১
তৃতীয়সংখ্যক “সাধনা’য় কোনো পাঠক নিছনি শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন; তাহার উত্তরে জগদানন্দবাবু নিছনি শব্দের অর্থ অনিচ্ছা লিখিয়াছেন। কিন্তু প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে অনিচ্ছা অর্থে নিছনির ব্যবহার কোথাও দেখা যায় নাই : গোবিন্দদাসে আছে :
গৌরাঙ্গের নিছনি লইয়া মরি।
স্পষ্টই অনুমান করা যায়, “বালাই লইয়া মরি’ বলিতে যে ভাব বুঝায় “নিছনি লইয়া মরি’ বলিতে তাহাই বুঝাইতেছে। কিন্তু সর্বত্র নিছনি শব্দের এরূপ অর্থ পাওয়া যায় না। বসন্ত রায়ের কোনো পদে আছে :
পরাণ কেমন করে মরম কহিনু তোরে,
জীবন নিছনি তুয়া পাশ।
এখানে নিছনি বলিতে কতকটা উপহারের ভাব বুঝায়।
বসন্ত রায়ের অন্যত্র আছে :
তোমার পিরীতে হাম হইনু বিকিনী,
মুলে বিকালাঙ আর কি দিব নিছনি।
এখানে নিছনি বলিতে ঠিক করিয়া বলা শক্ত। এরূপ স্থলে নিছনি শব্দের সংস্কৃত মূলটি বাহির করিতে পারিলে অর্থ নির্ণয়ের সাহায্য হইতে পারে।
গোবিন্দদাসের এক স্থলে আছে :
দোঁহে দোঁহে তনু নিরছাই।
এ স্থলে “নিছিয়া’ এবং “নিরছাই’ এক ধাতুমূলক বলিয়া সহজেই বোধ হয়।
অন্যত্র আছে :
বরু হাম জীবন তোহে নিরমঞ্ছব
তব হুঁ না সোঁপব অঙ্গ।
ইহার অর্থ, বরং আমার জীবন তোমার নিকট পরিত্যাগ করিব তথাপি অঙ্গ সমর্পণ করিব না।
আর-এক স্থলে দেখা যায় :
কুণ্ডল পিচ্ছে চরণ নিরমঞ্ছল
অব কিয়ে সাধসি মান।
অর্থাৎ তোমার চরণে মাথা লুটাইয়া কানের কুণ্ডল ও চূড়ার ময়ূরপুচ্ছ দিয়া তোমার পা মুছাইয়া দিয়াছে, তথাপি তোমার মান গেল না?
এই নির্মঞ্ছন শব্দই যে নিছনি শব্দের মূল রূপ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।
অভিধানে নির্মঞ্ছন শব্দের অর্থ দেখা যায়–“নীরাজনা, আরুতি, সেবা, মোছা।’ নীরাজনা অর্থ “আরাত্রিক, দীপমালা, সজলপদ্ম, ধৌতবস্ত্র, বিল্বপত্রাদি, সাষ্টাঙ্গপ্রণাম–এই পঞ্চ দ্বারা আরাধনা, আরুতি।” উহার আর-এক অর্থ “শান্তিকর্ম বিশেষ।’
অতএব যেখানে “নিছনি লইয়া মরি’ বলা হয়, সেখানে বুঝায় তোমার সমস্ত অমঙ্গল লইয়া মরি–এখানে “শান্তিকর্ম’ অর্থের প্রয়োগ।
দোঁহে দোঁহে তনু নিরছাই
এ স্থলে নিরছাই অর্থে মোছা।
নিরমল কুলশীল বিদিত ভুবন,
নিছনি করিনু তোমার ছুইয়া চরণ।
এখানে নিছনি অর্থে স্পষ্টই আরাধনার অর্ঘ্যোপহার বুঝাইতেছে।
পরাণ নিছিয়া দিই পিরীতে তোমার
অর্থাৎ, তোমার প্রেমে প্রাণকে উপহার স্বরূপে অর্পণ করি।
তোমার পিরীতে হাম হইনু বিকিনী
মুলে বিকালাঙ, আর কি দিব নিছনি।
ইহার অর্থ বোধ করি নিম্নলিখিত মতো হইবে
তোমার প্রেমে যখন আমি সমুলে বিক্রীত হইয়াছি তখন বিশেষ করিয়া আরাধনাযোগ্য উপহার আর কী দিব।
বর্তমানপ্রচলিত ভাষায় এই নিছনি শব্দের ব্যবহার আছে কি না জানিতে উৎসুক আছি; যদি কোনো পাঠক অনুগ্রহ করিয়া জানান তো বাধিত হই। চণ্ডীদাসের পদাবলীতে নিছনি শব্দ কোথাও দেখি নাই।
২
মনেতে করিয়ে সাধ যদি হয় পরিবাদ যৌবন সকল করি মানি
জ্ঞানদাসেতে কয় এমত যাহার হয় ত্রিভুবনে তাহার নিছনি।
এ স্থলে নিছনি অর্থে পুজা। আমার প্রবন্ধে উল্লেখ করিয়াছি “নির্মঞ্ছন’ শব্দের একটি অর্থ আরাধনা।
সই এবে বলি কিরূপ দেখিনু
দেখিয়া মোহন রূপ আপনে নিছিনু।
নিছনি অর্থে যখন মোছা হয় তখন “আপনে নিছিনু’ অর্থে আপনাকে মুছিলাম অর্থাৎ আপনাকে ভুলিলাম অর্থ অসংগত হয় না।
পদ পঙ্কজপরি মণিময় নূপুর রুনুঝুনু খঞ্জন ভাষ
মদন মুকুর জনু নখমণি দরপণ নিছনি গোবিন্দদাস।
আমার মতে এ স্থলে নিছনি অর্থে পূজার উপহার। অর্থাৎ গোবিন্দদাস চরণপঙ্কজে আপনাকে অর্ঘ্যস্বরূপে সমর্পণ করিতেছেন।
যশোদা আকুল হইয়া ব্যাকুলি রাইএরে করল কোলে
ও মোর বাছনি জান মু নিছনি ভোজন করহ ব’লে।
“জান মু নিছনি’ অর্থাৎ আমি তোমার নিছনি যাই। অর্থাৎ তোমার অশান্তি অমঙ্গল আমি মুছিয়া লই; যেরূপ ভাবে “বালাই লইয়া মরি’ ব্যবহার হয়, “নিছনি যাই’ বলিতেও সেইরূপ ভাব প্রকাশ হইতেছে।
নয়নে গলয়ে ধারা দেখি মুখখানি
কার ঘরের শিশু তোমার যাইতে নিছনি।
আমার বিবেচনায় এখানেও নিছনি অর্থে বালাই বুঝাইতেছে।
সবার অগ্রজ তুমি, তোরে কি শিখাব আমি
বাপ মোর যাইরে নিছনি।
এখানেও তাহাই।
নিছনি যাইয়ে পুত্র উঠহ এখন
কহয়ে মাধব উঠি বসিল তখন।
নিছনি যাইয়ে — অর্থাৎ সমস্ত অমঙ্গল দূর হইয়া।
১। অমিয়া নিছনি বাজিছে সঘনে মধুর মুরলী গীত
অবিচল কুল রমণী সকল শুনিয়া হরল চিত।
অমিয়া নিছনি– অর্থাৎ অমৃত মুছিয়া লইয়া।
২। নন্দের নন্দন গোকুল কানাই সবাই আপনা বোলে
মো পুনি ইছিয়া নিছিয়া লইনু অনাদি জনম ফলে।
নিছিয়া লইনু– আরাধনা করিয়া লইনু, অর্থাৎ বরণ করিয়া লইনু অর্থ হইতে পারে।
৩। তথা কনক বরণ কিরে দরপণ নিছনি দিয়ে যে তার
কপালে ললিত চান্দ যে শোভিত সিন্দুর অরুণ আর।
৪। তনু ধন জন যৌবন নিছিনু কালার পিরিতে।
উদ্ধৃত [১, ২, ৩, ৪] অংশগুলি চণ্ডীদাসের পদের অন্তর্গত সন্দেহ নাই।
নিছনি শব্দ যদি নির্মঞ্ছন শব্দেরই অপভাষা হয় তবে নির্মঞ্ছন শব্দের যতগুলি অর্থ আছে নিছনি শব্দের তদতিরিক্ত অর্থ হওয়ার সম্ভাবনা বিরল। দীনেন্দ্রকুমার বাবু নিছনি শব্দের যতগুলি প্রয়োগ উদ্ধৃত করিয়াছেন তাহার সকলগুলিতেই কোনো-না-কোনো অর্থে নির্মঞ্ছন শব্দ খাটে।
দীনেন্দ্রবাবু শ্রম স্বীকার করিয়া এই আলোচনায় যোগ দিয়াছেন সেজন্য আমি বিশেষ আনন্দ লাভ করিয়াছি। আমাদের প্রাচীন কাব্যে যে-সকল দুর্বোধ শব্দপ্রয়োগ আছে সাধারণের মধ্যে আলোচিত হইয়া এইরূপে তাহার মীমাংসা হইতে পারিলে বড়োই সুখের বিষয় হইবে।
১২৯৮