বায়ান্ন
পনেরো দিন পর।
নিউ ইয়র্কের সন্ধ্যা। ব্যস্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে একটা সাদা সেডান। ড্রাইভ করছে রানা। পাশে বসে আছে লামিয়া। দু’সপ্তাহ আগেকার ক্লান্ত-অবসন্ন-আহত চেহারা বদলে গেছে ইতিমধ্যে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা আর বিশ্রাম পেয়ে দু’জনেই হয়ে উঠেছে প্রাণচঞ্চল।
অনেক কিছু ঘটে গেছে গত ক’দিনে। জাতিসংঘ আর আফ্রিকান ইউনিয়নের যৌথ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে সিয়েরা লিওনে, সেখানকার অস্থির পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্যে। প্রেসিডেন্ট আকুম্বার সহযোগীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মুক্তি দেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বন্দিদের, তাদের মধ্যে আছেন নিহত প্রেসিডেন্টের ভাই ড্যানিয়েল আকুম্বা। শান্তিরক্ষীদের সহায়তায় তিনি এখন সমমনাদের নিয়ে অস্থায়ী সরকার গঠন করেছেন।
অপহৃত বিজ্ঞানীদেরও উদ্ধার করা হয়েছে। সৌভাগ্যই বলতে হবে, কোয়াডাঙ্গলের অয়েল রিগগুলোয় ছিলেন না তাঁরা; কাজশেষে তাঁদেরকে ফ্রিটাউনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। মোটামুটি অক্ষত অবস্থাতেই পাওয়া গেছে সবাইকে… মারা গেছেন শুধু বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. ফারুক আহমেদ। উদ্ধার পাওয়া সব বিজ্ঞানীকে ইতিমধ্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে যার যার দেশে।
সৌভাগ্যজনক আরেকটা ব্যাপার হলো, শেষ মুহূর্তের ইমার্জেন্সি ঘোষণায় যে-বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল ওয়াশিংটন ডিসি-তে, তাতেও মারা যায়নি কেউ। বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে রাস্তায়, ছোটাছুটি করতে গিয়ে আহত হয়েছে মানুষ… কিন্তু মৃত্যুর ঘটনা নেই একটাও। এক হিসেবে ব্যাপারটাকে মিরাই বলতে হয়।
সবই সুসংবাদ, তবে যেটা রানা আর লামিয়াকে সবচেয়ে বেশি স্বস্তি দিচ্ছে, তা হলো, এনার্জি ওয়েপন হাতে পড়েনি কারও। নর্দার্ন স্টার এমন এক জায়গায় ডুবেছে, যেখান থেকে তুলে আনা অসম্ভব। সিয়েরা লিওন উপকূলের বিশাল সেটআপটাও ধ্বংস হয়ে গেছে মিসাইলের আঘাতে। অস্ত্রটা তৈরির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, মারা গেছে তারাও। ফলে আমেরিকা আর রাশা-সহ সবার কাছেই অধরা রয়ে গেছে প্রযুক্তিটা। এখন আবার ওই অস্ত্র তৈরি করতে চাইলে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে সব—ঢালতে হবে অঢেল টাকা, প্রয়োজন হবে নতুন বিশেষজ্ঞের, যারা এমন একটা প্রজেক্টে স্বেচ্ছায় যোগ দেবে। সহজ হবে না সেটা। বলা বাহুল্য, নর্দান স্টারকে ডুবিয়ে দেয়ায় তলে তলে অনেকেই নাখোশ হয়েছে ওদের ওপর, তবে সেটা প্রকাশ করছে না।
এসবের পরে বাকি রইল ডেভিল’স ডোরওয়ের বাইরে ডুবে থাকা লকহিড কনস্টেলেশন বিমানটার ভাগ্য। স্পেন আর পর্তুগালের বিবদমান এলাকায় পড়ে আছে ওটা। বিমানটা আমেরিকান, আবার ওটার ভেতরে রয়েছে রোমানভ পরিবারের ধনসম্পদ – যার বৈধ মালিক রাশা। দীর্ঘ আলোচনার পর চার পক্ষ একটা বোঝাপড়ায় এসেছে। সমস্ত ট্রেজার তুলে আনার পর চার দেশের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা হবে, সেগুলো প্রদর্শন করা হবে বিভিন্ন মিউজিয়ামে। স্যালভিজের কাজটা নুমাকে দিতে সম্মত হয়েছে সবাই, সঙ্গে থাকবে বাকি তিন দেশের প্রতিনিধিরা। নুমার তরফ থেকে রানা ও মুরল্যাণ্ডকে দেয়া হয়েছে প্রজেক্টের দায়িত্ব, রাশার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে লামিয়া। আগামীকালই অ্যাযোর্সের উদ্দেশে রওনা হবে ওরা। তবে তার আগে আরেকটা কাজ সেরে নিতে চায় রানা। নিউ ইয়র্কে এসেছে সেজন্যেই।
প্রাচীন নকশার একটা ব্রাউনস্টোনের বাড়ির সামনে পৌঁছে গাড়ি থামাল রানা। লামিয়াকে নিয়ে নেমে পড়ল। সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল সদর দরজার সামনে। পাশের ফলক থেকে দেখে নিল বাড়ির নম্বর।
‘এটাই,’ বলল ও।
মাথা ঝাঁকিয়ে কলিং বেলের সুইচ টিপল লামিয়া। ভেতরে টুং টাং আওয়াজ হলো। একটু পরেই খুলে গেল দরজা। নার্সের ইউনিফর্ম পরা মাঝবয়েসী এক মহিলাকে দেখা গেল।
‘ইয়েস?’
‘আমি মাসুদ রানা, আর ইনি ড. লামিয়া লিভানোভা,‘ নিজেদের পরিচয় দিল রানা।
‘আসুন,’ সরে পথ করে দিল নার্স। ‘উনি অপেক্ষা করছেন আপনাদের জন্যে।’
ভেতরে ঢুকল রানা ও লামিয়া। ওদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল নার্স।
‘কী অবস্থা ওঁর?’ জিজ্ঞেস করল রানা। ‘কথা বলা যাবে তো?’
‘যাবে,’ বলল নার্স। ‘বয়স হলেও ওঁর জ্ঞান-বুদ্ধি এখনও টনটনে।’
‘কত হলো বয়স? আমার হিসেবে একশোর কাছাকাছি হবার কথা।’
‘আটানব্বই চলছে। তবে দেখলে অতটা মনে হয় না। যথেষ্ট ফিট আছেন এখনও। শুধু হার্ট খানিকটা দুর্বল। লক্ষ রাখবেন, যেন উত্তেজিত হয়ে না পড়েন।’
‘অবশ্যই। উনি যে এখনও বেঁচে আছেন, এটাই তো আশ্চর্য।’
সিঁড়ি ধরে ওদেরকে দোতলায় নিয়ে গেল নার্স। বড় একটা দরজা খুলে ঢোকাল সুপরিসর এক বেডরুমে। জানালার কাছে আর্মচেয়ারে শরীর এলিয়ে বসে আছেন একজন সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ। ভদ্রলোকের কোলে মোটাসোটা একটা খোলা রই, বাঁ হাতে ধূমায়িত কফির কাপ। চেহারার মধ্যে অভিজাত, স্মার্ট একটা ভাব আছে। জানা না থাকলে বয়স অন্তত বিশ বছর কমিয়ে ধরত রানা, কারণ মুখে বলিরেখা ফুটে থাকলেও শতবর্ষী থুথুরে বুড়ো নন তিনি মোটেও। পায়ের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে তাকাতেই দেখা গেল গভীর দুটো চোখ, আর তাতে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। রানার মনে হলো, ওর অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে নিচ্ছেন।
‘মি. মার্লো, এঁরাই আপনার অতিথি,’ বলল নার্স।
টমাস মার্লোর সৌম্য চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘ওয়েলকাম, মি. রানা, ড. লিভানোভা। প্লিজ, বোসো।’
সামনেই দুটো চেয়ার পাতা আছে, তাতে বসল রানা ও লামিয়া।
‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘ইট’স্ অ্যান অনার।’
‘কথাটা তো আমি বলব,’ বললেন বৃদ্ধ। ‘আমি নগণ্য মানুষ। কিন্তু তোমরা তো বিশাল এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছ। খবর পেয়েছি আমি।’
‘সামান্য একটা ব্যাপার,’ বিব্রত গলায় বলল রানা। ‘বড় কিছু না।’
‘বিনয়? বেশ, বেশ, এসব তো আজকালকার মানুষের মধ্যে দেখাই যায় না। এনিওয়ে, যদি ভুল করে না থাকি, আয়রন লেডির ব্যাপারে কথা বলতে এসেছ তোমরা, রাইট?’
‘আয়রন লেডি!’ বিভ্রান্তি ফুটল লামিয়ার কণ্ঠে।
‘আমার বিমান,’ বললেন মার্লো। ‘আদর করে ওকে আয়রন লেডি বলে ডাকতাম। হারিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। শুনে ভাল লেগেছে যে, তোমরা ওকে আবার খুঁজে পেয়েছ।’
‘অ্যাযোর্সের কাছাকাছি পাওয়া গেছে বিমানটা, ডেভিল’স্ ডোরওয়ে নামে একটা জিওলজিক্যাল ফর্মেশনের পাশে,’ রানা বলল। ‘ওটাকে স্যালভিজ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সরকারিভাবে কোনও বাধা নেই, কিন্তু বিমানটার আসল মালিক যেহেতু আপনি, ভাবলাম আপনার অনুমতিটাও নেয়া উচিত। তা ছাড়া ওটা ওখানে গেল কী করে, সেটাও জানার ইচ্ছে।’
‘চাইবার আগেই অনুমতি পেয়ে গেছ। আর ওখানে পৌছুবার কথা যদি তোলো…’ উদাস হয়ে গেলেন বৃদ্ধ। ‘রাশান এক রিফিউজিকে ইয়োরোপ থেকে আমেরিকায় নিয়ে আসার দায়িত্ব পেয়েছিলাম আমরা।’
‘স্তেফান কিরিলভ, রাইট?’ বলে উঠল লামিয়া। ‘রিফিউজি না, আসলে একজন ক্রিমিনাল ছিল সে। রাশার জাতীয় সম্পদ চুরি করে পালাচ্ছিল।’
ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন বৃদ্ধ মার্লো। বললেন, ‘সেটা দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। এক পক্ষের চোখে যে অপরাধী, আরেক পক্ষের চোখে সে বিপ্লবীও হতে পারে। যা হোক, সারায়েভো থেকে তাকে তুলে নিই আমরা। চলে আসি সান্তা মারিয়ায়। ওখানে রিফিউয়েলিং সেরে আটলান্টিক পাড়ি দেবার প্ল্যান ছিল আমাদের। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাওয়ায় আটকা পড়ে যাই, গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কিছু রাশান এজেন্ট হাজির হয়ে যায় দ্বীপটায়।’
‘তারপর?’
‘গুলি খেয়ে মারা যায় কিরিলভ। আমার বন্ধু… আমার কো-পাইলট জেরি ওয়ার্নারও মারা যায় ওদের হামলায়। আহত হই আমি। সে-অবস্থাতেই টেকঅফ করি বিমান নিয়ে। ঝড়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, ইঞ্জিন ফেল করেছিল, রক্ত হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম নিজেও… নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি আয়রন লেডিকে। শেষ পর্যন্ত ক্র্যাশ করেছিলাম সাগরে। বিমান থেকে যে কীভাবে বেরিয়ে এসেছিলাম, তা আজও জানি না।’
‘ডেভিল’স্ ডোরওয়ে নিয়ে একটা গুজব রটেছিল, শুনেছেন আশা করি?’ রানা বলল। ‘আপনার বিমানটার কারণে ওটা বিশ্বাস করে বসেছিলাম আমরা।’
আবার হাসলেন মার্লো। ‘সে-আমলে এসব ঘটনা নিয়মিতই ঘটত। যন্ত্রপাতি এত আধুনিক ছিল না তো! বিমান সোজা চলছে, নাকি ডাইভ দিচ্ছে নিচের দিকে, সেটাই অনেক সময় বোঝা যেত না… বিশেষ করে রাতের আঁধারে।
‘কিন্তু ইঞ্জিন ফেল করল কেন? সেটা তো পাইলটের ভুল নয়।’
‘এ-নিয়ে আমিও অনেক মাথা ঘামিয়েছি। আয়রন লেডির ইঞ্জিন ঠিকমত মেইনটেন করতাম আমরা। অকারণে বন্ধ হবার প্রশ্নই ওঠে না। এরপর হঠাৎ মনে পড়ল, দুর্ঘটনার আগে তিনদিন একটানা বৃষ্টি হয়েছিল। বিমানের ফিউয়েল নিয়েছিলাম আমরা এয়ারপোর্টের গ্রাউণ্ড ট্যাঙ্ক থেকে। নিশ্চয়ই কোথাও লিক ছিল, পানি ঢুকে গিয়েছিল ট্যাঙ্কে। আর আমরা সেই পানি মেশানো তেলই ভরেছিলাম আয়রন লেডিতে। কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কী। পানি দিয়ে কি আর ইঞ্জিন চলে?’
‘যাক, রহস্যটার জবাব মিলল,’ বলল রানা।
‘আমিও একটা জবাব খুঁজছি গত সত্তর বছর ধরে,’ বললেন মার্লো। ‘স্টিলের ট্রাঙ্কদুটোয় কী নিয়ে এসেছিল কিরিলভ? রাশার সম্পদ বুঝলাম… কিন্তু আসলে সেটা কী?’
‘রোমানভ পরিবারের ধনরত্ন,’ বলল লামিয়া। তারপর সংক্ষেপে ইতিহাসটা জানাল বৃদ্ধকে।
শুনে মাথা ঝাঁকালেন মার্লো। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরাই কি তুলে আনবে ওগুলো?’-
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা। ‘যদি সব ভালভাবে এগোয়, কয়েক সপ্তাহের ভেতরেই ওগুলো দেখার সৌভাগ্য হবে আপনার।’
‘ক্ষমা চাই, ওই ধনরত্ন আমার জন্যে অভিশাপ। ওগুলোর জন্যে সব হারিয়েছি। দেখার শখ নেই কোনও। তবে… তোমরা যেহেতু ওখানে যাচ্ছই, একটা অনুরোধ করতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই! কী করতে হবে, বলুন?’
‘আমার বন্ধু জেরির লাশটা নিয়ে আসতে পারবে? ওকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করতে চাই আমি। দেশের মাটিতে কবর হওয়া উচিত ওর।’
‘তা-ই হবে,’ কথা দিল রানা। ‘আমি নিজে সেটা নিশ্চিত করব, মি. মার্লো। এটুকু করা আমার কর্তব্য।’
‘কর্তব্য! কেন?’ একটু যেন অবাক হলেন বৃদ্ধ।
‘ওখানে আপনি আপনার বন্ধুকে হারিয়েছেন,’ বলল রানা,
‘কিন্তু এক হিসেবে আপনারা দু’জন আমাকে আর আমার এক বন্ধুকে বাঁচিয়েছেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। সে ঋণ শোধ করা কি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না?’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, রানা,’ আবেগাপ্লুত গলায় বললেন মার্লো। ‘থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।’
***