সপ্তম পরিচ্ছেদ
ব্রজেশ্বর কিয়ৎক্ষণ বিহ্বল হইয়া রহিল। শেষে জিজ্ঞাসা করিল, “সাগর! তুমি এখানে কেন?” সাগর বলিল, “সাগরের স্বামী! তুমিই বা এখানে কেন?”
ব্র। তাই কি? আমি কয়েদী, তুমিও কি কয়েদী? আমাকে ধরিয়া আনিয়াছে। তোমাকেও কি ধরিয়া আনিয়াছে?
সাগর। আমি কয়েদী নই, আমাকে কেহ ধরিয়া আনে নাই। আমি ইচ্ছাক্রমে দেবী রাণীর সাহায্য লইয়াছি। তোমাকে দিয়া আমার পা টিপাইব বলিয়া দেবী রাণীর রাজ্যে বাস করিতেছি।
তখন নিশি আসিল। ব্রজেশ্বর তাহার বস্ত্রালঙ্কারের জাঁকজমক দেখিয়া মনে করিল, “এই দেবী চৌধুরাণী”। ব্রজেশ্বর সম্ভ্রম রাখিবার জন্য উঠিয়া দাঁড়াইল। নিশি বলিল, “স্ত্রীলোক ডাকাইত হইলেও তাহার অত সম্মান করিতে নাই–আপনি বসুন। এখন শুনিলেন, কেন আপনার বজরায় আমরা ডাকাইতি করিয়াছি? এখন সাগরের পণ উদ্ধার হইয়াছে; এখন আপনাতে আর আমাদের প্রয়োজন নাই, আপনি আপনার নৌকায় ফিরিয়া যাইলে কেহ আটক করিবে না। আপনার জিনিসপত্র এক কপর্দক কেহ লইবে না, সব আপনার বজরায় ফিরিয়া পাঠাইয়া দিতেছি। কিন্তু এই একটা কপর্দক–এই পোড়ারমুখী সাগর, ইহার কি হইবে? এ কি বাপের বাড়ী ফিরিয়া যাইবে? ইহাকে আপনি লইয়া যাইবেন কি? মনে করুন, আপনি উহার এক কড়ার কেনা গোলাম।”
বিস্ময়ের উপর বিস্ময়! ব্রজেশ্বর বিহ্বল হইল। তবে ডাকাইতি সব মিথ্যা, এরা ডাকাইত নয়! ব্রজেশ্বর ক্ষণেক ভাবিল, ভাবিয়া শেষে বলিল, “তোমরা আমায় বোকা বানাইলে। আমি মনে করিয়াছিলাম, দেবী চৌধুরাণীর দলে আমার বজরায় ডাকাইতি করিয়াছে।”
তখন নিশি বলিল, “সত্যসত্যই দেবী চৌধুরাণীর এই বজরা। দেবী রাণী সত্যসত্যই ডাকাইতি করেন”,–কথা শেষ হইতে না হইতেই ব্রজেশ্বর বলিল, “দেবী রাণী সত্যসত্যই ডাকাইতি করেন–তবে আপনি কি দেবী রাণী নন?”
নি। আমি দেবী নই। আপনি যদি রাণীজিকে দেখিতে চান, তিনি দর্শন দিলেও দিতে পারেন। কিন্তু যা বলিতেছিলাম, তা আগে শুনুন। আমরা সত্য সত্যই ডাকাইতি করি, কিন্তু আপনার উপর ডাকাইতি করিবার আর কোন উদ্দেশ্য নাই, কেবল সাগরের প্রতিজ্ঞা রক্ষা। এখন সাগর বাড়ী যায় কি প্রকারে? প্রতিজ্ঞা ত রক্ষা হইল।
ব্র। আসিল কি প্রকারে?
নি। রাণীজির সঙ্গে।
ব্র। আমিও ত সাগরের পিত্রালয়ে গিয়াছিলাম–সেখান হইতেই আসিতেছি। কই, সেখানে ত রাণীজিকে দেখি নাই?
নি। রাণীজি আপনার পরে সেখানে গিয়াছিলেন।
ব্র। তবে ইহার মধ্যে এখানে আসিলেন কি প্রকারে?
নি। আমাদের ছিপ দেখিয়াছেন ত? পঞ্চাশ বোটে।
ব্র। তবে আপনারাই কেন ছিপে করিয়া সাগরকে রাখিয়া আসুন না?
নি। তাতে একটু বাধা আছে। সাগর কাহাকে না বলিয়া রাণীর সঙ্গে আসিয়াছে–এজন্য অন্য লোকের সঙ্গে ফিরিয়া গেলে, সবাই জিজ্ঞাসা করিবে, কোথায় গিয়াছিলে? আপনার সঙ্গে ফিরিয়া গেলে উত্তরের ভাবনা নাই।
ব্র। ভাল, তাই হইবে। আপনি অনুগ্রহ করিয়া ছিপ হুকুম করিয়া দিন।
“দিতেছি” বলিয়া নিশি সেখান হইতে সরিয়া গেল।
তখন সাগরকে নির্জনে পাইয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “সাগর! তুমি কেন এমন প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে?”
মুখে অঞ্চল দিয়া–এবার ঢাকাই রুমাল নহে–কাপড়ের যেখানটা হাতে উঠিল, সেইখানটা মুখে ঢাকা দিয়া সাগর কাঁদিল–সেই মুখরা সাগর টিপিয়া টিপিয়া, কাঁপিয়া কাঁপিয়া চুপি চুপি ভারি কান্না কাঁদিল। চুপি চুপি–পাছে দেবী শোনে।
কান্না থামিলে ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “সাগর! তুমি আমায় ডাকিলে না কেন? ডাকিলেই সব মিটিয়া যাইত।”
সাগর কষ্টে রোদন সংবরণ করিয়া, চক্ষু মুছিয়া বলিল, “কপালের ভোগ, কিন্তু আমি নাই ডাকিয়াছি–তুমিই বা আসিলে না কেন?”
ব্র। তুমি আমায় তাড়াইয়া দিয়াছিলে –না ডাকিলে যাই কি বলিয়া?
এই সকল কথাবার্তা যথাশাস্ত্র সমাপন হইলে ব্রজেশ্বর বলিল, “সাগর! তুমি ডাকাইতের সঙ্গে কেন আসিলে?”
সাগর বলিল, “দেবী–সম্বন্ধে আমার ভগিনী হয়, পূর্বে জানাশুনা ছিল। তুমি চলিয়া আসিলে, সে গিয়া আমার বাপের বাড়ী উপস্থিত হইল। আমি কাঁদিতেছি দেখিয়া সে বলিল, কাঁদ কেন ভাই–তোমার শ্যামচাঁদকে আমি বেঁধে এনে দিব। আমার সঙ্গে দুই দিনের তরে এসো।’ তাই আমি আসিলাম। দেবীকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিবার আমার বিশেষ কারণ আছে। তোমার সঙ্গে আমি পলাইয়া চলিলাম, এই কথা আমি চাকরাণীকে বলিয়া আসিয়াছি। তোমার জন্য এই সব আলবোলা, সট্কাা প্রভৃতি সাজাইয়া রাখিয়াছি–একবার তামাক-টামাক খাও, তার পর যেও।”
ব্রজেশ্বর বলিলেন, “কই, যে মালিক, সে ত কিছু বলে না।”
নিশিকে দেখিয়া ব্রজেশ্বর বলিল, “এখন আপনি ছিপ হুকুম করিলেই যাই।”
নি। ছিপ তোমারই। কিন্তু দেখ, তুমি রাণীর বোনাই–কুটুম্বকে স্বস্থানে পাইয়া আমরা আদর করিলাম না–কেবল অপমানই করিলাম, এ বড় দুঃখ থাকে। আমরা ডাকাইত বলিয়া আমাদের কি হিন্দুয়ানি নাই?
ব্র। কি করিতে বলেন?
নি। প্রথমে উঠিয়া ভাল হইয়া বসো।
নিশি মসনদ দেখাইয়া দিল। ব্রজেশ্বর শুধু গালিচায় বসিয়াছিল। বলিল, “কেন আমি বেশ বসিয়া আছি।”
তখন নিশি সাগরকে বলিল, “ভাই তোমার সামগ্রী তুমি তুলিয়া বসাও। জান, আমরা পরের দ্রব্য ছুঁই না।” হাসিয়া বলিল, “সোণা রূপা ছাড়া।”
ব্র। তবে আমি কি পিতল-কাঁসার দলে পড়িলাম।
নিশি। আমি ত তা মনে করি–পুরুষমানুষ স্ত্রীলোকের তৈজসের মধ্যে। না থাকিলে ঘর-সংসার চলে না–তাই রাখিতে হয়। কথায় কথায় সকড়ি হয়–মাজিয়া ঘষিয়া ধুইয়া ঘরে তুলিতে নিত্য প্রাণ বহিয়া যায়। নে ভাই সাগর, তোর ঘটি-বাটি তফাৎ কর–কি জানি, যদি সকড়ি হয়।
ব্র। একে ত পিতল কাঁসা–তার মধ্যে আবার ঘটি বাটি! ঘড়াটা গাড়ুটার মধ্যে গণ্য হইবারও যোগ্য নই?
নি। আমি ভাই বৈষ্ণবী, তৈজসের ধার ধারি না–আমাদের দৌড় মালসা পর্যন্ত। তৈজসের খবর সাগরকে জিজ্ঞাসা কর।
সা। আমি ঠিক কথা জানি। পুরুষমানুষ তৈজসের মধ্যে কলসী। সদাই অন্তঃশূন্য– আমরা যাই গুণবতী, তাই জল পুরিয়া পূর্ণকুম্ভ করিয়া রাখি।
নিশি বলিল, “ঠিক বলিয়াছিস–তাই মেয়েমানুষে এ জিনিস গলায় বাঁধিয়া সংসার-সমুদ্রে ডুবিয়া মরে।-নে ভাই, তোর কলসী, কলসী পিঁড়ির উপর তুলিয়া রাখ।”
ব্র। কলসী মানে মানে আপনি পিঁড়ির উপর উঠিতেছে।
এই কথা বলিয়া ব্রজেশ্বর আপনি মসনদের উপর উঠিয়া বসিল। হঠাৎ দুই দিক হইতে দুই জন পরিচারিকা–সুন্দরী যুবতী, বহুমূল্য বসন-ভূষণ-ভূষিতা–দুইটা সোণাবাঁধা চামর হাতে করিয়া, ব্রজেশ্বরের দুই পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইল। আজ্ঞা না পাইয়াও তাহারা ব্যজন করিতে লাগিল। নিশি তখন সাগরকে বলিল, “যা, এখন তোর স্বামীর জন্য আপন হাতে তামাকু সাজিয়া লইয়া আয়।”
সাগর ক্ষিপ্রহস্তে সোণার আলবোলার উপর হইতে কলিকা লইয়া গিয়া, শীঘ্র মৃগনাভি-সুগন্ধি তামাকু সাজিয়া আনিল। আলবোলায় চড়াইয়া দিল। ব্রজেশ্বর বলিলেন, “আমাকে একটা হুঁকায় নল করিয়া তামাকু দাও।”
নিশি বলিল, “কোন শঙ্কা নাই–ঐ আলবোলা উৎসৃষ্ট নয়। কেহ কখন উহাতে তামাকু খায় নাই। আমরা কেহ তামাকু খাই না।”
ব্র। সে কি? তবে এ আলবোলা কেন?
নি। দেবীর রাণীগিরির দোকানদারি–
ব্র। তা হৌক–আমি যখন আসিলাম, তখন যে তামাকু সাজা ছিল–কে খাইতেছিল?
নি। কেহ না–সাজাও দোকানদারি–
ঐ আলবোলা সেই দিন বাহির হইয়াছে–ঐ তামাকু সেই দিন কেনা হইয়া আসিয়াছে–সাগরের স্বামী আসিবে বলিয়া। ব্রজেশ্বর মুখনলটি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন–অভুক্ত বোধ হয়। তখন ব্রজেশ্বর ধূমপানের অনির্বচনীয় সুখে মগ্ন হইলেন। নিশি তখন সাগরকে বলিল, “তুই পোড়ারমুখী, আর দাঁড়াইয়া কি করিস–পুরুষমানুষে হুঁকার নল মুখে করিলে আর কি স্ত্রী পরিবারকে মনে ঠাঁই দেয়? যা, তুই গোটাকত পান সাজিয়া আন। দেখিস–আপন হাতে পান সাজিয়া আনিস–পরের সাজা আনিস না–পারিস যদি একটু ওষুধ করিস।”
সাগর বলিল, “আপন হাতেই সাজা আছে–ওষুধ জানিলে আমার এমন দশা হইবে কেন?”
এই বলিয়া সাগর চন্দন কর্পূর চুয়া গোলাপে সুগন্ধি পানের রাশি সোণার বাটা পুরিয়া আনিল। তখন নিশি বলিল, “তোর স্বামীকে অনেক বকেছিস–কিছু জলখাবার নিয়ে আয়।”
ব্রজেশ্বরের মুখ শুকাইল, “সর্বনাশ! এত রাত্রে জলখাবার! ঐটি মাফ করিও।”
কিন্তু কেহ তাহার কথা শুনিল না–সাগর বড় তাড়াতাড়ি আর এক কামরায় ঝাঁট দিয়া, জলের হাত মুছিয়া, একখানা বড় ভারি পুরু আসন পাতিয়া চারি-পাঁচখানা রূপার থালে সামগ্রী সাজাইয়া ফেলিল। স্বর্ণ-পাত্রে উত্তম সুগন্ধি শীতল জল রাখিয়া দিল। জানিতে পারিয়া নিশি ব্রজেশ্বরকে বলিল, “ঠাঁই হইয়াছে–উঠ।” ব্রজেশ্বর উঁকি মারিয়া দেখিয়া, নিশির কাছে জোড়হাত করিল। বলিল, “ডাকাইতি করিয়া ধরিয়া আনিয়া কয়েদ করিয়াছ–সে অত্যাচার সহিয়াছে–কিন্তু এত রাত্রে এ অত্যাচার সহিবে না–দোহাই।”
স্ত্রীলোকেরা মার্জনা করিল না। ব্রজেশ্বর অগত্যা কিছু খাইল। সাগর তখন নিশিকে বলিল, “ব্রাহ্মণ ভোজন করাইলে কিছু দক্ষিণা দিতে হয়।” নিশি বলিল, “দক্ষিণা রাণী স্বয়ং দিবেন। এসো ভাই, রাণী দেখিবে এসো।” এই বলিয়া নিশি ব্রজেশ্বরকে আর এক কামরায় সঙ্গে করিয়া লইয়া গেল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
নিশি ব্রজেশ্বরকে সঙ্গে করিয়া দেবীর শয্যাগৃহে লইয়া গেল। ব্রজেশ্বর দেখিলেন, শয়নঘর দরবার কামরার মত অপূর্ব সজ্জায় সজ্জিত। বেশীর ভাগ, একখানা সুবর্ণমণ্ডিত মুক্তার ঝালরযুক্ত ক্ষুদ্র পালঙ্ক আছে। কিন্তু ব্রজেশ্বরের সে সকল দিকে চক্ষু ছিল না। এত ঐশ্বর্যের অধিকারিণী প্রথিতনাম্নী দেবীকে দেখিবেন। দেখিলেন, কামরার ভিতর অনাবৃত কাষ্ঠের উপর বসিয়া, অর্ধাবগুণ্ঠনবতী একটি স্ত্রীলোক। নিশি ও সাগরে, ব্রজেশ্বর যে চাঞ্চল্যময়তা দেখিয়াছিলেন, ইহাতে তাহার কিছুই নাই। এ স্থিরা, ধীরা–নিম্নদৃষ্টি, লজ্জাবনতমুখী। নিশি ও সাগর, বিশেষতঃ নিশি সর্বাঙ্গে রত্নালঙ্কারমণ্ডিতা, বহুমূল্য বসনে আবৃতা, –কিন্তু ইহার তা কিছুই নাই। দেবী ব্রজেশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাতের ভরসায় বহুমূল্য বস্ত্রালঙ্কারে ভূষিতা হইয়াছিলেন, ইহা আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি। কিন্তু সাক্ষাতের সময় উপস্থিত হইলে, দেবী সে সকলই ত্যাগ করিয়া সামান্য বস্ত্র পরিয়া, হাতে কেবল একখানি মাত্র সামান্য অলঙ্কার রাখিয়া ব্রজেশ্বরের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। প্রথমে নিশির বুদ্ধিতে দেবী ভ্রমে পড়িয়াছিল; শেষে বুঝিতে পারিয়া আপনা আপনি তিরস্কার করিয়াছিল; “ছি! ছি! ছি! কি করিয়াছি! ঐশ্বর্যের ফাঁদ পাতিয়াছি!” তাই এ বেশ পরিবর্তন।
ব্রজেশ্বরকে পৌঁছাইয়া দিয়া নিশি চলিয়া গেল। ব্রজেশ্বর প্রবেশ করিলে, দেবী গাত্রোত্থান করিয়া ব্রজেশ্বরকে প্রণাম করিলেন। দেখিয়া ব্রজেশ্বর আরও বিস্মিত হইল–কই, আর কেহ ত প্রণাম করে নাই? দেবী তখন ব্রজেশ্বরের সম্মুখে দাঁড়াইল–ব্রজেশ্বর দেখিল, যথার্থ দেবীমূর্তি! এমন আর কখন দেখিয়াছে কি? হ্যাঁ, ব্রজ আর একবার এমনই দেখিয়াছিল। সে আরও মধুর, –কেন না, দেবীমূর্তি তখন বালিকার মূর্তি–ব্রজেশ্বরের তখন প্রথম যৌবন। হায়! এ যদি সেই হইত! এ মুখ দেখিয়া, ব্রজেশ্বরের সে মুখ মনে পড়িল, কিন্তু দেখিলেন, এ মুখ সে মুখ নহে। তার কি কিছুই এতে নাই? আছে বৈ কি–কিছু আছে। ব্রজেশ্বর তাই অবাক হইয়া দেখিতে লাগিল। সে ত অনেক দিন মরিয়া গিয়াছে–তবে মানুষে মানুষে কখন কখন এমন সাদৃশ্য থাকে যে, একজনকে দেখিলে আর একজনকে মনে পড়ে। এ তাই না ব্রজ?
ব্রজ তাই মনে করিল। কিন্তু সেই সাদৃশ্যেই হৃদয় ভরিয়া গেল–ব্রজের চক্ষে জল আসিল, পড়িল না। তাই দেবী সে জল দেখিতে পাইল না। দেখিতে পাইলে আজ একটা কাণ্ডকারখানা হইয়া যাইত। দুইখানা মেঘেই বৈদ্যুতি ভরা।
প্রণাম করিয়া, নিম্ননয়নে দেবী বলিতে লাগিল, “আমি আপনাকে আজ জোর করিয়া ধরিয়া আনিয়া বড় কষ্ট দিয়াছি। কেন এমন কুকর্ম করিয়াছি, শুনিয়াছেন। আমার অপরাধ লইবেন না।”
ব্রজেশ্বর বলিলেন, “আমার উপকারই করিয়াছেন।” বেশী কথা বলিবার ব্রজেশ্বরের শক্তি নাই।
দেবী আরও বলিল, “আপনি আমার এখানে দয়া করিয়া জলগ্রহণ করিয়াছেন, তাহাতে আমার বড় মর্যাদা বাড়িয়াছে। আপনি কুলীন–আপনারও মর্যাদা রাখা আমার কর্তব্য। আপনি আমার কুটুম্ব। যাহা মর্যাদাস্বরূপ আমি আপনাকে দিতেছি, তাহা গ্রহণ করুন।”
ব্র। স্ত্রীর মত কোন্ ধন? আপনি তাই আমাকে দিয়াছেন। ইহার বেশী আর কি দিবেন?
ও ব্রজেশ্বর! কি বলিলে? স্ত্রীর মত ধন আর নাই? তবে বাপ-বেটায় মিলিয়া প্রফুল্লকে তাড়াইয়া দিয়াছিলে কেন?
পালঙ্কের পাশে একটা রূপার কলসী ছিল–তাহা টানিয়া বাহির করিয়া, দেবী ব্রজেশ্বরের নিকটে রাখিল, বলিল, “ইহাই গ্রহণ করিতে হইবে।”
ব্র। আপনার বজরায় এত সোণা-রূপার ছড়াছড়ি যে, এই কলসীটা নিতে আপত্তি করিলে, সাগর আমায় বকিবে। কিন্তু একটা কথা আছে–
কথাটা কি–দেবী বুঝিল, বলিল, “আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, এ চুরি ডাকাইতির নহে। আমার নিজের কিছু সঙ্গতি আছে–শুনিয়া থাকিবেন। অতএব গ্রহণপক্ষে কোন সংশয় করিবেন না।”
ব্রজেশ্বর সম্মত হইল–কুলীনের ছেলের আর অধ্যাপক ভট্টাচার্যের “বিদায়” বা “মর্যাদা” গ্রহণে লজ্জা ছিল না–এখনও বোধ হয় নাই। কলসীটা বড় ভারী ঠেকিল, ব্রজেশ্বর সহজে তুলিতে পারিলেন না। বলিলেন, “এ কি এ? কলসীটা নিরেট না কি?”
দেবী। টানিবার সময় উহার ভিতর শব্দ হইয়াছেল–নিরেট সম্ভবে না।
ব্র। তাই ত? এতে কি আছে?
কলসীতে ব্রজেশ্বর হাত পুরিয়া তুলিল–মোহর। কলসী মোহরে পরিপূর্ণ।
ব্র। এগুলি কিসে ঢালিয়া রাখিব?
দেবী। ঢালিয়া রাখিবেন কেন? এগুলি সমস্তই আপনাকে দিয়াছি।
ব্র। কি?
দেবী। কেন?
ব্র। কত মোহর আছে?
দেবী। তেত্রিশ শ।
ব্র। তেত্রিশ শ মোহরে পঞ্চাশ হাজার টাকার উপর। সাগর আপনাকে টাকার কথা বলিয়াছে?
দেবী। সাগরের মুখে শুনিয়াছি, আপনার পঞ্চাশ হাজার টাকার বিশেষ প্রয়োজন।
ব্র। তাই দিতেছেন?
দেবী। টাকা আমার নহে, আমার দান করিবার অধিকার নাই। টাকা দেবতার, দেবত্র আমার জিম্মা। আমি আমার দেবত্র সম্পত্তি হইতে আপনাকে এই টাকা কর্জ দিতেছি।
ব্র। আমার এ টাকার প্রয়োজন পড়িয়াছে–বোধ হয়, চুরি-ডাকাতি করিয়াও যদি আমি এ টাকা সংগ্রহ করি, তাহা হইলেও অধর্ম হয় না; কেন না, এ টাকা নহিলে আমার বাপের জাতি রক্ষা হয় না। আমি এ টাকা লইব। কিন্তু কবে পরিশোধ করিতে হইবে?
দেবী। দেবতার সম্পত্তি, দেবতা পাইলেই হইল। আমার মৃত্যুসংবাদ শুনিলে পর ঐ টাকার আসল আর এক মোহর সুদ দেবসেবায় ব্যয় করিবেন।
ব্র। সে আমারই ব্যয় করা হইবে। সে আপনাকে ফাঁকি দেওয়া হইবে। আমি ইহাতে স্বীকৃত নহি।
দেবী। আপনার যেরূপ ইচ্ছা, সেইরূপে পরিশোধ করিবেন।
ব্র। আমার টাকা জুটিলে আপনাকে পাঠাইয়া দিব।
দেবী। আপনার লোক কেহ আমার কাছে আসিবে না, আসিতেও পারিবে না।
ব্র। আমি নিজে টাকা লইয়া আসিব।
দেবী। কোথায় আসিবেন? আমি এক স্থানে থাকি না।
ব্র। যেখানে বলিয়া দিবেন।
দেবী। দিন ঠিক করিয়া বলিলে, আমি স্থান ঠিক করিয়া বলিতে পারি।
ব্র। আমি মাঘ ফাল্গুনে টাকা সংগ্রহ করিতে পারিব। কিন্তু একটু বেশী করিয়া সময় লওয়া ভাল। বৈশাখ মাসে টাকা দিব।
দেবী। তবে বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমীর রাত্রে এই ঘাটেই টাকা আনিবেন। সপ্তমীর চন্দ্রাস্ত পর্যন্ত এখানে থাকিব। সপ্তমীর চন্দ্রাস্তের পর আসিলে আমার দেখা পাইবেন না।
ব্রজেশ্বর স্বীকৃত হইলেন। তখন দেবী পরিচারিকাদিগকে আজ্ঞা দিলেন, মোহরের ঘড়া ছিপে উঠাইয়া দিয়া আইসে। পরিচারিকারা ঘড়া ছিপে লইয়া গেল। ব্রজেশ্বরও দেবীকে আশীর্বাদ করিয়া ছিপে যাইতেছিলেন। তখন দেবী নিষেধ করিয়া বলিলেন, “আর একটা কথা বাকি আছে। এ ত কর্জ দিলাম–মর্যাদা দিলাম কই?”
ব্র। কলসীটা মর্যাদা।
দেবী। আপনার যোগ্য মর্যাদা নহে। যথাসাধ্য মর্যাদা রাখিব।
এই বলিয়া দেবী আপনার আঙ্গুল হইতে একটি আঙ্গটি খুলিল। ব্রজেশ্বর তাহা গ্রহণ করিবার জন্য সহাস্য বদনে হাত পাতিলেন। দেবী হাতের উপর আঙ্গটি ফেলিয়া দিল না–ব্রজেশ্বরের হাতখানি ধরিল–আপনি আঙ্গটি পরাইয়া দিবে।
ব্রজেশ্বর জিতেন্দ্রিয়, কিন্তু মনের ভিতর কি একটা গোলমাল হইয়া গেল, জিতেন্দ্রিয় ব্রজেশ্বর তাহা বুঝিতে পারিল না। শরীরে কাঁটা দিল–ভিতরে যেন অমৃতস্রোত ছুটিল। জিতেন্দ্রিয় ব্রজেশ্বর, হাতটা সরাইয়া লইতে ভুলিয়া গেল। বিধাতা এক এক সময়ে বাদ সাধেন যে, সময়ে আপন কাজ ভুলিয়া যাইতে হয়।
তা, দেবী সেই মানসিক গোলযোগের সময় ব্রজেশ্বরের আঙ্গুলে ধীরে ধীরে আঙ্গটি পরাইতে লাগিলেন। সেই সময়ে ফোঁটা দুই তপ্ত জল ব্রজেশ্বরের হাতের উপর পড়িল। ব্রজেশ্বর দেখিলেন, দেবীর মুখ চোখের জলে ভাসিয়া যাইতেছে। কি রকমে কি হইল, বলিতে পারি না, ব্রজেশ্বর ত জিতেন্দ্রিয়–কিন্তু মনের ভিতর কি একটা গোল বাধিয়াছিল–সেই আর একখানা মুখ মনে পড়িল; এই সেই এই, কি এমনই একটা গোলমাল বাধিয়া গেল। ব্রজেশ্বর কিছু না বুঝিয়া–কেন জানি না–দেবীর কাঁধে হাত রাখিল, অপর হাতে ধরিয়া মুখখানি তুলিয়া ধরিল–বুঝি মুখখানা প্রফুল্লের মত দেখিল। বিবশ বিহ্বল হইয়া সেই অশ্রুনিষিক্ত বিম্বাধরে–আ ছি ছি! ব্রজেশ্বর! আবার!
তখন ব্রজেশ্বরের মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কি করিলাম! এ কি প্রফুল্ল? সে যে দশ বৎসর মরিয়াছে! ব্রজেশ্বর ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিয়া একেবার ছিপে গিয়ে উঠিল। সাগরকে সঙ্গে লইয়াও গেল না। সাগর “ধর! ধর! আসামী পলায়!” বলিয়া, পিছু পিছু ছুটিয়া গিয়া ছিপে উঠিল। ছিপ খুলিয়া ব্রজেশ্বরকে ও ব্রজেশ্বরের দুই রত্নাধার–একটি সাগর আর একটি কলসী–ব্রজেশ্বরের নৌকায় পৌঁছাইয়া দিল।
এদিকে নিশি আসিয়া দেবীর শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখিল, দেবী নৌকার তক্তার উপর লুটাইয়া পড়িয়া কাঁদিতেছে। নিশি তাহাকে উঠাইয়া বসাইল–চোখের জল মুছাইয়া দিল– সুস্থির করিল। তখন নিশি বলিল, “এই কি মা, তোমার নিষ্কাম ধর্ম? এই কি সন্ন্যাস? ভগবদ্বাক্য কোথায় মা, এখন?”
দেবী চুপ করিয়া রহিল। নিশি বলিল, “ও সকল ব্রত মেয়েমানুষের নহে। যদি মেয়েকে ও পথে যেতে হয়, তবে আমার মত হইতে হইবে। আমাকে কাঁদাইবার জন্য ব্রজেশ্বর নাই। আমার ব্রজেশ্বর বৈকুণ্ঠেশ্বর একই।”
দেবী চক্ষু মুছিয়া বলিল, “তুমি যমের বাড়ী যাও।”
নি। আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমার উপর যমের অধিকার নাই। তুমি সন্ন্যাস ত্যাগ করিয়া ঘরে যাও।
দেবী। সে পথ খোলা থাকিলে আমি এ পথে আসিতাম না। এখন বজরা খুলিয়া দিতে। চার পাল উঠাও।
তখন সেই জাহাজের মত বজরা চারিখান তুলিয়া পক্ষিণীর মত উড়িয়া গেল।
নবম পরিচ্ছেদ
ব্রজেশ্বর আপনার নৌকায় আসিয়া গম্ভীর হইয়া বসিল। সাগরের সঙ্গে কথা কহে না। দেখিল, দেবীর বজরা পাল তুলিয়া পক্ষিণীর মত উড়িয়া গেল। তখন ব্রজেশ্বর সাগরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বজরা কোথায় গেল?”
সাগর বলিল, “তা দেবী ভিন্ন আর কেহ জানে না। সে সকল কথা দেবী আর কাহাকেও বলে না।”
ব্র। দেবী কে?
সা। দেবী দেবী।
ব্র। তোমার কে হয়?
সা। ভগিনী।
ব্র। কি রকম ভগিনী?
সা। জ্ঞাতি।
ব্রজেশ্বর আবার চুপ করিল। মাঝিদিগকে ডাকিয়া বলিল, “তোমরা বড় বজরার সঙ্গে যাইতে পার?” মাঝিরা বলিল, “সাধ্য কি! ও নক্ষত্রের মত ছুটিয়াছে।” ব্রজেশ্বর আবার চুপ করিল। সাগর ঘুমাইয়া পড়িল।
প্রভাত হইল, ব্রজেশ্বর বজরা খুলিয়া চলিল।
সূর্যোদয় হইলে সাগর আসিয়া ব্রজেশ্বরের কাছে বসিল। ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “দেবী কি ডাকাতি করে?”
সা। তোমার কি বোধ হয়?
ব্র। ডাকাতির সমান ত সব দেখিলাম–ডাকাতি করিলে করিতে পারে, তাও দেখিলাম। তবু বিশ্বাস হয় না যে, ডাকাতি করে।
সা। তবু কেন বিশ্বাস হয় না?
ব্র। কে জানে। ডাকাতি না করিলেই বা এত ধন কোথায় পাইল?
সা। কেহ বলে, দেবী দেবতার বরে এত ধন পাইয়াছে; কেহ বলে, মাটির ভিতর পোঁতা টাকা পাইয়াছে; কেহ বলে, দেবী সোণা করিতে জানে।
ব্র। দেবী কি বলে?
সা। দেবী বলে, এক কড়াও আমার নয়, সব পরের।
ব্র। পরের ধন এত পাইল কোথায়?
সা। তা কি জানি।
ব্র। পরের ধন হলে অত আমিরি করে? পরে কিছু বলে না?
সা। দেবী কিছু আমিরি করে না। খুদ খায়, মাটিতে শোয়, গড়া পরে। কাল যা দেখলে, সে সকল তোমার আমার জন্য মাত্র, –কেবল দোকানদারি। তোমার হাতে ও কি?
সাগর ব্রজেশ্বরের আঙ্গুলে নূতন আঙ্গটি দেখিল।
ব্রজেশ্বর বলিল, “কাল দেবীর নৌকায় জলযোগ করিয়াছিলাম বলিয়া দেবী আমাকে এই আঙ্গটি মর্যাদা দিয়াছে।”
সা। দেখি।
ব্রজেশ্বর আঙ্গটি খুলিয়া দেখিতে দিল। সাগর হাতে লইয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দেখিল। বলিল, “ইহাতে দেবী চৌধুরাণীর নাম লেখা আছে।”
ব্র। কই?
সা। ভিতরে–ফারসীতে।
ব্র। (পড়িয়া) এ কি এ? এ যে আমার নাম–আমার আঙ্গটি? সাগর! তোমাকে আমার দিব্য, যদি তুমি আমার কাছে সত্য কথা কও না কও। আমায় বল, দেবী কে?
সা। তুমি চিনিতে পার নাই, সে কি আমার দোষ? আমি ত এক দণ্ডে চিনিয়াছিলাম।
ব্র। কে! কে! দেবী কে?
সা। প্রফুল্ল।
আর ব্রজেশ্বর কথা কহিল না। সাগর দেখিল, প্রথমে ব্রজেশ্বরের শরীরে কাঁটা দিয়া উঠিল, তার পর একটা অনির্বচনীয় আহ্লাদের চিহ্ন–উচ্ছলিত সুখের তরঙ্গ শরীরে দেখা দিল। মুখ প্রভাময়, নয়ন উজ্জ্বল অথচ জলপ্লাবিত, দেহ উন্নত, কান্তি স্ফূর্তিময়ী। তার পরই আবার সাগর দেখিল, সব যেন নিবিয়া গেল; বড় ঘোরতর বিষাদ আসিয়া যেন সেই প্রভাময় কান্তি অধিকার করিল। ব্রজেশ্বর বাক্যশূন্য, স্পন্দনহীন, নিমেষশূন্য। ক্রমে সাগরের মুখপানে চাহিয়া চাহিয়া ব্রজেশ্বর চক্ষু মুদিল। দেহ অবসন্ন হইল; ব্রজেশ্বর সাগরের কোলে মাথা রাখিয়া শুইয়া পড়িল। সাগর কাতর হইয়া অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিল। কিছুই উত্তর পাইল না; একবার ব্রজেশ্বর বলিল, “প্রফুল্ল ডাকাত! ছি!”
দশম পরিচ্ছেদ
ব্রজেশ্বর ও সাগরকে বিদায় দিয়া দেবী চৌধুরাণী–হায়! কোথায় গেল দেবী? কই সে বেশভূষা, ঢাকাই সাড়ি, সোণাদানা, হীরা মুক্তা পান্না–সব কোথায় গেল? দেবী সব ছাড়িয়াছে–সব একেবারে অন্তর্ধান করিয়াছে। দেবী কেবল একখানা গড়া পরিয়াছে–হাতে কেবল এক গাছা কড়। দেবী নৌকার এক পাশে বজরার শুধু তক্তার উপর একখানা চট পাতিয়া শয়ন করিল। ঘুমাইল কি না, জানি না।
প্রভাতে বজরা বাঞ্ছিত স্থানে আসিয়া লাগিয়াছে দেখিয়া, দেবী নদীর জলে নামিয়া স্নান করিল। স্নান করিয়া ভিজা কাপড়েই রহিল–সেই চটের মত মোটা সাড়ি। কপাল ও বুক গঙ্গামৃত্তিকায় চর্চিত করিল–রুক্ষ, ভিজা চুল এলাইয়া দিল–তখন দেবীর যে সৌন্দর্য বাহির হইল, গত রাত্রির বেশভূষা, জাঁকজমক, হীরা মতি চাঁদনি বা রাণীগিরিতে তাহা দেখা যায় নাই। কাল দেবীকে রত্নাভরণে রাজরাণীর মত দেখাইয়াছিল–আজ গঙ্গামৃত্তিকার সজ্জায় দেবতার মত দেখাইতেছে। যে সুন্দর, সে মাটি ছাড়িয়া হীরা পরে কেন?
দেবী এই অনুপম বেশে একজন মাত্র স্ত্রীলোক সমভিব্যাহারে লইয়া তীরে তীরে চলিল–বজরায় উঠিল না। এরূপ অনেক দূর গিয়া একটা জঙ্গলে প্রবেশ করিল। আমরা কথায় কথায় জঙ্গলের কথা বলিতেছি–কথায় কথায় ডাকাইতের কথা বলিতেছি–ইহাতে পাঠক মনে করিবেন না, আমরা কিছুমাত্র অত্যুক্তি করিতেছি, অথবা জঙ্গল বা ডাকাইত ভালবাসি। যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে সে দেশ জঙ্গলে পরিপূর্ণ। এখনও অনেক স্থানে ভয়ানক জঙ্গল–কতক কতক আমি স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি। আর ডাকাইতের ত কথাই নাই। পাঠকের স্মরণ থাকে যেন যে, ভারতবর্ষের ডাকাইত শাসন করিতে মার্কুইস অব হেষ্টিংসকে যত বড় যুদ্ধোদ্যম করিতে হইয়াছিল, পঞ্জাবের লড়াইয়ের পূর্বে আর কখন তত করিতে হয় নাই। এ সকল অরাজকতার সময়ে ডাকাইতিই ক্ষমতাশালী লোকের ব্যবসা ছিল। যাহারা দুর্বল বা গণ্ডমূর্খ, তাহারাই “ভাল মানুষ” হইত। ডাকাইতিতে তখন কোন নিন্দা বা লজ্জা ছিল না।
দেবী জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করিয়াও অনেকদূর গেল। একটা গাছের তলায় পৌঁছিয়া পরিচারিকাকে বলিল, “দিবা, তুই এখানে বস। আমি আসিতেছি। এ বনে বাঘভালুক বড় অল্প। আসিলেও তোর ভয় নাই। লোক পাহারায় আছে।” এই বলিয়া দেবী সেখান হইতে আরও গাঢ়তর জঙ্গলমধ্যে প্রবেশ করিল। অতি নিবিড় জঙ্গলের ভিতর একটা সুরঙ্গ। পাথরের সিঁড়ি আছে। যেখানে নামিতে হয়, সেখানে অন্ধকার–পাথরের ঘর। পূর্বকালে বোধ হয় দেবালয় ছিল–এক্ষণে কাল সহকারে চারি পাশে মাটি পড়িয়া গিয়াছে। কাজেই তাহাতে নামিবার সিঁড়ি গড়িবার প্রয়োজন হইয়াছে। দেবী অন্ধকারে সিঁড়িতে নামিল।
সেই ভূগর্ভস্থ মন্দিরে মিট্ মিট্ করিয়া একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল। তার আলোতে এক শিবলিঙ্গ দেখা গেল। এক ব্রাহ্মণ সেই শিবলিঙ্গের সম্মুখে বসিয়া তাহার পূজা করিতেছিল। দেবী শিবলিঙ্গকে প্রণাম করিয়া, ব্রাহ্মণের কিছু দূরে বসিলেন। দেখিয়া ব্রাহ্মণ পূজা সমাপনপূর্বক, আচমন করিয়া দেবীর সঙ্গে কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলেন।
ব্রাহ্মণ বলিল, “মা! কাল রাত্রে তুমি কি করিয়াছ? তুমি কি ডাকাইতি করিয়াছ না কি?”
দেবী বলিল, “আপনার কি বিশ্বাস হয়?”
ব্রাহ্মণ বলিল, “কি জানি?”
ব্রাহ্মণ আর কেহই নহে, আমাদের পূর্বপরিচিত ভবানী ঠাকুর।
দেবী বলিল, “কি জানি কি, ঠাকুর? আপনি কি আমায় জানেন না? দশ বৎসর আজ এ দস্যুদলের সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইলাম। লোক জানে, যত ডাকাইতি হয়, সব আমিই করি। তথাপি একদিনের জন্য এ কাজ আমা হইতে হয় নাই–তা আপনি বেশ জানেন। তবু বলিলেন, ‘কি জানি’?”
ভ। রাগ কর কেন? আমরা যে অভিপ্রায়ে ডাকাইতি করি, তা মন্দ কাজ বলিয়া আমরা জানি না। তাহা হইলে, এক দিনের তরেও ঐ কাজ করিতাম না। তুমিও এ কাজ মন্দ মনে কর না, বোধ হয়–কেন না, তাহা হইলে এ দশ বৎসর–
দেবী। সে বিষয়ে আমার মত ফিরিতেছে। আমি আপনার কথায় এত দিন ভুলিয়াছিলাম–আর ভুলিব না। পরদ্রব্য কাড়িয়া লওয়া মন্দ কাজ নয় ত মহাপাতক কি? আপনাদের সঙ্গে আর কোন সম্বন্ধই রাখিব না।
ভ। সে কি? যা এতদিন বুঝাইয়া দিয়াছি, তাই কি আবার তোমায় বুঝাইতে হইবে?যদি আমি এ সকল ডাকাইতির ধনের এক কপর্দক গ্রহণ করিতাম, তবে মহাপাতক বটে। কিন্তু তুমি ত জান যে, কেবল পরকে দিবার জন্য ডাকাইতি করি। যে ধার্মিক, যে সৎপথে থাকিয়া ধন উপার্জন করে, যাহার ধনহানি হইলে ভরণপোষণের কষ্ট হইবে, রঙ্গরাজ কি আমি কখন তাহাদের এক পয়সাও লই নাই। যে জুয়াচোর, দাগাবাজ, পরের ধন কাড়িয়া বা ফাঁকি দিয়া লইয়াছে, আমরা তাহাদের উপর ডাকাইতি করি। করিয়া এক পয়সাও লই নাই, যাহার ধন বঞ্চকেরা লইয়াছিল, তাহাকেই ডাকিয়া দিই। এ সকল কি তুমি জান না? দেশ অরাজক, দেশে রাজশাসন নাই, দুষ্টের দমন নাই, যে যার পায়, কাড়িয়া খায়। আমরা তাই তোমায় রাণী করিয়া রাজশাসন চালাইতেছি। তোমার নামে আমরা দুষ্টের দমন করি, শিষ্টের পালন করি। এ কি অধর্ম?
দেবী। রাজা রাণী, যাকে করিবেন, সেই হইতেই পারিবে। আমাকে অব্যাহতি দিন–আমার এ রাণীগিরিতে আর চিত্ত নাই।
ভ। আর কাহাকেও এ রাজ্য সাজে না। আর কাহারও অতুল ঐশ্বর্য নাই–তোমার ধনদানে সকলেই তোমার বশ।
দেবী। আমার যে ধন আছে, সকলই আমি আপনাকে দিতেছি। আমি ঐ টাকা যেরূপে খরচ করিতাম, আপনিও সেইরূপে করিবেন। আমি কাশী গিয়া বাস করিব, মানস করিয়াছি।
ভ। কেবল তোমার ধনেই কি সকলে তোমার বশ? তুমি রূপে যথার্থ রাজরাণী–গুণে যথার্থ রাজরাণী। অনেকে তোমাকে সাক্ষাৎ ভগবতী বলিয়া জানে–কেন না, তুমি সন্ন্যাসিনী, মার মত পরের মঙ্গল কামনা কর, অকাতরে ধন দান কর, আবার ভগবতীর মত রূপবতী। তাই আমরা তোমার নামে এ রাজ্য শাসন করি–নহিলে আমাদের কে মানিত?
দেবী। তাই লোকে আমাকে ডাকাইতনী বলিয়া জানে–এ অখ্যাতি মরিলেও যাবে না।
ভ। অখ্যাতি কি? এ বরেন্দ্রভূমে আজি কালি কে এমন আছে যে, এ নামে লজ্জিত? কিন্তু সে কথা যাক–ধর্মাচরণে সুখ্যাতি খুঁজিবার দরকার কি? খ্যাতির কামনা করিলেই কর্ম আর নিষ্কাম হইল কৈ? তুমি যদি অখ্যাতির ভয় কর, তবে তুমি আপনার খুঁজিলে, পরের ভাবিলে না। আত্মবিসর্জন হইল কৈ?
দেবী। আপনাকে আমি তর্কে আঁটিয়া উঠিতে পারিব না–আপনি মহামহোপাধ্যায়, –আমার স্ত্রীবুদ্ধিতে যাহা আসিতেছে, তাই বলিতেছি–আমি এ রাণীগিরি হইতে অবসর হইতে চাই। আমার এ আর ভাল লাগে না।
ভ। যদি ভাল লাগে না–তবে কালি রঙ্গরাজকে ডাকাইতি করিতে পাঠাইয়াছিলে কেন? কথা যে আমার অবিদিত নাই, তাহা বলা বেশীর ভাগ।
দেবী। কথা যদি অবিদিত নাই, তবে অবশ্য এটাও জানেন যে, কাল রঙ্গরাজ ডাকাইতি করে নাই–ডাকাইতির ভাণ করিয়াছিল মাত্র।
ভ। কেন? তা আমি জানি না, তাই জিজ্ঞাসা করিতেছি।
দেবী। একটা লোককে ধরিয়া আনিবার জন্য।
ভ। লোকটা কে?
দেবীর মুখে নামটা একটু বাধ বাধ করিল–কিন্তু নাম না করিলেও নয়–ভবানীর সঙ্গে প্রতারণা চলিবে না। অতএব অগত্যা দেবী বলিল, “তার নাম ব্রজেশ্বর রায়।”
ভ। আমি তাকে বিলক্ষণ চিনি। তাকে তোমার কি প্রয়োজন?
দেবী। কিছু দিবার প্রয়োজন ছিল। তার বাপ ইজারাদারের হাতে কয়েদ যায়। কিছু দিয়া ব্রাহ্মণের জাতিরক্ষা করিয়াছি।
ভ। ভাল কর নাই। হরবল্লভ রায় অতি পাষণ্ড। খামকা আপনার বেহাইনের জাতি মারিয়াছিল–তার জাতি যাওয়াই ভাল ছিল।
দেবী শিহরিল। বলিল, “সে কি রকম?”
ভ। তার একটা পুত্রবধূর কেহ ছিল না, কেবল বিধবা মা ছিল। হরবল্লভ সেই গরিবের বাগদী অপবাদ দিয়া বউটাকে বাড়ী হইতে তাড়াইয়া দিল। দুঃখে বউটার মা মরিয়া গেল।
দেবী। আর বউটা?
ভ। শুনিয়াছি, খাইতে না পাইয়া মরিয়া গিয়াছে।
দেবী। আমাদের সে সব কথায় কাজ কি? আমরা পরহিত-ব্রত নিয়েছি, যার দুঃখ দেখিব, তারই দুঃখ মোচন করিব।
ভ। ক্ষতি নাই। কিন্তু সম্প্রতি অনেকগুলি লোক দারিদ্র্যগ্রস্ত–ইজারাদারের দৌরাত্ম্যে সর্বস্ব গিয়াছে। এখন কিছু কিছু পাইলেই, তাহারা আহার করিয়া গায়ে বল পায়। গায়ে বল পাইলেই তাহারা লাঠিবাজি করিয়া আপন স্বত্ব উদ্ধার করিতে পারে। শীঘ্র একদিন দরবার করিয়া তাহাদিগের রক্ষা কর।
দেবী। তবে প্রচার করুন যে, এইখানেই আগামী সোমবার দরবার হইবে।
ভ। না। এখানে আর তোমার থাকা হইবে না। ইংরেজ সন্ধান পাইয়াছে, তুমি এখন এই প্রদেশে আছ। এবার পাঁচ শত সিপাহী লইয়া তোমার সন্ধানে আসিতেছে। অতএব এখানে দরবার হইবে না। বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে দরবার হইবে, প্রচার করিয়াছি। সোমবার দিন অবধারিত করিয়াছি। সে জঙ্গলে সিপাহী যাইতে সাহস করিবে না–করিলে মারা পড়িবে। ইচ্ছামত টাকা সঙ্গে লইয়া আজি বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে যাত্রা কর।
দেবী। এবার চলিলাম। কিন্তু আর আমি এ কাজ করিব কি না সন্দেহ। ইহাতে আমার মন নাই।
এই বলিয়া দেবী উঠিল। আবার জঙ্গল ভাঙ্গিয়া বজরায় গিয়া উঠিল। বজরায় উঠিয়া রঙ্গরাজকে ডাকিয়া চুপি চুপে এই উপদেশ দিল, “আগামী সোমবার বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে দরবার হইবে। এই দণ্ডে বজরা খোল–সেইখানেই চল–বরক ন্দাজদিগের সংবাদ দাও, দেবীগড় হইয়া যাও–টাকা লইয়া যাইতে হইবে। সঙ্গে অধিক টাকা নাই।”
তখন মুহূর্ত মধ্যে বজরার মাস্তুলের উপর তিন চারিখানা ছোট বড় সাদা পাল বাতাসে ফুলিতে লাগিল; ছিপখানা বজরার সামনে আসিয়া বজরার সঙ্গে বাঁধা হইল। তাহাতে ষাট জন জোয়ান বোটে লইয়া বসিয়া, ‘রাণীজি-কি জয়’ বলিয়া বাহিতে আরম্ভ করিল–সেই জাহাজের মত বজরা তখন তীরবেগে ছুটিল। এদিকে দেখা গেল, বহুসংখ্যক পথিক বা হাটুরিয়া লোকের মত লোক, নদীতীরে জঙ্গলের ভিতর দিয়া বজরার সঙ্গে দৌড়াইয়া যাইতেছে। তাহাদের হাতে কেবল এক এক লাঠি মাত্র–কিন্তু বজরার ভিতর বিস্তর ঢাল, সড়কি, বন্দুক আছে। ইহারা দেবীর “বরক্ন্দাজ” সৈন্য।
সব ঠিক দেখিয়া, দেবী স্বহস্তে আপনার শাকান্ন পাকের জন্য হাঁড়িশালায় গেল। হায়! দেবী!–তোমার এ কিরূপ সন্ন্যাস!
একাদশ পরিচ্ছেদ
সোমবারে প্রাতঃসূর্যপ্রভাসিত নিবিড় কাননাভ্যন্তরে দেবী রাণীর “দরবার” বা “এজলারস”। সে এজলাসে কোন মোকদ্দমা মামলা হইত না। রাজকার্যের মধ্যে কেবল একটা কাজ হইত–অকাতরে দান।
নিবিড় জঙ্গল–কিন্তু তাহার ভিতর প্রায় তিন শত বিঘা জমি সাফ হইয়াছে। সাফ হইয়াছে, কিন্তু বড় বড় গাছ কাটা হয় নাই–তাহার ছায়ায় লোক দাঁড়াইবে। সেই পরিষ্কার ভূমিখণ্ডে প্রায় দশ হাজার লোক জমিয়াছে–তাহারই মাঝখানে দেবী রাণীর এজলাস। একটা বড় সামিয়ানা গাছের ডালে ডালে বাঁধিয়া টাঙ্গান হইয়াছে। তার নীচে বড় বড় মোটা রূপার ডাণ্ডার উপর একখানা কিংখাপের চাঁদওয়া টাঙ্গান–তাতে মতির ঝালর। তার ভিতর চন্দনকাষ্ঠের বেদী। বেদীর উপর বড় পুরু গালিচা পাতা। গালিচার উপর একখানা ছোট রকম রূপার সিংহাসন। সিংহাসনের উপর মসনদ পাতা–তাহাতেও মুক্তার ঝালর। দেবীর বেশভূষার আজ বিশেষ জাঁক। সাড়ি পরা। সাড়িখানায় ফুলের মাঝে এক একখানা হীরা। অঙ্গ রত্নে খচিত–কদাচিৎ মধ্যে মধ্যে অঙ্গের উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেখা যাইতেছে। গলায় এত মতির হার যে, বুকের আর বস্ত্র পর্যন্ত দেখা যায় না। মাথায় রত্নময় মুকুট। দেবী আজ শরৎকালে প্রকৃত দেবীপ্রতিমা মত সাজিয়াছে। এ সব দেবীর রাণীগিরি। দুই পাশে চারি জন সুসজ্জিতা যুবতী স্বর্ণদণ্ড-চামর লইয়া বাতাস দিতেছে। পাশে ও সম্মুখে বহুসংখ্যক চোপদার ও আশাবরদার বড় জাঁকের পোষাক করিয়া, বড় বড় রূপার আশা ঘাড়ে করিয়া খাড়া হইয়াছে। সকলের উপর জাঁক, বরকয়ন্দাজের সারি। প্রায় পাঁচ শত বরকয়ন্দাজ দেবীর সিংহাসনের দুই পাশে সার দিয়া দাঁড়াইল। সকলেই সুসজ্জিত–লাল পাগড়ি, লাল আঙ্গরাখা, লাল ধুতি মালকোচা মারা, পায়ে লাল নাগরা, হাতে ঢাল সড়কি। চারি দিকে লাল নিশান পোঁতা।
দেবী সিংহাসনে আসীন হইল। সেই দশ হাজার লোকে একবার “দেবী রাণী-কি জয়” বলিয়া জয়ধ্বনি করিল। তার পর দশ জন সুসজ্জিত যুবা অগ্রসর হইয়া মধুর কণ্ঠে দেবীর স্তুতিগান করিল। তার পর সেই দশ সহস্র দরিদ্রের মধ্য হইতে এক একজন করিয়া ভিক্ষার্থীদিগকে দেবীর সিংহাসনসমীপে রঙ্গরাজ আনিতে লাগিল। তাহারা সম্মুখে আসিয়া ভক্তিভাবে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিল। যে বয়োজ্যেষ্ঠ ও ব্রাহ্মণ, সেও প্রণাম করিল–কেন না, অনেকের বিশ্বাস ছিল যে, দেবী ভগবতীর অংশ, লোকের উদ্ধারের জন্য অবতীর্ণা। সেই জন্য কেহ কখনও তাঁর সন্ধান ইংরেজের নিকট বলিত না, অথবা তাঁহার গ্রেপ্তারির সহায়তা করিত না। দেবী সকলকে মধুর ভাষায় সম্বোধন করিয়া তাহাদের নিজ নিজ অবস্থার পরিচয় লইলেন। পরিচয় লইয়া, যাহার যেমন অবস্থা, তাহাকে সেইরূপ দান করিতে লাগিলেন। নিকটে টাকাপোরা ঘড়া সব সাজান ছিল।
এইরূপ প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেবী দরিদ্রগণকে দান করিলেন। সন্ধ্যা অতীত হইয়া এক প্রহর রাত্রি হইল। তখন দান শেষ হইল। তখন পর্যন্ত দেবী জলগ্রহণ করেন নাই। দেবীর ডাকাইতি এইরূপ–অন্য ডাকাইতি নাই।
কিছু দিন মধ্যে রঙ্গপুরে গুডল্যাড সাহেবের কাছে সংবাদ পৌঁছিল যে, বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলমধ্যে দেবী চৌধুরাণীর ডাকাইতের দল জমায়ৎবস্ত হইয়াছে–ডাকাইতের সংখ্যা নাই। ইহাও রটিল যে, অনেক ডাকাইত রাশি রাশি অর্থ লইয়া ঘরে ফিরিয়া আসিতেছে–অতএব তাহারা অনেক ডাকাইতি করিয়াছে সন্দেহ নাই। যাহারা দেবীর নিকট দান পাইয়া ঘরে অর্থ লইয়া আসিয়াছিল, তাহারা সব মুনকির–বলে, টাকা কোথা? ইহার কারণ, ভয় আছে, টাকার কথা শুনিলেই ইজারাদারের পাইক সব কাড়িয়া লইয়া যাইবে। অথচ তাহারা খরচপত্র করিতে লাগিল–সুতরাং সকল লোকেরই বিশ্বাস হইল যে, দেবী চৌধুরাণী এবার ভারী রকম লুঠিতেছে।
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
যথাকালে পিতৃসমীপে উপস্থিত হইয়া ব্রজেশ্বর তাঁর পদবন্দনা করিলেন।
হরবল্লভ অন্যান্য কথার পর জিজ্ঞাসা করিলেন, “আসল সংবাদ কি? টাকার কি হইয়াছে?”
ব্রজেশ্বর বলিলেন যে, “তাঁহার শ্বশুর টাকা দিতে পারেন নাই।” হরবল্লভের মাথায় বজ্রাঘাত হইল–হরবল্লভ চীৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে টাকা পাও নাই?”
“আমার শ্বশুর টাকা দিতে পারেন নাই বটে, কিন্তু আর এক স্থানে টাকা পাইয়াছি_”
হ। পেয়েছ? তা আমায় এতক্ষণ বল নাই? দুর্গা, বাঁচলাম।
ব্র। টাকাটা যে স্থানে পেয়েছি, তাহাতে সে গ্রহণ করা উচিত কি না, বলা যায় না।
হ। কে দিল?
ব্রজেশ্বর অধোবদনে মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল, “তার নামটা মনে আসচে না–সেই যে মেয়ে ডাকাইত একজন আছে?”
হ। কে, দেবী চৌধুরাণী?
ব্র। সেই।
হ। তার কাছে টাকা পাইলে কি প্রকারে?
ব্রজেশ্বরের প্রাচীন নীতিশাস্ত্রে লেখে যে, এখানে বাপের কাছে ভাঁড়াভাঁড়িতে দোষ নাই। ব্রজ বলিল, “ও টাকাটা একটু সুযোগে পাওয়া গিয়াছে।”
হ। বদ্ লোকের টাকা। লেখাপড়া কি রকম হইয়াছে?
ব্র। একটু সুযোগে পাওয়া গিয়াছে বলিয়া লেখাপড়া করিতে হয় নাই।
বাপ আর এ বিষয়ে বেশী খোঁচাখুচি করিয়া জিজ্ঞাসা না করে, এ অভিপ্রায়ে ব্রজেশ্বর তখনই কথাটা চাপা দিয়া বলিল, “পাপের ধন যে গ্রহণ করে, সেও পাপের ভাগী হয়। তাই ও টাকাটা লওয়া আমার তেমন মত নয়।”
হরবল্লভ ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, “টাকা নেব না ত ফাটকে যাব না কি? টাকা ধার নেব, তার আবার পাপের টাকা পুণ্যের টাকা কি? আর জপতপের টাকাই বা কার কাছে পাব? সে আপত্তি করে কাজ নাই। কিন্তু আসল আপত্তি এই যে, ডাকাইতের টাকা, তাতে আবার লেখাপড়া করে নাই–ভয় হয়, পাছে দেরী হলে বাড়ী-ঘর লুঠপাট করিয়া লইয়া যায়।”
ব্রজেশ্বর চুপ করিয়া রহিল।
হ। তা টাকার মিয়াদ কত দিন?
ব্র। আগামী বৈশাখ মাসের শুক্লা সপ্তমীর চন্দ্রাস্ত পর্যন্ত।
হ। তা সে হোলো ডাকাইত। দেখা দেয় না। কোথা তার দেখা পাওয়া যাবে যে, টাকা পাঠাইয়া দিব?
ব্র। ঐ দিন সন্ধ্যার পর সে সন্ধানপুরে কালসাজির ঘাটে বজরায় থাকিবে। সেইখানে টাকা পৌঁছিলেই হইবে।
হরবল্লভ বলিলেন, “তা সেই দিন সেইখানেই টাকা পাঠাইয়া দেওয়া যাইবে।”
ব্রজেশ্বর বিদায় লইলেন। হরবল্লভ তখন মনে মনে বুদ্ধি খাটাইয়া কথাটা ভাল করিয়া বিচার করিয়া দেখিলেন। শেষে স্থির করিলেন, “হাঁঃ, সেই বেটীর আবার টাকা শোধ দিতে যাবে! বেটীকে সিপাহী এনে ধরিয়ে দিলেই সব গোল মিটে যাবে। বৈশাখী সপ্তমীর দিন সন্ধ্যার পর কাপ্তেন সাহেব পল্টন তার বজরায় না উঠে–ত আমার নাম হরবল্লভই নয়। তাকে আর আমার কাছে টাকা নিতে হবে না।”
হরবল্লভ এই পুণ্যময় অভিসন্ধিটা আপনার মনে মনেই রাখিলেন–ব্রজেশ্বরকে বিশ্বাস করিয়া বলিলেন না।
এদিকে সাগর আসিয়া ব্রহ্মঠাকুরাণীর কাছে গিয়া গল্প করিল যে, ব্রজেশ্বর একটা রাজরাণীর বজরায় গিয়া, তাকে বিবাহ করিয়া আসিয়াছে, –সাগর অনেক মানা করিয়াছিল, তাহা শুনে নাই। মাগী জেতে কৈবর্ত–আর তার দুইটা বিবাহ আছে–সুতরাং ব্রজেশ্বরের জাতি গিয়াছে, সুতরাং সাগর আর ব্রজেশ্বরের পাত্রাবশিষ্ট ভোজন করিবে না, ইহা স্থির প্রতিজ্ঞা করিয়াছে। ব্রহ্মঠাকুরাণী এ সকল কথা ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করায় অপরাধ স্বীকার করিয়া বলিল, “রাণীজি জাত্যংশে ভাল–আমার পিতৃঠাকুরের পিসী হয়। আর বিয়ে, –তা আমারও তিনটা, তারও তিনটা।”
ব্রহ্মঠাকুরাণী বুঝিল, কথাটা মিথ্যা; কিন্তু সাগরের মতলব যে, ব্রহ্মঠাকুরাণী এ গল্পটা নয়নতারার কাছে করে। সে বিষয়ে তিলার্দ্ধ বিলম্ব হইল না। নয়নতারা একে সাগরকে দেখিয়া জ্বলিয়াছিল, আবার শুনিল যে, স্বামী একটা বুড়া কন্যে বিবাহ করিয়াছে। নয়নতারা একেবারে আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল। সুতরাং কিছুদিন ব্রজেশ্বর নয়নতারার কাছে ঘেঁষিতে পারিলেন না–সাগরের ইজারা-মহল হইয়া রহিলেন।
সাগরের অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল। কিন্তু নয়নতারা বড় গোল বাধাইল–শেষে গিন্নীর কাছে গিয়া নালিশ করিল। গিন্নী বলিলেন, “তুমি বাছা, পাগল মেয়ে। বামনের ছেলে কি কৈবর্ত বিয়ে করে গা? তোমাকে সবাই ক্ষেপায়, তুমিও ক্ষেপ।”
নয়ান বৌ তবু বুঝিল না। বলিল, “যদি সত্য সত্যই বিয়ে হয়ে থাকে?” গিন্নী বলিলেন, “যদি সত্যই হয়, তবে বৌ বরণ করে ঘরে তুলবা। বেটার বৌ ত আর ফেলতে পারবি না।”
এই সময়ে ব্রজেশ্বর আসিল, নয়ান বৌ অবশ্য পলাইয়া গেল। ব্রজেশ্বর জিজ্ঞাসা করিল, “মা, কি বলছিলে গা?”
গিন্নী বলিলেন, “এই বলছিলাম যে, তুই যদি আবার বিয়ে করিস, তবে আবার বৌ বরণ করে ঘরে তুলি।”
ব্রজেশ্বর অন্যমনা হইল, কিছু উত্তর না করিয়া চলিয়া গেল।
প্রদোষকালে গিন্নী ঠাকুরাণী কর্তা মহাশয়কে বাতাস করিতে করিতে, ভর্তৃচরণে এই কথা নিবেদন করিলেন। কর্তা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার মনটা কি?”
গিন্নী। আমি ভাবি কি যে, সাগর বৌ ঘর করে না। নয়ান বৌ ছেলের যোগ্য বৌ নয়। তা যদি একটি ভাল দেখে ব্রজ বিয়ে করে সংসার-ধর্ম করে, আমার সুখ হয়।
কর্তা। তা ছেলের যদি সে রকম বোঝ, তা আমায় বলিও। আমি ঘটক ডেকে ভাল দেখে সম্বন্ধ করব।
গিন্নী। আচ্ছা, আমি মন বুঝিয়া দেখিব।
মন বুঝিবার ভার ব্রহ্মঠাকুরাণীর উপর পড়িল। ব্রহ্মঠাকুরাণী অনেক বিরহসন্তপ্ত এবং বিবাহ-প্রয়াসী রাজপুত্রের উপকথা ব্রজকে শুনাইলেন, কিন্তু ব্রজের মন তাহাতে কিছু বোঝা গেল না। তখন ব্রহ্মঠাকুরাণী স্পষ্ট জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন। কিছুই খবর পাইলেন না। ব্রজেশ্বর কেবল বলিল, “বাপ-মা যে আজ্ঞা করিবেন, আমি তাই পালন করিব।”
কথাটার আর বড় উচ্চবাচ্য হইল না।