টি-রেক্স-রহস্য

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১০৯/২ – টি-রেক্স-রহস্য – কাহিনি রচনা : কাজী শাহনূর হোসেন / রূপান্তর : শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০০৯

এক

হাই স্কুলের উদ্দেশে হনহন করে এগোচ্ছে কিশোর, মুসা আর রবিন। জুলাইয়ের তিন তারিখ। সবার পরনে টি-শার্ট আর শর্টস। ফিতেয় বাঁধা বাঘা সবার আগে আগে চলেছে। কান দুটো ঝুলে পড়েছে ওর। পথে যা পাচ্ছে শুঁকছে।

ইস, টনির সাথে কখন যে দেখা হবে, বলল কিশোর, তর সইছে না আমার।

টনি হার্পার রাশেদ পাশার বন্ধুর ছেলে। মন্টানায় থাকে।

পোস্টকার্ডে বলেছে আমাদের জন্যে কী নাকি বিশাল এক। সারপ্রাইয আছে। কী সেটাই তো বুঝতে পারছি না, বলল রবিন।

চিঠিটা পড়ে শোনাও, মুসা বলল কিশোরকে।

পকেট থেকে পোস্টকার্ডটা বের করল কিশোর। ওরা প্লিজেন্ট স্ট্রীটে থমকে দাঁড়াতেই জোরে জোরে পড়ল ও:

হাই, কিশোর, মুসা, রবিন,

আমি জুলাইয়ের ৩ তারিখে গ্রীনহিলসে বিশাল এক সারপ্রাইয নিয়ে হাজির হব। দুপুরবেলা আমার সাথে হাই স্কুলের মাঠে দেখা কোরো। এখন বিদায়।

তোমাদের বন্ধু
টনি

সারপ্রাইযটা হয়তো বড়সড় কোন পিত্যা, বলল মুসা।

তুমি তাই দোয়া করতে থাকো, বলল রবিন।

ওই যে মিস্টার থিয়োডর প্যান্ট, বলল কিশোর। সেণ্টার পার্কের দিকে ঘুরে চাইল। ওদের বন্ধু থিয়োডর প্যান্ট দাঁড়িয়ে গোলাপ বাগানে। হাতে ওয়র্ক গ্লোভস আর বেলচা। তার কুকুর রুড সোয়ান পণ্ডের হাঁসগুলোর দিকে চেয়ে রয়েছে।

কিশোর ফিতে ছেড়ে দিতেই বাঘা দৌড়ে গেল খুদে কুকুরটার কাছে।

হাই, মিস্টার প্যান্ট, ডাকল রবিন।

কী খবর তোমাদের? সাদাচুলো ভদ্রলোক বললেন। কাল রাতে, ফায়ারওয়র্ক দেখবে না? সুইমিং পুলের পাশে ওরা সেটআপ করছে। দেখলাম।

আমরা সবাই যাব, বলল মুসা। আপনি আর রড যাবেন তো?

আমি যাব, বললেন মি. প্যান্ট। কিন্তু বুড়ো রুড বাসায় থাকতেই ভালবাসে। শব্দ পছন্দ করে না ও।

বাঘাও বাড়িতে থাকছে, জানাল কিশোর। ও তো জন্মদিনের মোমবাতিও সহ্য করতে পারে না!

মি. প্যাণ্ট মৃতপ্রায় এক গোলাপ চারা খুঁড়তে লাগলেন। পাতা। কিংবা কুঁড়ি কিছুই নেই ওটার। ঠেলাগাড়ির উপরে তরতাজা এক গোলাপ চারা দেখা গেল। নতুন পাতা চকচক করছে।

নতুন চারাটা প্ল্যান্ট করতে হাত লাগাতে চাও? ওদের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন মি. প্যান্ট।

ঘড়ি দেখল কিশোর।

চাই, কিন্তু আমাদের এক বন্ধু আসবে হাই স্কুলে। ওর সাথে দেখা করতে হবে। ওর নাম টনি হাপার। ভবিষ্যতে টিচার হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন।

মন্টানা থেকে আমাদের জন্যে সারপ্রাইয নিয়ে এসেছে, বলল। রবিন।

এখানে বেশি সময় লাগবে না, মি. প্যান্ট বললেন। ঝটপট কাজ ভাগ করে দিলেন তিনি।

গর্তের ভিতরে এক মুঠো সার ঢালল রবিন। কিশোর বেলচা দিয়ে গর্তে খানিকটা আলগা মাটি ভরল। মুসা গর্তটায় পানি দিল গার্ডেন হোস দিয়ে।

আজ রাতে হয়তো বৃষ্টি হবে, মেঘের দিকে চোখ তুলে চেয়ে বললেন মি. প্যান্ট। নতুন চারাটা ঠেলাগাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গর্তে বুনলেন তিনি। লক্ষ রাখলেন চারা যাতে সিধে হয়ে থাকে।

দারুণ দেখাচ্ছে, বললেন মি. প্যান্ট। তোমরা তিনজন দুর্দান্ত গার্ডেনার। কিশোর, তুমি হুইলবারোটা শেডে রেখে এসো, আমি মাটি ভরছি।

কিশোর বেলচাটা মি. প্যান্টের হাতে দিয়ে ঠেলাগাড়িটা ঠেলে নিয়ে গেল গার্ডেন শেডের কাছে। পুরানো এক স্কুড্রাইভার দরজাটাকে আটকে রেখেছে। কিশোর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল হুইলবারোটা।

ঠাসাঠাসি অবস্থা ছোট্ট শেডটার। তাকগুলোতে রাখা পট, জার, সারের থলে, পেইল, গার্ডেনিং সংক্রান্ত বই, এবং যন্ত্রপাতি। ইটের মেঝেতে আঁকশি, বেলচা, গোটানো হোস আর গার্ডেনিঙের সাজ সরঞ্জাম।

শেডের পিছন দিকে একগাদা খালি বারল্যাপ ব্যাগের গায়ে ঠেলাগাড়িটাকে ঠেস দিয়ে রাখল কিশোর। এবার ক্রুড্রাইভারটা যথাস্থানে বসিয়ে চলে এল।

কিশোর অন্যদের কাছে যেই পৌঁছেছে, অমনি লাল এক গাড়ি বাঁক ঘুরে হাই স্কুলের দিকে সাঁ করে চলে গেল। গাড়িটার হুডের নীচ থেকে ধোয়া বেরোচ্ছিল।

তোমাদের বন্ধু নাকি? মি. প্যান্ট প্রশ্ন করলেন। মন্টানা থেকে ওটায় চেপে এসেছে?

আমরা এখন যাই, বলল কিশোর। টনির সাথে দেখা করবেন, মিস্টার প্যান্ট?

এখন নয়, বললেন মি. প্যান্ট। রুড আর আমি খেয়েদেয়ে একটু ঘুমাব। সাহায্যের জন্যে তোমাদেরকে ধন্যবাদ।

ছেলেরা বাঘাকে নিয়ে লাল গাড়িটার উদ্দেশে দৌড় দিল। ইতোমধ্যে থেমে দাঁড়িয়েছে ওটা। ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে লম্বা এক তরুণ। মাথায় কোঁকড়া, কালো চুল। চওড়া কাঁধ। পরনে টি-শার্ট, কাট অফ জিন্স, আর লাল হাই-টপ স্নিকার্স।

এটা তো টনি নয়, বলল কিশোর। তরুণের উদ্দেশে এগিয়ে গেল ওরা।

দুই

তরুণ ঘুরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল।

হাই, তোমরা নিশ্চয়ই কিশোর, মুসা আর রবিন। আমি রয় হাডসন। আমি টনি আর ওর বন্ধু জনের সঙ্গে কাজ করি। ওরা এখুনি এসে পড়বে।

রয় গাড়ির হুড খুলতেই আরও ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়ে এল। সামনের সিট থেকে এক জগ পানি নিল ও, রেডিয়েটরের ক্যাপ খুলল। তারপর হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠে মুখে আঙুল পুরল।

এতদিনে আমার শিক্ষা হওয়া উচিত ছিল, বলে মাথা নাড়ল। পকেট থেকে একটা ব্যাণ্ড-এইড বের করল। তারপর মোড়ক খুলে সবুজ ব্যাণ্ড-এইডটা আঙুলে পেঁচিয়ে লাগাল।

ঠিক এসময় লম্বা এক ফ্ল্যাটবেড ট্রাক রয়ের গাড়ির পাশে এসে থেমে দাঁড়াল। বাদামী এক তেরপলে ঢাকা ট্রাকের বেড, বিশাল, ফোলা কোন কিছুকে ঢেকে রেখেছে। গোটা জিনিসটা দড়ি দিয়ে বাঁধা।

ড্রাইভারের আসন থেকে নেমে এল লম্বা, পাতলা এক লোক। পরনে জিন্স, শর্ট-স্লীভ শার্ট, আর কাউবয় হ্যাট।

হাউডি, তিন বন্ধুর উদ্দেশে উদ্ভাসিত হাসল টনি। হাই! একসঙ্গে বলে উঠল ওরা।

প্যাসেঞ্জার্স সিট থেকে এক লোক নেমে এল। খাটো, ছিপছিপে লোকটির কালো চুল পনিটেইল করে বাঁধা। পরনে ওয়র্ক সুট, ব্যাগি শর্টস আর হাতা কাটা ফ্লানেলের শার্ট।

এ হচ্ছে আমার রুমমেট আর প্রিয় বন্ধু জন ওয়েদারবার্ড। বলল টনি। জন, এরা কিশোর, মুসা আর রবিন।

জন ট্রাকটাকে পাক খেয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এল। মুখে বন্ধুভাবাপন্ন হাসি, চোখের মণি কালো। শার্টের পকেট কলম দিয়ে ঠাসা। বেল্টে আটকানো চাবির গোছা হাঁটার ফাঁকে টুংটাং শব্দ করল।

জনের সঙ্গে হাত মেলাল ছেলেরা। বাঘার সঙ্গে টনি আর জন পরিচিত হতেই দুজনকেই ভেজা চুমো উপহার দিল ও।

কাজে লেগে পড়া যাক, আকাশের দিকে চেয়ে বলল জন। মাঝরাতে বৃষ্টি নামবে, বাজি ধরতে পারি। দড়ি-দড়া খুলতে শুরু করল ও।

রয় ওর গাড়িতে উঠে পড়ল।

আসার পথে হোটেলটা পড়েছিল, বলল ও। যাই, রুমটা দেখে নিই। গাড়ি চালিয়ে চলে গেল ও। হুডের তলা থেকে এবার সামান্য ধোয়া বেরোল।

আমরা হাত লাগাব? প্রশ্ন করল রবিন।

জন মৃদু হাসল ওর দিকে চেয়ে।

তবে তো খুবই ভাল হয়।

আমরা দড়িগুলো খুলছি, তোমরা গোটাও, বলল টনি। মাটিতে শুইয়ে রাখলেই হবে।

বাঘাকে দাঁড়াতে বলে কাজে লেগে পড়ল ছেলেরা। কমিনিট বাদে সব দড়ি-দড়া খোলা হয়ে গেল। জন আর টনি তেরপলটা টেনে মাটিতে নামাল।

এ কিশোর যখন দেখল কী আছে ওটার নীচে তখন লাফিয়ে পিছ হটল। ও সরাসরি চেয়ে রয়েছে এক টির‍্যানোসরাসের মাথার দিকে!

এ হচ্ছে টিরোন, হেসে উঠে বলল টনি। একসঙ্গে জুড়লে ওকে আরও দারুণ দেখায়।

ঢোক গিলল কিশোর।

কোথায় পেয়েছেন ওটাকে? প্রশ্ন করল।

আমরা কিনেছি, বলল টনি।

দাঁত বের করে হাসল মুসা।

ডাইনোসর স্টোর থেকে?

না, যে টিরোনকে তৈরি করেছে তার কাছ থেকে, বলল টনি। সে চেয়েছিল একটা ডাইনোসর থিম পার্ক করবে, কিন্তু মাঝখানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পেপারে অ্যাড দিয়েছিল। তাই দেখে আমরা। টিরোন আর ট্রাকটা কিনেছি।

ইস, ডাইনোসর দিয়ে আপনারা কী করবেন? প্রশ্ন করল রবিন।

টাকা তুলব, বলল টনি। জন আর আমি বাচ্চাদেরকে ডাইনোসর সম্পর্কে শেখাব। ছোটখাট একটা জাদুঘর দেয়ার ইচ্ছে আছে। আমাদের।

টিরোন হবে তার প্রধান আকর্ষণ, যোগ করল জন।

টিরোনকে প্রথম যখন বার্নে দেখি তখন এখনকার মত টুকরো টুকরো ছিল। আমি একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ডেভেলপ করে ওকে দিয়ে চলাফেরা করাচ্ছি, কথা বলাচ্ছি। ওকে নিয়ে গোটা দেশ ঘুরে টাকা জোগাড় করি আমরা, ডোনেশন তুলি।

রয়ও কি টিচার নাকি? প্রশ্ন করল কিশোর।

না, ওর সাথে আমাদের ওয়াইয়োমিঙে পরিচয়। ও কাজ খুঁজছিল, তাই ওকে হায়ার করেছি আমরা। জানাল টনি। ও হোটেল রুম বুক করা, ফ্লায়ার বানানো, শো করার পারমিশন জোগাড় করা এসব কাজ করে। জাদুঘর তৈরি হলে সেখানেও কাজ করতে চায় ও।

ট্রাক বেড়ে উঠল জুন।

টনি, এটাকে জুড়ে ফেলি এসো, বলল ও।

কীভাবে জোড়েন? প্রশ্ন করল কিশোর।

সোজা। ইরেক্টর সেট দিয়ে মডেল বানানোর মতই, জানাল জন। ট্রাক বেডে রাখা এক বাক্স বড় নাট, বোল্ট আর তার দেখাল ও।

টিরোন কীসের তৈরি? রবিনের প্রশ্ন। ভারী নাকি?

না, জানাল টনি। জনের কাছ থেকে টির‍্যানোসরাসের লেজটা নিয়ে আলতো করে মেঝেতে শুইয়ে দিল।

বেশিরভাগটাই ফাইবার গ্লাস আর রবার। হাড়গুলো অ্যালুমিনিয়াম। দাঁত, পায়ের নখ আর চোখ প্লাস্টিকের।

ছেলেরা আলগোছে দুইঞ্চি লম্বা একটা দাঁত স্পর্শ করল।

দেখতে একদম সত্যিকারের মত! বলল মুসা।

সাবধান, কিছু কিছু কিনারা কিন্তু খুব ধারাল, বলল জন। হেসে সবুজ ব্যাণ্ড-এইডে মোড়া একটা আঙুল নাচাল।

রয়ের লাল গাড়ি হাজির হলে সবাই সেদিকে চাইল। রয় গাড়ির ভিতর থেকে এক গাদা কাগজ হাতে বেরিয়ে এল।

তোমরা হেল্প করবে? বলল ও। শহরে এই ফ্লায়ারগুলো ছড়িয়ে দিতে পারবে?

রবিনের হাতে ফ্লায়ারগুলো দিল রয়। সবচেয়ে উপরেরটায় চোখ রাখল ও। এক টির‍্যানোসরাসের ছবির নীচে এই কথাগুলো লেখা:

এসো, কথা-বলা টির‍্যানোসরাস টিরোনের সাথে পরিচিত হও!

হাই স্কুলের পিছনে, জুলাইয়ের ৪ তারিখে, দুপুরবেলা। মাথা পিছু এক ডলার করে দর্শনী।

তোমরা তিনজন ফ্রী পাবে, বলল টনি। রবিনের কাঁধের উপর দিয়ে চাইল।

খাইছে! বলল মুসা।

কাদেরকে দেব এগুলো? প্রশ্ন করল কিশোর।

যাকে খুশি, বলল রয়। যারা ডাইনোসর ভালবাসে।

রবিন ফ্লায়ারগুলো তিন ভাগ করল। সবাই একটা করে স্তূপ নিল।

আপনারা একটু বাঘাকে দেখে রাখবেন? প্রশ্ন করল কিশোর।

নিশ্চয়ই, জানাল রয়।

ছেলেরা ফ্লায়ার নিয়ে মেইন স্ট্রীটের উদ্দেশে এগোল।

.

এক ঘণ্টা বাদে ফিরে এল ওরা।

কালকে পুরো শহর টিরোনকে দেখতে আসছে! জানাল কিশোর।

খুব ভাল! ওকে এখন কেমন লাগছে তোমাদের? প্রশ্ন করল টনি।

পিছনের পা আর লেজের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে টিরোন। ওর দেহ আর লেজ একটা স্কুল বাসকে ছাড়িয়ে গেছে, ও লম্বায় প্রায় কিশোরদের বাড়ির সমান। বাঘা ওর একটা প্লাস্টিকের পায়ের নখ শুঁকছে।

কী বলব…মানে… কথা হারিয়ে ফেলেছে কিশোর। হেসে উঠল টনি আর জন।

এটা তো ছোট, বলল জন। প্রাপ্তবয়স্ক টি-রেক্স-এর চাইতে অনেক বড়। এসো, তোমাদেরকে দেখাই এটার পেটের ভিতরে কী আছে।

একটা চাবি বের করে টিরোনের একপাশে ছোট্ট এক ফুটোয় ঢোকাল ও। চাবি মোচড় দিতেই খুদে এক ধাতব রিং লাফিয়ে বেরিয়ে এল। জন রিংটা ধরে টানতেই কজা লাগানো এক দরজা হাট হয়ে খুলে গেল।

খাইছে! দেখাই যায়নি! বলে উঠল মুসা।

রবারের এক ওয়েজ তুলে নিল জন। দরজাটা খোলা রাখতে ব্যবহার করল ওটাকে! এবার দোরগোড়া দিয়ে হাত বাড়িয়ে টেনে নামাল ভাঁজ করা একসার কজা লাগানো সিঁড়ি।

দেখো, বলল ও।

ছেলেরা সিঁড়িতে হাঁটু গেড়ে বসে ডাইনোসরের পেটের ভিতর উঁকি দিল। দেয়ালগুলোকে সাপোর্ট দিচ্ছে অ্যালুমিনিয়ামের বার। এক সার হুক যন্ত্রপাতি, দড়ির কুণ্ডলী আর তার ধরে রেখেছে। কোন জানালা নেই। ভিতরে বেজায় গরম।

এক টুকরো কার্পেট দিয়ে আংশিক ঢাকা মেঝেটা। কার্পেটের মাঝখানে ছোট এক টেবিলের উপরে একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার। মেঝের উপর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে এক গোছা ধূসর কম্পিউটারের তার। কয়েকটা তার ডাইনোসরটার বুক বেয়ে উঠে উধাও হয়ে গেছে ঘাড় ও মাথার ভিতরে।

কম্পিউটার সব করে, বলল জন। আমি টিরোনের লেজ, মুখ। আর সামনের পা নাড়াতে পারি স্রেফ মাউস ক্লিক করে।

ছেলেদেরকে নিয়ে টিরোনের পেটের ভিতরে ঢুকল ও।

টিরোনের মাথায় একটা লাউডস্পিকার বসিয়েছি, ব্যাখ্যা করল জন। খুদে এক মাইক্রোফোন দেখাল ছেলেদেরকে। এতে কথা বললে মনে হয় টিরোন কথা বলছে।

খাইছে, ওকে দিয়ে এখন কথা বলাতে পারবেন? মুসার প্রশ্ন।

সেজন্য কালকে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, বলল জন। আমরা জার্নি করে খুব ক্লান্ত। অন্তত দশ ঘণ্টা ঘুমাব।

ছেলেরা আর জন বেরিয়ে এল টিরোনের পেট থেকে। দরজা। লাগিয়ে দিল জন।

আপনারা কি শাংরি-লায় উঠেছেন? প্রশ্ন করল রবিন।

টনি আর রয় উঠেছে, বলল। আমি এখানেই বিছানা পেতে, নেব। ট্রাকের ভিতর থেকে একটা স্লীপিং ব্যাগ বের করে মাটিতে ফেলল ও।

আপনি বাইরে ঘুমান কেন? কিশোরের প্রশ্ন। দাঁত বের করে হাসল জন।

ওদের দুজনের নাক ডাকে, বলে টনি আর রয়কে ইঙ্গিতে দেখাল। তা ছাড়া তারার আলোয় ঘুমাতে ভাল লাগে আমার। প্লাস, টিরোনকেও গার্ড দেয়া হয়। সকালে আমি হোটেলে গিয়ে ওদের শাওয়ার ইউয করব।

ভাল বার্গার কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারো? রয় জিজ্ঞেস করল ছেলেদের। আর সকালের নাস্তা?

কেলি’স ডিনার! এক বাক্যে জানাল কিশোর।

রবিন মেইন স্ট্রীটের দিকে আঙুল তাক করল।

ওটা পেট শপ আর ফিটনেস সেন্টারের মাঝখানে।

ধন্যবাদ। কালকে দেখা হবে, বলল টনি।

ওরা তিনজন লাল গাড়িটায় উঠল। মেইন স্ট্রীটের উদ্দেশে গাড়ি হাঁকাল রয়। এসময় মাথার উপরে বাজ গুড়গুড় করে উঠলে, বাড়ির দিকে দৌড় দিল তিন বন্ধু।

তিন

রাতে বাজের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। জানালা দিয়ে ঝড় দেখতে লাগল ও। বিজলী চমকালে টিরোনের কথা ভাবলা-আঁধারে, বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

পরদিন সাড়ে এগারোটা নাগাদ হাই স্কুলে হাজির হয়ে গেল। কিশোর। মুখ তুলে চাইল টিরোনের দিকে। নীল আকাশের নীচে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে বিশাল টির‍্যানোসরাসটা। মুখ বন্ধ

দৃষ্টি দূরে প্রসারিত। রাতের ঝড়ের ফলে ঘাস এখনও ভেজা, সূর্যের তাপে মিশে যাচ্ছে কুয়াশা।

টনি, জন আর রয়কে আশপাশে দেখা গেল না। কিশোর ট্রাকটার কাছে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিল। সিটের উপর ছড়ানো জনের স্লীপিং ব্যাগ।

একটু পরে, পৌঁছে গেল রবিন আর মুসা।

তার খানিক পরেই, টিরোনের পাশে লাল গাড়িটা দাঁড় করাল রয়। বেরিয়ে এসে হেঁটে এল ছেলেদের উদ্দেশে।

মর্নিং বলল সে। কী ঝড়টাই না হলে বাপরে বাপ!

মাটিতে বসে একজোড়া স্যাণ্ডেল পরল ও। ওর ভেজা জুতোজোড়া একসঙ্গে ফিতেয় বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে গাড়ির অ্যান্টেনা থেকে।

টনি আর জন সেন্টার পার্কের ভেতর থেকে হেঁটে বেরিয়ে এল।

হাই, টনি বলল ছেলেদের উদ্দেশে। রয়, তুমি দারুণ এক, ব্রেকফাস্ট মিস করলে। ওই কেলি দুর্দান্ত ওয়্যাফল বানায়া

মাথা ঝাঁকাল রয়।

আমার বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল না।

একে একে দর্শকরা আসতে শুরু করেছে। মেরি চাচী, মিসেস আমান আর মিসেস মিলফোর্ডও এসেছেন।

দর্শক বাড়তে দেখে খুশি হয়ে উঠল টনি।

বাহ, চমৎকার! বলল ও। জন, তুমি টিরোনকে রেডি করো, আমি আর রয় টাকা কালেক্ট করি।

টনি আর জন দর্শকদের কাছ থেকে এক ডলার করে তুলল। হাত ভর্তি টাকা এসে গেলে ট্রাকের ক্যাবের ভিতরে তালা মেরে রেখে দিল। ওদের দুজনকে দুতিনবার করে কাজটা করতে হলো-এত দর্শক এসেছে।

খাইছে, ওরা বহুত টাকা কামাবে, বলল মুসা। এখানে অন্তত দুশো মানুষ আছে।

টনি ট্রাকবেড়ে উঠে পড়ল কর্ডলেস এক মাইক্রোফোন হাতে।

আসার জন্যে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ, জানাল ও।

সবাই চুপ করলে পরে, টনি ব্যাখ্যা করল কেন ওরা টাকা তুলছে।

আমাদের জাদুঘরটা আগামী সামারের মধ্যে বানাতে চাই। আশা করি আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ ওটা দেখতে যাবেন। মাইকটা ডাইনোসরের দিকে তাক করল ও। আপনারা আমার বন্ধু টিরোনের সাথে পরিচিত হোন। টিরোন, তুই তোর সম্পর্কে দর্শকদের কিছু জানা।

কিছুই ঘটল না। টিরোন নীরবে ঠায় দাঁড়িয়ে। মুখে টু শব্দটি নেই।

টিরোন লজ্জা পাচ্ছে, বলল টান। এবার জোরাল গলায় বলল, টিরোন? বন্ধুদেরকে হাই বলবি না? লেজটা একটু নাড়া না।

কেউ কেউ হেসে উঠল, কিন্তু টিরোন নট নড়ন চড়ন নট কিছু।

ছোট দর্শকদের কেউ কেউ অসহিষ্ণু হয়ে উঠল। কিশোরের পিছনে বসা একটি ছেলে আওড়াল, টাকা ফেরত পাব কিনা কে জানে।

এবার হঠাৎই টিরোনের লেজটা ডান থেকে বাঁয়ে নড়ে উঠল। ওর

ছোট ছোট সামনের দুবাহু উপরে-নীচে দুলে উঠল। মুখ হাঁ হয়ে গেল। এবং টিরোন ভরাট কণ্ঠে বলে উঠল, হাই!

হাই, টিরোন! দর্শকরা বিপুলভাবে সাড়া দিল।

আমি কী ধরনের ডাইনোসর জানেন আপনারা? প্রশ্ন করল টিরোন। কিশোর চিনতে পারল জনের কণ্ঠ আসছে টিরোনের মুখ দিয়ে।

সবাই হাত তুলল।

টির‍্যানোসরাস! ছোট-বড় সবাই বলে উঠল।

ঠিক, আমি টির‍্যানোসরাস রেক্স। বলল টিরোন। আজ সকালে পেট পুরে নাস্তা করেছেন কতজন?

বেশিরভাগ মানুষ এক হাত ওঠাল।

ভাল, বলল টিরোন, প্রকাণ্ড মাথাটা নাড়ল। প্রায় সত্তর মিলিয়ন বছর আগে, আমি অন্যান্য ডাইনোসরদের দিয়ে নাস্তা সারতাম।

হেসে উঠল সবাই। টনি ট্রাক থেকে লাফিয়ে পড়ে তিন বন্ধুর সঙ্গে বসল।

জন ভাল জমিয়ে ফেলেছে, তাই না? বলল ও।

টিরোন তো দেখছি দারুণ কথা বলে, বলল কিশোর। মাথা ঝাঁকাল টনি।

হ্যাঁ, জন মেকানিকাল কিছু পেলে একেবারে জিনিয়াস। প্রথমটায় ভয় পাইয়ে দিয়েছিল আমাকে। আমি তো ভেবেছিলাম কম্পিউটারে গড়বড় হয়ে গেছে বুঝি।

ডাইনোসরদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক তথ্য দিল টিরোন। কী খেত, কীভাবে বাচ্চাদের বড় করত এসব আরকী।

শো প্রায় আধ ঘণ্টা চলল।

আশা করি আপনারা লাইব্রেরিতে গিয়ে ডাইনোসর সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানবেন, বলল টিরোন। খুদে খুদে বাহু নেড়ে বিদায় জানাল। আগামী গ্রীষ্মে আপনাদের সঙ্গে আমাদের মন্টানায় দেখা হবে।

বাচ্চাদের অনেকে চেঁচিয়ে উঠল, বাই, টিরোন! লোকজন বিদায় নিতে শুরু করল।

খাইছে, দারুণ লাগল! আপনারা এখন পর্যন্ত কতগুলো স্কুলে গেছেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।

মাথা চুলকাল টনি।

মনে নেই, গোটা পঞ্চাশেক হবে বোধহয়। রয়ের কাছে হিসেব আছে। আমরা মন্টানায় ফিরে যাওয়ার আগে হয়তো আরও গোটা বিশেক স্কুলে শো করব।

জন টিরোনের পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এল।

দারুণ হয়েছে, সপ্রশংস কণ্ঠে বলল টনি। কিন্তু শুরুতে কী হয়েছিল?

শ্রাগ করল জন।

ল্যাপটপের একটা তার ঢিলে ছিল। কাজ করছিল না।

যাক, ফিক্স করতে পেরেছ এই বেশি, বলে উঠে দাঁড়াল টনি।

গরম লাগছে, যোগ করল। আইসক্রিম খেলে কেমন হয়? সব গোছগাছ করার পর কেলির ওখানে যাব আমরা, কেমন?

মুসার পোয়াবারো, বলল রবিন

আমরা কি কোন সাহায্য করতে পারি?

পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করল টনি। কাগজগুলো যদি কুড়াতে পারো ভাল হয়, বলল।

টনি যখন ট্রাকের দিকে এগোল, তিন বন্ধু ছড়িয়ে পড়ে কুড়োতে লাগল।

কিশোর দুমড়ানো মোচড়ানো এক ফ্লায়ার ভোলার জন্য ঝুঁকছে, এসময় একটা চিৎকার শুনতে পেল। মুখ তুলে চাইল ও। চিৎকারটা টিরোনের কাছ থেকে এসেছে, খোলা দরজার সামনে জড় হয়েছে টনি, জন আর রয়।

একশো ফীট দূর থেকেও কিশোর শুনতে পেল৷ টনির গলা, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।

চার

টিরোনের উদ্দেশে দৌড়ে গেল তিন বন্ধু।

কী হয়েছে? প্রশ্ন করল কিশোর!

আমাদের টাকা চুরি গেছে! বলল রয়।

খাইছে, যে টাকাটা এইমাত্র ওঠালেন? মুসার প্রশ্ন।

মাথা নাড়ল টনি।

না, সেটা আছে। রাবার ব্যাণ্ডে মোড়া মোটা দুটো টাকার তাড়া দেখাল ও। আগেকার টাকার সাথে এটা রাখতে গিয়ে দেখি টাকা নেই!

টিরোনের পেটের ভিতরে মেঝের দিকে আঙুল তাক করল কিশোর। টেবিল, চেয়ার আর কার্পেট সরানো হয়েছে। টেবিল-চেয়ার যেখানে ছিল মেঝের সেখানটায় এখন চৌকো এক গর্ত। কজা লাগানো এক দরজা খোলা, বেরিয়ে পড়েছে এক কম্পার্টমেন্ট। ফাঁকা।

টাকাগুলো এখানেই লুকিয়ে রাখতাম, বলল, জন। ডাফেল ব্যাগে ভরে। মন্টানা থেকে আসার পর থেকে এখানেই ছিল।

কত টাকা ছিল? প্রশ্ন করল মুসা।

টনির মুখের চেহারা ফ্যাকাসে।

এতদিন যা জমিয়েছিলাম সব, বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল ওর। প্রায় পাঁচ হাজার ডলার।

ছজোড়া চোখ চেয়ে রইল ফাঁকা কম্পার্টমেন্টটার দিকে।

চোর এল কখন বুঝতে পারছি না, বলল রয়।

মুহূর্তের জন্য চোখ মুদল টনি।

ডাফেল ব্যাগটা কালকে ওখানে রেখেছিলাম, বলল ও। টিরোনকে সেটআপ করার পর।

তারমানে টাকাটা চুরি গেছে কাল বিকেল আর আজ সকালের মধ্যে, জানাল জন। ঘটনাটা কাল রাতে ঘটেনি, কারণ আমি এখানেই ঘুমিয়েছিলাম।

আমি অফিসার ফলেটকে ডেকে আনছি, বলল রবিন। উনি এখানকার পুলিস চীফ।

উনি আর এখন কী করবেন? প্রশ্ন করল টনি। টাকাটা তো অনেক আগেই চুরি গেছে।

অফিসার ফলেট অনেক বদমাশকে ধরেছেন, জানাল কিশোর।

মুসা মাটির দিকে চাইল, রোদের তাপে শুকিয়ে গেছে।

উনি এখান থেকে কিছু ক্ল পেতে পারেন, বলল ও।

পুলিস ডাকাই উচিত, টনি, বলল জন। টাকাটা ফেরত পাওয়ার জন্যে আমাদের সবরকম চেষ্টাই করতে হবে।

আমি এখুনি আসছি! বলে দৌড় দিল রবিন।

এই টাকায় কেউ হাত দিতে পারবে না, বলল টনি। শার্ট খুলে। নোটগুলো ভিতরে ঠেসে দিল।

মুসা কিশোরের বাহুতে চিমটি কাটল। ও মুখ তুলে চাইতেই মুসা ভ্রূ দেখিয়ে ওর সঙ্গে যেতে বলল।

মুসাকে অনুসরণ করল কিশোর।

বলতে খারাপ লাগছে, বলল মুসা, কিন্তু চুরিটা এই তিনজনের মধ্যে একজন করেছে। চিবুক দেখাল টনি, জন আর রয়ের উদ্দেশে।

ওরা চুরি করতে যাবে কেন? প্রশ্ন করল কিশোর। টনি আর জন সত্যি সত্যি জাদুঘরটা বানাতে চায়। আর রয় ওখানে কাজ করবে।

কিন্তু আর কার কাছে চাবি আছে, কিংবা টিরোনের ভিতরে যে গোপন জায়গা আছে সেটার কথা ওরা ছাড়া আর কে জানে? জোর দিয়ে বলল মুসা।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ছোট্ট এক নুড়িতে লাথি মারল।

আমি বিশ্বাস করি না টনি এমন কাজ করতে পারে, বলল।

এসময় রবিন আর অফিসার ফলেটকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল। ডাইনোসরটার কাছে ফিরে গেল কিশোর আর মুসা।

অফিসার ফলেট নিজের পরিচয় দিয়ে পকেট থেকে নোটবুক আর কলম বের করলেন।

রবিনের কাছে সব শুনলাম, বললেন। তিন যুবকের দিকে চাইলেন, আপনাদের নাম জানতে পারি?

সবার নাম টুকে নিলেন অফিসার ফলেট

টাকাটা শেষবার কোথায় দেখেছেন বলতে পারবেন? প্রশ্ন। করলেন।

দরজা ভেদ করে ফাঁকা কম্পার্টমেন্টটা দেখাল জন।

ওখানে ছিল, শুধু যখন আমরা রাস্তায় থাকতাম তখন ট্রাকে আমাদের সাথে রাখতাম।

কাল বিকেলে ডাফেলটা কম্পার্টমেন্টের ভিতরে রেখেছি আমি, বলল টনি। তখনই শেষবার দেখেছি টাকাগুলো। না, টাকাগুলো ব্যাঙ্কে রাখলে ভাল হত না? অফিসার ফলেট প্রশ্ন করলেন।

আমরা ভেবেছিলাম ডাইনোসরের ভিতরেই টাকাগুলো নিরাপদ, বলল টনি। আমরা ছাড়া আর কেউ গোপন কম্পার্টমেন্টটার কথা জানত না। টাকাগুলো মন্টানায় আমার ব্যাঙ্কে রাখার ইচ্ছা ছিল।

কম্পার্টমেন্টটা কি লক করা ছিল? পুলিস চীফের প্রশ্ন। নোটবইতে টুকছেন।

মাথা নাড়ল টনি।

না, কিন্তু আমরা সব সময় বাইরের দরজাটা বন্ধ রাখি।

কি হোলটা পরখ করলেন অফিসার ফলেট। রবারের ওয়েজটা সরিয়ে কজার উপরে দরজাটাকে আগু-পিছু করলেন।

এই দরজার চাবি কার কাছে আছে? জিজ্ঞেস করলেন।

আমার কাছে একটা আছে, জানাল জন। চাবির রিং ট্যাপ করল।

নিজের চাবিগুলো তুলে ধরল টনি।

আর আমার কাছে আছে অন্যটা, বলল ও।

প্যাডে নোট নিলেন অফিসার ফলেট।

তো মিস্টার টনি কাল বিকেলে কম্পার্টমেন্টে টাকাগুলো রেখেছিলেন, বললেন তিনি। তারপর আজ সকালে, শো-র পরে, মিস্টার জন টাকা খুঁজতে গিয়ে দেখেন টাকা নেই। ঠিক?

না, ঠিক তা নয়, জানাল জন। শো-টা আমি করেছি, কিন্তু টাকা নেই সেটা প্রথমে জেনেছে টনি।

টাকাগুলো কাল রাতে চুরি হয়নি তো? অফিসার প্রশ্ন করলেন। আপনারা রাতে কোথায় ঘুমিয়েছিলেন?

রয় আর আমি হোটেলে ঘুমিয়েছি, জানাল টনি। টাকাটা ছিল কম্পার্টমেন্টে। সব সময় তাই থাকে। জন বাইরে ঘুমোয়। টিরোনকে পাহারা দেয়।

অফিসার ফলেটকে বিভ্রান্ত দেখাল।

টিরোন কে?

আমাদের ডাইনোসরটার নাম টিরোন, ব্যাখ্যা করল রয়।

অফিসার ফলেট জনের দিকে চাইলেন।

আপনি রাতে এখানে ঘুমিয়েছেন? বৃষ্টির মধ্যে?

মৃদু হাসল জন।

না, বৃষ্টি শুরু হলে স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে ট্রাকের ভিতরে ঢুকে পড়ি।

অফিসার ফলেট প্যাডে আরও কী-সব নোট নিয়ে টনির দিকে ঘুরে চাইলেন।

আপনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন তখন কেউ কি চাবিটা চুরি করতে পারে?

মাথা নাড়ল টনি।

দরজা বন্ধ ছিল।

জনের দিকে চাইলেন অফিসার ফলেট।

আপনার চাবি, মিস্টার জন? ওটা কোথায় ছিল, আপনি যখন এখানে ঘুমাচ্ছিলেন?

চাবির গোছাটা তুলে ধরল জুন।

স্লীপিং ব্যাগের ভিতরে আমার বেল্টে ক্লিপ করা ছিল, জানাল।

অফিসার ফলেট দরজাটা ধাক্কা মেরে খুলে কম্পিউটারের দিকে চাইলেন।

টিরোনকে অপারেট করে কে? জিজ্ঞেস করলেন।

আমি, জানাল জুন। আর আমার কম্পিউটার।

তো আপনাদের জানা মতে, আজ সকালে ডাফেল ব্যাগটা মেঝের। নীচে লুকানো ছিল, অফিসার ফলেট মত প্রকাশ করলেন।

হ্যাঁ, জানাল জন।

টিরোনের ভিতরে উঁকি দিলেন অফিসার ফলেট।

মিস্টার জন, আপনি লুকানো টাকার ঠিক ওপরে কম্পিউটার নিয়ে বসে ছিলেন, তাই না?

মাথা ঝাঁকাল জন।

তবে আমার ধারণা ততক্ষণে টাকা চুরি হয়ে গেছে, বলল ও।

শো-র পরে, টনি যখন টেবিল সরিয়ে কার্পেট টানে ডাফেল ব্যাগটা তখন হাওয়া।

অফিসার ফলেট ওয়েজটা যথাস্থানে রাখলেন যাতে দরজাটা ঈষৎ খোলা থাকে। এবার তিন যুবকের দিকে চাইলেন তিনি।

আপনারা আমার অফিসে চলুন। আপনারা কাল এখানে আসার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব আমাকে লিখে দেবেন। ছোটখাট বিষয়ও বাদ দেবেন না, যতই গুরুত্বহীন মনে হোক না কেন।

এতে কতক্ষণ লাগবে? প্রশ্ন করল রয়। আমাদের আরও অনেক স্কুলে শো করতে যেতে হবে কিনা।

তা হলে আর দেরি না করে আসুন আমার সঙ্গে, বললেন অফিসার ফলেট।

পাঁচ

তিন বন্ধু তিন যুবককে পুলিস স্টেশনের দিকে যেতে দেখল। ওদের মাথার উপর দিয়ে টিরোন বড় বড় প্লাস্টিকের চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে।

কী বিশ্রী ব্যাপার! বলল কিশোর। টনি এল আমাদের সাথে দেখা করতে আর ওর টাকা কিনা খোয়া গেল।

কেউ কাজটা করল কীভাবে মাথায় আসছে না, রবিন বলল। কাল বিকেলে আমরা সবাই এখানে ছিলাম, আর জন টিরোনকে রাত্রিবেলা পাহারা দিয়েছে। তা ছাড়া, শো-র সময় ও টিরোনের ভিতরে বন্ধ অবস্থায় ছিল।

হয়তো জনই চোর, বুলল মুসা। কাল রাতে কিংবা আজ শো-র সময় হয়তো কাজটা করেছে। দরজা বন্ধ হবার পর ও কী করেছে কেউ জানে না।, কিন্তু আমরা তো জানি ও কী করেছে, বলল কিশোর। কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছিল, নইলে টিরোন নড়ত না, কথাও বলত না।

তা ঠিক, বলল মুসা। টিরোন প্রথমে কয়েক মিনিট নড়েনি, মনে, আছে? জন তখন হয়তো ডাফেল ব্যাগটা সরাচ্ছিল!

মাথা নাড়ল কিশোর।

জন ওর প্রিয় বন্ধুর টাকা চুরি করবে বলে মনে হয় না।

ঠিক এসময় অফিসার কীন তাঁর ক্রুজারে চেপে পৌঁছলেন। এক গাদা হলদে টেপ আর কাঠের কটা স্টেক নিয়ে নেমে এলেন গাড়ি থেকে।

হাই, কিডস, বললেন তিনি। উত্তেজনার খোরাক পাওয়া গেছে, তাই না?

টেপ আর স্টেকগুলো মাটিতে নামিয়ে রেখে টিরোনের কাছে হেঁটে এলেন। ওয়েজটা তখনও যথাস্থানে ছিল, দরজাটা আরেকটু ফাঁক করার সুযোগ দিল তাঁকে। ভিতরে উঁকি দিলেন তিনি।

বাপরে, ভিতরে পাই বেক করা যাবে, বললেন। টিরোনকে ঘিরে মাটিতে স্টেক খুঁজতে শুরু করলেন অফিসার। কীন। এবার স্টেকগুলোতে ক্রাইম-সিন টেপ দিয়ে ঘিরে দিলেন। ডাইনোসরটাকে।

চলো, কেলির ওখানে যাই, বলল মুসা। আমার মগজ একটা ড্রিঙ্ক চাইছে।

সেন্টার পার্কের ভিতরে ঢুকে পড়ল ছেলেরা। হাঁটছে।

জনকে তোমার সত্যিই চোর মনে হয়? মুসাকে প্রশ্ন করল রবিন।

হ্যাঁ, জানাল মুসা। ওর কাছে চাবি আছে, আর টাকা কোথায় লুকানো থাকে তাও ওর জানা।

রয়ের ব্যাপারে কী ভাবছ? ও টনি কিংবা জনের চাবি দিয়ে কাজট করতে পারে না? প্রশ্ন করল নথি।

করার সুযোগ থাকলে ওরা অফিসার ফলেটকে কথাটা জানাত, বলল মুসা।

চোর অন্য কেউও তো হতে পারে, বলল কিশোর। ডালা খুলতে জানে এমন কেউ।

কিন্তু জন বাইরে ঘুমোচ্ছিল, বলল রবিন। ওর পাশ দিয়ে চোর আসবে কীভাবে?

সেজন্যেই আমি জনকে সন্দেহ করছি, বলে কেলিস ডাইনারের দরজা টেনে খুলল মুসা।

জানালার কাছে এক বুঁদ দখল করল ওরা। একটা টিরোন ফ্লায়ার টেপ দিয়ে কাঁচে সাঁটা। কেলি হাত নেড়ে এগিয়ে এল।

হাই, কেলি বলল। ডাইনোসর শো দেখতে যাওনি?

শো শেষ, বলল মুসা। কিন্তু ওদের টাকা চুরি গেছে।

মুসার পাশে বসল কেলি।

কে কার টাকা চুরি করল?

রবিন টিরোনের পেটে লুকানো টাকার কথা জানাল।

আহারে বেচারারা, উঠে দাঁড়িয়ে বলল কেলি। আজ সকালে ব্রেকফাস্ট করতে এসেছিল। তখন কী এক্সাইটেড দেখলাম ওদেরকে!

অফিসার ফলেট কেসটা দেখছেন, রবিন বলল।

গুড! মুসা, তোমার তো জিভ বেরিয়ে পড়েছে। ফ্রেশ লেমোনেড হলে কেমন হয়? জিজ্ঞেস করল কেলি।

ছেলেরা সায় জানালে, তিনটে উঁচু গ্লাস নিয়ে এল কেলি

স্ট্র দিয়ে লম্বা টান দিল মুসা।

তো তোমরা আমার সাথে একমত যে জনই চোর?

লেমোনেড নাড়ল কিশোর।

আমি নই। যে পাহারার দায়িত্বে ছিল সে এত বোকা নয় যে চুরি করবে, বলল ও। সেক্ষেত্রে আঙুল তো ওর দিকেই উঠবে।

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

ও শো-র সময় ডাফেল ব্যাগটা নিয়ে থাকতে পারে, বলল ও।

কীভাবে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

খুব সহজ, বলল মুসা। নিজেকে ও টিরোনের ভিতরে লক করে। টেবিল আর কার্পেট সরায় ও, ডাফেল ব্যাগটা নিয়ে, কার্পেট আর টেবিল জায়গামত রেখে দেয়। মাত্র এক মিনিটের কাজ।

তারপর? ডাফেল ব্যাগটা কোথায় রাখল? জবাব চাইল কিশোর।

মুসার দিকে চেয়ে রয়েছে ও আর রবিন, জবাব আশা করছে।

চোখ পিটপিট করল মুসা। চুমুক দিল লেমোনেডে। এ ব্যাপারটা এরকম ঘটেছে, বলল ও। জন টিরোনের ভিতরে ছোট্ট খুপরিটা বানিয়েছে, তাই তো বলেছে? ও যদি ওরকম আরেকটা খুপরি বানিয়ে থাকে, যেটার কথা শুধু ও-ই জানে? টাকাগুলো যদি ওখানেই লুকিয়ে রেখে থাকে!

মুসার দিকে চাইল কিশোর।

তুমি ভাবছ টাকা এখনও টিরোনের ভেতরেই রয়েছে?

হতেই পারে, বলল মুসা। কেউ তো ওখানে খুঁজবে না।

রবিন চাইল মুসার দিকে।

তোমার মত খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ ছাড়া।

চলো, টিরোনের ভিতরটা খুঁজে দেখি আমরা, লেমোনেল্ড শেষ করে বলল মুসা। আমার ধারণা যদি ঠিক হয়, তা হলে প্রথম সুযোগেই ব্যাগটা হাতিয়ে নেবে জন।

মুসার কথায় কিন্তু যুক্তি আছে, বলল রবিন। খুঁজে দেখতে অসুবিধে কী?

ছেলেরা টেবিলে টাকা রেখে, কেলির উদ্দেশে হাত নেড়ে, ফিরে চলল হাই স্কুলের দিকে।

একটু পরে, হলদে ক্রাইম-সিন টেপ দিয়ে ঘেরা টিরোনের দিকে চেয়ে রইল তিন বন্ধু। অফিসার কীন চলে গেছেন।

টেপের ভিতরে যাওয়া বেআইনী, বলল কিশোর।

আমরা বলব দেখিনি, বাতলে দিল মুসা।

হ্যাঁ, ঝকঝকে দিনের আলোয় হলদে টেপ চোখে পড়েনি তিনজনের কারওই বলল কিশোর।

আমরা রাতে আসতে পারি না? রবিন বলল।

মাথা নাড়ল কিশোর।

আজ রাতে আমরা বড়দের সাথে ফায়ারওয়র্ক দেখতে যাচ্ছি।

মুসা এক হাত দিয়ে কিশোরের কাঁধ জড়িয়ে ধরল।

হ্যাঁ, বলল ও। সবার চোখ যখন আকাশের দিকে তখন আমরা লুকিয়ে এখানে চলে আসতে পারি।

শেষমেশ সায় জানাল কিশোর।

আমি রাজি হচ্ছি শুধু টনির জন্যে, বলল ও।

এ সময় ছেলেদের কানে কুকুরের ডাক ভেসে এল। মি, প্যান্ট আর রুডকে পার্কের গোলাপঝাড় পরীক্ষা করতে দেখল ওরা। হাই বলার জন্য হেঁটে ওদিকে গেল তিন বন্ধু।

ডাকাতির কথাটা শুনেছেন? রবিন প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, ছেলেগুলোর জন্য খারাপ লাগছে, বললেন মি, প্যান্ট।

কোন সুরাহা হলো?

মাথা নাড়ল কিশোর।

তবে আজ রাতে হতে পারে, বলে কিশোরকে আলতো কনুই মারল মুসা।

ঝাড়গুলো সুন্দর লাগছে, বললেন মি, প্যান্ট। তবে এই মরা। চারাটা সরাতে হবে। কিশোর, তুমি একটু হুইলবারোটা আনবে?

শেডে দৌড়ে গেল কিশোর। ঠেলাগাড়িটা যেখানে রেখে গিয়েছিল সেখানেই রয়েছে, বারল্যাপ ব্যাগগুলোর গায়ে ঠেস দেওয়া। কিশোর বেরিয়ে আসবে, কাদামাখা পায়ের ছাপ চোখে পড়ল ইটের উপর।

ঠেলাগাড়িটা মি, প্যান্টের কাছে নিয়ে এল ও।

ধন্যবাদ, বলে মরা চারাটা ঠেলাগাড়িতে তুললেন মি. প্যান্ট। এটাকে স্কুলের ডাম্পস্টারে ফেলে দেব। এবার রুডকে নিয়ে হেঁটে চলে গেলেন।

ওই যে টনি আর রয়! বলে ডাইনোসরটার দিকে আঙুল তাক করল মুসা।

ওরা দুজন ক্রাইম-সিন টেপের সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে। টনি কী সব বলছে আর টিরোনের এক পাশের এক দরজার দিকে ইঙ্গিত করছে। জবাব দিচ্ছে রয়, মাথা নাড়ছে।

ছেলেরা কিছু শুনতে পেল না, দূরে রয়েছে। একটু পরে, দুই যুবক রয়ের গাড়িতে উঠে চলে গেল।

জন ওদের সঙ্গে ছিল না।

অফিসার ফলেই মনে হয় জনকে সাসপেক্ট হিসেবে আটকে, রেখেছেন, বলল কিশোর। পেটের ভিতরের মিষ্টি লেমোনেড হঠাৎই তেতো লাগল ওর।

ছয়

বাড়ি ফেরার পথে ছেলেরা চুরিটা নিয়ে কথা বলল।

মুসা হঠাৎই থমকে দাঁড়াল। কালো চোখের মণিতে ধূর্ততার ছায়া।

জেনে ফেলেছি কে টাকা চুরি করেছে, ফিসফিস করে বলল ও।

কে? কিশোরের জিজ্ঞাসা।

টিরোন! বলল মুসা। সবাই যখন ঘুমিয়ে ও তখন ব্যাঙ্কে গিয়ে একটা ডাইনো ডিপোজিট করেছে!

মুসাকে ঠেলা দিল কিশোর। আর রবিন চোখ উল্টাল।

বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে একসঙ্গে ফায়ারওয়র্ক দেখতে যাবে ঠিক করল ওরা।

আমার বাসায় স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে চলে এসো, বলল কিশোর। চাচা-চাচী বলেছে ফায়ারওয়র্কের পর বাইরে ঘুমোতে পারি আমরা।

কালো পোশাক পরব, ঠিক আছে? বলল মুসা।

সাড়ে আটটায় মুসা আর রবিনের পরিবার মিলিত হলো : কিশোরদের বাসায়। পিকনিক টেবিলের উপর স্লীপিং ব্যাগ স্তূপ করে রেখেছে তিন বন্ধু। বড়রা এনেছেন ব্ল্যাঙ্কেট, পপকর্ন আর বাগ প্ৰে। এ তিনটি পরিবার মেইন স্ট্রীটে হেঁটে গিয়ে বয়ে মোড় নিল। বাঁয়ে আরেকটা মোড় ঘুরে সুইমিংপুলের দিকে পা চালাল। ওখানেই ফায়ারওয়র্ক সেটআপ করা হয়েছে।

তোমরা তিনজন কালো ড্রেস পরেছ কেন? মি. মিলফোর্ড প্রশ্ন করলেন। তোমাদেরকে নিনজার মত লাগছে।

মশা যাতে না কামড়ায় সেজন্যে, বলল রবিন। কিশোরের দিকে। চাইল।

অন্যদেরকে পিছনে নিয়ে হাঁটছে তিন গোয়েন্দা।

ভাল বলেছ, কেউ শুনছে না নিশ্চিত হয়ে বলল মুসা।

একটু পরে, সবাই হাজির হলো টাউন পুলে। কয়েকশো লোক ইতোমধ্যেই জড় হয়েছে। পুলের কাছে, টেনিস কোর্ট আর বেসবল মাঠে ব্ল্যাঙ্কেট আর চেয়ারের ছড়াছড়ি।

ফায়ার ট্রাক কাছেই পার্ক করা, যদি দরকার পড়ে।

টনি, জন আর রয়কে দেখতে পাচ্ছি, বলল মুসা।

বেসবেল মাঠ ঘিরে রাখা ফেলে হেলান দিয়ে বসা ওরা। চলো ওদের সাথে বসি।

তা সম্ভব নয়, বলল রবিন। পরে আমাদেরকে পালাতে হবে না?

তা হলে অন্তত হাই বলি চলো, বলল কিশোর।

হ্যাঁ, জনকে অপরাধী মনে হয় কিনা সেটাও দেখা যাবে, মন্তব্য করল মুসা।

ছেলেরা ব্ল্যাঙ্কেট আর চেয়ার এড়িয়ে পথ করে নিল। টনি সবার আগে ওদেরকে দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াল।

হাউডি, হাত নেড়ে বলল ও। আমাদের সাথে বসবে? রয় আর জনও হাই বলল, কিন্তু উঠে দাঁড়ায়নি।

ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পারব না, বলল মুসা। বাবা-মার সাথে থাকতে হবে।

অফিসার ফলেট ভাল মানুষ, বলল টনি। আমার বিশ্বাস উনি টাকাটা বের করতে পারবেন। আমরা টিরোনকে নিয়ে কাল চলে যাচ্ছি।

কোথায়? প্রশ্ন করল রবিন।

প্রথমে নিউ হ্যাঁভেন, তারপর অন্যান্য শহরে, বলল রয়।

আমাদেরকে আরও অনেক টাকা কামাতে হবে তো।

জন আলোচনায় যোগ দিল না। ওর চোখজোড়া সামনের দিকে স্থির।

গুড ইভনিং, একটি কণ্ঠ বলল। শাংরি-লা হোটেলের ম্যানেজার মি. লিস্টার। কফীট দূরে এক লন চেয়ারে বসে আছেন তিনি। সবাই হাই বলল। রুমটা কমফোর্টেবল লাগছে তো? টনি আর রয়ের উদ্দেশে বললেন মি. লিস্টার।

চমৎকার, জবাব দিল টনি।

ঠিক এসময় মাথার উপরে আকাশ নীল আলোয় আলোকিত হয়ে গেল।

উহ! চেঁচিয়ে উঠল দর্শকরা।

ওরা শুরু করছে! বলল রবিন। আমরা যাই।

কালকে কেলির ওখানে ব্রেকফাস্ট করলে কেমন হয়? টনি প্রশ্ন করল। তোমাদের সাথে দেখা না করে যেতে চাই না।

ঠিক আছে। কখন? বলল কিশোর।

আমাদেরকে ভোরে উঠতে হবে টিরোনকে পার্ট পার্ট করে ট্রাকে তোলার জন্যে, বলল টনি। নটা হলে কেমন হয়?

আমরা পৌঁছে যাব, বলল কিশোর। বড়দের সঙ্গে যোগ দিতে হাঁটা ধরল তিন গোয়েন্দা। টেনিস কোর্টের কাছে একটা জায়গা বেছে নিল ওরা। এখান থেকে তিন যুবকের উপর চোখ রাখতে পারবে।

টনি কী বলল শুনেছ? প্রশ্ন করল রবিন। কালকে টিরোনকে টুকরো টুকরো করবে ওরা!

কাজেই জন যদি ওখানে টাকা লুকিয়ে রেখে থাকে, তবে তার আগেই ওকে সেটা সরাতে হবে, বলল মুসা।

কথাটা অন্য কারও বেলাতেও খাটে, যোগ করল কিশোর।

জনই চোর, আমি তো বলছি, বলে চলল মুসা। ও কীভাবে চুপচাপ বসেছিল দেখনি? ও-ই দোষী।

ছেলেরা আরও কিছুক্ষণ ফায়ারওয়র্ক দেখল। মাথার উপরে আকাশ নানান রং ধারণ করছে-কালো, লাল, সাদা, নীল। জনতা হাততালি, শিস দিচ্ছে, চেঁচাচ্ছে।

আমাদের সটকাতে হবে, গলা খাদে নামিয়ে বলল মুসা। বড়সড় একটা ছুঁড়লেই।

একটু পরে, হলদে আলো ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। সবাই চোখ তুলে দেখছে, আলগোছে সরে পড়ল তিন বন্ধু।

ইস্ট গ্রীন স্ট্রীট ধরে ছুট দিয়ে হাই স্কুলের লনে চলে এল ওরা।

চাঁদের আলোয় ডাইনোসরটার ছায়া বিস্তার পেয়েছে খেলার মাঠের মাঝামাঝি অবধি। ওদের পিছনে, আকাশ তখন আলোকিত। বাতাসের দোলায় স্টেকের গায়ে পতপত করে বাড়ি খাচ্ছে হলদে টেপ।

এখন কী? প্রশ্ন করল কিশোর। এখানে আসতে চাইনি আমি, শুধু তোমাদের জন্যে আসলাম।

আমিও, বলল রবিন, কিন্তু ডাফেল ব্যাগটা যদি এখনও টিরোনের ভিতর থেকে থাকে তবে আজ রাতেই ওটা আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে!

সাত

কাজটা সেরে ফেলা যাক, বলল মুসা। পাঁচ মিনিট লাগবে। টাকাটা খুঁজে না পেলে ফিরে গিয়ে ফায়ারওয়র্ক দেখব।

হলদে টেপের নীচ দিয়ে সন্তর্পণে ভিতরে ঢুকল ওরা। টিরোনের কালো ছায়া ঢেকে রেখেছে ওদেরকে। রবারের ওয়েজটা দরজাটাকে। এক ইঞ্চি খুলে রেখেছে। মুসা ওটা সরিয়ে দরজা খুলে দিল।

কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না! বলল কিশোর। আঁধারে কী খুঁজব আমরা?

দাঁড়াও, বলে পকেট থেকে খুদে এক ফ্ল্যাশলাইট বের করল রবিন। সুইচ অন করে, ভাঁজ করা সিঁড়ির পাশ দিয়ে আলো ফেলল টিরোনের পেটের ভিতরে।

টেবিল আর কার্পেট এখনও এক পাশে সরানো। কম্পার্টমেন্টের ঢাকনা তোলা, ভিতরটা ফাঁকা। রবিন এবার বাতি বন্ধ করল।

সিঁড়িটা টেনে নামাল কিশোর, এবং ওরা নেমে এল টিরোনের পেটে। কিশোর সিঁড়িটা ভাঁজ করতেই দরজা লাগিয়ে দিল মুসা।

অন্ধকার, গুমোট এক গুহায় এখন ওরা।

গরমে তো সেদ্ধ হয়ে গেলাম! আঁধারে অভিযোগ করল মুসা।

কিশোর বসেছে হাঁটুতে ভর দিয়ে। ছোট টেবিলটার উপরে রেখেছে একটা বাহু। ডাফেল ব্যাগের খুপরিটা সামনে, তবে দেখতে পাচ্ছে না।

কাজটা ঝটপট সেরে ফেলা যাক, বলল কিশোর। চাচা-চাচী টের পাওয়ার আগেই ফায়ারওয়র্কের ওখানে ফিরতে হবে।

রবিন ফ্ল্যাশলাইট রেখে ছোট্ট খুপরিটার মধ্যে আলো ফেলল।

মুসা, তোমার গোপন কম্পার্টমেন্টটা দেখাও, বলল ও।

চোখের সামনে নিশ্চয়ই থাকবে না, বলল মুসা। এমন জায়গা খোজো যেটার কথা কেউ ভাববে না।

হাঁটু গেড়ে বসে পিছনের দুপায়ের চারপাশটা হাতড়াতে লাগল। কিশোর। বড় বড় বোল্ট দিয়ে বাকি দেহের সঙ্গে জোড়া ও দুটো।

পাগুলো মনে হয় ফাপা, বলল ও।

মুসা হাতড়াতে হাতড়াতে একটা হাত ঢুকিয়ে দিল এক পায়ের মধ্যে।

এখানে কিছু নেই, জানাল।

অপর পা-টা খুঁজল কিশোর, কিন্তু ভিতরে কিছুই পেল না।

মাথার ভিতরে নেই তো? রবিন বলল। টিরোনের বুক আর ঘাড়ের কাছে উঠে এল ওর ফ্ল্যাশলাইটের আলো। উপরে একটা ফাঁকা গর্ত-মাথাটা যেখানে থাকে।

খুঁজে দেখা যাক, বলল কিশোর। উঠে দাঁড়িয়ে টিরোনের মাথার গর্তে হাত ভরার চেষ্টা করল। নাহ, নাগাল পাচ্ছি না।

এক সেকেণ্ড, বলল মুসা। ল্যাপটপ কম্পিউটারটা টেবিল থেকে নামিয়ে মেঝেতে রাখল। এবার কিশোরের দিকে ঠেলে দিল টেবিলটা।

টেবিলে উঠে আবারও হাত বাড়াল কিশোর। এবার বাহু অবধি ঢুকে গেল টিরোনের মাথার মধ্যে। হাতটা নাড়াচাড়া করল ও।

শুধু কম্পিউটারের তারের গোছা, বলল ও। তবে আমার হাত, নীচ পর্যন্ত যাচ্ছে না।

আমি ভিতরে ঢুকতে পারব? প্রশ্ন করল নথি।

মনে হয়, বলল কিশোর। মাথাটা ফাঁপা।

তোমার মাথার মত, হেসে বলল মুসা।

আমাকে উঠতে দাও, বলল রবিন। আমি টেবিলে দাঁড়াব, তারপর তোমরা আমাকে তুলে দেবে।

জায়গা বদলে নিল কিশোর আর রবিন। মুখে ফ্ল্যাশলাইট ধরে রাখল মুসা। ও আর কিশোর রবিনকে ঠেলে তুলে দিল টিরোনের গলার কাছে। মাথার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল রবিন, শুধু দুপা বেরিয়ে রইল। এবার পা উধাও হয়ে গেল এবং নীচের দিক থেকে ওর মুখ উঁকি দিল বন্ধুদের উদ্দেশে।

এখানে তারের সাথে জোড়া একটা ছোট স্পিকার ছাড়া কিছু নেই, বলল ও। আর এক সার দাঁত।

দেয়ালের চারধারে আলো বুলাল মুসা।

টাকা লুকানোর কোন জায়গা তো দেখছি না, বলল ও।

তো কী করব আমরা? কিশোর প্রশ্ন করল।

আগে তাজা বাতাস নিয়ে নিই, বলল মুসা। কিশোরের হাতে ফ্ল্যাশলাইটটা দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল।

ফ্ল্যাশলাইটটা বন্ধ করল কিশোর।

বেশি ফাঁক কোরো না। আমি ধরা পড়তে চাই না!

মুসা দরজাটা ঠেলা দিল। নড়ল না ওটা।

হেল্প, কিশোর, দরজাটা আটকে গেছে।

ছেলেরা দরজায় কাঁধ ঠেকিয়ে ধাক্কা দিল।

আমরা বন্ধ করার সময় মনে হয় বড় হয়ে গেছে, বলল মুসা। রবারের জিনিসটা দিয়ে ভোলা রাখতে ভুলে গেছিলাম আমরা।

কিশোর ফ্ল্যাশলাইট অন করে আলোটা ধরল রবিনের উদ্দেশে।

এটা তোমাকে দিলে মুখের ভেতর দিয়ে আলো ফেলতে পারবে? প্রশ্ন করল। চেঁচালে কেউ হয়তো শুনতে পাবে।

মাথা নাড়ল রবিন।

মুখটা বন্ধ।

আমাদেরকে অন্য কিছু ট্রাই করতে হবে, বলে ফ্ল্যাশলাইট দোলাল কিশোর। আমি এখানে সারা রাত থাকব না!

পেয়েছি, বলে উঠল মুসা। জনের কম্পিউটার ব্যবহার করতে হবে। টিরোনের মুখ খোলা গেলে মাইক্রোফোন আঁর স্পিকার দিয়ে সাহায্যের জন্যে চেঁচানো যাবে।

ফায়ারওয়র্কের যা শব্দ হচ্ছে, কেউ শুনবে না, বলল নথি। তবে আমার মাথায় আরেকটা আইডিয়া এসেছে। তুমি টিরোনের মুখ খুলতে পারলে আমি বেরিয়ে আসতে পারি।

রবিন, টিরোনের মাথাটা মাটি থেকে অনেক উঁচুতে, বলল কিশোর।

মুসার দিকে চাইল ও।

মই হিসেবে ব্যবহার করার মত কিছু আছে?

হঠাই কিশোরের হাত থেকে ফ্ল্যাশলাইটটা কেড়ে নিল মুসা। হুকগুলোর উপর না পড়া পর্যন্ত দেয়ালে আলো বুলিয়ে গেল।

যা ভেবেছিলাম, বলল ও।

কী? কিশোরের প্রশ্ন।

মুসা হাত বাড়িয়ে এক গোছা দড়ি নিল।

এটা দিয়ে রবিনকে টিরোনের মুখ থেকে মাটিতে নামানো যায়!

কিশোর রবিনের দিকে মুখ তুলে চাইল।

পারবে?

মাথা ঝাঁকাল রবিন।

টিরোনের মুখ অনেক বড়।

মুসার মুখের মত, বলে বন্ধুর দিকে চেয়ে হাসল গোয়েন্দাপ্রধান।

খুব মজার কথা বলেছ, বিরস কণ্ঠে বলল, মুসা। কিশোরকে ফ্ল্যাশলাইটটা দিয়ে, ল্যাপটপের সামনে বসে পড়ল। অন করে কটা কি চাপল।

স্ক্রীনে কয়েকটা আইকন ফুটে উঠল। একটায় লেবেল দেখা গেল: টিরোন। মুসা ওটাতে ক্লিক করতেই একটা উইণ্ডো এল, কয়েকটা চয়েস নিয়ে। তার একটা শব্দ হলো: মাউথ।

খাইছে, রেডি হও, রবিন, বলে উঠল মুসা।

মাউথ-এ ক্লিক করল মুসা। এক সেকেণ্ড পরে ঘর-ঘর করে একটা শব্দ শুনল কিশোর।

কাজ হয়েছে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। টিরোনের মুখ খুলে যাচ্ছে!

আট

কিশোর ফ্ল্যাশলাইটটা মেঝেতে রেখে দড়ির এক প্রান্ত বাধল ফোল্ডিং সিঁড়ির সঙ্গে। মুসা অপরপ্রান্তে একটা লুপ তৈরি করল, রবিন যাতে ভিতরে ঢুকতে পারে। টেবিলে দাঁড়িয়ে রবিনকে লুপটা দিল ও।

ভয় পাচ্ছ না তো? প্রশ্ন করল কিশোর।

সোজা তো, বলল রবিন।

তুমি নামার জন্য রেডি না হওয়া পর্যন্ত আমরা দড়িটা ধরে রাখব, বলল মুসা। দাঁতগুলো থেকে সাবধান!

ওকে, আমাকে একটা মিনিট সময় দাও। রবিনের মুখটা অদৃশ্য হয়ে গেল। খানিকটা আলগা দড়ি ওর সঙ্গে নেমে গেল। অল রাইট। চেঁচাল ও। আমাকে আস্তে আস্তে নামাও।

ছেলেরা অনুভব করল রবিনের ওজন চাপায় দড়িটা শক্ত ঠেকছে। আস্তে আস্তে দড়িটা ছাড়ছে ওরা। হাতের তালু জ্বলছে কিশোরের।

এবার দড়িটায় পুরোপুরি ঢিল পড়ল।

নেমেছে ও? প্রশ্ন করল মুসা।

দুজনেই শুনতে পেল টিরোনের এক পাশের দরজায় কেউ ধুপ ধাপ শব্দ করছে।

আমি এখুনি আসছি! চেঁচাল রবিন।

কিশোর আর মুসা বাঁকা এক দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। ফ্ল্যাশলাইটের আলো ম্লান হয়ে আসছে, তাই কিশোর ওটা বন্ধ করে। দিল।

এখানে এয়ারকণ্ডিশনার থাকলে ভাল হত, বলল মুসা। টি-শার্ট দিয়ে মুখের ঘাম মুছল।

তোমার জন্যে খাবার ভর্তি ফ্রিজ থাকলে আরও ভাল হত, ফুট কাটল কিশোর।

হেসে ফেলল মুসা।

ছেলেরা আঁধারে বসে রইল। চোখে ঘাম ঢুকছে টের পেল কিশোর।

সেদ্ধ হয়ে গেলাম, গুঙিয়ে উঠল মুসা।

একটু সহ্য করো, বলল কিশোর। একটু পরে, বাইরে একটা শব্দ হতে শুনল ওরা।

ঢোক গিলল মুসা।

জন টাকাটা নিতে আসেনি তো?

কিশোর দরজার কাছে গিয়ে কান ঠেকাল। দরজাটা খুলে গেল, এবং কিশোর আরেকটু হলেই টনির গায়ের উপর পড়তে যাচ্ছিল।

ভাল বিপদেই পড়েছিলে তোমরা, বলে কিশোরের চোখে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেললেন অফিসার ফলেট। ভাগ্যিস টনিকে ফায়ারওয়র্কের ওখানে পেয়েছিলাম।

টনি সিঁড়িটা নামিয়ে দিল, কিশোর আর মুসা যাতে মাটিতে নেমে আসতে পারে।

ধন্যবাদ, ভিতরে গলে যাচ্ছিলাম, বলল মুসা।

রবিন আমাদেরকে সব বলেছে, বলল টনি। তোমরা টাকাটা খুঁজে পাওনি।

মাথা নাড়ল কিশোর।

সরি।

আমার ধারণা চোর ব্যাগটা নিয়ে সটকে পড়েছে, বললেন অফিসার ফলেট।

মাথা ঝাঁকাল টনি।

ঘটনাটা ঘটেছে কাল রাতে আমরা ঘুমোতে যাওয়ার পরে, বলল ও। কিন্তু কীভাবে ঘটল বুঝতে পারছি না।

অফিসার ফলেট তার লাইটের আলো ফেললেন মাটিতে।

কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, বললেন।

চোর যদি পায়ের ছাপও রেখে যেত, সেগুলো ধুয়ে মুছে যেত।

পায়ের ছাপ, ভাবল কিশোর।

গার্ডেন শেডে ভেজা পায়ের ছাপ দেখেছি আমি, বলল ও। আঁধার ভেদ করে গোলাপ বাগানের দিকে আঙুল তাক করল। মিস্টার প্যাণ্টের জন্যে আমি হুইলবারো আনতে গেছিলাম।

তারমানে বৃষ্টির পর কেউ ওখানে ঢুকেছিল, বলল রবিন। এবং সেটা মাঝরাতে!

পায়ের ছাপগুলো হয়তো চোরের, বললেন অফিসার ফলেট। কিশোরের কাঁধে একটা হাত রাখলেন। চলো, আমাকে দেখাবে।

অন্ধকার লন পেরিয়ে দলটিকে পিছনে নিয়ে চলল কিশোর।

ওই যে, ছোট্ট গার্ডেন শেডটার কাছে পৌঁছে বলল ও।

তোমরা এখানে থাকো, মুসা, রবিন আর টনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন অফিসার ফলেট। ওঁর ফ্ল্যাশলাইটের আলো ঝুঁড্রাইভারটা খুঁজে নিল। ওটা সরিয়ে দরজা খুললেন তিনি। আলো ফেললেন মেঝের উপর। কাদাটে, শুকনো পদচিহ্ন চলে গেছে দরজা থেকে শেডের পিছন পর্যন্ত।

এটা একটু ধরো, বলে ফ্ল্যাশলাইটটা কিশোরের হাতে দিলেন অফিসার। দরজার পাশে দাঁড়াও, যাতে আলোটা পাই আমি।

অফিসার ফলেট ভিতরে পা রেখে পদচিহ্ন পরীক্ষা করতে হাঁটু গেড়ে বসলেন। এবার শেডের ভিতর হাঁটাহাঁটি করে, একজন মানুষের লুকিয়ে থাকার উপযোগী সম্ভাব্য সব জায়গা নিরীখ করলেন।

শেডের পিছনে, ঠেলাগাড়িটা সরালেন তিনি। পায়ের পাতা দিয়ে খোঁচা দিলেন বারল্যাপ স্যাকগুলোর গায়ে। এবার কয়েকটা ব্যাগ সরিয়ে মেঝেতে রাখলেন।

কিশোর তাঁকে ঝুঁকে পড়ে অন্য ব্যাগগুলোর নীচ থেকে কিছু একটা বের করতে দেখলেন।

টনি, আপনি এখানে একবার আসুন, হাঁক ছাড়লেন।

দরজা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল টনি।

আপনারা কি এটাই খুঁজছেন?

অফিসার ফলেটের হাতে কালচে-বাদামী এক ডাফেল ব্যাগ। পেট মোটা, মনে হয় ভিতরে কিছু আছে। এক পাশে লম্বা এক যিপার।

টনির মুখে হাসি ধরে না।

হ্যাঁ, এটাই তো আমাদের ব্যাগ! সোল্লাসে বলে উঠল।

অফিসার ফলেট শেড থেকে ব্যাগটা বের করে মাটিতে রাখলেন। ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় যিপারটা খুললেন তিনি। ভিতরে রবার ব্যাণ্ডে বাধা নোটের তাড়া।

অফিসার ফলেট মুখ তুলে চাইলেন টনির দিকে।

এটা কি আপনার টাকা? প্রশ্ন করলেন। মাথা ঝাঁকাল টনি।

আশা করি পুরোটাই আছে।

ওটা কী? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ক্যানভাস ডাফেলের এক পাশ দিয়ে ম্লান সবুজ কিছু একটা বেরিয়ে রয়েছে।

ব্যাণ্ড-এইড, বলল রবিন।

ছুঁয়ো না, সাবধান করলেন অফিসার। পকেট থেকে ছোট্ট এক প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করলেন। কলমের নিব দিয়ে খুঁচিয়ে ব্যাগের ভিতরে ব্যাণ্ড-এইডটা ঢুকিয়ে, মুখ বন্ধ করে দিলেন।

জিনিসটা কার হতে পারে? অফিসার বললেন। প্লাস্টিক ব্যাগের উপর আলো ধরলেন।

রয় কালকে এরকম একটা ব্যাণ্ড-এইড পরেছিল, বলল রবিন। গাড়ির রেডিয়েটরে আঙুল পুড়ে গেছিল ওর।

আমি জনের আঙুলেও ওরকম একটা দেখেছি, জানাল মুসা।

আমরা সবাই এগুলো ইউয করি, বলল টনি। জিন্সের পকেট থেকে একটা ব্যাণ্ড-এইড বের করল ও।

টনির ব্যাণ্ড-এইড আর ব্যাগের ভিতরেরটা অবিকল একই রকম।

নয়

আপনারা সবাই এই একই ব্যাণ্ড-এইড ইউয করেন? অফিসার ফলেট টনিকে জিজ্ঞেস করলেন।

মাথা ঝাঁকাল টনি।

প্রায়ই আমাদের আঙুল কাটে, বলল টনি। তাই আমি এক বাক্স ব্যাণ্ড-এইড কিনেছি। সবাই কয়েকটা করে পকেটে রাখি।

অফিসার ফলেট ডাফেল ব্যাগটা এক ঝলক দেখে নিলেন।

ব্যাগটা শেষবার কার কাছে ছিল?

টাকাটা শুধু আমিই ব্যাগে রাখি, জানাল টনি। ব্যাগটা কম্পার্টমেন্টে রাখার সময় হয়তো আমার ব্যাণ্ড-এইড আঙুল থেকে খসে পড়ে গেছিল।

কিংবা হয়তো ব্যাগ চুরির সময় চোরের আঙুল থেকে ব্যাণ্ড-এইড খসে পড়েছে, বললেন অফিসার ফলেট। সেটা যে কেউই হতে পারে। টুনিকে খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন।

কথা বলার আগে দুমুহূর্ত ভেবে নিল টনি।

আমাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন চুরিটা করেছে বলে মনে হচ্ছে, বলল ও। কিন্তু আমি তো চুরি করিইনি, জন আর রয় করেছে। বলেও বিশ্বাস করি না।

ডাকাত কি অন্য কেউ হতে পারে? কিশোর জবাব চাইল।

কিন্তু কে? প্রশ্ন করলেন অফিসার ফলেট। টনি আর জন ছাড়া আর কারও কাছে তো ডাইনোসরের চাবি থাকে না।

হ্যাঁ, কিন্তু জন আমার প্রিয় বন্ধু, বলল টনি।

ছোট ব্যাগ আর কলমটা পকেটে চালান করলেন অফিসার ফলেট।

জন আর রয়ের মধ্যে কার পক্ষে ডাফেল ব্যাগটা হাতানো সহজ? প্রশ্ন করলেন টনিকে।

মাটিতে চোখ রাখল টনি।

মনে হয় জন, বিড়বিড় করে আওড়াল। কাল রাতে ও টিরোনের পাশে ঘুমিয়েছে।

টনির কাঁধে একটা হাত রাখলেন অফিসার।

আমি জনকে নিয়ে আসছি, আপনি ততক্ষণ আমার অফিসে ওয়েট করুন, বললেন। ও কি এখনও ফায়ারওয়র্ক দেখছে?

মনে হয়, জানাল টনি।

টাকাটা আমাদের সেফে থাকবে, কথার খেই ধরলেন অফিসার ফলেট। একটু পরেই থানায় আপনার সাথে দেখা হচ্ছে।

হতচকিত উনি ঘুরে দাঁড়িয়ে মেইন স্ট্রীটের দিকে হাঁটা দিল। কমুহূর্ত পরে মিশে গেল রাতের আঁধারে।

তিন গোয়েন্দার দিকে চাইলেন অফিসার ফলেট।

চলো, তোমাদের গার্জেনরা হয়তো চিন্তা করছেন।

তিন গোয়েন্দা অফিসারকে অনুসরণ করে তাঁর ক্রুজারের ব্যাকসিটে উঠল। অফিসার মেইন স্ট্রীট ধরে গাড়ি চালালেন।

সুইমিং পুলের আকাশে তখনও রঙিন আলো ছড়াচ্ছে আতশবাজি। টেনিস কোর্ট আর বেসবল মাঠের মাঝখানে গাড়ি পার্ক করলেন অফিসার।

ছেলেরা তাঁকে বেসবল মাঠের ফেন্সের দিকে পা বাড়াতে দেখে, বড়দের খুঁজতে গেল।

কীরে, এতক্ষণ কোথায় ছিলি তোরা? প্রশ্ন করলেন মেরি চাচী। আমি তো ভেবেছিলাম এলিয়েনরা তোদেরকে কিডন্যাপ করেছে বুঝি।

ঘড়ি দেখল কিশোর। ওরা প্রায় আধ ঘণ্টা গরহাজির ছিল।

অফিসার ফলেটকে দেখা যাবে এরকম এক জায়গা বেছে নিয়ে বসল ওরা। অফিসার হেঁটে গেলেন জনের কাছে, দুজনে দাঁড়িয়ে কথা বলল মিনিট খানেক। অফিসার এবার জনকে নিয়ে তাঁর ক্রুজারের উদ্দেশে এগোলেন। গাড়িটা মেইন স্ট্রীটে উঠে হারিয়ে গেল।

জন কাজটা করেছে বিশ্বাস হয় না, বলল রবিন।

ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল মুসা।

টিরোনের এখন কী হবে তাই ভাবছি, বলল ও।

কী আর হবে, টনি আর রয় জনের জায়গায় অন্য লোক নেবে, বলল কিশোর।

রয় কোথায়? প্রশ্ন করল রবিন।

জনের সাথে ছিল না? পাল্টা জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না, জানাল মুসা। শুধু জনকেই দেখলাম। রয় হয়তো হোটেলে ফিরে গেছে। ঝড়ের জন্যে কাল রাতে নাকি ঘুমোতে পারেনি।

কাল রাতের ঝড়ের কথা মনে পড়ল কিশোরের। শেডের মেঝেতে কাদাটে পদচিহ্নগুলোর কথাও মাথায় এল। আর কল্পনায় ভেসে উঠল সকালে, গাড়ির অ্যান্টেনা থেকে রয়ের ভেজা স্নিকার্স ঝোলার দৃশ্য।

আমার মনে হচ্ছে আমরা সবাই জনকে খামোকা দোষী ভাবছি, হঠাৎই বলে উঠল কিশোর। আমার ধারণা টাকাটা রয় চুরি করে গার্ডেন শেডে লুকিয়ে রেখেছিল!

কিন্তু ওর কাছে তো চাবি নেই, বলল মুসা।

আমার মনে হয় রয় জানত বৃষ্টি হলে জন বাইরে ঘুমোবে না। জন যখন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে ট্রাক ক্যাবে ঢুকেছে, সে সময় রয় ঢোকে টিরোনের ভিতরে।

কীভাবে? রয়ের কাছে তো চাবি নেই, আবারও বলল মুসা।

টনি যখন ঘুমোচ্ছিল তখন রয় ওর চাবিটা হাত করে, বলল কিশোর। রয় ডাফেল ব্যাগটা চুরি করে শেডে লুকিয়ে রাখে, তারপর দৌড়ে হোটেলে ফিরে যায়। নিশ্চয়ই শেড থেকে ব্যাগটা নিয়ে টাকা। হাতাত।

হঠাৎই শ্বাস টানল রবিন।

রয় এখন হয়তো ওখানেই আছে! বলল ও। আমরা যেভাবে সটকে পড়েছিলাম সেই একই কায়দা করেছে ও!

চলো! বলল কিশোর। মিস্টিক গ্রীনহাউসের পাশ কাটিয়ে, বুক নুকের পিছন দিয়ে, গোলাপ বাগানের উদ্দেশে ছুটে চলল ওরা। দস্তুরমত হাঁফাচ্ছে, শেডের থেকে গজ দশেক দূরে, গোলাপ ঝাড়ের পিছনে ঘাপটি মেরে বসল তিনজন। খোলা দরজা দিয়ে আলোর রেখা বেরিয়ে এসেছে।

ভেতরে কেউ আছে! হিসিয়ে উঠল মুসা।

ছেলেরা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল। বারল্যাপ ব্যাগগুলোর সামনে হাঁটু গেড়ে বসা এক ছায়ামূর্তি। লোকটা উঠে দাঁড়াতে বোঝা গেল ওটা রয়।

কী করা যায়? ফিসফিস করে বলল রবিন।

স্ক্রুড্রাইভারটা আছে, বলল মুসা। ওটা দিয়ে ওকে আটকে দেব!

না, চলো অফিসার ফলেটের কাছে যাই, বাধা দিয়ে বলল কিশোর।

মাথা নাড়ল মুসা।

অত সময় নেই! টাকাটা না পেলে রয় পগার পার হয়ে যাবে! গুঁড়ি মেরে শেডের দিকে এগোতে লাগল ও। আউচ! চেঁচিয়ে উঠল।

কী হলো? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রবিন।

কাঁটা!

আচমকা রয় ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল শেড থেকে। ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল মুসার উপরে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুসার বাহু চেপে ধরল ও।

টাকাটা কী করেছ? কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল।

ওকে ছেড়ে দিন! গর্জে উঠল রবিন। ও আর কিশোর দৌড়ে গেল মুসার পাশে।

হ্যাঁ, ওকে ছেড়ে দিন! ভরাট এক কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল। শেডের আড়াল থেকে উদয় হয়েছেন অফিসার ফলেট। সঙ্গে জন।

দশ

এক ঘণ্টা পর। কিশোরদের ব্যাকইয়ার্ডে স্লীপিংব্যাগে শুয়ে তিন গোয়েন্দা।

আমি এখনও বুঝতে পারছি না রয় টনির চাবি হাতাল কীভাবে, বলল রবিন।

খুব সোজা, বলল মুসা। আমি অনেক আগেই বুঝে গেছি।

কিশোর মাথা তুলে ওর দিকে চাইল।

দয়া করে বলবেন কি?

নাটুকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা।

রয় শুনেছিল জন কাল রাতে বৃষ্টি হতে পারে বলেছে। ও জানত জন গা বাঁচানোর জন্য অন্য কোথাও আশ্রয় নেবে। তখনই টাকা চুরির বুদ্ধিটা মাথায় আসে ওর। টনি ঘুমিয়ে পড়লে চাবিটা নেয় সে।

কিন্তু রয় টনির রুমে ঢুকল কীভাবে? প্রশ্ন করল কিশোর।

ঢুকতে হয়নি, ওরা একই রুমে ঘুমিয়েছে, জানাল মুসা।

তুমি জানলে কীভাবে? রবিনের জিজ্ঞাসা।

হাসল মুসা।

মিস্টার লিস্টারের সাথে ফায়ারওয়র্কের ওখানে দেখা হয়েছিল, মনে আছে? উনি টনি আর রয়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন রুমটা কেমন। রুমগুলো কেমন জানতে চাননি।

ভাগ্যিস অফিসার ফলেট সময় মত শেডে হাজির হয়েছিলেন, বলল কিশোর। উনি জানলেন কীভাবে যে রয়, ওখানে গেছে?

জন মনে হয় তাকে বোঝাতে পেরেছিল, বলল মুসা। জন হয়তো বুঝতে পেরেছিল চাবিটা হাতানোর একমাত্র সুযোগ রাতের বেলা, টনি যখন ঘুমিয়ে। আর জনের তো জানাই ছিল, টনি আর রয় একই রুমে থাকছে।

তোমার মাথায় বুদ্ধি ঠাসা, বলল কিশোর।

ধন্যবাদ, জানাল মুসা।

ইউ আর ওয়েলকাম, বলল কিশোর।

আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলে তোমাকে এফ.বি.আই. চীফ করব, বলল রবিন।

হাই তুলল মুসা।

না, আমাকে বরং খাদ্যমন্ত্রী কোরো।

আঁধারে ফিক করে হেসে ফেলল তিন বন্ধ। মাথার উপরে তারা। মিটমিট করছে, ধীরে ধীরে ঘুমে তলিয়ে গেল ওরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *