ডেথ সার্টিফিকেট…

ডেথ সার্টিফিকেট…

ঘরটা বেশ ছিমছাম। একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার। সিলিং ফ্যান হঠাৎ হঠাৎ শব্দ করে আবার নিজ থেকে থেমে যায়। অতঃপর একই রিদমে ট্যাকট্যাক শব্দ।

আমার সামনে বসে থাকা লোকটি, সেই ট্যাকট্যাক শব্দ উপেক্ষা করে বললেন, ‘এনেছ?’

আমি ব্যাগের ভেতর থেকে আমার বাবার ডেথ সার্টিফিকেট বের করলাম। ঠিক এমন সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। ঢিলেঢালা ফতুয়া গায়ে, উত্তেজিত ভঙ্গিতে আমার বাবা প্রবেশ করেন। বললেন, ‘তোমার হাতে কী?’

আমার সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। বাবাকে দু সপ্তাহ আগে কবর দেয়া হয়েছে। কবরের সামনে ঘাস দিয়ে লাগানো হয়েছে সুন্দর একটা নামফলক।

বাবার বিস্ময় মাখা চোখ দুটো কেমন যেন সরু থেকে আরও সরু হতে থাকে। নিজের ডেথ সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলে বললেন, ‘এসবের মানে কী?’

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম অপলক। এ রকম একটা জলজ্যান্ত মানুষকে কেন আমার মৃত মনে হবে?

পুরো ব্যাপারটা কি স্বপ্নের অংশ? লিম্বিক সিস্টেম অর্থাৎ ইমোশনাল ব্রেন ঘুমের সময় খুব সক্রিয় থাকলে এ রকম হতে পারে।

আমরা দুজন ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে গাড়ি পার্ক করা। বাবা ড্রাইভিং সিটে বসে বললেন, ‘তাই বলে ডেথ সার্টিফিকেট?’

আমি চুপ করে রইলাম।

‘আমরাও ছেলেবেলায় ডক্টরের প্রেসক্রিপশন নকল করেছি। তাই বলে ডেথ সার্টিফিকেট?’

বললাম, ‘আমার একটা ভয়ংকর অসুখ হয়েছে।’

‘কী অসুখ?’

‘আমার তোমাকে মৃত মনে হয়। সব সময় না, মাঝে মাঝে।’

দূরে কোথাও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আকাশে আলো ফুটছে। গাড়ির ভেতরে

থাকায় শব্দ কানে আসছে না।

বাবা অসহায় দৃষ্টি নিয়ে বললেন, ‘কবে থেকে এ রকম মনে হচ্ছে? ‘দু সপ্তাহ।’

‘মনে হবার কারণ?

‘সেটা জানি না।’

‘আমরা একসাথে থাকি, তারপরেও?’

‘কিন্তু আমি খুব কাছ থেকে তোমাকে মারা যেতে দেখেছি। আইসিইউতে নেয়া হয়েছিল।’

‘আইসিইউ?’

‘চোখের সামনে অক্সিজেনের লেভেল কমতে শুরু করে।‘

‘এসব কবেকার কথা?’

‘দু সপ্তাহ আগের।’

‘আমি তো রোজই অফিস করছি।’

‘তোমার মনে হচ্ছে, কিন্তু তুমি তখন লাইফ সাপোর্টে ছিলে।’

আমার কথা শুনে বাবা শব্দ করে হাসলেন।

‘তোমাকে আজই ডক্টরের কাছে নিয়ে যাব।’

‘আচ্ছা।’

‘ডক্টরকে খুলে বলবে সবকিছু। ডক্তর আর লইয়ার, এই দুজন মানুষের সাথে কখনো মিথ্যা বলতে নেই।

‘ঠিক আছে।’

‘তোমার কি শুধু আমাকেই মৃত মনে হয়? নাকি অন্যদের ক্ষেত্রেও এমন হয়?’

‘শুধু তোমাকে।

‘কীভাবে মারা গেছি আমি?’

‘লাং ক্যান্সারে।’

‘কোন হসপিটাল?’

‘মাউন্ট এলিজাবেথ।’

বাবা চিন্তিত মুখে সিগারেট ধরালেন। ‘তোমার অসুখটা আমি ধরতে পেরেছি।’

‘কী?’

‘অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা থেকে এ রকম হয়।’

‘কী রকম?’

‘মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের আইসিইউ, লাং ক্যান্সার সব ঠিক আছে। কিন্তু আমি সুস্থ হয়ে ফিরেছি বছর খানেক আগে।’

‘হ্যাঁ, তুমি সুস্থ হয়ে ফিরেছিলে।’

‘তাহলে?’

‘তারপর আবার ক্যান্সার ধরা পড়ে।

‘এটা তোমার অবচেতন মনের ভাবনা।’

‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’

বাবা বললেন, ‘তোমাকে ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব।’

তার কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হই। আমি বাবার হাতে হাত রাখলাম। হাত ঠান্ডা হয়ে আছে। এ রকম একটা জলজ্যান্ত মানুষকে কেন আমার মৃত মনে হবে?

আমার অবস্থা এমন, আমি আমার অবস্থানে স্থির থাকতে পারি না। মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা বেঁচে আছে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা মারা গেছে।

হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি। প্রচণ্ড বাতাসের সঙ্গে রাস্তায় ধুলা উড়ছে। গাড়িতে বেজে চলেছে বনি এমের গান। বাবা মাথা দোলায়।

‘তুমি একসময় খুব বনি এমের গান শুনতে।’

‘হ্যাঁ মনে আছে। ববি ফ্যারেলের মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল, সাথে চিরাচারিত স্কিন টাইট বেল বটম প্যান্ট।’

‘ববি ফ্যারেল কীভাবে মারা গেছে জানো? আগের দিন রাতে কনসার্টে গান করেছিল। পরদিন সকালে হোটেল রুমের বেড়ে মরে পড়ে রইল।’

‘তোমার মাথা থেকে এই মৃত্যুচিন্তা সরাতে হবে। যেকোনো কিছুতেই তুমি শুধু মৃত্যুকে খুঁজছ।’

‘কী রকম?’

বাবা বললেন, ‘তুমি যা চিন্তা করবে তোমার মন তাই খুঁজবে। আমরা যদি এখন সবুজ রং নিয়ে কথা বলি, আশেপাশে যত সবুজ দেখছ সব চোখে পড়তে শুরু করবে।’

সত্যি তাই হলো। মনে হচ্ছে রাস্তার সব সিএনজি পাখির মতো করে আমার চোখের সামনে উড়ছে।

আমি বাবার হাতে হাত রাখলাম। হাত ঠান্ডা হয়ে আছে। গাড়ি থামিয়ে বাবা দুটা আইস্ক্রিম নিয়ে এলেন।

বাইরে প্রচুর বৃষ্টি। আমরা দুজন আইস্ক্রিম খেতে খেতে কথা বলছি। আমার কি কখনো নিজেকে মৃত মনে হয় কিনা, জিজ্ঞাসা করেন বাবা।

‘কী সাংঘাতিক প্রশ্ন। এ রকম হয় নাকি?’

‘কোটার্ড সিনড্রোমে আক্রান্ত মানুষেরা নিজেদের কিংবা অন্যদেরও মৃত মনে করে।’

‘নিজেকে মৃত মনে করলে সে চিন্তা করছে কেমন করে?’

‘পুরো ব্যাপারটা এক ধরনের ডিলিউশন।’

‘তুমি বলতে চাইছ, আমি একটা ডিলিউশনের ভেতরে আছি?’

সন্ধ্যা ৬টা বাজে আমরা দুজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলাম। মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর, আমাকে ভেতরে যেতে বললেন।

ভদ্রলোক খুবই সুন্দর করে কথা বলেন। সরাসরি সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা না করে বললেন, ‘আপনার কথা বলুন।’

আমি বললাম, ‘আমার একটা কঠিন সমস্যা হচ্ছে।’

‘কী?’

‘আমার বাবা বেঁচে আছেন, কিন্তু মাঝে মাঝে আমার তাকে মৃত মনে হয়।’

‘আপনার বাবা এখন কোথায়?’

‘বাইরে বসে আছেন।’

ভদ্রলোক তার কম্পাউন্ডারকে ডেকে বললেন, ‘রোগীর সাথে যিনি এসেছেন, তাকে আসতে বল।’

‘কেউ তো আসেনি।

কেউ না?’ প্রশ্ন করে ডক্টর। ‘না, কেউ না।’

খানিকটা নীরবতা। ডক্টর সাহেব চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আপনার সমস্যা এটা না, আপনার বাবা বেঁচে আছেন, কিন্তু আপনি তাকে মৃত ভাবছেন। আপনার সমস্যা ঠিক এর উল্টোটা। আপনার বাবা মারা গেছেন কিন্তু মাঝে মাঝে আপনার তাকে জীবিত মনে হয়।’

2 Comments
Collapse Comments
বৃষ্টি June 28, 2023 at 1:25 pm

অদ্ভুত! প্রত্যেকটা গল্পই। এই লেখকের আরো বই পড়তে চাই।

borring! waste of time

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *