তিল থেকে তাল – ৩

কুসুম আরও বিপদে পড়েছে! গুপি মিত্তিরের ঘরে এসে ক্রমশ দেখছে কুসুম সে ওই লোকটাকে ঠিক মেনে নিতে পারছে না। শহরের ওদিককার মেয়ে, স্কুল ফাইনাল অবধি পড়েছিল। কিন্তু গরিবের ঘর। কোনো উপায় না দেখেই বাবা এখানেই বিয়ে দিয়েছিল! 

কুসুমের মনে হয় গুপি মিত্তিরের ধ্যান-জ্ঞান ওই টাকা—ব্যবসা। ইদানীং তার শখ হয়েছে যে ভাবে হোক এ দিগরের জনসেবক হবার ভান করে ভোটেও দাঁড়াবে, অন্ধকারের ব্যবসাও চালাবে। তাই রতনকেও এবাড়ি থেকে চলে যেতে হয়েছে। 

কুসুমের সঙ্গে তাই নিয়ে সকালেই এক চোট হয়ে গেছে গুপিনাথের। কুসুম বলে—ছেলেকে ফিরিয়ে আনো! নাহলে লোকে আমার নামেই যা-তা বলবে। সত্মা হয়ে আমিই ওকে বিষয়ের লোভে ঘরছাড়া করেছি। 

গুপিনাথ বলে—কারো পায়ে ধরতে যাব না। 

কুসুম চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে বলে—তাহলে আমাকেই যেতে হবে। আর দরকার হয় ওর বিয়ের কথাও বলে আসব। বকুলকে আমি কয়েকবারই দেখেছি, ভালো মেয়ে—পালটি ঘর। ওদের বিয়েই দোব। 

গুপির হাত থেকে চায়ের কাপটা যেন ছিটকে পড়বে। নেহাৎ কাপটা ভাঙতে মায়া হয় তার। নগদ একটাকা দাম। তাই কাপটা নামিয়ে রেখে গুপি মিত্তির জানায়, 

—তাহলে তোমাকেও ওই ছেলের মতোই আউট হয়ে যেতে হবে। এসব ব্যাপারে গুপি মিত্তির ভাঙবে তবু মচকাবে না। কভি নেহি। 

কাপটা নামিয়ে রেখে গটগট করে চলে এসে বাইরের ঘরে বসল। এ সময় কিছু লোকজন আসে, সুদি কারবারও চলে। তাই ঘর থেকে বের হয়ে এখানেই এসে বসেছে গুম হয়ে। 

হঠাৎ চমকে ওঠে গুপি মিত্তির। 

সদর দরজা খুলে ভিতরে যাচ্ছে ক’টি মহিলা। আর তাদের সঙ্গে রয়েছেন জাঁদরেল নেত্যকালীও। গুপির মনে হয় লাফ দিয়ে পড়ে দেওয়ালে টাঙানো রাম দা’খানা নিয়ে ওকে বলিদানই দেবে, কিন্তু পারে না। 

ওরা সদলবলে তার বাড়ির অন্দরমহলে গিয়ে ঢুকল। 

তার ঘরের ভিতরেই একপাল ডাকাত যেন এসে ঢুকেছে। 

এমন সময় ডাক শুনে তাকাল গুপি। 

—তুই! 

মতিয়া এসে বসল তক্তপোশের নিচে। মুখ-চোখ শুকনো। পিছনে বুধনও এসেছে।

মতিয়া বলে ওঠে—ঐ কারবার আর করব না মালিক, দুধ বেচব তবভি নেহি। 

মদের কারবারেও নগদ আমদানি মন্দ হয় না গুপি মিত্তিরের, তাছাড়া ওই দ্রব্যটার জোগান দিতে পারায়, ইদানীং তার রাতের কাজ করার জন্য লোকের অভাব হচ্ছে না। কম দামে মদ খাইয়ের লোক পাচ্ছে, মায় ওপারেও মাল জোগান দিয়ে এখন রমরমা বাণিজ্য করছে সে। 

হঠাৎ এসময় এ কাজ বন্ধ করলে গুপি মিত্তির বিপদেই পড়বে। 

গুপি মিত্তির বলে—কেন রে! লাভ তো বেশ পাচ্ছিস। কেন দর বাড়াচ্ছিস বাবা?

বুধন বলে—কাল পুলিশ আসল মালিক। চারিদিক তাল্লাসি করল। বল্লে ফিন আসবে।

চমকে ওঠে গুপিনাথ—পুলিশ হামলা করেছে? অ্যা—কিছু মালপত্র পায়নি তো?

মতিয়া বলে—না। সব হঠিয়ে দিলাম। লেকিন আবার তন করবে। 

জেলে যেতে পারব না মালিক। 

গুপিনাথ ভাবনায় পড়েছে—নিতাই কোথায় ছিল? 

—সেও ছিল। সব জানে। 

গুপি ভাবছে কথাটা। এবার ভেবে-চিন্তেই কাজ করতে হবে। তাছাড়া গুপিও জানতে চায় কেউ বোধহয় শত্রুতা করেই পুলিশের কানে তুলেছে এই খবর। 

তাই শুধোয়—কেউ খবর দিয়েছে? কিছু জানিস? 

মতিয়া বলে—হ্যাঁ, ওই ইস্টিশান গিন্নি, সাঁঝবেলায় এসেছিল, মাস্টার গিন্নিই করেছে ই কাম।

গুপিনাথের সব দিকেই ওই মহিলা এবার ঘা-মারতে শুরু করেছে। ছেলেকে ভাঙিয়েছে, হরেন ঘোষের ভাগনির বিয়ে নিয়ে হাঁড়ির হাল করেছে, তাকে এবার হাত দিয়েছে তার চালু ব্যবসাতেও। আর কি করবে কে জানে? 

গুপি মিত্তির রাগটা চেপে বলে—কিছু করতে পারলি না? 

বুধন গর্জায়—জবাব ইবার দিব। জরুর দিব। 

মতিয়াও সায় দেয়— জরুর। 

গুপি মিত্তির বলে—এখন যা। দু’একদিন ওসব বন্ধ থাকুক। তারপর দেখছি কী করা যায়।

মতিয়াকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই বলে—দুধের ব্যাবসা করে কি পাবি, এপথই হবে। দু’দিন সবুর কর মতিয়া। লক্ষ্মী মেয়ে। যা বুধন—তবে বাপু ওই মাস্টার গিন্নিকে জব্দ করার পথ ভাব। আমি দেখছি, দরকার হলে ওই ভজগোবিন্দকেই বদলি করবার জন্য দরখাস্ত ছাড়ব একখানা। এবারের ওয়াগনের টাকা নিতে আসুক—আমিও দেখছি ওকে। 

ওরা চলে যেতে গুপি গুম হয়ে বসে কি ভাবছে। নিতাইও এসে পড়ে। কাল রাতের ঘটনাটা ফলাও করে বর্ণনা করে নিজে কি করে এতবড় ব্যাপারটা নিপুণভাবে সামাল দিল সেই কথাই বলে চলেছে নিতাই 

গুপির শোনার মতো মানসিক অবস্থা নেই। কে জানে অন্দরমহলে আবার কি কাণ্ড চলেছে।

নিতাই বলে চলেছে—আজ ধানকল ইনসপেক্‌শন করতে আসছে সদর থেকে।

গুপিনাথ যেন শুনেও শোনে না। কি ভাবছে। 

কুসুম নেত্যকালী, সুলতাদি, মালতীদের দেখে খুশি হয়। এ গ্রামে দেখেছে মেয়েদের নিয়ে ওরাই অনেক কিছু করে। মেয়েদের স্কুলটা চলে ওদের চেষ্টাতেই। বকুলের মতো অসহায় একটা মেয়ের উপর এতবড় অত্যাচার হচ্ছিল, ওরাই এগিয়ে গিয়ে তাকে উদ্ধার করেছে। 

নেত্যকালী বলে—মহিলা সমিতির এসব কাজই তো কুসুম। আমরা এবার একটা মহিলা সেবাসদন খোলার চেষ্টা করছি। জায়গা পেয়ে যাব, মেয়েদের চিকিৎসা, ডেলিভারি কেস এসবই হবে ওখানে। কিছু চাঁদা দিতে হবে। আর তোমাকেও সভ্য হতে হবে। 

কুসুমও রাজি না হয়ে পারে না। 

সেও বুঝেছে এদের উদ্দেশ্য সৎ। আজ কুসুমই কথাগুলো এদের জানিয়ে নিজের বেদনাটাই প্রকাশ করে। কুসুম বলে, 

—বাপ ছেলের এই গোলমাল আমি চাইনি দিদি। রতনও আমার ছেলের মতোই। মাকে সেও মানে। অমন ছেলে হয় না। বকুলকেও দেখেছি। লক্ষ্মী মেয়ে। আমিও কর্তাকে বল্লাম—তা কর্তা বলে তোমাকেও দূর হয়ে যেতে হবে এ বাড়ি থেকে। 

সুলতা বলে ওঠে—এতবড় কথা বলেন মিত্তির মশাই? 

কুসুম জানায় ও ওই রকমই। রতন চলে যেতে আরও যেন রেগেই রয়েছে। ঘরে ঢেঁকা দায় হয়ে উঠেছে। 

সুলতা বলে—তুমিও ফুঁসে উঠবে। 

নেত্যকালী ঘোষণা করে—আমি একপক্ষের বউ, তাতেই যা তেজ, তুমি তো তেজপক্ষের বউ—তোমার তেজ হবে তার তিন গুণ; বুঝলে কুসুম, মেয়েদের চোপাই হচ্ছে হাতিয়ার, ওই চোপা সমানে চালিয়ে যেতে হবে। কুসুম নতুন কথা শুনছে। মনে হয় সে চুপ করেই তার স্বামীর সব অন্যায়গুলোকে আর মেনে নেবে না। এবার নিজের প্রতিষ্ঠাই সে দেখাবে। সুলতা মাস্টারি করে এর মধ্যে গোলগাল হয়ে উঠেছে। গলাটা চাঁছাছোলা। সুলতা বলে—যদি কোনো অসুবিধা বোধ করো আমাদের জানাবে। 

মেয়েদের উপর এতকাল অত্যাচারই চলে এসেছে, এবার আমাদের একমাত্র লক্ষ্য—এই অত্যাচারের শেষ করতেই হবে। আমরা সমবেত ভাবে তোমার পিছনে আছি। 

মালতী, অশ্বিনী দারোগার স্ত্রী, সে বলে ওঠে। 

—ওই জাঁহাবাজ দারোগাকে আমি ঢিট করেছি কুসুম, তুমি পারবে না ওই লোকটাকে সিধে করতে? আলবৎ পারবে। ও যদি তোমার মতে না চলে তুমিও কঠিন হয়ে উঠবে। 

কুসুম ভয়ে ভয়ে বলে—যদি চলে যেতে বলে? 

শেলফ্রেমের চশমার মধ্যে সুলতাদির চোখ-দুটো কঠিন হয়ে ওঠে। সে বলে ওঠে—মহিলা সমিতির স্কুল বোর্ডিং খোলা আছে। সিধে সিন্দুকের চাবি, ঘরের চাবি নিয়ে চলে যাবে ওখানে 

নেত্যকালী এতক্ষণ ধরে তালিম দেবার পর এবার বলে—আজ উঠি কুসুম। বৈকালের দিকে মহিলা সমিতিতে এসো। আর চাঁদাটা— 

কুসুমও পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বলে–আপাতত এই নেন। পরে দেবো আবার। 

ওরা বের হয়ে আসছে। হঠাৎ নেত্যকালীই বলে- 

সুলতা, একবার মিত্তির মশায়কেও দেখ না, চাঁদার ব্যাপারে যদি কিছু দেন। 

.

গুপি মিত্তির নিতাই-এর কথাগুলো শোনবার চেষ্টা করছে! ধানকল ইন্সপেকশন মানেই কিছু খরচান্ত। বয়লার দেখার নাম করলেই প্রণামি দিতে হবে। তারপর আছে ওই ক’টা মানুষের খাবার ব্যাপার। মাছ-মাংস-সন্দেশ-দই। 

হঠাৎ দরজায় কাদের দেখে তাকাল গুপি মিত্তির। আসতে পারি। 

সামনে শমন! সুলতা, মালতী আর সাক্ষাৎ নেত্যকালীদের দেখে গুপি মিত্তিরের বাকবদ্ধ হবার মতো অবস্থা শুরু হয়েছে। শত্রুপক্ষ যে এমনিভাবে তারই ঘরে এসে হাজির হবে ভাবতে পারে নি সে। 

গুপি তবু চতুর ব্যক্তি! সহজ হবার চেষ্টা করে বলে—আসুন! আসুন! 

নেত্যকালী বলে—বসার সময় নেই। মহিলা সমিতির তরফ থেকে এসেছি। বাকি কথাটা সুলতাই বলে। ক্লাশে পড়িয়ে আর সারার্থ-ভাবার্থ ইত্যাদি করিয়ে সুলতা ওইসব কথাগুলো বেশ গুছিয়ে বলতে পারে। সুলতা মহিলা সমিতির কথা সংক্ষেপে গুছিয়ে বলে এবার জানায়—তাই সেবা সদনের জন্য কিছু চাঁদা চাই আপনার কাছে। আপনাদের সাহায্য না পেলে এত বড় কাজ করা যাবে না। 

গুপি মিত্তির দেখছে ওদের। 

নেত্যকালীর গোলগাল মুখ, কপালে সিঁদুরের মাড়ুলিটা, সিঁথি তো নয় যেন রাঙামাটর সড়ক!

গুপি মিত্তিরের অনেক সর্বনাশ অলরেডি করেছে ওরা দলবেঁধে, আর ওই মহিলা কাল রাতে তার ব্যবসাতেও হাত দিয়েছে। তবু গুপিনাথ রাগটা চেপে বলে—ব্যবসাপত্র খুবই মন্দা, আয় পায় নেই। তবু শুভকার্যে বড় মুখ করে আপনারা পঞ্চজন এসেছেন, সাধ্যমতো দিতে তো ইচ্ছে করে। কী করি বলুন? খুবই চাপে আছি তবু ফেরাতে পারি না। 

গুপি মিত্তির ক্যাশবাক্স খুলে অনেক কষ্টে একটা আধুলি বের করে এগিয়ে দেয়—যৎকিঞ্চিৎ দিলাম, যদি গ্রহণ করেন। সুলতার চোখ যেন চশমা ঠিকরে বের হবে। 

মালতী চমকে ওঠে, অ্যাঃ! 

নেত্যকালী ভরাটি গলায় বলে—ওটা আবার ওখানেই রেখে দিন। চলো সুলতা। 

গুপিনাথও আধুলিটা যথাস্থানে রেখে ধপাশ্ করে ক্যাশবাক্স বন্ধ করে বলে—আপনারা রাগ করলেন? 

—না। চলে এসো সুলতা, মালতী! 

নেত্যকালী ওদের নিয়ে বের হয়ে যায়। গুপিনাথ গজগজ করে—আট আনার দাম নেই, ফ্যালনা, যে ফেরত দিয়ে গেলেন। নিতাই—নিতে। 

নিতে ঘরে নেই। গুপিনাথ ডাকছে তাকে। হঠাৎ দেখা যায় নিতাই-এর শীর্ণ সিড়িঙ্গে দেহটা তক্তপোশের নিচে থেকে ঠেলে বেরোচ্ছে, মাথায় ঝুল-ধুলো। 

নিতাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে কচ্ছপের মতো লম্বা গলাটা বের করে শুধোয়,—গ্যাছেন ত্যানারা? ওরে বাবা! 

নিতাই উঠে ঝুল ঝেড়ে বলে—আপনার সাহস বলিহারি যাই কর্তা, নগদ আধুলি দিতে গেলেন? 

গুপি গর্জায়—নিল না। না নিস না নিবি। এর বেশি সাধ্য নেই। বোস। 

হ্যাঁ—ধানকল ইনসপেকশনটা চুকিয়ে দে, তারপর দেখছি। গিন্নিকে ওদের খাবার কথা বলে আসি। 

.

কুসুম কথাটা ভেবেছে তারপর। 

সকাল থেকে গুপিনাথ তার উপরই তেজ ঝাড়ছে। রতনকেও বলে আসবে এসব কথা। দরকার হয় সেও এবার সবকিছু চুপ করে সইবে না। 

গুপিনাথকে আসতে দেখে কুসুম চুপ করে থাকে। 

ঘরে ঢুকে গুপিনাথ শুধোয়—ওই ধিঙ্গিগুলো কেন এসেছিল? 

কুসুম বলে—আসতে নেই? 

—না! এবার এলে ওদের ঝেঁটিয়ে দূর করে দেব। 

গুপিনাথের কথায় বলে ওঠে কুসুম—আমার বাড়িতে কেউ যদি আমার কাছে আসতে চায় কেন আসবে না? 

—না! আমার বাড়ি। গুপিনাথ ছিলেছেঁড়া ধনুকের মতো সিধে হয়ে রোখালো গলায় বলে—ওদের আসা চলবে না। ওরা সব বাজে মেয়ে। 

কুসুম চিনেছে মানুষটাকে। 

চুপ করে রইল সে। গুপিনাথ এবার ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বেশ ভারিক্কি-চালে বলে—যাও, রান্নাঘরে যাও। আজ ধানকলে চারপাঁচ জন সাহেব আসছেন ইনসপেকশনে, এখানে খাবেন। মাছ-মাংস করো, পায়েসও হবে, বাঁধাকপির তরকারি, মাছের মাথা দিয়ে মুড়ি-ঘন্ট।

কুসুম এবার সতেজ স্বরে জবাব দেয়—ওই যজ্ঞিবাড়ির রান্না আমি রাঁধতে পারব না। আমার গতর এত সস্তা নয়। ঠাকুর রাখো গে। 

—অ্যাঁ! গুপি মিত্তির এবার হাঁ-হয়ে গেছে কাতলা মাছের মতো। এতকাল যা বলেছে কুসুম তাই-ই করেছে। এই প্রথম সে প্রকাশ্যে এবার বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। গুপি মিত্তির ওই ধাক্কাটা সামলে নিয়ে এবার বীরদর্পে গর্জন করে। 

—কথাটা কানে গেল? 

কুসুমও তৈরি। এই মুখে সেও জানায়—বলেছি তো পারব না। লোক দেখো গে।

-–তোমার ঘাড় করবে। না হলে আউট হয়ে যেতে হবে এখান থেকে। গুপি মিত্তিরের কথায় কুসুম ওর দিকে একবার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। 

কুসুম স্থির কন্ঠে জানায়, 

তাই যাব। ছেলে গেছে, আমিও যাব। 

গুপির পায়ের নিচে থেকে মাটি যেন সরে যাচ্ছে—কী বললে? 

কুসুম জানায়—চলে যেতে বলছো, চলেই যাব। 

—কোথায় যাবে শুনি? গুপি জেরা করে। 

—ওই মহিলা সমিতির বোর্ডিং-এ। দরকার হয় ছেলের বিয়ে দিয়ে ওদের বাসাতেই থাকব। বুঝেছ? 

কুসুম কথাগুলো বেশ জোরের সঙ্গে ঘোষণা করে ওঘরে চলে গেল। গুপি মিত্তিরের টাক এবার বিনবিন ঘামছে। সবাই আজ তার পিছনে লেগেছে। আর কেন তাও জেনেছে। গর্জন করে গুপি। 

—এসব ওই ইস্টিশান গিন্নির শিক্ষে। ওকে ঠাণ্ডা করব। হঠাব এখান থেকে।

গুপি গর্জন করে বের হয়ে গেল। আজই সে একটা বিহিত করবে। 

.

দশটার লোকাল ট্রেন চলে যাবার পর ভজগোবিন্দ এবার স্টেশনে সংগৃহীত আলু-কপি মাছ- দুধ-এর ভাগটা বুঝে নিচ্ছে পয়েন্টসম্যান বুধনের কাছ থেকে। ওই কাজটা করে মতিয়া। 

মহাজন ফড়ের দল মালপত্র বুক করতে আসে মতিয়া বের হয় নজরানা নিতে। একটা বালতিতে দুধ-এর তোলা আদায় হয়। আর নগদ পয়সার হিসেব হবে দিনের শেষে। সব মিলিয়ে লাউগঞ্জ স্টেশনের আয়পয় ভালোই। তাছাড়া মহাজনদের মাল আসে ওয়াগনে। এখানের ধানকল থেকে চাল যায় ওয়াগন ভর্তি হয়ে, তার জন্য ফি ওয়াগনের রেট আলাদা। অবশ্য তার বখরা দিতে হয় ভজগোবিন্দকে হেডকোয়ার্টার বীরপুরেও, কারণ ওয়াগন দেবার মালিক তারাই। দুটো ওয়াগন এসে গেছে আজ, গুপি মিত্তিরের ধানকলে পাঠাতে হবে। কিছু আমদানি হবে ভজগোবিন্দের, খবরটা পাঠাতে হবে গুপিকে। 

এমন সময় স্বয়ং গুপি মিত্তিরকে আসতে দেখে ভজগোবিন্দ মাল ভাগাভাগি ছেড়ে উঠে এসে আপ্যায়ন করে—বসুন, বসুন মিত্তির মশাই। 

গলা তুলে হাঁক পাড়ে—ওরে রতি, ডবল হাফ একটা ইসপিশাল চা মিত্তির মশায়ের জন্যে, চিনি কম। 

গুপি মিত্তির মুখখানা বোদা করে বলে, 

—চা খাব না মাস্টার। 

ভজগোবিন্দ বলে—সুখবর আছে মিত্তির মশাই— 

ফোঁস করে ওঠে মিত্তির—তা আর থাকবে না? ওই জাঁহাবাজ গিন্নিটিকে এবার সামলাও ভজগোবিন্দ তোমাকে এবার লাস্ট ওয়ার্নিং দিতে এলাম। 

ঘর ভাঙাবে, ছেলেকে পর করবে, লোকের সামনে বেইজ্জত করবে আর আমি চুপ করে সইব বলছ? 

ভজগোবিন্দ ইস্টিশানেই থাকে কাজকর্ম নিয়ে। গ্রামে যায় না, বাজারে যাবার দরকারই হয় না তার সংসারে। তাই কি ঘটছে গ্রামে সেটাও জানে না। এমনকি বাড়ির খবরও রাখা নিরাপদ নয় বলেই ভজগোবিন্দ এড়িয়ে থাকে গিন্নিটিকে। তাই মিত্তিরের গর্জন শুনে শুধোয়, 

—কি হলো মিত্তির মশাই? আমি তো কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আপনাদের সেবাতেই থাকি। ফোন করে, চিঠি লিখে, দরবার করে আপনার দু’খান ওয়াগন এনে দিলাম। 

আজ গুপি মিত্তির চড়া-গলায় বলে ওঠে—ও তোমার ডিউটি মাস্টার। ওটা করতে হবে চাকরির জন্যে, আর চাকরি বাঁচাবার জন্যে এবার গিন্নিটিকে সামলাও। গুপি মিত্তিরের পিছনে. লাগলে তোমাকে এখান থেকে জয়েন্ট পিটিশন করে ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে বদলি করিয়ে ছাড়ব। বুঝলে? ভজগোবিন্দ চমকে ওঠে। গুপি মিত্তির এসব কর্মে খুবই নিপুণ। তাই কাঁচুমাচু স্বরে ভজগোবিন্দ বলে, 

—আপনার মতো মহৎ লোকের পিছনে কেন লাগবে স্যার? তাহলে আমি দেখছি। আর ওই দরখাস্ত-ফরখাস্ত করবেন না— 

গুপি মিত্তির হুকুমের স্বরে বলে—তাহলে সামলাও ওনাকে। আর হ্যাঁ ওয়াগন দুটো আজই প্লেস করে দাও। 

—দিচ্ছি! ভজগোবিন্দের আপশোসে রাগে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে! গিন্নি মাঝে মাঝে সর্দারি করতে যায় বাইরে, তাতেই যত বিপদ বাড়ে! কি সব হয়েছে গুপি মিত্তিরের ছেলের সঙ্গে। তাদের বাপ ছেলের ব্যাপারে তোর থাকা কেন? হাতে-হাতে ওয়াগন আসবার জন্য বখশিশের পঞ্চাশ টাকা হাতছাড়া হয়ে গেল বোধহয়! 

গুপি মিত্তির বের হয়ে গেল সটান। হঠাৎ দীনু পাগলাকে হাসতে দেখে তাকাল ভজগোবিন্দ।

দীনু বলে ওঠে—কান টানলেই মাথা আসে গ! কাল মাঠান মতিয়ার মদের ভাঁটি বন্ধ করিয়েছে, ব্যস তাল ঝেড়ে গেল মিত্তির। 

ভজগোবিন্দ এতক্ষণে কাল ওখানে পুলিশ রেডের কথাটা মনে করতে পারে। চমকে ওঠে সে। গিন্নি এবার গুপি মিত্তিরের অন্ধকারের ব্যবসাতেও হাত দিয়েছে! ভজগোবিন্দ এসব ব্যাপার আদৌ পছন্দ করে না। 

ভাগের মালপত্র রতির দোকানের ছেলেটাকে দিয়ে বাড়ির দিকে নিয়ে চলেছে সে। 

.

নেত্যকালী পা-ছড়িয়ে সবে পঞ্চম কাপ চা শেষ করে দ্বাদশতম তাম্বুলটি মুখে-পুরে সুগন্ধি জর্দার ছিটে দিয়ে পানের স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করছে এ হেন লগ্নে ভজগোবিন্দকে ঢুকতে দেখে তাকাল। 

ঝুলঝাড়া চেহারা, গুপি মিত্তিরের শাসনে যেন মিইয়ে গেছে। গিন্নিকে দেখে ভজগোবিন্দ বলে—ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে লাভ কি? জানো আজ গুপি মিত্তির স্টেশনে এসে আমাকে যা তা বলে শাসিয়ে গেল। বলে তুমি নাকি ওর অনেক ক্ষতি করছ, অন্যায়ভাবে অপমান করছ। ছেলের কান ভাঙিয়ে তাকে ঘরছাড়া করেছ— 

বাকিটা এবার নেত্যকালী পাদপূরণ করে, 

—ওর চোলাই মদের কারবার বন্ধ করেছি—বলো আর কি বলছিল সেই সিঁটকে লোকটা? অ্যা—এতবড় সাহস তার তোমাকে এসে শাসায়? 

ভজগোবিন্দ তার অর্ধাঙ্গিনীকে চেনে। তাই ভয়ে-ভয়ে বিনীত কন্ঠে বোঝাবার চেষ্টা করে—ওসব লোককে চটিয়ে লাভ কী বলো? 

—না। পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে পুজো করতে হবে। নেত্যকালী জবাব দেয়। 

ভজগোবিন্দ তবু বোঝাবার চেষ্টা করে—সদরে রিপোর্ট করে এখান থেকে বদলি করিয়ে দেবে বলেছে! সর্বনাশ হবে তাহলে! 

নেত্যকালী সমান তালে বলে চলেছে, 

—কার চাকরি করো তুমি, রেল কোম্পানির না ওই চশমখোর গুপি মিত্তিরের? আর যে চাকরি ওই গুপি মিত্তিরের মতো ইত্যিজনের রিপোর্টে খতম হয়ে যায় সে চাকরি যাওয়াই ভালো। যাক্! 

—অ্যাঁ। চমকে ওঠে ভজগোবিন্দ। এত সহজে চাকরিটা এককথায় ভাসিয়ে দিতে বুক কেঁপে ওঠে তার। 

নেত্যকালী বলে চলেছে—ওই ইস্টিশানের বাইরেই ওর ধানকলের সামনে তিনতলা ইমারাত বানিয়ে ওর বুকে বসে দাড়ি ওপড়াবো। কার মেয়ে আমি জানো? কুলদা মোক্তারের মেয়ে-জামাই-এর পিছনে লাগার শখ ঘুচিয়ে দেব জন্মের মতো। 

ওর পিছনে লেগেছি বেশ করেছি। এক নম্বর বদমায়েশ লোক ওটা। আর তোমাকে অফিসে গিয়ে শাসায় চাকরি খেয়ে নেব? 

ভজগোবিন্দ ঘাবড়ে গেছে। ভেবেছিল স্ত্রীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে একটু সমঝে চলতে বলবে, সবদিকই রক্ষে হবে। কিন্তু এমনি উল্টোপথে চলবে নেত্যকালী তা ভাবেনি। 

এবার নেত্যকালী ঠেলে উঠে বলে ভজগোবিন্দকে—চলো। 

ভজগোবিন্দ ঘাবড়ে যায়। মিনমিন করে শুধোয়—কোথায় যেতে হবে? 

—থানায়। নেত্যকালী সতেজ ভাবে বলে—তোমাকে শাসিয়েছে একটা ডায়েরি করে রাখতে হবে। থানায় বলবে শুধু শাসায়নি—মারধর করবেও বলেছে। 

ভজগোবিন্দের পিলে অবধি চমকে ওঠে—কী বলছ তুমি? 

নেত্যকালী পাকা মোক্তারের মেয়ে। সদরের একনম্বর মোক্তার ওই কুলদা গোঁসাই-এর কন্যা। সেও ছাড়তে রাজি নয়। ভজগোবিন্দ জানে পুলিশে গেলে বিপদ বাড়বে। তাই পালাবার পথ খুঁজছে সে। 

হঠাৎ বারোটার ডাউন ট্রেনের ঘন্টা বেজে ওঠে। 

ভজগোবিন্দ কি ভাবছে। হুঙ্কার ছাড়ে নেত্যকালী—চলো থানায়। 

ঘন্টার শব্দে অভ্যাস মতো ভজগোবিন্দ চনমন করে ওঠে। ওই ঘন্টাটা যেন ডাকছে তাকে। ভজগোবিন্দ বলে—লোকালটা ছেড়েই আসছি। 

কোনোমতে প্রাণ নিয়ে নেত্যকালীর হাত ছাড়িয়ে চো-চা দৌড় দিল ভজগোবিন্দ ইস্টিশানের দিকে। নেত্যকালীর শিকার হাত-ফসকে বের হয়ে গেল। গজরায় সে–যাও, ওই ঘন্টা বাজানো চাকরিই করো গে আর কুলোকের লাথি-ঝাঁটা খাও গে। 

পরক্ষণেই দম নিয়ে ফুল ইস্টিমে বাঁশি-বাজানোর সুরে হাঁকে নেত্যকালী। 

বি-ম-লি। জল দে– 

.

নেত্যকালীর বৈকালে একটু বেড়ানো অভ্যাস। ইদানীং শরীরটা একটু ভারী হয়ে আসছে, তাই রূপেন ডাক্তার বলে—হাওয়ায় বেড়াবেন বৈকালে। 

বিমলিকে নিয়ে বের হয় সে ইস্টিশনের ওদিকে ফাঁকা বাগান কাশবন ছাড়িয়ে নদীর দিকে। 

.

রতন আর বকুল আজ দু’জনেই ঘর-ছাড়া, এসে আশ্রয় নিয়েছে বোর্ডিং-এ। রতন চাকরি করছে, বকুলের চাকরিও হয়ে যাবে। দু’জনে দু’জনের জন্য কি নীরব একটা সমবেদনা বোধ করে। মনে মনে রতনও খুশি। 

বকুলের জন্য সে ঘর ছেড়ে পথে এসেছে। বকুলও জানে সেটা। তাই দু’জনে আজ দু’জনের মাঝে সেই নিঃশেষ প্রীতির স্পর্শ খুঁজে পায়। 

সূর্যের শেষ আলো ছড়িয়ে পড়েছে গাছগাছালির মাথায়, পাখি ডাকছে, নদীর বালুচরে নেমেছে সোনালি আবেশ। ওরা দুজনে যেন ওই রূপজগতের অসীমে হারিয়ে গেছে কিসের সন্ধানে। রতন বলে—তোমার চাকরিটাও হয়ে যাবে। তখন আমরা দু’জনে সব কিছু বাধা ঠেলে এগিয়ে যাব বকুল। 

বকুলও তার নিঃস্ব জীবনে সেই পূর্ণতার স্বপ্ন দেখে, তার কিছুই নেই। তবে মনে পড়ে মাসিমার কথা। ওই নেত্যকালীই তাকে পরম আশ্বাস দিয়ে এনেছিল ওই নরকের বাইরে। 

বলে বকুল—মাসিমাকে বলা দরকার। 

রতন অবাক হয়—মাসিমা। তোমার সেই দারোগা মাসিমাকে রিয়েলি ভয় করি বকুল। অ্যাই রে–

হঠাৎ লালমাটির পগারের ওদিকে তালগাছের আড়ালে ভ্রমণরতা সাক্ষাৎ নেত্যকালীকেই দেখেছে রতন। বকুল শুধোয়—কী হলো? 

রতন আঙুল দিয়ে দেখায়—ওই যে। উনি। 

অজানা-ভয়ে রতন ঘাবড়ে গেছে। দেখেছে ওই ভদ্রমহিলার কঠিন স্বরূপটিকে। তাই রতন বলে—আমি যাচ্ছি বকুল। পরে দেখা হবে। 

রতন গুড়ি মেরে সামনের কাশবনে সেঁদুতে যাবে, হঠাৎ পেছন থেকে বেশ ভরাটি গলায় আওয়াজ ওঠে—খাড়া রও। 

যেন পুলিশ বন্দুক তুলে তার দিকে তাক করে হুকুম দিয়েছে হল্ট। নড়লেই বুলেট ছুটে আসবে। ধমকের-চোটে রতনের-পা ওই শক্ত মাটিতেই আটকে গেছে। 

নেত্যকালীও ওদের দু’জনকে দেখে এগিয়ে আসছে, পিছনে রয়েছে বিমলি। 

নেত্যকালী হাঁক পাড়ে—বকুল ওটাকে নে আয়। এদিকে এসো অ্যাই ছেলে। 

নেত্যকালী এসে এবার ওদের সামনে দাঁড়িয়েছে। বকুল যেন হাতেনাতে কি অন্যায় কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে। রতনের বুক কাঁপছে দুরু দুরু। 

নেত্যকালী দেখছে ওকে পা থেকে মাথা অবধি। এর আগেও নেত্য রতনকে দেখেছে ওই মহিলা সমিতির অফিসে, তা দূর থেকেই। এমন সার্চলাইটের মতো তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নয়। রতন বলির পাঁঠার মতো চুপ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎ নেত্যকালীর খ্যানখ্যানে গলার আওয়াজ ওঠে। 

—তুমি ওই গুপি মিত্তিরের ব্যাটা না? 

রতন মাথা নাড়ে। 

বকুল ওকে বাঁচাবার জন্য বলে—ও-ই রতন। খুব ভালো ছেলে মাসিমা। স্কুলে মাস্টারি করে। 

নেত্যকালী ধমকে ওঠে—থাম লা তুই। তোকে ওর হয়ে ওকালতি করতে ডাকি নি। ও কি বোবা যে রা কাড়ছে না? 

বকুল থেমে যায়। নেত্যকালী জেরা করে, 

—তোমার বাবার তো শুনি নানান দু’নম্বরি কারবার। তা এটিও কি তোমার দু’নম্বরি পেরেম, অ্যাঁ। 

রতন বলে ওঠে—না মাসিমা। 

—মাসিমা, আমারও জানা আছে। ওসব মাসিমা ফাসিমাতে কাজ হবে না। সিধে করে বলো বকুলকেই বিয়ে-থা করবে কিনা? এখানে ওখানে পেরেম পেরেম খেলা করে শেষকালে বাপের সুপুত্রের মতো ব্যাণ্ড ব্যাগপাইপ বাজিয়ে টাকার লোভে আসল কোথায় বিয়ে করে ঘর ঢুকবে? আমে-দুধে মিশে যাবে আঁটিটাই শেষকালে গড়াগড়ি খাবে। তোমাদের বিশ্বাস নাই। 

রতন শুনছে কথাগুলো। স্পষ্ট সতেজ কথা। মনে হয় এর সাহায্যের দরকার হবে তার। উনিই পারেন রতনের জীবনে বকুলকে এনে দিতে। 

রতন বলে—বাবার অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্যই ঘর ছেড়ে এসেছি। ওর ব্যবসাতেও নামিনি। বকুলকে আমিও বিয়ে করতে চাই মাসিমা। 

সংসারে আজ আমার কেউ নেই। বাবাও যেন পরমানুষ। মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। আমি একা বকুলও তাই। আমরা দু’জনে তাই সুখী হতে চাই মাসিমা। 

নেত্যকালী শুনছে ওর কথাগুলো। ওর কন্ঠস্বরে কোনো কৃত্রিমতা নেই। নেত্যকালী বলে—ঠিক আছে। দেখো বাপু যেন কথার নড়চড় না হয়। আমি সব ব্যবস্থা করছি। তা বোর্ডিং-এ কি খেতে দেয় রে বকুল? 

বকুলও নিশ্চিন্ত হয়েছে মাসিমাকে সহজ হতে দেখে। রতনকে তার পছন্দ হয়েছে এটা বকুলও বুঝেছে। বকুল মাসিমার কথার জবাবে বলে—খেতে দেয় ওই বাজার ঝেটানো ঘ্যাঁট আর হড়হড়ে ডাল, লাল চালের ভাত, কুলের টক। মাছ সপ্তাহে দু’দিন। 

নেত্যকালী দুঃখ বোধ করে। তার সংসারে ওসব জিনিস গড়াগড়ি যায়। ইস্টিশানের তোলা যা ওঠে তার ভাগে সেটার পরিমাণও কম নয়। বকুল আসে সকাল বিকাল খেয়ে যায়। 

নেত্য বলে—রতনকেও নিয়ে আসিস। ভালোমন্দ করি—কেইবা খাবে, এসো রতন আমার বাসায়। 

মা-মরা ছেলেটাকে নেত্যকালীও যেন ভালোবেসে ফেলে। রতন সায় দেয়—যাব। 

নেত্য বলে—বুঝলি বকুল, ওকে নে আসবি। তারপর আমি দেখছি। যা তোরা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, ফাঁকা-মাঠে ঘুরবি না। রতন, সোজা বোর্ডিং-এ গে পড়তে বসবে, এম-এ পরীক্ষা দিচ্ছ শুনলাম। পড়ায় ফাঁকি দেবে না। ওইটাই এখন আসল। বুঝলি ছুঁড়ি এসময় এত ঘুরবি না দু’জনে যা—রতন যেন সরে যেতে পারলে বাঁচে। বকুলও। 

ছাড়া পেয়ে ওরা দু’জনে পগার-টপকে আমবাগানের ছায়া অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। 

.

গুপি মিত্তির মুখে গর্জন করে চলেছে, কিন্তু বেশ বুঝেছে তার অন্তঃপুরেও ফাটল ধরিয়েছে ওই মহিলা সমিতি, আর নেত্যকালীই তাদের দলনেত্রী, মদের কারবারও বন্ধ। কুসুমও এবার স্বমূর্তি ধরেছে। ও যদি দাঁড়িয়ে থেকে সত্যি রতনের বিয়েটা ঘটিয়ে দেয় ওই বকুলের সঙ্গে, গুপি মিত্তিরকে ঘাড় কাত করে সেটা মেনে নিতেই হবে। 

তাই গুপি এদিকে ইস্টিশান গিন্নিকে জব্দ করার জন্যে ভজগোবিন্দকে বদলি করাবেই, দরখাস্ত লেখা হয়ে গেছে। দু-চারজনের সইও করিয়েছে। গঞ্জের আরও কিছু ব্যবসাদারের সই করাবে। তার আগে রতনের সঙ্গে দেখা করা দরকার। বাপ-ছেলের বিবাদটা মেটাতে চায়, রতন তবু বাড়ি ফিরে আসুক। 

তাই গুপি মিত্তির নিতাইকে নিয়ে বের হয়েছে। বোর্ডিং-এ রতনের ঘরে গিয়ে দেখে রতন নেই। একটা তক্তাপোশের উপর সামান্য বিছানা ময়লা মশারি আর চারিদিকে বই খাতা ছড়ানো। দড়ির আলনায় দু’একটা জামা-ধুতি ময়লা-লুঙি-গামছা ঝুলছে। গুপি মিত্তির বলে, 

—দেখছিস নিতাই, বাবু বাড়িতে কাপ্তান সেজে থাকতেন, শুতেন ছপ্পর খাটে গদির উপর, বোম্বে ডাইং-এর দামি চাদর পাতা থাকত, ধুতি-পাঞ্জাবি ছাতা গড়াগড়ি যেত। বাবু তো এখন কাবু রে! 

নিতাই বলে—তা আর হবে না। খাওয়াও শুনছি ঘ্যাঁট আর ভাত! 

গুপি মিত্তির মন্তব্য করে—তবু এখানে পড়ে থাকব কেন রে? 

নিতাই শোনায়—পেরেমের গুতোঁ গো—বড় জব্বর গুতোঁ। তবে সিধে হয়ে আসছেন বোধহয়। চলো—দেখা করে বলোগে কথাটা। মনে হয় শুনবে রতন! 

কে বলে রতন নাকি এই আমবাগানের দিকে বেড়াতে গেছে। গুপি আর নিতাই চলেছে সেখানে যদি তার সন্ধান পায়। কথাটা নিরিবিলিতে বলাই ভালো। দু’জনে চলেছে, বাগানে নেমেছে আবছা অন্ধকার। 

সামনে নেত্যকালী আর বিমলিকে দেখে দাঁড়াল তারা। মুক্ত আকাশে তারাগুলো ঝকমক করছে। মাঠে কাশবন—সবুজ ধান খেতের বুকে হাওয়ার আনাগোনা 

নেত্যকালীও বুঝেছে গুপিনাথের এখানে এসময় আসার কারণটা। বলে সে—ছেলেকে খুঁজতে বেইরেছ বুঝি মিত্তিরমশাই? 

গুপি মিত্তির কড়াস্বরে বলে—সে খবরে আপনার কী দরকার? 

নেত্যকালী দেখছে ওকে। মনে পড়ে গুপি মিত্তির আজ স্টেশনে গিয়ে তার স্বামীকেও শাসিয়ে এসেছে। নেত্য বলে, 

—ঘর সামলাতে পারো না—পরকে ধমকানো কেন? আজ ইস্টিশানে গে আমাদের ঘরের লোকটিকেও শাসিয়ে এসেছ—বদলি করে দেবে! 

গুপি মিত্তিরের পকেটে সেই দরখাস্ত তখনও মজুত। গুপি মিত্তির শোনায়—যা খুশি করবেন—জবাব দিতে পারব না? 

নেত্যকালী গর্জে ওঠে—ওতে লাভ হবে না! আমিও কুলদা মোক্তারের কন্যা, বাপকে চেনো তো? তাই বলছিলাম ছেলেকে ফিরে পেতে চাও তবে যা বলছি তাই করো! 

গুপি মিত্তিরও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ী লোক, কাউকে সহজে চটাতে চায় না। তাই ভালো মানুষের মতো শুধোয়—কী করতে হবে? 

—ওই বকুলের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়ে বাড়ি নিয়ে যান! 

নেত্যকালীর কথা শেষ হয় না। গুপি মিত্তির কঠিন স্বরে প্রতিবাদ করে। 

—কভি নেহি! আরও শুনে রাখুন—যারা একাজ করাতে চায় তাদের কাউকে আমি ছাড়ব না।

—হ্যাঁ! এতবড় দাপট তোমার? 

নেত্যকালীর কথায় গুপি মিত্তির ঘোষণা করে। 

—হ্যাঁ! তাই করব। আপনাকেও ঠাণ্ডা করে দেব। ঢাকিসুদ্ধ বিসর্জন করে দেব এই লাউগঞ্জ থেকে! 

নেত্যকালী চটে ওঠে। এবার সে বিমলির দিকে তাকাল—বিমলি! 

বিমলিও জানে দিদিমণির পরবর্তী নির্দেশটা। সে ঘাড় নাড়ে। যেন তৈরিই হয়ে আছে সেও। নেত্যকালী তবু যেন সাবধানের ভঙ্গিতেই ফের শুধোয় গুপি মিত্তিরকে—তাহলে ওসব করবেন না? বিয়ে দেবেন না? 

গুপি মিত্তির বলে—না। কভি নেহি। বরং সব্বাইকে আমার পেছনে লাগার জন্য ঠাণ্ডা করে দেব। উৎখাত করে দেব! 

নেত্যকালী এবার ফাইনাল নোটিশ ছাড়ে—বিমলি, শুরু কর! 

বিমলিও তৈরি ছিল। পুরো ইস্টিমে বেজে ওঠা বাঁশির মতো বিমলির তীব্র সুরেলা গলাটা উদারা-মুদারা ছাড়িয়ে তারায় গিয়ে তীব্র পঞ্চম সুরে বেজে ওঠে ওই অন্ধকার স্তব্ধ মাঠের মধ্যে—ওগো কে কোথায় আছ ছুটে এসো গো—অবলা নারীকে একলা পেয়ে ইজ্জত নেবার জন্য এসেছে শয়তানরা—ওগো-ও…. 

আবছা অন্ধকার স্তব্ধ চারিদিক। 

একটু দুরে হাটতলা—এদিকে বোর্ডিং-এর শ’খানেক ছেলে থাকে তারাও শুনেছে ওই আর্তনাদ। ঘানি কলের বাঁশির মতো তীব্র সুরে বেজে চলেছে বিমলার আর্তনাদ। 

—ওগো—কে কোথায় আছ ছুটে এসো ও-সব্বোনাশ হয়ে গেল গো—অন্ধকারে চারিদিকে হইচই পড়ে যায়। গ্রামের চত্বরের মধ্যে এসব কাজ ঘটবে কেউ ভাবতে পারে না। হাটতলা থেকে ব্যাপারি-দোকানি-খদ্দেররা লাঠি বাঁশ নিয়ে চিৎকার করে ওঠে, 

—ভয় নাই। 

নিতাই চতুর ব্যক্তি! সে বুঝেছে এবার বিপদের গুরুত্ব। ওই লোকজনগুলো বাঁশ, লাদনা যে-যা পাবে নিয়ে এসে হাজির হবে, আর অন্ধকারে তাদের দু’জনকে পিটিয়ে লাশ করবে পয়লা চোটে, তারপর দেখে-শুনে যখন জানবে তখন আর তাদের হাড়গোড় আস্ত থাকবে না। 

গুপি মিত্তির ওকে চিৎকার করে উঠতে দেখে ধমকাতে থাকে। 

—অ্যাই বিমলি! আরে অ্যাই থাম্! অ্যাই— 

নেত্য প্রশ্ট করে—থামবি না। সমানে চালিয়ে যা, আরও জোরে- 

বিমলির চিৎকারের ফল ফলেছে। দূরে কাদের গলা শোনা যায়—ভয় নাই— 

নিতাই চমকে ওঠে—কর্তা! কেটে পড়ো, সটান দৌড় লাগাও ছামুপানে সিধে ওই নদীর চরের দিকে! 

কেন? অ্যাই থাম—তুই—কিন্তু গুপির কথা শুনতে বয়ে গেছে বিমলির। সে একদমে ওই আকাশ ফাটানো চিৎকার সমানে করে চলেছে। 

নিতে বলে—বাঁশ-লাঠি নে ধেয়ে আসছে ওরা, আর বাকি থাকবনি। পিটিয়ে লাশ করে দেবে! পালাও কৰ্তা। 

—অ্যাঁ! গুপিনাথ এবার বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারে। শিউরে উঠেছে সে। দূরে দেখা যায় লাঠি-রড নিয়ে দৌড়াচ্ছে লোকজন। এইদিকেই আসছে। নিতাই তাড়া দেয়—কর্তা—দৌড়াও! শেষ করে দেবে। 

গুপিও বুঝেছে যঃ পলায়তি সঃ জীবতি। ওসব কথা পরে হবে এখন পালানো ছাড়া পথ নেই। ক্ষীণ দেহ নিয়ে নিতাই আগেই দৌড় শুরু করেছে হরিণের বেগে, গুপি মিত্তিরের দৌড়ানো অভ্যাস নেই, প্রথম চোটেই সামনের পগারে হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ল ধানখেতের মধ্যে। কাদায় জলে মাখামাখি। পিছনে তখন পায়ের শব্দগুলো ধেয়ে আসছে। কাদা ঠেলে উঠে গুপিও প্রাণপণে তখন ধান খেত, খাল, পগার টপকে তিরবেগে দৌড়ে চলেছে সিধে কাশবনের দিকে। 

কতক্ষণ দৌড়োচ্ছিল জানে না—কাশবন পার হয়ে নদীর বালিতে ছিটকে পড়ে গুপি মিত্তির চিত হয়ে পড়ে খাবি খাচ্ছে, বুকটা কাঁপছে হাপরের মতো, গলা শুকিয়ে কাঠ। নড়ন- চড়ন নাস্তি! 

—কর্তা! কর্তা। 

নিতাই তার আগেই ওই পথ পাড়ি দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে এসে হাজির হয়েছে, ওদিকে কর্তাকে এসে বালিশয্যা নিতে দেখে এগিয়ে যায়। গুপি মিত্তিরকে চেনার উপায় নেই। কাদা মেখে পাভূতের মতো দেখাচ্ছে। কপালটা কেটে গেছে—হাঁটুটা ছড়ে রক্ত পড়ছে। গুপি ইশারায় দেখায়—জল! 

জলটল দিয়ে কোনরকমে সুস্থ করে উঠে বসায় ওকে নিতাই। তখনও পিছনের ওই বাগানের দিকে লোকজনের গোলমাল শোনা যায়। দু’চারটে হ্যারিকেন ঘুরছে। অনেকেই ফিরে গেছে কিছু না দেখে। 

নিতাই বলে—সাংঘাতিক মেয়ে ও কর্তা। ওনার ত্রিসীমানায় যেও না। বধ হয়ে যাবে।

গুপি মিত্তির তখনও গজরাচ্ছে—ওকে ঠাণ্ডা করে দেব। 

নিতাই বলে—ওকে ঠাণ্ডা করবে কি? আজই তো ও আমাদের ঠাণ্ডা করে দিত। ধরতে পারলে বাকি থাকত কিছু! 

গুপি মিত্তির করিতকর্মা অধ্যবসায়ী ব্যক্তি। সে এত সহজে কোর্ট ছাড়তে রাজি নয়। যা করার সেটা মনে মনেই রাখে। তাই নিতাই-এর কথার জবাব না দিয়ে বলে, 

বাড়ি চল। দ্যাখ ব্যাটারা সব ফিরেছে কিনা। 

রাত হয়ে গেছে। নদীর ব্রিজের উপর দিয়ে আলো জ্বেলে বাঁশি বাজিয়ে লাস্ট লোকাল বীরপুর থেকে এসে লাউগঞ্জে ইন করছে। দুটি ছায়া-মূর্তিও নীরবে চোরের মতো লাইন পার হয়ে ইস্টিশান বাঁ-হাতে ফেলে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গুপি মিত্তির রাগে গজগজ করছে। 

একনজর দেখল সে বুধনদের আড্ডার দিকে তাকিয়ে। অন্যদিন এসময় সেখানে হুল্লোড় চলে। মতিয়াও ওদিকে চোলাই মদ পাচার করে শেষ করতে পারে না। বেশ টাকাও পায় গুপি, দমকা অনেক টাকা। সেই রোজকারও আজ বন্ধ! লোকজন নেই, মৌমাছির ভিড় নেই। 

জায়গাটায় স্তব্ধতা নেমেছে। 

সব ঘটেছে ওই নেত্যকালীর জন্য, ওরই দাপটে। 

আজ স্বয়ং গুপি মিত্তিরকে ও যা প্যাঁচকলে ফেলেছিল—না পালালে গুপিও লাশ হয়ে যেত।

গুপি মিত্তির পদে পদে ঠকছে ওই মহিলার কাছে। ভয়ও হয়—ওর বাপটি আরও সাংঘাতিক ব্যক্তি! তাকে ভয় করে সকলেই! 

নিতাই কর্তাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে বলে, 

—চলোগো কর্তা। কাল ভোরে আবার সদরে যেতে হবে। 

কথাটা মনে ছিল না গুপির এইসব ঝামেলায়। এতক্ষণে খেয়াল হয়। কালই তার মামলার দিক পড়েছে সদরে, জরুরি মামলা। সাক্ষীদের নিয়ে যেতে হবে। 

গুপি পায়ে পায়ে এগোয়। এবার মামলার প্রসঙ্গে কথাটা মনে পড়ে। গুপি মিত্তির বলে—ভজন, গিরিধারী দু’জন সাক্ষী এই মামলায়! ওদের বাড়িতেও খবর দিয়ে যা, কাল ভোরের ট্রেনেই সদরে যেতে হবে আমার সঙ্গে। 

নিতাই বলে—একলা বাড়ি যেতে পারবে তো? তাহলে আমি ওদের খবর দিয়ে যাই!

—তাই যা! গুপি বাড়ির দিকে এগোলো। লাউগঞ্জ যেন নিশুতি। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *