দিল্লীর বুকে দস্যু বনহুর

দিল্লীর বুকে দস্যু বনহুর

বনহুর যখন গঙ্গার বুক থেকে তীরে উঠে এলো, তখন তার হাতের উপর এগিয়ে আছে সংজ্ঞাহীন এক নারী-দেহ। যদিও গঙ্গাবক্ষস্থ ভাসমান ল্যাম্পের আলো এবং ব্রীজের লাইটের ঝাপটা আলো-রশ্মি এসে পড়ছিলো তবু বনহুর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো না, কে এ নারী।

বনহুর যখন সংজ্ঞাহীন নারীটিকে নিয়ে তার গাড়ির পাশে এসে পৌঁছলো তখন লাইটের উজ্জ্বল আলোতে মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠলো, এ যে অভয়কর বিশ্বাসের কন্যা আরতী দেবী। ভাগ্যিস, আশেপাশে তখন কোন লোক ছিল না। গভীর রাত্রির নির্জনতায় ভরে উঠেছিলো গঙ্গাতীর ও ব্রীজের উপরিভাগ। বনহুর আর বিলম্ব করা উচিৎ মনে করলো না। হঠাৎ তাকে এবং আরতী দেবীকে দেখলে লোকে নিশ্চয়ই জঘন্য কিছু মনে করে বসবে। বিপদে পড়ার ভয় করে না বনহুর কিন্তু একটা অহেতুক হট্টগোল বা ফ্যাসাদ এ সময় পছন্দ নয়। তার। বনহুর গাড়ির পিছন আসনে আরতী দেবীকে শুইয়ে দিয়ে ড্রাইভিং আসনে চেপে বসলো। যদিও তার ভিজে কাপড়ে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো, তবু নিপুন ড্রাইভারের মত গাড়ি চালিয়ে চললো।

বনহুরের গাড়ি যখন তার বাসায় এসে পৌঁছলো, তখন চাকর-বাকর সব নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। আরতীর। সংজ্ঞাহীন দেহটা নামিয়ে নিজের শয্যায় এনে শুইয়ে দিলো বনহুর। কিন্তু ভিজে কাপড়ে ওকে এভাবে কতক্ষণ রাখা যায়। এতে খারাপ হবার সম্ভাবনা আছে যথেষ্ট।

ভিজে কাপড়টা আরতীর দেহের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে লেপটে গিয়েছিলো, সহজে খুলে ফেলার কোন উপায় ছিলো না। বাসায় কোনো মেয়ে পরিচারিকা নেই, তা হলেও তাকে নিয়ে ওর কাপড়-চোপড় পাল্টে নেওয়া যেতো।

বনহুর লাইটের উজ্জ্বল আলোতে তাকালো আরতীর এলিয়ে-পড়া সংজ্ঞাহীন দেহটার দিকে। যৌবনভরা দীপ্তময় একটি দেহ-বনহুর ধীরে ধীরে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। একটা সঙ্কোচ আর দ্বিধা তার মনকে সঙ্কোচিত করে ফেললো। অসম্ভব, সে কিছুতেই ওর জামা-কাপড় পাল্টে দিতে পারবে না। পারবে না ওর দেহে হাত। রাখতে।

কিন্তু ভোর হতেও বেশি বিলম্ব নেই। অল্পক্ষণ পরে চাকর-বাকর সব জেগে পড়বে, তখন ওকে এ অবস্থায় তার বিছানায় শায়িত দেখলে নিশ্চয়ই ওদের মনে নানারকম সন্দেহ জাগবে। তাছাড়া এভাবে রাখাটা ঠিক নয়। বনহুর একটা চাদর এনে আরতীর দেহে মুড়ে দিলো। তারপর মুক্ত জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যে বনহুর নিজের ভিজে কাপড় পাল্টে নিয়েছে। সিগারেট বের করে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো বনহুর।

ভোরের আকাশ সবে তখন ফর্সা হতে শুরু হয়েছে।

বনহুর একটির পর একটি সিগারেট নিঃশেষ করে চললো। মনের মধে: নানারকম ভাবনার ফুলঝুরি ঝরে। পড়তে লাগলো। আরতীকে সে দেখেছিলো একদিন অভয়কর বিশ্বাসের বাসভবনে। মাসুদ ইরানীর বেশে যেদিন সে পিয়ানো বাজাচ্ছিলো সেখানে। সেদিন বনহুর আরতীর পরিচয় জানতো না, তবে মেয়েটি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো সকলের অজ্ঞাতে। আরতীর মধ্যে সে দেখেছিলো সত্যিকারের একটি আদর্শ নারী-মূর্তি। ধীরস্থিরা গম্ভীরা একটি যুবতী তারপর আরতীই একদিন স্বয়ং গিয়ে হাজির হয়েছিলো মাসুদ ইরানীর খোঁজে স্বপ্নরাগ হোটেলে একেবারে তার ক্যাবিনে। সেদিন বনহুর তার চোখেমুখে যে উচ্ছ্বাস আর আনন্দের দ্যুতি দেখেছিলো সত্যি তা অপূর্ব। মাসুদ ইরানীর পিয়ানোর সুরে সে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। প্রায়ই সে যেতো মাসুদ। ইরানীর পিয়ানো শুনতে। কিন্তু যেদিন থেকে মাসুদ ইরানী হারিয়ে গেলো শ্যালনের মধ্যে সেদিন থেকে আরতীও আর তার মাসুদ ইরানীর সন্ধান পায়নি। শুধু আরতীই নয়, সমস্ত কলকাতায় মাসুদ ইরানীর অন্তর্ধান। নিয়ে একটা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিলো। পত্রিকায় পত্রিকায় এ ব্যাপার নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। কিন্তু মাসুদ ইরানীর সন্ধান আর পাওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে মাসুদ ইরানীর ভক্তগণ মুষড়ে পড়েছিলো বেশি।

পত্রিকায় মাসুদ ইরানী সম্বন্ধে নানারকম আলোচনা পড়ে হাসতে বনহুর। সমস্ত কলকাতাবাসীর মনে সে অহেতুক একটা চঞ্চলতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু সরে না পড়ে কোনো উপায় ছিলো না। বিশেষ করে শ্যালনের জন্য তাকে সরে পড়তে হয়েছে। শ্যালন ভালবেসে ছিলো মাসুদ ইরানীকে, তাই বনহুর ছলনা করে আর্থারকে সাজিয়ে ছিলো সে মাসুদ ইরানীর ড্রেসে। তার বাসনা সিদ্ধ হয়েছে। শ্যালনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হয়েছে সে।

বনহুর মুক্তির নিশ্বাস ফেলেছিলো।

হঠাৎ আবার একি এক সমস্যা এসে দাঁড়ালো তার সম্মুখে। কে এই লম্পট শয়তান যে আরতীর ইজ্জৎ লুটে নেবার চেষ্টা করছিলো। গভীর রাত্রিতে ব্রীজের উপর তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে কাবু করে নিয়েছিলো। আরতী নিশ্চয়ই শয়তান লোকটির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য গঙ্গার জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। ঠিক সে মুহূর্তে সে যদি ঐ স্থানে গিয়ে না পৌঁছতো তাহলে আরতীকে বাঁচানো যেতো না। কেউ জানতে পারতো না আরতী কোথায় চলে গেছে। অর্থলোভী অভয়কর বিশ্বাস অর্থের লোভে তখন খিদিরপুর ডকে মৃত মহাতকের পাশে দাঁড়িয়ে টাকার জন্য বিলাপ করছে।

মাগো, উঃ…

ফিরে তাকায় বনহুর, চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার। আরতীর জ্ঞান ফিরে এসেছে। বনহুরের মুখমণ্ডল দ্বীপ্ত-উজ্জ্বল হয়ে উঠে। এতোক্ষণ একটা দুঃচিন্তা বনহুরের মনে উঁকি দিচ্ছিল–আরতীর জ্ঞান আর ফিরে যদি না আসে। যদি ওর মৃত্যু হয় তাহলে তখন কি হবে। সরে আসে আরতীর পাশে, ঝুঁকে পড়ে বনহুর–আপনি কি খুব অসুস্থ বোধ করছেন?

আরতী চোখ দুটো মেলে তাকায়, তখন সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে আসেনি। বনহুরের কণ্ঠ তার কানে পৌঁছেছে কিনা সন্দেহ। অর্ধ-নিৰ্মীলিত আঁখি দুটি বনহুরের মুখে স্থির রেখে বলে আরতী–আমি কোথায়?

বনহুর আরতীর পাশে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বলে–আপনি নিরাপদ স্থানে শুয়ে আছেন।

না, আমাকে তুমি ধরে এনেছো। তুমি শয়তান…

 বনহুর দেখলো হঠাৎ আরতী বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

তার কণ্ঠ ক্ষীণ জড়িত হলেও তাতে ক্রুদ্ধভাব প্রকাশ পাচ্ছে। এতো বেশি উত্তেজিত হলে পুনরায় অজ্ঞান হতে পারে। বনহুর আরতীর দৃষ্টি নিজের দিকে ভালোভাবে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে বললো–আমি সে নই।

না না, আমি তোমার সব চালাকি জানি। দুষ্ট বদমাইশ শয়তান কোথাকার…

মিস আরতী, আপনি অযথা ক্রুদ্ধ হচ্ছেন। আমি সে নই, ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, আমি সে নই।

তবু আরতী উম্মাদের মতো বলে চলেছে আমাকে যেতে দাও। আমাকে যেতে দাও। আমি তোমার সব চালাকি জানি। শয়তান হরনাথ, তুমি আমাকে নতুন নামে ডেকে ভোলাতে চেষ্টা করছো!

হরনাথ–নতুন নামে ডেকে…এসব কি বলছে আরতী! তবে কি গঙ্গার বুকে হাবুডুবু খেয়ে তার মস্তিষ্ক বিকার ঘটেছে। হয়তো তাই হবে, কিন্তু ওর আরও বিশ্রাম দরকার। বনহুর আরতীর মাথায় হাত রেখে শান্তস্বরে বললো–আপনি এখন ঘুমাতে চেষ্টা করুন। পরে আপনাকে আপনার পিতার কাছে পৌঁছে দিবো।

বনহুরের কথায় আরতী ঘুমালো না বা চোখ মুদলো না। সে ভালো করে তাকালো বনহুরের দিকে, ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে এলো। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বললো–কে, কে আপনি?

আমার পরিচয় পরে জানতে পারবেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি শয়তান নই। মিস আরতী…আপনি…

আরতী? কে আরতী? আমি আরতী নই।

আপনি এখনও সুস্থ হননি, সুস্থ হলেই সব বুঝতে পারবেন।

আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছি। আমি আরতী নই–আমি আরতী নই…

ভোরের আলো তখন ফুটে উঠেছে।

বনহুর বয়কে ডেকে বললো–গরম দুধ নিয়ে আয়।

অল্পক্ষণে গরম দুধ এলো।

বনহুর বয়ের হাত থেকে দুধের গেলাস হাতে নিয়ে বললো–নিন, এ গরম দুধটুকু খেয়ে নিন।

আরতী কিন্তু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখের দিকে তন্ময় হয়ে দেখছে, হয়তো ভাবছে–কে এ যুবক।

বনহুর বলে–আমি কি খাইয়ে দিবো?

উঠে বসে আরতী, হাত বাড়িয়ে বনহুরের হাত থেকে দুধের গেলাসটা হাতে নেয়।

বনহুর বলে–আপনি দুধটুকু খেয়ে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমান।

 যতক্ষণ জানতে না পেরেছি আমি কোথায়, ততক্ষণ আমি ঘুমাতে পারবো না।

বেশ, আমি বলছি–আপনি এখন হাওড়া শালাকিয়া এরিয়ার একটি বাসায় রয়েছেন। এ বাসাটি আমার। আমান নাম মিঃ আলম।

আশ্চর্য কণ্ঠে বললো আরতী হাওড়া! আমি কি তাহলে কলকাতায় এসেছি?

 সেকি! সে কি আপনি তো কলকাতাই থাকেন।

না না, আমি কলকাতায় থাকি না। আমি কলকাতা চিনি না।

আপনি এসব কি বলছেন মিস আরতী?

কে–কে আরতী! আমি আরতী নই…

বনহুর বুঝতে পারলো, আরতীর স্বাভাবিক জ্ঞান এখনও ফিরে আসেনি। সে নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ, তারপর বললো–আপনি দুধটুকু খেয়ে নিয়ে, আপনার জামা-কাপড় পাল্টে নিন। কারণ এখনও আপনার জামাকাপড় সম্পূর্ণ ভিজা রয়েছে।

বলুন আপনি হরনাথের কে?

আমি তার কেউ নই! যা পরে সব জানতে পারবেন, আপনি অনুগ্রহপূর্বক আপনার জামা-কাপড় পাল্টে নিন। কিন্তু দুধের গেলাসটা আগে শূন্য করে ফেলুন দেখি?

এবার আরতী তার হস্তস্থিত গেলাসের দুধটুকু এক নিঃশ্বাসে পান করে নিলো।

 বনহুর বললো–পাশের কামরায় জামা-কাপড় আছে..

বনহুর কথা শেষ না করে হঠাৎ থেমে গেলো, তারপর বললো কিন্তু আমার বাসায় তো কোন মেয়েমানুষ নেই। মিস আরতী, আপনাকে আমার পাজামা আর পাঞ্জাবী পরতে হবে।

আরতী গম্ভীর কণ্ঠে বললো–আমি ওসব পরতে পারবো না। তাছাড়া আমার জামা-কাপড় প্রায় শুকিয়ে গেছে।

অনেক বলেও আরতীর জামকাপড় পাল্টানো গেলো না। সে যেমন ছিলো তেমনি রইলো। এবার আরতী জেদ ধরে বসলো–আমাকে দেশে পৌঁছে দিন।

 দেশ! অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো বনহুর।

 হাঁ, আমার দেশে আমাকে পৌঁছে দিন।

বেশ তো, একটু সুস্থ হয়ে উঠুন, আপনার বাবার কাছে আপনাকে পৌঁছে দিবো।

বাবা? আমার তো বাবা নেই।

সেকি, আপনি দেখছি গঙ্গায় ডুবে সব ভুলে গেছেন! আপনার বাবা অভয়কর বিশ্বাস কলকাতার ধনকুবের…

অভয়কর বিশ্বাস…সে কেন আমার বাবা হতে যাবেন! আমি তাকে চিনি না।

মিস আরতী…

আমাকে আরতী বলে ডাকবেন না, কারণ আমি মিস আরতী নই।

 তবে আপনি কে?

আমি মিস লুসী ফিগাই।

 লুসী ফিগাই।

হাঁ, আমার ঐ নাম।

আপনি মিস আরতী নন?

না না না, আমি আরতী নই। মিস আরতী কে আমি চিনি না।

বনহুর বিস্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। আরতী নয়–মেয়েটি শেষ পর্যন্ত উন্মাদ হয়ে গেলো! আরতীকে সে ভালোভাবে চেনে। সে মুখ, সে চোখ, কথা বলার সে ভঙ্গী–না না, এ আরতী না হয়েই যায় না।

বনহুর তখন আরতীকে বিশ্রাম করতে বলে পাশের কক্ষে চলে যায়।

*

আরতীকে শেষ পর্যন্ত কিছুতেই রাজি করাতে পারে না বনহুর। তার বাবা অভয়কর বিশ্বাস নয়–এ কথাই সে বারবার বলে চলে।

বনহুর একদিন একজনু বিজ্ঞ ডাক্তার ডেকে আরতীকে পরীক্ষা করলো, সত্যিকার কোনোরকম মস্তিষ্ক বিকার ঘটেছে কিনা? কিন্তু ডাক্তার বললেন, আরতীর মস্তিষ্ক স্বাভাবিক আছে, কোনোরকম অসুখ এখন তার নেই।

বনহুর চিন্তিত হলো…আরতী তাকে চিনতে না পারলেও আরতীকে সে ভালোভাবে চেনে। আরতী মাসুদ ইরানীর পিয়ানোর সুর ভালোবাসতো, কতদিন সে মাসুদ ইরানীর পাশে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছে। কাজেই আরতী তার অতি পরিচিত জন।

সেদিন রাত্রিতে বনহুর পাশের কামরায় শুয়ে শুয়ে মিস আরতীর কথা ভাবছে। আজ প্রায় সপ্তাহ হতে চললো আরতীকে গঙ্গার বুক থেকে উদ্ধার করে এনেছে। বনহুর ভেবেছিলো, আরতীর জ্ঞান ফিরে এলেই তাকে তার বাসায় পৌঁছে দেবো, কিন্তু যা ভেবেছিলো তা হয়নি। আরতীর জ্ঞান ফিরে আসার পর কিছুতেই স্বীকার করেনি–সে আরতী। হঠাৎ বনহুর শয্যা ত্যাগ করে, ওদিকে রাখা শ্যালনের পিয়ানোর পাশে গিয়ে বসে সে। বনহুর জানে পিয়ানোর সুর আরতীর অতি প্রিয়, বিশেষ করে মাসুদ ইরানীর হাতে। এই আরতীর স্বাভাবিক জ্ঞান ফিরে আনার নিপুণ কৌশল।

বনহুর পিয়ানো বাজাতে শুরু করলো।

অদ্ভুত অপূর্ব সুর!

আরতী কিন্তু যেমন শয্যায় শুয়েছিলো তেমনি শুয়ে রইলো। যদিও সে পিয়ানোর সুরে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু শয্যা ত্যাগ করে ছুটে যায়নি।

বনহুর বার বার তাকাচ্ছিলো দরজার দিকে, এবার হয়তো আরতী ছুটে আসবে তার পাশে। কিন্তু কই সে তো এলো না।

পিয়ানো বাজানো বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো বনহুর! পর্দা ঠেলে প্রবেশ করলো আরতীর কক্ষে। আরতী শয্যায় যেমন শুয়েছিলো তেমনি শুয়ে আছে। বনহুর অবাক হলো…আরতী তার পিয়ানো বাজানো শুনলে কিছুতেই এভাবে শয্যায় শুয়ে থাকতে পারতো না। তবে কি এ আরতী নয়?…

বনহুর আরতীর শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালো।

আরতী অবাক হয়ে উঠে বসলো, কারণ আজ এক সপ্তাহের মধ্যে কোনোদিন রাতে এ লোকটি তার কক্ষে প্রবেশ করেনি। আজ হঠাৎ এ গভীর রাতে সে তার কামরায় কি উদ্দেশ্য নিয়ে আগমন করেছে। ভীত হলো সে মনে মনে–তবে কি কোনো কুৎসৎ অভিসন্ধি নিয়ে এসেছে!

বনহুর আরতীর দিকে তাকিয়ে বললো–মিস লুসী, আজ আমাকে আপনি সব খুলে বলুন। আমি সব শুনবো। কারণ, আমি এতদিন জানতাম, আপনি আরতী দেবী ছাড়া অন্য কেউ নন, কিন্তু আজ আমার সে ভুল ভেঙে গেছে। বলুন আপনি কে? কি আপনার পরিচয়?

আমি কতদিন বলতে চেয়েছি, আপনি শুনতে চাননি।

 আজ বলুন, সব খুলে বলুন মিস লুসী? বনহুর একটা সোফা টেনে বসে পড়লো।

আমি মিস আরতী নই আপনাকে পূর্বেই বলেছি। আমার নাম মিস লুসী ফিগাই। আমার বাড়ি কলকাতায় নয়–দিল্লী শহরে।

দিল্লী!

হাঁ। আমার বাবা ছিলেন দিল্লীর বাঞ্ছারাম হোটেলের মালিক বাঞ্ছারাম ফিগাই।

 বনহুর মনের মধ্যে এ নামটা বার দুই উচ্চারণ করে নিলো তারপর বললো–বলুন? সব বলুন আপনি?

আমি কোনোদিন কলকাতায় আসিনি। আমার বাবার এক বন্ধু কলকাতায় থাকেন। তারই সঙ্গে আমি কলকাতায় বেড়াতে আসি। আমার বাবার বন্ধুকে আমি কাকা বলে ডাকি, তিনিও আমাকে মেয়ের মত ভালোবাসতেন। বিশ্বাস করে তার সঙ্গে চলে এসেছি, কিন্তু আমার বাবার বন্ধুর ছেলে আমার উপর অত্যন্ত জঘন্য আচরণ করেছে। সে আমাকে ফুসলিয়ে তার গাড়িতে বেড়ানোর নাম করে নিয়ে এসেছিলো, কিন্তু পরের ঘটনা অত্যন্ত অশোভনীয়…আমি এর বেশি আর বলতে পারবোনা। আমি তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য গঙ্গায় লাফিয়ে পড়েছিলাম…একটু নিশ্চুপ থেকে বললো আবার মিস লুসী–আপনি কেন আমাকে বাঁচালেন? আমাকে কেন আপনি বাঁচালেন?

আপনি উত্তেজিত হবেন না মিস লুসী, আমি যা জিজ্ঞাসা করবো সঠিক জবাব দিন?

লুসী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় বনহুরের মুখের দিকে। লোকটাকে একদিন সে অবিশ্বাস করেছিলো, প্রথমে ভেবেছিলো এ সে লোক যে তার সর্বনাশ করতে চেষ্টা নিয়েছিলো। কিন্তু পরে সে ভুল ভেঙে গিয়েছিলো লুসীর, যখন তার সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এসেছিলো। এর মুখে সে ঐ কুৎসিৎ লালসাপূর্ণ ভাব দেখতে পায়নি। এর কণ্ঠে শুনতে পায়নি সে প্রিয়সী সম্বোধন। লুসী আশ্বস্ত হয়েছিলো। বনহুরের আচরণে সে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলো, ভাল লেগেছিলো ওকে। বললো লুসী–বলুন!

বনহুর প্রশ্ন করলো–আপনার বাড়ি দিল্লী? আর আপনার বাবা ছিলেন দিল্লী শহরের বাঞ্ছারাম হোটেলের মালিক বাঞ্ছারাম?

হা।

এখন বাঞ্ছারাম জীবিত নেই?

না।

 আপনার মা আছেন?

আছেন। তিনিই এ হোটেল দেখাশোনা করেন।

আপনার বাবার বন্ধুর বাড়ি কলকাতা বলেছেন কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে দিল্লী বেড়াতে যান।

 না ঠিক বেড়াতে যান না।

তবে?

তিনিও বাঞ্ছারাম হোটেলের একজন মালিক। কারণ বাবার হোটেলে তারও শেয়ার আছে।

 তাই তিনি হিসাব-নিকাশ নিতে যান আর কি?

হ, আপনি ঠিক বলেছেন।

 আপনি কি তাকে ছোটবেলা হতেই দেখে আসছেন?

ছোটবেলা হতেই তাকে দেখে আসছি।

আচ্ছা মিস লুসী?

বলুন?

আপনার বাবার বন্ধুর নামটা কি এখনও কিন্তু আমাকে আপনি বলেন নি।

আমার বাবার বন্ধুর নাম কালীচরণ ভদ্রে।

আর তার সন্তানের?

ওর নাম ধরতে আমার কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসে।

তবু বলতে হবে?

 ধীরেনচরণ ভদ্রে।

 ধীরেনচরণ ভদ্রে?

হাঁ, বড় শয়তান, বড় দুষ্ট সে।

আমি তাকে চিনি মিস লুসী, তার বাবা কালিচরণ ভদ্রের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কলকাতার ধনী স্বর্ণ ব্যবসায়ী কালীচরণ?

আপনি ঠিক বলেছেন। বাবার বন্ধু তিনিও স্বর্ণ ব্যবসায়ী বটে। কিন্তু তিনি তো প্রকাশ্যে এ ব্যবসা করেন না? আপনি কি করে জানেন এ সংবাদ?

আমার অজানা কিছুই নেই মিস লুসী। আপনার বাবার বন্ধুর বাড়িটাও আমি চিনি–টালীগঞ্জে।

আপনি দেখছি সব জানেন।

হাঁ, আমি চিনি। এখন আপনাকে সচ্ছন্দে আপনার বাবার বন্ধুর কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে।

না না, আমি ওখানে আর যাবো না। আমি ওখানে আর যাবো না…

 তাহলে আপনি কোথায় যাবেন বা যেতে চান?

আমার মায়ের কাছে আমাকে পৌঁছে দিন।

দিল্লী?

হাঁ, আমাকে দিল্লী রেখে আসুন। আমাকে আপনি বাঁচিয়েছেন, এ কাজটুকু আপনাকে করতেই হবে।

বনহুর তখন ভেবে চলেছে…কি আশ্চর্য! মিস আরতী আর মিস লুসীর মধ্যে কি অদ্ভুত মিল রয়েছে। কিছুতেই এদের দু’জনকে পৃথক বলে মনে হয় না। মিস আরতী কলকাতায় আর মিস লুসী কোন্‌ সুদূর দিল্লী শহরে…

কি ভাবছেন আপনি?

 ভাবছি আপনার কথা।

হাঁ, আমাকে উদ্ধার করে আপনি ভুল করেছেন মিঃ আলম। এখন আমার বোঝা আপনাকে অত্যন্ত বিব্রত করে তুলেছে।

না, এ তেমন আর কি। দিল্লী শহরে কোনদিন যাইনি, একবার গেলে শহরটা দেখে আসা যাবে।

বনহুরের কথায় খুশি হলো মিস লুসী, বললো সে আমাদের হোটেলেই থাকবেন, মা আপনাকে পেলে অনেক খুশি হবেন।

মিস লুসীর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করার পর বনহুর নিজ কক্ষে চলে গেলো।

*

দিল্লী এক্সপ্রেস।

 উল্কাবেগে গাড়ি ছুটে চলেছে।

 ফার্স্ট ক্লাশ কামরায় শুধু বনহুর আর লুসী।

ওদিকের সিটে মিস লুসী জড়োসড়োভাবে বসে আছে গাড়িতে হেলান দিয়ে। চোখমুখ তার নিতান্ত স্বচ্ছ স্বাভাবিক নয়। হাজার হলেও সে একটি তরুণী। অজানা-অচেনা এক যুবকের সঙ্গে নির্জন এক ক্যাবিনে তার মনে নানারকম সঙ্কোচ আর দ্বিধার উদয় হচ্ছিলো। মনের ভাব-ধারার কিঞ্চিৎ প্রকাশ পাচ্ছিলো তার চোখেমুখে।

বনহুর যদিও একটা বইএর মধ্যে ডুবে ছিলো তবুও দৃষ্টি মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছিলো মিস লুসীর দিকে। লুসীর অবস্থা মনে মনে বেশ আঁচ করে নিচ্ছিলো সে। কারণ একটা যুবতী একটি যুবকের পাশে নিতান্ত একা– সত্যি বড় অসহায়! হাসি পাচ্ছিলো বনহুরের লুসী বার বার হাই তুলছে কিন্তু ঘুমানোর সাহস হচ্ছে না তার।

বনহুর বসেছিলো সম্পূর্ণ বিপরীত আসনে। মাঝে প্রচুর জায়গা রয়েছে। বনহুর এবার বইখানা বন্ধ করে রেখে হাতঘড়ির দিকে তাকালো–রাত একটা পঁচিশ। মিস লুসী, আপনি শুয়ে পড়ুন। কথাটা শেষ করে বনহুর নিজে শুয়ে পড়লো হাতের উপর মাথাটা রেখে।

লুসী কিন্তু তবু শুতে পারলো না, বসে বসে হাই তুলছে।

বনহুর শুয়ে পড়লেও সহজে সে ঘুমাতে পারলো না, হাতের আড়ালে সে লুসীকে লক্ষ্য করছে। লুসীর সুন্দর মুখখানা তাকে আকৃষ্ট করছে; তার মধ্যে জেগে উঠেছে পুরুষত্ব মনোভাব। কিন্তু তার স্বভাব নয় দুর্বলের প্রতি অন্যায় আচরণ করা। লুসী এখন একটি পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখির মত অসহায়। তার প্রতি যে কোনো অত্যাচার করলে সে পারবে না এতটুকু বাধা দিতে! পারবে না সে চিৎকার করে কাউকে ডাকতে বা লাফিয়ে পড়ে প্রাণ। বিসর্জন দিতে। ক্যাবিনের দরজা-জানালা এখন সম্পূর্ণ বন্ধ। একটু পূর্বে মুষলধারে বারিপাত শুরু হয়েছিলো। ‘ বৃষ্টির ঝাপটা আসছিলো কামরার ভিতরে, তাই বনহুর বাধ্য হয়ে বন্ধ করে দিয়েছে জানালাগুলো। এখনও বাইরে বৃষ্টি পড়ছে অবিরত।

বনহুর মাথা উঁচু করে বললো–মিস লুসী, আপনি শুয়ে পড়ুন।

মিস লুসী তবু সাহস পাচ্ছিলো না, কি জানি যদি ঘুমিয়ে পড়লে মিঃ আলম তাকে আক্রমণ করে। অজানিত একটা ভয় তার মনকে চঞ্চল করে তুলছিলো।

বনহুর তার মনোভাব বুঝতে পেরে হেসে বললো–মিস লুসী, আপনি যা ভাবছেন তা মিথ্যা। আপনি নিঃসন্দেহে ঘুমাতে পারেন।

এবার লুসী না শুয়ে পারলো না।

বনহুর বিপরীত দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লো।

এবার সত্যি ঘুমিয়ে পড়লো লুসী আর বনহুর।

দিল্লী মেল তখন তীর বেগে ছুটে চলেছে।

 এক সময় ঘুম ভেঙে গেলো লুসীর। ধড়ফড় উঠে বসলো সে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। তাকালো ওদিকে সিটের দিকে। মিঃ আলম অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। সত্যি, ভদ্রলোক অত্যন্ত সৎ এবং মহৎ। শ্রদ্ধায় মিস লুসীর মাথা নুয়ে এলো যেন। এমন পুরুষ সে কমই দেখেছে, তাকে একা নিঃসঙ্গ অবস্থায় পেয়েও এ যুবকটি কোনো রকম কুৎসিৎ ইঙ্গিত করেনি।

মিস লুসী তাকিয়ে রইলো বনহুরের ঘুমন্ত মুখের দিকে। এমনভাবে মিস লুসী ওকে কোনোদিন দেখেনি। বড় ভালো লাগলো ওকে! সুন্দর বলিষ্ঠ দীপ্তময় একটি ঘুমন্ত মুখ।

কতক্ষণ লুসী তাকিয়ে ছিলো বনহুরের ঘুমন্ত মুখের দিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ দেখলো সে…চলন্ত গাড়িখানার দরজা খুলে গেলো আস্তে করে! একটা গালপাট্টাবাধা লোক প্রবেশ করলো গাড়ির মধ্যে। লোকটার হাতে সূতীক্ষ্ণধার একটা ছোরা, ক্যাবিনের আলোতে ঝকঝক করে উঠলো।

মিস লুসী চিৎকার করতে যাবে ঠিক সে মুহূর্তে লোকটা লুসীর মুখ বাম হস্তে চেপে ধরলো। তবু একটা আর্তনাদের ক্ষীণ শব্দ বেরিয়ে এলো লুসীর মুখ থেকে।

ঘুম ভেঙে গেলো বনহুরের। তাকিয়েই উঠে বসলো বিদ্যুৎ গতিতে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো জ্বলে উঠলো আগুনের ভাটার মত।

ডাকু তখন মিস লুসীকে চেপে ধরে তার বুকের কাছে সূতীক্ষ্ণধার ছোরাখানা উদ্যত করে ধরেছে।

বনহুর সহসা এগুতে পারলো না, কারণ সে এতোটুকু অগ্রসর হলেই দুবৃর্ত্ত লুসীর বুকে ছোরা বসিয়ে দিতে কসুর করবে না।

দাঁতে দাঁত পিষে বনহুর বললো–কোন সাহসে তুমি এ কামরায় প্রবেশ করেছো?

 ডাকুও তেমনি কঠিন কণ্ঠে জবাব দিলো–এ কামরা শুধু তোমার জন্য নয়। তাছাড়া লুসীকে নিয়ে তুমি কোথায় ভাগছো শুনি?

বনহুর অবাক হলো, ডাকু তা হলে নতুন লোক নয়। সে রীতিমত লুসীকে চেনে। বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ হলো, বললো সেলুসীকে তুমি চেনো দেখছি!

শুধু চিনিই না, সে আমার শিকার।

কে তুমি?

 হেসে উঠলো ডাকু হাঃ হাঃ হাঃ আমার পরিচয় জানতে চাও! …আমার পরিচয় জানে লুসী।

লুসীর মুখ তখন মরার মুখের মত বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে! চোখেমুখে ভীতি আর উদ্বিগ্নতার চিহ্ন, করুণ চোখে তাকাচ্ছে লুসী বনহুরের মুখের দিকে। লুসী আর্তকণ্ঠে বলে উঠে–ধীরেন, তুমি আবার আমার কাছে এসেছো। ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমাকে…

বনহুর বুঝতে পারে–এই সে ধীরেনচরণ ভদ্রে, যার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য লুসী একদিন গঙ্গার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। সুযোগের অপেক্ষা করছে বনহুর, কেমন করে লুসীকে ওর কবল থেকে নিরাপদে সরিয়ে আনবে। এখনও লুসী শয়তানটার হাতের মুঠায়, ওর বুকের কাছে উদ্যত সূতীক্ষ্ণধার ছোরা।

বনহুরের হস্তদ্বয় মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছে। অধর দংশন করে সে। শয়তান ধীরেনচরণ লুসীকে নিয়ে পিছন হটছে।

গাড়ি তখন উদ্দাম গতিতে ছুটে চলেছে। গাড়ির জানালাগুলো সব বন্ধ। শুধু দরজাটা খোলা অবস্থায় রয়েছে। গাড়ি যখন লক্ষ্ণৌ ষ্টেশনে দাঁড়িয়েছিলো সে মুহূর্তে শয়তান ধীরেনচরণ গাড়ির পা-দানিতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারপর গাড়ি যখন ফুল স্পীডে চলতে শুরু করেছিলো তখন সে প্রবেশ করেছিলো গাড়ির মধ্যে।

ধীরেনচরণ যেমন লুসীকে নিয়ে পিছন হটতে গিয়ে আসনে ধাক্কা খেয়েছে, অমনি বনহুর লাফিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে তাকে। আচম্‌কা আক্রমণে ধীরেন পড়ে যায় গাড়ির মেঝেতে। লুসীও পড়ে যায় তার সঙ্গে। বনহুর লুসীকে এক টানে সরিয়ে দিয়ে বাম হস্তে চেপে ধরে শয়তানটার গলা। আর দক্ষিণ হস্তে ছোরাসহ। ধীরেনের দক্ষিণ হস্তখানা এঁটে ধরে।

শুরু হলো ভীষণ ধস্তাধস্তি।

 মিস লুসী ওদিকে দাঁড়িয়ে ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে দারুণ উৎকণ্ঠতার ভাব।

 বনহুর নিরস্ত্র আর ধীরেনচরণের হস্তে সূতীক্ষ্ণধার ছোরা।

বনহুর চেষ্টা করছে ওর হাত থেকে ছোরাখানা সরিয়ে নিতে।

সেকি তুমুল লড়াই। দস্যু বনহুর আর ধীরেনচরণ ভদ্রে। চলন্ত ট্রেন উল্কাবেগে ছুটে চলেছে। মেলের প্যাসেঞ্জারগণ নিজ নিজ আসনে নিশ্চিত মনে ঘুমাচ্ছে, কেউ জানে না তাদেরই ট্রেনের একটি কামড়ায় এতো কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে!

মিস লুসী এগুতে চেষ্টা করছে…গাড়ির চেইন টানবে, কিন্তু ওদিকে যাবার সুযোগ পাচ্ছে না।

ধীরেনচরণ যতই শক্তিমান হোক, দস্যু বনহুরের সঙ্গে পেরে উঠা মুস্কিল।

ধীরেন অল্পক্ষণেই কাবু হয়ে পড়লো। তার হাতের ছোরাখানা ছিটকে পড়েছে দূরে। এবার সে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

বনহুরের এক একটা ঘুষি এসে পড়ছে ধীরেনচরণের নাকের উপর। এবার সে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

দিল্লী এক্সপ্রেস যখন লক্ষৌ ব্রীজ অতিক্রম করছিলো। ধীরেন হঠাৎ বনহুরের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে লাফিয়ে পড়লো ব্রীজের নিচে যমুনাবক্ষে।

বনহুর ট্রেনের দরজায় ঝুঁকে তাকালো নিচের দিকে। গাঢ় অন্ধকারে কিছু দেখা গেলো না। ট্রেন তখন ব্রীজ অতিক্রম করে ছুটে চলেছে।

দরজা বন্ধ করে ফিরে এলো বনহুর মিস লুসীর পাশে। পাশের আসনে ছিটকে পড়া ধীরেনের হস্তের ছোরাখানা হাতে তুলে নিয়ে একবার ছোরাখানা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে ফেলে দিলো জানালা দিয়ে বাইরে।

লুসীর দু’চোখে বিস্ময়! নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সে বনহুরের বলিষ্ঠ দীপ্ত ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডলের দিকে। হঠাৎ লুসীর দৃষ্টি চলে যায়, দেখতে পায় বনহুরের দক্ষিণ বাহুর একটি জায়গা দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। হয়তো ধীরেনচরণের ছোরার সামান্য একটু আঁচড় লেগেছিলো।

লুসী ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠেই কি সর্বনাশ, আপনার হাত কেটে রক্ত পড়ছে!

লুসীর কথায় বনহুর ফিরে তাকায় নিজের বাহুর দিকে। এতোক্ষণ সে খেয়ালই করেনি, তার বাহু কেটে রক্ত পড়ছে।

তাড়াতাড়ি লুসী বনহুরের ক্ষতটা চেপে ধরে। তারপর নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে দিতে থাকে যত্ন করে। বলে সে আমার জন্য আপনাকে এতো কষ্ট ভোগ করতে হলো মিঃ আলম!

বনহুর পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে–এমন কিছু হয়নি মিস লুসী, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

সত্যি আপনার মত মহঞ্জন আমি এর পূর্বে দেখিনি। আপনি মহান ব্যক্তি।

অত্যন্ত বাড়িয়ে বলেছেন মিস লুসী।

না, আমি একটুও বাড়িয়ে বলিনি। আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

 যতক্ষণ না আপনাকে আপনার মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি, ততক্ষণ আমি নিশ্চিন্ত নই।

মিঃ আলম।

বলুন মিস লুসী?

না থাক, আজ নয় পরে বলবো।

বেশ তাই বলবেন।

 লুসী বনহুরের হাতে ব্যাণ্ডেজ বাধা শেষ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অপূর্ব দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকে লুসী বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুরও চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে না।

লুসী বলে–মিঃ আলম, আপনি কি আমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়েই চলে আসবেন?

না, আমি কয়েকদিন দিল্লীতে অপেক্ষা করবো, কারণ এ শহরটি আমি দেখিনি।

আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো লুসীর চোখ দুটো, বললো সে–তাহলে আমাদের হোটেলেই থাকছেন তো?

 সেকথা এখনও সঠিক বলতে পারি না মিস লুসী।

 কেন? আমাদের হোটেলে থাকাটা আপনার কাছে কি কষ্টকর হবে?

ঠিক তা বলছি না, তবে কখন কোথায় থাকবো বলে উঠতে পারছি না কিনা।

না, আপনাকে আমাদের ওখানেই থাকতে হবে।

 বেশ, চেষ্টা করে দেখবো।

চেষ্টা নয় থাকতেই হবে। মিস লুসী এতক্ষণে যেন অনেকটা সচ্ছ হয়ে এসেছে। বনহুরের পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে সে। একান্ত আপন জন বলে ওকে মনে হয় ওর।

বনহুর সিগারেট বের করে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে। একরাশ ধুম নির্গত করে বলে মিস লুসী, আপনার আর আমার মধ্যে পরিচয় অতি অস্বাভাবিক। কিন্তু আপনার মধ্যে যে একটি রূপ আমি দেখেছি, সেটা অতি আশ্চর্য।

কি রকম? প্রশ্ন করলো লুসী।

বললো বনহুর–ঠিক আপনার মতই আর একটি মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো।

 অবাক হয়ে শুনতে থাকে লুসী!

বনহুর বলে–আমি প্রথমে তাকেই মনে করেছিলাম। কারণ আপনার আর তার মধ্যে অদ্ভুত মিল রয়েছে।

এবার বুঝেছি–তারই নাম বুঝি মিস আরতী।

হাঁ, সে মেয়েটির নাম মিস আরতী।

আপনার সঙ্গে তার কি সম্বন্ধ মিঃ আলম?

আমার পিয়ানোভক্ত সে।

ও। ছোট্ট একটা শব্দ করলো লুসী।

বনহুর আর লুসী এরপর আর দু’চোখ বন্ধ করলো না। লুসী এবার বনহুরের পাশ থেকে সরে পরের আসনেও গেলো না। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে রইলো।

লুসীর চোখেমুখে তখনও ভয়ের আভাস।

কথার ফাঁকে বার বার তাকাচ্ছে সে গাড়ির দরজার দিকে।

 বনহুর অভয় দিলে বললো–এবার নিশ্চিন্ত থাকুন মিস লুসী, আর সে আসবে না।

*

দিল্লী স্টেশন।

 দিল্লী এক্সপ্রেস এসে থামলো।

গাড়ি থামতেই বনহুর আর মিস লুসী নেমে পড়লো। লুসীর চোখেমুখে আনন্দোচ্ছাস–আবার সে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে তার মাতৃভূমিতে।

ট্রেন থেকে নামবার পূর্বেই বনহুর তার কালো চশমাটা পরে নিয়েছিলো। বনহুরের হাতে শুধুমাত্র একটি সুটকেস।

 দিল্লী ষ্টেশনে বনহুরের এ প্রথম পদক্ষেপ। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অগ্রসর হলো বনহুর আর মিস লুসী।

সামনে এগুতেই কতগুলো শিখ ড্রাইভার বনহুর আর লুসীকে ঘিরে ধরলো–ট্যাক্সি চাইএ বাবু সাব? ট্যাক্সি চাইএ?

অমনি ঘিরে ধরলো কয়েকজন টাংঙ্গীওয়ালা–টাংঙ্গী লিয়ে বাবুজী? টাংঙ্গী লিয়ে…টাংঙ্গী লিয়ে? বহুৎ জোরদার ঘঘাড়েওয়ালা টাংঙ্গী…

যদিও ভোর হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, লাইটগুলো তখনও দপ দপ করে জ্বলছে। কুলি আর টাংঙ্গীওয়ালাদের চিৎকার আর হাঁকাহাঁকিতে সরগরম হয়ে উঠেছে দিল্লী স্টেশন।

এখানের কুলি, খালাসী সবাই দিল্লীর অধিবাসী, তাদের চেহারা দেখলেই তা বোঝা যায়। দোহারা লম্বা, গায়ের রঙ লালচে-তামাটে, মাথার চুল সামান্য কটা এবং খুব ছোট করে ছাটা। চোখগুলো একটু ঘোলাটে ধরণের। পরনে ঢিলা পাজামা আর হাঁটু অবধি লম্বা ঝুল জামা। মাথায় মস্ত বড় পাগড়ি রয়েছে। কারো কারো মুখে দাড়ি আছে, কারো শুধু গোঁফ। কতকটা পাঞ্জাবী দেশের লোকের মত চেহারা এদের।

আর একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক হলো বনহুর। এদেশের ভিখারীদের ভিক্ষে করার ভঙ্গী দেখে। বিশেষ করে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ওরা হাত দিয়ে হোতনায় আঘাত করে একরকম অদ্ভুত শব্দ করছে– হেঁ কুঁ, হেঁ কু, হুয়া হুয়া, বাবু পয়সা দে, বাবু পয়সা দে…কেউ কেউ উচ্চারণ করছে–বাবু তোর লাথি খাই একটা পয়সা দে…

এ সব অদ্ভুত উক্তি শুনে হাসি পেলো বনহুরের। ভিখারী বাচ্চাগুলো একেবারে জেঁকের মত পিছু লাগলো। বনহুর এদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য দ্রুত পা চালালো। কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা, পয়সা না নিয়ে ছাড়বে না। যদিও বনহুরের ইচ্ছা ছিলো আরও কিছুটা অগ্রসর হয়ে তবে ট্যাক্সি নেবে কিন্তু তা হলো না। অগত্যা একটা ট্যাক্সি সামনে দেখে এগুলো। তখনও পিছনে গুটিকয়েক ট্যাক্সিচালক আর টাংঙ্গীওয়ালা ঘিরে রয়েছে। ভিখারী বাচ্চাদল তো আছেই! বনহুর প্রত্যেকের হাতে কিছু পয়সা গুঁজে দিয়ে ট্যাক্সিতে চেপে বসলো।

এতক্ষণে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো বনহুর।

লুসীও পাশে বসেছে।

শিখ ড্রাইভার বললো–কাঁহা যাইয়ে বাবুসাব?

 লুসীই বললো–মোগলাই রোড়ে বাঞ্ছারাম হোটেল।

 বহুৎ আচ্ছে। বলে গাড়িতে স্টার্ট দিলো শিখ ড্রাইভার।

বনহুর তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। দিল্লী নগরী কেন্দ্রস্থল অতিক্রম করে ট্যাক্সি তখন ছুটে চলেছে। পথের দু’ধারে সুউচ্চ অট্টালিকা আর মনোরম দোকানপাট। ট্রাম, বাস আর ট্যাক্সিগুলো শ্রেণীবদ্ধভাবে নিজ নিজ পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দোতলা বাসগুলো একটির পর একটি চলেছে, যেন ছোট ছোট। পিপীলিকার মাঝে এক একটি ভেঁয়ে পিঁপড়ে। সত্যি বড় সুন্দর লাগছে বনহুরের কাছে এ দিল্লী শহরটি।

আরও একটা জিনিস বনহুরকে অবাক করলো–অসংখ্য গাড়ি আর যানবাহনের মধ্যে উটের গাড়িগুলো। ঠিক এক্কা গাড়ির মত দেখতে; কতকটা টাঙ্গার মত মনে হয়। উটগুলো তো আর ঘোড়ার মত ছুটতে পারে না, আস্তে মনে হলেও বেশ দ্রুত পা চালিয়ে যাচ্ছিলো।

প্রশস্ত পথ।

পথে অসংখ্য যানবাহনের ভীড় থাকলেও তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না। বনহুর আর লুসীর গাড়ি এক সময় মোগলাই রোডে বাঞ্ছারাম হোটেলের সম্মুখে এসে থামলো।

দিল্লী শহরের প্রায় এক প্রান্তে এ হোটেল। মোগলাই রোড হয়ে কিছুটা অগ্রসর হলেই আগ্রা যাওয়ার বড় পথ। বাঞ্ছারাম হোটেল খুব বড় এবং সেকেলে ধরনের। অতি পুরানো হোটেল। নিচে হোটেল আর উপর। তলায় থাকে মিস লুসীর মা বাঞ্ছারাম পত্নী মিসেস বাঞ্ছারাম।

বনহুর আর লুসীর গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।

 বনহুর ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে স্যুটকেসটা হাতে তুলে নিলো। লুসী পথ দেখিয়ে অগ্রসর হলো।

পিছনে অনুসরণ করলো বনহুর।

দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো লুসী আর বনহুর। মহানগরী দিল্লীর বুকে এমন ফাটল-ধরা জিরজিরে অট্টালিকা কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছিলো বনহুরের কাছে।

চুন-বালি খসে পড়া, ইটগুলো কঙ্কালের দাঁতের মত হিস হিস করছে যেন। কালি আর ঝুলগুলোও ঝাড়া হয়নি যেন কতকাল। একটা দরজার সামনের এসে দাঁড়ালো, লুসী বললো–এটা আমার মায়ের ঘর।

বনহুর কোনো কথা বললো না। সে আশ্চর্য হয়েছে–লুসী যে তাকে নিয়ে হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে এতোদূর। এলো, তবু একটি লোক সে দেখতে পেলো না।

লুসী দরজার পুরোন পর্দাটা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো। বনহুর তাকে অনুসরণ করলো। ভিতরে প্রবেশ করে থমকে দাঁড়ালো বনহুর। বিস্ময়ে থ’ মেরে গেলো সে!

একটি জমকালো পাহাড় যেন বসে আছে একটা চৌকির উপর। লুসী ততক্ষণে ছুটে গিয়ে জমকালো পাহাড়টার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে–মা মাগো!

জমকালো পাহাড়টা আদতে মানুষ, এবং একটি মহিলা। মাঝারী একটি চৌকির উপর জেঁকে বসে আছে মহিলাটি। সম্মুখে মস্ত বড় একটা পানের বাটা, বাংলাদেশের পানের বাটার মত নয়। ঠিক একটা পিতলের ডেকচির মত।

লুসীকে মহিলাটির বুকের মধ্যে একটি ছোট্ট পুতুলের মত মনে হলো।

কিন্তু আশ্চর্য, লুসীর মা মিসেস বাঞ্ছারাম কন্যাকে দেখে কিছুমাত্র খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না। লুসী মায়ের মুখে বারকয়েক চুমু দিয়ে বললো–মা, জানো ইনি কে?

জমকালো মিসেস বাঞ্ছারাম তার গোলাকার প্যাটপ্যাটে চোখ দুটো তুলে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে, তারপর বললো–এ-ই বুঝি তোকে উদ্ধার করে এনেছে?

হাঁ মা, ইনি আমাকে বাঁচিয়েছেন। সত্যি ইনি না থাকলে আমাকে আর ফিরে পেতে না।

মিসেস বাঞ্ছারাম যখন কথা বলছিলো, তখন মনে হচ্ছিলো বাংলা বলা ঠিকমত অভ্যাস নেই তার। বেশ একটু থিতিয়ে থিতিয়ে বললো–ভালো কথা। যাও লুসী ওকে থাকবার ঘর দেখিয়ে দাও।

একটা ধন্যবাদ বা সহানুভূতিসূচক কোন কথাই উচ্চারণ করলো না মিসেস বাঞ্ছারাম। কন্যাকে ফিরে পেয়ে এতোটুকু খুশি হয়েছে বলে মনে হলো না।

লুসী বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–আসুন আমার সঙ্গে।

 বনহুর নীরবে অনুসরণ করলো লুসীকে।

ওদিকের কামরায় লুসী প্রবেশ করে ডাকলো–আসুন।

 বনহুর পাশের কামরায় প্রবেশ করতে গিয়ে একবার ফিরে তাকালো নিজের অজ্ঞাতে মিসেস বাঞ্ছারামের দিকে। বনহুর তাকাতেই দেখলো মিসেস বাঞ্ছারাম কেমন যেন অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে পাশের কামরায় প্রবেশ করলো বনহুর।

মিস লুসী তখন পাশের কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে পড়েছে।

বনহুর লুসীর পাশে এসে দাঁড়ালো। সব যেন কেমন রহস্যময় বলে মনে হলো তার কাছে। মিস লুসীকে গঙ্গার বুক হতে উদ্ধার থেকে হোটেল বাঞ্ছারাম পর্যন্ত ঘটনাটি বিদ্যুৎগতিতে মাথায় খেলে গেলো একবার।

মিস লুসী বললো–আপনি এ কক্ষে থাকবেন। এ কক্ষটা আমাদের নিজস্ব গেষ্টদের থাকবার জন্য।

বনহুর একবার কক্ষমধ্যে তাকিয়ে দেখে নিলো। দোতলায় এ কামরাটা খুব ছোট নয়। বাইরের মত ভিতরেও চুন-বালি খসা। ইটগুলো দাঁত বের করে হাসছে। ওদিকে দুটো জানালা। জানালার শিকগুলো সেকেলে, জং ধরে জিরজিরে হয়ে গেছে। কক্ষটা পুরোন হলেও ভিতরের আসবাবগুলো বেশ মূল্যবান এবং আধুনিক। এক পাশে একটা খাট–শাল কিংবা মেহগনি কাঠের তৈরি হবে। খাটে দুগ্ধফেননি শয্যা পাতা রয়েছে। মেঝেতে পুরু কার্পেট, কয়েকখানা সোফাসেট বেশ রুচিমত সাজানো আছে।

লুসী সুইচ টিপে ফ্যান চালু করে দিলো। বললো সে–আপনি বিশ্রাম করুন। আমি খাবার আনছি।

বনহুরকে কোনো কথা বলার সময় না দিয়ে বেরিয়ে গেলো লুসী। খুশিতে আজ সে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

বনহুর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর একটা সোফায় বসে সিগারেট কেস্ বের করে একটা সিগারেট ধরালো। ধূম্র পান করতে করতে কক্ষমধ্যে নিপুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো! হঠাৎ বনহুর দেখলো…তার পায়ের নিচে কার্পেটখানায় এক জায়গায় খানিকটা জমাট রক্ত লেগে আছে। কিন্তু রক্তটা বেশ করে মুছে তুলে ফেলা হয়েছে। লাল কার্পেট রক্তের দাগ চট করে কেউ ধরতে পারবে না। রক্তটা শুকিয়ে কালো হয়ে উঠেছে।

বনহুর উবু হয়ে রক্তের দাগটা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখছিলো এমন সময় দরজায় পদশব্দ শুনে সজাগ হয়ে বসে সে।

ট্রের উপরে খাবার নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে মিস লুসী। বনহুরকে সোফায় বসে থাকতে দেখে বলে– আপনি এতোক্ষণ জামা-কাপড় ত্যাগ করেননি মিঃ আলম?

ও, সে কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছি। বনহুর হস্তস্থিত অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা এ্যাসট্রেতে নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়ায়।

মিস লুসী টেবিলে খাবারগুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলে–চট করে ফিরে আসবেন কিন্তু বাথরুম থেকে।

বনহুর জামাটা খুলে আলনায় রেখে বাথরুমে প্রবেশ করলো।

পুরোন হলেও বেশ রুচিপূর্ণ বাথরুম।

বনহুর ঠাণ্ডা পানিতে বেশ করে চোখমুখ ধুয়ে নিলো, মন থেকে হিজিবিজি চিন্তাধারা মুছে ফেলতে চেষ্টা করলো, বিশেষ করে তখনকার মত।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো, মিস লুসী টেবিলে তার খাবার সাজিয়ে নিয়ে বাংলার বধুর মত গালে হাত দিয়ে নিশ্চুপ বসে আছে। ফ্যানের হাওয়ায় চুলগুলো উড়ছে।

বনহুর এসে বসলো টেবিলে পাশের চেয়ারে।

মিস লুসী পাকা গৃহিণীর মত বললো-খিদেয় খুব কষ্ট পেয়েছেন। নিন, চটপট খেয়ে নিন এবার। প্লেটে খাবার উঠিয়ে দিচ্ছিলো লুসী।

বনহুর খেতে বসলো সুবোধ বালকের মত, ক্ষুধাও পেয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু খাবারগুলো যেন কণ্ঠ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। বনহুরের দৃষ্টি নিজের অজ্ঞাতে মেঝের কার্পেটে চলে যাচ্ছিলো। ওখানে নিশ্চয়ই কোনো নরহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার বুকের রক্ত কার্পেটখানাকে সিক্ত করে তুলেছিলো এক সময়। কিন্তু সে সে ব্যক্তি ছিলো, কেনই বা তাকে হত্যা করা হয়েছিলো…এমনি নানা চিন্তায় বনহুর আনমনা হয়ে পড়েছিলো।

মিস লুসী বললো–মিঃ আলম, খাবারগুলো বুঝি খুব খারাপ লাগছে?

বনহুরের এতোক্ষণ তেমনভাবে কোনো খেয়ালই হয়নি–খাবারগুলো শুধু গলাধঃকরণ করেই চলেছিলো, কেমন লাগছে খেতে তা তো লক্ষ্য করেনি। এবার বলে উঠলো–চমৎকার হয়েছে!

তবে খাচ্ছেন না কেন?

এই তো অনেক খেয়ে ফেলেছি।

মিঃ আলম, আমার মা কিন্তু বড় খামখেয়ালী। তাকে আপনার কেমন লাগলো?

হ্যাঁ কি বললেন?

 আমার মাকে আপনার কেমন লাগলো?

বনহুর মুখের খাবারটুকু গিলে বললো–অত্যন্ত মধুর।

কি বললেন?

 মানে, বেশ লোক কিন্তু উনি।

মাকে দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন না, না তার ভিতরটা কেমন উনি খুব ভাল মানুষ।

আমি তা বুঝতে পেরেছি মিস লুসী যখন তাকে প্রথম দেখেছি।

এ-কথা সে-কথার মধ্যে খাওয়া-পর্ব শেষ হয়।

 তখনকার মত শয্যায় দেহটা এলিয়ে দেয়ে সে।

 মিস লুসী বেরিয়ে যায়।

বনহুর বাইরে বের হবার জন্য তৈরি হয়ে নিচ্ছিলো, এমন সময় লুসী এসে দাঁড়ায় তার পাশে, হেসে বলে– বাইরে যাবেন বুঝি?

বনহুর টাইটা ঠিক করতে করতে বলে–হাঁ, দিল্লী শহরটা একবার পরিভ্রমণ করে আসি।

 মিঃ আলম, আমিও যাবো আপনার সঙ্গে।

চলুন।

অবশ্য আপনার কোনো অসুবিধা হলে…

না না, আপনি গেলে আমার ভালোই হবে, কারণ এখানের পথঘাট আমার কিছু চেনা নেই।

মিস লুসী সহ বনহুর বেরিয়ে পড়লো।

বনহুর আর লুসী যখন গাড়িতে উঠে বসেছিলো তখন হঠাৎ বনহুরের দৃষ্টি চলে গেলো হোটেলের দ্বিতলের বেলকনিতে। একখানা হেঁড়ে মুখ আলগোছে সরে গেলো যেন আড়ালে। বনহুর বুঝতে পারলো–ও মুখখানা অন্য কারো নয়, মিসেস বাঞ্ছরামের।

ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

 দিল্লীর চৌরঙ্গীর মোড়ে এসে বললো বনহুর–মিস লুসী, ট্যাক্সি ছেড়ে, চলুন টাংঙ্গী গাড়িতে যাওয়া যাক। সবদিক ভালোভাবে দেখতে পাওয়া যাবে।

তাই হলো। ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে একটা টাংঙ্গী ধরে উঠে বসলো বনহুর আর মিস লুসী। প্রথমে বনহুর আগ্রার পথে রওয়ানা দিলো। তাজমহলের অনেক নাম শুনেছে সে কিন্তু আজও দেখবার সৌভাগ্য হয়নি।

টাংঙ্গী আগ্রার পথে অগ্রসর হলো।

শহর ছেড়ে সোজা একটা পথ চলে গেছে আগ্রার দিকে। পথের দু’ধারে ধূসর প্রান্তর, মাঝে মাঝে। নানারকম বৃক্ষ-লতা-গুল্মের ঝাড় আর সবুজ বনানী। পথের দুপাশ দিয়ে সারিবদ্ধ শাল আর সেগুন গাছ।

বনহুর অবাক হয়ে দেখলো–পথের পাশের গাছপালার মধ্যে অসংখ্য ময়ুর আর ময়ুরী পেখম তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। টাংঙ্গীর শব্দে সরে যাচ্ছিলো কোনোটা বা ফিরে দেখছিলো টাংঙ্গীর দিকে। ময়ূরপাখি ছাড়াও কাকাতুয়া আর ময়নার ঝাক এ-গাছ থেকে ও-গাছে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে।

মুগ্ধ নয়নে বনহুর এ সব দৃশ্য দেখছিলো।

লুসী এসব জায়গার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত। সে সব বুঝিয়ে বলে দিচ্ছিলো। এ সব অঞ্চলের আবহাওয়া অত্যন্ত শুষ্ক। একটা উষ্ণতা অনুভব করছিলো বনহুর নিজের দেহে। আকাশ সচ্ছ নির্মল। কোথাও মেঘের খণ্ড ভেসে নেই। বাতাসও যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে।

বনহুরের টাংঙ্গীর পাশ কেটে চলে যাচ্ছে কতরকম যানবাহন। বেশির ভাগ ট্যাক্সি আর উটের গাড়ি। ক্কচিৎ দু’চারটে বড় বাস চলে যাচ্ছে দিল্লী থেকে আগ্রার দিকে। লুসী বললো–এ রাস্তা ছাড়াও আগ্রা যাওয়ার আর একটি পথ আছে। সে পথটি অত্যন্ত জনাকীর্ণ এবং যানবাহন পরিপূর্ণ।

কিন্তু আমার পক্ষে এ পথটাই বেশি শ্রেয়ঃ।

আপনি দেখছি নির্জনতা বেশি পছন্দ করেন।

 হা মিস লুসী আমি তাই চাই।

আচ্ছা মিঃ আলম, প্রথমে তাজমহল দেখতেই যাবেন মনস্থ করেছেন। না অন্য কোথাও?

না, অন্য কোনো জায়গা দর্শনের পূর্বে আমি আগ্রার তাজমহল দেখাই মনস্থ করেছি।

এ-কথা সে-কথার মধ্যে এক সময় বনহুর আর লুসী এসে পৌঁছে গেলো আগ্রায়। বেশ কিছু দূরে থাকতেই তাজমহলের অপরূপ দৃশ্য বনহুরের দৃষ্টি গোচর হলো। নীল আকাশের বুকে যেন শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা একটি ছবি।

তাজের বড় গেটটার সম্মুখে এসে টাংঙ্গী থামলো।

নেমে দাঁড়ালো বনহুর আর মিস লুসী।

গেটের মুখেই কতগুলো ফেরিওয়ালা শ্বেত পাথরের ছোট-বড় তাজমহল আর নানারকম পাথরের খেলনা নিয়ে বিক্রি করছে। কাঠের পুতুল আর মোমের পুতুলগুলো বড় সুন্দর মনোরম! বিশেষ করে বনহুর একটা তাজমহল তুলে নিলো হাতে, অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে।

লুসী হেসে বললো–সত্যিকারের তাজমহলের কাছে এসে নকল তাজমহল নিয়ে মাতলেন দেখছি।

বনহুর একটু লজ্জিত হলো, ফেরিওয়ালার হাতে ছোট্ট তাজমহলটা ফিরিয়ে দিয়ে বললো–রেখে দাও, ফেরার পথে নেবো।

লুসী আর বনহুর গেট পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।

অপূর্ব সে দৃশ্য!

বনহুর কিছুক্ষণ নির্বাক স্থির নয়নে তাকিয়ে রইলো। সেখান হতে তাজের সম্পূর্ণ অংশটা দেখা যাচ্ছে। শুভ্র বলাকার মত ধবধবে সাদা মর্মরে গাঁথা তাজমহল। বনহুর কবি নয়, না হলে সে এ মুহূর্তে একটি সুন্দর কবিতা সৃষ্টি করতে পারতো। মখমলের গালিচার মত সবুজ দুর্বার চাদর বিছানো, মাঝখানে ফোয়ারার সারি। দু’পাশ কাচি-ছাটা পাইন গাছ। ফোয়ারার দু’পাশ দিয়ে দুটো পথ সোজা চলে গেছে তাজের দিকে! দক্ষিণ দিকের। পথ দিয়ে অগ্রসর হলো লুসী আর বনহুর। কারণ এ পথেই দর্শকগণ এগিয়ে চলেছে। আর যারা ফিরে আসছে। তারা বাম দিকের পথ ধরে আসছে।

বনহুর আর লুসী অগ্রসর হলো তাজমহলের দিকে।

তাজের নিকটে পৌঁছতেই আরও অবাক হলো বনহুর। একটি লোক সকলের পা থেকে জুতো খুলে নিচ্ছে, আর যাদের মাথায় কোনোরকম সাহেবী টুপী রয়েছে সেগুলোও খুলে রাখছে সে। লোকটির সম্মুখে জুতো আর টুপি পাকার হয়ে উঠেছে। কয়েকটি লোক সারিবদ্ধভাবে জুতো ত্যাগ করার পর বনহুর আর লুসী গিয়ে দাঁড়ালো।

খাদেম লোকটা বনহুরের জুতো খুলে নিয়ে তাদের এক রকম সাদা কাপড়ের জুতো পরতে দিলো।

বনহুর আর লুসী কাপড়ের জুতো পরে নিয়ে এগুলো। অপূর্ব সুন্দর এ তাজমহল! শ্বেত পাথরে তৈরি তাজের গায়ে শুধু পবিত্র কোরানের আয়াত লেখা রয়েছে। তাজের কারুকার্য-নৈপুণ্য বনহুরের চোখে যেন তাক লাগিয়ে দিলো। না জানি কোন আলেম-শিল্পীর নিপুণ তুলির আঁচড়ে খোদাই করা হয়েছে এ আরবি অক্ষরগুলো।

তাজের চারপাশে চারটি মিনার। বনহুর লুসীসহ একটি মিনারে উঠে গেলো! অবশ্য তাকে এখানে খাদেমের হাতে কিছু বখশীস দিতে হলো।

মিনারের ভিতরে সিঁড়িগুলো বেশ চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে উপরের দিকে উঠে গেছে। প্রত্যেকটা সিঁড়ির বাঁকে একটি জানালা। ভিতরে আলোর কোন ব্যবস্থা নেই। এসব জানালাপথে পৃথিবীর আলো-বাতাস প্রবেশ করে মিনারের ভিতরটা উজ্জ্বল করে তোলে।

লুসী আর বনহুর মিনারের একেবারে শেষ অবধি উঠে গেলো। উপর থেকে জানালাপথে নিচে তাকালো বনহুর। নিচের লোকজনদের একেবারে ছোট্ট ঠিক লিলিপুটের মত মনে হলো।

কিন্তু নামবার সময় হলো মজাটা।

লুসী এতগুলো সিঁড়ি অতিক্রম করে উপরে উঠতে বেশ হাঁপিয়ে পড়েছিলো, নামবার সময় অত্যন্ত হাঁপাচ্ছিলো সে।

বনহুর বললো মিস লুসী, আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে আমার হাত ধরে নেমে চলুন।

 লুসী যেন এতোক্ষণে আশ্বস্ত হলো। বনহুরের হাতের উপর হাত রাখলো।

বনহুর আর লুসী নিচে নামতে লাগলো।

লুসীর কোমল উষ্ণ হাতখানা বনহুরের বলিষ্ঠ হাতের মুঠায় ঘেমে ভিজে উঠেছে। বনহুর নিজের মধ্যে একটা অনুভূতি উপলব্ধি করলো যেন। কেমন যেন একটা আলোড়ন তার ধমনীর রক্তকে চঞ্চল করে তুললো। লুসীর দেহের সেন্টের সুমিষ্ট একটা গন্ধ তাকে মোহগ্রস্ত করে ফেললো! বনহুর লুসীকে আকর্ষণ করলো নিজের দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো সে, লুসীর হাত ধরে দ্রুত নেমে এলো নিচে।

লুসী বনহুরের আচরণে অবাক হলো, কিন্তু সে কোনোরকম উক্তি প্রকাশ করল না।

 মিনার থেকে বেরিয়ে এলো ওরা দু’জনা।

তাজমহলের অপরূপ দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করতে লাগলো বনহুর আর লুসী। যদিও লুসী ইতিপূর্বে আরো কয়েকবার তাজমহল দেখবার সুযোগ লাভ করেছে, তবু আজ নতুন করে যেন দেখছে সে তাজের সৌন্দর্য।

তাজমহলের পিছনে এসে দাঁড়ালো ওরা।

 যমুনা…তার উপরে যেন ভাসছে তাজমহল।

স্নিগ্ধ-শীতল বাতাস বইছে। যমুনার বুকে পালতোলা নৌকাগুলো মন্থর গতিতে হেলেদুলে এগিয়ে চলেছে। কোন্ অজানার পথে।

বনহুর নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে। তাজের তুষারধবল ছায়া ভাসছে যমুনার বুকে, কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে তাজের প্রতিবিম্বটা।

কতক্ষণ বনহুর তাকিয়েছিলো হয়তো তার মনের মধ্যে মমতাজের মুখখানাই উদয় হচ্ছে; তার পাশে আর একটি মুখ–সে হলো সম্রাট শাহজাহান!

লুসীর কথায় সন্বিৎ ফিরে পায় বনহুর–বেলা শেষ হয়ে এলো, চলুন আজকের মত ফেরা যাক।

বনহুর ফিরে দাঁড়ায়–চলো। পরক্ষণেই বলে সে মাফ করবেন, একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম।

না না, আপনি এখন থেকে আমাকে তুমি’ই বলবেন। কারণ আমার চেয়ে আপনি অনেক বড়।

 একটু হাসলো বনহুর।

তাজমহলের খাদেমকে বলে বনহুর আর লুসী তাজের ভিতরে প্রবেশ করলো। বাইরের মত ভিতরটাও কারুকার্যখচিত। শ্বেত পাথরের গায়ে শিল্পীর নিপুণ হস্তের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে কোরআনের বাণীগুলো।

মেঝেতে পাশাপাশি দুটো কবর। মূল্যবান গেলাপে ঢাকা রয়েছে কবর দুটো। ভিতরে প্রবেশ করতেই সুমিষ্ট একটা গন্ধ বনহুর আর লুসীকে সাদর সম্ভাষণ জানালো! চন্দন আর লোবানের সুমিষ্ট গন্ধ এটা! হৃদয়ে যেন একটা অনুভূতি অনুভব করলো ওরা। বাদশাহ আজ ঘুমিয়ে পড়েছে, পাশে তার ঘুমন্ত মহিষী। কেমন একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে স্থানটিতে।

বনহুরের চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো নিজের অজ্ঞাতে। মনের কোণে উদয় হলো একটি মুখ–সে ঐ নূরী। না জানি নূরীর মৃতদেহ আজ কোথায় মিশে গেছে…

খাদেম জানালো তাদের এবার বেরিয়ে যেতে হবে।

বনহুর আর লুসী বেরিয়ে এলো তাজমহলের ভিতর থেকে। লুসী বললো–এখানে কারো প্রবেশ নিষেধ। কি-না, তাই খাদেম আমাদের বেশিক্ষণ থাকবার জন্য অনুমতি দিলেন না।

তাজমহল থেকে বিদায় নিয়ে বনহুর আর লুসী রওয়ানা দিলো সেকেন্দ্রা অভিমুখে। সেখানে নিশ্চিন্তে নিদ্রিত রয়েছেন দিল্লীর সম্রাট আকবর বাদশাহ্।

সেকেন্দ্রায় পৌঁছতেই বনহুর অবাক হয়ে দেখলো সেকেন্দ্রা টেট। দূর থেকেই লালে লাল মনে হচ্ছিলো, কে যেন আবির ঢেলে দিয়েছে। বেলাশেষের সূর্যের রশ্মিতে রক্তাক্ত মনে হচ্ছিলো সব!  

আকবরের সমাধিসৌধ দেখার পর বনহুর আর লুসী অন্দরমহলে চললো। সেকি সুন্দরভাবে তৈরি রাজপ্রাসাদ! দিল্লীর সম্রাট আকবরের বেগম মহল। পাশাপাশি সারি সারি কক্ষ। বেগম মহলের পাশেই চুড়ি মহল। এখানে আকবরের বেগমগণ চুড়ি পরতেন। এবার বনহুর আর লুসী চললো আরও ভিতরে, আকবরের হিন্দু বেগম মহলে।

বেশ সুন্দরভাবে তৈরি এ অন্দরমহলটা।

এখানে আকবরের হিন্দু বেগমগণ বাস করতেন। আকবরের কয়েকখানা তৈলচিত্র টাঙ্গানো রয়েছে দেখলো। ওরা। এ তৈলচিত্রে আকবর হিন্দু-সাজে সজ্জিত রয়েছেন। সেকি গম্ভীর বীর-পুরুষ চেহারা। দাড়িগুলো দু’ভাগে ভাগ করে কানের পিঠে সুন্দরভাবে আটকানো। কানে এবং গলায় মতির মালা শোভা পাচ্ছে। মাথায় মণি মুক্তা খচিত মুকুট।

বনহুর প্রতিটি ছবির পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছিলো। সম্রাট আকবরের শত শত চিহ্ন তার দৃষ্টির সম্মুখে ভেসে বেড়াচ্ছে যেন। এবার তারা আকবরের রাজপ্রাসাদ দেখা শেষ করে বেরিয়ে এলো। শেরশাহের স্থাপিত পাথরের ঘোড়ার মূর্তির সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। পাথরে খোদাই করা এ অশ্বমূর্তিটা সত্য বনহুরের মনে স্মরণ করিয়ে দিলো তার প্রিয় তাজের কথা। তাজের কথা মনে হতেই আনমনা হয়ে গেলো বনহুর।

লুসী বললো–আজ ফিরে চলুন মিঃ আলম। আবার আসা যাবে। এখনও অনেক বাকী আছে।

 হাঁ, আজ ফেরা যাক।

বনহুর আর লুসী এবার ট্যাক্সী নিয়ে চেপে বসলো।

বনহুর বললো–সত্যি লুসী, তোমার জন্যই আজ দিল্লী এলাম। তাইতো দেখতে পেলাম এতো সব।

বললো লুসী–কদিন থাকলে আরও কত কি দেখতে পাবেন–কুতুব মিনার, মতি মসজিদ, দিল্লী দুর্গ, দিল্লী দরবার, ময়ূর সিংহাসন…

হাসলো বনহুর ময়ূর সিংহাসন এখনও আছে নাকি?

আসল নেই, তবে নকলটা আছে।

বেশ তাহলে আর একদিন আসা যাবে।

 হোটেল বাঞ্ছারামে পৌঁছতে কিছুটা সময় লেগে গেলো। বনহুর আর লুসী হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো উপরে। লুসী বনহুরসহ প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে।

লুসী অগ্রে ছিলো, আর বনহুর পিছনে।

লুসী লক্ষ্য না করলেও বনহুরের দৃষ্টি এড়ালো না, লুসী আর সে প্রবেশ করতেই কে যেন মিসেস বাঞ্ছারামের কক্ষ থেকে দ্রুত পাশের কক্ষে চলে গেলো। লোকটা যে সিগারেট পান করছিলো তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। কারণ তখনও সিগারেটের একটা মিষ্টি গন্ধ কক্ষমধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো।

লুসী মায়ের কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে চুমু দিলো তার ফুটবলের মত গণ্ডে। মা কোনোরকম উক্তি প্রকাশ করলো না।

লুসী বললো–মা, উনি আগ্রায় তাজমহল দেখতে গিয়েছিলেন।

বেশ এবার ওকে ওর ঘরে যেতে দাও। আর তুমি খেয়ে নিজের কামরায় চয়ে যাও। টেবিলে তোমার খাবার ঢাকা দেওয়া আছে।

মিস লুসী আনন্দভরা কণ্ঠে বললো–তুমি খাবে না মা?

আজ আমি সকাল সকাল খেয়ে নিয়েছি।

লুসী আর বনহুর পাশের কক্ষে চলে গেলো।

বনহুরের জন্য টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া রয়েছে।

লুসী বললো–নিন, এবার খেয়ে নিন। ইস্ সারা দিন যা পরিশ্রম গেছে। বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে আপনার!

বনহুর জামাটা খুলতে খুলতে বললো- মোটেই না!

 আমার কিন্তু বড্ড ক্ষুধা পেয়েছে মিঃ আলম।

বনহুর জামাটা আলনায় রেখে, শয্যায় গা এলিয়ে দেয়!

লুসী বলে–বারে, শুয়ে পড়লেন যে?

এতো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, বিশ্রাম না করে খাবার উপায় নেই।

তাহলে আমি চলি, গুড নাইট।

অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো বনহুর–গুড নাইট!

মিস লুসী বেরিয়ে যায়।

বনহুর আর শুয়ে থাকে না, দ্রুত শয্যা ত্যাগ করে উঠে পড়ে। কলিং বেল টিপতেই বৃদ্ধা বয় চাঁদ এসে হাজির হলো-কিছু চাই বাবু?

বনহুর বললো–আমার মোটেই ক্ষুধা নেই, টেবিলের খাবারগুলো নিয়ে যাও!

সেকি বাবু, খাবেন না তা কি হয়! না খেলে গিন্নি-মাতা রাগ করবেন। আপনাকে খেতে হবে।

কিন্তু খাবার যে কোনো উপায় নেই চাঁদ। আচ্ছা চাঁদ, তুমি খেয়ে নিয়েছো?

কন কি বাবু? আমরা চাকর-বাকর মানুষ–সবার শেষে খাবো।

 বনহুর খুশি হয়ে বললো–তা হলে এক কাজ করো চাঁদ।

 বলুন বাবু?

আমার খাবারগুলো চেয়ারে বসে খেয়ে নাও।

 ছিঃ ছিঃ ছিঃ তা কি হয়?

 কেন হবে না। আমি বলছি খাও।

কিন্তু….

কেউ জানবে না। খাবার পর এটো থালাগুলো নিয়ে গিয়ে বলো বাবু খেয়েছে, বাস্ তা হলেই হলো।

বৃদ্ধা চাঁদ চাকর মানুষ, তাদের জন্য সব সময় আজে-বাজে খাবারগুলো থাকে ভালো খাবার কোনোদিনই তাদের ভাগ্যে জোটে না। সবার শেষে যা থাকে তাই ওরা খায়। বাবুর জন্য টেবিলে ঢাকা দেওয়া ভালো খাবারগুলোর লোভ চাঁদ ছাড়তে পারলো না। টেবিল থেকে থালাটা মেঝের এক কোণে নামিয়ে রেখে খেতে শুরু করলো।

বনহুর শয্যায় বসে তাকিয়ে রইলো চাঁদের দিকে।

খাওয়া শেষ হতে না হতে চাঁদ ঢলে পড়লো মেঝের কার্পেটে। বনহুর জানতো, আজ তার খাবার বিশুদ্ধ নেই…এটা তার সন্দেহ হয়েছিলো কাজেই সে খাবার স্পর্শ করেনি। যদিও ক্ষুধায় তার পেট চো চো করছে!

বনহুর দ্রুতহস্তে বয়ের দেহ থেকে তার পোশাকটা খুলে নিলো এবার, তারপর বয়কে তার শয্যায় শুইয়ে দিয়ে বেশ করে চাদর চাপা দিলো।

এবার বনহুর বয়ের ড্রেস আর নিজের সুটকেসটা নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করলো।

বনহুরের সুটকেসটার মধ্যে ছিলো তার ছদ্মবেশ ধারনের নানারকম জিনিসপত্র। বনহুর যখন তার বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন তাকে দেখলে বয় চাঁদ ছাড়া কিছু মনে হবে না। তেমনি দাড়ি-গোঁফ আর মাথার চুলগুলো সাদা, জ্বতেও পাক ধরেছে! একটু উবু হয়ে হাঁটছে সে–ঠিক চাঁদের মতই।

বনহুর সম্মুখের দরজা ভালোভাবে আটকে দিয়ে পিছন দিকের জানালার শার্শী খুলে বেরিয়ে পড়লো তার কক্ষ থেকে। অত্যন্ত দ্রুত সে এ কাজগুলো করে নিলো।

আর সে মুহূর্ত বিলম্ব না করে প্রবেশ করলো মিস লুসীর কক্ষে। মিস লুসী তখন বাথরুম থেকে ফিরে এসে সবেমাত্র খাবার টেবিলে বসেছে। মাথার উপর ইলেকট্রিক ফ্যানটা ভনভন করে ঘুরছে।

ফ্যানের হাওয়ায় মিস লুসীর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছিলো। দেহের কাপড়খানাও ঠিক সংযত নেই, এলিয়ে পড়েছে হাতের উপর।

চাঁদের আগমন টের পেয়ে বলে মিস লুসী, কিরে–এভোরাতে জেগে আছিস দেখছি?

দিদিমনি, তোমার খাবারটা বড্ড ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, যদি বলো গরম করে এনে দি। বনহুর তার গলার স্বর যতদূর সম্ভব চাঁদের অনুকরণ করে নিলো।

মিস লুসী জানে, চাঁদ তাকে অত্যন্ত স্নেহ করে, ছোট থেকে সে-ই নাকি ওকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে। কাজেই চাঁদের কথায় সে কিছুমাত্র অবাক না হয়ে বললো–আমার কিন্তু বড় ক্ষুধা পেয়েছে, খাবার গরম করতে দেরী হবে না তো?

এই তো এলাম বলে…বৃদ্ধ বয়ের বেশে দস্যু বনহুর লুসীর খাবার নিয়ে বেরিয়ে যায়!

হোটেলে প্রবেশ করে সে।

ছোট্ট কামরায় হোটেলের ম্যানেজারের খাবার ঢাকা দেওয়া আছে সে দেখতে পেলো। দ্রুতহস্তে টেবিল। থেকে খাবারের থালা হাতে তুলে নিয়ে লুসীর খাবারগুলো ঢাকা দিয়ে রাখলো যেমন ছিলো ঠিক তেমনি করে।

ফিরে এলো লুসীর কামরায়।

লুসীর সম্মুখে খাবার সাজিয়ে রেখে সরে দাঁড়ায় বৃদ্ধ বয়।

লুসী গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো।

বনহুরের সন্দেহ জেগেছিলো-যেমন তার খাবারে কোন বিষক্ত ঔষধ মেশানো হয়েছিলো, তেমনি লুসীর খাবারেও থাকতে পারে, তাই সে কৌশলে পাল্টে নিয়েছিলো খাবারগুলো! কারণ এখানে আসার পর তার সমস্ত ব্যাপারগুলো তেমন সুবিধার মনে হচ্ছিলো না। বিশেষ করে লুসীর মায়ের আচরণ কেমন যেন ঘোলাটে ঠেকছিলো।

লুসী খাওয়া শেষ করে বললো–চাঁদ, ওগুলো নিয়ে যা।

 চাঁদ টেবিলের এঁটো থালাগুলো নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। ডাকলো লুসী–ওগুলো রেখে একবার শুনে যাবি।

আচ্ছা দিদিমনি।

 চাঁদ বেরিয়ে যায়, একটু পরে ফিরে আসে সে–দিদিমনি, কিছু বলবে?

মিস লুসী তার দেহের জামাটা খুলে ফেললো। তারপর নাইট ড্রেস পরে নিলো সে। বৃদ্ধ চাঁদকে সে যেন কোনো সঙ্কোচই করে না। ছোটবেলা হতে ওকে দেখে আসছে, ওর হাতেই মানুষ হয়েছে কিনা তাই চাঁদ কতকটা ওর মায়ের মতই। বললো লুসী–চাঁদ, আজ বড্ড ঘুরেছি, পা দুটো আমার ব্যথা হয়ে গেছে। একটু টিপে দিবি?

এবার চাঁদবেশি দস্যু বনহুর একটু হতভম্ব হলো, শেষ পর্যন্ত তাকে…না না, এতে দোষ কি! বললো– দেবো দিদিমনি।

লুসী টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়ে বললো–আমি বই পড়ছি, তুই বেশ করে আমার পা দু’খানা দেবে দে চাঁদ।

লুসী বিছানায় শুয়ে পড়লো।

 চাঁদ বসলো ওর পাশে! কিন্তু সহসা লুসীর দেহে হাত রাখতে দ্বিধা বোধ করছিলো। সত্যি তো আর সে বৃদ্ধ চাঁদ নয়। তবু কোনো উপায় নেই, চাঁদের অভিনয় তাকে করে যেতে হবে।

লুসীর দেহে হাত রাখলো, আলগোছে টিপতেলাগলো ওর পা দু’খানা।

লুসী বইখানা কিছুক্ষণ চোখের সামনে মেলে ধরে তারপর বন্ধ করে রাখলো বুকের উপর, বললো–চাঁদ, ও ঘরে বাবু ঘুমিয়েছে?

বোধ হয় ঘুমিয়েছে কিন্তু কেন দিদিমনি?

 না এমনি বলছিলাম। আচ্ছা চাঁদ?

বলুন দিদিমনি?

বাবুকে তোর কেমন মনে হয়?

তেমনি সুবিধের বলে মনে হয় না আমার।

 সে কিরে?

 হ কেমন যেন বেয়াড়া ধরনের লোক।

 লুসী এবার বেশ রেগে গেলো, পা দু’খানা ওর হাতের তলা হতে সরিয়ে নিয়ে বললো–কি করে বুঝলি সে বেয়াড়া।

ঐ রকম মনে হয়।

 খবরদার, ওর সম্বন্ধে আর ওরকম কথা বলবি না। উনি বড় ভালো মানুষ। ওকে আমার খুব ভালো লাগে।

 সত্যি আপামনি?

 হাঁ। জানিস না উনি আমাকে মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচিয়েছেন!

 চাঁদ!

বলুন আপামনি?

 ওকে আমি ভালবেসে ফেলেছি।

 দিদিমনি।

হাঁ চাঁদ। জানিস না তুই, উনি মানুষ নন–দেবতা। ওকে আমি অন্তর দিয়ে ভালবেসেছি।

তুমি ভুল করেছে আপামনি।

না, আমি ভুল করিনি। চাঁদ,ওর মত মানুষ আমি আর দ্বিতীয় জন দেখিনি। জানিস না চাঁদ, আমি ওকে কতখানি ভালোবেসে ফেলেছি।

তা হয় না। তা হয় না দিদিমনি। একজন বিদেশী মানুষকে হঠাৎ এমন ভালোবাসা অত্যন্ত ভুল।

 চাঁদ, যার সম্বন্ধে কিছু জানিস না, তার সম্বন্ধে কিছু বলতে যাসনে।

কিন্তু আমি বলছি ওকে ভালোবেসে নিজেকে বিনষ্ট করোনা দিদিমনি…

মিস লুসী চাঁদের গালে ঠাই করে একটা চড় বসিয়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে, তারপর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে বেরিয়ে যা আমার সম্মুখ থেকে…যা বলছি..

শুভ্র দাড়ি-গোঁফের আড়ালে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো বনহুরের মুখে! ধীরে ধীরে কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলো বনহুর। ভাবলো, হায়রে নারী জাতি, তোমরা শুধু সরল মনে সবাইকে বিশ্বাস করতেই জানো! জানোনা উজ্জ্বল আলোর পেছনেই আছে গভীর অন্ধকার।

বনহুর নিজের কামরার দিকে অগ্রসর হলো, কিন্তু হঠাৎ তার কানে প্রবেশ করলো একটি চাপা কণ্ঠস্বর। থমকে দাঁড়ালো সে। কথার শব্দটা মিসেস বাঞ্ছরামের ঘর থেকেই আসছে বলে মনে হলো।

বনহুর লঘু পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো মিসেস বাঞ্ছরামের কক্ষের জানালার বদ্ধ শার্শীর পাশে। নিকটবর্তী হতেই শোনা গেলো অস্পষ্ট পুরুষ কণ্ঠ–বিশ হাজার দিয়েছি, কিন্তু মাল এখনও আমার ভোগে এলো না।

মিসেস বাঞ্ছারামের কণ্ঠ–সে দোষ কি আমার? আমি তো বারণ করিনি। নিয়ে যাও তুমি, আমার লোক সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।

সেই দুষ্ট লোকটাকেও তো অজ্ঞান করা হয়েছে?

হাঁ, তার খাবারেও ক্লোরফরম ঔষধ মিশানো হয়েছিলো। আর লুসীর খাবারেও। কিন্তু শোন ধীরেন, লুসীকে এতো বড় করতে আমার যা খরচা হয়েছে তা বিশ হাজারের অনেক বেশি। কাজেই আমাকে আরও দশ হাজার দিতে হবে, এবং পূর্বেও সে ভাবে কথা হয়েছিলো তোমার সঙ্গে।

বনহুর কান পেতে শুনছে। যা সে সন্দেহ করেছিলো তাই সত্য, লুসী নিশ্চয়ই মিসেস বাঞ্ছারামের মেয়ে নয়–কে সে। কার মেয়ে লুসী…আর ধীরেন, ধীরেন তাহলে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়েও মরেনি–সে বেঁচে আছে!

বনহুরের চিন্তায় বাধা পড়লো, আবার শোনা গেলো ধীরেনের কণ্ঠ-দশ হাজার দিতে রাজি আছি, কিন্তু যখন তোমার লুসী আমার বাধ্যের মধ্যে আসবে তার আগে নয়।

বনহুর জানালার ফাঁকে দৃষ্টি রেখে দেখলো–সেই লোক যে দিল্লী মেল থেকে লুসীকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলো–সেই ধীরেনচরণ। বনহুরের চোখ দুটো হিংস্র হয়ে উঠলো।

আবার বনহুর শুনতে পেলো ধীরেনের গলা–গাড়ি হোটেলের সম্মুখে তৈরি আছে!

আরও একটু বিলম্ব করো ধীরেন, কারণ এখনও হোটেলে লোক আছে। হাঁ, শোন আর একটা সুখবর আছে বলবো এবার।

কি সুখবর?

 গত পরশু রাতে ভীম সিংহকে হত্যা করা হয়েছে..

চমকে উঠে বনহুর, ভীম সিং–অভয়কর বিশ্বাসের বিশ্বস্ত অনুচর ভীম সিং। তার রিভলভারের গুলীতে একটি হাত ওর নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো চিরতরে। তবে কি সে ভীম সিং…

আবার শোনা গেলো মিসেস বাঞ্ছারামের গলা–ধীরেন, এখন তুমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থেকো। লুসীর ব্যাপারে শুধু সে-ই জানতো আর কেউ জানেনা লুসী অভয়কর বিশ্বাসের কন্যা…

আর একবার বনহুর চমকে উঠলো, লুসী অভয়কর বিশ্বাসের কন্যা–আশ্চর্য!

মিসেস বাঞ্ছারাম তখনও বলে চলেছে–ঐ ভীম সিং ওকে চুরি করে আমাকে এনে দিয়েছিলো। শুনেছি ওরা দুটি যমজ বোন ছিলো ঠিক এক রকম দেখতে। হাঁ, তার জন্য ভীম সিং আমার কাছ থেকে নগদ দশ হাজার টাকা নিয়েছিলো।

ধীরেনের কণ্ঠ–ভীম সিংকে হত্যা করে সব মুছে ফেলেছেন!

 হাঁ, লুসীর গোপন সংবাদ একমাত্র সে-ই জানতো।

তাকে হত্যা করার উদ্দেশ্য কি ছিলো মিসেস বাঞ্ছারাম?

লুসী যখন বড় হবে তখন ভীম সিংকে আরও পাঁচ হাজার দেয়ার কথা ছিলো, কারণ লুসী বড় হয়ে অপূর্ব সুন্দরী হবে–এটা সে জানতো এবং তার দামও হবে অনেক বেশি।

তাই বুঝি?

হাঁ, তাই সে বার বার কলকাতা থেকে ছুটে আসতো আমার কাছে, তার বাকি পাওনাটা বুঝে নিতে। আমাকে ভয় দেখাতে লুসীকে সব বলে দেবে।

তাই আপনি,..

হাঁ, তাই আমি পরশু রাতে তাকে খতম করে দিয়েছি।

বনহুর আড়ালে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো, সেদিন তার কামরায় কার্পেটে যে জমাট শুকনো রক্তের দাগ লক্ষ্য করেছে তা ঐ হতভাগ্য ভীম সিং-এর বুকের রক্ত।

আর বিলম্ব করা উচিৎ মনে করলো না বনহুর, সে দ্রুত নিজের কামরায় প্রবেশ করে শুধু রিভলভারটা তুলে নিলো পকেটে। তারপর বেরিয়ে এলো বাইরে। হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

হোটেলের সম্মুখে গাড়ি অপেক্ষা করছে দেখতে পেলো বনহুর। নিশ্চয়ই এটা সে গাড়ি যে গাড়িখানার কথা একটু পূর্বে ধীরেনের মুখে শুনেছে।

বনহুর গাড়িখানার পাশে গেলো, ড্রাইভার বসে বসে ঝিমুচ্ছে।

বনহুরের দেহে এখনও বৃদ্ধ বয় চাঁদের ড্রেস। বললো বনহুর–এই ড্রাইভার, তোমাকে ভিতরে ডাকছেন মিসেস বাঞ্ছারাম।

ড্রাইভার সোজা হয়ে বললো–আমাকে?

 হাঁ, কিছু বখশীস দিবেন উনি নিজের হাতে।

চলো! ড্রাইভার অনুসরণ করলো চাঁদকে।

চাঁদবেশি বনহুর ড্রাইভারকে নিয়ে হোটেলের মধ্যে ম্যানেজারের ছোট্ট কামরায় প্রবেশ করলো। দেখলো ম্যানেজার চেয়ারে কাৎ হয়ে পড়ে আছে। বুঝতে পারলো–লুসীর খাবার খেয়ে তার এ অবস্থা হয়েছে। বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে ড্রাইভারের বুকে রিভলভার উঁচু করে ধরলো। তারপর নাকের কাছে একটা রুমাল চেপে ধরতেই ড্রাইভার এলিয়ে পড়লো মেঝেতে।

বনহুর কৌশলে এ কাজগুলো সমাধা করে নিলো।

ড্রাইভার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতেই বনহুর ওর দেহের ড্রেস খুলে নিলো। পরেও নিলো ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। চাঁদ বয়ের ড্রেসটা পরে রইলো সেখানে।

গাড়িতে এসে বসে রইলো চুপ করে।

অল্পক্ষণ পর কয়েকজন মানুষ একটি যুবতীর সংজ্ঞাহীন দেহ ধরাধরি করে নিয়ে এলো গাড়ির পাশে।

ড্রাইভারবেশী দস্যু বনহুর বুঝতে পারলো, এ অন্য কেহ নয় মিস লুসী। তাকে নিশ্চয়ই ঘুমে ক্লোরফরম করে অজ্ঞান করা হয়েছে। গাড়ির হ্যাণ্ডেল চেপে বসে রইলো বনহুর।

লুসীকে লোকগুলো উঠিয়ে দিলো গাড়ির পিছন আসনে ড্রাইভিং আসনের পাশে চেপে বসলো শয়তান ধীরেন, বললো–ড্রাইভার চলো। জিন্সী রোড, ২৪ নং এ।

আচ্ছা স্যার। মুখে ‘আচ্ছা স্যার বললেও জিম্সী রোড কোথায় জানে না বনহুর, দিল্লীর পথঘাট তার তেমন করে পরিচিত নয়। তবু গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

জনহীন রাজপথ।

গাড়ি উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো।

ধীরেন বললো–কোন্ পথে যাচ্ছো?

স্যার, এ পথ দিয়েও যাওয়া যায়।

এ পথটাই বুঝি নির্জন?

 হ স্যার।

খুব সাবধানে গাড়ি নেবে ড্রাইভার। দেখে কেউ যেন টের না পায়। তোমাকে মোটা বকশীস দেবো।

 স্যার, একটা কথা বলবো?

 বলো?

 জিন্সী রোড আপনাদের জন্য খুব নিরাপদ নয়।

 কেন?

কারণ ওখানে গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার থাকেন। বড় সতর্ক ব্যক্তি তিনি। হঠাৎ যদি…।

তুমি কোথাকার কথা বলছো ড্রাইভার, জিন্সী রোডে পুলিশ গোয়েন্দা…

ঠিক সে মুহূর্তে বনহুর ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার চেপে ধরে ধীরেনের বুকে খবরদার নড়বে না!

বিস্ময়ভরা ভীত কণ্ঠে বলে ধীরেন কে তুমি?

হেসে উঠে বনহুর–আমিই জিন্সী রোডের সে পুলিশ গোয়েন্দা।

তুমি! তুমি…

 হাঁ, বন্ধু এবার তোমার পরিত্রাণ নেই।

সুচতুর ধীরেন হকচকিয়ে গেলো, একেবারে পুলিশ গোয়েন্দার কবলে পড়বে, কল্পনাও করতে পারেনি সে। কি করে উদ্ধার পাবে আর লুসীকে আত্মসাৎ করবে, এ চিন্তাই করতে লাগলো।

ঠিক সে মুহূর্তে পিছন আসনে মিস লুসী আর্তকণ্ঠে ককিয়ে উঠলো। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো বনহুর।

ধূর্ত ধীরেন আচম্বিতে বনহুরের হাতে আঘাত করতেই তার রিভলভারখানা ছিটকে পড়লো গাড়ির সামনের নিচে।

সঙ্গে সঙ্গে বনহুর রিভলভার তুলে নিতে গেলো কিন্তু জমাট অন্ধকারে সে কিছুই দেখতে পেলো না।

সে সুযোগে ধীরেন গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে অদৃশ্য হলো পথের ওপাশে। আর তার সন্ধান পাওয়া গেলো না!

বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে গাড়িতে ষ্টার্ট দিলো।

দিল্লীর পথঘাট তার পরিচিত নয়, কাজেই এ-পথ সে-পথ গাড়ি চালিয়ে বড় একটা হোটেলের সম্মুখে এসে গাড়ি রাখলো বনহুর।

লুসী তখন অনেকটা সুস্থ হয়ে এসেছে। বনহুর ওকে বললো–লুসী ভয় নেই–আমি মিঃ আলম।

আপনি!

 সব পরে তোমাকে বললো, এখন আমার হাত ধরে নেমে এসো।

কোথায় যাবো?

এটা একটা হোটেল। এ হোটেলের একটা ক্যাবিন রিজার্ভ করে থাকবো।

লুসীর মাথাটা তখনও ঝিমঝিম করছে, তবু বনহুরের শরীরে ড্রাইভারের ড্রেস দেখে বললো–আপনার শরীরে এ ড্রেস কেন?

সব পরে জানতে পারবে। এসো লুসী। বনহুর গাড়ির দরজা খুলে হাত বাড়ায় লুসীর দিকে।

 লুসীসহ বনহুর হোটেলে এসে উঠলো।

দিল্লীর বড় হোটেল গুলশান।

বনহুর বিপদে পড়লো…তার শরীরে এখন ড্রাইভারের ড্রেস। কাজেই হোটেলের ম্যানেজারের কাছে লুসীকে মালিক-পত্নী বলে পরিচয় দিলো সে।

হোটেলের ম্যানেজার মাহমুদ রিজভী অত্যন্ত ভালো মানুষ। তিনি স্বয়ং লুসীর জন্য ভালোভাবে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। কারণ লুসী তখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেনি।

প্রথমে ম্যানেজার মাহমুদ রিজভীর একটু সন্দেহ হয়েছিলো, কিন্তু পরে জানলেন, পথে হঠাৎ মাথা ঘুরে যাওয়ায় তার এ অবস্থা। তখন তিনি আর ভালোভাবে তার থাকা এবং খাওয়ার সব জোগাড় করে দিলেন।

লুসী রইলো ক্যাবিনে আর ড্রাইভারবেশি বনহুর রইলো তার দরজার পাশের বেলকুনিতে। অবশ্য ম্যানেজারের মত নিয়েই সে এখানে শুয়ে পড়লো।

লুসীর তখন ভালোই জ্ঞান হয়েছে, বললো–একি করেছেন?

 হেসে বললো বনহুর ড্রাইভারের ভাগ্যে এর চেয়ে বেশি কি আশা করা যায় বলো?

 রাতটা কোনোরকমে কাটলো।

*

পরদিন ড্রাইভারবেশী বনহুর ম্যানেজার সাহেবের কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো? যাবার সময় বললো–স্যার, মিসেস পারভিনের দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। আজ স্বয়ং মালিক মিঃ আলম আসবেন, আমি তাকে আনতে যাচ্ছি।

বনহুর লুসীর পরিচয় মিসেস পারভিন বলে দিয়েছিলো!

ম্যানেজার মাহমুদ রিজভী ড্রাইভারকে ভরসা দিলেন।

বনহুর চলে গেলো!

তারপর যখন বনহুর ফিরে এলো তখন তার দেহে মূল্যবান স্যুট। সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে তার চেহারা। কয়েক ঘন্টা পূর্বের সে ড্রাইভার যে এখনকার মিঃ আলম, এ কথা কেউ যেন ভাবতেই পারবে না।

ম্যানেজারকে এসে তার পরিচয় জানালো বনহুর।

ম্যানেজার সসম্মানে অভ্যর্থনা জানালেন, এবং বললেন–আপনার স্ত্রী এখন ভালো আছেন। তিনি নিজে মিঃ আলমকে নিয়ে চললেন লুসীর কামরার দিকে।

বনহুর আজ বিব্রত হলো না, কারণ এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। লুসীর স্বামীর অভিনয় তাকে করতেই হবে, বাঁচাতে হবে লুসীকে। তাকে পৌঁছে দিতে হবে তার বাবা অভয়কর বিশ্বাসের কাছে।

বনহুর লুসীর কক্ষে প্রবেশ করতে লুসী খুশিতে উচ্ছল হলো। এখন বনহুরের দেহে কোনোরকম ছদ্মবেশ নেই। স্বাভাবিক ড্রেস তার। বনহুরকে দিল্লীর কেউ চেনেনা, জানে না তার আসল পরিচয়। কাজেই বনহুরের স্বাভাবিক ড্রেসে এখানে কোনো অসুবিধা ছিলো না।

মাহমুদ রিজভী বনহুরকে ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিলো।

 মিস লুসী বললো–মিঃ আলম, আপনার জন্য আমি উদ্বিগ্ন রয়েছি। বলুন আমার মা কোথায়? এবং আমার এ অবস্থা কেন?

বনহুর ঠোঁটের উপর আংগুল চাপা দিয়ে বললো–আস্তে বলো লুসী! কেউ শুনে ফেললে বিপদ ঘটবে, কারণ তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ নও।

বনহুর একটা আসনে বসে পড়ে সিগারেট ধরালো।

 লুসী নির্নিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে বনহুরের সুন্দর-বলিষ্ঠ মুখমণ্ডলের দিকে। দৃষ্টি সে যেন ফিরিয়ে নিতে পারছিলো না।

বনহুর বললো–লুসী, যাকে তুমি মা বলে পরিচয় দাও, সে তোমার মা নয়।

লুসী অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–আপনি কি বলছেন মিঃ আলম!

 লুসী, মাফ করো–আমি তোমাকে কয়েকটি কথা বলবো, যা তোমার কাছে অশোভনীয় লাগবে।

 বলুন মিঃ আলম?

শোন লুসী, আমাকে কয়েকদিন দিল্লীতে অপেক্ষা করতে হবে, আমার সঙ্গে তোমাকেও। লুসী, এ হোটেলেই আমরা থাকবো। আমাদের একটা মিথ্যা অভিনয় করতে হবে–অবশ্য আমাদের সঙ্গলের জন্যই। তোমাকে আমি যদিও বোনের মত ভালবাসি, কিন্তু আপাততঃ তুমি আমার স্ত্রীর অভিনয় করবে।

লজ্জায় লুসী মাথা নিচু করলো, রক্তাভ হয়ে উঠলো তার গণ্ড। হাজার হলেও লুসী বাংলার মেয়ে।

 বনহুর মৃদু হাসলো, বললো–অবশ্য তুমি এতে কিছু মনে করবে না।

 লুসী একবার দৃষ্টিটা তুলে তাকালো, তারপর মুখ নিচু করে নিলো।

লুসী, প্রথমে জেনে নাও তুমি মিসেস বাঞ্ছারামের কন্যা নও। তুমি কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী অভয়কর বিশ্বাসের কন্যা।

অভয়কর বিশ্বাস!

হা।

না না আমি, আমি…আমার মা মিসেস বাঞ্ছারাম…চুপ করে শোন লুসী। গম্ভীর কণ্ঠস্বর বনহুরের!

 লুসী তাকালো। আর কোনো কথা বলতে পারলো না সে।

বনহুর বললো–শিকারী এখনও তোমার পিছু ছাড়েনি। ধীরেনচরণের নিকট তোমার মিসেস বাঞ্ছারাম তোমাকে বিশ হাজার টাকায় বিক্রয় করেছে।

আমার মা আমাকে ধীরেনচরণের নিকটে বিক্রয় করেছেন!

 হাঁ লুসী, এখন তুমি ধীরেনচরণের ক্রয় করা বস্তু।

 অসম্ভব?

 মিসেস বাঞ্ছারামের নিকটে কিছুই অসম্ভব নয় লুসী। তোমাকে সে ক্রয় করেছিলো ভীম সিং এর নিকট থেকে।

ভীম সিং! কলকাতার সে হিন্দুস্থানী একহাতশুন্য ভীম সিং?

সেই তোমাকে ছোটবেলায় হরণ করে আনে, এবং সুদুর দিল্লী নগরীতে বিক্রয় করে। বনহুর সে মুহূর্তে শোনা সমস্ত কথাগুলো বলে লুসীর কাছে। কোনো কথাই গোপন করে না। কেমনভাবে সে ড্রাইভার সেজে ধীরেনচরণ থেকে তাকে নিয়ে এ হোটেলে এসে উঠেছে, এবং মনিব-পত্নী বলে তার পরিচয় দিয়েছে–সব বলে বনহুর।

লুসীর মুখে কোনো কথা সরে না যেন। মুখমণ্ডল গম্ভীর থমথমে হয়ে পড়ে। ললাটে ফুটে উঠে চিন্তার রেখা।

বনহুর বলে–লুসী, তোমাকে যেদিন প্রথম গঙ্গবক্ষ থেকে উদ্ধার করেছিলাম, সেদিন আমি তোমাকে আরতী বলে ভুল করেছিলাম; কারণ তোমার চেহারার সঙ্গে মিস আরতী দেবীর হুবহু মিল আছে। মিস আরতী অভয়কর বিশ্বাসের কন্যা।

আমি এখন কি করবো মিঃ আলম?

তোমার বাবার কাছে যাবে।

 আমি তাকে চিনি না। কোনোদিন তাকে দেখেছি বলে মনে হয় না।

 সব সচ্ছ হয়ে যাবে লুসী, তুমি কিছু ভেবো না।

 কিন্তু ধীরেনচরণ যদি…

হাঁ, সে আবার তোমাকে চুরি করার চেষ্টা করবে!

আমি ধীরেনচরণের হাত থেকে বাঁচতে চাই। আমাকে বাঁচান আপনি?

তোমাকে বাঁচানোর জন্যই আমি আরও কয়েকদিন দিল্লী অপেক্ষা করবো। ধীরেনচরণ তোমার অন্বেষণে দিল্লী শহর চষে ফিরছে। লুসী, তোমাকে অত্যন্ত সতর্ক এবং সাবধানে থাকতে হবে।

আমাকে দিল্লী থেকে নিয়ে চলুন মিঃ আলম।

যাবে, কিন্তু যেখানেই যাও ধীরেনচরণ তোমাকে রেহাই দেবে না। তাই তাকে তোমার চলার পথ থেকে সরিয়ে তবে আমার নিস্কৃতি।

লুসীর চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো, কৃতজ্ঞতায় মন তার কানায় কানায় ভয়ে উঠেছে। যদিও মনটা বড় ভালো লাগছিলো না, কারণ একি আজব কথা শুনলো সে। মিসেস বাঞ্ছারাম তার জননী নয়। আজ নতুন করে স্মরণ হতে লাগলো অনেক কথা। তার জ্ঞান হবার পর থেকে সে দেখছে মিসেস বাঞ্ছারামকে। তার স্নেহ বলে কিছু ছিলো না, কেমন যেন নীরস কঠিনভাবে সব সময় দেখে এসেছে সে তাকে। কোনো কোনো সময় লুসীর মন বিদ্রোহ হয়ে উঠেছে, মিসেস বাঞ্ছারামের আচরণ অসহ্য লেগেছে তার কাছে। হয়তো হোটেলে কোনো ধনবান ব্যক্তির আগমন হলে লুসীকে সাজিয়ে-গুজিয়ে পাঠানোর চেষ্টা চলেছে তার কাছে। অর্থের লোভে লুসীকে অসৎ কাজে লিপ্ত করার চেষ্টা চলেছে রীতিমত। কিন্তু লুসীকে বাগে আনতে পারেনি কোনদিন। লুসীর মনে পড়ে আর একটি দিনের কথা…মিসেস বাঞ্ছারামের কোনো এক আত্নীয় এসেছিলো, লুসীকে নিয়ে গিয়েছিলো দিল্লী দুর্গ দেখবার নাম করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিল্লী-দুর্গে যায়নি সে, নিয়ে গিয়েছিলো সেকেন্দ্রা পার্কে। সেখানে তাকে জোরপূর্বক আলিঙ্গন করেছিলো শয়তান ভদ্রলোক জানিয়েছিলো প্রেম-নিবেদন। কিন্তু লুসী তাকে প্রশ্রয় দেয়নি, চরম আঘাত করেছিলো–জোরে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলো সে তার গালে।

এরপর লোকটার সঙ্গে মিসেস বাঞ্ছারামকে গোপনে আলাপ-আলোচনা করতে শুনেছে। হঠাৎ যদি সেখানে লুসী গিয়ে পড়েছে, অমনি কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেছে তাদের। এসব দেখে লুসীর মন বড় খারাপ হয়েছে। কিন্তু ভেবে পায়নি এর পিছনে তার মা মিসেস বাঞ্ছরামের কি স্বার্থ ছিলো! আজ সব সচ্ছ হয়ে গেছে, মিঃ আলম তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন।

বনহুর বললো–কি ভাবেছো লুসী?

ভাবছি আমার জীবনের বিগত ইতিহাসের কথাগুলো।

 যা তুমি যখন সব বুঝতে পেরেছো?

 হা মিঃ আলম। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো, বয় প্রবেশ করলো কক্ষে, বললো স্যার, ম্যানেজারবাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

আসতে বলো। বললো বনহুর।

বেরিয়ে গেলো বয়।

 বনহুর বললোলুসী, এবার আমাদের অভিনয় করতে হবে। কারণ, এখানে আমরা স্বামী-স্ত্রী, বুঝলে।

ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানালো লুসী।

 ম্যানেজার কক্ষে প্রবেশ করতেই লুসী মাথায় কাপড় তুলে দিলো।

 বনহুর উঠে অভ্যর্থনা জানালো তাকে।

ম্যানেজার মাহমুদ রিজভী অত্যন্ত ভদ্র এবং অমায়িক লোক। এভোবড় একটা হোটেলের কর্মকর্তা হলেও তিনি মিশুক লোক। আসন গ্রহণ করে বললেন মিঃ মাহমুদ–আপনার স্ত্রী কেমন আছেন আজ?

বনহুর বললো–ভালো আছেন। সত্যি, আপনি যা উপকার করেছেন সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

না না, এমন আর কি করেছি, যা করেছি সে তো আমার কর্তব্য।

আমার ড্রাইভারের নিকটে আপনার অনেক প্রশংসা শুনলাম। ঐ মুহূর্ত আপনি যা করেছেন তা আপনার কর্তব্যের চেয়ে অনেক বেশি করেছেন।

হাঁ, উনি না হলে আমার কি যে হত! ওনার সহায়তা আমাকে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে, বললো। মিস লুসী।

মিঃ মাহমুদ বললেন–ছিঃ ছিঃ বেশি বাড়িয়ে বলেছেন মিসেস পারভিন বেগম। আপনারা বিদেশী, আপনাদের সেবা করাই আমাদের কাজ। এখানে আপনাদের কোনোরূপ অসুবিধা হবে না।

আরও কিছু সময় গল্প-সল্প করার পর চলে গেলেন মিঃ মাহমুদ রিজভী।

এবার লুসী বললো–বড় হাপিয়ে পড়েছিলাম কিন্তু?

এরি মধ্যে হাঁপিয়ে পড়েছিলে লুসী? আরও অনেক বাকী। লুসী, আমাকে একবার এক্ষুণি বেরুতে হবে, তুমি সাবধানে থাকবে।

কোথায় যাবেন এখন?

বাইরে, কিন্তু কোথায় যাবো সঠিক বলতে পারছি না।

আমার কিন্তু ভয় করছে।

সাবধানে থেকো, আমি বাইরে বেশিক্ষণ বিলম্ব করবো না।

মিঃ আলম!

আস্তে বল–কারণ বাংলাদেশের মেয়েরা স্বামীকে এভাবে সম্বোধন করে না।

লজ্জিত হলো লুসী, বললো সে–আমিও যাবো আপনার সঙ্গে!

 না, তা হয় না লুসী, আমি কোথায় যাবো ঠিক নেই কি না।

 লুসী আর কোনো কথা বললো না।

 বনহুর লুসীর দিকে একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বেরিয়ে গেলো।

*

বনহুর ট্যাক্সি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

এ ট্যাক্সিখানা সে আজই ক্রয় করেছে। নতুন ঝকঝকে কুইন কার! বনহুর এ-পথ সে-পথ কিছু সময় ঘুরে বেড়ালো। বিশেষ করে দিল্লী শহরটা তার ভালোভাবে জানা নিতান্ত দরকার হয়ে পড়েছে। বেশ কিছুক্ষণ বনহুর ঘুরে বেড়ালো শহরের বিভিন্ন স্থানে।

দিল্লীদুর্গের সম্মুখে এসে গাড়ি রেখে নেমে পড়লো বনহুর। সুউচ্চ ফটকের সম্মুখে দু’জন রাইফেলধারী পাহারাদার পাহারা দিচ্ছে। একজন অফিসার ধরনের লোক অদূরে একটা উঁচুস্থানে দাঁড়িয়ে কি যেন লিখছিলেন। বনহুর জানতে পারলো, তিনি দুর্গে যারা প্রবেশ করছেন তাদের নাম লিখে নিচ্ছেন, এবং একটা টিকিট দিচ্ছেন। বিনা পারমিশানে দুর্গে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।

বনহুর এগিয়ে এলো, একটি পারমিশান কার্ড নিয়ে প্রবেশ করলো, গেটের ভিতরে। খানিকটা প্রশস্ত পথ পেরিয়ে বিরাট বড় বড় কয়েকখানা অট্টালিকা।

বনহুর এগুতেই একটি লোক এগিয়ে এলো, খাঁটি উর্দুতে বললো–আপনি দুর্গের মধ্যে যাবেন? না বাইরেই দেখবেন?

উর্দুতেই জবাব দিলো বনহুর–আমি দুর্গের মধ্যে যাবো।

লোকটা বনহুরকে নিয়ে অগ্রসর হলো, অবশ্য ওদের কাজ এা, তবে কিছু বখশীসের আশা আছে এ আর কি।

সম্মুখের বড় কামরাটায় প্রবেশ করলো লোকটা, তার পাশে দাঁড়িয়ে বনহুর।

বনহুর দেখলো লোকটা দেয়ালের একস্থানে একটা চক্রাকার চাবি ঘুরাতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে মেঝের একস্থানে একটা সুড়ঙ্গ পথ বেরিয়ে এলো।

লোকটা এবার সুড়ঙ্গ পথে নামতে লাগলো, বনহুর অনুসরণ করলো তাকে। সুড়ঙ্গ পথ বেশি প্রশস্ত নয়, পাশাপাশি দু’জন মানুষ নামতে বা উপরে উঠতে পারে। লোকটা আরও বললো, দিল্লী-দুর্গে প্রবেশের আর একটি পথ আছে, সেপথ অতি দুর্গম। এখন কীটপতঙ্গ আর ভগ্ন অবস্থায় সে পথ রোধ হয়ে পড়েছে!

সিঁড়ির ধাপ বেয়ে বনহুর আর লোকটি নেমে এলো নিচে। দুর্গের মধ্যে ইলেকট্রিক আলো নেই, সেকালে ঝাড়বাতি, লণ্ঠন বা ঐ ধরণের কোনো আলো জ্বালান হতো। লোকটি দু’হস্তে দুটি মোম-জ্বেলে গিয়েছিলো, সিঁড়ির মধ্যে অন্ধকার একটু বেশি। বনহুর আরও লক্ষ্য করলো সিঁড়ির দু’পাশে শ্বেত পাথরের বড় বড় টুকরা রাখা হয়েছে। ঐ পাথরগুলো অত্যন্ত সচ্ছ, পাথরের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর আলো প্রবেশ করছে। ঐ রকম শ্বেত পাথর দুর্গের নানাস্থানে দেয়ালে গাঁথা রয়েছে দেখলো বনহুর।

নিচে নেমে আসার পর ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো সে। একস্থানে বন্দীদের আটকে রাখা হতো। মোটা মোটা শিখ দিয়ে সে স্থানটি ঘেরাও করা রয়েছে। সে কি মজবুত প্রকোষ্ঠ, কোনোক্রমে এখান থেকে বন্দিগণ পালাতে সক্ষম হতো না! অন্য এক স্থানে অপরাধী দাস-দাসীদের বন্দী করে রাখা হতো, সে স্থানটি বন্দীদের কারাকক্ষের চেয়ে কিছুটা পৃথক ধরণের। অন্য এক-স্থানে ফাসীর মঞ্চ। এ ফাসীমঞ্চে অপরাধীদের ফাসী দেয়া হতো। রশি ছাড়া সব ঠিক রয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটা ফাসীর মঞ্চ। এক সঙ্গে কয়েকজনকে ফাঁসী দেয়া হতো হয়তো। প্রত্যেকটা ফাঁসীমঞ্চের নিচে এক একটি কূপ রয়েছে। লোকটা বনহুরকে বুঝিয়ে বললো, অপরাধী বন্দীদের ফাসী দেয়ার পর এসব কূপে তাদের ফেলে দেয়া হতো। এ কূপগুলোর সঙ্গে যুমনা নদীর যোগাযোগ আছে। লাশগুলো একেবারে চলে যেতো যমুনায়। এখন সে কূপগুলো বড় বড় পাথরের চাপ দিয়ে ঢাকা রয়েছে।

বনহুর এবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলো, সৈনিকগণ যেখানে থাকতে বা বিশ্রাম করতে! ছোট ছোট অনেকগুলো কামরা। এগুলোতে সৈনিকগণ কি করতো ঠিক বোঝা গেলো না। ওদিকে তাকাতেই দেখলো দুর্গের মধ্যে সারি সারি কামান খাড়া করা রয়েছে। কামানের মুখগুলো সব বাইরে। মাটি ভেদ করে উঠে গেছে উপরে। কিন্তু উপরে কামানের মুখ–টের পাবার জো নেই। কৌশলে বসানো হয়েছে কামানগুলো। শত্রুর আগমন জানতে পারলেই সম্রাটের আদেশে এ সব কামান গর্জে উঠতো। আজ অবশ্য কামানগুলো সম্পূর্ণ অকেজোভাবে রয়েছে।

বনহুর আরও কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলো। কত পুরানের স্মৃতি ভাসতে লাগলো তার চোখের সম্মুখে। দিল্লী-দুর্গ দেখা শেষ করে বনহুর উঠে এলো উপরে। হাতঘড়িটা দেখে নিলো, তারপর গাড়িতে এসে বসলো।

মতি মসজিদ, কতুবমিনার দেখা শেষ করে বনহুর আগ্রার গেটে এসে গাড়ি রাখলো, প্রথমেই তার নজরে পড়লো কঠিন পাথরে তৈরি বিরাট ঘোড়ার মূর্তি। সামনের দু’খানা পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই সুউচ্চ প্রাচীর, যার উপর থেকে ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে পড়েছিলো অমর সিংহ। এখানের প্রধান গেটের নাম অমরসিংহ গেট। দিল্লী দুর্গের চেয়ে এ দুর্গটি আরও বড়। এ দুর্গ তৈরি করেছিলেন সম্রাট আকবর। ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো নানারকম প্রকোষ্ঠ। দেওয়ানই খাস মহল, সম্রাটের আরামখানা। বেগম মহল, বেগমদের গোসলখানা। প্রত্যেকটা কক্ষে এক কালে মণি-মুক্তা-হীরা খচিত ছিলো, আজ আর সে সব নেই।

শাহজাহানকে যে কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো সেখানে গিয়ে বনহুর কিছুক্ষণ মৌন রইলো। তারপর গেলো উপরে, যেখানে দাঁড়িয়ে একদিন বলেছিলেন বৃদ্ধ শাহজাহান তার আদরিণী কন্যা জাহানারাকে, মা জাহানারা এখান থেকে লাফিয়ে পড়ে মরবো মা?

জাহানারা পিতাকে আঁকড়ে ধরে বলেছিলো–বাবা, আত্মহত্যা করা যে মহাপাপ।

বনহুরের কানে যেন আজ জাহানারার কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি জাগলো। শুনতে পেলো বৃদ্ধ শাহজাহানের কম্পিত কণ্ঠ।

চিরকুমারী জাহানারার কবর দেখলো, কোনোরকম সাজসজ্জা বা আড়ম্বড়ের বালাই নেই। শ্যামল দুর্বা ঘাসে আচ্ছাদিত কবরের বক্ষস্থল। শিয়রে একখণ্ড শীলা, তাতে লিখা রয়েছে জাহানারার হৃদয়ের কথা, তার অন্তরের বাণী।

তারপর বনহুর দিল্লীর শ্রেষ্ঠ আউলিয়া “চেরাগে দেহেলি” নিজাম উদ্দিনের গোর জিয়ারৎ করলো।

এবার ফিরে চললো সে, অনেক দেখেছে আজ আর নয়। লুসী হয়তো তার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে।

 নিজাম উদ্দিনের মাজার থেকে গাড়ি নিয়ে বনহুর সোজা চললো হোটেল গুলশানের দিকে।  

আজ একদিনে বনহুর অনেক কিছু পথঘাট সব চিনে নিলো, চিনে নিলো বড় বড় নামকরা জায়গাগুলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, বনহুরের গাড়িখানা তখন লাবলীং ক্লাবের সম্মুখপথ দিয়ে চলছিলো। বনহুরের দৃষ্টি আর্কষণ করলো লাবলীং ক্লাবের চোখ ঝলসানো আলোকসজ্জা।

বনহুর ব্যাক করে গাড়িখানা এনে রাখলো লাবলীং ক্লাবের সম্মুখে। নেমে পড়লো সে, ক্লাবে প্রবেশ করতেই অর্কেস্ট্রার সুর তার কানে এসে পৌঁছলো। বনহুর ক্লাবের ভিতরে প্রবেশ করে একটা টেবিলের পাশে বসে পড়লো।

এ ক্লাবটি শুধুমাত্র বিদেশীদের জন্য। দিল্লীর অধিবাসিদেরকে এ ক্লাবে কমই দেখতে পেলো বনহুর। বাঙালির সংখ্যা নেহাৎ কম নয়।

ডায়াসে তখন যন্ত্রসংগীতের ঐক্যতান একটানা বেজে চলেছে। উজ্জ্বল তীব্র আলোকে আলোকিত ক্লাবকক্ষ। ওদিকে ডাইনিং হলটি গমগম করছে। অভিজাত সম্প্রদায়ের সুবেশধারী নানা বয়সী নর-নারী সরগরম করে তুলেছে স্থানটি।

বনহুর একটা সিগারেট ধরালো। দৃষ্টি তার ক্লাবকক্ষের চারদিকে সতর্কভাবে ঘুরে ফিরছে। বয় এসে দাঁড়াতেই খাবারের অর্ডার দিলো, লাবলীং হোটেলের সুস্বাদু খাবারের লোভ বনহুর ত্যাগ করতে পারলো না, তাছাড়া ক্ষুধায় পেটের নাড়ি চো চো করছিলো তার।

খাবার এলো, তার সঙ্গে এলো মাংস আর মদ।

বনহুর খেতে শুরু করলো।

ওদিকে ডাইনিং হলের টেবিলে ছুরি-কাঁটা-চামচের ঠুং ঠাং শব্দের সঙ্গে চলেছে নানা রকম হাসিগল্পের ফুলঝুরি। তার সঙ্গে ভেসে আসছে বিলেতী মদের তীব্র গন্ধ, আর অভিজাত সম্প্রদায়ের নর-নারী দেহের প্রসাধনীর সুবাস।

বনহুর খেতে বসে লক্ষ্য করছিলো এসব নর-নারীদেরকে এবং কান পেতে শুনছিলো তাদের আলাপ আলোচনা।

হঠাৎ একটা হাসির শব্দে বনহুর ফিরে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতখানা থেমে গেল মাঝপথে। প্রায় অর্ধ-উলঙ্গ একটা যুবতী একটি পুরুষের কণ্ঠ বেষ্ঠন করে হাসির ঝঙ্কার তুলেছে। উভয়ের হস্তে সুরার পাত্র। যুবতীর দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নত করে নিলো। কিন্তু নিজের অজ্ঞাতেই আবার তার চোখ দুটো ফিরে গেলো নগ্ন তরুণীর দিকে।

লোকটা তখন তরুণীর কণ্ঠ বেষ্টন করে ওর গণ্ডে চুম্বন দিয়ে চলেছে। যুবতীও প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছে ঠিকভাবে। ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত হলো বনহুরের।

বনহুর বিল চুকিয়ে দিয়ে যেমন উঠতে যাবে অমনি দেখলো ক্লাবকক্ষে প্রবেশ করলো মিসেস বাঞ্ছারাম– তার সঙ্গে রয়েছে সে শয়তান ধীরেনচরণ!

বনহুর দ্রুত মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো, যাতে তাকে দেখে না ফেলে ওরা। আত্মগোপন করে একটা থামের। আড়ালে ঠেশ দিয়ে দাঁড়ালো বনহুর।

মিসেস বাঞ্ছারাম ও ধীরেনচরণ চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেলো হোটেলের ম্যানেজারের ক্যাবিনের দিকে।

বনহুরও এসে দাঁড়ালো ক্যাবিনের দরজায়। শুনতে পেলো লাবলীং ক্লাবের ম্যানেজারের কণ্ঠে অভ্যর্থনা বাণী। মিসেস বাঞ্ছারাম, পরিচিতা তাঁর। কিছুক্ষণ চাপা স্বরে আলাপ হলো মিসেস বাঞ্ছারাম, ধীরেনচরণ আর লাবলীং ক্লাবের ম্যানেজারের মধ্যে। অতি নিম্ন-কণ্ঠে কথাবার্তা চললো, কাজেই বনহুর বুঝতে পারলো না কিছু।

এবার বিদায় সম্ভাষণের পালা।

বনহুর সতর্কতার সঙ্গে বেরিয়ে এলো লাবলীং ক্লাব থেকে। গাড়িতে বসে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

অল্পক্ষণ পর বেরিয়ে এলো মিসেস বাঞ্ছারাম ও ধীরেনচরণ। ওদিকে গাড়িখানার দিকে এগিয়ে গেলো তারা।

গাড়িখানা চলে যেতেই বনহুর তার গাড়ি থেকে পুনরায় নেমে পড়লো, সোজা প্রবেশ করলো ম্যানেজারের ক্যাবিনে। গাঢ় নীল মখমলের পর্দা ঠেলে এগুতেই ম্যানেজার অবাক কণ্ঠে বললেন–কি চান আপনি!

বনহুর চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নিলো, কামরায় একমাত্র ম্যানেজার ছাড়া আর দ্বিতীয় জন ছিল না। ক্লাবের অভ্যন্তর হতে তখন অর্কেস্ট্রার সুর ভেসে আসছে। আরও ভেসে আসছে তরুণ-তরুণীদের উচ্ছল হাসির শব্দ।

বনহুর ম্যানেজারের নিকটে এগিয়ে এসেই রিভলভার চেপে ধরলো তার বুকের কাছে। তারপর গম্ভীর চাপা কণ্ঠে বললো–বলুন এ মুহূর্তে যারা বেরিয়ে গেলো তারা আপনাকে কি বলে গেলো?

কে আপনি?

আমি যে-ই হই, জবাব দিন আমার প্রশ্নের?

এক্ষুণি পুলিশ ডাকবো!

তার পূর্বেই আপনার মৃতদেহ গড়িয়ে পড়বে মেঝেতে। বলুন ওরা কি বলে গেলো? মিথ্যা বলার চেষ্টা করলে মৃত্যু অনিবার্য।

ম্যানেজার এবার ভয় পেয়ে গেলেন, এ অবস্থায় ভয় পাবারই কথা। ম্যানেজারের কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো বনহুর প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে। তবু দমবার লোক নন পাকা লোক ম্যানেজার; বললেন–যারা এমাত্র বেরিয়ে গেলো তারা আমার আত্মীয় এবং আমার সঙ্গে তাদের পারিবারিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে।

আমি জানি তারা কে। তাদের পরিচয় আমার অজ্ঞাত নেই। এবং যা তারা বলছে তাও আমি জানি। কিন্তু জানো, যার সর্বনাশ তোমরা করতে চাইছো সে এখন আমার হাতের মুঠায়?

মিস লুসী তোমার হাতের মুঠায়? সে তোমার কাছে আছে?

হাঁ।

 কে তুমি?

 দস্যু বনহুর!

 বিস্ময়ভরা অস্ফুটে ধ্বনি করে উঠলো ম্যানেজার দস্যু বনহুর! দক্ষিণ পশ্চিম কান্দাই অঞ্চলের দুর্ধর্ষ দস্যু….

হাঁ, আমিই সে!

ম্যানেজারের মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। তাকালেন সে বনহুরের হস্তস্থিত রিভলভারখানার দিকে। বনহুর এবার কঠিন কণ্ঠে বললো–বলবে যা আমি জানতে চাইলাম?

ম্যানেজারের কণ্ঠ বাকহীন হয়ে পড়েছিলো, তিনি তখন ভেবে চলেছেন–সুদূর কান্দাই-এর দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল থেকে দস্যু বনহুর দিল্লী শহরে এলো কি করে! দস্যু বনহুরের নাম তিনি শুনেছেন, আরও শুনেছেন কি ভয়ঙ্কর দুর্দান্ত দস্যু সে।

ম্যানেজারকে ভাবতে দেখে বললো বনহুর কি ভাবছো? যাক আজ তোমাকে রেহাই দিলাম, কিন্তু মনে রেখো–মিস লুসীর কোনো ক্ষতি করেছে তখনই তোমার মৃত্যু হবে।

বনহুর আর বিলম্ব না করে বেরিয়ে গেলো জানালার শাশী খুলে পিছন পথ দিয়ে।

পরক্ষণেই বনহুর লাফিয়ে পড়লো রাস্তায়, সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে চেপে বসলো।

 ততক্ষণে ম্যানেজার দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন ক্লাবঘরের মধ্যে, চিৎকার শুরু করে দেন–দস্যু দস্যু, ডাকু ডাকু…

সঙ্গে সঙ্গে ডায়াসে অর্কেস্ট্রা বাদ্য থেমে যায়, আরও থেমে যায় ডাইনিং হলের তরুণ-তরুণীর কলকণ্ঠে হাস্যধ্বনি। ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়ে ক্লাবকক্ষ। কিন্তু পর মুহূর্তেই একটা হট্টগোল শুরু হয়–কোন্ দিকে কে পালাতে থাকে তার ঠিক নেই।

ম্যানেজার রিসিভার তুলে নেন হাতে–হ্যালো পুলিশ পুলিশ, দস্যু বনহুরের আবির্ভাব ঘটেছে আমার লাবলীং ক্লাবে…শীঘ্র চলে আসুন।

অল্পক্ষণে পুলিশ চলে এলো, সমস্ত ক্লাব তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো কিন্তু দস্যু বা ডাকুর কোনো সন্ধান। পাওয়া গেলো না।

লাবলীং ক্লাবে একটা ভীতিকর থমথমে ভাব জেগে উঠলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্লাব জনশূন্য হয়ে পড়লো। পুলিশ অনেক সন্ধান নিয়েও দস্যুকে আবিস্কারে সক্ষম হলো না।

ম্যানেজারের মুখে সমস্ত শুনে দিল্লী পুলিশ ইন্সপেক্টর ডায়রী লিখে নিলেন।

*

বনহুর ইচ্ছে করেই ম্যানেজারের নিকটে তার আসল পরিচয় দিয়েছিলো। পরদিন দস্যু বনহুরের আবির্ভাব সংবাদ প্রচার হলো। কাগজে কাগজে দিল্লীর বুকে জাগলো এক ভীতিকর আতঙ্ক। এ দেশের অনেকেই দস্যু বনহুরের নামের সঙ্গে তেমন করে পরিচিত ছিলো না। এবার সবাই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। দস্যু বনহুর সম্বন্ধে নানা পত্রিকায় বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করলো।

দিল্লীর লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো সংবাদটা শহর থেকে শহরতলী পর্যন্ত।

হোটেল-রেষ্টুরেন্টে, ক্লাবে, পথে-ঘাটে সর্বস্থানে সবার মুখে মুখে ঐ এক কথা–সুদুর কান্দাই শহর থেকে দস্যু বনহুরের দিল্লী আগমন।

বনহুর সেদিন গুলশানে বসে মিঃ মাহমুদ রিজভীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে। তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্নভাবে বললেন–মিঃ আলম, অদ্ভুত সংবাদ, কান্দাই দেশ থেকে দস্যু বনহুর আমাদের দিল্লীতে আগমন করেছে।

আমিও পত্রিকায় সে রকম সংবাদ দেখলাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না একথা।

কারণ? বললেন মিঃ মাহমুদ রিজভী।

বললো বনহুর–কারণ কান্দাই দেশ ভারত থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে। সে দেশ থেকে এদেশে সে আসবে কি করে।

মিঃ মাহমুদ বললেন–বেশ কিছুদিন পূর্বে লেবাননে গিয়েছিলাম কোনো কাজে। তখন লেবানন পত্রিকায় দস্যু বনহুর সম্বন্ধে আমি জ্ঞাত হয়েছি। তার অসাধ্য কিছু নেই।

দস্যু বনহুর! আমি কিন্তু তার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। এর পূর্বে আমি তার নাম শুনেছি বলে মনে হয় না।

 মিঃ মাহমুদ দস্যু বনহুরের কার্যকলাপ সম্বন্ধে যা জানতেন বর্ণনা করে শোনালেন বনহুরের নিকটে।

বনহুর মনে মনে হাসলেও মুখোভাবে বার বার অবাক হবার অভিনয় করলো।

লুসীও বেশ ভড়কে গেছে, দস্যু বনহুরের নাম সে শোনেনি কোনোদিন। আজ নতুন করে এ নাম সে শুনলো। এক সময় বললো–মিঃ আলম, চলুন আমরা দিল্লী ত্যাগ করে চলে যাই!

অবাক হয়ে বললো বনহুর–এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন লুসী?

 দস্যু বনহুরের জন্য আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। না জানি সে কত বড় ভয়ঙ্কর দস্যু!

হোক সে ভয়ঙ্কর, তোমার তো সে কোনো ক্ষতি করেনি লুসী?

ক্ষতি সে করেনি কিন্তু যে দস্যু তার অসাধ্য কি আছে বলুন?

 লুসী, দস্যু বনহুর আমার বন্ধু, কাজেই তাকে বলে দেবো তোমার যেন কোনো ক্ষতি না করে।

 দস্যু বনহুর আপনার পরিচিত?

 শুধু পরিচিতই নয়, আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু সে!

আশ্চর্য, একজন দস্যুর সঙ্গে আপনার আন্তরিকতা আছে!

কেন, সেকি মানুষ নয়?

 মানুষ হলেও সে দুর্বৃত্ত!

তারও অন্তর আছে লুসী। তাছাড়া আজকের পৃথিবীতে সবাইতো দস্যু, সবাই দুবৃত্ত। ভদ্রতার মুখোশ পরে এক একজন দস্যুর চেয়েও অতি ভয়ঙ্কর মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করছে। লোকসমাজ তাদের উপরের খোলস দেখে সাধু ভ্রমে প্রণাম জানাচ্ছে, কিন্তু তারা জানে না–কত সাংঘাতিক সমাজপতিগণ!

ঠিক বলেছেন মিঃ আলম।

লুসী, তুমি নির্ভয়ে থাকবে, দস্যু বনহুর তোমার কেশও স্পর্শ করবে না।

আপনি বলে দেবেন তার সঙ্গে দেখা হলে।

নিশ্চয়ই দেবো। চলো, রাত অনেক হয়েছে–শোবে চলো।

মিস লুসী আর বনহুর শয্যার দিকে এগুলো। বিপদে পড়লো তারা; বিশেষ করে লুসী একটু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

বনহুর বললো–তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও লুসী, আমি জেগে রইবো, দস্যু বনহুর যেন তোমার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

লুসী শয্যায় শুয়ে পড়লো।

বনহুর সোফায় বসে পত্রিকাটা তুলে নিলো হাতে।

 রাত বেড়ে চললো।

বনহুর পত্রিকা রেখে সিগারেট ধরালো। একটির পর একটি নিঃশেষ করে চললো। তারপর এক সময় সোফায় ঠেস দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলো।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই, হঠাৎ একটা খট খট শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো তার। চমকে তাকালো একি, বিছানা শূন্য–লুসী কোথায়? ধরফড় উঠে দাঁড়ালো, চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলো– দরজা খোলা।

বনহুর দরজার পাশে এসে থমকে দাঁড়ালো। বাইরে মোটর ছাড়ার শব্দ হলো। ছুটে গেলো বনহুর। বেলকুনিতে, দেখলো একটা মডেল কার বেরিয়ে গেলো হোষ্টেল-প্রাঙ্গণ থেকে।

ফিরে এলো বনহুর কক্ষমধ্যে। মন অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। লুসীকে সে আশ্বাস দিয়েছিলো–দস্য বনহুর যাতে তোমার ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য আমি জেগে রইবো। কিন্তু তার আশ্বাস-বাণী রক্ষা করতে পারেনি সে। হঠাৎ নজর পড়লো তার বিছানার দিকে, একখানা ছোট্ট কাগজের টুকরা পড়ে আছে বালিশের। পাশে।

বনহুর এগিয়ে গেলো, কাগজের টুকরাটা হাতে নিতেই দেখলো দুটি লাইন লিখা মিস লুসীকে আমি নিয়ে গেলাম। কারণ, লুসী আমার শিকার। লুসীর অন্বেষণ করা সম্পূর্ণ বৃথা।

ধী…চা…ভৌ।

বনহুর চিঠি পড়ে হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে। তারপর সে চিঠিখানা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলো।

*

ভোরে প্রতিদিনের মত আজও এলেন মিঃ মাহমুদ রিজভী। বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করে বললেন–হ্যালো মিঃ আলম, গুড মর্নিং।

বনহুর মুখোভাব স্বাভাবিক রেখে হেসে বললো–গুড মর্নিং। আসুন মিঃ রিজভী।

মিঃ মাহমুদ রিজভী আসন গ্রহণ করলেন।

বনহুর একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরে সিগারেট কেসটা এগিয়ে দিলো মিঃ মাহমুদ রিজভীর দিকে নিন।

মিঃ মাহমুদ একটা সিগারেট তুলে নিলেন।

সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো–বনহুর। নিজের সিগারেট ধরিয়ে মিঃ রিজভীর সিগারেট ধরিয়ে দিলো সে।

মিঃ মাহমুদ বললেন–মিসেস পারভিনকে দেখছি না যে?

হেসে বললো বনহুর–ওর এক আত্নীয়ার বাড়ি বেড়াতে গেছেন।

ও। আপনি বুঝি এখন মুক্ত বিহঙ্গ?

কতকটা তাই।

 মিসেস পারভিন ফিরবেন কখন?

আজ বোধ হয় ফিরবেন না! দুচার দিন থাকতেও পারেন সেখানে। মিঃ রিজভী?

বলুন মিঃ আলম?

আজ বিকেলে আপনি আমার সঙ্গে বাইরে যেতে পারেন কি?

কোথায় যাবেন মিঃ আলম?

লাবলীং ক্লাবে।

মিঃ মাহমুদ যেন চমকে উঠলেন, অস্ফুট কণ্ঠে বললেন–লাবলীং ক্লাবে যাবেন আপনি?

ভ্রূকুঞ্চিত করে বললো বনহুর–আপনি যেন কথাটা পছন্দ করলেন না। ব্যাপার কি মিঃ রিজভী?

মিঃ আলম, ও ক্লাব ভদ্রসমাজের জন্য অত্যন্ত অমঙ্গলজনক। তবে হাঁ, লাবলীং ক্লাবে ভদ্রমুখোশধারী ব্যক্তিগণই গিয়ে থাকেন।

কারণ কি জানতে পারি কি?

নিশ্চয়ই পারেন। মিঃ আলম, আপনাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। আপনার সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনার ব্যবহারে আমি সন্তুষ্ট। আমি চাই না আপনার কোনো মন্দ হোক।

বেশ আমি যাবো না।

হ, কোনো সময় আপনি ঐ ক্লাবের ত্রিসীমানায় যাবেন না। বরং অন্য যেখানে খুশি যাবেন।

 মিঃ মাহমুদ রিজভী বিদায় গ্রহণ করলেন!

 বনহুর পুনরায় সিগারেট ধরালো। ললাটে তার ফুটে উঠলো গভীর চিন্তার ছাপ। বনহুর চিন্তা করছিলো। মিঃ মাহমুদের কথা–লোকটা সত্যি মহৎ ব্যক্তি, না ভিতরে ওর কোনো চক্রান্ত রয়েছে।

মিঃ মাহমুদ যতই বারণ করুন বনহুর গোপনে বেরিয়ে পড়লো–লুসীর সন্ধান তাকে করতেই হবে। ছদ্মবেশ ধারণ করলো বনহুর। মুখে চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি, গায়ে শেরওয়ানী, পায়ে নাগরা। এক্কা ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে হাজির হলো লাবলীং ক্লাবে।

নতুন আগন্তুকের আগমনে ক্লাবের ম্যানেজার স্বয়ং এলেন তাকে অভ্যর্থনা জানাতে। বনহুরকে দিল্লীর কোনো উচ্চ সম্ভ্রান্ত মহাজন বলে মনে করলেন তারা।

সসম্মানে নিয়ে বসালেন, নানারকম খাদ্যদ্রব্য আর পানীয় এলো বনহুরের সামনে। চললো নাচগান আর বাদ্যযন্ত্রের ঐক্যতান। সুন্দরী নর্তকীদের নাচ হলো, তারপর শুরু হলো খাবার পালা। একবার একটি তরুণীর ইংলিশ ড্যান্স চললো। ডায়াসে তখন অর্কেস্ট্রার পরিবর্তে ইংলিশ বাজনা বাজতে শুরু করেছে।

সারাব পান করা অভ্যাস নয় বনহুরের। সে যখন খাবার ভক্ষণ করছিলো সে ফাঁকে সারাব-পাত্র পাশের ফুলদানীতে উজার করে দিচ্ছিলো। এতো সতর্কতার সঙ্গে বনহুর অভিনয় করে চললো, সে যেন সত্যি সত্যি মদের নেশায় চুর চুর হয়ে গেছে।

মাঝে মাঝে নর্তকীরা তার কণ্ঠ বেষ্টন করে ধরছিলো। বনহুর জড়িত কণ্ঠে তাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে চলেছে। যেন সে একজন পাকা সারাবী।

তারপর বনহুর বিদায় নিলো যখন, তখন এক বাণ্ডিল নোট ম্যানেজারের হাতে তুলে দিয়ে টলতে টলতে তার এক্কা ঘোড়ার গাড়িতে এসে বসলো।

সেদিনের মত ফিরে এলো বনহুর গুলশান হোটেলে।

সকলের অলক্ষ্যে সে প্রবেশ করলো তার ক্যাবিনে। কিন্তু কক্ষে প্রবেশ করতেই চমকে উঠলো–মিঃ মাহমুদ রিজভী স্বয়ং বসে আছে একটা সোফায়।

মুখে চাপদাড়ি, মাথায় পাগড়ি, গায়ে শেরওয়ানী, পায়ে জরির নাগরা–এসব দেখে বনহুরকে চিনতে পারলেন না তিনি। সসম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন মিঃ রিজভী–আপনার পরিচয়? আপনি কি মিঃ আলমের সঙ্গে…

হঠাৎ ভড়কে যাবার লোক বনহুর নয়, চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো–মিঃ আলম আমার আত্নীয়। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। আমার পরিচয়, আমি দিল্লীর একজন স্থায়ী বাসিন্দা। নাম জিল্লুর আলী রিজভী।

কি বললেন, হাঁ ঐ নাম আমি ইতি পূর্বে শুনেছি। তশরিফ রাখুন।

 বসলো বনহুর। নতুন এক ফ্যাসাদে পড়লো সে। নিজের কক্ষে নিজেই সে মেহমান!

মিঃ মাহমুদ বললেন–নিতান্ত কোনো কাজেই আপনি এসেছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু মিঃ আলম সে যে বিকেলে বেড়িয়েছেন এতক্ষণও তার ফিরবার কোনো লক্ষণ নেই। আপনাকে কিছুক্ষণ বসতে হবে বলে মনে হচ্ছে।

তা আমি তো বেশি বিলম্ব করতে পারবো না।

তা কি হয়, এসেছেন যখন তখন তার সঙ্গে দেখা না করে যাবেন কি করে। আপনি বসুন, আমি নাস্তার জন্য বলি?

না না, তা আমি আজ যাই, আবার কাল হয়তো আসতে হবে।

 আপনাকে ছাড়লে তবে তো যাবেন! কলিংবেল টিপলেন মিঃ মাহমুদ।

বয় এলো।

মিঃ মাহমুদ নাস্তার অর্ডার দিলেন।

 বনহুর ফ্যাসাদে পড়লো।

 অল্পক্ষণ পর নানারকম খাবার এলো।

মিঃ মাহমুদ রিজভী নিজে পরিবেশন করে খাওয়ালেন। বললেন–আপনি আমার হোটেলের বাসিন্দার অতিথি। আপনার সম্মান আমি যদি না করবো তা হলে করবে কে। উনি এসে যদি জানতে পারেন, তার অতিথির অনাদর করা হয়েছে তাহলে তিনি কি মনে করবেন বলুন তো? কাজেই আপনাকে খেতে হবে।

বাধ্য হলো বনহুর খেতে।

খাবার পর বনহুর বিদায় চাইলো।

 মিঃ মাহমুদ বললেন–আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, এ এলেন বলে।

বনহুর জানে–আর কিছুক্ষণ কেন, গোটারাত অপেক্ষা করলেও মিঃ আলম আসবেন না। আলম যে সে জিল্লুর রিজভী–স্বয়ং দস্যু বনহুর।

রাত বেড়ে আসছে, মুখে একরাশ দাড়ি-গোঁফ লাগিয়ে আর কতোক্ষণ থাকবে বনহুর, এবার সে মিঃ মাহমুদ রিজভীর কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

তারপর ছদ্মবেশ পরিবর্তন করে ফিরে এলো অধঘন্টা পরে।

মিঃ মাহমুদ রেজভী শশব্যস্তে জানালেন–মিঃ আলম, আপনি এতোক্ষণে এলেন!

কেন? অবাক হয়ে বললো যেন বনহুর।

মিঃ মাহমুদ বললেন–আপনার সঙ্গে জনাব জিল্লুর আলী রিজভী সাক্ষাৎ করতে এসেছিলেন। এতোক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন কিন্তু দুঃখের বিষয়, আপনি বড় বিলম্ব করে ফেলেছেন ফিরতে।

একটা কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম, তাই ফিরতে বিলম্ব হলো।

 হাতঘড়ি দেখেন মিঃ মাহমুদ–এবার খানা খেয়ে শুয়ে পড়ুন। জনাব জিলুর রিজভী কাল আসবেন বলে গেছেন।

বয় তারপর খাবার নিয়ে এলো; বিপদে পড়লো বনহুর–খাবে কি করে সে! কিছুক্ষণ পূর্বে যে খাওয়া সে খেয়েছে, এরপর আর খাওয়া যায় না!

বনহুর কোনোরকমে চারটি মুখে দিয়ে শুয়ে পড়লো। লুসীর জন্য বড় অস্বস্তি বোধ করছিলো সে, না জানি। ওকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে। লুসীর করুণ মুখখানা ভাসছে তার চোখের সামনে।

শয়তান ধীরেনচরণকে এ দিল্লী শহরে খুঁজে বের করা যদিও কঠিন হবে, তবু যেমন করে হোক তাকে বের করতেই হবে। লুসীকে উদ্ধার করে পৌঁছে দিতে হবে তার পিতার কাছে।

বনহুর শয্যা গ্রহণ করলো বটে কিন্তু ঘুমাতে পারলো না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ শুয়ে থাকার পর শয্যা ত্যাগ করে নেমে দাঁড়ালো। সম্পূর্ণ জমকালো ড্রেসে সজ্জিত হয়ে হোটেলের পিছন সিঁড়ি বেয়ে প্রবেশ করলো হোটেলকক্ষে। হোটেলের পাশ কেটে আর একটি সিঁড়ি উঠে গেছে ম্যানেজার মিঃ মাহমুদ রিজভীর কামরার দিকে। বনহুর সে পথেই দ্রুত উঠে গেলো উপরে। মিঃ রিজভীর দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো বনহুর। হঠাৎ তার কানে এলো একটি কড় কড় শব্দ। বনহুর জানালার পাশে উঁকি দিলো কিন্তু কিছুই নজরে পড়লো না। এবার শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না।

বনহুর কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো।

কক্ষমধ্য থেকে আর কোনোরকম সাড়া এলো না।

কিছুক্ষণ ধৈৰ্য্য সহকারে দাঁড়ালো বনহুর, তারপর পিছন দিকের জানালার কপাট খুলে সন্তর্পণে প্রবেশ করলো ভিতরে। কক্ষমধ্যে কোনোরকম আলো নেই, জমাট অন্ধকার কক্ষটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বনহুর সুইচ টিপতেই বিস্ময়ে চমকে উঠলো–বিছানা শূন্য, মিঃ মাহমুদ রিজভী কক্ষে নেই। অথচ কক্ষের চারদিকে দরজা ভালোভাবে বন্ধ। অবাক হলো বনহুর, তার মনে একটা রহস্য দানা বেঁধে উঠলো। নিপুণ দৃষ্টি মেলে দেখতে লাগলো চারদিকে লক্ষ্য করে।

কিন্তু মধ্যে কোথাও কোনো ফাঁকা বা ছিদ্রপথ নেই। মিঃ মাহমুদ রিজভী গেলো কোথায়! অনেক অন্বেষণ করেও কোনো সন্ধান পেলো না বনহুর, তার চোখে কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু পরিলক্ষিত হলো না।

বনহুর যখন গভীরভাবে চিন্তা করছে ঠিক তখন পুনরায় সে শব্দ শুনতে পেলো সে, অদ্ভুত কড় কড় শব্দ। কোনো কপাট বা লৌহদরজা খুলে যাওয়ার মত শব্দ হলো যেন।

বনহুর দ্রুত একটা আলমারীর পাশে আত্মগোপন করে দাঁড়ালো কিন্তু দৃষ্টি তার রইলো কক্ষের সর্বত্র।

হঠাৎ বনহুর দেখলো–কক্ষের মেঝের একটা জায়গা ধীরে ধীরে ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। এবং শব্দটা ঐ স্থান থেকেই বের হচ্ছে। কর্কশ কড় কড় শব্দ। শব্দটা খুব বেশি জোরে হচ্ছেনা যদিও, তবু বেশ শোনা যাচ্ছে।

আরও বিস্মিত হলো বনহুর–মেঝেতে সুন্দর একটি সুড়ঙ্গপথ বেরিয়ে এলো এবং সে সুড়ঙ্গমুখে দেখা গেলো গুলশান হোটেলের ম্যানেজার মিঃ মাহমুদ রিজভীকে। আরও অবাক হলো যে, মাহমুদ রিজভীর মুখে এখন কোনো দাড়ি-গোঁফ নেই।

বনহুর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো, কোনোরকম শব্দ না করে। মিঃ রিজভী সুড়ঙ্গমুখ থেকে বেরিয়ে দেয়ালে টাংগানো একখানা ছবির পাশে এসে দাঁড়ালেন। ছবিটা কোনো কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো বা ঐ ধরনের নয়। দেয়ালের গায়ে পাথরে খোদাই করা যেন মূর্তি। মিঃ রিজভী সে মূর্তির গায়ে হাত দিয়ে চাপ দিতে লাগলো, অমনি সে কড় কড় শব্দ শোনা গেলো। তাকিয়ে দেখলো বনহুর–মেঝের সে সুড়ঙ্গমুখটা মিশে গেছে। একেবারে।

মিঃ রিজভী এবার পূর্বের ন্যায় মুখে দাড়ি গোঁফ পরে নিয়ে চেয়ারে এসে বসলেন। রিসিভার হাতে তুলে নিয়ে ফোন করলেন নাইন নাইন, জিরো জিরো ফাইভ ওয়ান লাবলীং ক্লাব।

বনহুর রুদ্ধ নিশ্বাসে মিঃ মাহমুদ রিজভীর কার্যকলাপ লক্ষ্য করে চললো। আশ্চর্য হলো–বিশেষ করে মিঃ রিজভীকে সে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে এসেছে। এমন সরল-সহজ মানুষটির মধ্যেও লুকায়ে আছে এত বড় রহস্যময় জীবন। বনহুর ধৈর্যসহকারে শুনতে লাগলো কি কথাবার্তা হয় জানার জন্য উন্মুখ হয়ে রইলো সে।

এবার মিঃ রিজভী কাকে যেন সম্বোধন করে বললেন–তোমার কথামতই আমি কাজ করে চলেছি। মেয়েটিকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না। তবে আর দুই তিন দিনের মধ্যে সে রাজি হবে বলে মনে করছি। তাকে অত্যন্ত সাবধানে রেখেছি। না না, কেউ টের পাবেনা–সে আমার এখানে আছে। হাঁ, সে অনেক। রাতে ফিরে এসেছে। জানিনা সে কোথায় গিয়েছিলো। হয়তো লুসীর সন্ধানে…হ্যালো, হ আমি ওকে একটু বুঝতে দেবো না। লুসীকে এখান থেকে সরানোর পূর্বেই ওকে আমি খতম করে ফেলবো। কিন্তু মনে রেখো লুসী শুধু তোমারই হবেনা আমারও…কথা যেন মনে থাকে বুঝেছো…

বনহুর দাঁতে অধর দংশন করছিলো, এ মুহূর্তে শয়তান রিজভীকে যমালয়ে পাঠাতে পারে সে কিন্তু এতো দ্রুত সে কারো ক্ষতি করতে রাজি নয়। মিঃ রিজভীকে সে এতোদিন সম্মান করে এসেছে শ্রদ্ধাও করেছে। বনহুর–কারণ তার ব্যবহারে মুগ্ধ ছিলো সে। আজ মিঃ রিজভীর মুখের খোলস উম্মোচিত হয়ে গেলো। বিশেষ করে লুসীর সন্ধান পেয়ে তৃপ্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো।

মিঃ রিজভী এবার রিসিভার রেখে শয্যায় এসে শয়ন করলো চাদরখানা টেনে দিলেন সমস্ত দেহে।

 বনহুর তখনও দাঁড়িয়ে রইলো নিশ্চুপ পাথরের মূর্তির মত। মিঃ রিজভী হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন।

 বনহুর পাশের আলমারীতে টোকা দিয়ে একটু শব্দ করলো। কোনো সাড়াশব্দ করলেন না মিঃ রিজভী।

বনহুর যে পথে এসেছিলো সে পথে বেরিয়ে গেলো সন্তর্পণে।

সোজা সে নিজের ক্যাবিনে গিয়ে শয্যা গ্রহণ করলো। লুসীর সন্ধানে বনহুর দিল্লীর কত স্থানই না সন্ধান করে ফিরেছে, তবু লুসীর খোঁজ পায়নি। আজ বনহুর কথাটা ভেবে নিজেই অবাক হলো–দস্যু বনহুরের চো খেও থোকা লাগিয়েছে মিঃ রিজভী! লুসী তারই হোটেলের কোনো এক গোপনকক্ষে বন্দিনী রয়েছে।

বনহুর মিঃ রিজভীকে খতম করে আজই লুসীকে উদ্ধার করতে পারে কিন্তু তা সে করবে না। এ ব্যাপারে শুধু মিঃ রিজভীই নয়, এমন একটা দল এর সঙ্গে জড়িত আছে যা সম্পূর্ণ বিনষ্ট করে ফেলতে হবে। তবেই তার স্বস্তি। এখন বনহুরের উদ্দেশ্য শুধু লুসীকে উদ্ধারই নয়–লুসীর হরণকারী দলকে শায়েস্তা করা।

*

পরদিন চায়ের টেবিলে মিঃ রিজভীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো বনহুরের। যেন কত সরল-সহজ-সুন্দর মানুষটি। মিঃ রিজভীকে দেখলে মনেই হয় না–তিনি একজন সত্যিকারের শয়তান।

বনহুর চায়ের কাপটা মিঃ রিজভীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো–সুপ্রভাত মিঃ রিজভী।

মিঃ রিজভী বনহুরের আচরণে একটু আশ্চর্য হয়ে অস্পষ্ট স্বরে উচ্চারণ করলেন–সুপ্রভাত। একটু থেমে। পুনরায় বললেন–আমার সম্মুখে আমার চা আছে। আপনি খান মিঃ আলম।

বনহুর হেসে বললো–গ্রহণ করুন, খুশি হবো!

মিঃ রিজভী হাতে তুলে নিতে বাধ্য হলেন বনহুরের দেয়া গরম চায়ের কাপটা।

বনহুর টি-পট থেকে আর এক কাপ চা নিজে ঢেলে গলধকরণ করলো।

 চা পান করছিলো বনহুর কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি অন্বেষণ করে ফিরছিলো মিঃ রিজভীর আসল রূপটা।

চায়ের টেবিল থেকে যখন উঠলো তখন বেলা ন’টা বেজে গেছে। একটু পূর্বে মিঃ রিজভী বনহুরের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তার নিজের অফিসরুমে।

বনহুর ডাইনিংরুম থেকে ফিরে এলো নিজের কামরায়।

অল্পদিন পর সে পূর্বদিনের সে মহাজনের ড্রেসে সজ্জিত হয়ে হোটেলের পিছন সিঁড়ি বেয়ে বেরিয়ে গেলো। ফিরে এলো সম্মুখ গেট দিয়ে। হোটেলে প্রবেশ করতেই একজন বয় এগিয়ে এলো–কেয়া চাইয়ে সাহার?

বনহুর বললো– ম্যানেজার সাহাব সে মিলনে আয়া।

 বয়টি বনহুরকে নিয়ে হাজির করলো ম্যানেজার মিঃ রিজভীর ওখানে।

 কক্ষে প্রবেশ করতেই মিঃ রিজভী অভ্যর্থনা জানালেন–আচ্ছালামো আলায়কোম জনাব। তশরিফ রাখুন।

বনহুর আসন গ্রহণ করলো।

মিঃ মাহমুদ রিজভীও আসন গ্রহণ করলেন। তারপর বললেন–মিঃ আলমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। বুঝি?

জ্বি হ, তার সঙ্গে দেখা করা আমার নিতান্ত প্রয়োজন। কারণ তার স্ত্রী মিসেস পারভিন নাকি এখানে নেই।

না, তিনি এখানে নেই। শুনেছি তার কোন আত্মীয়ের বাড়ি গেছেন।

কিন্তু আমি জানি, সে কোনো আত্মীয়ের বাড়ি যায়নি। দেখুন ম্যানেজার সাহেব, আপনার ব্যবহারে আমি অতি সন্তুষ্ট হয়েছি। আপনি অতি মহৎ জন, এ কথা আমি বুঝতে পেরেছি। একটা কথা আপনাকে বলবো, অবশ্য অত্যন্ত গোপন এক রহস্যপূর্ণ কথা।

আপনি নিঃসংকোচে বলুন? বলেন ম্যানেজার কি মাহমুদ রিজভী।

জিল্লুর রিজভীবেশি বনহুর বললো–আসলে ঐ মেয়েটি মিঃ আলমের স্ত্রী বা আত্মীয়া নয়।

অবাক হবার ভান করে বললেন মিঃ মাহমুদ–কি বললেন, মিসেস পারভিন মিঃ আলমের স্ত্রী বা আত্মীয়া নন!

না, মেয়েটি নাকি হিন্দু যুবতী। মিঃ আলম তাকে কোথা থেকে নাকি জোগাড় করেছেন। আমার সঙ্গে তার কথা হয়েছে–ঐ যুবতীটিকে তিনি আমার কাছে বিক্রয় করবেন।

বলেন কি?

সত্যিই বলছি এবং আমি জানি আপনি এসব জানা সত্বেও তাকে বলবেন না।

ছিঃ ছিঃ ছিঃ আমি বলবো এ কথা? আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখবেন। হ, কি বলছিলেন–মিসেস পারভিন মিঃ আলমের স্ত্রী নন?

না।

তবে কে মেয়েটি?

ঐটুকুই আমি জানি, মেয়েটিকে তিনি কোথা হতে সংগ্রহ করেছেন জানিনা।

কিছুক্ষণ যেন গভীরভাবে চিন্তা করলেন বা চিন্তার অভিনয় করলেন মিঃ মাহমুদ রিজভী, তারপর বললেন–আমি অবাক হচ্ছি, কারণ তারা আমার হোটেলে স্বামী-স্ত্রী বলেই পরিচয় দিয়েছেন।

এতে অবাক হবার কি আছে? হোটেলে এসব ব্যাপার নিত্য কত সংঘটিত হয়ে চলেছে।

আপনি কি তাকে ক্রয় করবেন মনস্থ করেছিলেন?

 আপনার কাছে লুকোবার কিছু নেই। হাঁ, তার সঙ্গে আমার ঐ রকম কথাবার্তা চলছিলো।

বললেন মাহমুদ রিজভী–আপনার সঙ্গে তার কোনোরকম দাম চুক্তি হয়েছিলো কি?

 হয়েছিলো!

কত স্বীকার করেছিলেন আপনি?

 প্রায় এক লক্ষ পঁচিশ হাজার। কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বনহুর মিঃ মাহমুদ রিজভীর মুখে।

চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠলো মাহমুদ রিজভীর, ঠোঁটখানা জিভ দিয়ে চেটে নিলের অলক্ষ্যে একবার। ভাজা মাছের গন্ধে বিড়াল যেমন উগ্র হয়ে উঠে ঠিক তেমনি। বললেন মাহমুদ রিজভী–তাতেও কি সে রাজি হয়নি?

না, পুরো দু’লক্ষ টাকা তার দাবি ছিলো।

 কিছুক্ষণ মৌন রইলো মাহমুদ রিজভী, তারপর বললেন–সেই মেয়েটি ছাড়া আপনি কি…

হাঁ হাঁ যে কোনো একটি সুন্দরী অল্পবয়স্ক মেয়ে হলেই আমার চলবে।

হেসে বললেন মাহমুদ রিজভী–আর যদি সে মিসেস পারভিনকে পান?

 যা চাইবেন তাই দেবো, কিন্তু মিঃ আলম কি এ ব্যাপারে…

 তিনি এর বিন্দু বিসর্গ জানবেন না।

অবাক হবার ভান করে বলে বনহুর–দেখুন দয়া করে মিসেস পারভিনকেই আমায় দিন..

কোনো চিন্তা নেই, সে এখন আমার হাতের মুঠায়। তবে আমি এখন তার রক্ষক হিসাবে আছি। সে হলো ধীরেনচরণ ভৌমের শিকার।

তার মানে?

মানে মিঃ আলমের হাত থেকে মিস লুসী এখন চলে এসেছে…

 মিস লুসী! অবাক হবার অভিনয় করে জিল্লুর রিজভীবেশী বনহুর।

হাঁ, মিস লুসীই ছিলো মিঃ আলমের কাছে এবং তারা উভয়ে স্বামী-স্ত্রী বলে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু আমার চোখে সে ধূলো দিতে পারেনি। পারভিন লুসীর ছদ্মনাম।

জিল্লুর রিজভী বললেন–আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন, আমি মিস লুসীকে চাই।

 বেশ তাই হবে।

 তা হলে আমি মিঃ আলমের সঙ্গে দেখা করবো না?

না, কারণ মিঃ আলম এখন মিস লুসীর সন্ধানে উন্মত্ত।

তাহলে কবে আমি তাকে পেতে পারি?

আপনি যখন খুশি তার উচিৎ মূল্য দিয়ে গ্রহণ করতে পারেন। আচ্ছা আজ আপনি আসুন, পরে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হবে।

আচ্ছা আমি চললাম–জিলুর রিজভীবেশী বনহুর বেরিয়ে গেলো তখনকার মত।

সোজা সে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে ড্রেস পরিবর্তন করে নিলো। এখন সে সম্পূর্ণ ড্রাইভারের ড্রেসে সজ্জিত হয়ে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে।

গাড়ি বারান্দায় যে গাড়িখানা দাঁড়িয়েছিলো বনহুর সোজা এসে চেপে বসলো তার ড্রাইভিং আসনে। মিনিট দুই পরেই গাড়িখানার পাশে এসে দাঁড়ালো মিঃ মাহমুদ রিজভী, দামী স্যুট-পরা, মাথায় ক্যাপ। একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে চেপে বসলেন গাড়ির পিছন আসনে, বললেন–লাবলীং ক্লাব।

বনহুরের অপরিচিত নয় লাবলীং ক্লাব, গাড়ি ছুটলো এবার দিল্লীর শেরশাহ রোড় ধরে ফরিদা রোড়ের দিকে।

গাড়ি ছুটে চলেছে।

 রাত্রির গভীরতার সঙ্গে দিল্লী নগরীর নির্জনতা যেন থমথমে হয়ে উঠেছে! পথ জনশূন্য। ইলেকট্রিক আলোগুলো কেমন যেন স্তিমিত মনে হচ্ছিলো। পথের দু’পাশের সুউচ্চ অট্টালিকাগুলো যেন সুপ্তির কোলে ঢলে। পড়েছে।

মিঃ মাহমুদ রিজভীর গাড়ি তখন লাবলীং ক্লাবের উদ্দেশ্যে ছুটে চলছে।

 ড্রাইভিং আসনে স্বয়ং দস্যু বনহুর।

 কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িখানা লাবলীং ক্লাবের সম্মুখে এসে থামলো।

লাবলীং ক্লাবের উজ্জ্বল আলোগুলো তখনও দপদপ করে জ্বলছে। ভিতর থেকে ভেসে আসছে সুমিষ্ট একটা বাজনার সুর। মাঝে মাঝে জড়িত কণ্ঠের অস্পষ্ট আওয়াজের সঙ্গে শোনা যাচ্ছে নারী-কণ্ঠের হাস্যধ্বনি।

মিঃ মাহমুদ রিজভী গাড়ি থেকে নেমে চলে গেলেন ক্লাবের মধ্যে।

মাহমুদ রিজভী ক্লাবে প্রবেশ করতেই বনহুর তার ছদ্মবেশ পাল্টে নিলো। গাড়ির মধ্যে সে লুকিয়ে রেখেছিলো তার স্বাভাবিক ড্রেস। সাধারণ এক নাগরিকের বেশে সজ্জিত হয়ে প্রবেশ করলো সে ক্লাবকক্ষে।

হলকক্ষের একটা কোণে গিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো বনহুর। তাকালো সে কক্ষের চারপাশে। লাবলীং ক্লাব এখন বেশ নীরব। প্রায় টেবিলগুলোই শূন্য–ফাঁকা। দু’একটা টেবিল অধিকার করে তখনও বসে আছে কয়েকটা বিশিষ্ট মাতাল ব্যক্তি। সম্মুখে শূন্য বোতল আর কাঁচপাত্র। কেউ কেউ খালি বোতলটা তুলে ধরে নিঃশেষিত সারাটুকু ঢেলে দিচ্ছে গলার মধ্যে। কেউ বা টেবিলে মাথা রেখে পড়ে আছে উবু হয়ে, হাত দুখানা ঝুলছে টেবিলের নিচে।

বনহুর সিগারেট ধরালো।

একটা বয় নিদ্রাজড়িত কণ্ঠে বললো–আনবো স্যার?

 হ নিয়ে এসো।

লাবলীং ক্লাবে কিছু বলতে হয় না–ওরা জানে, বেশি রাতে যারা আসে তারা কোন জিনিসের লোভে আসে। বনহুর লক্ষ্য করলো, ডাইনিং হলে তখনও কয়েকজন লোক বসে আছে। এবং তাদের মধ্যে কিছু আলাপ-আলোচনা চলছে। যদিও তারা সারাব পানে চুর চুর তবু বেশ স্বাভাবিকভাবেই ফিস ফিস করে আলাপ করছে। দুটো যুবতীও আছে তাদের দলে! বনহুর আরও লক্ষ্য করলো, যে দুটি যুবতী তখনও ক্লাবের জৌলুস বাড়াবার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিলো তারা প্রায় নগ্নদেহী নারী। চোখ দুটো নেশায় লালে লাল হয়ে উঠেছে। দুটো পুরুষের পাশে চেয়ারের হাতলে বসে সিগারেট ফুকছিলো। আর মাঝে মাঝে ঝঙ্কার তুলে হাসছিলো যুবতীদ্বয়। কখনও বা ঢলে পড়েছে তারা পুরুষগুলোর গায়ে।

এসব দৃশ্য বনহুরের কাছে অত্যন্ত ঘৃণাজনক! তবু তাকে স্থির হয়ে দেখতে হচ্ছে। সকলের অলক্ষ্যে সে অন্বেষণ করে চলেছে মিঃ মাহমুদ রিজভীকে।

ক্লাবে প্রবেশ করেই কি সে হাওয়ায় উবে গেলো, বিরাট কক্ষটার কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।

বনহুরের সম্মুখে ততক্ষণে কয়েকটা মদের বোতল আর কয়াচপাত্র এনে রাখা হয়েছে। বয় চলে যেতেই। একটি নগ্নপ্রায় যুবতী এগিয়ে এলো, বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে হাসলো ফিক করে।

বনহুর মৃদু হেসে বললো–দাও।

যুবতী কাঁচপাত্রে খানিকটা মদ ঢেলে হাতখানা এগিয়ে ধরলো বনহুরের ঠোঁটের কাছে!

এবার বনহুর বেশ বিব্রত হয়ে পড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই যুবতীর হাতখানা ধরে কাঁচপাত্রটা তুলে নিলো নিজের হাতে, তারপর যুবতীর মুখে তুলে ধরে বললো–তুমি খাও।

যুবতীর চোখ দুটো আনন্দে চক্ করে উঠলো। এক নিঃশ্বাসে কাঁচপাত্রের মদটুকু পান করে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে। দু’চোখ তার নোশায় ঢুলু ঢুলু করছে। একরাশ কোকড়ানো চুল ছড়িয়ে পড়েছে তার চোখে-মুখে-কপালে। বনহুরের চোখে-চোখ রেখে বললো–তুমিও খাও।

হা খাবো।

বনহুর আর যুবতীর যখন কথাবার্তা চলছিলো, তখন বনহুরের দৃষ্টি ছিলো ক্লাবকক্ষের চারদিকে। ওদিকে ডাইনিং হলে লোকগুলো বেশ মাতাল হয়ে পড়েছে, ওদের কথাবার্তা এখন আর চাপা নেই, জড়িত গলায় স্পষ্টভাবে আলাপ হচ্ছিলো।

যুবতীদ্বয়ের একজন তখন বনহুরের পাশে, আর একজন তখনও ঐ মাতাল লোকগুলোর মনঃতুষ্টি সাধন করে চলেছে। আর অবিরত সিগারেট থেকে ধুম্র নির্গত করে চলেছিলো সে।

যে যুবতীটি এখন বনহুরের পাশে, তার সঙ্গে বনহুরের প্রথম দিন লাবলীং ক্লাবে দেখা হয়েছিলো কিন্তু সেদিন বনহুরের মুখে ছিলো চাপদাড়ি আর বড় বড় গোঁফ, মাথায় পাগড়ি। আজ বনহুর সাধারণ ড্রেসে এসেছে। যুবতীটি যদিও তাকে চিনতে পারছে না কিন্তু সে তাকে চিনতে পেরেছে।

যুবতী বলে উঠলো–মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড, তুমি মোটেই খাচ্ছো না কেন?

বনহুরের দৃষ্টি যদিও ফিরে এলো যুবতীর মুখে কিন্তু তার কান সজাগ রইলো। বললো বনহুর–অনেক খেয়েছি আর নয়।

উঁ হুঁ হবে না, আমার হাতে আর একটু খাও…যুবতী কাঁচপাত্রটা আবার তুলে ধরলো বনহুরের মুখের সামনে।

বনহুর কাঁচপাত্রটা হাতে নিলো, তারপর বললো–ঐ দেখ কি সুন্দর আকাশ!

 যুবতী পাশের জানালা দিয়ে তাকালো জোছনা প্লাবিত আকাশের দিকে।

বনহুর দ্রুতহস্তে কাঁচপাত্র থেকে মদটুকু ফেলে দিলো পাশের ফুলদানীতে। খালি কাঁচপাত্রটা মুখের কাছে নিয়ে বললো,–চমৎকার!

যুবতী এবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো বনহুরের মুখে।

বনহুর খালি কাঁচপাত্রটা রাখলো টেবিলে।

এমন সময় লাবলীং ক্লাবের ম্যানেজার সে স্থানে উপস্থিত হলো। বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো তার। বনহুরের চিনতে বিলম্ব হলো না, এর সঙ্গে পূর্বের ঐ দিন সাক্ষাৎ হয়েছে। ধীরেনচরণের দক্ষিণ হস্ত এ শয়তান। বনহুর বিশ্বাস করেছিলো, লাবলীং ক্লাবের ম্যানেজার মিঃ মাহমুদ রিজভীকে, কিন্তু তার আসল রূপ উদঘাটন হয়ে গেছে বনহুরের কাছে। লাবলীং ক্লাব আর গুলশান ক্লাবের মধ্যে রয়েছে ভীষণ এক রহস্যময় যোগাযোগ। অত্যন্ত জঘন্য আর অপ্রীতিকর এ দুটি ক্লাব। বনহুর এ দুটি ক্লাবের ধ্বংস কামনা করে। এখানে দিনের পর দিন কত সচ্চরিত্র ব্যক্তি তাদের জীবনকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে! কত সতী নারী বিসর্জন দিচ্ছে তাদের মহামূল্যবান ইজ্জৎ। আজ কদিন ধরে বনহুর নিজে উপলব্ধি করে চলেছে এসব ক্লাবের পরিবেশ। ঘৃণায় বিতৃষ্ণায় তার মন বিষিয়ে উঠেছে, তার বিবেক বাধা দিয়েছে এখানে আসতে কিন্তু না এসে উপায় নেই। লুসীকে তার উদ্ধার করতে হবে আর সায়েস্তা করতে হবে এ সব ক্লাবের শয়তান দুষ্ট বদমায়েশদের! বনহুর এদের ক্ষমা করবে না কিছুতেই।

ম্যানেজারকে বনহুর চিনতে পারলেও ম্যানেজার তাকে বুঝতেই পারেনি, এ লোক একদিন তার বুকে রিভলভার চেপে ধরেছিলো। ম্যানেজার তাকে নতুন আগন্তুক মনে করে যুবতীটিকে ইঙ্গিত করলো কিছু।

যুবতীও ইশারা করলো তার দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে।

 চলে গেলো ম্যানেজার।

যুবতী বনহুরের হাত ধরে বললো মাই ডিয়ার ফ্রেণ্ড, চলো। উঠে দাঁড়ালো বনহুর, যন্ত্রচালিতের ন্যায় যুবতীর সঙ্গে এগিয়ে চললো। এমনি করে লোকের সর্বনাশ এরা করে চলে দিনের পর দিন রাত্রির পর রাত্রি।

বনহুরসহ যুবতী একটি কক্ষে প্রবেশ করলো।

চমকে উঠলো বনহুর।

দেখলো ওদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে দুই ব্যক্তি, নিম্নস্বরে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে তাদের মধ্যে।

যুবতী এবং বনহুরের পদশব্দে তারা ফিরে তাকালো না। যেমন বসেছিলো তেমনি রইলো। যুবতী। বনহুরকে ইঙ্গিত করলো ওদিকের কামরায় যেতে।

বনহুর অনুসরণ করলো যুবতীকে।

যদিও বনহুর যুবতীর সঙ্গে সে কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলো। কিন্তু সে লোক দুটিকে সম্পূর্ণ চিনতে পারলো। একজন শয়তান ধীরেনচরণ আর দ্বিতীয় জন মিঃ মাহমুদ রিজভী।

যে কক্ষে ওরা নিভৃতে আলাপ-আলোচনা করছিলো ঠিক তার পাশের কক্ষে যুবতীসহ প্রবেশ করলো বনহুর।

কক্ষটা মাঝারী গোছের।

একটা ডিমলাইট জ্বলছে টেবিলে।

 সুন্দরভাবে সজ্জিত কক্ষটা।

 যুবতী বনহুরকে ধরে বসিয়ে দিলো একটা চেয়ারে।

একটা বয় এসে টেবিলে রেখে গেলো এক বোতল বিলেতী মদ আর দুটো গ্লাস।

যুবতী নেশায় তখন ঢুলু ঢুলু করছে, তবু বোতলটা হাতে তুলে নিয়ে এক টানে দাঁত দিয়ে খুলে ফেললো। বোতলের মুখের ছিপিটা, তারপর গ্লাস দুটো পূর্ণ করে একটি তুলে নিলো হাতে, বললো– নাও।

বনহুর ওর হাত থেকে গ্লাসটা নিজের হাতে নিলো।

 যুবতী দ্বিতীয় গ্লাসটা তুলে নিলো।

 বনহুর মদের গ্লাস হস্তে তখন ভাবছে অন্য কথা, ধীরেনের সঙ্গে লুসীকে নিয়ে মাহমুদ রিজভীর দাম কষাকষি চলছে নিশ্চয়ই। এতো রাতে সে এসেছে এখানে ঐ কারণে। ধীরেন তাহলে লাবলীং ক্লাবে থাকে। কিন্তু সে জানে না লুসী এখন কোথায় আছে। কিন্তু চিঠিখানা যে ধীরেনের লেখা ছিলো, তাতে মনে হয় ধীরেন চরণই তাকে হরণ করেছে। আসলে তা নয়, হরণ করেছেন লুসীকে মিঃ রিজভী। লোকটা যে অত্যন্ত চালাক তাতে কোন সন্দেহ নেই। চিঠিখানা লেখার উদ্দেশ্যই ছিল মিঃ আলম যেন ধীরেনচরণকেই সন্দেহ করে।

যুবতী গ্লাসের মদ নিঃশেষ করে টেবিলে রাখলো, তারপর বনহুরের হাটুর উপর মাথা রেখে বললো–কি ভাবছো ডার্লিং।

বনহুরের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায়, বলে–তোমার রূপসাগরে ডুববো কিনা তাই ভাবছি।

কেন, তুমি; তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না? জড়িত কণ্ঠে বললো যুবতী।

বনহুর যুবতীর চিবুকটা তুলে ধরলো–অবিশ্বাস তো করিনি তোমাকে তবে ভাবছি এর শেষ হবে কোথায়? কথার ফাঁকে বোতল থেকে কিছুটা তরল পদার্থ ঢেলে তুলে ধরলো যুবতীর মুখে–খাও প্রিয়া।

যুবতী আত্মহারা, বনহুরের হাতের মদটুকু নিঃশেষে ঢেলে দিলো কণ্ঠে, তারপর বললো–দাও আরও দাও আমাকে।

বনহুর আবার গ্লাস পূর্ণ করলো, এগিয়ে দিলো যুবতীর দিকে–নাও।

আবার যুবতী পান করলো সবটুকু।

 বনহুর পর পর কয়েক গ্লাস মদ পান করালো যুবতীকে। এক সময় যুবতী ঢলে পড়লো বনহুরের হাতের

এবার বনহুর বিলম্ব না করে ওকে শুইয়ে দিলো ওর বিছানায়। তারপর চাদর দিয়ে ঢেকে দিলো গা অবধি।

বনহুর ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে, এ ঘরে প্রবেশ করতেই কানে এলো মিঃ মাহমুদ রিজভীর চাপা কণ্ঠ–তা হলে কথা ঠিক রইলো তো?

ধীরেনচরণের গলা–বন্ধুর সঙ্গে কথা বেঠিক আবার কবে হয়েছে! তবে হাঁ, তুমি যা চাইছো তাই পাবে কিন্তু পথ পরিস্কার করে দিতে হবে, বুঝলে তো?

বুঝেছি। আজ রাতেই আমি তোমার পথ পরিস্কার করে দিবো। কিন্তু মনে রেখো এক পয়সা কম নিবো না।

চলি, গুড নাইট…উঠে পড়লেন মিঃ মাহমুদ রিজভী।

ধীরেনচরণ পুনরায় ওকে টেনে বসিয়ে দিয়ে বললো–লুসী এখন কোথায়, তোমার হোটেলে না বাইরে আছে?

সে কথা আমি বলতে রাজি নই। তবে কথা দিলাম, তোমার মাল তোমার হাতেই আসবে।

বনহুর বুঝতে পারলো–ওদের কথাবার্তা শেষ হয়ে গেছে, এবার বিদায়ের পালা। মুহূর্ত বিলম্ব না করে আড়ালে আত্মগোপন করে গাড়িতে পৌঁছে গেলো। গাড়ির পিছন থেকে তার ড্রাইভারের ড্রেস নিয়ে ওদিকে একটা থামের আড়ালে গিয়ে পাল্টে নিলো তার সাধারণ পোশাকটা। তারপর এসে বসলো ড্রাইভ আসনে।

ঘনীভূত নিদ্রাতুরের মত গাড়ির হ্যাণ্ডেলে মাথা রেখে ঝিমুতে লাগলো বনহুর।

গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালেন মিঃ মাহমুদ রিজভী ও ধীরেনচরণ।

মিঃ মাহমুদ বললো–ড্রাইভার! ড্রাইভার ঘুমাচ্ছো নাকি?

চোখ রগড়ে সোজা হয়ে বসলো বনহুর।

 ধীরেন বললো–আগামী রাতে আবার দেখা হবে।

 গুড নাইট! কথাটা উচ্চারণ করে গাড়িতে চেপে বসলেন মাহমুদ রিজভী।

 ষ্টার্ট দিলো বনহুর।

 গাড়ি ছুটলো এবার গুলশান হোটেল অভিমুখে।

*

বিছানায় শুয়ে ভাবলো বনহুর, আজ রাতেই তাকে খতম করবার সঙ্কল্প করেছে মাহমুদ রিজভী, নিশ্চয়ই সে তার সঙ্কল্প অটুট রাখবার জন্য এখানে আগমন করবে। হাতঘড়ির দিকে তাকালো বনহুর, রাত চারটা বেজে পঁচিশ মিনিট হয়েছে। শয্যা ত্যাগ করে বিছানার পাশের লম্বা বালিশ দুটো চাদর ঢাকা দিয়ে রাখলো।

ওপাশের আলমারীটার আড়ালে লুকিয়ে রইলো নিশ্চুপ হয়ে। দক্ষিণ হস্তে তার গুলীভরা রিভলভার।

কয়েক মিনিট কেটে গেলো।

হঠাৎ ওদিকের জানালা খুলে গেলো, খুট করে একটা শব্দ হলো। বনহুর দাঁড়িয়ে আছে আলমারীটার আড়ালে। কিন্তু দৃষ্টি তার জানালার দিকে।

ধীরে ধীরে একটি লোক প্রবেশ করলো, ইলেকট্রিক আলোতে তার হাতে সূতীক্ষ ছোরাখানা চক্ চক্ করে উঠলো। লোকটা সন্তর্পনে এগুচ্ছে তার বিছানার দিকে।

বনহুর রুদ্ধ নিশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে।

 লোকটার মুখে মুখোশ, দেহে কালো পোশাক।

বিছানার কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো লোকটা এবার। এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে ছোরাখানা সমূলে বসিয়ে দিলো বিছানায় শায়িত বালিশটার বুকে।

অমনি বনহুর ওর পিছনে এসে দাঁড়ালো, হেসে উঠলো অদ্ভুত ভাবে–হাঃ হাঃ হাঃ মিঃ আলমকে হত্যা করলে?

মুখোশ-পরা লোকটা মুহূর্তে হকচকিয়ে গেলে। ফিরে দাঁড়ালো বনহুরের দিকে মুখ করে।

 বনহুর রিভলভারের আগা দিয়ে লোকটার মুখের মুখোশ সরিয়ে দিলো, সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো–আপনি!

লজ্জায় মাথা নত করে নিলেন মিঃ মাহমুদ রিজভী।

বনহুর হেসে বললো–লজ্জিত হবার কিছু নেই। বসুন মিঃ রিজভী।

 মাহমুদ রিজভী কোনো জবাব না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। পথ রোধ করে দাঁড়ালো বনহুর দাঁড়ান।

 মাহমুদ রিজভী থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, কিন্তু দৃষ্টি তার দরজার দিকে রইলো।

গম্ভীর কণ্ঠে বললো বনহুর–উদ্দেশ্য সফল হলো না মিঃ রিজভী? মিঃ আলমকে খতম করে মিস লুসীকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলো!

নত দৃষ্টি তুলে তাকালেন মাহমুদ রিজভী বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর পুনরায় বললো–মিঃ রিজভী, আপনি মিঃ জিল্লুর আলীর কাছে মিস লুসীকে বিক্রয় করতে চেয়ে আবার গিয়েছিলেন ধীরেনের হাতে তুলে দিতে।

চমকে উঠলেন মিঃ মাহমুদ রিজভী, ভাবছেন এত সব মিঃ আলম জানলো কি করে?

বনহুর এবার মিঃ মাহমুদ রিজভীর পিঠে রিভলভার চেপে ধরলো, তারপর বললো–চলুন আমিই মিঃ জিল্লুর আলী রিজভী, মিস লুসীর সম্বন্ধে আমার সঙ্গেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন! আমি তার প্রথম গ্রাহক।

আশ্চর্য হয়ে তাকালেন মিঃ মাহমুদ, কিন্তু কোনো কথা তার কণ্ঠ দিয়ে বের হলো না।

বনহুর চাপা স্বরে গর্জে উঠলো–চলুন। দেখুন আমার সঙ্গে কোনোরকম চালাকি করতে গেলে মরবেন। লক্ষ টাকাও যাবে প্রাণও হারাবেন।

মিঃ রিজভী বাধ্য হয়েই অগ্রসর হলেন।

বনহুর তাকে অনুসরণ করলো। তার হস্তে গুলীভরা রিভলভার।

মিঃ রিজভী সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন।

নিশীথ রাতের গভীরতায় সমস্ত দিল্লী নগরী নিস্তব্ধ। গুলশান হোটেলও ঢলে পড়েছে সুপ্তির কোলে। কোথাও জনপ্রাণী নেই। বনহুর আর মিঃ মাহমুদ রিজভী চলেছে, দুটো যন্ত্রচালিত মূর্তির মত।

চাপা কণ্ঠে বনহুর বললো–খবরদার, ফাঁকি দিতে চেষ্টা করবেন না মিঃ রিজভী।

এতোক্ষণ মিঃ রিজভী কোনো কথা বলেননি, এবার বললেন তিনি–মিস লুসী বাইরে আছে! আমার গাড়িতে আপনাকে যেতে হবে।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–প্রথমেই বলেছি, কোনো রকম চালাকি করবেন না। আমি জানি, মিস লুসী এ হোটেলেই আছে।

নেই, তাকে লাবলীং হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

 চলুন আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি…বনহুর হস্তস্থিত রিভলভারখানা চেপে ধরলো মিঃ মাহমুদ রিজভীর পিঠে।

এবার মাহমুদ রিজভী নির্বাকভাবে অগ্রসর হলেন, পিছন ফিরে তাকাবার সাহস তার হলো না।

গুলশান হোটেলের চোরাকক্ষের সুড়ঙ্গমুখে এসে দাঁড়ালো বনহুর আর মাহমুদ রিজভী।

বনহুর পূর্বদিন দেখেছিলো কেমনভাবে সুড়ঙ্গপথ আবিস্কার করতে হয়। আজ তার কোনো অসুবিধা হলো না। বনহুর দেয়ালে একটি যন্ত্রে চাপ দিতেই মেঝেতে বেরিয়ে পড়লো একটি সিঁড়ির মুখ।

মিঃ রিজভীর চোখমুখ রাগে কালো হয়ে উঠেছে। তিনি জানতেন তার এ সুড়ঙ্গপথের সন্ধান বাইরের কেউ জানে না! মিঃ আলম কি করে জানলো বা সন্ধান পেলো এ পথের!

সব রহস্য ফাঁস হয়ে গেলো দেখে তিনি ক্রুদ্ধ সিংহের ন্যায় গর্জে উঠলেন–মিঃ আলম, আপনি কি করে এ পথের খোঁজ পেলেন?

হেসে বললো বনহুর–আপনার কাছে।

 আমার কাছে?

হাঁ। আপনি লুসীর কাছে যখন যান তখন আমিও আপনার সঙ্গে ছিলাম মিঃ রিজভী।

 অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন মিঃ রিজভী–মিঃ আলম!

বনহুর রিভলভার চেপে ধরলো সজোরে তার বুকে কোনো রকম উত্তেজিত হবেন না। আমি মিঃ আলম নই।

কে! কে তবে আপনি?

 আমি দস্যু বনহুর।

দস্যু বনহুর আপনি?

হাঁ।

 বিশ্বাস হয় না। দস্যু বনহুরের যে কাহিনী আমি শুনেছি, তার সঙ্গে আপনার কোনোরকম মিল নেই।

তা হলে আপনার বন্ধুই মনে করুন। বেশ, চলুন এবার বন্ধু। মিস লুসীকে আমার চাই।

কিন্তু…

লক্ষ টাকা তো?

 হাঁ, লুসীকে আমি…

লুসীকে আপনি হরণ করেছেন আমার নিকট হতে। জানেন তার শাস্তি কি? মৃত্যু। যদি মরতে না চান। তবে বিনা বাক্যে প্রবেশ করুন এ চোরা সুড়ঙ্গপথে, চলুন।

অগত্যা মিঃ মাহমুদ রিজভী চোরা সুড়ঙ্গপথে পা বাড়ালেন। বনহুর চললো তার পিছনে পিছনে।

গভীর মাটির নিচে একটি কক্ষ।

 ক্ষীণ একটা আলো টিপ টিপ করে জ্বলছে।

 কক্ষমধ্যে আরো অন্ধকার। বনহুর দেখলো, ওপাশে একটা শয্যায় শুয়ে আছে মিস লুসী! ঘুমিয়ে আছে।

মিঃ রিজভী আর বনহুরের পদশব্দ তার কানে পৌঁছলো না। যেমন নিশ্চুপ ঘুমিয়েছিলো, তেমনি রইলো।

 বনহুর মিঃ রিজভীসহ পাশের খুপড়িতে প্রবেশ করলো। বললো সে–আপনার ছদ্মবেশ ত্যাগ করুন।

অবাক হবার ভান করে বলেন মিঃ মাহমুদ রিজভী–ছদ্মবেশ! আমি তো ছদ্মবেশ ধারণ করিনি।

বেশি কথা বলার সময় এখন নেই। আপনার দাড়ি-গোঁফ খুলে আমাকে দিন। এখন আপনি বিশ্রাম করুন। আজ থেকে আমি গুলশান হোটেলের ম্যানেজার মিঃ মাহমুদ রিজভী।

*

বনহুর মিঃ মাহমুদ রিজভীর ড্রেসে সজ্জিত হয়ে মিস লুসীর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।

 ভীত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো লুসী বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর বললো–মিস লুসী, ভয় পাবার কিছু নেই। জানো আমি কেন এসেছি?

কেঁদে কেঁদে লুসীর দু’চোখ ফুলে গেছে। দেহটা পূর্বের চেয়ে ক্ষীণ হয়ে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো তৈলহীন।

বনহুর লুসীর হাত ধরলো–এসো আমার সঙ্গে।

না না আমি যাবো না, আমাকে ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন, আপনার পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে দিন…

 হবে না, চলো আমার সঙ্গে যেতে হবে তোমাকে।

 কোথায় নিয়ে যাবেন আমাকে?

ধীরেনচরণের কাছে।

উঃ তার চেয়ে আমাকে মেরে ফেলুন। আমাকে মেরে ফেলুন আপনি।

 কোনো কথা শুনতে চাই না, এসো আমার সঙ্গে।

বনহুর মিঃ মাহমুদ রিজভীর বেশে মিস লুসীকে নিয়ে সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে উঠে এলো উপরে।

 চোরা কুঠরীর মধ্যে বন্দী করে রাখলো বনহুর আসল মাহমুদ রিজভীকে। সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই তার। নিজের তৈরি মৃত্যুকূপে আটকা পড়েছেন এবার মাহমুদ রিজভী। এতোকাল বহু অন্যায় কাজ তিনি সমাধা করে এসেছেন গুলশান হোটেলের অন্তরালে, সর্বনাশ করেছেন অনেক মহৎ ব্যক্তির। এবার হবে তার উপযুক্ত শাস্তি।

বনহুর মিস লুসীকে নিয়ে গোপন সুড়ঙ্গপথ বেয়ে গুলশান হোটেলের ভিতরে এসে দাঁড়ালো। রাত তখন শেষ হয়ে এসেছে।

মিস লুসী করুণ সুরে বললো–আমাকে আমার ক্যাবিনে পৌঁছে দিন দয়া করে। আমাকে আমার ক্যাবিনে পৌঁছে দিন…

বেশ চলো। মিঃ রিজভীবেশি বনহুর বললো।

লুসীসহ বনহুর তাদের পূর্বের ক্যাবিনে হাজির হলো। ব্যাকুল আগ্রহে তাকালো লুসী কক্ষের মধ্যে। ওপাশে খাটখানা শূন্য পড়ে আছে। মিঃ আলম কই, তবে কি তিনি এ হোটেল ত্যাগ করে চলে গেছেন! কিন্তু পাশের আলনায় নজর পড়তেই কতকটা আশ্বস্ত হলো লুসী, দেখলো কোট-প্যান্ট-সার্ট ঝুলছে। এসব যে মিঃ আলমের তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আনন্দ উজ্জ্বল হলো ওর চোখ দুটো।

বনহুর তার দাড়ি-গোঁফের আড়ালে লুসীর আনন্দভরা মুখের দিকে তাকালো। মনে মনে সেও কত খুশি হলো, না, লুসীকে সে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সে এ ভাবে তাকে পরিচয় দিতে রাজি নয়, আরও বিলম্ব আছে। দিল্লী নগরীতে আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হবে তাকে! কারণ ধীরেনচরণকে এখনও উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়নি।

মিঃ রিজভীবেশি বনহুর বললো–তুমি এখানে থাকতে পারো। কিন্তু এ হোটেল ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।

বনহুর লক্ষ্য করলো তার কথায় লুসীর মুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠেছে। এ কথা তার মনে একটা শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিয়েছে যেন; এখানে তার রক্ষক আলমকে পাবে–এই তার ভরসা।

মিল লুসীকে এ ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে সরাসরি চলে গেলো বনহুর ম্যানেজার মিঃ মাহমুদ রিজভীর ক্যাবিনে। তাকে কয়েকদিন মিঃ রিজভীর অভিনয় করতে হবে।

বনহুর চলে যেতেই লুসী কক্ষের চারদিকে ব্যাকুল আঁখি মেলে তাকাতে লাগলো, কোথায় তিনি, যার প্রতীক্ষায় তার দিন-রাত্রি চোখের জলে বুক ভাসছে। কোথায় সে দেব সমতুল্য মিঃ আলম। লুসীর মনে ঝড় বইছে, তবে কি তিনি নেই এখানে তাকেও কি ঐ শয়তান সরিয়েছে?

লুসী শয্যায় গিয়ে বসলো, রাত শেষ হয়ে এসেছে। তবে সূর্য উঠতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি।

লুসী শয্যায় শুয়ে পড়লো, কিন্তু ঘুম তার চোখে আসছে না। মনের মধ্যে ঝড় বইছে তার।

এমন সময় ক্যাবিনের দরজায় মৃদু আঘাতের শব্দ হয়। চমকে উঠে লুসী, তাকায় বদ্ধ দরজার দিকে। পরপর দরজায় মৃদু আঘাত হচ্ছে।

লুসী খুলে দেয় দরজা–যা তার ভাগ্যে থাকে হবে। দরজা খুলেই দেখতে পায় সে মিঃ আলমকে, উজ্জ্বল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে লুসী বনহুরের বুকে–আপনি!

বনহুরও নিজেকে সংযত রাখতে পারে না, বেশ কিছুদিনের ঘনিষ্ঠতায় লুসীর প্রতি তার একটা অনুরাগ জন্মেছিলো। হাজার হলেও সেও তো মানুষ, তার মধ্যেও আছে একটা মানুষের প্রাণ। বনহুর লুসীকে সরিয়ে দিতে পারে না, নিবিড়ভাবে টেনে নেয় কাছে।

বনহুরের বুকে মুখ লুকিয়ে লুসী আবেগভরা গলায় বলে–আপনি আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবেন না। বলুন আর কোথাও যাবেন না?

না লুসী। তোমাকে ছেড়ে আমি তো যাইনি, তুমিই তো আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলে।

আমি যাইনি মিঃ আলম, আমাকে ঐ শয়তান মিঃ রিজভী ফুসলিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো।

বনহুর লুসীর চোখের পানি নিজের হাতে মুছিয়ে দিয়ে বললো–শয়তানকে আমি উপযুক্ত শাস্তি দেবো;

না না, সে এখন আমাকে এ ক্যাবিনে পৌঁছে গিয়েছে, বলেছে আমি যেন এ ক্যাবিন ছেড়ে কোথাও না যাই। ওকে আপনি আর কিছু বলবেন না। হয়তো আবার সে আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে পারে।

লুসী, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো–আমি বললাম আর কেউ তোমার বা আমার উপর কোনোরকম অত্যাচার করতে সক্ষম হবে না।

মিঃ আলম।

বলো লুসী?

বনহুর আর লুসী বিছানায় এসে বসে।

লুসীর মায়াময় চোখে, চাহনী বনহুরের মনে একটা আলোড়ন জাগায়। বনহুর লুসীকে বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলে, মুখখানা নেমে আসে ওর মুখের উপর।

লুসী বাধা দেয় না বনহুরকে, কারণ সে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে অন্তর দিয়ে।

কিন্তু বনহুর পরক্ষণেই লুসীকে বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে–না না, লুসী, তুমি…তুমি…যাও। লুসী, তোমার পবিত্রতা আমি নষ্ট করতে চাই না।

বনহুর উঠে দাঁড়ায়, স্থির দৃষ্টি মেলে তাকায় সে লুসীর মুখের দিকে।

লুসী দৃষ্টি নত করে নেয়।

বনহুর বেরিয়ে যায় কক্ষ ত্যাগ করে।

ভোরের আকাশ তখন ফর্সা হয়ে এসেছে।

*

মিঃ মাহমুদ রিজভীর বেশে দস্যু বনহুর বসে আছে গুলশান হোটেলের ম্যানেজারের আসনে। নিপুণভাবে ছদ্মবেশ ধারণে অভিজ্ঞ বনহুর। কণ্ঠস্বরকেও পাল্টে নিয়েছে সে অদ্ভুতভাবে।

মিঃ মাহমুদ রিজভী বেশি কথা বলছে না, তার অন্যান্য কর্মচারীদের বলে দিয়েছে, আজ যেন তাকে বেশি বিরক্ত না করে। কারণ, তার শরীর আজ মোটেই ভাল নয়।

নিজের ক্যাবিনে বসে কাজ করে চলেছে সে।

এমন সময় একটি বয় এসে একটা কার্ড রাখলো তার সামনে।

 মিঃ মাহমুদ রিজভী কার্ডখানা হাতে তুলে নিতেই বুঝতে পারলো ধীরেনচরণ এসেছে। বয়কে বললো– আসতে বলো।

বয় বেরিয়ে গেলো।

একটু পরে কক্ষে প্রবেশ করলো ধীরেনচরণ! চোখে কালো চশমা, মাথায় ক্যাপ। ক্যাপ দিয়ে মুখ অর্ধেকটা ঢাকা।

মিঃ মাহমুদ রিজভীবেশি বনহুর এক নজরেই ধীরেনকে চিনে নিতে পেরেছিলো। বনহুরের সূতীক্ষ দৃষ্টির কাছে কোনোরকম চালাকি চলে না। বললো–বসুন।

মাহমুদ রিজভীর কথায় আসন গ্রহণ করলো ধীরেনচরণ, তারপর বললো–শুনলাম আপনি নাকি অসুস্থ?

হাঁ। বড় সর্দি-কাশি হয়েছে। গলাটা কেমন ভার ভার বোধ হচ্ছে! বলে গলায় মাফলারটা আরও ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো।

ধীরেনকে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছিল। মিঃ রিজভীর কথায় কান না দিয়ে বললো–আমার কথার কি হলো? ভেবে দেখেছেন তো?

হা দেখেছি, কিন্তু আমি যা চেয়েছি তার কম হবে না।

 জানেন লুসী আমার শিকার।

একথা বার বার শুনিয়ে কোনো ফল হবে না মিঃ ধীরেনচরণ, যা চেয়েছি তাই দিতে হবে।

 বেশ তাই দেবো। কিন্তু মিঃ আলমকে খতম করে দিতে হবে।

সে দায়িত্ব আমার, আমি তাকে সরিয়ে ফেলেছি।

আনন্দধ্বনি করে উঠলো ধীরেনচরণ–সত্যি বলছেন?

হাঁ, মিঃ আলমকে গত রাতে গুম করে দিয়েছি।

আপনাকে ধন্যবাদ মিঃ মাহমুদ। হাত বাড়িয়ে হ্যাণ্ডসেক করলো ধীরেনচরণ।

 বনহুর মৃদু হাসলো–আপনার পথ আমি পরিস্কার করে দিয়েছি।

 মিস লুসীকে তাহলে পাবো?

পুরো টাকা দিলেই পাবেন!

আচ্ছা–আজ রাতে আবার দেখা হবে।

লাবলীং ক্লাবে?

না, আপনার গুলশানে। আপনাকে টাকা দিয়ে মিস লুসীকে নিয়ে যাবো!

বেশ তাই হবে।

ধীরেনচরণ বেরিয়ে যায়।

মিঃ মাহমুদ রিজভীবেশি বনহুর হাসে।

এমন সময় অন্য একজন বয় আসে তার ক্যাবিনে–স্যার, রীণা সাঈদ এসেছেন।

বনহুর থতমত খেয়ে যায়, রীণা সাঈদ–এ আবার কে! এর সঙ্গে মিঃ মাহমুদ রিজভীর কি সম্বন্ধ? এবার হয়তো তার ছদ্মবেশ উদঘাটন হয়ে যাবে। তবু সামলাতে হবে তো! বললো বনহুর–আচ্ছা আসতে বলো!

বয় অবাক চোখে তাকালো, কেমন যেন হতভম্ব ভাব।

 বনহুর বললো নিজেকে সামলে নিয়ে কোথায় ওনি?

স্যার, আপনার ক্যাবিনে!

আচ্ছা যাও, আমি আসছি।

বয় বেরিয়ে যায়।

বনহুর ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করে নিজের ছদ্মবেশটা ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখে নেয়। না, ধরবার কোনো উপায় নেই, তবে গলার স্বরটা যা একটু অন্যরকম। মালারটা ভালোভাবে গলায় জড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়ে এলো বনহুর বাইরে।

মিঃ মাহমুদ রিজভীর ক্যাবিন, বনহুর পূর্ব হতেই চিনতো, কাজেই কোনো অসুবিধা হলো না।

বনহুর মিঃ রিজভীর বেশে প্রবেশ করলো তার ক্যাবিনে! প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়ালো বনহুর, একটি তরুণী কক্ষমধ্যে পায়চারী করছে।

মিঃ মাহমুদ রিজভীকে দেখেই তরুণী ছুটে এলো, জড়িয়ে ধরলো ওর গলা–হ্যালো রিজভী, এতো দেরী করলে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো সে আবার–সব বুঝি ভুলে বসে আছো? যাবে কখন?

হঠাৎ কোনো জবাব দিতে পারলো না মিঃ রিজভী, কারণ সে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।

 তরুণী মিঃ রিজভীর আচরণে যে সন্তুষ্ট হতে পারছে না, বললো–কি হলো তোমার বলো তো?

বনহুর এমনি একটা ফ্যাসাদে আর একবার পড়েছিলো, এমনি এক তরুণীর কবলে। বনহুর ঘাবড়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো, কেশে বললো–বড় সর্দি কাশি হয়েছে। গলাটা কেমন যেন বসে গেছে রীণা।

বনহুর বয়ের মুখে শুনেছিলো তরুণীর নাম রীণা সাঈদ। তাই সে ওকে রীণা বলেই সম্বোধন করলো।

রীণার বাহুদুটি মিঃ রিজভীর কণ্ঠ আলীঙ্গন করে আছে।

বললো মিঃ রিজভী–চলো, যাবার সময় হয়ে গেছে যে! তরুণী মিঃ রিজভীর কণ্ঠ মুক্ত করে দিয়ে বললো–এতোক্ষণে তোমার হুঁস হলো বুঝি? চলো।

তরুণী মিঃ রিজভীর হাত ধরে অগ্রসর হলো।

গাড়িতে বসে ড্রাইভ আসনে বসলো রীণা সাঈদ।

নিশ্বাস ফেললো বনহুর, কারণ রীণা আর মিঃ রিজভীর গন্তব্য স্থানের সন্ধান জানে না সে।

 দিল্লীর পথ বেয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে।

পাশের আসনে বসে আসে মিঃ রিজভীবেশী দস্যু বনহুর। হাওয়ায় রীণা সাঈদের আঁচলখানা উড়ছে। একটা উগ্র সেন্টের গন্ধ প্রবেশ করছে বনহুরের নাকে। রীণা সাঈদের চুলগুলো এলো মেলোভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তার ললাটে-ঘাড়ে-কপালে। মাঝে মাঝে দক্ষিণ হস্তে গাড়ির হ্যাণ্ডেল ঠিক রেখে চুলগুলো বাম হস্তে সরিয়ে নিচ্ছিলো।

বনহুর ওর অলক্ষ্যে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছিলো, কে এ মেয়েটি রীণা সাঈদ। এখন তাকে নিয়ে কোথাই বা চলেছে। মেয়েটিকে স্বাভাবিক তরুণী বলে মনে হয় না! রীণা সাঈদ পকেট থেকে সিগারেট প্যাক বের করে বাড়িয়ে ধরলো মিঃ রিজভীর দিকে–অমন বোবা বনে গেছো কেন? নাও আমি দিচ্ছি ধরাও।

রীণা সাঈদের হাত থেকে সিগারেট কেসটা নিয়ে লক্ষ্য করতেই বুঝতে পারলো সিগারেট কেসটা সোনার তৈরি। এবং সিগারেটগুলো অতি মূল্যবান সিগারেট।

বনহুর নিজে একটা ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে আর একটা গুঁজে দিলো রীণা সাঈদের ঠোঁটে। তারপর অগ্নিসংযোগ করলো সে সিগারেট দুটোতে।

দিল্লীর সেরা সিগারেট এা, রীণা সাঈদ সম্মুখে দৃষ্টি রেখে গাড়ি চালাচ্ছিলো। একরাশ ধুয়া ছড়িয়ে পড়ছিলো। চারপাশে। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট চেপে ধরে বললো রীণা সাঈদ–রিজভী আজ কিন্তু তোমাকে ছাড়বোনা। থাকতে হবে আমার ওখানে।

উঁ হুঁ আজ সম্ভব হবে না রীণা।

কই কোনোদিন তো আমার কথায় অমত করনি রিজভী? আজ তোমার কোনো কথা আমি শুনবো না।

বনহুরবেশী রিজভী কোনো কথা বলতে নারাজ, কারণ সে দেখতে চায় এর শেষ কোথায়?

 রীণা সাঈদ গাড়িখানা স্পীডে চালাচ্ছিলো।

দিল্লীর সেকেন্দ্রো রোড ধরে আগ্রার দিকে অগ্রসর হলো।

প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পর গাড়িখানা একটা বড় বাড়ির সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। বাড়িটা বেশ নির্জন এবং শহরের এক প্রান্তে বলে মনে হলো।

গাড়িখানা দাঁড়িয়ে পড়তেই একটি দীর্ঘদেহী জমকালো লোক সেলুট করে দাঁড়ালো–মালিক বড্ড দেরী হয়ে গেছে, শীঘ্র চলুন।

রীণা সাঈদ দ্রুত ড্রাইভ আসন থেকে নেমে দাঁড়ালো, বললো–তোমার জন্য বিলম্ব হলো রিজভী।

বনহুর কোনোরকম কথা না বলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো, বললো–শীগগীর চলো।

রীণা সাঈদ অগ্রসর হলো।

তাকে অনুসরণ করলো রিজভী, পকেটে হাত দিয়ে একবার রিভলভারটার অস্তিত্ব অনুভব করে নিলো সে।

পিছনে চলেছে জমকালো দীর্ঘদেহী লোকটা।

বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করতেই বনহুর অনুভব করলো কেমন যেন একটা থমথমে গুরুগম্ভীর ভাব। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত না হলেও বাড়িটা বেশ অন্ধকার লাগছিলো।

বড় বড় দুটো ঘর পেরিয়ে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো রীণা সাঈদ।

বনহুর আর জমকালো লোকটা দাঁড়িয়ে রইলো পিছনে। লিফটের মত একটা চৌকা জিনিস নেমে এলো। নীচে। রীণা সাঈদ লিফটে চেপে পড়লো।

মিঃ রিজভীবেশি বনহুরও উঠে দাঁড়ালো।

কালো লোকটা উঠলো না, সে পূর্বের ন্যায় সেলুট করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

 লিফট উঠে গেলো উপরের দিকে।

সাঁ সাঁ করে লিস্ট উঠছে। রীণা সাঈদ মিঃ রিজভীর হাতখানা নিজের হাতে চেপে ধরে বলে–সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

মিঃ রিজভী তার কথায় কোন জবাব দিলে না, কিন্তু ওর হাতে চাপ দিলো একটু।

 রীণা সাঈদ হাসলো।

মিঃ রিজভী বললো–হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ায় বড় নার্ভাস মনে করছি, মাফ করো রীণা।

 খিল খিল করে হেসে উঠলো রীণা সাঈদ–তবে এলে কেন, চলো সব ঠিক হয়ে যাবে।

 লিফটা একটা বড় ধরনের হলঘরে এসে থামলো।

নেমে পড়লো রীণা সাঈদ।

 মিঃ রিজভীও রীণাকে অনুসরণ করলো। কিন্তু পরক্ষণেই চক্ষু তার স্থির হলো। কতগুলো লোক বসে আছে, এক একটা লোকের পাশে এক একটা যুবতী দাঁড়িয়ে! কেউ বা পুরুষটির গায়ে হেলান দিয়ে, কেউ বা চেয়ারের হাতলে বসে, কেউ বা কারো কাঁধে হাত রেখে অদ্ভুত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে।

মিঃ রিজভীকে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়ালো, অভিনন্দন করলো সকলে নত মস্তকে।

রীণা সাঈদের বাহুখানা তখন মিঃ রিজভীর বাহুর মধ্যে রয়েছে।

 মাহমুদ বিজভীসহ রীণা সাঈদ একটা উচ্চ স্থানে এসে দাঁড়ালো। কক্ষটা এতক্ষণ যেন ঘুমিয়ে ছিলো, এবার জেগে উঠলো নব উদ্যমে। ওদিকে কতগুলো বাদ্যকর বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসেছিলো, এবার সবাই নিজ নিজ বাদ্যযন্ত্রে হাত রাখলো।

হঠাৎ যেন কক্ষটা মুহূর্তে সরগরম হয়ে উঠলো।

বাজনার তালে তালে এক একটি পুরুষ আর নারী মিলিতভাবে চললো অদ্ভুত ভঙ্গীমায় নাচ।

রীণা সাঈদ মাহমুদ রিজভীকে বললো–চলো।

আসলে তো মাহমুদ রিজভী সে নয়, বনহুর কোনোদিন এ ধরণের নাচে দক্ষ নয়। বলড্যান্স বা ফ্যান্সি নাচে তার কতকটা অভিজ্ঞতা আছে। কিন্তু একি ধরনের অদ্ভুত ভঙ্গীমায় নাচ। বললো সে–আমাকে মাফ করো রীণা, আজ আমি বড় অসুস্থ।

কিন্তু তুমি না আমায় কথা দিয়েছিলে?

 হঠাৎ শরীর খারাপের জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।

রীণার মুখ গম্ভীর হলো।

তখন হলঘরটার মধ্যে শুরু হয়েছে নারী-পুরুষে মিলিত বিশেষ ভঙ্গীমায় নাচ। শুধু নাচ নয়, নাচের সঙ্গে সঙ্গে মদপান–আরও কত কি!

বনহুর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো।

কিন্তু রীণা সাঈদ কিছুতেই তাকে ছাড়বে না, আজ নাকি এদের এ উৎসবের দিন। দিল্লীর অধিবাসীদের মধ্যে নাকি এ নাচ প্রসিদ্ধ। কাজেই একটু-আধটু নাচতেই হবে তাকে।

রীণা যখন জেদ করছিলো, তখন বনহুর নিপুণ দৃষ্টি মেলে লক্ষ্য করছিলো, পারবে কিনা এ নাচ। তবে চেষ্টায় দোষ কি। দস্যুতা তার নেশা-পেশা সবকিছু। দস্যুতা করতে গিয়ে তাকে জীবনে অনেক অসাধা সাধন করতে হয়েছে, আজ না হয় একটু নাচবে!

বললো বনহুর–চলো তা হলে।

রীণা সাঈদের চোখেমুখে আনন্দের দ্যুতি খেলে গেলো, খুশি হলো সে। টেবিল থেকে গ্লাস ভরা মদ তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে খেলো। বললো রিজভী খাও।

না শরীর খারাপ ওসব খাবো না।

 বেশ এসো। রীণা মাহমুদ রিজভীবেশি বনহুরের বাহুর মধ্যে বাহু দিয়ে বেষ্টন করে ধরলো।

অদ্ভুত নাচ শুরু হলো রীণা সাঈদের সঙ্গে দস্যু বনহুরের। বাজনার তালে তালে পা এবং অঙ্গভঙ্গী করে নাচতে লাগলো।

সত্যিই একটা নাচের উন্মাদনা সৃষ্টি হচ্ছে বাজনার শব্দে। বাদ্যযন্ত্রিগণ অদ্ভুতভাবে বাজাচ্ছে তাদের যন্ত্রগুলো।

রীণা সাঈদ বনহুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়েছে।

 বললো রীণা সাঈদ–রিজভী, তুমি না অসুস্থ?

বনহুর বললো–অসুখ সেরে গেছে তোমার স্পর্শে।

রিজভী!

হাঁ রীণা।

নাচের ফাঁকে ফাঁকে কথা হচ্ছিলো ওদের মধ্যে।

বনহুর অল্পক্ষণের চেষ্টায় দিল্লীর অধিবাসীদের এ অদ্ভুত নাচে দক্ষ হয়ে উঠলো।

রীণা বললো–আর পারছি না।

হেসে বললো বনহুর–আমিও ছাড়ছি না তোমাকে।

উঁ আর নয় রিজভী!

এরি মধ্যে সখ মিটলো?

পারছি না আর।

বনহুর লক্ষ্য করলো, তার হাতের উপর ক্রমে এলিয়ে পড়ছে, রীণা সাঈদের দেহটা শিথিল হয়ে আসছে ক্রমেই।

ওদিকে বাদ্যযন্ত্রিগণ ঠিক তালে তালে বাজনা বাজিয়ে চলেছে।

ধীরে ধীরে নাচছে অন্যান্য ব্যক্তিগণ।

 মাঝে মাঝে মদ পান করছে ওরা।

রীণা সাঈদের দেহটা ক্রমান্বয়ে এলিয়ে পড়লো বনহুরের বাহুর মধ্যে। বনহুর আর বিলম্ব না করে আস্তে সরে পড়লো রীণা সাঈদকে নিয়ে আড়ালে। পাশের কক্ষে এনে শুইয়ে দিলো রীণার শিথীল দেহটা। তারপর সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে! আড়ালে আত্মগোপন করে দেখতে লাগলো সব। বুঝতে পারলো, এটা শয়তান মাহমুদ রিজভীর আড্ডাখানা। এখানে তার সমস্ত দলবল নিয়ে আমোদ-প্রমোদ করে থাকে সে।

মাহমুদ রিজভীর বেশ এখনও বনহুরের শরীরে রয়েছে। কাজেই তার কোনো অসুবিধা হলো না। লিফটের। নিকটে পৌঁছতেই তাকে সানন্দে নিচে নামিয়ে দিলো লিফটম্যান।

বনহুর এবার গাড়ি নিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়লো দিল্লীর পথে। লাবলীং ক্লাবের সম্মুখে এসে গাড়ি রেখে নেমে পড়লো। ভিতরে প্রবেশ করতেই ক্লাবের ম্যানেজার তাকে গুরুদেবের মত অভিনন্দন জানালো।

বনহুর বললো–ধীরেনচরণ আছেন।

ম্যানেজার বিনীতভাবে জানালো আছেন।

ডেকে দিন তাকে!

ম্যানেজার বললো–আপনি বসুন, আমি তাকে ডেকে আনছি।

 ম্যানেজার চলে গেলো।

মিঃ রিজভীবেশি বনহুর বুঝতে পারলো, লাবলীং ক্লাবের সবাই মাহমুদ রিজভীর অনুগত দাস।

একটু পরে এলো লাবলীং ক্লাবের ম্যানেজার এবং তার সঙ্গে শয়তান ধীরেনচরণ। অত্যন্ত নেশা করায় ঢুলু। ঢুলু করছে তার চোখ দুটো। মিঃ রিজভীকে দেখে তার চোখ চক্ চক্ করে উঠলো। জড়িত কণ্ঠে বললো আপনি এসেছেন মিঃ রিজভী। আমার মাল কই?

বললো রিজভী–মাল মজুত আছে। কথাবার্তা পাকা করতে এলাম।

কথা আবার কি মিঃ রিজভী। যা দেবো বলেছি তাই হবে। কিন্তু ঐ পথের কাঁটাটাকে সরিয়ে,…

হাঁ সে আপদ দূর করেই এসেছি মিঃ ভৌম।

 তবে তো আর কথাই নেই। লুসীকে পাওয়া এখন আমার পরম সৌভাগ্য।

 হাঁ, এবার আপনি পরম নিশ্চিন্ত।

তবে কখন লুসীকে পেতে পারি বন্ধু?

যখন আমার পাওনা পরিশোধ করবেন।

বেশ, আমি এক্ষুণি আপনার টাকা নিয়ে যাচ্ছি। লুসীকে ঠিক পাবো তো?

পাবেন মানে? নিশ্চয়ই পাবেন। আপনি জানেন, মিঃ রিজভী কোনোদিন মিথ্যা কথা বলে না।

আপনি অপেক্ষা করুন, আমি এক্ষুণি আসছি।

বেরিয়ে যায় মিঃ ধীরেনচরণ ভৌম।

মাহমুদ রিজভীবেশি দস্যু বনহুর আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজের ছদ্মবেশটা একবার ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেয়। না, তাকে চিনবার কোনো উপায় নেই।

ফিরে আসে ধীরেনচরণ, হাতে তার ব্যাগ। ঐ ব্যাগের মধ্যে যে টাকা রেখেছে–লুসীর মূল্য। বললো সে–চলুন মিঃ রিজভী।

গাড়িতে এসে বসলো ওরা।

মাহমুদ রিজভী নিজে ড্রাইভিং আসনে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি ছুটে চললো।

ধীরেনচরণ ভয়ানক নেশা করেছে সে এখনও জড়িতকণ্ঠে আবোল-তাবোল কথাবার্তা বলছিলো। এক লক্ষ পঁচিশ হাজার টাকার ব্যাগ তার কোলের উপর রয়েছে। মিঃ রিজভীবেশি দস্যু বনহুর একবার পকেটে হাত রেখে রিভলভারের অস্তিত্ব অনুভব করে নিলো। হাতঘড়ির দিকে তাকালো বনহুর, রাত এখন বারোটা।

গুলশান হোটেলে পৌঁছে ধীরেনচরণসহ মিঃ রিজভী সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো উপরে। রাত বারোটা গুলশান হোটেল এখনও গমগম করছে। অসংখ্য নর-নারী হোটেল কক্ষ সরগরম করে তুলেছে। হোটেলের সম্মুখে নানা ধরণের গাড়ি অপেক্ষা করছে। কোনো কোনো গাড়ির ড্রাইভার গাড়ির হ্যাণ্ডেলে মাথা রেখে ঝিমুচ্ছে। এখনও মনিবের ফিরবার কোনো লক্ষণ নেই। রাত বারোটা–কিন্তু গুলশান ক্লাবে যেন এমাত্র সন্ধ্যা হলো।

মিঃ রিজভীসহ ধীরেনচরণ এসে পৌঁছলো মিস লুসীর দরজায়।

মিঃ রিজভী দরজায় মৃদু আঘাত করলেন।

লুসীর সবেমাত্র একটু নিদ্রা এসেছিলো, এতোক্ষণ সে প্রতীক্ষা করছে মিঃ আলমের। তিনি তো এতো রাতেও ফিরলেন না! কোথায় গেলেন তিনি, কেনই বা গেছেন–এমনি নানা চিন্তা করতে করতে সবেমাত্র একটু তন্দ্রা এসেছে। সেদিনের পর মিঃ আলম যেন তাকে এড়িয়ে চলে সব সময়। লুসীও সাহস পায় না তার। সঙ্গে কোনোরকম কথা বলার। হাজার হলেও সে তো বাঙালি নারী, লজ্জা-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তাকে সঙ্কোচিত করে তুলে।

হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ায় তন্দ্রা ছুটে যায় লুসীর। চমকে বিছানায় উঠে বসলো, কান পেতে শুনলো– আবার দরজায় আঘাত হলো।

লুসী বুঝতে পারলো, এ মিঃ আলমের সংকেতপূর্ণ শব্দ। মিঃ আলম লুসীকে বলে দিয়েছিলো–পর পর জোড়াভাবে টোকা পড়লে তবেই তুমি দরজা খুলবে, নচেৎ খুলবে না।

লুসী বুঝতে পারলো আলম ছাড়া কেউ নয়।

তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখে যম দেখার মতই আঁতকে উঠলো লুসী। দেখলো মিঃ মাহমুদ রিজভী আর ধীরেনচরণ ভৌম সাক্ষাৎ ভয়ঙ্করের মত দাঁড়িয়ে আছে।

লুসীকে দেখে ধীরেনের চোখ দুটো ক্ষুদ্ধ শার্দুলের মত দপ করে জ্বলে উঠলো।

দৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলো লুসী ধীরেনচরণকে, এ শয়তান তাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো, কতবার সে হামলা চালিয়ে তাকে নাজেহাল পেরেশান করে ফেলেছে। ভাগিস মিঃ আলম তাকে পর পর বাঁচিয়ে নিয়েছেন ঐ লম্পট পাপিষ্ঠের হাত থেকে। মিঃ মাহমুদ রিজভীকেও সে ভালো মনে করেছিলো, কিন্তু আজ তাকে বিশ্বাস করতে পারলো না। কারণ মিঃ রিজভীর আসল রূপ উদঘাটন হয়েছে তার কাছে। মিঃ রিজভী তাকে চোরা কুঠরীতে বন্দী করে রেখে তার উপর চালিয়েছে নানা রকম অকথ্য অত্যাচার। লুসীকে তবু সে আয়ত্তে আনতে পারেনি। ধীরেনচরণের সঙ্গে মিঃ রিজভীকে দেখে শিউরে উঠলো লুসী। ভয়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা।

মিঃ মাহমুদ রিজভীর বেশে দস্যু বনহুর আর ধীরেনচরণ ভৌম প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে।

লুসীর তখন হৃদকম্প শুরু হয়েছে। চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে ভয়-ভীতি আর উৎকণ্ঠা। মিঃ আলম তাকে বলেছিলো সংকেত-পূর্ণ শব্দ ছাড়া সে যেন দরজা না খোলে। কিন্তু এরা কি করে তার সে সংকেত জানতে পারলো! লুসী ভেবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলো না।

ধীরেনচরণ বললো–লুসী, আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলে কিন্তু এবার আর তোমার উদ্ধার নেই।

মিঃ রিজভী বললো–হাঁ, তোমার জিনিস তুমি এবার বুঝে নাও বন্ধু। কিন্তু তার পূর্বে আমার পাওনাটা মিটিয়ে দাও। শুধু লুসীকেই আমি তোমার হাতে তুলে দিলাম তাই নয়, তোমাদের পথের কাঁটা মিঃ আলমকেও তোমাদের চলার পথ থেকে সরিয়ে ফেলেছি…

লুসী কথাটা শুনে যেন আর্তনাদ করে উঠলো–উঃ মিঃ আলমকে তোমরা হত্যা করেছো?

হা সুন্দরী, মিঃ আলম যেন আর ধীরেনচরণের কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিতে না পারে সেজন্য তাকে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছি। বললো রিজভী।

দু’হাতে মুখ ঢেকে লুসী আকুলভাবে কেঁদে উঠলো।

ধীরেনচরণ হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–মিস লুসী, হাজার বার রোদন করেও কোনো ফল হবে না। এখন তুমি আমার…

গম্ভীর গলায় বললেন মিঃ রিজভী–তার পূর্বে আমার টাকা?

হাঁ, আপনার টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছি। ধীরেনচরণ ব্যাগ খুলে টাকার বাণ্ডিলগুলো বের করে টেবিলে রাখলো।

মিঃ মাহমুদ রিজভী বাণ্ডেলগুলো গুণে নিলেন হাতে উঠিয়ে, একটির পর একটি করে। তারপর ব্যাগে ভরে তুলে নিলেন ব্যাগটা হাতে।

ধীরেনচরণ লুসীর হাত ধরলো এবার–চলো লুসী, এবার তুমি আমার।

 মিঃ রিজভী বাম হস্তে টাকার ব্যাগ আর দক্ষিণ হস্ত লুসীর মাথায় রেখে বললো–আপত্তি করে কোনো ফল হবে না মিস লুসী, চলুন আপনাকে গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিয়ে আসি।

লুসী উচ্ছলভাবে কেঁদে উঠলো,–আমাকে হত্যা করুন, তবু আমি যাবো না।

 যাবে না?

না!

 জানো হোটেল আমার? এখানে থাকলে তোমার নিস্তার নেই। তোমাকে নাচতে হবে, গাইতে হবে, আমার আদেশে আরও অনেক কিছু করতে হবে তোমাকে–পারবে? বললো মাহমুদ রিজভী।

অসহায় কাতর চোখে তাকালো লুসী মিঃ রিজভীর মুখের দিকে।

ধীরেনচরণ বললো–শুনলে? কোটা চাও–আমার ঘর করতে চাও, না সকলের মন তুষ্টি সাধনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সুখী হতে চাও? বলো কোটা তুমি বেছে নেবে?

লুসী দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠে–তোমার ঘর করবার আগে আমি মরতে চাই।

 কিন্তু তোমাকে মরতে দিলে তো মরবে! যাক, বেশি সময় আমি নষ্ট করতে চাই না। এসো লুসী। জোরপূর্বক লুসীকে টেনে নিয়ে চলে ধীরেন।

মিঃ মাহমুদ রিজভী অনুসরণ করেন ওদের। বলে তিনি–চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।

লুসীকে গাড়ির পিছন আসনে তুলে নেওয়া হলো। লুসীর পাশে বসলো ধীরেনচরণ।

আর মিঃ মাহমুদ রিজভীবেশি বনহুর বসলো ড্রাইভ আসনে।

ধীরেন বললো–লাবলীং ক্লাবে চলুন মিঃ রিজভী।

 হাঁ তাই যাবো।

গাড়ি চলতে শুরু করলো।

লুসী যেন চিৎকার করতে না পারে তার জন্য লুসীর মুখে রুমাল গুঁজে দেয়া হয়েছিলো ইতিপূর্বে। লুসী মৃতের ন্যায় পড়েছিলো পিছন আসনে।

দিল্লীর রাজপথ প্রায় জনশূন্য হয়ে এসেছে।

এ-পথ-সে-পথ করে গাড়ি ছুটছে।

মিঃ রিজভী অধর দংশন করছিলেন ড্রাইভিং আসনে বসে। চোখ দুটো তার আগুনের ভাটার মত জ্বলছিলো অন্ধকারে।

লাবলীং ক্লাবের সম্মুখে এসে গাড়ি থামলো।

রাত তখন দুটো বেজে গেছে।

লাবলীং ক্লাব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। তবে দু’একটা মাতাল তখনও টেবিলে মাথা রেখে জড়িত কণ্ঠে আবোল তাবোল বকছিলো।

মিঃ রিজভীর সহায়তায় ধীরেনচরণ মিস লুসীকে উপরে নিয়ে এলো।

 লুসীর মুখের রুমাল খুলে ফেলা হয়েছে।

করুণ চোখে তাকাচ্ছে লুসী চারদিকে। ব্যথাভরা অসহায় তার মুখোভাব। সাগরে পড়লে মানুষ যেমন কূল পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে তেমনি লুসীর অবস্থা।

মিঃ রিজভী চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।

লুসী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো মিঃ রিজভীর পা দু’খানা–আমাকে উদ্ধার করুন। আমাকে বাঁচান এ দুষ্টের হাত থেকে।

হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো ধীরেনচরণ, ভয়ঙ্কর পাশবিক সে হাসি। লুসীর হাত ধরে টেনে তুলে নিলো জোরপূর্বক।

লুসী ভয়ার্তভাবে আর্তনাদ করে উঠলো–মিঃ রিজভী, আমাকে ফেলে যাবেন না। বাঁচান আপনি…

কিন্তু শয়তান ধীরেন লুসীকে আকর্ষণ করলো, জাপটে ধরলো ওকে।

লুসী নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

ফিরে দাঁড়ালো মাহমুদ রিজভী, দক্ষিণ হস্তে তার রিভলভার গভীর কণ্ঠে বললো–মুক্ত করে দাও লুসীকে।

চমকে ফিরে তাকালো ধীরেন–এ কি এ যে মিঃ আলম! মিঃ রিজভীর দাড়ি গোঁফ অদৃশ্য হয়েছে, সুন্দর পুরুষ দীপ্ত বলিষ্ঠ একটা মুখ বেরিয়ে এসেছে তখন।

ধীরেনের চোখে যেন সর্ষে ফুল ঝরে পড়ছে। চোখ রগড়ে তাকায় সে।

বনহুর রিভলভার উদ্যত করে এগিয়ে আসে–মুক্ত করে দাও লুসীকে।

 ধীরেনের বাহুবন্ধনে তখন আবদ্ধা লুসী।

 লুসীর চোখেমুখে বিস্ময়, তেমনি একটা আনন্দদ্যুতি বয়ে যায় তার সমস্ত মুখে!

লুসীকে মুক্ত করে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ধীরেন। এততক্ষণে যেন হুস হলো তার। একি কথা! মিঃ। আলম তাহলে মিঃ রিজভীর বেশে তাকে ধোকা লাগিয়েছে! তার সমস্ত অর্থ লুটে নিয়েছে মিঃ আলম আর লুসীকেও উদ্ধার করে নিতে এসেছে। ধীরেন দ্রুত টেবিলের পাশে ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলো হাতে।

অমনি বনহুরের রিভলভারের একটি গুলী তার দক্ষিণ হস্তে বিদ্ধ হলো।

 সঙ্গে সঙ্গে রিসিভার খসে পড়লো ধীরেনের হাত থেকে। মুখটা বিকৃত করে বাম হস্তে দক্ষিণ বাহু চেপে ধরলো। রক্তে ভেসে গেলো সমস্ত হাতখানা।

বনহুর দাঁত পিষে বললো–ধীরেন, জানো না আমি কে। আমার চোখে ধুলো দিয়ে তুমি লোকের সর্বনাশ করবে! মিঃ মাহমুদ রিজভী তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে, তারই হাতে তৈরি মৃত্যুকূপে তিল তিল করে শুকিয়ে মরছে সে। পৃথিবীর কেউ আর তার সন্ধান পাবে না। এবার তোমাকে যমালয়ে পাঠাবো, আর যেন কারো সর্বনাশ তুমি না করতে পারো।

বনহুরের গম্ভীর কণ্ঠস্বর আর অগ্নিমূর্তি রূপ দেখে ধীরেনের মুখমণ্ডল বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো, ভুলে গেলো সে তার হাতের ক্ষতের ব্যথা। পালাবার জন্য দ্রুত এগুলো দরজার দিকে।

বনহুর পিছন থেকে গর্জে উঠলো–খবরদার, এগুবে না।

 থমকে দাঁড়ালো ধীরেন! তার ঝুলে পড়া হাত দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছে।

 লুসী ভয়বিহ্বল চোখে আনন্দভরা অন্তরে উপলব্ধি করছে এ দৃশ্য!

হঠাৎ ধীরেন ওদিকে ড্রয়ার খুলে বের করলো একটা ক্ষুদে পিস্তল। বাম হস্তেই সে ওটা উঁচু করে ধরলো।

 কিন্তু বনহুর ওকে গুলী করার সুযোগ দিলো না, তার রিভলভার গর্জে উঠলো আবার।

সঙ্গে সঙ্গে ধীরেন মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ভূতলে। ওর হাতের ক্ষুদে পিস্তলটা ছিটকে পড়লো দূরে। ধীরেনের বুকের রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো মেঝেটা।

লুসী আর্তকণ্ঠে বললো–একি করলেন মিঃ আলম?

 বনহুর পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো–শয়তানের উপযুক্ত শাস্তি দিলাম। চল লুসী।

 বনহুর লুসীর হাত ধরে সিঁড়ি বেড়ে দ্রুত নেমে এলো নিচে।

 লাবলীং ক্লাবের সম্মুখে তাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। বনহুর লুসীকে তার পাশে বসিয়ে নিয়ে গাড়িতে ষ্টার্ট

লুসীর চোখে শুধু বিস্ময় নয়, তার অন্তরে এক বিরাট প্রশ্ন–মানুষ না দেবতা ইনি। লুসী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে বনহুরের মুখের দিকে। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছে তার মন।

বনহুর স্পীডে গাড়ি ছাড়লো। সে বুঝতে পারলো, তার রিভলভারের গুলীর শব্দে লাবলীং ক্লাবের তন্দ্রা ছুটে গেছে। আরও লক্ষ্য করলো, একটা গাড়ি তাদের গাড়িখানাকে ফলো করে তীর বেগে ছুটে আসছে।

লুসী বললো– মিঃ আলম, পিছনে একটা গাড়ি আসছে।

সম্মুখে দৃষ্টি রেখে বললো বনহুর–আমি ঐ গাড়িখানাকে দেখতে পেয়েছি লুসী। এ গাড়ি আমাদের গাড়িকে ফলো করছে। কারণ, লাবলীং ক্লাবে ধীরেনের হত্যা রহস্য প্রকাশ হয়েছে।

এখন উপায়।

উপায় করতেই হবে একটা।

আমার ভয় করছে মিঃ আলম।

ভয় পাবার কিছু নেই।

ওরা যদি ধরে ফেলে, তাহলে কি হবে?

ফাঁসী হবে!

উঃ।

তোমার নয় লুসী, আমার।

কিন্তু আমি যে আপনার কথাই ভাবছি।

আমার জন্য ভেবো না। আমার চেয়ে তোমার নিজের কথা ভাবো লুসী।

গাড়িখানা অনেক এগিয়ে এসেছে।

বনহুর ডবল স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছে। সামনের আয়নায় দেখা যাচ্ছে। গাড়ির সার্চলাইটের আলো। অত্যন্ত দ্রুত গাড়িখানা ছুটে আসছে।

বনহুর এলোপাতাড়ি গাড়ি চালাচ্ছিলো, সোজা পথে না গিয়ে এ পথ সে-পথ ধরে এগুচ্ছিলো সে।

পিছনের গাড়িখানা যদিও দ্রুত আসছিলো তবু সম্মুখের গাড়ির সঙ্গে পেরে উঠছিলো না। বনহুর মৃত্যুকে ভয় করে না। তার গাড়ি ছুটছিলো উল্কা বেগে।

যে পথ দিয়ে এখন গাড়ি যাচ্ছিলো সো হলো হুমায়ুন রোড, এ পথে কয়েক মাইল অগ্রসর হলেই পৃথীরাজের রাজপ্রাসাদ। বিরাট একটি দীঘির পাড়ে এ প্রাসাদটি গড়ে উঠেছিলো। আজ অবশ্য সে দীঘির কোনো অস্তিত্ব নেই। নব নব প্রাসাদ সমতুল্য অট্টালিকা শোভা বর্ধন করছে।

বনহুরের গাড়ি এক সময় পৃথীরাজের প্রাসাদের সম্মুখপথে এসে হাজির হলো।

এখন পিছনের গাড়িখানা সম্পূর্ণ আড়ালে পড়ে গেছে।

বনহুর একটা বাগানের আড়ালে গাড়ি রেখে লুসী সহ নেমে পড়লো। দক্ষিণ হস্তে তার টাকার ব্যাগটা রয়েছে।

বাগানের ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করে পৃথীরাজের প্রাসাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।

 ঠিক সে মুহূর্তে সম্মুখ পথ দিয়ে দ্রুত চলে গেলো ঐ গাড়িখানা। যে গাড়িখানা দিল্লীর লাবলিং ক্লাব থেকে তাদের অনুসরণ করে আসছে।

বনহুর লুসীকে বললো–দেখলে তো চলে গেলো।

 উঃ! বাচলাম এবার। লুসী যেন নিশ্বাস নিলো প্রাণ ভরে।

বনহুর বললো–লুসী, এবার কোথায় যাওয়া যায় বলোতো?

চিন্তিত কণ্ঠে বললো লুসী–তাই তো!

অন্ততঃ রাতের মত একটু আশ্রয় চাই কি বলো?

হা।

এখন কটা বাজে?

চারটা। দু’ঘন্টা ধরে দিল্লী শহরটায় ছুটোছুটি করেছি।

 আশ্চর্য মানুষ আপনি!

লুসী, পৃথীরাজের প্রাসাদ এটা। এ পৃথীরাজ সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ শক্তিবান মহারাজা ছিলেন। কাল সমস্ত প্রাসাদটা আমরা ঘুরে ফিরে দেখবো। কিন্তু আজ রাত…

ঐ যে সম্মুখে একটা ঘর–চলুন ওখানে রাতটুকু কাটিয়ে দিই।

তাই চলো লুসী, ওখানে কোন মানুষ-জন নেই বলে মনে হচ্ছে।

বনহুর আর লুসী সে ঘরটার দরজায় এসে দাঁড়ালো। দেখলো বেশ ঝকঝকে তকতকে পরিস্কার সুন্দর মেঝে। মনে হলো এককালে মন্দির ছিলো ওটা। এক পাশে শিবলিঙ্গ, আরও কয়েকটা কালো পাথর রয়েছে।

বনহুর আর লুসী কক্ষে প্রবেশ করলো।

কক্ষমধ্যে অন্ধকার তেমন জমাট নয়, বাইরের লাইটের আলো কক্ষমধ্যে কিঞ্চিৎ আলোকিত করে তুলেছে।

বনহুর ব্যাগটা এক পাশে ধাপ্ করে ফেলে দিয়ে নিজেও বসে পড়লো এতোক্ষণ একটানা গাড়ি চালিয়ে ক্লান্তি বোধ করছিলো সে।

লুসী দাঁড়িয়ে ছিলো পুতুলের মত স্থির হয়ে।

 বনহুর বললো– লুসী, বিছানার আশা ত্যাগ করে আজ ভূতলে শয্যা গ্রহণ করো।

লুসী বললো–না, সেজন্য নয়।

তবে দাঁড়িয়ে রইলে কেনো?

 কিছু না।

বনহুর টাকার ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লো।

লুসী বসলো।

বনহুর বললো–শুয়ে পড় লুসী।

কখন যে বনহুর ঘুমিয়ে পড়েছে, হঠাৎ একটা কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করলো সে মাথায়। ধীরে ধীরে কেউ যেন তার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বনহুরের ঘুম ভেঙে গেলেও সে চোখ মেলে চাইলো না, ঘুমের ভান করে পড়ে রইলো। কোমল হস্তের অংগুলো সঞ্চালন আজ বনহুরের সমস্ত মনে একটা মধুর আবেশ এনে দিলো। ভাববিহ্বল কণ্ঠে বললো বনহুর-লুসী!

চমকে উঠলো লুসী, কিন্তু পালালো না বা সরে গেলো না। বনহুরের ডাকে জবাব দিলো–বলুন?

ঘুমাওনি কেন?

লুসী কোনো জবাব দিলো না।

বনহুর পাশ ফিরে শুলো।

লুসীর হস্ত সঞ্চালন তখনও বন্ধ হয়নি।

বললো বনহুর–লুসী, আজ রাত শেষ হলে কাল আমি তোমাকে নিয়ে কলকাতার পথে রওয়ানা দেবো। পৌঁছে দেবো তোমাকে তোমার পিতার কাছে।

তারপর আপনি?

একটু হাসলো বনহুর–আমি! আমার কেউ নেই, কিছু নেই। আমি যে বন্ধনহীন, লুসী।

মিঃ আলম!

আমার আসল পরিচয় তুমি জানো না লুসী, কে আমি।

জানি আপনি মুসলমান।

শুধু তাই আমার পরিচয় নয়। আরও একটা পরিচয় আমার আছে। যা জানলে শিউরে উঠবে তুমি। যা সে কথা লুসী যতক্ষণ আমি তোমাকে তোমার পিতা-মাতার কাছে পৌঁছে দিতে না সক্ষম হয়েছি ততক্ষণ আমি নিশ্চিত নই।

কিন্তু আমি আর ফিরে যাবো না মিঃ আলম, আমার বাবা-মা কে আমি জানি না, চিনি না তাদের কাউকে। আমাকে আপনি কলকাতায় নিয়ে যাবেন না।

তাহলে কোথায় যাবে?

আমি চিরদিন আপনার পাশে থাকতে চাই।

বনহুরের ললাটে ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু, চমকে উঠে বসে বনহুর– লুসী তুমি কাঁদছো?

আপনি আমাকে দূরে ঠেলে দেবেন না।

লুসী!

আপনার পায়ে পড়ি…লুসী বনহুরের পা দুটি জড়িয়ে ধরে।

বনহুর অস্বস্তি বোধ করে, লুসীকে তুলে নেয় সে, নিবিড়ভাবে টেনে নেয় কাছে।

 ঠিক সে মুহর্তে জমকালো একটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায় কক্ষটার দরজায়। অন্ধকারে চোখ দুটো যেন হিংস্র। ব্যাঘ্রের মত জ্বলছে।

বনহুর লুসীকে সরিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায়।

 অন্ধকারে মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে লুসী ভয়ার্ত-শব্দ করে উঠে–উঃ! মা গো।

ভয়ঙ্কর মূর্তিটা দু’হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসে বনহুরের দিকে।

 বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে পকেট থেকে রিভলভারখানা বের করে উদ্যত করে ধরে।

 ভয়ঙ্কর মূর্তিটা এগিয়ে আসছে। চোখ দু’টো তার আগুনের গোলার মত জ্বলছে যেন।

লুসী মুখ লুকায় বনহুরের বুকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *