জীবনযাপন – ২

অজিত বললে—এসো পূর্ণিমা।

পূর্ণিমা সত্যভামার পার্ট অভিনয় করে। এ তার খুব ভালো লাগে; খুব অনুরাগের সঙ্গে বলতেও পারে সে; অভিনয়ে তাই তার একটা চমৎকার সুর বাজে।

অজিত প্রথম কয়েক দিন পূর্ণিমাকে আপনি বলে ডাকত; কিন্তু পূর্ণিমা একদিন অভিমান ক’রে বললে—আপনি বললে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব না আর।

অজিত বললে—আচ্ছা, তুমিই বলব।

তবুও কয়েক বার ভুল করে ফেলেছিল সে; পূর্ণিমাও কথা প্রায় বন্ধ করে এনেছিল। কিন্তু এখন ‘তুমি’ ছাড়া আর কিছু বলে না-অজিতের মুখে আর কিছু আসেও না-তা ভালোও লাগে না তার।

পূর্ণিমা অবিশ্যি অজিতকে এখনও আপনিই বলে-কিন্তু তাতে অজিতের কোনো রাগ বা অভিমানের কথা মনেই আসে না; এ নিয়ে সে চিন্তাও করতে যায় না।

পূর্ণিমা বললে—বাঃ, আপনি দেখি বই, খুলে বসে রয়েছেন—

—বসেই রয়েছি শুধু

—পড়ছেন না?

—নাঃ

—তবে যে বড় খুলে আছেন

—এ পড়তে আমার প্রবৃত্তি হয় না

—কি বই?

পূর্ণিমা কাছে এল—

অজিত বললে—বোস

একটা কৌচের ওপর বসল সে

পূর্ণিমা বললে—বইটা দিন

অজিত দিল

—ওঃ এই বইটা—

বইটা অজিতের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে পূর্ণিমা বললে—তা আপনার পার্ট তো বেশ নির্ভুলই বলতে পারেন আপনি-বইটা আর মিছেমিছি খুলে রেখেছিলেন কেন—

অজিত একটু হেসে বললে—নির্ভুল!

—বই যখন খুলে বসেছেন তখন নিশ্চয়ই ভুলের ভাবনা আপনার ছিল—

—তা নয়—

—আমিও তো জানি না কি অজিতবাবু; এ সব আপনার মনের ধাঁধা। এত ভালো পার্ট করেন–কিন্তু তবুও আপনার মনের ভিতর একটা সন্দেহ কেন যেন ঘোচে না—

—তাই না কি পূর্ণিমা?

—হ্যাঁ

—তুমি লক্ষ্য করেছ?

-করেছি বৈ কি—

অজিত প্রাণ খুলে হেসে উঠল।

তারপর ধীরে ধীরে পূর্ণিমার দিকে তাকিয়ে বললে—তুমি সবই বুঝে ফেলতে পার দেখেছি—

অজিস আবার হাসল

তারপর বললে—আমি ভেবেছিলাম স্টেজে যেমন জীবনেও তেমনি আমার সব সময়ের অভিনয়ের পিছনের মানুষটিকে কেউ দেখ না—

পূর্ণিমা নিস্তব্ধ হয়ে রইল—

অজিত বললে—স্টেজে দাঁড়িয়ে ভুল পড়বার ভয় আমার নেই পূর্ণিমা। এ যা বই-এ যে রকম সব কথাবার্তা এর চেয়ে ভালো জিনিস অভিনয় করতে দাঁড়িয়ে তখন তখনই আমি নিজের মনের থেকে তৈরি করে নিতে পারি—

পূর্ণিমা ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল।

অজিত বললে—আমার মুখে এ বইয়ের এ পদগুলোর অনবরত গরমিল হয়ে যায় যদি তাতে আমি একটুও ভাবি না-অনেক সময় তা হয়-আমি চাই যে তা হোক্-না হ’লে আমার মন খোলে না। কোনো একটা বিশেষত্বহীন অসাড় বইয়ের ভুল পড়া ঠিক পড়া নিয়ে আমি একটু মাথা ঘামাই না। আমার মনের সন্দিগ্ধতা সত্য কিছু নিয়ে।

—কি নিয়ে?

—এই এক্ষুণি ভাবছিলাম এমন বই আমাদের অভিনয় করতে হয় কেন; কোনো দিন লিখি না বটে-কিন্তু কলম নিয়ে বসলে এই জিনিসই এর চেয়ে আমিও তো ঢের ভালো করে লিখতে পারতাম-বাংলাদেশের অন্য লেখকদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম—

—বইটা ভালো কি মন্দ আমি বুঝি না অজিতবাবু। কিন্তু আপনার পার্ট শুনতেই ঘরটা তো অজস্র লোকে ভরে যায়—

অজিত মনে ভাবছিল।—কিন্তু এই ঘরভরা লোকদের ভিতর দু’চার জন বিচক্ষণ মানুষও যদি এক কোণে পড়ে থাকে তারা এই কথাই ভাবে যে এই একটা বই (কোনো দিক দিয়ে যার কোনো প্রয়োজন ছিল না-লেখকের কোনো বুদ্ধি ছিল না-হৃদয় ছিল না-ভাষা ছিল না-লিখবার কোনোই দরকার ছিল না তার-কতকগুলো অসাড় নির্বোধ অবাস্তব জিনিস দিয়ে একটা মিথ্যা সত্যভামাকে দাঁড় করাল মিছেমিছি সে-কিন্তু তবুও এই হাড্ডিসার চরিত্রের ভিতরেও পূর্ণিমা এমন প্রাণসম্পদ ফুটিয়ে তুললে যে বিমুগ্ধ হয়ে রাতের পর রাত বসে থাকতে ইচ্ছে করে শুধু—বইটার সম্বন্ধেই একটা ভুল ধারণা হয়ে যায়-এই তারা ভাবে না কি?

কিন্তু মুখে সে কিছু বললে না।

পূর্ণিমার অভিনয়ের কোনো প্রশংসা করলে না সে।

দু’জনেই চুপ করে বসে রইল।

পূর্ণিমা বললে—ওঃ এই আপনার সন্দেহ; এই সব বইটই নিয়ে।

—হ্যাঁ

—তাহ’লে নিজেই আপনি লিখুন না কেন?

অজিত বললে—আমি লিখতে পারি না।

—তবে কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিন।

—কাকে দিয়ে লেখাব?

পূর্ণিমা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে—তবে কি হবে?

—থাক এ সব কথা এখন।

পূর্ণিমা বললে—আপনার বো” হয় মনে আছে কিছুদিন আগে বেশ একটা নামজাদা উপন্যাসকে ড্রামাটাইজ করা হয়েছিল এখানে—

—হ্যাঁ

—আপনি বুঝি সেই চান

—হ্যাঁ; এর চেয়ে ঢের ভালো হয়।

—কিন্তু সে রকম উপন্যাস কটা আর আছে?

—বেশি নেই—

—কিন্তু যে কটা আছে, সেগুলো একবার আমানত করলে মন্দ হয় না।

-আমিও তো তাই বলি—

অজিত বললে—কিন্তু, তোমার হয়তো তা ভালো লাগবে না পূর্ণিমা—

—আমার? সে উপন্যাসের অভিনয়ে আমি তো নেমেছিলাম—

–তা আমি জানি—

—কিন্তু এক রাত কি দু’রাত হয়েছিল শুধু—

—কেন?

—ভালো করে তৈরি না হতেই নামানো হয়েছিল।

—ওঃ

—কিন্তু এবার আপনি তৈরি করে দিন না।

—তাই ভাবছি—

—তা হ’লে হয়তো একশো দেড়শো রাতও চলতে পারে।

—চলবে কি পূর্ণিমা? তুমি পারবে (…)? তোমার ভালো লাগবে?

—আমার?

—একটা গল্প হলেই বুঝি তোমার খুব ভালো লাগে?

—আপনার যা ভালো লাগে না আমার তা খুব ভালো লাগে এই কথা বোধ করতেই আপনি বুঝি খুব তৃপ্তি পান।

অজিত হেসে উঠল।

পূর্ণিমা হাসছিল না।

অজিত গম্ভীর হয়ে গেল।

পূর্ণিমা বললে—আপনাকে খুব বড় মনে করেন আপনি; সে আপনার শোভা পায়-কিন্তু—

পূর্ণিমা থমকে চুপ করে রইল।

অজিত বললে—বড় মনে করি আমাকে? কোন বিষয়ে?

—সব বিষয়েই।

—অজিত—

পূর্ণিমা বললে—আপনি ঢের শিক্ষাদীক্ষা পেয়েছেন আমাদের চেয়ে-অনেক জানেন-অনেক বোঝেন-সদ্বংশের ছেলে-ভগবান আপনাকে ঢের ক্ষমতা দিয়েছেন-থিয়েটারে না এলেও আপনার কিছু এসে যেত না; যেখানেই যেতেন সেখানেই আপনি মানুষের পূজো পেতেন; থিয়েটারে আপনি এসেছেন এ আমাদের সৌভাগ্য কিন্তু একটা কথা আপনাকে অজিতবাবু-বরাবর আদর আহ্লাদ পেয়েই হোক বা যে করেই হোক—মনে আমার বড় অভিমান; সে অভিমানে অজ্ঞাতসারেও যদি আপনি এক আধ বার ঘা দিয়ে বসেন তা হ’লে বড় কষ্ট লাগে আমার—

—আমি কি তোমাকে আঘাত দিয়েছি পূর্ণিমা? কখন?

—আপনি বললেন যে কোনো একটা গল্প হলেই তো তোমার চলে—

–অজিত হাসতে লাগল—

কিন্তু পূর্ণিমা কাঠের মত শক্ত—

অজিত দু’এক মুহূর্ত নিস্তব্ধ হয়ে নিগূঢ় ভাবে চিন্তা করে বুঝে উঠতে পারল না এ কথা পূর্ণিমাকে কি করে-কেমন করে-কোথায় আঘাত দিতে পারে-কিন্তু তারপর চমকে উঠে বুঝতে পারল যেন সব-এ মেয়েটির অভিমান ও একটা প্রখরতার অপরিসীম পরিধি চোখ বুজে দেখে ফেলল যেন সব অজিত।

কিন্তু পূর্ণিমা হাসছিল, বললে—আপনি এত কি ভাবছেন?

অজিত কোনো উত্তর দিল না।

পূর্ণিমা বললে—রাগ করেছেন?

—আমি কখন কি বলে ফেলি-আমাকে সতর্ক করে দিও —

পূর্ণিমা বললে—আমি বড় বোকা; এই এক্ষুণি বলছিলাম আমার খুব অভিমান-কিন্তু অভিমানটা আপনার কাছে এলেই যেন বেড়ে ওঠে আমার। এর সমুচিত শাস্তি যখনই আপনার দরকার হয় তখনই আপনি দেবেন। আর কিছু বলবার নেই আমার।

বলেই মনে হল পূর্ণিমার সে ঢের বলে ফেলেছে যেন-এত বলবার কি প্রয়োজন ছিল তার। অত্যন্ত লজ্জা পেতে লাগল পূর্ণিমা-এক এক সময় যেন মাটির সঙ্গে মিশেও যেতে ইচ্ছে করে।

—পড়বেন?

—হ্যাঁ

—যাই তাহ’লে এখন আমি?

—আচ্ছা যাও—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *