নরকে গতি
আমাদের বন্ধু মনোময় সংসারের মায়া কাটিয়ে চলে গেল। গত সোমবার। সকালে। সূর্য ওঠার পর পর। আজ শুক্রবার। দেখতে দেখতে চার পাঁচ দিন কাটল। শোকের প্রথম দিকটায় একটা ঝাপটা থাকে। মনোময়ের বেলায় তার বাড়িতে ঠিক সে রকম কিছু ছিল না। মনোময়ের স্ত্রী বিগত। বড় ছেলে সুভাষ বিয়ে-থা করেনি। মেজছেলে বিকাশ জয়পুরে! বউ বাচ্চা নিয়ে সেখানেই থাকে। আর মেয়ে রানু পাটনায়। পাটনায় রানুর স্বামী ব্যাংক অফিসার। সুভাষই বাবার কাছে থাকত। চাকরি-বাকরি নয়, সুভাষ—যাকে আমরা বড়কু বলে ডাকি—সেই বড়কু এখানে বাস সার্ভিস চালায়। তার নিজের একটা বাস, বাকি দুটোর একটা লালাবাবুর, অন্যটা রূপরতন বাবুর। বাস, বাস-অফিস, ড্রাইভার, কণ্ডাক্টর, ঝাড়ুদার—সবেরই দায়িত্ব বড়কুর। বড়কুর বয়স এখন প্রায় বিয়াল্লিশ। মনোময়ও আর ক’দিন পর সত্তরের নাগাল ধরত।
বাড়িতে যদি স্ত্রী না থাকে—যা মনোময়ের ছিল না, এক আধজন বউমাটউমাও না থাকে—তবে কান্নাকাটি করার মতন লোকই বা কোথায়! বড়কুর পক্ষে সম্ভব ছিল না এক বেলার মধ্যে জয়পুর থেকে মেজভাই বা পাটনা থেকে বোনকে আনানো। চৈত্রমাসের ঝলসানো গরমে গাছপালা মানুষ পাখি সবই যখন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে—তখন মৃত মনোময়কে একটা বেলাও ফেলে রাখা যায় না। যা করার তাকে একাই করতে হল, আর বাড়ির কাজকর্ম করার লোকদের। মনোময়কে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় প্রবল শোক দেখা গেল না। চেঁচামেচি কান্নাকাটিও নয়। সহদেব— যে মনোময়ের দেখাশোনা করত—শুধু সে একাই জোরে জোরে কাঁদছিল ; আর বাড়ির রান্নাবান্না যে করত—কামিনী হরীতকীতলায় দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিল। চৈত্রমাসের শুকনো শাকনা বাগান, গাছপালা, কত হলুদ পেয়ারা পাতা মাড়িয়ে ফটকের কৃষ্ণচূড়ার তলা দিয়ে আমরা মনোময়কে নিয়ে চলে গেলাম।
শ্মশান অনেক দূর। আড়াই মাইল মতন। আমার আর শরদিন্দুর জন্যে গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছিল। আমরা দুজনও বৃদ্ধ। মনোময়ের বৃদ্ধ বন্ধু, সঙ্গী। বড়কু ইচ্ছে করলে তার বাসটা আনতে পারত। মনোময়কে বাসের মধ্যে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আমরা শ্মশানযাত্রা করতে পারতাম। কিন্তু বড়কু সেটা করেনি। মনোময়েরই নিষেধ ছিল। ‘তোমরা আমাকে সাধারণভাবে নিয়ে যেও। ট্রাক গাড়িটাড়ি করে নয়।’ এমন কি সে বলে রেখেছিল—বরাকর নদীর পাড়ে—যেখানে বড় শিমূল গাছটা আছে—কালো পাথর—সেখানেই যেন তাকে দাহ করা হয়। ‘তোমাদের মা ওখানেই গিয়েছিল।’
বড়কুর লোকবল যথেষ্ট। তবু মনোময়কে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহকর্ম শুরু করতে করতে দুপুর গড়াল। আকাশ তখন রক্তবর্ণ অগ্নি। চৈত্রের ভীষণ লু বইছে গোঁগোঁ করে, যেন খেপা কুকুর তাড়া করছিল আমাদের। নদীর চর খাঁ-খাঁ, বালিতে পা ছোঁয়ানো যায় না। রক্ষে এই যে, নদীর পাড়ে নিম-জাম-অর্জুন-বাবলার ছায়া ছিল, আর তপ্ত দিনের বাতাসের সঙ্গে মাঝে মাঝে শীর্ণ বরাকর নদীর জলের ঈষৎ ঠাণ্ডা স্পর্শ মুখে গায়ে এসে লাগছিল।
এই সময় এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। নদী পাড়ের গাছপালা, ছায়া, ঘুঘুর ডাক, পাখিটাখির ক্লান্ত চিকির চিক রব, জঙ্গলের বিট চৌকি, খোঁড়া কামরিবাবার একফালি মন্দির—ঠিক কোন দিক থেকে কে জানে একটা লোক সাজানো চিতার কাছে এসে হাজির। ঢেঙা কালো চেহারা, ঘাড় পর্যন্ত রুক্ষ চুল, ছেঁড়া গামছায় কপাল কান জড়ানো। চোখ দুটি এত লাল যে মনে হয়, লু লেগে জ্বর এসেছে, বা রক্ত জমেছে চোখের জমিতে। গায়ে ছেঁড়া ফতুয়া, পরনে ময়লা চিট এক টুকরো কাপড়, ছেঁড়া খোড়া। হাতে তিনটে লাল রঙের কাঠি লম্বায় হাত দেড়েক হবে। দেখতে ধনুকের তীরের মতন।
মনোময়কে তখন সদ্য চিতায় শোয়ানো হয়েছে।
সেই খেপাটা হঠাৎ ছুটতে ছুটতে চিতার সামনে গিয়ে হাজির।
সে যে কী বলছিল আমরা দূর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমরা ছায়ায় বসে। আমাদের মাথায় জলে-ভেজানো গামছা-তোয়ালে। গলা শুকিয়ে কাঠ, বাড়ি থেকে বয়ে-আনা জলের কুঁজো প্রায় শেষ।
দূর থেকে মনে হল, লোকটা ঝামেলা করছে কিছু। হাত পা নাড়ছে। তারপর তার তিনটে কাঠি মাথার ওপর তুলে অনেকটা ত্রিভুজ আকার করে চিতার চারপাশ ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে মাথা দোলাচ্ছিল। দুলুনি বেড়ে গেল। যেন লাফাতে লাগল। শেষে তিনটে কাঠি এক এক করে প্রাণপণে দূরে নদীর দিকে ছুঁড়ে দিল। আকাশের দিকে মুখ করেই।
তিনটে কাঠি তিন দিকে গিয়ে পড়ল। লোকটা ছুটে গিয়ে এখান ওখান থেকে কাঠি তিনটে তুলে নিয়ে কী দেখল। তারপর থু থু করে থুতু ছিটোতে ছিটোতে কী বলল। বোধহয় বমিও করল একটু। শেষে যেমন এসেছিল সেই ভাবেই পালিয়ে গেল।
ততক্ষণে মনোময়ের মুখাগ্নি হয়ে গিয়েছে।
দেখতে দেখতে চৈত্রের সেই দুঃসহ তপ্ত দুপুরে চিতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।
চিতা যখন জ্বলছে তখন বড়কুদের অনেকেই গাছের ছায়ায় এসে গলা বুক কপাল মুছে নিচ্ছিল।
রেলের তারক—বড়কুর বন্ধুর মতন—আমাদের কাছে এল। দু ঢোঁক জল খাবে।
শরদিন্দু বলল, ‘লোকটা কে, তারক?’
‘পাগল!’
‘কী করতে এসেছিল? করছিল কী!’
‘আর বলবেন না। বেটা, কাঠিবাজি করে দেখতে এসেছিল, জেঠামশায়ের গতি কী হবে?’
‘মানে!’
‘ওই আপনাদের পরকালের গতি?’…স্বর্গ, মর্ত, নরক—কী যেন সব।’
‘সে কী! আচ্ছা পাগল তো! এ-বেটা এখানে কেমন করে জুটল?’
‘কে জানে। বেটাকে মারতাম। নেহাত…’
‘মারতে কেন?’
‘বেটা বলে কিনা, জেঠামশাইয়ের গতি নরকে।’
‘সে কী হে। লোকটা….
‘ওর কাঠি নাকি বলছে, গতি নরকে। রাস্কেল। হারামজাদা! ওই জন্যে থুথু করছিল। …এমনিতেই মেজাজ খারাপ; তার ওপর শালা,—বলেই জিব সামলালো তারক, ‘আরও মেজাজ খাট্টা করে দিল। যত্ত সব পাগল!’ বলে তারক চলে গেল।
আমি আর শরদিন্দু পরস্পরের দিকে বোকার মতন তাকিয়ে থাকলাম।
শ্মশানের কাজ মিটতে মিটতে বিকেল ফুরলো।
সারাদিনের ওই অসহ্য গরম, দুপুরের দাহ থেকে বোঝা যায়নি শেষ বিকেলের পর আকাশ কালো হয়ে আসবে মেঘে-মেঘে।
সন্ধের মুখে কালবৈশাখী দেখা দিল। ততক্ষণে আমরা বাড়ি ফিরে এসেছি। বছরের দ্বিতীয় কালবৈশাখী। ঝড়ে জলে একাকার হয়ে রাত নামল। মনোময় তখন কোন শূন্যে কে জানে!
সেই সোম আর আজ শুক্রবার। চার পাঁচটা দিন কেটে গেল।
মনোময়ের বাড়িতে আমরা রোজই আসি। দ্বিতীয় দিন বেশিক্ষণ বসতে পারিনি। প্রথম দিনের ধাক্কা আমাদের দুজনকেই খানিকটা কাহিল করে দিয়েছিল। বয়েস তো আমাদেরও হয়েছে। মনোময় সত্তরে পা দিতে যাচ্ছিল শরদিন্দু এখন আটষট্টি। আমি উনসত্তর। শরদিন্দু এই বয়েসে ভেঙেও যেন কাঠামোটা ধরে রাখতে পেরেছে খানিক। আমি পারিনি। আমাকে আরও বেশি বুড়ো দেখায়। মাথার সব চুল সাদা। অর্ধেক দাঁত নেই। চোখে দেখতে অসুবিধে হয় খানিকটা, চশমা সত্বেও। ছানি পড়ছে।
তৃতীয় দিন থেকে আমরা ভালই ছিলাম। বিকেলের শেষে মনোময়ের বাড়িতে এসে বসি দুই বৃদ্ধ। বাড়ির বাইরে গোল গোল নুড়ি পাথর ছড়ানো জায়গায় বেতের চেয়ার বার করে দেয় সহদেব। আমি আর শরদিন্দু বসি। বসে থাকি। মনোময় থাকতে আরও একটা চেয়ার বাইরে পাতা হত। সে বসত। আমরা তিনজনে গল্প গুজব করতাম। সাড়ে সাত আটটা নাগাদ উঠে পড়তাম দুজনে—আমি আর শরবিন্দু। ‘চলি গো, আজ।’ ‘এসো। সাবধানে যেও। চোখের মাথাটি তো খেয়েছ।’
তখন আসতাম, আর এখন আসব না, এমন তো হয় না। বরং এখন ক’দিন রোজই আসা দরকার। বড়কু ছেলেমানুষ নয়—সে একাই সব সামলাতে পারে। তবু এসময় আমরা তার সহায়। পিতৃদায় বলে কথা। অশৌচ, শ্রাদ্ধ-শান্তি, পুরোহিত, নিমন্ত্রণ কত কী আছে। বড়কু আমাদের পরামর্শ নেয়। আমরা দিই।
এরই মধ্যে রানু পাটনা থেকে চলে এসেছে ছেলেমেয়ে স্বামী নিয়ে। ছোটকু—মানে মনোময়ের মেজছেলে বিকাশ—জয়পুর থেকে বুধবারই বেরিয়ে পড়েছে। আজ বা কাল তার আসার কথা।
অন্য দু একজনও এসেছে। মনোময়ের এক বোন। দূর সম্পর্কের এক দেওর। দু একজন অন্য কেউ হতে পারে, চিনি না।
পাথর ছড়ানো জায়গাটুকুতে আমরা বসি। মাঝে মাঝে ফটক খোলার শব্দ হচ্ছে। বাগানের রাস্তা ধরে কেউ আসছে। পাড়া প্রতিবেশী। মেয়েরাও কেউ কেউ। রানু আসার পর মেয়েরাই যেন বেশি আসছে। আমার আর শরদিন্দুর স্ত্রী রোজই বেলার দিকে একবার করে আসেন। তদারকি করে যান।
খানিকটা আগে বড়কু একবার এসেছিল। জগন্নাথ পুরুত এক ফর্দ বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সেটা দেখাবে। তার চেয়েও বড় কথা, বড়কু যে নেমন্তন্নর লিস্টি করেছে সেটা একবার দেখিয়ে নেবে। ভুলচুক না হয়ে যায়।
এমন সময় রানু এল। এসে বলল, ”কাকাবাবু, আর একটু চা এনে দিই।”
আমি মাথা নাড়লাম। ”না না, একটু আগেই খেলাম।”
”তা হোক। একটু করে খান। তৈরি হয়েছে।”
”দাও তবে সামান্য।”
”কাকাবাবু?”
”বল?”
”মেজদা হয়ত আজ রাত্তিরেই এসে পৌঁছবে! বড়দা বলছে, বাড়িতে কেত্তন-টেত্তন চলবে না। আমি বলছিলাম ঝরিয়া থেকে পূর্ণিমামাসিকে আনতে। পূর্ণিমামাসি ভাল কেত্তন গায়। কত জায়গায় গাইতে নিয়ে যায়। তা বড়দার ইচ্ছে না থাকুক—যদি মেজদার ইচ্ছে থাকে….”
শরদিন্দু বলল, ”ছোটকু আসুক। দেখা যাক কী বলে?”
”আপনারা একটু বড়দাকে বলবেন।”
রানু চলে গেল।
শরদিন্দু তার সিগারেটের প্যাকেট বার করল পকেট থেকে। দেশলাই। ও সব কিছু ধীরে-সুস্থে করে। বরাবরের স্বভাব। পোস্ট অফিসের বড় মাস্টারবাবু থেকে আরও উঁচু জায়গায় উঠে রিটায়ার। করেছে ঘুরেছে নানা জায়গায়। সতর্ক সাবধানী ধীর-স্থির মানুষ। এই জায়গাটায় ওরা দু পুরুষ কাটাল। তিনও বলা যেতে পারে। অনেকটা মনোময়ের মতন।
আমি সেদিক থেকে নতুন। ফরেস্ট অফিসে কাজ করে এখানে এসে বসেছি। ছোট বাড়ি আমার। নতুন প্রায়। জায়গাটা আমার ভাল লাগে। আমরা নিঃসন্তান। এক ভাইঝিকে মানুষ করেছি। সেই আমাদের মেয়ে। বিয়ে হয়েছে কলকাতায়। জামাই চাকরি করে ইনশিওরেন্সে। এখানে আমরা বুড়োবুড়িতে থাকি। ভালই ছিলাম। মনোময়ই যেন বড় রকম ধাক্কা দিয়ে গেল।
মনোময় যে এভাবে হুট করে চলে যাবে ভাবিনি। তার বড় অসুখ বিসুখ ছিল না। বুড়ো বয়েসে যেমন হয়। প্রেসারের কম-বেশি গোলমাল, একটু আধটু ব্লাড সুগার, কিংবা বাতের ভাব, শীতের সময় শ্লেষ্মার টান—এরকম ছোট-খাট রোগ বাদ দিলে মনোময়ের বিশেষ ভয় পাবার মতন কিছু ছিল না। তার একটা রোগ ছিল, কিংবা বলা যেতে পারে শারীরিক গণ্ডগোল। মনোময়ের শ্বাসনালীর তলায় একটা অবসট্রাকশন ছিল। এটা সে জানত। তবে সেটা ভয়ংকর কিছু হয়ে ওঠেনি, বা তাকে জানান দিত না। ওর ডাক্তার, যখন ও রেলের অ্যাকাউন্টস অফিসার, দানাপুরে রয়েছে, ধরা পড়েছে টিউমারটা—তখন ওকে বলেছিল ‘ওয়েল মিস্টার মুখার্জি, ডোন্ট ডিস্টার্ব ইট। লেট ইট স্লিপ। অফকোর্স সাম ডে ইট মে গিভ ইউ ট্রাবল।’ আরও বলেছিল, হয় তুমি এটার কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করো, না হয় কলকাতায় গিয়ে দেখাও—হয়ত ওরা অপারেশান অ্যাডভাইস করতে পারে।
মনোময়ের তখন রিটায়ার করতে আর বছর খানেক। ও ভেবেই নিয়েছিল, জীবনটা তো এমনিতেই ফুরিয়ে এল; এখন আর কাটাছেঁড়া করে লাভ কী। তাতে ভাল হবেই এমন কোনো কথা নেই, মন্দও হতে পারে।
মৃদুলা তখন বেঁচে, মনোময়ের স্ত্রী। মনোময় তার স্ত্রীকে বলত ‘মৃদুবালা’। ঠাট্টা করে। চেহারা এবং কন্ঠস্বর—এই দুয়েতেই সে মৃদু ছিল। মৃদুলারও আপত্তি ছিল কাটাকুটিতে।
মৃদুলাকে আমি দেখিনি। শরবিন্দুর কাছে শুনেছি সব। আমি এখানে আসার আগেই, মৃদুলা মারা যায়।
সৌভাগ্যই হোক বা দুর্ভাগ্য, মনোময় চাকরি থেকে বরাবরের ছুটি নিয়ে এখানে—তার পৈতৃক বাড়িতে এসে স্থায়ীভাবে বসল, তার স্ত্রী চলে গেল আগেই, সে কিন্তু টিউমারটা নিয়ে বেঁচে থাকল আরও বছর দশ; কিন্তু গেল যখন তখন সেই ঘুমন্ত টিউমারই সাত ভোরে জেগে উঠে বিছানা বালিস রক্তে লাল করে মনোময়কে নিয়ে চলে গেল। জীবন বড় অদ্ভুত!
শরদিন্দু বলল, ”একটা সিগারেট খাবে নাকি, দত্ত?”
”দাও।”
শরদিন্দু সিগারেট দিল। কয়েকটা কাঠি নষ্ট হল সিগারেট ধরাতে। এলোমেলো হাওয়া বইছে। জ্যোৎস্নাও ফুটে উঠেছে বেশ। নুড়ি পাথরের কোথাও কোথাও ঝকঝক করছিল চাঁদের আলোয়।
সিগারেট খেতে খেতে শরদিন্দু বলল, ”দত্ত, কেত্তনের কথা যদি ওঠে—আমি কিছু বলব না। তুমিই বলো।”
”কেন? তোমার কী হল?”
সিগারেটের ধোঁয়া আস্তে করে গিলে শরদিন্দু তার শখের ছড়িটা চেয়ারের পাশে আরও হেলিয়ে রাখল। বলল, ”তুমি তো জান, মানোময়ের কতগুলো জেদ ছিল।”
”তার সঙ্গে কেত্তনের কী?”
”মনোময় পছন্দ করত না। পছন্দ করলে মৃদুলার শ্রাদ্ধের সময় ব্যবস্থা করতে পারত। করেনি তো।”
‘আমি দেখিনি। জানি না।….তবে মনোময় গানটান পছন্দই করত। ধরো, ও নিজে এস্রাজ বাজাত। ভালই বাজাত। এক আধদিন আমাদের গানও শুনিয়েছে, ভজন। ওদের বসার ঘরে পুরনো একটা অর্গানও পড়ে আছে হে!……তা ভজন যদি হয়, কীর্তনে আপত্তি কিসের?”
এমন সময় রানু এসে চা দিয়ে গেল। দাঁড়াল না। সে খুবই ব্যস্ত।
চা খেতে খেতে শরদিন্দু বলল, ”যুক্তিতর্ক দিয়ে তোমায় সব বোঝানো যাবে না। আমিও বুঝি না। তবে তুমি নিজেই দেখেছ, মনোময় ঠাকুর দেবতা, দীক্ষা পুজোটুজো বিশ্বাস করত না। ভগবান ভগবানের কথা উঠলে ঠাট্টা করত। বলত : ফাদার, গিভ মি দি পোরসান অফ গুডস দ্যাট ফলেথ টু মি…..।”
আমি বললাম ”ওটা মনোময়ের তামাশা। বাইরে হাসি তামাশা করত। কিন্তু তুমি তো জান শরদিন্দু, ও বাইবেল পড়ত, নানান গল্প শোনাত। তা ছাড়া তোমাকে ফ্র্যাংকলি বলছি, মাঝে মাঝে ও গীতা, রামায়ণ, মহাভারতের কথা তুলে এমন সুন্দর কথাবার্তা বলত যে আমার যেন একটা মেন্টাল এলিভিসন হত। মনোময় মুখ্যু ছিল না গো, পড়াশোনা করত। ওর বসার ঘরে কত পুরনো বই ঠাসা আছে আলমারিতে দেখেছ তো!”
”কী মুশকিল! আমি মনোময়কে মুখ্য বলব কেন। ও যে নানা রকম বই পড়ত, ধর্মের বই-ও তাও আমি জানি। কিন্তু বই পড়ার সঙ্গে মানুষের চরিত্রের কী সম্পর্ক! মনোময় অনেক ব্যাপারে জেদ গোঁ ধরে বসে থাকত, ঠাট্টা কারও নানা ব্যাপারে। ওর নিজের একটা কাণ্ডিশান ছিল—তার বাইরেও কোনো কিছুই অ্যাকসেপ্ট করত না।”
”ওটাই ওর চরিত্র।” আমি চায়ের কাপ মাটিতে নামিয়ে রাখলাম। একটু চুপ করে থাকলাম। তাকালাম আকাশের দিকে। আধা-আধি চাঁদ, আকাশ, পরিষ্কার, দমকে দমকে এলোমেলো বাতাস ছুটে আসছিল ডুমুর আর পেয়ারা গাছের পাতা কাঁপিয়ে! শব্দ হচ্ছিল পাতার। হঠাৎ আমার মনোময়ের একটা কথা মনে পড়ল। একদিন সে বলেছিল, ‘সংসারে বোধহয় কোনো কিছুই খাঁটি নয় হে। যেমন ধরো, আমরা—হাত-পা-অলা মানুষরা খাই মাছ মাংস, হরিণরা খায় ঘাস, কাঁকড়া বিছে খায় পোকামাকড়, আর তোমার ওই পেঁচা আর কাকরা ভালবাসে মরা ইঁদুর। আমি মানুষ বলে বলব, আমার রুচি ভাল। হরিণ তো কথা বলতে পারে না, নয়ত সে বলত তার রুচি ভাল। কাকও বলত, তার রুচিটাই ভাল। তা অত ঝগড়ার দরকার কী! যার কাছে যা ভাল, সেটাই তার কাছে খাঁটি।’ বলেই হেসে ফেলে মনোময় বলল, ”কথাটা কিন্তু আমার নয় হে, জ্ঞানীদের কথা।”
শরবিন্দু বলল, ”মনোময়কে আমি ছেলেবেলা থেকেই চিনি বলতে পার। একই জায়গার লোক। আমার মনে হয়, ও কোনো একটা সময় থেকে একগুঁয়ে, জেদী, অহংকারী হয়ে পড়ে। না না বাজে অহংকার নয়। ওর মধ্যে ‘আমি’টা বড় হয়ে ওঠে। সাবমিশান জিনিসটাকে ঘেন্না করতে শুরু করে। ফলে শেষের দিকে এক ধরনের আমিত্ব পেয়ে বসে তাকে। কিছু সাংসারিক পারিবারিক অশান্তিও হয়।”
আমি চুপ করে থাকলাম। কোনো সন্দেহ নেই, শরদিন্দু মনোময়কে বেশি চিনত। চেনে।
শরদিন্দুও চুপ করে থাকল।
অনেকক্ষণ পরে বলল, ”দত্ত, তোমায় একটা কথা বলব ভাবছি।”
”বলো!”
”এখন নয়।….আমি এখনও মনস্থির করতে পারিনি। বুঝতে পারছি না, বলা উচিত হবে কিনা! ভাবছি।”
আমি শরদিন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দেখলাম কয়েক মুহূর্ত। শরদিন্দুকে দেখছি, আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলব বলব করে, তারপর আর বলে না। অন্যমনস্ক হয়ে যায়। গত দু-তিনদিন ধরেই এরকম হচ্ছে।
আমরা দু ‘জনেই চুপচাপ।
বাড়ির মধ্যেও একেবারে আচমকা এক নিস্তব্ধতা।
হঠাৎ শরদিন্দু বলল, ”এখানে এভাবে আমরা দুজন বসে থাকি। তোমার কেমন লাগে, দত্ত? ভীষণ ফাঁকা নয়?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার চোখের সামনে কেন যে একঅন্য দৃশ্য ভেসে উঠল কে জানে! মনে হল, আমরা যেন এক রেল স্টেশনের ফাঁকা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। একটু আগে দাঁড়িয়ে-থাকা-গাড়িটা চলে গিয়েছে। সারা প্লাটফর্ম জুড়ে কেমন এক গন্ধ, ছেঁড়া শালপাতা, পানের দোনা, ভাঙা মাটির খুরি, ছেঁড়া কাগজ ছড়িয়ে রয়েছে। বাতাসে উড়ছে। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। দেখছি কি দেখছি না—অনুমান করছি—গাড়িটা কত দূর চলে গেল।
শরদিন্দু বলল, ”নাও, ওঠো। বড়কু আর রানুকে ডাকি একবার। রাত হচ্ছে।” বলে শরবিন্দু উঠে দাঁড়াল।
দুই
শ্রাদ্ধকর্মের আগের দিন। বাড়ির মধ্যে যথেষ্ট ব্যস্ততা। বাইরে অনেকটা জায়গা জুড়ে মাঠ পরিষ্কার করে তেরপল খাটানো হয়েছে। শ্রাদ্ধের কাজকর্ম হবে বাড়ির মধ্যে। আর এই তেরপলের তলায় লোকজন বসবে। কিছু কাঠের ফোল্ডিং চেয়ার জড়ো করা আছে এক পাশে। শ্রাদ্ধের পরের দিন খাওয়া-দাওয়া। এই তেরপলের তলাতেই।
মনোময়ের বাড়িতে এখন অনেক লোকজন। ছোটকুরা এসে পৌঁছেচে আগেই। আরও কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছে দূর সম্পর্কের। তাদের চোদ্দআনাকেই আমরা চিনি না। দেখিনি আগে।
আমাদের যা কর্তব্য—কোথায় কী হচ্ছে, কোনো অসুবিধে ঘটছে কী না, জগন্নাথ পুরুত কখন থেকে কাজে বসবে—ইত্যাদি তদারকি সেরে আমরা আজ সামিয়ানার তলাতেই বসলাম। চাতালের তলায় নুড়ি পাথরের জায়গাটায় আজ বসার উপায় নেই। অনবরত লোকজন আসছে যাচ্ছে। বারান্দায় এক জোড়া জোরাল আলো। ক’দিনের ফাঁকা চুপচাপ বিষণ্ণ ভাবটা যেন ক্রমশ কাটতে কাটতে আজ বড় সরব, ব্যস্ত কাজের বাড়ি হয়ে উঠেছে।
শরদিন্দু হঠাৎ বলল, ”দত্ত, উঠবে নাকি! সবেই সন্ধে। চলো বাইরে গিয়ে একটু পায়চারি করি।”
বললাম, ”চলো।”
দুজনে উঠে গেট পর্যন্ত যেতেই সহদেবের সঙ্গে দেখা। ঝুড়ি মাথায় একটা লোককে নিয়ে আসছে। বলল, ”তাড়াতাড়ি যাচ্ছেন, বাবু?”
”না। কাছেই আছি। ঘুরছি একটু।”
ফটকের বাইরে এসে কাঁচা রাস্তা, পাথর আর মাটি ছড়ানো। মোরন আর নেই। শুধুই মাটি। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা। গজ পঞ্চাশ দূরে ফাঁকা মাঠ। শচীনন্দনের এক শিব মন্দির।
মাঠ পর্যন্ত প্রায় চুপচাপ। তারপর শরদিন্দু হঠাৎ বলল, ”দত্ত, তোমায় একটা কথা বলব বলেছিলাম…”
”হ্যাঁ। কথাটা বলোনি। বলেছিলে ভেবে দেখছ—” আমি একটু হাসলাম।
”ভেবেই দেখলাম। ক’দিন ভাবছি।” শরদিন্দু তার হাতের ছড়ি দিয়ে কী একটা সরিয়ে দিল সামনে থেকে। আজ কি চতুর্দশী না পূর্ণিমা, অমন চাঁদ রয়েছে আকাশে, অঝোর জ্যোৎস্নাধারা।
”তোমায় দেখে মাঝে মাঝে তাই মনে হয়!—মনোময়ের পরে তোমার কি মনে ভয় ঢুকেছে?”
”সে তো ঢুকতেই পারে, ভাই। আমাদের এখন বাসায় ফেরার বেলা। নয় কী!…না, আমি সে-কথা বলছি না।”
”তবে?”
শরদিন্দু সামান্য সময় চুপ করে থেকে বলল, ”তুমি কি পরজন্ম বিশ্বাস করো? বা ধরো এই ইহকালের পর কোনো পরকাল—”
আমার যেন মজা লাগল। হঠাৎ এসব কথা কেন? আমরা তো অনেক বার একথা সেকথায় এই সব বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা তুলেছি। মনোময়ের সামনেই। আমি বললাম, ”না”। বলে মাথা নাড়লাম। ”ইহজন্মের কথা ভাবতেই জীবনটা ফুরিয়ে গেল।” বলে একটু হাসলাম। ”হঠাৎ এসব কথা কেন?”
শরদিন্দু ধীরে ধীরে হাঁটছিল। সে মনোময়ের মতন নয়, আমার মতনও না! মনোময়ের মধ্যে কোথাও যেন একটা শ্লেষ ছিল। বুড়ো বয়েসে যা হয়—তুড়ি মেরে কোনো কথা উড়িয়ে না দিয়ে গম্ভীর মুখে শ্লেষ ও বিদ্রূপ করে কথাগুলোকে কাটিয়ে দিত। এটা তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। আমি বহু ব্যাপারেই মূর্খ মনোময়ের মতন সাত রকম বইও পড়িনি। ধর্মাধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাবার চেষ্টাও করিনি কোনোদিন। তবে হ্যাঁ, আমার মধ্যে তুড়িমারা বা শ্লেষের অভ্যেস ছিল না। বরং কোথাও কোথাও দ্বিধা করতাম। জগৎ এত বড়, বিচিত্র, হাজার রকম কত ঘটনাই ঘটে, আমি তার এক কণাও জানি না। কী দরকার বৃথা তর্কে। কিন্তু শরদিন্দু সাধারণ বাঙালি হিন্দু। তার মধ্যে বিশ্বাস ছিল আবার দ্বিধাও ছিল ঈশ্বর, পুনর্জন্ম, পরকাল, কত কী নিয়ে। ভক্তির সঙ্গে ভয়, নির্ভরতার সঙ্গে সন্দেহ—।
এখানকার মাটি শক্ত। কাঁকরের ভাগ বেশি। কাঁকড়ে মাঠ ঝকঝক করছিল কোথাও, চাঁদের আলোয়। নয়ত পুরো মাঠই বেশ পরিষ্কার।
শরদিন্দু ধীরে ধীরে হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ”না, কথা ঠিক নয়। আমার সেদিন থেকেই মনটা কেমন খচখচ করছে।”
”কোন দিন থেকে?”
”শ্মশানে মনোময়কে দাহ করার দিন থেকে।”
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। শরদিন্দুর দিকে তাকালাম।
শরদিন্দু বলল, ”ওই লোকটার কথা আমি ভুলতে পারছি না। কাঠি হাতে যে লোকটা হঠাৎ এসে হাজির হল—!”
”ওই পাগলাটা? বলো কী?” আমি যত অবাক, ততই যেন মজা পেয়ে হেসে ফেললাম। শেষে হো হো করে হেসে উঠলাম।
শরদিন্দু বলল, ”দত্ত, তিনটে কাঠি হাতে যে লোকটা জঙ্গল ফুঁড়ে হাজির হয়েছিল সে পাগল হতে পারে। হয়ত বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু—”
”কী কিন্তু?”
”ধরে নাও যদি এমন হয়—মরার পর আমাদের কোথাও একটা যদি গতি থাকে—”
”তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ শরদিন্দু। কী যা-তা বকছ! কোথাকার একটা পাগল এসে কী মাদারির খেলা খেলল—”
”এসো, এখানে একটু বসি।” শরদিন্দু তকতকে জ্যোৎস্না ভরা মাঠের একটা জায়গা দেখাল। চারদিক দেখে নিল টর্চের আলো জ্বেলে। গরমের দিন সাপ বিছে থাকা অসম্ভব নয়।
আমরা বসলাম।
শরদিন্দু তার অভ্যেস-মতন সিগারেটের প্যাকেট বার করল।
আমাদের সিগারেট ধরানো হয়ে গেল।
খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শরদিন্দু বলল, ”দত্ত, তুমি তো সারাটা জীবন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালে। আমরা যাদের বলি, প্রিমিটিভ, বুনো অসভ্য জংলি দেহাতি কত কী, তাদের মধ্যে অনেকের এক এক রকম সংস্কার থাকে-প্র্যাকটিস, বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। তাকে তুমি টোটেম বলতেও পার এক ধরনের। না বললেও ক্ষতি নেই। সংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, মিথ রীতি যা খুশি বলতে পার। বড় অদ্ভুত বিশ্বাস সংস্কার এদের থাকে। আমি দু-একটা দেখেছি! যেমন ডাইনি ধরা—।”
কথাটা আমাকে স্বীকার করতেই হল। সংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস ওদের মধ্যে আমিও দেখেছি। কিম্ভূত সব কাণ্ড। অদ্ভুত বিশ্বাস।
শরদিন্দু বলল, ”ধরে নাও, লোকটা সেই রকম। পাগল হয়ত, কিন্তু ওর ধারণা ও তিনটে কাঠি ছুঁড়ে বলে দিতে পারে, যে লোকটা মারা গেল—তার পর-কালের গতি কী হবে!”
”তুমি সত্যিই পাগল হয়েছ শরদিন্দু।—বেশ ধরেই না হয় নেওয়া গেল—লোকটা ত্রিকালজ্ঞ! তাতে কী হল?”
”না, আমি বলছি, যদি এমনই হয়—মরার পর কোথাও—”
”গতি হয়?” আমি হাসলাম। ”হোক গতি। গতি হলেও কি তুমি মনে করো, ওই পাগলটা যা বলে গিয়েছে—মনোময়ের নরকে গতি হবে—তুমি কি সেটা বিশ্বাস করো? মনোময়ের মতন মানুষ তুমি ক’টা পাবে সংসারে? ভদ্র, শিক্ষিত, সাদামাটা, রুচিবান, সাহসী, হৃদয়বান, স্পষ্ট-বক্তা…। কোন সাধারণ গুণ তার ছিল না! এই মানুষের যদি নরকে গতি হয় ভাই—আমার মতন মানুষের তো তাহলে আরও নিম্নস্তরের কোনো জায়গায় গতি হওয়া দরকার। ঠিক কি না?”
শরদিন্দু সিগারেটের টুকরোটা ফেলে দিল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ”দত্ত তুমি মনোময়কে নিশ্চয় চেনো। কিন্তু তাকে ততটা চেনো না, বা জান না, যতটা আমি জানি! তুমি তাকে শেষ বয়েসে দেখেছ! তুমি দেখেছ তার বসার ঘর। তার অন্দরমহল তুমি দেখনি। জান না! মানুষ হল অদ্ভুত জিনিস। তার বাইরের দিকে যে ছালটা চাপানো থাকে—তা দিয়ে আমরা তাকে বিচার করি। তার মুখের ওপর এমন করে এক মুখোশ আঁটা থাকে—যা আমরা চোখে ধরতে পারি না। তুমি আমি যা দেখছি আসলে হয়ত সে তা নয়।….না, না, আমি মনোময়কে গালাগাল দিচ্ছি না! তুমি যা বলেছ, তার অনেকটা সত্যি। সবটা নয়।”
আমি অবাক হয়ে শরদিন্দুর মুখ দেখছিলাম। মৃত বন্ধুর জন্য তার মনোকষ্ট, বেদনা সবই রয়েছে, তবু যেন আজ সে অন্য কিছু বলতে চায়। যা আমি জানি না।
”তুমি বলছ মনোময়ের মধ্যে অনেক মিথ্যে ছিল?” আমি বললাম।
মাথা নুইয়ে শরদিন্দু বলল, ”হ্যাঁ।” বলে একটু চুপ করে থেকে বলল, ”দত্ত, মনোময় আজ নেই। আমি যা বলছি তুমি বিশ্বাস করতে পার, না-ও পার। আমি শুধু শপথ করে বলতে পারি, আমি মিথ্যে বলছি না। মনোময়কে আমিও ভালবাসতাম। আবার কোনো কোনো ব্যাপারে ঘেন্নাও করতাম।”
”না, তুমি মিথ্যে বলবে না। আমি বুঝতে পারছি।”
শরদিন্দু আমার দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ”বড়কু কেন বিয়ে করেনি জান?”
”না।”
”তাহলে তোমায় ছোট করে একটা কথা বলি।….তুমি কি জান, বড়কু মনোময়ের প্রথমা স্ত্রীর সন্তান?”
”কানাঘুষো শুনেছি।”
”শুনতে পার। কিন্তু তুমি শোননি, বড়কুর মা রাজলক্ষ্মী দেখতে খুবই সুন্দর ছিল। স্বভাবেও ছেলেমানুষি ছিল লক্ষ্মীর। তার অল্প বয়সের সন্তান বড়কু। মনোময়ের কেন যেন ধারণা হয়েছিল, লক্ষ্মী ভাল স্বভাবের মেয়ে নয়। মারধোর করত কিনা জানি না, তবে মেন্টালি টরচার করত। লক্ষ্মী শেষ পর্যন্ত আফিংয়ের ডেলা খেয়ে আত্মহত্যা করে।”
আমি যেন স্তব্ধ। বিমূঢ়। এমন কথা আমি শুনিনি। বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না।
শরদিন্দু বলল, ”মনোময় বাইরে বাইরে সৌন্দর্য নিয়ে ভাল ভাল কথা বলত। বলত, সৌন্দর্যই একমাত্র জিনিস তা অজ্ঞাত কোনো স্রষ্টার পরিপূর্ণ সৃষ্টি। বলত না? ভেতরে সে কিন্তু সহ্য করতে পারত না সৌন্দর্যকে, সরলতাকে।…দত্ত, তোমার কাছে এ-কথা বলতে আমার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। তবু তোমায় বলি, আমার বড় মেয়েকে তুমি দেখেছ। চন্দনা। আজ সে শক্তিপুর কোলিয়ারির ম্যানেজারের বউ। বাচ্চাকাচ্চার মা। কিন্তু তার যখন সতেরো আঠারো বয়েস তখন থেকেই বড়কুর সঙ্গে তার একটা ভাল সম্পর্ক ছিল। তুমি তো জান, আমরা এখানকার লোক, আমি আর মনোময়। চাকরির কাজে বাইরে বাইরে ঘুরলেও আমাদের বাড়িতে—মানে এখানে আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত। পূজোয় তো বটেই। ……হ্যাঁ, ভাল কথা। বড়কু এখানেই থাকত, তার ঠাকুমার কাছে। মনোময় আবার বিয়ে করছিল? মৃদুলাকে।….কী বলছিলাম, আমার মেয়ের কথা। চন্দনা আর বড়কুর কথা আমরা ভেবেছিলাম, আরও দু-চার বছর যাক, তারপর দুজনের বিয়ে-থার কথা তোলা যাবে। কিন্তু একদিন, পুজোর সময়, সবাই আমরা যখন এখানে পুজো কাটাতে এসেছি, চন্দনা কাঁদতে কাঁদতে তার মাকে এসে বলল, মনোময় তাকে—চন্দনাকে—একলা ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে অসভ্যের মতন কথাবার্তা বলেছে। এখন কি….।” শরদিন্দু চুপ করে গেল। তার গলা ধরে এসেছিল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে বলল, ”যাকগে, ও-কথা আর না বললাম। চন্দনার আমরা অন্য জায়গায় বিয়ে দিই বছর দুই পর।”
আমার যেন কেমন লাগছিল। অবিশ্বাস্য। মনোময় এত ছোট হতে পারে! নোংরা? নীচ? আমি বললাম, ”কিন্তু মনোময় তার দ্বিতীয় স্ত্রী মৃদুলাকে….”
”হ্যাঁ। খুব ভালবাসত,” শরবিন্দু বলল, ”আদর করে বলত, মৃদুবালা। কিন্তু তুমি জান না দত্ত, মনোময় তার শান্তশিষ্ট দুর্বল স্ত্রীকে যেভাবে রেখেছিল—সেভাবে কোনো মানুষকে কেউ রাখে না। খাঁচার পাখি করে রেখেছিল মৃদুলাকে। যেন হাট-মাঠ থেকে একটা পাখি ধরে এনেছে বা কিনে এনেছে। মৃদুলার কোনো কথা বাড়িতে থাকত না। কোনো ইচ্ছের কোনো দাম ছিল না। তার কোনো সুখ-সাধ সে জানাতে সাহস করেনি। টোটাল সাবমিশান নিয়ে সে বেঁচে ছিল। মনোময় স্ত্রীর মৃত্যুর পর পত্নীপ্রেম দেখাবার জন্যে শ্রাদ্ধের দিন স্ত্রীর বিরাট এক ছবি সাজিয়ে রেখে দুচোখ জলে ভাসিয়ে দিল।”
আমার কেমন সন্দেহ হল, বললাম, ”তুমি কোনোরকম রাগ পুষে রাখনি তো, শরদিন্দু?”
”রাগ কতদিন পুষে রাখা যায়, দত্ত?…..আর কীই বা লাভ হত পুষে! জীবনের শেষবেলায় আবার আমরা মিলেছিলাম এখানে। একজন সঙ্গী তো দরকার। তাছাড়া একসময় যখন মনোময়ের বয়েস ছিল, তেজ ছিল—তখন সে যতটা দুর্মুখ, নিষ্ঠুর, ইতর, আধিপত্য লোভী ছিল, পরে আর তেমন ছিল না। বাইরে যেমনই দেখাক, ভেতরে ভেঙে গিয়েছিল। ওর মেজ ছেলে জয়পুরে চলে গেল। বিয়ে করল বাপকে তোয়াক্কা না করে। বাপকে সে ঘেন্না করত। বড়কুও করে। তুমি আর কতটুকু জানবে! আমি জানি।….রানু বছরে একবারও এখানে আসে কি আসে না। সে তার মাকে দেখেছে। দেখে দেখে বাবাকে বুঝেছে। একটা মানুষ যে শুধু নিজের কর্তৃত্ব বোঝে, কর্তব্য নয়। যার মায়া মমতা নিতান্তই একটা শৌখিন, বৃত্তি, হৃদয়ের অনুভব নয়। …..তুমি আর কী আশা করতে পার, দত্ত! এ ফাদার হেটেড বাই হিজ ওউন সানস অ্যান্ড ডটার।…..তা যদি হয়—তবে পিতা হয়ে কী লাভ!”
”কী জানি শরদিন্দু! মনোময়কে আমার বরাবর হৃদয়বান, সাহসী, সংযমী বলে মনে হয়েছে!”
শরদিন্দু ম্লান হাসল। ”কে হৃদয়বান? যে তার স্ত্রীকে আফিং খেতে বাধ্য করে? যে তার বড় ছেলের ভালবাসার মেয়েটিকে নোংরা কথা বলে, যে তার শান্তশিষ্ট বউকে খাঁচায় বন্ধ করে রেখে ছোলা খাওয়ায়? কেন ওর ছেলেমেয়েরা একে একে ওকে ত্যাগ করল ভেবে দেখেছ? ও শেষ জীবনে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে গিয়েছিল—অনুভব করতে পার?”
”আমার যেন কেমন লাগছে শরদিন্দু?”
”তোমার চেয়েও আমার বেশি লাগছে….তুমি মনোময়কে সাহসী বলেছ? হ্যাঁ, ও সাহসী ছিল। কিন্তু কখন? যখন দেখেছে সাহস দেখালে ওর ক্ষতি হবে না, লাভ হবে। ওর চাকরির জীবনে মনোময় কারও দোষত্রুটি ক্ষমা করেনি। যা করা যেত। করলে ওর পর পর প্রমোশন যদি বন্ধ হয়ে যায়—! এই কথাটা মাথায় রেখেই সুবিধের জন্যে সাহস দেখাত। আমার তো মনে হয় ওর সাহসের ব্যাপারটা ছিল সার্কাসের সঙ্গে রিং মাস্টারের খেলা দেখানোর মতন। ….ও ভীষণ স্বার্থপর ছিল। স্বার্থপর, মতলববাজ।….না না, ওর উদারতার কথা বলো না। এখানকার এক আশ্রমের জমির টাকা ও অর্ধেক দিয়েছিল, যদিও মনোময় আশ্রমটাশ্রম বিশ্বাস করত না। কেন দিয়েছিল জান? নাম কিনতেও ততটা নয় যতটা ওই ঝরিয়ার পূর্ণিমা মাসিকে—হটিয়ে রাখতে। জমিটা তারই কেনার কথা ছিল। মনোময় কিনতে দেয়নি। কারণ একসময় মনোময় পূর্ণিমার সর্বনাশ করেছিল। পূর্ণিমাকে ভীষণ ভয় পেত মনোময়। তোমরা নয়, আমি এসব জানি।”
আমি মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। জ্যোৎস্নায় ভরা। ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দূরে খাজানবাবুর পুকুরের চারপাশে উঁচু করা জমির ওপর গাছ-গাছালি কালোতে, ঝাপসা। ক্রমশই একটা যবনিকার মতন হয়ে আসছিল ও-দিকটা।
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আমি বললাম, ”তা হলে কি তুমি বলতে চাইছ শরদিন্দু, ওই শ্মশান পাগলটা ঠিক কথাই বলে গেল?”
মাথা নাড়ল শরদিন্দু। বলল, ”না, তা আমি বলতে চাইছি না। আমি একটু ভীতু ধাতের মানুষ। পাগল কী বলেছে, না বলেছে—বাদ দাও। স্বর্গ নরক কোনোটাই আমার জানা নেই। মর্তটা জানা আছে। যদি আমায় বলো, আমি বলব, ইহকালের পরিচয়ই মানুষের পরিচয়। স্বর্গে তার পরিচয় থাকে না। আর নরকে তার কী পরিচয় থাকে আমি জানি না। মনোময় মর্তজগতেই তার যা পরিচয় রেখে গেল—তার ছেলেমেয়েরা জানে, আর আমার মতন দু-একজন জানে। এ-বড় দুঃখের পরিচয়, দত্ত! মনোময় সে দুঃখ অন্তরে নিশ্চয়ই পেয়েছে। শেষ বয়েসেই পেয়েছে। তার আর নরকে গতি হয়ে কী লাভ।”
আমার চোখের সামনে কী ঘটছিল কে জানে! দৃষ্টির কোন গভীরে স্থলে-জলে একাকার এক শ্মশান ভূমি। জ্যোৎস্না প্লাবিত মাঠের কোন প্রান্তে যেন এক শববাহকের দলকে দেখতে পাচ্ছিলাম। গুনগুন শব্দ করে তারা চলে যাচ্ছে। হরিধ্বনি দিচ্ছে? রাম নাম সাত হায় বলছে? নাকি বলছিল; হায়রে হায় হায় রে হায়!
আর আমি বুঝতে পারছিলাম না, কার শব ওরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে? মনোময়ের, শরদিন্দুর, না আমার!
(১৯৮৭)