দ্বিতীয় পুস্তক [১৭২৮-১৭৩১]
মনে আমার ব্যথা যতোই লাগুক, একবার যখন মনে হলো এই যাতনা থেকে পালাতে আমার হবেই, তখন সে সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে গিয়ে আর দুঃখ নয়, বেশ ভালই লাগল। অথচ আমার সেই কিশোর বয়সে, যে শিক্ষানবিসির কাজটা করছিলাম তার অর্ধেকও শেষ না করে আমার আত্মজনদের আশ্রয় পরিত্যাগ করে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য বেরিয়ে পড়ার মধ্যে কোনও রোমান্টিকতার ব্যাপার ছিল না। ছিল কঠিন এক বাস্তবে নিক্ষিপ্ত হওয়া। জীবিকা অর্জনের উপায়শূন্য, একটা নিষ্পাপ জীবনকে বাস্তব জগতের মারাত্মক সব আকর্ষণ আর বিকাশের মধ্যে নিজেকে টেনে নেয়ার ঘটনাটার কথা স্মরণ করলে এখনও আমি শিউরে উঠি। যে নির্যাতনের জীবন আমার কাছে সহ্যের অতীত বলে মনে হয়েছিল, তার চাইতে বহুগুণ অধিক কষ্ট, সহায়-শূন্যতার–হতাশার জীবনের মধ্যে যে আমাকে নিত্য মুহূর্তে যাতনা ভোগ করতে হবে, এমন অবস্থার কথা আমি আগে কল্পনা করতে পারিনি। অথচ কী কল্পনাই না আমি করেছিলাম। তখন আমার একমাত্র চালিকাশক্তি ছিল আমার স্বাধীনতার স্বপ্ন। আমি স্বাধীন হয়েছি। আমি এখন আর কারোর দাস নই। কারোর চাকর নই। কারোর হুকুমদার নই। এখন আর কী? এখন আমি যা ইচ্ছা করতে পারি। যা ইচ্ছা তা আমি লাভ করতে পারি। কেবল ইচ্ছা করলেই হলো। এখন আমি পরীর মতো বাতাসে উড়তে পারি। যেন এই দিগন্ত বিস্তৃত বিশ্বে আমার কোনও ভয় নেই। ভয়ের কোনও কারণ নেই। এখন থেকে সর্ব সাফল্যে আমি খ্যাতিমান হয়ে উঠবে। প্রতিটি পদক্ষেপে আমি লাভ করব আনন্দ আর রত্ন আর সম্পদ। এখন আমার কেবল অভিযান আর অভিযান। দুঃসাহসিক অভিযান! স্যাঙ্গাতের আমার অভাব হবে না। আমার হুকুম মাত্র ওরা আমাকে মান্য করবে। আমার মক্ষীরানীদেরও অভাব ঘটবে না। আমাকে আনন্দ দানের জন্য তারা উদগ্র হয়ে আছে। এখন কেবল আমার কামনা। সমগ্র পৃথিবীকে আমি কামনা করতে পারি। আবার ভাবলাম, এত পেয়েই বা আমি কী করব। একটি মনোহর জগৎই আমার জন্য যথেষ্ট। এর অধিক চিন্তা করে আমি কী করব। আমার বিনম্র চিন্তা হলো এমন একটি সুজন আর সুহৃদমণ্ডলী যেখানে আমি হব রাজা। আমি হব সার্বভৌম। আমার একটা দুর্গ হবে, আমার কামনার উঙ্গতায় যে উন্মুক্ত এবং উচ্চ। সে দুর্গে আমি হব প্রভু এবং প্রভুপত্নী উভয়েরই প্রেমাস্পদ, কামনার পাত্র। তাদের কন্যারা হবে আমার প্রেমের পাত্রী। তাদের পুত্রগণ হবে আমার সখা। তাদের প্রতিবেশীদের আমি হব মহারক্ষক। এমন কল্পনায় আমি আমার সমগ্র অস্তিত্বে পূর্ণ হলাম। অভিষিক্ত হলাম।
.
[কিন্তু হা হতোস্মি : একটা ক্যাথলিক ধর্মযাজকের সে পাল্লায় পড়ল : তার নাম ছিল মশিয়ে দায় পল্টভেরী। এই পাদ্রী তাকে নিয়ে গেল তার এক নতুন ধর্মান্তরিতের নিকট; অ্যানেসিতে এক মাদাম দ্য ওয়ারেনসের কাছে। তার পরের কাহিনী]
.
হ্যাঁ, শেষতক আমি মাদাম দ্যা ওয়ারেনসের কাছে নীত হলাম। তার সামনে আমি হাজির হলাম। আর সেই ঘটনাই। আমার জীবনের এই পর্যায়ের ভাগ্য যেন নির্ধারিত করে দিল। এই ঘটনার স্মৃতিকে আমি এখনও হাল্কাভাবে উড়িয়ে দিতে পারিনে। আমার বয়স তখন মোল বছরের মধ্য ভাগ। পরম সুন্দর বালক ছিলাম কী-না
তা জানিনে। তবে আকর্ষণীয় তো বটেই। আমার পা দুটি দেখতে অবশ্য খুব সুন্দর ছিল। স্বভাবে, আচরণে স্বত:স্ফুর্ত, স্বাভাবিক। একটি ছোট্ট সুন্দর মুখ। একটু গভীরে প্রবিষ্ট দুটি চোখের তারা। ক্ষণে ক্ষণে সে দু’টি যেন ঔৎসুক্যে এবং আমার টগবগের রক্তের পেষণে অক্ষিগোলক থেকে উঁকি মারছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার যে, এখন বলছি বটে, কিন্তু তখন আমি আমার দৈহিক সৌন্দর্য বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আদৌ সজাগ ছিলাম না। এবং আমার জীবনে আমি আমার দেহের সৌন্দর্য বা আকর্ষণের বিষয়ে কখনও চিন্তা করিনি। কিন্তু অবশেষে সে দিকটায় যখন দৃষ্টি পড়ল তখন অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে। দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে আমার বয়সুলভ ভীরুতার মনে যুক্ত হয়ে উঠল একটা আকর্ষণীয় বিনম্র আচরণ। আমার ভয় দাঁড়াল পাছে আমি কাউকে আঘাত দিয়ে ফেলি। পাছে কেউ আমার ওপর কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে। তাছাড়া আবার মনের গঠন ভাল হলেও আমি তখন জগৎ কাকে বলে তা চিনিনি। সামাজিক, ভ্রান্ত বংশীয় আদব-কায়দা কাকে বলে তা আমি একেবারে জানতামই না। আমার যা জ্ঞান তা আমার এই অপূর্ণতাকে পূর্ণ করার বদলে আমাকে সর্বদা একটা চাপের মধ্যে রাখত। আমার মনে হতো, আমার কিছুই তো নাই। এই সমাজের সভ্যতা কিছুই আমার নাই। এখন আমি কী করব? ফলে আমার ভয় কেবল বৃদ্ধি পেল, পাছে মাদাম ওয়ারেন্স আমার প্রথম দর্শনেই আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। তাই কেমন করে আমি তাকে তুষ্ট করতে পারি তার চিন্তাতেই আমি আরও ভয়ার্ত আচরণে রপ্ত হতে লাগলাম। মাদামকে উদ্দেশ্য করে আমি আমার শিক্ষানবিসের বইপত্রের ভাষা থেকে উদ্ধৃত করে এক পত্র রচনা করে ফেললাম। মাদামের স্নেহ লাভের কামনায় আমি কোনও শব্দ ব্যবহারেই কার্পণ্য করলাম না। একেবারে উদার এবং উদগ্র হয়ে নিজেকে প্রকাশ করার প্রয়াস পেলাম। আমি মঁসিয়ে পল্টভেরার সুপারিশ পত্রও আমার পত্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিলাম এবং তাকে সঙ্গে করে একবার তার সাক্ষাৎকারে হাজির হলাম। সে এক ভয়ার্ত সাক্ষাৎকার। সেদিন মাদাম দ্যা ওয়ারেন্স বাড়িতে ছিলেন না। এ হচ্ছে ১৭২৮-এর এক রবিবারের কথা : ‘পাস-সানডে’ বলে কথিত এক রবিবার। শুনলাম মাদাম গির্জায় গেছেন। এ কথা শুনে অমনি আমি ছুট লাগালাম। তখনও তিনি গির্জায় পৌঁছাননি। আমি ধরে ফেললাম। আমি সম্মুখপানে দাঁড়িয়ে নতজানু হয়ে তার সুন্দর পা দুটিকে চুম্বনে চুম্বনে অভিসিক্ত করলাম। এ দৃশ্য যে কতবার আমি স্মরণ করার চেষ্টা করেছি। যে স্থানটিতে এই ঘটনাটি ঘটেছিল, আমি যদি পারতাম, আমি তাকে সোনার রেলিং-এ ঘিরে দিতাম। এবং সেই রেলিং-এর গায়ে আমি খোদিত করে দিতাম জগতের মুক্তির আর্ত আবেদন। তাই তো স্বাভাবিক। তাই তো উচিত। তুমি যদি তোমার মুক্তির মঞ্জিলে যথার্থই পৌঁছ, তবে তোমাকে অবশ্যই নতজানু হতে হবে!
ঘটনাটি ঘটেছিল তার বাসগৃহের পেছনে একটি ঝরনা দ্বারা বিভক্ত বাগানে যাওয়ার পথটিতে। মাদাম দ্যা ওয়ারেন্স তার গৃহে-প্রবেশের মুহূর্তটিতে আমার কণ্ঠ শুনে ঘুরে দাঁড়ালেন। তার সে দৃষ্টিতে কি ছিল! আমি মুহূর্তেই যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম। আমি ভেবেছিলাম তিনি হবেন এক ধর্মপ্রাণ সন্ন্যাসিনী : এক গম্ভীর মুখাবয়বের ভিক্ষু। অথচ আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল অনিন্দ্যসুন্দর একটি মুখ। তার নীল অক্ষি দুটি কী মনোহর, তার কী দুর্বার আকর্ষণ! মমতায় মণ্ডিত। রঙের কি বাহার, বক্ষ দু’টি কত উন্নত! প্রায় কিশোর একটি ধর্মাশ্রয়ীর চোখে তার দেহ সৌষ্ঠবের কিছুই দৃষ্টির আড়ালে থাকেনি। আমি যেন মুহূর্তের মধ্যে তার অচ্ছেদ্য অস্তিত্বের অংশ হয়ে গেলাম প্রচারিত ধর্ম আমাকে মহান স্বর্গ বৈ কোনও দেশে নিয়ে যাবে! স্ফীত মুখে তিনি আমার কম্পিত হস্ত থেকে আমার প্রার্থনা পত্রটি তার হাতে তুলে নিলেন। তিনি মঁসিয়ে পাল্টিভেরীর সুপারিশটি পাঠ করলেন। আবার যেন সেটি পাঠ করতে যাচ্ছিলেন, তখনি তার ভৃত্যটি বলল : মাদাম, এখন আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। তিনি পদক্ষেপ দিয়ে এমন কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “আহা প্রিয় বৎস, তুমি তোমার এই কচি বয়সে এমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছ?’ তার কণ্ঠের শব্দ আমার আপাদমস্তক শিহরিত করে তুলল। তোমাকে দেখে আমার করুণা হচ্ছে। আমার কোনও জবাবের অপেক্ষা না করে তিনি আবার বললেন : তুমি এর সঙ্গে ভেতরে যাও এবং তোমাকে সকালের কিছু নাশতা দিতে বল। আমি আসছি। আমার প্রার্থনার পরে আমি এসে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
[এই পর্যায়টিতে জ্যাঁ জাক মাদাম ওয়ারেনস-এর বিগত জীবনের নানা চিত্তাকর্ষক কাহিনীর উল্লেখ করছেন। জঁ জাকের চেয়ে মাদাম ওয়ারেলসের বয়স তখন বার বছরের অধিক ছিল। জ্যা জাক তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনা দিচ্ছেন।]
আমার মনে তখন প্রশ্ন জাগল : এখন আমি কী করব? আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ করার জন্য তিনি আমাকে মধ্যাহ্ন আহার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। মধ্যাহ্ন আহারে বসে আমার মনে হলো জীবনে এই যেন প্রথম আমি ক্ষুধা-তৃষ্ণা সব বিস্মৃত হয়েছি। তার যে দাসীটি আমাকে আহার পরিবেশন করছিল সে বলল : এমন শিশুকে এমন দুরবস্থায় আমি আর কখনও দেখিনি। তার এই মন্তব্যটিতে আমি বিস্মিত হলাম না। বরং আমার দৃষ্টি গেল আমাদের খাওয়ার টেবিলেই উপবিষ্ট হাভাতে ক্ষুধার্তের দিকে। তার ভক্ষণের দৃশ্যই আমাকে বিস্মিত করেছিল। সে ইতোমধ্যেই দুজনের আহার ভক্ষণ করে ফেলেছে। আমার ব্যাপারটা দাঁড়াল সংকটজনক। আমি তখনও যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমার পক্ষে কিছুই খাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। অন্তরে যেন অনাস্বাদিত অনুভূতির সৃষ্টি হলো। এ অনুভূতি আমার সমগ্র অস্তিত্বকে যেন গ্রাস করতে উদ্যত হলো। ফলে আর কিছুতেই আমি মনোযোগ দিতে সক্ষম হলাম না।
এবার মাদাম ওয়ারেন্স আমার অবস্থা সম্পর্কে কথা তুললেন। আমি কোথায় কীভাবে থেকেছি, তার কথা জানতে চাইলেন। তার কথার জবাব দিতে গিয়ে যেন আমি আবার আমার হৃদয় তরঙ্গকে ফিরে ফেললাম। আমার শিক্ষানবিসির দুর্দশাগ্রস্ত অস্তিত্বের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলাম। আমি যত আমার অতীতের কথা তাকে বলতে থাকলাম তত তিনি আমার জন্য তার আন্তরিক সমবেদনাকে প্রকাশ করলেন। তিনি আমাকে আবার জেনেভাতে ফেরত যেতে বললেন না। যেন এমন করাটা তার ক্যাথলিক বিশ্বাসের প্রতিই অধার্মিক আচরণ করা হবে। তিনি জানতেন আমি তার প্রতিটি শব্দকে কেমন মোহগ্রস্তের মতো আমার হৃদয়ে গ্রহণ করছি। কিন্তু তিনি আমার পরিত্যক্ত পিতার জন্যও এত সমবেদনা বোধ করছিলেন যে তার পক্ষে স্বাভাবিক হতো আমাকে উপদেশ দিয়ে বলা : বাছা, তুমি তোমার দুঃখি বাবার কাছে ফিরে যাও। তাকে তোমার সান্ত্বনা প্রদান কর। আসলে তিনি বুঝতে পারছিলেন না, আমার প্রতি তার মনের মুগ্ধতা প্রকাশের কী ব্যর্থ চেষ্টাই না তিনি করে চলেছেন।
পাঠকরা বুঝতে পারছেন, আমার মন আমি ইতোমধ্যে তৈরি করে ফেলেছি। আর তিনি যতই আবেগ দিয়ে আমাকে ফেরত পাঠাতে চাচ্ছিলেন আমি ততই তাকে আঁকড়ে ধরছিলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি তার এমন পরামর্শে যদি সত্যই জেনেভা ফিরে যাই তাহলে আমি আর তার কাছে প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হব না। তার এবং আমার মধ্যে একটা অপরিপূর্ণ বিচ্ছেদের সৃষ্টি করবে। আর তাই আবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি আর পিছু হটব না। যা থাকে আমার ভাগ্যে। আর তাই আমি দৃঢ় রইলাম। একটুও নড়লাম না। মাদাম ওয়ারেন্স দেখলেন তার কোনও কথায় কাজ হচ্ছে না, তখন যেন তিনিই আমার ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। আমার দিকে তখন তিনি করুণার চোখে তাকিয়ে বললেন : আহা বাছাধন, আমি কী করব! গড যেখানে তোমাকে আহ্বান করবেন, তুমি অবশ্যই সেখানে গমন করবে। গড় তোমার মঙ্গল করুন। কিন্তু যখন তুমি বড় হবে, তখন নিশ্চয়ই এই বৃদ্ধার কথা তোমার স্মৃতিতে আসবে। আমি জানি তিনি তখনও জানতেন না কী নির্মম ভবিষ্যদ্বাণীই তিনি সেই ক্ষণে আমার সম্পর্কে উচ্চারণ করেছিলেন।
[এবার ঠিক হলো যে, রুশো তুরিনে যাবে এবং সেখানে সে ক্যাথলিক ধর্মান্তরকৃতদের আবাসনে অবস্থান করবে।]
আমার বাবার কথা আবার বলছি। আমার বাবা কেবল যে একজন সৎ ব্যক্তি ছিলেন, তাই নয়, তিনি যথার্থই একজন উন্নত স্তরের মানুষ ছিলেন। তার অন্তঃকরণ এত বৃহৎ ছিল যে কোনও মহৎ কর্ম থেকেই তিনি নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারতেন না। এছাড়াও আমাকে বলতে হয় তিনি আমার জন্য একজন হৃদয়বান পিতা ছিলেন। অপর কারোর চাইতে আমার প্রতি তিনি মমতায় অধিকতর পূর্ণ ছিলেন। তিনি আমাকে ভালবাসতেন গভীরভাবে। তিনি নিজে তার আনন্দকে উপভোগ করতেন। কিন্তু আমি সে কৈশোর থেকে তার নৈকট্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম তাই তার নিজের অপরাপর দায় দায়িত্ব আমার প্রতি তার স্নেহ-ভালবাসার উষ্ণতাকে হয়তো কিছুটা হ্রাসও করে দিয়েছিল। তিনি নিয়ন শহরে দ্বিতীয়বার এক মহিলাকে বিয়ে করেন। যদিও সে মহিলার পক্ষে সম্ভব ছিল না আমার নতুন কোনও সহোদরকে জন্মদানের, তবু তার নানা সম্পর্ক ছিল। ফলে আমাদের পারিবারিক জীবনে কিছুটা বিশৃঙ্খলা তথা বিভক্তি এল। অন্য পরিবার তৈরি হলো। আর সে কারণে আমি হয়তো আমার পিতার স্মৃতিতে আগের মতো আবেগময়ভাবে জাগরিত হতাম না। আমার পিতার বয়স বাড়ছিল। তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। তার আয় উপার্জনও অপ্রতুল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু আমার যে এক সহোদর ছিল সে এবং আমি, আমরা দু’জনে আমার মাতৃকুলের কিছু সম্পদের উত্তরাধিকারী হতে পেরেছিলাম। সেই সম্পদের ওপর প্রাপ্য সুদ বা লাভ আমি এবং আমার সহোদরের অনুপস্থিতিতে তিনি ভোগ করতে পারতেন। অবশ্য তিনি এভাবে তেমন ভাবেননি, এই সম্পত্তির কথা। আর তাই আমার প্রতি তার দায়িত্ব পালনে তিনি কখনও অবহেলা করেননি। তবু কোনও কোনও ক্ষেত্রে অচেতনভাবে হলেও তার স্নেহের উষ্ণতার কিছুটা ম্লানতা আমার মনকে বেদনাসিক্ত করে তুলত। হয়তো এ কারণেই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পরে তিনি আমার অনুসন্ধানে আর তত নিজেকে নিযুক্ত করেননি। একবার অ্যানেসিতে গিয়েছিলেন কিন্তু চাম্বেরিতে যাননি। সেখানে গেলে তিনি আমাকে ধরে ফেলতেন। আর সে কারণেই আমার বাড়ি ছাড়ার পরে যখনি আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যেতাম তখন তিনি অবশ্যই পিতার স্নেহ দিয়ে আমাকে আদর করতেন, কিন্তু আমাকে ধরে রাখার জন্য তত চেষ্টা করতেন না। আমার পিতা, যার সততা এবং মমতার কথা আমি গভীর জানতাম, তবু তার এই পরিবর্তন যে আমার চিন্তার ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন না এনেছে, তা নয়। আমি ব্যাপারটা নিয়ে একটু নিরাসক্তভাবে চিন্তা করেছি। এতে আমার লাভই হয়েছে। আমি এর মধ্য দিয়ে বুঝতে পেরেছি যে, আমাদের কতব্যের সঙ্গে যদি কোনও অবস্থায় স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হয়, তাহলে এমন অবস্থা আমাদের পরিহার করাই উচিত। কারণ তখন অন্যের দুঃখ থেকে নিজের সুখ লাভের একটা ইচ্ছার জন্ম হয়। কারণ এমন অবস্থায়, ন্যায়ের প্রতি আমার আনুগত্যবোধ যতোই হোক না কেন, আমাদের নিজেদের অজ্ঞাতেই আমাদের নৈতিক বোধ এবং আনুগত্য আজ না হোক, কাল দুর্বল হয়ে পড়তে বাধ্য। তখন ক্রমান্বয়ে আমাদের অসৎ এবং দুর্বিনীত হতেও আমাদের বাধবে না। আমার এই বোধটা বিলম্বে হলেও, বাস্তব জগতে অপরের চোখে আমার আচরণ অনেক সময়েই অস্বাভাবিক এবং নির্বোধ সুলভ বলে বোধ হয়েছে। বিশেষ করে আমার পরিচিতজনরা আমাকে অদ্ভুত এক প্রাণী বলে মনে করতে লাগল। আমাকে তারা, আমি বাহাদুরির ভান করছি বলে আমার ওপর দোষারোপ করেছে। আসলে অপর কারোর থেকে ভিন্ন হওয়ার ভাব আমি কখনও দেখাইনি। আমি যা সঠিক মনে করতাম তাকে সাধন করারই চেষ্টা করতাম। কারোর স্বার্থ ক্ষুণ্ণকারী অবস্থা থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার আমি চেষ্টা করেছি। তাতে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়তো তারা নিজেদের আহত বলে বোধ করেছে। বছর দুই আগের কথা। আমার লর্ড মার্শাল বললেন : আমি তোর নাম আমার উইলের মধ্যে রেখে যাব। আমি তার এই প্রস্তাবে যারপরনাই আপত্তি জানালাম। আমি তাকে বললাম : দোহাই আপনার, এই কাজটি আপনি করবেন না। সারা পৃথিবীর বিনিময়েও আমি এটা চাইব না। শেষপর্যন্ত আমার কথায় তিনি দমলেন। বললেন : ঠিক আছে, তোর কথা আমি মানলাম। তবে তোর জন্য আমি একটা আজীবন পেনশনের ব্যবস্থা করব। তার এ প্রস্তাব আর স্বীকার না করে পারলাম না। অবশ্য এ ব্যাপারে আপনারা বলতে পারেন : শেষ পর্যন্ত নিলে তো! তা আমি স্বীকার করি। তবু আমি নিজের মনে আজো বলি, হে আমার মহা-উপকারী এবং পিতা: আপনার ইচ্ছাটি মহৎ। কিন্তু ঈশ্বর না করুন আপনার মৃত্যুর পরেও যদি আমি বেঁচে থাকি তবে আপনার মৃত্যুতে আমার অপকার বৈ কোনও উপকার ঘটবে না। আপনার মৃত্যুর পরে আমার কিছুই থাকবে না। আগে যা কিছু ছিল তার কিছুই আর থাকবে না? এ সত্যকে আমি অস্বীকার করি কী করে?
আমি মনে করি, এটাই মানুষের আসল দর্শন। আমি এই দর্শনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। শুভাকাঙ্ক্ষী ভাল। কিন্তু আসল ভাল নিজের ওপরই নির্ভর করে। অপরে যতোই শুভেচ্ছা প্রকাশ করুক না কেন। একথা অন্যকে বোঝানো শক্ত। তবু আমি মনে করি, আমার হয়তো এখন যে কাজ আছে, তা শেষ করে আমার ‘এমিলির’ মধ্যে আমার এই চিন্তাটিকে আরও বিস্তারিত এবং আকর্ষণীয় করে প্রকাশ করার চেষ্টা করব। তখন পাঠকরা আমার চিন্তাটি ভাল করে বুঝতে বাধ্য হবে। কিন্তু এ বিষয়ে এখন আর না। এখন আমি পদাতিক। আমি একটা লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। তুরিনকে সামনে রেখে।
[রুশোর তুরিন যাত্রাটি তার জন্য যেমন সুখদায়ক তেমনি বিশেষ অভিজ্ঞতাপূর্ণও হয়েছিল।]
সত্যিই তুরিন যাত্রাটি আমার একটা তীর্থ দর্শনের মতো কাজ করেছে। তুরিন যাত্রার স্মৃতিটি আমাকে এখনও উদ্দীপিত করে। সেটা ছিল একটা পাহাড়ি পথের যাত্রা। সেই কিশোর কালের পরে এমন করে আর কখনও আমি পায়ে হাঁটিনি। এই পদ্যাত্রায় সুখ বৈ কোনও দুঃখ ঘটেনি। কর্তব্য বলি কর্তব্য, বোঝা বিড়া ঘাড়ে করে বহন করার কথা বলে তাকে বহন করেছি। পরে অবশ্য আমাকে আর একটু ভদ্র হতে হয়েছে। আমি একটা যাত্রী কোচও ভাড়া করেছি। তুরিন পর্যন্ত আমার কোনও ক্লেশ ঘটেনি। প্যারিসে পৌঁছার পরে আমি চেষ্টা করলাম আমার স্বভাবের আর দু’জনকে যোগাড় করতে পারি কিনা যারা আমার সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকবে। অন্তত পঞ্চাশটা লুই তারা খরচ করতে রাজি হবে। পঞ্চাশটা লুই খরচ করতে পারবে। তুরিন ইতালির একটি শহর। পথে বোঝা বইবার জন্য কেবল একটি ছোঁকড়াকে যোগাড় করেছিলাম। তুরিন যাওয়ার ব্যাপারটায় অনেকের উৎসাহ ছিল। কল্পনায় তারা ব্যাপারটাকে বেশ মনোহর এবং সহজ ভেবেছিল। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা তা ছিল না। দিদেরো এবং গ্রিম এই দুজনের কথা বলছি। এই দু’জনের সঙ্গে আমি বিশেষ উৎসাহ নিয়েই কথা বলেছিলাম। প্রথমে দু’জনেই উৎসাহ দেখাল। কিন্তু বাস্তবে দেখলাম, তাদের কল্পনা কাগজে যত লেখা যায়, ততোটা বাস্তবে নয়। বাস্তবে দেখলাম স্রিমের আর উৎসাহ টিকল না। স্লিম দিদেবরাকে কতগুলো অপকর্মেই জড়িয়ে ফেলল। আর আমাকে এক পর্যায়ে ইনকুইজিশনের হাতে সঁপে দিল।
আমি তুরিনে পৌঁছে গেলাম। আসলে এত তাড়াতাড়ি যে আমি তুরিনে পৌঁছে যাব, তা কল্পনা করিনি। কিন্তু এটা কোনও দুঃখ বা হতাশার ব্যাপার ছিল না। আমার ভাগ্যে কোনও দুঃখ বা হতাশার ব্যাপার ছিল না। আমার ভাগ্যে ঘটল তুরিনের মতো এত বড় একটা শহর দেখার ভাগ্য। আমি ভাবলাম এবার আমার মনষ্কামনা পূরণ হবে।
আমি দেখলাম আমার ভেতরে বেশ পরিমাণ বড় হওয়ার তথা বিখ্যাত হওয়ার একটা স্বপ্নের সৃষ্টি হয়েছে। কোথায় আগে ছিলাম একটা শিক্ষানবিস। কিন্তু এখন আমি সেই অবস্থা ছাড়িয়ে বহু ওপরে উঠে যাবো। কেবল এই সন্দেহটি আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। উপরে ওঠার বদলে যে অতলে আমি তলিয়ে গেলাম তা
আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। আমার কাছে কয়েকটি পত্র ছিল। সেগুলো আমি তুরিনে পৌঁছে দেখালাম। আমার পত্র দেখে আমাকে অভ্যর্থনাকারী সাথে সাথেই ক্যাথলিক ধর্মীয় অনাথ আশ্রমে নিয়ে গেল। আমি সামনে তাকাতেই একটা বিরাটাকারের গেট দেখলাম। আমাকে গেটের ভেতরে ঢুকিয়ে একটা বড় ঘরের মধ্যে নেয়া হলো ভেতরের আসবাবপত্রের মধ্যে। ঘরের শেষপ্রান্তে একটি ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি দেখতে পেলাম। তাছাড়া সম্মুখে কয়েকখানি কাঠের চেয়ারও দেখলাম। আমার মনে হলো চেয়ারগুলোকে ঘষামাজা করে মসৃণ করা হয়েছে। আসলে এই মসৃণতা এসেছিল চেয়ারগুলোর প্রতিদিনের ব্যবহারের মাধ্যমে। এ হলঘরের মধ্যে আমার চোখের সামনে দেখলাম চার চারটা ভীতিজনক মাস্তানজাতীয় জীব। এদের আর যা কিছুই ভাব থাক না কেন এদেরকে কোনও ঈশ্বরের সন্তান বলে কল্পনা করা যায় না। এই মাস্তানগুলোর অন্তত দুইটা ছিল স্লোভানিয়ান। এরা নিজেদের বলছিল ইহুদি বা মুরজাতীয় বলে। এদের দুইটার সঙ্গে আলাপ ঘটে। আমাকে তারা বলে, তারা এতদিন মুক্তির খোঁজে স্পেন এবং ইতালি ঘুরে বেরিয়েছে। এখন এখানে যখন পৌঁছতে পেরেছে তখন তারা ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করবে। এর পরে আর একটা লোহার দরজা খুলে দেয়া হলো। এর মধ্য দিয়ে দেখা গেল যেন সামনের আঙ্গিনাটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। এই দরজার মধ্য দিয়ে এবার সিসটারস বা সন্ন্যাসিনীর দল এসে প্রবেশ করল। এদেরও এবার নবজীবন বা ধর্মান্তকরণ ঘটবে। এরাও এবার নিজেদের ধর্ম পরিত্যাগ করে নতুন ধর্মে জীবন লাভ করবে। এদের দিকে আমার চোখ তুলে তাকাতে ইচ্ছা করল না। দেখতে যেমন বদখত তেমনি মনে হলো এরা গণিকা বৈ আর কিছু নয়। তবে এদের মধ্যে একটি ছিল আমারই বয়সী। একে আমার সুন্দর বলে বোধ হলো। আমার বয়সী, কিংবা দু’তিন বছর বড়ও হতে পারে। তার চোখ দুটোতে একটু দুবৃত্তপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। মেয়েটা আমার দিকে দু’একবার দৃষ্টিও ফেরাল। আমাদের যেন চক্ষু বিনিময় হলো। ফলে ভাবলাম, আমি একটু কথা বলি। মেয়েটা এই আবাসে প্রায় তিন মাস আগেই এসেছিল। আর আমি আসার পরে যে দুইমাস কেটে গেল তার মধ্যে একদিনও ওর সঙ্গে কোনও আলাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। এই মেয়েটাকে যে রক্ষকদের অধীনস্থ করে রাখা হলো এবং তারাও ওকে যেভাবে কয়েদীর ন্যায় সতর্কভাবে পাহারা দিয়ে রাখল, যাতে আমার পক্ষে আদৌ ওর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হলো না। ওই রক্ষিতারা ওকে যতো-না বুদ্ধির সঙ্গে, তার অধিক দেহের জোরে যেন ওকে ধর্মান্তকরণের জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল। মেয়েটাকে আমার নির্বোধ বলে মনে হলো। ধর্ম শিক্ষার ব্যাপার যদি হয় তাহলে কোনও মানুষেরই এত অধিক সময় লাগার কথা নয়। যে পাদ্রী ওকে শিক্ষা দেয়ার দায়িত্বে ছিল সে ক্রমান্বয়ে হতাশ হয়ে উঠল। ভাবল, এর দ্বারা তার পাপের স্বীকৃতি আদায় করা আদৌ সম্ভব হবে না। মেয়েটাও ক্রমান্বয়ে তার এই ধর্মীয় বন্দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। অবশেষে সে বলেই ফেলল : খ্রিস্টান আর অখ্রিস্টান যাই হই না কেন, আমি এখানে থাকব না। আমি চলে যাবো। তার দীক্ষা দাতারা ভাবল, অধিক জবরদস্তি করলে শেষে একেবারেই অস্বীকার করবে।
এবার নবাগতের সম্মানে নিবাসের সকলের একটি সমাগম ঘটানো হলো। পাদ্রীদের পক্ষ থেকে প্রথমে একটি বক্তৃতা প্রদান করা হলো। এই বক্তৃতার প্রধান লক্ষ্য হলাম আমি। ‘বৎস! তুমি ভেবে দেখ। তুমি স্বীকার কর। ঈশ্বর তোমাকে কী ভাগ্যে ভাগ্যবান করেছেন।’ অপর সকলকে বলা হলো : তোমরা সকলে ওর মঙ্গলের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর এবং তোমাদের আচরণ দ্বারা ওকে অনুপ্রাণিত করে তোল।
এর পরে সন্ন্যাসিনীরা তাদের ঘরে গমন করল। ফলে আমি একটু রেগেই গেলাম। আমি এবার নিজের দিকে তাকাবার একটু ফুরসত পেলাম। আমি যে অবস্থাতে এতক্ষণে নিক্ষিপ্ত হয়েছি তার দিকে তাকিয়ে যারপরনাই বিস্মিত বোধ করলাম। … আমি এতদিন যা মনে করেছি বা বলেছি তা কারোর শেখানো কথা নয়। আমার অভিজ্ঞতার কথা। আমি এখনও বলি, শিশুদের কাছে ধর্মের কথা বলা উচিত নয়। তারা ঈশ্বরকে এখনও দেখেনি। ঈশ্বর তথা গড় কাকে বলে তা তারা জানে না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি। আমার এ বুঝ অপর কারোর ওপর চাপানো যায় না। আমি বলি একটি ছ’বছর বা সাত বছর বয়সের এক বালক যার নাম জ্যাঁ জ্যাক তাকে আপনারা আপনাদের সামনে উপস্থিত করুন। হা এরপরে অন্তত আমাকে সাত বছরের হতে দিন। তারপর আপনাদের গডের কথা কিছু বলুন। দেখবেন তাতে আপনাদের কোনও লোকসান ঘটবে না।
একদিক দিয়ে একথাটা সত্য যে শিশুদের যখন আমরা ধর্মের কথা বলি তখন সেও যেমন, আমরাও তেমন মনে করি জন্মগতভাবে ও যা, সেটাই ওর ধর্ম। এই যে জন্মগত বিশ্বাস এর জোর প্রায়শই বয়োবৃদ্ধিতে হ্রাস প্রাপ্ত হয়, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত নয়। শিশুকালের এমন শিক্ষায় ধর্মীয় কতগুলো গোঁড়ামিরই উদ্ভব ঘটে। চিন্তার নয়। আমার পিতার ধর্মের প্রতি বা পারিবারিক বিশ্বাসের প্রতি আমার আকর্ষণ ব্যতীত আর একটা ব্যাপার ছিল যার দ্বারা আমার কৈশোরের ধর্মানুভূতি তৈরি হয়েছিল। সে হিসেবেই জেনেভায় আমাদের গ্রামের ধর্মীয় পরিবেশ। আমাদের গ্রামের ক্যাথলিক ধর্মের পরিবেশে আমি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠছিলাম। ক্যাথলিকদের আচরণের মধ্যে আমি ব্যক্তিপূজা তথা মূর্তি পূজার প্রকাশ যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কাছে সে ছিল এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। ফলে ক্যাথলিকবাদকে আমি কালো, কৃষ্ণ কালো বৈ অপর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। এর ফলে ক্যাথলিক পাদ্রীদের আমি খারাপ বৈ ভাল ভাবতে পারিনি। গোড়ার দিকে এই বিতৃষ্ণাটা এত তীব্র ছিল যে, এর ফলে কোনও গির্জার ভেতরের কোনও সৌকর্যের প্রতি আদৌ চোখ ফেরাতে আমার ভাল লাগেনি। ধর্মের জোব্বা পরা কোনও পাত্রীর দিকে চোখ ফেরাতে আমার ভাল লাগেনি। প্রার্থনার ঘণ্টাও যেন আমি শুনতে পেতাম না। ঘণ্টা ধ্বনির এ যন্ত্রণা শহরে তত শোনা যেত না। কিন্তু গ্রামের গির্জাগুলোর ঘণ্টার শব্দ থেকে রেহাই ছিল না। আসলে আমার এমন বোধের উৎস ছিল সেই জেনেভার আমার শৈশবের ধর্মযাজকদের শিশুদের প্রতি তাদের পিতৃসুলভ স্নেহপূর্ণ আচরণ। অবশ্য এখানেও প্রার্থনার ঘণ্টা কেবল যে ভীতিজনক ছিল, এমন নয়। প্রার্থনার ঘন্টার সঙ্গে অবশ্যই খাবার ঘরের মাখন, রুটি, আপেল এবং অন্যান্য খাবারেরও একটা প্রলোভন ছিল সেটা রোধ করা সহজ ছিল না। মশিয়ে পল্টিভারের উপাদেয় খাবারগুলোর আকর্ষণ কম ছিল না। কাজেই ক্যাথলিকদের প্রতি প্রাথমিক বিতৃষ্ণা কাটাতে আমার খুব বেগ পেতে হলো না। তখন ‘প্যাপিজম বা পোপবাদ বলতে বেশ ভাল রকমের খাবার-দাবারের একটা উদ্দীপনাও যেন যুক্ত হয়ে উঠল। তখন আর এমন আশ্রমে বাস করা তেমন কষ্টকর কিছু বলে বোধ হলো না। তবুও রোমের পোপের সন্নিধানে যাওয়ার ব্যাপারটা তখনো আমার কাছে দূর কল্পনার ব্যাপারই হয়ে রইল। এখন আমার বুঝের বয়স হয়েছে। এখন পেছনে তাকালেই বুঝি ধর্মান্তরের সম্মতিতে কী বিপজ্জনক সিদ্ধান্তই না সেদিন আমি গ্রহণ করেছিলাম। ক্রমান্বয়ে যে সব নবদীক্ষিতের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটতে লাগল, তাতে তাদের আচরণ আমার সাহসকে একটুও বৃদ্ধি করল না। মনে ক্রমান্বয়ে আমার নিজের মধ্যে এমন একটা বদ্ধমূল ধারণার সৃষ্টি হতে লাগল যে আমার ভবিষ্যতের কাজ কোনও ধর্মীয় কাজ হবে না। সে কাজ হবে দস্যুতামূলক। কোন ধর্ম ভাল বা মন্দ তা আমি আজো জানিনে। শুধু এটুকুই আমি জানি, যে ধর্মই আমি গ্রহণ করি না কেন, তা আসলে আমার নিজের চারিত্র-ধর্মকে বিক্রি করা ছাড়া আর কিছু হবে না।
এ নিয়ে আমি যতই চিন্তা করতে লাগলাম, ততই আমি নিজের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলাম। যেন আমি একটা চক্রের মধ্যে পড়ে গিয়েছি এরকম হলো আমার, এ আমার স্বাধীন ইচ্ছার পরিণতি নয়। এই চিন্তা ক্রমান্বয়ে এমনভাবে পেয়ে বসেছিল যে, আমি যদি তখন এই আশ্রম থেকে পালাবার পথ পেতাম তাহলে আমার যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই চলে যেতাম। কিন্তু তখন এমনভাবে পালানোর আমার উপায় ছিল না। তেমন জোরালো ইচ্ছাশক্তিও তখন আমার ছিল না। আমার মনে তখন এত এলোমেলো চিন্তা আসছিল যে আমি কিছুই করতে পারলাম না। তাছাড়া আমি আর কিছুতেই জেনেভা ফিরে যাবো না, সেই পাহাড় চূড়া আমাকে অতিক্রম করতে হবে, তা আমি আর ভাবতেই পারছিলাম না। এখন কী করি আর করি না এই অস্থিরতার জন্য আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দায়ী করতে পারছিলাম না। আমি নিজের প্রতিকৃতিকেই প্রতিদ্বন্দী কল্পনা করে যা কিছু ভর্ৎসনা আমি তাকেই করলাম। বললাম : তুমিই এর জন্য দায়ী। আমার অতীত সব কর্মকাণ্ডই এখন আমার কাছে গর্হিত বলে মনে হতে লাগল। আমি ভাবলাম, যে অবাঞ্ছিত ভবিষ্যৎ আমার জন্য এখন অপেক্ষা করছে, সে আমারই কর্মকাণ্ডের ফল। আমি আমার নিজের অস্তিত্বকে আর বলতে পারলাম না কী হয়েছে, সাহস হারাচ্ছ কেন? তোমার সততাকে তো কেউ হরণ করেনি। তুমি তোমার সততায় স্থির থাক। আমার প্রতিকৃতিকে এখন আমি কেবল বলতে পারলাম : ‘সে দিন আমার গেছে। আর আমি তাকে উদ্ধার করতে পারবো না। আমি আর সে আমি হতে পারবো না। সে ছিল আমার হতাশার এক চরম অবস্থা।
যে আত্মধিক্কারে নিজেকে ধিকৃত করলাম, সে অবস্থা আমার অকল্পনীয় নয়। যারাই এমন অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয়, তখন সে তার সব সাহস এবং উদ্যমকে হারিয়ে ফেলে। সে মনে করে তার বয়স হয়ে গেছে। সে শেষ হয়ে গেছে। আমরা আমাদের ন্যায়কে যখন হারাই, তখন সে ঘটনা আমাদেরই নিজেদের কর্মের ফল। আসলে আমরা যদি প্রাজ্ঞ হতে পারি তাহলে আমাদের অজ্ঞ হওয়ার অবস্থা ঘটে না। কিন্তু চরিত্রের প্রবণতাকে যখন প্রতিরোধ করা সম্ভব তখন তার লাগাম ছেড়ে দিলে আর তাকে ফেরানো যায় না। সে তখন ক্রমান্বয়ে অদম্য হয়ে ওঠে। তখন ক্রমে যে। তুচ্ছতাকে আমি ঘৃণ্য মনে করতাম তার সাধনে আর লজ্জা বোধ করিনে। আমাদেরই অজান্তে আমরা তখন বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নিপতিত হই। অথচ একদিন আমি এ অবস্থার শিকার না হতে পারতাম। কিন্তু এখন আর শত আত্মধিক্কারেও সেখানে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্তত তেমন করতে হলে যে অদম্য সাহস দরকার আমার তা তখন ছিল না। এমন অবস্থায়ই শেষপর্যন্ত আমাদের গডকে আমরা ধিকৃত করি। আমরা তার জবাবদিহি করি : ঈশ্বর এ তুমি কী করলে! আমাকে এমনতর দুর্বল করে কেন বানালে?
ঈশ্বর তার জবাবে বলে; আমি নই তুমিই এর কারণ। তুমি এ জন্য দায়ী। আমি তোমাকে শক্তি দিয়েছিলাম, গভীর এই গহ্বরে নিপতিত না হওয়ার। তোমার নিজের অশক্তিতে তুমি আজ এই গহ্বরে পতিত হয়েছ।
আমি তখনো এমন সিদ্ধান্ত নিইনি, যে আমি ক্যাথলিক হব। অবশ্য তেমন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তখনও আসেনি। সামনে সময় অনেক বাকি। আমি ভাবলাম হাতে যে সময়টা আছে সেটা বরং আমি ব্যবহার করি কেমন করে এই জাল কেটে আমি বেরিয়ে পড়তে পারি। সময় পাওয়ার জন্য আমি চিন্তা করতে লাগলাম কোন্ যুক্তি আমার লাগসই হবে। কিন্তু আমার অহংবোধ থেকে এ চিন্তাও আমি বাদ দিলাম। পরে আমি দেখলাম যারা আমার ওপর ধর্মের মাতব্বরি করতে চাচ্ছে তারা আমার আচরণে বিরক্তি বোধ করতে শুরু করছে, তখন আমি নিজের মনে বললাম : দেখা যাবে কে কাকে শোওয়ায়?
আমি ভাবলাম, যে কয়টা আমার সামনে আসবে সবকয়টাকেই আমি শুইয়ে দেব। এবার এ ব্যাপারে আমি দুরন্ত হতে শুরু করলাম। একদিকে এরা যখন আমাকে ক্যাথলিক বানাতে শুরু করল, আমি তখন ওদের পাল্টা প্রটেস্ট্যান্ট বানাবার প্যাঁচ কষতে লাগলাম। ক্রমান্বয়ে আমার বিশ্বাস জন্মাল যে ওদের প্রটেস্ট্যান্ট বানাতে আমি সক্ষম হবই। ওদের মনে কেবল বিশ্বাস জন্মানো দরকার।
ফলটা মন্দ হলো না। আমার ওপর ওরা ওদের বিশ্বাস হারাতে শুরু করল। ওরা দেখল ক্যাথলিক হতে আমার প্রয়োজনীয় জ্ঞান আর কোনওটাই নাই।
আসলে প্রটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় শিক্ষা পদ্ধতি ক্যাথলিকদের চাইতে ছিল উন্নতমানের। এটাই স্বাভাবিক। কারণ একটার মধ্যে তথা প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে যেখানে যুক্তি আর আলোচনার অবকাশ থাকতো, সেখানে ক্যাথলিকদের মধ্যে একেবারে অন্ধ বিশ্বাস ছাড়া আর কিছুরই জায়গা ছিল না। ক্যাথলিকদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল, তোমাকে যা বলা হবে, তা তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে, বিতর্কে। প্রটেস্ট্যান্টদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল যুক্তির। তারা বলত তোমার সিদ্ধান্ত তুমি নিবে। এখানে কোনও জবরদস্তির ব্যাপার নাই। জোর নয়। যুক্তি। ব্যাপারটা জানা।
কিন্তু আমার মতো বয়স্ক আর অভিজ্ঞতার লোকের কাছ থেকে ক্যাথলিকরা কোনও প্রতিরোধেরই আশা বা আশঙ্কা করেনি। তাছাড়া আমি এখনও মন্ত্রগুপ্তির পর্যায় পার হইনি। এ ব্যাপারে যা আমার করণীয়, তাও আমাকে পরিষ্কার করে বলা হয়নি। এসব ওরাও জানত, আমি জানতাম। কিন্তু যে ব্যাপারটা ওরা আমার বিষয়ে জানত না, তা হচ্ছে এই যে মশিয়ে লাম্বারসিয়েরের কাছে আমার একটা ভিন্নরকম শিক্ষা ঘটে গিয়েছিল। তাছাড়া আমি দেখতে ক্ষুদ্র হলেও আমার মস্তিষ্কে কিছু বুঝের ঘিলু ছিল। এটা ওরা জানত না, আর এটার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ওদের ক্ষমতা ছিল না। প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্রিস্টান গির্জার কাহিনী আমি জানতাম এবং রোমান সাম্রাজ্যের জ্ঞানও আমার কিছুটা ছিল। আমার পিতার কাছে যখন আমি ছিলাম তখন এসবই আমি প্রায় কণ্ঠস্থ করে ফেলেছিলাম। অবশ্য ইতোমধ্যে আমি তা প্রায় বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন যখন ধর্মে-ধর্মে তর্কাতর্কির ব্যাপার দাঁড়াল তখন দেখলাম আমার পিতার কাছ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ও শক্তি আমার পাশে এসে সহায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
এই সময়ের একটা কথা বলি। এ সময়ে দেখলাম কিছুটা বয়স্ক এবং শ্রদ্ধাযোগ্য এক পুরোহিত একদিন আমাদের সকলকে এক সঙ্গে নিয়ে বসলেন। আমাদের পুরোহিত দেখলেন তার অধিকাংশ শিষ্যদের জন্য প্রয়োজন যত না তাদের আপত্তি বা প্রশ্নের জবাব দান, তার চাইতে অধিক তাদের মস্তিষ্কের পরিষ্কারকরণ। সোজা কথায় তাদের মগজ ধোলাই। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন। তিনি যখন আমাকে নিয়ে পড়লেন, তখন তার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, এ মাল তত সোজা নয়। আর তাই তার কোনও কথাতেই আমি তাকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলাম। এর ফলে আমাদের তর্কবিতর্কের বৈঠকটা অপর সকলের জন্য যেমন অসহ্য হয়ে দাঁড়াল, আমার জন্য তত মজাদার হয়ে উঠল। বয়স্ক, বরং বলা চলে বৃদ্ধ পুরোহিতটি যতো আমার কথার জালে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন তত তিনি আলোলাচনা কথার বিষয় পাল্টাতে লাগলেন; এক কথা থেকে আর এক কথায়, এক প্রশ্ন থেকে আরেক প্রশ্নে সরে পড়তে লাগলেন। শেষপর্যন্ত এমন অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তিনি বললেন : আমি বাবা তোমার মতো ফরাসি জানিনে। পরের দিন দেখলাম আমাকে আমার অপর সঙ্গীদের সাথে এক আসরে না বসিয়ে, আমাকে একটি ভিন্ন ঘরে একজন আলাদা পুরোহিতের হেফাজতে দেয়া হলো। এবার যার হেফাজতে আমাকে দেয়া হলো তার বয়স যেমন পূর্বজনের চাইতে কম, তেমনি তাকে দেখলাম সে বাকপটুও বটে। বেশ ভাল শব্দগুচ্ছ তিনি তৈরি করতে পারতেন। এবং আমার সঙ্গে তার আলাপে তিনি শিক্ষক হিসেবে বিব্রতবোধ করার চাইতে আত্মতৃপ্তি বোধ করতে লাগলেন। আমি অবশ্য সতর্ক ছিলাম। অত সহজে তুমি পার পাবে না। আর যখন দেখলাম আমি তার কোনও প্রশ্নেই অবাক হচ্ছি না, ঘাবড়ে যাচ্ছি না তত আমার নিজের উপর বিশ্বাস বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমিও তার প্রতিটি প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। আমি শক্তিবোধ নিয়েই তার সঙ্গে আলাপ করতে লাগলাম। এবার তিনি তার জ্ঞান দিয়ে আমাকে অভিভূত করতে চেষ্টা করলেন। তিনি আমার কাছে দার্শনিক এবং সন্তু সেন্ট অগাস্টিনের কথা বললেন, সেন্ট গ্রেগরির কথা বললেন। এদের ছাড়া অন্য ধর্মপুরুষদের কথাও বললেন। এবং আমার জবাবে তিনি বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে এসব বিষয়ে তার চেয়ে আমার জ্ঞান কম নয়। এর মানে অবশ্যই এই নয় যে এই ধর্মীয় পুরুষদের সম্পর্কে আমার যথার্থই জ্ঞান ছিল। আসলে আমার চাইতে অধিক কোনও জ্ঞান এই পুরোহিতটির ছিল না। আমি এদের কোনও কিছু যে পড়েছিলাম তা নয়। তবু ‘লা সিউএর (‘Le Suer) থেকে স্রোত্র মুখস্থ বলতে বাধল না। আবার তিনি যখন অপর কোনও ধর্মগুরুর বাক্য উদ্ধৃত করলেন, আমি তার সেই ধর্মগুরুর অপর কোনও বাক্য দিয়ে জবাব দিতে শুরু করলাম। ফলে সুজন এই পুরোহিত বেশ কিছুটা বিব্রত বোধ না করে পারলেন না। অবশ্য দুটো কারণে এই তর্কের যুদ্ধে বিজয় তারই ঘটলো। কারণের একটা হলো, এই পুরোহিত আর যাইহোক বয়সে তো আমার চাইতে অধিক ছিলেন। তাই এ বিবেচনাটা আমার ছিল, এর সঙ্গে অধিক দূর আমার অগ্রসর হওয়া উচিত হবে না। আসলে আমি তো এদের জালের মধ্যে এসে গেছি। এদের হাতের পুতুল বৈ আর কিছু নই। এই পুরোহিতটি আমার জ্ঞানে যে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এমন নয়। আমার জন্য তার অন্তরে তেমন কোনও স্নেহ জাগরিত হয়েছিল, এমন নয়। আর তাছাড়া অল্প বয়স্ক এই পুরোহিতটি শিক্ষিতই ছিল। আমি তো তা নই। এর ফলে সে এবার আমাকে নানা কঠিন প্রশ্নে বিদ্ধ করতে চাইল। এবার আর আমি পেরে উঠলাম না। আমার কোনও প্রশ্নের জবাব দিতে অক্ষম হলেই বলে উঠতে লাগলেন এটা আজ থাক! আমার বিরুদ্ধেই তিনি অভিযোগ তুললেন : তুমি ছুটাছুটি এত করছ কেন? এক জায়গায় থেকে আর এক জায়গায়? এক বিষয় থেকে আর এক বিষয়ে? মাঝে মাঝে আমার উদ্ধৃতিকে তিনি বেঠিক বলে মত প্রকাশ করে বললেন : এগুলো মিথ্যা। বলে আমাকে বই এনে দেখাতে বললেন : দেখাও কোথায় তুমি একথা পেয়েছ? এবারে অবশ্যই আমি অসুবিধায় পড়লাম। সে দেখল তার কৌশলটা কাজে লাগছে। আমার শিক্ষার দৌড় তো ছিল ধার করা বিদ্যার দৌড়। ফলে লোকটির বুঝতে অসুবিধা হলো না যে, বই পড়ার জ্ঞান আমার নিতান্তই কম। আমি ল্যাটিনও তত জানতাম না যে একটা বড় ল্যাটিন বই এর মধ্য থেকে কোনও সূত্রকে আমি বার করে দেখাব। অবশ্য আমি জানতাম এসব বইতে আমার সব কথাই আছে। এখন দেখলাম তিনি অপর পুরোহিতদের ওপর নিজে অসত্যতার যে অভিযোগ তুলেছেন সেই অভিযোগ তিনি এখন আমার ওপরও আরোপ করছেন। এমনও হয়েছে, কোনও সূত্রকে নিজে বার করতে অক্ষম হয়ে নিজে বানিয়েই বলছেন। এভাবেই তিনি তার নিজের বিব্রতকর অবস্থা থেকে রেহাই পেতে চাইলেন।
এই রকম তর্ক-বিতর্কে যখন আমাদের সময় নষ্ট হতে লাগল, প্রায় তিক্ত-বিরক্তের শেষ পর্যায় আমরা পৌঁছলাম, তখন একটা দুর্ঘটনাই ঘটল, যেটা আমার জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল।
আসলে এমন দুরাত্মা আর বর্বর খুব কমই আছে যার মনে মায়া মমতা বলে কিছুই নাই। বা থাকে না। আমাদের মধ্যে এমন দুটা হতচ্ছাড়া ছিল যারা নিজেদের ‘মুর’ বলে আখ্যায়িত করত; তাদের একটার মধ্যে আমার জন্য যেন একটু প্রেমের সঞ্চার হলো। সে আমাকে সময়ে অসময়ে কাছে ডাকত, নিজেদের ভাষায় কথা বলত। আমাকে নানাভাবে আদর করতে লাগল। ওর নিজের খাবার থেকে আমাকে ভাগ দিতে লাগল। এবং মাঝে মধ্যেই আমাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করত। এটা আমার ভাল লাগত না। আমি লোকটার পোড়াদাগের মুখ দেখে ভয়ই পেতাম। ওর মুখটাকে আমি নরম বলে ভাবতে পারতাম না। তবুও ওর চুম্বনের বাড়াবাড়িকে আমি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। আমি নিজেকে বলতাম, এই বর্বরটাও তো একটা মানুষ। ও আমাকে একটু খাতির করতে চায়। তা করুক না। কিন্তু দেখলাম ওর বাড়াবাড়িটা কেবল বৃদ্ধিই পেতে লাগল। এমন সব প্রস্তাব এখন সে করতে লাগল যে আমি ওটাকে এক বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারলাম না। ওটা একদিন আমার সঙ্গে বিছানায় শুতে চাইল। আমি বললাম না আমার বিছানা খুব ছোট। আমাকে বলল : তুই আমার বিছানায় আয়। আমি তাতেও রাজি হলাম না। ওর গায়ের ভোতকা গন্ধে আর মুখের তামাক চিবানোর গন্ধে আমার বমি পেতে লাগল। পরের দিন সকালে আমরা দু’জনেই হল ঘরটাতে ছিলাম। হারামিটা আবার আমাকে আদর করতে শুরু করল এবং এমন উন্মাদের মতো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল যে আমি রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। দুরাত্মাটা ওর হাত দিয়ে আমার হাতটা ধরে ওর দিকে আকর্ষণ করতে লাগল। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে লাফ দিয়ে হারামজাদার হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিলাম। আমি বুঝতে পারলাম না সে কী করতে চায়। আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। এবার আমায় ছেড়ে দিয়ে এমন আত্মরতি শুরু করল যে আমি দেখলাম ওর লিঙ্গ থেকে কী যেন একটা পতিত হলো। ঘৃণায় আমার পেট যেন উল্টে এল। আমি দৌড়ে অলিন্দে ছুটে এলাম। আমার জীবনে আর কখনও এমন অভিজ্ঞতা ঘটেনি। আমার শরীর যেন অসুস্থ হয়ে পড়ল।
আমি তবু বুঝতে পারলাম না দুবৃত্তটার হলো কী। আমার মনে হলো ওর মৃগী রোগে ধরেছে। নয়তো ওটাকে আরও কোনও সাংঘাতিক রোগে ধরেছে। যথার্থই তাই। আমি ওটার চেয়ে এমন অবস্থার খারাপ আর কোনও প্রাণী এ পর্যন্ত দেখিনি। এমন প্রচণ্ড লালসার প্রকাশ আমি ভাবলাম কোনও মেয়ের সঙ্গে আমার যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে সেই মেয়েটা তো আমার প্রতি এমন ঘৃণাই বোধ করবে।
আমি ভাবলাম এ ঘটনার কথা আমাকে বলতে হবে। আমি সকলকে বলে দেব, হারামি আমাকে কী করেছে। আমাদের তত্ত্বাবধায়ক বৃদ্ধা আমাকে সাবধান করল : খবরদার, মুখ খুলবি না। আমি দেখলাম, ঘটনাটায় সেও খুব ক্ষিপ্ত হয়েছে। মহিলা কেবল তার ভাষায় বিড় বিড় করে বলতে লাগল : কুকুরের বাচ্চা, পিশাচের অধম! আমি বুঝলাম না এই আয়াটা আমাকে নিষেধ করছে কেন। আমি তার নিষেধ না শুনে এমন সব কথা বলতে লাগলাম যে পরের দিন সকালে আর একটা রক্ষক এসে আমাকে সাংঘাতিক ধানি দিতে শুরু করল। বলল; তুই-ই এ জন্য দায়ী। আমাদের পবিত্র আশ্রমকে তুই অপবিত্র করেছিস। আর একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুই এত হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিয়েছিস। তুই-ই যত নষ্টের মূল।
.
এই লোকটা তার বক্তৃতায় এবার এমন সব ব্যাপার বলতে লাগল যার সম্পর্কে এতদিন আমি কিছুই জানিনি। লোকটা ভাব দেখাল যেন এসবই আমি জানতাম। আসলে আমি লোকটার কথায় রাজি না হয়েই অপরাধ করেছি। উপরন্তু সে আমাকে বলল : এমন কাজে বাধা দান আমাদের ধর্মের বিরোধী। যেন ওই লোকটার কোনও দোষ নেই, দোষ আমার। আমাকে লোকটা আদর করতে চেয়েছে, এটা যেন আমার ভাগ্যের ব্যাপার! সে আমাকে বলল : আমার ছোট বেলায়ও তো আমি এমন করেছি; তাতে কী হয়েছে? একজনে এমন করে ধরলে ছটফট না করাই ভাল। বাধা না দিলেই বরং আরাম। এই হারামজাদাও এমন নির্লজ্জভাবে কথা বলছিল যেন আমার আপত্তির কারণ ছিল দৈহিক যাতনার আতঙ্ক। আসলে আমার ঘৃণা নয়। ব্যাটা বলল : এতে ভয়ের কিছু নাই। আর তাই আমার এমন অবস্থায় ভীত হওয়ার কিছু নাই।
আমাকে এই পিশাচের বক্তৃতা শুনতে হলো। যেন লোকটা খারাপ কিছু বলছে না। লোকটা আমার ভালর জন্য উপদেশ দিচ্ছে। ব্যাপারটাকে সে এমন সরল এবং স্বাভাবিক বলে ভাবল যে এটাকে আর গোপন রাখার কোনও প্রয়োজনই সে বোধ করল না। আমাদের এ আলাপ একজন ধর্মযাজকেরও কানে গেল। আর সেও যেন এতে কোনও খারাপ কিছু দেখল না। এসব আচরণকে এরা এমন স্বাভাবিকভাবে মনে করতে লাগল যে শেষে আমারই মনে হতে লাগল যেন এই জগতে এটাই স্বাভাবিক। আমার অপরাধ আমি এটা এতদিন জানতাম না। ফলে এখন থেকে এ সমস্ত আলাপে যেন আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলাম। রাগের চাইতে ঘৃণাতে আমি দগ্ধ হতে লাগলাম।
কিন্তু ব্যাপারটা আমার স্মৃতিতে এমনভাবে আটকে রইল যে, যা আমি নিজের চোখে দেখেছি, তা আমি কিছুতেই আমার মন থেকে তাড়াতে পারছিলাম না। ফলে ঘটনাটার কথা মনে হলেই আমার শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠত। আমি এর আদি অন্ত কিছুই বুঝতে পারলাম না। ফলে আবার ঘৃণা যেটা আমাকে নির্যাতন করেছে তার চাইতে যারা তাকে সমর্থন করছে তাদের ওপরই বিস্তৃত হতে লাগল। ফলে আমার ওপর নীতিজ্ঞানের এমন বক্তৃতার বিরুদ্ধে আমার ঘৃণা প্রকাশ না করে পারলাম না। তার এমন উপদেশের মারাত্মক পরিণতির কথা আমি জোরের সঙ্গে প্রকাশ করার চেষ্টা করলাম। এতে এই পাদ্রী আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যাতে আমার প্রতি মমতা বা সহানুভূতির কোনও প্রকাশ দেখলাম না। বরং এখন থেকে এই আশ্রমে আমার অবস্থানকে রোজকে রোজ অধিকতর অসহ্য করে তুলল। এ ব্যাপারে লোকটা এত সফল হয়ে উঠল যে এবার আমি যে সাহস এতদিন করিনি সেই সাহস করার জন্যই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠলাম। এতদিন যত না প্রতিরোধ করেছি, এখন তার চাইতে অধিক আমার সিদ্ধান্তে অটল হয়ে উঠলাম।
[রুশোকে কিন্তু শেষপর্যন্ত ধর্মান্তরিত করা হলো। তাকে রাস্তায় রাস্তায় ভক্ত এবং বিশ্বাসী বলে প্রদর্শন করা হলো এবং সে প্রকাশ্যে নিজের পাপের কথা স্বীকার করল।]
কিন্তু এতেই শেষ হলো না। আমাকে ইনকুইজিশন বা ধর্মীয় বিচারে হাজির করা হলো। আমার ধর্মবিরোধিতার পাপের প্রায়শ্চিত্য করে রোমান ক্যাথলিক হতে হবে। তা না হলে আমার পাপমুক্তি ঘটবে না। চতুর্থ হেনরিকেও এমন দণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু আমাকে যে ধর্মযাজকের সামনে হাজির করা হলো, তার আচরণে আমার নিজের মধ্যে সঞ্চিত আতঙ্ক দূর হলো না। আমাকে নানা প্রশ্ন করা হতে লাগল। আমি কিসে বিশ্বাস করি, আমার পারিবারিক অবস্থা কেমন। এত সবের পরে সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল : তোমার মা তার মৃত্যুকালে কি বিশ্বাসী, না অবিশ্বাসী ছিল? এমন প্রশ্ন শুনে আমার মনের আতঙ্কে আমি আমার ক্রোধকে প্রকাশ করার সাহস যোগালাম না। আমি কেবল বলতে পারলাম, আমার মা কেন অবিশ্বাসী হবে। তিনি তো আজ মৃত। মনে হলো এতেও পাদ্রী সন্তুষ্ট নন। সে তার মুখের এমন ভঙ্গি করল যাতে এটা প্রকাশ পেল যে, সে আমার কথা বিশ্বাস করে না। এসব যখন শেষ হলো এবং আমি যখন ভাবছি আমাকে এবার ছেড়ে দেয়া হবে, তখন আমার হাতে গোটা কুড়ি ফ্রাংক গুঁজে দিয়ে আমাকে দরজার বাইরে বার করে দেয়া হলো। আমাকে উপদেশ দিয়ে বলা হলো, একজন উত্তম খ্রিস্টানের জীবন তোমাকে যাপন করতে হবে। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুক বলে আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হলো। এর পরে আর কখনও এদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটেনি।
ফলে এখন আমার জন্য ফল কী দাঁড়াল? মুহূর্তের মধ্যে আমার মনের সব আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম একজন ক্যাথলিক হিসেবে আমি প্রাসাদে প্রবেশ করব। আমি সাদরে গৃহীত হব। এখন কি দাঁড়াল যে, রোমান ক্যাথলিকের বৃত্ত থেকে আমি বিতাড়িত এক কিশোর ও প্রতারিত এক রাস্তার ভিক্ষুক। হাতে আমার মাত্র বিশটা ফ্রাংক। এমন অবস্থায় হতাশাই আমার অনিবার্য ভাগ্য ছিল। কিন্তু আমি নিজের মনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম : আমি দমিত নই। আমি হতাশ নই। যেন আমি একটা নতুন চেতনায় জাগ্রত হয়েছি। আমি মুক্তি লাভ করেছি। যদিও দুমাস আমি এদের দুর্গে বন্দির জীবনযাপন করেছি। রুদ্ধদ্বার দুর্গে, এদের হাতের পুতুল, এখন আমি মুক্ত। দাসত্ব থেকে মুক্ত একটা মানুষ যেন।
বিহঙ্গ হলাম। যে বিরাট শহরে আমি এসেছি, সে যেন আমার শহর। এ নগরীর রাস্তাঘাট, জীবন আমার রাস্তাঘাট, এই নগর আমার নগর, আমি নিঃস্ব পথের ভিখারি হলেও আমি দাস নই। আমি একটা মুক্ত স্বাধীন মানুষ। এ তো আমার ভাগ্য যে এই বিরাট নগরে আমি পৌঁছতে পেরেছি। সে তো আমার নিজেরই সিদ্ধান্তের ফল। তাই নিজেকে এই মুহূর্তে নিজের কাছে শক্তির আধার এক পুরুষ বলে বোধ হলো। বিশ ফ্র্যাংকই আমার কাছে বিরাট রত্ন বলে বোধ হলো : এর প্রতিটি খণ্ডের আমি মালিক। আমার যেমন ইচ্ছা আমি খরচ করতে পারব। কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না। রাস্তায় ঘুমাব তো স্বাধীনভাবে ঘুমাব। ওই লম্পটদের হাতের পুতুল আর আমি নই। সে মুহূর্তের শেকল মুক্তির মনের অবস্থা আমি এভাবেই মাত্র প্রকাশ করতে পারি।
হ্যাঁ, এই মুহূর্তের ভাগ্যের নিয়ন্তা আমি নিজে, অপর কেউ নয়।
[রুশো যথার্থই মুক্ত এবং স্বাধীনভাবে তার স্বপ্নের শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগল, নিজের মনের আনন্দে। আতঙ্কহীন আনন্দে। কিন্তু বাস্তব জীবনকেও সে অস্বীকার করতে পারল না। তার হাতের ফ্রাংককটা নিঃশেষ হতে অধিক সময় লাগল না!]
কিছু একটা ভাল হবে, এমন আশা করে আমি এ দোকান থেকে সে দোকানে গিয়ে বললাম : আমাকে একটু কাজ দেন। আমি মূর্তির গায়ে রঙ মাখিয়ে দেব। রৌপ্যদানকে রঙ করে দেব। আপনারা যা দিবেন, তাতেই হবে। কিন্তু দেখলাম ব্যাপারটি তত জমল না। এদের কাছ থেকে যে কাজ এবং ফ্রাংক পেলাম তাতে আমার দুই বেলা কিংবা তিনবেলার অধিক খাবার জোগাড় করতে পারলাম না। দু’একদিন পরের কথা। দোকানের পাশ দিয়ে একটা ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। একটি দোকানের জানালা দিয়ে আমি একটি সুন্দরী তরুণীকে দেখতে পেলাম। মেয়েটিকে আমার এত সুন্দরী আর আকর্ষণীয় বলে বোধ হলো যে মেয়েদের ব্যাপারে আমার স্বভাব সংকোচ সত্ত্বেও আমি দোকানে ঢুকে তার কাছে আমার দুরবস্থার কথা বললাম। তরুণীটি আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করল না। আমাকে সে সাহস দিল। বলল, একজন উত্তম খ্রিস্টানকে ঈশ্বর নিশ্চয়ই পরিত্যাগ করবেন না। আমি তোমার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছি। মেয়েটি তাই করল। আমাকে তরুণীটি সামান্য কিছু কাজও দিল। আমার কাছে ব্যাপারটি খারাপ মনে হলো না। আমার কাজ দেখেও সে যেন খুশি হলো। আমি যখন একটু স্বাভাবিক হয়ে তাকে আমার অবস্থার কথা বলতে লাগলাম, তখন দেখলাম সে বেশ সহানুভূতির সঙ্গে আমার বলা কাহিনী শুনল। আমি তার সৌন্দর্যে যেমন মুগ্ধ হচ্ছিলাম তেমনি তার সহানুভূতিপূর্ণ আচরণে আমি নিজের সাহস এবং স্বাভাবিকতাও ফিরে পাচ্ছিলাম। মেয়েটি যেমন সুন্দর ছিল, তেমনি সে ছিল একজন ইটালীয়। তার আচরণে আমি গভীরভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সে প্রায় ভালবাসার মতো। কিন্তু বাস্তবে এর অধিক কিছু আমি করতে পারিনি। তবু আজো যখন আমার সেই অভিজ্ঞতাকে স্মরণ করি তখন আমি রোমাঞ্চিত বোধ করি। আমার সেই বিরল ঘটনাটিতে আমি যেন উপলব্ধি করেছিলাম, ভালবাসা কাকে বলে।
এ আমার সেই কৈশোরের এক ভালবাসার কাহিনী। তারই রোমাঞ্চকর স্মৃতি।
এই তরুণী মাদাম বেসিলিকে আমার মনে হতো অসম্ভব সুন্দরী। তার দেহের রঙ যে শুদ্র ছিল, এমন নয়। হয়তো একটু শ্যামবর্ণের। তবু আমার জন্য তার আকর্ষণ ছিল দুরাবোধ্য। তার সুন্দর মুখমণ্ডলে আমার প্রতি তার সহানুভূতির প্রকাশ আমাকে বিমোহিত করে তুলত। তার একজন স্বামী ছিল। তার চাইতে বয়সে বড়। আমার প্রতি অবশ্যই তার একটু ঈর্ষা জন্মাচ্ছিল। আমরা দুজনে কথা বলতে শুরু করলে সে মাদাম বেসিলিকে রেখে চলে যেত। লোকটা দেখতেও ভাল ছিল না। তবু তার একটা দেমাগ ছিল। আমার প্রতি তার বিতৃষ্ণা তার কণ্ঠের উচ্চারণেও লুকানো থাকত না। লোকটার অবশ্য একটা গুণ ছিল : সে মোটামুটি ভাল বাঁশী বাজাতে পারত। হয়তো এটার নাম ছিল এগিসথাস। আমাকে আসতে দেখলেই লোকটা কটমট করে আমার দিকে তাকাত। আমার প্রতি তার আচরণে ঘৃণার প্রকাশ থাকত স্পষ্ট। আবার মজা লাগত এই দেখে যে, লোকটা যত আমাকে ঘৃণা করত মাদাম বেসিলি তত তার সামনেই আমাকে ভালবাসার প্রকাশ দেখাত। আমার মনে হতো যেন মাদাম বেসিলি তার সামনে আমাকে ভালবাসার প্রকাশ দেখাত তাকে উত্তেজিত করে তোলারই জন্য। লোকটার প্রতি মাদামের এমন প্রতিহিংসায় আমি মজাই পেতাম। ব্যাপারটা চরম হয়ে উঠত যখন আমরা দুজনে একটু আড়ালে বসে গল্প করতাম। কিন্তু মাদাম ব্যাপারটি নিয়ে বাড়াবাড়ি করত না। ওর মধ্যে একটু সংযম ছিল। আমি জানি না তার এমন সংযমের মধ্যে এই ভাবটি ছিল কিনা যে, আমি তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট ছিলাম। এবং সে জানত না এমন অবস্থায় তার কী করা উচিত। তার এমন সংযমে আমি অস্থির হয়ে উঠতাম। আমার এমন অস্থিরতার কারণও আমি বুঝতাম না। অবশ্য এই মেয়েটির প্রতি আমার যে কোনও সমীহভাব ছিল, এমনও নয়। বরং মাদাম দা ওয়ারেন্স-এর প্রতি আমার যেমন সম্মান, তেমনি একটা সমীহবোধের সৃষ্টি হয়েছিল। তার ব্যাপারে আমি যেমন অধিকতর ভয়ার্তবোধ করতাম। তেমনি তিনি আমার কাছে অপরিচিত বোধ হতেন। তার দিকে আমি চোখ তুলে তাকাতে পারতাম না। তার পাশে দাঁড়িয়ে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়াও কষ্টকর হয়ে দাঁড়াত। তবু আমি তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে পারতাম না। তা যেন আমার মৃত্যুতুল্য মনে হতো। আমার চোখ তাকে আপাদমস্তক দেখতে চাইত। তার কাঁধের এবং হাতের আচরণের মধ্য দিয়ে দৃষ্ট তার সৌন্দর্যের আকর্ষণ আমার জন্য দুরারোধ্য হতো। তার বক্ষের উত্থান পতনকে যেন টের পেতাম। আমি পাছে ধরা পড়ি, সে ভয় আমার ছিল। তবু তার পোশাকে অঙ্কিত ফুলগুলো, তার পদযুগলের রাঙানো চিহ্ন কিছুই আমার নজর এড়াত না। তার যা কিছু দেখতাম তাই আমার কাছে অপর সব কিছুর চাইতে মনোহর বলে বোধ হততা। চোখে যা পড়ত তার চাইতে অধিক আমি কল্পনা করতাম। আর তাতে আমার দেহ আমার চোখ সব যেন একটা উত্তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠত। আমার চোখে যেন জল জমত। আমার বুকের দম যেন বন্ধ হয়ে আসত। আমার নিঃশ্বাস নিশ্চল রুদ্ধ হয়ে উঠত। আমাদের এমন সাক্ষাৎ আমাকে ভয়ানক বিব্রত করে তুলত। আমরা দুজনে যখন একান্ত হতাম তখন শব্দহীন নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে আমি যেন ডুবে যেতাম। অবশ্য মাদাম বেসিলের কাজের অন্ত ছিল না। তাই আমার মনের অবস্থা দেখা বা বোঝার তার সময় হতো না। তথাপি আমার মনে হতো যেন আমার প্রতি তার সহানুভূতিতে তার বক্ষের উত্থান-পতন দ্রুততর হয়ে উঠছে। এ অবস্থা ছিল আমার জন্য বিপজ্জনক। এমন আবেগে যখন আমার চৈতন্য প্রায় হারাতে বসতাম, তখন সে হয়তো শান্তভাবে এমন কোনও শব্দ উচ্চারণ করত যাতে আমি আমার চেতনা আবার ফিরে পেতাম।
এভাবে কয়েকবারই আমি একান্তে তার সঙ্গে দেখা করতে পেরেছি। অথচ এমন সাক্ষাতে আমি কোনওদিন একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারিনি। কোনওভাব প্রকাশ করতে পারিনি। একটু মুখ তুলে চাইতে পারিনি। এমন অবস্থা আমার জন্য যে কত যন্ত্রণাদায়ক ছিল তা আজও আমি প্রকাশ করে বলতে পারছিনে। তবু এটা আমার অন্তরে একটা ভীষণ আনন্দেরও সৃষ্টি করত। আমার সরল অন্তরে আমি কিছু বুঝতাম না, তবু যন্ত্রণাবিদ্ধ হতাম। অবশ্য এটা বুঝতাম আমাদের এমন সংগোপন মিলনটি মাদাম বেসিলির খারাপ লাগত না। কারণ এমন সুযোগটি যেন আমাদের ঘটে, তার ব্যবস্থাটি সেই-ই তৈরি করে দিত। এমন অনেকবারই ঘটেছে। তবু এ ছিল একেবারে নির্দোষ। বেসিলির নিজের দিক দিয়েও যেমন, আমার দিক থেকেও তেমনিঃ কারোরই কোনও প্রকাশ ছিল না।
একদিনের ঘটনা মনে পড়ে। দেখলাম পাদ্রির বকবকানি আর সইতে না পেরে বেসিলি তার উপরের ঘরে উঠে গেল। ঘরের পেছনে যা একটু কাজ ছিল আমার তলাটি তা তুরিত বেগে শেষ করে আমিও উপরের ঘরে উঠে গেলাম। আমি দেখলাম বেসিলির ঘরের দোর প্রায় অর্ধখোলা অবস্থায় রয়েছে। আমি তার ঘরে একেবারে নিঃশব্দে ঢুকে পড়লাম। বেসিলি একেবারেই টের পেল না। সে তখন সেলাই-এর কাজে মগ্ন ছিল, কাছের জানালাটির পাশে উপবিষ্ট হয়ে তার পৃষ্ঠদেশটি ছিল দরজার দিকে। মুখটি ভেতরের দিকে। সে আমার ঢোকার কোনও শব্দ পায়নি। আমাকে সে দেখতেও পায়নি। বাইরের গাড়ি ঘোড়ার শব্দে আমার পায়ের শব্দও সে টের পায়নি। বেসিলির পরিধানের পোশাক সবসময়ই সুন্দর থাকত। আজও তেমনি ছিল। মুখের প্রসাধনে যেন একটু উগ্রতাও ছিল। তার ভাবটি ছিল মনোহর। হাতের কাছে মাথাটি ছিল একটু যেন অবনত। তাই পেছন থেকে আমি তার সুন্দর গ্রীবাটিকে দেখতে পাচ্ছিলাম। তার মাথার চুল বেশ সুন্দর করে বাধা ছিল। সে চুলে যেন কয়েকটি ফুলও পুঞ্জিত ছিল। তার সমগ্র তনুতে একটি মনোহর ভাব ছিল। আমার চোখে আর অন্তরে এ সৌন্দর্যের প্রভাবের কোনও শেষ ছিল না। আমি যেন অভিভূত হয়ে পড়ছিলাম। আমি নিজের অস্তিত্বেও যেন বিস্মৃত হয়ে গেলাম। আমি হাঁটু গেড়ে আমার দুটি হাত বাড়িয়ে তার সামনে নতজানু হয়ে বসে পড়লাম। আমি কোনও শব্দ উচ্চারণ করিনি। সে আমাকে দেখতে পেয়েছে এমনও আমি মনে করিনি। কিন্তু পাশের বড় ড্রেসিং আয়নাটিতে আমি ধরা পড়ে গেলাম। আমি জানি না আমার এই উন্মাদনা তাকে কীভাবে স্পর্শ করেছিল। তখনো সে না আমার দিকে তাকাল, না একটি শব্দ উচ্চারণ করল। একটু যেন মাথাটি নাড়ল এবং তার আঙুলের ইশারাতে তার সামনের মেঝেতে যেন বসার ইঙ্গিত দিল। আমার দেহ যেন কেঁপে উঠল। আমার কণ্ঠ দিয়ে হয়তো কোনও শব্দ বেরিয়েছিল। আমি নিমেষের মধ্যে নিজেকে মেঝেতে পতিত করলাম। এখনও অবিশ্বাস্য মনে হয়। তবু একথা ঠিক যে এমন অবস্থায় আমি কিছুই করলাম না। কিছুই করতে পারলাম না। একটা শব্দও আমি উচ্চারণ করতে সক্ষম হলাম না। আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে পারলাম না। তার পায়ে যে একটু হাত লাগাব। হাত দিয়ে তাকে একটু স্পর্শ করব। তাও আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। এ কথা ঠিক কোনও শব্দ করতে পারিনি, তাকে স্পর্শ করতে পারিনি। তবু আমার অদম্য অস্থিরতাকে তো আমি গোপনও করতে পারিনি। আমার সমগ্র অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটছিল। আবার আনন্দ আর কৃতজ্ঞতার যেন শেষ ছিল না। আমার কামনারও যেমন না ছিল প্রকাশ, তেমনি না ছিল তার অন্ত। আমার এমন অস্থিরতার যে কোনও ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য ছিল, তাও নয়। পাছে আমার কোনও আচরণে তার অসন্তুষ্টি ঘটে, সে ভয়ে আমি যেন পাথর হয়ে যাচ্ছিলাম। ফলে আমি যেন আমার আত্মার সকল স্বাভাবিকতাই হারিয়ে ফেলছিলাম।
তার অবস্থাও যে এরকম হয়ে পড়ছিল, তা আমি বুঝতে পারছিলাম। তারও যেন সঙ্কোচের সীমা ছিল না। তার দেহেও বিন্দুমাত্র আলোড়ন ছিল না। তার সামনে আমার এমন উপস্থিতি, তারই অঙুলি নির্দেশে আমার মেঝেতে উপবেশন : এ সব কিছুতেই সে উদ্বেগে অস্থির হচ্ছিল। আচরণে না পারছিল আমাকে তাড়িয়ে দিতে, না পারছিল আমাকে আকর্ষণ করতে। বেসিলি তার হাতের কাজ বন্ধ করল না। তার আচরণ এমন ছিল যেন সে আমাকে আদৌ দেখেনি। যেন সে জানেই না যে আমি তার পা দু’খানির কাছে উপবিষ্ট হয়ে রয়েছি। আমি তো বোকার বোকা বনে গিয়েছিলাম। তবু আমি কি বুঝতে পারিনি, আমার মতো মাদাম বেসিলিও নিজের অন্তরে আলোড়িত হচ্ছিল। আমার কামনা তাকে স্পর্শ করছিল। আবার আমার যেমন সঙ্কোচ, তেমনি তারও সঙ্কোচ। আমি এটা বুঝলেও কোনও আচরণেই নিজেকে নিরস্ত করতে পারছিলাম না। আমার চেয়ে বেসিলির বয়স ছিল পাঁচ কি ৬ বছর বেশি। তাই তার তো সাহসের অভাব হবার কথা নয়। আমি আমার মনকে বললাম, ও যখন কিছু করছে না আমারও তখন কিছু করা উচিত নয়। এই মুহূর্তে সেদিনের স্মৃতিচারণ করে দেখছি, আমার সেই আচরণই ঠিক ছিল। আর বেসিলিও এমন বুদ্ধিমতী ছিল যে এটা তার না বুঝার কথা নয় যে আমার মতো অনভিজ্ঞ নিজে থেকে কিছু করতে পারবে না। সেজন্য আমাকেই তার শেখাতে হবে, কী আমাকে করতে হবে।
আমি এখনও বুঝতে পারছিনে এমন অদ্ভুত অনড় অবস্থাতে আমরা দু’জন কতক্ষণ থাকতে পারতাম যদি না এই সময়ে একটা ঘটনা ঘটে যেত। আমি দেখলাম, যে দরজাটা এতক্ষণ বন্ধ ছিল, সে দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। এবার বেসিলি ভয়ার্ত হয়ে বলে উঠল : এই, তুই ওঠ, রোসিনা আসছে। আমি ত্বরিত বেগে তার বাড়িয়ে ধরা হাতখানি ধরে উঠে দাঁড়ালাম এবং আমার উত্তপ্ত ঠোঁট দুটিকে দু’বার তার হাতের ওপর চুম্বনে চেপে ধরলাম। মনে হলো যে আমার দ্বিতীয় চুম্বনটিতে বেসিলি তার অমিয় সুন্দর হাত দিয়ে আমার ওষ্ঠাধরকে একটু যেন পিষ্ট করে দিল। আমার জীবনে আর কখনও এমন মধুর অভিজ্ঞতা আমি লাভ করিনি। কিন্তু একথাও ঠিক, যে সুযোগটুকু আমার ভাগ্যে সেদিন এসেছিল, তা আর আমি কখনও পাইনি। আমাদের সেই কৈশোর প্রেমের সমাধি সেদিন এমনি করেই ঘটেছিল।
আমার অন্তরে এই অনিন্দ্যসুন্দর তরুণীটির লাবণ্যচ্ছটা যে এমন অক্ষয়ভাবে আমার অন্তরে মুদ্রিত হয়ে রইল তার কারণও বোধহয় সেই মুহূর্তের আমার সেই অতৃপ্ত কামনা। আমি বলব এরপর আমি যত জগৎটাকে চিনতে পেরেছি, যত নানা প্রকার স্ত্রীলোকের সান্নিধ্যে আমি এসেছি, আমাদের কৈশোরের সেই ভালবাসার অনুভূতি আমি তত তীব্রভাবে বোধ করেছি। ওর নিজেরও যদি এমন ভালবাসার আর একটু অভিজ্ঞতা থাকত, তাহলে আমার বিশ্বাস মাদাম বেসিলিও আমার সঙ্গে একটু ভিন্নতর আচরণে লিপ্ত হতো। সে হয়তো তার আচরণ দিয়ে আমার মনে আর একটু সাহস যোগাত। তা সে পারেনি। সেও তখন অনভিজ্ঞ এবং দুর্বল ছিল। আর তাই আমি মনে করি বেসিলি যথার্থই নিজের অনুভূতিতে একান্তই সৎ ছিল। তার নিজের সেই নিষ্পাপ অনুভূতির কাছে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই আত্মসমর্পণ করেছিল। যদি অবিশ্বস্ততা বলি, এটিই বোধ হয় ছিল তার জীবনের প্রথম অবিশ্বস্ততা, ও যদি সাহসী হতো তাহলে আমার পক্ষে আমার সঙ্কোচকে অতিক্রম করা অধিকতর দুঃসাধ্য হতো। আমি আমার কোনও আচরণ দিয়ে তার সঙ্কোচকে দূর করে দিতে পারতাম না। আমার পরম ভাগ্য যে সেদিন সেপথে আর আমি অগ্রসর হইনি। আর তাই ওর সামনে থাকার যে অমিয় মুহূর্তটি আমার ভাগ্যে ঘটেছিল, তেমন সুখের বোধও আমি আর কখনও পাইনি। জীবনে কম মেয়েকে আমি ভোগ করিনি। কিন্তু এ জীবনে সেদিন এ মেয়েটির পায়ের কাছে উপবিষ্ট হয়ে যে সুখ ও তৃপ্তি আমি লাভ করেছিলাম, সে অনুভূতির তুলনা আমি আর কোনও ঘটনাতে লাভ করিনি। সেদিন আমি মাদাম বেসিলির আচ্ছাদনের একটু অঙ্গও স্পর্শ করতে পারিনি। না। এই আমার বোধ যে, একটি নিষ্পাপ মেয়ে তার ভালবাসার পাত্রের মনে এমন নিষ্পাপ আচরণ দিয়ে যে সুখানুভূতির সৃষ্টি করতে পারে তার কোনও তুলনা হয় না। সেদিন মেয়েটি আমাকে নিয়ে যেমন তার ইচ্ছা তেমন সে করতে পারত। অথচ সেদিন তার একটু অঙুলি হেলন, আমার ওষ্ঠের ওপর তার অঙুলির একটু স্পর্শ : মাদাম বেসিলির কাছ থেকে এটুকুই মাত্র লাভ করেছিলাম। অথচ এর স্মৃতিই এখনও, আমার এই বয়সী জীবনে আমাকে রোমাঞ্চিত করে তোলে।
এরপরের দু’দিনও অবশ্য আমি চেষ্টা করলাম ওর এমন আর একটি একান্ত সঙ্গ লাভের। কিন্তু সে ভাগ্য আর আমার হলো না। বেসিলির আচরণেও এমন আগ্রহের কোনও প্রকাশ আমি দেখিনি। তার আচরণ আমার প্রতি যে উত্তাপহীন হয়ে উঠল, এমন নয়। তবুও ওর আচরণে একটা সতর্কতার যেন ভাব এল। এবং আমার মনে হলো সেও সতর্ক হলো যেন আমার প্রতি কোনও আচরণ যেন তার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে না যায়। তার তত্ত্বাবধায়কটিও যেন অধিকতর সতর্ক হয়ে উঠল। সে লোকটা অবশ্য আমার ওপর অধিকতর হাসিঠাট্টার প্রয়োগ ঘটাতে লাগল। তার ভাব ছিল এরূপ যে মেয়েদের সঙ্গ পাওয়ায় তোমার আচরণে আরও সাহস থাকা আবশ্যক। আমি কি তাহলে বেসিলির সঙ্গে কোনও অন্যায় আচরণ করেছি? এমন চিন্তায় আমি ভীত হয়ে উঠলাম। আমি তখন থেকে মাদামের সঙ্গে আমার আচরণে অধিকতর সতর্ক হয়ে উঠলাম। আমার মনোভাবটি যেন বেসিলি উপলব্ধি করতে পেরেছিল। আমার যে কোনও ইচ্ছাকে এখন থেকে আমি দমিত করে রাখার চেষ্টা করলাম। অথচ এই ঘটনার পূর্বে এমনটি আমাকে কখনও করতে হয়নি। আর তাই আর কোনও সুযোগকেই আমি ব্যবহার করতে চাইনি। আর এ সতর্কতা থেকে আর কোনও সুযোগেরও সৃষ্টি হয়নি। আমার এই সব রোমান্টিক ঘটনার কথা স্মৃতিতে এলে মনে হয়, এর কোনওটাতেই আমার নিজের সঙ্কোচের কারণে আমার কোনও ইচ্ছাপূরণ করা সম্ভব হয়নি।
তাই বলছি পাদ্রী আমার সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, তার কোনওটা বাস্তবে ঘটেনি। আমি যখনি কাউকে ভালবেসেছি তখনি তাতে আমার এমন গভীর আন্তরিকতা ছিল, এত সম্পূর্ণতা ছিল যে আমার পক্ষে তাৎক্ষণিকভাবে সুখি হওয়া সম্ভব হয়নি। আমার কামনার কথা বলি কামনা, আমার আকর্ষণের কথা বলি আকর্ষণ–এর কিছুতেই আমি আমার সেই আন্তরিকতা আর ভালবাসা এবং মমতার চাইতে অধিকতর কিছুর কল্পনা করতে পারিনি। যে আমার ভালবাসার পাত্র বা পাত্রী হয়েছে তার জন্য আমি আমার সমস্ত জীবনকে ব্যয় করে দিতে পারতাম। তার সম্মানের হানিকর কোনও কিছুর কথা আমি কল্পনা করতে পারতাম না। আমার নিজের কোনও সুখানুভূতির জন্য আমার প্রেমাস্পদের বিন্দুমাত্র অসম্মান আমার কাছে অকল্পনীয় ছিল। আমার এই অনুভূতির কারণে এসব ঘটনায় আমি এত সতর্কতা অবলম্বন করতাম, এত গোপনীয়তা এবং এত উদ্বেগ যে, এর ফলে কোনও ঘটনাই আমার কামনা মতো বাস্তবায়িত হতে পারত না। মেয়েদের ব্যাপারে আমার এই যে অক্ষমতা বা বিফলতা তার আসল কারণ ছিল মেয়েদের জন্য আমার অন্তরের গভীরতম প্রদেশের গভীর মমতা আর সহানুভূতি।
[এই ঘটনার আনুপূর্বিক ব্যাপারটি ছিল এরূপ যে ভদ্রমহিলার স্বামীর আগমন ঘটেছিল এবং এক পাদ্রীর কাছ থেকে বৃত্তান্ত শুনে সে রুশোকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল। রুশো এরপরে মাদাম কাউন্টেস দা ভারসিলির ভৃত্যের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। বলা চলে তার সেক্রেটারি বা সচিব হয়ে দাঁড়ায়। তার তখন ক্যান্সার চলছিল। সে রুশোকে তার চিঠিপত্রের শ্রুতিলিপিকর হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে।]
আমার বিশ্বাস আমি তখন থেকেই কারোর গোপন আলাপ আলোচনা, ষড়যন্ত্র তৈরি করা ইত্যাদিতে বেশ আকৃষ্ট বোধ করতে শুরু করি এবং তাতে মজাও পেতে লাগলাম। আবার যার মধ্য দিয়ে এসব ঘটে তার প্রতি আমার একটা বিতৃষ্ণাও তৈরি হতে লাগল। এই মাদাম দা ভারসিলি ছিলেন নিঃসন্তান। তার সম্পদের যে উত্তরাধিকারী হয়ে দাঁড়াল সে সম্পর্কে ছিল তার ভাগ্নে। সে ছিল কোতে দা লা রো। সে মাদামকে তখন থেকে দস্তুর মতো পুজো করতে শুরু করল। তাছাড়া মাদামের আর সব ভূতদেরও ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না যে সংকট মুহূর্তটি আসন্ন প্রায়। তাই তাদের স্বার্থ গোছাতেও তারা তৎপর হয়ে উঠল। আর এদের দলে সংখ্যাও এত অধিক ছিল মাদামের পক্ষে আমার দিকে দৃষ্টি দেয়ার তার সময়ই ঘটছিল না। বাড়িঘরের কর্তার নাম ছিল মঁসিয়ে লরেনজী। লোকটি বেশ ভাল রকমেরই দুষ্ট প্রকৃতির ছিল। আর তার স্ত্রী ছিল আরো এক কদম অধিক চতুর। সে এমনভাবে চলত যেন সে যতো না আসল কত্রীর দাসী তার অধিক সে তার প্রভু। এ মহিলা তারই ভাতিঝিকে কত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকারিণী হিসেবে নিযুক্ত করল। ফলে মাদাম দা ভারসিলির কাজকর্ম সবকিছুরই চক্ষুকর্ণ হস্তপদ হয়ে দাঁড়াল এই ভৃত্যকুল। আমার পক্ষে এই তিন ভৃত্যকে সন্তুষ্ট রাখার আর উপায় রইল না। আমি এদের ভূত্যতে পরিণত না হলেও, এদের অবাধ্য হওয়ারও আমার উপায় ছিল না। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে আসল গৃহকত্রী মাদাম দা ভারসিলির দাসীদেরও দাস হিসেবে আমার কাজ করতে হবে। তাছাড়া আমার দিকে তাদের দৃষ্টিতে বোঝা যেত যে আমাকে নিয়েও তাদের তেমন স্বস্তি ছিল না। তারা দেখল, আমার যে অবস্থান হওয়া দরকার সে অবস্থানে আমি যেমন নিযুক্ত হইনি, তেমনি মাদাম ভারসিলিও সে ব্যাপারে যেমন সচেতন তেমনি আমাকে আবার উপযুক্ত অবস্থানে স্থাপন করতেও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। ভূত্যকুল বুঝল মাদাম যদি তার সেই চেষ্টায় সফল হন তাহলে তাদের নিজেদের ভাগ বাটোয়ারায় বেশ টান পড়ে যাবে। এই শ্রেণীর লোকরা এরূপই হয়। তারা মনে করে বাড়ির গিন্নীর সব কিছুতেই তাদের ন্যায্য অধিকার আছে। অপর আর কারোর কিছু থাকলেও তা তাদের ভাগ থেকেই নেয়া হয়েছে। ফলে ওরা চেষ্টা করতে লাগল আমি যেন বাড়ির গিন্নীর নজরে না আসতে পারি। গিন্নীর ঝোঁক ছিল বন্ধু-বান্ধবদের কাছে চিঠি লেখার। আর সে কাজটি সে আমাকে দিয়েই করাত। এই চাকর বাকররা এবার আমাকে এ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে শুরু করল। তারা তার ডাক্তারকে বোঝালো এমন কাজ গিন্নীর পক্ষে করা উচিত নয়। এতে তার শরীর আরও খারাপ হয়ে পড়বে। ওরা এমন ভাব দেখাল যেন আমি গিন্নীর সেবা ঠিক মতো করতে পারছিনে। সে জন্য কত্রীর বহনের জন্য একটা হুইল চেয়ার এবং তার জন্য দু’জন দাসীরও ব্যবস্থা করল। এগুলো এত ধূর্ত ছিল যে মাদাম যখন তার উইল তৈরি করা শুরু করলেন তখন ওরা আট দিন ধরে তার কক্ষে আমাকে ঢুকতেই দিল না। কিন্তু আমিও সহজে ওদের কাছে নিজেকে ছেড়ে দিলাম না। আমি যথারীতি গিন্নীর ঘরে যাতায়াত বজায় রাখলাম। অন্য কারোর চাইতে বেশি করে তার সেবায় আমার দক্ষতা আমি দেখাতে লাগলাম। আর যথার্থই এই ভদ্রমহিলা তার রোগে যেরূপ কষ্ট পাচ্ছিলেন, তা দেখে তার প্রতি আমার মমতা যথার্থই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আমি তার কষ্টে তার এবং অপর সকলেরই দৃষ্টির আড়ালে আমি আন্তরিকভাবে কেঁদে ফেলতাম। এতে আমার কোনও কৃত্রিমতা ছিল না। পরিণামে তাকে আমাদের হারাতে হলো। বাড়ির কত্রী মারা গেলেন। আমার নিজের বেদনার্ত চোখেই আমি তাকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে দেখলাম। আজ আমি একথা বুঝি যে এই ভদ্রমহিলা যথার্থ একজন বুদ্ধিমতী এবং সৎ মহিলা ছিলেন। বস্তুত তার মৃত্যু ছিল এই বছরের একজন যথার্থ দার্শনিকের মৃত্যু। আমার বলতে দ্বিধা নেই যে তার কষ্টের মধ্যে আমি একজন যথার্থ রোমান ক্যাথলিককেই যেন দেখতে পেয়েছিলাম। রোমান ক্যাথলিক ধর্মের নির্দেশ এবং আচরণ পালনে তার স্বত:ইচ্ছা ব্যতীত কোনও কৃত্রিমতা বা অনিচ্ছা ছিল না। কাজেই তার মধ্যে আমি যেন একটি দায়িত্ব বোধসম্পন্ন চরিত্রেরই সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তার মধ্যে আমি যেন একটা আনন্দের শিখা জ্বলে উঠতে দেখলাম। এর মধ্যে কোনও কৃত্রিমতা ছিল না। এ প্রায় তার এতদিনের বিষণ্ণতার স্থানে একটি আনন্দের রূপ ধারণ করেছিল। মনে হতো এর মধ্য দিয়ে তার বুদ্ধির দীপ্তি প্রকাশিত হয়। শেষ দু’দিন তার বাকস্ফুর্তি যেন বৃদ্ধি পেল। সে তার বিছানায় শায়িত অবস্থায় সকলের সঙ্গেই ধীরলয়ে বাক্যালাপ করলেন এবং শেষ মুহূর্তে তিনি তার নিদারুণ দৈহিক কষ্টের মধ্যেই যেন শব্দ করে উঠলেন : যে মানুষ মৃত্যুর মুহূর্তে কথা বলে সে কি মৃত হয়? তোমরা কী বল?
হ্যাঁ, মাদাম এই কথাটিই শেষ মুহূর্তে উচ্চারণ করেছিলেন।
আমাদের গৃহকর্ত্রী এই মাদাম তার উইলে সকল ভৃত্যের এক বছরের বেতনের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমার ভাগ্যে কিছু জুটল না। কারণ আমাকে ওরা তার মৃত্যুর মুহূর্তে, উইল তৈরির সময়ে তার ঘরের মধ্যেই ঢুকতে দেয়নি। তাই ভত্যের নামের তালিকায় আমার নাম ছিল না। সে যাহোক কোতে দা রোক আমাকে ত্রিশ লিঙার দেয়ার একটা হুকুম দিলেন। তাছাড়া যে সুটটা আমার পরনে ছিল সেটা যখন মঁসিয়ে রেঞ্জি নিতে যেতে চাইলেন মশিয়ে তোক নিতে দিলেন না। তিনি আমাকে বললেন আমি যেন তার সঙ্গে পরে দেখা করি। তিনি আমার একটা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবেন। আমি এর পরে তার কাছে দুতিনবার যাওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার সঙ্গে কোনও কথা বলার সুযোগ পাইনি এবং আমার অবস্থার কথা আমি বলতে পারিনি। এভাবে ব্যর্থ হয়ে আমি আর যাইনি। অথচ আমার যাওয়া উচিত ছিল। আমি যদি মাদাম দা ভারসিলির গৃহে থাকার কথা বলতে পারতাম তাহলে তাতে আমার উপকারই হতো। তবে একথা বলা দরকার যে এই গৃহে একদিন যেভাবে আমি প্রবেশ করেছিলাম ঠিক সেভাবে ওই বাড়ি থেকে আমি বেরিয়ে আসিনি। নানা অপরাধের স্মৃতি নিয়েই আমি সে গৃহ পরিত্যাগ করেছিলাম। কেবল তাই নয়, আমার দুঃখ বোধও ছিল। সে দুঃখের ভার আজ এই চল্লিশ বছর পরেও যেন আমার বুকে। আমার বিবেকে বোঝা হয়ে বাজে। এবং তার তিক্ততাও যেন আমার বয়স বৃদ্ধির সাথে দুর্বল হওয়ার বদলে যেন আরও ভারি হয়েই বাজছে। এমন কখনও আমি চিন্তা করতে পারিনি। কোন সেই ছেলেবেলার একটা অপরাধের যে এমন মারাত্মক ফল হতে পারে, তা আমি চিন্তা করতে পারিনি। কী হতে পারত, তার চাইতে যা হয়েছে তাই-ই এখনও আমার আত্মার জন্য দুর্বহ বোধ হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে আমি একটি ভদ্র, শান্ত, সৎ মেয়ের সর্বনাশের কারণ হয়েছি। অথচ আমার চাইতে ও অনেক বেশি সৎ ছিল। আমি যেন ওর অপার দুর্ভোগের কারণ বলে নিজেকে গণ্য করতে লাগলাম।
একথা ঠিক যে একটা পরিবারের শান্তির বিনষ্টি নানা দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে উঠতে পারে। নানা জিনিসই ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। অপহৃত বা বিনষ্ট হতে পারে। কিন্তু তেমন কিছু এই পরিবারে ঘটল না। লরেঞ্জিদের দৃষ্টি এত সতর্ক ছিল যে মালামালের তালিকা তৈরি করে দেখা গেল কোনও কিছুই খোয়া যায়নি। দেখা গেল কেবল মাত্র মাদামসেল পল্টাল একটি ফিতা খুঁজে পাচ্ছেন না। এর চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান জিনিস আমার এক্তিয়ারে ছিল। তার মধ্যে কেন যে এই ফিতাটির প্রতি আমার চোখ পড়েছিল, তা আমি আজো বুঝতে পারছিনে। আমিই সেটি চুরি করেছিলাম। আর সেটি আমি লুকোবারও কোনও চেষ্টা করিনি। ফলে ফিতাটা পাওয়াও গিয়েছিল। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করল : তুই এটা পেলি কী করে? এর জবাবে আমি কী বলব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। আমি আমতা আমতা করে কী যেন বললাম। আমার মুখে লজ্জার ভাব এল। শেষে বললাম : মারিয়ন ওটা আমাকে দিয়েছিল। এই মারিয়ন ছিল একটি অল্প বয়সের মেয়ে। ও এসেছিল মরিয়েন এলাকা থেকে। মাদাম দা প্ররসিলি মেয়েটিকে তার রান্নার কাজে লাগিয়ে ছিলেন। মারিয়ন কেবল যে সুন্দর ছিল তাই নয়। ওর মুখে আমি যেন একটা রঙের আভাস পেয়েছিলাম। এমন রঙ কেবল পাহাড়ি মেয়েদের মধ্যেই পাওয়া যেত। তাছাড়া মেয়েটির মুখে আর আচরণে এমন একটা সারল্য আর লাবণ্য ছিল যে কারোর পক্ষেই ওকে ভাল না বাসা সম্ভব ছিল না। ওকে কোনও পাপ স্পর্শ করতে পারত না। ওর মতো সততাও আর কারোর ছিল না। তার ফলে আমি যখন ওর নাম উচ্চারণ করলাম, তখন সকলেই যেন বিস্মিত হলো। আবার আমাদের দুজনেরই সৎ বলে সবার কাছে একটা পরিচয় ছিল। ফলে এখন সবারই গরজ দাঁড়াল আমাদের দুজনের মধ্যে আসল অপরাধ কার। মেয়েটাকে ডেকে পাঠানো হলো। বাড়ির আর সবাইও হাজির হলো। যারা হাজির হলো তাদের মধ্যে কোতে দা রোকও ছিল। সে এলে ফিতাটা তাকে দেখানো হলো। আমি মেয়েটাকে জোরের সঙ্গে দায়ী করলাম। আমার এমন আচরণে মেয়েটা একেবারে স্তব্ধ এবং হতভম্ব হয়ে গেল। মেয়েটা একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। কেবল আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকল। তার সেই দৃষ্টিতে শয়তানেরও মন গলত। কিন্তু আমার মন গলল না। শেষে মেয়েটা জোরের সঙ্গেই বলল সে এ কাজ করেনি। তারপর মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে কোনও রাগ বাদেই বলল : তুই ভাল করে চিন্তা করে দেখ তুই কী বলছিস! তুই আমাকে কেন দোষ দিচ্ছিস? আমি তোর কী
ক্ষতি করেছি?
কিন্তু আমি তখন বর্বরতার চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। আমি একটুও পিছু হটলাম না। আমি আবার জোরের সঙ্গে বললাম তুই আমাকে এই ফিতা দিয়েছিস। মেয়েটা তখন কাঁদতে শুরু করল আর আমার দিকে তাকিয়ে বলল : ‘রুশো তুই এই কথা এখনো বলছিস! অথচ আমি তোকে ভাল মানুষ মনে করেছিলাম! তুই আমাকে এই দুঃখ দিলি! তবু আমি নিজেকে তোর জায়গায় দেখতে চাইনে।’ এর বেশি ও আর কিছু বলল না। কেবল নিজে যে নির্দোষ সে কথাটাই বারংবার বলতে লাগল। ওর কথার মধ্যে একটা সরলতা আর দৃঢ়তা ছাড়া আমার প্রতি ওর রাগের কোনও প্রকাশ ছিল না। একদিকে আমার জবরদস্তি আর অপরদিকে ওর এমনি সরল ভাব ওর দুর্ভোগের কারণ হলো। হাজির যারা ছিল তারা আমার গলাকেই নির্দোষ ভাবল আর মেয়েটার সরলতাকেই দোষী সাব্যস্ত করল। ব্যাপারটা যে তখনই শেষ হলো তা নয়। তবু সকলে যেন আমার পক্ষে এবং মেয়েটার বিপক্ষে স্থান নিল। এমন একটা উত্তেজনার মধ্যে আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছিল তা কেউ অন্বেষণ করল না। আমাদের দুজনকেই ঘর থেকে বার করে দিয়ে কোঁতে দা লা রোক কেবল বলল : যে দোষী তার যদি কোনও বিবেক থাকে তবে সে বিবেকই ওর শোধ নিবে! তার এমন কথার মধ্যে কোনও মিথ্যা ছিল না। বিবেক তার কাজ করে। এখনও মেয়েটার সেদিন কী হয়েছিল। তবে এটা ঠিক ওই বাড়িতে একটা ভাল কাজ যোগাড় করা ওর পক্ষে আর সহজ হয়নি। নিজের সততার ওপর আঘাতকে ওর বহন করে চলতে হয়েছে। চুরির ব্যাপারটা যে কিছু সাংঘাতিক ছিল, এমনও নয়। একটা সামান্য ফিতার ব্যাপার। তবু ব্যাপারটা তো চুরি বলেই সাব্যস্ত হলো। এবং তার চাইতেও বড় এই চুরির অপবাদ ওর চাইতে যাকে সেদিন বেশি আঘাত করেছিল, সে বর্বর হলেও তার নাম ছিল রুশো! শেষে শুধু এই বলা যায়, যে কিশোরপ্রায় লোকটার নাম ছিল রুশো সে তখন বিকারের তুঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল। ইতোমধ্যে অনেক বিকারেরই স্তূপ ঘটে গিয়েছিল আমার মধ্যে। মেয়েটার জীবনে কেবল যে আমি দুর্ভাগ্য এবং দারিদ্র্যের কারণ হলাম তাই নয়। কে জানে তার সেই বয়সে এমন আঘাতে কী পরিণতি তার ঘটেছিল! সেদিনের আমার সাফল্যে আজ যদি আমার কোনও বেদনা বোধের উদয় হয়ে থাকে তবে, সে দুঃখ যদি আজ আমার পক্ষে সহ্যের অতীত হয়ে থাকে, তবে তাতেও কেউ বুঝবে না যে, সেই হতভাগিনীকে আমার চাইতেও দুঃখি করার জন্য আজ আমার নিজের অনুতাপ গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়েছে!
আজকের আমার এমন নির্মম স্মৃতি মাঝে-মাঝে আমাকে এত বেদনার্ত এবং উত্তাল করে তোলে যে, আমার নিঘুম অসময়ে আমার মনে হয় যেন মেয়েটা আমার অপরাধের জন্য প্রতিশোধে এগিয়ে আসছে এবং যেন ঘটনাটা ঘটেছে সেকালে নয়, একালে এবং মাত্র গতকালই। তারপরে নিজের নিরাপদ জীবনে যদি ওকে বিস্মৃত হতে পেরেছি, কিন্তু আমার চরম দুর্ভোগের জীবনে ওকে আমি বিস্মৃত হতে পারিনি। আমার এই মনোভাবই হয়তো আমার কোনও বইতে প্রকাশও করেছি। বলেছি : মনের অনুভব যত সুখের সময়ে স্মৃত হয় না, যতোটা সে জেগে ওঠে দুর্ভাগ্যের মুহূর্তে। আর একথাও ঠিক যে আমার আত্মার এই ক্রন্দনকে আমি আমার কোনও বন্ধুর কাছে কোনওদিনই প্রকাশ করে বলতে পারিনি। কারোর সঙ্গে কোনও অন্তরঙ্গতার মুহূর্তে আমার জীবনের সেই ঘটনাকে উন্মোচিত করতে পারিনি। মাদাম দা ওয়ারেন্স-এর কাছেও নয়। কাউকে বলতে গেলেও কেবল হয়তো বলেছি, আমি একটা অপরাধের অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছি। কিন্তু তবু ঘটনাটার কথা বলতে পারিনি। আমার জীবনের এ একটা বোঝ। এখনও আমার বিবেকের ওপর একটা ভার হয়ে আছে। এ গুরুভারের কোনও লাঘব ঘটেনি। আমি শুধু আজ এই বলতে পারি যে, আজ যদি আমি এই আত্ম-উন্মোচনের কাজটি শুরু করে থাকি তবে সে আমার সেই অমোচনীয় অপরাধবোধের একটু লাঘবতা লাভের কামনাই তার কারণ।
আমার আজকের এই আচরণে কোনও কৃত্রিমতা নেই। আমার সেদিনের সেই ঘৃণ্য অপরাধের ওপর কোনও প্রলেপ লেপনের জন্য আমার আজকের এই আত্মস্বীকার নয়। ঘটনার সেদিন সেই মুহূর্তে আমার মনের মধ্যে কোনও দুষ্ট বুদ্ধি আদৌ ছিল না। এ কথা আমি আজও জোরের সঙ্গেই বলব। সেই নির্মম সময়ে যখন আমি অসহায় মেয়েটাকে চুরির দায়ে দায়ী করছিলাম, তখনও সেই মুহূর্তে মেয়েটাকে আমি অন্তর দিয়ে ভালবাসছিলাম। তাই স্মৃতি দিয়ে হলেও আমার সেদিনের সেই মুহূর্তের দিকে তাকিয়ে আমি যদি আজ আমার অন্তরের সত্যকে প্রকাশ না করি তাহলে যার জন্য আজ আমি এই স্মৃতিচারণে রত হয়েছি, আমার সে উদ্দেশ্য মিথ্যা হয়ে যাবে। তাই আজো বলছি সেই হতভাগ্য মেয়েটাকে যখন আমি নির্মমভাবে আহত করছিলাম, তখনও ওর ওপর আমার এই নির্মম আঘাতের কারণও ছিল ওর প্রতি আমার ভালবাসা। কথাটা আজ অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবু কথাটা সত্য। আমার চেতনার সর্বমুহূর্তে আমার হৃদয়ে ও বিরাজ করছিল। আর তাই সবাই যখন কেবল আমাকে প্রশ্ন করছিল, বল তুই, কে করেছে এ কাজ, তখন আমার মনের মধ্যে ও ছাড়া আর কেউ তো ছিল না। আর তাই ওর নামই সেদিন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়েছিল : ও করেছে। আমার মনের মধ্যে সেই মুহূর্তে যে ইচ্ছাটি বিরাজ করছিল, ও আমাকে ফিতাটা দিক, আমি সেই ইচ্ছাই প্রকাশ করে বলেছিলাম : ও আমাকে ফিতাটা দিয়েছে। পরে যখন ওর হত দুর্দশা আমি দেখেছি তখন আমার হৃদয় রক্তাক্ত হয়ে উঠছিল, তবু আর সব মানুষের উপস্থিতি আমার গ্লানিবোধের চাইতে অধিকতর প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে মুহূর্তে আমি যে কোনও দণ্ডের জন্য ভীত হয়েছিলাম তা নয়। আমার অপমানিত হওয়ার বোধটাই সব অনুভূতিকে অতিক্রম করে প্রবল হয়ে উঠেছিল। আসল অপরাধের চাইতে অপমানিত হওয়ার বোধটাই যেন আমাকে পেয়ে বসেছিল। তাকেই যেন আমার মৃত্যুর বাড়া বলে বোধ হয়েছিল। যেন এর চাইতে বড় দুর্দৈব জগতে আর কিছু ছিল না। অথচ সেদিন যদি আমার পায়ের নীচে মাটিও ফাঁক হয়ে যেত, যদি আমার গলাটাকে কেউ টিপে ধরত, তাহলে আমি আমার অন্তরে আনন্দিত হতাম। একটা অজেয় লজ্জাবোধ আমাকে সেদিন গ্রাস করে একটা ঘৃণ্য প্রাণীতে পরিণত করেছিল। আমার মুখ না খোলার অপরাধ যত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, মুখ খোলার ভয় যেন আমাকে তত বেশি ভয়ার্ত করে তুলছিল। সবাই আমাকে মিথ্যাবাদী বলে জানবে, আমাকে একটা চোর বলে চিহ্নিত করবে। আমার চোখের সামনে আমাকে ঘৃণ্য বলে চিহ্নিত করবে, এমন আমি চিন্তা করতে পারছিলাম না। একটা বিব্রতবোধের অনুভূতি ছাড়া আর সব অনুভূতিই যেন আমি সেই মুহূর্তে বিস্মৃত হয়েছিলাম। যদি একটু শান্ত হবার সময় পেতাম, আমি তাহলে সেদিন সবকিছুই স্বীকার করতাম। মঁসিয়ে দা লা রোক যদি সেদিন আমাকে একটু আড়ালে ডেকে বলতেন : “এই মেয়েটাকে তুই মারিস না। তুই যদি দোষী, তুই যদি কাজটা করে থাকিস, তুই আমার কাছে স্বীকার কর’, তাহলে আমি তার পদপ্রান্তে নমিত হয়ে সব কিছু যে স্বীকার করতাম, সে বিষয়ে আজ আমি নিঃসন্দেহ। কিন্তু হায় ভাগ্য! যখন আমি একটু সহানুভূতি আর সাহস চাচ্ছিলাম, তখন সকলে কেবল আমাকে ধমকাচ্ছিল। সেদিন আমার বয়সেরও একটা ব্যাপার ছিল। তখনও আমার তেমন বয়স হয়নি। তখন আমি একটা শিশু প্রায়; একটা কিশোর। আসলে একটা শিশুই ছিলাম আমি।
এটা ঠিক যে যেটা অপরাধ সেটা বয়স্কের চাইতে শিশুর ক্ষেত্রে কম অপরাধ নয়। কিন্তু যেটা একটা দুর্বলতা আর অক্ষমতার ব্যাপার। সেটাকে তখন অপরাধ বলা যায় না এবং আমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেদিন, তাই ছিল। আর কিছু নয়। আর তাই তার স্মৃতি আজ আমাকে যত না অপরাধ বোধে পীড়িত করছে, তার চাইতে অধিক পীড়িত করছে ঘটনার ফলাফল আমার জীবনে যা ঘটেছিল তার ভয়ঙ্করতার বোধ। অপরাধের প্রতি যে আকর্ষণ সেদিন আমার মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল, আসল অপরাধ তার কাছে আদৌ কিছু নয়। আমার জীবনের ক্ষতি সেখানে। আমি তখন থেকে অপরাধের যে প্রবণতার মধ্যে নিপতিত হলাম, তার মূল কারণ সেই জীবনের শুরুতে আমার কৃত সেই অপরাধ; অপরাধকে স্বীকার করতে না পারার অপরাধ। এবং আমার বিশ্বাস মিথ্যার প্রতি জীবনব্যাপী আমার যদি কোনও ঘৃণার জন্ম ঘটে থাকে তবে তার মূল সেই একটি মিথ্যা যা আমার কিশোর জীবনে ঘটেছিল এবং যা একটি নিষ্পাপ কিশোরীর জীবনে করুণাহীন দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদি সেদিনের সেই পাপের কোনও প্রায়শ্চিত্তের কথা চিন্তা করা যায় তবে আমার জীবনভর অনুতাপের প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া অপর কোনও প্রায়শ্চিত্তের কথা আমি কল্পনা করতে পারিনে। আমার শেষ জীবনের যা কিছু দুঃখ তা সবই সেই আমার আদিকালের অপরাধের অনুতাপের প্রায়শ্চিত্ত বৈ আর কিছু নয়। আর আমি যদি আমার জীবনে বিবেকপূর্ণ কোনও কিছু সাধন করতে পেরে থাকি তবে তার মুখে সেই নিষ্পাপ কিশোরী মারিয়েনের বেদনা। ওর বিরুদ্ধে কৃত আমার সেদিনের অপরাধের ভার যত বড়ই হোক না কেন আমি যে তার প্রায়শ্চিত্ত বাদে মারা যাইনি তাই হবে আমার মৃত্যু মুহূর্তের সান্ত্বনা।
এ ব্যাপারে আমার জীবনের এই হোক শেষ কথা। আর কিছু নয়।