দেশভেদে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক অবস্থার প্রভেদ হইয়া থাকে, এ কথা সকলেই জানেন। সেই ভেদকে স্বীকার না করিলে কাজ চলে না। যাহারা বিলখালের মধ্যে থাকে তাহারা মৎস্যব্যবসায়ী হইয়া উঠে; যাহারা সমুদ্রতীরের বন্দরে থাকে তাহারা দেশবিদেশের সহিত বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হয়; যাহারা সমতল উর্বরা ভূমিতে বাস করে তাহারা কৃষিকে উপজীবিকা করিয়া তোলে। মরুপ্রায় দেশে যে আরব বাস করে তাহাকে যদি অন্যদেশবাসীর ইতিহাস শুনাইয়া বলা যায় যে কৃষির সাহায্য ব্যতীত উন্নতিলাভ করা যায় না তবে সে উপদেশ ব্যর্থ হয় এবং কৃষিযোগ্য স্থানের অধিবাসীর নিকট যদি প্রমাণ করিতে বসা যায় যে মৃগয়া এবং পশুপালনেই সাহস ও বীর্যের চর্চা হইতে পারে, কৃষিতে তাহা নষ্টই হয়, তবে সেরূপ নিষ্ফল উত্তেজনা কেবল অনিষ্টই ঘটায়।
বস্তুত, ভিন্ন পথ দিয়া ভিন্ন জাতি ভিন্ন শ্রেণীর উৎকর্ষ লাভ করে এবং সমগ্র মানুষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতিলাভের এই একমাত্র উপায়। য়ুরোপ কতকগুলি প্রাকৃতিক সুবিধাবশত যে বিশেষপ্রকারের উন্নতির অধিকারী হইয়াছে আমরা যদি ঠিক সেইপ্রকার উন্নতির জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠি তবে, নিজেকে ব্যর্থ ও বিশ্বমানবকে বঞ্চিত করিব। কারণ, আমাদের দেশের বিশেষ প্রকৃতি অনুসারে আমরা মনুষ্যত্বের যে উৎকর্ষ লাভ করিতে পারি, পরের বৃথা অনুকরণ-চেষ্টায় তাহাকে নষ্ট করিলে এমন একটা জিনিসকে নষ্ট করা হয় যাহা মানুষ অন্য কোনো স্থান হইতে পাইতে পারে না। সুতরাং, বিশ্বমানব সেই অংশে দরিদ্র হয়। চাষের জমিকে খনির মতো ব্যবহার করিলে ও খনিজের জমিকে কৃষিক্ষেত্রের কাজে লাগাইলে মানবসভ্যতাকে ফাঁকি দেওয়া হয়।
যে কারণেই হউক, য়ুরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের কতকগুলি গুরুতর প্রভেদ আছে। উৎকট অনুকরণের দ্বারা সেই প্রভেদকে দূর করিয়া দেওয়া যে কেবল অসম্ভব তাহা নহে, দিলে তাহাতে বিশ্বমানবের ক্ষতি হইবে।
আমরা যখন বিদেশের ইতিহাস পড়ি বা বিদেশের প্রতাপকে প্রত্যক্ষ চক্ষে দেখি তখন নিজেদের প্রতি ধিক্কার জন্মে– তখন বিদেশীর সঙ্গে আমাদের যে যে বিষয়ে পার্থক্য দেখিতে পাই সমস্তই আমাদের অনর্থের হেতু বলিয়া মনে হয়। কোনো অধ্যাপকের অর্বাচীন বালকপুত্র যখন সার্কাস দেখিতে যায় তাহার মনে হইতে পারে যে, এমনি করিয়া ঘোড়ার পিঠের উপরে দাঁড়াইয়া লাফালাফি করিতে যদি শিখি এবং দর্শকদলের বাহবা পাই তবেই জীবন সার্থক হয়। তাহার পিতার শান্তিময় কাজ তাহার কাছে অত্যন্ত নির্জীব ও নিরর্থক বলিয়া মনে হয়।
বিশেষ স্থলে পিতাকে ধিক্কার দিবার কারণ থাকিতেও পারে। সার্কাসের খেলোয়াড় যেরূপ অক্লান্ত সাধনা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা নিজের ব্যবসায়ে উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে, সেইরূপ উদ্যম ও উদ্যোগের অভাবে অধ্যাপক যদি নিজের কর্মে উন্নতি লাভ না করিয়া থাকেন তবেই তাঁহাকে লজ্জা দেওয়া চলে।
য়ুরোপের সঙ্গে ভারতের পার্থক্য অনুভব করিয়া যদি আমাদের লজ্জা পাইতে হয় তবে লজ্জার কারণটা ভালো করিয়া বিচার করিতে হয়, নতুবা যথার্থ লজ্জার মূল কখনো উৎপাটিত হইবে না। যদি বলি যে, ইংলাণ্ডের পার্লামেন্ট আছে, ইংলাণ্ডের যৌথ কারবার আছে, ইংলাণ্ডে প্রায় প্রত্যেক লোকই রাষ্ট্রচালনায় কিছু-না-কিছু অধিকারী, এইজন্য তাহারা বড়ো, সেইগুলি নাই বলিয়াই আমরা ছোটো, তবে গোড়ার কথাটা বলা হয় না। আমরা কোনো কৌতুকপ্রিয় দেবতার বরে যদি কয়েক দিনের জন্য মূঢ় আবুহোসেনের মতো ইংরেজি মাহাত্ম্যের বাহ্য অধিকারী হই, আমাদের বন্দরে বাণিজ্যতরীর আবির্ভাব হয়, পার্লামেন্টের গৃহচূড়া আকাশ ভেদ করিয়া উঠে, তবে প্রথম অঙ্কের প্রহসন পঞ্চম অঙ্কে কী মর্মভেদী অশ্রুপাতেই অবসিত হয়! আমরা এ কথা যেন কোনোমতেই না মনে করি যে পার্লামেন্ট মানুষ গড়ে– বস্তুত মানুষই পার্লামেন্ট গড়ে। মাটি সর্বত্রই সমান; সেই মাটি লইয়া কেহ বা শিব গড়ে, কেহ বা বানর গড়ে; যদি কিছু পরিবর্তন করিতে হয় তবে মাটির পরিবর্তন নহে– যে ব্যক্তি গড়ে তাহার শিক্ষা ও সাধনা, চেষ্টা ও চিন্তার পরিবর্তন করিতে হইবে।
এই ত্রিপুররাজ্যের রাজচিহ্নের মধ্যে একটি সংস্কৃতবাক্য অঙ্কিত দেখিয়াছি– “কিল বিদুর্বীরতাং সারমেকং’– বীর্যকেই সার বলিয়া জানিবে। এই কথাটি সম্পূর্ণ সত্য। পার্লামেন্ট সার নহে, বাণিজ্যতরী সার নহে, বীর্যই সার। এই বীর্য দেশকালপাত্রভেদে নানা আকারে প্রকাশিত হয়– কেহ বা শস্ত্রে বীর, কেহ বা শাস্ত্রে বীর, কেহ বা ত্যাগে বীর, কেহ বা ভোগে বীর, কেহ বা ধর্মে বীর, কেহ বা কর্মে বীর। বর্তমানে আমাদের ভারতবর্ষীয় প্রতিভাকে আমরা পূর্ণ উৎকর্ষের দিকে লইয়া যাইতে পারিতেছি না তাহার কতকগুলি কারণ আছে, কিন্তু সর্বপ্রধান কারণ বীর্যের অভাব। এই বীর্যের দারিদ্রবশত যদি নিজের প্রকৃতিকেই ব্যর্থ করিয়া থাকি তবে বিদেশের অনুকৃতিতে সার্থক করিয়া তুলিব কিসের জোরে?
আমাদের আমবাগানে আজকাল আম ফলে না, বিলাতের আপেল বাগানে প্রচুর আপেল ফলিয়া থাকে। আমরা কি তাই বলিয়া মনে করিব যে, আমগাছগুলা কাটিয়া ফেলিয়া আপেলগাছ রোপণ করিলে তবেই আমরা আশানুরূপ ফললাভ করিব। এই কথা নিশ্চয় জানিতে হইবে, আপেলগাছে যে বেশি ফল ফলিতেছে তাহার কারণ তাহার গোড়ায়, তাহার মাটিতে সার আছে — আমাদের আমবাগানের জমির সার বহুকাল হইল নিঃশেষিত হইয়া গেছে। আপেল পাই না ইহাই আমাদের মূল দুর্ভাগ্য নহে, মাটিতে সার নাই ইহাই আক্ষেপের বিষয়। সেই সার যদি যথেষ্ট পরিমাণে থাকিত তবে আপেল ফলিত না, কিন্তু আম প্রচুর পরিমাণে ফলিত এবং তখন সেই আম্রের সফলতায় আপেলের অভাব লইয়া বিলাপ করিবার কথা আমাদের মনেই হইত না। তখন দেশের আম বেচিয়া অনায়াসে বিদেশের আপেল হাটে কিনিতে পারিতাম, ভিক্ষার ঝুলি সম্বল করিয়া এক রাত্রে পরের প্রসাদে বড়োলোক হইবার দুরাশা মনের মধ্যে বহন করিতে হইত না।
আসল কথা, দেশের মাটিতে সার ফেলিতে হইবে। সেই সার আর-কিছুই নহে– “কিল বিদুর্বীরতাং সারমেকং’, বীরতাকেই একমাত্র সার বলিয়া জানিবে। ঋষিরা বলিয়াছেন : নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ। এই-যে আত্মা, ইনি বলহীনের দ্বারা লভ্য নহেন। বিশ্বাত্মা-পরমাত্মার কথা ছাড়িয়া দেওয়া যাক– যে ব্যক্তি দুর্বল সে নিজের আত্মাকে পায় না, নিজের আত্মাকে যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ উপলব্ধি না করিয়াছে সে অপর কিছুকেই লাভ করিতে পারে না। য়ুরোপ নিজের আত্মাকে যে পথ দিয়া লাভ করিতেছে সে পথ আমাদের সম্মুখে নাই; কিন্তু যে মূল্য দিয়া লাভ করিতেছে তাহা আমাদের পক্ষেও অত্যাবশ্যক– তাহা বল, তাহা বীর্য। য়ুরোপ যে কর্মের দ্বারা যে অবস্থার মধ্যে আত্মাকে উপলব্ধি করিতেছে আমরা সে কর্মের দ্বারা সে অবস্থার মধ্যে আত্মাকে উপলব্ধি করিব না– আমাদের সম্মুখে অন্য পথ, আমাদের চতুর্দিকে অন্যরূপ পরিবেশ, আমাদের অতীতের ইতিহাস অন্যরূপ, আমাদের শক্তির মূলসঞ্চয় অন্যত্র– কিন্তু আমাদের সেই বীর্য আবশ্যক যাহা থাকিলে পথকে ব্যবহার করিতে পারিব, পরিবেশকে অনুকূল করিতে পারিব, অতীতের ইতিহাসকে বর্তমানে সফল করিতে পারিব এবং শক্তির গূঢ় সঞ্চয়কে আবিষ্কৃত উদ্ঘাটিত করিয়া তাহার অধিকারী হইতে পারিব। “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ’ — আত্মা তো আছেই, কিন্তু বল নাই বলিয়া তাহাকে লাভ করিতে পারি না। ত্যাগ করিতে শক্তি নাই, দুঃখ পাইতে সাহস নাই, লক্ষ্য অনুসরণ করিতে নিষ্ঠা নাই; কৃশ সংকল্পের দৌর্বল্য, ক্ষীণ শক্তির আত্মবঞ্চনা, সুখবিলাসের ভীরুতা, লোকলজ্জা, লোকভয় আমাদিগকে মুহূর্তে মুহূর্তে যথার্থভাবে আত্মপরিচয় আত্মলাভ আত্মপ্রতিষ্ঠা হইতে দূরে রাখিতেছে। সেইজন্যই ভিক্ষুকের মতো আমরা অপরের মাহাত্ম্যের প্রতি ঈর্ষা করিতেছি এবং মনে করিতেছি, বাহ্য অবস্থা যদি দৈবক্রমে অন্যের মতো হয় তবেই আমাদের সকল অভাব, সকল লজ্জা দূর হইতে পারে।
বিদেশের ইতিহাস যদি আমরা ভালো করিয়া পড়িয়া দেখি তবে দেখিতে পাইব, মহত্ত্ব কত বিচিত্র প্রকারের– গ্রীসের মহত্ত্ব এবং রোমের মহত্ত্ব একজাতীয় নহে– গ্রীস বিদ্যা ও বিজ্ঞানে বড়ো, রোম কর্মে ও বিধিতে বড়ো। রোম তাহার বিজয়পতাকা লইয়া যখন গ্রীসের সংস্রবে আসিল তখন বাহুবলে ও কর্মবিধিতে জয়ী হইয়াও বিদ্যাবুদ্ধিতে গ্রীসের কাছে হার মানিল, গ্রীসের কলাবিদ্যা ও সাহিত্যবিজ্ঞানের অনুকরণে প্রবৃত্ত হইল, কিন্তু তবু সে রোমই রহিল, গ্রীস হইল না– সে আত্মপ্রকৃতিতেই সফল হইল, অনুকৃতিতে নহে — সে লোকসংস্থানকার্যে জগতের আদর্শ হইল সাহিত্য-বিজ্ঞান-কলাবিদ্যায় হইল না।
ইহা হইতে বুঝিতে হইবে, উৎকর্ষের একমাত্র আকার ও একমাত্র উপায় জগতে নাই। আজ য়ুরোপীয় প্রতাপের যে আদর্শ আমাদের চক্ষের সমক্ষে অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে উন্নতি তাহা ছাড়াও সম্পূর্ণ অন্য আকারে হইতে পারে– আমাদের ভারতীয় উৎকর্ষের যে আদর্শ আমরা দেখিয়াছি তাহার মধ্যে প্রাণসঞ্চার বলসঞ্চার করিলে জগতের মধ্যে আমাদিগকে লজ্জিত থাকিতে হইবে না। একদিন ভারতবর্ষ জ্ঞানের দ্বারা, ধর্মের দ্বারা চীন-জাপান ব্রহ্মদেশ-শ্যামদেশ তিব্বত-মঙ্গোলিয়া– এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশই জয় করিয়াছিল। আজ য়ুরোপ অস্ত্রের দ্বারা বাণিজ্যের দ্বারা পৃথিবী জয় করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। আমরা ইস্কুলে পড়িয়া এই আধুনিক য়ুরোপের প্রণালীকেই যেন একমাত্র গৌরবের কারণ বলিয়া মনে না করি।
কিন্তু ইংরেজের বাহুবল নহে– ইংরেজের ইস্কুল ঘরে-বাইরে দেহে-মনে আচারে-বিচারে সর্বত্র আমাদিগকে আক্রমণ করিয়াছে। আমাদিগকে যে-সকল বিজাতীয় সংস্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন করিতেছে তাহাতে অন্তত কিছুকালের জন্যও আমাদের আত্মপরিচয়ের পথ লোপ করিতেছে। সে আত্মপরিচয় ব্যতীত আমাদের কখনোই আত্মোন্নতি হইতে পারে না।
ভারতবর্ষের দেশীয় রাজ্যগুলির যথার্থ উপযোগিতা কী তাহা এইবার বলিবার সময় উপস্থিত হইল।
দেশবিদেশের লোক বলিতেছে, ভারতবর্ষের দেশীয় রাজ্যগুলি পিছাইয়া পড়িতেছে। জগতের উন্নতির যাত্রাপথে পিছাইয়া পড়া ভালো নহে, এ কথা সকলেই স্বীকার করিবে, কিন্তু অগ্রসর হইবার সকল উপায়ই সমান মঙ্গলকর নহে। নিজের শক্তির দ্বারাই অগ্রসর হওয়াই যথার্থ অগ্রসর হওয়া– তাহাতে যদি মন্দগতিতে যাওয়া যায় তবে সে ভালো। অপর ব্যক্তির কোলে-পিঠে চড়িয়া অগ্রসর হওয়ার কোনো মাহাত্ম্য নাই– কারণ, চলিবার শক্তিলাভই যথার্থ লাভ, অগ্রসর হওয়ামাত্রই লাভ নহে। ব্রিটিশ-রাজ্যে আমরা যেটুকু অগ্রসর হইতে পারিয়াছি তাহাতে আমাদের কৃতকার্যতা কতটুকু! সেখানকার শাসনরক্ষণ-বিধিব্যবস্থা যত ভালোই হউক-না কেন, তাহা তো বস্তুত আমাদের নহে। মানুষ ভুলত্রুটি-ক্ষতিক্লেশের মধ্য দিয়াই পূর্ণতার পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু আমাদিগকে ভুল করিতে দিবার ধৈর্য যে ব্রিটিশ-রাজের নাই। সুতরাং তাঁহারা আমাদিগকে ভিক্ষা দিতে পারেন, শিক্ষা দিতে পারেন না। তাঁহাদের নিজের যাহা আছে তাহার সুবিধা আমাদিগকে দিতে পারেন, কিন্তু তাহার স্বত্ব দিতে পারেন না। মনে করা যাক কলিকাতা ম্যুনিসিপ্যালিটির পূর্ববর্তী কমিশনারগণ পৌরকার্যে স্বাধীনতা পাইয়া যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখাইতে পারেন নাই, সেই অপরাধে অধীর হইয়া কর্তৃপক্ষ তাঁহাদের স্বাধীনতা হরণ করিলেন। হইতে পারে এখন কলিকাতার পৌরকার্য পূর্বের চেয়ে ভালোই চলিতেছে, কিন্তু এরূপ ভালো চলাই যে সর্বাপেক্ষা ভালো তাহা বলিতে পারি না। আমাদের নিজের শক্তিতে ইহা অপেক্ষা খারাপ চলাও আমাদের পক্ষে ইহার চেয়ে ভালো। আমরা গরিব এবং নানা বিষয়ে অক্ষম; আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্য ধনী জ্ঞানী বিলাতের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত তুলনীয় নহে বলিয়া শিক্ষাবিভাগের দেশীয় লোকের কর্তৃত্ব খর্ব করিয়া রাজা যদি নিজের জোরে কেম্ব্রিজ-অক্সফোর্ডের নকল প্রতিমা গড়িয়া তোলেন, তবে তাহাতে আমাদের কতটুকুই বা শ্রেয় আছে– আমরা গরিবের যোগ্য বিদ্যালয় যদি নিজে গড়িয়া তুলিতে পারি তবে সেই আমাদের সম্পদ। যে ভালো আমার আয়ত্ত নহে সে ভালোকে আমার মনে করাই মানুষের পক্ষে বিষম বিপদ। অল্পদিন হইল একজন বাঙালি ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেট দেশীয় রাজ্যশাসনের প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেছিলেন– তখন স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম তিনি মনে করিতেছেন, ব্রিটিশ-রাজ্যের সুব্যবস্থা সমস্তই যেন তাঁহাদেরই সুব্যবস্থা; তিনি যে ভারবাহীমাত্র, তিনি যে যন্ত্রী নহেন, যন্ত্রের একটা সামান্য অঙ্গমাত্র, এ কথা যদি তাঁহার মনে থাকিত তবে দেশীয় রাজ্যব্যবস্থার প্রতি এমন স্পর্ধার সহিত অবজ্ঞা প্রকাশ করিতে পারিতেন না। ব্রিটিশ-রাজ্যে আমরা যাহা পাইতেছি তাহা যে আমাদের নহে, এই সত্যটি ঠিকমত বুঝিয়া উঠা আমাদের পক্ষে কঠিন হইয়াছে, এই কারণেই আমরা রাজার নিকট হইতে ক্রমাগতই নূতন নূতন অধিকার প্রার্থনা করিতেছি এবং ভুলিয়া যাইতেছি– অধিকার পাওয়া এবং অধিকারী হওয়া একই কথা নহে।
দেশীয় রাজ্যের ভুলত্রুটি-মন্দগতির মধ্যেও আমাদের সান্ত্বনার বিষয় এই যে, তাহাতে যেটুকু লাভ আছে তাহা বস্তুতই আমাদের নিজের লাভ। তাহা পরের স্কন্ধে চড়িবার লাভ নহে, তাহা নিজের পায়ে চলিবার লাভ। এই কারণেই আমাদের বাংলাদেশের এই ক্ষুদ্র ত্রিপুররাজ্যের প্রতি উৎসুক দৃষ্টি না মেলিয়া আমি থাকিতে পারি না। এই কারণেই এখানকার রাজ্যব্যবস্থার মধ্যে যে-সকল অভাব ও বিঘ্ন দেখিতে পাই তাহাকে আমাদের সমস্ত বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য বলিয়া জ্ঞান করি। এই কারণেই এখানকার রাজ্যশাসনের মধ্যে যদি কোনো অসম্পূর্ণতা বা শৃঙ্খলার অভাব দেখি তবে তাহা লইয়া স্পর্ধাপূর্বক আলোচনা করিতে আমার উৎসাহ হয় না– আমার মাথা হেঁট হইয়া যায়। এই কারণে, যদি জানিতে পাই তুচ্ছ স্বার্থপরতা আপনার সামান্য লাভের জন্য, উপস্থিত ক্ষুদ্র সুবিধার জন্য, রাজশ্রীর মন্দিরভিত্তিকে শিথিল করিয়া দিতে কুণ্ঠিত হইতেছে না, তবে সেই অপরাধকে আমি ক্ষুদ্ররাজ্যের একটি ক্ষুদ্র ঘটনা বলিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি না। এই দেশীয় রাজ্যের লজ্জাকেই যদি যথার্থরূপে আমাদের লজ্জা এবং ইহার গৌরবকেই যদি যথার্থরূপে আমাদের গৌরব বলিয়া না বুঝি, তবে দেশের সম্বন্ধে আমরা ভুল বুঝিয়াছি।
পূর্বেই বলিয়াছি, ভারতীয় প্রকৃতিকেই বীর্যের দ্বারা সবল করিয়া তুলিলে তবেই আমরা যথার্থ উৎকর্ষলাভের আশা করিতে পারিব। ব্রিটিশ-রাজ ইচ্ছা করিলেও এ সম্বন্ধে আমাদিগকে সাহায্য করিতে পারেন না। তাঁহারা নিজের মহিমাকেই একমাত্র মহিমা বলিয়া জানেন– এই কারণে, ভালো মনেও তাঁহারা আমাদিগকে যে শিক্ষা দিতেছেন তাহাতে আমরা স্বদেশকে অবজ্ঞা করিতে শিখিতেছি। আমাদের মধ্যে যাঁহারা পেট্রিয়ট বলিয়া বিখ্যাত তাঁহাদের অনেকেই এই অবজ্ঞাকারীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। এইরূপে যাঁহারা ভারতকে অন্তরের সহিত অবজ্ঞা করেন তাঁহারাই ভারতকে বিলাত করিবার জন্য উৎসুক– সৌভাগ্যক্রমে তাঁহাদের এই অসম্ভব আশা কখনোই সফল হইতে পারিবে না।
আমাদের দেশীয় রাজ্যগুলি পিছাইয়া পড়িয়া থাকুক আর যাহাই হউক, এইখানেই স্বদেশের যথার্থ স্বরূপকে আমরা দেখিতে চাই। বিকৃতি-অনুকৃতির মহামারী এখানে প্রবেশ লাভ করিতে না পারুক, এই আমাদের একান্ত আশা। ব্রিটিশ-রাজ আমাদের উন্নতি চান, কিন্তু সে উন্নতি ব্রিটিশ মতে হওয়া চাই। সে অবস্থায় জলপদ্মের উন্নতি-প্রণালী স্থলপদ্মে আরোপ করা হয়। কিন্তু দেশীয় রাজ্যে স্বভাবের অব্যাহত নিয়মে দেশ উন্নতিলাভের উপায় নির্ধারণ করিবে, ইহাই আমাদের কামনা।
ইহার কারণ এ নয় যে, ভারতের সভ্যতাই সকল সভ্যতার শ্রেষ্ঠ। য়ুরোপের সভ্যতা মানবজাতিকে যে সম্পত্তি দিতেছে তাহা যে মহামূল্য, এ সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা ধৃষ্টতা।
অতএব, য়ুরোপীয় সভ্যতাকে নিকৃষ্ট বলিয়া বর্জন করিতে হইবে এ কথা আমার বক্তব্য নহে– তাহা আমাদের পক্ষে অস্বাভাবিক বলিয়াই, অসাধ্য বলিয়াই স্বদেশী আদর্শের প্রতি আমাদের মন দিতে হইবে– উভয় আদর্শের তুলনা করিয়া বিবাদ করিতে আমার প্রবৃত্তি নাই, তবে এ কথা বলিতেই হইবে যে উভয় আদর্শই মানবের পক্ষে অত্যাবশ্যক।
সেদিন এখানকার কোনো ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন যে, গবর্মেন্ট আর্ট স্কুলের গ্যালারি হইতে বিলাতি ছবি বিক্রয় করিয়া ফেলা কি ভালো হইয়াছে?
আমি তাহাতে উত্তর করিয়াছিলাম যে, ভালোই হইয়াছে। তাহার কারণ এ নয় যে, বিলাতি চিত্রকলা উৎকৃষ্ট সামগ্রী নহে। কিন্তু সেই চিত্রকলাকে এত সস্তায় আয়ত্ত করা চলে না। আমাদের দেশে সেই চিত্রকলার যথার্থ আদর্শ পাইব কোথায়? দুটো লক্ষ্ণৌ-ঠুংরি ও “হিলিমিলি পনিয়া’ শুনিয়া যদি কোনো বিলাতবাসী ইংরেজ ভারতীয় সংগীতবিদ্যা আয়ত্ত করিতে ইচ্ছা করে, তবে বন্ধুর কর্তব্য তাহাকে নিরস্ত করা। বিলাতি বাজারের কতকগুলি সুলভ আবর্জনা এবং সেইসঙ্গে দুটি একটি ভালো ছবি চোখের সামনে রাখিয়া আমরা চিত্রবিদ্যার যথার্থ আদর্শ কেমন করিয়া পাইব? এই উপায়ে আমরা যেটুকু শিখি তাহা যে কত নিকৃষ্ট তাহাও ঠিকমত বুঝিবার উপায় আমাদের দেশে নাই। যেখানে একটা জিনিসের আগাগোড়া নাই, কেবল কতকগুলা খাপছাড়া দৃষ্টান্ত আছে মাত্র, সেখানে সে জিনিসের পরিচয়লাভের চেষ্টা করা বিড়ম্বনা। এই অসম্পূর্ণ শিক্ষায় আমাদের দৃষ্টি নষ্ট করিয়া দেয়– পরের দেশের ভালোটা তো শিখিতেই পারি না, নিজের দেশের ভালোটা দেখিবার শক্তি চলিয়া যায়।
আর্ট স্কুলে ভর্তি হইয়াছি, কিন্তু আমাদের দেশে শিল্পকলার আদর্শ যে কী তাহা আমরা জানিই না। যদি শিক্ষার দ্বারা ইহার পরিচয় পাইতাম তবে যথার্থ একটা শক্তিলাভ করিবার সুবিধা হইত। কারণ, এ আদর্শ দেশের মধ্যে, থালায়, ঘটিতে, বাটিতে, ঝুড়িতে, চুপড়িতে, মন্দিরে, মঠে, বসনে, ভূষণে, পটে, গৃহভিত্তিতে, নানা-অঙ্গপ্রত্যঙ্গে-পরিপূর্ণ একটি সমগ্র মূর্তিরূপে দেখিতে পাইতাম; ইহার প্রতি আমাদের সচেষ্ট চিত্তকে প্রয়োগ করিতে পারিতাম; পৈতৃক সম্পত্তি লাভ করিয়া তাহাকে ব্যবসায়ে খাটাইতে পারিতাম।
এই কারণে, আমাদের শিক্ষার অবস্থায় বিলাতি চিত্রের মোহ জোর করিয়া ভাঙিয়া দেওয়া ভালো। নহিলে নিজের দেশে কী আছে তাহা দেখিতে মন যায় না– কেবলই অবজ্ঞায় অন্ধ হইয়া যে ধন ঘরের সিন্দুকে আছে তাহাকে হারাইতে হয়।
আমরা দেখিয়াছি, জাপানের একজন সুবিখ্যাত চিত্ররসজ্ঞ পণ্ডিত এ দেশের কীটদষ্ট কয়েকটি পটের ছবি দেখিয়া বিস্ময়ে পুলকিত হইয়াছেন– তিনি একখানি পট এখান হইতে লইয়া গেছেন, সেখানি কিনিবার জন্য জাপানের অনেক গুণজ্ঞ তাঁহাকে অনেক মূল্য দিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু তিনি বিক্রয় করেন নাই।
আমরা ইহাও দেখিয়াছি, য়ুরোপের বহুতর রসজ্ঞ ব্যক্তি আমাদের অখ্যাত দোকানবাজার ঘাঁটিয়া মলিন ছিন্ন কাগজের চিত্রপট বহুমূল্য সম্পদের ন্যায় সংগ্রহ করিয়া লইয়া যাইতেছেন। সে-সকল চিত্র দেখিলে আমাদের আর্ট স্কুলের ছাত্রগণ নাসাকুঞ্চন করিয়া থাকেন। ইহার কারণ কী? ইহার কারণ এই, কলাবিদ্যা যথার্থভাবে যিনি শিখিয়াছেন তিনি বিদেশের অপরিচিত রীতির চিত্রের সৌন্দর্যও ঠিকভাবে দেখিতে পান– তাঁহার একটি শিল্পদৃষ্টি জন্মে। আর, যাহারা কেবল নকল করিয়া শেখে তাহারা নকলের বাহিরে কিছুই দেখিতে পায় না।
আমরা যদি নিজের দেশের শিল্পকলাকে সমগ্রভাবে যথার্থভাবে দেখিতে শিখিতাম, তবে আমাদের সেই শিল্পদৃষ্টি শিল্পজ্ঞান জন্মিত যাহার সাহায্যে শিল্পসৌন্দর্যের দিব্য-নিকেতনের সমস্ত দ্বার আমাদের সম্মুখে উদ্ঘাটিত হইয়া যাইত। কিন্তু বিদেশী শিল্পের নিতান্ত অসম্পূর্ণ শিক্ষায়, আমরা যাহা পাই নাই তাহাকে পাইয়াছি বলিয়া মনে করি, যাহা পরের তহবিলেই রহিয়া গেছে তাহাকে নিজের সম্পদ্ জ্ঞান করিয়া অহংকৃত হইয়া উঠি।
“পিয়ের লোটি’ ছদ্মনামধারী বিখ্যাত ফরাসি ভ্রমণকারী ভারতবর্ষে ভ্রমণ করিতে আসিয়া আমাদের দেশের রাজনিকেতনগুলিতে বিলাতি আসবাবের ছাড়াছড়ি দেখিয়া হতাশ হইয়া গেছেন। তিনি বুঝিয়াছেন যে, বিলাতি আসবাবখানার নিতান্ত ইতরশ্রেণীর সামগ্রীগুলি ঘরে সাজাইয়া আমাদের দেশের বড়ো বড়ো রাজারা নিতান্তই অশিক্ষা ও অজ্ঞতা-বশতই গৌরব করিয়া থাকেন। বস্তুত বিলাতি শিল্পকলা সজীব, সেখানে শিল্পীরা প্রত্যহ নব নব রীতি সৃজন করিতেছেন, সেখানে বিচিত্র শিল্পপদ্ধতির কালপরম্পরাগত ইতিহাস আছে, তাহার প্রত্যেকটির সহিত বিশেষ দেশকালপাত্রের সংগতি সেখানকার গুণী লোকেরা জানেন– আমরা তাহার কিছুই না জানিয়া কেবল টাকার থলি লইয়া মূর্খ দোকানদারের সাহায্যে অন্ধভাবে কতকগুলা খাপছাড়া জিনিসপত্র লইয়া ঘরের মধ্যে পুঞ্জীভূত করিয়া তুলি– তাহাদের সম্বন্ধে বিচার করা আমাদের সাধ্যায়ত্ত নহে।
এই আসবাবের দোকান যদি লর্ড কর্জন বলপূর্বক বন্ধ করিয়া দিতে পারিতেন তবে দায়ে পড়িয়া আমরা স্বদেশী সামগ্রীর মর্যাদা রক্ষা করিতে বাধ্য হইতাম। তাহা হইলে টাকার সাহায্যে জিনিস-ক্রয়ের চর্চা বন্ধ হইয়া রুচির চর্চা হইত। তাহা হইলে ধনীগৃহে প্রবেশ করিয়া দোকানের পরিচয় পাইতাম না, গৃহস্থের নিজের শিল্পজ্ঞানের পরিচয় পাইতাম। ইহা আমাদের পক্ষে যথার্থ শিক্ষা, যথার্থ লাভের বিষয় হইত। এরূপ হইলে আমাদের অন্তরে-বাহিরে, আমাদের স্থাপত্যে-ভাস্কর্যে, আমাদের গৃহভিত্তিতে, আমাদের পণ্যবীথিকায় আমরা স্বদেশকে উপলব্ধি করিতাম।
দুর্ভাগ্যক্রমে সকল দেশেরই ইতরসম্প্রদায় অশিক্ষিত। সাধারণ ইংরেজদের শিল্পজ্ঞান নাই– সুতরাং তাহারা স্বদেশী সংস্কারের দ্বারা অন্ধ। তাহারা আমাদের কাছে তাহাদেরই অনুকরণ প্রত্যাশা করে। আমাদের বসিবার ঘরে তাহাদের দোকানের সামগ্রী দেখিলে তবেই আরাম বোধ করে– তবেই মনে করে, আমরা তাহাদেরই ফরমায়েশে তৈরি সভ্যপদার্থ হইয়া উঠিয়াছি। তাহাদেরই অশিক্ষিত রুচি অনুসারে আমাদের দেশের প্রাচীন শিল্পসৌন্দর্য সুলভ ও ইতর অনুকরণকে পথ ছাড়িয়া দিতেছে। এ দেশের শিল্পীরা বিদেশী টাকার লোভে বিদেশী রীতির অদ্ভূত নকল করিতে প্রবৃত্ত হইয়া চোখের মাথা খাইতে বসিয়াছে।
যেমন শিল্পে তেমনি সকল বিষয়েই। আমরা বিদেশী প্রণালীকেই একমাত্র প্রণালী বলিয়া বুঝিতেছি। কেবল বাহিরের সামগ্রীতে নহে, আমাদের মনে, এমন-কি, হৃদয়ে নকলের বিষবীজ প্রবেশ করিতেছে। দেশের পক্ষে এমন বিপদ আর হইতেই পারে না।
এই মহাবিপদ হইতে উদ্ধারের জন্য একমাত্র দেশীয় রাজ্যের প্রতি আমরা তাকাইয়া আছি। এ কথা আমরা বলি না যে, বিদেশী সামগ্রী আমরা গ্রহণ করিব না। গ্রহণ করিতেই হইবে, কিন্তু দেশীয় আধারে গ্রহণ করিব। পরের অস্ত্র কিনিতে নিজের হাতখানা কাটিয়া ফেলিব না; একলব্যের মতো ধনুর্বিদ্যায় গুরুদক্ষিণাস্বরূপ নিজের দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুষ্ঠ দান করিব না। এ কথা মনে রাখিতেই হইবে, নিজের প্রকৃতিকে লঙ্ঘন করিলে দুর্বল হইতে হয়। ব্যাঘ্রের আহার্য পদার্থ বলকারক সন্দেহ নাই, কিন্তু হস্তী তাহার প্রতি লোভ করিলে নিশ্চিত মরিবে। আমরা লোভবশত প্রকৃতির প্রতি ব্যভিচার যেন না করি। আমাদের ধর্মে-কর্মে ভাবে-ভঙ্গিতে প্রত্যহই তাহা করিতেছি, এইজন্য আমাদের সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল হইয়া উঠিতেছে — আমরা কেবলই অকৃতকার্য এবং ভারাক্রান্ত হইয়া পড়িতেছি। বস্তুত জটিলতা আমাদের দেশের ধর্ম নহে। উপকরণের বিরলতা জীবনযাত্রার সরলতা আমাদের দেশের নিজস্ব — এইখানেই আমাদের বল, আমাদের প্রাণ, আমাদের প্রতিভা। আমাদের চণ্ডীমণ্ডপ হইতে বিলাতি কারখানাঘরের প্রভূত জঞ্জাল যদি ঝাঁট দিয়া না ফেলি, তবে দুই দিক হইতেই মরিব– অর্থাৎ বিলাতি কারখানাও এখানে চলিবে না, চণ্ডীমণ্ডপও বাসের অযোগ্য হইয়া উঠিবে।
আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে এই কারখানাঘরের ধূমধূলিপূর্ণ বায়ু দেশীয় রাজ্যব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে– সহজকে অকারণে জটিল করিয়া তুলিয়াছে, বাসস্থানকে নির্বাসন করিয়া দাঁড় করাইয়াছে। যাঁহারা ইংরেজের হাতে মানুষ হইয়াছেন তাঁহারা মনেই করিতে পারেন না যে, ইংরেজের সামগ্রীকে যদি লইতেই হয় তবে তাহাকে আপন করিতে না পারিলে তাহাতে অনিষ্টই ঘটে — এবং আপন করিবার একমাত্র উপায় তাহাকে নিজের প্রকৃতির অনুকূলে পরিণত করিয়া তোলা, তাহাকে যথাযথ না রাখা। খাদ্য যদি খাদ্যরূপেই বরাবর থাকিয়া যায় তবে তাহাতে পুষ্টি দূরে থাক, ব্যাধি ঘটে। বিলাতি সামগ্রী যখন আমাদের ভারতপ্রকৃতির দ্বারা জীর্ণ হইয়া তাহার আত্মরূপ ত্যাগ করিয়া আমাদের কলেবরের সহিত একাত্ম হইয়া যায় তখনই তাহা আমাদের লাভের বিষয় হইতে পারে– যতক্ষণ তাহার উৎকট বিদেশীয়ত্ব অবিকৃত থাকে ততক্ষণ তাহা লাভ নহে। বিলাতি সরস্বতীর পোষ্যপুত্রগণ এ কথা কোনোমতেই বুঝিতে পারেন না। পুষ্টিসাধনের দিকে তাঁহাদের দৃষ্টি নাই, বোঝাই করাকেই তাঁহারা পরমার্থ জ্ঞান করেন। এইজন্যই আমাদের দেশীয় রাজ্যগুলিও বিদেশী কার্যবিধির অসংগত অনাবশ্যক বিপুল জঞ্জাল জালে নিজের শক্তিকে অকারণে ক্লিষ্ট করিয়া তুলিতেছে। বিদেশী বোঝাকে যদি অনায়াসে গ্রহণ করিতে পারিতাম, যদি তাহাকে বোঝার মতো না দেখিতে হইত, রাজ্য যদি একটা আপিসমাত্র হইয়া উঠিবার চেষ্টায় প্রতিমুহূর্তে ঘর্মাক্তকলেবর হইয়া না উঠিত, যাহা সজীব হৃৎপিণ্ডের নাড়ির সহিত সম্বন্ধযুক্ত ছিল তাহাকে যদি কলের পাইপের সহিত সংযুক্ত করা না হইত, তাহা হইলে আপত্তি করিবার কিছু ছিল না। আমাদের দেশের রাজ্য কেরানিচালিত বিপুল কারখানা নহে, নির্ভুল নির্বিকার এঞ্জিন নহে– তাহার বিচিত্র সম্বন্ধসূত্রগুলি লৌহদণ্ড নহে, তাহা হৃদয়তন্তু — রাজলক্ষ্মী প্রতিমুহূর্তে তাহার কর্মের শুষ্কতার মধ্যে রসসঞ্চার করেন, কঠিনকে কোমল করেন, তুচ্ছকে সৌন্দর্যে মণ্ডিত করিয়া দেন, দেনাপাওনার ব্যাপারকে কল্যাণের কান্তিতে উজ্জ্বল করিয়া তোলেন এবং ভুলত্রুটিকে ক্ষমার অশ্রুজলে মার্জনা করিয়া থাকেন। আমাদের মন্দভাগ্য আমাদের দেশীয় রাজ্যগুলিকে বিদেশী আপিসের ছাঁচের মধ্যে ঢালিয়া তাহাদিগকে কলরূপে বানাইয়া না তোলে, এই-সকল স্থানেই আমরা স্বদেশলক্ষ্মীর স্তন্যসিক্ত স্নিগ্ধ বক্ষঃস্থলের সজীব কোমল মাতৃস্পর্শ লাভ করিয়া যাইতে পারি– এই আমাদের কামনা। মা যেন এখানেও কেবল কতকগুলো ছাপমারা লেফাফার মধ্যে আচ্ছন্ন হইয়া না থাকেন– দেশের ভাষা, দেশের সাহিত্য, দেশের শিল্প, দেশের রুচি, দেশের কান্তি এখানে যেন মাতৃকক্ষে আশ্রয়লাভ করে এবং দেশের শক্তি মেঘমুক্ত পূর্ণচন্দ্রের মতো আপনাকে অতি সহজে অতি সুন্দরভাবে প্রকাশ করিতে পারে।
শ্রাবণ ১৩১২