দেনা-পাওনা – ২২

বাইশ

অনুমান যে ভুল নয়, লোকটি যে সত্য সত্যই নির্মল বসু, তাহা বুঝিতে পারিয়া জীবানন্দ প্রথমে চমকিত হইল, কিন্তু যে-কোন অবস্থায় নিজেকে মুহূর্তে সামলাইয়া লইবার শক্তি তাহার অদ্ভুত। সে সামান্য একটু হাসিয়া বলিল, বিলক্ষণ! বন্ধু নয় ত কি? ওঁদের কৃপাতেই ত টিকে আছি, নইলে মামার জমিদারি পাওয়া পর্যন্ত যে-সব কীর্তি করা গেছে, তাতে চণ্ডীগড়ের শান্তিকুঞ্জের বদলে ত এতদিন আন্দামানের শ্রীঘরে গিয়ে বসবাস করতে হতো।

নির্মলের গোড়া হইতেই ভাল লাগে নাই, কিন্তু নিজের দুষ্কৃতির এই লজ্জাহীন, অনাবৃত রসিকতার চেষ্টায় তাহার গা জ্বলিয়া গেল। মুখ লাল করিয়া কি একটা বলিতেও চাহিল, কিন্তু বলিতে হইল না। ষোড়শী জবাব দিল, কহিল, চৌধুরীমশায়, উকিল-ব্যারিস্টার বড়লোক বলে বাহবাটা কি একা ওঁরাই পাবেন? আন্দামান প্রভৃতি বড় ব্যাপার না হোক, কিন্তু ছোট বলে এ দেশের শ্রীঘরগুলোও ত মনোরম স্থান নয়—দুঃখী বলে ভৈরবীরা কি একটু ধন্যবাদ পেতে পারে না?

জীবানন্দ অপ্রস্তুত হইয়া হঠাৎ যাহা মুখে আসিল কহিল। বলিল, ধন্যবাদ পাবার সময় হলেই পাবে।

ষোড়শী হাসিয়া কহিল, এই যেমন মন্দিরে দাঁড়িয়ে এইমাত্র একদফা দিয়ে এলেন।

জীবানন্দ ইহার কোন জবাব দিল না। নির্মলের প্রতি চাহিয়া কহিল, আপনার শ্বশুরমহাশয়ের মুখে শুনলাম আপনি আসচেন—আশা করেছিলাম মন্দিরেই আলাপ হবে।

ষোড়শী বলিল, সে আমার দোষ চৌধুরীমশায়। উনি এসেও ছিলেন এবং সদালাপে যোগ না দিন, ভিড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে গলা বাড়িয়ে শোনবার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু আমি দেখতে পেয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে এলাম। বললাম, চলুন নির্মলবাবু, ঘরে বসে বরঞ্চ দুটো গল্প-সল্প করা যাক।

জীবানন্দ মনের উত্তাপ চাপিয়া কতকটা সহজ গলাতেই কহিল, তা হলে আমি এসে পড়ে ত ব্যাঘাত দিলাম।

ষোড়শী বলিল, দিয়ে থাকলেও আপনার দোষ নেই—আমিই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।

জীবানন্দ কহিল, কিন্তু কেন? গল্প করতে নয় বোধ হয়?

ষোড়শী হাসিয়া ফেলিল; বলিল, না গো মশায়, না—বরঞ্চ ঠিক তার উলটো। আজ আপনাকে আমি ভারী বক্‌বো। তাহার কণ্ঠস্বর ও কথা কহিবার ভঙ্গী দেখিয়া নির্মল ও জীবানন্দ উভয়েই আশ্চর্য হইয়া চাহিয়া রহিল। ষোড়শী হঠাৎ একটুখানি গম্ভীর হইয়া বলিল, ছি, ছি, ওখানে অত কি করছিলেন বলুন ত? একটা সভার আড়ম্বর করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’জন অসহায় স্ত্রীলোকের কি কুৎসাই রটনা করছিলেন! এর মধ্যে একজন আবার বেঁচে নেই। এ কি কোন পুরুষের পক্ষেই সাজে? তা ছাড়া, কি প্রয়োজন ছিল বলুন ত?
সেদিন এই ঘরে বসেই ত আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আমাকে যা আদেশ করবেন আমি পালন করব। আপনিও আপনার হুকুম স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, আমিও আমার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করিনি। এই নিন মন্দিরের চাবি, এবং এই নিন হিসাবের খাতা। বলিয়া সে অঞ্চল হইতে চাবির গোছা খুলিয়া এবং তাকের উপর হইতে একখানা খেরো-বাঁধানো মোটা খাতা পাড়িয়া জীবানন্দের পায়ের কাছে রাখিয়া দিয়া কহিল, মায়ের যা-কিছু অলঙ্কার, যত-কিছু দলিল-পত্র সিন্দুকের ভিতরেই পাবেন, এবং আরও একখানা কাগজ পাবেন যাতে ভৈরবীর সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য ত্যাগ করে আমি সই করে দিয়েচি।

জীবানন্দ বোধ করি ঠিক বিশ্বাস করিতে পারিল না, কহিল, বল কি! কিন্তু ত্যাগ করলে কার কাছে?

ষোড়শী বলিল, তাতেই লেখা আছে দেখতে পাবেন।

তাই যদি হয় ত এই চাবিটাবিগুলো তাঁকেই দিলে না কেন?

তাঁকেই যে দিলাম। বলিয়া ষোড়শী মুখ টিপিয়া একটু হাসিল। কিন্তু সেই হাসি দেখিয়া এইবার জীবানন্দের মুখ মলিন হইয়া উঠিল। সে ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া সন্দিগ্ধ কণ্ঠে কহিল, কিন্তু এ ত আমি নিতে পারিনে। খাতায় লেখা নামগুলোর সঙ্গে যে সিন্দুকে রাখা জিনিসগুলোও এক হবে, সে আমি কি করে বিশ্বাস করব? তোমার আবশ্যক থাকে তুমি পাঁচজনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ো।

ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, আমার সে আবশ্যক নেই। কিন্তু চৌধুরীমশায়, আপনার এ অজুহাতও অচল। একদিন চোখ বুজে যার হাত থেকে বিষ নিয়ে খাবার ভরসা হয়েছিল, তার হাত থেকে আজ এটুকু চোখ বুজে নেবার সাহস হওয়া আপনার উচিত। অপরকে বিশ্বাস করবার শক্তি আপনার সত্য সত্যই এত কম, এ কথা আমি কোনমতে স্বীকার করতে পারিনে। নিন—ধরুন, বলিয়া সে খাতা এবং চাবির গোছা মাটি হইতে তুলিয়া একরকম জোর করিয়া জীবানন্দের হাতে গুঁজিয়া দিয়া বলিল, আজ আমি বাঁচলাম। আমার কোন ভারই ত কোনদিন নেননি, এইটুকুও না নিলে যে ধর্মে পতিত হবেন। তা ছাড়া, পরকালে জবাব দেবেন কি? বলিয়া সে হাসিতে হাসিতে কহিল, পরকালের চিন্তায় ত আপনার ঘুম হয় না, সে আমি জানি, কিন্তু যা হয়ে গেছে তা গেছে, ভবিষ্যতে কিছু কিছু চিন্তা করতে হবে তা বলে দিচ্চি। তাহার মুখের হাসি সত্ত্বেও কণ্ঠস্বর যেন ইহার শেষ দিকে কোমলতায় বিগলিত হইয়া উঠিল। কহিল, আর একটিমাত্র ভার আপনাকে দিয়ে যাবো, সে আমার গরীব দুঃখী প্রজাদের ভার। আমি শত ইচ্ছে করেও তাদের ভাল করতে পারিনি, কিন্তু আপনি অনায়াসে পারবেন। নির্মলের প্রতি চাহিয়া কহিল, আমার কথাবার্তা শুনে আপনি আশ্চর্য হয়ে গেছেন, না নির্মলবাবু?

নির্মল মাথা নাড়িয়া বলিল, শুধু আশ্চর্য নয়, আমি প্রায় অভিভূত হয়ে পড়েচি। ভৈরবীর আসন ত্যাগ করে যে আপনি ইতিমধ্যে ছাড়পত্র পর্যন্ত সই করে রেখেছেন, এ খবর ত আমাকে ঘূণাগ্রে জানান নি?
ষোড়শী হাসিমুখে কহিল, আমার অনেক কথাই আপনাকে জানানো হয়নি, কিন্তু একদিন হয়ত সমস্তই জানতে পারবেন। কেবল একটিমাত্র মানুষ সংসারে আছেন যাঁকে সকল কথাই জানিয়েচি, সে আমার ফকিরসাহেব।

এ সকল পরামর্শ বোধ করি তিনিই দিয়েচেন?

ষোড়শী তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, না, তিনি আজ সকাল পর্যন্ত কিছুই জানতেন না, এবং ওই যাকে ছাড়পত্র বলচেন সে আমার কাল রাত্রের রচনা। যিনি এ কাজে আমাকে প্রবৃত্তি দিয়েচেন, শুধু তাঁর নামটিই আমি সংসারে সকলের কাছে গোপন রাখবো।

জীবানন্দ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, মনে হচ্ছে যেন বাড়িতে ডেকে এনে আমার সঙ্গে কি একটা প্রকাণ্ড তামাশা করচ ষোড়শী। এ বিশ্বাস করা যেন সেই মরফিয়া খাওয়ার চেয়ে শক্ত ঠেকচে!

এতক্ষণ পরে নির্মল তাহার পানে চাহিয়া একটু হাসিল, কহিল, আপনি ত তবু এই কয়েক পা মাত্র হেঁটে এসে তামাশা দেখছেন, কিন্তু আমাকে কাজকর্ম বাড়িঘর ফেলে রেখে এই তামাশা দেখতে আট শ’ মাইল ছুটে আসতে হয়েছে। এ যদি সত্য হয়, আপনি যা চেয়েছিলেন অন্ততঃ সেটা পেয়ে গেলেন, কিন্তু আমার ভাগ্যে ষোল আনাই লোকসান। একে তামাশা বলব কি উপহাস বলব ভেবেই পাচ্চিনে। বলিয়া সে লোকটার মুখের প্রতি আর একবার ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিতে, দেখিতে পাইল তাহার দুই চক্ষু আকস্মিক বেদনার ভারে যেন ভারাক্রান্ত। সে জবাব কিছুই দিল না, শুধু একটুখানি হাসিবার চেষ্টা করিল।

নির্মল ষোড়শীকে প্রশ্ন করিল, এ-সকল ত আপনার পরিহাস নয়?

ষোড়শী বলিল, না নির্মলবাবু, আমার এবং আমার মায়ের কুৎসায় দেশ ছেয়ে গেল, এই কি আমার হাসি-তামাশার সময়? আমি সত্য সত্যই অবসর নিলাম।

নির্মল কহিল, তা হলে বড় দুঃখে পড়েই এ কাজ আপনাকে করতে হলো!

ষোড়শী উত্তর দিল না। নির্মল নিজেও একটু স্থির থাকিয়া বলিল, আমি আপনাকে বাঁচাতে এসেছিলাম, বাঁচাতেও হয়ত পারতাম, তবু কেন যে হতে দিলেন না তা আমি বুঝেচি। বিষয় রক্ষা হতো, কিন্তু কুৎসার ঢেউ তাতে তেমনি উত্তাল হয়ে উঠত। এবং সে থামাবার সাধ্য আমার ছিল না। বলিয়া সে যে কাহাকে কটাক্ষ করিল তাহা উপস্থিত সকলেই বুঝিল। কিন্তু জীবানন্দ নীরব হইয়া রহিল, এবং ষোড়শী নিজেও ইহার কোন প্রতিবাদ করিল না।

নির্মল জিজ্ঞাসা করিল, এখন তা হলে কি করবেন স্থির করেছেন?

ষোড়শী বলিল, সে আপনাকে আমি পরে জানাবো।

কোথায় থাকবেন?

এ সংবাদও আপনাকে আমি পরে দেবো।
বাহির হইতে সাড়া আসিল, মা! ষোড়শী গলা বাড়াইয়া দেখিয়া কহিল, ভূতনাথ? আয় বাবা, ঘরে নিয়ে আয়। মন্দিরের ভৃত্য আজ একটা বড় ঝুড়ি ভরিয়া দেবীর প্রসাদ, নানাবিধ ফলমূল ও মিষ্টান্ন আনিয়াছিল। ষোড়শী হাতে লইয়া জীবানন্দের মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া স্নিগ্ধ হাসিমুখে কহিল, সেদিন আপনাকে পেটভরে খেতে দিতে পারিনি, কিন্তু আজ সে ত্রুটি সংশোধন করে তবে ছাড়ব। নির্মলের প্রতি চাহিয়া বলিল, আর আপনি ত ভগিনীপতি, কুটুম্ব—আপনাকে শুধু শুধু যেতে দিলে ত অন্যায় হবে। অনেক তিক্ত কটু আলোচনা হয়ে গেছে, এখন বসুন দিকি দু’জনে খেতে। মিষ্টিমুখ না করিয়ে ছেড়ে দিলে আমার ক্ষোভের সীমা থাকবে না।

নির্মল কহিল, দিন। কিন্তু জীবানন্দ অস্বীকার করিয়া বলিল, আমি খেতে পারব না।

পারবেন না? কিন্তু পারতেই যে হবে।

জীবানন্দ তথাপি মাথা নাড়িয়া বলিল, না।

ষোড়শী হাসিয়া কহিল, মিথ্যে মাথা নাড়া চৌধুরীমশায়। যে সুযোগ জীবনে আর কখনো পাবো না, তা যদি হাতে পেয়ে ছেড়ে দিই ত মিছেই এতকাল ভৈরবীগিরি করে এলাম! বলিয়া সে জল-হাতে উভয়েরই সম্মুখের স্থানটা মুছিয়া লইয়া শালপাতা পাতিয়া মিষ্টান্ন পরিবেশন করিয়া খাওয়াইতে বসিল।

মিষ্টান্ন যে আজ যথার্থ-ই জীবানন্দের গলায় বাধিতেছিল, ইহা লক্ষ্য করিতে ষোড়শীর বিলম্ব হইল না। সে গলা খাটো করিয়া কহিল, তবে থাক, এগুলো আর আপনার খেয়ে কাজ নেই, আপনি শুধু দুটো ফল খান। বলিয়া নিজেই হাত বাড়াইয়া তাঁহার পাতার একধারে উচ্ছিষ্ট খাবারগুলা সরাইয়া দিয়া বলিল, কি হলো আজ? সত্যিই ক্ষিদে নেই নাকি? না থাকে ত জোর করে খাবার দরকার নেই। দেহের মধ্যে যে অসুখের সৃষ্টি করে রেখেচেন, সে মনে হলেও আমার ভয় হয়।

নির্মল একমনে খাইতেছিল, সে মুখ তুলিয়া চাহিল। এই কণ্ঠস্বরের অনির্বচনীয়তা খট্‌ করিয়া তাহার কানে বাজিয়া অকারণে বহুদূরবর্তী হৈমকে তাহার স্মরণ করাইয়া দিল। দু’জনের অনেক হাস্য-পরিহাসের বিনিময় হইয়া গেছে, আজ সকালেও এই ষোড়শীর কথায় ও ইঙ্গিতে সর্বশরীরে তাহার পুলকের বিদ্যুৎ শিহরিয়া গেছে; কিন্তু এ গলা ত সে নয়! মাধুর্যের এরূপ নিবিড় রসধারা ত তাহাতে ঝরে নাই! মিষ্টান্নের মিষ্ট তাহার মুখে বিস্বাদ এবং ফলের রস তিতো লাগিয়া আহারের সমস্ত আনন্দ যেন মুহূর্তে তিরোহিত হইয়া গেল। খানিক পরে লক্ষ্য করিয়া ষোড়শী সবিস্ময়ে কহিল, আপনারও যে ওই দশা হলো নির্মলবাবু, খেলেন কৈ?

নির্মল বলিল, যা খেতে পারি তা আপনার বলবার আগেই খেয়েচি, অনুরোধের অপেক্ষা করিনি।

খাবারগুলো আজ বুঝি তা হলে ভাল দেয়নি?
তা হবে। অন্যদিন কেমন দেয় সে ত জানিনে! বলিয়া সে হাত ধুইবার উপক্রম করিল। এ বিষয়ে তাহার কৌতূহলের একান্ত অভাব শুধু ষোড়শীর নয়, জীবানন্দেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করিল; কিন্তু এ লইয়া কেহ আর আলোচনা তুলিল না। বাহিরে আসিয়া ষোড়শী মুখ-হাত ধুইবার জল দিয়া এবং সাজা পান হাতে দিয়া তাহা ঠিক আছে কিনা দেখিয়া লইতে অনুরোধ করিল, কিন্তু নিজের বা তাহার সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করিল না।

নির্মল কহিল, আমি এখন তা হলে যাই—

আপনি বাড়ি ফিরবেন কবে?

আমার আর ত কোন প্রয়োজন নেই, হয়ত কালই ফিরতে পারি।

ছেলেকে, হৈমকে আমার আশীর্বাদ দেবেন।

নির্মল একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, আমাকে আর বোধ হয় কোন আবশ্যক নেই?

ষোড়শী নিজেও ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, এতবড় অহঙ্কারের কথা কি আমি বলতে পারি নির্মলবাবু? তবে মন্দির নিয়ে আর বোধ হয় আমার কখনো আপনাকে দুঃখ দেবার আবশ্যক হবে না।

নির্মল ম্লানমুখে হাসির প্রয়াস করিয়া কহিল, আমাদের শীঘ্র ভুলে যাবেন না আশা করি?

ষোড়শী মাথা নাড়িয়া শুধু কহিল, না।

নির্মল নমস্কার করিয়া কহিল, আমি চললাম। যদি সকালের গাড়িতে যাওয়া হয় ত, আর বোধ হয় দেখা করবার সময় পাবো না। হৈম আপনাকে বড় ভালবাসে, যদি অবকাশ পান মাঝে মাঝে একটা খবর দেবেন। বলিয়া সে আর কোন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করিয়া বাহির হইয়া গেল। প্রবঞ্চিতের লজ্জা ও জ্বালা অত্যন্ত সঙ্গোপনে তাহার বুকের মধ্যে ধকধক করিয়া জ্বলিতে লাগিল, এবং বিফল-মনোরথ মাতাল যেমন করিয়া তাহার মদের দোকানের রুদ্ধ-দুয়ার হইতে ফিরিবার পথে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে থাকে, তেমনি করিয়া সে সমস্ত পথটা মনে মনে বলিতে লাগিল, আমি বাঁচিয়া গেলাম। স্বেচ্ছাচারিণীর মোহের বেষ্টন হইতে বাহির হইতে পারিয়া আমার হৈমকে আবার ফিরিয়া পাইলাম। কথাগুলো কেবলমাত্র বারংবার আবৃত্তি করিয়াই সে তাহার পীড়িত, আহত হৃদয়ের কাছে যেন সপ্রমাণ করিতে চাহিল যে, এ ভালই হইল যে, ষোড়শীর গৃহের দ্বার তাহার মুখের উপর চিরদিনের মত বন্ধ হইয়া গেল।

মিনিট দুই-তিন পরে জীবানন্দ বাহিরে আসিয়া দেখিল, অন্ধকারে একটা খুঁটি ঠেস দিয়া ষোড়শী চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। কাছে আসিয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, নির্মলবাবু কি চলে গেলেন?

এ প্রশ্নের উত্তর দেবার প্রয়োজন ছিল না, ষোড়শী তেমনি চুপ করিয়াই রহিল।

জীবানন্দ কহিল, ভদ্রলোকটিকে ঠিক বুঝতে পারলাম না।

ষোড়শী পথের দিকে চাহিয়াছিল, সেইদিকেই চক্ষু রাখিয়া বলিল, তাতে আপনার ক্ষতি কি?
আমার ক্ষতি? না, তা বোধ করি কিছু নেই, কিন্তু তোমার ত থাকতে পারে? তুমি কি তাঁকে বুঝতে পেরেছ?

ষোড়শী কহিল, আমার যতটুকু দরকার তা পেরেছি বৈ কি।

তা হলে ভাল। বলিয়া সে ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া যেন নিজের মনেই কহিল, তাঁকে মনে রাখবার জন্যে কি রকম ব্যাকুল প্রার্থনা জানিয়ে গেলেন, দরখাস্ত মঞ্জুর করলে ত? বলিয়া মুখ তুলিয়া চাহিতে সেই অন্ধকারেও দু’জনের চোখে চোখে মিলিল।

ষোড়শী দৃষ্টি অবনত করিল না, বলিল, আমি তাঁকে যতখানি জানি, তার অর্ধেকও যদি আমাকে জানবার তাঁর সময় হতো, এতবড় বাহুল্য আবেদন আমার কাছে তিনি মুখে উচ্চারণ করতেও পারতেন না। আমার যা-কিছু কল্পনা, যত-কিছু আনন্দের ভাবনা, সে ত কেবল তাঁদের নিয়েই। তাঁদের দেখেই ত আমি সে-ষোড়শী আর নেই। এই যে চণ্ডীগড়ের ভৈরবী-পদ, যা ভাগ করে নেবার লোভে আপনাদের ছেঁড়াছিঁড়ির অবধি নেই, যে জন্যে কলঙ্কে দেশ আপনারা ছেয়ে দিলেন, সে যে আজ জীর্ণবস্ত্রের মত ত্যাগ করে যাচ্চি, সে শিক্ষা কোথায় পেয়েচি জানেন? সে ওইখানে। মেয়েমানুষের কাছে এ যে কত ফাঁকি, কত মিথ্যে, সে কথা ওঁদের দেখেই বুঝতে পেরেছি। অথচ এর বাষ্পও তিনি জানেন না, কোনদিন হয়ত জানতেও পারবেন না।

জীবানন্দ অবাক হইয়া চাহিয়া ছিল, সহসা সেইদিকে দৃষ্টি পড়ায় ষোড়শী নিজের উচ্ছ্বসিত আবেগে লজ্জিত হইয়া নীরব হইল। কিছুক্ষণ উভয়েই মৌন থাকার পরে জীবানন্দ ধীরে ধীরে কথা কহিল। বলিল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে আমার ভারী লজ্জা করে, কিন্তু যদি পারতাম, তুমি কি তার সত্যি জবাব দিতে পারতে অলকা?

জীবানন্দের মুখে এই অলকা নামটা ষোড়শীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তিন অক্ষরের এই ছোট্ট কথাটি তাহার কোন্‌খানে যে গিয়া আঘাত করিত, সে ভাবিয়া পাইত না। বিশেষ করিয়া তাহার প্রশ্ন করার এই কৌতুককর ভঙ্গীতে ষোড়শীর হাসি পাইল; কহিল, আপনি যদি কোন একটা আশ্চর্য কাজ করতে পারতেন, তার পরে আমি আর কোন একটা তেমনি অদ্ভুত কাজ করতে পারতাম কি না, এতবড় সত্য করবার শক্তি আমার নেই। কিন্তু সে-কাজ করবার আপনার আবশ্যক নেই—আমি বুঝেচি। অপবাদ আপনারা দিয়েচেন বলেই তাকে সত্যি করে তুলতে হবে, তার অর্থ নেই। আমি কিছুর জন্যেই কখনো কারও আশ্রয় গ্রহণ করব না। আমার স্বামী আছেন, কোন লোভেই সে-কথাটা আমি ভুলে যেতে পারব না। এই ভয়ানক প্রশ্নটাই না আপনাকে লজ্জা দিচ্ছিল চৌধুরীমশায়?

তুমি আমাকে চৌধুরীমশায় বল কেন?

তবে কি বলব? হুজুর?

না, অনেকে যা বলে ডাকে—জীবানন্দবাবু।

ষোড়শী বলিল, বেশ ভবিষ্যতে তাই হবে।
জীবানন্দ কহিল, ভবিষ্যতে কেন, আজই বল না?

ষোড়শী ইহার কোন উত্তর দিল না। ভিতরে প্রদীপ স্তিমিত হইয়া আসিতেছিল। সে ঘরে আসিয়া তাহা উজ্জ্বল করিয়া দিল। জীবানন্দ ফিরিয়া আসিয়া বসিতেই ষোড়শী বিস্মিত হইয়া কহিল, রাত্রি হয়ে যাচ্চে, আপনি বাড়ি গেলেন না? আপনার লোকজন কৈ?

আমি তাদের পাঠিয়ে দিয়েচি।

একলা বাড়ি যেতে আপনার ভয় করবে না?

না, আমার পিস্তল সঙ্গে আছে।

তবে তাই নিয়ে বাড়ি যান, আমার ঢের কাজ আছে।

জীবানন্দ কহিল, তোমার থাকতে পারে, কিন্তু আমার নেই। আমি এখন যাবো না।

ষোড়শীর চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিল, কিন্তু শান্তভাবে বলিল, রাত হয়েছে, আমি লোক ডেকে আপনার সঙ্গে দিচ্চি, তারা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে।

জীবানন্দ বুঝিল কথাটা তাহার ভাল হয় নাই। অপ্রতিভ হইয়া কহিল, ডাকতে কাউকে হবে না, আমি আপনিই যাচ্চি। যেতে আমার ইচ্ছে হয় না, তাই শুধু আমি বলছিলাম। তুমি কি সত্যই চণ্ডীগড় ছেড়ে চলে যাবে অলকা?

আবার সেই নাম! জীবানন্দের মুখের পানে চাহিয়া তাহার ক্লেশ বোধ হইল, ঘাড় নাড়িয়া জানাইল যে সত্যই সে চলিয়া যাইবে।

কবে যাবে?

কি জানি, হয়ত কালই যেতে পারি।

কাল? কালই যেতে পারো? বলিয়া জীবানন্দ একেবারে স্তব্ধ হইয়া বসিল। অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আশ্চর্য! মানুষের নিজের মন বুঝতেই কি ভুল হয়! যাতে তুমি যাও, সেই চেষ্টাই প্রাণপণে করেছি, অথচ তুমি চলে যাবে শুনে চোখের সামনে সমস্ত দুনিয়াটা যেন শুকনো হয়ে গেলো। নির্মলবাবু মস্ত লোক, মস্তবড় ব্যারিস্টার, তিনি আছেন তোমার পক্ষ নিয়ে—হাঙ্গামা বাধাবে, লড়াই শুরু হবে—আমরা জিতবো, ওই যে জমিটা দেনার দায়ে বিক্রি করেচি, ও নিয়ে আর কোন গোলমাল হবে না—কতকগুলো নগদ টাকাও হাতে এসে পড়বে, আর তোমাকে ত যা বলব তাই করতে হবে, এই দিকটাই কেবল দেখতে পেয়েচি, কিন্তু আর যে একটা দিক আছে—তুমি নিজেই সমস্ত ছেড়েছুড়ে দিয়ে বিদায় নিলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াবে, তামাশাটা কোথায় গিয়ে গড়াবে, তা আমার স্বপ্নেও মনে হয়নি—আচ্ছা অলকা, এমন ত হতে পারে, আমার মত তোমারও ভুল হচ্চে—তুমিও নিজের মনের ঠিক খবরটি পাওনি?

কথাগুলি এত চমৎকার এবং এমন নূতন যে হঠাৎ বিস্ময় লাগে, ইহা জীবানন্দের মুখ দিয়া বাহির হইয়াছে। জবাব দিতে ষোড়শীর একটু থামিতে হইল। শেষে সায় দিয়া বলিল, হতে পারে বৈ কি। শুধু এই খবরটা নিশ্চয় জানি, যা আমি স্থির করেচি, সে আর অস্থির হবে না।
জীবানন্দ বলিয়া উঠিল, বাপরে বাপ! তোমার পুরুষমানুষ, আর আমার মেয়েমানুষ হওয়া উচিত ছিল; আচ্ছা, সেইখানেই বা তোমার চলবে কি করে?

ষোড়শী পূর্বের মতই সহজ গলায় উত্তর দিল, এ আলোচনা আমি আপনার সঙ্গে কোনমতে করতে পারিনে।

জীবানন্দ রাগ করিয়া বলিল, তুমি কিছুই পারো না, তুমি পাথর। চুলে আমার পাক ধরে এলো, আমি বুড়ো হয়ে গেলাম—তোমার কাছে কি এখন আমি হাতজোড় করে কাঁদতে পারি তুমি ভেবেচ?

ষোড়শী কহিল, দেখুন অনেক রাত্রি হ’লো, এখনো আমার আহ্নিক পর্যন্ত সারা হয়নি—

পুরোহিতের কাশি এবং পায়ের শব্দ বাহিরে শোনা গেল; সে দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল, মা, সকলের সম্মুখে মন্দিরের দোর বন্ধ করে চাবিটা আমি তারাদাস ঠাকুরের হাতেই দিলাম। রায়মশায়, শিরোমণি—এঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ষোড়শী কহিল, ঠিকই হয়েছে। তুমি একটু দাঁড়াও, আমি সাগরের ওখানে একবার যাবো, বলিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল।

জীবানন্দ নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিল, এগুলোও তা হলে তুমি রায়মশায়ের কাছেই পাঠিয়ে দিয়ো।

ষোড়শী ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না, সিন্দুকের চাবি আর কারও হাতে দিয়ে আমার বিশ্বাস হবে না।

শুধু আমাকেই হবে?

ষোড়শী ইহার কোন উত্তর না দিয়া ঘরের তালাটা হাতে লইয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, এবং জীবানন্দ বাহিরে আসিতেই কবাট বন্ধ করিয়া তাহার পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া পুরোহিতের পিছনে পিছনে নিঃশব্দে প্রস্থান করিল। শুধু একাকী জীবানন্দ সেই অন্ধকার বারান্দায় ভূতের মত নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *