দস্যু বনহুর ও মিস লুনা

দস্যু বনহুর ও মিস লুনা– ৯৪

বললো মালোয়া–তোমরা আমাকে কবর–চাপা দিয়ে ফিরে যাচ্ছো? হাঃ হাঃ হাঃ…বন্ধুরা, তোমরা যাকে কবর–চাপা দিয়ে এলে, সে তোমাদেরই দলপতি নিরুসিং।

একসঙ্গে সবাই বিস্ময়ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো দলপতি নিরুসিং। তাকে আমরা……

 হাঁ, তাকেই তোমরা কবর–চাপা দিয়েছো, বুঝলে?

 ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠলো সবার মুখমন্ডল।

 মালোয়া বুঝতে পারলো ওরা ভীষণ ভড়কে গেছে। সে এবার বললো–ঘাবড়াবার কিছু নেই। দলপতি আর ফিরে আসবে না। তাকে তোমরা মাটিচাপা দিয়ে এসেছে। শোন তোমরা–এখন আমিই দলপতিতোমরা সবাই আমার কথায় উঠবে–বসবে–আমার কথামত কাজ করবে। বলে রাজি আছো? হাঁ, আগে বলে রাখা ভাল–আমার নির্দেশ যদি না মেনে চললো তাহলে তোমাদের সবাইকে আমি নিরুসিংয়ের অবস্থা করবো।

যারা নিরুসিংয়ের নির্দেশে মালোয়াকে কবর–চাপা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছিলো, তারা এ ওর মুখ চাওয়া–চাওয়ি করে নিলো।

মালোয়া বললো–নিরুসিংয়ের আড্ডা এখন আমার হাতের মুঠোয়। কারও সাধ্য নেই আমার কাজে বাধা দেয়। আমি যা করবো তাতেই তোমাদের সবাইকে সম্মতি দিতে হবে। বলল, তোমরা রাজি আছো?

পুনরায় সবাই একবার মুখ চাওয়া–চাওয়ি করে নিলো, তারপর বলে উঠলো একজন–হাঁ, আমরা রাজি……।

বললো মালোয়া–সাবাস! আমি জানতাম তোমরা আমার কথা মানবে। মনিমালা সহ নীলমনি আমার আর যত মালামাল আছে সব তোমাদের মধ্যে বিলিয়ে দেবো।

সবাই হর্ষধ্বনি করে উঠলো।

হাতে হাত মিলালো মালোয়া ওদের সাথে। খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠে সে।

একটা মশাল হাতে নিয়ে বললো মালোয়া–জানো আমি কি ভাবে নিরুসিংকে কৌশলে আমার বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলাম।

একজন বলে উঠলোনা, আমরা কেউ তা জানি না। আমরা জানবোই বা কি করে! মালোয়া তুমি যখন আমাদের দলপতি হলে তখন সব কথাই বলবে এবং সবকিছুই আমাদের জানা দরকার।

মালো বললো–হাঁ, সব বলবো তোমাদের কাছে। শোন, নিরুসিং যখন তোমাদের সাথে আমাকে হত্যা করার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিলো তখন আমি গোপনে সব শুনি এবং প্রস্তুত হয়ে থাকি। রাতে যখন নিরুসিংয়ের সঙ্গে বসে একত্রে আহার করছিলাম তখন আমি কৌশলে তার খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। এবার বুঝতেই পারছো সবকিছু…..আমি ওকে সরিয়ে দিয়েছি সবার চোখে ধুলো দিয়ে। নিরুসিং নিজেই কবরস্থ হয়েছে। হাঃ হাঃ হাঃ……হাঃ হাঃ হাঃ……অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মালোয়া।

চাঁদরাম ও তার সঙ্গীরাও হাসতে শুরু করলো। কেন তারা হাসছে তারা নিজেরাই জানে না।

মালোয়া সেদিন থেকে নিরুসিংয়ের দলের দলপতির আসন গ্রহণ করলো। শয়তান নিরুসিংয়ের চেয়ে মালোয়া আরও বেশি শয়তান।

নিরুসিংয়ের দলে মালোয়া অনেকদিন ছিলো। নিরুসিংয়ের কাজে সে সহায়তা করতে বটে কিন্তু তার মনে ছিলো কুমতলব। প্রথম থেকেই নানাভাবে নিজকে নিরুসিংয়ের দৃষ্টির বাইরে রাখতে এবং গোপনে সে আস্তানা থেকে মাল সরাতো। নিরুসিং একবার ব্যাপারটা জানতে পারে, তখন তার উপর কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে কিন্তু নিরুসিং ও তার দলের দৃষ্টি এড়িয়ে পালিয়ে যায় মালোয়া।

নিরুসিং ও তার দলবল অনেক সন্ধান করেও আর তার খোঁজ পায় না।

মালোয়া সাধুর ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে। কিন্তু সে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আত্নগোপন করে থাকে যেন তাকে কেউ চিনতে না পারে।

এমন দিনে সে পরিচিত হয় বনহুরের এক অনুচরের সঙ্গে। পরিচয়টা অবশ্য আকস্মিক ঘটেছিলো। মালোয়া সেদিন শুয়েছিলো কোনো এক হোটেলের চৌকির উপর।

জেগেই ছিলো সে।

এমন সময় ফয়সল নামক বনহুরের এক অনুচরের সঙ্গে পরিচয় হয় মালোয়ার। মালোয়া এমন ভাব দেখায় যেন এ পৃথিবীতে তার কেউ নেই, কিছু নেই। সে কাজ করতে চায় এবং কাজের বিনিময়ে চায় পারিশ্রমিক। যদি সে কোনো কাজ না পায় তাহলে আত্নহত্যা করা ছাড়া উপায় নেই।

ফয়সলের মনটা ব্যথিত হয়ে উঠে; সে মালোয়াকে ভরসা দেয় তাকে কাজ দেবে বলে। তাকে ঐ হোটেলেই প্রতীক্ষা করতে বলে সে চলে যায়।

কান্দাই শহরের আস্তানায় গিয়ে সব কথা বলে ফয়সল, সব শোনে ইয়াকুব। সে প্রথমে রাজি হয় না এবং বিশ্বাস করতে পারে না। কথাটা সর্দারকে জানাবে বলে আশ্বাস দেয় ইয়াকুব ফয়সলকে।

একদিন দু’দিন কেটে যায়, ফয়সলের আশায় প্রতীক্ষা করতে থাকে মালোয়া সেই হোটেলে।

এদিকে বনহুর এলে তাকে ইয়াকুব বলে ফয়সলের কথাটা এবং ফয়সলের হয়ে অনুরোধ জানায়।

বনহুর সমস্ত দায়িত্ব দেয় ইয়াকুবের উপর। সে যেন তাকে ভালভাবে যাচাই করে কাজে বহাল করে। এর বেশি বলতে পারে না বা বলবার সময় পায় না বনহুর।

ইয়াকুব এক সময় বলে–ফয়সল, যাও তাকে নিয়ে এসো। আমি কোনো এক জায়গায় অপেক্ষা করবো। তাকে যাচাই করার দায়িত্ব আমার।

ফয়সল তো খুশি হয়ে ছুটলো–সাদাসিদা মানুষ সে, সরল প্রাণে বিশ্বাস করেছিলো মালোয়াকে।

মালোয়াও বুঝতে পেরেছিলো অত্যন্ত সহজ মানুষ ফয়সল, তাই সেও প্রতীক্ষা করছিলো।

এক সময় ফয়সল এসে হাজির হলো হোটেলে।

মালোয়া আনন্দধ্বনি করে এগিয়ে গেলো–বন্ধু, এসে গেছো তুমি?

ফয়সল খুশিতে ডগমগ হয়ে বললো–তোমাকে নিতে এসেছি, এবার চললো।

মালোয়া ফয়সলের সঙ্গে এসেছিলো সেদিন। যেন গোবেচারী–কিছু জানে না। সে এমন সরল সহজ রূপ ধরে হাজির হয়েছিলো ইয়াকুবের সামনে যেন সে মাটির মানুষ।

ইয়াকুব মালোয়াকে ভালভাবে যাচাই করেও তার ভিতরের রূপ উদঘাটন করতে সক্ষম হলো না। তাকে বিশ্বাস করে নিজ দলে আশ্রয় দিলো।

মালোয়াকে ইয়াকুব প্রথমে বাইরে কাজে নিয়োজিত করেছিলো, কারণ কাউকে আস্তানার অভ্যন্তরে নেওয়া যায় না। মালোয়া কাজে বহাল হয়ে সুন্দর সুষ্ঠুভাবে কাজ করে চললো, তার মধ্যে কোনো রকম ত্রুটি দেখা গেলো না। কিন্তু মনের ভিতরে ছিলো তার কুমতলব।

অত্যন্ত সাবধানে মনোভাব সংযত রেখে বনহুরের অনুচরদের মধ্যে মিশে গেলে সে একদিন। তারপর বছর গড়িয়ে চললো। এক দু’তিন বছর কেটে গেলোমালোয়া বিশ্বস্ত অনুচরে পরিণত হলো।

এমন দিনে ফুল্লরার গলায় নীল মনিহার তার মনে লালসা লাগায়। মনটা তার উসখুস করতে থাকে কেমন করে নীলমনি হার সে আত্নসাৎ করবে, এই নিয়ে অহরহ ভাবতে লাগলো মালোয়া। শুধু নীলমনি হার নয়, ফুল্লরাকে চুরি করতে পারলে সে লাভবান হবে। মালোয়া একদিন ভাবলো দু’দিন ভাবলো তিন দিন ভাবলো কিন্তু সাহস হলো না, সে জানে সর্দারের শাস্তি কত কঠিন, কত সাংঘাতিক। বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। মালোয়া লালসার কাছে পরাজয় বরণ করলো। অবশ্য সে এই দীর্ঘ সময়ে অনেকটা শুধরে এসেছিলো তার মন্দ অভ্যাস থেকে। নীলমনি হার আবার তার মনে কুমতলব জাগালো।

একদিন সুযোগ করে নিয়ে মালোয়া ফুরাকে তুলে নিলো ঘোড়ার পিঠে। তারপর আর তাকে কে পায়। সোজা সে এসে হাজির হলো তার পুরোনো আড্ডা নিরুসিংয়ের দলে। একদিন মালোয়া নিরুসিংয়ের দল ছেড়ে ভেগেছিলো কিছু আত্নসাৎ করে। পুনরায় ফিরে এলো মহামূল্যবান সম্পদ নিয়ে, তাই নিরুসিং তাকে ক্ষমা করে দিলো, ফুল্লরার রূপ এবং তার গলার নীলমনি হার নিরুসিংকে অভিভূত করে ফেললো, সে ক্ষমা করে দিলো মালোয়াকে।

মালোয়া কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলো না, সে সর্বক্ষণ সুযোগ খুঁজছিলো কেমন করে নিরুসিংকে কাবু করা যায়। তাকে সরাতে পারলে সেই হবে দলপতি। সমস্ত আড্ডা মালিক হবে সে, লাভ করবে প্রচুর ধনসম্পদ। ফুল্লরা আর নীলমনি হার হারানোর ভয় থাকবে না।

আজ মালোয়া তার সিদ্ধান্তে জয়যুক্ত হয়েছে, সব চিন্তার অবসান ঘটেছে।

নিরুসিংকে সরিয়ে সে দলপতি হয়ে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলো। ফুল্লরা আর নীলমণি হার নিয়ে তার কোনো দুর্ভাবনা রইলো না।

শিশু ফুল্লরা এখন বেশ বড় কিশোরী বলা চলে। সে সব বোঝে, নিরুসিংকে সরিয়ে মালোয়া দলপতি হলো এবং এখন সব মালোয়র হাতের মুঠায় তাও জানে সে। তাই ফুল্লরা মালোয়র কথায় নাচে, গান গায় কিন্তু সব সময় সুযোগ খোঁজে কেমন করে পালাবে সে। গভীর মাটির নিচে বিরাট কক্ষ, সেই কক্ষে তাকে আটক করে রাখা হয়, যখন বাইরে বের করা হয় জরিনা বিবি তাকে তার সাথে। জরিনা বিবি ছাড়াও আরও কতকগুলো তরুণী আছে যাদেরকে তারই মত চুরি করে এনে আটক করে রাখা হয়েছে।

তারা অবশ্য বশ মেনে গেছে, জানে পালাবার কোনো উপায় নেই আর পালিয়েই বা যাবে কোথায়? গহন বন, তারপর সম্পূর্ণ অজানা অচেনা দেশ, কোন পথে কিভাবে পালাবে তারা?

ফুল্লরাকে ওরা সবাই ভালবাসে, ওর সুন্দর ফুটফুটে চেহারা সবাইকে আকৃষ্ট করেছে, তাই মুগ্ধ ওরা।

সুন্দর করে ওরা চুল বেঁধে দেয়, সাজিয়ে দেয় ওকে।

তবু শান্তি বা স্বস্তি নেই ফুল্লরা মনে, সে সর্বক্ষণ মনে মনে খোদাকে স্মরণ করে চলে। মনে পড়ে মায়ের কথা, মনে পড়ে অন্যায়ের কথা। ফুল্লরার ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছা করে, মাকে দেখতে বড় ইচ্ছা করে তার, কিন্তু কোনো উপায় নেই। ছোট্ট হলেও ফুল্লরা বুদ্ধিমতী ছিলো ঠিক মায়ের মত। সে বুঝে নিয়েছিলো কেঁদে লাভ হবে না। এদের মধ্যে থেকেই খোঁজ করতে হবে তার বাবা–মাকে। তাছাড়া জাবেদ আছে…ছোট্ট হলেও সে দুর্দান্ত সাহসী, নিশ্চয়ই ভাবছে তার কথা। হয়তো বা সাথীর সন্ধান করে ফিরছে বনে বনে। জাভেদ তার ছোটবেলার সাথী, একেবারে ছোট্ট বাচ্চা বয়স থেকে দুজন একসঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে খেলা করেছে, একে অন্যকে মেরেছে, কখনও বা কামড়ে দিয়েছে, কখনও চুল ধরে টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে–আবার মিলেমিশে খাবার খেয়েছে। ফুল্লরার সাথী ছিলো জাভেদ, তাই বারবার মনে পড়ে ওর কথা। ফুল্লরার সবচেয়ে বড় ভরসা তাদের সর্দার, সে চুপ করে নেই জানে ফুল্লরা, একদিন নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবে তাকে। মায়ের মুখে শুনেছে ফুল্লরা আল্লাহর নাম। তিনি মহান, বিপদে পড়লে তাকে স্মরণ করতে হয়, তাহলেই, সব বিপদ কেটে যায়। ফুল্লরার সব চিন্তা–ভাবনা ছাপিয়ে মায়ের কথাগুলো খেয়াল হয়। আল্লাহর নাম নিয়েই সে যেন বেঁচে আছে।

ছোট্ট ফুল্লরা কিশোরী হয়েছে এখন। যত দিন যাচ্ছে ততই যেন সে বেশি শান্ত, গম্ভীর হয়ে পড়েছে।

*

রাণীগঞ্জ।

আজ মিস লুনার জন্মদিন।

সমস্ত বাড়িটা যেন আলোকে আলোময় হয়ে উঠেছে। বড় হলঘরটার মধ্যে নানাবর্ণের ফুলঝাড় দিয়ে আলোর ফোয়ারা তৈরি করা হয়েছে। হলঘরের দু’পাশ দিয়ে দুটো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার দিকে। দোতলার ছাদ আর রেলিংয়ে বৈদ্যুতিক আলোর মালা দুলছে। দুলছে নানা ধরনের বেলুন আর আলোর বল।

সিঁড়ির হাতলগুলো রূপালী গিল্টি করা, যেন দুটো রূপালী সাপ আঁকাবাঁকা হয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে।

রঙিন ফানুস আর বেলুনে হলঘরের ছাদ ঢাকা পড়েছে। মেঝেতে মূল্যবান কার্পেট বিছানো, কয়েকটা সোফা সুন্দর করে সাজানো কার্পেটের মাঝামাঝি।

নতুন ধরনে সাজানো হয়েছে হলঘরটা। সোফাগুলো মাঝামাঝি গোলাকার করে সাজানো। প্রতিটি সোফার পাশে একটি করে ছোই টি–পট। প্রতিটি টি–পটের উপরে কাঁচপাত্র এবং মূল্যবান পানীয়!

বৈদ্যুতিক আলোতে কাঁচপাত্রগুলো হীরকখচিত পাত্রের মত ঝলমল করছিলো।

 মিস রুনা অতিথিদের অভ্যর্থনা জানিয়ে হলঘরে নিয়ে আসছিলো এবং নিজ হাতে কাঁচপাত্রে পানীয় পরিবেশন করছিলো। হাস্যোজ্জল দীপ্ত ওর মুখমন্ডল। হীরকহার হারানোর পর একেবারে মুষড়ে পড়েছিলো মিস লুনা, এখন অনেকটা সামলে উঠেছে। হীরকহার ছাড়াও তার অনেক টাকা হারাতে হয়েছে, বনহুর তার হাত দিয়েই টাকাগুলো বস্তি এলাকার দুঃস্থ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিতে বাধ্য করেছিলো। সব যেন আজ ভুলে গেছে মিস লুনা।

আজ জন্মদিনের আনন্দে আত্মহারা সে।

বন্ধুবান্ধব সবাই আসছে, আরও আসছেন প্রযোজক পরিচালক মহল। আসছেন মিস লার বিপরীতে যে সব অভিনেতা অভিনয় করেন তারা।

মিঃ বারোনা মিস লুনার জুটি।

 নায়ক বটে।

সমস্ত দেশ জুড়ে তার নাম। তার সৌন্দর্যের প্রশংসা।

 মিঃ বায়োনা আর মিস লুনা যে ছবিতে থাকে সে ছবি হিট না করে পারেই না। দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিরা ছাড়াও সবল শ্রেণীর লোক মিস লুনা আর বারোনাকে চায়, এরা নাকি তাদের প্রিয় নায়ক নায়িকা। দর্শকমহল এই জুটিকে একত্রে দেখার জন্য সদা উদগ্রীব।

মিস লুনাও ভালবাসতো বারানাকে। বায়োনার সঙ্গে অভিনয় করতে তার খুব আগ্রহ ছিলো। মিঃ বারোনাও তাই মিস লুনার বাসায় ঘন ঘন আসা যাওয়া করতো।

এক কথায় বানোনার আসন মিস লুনার বাড়িতে ছিলো সবার উপরে, তাই বারোনা এসেছে সবার আগে।

মিস লুনা অতিথিদের অভ্যর্থনার ফাঁকে ফাঁকে বারবার এসে দাঁড়াচ্ছে বানোনার পাশে। মিষ্টি হাসিতে তাকে আপ্যায়িত করছে সে।

পুলিশমহলের স্বনামধন্য ব্যক্তিগণও আমন্ত্রিত মিস লুনার বাসায়। সম্মুখস্থ রাস্তায় নানা বর্ণের গাড়ি থেমে আছে। মিস রুনার জন্মদিনে শহরের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

মিস লুনা আত্নহারা।

 মূল্যবান উপঢৌকন নিয়ে আগমন করছেন অতিথিবৃন্দ, খুশিতে উচ্ছল সবার মুখমন্ডল।

কক্ষের একপাশে অর্গানের সম্মুখে এসে বসেছে মিস রুনার বান্ধবী মিস রীতা সেন। রীতার সুরের মূৰ্ছনা ঝরে পড়ছে কক্ষের চারপাশে। সত্যি তার সুর অপূর্ব মিস রীতা রেডিও এবং টেলিভিশন শিল্পী, তার গানের কদর আছে।

উপস্থিত অতিথিবৃন্দ আত্মহারা হয়ে গান শুনছেন। মাঝে মাঝে করতালিতে মুখর হয়ে উঠছে হলঘরটা।

মিস লুনা নিজেও করতালি দিচ্ছিলো।

হঠাৎ আলো নিভে গেলো কক্ষের।

মুহূর্তে শোনা গেলো মিস লুনার আর্তচিৎকার, তারপর নিস্তব্ধ, অন্ধকার। পরক্ষণেই আবার আলো জ্বলে উঠলো।

কিন্তু মিস রুনা নেই।

যে স্থানে মিস লুনা দাঁড়িয়েছিলো সেখানে পড়ে আছে একটি ভাজকরা কাগজ।

 উপস্থিত মন্ডলীর চোখেমুখে ফুটে উঠেছে উদ্বিগ্নতা। সবাই বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়লেন মুহূর্তের মধ্যে। পুলিশপ্রধান দ্রুত এগিয়ে এসে কাগজখানা তুলে নিলেন হাতে। আলোর সম্মুখে মেলে ধরেই অস্ফুট উচ্চারণ করলেন–দস্যু বনহুর! মিস রুনাকে দস্যু বনহুর সরিয়েছে।

অতিথিবৃন্দের মুখমন্ডল কালো হয়ে উঠলো। এবার সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করছেন।

অতিথিদের মধ্যে একজন বললেন–দস্যু বনহুর এসেছিলো এখানে! সর্বনাশ, তাহলে কারও রক্ষা নেই। তিনি তার বিশাল বপুনিয়ে সরে পড়তে যাচ্ছিলেন, পুলিশপ্রধান বললেন–আপনারা এখন কেউ বাইরে যেতে পারবেন না। দস্যু বনহুর নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও আছে, মিস লুনাকে নিয়ে বেশিদূর যেতে পারেনি সে।

পুলিশপ্রধান তখনই পুলিশ অফিসে ফোন করলেন এবং নিজেরা দলবল নিয়ে হলঘরটা ঘিরে ফেললেন।

ওদিকে মিস রুনার মুখে হাতচাপা দিয়ে বনহুর তাকে তুলে নিয়েছে কাঁধে। তারপর দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেছে নিচে। বনহুরের গাড়িখানা নিচেই অপেক্ষা করছিলো। মিস লুনাকে গাড়ির পিছন আসনে বসিয়ে দিয়ে দ্রুত ড্রাইভ আসনে উঠে বসলো বনহুর।

মিস লুনা চিৎকার করে উঠল–বাচাও বাঁচাও…

মিস লুনার চিৎকার হলঘরের অতিথিবৃন্দের কানে গিয়ে পৌঁছলো।

ততক্ষণে বনহুরের গাড়িখানা বেরিয়ে গেছে মিস লুনাকে নিয়ে।

পুলিশপ্রধান নিজে এবং তার দু’তিনজন সহকারী যারা উপস্থিত ছিলেন তারা সবাই মিলে নিজ নিজ গাড়ি নিয়ে ছুটলেন।

অবশ্য গাড়ি নিয়ে ছুটবার পূর্বে পুলিশপ্রধান নিজে পুলিশ অফিসে ফোন করলেন। পুলিশ যেন শহরের বিভিন্ন পথ ঘেরাও করে ফেলে এবং কিছুসংখ্যক পুলিশ যেন মিস লুনার বাড়ি অভিমুখে রওনা

পুলিশ অফিসে ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশমহলে সাড়া পড়ে গেলো। মিস রুনাকে নিয়ে দস্যু বনহুর উধাও হয়েছে–এটা ভীষণ সংবাদ!

ফ্যাইং লেডী জীমস মেরী ছবির প্রযোজক সংবাদটা শুনে হতভম্ব হয়ে পড়লেন। মনে হচ্ছে কে যেন বজ্রাঘাত করেছে কিংবা তাকে হত্যার ভয় দেখানো হয়েছে। রক্তশূন্য মুখে তিনি সোফায় ধপ করে বসে পড়লেন।

পুলিশপ্রধান ও তার সহকারীরা গাড়ি নিয়ে ছুটলেন বটে কিন্তু বনহুর আর মিস লুনার সন্ধান পেলেন না।

কিছুদূর এগিয়ে পুলিশ অফিসারগণ দিশেহারা হয়ে পড়লেন, তারা গাড়ি থামিয়ে পথচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে বিভ্রাটে পড়লেন। কেউ বললে গাড়ি এই পথে গেছে, কেউ বললে ও পথে এমনি নানাজনের নানা উক্তি।

কোন পথে যাবেন ভেবে অস্থির হলেন পুলিশপ্রধান।

ততক্ষণে মিস রুনাকে নিয়ে এক নির্জন পথ ধরে বনহুরের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। মিস রুনা এখন নীরব, কারণ চিৎকার করেও কোনো ফল হয়নি। এখন যে পথে গাড়ি চলেছে সে পথ জনহীন।

বনহুর বললো মিস লুনা, আজকের মধুময় জন্মদিনটা নষ্ট হয়ে গেলো, তাইনা?

মিস লুনা তখন ক্রুদ্ধ সিংহীর ন্যায় ফোঁসফোঁস করছিলো, দৃষ্টি তার গাড়ির বাইরে–কখনও বা তাকাচ্ছিলো সে ড্রাইভ আসনে বনহুরের দিকে।

বনহুরের দেহে জমকালো পোশাক ছিলো। তবে মুখমন্ডল খোলা ছিলো তার। সম্মুখে দৃষ্টি রেখে কথা বলছিলো বনহুর।

গাড়িখানা যখন লাইটপোষ্টের পাশ কেটে যাচ্ছিলো তখন লাইটপোষ্টের আলো গাড়িতে প্রবেশ করে আলোকিত করে তুলছিলো গাড়ির ভিতরটা।

মিস রুনা এতক্ষণ নিশ্চুপ বসে আছে। সে বুঝতে পেরেছে আজ তাকে ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হবে। দস্যু বনহুর ছাড়া এ ব্যক্তি অন্য কেউ নয়–তা সে প্রথমেই অনুমান করে নিয়েছে।

এতক্ষণে বনহুরের দিকে তাকিয়ে ভালভাবে লক্ষ্য করে না বলে আমাকে কেন নিয়ে এলে? আজ ছাড়া কি তোমার সময় হলো না?

বনহুর বললো–মিস লুনা, আমি বলেছি যখন সময় আসবে তখনই আসবো। আজ আমার সময়

কিন্তু এভাবে আমাকে নিয়ে আসার কারণ কি?

দরকার ছিলো। মিস লুনা, আজ আপনার রাণীকুঞ্জে আপনি আনন্দ উৎসবে মেতে আছেন আর আপনারই দুঃস্থ ভাই–বোনরা হাহাকার করছে। আজ আপনি আপনার অতিথিবৃন্দের মুখে যে মহামূল্যবান খাদ্যসামগ্রী তুলে দিচ্ছেন, তার কিঞ্চিৎ যদি তাদের মুখে তুলে দিতেন তাহলে কতগুলো জীবন রক্ষা পেতো…যাক, এসব কথা নতুন কিছু নয় মিস লুনা। আমার মূল উদ্দেশ্য নিয়ে আলাপ করবো গন্তব্যস্থানে পৌঁছে। এই তো এসে গেছি প্রায়।

মিস লুনা তাকিয়ে দেখলো পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। রাত দশটায় তাকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়েছিলো আর এখন ভোর পাঁচটা। মিস লুনা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলো। বুঝতে পারলো সমস্ত রাত গাড়ি চালিয়ে বনহুর তাকে বহুদূর নিয়ে এসেছে।

এর পূর্বে আরও একদিন অমনি করে বনহুর তাকে ব্যাঙ্কে যাবার পথ থেকে নিয়ে গিয়েছিলো। সেদিনও দস্যু বনহুর ছিলো ড্রাইভ আসনে। তার দেহে ছিলো ড্রাইভারের পোশাক। প্রথমে চিনতে না পারলেও পরে তাকে চিনতে পেরেছিলো মিস লুনা। তার সমস্ত অর্থ বিলিয়ে দিতে বাধ্য করেছিলো সেদিন বনহুর কোনো এক বস্তির দুঃস্থ জনগণের মধ্যে। আজও বনহুর তাকে তেমনি ভাবেই পাকড়াও করে নিয়ে এসেছে……

সে দেখতে পেলো যে পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে তা কাদাযুক্ত পিচ্ছিল পথ। ভালভাবে চাইতেই স্তম্ভিত হলো মিস লুনা। চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে অগণিত মৃতদেহ। কোনো মৃতদেহ উবু হয়ে পড়ে আছে, কোনোটা বা চিৎ হয়ে, কোনোটা উলঙ্গ, কোনোটা বা অর্ধউলঙ্গ। কোনো মৃতদেহের অর্ধাংশ শিয়াল শকুনি খেয়েছে আর কোনোটার বা সামান্য কিছু। আবার কোনোটা একেবারে অক্ষত রয়েছে। মিস লুনা ভীত আতঙ্কিত অভিভূত হয়ে পড়লো, এ তাকে কোথায় নিয়ে এলো বনহুর–এ যে শশ্মান।

বনহুর গাড়ি রাখলো।

পূর্বাকাশ রাঙা করে উদয় হয়েছে সূর্য। সোনালী আলোয় ঝলমল করে উঠেছে গোটা পৃথিবী। সূর্যের সোনালী আলোর রং ছড়িয়ে মৃতদেহগুলো আরও ভয়ঙ্কর লাগছিলো।

কোনো কোনো মৃতদেহ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অর্ধেকটা মাথা তার ডুবে আছে কাদার মধ্যে। কোনো মৃতদেহ অর্ধেক কাদায় অর্ধেক শুকনোতে।

সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য!

লুনা চোখ ঢেকে ফেললো।

 বনহুর ড্রাইভ আসন থেকেই ঘাড় বাকিয়ে বললো–মিস লুনা, দেখুন মি মর্মান্তিক দৃশ্য!

মিস লুনা ধীরে ধীরে চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফেললো। তাকালো সে ফ্যাকাশে মুখে বনহুরের দিকে, তারপর বললো–এ তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে?

মিস লুনা, আমি আপনাকে কোথায় এবং কেন নিয়ে এলাম সব জানাবো। মিস লুনা, ক’দিন পূর্বে জুবরা বাঁধ ধসে হাজার হাজার পল্লী ধ্বংসের কাহিনী আপনি শোনেননি?

শুনেছি ছোট্ট জবাব মিস লুনার।

বনহুর ভালভাবে ফিরে বসলো মিস লুনার দিকে মুখ করে, একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো–শুনেছিলেন, এবার চোখে দেখুন। মিস লুনা, সংবাদপত্রে এবং লোকের মুখে শুনে মনে ব্যথা জাগে সত্য, কিন্তু সম্পূর্ণ আঁচ করতে পারেন না। একটু থেমে বললো বনহুর–একই দেশের একই রক্তেমাংসে গড়া মানুষ হয়ে কেউ হাসছে, আবার কেউ কাঁদছে, কেউ জীবনে নানাভাবে উপভোগ করছে, আর কেউ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে চিরনিদ্রায় লুটিয়ে পড়ছে। ধূলির ধরায় তার বেঁচে থাকার মত এতটুকু সম্বল পাচ্ছে না। এই দেখুন তার জ্বলন্ত প্রমাণ……

থামলো বনহুর।

মিস লুনা নির্বাক হয়ে শুনছে।

বনহুর বললো–কোনো ষড়যন্ত্রকারীর নির্মম ইংগিতে ধ্বসে পড়েছে জুবরা বাধ। ঘটেছে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু। মিস লুনা, আপনার জন্মদিনে আপনার বাড়িতে চলেছে আনন্দ উৎসব। খুশিতে উচ্ছল আপনি এবং আপনার আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ, আর আপনারই দেশের এক অংশে মৃত্যু বিভীষিকার তান্ডবলীলা চলছে।

মিস লুনা বললো–আমি কি করতে পারি? যা ঘটেছে তাতে তোমার বা আমার করবার কিছু নেই।

আছে মিস লুনা।

 বাধ ধসে মানুষ মারা গেছে তাতে তোমার আমার কি করবার আছে?

হা।

বিস্ময় নিয়ে তাকায় মিস রুনা বনহুরের দিকে।

বনহুর করুণ আঁখি মেলে গাড়ির বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে–প্রথমেই বলেছি জুবরা বাঁধ ধসে দেবার পিছনে আছে কোনো বিদেশী চক্রীর চক্রান্ত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ বাঁধ ধসে পড়েনি।

মিস রুনা অবাক কণ্ঠে বললোবাধ ধসে দেবার মত শক্তি মানুষের আছে, বল কি তুমি!

আছে মিস লুনা এবং কিভাবে বিদেশী চক্রীদল এ বাঁধ ধ্বংস করেছে তা বের করতে হবে।

 বলো কি।

হ্যাঁ এবং তা আপনাকেই করতে হবে, কারণ…একটু থেমে বললো–থাক, আজ নয় পরে সব জানাবো। অবশ্য না জানলে আপনি আমাকে ঠিকভাবে সহায়তা করতে পারবেন না।

আমি তোমাকে সহায়তা করবো, এ কথা তুমি কি করে ভাবলে?

আপনার ইচ্ছা না থাকলেও আমি আপনাকে বাধ্য করবো এ কাজে। মিস লুনা, সম্মুখে তাকিয়ে দেখুন এই যে মর্মান্তিক দৃশ্য, একি সত্যি নির্মম নয়? এই হৃদয়বিদারক অবস্থা কেউ সহ্য করতে পারে?

লুনা তাকায় গাড়ির সম্মুখে উবু হয়ে পড়ে থাকা একটি গলিত মৃতদেহের দিকে। একটি কুকুর সেই গলিত দেহটা থেকে পঁচা মাংস টেনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিলো।

বনহুর বললো–দেখুন মিস লুনা, ঐ মৃতদেহটা আজ অসার একটি বস্তুতে পরিণত হয়েছে। কুকুর শিয়াল শুকুনি ওর দেহ থেকে মাংস টেনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে অথচ ঐ অসার বস্তুটি একদিন জীবন্ত একটি মানুষ ছিলো–ওর দেহেরও আপনার আমার মত রক্তমাংস ছিলো। আমাদেরই মত ছিলো বাঁচার প্রেরণা, ছিলো আশা ভরসা স্বপ্ন সাধ কিন্তু সে এসব থেকে বঞ্চিত করেছে। এমন হাজার হাজার মানুষ আজ মৃত্যুবরণ করেছে। জুবরা বাঁধ ধ্বসে জুবার জলোচ্ছাসের কত গ্রাম যে ভেসে গেছে তার হিসেব নেই।

মিস লুনা শুষ্ককণ্ঠে বললো–কিন্তু আমি কি করবো? এ জন্য দায়ী প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো বনহুর। তারপর হাসি থামিয়ে বললো—প্রাকৃতিক দুর্যোগ মনে করেই তো আজ সবাই নিশ্চুপ রয়েছে কিন্তু আসলে তা নয়। যা সত্য তা উদঘাটন করতে হবে মিস রুনা। এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘটেনি–ঘটিয়েছে কোনো চক্রান্তকারী দল। কেন তারা দেশের এমন সর্বনাশ করলো, কি তাদের উদ্দেশ্য তাই খুঁজে বের করতে হবে মিস লুনা। এ ব্যাপারে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন বলেই আমি আশা করছি।

মিস লুনা নিশ্চুপ–অবাক দৃষ্টি মেলে এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলো বনহুরের মুখের দিকে। এমন স্পষ্টভাবে সে এর পূর্বে বনহুরকে দেখেনি। দিনের আলোতে মিস লুনা দেখেছে একটা দস্যু–ডাকু একটা হৃদয়হীন মানুষকে। মিস লুনার সঙ্গে পরিচয় নেই এমন স্বনামধন্য ব্যক্তি শহরে কমই আছে। বহু লোক তার হলঘরে আসে তার সঙ্গে ক্ষণিকের আলাপ করার জন্য উন্মুখ হয়ে। মিস লুনা তাদের সঙ্গে মিশেছে তাদের আসল রূপ দেখেছে কিন্তু আজ সে যাকে দেখছে তার সঙ্গে যেন তুলনা হয় না কারও–অদ্ভুত এক মানুষ। দস্যু বনহুর সম্বন্ধে মিস লুনা অনেকের মুখে অনেক কথা শুনেছিলো। এমনি পুলিশ বাহিনীর ডায়রীতেও সে এই ব্যক্তি সম্বন্ধে জেনেছে অনেক কিছু। পুলিশমহলের অনুরোধে মিস লুনা বনহুরকে পাকড়াও করার জন্য প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলো। পুলিশ মহলকে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করতে গিয়ে বনহুর সম্বন্ধে অনেক কথা জানার সুযোগ সে পেয়েছিলো। কিন্তু সে জানায় ছিলো চরম এক ভয়ভীতি আর হিংস্রতা।

মিস লুনা ওকে প্রথম দিন দেখেই বিস্মিত হয়েছিলো। নৃশংস হৃদয়হীন দস্যু ভয়ানক ও ভয়ঙ্কর হবে কিন্তু অভিভূত হয়েছিলো মিস রুনা ওকে দেখে! সেদিন সে বিশ্বাসই করতে পারেনি প্রথমে এই সেই বনহুর……।

কি ভাবছেন মিস লুনা? বনহুর মিস লুনার দীপ্ত সুন্দর মুখখানার দিকে তাকিয়ে বললো।

মিস লুনা দৃষ্টি নত করে নিলো, কারণ সে বনহুরের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সংকোচিত হচ্ছিলো। একজন অভিরেনী মিস লুনা; তাকে ক্যামেরার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিমায় অভিনয় করতে হয়, তার তো লজ্জা থাকবার কথা নয়। কিন্তু বনহুরের দৃষ্টি কাছে তার নারীসুলভ মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। বললো সে–তুমি যা বলবে আমি রাজি আছি……

মিস লুনা, শুধু এই কথাটা আপনার মুখ থেকে শোনার বা জানার জন্যই আজ আমি আপনাকে এমনভাবে আপনার সেই সুখময় পরিবেশ থেকে তুলে আনতে বাধ্য হয়েছি। একটু থামলো বনহুর হয়তো এক কাজ করতে গিয়ে আপনাকে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে কিন্তু আমি নিরূপায় কারণ এ কাজে শুধু আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে এবং সেজন্যই আজ আমি আপনাকে এনেছি এখানে। তাকালো বনহুর সম্মুখের অগণিত মৃতদেহগুলোর দিকে, চোখ দুটো ছলছল হয়ে এলো তার।

মিস লুনার চোখের পাতা দুটোও ভিজে উঠেছে, সত্যিই কি মর্মস্পর্শী দৃশ্য!

জানেন মিস লুনা, এরা কত আশা নিয়ে, কত ভরসা নিয়ে জুরার তীরে ঘর বেঁধেছিলো। এদের সংসার ছিলো, সন্তানসন্ততি ছিলো, পরিবার পরিজন ছিলো ছিলো নিত্য প্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য ছিলো গৃহপালিত জীবজন্তু…ঐ দেখুন একটা মৃতদেহ হয়তো বা কোনো কৃষক হবে, সে তার গরুটার জীবন রক্ষার আশায় গড়িটা হাতের মুঠায় আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো কিন্তু পারেনি, দড়িটা ওর হাতের মুঠায় এখনও ধরা আছে। দড়িটা তার হাতের মুঠা থেকে খুলে যায়নি বা যেতে পারেনি, তার আগেই উভয়ের প্রাণ জলোচ্ছাসের তলায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। কি মর্মান্তিক–একটু থেমে বললো বনহুর–মিস লুনা, আপনাকে এখানে নিয়ে আসার একমাত্র কারণ আপনি স্বচক্ষে দেখুন এ দৃশ্য এবং উপলব্ধি করুন মানুষ কত নির্মম হৃদয়হীন হতে পারে। বিদেশী চক্রান্তকারী যে এরা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মিস লুনা বললো–আমি শপথ করছি তুমি যা বলবে আমি তাই করবো……

মিস লুনা!

হ্যাঁ বনহুর, এতক্ষণে মনে হচ্ছে আমি যে রাজ্যে বাস করি তা স্বপ্নময় কল্পনার রাজ্য, আসল রাজ্য হলো তোমার রাজ্য। যে রাজ্য নিয়ে তুমি কাজ করো…..

বনহুর বললো–এখানে বেশিক্ষণ আপনাকে ধরে রাখবো না মিস লুনা, কারণ পঁচা মৃতদেহের উৎকট গন্ধে আপনার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, কাজেই চলুন ফেরা যাক। গাড়িতে স্টার্ট দিলো বনহুর।

সূর্যের আলোতে চারদিক ঝলমল করছে।

জলোচ্ছাস নেমে গেলেও এখনও একেবারে শুকিয়ে যায় নি। আশেপাশের নিচু জায়গায় প্রচুর জলরাশি জমে আছে। শুধু জলরাশিই জমে নেই, তার মধ্যে অর্ধ ভাসমান গলিতে মৃতদেহ এবং গবাদি ভাসছে!

ব্যাক করে গাড়ির মুখখানা ফিরিয়ে নিলো বনহুর–তারপর ফিরে চললো তারা শহর অভিমুখে।

মিস রুনা যখন বনহুরের সঙ্গে জুবৃরনা বধের ধ্বংসলীলা দেখছিলো তখন শহরে তাকে নিয়ে ভীষণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিলো।

পুলিশ সুপার মিঃ লোদী দলবল নিয়ে মিস লুনা আর বনহুরের গাড়ির পিছু ধাওয়া করেও তারা বিমুখ হলেন। বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর হারিয়ে ফেললেন পথের দিশা।

ততক্ষণে অবশ্য পুলিশ ভ্যানগুলোও হাজির হয়েছিলো। মিস লুনার বাড়ি এবং শহরের বিভিন্ন পথ তারা ঘেরাও করে ফেলেছিলো সাবধানতার সঙ্গে।

কিন্তু সমস্ত রাত শহর এবং শহরতলী তন্ন তন্ন করে সন্ধান করেও মিস লুনার বা দস্যু বনহুরের হদিস পেলেন না। বিফল হলেন পুলিশ মহল। নানাজনের নানা মতবাদ শুরু হলো দস্যু বনহুর আর মিস লুনাকে নিয়ে। বিশেষ করে ফ্যাইং লেডী জীমস মেরী ছবির পরিচালক এবং প্রযোজক গাড়ি নিয়ে ছুটাছুটি করছেন। মিস রুনার হরণ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে প্রযোজক মিঃ দেওয়ানজীর। তিনি কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এ ছবি তৈরি করছেন।

পুলিশমহলকে জানিয়েছেন যত টাকা লাগে তিনি মিস লুনার উদ্ধার ব্যাপারে খরচ করতে রাজি আছেন। মিস লুনাকে তার চাই, নাইলে ফ্যাইং লেডী জীমস মেরী বরবাদ হয়ে যাবে।

সমস্ত শহরে যখন মিস রুনা আর দস্যু বনহুরকে নিয়ে নানা রকম আলোচনা চলছে তখন বনহুর মিস লুনাকে পৌঁছে দিলো তার বাড়িতে।

হঠাৎ মিস লুনার আবির্ভাব শহরে ভীষণ এক আলোড়ন সৃষ্টি করলো। মিস লুনাকে দস্যু বনহুর ফিরিয়ে দিয়ে গেছে–এ যেন এক বিস্ময়।

পুলিশমহলের লোকজন এসে হাজির হলেন মিস লুনার বাড়িতে। মিঃ লোদী স্বয়ং এসে উপস্থিত হয়েছেন। এলেন রিপোর্টারগণ, ক্যামেরাম্যান এবং ফ্যাইং লেডী জীমস মেরী ছবির পরিচালক ও প্রযোজক মিঃ দেওয়ানজী।

মিস লুনা কিন্তু সম্পূর্ণ নীরব, কোনো কথা সে বলছে না মিঃ লোদী নিজে নানা প্রশ্ন করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না। রিপোটার ও অন্য সবাই বিমুখ হয়ে পড়েছেন।

নানা প্রশ্নে মিস লুনা মুখ খুলছে না।

পুলিশ সুপার মিঃ লোদী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মিস লুনা, আপনি জ্ঞান, বুদ্ধিমতী মহিলা, আপনাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। জানি, আপনি দস্যু বনহুর সম্বন্ধে কিছু বলতে ভয় পাচ্ছেন কিন্তু সে ভয় বা ভীতি আপনার পক্ষে অহেতুক, কারণ পুলিশমহল আপনাকে যথাসাধ্য সহায়তা করবে এবং সাবধানতা অবলম্বন করবে যেন দস্যু বনহুর আপনার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

মিস লুনা এবার কথা না বলে পারলো না, সে বললো–দেখুন আপনি যা বলছেন তা করবেন সত্য কিন্তু আমি জানি পুলিশমহল আমাকে দস্যু বনহুরের কবল থেকে কিছুতেই রক্ষা করতে পারবে না।

পুলিশপ্রধান পুনরায় বললেন–দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশবাহিনী এবার নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করেছে, যা কারো জানা নেই। মিস লুনা, আপনাকে সে হরণ করে নিয়ে গিয়ে ভাল করেনি। আপনি চিত্রজগতের এক সম্পদ…

মিস লুনা এবার মৃদু হেসে বললো–আপনারা হয়তো মনে করেছেন বনহুর আমাকে নিয়ে গিয়ে আমার উপর মন্দ আচরণ করেছে।

হা মিস লুনা, আমরা সবাই তাই মনে করছি। কথাটা বললেন মিঃ কিবরিয়া।

জীমস মেরী ছবির প্রযোজক ও মিঃ কিবরিয়ার কথায় সায় দিয়ে বললেন–দস্যু বনহুর যে সাংঘাতিক দুর্ধর্ষ তার প্রমাণ সে নিজে। দেশবাসী জানে সে কত ভয়ঙ্কর। তার কবলে যে পড়েছে তার নিস্তার নেই…

না, সে ধারণা আপনাদের ভুল। বললো–মিস লুনা।

মিঃ ফিরোজ উপস্থিত ছিলেন, তিনি বললেন–দস্যু বনহুর সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ভুল?

 হ। তাকে একদিন আমি নিজেও ভুল বুঝেছিলাম। আসলে সে মহৎ ব্যক্তি।

অট্টহাসি হাসলেন মিঃ লোদী–মিস লুনা, দস্যু বনহুর দেখছি আপনাকে যাদু করেছে। একটু থেমে তিনি বললেন–একদিন দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আপনি পুলিশমহলকে সহায়তা করতে গিয়ে বিমুখ হয়েছিলেন মিস লুনা।

হাঁ, হয়েছিলাম তন্তু আপনারা ভবিষ্যৎ চিন্তা করে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও আমাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করেছিলেন।

কিন্তু সে অর্থ আপনাকে দস্যু বনহুর ভোগ করতে দেয়নি মিস সুনা, তাই নাকি? বললেন মিঃ লোদী।

মিস লুনা এবার ভারী গলায় বলে উঠলো–মিঃ লোদী, এতদিন যা উপার্জন করেছি তা আমার কোনো কাজে আসেনি। যে অর্থ আপনারা দিয়েছিলেন ঐ অর্থ আমার কাজে এসেছে…একটু থেমে বললো মিস লুনা–ঐ অর্থ আমি আমার দুঃস্থ অসহায় ভাই–বোনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পেরেছি। তাদের মুখে হাসি ফোঁটাতে পেরেছি, এটাই আমার আনন্দ…

মিস লুনা, একটা দস্যু আপনাকে কৌশলে বাধ্য করেছিলো আপনার টাকাগুলো দুঃস্থ জনগণের মধ্যে বিলিয়ে দিতে। আর আপনি কিনা বলছেন তাতে আনন্দ লাভ করেছেন?

হা ইন্সপেক্টার, আমি এমন আনন্দ আর কোনোদিন পাইনি। মিস লুনার গলায় উচ্ছ্বাস।

মিঃ লোদী বললেন–হাঁ, আমি দুঃস্থ জনগণের মুখে হাসি দেখলেই মন খুশিতে ভরে যায়, তাই বলে কোনো ডাকু বা দস্যু যদি কাউকে জোরপূর্বক বাধ্য করে তার সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে…….

আপনি বুঝবেন না মিঃ লোদী, যে দৃশ্য সেদিন আমি দেখেছি, উপলব্ধি করেছি, তা কল্পনাতীত। চিরদিন উচ্ছল আনন্দ আর প্রাচুর্যের পর থেকেই…একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললো পুনরায় মিস লুনা দুঃখ ব্যথা বেদনা কাকে বলে জানতাম না, দুঃস্থ অসহায় মানুষকে নিয়ে কোনোদিন ভাববার সময় পাইনি। মিঃ লোদী, বস্তির মানুষগুলো কিভাবে জীবন–যাপন করে, যদি সভ্যসমাজের মানুষ তা নিয়ে ভাবতো বা নিজ চোখে দেখতো তাহলে বুঝতে পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যারা স্যাৎসঁতে নোংরা মেঝেতে ছেঁড়া মাদুর বিছিয়ে শোয়, যারা পথের ধারে আবর্জনা হাতড়ে আহার সংগ্রহ করে, যারা চট আর ছেঁড়া কাথা পরে লজ্জা নিবারণ করে…সত্যি, এদের মানুষ বলে মনে হয় না, মনে হয় এরা অন্য কিছু……

মিস লুনা কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো। চোখ দুটো তার অশ্রুছলছল হয়ে উঠে গলাটা বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে।

মিঃ লোদী হেসে বললেন–আপনি দেখছি একেবারে পাল্টে গেছেন মিস লুনা। যাদের জন্য আজ ভাবছেন দু’দিন পূর্বে তাদের কথা আপনার মনে স্থান লাভ করেন……

হাঁ, এ কথা সত্য। তেমন পরিবেশ আমার জীবনে আসেনি বা সৃষ্টি হয়নি, তাই….

যাক ওসব কথা, আমরা অসময়ে কেন এসেছি, এ কথা আপনাকে খুলে না বললেও আপনি বেশ বুঝতে পেরেছেন।

হাঁ, আপনারা জানতে চান দস্যু বনহুর আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আমার প্রতি কি রকম আচরণ করেছে কিংবা কি ভাবে সে আমাকে নির্যাতিত করেছে।

এ কথা মিথ্যা নয়, আমরা পুলিশমহল আপনার মুখে সবকিছু শুনতে এবং চানতে চাই মিস লুনা। আপনি বলুন সে আপনাকে জোরপূর্বক পাকড়াও করে নিয়ে যাবার পর কোথায় নিয়ে গিয়েছিলো আর কেনই বা নিয়ে গিয়েছিলো কি উদ্দেশ্য ছিলো তার? মিস লুনা, তার সম্বন্ধে শুধু শুনতে বা জানতে চাই না, তাকে গ্রেপ্তার করতে চাই আপনার সহায়তা। কথাগুলো বলে থামলেন মিঃ লোদী।

মিঃ লুনা তখন আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে গভীরভাবে।

পুলিশমহলের নানা জেরা সত্ত্বেও মিস লুনা আসল কথা বললো না, শুধু জানালো দস্যু বনহুর তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলো যেখানে সে দেখেছে বা জেনেছে অনেক কিছু কিন্তু সব কথা বলতে সে রাজি নয়। কারণ দেশের মঙ্গলের জন্য তাকে অনেক কিছু চেপে যেতে হবে, তবে কাজ সমাধা হলে জানাবে সে সবকিছু, এমন কি এ ব্যাপারে পুলিশমহলের সহায়তাও প্রয়োজন হতে পারে।

রিপোর্টার এবং সাংবাদিকগণ বিফল মনে ফিরে গেলেন। মিস লুনার কাছে এমন কিছু তারা জানতে পারলেন না যা সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার করতে পারে না।

*

গভীর রাতে সমস্ত পৃথিবী যখন নিস্তব্ধ, নিকষ অন্ধকারে আচ্ছন্ন, তখন জুবরা নদীর বুকে ভেসে উঠে একটা ডুবন্ত অট্টালিকা। ঠিক অট্টালিকা না ডুৰু জাহাজ তা বোঝা মুস্কিল। কারণ অট্টালিকা কখনও জলমগ্ন হয়ে পুনরায় ভেসে উঠতে পারে না। ওটা নিশ্চয় কোনো ডুবুজাহাজ।

এক জায়গায় নয় জুব্রা নদীর বুকে প্রায়ই এখানে সেখানে দেখা যায় এই অট্টালিকার মত অদ্ভুত ডুবুজাহাজখানাকে। তবে লোকচক্ষুর আড়ালেই এই রহস্যময় ডুবু জাহাজখানার বিচরণ।

যেদিন বুজরা বাক ধসে পড়ে জুবরার আশেপাশের গ্রামগুলো ভেসে গিয়েছিলো, সেদিন ঐ ডুবু অট্টালিকাটিকে দেখা গিয়েছিলো জুবরা নদীর বুকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কিছুক্ষণ।

ডুবু অট্টালিকা বা জাহাজখানা আকারে এত বড় যে, হঠাৎ রাত্রির অন্ধকারে কেউ দেখলে পাহাড় বলে মনে করবো। ঐ অট্টালিকা বা ডুবাজাহজের ভিতরে রয়েছে কয়েকটা স্তর বা তরা। জুবৃরা নদীর গভীর তলদেশে জাহাজখানা ডুবে থাকলেও সেখানে রয়েছে নানা ধরনের মেসিন ও কলকারখানা।

ঐ জাহাজের তলদেশের একটি ক্যাবিনে রয়েছে একজন মহিলা এবং তিনজন পুরুষ। এরা সর্বক্ষণ ডুবুজাহাজখানার মেসিন এবং যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কি এদের উদ্দেশ্য কে জানে!

তবে এদের উদ্দেশ্য যে ভাল না তা সত্য। গভীর জলের তলে ডুবুজাহাজে চলেছে এদের কাজ। মহিলাটি বসে আছে এমন একটি যন্ত্রের পাশে, যা দেখতে অতি সূক্ষ্ম এবং ভয়ঙ্কর।

মহিলার চোখে অদ্ভুত ধরনের চশমা।

মাঝেমাঝে সে আসন ত্যাগ করে একটা ওয়্যারলেস মেশিনের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। কোথায় কার সঙ্গে কথা বলছে সে, কেউ জানে না। সাংকেতিক শব্দেই কথাবার্তা বলছিলো।

মহিলা যে বিদেশী তাকে দেখেই বুঝা যায়।

চোখ দুটি যদিও তার কালো কাঁচের আবরণে ঢাকা তবু বেশ বোঝা যায় ঐ আবরণের পেছনে দুটি শ্যেনদৃষ্টি জ্বলজ্বল করছে।

মহিলাটি যখন ওয়্যারলেসে কথা বলছিলো তখন তার মুখে ফুটে উঠছিলো এক ধরনের পৈশাচিক হাসি।

এমন সময় পাশে এসে দাঁড়ালো একজন পুরুষ অনুচর, বললো সে–মিসেস এলিনা, জুবরা বাঁধ ধ্বংস করার পর আমাদের মারুলা আনন্দ উৎসবে যোগ দেবার কথা ছিলো কিন্তু…

হবে, সবুর করো কাংগালো। কাজ শেষ হলেই আমি তোমাদের নির্দেশ দেবো মারুলা আনন্দ উৎসবে। যোগ দিতে, বুঝলে?

বুঝেছি মিসেস এলিনা।

হা, চুপচাপ কাজ করে যাও।

 মিসেস এলিনা, একটা কথা বলতে চাই? বললে কাংগালো।

মিসেস এলিনা চোখ থেকে কাঁচের অদ্ভুত চশমাটা খুলে ফেললো, তারপর কুচকে তাকালো কাংগালোর মুখের দিকে।

কাংগালো বললো–আমি আপনাদের নির্দেশমত কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু…

 আজও আমাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য তুমি সঠিক কিছু জানো না, তাই না?

 হাঁ মিসেস এলিনা, আমি আমাদের কাজ সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানি না। আমার জানার খুব ইচ্ছা…

তবে শোন কাংগালো, আমাদের মূল উদ্দেশ্য জুবৃরা বাধ ধ্বংস করাই শুধু নয়, এমনি হাজার হাজার কাজ আমাদের সমাধা করতে হবে।

মিসেস এলিনা, ধ্বংসলীলা চালানোই কি আমাদের মূল উদ্দেশ্য?

হাঁ, তবে অকারণ নয়।

 কাজে যোগ দেবার পূর্বে আমি যতটুকু জানতে পেরেছিলাম তাতে তেমন কিছু জানতে বা বুঝতে পারিনি।

তাই তুমি জানতে চাচ্ছো?

হাঁ, মিসেস এলিনা।

মিসেস এলিনা তার প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছে নিলো, তারপর বলতে শুরু করলো–আমাদের নেতা চান আমরা শুধু কাজ করে যাবো, কোনোদিন প্রশ্ন করবো না কেন একাজ করছি। তবে,..কাংগালো, তুমি সব জানতে পারবে।

তাহলে আপনি আমাকে

না, আজ বলা চলবে না। সব জানতে পারবে কাজের মাধ্যমে। যাও কাজ করোগে।

চলে যায় কাংগালো।

মিসেস এলিনা উঠে দাঁড়ালো, ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলে একটা বাঁকা হাসি।

ঐদিন রাতে যখন কাংগালো ঘুমিয়ে ছিলো, তখন তার শিয়রে এসে দাঁড়ালো মিসেস এলিনা। তার চোখে তখন কালো কাঁচের চশমা, হাতে একটা যন্ত্র। এলিনার পিছনে আরও দু’জন লোক দাঁড়িয়ে ছিলো।

মিসেস এলিনা নিজ হাতের যন্ত্রখানা কাংগালোর মুখের কাছে ধরলো, তারপর আংগুল দিয়ে একটা সুইচে চাপ দিলো। অমনি একটা আলোকরশ্মি বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়লো কাংগালোর মুখের উপর।

সঙ্গে সঙ্গে কাংগালো আর্তনাদ করে উঠলো।

পরক্ষণেই দেখা গেলো পোড়া কয়লার মত কালো হয়ে উঠেছে কাংগালোর মুখখানা। তীব্রযন্ত্রণায় ছটফট করছে সে।

কাংগালো যখন যন্ত্রণায় গড়াগড়ি দিচ্ছিলো তখন মিসেস এলিনা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। কি ভীষণ অদ্ভুত সে হাসি।

মিসেস এলিনার পিছনে যারা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো এবার তারা এগিয়ে এলো।

এতোক্ষণে কাংগালোর দেহটা স্থির হয়ে গেছে।

মিসেস এলিনা ইংগিত করলো।

সঙ্গে সঙ্গে লোক দু’জন কাংগালোর দেহটা তুলে নিলো, তারপর বেরিয়ে গেলো সেই ক্যাবিন থেকে। ডুবুজাহাজের তলদেশে এমন এক জায়গায় এসে তারা দাঁড়ালো যেখানে ভয়ঙ্কর একটা মেশিন চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে অবিরত, ঠিক যেন যাতা কলের মত!

মিসেস এলিনা ইংগিত করলো কাংগালো দেহটাকে ঐ যাতাকলে নিক্ষেপ করতে।

অমনি কাংগালোর দেহটা নিক্ষেপ করলো ওরা সেই মেশিনটার মধ্যে–শুধু একটাশব্দ হলো ক্যাক করে, তারপর মেশিনটা যেমন ঘুরে চলছিলো তেমনি ঘুরে চললো।

মিসেস এলিনা দাতে দাঁত পিষে বললো–সব জনার ইচ্ছা ঘুচিয়ে দিলাম। চলো মাংলো, চলো রিপনবাং…তোমরাও মনে রেখো, আমাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কেউ কোনোদিন জানতেও চেও না, তাহলে তোমাদের অবস্থাও এমনি হবে।

রিপনবাং ও মাংলো শিউরে না উঠলেও মনে মনে ভীত যে না হলে তা নয়। কাংগালোর অবস্থা স্বচক্ষে তারা দেখলো–কি ভীষণ আর ভয়ঙ্কর মৃত্যু হলো কাংগালোর!

মিসেস এলিনা ওয়্যারলেসে কথা বললো সাংকেতিক ভাষায়। জবাব ভেসে এলো। সংগে সংগে মিসেস এলিনার মধ্যে দেখা গেলো একটা চাঞ্চল্য। একটা সুইচে চাপ দিলো সে, সঙ্গে সঙ্গে ডুবুজাহাজখানা দুরে উঠলো, পরক্ষণেই কচ্ছপের মত এগুতে লাগলো জুবরা নদীর তলদেশ দিয়ে।

কিছুদূর গিয়ে ধীরে ধীরে ভেসে উঠলো ডুবন্ত অট্টালিকার মত মাথা উঁচু করে।

সেই মুহূর্তে আকাশে দেখা গেলো অদ্ভুত ধরনের একটা ছোট বিমান। বিমানটা জুরা নদীর বুকের উপর শূন্যেচক্রাকারে উড়ছিলো।

ডুবু জাহাজখানার সুউচ্চ মাধাটা পানির বুকে ভেসে উঠলো।

 সঙ্গে সঙ্গে বিমানখানা নেমে এলো নিচে!

ডুবু জাহাজখানা ততক্ষণে আরও কিছু মাথা উঁচু করে দিয়েছে।

এবার বিমান থেকে প্যারাসুট নামানো হলো।

আলগোছে নেমে এলো তিনজন অদ্ভুত পোশাকপরা লোক। ঐ প্যারাসুট বেয়ে ডুবুজাহাজখানার মাথায়।

প্যারাসুটধারী লোক তিনজন জাহাজখানার উপরে পৌঁছতেই হোট বিমানখানা দ্রুত উঠে গেলো, আকাশে অনেক উঁচুতে। তারপর উড়ে কোথায় চলে গেলো কে জানে।

এবার জাহাজখানা ধীরে ধীরে নেমে চললো গভীর জলরাশির তলদেশে।

প্যারাসুটধারী লোকগুলো ততক্ষণে ডুবুজাহাজের ভিতরে প্রবেশ করে মিসেস এলিনার সামনে এসে বসেছে। তারা গোপনে কিছু আলোচনা করে চললো।

একজন একটি চিঠি বের করে দিলো মিসেস এলিনার হাতে। চিঠিখানা সীলমোহর করা ছিলো।

মিসেস এলিনা সীলমোহর খুলে ফেলার জন্য তার পাশে দাঁড়ালো একজনকে নির্দেশ দিলো।

লোকটা চিঠিখানা নিয়ে সীলমোহর খুলে ফেললো, তারপর মিসেস এলিনার হাতে দিলো।

 মিসেস এলিনা চিঠিখানা মেলে ধরলো চোখের সামনে। চিঠিখানায় দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললো মিসেস এলিনা–মসিউর, জুরা বাধ ধ্বংস করার পর আমরা ফিরে যাবো ভেবেছিলাম কিন্তু তা হলো না।

মসিউর, গ্যারিসন আর মাংথাপুরা একসঙ্গে তাকালো মিসেস এলিনার দিকে।

মিসেস এলিনা বললো–জুবরার তীরে যে দৃশ্য আমরা সৃষ্টি করেছি, ঐ দৃশ্যগুলো ধরে রেখেছি আমাদের ক্যামেরায়। একটু থেমে পুনরায় বললো–জুরা বাধ ধ্বংস আমাদের সাত নম্বর কাজ প্রথম হলো হিরোদ্বীপের শিকাগো মিনার ধ্বংস, দ্বিতীয় হলো রোহানী বধ নষ্ট করা, তৃতীয় হলো ফিরু পর্বতের মিনা গুহা ধ্বংস করা, চতুর্থ হলো নলাগড়ের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ ভেঙে চুরমার করে দেওয়া, পঞ্চম হলো ফালানা প্লেন ধ্বংস করা, ষষ্ঠ হলো মসিহা বাধ ধ্বংস করা, সপ্তম কাজ ছিলো আমাদের জুবৃরনা বাঁধ। এই বাঁধ ধ্বংস করে আমরা কান্দাই সরকারকে চরম আঘাত হেনেছি। কান্দাই সরকারই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, জুবরা নদীর তীরে বসবাসকারী গ্রাম বাসী ধ্বংস হয়ে গেছে, তারা আর কোনোদিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। হা, এবার অষ্টম কাজ আমাদের নাংহা জাহাজ ধ্বংস করা। কান্দাই সরকারের চরম ক্ষতি হবে এই জাহাজটিকে ধ্বংস করতে পারলে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম জাহাজ নাংহা। এই জাহাজের যাত্রীসংখ্যা প্রায় বিশ হাজার। মরালু–

বলো মিসেস এলিনা?

নাংহা এখন কোথায়?

শুনেছি জুবরা নদ বেয়ে কান্দাই সাগরের দিকে যাত্রা করেছে।

হা, এইতো সুযোগ। মালিকের আদেশ আমরা যেন জবরা বাধ ধ্বংস করার পরপরই নাংহা’ ধ্বংস করে মালিকের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করতে পারি। মরালু, শুধু সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারের ললাতেই আমরা এ কাজ বেছে নেইনি। আমরা চাই কান্দাই যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। কোনোদিন

ঠিক বলছে এলিনা, ঝামদেশ থাকবে পৃথিবীর সবেচেয়ে উন্নত দেশ হিসেবে। আমরা ঝাম অধিবাসী, কাজেই ঝামকে সব দেশ থেকে বৃহৎ শক্তিশালী দেশ হিসেবে তুলে ধরতে হলে পার্শ্ববর্তী দেশ কান্দাইকে দাবিয়ে রাখতে হবেই। এ ব্যাপারে আমরা জীবন দিতেও রাজি আছি!

হাঁ, কথাটা উচ্চারণ করেই মিসেস এলিনা ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিলে মরালু নামক অনুচরটির দিকে।

মরালু হাত মিলালো মিসেস এলিনার সঙ্গে। একটা তীব্র এবং তীক্ষ্ণ হাসি ফুটে উঠলো মিসেস এলিনার মুখে।

মিসেস এলিনার সম্মুখের টেবিলে ছিলো কয়েকটা সুইচ এবং পাশাপাশি কয়েকটা বোম নীল–লাল আর হলুদ। প্রতিটি বোতামের উপর নম্বর দেওয়া আছে। মিসেস এলিনা হলুদ বোতামে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে ডুবুজাহাজখানা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণ কচ্ছপের মত গুটিগুটিভাবে এগুচ্ছিলো জাহাজখানা।

লাল বোতামে চাপ দিতেই সম্মুখস্থ টেলিভিশনের আলো জ্বলে উঠলো। ধীরে ধীরে পর্দায় ভেসে উঠলো একটা বিরাট জাহাজ–সাগরের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে।

মিসেস এলিনা এবং সঙ্গীরা তাকালো সম্মুখস্থ টেলিভিশনটির পর্দায়। জাহাজখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, জাহাজের গতি স্বাভাবিক। বিশ হাজার যাত্রী নিয়ে এ জাহাজ চলেছে ফাংহা দ্বীপ অভিমুখে।

মরালু বললো–মিসেস এলিনা, জাহাজখানা আমাদের ধ্বংস মিটারের সীমানার বাইরে আছে বলে মনে হচ্ছে।

হা মরালু। একটু থেমে বললো মিসেস এলিনানাংহা যখন ফাংহা থেকে ফিরবে তখন ফেরার পথে…বাস, খতম করবো। এখুনি আমি মালিকের সঙ্গে কথা বলবো এ ব্যাপারে। মিসেস এলিনা এসে দাঁড়ালো ওয়্যারলেস মেশিনের সম্মুখে। সুইচ টিপতেই মাথার উপর লাল নীল বালবগুলো টিপ টিপ করে জুলতে আর নিভতে লাগলো।

অদ্ভুত এ আলোর বালবের খেলা।

 মিসেস এলিনা কথা বলে চলেছে, সাংকেতিক ভাষায় কি কথা হলো সেই জানে, মুখখানা তার দীপ্ত মনে হলো। মিসেস এলিনা ওয়্যারলেসের পাশ থেকে সরে এলো তার টেবিলে এবং নীল রঙের বোতাম টিপলো।

সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় টেলিভিশনে ফুটে উঠলো দুটি অদ্ভুত পোশাকপরা লোক। ডুবুরী বলেই মনে হলো তাদের, তারা গভীর জলের তলদেশে সাঁতার কেটে এগুচ্ছে। অদূরে দেখা গেলো একটা সাবমেরিন জাতীয় ছোট্ট জলযান। অদ্ভুত পোশাকপরা লোক দু’জন সাবমেরিন জাতীয় জলযানটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

মিসেস এলিনা হেসে উঠলো, তারপর বললো–মরালু, এরা কারা জানো?

এই তো প্রথম দেখলাম, ওরা কারা জানবো কি করে? তবে মনে হচ্ছে এরা…

মরালুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে মিসেস এলিনা–এরা গোয়েন্দা বিভাগের লোক। ডুবুরীর পোশাক পরে জুরা নদের তলদেশে সন্ধান চালিয়ে চলেছে। দেখো, দেখো মরালু, লোক দুটো এত দ্রুত সাঁতার কেটে আসছে তাতে মনে হচ্ছে ওরা যেন যন্ত্রচালিত জলযান।

হাঁ মিসেস এলিনা, লোক দুটি যেভাবে দ্রুত সাবমেরিনটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ওরা স্বাভাবিকভাবে সাঁতার কেটে এগুচ্ছে না, নিশ্চয়ই কোনো…

কথাটা শেষ না হতেই মিসেস এলিনা অপর একটি সুইচ টিপলো। সঙ্গে সঙ্গে দুলে উঠলো ডুবুজাহাজখানা এবং এগুতে শুরু করলো।

কিছুক্ষণ পূর্বে যে বিশালকায় ডুবুজাহাজখানা কচ্ছপের মত এগুচ্ছিলো, এখন সেই জাহাজখানা ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে চলতে শুরু করলো।

জাহাজ তো নয়, একটি অট্টালিকা ডুবন্ত অবস্থায় এগিয়ে যাচ্ছে যেন! কিন্তু মিসেস এলিনা তার আসন ত্যাগ করে সরে যায়নি, সে সুইচের পাশে বসে সম্মুখস্থ টেলিভিশনটার পর্দায় তাকিয়ে আছে। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে লোক দুটি সাবমেরিনের কাছাকাছি এসে গেছে। সাবমেরিনটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিরাট পাথরখন্ডের পাশে।

মিসেস এলিনা বললো–মরালু, তুমি কি কিছু বুঝতে পারছে? ঐ সাবমেরিনটার মধ্যে কোনো চালক নেই

হাঁ, সেই রকমই মনে হচ্ছে। বললো মরালু।

মিসেস এলিনা বললো–সাবমেরিনটার কাছাকাছি পৌঁছবার পূর্বেই আমরা অদ্ভুত ডুবুরী দুজনকে গ্রেফতার করব। কথা শেষ করেই মিসেস এলিনা পাশের চেয়ারে একটি হ্যান্ডেল ঘোরাতে শুরু করলো।

হ্যান্ডেলটা ঘোরাবার সঙ্গে সঙ্গে ডুবন্ত জাহাজ থেকে একটি হাতল বেরিয়ে তীরবেগে ছুটলো জুবরা নদের তলদেশ দিয়ে ডুবুরী দুজনের দিকে। ডুবুজাহাজখানার সঙ্গে আটকা রয়েছে হাতলখানার পিছন অংশ। হাতলের আগায় একটা বল যেন গুটি পাকিয়ে রয়েছে।

হাতলটা তীরে মত এগিয়ে যাচ্ছে সা সা করে। মাত্র কয়েক মিনিট, হাতলটা দ্রুত ছুটে এসে অদ্ভুত পোশাকধারী ডুবুরী দু’জনকে ঘিরে ফেললল, আশ্চর্যভাবে হাতলের বলটা ছড়িয়ে পড়লো জালের মত।

ডুবুরী দু’জন আটকা পড়ে গেলো জালের মধ্যে। তারা প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো জাল থেকে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে নেবার জন্য।

মিসেস এলিনা এবং তার সঙ্গীরা দেখতে লাগলো তাদের সম্মুখস্থ টেলিভিশন পর্দায় ডুবুরীদ্বয়ের অবস্থা। ডুবুরীদ্বয় আর কিছুতেই তাদের জল্যান বা সাবমেরিনটার নিকটে পৌঁছাতে পারলো না।

জালসহ হাতলখানা ক্রমান্বয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ডুবুজাহাজখানার দিকে। মিসেস এলিনার নির্দেশে তার এক অনুচর হাতলখানার সুইচ চেপে ধরে রইলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জালসহ হাতলখানা গুটিয়ে এলো ডুবুজাহাজখানার পাশে। জাহাজের গায়ে বেরিয়ে এলো একটি সুড়ঙ্গপথ।

জালসহ হাতলখানা প্রবেশ করলো সেই সুড়ঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ হয়ে গেলো, দু’জন বলিষ্ঠ লোক অদ্ভুত পোশাকধারী ডুবুরী দু’জনকে জাল থেকে বের করে নিলো।

তারপর ওরা ডুবুরী দু’জনকে নিয়ে চেপে দাঁড়ালো লিফটের উপর। লিফ্টখানা সাঁ সাঁ করে উপরে উঠতে লাগলো। এক তলা দু’তলা তিন তলা চার তলায় উঠে এলো লিফট।

মিসেস এলিনার সম্মুখে একটা গোলাকার আলোর বল জলছে আর নিভছে।

বললো এলিনা–দেখলে মরালু, কেমন করে জুবরা নদের তলদেশে আমি কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

 হাঁ, দেখলাম।

ততক্ষণে টেলিভিশন পর্দা অন্ধকার হয়ে গেছে। কারণ এলিনা বোতাম টিপে অফ করে দিয়েছে অদ্ভুত বিস্ময়কর টেলিভিশনের সুইচটা।

বললো মিসেস এলিনা–ওরা কারা এবার সব জানতে পারবো। কথাগুলো যখন মিসেস এলিনার কণ্ঠ দিয়ে বের হচ্ছিলো তখন তার দৃষ্টি ছিলো সম্মুখের আলোকটার দিকে। আলোর বলটা তখনও জ্বলছে আর নিভছে।

সম্মুখস্থ টেবিলের একটি বোতামে চাপ দিতেই দেয়ালে অর্ধউলঙ্গ একটি ছবিসহ দেয়ালখানার কিছু অংশ সরে গেলো, অমনি একটি দরজা বেরিয়ে এলো ওপাশ থেকে।

সেই দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো মিসেস এলিনার বলিষ্ঠ অনুচরদ্বয় এবং তাদের সঙ্গে সেই ডুবুরী দুজন। মিসেস এলিনা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। তারপর হাসি থামিয়ে বললো–ডুবুরী সেজে জুবরা নদের তলদেশে সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিলে না?

কোনো জবাব দিলোনা ডুবুরীদ্বয়।

মিসেস এলিনা সঙ্গীদের দিকে ইংগিত করলো–ওদের মুখের আবরণ খুলে ফেল।

*

বনহুর তার শক্তিশালী ওয়্যারলেস সংযুক্ত টেলিভিশনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে দেখছিলো কিভাবে ডুবুরীবেশী রহমান আর কায়েসকে কুচক্রীদল জুবরা নদের তলদেশে জাল ঘিরে আটকিয়ে ফেললো।

রহমান তার বুকে বাঁধা যন্ত্রের মাধ্যমে ছবি পাঠিয়ে যাচ্ছিলো। যখন তাকে মিসেস এলিনার সম্মুখে হাজির করা হলো তখন বনহুর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রহমান এবং কায়েসকে।

মিসেস এলিনার কথাগুলোও বনহুর স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। মিসেস এলিনা ইশারায় যখন ডুবরীদ্বয়ের পোশাক খুলে নেবার জন্য নির্দেশ দিলো তখন বনহুর বুঝতে পারলো এবার সব ফাস হয়ে যাবে।

সত্যিই তাই ঘটলো! কিছুক্ষণের মধ্যেই তার টেলিভিশনের পর্দা অন্ধকার হয়ে গেলো।

বনহুর এবার সুইচ অফ করে দিয়ে ফিরে দাঁড়ালো।

 নূরী বললো–আমি যে অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম তা কি সত্যি? সত্যিই রহমান আর কায়েস…

হ নূরী, এরা জুবরা নদীর তলদেশে কোনো কুচক্রীদলের কবলে বন্দী হলো। কথাটা বলে শয্যায় দেহটা এলিয়ে দিলো বনহুর।

নুরী পাশের টেবিল থেকে সিগারেট কেসটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট বের করে বনহুরের ঠোঁটের ফাঁকে খুঁজে দিলো, তারপর ম্যাচ জ্বেলে ধরিয়ে দিলো সিগারেটটা।

বনহুর একমুখ ধোয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, তার ললাটে ফুটে উঠেছে গভীর চিন্তারেখা। পায়চারী করতে লাগলো সে।

নূরী জানে, বনহুর যখন গভীরভাবে কিছু চিন্তা করে তখন সে অবিরত পায়চারী করে চলে কিংবা। বিছানায় চীৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবে। নূরী তখন সহসা কোনো কথা বলতে সাহসী হয় না।

বনহুর কিছুক্ষণ আপন মনে পায়চারী করার পর শয্যায় বসে পড়লো।

 নূরী তখন এসে দাঁড়ালো বনহুরের পাশে।

এতক্ষণ সে ওদিক থেকে লক্ষ্য করছিলো বনহুরকে। এবার সে বনহুরের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে হুর, আমাকে বলোনা, যদি তোমাকে সাহায্য করতে পারি?

বনহুর বললো–নূরী, যে চক্রান্তকারী শয়তান দলের সন্ধান আমি পেয়েছি, তারা এ দেশের নয়…

তবে তারা কারা?

 বিদেশী বিদেশী চক্রীদল…….

বিদেশী চক্রী?

হাঁ, নূরী। শয়তানরা চায় কান্দাইয়ের আশেপাশে যত শহর–নগর–বন্দর–গ্রাম আছে তা ধ্বংস করতে।

এতে তাদের লাভ?

 লাভ…….লাভ আছে বৈকি। বিদেশী বন্ধুরাষ্ট্র বলে আমরা এতদিন যাদের পূজা করে এসেছি, তারা বন্ধুবেশে আমাদের জনগণের সর্বনাশ করার জন্য গোপন ষড়যন্ত্র চালিয়ে চলছিলো এবং এখনও চলেছে।

আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।

নূরী, সাধারণ মানুষ যারা তারা এতকিছু বুঝতে পারে না বা বুঝতে চায় না। তুমিও তো একজন সাধারণ মানুষ।

না, আমি সাধারণ মানুষ নই হুর! তুমি যা বলবে আমি ঠিক বুঝতে পারবো। বন্ধুবেশী বিদেশী শক্তি আমাদের দেশকে দাবিয়ে রাখতে চায়, এই তো?

বনহুর হঠাৎ হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে, তারপর নূরীকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বললো–ঠিক বুঝেছে নূরী। বন্ধুবেশী বিদেশী শক্তি আমাদের দেশকে শুধু দাবিয়ে রাখতে চায় না, চায় আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাক।

এতে তাদের লাভ? নূরী প্রশ্ন করলো।

বনহুর ওকে বাহুমুক্ত করে দিয়ে বললো–লাভ প্রতিহিংসায় সফলকাম হওয়া। একটু থেমে পুনরায় বললো বনহুর–সূরী, এরা আজ নতুন নয়, বহুকাল ধরে আমাদের দেশ ও দেশের জনগণের অমঙ্গল কামনা করে আসছে। বন্ধুবেশে নানাভাবে সাহায্যের ছলনায় ওরা আমাদের দেশের বৃহৎ শক্তি নষ্ট করতে বদ্ধপরিকর।

হাঁ, তুমি একদিন বলেছিলে হুর, আমাদের দেশের অবোধ জনগণকে ফুসলিয়ে তাদের দ্বারা দেশের সর্বনাশ সাধনে তৎপর হয়ে উঠেছে বিদেশী বন্ধুগণ। যেমন বড় বড় কলকারখানা ধ্বংস করে দেশকে পঙ্গু করা হচ্ছে, যেমন বড় বড় গুদামে আগুন ধরিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ বিনষ্ট করা হচ্ছে, যেমন রেললাইন বা যানবাহন বিনষ্ট করে দেশকে সম্পদহীন করে ফেলা হচ্ছে……

কিন্তু এসব করছে কারা–আমাদেরই দেশের জনগণ। কারণ তারা এত নির্বোধ যে, নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুঠারঘাত করছে। বিদেশীচক্রীদল প্রচুর টাকা ঢেলে এইসব নির্বোধকে দিয়ে কার্যসিদ্ধি করে চলেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য আমাদের দেশ ও দেশের জনগণকে পঙ্গু করে দেওয়া। নূরী, শুধু কলকারখানা আর মূল্যবান সম্পদ বিনষ্ট করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা জুবরা বাধ ধ্বংস করে জুবার তীরে বসবাসকারী শত শত গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে……ভাসিয়ে দিয়েছে হাজার গৃহপালিত জীবজন্তুকে। নূরী, তুমি যদি সে দৃশ্য দেখতে জুরার তীরে–উঃ! কি মর্মান্তিক…….বনহুর উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।

নূরীও এসে দাঁড়ালো তার পাশে।

বনহুরের গোটা মুখ তার দৃষ্টিগোচর না হলেও সে বেশ বুঝতে পারলো ওর চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে।

নূরী বললো–যারা এতবড় সর্বনাশ করতে পারে তারা শুধু কান্দাইয়ের শত্রু নয়, তারা সমস্ত পৃথিবীর শত্রু–পৃথিবীর জনগণের শত্রু।

 হাঁ নূরী, এরা বিশ্ববাসীর পরম শত্ৰু ঐ যে ডুবুজাহাজখানা আমরা টেলিভিশনে দেখেছি, ওটা এই শত্রুপক্ষের ডুবু অট্টালিকা বা ডুবুজাহাজ। জুবরার তলদেশে আত্মগোপন করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসলীলার খেলা খেলে যাচ্ছে।

দাতে দাঁত পিষে কথা শেষ করলো বনহুর, তারপর ফিরে এলো শয্যার পাশে। পুনরায় একটা সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে একমুখ ধোয়া ছেড়ে কুকচে বললো–জানো এদের শক্তি কত? এরা অপর এক দেশকে ধ্বংস করার জন্য অদ্ভুত এক মেশিন ব্যবহার করে চলেছে। যে মেসিনের সুইচ টিপলে মিটারের মাপ অনুযায়ী যে কোনো সূদৃঢ় প্রাচীর বা স্তম্ভ কিংবা বাঁধ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

কেন, এ ধরনের মেশিন তো আমাদের দ্রুতী’ জাহাজেও আছে হুর?

 হাঁ আছে।

তা ছাড়া আছে সেই হাজার হাজার গুণ শক্তিশালী আলোকরশ্মি, যা দিয়ে তুমি জ্বালিয়ে দিতে পারো যে কোনো কঠিন জিনিস?

নূরী, আমি কোনোদিন এসব শক্তিশালীযন্ত্র সাধারণ ব্যাপারে ব্যবহার করতে চাই না বা চাইনি। যখন বিশেষ প্রয়োজন হয় তখন আমি……

জানি, তুমি অসাধারণ কাজ ছাড়া এসব যন্ত্র ব্যবহার করোনা। হুর, সত্যি আমি মাঝে মাঝে অবাক ন হয়ে পারি না মানুষ আজও তোমাকে দেবতা হিসেবে পূজা কেন করে না?

কে বললো ওকে মানুষ দেবতা হিসেবে পূজা করেনা? যারা মানুষ তারা ঠিকই ওকে পুজা করে। যারা নির্বোধ তারাই শুধু চায় বনহুরের অমঙ্গল…কথাগুলো বলতে বলতে বৃদ্ধা দাইমা এসে দাঁড়ালো বনহুর আর নূরীর মাঝামাঝি।

বনহুর একটু হেসে বলল–দাইমা, পূজা করুক কেউ আমাকে তা আমি চাই না। আমি চাই মানুষ আমাকে ঘৃণা করুক। ঘৃণা আর অবহেলার মধ্যেই আমি নিজকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই।

দাইমা গদগদ হয়ে বললো–তোকে যারা ঘৃণা করে তারা মানুষ না, তারা পশু। বনহুর, তুই তো কারো অমঙ্গল চিন্তা করিস না। সবাইকে তুই ভালবাসিস, সবার মঙ্গল চাস তুই।

সেটাই আমার জীবনের ধর্মব্রত, বুঝলে দাইমা?

হাঁ রে, আমি সব বুঝি, সব বুঝি। বনহুর, তুই যেদিন সর্দার হলি সেদিন থেকে আমার কি যে আনন্দ রে! আমাদের সর্দার কালু খা মরে গেছে, দুঃখ পেয়েছিলাম সেদিন খুব কিন্তু তোকে পেয়ে আমার সব দুঃখ, সব ব্যথা ঘুচে গিয়েছে। বনহুর ওরে বাপ আমার, তুই সারাটা দিন কাজ নিয়ে মেতে থাকিস কিন্তু নাসরিন মা যে ওর ফুল্লরার জন্য কেঁদে কেঁদে মরে গেলো।

দাইমার কথায় বনহুরের চোখ দুটো ছলছল হয়ে এলো।

 নূরীও গম্ভীর হয়ে পড়লো মুহূর্তে।

 ফুল্লরার অন্তর্ধানে বনহুরের আস্তানায় অশান্তি বিরাজ করছিলো। বহু সন্ধান করেও যখন ফুল্লরাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলো না, তখন বনহুর হতাশ না হলেও আস্তানার সবাই হতাশ হয়ে পড়েছিলো। এমন কি রহমানও চষে ফিরেছে সারাটা দেশ, বনজঙ্গল পাহাড়–পর্বত সব জায়গায় তবুও ফুল্লরাকে খুঁজে পায়নি।

আস্তানার সবার মনেই ফুল্লরাকে হারানোর ব্যথা কিন্তু নিরুপায় সবাই, কেউ কাউকে সান্তনা দিতে পারে না, আর কিই বা সান্তনা দেবে কে কাকে–ফুল্লরাকে নিয়ে মালোয়া কোথায় উধাও হয়েছে কেউ তার সন্ধান জানে না।

এ ব্যথা বনহুরকেও কম ব্যথিত করেনি কিন্তু বনহুর নিজকে সংযত করে কাজ করে চলেছে। তবে এটা সুনিশ্চয়, কাজের মাধ্যমেই বনহুর ফুল্লরার সন্ধান করে ফিরছে। মালোয়াকে জীবন্ত পাকড়াও করে আনার জন্য নির্দেশ আছে যদি তাকে খুঁজে পাওয়া যায়।

মালোয়র চামড়া খুলে লবণ মাখিয়ে তাকে শাস্তি দেবে, ফুল্লরাকে চুরি করার অপরাধ শুধু মৃত্যুদন্ড নয়, তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু।

দাইমার কথায় বনহুর ব্যথা পেলো, চট করে কোনো জবাব দিতে পারলো না। নাসরিনের চোখের পানি তাকে কম বিচলিত করেনি, কিন্তু সে এর কোনো হদিস খুঁজে পেচ্ছে না। মাঝে মাঝে বনহুর হতাশ হয়ে পড়তো, তার চোখকে মালোয়া ফাঁকি দিয়েছে। বনহুর ভাবে ফুল্লরাকে হারানোর অপরাধটা যেন তারই। কারণ নীলমণি হারখানা যদি সে ফুল্লরার গলায় পরিয়ে না দিতো তাহলে মালো ওকে কিছুতেই চুরি করতো না। ঐ নীলমণি হারখানাই অপেয়া, যার জন্য বনহুরের আস্তানায় আজ বিরাজ করছে একটা গভীর শোক আর বেদনার ছায়া। শুধু নাসরিন কেন, ফুল্লরার জন্য রহমানের মনটাও সর্বক্ষণ কেমন বিষণ্ণ থাকে, যদিও সে মুখ তুলে নিজের মনের দুর্বলতা প্রকাশ করে না। বনহুর সব বোঝে, রহমান কন্যা হারানোর ব্যথা বুকে চেপে ঠিকমত তার কাজ করে চলেছে……

দাইমা বলে উঠলো–কি ভাবছিস সর্দার?

 দাইমার কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় বনহুর বলে উঠলো– কি বললে দাইমা?

বলছি ফুল্লরা কি সত্যি হারিয়ে যাবে রে?

দাইমা, আমি সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যতদিন ফুরাকে খুঁজে না পাবো ততদিন আমি নিশ্চিন্ত নই। দাইমা, মনে রেখো ফুল্লরাকে একদিন খুঁজে বের করবোই।

দাইমা অশ্রুসিক্ত বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো–সর্দার ফুল্লরা বেঁচে আছে তো?

হাঁ, সে বেঁচে আছে। মালোয়ার এমন সাহস নেই যে, তাকে হত্যা করে। যেখানেই থাক সে বেঁচে আছে। দাইমা, ফুল্লরা আজ কতদিন হলো হারিয়ে গেছে বলতে পারো?

কেন, তুই ভুলে গেছিস? ফুল্লরা কবে হারিয়ে গেছে এরই মধ্যে ভুলে গেছিস বনহুর? ও হারিয়ে যাবার পর দুটো বর্ষ কেটে গেছে।

নূরী বললো–হাঁ, দিন কোথা দিয়ে চলে যায় টের পাওয়া যায় না। ফুল্লরা হারানোর পর দীর্ঘ সময় কেটে গেছে কিন্তু তুমি তা অনুভব করতে পারোনি, কারণ সব সময় তুমি ব্যস্ত আছে কাজ নিয়ে।

নুরী, তোমরা কি মনে করো আমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি বলে অন্য সবকিছু ভুলে যাই।

আমি জানি তুই ভুলিস না কিছু, সব জানি রে বনহুর। তবু বলছি নাসরিনের চোখের পানি যে আর সহ্য হয় না।

দাইমা, এ বিপদ ছাড়াও আর একটা নতুন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি আমরা। দোয়া করো দাইম…কথাটা বলতে গিয়ে গলা ধরে আসে নূরীর।

নূরী কি বলতে চায় বুঝতে পারলো বনহুর, তাই সে বললো–নাসরিন কন্যাকেই শুধু হারায়নি, রহমান আজ বিদেশী কুচক্রীদলের কবলে বন্দী। দাইমা, রহমানকে মুক্ত করে আনবো, তার সঙ্গে কুচক্রীদলকেও যেন ধ্বংস করতে পারি এই দোয়া করো, ফিরে আসার পর আমার কাজ হবে ফুল্লরাকে খুঁজে বের করা। যতদিন ফুরাকে খুঁজে বের করতে না পারবো ততদিন আমি কোনো কাজে হাত দেবো

রহমান বন্দী হয়েছে! কেন সে বন্দী হয়েছে। কোথায় সে বন্দী হয়েছে? একসঙ্গে দাইমা প্রশ্ন করে চললো ব্যস্তভাবে।

বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো, তারপর স্থিরকণ্ঠে বললো–দাইমা, তুমি কিছু ভেবো না, শুধু দোয়া করো।

*

মিস লুনা, আপনাকে এবার কাজে নামতে হবে। আপনি তার জন্য পারিশ্রমিক পাবেন মানে উচিত মূল্যই পাবেন আপনি। কথাগুলো বলে সোফায় বসে পড়লো বনহুর।

মিস লুনা সামনের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছিলো, চোখে–মুখে তার উদ্বিগ্নতার ছাপ ফুটে উঠেছে। বারবার সে তাকাচ্ছিলো দরজার দিকে। বনহুরকে সোফায় বসতে দেখে বললো মিস লুনা–বনহুর, তুমি তো জানো এ জায়গা তোমার জন্য মোটেই নিরাপদ নয়! এক্ষুণি মিঃ লোদী আসতে পারেন এবং এলে তোমার অবস্থা সম্বন্ধে ভাল করে বুঝিয়ে বলতে হবে না…….

জানি এবং সেজন্য আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি। মিস লুনা, যে কাজে আমরা নামছি সে ব্যাপারে মিঃ লোদী ও তার লোকজনের প্রয়োজন হতে পারে। পুলিশের সহায়তা দরকার হলে তাদেরকে এড়িয়ে চলা যাবে না।

তুমি কি তাহলে মিঃ লোদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাও?

 হাঁ, আমি জানি তিনি দলবল নিয়ে আজ সন্ধ্যায় এখানে আসবেন, আর সে কারণেই আমি এসেছি।

 কিন্তু…..

কোনো কিছু নেই মিস লুনা, আপনি ইচ্ছা করলেই আমাকে উৎরে নিতে পারেন।

 মানে…

মানে মোটেই কঠিন নয়। পুলিশমহল কেউ দস্যু বনহুরকে চেনেন না, মানে যারা এখন আপনার দরবারে হাজির হবেন তারা কেউ দেখেননি আমাকে, কাজেই আপনি যে কোনোভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেই চলবে মিস লুনা।

এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো।

 বয় এসে জানালো–মেম সাহেব, তেনারা এসেছেন।

 মিস লুনা তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।

 বনহুর বললো…আসতে বলুন মিস লুনা।

বয়কে লক্ষ্য করে বললো মিস লুনা–যাও, নিয়ে এসো উপরে।

 চলে গেলো বয়।

 কিছুক্ষণের মধ্যে সিঁড়িতে ভারী বুটের শব্দ শোনা গেলো।

 মিস লুনার মুখমন্ডল স্বাভাবিক ছিলো না, সে বারবার তাকাচ্ছিলো বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুরের মুখোভাব কিন্তু কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না। সে যেমন বসেছিলো তেমনি বসে রইলো, মুখে মৃদু হাসির রেখা। চাপকণ্ঠে বললো সে বলবেন নতুন প্রযোজক হবার ইচ্ছা নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি। আমার নাম মিঃ ম্যারোলিন, বুঝলেন? মনে থাকবে তো?

মিস লুনার মুখমন্ডল এবার প্রসন্ন হয়ে এলো, উপস্থিত বিপদ থেকে বাঁচবার একটা উপায় যেন সে খুঁজে পেলো এতক্ষণে, সে ঘাড় নেড়ে সায় দিলো।

কক্ষে প্রবেশ করলেন মিঃ লোদী এবং আরও দু’জন পুলিশ অফিসার।

 মিস লুনা এগিয়ে গিয়ে তাদের অভিবাদন জানালো, তারপর বনহুরের দিকে তাকিয়ে বললো–মিঃ লোদী, আসুন এনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।

মিঃ লোদী এবং অন্য দু’জন অফিসার তাকালেন বনহুরের দিকে।

 বনহুর হাস্যোজ্জ্বল মুখে উঠে দাঁড়িয়েছে।

বললো মিস লুনা–ইনি হলেন মিঃ ম্যারোলিন। একটা নতুন ছবি করছেন, তার নায়িকা হিসেবে আমাকে উনি চুক্তিবদ্ধ করতে চান এবং সে কারণেই এসেছেন।

বনহুর হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলো পুলিশ প্রধান ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে।

মিস লুনা পুলিশপ্রধান ও তার সঙ্গীদের পরিচয় করিয়ে দিলো বনহুরের সঙ্গে। অবশ্য বনহুর এদের পরিচয় জানতো ভালভাবে। মিঃ লোদী বনহুরকে গ্রেফতার করার জন্য কিছুদিন পূর্বে ফিরু পর্বতের পাদমূল ঘেরাও করেছিলেন এবং মিস লুনাকে বেছে নিয়েছিলেন তাদের সাহায্য করার জন্য। সত্যি, লুনার অভিনয় ক্ষমতার কাছে পরাজয় বরণ করেছিলো বনহুর সেদিন।

আজও মিস রুনা নিখুঁত অভিনয় ভঙ্গিমায় পরিচয়পর্ব শেষ করলো।

আসন গ্রহণ করলেন পুলিশ অফিসারগণ।

মিঃ লোদী যদিও ফিরু পর্বতের পাদমূলে বনহুরকে কিছু সময়ের জন্য দেখেছিলেন, এমন কি সামনা সামনিই দেখেছিলেন তাকে, তবু তিনি চিনতে পারেন না আজ তাকে, কারণ সেদিন বনহুরের মুখে ছিলো খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ। চুল ছিলো রুক্ষ উস্কখুস্ক! আজ পরিচ্ছন্ন অবস্থায় তাকে মোটেই আন্দাজ করতে সক্ষম হলেন না পুলিশ প্রধান।

মিস লুনা পরিবেশটা স্বাভাবিক করে নেবার জন্য নিজেও আসন গ্রহণ করলো এবং হাস্যদীপ্ত মুখে বললো–নতুন ছবিতে চুক্তিবদ্ধ হবার মুহূর্তে আপনারা এসেছেন, এজন্য আমি নিজকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে করছি।

মিঃ লোদী হেসে বললেন–মিঃ ম্যারোলিনের সঙ্গে পূর্বে কোনোদিন পরিচিত হবার সুযোগ হয়নি, আজ পরিচিত হয়ে আমরাও খুশি হলাম। আপনার ছবির নামটা বুঝি এখনও…….

হাঁ, এখনও ঠিক করা হয়নি, তবে আমার ইচ্ছা নায়িকার নাম অনুসারে আমার ছবির নাম রাখবো। শুধু তাই নয়, আমার নামের সঙ্গেও যোগ থাকবে যেমন ম্যারোলুনা কথাটা বলে হাসে বনহুর।

মিঃ লোদী এবং তার সহকারীরা আনন্দসূচক শব্দ করলেন।

 মিঃ লোদী বলেই বসলেন–ম্যারোলুনা বাঃ! ভারী সুন্দর নাম। ছবির মূল বক্তব্য কেমন হবে?

বনহুর সিগারেট কেসটা এগিয়ে ধরলো পুলিশপ্রধানের সামনে।

পুলিশপ্রধান মিঃ লোদী একটা সিগারেট তুলে নিলেন এবং হেসে ধন্যবাদ জানালেন।

বনহুর ততক্ষণে অন্য পুলিশ অফিসার দু’জনের সম্মুখে সিগারেট কেস এগিয়ে ধরেছে।

সবাই সিগারেট গ্রহণ করার পর বনহুর নিজ হাতে তাদের সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো। তারপর সোফায় হেলান দিয়ে বসে কয়েকমুখ ধোয়া ছেড়ে বললো–আমার ছবির মূল বক্তব্য হবে, যারা জনসমুদ্রে আত্নগোপন করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করে চলেছে, সেইসব কুচক্রীর মুখের মুখোস খুলে ফেলা…

চমৎকার আপনার রুচিবোধ মিঃ ম্যারোলিন! কথাটা বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন মিঃ লোদী মিঃ ম্যারোলিনের মুখে।

ছবির কাহিনী নিয়ে আলাপ আলোচনা চললো। আজকাল কোনো বলিষ্ঠ কাহিনী নিয়ে ছবি করা হচ্ছে না, শুধু পয়সার প্রয়োজনেই যেন ছবি করা হয়। মানুষের জীবনে পয়সার প্রয়োজনটাই একমাত্র লক্ষ্য নয়, এটা যেন কেউ বুঝতেই চায় না। কথাগুলো বললেন মিঃ লোদী।

মিঃ হ্যারিসন বললেন–চলচ্চিত্র আমাদের জাতীয় জীবনে এক সম্পদ। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেশ ও দেশের জনগণের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব হয়।

মিঃ হ্যারিসন ইমরানের পুলিশ সুপার। তিনি এসেছেন দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে মিঃ লোদীকে সহায়তা করবার জন্য। যদিও তার বয়স বেশি নয়, তবু কর্তব্যপরায়ণতায় তার জুড়ি মেলা ভার।

মিঃ লোদী এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার মিঃ হ্যারিসনের কথায় খুশি হলেন, তারা সমর্থন করলেন তাকে। এ ধরণের কাহিনী নিয়ে যদি সবাই ছবি বানাতো তাহলে চলচ্চিত্রের মান অনেক বেড়ে যেতো এবং দেশ অনেক উন্নতি লাভ করতো!

মিঃ লোদী একমনে সিগারেট পান করে চলেছিলেন, তিনি এবার বলে উঠলেন–অনেক সময় দেখা গেছে কাহিনী বলিষ্ঠ হলেও পরিচালকের ত্রুটির জন্য এবং প্রযোজকের পয়সার লালসায় কাহিনীর মূল বক্তব্য হারিয়ে গেছে অশ্লীলতার অন্ধকারে! সে ছবি শুধু পয়সা দেয় কিন্তু দেশ ও দেশের জনগণকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে। মানুষের মনে ঘৃণ্য জঘন্য রুচির সৃষ্টি করে এসব ছবি।

মিঃ লোদীর কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনছিলো বনহুর, সে হেসে বললো–এ কথা অতি সত্য কিন্তু সে যুগ পেরিয়ে গেছে, এখন দর্শক রুচিহীন ছবি গ্রহণ করতে আর রাজি নয়। তারা বুঝতে শিখেছে, তারা জানে কোন ছবি কেমন? কোন ছবি দেশ ও দেশের জনগণকে সমৃদ্ধশালী করবে বা করতে পারে।

মিস রুনা নিশ্চুপ শুনে যাচ্ছিলো, এবার সে বললো–আপনারা কথা বলুন, আমি আপনাদের জন্য কিছু…

না, কিছু নয়–বেশি। আজ এমন কিছু খাবো যা স্মরণ থাকবে। কথাটা বললেন মিঃ লোদী।

 মিস লুনা উঠে দাঁড়ালো–ঠিক তাই হবে মিঃ লোদী। আজ আমি এমন জিনিস খাওয়াবো যা কোনোদিন খান নি।

সত্যি! এমন কোনো জিনিস খাওয়াবেন যা কোনোদিন খাইনি? কথাটা বললেন মিঃ হ্যারিসন।

 মিস লুনা বললো–হা, আপনারা বসুন, আমি আসছি।

 লুনা চলে গেলো।

যখন সে ফিরে এলো তখন তার হাতে দেখা গেলো একটা শিশি এবং পেছনে বয়ের হাতে ট্রেতে। চারটা গেলাস।

গেলাসগুলো গাঢ় সবুজ রঙের।

 আর শিশিটা লাল রঙের।

সবাই অবাক হয়ে তাকালেন মিস লুনার হাতের শিশির দিকে।

ঐ শিশির মধ্যে কি আছে কে জানে।

 মিস লুনা শিশি থেকে খানিকটা লাল পদার্থ ঢেলে প্রথমে মিঃ লোদীর সামনে বাড়িয়ে ধরলো মিস লুনা।

মিঃ লোদী অবাক কণ্ঠে বললেন–এটা কি?

পান করুন, বুঝতে পারবেন। বললো মিস লুনা।

মিঃ লোদী পান করলেন এক নিঃশ্বাসে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন–আঃ কি সুন্দর সুমিষ্ট এবং সুগন্ধ…সত্যি, এমন সুমিষ্ট বস্তু আমি কোনোদিন পান করিনি। মিঃ হ্যারিসনের সামনে ততক্ষণে আরেকটা গেলাসে খানিকটা ঢেলে তুলে ধরলো মিস লুনা।

মিঃ হ্যারিসন পান করলেন, তিনিও উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলেন–চমৎকার, এটা কি খাওয়ালেন মিস লুনা?

তারপর সবাই পান করলেন এক এক করে।

বনহুরও পান করলো।

 মিস লুনা হেসে বললো–বলুন তো, আমি এই মুহূর্তে আপনাদেরকে যা পান করাতাম তা কি জিনিস?

চাওয়া চাওয়ি করলেন অফিসারগণ। তারা কেউ বুঝতে পারেননি কি পান করলেন।

বনহুর বললো–অমৃত!

 পুলিশ অফিসারগণ একবাক্যে বলে উঠলেন–হাঁ, ঠিকই বলেছেন, অমৃতই বটে!

মিস রুনা বললো–এ সুধা পাওয়া যায় ঝামদেশের কোনো এক গ্রামে। সে এক অদ্ভুত কাহিনী……

 মিস রুনার কথাগুলো সবার কাছেই অমৃতের মত লাগছে। এই মুহূর্তে যে সুধা তারা পান করেছেন তা সত্যি অপূর্ব। এমন সুধা তারা কোনোদিন পান করেননি। শুধু লুনার কথাই নয়, লুনাকেও অপুর্ব লাগছে তাদের চোখে।

মিঃ লোদী বললেন মিস লুনা, সে অদ্ভুত কাহিনী আমরা শুনতে চাই।

খিল খিল করে হেসে উঠলো মিস লুনা, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–সেই কাহিনী শোনার জন্যই তো আজ আমি আপনাদের ডেকেছি মিঃ লোদী। আপনারা ভালভাবে বসুন, আমি বলছি।

সবাই তাকালেন মিস লুনার মুখের দিকে।

মিস লুনা শিশি এবং গেলাসগুলো টেবিলে রেখে পুনরায় আসন গ্রহণ করলো, তাকালো সে পাশে উপবিষ্ট বনহুরের দিকে!

বনহুর তখন সিগারেট টানছিলো।

মিস লুনা বললো–আমার জন্মস্থান ঝামদেশের শ্যাম নগরে। যখন আমি ছোট তখন আমি আমার বাবার ঘরে ঘুমাতাম, কারণ ছোটবেলায় আমার মা মারা যান, সেই থেকে বাবাই আমাকে মা ও বাপের স্নেহ দিয়ে লালন পালন করছিলেন, তাই আমি সর্বক্ষেণ বাবাকে আঁকড়ে থাকতাম। একদিন গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়, আমি চোখ মেলে দেখতে পাই আব্বা আমার পাশে নেই। আমি ভীত আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম, চোখ মেলে তাকিয়ে দেখবো সে সাহসও আমার লোপ পেয়ে গেলো। বাবা কোথায় গেলেন ভেবে অস্থির হলাম। এমন সময় দরজায় শব্দ হলো। আমি ভয়ে ভয়ে চোখ মেলে তাকালাম। এক নিমিষে ভয়ভীতি দূর হয়ে গেলো। দেখলাম বাবা ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করলেন। আরও দেখলাম বাবার হাতে একটা শিশি……।

সবাই তন্ময় হয়ে শুনছেন, তাদের নিঃশ্বাস পড়ার শব্দও শোনা যাচ্ছিলো। মিস লুনা বলেই চলেছে– শিশিটা কিসের বা তাতে কি আছে কিছু বুঝতে পারলাম না। চুপচাপ ঘুমের ভান করে দেখতে লাগলাম। বাবা শিশি হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন আমার বিছানার পাশে। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর শিশিটা লুকিয়ে রাখলেন খাটের ওপাশে একটা গর্তের মধ্যে।

আমি চুপ করেই রইলাম ঘুমের ভান করে। বাবা আমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমিও একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন বাবা কোনো কাজে বাইরে গেলেন। শুধু আমি একা বাসায় রইলাম। সুযোগ বুঝে খাটের আড়াল থেকে শিশিটা বের করে আনলাম, চোখের সামনে তুলে ধরে দেখলাম লালে রাল শিশিটা। কিছু বুঝতে পারছি না, লাল পদার্থটা কি জিনিস। আমি এক নিঃশ্বাসে খানিকটা পান। করলাম। আঃ কি মধুময় স্বাদ সেই লাল পদার্থ, জীবন জুড়িয়ে গেলো একি, আপনারা অমন করে ঝিমুচ্ছেন কেন? মিঃ লোদী, কি হলো আপনাদের? হাঃ হাঃ হাঃ, অমৃতই বটে। খিল খিল করে হাসতে লাগলো মিস লুনা।

এদিকে মিঃ লোদী এবং তার সঙ্গী তিনজন সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

তাকালো মিস লুনা বনহুরের দিকে সেও তার সোফায় সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছে।

 মিস লুনা হেসেই চলেছে আপন মনে।

হাসি থামিয়ে আপন মনে বলে উঠলো মিস লুনা–তোমরা কেউ আমার আসল পরিচয় জানো না, জানলে আমার ছায়াও মাড়াতে না তোমরা। বনহুর, তুমিও আমাকে চিনতে পারোনিহাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ… করতালি দিলো মিস লুনা।

সঙ্গে সঙ্গে এক তরুণী এসে দাঁড়ালো তার সম্মুখে।

মিস লুনা ইংগিত করলো কিছু।

তরুণী দেয়ালের পাশে একটা ছবির সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।

মিস লুনা আংগুল দিয়ে কিছু দেখালো।

 তরুণী ছবির উপর হাত রাখলো।

অমনি ছবির পাশে বেরিয়ে এলো একটা সুড়ঙ্গমুখ।

 মিস লুনা পুনরায় করতালি দিলো।

এবার সেই সুড়ঙ্গ থেকে দু’জন জোয়ান লোক এলো এবং মিস লুনাকে নতমস্তকে কুর্ণিশ জানালো।

মিস লুনা বললো, নিয়ে যাও এই পুলিশপ্রধান ও তার সঙ্গী দু’জনকে। আংগুল দিয়ে সে দেখিয়ে দিলো মিঃ লোদী ও তার সহকারীদেরকে।

লোক দু’জন মিঃ লোদীকে তুলে নিলো, তারপর সুড়ঙ্গে প্রবেশ করলো। মিনিট কয়েক পর ফিরে এলো তারা এবং দ্বিতীয় জনকে নিয়ে এ সুড়ঙ্গে প্রবেশ করলো। পুনরায় ফিরে এলো এবং অপরজনকেও নিয়ে গেলো ঐভাবে।

এবার বনহুরের দিকে তাকালো মিস লুনা।

তরুণী তখনও সেই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। ঐ স্থান থেকে সরে দাঁড়াতেই সুড়ঙ্গমুখ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ। হয়ে যাবে। সে কারণেই তরুণী নির্বাক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ছবি থেকে হাত সরাবার নির্দেশ পাওয়ামাত্র সে হাত সরিয়ে নেবে।

লোক দু’জন পুলিশ অফিসারদের নিয়ে উধাও হবার পর তরুণী মিস লুনার ইংগিতে ছবি থেকে হাত সরিয়ে নিলো। অমনি সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ হয়ে গেলো।

মিস লুনা তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললো–পুলিশপ্রধান ও তার সঙ্গীদের নেশা ছুটতে লাগবে এক .. সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহ কেউ আর আমাকে জ্বালাতে আসবে না।

তরুণী একটু নড়ে দাঁড়ালো, ঠোঁট দু’খানা কেঁপে উঠলো তার, কিছু বলবে বলে প্রস্তুত হলো।

মিস লুনা ওর মনোভাব আন্দাজ করে নিয়েছে তরুণীকে লক্ষ্য করে বললো সে–এর পরিচয় তুমি এখনও জানো না মিস রীমুনিলা।

কি ওর পরিচয় মিস লুনা? বললো তরুণী।

মিস লুনা ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকালো বনহুরের সংজ্ঞাহীন মুখের দিকে, তারপর বললো–এই ব্যক্তি হলো বিশ্ববিখ্যাত দস্যু বনহুর।

মিস লুনার কথায় চমকে উঠলো মিস রীমুনিলা, বললো দস্যু বনহুর! মিস রূনা, পুলিশমহল দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য পুরস্কার দেবেন। এমন সুযোগ আপনি…..

মিস রীমুনিলা, তুমি বুঝবে না, পরে সব জানতে পারবে। দস্যু বনহুরকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে পুরস্কার পাবো লক্ষ টাকা আর আমি তাকে আমাদের মালিকের হাতে তুলে দিলে পাবো কোটি কোটি। টাকা।

মিস লুনা।

হা মিস রীমুনিলা, তুমি জানো না এর মূল্য কত?

 মিস রুনা হাততালি দিলো, সংগে সংগে চারজন বলিষ্ঠ লোক এসে ঢুকলো কক্ষে। মিস লুনা। বললো–যাও, ওকে কফিনে ভরে নিয়ে যাও।

সংজ্ঞাহীন বনহুরকে কফিনের মধ্যে তুলে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হলো।

 লোক চারজন কফিন কাঁধে তুলে নিলো।

মিস লুনা ইংগিত করলো।

মিস রীমুনিলা পুনরায় সেই ছবির গায়ে বামপাশে হাত রেখে চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলো অপর একটা সুড়ঙ্গমুখ।

কফিন নিয়ে লোক চারজন প্রবেশ করলো সেই সুড়ঙ্গে।

মিস লুনা নিজেও ওদের পিছনে পিছনে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করলো। সুড়ঙ্গটা সোজা এগিয়ে গেছে ডানদিকে তারপর একটা সমতল জায়গা। কফিন বাহক চারজন দাঁড়ালো সেখানে।

একটা আলো জ্বলছে আর নিভছে।

 মিস লুনা আর কফিন বাহক চারজন আলোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

 হঠাৎ আলোটা স্থির হয়ে জুলতে লাগলো।

ঐ মুহূর্তে সামনের দেয়ালে একটা ফাঁক নজরে পড়লো। মিস লুনা কফিন বাহকগণকে সেই ফাঁক দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে বললো।

কফিন বাহকগণ মিস লুনার আদেশ পালন করলো।

 মিস লুনাও রয়েছে তাদের সঙ্গে।

ওপাশে পৌঁছতেই একটা লিফট নেমে এলো তাদের সম্মুখে।

মিস লুনাসহ কফিন বাহকগণ লিফটে চেপে দাঁড়ালো।

 লিফটখানা চলতে শুরু করলো। লিফটের মাথায় আলো বল জ্বলছে আর নিভছে।

মিস রুনা বললো–তোমার কফিন পৌঁছে দিয়েই ফিরে আসবে।

বাহকগণ সম্মতিসূচক শব্দ করলো।

প্রায় বিশ মিনিটকাল লিফট চলার পর হঠাৎ থেমে পড়লো।

মিস লুনা কফিন বাহকগণ সহ নেমে দাঁড়ালো লিফট থেকে। সঙ্গে সঙ্গে লিফট চললো আপন ইচ্ছায়। যেন কারো অদৃশ্য হাতের ইংগিতে লিফটখানা চালিত হচ্ছে।

মিস লুনা আর কফিন বাহকগণের সম্মুখে একটা ক্ষুদ্র চক্রাকার মেশিন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। চক্রাকার মেশিনটার উপরে লাল ও নীল রঙের আলো জ্বলছে আর নিভছে।

মিস লুনা চক্রাকার মেসিনের নিচে একটা সুইচে চাপ দিলো, অমনি লাল আলোটা নিভে গেলো, শুধু নীল আলোটা জ্বলছে আর নিভছে।

চক্রাকারের মেশিনটা একটু থেমে ঠিক বিপরীত দিতে ঘুরপাক খেতে লাগলো।

 ধীরে ধীরে সামনের দেয়ালখানা সরে গেলো একপাশে।

মিস রুনা কফিন বাহকগণসহ দেয়ালের ওপাশে চলে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে দেয়াল যেমন ছিলো, পুনরায় তেমনি হয়ে গেলো।

ওপাশে অসংখ্য আলোর বল জ্বলছে আর নিভছে, যেন তারার মালা।

 মিস লুনা কফিন বাহকগণসহ সেই অদ্ভুত সুড়ঙ্গপথ অতিক্রম করে এগিয়ে চললো।

মিস লুনা এবং কফিন বাহকগণ প্রায় বিশ মিনিট চলার পর এমন এক স্থানে এসে পৌঁছলো যেখানে শুধু কাঁচের আবরণ। সামনে লক্ষ্য করলে দেখা যায় অগণিত জলজীব ওপাশে সাঁতার কাটছে।

মিস লুনা কফিন বাহকগণকে কফিন নিচে নামিয়ে রাখার নির্দেশ দিলো।

আদেশ পালন করলো কফিন বাহকগণ।

এবার মিস রুনা কফিনের মুখ খুলে ফেললো। দেখলো বনহুরকে যেভাবে রাখা হয়েছে সেইভাবেই শায়িত আছে।

কফিন বাহকগণ পুনরায় কফিন কাঁধে তুলে নিলো। অবশ্য মিস লুনার ইংগিত তারা কফিন তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

মিস লুনা ও কফিন বাহকগণ যেখানে দাঁড়িয়ে সে স্থান গভীর জলদেশের তলে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ সম্মুখস্থ কাঁচের আবরণের মধ্যে দিয়ে যে সব জলজীব এবং জলীয় উদ্ভিদ নজরে পড়ছে। সেগুলো সামুদ্রিক জীব বা উদ্ভিদ ছাড়া কিছু নয়।

মেঝের এক স্থানে পা রেখে চাপ দিলো মিস লুনা।

সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে নেমে এলো একটা অদ্ভুত ধরনের আসন। কতকটা ঝুলন্ত দোলনার মত। মিস লুনা এবং কফিন বাহকগণ কফিন সহ দোলনাটার উপর চেপে দাঁড়ালো।

অমনি দোলনা সাঁ সাঁ করে উপরে উঠে চললো।

 মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

 দোলনা সহ কফিন বাহকগণ এবং মিস লুনা সেই ভূগর্ভ হতে এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছলো, যা অতি বিস্ময়কর স্থান।

দোলনা থেকে নেমে দাঁড়ালো মিস লুনা।

কফিন বাহকগণও কফিন সহ নেমে পড়লো।

 সামনে দাঁড়িয়ে এক নারীমূর্তি! চোখে কালো চশমা, পরনে ফুলপ্যান্ট, কোমরের বেল্টে পিস্তল।

কফিন সহ মিস লুনা নারীমূর্তিটার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বিশেষ ভঙিমায় অভিবাদন জানিয়ে বললো–কাজ সমাধা করেছি মিসেস এলিনা। এবার আমার পুরস্কার?

মিসেস এলিনার ঠোঁটে ফুটে উঠলো বাঁকা হাসির রেখা। বললো সে–আমি জানতাম তুমি কাজ সমাধা করতে সক্ষম হবে মিস লুনা।

মিসেস এলিনার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো একজন পুরুষ। সে বলে উঠলো–মিস লুনা, দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে পুলিশমহলকে সহায়তা করতে গিয়ে বিফল হয়েছিলো–এবার সে জয়ী হয়েছে, কাজেই পুরস্কার তার প্রাপ্যই বটে!

হাঁ মরালু, তুমি ঠিক বলছো, মিস লুনাকে আমি তার প্রাপ্য পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করবো না। মরালু, খুলে ফেলো কফিনের আবরণ।

মরালু মিসেস এলিনার নির্দেশমত কফিনের মুখের ডালা খুলে ফেললো।

 মিসেস এলিনা এসে ঝুঁকে পড়লো কফিনটার উপরে। সহসাচোখ দুটোকে সরিয়ে নিতে পারলো না, কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টি মেলে দেখলো সে সংজ্ঞাহীন দস্যু বনহুরকে। তারপর মিসেস এলিনা কুঞ্চিতা করে তাকালো মিস লুনার দিকে। একটু হেসে বললো–মিস রুনা ফ্যাইং লেডী জীমস মেরী ছবির নায়িকা তুমি। হিরোই সেজে পসার বেশ জমিয়েছো দেখছি। শেষ পর্যন্ত দস্যু বনহুরকেও ফাঁদে আটকে ফেলেছে।

মিস লুনা বললো–মনিবের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি, এই যা।

 মিস লুনা, তুমি কি বলতে চাও পুরস্কারের লোভ তোমার নেই।

আছে এবং আছে বলেই তো এই কাজে নেমেছি মিসেস এলিনা, নাহলে,

 নাহলে কি করতে।

 লোভ না থাকলে আমি কেন, কেউ এমন জঘন্য কাজে……

 মিস লুনা, সাবধানে কথা বলল। বনহুরকে কৌশলে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছে বলেই তুমি নিজকে বাহাদুর মনে করোনা। জানো, আমি এই জাহাজে থেকেই দস্যু বনহুরের সহচর দু’জনকে বন্দী করেছি……

মিস লুনা চমকে উঠলো যেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মিস লুনা মিসেস এলিনার দিকে।

মিসেস এলিনার প্রধান সহচর মরালু বললো–বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি মিস লুনা।

 যাও মরালু, কফিন থেকে বনহুরের সংজ্ঞাহীন দেহ বের করে নাওগে। অত্যন্ত সাবধানে রাখবে। সংজ্ঞা ফিরে পেলে আমাকে জানাবে–হাঃ হাঃ হাঃ, দস্যু বনহুর চেয়েছিলো আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে। মিস লুনা, তুমি যাও, কাজ করোগে, পুরস্কার ঠিক সময়মত পাবে। হাঁ, পুলিশপ্রধান এবং তার সহকারীরা কোথায়?

মিস লুনা বললো–তাদের যেখানে রাখার কথা ছিলো আমি সেখানেই পাঠিয়েছি।

 সাবধানে রাখবে।

সাতদিন তারা ঘুমাবে

তারপর?

তারপর হাজির করবো মালিকের দরবারে।

 কোনো দরকার নেই।

তাহলে কি করবো?

 ফেরত পাঠিয়ে দাও….

আর আমি?

এখানের পর্ব শেষ, কাজেই তুমি…..

মিসেস এলিনা, কাজ এখনও শেষ হয়নি, কাজেই আমি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছি না।

 তাহলে খতম করে দাও, কেউ জানবে না তারা কোথায় গেছে……

আমি চিন্তা করে দেখবো কি করতে পারি। মিস লুনা তাকালো সম্মুখস্থ কফিনে শোয়ানো বনহুরের দিকে। হয়তো বা বিশ্বাসঘাতকতার জন্য নিজকে সে অপরাধী মনে করছে।

মিসেস এলিনার ইংগিতে মরালু ততক্ষণে কফিনের মুখ বন্ধ করে ফেলেছে।

 মরালু করতালি দিলো।

অমনি দু’জন লোক এসে দাঁড়ালো সেখানে।

এবার কফিন বয়ে নিয়ে চললো নতুন আগন্তুকদ্বয়। মরালুও তাদের অনুসরণ করলো।

 মিস লুনা ও কফিন বাহক চারজন মিসেস এলিনাকে কুর্ণিশ জানালো, তারপর ফিরে গেলো তারা।

*

মিসেস এলিনা এসে দাঁড়ালো তার আসনের পাশে। চোখে তার কালো চশমা, পরনে প্যান্ট এবং শার্ট। মাথায় ক্যাফ। অদ্ভুত এক নারী সে। মুখে তার প্রতিহিংসার হাসি। মিসেস এলিনা যেন এক শয়তানী। চোখ দিয়ে তার আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে, দাঁতে দাঁত পিষে বললো–মরালু কোথায়?

 সম্মুখে দন্ডায়মান ব্যক্তি বললো–মরালুকে কাল থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ডুবুজাহাজের সর্বত্র তোমরা সন্ধান করে দেখেছো?

 দেখেছি কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না, মরালু যেন হাওয়ায় মিশে গেছে।

 আশ্চর্য!

হাঁ, আশ্চর্য বটে।

কিন্তু কোথায় গেলো সে? তাহলে কি কোনো চক্রে গিয়ে যোগ দিয়েছে?

আমাদের সন্দেহ হচ্ছে মিসেস এলিনা।

 কি সন্দেহ হচ্ছে?

মরালু নিশ্চয়ই কোনো অভিসন্ধি নিয়ে সরে পড়েছে।

 মিসেস এলিনার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। কঠিন কণ্ঠে বললো–আমি ওকে খুঁজে বের করবোই….

সম্মুখে দন্ডায়মান ব্যক্তি মাথার ক্যাপটা আর একটু টেনে দিয়ে গালপাট্টাখানা ঠিক করে নিয়ে বললো–এখন আমার কাজ আপনাকে সহায়তা করা। চলুন আমি আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।

না, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে না হ্যারিসন। তুমি যাও দস্যু বনহুরের কফিন আমার সম্মুখে নিয়ে এসো। আর নিয়ে এসে সেই বন্দী দুজনকে। আমি জানি তারা দস্যু বনহুরের অনুচর। আমি তাদের দিয়ে যাচাই করতে চাই মিস লুনা যাকে আজ বনহুর হিসেবে বন্দী করে এনেছে সে সত্যিই বনহুর কিনা……আমি তার অনুচরদের সম্মুখে কফিনের মুখ খুলবো। দলপতিকে কফিনের মধ্যে দেখে নিশ্চয়ই তাদের মুখোভাবে পরিবর্তন আসবে। আমি তাদের মুখোভাব লক্ষ্য করেই বুঝতে পারবো কফিনে আটক ব্যক্তি সত্যিই দস্যু বনহুর কিনা।

মিসেস এলিনা কথা শেষ করতেই হ্যারিসন নত হয়ে কুর্ণিশ জানিয়ে বিদায় গ্রহণ করলো।

অল্পক্ষণ পরই চারজন কফিন বাহকসহ হ্যারিসন এসে উপস্থিত হলো।

 কফিন নামিয়ে রাখলো নিচে।

 মিসেস এলিনা সামনের টেবিলের উপর একটা সুইচে চাপ দিলো, অমনি মাথার উপর আলো জ্বলে উঠলো। পাশে বেরিয়ে এলো একটা সুড়ঙ্গপথ।

অপর একটা সুইচে চাপ দিতেই সুড়ঙ্গপথে একটা লিফট উঠে এলো। লিফটটা একটা বন্দীশালা বলে মনে হচ্ছে। চারদিকে লোহার শিকে ঘেরা একটা খাঁচা।

অপর এক সুইচে চাপ দিতেই লিফটের দরজা খুলে গেলো, চোখ এবং হাত দু’খানা পিছমোড়া করে বাধা রহমান ও কায়েসকে নামিয়ে আনা হলো লিফট থেকে।

মিসেস এলিনা করতালি দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে দু’জন লোক এসে দাঁড়ালো। তাদের চেহারা বিকৃত। মুখে একমুখ দাড়ি, কতকটা নিগ্রোদের মত চেহারা।

তারা দাঁড়িয়ে রইলো আদেশের প্রতীক্ষায়।

মিসেস এলিনা লোক দুজনকে বললোতোমরা বন্দী দু’জনকে কফিনের সম্মুখে নিয়ে এসো।

সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করলো তারা।

হ্যারিসন দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। মাথার ক্যাপ দিয়ে মুখের অর্ধেক ঢাকা। চিবুকের কিছু অংশ। গালপাট্টায় ঢাকা, চোখে কালো চশমা।

মিসেস এলিনা হ্যারিসনে লক্ষ্য করে বললো–হ্যারিসন, কফিনের মুখ খুলে ফেলল। তারপর বন্দী দু’জনকে লক্ষ্য করে বললো–তোমরা কফিনের দিকে তাকাও।

ততক্ষণে বন্দী দু’জনকে লিফট–খাটা থেকে বের করে আনা হয়েছে।

 হ্যারিসন ধীরে ধীরে কফিনের মুখ খুলে ফেললো।

 মিসেস এলিনাই প্রথমে কফিনের মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো এবং সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটধ্বনি করে উঠলো–মরালু…….।

হ্যারিসন এবং যারা উপস্থিত ছিলো তারাও বলে উঠলো এক সঙ্গে একি, কফিনে মরালুর সংজ্ঞাহীন দেহ….

বন্দী দুজন নীরব, তারা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকায় মিসেস এলিনা এবং তার অনুচরগণের দিকে। কফিনের মধ্যে যাকে তারা এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছে সে মুখ রহমান এবং কায়েসের অপরিচিত। ঐ ব্যক্তি যে এই চক্রের একজন চক্রী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ব্যাপারটা কি এটা তারা এখনও বুঝতে পারেনি। রহমান তাকালো কায়েসের মুখে, কায়েস তাকালো রহমানের মুখে, দৃষ্টি বিনিময়েই তারা আন্দাজ করে নিলো এমন কিছু ঘটেছে যা তারা ঠিকমত অনুমান করে নিতে পারছে না।

মিসেস এলিনার দু’চোখে আগুন ঝরছে, সে ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত ফোঁস ফোঁস করছে। অধর দংশন করে বললো সে মরা কেমন করে কফিনের মধ্যে এলো?

সবাই নীরব।

 কারও মুখে কোনো কথা নেই।

 মিসেস এলিনা পা–দিয়ে মেঝের এক স্থানে চাপ দিলো, অমনি একটা সংকেতপূর্ণ শব্দ হতে লাগলো।

 মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

মিসেস এলিনার অনুরগণ সবাই চারদিক থেকে ছুটে এলো। যে মরালুকে খুঁজে খুঁজে হয়রান পেরেশান হয়ে পড়েছিলো তারা, সেই মরালুকে কফিনের মধ্যে দেখতে পেয়ে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়লো। কফিনের মধ্যে এলো কি করে সে, আর সবচেয়ে বড় কথা দস্যু বনহুর গেলো কোথায়!

মিসেস এলিনা ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো–তোমরা বুঝতে পেরেছে কিছু এই কফিনে দস্যু বনহুরের সংজ্ঞাহীন দেহ বহন করে আনা হয়েছিলো।

সবাই এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিলো।

রহমান এবং কায়েস চমকে উঠলো সর্দারের নাম শুনে। তবে কি সত্যি তাদের সর্দারকে এরা বন্দী করে আনতে সক্ষম হয়েছে? সত্যি যদি তাই হয় তবে কি করে সর্দার কফিন থেকে বেরিয়ে পড়লো? ঐ নরপশু মরালুই বা কফিনে এলো কি করে? সব যেন কায়েস আর রহমানের কাছে এলোমেলো লাগছে। কিন্তু তারা জানে তাদের সর্দারের অসাধ্য কিছু নেই।

রহমান আর কায়েস বেশিক্ষণ ভাবার সময় পেলো না, মিসেস এলিনা গর্জে উঠলো–বন্দীদ্বয়, তোমরাই জানো তোমাদের সর্দার এখন কোথায়?

রহমান বলিষ্ঠ কণ্ঠে জবাব দিলো–আমরা এখন কোনখানে বন্দী আছি তা–ই ঠিক জানি না, আমাদের সর্দার এখন কোথায় কেমন করে জানবো?

হ্যারিসনকে লক্ষ্য করে বললো মিসেস এলিনা–হ্যারিসন স্মিথ, তুমিই বুঝিয়ে দাও ওদেরকে সমস্ত ঘটনাটা।

হ্যারিসনের আসল নাম হলো হ্যারিসন স্মিথ। তার জন্ম কোন দেশে সে নিজেও জানে না। নিজকে সে যখন আবিস্কার করলো তখন নিজকে দেখলো হিন্দলের কোনো এক বস্তি এলাকায়। বয়স আট নয় হবে। বস্তির এখানে সেখানে তার রাত কাটতো। দিনে এক কয়লার খনিতে কয়লা কুড়াতে সে, তাই বিক্রি করে যা পয়সা পেতো তা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতো। প্রায় দিনই আধপেটা খেয়ে কাটাতো। তারপর একদিন ঘটানচক্রে সে আহত হয়। তাকে হসপিটালে ভর্তি করে দেয় কোনো এক শ্রমিক। বেশ কিছুদিন হসপিটালে কাটার পর যেদিন হ্যারিসন স্মিথ ছাড়া পেলো সেদিন সে নিজকে বড় অসহায় মনে করলো। দিশেহারার মত ঘুরতে লাগলো পথে পথে। সৌভাগ্যক্রমে কোনো এক ড্রাইভার তাকে নিয়ে যায়, তারপর তাকে গাড়ি পরিষ্কারের কাজে নিয়োগ করে। হ্যারিসন স্মিথ একটা পথ পেলো, কাজ করে। খাবার পায়। বয়স বাড়তে লাগলো…একদিন সে গাড়ি পরিস্কার করা থেকে গাড়ি মেরামত এবং গাড়ি চালানো শিখে নিলো। তারপর হঠাৎ কেমন করে সে গাড়ি ছেড়ে জাহাজে এলো, জাহাজ থেকেই তার আসা মিসেস এলিনার ডুবুজাহাজে। এখানে সে মিসেস এলিনার প্রিয়পাত্র হিসেবে স্থান লাভ করেছে। মরালু মিসেস এলিনার প্রধান সহকারী আর হ্যারিসন স্মিথ তার ডান হাত বলা চলে।

মিসেস এলিনার কথায় হ্যারিসন স্মিথ একটু হেসে এগিয়ে এলো, বললো–যে কথা তোমরা বলছে তা সত্যি। বন্দী অবস্থায় তোমরা সঠিক কিছু জানোনা বা বলতে পারবে না। তবে শোন, গতকাল সন্ধ্যায় তোমাদের সর্দার দস্যু বনহুর আমাদের হাতে বন্দী হয়েছে এবং আমরা তাকে কৌশলে কফিন বাক্সে আটক করে এখানে নিয়ে এসেছি।

রহমান বলে উঠলো–সর্দার বন্দী?

হাঁ, সে আমাদের বন্দী কিন্তু বন্দী হলেও সে এখন কোথায় তা আমরা কেউ জানি না। কারণ এই কফিনের ভিতর থেকে সে উধাও হয়েছে এবং তার পরিবর্তে আমরা যাকে কফিনের মধ্যে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি সে আমাদেরই বিশ্বস্ত অনুচর মিঃ মরালু।

উপস্থিত সবাই একবার তাকালো ঐ কফিনটার মধ্যে। মরালুর সংজ্ঞাহীন মুখখানা নিদ্রাতুরের মত মনে হচ্ছে।

হ্যারিসন বলে উঠলো–জানি তোমরা কিছু বলতে পারবে না, তবু আমাদের হুকুম, যদি কোনক্রমে তোমরা কিছু জানতে পারো তোমাদের সর্দার সম্বন্ধে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানাবে, তা না হলে মৃত্যুদন্ডই হবে তোমাদের প্রাপ্য।

রহমান বললো–আপনাদের আদেশ শিরোধার্য।

 শোন বন্দীদ্বয়, আজ আমরা একটা আলোচনাসভা করবো। সেই সভায় তোমরা থাকবে……

 হ্যারিসন, তুমি কি পাগল হলে? মিসেস এলিনা গম্ভীর কণ্ঠে কথাগুলো বললো।

হ্যারিসন স্মিথ পূর্বের ন্যায় স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো–মিসেস এলিনা, আমি জানি বন্দীদ্বয় আর কোনোক্রমে আমাদের এই জাহাজ থেকে জীবন নিয়ে ফিরে যেতে পারবে না। কাজেই তাদের সম্মুখে আমরা আমাদের সবকিছু আলোচনা করতে পারি।

তাতে লাভ কি হবে?

 লাভ–লোকসানের কথা নয়। বন্দীদের মৃত্যুর পূর্বে আমরা তাদের জানিয়ে দেবো–আমরা শুধু কুচক্রীই নই, আমাদের কাজ কত জঘন্য তার প্রমাণ তারা কিছু জেনে যাবে, এই……

হ্যারিসন! গর্জে উঠলো মিসস এলিনা।

হ্যারিসন বললো–জানি আপনি ক্রুদ্ধ হচ্ছে কিন্তু ভেবে দেখুন আমি যা বলছি মিথ্যা নয়। যদি আপনি এ কথাটা অশোভনীয় মনে করেন তাহলে……

শোন হ্যারিসন, এখন আমরা ভীষণ এক অবস্থায় উপনীত হয়েছি। স্বয়ং দস্যু বনহুর আমাদের এই ডুবুজাহাজের কোনো এক স্থানে অবস্থান করছে, কাজেই এ মুহূর্তে সময় আমাদের নষ্ট করা উচিত নয়।

আদেশ করুন মিসেস এলিনা?

 বন্দী দুজনকে এখানে রাখার আর প্রয়োজন নেই।

মিসেস এলিনা বন্দী দু’জনকে পুনরায় লিফট–খাঁচায় ফিরে যাবার জন্য আদশ করলো।

সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করলে বন্দী দুজন, তারা আপন ইচ্ছায় লিফট–খাঁচায় চেপে দাঁড়ালো।

মিসেস এলিনা সম্মুখস্থ টেবিলের একটি সুইচে চাপ দিলো। তৎক্ষণাৎ ফিলট সহ বন্দীরা অদৃশ্য হলো দৃষ্টির আড়ালে।

হ্যারিসন বললো–মরালুকে কফিন থেকে বের করে তার সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।

হা তাই করো। মরালুর সংজ্ঞা ফিরে এলে তার মুখেই সঠিক সংবাদ জানা যাবে এই কফিনে যাকে দেখলাম সে কোথায় গেলো আর মরালুই বা এর মধ্যে এলো কি করে। কথাগুলো বলে মিসেস এলিনা আসন গ্রহণ করলো।

এমন সময় ওয়্যারলেস মেসিনের উপরের লাল আলোটা জ্বলে উঠলো।

মিসেস এলিনার দৃষ্টির সঙ্গে উপস্থিত সকলেই দৃষ্টি পড়লো লাল আলোটার উপরে। মিসেস এলিনা সকলের দিকে তাকিয়ে কিছু ইংগিত করলো, অমনি সবাই বেরিয়ে গেলো পাশের ক্যাবিনে।

শুধু হ্যারিসন এবং কফিনস্থ মরালু ছাড়া আর কেউ রইলো না। মিসেস এলিনা ওয়্যারলেস মেসিনের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। লাল আলোটা জ্বলছে আর নিভছে। ওয়্যারলেস সাইডবক্সে ভেসে এলো অদ্ভুত চাপা গম্ভীর একটা কণ্ঠস্বর…..নাংহা কান্দাই সাগরের মাঝামাঝি এসে পৌঁছছে……তোমরা প্রস্তুত

মিসেস এলিনা বললে উঠলো……প্রস্তুত……

……তাহলে কাজ হাসিল করতে দ্বিধা করো না……নাংহা বিশ হাজার যাত্রী এবং বহু খাদ্যশস্য নিয়ে কান্দাই বন্দর অভিমুখে যাচ্ছে..আমরা নাংহা ধ্বংস করে কান্দাই সরকারের চরম ক্ষতি সাধন করবো। নাংহাকে গভীর জলদেশে অতলে তলিয়ে দিয়ে কাজ সমাধা করবো….

মিসেস এলিনা জানালো…ওকে..

লাল আলো নিভে গেলো।

 মিসেস এলিনা ফিরে তাকালো হ্যারিসন স্মিথের দিকে, বললো–আর মুহূর্ত বিলম্ব করা চলবে না। চলো হ্যারিসন, কাজ শুরু করা যাক। তার আগে দেখে নেই নাংহার কান্দাই সাগরের কোন অংশে এসে পৌঁছেছে……

হ্যারিসন স্মিথ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো।

মিসেস এলিনা এসে দাঁড়ালো সেই অদ্ভুত টেলিভিশন মেশিনের সম্মুখে। মিসেস এলিনার কালো চশমার ফাঁকে চোখ দুটো জ্বলে উঠলো চকচক করে।

সুইচ টিপলো মিসেস এলিনা, তারপর হ্যান্ডেলঘুরাতে লাগলো উত্তর দক্ষিণ কোণ লক্ষ্য করে। কান্দাই সাগরের দিকে হ্যান্ডেল ঘোরাতেই টেলিভিশন মিটারে ভেসে উঠলো জাহাজ নাংহা। নাংহা বিরাট কলেবর নিয়ে নিশ্চিন্তে এগিয়ে আসছে।

মিসেস এলিনা ও হ্যারিসন তাকিয়ে আছে সেই অদ্ভুত টেলিভিশন পর্দার দিকে।

বিরাটকায় জাহাজখানা ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে। হাজার হাজার যাত্রী নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে আছে জাহাজখানার ভিতরে। তারা জানে না কত বড় অভিশাপ এগিয়ে আসছে তাদের জীবনে।

মিসেস এলিনা হাসলো একটুখানি, তারপর বললো–হ্যারিসন, মাপ মিটারের বোতাম টিপে দাও।

হ্যারিসন বোম টিপে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে মিটার চক্রাকারে ঘুরপাক খেয়ে থেমে গেলো। মিসেস এলিনা আনন্দসূচক শব্দ করে উঠে বললো–আর মাত্র কয়েক শ’ মাইল দূরে আছে নাংহা, তারপর আমাদের আয়ত্তের মধ্যে এসে যাবে, তখন……

হ্যারিসন স্মিথ বলে উঠলো–তাহলে আমরা আর কতক্ষণ বা কতদিন অপেক্ষা করতে পারছি?

মিসেস এলিনা মিটারের সুইচ অফ করে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তারপর বললো–আমরা কয়েক দিন অপেক্ষা করতে পারছি, কারণ ঐ দেখো, কান্দাই সাগরের জলরাশি মোটেই শান্ত নয়। ঐ অশান্ত জলতরঙ্গ ভেদ করে নাংহা ধীরগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা প্রস্তুত, কিন্তু ব্যস্ত নই। কথাটা বলে মিসেস এলিনা অদ্ভুত টেলিভিশনটার বোম টিপে অফ করে দিলো। তারপর এসে দাঁড়ালো কফিনটার পাশে, মরাল তখনও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আছে।

হ্যারিসন স্মিথ বললো–মিসেস এলিনা, এবার আমি মরালু সহ কফিন নিয়ে যাওয়ার জন্য আপনার অনুমতি চাই?

না, তুমি আমার সঙ্গে এসো।

আর মরালু?

ও কফিনে শুয়ে শুয়ে ঘুমাক।

 ওর সংজ্ঞা ফিরানোর চেষ্টা……

তোমাকে করতে হবে না হ্যরিসন স্মিথ। মসিউর আছে, মাংথাপুরা এবং গ্যারিসন আছে, তারাই ওর। সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। তুমি এসো……

কিন্তু

মিসেস এলিনা পা বাড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বললো–কিন্তু কি হ্যারিসন স্মিথ?

হ্যারিসন স্মিথ মাথার ক্যাপটা আরও কিছুটা টেনে দিলো সামনের দিকে, তারপর গালপাট্টাটা ঠিক করে নিয়ে কালো পুরু চশমার ফাঁকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মিসেস এলিনার মুখে, তারপর বললো স্বয়ং দস্যু বনহুর আমাদের এই গোপন আস্তানায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে, এই অবস্থায় আমরা এক মুহূর্ত সময়…

নষ্ট করতে চাওনা, এই তো?

মিসেস এলিনা!

হ্যারিসন স্মিথ, আমার চেয়ে বেশি তুমি জানো না। জানলে এমন কথা বলতে না। আমার এই ডুবুজাহাজ থেকে তার সাধ্য নেই যে পালায়। কাজেই সে আমার ডুবুজাহাজের যেখানেই থাক সে আমার বন্দী…কথাটা বলে এলিনা দ্রুত বেরিয়ে গেলো।

হ্যারিসন মিসেস এলিনাকে অনুসরণ না করে বিপরীত দিকে অগ্রসর হলো। কিন্তু সেইদিকের দরজায় পৌঁছতেই দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে মিসেস এলিনা। হাত বাড়ালো এলিনা হ্যারিসনের দিকে।

হ্যারিসন স্মিথ হাত রাখলো মিসেস এলিনার হাতের উপর।

মিসেস এলিনার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। হ্যারিসন স্মিথের হাত ধরে এগিয়ে যায় সে পাশের ক্যাবিনের দিকে।

সম্মুখে সুড়ঙ্গপথের মত একটা ফোকর।

 মিসেস এলিনা সেই ফোকরের মধ্যে প্রবেশ করলো, তখনও তার হাতের মুঠোয় হ্যারিসন স্মিথের হাত।

সেই সুড়ঙ্গপথ বা ফোকরে প্রবেশ করতেই অদ্ভুত এক কক্ষের মধ্যে এসে দাঁড়ালো তারা। কক্ষের দেয়ালে নানা ধরনের বোম এবং সুইচ রয়েছে। ছাদে গোলাকার আলোর বাল্ব জ্বলছে। আলোর বাল্বের চারপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রপথ রয়েছে। প্রতিটি ছিদ্রপথে এক ধরনের সাউন্ড বক্স এবং মেশিন রয়েছে।

মিসেস এলিনা মেঝের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে হ্যারিসন স্মিথের হাতখানা মুক্ত করে দিয়ে বললো– আজ তুমি যেন অন্যরকম হয়ে গেছো হ্যারিসন?

হ্যারিসন বললো–কি রকম?

 কথাবার্তা সব উল্টাপাল্টা বলছ, তাছাড়া একটিবারও তুমি আমাকে প্রেমবাণী শোনালে না……

ও এই কথা!

এ ছাড়াও তোমার মধ্যে আমি নতুন ধরনের……

 ও কিছু না মিসেস এলিনা। আমি চাই আপনার ন্যায্য মর্যদা আমি আপনাকে দেই, তাই…..

হ্যারিসন, তুমি তো জানো, মর্যাদা আমি অনেক পেয়েছি। আমার অনুচররা সবাই আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। কিন্তু আমার মনের বাসনা তারা পূর্ণ করতে পারে না। আমিও তো মানুষ–প্রেম–ভালবাসা আমারও কাম্য…তাই আমি বেছে নিয়েছি তোমাকে। হ্যারিসন, তোমার বলিষ্ঠ সুঠাম দেহ আমাকে আকৃষ্ট করেছে, তোমার অদ্ভুত চোখ দুটো আমার মনকে জয় করে নিয়েছে। যা তুমি আজ কালো চশমায় ঢেকে রেখেছো হ্যারিসন……

মিসেস এলিনা, আমি আজ চোখে অত্যন্ত ব্যথা অনুভব করছি, তাই…

আমি জানি তুমি কেন চোখে কালো চশমা পরেছে। সব জানি হারিসন স্মিথ..

সব জানেন মিসেস এলিনা?

হাঁ।

তুমি মনে করেছে আমি এত বোকা?

 মিসেস এলিনা।

হ্যারিসন স্মিথ…..

এ্যা!

মিসেস এলিনা হ্যারিসন স্মিথের কণ্ঠদেশ আলিঙ্গন করে বলে–হ্যারিসন,. তুমি আমার প্রিয়জন। তোমাকে আমি ভালবাসি। গভীর জলরাশির অতলে আমার এই বিশাল ডুবুজাহাজে একঘেয়েমি জীবন থেকে তুমি আমাকে নতুন প্রাণের আস্বাদ দিয়োছা….হ্যারিসন, কথা বলছো না কেন? হ্যারিসন, কিছু বলো……

হ্যারিসন বলে উঠে–মিসেস এলিনা, প্রেমাভিনয়ের সময় এটা নয়। মিস লুনা কর্তৃক দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার এবং তাকে কফিনে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এখানে আনয়ন। সেই কফিন থেকে অদ্ভুত উপায়ে দস্যু বনহুরের অন্তর্ধান এবং সেই কফিনে আমাদের বিশ্বস্ত ব্যক্তি মিঃ মরালু সংজ্ঞাহীন দেহ আটক,

কণ্ঠদেশ মুক্ত করে দিয়ে বলে মিসেস এলিনা–দস্যু বনহুরের ব্যাপারে আমি মোটেই বিচলিত নই হ্যারিসন কারণ মিস লুনাই তাকে চক্রান্ত করে সরিয়েছে এবং মরালুকে ঐ কফিনে ভরেছে। আমি মিস লুনাকে এ জন্য কঠিন শাস্তি দেবো, যে শাস্তির কথা সে কোনোদিন চিন্তাও করতে পারেনি।

হ্যারিসন বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠলো–মিস রুনার এ কাজ!

 হাঁ, আমার তাই মনে হয়।

কারণ?

দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার ছলনামাত্র, সে কোনো এক ব্যক্তিকে কফিনে বন্দী করে আমার সম্মুখে হাজির করে এবং তাকে কৌশলে সরিয়ে মরালুকে সেই কফিনে ভরে রাখে……

উদ্দেশ্য?

 উদ্দেশ্য আমাকে ধোকা দেওয়া।

 তার মানে?

হ্যারিসন, তুমি কি জানো না, মিস লুনা আমাকে আমার আসন থেকে সরিয়ে সে আমার আসনে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

কিন্তু এতে তার লাভ?

খিল খিল করে হেসে উঠলো মিসেস এলিনা–হ্যারিসন, তুমি যে আজ নতুন সবকিছু শুনছ?

হ্যারিসন স্মিথ কালো চশমার নিচে দিয়ে তীবদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মিসেস এলিনার মুখে।

 মিসেস এলিনা এগিয়ে এলো এবং হাত বাড়িয়ে হ্যারিসনের চোখ থেকে কালো চশমাখানা খুলে নেবার চেষ্টা করতেই হ্যারিসন স্মিথ তার হাতখানা ধরে ফেললো, তারপর মৃদু হেসে বললো–মিসেস এলিনা, আজ আপনাকেও বড় অদ্ভুত লাগছে। বড় সুন্দর লাগছে……

মিসেস এলিনা একটি বোতাম টিপে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে এক বিস্ময়কর সুমিষ্ট মিউজিকের সুর ছাদের ফোকর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো।

হ্যারিসন স্মিথ মৃদু হাসলো।

 মিসেস এলিনা তখন হ্যারিসনের বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো–আমার প্রিয় হ্যারিসন…….

হ্যারিসন স্মিথ টেবিল থেকে গেলাস এবং বোতলটা তুলে নিলো হাতে।

 মিসেস এলিনা বললো–দাও প্রিয়, সুধা দাও পান করি…..সুধা দাও..

হ্যারিসন বোতল থেকে কিছু তরল পদার্থ ঢেলে নিলো গেলাসে, তারপর মিসেস এলিনার হাতে দিয়ে বললো–নিন পান করুন।

মিসেস এলিনা হ্যারিসন স্মিথের হাত থেকে গেলাসটা হাতে নিয়ে পান করলো ঢক ঢক করে, তারপর শূন্য গেলাসটা ফিরিয়ে দিলো নাও রাখো…….

হ্যারিসন স্মিথ মিসেস এলিনার কথামত কাজ করলো, শূন্য গেলাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখতেই মিসেস এলিনা ওর কণ্ঠ বেষ্টন করে বললো–সব ভুলে যাচ্ছি প্রিয়তম, শুধু তুমি আর আমি,

মিউজিকের সুর তখন মিসেস এলিনার ধমনির রক্তে আনন্দ শিহরণ বয়ে এনেছে! অভিভূত মিসেস এলিনা।

হ্যারিসন স্মিথ ধীরে ধীরে ওর হাত দুখানাকে নিজ কণ্ঠ থেকে মুক্ত করে দিয়ে বললো–মিসেস এলিনা, কয়েক মিনিটের জন্য আমাকে ছুটি দিন, আমি এক্ষুণি ফিরে আসবো।

কোথায় যাবে তুমি হ্যারিসন স্মিথ?

জরুরি কোনো কাজে, ফিরে এসে বলবো। কথাটা বলেই হ্যারিসন স্মিথ বেরিয়ে গেলো। মিসেস। এলিনা নেশাগ্রস্তভাবে জড়িত কণ্ঠে বললো–যা…ও…কিন্তু শিগ্‌গির ফিরে এসো…

ততক্ষণে হ্যারিসন চলে গেছে সেঋন থেকে।

হ্যারিসন স্মিথ দ্রুত এগিয়ে গেলো ওয়ারলেস মেসিনের কক্ষে। ওয়্যারলেস মেসিনের সুইচ টিপতেই লাল নীল আলোর বাল্ব জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করলো। হ্যারিসন স্মিথ ওয়্যারলেস মুখে রেখে কিছুক্ষণ কথা বললো। তারপর এলো টেলিভিশন সুইচের পাশে, সুইচ টিপে মাপ মিটারের বোতাম টিপলো। টেলিভিশন পর্দায় ভেসে উঠলো নাংহা জাহাজখানা। হ্যারিসন স্মিথ তাকিয়ে দেখলো নাংহা ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে। মিটারে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলো এখনও তাদের ধ্বংস রশ্মির আওতা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। সুইচ অফ করে দিলো এবং দ্রুত পা চালিয়ে লিফটের পাশে এসে দাঁড়ালো।

লিফটের বোম টিপতেই লিফটখানা সাঁ সাঁ করে উঠতে লাগলো উপরের দিকে। লিফট এসে থামলো তিন নাম্বার ছাদের সম্মুখের দরজায়। হ্যারিসন স্মিথ নেমে পড়লো লিফট থেকে, তারপর সে দৌড়ে চললো লম্বা টানা বারান্দা দিয়ে ইঞ্জিন কক্ষের দিকে। যেখানে ডুবুজাহাজখানার সমস্ত কল এবং মেসিন রয়েছে। দু’জন অদ্ভুত পোশাকপরা লোক বসে আছে ওয়্যারলেস মেসিনের সম্মুখে, তাদের কানে বিস্ময়কর যন্ত্র আটকানো। হ্যারিসন স্মিথ তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো, বললো–তোমরা প্রস্তুত আছে?

হ্যাঁ, আমরা প্রস্তুত আছি।

তোমরা জানো এতে তোমাদের জীবন বিনষ্ট হবে?

 জানি। এতদিন আমরা যে পাপ করেছি এ জীবন বিনষ্ট করে তার প্রায়শ্চিত্ত করবো।

হ্যারিসন স্মিথ ওদের পিঠ চাপড়ে দিলো।

 ঐ মুহূর্তে ওদের চোখগুলো দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

হ্যারিসন সেখান থেকে ফিরে এলো লিফটের পাশে। লিফটে চেপে দাঁড়িয়ে বোম টিপলো।

সঙ্গে সঙ্গে লিফটা নামতে লাগলো গভীর অতলে।

লিফটা নেমে চলছে।

সম্মুখস্থ কাঁচের আবরণে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের জলীয় জীব এবং জলীয় উদ্ভিদ। হ্যারিসন স্মিথ লিফটের বোম টিপে লিফটা থামিয়ে দিলো। অমনি লিফটের দরজা খুলে গেলো।

হ্যারিসন স্মিথ নেমে পড়লো লিফট থেকে। তারপর একটা দড়ির ফিতা বেয়ে আরও নিচে খোলের মধ্যে নেমে চললো। এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো হ্যারিসন যেখানে শুধু মেসিনের দাঁত ঘুরপাক খাচ্ছে।

অতি সাবধানে হ্যারিসন স্মিথ আত্নরক্ষা করে চক্রাকার মেশিনটার ওপাশে এসে দাঁড়ালো।

 হাত পা মুখ বাঁধা একটা লোক কাৎ হয়ে পড়ে আছে সেখানে। তার দেহ প্রায় উলঙ্গই বলা চলে, সামান্য বস্ত্ৰদ্বারা লজ্জাস্থান শুধু ঢাকা রয়েছে।

হ্যারিসন স্মিথ সোজা তার পাশে এসে দাঁড়ালো, পা দিয়ে আঘাত করলো তার দেহে।

লোকটা গোঙ্গানির মত শব্দ করলো।

 হ্যারিসন স্মিথ ওর মাথার চুল ধরে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলো।

 লোকটা চোখ তুলে তাকালো হ্যারিসন স্মিথের দিকে।

 হাত দু’খানা ওর পিছমোড়া করে বাধা। মুখে রুমাল গোঁজা, পা দুখানাও মজবুত করে বাঁধা রয়েছে দু’পাশের দুটো কড়ার বালার সঙ্গে। যেন সে হামাগুড়ি দিয়েও পালাতে না পারে।

লোকটা কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু সে বলতে পারছে না।

হ্যারিসন স্মিথ ওর মুখের কালো রুমালখানা খুলে দিলো এবং ওর মুখের ভিতর থেকে অপর রুমালখানা টেনে বের করে ফেললো।

হ্যারিসন স্মিথ এবার চুল ধরে ওর মুখখানা উঁচু করে–হ্যারিসন স্মিথ, মিসেস এলিনা তোমার জন্য প্রতীক্ষা করছে। যাও, তার সঙ্গে মিলিত হও……কিন্তু মনে রেখো এর একটা কথা যদি তার কাছে বা তোমাদের দলের কারও কাছে বলো তাহলে সেই মুহূর্তে তোমার মৃত্যু ঘটবে। আমি তোমার কাছাকাছিই থাকবো। যাও……কথাটা শেষ করে প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভারখানা বের করে হ্যারিসন স্মিথের সম্মুখে উদ্যত করে ধরলো এবং বাম হাতে খুলে দিলো সে হ্যারিসন স্মিথের হাত এবং পায়ের বাঁধন।

হ্যারিসন স্মিথ তারই পোশাকপরা তারই চেহারার দ্বিতীয় ব্যক্তিটাকে লক্ষ্য করে বললো–আমাকে যখন মুক্ত করেই দিলে বন্ধু, তাহলে তোমার আসল পরিচয়টা যদি জানাতে, আমি তোমাকে সমীহ করে চলতাম।

হাঁ, তুমি আমার বন্ধুই বটে, কারণ তুমি শুধু তোমার পোশাক দিয়েই আমাকে সহায়তা করোনি, তুমি ডুবুজাহাজের গোপন রহস্যের সবকিছু বলে দিয়েছে আমার কাছে…..অবশ্য বাধ্য হয়েই সবকিছু জানিয়েছো তুমি। আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছি, কারণ যা বলেছে তা সব সত্য। হ্যারিসন স্মিথ, তুমি যেসবের বর্ণনা বা খোঁজ দিয়েছো আর যদি একবর্ণ মিথ্যা হতো তাহলে তোমাকে শুধু হত্যাই করতাম না, তোমাকে এই মেসিনের দাঁতের মধ্যে ফেলে পিষে মারতাম।…যাও আর বিলম্ব করো না। হাঁ, প্রথমে তুমি নিজের ক্যাবিনে যাও, সেখানে গিয়ে তুমি তোমার দ্বিতীয় পোশাক পরে নাওগে। আর আমি তোমার এই পোশাকেই থাকবো, যতক্ষণ না আমার কাজ শেষ হবে।

তুমি কে আমাকে বলবেনা?

মিসেস এলিনা মুখেই তুমি জানতে পারবে আমি কে এবং কি আমার পরিচয়। কিন্তু মনে রেখো কোনোক্রমে যেন মিসেস এলিনা জানতে না পারে একটু পূর্বে যে হ্যারিসন স্মিথ তার পাশে ছিলো সে তুমি নও।

হ্যারিসন স্মিথ অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আগন্তুকটির দিকে, তারপর সে নিজ ক্যাবিনের দিকে যাবার জন্য পা বাড়ালো।

মৃদু হাসি ফুটে উঠলো প্রথম হ্যারিসন স্মিথ বেশি দস্যু বনহুরের মুখে।

*

মিসেস এলিনা ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললো–মরালু, চুপ করে আছো কেন, জবাব দাও? বলো কেমন করে তুমি কফিনে এলে?

মরালু চোখ তুলে তাকালো মিসেস এলিনার মুখের দিকে, কিন্তু জবাব সে দিতে পারলো না। কেমন যেন উদাস নয়নে তাকাতে লাগলো সে।

মরালুর দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুজন লোক।

সম্মুখে মিসেস এলিনা।

এলিনার পাশে হ্যারিসন স্মিথ।

হ্যারিসন স্মিথের চোখেমুখেও উদ্বিগ্নতার ছাপ সে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক।

মিসেস এলিনা কঠিন কণ্ঠে বললো–জবাব দাও, নাহলে এখুনি তোমাকে যমালয়ে পাঠাবো।

মরালু ঢোক গিলে বললো–আমি কিছু জানি না কেমন করে কফিনে এলাম……

মিথ্যে কথা।

 বিশ্বাস করুন মিসেস এলিনা, আমি কফিনে কেমন করে এলাম কিছু জানি না…….

অপদার্থ কোথাকার! তোমাকে জীবিত রাখা মোটেই আর উচিত হবে না। কথা শেষ করেই মরালুর দিকে পিস্তল উদ্যত করে ধরলো মিসেস এলিনা এবং সঙ্গে সঙ্গে গুলী ছুড়লো তার বুক লক্ষ্য করে। একটা তীব্র আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লো মরালু মিসেস এলিনার পায়ের কাছে।

মিসেস এলিনা এবার ইংগিত করলো, সঙ্গে সঙ্গে দন্ডায়মান ব্যক্তিদ্বয় মরালুর রক্তাক্ত দেহখানা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।

মিসেস এলিনা তাকালো হ্যারিসনের মুখের দিকে।

হ্যারিসন স্মিথের মুখমন্ডল বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, মরালুর মৃত্যু দৃশই শুধু তাকে বিচলিত ও উদ্বিগ্ন করেনি একটা, বিরাট রহস্যজাল তাকে ঘিরে ফেলেছে কে ঐ ব্যক্তি যে তাকে এভাবে আটক করে তাকে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়ছে।

মিসেস এলিনা বলে উঠলো–হ্যারিসন, কাল থেকে তোমাকে অত্যন্ত অন্যমনস্ক লাগছে। তাছাড়া তোমার কণ্ঠস্বর যেন কেমন লাগছে, তুমি কি দস্যু বনহুরের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছো হ্যারিসন স্মিথ?

দস্যু বনহুর! দস্যু বনহুর…….এ আপনি কি বলছেন মিসেস এলিনা?

কেন, কাল তুমি নিজে দস্যু বনহুরের সন্ধান করেও বিমুখ হয়ে ফিরে এলে……

হ্যারিসনের কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হলো সেই কণ্ঠস্বর…মিসেস এলিনার মুখেই তুমি জানতে পারবে আমি কে এবং কি আমার পরিচয়, কিন্তু মনে রেখো, কোনোক্রমে যেন মিসেস এলিনা জানতে না পারে যে, হ্যারিসন স্মিথ তার পাশে ছিলো সে তুমি নও…… হ্যারিসন স্মিথ যেন সম্বিৎ ফিরে পেলো। দ্রুত নিজকে সংযত করে নিয়ে বললো–কিছু পূর্বে নেশাপান করে মাথাটা যেন কেমন করছে, সব যেন এলোমেলো হয়ে আসছে। দস্যু বনহুর……এবার আমি সবকিছু বুঝতে পারছি।

হ্যারিসন, মরার মত অবস্থা যখন তোমার হবে এখন তোমার সব নেশা কেটে যাবে।

মিসেস এলিনা!

শোন হ্যারিসন, আজ কয়েক ঘন্টা সময় আমি দেবো এই সময়ের মধ্যে যদি দস্যু বনহুরকে খুঁজে না বের করতে পারা যায় তাহলে কাউকে রেহাই দেবো না। তুমি সবাইকে জানিয়ে দাও আমার আদেশ।

হ্যারিসন স্মিথ নত মস্তকে জানালো–আচ্ছা, আমি এক্ষুণি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি।

মিসেস এলিনা চলে গেলো সেখান থেকে।

 মরালুর বুকের রক্ত তখনও মেঝেতে জমাট বেঁধে উঠেনি।

 হ্যারিসন সুইচ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত ধরনের একরকম ঘন্টাধ্বনি হতে লাগলো।

মুহূর্তে ছুটলো সবাই সেই ঘন্টাধ্বনিটার দিকে।

ডুবুজাহাজখানাতে তেমন বেশি লোক সহসা নজরে না পড়লেও প্রায় পঞ্চাশ জন অনুচর কাজ করে চলেছে ডুবুজাহাজখানার ভিতরে।

সবাই এসে জমায়েত হলো হ্যারিসন স্মিথের সামনে।

ঐ সময় রহমান এবং কায়েস কিছু বলছিলো। তারা বুঝতে পেরেছে তাদের সর্দারের আগমন ঘটেছে। তারা যখন বন্দী হলো তখনই আন্দাজ করে নিয়েছি সর্দার নিশ্চয়ই তাদের অবস্থা টেলিভিশনে দেখে নিশ্চুপ থাকবে না…..

যখন তারা লিফট–খাঁচার অসহ্য যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো, ঠিক ঐ সময় হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে লিফট উপরে উঠতে লাগলো। রহমান আর কায়েস এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিলো, অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা এমন একস্থানে এসে পৌঁছলো যে স্থান তাদের কাছে বিস্ময়কর। কাঁচের আবরণের ফাঁকে দেখলো দু’জন বলিষ্ঠ লোক দাঁড়িয়ে।

লিফট এসে থামতেই লোক দু’জন দরজা খুলে দিলো, রহমান ও কায়েস দেখলো তাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে তারা।

রহমান বললো–আমাদের হাত-পা বাঁধা, খাবো কি করে? যদি বাঁধন খুলে দাও তাহলে খেতে

লোক দুজনের একজন বললো–আজ তিনদিন তিন রাত্রি এরা উপবাসী। দাও, খুলে দাও ওদের হাতের বাধন।

অপরজন প্রথম জনের আদেশ পালন করলো। খুলে দিলো বন্দী দুজনের হাতের বাঁধন।

প্রথম রহমানের, তারপর কায়েসের।

 যখন কায়েসের হাত দু’খানা খুলে দিচ্ছিলো তখন রহমান প্রচন্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলো একজনের নাকে। সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়লো লোকটা নিচে।

সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই কায়েস এসে তার গলা টিপে ধরলো।

 রহমান ততক্ষণে অপরজনকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলেছে। কায়েস টাই ধরে টেনে আনলো প্রথম জনকে, তাকেও পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো, তারপর দুজনকে লিফট–খাঁচায় বন্দী করে রাখলো। দুজনেরই মুখে রুমাল গুঁজে দিলো যেন তারা কোনো শব্দ করতে না পারে।

রহমান এবং কায়েস আত্নগোপন করে এগুতে লাগলো। নানা ধরনের কলকজা আর মেশিনের ফাঁকে ফাঁকে এগিয়ে চললো তারা।

বেশিদূর এগুতে হলো না, সম্মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রহমান এবং কায়েস দেখলো একজন লোক এগিয়ে আসছে তাদের দিকে।

রহমান বললো–সর্বনাশ, এই লোকটির নাম হ্যারিসন স্মিথ। ও আমাদের দেখে ফেলেছে, এবার সে গোলমাল।

রহমান এবং কায়েস দ্রুত একটা বয়লারের আড়ালে লুকিয়ে পড়তেই হ্যারিসন স্মিথ তাদের সম্মুখে এসে পড়লো। চাপাকণ্ঠে ডাকলো রহমান…….

কে সর্দার…বেরিয়ে এলো রহমান ও কায়েস।

হাঁ, রহমান কায়েস তোমরা মুক্ত হয়েছে খুব ভাল। আমি সব গুছিয়ে নিয়েছি, মাত্র আর কয়েক ঘন্টা বাকি……একটু থেমে বললো–তোমরা তোমাদের ডুবুরী পোশাক সগ্রহ করে নাও। ঐ পোশাক পরে নিয়ে প্রস্তুত থাকবে…এখন যাও হ্যারিসন স্মিথকে খুঁজে বের করতে হবে, কারণ সে মিসেস এলিনার সঙ্গে নতুন কোনো চক্রান্ত করার চেষ্টায় আছে। কথাগুলো বলে হ্যারিসন স্মিথবেশী দস্যু বনহুর সরে গেলো।

রহমান ও কায়েস তাদের নিজস্ব পোশাকগুলোর সন্ধানে এগুতে লাগলো।

রহমান এবং কায়েস জানতো তাদের পোশাকগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছে মিসেস এলিনার অনুচরগণ। কিন্তু সে স্থান অতিদূর্গম কঠিন স্থান। সর্দারের নির্দেশ পোশাক তাদের সংগ্রহ করতেই হবে।

নানাভাবে এগিয়ে চললো রহমান ও কায়েস। কোনো সময় বয়লারের পাশ কেটে, কোনো সময় লিফটের ফিতা বয়ে, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যু ঘটতে পারে তবু তারা প্রাণপণ চেষ্টায় তাদের সেই ডুবরী পোশাকের সন্ধানে চললো। যেমন করে হোক এ পোশাক তাদের সংগ্রহ করতেই হবে।

ডুবুরী পোশক দুটো রাখা হয়েছিলো মিসেস এলিনার পাশের ক্যাবিনে।

রহমান এবং কায়েস খুব সাবধানে মিসেস এলিনার ক্যাবিনের কাছাকাছি এসে পৌঁছলো।

ঐ মুহূর্তে হ্যারিসন স্মিথ এবং মিসেস এলিনা তাদের ডুবুজাহাজের অদ্ভুত টেলিভিশনে নাংহার দূরত্ব লক্ষ্য করছিলো। মিসেস এলিনার কালো চশমার নিচে চোখ দুটো জ্বলছে যেন। হিংসার দাবানলে জ্বলছে তার মন। বিদেশী শত্রুদের মধ্যে সে একজন শ্রেষ্ঠ স্থানীয়।

নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সে সবকিছু করতে পারে। এমন কোনো পাপ নেই যা সে করে না বা করেনি। মিসেস এলিনার জীবন কাহিনী বড় অদ্ভুত। সে কোনো এক নাবিকের মেয়ে। জন্মাবার পর সে পিতাকে দেখেনি, মা–ই তাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে। যখন সে উচ্চশিক্ষিত হয়ে মায়ের কাছে ফিরে এলো তখন তার পিছনে লেগেছে কয়েক গুন্ডা বয়ফ্রেন্ড। এলিনার রূপ ছিলো তাই তাকে পাবার জন্য লালায়িত ছিলো অনেকে।

এলিনা সবার সঙ্গে মিশতো কিন্তু কাউকে সে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে পারেনি। একদিন এক শিকারীর প্রেমে পড়লো এবং তাকে সে বিয়ে করলো নিজেদের ধর্মানুযায়ী।

হলো মিসেস এলিনা।

কিন্তু বেশিদিন সে শিকারী স্বামীকে বরদাস্ত করতে পারলো না, একদিন শিকারে গিয়ে স্বামীর বন্দুক নিয়ে তাকেই শিকার করে বসলো।

কি সাংঘাতিক সে দৃশ্য।

সেদিন মিসেস এলিনা নিজেই সখ করে বলছিলো–ওগো, চলো আজ শিকারে যাই। বড় ইচ্ছা হচ্ছে নিজ হাতে শিকার করবো।

স্বামীর মনে স্ত্রীর কথাগুলো আনন্দ উচ্ছ্বাস বয়ে আনলো। শিকারী মন নেচে উঠলো শিকারের আশায়। কোনোদিন সে স্ত্রীর মুখে শিকারের কথা শোনেনি। বরং সে রাগ করেছে শিকারের কথা শুনলে।

আজ স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করলো শিকারী স্বামী।

 মিসেস এলিনার চোখে হিংসার আগুন জ্বলে উঠলো। হাসলো সে ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি।

 শিকারে গেলো।

সম্মুখ অশ্বে স্বামী পিছন অশ্বে মিসেস এলিনা। শিকারের সন্ধানে বেশিক্ষণ তারা ঘুরে বেড়ালোনা আজ। মিসেস এলিনা আর তার স্বামী নেমে দাঁড়ালো অশ্বপৃষ্ঠ থেকে। স্বামীকে লেলিয়ে দিলো শিকারের খোঁজ করার জন্য, পিছনে রইলো সে।

স্বামী উবু হয়ে লক্ষ্য করছিলো সম্মুখে।

 ঠিক ঐ মুহূর্তে মিসেস এলিনার বন্ধুক গর্জে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো এলিনার স্বামী, তারপর উল্টে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো জঙ্গলের মধ্যে।

মিসেস এলিনা অট্টহাসি হেসে উঠলো, তারপর সে বন্দুক কাঁধে তুলে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসলো।

মিসেস এলিনার স্বামীর রক্তাক্ত দেহটা পড়ে রইলো জঙ্গলের মধ্যে।

সেদিন এলিনার আনন্দ ধরে না।

স্বামীকে হত্যা করে সে বাড়িতে বিরাট পার্টি দিলোর আনন্দ উৎসবে এসেছিলো অনেকে। তবে ভাল লোক সংখ্যা সে উৎসবে কমই ছিলো, যত কুচক্রীদল যোগ দিয়েছিলো মিসেস এলিনার সঙ্গে।

তারপর সে এমন এক দলে যোগ দিলো যারা পরের অমঙ্গল চিন্তা করে সর্বক্ষণ। তারপর থেকে তার কাজ হলো নানাভাবে বিদেশ থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ করা।

এরপর সে এলো ডুবুজাহাজে।

এখানে সে নতুন রূপ নিলো, একটার পর একটা ধ্বংসলীলা চালিয়ে চললো কৌশলে। ধ্বংস করাই হলো তার জীবনের ব্রত এবং কাজ।

মিসেস এলিনাই ডুবুজাহাজের একচ্ছত্রী অধিকারিণী। তার কথামত অনুচরগণ সবাই কাজ করে; কেউ কোনো প্রশ্ন করবার সাহসী হয় না। যদি কেউ ভুল করে মিসেস এলিনার কাছে কোনো প্রশ্ন করে বসে বা কোনো কাজে প্রতিবাদ করে তাহলে মৃত্যুই তার হয় প্রাপ্য শাস্তি।

এ কারণে কেউ কোনো কাজে প্রতিবাদ বা প্রশ্ন করে না। সবাই নীরবে মিসেস এলিনার আদেশ পালন করে।

মিসেস এলিনা যখন টেলিভিশনে নাংহা জাহাজখানা দেখছিলো তখন তার পাশের ক্যাবিনে প্রবেশ করে রহমান, কায়েস দাঁড়িয়ে থাকে ক্যাবিনের দরজায়, হাতে তার পিস্তল।

রহমান দুটো পিস্তল সংগ্রহ করে নিয়েছিলো যে অনুচরদ্বয়কে বন্দী করেছিলো তাদেরই কোমরের বেল্ট থেকে। পিস্তল উদ্যত করে দাঁড়িয়ে এদিকে আসছে।

রহমান এবং কায়েস উভয়েরই লুকিয়ে পড়লো।

দু’জন লোক উদ্যত রাইফেল হাতে তাদের সামনে দিয়ে চলে গেলো। রহমান এবং কায়েস অনুমানে বুঝতে পারলো লোক দুজন দস্যু বনহুরের অনুসন্ধান করে। এখনও তারা বুঝতে পারেনি বন্দীদ্বয় তাদের লিফট–খাঁচা থেকে উধাও হয়েছে।

রহমান এবং কায়েস শুধু তাদের পোশাকই সংগ্রহ করলো না, তাদের পোশাকের মত অপর আর একটা পোশাকও ঐ ক্যাবিনে থেকে সংগ্রহ করে নিলো তাদের সর্দারের জন্য।

এরপর রহমান এবং কায়েস আত্মগোপন করে সরে পড়লো সেখান থেকে।

পরক্ষণেই শোনা গোলা এক অদ্ভুত আওয়াজ।

ডুবুজাহাজের সর্বত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছুটাছুটি শুরু করেছে সবাই। সবার হাতেই রাইফেল। তারা যে ভীষণ উদ্বিগ্নতার সঙ্গে কারও সন্ধান করে ফিরছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ওদিকে ভয়ঙ্কর বিপদসংকুল এক জায়গায় এসে জড়ো হলো, রহমান, কায়েস এবং স্বয়ং দস্যু বনহুর।

 দস্যু বনহুরের শরীরে হ্যারিসন স্মিথের পোশাক।

 তাকে দেখলে সহসা চিনতেই পারবে না কেউ। হ্যারিসন স্মিথের বেশে বনহুর নিজকে মিসেস এলিনার অনুচরগণের সম্মুখে চালিয়ে নিচ্ছিলো।

অবশ্য হ্যারিসন স্মিথকে বনহুর মুক্ত করে দিলেও তাকে ভালভাবে সাবধান করে দিয়েছিলো যেন সে কোনোক্রমে প্রবেশ না করে হ্যারিসনের বেশে আরও একজন আছে এই ডুবুজাহাজে।

*

মিসেস এলিনা তার আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো–তোমরা সবাই অপদার্থ, একজন লোক এই ডুবুজাহাজের ভিতরে আত্মগোপন করে রয়েছে অথবা তোমরা তাকে খুঁজে বের করতে পারলে না। এবার আমি নিজে তার সন্ধান করবো।

এমন সময় হ্যারিসন স্মিথ বললো–মিসেস এলিনা, দস্যু বনহুরের সাধ্য নেই সে আমাদের কোনো ক্ষতি সাধন করে। কাজেই তার সন্ধানে সময় নষ্ট না করে আমরা আমাদের কাজ করে যাই।

ঘরে শক্ত রেখে কোনো কাজ সমাধা করা কি সম্ভব?

কেন সম্ভব নয়? সে তো এখনও আমাদের কোনো ক্ষতি সাধন করেনি, তবে……করতে পারে।

 পারে নয়, করবে বলেই তো সে এসেছে এখানে এবং আত্মগোপন করে আছে।

তাই বলে আমরা তার সন্ধানে সব সময় নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারি না। আমরা কাজ করে যাবো–আনন্দ করবো, উৎসব করবো। চলুন মিসেস এলিনা, আমরা নাচগানে মেতে উঠি…হ্যারিসন স্মিথ মিসেস এলিনার হাত ধরে কথাগুলো বললো।

মিসেস এলিনা অগত্যা না গিয়ে পারলো না। ডুবুজাহাজখানার ভিতরে এমন একটি স্থান ছিলো যেখানে চলে নানারকম আনন্দ নৃত্য গীত। সাজানো আছে সেখানে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র এবং আছে খানাপিনার ব্যবস্থা। হ্যারিসন স্মিথ মিসেস এলিনার হাত ধরে নিয়ে আসে সেই ক্যাবিনে।

একটা সুইচ টিপতেই শুরু হলো মিউজিক।

অদ্ভুত মোহময় সে সুর।

হ্যারিসন স্মিথের গলা জড়িয়ে ধরলো মিসেস এলিনা দুটি কোমল বাহু দিয়ে। মিউজিকের তালে তালে হেলেদুলে নাচতে লাগলো সে।

হ্যারিসন স্মিথ আলগোছে খুলে নিলো নিজ কষ্ট থেকে মিসেস এলিনার হাত দু’খানা। তারপর হাত ধরে সে নাচতে লাগলো মিউজিকের তালে তালে।

হ্যারিসন স্মিথ টেবিল থেকে বোতল আর গেলাস তুলে নিয়ে কিছু মদ ঢেলে নিলো, তারপর মিসেস এলিনার হাতে দিলো।

মিসেস এলিনা ঢক করে গলায় ঢেলে দিলো কাঁচপাত্র থেকে রঙিন সুধা, তারপর মোহময় কণ্ঠে বললো–হ্যারিসন, তুমি সত্যি আমার প্রিয়জন। তোমারে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না।

হ্যারিসন মিসেস এলিনার হাত ধরে বলে–মিসেস এলিনা, আপনাকে ছাড়াও আমি বাঁচতে পারি না কিন্তু এখন আসুন কাজের কথা হোক।

না, এখন কাজের কথা নয়।

 মিসেস এলিনা, ভুলে গেছেন আমাদের সম্মুখে বিরাট কাজ রয়েছে। নাংহা জাহাজখানা প্রায় আমাদের ধ্বংস মিটারের কাছাকাছি এসে গেছে……

হাঁ, আমি সে কথা প্রায় ভুলেই বসে আছি। দাও হ্যারিসন, মিউজিক বক্সের সুইচ অফ করে দাও, চলো মেসিনকক্ষে চলো।

কিন্তু,

ও, সে ক্যাবিনে তোমাদের প্রবেশ নিষেধ। একটু থেমে বললো মিসেস এলিনা–প্রবেশ নিষেধ হলেও আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। বলে রাজি আছো?

হ্যারিসন স্মিথ বললো–রাজি!

 হাত মিলালো মিসেস এলিনা হ্যারিসন স্মিথের সঙ্গে। তারপর হাত ধরে বললো–চলো ধ্বংস মিটার ক্যাবিনে।

চলুন মিস এলিনা।

 কথাটা বলে হ্যারিসন স্মিথ এবং মিসেস এলিনা বেরিয়ে এলো সেই ক্যাবিন থেকে।

মিসেস এলিনা হেসে উঠলো, সে হাসি অদ্ভুত ধরণের।

 চমকে উঠলো হ্যারিসন স্মিথ।

 কিন্তু সে কিছু বলবার পূর্বেই মিসেস এলিনা একটা সুইচ টিপলো।

সঙ্গে সঙ্গে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই স্থান সহ মেঝেটা নিচে নেমে চললো।

হ্যারিসন স্মিথ সহসা ঝাঁকুনি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে টাল সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।

ততক্ষণে মেঝেটা দ্রুত নেমে যাচ্ছে নিচে।

গভীর জলদেশের নিচে এসে থেমে পড়লো মেঝেটা।

 মিসেস এলিনা অপর একটা সুইচে চাপ দিলো, অমনি লিফটের মত একটা আসন সহ দরজা জেগে উঠলো মিসেস এলিনা এবং হ্যারিসন স্মিথের সম্মুখের দেয়ালে।

পুনরায় একটা সুইচে চাপ দিলো মিসেস এলিনা, তৎক্ষণাৎ দরজার ওপাশের দেয়াল সরে গেলো। অদ্ভুত কাঁচের দেয়াল দেখা গেলো। আরও দেখা গেলো জলজন্তু ধরনের একপ্রকার গোলাকার বস্তু।

মিসেস এলিনা বললো–ঐ যে ভয়ঙ্কর জল জলজন্তু ধরনের গোলাকার বস্তুটা দেখতে পাচ্ছো ওটা কি বলতে পারো?

এর পূর্বে জানতাম কিন্তু……

 এখন ভুলে গেছে, তাইনা?

হাঁ।

ওটা কি তুমি জানো হ্যারিসন। আজ তোমাকে বলবো, কারণ তুমি আমার প্রিয়জন। তোমাকে না জানালে আমার শান্তি নেই, স্বস্তি নেই।

…..যদিও এতদিন এই গভীর রহস্যের কথা কেউ জানো না, যদি কেউ জানতে পেরেছে তাকে আমি পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে সরিয়ে ফেলেছি, কারণ একমাত্র আমি ছাড়া এর সন্ধান কেউ জানে না।

মিসেস এলিনা, যার সন্ধান কেউ জানে না তা আমাকেও জানানো উচিত হবে না……

কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করি।

মিসেস এলিনা!

হা হ্যারিসন, আমি স্বামীকে হত্যা করেছি, আরও হত্যা করেছি অনেককে কিন্তু তোমার কাছে আমার পরাজয়, কারণ তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। হ্যারিসন, একটা সমস্যা আমাদের সম্মুখে দেখা দিয়েছে। দস্যু বনহুর যে কোনো মুহূর্তে আমাদের ডুবুজাহাজের বিরাট ক্ষতি সাধন করতে পারে।

তাহলে কি আমরা নতুন কোনো বিপদের সম্মুখীন হচ্ছি বলে মনে করেন মিসেস এলিনা?

হাঁ, হাঁ হ্যারিসন, যে কোনো মুহূর্তে আমরা বিপদে পড়তে পারি। মেসিন কক্ষের নিচে একটা চোরা ক্যাবিন আছে, এ ক্যাবিনটার সন্ধান তোমরা কেউ জানে না। বড় ভয়ঙ্কর সেই ক্যাবিন, ঐ ক্যাবিনের দক্ষিণ কোণে যে মেশিনটা আছে তার সুইচ আছে ক্যাবিনের উত্তরের কোণে। জানো হ্যারিসন, ঐ সুইচটা হলো এই ডুবুজাহাজের প্রাণ, যদি বনহুর কোনোক্রমে ঐ সুইচটার সন্ধান পায় বা জানতে পারে তাহলে সে ইচ্ছা করলে এই ডুবুজাহাজটাকে যে কোনো মুহূর্তে ধ্বংস করতে পারে……

বিস্ময় নিয়ে তাকিয়েছিলো হ্যারিসন স্মিথ মিসেস এলিনার দিকে।

মিসেস এলিনা বলে চলে মোগ্রস্তের মত–কাজেই আমাদের কোনো বিপদ এলে ঐ যে দেখছো জলজন্তুর মত ঐ বস্তুটা, ওটাই হলো নিজেদের বাঁচবার পথ। ঐ যে সুইচ দেখছো এই সুইচে চাপ দিলেই কাঁচের দরজা খুলে যাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঐ অদ্ভুত যানটি এগিয়ে আসবে দ্রুতগতিতে।

তারপর?

ঐ যানটার মুখ খুলে যাবে, আমরা প্রবেশ করবো ঐ যানের মধ্যে যানে চেপে বসার সঙ্গে সঙ্গে যানটি বেগে ছুটতে থাকবে মিনিটে এক শ মাইল।

সত্যি মিসেস এলিনা?

হাঁ সত্যি এবং যা এতদিন তোমরা কেউ জানো না, আজ আমি তা তোমাকে বলছি…..

 মিসেস এলিনা, আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন তাই…….

শুধু বিশ্বাস করি না, তোমাকে ভালবাসি তাই…মিসেস এলিনা হ্যারিসন স্মিথের গলা জড়িয়ে ধরে মুখখানা উঁচু করে বলে–হ্যারিসন, নাংহা ধ্বংস করার পর আমি আমাদের এই রহস্যপূর্ণ ডুবুজাহাজটাকে ধ্বংস করবো মনস্থ করেছি, কারণ দস্যু বনহুরকে আমি ধ্বংস করতে চাই এই ডুবুজাহাজটার সঙ্গে। জীবনে বহু ধ্বংসলীলা সংঘটিত করেছি–আর নয়, এবার তুমি আর আমি চলে যাবো দূরে অনেক দূরে……যেখানে মহাজন ক্যারিলং আমার সন্ধান পাবে না।

হ্যারিসন স্মিথ বলে উঠলো–ক্যারিলং! মহাজন ক্যারিলং…হাঁ, সে আমাদের সন্ধান পাবে না, কিন্তু……

খিল খিল করে হেসে উঠলো মিসেস এলিনা, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–হ্যারিসন, কদিন হলো তোমাকে বড় অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন হেঁয়ালি নিয়ে কথা বলল। খুলে ফেলো তোমার কালো চশমা, খুলে ফেলো তোমার মুখের গালপাট্টা……তোমার খোলা মুখ ভাল লাগে। তুমি আজকাল মুখখানাকে অমন করে ঢেকে রাখো কেন বলতো।

সে কথা আজ নাইবা শুনলেন মিসেস এলিনা, তবে জেনে রাখুন আমরা বিপদমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত……কথা শেষ না করেই হাসে হ্যারিসন স্মিথ।

এমন সময় ওয়্যারলেস মেসিনকক্ষ থেকে সংকেতধ্বনি ভেসে আসে, কো…কো একঅদ্ভুত শব্দ।

মুহর্তে মিসেস এলিনার মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে উঠলো। হ্যারিসন স্মিথ বুঝতে পারলে নিশ্চয়ই এটা কোনো বিশেষ শব্দ, যার জন্য মিসেস এলিনা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। শব্দটা কানে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্তকণ্ঠে বললো–চলো হ্যারিসন, ডাক পড়েছে। হ্যারিসন স্মিথের হাত ধরে মিসেস এলিনা মেঝেটার মাঝামাঝি দাঁড়ালো, তারপর একটা সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে মেঝেটা দ্রুত স স করে উঠতে লাগলো উপরের দিকে।

মাথার উপরিভাগে লাল নীল আলো টিপটাপ করে জ্বলছে।

মেঝেটা এসে থেমে গেলো মাঝামাঝি স্থানে।

 সুইচ টিপতেই দেয়ালে দরজা বেরিয়ে এলো।

 হ্যারিসন স্মিথসহ মিসেস এলিনা নেমে গেলো দরজা দিয়ে তার অভ্যন্তরে।

ওপাশে ওয়্যারলেস কক্ষ।

ওয়্যারলেস মেসিনের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো মিসেস এলিনা। একটা সুইচ টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো সেই ভয়ঙ্কর অদ্ভুত কণ্ঠস্বর……মিসেস এলিনা, নাংহা, তোমার আয়ত্তের মধ্যে এসে গেছে…..কেন তুমি বিলম্ব করছে ঠিক বুঝতে পারছি না…মুহূর্ত বিলম্ব করা উচিত নয়…এরজন্য তোমাকে সাজা পেতে হবে……

মিসেস এলিনা কাঁপা গলায় বললো–এক্ষুণি আমি আপনার আদেশ পালন করছি স্যার…মিসেস এলিনা হ্যারিসন স্মিথের মুখের দিকে তাকালো।

হ্যারিসন স্মিথ কিছু বলতে গেলো।

ওর ঠোঁট দু’খানা নড়ে উঠতেই মিসেস এলিনা ইংগিতে তাকে চুপ থাকতে বললো।

ততক্ষণে আরও শব্দ শোনা গেলো–সাংকেতিক শব্দ, কাজেই হ্যারিসন স্মিথ তা বুঝতে পারলো না।

আলো নিভে গেলো।

ওয়্যারলেসে মেসিনের সুইচ অফ করে দিলো মিসেস এলিনা। তারপর সে নেমে এলো নিচে এবং এসে দাঁড়ালো পূর্বের সেই মেঝেতে।

অপর একটা সুইচ টিপতেই মেঝেটা দুলে উঠলো এবং সঙ্গে সঙ্গে উঠতে লাগলো উপরের দিকে।

আশ্চর্য হলো হ্যারিসন স্মিথ, যে জায়গায় এসে দাঁড়ালো তাদের মেঝেটা, সেটা মিসেস এলিনার বিশ্রামকক্ষ।

মিসেস এলিনা বললো–হ্যারিসন, ভাগ্যিস তুমি কথা বলোনি। মহাজন ক্যারিলং যদি অপর একটা কণ্ঠ ঐ কক্ষে শুনতো তাহলে রক্ষা ছিলো না। হ্যারিসন, তুমি হয়তো জানো না ঐ ক্যাবিনে কারও সাধ্য নেই প্রবেশ করে একমাত্র আমি ছাড়া।

কারণ?

 কারণ ঐ ক্যাবিনে প্রবেশের কৌশল কাউকে জানানো মানা আছে?

 তাই নাকি, তা তো……

জানতে না, এইতো?

হাঁ।

তুমি কেন, কেউ জানে না মহাজন ক্যারিলংয়ের কঠিন সে নির্দেশের কথা। বহুদিন ধরে আমাকে নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তারপর, বুঝলে হ্যারিসন..

কি দরকার ওসব আমার বুঝে, না বুঝাই ভাল।

না, আমি সবকিছু তোমাকে বলতে চাই, কারণ নাংহা ধ্বংস করার পর আমি আর ক্যারিলংয়ের কঠিন নির্দেশ পালনে রাজি নই।

হ্যারিসন স্মিথ বললো–এত অল্প সময়ে আপনি বিগড়ে গেলেন মিসেস এলিনা?

তোমাকে তো আগেই বলেছি চিরদিন আমি এদের হুকুমের চাকর হয়ে থাকতে রাজি নই।

 মিসেস এলিনা

হাঁ হ্যারিসন, মহাজন ক্যারিলং সুনাম অর্জন করছে আর পয়সাও কামাচ্ছে লাখ লাখ ডলার……

আর আপনিও তো……কথা শেষ না করে হাসে হ্যারিসন স্মিথ।

মিসেস এলিনা বলে উঠলো–মোটেই না। শুধু সুনামের জন্যই আমি কাজ করছি। গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে সুমান অর্জন করেছিলাম একসময় এবং সে কারণেই আমি মহাজন ক্যারিলংয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম, তাই তো সে আমাকে বেছে নিয়েছিলো এই কাজে…কিন্তু……।

মিসেস এলিনা, আপনার জীবন কাহিনী আমি কিছু কিছু অবগত আছি, কিন্তু কি বলুন?

হ্যারিসন, মহাজন ক্যারিলং আমাকে তার পুতুল হিসেবে ব্যবহার করছে। সে যা বলছে আমি তার নির্দেশমত কাজ করছি।

এতে আপনার লাভ?

 লাভ..হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো–লাভ প্রতিহিংসা চরিতার্থ। মহাজন ক্যারিলং শুধু এই কাজেই ব্যস্ত নেই, কালাই থেকে লাখ লাখ টাকার সামগ্রী গোপনে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এতে আমাদের কোটি কোটি টাকা লাভ হচ্ছে। হ্যারিসন, তুমি তো সব জানো তবু কেন না জানার ভান করছো বলো তো?

ঠিক ঐ মুহূর্তে রহমান ও কায়েস মিসেস এলিনার কোনো এক অনুচরের দৃষ্টিতে পড়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠে বিপদ সংকেতধ্বনি।

কয়েকজন মিলে আক্রমণ করে রহমান এবং কায়েসকে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।

রহমান এবং কায়েস কম শক্তিশালী নয়, তারা কৌশলে পরাজিত করে চলে মিসেস এলিনার অনুচরদের।

যুদ্ধ বা লড়াই চলাকালে রহমান এবং কায়েস তাদের ডুবুরী পোশাক বা ডুবুজাহাজের গোপন কক্ষ থেকে উদ্ধার করে নিয়েছিলো তা অতি সাবধানে রক্ষা করে চলে।

মিসেস এলিনা বিপদ সংকেতধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো এবং উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো নিশ্চয়ই দস্যু বনহুরকে খুঁজে পাওয়া গেছে।

চলুন মিসেস এলিনা, দেখা যাক কি ঘটনা?

কিন্তু এ মুহূর্তে আমি একটুও সময় নষ্ট করতে পারছি না হ্যারিসন। কথা শেষ করেই একটা সুইচে চাপ দেয় মিসেস এলিনা।

সঙ্গে সঙ্গে একটা সুড়ঙ্গমুখের মত দরজা বেরুলো দেয়ালের গায়ে।

মিসেস এলিনা সেই সুড়ঙ্গে প্রবেশ করলো।

হ্যারিসন স্মিথ বুঝতে পারলো মিসেস এলিনা নাংহা ধ্বংসে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। হ্যারিসন স্মিথ একদন্ড বিলম্ব না করে ছুটলো অপর দরজা দিয়ে পাশের ক্যাবিনে। একটা আলোর বল সেখানে জ্বলছে আর নিভছে। পাশেই একটা মেসিন ঘুরপাক খাচ্ছে, নিচে একটা বোম এবং হ্যান্ডেল।

হ্যারিসন স্মিথ আর দেখতে পেলো ওদিকে একটা টেলিভিশন সেট আর একটা ক্যামেরা। সে দ্রুত বোতাম টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশন পর্দায় পরিলক্ষিত হলো একটা জাহাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে সম্মুখদিকে। পূর্বের চেয়ে অনেক নিকটে মনে হচ্ছে জাহাজখানা।

বুঝতে পারলো হ্যারিসন স্মিথ আর বিলম্ব নেই, মিসেস এলিনার ধ্বংস মিটারের সীমার মধ্যে জাহাজখানা এসে গেছে। এবার মিসেস এলিনা ধ্বংস মিটারের সুইচ টিপলেই হাজার হাজার যাত্রী এবং মূল্যবান সামগ্রী সহ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গভীর পানির অতলে তলিয়ে যাবে।

হ্যারিসন স্মিথ সুইচ টিপলো সঙ্গে সঙ্গে অপর দেয়ালে বেরিয়ে এলো একটা দরজা। সে বুঝতে পারলো এটা লিফটের দরজা। সে মুহূর্ত বিলম্ব না করেই দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। টিপটাপ করে দুটো আলো জ্বলছে। আলোর উপরে দুটো লাল নীল বোতাম। হ্যারিসন স্মিথ লালবোম টিপলো, সঙ্গে সঙ্গে উপরে উঠতে লাগলো লিফটখানা। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, এমন এক জায়গায় এসে লিফট থামলো, সেখানে মিসেস এলিনা দাঁড়িয়ে টেলিভিশনে নাংহাকে লক্ষ্য করছে, তার ডান হাতখানা পাশের হ্যান্ডেলে, মুখের সামনে ওয়্যারলেস মেসিন। নাংহা ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুত এলিনা বুঝতে পারলো হ্যারিসন।

ঐ মুহূর্তে ওপাশের একটা দরজা দিয়ে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় ভিতরে প্রবেশ করলো আসল হ্যারিসন স্মিথ, তার হাত দু’খানা তখনও পিছমোড়া করে বাঁধা। মাথার চুল এলোমেলো, মুখ শুকনো বিবর্ণ, চোখেমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ, ললাটে দুশ্চিন্তার রেখা।

ওকে দেখামাত্র বিস্ময়ে থ’ হয়ে গেলো মিসেস এলিনা। ভুলে গেলো সে তার কর্তব্যকাজের কথা, অস্ফুট কণ্ঠে বললো হ্যারিসন তুমি……তোমার এ অবস্থা কেন? মিসেস এলিনা ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত লক্ষ্য করে কথাগুলো বলে উঠলো।

হ্যারিসন কিছু বলবার পূর্বেই পুনরায় বলে উঠলো মিসেস এলিনা–একটু পূর্বেই তোমাকে যে অবস্থায় দেখলাম……।

হ্যারিসন স্মিথ অসহায় কণ্ঠে বললো–মিসেস এলিনা, একটু পূর্বে যে হ্যারিসনকে আপনি দেখেছেন সে আমি নই…

বল কি হ্যারিসন।

হাঁ, আমি আজ চারদিন তিন রাত্রি এই অবস্থায় ডুবুজাহাজের ইঞ্জিন মেশিনের ফাঁকে পড়েছিলাম….

তাহলে?……

সে স্বয়ং দস্যু বনহুর।

দস্যু বনহুর–বলো কি!

এখানে যখন মিসেস এলিনা নাহহা ধ্বংস করতে গিয়ে আসল হ্যারিসন স্মিথকে দেখে ভীষণ চমকে উঠলো, তখন নকল হ্যারিসন স্মিথ স্বয়ং দস্যু বনহুর দ্রুত লিফট থেকে নেমে চললো সে ক্যাবিনের দিকে যে ক্যাবিনের সন্ধান একমাত্র মিসেস এলিনা ছাড়া আর কেউ জানে না।

একটু এগুতেই রহমান এবং কায়েস এসে দাঁড়ালো বনহুরের সম্মুখে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে রহমানের বাম চিবুক।

কায়েসের দেহেও অনেক জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, রক্ত ঝরছে এবং জামাকাপড় লাল হয়ে উঠেছে। সর্দারকে দেখামাত্র কুর্ণিশ জানালো উভয়ে।

বনহুর দ্রুত কণ্ঠে বললো—অদৃষ্ট ভাল তাই তোমাদের সাক্ষাৎ ঘটলো, নইলে এই ডুবুজাহাজের সঙ্গে তোমরাও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অতলে তলিয়ে যেতে……মুহূর্ত বিলম্ব করো না, তোমাদের পোশাক পরে নিয়ে তাড়াতাড়ি জুববার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো এবং শীঘ্র পায়রা ডুবুজাহাজের কাছ থেকে সরে যাও….

সর্দার আপনি!

আমার জন্য ভেবো না।

রহমান তৃতীয় পোশাকটা বনহুরের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো–সর্দার, এটা আমরা সংগ্রহ করে নিয়েছি আপনার জন্য।

বনহুর রহমানের হাত থেকে পোশাকটা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিয়ে পরে ফেলে এবং রহমান ও কায়েসকেও পরতে বলে। রহমানও কায়েস দ্রুত পরে নেয়।

বনহুর বললো–তোমরা একটুও দেরী করোনা……কথাটা বলে বনহুর চলে গেলো সম্মুখের মেশিনটার ফিতা বেয়ে উপরে, এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ালো যেখানে শুধু সারি সারি সুইচ রয়েছে।

সাত নম্বর সুইচ টিপলো বনহুর।

অমনি মেঝেটা নামতে লাগলো নিচের দিকে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, সেই কক্ষে এসে পৌঁছে গেলো বনহুর যে কক্ষ এই মুহূর্তে তাকে সবকিছুর সমাধান করে দেবে, মেশিনকক্ষের নিচে সেই চোরা ক্যাবিন। বনহুর তাকালো চোরা ক্যাবিনের দক্ষিণ কোণে, দেখলো সত্যিই একটা বিরাট অদ্ভুত মেশিন। তারপর ফিরে তাকালো সে উত্তর কোণে……হাঁ, ওখানে একটা সুই রয়েছে। বনহুরের কানের কাছে প্রতিধ্বনিত হলো–ঐ সুইচটাই হলো এই ডুবুজাহাজটার প্রাণ……মিসেস এলিনার কন্ঠস্বর পুনরায় প্রতিধ্বনিত হয়…..যদি কোনো মুহূর্তে বিপদ আসে তাহলে ঐ সুইচে চাপ দিলেই এই ডুবুজাহাজখানা ধ্বংস হয়ে যাবে, কাজেই ঐ যে দেখছো ঐ জলজন্তু ধরনের বস্তুটা, ওটাই হলো নিজেদের বাঁচাবার একমাত্র পথ…এই যে সুইচ দেখছো, এই সুইচে চাপ দিলেই কাঁচের দরজার খুলে যাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ঐ অদ্ভুত যানটি এগিয়ে আসবে দ্রুতগতিতে…যানটির মুখ খুলে যাবে, আমরা প্রবেশ করব ঐ যানের মধ্যে…যানটিতে চেপে বসার সঙ্গে সঙ্গে যানটি বেগে ছুটতে থাকবে মিনিটে একশ’ মাইল…এত এলোমেলো।

বনহুরের হুশ হলো, আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করা তার উচিত হবে না। এতক্ষণে মিসেস এলিনা হয়তো হ্যারিসনের অবস্থা নিয়ে ভাবনা শেষ করে নিয়েছে। রহমান এবং কায়েস তারাও ডুবুজাহাজ থেকে সরে পড়েছে এবং সরে গেছে অনেক দূরে। কিন্তু বেশিক্ষণ চিন্তা করবার সময় নেই। বনহুর ক্ষিপ্রগতিতে ক্যাবিনটার উত্তর কোণে সুইচটার পাশে গেলো এবং সুইচে চাপ দিলো। মাত্র এক সেকেন্ড, অষণভাবে দুলে উঠলো ডুবুজাহাজখানা। পরক্ষণেই বনহুর দরজার মুখের সুইচ টিপলো সংগে সংগে কাঁচের দরজা খুলে গেলে সেই অদ্ভুত ধরনের জলযানটা একেবারে সেই দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

বনহুর কালবিলম্ব না করে কাঁচের দরজা দিয়ে ওপাশে সেই বিস্ময়কর জলযানটার মধ্যে প্রবেশ করে, অমনি জল্যানটার মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

বনহুর দেখতে পায় জলযানটার ভিতরে নানা ধরনের মেসিন এবং কলকজা। সম্মুখে একটা সুইচ। বনহুর সুইচটা টিপলো, অমনি গভীর জল ভেদ করে তীরবেগে ছুটতে শুরু করলো জলযানটা।

জলযানটার দু’পাশে দুটো আয়নার চোখ। একটা সামনে অপরটা পিছনে। বনহুর সেই চোখ দিয়ে সম্মুখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো, জলযানটা এত দ্রুত চলছে দুপাশে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ ভীষণ একটা আওয়াজ তোলপাড় করে উঠলো জুবরার পানি। বনহুর হ্যান্ডেল চেপে ধরে পিছনে তাকালো। শুধু পানির প্রচন্ড আলোড়ন ছাড়া কিছুই নজরে পড়লো না।

বুঝতে পারলো বনহুর ডুবুজাহাজখানা মিসেস এলিনা এবং তার দলবল সহ বুজরার অতল গহ্বরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। বনহুরের মনটা আনন্দিত হয়ে উঠলো, যাক তার প্রচেষ্টা সফল হলো কিন্তু মহাজন ক্যারিলং……কে সে যে মিসেস এলিনা ও তার দলবলকে পরিচালনা করতে যেমন করে থোক তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। মিসেস এলিনার মুখে যতটুকু জানতে পেরেছে তাতেই চলবে।

অদ্ভুত জলযানটা তীরের সন্নিকটে পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গে যানের ভিতরে অকস্মাৎ লাল আলো জ্বলে উঠলো। বনহুর লক্ষ্য করলো জলযানটা যেন ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে উপরের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জুবরা নদের বুকে ঠিক তিমি মাছের মত ভেসে উঠলো যানটা।

বনহুর সম্মুখের কাঁচের আবরণের মধ্য দিয়ে তাকাতেই বিস্মিত হলো, স্পষ্ট দেখতে পেলো দূর থেকে একটা সীমার তার জলযানটাকে লক্ষ্য করছে। স্টীমারের ডেকে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কারও কারও হাতে দূরবীক্ষণ যন্ত্র। চোখে দুরবীক্ষণ যন্ত্র লাগিয়ে চারদিকে লক্ষ্য করছিলো তারা। হঠাৎ তার জলযানটা নজরে পড়ায় স্টীমার তার জলযানটার দিকে এগিয়ে আসছে।

বনহুর লক্ষ্য করলো, তার জলযানটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ জলযানটা থেমে গেলো এবং ভেসে ভেসে উঠলো উপরে, সত্যিই যেন আশ্চর্যকর বটে। পায়ের নিচে একটা বোতম ধরনের কিছু দৃষ্টিগোচর হলো।

সেই অদ্ভুত বোতামটার উপর পা দিয়ে চাপ দিলে বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে জলযানটার উপরে ছাদের ঢাকনা খুলে গেলো। একটা হিমেল হাওয়া বনহুরের শরীরে এসে লাগলো। বনহুর বেরিয়ে এলো বাইরে।

উপরে উঠে দাঁড়াতেই দেখলো স্টীমারখানা অত্যন্ত দ্রুত জলযানটার দিকে এগুচ্ছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্টীমারের ডেকে লোকগুলোর মধ্যে একটি নারীও রয়েছে। নারীটির হাতেও দূরবীক্ষণ যন্ত্র, সে দূরবীক্ষণ যন্ত্র চোখে লাগিয়ে দেখছে সম্মুখের দিকে, হয়তো বা তারই অদ্ভুত জলযানটাকেই লক্ষ্য করছে তারা সবাই মিলে।

অল্পক্ষণের মধ্যেই স্টীমারখানা জলযানটার নিকটে পৌঁছে গেলো।

 বনহুর বিস্ময়ভরা চোখে দেখলো স্টীমারের ডেকে দাঁড়িয়ে আছে মিস লুনা এবং মিঃ লোদী সহ আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার।

স্টীমারখানা জলযানটার নিকটবর্তী হতেই মিস লুনা উচ্চস্বরে বলে উঠলো–মিঃ ম্যারোলিন! মিঃ ম্যারোলিন, আপনার ছবির কাজে যোগ দেবার জন্য এসেছি……।

 বনহুর স্তব্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে মিস লুনার দিকে। দ্বীপ্ত উজ্জ্বল মিস লুনার চোখ দুটো, সোনালি চুলগুলো সূর্যের আলোতে আরও সোনালি লাগছে, চক্ চক্ করছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে মিঃ লোদী এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা সেদিন মিস লুনার অমৃত সুধা পান করেছিলেন তারা।

অদ্ভুত জলযান থেকে বনহুরকে তুলে নেওয়া হলো স্টীমারে। মিঃ লোদী এবং পুলিশমহল অভিনন্দন জানালেন তাকে। সবাই হাত মিলালেন এক এক করে বনহুরের সঙ্গে।

মিঃ লোদীর কথায় বনহুরের বিস্মিত হবার কথা ছিলো কিন্তু বনহুর কোনো রকম বিস্ময় প্রকাশ করলো না, কারণ সে বুঝতে পেরেছে মিস লুনা পুলিশমহলকে সব জানিয়েছে। তবে ভিতরে ভিতরে অবাক হলো, কারণ জুবার গভীর পানির তলায় বনহুর কিভাবে কাজ করেছে এবং কি করেছে পুলিশমহল জানলো কি করে!

বনহুরকে ভাবতে দেখে বললেন মিঃ লোদী–আপনি জানেন না মিঃ ম্যারেলিন, মিস রুনা যদিও মিসেস এলিনার একজন বিশ্বস্ত সহকারিণী কিন্তু আসলে সে আমারদেরই গোয়েন্দা বিভাগের লোক। বহুদিন যাবৎ আমরা এই কুচক্রীদলকে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছি কিন্তু সফলকাম হইনি। মিস লুনার বিশ্বাস ছিলো আপনিই একমাত্র শক্তিশালী ব্যক্তি যার দ্বারা এই কুচক্রীদলকে শায়েস্তা করা সম্ভব। কথাগুলো বলে থামলেন মিঃ লোদী।

বললো মিঃ লুনা–মিঃ ম্যারোলিন, কৌশলে আপনাকে বাক্স বন্দী করে হাজির করেছিলাম জুবার তলদেশে কুচক্রীদের ডুবুজাহাজে মিসেস এলিনার সম্মুখে। আমি জানতাম আপনি ছাড়া কেই একাজে জয়যুক্ত হতে পারবে না। মিঃ ম্যারোলিন, আমি নিজেও আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

বনহুর এতক্ষণ গম্ভীর হয়ে কিছু ভাবছিলো, এবার সে বললো– মিঃ লোদী এবং মিস রুনা, জুবরার তলদেশের কুচক্রীদলসহ ডুবুজাহাজখানাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হলেও আমি আসলে সফলকাম হইনি, কারণ কুচক্রীদলের নেতা মহাজন ক্যারিলং এখন কোথায় অবস্থান করছে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

মিস লুনা বলে উঠলো–মহাজন ক্যারিলংকে খুঁজে বের করতে আমি আপনাকে সহায়তা করবো, আমি আছি আপনার সঙ্গে….

ধন্যবাদ মিস লুনা, সত্যিই আপনি একজন বুদ্ধিমতী নারী। জানি আপনার সহায়তা পেলে মিঃ মারোলিন অসাধ্য সাধনে সক্ষম হবেন।

মৃদু হেসে তাকালো বনহুর মিস লুনার মুখের দিকে।

লুনার চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আবার সে ওকে সহায়তা করবার সুযোগ পেলো, এ যেন মিস লুনার সৌভাগ্য।

এমন সময় একজন পুলিশ অফিসার বলে উঠলেন–ঐ যে কালো মত পাশাপাশি দুটো কি যেন ভেসে যাচ্ছে।

সবাই তাকালো জলতরঙ্গের দিকে।  

[পরবর্তী বই ক্যারিলং ও দস্যু বনহুর]

1 Comment
Collapse Comments
Mohammad Masud Hosain Rana January 11, 2024 at 8:39 am

অসাধারণ গল্প

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *