নরকের রাজা

নরকের রাজা

[বাস্তব জগতে আমাদের সাধারণ চোখে যারা ধরা পড়ে, তারাই কেবল সত্য নয়। মানুষ যা কল্পনা করে তাকেও সত্য বলে গ্রহণ করা যেতে পারে— এমনকী সাধারণ চোখের সামনে তা মূর্তি ধরতে পারে। অবশ্য বৈজ্ঞানিকরা এ-সব ব্যাপারকে ‘হিপনোটিজম’ বা সম্মোহন ও যোগনিদ্রা বলে উড়িয়ে দেন। আমেরিকার প্রসিদ্ধ পত্রিকা ‘Harper’s Magazine’-এ একটি আশ্চর্য ঘটনা প্রকাশিত হয়েছিল। হ্যারিসন ফর্ম্যান সাহেব ছিলেন একজন বিখ্যাত ভূ-পর্যটক। বিশেষ করে প্রাচ্যের নানা দেশে গিয়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন।

চিন-অধিকৃত পূর্ব-তুর্কিস্থানের মধ্য দিয়ে তিনি প্রবেশ করেছিলেন তিব্বতের ভিতরে। সেখানে বুড়ো সেরাপ নামে এক তিব্বতী জাদুকরের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। সাহেবের অত্যন্ত আগ্রহ দেখে সেরাপ তাঁকে ছদ্মবেশ পরিয়ে তিব্বতী জাদুকরদের এক সম্মিলনীতে নিয়ে যায়।

সেখানে গিয়ে ফর্ম্যান সাহেব যে আশ্চর্য দৃশ্য দেখেন, সেটা তাঁর নিজের জবানিতেই শ্রবণ করুন। ইতি— লেখক]

সে

 জায়গাটার নাম হচ্ছে রাডজা গোম্বার পবিত্র অরণ্য। পাহাড়ের ওপরে সেই বৃহৎ বন।

বুড়ো সেরাপ আমার পথপ্রদর্শক বটে, কিন্তু তার মুখ দেখেই বুঝলুম, সে রীতিমতো ভয় পেয়েছে।

বন-বাদাড় ভেঙে আমরা যখন একটা ফর্সা জায়গায় এসে পড়লুম, সূর্য তখন আস্তে নেমে যাচ্ছে। সেইখানে মণ্ডলাকারে বসে আছে একদল জাদুকর। সংখ্যায় তারা বিশজন।

আমিও বিনাবাক্যব্যয়ে তাদের পাশে গিয়ে বসে পড়লুম। তারা আমার দিকে একবার চোখ তুলে তাকালে মাত্র, মুখে কিছু বললে না। তারা আমার ছদ্মবেশ ধরতে পারলে না দেখে বুড়ো সেরাপ আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলে।

ঠিক পাশের লোকটির দিকে চেয়ে দেখলুম। সে যেমন নোংরা তার মুখখানাও তেমনি কুৎসিত। তার মাথায় রয়েছে অতিরিক্ত লম্বা সাপের মতন পাকানো পাকানো কালো চুলের গোছা। তার কয়লার মতো কালো চোখ দুটো তাকিয়ে আছে যেন শূন্যতার দিকে। তার ভাবভঙ্গি সমাধিগ্রস্তের মতো।

এদের ধর্ম হচ্ছে অপদেবতা বা প্রেতাত্মার সাধনা। উপাসনার দ্বারা এরা প্রেতাত্মাদের শান্ত রাখার চেষ্টা করে।

গাছের পাতায় পাতায় শিহরন তুলে জেগে উঠল সন্ধ্যার বাতাস, যেন জানিয়ে দিলে আসছে সেই ভয়াবহরা—আসছে। কিন্তু আমার অবিশ্বাসী মন বললে, মিছেই তোমরা এখানে বসে আছ, আসবে না কেউ, আসবে না!

ওধারের জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক দীর্ঘ মূর্তি। ভাবভঙ্গি তার ভারিক্কি। সে হচ্ছে এই জাদুকরদের দলপতি, নাম দ্রুক সিম।

সে মস্ত একখানা পাথরের উপরে উঠে আসনপিঁড়ি হয়ে বসল। মৌন তার মুখ, মর্মভেদী তার দৃষ্টি। তার হাতে রয়েছে মানুষের ঊরুর একখানা হাড়, আর এক হাতে মড়ার মাথার খুলি।

কিছুক্ষণ কারুর মুখেই কথা নেই। নীরবতার মধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার বেশি ঘন হতে লাগল ক্রমে ক্রমে।

আচম্বিতে যেন কার মৌন ইঙ্গিতেই জাদুকরেরা একসঙ্গে সামনে আর পিছনে দুলতে দুলতে তিনবার বললে, ‘যমন্তক! যমন্তক! যমন্তক!’

এদের নরকের রাজার নাম যম, এরা তাকেই আহ্বান করছে!

তারপরেই দলপতি ঊরুর সেই ফাঁপা হাড়ে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিলে এবং সেই বিচিত্র ভেঁপু থেকে একটা ধ্বনি জেগে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল ছায়াচ্ছন্ন অরণ্যের উদ্দেশে। ডান হাতের মড়ার খুলি মুখে তুলে ঢক ঢক করে কী পান করলে। শুনলুম, মানুষের রক্ত! আগে এরা নাকি মানুষের মাংস আহার করত। তার অভাব পূরণ করে এখন মানুষের তাজা রক্ত।

আবার জাগল সেই আহ্বান স্বর—‘যমন্তক! যমন্তক! যমন্তক!’

প্রত্যেক জাদুকরের মুখ নত। আমিও দেখাদেখি মুখ নামালুম বটে, কিন্তু আড়চোখে দৃষ্টিকে রাখলুম সজাগ! আমার সঙ্গে কোনোরকম ছলচাতুরী চলবে না। ভূত-প্রেত, দৈত্যি-দানো, শয়তান, যম এ-সব কিছুই মানি না, তাদের চোখে দেখা যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না। আমি যা দেখব, বৈজ্ঞানিকের চোখ দিয়েই দেখব।

আবার বাজল অস্থি ভেঁপু, আবার জাগল আহ্বানধ্বনি—‘যমন্তক! যমন্তক! যমন্তক!’

দ্রুত এবং দ্রুততর হয়ে উঠল আহ্বানধ্বনি, তাদের সঙ্গে দুলতে দুলতে আমিও দিলুম যোগ!

এবং একটা কী-যেন আমার ভিতর প্রবেশ করলে—সঞ্চারিত হয়ে আমার রক্তের মধ্যে। জানি না, সেটা কি, কিন্তু তাকে অনুভব করলাম। তখন আমার মনে হল কোনো অসম্ভবই আর অসম্ভব নয়! এ কী কাণ্ড! আমি কি ‘হিপনোটিজিমে’র দ্বারা অভিভূত হচ্ছি? মনে হতেই আমার ইচ্ছাশক্তিকে আবার সতর্ক করে তুললুম।

তারা সকলে তখন একসঙ্গে একঘেয়ে মৃদু কান্নার মতো স্বরে বিড় বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করছে! এই যদি হিপনোটিজিম হয়, বহুত আচ্ছা! আমি এর দ্বারা বশীভূত হব না!

কিন্তু আমি কেমন চঞ্চল হয়ে উঠলাম। কেমন যেন ধোঁকা লাগছে! ওই অরণ্যের মধ্যে যেন কীসের আবির্ভাব হয়েছে! যেন কোনো অদৃশ্য হস্ত আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই আমাকে ধারণ করতে চায়! আমার বৈজ্ঞানিক মন এর কারণ খুঁজতে লাগল।

এইবারে জাদুকররা ডাইনে-বাঁয়ে হেলতে-দুলতে আরম্ভ করলে।

—‘যমন্তক! যমন্তক! যমন্তক!’

এখানে কার আবির্ভাব সম্ভাবনায় আমরা বসে আছি, বুড়ো সেরাপ সেকথা আগেই আমাকে বলে রেখেছে। এখানে আসবে স্বয়ং যমরাজা এবং তার অনুচর তাল-বেতাল ও অপদেবতারা! যেখানে তাদের মূর্তি ধরবার কথা সেইখানে চোখ চালিয়ে আমি দেখবার চেষ্টা করলুম যাকে দেখা যায় না—যাকে দেখা অসম্ভব!

কিন্তু—কিন্তু! কাকে যেন দেখা যায় যায়, যায় না। ও কে? একটু একটু করে আবির্ভূত হচ্ছে এবং পরমুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে?…এইবারে সত্য সত্যই তার আকার পূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল!

জাদুকররাও তাকে দেখলে। তাদের একটানা সুরেলা আবৃত্তিও হয়ে পড়ে কেমন যেন বন্য!

না, না, স্বপ্ন নয়—অপচ্ছায়াও নয়! ওই তো রয়েছে জাদুকররা, ওই তো রয়েছে ওদের দলপতি! ওই তো রয়েছে আমার পাশে বসে বুড়ো সেরাপ! আমি ওদের সকলকার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! ওই তো রয়েছে আমার চারদিকে ঝাউ আর সরল গাছের সার! ওই তো শুনছি সকলে ডাকছে—‘যমন্তক! যমন্তক! যমন্তক!’

প্রথমেই নজরে পড়ল তার ফোলা ফোলা, জ্বলজ্বলে চোখ দুটো! মাটির উপরে মানুষের মাথা সমান উঁচু থেকে হিংস্র দৃষ্টিতে চোখ দুটো তাকিয়ে আছে আমাদের পানে! চোখ দুটোর এপাশে-ওপাশে রয়েছে ধোঁয়া-ধোঁয়া কুয়াশার মতন কী! ক্রমে সেই ধোঁয়া জমাট হয়ে আকার ধরছে—হঠাৎ ফুটছে যেন প্রেতপুষ্পের কুঁড়ি!

কী মূর্তি! চৌত্রিশ হাতে ধরে আছে চৌত্রিশ রকম মারাত্মক অস্ত্র! এবার প্রথম মুণ্ডের এপাশ-ওপাশে গজিয়ে উঠল আরও আট আটটা মুণ্ড! সব মুখের উপরেই রয়েছে নীল অগ্নিশিখার স্বচ্ছ আবরণ—শিখাগুলো কাঁপছে আর নাচছে অশ্রান্ত ভাবে! দুই কাঁধ বেড়ে ঝুলছে নরমুণ্ডমালা—পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করে শোনাচ্ছে তার বিষম হাড়ের বাজনা!

গায়ে আমার কম্প দিলে। তাড়াতাড়ি অন্যদিকে মুখ ফেরালুম।…খানিক পরে ভাবলুম, সেই মূর্তিমান বীভৎসতা হয়তো এতক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কিন্তু আবার ফিরে দেখি, এবারে দেখা যাচ্ছে কেবল সেই ফোলাফোলা জ্বলন্ত চোখ নয়—অতি বিশ্রী পুরু পুরু ওষ্ঠাধরও! ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে পড়েছে যে করাল দাঁতগুলো, পৃথিবীর কোনো হিংস্র পশুরই সে-রকম ভয়াবহ দাঁত নেই।

কিন্তু যম থেকে তো কেবল আবির্ভাব শুরু। যমের পরে একে একে দেখা দিলে তার বহু সাঙ্গোপাঙ্গ। ওই দেখছি লালসাদানবকে, দেহ তার হিলবিলে। সে আবার ধেই ধেই করে নাচতে লাগল। কুৎসিত নাচ। তার পরেই বুভুক্ষাদৈত্য, চামড়ার তলা থেকে তার রোগা দেহের হাড়গুলো বেরিয়ে পড়েছে। দেখা দিলে ক্রোধপিশাচ, প্রচণ্ড রাগের চোটে তার মুখখানা মোচড়ের পর মোচড় খাচ্ছে। পরে পরে মূর্তি ধরলে আরও কত দৈত্য-দানব।

এই ভয়ংকর আবির্ভাবের পালা শেষ হলে পর যম নিজেই আরম্ভ করলে এক বুকদমানো মহা তাণ্ডবনৃত্য। সে নাচ দেখতে দেখতে প্রাণ যেন মূর্ছিত হয়ে পড়তে চায়। তার প্রত্যেক ভাবভঙ্গি ও মুণ্ডমালার হাড়ঠকঠকানির মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে যেন নিখিল মানবের দুঃখ দুর্ভাগ্য নিয়ে নিষ্ঠুর ব্যঙ্গকৌতুক! আমার নাকে আসতে লাগল যেন গলিত মৃত্যুর দুর্গন্ধ!

একটা কথা ভেবে বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল। আমার নিজের কাছে আমি যেমন সত্য, এই যম ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও তো আজ আমার দৃষ্টির সামনে তেমনি সত্য হয়ে উঠেছে! কিন্তু যারা ওদের বাস্তব জগতে ডেকে এনে নিরেট দেহ লাভের সুযোগ দিয়েছে, সেই জাদুকররাই যদি এখন ওদের আর সামলাতে না পারে? ওরা যদি একবার ছাড়ান পায় তাহলে সারা দেশ যে যাবে রসাতলে! কী ভয়ানক!

আমার মনে হল, জাদুকরদেরও মনে জেগেছে এই সম্ভাবনাই! দানবরা তাদের অদৃশ্য বন্ধন ছিঁড়ে ফেলবার চেষ্টা করছে বুঝে জাদুকরেরাও নিজেদের ইচ্ছাশক্তি প্রবলতর করে তুললে। আমিও নিজেই বিদ্রোহী আত্মাকে দাঁড় করালুম তাদের বিরুদ্ধে! আরম্ভ হল যেন দানবে-মানবে এক নতুন যুদ্ধ! আমি নিজের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা ভুলে গিয়ে এতক্ষণে হয়ে পড়লুম যেন জাদুকরদেরই একজন এবং এই মূর্তিমান অমঙ্গলগুলোকে পৃথিবী থেকে বিদায় করবার জন্য নিযুক্ত হলুম প্রাণপণ চেষ্টায়!…পারব? না হারব? মনে মনে এই প্রশ্ন করছি আর কেটে যাচ্ছে যেন যুগের পর যুগ! আমাদের চেষ্টা বুঝি ব্যর্থ হয়!

অবশেষে! হ্যাঁ যমের ভীষণ মূর্তি অস্পষ্ট হচ্ছে, ক্রমে আরও—আরও অস্পষ্ট! তারপর একেবারে অদৃশ্য! দেখতে দেখতে একে একে যমের অনুচররাও যেন একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিদায় নিতে বাধ্য হল। এখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত আছি কেবল আমি আর জাদুকররা।

তখন আমার কারুর দিকে তাকাবার শক্তি নেই। বুক কাঁপছে, সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে গেছে। বাহ্যজ্ঞানহারা হয়ে কেবল ভাবছি আর ভাবছি—আমি কী দেখলুম? দুঃস্বপ্ন? না উদ্ভট সত্য?…

ইতিমধ্যে কখন জাদুকররা গাত্রোত্থান করে চলে গিয়েছে বনের ভিতরে, চোখের আড়ালে।

বুড়ো সেরাপের কথায় আমার সাড় হল। রহস্যপূর্ণ স্বরে সে জিজ্ঞাসা করছে, ‘যা দেখলেন এখন কি আপনি বিশ্বাস করেন?’

বললুম, ‘জানি না বন্ধু। বোধ হচ্ছে আজ আমি যম আর তার অনুচরদের স্বচক্ষে দেখলুম। কিন্তু কাল আমি কি বিশ্বাস করব আর করব না, সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই নেই।’

আজ পর্যন্ত সে-দৃশ্য ভুলতে পারিনি। তিব্বতের সেই পর্বতরাজ্যে, সেই পবিত্র অরণ্যে, সেই সান্ধ্য আলো-আঁধারির মধ্যে সত্য সত্যই এমন কোন রহস্যের আবির্ভাব ঘটেছিল, যার অর্থ এখনও আমার কাছে ধরা পড়েনি! বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না, কিন্তু বিশ্বাস না করেও উপায় কি?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *