টোপ

টোপ

কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল গর্ডনের। মাথাটা টনটন করছে। গতরাতে অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছিল। আজ এখন চোখ খুলেই বুঝল, শরীর আরও ঘুম চায়। শরীর তার সমস্ত আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চায় বিছানাকে। আরও কিছুক্ষণ মিশে থাকতে চায় ঘুমের সঙ্গে। কিন্তু সে উপায় কি আছে? বেল যখন বেজেছে, দরজা তো খুলতেই হবে।

বিছানায় বসে মাথার কাছে রাখা ডোনাল্ড ডাকের মুখ আঁকা টি-শার্টটা গলিয়ে নিল গর্ডন। এমন টি-শার্ট ওর অনেকগুলো রয়েছে। প্রাগের একটা মেলার থেকে কেনা। সবক’টা একই ডোনাল্ডের ছবি, শুধু নাগরা জুতোর মতো ঠোঁটের রংটা এক-একটা টি-শার্টে এক-এক রকম। আজ হলুদ ঠোঁটের ডোনাল্ড পরেছে ও।

ডিজিট্যাল দেওয়াল ঘড়িতে এখন সাতটা বেয়াল্লিশ। এমন সকালে কে এল? খবর কাগজওলা আর দুধওলা তো দরজার কাছে কাগজ আর দুধ নামিয়ে রেখে যায়। ওরা তো বেল বাজায় না! গতকালও এমন সময় বেল বেজেছিল, আজও বাজল। লেট রাইজ়ার হিসেবে গর্ডনের নাম আছে পরিচিত মহলে। এই পৌনে আটটার সকাল তো ওর কাছে ভোর। মানুষজন কি রোজ এমন সময়েই আসবে? কেউ কি ওকে ঘুমোতে দেবে না?

এই পাড়াটা খুব নির্জন। তাই এখানে ছোট্ট বাড়িটা নিয়েছে গর্ডন। এই সকালে চারিদিক এতটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে যে, মনে হচ্ছে বন্ধুর সেই পাহাড়তলির নির্জন কটেজেই রয়েছে যেন!

হলঘর পেরিয়ে বাইরের আই হোলে চোখ রাখল গর্ডন। ও, এ তো পরিচিত মানুষ। মনটা ভাল হয়ে গেল গর্ডনের। হাত দিয়ে এলোমেলো চুলটা ঠিক করে মুখে হাসি নিয়ে দরজা খুলল ও, গুড মর্নিং। প্লিজ় কাম ইন। হঠাৎ এত সকালে?

দরজার বাইরের মানুষটি হাসল শুধু। তারপর আচমকা কোটের পকেট থেকে সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল বের করে গর্ডনের বুক লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল। ফট ফট শব্দ হল দুটো। গরম লোহা শরীরের ভিতর গিয়ে পাক মারল। মাংস, মেদ আর হাড় জড়িয়ে গেল একে অপরের সঙ্গে। তীব্র যন্ত্রণা নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। দৃশ্য ঝাপসা হয়ে গেল একদম। কিছু বোঝার আগেই গর্ডন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ডোনাল্ড ডাকের মাথা ফুটো করে ঢুকে যাওয়া গুলির পথ ধরে রক্তের দাগ লম্বা হয়ে নেমে এল মাটিতে।

দরজার সামনে পড়ে থাকা নিস্পন্দ দেহটাকে দেখে পাখি-ভাষায় উত্তেজনা প্রকাশ করল বাইরের বাগানে এসে বসা বসন্তের দুটো ছোট্ট সোয়ালো।

দশ দিন পর: ভারতবর্ষের কোনও এক জায়গায়

“বসন্তে ফুলের চাষ না করে এরা পপির চাষ করে কী করে?” চিফ ভুরু কুঁচকে মাটির দিকে তাকালেন। লোকটা যে দিলীপকুমারের অন্ধ ভক্ত, এই ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। গর্গ ঠোঁট টিপে হাসি চাপল অনেক কষ্টে। চিফ মাঝে মাঝে একটু নাটুকে হয়ে যান।

চিফ বললেন, “চিন্তা করতে পারো চেতন, ইউনাইটেড নেশনসের রিপোর্ট বলছে যে, সারা পৃথিবীতে নাকি ড্রাগ ট্রেডের পরিমাণ বছরে চারশো বিলিয়ন ডলার! আর এর বেশিরভাগটাই টেররিজ়মকে প্রোমোট আর সাপোর্ট করতে খরচ করতে হয়। তুমি বুঝতে পারছ পৃথিবী কোনদিকে যাচ্ছে?” চিফ এবার রাজেন্দ্রকুমার।

চেতন গর্গ টেব্ল থেকে আর-একটা কাগজ তুলে নিলেন হাতে। দ্য অফিস অফ ন্যাশনাল ড্রাগ কন্ট্রোল পলিসির বিজ্ঞাপন এটা। বলা হচ্ছে যে, যারা ড্রাগস কিনছে, তারা এই দুনিয়াজোড়া সন্ত্রাসে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছে। অবশ্য এমন অনেক কিছুই গর্গের মুখস্থ আছে। ও জানে যে, এই ড্রাগ সারা পৃথিবীতে প্রায় দেড় কোটি মানুষের কাছে পৌঁছোয়, যার ভিতর এক লক্ষ মানুষ প্রতি বছর মারা যায়। আজকের মিটিং-এ এইসব নিয়েই কথা হয়েছে। তবু মিটিং ভেঙে যাওয়ার পর চিফ গর্গকে বসিয়ে রেখেছেন। ও জানে, চিফ যতই নাটক করে যান না কেন ড্রাগ নিয়ে চিফ যা বলতে চান, সেই ব্যাপারটা সিরিয়াস। ওদের এই হাইলি ক্লাসিফায়েড সংস্থাটির একদম ইনার সার্কেলে বসে রোজ টেররিজ়ম আর ড্রাগসের নেক্সাসের চাপ বুঝতে পারে গর্গ। ভারতবর্ষের মতো একটা দেশ যে কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় টিকে আছে, তা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় ওর। এর চারিদিকে এত শত্রু! তারা যেন-তেন প্রকারে দেশটাকে কামড়ে, আঁচড়ে, ছিঁড়ে ফেলতে চায়। আর এ ব্যাপারে ড্রাগস মাফিয়াদের টাকা প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন জোগায়। তবু দেশটাকে সঙ্ঘবদ্ধভাবে টিকিয়ে রাখার জন্যই গর্গরা নিরন্তর চেষ্টা করে। অ্যান্টি-টেররিজ়মের বিরুদ্ধে ভারতের লজিস্টিকের মেরুদণ্ড হল গর্গদের সংস্থা আর সেই সূত্রে ড্রাগসের থেকে আসা স্পনসরশিপ বন্ধ করাও ওদের কাজের মধ্যে পড়ে।

চিফ বললেন, “তুমি তো জানোই, গত দশ দিন আগে আমাদের ‘মোল’কে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে আমরা কিন্তু অনেকটাই রাডারলেস জাহাজের মতো হয়ে পড়েছি। নেক্সট দু’সপ্তাহের ভিতর বারো হাজার টন ড্রাগস, প্রধানত হেরোইনের একটা ডিল হতে যাচ্ছে। আমাদের এই সাউথ-ইস্ট এশিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত ড্রাগ চোরাচালানকারী সংস্থা সান কার্টেল পরের তিন বছরে মোট বারো হাজার টন হেরোইন হ্যান্ডেল করবে।

বুঝতে পারছ, এর থেকে এরা কী পরিমাণ মানুষ মারবে? টেররিজ়মকে ফান্ডিং করে এরা সামনের তিন বছরে একটা বিরাট পরিবর্তন আনতে চাইছে এই অঞ্চলে। ‘মোল’-এর থেকে এই খবরটা পাওয়ার পর দিনই ‘মোল’-কে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু তা হলে তো আমাদের থেমে থাকলে চলবে না। না?

“ইয়েস স্যর,” গর্গ মাথা নাড়ল।

‘মোল’ অর্থাৎ গর্গদের হয়ে কাজ করা একজন গুপ্তচর। সে সান কার্টেলের ভিতরের খবর গর্গদের পৌঁছে দিত। বোধহয় কার্টেলের লোকরা বুঝে গিয়েছিল যে, এ লোকটা ভারত সরকারের গুপ্তচর! তাই তাকে খুন করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের স্যরের একটা বাড়িতে দশদিন আগের এক সকালবেলা খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল লোকটাকে। ইনস্ট্যান্ট ডেথ। পুলিশ এসে তদন্ত, পোস্টমর্টেম ইত্যাদি করলেও ধরতে পারেনি। আর লোকটার ক্রিমিনাল রেকর্ড ছিল বলেই বোধহয় পুলিশ অত গা করেনি। এটা গর্গদের কাছে একটা খুব বড় ধাক্কা।

চিফ বললেন, “প্ল্যান ‘এ’ তো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। তা তোমার প্ল্যান ‘বি’ বলে কি কিছু আছে? একজন মারা গিয়েছে বলে তো আর আমাদের থামলে হবে না। শুধু তো ড্রাগস সিজ় করা নয়। বরং সেই সূত্রে ড্রাগসের থেকে আসা স্পনসরশিপ বন্ধ করাও আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে। ঠিকভাবে বললে ওটাই আমাদের প্রায়োরিটি। মনে রেখো আমারও বাপ রয়েছে, তারা তো আমায় শান্তিতে ঘুমোতেও দিচ্ছে না!

“স্যর, আমরা তো জানি যে পরমজিৎ অরোরা, পুরুষোত্তম স্বামী আর নবীন সুদ হল সান কার্টেলের তিন মাথা। তো এদের ধরলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়,” গর্গ চিফের দিকে সহজ সমাধান দিয়ে তাকাল।

“তোমার মাথা,” চিফ এমনভাবে বললেন যেন গর্গের ‘ওটি’ নেই, “শোনো, সব জানলেও প্রমাণ কিছু করতে পারবে? এরা সমাজের কাছে সবাই সম্মানীয় ব্যবসায়ী। বেশিরভাগ সময়ই এরা বিদেশে থাকে। তুমি যদি এঁদের ধরো, নানান কেষ্ট-বিষ্টুরা তাদের পেশি ফুলিয়ে এদের ছাড়াবার জন্য নেমে পড়বে। আর তুমিই কিচ্ছু প্রমাণ করতে পারবে না। ফলে এদের ধরার প্রশ্ন নেই। জাস্ট এলিমিনেট দেম। একসঙ্গে সব মাথারা কাটা গেলে, গোটা কার্টেল থতমত খেয়ে যাবে। আর ওই বারো হাজার টনের ডিলটাও পিছিয়ে যাবে। আমরাও সময় পেয়ে যাব এই কনফিউশনের মধ্যে ওদের ঘিরে ফেলতে। বুঝেছ?”

“স্যর, এটা আমিও ভেবেছিলাম। আর আপনি যখন বলছেন তখন এটাই আমাদের প্ল্যান ‘বি’ হোক,” গর্গ ঠোঁট কামড়াল।

চিফ চশমা খুলে তাকালেন, “গুড, দেন ডিপ্লয় ইয়োর মেন। কাজটা এখুনিই শুরু করতে হবে।”

গর্গ জানে এসব অ্যাসাসিনেশনের কাজ ঠিক নিয়মকানুনের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু যুদ্ধে জিততে হলে কে কবে রুল বুক ফলো করেছে? তবে গর্গরা নিজেরা এইসব কাজ করে না। এই জন্যই ‘মোল টু’ কার্টেলের ভিতরে তৈরি করেই রেখেছিল গর্গ। তবে ‘মোল টু’ এতদিন ঘুমন্ত ছিল, কারণ কীভাবে তা ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে ঠিক ধারণা ছিল না। কিন্তু এবার তাকে জাগাবার সময় হয়েছে। চিফের প্ল্যান অনুযায়ী তাকে কাজে লাগাবার সময় হয়েছে।

গর্গ মোবাইলটা বের করে একটা নম্বর ডায়াল করল। আর ভারতবর্ষের সীমানার বাইরে, বহুদূরে ইয়োরোপের ছোট্ট একটা দেশে ইলেকট্রনিক সিগন্যাল পেয়ে কোকিলের মতো শিস দিয়ে জেগে উঠল আর একটা মোবাইল। বোঝা গেল হানাহানির ভিতরেও বসন্ত সত্যিই আগত!

তখন ইয়োরোপের ছোট্ট একটা দেশে

ফোনটা বন্ধ করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল রুপিন। জানলার বাইরে বিরাট পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে। সবুজ চাদরে ঢাকা একটা পাহাড়। তার পায়ের কাছে নানা রঙের ফুল ফুটে রয়েছে। শান্ত মাঠ ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে। তার পাশে এই ছোট্ট কাঠের বাড়িটা কেমন যেন দেশলাই বক্সের মতো লাগে দূর থেকে। মনে হয় কেউ যেন অযত্নে ফেলে দিয়ে গিয়েছে। কেন যে অ্যাডাম এতদূরে এমন একটা নির্জন বাড়িতে থাকে! ওকে খুঁজে পেলে তো ওরা খুব সহজে মেরে দেবে। এর আগেও তো চারবার মারার চেষ্টা করেছে। তবু…

রুপিন সামনে বসা অ্যাডামের দিকে তাকাল। খুবই অল্প বয়স। দোহারা চেহারা। দেখতেও খুব সাধারণ। কিন্তু ভিতরের আগুনটা অ্যাডামের চোখ দুটো দেখলে বোঝা যায়।

“বলো, হঠাৎ এভাবে এলে কেন?” অ্যাডাম অন্যমনস্ক গলায় জিজ্ঞেস করল।

“চারবার, চার-চার বার তোকে ওরা মারার চেষ্টা করল কিন্তু…”

“ওরা তো বলছে যে ওরা চেষ্টা করেনি অন্য কেউ করেছে।”

“তুই বিশ্বাস করছিস?” রুপিন উত্তেজিত হল সামান্য, “তুই কার্টেল ছাড়ার সময় ওরা তোকে বলেনি যে, সান কার্টেল ছাড়লে তাকে এই পৃথিবী ছাড়তে হবে? তারপর মিলান, প্রাগ, ব্রাসেলস আর মাদ্রিদ, চারবার তোর ওপর অ্যাটেম্পট হল। আর তুই… দেখলি তো তোর বন্ধু গর্ডনকে কীভাবে মারল ওরা?”

“ওরা মেরেছে?” অ্যাডাম সোজা হয়ে বসল।

“আমার কাছে প্রমাণ আছে। অরোরা, স্বামী আর সুদ!”

“ওরা নিজেরা? কিন্তু লোক দিয়েই তো মারাতে পারত।”

“ডোন্ট বি সো নাইভ। কিছু কাজ ওরা নিজেরা করতে ভালবাসে, কারণ গর্ডনের কাছ থেকে কিছু পেপার্স ওদের নেওয়ার ছিল, যা অন্য কারও হাতে পড়লে বিপদ হত! তাই ওরা নিজেরাই… বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, এই দ্যাখ।” রুপিন একটা খাম অ্যাডামের পাশের ওক কাঠের টেব্‌লে ছুড়ে রাখল।

অ্যাডাম খামটা খুলল। দুটো ছবি আর একটা নেগেটিভ।

“ভাল করে দ্যাখ,” রুপিন চেয়ার থেকে উঠে এসে দাঁড়াল অ্যাডামের চেয়ারের পিছনে। রুপিনের পায়ের চাপে কাঠের মেঝেটা মড়মড় করে উঠল।

অ্যাডাম দেখল বড় করে প্রিন্ট করা একটা ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে গর্ডন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরনে পাজামা আর গোল গলার টি-শার্ট। দরজার পায়ের কাছে দুটো দুধের বোতল আর খবর কাগজ রাখা। এ ছাড়াও ছবিতে আরও তিনজনকে দেখা যাচ্ছে সুদ, অরোরা আর স্বামী। তিনজনেই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে যে, ওরা এসেছিল বলেই গর্ডন দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিল। ছবিটা দূর থেকে টেলিফোটোয় নেওয়া।

অ্যাডাম বলল, “দেখলাম। তো?”

“ইউ আর লুজ়িং ইট,” রুপিন মাথা নেড়ে হাঁটু ভাঁজ করে অ্যাডামের পাশে বসল, তোর “রিফ্লেক্স নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাল করে দ্যাখ। ছবিটা তোলা হয়েছে গর্ডনের মৃত্যুর দিন।”

“মানে?” অ্যাডাম ঘুরে বসল।

রুপিন বলল, “মানে, পোস্টমর্টেম অনুযায়ী, মৃত্যু হয়েছিল সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার ভিতর মার্চের পনেরো তারিখ। এই দ্যাখ, ছবির কোনায় সেল্‌ফ প্রিন্ট ক্যামেরার তারিখ প্রিন্ট করা, ফিফটিন্থ মার্চ। আর এই দ্যাখ,” রুপিন এবার দ্বিতীয় ছবিটা বের করল, “সুদের হাতের ক্লোজ় আপ। নেগেটিভ থেকে বড় করিয়েছি। কবজির ঘড়িটা দ্যাখ, সাতটা চল্লিশ বাজে। হল? বিশ্বাস হল?”

অ্যাডাম ভুরু কুঁচকে বলল, “ডেটটা যে প্রিন্ট হয়েছে, সেটা তো ম্যানিপুলেটেডও হতে পারে। মানে ক্যামেরায় তো সেটা সেট করা যায়।” “জানি, সেইজন্য এই নে দ্যাখ, এটা ফিল্মে তোলা ছবি। পাতি ডিজিট্যাল ক্যামেরায় নয়। এই যে নেগেটিভ। তা ছাড়া মেনে নিলাম যে ডেটটা বানানো, কিন্তু গর্ডনের টি-শার্টটা? এই যে ডোনাল্ড ডাক আঁকা রয়েছে বুকের কাছে। সেটা? মনে নেই, বডি দেখে বেরোবার সময় একজ়িবিট হিসেবে রেখে দেওয়া গুলির ফুটোওয়ালা টি-শার্টটা? মনে নেই ডোনাল্ড ডাকের মুখটা প্রিন্ট করা ছিল টি-শার্টে? সত্যিই অ্যাডাম, তুই এই নির্জনতায় থাকতে থাকতে কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছিস। ইউ আর লুজ়িং ইট।”

“ছবিটা তুমি তুলেছ?” অ্যাডামের গলা আবছা হয়ে গেল আবার।

চোখ দুটো ছবির দিকে থাকলেও কেমন যেন অন্যমনস্ক।

“আই হ্যাভ মাই মেন।”

“কেন? তুমি তো ওদের সঙ্গেই…”

“কাজ করি?” রুপিন হাসল, “সময়মতো বলব তোকে। এখনও বলার সময় আসেনি। তবে শোন, ওদের মরতে হবে। চারজনকেই। এই ড্রাগস আর তার পয়সায় ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টে বাড়তে থাকা টেররিজ়ম বন্ধ করতে হবে।”

“সরি,” অ্যাডাম ভুরু কোঁচকাল, “সুদ, স্বামী, অরোরা তিনজন। চারজন হল কী করে?”

“ওরা তিনজন সামনে থাকে। তবে আরও একজন আছে। যদিও জানি না সে কে, কিন্তু আছে। তবে তুই আগে এই তিনজনকে মার। তার মধ্যে চতুর্থজনের খবর নিয়ে এসে দিচ্ছি তোকে।”

অ্যাডাম ছবিটা হাতে মাথা নিচু করে রইল। গর্ডন, ওর বন্ধু। কতবার গর্ডন পুলিশের থেকে বাঁচিয়েছে ওকে! কতবার ওকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছে? তাকে সুদরা মারল?

অ্যাডাম ছবিটার দিকে তাকাল আবার। জিজ্ঞেস করল, “সুদরা মারল কেন ওকে?”

“হি ওয়জ় আ মোল। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের ইনফরমার ছিল ও। সুদদের বিপক্ষে তথ্য জোগান দিচ্ছিল। তুই তো ড্রাগসের ব্যবসায় জড়াবি না বলে কার্টেল ছাড়লি, কিন্তু গর্ডন তোর মতো পালায়নি। ও কার্টেলের ভিতরে থেকে তাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ডোন্ট বি অ্যান এসকেপিস্ট র‍্যাট। ফাইট ফর ইয়োর ফ্রেন্ড, ইয়োর ডিগনিটি। শোন, আমি জানি তুই তিন-চারটে অরফ্যানেজকে টাকা দিস। জানি ফাদার ফ্রান্সিস বলে একজনের অরফ্যানেজের মেন ফাইনানসারও তুই, মানে অদম্য সেন। সুদরা তোকে না মারতে পেরে যদি ওই অনাথ বাচ্চাগুলোর ওপর হামলা করে? বাচ্চাগুলো যদি মারা পড়ে? তুই এটা কি হতে দিতে পারিস? আমি তোর মতো কমপিটেন্ট নই। এদের ভিতরে থেকে এদের দুর্বল জায়গাগুলো দেখিয়ে দিতে পারি মাত্র। কিন্তু কিচ্ছু করার মতো ক্ষমতা আমার নেই। থাকলে তোকে বলতাম না।”

“কিন্তু কীভাবে?” অ্যাডাম মুখ তুলে তাকাল রুপিনের দিকে।

“একসঙ্গে মারতে হবে ওদের। আলাদা আলাদা করে মারতে গেলে সতর্ক হয়ে যাবে ওরা। ওদের কোনও নির্জন জায়গায় একসঙ্গে ডাক। তারপর…” রুপিন হাসল, “এটা খুব দরকার। সারা পৃথিবীতে যুদ্ধে যত না লোক মারা যায়, ড্রাগের জন্য তার চেয়েও বেশি! তা ছাড়া টেররিজ়মকে ফান্ডিং তো আছেই। তুই ড্রাগসের সঙ্গে জড়াবি না বলে কার্টেল ছাড়লি। কিন্তু যদি কার্টেল তোকে না ছাড়ে? থিঙ্ক অফ দোজ় লিট্‌ল চিলড্রেন। তোর বন্ধুর কথাও ভাব। অর্ধেক কাজ করে এই নির্জনতায় লুকিয়ে থাকিস না। বি আ ম্যান অ্যাডাম। কিল দেম।”

চারদিন পরে এক সকালবেলায়

লেকের ধারের এই বাড়িটাও কাঠের। দেখলে মনে হয় খেলনা-বাড়ি। আশপাশে আর কোনও বসতি নেই। একটা রাস্তা এঁকেবেঁকে সাদা ওড়নার মতো পড়ে রয়েছে মাঠে। আর মাঠটাও উঁচু-নিচু হতে হতে উঠে গিয়েছে পাহাড়ে। সেই পাহাড়ের ছায়া বিরাট বড় লেকের গায়ে পড়েছে। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে গোটা দৃশ্যপটকেই মনে হচ্ছে ক্যালেন্ডার থেকে ছিঁড়ে নেওয়া ছবি। এমন জায়গায় আগুন, ধোঁয়া আর রক্ত কি মানায়?

কিন্তু কত কিছুই তো মানায় না জীবনে, তা বলে কি সেসব হয় না? ছোট বয়সে মা-বাবাকে হারানো কি মানায়? অরফ্যানেজ হোমের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করা কি মানায়? ক্রমশ অন্ধকার জীবনে ঢুকে পড়াও কি মানায়? বা এই সান কার্টেল যদি ফাদার ফ্রান্সিস আর তাঁর অরফ্যানেজের বাচ্চাদের উপর আক্রমণ করে অ্যাডামের কার্টেল ছাড়ার শোধ নেয়, তাও কি মানায়? অ্যাডাম এখন বোঝে মানানো বা না-মানানোর, এই ধারণাটাই পেটি রোম্যান্টিসিজ়ম। বাস্তবের সঙ্গে কোনও মিল নেই।

“ওই দ্যাখ, তিনটে গাড়িই এসেছে,” রুপিনের কথায় সংবিৎ ফিরল অ্যাডামের। ও চোখ রাখল সামনের ট্রাইপডের উপর রাখা দূরবিনে। তিনটে লম্বা গাড়ি এতদূর থেকেও রোদে ঝলসাচ্ছে। ওদের তিনজনকে আলাদা আলাদা ভাবে তো একাই দেহরক্ষী ছাড়া আসতে বলেছিল, ওরা কি একা এসেছে? না…

না, কেবল তিনজন তিনটে গাড়ি থেকে বেরোল। নিজেদের মধ্যে কথা বলল কীসব, তারপর ঢুকে গেল কাঠের বাড়ির ভিতর।

রুপিন উত্তেজিতভাবে অ্যাডামের কাঁধ খামচে ধরল। বলল, “সব ঠিকমতো বলেছিস তো? ওরা আবার সন্দেহ করবে না তো? ইস, চতুর্থ মাথাটা যে কে, সেটা যদি জানতে পারতাম তা হলে সবক’টাকে একসঙ্গে নিকেশ করা যেত!”

“সব বলেছি, টেনশন কোরো না। বলেছি, এমন কিছু ডকুমেন্টস ওদের আজ দেব, যা বাইরে থাকলে বা অন্যের হাতে পড়লে ওদের সর্বনাশ হবে। তবে টাকার বিনিময়ে অবশ্যই। আর বলেছি সঙ্গে করে কাউকে আনলে ওরা তো জানেই কী হতে পারে,” অ্যাডাম কথা শেষ করে রুপিনের দিকে তাকাল, “ঠিক না? ওদের আমায় ভয় পাওয়া উচিত কিনা, বলো?”

রুপিন হাসল, “তোকে এই লাইনে ভয় পায় না এমন কেউ আছে? যদিও তোকে দেখলে কিচ্ছু মনে হয় না, তবু তোর নামে ভয় পায় না, এমন কেউ নেই।”

“রাইট,” অ্যাডাম পাশের সুটকেস থেকে ছোট্ট রিমোটটা বের করল, “গোটা বাড়ির নীচেই এক্সপ্লোসিভ লাগানো আছে। জাস্ট এই বোতামটা টিপলেই…”

“ওয়েট করছিস কেন? ঘরে ঢুকে তোকে না দেখলে প্যানিক করবে ওরা। পালাতেও পারে। তাড়াতাড়ি কর।” রুপিন উত্তেজিত হল।

“ওরা জানে আমি থাকব না। একটু পরে আসব। দে উইল ওয়েট। ডকুমেন্টসগুলো এ দেশের অ্যান্টি নারকোটিক ব্রাঞ্চের হাতে পড়লে ওরা জানে, ওদের কী অবস্থা হবে! তাই আমার জন্য ওরা অপেক্ষা করবেই।”

“তাও, দেরি করছিস কেন? দশ মিনিট তো হল ওরা ঢুকেছে। এবার ওড়া ওদের। উড়িয়ে দে,” রুপিন উত্তেজিত গলায় বলল।

অ্যাডাম রিমোটটা রুপিনের হাতে দিয়ে বলল, “ইউ প্রেস ইট। তুমি বলেছিলে তোমার ক্ষমতা নেই ওদের মারার। নাও, তোমার হাতে ক্ষমতা তুলে দিচ্ছি। ডু দ্য নিডফুল।”

“আমি?” রুপিন থতমত খেল একটু, তারপর দু’সেকেন্ড সময় নিল চিন্তা করতে, বলল, “ঠিক আছে। লেট মি… এরা এক-একটা শয়তান। এদের মারার জন্যই আমি জয়েন করেছি এখানে। আজ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।”

বিকট শব্দ করে যখন বাড়িটা প্রায় শূন্যে উড়ল অ্যাডাম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়েছিল। শব্দটা লেক পেরিয়ে দূরের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। কিছু টুকরো ফিরে এল, কিছু মিলিয়ে গেল। অ্যাডাম দেখল লেকের জলে বসা পাখিরা ভীষণ ভয় পেয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ল খানিক। ডুবল খানিক। খানিক চিৎকার শুরু করল। মানুষ আর কতভাবে এদের ভয় দেখাবে?

রুপিন বলল, “রইল বাকি এক। দু’দিনের ভিতরে তোর ওই লোনলি কটেজে গিয়ে চতুর্থজনের নাম বলে আসব। তাকে মেরে সান কার্টেলকে সারা জীবনের জন্য অস্তে পাঠিয় দে দেখি। এক নতুন সূর্যাস্ত হোক।”

দু’দিনের মাথায়

কাঠের টেব্‌লের উপর টিভির রিমোটটা নামিয়ে রেখে দরজার দিকে তাকাল অ্যাডাম। রুপিন দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজায়। পকেটে হাত, মুখে হাসি, “কী রে, জানলাগুলো সব বন্ধ করে রেখেছিস কেন? তার উপর ঘরের আলোটা এত ডিম করে রেখেছিস? ব্যাপার কী? এরকম একটা খুশির দিনে এমন আবছা আলোয় বসে রয়েছিস কেন?”

“খুশির দিন?” অ্যাডাম ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল।

“চতুর্থ মাথার নামটা পাওয়া গিয়েছে,” রুপিন দরজা দিয়ে এসে দাঁড়াল ঘরের মাঝখানে, “কী রে, এই অ্যাডাম, আমার কথা কানে যাচ্ছে না?” রুপিন আবার বলল।

অ্যাডাম এতক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল, এবার রুপিনের কথায় যেন জোর করেই মাথা তুলল, “চতুর্থজন?”

“ইয়েস। তুই ভুলে গেলি?” রুপিন হাসল, “এবার তাকে মরতে হবে। সেও তো গর্ডনের মৃত্যুর জন্য সমান দায়ী, না?”

“সমান নয়, একমাত্র দায়ী,” ক্লান্ত গলায় বলল অ্যাডাম।

“একমাত্র, মানে?” রুপিন অবাক হল, “কী বলছিস? স্পষ্ট করে বল। চতুর্থজন একমাত্র দায়ী?”

“চতুর্থজন যে কিনা প্রথমজন বা একমাত্রজন, মানে একজন।”

অ্যাডাম রুপিনের দিকে তাকাল। রুপিন বলল, “কী বলছিস তুই? এ কেমন ধাঁধা?”

“অরোরা, স্বামী বা সুদ নয়, গর্ডনকে মেরেছে…” অ্যাডাম মাথা নামিয়ে নিল, “কেন এমন হল? গর্ডন তো কোনও দোষ করেনি! তা হলে কেন তাকে মারলে তুমি?”

“না হলে অ্যাডাম ইনভল্‌ভড হত কী করে?” রুপিনের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যাতে অ্যাডাম চোখ তুলে তাকাল। দেখল, রুপিনের হাত আর পকেটে নেই। বরং তা সামনে সোজা হয়ে আছে। আর তাতে ধরা আছে একটা স্বয়ংক্রিয় পিস্তল, “ওকে না মারলে কি তুই সুদদের মারতে রাজি হতিস? ও তো জাস্ট একটা ডিসপোজ়েবল অ্যাকসেসরি। একটা টোপ। গর্ডন গিয়েছে। সুদ, স্বামী আর অরোরাও গিয়েছে। এবার লাস্ট পেরেকটা হলি তুই। তোকে না মারলে বারো হাজার টন ড্রাগসের যে কন্ট্রোল সেটা তো সম্পূর্ণভাবে নেওয়া যাবে না। কী বল?” রুপিন হাসল।

“তুমি শিয়োর যে আমি শেষ পেরেক?” অ্যাডাম আবছা গলায় বলল।

“ইয়েস,” কনফিডেন্ট গলায় বলল রুপিন, “তুই একটা বোকা, ‘ড্রাগসের লাইনে কাজ করব না,’ এমন কেউ বলে? শোন, সামনের পৃথিবী কন্ট্রোল করবে, তেল নয়, ড্রাগস। আর সেখানে আমি তার অধিকার না নিয়ে সুদ, স্বামী, অরোরার লেজ হয়ে কাজ করব? তবে তোকে মারার আগে একটা কথা বলতেই হবে, তুই ঠিক ধরেছিস ব্যাপারটা। আমি যে গর্ডনকে মেরেছি, সেটা ঠিক ধরেছিস। কী করে ধরলি বল তো?” রুপিন কৌতূহলী বাচ্চার গলায় জিজ্ঞেস করল।

“কঠিন কিছু নয়। নেগেটিভ। আর ডোনাল্ড ডাকের ঠোঁট,” অ্যাডাম ক্লান্ত গলায় বলল।

“মানে?” রুপিন একটু থমকাল।

অ্যাডাম মাথা নাড়ল, “কেন আমায় ছবি ব্লো-আপ করার আইডিয়া দিলে? ছবিটা তো পনেরোই মার্চ তোলা নয়। চোদ্দোয় তোলা। শুধু ছবির ডেট আর হাত ঘড়ির ব্লো-আপ দেখালেই হবে? ছবির অন্য কোণে যে খবরের কাগজ পড়ে ছিল সেটা ভুলে গেলে? আমি সেই অংশটা এনলার্জ করে দেখেছি। পেপারে ডেট থাকে। ওটাতেও ছিল। চোদ্দোই মার্চ। ফোটোয় যে প্রিন্ট ডেট ছিল তা বদলানোই যায়, কিন্তু এটা বদলাবে কী করে?. আর ডোনাল্ড ডাকের ঠোঁট? চোদ্দোই মার্চ যে টি-শার্ট পরেছিল গর্ডন, সেই ডোনাল্ড ডাক ছাপা টি-শার্টের ডাকটির ঠোঁট ছিল লাল রঙের। আর মৃত্যুর দিন অর্থাৎ পনেরো তারিখ যে টি-শার্ট পরেছিল, তাতে ছাপা ডাকটির ঠোঁটের রং ছিল হলুদ। এটা খেয়াল করোনি? খুব ছোট্ট ভুল, কিন্তু পরিণাম বিরাট বড়। তুমি কী ভেবেছ? তুমি কি ভেবেছ আমি সত্যি ভোঁতা হয়ে গিয়েছি? তুমি ছবি দেখিয়ে যা বলবে, তাই আমি বিশ্বাস করে নেব? অ্যাম আই রিয়েলি লুজ়িং ইট?”

রুপিন বন্দুকটা বিপজ্জনকভাবে নাচিয়ে হেসে বলল, “ইয়েস ইউ আর লুজ়িং ইট ডিয়ার। বিশ্বাস তো করেছিস। না হলে অরোরাদের মারতিস?”

“মনে আছে, ওরা সেই কাঠের বাড়িতে ঢোকার পর আমি দশ মিনিটেরও বেশি সময় নিয়েছিলাম ব্লাস্টটা করাতে? তুমি আমায় তাড়া দিচ্ছিলে? মনে আছে? আসলে, আই ওয়জ় বাইং টাইম। বাড়ির পিছনেই ছিল লেক। আর বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে লেকে নামবার চমত্কার বন্দোবস্ত ছিল। সেখানে তিনটে ডাইভার’স কিট রাখা ছিল। জলের তলায় অনায়াসে আধ ঘণ্টা কাটানো যায়, এমন অক্সিজেনের বন্দোবস্ত করাই ছিল। বোমায় বাড়িটা উড়ে যায়, কিন্তু…”

“তুই, জানোয়ার, সন অফ…” অবস্থা বুঝে হঠাৎ রুপিন বন্দুক হাতে হিংস্রভাবে এগিয়ে আসতে গেল, কিন্তু তার আগেই অ্যাডাম চকিতে উঠে দাঁড়িয়ে হাতের মুঠোয় লুকোনো ছোট্ট একটা রিমোটের বোতাম টিপে বলল, “নোড়ো না, তা হলে মারা যাবে। তোমার পায়ের চাপে প্রাইমারি অ্যাক্টিভেশন হয়ে গিয়েছিল কাঠের মেঝের নীচে রাখা বোমটার। এবার সেটাকে সম্পূর্ণ আর্ম করলাম। এটা প্রেশার অ্যাকটিভেটেড স্প্লিনটার মাইন। কাঠের মেঝের থেকে পা ওঠালেই, ফিউজ়টা উড়ে যাবে আর বিস্ফোরণে তোমার শরীরের নীচের অংশটা জাস্ট ‘নেই’ হয়ে যাবে। আর বন্দুক তুললে এই বোতাম টিপে এখনই বোমা ফাটিয়ে দেব। ওই দ্যাখো, তোমার পায়ের নীচের কাঠের পাটাতন পাতা মেঝের ফাঁক দিয়ে আর্মড বোমের ছোট্ট লাল আলোটা দেখা যাচ্ছে।’’

“তুই, তুই, সুদদের…” রুপিন কথা শেষ করতে পারল না, পাশের ঘরের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল পরমজিৎ অরোরা, পুরুষোত্তম স্বামী আর নবীন সুদ। তিনজনের বন্দুকই রুপিনের দিকে তাগ করা।

দরজাটা বন্ধ করে রাস্তায় পা দিল অ্যাডাম। রুপিনকে ঘিরে ধরে তিনজন বন্দুকবাজ কী করবে, তা ও জানে। ঘর থেকে বেরোবার আগে ও শুনছিল রুপিন শেষ চেষ্টা করছে বোঝাবার, বলছে, “গর্ডন ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্সের চর ছিল। ওকে না মারলে সান কার্টেলকে বাঁচানো যেত না। আর অ্যাডাম তো লাইন ছেড়ে সব ফাঁস করে দিত বলেই…” অ্যাডাম জানে, মৃত্যু খুব বড় মোটিভেশন। আর প্রতিশোধ তার চেয়েও বড়। ও পিছনে তাকাল।

বড় পাহাড়ের পায়ের কাছে দেশলাই বাক্সের মতো পড়ে আছে বাড়িটা। তবে খালি নয়, বারুদ ঠাসা বাক্স। তার উপর দরজা জানলা সব বন্ধ। ভিতরে সান কার্টেলের তিনজন মাথা, সঙ্গে মাথা হতে চাওয়া রুপিন। গোটা সাউথ এশিয়ার ড্রাগ লিঙ্কটাই জড়ো হয়ে রয়েছে কাঠের বাড়ির ভিতরে।

ড্রাগ, যা গোটা একটা জেনারেশনকে শেষ করে দিচ্ছে।

ড্রাগ, যা সন্ত্রাসবাদকে তার রসদ জুগিয়ে যাচ্ছে আর তার তাপে কখনও মুম্বই, কখনও লাহোর, কখনও বালি বা মাদ্রিদে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে নির্দোষ, সাধারণ মানুষ। এই শান্ত সুন্দর পৃথিবীতে ফাদার ফ্রান্সিসের পাশাপাশি এমন নরখাদকরাও থাকে!

হ্যাঁ, এরা নরখাদক, মুখোশের আড়ালে নরমাংসভোজী!

পকেট থেকে সেই ছোট্ট যন্ত্রটা আবার বের করল অ্যাডাম। লাল বোতামটায় আঙুল রাখল তারপর আলতোভাবে টিপে দিল বোতামটা। দরজা জানলা বন্ধ বাড়িটার ভিতরে বোমা ফেটে, পুরো বাড়িটাকে বেলুনের মতো ফাটিয়ে দিল। রুপিন যদি বুঝত কেন জানলাগুলো বন্ধ করে রেখেছিল অ্যাডাম! প্রেশারাইজ জায়গায় বোমা অনেক বেশি কার্যকর।

টোপ। ঠিকই বলেছে রুপিন। তবে ঘটনাটা বোঝেনি। সুদ, স্বামী আর অরোরা ছিল রুপিনের টোপ আর রুপিন টোপ ছিল ওদের। কারণ, রুপিনের গন্ডগোলের কথা সুদদের জানালে আর রুপিনকে এর জন্য ওদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি না দিলে সুদরা তিনজনে রাজি হত না, একসঙ্গে ওই লেকের ধারের বাড়িতে আসতে। রাজি হত না সেই বাড়িটার বিস্ফোরণের প্ল্যানের অংশ হতে। এইভাবে ওদের অপরের বিরুদ্ধে লড়াতে না পারলে কার্টেলকে শেষ করার অন্য কোনও উপায় ছিল না।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করল অ্যাডাম। নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল, “হ্যালো, মিস্টার গর্গ? আমার টাকাটা কি জমা পড়েছে?”

গর্গ বলল, “হ্যাঁ, আর ওরা?”

“সান হ্যাজ় সেট।”

“ফ্যানটাসটিক,” গর্গের গলায় আনন্দ, “শোনো আর একটা কাজ আছে। ওই বারো হাজার টন ড্রাগের জন্য কলম্বিয়ান আর রাশিয়ান দুটো গ্রুপ ঝাঁপাচ্ছে। ওই ড্রাগের ফার্স্ট কনসাইনমেন্ট যাওয়ার কথা আজ থেকে ঠিক একমাস পরে। আফগানিস্তান রাশিয়ান বর্ডারে। প্রথম লটে প্রায় দেড় হাজার টন মাল যাবে। গোটাটাকে ধ্বংস করতে হবে। মানি উইল বি গুড। শোনো, কাজটা কবে থেকে শুরু করবে? হ্যালো… শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো… হ্যালো…”

মোবাইলটা কান থেকে নামিয়ে কানেকশন কেটে রাস্তার পাশের লম্বা লম্বা ঘাসের ভিতরে ফেলে দিল অ্যাডাম। তারপর এগিয়ে গেল। ও এখন ক্লান্ত। ওর যুদ্ধ শেষ।

এবার অন্যরা আসুক। অন্যরা চেষ্টা করুক। তারপর তারা না পারলে তখন… নাঃ, আর ভাবতে ভাল লাগছে না ওর। অ্যাডাম শুনতে পেল ঝোপের মধ্যে পড়ে থাকা মোবাইল থেকে প্রাণপণে ডেকে চলেছে কোকিল। কিন্তু আর সাড়া দেবে না অ্যাডাম। এই নির্জন উপত্যকা ছেড়ে যাওয়ার সময় হল ওর। ফাদার ফ্রান্সিসের অরফ্যানেজে ওর ছোট্ট ঘরটায় ফিরতে হবে ওকে।

সেখানে ও অ্যাডাম নয়, অদম্য সেন। ফাদার এখন ফুলের চাষ করেন। সেখানে হাত লাগাবে ও। সারাদিন কাদা-মাটি মেখে ফুল বের করে আনবে কুঁড়ি থেকে। শান্তি বের করে আনবে জীবন থেকে। বসন্তের ফুল ফোটানো ছাড়া আর কী কাজ থাকতে পারে মানুষের?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *