তুমি যখন আঠেরো প্লাস (গল্প)

তুমি যখন আঠেরো প্লাস (গল্প)

—তখন তোমার জীবন যাবে পালটে৷ আসলে এই আঠেরো সংখ্যাটার মধ্যেই একটা ম্যাজিক আছে৷ কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে ওঠার ম্যাজিক৷ এই ম্যাজিক মোমেন্টের ওদিকে তুমি ছিলে কিশোরী—আর এদিকে ঝলমলে তরুণী৷ দ্য সুইচিং পয়েন্ট৷ যেন এই পারটিকুলার মোমেন্টে তুমি একটা লুকোনো সুইচ অন করে দিলে, আর তোমার মাইন্ড, বডি অ্যান্ড সোলে দপ করে নানান রঙের আলো জ্বলে উঠল৷ বল, ঠিক বলছি না?’ চট করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাস্তার একটা বাঁককে ম্যানেজ করলেন সোমরঞ্জন৷ তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের সিটে বসে থাকা মেয়ে রূপরেখার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচালেন৷

সোমরঞ্জনের পাশে বসে থাকা রূপশ্রী স্বামীর গালে আলতো চাপ দিয়ে ওঁর মুখটাকে সামনের রাস্তার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন: ‘নাও, এবার সামনে তাকাও—নইলে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবে!’ তারপর রূপরেখার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বুঝলি, রুপি, ইয়াং এজে তোর ড্যাড সাহিত্য-টাহিত্য করত৷ ওই লিটল ম্যাগ নিয়ে বিগ-বিগ ব্যাপার…৷’

‘লিটল ম্যাগের মর্ম তুমি কোনওদিনই বুঝতে চাইলে না, শ্রী৷’ সোমরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আর তেমনই বোঝোনি আঠেরো বছর বয়েসটা ছুঁয়ে ফেলার মর্ম৷ টুডে ইজ আ গ্রেট ডে ফর রুপি৷ আর অ্যাপ্রক্সিমেটলি এক ঘণ্টার মধ্যে ও সেই ম্যাজিক মোমেন্টকে টাচ করে ফেলবে৷ আমরা তিনজনে মিলে সেই ইভেন্টটাকে সেলিব্রেট করব…৷’

যদিও ওকে ঘিরেই সব কথাবার্তা তবুও রূপরেখা চুপ করেই ছিল৷ তাকিয়ে ছিল সামনের কালো রাস্তার দিকে৷ হেডলাইটের সাদা আলো পড়েছে সেখানে৷ সেই আলোয় রুপোলি ঝালরের মতো চিকচিক করছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মিহি ফোঁটা৷

আজ বিকেল থেকেই ড্যাড আর মমের সঙ্গে ডে-আউটে বেরিয়েছে রূপরেখা৷ আজ ওর জন্মদিন ঠিকই, কিন্তু ড্যাড আর মম সেটা নিয়ে যেন একটু বেশিরকম আদেখলেপনা করছে৷ বলছে, আঠেরো বছর পার করে উনিশ ছুঁয়ে ফেলাটা নাকি দারুণ স্পেশাল ব্যাপার৷

অন্যান্য বছরেও তো রূপরেখার জন্মদিন আসে, জন্মদিন যায়৷ সেই দিনগুলোয় জন্মদিনের সেলিব্রেশানও করা হয়৷ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব আসে, ড্যাড অফিস থেকে সেদিন জলদি-জলদি ফেরে৷ মম একটা বিউটি পার্লার চালায়৷ কিন্তু রুপির বার্থডের দিন তিন ঘণ্টা আগে পার্লার বন্ধ করে বাড়ি চলে আসে৷ তারপর সবাই মিলে হই-হুল্লোড় হয়, খাওয়া-দাওয়া হয়৷ বেশ মজা আর আনন্দে কাটে দিনটা৷

কিন্তু এবার ব্যাপারটাই যেন আলাদা৷

মম দু-দিন আগে থেকেই বলে দিয়েছে, রুপির এবারের জন্মদিনটা একটু অন্যরকম, কিন্তু দারুণভাবে সেটা সেলিব্রেট করা হবে৷ এবং সেই স্পেশাল সেলিব্রেশানে থাকবে শুধু তিনজন: রূপরেখা, ওর মম, আর ড্যাড৷ মম আর ড্যাড এও বলেছে, এবারে আর ইনডোর সেলিব্রেশান নয়, সবটাই হবে আউটডোরে, খোলা আকাশের নীচে, প্রকৃতির খুব কাছাকাছি৷

বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই ওরা তিনজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে৷ স্টিয়ারিং-এ সোমরঞ্জন৷ পাশে রূপশ্রী৷ আর পিছনের সিটে বার্থডে গার্ল রূপরেখা৷

আকাশে তখন মেঘ থাকলেও একটা কনে-দেখা-আলো ছড়িয়ে ছিল চারিদিকে৷ কিন্তু তারপর মেঘের ওপরে মেঘ জমেছে৷ শুরু হয়েছে বৃষ্টি—তবে তেমন জোরে নয়, ঝিরিঝিরি৷ যেমন এখন চলছে৷

সোমরঞ্জন গাড়ি চালাচ্ছিলেন, আর আপনমনে বকবক করছিলেন৷ রূপরেখার ছোটবেলার কথা বলছিলেন, বলছিলেন ওর স্কুলজীবনের নানান কাণ্ড-কারখানার কথা৷ যেমন, ও ছোটবেলায় টিফিন না খেয়ে সেটা স্কুলের উঠোনের গাছতলায় ঘুরে বেড়ানো ‘ম্যাঁও’ আর উড়ে বেড়ানো কাককে খাইয়ে দিত৷

সেটা জানাজানি হওয়ার পর মম যখন ওকে জিগ্যেস করেছে, ‘এ কী ব্যাপার, রুপি! তুমি নিজের টিফিন এভাবে বিলিয়ে দাও কেন?’ তখন রুপি বলেছে, ‘ওরা তো রোজ স্কুলে আসে, কিন্তু টিফিন আনে না! তাই আমি ওদের টিফিন খাওয়াই—৷’

একবার ওর স্কুলের এক ম্যাডাম বিয়ের জন্য বেশ কিছুদিন ছুটি নিয়েছিলেন৷ তো বিয়ের পর তিনি যখন আবার ওদের ক্লাস নেওয়া শুরু করেন তখন রূপরেখা আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে ম্যাডামকে বলেছিল, ‘ম্যাম, আমিও আপনার মতো বিয়ে করব, সিঁদুর পরব—৷’

গোটা ক্লাস জুড়ে হাসির রোল উঠেছিল৷

ম্যাডাম একটুও রাগ না করে ওকে বলেছিলেন, ‘অফ কোর্স বিয়ে করবে, সিঁদুর পরবে৷ তবে তোমাকে চোদ্দো-পনেরো বছর ওয়েট করতে হবে, রূপরেখা—৷’

আবার হাসির রোল৷

হাসির রোল উঠেছে গাড়িতেও৷ সোমরঞ্জন কথায়-কথায় হেসে ওঠেন৷ আর ওঁর হাসি মানেই অট্টহাসি৷ হাসির সঙ্গে-সঙ্গে ওঁর ভুঁড়ি কেঁপে-কেঁপে ওঠার কথা, কিন্তু স্টিয়ারিংটা ভুঁড়িতে চেপে বসায় কাঁপুনির অসিলেশানে ড্যাম্পিং ফ্যাক্টর কাজ করছে৷

রূপশ্রী ভুরু কুঁচকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘উঃ, এত জোরে-জোরে হাসছ কেন? আমার ডানদিকের কানটা তো কালা হয়ে যাবে—!’

রূপরেখা সোমরঞ্জনের কলারে ছোট্ট টান মেরে বলল, ‘ওঃ, ড্যাড! তুমি এত জোরে হাসো যে ভীষণ আনসিভিলাইজড৷ তোমাকে অফিসে কিছু বলে না? জানো, এরকম লাউডলি হাসলে গ্র্যাভিটি কমে যায়!’

‘শোন, শোন, রুপি৷ মোটাসোটা মানুষরা দিলখোলা হয়, তাই প্রাণ খুলে হাসে৷ আর যারা…৷’

সোমরঞ্জন আড়চোখে স্ত্রীকে দেখলেন৷ রূপশ্রী যথেষ্ট স্লিম৷ এবং রোগা থাকার চেষ্টায় বলতে গেলে ঘাস-পাতা ইত্যাদি খেয়ে দিনযাপন করেন৷ আর রূপরেখাও বেশ তন্বী৷ সুতরাং, সোম বুঝলেন, ওঁর সেনটেন্সের শুরুটা ভুলভাল হয়ে গেছে৷ তাই মরিয়া হয়ে কারেকশনের চেষ্টায় বললেন, ‘আর যারা রোগা, তারাও দারুণ দিলখোলা দিলদরিয়া হয়৷ তা ছাড়া তারা দেখতেও হেবি সুন্দর হয়…৷’

রূপরেখা পিছনের সিট থেকে বলে উঠল, ‘ড্যাড, কী হচ্ছে এবার?’

গাড়ির ভেতরে ওরা তিনজনে এরকম মজা-মশকরায় মশগুল ছিল৷

নির্জন রাস্তা ধরে একঘেয়েভাবে গাড়ি চলছিল৷ রাস্তা কখনও-কখনও বাঁক নিচ্ছিল৷ রূপরেখা গুনগুন করে গান করছিল৷ রূপশ্রীও তার সঙ্গে গুনগুনিয়ে গলা মেলালেন৷

হঠাৎই রাস্তার ধারে একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ল রুপির৷

গাড়িতে এসি চলছে বলে সব কাচ তোলা৷ বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷ জানলায় ভাপ জমেছে৷ কিন্তু এতরকম অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও সাইনবোর্ডের লেখাটা রুপি পড়তে পারল, কারণ, ও উইন্ডশিল্ডের মধ্যে দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চলছে বলে ওর একটু একঘেয়ে লাগছিল৷ লাস্ট ফর্টি মিনিটস ধরে ড্যাড গাড়ি চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই! তাই ও নতুন কিছু দেখার আশায় মুখিয়ে ছিল৷

সাইনবোর্ডের লেখাটা ভারী অদ্ভুত:

কেন? রাস্তাটা নিরাপদ নয় কেন? সাবধানে গাড়ি চালাতেই বা বলছে কেন?

রুপির কপাল ভালো যে, ইংরেজিটা সঙ্গে থাকার জন্য সরকারি বাংলা ‘অ-নিরাপদ’ পড়ে ও আসল মানেটা বুঝতে পেরেছে৷

কিন্তু ব্যাপারটা কী? কীসের ভয় আছে এখানে?

সে-কথাই ও রূপশ্রীকে জিগ্যেস করলঃ ‘মম, এই রাস্তাটায় কীসের ভয়? কেয়ারফুলি ড্রাইভ করতেই বা বলছে কেন?’

রূপশ্রী কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন৷ তাকালেন সোমরঞ্জনের দিকে৷ অন্ধকারে ওঁর মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না৷ দু-হাতে স্টিয়ারিং মুঠো করে ধরে আছেন৷ তাকিয়ে আছেন সামনের রাস্তার দিকে৷

সোম রূপশ্রীর তাকিয়ে থাকাটা কীভাবে যেন অনুভব করলেন৷ শব্দ করে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘ও. কে.—আমিই বলছি৷’ ঘাড় ঘুরিয়ে রূপরেখার দিকে তাকালেন: ‘শোন, রুপি…ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং৷ তুই কি কখনও ওয়্যারউলফের কথা শুনেছিস বা পড়েছিস?’

‘ওয়্যারউলফ? হোয়াট ইজ দ্যাট? তোমাদের মুখে তো কখনও এই পিকিউলিয়ার ওয়ার্ডটা শুনিনি!’

‘শুনিসনি বিকজ তোর সামনে আমরা কখনও ওয়্যারউলফের টপিকটা ডিসকাস করিনি৷ তবে একটু পরেই করতাম, বিকজ টুডে ইজ আ স্পেশাল ডে৷’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর সোম বললেন, ‘ওয়্যারউলফ—মানে, মানুষ- নেকড়ে…অথবা নেকড়ে-মানুষ৷’

‘নেকড়ে-মানুষ!’ রূপরেখার গলায় ভয় আর বিস্ময়৷

‘তুই ফর নাথিং ভয় পাচ্ছিস, রুপি—৷’ মেয়ের ভয় কমাতে আশ্বাস দিলেন রূপশ্রী, ‘ব্যাপারটা খুব সিম্পল৷ কোনও-কোনও মানুষ এক-একসময় নেকড়েতে পালটে যায়৷ মানে, হাফ অ্যানিম্যাল, হাফ ম্যান৷ যাকে বলে ওয়্যারউলফ৷ এই ওয়্যারউলফরা ভীষণ হিংস্র হয়, ওদের গায়ে অসম্ভব শক্তি৷’

‘কিন্তু হঠাৎ করে কোনও-কোনও মানুষ এরকম পালটে যায় কেন?’ রূপরেখা অবাক হয়ে জানতে চাইল এবার৷

বাইরে বৃষ্টির চেহারা একইরকম৷ তবে বৃষ্টি-ভেজা রাস্তার দু’পাশে এখন শুধুই গাছপালা আর জঙ্গল৷ কোনও লোকজন চোখে পড়ার কোনও প্রশ্নই নেই৷

মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিলেন সোমরঞ্জন, ‘কেন যে এমন ট্রান্সফরমেশান হয় সেটা এখনও কেউ জানে না৷ সায়েন্টিস্টরা এখনও এই প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়াচ্ছে৷ তবে অনেকের ধারণা, ব্যাপারটা জিনের সঙ্গে রিলেটেড এবং এটা এক ধরনের অসুখ৷

‘একটা সময় ছিল, যখন এই টাইপের অসুস্থ মানুষরা পূর্ণিমার রাতে ওয়্যারউলফের চেহারায় পালটে যেত৷ কিন্তু পরে দেখা গেছে, পূর্ণিমার রাতের এই নিয়মের বাইরেও কোনও-কোনও মানুষ নেকড়ে-মানুষে পালটে যাচ্ছে৷ কেউ পূর্ণিমার বদলে অমাবস্যার চক্র মেনে চলছে৷ কেউ বা নিজের ইচ্ছেয় চেহারা পালটাতে পারছে৷ কেউ আবার নেকড়ে-মানুষের বদলে অন্য চেহারা নিতে পারছে৷ আসলে পুরো ব্যাপারটাই জিনের ম্যাজিক৷ এ-জিন কিন্তু আলাদিনের প্রদীপের জিন নয়—এ-জিন হল আমাদের শরীরের ভেতরের ব্যাপার—মানে, বংশাণু, বুঝলি?’

‘কী এক্সাইটিং, ড্যাড!’ অবাক হওয়ার আনন্দ-উত্তেজনা রূপরেখাকে ছুঁয়ে ফেলেছেঃ ‘আচ্ছা, একটা ওয়্যারউলফ যখন নরমাল থাকে তখন তাকে দেখে কি বোঝা যায় যে সে, আই মিন, একজন মানুষ যদি আসলে ওয়্যারউলফ হয়, তা হলে তাকে দেখে সেটা বোঝার কি কোনও ওয়ে আছে?’

‘ব্যাপারটা এত সিম্পল নয়, রুপি৷’ মম এবার কথা বলল, ‘বিকজ ওয়্যারউলফ অনেক রকমের হয়৷ যেমন, ফুল মুন ওয়্যারউলফ, নিউ মুন ওয়্যারউলফ, শেপ শিফটার, সাইকললেস ওয়্যারউলফ—আরও অনেক-রকম৷ আমরা যতদূর জানি, নিউ মুন ওয়্যারউলফ ছাড়া আর কোনও টাইপের ওয়্যারউলফকে চিনে ফেলার কোনও উপায় নেই…৷’

‘নিউ মুন ওয়্যারউলফকে চেনা যায়!’ অবাক হয়ে বলল রূপরেখা, ‘বাট হাউ? কীভাবে চেনা যায়, মম?’

রূপশ্রী একবার তাকালেন সোমরঞ্জনের দিকে৷ আজ রুপির জন্মদিন৷ বিকেল থেকে ওঁরা তিনজন কত না আনন্দ করেছেন! সুখিয়ানা নদীর তীরে ‘ড্রিমল্যান্ড’ থিম পার্কে গেছেন৷ সেখানে মনের সুখে বোটিং করেছেন৷ সমুদ্রের নকল ঢেউয়ে লাফালাফি করে স্নান করেছেন৷ হরেকরকম রঙিন ফুল আর গাছ দিয়ে সাজানো চোখভোলানো মনভোলানো বনানীতে অসংখ্য রঙিন পাখপাখালির ফটো তুলেছেন৷ সেখানে ছুটোছুটিও করেছেন তিনজনে৷ ওঁদের বয়েস যেন দশবছর করে কমে গিয়েছিল৷ তারপর শুরু হয়েছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি৷ কিন্তু বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই ওঁরা আনন্দ করেছেন৷ রূপরেখাকে খুশি দেখে ওঁদের খুশি অনেক বেড়ে গেছে৷ সন্ধের পর ‘ড্রিমল্যান্ড’-এর পশ রেস্তোরাঁয় আর্লি ডিনার সেরে তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন৷ এবং ইচ্ছে করেই এই অ-নিরাপদ রাস্তা ধরে ওঁরা এখন চলেছেন৷ কারণ, আঠারো পেরোলেই রূপরেখা হিসেব মতো বড় হয়ে যাবে৷ তখন ওর ভয়ের একটু মুখোমুখি হওয়া দরকার, ভয়ের সঙ্গে মোকাবিলা হওয়া দরকার৷ ভাগ্যিস ওই রোড সাইনটা দেখে রুপি নিজেই ইস্যুটা তুলল৷ না তুললে রূপশ্রী অথবা সোমরঞ্জন অবশ্যই তুলতেন৷

‘মম, কী হল? টেল মি, কী করে নিউ মুন ওয়্যারউলফকে চেনা যায়—৷’

‘আমি বলছি৷’ সোমরঞ্জন রূপশ্রীর অস্বস্তি যেন সূক্ষ্ম বেতার তরঙ্গে টের পেলেন৷ সামনে সোজা রাস্তা—কোনও বাঁক চোখে পড়ছে না৷ শুধু চোখে পড়ছে আকাশ থেকে ওপরওয়ালার ছিটিয়ে দেওয়া শান্তির জল, আর দু’পাশের গাছপালা৷ আর কখনও-কখনও রাস্তার ধারে পার্ক করে রাখা একটা কি দুটো গাড়ি৷

‘শোন বলছি—’ ঘাড় ঘুরিয়ে রূপরেখার দিকে একবার দেখলেন সোমঃ ‘নিউ মুন ওয়্যারউলফদের হাতের আঙুল একটু পিকিউলিয়ার টাইপের হয়৷ ওদের দু-হাতের অনামিকা—মানে, রিং ফিঙ্গার—মধ্যমার সমান কিংবা তার চেয়ে একটু বড় হয়৷ তবে কেন যে এটা হয় সেটা এখনও কেউ জানে না…৷’

‘মধ্যমা মানে? কোন ফিঙ্গারটা?’ রুপি জানতে চাইল৷

‘মিডল ফিঙ্গার—৷’

রূপরেখা চুপ করে গেল৷

‘অবাক হোস না, রুপি—’ সোমরঞ্জন হেসে বললেন, ‘এসবই জিনের ম্যাজিক৷ জিনের প্যাটার্ন—মানে, স্ট্রাকচারের মধ্যেই সেই ম্যাজিক লুকিয়ে আছে৷ কেউ-কেউ ব্যাপারটাকে একটা অসুখ বলে মনে করে৷ তাই জিন থেরাপি দিয়ে ট্রিটমেন্টের চেষ্টা করে৷ কিন্তু তাতে সমাধান কিছু পাওয়া গেছে বলে শুনিনি…৷’

‘তোমরা ওয়্যারউলফ নিয়ে এত কথা জানলে কেমন করে?’

‘আমি আর তোর মম এই টপিকটা নিয়ে একটু-আধটু স্টাডি করেছি—স্রেফ নিজেদের ইন্টারেস্টে৷ সায়েন্টিস্টরা অবশ্য এখনও বলে, এই ওয়্যারউলফে পালটে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি একটা ইলিউশান৷ একটা সাইকোলজিক্যাল ট্রান্সফরমেশান৷ বাট বেশিরভাগ মানুষই এই থিয়োরিটা মেনে নেয়নি৷ তারা মনে করে, লাইক্যানথ্রপি—মানে, এই পালটে যাওয়ার ব্যাপারটা হান্ড্রেড পার্সেন্ট রিয়্যাল৷ আমাদেরও সেই একই ধারণা৷ যাকগে— যে-কারণে তোকে নেকড়ে-মানুষ—আই মিন, মানুষ-নেকড়ে নিয়ে এত কথা বলা…সেটা হচ্ছে ওই সাইনবোর্ড৷ বিপজ্জনক রাস্তা, সাবধানে গাড়ি চালান৷

‘রুপি, এই যে দু’পাশের গাছপালা আর জঙ্গল দেখছিস, এটা হচ্ছে ওয়্যারউলফদের প্রিয় এলাকা৷ এখানে এসে ওরা মনের সুখে শিকার ধরে৷ এই জঙ্গল ওদের হ্যাপি হান্টিং গ্রাউন্ড৷ সেইজন্যেই এই রাস্তা দিয়ে সাবধানে গাড়ি চালাতে হয়৷ এ-রাস্তায় খুব একটা কেউ আসে না…৷’

‘তা হলে আমরা এলাম কেন?’ প্রশ্নটা করার সময় রূপরেখার ভুরু কুঁচকে গেল৷

‘তোকে সাহসী করে তোলার জন্যে—’ রূপশ্রী মেয়ের প্রশ্নের জবাব দিলেন, ‘তুমি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আঠেরো প্লাস হবে৷ তুমি একটা মোমেন্টেই অ্যাডাল্ট হয়ে যাবে৷ তোমাকে সেই মোমেন্ট থেকে অ্যাডাল্ট হিসেবে সবকিছুর মোকাবিলা করতে হবে৷ সেই সঙ্গে ভয়েরও৷ তখন চট করে ভয় পেলে কিন্তু চলবে না…৷’

মমের কথা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই রূপশ্রী দেখল, দূরে রাস্তার ধারে নীল রঙের একটা ছোট গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা লোক৷ লোকটা বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে মাথার ওপরে দু-হাত তুলে নাড়ছে—গাড়ি থামাতে ইশারা করছে৷

‘ড্যাড, গাড়ি থামাবে না কিন্তু…৷’

‘কেন রে?’ সোমরঞ্জন মেয়ের দিকে আড়চোখে তাকানোর চেষ্টা করে হাসলেন, ‘নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের গাড়িটা বিগড়ে গেছে…৷ তার ওপর এই বৃষ্টি…!’

‘আননোন লোকদের লিফট দিতে গিয়ে কত ছিনতাই, ডাকাতি আর মার্ডার হয় নিউজপেপারে পড় না! ডোন্ট স্টপ, ড্যাড!’

‘রুপি, তুই ফর নাথিং ভয় পাচ্ছিস৷’ রূপশ্রী এবার মেয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বললেন, ‘আজ যদি আমাদের গাড়িটাই মাঝ-রাস্তায় খারাপ হত তা হলে আমরা কি লিফট চাইতাম না, হেলপ চাইতাম না, বল?’ তারপর স্বামীর দিকে তাকালেন: ‘সোম, আমাদের হেলপ করা উচিত…৷’

‘নিশ্চয়ই! এরকম বিপদে পড়ে একজন হেলপ চাইছে…৷’

সোমরঞ্জনের গাড়ির গতি কমতে শুরু করল৷ বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা ক্রমশ ওঁদের কাছে চলে আসতে লাগল৷ তারপর একসময় থামল৷

লোকটা বেশ লম্বা৷ ছ’ফুট কেন, তার বেশিও হতে পারে৷ হয়তো সেইজন্যেই সামান্য কুঁজো হয়ে গেছে৷ গায়ে শ্যাওলা রঙের একটা বর্ষাতি৷ মাথায় সাদা রঙের একটা ছোট ক্যাপ—বেশ শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে৷

গাড়ি থামতেই লোকটা ব্যস্তভাবে গাড়ির পিছনের দরজার কাছে চলে এল৷

‘রুপি, দরজাটা খুলে দে…৷’ রূপশ্রী বললেন৷

রূপরেখার ভীষণ রাগ হচ্ছিল৷ ড্যাড আর মম যেন হঠাৎ করে দয়ার অবতার হয়ে উঠল৷ এই রাতে বৃষ্টির মধ্যে এই শুনসান রাস্তায় অচেনা-অজানা উটকো একটা পাবলিককে হুট করে গাড়িতে তুলে নিল!

লোকটা মাথার টুপিটা খুলে বর্ষাতির পকেটে ঢোকাল৷ রূপরেখা দরজা খুলতেই সে চট করে বর্ষাতিটা খুলে ফেলল৷ অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় সেটা কার্পেটের মতো রোল করে গুটিয়ে ছোট করে ফেলল, ছুড়ে দিল গাড়ির মেঝেতে৷ তারপর তিন সেকেন্ডের মধ্যে উঠে বসল রূপরেখার পাশে, এবং দরজা বন্ধ করে দিল৷

কোনও কারণ ছাড়াই রূপরেখা ওর দিকের দরজার কাছে আরও সরে গেল৷

লোকটা বলল, ‘মেনি থ্যাংকস৷’ রূপকথার দিকে তাকিয়ে নড করল৷ তারপর সোমরঞ্জনকে লক্ষ করে বলল, ‘ভাগ্যিস আপনি গাড়ি থামালেন! নইলে এই বিচ্ছিরি ওয়েদারে কতক্ষণ সাফার করতাম কে জানে!…আমার নাম বিজয়েশ৷ সফটওয়্যারে আছি৷ অ্যাবাকাস স্কোয়ারে আমি নেমে যাব৷ আজ অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে এই ট্রাবল৷ এখন এই সিচুয়েশান থেকে উদ্ধার পেলে হয়!’

বিজয়েশ৷ নামটা তো অদ্ভুত! রূপরেখা ভাবছিল৷ ও একইসঙ্গে বিজয়েশকে লক্ষ করছিল৷

লম্বাটে মুখ৷ কপালটা বেশ বড় হয়ে মাথার টাকে মিশে গেছে৷ তবে সেই টাক মাথার আধাআধি পর্যন্ত৷ তারপরই দিব্যি চুল রয়েছে এবং সেই চুল লম্বা হয়ে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে৷

অন্ধকারে বিজয়েশের মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না৷ গাড়ির ড্যাশবোর্ডের আবছা আলো ওর কপালে, গালে, নাকের ডগা আর থুতনিতে হালকা হাইলাইট তৈরি করেছে৷

অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, ওর বেশ পুরু গোঁফ রয়েছে৷ আন্দাজে মনে হচ্ছিল, ওর বয়েস পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ হবে৷ কিন্তু বয়েসের তুলনায় গলাটা বেশ ভরাট৷

রূপরেখার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল৷ একইসঙ্গে বিরক্তও লাগছিল৷ বারবার করে বারণ করা সত্ত্বেও ড্যাড আর মম শুনল না৷ উটকো লোকটাকে সেই গাড়িতে তুলল!

বিজয়েশের গা থেকে একটা গন্ধ বেরোচ্ছিল৷ অন্তত রূপরেখার নাক সেইরকমই জানান দিচ্ছিল৷ গন্ধটা ঘামের নয়—একটু অন্যরকম৷

সোমরঞ্জন বিজয়েশকে নিজেদের পরিচয় দিয়ে তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘এদিকে কোথায় এসেছিলেন?’

‘আমার এক বন্ধুর সঙ্গে জাস্ট এমনি অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছিলাম৷ ওর খেয়াল চেপেছিল বলে এই নটোরিয়াস রাস্তাটায় ঢুকে পড়েছিলাম৷ তারপর…৷’ কথা বলতে-বলতে হঠাৎই থেমে গেল বিজয়েশ৷ বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল৷

‘না, না—আপনি টেনশান করবেন না৷ রিল্যাক্স করুন৷ অ্যাবাকাস স্কোয়্যার মানে এই জঙ্গল শেষ হওয়ার পর…ও আসতে অনেক দেরি আছে৷’ সোমরঞ্জন ওকে ভরসা দিলেন৷

বিজয়েশ গাড়িতে ওঠার আগে ওর গাড়ির দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল রূপরেখা৷ সেটা নিয়ে ও কোনও কথাই বলেনি৷ ভয়ে৷ সেই দৃশ্যটার কথা মনে করেই ও বিজয়েশকে ভয় পাচ্ছিল৷ ওকে বিশ্বাস করতে পারছিল না৷

এখন ড্যাডের প্রশ্নের উত্তরে ও যা বলল সেটাও তো অসম্পূর্ণ অস্পষ্ট!

রূপরেখা বিজয়েশের গাড়ির জানলা দিয়ে দেখেছিল একটা ফরসা হাত৷ হাতটা স্টিয়ারিং-এর ওপরে এলিয়ে আছে৷ সে-হাতে লেগে আছে রক্তের ছোপ৷

রূপরেখার মনে হয়েছে, বিজয়েশের বন্ধু সামনের সিটে এমনভাবে পড়ে আছে যে, তাকে জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে না৷ শুধু ডানহাতটা স্টিয়ারিং-এর ওপরে এলিয়ে থাকায় রূপরেখার চোখে পড়েছে৷ তার মানে…তার মানে…৷

‘তারপর কী হল?’ রূপশ্রী বিজয়েশকে কথার খেই ধরিয়ে দিলেন৷

‘তারপর যেটা হল সেটা এত আনএক্সপেক্টেড, এত সাডেন যে, কী বলব! আমার বন্ধু মোহন গাড়ি চালাচ্ছিল৷ ওরই গাড়ি৷ হঠাৎ ও বুকে ব্যথা বলে স্টিয়ারিং-এর ওপরে ঝুঁকে পড়ল৷ কোনওরকমে গাড়িটা সাইড করল৷ তারপর কাত হয়ে পড়ল৷ দেখলাম, ওর মুখ দিয়ে বেশ খানিকটা ব্লিডিং হয়েছে৷ সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়েছে বলে মনে হল৷ তাড়াতাড়ি ওকে যে একটা নার্সিংহোম-টোমে নিয়ে যাব সেটাও পসিবল নয়৷ বিকজ আমি গাড়ি চালাতে জানি না৷ তখন কী করব ভেবে না পেয়ে ওকে কোনওরকমে আধশোয়া করে গাড়ি থেকে নেমে এসেছি৷ মোহনের দিকের দরজা খুলে ওর পালস-টালস চেক করেছি৷ না, কোনও ধুকপুকুনি নেই৷ সব শেষ৷ ওর বাড়ির ফোন-নাম্বার আমার কাছে নেই৷ তাই আমাদের দুজন কমন ফ্রেন্ডকে ফোন করলাম৷ ওরা মোহনের বাড়ি, পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স—এসব জায়গায় ফোন-টোন করছে, সব ব্যবস্থা করছে৷ আমাকে বলল, মোহনের বডি গাড়িতে লক করে রেখে চটপট বাড়ি ফিরতে৷ ওরা আমার জন্যে আমার বাড়িতে ওয়েট করবে৷ তারপর সবাই মিলে যা করার করব…৷’ কথা বলতে-বলতে বিজয়েশ বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল আবার৷

ওর গল্পের মাঝে-মাঝে ড্যাড আর মম ‘হুঁ’, ‘হ্যাঁ’, ‘তারপর’ ইত্যাদি বলছিল, কিন্তু রূপরেখা চুপ করে বিজয়েশের কথা শুনছিল৷ ওর মনে হচ্ছিল, গল্পটার মধ্যে কোথায় যেন একটা গরমিল রয়েছে৷

‘তাই আমি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে লিফট পাওয়ার চেষ্টা করছিলাম৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভয়ও করছিল৷ কারণটা তো আপনারা নিশ্চয়ই জানেন! এই জঙ্গলে ভীষণ নেকড়ে-মানুষের উৎপাত৷ নেকড়ে-মানুষ—মানে, ওয়্যারউলফ৷ দু-দুটো গাড়ি আমাকে পেরিয়ে চলে গেল৷ আমার ইশারায় একটুও পাত্তা দিল না৷ তারপর…তারপর আমার গুডলাক যে আপনারা দাঁড়ালেন৷ সিরিয়াসলি বলছি, এই রাস্তায় একা-একা দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ ভয় করছিল৷ ওয়্যারউলফরা যেরকম ফেরোশাস হয়…৷’

বিজয়েশ ভয় পাওয়ার কথা বলছিল বটে কিন্তু ওর কথাবার্তায় ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা মোটেই ফুটে উঠছিল না৷ বিজয়েশ যত যা-ই বলুক না কেন, রূপরেখার মনে সন্দেহের কাঁটাটা একঘেয়েভাবে খচখচ করছিল৷ অথচ ড্যাড আর মমকে দ্যাখো! অচেনা লোকটার সঙ্গে এমনভাবে গল্প জুড়ে দিয়েছে যেন কতদিনের চেনা! তার ওপর ড্যাড আবার হাসতে-হাসতে বলে বসেছে, ‘আপনাকে একটা গুড নিউজ দিই, বিজয়েশ৷ আর ঠিক…’ হাতঘড়ির দিকে তাকাল ড্যাড: ‘আর ঠিক বাইশ মিনিট পরই একটা ঘটনা ঘটবে এই গাড়ির ভেতরে—কিন্তু আপনি সেই ঘটনাটা দেখতেও পাবেন না, শুনতেও পাবেন না…৷’

‘সে আবার কীরকম ঘটনা!’ অবাক হয়ে বলে উঠল বিজয়েশ৷

সোমরঞ্জন আবার হাতঘড়ি দেখে বললেন, ‘আর ঠিক সাড়ে একুশ মিনিট পর আমার মেয়ে রূপরেখা ওর আঠেরো বছর কমপ্লিট করে আঠেরো প্লাস হবে৷ আজ ওর জন্মদিন—৷’

‘ও, তাই নাকি! ভেরি গুড!’ রূপরেখার দিকে তাকাল বিজয়েশ: ‘হ্যাপি বার্থডে, রূপরেখা৷ কনগ্র্যাচুলেশানস!’

রূপরেখার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল৷ ও হ্যান্ডশেখ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল বিজয়েশের দিকে৷ বিজয়েশ একটু ইতস্তত করে হাত মেলাল৷ কুণ্ঠিতভাবে বলল, ‘সরি, কোনও গিফট দিতে পারলাম না…৷’

রুপি হেসে বলল, ‘গিফটের কোনও দরকার নেই—উইশটাই আসল৷’

আধো-অন্ধকারে যতটা পেরেছে বিজয়েশের হাতটা ততটাই অনুভব করার চেষ্টা করেছে রূপরেখা৷ অনামিকার দৈর্ঘ্যটা বুঝতে চেয়েছে৷ ওটা মধ্যমার সমান, না কি বড়?

না, সেটা বুঝতে পারা যায়নি৷ তার আগেই হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে বিজয়েশ৷

সামনের সিট থেকে রূপশ্রী বলে উঠলেন, ‘রুপি ঠিক বলেছে, বিজয়েশ৷ গিফটের চেয়ে উইশটা অনেক বড়৷ তা ছাড়া…’ হাসলেন রূপশ্রী: ‘বলতে গেলে আপনার প্রেজেন্সটাই তো একটা গিফট! কী, বলুন?’

বিজয়েশ আমতা-আমতা করে বলল, ‘দারুণ বলেছেন, ম্যাডাম৷’

‘হ্যাঁ—সত্যি এটা দারুণ বলেছ, রূপশ্রী৷’ সোমরঞ্জন হেসে তারিফ করলেন৷

রূপরেখা ওর সাইডব্যাগটা পাশেই সিটের ওপরে রেখেছিল৷ এখন ব্যাগ হাতড়ে ওর মোবাইল ফোনটা বের করে নিল৷ বোতাম টেপাটিপি করতে-করতে বিজয়েশকে লক্ষ করে বলল, ‘আপনার একটা ট্রিট পাওনা রইল৷ বিকজ এরকম একটা দিনে আপনি আমাদের মাঝে এসে পড়েছেন৷’ কথা বলতে-বলতে ও মোবাইল ফোনের আলোয় বিজয়েশের আঙুল দেখতে চেষ্টা করল৷ কিন্তু কপাল খারাপ৷ বিজয়েশের ডান হাতটা মুঠো করে সিটের ওপরে রাখা৷ আর বাঁ-হাতটা ওর শরীরের ওপাশে—দেখা যাচ্ছে না৷

রূপরেখার কথার খেই ধরে রূপশ্রী বলে উঠলেন, ‘খুব ভালো বলেছ, রুপি৷ আমাদের দুজনেরই উচিত ছিল আগেই বিজয়েশবাবুকে নেমন্তন্ন করা৷’ কথাটা বলে সোমরঞ্জনের দিকে তাকালেন রূপশ্রী: ‘কী, ঠিক বলিনি?’

‘অফ কোর্স ঠিক বলেছ৷ ও. কে., বিজয়েশ৷ আমি আর ‘‘বাবু-টাবু’’ বলছি না৷ স্ট্রেট ‘‘তুমি’’ করে বলছি৷ আমাদের বাড়িতে তোমার নেমন্তন্ন রইল৷ এনি ডে অফ ইয়োর চয়েস৷ জাস্ট দু-দিন আগে একটা ফোন করে জানিয়ে দেবে যে, তুমি আসছ৷ রুপি তোমাকে ওর ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছে…৷’

‘আপনার মোবাইল নাম্বারটা বলুন, আমি একবার রিং বাজিয়ে দিচ্ছি—৷’

বিজয়েশ ওর মোবাইল নম্বর বলল, একটু পরেই জলতরঙ্গের মিষ্টি সুর বেজে উঠল৷ দু’বার বেজে থেমে গেল৷

‘আপনি যেদিন আসবেন, বলবেন—আমাদের বাড়ির ডায়রেকশনের ডিটেইলস আপনাকে দিয়ে দেব৷’ রূপরেখা বলল৷

বিজয়েশ ‘ঠিক আছে’ বলে পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিল৷ রূপরেখার নম্বরটা সেভ করল৷ কিন্তু তখনও ওর আঙুলের ডগা দেখা গেল না৷

হঠাৎই সোমরঞ্জন গাড়ির স্পিড কমালেন৷ গতিজাড্যের জন্য রূপরেখা আর বিজয়েশ দুজনেই ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে৷ দূরে, হেডলাইটের এলাকার শেষ প্রান্তে, একটা প্রাণী রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ বেশ লম্বা চেহারা৷ এতটাই লম্বা যে সামনের দিকে ঝুঁকে বেশ খানিকটা কুঁজো হয়ে রয়েছে৷ সারা গায়ে লোম৷ হাত দুটো সামনে ঝুলছে৷ হাতের প্রান্তে লম্বা-লম্বা আঙুল৷ আঙুলের ডগায় নখ হয়তো আছে, কিন্তু মলিন আলো আর বৃষ্টির ঝালর নজর ঝাপসা করে দিয়েছে৷

‘ওয়্যারউলফ!’ চাপা গলায় বলল রূপরেখা৷

‘হ্যাঁ—৷’ শান্তভাবে বললেন রূপশ্রী, ‘এটা ওদের এলাকা…৷’

সোমরঞ্জন জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলেন৷

অদ্ভুত প্রাণীটা নেকড়ের মতো ক্ষিপ্র দু-তিন লাফে ডানদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল৷

‘নিন, স্যার, এবার গাড়িতে স্টার্ট দিন…৷ ওটা চলে গেছে…৷’ বিজয়েশ চাপা গলায় বলল৷

সোমরঞ্জন শান্ত গলায় বললেন, ‘না, বিজয়েশ—গাড়িটা এখন বেশ কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে৷ এইমাত্র রূপরেখা এইটিন প্লাস হল৷ আমরা চারজনে এই মোমেন্টটাকে সেলিব্রেট করব…৷’

বিজয়েশ অবাক হয়ে বলল, ‘তার মানে!’

‘বলছি—বুঝিয়ে বলছি…৷’ সোমরঞ্জন অনেকটা ঘুরে বসলেন নিজের সিটে৷ যাতে বিজয়েশের সঙ্গে কথা বলতে সুবিধে হয়৷ এপাশ-ওপাশ তাকালেন৷ কাচের বাইরে বৃষ্টি আর জঙ্গলকে দেখলেন৷ তারপর: ‘বিজয়েশ, তোমাকে আগে মাছরাঙার ব্যাপারটা বলি৷ হয়তো তুমি জানো…তবুও…৷’

রূপরেখা বেশ উশখুশ করছিল৷ মাথা ঝাঁকাচ্ছিল বারবার৷

রূপশ্রী জানতে চাইলেন, ‘কী হল, রুপি?’

‘শরীরের ভেতরটা কেমন করছে, মম৷ ফিলিং আনইজি…৷’

‘মাছরাঙা পাখি পুকুর, ঝিল কিংবা নদীর কাছে গাছের ডালে ধৈর্য ধরে চুপটি করে বসে থাকে৷ জলের সারফেসে মাছ নড়তে দেখলেই সাঁ করে উড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে সেটাকে তুলে নেয়৷ ওদের ঠোঁটে করাতের মতো দাঁত কাটা থাকে৷ তাই ওদের কাছ থেকে শিকার কখনও ছিটকে পালাতে পারে না৷

‘অথচ এই মাছরাঙাকে যদি কখনও জ্যান্ত তিড়িংবিড়িং মাছ সামনে ধরে দাও সে সেটা ছুঁয়েও দেখবে না৷ ওর অভ্যেস ছোঁ মেরে নদী অথবা পুকুরের জল থেকে মাছ শিকার করা৷’ একটু চুপ করে থেকে তারপর: ‘ওয়্যারউলফদেরও ঠিক তাই৷ ওরা শিকারি…মাছরাঙার মতো…৷’

‘ড্যাড!’ অদ্ভুত কর্কশ গলায় ডেকে উঠল রূপরেখা৷ ওর মুখের চামড়ায় টান ধরছিল৷ হাতের আঙুলগুলো কী একটা অদ্ভুত ম্যাজিকে লম্বা হয়ে যাচ্ছিল৷ নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিল ও৷

‘বয়েস আঠেরো প্লাস হওয়ামাত্রই আমাদের ওয়্যারউলফদের একটা রূপান্তর ঘটে যায়৷ সেটার ওপরে কারও কন্ট্রোল থাকে না৷’ সোমরঞ্জন তখনও বলে যাচ্ছিলেন, ‘সবই জিনের ম্যাজিক৷ যে-ম্যাজিকের মিস্ট্রি আজও কেউ এক্সপ্লেইন করতে পারেনি…৷’

রূপরেখার গলা দিয়ে একটা হিংস্র গর্জন বেরিয়ে এল৷ ওর চোখ এখন নেকড়ের মতো হলদে-সবুজ, ধকধক করে জ্বলছে৷ গায়ের চামড়ায় গজিয়ে উঠেছে গোছা-গোছা কালো লোম৷

ও ভাঙা-ভাঙা কর্কশ গলায় বলে উঠল, ‘ড্যাড, মম! হোয়াট ইজ হ্যাপেনিং টু মি? কী হচ্ছে এসব?’

‘ভয় পেয়ো না, রুপিসোনা৷ আমরা সাইকললেস ওয়্যারউলফ৷ আমাদের প্রথম ট্রান্সফরমেশান হয় এইটিন প্লাস বয়েস হওয়ামাত্রই৷ এর ওপরে কারও কোনও কন্ট্রোল থাকে না৷ তারপরই তোমার কাজ হল শিকার ধরা—মাছরাঙার মতো৷ সো, বিজয়েশ, এক্ষুনি তুমি দরজা খুলে পালাও—প্রাণপণে ছুটে পালাও৷ যাতে রুপি তোমাকে তাড়া করে শিকার করতে পারে…৷ রান! রান! রান!’ চিৎকার করে বললেন সোমরঞ্জন৷

বিজয়েশের গলা শুকিয়ে কাঠ৷ ও এক ঝটকায় গাড়ির দরজা খুলে ভেজা রাস্তায় নেমে পড়ল৷ কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল৷ তারপর কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছুট লাগাল জঙ্গলের দিকে৷ ভিজে গাছপালা আর সবুজ পাতার ঝাঁক বিজয়েশকে যেন গিলে ফেলল৷

রক্ত হিম করা এক হিংস্র গর্জন করে একটা নেকড়ে-মানুষ গাড়ির পিছনের দরজা ঠেলে লাফিয়ে এল বাইরে৷ প্রাণীটার ধাক্কায় দরজা খুলে পড়ে গেল রাস্তায়৷ শরীরটা মাপে বড় হয়ে যাওয়ায় পরনের পোশাক ছিঁড়ে কয়েক ফালি হয়ে গা থেকে ঝুলছে৷ মেঘলা আকাশের দিকে মুখ তুলে হাঁ করে একটা লম্বা চিৎকার করল৷ তারপর দুটো ভয়ংকর লাফ মেরে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে৷

বিজয়েশের গন্ধ এখনও ওর নাকে লেগে আছে৷ ওকে শিকার করে ধারালো নখে চিরে ফালাফালা না করা পর্যন্ত ওয়্যারউলফ ধর্মে ওর দীক্ষা সম্পূর্ণ হবে না৷

ততক্ষণ রূপশ্রী আর সোমরঞ্জন জঙ্গলের কিনারায় দাঁড়িয়ে মেয়ের জন্য অপেক্ষা করবেন৷ নিজেদের দীক্ষা নেওয়ার রাতগুলো ওঁদের মনে পড়ে যাচ্ছিল৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *