ধানকুড়ির কিংকং – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস
ধান্যকুড়িয়া প্রাথমিক আদর্শ শিশুশিক্ষা নিকেতনের প্রধানা শিক্ষয়িত্রী দেবিকা ঘোষাল মাথা নামিয়ে নিবিষ্ট মনে ক্লাস ফোরের অঙ্কের ফাইনাল পরীক্ষার খাতায় দেওয়া নম্বরগুলো স্ক্রুটিনি করছিলেন। চল্লিশটার মধ্যে তেরোটা দেখা হয়েছে এবং নম্বর যোগ দেওয়ায় তিনটি ভুল আবিষ্কার করেছেন। ঠিক এমন সময়ই তিনি শুনলেন, ”বড়দিদিমণি আসব?”
দেবিকা মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, ”আসুন।” আবার খাতা দেখতে শুরু করলেন।
যিনি বললেন ”বড়দিদিমণি আসব” তিনি বছর ষাটের সাদা থান কাপড় পরা বেঁটেখাটো স্থূলকায় ধীর শান্ত নম্র স্বরের সুলতা মণ্ডল। ধানকুড়ির (ধান্যকুড়িয়ার এটাই ডাকনাম) অন্তত সত্তরভাগ মানুষ তাঁকে চেনেন এবং বড়দিদিমণিও তাঁর নাম শুনেছেন এবং এই চেনা ও শোনার কারণটা পরে বলা যাবে।
মুখ নামিয়েই দেবিকা বললেন, ”বলুন মাসিমা।”
ইতস্তত করে সুলতা বললেন, ”আমার নাতিটাকে ভর্তি করাতে এনেছি।”
”কোথায় নাতি?”
”এই তো।” সুলতা মুখ ফিরিয়ে দেখালেন।
দেবিকা মুখ তুলে দেখলেন লম্বা একট কিশোর। ঘোর কালো গায়ের রং। নাকটি ভোঁতা, ঝাঁকড়া রুক্ষ চুল। সারল্য ও বোকামি মুখে মাখানো। অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানেন গ্রামাঞ্চলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া একটু বেশি বয়সেই শুরু করে। কিন্তু এত বড় ছেলে তো শিশুশিক্ষা নিকেতনের অর্থাৎ প্রাইমারি স্কুলের পক্ষে অত্যন্ত অনুপযুক্ত।
দেবিকা হেসে বললেন, ”মাসিমা, দশটার পর এসে বড়বাড়ির হেডমাস্টারের সঙ্গে দেখা করুন।”
প্রাথমিক স্কুলের টালির চালের তিনখানি ঘরকে বলা হয় ছোট বাড়ি আর তার পঞ্চাশ গজ দূরের দোতলা মাধ্যমিক স্কুলটিকে বলা হয় বড়বাড়ি।
”না, না, আমি কালীকে বড় স্কুলে নয়, এখানে ভর্তি করাব বলেই এনেছি।” সুলতা ব্যস্ত হয়ে বললেন।
দেবিকা কপাল কুঁচকে জানতে চাইলেন, ”বয়স কত?”
উত্তরে যা শুনলেন তাতে চেয়ার থেকে ওঁর পড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু পড়লেন না কেন না উনি খুব শক্ত ধাতের মহিলা, তবে টেবলের কোনা চেপে ধরে বিস্ফারিত চোখে শুধু বললেন, ”আপনার নাতির বয়স ছয়।”
সুলতাও অবাক স্বরে বললেন, ”হ্যাঁ। ছয়। আমি ওর বাথ সাট্টিফিকেট সঙ্গে করে এনেছি। কালী তো জন্মেছে এখানেই, এই তো আমাদের মিনিসিপ্যাল হাসপাতালে মেয়ের পেট কেটে ওকে বার করতে হয়েছিল। যমে মানুষে সে কী টানাটানি! ডাক্তারবাবুও খুব শক্তপোক্ত ছিল, যম একদম সুবিধে করতে পারেনি। একমাস পর জামাই এসে মা—ছেলেকে সুন্দরবনের মৌসুনীতে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়।” বলতে বলতে সুলতা ধান্যকুড়িয়া মিউনিসিপ্যালিটির দেওয়া বার্থ সার্টিফিকেট কাগজটা খাম থেকে বার করে এগিয়ে দিলেন।
দেবিকা তিনবার জন্মতারিখটা দেখে মনে মনে দ্রুত একটা অঙ্ক কষে ফলটা বার করে নিলেন, কালীর বয়স আজ ছ’বছর দুশো দশ দিন। আড়চোখে ঘরের বাইরে দাওয়ায় মাদুরে—বসা পাঁচ ছয় বছরের ছেলেমেয়েদের একবার দেখে নিলেন তিনি।
বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে শক্তধাতের বড়দিদিমণি এবার কৌতূহলী হয়ে পড়লেন।
”নাতি কতটা পড়েছে, মানে অ আ ক খ, এক দুই তিন চার কাকে বলে জানে?”
”জানবে কী করে? আমার মেয়ে তো তিন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছে, আমার মতো তো পেরাইমারি পাশ করেনি আর জামাই…. ” সুলতা এধার—ওধার সন্তর্পণে তাকিয়ে এগিয়ে এসে টেবলে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ”কাউকে বলবেন না কথা দিন।”
”দিলুম।”
সুলতা এবার গলা আরও নামিয়ে বললেন, ”ডাকাত।”
দেবিকাও ফিসফিস করে বললেন, ”কে ডাকাত?”
”আমার জামাই। মাধ্যমিক পাশ, লেখাপড়া জানা।”
খবরটা শুনে বড়দিদিমণি যতটা শিহরিত হলেন ততটা আতঙ্কিতও। কিন্তু তিনি শক্ত ধাতের মানুষ, ঘাবড়ালেন না।
”আপনি ডাকাতকে জামাই করলেন?”
সুলতা এবার বিরক্ত হয়েই বললেন, ”আমি কেন জামাই করতে যাব? ও তো নিজে থেকেই জামাই হল, শিবু এখানে এসেছিল একটা খোঁজখবর করতে, নস্করবাড়িতে ডাকাতি করবে বলে। তখনই ওর চোখে পড়ে যায় আন্না, আমার মেয়ে এই কালীর মা, দারুণ কবাডি খেলত। নস্করবাড়ির সেজো মেয়ের বন্ধু, ডাকাতির সময় সন্ধেবেলা ওদের বাড়িতে আন্না তখন লুডো খেলছিল। মেয়েদের গা থেকে গয়না খুলতে খুলতে শিবু আন্নার সামনে এসে বলল, ”খোল নাকছাবি, নয়তো নাক কেটে নোব।”
”তারপর?” উদগ্রীব দেবিকা।
”তারপর আর কী, ”নির্বিকার মুখে সুলতা বললেন, ”আন্না টেনে এমন একটা চড় কষাল, শিবু ছিটকে পড়ল।”
”তারপর?” দেবিকা উত্তেজিত। ”ডাকাত চড় খেয়ে ছিটকে পড়ল? ওরে বাব্বা।”
”পড়বে না? আন্নার থাবাটা তো আপনি দেখেননি, এই অ্যাত্তো বড়।” সুলতা দু’হাতের পাঞ্জা পাশাপাশি রেখে দেখালেন।
”তারপর?”
”তিনদিন পর রাতে আমার বাড়িতে ডাকাত পড়ল, কালো কাপড় দিয়ে সবগুলোর মুখ ঢাকা। আমাকে শোবার ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় শেকল তুলে দিল। জানালা দিয়ে চিৎকার করে লোকজন ডাকতে লাগলুম। আমার বাড়ি তো গ্রামের একটেরেয় একেবারে কিনারে, মাঠ বনজঙ্গল পেরিয়ে লোক আসতে আসতে ততক্ষণে ডাকাতরা চলে গেছে।”
”জিনিসপত্র গয়নাগাটি টাকাকড়ি সব সাফ করে নিয়ে গেল তো?”
”একটা জিনিসও নেয়নি, যেখানে যা ছিল সব ঠিকঠাক রয়েছে, শুধু আন্না নেই।”
”সে কী।” দেবিকা আঁতকে উঠলেন। ”মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল? কেন, চড় মারার বদলা নিতে? মানে খুন করার জন্য?”
”চড় খেয়ে শিবুর টনক নড়ে, তখনই বুঝে যায় এই মেয়েই ডাকাতের বউ হবার উপযুক্ত। তা ছাড়া খুন করে দিলে কি কালী জন্মাত?” সুলতাকে একটু বিরক্ত দেখাল।
”খুন করতে চাইলে তুলে নিয়ে যাবে কেন, বাড়িতেই তো দায়ের এক কোপে আন্নার মুণ্ডুটা নামিয়ে দিতে পারত।”
অপ্রতিভ দেবিকা বললেন, ”তা বটে। আচ্ছা আপনার জামাই ক’টা মুণ্ডু আজ পর্যন্ত নামিয়েছে?”
”তা আমি কী করে বলব, চোখে তো দেখিনি। আর এখনকার ডাকাতরা দা কাটারি সড়কি নিয়ে তো ডাকাতি করে না, এখন তো বোমা বন্দুক মোটরবাইক পিস্তলের যুগ।”
”আপনার মেয়ে আপনার কাছে এখন আসে।”
”খুব কম। কলকাতার বউবাজারে ফেলাট কিনেছে শিবু। আন্না সেখানেই থাকে, বাচ্চচা একটা মেয়েকে নিয়ে। শিবু এখন কলকাতাতেই দল করে কারবার চালাচ্ছে। আন্না ছেলেকে আমার কাছে দিয়ে বলে গেছে, ‘মা তুমি ওকে মানুষ করো, আমার কাছে থাকলে কালীকে ডাকাত বানাবে ওর বাপ। একদিন ওর হাতে একটা পাইপগান দিয়েছিল তোমার জামাই, খেলা করার জন্য।’ শুনে কী বলব বড়দিমণি, বুকটা ধড়াস করে উঠল। আন্নাকে বললুম ভাল করেছিস, কালী আমার কাছেই থাকুক। ওকে পাঠশালায় পড়াব তারপর বড় ইস্কুলে তারপর কলেজে। ভদ্দর সমাজে মেশার উপযুক্ত করে তুলব।”
সুলতা দু’পা এগিয়ে ঝুঁকে বড়দিদিমণির দুটো হাঁটু চেপে ধরে বললেন, ”আপনি কালীকে রক্ষে করুন, নইলে শিবু ওকে নিয়ে গিয়ে ডাকাত বানাবে। দয়া করুন বড়দিমণি।”
শান্ত মানুষ দেবিকা সিঁটিয়ে গেছেন। উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি বললেন, ”আপনি একদম চিন্তা করবেন না। কাল ওকে নিয়ে আসুন। ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে নেব।”
”না বড়দিমণি ওয়ান বড্ড নিচু কেলাস, কালীকে ফোর নয়তো থিরিতে ভর্তি করে নিন।”
”সে কী! অ আ ক খ, এক দুই তিন, চার যে শেখেনি তাকে একেবারে থ্রি, ফোরে ভর্তি করে নিলে আমার তো চাকরি থাকবে না।”
”থাকবে সে ব্যবস্থা শিবুকে দিয়ে আমি করব। কালী কী পরিশ্রমী আর বাধ্য আপনি জানেন না। একবার যদি মনে করে অ—আ থেকে বিসগ্য চন্দবিন্দু মুখস্ত করব তা হলে না খেয়েদেয়ে দিনরাত পড়ে তিনদিনেই গড়গড়িয়ে মুখস্ত বলে দেবে। তিনদিনে পাঁচঘরের পর্যন্ত নামতা পড়ে দেবে।”
চমৎকৃত দেবিকা বললেন, ”আপনি কাল আসুন তো তারপর দেখা যাবে।” বলেই তিনি আড়চোখে কালীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন। হাফ প্যান্ট হাওয়াই শার্ট পরা ছেলেটি তখন থেকে পাথরের মূর্তির মতো একভাবে দাঁড়িয়ে। মিষ্টি হেসে বললেন, ”তোমার নাম কী খোকা?”
সর্দি হওয়ায় কালীর কণ্ঠস্বর ঘড়ঘড়ে হয়ে রয়েছে। সে নাম বলল। বাল্যকালে পুকুরে স্নান করার সময় দেবিকার কানে জল ঢুকে তাঁর শ্রবণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। তাই তিনি কালীর কথা ভাল করে বুঝতে পারলেন না। বললেন, ”কী নাম তোমার? কালী, তারপর কী যেন বললে?”
কালী আবার ঘড়ঘড়ে স্বরে বাকিটা বলল।
দেবিকা একটু অবাক হয়ে বললেন, ”কালী কিং কং? অদ্ভুত পদবি তো।” সুলতা দ্রুত ভুল শুধরে দিলেন, ”না গো বড়দিমণি, কিং কং নয়, কিং কং নয় কিঙ্কর, কালীকিঙ্কর ঢালি। বাবার নাম শিবশঙ্কর ঢালি।”
”ওর হাইট কত, মানে লম্বা কতটা?”
”এই তো দেখতেই পাচ্ছেন।”
”তা তো পাচ্ছিস, তবে কত ফুট কত ইঞ্চি?”
”অতশত জানি না।” সুলতা কিঞ্চিৎ বিড়ম্বিত স্বরে বললেন, ”আজ তক্তপোশে শুইয়ে মাপব ক’হাত লম্বা। কাল আপনাকে জানাব।”
পরের দিন কালীকে সঙ্গে নিয়ে সুলতা শিশুশিক্ষা নিকেতনে হাজির হলেন। দেবিকা তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন। ওদের অপেক্ষা করতে হল। দাওয়ায় মাদুরে বসে ক্লাস ওয়ানের প্রায় ত্রিশটি বাচ্চচা শ্লেটে দাগা বুলোচ্ছে স্বরবর্ণের অক্ষরে। রোগা লম্বা ব্যাজার মুখের এক শিক্ষিকা চেয়ারে বসে । টেবল নেই। তার হাতে বাঁশের একটা ছ’ফুট লম্বা কঞ্চি। দাওয়ার পাশে দাঁড়িয়ে কালী ও সুলতা। দেবিকা ক্লাস ফোরের ঘরে নারকেল দড়িতে দেওয়ালে ঝোলানো কালো বোর্ডে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক পনেরোটি ছাত্রকে কষে বোঝাচ্ছিলেন। এ ঘরে অবশ্য ছাত্রদের জন্য বেঞ্চ আছে।
ক্লাস ওয়ানের শিক্ষিকা কঞ্চি দিয়ে তৃতীয় সারিতে বসা এক বাচ্চচার মাথায় ঠক করে মেরে ধমকে উঠলেন, ”অ্যাই, তখন থেকে আ—টাকে ঘষে ঘষে মোটা করছিস, যেমন করে দাগ বুলোতে বলেছি সেইভাবে বুলিয়ে বুলিয়ে মোটা কর। ” এরপর তিনি অপেক্ষমাণ দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকালেন। ভারিক্কি স্বরে বলে উঠলেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কাউকে দরকার?”
সুলতা ঢোঁক গিলে বললেন, ”হ্যাঁ, ভর্তি করাব বলে এসেছি।”
”তাকে নিয়ে আসুন।”
”কাকে?”
”কাকে আবার, যাকে ভর্তি করাবেন তাকে।”
”এই তো সঙ্গে রয়েছে।” সুলতা মাথা হেলিয়ে দেখিয়ে দিলেন। ওয়ানের শিক্ষিকার চোখ—মুখের অবস্থা ঠিক সেইরকমই হল যা গতকাল বড়দিদিমণির হয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড কালীর দিকে তাকিয়ে থেকে ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ”কোন ক্লাসে ভর্তি হবে, ফোরে?”
”আমি তো তাই—ই চেয়েছি, কিন্তু বড়দিমণি বললেন, আগে ওয়ানে তো ভর্তি হোক।”
শিক্ষিকার হাতের কঞ্চিটা ধীরে ধীরে নেমে এসে দাওয়ায় ঠেকল। ফ্যালফ্যাল চোখে কালীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক বোঝানো হয়ে গেছে। দেবিকা দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে সুলতাকে দেখতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ”এসে গেছেন। রাধা, দ্যাখো তো এই ছেলেটিকে তোমার ক্লাসে ভর্তি করা যায় কিনা?”
রাধা অর্থাৎ ক্লাস ওয়ানের শিক্ষিকার মুখ ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গেছে। ক্ষীণস্বরে বললেন, ”দেবীদি, ক্লাস ওয়ানে এ পড়বে?”
”তুমি একটু পরীক্ষা করে দেখো না, হয়তো ক্লাস ফোরেও অ্যাডমিট করা যেতে পারে।”
একটু ভেবে রাধারানি গায়েন জিজ্ঞাসা করলেন কালীকে, ”পদ্য পড়েছ?”
”হুঁ।” কালী মাথা হেলিয়ে দিল।
”জানেন বড়দিমণি, কাল এখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে মর্জিনার বাড়িতে গেছলুম, ওর সেজছেলে রহিম বড় স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। মর্জিকে বললুম রমুকে আমার বাড়িতে একবার পাঠিয়ে দিস তো স্কুল থেকে ফিরলেই যেন কালীকে একটু পড়া করিয়ে দিয়ে যায়। বিকেলে রমু এসে বাদাম আর বাতাসা দিয়ে চালভাজা খেতে খেতে কালীকে আধঘণ্টা পড়িয়েছে। তারপর মাঝরাত্তির পর্যন্ত কালী শুধু বিড়বিড় করে মুখস্থ করে গেছে রমু যা যা ওর কানে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। বল না কালী সেই পদ্যটা যেটা আমাকে রাত্তিরে শোনালি।”
সুলতা থামামাত্র কালী ঝড়ের বেগে শুরু করল, ”পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল, কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল, রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে, শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে, ফুটিল মালতী ফুল সৌরভ ছুটিল, পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল।” এক নিশ্বাসে বলে কালী থমকে গেল। পরের লাইনটা মনে পড়ছে না। মনে করার জন্য চেষ্টা করতে করতে কালো মুখ বেগুনি হয়ে উঠল, কপালে বিনবিনে ঘাম ফুটল, ঠোঁট চাটল, আড়চোখে তাকিয়ে দিদিমার উৎকণ্ঠিত মুখ দেখে আরও ঘাবড়ে গেল।
উৎকণ্ঠিত চোখ রাধারানি গায়েনেরও। ছেলেটা যদি ফেল করে তা হলে দেবীদি তো বলবেন, থ্রি ফোর নয়, ক্লাস ওয়ানেই ভর্তি হোক। আর এতবড় একটা ছেলেকে ম্যানেজ করা কি সোজা ব্যাপার হবে। ”বলো বলো ভয় কী, মনে করো পরের লাইনটা।” রাধারানি অভয় দিলেন স্নেহ বাৎসল্য গলায় ঢেলে।
এবার মনে পড়েছে কালীর। দুটো লাইন বাদ দিয়ে সে তড়বড়িয়ে শেষ দুটো লাইন বলল, ”ওঠো শিশু মুখ ধোও পর নিজ বেশ, আপন পাঠেতে মনে করহ নিবেশ।” বলেই সে যুদ্ধ জয়ের হাসি হাসল।
উদ্ভাসিত মুখে রাধারানি বললেন, ”শুনলেন দেবীদি, শুনলেন, হুবহু সবটা মুখস্থ বলে গেল। সেই কবে বিদ্যাসাগর মশায়ের ”ভোরের কাজ” পদ্যটা ক্লাস ফোরে পড়েছিলুম আমার আজও মনে আছে।”
দেবিকা চোখে হাসি নিয়ে বললেন, ”অঙ্ক জানো? যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ?”
কালী চুপ! সুলতা বললেন ”আধঘণ্টায় আর কতটা পড়া হয়, তবু যতটা পেরেছে অঙ্ক শিখেছে।”
”দেখা যাক। বলো তো পাঁচ আর পাঁচে কত হয়।”
কালী আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে যোগ দিয়ে বলল, ”দশ।”
রাধারানি প্রায় হাততালি দিয়ে বলল, ”দারুণ মাথা। এ তো ক্লাস ফোরের অঙ্ক।”
”এবার বিয়োগ, পাঁচ থেকে পাঁচ বাদ দিলে কত থাকে হাতে?”
কালী একমুহূর্তও না ভেবে বলল, ”শূন্য।”
দেবিকার মুখের হাসি মুছে গেল। সিরিয়াস হয়ে গেল চাহনি। ”পাঁচকে পাঁচ দিয়ে গুণ করলে কত হয়।”
”পঁচিশ।”
দেবিকার এবার যেন জেদ চেপে গেল। বললেন, ”এবার ভাগ। পাঁচকে পাঁচ দিয়ে ভাগ করলে কত হবে ভাগফল।”
এইবার কালী চুপ। দিদিমার দিকে ফ্যাকাসে মুখে তাকিয়ে রইল। বড়দিদিমণি মুচকি হাসলেন, রাধারানি প্রমাদ গুনছেন।
”ভাগফলের অঙ্ক পর্যন্ত পৌছবার আগেই তো রমুর বাটির চালভাজা শেষ। তড়াক করে লাফিয়ে ফুটবল মাঠের দিকে দৌড় দিল, কালী তা হলে শিখবে কী করে? বড়দিমণি আপনি ওকে ফোরেই ভর্তি করান আমি বাড়িতে মাস্টার রেখে ওকে পড়াব। দেখবেন চার বছরের পড়া ও এক বছরে শেষ করে দেবে।”
রাধারানি মাথা নেড়ে সুলতাকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, ”অসম্ভব নয়। যে অ আ ক খ, এক দুই তিন চার কী জিনিস গতকালও জানত না, সে গড়গড়িয়ে পদ্য মুখস্থ বলল, যোগ বিয়োগ গুণ পর্যন্ত শেলেট পেন্সিল ছাড়াই করে দিল মাত্র আধঘণ্টার কোচিং নিয়ে। দেবীদি, এ ছেলে চার কেন, পাঁচ বছরের পড়া এক বছরে হজম করে দেবে। এতদিন পড়াচ্ছি অন্তত দুশো ছেলেমেয়ে তো দেখলুম, অভিজ্ঞতাও কম হয়নি কিন্তু এরকম ব্রেন জীবনে দেখিনি।”
দেবিকা চুপ করে কীসব ভাবলেন। মাথা চুলকে বললেন, ”ঠিক আছে ক্লাস ফোরেই পড়ুক, তবে টেম্পোরারি ছাত্র হবে একমাসের জন্য। যদি দেখি প্রোগ্রেস করেছে তবে পার্মানেন্ট স্টুডেন্ট করব। না পারলে ক্লাস ওয়ানে নামিয়ে দোব, রাজি?”
”রাজি।” সুলতা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন।
কালী পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভর্তি হয়ে গেল। বড়দিদিমণি বললেন ”সামনের সোমবার থেকে ক্লাস করুক।” সুলতা যখন ধান্যকুড়িয়া প্রাথমিক আদর্শ শিশুশিক্ষা নিকেতন থেকে বেরিয়ে আসছেন বড়দিদিমণি তখন পিছু ডাকলেন।
”মাসিমা, কালীকে মেপেছেন?”
”ওই দ্যাখো বলতে ভুলেই গেছি। তক্তপোশে শুইয়ে কালকেই মেপেছি, সাড়ে তিনহাত থেকে এই দু’ আঙুল কম। তা হলে কতটা হল?”
”আপনার হাতের মাপ তো পুরুষদের মতো আঠারো ইঞ্চি নয়, একটু কমই হবে। তা হলেও…”বড়দিদিমণি মনে মনে একটা অঙ্ক কষে নিয়ে বললেন, ”পাঁচফুট দু’ইঞ্চির মতো।” তারপরই শিউরে উঠে প্রায় আর্তনাদের মতো বললেন ”সাড়ে /ছ’বছর/বয়সেই এই, তা হলে বারো বছর বয়সে কী দাঁড়াবে!”
কথাগুলো সুলতা বা কালী শুনতে পেল না, তারা ততক্ষণে হাঁটা দিয়েছে বাড়ির দিকে। রাধারানি তখন হঠাৎ ধড়মড়িয়ে প্রায় ছুটে গেলেন সুলতাকে ধরার জন্য।
”মাসিমা, মাসিমা, দাঁড়ান, একটা কথা ছিল।”
অবাক সুলতা দাঁড়িয়ে পড়লেন।
”আপনি তখন বললেন কালীর জন্য মাস্টার রাখবেন।”
”রাখবই তো। আপনার হাতে মাস্টার আছে?”
”আছে। খুব ভাল ছেলে বড়বাড়িতে ক্লাস টেনে পড়ে। খুব গরিব। থাকে আমার পাশের পাড়ায়। কয়েকটা টাকা পেলে ওর খুব উপকার হবে। আমি বলছি খুব যত্ন করে কালীকে পড়াবে।”
”বলছেন ভাল করে পড়াবে? বেশ পাঠিয়ে দেবেন আজ বিকেলে। চেনে আমার বাড়ি?”
”চিনে নেবে, এখানকারই ছেলে তো।”
রাধারানি স্কুলে ফিরে আসামাত্র দেবিকা তাকে ডাকলেন। স্কুলে মোট তিনজন পড়ান। তৃতীয়জন অধীরবাবু ম্যালেরিয়ায় শয্যাশায়ী থাকায় অনুপস্থিত।
”রাধা, ক্লাস ওয়ানকে ছুটি নিয়ে দিচ্ছি। ক্লাস টুকে মাছ আঁকতে বসিয়ে দাও। অঙ্ক দিচ্ছি ক্লাস থ্রিকে, ফোরকে পদ্য মুখস্থ করাও। আর শোনো, যা ভাল করে জানো না সেই বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যেয়ো না। পাখি সব করে রব বিদ্যাসাগর মশায়ের লেখা তোমায় কে বলল? ওটা তো মাইকেলের লেখা, পড়েছ কিছু ওঁর লেখা?”
”বাহ পড়ব না? উচ্চচ মাধ্যমিকে তো পলাশীর যুদ্ধ আমাদের পড়তে হয়েছে।”
.
বিকেলে একটি ছেলে হাজির হল সুলতার বাড়ি। পরনে হাফপ্যান্ট হাফশার্ট। কালী যতটা কালো, ছেলেটি ততটাই ফরসা, কালীর থেকে অন্তত ইঞ্চি চারেকের খাটো, ওজনেও প্রায় দশ কেজি কম।
সুলতা আপাদমস্তক দেখে বললেন, ”আগে তো কখনও দেখিনি, থাকিস কোথায়?”
”শেতলাতলায়।” ছেলেটির কণ্ঠস্বর কোমল ও মিষ্টি, প্রায় মেয়েলি।
”ওটা তো বামুনপাড়া, নাম কী?”
”সুধন্য হালদার। ডাক নাম ধানু।”
”টেন ক্লাসে পড়িস? অঙ্কে কত নম্বর পেয়েছিলিস ক্লাসে ওঠার পরীক্ষায়?”
”একশো।”
”কতোর মধ্যে একশো?” সুলতা হঠাৎ গম্ভীর করে ফেললেন স্বর।
ধাতু ভ্যাবাচ্যাকা। এমন প্রশ্নের মুখে কখনও আগে পড়েনি। উত্তর হাতড়াতে শুরু করল। একটা কথা সে বুঝে গেছে, তার সামনে এখন যে মহিলা লেখাপড়া সম্পর্কে তার কোনও ধারণা নেই কিন্তু কাজটা তার চাই এবং ইনি যাতে বিরূপ না হন এমনভাবে উত্তরটা দিতে হবে।
”একশো পাঁচের মধ্যে একশো।”
”হুমম পাঁচ নম্বর কম।” সুলতার ভুরু কুঁচকে উঠল। ”পুরো নম্বর পাসনি কেন?”
”ওটা নিয়ম। অঙ্ক থেকে পাঁচ নম্বর তুলে রাখা হয়। অন্য কোনও বিষয়ে নম্বর কম পড়লে তখন ওই তোলা নম্বরটা থেকে দেওয়া হয়। আমার নম্বর কম পড়েছিল জীবন বিজ্ঞানে, পাঁচ নম্বর ওখান থেকে দিয়েছিল।”
উত্তর পেয়ে কী বুঝলেন সুলতা, সেটা বুঝতে পারল না ধানু। তবে নম্বরের পথে প্রৌঢ়া আর এগোলেন না। ”তোকে কী করতে হবে ছোটদিদিমণি বলে দিয়েছেন?”
”দিয়েছেন। চার বছরের পড়া এক বছরে করিয়ে দিতে হবে।”
”পারবি?”
”চেষ্টা করব।”
”কী করে চেষ্টা করবি। মারধোর করতে পারবি না কিন্তু। কালী বাচ্চচা ছেলে, সাড়ে ছ’বছর মাত্র বয়স।”
”বাচ্চচাদের আমার খুব ভাল লাগে।”
”কালীকে দেখেছিস?”
”না। তবে রাধামাসির কাছে শুনেছি চেহারাটা একটু বড়সড়।”
”ওকে আগে দ্যাখ, কথা বল, তারপর ঠিক কর ওকে পড়াতে পারবি কি না। ওর মাথাটা খুব ভাল আর ঠাণ্ডা ছেলে, কম কথা বলে। মুশকিল কী জানিস বাবা, এমন একটা গতর ও পেয়েছে, যেজন্য লোকজনের নজর পড়ে ওর ওপর। সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কেউ বিশ্বাস করে না ওর বয়স এত কম। আর সেজন্যই কালী লোকজন এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। মনটা বাচ্চচাছেলের, লোকে তো তা জানে না, তারা বড়ছেলে ভেবে সেইরকম ব্যবহার করে ওর সঙ্গে। তাইতে ও অবাক হয়ে যায়। ওর বয়সিরা ওর সঙ্গে মিশতে চায় না, খেলতে চায় না। মনে মনে সেজন্য ও কষ্ট পায়।”
সুলতার কথা শুনে ধানুর মন কালীর জন্য সহানুভূতিতে ভরে গেল। সে বলল, ”দিদিমা, আপনি ওর জন্য ভাববেন না, আমি যতটা পারি ওকে দেখব। এখন ও কোথায় দেখতে পাচ্ছি না তো!”
”বোধহয় খালধারের মাঠে গেছে বল খেলা দেখতে, গিয়ে দ্যাখ তো।”
ধানু চলে যাচ্ছে সুলতা ডাকলেন। ”আসল কথাটাই তো হল না, মাইনে নিবি কত?”
ইতস্তত করছে ধানু। কখনও টিউশনির কাজ সে করেনি, কত টাকা চাইবে বুঝে উঠতে পারছে না। সুলতা বুঝতে পারলেন ধানুর জলে পড়ে যাওয়া হাঁসফাসে অবস্থাটা। ছেলেটিকে তার ভাল লেগেছে।
”বাড়িতে আছে কে কে?”
”মা আর দুটো ছোট বোন।”
”বাবা?”
”গত বছর যক্ষ্মায় মারা গেছে।”
”সংসার চলে কী করে?”
ধানু পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল মুখ নামিয়ে। সুলতা বুঝলেন বলতে চায় না।
”কাল সকাল থেকে পড়াতে আয়।”
”না দিদিমা সকালে পড়াতে পারব না, কাজ থাকে।”
সুলতা গলাটা একটু চড়িয়ে বিরক্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ”পড়াশুনো তো ভোর ভোর সকালে করলে ভাল করে মাথায় ঢোকে। এই তো আমি বাড়িতে বসেই শুনতে পাই সক্কালবেলা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এবাড়ি ওবাড়ির ছেলেমেয়েরা পড়া মুখস্ত করছে। কালীকেও তো চার বছরের বই এক বছরই শেষ করে ফেলতে হবে নইলে নীচের ক্লাসে নামিয়ে দেবে। তুই তো সকালে এসে ওকে মুখস্ত করাবি।”
”তাকিয়ে রইলেন সুলতা তাঁর কথাগুলো ভুল না ঠিক ধানুর চোখ থেকে তা যাচাই করে নেওয়ার জন্য। ধাতুর চোখে বিব্রত ভাব।
”না দিদিমা, আমি পারব না।” ধানুর গলা যথেষ্ট কঠিন ও জেদি।
সুলতা আশা করেননি এইটুকু একটা ছেলে যে অভাবের সংসার থেকে এসেছে,স্পষ্ট ভাষায় বলবে ‘পারব না।’ তার মানে কাজটা সে নেবে না। কিন্তু কেন?
”ভোরবেলায় সূর্য ওঠার আগেই আমি বাবার ভ্যানরিকশাটা নিয়ে বেরোই। ওই পূব দিকে বাগডাঙা কুসুমতলা লাউগেছে যেতে হয়। চাষিরা আমার রিকশায় তাদের খেতের আনাজপাতি বেগুন, নটে, লাউ, কলমি শাক, কচু, ডাব, কাঁচকলা এইসব তুলে দেয়। সেগুলো সন্তাোষপুরের বাজারে পৌঁছে দিতে হয়। তারপর বাড়ি ফিরে স্কুলের পড়া নিয়ে বসি, তিন ঘণ্টা পড়ি তারপর স্কুলে যাই। না দিদিমা, আমার কাজ আর পড়া ফেলে সকালে আসতে পারব না।” যে কথাটা উহ্য রয়ে গেল— তাতে যদি পড়ানোর চাকরিটা হাতছাড়া হয় তো হবে।
সুলতা বাস্তব বোঝেন, বুদ্ধিমতী এবং নমনীয় চরিত্রের। ধানু তাঁর স্নেহ ও সমীহ ইতিমধ্যেই অর্জন করে ফেলেছে। বুঝে গেছেন মেয়েলি গলার এই কিশোর শান্ত ধাতের, একবগগা, সৎ। কালীর জন্য এমন একজনকেই তিনি চাইছেন।
”দিনে কত টাকা রোজগার করিস?”
”কুড়ি টাকা। মা সকালে ন’টার মধ্যে দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ করে, আটশো টাকা পায়। এই দিয়ে আমাদের সংসার চলে।”
”তা হলে কালই বিকেল—সন্ধে নাগাদ আয়। দু’দিন তো পড়া তারপর মাইনেপত্তর ঠিক হবে।”
সুলতার বাড়ি থেকে মিনিটতিনেক হেঁটে ধানু এল খালধারের ফুটবল মাঠে। খাল বলতে একটা বারো মিটার চওড়া নালা। জল খুবই কম, হেঁটে পার হওয়া যায়। পঞ্চাশ বছর আগে এটা ছিল জলভরা খাল এবং তাই দিয়ে নৌকা চলত। খালের ধারে মিউনিসিপ্যালিটির বড় মাঠ। পরিচর্যা করা হয় না, এখানে ওখানে সামান্য ঘাস ছাড়া বাকিটা ন্যাড়া এবড়ো—খেবড়ো উঁচু নিচু মাটিতে ঢাকা। দু’দিকে কাঠের গোলপোস্ট ও ক্রসবার। মাঠ ঘিরে বট, তাল, নিম অশ্বত্থগাছ আর ঝোপঝাড়। ধান্যকুড়িয়া স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন ও ধান্যকুড়িয়া আদর্শ উচ্চচ মাধ্যমিক শিক্ষা নিকেতনকে মাঠে খেলা করার অনুমতি দিয়েছে মিউনিসিপ্যালিটি।
মাঠে তখন লিগ খেলা চলছে। স্থানীয় বালক সঙ্ঘের সঙ্গে উদয়পুরের অরুণোদয় ক্লাবের। মাঠ ঘিরে পাঁচ—ছ’শো লোক। বেশিরভাগই পাশের গ্রাম উদয়পুরের। এই ম্যাচটা লিগ জেতার জন্য উদয়পুরের কাছে খুবই দরকারি। আজ তারা একটা পয়েন্ট খোয়ালে ধান্যকুড়ির পূর্বাচল ক্লাবের চ্যাম্পিয়ান হওয়ার রাস্তাটা খুলে যাবে। মাঠ ঘিরে টানটান পরিস্থিতি। পূর্বাচলের সাপোর্টাররা চিৎকার করে বালক সঙ্ঘকে চাগিয়ে যাচ্ছে।
ধানু যখন মাঠে এল তখন ম্যাচ শেষ হতে বাকি তিন মিনিট এবং ফল ০—০। বালক সঙ্ঘের গোলের পিছনে তিনটে তালগাছের ধারে সে এসে দাঁড়াল। সেখানে রয়েছে উদয়পুরের সাপোর্টাররা। হঠাৎ গোল খেয়ে গেল বালক সঙ্ঘ। লব করে দেওয়া বলটা ব্যাকের মাথার উপর দিয়ে বালক সঙ্ঘের পেনাল্টি স্পটের উপর পড়ছিল অরুণোদয়ের স্ট্রাইকার ছিটকে ঢুকে গিয়ে বলটা গোলে ঠেলে দেয়। রেফারি গোলের বাঁশি বাজাতেই উদয়পুরবাসীরা উল্লাসে মাঠে নেমে ডিগবাজি খেতে শুরু করে, গোলদাতাকে জড়িয়ে সাত—আটজন মাঠে গড়াগড়ি দিতে থাকে। লাইন্সম্যান যে অফসাইডের জন্য ফ্ল্যাগ তুলে রয়েছে সেটা আর তারা লক্ষ করেনি। রেফারি বলটা জমিতে বসিয়ে বালক সঙ্ঘকে যখন ফ্রি কিক দিল তখনই শুরু হয়ে গেল মাঠের মধ্যে দাঙ্গা। গাছের ভাঙা ডাল, বাঁশের খেটো নিয়ে মাঠে ঢুকে পড়ল কিছু লোক। তাদের মুখে একটাই কথা, ”জোচ্চচুরি, জোচ্চচুরি। আমাদের চ্যাম্পিয়ান হতে না দেবার জন্য চক্রান্ত। ল্যাইন্সম্যানকে ম্যানেজ করা হয়েছে।”
বালক সঙ্ঘ আর পূর্বাচলের লোকেরা ধানকুড়ির। সংখ্যায় তারা তো বেশি হবেই। বাইরের লোকেরা তাদের পিটোবে এটা তারা সইবে কেন। সুতরাং ধানকুড়ির লোকেরাও হাতের কাছে যা পেল তাই নিয়ে নেমে পড়ল। ফটাফট ফটাফট আওয়াজ মাঠ জুড়ে। মাঝে মধ্যে মানুষের গলায় ”বাবা রে, মরে গেলুম।” ”মার মার, মাথা ভেঙে দে।” সুখের বিষয় ছোরা, বোমা বা পাইপগান যা এইরকম মারপিটে ব্যবহার করা হয়, কোনও পক্ষের কাছে এইসব অস্ত্র ছিল না। কিন্তু কাঠ, বাঁশ, মাটির ঢেলা, ইট তাই—বা কম কী।
ধানু দাঙ্গা থামাতে মঠে ঢুকে গেছল। (পরে অবশ্য স্বীকার করে বোকামি করে ফেলেছিল।) এবং একটা বাঁশ মাথায় পড়তেই দু’হাতে মাথা চেপে বসে পড়ে। আর এক ঘা পিঠে পড়বে ধরে নিয়ে সে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু বাঁশ আর পড়ল না। ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে দেখে হাফপ্যান্ট পরা একটা লোক বাঁশ মুঠোয় ধরে টানাটানি করে চলেছে। অবশেষে হ্যাঁচকা টানে বাঁশটা ছাড়িয়ে দিল।
”পালান এখান থেকে।”
লোকটির কথামতো ধানু দৌড়ে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মাথা থেকে অল্প রক্ত পড়েছিল। জখমটা গুরুতর হয়নি। ডাক্তারবাবু মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দেন। পরদিন ভোরে সে প্রতিদিনের মতো সবজি বইতে ভ্যানরিকশা নিয়ে বেরোয়, স্কুলেও যায়।
বিকেলে সে সুলতার বাড়িতে হাজির হল। সদর দরজার পাশে টানা রোয়াক। তাইতে পা ঝুলিয়ে বসে সেই লোকটা, গতকাল যে বাঁশ ধরে ফেলে তাকে বাঁচিয়ে দিল। হাতে চালভাজার বাটি, পা দোলাতে দোলাতে চালভাজা খাচ্ছে। ধানুকে দেখে রোয়াক থেকে লাফিয়ে নামল।
”আপনি কি ধানুদা?”
”হ্যাঁ, আপনি?”
”আমি কালী।” বলেই একগাল হাসি। ”দিদা বলেছে এখন থেকে আমি তোমার ছাত্তর।”
ধাতু বলল, ”ছাত্তর নয় বলবে ছাত্র।”
কালীকে শিক্ষাদানের প্রাথমিক কাজ এইভাবেই ধানু শুরু করল।
.
প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের এই বিনামূল্যে পড়ুয়াদের দেওয়া হয়। কিন্তু ধানকুড়ির এই প্রাথমিক স্কুলে সেইসব বই এখনও এসে পৌঁছয়নি। তা হলে কালী কী বই পড়বে?
ওর সঙ্গে প্রথম কথা বলার পরের দিন ধানু তার পড়শি নীলামাসির মেয়ের অঙ্ক আর বাংলা বই কয়েক ঘণ্টার জন্য ধার করে নিয়ে এল। ক্লাস টু—এ পড়ে মেয়েটি। বিনামূল্যে স্কুল থেকে পাওয়া ওইসব বই পুরনো। বছর শেষ হলে বই ফিরিয়ে দিতে হয় স্কুলে, কেন না নিচু ক্লাস থেকে যারা উঠেছে তারা এবার পড়বে এই বই।
ধানুর কথামতো সুলতা লাইনটানা ফুলস্ক্যাপ কাগজ, শ্লেট ইত্যাদি কিনে রেখেছিলেন। কালী পাঁচ আর পাঁচে দশ হয় জানে, পাঁচ থেকে পাঁচ বাদ দিলে শূন্য হয় জানে, পাঁচকে পাঁচ দিয়ে গুণ করলে পঁচিশ হয় এটাও জানে, শুধু ভাগটাই জানে না।
নব গণিত মুকুল বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে ধানু বুঝে গেল এই বই কালীর আর পড়ার দরকার নেই। এখন যেটা ওর দরকার অক্ষর আর রাশি চিনে পড়তে শেখা এবং লিখতে পারা। কিশলয় বইটি সে কালীর সামনে খুলে ধরে বলল, ”তোমাকে এইসব অক্ষর চিনে পড়তে হবে আর লিখতে হবে। পারবে তো?”
সুলতা দু’জনের পাশে বসে ধানুর কথা শুনছিলেন, গজগজিয়ে বললেন, ”তো মানে? হবে, পারতে হবে। ওসব তো—টো চলবে না। সামনের বছরই বড় বাড়িতে ভর্তি হতে হবে। মনে থাকে যেন। এরপর কোমল স্বরে বললেন, ”হ্যাঁরে ধানু, গুড় দিয়ে দুটো রুটি খাবি? এখুনি বানিয়ে দিচ্ছি।”
উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সুলতা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। কালী সহজপাঠ বই খুলে ছবি দেখছে। একটা পাতার উপরের কোণে আঁকাবাঁকা অক্ষরে নাম লেখা। কালীর কৌতূহল হল নামটা জানতে।
”ধানুদা এটা কী লেখা?”
ধানু দেখল লেখা রয়েছে ‘পিংকী শিকারী’। বলল, ‘পিঙ্কি শিকারি। একটা মেয়ের নাম এটা। বইটা তার।”
”নিজের হাতে লিখেছে।” কালীর চোখে সমীহ ফুটে উঠল।
অক্ষরগুলোর চেহারা দেখে ধানু বলল, ”হ্যাঁ, নিজের হাতে লিখেছে।”
আবদেরে স্বরে কালী বলল ”ধানুদা, নিজের হাতে আমিও নাম লিখব, শিখিয়ে দেবে?”
ধানুর ভাল লাগল কালীর এই ইচ্ছাটা নিজে থেকে জেগেছে দেখে, সেই সঙ্গে খেয়াল হল ওর বয়স মাত্র সাড়ে ছয় বছর। মনে পড়ল সুলতার কথাগুলো , ”মনটা বাচ্চচাছেলের লোকে তো তা জানে না, তারা বড় ছেলে ভেবে সেইরকম…’
তারপর সে ক—এর পাশে আ—কার এবং ল—এর পাশে দীর্ঘ ঈ চিহ্ন এঁকে উচ্চচারণ করে বুঝিয়ে দিল চিহ্নগুলো দিয়ে কী রকমভাবে কালী শব্দটি তৈরি করা হল। কিঙ্কর লিখতে গিয়ে তার মনে হল ‘ঙ্ক’—টা বেশ খটমট। পিংকী বানানটার মতো লেখা কালীর পক্ষে সহজ হবে যদি কিংকর লেখে। ধানু তাই লিখল। ঢালি শব্দটায় জটিলতা নেই। পুরো নামটা লিখে সে বলল, ”এভাবে কিন্তু অক্ষর পরিচয় হয় না। তোমাকে অ, আ, ক খ থেকে শিখতে হবে।”
এই বলে কাগজে সে স্বরবর্ণ অ থেকে ঔ এবং ব্যঞ্জনবর্ণ ক থেকে চন্দ্রবিন্দুপর্যন্ত মুক্তোর মতো অক্ষরে লিখে বলল, ”বইগুলো তো আজকেই পিঙ্কিকে ফেরত দিতে হবে নইলে বই দেখেই করতে পারতে। তুমি আমার এই লেখা দেখেই শুরু করো বরং। অ—র নীচে দশটা অ, আ—র নীচে দশটা আ লিখবে ঠিক যেভাবে আমি লিখেছি, একেবারে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত। পারবে তো আজ রাতের মধ্যে।”
কালী একদৃষ্টে ধানুর লেখা অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে। প্রশ্নের জবাবে শুধু মাথা নাড়ল। গরম রুটি আর গুড় দু’জনের জন্য দু’টি স্টিলের থালায় নিয়ে এলেন সুলতা।
”আগে খেয়ে নে তারপর পড়া। পেটে খিদে নিয়ে পড়াশুনো হয় না।”
ধানু হেসে থালা টেনে নিতে গিয়ে দেখল সুলতার হাতে একটা শুকনো বাঁশের কঞ্চি। অবাক হয়ে তাকাতেই সুলতা বললেন, ”রান্নাঘরে পেলুম, তোর কাজে লাগবে। চার বছরের পড়া এক বছরে তুলে দেওয়া কি সোজা ব্যাপার।” বলেই তিনি কঞ্চিটা সপাং করে মেঝেয় কষালেন। ”পাঠশালায় আমাদের সময় গুরুমশায়দের হাতে বেত থাকত। বেতটা হাতে নড়ে উঠলেই ভুলে যাওয়া নামতা মনে পড়ে যেত।”
”না না দিদিমা, বেত কঞ্চি কিছুরই আমার দরকার হবে না। কালী তো শুনেছি একবার শুনলেই সব মনে রাখতে পারে।”
”পারেই তো। তুই আজ পড়া দিয়ে যা, কালকে এসে পড়া ধরলে দেখবি সব বলে দেবে। রমু তো আধঘণ্টা মোটে পড়িয়েছিল তাইতেই কালী দিদিমণিদের তাক লাগিয়ে দেয়। কিন্তু মুশকিল কী হয়েছে জানিস বাবা, ওর এই গতরটা।”
ধানু বলল, ”মুশকিল এখন ততটা হবে না কিন্তু পরে হবে, যদি সাড়ে সাত বছরে কালী ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়।” কথাটা বলে সে আড়চোখে কালীর দিকে তাকাল। মাথা নামিয়ে কালী তখনও অ আ, ক খ লেখা কাগজের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁট নড়ছে।
”কালী, তুমি এখন খেয়ে নাও, পরে পড়বে।” ধানু বলল।
”খাচ্ছি।” কালী মুখ তুলে হাত বাড়াল রুটির দিকে। ”ধানুদা, তুমি আর একবার অক্ষরগুলো চিনিয়ে দেবে? আচ্ছা, এটা তো হস্বই আর এটা ওঔ, তাই না?”
ধানু শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, ”হ্যাঁ।”
”আরে এটা গ, এটা ইঁও, এটা থ, এটা….?” কালী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল ধানুর দিকে।
”দন্তান্ন। তারপর প ফ…।”
কালী হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল, ”জানি।”
সুলতা ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে বললেন, ”কী বলেছিলুম।” তারপর কালীকে বললেন, ”লক্ষ্মী বাবা, রুটিগুলো খেয়ে নে, জুড়িয়ে যাচ্ছে।”
”না দিদিমা আগে পড়া শেষ করি তারপর খাব।” কাগজগুলো নিয়ে কালী ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে দালানে গিয়ে বসল।
এখন ধানুর মনে হচ্ছে একবছর পর কালী ক্লাস ফাইভে পড়তে বড় বাড়িতে যাবে। সে বলল ”দিদিমা সামনের বছর কালী যদি ফাইভে পড়ে তবে পাঁচ বছর পরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় কত বছর বয়সে বসবে?”
”এখন সাড়ে ছয়, সামনের বছর সাড়ে সাত, তার সঙ্গে পাঁচ যোগ কর, কত হয়?”
”সাড়ে বারো। অত কম বয়সে তো পরীক্ষা দেওয়া যায় না। আপনি অন্তত আর চার বছর বয়স বাড়ান।”
সুলতার মাথায় এবার বাজ ভেঙে পড়ল। ”লোকে তো ছেলেমেয়ে ইস্কুলে ভর্তি করার সময় বয়স কমায়! কালীর বয়স বাড়াতে বলছিস? এ কী সব্বোনেশে কথা। এখন কী করে বাড়াব? মিনিসিপালের বাথ সাট্টিফিকেট কি ফেলে দোব?”
”না, না, দিদিমা ফেলবেন না।” ধানু আঁতকে উঠল। ”ব্যবস্থা করে জন্মসালটা চার বছর শুধু পিছিয়ে দিতে হবে। শ’দুয়েক টাকা খরচ করলেই কালীর বয়স বাড়ানো যাবে। বড় বাড়ির যতীন মাস্টারমশাই এইসব ব্যবস্থা করেন। কত ছেলের বয়স কমিয়ে সার্টিফিকেট বার করে এনেছেন আর এ তো বাড়ানো।”
”তা হলে তাই করে দিস বাবা। লেখাপড়া করতে গেলে যে অ্যাতো হ্যাপায় পড়তে হবে কে জানত। আর কী কী করতে হবে বলে দিস।”
”কালীর হাফপ্যান্ট পরাটা বন্ধ করতে হবে। বড্ড বেখাপ্পা দেখায়। লোকজন বারবার তাকাবে তাতে ও অস্বস্তিতে পড়বে। গড়িয়ায় রেডিমেড ফুলপ্যান্টের অনেক দোকান আছে একজোড়া কিনে দিন।”
”এই তো বাপু আবার খরচের ধাক্কায় ফেললি। ধুতি পরলে হয় না? ওর দাদামশায়ের তিন—চারটে ধুতি তোলা আছে, ছেঁড়াখোড়া নয়, আস্ত।”
ধানু মাথা নেড়ে বলল, ”প্যান্টে অনেক সুবিধে দিদিমা, দেখেন না এখন বেশির ভাগ লোক প্যান্ট পরে। কালীর তো বয়স কম। ও লাফাবে ছুটবে ঝাঁপাবে তখন তো ধুতি খুলে যেতে পারে।”
সুলতার মনে হল ছেলেটা বিচক্ষণও বটে। ”বেশ কালকেই কালীকে বিকেলে নিয়ে গিয়ে তুই কিনে নিস। কত পড়বে একজোড়ার দাম?”
কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে ধানু বলল, ”চারশো টাকায় দুটো প্যান্ট হয়ে যাবে। যদি আরও ভাল চান তো বারো—তেরোশো টাকা।”
”ওরে বাবা বলিস কী।” অত টাকা কিন্তু আমার নেই। রোববার আন্না আসবে ছেলেকে দেখতে, বলব দুটো প্যান্ট কিনে দিয়ে যা নয়তো শিবুর পুরনো দুটো পাঠিয়ে দে।”
রবিবার ধানুর স্কুলে যাওয়া নেই, ভোরে বাজারে সবজি আনাজ পৌঁছে দিয়ে, ঘণ্টাতিনেক নিজের পড়া করে আর বোনেদের পড়িয়ে কালীর অ আ ক খ কতদূর এগোল জানার জন্য রওনা দিল সুলতার বাড়ি। আন্নাকালী তার ছোট্ট মেয়ে কৃষ্ণকলিকে সঙ্গে নিয়ে সন্দেশের বাক্স হাতে তখনই হাজির হয়েছে। বোনকে দেখেই কালী ছুটে গিয়ে দু’হাতে তাকে তুলে বনবন করে ঘোরাতে শুরু করল। সাত আট পাক ঘুরিয়ে নামিয়ে দিয়ে তারপর জড়িয়ে ধরল মাকে। প্রায় একমাস পর সে মাকে কাছে পেয়েছে।
”জানো মা, আমি ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি।” গর্বে আর আনন্দে কালী উচ্ছ্বসিত।
সুলতা বললেন, ”দিলুম শিক্ষা নিকেতনে ভর্তি করে। কাল থেকে পড়তে যাবে। বড়দিমণিকে অনেক করে বলে ফোর কেলাসে নিইয়েছি তবে বলে দিয়েছেন, ওয়ান কেলাসে নামিয়ে দেবেন যদি পড়া না পারে। একটা ছেলেকে রেখেছি পড়াবার জন্য, কাল পড়া দিয়ে গেছে। আন্না তোর কাছে হাজারখানেক টাকা হবে?”
অবাক হয়ে আন্না বলল, ”অত টাকা! কেন কী দরকার?”
”কালীর দুটো ফুলপ্যান্ট কিনতে হবে আর সাট্টিফিকেটে ওর বয়স বাড়াতে দুশো টাকা খরচা লাগবে। চটিটারও তো এখন তখন অবস্থা। জামাইয়ের তো অনেক প্যান্ট আছে দুটো প্যান্ট আর জামা গেঞ্জি পাঠিয়ে দিস না, কালীর গায়ে লেগে যাবে।”
আন্না ভ্রুকুটি করে বলল, ”আমার ছেলে পুরনো জামাকাপড় পরবে কেন, ও ভিখিরি, না হাঘরে।” হাতের ব্যাগ খুলে সে পঞ্চাশ ও একশো টাকার নোট মুঠোয় বার করে মা’র হাতে দিয়ে বলল, ”তোমার কাছে রেখেছি ডাকাত না হয়ে যাতে মানুষ হয় আর সেজন্য যত টাকা লাগে আমি দোব। ভগবান আশীব্বাদ করে ওকে আশ্চর্য রকমের একটা শরীর দিয়েছেন পিথিবীতে আর কোনও ছেলের এমন বডি আছে? আগের জন্মে কত যে পুণ্যি করেছিলুম তাই এ জম্মে আমি ওর মা হয়েছি।” বলতে বলতে আন্নার দু’চোখ ছলছল করে উঠল।
‘শুধু কি গতর রে আন্না! ওর মাথাটার মধ্যে ভগবান কী জিনিস যে ভরে দিয়েছেন তা বোঝা দুষ্কর। যা একবার শুনবে ঠিক মনে করে রেখে দেবে। দেখবি?”
সুলতা ডাকলেন কালীকে। সে তখন বোনকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরের উঠোনে কামিনী গাছ থেকে ফুল পাড়ছে। একটা হলুদ ছোট্ট পাখি ফুড়ুত করে উড়ে এসে বসল নিম গাছে। ফুল থেকে চোখ সরে গেল কৃষ্ণকলির। কালী বলল, ”ওটা বেনেবউ। কী সুন্দর, না?”
”আমাদের বাড়িতে ময়না আছে। সেটাও খুব সুন্দর, মা রোজ ভাত খেতে দেয়।”
”ওই দ্যাখ পাখিটা কেমন উড়ে উড়ে খেলা করছে। তোদের ময়নাটা করে?”
”কী করে করবে, থাকে তো খাঁচার মধ্যে। খাঁচার মধ্যে কি ওড়া যায়?”
কালী চুপ করে রইল। আবছা কষ্ট ছাপ ফেলল তার মুখে। অস্ফুটে বোনকে বলল, ”উড়তে না পারার জন্য ওর দুঃখু হয়।”
”তুমি জানলে কী করে দুঃখু হয়?”
”আমি জানি…হয়।”
তখনই দিদিমার ডাক শুনতে পেয়ে সে বোনকে নিয়ে বাড়ির মধ্যে এল।
”ধানু তোকে কাল যে পড়া আর লেখাগুলো করতে বলে গেছল করেছিস? বলব কী আন্না এই অ্যাত্ত মুখস্ত আর লেখা।” সুলতা দুটো হাত বিস্তার করে দেখালেন। ”কাল রাতে না খেয়ে না দেয়ে পড়েছে আর লিখেছে। দ্যাখা না কালী, মাকে দ্যাখা না।” সুলতা ছেলেমানুষের মতো ছুটে গিয়ে কাগজগুলো নিয়ে এলেন।
আন্নাকালীর বিদ্যাবুদ্ধি তার মায়েরই মতন। অবশ্য অ আ ক খ সে বোঝে, নিজের নামটাও লিখতে পারে। কাগজ ভর্তি আ ই দীর্ঘ ঈ—র চিহ্নগুলো সে চিনতে পারল। একটা কাগজে পরপর লেখা কালী কিংকর ঢালি, লেখা দেখে আন্না বানান করে করে পড়ে ছেলেকে জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল, ”করেছিস কী, একরাতেই নামটাও লিখতে শিখে গেছিস।”
সেই সময় বাড়িতে ঢুকল ধানু। সুলতা মেয়েকে বললেন, ”আন্না, এই হল কালীর মাস্টার ধানু। এখানকার ছেলে, এই বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। পড়াশুনোয় খুব ভাল। অঙ্কে একশো পাঁচের মধ্যে একশো পেয়েছে।”
আন্না অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, ”অ্যাতটুকু ছেলে, পারবে কালীকে পড়াতে?”
সুলতা এবার ধানুকে বললেন, ”হ্যাঁ রে ধানু, কালীর মা বলছে পারবি পড়াতে?”
ধানু ঠোঁট কামড়ে বলল, ”কালীকে পড়াতে হয় না দিদিমা, শুধু দেখিয়ে দিতে হয়, আর বলে দিতে হয়। পড়াটা ও নিজেই করে নেয়।”
কালীর লেখা কাগজগুলো হাতে নিয়ে ধানু দেখতে লাগল। তারপর সে কালীকে স্বরবর্ণ অ থেকে ঔ মুখস্থ বলতে বলল। নির্ভুলভাবে কালী বলে গেল। তারপর ব্যঞ্জন বর্ণ। ক থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত বলতে গিয়ে মাত্র দু’বার তার আটকাল।
আন্না মায়ের কানে ফিসফিস করে বলল, ”মাস্টার তো খুব ভাল। মাইনে কত?”
”টাকা তো তুই দিবি, এখনই কথা বলে নে।”
গম্ভীর হয়ে গেল আন্না। হিসেবি গলায় বলল, ”একদিনের পড়া থেকে অবশ্য কিছু বোঝা যায় না তুমি কেমন মাস্টার, তবে আন্দাজ একটা পাওয়া যায়।” হাতের সোনার বালাটা ঘোরাতে ঘোরাতে সে বলল, ”উঁচু ক্লাসের ছাত্তর নয় কালী, তোমাকে বেশি খাটতে হবে না। বলো কত মাইনে নেবে?”
ধানু যেন তৈরিই ছিল প্রশ্নটার জন্য। বলল, ”আপনার মেয়ে কী স্কুলে পড়ে?”
”ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে কে জি—টুতে।”
”ওর প্রাইভেট টিউটর আছে?”
এবার সুলতা আগ বাড়িয়ে জবাব দিলেন। ”মাস্টার থাকবে না? ইংরিজি তা হলে পড়াবে কে? হ্যা রে, আন্না, কত যেন মাইনে নেয় আন্টি?”
”এম এ পাশ। কমই নেন, পাঁচশো টাকা।”
সুলতার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ”শুনলি তো ধানু, এম এ পাশ। তুই তা হলে একশো নে।”
ধানুর মুখ কঠিন দেখাল। ”আমি এখনও মাধ্যমিক পাশও করিনি। ঠিক কথা। কিন্তু চার বছরের পড়া এক বছরের মধ্যে করিয়ে দেওয়াটা সহজ ব্যাপার নয়। কালীর মতো পড়ুয়া ছেলে এমন অসাধারণ ওর মেমারি দেখেই রাজি হয়েছি। ফাঁকি আমি দোব না, দিতে পারবও না। আন্টিকে যে টাকা দেন আমাকেও তা দিতে হবে।” শেষের বাক্যটি বলার সময় ধানুর স্বর শক্ত হয়ে উঠল।
আন্না ভ্রু কুঁচকে চোখ সরু করে তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে ধানুকে দেখছিল। মনে মনে জরিপ করে নিচ্ছিল এই কিশোরের মানসিক ক্ষমতাটা। কীসের জোরে এতটুকু ছেলে বলল, আন্টিকে যে টাকা দেন আমাকেও তা দিতে হবে। অনেক ধরনের মানুষ ওই ডাকাতের বউকে দেখতে হয়েছে, অনেক রকমের বিপদ—আপদ থেকে বুদ্ধি করে তাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। সুলতাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে সে গলা নামিয়ে বলল, ”মনে হচ্ছে ছেলেটা সলিড। মা রাজি হয়ে যাও। টাকাটা বড় কথা নয়। কালীকে শিক্ষিত করে তুলতে হলে এই ছেলেটাকে দরকার।”
মেয়ের জ্ঞানগম্যির উপর সুলতার অগাধ আস্থা। গত সাত আট বছর ডাকাত স্বামীকে চরাচ্ছে, ডাকাতি আর তোলাবাজি ছাড়িয়ে বাড়ির প্রমোটারি ব্যবসায় নামিয়ে শিবুকে ভদ্রসমাজে মেলামেশার উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টায় আন্না অনেকটা সফল, মেয়েকে ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। এসবই সুলতার গর্বের কারণ।
”দ্যাখ ধানু,” সুলতা গভীর চিন্তার মধ্যে ডুবে গেছেন এমন একটা ভাব নিয়ে বলতে শুরু করলেন। ”টাকাটা তো কোনও ব্যাপার নয়, এম এ পাশ করাটাও নয়। আসল কথা হল যত্ন নিয়ে ফাঁকি না দিয়ে পড়ানো। কিন্তু পড়াবে কী করে তোর তো ছোট্টখাট্ট দুবলা টিঙটিঙে শরীর। তোকে মোটা হতে হবে। আর সেজন্য দু’বেলা আমার এখানে ভাত খেতে হবে। সকালে ইস্কুলে যাওয়ার আগে আর রাতে কালীকে পড়িয়েটড়িয়ে বাড়ি ফেরার আগে। রাজি কি না বল?”
সুলতার এহেন প্রস্তাবে ধানু তাজ্জব হয়ে গেল। শুধু বলল, ”মাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু বলতে পারব না।”
ধানু চলে যাওয়ার পর সুলতা আন্নাকে বললেন, ”কেন খেতে বললুম বল তো? রাতে খেতে দিতে দেরি করলে ওই সময়টা বেশি পড়িয়ে নেওয়া যাবে।”
মায়ের বুদ্ধির বহরে আন্না তো চমৎকৃত।
.
কালী প্রথম দিন স্কুলে যাওয়ামাত্র বড়দিদিমণি দেবিকা তাকে স্বাগত জানালেন, ”আরে কিং কং, এসো, এসো। ফুলপ্যান্ট পরে ভালই করেছ। যাও, ক্লাসে বোসো।” ক্লাস ফোরের ঘরটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তিনি কথা বলে যেতে লাগলেন এক ছাত্রীর মায়ের সঙ্গে।
একটু পরে দেবিকা ক্লাস ঘরে ঢুকে দেখলেন কালী জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে।
একটি ছেলে বলে উঠল, ”দেখুন না বড়দি, এই লোকটা এসে বেঞ্চিতে বসেছিল। আমরা সামনে কিছু দেখতে পাচ্ছিলুম না।”
”আরে ও লোক নয়, লোক নয়, তোমাদের থেকেও বয়সে দু’ তিন বছরের ছোট। ওর নাম কালী কিং কং ঢালি। চেহারাটাই যা বড়, এখন থেকে ও তোমাদের সঙ্গে পড়বে। কালী তুমি পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বোসো।”
সারা ক্লাস অবাক চোখে কৌতূহল ভরে মুখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে কালীকে দেখতে থাকে, তাইতে অস্বস্তিতে সে থেমে উঠল। দেবিকা পড়ালেন ভূগোল। ভারতের সীমানা আর জলবায়ু ছিল পাঠের বিষয়। কালী চুপচাপ বসে শুনে গেল। সকলেই বই এনেছে শুধু তারই বই নেই। সঙ্গে শুধু খাতা আর কলম। ছুটির পর দেবিকা তাকে বললেন, ”স্কুল থেকে কবে বই পাবে তার ঠিক নেই, দোকান থেকে বই কিনে নিয়ো, আজই।”
সেই দিন বিকেলেই সুলতা ধানকুড়ির একমাত্র বইয়ের দোকান পপুলার বুক স্টোর থেকে ক্লাস ফ্লোরের যাবতীয় বই কিনে আনেন। সন্ধ্যায় ধানু পড়াতে এসে দেখে কালী ভূগোল বই খুলে বানান করে করে পড়ার চেষ্টা করছে। তাই দেখে ধানু সুলতাকে বলল, ”দিদিমা আমি দু’বেলা কালীকে পড়াব। সকালে আমার বই নিয়ে এখানে চলে আসব নিজে পড়ব আর কালীকে পড়াব, এখান থেকেই চান করে ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যাব।”
পুলক চেপে সুলতা বললেন, ”তোমার বোনেদের সকালে পড়াও, তার কী হবে?”
”সে হয়ে যাবে। ওরা লিখতে পড়তে জানে, ফাইভ সিক্সের যা পড়া তা নিজেরাই পড়ে নিতে পারে। আটকে গেলে তখন বুঝিয়ে দিয়ে হেলপ করব, সেটা বিকেলেও করা যাবে।”
সুলতা এবার আন্তরিকভাবে বললেন, ”আর তোর নিজের পড়া? অঙ্কে তো তুই কাঁচা, তার কী হবে? একশো পাঁচের মধ্যে একশো পাঁচ কিন্তু বড় পরীক্ষার তোকে পেতেই হবে। ধানু, এবার তুই মাস্টারের কাছে পড়। তোর নিজের মাস্টারি করার টাকাটা এবার খরচ কর।”
ধানু মন দিয়ে এই প্রৌঢ়ার কথাগুলো শুনল, মনে গেঁথে নিল এবং মা—কে রাত্রে জানাল।
”তোকে টিউশনির টাকা সংসারে দিতে হবে না।” মা বলেছিলেন, ”তোকে দাঁড়াতে হবে। পরীক্ষায় ভাল ফল না করলে দাঁড়াবি কী করে। তোর বাবা কী কষ্টটা করেছেন সে তো দেখেছিস, তাঁর কী মনের আশা ছিল তাও জানিস। এতগুলো টাকা পাচ্ছিস তাকে ভালমতো ব্যবহার কর। সংসার যেমন করে চলছে তেমনই চলবে।”
ধানু জানত মা এইরকম কথাই বলবে। স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক মধুসূদন ভটচাজ বাড়িতে কয়েকজন ছাত্র পড়ান। পরদিনই ধানু মধুবাবুর কোচিং—এ ভর্তি হয়ে যায়। সপ্তাহে দু’দিন চারশো টাকা।
বিকেলে ধানু খালপাড়ের খেলার মাঠে যায়। তার স্বাস্থ্য ফুটবলের মতো ধাক্কাধাক্কির খেলার উপযুক্ত নয়। মাঠের একধারে কবাডি খেলা হয়। সেখানেই সে দেখতে পায় কালীকে। কবাডি মাঠের ধারে সে তুমুলভাবে দুটো দলের কোনও একটিকে সমর্থন করে যাচ্ছে, ধানু তাকে বলেছিল, ”তুমিও খেলো না কেন? গায়ে তোমার এত জোর! খুব সরল খেলা দু’বার দেখেই তো শিখে ফেলা যায়। খেলতে চাও তো শক্তি সঙ্ঘকে বলি ওখানে আমার চেনা আছে।”
”ধানুদা আমার বয়স জানলে ওরা আমাকে খেলতে নেবে না।”
”বয়স জানাব না। বলব তোমার বয়স—কত বলব?” জিজ্ঞাসা করল ধানু কালীকেই।
ফাঁপরে পড়ল সাড়ে ছয় বছরের পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির ছেলেটি। হতভম্ব চোখে সে ধানুর দিকে তাকিয়ে রইল। হেসে ধানু বলল, ”আঠারো।”
শক্তি সঙ্ঘ লুফে নিল কালীকে। ওদের একজন বলিষ্ঠ রেইডার দরকার ছিল যে একটা হানাতেই দু’জনকে অন্তত মোড় করে আসতে পারবে। কালী তাদের আশা পূরণ করল। কালীর উচ্চচতা গড়পড়তা বাঙালি পুরুষের মতো তাই লোকের চোখে পড়ে না, তবে কথা বললেই বোঝা যায় সে বালক কিন্তু সে লোকের সঙ্গে কথা বলে না। তাই পাঁচজনের একজন হয়েই সে ভিড়ে মিশে রইল।
একদিন ভোররাতে প্রবল ঝড়বৃষ্টি ধানকুড়ির উপর নেমে এল। আধঘণ্টা প্রলয় চালিয়ে ঝড় উধাও হল বৃষ্টিকে সঙ্গে নিয়ে। সুলতা বললেন, ”কালী ইস্কুলে যাবি? যা দুর্যোগ গেল, মনে হয় না তোর ইস্কুলবাড়ি আস্ত আছে, যা একবার ঘুরে আয়।”
বই খাতা ভরা থলি কাঁধে ঝুলিয়ে কালী স্কুলে যাবার জন্য বেরোল। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, ধানুদা কি ভ্যানরিকশা নিয়ে বেরোতে পেরেছে? ছোট গাছগুলো উপড়ে পড়ে আছে। অশ্বত্থ গাছের বড় মোটা একটা ডাল ভেঙে পড়ে আছে রাস্তায়, সেটা এড়িয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার মনে হল একটা ‘ব্যা আ আ’ শব্দ যেন সে শুনতে পেল। কৌতূহলী হয়ে সে ভাঙা ডালটার দিকে এগিয়ে গেল।
ডালের পাতাগুলো সরিয়ে সে দেখতে পেল, একটা ছাগল ডাল চাপা পড়ে মরে রয়েছে আর একটা ছোট্ট ছাগলছানা কীভাবে যেন বেঁচে গিয়ে মরা ছাগলটার কোলের কাছে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে। কালী পাতা সরাতেই মুখ তুলে ‘ব্যা আ আ’ করে ডেকে উঠল। কালী বুঝল মরা ছাগলটা এই ছানার মা। সে সন্তর্পণে দুহাত দিয়ে তুলে দাঁড় করিয়ে দিতেই ছানাটা হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল।
ছাগলছানাটাকে কোলে নিয়ে কালী স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে সুলতাকে ডেকে বলল, ”দ্যাখো দিদিমা, কাকে এনেছি। গাছচাপা পড়েছিল শিবতলার কাছে। মা’টা মরে গেছে। আমার মনে হচ্ছে এর পা ভেঙেছে, একটু দ্যাখো তো।”
”আহা রে!” বলে সুলতা কালীর হাত থেকে ছানাটাকে নিয়ে নিলেন।
কালী আশ্বস্ত হয়ে আবার স্কুলের দিকে রওনা হল। সেখানে পৌঁছে দেখল, স্কুলের ঘরের টালির চালা ভেঙে ক্লাস ঘরের বেঞ্চের উপর পড়ে রয়েছে। কিছু টালি উড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বড় বাড়ির উঠোনে। বড়দিদিমণি দেবিকা আর অধীরবাবু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে। ছোটদিদিমণি রাধারানি টালি সরিয়ে একপাশে জড়ো করে রাখছেন। প্রায় তিরিশটি ছেলেমেয়ে একটু দূরে জটলা করে ভয় ভয় চোখে স্কুলের দশার দিকে তাকিয়ে।
দেবিকা বললেন, দেখতেই তো পাচ্ছ কী অবস্থা? আজ বাড়ি যাও তোমরা, বড় বাড়ির মাঠে ক্লাস করা যায় কি না তাই নিয়ে হেডমাস্টার মশায়ের সঙ্গে আজ কথা বলব। তোমরা কাল এসো।”
কালী বাড়ি ফিরে আসছে এবার অন্য একটা সরু পায়ে চলা পথ দিয়ে। একই রাস্তা দিয়ে বারবার হাঁটতে তার ভাল লাগে না। দু’ধারে ঝোপ আর তার মধ্যে বড় বড় গাছ। এই পথটা হেকিমপুকুর নামে আগাছাভরা বড় জলাশয়ের ধার দিয়ে একটা বড় বাঁশবনের পাশ কাটিয়ে ফণীমনসা ঝোপের ধার ঘেঁষে তার বাড়ির দিকে গেছে। যেতে যেতে কালী দেখল একটা বিশাল রাধাচুড়া গাছের তলায় গোটা পঁচিশ কাক ওড়াওড়ি করছে আর ‘কা কা’ শব্দে ডেকে চলেছে। কিছু একটা জিনিসকে ওরা ঠোকরাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। বড় বড় ঘাসের জন্য কালী জিনিসটা দূর থেকে দেখতে পেল না।
কালী পায়ে পায়ে সতর্ক ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল। ব্যাপারটা কী তাকে দেখতে হবে। তাকে দেখে কাকগুলো অল্প হটে গেল। আর একটু এগিয়ে সে পাখির মাথা দেখতে পেল, মাথাটা কাক শালিখ ছাতারে এমনকী চিলের মাথার থেকেও বড়। মাথাটা সাদা। কালী কৌতূহলী হয়ে আরও এগোল। পাখিটা তাকে দেখতে পেয়েছে কিন্তু উড়ে যাওয়ার কোনও চেষ্টা করল না। উবু হয়ে যেমন বসেছিল তেমনই বসে রইল।
পাখিটার ভাবভঙ্গি দেখে কালীর মনে হল, ওর ওড়ার ক্ষমতা নেই। বোধহয় ঝড়ের দাপটে আকাশ থেকে ছিটকে এসে পড়েছে। ঠোঁট দুটি তীক্ষ্ন এবং বাঁকানো। হিংস্র ও শিকারি পাখি কিন্তু এখন অসহায়। কালী তার সাড়ে ছয় বছরের বুদ্ধিতেই বুঝে গেছে একবার যদি ঠোকরায় তা হলে মাংস খুবলে নেবে। সে কাকগুলোকে তাড়াবার জন্য একটা মরা সরু ডাল কুড়িয়ে নিয়ে ”হেই হুশশ” করে ঘোরাতে শুরু করল। কাকেরা পিছিয়ে গেল, অনেকে গাছে চড়ে বসল কিন্তু পালাল না বরং দ্বিগুণ রবে ‘কা—কা—কা’ শুরু করে দিল।
এইবার কালী পাখিটার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। তার মনে হল পাখিটার চাহনিতে স্বস্তি ফুটে উঠেছে, মোলায়েম হয়েছে চোখের মণি, গলা থেকে বুক পর্যন্ত পালকের রং সাদা। ঘাড়ের কাছে ইটের রং, ডানা আর পিঠ আরশোলা রঙের। পাখিটা মুখ তুলে হাঁ করল, মুখের মধ্যেটা গোলাপি। গোটা শরীর আকারে চিলের থেকে সামান্য বড়।
কালী আলতো করে ওর মাথায় আঙুল ছোঁয়াল, পাখিটা চোখ বন্ধ করে ফেলল। আঙুলটা আস্তে দু’তিনবার বোলাল, মাথাটা নামিয়ে পাখিটা এবার যেন জানিয়ে দিল ‘আমার ভাল লাগছে।’ দু’পায়ে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। সারা পা সাদা লোমে মোড়া। কালীর মনে হল যেন সাদা ফুল মোজা পরে রয়েছে, দেখে তার মজাই লাগল । সে পাখিটার দু’পাশ ধরে তুলে নিল। চুপটি করে থেকে সে মাথা বাঁকিয়ে শুধু কালীর মুখের দিকে তাকাল। কাকগুলো অর্ধেক পথ কালীর চারপাশে ঘিরে উড়ে অবশেষে ফিরে গেল। বাড়িতে ঢুকেই কালী হাঁক পাড়ল। ”দিদিমা, দেখে যাও। আর একজনকে এনেছি।”
সুলতা তখন ছাগল ছানার সামনের ডান পায়ে কাপড়ের পাড় জড়িয়ে ব্যান্ডেজ করছিলেন।
”আবার কাকে আনলি।” বলে পিছনে মুখ ফিরিয়ে দেখলেন উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে বড় মোরগের আকৃতির একটা পাখি। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সুলতা। ”ওমমা, এ তো ভারী সুন্দর দেখতে রে, কোথায় পেলি?”
‘হেকিমপুকুরের ধারে গাছের নীচে কাকে ঠোকরাচ্ছিল, উড়তে পারে না।”
”কেন পারে না?”
”সেটা দেখতে হবে। ইস্কুল ছুটি দিয়ে দিল ঘরের চালা ভেঙে পড়েছে। যদি বড়বাড়ির হেডমাস্টার মশাই বলেন তো ওঁদের মাঠে ক্লাস হবে। দিদিমা ছানাটার পায়ে কী হয়েছে?”
”বোধহয় ভেঙেছে, মনে হচ্ছে খিদে পেয়েছে রে কালী। কার ছাগল বাচ্চচা কে জানে, খোঁজ নিয়ে ফেরত দিতে হবে। মায়ের দুধ তো দিতে পারব না, গরুর দুধই খাওয়াই।” দুধের সন্ধানে সুলতা গোয়ালঘরে ঢুকলেন বাটি হাতে।
কেন উড়তে পারছে না জানার জন্য কালী পাখিটাকে তুলে ধরে ছুড়ে দিল আকাশের দিকে। ডানা বিস্তার করে দু—তিনবার ঝাপটাল এবং উঠোনে পড়ে গেল। অবাক হয়ে কালী দেখল পাখিটার ডানার পালক কেটে নেওয়া হয়েছে এমনভাবে, যাতে উড়তে না পারে। কাজটা মানুষেরই করা। কে করেছে কেন করল তাই নিয়ে কালী মাথা ঘামাল না। দুধের বাটি হাতে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে আসা দিদিমাকে সে বলল, ”এই পাখিটারও কিন্তু খিদে পেয়েছে। দুধ একেও দাও দিদিমা।”
”দুর বোকা এসব পাখি নিরিমিষ্যি খায় না, ইঁদুর টিকটিকি ছোটখাটো সাপ পায়রা শালিক এইসব খায়। পুকুরে গিয়ে দেখি গেঁড়ি কি গুগলি পাই কি না।”
”দিদিমা পাখিটাকে আমি পুষব।”
”বেশ তো। এমন চেহারার পাখি তো আমি জন্মে দেখিনি। পোষ মানবে কি না জানি না।”
বিকেলে ধানু আসতেই কালী প্রবল উৎসাহে পাখিটাকে দেখাল। ধানু তো দেখে চমৎকৃত।
”কী পাখি আমি বলতে পারব না তবে মধুবাবু হয়তো বলতে পারবেন। ওঁর বাড়িতে এইসব বিষয়ে অনেক বই আছে।”
দু’দিন পর ধানু জানাল, ”মধুবাবু আমার কাছ থেকে সব শুনে বইটই খুলে বললেন, ভারত থেকে উত্তর—পূর্ব অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত চিলের মিলভিনে প্রজাতির একটা শাখা হয়তো হতে পারে। খুব বিরল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সমুদ্রের ধারে আর বাদা অঞ্চলে দু’চারটে দেখা যায়। ওরা মাছ খায়, গেঁড়ি গুগলিও খায়। বাংলায় এই পাখিকে সিন্ধু—গরুড়ও বলে।”
মন দিয়ে শুনে কালী বলল, ”ধানুদা, এর একটা নাম ঠিক করে দাও।”
”নাম তো সিন্ধু—গরুড় রয়েছেই, তুই একে গরুড় বলবি।”
ঠিক সেই সময় ঘরের বাইরের দাওয়া থেকে ”ব্যা—আ—আ’ শব্দ ভেসে এল। ছাগল ছানাটাকে সুলতা একটা চটের থলির উপর শুইয়ে রেখেছেন।
”ধানুদা, ওই শোনো আর একজনও নাম চাইল। তবে দিদিমা বলছিল কুড়িয়ে পাওয়া তাই কুড়োন নাম রাখতে। তুমি কি বলো।”
”খুব ভাল নাম, একজন কুড়োন আর অন্যজন…।” ধানু ভাবতে লাগল।
”উড়োন।’ কালী লাফিয়ে উঠে বলল। ”ও তো একদিন না একদিন উড়বেই, ডানার পালক কি চিরকাল ছোটই থাকবে।”
কালীর কথাই ঠিক। উড়োনের পাখার পালক যেমন ধীরে ধীরে বাড়ল তেমনি কালীও একটু একটু করে আরও লম্বা হল, কুড়োন তিন পায়ে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে বেড়াতে শুরু করল। ধানুও মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসল।
কালী ক্লাস ফাইভে ভর্তি হল বড়বাড়িতে। হেডমাস্টার প্রণব মাইতি শুনেছিলেন, ছোটবাড়ির একটি ছেলে অস্বাভাবিক লম্বা, প্রবল স্মৃতিধর এবং অবিশ্বাস্য পরিশ্রমী। মাত্র এক বছরেই সে অ আ ক খ এবং এক দুই তিন চার শিখে ক্লাস ফোর—এর পড়া শেষ করেছে। দেবিকা ঘোষাল তাঁকে একথাও বলে গেছেন যে, ”দেখবেন ও ছ’বছরের পড়া তিন বছরে শেষ করে স্টার নিয়ে মাধ্যমিক পাস করবে।”
প্রণব মাইতি অবশ্য ছোটবাড়ির বড়দিদিমণির কথা বিশ্বাস করেননি। তার মনে হয়েছে ছেলেটা আর সবার মতোই বাড়িতে পাঁচ ছয় বছর বয়স থেকে পড়া শুরু করে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়েছিল। বার্থ সার্টিফিকেটে তিনি দেখেছেন কালীকিঙ্কর ঢালির এখন বয়স বারো। অস্বাভাবিক কিছু নয়, শুধু ওর উচ্চচতাটাই স্বাভাবিক নয়। হেডমাস্টার শুনেছেন কালীকিঙ্কর যখন ক্লাস ফোর—এ ভর্তি হয় তখন ছিল পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চি। এক বছর পর এখন তার মনে হচ্ছে উচ্চচতাটা ভুল রয়েছে, ছেলেটা আরও লম্বা।
তার মনে হওয়ার কারণ একদিন তিনি লাইব্রেরিতে ভারতের নদীর ম্যাপ নিতে যান ক্লাসে যাওয়ার আগে। কালী তখন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল একটা বই নেওয়ার জন্য। প্রণব মাইতি কালীর গা ঘেঁষে এসে আড়চোখে দেখেন তাঁর কাঁধ ও কালীর কাঁধ সমান্তরাল রেখায় এবং তিনি পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চি। ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম হতেই তিনি অস্বস্তিতে পড়ে যান—ক্লাস ফাইভেই কলেজের উচ্চচতর ছাত্র! ক্লাস টেন—এ তা হলে কী দাঁড়াবে!
.
স্কুলে হইহই পড়ে গেল। সুধন্য হালদার, গরিব ভ্যানরিকশাচালকের ছেলে স্টার পেয়ে মাধ্যমিক পাস করেছে। তার নম্বর চারটি লেটার সহ ছ’শো তিপ্পান্ন। এক বাক্স সন্দেশ হাতে নিয়ে ধানু সুলতাকে প্রণাম করতেই তিনি কাঁটা হয়ে গেলেন, ”বামুনের ছেলে পায়ে হাত দিলি, আমার নরক বাস যে সাত জম্মো ধরে হবে রে, এ কী করলি ধানু!” সুলতা হায় হায় করে উঠলেন।
ধানু হেসে বলল, ”হয় যদি হবে। দু’বেলা আপনার অন্ন ধ্বংস করেছি আপনার পুণ্যিও নয় খানিকটা ধ্বংস করলুম।”
”অঙ্কে পুরো নম্বর পেয়েছিস তো?”
”না দিদিমা, আট নম্বর কেটে রেখে দিয়েছে।”
হতাশ সুলতা বললে, ”একশো পাঁচ তোর কপালে আর নেই।”
টেলিফোনে কালীর কাছ থেকে খবর পেয়ে শিবুর মোটরবাইকের পিছনে বসে একঘণ্টার মধ্যে আন্নাকালী পৌঁছে গেল। ধানকুড়ির সীমানার বাইরে ই এম বাইপাসে আন্নাকে নামিয়ে দিয়ে শিবু সোনারপুর চলে গেছে, একঘণ্টা পর এখান থেকেই সে বউকে আবার তুলে নেবে। শীতলাতলায় বামুনপাড়াটা আন্না চেনে। সোজা সেখানে চলে গেল পলিথিনের ব্যাগটা হাতে নিয়ে। ধানু এখন বিখ্যাত ছেলে তার বাড়ি খুঁজে নিতে তিরিশ সেকেন্ডও খরচ হল না। তখন বাড়িতে মা আর বোনেরা ছিল।
টিনভর্তি রসগোল্লা, ফুলপ্যান্ট ও বুশশার্ট মায়ের হাতে দিয়ে আন্না জানতে চাইল ধানু এবার কোথায় পড়বে?
মা বললেন, ”টালিগঞ্জে, নয়তো কাছেই গড়িয়ায় উচ্চচ মাধ্যমিক পড়তে চায়, কলকাতায় ভাল ইস্কুলে তো এই নম্বরে ভর্তি নেবে না।”
”যাতায়াতে তো অনেক সময় যাবে।”
”তা তো যাবেই।”
”তা হলে কালীকে পড়াবে কখন? কালীর বাবার একটা স্কুটার পড়ে পড়ে পচছে। ধানু ওটা নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করুক, সময় বাঁচবে। পেট্রল খরচ আমার। স্কুটার চালানোটা ওকে শিখে নিতে হবে।”
কালীর পড়াশুনোয় এতটুকু ব্যাঘাত আন্না হতে দেবে না।
ধানুদের বাড়ি থেকে আন্না এল বাপের বাড়ি। কালী তখন স্কুলে। সুলতা বাইরের উঠোনে ধানঝাড়াই তদারক করছিলেন। একটা প্রায় তিনতলা সমান বাঁশ কালী উঠোনে পুঁতে দিয়েছে, উড়োন সেই বাঁশের ডগায় বসে ধানঝাড়া দেখছে। এখনও সে দূরে উড়ে যেতে পারে না। তার ডানার পালক পুরোপুরি গজায়নি। একদিন আকাশে কিছুটা উঠেছিল। তখন একটা চিল কোথা থেকে উড়ে এসে তাকে তাড়া করে। ডানার পূর্ণতা না থাকায় সে আকাশে মহড়া দিতে পারেনি। ঠোকরানি খেয়ে উঠোনে নেমে পড়ে। কালী ওর মাথায় মলম লাগিয়ে দিয়েছিল।
কুড়োন এখন ভালই হাঁটে, তবে খুঁড়িয়ে। সুলতার যত্নে এখন সে হৃষ্টপুষ্ট, উজ্জ্বল হয়েছে কালো চামড়া। বড়ির মতো দুটো শিংও দেখা যাচ্ছে। সুলতা বাড়ির পিছনের পাঁচ কাঠা জমিতে আনাজের ছোট বাগান করেছেন। সেখানে বেগুন, কুমড়ো, ঢ্যাঁড়স, লঙ্কা, মানকচু ওল আর মাচা করে ঝিঙে, চিচিঙ্গে, করলা, উচ্ছে লাগিয়েছেন। প্রতিদিন পরিচর্যা করেন গাছপালার, সঙ্গে থাকে কালী। বালতি বালতি জল এনে ঢালা, খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে গোবরসার, খইলসার দেওয়ার কাজ কালীই করে। খিড়কির দরজা দিয়ে যেতে হয় আনাজের বাগানে। কুড়োন হাঁটাচলা শুরু করার পর থেকেই খিড়কি দরজা বন্ধ করে রাখেন সুলতা।
একদিন সকালে বাগানে কাজ করে এসে কালী বলল, ”দিদিমা কুমড়ো ফুলগুলো বেশ বড় বড় হয়েছে ভাজা খাওয়াও না, অনেকদিন খাইনি।”
নাতির আবদার শুনে সুলতা চাল গুঁড়োলেন। বাগান থেকে কমলা রঙের গোটা কয়েক কুমড়ো ফুল তুলে আনলেন। লঙ্কা দিয়ে চালগুড়োয় মাখিয়ে ভেজে কালীকে খাওয়ালেন। রাত্রে বাড়ির দরজাগুলো তিনি নিজের হাতে বন্ধ করেন। এটা তার বহু বছরের অভ্যাস। প্রথমেই দেখে নেন খিড়কির দরজা বন্ধ আছে কি না। দেখতে গিয়ে আঁতকে ”সব্বোনাশ করেছে,” বলে উঠলেন। দরজা হাট করে খোলা!
রাতটা প্রায় জেগেই কাটিয়ে পরদিন সকাল হতেই বাগানে গিয়ে সুলতা দেখলেন, পালং চারা আর কুমড়ো ডগা সাফ। রান্নাঘর থেকে কঞ্চিটা নিয়ে অপরাধীর সন্ধানে বেরিয়েই চোখে পড়ল কালী দু’হাতে উড়োনকে ধরে কুড়োনের পিঠের উপর বসাবার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা কুড়োনের মনঃপূত নয় কেন না উড়োনের তীক্ষ্ন নখগুলো তার পিঠের চামড়া আঁকড়ে ধরায় সে যন্ত্রণায় গা ঝাড়া দিয়ে ছুট লাগাল।
সুলতা কঞ্চি হাতে কুড়োনের পিছু নিলেন। ছুটে পারলেন না। কঞ্চিটা মাটিতে আছড়ে বললেন, ”হতভাগা পাঁঠা। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।” তারপর কালীর বিস্মিত মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ”একটা পালং গাছ আস্ত রাখেনি সব মুড়িয়ে খেয়েছে, কুমড়োর ডগা বলে আর কিছু নেই। বিদেয় কর, আজই, এখুনি।”
সুলতা যাকে বিদায় করতে বললেন তার ল্যাজের ডগাটি ত্রিসীমানায় সারা সকাল আর দেখা গেল না। আন্না তার কথামতো স্কুটার পাঠিয়ে দিয়েছে। একটি ছেলে কলকাতা থেকে চালিয়ে এনে ধানুকে বুঝিয়ে দেখিয়ে এবং তাকে সিটে বসিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাটি দিয়ে যায়। ছেলেটি যখন বুঝিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল কালী তখন সেখানে দাঁড়িয়েছিল। ধানু প্রায় পঞ্চাশ গজ ছেলেটির সামনে কয়েকবার টলমল করে চালায়। সাইকেল চালাতে সে ভালই জানে সুতরাং ব্যালান্স নিয়ে তাকে ঝঞ্ঝাটে পড়তে হয়নি। শুধু অ্যাক্সিলেটর, গিয়ার, ব্রেক ইত্যাদির প্রয়োগ বুঝতে সময় ব্যয় করতে হয়েছে।
প্রতিদিন ধানু বিকেলে এসে স্কুটারটি দাওয়া থেকে বার করে ধানকুড়ির ভিতরের রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষণ চালায়। ভিড় রাস্তা দিয়ে স্কুল ‘পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার মতো হাত এখনও যথেষ্ট পাকেনি। তবে যন্ত্রের নিয়মগুলোয় সড়গড় হয়ে গেছে। কালীর ইচ্ছা করে স্কুটার চালাতে। রোজ সকালে ধানু তাকে পড়িয়ে ভাত খেয়ে গড়িয়ায় তার স্কুলে রওনা হওয়ার পর কালী নিঃসাড়ে স্কুটারটি বার করে কিছুদূর হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে স্টার্ট দেয়। শব্দ শুনেই বাঁশের ডগা থেকে উড়োন উড়তে শুরু করে। ধীর গতিতে চালিয়ে সে খালপাড়ের ফুটবল মাঠে আসে। তার মাথার উপর পাক দেয় উড়োন আর স্কুটারের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর করে মাঠটা সে চক্কর দিতে থাকে। দিতে দিতে কালী খুশিতে আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে—
”হেই উড়োন আমিও আকাশে উড়ব।…..সাঁ সাঁ করে সাঁ সাঁ করে আকাশে স্কুটার চালাব। আমাকে তুই ধরতে পারবি না….কেউ ধরতে পারবে না আমাকে।” বলতে বলতে সে অদ্ভুত সুরে শিস দিয়ে ওঠে। ”লম্বা, আমি আরও লম্বা হব, পুঁচকে বেঁটেরা হাঁ করে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে….হা হা হা, তাকাবে তাকাবে! শুধু তুই তুই সিন্ধু—গরুড় আকাশ থেকে ঘাড় বেঁকিয়ে আমাকে দেখবি।”
ফাঁকা মাঠে কালি স্কুটার চালায় আর চেঁচিয়ে যায়। মিনিট দশেক পর সে বাড়ি ফিরে আসে। উড়োন তখন হেকিমপুকুরের পাড়ে উড়ে যায় শামুক আর মাছের খোঁজে। ফেরে দুপুরে। একতলা বাড়ির ছাদের দক্ষিণ দিকের কার্নিসে বসে থাকে যতক্ষণ না কালী স্কুল থেকে ফেরে। কালীকে দেখামাত্র ‘খক খক’ করে ডেকে দুটো ডানা ছড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে।
সেদিন কুড়োনকে দুপুরেও দেখতে না পেয়ে সুলতার মুখ শুকিয়ে গেল। তার শুধু মনে হতে লাগল, ওকে কেউ চুরি করল না তো? এখানে বাচ্চচা বেওয়ারিশ পাঁঠা প্রায়ই চুরি হয়। চুরি যাওয়া পাঁঠা চালান হয়ে যায় কসবা কিংবা যাদবপুরের মাংসের দোকানে। সুলতা মুখে ভাত তুলতে পারলেন না। সারা দুপুর সদর দরজার পাশের রোয়াকে বসে কাটালেন।
কালী স্কুল থেকে ফিরতেই সুলতা বললেন, ”দ্যাখ তো কালী কুড়োন রাগ করে সকাল থেকে কোথায় যে চলে গেল এখনও ফেরেনি।”
কালী মুখের দু’পাশে হাতের তালু রেখে ছাগলের ডাকের নকল করে কয়েকবার ‘ব্যা ব্যা’ আওয়াজ করল। দু’মিনিট অপেক্ষা করে আবার করল। কুড়োনের সাড়াশব্দ এবারও মিলল না। কালী হুমম শব্দ করে উড়োনকে কার্নিস থেকে উড়িয়ে দিল। উড়োন হেকিমপুকুরের দিকে উড়ে গেল।
মিনিট পাঁচেক পর দেখা গেল কুড়োন ছুটতে ছুটতে আসছে আর উড়োন ওর পিঠে বসার চেষ্টায় দুটো ডানা ছড়িয়ে ব্যালান্স করার জন্য বাঁকানো লোহার হুকের মতো নখগুলো দিয়ে পিঠটা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে। ছুটন্ত কুড়োনের পিঠে দু’তিন সেকেন্ড বসেই উড়োন আবার শূন্যে উঠল আবার বসল। যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে কুড়োন এবার সুলতার কোলে একছুটে পৌঁছে গেল। এরপর কুড়োনের পিঠে কয়েকটা চড় পড়ল এবং দুপুরে না খাওয়া সুলতার ভাত তাকে খেতে হল।
কালী ফাইভ থেকে সিক্সে উঠল প্রথম হয়ে এবং তার দেহের উচ্চচতাও নজর কাড়ার মতো ইতিমধ্যে বেড়ে গেছে। হেডমাস্টারমশাই শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম দিনই কালীকে ক্লাস থেকে ডাকিয়ে তার ঘরে নিয়ে এলেন।
”তোমার হাইট এখন কত?”
হেডস্যারের গম্ভীর স্বরে কালী মনে মনে কুঁকড়ে গেল। যখন বেয়ারা ক্লাসে গিয়ে বলল কালীকিঙ্কর ঢালিকে হেডস্যার ডাকছেন, তখন সে ভেবেছিল পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার জন্য পিঠ চাপড়ে বলবেন, ‘খুব ভাল। এবার আরও ভাল ফল করতে হবে। ইংরিজিটা নতুন বিষয়, তবে শক্ত নয়। তুমি ঠিক ধরে ফেলতে পারবে।’ ধানুদা এই ভাবেই তাকে বলেছে, হেডস্যারও নিশ্চয় এইরকমই কিছু বলবেন, কিন্তু একী অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন?
”আমি জানি না স্যার, মেপে দেখিনি।”
প্রণব মাইতি বিশাল একটা ‘হমমম’ শব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। টেবল থেকে কাগজ কাটার ছুরিটা তুলে নিয়ে দেওয়ালের কাছে গিয়ে বললেন, ”এদিকে এসো, দেওয়াল ঘেঁষে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াও!”
কালী তাই করল। হেডস্যার ছুরিটা কালীর ব্রহ্মতালুর উপর চেপে দেওয়ালে ঠেকিয়ে বললেন, ”এবার সরে দাও।”
কালী সরে গেল। ছুরি যেখানে ছিল সেইখানে দেওয়ালে দাগ কাটলেন। তারপর পেনসিল দিয়ে কালো আঁচড় টেনে বললেন, ”মনে হচ্ছে এক বছরে ইঞ্চি চারেক বেড়েছ। ছ’ ফিটের কাছাকাছি হবে। এখন যাও, টিফিনে দেখা কোরো।”
টিফিনের সময় কালী হেডমাস্টারের ঘরে গেল। দেখল একটা দৈর্ঘ্য মাপার ফিতে টেবলের উপর আর হেডস্যারের কপালের উপর দুটো রেখা।
”যা আন্দাজ করেছিলুম, পাঁচ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি। কালীকিঙ্কর তুমি যদি এইভাবে বাড়তে থাকো তা হলে ক্লাস টেনে কী হবে? একটা উৎকট বীভৎস লম্বা দৈত্য হবে।”
কালী চুপ করে রইল। শুধু দৈত্য শব্দটা কানে একঘেয়ে স্কুটার হর্নের মতো বেজে যেতে লাগল।
”কমাও, হাইট কমাও। মানুষের মতো, আমাদের মতো হাইট করো, নয়তো এই স্কুলে তোমায় রাখা যাবে না।”
ঢোঁক গিলে কালী বলল, ”কী করে হাইট কমাব স্যার?”
হেডমাস্টার নিশ্চিত স্বরে বললে, ”এটা একটা অসুখ, ডাক্তার দেখাও, নয়তো যাগযজ্ঞ করো। সব থেকে ভাল হয় বাড়িতে বসে থাকো আর পড়ো। পরীক্ষার ক’টা দিন এসে পরীক্ষা দিয়ে যেও। সুধন্য তোমার প্রাইভেট টিউটর তো, ওকে বলো আমার সঙ্গে দেখা করুক।”
আকাশ কারুর মাথায় ভেঙে পড়ে না, কিন্তু কালীর মাথায় পড়ল। সে বাড়িতে এসেই দিদিমাকে বলল হেডস্যারের কথাগুলো।
সুলতা অবাক হয়ে বললেন, ”বলছিস কী, লম্বা হওয়াটা অপরাধ? মানুষ তো লম্বা—চওড়াই হতে চায়, এটা তো ভগবানের আশীব্বাদ!” তারপরই ক্ষিপ্তস্বরে বললেন, ”দেখি তোর হেডস্যারের কেমন মুরোদ ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে। আমি রাস্তা আটকাব, বাইপাস বন্ধ করব, ধন্না দিয়ে ইস্কুলে বসে থাকব।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে সুলতা হাঁফাতে লাগলেন।
সন্ধ্যায় সব শুনে ধানু বলল, ”কালকেই আমি হেডস্যারের সঙ্গে দেখা করব।”
স্কুল কামাই করে ধানু দেখা করতে গেল প্রণব মাইতির সঙ্গে। হেডমাস্টারের দরজা বন্ধ, কামরার বাইরে তখন বয়স্ক নারীপুরুষের ভিড় আর চেঁচামেচি চলেছে। ওরা এসেছে কয়েক নম্বরের জন্য ফেল করা ছেলেমেয়েদের পাশ করিয়ে দেওয়ার আর্জি নিয়ে। হেডমাস্টার মশাই ‘অসম্ভব’ বলে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন। আরজিটা এর পরই বদলে গিয়ে হয়েছে দাবি এবং দাবির যা পরিণতি হয় এখন সেটাই চলছে, বিক্ষোভ এবং স্লোগান।
এক মহিলা কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, ”দেখুন তো কী জুলুম, মোটে সতেরো নম্বর কম পেয়েছে ভূতের বিজ্ঞানে আর কিনা ফেল করিয়ে দিল?”
তাই শুনে এক মাঝবয়সী পুরুষ হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”হেডমাস্টারের অন্যায় জুলুম মানছি না মানব না।”
ধানু একধারে দাঁড়িয়ে দেখছিল। পাশে দাঁড়ানো একজনকে নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ”আপনি এখানে কেন, কেসটা কী?”
”ইতিহাস, বাংলা আর অঙ্ক। ইতিহাসে চব্বিশ, বাংলায় তেরো, অঙ্কে নয় পেয়েছে। ভাল ছেলে তবু কেন যে এমন নম্বর পেল! খাতাই ঠিকমতো দেখা হয়নি। দেখবে কখন, টিউশনি করে সময় পেলে তো দেখবে।” ব্যাজার মুখে কথাগুলো বলে ভদ্রলোক মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ”চলবে না, চলবে না।”
ধানু আবার জিজ্ঞাসা করল, ”আপনি রোজ পড়াতে বসাতেন?”
বিরক্ত মুখে ভদ্রলোক বললেন, ”অতো সময় কোথায় আমার।”
থানায় খবর চলে গেছে। দুজন লাঠিধারী কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে খাঁকি উর্দিপরা দারোগা হবিবুল মোল্লা (ধানকুড়িতে তিনি হাবু দারোগা নামে প্রসিদ্ধ) জিপ থেকে নামলেন। ধানুর সঙ্গে পরিচয় আছে হাবু দারোগার। ওর ছেলে বসির মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল ধানুর সঙ্গে, ভাল বন্ধুত্বও রয়েছে।
”তুই কেন এখানে? পড়তে যাসনি?” ধানুকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ধমকে বলেন হাবু দারোগা। ভিড় ঠেলে হেডমাস্টারের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, ”যে স্কুটারটা চালাস ওটা এক ডাকাতের, তবে বেনামে, আর তোর ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।”
দারোগার সঙ্গে ধানুও হেডসারের ঘরে ঢুকে গেল। প্রণব মাইতিকে সেলাম করে দারোগাবাবু বললেন, ”স্কুল থেকে থানায় টেলিফোন গেছল আপনি বিপন্ন, প্রাণ সংশয়ও রয়েছে। স্যার যদি বলেন লাঠি চালিয়ে স্কুল থেকে এদের বার করে দিতে পারি।”
”তারপর এই স্কুল থেকে চিরকালের জন্য আমাকেও বেরিয়ে যেতে হবে।” শুকনো মুখে হেডস্যার জানিয়ে দিলেন। ”লাঠিফাটি একদম নয়। সব ক’টাকে পাশ করিয়ে দিচ্ছি। ভবিষ্যৎ তো ঝরঝরে হয়ে গেছে, বাপ মা যদি আরও ঝরঝরে করতে চায় তো হোক। তিনবার খাতা দেখে টেনেটুনে বাড়িয়েও যদি পাশমার্ক না পায় তা হলে ফেল না করিয়ে উপায় কী?”
হাবু দারোগা ঘর থেকে বেরিয়ে উৎকণ্ঠিত ভিড়কে জানিয়ে দিলেন, ”হেডমাস্টারমশাই বলেছেন সবাই পাশ, খুশি তো? এবার আপনারা বাড়ি যান।”
একজন বলে উঠল, ”হেডমাস্টার প্রণব মাইতি জিন্দাবাদ।”
”জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।” সমস্বরে জয়ধ্বনি দিতে দিতে ভিড় উধাও হল।
ঘর ফাঁকা হতে প্রণব মাইতি বললেন, ”সুধন্য, কালী ছেলেটি পড়াশুনোয় ভাল, খুবই ভাল, বিনয়ী নম্র শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করে কিন্তু মুশকিল কী জানো, ওর চেহারাটা বড্ড বড়, হাইট প্রায় ছ’ফুট, যখন প্রথম আসে ছিল সাড়ে পাঁচ ফুট, আমার সমান। স্কুলের রেকর্ডে বয়স এখন বারো। অবশ্য ছোটবাড়ির হেডমিস্ট্রেস দেবিকা ঘোষাল বলেছেন বয়সটা বছর চারেক বাড়ানো হয়েছে। সারা স্কুল এখন আড়ালে ওকে কিংকং বলতে শুরু করেছে। নামটা যে কী করে তৈরি হল কে জানে।”
ধানু বলল, ”আমি জানি স্যার। ছোট দিদিমণি আমার প্রতিবেশী তিনি আমাকে বলেছেন, কালী যখন ভর্তি হয়ে যায় তখন নাম জিজ্ঞাসা করেন বড়দিদিমণি। উনি কানে একটু কম শোনেন আর কালীর তখন সর্দি হয়ে গলা ঘড়ঘড়ে। কিঙ্করকে তিনি শোনেন কিংকং। কালীকে উনি খুব স্নেহ করতেন, খুশি হলে কিংকং বলে ডাকতেন।”
”কিন্তু নামটা যে ফিল্মের পরদা থেকে ধানকুড়িতে নেমে আসছে। একটা বিরাট চেহারা ক্লাস সিক্সে বসে, ছেলেদের তো বটেই মাস্টারমশাইদেরও পড়াতে অস্বস্তি হয়। মদনবাবু, ননীগোপালবাবু, সেলিমসাব আমাকে বলেছেন ছোট ছোট ছেলেদের মধ্যে ওকে দেখলে একদম বেমানান লাগে, পড়াতে অস্বস্তি হয়। আমার ধারণা কালীরও হয়। বছর যতই গড়াবে আমার মনে হচ্ছে কালীর শরীরও ততই বাড়বে। তখন তো ধান্যকুড়িয়া আদর্শ মাধ্যমিক শিক্ষা নিকেতন একটা দ্রষ্টব্য স্থান হয়ে উঠবে চিড়িয়াখানার মতো।”
”চিড়িয়াখানা’ শব্দটা গরম করে দিল ধানুর মাথা। কালীকে পশু বা পাখি ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছে। আবার হেডস্যারের কথাগুলোও ফেলে দেওয়ার মতো নয়, তারও মনে হচ্ছে কালীর শরীরের বৃদ্ধি ঘটবে, সমস্যায় পড়বে।
”তা হলে কী করতে বলেন?”
”আমার মনে হয় না চিকিৎসা করে ওর বাড়বৃদ্ধি বন্ধ করা যাবে বা তাগা মাদুলি পুজো দিয়েও কিছু করা যাবে। তুমি তো ওকে বাড়িতে পড়াও, তাই করো। স্কুলে আসার কোনও দরকার নেই। এই স্কুল থেকেই কালী সোজা মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে সে ব্যবস্থা আমি করব।”
”স্যার, এখন ওর যা হাইট সেটা এমন কিছু চোখে পড়ার মতো নয়। ছয় কি সাড়ে ছয় ফুট লম্বা লোক তো প্রচুর দেখা যায়।” ধানু যথাসাধ্য সওয়াল করার চেষ্টা চালাল কালীর স্কুলে পড়ার পক্ষে। ”আরও দু’—তিনটে বছর দেখুন না, তেমন মনে হলে আমিই ওকে স্কুলে আসতে দেব না।”
হেডমাস্টারমশাই রাজি হলেন ধানুর কথায়।
ধানু সুলতাকে জানিয়ে দিল কালী যেমন স্কুলে যাচ্ছে তেমনই যাবে।
স্বস্তি পেলেন সুলতা, তাকে পথ অবরোধে বা ধর্নায় আর বসতে হবে না।
খেলার ও ভূগোলের যুগ্মশিক্ষক নুরমহম্মদস্যারের হঠাৎই মনে হল তার স্কুলেই লুকিয়ে রয়েছে ব্রেট লী। কালীকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে ওকে দিয়ে বল করানোটা কোনও ব্যাপারই হবে না। কালীকে তিনি ডেকে পাঠালেন।
”কালী তুমি কখনও কোনও খেলা খেলেছ?”
”কবাডি খেলি স্যার।”
”ফুটবল ক্রিকেট হকি?”
”না স্যার।”
”ফাস্টবোলার চাই আমাদের স্কুল টিমের, তুমি হবে?”
”হব স্যার।”
”কখনও বল করেছ?”
”না স্যার।”
”খালপাড়ের মাঠে আজ বিকেলে এসো।”
এইভাবে কথাবার্তা হল টিচার্স রুমে দু’জনের মধ্যে। বিকেলে কালী হাজির হল খালপাড়ে। দুটি পুরনো ক্রিকেট বল, দু’জোড়া ব্যাটিং গ্লাভস, দু’ সেট স্টাম্প, দু’জোড়া প্যাড, দুটি ক্রিকেট ব্যাট এবং উইকেটে কিপিং গ্লাভস এই হল স্কুলের ক্রিকেট—সম্পদ। মাঠের একবারে ঘাস চেঁছে মাটিতে জল ঢেলে দুরমুশ করে যথাসাথ্য সমান করার চেষ্টায় পিচ ঢেউ খেলানো। জনাআষ্টেক ছেলে নেট প্র্যাকটিসে হাজির এবং নুরমহম্মদস্যারও।
কালীকে দেখেই নুরুসার (ছাত্ররা ওই নামেই তাঁকে ডাকে), বললেন, ”কালী, বল করার আগে মাঠটা দু’পাক দৌড়ে নাও।”
কালী দুটো পাক দিয়ে আসতেই নুরুস্যার বললেন, ”কোন হাতে বল করবে, ডান হাতে তো?”
”হ্যাঁ।”
”আমি বল করছি তুমি দেখো, মন দিয়ে লক্ষ করো।” নুরুস্যার ছিপছিপে, বয়স বছর চল্লিশ। কলকাতার ময়দানে দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাব কসবা ফ্রেন্ডস ইউনিয়নে অফস্পিন বোলার ছিলেন। খেলেছেন এক বছর, চারটি ম্যাচে। ট্রাউজার্স হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে বল হাতে একুশ পা হেঁটে একটা ইট দিয়ে মাটিতে দাগ কাটলেন। বলটা ট্রাউজার্সে ঘষতে ঘষতে কালীকে চেঁচিয়ে বললেন, ”ওয়াচ মি কালী। এইভাবে ধরলে ইনসুইং করবে বল।”
এর পর নুরুস্যার প্রবল গতিতে ছুটে বোলারের উইকেটের কাছে পৌঁছেই তড়াক করে একটা লাফ দিয়ে হাত ঘুরিয়ে বল ছাড়লেন। ব্যাট হাতে ক্লাস টেন—এর শম্ভু, স্কুলটিমের সেরা ব্যাট। বলটা তার মাথার সমান উঁচুতে আসছে দেখে সে ভয়ে বসে পড়ল। গ্লাভস হাতে একটি ছেলে উইকেটের পিছনে ছিল সে বলটা ধরার কোনও চেষ্টাই করল না। বলটা কুড়িয়ে আনতে দৌড়ল আর একজন।
”ঠিক যেভাবে ডেলিভারি দিলুম সেইভাবে বল করে দেখাও!” নুরুস্যার কালীর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন। একটা দারুণ এক্সপেরিমেন্ট সফল হবে কি হবে না, সেই উত্তেজনায় তাঁর বুকের মধ্যে কাঁপন দিচ্ছে।
যেভাবে নুরুস্যার দৌড়ে এসেছিলেন ঠিক সেইভাবে কালী বল হাতে দৌড়ে এল একুশ কদম। লাফাল এবং হাত ঘুরিয়ে বল করল। নুরুস্যারের থেকে দশ গুণ গতিতে বলটা শম্ভুর মাথা লক্ষ্য করে ধেয়ে গেল। সে সরে যাওয়ার কি মাথা নামাবার সময়টুকুও পেল না তবে আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশে ব্যাটটা মুখের কাছে তুলে ধরে। ‘খটাস’ একটা শব্দ হল। শম্ভু ব্যাট ছুড়ে ফেলে দিয়ে গ্লাভস খুলে ডান হাতের তর্জনী চোখের সামনে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
কান্না দেখে নুরুস্যার ঘাবড়ে গেলেন। কালীকে ধমকে বললেন, ”এটা কী বল হল?”
কাঁচুমাচু হয়ে কালী বলল, ”আমি তো স্যার ঠিক যেভাবে আপনি বল করবেন সেই ভাবেই করেছি, ভুল হয়েছে কী?”
নুরুস্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, ”বল কোথায় পিচ করতে হয় জানো না। গবেট কোথাকার।” তারপর শম্ভুকে বললেন, ”অ্যাই শম্ভু বাচ্চচাছেলের মতো কাঁদিস না। ক্রিকেট পুরুষমানুষের খেলা। ওরকম একটু—আধটু সবারই লাগে। যা ব্যাট কর।”
”না স্যার।” গোঁয়ারের মতো গলায় শম্ভু মাথা নেড়ে প্যাড খুলতে খুলতে বলল, ”ওই কিংকংটা বল করলে আমি ব্যাট ধরব না।”
ঘটনাটা এবং নুরুস্যারকে দেওয়া শম্ভুর উত্তরটা পরদিনই স্কুলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। কালীকে এখন সবাই কিংকং বলে। প্রথমে সে অবাক হয়ে যেত। বড়দিদিমণিকে একবার সে জিজ্ঞাসা করেছিল নামটার মানে কী? তিনি বলেছিলেন, ”আফ্রিকার কঙ্গো রাজ্যের জঙ্গলে একটা গেরিলা ছিল, পাহাড়ের মতো তার চেহারা। কয়েকটা দুষ্টুলোক ওর চেহারা ভাঙিয়ে ব্যবসা করবে বলে ওকে অজ্ঞান করে লোহার খাঁচায় পুরে জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে আসে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে। তারা ওর নাম দেয় কিংকং অর্থাৎ রাজা কং। শ’য়ে শ’য়ে লোক টিকিট কেটে কং—কে দেখতে আসে। তখন সে খেপে উঠে লোহার শিকল ছিঁড়ে খাঁচার লোহার গরাদ দুমড়েমুচড়ে বেরিয়ে এসে লণ্ডভণ্ড শুরু করে দেয়। দু’হাতে বেয়ে বেয়ে কং প্রায় আটশো হাত উঁচু এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ে ওঠে। শেষকালে অবশ্য তাকে পুলিশ এরোপ্লেন থেকে গুলি করে মেরে ফেলে। আমার বাবা ছোটবেলায় কিংকং সিনেমাটা দেখেছিলেন। গল্পটা আমার ছোটবেলায় বাবা বলেছিলেন। কং—এর মনটা খুব ভাল ছিল, মায়ামমতায় ভরা ছিল।”
বড়দিদিমণির কাছে যতটুকু শুনেছিল তাতে কিংকং—কে ভালই লেগেছিল কালীর। সে তো খারাপ কাজ কিছু করেনি। তাকে জঙ্গল থেকে ধরে আনল যে লোকগুলো তারাই তো বদমায়েশি করেছিল। কং—এর উপর অত্যাচার হয়েছিল বলেই সে খেপে উঠেছিল, নয়তো সে ভালমানুষই ছিল। কালী মনে মনে কং—এর পক্ষ নিয়ে যুক্তি সাজিয়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে। ছেলেরা কিংকং বলে ডাকলে তার ভালই লাগে। রাতে খোলা জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের শরীরটাকে কল্পনায় কং—এর মতো বিরাট করে সে শিকল ছিঁড়ে গরাদ ভেঙে বেরিয়ে আসে, তারপর উড়োন হয়ে উড়ে যায়। আকাশের পর আকাশ পার হয়, মেঘ নিয়ে লোফালুফি করে, দু’হাতে তারাদের কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করে, একটা একটা করে সেগুলো নীচে ফেলে দিয়ে দেখে, দিদিমা উঠোনে ঝাঁট দিয়ে তারা কুড়োচ্ছে। তারাগুলো আঁচলে তুলে দিদিমা রান্নাঘরে চলে গেল বোধহয় চালভাজার মতো করে ভাজবে । কালী তারপর শোঁ শোঁ করে নেমে আসে। তারাভাজা খেতে কেমন লাগে সেটা পরখ করবে বলে। রান্নাঘরের দরজায় বসে থাকতে থাকতে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
কিন্তু উড়ে বেড়াবার বদলে সে প্রথম ধাক্কা গেল ক্লাস সেভেনে উঠে।
.
হেডমাস্টারমশাই বলেছিলেন, ‘বছর যতই গড়াবে আমার মনে হচ্ছে কালীর শরীরও ততই বাড়বে।’ দেখা গেল তাঁর অনুমানটাই ঠিক। ক্লাস সেভেনে কালী উঠল সাড়ে ছয় ফুট লম্বা হয়ে।
উঁচু ক্লাসেরই কোনও ছাত্রের মাথা থেকে বেরিয়েছিল পাঞ্জা লড়াইয়ের ব্যাপারটা। প্রত্যেক সেকশন থেকে তিন জনের একটা করে টিম হবে। তিনটি ছেলে অন্য সেকশানের তিনটি ছেলের সঙ্গে লড়বে। জিতলে পাবে এক পয়েন্ট। ফাইভ থেকে টেন মোট পনেরোটি সেকশনের মধ্যে, ‘ধান্যকুড়িয়া মাধ্যমিক আদর্শ শিক্ষা নিকেতন আর্ম রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপে’ নাম দিল আটটি সেকশন। সাতটি সেকশন নাম দিল না একটি কারণে, যথেষ্ট বলশালী ছেলে সংগ্রহ করে উঠতে না পারায়।
পাঞ্জা লড়াইকে ঘিরে স্কুলে উৎসাহের জোয়ার বইল। চ্যাম্পিয়নদের জন্য কাপ, রানার্সদের জন্য মেডেল দেওয়া হবে। সে কথা পোস্টারে লিখে দেওয়ালে সাঁটা হয়ে গেল। উদ্যোক্তা ছাত্ররা পুরস্কার কেনার জন্য চাঁদা তুলল। প্রতিযোগিতার সূচি তৈরি করতে বসে সংগঠকরা ক্লাস সেভেন ‘বি’ সেকশনের টিমে কালীকিঙ্কর ঢালি নামটা দেখে আঁতকে উঠল।
”সর্বনাশ! কিংকং! ওর থাবায় কে হাত দেবে? ধরবে আর গুঁড়িয়ে দেবে। আমি বাবা পাঞ্জা লড়ায় নেই, তুলে নিচ্ছি আমার নাম।” কথাটা বলল হৃষ্টপুষ্ট দেহের দশম ক্লাসের ছাত্র বিজন ঘোষ।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল।
”ভেবে দেখার মতো কথা।” আর একজন বলল, ”কালীকে ছেঁটে ফেলে দিতে হবে নইলে ও একাই কাপ জিতে নিয়ে যাবে।”
সংগঠক ছেলেরা দেখা করল নুরুস্যারের সঙ্গে। তিনি বললেন ”এ আর এমন কী শক্ত ব্যাপার। তোমরা শরীরের ওজনের ভিত্তিতে গ্রুপ করো। কালীর এখন ওজন কত?”
ছেলেরা মাথা চুলকোতে লাগল। একজন বলল, ”আশি—পঁচাশি কেজি হবে।” আর একজন বলল, ”একশোর কাছাকাছি হতে পারে।”
নুরুস্যার বললেন, ”কুস্তি, ওয়েটলিফটিং, বক্সিংয়ে যেমন ওয়েটের ক্যাটাগরি থাকে তোমরা সেইভাবে তিনটে ভাগ করো। পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ কেজি একটা, আর একটা পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চান্ন আর তৃতীয়টা পঞ্চান্ন থেকে—তিনি ভ্রূ কুঁচকে চোখ সরু করলেন। ”কত পর্যন্ত রাখতে চাও?”
একটি ছেলে তাড়াতাড়ি বলল, ”বিজনের ওয়েট যতটা আমাদের মধ্যে ওরই ওজন সব থেকে বেশি।”
”কত ওয়েট বিজনের?”
”তা তো জানি না, ডাক্তারবাবুর চেম্বারে গিয়ে ওজন করিয়ে আনতে হবে।”
নুরুস্যার বললেন, ”এখনও জানো না? তা হলে আজই করিয়ে নাও আর বিজনের ওজনটাই হবে তৃতীয় ক্যাটাগরির লিমিট।”
সেদিন সন্ধ্যাতেই ডাক্তারমল্লিকের চেম্বারে গিয়ে বিজন ওজন নিল—সাড়ে তেষট্টি কেজি। এরপর ঠিক হল তৃতীয় ক্যাটাগরি হবে পঞ্চান্ন থেকে পঁয়ষট্টি কেজি। ওরা নিশ্চিত, কালী এই ওজনের থেকে বেশিই হবে।
পরদিনই প্রতিযোগিতার নতুন নিয়ম ক্লাসে ক্লাসে জানিয়ে দেওয়া হল। ওজন না করিয়েই এর ফলে বাদ পড়ে গেল কালী। এই ক’দিন ক্লাস সেভেন হৈ হৈ করে বলে বেড়াচ্ছিল, তারা চ্যাম্পিয়ন হচ্ছেই কেন না তাদের টিমে আছে ‘কিংকং’ কালী। সে নিজেও ধরে নিয়েছিল তার ক্লাসকে জেতাচ্ছে, সবাই তার কাছে এসে হাতটা ধরছে। ক্লাসের সব থেকে লম্বা ছেলেটি তার থেকে এক ফুট ছোট, বাকিরা সব একহাত নীচে। দূরে দূরে থাকে ওরা। পাঞ্জা লড়ায় ক্লাসকে স্কুলের সেরা করলে আনন্দে ওরা তার কাছে এগিয়ে আসবে। এই ভেবে কালী মনে মনে খুশিতে ফুরফুরে হয়েছিল। হঠাৎ নতুন নিয়মের বজ্রাঘাতে তার মনের খুশি জ্বলে খাক হয়ে গেল।
তার মনমরা মুখ দেখে নুরুস্যার বুঝলেন আঘাত পেয়েছে, অপরাধ বোধে পীড়িত হলেন। আসলে তাঁর দেওয়া বুদ্ধিতেই তো কালীকে বাদ দেওয়া গেছে। তিনি স্থির করলেন, ছেলেটিকে অন্য কোনও খেলার মধ্যে নিয়ে সকলের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দেবেন। স্কুলে ক্রিকেট ছাড়া খেলা বলতে আর আছে ফুটবল। ফুটবল দলেই কালী তা হলে আসুক।
তিনি স্কুলের গেটের কাছে কালীকে ধরলেন।
”কালী ফুটবল খেলেছ কখনও?”
”না স্যার, তবে খালপাড়ের মাঠে দেখেছি।”
”গোলকিপার কীভাবে খেলে দেখেছ তো? পারবে গোলকিপার খেলতে?”
কালী মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলল, ”দু’—চারদিন প্র্যাকটিস করলেই পারব।”
খুব আনন্দ হল কালীর। অনেকের সঙ্গে মিশে গিয়ে খেলতে তার ইচ্ছে করে। সে অনেক অনেক ছেলের মধ্যে থাকতে চায়।
”তা হলে কাল সকালে সাতটার মধ্যে মাঠে চলে এসো। গোলকিপিং কীভাবে করতে হয় সেটা শিখিয়ে দেব। আমি অবশ্য ফুটবলের নই ক্রিকেটের লোক, তা হলেও ফুটবল নিয়ে অল্পসল্প পড়েছি। ফান্ডামেন্টাল জ্ঞানটা আমার আছে। যাই হোক তোমার এই হাইটটা কাজে লাগাতে চাই। আমাদের দেশে লম্বা গোলকিপার খুব কমই পাওয়া গেছে। দেখি তোমাকে দিয়ে অভাবটা পূরণ করা যায় কি না। কাল এসো কিন্তু।” এই বলে তিনি কালীর পিঠে দুটো চাপড় দিলেন।
পরদিন কালী সকালে খালপাড়ের মাঠে ঠিক সময়ে পৌঁছল। স্কুলের উঁচু ক্লাসের জনা বারো ছেলে দল করে খেলছে। তাকে দেখে নুরুস্যার মাঠটা দুটো চক্কর দিয়ে দৌড়তে বললেন। সে দৌড়ল। দৌড়তে দৌড়তে সে দেখল উড়োন উড়ে এসে অশ্বত্থ গাছটায় বসল। গাছটার পাশ দিয়ে সে দৌড়ে যাওয়ার সময় উড়োন ডানা ঝাপটে উড়ল এবং ছুটন্ত কালীর মাথার উপর তাকে অনুসরণ করে উড়তে থাকল। নুরুস্যার ব্যাপারটা লক্ষ করলেন।
দু’ চক্কর ছুটে এসে কালী দাঁড়াতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ”পাখিটা কি তোমার?”
উড়োন আবার অশ্বত্থ গাছে গিয়ে বসেছে। সেদিকে তাকিয়ে কালী হাসল। ”হ্যাঁ স্যার।”
”পেলে কী করে?”
”এই হেকিমপুকুরের ধারে গাছতলায়। রাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল, সকালে ও ঘাসের ওপর পড়ে ছিল, কাকে ঠোকরাচ্ছিল, ডানার পালকগুলো কাটা ছিল, উড়তে পারছিল না। বোধহয় ওর ওড়া বন্ধ করার জন্য কোনও লোক ডানা ছেঁটে দিয়েছিল। ওর নাম রেখেছি উড়োন, নামটা ভাল নয় স্যার?” কালী উদ্দীপনাভরা চোখে তাকাল।
”ওকে একটু ভাল করে দেখতে হবে। তোমাদের বাড়িতে গেলে দেখা যাবে?”
”দেখবেন? এখুনি দেখাচ্ছি।” কালী মুখে আঙুল ঢুকিয়ে তীক্ষ্ন শিস দিল। তারপর সুর করে গলা ছেড়ে ডাকল, ”উ উ উ উ ড় অ অ ন।”
শিস শুনেই উড়োন চকিত হয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। ডাক শুনে উড়ে এল। দুটো ডানা ছড়িয়ে কালীর মাথার উপর গোল হয়ে ঘুরতে লাগল। নুরুস্যার মুখ তুলে চোখ বিস্ফারিত করে উড়োনকে দেখতে লাগলেন।
”রেয়ার বার্ড, বিরল প্রজাতির, আমি এই প্রথম এমন একটা পাখি দেখলুম। কালী ওকে গাছে গিয়ে বসতে বলো তো।”
কালী অশ্বত্থ গাছের দিকে হাত ছুড়ে ছুড়ে ”যাহ যাহ” বলল। উড়োন শোনামাত্র গাছের দিকে উড়ে গেল কিন্তু কোনও ডালে বসল না, না বসে গাছটা পেরিয়ে উড়ে গেল দক্ষিণে।
কালী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ”খাবারের খোঁজে গেল।”
ছেলেরা খেলা শেষ করে মাঠের ধারে এসে দাঁড়াল। নুরুস্যার ওদের বললেন, ”কালীকে যদি গোলকিপার করা যায় তা হলে কেমন হবে বল তো ভোলা?”
ভোলা বলল, ”দারুণ হবে স্যার, ওপর দিয়ে কেউ গোল দিতে পারবে না।”
”তা হলে ওকেই আমাদের গোলকিপার করা যাক। কিন্তু মুশকিল কী জানিস, কালী কোনওদিন ফুটবল খেলেনি, শুধু কবাডিই খেলেছে।” নুরুস্যার চিন্তিত মুখে বললেন। ”ওকে গোলকিপিংটা শেখাতে হবে। ঠিক আছে, শিখিয়ে দেওয়া যাবে। কালী গোলে গিয়ে দাঁড়াও।” নুরুস্যার আঙুল তুলে একদিকের গোল দেখালেন।
প্রথমে পনেরো মিটার দূর থেকে অমিয় শট নিল। মাঝারি গতির শট কালীর মুখের কাছে। মাছি ধরার মতো খপ করে সে বলটা দু’হাতে ধরে নিল। পরের শটটা নিল শামিম, বেশ জোরে কালীর ডান দিকে। লম্বা হাত দিয়ে মশা তাড়াবার মতো সে বলটা সরিয়ে দিল। নুরুস্যার উত্তেজিত হয়ে দু’হাত মুঠো করে ঝাঁকালেন।
”এই তো পেয়ে গেছি, দেখলি পাঁচকড়ি কীভাবে দুটো শিওর গোল বাঁচাল কালী। এবার নীচে দিয়ে শট নিয়ে দ্যাখ তো, পারে কি না।”
পাঁচকড়ি পঁচিশ হাত দূর থেকে জমি ঘেঁষে কড়া শট নিল। কালী ডান পা বাড়িয়ে বলটা গোললাইনের বাইরে ঠেলে দিল। নুরুস্যার চেঁচিয়ে উঠলেন, ”ওয়ার্ল্ড ক্লাস শেভ। পাঁচকড়ি, জার্মান গোলকিপারকে দেখেছিলি ঠিক ওইভাবে পা দিয়ে ১০ গজ থেকে ফিগোর মারা বলটা শেভ করেছিল। নে আরও গোটা দশেক মার।”
দশ নয় পরপর কুড়িটা শট মারল সাতজন। এগারোটা গোলে এল এবং প্রত্যেকটাই কালী হাত নয়তো পা দিয়ে আটকে দিল। একটা ব্যাপার সবারই নজরে পড়ল, কালী বিশেষ নড়াচড়া করে না হয়তো করার দরকার হয়নি বলে। নুরুস্যার একটা সারকথা বুঝে গেছেন, কালী যেভাবে খেলছে খেলুক, কিছু শেখাতে গেলেই স্বাভাবিক খেলাটা ও হারিয়ে ফেলবে। দরকার নেই শিখিয়ে।
এক সপ্তাহ পর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপের ‘ডি’ গ্রুপের প্রথম ম্যাচ চড়কহাটিতে। ধানকুড়ির সঙ্গে গ্রুপে আছে আরও তিনটি স্কুল। কালী স্কুল টিমের গোলকিপার। একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করা হয়েছে। জনাপনেরো ছেলে দুটো বল আর বগলে ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়ল, নুরুস্যার ড্রাইভারের পাশে। ম্যাটাডোর ভাঙাচোরা গর্তভরা রাস্তা দিয়ে প্রায় অর্ধেক পথ গেছে তখন পিছনের একটা চাকার টিউবে রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়ার শব্দ হল এবং বাহনটি একদিকে হেলে পড়ল।
ম্যাটাডোরে বাড়তি একটি টায়ার ছিল এবং ড্রাইভারও খুব চটপটে। চাকা খুলে আবার পরাতে গেলে গাড়িটাকে উঁচু করে তুলে রাখতে হয় সেজন্য দরকার জ্যাক—এর। সেই জ্যাকটিই গাড়িতে আনা হয়নি। চটপটে ড্রাইভার পাঁচ মিনিটেই চাকা বদলে ফেলল এবং সেই পাঁচ মিনিট গাড়িটি জমি থেকে চার ইঞ্চি উপরে তুলে ধরে রেখেছিল কালী। অবশ্য একা নয় আরও দুটি ছেলে তিন মিনিট তাকে সাহায্য করে।
চড়কহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে খেলাটি ০—০ থাকে, প্রায় এক হাজার মানুষ খেলা দেখেছিল।
খেলার পর তারা একবাক্যে বলে, ধানকুড়ি এক ডজন গোলে হারত এই ঢ্যাঙা গোলকিপারটা না থাকলে। পরের ম্যাচ শাঁখাপোতা দেবেন্দ্রনাথ উচ্চচ বিদ্যালয়ের সঙ্গে। পাঁচ মাইল বাসে যেতে হয়। কালীর ব্রহ্মতালু সাড়ে ছয় ফুট উঁচুতে, সেটা বাসের ছাদে প্রায় ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হল। শাঁখাপোতার রেফারি তিনটে পেনাল্টি দেয় ধানকুড়ির বিরুদ্ধে, এর দুটিকে নিশ্চিতভাবে অন্যায্য বলা যায়। নুরুস্যার তক্ষুনি মাঠেই লিখিত প্রতিবাদ দেওয়ার জন্য স্কুলের প্যাড বার করেও ‘প্রোটেস্ট লেটার’ লেখেননি। একটিই কারণে, ধানকুড়ির গোলকিপার তিনটি পেনাল্টি শটই গোলের মুখ থেকে সরিয়ে দিয়ে কর্নার করে দিয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা তারা জিতেছিল ১—০। জেতা যখন হয়েই গেছে তখন আর প্রোটেস্ট করার দরকার কী।
গ্রুপের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ খেলা হবে ধান্যকুড়িয়া স্কুলের মাঠে অর্থাৎ খালপাড়ের মাঠে। দুটো ম্যাচ খেলে তাদের তিন পয়েন্ট। হাতাখালি পল্লী সেবক বিদ্যালয়ের এখন চার পয়েন্ট। ধান্যকুড়িয়ার এই ম্যাচে হারলে তো চলবেই না, ড্র করলেও চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে ছিটকে যাবে। নক আউট পর্যায়ে উঠতে হলে জেতা ছাড়া আর কোনও পথ নেই এবং সবাই জানে জয়ের প্রধান ও একমাত্র ভরসা ক্লাস সেভেনের কালীকঙ্কর ঢালি।
পাঞ্জা লড়াই প্রতিযোগিতায় ‘নায়ক’ হয়ে ওঠার সুযোগ থেকে কালী বঞ্চিত হলেও আরও জনপ্রিয় ফুটবল ‘নায়ক’ হওয়া থেকে তাকে ঠেকানো যায়নি। প্রথম দুটো ম্যাচে তার আজব গোলরক্ষার গল্প মুখে মুখে শুধু স্কুলেই নয়, সারা ধান্যকুড়িয়ার ছড়িয়ে গেছে। এখন সুলতা মণ্ডলের নাতিকে সবাই চেনে।
এই চেনার জন্যই হাবু দারোগা হাতাখালির সঙ্গে ম্যাচের দু’দিন আগে হাজির হলেন সুলতার বাড়িতে। সঙ্গে কনস্টেবল প্রহ্লাদ পোদ্দার।
.
পুলিশ দেখেই ছ্যাঁত করে উঠল সুলতার বুকের মধ্যে। প্রথমেই মনে হল জামাই শিবু কিছু করেছেটরেছে নাকি? এখন তো সে ভদ্দরলোক হয়ে গেছে, তা হলে?
হবিবুল মোল্লা ঝানু দারোগা। সুলতার মুখ দেখেই বুঝলেন, ভয় পেয়েছে। এটাই স্বাভাবিক, বাড়িতে পুলিশ আসা আর অমঙ্গল আসা সমান কথা। তবে হাবুদারোগা মোটেই অত্যাচারী নন সেকেলে দারোগাদের মতো। এক পয়সাও ঘুষ খান না এবং এইজন্যই তাঁকে নিয়ে মুশকিলে পড়ে বদমায়েশ লোকেরা, কিছুতেই কবজা করতে পারে না মোটা বেঁটে এই মোল্লাকে। হাবুদারোগা আতঙ্কের কারণ, তিনি আইনের দাস হিসাবে প্রভু—সরকারকে মেনে চলেন। পান থেকে চুন হয়তো বা খসতে পারে কিন্তু আইন থেকে এক সেন্টিমিটারও তিনি নড়েন না। একদিনে তিনি আটটি ভ্যানরিকশা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন লাইসেন্স না থাকার অপরাধে। পরদিন স্ট্যান্ডে একটিও রিকশা ছিল না। দূরের গ্রামের যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়ে। হাবুদারোগা তাতে ভ্রূক্ষেপও করেননি। তিনটি রাজনৈতিক দল, ম্যাজিস্ট্রেট, পুর চেয়ারম্যান এবং এস পি—কে দরখাস্ত দিল, হুমকি দিল তাঁকে বদলি করিয়ে দেবে। তাতেও হাবুদারোগা নির্বিকার, অটল। শেষ পর্যন্ত তিনিই উদ্যোগী হয়ে দু’দিনের মধ্যে লাইসেন্স করিয়ে তবেই স্বস্তি পান। তাঁর শুধু একটাই কথা—সরকারি আইন মেনে কাজ করেছি।
এ হেন হাবুদারোগাকে বাড়িতে হাজির হতে দেখে সুলতার বুক কেঁপে ওঠা স্বাভাবিক। সৎ মানুষকে কে না ভয় পায়। কিন্তু তিনি এটাও জানেন, একমাত্র শিবু যদি কিচ্ছু গণ্ডগোল করে না থাকে তা হলে হাবুদারোগাকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। চরিত্রের পরিচ্ছন্নতায় তিনি এই দারোগার সঙ্গে সমানে টক্কর দিতে পারেন।
”কী ভাগ্যি আমার, দারোগাবাবু আমার বাড়িতে! বসুন বসুন। ওরে লক্ষ্মী একটা টুল দিয়ে যা।”
”না, না বসতে আসিনি, যাচ্ছিলুম এদিক দিয়ে জল তেষ্টা পেল তাই এলুম একগ্লাস জল খেতে।”
বাড়ির বাইরের খোলা জায়গায় তাঁরা কথা বলছেন। কাজের বউ লক্ষ্মী একটা টুল রেখে গেল।
”পরশু ডাব পাড়িয়েছি, টিউবকলের জল থাকেন কেন ডাব খান।”
”কীরে পেল্লাদ ডাব খাবি নাকি?” হাবুদারোগা জিজ্ঞাসা করলেন টুলে বসে। পেল্লাদ তখন চারপাশের গাছপালায় তীক্ষ্ন নজরে কী যেন খোঁজাখুজি চালাচ্ছিল।
”হ্যাঁ স্যার খাব। শুনেছি মাসিমার ডাবের জল খুব মিষ্টি।”
”দিন মিসেস মণ্ডল, খেয়েই যাই।”
অতিথিসেবার সুযোগ পেয়ে সুলতা যত খুশি তার থেকেও বেশি আনন্দ পেলেন দারোগার মুখে ‘মিসেস’ শব্দটি শুনে। তিনি জানেন যাকে—তাকে এভাবে সম্বোধন করা হয় না। তিনি বাড়ির ভিতরে চলে যেতেই হাবুদারোগা চাপা স্বরে বললেন, ”দেখতে পেলি? মনে হচ্ছে এখন থাকে না।”
প্রহ্লাদ বলল, ”আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার। সন্ধে—সন্ধেয় এলে দেখতে পাওয়া যাবে। কিন্তু ধরবেন কী করে স্যার? এ তো পায়রা কি ঘুঘু নয় যে উঠোনে কি বাড়ির ছাদে দু’মুঠো ধান ছড়িয়ে জাল দিয়ে ধরবেন।”
হাবুদারোগা গম্ভীর হয়ে গেলেন, চিন্তিত স্বরে বললেন, ”জালটাল দিয়ে যে ধরা যাবে না সেটা আমি জানি। পাখিটা তো পোষ মানা। কালীকেই বলব ওটাকে ধরে আমার হাতে দাও।”
প্রহ্লাদ বলল, ”দাও বললেই অমনি আপনার হাতে তুলে দেবে?”
হাবুদারোগা বললেন, ”যাতে দেয় সেইভাবে বলতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কথা বলতে হবে, শিডিউল টু—এ কী বলা আছে বলতে হবে। ভয় পাওয়াতে একটু বাড়িয়ে, একটু বানিয়ে বলতে হবে। আমি তো আর পাখিটা পুষব না বিক্রিও করব না। সরকারের ঘরে জমা করে দেব। দুষ্প্রাপ্য প্রাণীদের বুঝলি রক্ষা করা দরকার। নুরমহম্মদ পাখিটাকে দেখেছে, বউকে বলেছে রেয়ার বার্ড। সমুদ্রে ধারে পাওয়া যায়।”
প্রহ্লাদ মন দিয়ে শুনছিল, ”স্যার, সমুদ্দুর তো এখান থেকে অনেক দূরে। ডায়মন্ড হারবার এখান থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল তারপর কাকদ্বীপ নামখানা তারপর সমুদ্দুর। সেখান থেকে এখানে উড়ে এল।”
দু’হাতে কাচের আর স্টিলের দুটো গ্লাসে ডাবের জল নিয়ে এলেন সুলতা। দু’জনের পান করার পর ঢেকুর তোলার শব্দে তিনি তৃপ্ত হয়ে বললেন, ”আর এক গ্লাস দোব?”
হাবুদারোগা বললেন, ”না না এই যথেষ্ট।”
প্রহ্লাদ ডাকল, ”আমি তো বলেইছিলুম মাসিমার ডাব খুব মিষ্টি। বউকে গিয়ে গল্প করব।”
সুলতা চেঁচিয়ে বললেন, ”ওরে লক্ষ্মী দুটো ডাব নিয়ে আয় তো।”
হাবুদারোগা সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন, ”দুটো নয়, একটা।”
প্রহ্লাদ তাড়াতাড়ি বলল, ”স্যার, এভাবে কিছু নেনটেন না। দুটো ডাব আমিই নিয়ে যাব, বউকে বলব তোর জন্য মাসিমা দিয়েছে।”
”মিসেস মণ্ডল আপনার এখানে তো দেখছি বেশ গাছপালা। কিন্তু পাখিটাখি তো তেমন দেখছি না।” হাবু দারোগা চারপাশে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললেন।
”পাখি তো অনেক আছে। ঘুঘু, শালিক, বুলবুলি অনেক টিয়াও আসে।”
”বড় পাখি আসে না।” প্রহ্লাদ অধৈর্য গলায় জানতে চাইল।
”নাহ, বড় পাখি এখানে কী কত্তে আসবে। বছর দশেক আগে চিল একবার বাসা করেছিল ওই বটগাছটায়। তারপর আর বড় পাখি কোথায় একমাত্র উড়োন ছাড়া।”
হাবুদারোগা চকিত হলেন। ”উড়োন? সে আবার কে?”
”একটা সুন্দর দেখতে পাখি। ওই বড়সড়ো একটা মোরগের মতো। বুক আর পা দুটো সাদা। কালী কুড়িয়ে পায় হেকিমপুকুরের ধার থেকে। ডানা ছাঁটা ছিল তাই উড়তে পারছিল না। কালী ওকে তিন বছর ধরে পালছে। কী যে ভাব দু’জনের মধ্যে কী বলব। রাত্তিরে ও তো কালীর সঙ্গে এক ঘরেই ঘুমোয়। কালী ওকে যা বলবে উড়োন তাই করবে।”
হাবুদারোগা বললেন, ”এমন পাখি আপনি আগে কখনও দেখেছেন। বা এইরকম পাখি দুনিয়ায় থাকতে পারে বলে কখনও ভাবতে পেরেছিলেন।”
”না দারোগাবাবু, আগে কখনও দেখিনি, ভাবতেও পারিনি। এমন জীব থাকতে পারে। দেখে মনে হয় বিষ্ণুর বাহন গরুড় নিজে যেন ধানকুড়িতে নেমে এসেছেন আকাশ থেকে।”
”তার মানে বিরল দুষ্প্রাপ্য। মিসেস মণ্ডল, আমাদের দেশে একটা আইন আছে” হাবুদারোগার স্বর হালকা থেকে গম্ভীর হয়ে গেল।
”দুষ্প্রাপ্য জীবজন্তু রক্ষা করা ভীষণভাবে দরকার হয় এদের চিড়িয়াখানায় রেখে, নয়তো তাদের নিজস্ব প্রকৃতির মধ্যে বিচরণ ক্ষেত্রে, বনজঙ্গল খালবিল নদীতে বসবাস করতে দেওয়া উচিত, যেখানে তারা বংশবৃদ্ধি করতে পারে। নয়তো এদের প্রজাতি লোপ পেয়ে যাবে, সেটা কি উচিত?”
হাবুদারোগা তাঁর বিবৃতির প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার জন্য থামলেন। দেখলেন প্রতিক্রিয়াটা সুবিধাজনক নয়। সুলতা অশিক্ষিত বটে, কিন্তু দারোগার মতোই বা তার থেকেও বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিমতী। যা শুনলেন তার মমার্থ ঠিকই বুঝে ফেলেছেন।
”উচিত কি অনুচিত অতশত জানি না। তবে উড়োন যদি, ওই যেন কী বললেন?”
”দুষ্প্রাপ্য বিরল প্রজাতির।” হাবুদারোগা ধরিয়ে দিলেন।
”হ্যাঁ। উড়োন দুষ্পাপ্য যদি হয় তবে হোক। ওকে বনজঙ্গলে গিয়ে বংশ রক্ষা করতে হবে না, চাইলে আমার এখানেই করতে পারে।”
হাবুদারোগা ঢোক গিললেন।
”আমার যা কর্তব্য আমি করলুম। এবার সল্ট লেকে ওয়াইল্ড লাইফ প্রিজার্ভেশনের অফিসে জানিয়ে দোব। তারা যদি কিছু করে তো করবে। তবে এই উড়োনকে ধরে রাখাটা কিন্তু বেআইনি।”
”ধরে রাখা?” সুলতা চোখ কপালে তুললেন। ”কে কাকে ধরে রাখে সেটা সারাদিন থেকে একদিন রেখে যাবেন।”
”পেল্লাদ চল।” হাবু দারোগা উঠে হাঁটা দিলেন।
সুলতা পিছু ডাকলেন, ”ও হে পেল্লাদ, ডাবদুটো ফেলে যাচ্ছ কেন, বউমা জল খেয়ে কী বলে আমাকে বলে যেয়ো।”
.
স্কুল থেকে ফেরামাত্র কালী দিদিমার কাছে দারোগার আসার ‘সব্বোনেশে’ উদ্দেশ্যেটা শুনল। তার আসার সঙ্গে সঙ্গে উড়োনও এসে বসেছে বটগাছে। এখন কালী যাবে খালপাড়ের মাঠে প্র্যাকটিসে, মাথার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে চক্কর দিচ্ছে উড়োন।
মাঠে পুরো স্কুলটিম আর নুরুস্যার হাজির। তা ছাড়াও প্র্যাকটিস দেখতে জমা হয়েছে ষাট—সত্তরজন ছেলে আর বয়স্ক লোক। সবার আসার একটাই উদ্দেশ্য, কালী ‘কিংকং’—কে দেখা। কালীকে অনেকেই আগে দেখেছে, একটা সাড়ে ছ’ফুট লম্বা লোক এইভাবেই তারা জেনেছে কিন্তু তার আসল বয়স সে সাড়ে আট বছর (স্কুলের খাতায় অবশ্য বয়স ১৩) এটা কেউ জানত না। এবার সেটা জানাজানি হতেই বিস্ময় আর কৌতূহল আকাশছোঁয়া উচ্চচতা পেয়েছে।
উড়োন যথারীতি উড়ে গিয়ে বসল অশ্বত্থ গাছে। কালী মুখভার করে নুরুস্যারকে বলল, ”আমি কাল খেলব না স্যার।”
”কেন?” অবাক এবং আতঙ্কিত হয়ে তিনি বললেন, ”হল কী? জ্বর হয়েছে।” কালীর কপালে আঙুল ছুঁইয়ে আশ্বস্ত হলেন। ”নাহ ঠিকই আছে তা হলে খেলবে না কেন?”
”দারোগাবাবু দিদিমাকে বলেছেন উড়োনকে তিনি নিয়ে যাবেন, সল্ট লেকে জমা করে দেবেন। উড়োন নাকি বিরল রেয়ার বার্ড, ওকে বাড়িতে রেখে পোষা যাবে না। আইনে নাকি সেটা বারণ।”
‘রেয়ার বার্ড’ কথাটা নুরুস্যারের মুখ দিয়েই কিছুদিন আগে বেরিয়েছিল এই মাঠেই উড়োনকে প্রথম দেখে। সেইদিনই কথায় কথায় কী লায়লাকে বলেন, ”আজ একটা অদ্ভুত সুন্দর পাখি দেখলুম, আমার ছাত্র কালী তাকে পুষছে, এই অ্যাত্তোবড় ডানা, লম্বা লম্বা পা, সাদা পালকে ঢাকা, রংটাও সাদা, রেয়ার বার্ড। এসব পাখি বিরল প্রজাতির।” তারপর লায়লা হয়তো হাবুদারোগার বিবির কাছে বাজারে কি দরগায় দেখা হতে গল্প করেছে। দারোগার কানে সেটা পৌঁছে যেতে তারপর আর বেশি সময় লাগেনি।
নুরুস্যার একবার তো কালীকে পাঞ্জা প্রতিযোগিতা থেকে বাদ দেওয়ার কৌশল বাতলে বিবেকের কামড় খেয়েছিলেন, এখন আবার দংশন অনুভব করলেন। মনে মনে নিজের গালে চড় মেরে বললেন, ‘রেয়ার বার্ড কথাটা কেন যে মরতে বউকে বলতে গেলুম! দারোগা পাখিটাকে ধরে নিয়ে গেলে কালী বিরাট আঘাত পাবে। কুড়িয়ে এনে তিন বছর ধরে সে পালন করছে, দু’জনের মধ্যে যে ভীষণ ভাব সেটা তো তিনি নিজের চোখেই দেখেছেন। আলাদা হয়ে গেলে কষ্ট পাবে দু’জনেই। নুরুস্যার খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন।
”কালী তুমি ভেব না, তোমার উড়োনকে হাবুদারোগা ধরতে পারবে না যদি এই ম্যাচটা জিতিয়ে দিতে পারো। যাও যাও মাঠে নামো।”
”জিতলে উড়োন আমার কাছে থাকবে? ঠিক বলছেন স্যার?”
হ্যাঁ থাকবে। কথা দিচ্ছি।”
কালী ছুটে মাঠে নামল। সে গোলে গিয়ে দাঁড়াতেই ভিড়টা সেদিকে সরে গেল।
সন্ধ্যাবেলায় ধানু পড়াতে এল। এখন সে আশুতোষ কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে বি এসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। এখনও সে ভোরে ভ্যান রিকশা নিয়ে বেরিয়ে তিনটে গ্রাম থেকে আনাজ—তরকারি সংগ্রহ করে। সকালে নিজে পড়ে কালীকে পড়িয়ে ভাত খেয়ে স্কুটারে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যায় এসে কালীকে নিয়ে বসে। আজ সে সুলতার মুখে শুনল হাবু দারোগার আগমন বৃত্তান্ত। কালী তাকে জানাল নুরুস্যার আশ্বাস দিয়েছেন উড়োনকে দারোগা ধরতে পারবে না। শর্তটাও সেইসঙ্গে ধানুকে জানিয়ে দিল—যদি ম্যাচটা জিতিয়ে দিতে পারে।
এইসব শুনে ধানু তখনি বেরিয়ে পড়ল স্কুটারে, সে গেল থানায়। হাবুদারোগা এই সময় থানায় থাকেন। ধান্যকুড়িয়া থানাটি বেশ বড়। মেজোবাবু, সেজোবাবুসহ আঠারোজন কর্মী। ধানু যখন পৌঁছল হাবুদারোগা তখন মেজোবাবুকে বকছিলেন।
”দুটোকে ধরে এনে আবার ঝামেলা বাড়ালে কেন, আচ্ছাসে পিটিয়ে ছেড়ে দিতে পারতে তো। এখন তো ওদের নেতারা এসে হম্বিতম্বি করে মাথা খারাপ করে দেবে।”
”স্যার, যা পেটাবার পিটিয়েছি। মানবাধিকার এক ইঞ্চিও লঙ্ঘন করিনি। একটা ভোজালি আর পাইপগান ছাড়া আর কিছু পাইনি। এই দেখুন স্যার।”
ধানু দেখল টেবলে রাখা অস্ত্র দু’টি। যে দু’টি ছেলে দাঁড়িয়ে বড়বাবুর টেবলের পাশে গোঁজমুখ করে তারা ধানুকে চেনে, পাড়ারই ছেলে এবং ভ্যানরিকশা চালায় সকাল—সন্ধ্যায়, একজনের নাম অসিত, অন্যজনের নাম ছোট গ্যাঁড়া। স্ট্যান্ডে আগে—পরে রিকশা রাখা নিয়ে অনেকদিনের ঝগড়া, এজন্য মারপিট প্রায়ই হয়, আজও হয়েছিল। হাবুদারোগা কড়া চোখে প্রথমে দু’জনকে দেখে নিয়ে তারপর ধানুকে দেখলেন।
”তুই কী কত্তে এখন এসেছিস? কেমিস্ট্রি খুব কঠিন সাবজেক্ট, দিন—রাত বই মুখে নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। বসিরকে তো দেখি এখন থেকেই মোটা মোটা বই কিনেছে। ডাক্তারি পড়ানোর খরচ যে কত এইবার মালুম হচ্ছে। বল কী বলবি?”
জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স পাশ করে বসির বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে, সেখানেই থাকে। ধানু বলল, ”চাচা, পাখিটা বিরল প্রজাতির ঠিকই, এর নাম সিন্ধু—গরুড়, আপনি দেখেননি, আমি তিন বছর ধরে দেখেছি।”
হঠাৎ ছোট গ্যাঁড়া বলে উঠল, ”বড়বাবু আমিও দেখেছি। বিউটিফুল দেখতে, গোদা চিলের থেকেও বড়, হাত—পা—বুক ধবধবে সাদা—”
”চুপ কর।” হাবুদারোগার মুখ থেকে বজ্র বেরিয়ে এল। ”তোকে কে দালালি করে কথা বলতে বলেছে?” রক্তচক্ষু এবার সরিয়ে তিনি ধানুর উপর নিক্ষেপ করলেন, ”তিন বছর ধরে দেখছিস তো কী হয়েছে?”
”উড়োন তো বিপন্ন নয় তা হলে ওকে ধরতে চাইছেন কেন, ওকে তো কাকে ঠুকরে মেরে ফেলছিল, কালীই উদ্ধার করে ওকে বাঁচায়। উড়োন একটা আশ্রয় পেয়েছে, ভালবাসা পেয়েছে, ধানকুড়ি জায়গাটা ওর পছন্দ হয়েছে, এখান থেকে অন্য কোথাও ওকে পাঠিয়ে দিলেই বরং উড়োন বিপন্ন হবে।”
”ঠিক বলেছে ধানু। পোষ মেনে যাওয়া পাখি লড়তে পারে না। আমার একটা পোষা চন্দনা ছিল স্যার—!”
”আবার।” হাবুদারোগা বজ্রপাত ঘটিয়ে টেবলের উপর থেকে পাইপগানটা তুলে নিয়ে বললেন, ”আর একটা যদি কথা বলেছিস তা হলে গুলি করে খুলি উড়িয়ে দোব।”
অপারাধীর মতো কুণ্ঠিত স্বরে ছোট গ্যাঁড়া বলল, ”স্যার গুলিটা ফায়ার করে দিয়েছি, ওতে এখন ফাঁকা খোলটাই শুধু রয়েছে।”
হাবুদারোগা সপ্রতিভ গলায় বললেন, ”তাতে কী হয়েছে। এর বাঁটটা দিয়ে তোর খুলি ভেঙে দিতে পারি, তা জানিস?”
”স্যার, মানবাধিকার!” মেজোবাবু ঝুঁকে বড়বাবুর কানে ফিসফিস করে বললেন। হাবুদারোগা পাইপগানটা টেবলে রেখে দিলেন ধীরে ধীরে।
”চাচা পরশুদিন জেলা স্কুল চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচ, ধান্যকুড়িয়া স্কুলের কাছে এটা মরণ—বাঁচনের খেলা, জেতা—হারা অনেকটা নির্ভর করছে গোলকিপারের উপর আর সেখানেই খেলবে কালী। ও বলছে উড়োনকে যদি পুলিশে ধরে তা হলে খেলবে না। স্কুলের ছেলেরা তো বটেই তাদের গার্জেনরা পর্যন্ত এই ম্যাচটার জেতা দেখতে চাইছে। জিতলে ধানকুড়ির স্কুল চ্যাম্পিযনশিপের গ্রুপ থেকে মূলপর্বে উঠবে। সেটা হবে বিরাট কৃতিত্ব।”
অসিত এতক্ষণ কথা বলেনি। এইবার বলল, ”হ্যাঁ বড়বাবু, আমার প্যাসেঞ্জাররা দু’দিন ধরে বলাবলি করে যাচ্ছে, তারা কালীর খেলা দেখতে শনিবার মাঠে আসবে।”
ছোট গ্যাঁড়া বলল, ”আমিও যাব দেখতে।”
হাবুদারোগা তাকালেন মেজোবাবুর দিকে। মেজোবাবু পাইপগানটা চট করে তুলে নিলেন টেবল থেকে।
”এই ‘বিরাট কৃতিত্ব’ পাওয়ার জন্য আইনকানুন শিকেয় তুলে বিরল পাখিটাকে বাড়িতে রেখে দিতে হবে?” হাবুদারোগা একটুও নরম না হয়ে বললেন। ”মামদোবাজি পেয়েছ? পরশুই আমি পাখিসমেত কালীকে অ্যারেস্ট করব তাতে স্কুলের বিরাট কৃতিত্ব পাওয়া হোক আর নাই হোক।” তারপর তিনি মেজোবাবুর দিকে চোখ তুলে বললেন, ”এই দুটো বাঁদরকে কী করা যায়? পাইপগান নিয়ে শান্তিভঙ্গ করা তো এদের কাছে খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী করা যায় বলো তো?”
মেজোবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ”স্যার, এরা বাঁদর ঠিকই কিন্তু বিরল প্রজাতির নয়। এদের মতো বাঁদর চারদিকে গিস গিস করছে। বলি কী, দুটোকে ছেড়েই দিন, কেউ তো ইনজিওর্ড হয়নি।”
”বিনা শাস্তিতে। তাই হয় নাকি! হাতে না হলে ভাতে মারা দরকার, রিকশা দুটো কোথায়?”
”স্যার, থানার দরজায়।”
হাবুদারোগা টেবল থেকে ভোজালিটা তুলে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ধানুও ঘর থেকে বেরোল হাবুদারোগা ভোজালি দিয়ে কী করেন দেখার জন্য। যা দেখল তাতে অবাক হয়ে গেল এবং দুঃখবোধ করল।
ভোজালি দিয়ে দুটো রিকশার সামনের চাকার টায়ার হাবুদারোগা চিরে দিলেন। টায়ারের রবার প্রায় পাঁচ ইঞ্চি ফাঁক হয়ে গেল। যাওয়ার মতোই গটগটিয়ে তিনি ফিরে এলেন।
”যা এবার রিকশা নিয়ে স্ট্যান্ডে দাঁড়াগে যা।”
অসিত আর ছোট গ্যাঁড়া বেরিয়ে এসে রিকশার চাকার দিকে মিনিটখানেক তাকিয়ে রইল। তারপর অসিত মাথায় হাত দিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। ছোট গ্যাঁড়া রিকশার হ্যান্ডেল ধরে সামনে কিছুটা টেনে নিয়ে গিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ”বড়বাবু শেষে কিনা এ ভাবে ভাতে মারল।”
হাবুদারোগা ধানুকে বললেন, ”কালীকে গিয়ে বল, পাখিটাকে থানায় দিয়ে যেতে।”
”থানায় রাখবেন কোথায় চাচা?”
হাজত এখন খালি রয়েছে ওখানেই রাখব।”
আর কথা না বলে ধানু বেরিয়ে এল থানা থেকে। স্কুটারে কিছুটা যেতেই দেখল ভ্যানরিকশা দুটো হাতে করে টানতে টানতে চলেছে অসিত আর ছোট গ্যাঁড়া। ধানুকে হাত তুলে থামিয়ে বলল, ”বড়বাবুকে একটা শিক্ষে দিতে হবে। কী ক্ষতিটা আমাদের করে দিল দেখেছিস।” ধানু দেখল অসিতের চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে।
”দেখব পাখিটাকে কী করে অ্যারেস্ট করে। মামদোবাজি করে, আমি দেখাব কে মামদো, আমি না হাবুদারোগা।” ছোট গ্যাঁড়ার কথাগুলো হাবুদারোগার দেহের খণ্ড খণ্ড মাংসের মতো তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। হিংস্রমুখে সে রিকশার সিটে ঘুঁষি বসাল।
ধানু বলল, ”আমি তো অবাক হয়ে গেলুম। ওইভাবে যে সাইকেলের টায়ার ফাঁসিয়ে দেবে কল্পনাও করতে পারি না। অথচ লোকটা সৎ, আইন মেনে কাজ করে, ডিসিপ্লিনড। ওর মনের মধ্যে যে এমন একটা কসাই লুকিয়ে আছে জানতুম না।”
”তুই জেনে রাখ ধানু, যা বললুম, তাই করব। চল অসিত, সবাইকে গিয়ে চাকাদুটো দেখাই।”
ধানু এবার নুরুস্যারের বাড়ির দিকে রওনা দিল, উনি কথা দিয়েছেন উড়োন কালীর কাছেই থাকবে, হাবুদারোগা ধরতে পারবে না। কী করবেন নুরুস্যার যে জন্য উড়োনকে ধরা যাবে না? সেটা এখন তাকে জানতে হবে।
.
খেলা শনিবার, তার আগের দিন নুরমহম্মদ ওরফে নুরুস্যার বিজন, ভোলা, অমিয়, শামিম, পাঁচকড়ি এবং আরও দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে ক্লাসে ঘুরে তিন মিনিটের একটি বক্তৃতা দিলেন, তার শুরুটা ছিল এই রকম।
”তোমরা নিশ্চয় চাও তোমাদের স্কুলের গৌরব বাড়ুক, ঠিক কি না? এই যে কালকের ফুটবল ম্যাচ এটা যদি জিতি তা হলে জেলা চ্যাম্পিয়ন হবার পথে আমরা প্রথম ধাপটা পেরোব, এটা গৌরব অর্জনের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে আমাদের। আর এই জয়ের জন্য আমরা নির্ভর করছি আমাদের গোলকিপার কালীকিঙ্করের উপর।” এইবার ক্লাসের ছেলেরা ”কিংকং, কিংকং” বলে ফিসফিস শুরু করে দেয়।
”শোনো মন দিয়ে, কালী বলছে তার পোষা পাখি উড়োনকে অ্যারেস্ট করবে দারোগা হবিবুল মোল্লা, কেন না উড়োন বিরল বিপন্ন প্রজাতির, কিন্তু আমরা মনে করি সে বিরল বটে, কিন্তু বিপন্ন নয়, উড়োনকে যদি দারোগা ধরে, কালী বলেছে তা হলে সে খেলবে না। সুতরাং তাকে অ্যারেস্ট করা চলবে না। এবার আমাদের কী করতে হবে সেটা এরা তোমাদের বলে দেবে।” নুরুস্যার আঙুল দিয়ে পাঁচকড়ি , অমিয়দের দেখিয়ে তাঁর বক্তৃতা শেষ করে অন্য ক্লাসে চলে যান। সেখানেও আবার একই বক্তৃতা তিনি দেন।
হাবুদারোগার ভয়ে কালী হাফ ছুটি হওয়ামাত্র বাড়ি ফিরে বাইরের উঠোনের বাঁশের খুঁটির উপর উড়োনকে বসে থাকতে দেখল। সুলতা খুঁটির পাশে বসে কুড়োনকে তখন কাঁঠালপাতা খাওয়াচ্ছিলেন। কালীকে দেখে বললেন, ”উড়োনকে বসিয়ে রেখে আমিও বসে আছি। দারোগাকে দেখলে ওকে উড়ে যেতে বলব। দেখি কী করে ওকে ধরে।”
”দিদিমা, উড়োনের বদলে তখন তো আমায় ধরবে।”
”ধরুক না। উড়োনের কথা এখন ধানকুড়ির সবাই জেনেছে। চণ্ডীউকিলের বউ এসেছিল ওকে দেখতে। বললাম দারোগার কথা। তো বউমা বলল, ওরেন্ট ছাড়া কাউকে অমনি অমনি হাজতে ভরা যায় না, ভরলে দারোগাকে কোর্টে টেনে নিয়ে গিয়ে হাকিমের ধমকানি খাওয়ানো যাবে। ওর স্বামীকে উকিল দিলে সে ব্যবস্থাও হবে।”
কালী কিছু বলল না। উড়োনকে দু’হাতে তুলে ঘরে নিয়ে গিয়ে তক্তপোশের ধারে উপুড় করা ঝুড়িটার উপর বসিয়ে দিয়ে বলল, ”চুপ করে বসে থাক। হাবুদারোগা যেন দেখতে না পায়। দেখলেই ধরে নিয়ে যাবে।”
আজ কালী খালপাড়ের মাঠে প্র্যাকটিসে গেল না। বাইরের উঠোনে বসে দিদিমার সঙ্গে এটা—ওটা নিয়ে কথা বলতে লাগল। তখনই হাজির হল প্রহ্লাদ।
”কী ব্যাপার পেল্লাদ, ডাব খেয়ে বউ কী বলল?” সুলতা একটু বাঁকাসুরে বললেন।
”ডাব খেয়ে তো বাপের বাড়ির জন্য বউয়ের মন কেমন করতে লেগেছে। এমন মিঠে জলের ডাব ওর বাপের বাড়ির একটা মাত্তির গাছেই হয়। সেই গাছটার কথা খালি মনে পড়ছে আর চোখ দিয়ে জল ঝরছে।”
”জল ঝরছে আর বলছে আরও দুটো খাব, কেমন? ঠিক বলেছি?” সুলতা হাসি চেপে চোখ পিট পিট করে বললেন।
”আপনি জানলেন কী করে মাসিমা, বউ আরও দুটো খেতে চাইছে?”
”জানি, জানতে হয়। দুটো কেন চারটে ডাব দোব, এবার বলো তো, তোমার বড়বাবু কী মতলব ভেঁজেছে? উড়োন আর কালীকে কাল কখন ধরতে আসবে?”
প্রহ্লাদ ডান হাতের পাঞ্জা দেখিয়ে বলল, ”চারটে নয় পাঁচটা ডাব।”
”ঠিক আছে, পাঁচটা।”
এধার ওধার তাকিয়ে গলা নামিয়ে প্রহ্লাদ বলল, ”ঝড়খালিতে পাখি ধরার লোক আছে তাকে আনতে কনস্টেবল পাঠিয়েছে বড়বাবু। কাল চারটের সময় খেলা, বড়বাবু তিনটের সময় বারো জনকে নিয়ে আসবে, তাদের তিন জনের সঙ্গে আর্মস থাকবে, মাছ ধরার খ্যাপলা জাল আজ থানায় আনা হয়েছে। সবাইকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে পাখির গায়ে আঁচড়টি যেন না পড়ে। বিরল প্রজাতির বিপন্ন পাখি বলে কথা।”
শুনতে শুনতে সুলতার বুক শুকিয়ে এল। এ তো বাড়িতে ডাকাত পড়ার থেকেও ভয়ংকর ব্যাপার।
”মাসিমা এবার আমি যাব, পাখিটা আছে কি না দেখতে পাঠিয়েছিল, গিয়ে বলব এখনও ফেরেনি সন্ধের সময় ফিরবে।”
সুলতা ডাব আনতে নিজেই ভিতরে চলে গেলেন। প্রহ্লাদ তখন কথা শুরু করল কালীর সঙ্গে।
”শুনলুম তুমি নাকি দারুণ গোলকিপারিং করো? কাল দেখব কেমন তুমি খেলো।”
”খেলব কী করে, উড়োনকে তো হাবুদারোগা অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।”
”যাক না নিয়ে, তাতে খেলতে অসুবিধের কী?”
প্রহ্লাদের কথা শুনে রাগে থমথমে হয়ে গেল কালীর মুখ। সে উঠে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”যদি আমি সত্যিকারের কিংকং হতুম তা হলে থানাটাকে গুঁড়িয়ে দিতুম।”
কথাটা বলেই সে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। সুলতা ডাব হাতে ঝুলিয়ে এলেন। প্রহ্লাদ দেখেই বলল, ”মাসিমা আপনি তো পাঁচটা দিতে রাজি হলেন।”
”আর একটা কাল এসে নিয়ে যেয়ো, এই চারটেই ঘরে ছিল।”
রাতে কালীর ঘুম আর আসছে না। মাথার মধ্যে শুধু পুলিশের বারো জোড়া বুটের শব্দ খট খট করে এগিয়ে আসছে। মাথার উপর দু’পাক ঘুরিয়ে কে যেন খ্যাপলা জাল ছুড়ল উড়োনকে লক্ষ্য করে। চমকে উঠল কালী। ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দেখল ঝুড়ির উপর গুটিসুটি হয়ে বসে রয়েছে উড়োন, মাথাটা সামনে ঝোঁকানো। ঘুমোচ্ছে। কালী আশ্বস্ত হয়ে আবার শুয়ে পড়ল আলো নিভিয়ে। আর একবার তার মনে হল, খোলা জানলায় কেউ দাঁড়িয়ে, মুখটা যেন হাবুদারোগার। ভয়ে তার বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে গেল। কোনওক্রমে সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ”কে?”
”আমি হাবুদারোগা।”
”কী দরকার আপনার?”
”উড়োনকে ধরতে এসেছি।” বলেই হাবুদারোগা জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে টর্চের আলো ফেলল। কালী মুখ ফিরিয়ে উড়োনকে দেখার জন্য তাকাল। আশ্চর্য, উড়োন ঝুড়ির উপর নেই।
কোথায় গেল পাখিটা, একটু আগেও তো ঝুড়ির উপর ছিল, কোথায় গেল? হাবুদারোগা জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কালীর চুল মুঠোয় ধরে ঝাঁকাতে লাগল।
”বলো, বলো, কোথায় গেল উড়োন?”
”লাগছে, ছাড়ুন চুল, লাগছে। উড়োন এখন খালপারের মাঠে অশথ গাছটায় বসে আছে। আমি মাঠে গেলে ও আমার মাথার ওপর চক্কোর দিয়ে উড়বে। আপনি কি ওকে অ্যারেস্ট করবেন?” টর্চের আলো মুখের উপর পড়ায় কালীর চোখ আধবোজা। সে মুখটা পাশে ঘুরিয়ে বলল, ”উড়োনকে আপনি ধরতে পারবেন না। ও বিরল পাখি, ও এখানকার নয়, উড়োন সিন্ধু—গরুড়, আমার বন্ধু। আমি কিংকং, আমিও এখানকার নই। আমরা দু’জনে আকাশে উড়ে যাব কেউ আমাদের ধরতে পারবে না, আপনিও নয়।”
”বটে! দেখা যাক ধরতে পারি কি না।” হাবুদারোগা চুলের মুঠি ছেড়ে দিয়ে বলল, ”কাল দেখা হবে।”
কালী বিছানায় উঠে বসে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ফাঁকা মাঠ, ঝাঁকড়া বটগাছ, একাদশীর চাঁদের আলো, নিঝুম চরাচর। সবই তার পরিচিত কিন্তু হাবুদারোগা এর মধ্যে মিলিয়ে গেল কী করে। সে আলতো করে মাথার চুল টানল। ঝুড়িতে সড়সড় শব্দ হল। কালী ফিসফিস করে ডাকল, ”উড়োন।” খড়খড় শব্দ জোরে হল। ”কাল উড়ে যাব তোর সঙ্গে।”
প্রহ্লাদ বলেছে, বড়বাবু তিনটের সময় বারো জনকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। কালী প্রতিদিনের মতো উড়োনকে ছেড়ে দিতেই সে প্রথমে বাঁশের খুঁটির উপর কিছুক্ষণ বসল। তারপর উড়ে গেল দক্ষিণ আকাশে। দেখে কালী ও সুলতা হাঁফ ছাড়লেন। ধানু এসে উপস্থিত।
”কালী আজ আর লেখাপড়া নয়। জীবনের প্রথম বড় ম্যাচ। হাতাখালি টিমে তিন—চারটে বয়স্ক ছেলে আছে, কলকাতার ময়দানে সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে। এসব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না, যেভাবে খেলিস সেইভাবেই খেলবি। রাতে ভাল ঘুম হয়েছে।”
”হয়েছে।”
”সাড়ে তিনটের সময় টিম মাঠে যাবে। ড্রেস করে রেডি থাকিস। দিদিমা, আমি একটু ঘুরে আসছি।”
ধানু স্কুটার নিয়ে বেরিয়ে গেল।
হবিবুল মোল্লা ঠিক তিনটেয় থানা থেকে জিপে উঠলেন। পিছনে রাইফেল হাতে দু’জন পুলিশের সঙ্গে খ্যাপলা জাল নিয়ে একজন বসে, তার পেশা মাছ ধরা। মেজোবাবুর আজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন। থানা দেখার জন্য সেজোবাবু রয়ে গেছেন। দশ জন লাঠিধারী পুলিশ জিপের পাঁচ মিনিট পর হাঁটতে হাঁটতে রওনা দিল।
জিপ বড় সড়ক থেকে মাঝারি একটা রাস্তা ধরবে, তারপর স্কুলবাড়ির পাশ দিয়ে বাজার ঘেঁষে শীতলা মন্দিরের পাশ কাটিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির অফিস আর পূর্বাচল ক্লাবের সামনে দিয়ে যে রাস্তাটা দক্ষিণে গেছে সেটা দিয়ে হাবুদারোগার জিপকে সুলতা মণ্ডলের বাড়িতে পৌঁছনোর জন্য যেতে হবে। মোটরে তিন মিনিট, হেঁটে দশ মিনিটের পথ।
জিপ যখন স্কুল বাড়ির কাছাকাছি তখনই ”পিঁইইপ পিপ পিপ” আওয়াজ হল হুইসলের। ঠিক এইভাবেই হুইসলের আওয়াজ করে নুরুস্যার মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিস করান। স্কুলের উঠোনে জমা হওয়া শ’তিনেক ছেলে হুইসলের আওয়াজ শোনামাত্র সার দিয়ে, স্কুল গেট দিয়ে দুই সারিতে বেরিয়ে আসতে শুরু করল।
ব্রেক কষে জিপ দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে রাস্তা জুড়ে দুই সারিতে চলেছে ছেলেরা, তাদের হাতে কাঠিতে লাগানো হাতে লেখা পোস্টার। নানানা রকম স্লোগান তাতে লেখা, যেমন—”পুলিশের অন্নায় জুলুম চলবে না।” ”উড়োন বিপন্ন পাখি নয়/ওকে স্বাধীনতা দেওয়া হোক।” ”কালীকিঙ্কর জিন্দাবাদ/আজ কালী খেলবেই খেলবে।” ”হাবুদারোগার কালো হাত/ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও।”
হাবুদারোগা মুখ বার করে দেখে বিড় বিড় করলেন, ”বড়দের দেখে শিখেছে। এই জিপ রাখ। হেঁটেই যাব।”
তিনি জিপ থেকে নামতেই ড্রাইভার বাদে বাকিরাও নামল। তারা দুই সারি ছেলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এগোতে লাগল। ড্রাইভার জিপটা ঘোরাবার জন্য পিছনে হটতে গিয়ে দেখল সার দিয়ে খালি ভ্যানরিকশা দাঁড়িয়ে, প্রথম দুটো রিকশায় ছোট গ্যাঁড়া আর অসিত।
”এই রিকশা হটা।” ড্রাইভার খেঁকিয়ে উঠল।
”হটাব কোথায়, পেছনে তাকিয়ে দেখো না!” অসিত বলল।
ড্রাইভার মুখ উঁচু করে তাকিয়ে দেখল অন্তত কুড়িটা রিকশা পর পর দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, ”মতলবটা কী বল তো?”
”তোমার বড়বাবু রিকশার দুটো চাকা নিয়েছে, আমরা তোমার গাড়ির চারটে চাকা নোব।” ছোট গ্যাঁড়া হাতে তুলে ধরল এক হাত লম্বা লোহার তীক্ষ্ন মুখ একটা গজাল। অসিত তুলে দেখাল একটা করাত।
ড্রাইভার আর কথা না বাড়িয়ে বড়বাবুকে খবর দিতে ছুটল। হনহনিয়ে হেঁটে হাবুদারোগা তখন পূর্বাচল ক্লাব পর্যন্ত পৌঁছেছেন, ছাত্রদের মিছিলকে পিছনে ফেলে।
”স্যার স্যার”। বলে চিৎকার করতে করতে ড্রাইভার ছুটে এল। ”বিপদ স্যার। অসিত আর ছোটগ্যাঁড়া কালকের বদলা নিতে জিপের চাকা ফাঁসাচ্ছে, কাটছে।”
”জিপ ব্যাক করে থানায় চলে যাও।”
”যাবার উপায় নেই স্যার, রাস্তা জ্যাম করে রেখেছে গোটা কুড়ি—তিরিশ ভ্যানরিকশা।”
হাবু ঠোঁট কামড়ালেন। ”প্ল্যান করে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করছে।” রাইফেলধারী দু’জনকে বললেন, ”এখুনি গিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করে দাও।”
”স্যার, যদি ক্লিয়ার না হতে চায়।”
”ফায়ার করবে।”
”ফায়ারিং—এর অর্ডার কে দেবে স্যার। আপনি তো এখানে।”
”নিজেরা দেবে।”
”না, স্যার, আপনি অর্ডার না দিলে ফায়ার করতে পারব না। শেষে চাকরি নিয়ে টানাটানি হোক আর কী!”
তিক্ত মুখে হাবুদারোগা বললেন, ”সিপাইরা পিছনে আসছে। তাদের বলো বড়বাবু অর্ডার দিয়েছেন লাঠি চার্জ করতে। রাস্তা ক্লিয়ার হলে জিপটা থানায় নয় এখানে নিয়ে আসবে। ছেলেদের মিছিল তো মাঠে চলে যাবে। আমি কালী মণ্ডলকে আগে অ্যারেস্ট করে জিপে তুলব তারপর পাখিটাকে—যাও যাও, কুইক।”
রাস্তা থেকে বাঁ দিকে বেঁকে নিমগাছটাকে ডাইনে রেখে অন্তত তিরিশ গজ মাটির রাস্তা ধরে গেলে সুলতা মণ্ডলের বাড়ির বাইরের উঠোন। ছাত্রদের সারি সোজা মাঠের দিক না গিয়ে নিমগাছের পাশ দিয়ে সুলতা মণ্ডলের বাড়ির দিকে বেঁকে গেল। বাইরের উঠোনে বাঁশের খুঁটির উপর বসে রয়েছে উড়োন, খুঁটির পাশে দাঁড়িয়ে সুলতা, ধানু আর খেলার ড্রেস করে কালী। উড়োন ব্যস্ত উদ্বিগ্ন চোখে এতগুলো ছেলেকে দেখে উড়ে পালাবার উদ্যোগ নিচ্ছে।
”এই উড়োন বসে থাক।” কালী থমকে উঠল।
ছাত্ররা নিঃশব্দে গোল হয়ে খুঁটিটাকে ঘিরে দাঁড়াল। কম করে দশ সারি ছেলে। হাবুদারোগা এসে হতভম্ব। পাখিটা দেখতে পাচ্ছেন, কালীকেও। জাল হাতে জেলে তাঁর পাশে। তিনি বললেন, ”এখানে থেকে জাল জুড়ে পারবে ওটাকে ধরতে?”
”না দারোগাবাবু, আর একটু কাছে যেতে হবে।”
”ঠিক আছে, আমার পেছনে এসো।” হাবুদারেগা রাস্তা বার করার জন্য ছেলেদের ধাক্কা দিয়ে এগোতে যাওয়া মাত্র ”পিপ পিপ পিইইপ” হুইসল বেজে উঠল। ছেলেরা মুহূর্তে হাবুদারোগাকে ঘিরে শুয়ে পড়ল।
”এখন তো আমিই বিপন্ন প্রজাতির হয়ে গেলুম।” বড়বাবু কাকে শুনিয়ে বললেন কে জানে।
ধানু বলল, ”কালী, এখন মাঠে যেতে হবে। উড়োনকে কোলে করে নে।”
কালী ”আয়, আয়” বলে মাটিতে চাপড় দিল। খুঁটির উপর থেকে উড়োন ঝপ করে মাটিতে নেমে এল। কালী দু’হাতে তাকে তুলে বুকের কাছে ধরে রইল।
ঘেরাও করে শুয়ে থাকা ছেলেদের মাঝে দাঁড়িয়ে হাবুদারোগা দেখলেন, কালীর কোলে চড়ে বিরল বিপন্ন সিন্ধু—গরুর ফুটবল খেলা দেখতে রওনা হল।
”ও ধানুদা, কতক্ষণ শুয়ে থাকব, আমরা খেলা দেখব না?”
”হুইসল বাজলে ছেড়ে দিবি।”
পাঁচ মিনিট পর কালী যখন উড়োনকে কোলে নিয়ে মাঠে পৌঁছেছে তখন নিমগাছের তলা থেকে ‘পিইইইইপ’ শোনা গেল, স্কুল ছুটির ঘণ্টা শুনে ছেলেরা যেমন কলরব করে ওঠে, সেইভাবে ঘেরাওকারীরা হইহই করে লাফিয়ে উঠে ছুট লাগাল মাঠের দিকে।
হাবুদারোগা নিমগাছের তলায় হুইসল মুখে লোকটির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ”নুরমহম্মদ, চক্রান্তটা তা হলে তোমার।”
কালী উড়োনকে ছেড়ে দিতেই সে অশ্বত্থ গাছে নীচের ডালটিতে গিয়ে বসল। মাঠে দুটো টিমই নেমে ওয়ার্ম—আপ করছে। মাঠ ঘিরে হাজার পাঁচেক লোক। ভিড়টা দু’দিকের গোলের পিছনে ও দু’পাশে, খুব কাছের থেকে ওরা কালীকে দেখতে চায়।
হাতাখালির বেশিরভাগ ছেলেই আকারে বড়। বয়সও বেশি। ওদের দু’তিনজন কলকাতার ময়দানে খেলে। হাতাখালি স্কুলই আজ ফেভারিট। নুরুস্যার গত তিন দিন ধরে সকালে প্র্যাকটিসে বলেছেন, ”মনে আছে ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল। লয়েডের টিমে তো বাঘা—বাঘা ব্যাটসম্যান আর ফাস্ট বোলার ছিল, ওরাই তো ফেভারিট। কিন্তু কী হল বল তো। শেষ পর্যন্ত তো কপিলরাই জিতল। কেন জিতল? এগারো জনই জান লড়িয়ে দিয়েছিল। ভারত রান কম করেছিল তাতে কী, একটা ক্যাচও কেউ ফসকায়নি। বাউন্ডারি লাইন পর্যন্ত তাড়া করে বল ধরেছে। ওদের মতো তোরাও বিশ্বাস কর আমরা জিতছি, জিতব। হাতাখালি তো রিয়েল মাদ্রিদ নয়। পজিটিভ চিন্তা কর।”
ধান্যকুড়িয়া যে চিন্তাই করে থাকুক খেলার প্রথম দশ মিনিট পায়ে বল ঠেকাতে পারেনি। তার মধ্যে চারটে শট, দুটো হেড কালী দু’হাতে চাপড়ে, ঘুঁষি মেরে, হাঁটু দিয়ে থামিয়ে নিশ্চিত গোল খাওয়া থেকে ধানকুড়িকে রক্ষা করে। অবশ্য হাফ টাইমের আগে তারা হাতাখালির কাছ থেকে খেলার দখল কিছুটা নিয়ে নেয়। সেখানে বল সেখানেই ধানকুড়ির কেউ না কেউ বল ছিনিয়ে নেবার জন্য হাজির। এই পদ্ধতি নিয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত করে দেয় হাতাখালিকে। প্রচুর ফাউল হতে থাকে। একবার গোলের মুখে উঁচু বল কালী ধরার জন্য লাফিয়ে উঠতেই কে একজন তার পেটে ঘুঁষি মারল। সে জমিতে পড়ে গিয়ে ফসকানো বলটা আঁকুপাকু করে ধরতে হাত বাড়াল। হাতটা মাড়িয়ে দিল একজন। কালী হাতটা দু’বার ঝেড়ে নিল মাত্র।
খেলা যখন চলছে উড়োন গাছের ডালে বসেছিল। হাফ টাইমে সে উড়ে মাঠের উপর চক্কর দিতে লাগল। সারা মাঠ মুখ তুলে হাঁ করে পাখি দেখতে লাগল।
কে একজন বলল, ”পাখিটা পয়মন্ত। দেখবি ধানকুড়ি জিতবে।”
আর একজন বলল, ”কালীর পোষা পাখি। দেখতে অদ্ভুত সুন্দর তাই না?”
”ওটা কী পাখি বলুন তো? অনেকটা চিল আর ঈগলের মাঝামাঝি দেখতে।”
উড়োনের জাত কী, তাই নিয়ে আলোচনা হতে হতেই দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হয়ে গেল। কালীর ডান কবজিতে একটা ব্যান্ডেজ। উড়োন গাছের ডালে। নুরুস্যার ছাপা স্কুলের প্যাড বার করেছেন। জঘন্য রেফারিং সম্পর্কে প্রতিবাদ জানাবেন বলে। কালীর হাত বেঁটে ছেলেটা যে মাড়িয়ে দিয়েছিল তার দিকে নজর রেখেছিল পাঁচকড়ি। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বল নিয়ে ঢুকে সেই বেঁটে শট নিতে যাবে পাঁচকড়ি পাশ থেকে তার পায়ের গোছ লক্ষ্য করে পা চালাল। ছেলেটি পড়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল। কোনও দ্বিধা না করে রেফারি পেনাল্টি দিলেন। খেলা তখন ০—০। আর মিনিট চারেক বাকি খেলা শেষ হতে।
পেনাল্টি স্পটে বল বসিয়ে ছেলেটি দশ পা পিছিয়ে এসে কালীর মুখের দিকে তাকাল। পা ফাঁক করে দুটো হাত ডানার মতো ছড়িয়ে কালী ডাইনে—বাঁয়ে দুলছে। ছেলেটি ছুটে এসে প্রচণ্ড শট নিল নিচু এবং সোজা। মাঠের সবাই চোখ বন্ধ করে ফেলল। কালী একচুলও নড়েনি। সোজা বলটাকে সোজা শট মেরে ফাঁকা মাঝ মাঠে পাঠিয়ে দিল। শামিম তড়াক করে বল ধরে হাতাখালির জনবিরল রক্ষণ এলাকার দিকে এগোচ্ছে, গোলকিপারও ছুটে পেনাল্টি এলাকার বাইরে এসে গেছে। শামিম তাড়াহুড়ো করে বলটা মারল। গোলকিপার ডান দিকে ঝাঁপিয়ে হাত দিয়ে কোনও ক্রমে আটকাল।
আইন ভেঙে তার এলাকার বাইরে এসে গোলকিপার বলে হাত লাগিয়েছে। ফ্রি কিক দিলেন রেফারি। নুরুস্যার প্যাডের পাতা মুড়ে পাশে রেখে দিলেন। ভাল ফ্রিকিক মারে অমিয়। মারলও এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে বল কর্নার হয় গেল। রেফারির সঙ্গে দর্শকদের অনেকেই হাত তুলে ঘড়ি দেখলেন। আর বোধহয় এক মিনিট বাকি।
হঠাৎ উড়োন গাছ থেকে ডানা ঝাপটে উড়ল। কর্নার কিক নিতে গেল রতন। বল মারতে যাবে সেই সময় কালী ছুটতে শুরু করল হাতাখালির গোলের দিকে। খেলোয়াড়রা এবং দর্শকরাও অবাক। গোল ছেড়ে গোলকিপারের এ কী পাগলামি! রতন বল মারল। উড়োন উড়ছে কালীর মাথার উপর। লাফিয়ে সে বলে মাথা ছোঁয়াল। গোলার মতো বলটা গোলে ঢুকে গেল। রেফারি বাঁশি বাজিয়ে দু’হাত দিয়ে সেন্টার দেখালেন। তারপরই খেলা সমাপ্তির লম্বা বাঁশি বাজালেন।
মাঠে লোক নেমে এসেছে। কালীকে কাঁধে তোলার জন্য একটা চেষ্টা শুরু হল। নুরুস্যার মন্তব্য করলেন, ”গুড রেফারি।” গোলটা হওয়ার পরই উড়োন উধাও। কোথায় গেল? কালী এই নিয়ে চিন্তিত নয়। সে জানে উড়োন এখন বাঁশের খুঁটিতে বসে। ধান্যকুড়িয়া স্কুল মূলপর্বে উঠল।
শোভাযাত্রা করে কালীকে বাড়ি পৌঁছে দিল স্কুলের ছেলেরা। তাদের মুখে ছিল একটাই স্লোগান ”কিং কিং, কিং কিং, কিং কং।”
কালী যা ভেবেছিল তাই, বাঁশের খুঁটিতে বসে উড়োন আর খুঁটির পাশে টুলে বসে হাবু দারোগা। সুলতা বললেন, ”আর এক গ্লাস দি?” হাবু দারোগা বললেন, ”দিন আপনার ডাবের জল সত্যিই মিষ্টি।”
তখনই হইহই করে ছেলেরা নিয়ে এল ধানকুড়ির কিং কং—কে।