নখরাঘাত

নখরাঘাত

শাল-মহুয়ার এ অরণ্যভূমি বাংলায় না হলেও পাশের রাজ্যের এ অঞ্চলে এক সময়, অর্থাৎ ষাট-সত্তর বছর আগেও বহু বাঙালি, বিশেষত পয়সাওয়ালা বাঙালির আনাগোনা ছিল। তারা কেউ কেউ আসতেন প্রকৃতির মনোরম পরিবেশে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য, আবার কেউ কেউ বা আসতেন শিকারের জন্য। সে সময় বাঘেরও দেখা মিলত এ তল্লাটে। বাঘ যা ছিল তা কবেই সাফ করে দিয়েছিল সাদা চামড়া আর তাদের দোসর কালো চামড়ার দেশি সাহেবরা। এ দেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন তৈরি করতে স্বাধীনতার পর প্রায় পঁচিশ বছর লেগে যায়, বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হয়। আইন দেরিতে হলেও সে কারণেই হয়তো বা বাঘ না হলেও বেশ কিছু বন্যপ্রাণী এখনও এ অঞ্চলে টিকে আছে। নেকড়ে, হায়না, ভাল্লুকের মতো কিছু প্রাণী। এছাড়া হরিণ আর বন্য শূকর। তাই বর্তমানে এ বনাঞ্চল সংরক্ষিত বনাঞ্চল, আর এখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা অফিসও আছে। কাঁটাতার ঘেরা টিনের চালের অফিসের সঙ্গেই ছোটো স্টাফ কোয়ার্টার, আর অফিসের পিছন দিকে জলে ঘেরা একটা খোঁয়াড়ের মতো দেখতে ঘর আছে। কোনো সময় ছোটোখাটো বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে আনা হলে সেখানে রাখা হয়। তারপর তাদের শুশ্রূষা করে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয় অথবা রাঁচির চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন দপ্তরের এই ছোটো অফিসটাতে কৌস্তভ ছাড়া কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র তিনজন। তাদের একজন পিয়ন, আর দুজন ফরেস্ট গার্ড। কৌস্তভ অবশ্য মাত্র এক সপ্তাহ হল এই অফিসের দায়িত্ব নিয়ে এখানে এসেছে। তার অধস্তন পিয়ন আর বনরক্ষীরা অবশ্য বেশ কয়েকবছর ধরেই এখানে কাজ করছে।

সকাল আটটা নাগাদ হাজারিবাগ শহর থেকে একাই কৌস্তভের অফিসে হাজির হয়েছেন তার ওপরঅলা মিশ্র সাহেব। লোকে তাকে ডাকে ‘মিশিরজী’ নামে। মাঝবয়সি, শক্তপোক্ত চেহারার লোক। দীর্ঘদিন বন বিভাগে আছেন মিশিরজী। ধৃতিমানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা অর্থাৎ ডিএফও সাহেবের পরই এই মিশিরজীর স্থান। তিনি এখানে এসেছেন এ অফিসে নব নিযুক্ত অধস্তন অফিসার কৌস্তভকে কিছু সরকারি কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে আর অফিসটা পরিদর্শন করতে।

কাগজপত্র কৌস্তভকে বুঝিয়ে দিতে অবশ্য তার ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগল না। কৌস্তভ সে কাজ মিটলে মিশিরজীকে বলল, ‘আজকের দিনটা আমার এখানে থেকে যান স্যার। এখানকার দেশি মোরগের স্বাদ যে অন্য জায়গার থেকে বেশি তাতো আপনি আমার থেকে ভালো জানেন। এছাড়া অন্য সব ব্যবস্থাও ফাগুয়া করে রেখেছে।

অন্য সব ব্যবস্থার অর্থ হল বিলাতি মদ বা হুইস্কি। মিশির সাহেব এর আগেও বহুবার এসেছেন এখানে। তাঁর সুরাপানের অভ্যাসের কথা পিয়ন ফাগুয়া জানে। বড়োকর্তারা যখন শহর থেকে অফিস পরিদর্শনে আসেন তখন তাদের পান-ভোজন করানোর রীতি বহু দিনের। তাই কৌস্তভের অনুমতিক্রমে গতকাল শহর থেকে সে সব জোগাড় করে এনে রেখেছে ফাগুয়া।

এখন বর্ষার মরশুম। ট্যুরিস্ট বা বাইরের লোকেদের জন্য ফরেস্ট বন্ধ থাকে এ সময়। ডিপার্টমেন্টে কাজের চাপও তুলনামূলকভাবে কম থাকে। অধস্তন অফিসারের প্রস্তাব শুনে তাই হয়তো একটু ভেবে নিয়ে মিশিরজী বললেন, ‘আপনি যখন চাইছেন এখন এখানে একদিন থাকা যেতেই পারে। তা ছাড়া একটা কাজও করার আছে এখানে।’

কৌস্তভ তাকে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, ‘কী কাজ স্যার?’ কিন্তু তার আগেই তিনি ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ফরেস্ট গার্ড বুদ্ধু সিংকে বললেন, ‘তোমার বাড়ি তো লছমীপুর গ্রামে তাই না?’

এই জঙ্গল অঞ্চলে জঙ্গল ঘেরা ছোটো ছোটো আদিবাসী গ্রাম আছে। লছমীপুর তারই একটা। যদিও কৌস্তভের এখনও এখানকার এ জায়গাগুলো ঘুরে দেখার সুযোগ হয়নি।

মিশিরজীর কথা শুনে বুদ্ধু সিং জবাব দিল, ‘জী সাহেব।’

মিশিরজী তার জবাব শুনে তাকে বললেন, ‘ওখানকার হাটে একটা মেয়ে ভাল্লুকের খেলা দেখায়, তা তুমি জানো? কথাটা তুমি তোমাদের নতুন সাহেবকে জানিয়েছ?’

কোন ধরনের বন্যপ্রাণী নিয়ে খেলা দেখানো বা তাদের পোষা বর্তমানে আইনত নিষিদ্ধ। যদিও এখনও এসব অঞ্চলে কোথাও কোথাও বাঁদর বা ভাল্লুকের খেলা দেখানো হয়। কৌস্তভের খবরটা দেয়নি বুদ্ধু সিং। কাজেই প্রশ্ন শুনে সে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

বুদ্ধু সিং-এর জবাব শুনে মিশিরজী একটু উষ্মা প্রকাশ করে বুদ্ধু সিংকে বললেন, ‘আমি হাজারিবাগ শহরে বসে খবরটা পেয়েছি আর তুমি তোমার গ্রামের খবর জানোনা তা হতে পারে না। আমি এও খবর পেয়েছি যে ওই মেয়েটা তার ভাল্লুকটাকে নিয়ে ওখানেই কাছাকাছি কোনো একটা জায়গাতেই থাকে। আসলে তোমার গ্রামের ব্যাপার বলেই তুমি খবরটা তোমার সাহেবকে জানাওনি।’

মিশিরজীর কথা শুনে এবার ব্যাপারটা স্বীকার করে নিয়ে বুদ্ধু সিং বলল, ‘জী সাব, ওই মেয়েটার নাম, ছামিয়া। গ্রামের কাছেই জঙ্গলের ধারে একটা কুঁড়েতে জন্তুটাকে নিয়ে থাকে।’

মিশিরজী এরপর কৌস্তভের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি যখন আমাকে এখানে আজ থাকতেই বললেন, তখন দিনটাকে কাজে লাগানো যাক। চলুন বেরব। ওই ভাল্লুকটাকে রেসকিউ করে আনতে হবে।’

বড়ো কর্তার নির্দেশ শুনে কৌস্তভ বলল, ‘আচ্ছা স্যার, আমি ব্যবস্থা করছি।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিস থেকে কৌস্তভরা বেরিয়ে পড়ল দুটো গাড়ি নিয়ে। মিশিরজীর গাড়িতে তিনি, কৌস্তভ আর পথ প্রদর্শক বুদ্ধু সিং আর একটা গাড়ি নিয়ে আর একজন ফরেস্ট গার্ড রামদেও। দ্বিতীয় গাড়িটা দেখতে অনেকটা ছোটো ম্যাটাডোর গাড়ির মতো। গাড়ির পিছনে একটা বড়ো লোহার খাঁচা রয়েছে। ওটা রেসকিউ ভ্যান। অর্থাৎ ওই গাড়িতে করে বন্য প্রাণী উদ্ধার করে আনা হয়। ফরেস্ট অফিস থেকে বেরিয়ে বন পথ ধরল কৌস্তভরা। বর্ষা শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হল। এই মুহূর্তে বৃষ্টি না থাকলেও সূর্যের আলোতে ঝলমল করছে বৃষ্টি ধোয়া শাল গাছের বড়ো বড়ো পাতাগুলো। প্রচুর মহুয়া গাছও আছে এ বনে। তাদের গাড়িগুলো কাছ থেকে ভালো করে লক্ষ্য করলে অনেক সময় গাছের গুঁড়ির গায়ে লম্বা লম্বা দাগ দেখা যায়। ভাল্লুকের নখ ঘসার দাগ। কৌস্তভ আর মিশিরজী নানা কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললেন। মিশিরজী এ সব অঞ্চলে কাজের সূত্রে বহু ঘুরেছেন। অভিজ্ঞতা প্রচুর। এখানকার কোনো জঙ্গলের কি বিশেষত্ব এসব ব্যাপারেই তিনি বলতে লাগলেন নবাগত কৌস্তভকে। তাদের যাত্রা পথে বেশ বড়ো একটা ধনেশ পাখি চোখে পড়ল কৌস্তভদের। তাদের দেখে পাখিটা কর্কশ ডাক ছেড়ে গাছের মাথা থেকে অন্যত্র উড়ে গেল। মিশিরজী, কৌস্তভকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘এই ধনেশ পাখির ব্যাপারটা খেয়াল রাখবেন। অনেক সময় স্থানীয় মানুষরা গাছের মাথায় জাল পেতে রাখে ধনেশ পাখি ধরার জন্য। ওর চর্বি দিয়ে ওরা বাতের ওষুধ বানায়।

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলার পর জঙ্গল ঘেরা একটা ছোটো গ্রাম চোখে পড়ল। বুদ্ধু সিং জানাল এটাই লছমীপুর। প্রথমে সে গ্রামে প্রবেশ করল তারা। আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম। ছোটো ছোটো বাড়ি, মাথায় শালপাতার ছাউনি। জঙ্গল অঞ্চলের অন্য গরিব গ্রামগুলোর মতো এ গ্রামের মানুষরাও বনের পাতা-কাঠ-মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। গাড়ি দুটো গ্রামে প্রবেশ করতেই একদল বাচ্চা ছেলে উৎসাহিত হয়ে তাদের পিছু নিল। ঘরগুলোর সামনে যে সব নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে তাদের চোখেও কৌতূহলী দৃষ্টি। হুড খোলা জিপে বসে থাকা বুদ্ধু সিং-যে একটু অস্বস্তিতে পড়েছে তা তার মুখ দেখে কৌস্তভ অনুমান করতে পারল। গ্রামের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে তারা গ্রামের পিছনে উপস্থিত হল। সামনেই জঙ্গল। বুদ্ধু সিং সেই জঙ্গলের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে স্যার, ছামিয়ার কুঁড়ে।’

শাল গাছের জঙ্গলের ভিতর কিছুটা দূরে একটা কুঁড়ে দেখা যাচ্ছে। গাড়ি আর যাবে না। তাই জঙ্গলের মুখেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল সবাই। রামদেও নামল কাঁধে বন্দুক আর নাইলেনের জাল নিয়ে। যদিও যে প্রাণীটাকে তারা উদ্ধার করতে যাচ্ছে সেটা পোষমানা প্রাণী। বন্দুক বা জালের দরকার পড়বে না বলেই কৌস্তভের অনুমান। তারা যখন জঙ্গলে প্রবেশ করল তখনই সূর্যের আলো হঠাৎ যেন কেমন ম্লান হয়ে এল। আকাশে আবার মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। কৌস্তভের অনুসরণ করল সেই বাচ্চা ছেলের দল ও গ্রামের কয়েকজন।

কুঁড়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। গাছের ডালের বেড়ার ঘর। মাথার ওপর শালপাতার ছাউনি। দরজাটা একটু ফাঁকা করা আছে। বুদ্ধু সিং সেই দরজার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে হাঁক দিল—’ছামিয়া? হেই ছামিয়া?’

কোনো জবাব এল না ঘরের ভিতর থেকে। বার কয়েক হাঁকের পর যখন কোনো সাড়া মিলল না তখন বুদ্ধু সিং উপস্থিত ছেলের দল আর লোকগুলোকে বলল, ‘ছামিয়া কোথায় জানিস তোরা? এই যে ফরেস্টের বড়ো সাহেবরা এসেছে ওদের খুঁজতে।’

বুদ্ধু সিং-এর কথায় কোনো জবাব দিল না। কৌস্তভের মনে হল কোনো কিছু যে ঘটতে চলেছে তা অনুমান করেই হয়তো বা ছামিয়ার খোঁজ দিতে নারাজ গ্রামবাসীরা। মিশিরজী, বুদ্ধুকে বললেন, ‘ঘরের ভিতর একবার উঁকি মেরে দেখ। হয়তো বা ও ঘরের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে।’

বড়ো সাহেবের কথা শুনে বুদ্ধু দরজার দিকে এগোতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ভিতর থেকে ঠেলা খেয়ে দরজার পাল্লাটা খুলে গেল। আর দরজার বাইরে বেরিয়ে এত লোকজন দেখে থমকে দাঁড়াল বেশ বড়ো মিশমিশে কালো রঙের একটা পুরুষ ভাল্লুক! প্রাণীটার গলাতে দড়ি বাঁধা আছে। অর্থাৎ প্রাণীটা বন্য নয়, পোষা। এই সেই প্রাণী, যাকে নিয়ে ছামিয়া খেলা দেখায়। প্রাণীটা দেখা দিতেই কয়েকটা বাচ্চা ছেলে বলে উঠল—’সুলতান! সুলতান!’

কৌস্তভ বুঝতে পারল প্রাণীটার নাম সুলতান। প্রাণীটার ভঙ্গি দেখে তাকে নিরীহ বলেই মনে হল কৌস্তভের। ঘরের বাইরে এত লোক দেখে বেশ হকচকিয়ে গেছে সে। চারপাশে তাকাচ্ছে। খোলা দরজা দিয়ে ঘরের ভিতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভিতরে শোবার জন্য একটা বাঁশের মাচা, কিছু কাপড় আর কয়েকটা মাটির হাড়ি-কলসি ছাড়া ঘরে কিছু নেই। ছামিয়া নামের মেয়েটা বা অন্য কেউ সে কুঁড়ের ভিতর নেই।

বুদ্ধু সিং এবার জানতে চাইল, ‘এবার কী করবেন সাহেব?’

মিশিরজী জবাব দিলেন, ‘কী আবার? প্রাণীটাকে গাড়িতে ওঠাতে হবে।’

বুদ্ধু বলল, ‘কিন্তু ছামিয়াতো নেই।’

মিশিরজী বললেন, ‘সে নেইতো কি হয়েছে? এটা কি ওর সম্পত্তি? ওকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে ওর জেল হবে বন্যপ্রাণী আটকে রাখার অপরাধে। তার জন্য অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন নেই।’

বড়ো সাহেবের মতামত শুনে কৌস্তভ, বুদ্ধু আর রামদেওকে বলল, ‘প্রাণীটাকে নিরীহ বলেই মনে হচ্ছে। আক্রমণ করতে পারে বলে মনে হচ্ছে না। গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে চলার চেষ্টা কর।’

তার নির্দেশ শুনে রামদেও একটা দড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল প্রাণীটার দিকে। তার আগে তার হাত থেকে বন্দুকটা নিলেন মিশিরজী। কোনো অঘটন ঘটলে যাতে তিনি রামদেওকে রক্ষা করতে পারেন সে জন্য। রামদেও জন্তুটার কাছে গিয়ে প্রথমে সাহসে ভর করে তার পিঠে হাত রাখল। পোষা প্রাণী মানুষের সাহচর্যে পালিত। তাই সে আপত্তি করল না, শুধু কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল রামদেওর দিকে। এর কিছু সময়ের মধ্যেই প্রাণীটার শরীরে হাত বোলাতে বোলাতে রামদেও কৌশলে দড়িটা বেঁধে ফেলল ভাল্লুকের গলায় বাঁধা দড়িটার সাথে। হাসি ফুটে উঠল কৌস্তভ আর মিশিরজীর মুখে। মিশিরজী ইশারা করলেন গাড়ির দিকে এগোবার জন্য। প্রাণীটা বাঁধা দিল না। রামদেওর দড়ির টানে পোষা কুকুরের মতো হাঁটতে শুরু করল তার পিছনে। তাদের সঙ্গেই এগোল কৌস্তভরা আর কৌতূহলী জনতা। রেসকিউ ভ্যানের কাছে পৌঁছে গেল সবাই। বুদ্ধু সিং ভ্যানে উঠে একটা কাঠের পাটাতন নীচে নামিয়ে দিল। রামদেও সেই পাটাতন বেয়ে গাড়িতে উঠে প্রাণীটাকে ওপরে তোলার চেষ্টা শুরু করল। এবার অবশ্য প্রথমে আপত্তি করল প্রাণীটা। পাটাতনের মুখে দাঁড়িয়ে পড়ে শব্দ করতে করতে চারপাশের লোকেদের দিকে তাকাতে লাগল। হয়তো বা সে তার মালকিনকে খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাকে ওপরে তুলে খাঁচায় ভরে ফেলল রামদেও। ব্যাস কাজ শেষ। এরপরই ভাল্লুকটাকে নিয়ে কৌস্তভরা ফেরার জন্য রওনা হয়ে গেল। বৃষ্টিও শুরু হল ঠিক সেই সময়। ফেরার পথে একটু বেশি সময় লাগল তাদের। পথে জঙ্গলের মধ্যে যে নালাগুলো আছে সেগুলো প্লাবিত হতে শুরু করেছে বৃষ্টিতে। ধীরে গাড়ি নিয়ে ফিরতে হল তাদের। তারা যখন দুপুর বেলা ফরেস্ট অফিসে ফিরল তখনও নাগাড়ে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। ভাল্লুকটাকে খাঁচা থেকে নামিয়ে নিয়ে পোরা হল অফিসের পিছনে জালে ঘেরা খোঁয়াড়ের মতো জায়গাটাতে। ফাগুয়া ইতিমধ্যেই স্টাফ কোয়ার্টারে সব থেকে বড়ো ঘরটা গুছিয়ে ফেলেছে মিশির সাহেবের থাকার জন্য। সে ঘরে যাবার আগে তিনি কৌস্তভকে বললেন, ‘হেড অফিসে টেলিফোন করে জানিয়ে দিন একটা ভাল্লুক উদ্ধার করেছেন আপনি। তবে ইনফরমেশনটা যে আমারই ছিল এবং আমি যে আপনার সঙ্গে ছিলাম এ কথা বলার দরকার নেই। নতুন কাজে জয়েন করেছেন আপনি, তাই আমি চাই এ কাজের ক্রেডিটটা আপনি একলাই পান। এতে ডিপার্টমেন্টের গুড বুকে নাম থাকবে আপনার।’

কৌস্তভ এ কথা শুনে একটু লজ্জাবোধ করলেও বেশ খুশিও হল মিশিরজীর উদার মানসিকতার পরিচয় পেয়ে।

একটানা ভারী বৃষ্টি চলল বিকাল পর্যন্ত। যাকে বলে অঝোরে বর্ষণ। তারপর বৃষ্টির রেশ একটু কমলেও ফোঁটাফোঁটা, ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েই চলল। সূর্য ডুবল এক সময়। কৌস্তভ নিজের ঘরেই বসে ছিল। মিশিরজী দুপুরবেলা কৌস্তভকে সঙ্গে নিয়েই দেশি মুরগি সহযোগে ভূরিভোগ সাঙ্গ করে ঘুম দিয়েছিলেন। কৌস্তভেরও ঘরের বাইরে বেরোবার আর প্রয়োজন হয়নি। সন্ধ্যা নামার কিছুক্ষণ পরে ফাগুয়া এসে কৌস্তভকে বলল, ‘বড়ো সাহেব আপনাকে ডাকছেন।’

টিনের চালঅলা বারান্দার গায়ে কৌস্তভের ঘরের একটা ঘর পরেই মিশিরজীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাঁর ডাক শুনে কৌস্তভ মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তার ঘরে গিয়ে হাজির হল। এখানে ইলেক্ট্রিসিটির তেজ কম। ঘরের ঠিক মাঝখানে মাথার ওপর থেকে নেমে আসা ঝুলন্ত বাতির নীচে টেবিলের সামনে বসে ছিলেন মিশিরজী। টেবিলের ওপর মদের বোতল, জল, গ্লাস, মাছ ভাজা ইত্যাদি রাখা। অর্থাৎ বড়ো সাহেবের পানাহারের আয়োজন ফাগুয়া সম্পন্ন করে ফেলেছে। মিশিরজীর চোখের ইশারাতে তাঁর মুখোমুখি টেবিলের অন্যপাশে একটা চেয়ারে বসল কৌস্তভ।

মিশিরজী টেবিলে রাখা হুইস্কির বোতলটা দেখিয়ে বললেন, ‘আপনার চলে? লজ্জা পাবার কোনো দরকার নেই। আর সব সময় অফিস ডেকোরমের প্রয়োজন নেই।’

কৌস্তভ হেসে বলল, ‘না স্যার, আমার সত্যিই চলে না। দু-চারবার ট্রাই করে দেখেছি। কিছুতেই সহ্য হয় না, বমি হয়ে যায়।’

জবাব শুনে মিশিরজী বললেন, ‘ঠিক আছে আমি আপনাকে জোর করব না। তবে এটা আমার পুরানো অভ্যাস। ডিপার্টমেন্টের অনেকেই জানে।’

এ কথা বলার পর নিজেই বোতল খুলে গ্লাসে ঢেলে একটা পেগ বানিয়ে তাতে বেশ আয়েস করে একটা চুমুক দিয়ে তিনি কৌস্তভকে বললেন, ‘যাক, এখানে এসে একটা কাজ হল। ভাল্লুকটাকে রেসকিউ করা গেল। হেড অফিসে খবরটা জানিয়েছেন তো?’

কৌস্তভ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, জানিয়েছি। ওরা বলল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে দিন তিনেক পরে প্রাণীটাকে নিয়ে যাবে।’

গ্লাসে চুমুক দিয়ে মিশিরজী বললেন, ‘ওটা এ বনের ভাল্লুক বলেই মনে হয়। প্রাণীটা বেশ শান্ত প্রকৃতিরই। নইলে অমনভাবে এত সহজে গাড়িতে তোলা যেত না। আমার মনে হয় ভাল্লুকটাকে দু-তিন দিন আপনার এখানে রাখতে সমস্যা হবে না।’

কৌস্তভ বলল, হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। প্রাণীটার নখগুলো বেশ বড়ো। রামদেও যখন ওর গলাতে দড়ি পরাল তখন ও বাঁধা দিলে সমস্যা হত।’

মিশিরজী বললেন, ‘এখানকার বনে যে প্রজাতির ভাল্লুকের দেখা মেলে তাদের নখ বড়ো হয়। ওই দেখেই অনুমান করলাম প্রাণীটা এ জঙ্গলেরই।

এ কথা বলে তিনি তাঁর বাঁ হাতের তর্জনীটা কৌস্তভের সামনে উঁচিয়ে ধরে মজা করে বললেন, ‘এই দেখুন আমারও অমন নখ আছে। বন্য প্রাণীদের নিয়ে কাজ করি তো, তাই ওদের মতো নখ রেখেছি শখ করে।’

কৌস্তভ ব্যাপারটা আগে খেয়াল করেনি। সে এবার দেখল মিশিরজীর তর্জনীর নখটা সত্যিই বেশ বড়ো। ভাল্লুকের নখের মতো বড়ো না হলেও বাঁকানো নখটা অন্তত ইঞ্চি দেড়েক হবে। আর নখের প্রান্ত ভাগটা বেশ তীক্ষ্ন। ভাল্লুকের প্রসঙ্গ ছেড়ে এরপর অন্য নানা কথায় চলে গেলেন তিনি। বনকে কেন্দ্র করে তাঁর চাকরি জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তিনি বলতে লাগলেন কৌস্তভকে। আর তার সাথে এগিয়ে চলল সময় আর মিশিরজীর মদ্যপান। ঘণ্টাখানেক কথাবার্তা চলার পর হঠাৎ বাইরে একটা নারী কণ্ঠের আওয়াজ শুনে মিশিরজীর অনুমতি নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল কৌস্তভ। বারান্দায় ওঠার মুখে সিঁড়ির কাছটাতে এক কম বয়সি আদিবাসী যুবতীর সাথে কথা বলছে বুদ্ধু সিং। কৌস্তভকে দেখতে পেয়েই বুদ্ধুকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বারান্দায় উঠে কৌস্তভের সামনে এসে দাঁড়াল সেই রমণী। মেয়েটার বয়স মনে হয় পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। পরনে একটা ভেজা শাড়ি জড়ানো। বৃষ্টি তখনও পুরোপুরি থামেনি। জল ঝরছে মেয়েটার চুল আর উন্মুক্ত কাঁধ বেয়ে। কৌস্তভকে সে বলল, ‘বাবু, আমি ছামিয়া। তোরা আমার সুলতানকে নিয়ে এসেছিস কেন?’

কৌস্তভ জবাব দিল, ‘জংলি প্রাণী ধরা, পোষা নিষিদ্ধ, তাই। ভাল্লুক রাখার নিয়ম নেই, তাই।’

মেয়েটা বলল, ‘আমিও তো জংলি। ওকে নিয়ে জঙ্গলেই থাকি। আমার ঘরতো তোরা দেখেছিস। জঙ্গলের মধ্যে ঘর। আমি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।’

কৌস্তভ বলল, ‘ওকে আর ফেরানো যাবে না। এটা সরকারি ব্যাপার। সরকারি আইন বলে কেউ জংলি প্রাণী নিয়ে খেলা দেখাতে পারবে না।’

এ কথার জবাবে মেয়েটা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই পেছনের ঘরের ভিতর থেকে মিশিরজীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘ওকে আমার কাছে নিয়ে আসুন।’ কৌস্তভ আর আদিবাসী নারীর কণ্ঠস্বর ভিতর থেকে শুনতে পেয়েছেন তিনি।

কৌস্তভ মেয়েটাকে বলল, ‘ঘরে চল, বড়ো সাহেব তোমাকে ডাকছেন।’

ছামিয়া, কৌস্তভের সাথে ঘরে প্রবেশ করে মিশিরজীর টেবিলের কাছে দাঁড়াল। তাকে একবার ভালো করে দেখার পর মিশিরজী তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘ওই ভাল্লুকটা তুমি কীভাবে জোগাড় করেছিলে?’

সে প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে ছামিয়া বলল, ‘ফরেস্টবাবু তুই ওকে ছেড়ে দে। আমি নিয়ে যাই।’

মিশিরসাহেব বললেন, ‘ওকে আর তুমি নিয়ে যেতে পারবে না। জানো, তোমাকে যদি আমি পুলিশে দিই তবে ভাল্লুক পোষার অপরাধে তোমার জেল হতে পারে?’

ছামিয়া বলল, ‘তবে তাই কর ফরেস্টবাবু। হয় সুলতানকে আমার কাছে দে, নইলে আমাকেও খাঁচাতে ভর, জেলে পাঠা। জেলে দুজন একসাথে থাকব।’

তিনি বললেন, জেলে গেলে তুমি একলা যাবে। ভাল্লুকটাকে রাঁচির চিড়িয়াখানাতে পাঠানো হবে।’

ছামিয়া এবার এ কথা শুনে স্পষ্টতই আঁতকে উঠে বলল, ‘ওকে তোরা চিড়িয়াঘরে পাঠাবি! এ কাজ করিস না বাবুরা। সুলতানকে আমায় দিয়ে দে। আমি চলে যাই।’

মিশিরজী এবার তার কণ্ঠে কাঠিন্য ফুটিয়ে বললেন, ‘ভাল্লুকটা দেওয়া যাবে না। ও চিড়িয়াঘর যাবে।’

মেয়েটা এবার কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, ‘ওকে তোরা দিয়ে দে।’

মিশিরজী কোনো কথা না বলে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। হঠাৎ কৌস্তভের যেন মনে হল আবছা একটা হাসি যেন ফুটে উঠেছে মিশির সাহেবের ঠোঁটের কোণে! তিনি কি উপভোগ করছেন এই আদিবাসী রমণীর করুণ অবস্থা? আর এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মিশির সাহেবের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠার কারণটা কৌস্তভ অনুমান করতে পারল। অন্তর্বাসহীন আদিবাসী যুবতীর ভেজা কাপড়টা এমনভাবে তার বুকে লেপটে আছে যে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার সুডৌল স্তন আর তীক্ষ্ন স্তন বৃন্ত।

মাঝবয়সি বনকর্তা যে আদিবাসী রমণীর স্তনের প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন তা কৌস্তভের বুঝতে অসুবিধা হল না। ছামিয়া এক সময় বলে উঠল, ‘ওকে ছেড়েদে বাবু। তার জন্য যা করতে বলবি করব।’

মিশিরজী ছামিয়ার শরীরের দিকে চোখ রেখেই নিঃশব্দে হাতে ধরা গ্লাসটা শেষ করলেন। তার ঠোঁটের হাসিটা কৌস্তভের এবার যেন আরও স্পষ্ট বলে মনে হল। হুইস্কির বোতলটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। টিনের চালের ওপর ঝম ঝম শব্দে আবার প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। মিশিরজীর এরপর হঠাৎ যেন খেয়াল হল যে তিনি যে ছামিয়ার বুকের দিকে তাকিয়ে আছেন, কৌস্তভ তা বুঝতে পারছে। মুহূর্তের জন্য মৃদু অপ্রস্তুত ভাব ফুটে উঠল তাঁর মুখে। তিনি কৌস্তভের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে আপনি এবার ঘরে যান, আমি মেয়েটাকে বুঝিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছি। আর, রাতে খাবার দেবার দরকার নেই। প্লেটে যা খাবার আছে তাই যথেষ্ট। আর কাল সকালে ব্রেকফাস্ট করেই কিন্তু আমি রওনা হব।’

মিশিরজীর এ কথার পর আর সে ঘরে থাকা যায় না। ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোল কৌস্তভ। বারান্দার শেষ প্রান্তে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল ফাগুয়া আর বুদ্ধু। মিশিরজী যে রাতে খাবেন না তা ফাগুয়াকে জানিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। বাইরে ঝম ঝম শব্দে অঝোরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। সময় এগিয়ে চলল।

রাত ন-টা নাগাদ ঘরের বাইরে বেরোল কৌস্তভ। নিজের খাবার দেবার কথা বলতে হবে ফাগুয়াকে। মিশিরজীর ঘরেও একবার যেতে হবে তাঁর কোনো প্রয়োজন আছে কিনা তা জানার জন্য। বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে ফাগুয়া বা অন্য কাউকে সে দেখতে পেল না। হয়তো তারা কিচেনে আছে। বারান্দার কোণের ঘরটা কিচেন, সেদিকে এগোতে যাচ্ছিল কৌস্তভ। ঠিক সে সময় মিশিরজীর ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল ছামিয়া! তাকে দেখে কৌস্তভ বেশ অবাক হয়ে গেল। এতক্ষণ মিশিরজীর ঘরে ছিল সে! কৌস্তভের সামনে এসে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল ছামিয়া। সে মৃদু মৃদু টলছে। কৌস্তভের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি ছুঁড়ে দিল সে। তারপর বারান্দা থেকে নীচে নেমে প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে বাইরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

মাঝরাত পর্যন্ত হবার পর বৃষ্টি থামল। জঙ্গলের দিক থেকে ভেসে আসা ময়ূরের ডাকে কৌস্তভের যখন ঘুম ভাঙল তখন ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। পাছে মিশিরজী বিরক্ত হন তাই গত রাতে আর তার ঘরে যায়নি কৌস্তভ। সকাল ছ’টা। মিশিরজী ফিরে যাবেন, তাই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে কৌস্তভ। দরজা খুলতেই সে দেখতে পেল ফাগুয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকে জানালো বড়ো সাহেব ভোর পাঁচটাতেই উঠে পড়েছেন, ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন। একটু পরেই তিনি বেরোবেন।

মিশিরজীর জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল কৌস্তভ। তিনি ফিরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে বেরলেন কিছুক্ষণ পর। তাকে বিদায় জানাবার জন্য কৌস্তভের সাথে তিন বনকর্মীও প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে। কৌস্তভের সাথে সুপ্রভাত বিনিময়ের পর, তিনি তাকে বললেন, ‘আপনার আতিথ্যে ভালোই কাটল কালকের দিনটা। আবার আসব আমি যখন সময় পাব। আপনার কোনো অসুবিধা হলে আমাকে সরাসরি ফোন করবেন। আমি আছি আপনার পাশে।’

কৌস্তভ বলল, ‘হ্যাঁ, আবার আসবেন স্যার। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’

মিশিরজীকে তার গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবার জন্য তার সাথেই বারান্দা ছেড়ে নামল সবাই। কম্পাউন্ডের যেদিকে মিশির সাহেবের গাড়ি রাখা আছে, সেদিকে এগোতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে তিনি বললেন, ‘যাবার আগে একবার ভাল্লুকটাকে দেখে যাই।’

তাঁর কথা শুনে সবাই তাঁকে নিয়ে উপস্থিত হল কম্পাউন্ডের পিছনে খোঁয়াড়টার সামনে, জালে ঘেরা খোঁয়াড়টার তালা নেই। একটা শক্ত কাঠের খিল দিয়ে বাইরে থেকে সেটা ভালোভাবে আটকানো। কালো ভাল্লুকটা ঘরটার এক কোণে বসেছিল। কৌস্তভরা জালের বাইরে গিয়ে দাঁড়াতেই সে উঠে দাঁড়াল। সবার দিকে তাকাতে তাকাতে প্রাণীটার দৃষ্টি গিয়ে থামল মিশিরজীর ওপর। তাকেই যেন এক দৃষ্টিতে দেখছে সে। মিশিরজীও কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল তাঁর। তিনি এরপর বললেন, ‘ভাল্লুকটার বয়স বেশি নয়, যুবক ভাল্লুক। চিড়িয়াখানাতে ওকে দেখে লোকজনের ভালো লাগবে। চলুন এবার ফিরব।’

কথাগুলো বলে মিশিরজী সবে পিছু ফিরেছেন, ঠিক সেই সময় ভাল্লুকটা হঠাৎ প্রচণ্ড গর্জন করে যেন মিশিরজীকেই লক্ষ করে জালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল! জাল ছিঁড়ে ফেলার জন্য তার বড়ো বড়ো নখ দিয়ে জালের ওপর আঁচড়াতে থাকল! ব্যাপারটাতে চমকে গেল সবাই। খর খর শব্দ তুলে নখ আর দাঁত দিয়ে জাল ছেঁড়ার চেষ্টা করছে প্রাণীটা। মিশিরজী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আটকে থাকার কারণে প্রাণীটার মনে হয় মেজাজ বিগড়েছে। দু-দিন আটকে থাকলেই খাঁচায় থাকার অভ্যাস মানিয়ে নেবে।’

সে জায়গা ছেড়ে এরপর অফিসের সামনের দিকে ফিরে এল সবাই। মিশিরজী, কৌস্তভের থেকে বিদায় নিয়ে কম্পাউন্ড ছেড়ে জিপ চালিয়ে রওনা হয়ে গেলেন হাজারিবাগের দিকে।

তিনি চলে যাবার পর বুদ্ধু সিং কৌস্তভকে বলল, ‘আজতো শনিবার। আমি গ্রামে যাব। কাল সকালেই আবার ফিরে আসব।’

সপ্তাহে একদিন ছুটি পায় কৌস্তভের কর্মচারীরা। বুদ্ধু সিং আর ফাগুয়া স্থানীয় লোক। তারা বাড়ি ফিরে যায়। ফেরার সময় বাজার-হাটও আনে অনেক সময়। রামদেও অবশ্য কোয়ার্টারেই থাকে। বুদ্ধু সিং-এর কথা শুনে কৌস্তভ বলল, ‘ঠিক আছে যেও। যাবার সময় টাকা নিয়ে যেও, ডিম কিনে এনো গ্রাম থেকে।’

কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে গেল কৌস্তভ।

ঘণ্টাখানেক পর কৌস্তভের তখন ব্রেকফাস্ট সার হয়ে গেছে, বেলা আটটা নাগাদ সে ঘরের বাইরে থেকে বুদ্ধু সিং-এর গলা শুনল—’স্যার, আমি এবার রওনা হব।’

ডিম কেনার টাকা নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল কৌস্তভ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুদ্ধু। বারান্দার নীচে রাখা তার মোটর সাইকেল। কৌস্তভ তার হাতে টাকাটা দেবার সময় দেখতে পেল কম্পাউন্ডের গেট ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করছে ছামিয়া নামের মেয়েটা! তাকে দেখে বেশ আশ্চর্য হয়ে বুদ্ধু সিং-কে নিয়ে বারান্দাতে নেমে দাঁড়াল কৌস্তভ। বেশ খুশি মনেই এগিয়ে আসছে মেয়েটা। সকালের আলোতে ঝলমল করছে তার মুখ, কৃষ্ণকায়া আদিবাসী যুবতীর উদ্ভিন্ন যৌবন। সে এসে দাঁড়াল কৌস্তভের সামনে। তার দিকে তাকিয়ে ছামিয়া হেসে বলল, ‘দে বাবু, আমার সুলতানকে এবার নিয়ে যাই।’

কৌস্তভ বলল, ‘সুলতানকে নিয়ে যাই মানে?’

ছামিয়া বলল, ‘হ্যাঁ, কাল রাতে বড়ো ফরেস্টবাবু আমাকে বলেছিলেন আজ সকালে সুলতানকে ছেড়ে দেবে। তাই আমি তাকে নিতে এসেছি।’

কৌস্তভ বলল, ‘ওই ফরেস্টবাবু চলে গেছেন। তিনি আমাকে ভাল্লুকটা তোমাকে দেবার জন্য কিছু বলেননি। তিনি কথাটা তোমাকে বলতে পারেন না। কারণ, ব্যাপারটা বেআইনি। ভাল্লুকটা চিড়িয়াখানায় পাঠানো হবে।’

কথাটা শুনে মুহূর্তের মধ্যে ছামিয়ার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। সে চেয়ে রইল কৌস্তভের দিকে। কৌস্তভও তাকিয়ে তার দিকে। এবার হঠাৎই কৌস্তভের চোখে একটা ব্যাপার ধরা দিল। ছামিয়ার গলাতে, কাঁধে সূর্যালোকে জেগে আছে লম্বা লম্বা দাগ! যেগুলোকে দেখে নখরাঘাত বলেই মনে হয়! কার নখ? ওর ভাল্লুকের নাকি? কিন্তু ও চিহ্ন তো ছামিয়ার শরীরে গত রাতে খেয়াল করেনি কৌস্তভ! দাগগুলো টাটকা বলেই মনে হয়! আর এরপরই কেন জানি না কৌস্তভের হঠাৎ মনে পড়ে গেল গত রাতে ছামিয়ার টলতে টলতে মিশিরজীর ঘর থেকে বেরোনোর দৃশ্যটা আর মিশিরজীর আঙুলের সেই বাঁকানো নখটার কথা! চমকে উঠল কৌস্তভ।

ছামিয়া শেষবারের মতো প্রশ্ন করল, ‘ওকে তোরা দিবি না? আমি যে ওকে ছাড়া বাঁচব না।’

মেয়েটা যে তার ভাল্লুকটাকে খুব ভালোবাসে তা বুঝতে অসুবিধা হল না কৌস্তভের। কিন্তু মিশিরজী তাকে তেমন কোনো নির্দেশ দেননি। দু-তিনদিনের মধ্যেই চিড়িয়াখানার লোকেরা ভাল্লুকটাকে নিতে আসবে। সরকারি নিয়মে কৌস্তভের হাত-পা বাঁধা। তাই সে কণ্ঠে কাঠিন্য ফুটিয়ে বলল, ‘ভাল্লুকটাকে ফেরত দেওয়া যাবে না। তুমি চলে যাও।’

কৌস্তভের কঠিন কণ্ঠে বলা কথাটা শুনে একটা আর্তনাদ করে উঠল ছামিয়া। রামদেও উপস্থিত হয়েছে এখানে। কৌস্তভের কথা শুনে সেও মেয়েটার উদ্দেশ্যে কর্কশভাবে বলল, ‘যাও, ভাগো হিয়াসে। সাহেবকো তাং মত কর।’

বন্দুকধারী ফরেস্ট গার্ড রামদেওর ধমক শুনে এবার হতাশায় বিবর্ণ হয়ে গেল ছামিয়ার মুখ। গলায় নখের আঁচড়ের জায়গাটাতে এবার সে হাত বুলিয়ে পিছন ফিরল। কৌস্তভ খেয়াল করল তার উন্মুক্ত পিঠেও জেগে আছে নখরাঘাতের চিহ্ন! মেয়েটা আর দাঁড়াল না, এক ছুটে কম্পাউন্ড ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

সে চলে যাবার পর বুদ্ধু সিং কৌস্তভকে বলল, ‘ছামিয়ার গলায়, কাঁধে দাগগুলো দেখলেন সাহেব? নখের দাগ। আমি সামান্য ফরেস্ট গার্ড, তবু বলি, বড় সাহেব কিন্তু কাজটা ভালো করেননি।’

তার কথা শুনে কি জবাব দেবে তা কৌস্তভ বুঝে উঠতে পারল না। আর কোনো কথা না বলে বুদ্ধু সিং তার মোটর সাইকেল নিয়ে রওনা হল তার গ্রামে ফেরার জন্য। গত রাতে এই আদিবাসী রমণীর সাথে কী ঘটেছে তা আর কৌস্তভের বুঝতে বাকি নেই। একরাশ বিস্ময় আর মন খারাপ নিয়ে বারান্দায় উঠে নিজের ঘরে ঢুকল কৌস্তভ। একটা ভয়ও কাজ করতে শুরু করল তার মনে। বড়ো সাহেব ঘটনাটা ঘটালেও তার অফিসে ব্যাপারটা ঘটেছে। মেয়েটা আবার গ্রামের লোকজন জুটিয়ে এনে কোনো কাণ্ড ঘটাবে নাতো? অস্থির ভাবে ঘরের মধ্যে সে পায়চারী করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ফাগুয়া এসে দাঁড়াল তার ঘরের সামনে। তাকে দেখে উৎকণ্ঠিতভাবে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কৌস্তভ। ফাগুয়া ইতিমধ্যে রামদেওর কাছ থেকে গতরাতের ব্যাপারটাও যে কোনোভাবে জেনেছে বা অনুমান করেছে। কৌস্তভের মুখে উত্তেজনার ভাব দেখে সে বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না সাহেব। এ সব ব্যাপার এখানে আকছার ঘটে। মেয়েটা কাউকে কিছু বললে সমাজে থাকতে পারবে না। আর তেমন যদি কিছু ঘটে তবে আমরা সামলে নেব ব্যাপারটা। ওই আদিবাসী গ্রামের লোকেরা ফরেস্টের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকে। ফরেস্টবাবুদের বিরুদ্ধে ওরা যেতে পারবে না।’

কৌস্তভ তার কথা শুনে একটু আশ্বস্ত হল। একটা কাজের কথা জানতে এসেছিল ফাগুয়া। সেটা জেনে এরপর সে ফিরে এল। তার কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও কৌস্তভের মনের মধ্যে ব্যাপারটা ঘুরপাক খেতে লাগল। এই আদিবাসী রমণীকে, তার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মিশিরজী তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি কিছু করে থাকেন তবে তা তিনি ভালো করেননি। ব্যাপারটা চূড়ান্ত অন্যায়। কিন্তু কৌস্তভের কিছুই হাত ছিল না এ ব্যাপারে। মেয়েটার জন্য ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল কৌস্তভের মন।

ছামিয়া চলে যাবার পর একঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেছে। হঠাৎই বাইরে একটা গাড়ির হর্ন শুনতে পেল কৌস্তভ। ঘরের বাইরে এসে বেশ অবাক হয়ে দেখল মিশিরজী তার হুড খোলা জিপটা নিয়ে আবার কম্পাউন্ডে প্রবেশ করেছেন। তাকে দেখে বিস্মিত কৌস্তভ তাড়াতাড়ি বারান্দা থেকে নীচে নেমে এল।

মিশিরজী গাড়ি থেকে নেমে বললেন, ‘আপনার এ জায়গা মনে হচ্ছে আমাকে ছাড়তে চাইছে না। হাজারিবাগে যাবার পথে দশ মাইল দূরে যে কাঠের সাঁকোটা আছে সেটা গত রাতে ভেঙে গেছে। রাস্তা বন্ধ। সাঁকো সারাইয়ের জন্য লোকজন এসেছে ঠিকই কিন্তু তারা যা বলছে তাতে রাস্তা, সাঁকো মেরামত হতে একদিন সময় লাগবে। কাল সকালের আগে ফেরা সম্ভব নয়। আজ রাতেও এখানে থাকব।’

কথাটা শুনে মিশিরজীর অধস্তন কর্মচারী কৌস্তভ বলল, ‘এত সৌভাগ্য স্যার। কোনো অসুবিধা হবে না।’

কথাটা শুনে তিনি বললেন, ‘বেশি কিছু করার দরকার নেই। শুধু একটা হুইস্কির বোতল হলেই হবে।’

কৌস্তভ বলল, ‘ফাগুয়া দুটো বোতল এনেছিল, তার একটা রয়ে গেছে। মুরগিও আছে।’

মিশিরজীকে নিয়ে কৌস্তভ এরপর বারান্দাতে উঠে আগের রাতে মিশিরজীর ঘরের দিকে এগোল।

তবে ছামিয়ার ব্যাপারটাতে তার মনে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। মিশিরজীকে তার ঘরে পৌঁছে দিয়ে কৌস্তভ তাকে বলেই ফেলল ব্যাপারটা। সে বলল—’ছামিয়া নামের মেয়েটা ঘণ্টাখানেক আগে এসেছিল ভাল্লুকটা ফেরত নিতে। সে বলেছিল আপনি নাকি ভাল্লুকটা ফেরত দেবেন বলেছিলেন। আমি দেইনি, তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছি।’

কথাটা শুনে মিশিরজী প্রথমে কয়েক মুহূর্ত কৌস্তভের দিকে তাকিয়ে থেকে যেন বোঝার চেষ্টা করলেন যে মেয়েটা তাকে গত রাতের ব্যাপারে কিছু জানিয়েছে কিনা? কৌস্তভকে ছামিয়া এ প্রসঙ্গে কিছু না বললেও ব্যাপারটা অনুমান করতে বাকি নেই। তবে ঘটনাটা নিয়ে তার বড়ো কর্তাকে প্রশ্ন করা সমীচীন নয় কৌস্তভের পক্ষে। তাই সে চুপ করে রইল। মিশিরজী এরপর অবশ্য কিছুটা ব্যাঙ্গের ছলে বললেন, ‘ভাল্লুকটা তাকে ফিরিয়ে দেব বলেছিলাম নাকি? তবে তো ফেরত না দিয়ে অন্যায় হল! যদিও একশো টাকা আমি তাকে দিয়েছি।’

কৌস্তভ আর এ প্রসঙ্গে তার সাথে কোনো কথা বলল না, মিশিরজী আর কী কী প্রয়োজন হতে পারে তা জেনে ঘরের বাইরে বেরিয়ে সে সম্বন্ধে ফাগুয়াকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিল।

দুপুর পর্যন্ত নিজের অফিস ঘরে বসে কাজ করতে করতে সময়টা নিস্তরঙ্গভাবেই কেটে গেল কৌস্তভের। মিশিরজী সেই যে এসে ঘরে ঢুকেছেন আর বাইরে বেরোননি। ছামিয়ার সাথে মিশিরজীর ব্যাপারটা নিয়ে কৌস্তভের মনের ভিতর উত্তেজনাটাও অনেকটা প্রশমিত হয়ে এল। এমনকি তার এও মনে হতে লাগল হয়তো তার অনুমান ভুল। ছামিয়ার গলায়, কাঁধে যে চিহ্নগুলোকে সে মিশিরজীর নখরাঘাত বলে ভাবছে আসলে তা অন্য কিছুর দাগ। তা ছাড়া মিশিরজী যদি ছামিয়ার সাথে গত রাতে কিছু ঘটিয়েই থাকেন তবে কি তিনি এমন নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন?’

বেলা একটা নাগাদ ফাগুয়া ডাকতে এল দুপুরের খাবারের জন্য। অফিস থেকে বেরিয়ে খাবার ঘরে ঢুকল কৌস্তভ। অফিসে খাবার ঘর বলে আসলে কিছু নেই। মিশিরজীর হেতু একটা ঘরকে টেবিল-চেয়ার দিয়ে সাজিয়ে খাবার ঘরে পরিণত করা হয়েছে। কৌস্তভ সে ঘরে পৌঁছোবার পর মিশিরজীকেও ডেকে আনল ফাগুয়া। মিশিরজীর চোখ-মুখে ফোলা ভাব লক্ষ্য করে কৌস্তভের মনে হল এতক্ষণ তিনি টানা ঘুম দিচ্ছিলেন। খেতে বসল তারা দুজন। খাবার টেবিলে মামুলি কিছু কথাবার্তা হল তাদের দুজনের মধ্যে। খাওয়া শেষে মিশিরজী ফিরে গেলেন নিজের ঘরে আর কৌস্তভও নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।

ঘণ্টাখানেক পর হঠাৎ একটা শব্দে কৌস্তভের ঘুম ভেঙে গেল। কোয়ার্টারের পিছন থেকে ভাল্লুকটা কেমন যেন এক অদ্ভুত করুণ সুরে ডাকছে! সেই শব্দতেই কৌস্তভের ঘুম ভাঙল। দুপুর তিনটে বাজে। বিছানাতে শুয়ে কিছুক্ষণ ডাকটা শোনার পর কেমন যেন অস্বস্তি লাগল কৌস্তভের। বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে রামদেওকে দেখে সে বলল, ‘ভাল্লুকটা এমন চিৎকার করছে কেন? যাও একবার গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসো।’

কৌস্তভের কথা শুনে প্রাণীটিকে দেখতে গেল রামদেও। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে জানাল, ‘ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। খোঁয়াড়ে ওর জল, খাবার সব দেওয়া আছে। তবে সেগুলো ও ছোঁয়নি। খোঁয়াড়ের ভিতর চারপাশে ও পাক খাচ্ছে। আর অমন শব্দ করছে, কাঁদছে প্রাণীটা।’

কৌস্তভের এ ব্যাপারে কিছু করার নেই। আবার ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে ভাল্লুকটার ভেসে আসা কান্না শুনতে লাগল সে। কখনো বা থেমে থেমে কেঁদে চলল প্রাণীটা। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল। তারপর এক সময় সন্ধ্যা নামতে শুরু করল। অন্ধকার নামতেই হয়তো ক্লান্ত হয়ে কান্না থামিয়ে দিল প্রাণীটা। অন্ধকারের সাথে সাথে একটা অপার নিস্তব্ধতা নেমে এল কম্পাউন্ডে। কৌস্তভ বিছানা ছেড়ে বাতি জ্বালাতেই ফাগুয়া চা নিয়ে ঘরে ঢুকে জানাল, ইতিমধ্যেই মিশিরসাব মুরগির রোস্ট আর বোতল নিয়ে বসে পড়েছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন গত রাতের মতো এদিন রাতেও খাবেন না। কোনো প্রয়োজন হলে তিনি নিজেই ডাক দেবেন।

ফাগুয়ার কাছে একথা শোনার পর তখন আর মিশিরজীর ঘরে যাওয়া সমীচীন বোধ করল না কৌস্তভ। সে ভাবল রাতে একবার তার সাথে গিয়ে সাক্ষাৎ করে আসবে। ফাগুয়া চা দিয়ে চলে যাবার পর একটা বই নিয়ে বসল কৌস্তভ। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি শুরু হল।

রাত ন-টা নাগাদ খাবার জন্য ডাক এল। বাইরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে আর তার বেগ ক্রমশ বাড়ছে। খাওয়া সেরে মিশিরজীর ঘরে তার যাবার ইচ্ছা থাকলেও খাবার ঘরে ঢুকে কৌস্তভ জানতে পারল মিশিরজী ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। সম্ভবত তিনি শুয়ে পড়েছেন। কাজেই খাওয়া সেরে সে ঘরে আর না গিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল কৌস্তভ। এরপর ঘণ্টাখানেক পড়ে বাতি নিভিয়ে সে শুয়ে পড়ল।

কিন্তু কৌস্তভের ঘুম এল না। মাথার ওপরে টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটার অবিশ্রান্ত শব্দ হয়ে চলেছে। ঘরের জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখা যাচ্ছে। কম্পাউন্ডে ঢোকার মুখে একটা লাইট পোস্টে হলদেটে একটা আলো জ্বলে। বৃষ্টির জন্য সেই কমজোরি আলোটা আজ আরও ম্লান, অস্পষ্ট লাগছে। খোলা জানলার বাইরে আধো অন্ধকার বৃষ্টিস্নাত অস্পষ্ট পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে কৌস্তভ নানা কথা ভাবতে লাগল। সেই যে সন্ধ্যাবেলাতে ভাল্লুকটা তার কান্না থামিয়েছে তারপর থেকে তার আর কোনো শব্দ নেই। রাত বেড়ে চলল।

বাইরের দিকেই তাকিয়ে ছিল কৌস্তভ। হঠাৎ যেন মনে হল সামনের বারান্দায় বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই যেন একটা ছায়ামূর্তি উঠে এল। তারপর চকিতে তার ঘরের সামনে দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। আর তারপরই একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল সে। কেউ যেন পাশের কোনো ঘরের দরজা ধাক্কাচ্ছে! সম্ভবত মিশিরজীর ঘরের দরজা! শব্দটা শুনে কৌস্তভ বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যাপারটা দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে এল। সে বেশ অবাক হয়ে গেল এরপর। মিশিরজীর ঘরের দরজা ধাক্কাচ্ছে সেই ছামিয়া! ভেজা শরীর বেয়ে জল ঝরছে তার। কৌস্তভ শুনতে পেল দরজা ধাক্কা দিতে দিতে ছামিয়া চাপা স্বরে বলছে—’বাবু দরজা খোল। আমি ছামিয়া, দরজা খোল?’

ছামিয়া নিশ্চয়ই কোনোভাবে জানতে পেরেছে যে মিশিরজী আবার ফিরে এসেছেন। তাই সে এত রাতে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তার ভাল্লুকটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য ছুটে এসেছে। এ কথা ভেবে কৌস্তভ ছামিয়ার সাথে কথা বলার জন্য এগোল তার দিকে। ছামিয়া তাকে খেয়াল করেনি। কিন্তু ছামিয়ার কাছে পৌঁছোবার আগেই সে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। কৌস্তভকে অবাক করে দিয়ে একটা হাত বেরিয়ে এসে ছামিয়ার কোমর ধরে তাকে টেনে নিল ঘরের ভিতর। হ্যাঁ, সেটা মিশিরজীরই হাত হবে। মুহূর্তর জন্য যেন সে হাতে সেই বড়ো নখটাও দেখতে পেল কৌস্তভ।

একটু ইতস্তত করে কৌস্তভ যখন পায় পায়ে এগিয়ে গিয়ে সেই ঘরের সামনে দাঁড়াল তখন ঘরের দরজা থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ দরজার ভিতর থেকে ছামিয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল কৌস্তভ— ‘ফরেস্টবাবু তোকে ফিরতে দেখে তোর সাথে রাত কাটাতে এলাম।’

জবাবে মিশিরজী বললেন, ‘ভালো করেছিস। কেউ দেখেনিতো তোকে?’

মেয়েটা জবাব দিল, ‘না, দেখেনি। সব ঘুমাচ্ছে। সে জন্যইতো এত রাতে এলাম।’

মিশিরজী আবারও কিছু একটা বললেন তাকে। কিন্তু ছামিয়ার হাসির আড়ালে সব কথা চাপা পড়ে গেল। কৌস্তভ অনুমান করল ব্যাপারটা। ছামিয়া তার ভাল্লুক ফিরে না পেলেও সম্ভবত টাকার লোভেই এমন চুপিসারে মিশিরজীর সাথে রাত কাটাতে এসেছে। মিশিরজীতো বলেইছেন যে গতরাতে তিনি মেয়েটাকে একশো টাকা দিয়েছেন। গরিব আদিবাসী রমণীর কাছে রাত পিছু একশো টাকা দাম কম নয়। কয়েক মুহূর্ত সেই বন্ধ দরজার সামনে কৌস্তভ দাঁড়িয়ে থাকার পর তার মনে হল এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে ঠিক নয়। বন্ধ দরজার ওপাশে যা ঘটছে বা ঘটতে চলেছে তা তো দুজনের সম্মতিতেই ঘটছে। এক্ষেত্রে কৌস্তভের কিবা করার আছে? এ কথা ভেবে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল কৌস্তভ। বৃষ্টি এবার প্রচণ্ড জোরে পড়তে শুরু করেছে। বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টির ছাট বারান্দাতেও প্রবেশ করছে। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল কৌস্তভ। শুধু মদ নয়, নারী শরীরের নেশাও যে মিশিরজী প্রবলভাবে আছে তা বুঝতে পারল সে। কৌস্তভ এখন নিশ্চিত যে ছামিয়ার শরীরের ক্ষতচিহ্নগুলো মিশিরজীর নখরাঘাত। গতরাতে কামস্রোতে মিশিরজীর বাঁ-হাতের ওই তীক্ষ্ন নখের আঘাতেই সৃষ্টি হয়েছে ছামিয়ার শরীরের ক্ষতচিহ্ন। ঝমঝমে বৃষ্টির শব্দর মধ্যে জেগে রইল কৌস্তভ।

বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল। এরপর তার হাই উঠল। এতক্ষণ পর তার চোখে ঘুম নামতে চলেছে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা শব্দ কানে এল তার। ভাল্লুকের ডাক! প্রথমে একবার সে ডাক শোনা গেল, তারপর কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে আবারও শোনা গেল ডাকটা। আর দ্বিতীয়বার যেই ডাকটা শুনল সে বুঝতে পারল ডাকটা বাড়ির পিছন দিয়ে নয় সামনের দিক থেকে আসছে। তবে কি ছামিয়া মিশিরজীর ঘরে ঢোকার আগে পিছন দিক দিয়ে খোঁয়াড়ের অর্গলটা খুলে দিয়ে ভাল্লুকটাকে মুক্ত করেছে। কৌস্তভের মনে পড়ল তার ঘর অতিক্রম করেই ছামিয়া মিশিরজীর ঘরে ঢুকেছিল। কেউ যদি খোয়ারের দিক থেকে এসে বারান্দায় ওঠে তবে কৌস্তভের ঘর পেরিয়েই তাকে মিশিরজীর ঘরের দিকে যেতে হবে। কথাটা মনে হতেই খাট ছেড়ে লাফিয়ে নেমে ঘরের বাইরে এল কৌস্তভ। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে। তার মধ্যেই সামনে তাকিয়ে কৌস্তভ দেখতে পেল, কম্পাউন্ড থেকে বাইরে বেরোনোর মুখে সেই ক্ষয়াটে লাইটপোস্টের আলোটা যেখানে জ্বলছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা ভাল্লুক! প্রাণীটা ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে বারান্দার দিকেই। কৌস্তভ চিনতে পারল ভাল্লুকটাকে। হ্যাঁ, ওটাই তাদের ধরে আনা ভাল্লুকটা। ওইতো তার গলায় বাঁধা দড়িটা দেখা যাচ্ছে।

কৌস্তভ বিস্মিতভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল প্রাণীটার দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে ডাকতে যাচ্ছিল রামদেওকে। কিন্তু রামদেও নিজেই বন্দুক হাতে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভাল্লুকের ডাক তারও কানে গেছে। সে কৌস্তভের পাশে এসে দাঁড়াতেই কৌস্তভ আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল ভাল্লুকটাকে। প্রাণীটাকে দেখে বিস্মিতভাবে রামদেও বলল, ‘খোঁয়াড়ের খিলটা কে খুলে দিল? বাইরে যাবার দরজাটাও যে খোলা দেখছি!’

একটু ইতস্ততভাবে কৌস্তভ প্রথমে জবাব দিল, ‘ছামিয়া নামের মেয়েটা মনে হয়।’

এ কথা বলার পর কৌস্তভ বলল, ‘দেখ, প্রাণীটাকে ধরা যায় কিনা?’

কৌস্তভের কথা শুনে বৃষ্টির মধ্যেই বারান্দা থেকে নীচে নেমে পড়ল রামদেও। কৌস্তভও উত্তেজিত হয়ে তার সাথেই বৃষ্টির মধ্যে নেমে পড়ল। আর তাদের নীচে নামতে দেখেই তাদের দেখে রক্তজল করা হিংস্র গর্জন করে উঠল ভাল্লুকটা। নখ দিয়ে প্রাণীটা মাটি আঁচড়াতে লাগল। তার চোখ দুটো যেন জ্বলছে।

ব্যাপারটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রামদেও। সে অভিজ্ঞ লোক। ভাল্লুকটার দিকে তাকিয়ে সে চাপা স্বরে কৌস্তভকে বলল, ‘প্রাণীটা ক্ষেপে গেছে স্যার। কাছে গেলেই আক্রমণ করবে। ওর নখগুলো বড়ো সাংঘাতিক।’

কৌস্তভ জিজ্ঞেস করল, ‘তবে কীভাবে আটকাবে ওকে?’

রামদেও বলল, ‘ওর পায়ে গুলি করব স্যার? তারপর সকালে জাল দিয়ে ধরে ওকে পশু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব।’

কৌস্তভ, রামদেওকে কি নির্দেশ দেবে তা ভেবে ওঠার আগেই ভাল্লুকটা আবারও একটা ডাক ছাড়ল। তারপর হিংস্রভাবে এক পা, এক পা করে এগিয়ে আসতে লাগল কৌস্তভদের দিকে। কৌস্তভের নির্দেশের অপেক্ষা না করেই এবার সম্ভবত আত্মস্বার্থেই রামদেও এবার তার বন্দুকটা উঁচিয়ে ধরল প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে। এগিয়ে আসছে হিংস্র প্রাণীটা!

রামদেও ভাল্লুকটার দিকে লক্ষ্য করে সম্ভবত গুলি চালাতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় কৌস্তভদের পিছনে মিশিরজী ঘরের দরজাটা হঠাৎ দড়াম করে খুলে গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে এল আরও একটা কালো ভাল্লুক। কৌস্তভরা ভালো করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বারান্দা থেকে সটান ঝাঁপ দিল রামদেওর ওপর। অত বড়ো প্রাণীটা তার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়াতে নিজের ভারসাম্য রাখতে পারল না রামদেও। ট্রিগারে চাপ লেগে প্রচণ্ড শব্দ তুলে আকাশের দিকে ছুটে গেল তার বন্দুকের গুলি। বন্দুকটা ছিটকে পড়ল তার হাত থেকে। রামদেও মাটিতে পড়ে গেল দ্বিতীয় ভাল্লুকটাকে নিয়ে। কিন্তু রামদেও মাটিতে পড়ে যাবার পর ভাল্লুকটা তাকে ছেড়ে দিয়ে লাফিয়ে ছুটল কম্পাউন্ড ছেড়ে বাইরে বেরোবার জন্য। প্রথম ভাল্লুকটা যেন এই প্রতীক্ষাতেই ছিল। সেই মুখ ফিরিয়ে ছুটল খোলা গেটের দিকে। রামদেও তার বন্দুক কুড়িয়ে নিয়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়াবার আগেই ভাল্লুক দুটো প্রবল বর্ষণের মধ্যে কম্পাউন্ডের গেট অতিক্রম করে বাইরে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল। রামদেও বন্দুক নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্মিত ভাবে বলল, ‘ওদের আর এখন ধরা যাবে না। কিন্তু দ্বিতীয় ভাল্লুকটা কোথা থেকে এল? জঙ্গল থেকে নাকি?’

পুরো ব্যাপারটাতে কৌস্তভও প্রচণ্ড বিস্মিত। সে জবাব দিল, ‘বড়ো সাহেবের ঘরের থেকে বেরোল বলেই মনে হল!’—এ কথাটা বলার পরই অজানা কোনো এক আশঙ্কাতে কৌস্তভের বুক কেঁপে উঠল। গুলির শব্দে ইতিমধ্যে ফাগুয়াও টর্চ হাতে তার ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছ। তাকে দেখে কৌস্তভ সংক্ষিপ্তভাবে তাকে ব্যাপারটা জানিয়ে বারান্দায় উঠে এগোল মিশিরজীর ঘরের দিকে। তার সঙ্গী হল রামদেও আর ফাগুয়া।

মিশিরজীর ঘরের খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তারা। ঘরের ভিতর জমাট বাঁধা অন্ধকার খেলা করছে। কৌস্তভও বার কয়েক ডাক দিল মিশিরজীকে। কিন্তু সাড়া মিলল না। কৌস্তভের ইশারাতে ফাগুয়া এরপর টর্চের আলো মেলে ধরল ঘরে। তারা দেখতে পেল ঘরের মাঝখানে চিত হয়ে পড়ে আছেন মিশিরজী। ব্যাপারটা দেখেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল তারা তিনজন। কিন্তু মিশিরজী কাছে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। শক্তিশালী টর্চের উজ্জ্বল আলোক বৃত্তের মাঝখানে পড়ে আছে মিশিরজীর নগ্ন দেহ। প্রচণ্ড আতঙ্কে যেন বিস্ফোরিত হয়ে আছে তার স্থির চোখদুটো। রক্তের স্রোত বইছে তার সারা শরীর বেয়ে। কেউ যেন তার শরীরটাকে চিরে ফালাফালা করেছে। নখরাঘাত! তবে মানুষের নয় ভাল্লুকের। যে ভাল্লুকটা এ ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল তারই নিশ্চয়ই কীর্তি হবে এটা। কৌস্তভেরা মিশিরজীর দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে বুঝতে পারল মিশিরজীর দেহে আর প্রাণ নেই। কৌস্তভের বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল প্রাথমিক বিস্ময় আর আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে উঠতে। তারপর সে বলল, ‘আমি ও ঘরে ছামিয়া নামে মেয়েটাকে ঢুকতে দেখেছিলাম। কিন্তু সে কই? চলতো দেখি সে বাড়ির পিছনের দিকে লুকিয়ে আছে কিনা? এমনও হতে পারে যে সেই খোঁয়ারের দরজাটা খুলেছে, আর দ্বিতীয় ভাল্লুকটা তার সাথেই এসেছিল।’

এ কথাটা বলে সে তাদের দুজনকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই ছুটল বাড়ির পিছনটাতে। খোঁয়ারটার কাছে পৌঁছে গেল তারা। খোয়ারের দরজাটা খোলা। নিশ্চয়ই মানুষেরই কাজ সেটা। কিন্তু সেখানে ছামিয়াকে পাওয়া গেল না। অগত্যা আবার বাড়ির সামনের অংশের বারান্দাতে ফিরে এল তারা তিনজন। কৌস্তভ তার সঙ্গীদের নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে নিল। এই প্রবল বর্ষণমুখর মধ্যরাতে তাদের এখন আর কিছু বলার নেই। সকালের জন্য অপেক্ষা করতে হবে তাদের। বুদ্ধুরও ভোরবেলাই ফিরে আসার কথা। ভোরের আলো ফুটলে বন দপ্তরের বড়ো অফিসে, থানা ইত্যাদি জায়গাতে ভাল্লুকের আক্রমণে মিশিরজীর মৃত্যুর খবরটা দিতে হবে। বারান্দায় বসেই তারা অপেক্ষা করতে লাগল রাত শেষ হবার জন্য। ঘরের মধ্যেও পড়ে রইল মিশিরজীর নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ। শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি ধরে এল।

সব রাতেরই যেমন শেষ থাকে তেমনই ওই ভয়ংকর রাতেরও শেষ হল এক সময়। পুব আকাশে ধীরে ধীরে সূর্যোদয় হল। পিছনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসতে লাগল বন মোরগের ডাক। ভালো করে ফোটার পর বারান্দায় নীচের জমিতে নেমে এল তারা। কৌস্তভরা গিয়ে দাঁড়াল গতরাতে ঠিক যেখানে তারা দাঁড়িয়ে ছিল, যেখানে ভাল্লুকটা রামদেওকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল সেখানে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ভেজা মাটিতে সেখানে তখনও জেগে আছে ভাল্লুকটার পদচিহ্ন। ছাপগুলো পরীক্ষা করে অভিজ্ঞ বনকর্মী রামদেও কৌস্তভকে বলল, ‘এ ছাপগুলো আকারে একটু ছোটো। মাদী ভাল্লুকের পায়ের ছাপ। আমার ওপর যেটা ঝাঁপিয়ে ছিল সেটা মাদী ভাল্লুক অর্থাৎ ভাল্লুকী।’

কৌস্তভ অনুমান করার চেষ্টা করতে লাগল পুরো ঘটনাটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই মোটর সাইকেলের শব্দ কানে এল তাদের। মোটর সাইকেল নিয়ে কম্পাউন্ডের ভেতর প্রবেশ করে কৌস্তভের সামনে এসে দাঁড়াল বুদ্ধু সিং। এবার কৌস্তভকে কাজ শুরু করতে হবে। বুদ্ধুর মোটর বাইক আছে। তাকে প্রথমে স্থানীয় থানাতে পাঠাতে হবে খবরটা জানাবার জন্য বুদ্ধু সিং বাইক থেকে নামার পর কৌস্তভ প্রথমে তাকে বলল, ‘তোমাকে এখনই থানাতে খবর দিতে যেতে হবে। কাল রাতে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। একটা মাদি ভাল্লুকের আক্রমণে ঘরের ভিতরই মিশিরজী মারা গেছেন। আর যে ভাল্লুকটা আনা হয়েছিল সেটা পালিয়েছে।’

কথাটা শুনে বুদ্ধু সিং অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু দ্বিতীয় ওই ভাল্লুকটা কোথা থেকে এল?’

কৌস্তভ উত্তর দিল, ‘কাল মাঝরাতে বৃষ্টির মধ্যে ওই ছামিয়া নামের মেয়েটা এখানে এসেছিল। আমি প্রথমে তাকে দেখতে পাইনি। ছামিয়াকেও আর পরে মিশিরজীর ঘরে পাওয়া যায়নি। পুলিশ এলে হয়তো বা ওই ভাল্লুক দুটোকেও তার সাথে পাওয়া যেতে পারে।’ দুটো ভাল্লুকই একসাথে পালিয়েছে।’

কৌস্তভের কথা শুনে বুদ্ধু সিং আরও যেন অবাক হয়ে বলল, ‘ছামিয়াকে কাল রাতে আপনি দেখেছেন! কিন্তু তাতো সম্ভব নয়!’

কৌস্তভ প্রশ্ন করল, ‘কেন? সম্ভব নয় কেন? আমি নিজের চোখে তাকে বারান্দাতে দেখেছি।’

বনকর্মী বুদ্ধু সিং কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমি তো গ্রাম থেকেই ফিরছি। কাল এখান থেকে গ্রামে ফিরে দুপুরবেলাতে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে ছামিয়া। আমি নিজে চোখে তার লাশ দেখেছি। নিজের শরীর বিলিয়েও ভাল্লুকটাকে ফেরত না পাবার কষ্ট মনে হয় সহ্য করতে পারেনি ছামিয়া।’

বুদ্ধুর কথা শুনে রামদেও বলে উঠল, ‘স্যার, কাল দুপুর থেকেই তো হঠাৎ কাঁদতে শুরু করেছিল খোঁয়াড় বন্দি ভাল্লুকটা!

কৌস্তভ হতভম্ব হয়ে গেল বুদ্ধু সিং-এর কথা শুনে। তার সামনে মাটিতে জেগে আছে ভাল্লুকটার পায়ের ছাপ। তার নখগুলো আঁকা হয়ে আছে মাটিতে। সে নখ মিশিরজীর নখরাঘাতের বদলা নিতে পালটা নখরাঘাত হেনেছে মিশিরজীর দেহে, ছিন্নভিন্ন করেছে মিশিরজীর শরীর! মুহূর্তের মধ্যে ব্যাপারটা যেন স্পষ্ট হয়ে গেল কৌস্তভের কাছে। তার চোখে ভেসে উঠল গতরাতের সেই দৃশ্য—প্রবল বর্ষণের মধ্যে কম্পাউন্ডের বাইরের অন্ধকারে ছুটতে ছুটতে মিলিয়ে যাচ্ছে ভাল্লুক আর ভাল্লুকী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *