবি ছাড়া আর কিছু বোঝেন না তিনি। 

তাহলে এখানে যারা কাজ করে তাদের কেউ?’ 

‘নিউম্যানদের কথা জিজ্ঞেস করছো!’ 

‘না। আমরা শিওর হয়ে গেছি, নিউম্যান কাকতাড়ুয়া সাজেনি। অন্য কেউ? মালি-টালি? আমি জানি, হপ্তায় দু’দিন করে আসে ওরা। তারপর রয়েছে পুল মেরামতের লোক । সে-ও তো নিয়মিতই আসে, নাকি?’ 

আসে। কিন্তু আমাকে অপছন্দ করবে কি কারণে? তাকে ভালোমতো চিনিই না আমি । ইউ সি এল এ-র ছাত্র সে, যদ্দূর জানি । 

তরুণ?” অবাক হয়েছে কিশোর 

‘নিশ্চয়।’ 

ভূকুটি করলো কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করলো। 

‘বুঝতে পারছি, আর বেশি দিন থাকতে পারবো না এখানে,’ এলিজা বললো। ‘না পারলে নাই। ইউরোপে চলে যাবো আবার।…ও হ্যাঁ, কাল রাতে আবার এসেছিলো কাকতাড়ুয়া । 

তার দিকে তাকিয়ে রইলো কিশোর আর মুসা। 

মাঝরাতের দিকে। তখন আমি মিসেস রোজারিওর ঘরে। আলো নেভানো । ড্রাইভওয়েতে দেখা গেছে তাকে। একটা ঠেলা ঠেলে নিয়ে চলেছিলো গ্যারেজের দিকে। 

‘ঠেলা?’ প্রতিধ্বনি করলো যেন কিশোর। ‘খালি? নাকি মাল ছিলো?’ 

স্তূপ করে রাখা ছিলো কি যেন। অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। মাটি-টাটি হতে পারে। 

নিশাচর 

১৩৭ 

কাউকে ডাকেননি?” 

“না। ডাকতে ডাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি,’ কেমন যেন শূন্য মনে হলো তার কণ্ঠস্বর। ‘লোকের কাছে পাগল সেজে লাভ কি? তার চেয়ে চুপচাপ থাকবো, এই ভালো।’ 

হুঁ।’ 

‘আমি জানিই না আমার বিরুদ্ধে কার এমন ক্ষোভ আছে। হলে খুব পুরনো শত্রুতা হবে । কারণ মাঝখানে বহু বছর লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকিনি আমি । 

ডাইনিং রুম আর লিভিং রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো নরিটা । জানালো, তার স্বামী রকি বীচ বাজারে যাচ্ছে। জানতে চাইলো এলিজার জন্যে কিছু আনতে হবে কিনা । 

‘অ্যাসপিরিন,’ বলে দিলো এলিজা। 

‘আচ্ছা।’ 

চলে গেল নরিটা। উঠে দাঁড়ালো এলিজা। ‘তোমরা কি থাকবে আরও কিছুক্ষণ? থাকলে ভালোই হয়। তোমরা থাকলে বেশ সাহস পাই, নিরাপদ বোধ করি।’ 

‘নিশ্চয়ই থাকবো, কিশোর বললো। ‘আচ্ছা, ডক্টর রেন কোথায়?’ 

‘গেস্ট হাউসটা পুড়ে যাওয়ায় গোলাঘরে ঠাঁই নিয়েছে। হয়তো ওখানেই আছে এখন, বিশ্রাম নিচ্ছে। আমারও বিশ্রাম দরকার, যাই।’ 

হলের দিকে রওনা হলো এলিজা। কি ভেবে দাঁড়িয়ে গেল। ‘দেখি, নরিটাকে নিয়ে যাই। একা যেতে ভয় লাগে।’ 

তাই করুন। 

রান্নাঘরের দিকে চলে গেল এলিজা। একটু পরেই নরিটার আন্তরিক কণ্ঠ কানে এলো দুই গোয়েন্দার। সিঁড়ি বেয়ে দু’জন মানুষের উঠে যাওয়ার শব্দ শোনা গেল । সামনের একটা জানালার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। দেখলো, বড় কালো একটা বুইক গাড়ি চলে যাচ্ছে চ্যাপারাল ক্যানিয়ন ধরে, খুব আস্তে চলেছে গাড়িটা। নিউম্যান শহরে যাচ্ছে,’ জানালো সে । 

এই সময় সেখানে এসে ঢুকলো রবিন। ‘মিসেস রোজারিও ঘুমিয়ে পড়েছেন । ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন ব্যথায়।’ এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো সে। তারপর বললো, ‘অবাক কাণ্ড, বুঝলে। তাঁর হুইল চেয়ারটা ঠেলে নিয়ে চলেছি, বেডরুমে দিয়ে আসার জন্যে । মিউজিয়মে ঝোলানো আসল ভারমিয়ারটার কথা বললেন তিনি তখন। ঝাড়বাতিদানটার কথাও বললেন। বুঝিয়ে দিলেন কি করে প্রিজমগুলো কাঁপে, যখন সিঁড়ির গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়িটা বাজে। 

তাকিয়ে রয়েছে মুসা। বলেছেন? কি করে? তিনি তো সিঁড়ি বেয়েই উঠতে পারেন না । জানলেন কিভাবে?” 

‘নিশ্চয় কলিগ বলেছেন,’ কিশোর বললো। ‘ওই ঝাড়বাতিদানটা তাঁর খুব পছন্দ। 

উজ্জ্বল হলো তার চোখ। ‘এই শোনো, এখন মিসেস রোজারিও ঘুমোচ্ছেন । এলিজাকে নিয়ে নরিটা গিয়ে ওপরতলায় উঠেছে। নিউম্যান চলে গেছে বাজারে। 

১৩৮ 

ভলিউম-১৬ 

এটাই সুযোগ। অনেক আগেই যা করা উচিত ছিলো, এখন সেটা সেরে ফেলা দরকার। 

‘কী?’ জানতে চাইলো মুসা । ‘বাড়িটা তল্লাশি।’ 

সতেরো 

নিঃশব্দে কাজ করছে তিন গোয়েন্দা। ওপরতলায় এলিজা আর নরিটা যে জেগে রয়েছে, একথাটা অবশ্যই মনে রেখেছে। আলমারির ভেতরে, ক্লোজেটের ড্রয়ারে, কেবিনেটের ওপরে, সমস্ত জায়গায় খুঁজছে। 

রান্নাঘর আর ভাঁড়ারে কোনো সূত্র পেলো না, কাকতাড়ুয়াকে ধরতে যেটা সাহায্য করবে। চাকরদের ছোট সিটিংরুমেও কিছু মিললো না। বাকি রইলো ওদের দুটো বেডরুম । 

একটা ঘরের ক্লোজেটে কিছু ইউনিফর্ম দেখা গেল। কিছু শার্ট-প্যান্ট আছে, জ্যাকেট আছে, মোজা আছে। কিন্তু চটের বস্তাও নেই, কালো হ্যাটও নেই, যা পরে কাকতাড়ুয়া সাজা যায় । 

‘নিউম্যান যদি কাকতাড়ুয়া না-ই হয়ে থাকে,’ রবিন বললো, ‘এখানে কেন খুঁজতে এসেছি আমরা?’ 

কারণ না খোঁজাটা বোকামি,’ জবাব দিলো কিশোর। ‘সব জায়গায়ই খুঁজতে হয় । কিছুই বাদ দেয়া উচিত হবে না। এখানে কিছু পাওয়ার আশা করছি না, তবু দেখবো। তারপর যাবো বেসমেন্টে।’ 

বাড়িটা যেমন বিরাট তার সেলারও তেমনি। কয়েকটা কামরায় ভাগ করা। একটাতে মদ রাখা হয়। একটা হলো ফারনেস রুম, কয়েকটা আছে স্টোর রুম, এর একটা ওয়ার্কশপ। আগে আগে চলেছে কিশোর। মিসেস রোজারিওর ঘরের নিচের ঘরটায় চলে এলো। আগের রাতে এই ঘরের দরজা খুলেই লনে লোক বেরোতে দেখেছে সে। ওখানটায় বাইরের মাটি আর বেসমেন্টের মেঝে একই সমতলে। 

‘দেখছো?’ নরম গলায় বলে হাত তুলে দেখালো কিশোর। সিমেন্টের মেঝেতে টায়ারের দাগ। ‘এখান দিয়েই ঠেলাটা বের করে নিয়ে গেছে কাকতাড়ুয়া। রবারের চাকা। মাটি বোঝাই করা হয়েছিল। ওই যে দেখ, মাটির ঢেলা পড়ে রয়েছে । 

কিন্তু এলো কোত্থেকে মাটি?” অবাক হয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে রবিন । 

চাকার দাগ ধরে এগোলো তিন গোয়েন্দা। দাগের পাশে পড়ে রয়েছে মাটির টুকরো। অনুসরণ করতে অসুবিধে হলো না। সরু একটা করিডরে এসে ঢুকলো ওরা। অব্যবহৃত একটা স্টোর রুম আর ভারি কাঠের দরজাওয়ালা একটা ঘরের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পথটা। দ্বিতীয় ঘরটার আলো জ্বাললো মুসা। ছাতে কিছু পাইপ দেখা গেল, ময়লা লেগে রয়েছে । 

*গোশত রাখার ঘর ছিলো এটা একসময়,’ বললো মুসা। রকি বীচ মার্কেটে 

নিশাচর 

১৩৯ 

কোল্ড রুম দেখেছো না, ওরকম। অতোটা বড় না আরকি । 

‘একটা বাড়িই ছিলো তখন,’ রবিন বললো। ওয়াগনাররা সবাই যখন থাকতো এখানে । ভাবতে পারো, বাড়ির মধ্যে ব্যক্তিগত কোল্ড স্টোরেজ!’ 

সামান্য মাথা ঝোঁকালো কিশোর। তবে রবিনের কথায় বিশেষ কান দিলো না। সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে। যেন যা খুঁজতে এসেছিলো পেয়ে গেছে। হাত তুলে করিডরের শেষ প্রান্ত দেখিয়ে বললো, মাটি এসেছে ওখান থেকে।’ 

রবিন আর মুসাও তাকালো। করিডরের শেষ মাথায় সিমেন্টের দেয়াল থাকার কথা যেখানে, সবখানেই যেরকম আছে, সেরকম কিছু নেই। তার জায়গায় যেন হাঁ করে রয়েছে কালো একটা ফোকর। 

‘খাইছে!’ ফিসফিস করে বললো মুসা, সুড়ঙ্গ!’ 

পকেট থেকে টর্চ বের করলো কিশোর। রান্নাঘরের ড্রয়ারে পেয়েছি,’ বললো সে । ভাবলাম, কাজে লাগতে পারে। তাই নিয়ে এসেছি।’ 

আলো ফেললো সুড়ঙ্গে । 

‘বাবারে!” বলে উঠলো রবিন, ‘কাঠের রীম পর্যন্ত লাগিয়ে দিয়েছে হাতে, যাতে ধসে না পড়তে পারে। প্রচুর খেটেছে। 

‘খনির সুড়ঙ্গের মতো,’ মুসা বললো। ‘তাহলে কাকতাড়ুয়া মিয়া একাজেই ব্যস্ত। কিন্তু…কিন্তু…’ থেমে গেল সে । 

‘কিন্তু কেন এরকম একটা কাজ করলো,’ কিশোর বললো।, ‘বোঝা যাচ্ছে না, তাই না? আরেকজনের বাড়ির নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খোঁড়া … ধরা পড়ে যেতে পারতো । অচেনা হলে । 

‘তার মানে এবাড়িরই কেউ, অনুমান করলো মুসা। সে নিজে হয়তো কাকতাড়ুয়া নয়, তবে ওটার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। নিউম্যানরা?’ 

‘নজরটা তো ওদের দিকেই যায়, কিশোর বললো। ‘এই সুড়ঙ্গ কোথায় গেছে আন্দাজ করতে পারছি।’ 

দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। বাড়ির একপাশে, রাস্তার দিকে মুখ করে রয়েছে ওটা। “রাস্তার নিচ দিয়ে মসবি হাউসে চলে গেছে সুড়ঙ্গটা,’ বললো সে ফিসফিস করে। মসবি মিউজিয়মে ঢোকার প্ল্যান করেছে কেউ।’ 

‘চলোই না, দেখি। 

ভেতরে ঢুকে পড়লো কিশোর। ডানে বাঁয়ে আলো ফেলছে । 

পেছনে ঢুকলো দুই সহকারী গোয়েন্দা। কারো মুখে কথা নেই। নরম মাটিতে জুতোর শব্দ হচ্ছে না। যতোই এগোচ্ছে এক ধরনের ভেজা ভেজা গন্ধ বাড়ছে বাতাসে। পথ যেন আর ফুরায়ই না। অন্ধকার সুড়ঙ্গ ধরে যেন কয়েক যুগ চলার পর থেমে গেল কিশোর। থামতেই হলো। কারণ সামনে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে সিমেন্টের দেয়াল। ছুঁয়ে দেখলো ওটা। কিল মেরে দেখলো। নিরেট। মসবি হাউসের বেসমেন্ট,’ ফিসফিসিয়ে বললো সে। মিউজিয়মের এই একটিমাত্র দিকে পাহারা নেই। তবে বার্গলার অ্যালার্ম সব জায়গায়ই আছে।’ 

রবিন আর মুসা দু’জনেই মাথা ঝাঁকালো। টর্চটা রবিনের হাতে তুলে দিলো কিশোর। ঘুরলো তিনজনেই। ফেরার পথে এবার আগে আগে রইলো রবিন। মুসা 

180 

ভলিউম-১৬ 

আগের মতোই মাঝখানে। কিশোর সবার পেছনে। 

‘অবিশ্বাস্য!’ ওয়াগনার হাউসের বেসমেন্টে ফিরে এসে বলে উঠলো মুসা ‘এই সুড়ঙ্গ খুঁড়তে নিশ্চয় অনেক দিন লেগেছে। কয়েক মাস । 

‘এখন আমরা জানি,’ কিশোর বললো । এলিজাকে কেন ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইছে কাকতাড়ুয়া। ওটার ভয়, যে কোনো সময় বেসমেন্টে ঢুকে সুড়ঙ্গটা দেখে ফেলতে পারে সে। কিংবা রাতের বেলা জানালার বাইরে চোখ পড়লে কিছু দেখে ফেলতে পারে। সর্বক্ষণ তো আর হুঁশিয়ার থাকতে পারবে না কাকতাড়ুয়া।’ 

টর্চ নিভিয়ে দিলো রবিন। করিডর ধরে সিঁড়ির দিকে চললো তিন গোয়েন্দা । ‘আরেকটা ব্যাপার বুঝতে পারছি এখন,’ আবার বললো কিশোর। ‘রকি বীচে বাজার করতে যাওয়ার সময় এতো আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলো কেন ব্রড। মাটিতে বোঝাই ছিলো গাড়িটা। সুড়ঙ্গের মাটি ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে ভরে রেখেছিল গাড়িতে। সেগুলোই ফেলতে গেছে। বাড়ির কাছাকাছি ফেললে লোকের নজরে পড়ে যাবে, এই ভয়ে সরিয়ে নিয়ে গেছে।’ 

পরিত্যক্ত কোল্ড স্টোরেজের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো মুসা। নাক উঁচু করে বাতাস শুঁকতে লাগলো। বললো, ‘কি যেন পুড়ছে! এই, ‘গন্ধ পাচ্ছো?” 

সুইচ টিপে আবার আলো জ্বেলে দিলো সে। 

ধোয়ায় ভরে গেছে পুরনো ঘরটা। এক কোণে স্তূপ করে রাখা পুরনো কম্বল । আর গোটা দুই রঙের টিন, ঢাকনা খোলা। 

‘চমৎকার!’ মুসা বললো। একে ফেলে গেছে এখানে এগুলো?’ 

এগিয়ে গিয়ে লাথি মারলো কম্বলের স্তূপে। ছড়িয়ে পড়লো কম্বল । ছিটকে গেল অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। কয়েকটাতে লাফিয়ে উঠলো আগুন। 

‘সাবধান!’ মুসার পেছনে আগুন দেখে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। দৌড়ে গেল আগুন নেভাতে মুসাকে সাহায্য করার জন্যে। কিশোরও গেল । 

হঠাৎ দরজার কাছে শোনা গেল খসখসে হাসি । 

চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলো তিনজনে 

ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে কাকতাড়ুয়া। হাতে ঝোলানো ইলেকট্রিক বাল্বের পরিষ্কার আলোয় বিকট লাগছে ওটার রঙ করা মুখ। একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো ওটা। তারপর হাত বাড়িয়ে চেপে ধরলো ভারি দরজাটা, একটানে বন্ধ করে দিলো । 

‘না না!’ বলে চিৎকার করে উঠে দৌড় দিলো মুসা। প্রায় ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে পড়লো দরজার ওপরে। হ্যাণ্ডেল চেপে ধরে টান মারলো । 

নড়লো না দরজা। 

‘এই শোনো শোনো!’ চেঁচাতে লাগলো মুসা। শুনে যাও! খুলে দাও দরজাটা!’ ‘হয়েছে, থামো!’ শান্ত থাকার চেষ্টা করছে কিশোর। ‘চেঁচিয়ে লাভ হবে না। খুলবে না ও। আমাদেরকে আটকে রেখে গেছে ইচ্ছে করেই। কখনোই আর খোলার ইচ্ছে আছে কিনা, তা-ই বা কে জানে!” 

দরজার ভেতর দিকের হুড়কোটা পরীক্ষা করে দেখলো রবিন। আমাদের ভাগ্যই বলতে হবে! এটা ভাঙা!’ 

নিশাচর 

১৪১ 

‘ভাগ্যটাগ্য সব ফালতু কথা, কিশোর বললো। ‘আসল ব্যাপার হলো, কাকতাড়ুয়াটা আমাদেরকে সুড়ঙ্গে ঢুকতে দেখেছে। আন্দাজ করে নিয়েছে আমরা অনেক কিছু জানি। হুড়কোটা ভেঙেছে। তারপর আগুনের টোপ দেখিয়ে আমাদেরকে এখানে এনে ভরেছে।’ 

‘আর আমরাও বোকা গাধা, তিক্ত কণ্ঠে বললো মুসা। তার টোপ দেখে মজে গেলাম । বাড়িটা এখন পুড়ে না গেলেই হয়।’ 

‘পুড়বে না। এই সুবিধেটাই তো নিতে চেয়েছে কাকতাড়ুয়া। এই ঘরে আমাদের আটকে চুপ করিয়ে রাখতে চেয়েছে। যতোই চেঁচাই, দরজা ধাক্কাই, কেউ শুনতে পাবে না। এখানে যে আগুন লেগেছে, বাইরের কেউ দেখতে পাবে না।’ 

‘ওই পাইপগুলোতে যদি বাড়ি মারি? বাইরের ঘরে কি ওই আওয়াজও যাবে না? পাইপ তো শব্দ বয়ে নিয়ে যাওয়ার ওস্তাদ । 

মাথা নাড়লো কিশোর। ‘বাইরের ঘরের সঙ্গে এই পাইপের যোগাযোগ নেই । কোনো একটা রেফ্রিজারেশন ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত ওগুলো । বাইরেই কোথাও আছে ওটা। বাড়ি মারলেও কেউ শুনবে না। তবে বেসমেন্টের কাছাকাছি থাকলে শুনলেও শুনতে পারে।’ 

ধপ্ করে মেঝেতে বসে পড়লো মুসা। ‘তাহলে কাকতাড়ুয়াটা আমাদের ভালোমতোই আটকে রেখে গেল! আর কোনোদিন বেরোতে পারবো না!” 

‘তা বোধহয় রাখতে পারবে না। খোঁজাখুঁজি শুরু হবেই,’ নিজেকেই যেন ভরসা দিলো কিশোর। ‘সাইকেলগুলো ফেলে এসেছি আমরা। এলিজার গাড়ির পাশে। তার চোখে পড়বেই।’ 

‘চোখে পড়লেই কি আর এখানে আসবে?’ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো রবিন। ‘এই মাটির তলার ঘরে? মাকড়সার মধ্যে?” 

কথাটা ভেবে দেখলো কিশোর। ‘না, তা আসবে না,’ বিষণ্ণ শোনালো তার কণ্ঠস্বর। ‘সাইকেলগুলো দেখলে ভাববে ডক্টর রেনের সঙ্গে রয়েছি। আর নিউম্যানদের চোখে যদি পড়ে… তাহলে কি করবে আল্লাই জানে। ওরা সাহায্য করতে আসবে বলে মনে হয় না।’ 

চুপ হয়ে গেল তিনজনেই। ভাবছে। একসময় অসহ্য লাগলো ওই নীরবতা । ‘মেরিচাচী জানে আমরা কোথায় এসেছি,’ অবশেষে নীরবতা ভাঙলো কিশোর। ‘বোরিস আর রোভারকে পাঠাবে খোঁজ নিতে। ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচারকেও ফোন করতে পারে। তবে সেটা অনেক সময়ের ব্যাপার…’ 

আবার চুপ হয়ে গেল সে । অন্য দু’জনও কোনো কথা বললো না। তিনজনের মনেই একটা ভাবনা,ততোক্ষণ ঘরে বাতাস থাকবে তো? নাকি উদ্ধারকারী দল- এসে দেখবে তিনটে লাশ পড়ে রয়েছে মেঝেতে, অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত? 

শামুকের মতো ধীর গতিতে যেন এগোতে লাগলো সময়। একটা দীর্ঘ সেকেণ্ডের পর আরেকটা সেকেণ্ড। এমনি করে যেন বহুযুগ পরে কাটলো একটা ঘন্টা। পেটে মোচড় দিতে আরম্ভ করেছে কিশোরের। বাতাসের কথাই শুধু 

182 

ভলিউম-১৬ 

ভাবছে, খিদের কথাটা ভুলেই গিয়েছিলো। 

হঠাৎ যেন মৃদু কেঁপে উঠলো ঘরটা। 

“কি হলো?’ শুয়ে পড়েছিলো, ঝট্ করে উঠে বসলো মুসা । ‘ভূমিকম্প, আর কি?’ হাত ওল্টালো রবিন । 

‘চমৎকার!’ পিছিয়ে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিলো মুসা। সামান্য যেটুকু আশা হয়েছিলো তা-ও উবে গেল। ‘একেই বলে কপাল ! বন্ধ ঘরে আটকে থেকে শুধু বাতাসের অভাবে মরাই নয়, একেবারে জীবন্ত কবর দিয়ে ফেলার ব্যবস্থা! প্রকৃতিও আমাদের সঙ্গে বিরোধিতা শুরু করলো নাকি!’ 

ঘন্টা । 

আবার গড়িয়ে চললো যেন সময়ের শামুক। সেকেণ্ড গেল, মিনিট, তারপর 

‘কল্পনা করছি, নাকি সত্যি?’ রবিন বলে উঠলো। বাতাস খারাপ হয়ে আসছে?’ 

‘কি জানি!’ কিশোর বললো। ‘তবে…’ থেমে গেল সে। মুহূর্তের জন্যে দম বন্ধ করে ফেললো। ‘কি ব্যাপার?’ ফিসফিসিয়ে বললো সে। 

অন্য দু’জনও কান পেতে শুনলো । 

‘দরজায় থাবা মারছে না তো?’ মুসার প্রশ্ন। উঠে দরজার দিকে এগোলো সে । ‘অ্যাইই!’ চিৎকার করে বললো, ‘আমরা এখানে আছি! আটকা পড়েছি!’ পাল্লায় কিল মারতে শুরু করলো । 

জুতো খুলে ফেললো কিশোর। সে-ও এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। জুতো দিয়ে দমাদম বাড়ি মারতে শুরু করলো পাল্লায় ৷ 

রবিনও উঠে এলো । একসঙ্গে চেঁচাতে শুরু করলো তিনজনে 

অবশেষে, ঝট্‌কা দিয়ে খুলে গেল কোল্ড রুমের বিরাট দরজা। লম্বা একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় ঝাঁকড়া শাদা চুল। অনবরত রোদে থেকে থেকে স্যুটকেসের চামড়ার মতো ট্যান হয়ে গেছে যেন হাত আর মুখের চামড়া। নাকের দু’পাশ থেকে অনেকগুলো গভীর রেখা গিয়ে মিশেছে ঠোঁটের কোণে । তার হাত আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এলিজা ওয়াগনার 

‘গঅড!’ লোকটা বললো। আমার মনে হচ্ছিলো তোমরা এখানেই কোথাও আছো। ঢুকতে দেখেছিলাম, কিন্তু বেরোতে দেখিনি।’ 

ক্লান্ত হাসি হাসলো কিশোর। বেরিয়ে এলো করিডরে। ‘ভালোই হয়েছে। রহস্যময় লোকেরা যখন বাড়ির ওপর চোখ রাখে, তখনও উপকার হয় মাঝেমধ্যে।’ 

‘রহস্যময় লোক?’ নাক কুঁচকালো এলিজা। ‘ও রহস্যময় নয়। আমাদের পুল মেরামত করে। জন ডিলন। যা-ই হোক, ব্যাপারটা কি বলবে? ঘটছে কি এখানে? ব্রড আর নরিটাও নেই। ঘুম থেকে উঠে দেখি পুরো বাড়িটা খালি।’ 

‘ও, চলে গেছে তাহলে। তারমানে ওদের কাজ শেষ, ইশারায় সুড়ঙ্গমুখটা দেখালো কিশোর। 

তাকালো ডিলন। তাহলে ওখানেই গেছে! সুড়ঙ্গ! 

‘মসবি হাউসে, বলে টর্চ জ্বাললো কিশোর। এগোলো সুড়ঙ্গের দিকে । পিছু 

নিশাচর 

১৪৩ 

নিলো রবিন, মুসা আর ডিলন। 

একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকলো এলিজা। দ্বিধা করলো। তারপর চেঁচিয়ে উঠলো, “না না, আমাকে ফেলে যেও না! আমিও যাবো!’ 

‘তাহলে জলদি এসো!’ হাত নেড়ে ডাকলো ডিলন । 

চারজনের মধ্যে রবিন ঢুকলো সবার পেছনে। তার পেছনে রইলো এলিজা সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় পৌছার আগে কেউ কথা বললো না। বিরাট একটা ফোকর দেখা গেল কংক্রীটের দেয়ালে । বাতাসে বারুদের কড়া গন্ধ । 

‘ডিনামাইট,’ বাতাস শুঁকে বললো ডিলন। ‘ডিনামাইট দিয়ে ভেঙেছে, ‘ শক্ত হয়ে গেছে তার বাদামী, লম্বাটে মুখটা। 

‘হ্যাঁ,’ একমত হয়ে বললো কিশোর। ‘কাঁপুনিটা টের পেয়েছি। তখন ভূমিকম্প মনে করেছিলাম। নিশ্চয় বিকেল পাঁচটার পর ফাটিয়েছে, গার্ডেরা বাড়ি 

চলে যাওয়ার পর । 

ফোকরটা দিয়ে মসবি হাউসের পাতালঘরে ঢোকা যায়। ঢুকলো ওরা। টর্চের আলো ফেলে সুইচবোর্ডটা খুঁজে বের করলো কিশোর। সুইচ টিপে আলো জ্বাললো । নানারকম বাক্স স্তূপ করে রাখা হয়েছে। বেসমেন্টে একটা ফারনেস রুম আছে। আরেকটা ঘরে রয়েছে মেশিনপত্র, যেসব ঘরে ছবিটবি রয়েছে, সেসব ঘরের তাপমাত্রা একই রকম রাখার ব্যবস্থা। দ্রুত একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো ডিলন আর তিন গোয়েন্দা, তারপর ওপরে ওঠার সিঁড়ির দিকে এগোলো । সঙ্গে চললো এলিজা। ওদের গা ঘেঁষে থাকতে চাইছে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে চেহারা । 

একটা হলঘরে ঢুকে চিৎকার করে ডাকলো কিশোর, ‘মিস্টার কলিগ?’ সাড়া এলো না । 

‘নেই হয়তো,’ মুসা বললো। ‘ডিনামাইট ফাটানোর আগেই বেরিয়ে গেছেন।’ নিচতলায় একঘর থেকে আরেক ঘরে ঢুকতে লাগলো ওরা। যেখানে যা যেমন ছিলো তেমনি রয়েছে। বার বার কলিগের নাম ধরে ডাকা হলো। জবাব মিললো না। পুরো বাড়িটা নীরব। কেউই যেন নেই । 

স্টেবিন কলিগ কোথায় গেলেন? বাইরে বেরিয়েছেন? নাকি মিউজিয়মেই আছেন? নাকি তাঁকেও কোথাও আটকে রাখা হয়েছে, তিন গোয়েন্দার মতো? গায়ে কাঁটা দিলো কিশোরের। লোকগুলো নিষ্ঠুর! ‘মিস্টার কলিগ?” আরেকবার ডাক দিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলো সে। 

দ্বিতীয় ঘরটাকে যেন ছিলে নগ্ন করে ফেলা হয়েছে। ভারমিয়ারের আঁকা ছবি নেই। পাশের ঘরের র‍্যামব্র্যাণ্ডৎ, ভ্যান ডাইক আর রুবেনগুলোও গায়েব। উজ্জ্বল রঙে জ্বলজ্বল করতো যেসব পুরনো ফ্লেমিশ ছবি, সেগুলোও নেই। যে ঘরেই ঢুকছে ওরা, সব খালি । 

‘অনেক টাকা।’ কিশোর বললো। ‘অনেক টাকার ছবি চুরি করে নিয়েছে!’ 

শাদা শূন্য দেয়ালগুলোর দিকে শূন্য দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রয়েছে এলিজা। ‘সমস্ত মসবি কালেকশন।’ ফিসফিস করে বললো সে। ব্রড আর নরিটা! সব, সঅর একদলে! সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে ওরাই! …তাহলে.. তাহলে নিউম্যানই কাকতাড়ুয়া… 

88 

ভলিউম-১৬ 

থ্যাপ থ্যাপ শব্দ হলো মাথার ওপরে । 

‘ওই তো!’ চিৎকার করে দৌড় দিলো কিশোর । 

একেক লাফে দু’তিনটে করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এলো সে। যেখানে রয়েছে মিস্টার কলিগের ওয়ার্কশপ আর ব্যক্তিগত ঘর। জোরালো হয়েছে আওয়াজ । কিশোরের পেছনেই রয়েছে রবিন আর মুসা। সিঁড়ির বাঁয়ের ছোট বেডরুমের ভেতরে ঢুকে একটা আলমারির দরজা খুললো। 

পাজামার নেয়ার দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে মিস্টার কলিগকে। মুখ বেঁধেছে তোয়ালে দিয়ে । 

শান্ত হোন, মিস্টার কলিগ,’ বাঁধন খোলার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো কিশোর। আর ভয় নেই ।’ 

আঠারো 

‘হচ্ছেটা কি এখানে! কিছুই তো বুঝতে পারছি না!’ হুইল চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন মিসেস রোজারিও। খামচে ধরলেন পায়ের ওপর ফেলে রাখা কম্বলটা । দু’চোখে তীক্ষ্ণ কৌতূহল। 

‘আপনার জন্যেই ভয় পাচ্ছিলাম, মিসেস রোজারিও,’ ডিলন বললো। একটা আর্মচেয়ারে বসেছে লম্বা মানুষটা। আরও চারটে চেয়ারে বসেছে এলিজা আর তিন গোয়েন্দা। পাতালঘরে অনেক মানুষের নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে এখান থেকেই। পুলিশের লোক । ছবি তুলছে, সূত্র জোগাড়ের চেষ্টা চালাচ্ছে । রাস্তার ওপাশে মসবি হাউসে ব্যস্ত আরেকদল পুলিশ । 

“নিউম্যানদের কি হলো?’ জানতে চাইলেন মিসেস রোজারিও। ‘এলিজা, খাবার সময় যে হয়ে গেল। চা-ও দিয়ে গেল না কেউ।’ 

‘কেটলি চাপিয়ে দিয়ে আসি, এলিজা বললো। কিন্তু উঠলো না। আরও আরাম করে গা এলিয়ে দিলো আর্মচেয়ারে। ডিলনের পাশে বসেছে। কৌতূহলী হয়ে বার বার তাকাচ্ছে পুল মেরামতকারীর দিকে। শেষে বলেই ফেললো, ‘এ- বাড়ির ওপর নজর রেখেছিলেন? আপনি খুব চালাক!’ 

লাল হয়ে গেল ডিলনের মুখ। ‘আরে না না, কি যে বলেন! আসলে মিসেস রোজারিওর জন্যে ভাবনা হচ্ছিলো আমার।’ 

‘আমাকে নিয়ে অনেক ভাবো তুমি, জন,’ মিসেস রোজারিও বললেন। ‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে । কিন্তু কেন ভাবো?” 

‘ওই ব্রড নিউম্যান লোকটাকে ভালো মনে হয়নি আমার শুরু থেকেই, ‘ ডিলন বললো। ‘সে-কারণেই এই বাড়ির ওপর চোখ রাখতাম। লোকটা আসার পর থেকেই কেমন যেন সব কিছু বদলে যেতে লাগলো।’ 

‘তা বদলেছে,’ মেনে নিলেন মিসেস রোজারিও। তবে বদলে ভালো হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো আবার কিছু সত্যিকারের কাজের লোক ঢুকেছে এবাড়িতে। ভালো চাকর থাকার অনেক সুবিধে। কল্পনা করতে পারবে না তুমি, এলিজা, কি কষ্টটাই না হয়েছে। তোমার মা মারা যাওয়ার পর থেকে ছ’সাত 

১০- নিশাচর 

জোড়া কাজের লোক বদলেছি আমি, সন্তুষ্ট হতে পারিনি। নিউম্যানরা আসার পর হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি।’ 

‘আপনার ওই এতো ভালো চাকরগুলো মোটেও ভালো লোক নয়, বললেন। চোর!’ সুড়ঙ্গের কথা জানালেন তিনি । 

কলিগ 

‘কি বলছেন!’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মিসেস রোজারিও। ‘আপনি বলতে চাইছেন ওরা ওই সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে! অসম্ভব! কখন করলো একাজ! সময়টা পেলো কোথায়?’ 

হয়তো রাতের বেলা, মিসেস রোজারিও,’ কিশোর বললো। ‘যখন আপনি ঘুমিয়ে থাকতেন।’ 

“আর বোলো না! শুনতে ভাল্লাগছে না এসব ফালতু কথা! রাতের বেলা যদি খালি সুড়ঙ্গই খুঁড়বে, ঘুমাতো কখন ওরা? না ঘুমিয়ে কি মানুষ থাকতে পারে? কতোদিন পারে?’ 

রোজ রাতে তো আর খুঁড়তে যেতো না, ডিলন বললো। ‘মাঝে মাঝে দিনের বেলায়ও খুঁড়তো। সেজন্যেই আমাকে বিদেয় করা হয়েছিলো। যাতে সুযোগ পায়। 

বুঝলাম না । ব্রড তো বললো, তুমি আর কাজ করতে পারবে না বলে চাকরি ছেড়ে দিয়েছো। তখন অন্য লোকটাকে বহাল করলো । অল্পবয়েসী লোকটাকে। ‘ ব্রড আমাকে বের করে দিয়েছে,’ ডিলন বললো। ‘অনেক ক্ষমতাই তো দেয়া হয়েছিলো তাকে। অকাজে লাগিয়েছে সেসব। একদিন সকালে দেখলাম বেসমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসছে, পরনে কাজের পোশাক। একটা ঠেলাগাড়ি বোঝাই করে মাটি নিয়ে বেরোচ্ছে। একজন খানসামা কিংবা হাউসম্যানকে কে কবে শুনেছে পাতালঘর থেকে ঠেলাগাড়িতে করে মাটি নিয়ে বেরোতে? কৌতূহল হলো। গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মাটি আনলো কোত্থেকে। সে বললো, পাতালঘরের একটা দেয়াল নাকি ধসে পড়েছে। মাটি পড়ে স্তূপ হয়ে রয়েছে মেঝেতে। পরিষ্কার করে ফেলছে ! 

বিশ্বাস করলাম না। এবাড়ির বেসমেন্টে বহুবার ঢুকেছি আমি। দেয়াল এতো নরম নয় যে খামোকাই ধসে পড়বে। 

বললাম সেকথা। রেগে গিয়ে আমাকে বের করে দিলো সে।’ 

“ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়েছিলো বটে, তবে সেটা বোধহয় আপনিই দিয়েছিলেন মিসেস রোজারিও। কারণ সব কিছু দেখাশোনার ভার তো আপনারই ওপর। ভাবলাম, আপনার অনুমতি নিয়েই চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে সে। এতো বছর ধরে আছি, এভাবে এককথায় বের করে দেবেন, বিশ্বাস করতে পারলাম না। তাই আপনার সঙ্গে দেখা করতে এলাম। বেল বাজাতে খুললো নরিটা। বললো, আপনি ঘুমোচ্ছেন। বিরক্ত করা চলবে না। তারপর যতোবার দেখা করতে চেয়েছি, বাদ সেধেছে সে। টেলিফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছি। ফোন ধরেছে ব্রড কিংবা নরিটা। আপনার সঙ্গে লাইন দেয়নি। দু’বার চিঠিও লিখেছি। মনে হয় আপনার হাতে পড়েনি ওগুলো।’ 

১৪৬ 

মাথা নাড়লেন মিসেস রোজারিও। ‘বলো কি! আমাকে গৃহবন্দী করে 

ভলিউম-১৬ 

রেখেছিলো দুটো চোর! মেরেও ফেলতে পারতো!’ 

‘না, তা করতে সাহস করতো না। তবে আপনার জন্যে দুশ্চিন্তা হয়েছে আমার । কাজেই নজর রাখতে শুরু করলাম। রক রিম ড্রাইভের ওই পুরনো বাড়িটা থেকে। রোজ এসে ওখানে উঠতাম । যতোক্ষণ বারান্দায় থাকতেন আপনি, আমিও থাকতাম। আমার মনে হয়েছিলো, আপনি যতোক্ষণ ঠিক থাকবেন সব কিছুই ঠিকঠাক থাকবে। 

‘তারপর এলো সেই টেকো লোকটা। শস্যখেতে ফসল বুনলো । আর ওই সময়ই এবাড়ির পুরনো মালী, হ্যারি হোলসামকে বের করে দেয়া হলো বিনা নোটিশে, বিশ বছর ধরে যে চাকরি করেছে এখানে। অত্যন্ত বিশ্বাসী একজন লোক।’ 

‘ওকে আমিই বের করেছি’ মিসেস রোজারিও বললেন। বয়েস হয়ে গিয়েছিলো। কাজকর্ম আর ঠিকমতো করতে পারছিলো না। তাছাড়া তারও আর কাজ করার ইচ্ছে ছিলো না।’ 

‘জানি। বহুদিনের পুরনো লোক, তাই মায়া কাটাতে কষ্ট হচ্ছিলো। কাজ করার খুবই ইচ্ছে ছিলো তার, কিন্তু নিউম্যানদের সে-ও সহ্য করতে পারেনি।’ আগের কথায় খেই ধরলো ডিলন, ‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। বিদেশ থেকে বাড়ি এলেন মিস ওয়াগনার। রোজই তাঁকে দেখতাম বারান্দায় বসে আছেন। কেমন যেন একা হয়ে গেছিলেন আপনারা দু’জনে। কেউ দেখা করতে আসতো না। শুধু মিস্টার কলিগ, আর ফসল করেছে যে টেকো লোকটা সে বাদে।’ 

‘আমার কথা বলা হচ্ছে নাকি?” দোড়গোড়া থেকে বলে উঠলেন কীটপতঙ্গ বিশারদ। ‘পুলিশ আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। জিজ্ঞেস করেছে, সারাদিন কোথায় ছিলাম। জানিয়ে দিয়েছি। তারপর বললো, এখানে এসে আপনাদের সঙ্গে বসে অপেক্ষা করতে। মনে হচ্ছে আর থাকা চলবে না আমার। এবার বের করে ছাড়বে।’ 

জন ডিলনের দিকে তাকিয়ে সামান্য মাথা নোয়ালেন রেন। ‘আপনার কথায় বাধা দিলাম বোধহয়?’ 

লাল হয়ে গেছে ডিলনের গাল। ডক্টরকে টেকো বলে ফেলেছে, এবং সেটা তিনি শুনে ফেলেছেন বলে। আরেকদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমার কথা শেষ।’ 

‘এতোই যদি উদ্বিগ্ন হয়ে থাকো তুমি,’ এলিজা জানতে চাইলো। ‘এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করলেই পারতে! কথা বলতে পারতে!’ 

‘আসার ইচ্ছে তো ছিলোই,’ ডিলন বললো। ‘কিন্তু বললে যদি আপনারা বিশ্বাস না করেন? তা-ও সাহস করে একদিন রওনা হয়ে পড়লাম । পড়ে গেলাম ছেলেগুলোর সামনে,’ মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে তিন গোয়েন্দাকে দেখালো সে। ‘তাড়া করলো । ভয়ে পালালাম।’ 

‘কিন্তু কাকতাড়ুয়ার ব্যাপারটা কি? ওটাকে তো দেখেছেন । কি ভেবেছেন?” ‘একমাত্র কাকতাড়ুয়া আমি যেটা দেখেছি, সেটা শস্যখেতের বেড়ার ওপরে দাঁড় করানো। আর কিছু দেখিনি,’ হাত নাড়লো ডিলন। তবে একটা কথা জোর গলায় বলতে পারি। ছেলেগুলো যখন এখানে এসে ঘোরাঘুরি শুরু করলো, 

নিশাচর 

খুশি 

১৪৭ 

হলাম। ওরা এসে আপনার সঙ্গে কথা বললো। তারপর আসতেই থাকলো ৷ বাইরের লোকের সঙ্গে তো যোগাযোগ ছিলো না আপনার, ওরাই শুধু আসে । ছেলেদের দিকে ফিরে বললো, ‘আজ যখন এসে ফিরে গেলে না, অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম । ব্রড তোমাদের সাইকেলগুলো নিয়ে গিয়ে রাখলো গ্যারেজে। অনেকক্ষণ ধরে মিস ওয়াগনারকে বারান্দায় দেখলাম না, মিসেস রোজারিওকে দেখলাম না। খুঁতখুঁত করতে লাগলো মনটা । তাকিয়েই রইলাম । ব্রড চলে গেল । ফিরে এলো ভাড়া করা একটা ট্রেলার নিয়ে। 

‘কৌতূহল আরও বাড়লো। একজন খানসামা ট্রেলার দিয়ে কি করবে? তাকিয়ে রইলাম। ঘণ্টা দুই পর ব্যাগ স্যুটকেস গুছিয়ে নিয়ে তাতে গিয়ে উঠলো ব্রড আর নরিটা। আরও অনেক মালপত্র নিলো, চিনতে পারলাম না। আসলে অতো দূর থেকে দেখে বোঝা যায়ও না ।’ 

‘ওগুলো?’ কলিগ বললেন। ‘ওগুলো কয়েক কোটি ডলার দামের সুন্দর সুন্দর ছবি ! 

‘যা-ই হোক, আমার কাছে অদ্ভুত লাগলো জিনিসগুলো। বাড়িটা থেকে বেরিয়ে চলে এলাম ওয়াগনার ম্যানশনের কাছে। সামনে দিয়ে ঢুকতে গেলে যদি আবার আটকে দেয়, ঢুকতে না দেয়, এই ভয়ে বারান্দা দিয়ে উঠে একটা জানালা গলে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।’ 

এবং আমাকে জাগালে,’ এলিজা বললো। ‘আমরা দু’জনে গিয়ে জাগালাম মিসেস রোজারিওকে। ছেলেগুলোকে দেখলাম না কোথাও। খুঁজতে লাগলাম । শেষে তোমার মনে পড়লো পাতালঘরের কথা, সেখানকার রেফ্রিজারেটর রুমের কথা ।’ 

ভাগ্যিস মনে পড়েছিলো,’ বললো কিশোর। উঠে চলে গেল ফায়ারপ্লেসের কাছে । ম্যানটেলের ওপরে দেয়ালের দিকে চোখ। ভারমিয়ারের যে কপিটা রয়েছে, ফ্রেমে বাঁধানো, তার চারপাশের দেয়ালে কাগজের রঙ উজ্জ্বল, বাকি অংশের মতো নয়। ব্রড আর নরিটাকে বাধ্য করেছি আমরাই, আজকেই কাজ সেরে ফেলতে । নইলে এতো তাড়াহুড়া করতো না ওরা। আমরা সুড়ঙ্গটা দেখে ফেলার পর আর কিছু করার ছিলো না ওদের। আমাদেরকে সেলারে আটকে রেখে দ্রুত কাজটা সেরে ফেললো।’ 

দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন চীফ ইয়ান ফ্লেচার। শীঘ্রি সেলারের কাজ শেষ হয়ে যাবে আমাদের। রিপোর্টাররা এসে পড়লো বলে। ওদের সঙ্গে দেখা করতে না চাইলে, বলুন, ঠেকানোর ব্যবস্থা করে ফেলি।’ 

‘প্লীজ! তাহলে খুবই ভালো হয়,’ অনুরোধের সুরে বললেন মিসেস রোজারিও । ‘এলিজা, চায়ের পানি বসানো কিন্তু হলো না। এক কাপ চা পেলে খুবই ভালো ‘হতো এখন।’ 

‘ঠিক আছে, আমিই বানিয়ে আনছি,’ বলে একটা মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে গেল কিশোর। 

চট্ করে পরস্পরের দিকে তাকালো মুসা আর রবিন। ওরা লক্ষ্য করেছে, বেরোনোর আগে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছিলো গোয়েন্দাপ্রধান। নিশ্চয় কোনো 

১৪৮ 

ভলিউম-১৬ 

সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে। নতুন কি এমন ব্যাপার ঘটলো, যা নিয়ে এতো গভীরভাবে ভাবতে হচ্ছে? 

কিছুই বুঝতে না পেরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাল ছেড়ে দিলো মুসা। রবিন জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। কিশোর কি ভাবছে, সেটা বোঝা তো দূরের কথা, অনুমান করারও সাধ্যি ওদের নেই । 

ঊনিশ 

রান্নাঘরের টেবিলে বসে পানি ফোটার অপেক্ষায় রইলো কিশোর। একটা টেলিফোন রয়েছে টেবিলে। তারটা চলে গেছে ভাঁড়ার ঘরের দরজার কাছে, জ্যাকটা ওখানে। ফোনের পাশে একটা খবরের কাগজ পড়ে আছে, উল্টে ভাঁজ করা, ক্রসওয়ার্ড পাজলের পৃষ্ঠাটা বের করে রেখেছে। সেটা দেখেই কৌতূহলী হয়ে কাগজটা তুলে নিলো কিশোর। নিচে একটা প্যাড পড়ে রয়েছে। 

কেউ আঁকাআঁকি করেছে প্যাডটায়। একটা হরতন এঁকে তীর দিয়ে সেটাকে বিদ্ধ করা হয়েছে। ডলারের চিহ্ন আঁকা রয়েছে। আর কয়েকবার করে লেখা রয়েছে ‘ভারমিয়ার’ শব্দটা এবং একটা টেলিফোন নম্বর। 

‘বাহ্! নম্বরও আছে তাহলে!’ আনমনে বিড়বিড় করতে করতেই তুলে নিলো রিসিভার। ডায়াল করলো। ওপাশে দু’বার রিঙ হতেই রিসিভার তোলার শব্দ হলো। একটা ভারি কণ্ঠ বললো, ‘রবিনসন ট্রেলার কোম্পানি। কি সাহায্য করতে পারি?” 

‘করে ফেলেছেন,’ বলেই রিসিভার রেখে দিলো কিশোর। প্যাডের কোণে লেখা কয়েকটা শব্দের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো । 

‘মেরি কুইন, পেন্সিল দিয়ে লিখেছে কেউ। ‘পানামানিয়ান রেগ।’ 

গরম হয়ে শিস দিতে আরম্ভ করেছে কেটলির পানি। ফিরেও তাকালো না কিশোর । সন্তুষ্ট মনে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে লাগলো । 

‘এই, কি করছো?’ দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে রবিন। ‘পানি তো ফুটছে! কালা নাকি?’ 

জবাব দিলো না কিশোর। 

এগিয়ে গিয়ে স্টোভের নবে মোচড় দিয়ে আগুন কমিয়ে দিলো রবিন। ‘কিশোর?’ মুসাও এসে দাঁড়িয়েছে রান্নাঘরের দরজায়। ‘কি করছো তুমি? কি হয়েছে?’ 

‘পেয়েছি!” হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো গোয়েন্দাপ্রধান। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিলো। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় আরেকটু হলেই ধাক্কা লাগিয়ে বসেছিলো পুলিশ চীফের গায়ে। তাঁকে বলতেই যাচ্ছিলো। 

‘কি ব্যাপার?’ জানতে চাইলেন ফ্লেচার 

‘দেখুন!’ উত্তেজিত ভঙ্গিতে প্যাডটা বাড়িয়ে ধরলো কিশোর। হাত কাঁপছে। ‘মেরি কুইন! দেখছেন? আর এই দেখুন পত্রিকায় রয়েছে জাহাজের খবর। মেরি কুইন, পানামায় রেজিস্ট্রি করা। আজ সন্ধ্যা সোয়া ছটায় স্যান পেদ্রো থেকে 

নিশাচর 

১৪৯ 

ছাড়বে। চীফ, আর এক ঘণ্টাও নেই।’ 

একটানে কিশোরের হাত থেকে প্যাডটা নিয়ে চীফ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় পেলে?’ 

রান্নাঘরের টেবিলে। টেলিফোনের কাছে। একটা ফোন নম্বর রয়েছে, দেখছেন, রবিনসন ট্রেলার কোম্পানির। চীফ, ট্রেলারটা যে ভাড়া করেছে, সে ওই টেলিফোন দিয়েই ফোন করেছে। জেনে নিয়েছে মেরি কুইন কোত্থেকে কখন ছাড়বে, অবশ্যই পত্রিকা ঘেঁটে। অনেক জাহাজ কোম্পানিই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়, জানা আছে তার। ব্রড আর নরিটা তাড়াহুড়ো করে এই প্ল্যান করেছে, ছবিগুলো দেশ থেকে বের করে নিয়ে যাবার। মেরি কুইন যেখানে যাবে সেখানেই যাবে ওরা। তারপর প্রয়োজন মনে করলে অন্য কোথাও । 

‘হুঁ!’ 

‘দেরি করবেন না, স্যার! ওদের ঠেকান!’ 

রান্নাঘরে ঢুকলেন চীফ। রিসিভার তুলে অপারেটরকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন জলদি স্যান পেদ্রোর হারবার মাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। লাইন পাওয়া গেল। জরুরী কণ্ঠে হারবার মাস্টারের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। সব শেষে বললেন, ‘আধ ঘন্টার মধ্যেই আসছি। আমি আসার আগে কিছুতেই জাহাজটাকে বেরোতে দেবেন না!’ 

রিসিভার রেখে দিলেন তিনি । 

রান্নাঘরে এলেন স্টেবিনস কলিগ। “মিসেস রোজারিও পাঠালেন, কি করছেন আপনারা দেখার জন্যে। চায়ের জন্যে এতো পাগল হয়ে যেতে আর কোনো মহিলাকে দেখিনি!’ 

‘এখুনি বানিয়ে ফেলবে কিশোর,’ চীফ বললেন। ‘কলিগ, আপনাকে আমার দরকার। 

‘কি বললেন?’ 

‘আমার সঙ্গে স্যান পেদ্রোতে যেতে হবে। কিশোর ভাবছে, মেরি কুইন জাহাজে করে পালানোর চেষ্টা করছে চোরেরা। ফোন করে বলে দিয়েছি জাহাজটাকে যাতে আটকায়। আমি যাচ্ছি। আপনাকে যেতে হবে ছবিগুলো সনাক্ত করার জন্যে।’ 

‘তাই নাকি।’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন কলিগ । 

‘আমরা যাবো না?’ মুসা জিজ্ঞেস করলো। ‘অন্তত কিশোরকে তো নেয়া উচিত। সে-ই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। 

‘ছবিগুলো পাওয়া গেলে তাকেই প্রথম ফোন করবো,’ চীফ বললেন । এখন যাওয়ার দরকার নেই। আসুন, মিস্টার কলিগ। কিউরেটরের হাত ধরে প্রায় টেনে বের করে নিয়ে গেলেন তিনি । 

‘খুব অন্যায় করলেন!’ দরজার দিকে তাকিয়ে বললো মুসা । 

কিশোর কিছুই বললো না। স্টোভের নব ঘুরিয়ে আবার আগুন বাড়িয়ে দিলো। পানি ফুটলে কেটলি নামিয়ে এনে চা বানাতে আরম্ভ করলো। কাপ আর পিরিচ ধুয়ে আনলো রবিন। রেফ্রিজারেটর থেকে কেক আর স্যাণ্ডউইচ বের করলো মুসা । 

১৫০ 

ভলিউম-১৬ 

ট্রেতে চা নাস্তা সাজিয়ে নিয়ে চললো মিসেস রোজারিওর ঘরে। 

‘এনেছো! আহ্, বাঁচলাম!’ হাঁপ ছাড়লেন মিসেস রোজারিও। ‘চায়ের জন্যে জানটা বেরিয়ে যাচ্ছিলো! এলিজা, তুমিও খাও। সারাদিন তো আজ প্রায় কিছুই পেটে পড়েনি। 

‘আমার খিদে নেই।’ 

‘আমার আছে। বাহ্, চমৎকার কেক! মিস্টার রেন, আপনিও নিন। জন, নাও। তোমরা নেবে না?’ তিন গোয়েন্দাকে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস রোজারিও । ‘কলিগ কোথায়? চা খাবে না?” 

তাঁকে নিয়ে চীফ চলে গেছেন,’ জবাব দিলো কিশোর। ‘স্যান পেদ্রোতে যাবেন। মেরি কুইন জাহাজে করে ব্রড আর নরিটা পালাচ্ছে কিনা দেখার জন্যে । 

হাত কেঁপে গেল মিসেস রোজারিওর। খানিকটা চা ছলকে পড়লো কোলের কাছে ধরা পিরিচে । 

‘চীফ নেই, তাতে কি?’ শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর। ‘আমরা তো কথা বলতে পারি, কি বলেন, মিসেস রোজারিও? দয়া করে এখন বলে ফেলুন তো, কিভাবে রাজি করিয়েছেন নিউম্যানদের? টাকাটা কিভাবে ভাগাভাগি হবে?” 

বিশ 

মিসেস রোজারিওর পাশের একটা সোফায় আধশোয়া হয়ে ছিলো এলিজা, ঝট্ করে সোজা হয়ে বসলো। কি বললে?’ 

‘না, এই, মিসেস রোজারিওর সঙ্গে আলাপ করছি আরকি। ডাকাতির টাকা কিভাবে ভাগ হবে জানতে চাইছি,’ নির্বিকার রয়েছে কিশোরের মুখ । 

জানালার পাশে বসেছে মুসা আর রবিন। গাঢ় হচ্ছে গরমের গোধূলি, ঘরের জিনিসপত্র অস্পষ্ট হয়ে আসছে। কিন্তু কেউ উঠে গেল না আলো জ্বেলে দেয়ার জন্যে। 

আপনার জন্যেই সম্ভব হয়েছে ডাকাতিটা,’ আবার বললো কিশোর । আপনি সাহায্য করাতেই। আপনাকে না জানিয়ে একাজ কিছুতেই করতে পারতো না ওরা।’ 

‘বড় বেশি বাজে কথা বলছো তুমি, ইয়াং ম্যান, মিসেস রোজারিও বললেন। চীফ আসুক, তারপর দেখছি। আর যাতে কোনোদিন এবাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাখতে না পারো সেই ব্যবস্থা করবো। ‘ 

‘হয়তো করবেন,’ কিশোর বললো। ‘তবে সেটা বুমেরাং হয়ে আপনাকেই আঘাত করতে পারে। হয়তো আপনার বিরুদ্ধে চলে গেল নিউম্যানদের স্বীকারোক্তি। তখন?’ 

‘আশ্চর্য!’ উঠে মিসেস রোজারিওর সামনে চলে গেল এলিজা। ‘কেন একাজ করতে যাবে? সবই তো আছে তার। কিছু চাইলেই পেয়ে যায়। আমার ভাইকে বললে এনে দেয় । আমাদের পরিবারেরই লোক। এটাই তার বাড়ি। 

‘কিশোর, বুঝেশুনে কথা বোলো!’ হুঁশিয়ার করলেন ডক্টর রেন। এককোণে 

নিশাচর 

১৫১ 

শান্ত হয়ে বসে আছেন কীটপতঙ্গবিদ। হাত বাড়িয়ে টেবিলে রাখা আলোটা জ্বেলে দিলেন। ভদ্রমহিলাকে অপমান করার জন্যে বিপদে পড়তে পার তুমি!’ 

‘না, পড়বো না। কারণ জেনেশুনেই বলছি আমি । 

হুইলচেয়ারে বসা মহিলার দিকে ঘুরে বসলো কিশোর। ‘ছয় মাস দু’জন মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে বাস করছেন আপনি। ওরা যে সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে এটা না জানার কথা নয় আপনার । মাটি খোঁড়ার শব্দ আপনার কানে আসবেই। কারণ সুড়ঙ্গটা গেছে ঠিক আপনার ঘরের নিচ দিয়ে । 

‘আমার ঘুম খুব গভীর । 

‘সব সময় না । কাল রাতেও মিস ওয়াগনারকে আপনার কাছে রেখেছেন, ঘুম হচ্ছে না বলে । কিংবা ইচ্ছে করেই ঘুম না আসার ভান করেছেন। তাকে আটকে রেখেছেন আপনার ঘরে। 

· 

‘আজ সকালে রবিনকে বলেছেন ঝাড়বাতিদানটার কথা, মসবি মিউজিয়মের ভারমিয়ার রুমের বাইরে যেটা ঝোলানো রয়েছে। দাদা ঘড়িটা বাজলে যে ঝাড়বাতিদানের প্রিজমগুলো কেঁপে ওঠে, সেকথা বলেছেন। মিস্টার কলিগের কাছে শুনেছি, ওটা তাঁর নতুন আবিষ্কার। আপনি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারেন না। কি করে দেখলেন এবং জানলেন সেটা?” 

চমকে গেছেন মিসেস রোজারিও। ‘আ-আমি…আমি…মনে হয় স্টেবিনসই বলেছে আমাকে!’ 

‘বিশ্বাস করতাম, যদি ছবিগুলো না থাকতো।’ 

‘ছবি?’ 

‘কাল রাতে এবাড়ির চারপাশে টহল দিচ্ছিলাম। কাকতাড়ুয়াটাকে দেখার জন্যে। জানালার পর্দা খুলে রেখেছিলেন আপনি। মিস্টার কলিগের সঙ্গে দাবা খেলছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর আপনি শোবার ঘরে চলে গিয়েছিলেন, তাই না?’ 

‘হয়তো গিয়েছিলাম। তাতে কি?’ 

‘আপনার আলমারি খুলেছিলেন। আলমারির তাকে বাক্সগুলো দেখতে পেয়েছি আমি। 

“তাতেই বা কি?’ 

তারপর আবার পর্দা টেনে দিয়েছিলেন আপনি। এরপর কি করেছেন আর দেখতে পারিনি। একটু পরেই বড় এক বাক্স ছবি নিয়ে সিটিংরুমে চলে এসেছেন আপনি । 

‘কাল রাতে ছবিগুলো নিয়ে ভাবার সময় পাইনি আমি । কারণ আপনি আসার পর পরই কাকতাড়ুয়াটাকে দেখতে পেলাম । আজ যখন আমাদেরকে কোল্ড রুমে আটকে রাখা হলো, তখন ভাবার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছি। মিসেস রোজারিও, ওই বাক্সটা তাক থেকে কি করে নামিয়ে আনলেন আপনি? * 

নাকমুখ কুঁচকে ফেলে যেন মনে করার চেষ্টা করলেন মিসেস রোজারিও। ‘মনে হয় লাঠিটা দিয়ে নামিয়েছি। আলমারির কাছে সব সময় একটা লাঠি রেখে দিই। ওপরের তাক থেকে কিছু নামানোর দরকার হলে লাঠি দিয়ে গুঁতো 

১৫২ 

ভলিউম-১৬ 

মেরে ফেলে দিই। তারপর লুফে নিই সেটা। বার বার কোনো জিনিসের জন্যে লোক ডাকাডাকি করতে ভালো লাগে না আমার 

“না, তা করা সম্ভব নয়,’ মাথা নাড়লো কিশোর। ‘অন্তত আপনার ওই ছবির বাক্সটার ক্ষেত্রে। ভারি বাক্স। গায়ে পড়লে ব্যথা লাগবে। তাছাড়া খুলে গিয়ে ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়ার কথা। না, মিসেস রোজারিও, লাঠি দিয়ে নয়, উঠে দাঁড়িয়ে বাক্সটা পেরেছেন আপনি।’ 

‘পাগল হয়ে গেছ!’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন মিসেস রোজারিও। ‘আমি দাঁড়াতে পারি না। সবাই জানে একথা। অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকেই আমি পঙ্গু।’ 

‘আপনি জানতেন, কাকতাড়ুয়াকে কি রকম ভয় করে মিস ওয়াগনার, মহিলার কথা যেন কানেই যায়নি কিশোরের। ‘পোকমাকড়কে যে ভয় করে, তা-ও জানেন। মিসেস রোজারিও, ওই কাকতাড়ুয়া বানানোর পরিকল্পনা আপনার মাথা থেকেই বেরিয়েছে। 

না!’ চিৎকার করে উঠলো এলিজা। ‘অসম্ভব! এ হতেই পারে না!’ 

‘কিন্তু হয়েছে, মিস ওয়াগনার। খুবই সম্ভব। শুধু পরিকল্পনাই নয়, আমার জানা মতে একবার কাকতাড়ুয়াও সেজেছেন, তাই না, মিসেস রোজারিও? 

‘তুমি একটা অসভ্য ছেলে!’ কঠিন গলায় বললেন মিসেস রোজারিও। ‘আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি । ঘুমোতে যাবো।’ 

দাঁড়ান! আমার কথা এখনও – 

হয়েছে কিশোর, যথেষ্ট হয়েছে,’ বাধা দিলেন ডক্টর রেন। ‘এতোক্ষণ যা যা বললে, সবই তোমার অনুমান। কোনো প্রমাণ নেই। এমন কিছুই দেখাতে পারোনি, যাতে বোঝা যায় তোমার কথা সত্য। 

‘নিশ্চয় পারবো,’ জোর গলায় বললো কিশোর। আসল কথাটাই বলিনি এখনও । শুনতে চান, মিসেস রোজারিও?’ 

‘জাহান্নামে যাও তুমি!’ চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস রোজারিও। এক ঝটকায় হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে শোবার ঘরের দরজার দিকে রওনা হলেন । 

‘দাঁড়ান!’ বলে উঠলো এলিজা। 

ফিরে তাকালেন মিসেস রোজারিও। এলিজার চোখে সন্দেহের ছায়া দেখতে পেলেন । ‘আমাকে ঠেলে নিতে চাইছো তো? লাগবে না। একাই পারবো।’ বলেই আবার চলতে শুরু করলেন। কেউ কিছু করার আগেই বেরিয়ে গেলেন। পেছনে বন্ধ করে দিলেন দরজা । 

“না না, সে করেনি!’ আনমনে মাথা নেড়ে যেন নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করলো এলিজা। তার মতো পঙ্গু একজন অসহায় মহিলা একাজ করতেই পারে না! সম্ভব না… 

জোরে একটা চিৎকার শোনা গেল । 

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো মুসা। দৌড় দিলো মিসেস রোজারিওর শোবার ঘরের দিকে। কিশোর ছুটলো তার পেছনে। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছার আগেই ঝট্‌কা দিয়ে খুলে গেল আবার পাল্লা । 

শয়তান! জানোয়ার!” কিশোরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন 

নিশাচর 

১৫৩ 

মিসেস রোজারিও। দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। রাগে লাল হয়ে গেছে মুখ। হাঁপাচ্ছেন । হাতে একটা বালিশ। ইচ্ছে করে করেছিস একাজ!’ 

বালিশটা ছুঁড়ে মারলেন তিনি। ঝট্ করে মাথা সরিয়ে ফেললো কিশোর। স্তব্ধ হয়ে গেছে ঘরের প্রতিটি মানুষ। যেন পা নাড়ানোর ক্ষমতা নেই । আর এই সুযোগটাই নিলেন মিসেস রোজারিও। একছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল বাড়ির সামনের দরজা। 

হাঁটতে পারে! দৌড়াতে পারে!’ নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না জন ডিলন । 

‘পঙ্গু নয়!’ 

একটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ কানে এলো । 

‘এহহে!’ এলিজা বললো, ‘আমার গাড়ি! চাবি ফেলে এসেছিলাম ! এজন্যে বকাও শুনতে হয়েছে মিসেস রোজারিওর । বললো…বললো এভাবে চলতে থাকলে একদিন না একদিন গাড়িটা চুরি হবেই।’ 

নাক দিয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করলেন ডক্টর রেন । 

কি দেখে এরকম করলেন মিসেস রোজারিও, দেখার জন্যে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো মুসা । পরক্ষণেই বিকট এক চিৎকার দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো। ‘খাইছে! ডক্টর রেন, দেখে আসুন!” 

তাড়াহুড়ো করে দরজার কাছে চলে গেলেন রেন। অন্যেরা তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে এসে উঁকি দিলো দেখার জন্যে। 

ঘরের মেঝেতে পিলপিল করছে হাজার হাজার পিঁপড়ে। একটা খোলা জানালা দিয়ে এসেছে। খাটের পা বেয়ে বিছানার ওপর উঠে যাচ্ছে কতগুলো । 

‘আরেকটা কলোনি!’ ডক্টরের কণ্ঠে খুশির আমেজ। ‘এজন্যেই পালিয়েছে। কে চায় পিঁপড়ের কামড় খেতে?’ 

একুশ 

মাঝরাতে ফিরে এলেন ইয়ান ফ্লেচার আর স্টেবিনস কলিগ। ব্রড আর নরিটাকে হাজতে রেখে এসেছেন। 

ছবিগুলো পাওয়া গেছে?’ কিশোর জিজ্ঞেস করলো। 

‘হ্যাঁ,’ কলিগ জানালেন। ‘স্যান পেদ্রোতেই রেখে এসেছি। হারবার মাস্টারের দায়িত্বে। রাতটা থাকবে ওখানেই। কড়া পাহারা আছে। অসুবিধে হবে না । কাল গিয়ে নিয়ে আসবো।’ 

হাই তুললেন কিউরেটর। “মিসে রোজারিও কোথায়? শুয়ে পড়েছেন?’ 

কি ঘটেছে, তাঁকে জানালো এলিজা আর ডক্টর রেন। কিশোর তাঁকে কিভাবে রাগিয়ে দিয়ে বেডরুমে পাঠিয়েছে, তারপর পিঁপড়ে দেখে তিনি কিভাবে পালিয়েছেন, সব। পোকা মারার ওষুধ দিয়ে পিঁপড়েগুলোকে মেরে ফেলেছেন 

রেন। 

১৫৪ 

‘গাড়ির নম্বর আছে। এখুনি সতর্ক করে দিচ্ছি হাইওয়ে পেট্রোলকে,’ চীফ 

ভলিউম-১৬ 

বললেন। ‘বেশি দূর যেতে পারবেন না মিসেস রোজারিও। 

‘তিনি পঙ্গু নন?’ অন্যদের মতোই বিশ্বাস করতে পারছেন না কলিগ । ‘দৌড়ালো তো খরগোশের মতো, হেসে বললো মুসা। 

‘কিন্তু ওরকম একটা অভিনয় কেন করলেন?’ কলিগের প্রশ্ন । এতোগুলো বছর হুইলচেয়ারে কাটানো কি কম কষ্ট!’ এলিজার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘টাকার কি খুব দরকার ছিলো তাঁর?’ 

‘একটুও না,’ জবাব দিলো এলিজা। ‘আমার আম্মা খুব বিবেচক ছিলো । উইল লেখার সময় সবার কথা মনে রেখেছে। বিশেষ করে মিসেস রোজারিওর কথা। তার পরেও কাকতাড়ুয়া বানাতে গেল মহিলা। দুনিয়ায় কাকে বিশ্বাস করবেন? তার আলমারিতে কাকতাড়ুয়ার পোশাক পেয়েছি। চোখে আর পানি নেই এখন এলিজার, রাগে জ্বলছে। ‘শয়তান মেয়েমানুষ! নিষ্ঠুর! আমাকে কি কষ্টটাই না দিয়েছে! অথচ আমি তাকে মায়ের মতো দেখতাম!’ 

“মনে হয় কোনোরকম ফাঁদে আটকে গিয়েছিলেন মহিলা, কিশোর বললো। তাঁকে ধরে সব না শোনা পর্যন্ত শিওর হওয়া যাবে না। তবে অনুমানে অনেক কিছু বলতে পারি আমি ।’ 

চেয়ারে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলো কিশোর। ধীরে ধীরে বলে চললো সব কথা। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ না দিয়ে 

‘মিসেস রোজারিও নিশ্চয় ঘাবড়ে গিয়েছিলেন মিসেস ওয়াগনার মারা যাওয়ার পর,’ বললো সে। ‘এই বাড়িটা খোলা রাখার আর কোনো প্রয়োজন ছিলো না তখন। কিন্তু এটাই তখন মিসেস রোজারিওর বাড়ি। হয়তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন এখানকার আরাম-আয়েস ছেড়ে গিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসের কোনো ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে উঠতে হবে। একলা মানুষ তিনি। বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। কাজেই ওখানকার জীবন তাঁর জন্যে বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে, এই ভয় করছিলেন। 

‘এই সময় ঘটলো অ্যাক্সিডেন্ট। কোমর ভাঙলেন তিনি। আর হাসপাতালে শুয়ে শুয়েই সমস্ত কথা ভাবতেন। অনেকেই কোমর ভাঙে, পঙ্গু হয়। পঙ্গু হলো কি হলো না, সেটা প্রমাণ করতে পারে না ডাক্তাররা। মিসেস রোজারিও ভাবলেন, তিনি যদি দাঁড়াতে না পারেন, না পারার ভান করেন, কে প্রমাণ করতে যাচ্ছে? ডাক্তাররা কিছুই বুঝবে না। তিনি বলবেন তিনি দাঁড়াতে পারছেন না, কারো কিচ্ছু বলার নেই ।’ 

*এবং তাতে মানুষের করুণা নিতে সুবিধে হয়!’ তিক্ত কণ্ঠে বললো এলিজা। ‘আমার ভাইকে বলে আবার বাড়িটা খুলিয়েছে। ওয়াগনারদের কেউ নেই তখন। কাজেই এবাড়ির সর্দার হয়ে বসলো মিসেস রোজারিও। চাকর-বাকরেরা সব তার কথায় ওঠবস করতে লাগলো। আমি এলেই তার ক্ষমতা নষ্ট হয়। সে কারণে যখন তখন আমার আসাটাও পছন্দ করতো না ।’ 

‘ছবি চুরির ব্যাপারটা, আমার যা মনে হয়, কিশোর বললো, ‘নিউম্যানরা আসার আগে ভাবেননি মিসেস রোজারিও। সুড়ঙ্গ খুঁড়তে শুরু করলো ব্রড। আপনি এলেন। ওদের মুশকিলে ফেলে দিলেন। কাজেই কাকতাড়ুয়া আর পোকামাকড়ের ভয় দেখিয়ে আপনাকে তাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো ওয়া । 

নিশাচর 

১৫৫ 

মজার ব্যাপার হলো, একটা চমৎকার কোইনসিডেন্স, তিনজনেরই উচ্চতা প্রায় একই রকম। শরীর-স্বাস্থ্য প্রায় এক। কাজেই একই কাকতাড়ুয়ার পোশাক তিনজনেরই গায়ে লেগে গেল। পরস্পরের অ্যালিবাই হতে কোনো অসুবিধে হলো না ওদের। 

‘যে রাতে কাস্তে হাতে আমরা কাকতাড়ুয়া দেখেছি, সে রাতে মিসেস রোজারিও আর ব্রুড নিউম্যান বাড়ির সামনে আপনার সঙ্গে ছিলো। সেদিন কাকতাড়ুয়া সেজেছিলো নরিটা। অন্ধকারে দৌড়ে আমাদের কাছ থেকে সরে চলে গিয়েছিলো বাড়ির পেছন দিকে। সেলারের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লো। তারপর পোশাক খুলে রেখে গিয়ে তাড়াতাড়ি পুলিশকে ফোন করলো। চলে গেল লিভিং রুমে। বললো, জানালার বাইরে সে-ও কাকতাড়ুয়াটাকে দেখেছে। আমরা ভাবলাম, সারাক্ষণ ঘরেই বসে ছিলো সে।’ 

‘কিন্তু যেদিন ডক্টর রেনের ল্যাবরেটরিতে আবার ঢুকেছিলো, সেদিন?’ জিজ্ঞেস করলো রবিন। তুমি দেখলে কাকতাড়ুয়াটাকে। নরিটা ছিলো রান্নাঘরে, ব্রড সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে বসে টিভি দেখছিলো, আর মিসেস রোজারিও ছিলেন লিভিং রুমে মিস ওয়াগনারের সাথে। 

‘হয়তো আদৌ টিভি দেখছিলো না ব্রড,’ জবাব দিলো কিশোর। ‘একটা ডামি বানিয়ে ফেলে গিয়েছিলো। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়েছে, টিভি দেখছে একজন মানুষ। সে জানতো, লিভিং রুমে থেকে পুলের ওপাশে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার দেখা যায়। তবে দূর থেকে ডামি আর মানুষ আলাদা করে চেনার জো নেই আবছা আলোতে। তাই ডামি বানিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলো ডক্টরের ল্যাবরেটরিতে, আর কিছু পিঁপড়ে চুরি করে আনতে। 

‘আর আজকে আমাদেরকে কোল্ড রুমে আটকেছিলেন মিসেস রোজারিও, কাকতাড়ুয়া সেজে গিয়ে। নিশ্চয় আমাদের সেলারে নামার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। কিংবা নরিটাও হতে পারে। তিনজন একই দলের লোক । কাজেই যাকে দিয়ে যা সুবিধে হয় তা-ই করানো হয়েছে। 

‘কিন্তু মিসেস রোজারিওর তো কোনো কিছুর প্রয়োজন ছিলো না,’ প্রশ্ন তুললো এলিজা। ‘কেন দুটো চোরকে ডেকে আনবে মসবি মিউজিয়ম লুট করার জন্যে?’ 

‘আগেই বলেছি, প্রথমে একথাটা তিনি ভাবেননি,’ কিশোর বললো । ফন্দিটা ব্রড আর নরিটার। ওরা চাকরিই নিয়েছে মিউজিয়মটার কাছে, ডাকাতি করার জন্যে। পঙ্গু মিসেস রোজারিওকে দেখে খুশি হয়েছে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবে ভেবে । কারণ ওই অবস্থায় হুইল চেয়ার নিয়ে তিনি নিচে নামতে পারবেন না । 

তারপর একটা সময় জেনে ফেলেছে যে তিনি হাঁটতে পারেন । আর মিসেস রোজারিওও জেনে গেছেন ওদের সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কথা। দুই দলেরই দুর্বলতা রয়েছে। ফলে সমঝোতায় আসতে পেরেছে সহজেই। ওরা ব্ল্যাকমেল করেছে মিসেস রোজারিওকে, আর তিনি করেছেন ওদেরকে। ওরা কি করছে সেটা না জানার ভান করে থেকেছেন তিনি। বিনিময়ে ওরা ফাঁস করে দেয়নি যে তিনি হাঁটতে পারেন । আপনি যখন বাড়ি এলেন মিসেস ওয়াগনার, তখন একজোট হয়ে 

১৫৬ 

ভলিউম-১৬ 

গেছে ওরা। ওদের কাছে হুমকি হয়ে গেলেন আপনি। একটা কিছু বুদ্ধি করে আপনাকে তাড়ানোর চিন্তা করতে লাগলো। এই সময় টেলিভিশনে দেখালো “দ্য উইজার্ড অভ ওজ” ছবিটি। তা থেকেই কাকতাড়ুয়া বানানোর বুদ্ধিটা মাথায় ঢুকলো ওদের । 

‘তাজ্জব ব্যাপার!’ কলিগ বললেন । 

হ্যাঁ, মিস্টার কলিগ । তবে ওদের চেয়ে অনেক চালাক আপনি ।’ 

‘কী?’ 

‘হ্যাঁ। আপনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি যে মিসেস রোজারিও ভারমিয়ারের একটা কপি নিয়ে সন্তুষ্ট নন। বুঝতে পারেননি আসল জিনিসটাই তিনি চান। 

চট করে ম্যানটেলের ওপরের ছবিটার দিকে চোখ চলে গেল কলিগের 

‘নিউম্যানদের সঙ্গে আরও কিছু চুক্তি হয়েছিলো মিসেস রোজারিওর, কিশোর বললো। ‘তিনিও একটা ভাগ নেবেন। শুধু একটা ছবি হলেই চলবে। একটা ভারমিয়ার । 

‘ঈশ্বর!’ চিৎকার করে বলতে গিয়েও কণ্ঠস্বর নামিয়ে ফেললেন কলিগ । উঠলেন । পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালেন ছবিটার কাছে। ভালো করে দেখে বললেন, ‘এটাই! মিউজিয়ম থেকে চুরি করে আনা! দেখেই চেনা উচিত ছিলো । কপিটার কি হলো? 

‘পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ফায়ারপ্লেসে কয়েক টুকরো পোড়া ক্যানভাস পেয়েছি আমি । তুলে এনে রেখে দিয়েছি। যেটা দেখছেন এখন, সেটা সত্যিই মিউজিয়ম থেকে চুরি করে আনা হয়েছে, আজ । বন্দরে সব ছবি দেখলেন, অথচ ভারমিয়ারটা যে নেই, এটা আপনার নজর এড়িয়ে গেল। যে ভাববে তাকেই অবাক করবে ব্যাপারটা। তাই না?’ 

‘আমি…আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম!’ 

‘না, তা ছিলেন না। আসলে আজ বিকেলেই ছবিটা আপনি এখানে দেখেছেন । আপনার মতো মানুষের চোখে ছবি না পড়ার কথা নয়। ছবিটার চারপাশের দেয়ালের কাগজ যে কারো চোখে পড়তে বাধ্য, ভালো করে তাকালে ! এটা দেখেই বুঝে গেলাম মিসেস রোজারিওও চোরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। আগের ছবিটা আরেকটু বড় ছিলো । এটা কিছুটা ছোট। ফলে ফ্রেমের চারপাশে কাগজ বেরিয়ে আছে । ফ্রেমের নিচে চাপা পড়েছিলো বলে রঙ নষ্ট হয়নি, বাইরের অংশে যেমন মলিন হয়ে গেছে। আমি জানতাম নকল ছবিটার চেয়ে আসল ছবিটা ছোট। তাই অনুমান করতে কষ্ট হলো না, মিউজিয়মের আসল ছবি এখন মিসেস রোজারিওর ঘরে ঝোলানো। আর একটা উপায়েই সেটা তিনি পেতে পারেন। নিউম্যানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে । 

‘নিশ্চয় আপনার চোখে পড়েছে ছবিটা, মিস্টার কলিগ। ছোট, তা-ও দেখেছেন। বুঝে গেছেন এটা মিউজিয়মেরই ছবি। তবু কাউকে কিচ্ছু বলেননি।’ 

‘বললামই তো, গাল চুলকালেন মিস্টার কলিগ। “মিউজিয়মে ডাকাতি হয়ে যাওয়ায় খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। উত্তেজিত।’ 

নিশাচর 

১৫৭ 

“না, তা নয়। উত্তেজিত আপনি মোটেও হননি। বরং খুব শান্ত ছিলেন, যেটা অস্বাভাবিক লেগেছে আমার কাছে। তাছাড়া হাত-পা বেঁধে, মুখে তোয়ালে গুঁজে আলমারির ভেতরে পড়ে থাকা মানুষ এতোটা শান্ত থাকলে সন্দেহ হবেই। তখন থেকেই আপনার কথা ভাবতে আরম্ভ করেছি। ছবিটার কথাও। 

‘আমি… আমি আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম!’ 

শুনলোই না যেন কিশোর। মিসেস রোজারিও পালানোর পর ছবিটা দেখেছি আরও ভালোমতো । ক্যানভাসের রঙ আঠা আঠা। পুরনো ছবির যেমন শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়, তেমন নয়। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেননি মিসেস রোজারিও। হয়তো আসল ছবিটা তিনি কখনও ছুঁয়ে দেখেননি। আর নিউম্যানদের তো লক্ষ্য করার সময়ই ছিলো না । 

‘আসল ছবির জন্যে সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়েছিলেন মিসেস রোজারিও। তাঁর মান সম্মান সব কিছু। হয়তো অন্যের বাড়িতে অন্যের দয়ায় থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাই তিনি চাইছিলেন এমন কিছু, যা থেকে মোটা টাকা আসবে। বাকি জীবনটা আরামে কাটাতে পারবেন। এতো ঝুঁকি নিয়ে কি তিনি পেলেন? একটা জাল ছবি । 

মিস্টার কলিগ, মিসেস রোজারিও যখন একটা জাল ছবি পেয়েছেন, ব্রড আর নরিটাও একই জিনিস পেলে, খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু আছে কি? এমন একজন মানুষের আঁকা ছবি, যিনি হুবহু আসলের মতো করেই এঁকে ফেলেন?’ 

থেমে দম নিলো কিশোর। তারপর আবার বলতে লাগলো, “শুক্রবারে আপনার বেড়াতে যাওয়ার কথা। সবগুলো জাল ছবি ঝুলিয়ে দিয়ে আসলগুলো নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলেন আপনি। আজকের চুরির পর আর আপনার ঘাড়ে কোনো দোষ পড়তো না, ছবিগুলো পাওয়া না গেলে। আর সে জন্যেই মিসেস রোজারিওর ঘরের ছবিটার প্রতি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাননি। তাহলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিলো আপনার । 

‘আর এই কারণেই নিউম্যানদের কাছ থেকে ছবিগুলো উদ্ধারের পরেও ভারমিয়ারটা যে নেই একথা বলেননি কাউকে। ভেবেছিলেন, পরে খুঁজে বের করবেন। আর যেহেতু ডাকাতি হয়েছে, একআধটা ছবি পাওয়া না গেলেও আপনার ঘাড়ে দোষ চাপাতে যেতো না কেউ। তেমন মনে করলে আসল ভারমিয়ারটা মিউজিয়মের দেয়ালে ঝুলিয়ে দিতেন আবার। আছে তো আপনার কাছেই। কেউ কল্পনাও করতে পারতো না যে আপনি এই কাজ করেছেন। 

কিন্তু আপনার কপাল খারাপ। সমস্ত ছবি এখন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরীক্ষা করানো হবে। বাঁচতে আর পারবেন না। আসল ছবিগুলো কোথায়, মিস্টার কলিগ? আপনার সান্তা মনিকার অ্যাপার্টমেন্টে?’ 

ম্যানটেলের ওপরে ঝোলানো ছবিটার কাছে এসে দাঁড়ালেন ইয়ান ফ্লেচার। ছবির এক জায়গায় আঙুল ছুঁইয়ে জোরে চাপ দিলেন। চোখের সামনে নিয়ে এলেন আঙুলটা। একবার তাকিয়েই বলে উঠলেন, ‘একটা সার্চ ওয়ারেন্ট দরকার।’ 

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিশোরের দিকে তাকালেন কলিগ। পারলে চোখের আগুনেই ভস্ম করে ফেলেন। ‘বি-বিচ্ছু ছেলে! ইবলিস!’ 

১৫৮ 

ভলিউম-১৬ 

গায়েই মাখলো না কিশোর। ‘নিউম্যান আর মিসেস রোজারিওর জন্যে দুঃখই হয় আমার। বেচারারা এতো ঝুঁকি নিয়েও কিছুই পেলো না। একগাদা জাল ছবির জন্যে এখন জেল খাটতে হবে। কল্পনাও করতে পারেনি একজন মাস্টার জালিয়াতের কবলে পড়ে এমন একটা ছ্যাঁক খাবে।’ 

বাইশ 

অপরাধ ঢেকে রাখা খুব মুশকিল,’ মন্তব্য করলেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার । 

তাঁর অফিসে বসে আছেন। বিশাল ডেস্কের ওপর খোলা পড়ে আছে রবিনের দেয়া ফাইলটা। সবটাই মন দিয়ে পড়েছেন। তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আরেকবার কংগ্রাচুলেশন জানাচ্ছি তোমাদেরকে। একই সঙ্গে দুই দল চোর অপারেশন চালাচ্ছে যে একথা আন্দাজ করা সহজ কাজ নয়। একের বুদ্ধির কাছে পরাস্ত হতে হলো অন্য দলটাকে। নিউম্যানরা সুড়ঙ্গ খুঁড়েছে, অত্যন্ত সাদামাঠা ব্যাপার। ওদের তুলনায় কলিগের সূক্ষ্ম বুদ্ধি অনেক বেশি । 

আসল আর নকল বোঝা খুবই কঠিন,’ রবিন বললো । এখন বুঝতে পারছি, আসল ছবির আকারে কেন ছবি আঁকার অনুমতি দেন না মিউজিয়ম কর্তৃপক্ষ। কিছুটা বড় কিংবা ছোট করে আঁকতে বলেন। 

‘জালিয়াতির ভয়ে,’ পরিচালক বললেন। যাই হোক, ফাইলটা মন দিয়ে পড়লাম । চমৎকার একটা কেস। আজব কাকতাড়ুয়া! তবে তোমরা যে গিয়ে এই কেসে জড়িয়েছো, তা জেনে মোটেও অবাক হইনি আমি। রকি বীচের এতো কাছে এরকম একটা রহস্যময় কাণ্ড ঘটতে থাকবে, আর তিন গোয়েন্দার নেক নজরে পড়বে না, এ-কি হয়?” 

হাসলো রবিন। 

ফাইলটা বন্ধ করে রবিনের দিকে ঠেলে দিলেন পরিচালক। ‘কাহিনীটা ভালো লেগেছে আমার। ছবি করা যায় কিনা ভাববো। তবে কয়েকটা প্রশ্নের জবাব জানা দরকার। যেমন ধরো, ব্রড আর নরিটা কি করে একজন ইংরেজ লর্ডের মতো সম্মানিত লোকের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র আনতে পারলো?’ 

‘ওদের আসল নাম নিউম্যান নয়, স্যার,’ জবাব দিলো কিশোর। ‘আসল নাম ক্লাইভ।’ 

‘তাই নাকি!’ 

‘হ্যাঁ। রবার্ট ক্লাইভ। তার স্ত্রীর নাম ডলিনা ক্লাইভ । জন্ম ইভিলিন বেলরিজে। অনেক ছদ্মনাম রয়েছে ওদের। চুরি করার লম্বা আন্তর্জাতিক রেকর্ড রয়েছে। 

“ইংল্যাণ্ড থেকে প্লেনে করে আসছিলো দু’জনে। পরিচয় হয় আরেক দম্পতির সঙ্গে । আসল নিউম্যান দম্পতি। ইংরেজ লর্ডের বাবুর্চি আর খানসামা। অনেক দিন কাজ করে অবসর নিয়ে চলেছিলো ফ্লোরিডায়, বাকি জীবন কাটাতে। নিউ ইয়র্কে প্লেন বদল করে ওরা। ওদের সঙ্গে কথা বলে এটা বুঝে ফেলেছে ক্লাইভ, যে আমেরিকায় কোনো বাড়িতে কাজ করার জন্যে রেফারেন্সের দরকার হলে 

নিশাচর 

১৫৯ 

নিউম্যানদেরকে সেটা অবশ্যই দেবেন লর্ড কপারফিল্ড। পরে কাজে লাগতে পারে ভেবে লর্ডের নাম ঠিকানা লিখে রেখে দিয়েছিলো সে। চলে এসেছিলো লস অ্যাঞ্জেলেসে। 

তখন, কিংবা তার আগে থেকেই হয়তো মসবি মিউজিয়ম লুট করার প্ল্যান করে ফেলেছে ওরা। সময় নষ্ট করেনি। ইংল্যাণ্ড থেকে আসার হপ্তাখানেক পরেই চলে গেল বেভারলি হিলের এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সিতে। পুলিশ চেক করে দেখেছে, ওয়াগনার হাউসে আসার আগে কয়েকটা চাকরির অফার ফিরিয়ে দিয়েছে ক্লাইভ দম্পতি, অবশ্যই নিউম্যানদের ছদ্মবেশে। ওগুলোর বেতনও ছিলো ওয়াগনার হাউসের চেয়ে অনেক বেশি।’ 

‘তারমানে,’ পরিচালক বললেন। ‘ওরা অপেক্ষাই করছিলো ওয়াগনার হাউসে ঢোকার জন্যে । ভাগ্য ভালো, তাড়াতাড়িই পেয়ে গেছে। বছরখানেকও অপেক্ষা করতে হতে পারতো ওদের। মিসেস রোজারিও চাকর-বাকর বেশি তাড়াতো বলেই এতো জলদি পেয়ে গেছে।’ 

শুধু মসবি হাউসে লুট করার আশায় বসে থাকেনি ক্লাইভেরা,’ কিশোর বললো। “লস অ্যাঞ্জেলেসের অনেক বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করেছে, যেগুলোতে লোক দরকার হয় । আর ওসব জায়গায় চুরি করারও অনেক জিনিস আছে। এই যেমন অলংকার, ছবির মতো দামী দামী জিনিস ।’ 

মাথা দোলালেন পরিচালক। হুঁম! এরকম লিস্ট রেখে আরেকটা ভুল করেছে। তবে অপরাধীরা ভুল করে বলেই ধরাও পড়ে। লিস্ট করার আগেই অবশ্য আরেকটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলো ওরা। লর্ড কপারফিল্ডকে ফোন করেছে, রেফারেন্স জোগাড়ের জন্যে। যদি আসল নিউম্যানরা ফোন করতো কোনো কারণে? তাহলে এজেন্সি যে ফোন করেছিলো তাঁকে, সেটার ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারতেন তিনি। 

উঠেছেন। ওরকম ব্যাপার ঘটে গেছে। মিউজিয়মে যেদিন চুরি হয়েছে, তার আগের দিন এজেন্সিকে ফোন করেছিলেন লর্ড। এজেন্সি সঙ্গে সঙ্গে মিসেস রোজারিওকে ফোন করে সাবধান করে দিয়েছে যে নিউম্যানদের ব্যাপারে সন্দেহ আছে। ওরা আসল লোক না-ও হতে পারে। তিনি বলে দিয়েছেন, না হলে নেই, তাতে কিছু এসে যায় না। এরকম কাজের লোক আর জীবনে পাননি । লোক যে-ই হোক, কাজ পেলেই তিনি খুশি।’ 

‘দুর্ভাগ্য মহিলার,’ পরিচালক বললেন। ‘একেবারে কুক্ষিগত করে ফেলেছিলো তাকে শয়তান লোকগুলো । 

‘নিজের দুর্ভাগ্য নিজেই টেনে এনেছেন, বেশি লোভ করতে গিয়ে। নইলে পঙ্গু সাজার কি দরকার ছিলো? মহিলার জন্যে সত্যিই দুঃখ হয়। সান্তা বারবারায় পুলিশ তাঁকে ধরেছে। পেট্রোল ফুরিয়ে গিয়েছিলো। টাকাপয়সা সঙ্গে নিতে পারেননি। পেট্রোল কেনার জন্যে পাশে একটা আংটি দিতে চেয়েছিলেন। সন্দেহ হলো ওদের। মহিলার আচরণে। পুলিশকে ফোন করলো ওরা।’ 

১৬০ 

‘কি শাস্তি হবে, কিছু বলেছে পুলিশ?’ 

‘জেলে যাবেন না। বয়েসটা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তাছাড়া আগের 

নো 

ভলিউম-১৬ 

ক্রিমিন্যাল রেকর্ড নেই। তাঁর জন্যে একজন উকিলও ঠিক করেছে এলিজা ওয়াগনার। বদমেজাজী, কোনো সন্দেহ নেই, তবে মনটা খুবই ভালো মৈয়েটার। প্রতিশোধ নেয়া তো দূরের কথা, মিসেস রোজারিওর জন্যে মনই খারাপ হয়ে গেছে তার।’ 

“হ্যাঁ, ভালো মেয়ে, বোঝাই যাচ্ছে।’ 

‘কাকতাড়ুয়ার এই ব্যাপারটা অনেক বদলে দিয়েছে এলিজাকে । ঠিক করেছে, আর ইউরোপে ফিরে যাবে না। চ্যাপারাল ক্যানিয়নেই বাস করবে। নতুন করে চাকর-বাকর জোগাড় করে নেবে। বাড়ির দেখাশোনার ভার নিজেই নেবে। সময় কাটাবে নানা রকম সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে। ইতিমধ্যেই কথা বলে ফেলেছে-ইউ সি এল এল-এর মেডিক্যাল সেন্টারের সঙ্গে। ভলানটিয়ারের কাজ করতে চায়।’ 

‘হুঁ, পাগলামি সেরে যাচ্ছে আরকি। 

‘তবে একটা ব্যাপার এখনও একই রকম রয়েছে, বদলায়নি, মুসা বললো । ‘পোকামাকড়। এখনও দেখলে ঘাবড়ে যায়। মৌমাছি দেখেই সেদিন যা চিৎকার শুরু করেছিলো। পোকামাকড়ের ভয়টা কোনোদিনই যাবে না ওর। 

ভালো কথা মনে করেছো,’ হাত তুললেন পরিচালক। ‘ডক্টর রেন? তাঁর কি অবস্থা? এখনও ওখানেই আছেন?’ 

‘আছেন,’ কিশোর বললো। পিঁপড়ে নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘোরেন। আর জন ডিলনকে আবার পুল ম্যান হিসেবে চাকরিতে বহাল করেছে এলিজা।’ 

‘ভেরি গুড,’ খুশি হলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। ‘চমৎকার একটা উপন্যাসের হ্যাপি এনডিং-এর মতো। তবে রহস্য কাহিনী তো, একটু অন্যরকম। যা-ই হোক, বেশ মজার। গল্পটায় নূতনত্ব আছে । 

‘ঠিক বলেছেন, স্যার, মুসা বললো। ওরকম পাজি কাকতাড়ুয়ার পাল্লায় জীবনে পড়িনি। কোনোদিন আর পড়তেও চাই না। ভাগ্যিস ওটা মানুষের কাজ, ভূতপ্রেত নয়!’ 

ভূতের ভয়টা তোমার এখনও গেল না। এতো কারাত আর জুডো শিখেও।’ ‘ওগুলো স্যার মানুষের ওপর খাটানো যায়, ভূতের গায়ে লাগে না * বেশি বাড়াবাড়ি করতে গেলে ঘাড়টা ধরে মটকে দেবে। ঔরকম করে মরার চেয়ে ভয় পেয়ে বেঁচে থাকাও অনেক ভালো। 

‘তা যা বলেছো,’ মুসার দর্শন শুনে না হেসে পারলেন না মিস্টার ক্রিস্টোফারের মতো গম্ভীর মানুষও। 

রবিন আর কিশোরের মুখেও হাসি। 

১১- নিশাচর 

-: শেষ :- 

১৬১ 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *